Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    বাল্মীকির রাম ও রামায়ণ – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

    September 9, 2025

    মহাভারতের ছয় প্রবীণ – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

    September 9, 2025

    পুরাণী – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

    September 9, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    প্রসন্ন স্যার

    উপন্যাস সত্যজিৎ রায় এক পাতা গল্প12 Mins Read0

    প্রসন্ন স্যার

    অর্ধেন্দু সেনগুপ্ত সাতদিনের ছুটি নিয়ে শিমুলতলায় এসেছে। সে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে ভালো চাকরি করে, যদিও মাত্র পঁচিশ বছর বয়স। চেহারা সুশ্রী, চলনে বলনে রীতিমতো স্মার্ট। ব্যাচেলার হিসেবে তার এই শেষ ছুটি ভোগ, কারণ ফিরে গিয়ে দুমাসের মধ্যেই তার বিয়ে, পাত্রী ঠিক করেছেন তার মা নিজে। অর্ধেন্দুর একটু কাব্যচর্চার বাতিক আছে, সে শিমুলতলায় সেটার পিছনে কিছুটা সময় দিতে চায়, কলকাতায় কাজের চাপে আর হয়ে ওঠে না।

    দ্বিতীয় দিনই বিকেলে স্টেশন প্ল্যাটফর্মে বেড়াতে গিয়ে প্রসন্ন স্যারের সঙ্গে দেখা। প্রসন্ন চক্রবর্তী অর্ধেন্দুর ইস্কুলে ইংরিজি পড়াতেন। তাঁর স্মরণশক্তির কথা সকলেই জানে, তিনি পুরোন ছাত্রদের কখনো ভোলেন না—সে ভালো ছেলেই হোক আর মন্দ ছেলেই হোক। অর্ধেন্দু তাঁকে ক্লাস নাইন পর্যন্ত পেয়েছিল—একটানা ছ’বছর—তারপর প্রসন্ন স্যার চাকরি ছেড়ে দেন শারীরিক অসুস্থতার জন্য। এখনও তাঁকে দেখে খুব সুস্থ বলে মনে হল না। বারো বছর হয়ে গেছে, কিন্তু তাও প্রসন্ন স্যার অর্ধেন্দুকে দেখেই চিনে ফেললেন।

    ‘কীরে, মাকাল ফল, তোকে এখানে দেখব ভাবিনি তো!’ বললেন প্রসন্ন স্যার। শুধু চেনা নয়; অর্ধেন্দুকে তিনি যে মাকাল ফল বলে ডাকতেন সে কথাও মনে আছে। তখন মাকাল ফল নামকরণে একটা সার্থকতা ছিল। মাকাল ফল দেখতে লাল টুকটুকে, কিন্তু অখাদ্য। ক্লাস নাইন পর্যন্ত অর্ধেন্দুর চেহারাটাই শুধু ভালো ছিল, অন্যদিক দিয়ে সে খুব সাধারণ ছাত্রের পর্যায়ে পড়ত। প্রসন্ন স্যার ছাত্রদের মানানসই নামকরণ করতে খুব ভালোবাসতেন। এবং এ ব্যাপারে তাঁর ক্ষমতাও ছিল। এক অর্ধেন্দুর ক্লাসেই ছিল রামগরুড়ের ছানা, কুমড়ো পটাশ, ঈদের চাঁদ (রাধিকারঞ্জনের নাম, কারণ সে কামাই করত কথায় কথায়), খাঞ্জা খাঁ, যশুরে কৈ ইত্যাদি আরো অনেকে। সত্যি বলতে কি, খুব কম ছাত্রদেরই আসল নাম ধরে ডাকতেন প্রসন্ন স্যার। অবিশ্যি ছাত্ররাও তাঁর অগোচরে তাঁকে ‘অপ্রসন্ন স্যার’ বলত, কারণ প্রসন্ন চক্রবর্তীর মেজাজখানাও ছিল কড়া। সেটা অবিশ্যি সব সময়ে ধমকে প্রকাশ না পেয়ে ব্যঙ্গোক্তিতে পেত। সে খোঁচা বড় সাংঘাতিক খোঁচা।

