Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    হলুদ বসন্ত –বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প131 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৫-৮. গাড়িভরা ঘুম

    গাড়িভরা ঘুম, কামরা নিঝুম।

    শীতকালের রাত চারটে অনেক রাত। কোনওক্রমে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে একটি বান্ডিলের মতো এসে হোল্ডল বিছিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। এখনও অনেকক্ষণ ঘুমুনো যাবে। কূপেতে আমি একা। ভিতর থেকে লক করে দিয়ে কম্বল মুড়ে ঘুম লাগিয়েছিলাম।

    লালগোলা প্যাসেঞ্জার চলেছে। শীতের আধো-ফোঁটা ভোরে–রিকঝিক; রিকঝিক; রিকিঝিকি রিকিঝিকি–রিকঝিক রিকঝিক।

    শুয়ে থাকতে থাকতে বুঝলাম, একসময় ভোর হল। চোখ মেলোম। বাইরে সোনালি রোদ–আকাশময় সাঁতরে বেড়াচ্ছে। মনে হল, যেন এই সকালে কারওই কোনও দুঃখে ডুবে মরার ভয় নেই।

    পায়ের কাছের জানালা দিয়ে একফালি রোদ এসে ধূসর কম্বলে লুটিয়ে পড়েছে।

    শিকারে-টিকারে গিয়ে আমার যখন ভীষণ শীত করে, পাতার ঘরে কি কোনও ডাকবাংলোয় চৌপায়ায়, যখন একটি কি দুটি কম্বলেও শীত মানে না–ঠোঁট যখন ঠান্ডায় নীল হয়ে যায়, পায়ের পাতাদুটি হিমেল হাওয়ায় হিম হয়ে ফ্যাকাশে হয়ে আসে, তখন আমি নয়নার কথা ভাবি। নয়নামোনার ভাবনা তখন কোনও চিকন পাখির পালকের লেপের মতো আমার কম্বলের তলায় আস্তে আস্তে ছড়িয়ে যায়। আমার সমস্ত সত্তা উষ্ণ হয়ে উঠতে থাকে, ধীরে ধীরে। তারপর আমার সমস্ত আমিত্বে একটি মসৃণ চিতাবাঘের চেকনাই লাগে। শীত কাকে বলে আমি ভুলে যাই।

    কিন্তু এই রেলগাড়ির কামরার সামান্য শীতে অতসব দরকার হয় না। এমনিই শুয়ে শুয়ে রোদ দেখলেই গা গরম হয়ে ওঠে। ভাল লাগে।

     

     

    রানাঘাট বোধহয় এসে গেল। চা খেতে হবে। বার্থ ছেড়ে উঠে বাথরুমে গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে নিলাম। পলাশী আসতে এখনও অনেক দেরি। চা খাবার পর আরও কিছুক্ষণ আরাম করা যাবে।

    রানাঘাট স্টেশনে চা নিলাম। কম্বল মুড়ি দিয়ে বসেই চা খেলাম। বেয়ারা এসে পেয়ালা-পিরিচ নিয়ে গেল।

    এবার লম্বা দৌড় দেবে গাড়ি।

    গায়ের পাশের জানালাটি এবার খুলে দিলাম। উঠে বসলাম। বাইরে ভাল করে তাকালাম।

    খেতে খেতে ধান কাটা শেষ হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও শীতের আনাজ লেগেছে। শিশির-ভেজা সবুজ ঝোপে ঝাড়ে প্রজাপতি ফুরফুর করছে। শুকনো খেতে পাখির ঝক একরাশ চঞ্চল ভাবনার মতো ছড়িয়ে পড়ছে; উড়ে যাচ্ছে। দূরে দূরে আম কাঁঠাল ঘেরা ছোট ছোট গ্রাম। কাছাকাছি ভেরাভার বেড়া দেওয়া কাদালেপা বাড়ি। পুকুরপাড়ে হাঁস প্যাঁকপ্যাঁকাচ্ছে। কোথাও খোঁটায়-বাঁধা একলা ছাগল দার্শনিকের মতো একদিকে চেয়ে কত কী ভাবছে। বাঁশবনের ছায়ায় ছাতার পাখিরা পঞ্চায়েত বসিয়েছে। ছ্যাঃ ছ্যাঃ ছ্যাঃ করে পরনিন্দা পরচর্চা হচ্ছে।

     

     

    সেই নদীটি এল।

    কী নীল জল! যতবার নদীটি পেরুই প্রতিবারই নতুন করে ভাল লাগে। ছিপছিপে, নীল, ব্যক্তিত্বসম্পন্না নদী। গুম গুম গুম গুম–গুম গুম গুম গুম করে লোহার কড়ি বরগা পেরিয়ে রেলগাড়ি নদী পার হল। পার হয়েই ছুটল–রিকিঝিকি রিকিঝিকি রিকিঝিকি ঝিকিঝিকি।

    বাইরের আদিগন্ত আকাশ আর সোনালি রোদ্দুরে তাকিয়ে হঠাৎ আমার মনে হল যেন দূরে, রেলগাড়ির পাশে পাশে, গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাল রাতের নীল বেনারসি পরে নয়নাসোনা শুটিখেতে, সরষেখেতে  শাড়িতে ঢেউ তুলে তুলে ছুটে চলেছে। ওকে দৌড়োলে যা সুন্দর লাগে! চিকি-চুঙ-চিকি-চুঙ-টাকা-টাকা-টিকি-টঙ গাড়ির তালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একবার ত্রিতালে, একবার কাহারবায়, একবার দাদরার ছন্দে নয়না আমার পাশে পাশে নীল বেনারসি পরে ছুটে চলেছে। যেন উড়ে উড়ে চলেছে। ওর পায়ের পাঁয়জোরের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ওর কোমরের রুপোর চাবির রিংয়ের ঝুনঝুনি শুনতে পাচ্ছি। নয়না আমার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। হাওয়ায় ওর। শাড়ি ফুলে উঠছে–আঁচল দুলে দুলে উঠছে–চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। দুলে দুলে, হাওয়ায় ফুলে ফুলে, ফুলের মতো ও কী যেন বলছে–হাওয়া আর চাকার শব্দ কথাগুলিকে নিয়ে কাঁপাস-তুলোর মতো উড়িয়ে দিচ্ছে–শুনতে পাচ্ছি না কিছু–কেবল বুকের কাছে নয়নার অস্তিত্ব অনুভব করছি। আমার সবটুকু ভাললাগা এই ভোরের রোদ্দুর হয়ে আকাশময়, মাঠময়, বিশ্বময় ছড়িয়ে গেছে।

     

     

    মনে হল, ট্রেনটার গতি কমে এল। চাকাগুলো কুমিরের শিস দেওয়ার মতো আওয়াজ করতে লাগল। হঠাৎ দেখলাম নয়না নেই। নয়না আমার সঙ্গে আর দৌড়োচ্ছে না।

    বীরনগরে পৌঁছে গেছে গাড়ি। বড় বড় সেগুন গাছ। সেগুন গাছের বন হয়ে আছে। স্টেশনের দু’পাশে। মনে হয় না, নদিয়া জেলায় আছি। গোদাপিয়াশাল বা শালবনী বলে মনে হয়।

    ট্রেনটা দাঁড়িয়ে পড়ল। সেগুনবনের আড়াল থেকে পাকু পাকু করে সাইকেল রিকশার হর্ন শোনা যাচ্ছে। প্লাটফর্মে একটি বিতিকিচ্ছিরি বিনতা বউ একটি নীল-রঙা শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে। ভেবেছে, বুঝি নীল-রঙা শাড়ি পরলেই নয়নার মতো দেখাবে। সঙ্গে, হলুদ শার্ট পরে নতুন বর। টোপর মাথায়।

    বীরনগরে ক্রশিং হবে। এখানে সিঙ্গল লাইন। কৃষ্ণনগর থেকে ডাউন লালগোলা প্যাসেঞ্জার আসবে, তবে এ গাড়ি ছাড়বে। প্রতিবারই এমনি অপেক্ষা করতে হয়। কোনও এক গাড়ির। যে গাড়ি আগে আসে।

    নয়না আমার সঙ্গে সঙ্গে আসছিল। একটু আগেও দেখেছিলাম। জানি না ও এখানে দৌড়ে আসছে কি না। কী বলছিল ও, শোনা হল না। বলছিল হয়তো–ঋজুদা, কাল আপনি না খেয়ে চলে এলেন বলে আমারও খাওয়া হল না। অসভ্য। না খেয়ে চলে এলেন কেন?

     

     

    জানি না কী বলছিল।

    জানি না, বীরনগরে আমাকে ও অপেক্ষা করতে বলেছিল কি না। দরকার হলে, মানে, ও এখানে আসবে জানলে, আমি আজীবন অপেক্ষা করতে পারি। শুধু এই জীবনই বা কেন? অনেক জীবন। জানি না আমি আর ও, একই সিঙ্গল লাইনে এই লালগোলা প্যাসেঞ্জার দুটির মতো বিপরীত মুখে ছুটে আসছি কি না। নয়না কিন্তু আমার সঙ্গে একই দিকে ছুটছিল–আমার পাশে পাশে। সে জন্যেই ভয়। বিপরীত মুখে ছুটলে কোনও-না-কোনও শান্ত স্টেশনে আমাদের দেখা হয়ে যেতই যে, সে বিষয়ে নিঃসংশয় হতাম। কিন্তু একই দিকে ছুটছি বলে, আমি হয়তো যখন ঘুমিয়ে থাকব কামরাতে, ও হয়তো আমাকে পিছনে ফেলে কোনও অজানা স্টেশনের দিকে চলে যাবে–যার টিকিট আমার কাছে নেই। অথবা, এই কানী রেলগাড়ির কামরার মতো কোনও কামরা, আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, আমার অজানিতে, হয়তো আমার নয়নার কাছ থেকে আমায় দূরে, বহু দূরে নিয়ে চলে যাবে। কোনও স্টেশনেই হয়তো আমাদের আর দেখা হবে না।

    বড় ভয় করে। আমার বড় ভয় করে।

    ঘণ্টা পড়ল। ডাউন লালগোলা প্যাসেঞ্জার আসছে। নীল বেনারসি পরা কুৎসিত বউটি একটু হাসল। বরটি যেন কী বলল। তারপর বিড়িটায় একটি শেষ সুখটান দিল।

     

     

    ওদের দুজনের জীবনের আপ ট্রেন আর ডাউন ট্রেন বীরনগরের মতো কোনও পূর্বনির্ধারিত স্থানে ক্রসিং করেছে। ওদের দেখে খুব ভাল লাগল। ওরা হারিয়ে যায়নি। দু’জনে দু’জনকে হারিয়ে ফেলেনি।

    এমন সময় গুম গুম করতে করতে অন্যদিক থেকে ট্রেনটি এসে ওদের মুখ দুটি আমার চোখ থেকে মুছে দিল। একটি খয়েরি চলমান রেখা ধীরে ধীরে প্রশস্ত হয়ে থেমে গেল লাইনের উপর। আমার দাঁড়ানো কামরার তলা থেকে একটি ধবধবে বেড়াল লাফ দিয়ে নিচু প্ল্যাটফর্মে উঠল। দুষ্টুমি করে আমাকে একবার চোখ টিপল–তারপর শীতের রোদে আড়মোড়া ভেঙে আর এক লাফে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে সেগুন বনে। লাফিয়ে নামল।

    দরজা খুলে মুখ বাড়িয়ে পেছনের মাঠভরা সোনালি রোদ্দুরে তাকালাম। এখনও আমার নয়ন দৌড়ে আসছে কি না তা দেখার জন্যে। দেখলাম, একটি সোহাগী নীলকণ্ঠ পাখি টেলিগ্রাফের তারে বসে আনন্দে গদগদ গলায় আপনমনে কী যেন স্বগতোক্তি করছে। এবং খুশি খুশি রোদ-ঠিকরানো ঠোঁটে মসৃণ পালক পরিষ্কার করছে। ওর গর্বিত মুখ দেখে মনে হল, এই নীল বেনারসি-পরা নিরিবিলি পাখিকেও বোধহয় আমার মতো করে অন্য কোনও নীলকণ্ঠ পাখি এই রোদ্দুর মাখা সকালে ভালবেসেছে। নইলে, ওর মুখ নয়নার মতো অমন নিরালা নরম দেখাত না।

     

     

    .

    ০৬.

    ভোরবেলা সামনের বাড়ির রেডিয়ো থেকে মুহূর্তবাহী “খোল দ্বার খোল লাগল যে দোল”-এর ঘুম ভাঙানো সুর কানে এসে লাগল। ঘুম ভেঙে গেল। হঠাৎ মনে পড়ল আজ দোল; আজ ছুটি।

    ভোরবেলার প্রথম কাপ চা খেয়ে অনেকক্ষণ ধরে নিপুণভাবে দাড়ি কামালাম। খবরের কাগজটা উলটে পালটে দেখলাম। কাল অফিস-ফেরতা একটি আনন্দবাজার দোলসংখ্যা কিনেছিলাম–সেইটে নিয়ে আরাম করে বারান্দায় ইজিচেয়ারে, মোড়ার উপর পা তুলে, মৌজ করে বসব। তার আগে অত্যাচারী আগন্তুকদের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে আলমারি খুলে একটা ছেঁড়া পায়জামা ও পাঞ্জাবি বের করলাম।

    এমন সময় সুজয় ফোন করল, কী রে? কী করছিস? এদিকে আসবি না?

    অতদূর হেঁটে কী করে যাব?

     

     

    গাড়ি নিয়েই আয়।

    সাদা গাড়ি। রং দেবে ভীষণ।

    তুই কে রে একটা মস্তান যে, বেছে বেছে তোর গাড়িতেই রং দেবে?

    কেউ নয় বলেই তো দেবে!

    যাঃ যাঃ ইয়ারকি মারিস না। দ্যাখ, বিদেশে ঠান্ডায় গিয়ে পচে মরব–কত বছর দোল খেলতে পারব না কে জানে? এই আমার আপাতত শেষ দোল খেলা–আয় না বাবা। মা ইয়া-ইয়া পান্তুয়া বানিয়েছে। নয়না কুচো নিমকি বানিয়েছে। একটু পর পাড়ার সব ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে আসবে। রমরমে কাণ্ড হবে। জানিস তো কলের ‘ফেরুল’ বাড়ানো হয়েছে। এবার আমাদের ওয়াটার-ফেস্টিভ্যালও খুব জমবে।

    আমার সর্দি সর্দি হয়েছে। জল দিলে যাব না।

     

     

    ও বলল, আমাকে অত ইনকনসিডারেট ভাবিস কেন? আমার ড্রয়ার ভরতি সেলিন ট্যাবলেট আছে–‘ভিটামিন সি’। আগে গোটা দুই খাইয়ে তারপর জল দেব। এমন সময় শুনলাম সুজয়ের পাশ থেকে কে যেন বলল, কে রে দাদা?

    ও বলল, ঋজু।

    আসতে চাইছে না?

    না।

    তারপরই নয়নার গলা শুনলাম।

    কী হে মশাই–আসতে পারছেন না?

    কেন যাব?

    বন্ধুদের সঙ্গে রং খেলবেন–পান্তুয়া খাবেন নিমকি খাবেন–মজা হবে–আর কেন?

     

     

    আমার ওরকম চেঁচামেচি, বেশি হই-হট্টগোল ভাল লাগে না।

    তো কীসে লাগে?

    একা একা তোমার সঙ্গে গল্প করতে।

    কোনও উত্তর দিল না ও।

    কী? বুঝলে?

    হুঁ!

    হুঁ মানে? কী বুঝলে?

    যা বোঝার ঠিকই বুঝেছি।

     

     

    হঠাৎ টোকা-খাওয়া টাকা-কেন্নোর মতো কুঁকড়ে গেলাম। আসলে আমার এই পাগলামি দেখে ও নিশ্চয়ই হাসে।

    বোধহয় বন্ধুদের কাছে আমার গল্প করে, অফ-পিরিয়ডে বোধহয় আমায় নিয়ে হাসাহাসি করে। সব বুঝি, মনে মনে লজ্জায়, অপমানে, প্রত্যাখ্যানে মরে থাকি–তবু বারে বারে ফিরে ফিরে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে গিয়ে দাঁড়াই। কোনও পুঁজিপতির মতো “নেহি হোগা; নেহি হোগা। চলো, ঠো হিয়াসে” বলে ও আমাকে তাড়িয়ে দেয়। মুখে কিছু বলে না। কিন্তু ওর নিস্পৃহতা দেখে বুঝতে পারি। বুঝতে পারি, আর মরমে মরে যাই। কিন্তু পরক্ষণেই আবার লজ্জাহীনের মতো ভিক্ষা চাই।

    এই ঋজুদা!

    কী?