    অর্ধেন্দু তার পুরনো মাস্টারকে প্রণাম করল।

    ‘আজকাল কিছু করা হচ্ছে, নাকি ফ্যাফ্যাগিরি?’ জিগ্যেস করলেন প্রসন্ন স্যার।

    অর্ধেন্দু বলল, ‘আপনাদের আশীর্বাদে একটা চাকরি করছি, তা সে তেমন কিছু নয়।’

    প্রসন্ন স্যারের ধারণাটা যাতে বজায় থাকে সেইদিকেই দৃষ্টি রেখে অর্ধেন্দু কথাটা বলল। মাকাল ফল আর ভালো চাকরি পায় কী করে? আসলে প্রসন্ন স্যার ইস্কুল ছেড়ে দেবার পরে অর্ধেন্দুর অনেক পরিবর্তন হয়। হায়ার সেকেন্ডারিতে সে রীতিমতো ভালো রেজাল্ট করে। কলেজে গিয়েও কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে সে হাই সেকেন্ড ক্লাস পায়। সে খবর অবশ্য প্রসন্ন স্যারের জানবার কথা নয়, কারণ তিনি কলকাতা ছেড়ে দেশে গিয়ে সেখানে একটা ইস্কুলে চাকরি নেন এবং সেখান থেকেই রিটায়ার করেন।

    ‘যাক, তাহলে একটা হিল্লে হয়েছে তোর। ইস্কুলে তোর হাবভাব দেখে মনে হয়েছিল যে বায়স্কোপে অ্যাকটিং করা ছাড়া তোর আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। যত গবেট সব ওই লাইনেই যায় ত!’

    দিনে অন্তত দুবার করে ‘বায়স্কোপের’ বিরুদ্ধে কিছু না কিছু বলতেন প্রসন্ন স্যার। তিনি নাকি জীবনে দুখানা ছবি দেখেছেন। তাতেই তাঁর সাধ মিটে গেছে।

    ‘আপনার শরীর এখন কেমন?’ অর্ধেন্দু জিজ্ঞেস করল।

    ‘সেই তো মাইল্‌ড স্ট্রোক হয়ে ইস্কুল ছাড়লাম।’ বললেন প্রসন্ন স্যার। ‘তারপর নানান ব্যারামে ভুগেছি। নৈহাটি চলে গেস্‌লাম নিজের দেশে। সেইখানেই একটা ইস্কুলে চাকরি নিই। বছর চারেক হল সেখান থেকে রিটায়ার করেছি। এখন তবু খানিকটা ভালো আছি, কেবল হাঁপের কষ্ট। তাই ত শিমুলতলায় এলাম—একটু আরামে নিশ্বাস নেব বলে।’

    ‘পুরোন ছাত্রদের সঙ্গে দেখা হয়?’

    ‘এই ত তোর সঙ্গে হয়ে গেল। তুই ছাড়া আর কেউ এসেছে নাকি এখানে?’

    ‘আর ত কাউকে দেখিনি। তবে আমিও সবে এসেছি।’

    রোদ পড়ে আসছে দেখে হাতের ছাতাটা বন্ধ করে প্রসন্ন স্যার বললেন, ‘আসি, মাকাল ফল। আছিস যখন তখন নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে।’

    প্রসন্ন স্যার ছাতা বগলে নিয়ে চলে গেলেন।

    পরদিন সকালে বাজারে অর্ধেন্দুর কিরণের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল—কিরণ বিশ্বাস। কিরণ অর্ধেন্দুর সঙ্গে একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ত। নিচের দিকের ক্লাসে সে ছিল ভালো ছেলের দলে। প্রসন্ন স্যার তাকে ‘সানশাইন’ বলে ডাকতেন। তাঁর বড় প্রিয় ছাত্র ছিল কিরণ। অবিশ্যি পরের দিকে কিরণের ইতিহাস অর্ধেন্দুর ঠিক উল্টো। উঁচু ক্লাসে উঠে সে অসৎ সঙ্গে পড়ে অমনোযোগী হয়ে পড়ে। হায়ার সেকেন্ডারিতে একবার ফেল করে। কিরণের এ পরিণাম কেউ আশা করেনি। অবিশ্যি প্রসন্ন স্যার কিরণের নৈতিক অবনতির কথা জানেন না।

    ‘কী করছিস আজকাল?’ অর্ধেন্দু জিগ্যেস করল। ‘ম্যাকফারসন কোম্পানির চাকরিটা আছে?’