    আসুন না বাবা।

    আমি গেলে তোমার ভাল লাগবে?

     

     

    বেশ কিছুক্ষণ কথার উত্তর নেই।

    তারপর বলল, আপনি জানেন না?

    না।

    তবে জানেন না।

    বলো। বলো না? ভাল লাগবে কি না?

    হুঁ।

    আবার হুঁ। নাঃ। তোমাকে বলতেই হবে।

    আচ্ছা নাছোড়বান্দা তো আপনি। লাগবে। হল তো? আপনি যেন কী? কোনওদিন কি বড় হবেন না?

    বড় হয়েছি বলেই তো এত যন্ত্রণা।

    অত আমি বুঝি না। তাড়াতাড়ি আসুন। আপনার জন্যে আমি বাঁদুরে রং গুলছি।

    .

    সুজয়দের বাড়ি গিয়ে যখন পৌঁছোলাম, তখন প্রায় দশটা। দেখলাম কুরুক্ষেত্র কাণ্ড বেধেছে। পাড়ার যত ছেলেমেয়ে সব ওদের বাড়িতে। নয়না একটা কালোর উপর লাল ফুল-তোলা বাঁধনি  শাড়ি পরেছে। দৌড়াদৌড়িতে শাড়ির প্রান্তে কালো মোটা সিল্কের সায়ার আভাস দেখা যাচ্ছে। মাথা—কপাল—শাড়ি–ব্লাউজ সব নানা রঙে রঙিন হয়ে গেছে। ওকে দেখে, কোনও ইম্প্রেশনিস্ট আর্টিস্টের চলমান ছবি বলে মনে হচ্ছে। ও কাছে আসছে, দূরে যাচ্ছে, অন্য মেয়েদের সঙ্গে দলবদ্ধ হচ্ছে, আবার পরক্ষণেই দলছুট হচ্ছে। ওর পায়ের পাতা দুটি শ্রীরাধার পায়ের মতো সুন্দর। পাতলা সরু দুটি পাতা। ইচ্ছে করে ধরে থাকি–মুখের সঙ্গে ঘষি।

    সুজয়ের বন্ধুরা মিলে আমাকে অতর্কিতে ও অন্যায়ভাবে জবরদস্তির সঙ্গে রঙে রঙে ভূত করল, তারপর এ ওকে বালতি বালতি জল ঢালল! সকলে মিলে ভিজে ঝোড়োকাক। ওদের ছোট্ট লনটিতে আমরা বসলাম সবাই। মাসিমা পান্তুয়া পাঠালেন, সঙ্গে নিমকি। তারপর কফি। নয়নার বান্ধবীরা মিলে কোরাস গাইল, “ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে।”

    দোলের দিনে প্রতিটি লোকই হেরে যাবার জন্যে মনে মনে প্রস্তুত থাকে। বলবান লোক, কিশোরী মেয়ে, রূপসি বউদি সেদিন যে-কোনও ছোট ছেলে অথবা যে-কোনও অবাধ্য দেওরের কাছে হেরে যাবার জন্যে মনেপ্রাণে হন্যে হয়ে থাকে। আমি যেমন অনুক্ষণ ভাগ্যের হাতে নিজেকে সমর্পণ করে বসে থাকি–এই একটি দিনে, সবাইকে তেমনি পরনির্ভর দেখি।

    আমারও ইচ্ছে ছিল, নয়নার কাছে সম্পূর্ণভাবে রাস্ত হব। ভেবেছিলাম, নয়না আমার খুব কাছে এসে যখন ওর সুন্দর সুরেলা আঙুল বুলিয়ে আমার সমস্ত সত্তাকে চাবি-টিপে টিপে একটি উদবেল পিয়ানোর মতো বাজাবে, তখন আমি আমার স্বপ্নের খুব কাছাকাছি আসব। মুহূর্তিক যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাব। কিন্তু নয়না কিছুই করল না। কাছে এল। যথেষ্ট ব্যবধান রেখে আমার কপালে আবির দিল–পায়ে আবির ছুঁইয়ে প্রণাম করল। আবির-মাখা মুখে, সুন্দর সুগন্ধি সঁতে একফালি আশাবাদী রোদের মতো হাসল। তাতেই আনন্দে মরে গেলাম। ইচ্ছে করলে আশীর্বাদ করার ছুতোয় আমি ওকে কাছে টেনে আনতে পারতাম–ওর মুখকে আমার বুকে, ঝড়ের রাতের ভয়ার্ত পাখিকে ঝাকড়া ঝাউ গাছ যেমন করে আশ্রয় দেয়, তেমনি করে আশ্রয় দিতে পারতাম। জড়িয়ে থাকতাম থরথরানো শরীরলতাকে। কিন্তু কিছুই পারলাম না। যে আমি অনুক্ষণ ওকে কল্পনা করে কাঁদি–ওর সুরেলা শরীরকে স্বচ্ছন্দে কোমল ‘নি’তে বাজাই, ওর নূপুরের মতো নিবিড় নাভিতে কল্পনায় অনিঃশেষ মৃগনাভির গন্ধ পাই, সেই আমি ওরই আঁচল থেকে একমুঠো বেগুনি আবির নিয়ে ওর মাথার উপরে উড়িয়ে দিয়ে বললাম, দিস ইজ দ্য সোবার ওয়ে।

    অন্য অনেক ছেলে নির্দ্বিধায় হয়তো যা করতে পারে–আমি তার কিছুই করতে পারি না। এমনকী, আমি যতখানি ভাল নই, নয়নার কাছে এলে আমি তাই হয়ে উঠি। আমার সত্যি আমি’র চেয়ে অনেক সংযত। যে কামনার ছুরি অনুক্ষণ হ্যাঁকস ব্লেডের মতো আমাকে চিরে চিরে চলে, ওর কাছে গেলে, কোনও অদৃশ্য মন্ত্রবলে আমার সেই সমস্ত কামনা শীতল শামুকের তুলতুলে শরীরের মতো বাইরের সংযমী আবরণের ভিতর মুখ লুকোয়। আমি অনেকদিন নিজেকে শুধিয়েছি–এ কি নিছক ভণ্ডামি? নিজেকে মহান করে লোকের সামনে তুলে ধরার কোনও নীচ প্রচেষ্টা? ধার করে অন্য লোকের মার্সিডিস গাড়ি চড়ার মতো এও কি কোনও সস্তা বড়লোকি? কিন্তু না। নিস্তব্ধ নির্জন বিকেলে অথবা কোনও হঠাৎ ঘুমভাঙারাতে নিজেকে বারবার শুধিয়ে এক জবাবই পেয়েছি। জুতো পায়ে যত ময়লাই মাড়াই না কেন–মন্দিরে যাবার আগে যেমন জুতো ছেড়ে রাখি বাইরে–নয়নাসোনার কাছে এলেও জুতো পায়ে আসার কথা আমি ভাবতে পারি না। ওর কাছ থেকে চলে এলেই আবার জুতো পরে ফেলি। লোক ঠকাই–ময়লা মাড়াই, কামনার অক্টোপাসের সঙ্গে কর্কশ কুস্তি করি। নয়নাসোনা আমার মন্দির।

    পাশের বাড়ির দেবদারু গাছে একটি কোকিল ডাকছিল। ফুরফুর করে বসন্তের হাওয়া দিচ্ছিল। ভিজে পাঞ্জাবিতে গা’টা শিরশির করে উঠে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল।

    এমন সময় সেই ছেলেটি এল। প্রথম দিন থেকেই আমি দু’চোখে একে দেখতে পারি না। নয়না যেন ওকে কী এক বিশেষ চোখে দেখে–কোনও বিশেষ কোণ থেকে। ছেলেটি ফরসা, লম্বা, মিষ্টি মিষ্টি হাসে, পেটের কাছে একটি মাঝারি সাইজের নাদু। পান খেয়েছে। পায়জামা ও আদ্দির পাঞ্জাবি পরেছে। গায়ের রং যে ফরসা তা দেখানোর জন্যে ইচ্ছে করেই বোধহয়, পিঠের কাছে অনেকখানি ছিঁড়ে রেখেছে। নীতীশ। মনে পড়েছে। এর নাম নীতীশ সেন। সেদিন সুজয় আলাপ করিয়ে দিয়েছিল।