    কিরণ মাথা নাড়ল।

    ‘আমার কপালে চাকরি নেই।’

    ‘এখনো রেসের মাঠে যাস?’

    ‘ওটা একবার ধরলে আর ছাড়া যায় না।’

    ‘তাহলে সংসার চলছে কি করে?’

    ‘বাবা মারা গেছেন তিন বছর হ’ল। তার ফলে হাতে কিছু টাকা এসেছে।’

    ‘সে আর কদিন?—ভালো কথা, প্রসন্ন স্যার এখানে রয়েছেন।’

    ‘তাই বুঝি?’

    ‘কাল স্টেশনে দেখা হয়েছিল। তুই আছিস জানলে খুব খুশি হবেন। আমাকে এখনো মাকাল ফল বলে ডাকেন।’

    ‘তার মানে আমাকে সানশাইন বলবেন।’

    ‘তা তো বটেই। ওঁর মেমরি ত জানিস। ইস্কুলের কোনো কথাই ভোলেননি।’

    ‘তুই কোথায় উঠেছিস?’ কিরণ জিগ্যেস করল।

    অর্ধেন্দু তার ডেরার অবস্থান বুঝিয়ে দিল। —‘এক বন্ধুর বাড়ি। এখন শুধু একটা মালি আর একটা চাকর আছে।’

    কিরণ বিদায় নিল।

    বিকেলে চা খেয়ে অর্ধেন্দু বেরোতে যাবে এমন সময় হন্তদন্ত কিরণ এসে হাজির।

    ‘কেলেঙ্কারি ব্যাপার!’

    ‘কী হল?’ অর্ধেন্দু জিগ্যেস করল।

    ‘প্রসন্ন স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।’

    ‘সে ত হবেই—এতটুকু জায়গা! কী বললেন?’

    ‘এখনো সানশাইন নাম ধরে বসে আছেন। কী করছি জিগ্যেস করতে একঝুড়ি মিথ্যে কথা বলতে হল। ভেরেন্ডা ভাজছি আর ঘোড়ার পেছনে পয়সা ঢালছি সে ত আর বলা যায় না।’

    ‘কী বললি?’

    ‘বললুম চাকরি করছি। তুই তোর আপিসের কথা বলিসনি তো?’

    ‘নাম বলিনি। কেন—তুই বলেছিস নাকি?’

    ‘আর কিছু মাথায় এল না। ভদ্রলোক আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, তিনি ইস্কুলেই জানতেন যে আমি জীবনে উন্নতি করব। তোর কথাও বললেন। বললেন, ‘মাকাল ফলটা এখনও সেই রকমই আছে। বললে, একটা চাকরি করছে, কিন্তু সে চাকরি যে কিরকম সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।”

    অর্ধেন্দু হেসে উঠল।

    ‘এখানেই শেষ না,’ বলল কিরণ। ‘আরো ব্যাপার আছে।’

    ‘কী ব্যাপার?’

    ওঁর একটি ছেলে আছে। বাইশ বছর বয়স। ওঁর ছোট ছেলে। বি. কম. পাশ করেছে, কিন্তু চাকরি পায়নি এখনো। চেষ্টা করেও সুবিধা করতে পারছে না। প্রসন্ন স্যার বললেন, যদি তার জন্যে একটা কিছু করে দিতে পারি।’

    ‘তুই কি বললি?’

    ‘আমি বললাম, চেষ্টা করব। কী আর বলব বল!’

    ‘ঠিক আছে। প্রসন্ন স্যারের ধারণাটা বজায় রাখতে হবে। নাহলে লোকটা মনে বড় কষ্ট পাবে। হাজার হোক, অভাবী লোক ত, তার উপরে অসুস্থ। আর এককালে ক্লাসে ভাল পড়াতেন সেটা বলতেই হবে। ওঁর কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি।’

    ‘তাহলে কী করা যায় বলত?’

    ‘ওঁর ছেলেকে একটা চাকরি যোগাড় করে দিতে হবে। ছেলেটা লেখাপড়ায় কেমন?’

    ‘বললেন ত ভালো, কিন্তু ব্যাকিং ছাড়া নাকি কিছু হচ্ছে না।’

    ‘তাহলে এক কাজ কর। ওঁর সঙ্গে দেখা করে বল, তোর আপিসে, অর্থাৎ আমার আপিসে গিয়ে দেখা করতে। আমি চেষ্টা করে দেখি ওর জন্য কিছু করা যায় কিনা।’

    ‘তাই বলব ত? তুই ঠিক বলছিস?’

    ‘ঠিক বলছি। ওঁর ছেলের জন্য যদি কিছু করতে হয় তাহলে সানশাইনই করবে। মাকাল ফলের দ্বারা কিছু হবে না।’

    ‘যাক, তুই আমাকে বাঁচালি।’

    ‘তবে একটা কথা ভুলিস না।’

    ‘কী?’

    ‘প্রসন্ন স্যার এককালে তোর কী নাম দিয়েছিলেন, আর আজকাল তোর কী অবস্থা হয়েছে!’

    কিরণের মাথা হেঁট হয়ে গেল। সে বলল, ‘বাবা মারা যাবার আগে ঠিক এই কথাটাই বলেছিলেন।’

    ‘তাহলে?’

    ‘তোর কথাটা মনে রাখব।’

    ‘ঠিক ত?’

    ‘ঠিক। কথা দিচ্ছি। কিরণ বিশ্বাস যে একেবারে শেষ হয়ে গেছে তা নয়।’

    পরদিন বিকেলে স্টেশন প্ল্যাটফর্মে আবার প্রসন্ন স্যারের সঙ্গে দেখা। বললেন, ‘সানশাইন এখানে রয়েছে, জানিস ত?’

    ‘জানি, কাল দেখা হয়েছে।’

    ‘ছেলেটা একটুও বদলায়নি। বলল, আমার ছেলের জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেবে। তোকে আর দীপ্তেনের কথাটা বলিনি, কারণ জানি তোর দ্বারা কিছু হবে না।’

    ‘আপনি ঠিক লোককেই ধরেছেন স্যার। আর আপনার নামকরণের কোনো তুলনা নেই।’

    প্রসন্ন স্যার

    অর্ধেন্দু সেনগুপ্ত সাতদিনের ছুটি নিয়ে শিমুলতলায় এসেছে। সে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে ভাল চাকরি করে, যদিও মাত্র পঁচিশ বছর বয়স। চেহারা সুশ্রী, চলনে বলনে রীতিমতো স্মার্ট। ব্যাচেলার হিসেবে তার এই শেষ ছুটি ভোগ, কারণ ফিরে গিয়ে দুমাসের মধ্যেই তার বিয়ে, পাত্রী ঠিক করেছেন তার মা নিজে। অর্ধেন্দুর একটু কাব্যচর্চার বাতিক আছে, সে শিমুলতলায় সেটার পিছনে কিছুটা সময় দিতে চায়, কলকাতায় কাজের চাপে আর হয়ে ওঠে না।

    দ্বিতীয় দিনই বিকেলে স্টেশন প্ল্যাটফর্মে বেড়াতে গিয়ে প্রসন্ন স্যারের সঙ্গে দেখা। প্রসন্ন চক্রবর্তী অর্ধেন্দুর ইস্কুলে ইংরিজি পড়াতেন। তাঁর স্মরণশক্তির কথা সকলেই জানে, তিনি পুরনো ছাত্রদের কখনও ভোলেন না–সে ভাল ছেলেই হোক আর মন্দ ছেলেই হোক। অর্ধেন্দু তাঁকে ক্লাস নাইন পর্যন্ত পেয়েছিল–একটানা ছবছর–তারপর প্রসন্ন স্যার চাকরি ছেড়ে দেন শারীরিক অসুস্থতার জন্য। এখনও তাঁকে দেখে খুব সুস্থ বলে মনে হল না। বারো বছর হয়ে গেছে, কিন্তু তাও প্রসন্ন স্যার অর্ধেন্দুকে দেখেই চিনে ফেললেন।