    কেন জানি না, এতক্ষণ ধরে মনে মনে যে খুশির আলাপ করছিলাম, যে মহত্ত্বের জোড়কে গড়িয়ে গড়িয়ে ঔদার্যের মেরজাপ পরে একেবারে ঝনঝনে ঝালায় পৌঁছে দিয়েছিলাম–এক লহমায় তার সব শেষ হয়ে গেল। ঝনাত করে তার ছিঁড়ে গেল, ঢপ করে বাঁয়ার মধ্যে হাত ঢুকে গেল। আমার সকালটাই মাটি হল।

    নয়না এগিয়ে এসে আপ্যায়ন করে বলল, আসুন আসুন। ছেলেটি মাঝপথে দাঁড়িয়ে পড়ে নয়নাকে আবির দিল। বেশ ভদ্রভাবেই দিল। কিন্তু আমি নয়নার মুখে চেয়ে বুঝতে পারলাম যে নিছক শটিবাটা আবির, কপাল ভেদ করে আরও গভীরে প্রবেশ করল। আমার কানটা গরমে ঝাঁ- ঝাঁ করতে লাগল! মাথার মধ্যে কুনুক ঝুনুক করতে লাগল রক্ত। এত খারাপ লাগতে লাগল যে কী বলব। মনে হল ডেঙু হয়েছে। গায়ে পায়ে ব্যথা। সারা গায়ে অবসাদ, বিরক্তি; মুখ বিস্বাদ। নয়না কি ছেলেটিকে ভালবাসে নাকি? ছেলেটিও বোধহয় ভালবাসে।

    মনে হচ্ছে। এ সব ব্যাপারে আমার মনে-হওয়া মারাত্মক। এরকম মনে হওয়ার ক্ষমতা কোনও রেসুড়ের থাকলে সে কোটিপতি হয়ে যেত। আমার বারবার মনে হল, যা মনে হচ্ছে তা ঠিক।

    ছোটবেলা থেকে নয়না ছেলেটিকে চেনে। সুজয়দের মতে, ওরকম ছেলে নাকি হয় না। ও নাকি আদর্শ ছেলে। তার মানে বুঝতেই পাচ্ছি। গুডি গুডি টাইপ। মানে ন্যাকা। খেঁকি কুকুরের লেজে তারাবাতি বেঁধে এইসব ছেলের দিকে লেলিয়ে দিতে হয়। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। বাড়ির অবস্থা ভাল। শিলঙে কোন সাহেবি কোম্পানির চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট। ওখানেই থাকে। দোলে-দুর্গোৎসবে কলকাতা চলে আসে প্লেনে। দিনকয় অন্তঃসলিলা চালিয়াতি করে চলে যায়।

    ঠান্ডা মাথায় প্রতিপক্ষকে দেখতে লাগলাম। ষাঁড় যেমন বুল-ফাইটারকে দেখে। কীই-বা এমন ছেলে? হতে পারে আমার চেহারাটা ভাল না। কিন্তু পৃথিবীতে চেহারাই কি সব? হতে পারে ও চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট–কিন্তু তা বলে আমিও কি এঞ্জিনিয়র নই? ও লিখতে পারে? ছবি আঁকতে পারে? পারে না। ও খালি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। ও খালি টাকা রোজগার করতে পারে আর পাঙাস মাছের মতো চোখ করে অন্য লোকের টাকার হিসাব রাখে। যাচ্ছেতাই। যাচ্ছেতাই। ও আমার মতো করে ভালবাসতে পারে নয়নাকে? আমার মতো করে রাত্রি দিন, নীরবে ও সোচ্চারে নয়নাকে মনে করে? কিছুই করে না। অথচ, অথচ নয়না ভালবাসে ওকে। আমাকে নয়।

    পায়ের কাছের একমুঠো কচি দূর্বা ফস করে হ্যাঁচকা টানে টেনে তুললাম। নয়নাদের অ্যালসেশিয়ানটা গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে আমার কাছে এল। মনে মনে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললাম–গন্ধগোকুল কুত্তা–আমার কাছে কেন? অনেক সুগন্ধ ওদিকে আছে, যাও না শালা।

    কেন এমন হয়, কেন এমন হল, জানি না। আমার সমস্ত খুশি, সমস্ত ভাললাগা এক লহমায় বিষাদে ভরে গেল। পৃথিবীতে বিষাদ ছাড়া আর কিছু যে আছে, তা চেষ্টা করেও মনে আনতে পারলাম না।

    কেউ কেউ দ্বিতীয় কাপ কফি খাচ্ছিল। নয়না নিজে হাতে এক কাপ কফি এনে আমাকে বলল, নিন। ও জানত, কফি আমি ভালবাসি এবং ভিজে জামা কাপড়ে আর এক কাপ কফি না খাবার কোনও কারণ ছিল না। তবু ও কাছে এসে যে মুহূর্তে আমার সামনে দাঁড়িয়ে প্রীতিঝরানো হাসি হেসে বলল, নিন, ধরুন; সেই মুহূর্তে সব রাগ গিয়ে পড়ল ওর উপর। বললাম, খাব না।

    ও বুঝতে পারল কোনও কারণে আমি অখুশি আছি। আরও কাছে এসে বলল, রাগ করেছেন আমার উপর?

    ওর মুখের দিকে না চেয়েই অন্যদিকে চেয়ে বললাম, রাগ করার কোনও কারণ তো ঘটেনি। তবু আমার মুখে চেয়ে ও ব্যথিত হল। একটু চুপ করে থেকে বলল, খাবেন না? সত্যি?

    আমি কোনও জবাবই দিলাম না।

    অন্য অনেকে সেখানে ছিল। আর কিছুই না বলে ও কফিটা নিয়ে ফিরে গেল।

    একটুক্ষণ বসে থাকার পরই আমার মনে হল যে, আমার এখানে আর থাকবার কোনও মানে নেই। আর একটুও থাকা-না-থাকা সম্পূর্ণ অর্থহীন। আমার কাছে তো বটেই–নয়নার কাছেও। এবং অন্য কারও মতামত নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।

    হঠাৎ উঠে পড়লাম। উঠে সুজয় ও মাসিমার কাছে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। নয়না গেটের কাছ অবধি পৌঁছে দিতে পর্যন্ত এল। আমার উচিত ছিল যে একটা ভদ্রতাসূচক “চলি”অন্তত বলি। কিন্তু আমার রক্তের মধ্যে যে ভাবপ্রবণ জানোয়ারটা বাস করে সে নীরব রইল। দড়াম আওয়াজ করে অসভ্যর মতো দরজাটা বন্ধ করলাম। তারপর গাঁ গাঁ করে গাড়িময় কুৎসিত আর্তনাদ তুলে সোজা বাড়ি এসে পৌঁছোলাম। ঘরে বসে–চুপচাপ–একেবারে একা একা অনেকক্ষণ পাইপ খেলাম। তারপর চানঘরে ঢুকে যাওয়ার খুলোম। সমস্ত শরীরের রং–লাল, নীল, বেগুনি, সবুজ, রুপালি, সোনালি, সব রং অহংকারের মতো, আমার অন্ধ আবেগের মতো গলে গলে পড়তে লাগল। চানঘরের আয়নায় সেই সিক্ত, পরিবর্তনশীল, বহু রঙে-রঙিন ছবি দেখে, হঠাৎ নিজেকে মনে হল এ কোনও অনাদিকালের বহুরূপী। একে আমি নিজেও কোনওদিন চিনিনি। সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে রং তুলতে তুলতে হঠাৎ নিজের উপর খুব রাগ হল, ঘৃণা হল, নিজেকে মারতে ইচ্ছা করল।

    এত খারাপ লাগতে লাগল যে, কী বলব! মেয়েটিকে অমনভাবে বিনা কারণে ব্যথা দিয়ে এলাম–একটি কুৎসিত, নোংরা, একরোখা শুয়োরের মতো। ছিঃ ছিঃ ছিঃ। নয়নাকে আমি অন্যায়ভাবে ব্যথা দিয়ে এলাম। ভারী খারাপ আমি; ভীষণ খারাপ।

    .

    ০৭.

    দমদম এয়ারপোর্টের রিসেপশন কাউন্টারের পাশের টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করছিলাম। ডায়াল টোন শুনতে পেলাম ঘটাং করে পয়সা ফেললাম।

    একবার পিছন ফিরে তাকালাম। ইনশিয়োরেন্স কাউন্টারের ভদ্রলোক তখনও আমার দিকে অনিমেষ তাকিয়ে আছেন। হাতটা যদি ইচ্ছে মতো লম্বা হত তো ওইখানে দাঁড়িয়েই হাত বাড়িয়ে চটাস করে চড় মারতাম। মজা নাকি? পয়সা খরচ করে প্রিমিয়াম দেব আর উনি বলছেন ইনশিয়োরেন্স করবেন না। বলে কিনা, ইনশিয়োরেবল ইন্টারেস্ট নেই। যদি নয়নার জীবনে আমার ইন্টারেস্ট না থাকে–তো কার জীবনে আছে? তা ছাড়া পলিসি তো করছি আমি। প্লেন ক্র্যাশে মরলে নয়না দু’লাখ টাকা পাবে। ওকে তো নমিনি করলাম মাত্র।

    ভদ্রলোক চশমার ফাঁক দিয়ে শুধোলেন, রিলেশন?