    কী রে, মাকাল ফল, তোকে এখানে দেখব ভাবিনি তো! বললেন প্রসন্ন স্যার। শুধু চেনা নয়; অর্ধেন্দুকে তিনি যে মাকাল ফল বলে ডাকতেন সেকথাও মনে আছে। তখন মাকাল ফল নামকরণে একটা সার্থকতা ছিল। মাকাল ফল দেখতে লাল টুকটুকে, কিন্তু অখাদ্য। ক্লাস নাইন পর্যন্ত অর্ধেন্দর চেহারাটাই শুধু ভাল ছিল, অন্যদিক দিয়ে সে খুব সাধারণ ছাত্রের পর্যায়ে পড়ত। প্রসন্ন স্যার ছাত্রদের মানানসই নামকরণ করতে খুব ভালবাসতেন। এবং এ ব্যাপারে তাঁর ক্ষমতাও ছিল। এক অর্ধেন্দুর ক্লাসেই ছিল রামগরুড়ের ছানা, কুমড়ো পটাশ, ঈদের চাঁদ (রাধিকারঞ্জনের নাম, কারণ সে কামাই করত কথায় কথায়), খাঞ্জা খাঁ, যশুরে কৈ ইত্যাদি আরও অনেকে। সত্যি বলতে কি, খুব কম ছাত্রদেরই আসল নাম ধরে ডাকতেন প্রসন্ন স্যার। অবিশ্যি ছাত্ররাও তাঁর অগোচরে তাঁকে অপ্রসন্ন স্যার বলত, কারণ প্রসন্ন চক্রর্তেীর মেজাজখানাও ছিল কড়া। সেটা অবিশ্যি সবসময়ে ধমকে প্রকাশ না পেয়ে ব্যঙ্গোক্তিতে পেত। সে খোঁচা বড় সাংঘাতিক খোঁচা।

    অর্ধেন্দু তার পুরনো মাস্টারকে প্রণাম করল।

    আজকাল কিছু করা হচ্ছে, নাকি ফ্যাফ্যাগিরি? জিজ্ঞেস করলেন প্রসন্ন স্যার।

    অর্ধেন্দু বলল, আপনাদের আশীর্বাদে একটা চাকরি করছি, তা সে তেমন কিছু নয়।

    প্রসন্ন স্যারের ধারণাটা যাতে বজায় থাকে সেইদিকেই দৃষ্টি রেখে অর্ধেন্দু কথাটা বলল। মাকাল ফল আর ভাল চাকরি পায় কী করে? আসলে প্রসন্ন স্যার ইস্কুল ছেড়ে দেবার পরে অর্ধেন্দুর অনেক পরিবর্তন হয়। হায়ার সেকেন্ডারিতে সে রীতিমতো ভাল রেজাল্ট করে। কলেজে গিয়েও কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে সে হাই সেকেন্ড ক্লাস পায়। সে খবর অবশ্য প্রসন্ন স্যারের জানবার কথা নয়, কারণ তিনি কলকাতা ছেড়ে দেশে গিয়ে সেখানে একটা ইস্কুলে চাকরি নেন এবং সেখান থেকেই রিটায়ার করেন।

    যাক, তা হলে একটা হিল্লে হয়েছে তোর। ইস্কুলে তোর হাবভাব দেখে মনে হয়েছিল যে বায়স্কোপে অ্যাকটিং করা ছাড়া তোর আর কোনও ভবিষ্যৎ নেই। যত গবেট সব ওই লাইনেই যায় তো!

    দিনে অন্তত দুবার করে বায়স্কোপের বিরুদ্ধে কিছু না কিছু বলতেন প্রসন্ন স্যার। তিনি নাকি জীবনে দুখানা ছবি দেখেছেন। তাতেই তাঁর সাধ মিটে গেছে।

    আপনার শরীর এখন কেমন? অর্ধেন্দু জিজ্ঞেস করল।

    সেই তো মাইন্ড স্ট্রোক হয়ে ইস্কুল ছাড়লাম। বললেন প্রসন্ন স্যার। তারপর নানান ব্যারামে ভুগেছি। নৈহাটি চলে গেলাম নিজের দেশে। সেইখানেই একটা ইস্কুলে চাকরি নিই। বছর চারেক হল সেখান থেকে রিটায়ার করেছি। এখন তবু খানিকটা ভাল আছি, কেবল হাঁপের কষ্ট। তাই তো শিমুলতলায় এলাম–একটু আরামে নিশ্বাস নেব বলে।

    পুরনো ছাত্রদের সঙ্গে দেখা হয়?

    এই তো তোর সঙ্গে হয়ে গেল। তুই ছাড়া আর কেউ এসেছে নাকি এখানে?

    আর তো কাউকে দেখিনি। তবে আমিও সবে এসেছি।

    রোদ পড়ে আসছে দেখে হাতের ছাতাটা বন্ধ করে প্রসন্ন স্যার বললেন, আসি, মাকাল ফল। আছিস যখন, তখন নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে।

    প্রসন্ন সার ছাতা বগলে নিয়ে চলে গেলেন।

    পরদিন সকালে বাজারে অর্ধেন্দুর কিরণের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল–কিরণ বিশ্বাস। কিরণ অর্ধেন্দুর সঙ্গে একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ত। নীচের দিকের ক্লাসে সে ছিল ভাল ছেলের দলে। প্রসন্ন স্যার তাকে সানশাইন বলে ডাকতেন। তাঁর বড় প্রিয় ছাত্র ছিল কিরণ। অবিশ্যি পরের দিকে কিরণের ইতিহাস অর্ধেন্দুর ঠিক উলটো। উঁচু ক্লাসে উঠে সে অসৎসঙ্গে পড়ে অমনোযোগী হয়ে পড়ে। হায়ার সেকেন্ডারিতে একবার ফেল করে। কিরণের এ পরিণাম কেউ আশা করেনি। অবিশ্যি প্রসন্ন স্যার কিরণের নৈতিক অবনতির কথা জানেন না।

    কী করছিস আজকাল? অর্ধেন্দু জিজ্ঞেস করল। ম্যাকফারসন কোম্পানির চাকরিটা আছে?

    কিরণ মাথা নাড়ল।

    আমার কপালে চাকরি নেই।

    এখনও রেসের মাঠে যাস?

    ওটা একবার ধরলে আর ছাড়া যায় না।

    তা হলে সংসার চলছে কী করে?

    বাবা মারা গেছেন তিন বছর হল। তার ফলে হাতে কিছু টাকা এসেছে।

    সে আর কদিন?–ভাল কথা, প্রসন্ন স্যার এখানে রয়েছেন।

    তাই বুঝি?

    কাল স্টেশনে দেখা হয়েছিল। তুই আছিস জানলে খুব খুশি হবেন। আমাকে এখনও মাকাল ফল বলে ডাকেন।

    তার মানে আমাকে সানশাইন বলবেন।

    তা তো বটেই। ওঁর মেমরি তো জানিস। ইস্কুলের কোনও কথাই ভোলেননি।

    তুই কোথায় উঠেছিস? কিরণ জিজ্ঞেস করল।

    অর্ধেন্দু তার ডেরার অবস্থান বুঝিয়ে দিল।–এক বন্ধুর বাড়ি। এখন শুধু একটা মালি আর একটা চাকর আছে।

    কিরণ বিদায় নিল।

    বিকেলে চা খেয়ে অর্ধেন্দু বেরোতে যাবে এমন সময় হন্তদন্ত কিরণ এসে হাজির।

    কেলেঙ্কারি ব্যাপার!

    কী হল? অর্ধেন্দু জিজ্ঞেস করল।

    প্রসন্ন স্যারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

    সে তো হবেই–এতটুকু জায়গা! কী বললেন?

    এখনও সানশাইন নাম ধরে বসে আছেন। কী করছি জিজ্ঞেস করতে একঝুড়ি মিথ্যে কথা বলতে হল। ভেরেন্ডা ভাজছি আর ঘোড়ার পিছনে পয়সা ঢালছি, সে তো আর বলা যায় না।

    কী বললি?

    বললুম চাকরি করছি। তুই তোর আপিসের কথা বলিসনি তো?

    নাম বলিনি। কেন–তুই বলেছিস নাকি?