    প্রথমে গম্ভীর হলাম।

    তারপর ভাবলাম, গম্ভীর হয়ে থাকলে খারাপ কিছু ভাবতে পারে–কত রকম বদখত লোক আছে কলকাতা শহরে–তাদের কত শত মেয়ের সঙ্গে কত রকম সম্পর্ক আছে। পাছে এই রামগড়ুরের ছানা, নয়না সম্বন্ধে খারাপ কিছু ভাবে–তাই হেসে ফেললাম। একেবারে এক গাল।

    বললাম, ভালবাসি।

    ভদ্রলোক চশমার তলা দিয়ে আমায় দরদরিয়ে দেখলেন, বললেন, তা হলে কী লিখব? লাভার?

    আমি বাধা দিয়ে বললাম, না না।

    তারপর অসহায়ভাবে বলাম, কিছুই না লিখলে হয় না?

    ভদ্রলোক পেনসিলটাকে দু’বার প্ল্যানচেটের মতো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বললেন, ফিঁয়াসে?

    খুশি হলাম।

    ভয়ে ভয়ে বললাম, আচ্ছা এইসব টেকনিকাল অসুবিধার জন্যে আমি মরে গেলে টাকাটা পেতে কোনও ঝামেলা হবে না তো?

    উনি কনফিডেন্টলি বললেন, দেখবেনই তখন স্যার।

    ফোন করতে করতে ভাবলাম, বেশ বলল বটে, দেখবেনই তখন স্যার। মরে গেলে কোথায় থাকব তা আমি কী করে জানব? দেখতে পাব কি না তাই বা কে জানে? আর দেখতে পেলেও অন্যায়ের প্রতিকার করতে পারবই যে এমন কি কোনও গ্যারান্টি আছে?

    তবে মরে যাবার পর যাই হোক, মরবার আগের মুহূর্তটিতে তো অন্তত আরামে মরতে পারব। এই ভেবেই আশ্বস্ত হলাম। পাশের সিটের ব্যবসায়ী প্যাসেঞ্জার যখন কোমরে বাঁধা টাকার থলি নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদবে–গর্বিতা এয়ার হোস্টেসের যখন নাক দিয়ে খুকুমণির মতো জল গড়াবে, কন্ট্রোলে-বসা পাইলট আর কো-পাইলটের তলপেট যখন গুড়গুঁড়িয়ে উঠবে আষাঢ়ে মেঘের মতো–তখন একা আমি আরাম করে শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখব। দু’লাখ টাকায় নয়না অনেক কিছু করতে পারবে। একটি ছোট্ট লনওয়ালা বাড়ি। একটি আকাশি-নীল রঙা স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড। তারপর ও যাকে ভালবাসবে, তার জন্যে কিছু করতে পারবে। সেই ছেলে। যদি পড়াশুনা করতে ভালবাসে, তাকে একটি মনোমতো স্টাডি করে দিতে পারবে। সে যদি শিকার করতে ভালবাসে, তাকে দামি দামি ডাবল ব্যারেল রাইফেল কিনে দিতে পারবে–আরও অনেক কিছু করতে পারবে–যা নয়না করতে চায় এবং যা ও আমায় কোনওদিনও জানতে দেয়নি।

    অত সামান্য প্রিমিয়ামের বদলে এমন একটি তৃপ্তি যে পাওয়া যাবে তা ভেবেই ভাল লাগছে।

    ফোনটা বাজছে। প্রায় দু’মিনিট হল। এত সকালে বোধহয় কেউ ওঠেনি।

    বেয়ারা ধরল। বলল, নয়না উঠেছে। চা খাচ্ছে।

    নয়না এসে ফোন ধরল।

    কী ব্যাপার? এত সকালে?

    দমদম এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করছি।

    কোথায় গেছিলেন?

    কোথাও যাইনি। এখন যাচ্ছি। গৌহাটি। সেখান থেকে শিলং।

    বেড়াতে?

    না না। অফিসের কাজে।

    আগেই যখন বলেননি, তখন তো পৌঁছেই খবরটা দিতে পারতেন।

    রাগ কোরো না। বিশ্বাস করো। গতকাল দিনে ও রাতে তোমায় তিনবার ফোন করেছিলাম।

    আমি তো সবসময়ই বাড়ি ছিলাম।

    হয়তো ছিলে। কিন্তু তুমি একবারও ফোন ধরোনি।

    কে ধরেছিল?

    প্রথম দু’বার তোমার জামাইবাবু, মানে দিলীপদা ধরেছিলেন, তার পরের বার ময়নাদি। আমি যখন কথা বললাম না তখন দিদি বললেন Ghost call.

    নয়না রেগে গেল। বলল, কেন? আপনি কী করেছিলেন?

    আমি কিছুই করিনি বা বলিনি। মানে বলতে পারিনি। আসলে আমার লজ্জা করছিল ভীষণ।

    লজ্জা করছিল? কেন?

    মানে ভেবেছিলাম, কিছু মনে করতে পারেন ওঁরা। কী কারণে আমি তোমাকে রোজ রোজ ফোন করি–একথা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।

    কেন ফোন করেন আপনি জানেন না?

    আমি জানি। আমি তো জানিই। আমার জন্যে ভয় নয়। ভয় তোমার জন্যে। তোমাকে পাছে ওঁরা কিছু ভাবেন। অথচ ভাবার কিছুই নেই।

    আমি কাউকে কেয়ার করি না।

    তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, আচ্ছা, আপনি না বাঘ মারেন?

    বললাম, সে সাহস অন্য সাহস। সে অনেক সহজ সাহস। তুমি বুঝবে না। কীসের ভয়, তা তুমি বুঝবে না।

    ও চুপ করে রইল।

    বললাম, শোনো। এক্ষুনি একটি দু’লাখ টাকার পলিসি করেছি। রসিদটা খামে করে তোমাকে পাঠালাম। আমার যদি কিছু হয় টাকাটা তোমার খুশিমতো খরচ কোরো। তোমাকে তো কিছুই দিতে পারিনি।

    ব্যাপারটার অভিনবত্বে ও বোধহয় রীতিমতো অভিভূত হয়ে পড়ল। অনেকক্ষণ কিছু বলল না।

    তারপর বলল, প্লেনে চড়লেই সকলে মরছে কিনা।

    বললাম, একদিন না একদিন তো মরতে পারে। অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট। তারপর, ওর কাছে প্রতি বার বাইরে যাবার আগে যেমন করে ভিক্ষা চাই, তেমনি করে ভিক্ষা চাইলাম।

    আমাকে চিঠি লিখবে? অন্তত একটি চিঠি।

    চিঠি? আচ্ছা। একটা তো? আচ্ছা। একটা লিখব। উঠবেন কোথায়?

    পাইনউড হোটেলে উঠব। খুব চমৎকার হোটেল। তুমি গেছ শিলং?

    অনেকদিন আগে। ছোটবেলায়। আমরা পিক হোটেলে ছিলাম।

    বললাম, ইস, যদি আমরা দুজনে একসঙ্গে যেতে পারতাম? খুব মজা হত, না? হয়তো মজা হত। কিন্তু কিছু কিছু মজা থাকে যা বাস্তবে হয় না। যা কল্পনায় করতে হয়।

    বললাম, জানি তা।

    কিছুক্ষণ পরে ও বলল, ঋজুদা, আপনি একটা পাগল। সত্যি সত্যিই ইনশিয়োরেন্স করেছেন? কেন করেছেন? আমি আপনার কে?

    বললাম, তুমি আমার কেউ নও। কিন্তু আমার মৃত্যুর পর হয়তো কেউ হবে।

    ও অস্বস্তিভরা গলায় বলল, আপনাকে নিয়ে মহা মুশকিলেই পড়লাম আমি। শুনুন। খুব ভাল হয়ে থাকবেন কিন্তু। দুষ্টুমি করবেন না। রোজ আমাকে একটা করে চিঠি দেবেন।

    নয়নার গলাটা একটু ভারী ভারী লাগল।

    আমি নিশ্চয়ই দেব। তুমি দেবে তো? তোমার চিঠির জন্যে বসে থাকব কিন্তু। তোমার যা খুশি লিখো; কিন্তু লিখো।

    একটা চিঠি তো? বেশ! এবারে ঠিক দেব। দেখবেন। তারপর বলল, ভাল লাগে না। কী যে চলে যান না, না বলে কয়ে এমনি হুট করে। ভেবেছিলাম, এই রবিবারে আপনাকে খেতে বলব। মা অনেকদিন হল আমায় বলছেন।

    কী করব বলো? অফিসের কাজ। না গিয়ে উপায় নেই।

    শিলঙে তো এখন বেশ ঠান্ডা হবে। ভাল করে গরম  কাপড় জামা নিয়েছেন তো? ঠান্ডা লাগাবেন না কিন্তু।

    এমন সময় প্লেন ছাড়ার অ্যানাউন্সমেন্ট শুনলাম মাইক্রোফোনে।

    বললাম, নয়না, ছাড়ছি এখন। প্লেনে উঠতে হবে। চলি।

    ওপাশ থেকে নয়না তাড়াতাড়ি বলল, ঋজুদা, ভাল হয়ে থাকবেন। চিঠি দেবেন। আচ্ছা!

    ফোন ছেড়ে দিয়ে প্লেনটি যেখানে টেক-অফের জন্যে রানি মৌমাছির মতো উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে দৌড়োলাম।

    দরজা দিয়ে বেরোতে গিয়ে একজন মোটা ভদ্রলোকের সঙ্গে ধাক্কা লাগল। ভদ্রলোক মারেন আর কী। যেন আমারই দোষ।

    কিন্তু আমার এখন কারও সঙ্গেই ঝগড়া করার ইচ্ছে নেই।

    হাত জোড় করে থিয়েটারি ভঙ্গিতে বললাম, অন্যায় হয়ে গেছে, মাপ করুন। আবার দৌড়োলাম। আমার পায়ে এখন খুরাল হরিণের বেগ। আমি এখন প্লেনের চেয়েও জোরে ছুটতে পারি। আমি নাচতে নাচতে দৌড়োলাম। আমি ভাল হয়ে থাকব, আমি ভাল হয়ে থাকব, আমি ভাল হয়ে থাকব…।

    প্লেনে উঠে গেলাম। সিঁড়ির মুখে, পাকা এয়ারহোস্টেস বিজ্ঞের মতো বলল, গুড মর্নিং। আমি হাসলাম, বললাম, ‘ভেরি গুড মর্নিং ইনডিড।’ মেয়েটি একটু ঘাবড়ে গেল। জায়গায় গিয়ে বসলাম। পাশে এক ছোকরা মিলিটারি অফিসার। আমাদের বয়সিই হবে। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট। তাকে পাশ কাটিয়ে জানালার পাশে আমার সিটে বসলাম।

    ফকার-ফ্রেন্ডশিপ বা অন্য কোনও প্রেশারইজড প্লেনে চড়ার মানে হয় না কোনও। বাইরের শব্দটব্দ কিছুই কানে আসে না। সাইলেন্ট পিকচারের মতো শুধু দেখা যায়। এর চেয়ে পুরনো ভাঙা ড্যাকোটা ভাল। পয়সা দিয়ে যে প্লেনে চড়েছি, তা প্রতি মুহূর্তে বুঝতে পারা যায়। ধড়ফড়-গড়গড় করে। ক্ষণে ক্ষণে এয়ার-পকেটে পড়ে বডি-থ্রো দেয়। ডিগবাজি খেতে চায়। মানে, প্রাণ এবং কান নিয়ে প্রতিমুহূর্তে লোফালুফি করে। বেশ অ্যাডভেঞ্চারাস এক্সপিরিয়েন্স। তা নয়, এ যেন। এয়ার কন্ডিশনড ঘরে বসে থাকা।

    প্লেনটা ট্যাক্সিয়িং করছে–উড়ল–উড়ল–ব্যস। এবার সোঁ সোঁ করে মেঘ ফুড়ে উপরে উঠল–মেঘকে নীচে ফেলে আরও উঠে গেল। তারপর মুখ সোজা করে গন্তব্যের দিকে চলল।

    পাকিস্তান আমাদের সঙ্গে নাক ঘষাঘষি করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হয়তো, কিন্তু আমাদের মতো প্লেন যাত্রীর লাভ হয়েছে বিস্তর। আগে প্লেন গৌহাটি যেত পাকিস্তানের উপর দিয়ে। এয়ার-হোস্টেস ক্যানক্যানে গলায় বলত, উই উইল শর্টলি ফ্লাই ওভার দি রিভার পদমা।

    জানালা দিয়ে পদ্মার ছবি দেখতাম–চর, জল; অববাহিকা। গল্পে-শোনা ভাটিয়ালি গানের পদ্মা, কল্পনার রাজকন্যা পদ্মা।

    কিন্তু এ বছর পাকিস্তানের উপর দিয়ে যাওয়া চলবে না।

    গেলেই হয়তো কড়াক-পিঙ করে দেবে।

    এখন প্রায় হিমালয়ের কোল ঘেঁষে যেতে হয়। ভারতের মধ্যে মধ্যে। আর ভাগ্যিস যেতে হয়। তুষারমৌলি হিমালয়ের সে কী রূপ। বরফাবৃত চূড়ায় সকালের রোদ এসে পড়েছে–আজ যেন নগাধিরাজের অভিষেক হচ্ছে। দার্জিলিং-আলমোড়া থেকেও হিমালয় দেখা, আর এ একেবারে নগাধিরাজের মুখের কাছে গিয়ে দেখা। এ দেখার তুলনা হয় না। কী সোনালি সুখ। কী সুন্দর। আমার নয়নাসোনার চেয়েও সুন্দর। এ দৃশ্য না-দেখলে জীবনে সত্যিই একটা দেখার মতো কিছু অদেখাই রয়ে যেত।

    এয়ারহোস্টেস ব্রেকফাস্টের ট্রে-টা নামিয়ে দিয়ে গেল। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে শুধোল, চা না কফি? বললুম, কফি। সামনে বসা গুজরাটি ভদ্রলোককে মেয়েটি শুধোল, ভেজেটারিয়ান অর নন-ভেজেটারিয়ান?

    ভদ্রলোক সাবধানে এদিক-ওদিকে তাকালেন, তারপর প্রাইভেটলি শুধোলেন, হুইচ উইল বি বেটার?

    তার মানে, বুঝলাম ডিম মাংস খাবার ইচ্ছে হয়েছে।

    বেচারি মেয়েটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

    ওর এয়ার-হোস্টেসের জীবনে এমন তাজ্জব প্রশ্ন ও শোনেনি।

    আমার চোখে চোখ পড়তেই ইশারায় বললাম, নন-ভেজ। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি পেশাদারি হাসি হেসে বলল, নন-ভেজেটারিয়ান।

    ভদ্রলোক যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বললেন, দেন, নন-ভেজেটারিয়ান প্লিজ।

    ব্রেকফাস্ট খেয়ে জমিয়ে পাইপটা ধরালাম। এখন খুব ভাল লাগছে। প্লেনে উঠেই প্রথম মিনিট পনেরো কুড়ি কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। মাটি ছেড়ে, সাধের পৃথিবী ছেড়ে মনটা দুখায়।

    এখন বেশ ভাল লাগছে। প্রপেলার দুটো নীল আকাশে হাওয়া কাটছে। পুজোর আর বেশি দেরি নেই। ধবধবে সাদা মেঘে সোনালি রোদ লেগেছে। পায়ের তলায় সুন্দরী পৃথিবী লুটিয়ে রয়েছে। ধুলো নেই, বালি নেই, স্টেটবাসের ধোঁয়া নেই, ধ্বংস করো ধ্বংস করো, চলবে না চলবে না, চিৎকার নেই। এখানে সবকিছু চলবে। গান গাওয়া চলবে, কাউকে ভীষণভাবে ভালবাসা চলবে, মানে, এখানে জীবন ছাড়িয়ে এসেও বেঁচে থাকা চলবে।

    প্রপেলার দুটো ঘুরছে। নিশ্চয়ই গুনগুন করছে। ভিতরে বসে শোনা যাচ্ছে না। প্লেনের স্টার-বোর্ড উইংয়ের একটা পাশে ছায়া পড়েছে। সাদা বরফের মতো কুচি কুচি জল জমেছে ধূসর পাখাটার গায়ে। যেন কোনও করুণ জাঙ্গিল–উড়ে চলেছে–উড়ে চলেছে–উড়ে চলেছে। ভারী ভাল লাগছে। বেঁচে আছি বলে আনন্দ হচ্ছে। মরার কথা ভাবতেও ইচ্ছে করছে না। পৃথিবীটা এত সুন্দর জায়গা। এত কিছু কান ভরে শোনার আছে, চোখ ভরে দেখার আছে, আর এই একটি পাগল মন নিয়ে ভাবার আছে যে, আমার মরতে ইচ্ছে করে না।

    আমি খুব ভাল আছি; ভাল হয়ে থাকব।

    .