    আর কিছু মাথায় এল না। ভদ্রলোক আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, তিনি ইস্কুলেই জানতেন যে, আমি জীবনে উন্নতি করব। তোর কথাও বললেন। বললেন, মাকাল ফলটা এখনও সেইরকমই আছে। বললে, একটা চাকরি করছে, কিন্তু সে চাকরি যে কীরকম সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

    অর্ধেন্দু হেসে উঠল।

    এখানেই শেষ না, বলল কিরণ। আরও ব্যাপার আছে।

    কী ব্যাপার?

    ওঁর একটি ছেলে আছে। বাইশ বছর বয়স। ওঁর ছোট ছেলে। বি. কম. পাশ করেছে, কিন্তু চাকরি পায়নি এখনও। চেষ্টা করেও সুবিধা করতে পারছে না। প্রসন্ন স্যার বললেন, যদি তার জন্যে একটা কিছু করে দিতে পারি।

    তুই কী বললি?

    আমি বললাম, চেষ্টা করব। কী আর বলব বল!

    ঠিক আছে। প্রসন্ন স্যারের ধারণাটা বজায় রাখতে হবে। নাহলে লোকটা মনে বড় কষ্ট পাবে। হাজার হোক, অভাবী লোক তো, তার উপরে অসুস্থ। আর এককালে ক্লাসে ভাল পড়াতেন সেটা বলতেই হবে। ওঁর কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি।

    তা হলে কী করা যায় বল তো?

    ওঁর ছেলেকে একটা চাকরি জোগাড় করে দিতে হবে। ছেলেটা লেখাপড়ায় কেমন?

    বললেন তো ভাল, কিন্তু ব্যাকিং ছাড়া নাকি কিচ্ছু হচ্ছে না।

    তা হলে এক কাজ কর।

    ওঁর সঙ্গে দেখা করে বল, তোর আপিসে, অর্থাৎ আমার আপিসে গিয়ে দেখা করতে।

    আমি চেষ্টা করে দেখি ওর জন্য কিছু করা যায় কিনা।

    তাই বলব তো? তুই ঠিক বলছিস?

    ঠিক বলছি। ওঁর ছেলের জন্য যদি কিছু করতে হয় তা হলে সানশাইনই করবে। মাকাল ফলের দ্বারা কিছু হবে না।

    যাক, তুই আমাকে বাঁচালি!

    তবে একটা কথা ভুলিস না।

    কী?

    প্রসন্ন স্যার এককালে তোর কী নাম দিয়েছিলেন, আর আজকাল তোর কী অবস্থা হয়েছে।

    কিরণের মাথা হেঁট হয়ে গেল। সে বলল, বাবা মারা যাবার আগে ঠিক এই কথাটাই বলেছিলেন।

    তা হলে?

    তোর কথাটা মনে রাখব।

    ঠিক তো?

    ঠিক। কথা দিচ্ছি। কিরণ বিশ্বাস যে একেবারে শেষ হয়ে গেছে তা নয়।

    .

    পরদিন বিকেলে স্টেশন প্ল্যাটফর্মে আবার প্রসন্ন স্যারের সঙ্গে দেখা। বললেন, সানশাইন এখানে রয়েছে, জানিস তো?

    জানি, কাল দেখা হয়েছে।

    ছেলেটা একটুও বদলায়নি। বলল, আমার ছেলের জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেবে। তোকে আর দীপ্তেনের কথাটা বলিনি, কারণ জানি তোর দ্বারা কিছু হবে না।

    আপনি ঠিক লোককেই ধরেছেন স্যার। আর আপনার নামকরণের কোনও তুলনা নেই!

    শুকতারা, বৈশাখ ১৩৯৮

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅক্ষয়বাবুর শিক্ষা
    Next Article অভিরাম

    Related Articles

    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    ফেলুদা এণ্ড কোং – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    বাল্মীকির রাম ও রামায়ণ – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

    September 9, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    বাল্মীকির রাম ও রামায়ণ – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

    September 9, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    বাল্মীকির রাম ও রামায়ণ – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

    September 9, 2025

    মহাভারতের ছয় প্রবীণ – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

    September 9, 2025

    পুরাণী – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

    September 9, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.