    ০৮.

    এসবে এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এই উত্তাপহীনতা, এই ব্যথা পাওয়া, এই নিজেকে ছোট করার সীমালঙ্ঘন–এই সবকিছুতে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমি একটুও ভাল নেই।

    আমার মনে পড়ে না, নয়না কোন ব্যাপারে আমার অনুরোধ রেখেছে। আমাকে কোন অবকাশে অপমান না করেছে। আমার কোন আশাকে সে সফল করেছে?

    শিলং থেকে রোজ রাতে নয়নাকে আমি একটি করে চিঠি দিয়েছি। সকাল থেকে রাতে কী করলাম লিখেছি–। রোজ শোবার সময় পার্স থেকে ওর ছোট্ট ফোটোটি বের করে শুয়ে শুয়ে দেখেছি। ওর ছবির দিকে চাইলে মনে হয় না ও এরকম নিষ্ঠুর হতে পারে, এমন বিবেকহীন হতে পারে। রোজ শোবার সময়, আমি ওর জন্যে শুভকামনা করে ঘুমিয়েছি। কাজের অবকাশে, পাখি-ডাকা দুপুরে, ঝাউবনে-দোলা-দেওয়া হাওয়ায় যখন রোদের বাঁকা ফালি এসে পড়েছে–পাইনউড হোটেলের কাঠের ফ্লোরের বিরাট ডাইনিং রুমের পরদা-দেওয়া জানালার পাশে বসে, আমি একা একা লাঞ্চ খেয়েছি–আর নয়নার কথা ভেবেছি।

    আমার সজ্ঞানে, আমার চোখ খুলে, নয়না যা পছন্দ করে না তেমন কোনও কিছুই যে আমি করতে পারি এমন ভাবনাগুলিকে পর্যন্ত আমি ট্রাউজারের চোরকাটার মতো একটি একটি করে উপড়ে ফেলেছি।

    প্রতিদিন দুপুরে ও রাতে ম্যানেজারের অ্যাসিন্ট্যান্টের কাছে খোঁজ করেছি আমার চিঠি এসেছে কি না। তার সঙ্গে বসে ডাকবিভাগের নিরীহ কর্মচারীদের গাফিলতির তীব্র নিন্দা করেছি। ভেবেছি, চিঠি না-পাওয়ার জন্য তারাই দায়ী।

    হয়তো কিছুই লিখত না নয়না চিঠিতে হয়তো লিখত, ‘সু’দার, টেবলটেনিস টুর্নামেন্ট আরম্ভ হয়েছে–ওদের অ্যালসেশিয়ান কুকুরটার (জিম) শরীর ভাল যাচ্ছে না। ওর পড়াশুনার চাপ চলেছে। ইত্যাদি।

    ও যে কোনওদিন চিঠিতে আমাকে এমন কিছু লিখবে যা পরে ওর বিপদ ডেকে আনতে পারে, তা আমি মনে করি না। তা ছাড়া কোনও ব্যাপারে, বিশেষ করে ওর লেখা চিঠি দেখিয়ে ওকে ব্ল্যাকমেল করে ঠকানোর কথা, আমি অন্তত মনেও আনতে পারি না। তা ছাড়া ব্ল্যাকমেল যদি কেউ কোনওদিন আমাকে করতে চায়, তা ওই করতে পারবে। কারণ, আমি ওকে কিছু বাকি রেখে চিঠি লিখিনি। একজন সদ্বংশজাত ছেলে একজন সবংশজাতা মেয়েকে কিছুই বাকিনা-রেখে ভালবাসলে যেমন করে চিঠি লিখতে পারে তেমন করেই লিখেছি। এ চিঠিগুলির জন্যে হয়তো ভবিষ্যতে অনেক নিগৃহীত হতে হবে আমাকে। অনেকে এবং হয়তো নয়নাও গায়ে থুথু দেবে। আমার কী হবে তা নিয়ে কখনও আমি ভাবিনি। কারণ আমার ভালবাসায় কোনও মেকি ছিল না–আজও নেই। ও যদি আমার উজাড় করা ভালবাসার প্রতিদানে আমায় আরও শাস্তি দিতে চায় তা দেবে। আমার অধিকার বোধহয় শাস্তিতেই–পুরস্কারের ভাগ্য করে তো এ জন্মে জন্মাইনি।

    কিন্তু আমি তো ওর কাছে প্রেমপত্র প্রত্যাশা করিনি। শুধু ও কথা দিয়েছিল যে, একটা চিঠি দেবে। পাঁচটা নয়, দশটা নয়; মাত্র একটা চিঠি। সেই প্রতিশ্রুত একটি মাত্র চিঠিও আমাকে দেয়নি। আসলে আমিও যে একটা মানুষ, একটা রক্ত-মাংস–শরীর-হৃদয়ের মানুষ তো বোধহয় নয়না কোনওদিন ভেবে দেখেনি।

    আমি কি ব্যর্থ প্রেমিক? হয়তো ব্যর্থ আমি। ব্যর্থ; কারণ আমি নিজেকে সার্থক করতে পারিনি। কিন্তু তা বলে প্রেম কখনও ব্যর্থ হয় না। কারও প্রেমই কোনওদিন ব্যর্থ হয়নি। আমি সব সময় বুঝি, ভাবি, মনে রাখি যে, আমি একটি সামান্য ছেলে–একটি সামান্য ইঞ্জিনিয়র ঋজু বোস। আমার গর্ব করার মতো জীবনে কীই বা ছিল। না চেহারা, না গুণ; না অন্য কিছু। আমার মতো অনেক অকালকুষ্মাণ্ড ছেলে কলকাতার পথেঘাটে আকছার ঘুরে বেড়ায়। আসলে আমার সর্বস্ব দিয়ে নয়নাকে ভালবাসার আগে আমার কোনও পরিচয়ই ছিল না। আমি একটি Negative entity ছিলাম। কিন্তু এখন আমি একজন মহৎ মানুষ। প্রেম আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে যা আমার কোনওদিন ছিল না; যা কোনওদিন আমি অন্যত্র পেতাম না।

    নয়না আমাকে কিছুই দেয়নি এতবড় মিথ্যা কথা বললে আমার পাপ হবে। নয়না আমাকে যা দিয়েছে তার ঋণ শোধ করতেই আমার আবার এ পৃথিবীতে আসতে হবে। কিংবা হয়তো গত জন্মেও কিছু ঋণ ছিল। সে বোঝাই এখন হালকা করছি। কিন্তু এও তো সত্যি, নিজের কিছুমাত্রই না হারিয়ে নয়না আমাকে যা দিতে পারত তার কিছুই ও দেয়নি। নয়না সে কথা আমার চেয়েও ভাল করে জানে। তবু, ওর যদি বুদ্ধি বলে কিছু থেকে থাকে, যদি মন বলে কোনও পরিশীলিত বস্তু থেকে থাকে, তবে একদিন ও বুঝবে যে, যার বুকেই শুয়ে থাকুক না কেন, ঋজু বোসের মতো করে আর কেউ এ জন্মে ওকে ভালবাসতে পারবে না; পারেনি। একদিন না একদিন, এ সত্য তার কাছে প্রতিভাত হবেই।

    ভুলে থাকার চেষ্টা করি। সবসময় চেষ্টা করি। কিন্তু ভারী দেখতে ইচ্ছে করে ওকে, বড় কথা বলতে ইচ্ছে করে। মনটা পাগল পাগল করে। মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুব শাসন করি, বলি, কলকাতা শহরে নয়নাপেঁচি ছাড়া আর কি মেয়ে নেই? তোমাকে কি আর কেউ ভালবাসতে চায় না? চায়নি কোনওদিন? তক্ষুনি যে-আমি মনকে শাসন করে, সে-আমিকে ভীষণ ধমকে দিয়ে অন্য-আমি বলে, ইডিয়টের মতো কথা বোলো না। নয়না নয়নাই। নয়নার অভাব অন্য কাউকে দিয়ে পূরণ হয় না।

    আসলে এই ছুটির দিনগুলোই জ্বালায়। যেই নিমগাছটায় ঝুরু ঝুরু হাওয়া দেয়, স্থলপদ্ম গাছের সারিতে রোদের আঁচ লাগে–রঙ্গনেদের ডালে মৌটুসি পাখি এসে কিকি করে কথা বলে, অমনি ভিতরের পাগলটা গরাদ ভেঙে বাইরে আসতে চায়।

    আমাকে চিঠি না লিখে ও যা অন্যায় করেছে তার কোনও ক্ষমা হয় না। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ওকে ভুলে যাব। অন্তত এক মাস ওর সঙ্গে কোনও সংশ্রব রাখব না। মানে, ভেবেছিলাম, ওকে একটু টাইট দিতে হবে।

    কিন্তু শিলং থেকে ফিরেছি মাত্র পাঁচ দিন। ফিরে আসার পর এই প্রথম ছুটির দিন। কিন্তু আর প্রতিজ্ঞা রাখা হয়ে উঠল না। ভাবলাম একটা টেলিফোন করিই না নয়নাকে। এবারের মতো ক্ষমা করে দিই। যেতেও পারতাম ওদের ওখানে। কিন্তু একা একা কথা বলতে পাই না। সুজয়টা খেলার আলোচনা করবে। কোন প্লেয়ার কোন টিমে গেল–এই সিজনে কে ক’টা গোল দিল–। এখনও সেই কলেজের ছেলেই রয়ে গেছে–মাসিমা তার ন’দেওরের সেজ ছেলে দুর্গাপুরে কী ভাবে অ্যাকসিডেন্টে মারা গেল তার গল্প করবেন। নয়নার মুখের দিকে ভাল করে একবার তাকাতে পর্যন্ত পারব না। ওদের মুখের দিকে চেয়ে কথা শুনতে হবে, মাথা নাড়তে হবে–তারপর চা কি কফি খেয়ে রাগে গরগর করতে করতে চলে আসতে হবে। তার চেয়ে ফোন করা ভাল।

    ফোনটা নয়না ধরল। ইস কী বরাত আজ।

    কে?

    আমি নয়না বলছি। কে? ঋজুদা?

    হ্যাঁ। তোমার সঙ্গে কথা বলব না।

    বা রে। তা হলে ফোন করা কেন? ছেড়ে দিই? (বলে হাসল)।

    রাগে গা জ্বালা করতে লাগল।

    ও আবার বলল, কেন? কথা বলবেন না কেন?

    কেন, তুমি জানো না?

    না! কী হয়েছে? কবে এলেন আপনি?

    তা দিয়ে কী হবে!

    আপনার সব কটি চিঠি পেয়েছি। প্রতিটি চিঠি দারুণ হয়েছে। ভীষণ–ভীষণ ভাল লেগেছে। মানে, এত ভাল লেগেছে যা দাদা এবং মাকেও দেখিয়েছি।

    কী করেছ?

    চিঠিগুলি দাদা এবং মাকে দেখিয়েছি।

    তুমি না প্রতিজ্ঞা করেছিলে আমার চিঠি কাউকে দেখাবে না?

    করেছিলাম। কিন্তু এই চিঠিগুলো দারুণ ভাল হয়েছিল। এদের বেলা ও সব প্রতিজ্ঞা-টতিজ্ঞা খাটে না। সুমিতাকেও দেখিয়েছি।

    কিছু বলার নেই।

    অনেকক্ষণ চুপ করে রইলাম।

    কী হল? কথা বলুন।

    তুমি আমাকে চিঠি দাওনি কেন?

    ও খুব ক্যাজুয়ালি বলল, আর বলবেন না। জানেন, একদিন মনেও পড়ল। কিন্তু খাম-টাম ছিল না–। লিখব লিখব করে, আর হয়ে উঠল না। আর কীই বা লিখতাম? লিখিনি ভালই হয়েছে। পড়ে, আপনি হয়তো হাসতেন।

    কী আর বলব? সত্যিই বলার কিছুই নেই। চুপ করে রইলাম।

    নয়না বলল, তারপর? খুব তো বেড়িয়ে এলেন।

    হ্যাঁ, বেড়াতেই তো গেছিলাম কিনা? শিলঙে উঠতে যা বমি হয়। ভদ্রলোক শিলঙে যায়?

    বমি হয়? সে কী? আপনি কি মেয়ে নাকি?

    ভীষণ রাগ হল। বললাম, মানে? মেয়ে নাকি মানে কী? ট্রাক ট্রাক ষণ্ডা গুন্ডা মিলিটারির জোয়ানগুলি গলগল গলগল করে সারারাস্তা বমি করতে করতে যায় যে–তারাও বুঝি মেয়ে?

    নয়না হাসতে হাসতে বলল, তা জানি না, কিন্তু খুব হাসি পাচ্ছে। আপনি দোলনা দুলতে পারেন?

    দোলনায় আবার ছেলেরা চড়ে নাকি?

    পারেন?

    না। আমার গা গোলায়।

    ছিঃ। লোককে বলবেন না। সকলে হাসবে।

    একটু থেমেই বলল থাক, বাজে কথা থাক। এই একটু আগেই আপনার কথা ভাবছিলাম।

    আমার কী সৌভাগ্য!

    সত্যি। আপনার বন্দুকটা নিয়ে একবার আমাদের বাড়ি আসবেন?

    কেন? পাগল কুকুর বেরিয়েছে নাকি?

    না। পাগল কুকুর নয়। টিকটিকি–মানে মোটা মোটা বিচ্ছিরি কুমিরের মতো গাটা–কালো দেখতে।

    কোথায়?

    আমার বাথরুমে। দেওয়ালে। এমন ভয় দেখিয়েছে না আজ সকালে! সকালে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে জলের ঝাঁপটা দিয়ে যেই মুখ তুলেছি, দেখি আয়নার নীচে থেকে একেবারে আমার নাকের সামনে উঁকি মারছে। চমকে উঠে এমন চিৎকার করেছি যে মা দৌড়ে এসেছেন। পার্টিকুলারলি এই একটা টিকটিকিই খারাপ। যেমন দেখতে, তেমন স্বভাব।

    বললাম, আমার মতো?

    ও সিরিয়াসলি বলল, না না, ঠাট্টা নয়। এমন গোল্লা গোল্লা চোখে তাকায় না! চান করার সময়ও ভয় দেখায়। অন্য সাদা টিকটিকিগুলো কিছু করে না; ভাল। বেশ মেয়েলি স্বভাবের। এইটা একটা জংলি। পুরুষ পুরুষ।

    তারপর একটু থেমে বলল, আসবেন বন্দুকটা নিয়ে?

    টিকটিকি মারতে বন্দুক লাগে না। এয়ার রাইফেলেই কাজ হবে।

    কিংবা, গিয়ে, হাতে ধরে পকেটে পুরেও নিয়ে আসতে পারি।

    ইস, ঘেন্না করবে না?

    ঘেন্না করবে কেন? এমন একজন ভাগ্যবান ভদ্রলোক।

    কেন? কেন? ভাগ্যবান কেন?

    তা জানি না। তবে আমার খুব ইচ্ছে করে, আমি তোমার চান-ঘরের টিকটিকি হই।

    কেন?

    পরক্ষণেই মানে বুঝতে পেরে বলল, ই–স, কী খারাপ আপনি। ভারী, ভারী খারাপ হয়েছেন। সত্যি সত্যিই আপনি টিকটিকিটার মতোই জংলি। ছিঃ।

    অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম।

    ও সামনে থাকলে, সর্বাঙ্গীণ লজ্জায় লাল হলে ওকে কেমন দেখায় দেখতে পেতাম।

    তুমি কেমন আছ?

    ভাল। খুব ভাল। আপনি কেমন আছেন?

    ভাল।

    শিলঙে ভাল হয়ে ছিলেন তো?

    কেন? তুমি বললেই কি ভাল হয়ে থাকতে হবে?

    বা রে! আমি তো তা বলিনি।

    তোমার কথা আমি কেন শুনব? তুমি আমার কোনও কথা শোনো?

    এবারের মতো ক্ষমা করুন। দেখবেন, আমি আপনার সব কথা শুনব।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleহাজারদুয়ারি – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article স্বগতোক্তি – বুদ্ধদেব গুহ

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }