Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    হলুদ বসন্ত –বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প131 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৯-১২. পাড়াটা থমথম

    পাড়াটা থমথম করছে। ভয়ে নয়, নিস্তরঙ্গতায়। মিষ্টি মিষ্টি রোদে পাশের বাড়ির বউ চান করে, খড়কে-ডুরে শাড়ি পরে, দোতলার বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে ম্যাগাজিন দেখছে। কর্তা অফিস থেকে ফিরবেন, সে অপেক্ষায় নিশ্চয়ই অপেক্ষমাণ। আজ শনিবার। নিশ্চয়ই দুপুরে বাড়ি ফিরে লাঞ্চ করবেন। ভাল ভাল পদ রান্না হয়েছে। আজকে কর্তা রেলিশ করে কিছু খাবেন। তারপর হয়তো কর্তা-গিন্নি সিনেমায় যাবেন। বড় সাহেব হলে টার্ফ ক্লাবে, কি গলফ ক্লাবেও যেতে পারেন। নইলে অনেক কিছু করবেন, ভাবনীয় বা অভাবনীয়।

    এমন সময় নয়না ঘরে ঢুকে বলল, আকাশের দিকে তাকিয়ে কী ভাবছেন?

    হাতেধরা ম্যাগাজিনটা ফেলে বললাম, শুধু আকাশে নয়।

    নয়না কাছে এসে আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে বলল, ওর নাম রানী। আমাদের রানীবউদি।

    দেখে মনে হচ্ছে ভদ্রমহিলার স্বামী খুব শৌখিন?

    শৌখিন? থার্ডক্লাস। শখ বলে কোনও জিনিস নেই। রানীবউদির রুচি কিন্তু খুব ভাল। তার মধ্যে একটি দৃষ্টান্ত যদি দিতে পারি–যেমন আপনার লেখা খুব ভালবাসেন।

    কী ব্যাপার? আজ সকালে আমার কল্যাণে লেগেছ কেন?

    কখনও কি অকল্যাণে লেগেছি?

     

     

    না। তা লাগেনি। তুমি যে কল্যাণী।

    ঠাট্টা নয়। একদিন বুঝতে পাবেন। কল্যাণী কি না।

    নয়না চেয়ার টেনে বসে কী যেন ভাবতে লাগল।

    রানীবউদি কিন্তু অনেকদিন আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চেয়েছেন। দাদাকেও অনেকদিন বলেছেন। আমার কাছে আপনার কথা প্রায়ই জিগ্যেস করেন। আপনি কখন লেখেন? কে আপনার কপি ফেয়ার করে দেয়? আপনার মেজাজ কেমন? ইত্যাদি ইত্যাদি।

    তুমি কী বলে?

    আমি আবার কী বলব? আমি কি আপনার প্রাইভেট সেক্রেটারি যে এ সব কথার খবর রাখব? তবু, আমি বলি যা খুশি বানিয়ে বানিয়ে।

     

     

    বললাম, বানিয়ে বানিয়ে মানে?

    মানে, আমার যা বানাতে ইচ্ছে করে।

    বললাম, তোমার তো বুদ্ধি রাখার জায়গা নেই–কিন্তু এও বলে দাওনি তো যে আমার লেখার অনুপ্রেরণা তুমিই।

    ভারী তো লেখেন, তার আবার অনুপ্রেরণা।

    আচ্ছা। তোমাকে নিয়েই যদি একটি গল্প লিখি।

    আমাকে নিয়ে মানে?

    তোমাকে নিয়ে মানে, তোমাকে নায়িকা করে।

    আমি আবার নায়িকা হব কী করে? নায়িকা হবার যোগ্যতা কোথায়?

     

     

    সে তো নায়ক এবং যে লিখবে সে বুঝবে।

    তা হলে লিখুন। মনে হল, খুব নিস্পৃহ গলায় বলল কথাটা।

    বললাম, তোমার গর্ব হবে না নয়না?

    নয়না আমার চোখের দিকে চাইল–অনেকদিন পরে ও এরকমভাবে চাইল। তারপর মুখ নিচু করে নিয়ে বলল, হয়তো হবে। জানি না। কিন্তু নায়িকার গর্ব হলে লেখকের কী লাভ? লেখক কী পাবে?

    বললাম, লেখকরা তো কিছু পাবার জন্যে লেখেন না। নিজেদের নিঃশেষে ফুরিয়ে ফেলার জন্যে লেখেন। লেখকরা কোনওদিনও লাভবান হন না। নায়ক-নায়িকারা খুশি হলেই তারা খুশি হন।

    নয়না বলল, আমি অত জানি না। তবে আমার ভাবতেই মজা লাগে। নায়িকাকে কিন্তু আমার চেয়ে সুন্দর করে আঁকবেন। আর যিনি ছবি আঁকবেন, তাকেও বলে দেবেন–নায়িকা যেন দারুণ দেখতে হয়।

     

     

    বললাম, তোমার চেয়ে ভালয় আমার দরকার নেই। হুবহু তোমার মতো আঁকতে বলব।

    কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম।

    নয়না বলল, সত্যি, সত্যি, সত্যি? আমাকে নিয়ে গল্প লিখবেন?

    বললাম, সত্যি। সত্যি। সত্যি।

    অনেকক্ষণ নয়না মুখ নিচু করে বসে কী যেন ভাবতে লাগল। কিছুক্ষণ আগে ও চান করেছে। একটি খাটাউ ভয়েল পরেছে। চোখের নীচটা লালচে লাগছে। ভুরুতে একটু হালকা আইব্রো পেনসিল ছুঁইয়েছে। ঠোঁটে পাতলা করে ভেসলিন। চোখে সামান্য কাজল বুলিয়েছে। বারান্দার হাওয়ায়, ওর শিকাকাই-ঘষা চুল এলোমেলো হচ্ছে।

    ভালবাসা কাকে বলে জানি না। কোনওদিন, জানতেও চাইনি। হয়তো কোনওদিন জানতে চাইও না। এই মুখটি, এই সুগন্ধি শরীরটিকে কাছে পেলে আমি আর কিছু চাইনি–কোনওদিন চাই না। বেঁচে থাকবার জন্যে আমি আর কিছুই চাই না।

     

     

    বললাম, নেমন্তন্ন করেছ বলে কি মনে করেছ বাইরের রেস্তোরাঁগুলো সব বন্ধ হয়ে গেছে নাকি? খিদেয় যে নাড়িভুঁড়ি হজম হয়ে গেল। খেতে দেবে না?

    নয়না হাসল। ক্ষমা চাওয়া হাসি। বলল, বেচা–রা। খুব খিদে পেয়েছে, না?

    মায়ের মেয়ে তো এতক্ষণ নিজের কায়দা দেখিয়ে এল। এখন মা নিজে ছেলের বন্ধুর জন্যে বিশেষ পদ রান্না করছেন। আর একটু ধৈর্য ধরুন। বুড়ো মানুষ তো। মনে কষ্ট দিতে নেই! শখ করে রাঁধছেন।

    বললাম, মেয়েকে শিক্ষা তো খুব চমৎকার দিয়েছেন মাসিমা। দেবদ্বিজে ভক্তি করিবে, বৃদ্ধের মনে ব্যথা দিবে না। কিন্তু সে সঙ্গে এও তো শেখাতে পারতেন যে জীব মাত্ররই প্রাণ আছে। এবং প্রাণ থাকিলেই আঘাত লাগিতে পারে। অতএব যুবার প্রাণে কষ্ট দিবে না।

    নয়না এক ঝিলিক হেসে উঠল। বলল, আমি কোনও যুবার মনে সজ্ঞানে কষ্ট দিয়েছি বলে তো মনে পড়ে না। এখন যদি কেউ কষ্ট পায়, মন-গড়া কষ্টে নিজেকে ভোগায়, তা হলে তাকে ভগবানও বাঁচাতে পারেন না।

     

     

    মানুষ তো দূরের কথা, কী বলে?

    ও চোখ দিয়ে সায় দিল।

    মাসিমা বারান্দায় এলেন। বললেন, দেখেছ তোমার বন্ধুর কাণ্ড! এক্ষুনি ফোন করল যে ও আসতে পারবে না, ঋজুকে বলে দিতে, যেন কিছু মনে না করে।

    ও গেছে কোথায়?

    ওর এক বন্ধু রমেশ, তুমি চেনো না বোধহয়, আজ বিলেত চলে যাচ্ছে। বম্বে থেকে জাহাজ ধরবে। আজ বম্বে যাচ্ছে। তারই বাড়িতে গেছে।

    না মাসিমা। আমি চিনি না।

    সুজয়টার রকমই অমনি। বন্ধু এল বাড়িতে, তিনি গেলেন অন্য বন্ধুর বাড়ি।

     

     

    নয়না বলল, তাতে কী হয়েছে, মা, ঋজুদা তো কিছু মনে করেনি।

    মাসিমা বললেন, ঋজু মনে করুক আর না করুক, ও আসবেই বা না কেন?

    চলুন চলুন মাসিমা। ভীষণ খিদে পেয়েছে।

    চলো বাবা।

    নয়নাদের খাবার ঘরটি আমার ভারী ভাল লাগে। এমনকী, বসবাস ঘরের চেয়েও ভাল লাগে। সত্যি কথা বলতে কী, যে খাবার ঘরে ঢুকেই কেবল খিদে খিদে না পায়, বেশ শান্তির সঙ্গে নিরিবিলিতে খাওয়া না যায়, সেখানে খাওয়া-না-খাওয়া সমান।

    ঘরটি ছোট। দুটি জানালা। জানালা দিয়ে ওদের লনটি চোখে পড়ে। চেরিগাছের পাতায় চারটি চড়াই চিড়বিড় করছে। হা-হা হাওয়া, বোগেনভিলিয়ার পাতায় হইহই করছে। ঘরের দেওয়ালে একটি স্টিল লাইফ। তেলরঙা কাজ। এক কোণে ছোট্ট একটি রেফ্রিজারেটার ফিসফিস করে কী যেন কী বলে চলেছে। এক পাশে একটি মানানসই কাবার্ড। তাতে চিনে ঐকারি। এক দেওয়ালে নয়নার একটি ফ্রক-পরা বেণি-ঝোলানো ফোটো। ছোটবেলায় নয়নার চেহারাটা এখনকার মতো ছিল না। কেমন যেন অন্য রকম ছিল। সাপের খোলস ছাড়ার মতো ও যেন পুরনো শরীর ছেড়ে হঠাৎ এই নতুন সুগন্ধি শরীরে প্রবেশ করেছে।

     

     

    টেবিলে সুন্দর করে ফুল সাজিয়েছে নয়না। চমৎকার ম্যাটস পেতেছে। এরকম টেবিলে, এরকম ঘরে বসে, নুন-ভাত খেতেও ভাল লাগে। তাতেই পেট ভরে যায়। অনেক সময় কী খাচ্ছি সেটাই বড় হয় না, কেমন করে যাচ্ছি সেইটে বড় হয়। নয়নাদের খাবার ঘরে ঢুকলে কেবল আমার তাই মনে হয়।

    সুজয়টার রুচি দিন দিন বিড়িওয়ালার মতো হচ্ছে। কলেজে ও অন্য রকম ছিল। অথচ নয়নার রুচি দিনে দিনে আরও সুন্দর হচ্ছে। ঠিক মনে মনে আমি যেমনটি চাই, যেমনটি কল্পনা করি। নয়না যেন আমার সবরকম চাওয়াকে সফল করবে বলেই এ-জন্মে জন্মেছিল।

    মাসিমা চেয়ারটি টেনে দিয়ে বললেন, বোসো।

    তারপর বললেন, নয়না ফ্রায়েড রাইস আর মুরগিটা নিজে বেঁধেছে। অন্য রান্না ঠাকুরের। আমি কেবল তোমার জন্যে নারকেল দিয়ে বুটের ডাল বেঁধেছি। নয়না বলছিল, তুমি ভালবাসো।

    অবাক হলাম। আমি ভালবাসি? কই? আমি নিজেই জানি না। বললাম, নিজে জানি না আর নয়না জানল কী করে?

     

     

    নয়নার মুখ লাল হয়ে গেল।

    বলল, আপনি কী? সেই পিকনিকে কতখানি ভাত চেয়েছিলেন খালি ওই ডাল দিয়ে? মনে নেই? নিজে ভুলে যাবেন নিজের লোভের কথা, আর অন্যকে অপদস্থ করবেন।

    মনে পড়ল, মনে পড়ল। ঠিক তো। আমি তো ভালবাসি। আমি যে ভালবাসি নিজেই কোনওদিন জানিনি। আমার লোভের কথা আমি ভুলে গেছি। এমনি করে আমার সমস্ত দুরন্ত লোভগুলির কথা যদি আমি ভুলে যেতে পারতাম!

    মাসিমা বললেন, তোমরা দু’জনে খাও, আমি পুজোটা সেরে আসি ততক্ষণে। লজ্জা কোরো না ঋজু। তুমি আর সুজয় তো আমার কাছে আলাদা নও।

    নয়না বলে উঠল, লজ্জা করার পাত্র কিনা উনি । দাদার দু’গুণ খান।

    মাসিমা বকলেন, বললেন, এই! তুমি ভারী অসভ্য তো। বেশ করে। খায়। স্বাস্থ্যবান ছেলে, খাবে না তো কী? তোদের মতো ফিগার ফিগার বাতিক তো নেই?

     

     

    নয়না বলল, বাতিক থেকেই বা কী লাভ হত? না খেলেই যেন রক-হাডসন হয়ে যেত।

    নয়না আজ খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে রয়েছে সকাল থেকেই। কেন জানি না। এত কথা ওকে খুব কম বলতে শুনেছি।

    মাসিমা চলে গেলেন।

    আমি বললাম, চেহারাটা নিয়ে ঠাট্টা করো কেন? তুমি কি মনে করো তুমি খুব সুন্দরী? নিজে তো কাঁড়িয়া-পিরেতের মতো দেখতে!

    তা তো আমি জানিই, তবু তো…।

    কথা বললাম না। ফ্রায়েড রাইসটা জব্বর বেঁধেছে নয়না। একেবারে পিপিং কি ওয়ালডর্ফ বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।

    বললাম, রেস্তোরাঁ থেকে খাবার কিনে এনে নিজের বানানো বলে চালানো কি মহৎ কাজ? আমি সবই জানি।

    জানেন তো সবই। তবে জেনেশুনে অন্য লোকের লেখা বেমালুম টুকে নিজের বলে চালিয়ে কয়েকটি সরলবুদ্ধি মেয়ের কাছে নাম কেনার আকাঙ্ক্ষাই বুঝি খুব মহৎ?

     

     

    বললাম, তোমার সঙ্গে কথা বলব না। এই লেখা-টেখা নিয়ে কোনও কথা বোলো না। যা বোঝে না, তা নিয়ে কথা বলো কেন?

    বেশ বলব না। কিন্তু আপনি কী রান্না বোঝেন? বলুন তো ফ্রায়েড রাইস কীসে রাঁধে? ঘি, সরষের তেল, না ডালডা?

    খুব বোকা ভেবেছ? জানি না বুঝি? স্যালাড অয়েলে।

    ও মা। তা হলে জানেন? সরি। সরি। আই উইথড্র। সত্যি। আপনি ক–ত্ব। জানেন। বলেই হাসতে লাগল।

    হেসো না বলছি।

    ও বলল, বেশ হাসব না–খান খান–please ঝগড়া করবেন না। ভারী ঝগড়া করেন আপনি।

    দু’জনে অনেকক্ষণ বসে আস্তে আস্তে খেলাম। খাওয়ার সময়ে যে-কোনও মেয়েকে দেখে বলা যায় সে সদ্বংশজাত কি না। কেউ কেউ রাক্ষসীর মতো গেলে। কেউ কেউ বাঘিনির মতো ভাতের থালায় থাবড়া মারে, আর কেউ বা পদ্মিনীর মতো স্বপ্নভরা আঙুলে আলতো করে খাবার তুলে মুখে দেয়। তাকে তখন দেখলে, সে যে আহারের মতো অমন একটি প্রাচীন, আদি ও পশুভিনরাণাং প্রক্রিয়া করছে, তা দেখে বোঝার উপায় থাকে না। যেমন করে আলপনা দেয় তেমনি করেই নয়না খায়। ও আমার চোখে আর্টের সংজ্ঞা। ওকে কখনও কোনও অবস্থায়, হঠাৎ ঘুম-ভেঙে, অথবা ভীষণ ক্লান্ত অবস্থাতেও কুৎসিত দেখায় না। ওর সৌন্দর্য আমার ভালবাসার মতো ওকে সবসময় জড়িয়ে থাকে।

    খাওয়া শেষ হল। মশলা-টশলা কিছু খাবেন?

    না। পাইপ খাব।

    চলুন। আমার ঘরে চলুন। দুপুরে মা’র কাছে মহিলা-সম্মিলনীর বন্ধুরা আসবেন। ও ঘরে থাকলে আপনার বিপদ আছে।

    কেন? বিপদ কীসের?

    বাঃ বাঃ। কী বলেন? এমন একজন এলিজিবল বাঁচেলার। মায়ের প্রত্যেক বন্ধুর গোটা তিনেক করে উজ্জ্বল কন্যারত্ন আছে। কাজেই বিপদ অনিবার্য।

    আর তোমার মায়ের বুঝি কোনও কন্যা নেই?

    আমার মায়ের মেয়ের ভার মাকে নিতে হবে না। সে নিজেই নিজের ভার বইতে পারে।

    পারে বুঝি?

    পারে না?

    নয়নার ঘরটি দক্ষিণ-খোলা। একটি বিল্ট-ইন ওয়াড্রোব, একটি চওড়া ডিভান। কোনায় একটি পড়ার টেবল। একটি মোড়া। একফালি জাফরানি-রঙা মির্জাপুরি গালচে। তার উপরে একটি অ্যামপ্লিগ্রাম। দেওয়ালে, গোপাল ঘোষের একটি প্যাস্টেলে আঁকা স্কেচ।।

    ডিভানে বসে পাইপটা ধরালাম।

    নয়না বলল, আপনি একটু বসুন। আমি মায়ের খোঁজখবর নিয়ে আসি। বেচারি মা। মা’র জন্যে আমার ভারী কষ্ট হয়। একা একা মানুষ থাকতে পারে? আমার বন্ধুর মা’দের কত মজা। বাবাদের সঙ্গে সিনেমায় যান, চওড়া-চওড়া কস্তাপেড়ে শাড়ি পরেন। লে-দুর্গোৎসবে কত আনন্দ করেন। আর মা আমার কীরকম ফ্যাকাশে হয়ে থাকেন। বাবার উপর রাগ হয়। কোনও মানে হয়, এমন করে মাকে ফেলে যাবার?

    বললাম, কী করবে বলো? আমার তোমার তো কোনও হাত নেই।

    নয়না বলল, আমি এক্ষুনি আসছি, হ্যাঁ?

    নয়না চলে গেল।

    আমি বসে বসে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম, ওইটুকু মেয়ের সকলের প্রতি কী সমবেদনা। ওর ওই ক্ষীণ শরীরের ভিতর যে এতবড় একটি বুদ্ধিমতী মহতী প্রাণ লুকিয়ে আছে তা ওকে যে কাছ থেকে না জানে, সে কখনও জানবে না।

    ও ওর কাছের লোকেদের এমন হৃদয় দিয়ে অনুভব করে যে সে বলার নয়। আমি জানি ও আমাকে ভালবাসে না। হয়তো কোনওদিন ভালবাসবেও না। অথচ ও কোনওদিন আমাকে ঘুণাক্ষরেও জানতে দেয়নি যে, আমার কোনও ভবিষ্যৎ নেই। একে ফ্লার্ট করা বলে না। একে কী বলে তা জানি না। তবে এটুকু জানি, খুব কম মেয়ে জানে যে, আত্মসম্মান অক্ষুণ্ণ রেখে নিজের চাওয়াকে অবিকৃত রেখেও নিজেকে অনিঃশেষে কোনও ভিক্ষুকের হাতে তুলে দিতে হয়।

    হাই-ভোল্টেজ তামার তারের মতো, নয়না অনেক বিদ্যুৎভার সইতে পারে, বইতে পারে; কিন্তু ও নিজে জ্বলে যায় না। ও সেই বিদ্যুৎ বয়ে নিয়ে গিয়ে মনে মনে ঘরে ঘরে আলো জ্বালায়। ও আমার মন-দেয়ালি।

    নোংরা ভিক্ষুকের নোংরা হাতে ওর শালীনতা কলুষিত হতে পারে যে, সে সম্ভাবনার কথা ও জানে। অথচ, তবু যুদ্ধক্ষেত্রে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের মতো, ও আমার কামনাহত মনকে পবিত্রতার প্রদীপ জ্বেলে শুশ্রূষা করে, নিজের শরীরের গেরিলা বাহিনীকে ও অবহেলায় অগ্রাহ্য করে। কী করে ও পারে জানি না। শুধু জানি যে, ও পারে। একমাত্র ও-ই পারে।

    একটু পরে নয়না ফিরে এল।

    মোড়াটার উপর বসে বলল, Sound of Music দেখেছেন? গ্লোব-এ হচ্ছে।

    বললাম, যখন কলেজে পড়তাম তখন আমাদের কলেজ হলে একবার হয়েছিল। তখন দেখেছিলাম। অবশ্য অনেক দিন হয়ে গেল।

    সে তো পুরনো ছবি। নতুন ছবি দেখেননি? সেভেন্টি মিলিমিটারের ছবি। আর কী গান; কী গান!

    ব্যাপারটা কী বলো তো? ভাল করে মনে নেই।

    ব্যাপারটা গান।

    তারপর মোড়া ছেড়ে উঠে বলল, শুনুন তবে। আমার কাছে রেকর্ড আছে। শোনাচ্ছি।

    লং-প্লেয়িং রেকর্ড–অনেক গান। তার মধ্যে একটি গান আমাকে ও বিশেষ করে শুনতে বলল। বিশেষ করে কানে লাগল–

    Nothing comes from nothing,
    Nothing ever could,
    In my youth,
    Or in my childhood:
    I must have done
    Something good…

    গান শেষ হল।

    শুধোলাম, আচ্ছা এই ছবিতে অনেকগুলো বাচ্চাটাচ্চা ছিল না? জুলি এভুজ আছে?

    হ্যাঁ। আগে নান ছিল। পরে সাত-সাতটি ছেলেমেয়ের বাবা এক বদমেজাজি ক্যাপ্টেনের বাড়িতে গভর্নেস অ্যাপয়েন্টেড হল। পরে সেই ক্যাপ্টেনকে সে বিয়ে করল। মানে, “হাত দিয়ে দ্বার খুলব না গো; গান দিয়ে দ্বার খোলাব”।

    বললাম, বলো কী? সাত-সাতটি ছেলেমেয়ের বাবাকে সুশ্রী কুমারী মেয়ে বিয়ে করল?

    আজ্ঞে হ্যাঁ, স্যার।

    পুলকিত গলায় বললাম, তা হলে নিশ্চয় আমার মতো ব্যাচেলারদের আরও ভাল।

    নয়না এক চিলতে হাসল। বলল, বলা যায় না। হয়তো ভালও হতে পারে–তবে only if they have done something good in their youth or in their child hood.

    .

    ১০.

    পুজো পুজো পুজো। এসে গেল পুজো।

    জানি, লাউড-স্পিকারের শব্দে প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে, লোকের ভিড়ে মাথা ধরবে। তবু, কেন জানি পুজো এলে ভাল লাগে।

    বাঙালি বলে বোধহয়।

    মনে-প্রাণে পুরোপুরি বাঙালি বলে বোধহয়।

    শম্পু সরকার কি রুশি বিয়ান্দকারের তো এমন মনে হয় না। ওরা সাহেব। পুজোর ছুটিকেও ওরা অন্য যে কোনও ছুটি বলে মনে করে।

    সকালে উঠে ওরা যথারীতি চান করবে, ব্রেকফাস্ট করবে, তারপর ড্রেইনপাইপ গলিয়ে কারও বাড়ি গিয়ে তাসের আড্ডায় বসবে, নয়তো ক্লাবে গিয়ে বিয়ার খাবে। চঞ্চল চন্দ হয়তো বারান্দায় পাজামা পরে বসে, নিউ স্টেটসম্যানের ফিনফিনে পাতা খুলে নিজেকে যথার্থ কালচারড মনে করবে। যেন, পুজো তো কী? যেন পুজো কিছুই নয়।

    আমি তা ভাবতে পারি না। মহালয়ার ভোরে, আধো-ঘুমে-আধো-জাগরণে বালিশটা আঁকড়ে ধরে শুয়ে শুয়ে যখন মহিষাসুর বধের বর্ণনা শুনব রেডিয়োতে, যখন সেই শেষরাতে, সমস্ত পাড়া সমস্ত কলকাতা শহর, সমস্ত বাংলাদেশ গমগম করবে এক শুদ্ধ বিমুগ্ধ প্রভাতী বন্দনায়, তখন যে কী ভাল লাগবে সে কী বলব! শুধু আমার কেন? খাঁটি বাঙালি মাত্রেরই লাগবে। পুজো আসছে। ভাল লাগবে না?

    তারপর মহালয়ার ভোর হবে। শরতের নীল আকাশে রোদ্দুর ঝিলিক দেবে। সকালে হয়তো রেডিয়োতে কণিকা ব্যানার্জির গান থাকবে–শরত-আলোর কমল বনে, বাহির হয়ে বিহার করে, যে ছিল মোর মনে মনে…। শুনব। চুপ করে বসে কান পেতে শুনব; চোখ চেয়ে শরতের রোদ দেখব, নাক ভরে শিউলি ফুলের গন্ধ নেব; আর ভাললাগায় মরে যাব।

    সেই পুজো এসে গেল।

    অনেকদিন থেকে ভেবেছিলাম যে, নয়নাকে একটি ভাল শাড়ি কিনে দেব পুজোয়। পথ চলতে হঠাৎ কোনও শো-কেসে চোখ পড়তে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছি অনেকদিন। কোনও সুন্দর শাড়ি দেখেছি। মনে মনে নয়নাকে সে শাড়ি পরিয়ে, মনের চোখের সামনে দাঁড় করিয়ে কেমন দেখিয়েছে, ভেবে নিয়েছি। তারপর মনে হয়েছে, এ চলবে না। এ রং বড় ক্যাটকেটে। রং ভাল লেগেছে যদিবা তো পাড় পছন্দ হয়নি। পাড় যদি বা পছন্দ হয়েছে তো আঁচলটা বড় জবরজং লেগেছে!

    পথে পথে দোকানে দোকানে এ ক’দিন অবকাশ পেলেই ঘুরেছি, কিন্তু নয়নার শাড়ি পছন্দ হয়নি। নয়নাকে যে শাড়ি আমি দেব সে তো নিছক একটি শাড়ি মাত্র নয়। তা আমার ভালবাসার সুতো দিয়ে বোনা, তাতে যে আমার দুঃখের পাড়-বসানো–সে শাড়ির আঁচলার জরিতে যে আমার অনেক অবুঝ চাওয়া শরতের আলোয় জ্বলবে। সে শাড়ির সমস্ত মসৃণতায় আমি যে আমার নয়নামোনার সমস্ত শরীরে মিশে থাকব ছড়িয়ে থাকব। আমি যে জড়িয়ে থাকব।

    অনেক বেছে বেছে শেষে পছন্দ হল একটি তসরের শাড়ি। শাড়ির মতো শাড়ি। আমার পুজোর ড্রয়িংস-এর বেশ একটি মোটা অঙ্কই তাতে চলে গেল।

    ভাগ্যিস গেল।

    নইলে ও টাকায় আমার কী হত? টাকায় কী হয়? কারই বা কী হয়? একটা সীমা–ন্যূনতম ভদ্রলোকি সীমায় পৌঁছোনোর পর টাকায় কারই বা কী হয়? ভালবাসার ধনকে উপহার দেবার মতো মহৎ উপায়ে নষ্ট করা ছাড়া প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা থাকার মানে হয় না। আমি এ ব্যাপারে অনেক ভেবেছি। নিজের প্রয়োজন কোনওদিন মিটবে না। প্রয়োজনের শেষ হবে না। বাড়ালেই বাড়বে। তার চেয়ে নিজের প্রয়োজন সীমিত রেখে, যাদের ভালবাসি তাদের জন্যে কিছু করতে পারলে আনন্দে বুক ভরে যায়।

    যে টাকায় নয়নাকে শাড়ি কিনে দিলাম, সে টাকায় আমার একটি ভাল টেরিলিনের সুট হত। কিন্তু বিনিময়ে এ যে আমার কত বড় পাওয়া হল আমিই জানি। নয়না যেদিন পুজোর মধ্যে ওই শাড়িটি পরে আমার সঙ্গে দেখা করবে, ওই শাড়িটি পরে যখন হাসি হাসি মুখে আমার দিকে চাইবে, তখন আমি দশ-দশটি টেরিলিনের সুট-প্রাপ্তি আনন্দ পাব। সব আনন্দের মাপ কি একই কাঁটায় হয়? এ আনন্দ অন্য আনন্দ, উদার আনন্দ। মহৎ আনন্দ।

    পুজোর দিনে পুজোমণ্ডপে ধূপের গন্ধ, ফুলের গন্ধ, ফলের গন্ধ, ভোগের খিচুড়ি রান্নার গন্ধ, ঢাকের শব্দ, শিশুর কান্নার শব্দ, যুবতীর উচ্ছল হাসির জলতরঙ্গ, এবং বিধবার করুণ বিষণ্ণ নিস্তব্ধতার মাঝে মা দুর্গার সামনে নয়না এই শাড়ি পরে যখন আমার সামনে এসে দাঁড়াবে, তখন আমি ভাললাগার পবিত্রতায় নিস্তরঙ্গ হয়ে যাব। তখন আমি নয়নাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে চাইব। চান করা। খোলা চুল ওর পিঠময় ছড়িয়ে থাকবে। ওকে আমি নিচু হয়ে প্রণাম করব। ও বলবে, আঃ কী করছেন ঋজুদা! ওকে আমি প্রণাম করব, মা দুর্গাকে প্রণাম করব। সেই পুজোর সকালকে প্রণাম করব, আমার সুগন্ধি ভালবাসাকে প্রণাম করব। কী করে হবে জানি না, সেই মুহূর্তে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে নয়নাকে মায়েরই অন্য এক রূপ বলে আমার মনে হবে। সেই সকালে নয়নার কাছে আমি সস্তা কিছু চাইব না। শুধু মনের সুগন্ধ চাইব, শুধু নিচু হয়ে মাথা নত করে প্রণাম করতে চাইব। নিজেকে ছোট করে, মাটির সঙ্গে মিশিয়ে, ধুলো করে মায়ের সামনে নিজেকে জানার চেষ্টা করব।

    .

    আজ মহাষ্টমী। স্নান করে জাস্টিস মুখার্জির বাড়ির পুজোমণ্ডপে গিয়ে অঞ্জলি দিয়ে এসেছি। এখন ধুতি-পাঞ্জাবি পরে নিজের ঘরে বসে আছি। ভাবছি, কী করা যায়। যতিদের বাড়ি পুজো হয়। দুপুরে যেতে বলেছে। খেতে বলেছে। পুজোর পরই ওরা ক’দিনের জন্যে হাজারিবাগে যাচ্ছে শিকারে। অনেকবার যেতে বলেছে আমায়। সুগতও যাচ্ছে। রঞ্জনও যাবে। ভাবছি, ঘুরেই আসি। অনেকদিন যাই না জঙ্গলে। ঘোড়ফরাসদের সঙ্গে কথা বলি না। টুঙি পাখির শিস শুনি না। কালি-তিতিরের ডাক শুনি না। মাদলের আওয়াজ শুনি না। মানে, অনেক কিছু অনেকদিন দেখি না, শুনি না; গন্ধ নিই না। অতএব যাব।

    সুগতকে একটি ফোন করলাম। বললাম, যতির বাড়ি এসো। কথা আছে। আমিও হাজারিবাগ যাচ্ছি।

    ও বলল, খুব ভাল কথা। এগারোটা নাগাদ চলে এসো। আমিও পৌঁছোচ্ছি। ফোন রেখে দিলাম।

    এমন সময় দরজার পরদার আড়ালে দাঁড়িয়ে কে যেন আমার ঘরের খোলা দরজায় দু’বার টোকা দিল।

    চেয়ে দেখি, পরদার নীচে ফলসারঙা শাড়ির তলায় দুটি পা–খালি পা। এ পায়ের পাতা আমি চিনি। এ পায়ের পাতা অনেক রাতে আমি স্বপ্ন দেখেছি।

    নয়না বলল, আসতে পারি?

    উঠে বললাম, এসো এসো, আমার কী সৌভাগ্য!

    ও ঘরে ঢুকল। একটু হাসল, তারপর আমার লেখার টেবলের সামনের চেয়ারে বসল।

    বলল, মিনুদির সঙ্গে দেখা করে এলাম। উনি এক্ষুনি বেরুচ্ছেন। কাকিমাও দক্ষিণেশ্বরে গেছেন।

    হুঁ। ভাগ্যিস গেছেন। নইলে কি রাধারানীর পা আমার ঘরে পড়ত?

    পড়ত না?

    না।

    কী করে জানলেন?

    জানি।

    ও উত্তরে কিছু বলল না। আমার দিকে চেয়ে থাকল চুপ করে।

    বললাম, নোডো না। চুপ করে বোসো। তোমাকে আশ মিটিয়ে দেখি। পরদাগুলো সরিয়ে দিই–ঘরটা আলোয় ভরে যাক। তোমার আলোয়।

    ও, কথা না বলে, আমার পরদা সরানো দেখতে লাগল।

    পরদা সরাতে আমাকে ওর কাছে যেতে হল। ওর গা দিয়ে নতুন তাঁতের শাড়ির গন্ধ বেরুচ্ছে–। নতুন ব্লাউজ পরেছে–চুলের তেলের গন্ধ এবং নতুন শাড়ি-জামার গন্ধ মিলে ওকে কেমন নতুন নতুন লাগছে।

    আবার এসে বসলাম মোড়াতে।

    ও পা দুটি জোড়া করে সামনে ছড়িয়ে দিয়েছে।

    চুপ করে আমি ওর পায়ের পাতার দিকে চেয়ে রইলাম।

    কী দেখছেন? অসভ্যের মতো?

    তোমার পায়ের পাতা। আমায় একটু ধরতে দেবে?

    ও উত্তেজিত হয়ে বলল, না। না। দেখতেও দেব না। বলেই শাড়ির পাড়ের আড়ালে পা ঢেকে নিল।

    বললাম, তুমি এত কৃপণ কেন? পায়ের পাতা তো ভিখিরিকেও লোকে ধরতে দেয়। তুমি আমার সঙ্গে এমন করো কেন?

    আপনি ভিখিনি নন বলে।

    আমি তবে কী?

    কী জানি না। তবে ভিখিরি নন।

    নয়নার চোখে এমন একটি ভাব দেখলাম, যেন ও আমার এই পাগলামি দেখে কষ্ট পাচ্ছে। যেন ও আমাকে কিছুই যে দিতে পারল না, এই পুজোর দিনে, যে দিনে ভিখিরিরাও ভিক্ষে পায়, সে দিনে আমার এই সামান্য চাওয়াও ও পূরণ করল না–আমাকে এমন করে ফেরাল বলে, মনে হল, যেন ও দুঃখ পাচ্ছে।

    আমি কিছু বললাম না। ওর অপমান এখন আমার গা সওয়া হয়ে গেছে।

    ও-ও আর কিছু বলল না। চুপ করে মুখ নামিয়ে নিল।

    কিছুক্ষণ পর আমার টেবলে যে লেখাটি পড়ে ছিল সেটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল।

    বলল, এটা কী লিখছেন?

    তোমাকে নিয়ে যে গল্প লিখব বলেছিলাম, মনে আছে? সেই গল্প লিখছি।

    যে-কোনও অন্য মেয়ে হলে উল্লসিত হয়ে উঠত। কিন্তু আমি আমার নয়নাকে চিনি। ও কিছুই করল না। আমার দিকে একবার চাইল, যেন বলতে চাইল, এ আবার কী নতুন পাগলামি?

    শুধোলাম, তোমার নিজের কী নাম হলে তুমি সবচেয়ে সুখী হতে? মানে, তোমাকে যদি তোমার নিজের নাম রাখতে বলা হত, তা হলে কী নাম রাখতে?

    ও ওর হাতের রুপোর বালাটা নাড়তে নাড়তে বলল, নয়না।

    বললাম, বেশ। নায়িকার নাম তা হলে নয়নাই থাকবে। তোমার নিজের নামের নায়িকা হবে–তোমার ভয় করবে না?

    আমি তো বলেছি আপনাকে যে, আমি কাউকে ভয় করি না।

    কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, গল্প গল্পই। গল্প পড়ে আবার আমাকে সলিসিটারের নোটিশ দিয়ো না যেন।

    ও আমার কথা ঘুরিয়ে বলল, জানি, দেব না, কারণ গল্প গল্পই।

    তারপর চুপ করে আমার চোখের দিকে চেয়ে বসে রইল।

    ওর দিকে চেয়ে ভাবলাম, এ গল্প সত্যি সত্যি লেখার হয়তো দরকার ছিল না। কিন্তু নয়নার প্রতি আমার ভালবাসা যে নিছক খেলা নয়, নিছক ছেলেমানুষি নয়, নিছক পাগলামিই নয়, নয়নাকে তা জানানো দরকার। নয়নাকে মুখে যা বলতে পারিনি, চিঠিতে যা লিখতে পারিনি, তা আমি এই গল্পে বলতে পারব। আমার যা ছিল, সব যে ওকে আমি দিয়ে ফেলেছি, তা ওর জানা দরকার। আমার এই

    অসহায়তা সম্বন্ধে ওর একটু ভাবা দরকার।

    যখন রোজ একটি করে চিঠি লিখে নয়নাসোনাকে এবং তার বাড়ির অন্যান্যদের আমি আর বিব্রত করব না–তখন আমার এই বই নয়না হাতের কাছে রাখতে পারবে। কখনও যদি কোনও মেঘলা দুপুরে কি কোনও উদাস বাসন্তী রাতে কখনও ভুল করে তার এই পাগলকে মনে পড়ে, সে তখন আমার এই গল্পের দিলরুবা নেড়েচেড়ে দেখবে। আমি মৃত্যুর পর যেখানেই থাকি না কেন, সে মুহূর্তে একটি সুন্দর কাঁচপোকা হয়ে জানালা দিয়ে উড়ে এসে সেই দিলরুবার দুঃখের সুরে গলা মিলিয়ে নয়নার কানের কাছে গান গাইব। নয়না যদি আমাকে কোনওদিন একটুও ভালবেসে থাকে, তা হলে সেই মুহূর্তে সেই কাঁচপোকার করুণ কান্না সে ঠিক চিনতে পারবে। হয়তো আমার জন্যে তার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে এই বইয়ের উপরেই পড়বে।

    তাই, একে শুধু গল্পই বা বলি কেন! এ যে অনেক কিছু। আমার জবানবন্দি।

    নয়না বলল, গল্পের নাম ঠিক করেছেন?

    না। ভাবছি–হলুদ বসন্ত।

    কেন? আমার নাম কেন?

    বাঃ রে, তোমার গল্প, তোমার নামের নায়িকা, আর তোমার সোহাগী নামের নাম হবে না? তুমি যে সত্যিই আমার হলুদ-বসন্ত পাখি।

    সত্যি? ওই নামের কোনও পাখি আছে?

    নেই? ভারী সুন্দর পাখি। আমি ছোটবেলায় না চিনে একটি পাখি মেরেছিলাম। উড়িষ্যায়। এত কষ্ট হয়েছিল কী বলব! কী যে সুন্দর পাখি। হুবহু তোমার মতো।

    জানি না। আপনি কী যে করছেন। কী সব লিখছেন। শেষকালে লোকে ভাবুক ভুল কিছু।

    আমার বুকের মধ্যেটা ব্যথায় মুচড়ে উঠল। বললাম, লোকে কী ভাববে? নয়না ঋজু বোসকে ভালবাসত? তোমার কোনও ভয় নেই সোনা। লোকে তা ভাববে না। যা সত্যি নয়, যা আগাগোড়া মিথ্যা, তা তারা কেন ভাববে? তারপর একটু থেমে বললাম, তোমাকে আমি কাঙালের মতো চেয়ে নিজেকে নিঃশেষ করেছি মাত্র। তুমি তো আমাকে কিছুমাত্র দাওনি, ভালবাসনি, অন্যায় করোনি, তাই তোমাকে ভুল বোঝার কিছুই নেই এতে। তুমি বাস্তবে যেমন শীতল, নিষ্ঠুর এবং মহৎ, তোমাকে তেমনি করেই আঁকব।

    আর আপনাকে?

    আমার মতো হীন, নীচ ও বঞ্চিত করে।

    অনেকক্ষণ পর ও আমার চোখের দিকে সোজা একবার চাইল। তারপর আবার চোখ নামিয়ে নিল।

    একটু পরে বললাম, কিছু খেয়েছ?

    হ্যাঁ। লেমন স্কোয়াস খেয়েছি।

    আর কিছু খাবে?

    না। অনেক দেরি হল। এবার উঠি।

    উঠবে?

    হ্যাঁ, আজ উঠি।

    মনে হল, আমার সমস্ত আনন্দ, ওকে চোখের সামনে দেখার আনন্দ, ওকে সামনে বসিয়ে অনর্গল কথা বলার আনন্দ–সব আনন্দ শেষ হয়ে গেল।

    বললাম, তুমি এলে বলে খুব ভাল লাগল।

    আপনার কাছে আসতে আমারও খুব ভাল লাগে।

    কেন?

    জানি না। হয়তো আপনার মতো এমন একজন বন্ধুর আমার খুব দরকার। এমন বন্ধু হয়তো আমার আর নেই বলে।

    গেটের কাছে এসে বললাম, যাবে কীসে? গাড়ি কোথায়?

    গাড়ি তো দাদা নিয়ে বেরিয়েছে। বাসে চলে যাব।

    থাক। দাঁড়াও বাসে যাব বললেই তো পুজোর দিনে বাসে যেতে পারবে না।

    আমি গাড়ির চাবিটা নিয়ে আসছি। পৌঁছে দেব।

    ভাবলাম, তাও আরও দশটা মিনিট তো ওর সঙ্গে একা থাকতে পারব। ও জানে না, ওর উপস্থিতিটাই আমার কাছে একটা কতবড় পুরস্কার।

    গাড়িতে নয়না বলল, ঋজুদা, আজ রাতে প্রতিমা দেখাতে নিয়ে যাবেন? রানি রাসমণির বাড়ির প্রতিমা নাকি খুব ভাল হয়েছে।

    কখন যাবে?

    এই আটটা ন’টা নাগাদ।

    বেশ। আমি যাব। তুমি তৈরি হয়ে থেকো বাড়িতে।

    আচ্ছা।

    নয়নাকে নামিয়ে দিয়ে এলাম বাড়িতে।

    .

    ১১.

    যতিদের বাড়ি শ্যামবাজারের কাছাকাছি।

    সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে গাড়ি রেখে নামলাম।

    পথে কত লোক। কত বেলুন, কত মেলা, কত হাসিখুশি শিশু, কত দুঃখভোলা দুখী। পুজোর ওই কটা দিনে ভারী ভাল লাগে। সবকিছু ভাল লাগে।

    যতিদের বাড়ির সামনে বেশ বড় প্যান্ডেল হয়েছে। পুজো হচ্ছে ভিতরের চত্বরে। অ্যামপ্লিফায়ারে পুরুতমশাই মন্ত্রোচ্চারণ করছেন।

    “যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা,
    নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।”

    যতিদের গেটের বাইরে, দিল্লি দেখো, বোম্বাই দেখো, কালকা গাড়ি, কোলকাত্তা দেখো হচ্ছে। চোঙাওয়ালা কলের গান বাজছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা গোল গোল চোঙে চোখ লাগিয়ে অদৃষ্টপূর্ব দৃশ্যাবলী চোখ দিয়ে গিলছে।

    গান শুনে থমকে দাঁড়াতে হল। হেমন্ত মুখার্জির রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড বাজছে–“পথ দিয়ে কে যায় গো চলে, ডাক দিয়ে সে যায়, আমার ঘরে থাকাই দায়”–কিন্তু রেকর্ডটি এমন স্পিডে বাজছে যে মনে হচ্ছে যেন ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেস চলছে। কোঁত কোঁত করে আওয়াজ বেরুচ্ছে।

    পত্‌দিয়েকে। যায়গোচলে।
    ডাক্‌দিয়েসে। যায়–
    আমার্‌। ঘরেথাকাই দায়্‌…..

    সে এক বীভৎস আওয়াজ। একা একাই হাসতে লাগলাম। কলকাতার পথেঘাটে এমন কত মজাই না আছে। বিনি-পয়সার মজা।

    যতি ‘এসো এসো’ করে আপ্যায়ন করে ভেতরে নিয়ে গেল। একটি ঘরে রঞ্জন সুগত ওরা সবাই গল্প করছিল। সে ঘরে নিয়ে গেল।

    সুগত শুধোল, অঞ্জলি দিয়েছ?

    দিয়েছি।

    চলো আর একবার দেবে।

    আরে নাঃ, খেয়েছি যে।

    কী খেয়েছ?

    চা।

    আরে চা আবার খাওয়া নাকি?

    চলো চলো। একা একা ভাল লাগে না।

    অগত্যা যেতে হল।

    ডাকের সাজের ঠাকুর। তেলতেলে মুখ। লাবণ্য চুঁইয়ে পড়ছে। চোখ দুটি ব্যক্তিত্বসম্পন্না। চোখের দিকে চাইলে মনে হয়, এ দেবীর কাছে ভরসা করে কিছু চাওয়া যায়–চাইলে হয়তো পাওয়া যাবে।

    ফুল বেলপাতা হাতে নিয়ে পুরুতমশাইয়ের সঙ্গে মন্ত্রোচ্চারণ করতে লাগলাম। কেন হয় জানি না, এই মন্ত্রের মধ্যে কী যেন জাদু আছে–একবার দু’বার বললেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে; নাভির কাছটা পিনপিন করে ব্যথায়, মনে হয় যেন যুগযুগান্ত ধরে এমনি ভক্তিভরেই পুজো করে আসছি।

    তিন-তিনবার অঞ্জলি দেবার পর–সকলে মাথা নিচু করে গড় হয়ে প্রণাম করতে লাগলেন। আমিও মাথা নিচু করলাম। কিন্তু মায়ের কাছে কী কামনা করব ভেবে পেলাম না। নয়নার মুখটি মনে পড়ল। একটু আগে ও যখন আমার ঘরে বসে ছিল–সেই পুজোর সকালের শুচি-মুখটি মনে পড়ল। খুব ইচ্ছে হল বলি, ঠাকুর, তুমি আমার নয়নাকে কেবল আমার করে দাও–এ জন্মের মতো, বরাবরের মতো, আমার একার করে দাও। ও আমার ভালবাসা চিনতে পারুক।

    কিন্তু পরক্ষণেই কী যেন হল। কোনও অদৃশ্য হাত যেন আমার মুখ চেপে ধরল। মনে হল, মা বছরে মোটে তিনদিনের জন্য আসেন, তার কাছে নিজের জন্যই চাইব শুধু? সে বড় স্বার্থপরতা হবে। তার চেয়ে কামনা করি, নয়না আমার সুখী হোক, দশজনের একজন হোক, যেভাবে ও সুখী হতে চায়, সেভাবে হোক। ও বাংলাদেশের সেরা মেয়ে হয়ে উঠুক। এবং এই কামনা করার সঙ্গে সঙ্গেই আমি যে মাঝে মাঝে উদারও হতে পারি, সবসময় যে হ্যাংলামি করি না, এইটে জানামাত্র ভীষণ গর্বও হতে লাগল। ভারী ভাল লাগতে লাগল। মহাষ্টমীর সকালটা যে অভীষ্ট সিদ্ধির সকাল নয়, এ যে মঙ্গলকামনার সকাল, এইটে ভেবেই ভীষণ আনন্দ হল। আমিও মাঝে মাঝে বড় হতে পারি। এ জানা যে কত বড় জানা, সে কী করে বোঝাব!

    অঞ্জলি দিয়ে ফিরে এসে, সকলে মিলে সেই ঘরে গুলতানি শুরু হল। সুগত বলল, তা হলে আমাদের যাওয়া ঠিক। কী বলো যতি?

    নিশ্চয়ই। পাক্কা।

    যতি বলল, ঋজুদাকে বোলা না, ও খালি দর বাড়ায়। আর যেন কেউ কাজ করে না।

    বললাম, কাজ করবে না কেন? এমন চাকরি তো কেউ করে না। করলে বুঝতে।

    যাঃ যাঃ, তোর খালি বাজে কথা। রঞ্জন বলল।

    বুঝলাম। তা যাবে ঠিক কোন জায়গায়?

    হাজারিবাগ। সেখান থেকে কুসুমভা। ক্যাম্প করা যাবে।

    তার মানে বেড়ানো। বিগ-গেমস্ তেমন কিছু হবে না।

    বাঃ, হবে না কেন? গত বছরই সুগত একটা কোটরা মারল ছুলোয়াতে। শুয়োর। আছে অনেক। তা ছাড়া পাখির প্যারাডাইস। চিতাও কম নেই।

    যতি বলল, সুগতদা তো কালি-তিতির ও মুরগি আর রাখেনি ওখানে। সব শেষ।

    সুগত বলল, এমন বাড়িয়ে বলিস না, মানে হয় না।

    আমি বললাম, বেশ চল। শিকার হোক চাই নাই হোক, তিন-চার দিন জঙ্গলে থাকা তো হবে। কুসুমভা আমার বড় ভাল লাগে। তা ছাড়া আমাদের ছোটবেলার কত স্মৃতি ছড়ানো আছে ওখানে–কী বল সুগত?

    যা বলেছ।

    মনে আছে ঋজু, সেই বর্ষার রাতে ধানখেতে কাড়ুয়ার সঙ্গে ছোটবেলায় খরগোশ মেরে বেড়ানো?

    বললাম, আছে, আর মনে আছে, সেই রাত আড়াইটে নাগাদ মেঘ ফুঁড়ে পানুয়ানা টাড়ের দিকের আকাশে কেমন চাঁদ উঠল?

    সুগত বলল, মনে নেই? কী বলো! ও চাঁদের কথা আমি জীবনে ভুলব না।

    রঞ্জন বলল, রেমিনিসেন্স ছাড়–তা হলে আমরা যাচ্ছি?

    যতি বলল, হ্যাঁ, তা তো যাচ্ছি। কিন্তু তোমাকে নিয়েই ভয়। মনে আছে গৌরী কারমার কাছে সেবারে কার পোষা শুয়োর মেরেছিলে জংলি ভেবে? কী কেলেঙ্কারি!

    রঞ্জনের এটা বড় দুর্বল স্থান। চটে গিয়ে বলল, যাঃ যাঃ, ওরকম সকলেরই দু’-একবার ভুল হয়। ঋজুকে জিজ্ঞেস কর না, কার সঙ্গে গিয়ে ও মির্জাপুরে শম্বর ভেবে পা বাঁধা ঘোড়াকে গুলি করেছিল। আমার বেলাই তোদের যত সব মনে থাকে।

    অনেকদিন পর জমিয়ে আড্ডা মারা হল। ঠিক হল, বিজয়াদশমীর একদিন পর ভোরে আমরা হাজারিবাগের দিকে রওনা হচ্ছি। যতির জিপেই যাওয়া হবে। আমি, যতি, রঞ্জন, সুগত। হাজারিবাগে এক রাত সুগতদের বাড়ি কাটিয়ে পরদিন ভোরে কুসুমভা। কুসুমভায় তিন-চার দিন থেকে আবার ফেরা হবে কলকাতায়।

    নয়না বলেছিল রাত আটটা ন’টা নাগাদ যেতে। সাড়ে আটটা নাগাদ ওদের বাড়ি গেলাম। দেখলাম নয়না নেই। ওর দিদি ময়নাদি সেজেগুজে বসে আছে। ময়নাদি এ ক’বছরে যা মোটা হয়েছে তা বলার নয়। অথচ বিয়ের আগে দারুণ ফিগার ছিল। বাঙালি মেয়েরা যে কেন এমনি হয় জানি না। চা বাগানেও দেখেছি, সাহেব ম্যানেজারের স্ত্রীরা সারাদিন বাগান করছে, রান্না করছে, ঘরের কাজ করছে, আর বাঙালি ম্যানেজারের স্ত্রীরা দিনরাত ঢাউস বজরার মতো খাটে বাঁধা অবস্থায়, বেঁকে শুয়ে, হয় ঘুমোচ্ছে, নয় নভেল পড়ছে। যাচ্ছেতাই। যাচ্ছেতাই। নয়নাও হয়তো বিয়ের পর এরকম হয়ে যাবে। ইস, ভাবা যায় না।

    শুধোলাম, নয়না নেই?

    না। ও একটু পুজো মণ্ডপে গেছে। এক্ষুনি আসবে। তোমাকে বসতে বলে গেছে।

    আপনি একা যে? দিলীপদা কোথায়?

    আর বলল কেন ভাই? ছুটির মধ্যেও কাজ করে বড়সাহেবকে প্লিজ করছে।

    মনে মনে বললাম, এইরকম করে রোজগার করা টাকায় তৈরি বাড়ি যেন ধসে যায়। কোনও মানে হয়?

    ভাবছি, আমিও তোমার সঙ্গে যাব।

    অবাক হলাম; বললাম, কোথায়?

    প্রতিমা দেখতে।

    হেসে বললাম, বেশ তো! খুব আনন্দের কথা। কিন্তু মনে মনে নয়নার উপর এমন রাগ হল যে কী বলব! ও কি জানে না যে, ও একটু একা আমার সঙ্গে থাকলে আমার কতখানি ভাল লাগে? আমি কি ওদের ড্রাইভার যে, পুজোর দিনে ওর মোটা দিদিকে প্রতিমা দেখিয়ে বেড়াব? তা ছাড়া সুজয় ওয়ার্থলেসটা কী করছে? সে নিশ্চয়ই ইয়ারদোস্তি নিয়ে আড্ডা মারতে বেরিয়েছে। আর আমারই যেন কোনও বন্ধু-টন্ধু থাকতে নেই। তাদের সঙ্গে যেন আমি আড্ডা মারতে পারতাম না। রাগে গা-জ্বালা করতে লাগল।

    এমন সময় নয়না এল। সঙ্গে নীতীশকে নিয়ে।

    আবদারে গলায় বলল, ঋজুদা, নীতীশদাকেও আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাব কিন্তু।

    জোর করে হাসলাম, বললাম, বেশ তো। ভাল কথা।

    এ যাত্রা নীতীশের অগস্ত্য যাত্রা হলেই ভাল হত। কী কুক্ষণেই আমি আজ এখানে এসেছিলাম। যদিও বা ময়নাদিকে সহ্য করা যেত–তার উপর নীতীশ–সোনায় সোহাগা। অফ-অল-পার্সনস্ নীতিশ। নীতীশ সেন।

    সত্যি, নয়না কী ভাবে আমাকে? আমি ওকে ভালবাসি বলে কি ও মনে করে, ও আমাকে দিয়ে যা-ইচ্ছে তাই করাবে? ও বললেই বা আমি করব কেন? মহাষ্টমীর সন্ধেটাই আমার মাঠে মারা গেল। নীতীশ সেনের ড্রাইভার হয়ে প্রতিমা সন্দর্শনে যাব। দরজা খুলে সাহেব মেমসাহেবদের নামাব-ওঠাব। ভাবতে পারি না। আমি যথার্থই একটি কুকুর।

    আমাকে দেখে নীতীশ দেখানো বিনয়ের হাসি হাসল।

    বলল, কেমন আছেন?

    এই চলে যাচ্ছে গড়িয়ে গড়িয়ে। আপনি?

    ভাল আছি।

    ছুটি ক’দিন?

    দশমীর পরের দিনই চলে যাব সকালের প্লেনে।

    বললাম, আমি গত মাসে গেছিলাম একবার শিলং। আপনার ঠিকানা ছিল না, তাই দেখা করতে পারিনি।

    ওহোঃ, আগে জানলে খুব ভাল হত। আমাদের কোম্পানির গেস্ট হাউসে থাকতে পারতেন।

    বুঝলাম. চাল দেখাচ্ছে। কেন? আমার কি থাকবার জায়গা নেই?

    বললাম, আমি পাইন-উডে ছিলাম।

    বলল, ওঃ তা হলে তো কথাই নেই।

    নয়না ভিতর থেকে ফিরে এসে বলল, চলুন যাওয়া যাক।

    সবাই গাড়িতে গিয়ে বসলাম।

    বলবার কিছু নেই। আমি গাড়ি চালাচ্ছি। নীতীশ সেন আমার পাশে। সেই জীবনানন্দ দাশ নাটোরের বনলতা সেনকে ভালবেসেছিলেন, আর আমি শিলঙের নীতীশ সেনকে ভালবেসেছি–মধ্যে বেবাক সমুদ্র! একটি ট্রাফিক পুলিশ আচমকা হাত তুলল। কোনওক্রমে ব্রেক কষলাম। ভিতরে ভিতরে ভীষণ টেনশনে ছিলাম। আমি মেজাজ দেখালাম। সে কী একটা বলল। আমি ওকে অগ্রাহ্য করে গাড়ি চালিয়ে দিলাম–ব্যাটা নম্বর নিল।

    আজকালকার লিটল-লার্নিং-ডেঞ্জারাস কনস্টেবলদের কিছু বলেও পার পাবার উপায় নেই। তত্ত্বকথা শুনিয়ে দেবে। আগেই ভাল ছিল। এক গাল হেসে বলতাম, “গলতি হো গ্যয়া পাঁড়েজি”। পাঁড়েজি গোঁফ ঝুলিয়ে, গাল ফুলিয়ে বলত, “ঠিকে হ্যায়, গতি সহিকা হোতা। ফিন গতি মত কিজিয়ে”।

    নীতীশ মন্তব্য করল, কলকাতায় গাড়ি চালানো আজকাল–সত্যি ডিসগাস্টিং। ভীষণ স্ট্রেন হয়।

    পেছন থেকে নয়না বলল, এমন কিছুই না। ঋজুদা একটুতে রেগে যান। বড় অধৈর্য উনি। এ জন্য আরও বেশি স্ট্রেন হয়। তা ছাড়া বললে কী হবে ঋজুদা, আপনি বেশ জোরে গাড়ি চালান।

    ময়নাদি বললেন, তোর দিলীপদা কিন্তু খুব সাবধানী। বলেন, শহরে কুড়ি মাইলের বেশি জোরে গাড়ি চালানোই উচিত নয়। উনি কিন্তু খুব আস্তে আস্তে গুটগুট করে গাড়ি চালান।

    এমন রাগ হল যে ইচ্ছে হল বলি, গুটুগুটু বাবুর বাবা বোধহয় গোরুর গাড়ির গাড়োয়ান ছিলেন। নইলে গুটুগুটু বাবু অমন ইশপ ফেব্‌লের কচ্ছপের মতো চলবেন কেন?

    জানবাজারে রানি রাসমণির বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করালাম। বেশ ভিড়।

    চত্বরে ঢুকলাম।

    নয়না এই রাতে আমার দেওয়া শাড়িটি পরেছে। আমাকে নিঃসন্দেহে সম্মানিত করেছে। নইলে, মহাষ্টমীর রাতে আমার দেওয়া শাড়ি পরত না।

    নয়না আর নীতীশ আগে আগে চলেছে।

    নীতীশ একটি সিল্কের পাঞ্জাবি পরেছে, আর ধুতি। পান খেয়েছে। হিরো হিরো তাকাচ্ছে। যাচ্ছে, যেন রাজকুমার। ছেলেটা সত্যিই আমার চেয়ে দেখতে অনেক ভাল। ভগবানই আমাকে মেরে রেখেছেন। আমার চেহারা ভাল হলে কি আর নয়না আমাকে এমন করে ব্যথা দিতে পারত? একটু না একটু ভাল বাসতই।

    নয়নাকে খুব খুশি খুশি লাগছে। নয়না ওর খুব কাছ ঘেঁষে হাঁটছে। দু’জনে কী যেন বলাবলি করছে–নয়না হাত নেড়ে নেড়ে কী যেন বোঝাচ্ছে–নীতীশ বাধ্য-বেড়ালের মতো ওর কথা শুনছে ওদের কথা শুনতে পাচ্ছি না–ঢাকের শব্দে সব কথা ডুবে যাচ্ছে। ময়নাদি আমার পাশে পাশে আসছিলেন। হঠাৎ বললেন, এই ঋজু, অত তাড়াতাড়ি যেয়ো না। আমি হারিয়ে যাব।

    দাঁড়ালাম।

    বেশ বললেন ময়নাদি। উনি যেন ছুঁচ। হারিয়ে গেলে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

    নয়না আর নীতীশ অনেকখানি এগিয়ে গেছে।

    আমি যে আছি–আমার অস্তিত্ব পর্যন্ত ভুলে গেছে নয়না, মনে হচ্ছে। খুশিতে, আনন্দে বিহ্বল হয়ে আছে। দুধলি হাঁসের মতো সুখের জলে বিলি কাটছে।

    বেশ লাগছে কিন্তু পাশাপাশি দাঁড়ানো ওদের দু’জনকে।

    নয়নার সরু কোমর, চুড়ো করে বাঁধা চুল, চমৎকার মরালী গ্রীবা।

    নীতীশের সুন্দর, দীর্ঘ চেহারা, ধবধবে রং, সব মিলিয়ে চমৎকার মানিয়েছে।

    পরমুহূর্তে সংবিৎ ফিরে এল। চমকে উঠলাম।

    আমি কি নয়নার দাদু যে, নাতনি-নাতজামাইকে জোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আহ্লাদে আহা-আহা করছি?

    এতদিনে নিজের শত্রু নিজে চিনলাম না?

    শত্রুকে বাহবা দিচ্ছি।

    আমার কপালে দুঃখ নেই তো কার কপালে আছে?

    এতক্ষণ ব্যাপারটা সিরিয়াসলি ভাবিনি। হঠাৎ ঢাকের শব্দ, কসরের শব্দ, আরতির নৃত্য থেমে যাওয়াতে–একটি নিবিড় ক্ষণিক নিস্তব্ধতা–যা একমাত্র অনেক লোকের ভিড়েই অনুভব করা সম্ভব, তা সারা চত্বরে, ঠাকুর ঘরে, প্রত্যেকের মনে মনে ছড়িয়ে পড়ল। তারপরই একটি শিশু কেঁদে উঠল। একজন বৃদ্ধ থামে মাথা ঠেকিয়ে মা! মা! করে উঠলেন।

    কিন্তু সেই একটি নিস্তব্ধ মুহূর্তে আমার মনে হল, আমার ভিতরের সবকিছু ওই মুহূর্তটির মতোই নিস্তব্ধ, শীতল, ভ্যাকুয়াম হয়ে গেল। মনটা ভীষণ খারাপ লাগতে লাগল। নয়না আর নীতীশের কথা ভেবে। সত্যি সত্যিই আমার নয়নাসোনা আমাকে একটুও ভালবাসে না। এই কথাটি প্রতি মুহূর্তে জানি,নতুন করে বুঝতে পাই, তবু যেন কেন মনে-ধরে বিশ্বাস করতে পারি না। যেদিন একথা অন্তর থেকে বিশ্বাস করব সেদিন এ পৃথিবীর উপর, জীবনের উপর, সব আশা, সব ভরসা, সব ভালবাসা আমার চলে যাবে। আমি তখন এই আমি থাকব না। আমার কিছুই আর বাকি থাকবে না।

    নয়না পেছন ফিরল। হাতছানি দিয়ে আমাকে ডাকল। চেঁচিয়ে বলল, ঋজুদা, হারিয়ে গেলেন কেন? আসুন।

    ভিড় ঠেলে আমি ওর দিকে এগোতে লাগলাম।

    অনুক্ষণ তো আমি হারিয়েই যাই–ভাগ্যিস নয়না মাঝে মাঝে আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে।

    .

    ১২.

    রঞ্জন বলল, এই যতি, কী হচ্ছে কী? আস্তে চালা না। জিপ উলটে মারবি নাকি?

    মারবার মতো ড্রাইভার আমি নই।

    সুগত বলল, তবু, মেটাল-ফেটিগ বলে একটা কথা আছে তো। এত জোরে চালাবার তোমার কী দরকার বাবা?

    দরকার কিছুই নেই। এমনিই চালাই। মজা লাগে বলে।

    এবার গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ছেড়ে, বাগোদরে বাঁয়ে মোড় নিলাম। সন্ধে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। কলকাতা থেকে বেরোতে বেরোতেই দেরি হয়ে গেছিল। এখন পথটা এঁকেবেঁকে চলেছে শালবনের মাঝে মাঝে। মাইল আট-নয় গিয়ে, কোনার ড্যাম, গোমীয়া ইত্যাদি যাবার পথ পড়বে বাঁয়ে। আমরা সোজা চলে যাব। টাটিঝারিয়া হয়ে হাজারিবাগ।

    যাই বল ঋজু, হাজারিবাগে এলেই আমাদের যেন কীরকম ভাল লাগে, তাই না?

    রঞ্জন বলল, যেন কী এক স্পেশাল ভাল লাগা।

    বললাম, আসলে আমরা এমন একটি বয়সে বন্দুক হাতে এখানের বনে-পাহাড়ে পাগলামি করে বেড়িয়েছি যে, সে বয়সে সব কিছুকেই ভাল লাগত। চোখটা সব কিছুতেই রামধনু দেখত।

    যতি বলল, এমন করে বলছ, যেন কেওড়াতলার ইলেকট্রিক চুল্লির মধ্যে বসে কথা বলছ। তবে, সে বয়সটা সত্যিই ভাল বয়স। মানে, যে বয়সে কাক ডাকিলে কোকিল বলিয়া ভ্রম হয়, পরের বোনকে নিজের বোন অপেক্ষা অধিক সুন্দরী বলিয়া মনে হয়। সেই বয়স।

    তুই বড় ফাজিল হয়েছিস যতি। বড়দের সামনে কী করে কথা বলতে হয় জানিস ।

    যতি একটি হেয়ারপিন-বেন্ড নেগোশিয়েট করতে করতে বলল, প্রাপ্তেম্ভ ষোড়শবর্ষেণ……

    রঞ্জন বলল, তোর আজকাল সত্যিই বেশি জ্ঞান হয়ে গেছে।

    যতি ছাড়বার পাত্র নয়। বলল, শাস্ত্র পড়েছ? শাস্ত্রে লিখেছে, অজ্ঞানকে জ্ঞান দিবে। হনুমানকে কলা খাওয়াইবে।

    অনেকক্ষণ একটানা টপ গিয়ারে জিপ চলছে গোঁ গোঁ করে বাঘের বাচ্চার মতো। সুগতটার ঝিমুনি মতো এসেছে। মাঝে মাঝে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঝিমিয়ে নিচ্ছে। হেডলাইটের আলোটা লাফাতে লাফাতে চলেছে গাড়ির আগে আগে।

    হঠাৎ সুগত ঘুম ভেঙে চেঁচিয়ে উঠে বলল, আরে থামো থামো। চলেছ কোথায়? টাটিঝারিয়া পেরিয়ে এলে যে।

    চা খাবে না?

    যতি কুতকুত করে হেসে উঠল। বলল, দাদার ঘুমটা ভালই এসেছিল। তুমি কি খখায়াব দেখছ? টাটিঝারিয়া নয় ওটা। টাটিঝারিয়া সামনে দাঁড়াব নিশ্চয়ই। ঠান্ডায় আমার হাত জমে গেছে। স্টিয়ারিং ধরতে পাচ্ছি না।

    বললাম, সত্যি কথা। তুমি একটানা চালাচ্ছ যতি অনেকক্ষণ। এবার আমায় দাও।

    ও বলল, চলো টাটিঝারিয়া অবধি। এসে গেছি। তারপর নিয়ো।

    টাটিঝারিয়ার পণ্ডিতজির দোকানে চা খাওয়া হল। আর ছোট ছোট চৌকো-চৌকো নিমকি। দোকানে শুনলাম, এই রাস্তায় এগারো মাইলের মাথায় একটি বড় বাঘকে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে রাস্তা পার হতে।

    যতি বলল, ঋজুদা, রাইফেলটা বের করে রাখি? যদি পাওয়া যায় পথে।

    রঞ্জন বলল, থাম তো তুই। এরকম কত রাস্তা-পেরুনো বাঘের গল্প শুনলাম এ পর্যন্ত। কারও সঙ্গেই তো কখনও দেখা হল না। বাঘ তোর মতো বরিশালিয়া কিনা যে, হাটখোলায় বসে কীর্তন গাইবে।

    যতি টিপিকাল বরিশালিয়ার মতো উত্তেজিত হয়ে বলল, এই তো তোমার দোষ। রসিকতা করো করো, কিন্তু বদ-রসিকতা কেন?

    এখন জিপ চালাচ্ছি আমি। কেন জানি না, আমার হাতে থার্ড গিয়ারটা মোটে বসছে না। কেবলই স্লিপ করছে। যতি পেছন থেকে ডিরেকশন দিচ্ছে–হ্যাঁ, পুরো ক্লাচ করো, একটু উপরে ঠেলে ফেলো লিভারটাকে, হ্যাঁ। এমন সময় ও-পাশ থেকে একটি ট্রাক আসল। স্পিড কমালাম। সেকেন্ড গিয়ারে দিলাম–আবার থার্ড গিয়ারে দিতে গেলাম এবং আবার সেই গন্ডগোল এবং সঙ্গে সঙ্গে রঞ্জন ফিসফিস করে বলল, চোখ, চোখ–বাঘের চোখ!

    এদিকে গিয়ার ফঁসার উপক্রম। কোনওরকমে ম্যানেজ করলাম। অ্যাকসিলারেটর একদম ছেড়ে দিলাম–এমন সময় আমিও দেখলাম, জিপের হেডলাইটে পথের ডানদিকে শালবনের আড়ালে একজোড়া লাল বড় চোখ জুলজুল করছে। দেখতে দেখতে, জিপ গড়াতে গড়াতে প্রায় তার কাছাকাছি পৌঁছে গেল।

    আরে, এ যে সত্যি সত্যিই বাঘ। রীতিমতো বড় রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। বেশ কায়দার সঙ্গে, কলার তুলে আস্তে আস্তে রাস্তা পেরোল। ডানদিক থেকে বাঁয়ে। বন্দুক রাইফেল সব পেছনে বাক্সবন্ধ। তার উপরে যতি আসন-পিড়ি হয়ে বসে আছে।

    বাঘটা রাস্তা পেরিয়েই, একটি বড় লাফ দিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল।

    বাঘটা অদৃশ্য হবার সঙ্গে সঙ্গে, যতি অদ্ভুতভাবে খিকখিকিয়ে হাসতে লাগল। সে এক বিচিত্র হাসি। তারপর রঞ্জনের কাঁধে টোকা দিয়ে বলল, কী হে সবজান্তা, বাঘ হাটখোলায় কীর্তন গায় কি না দেখলে? তোমাদের দ্বারা শিকার-টিকার হবে না। তোমরা বেহালা বাজাও। এমনভাবে বন্দুক প্যাক করে রেখেছ যে বন্দুকের বাক্স না বেহালার বাক্স, বোঝে কার সাধ্যি।

    সত্যি সত্যিই ব্যাপারটার অভাবনীয়তায় আমরা সকলে অবাক হয়ে গেছিলাম।

    সুগত বলল, তোমাকেও বলিহারি যাই ঋজু, আর একটু হলে তো বাঘের লেজে বাম্পার ঠেকত। অত কাছে যাবার কী দরকার ছিল?

    বললাম, আমি কি ইচ্ছে করে গেছি? মুখ নিচু করে ভাল করে গিয়ারটাকে নিরীক্ষণ করছিলাম। ইতিমধ্যে গাড়ি গড়িয়ে গেছে।

    যতি বলল, একটু হলে ঝুলিয়েছিলে। নিরস্ত্র অবস্থায় বাঘের থাপ্পড় খাবার মানে হয়?

    রঞ্জন একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, তা যা বলেছিস। হাতে বন্দুক থাকলে ব্যথা কম লাগত।

    হাজারিবাগের আলো দেখা যাচ্ছে। কনহারি–সিলাওয়ার আর–সীতাগড়ার পাহাড় ঘেরা হাজারিবাগ। যতবার আসি, ততবার নতুন করে ভাল লাগে!

    গয়া রোডে সুগতদের বাড়ি। চমৎকার। ছবির মতো। খিদমদগার চমনলাল বুদ্ধিমান লোক। ইচ্ছে করলে কানে শোনে, নইলে শোনে না। খিচুড়িটা দারুণ রাঁধে। হাসিটা কর্ণমূলে পৌঁছোনো এবং নয়নাভিরাম।

    পরদিন ভোরে উঠেই এককাপ করে চা খেয়ে কুসুমভার দিকে বেরিয়ে পড়া গেল। বড়কাগাঁও রোড দিয়েও যাওয়া যায়–সিমারীয়া যাবার রাস্তা দিয়েও যাওয়া যায়। যখন আমাদের কারওই কোনও বাহন ছিল না তখন সিমারীয়ার পথে বানাদাগ অবধি আমরা সাইকেল-রিকশায় চড়ে আসতাম–কিচিং কিচিং করতে করতে। তারপর ঝুলি-ঝালা নিয়ে পায়দল মারতাম খোয়াই ভেঙে শালবনের পথ দিয়ে। অনেকখানি পথ।

    পথে বোকারা নদী পেরুতে হত। নদীর বালুরেখায় কোটরা হরিণ খেলা করত। বহুদূর থেকে আমাদের দেখতে পেয়েই পালাত। পথের বাঁদিকের ফঁকড়া অশথগাছে বড় বড় জিরহুল ফুলের মতো জাঙ্গিলেরা শীতের সকালের রোদ পোয়াত! টাঁড় থেকে কালি-তিতির ডাকত। সির্‌কার দিক থেকে বনমোরগ ডাকত কঁকরক্ক—ক্কঁ-ক্কঁ-ক্কঁ-ক্কঁ। ভারী ভাল লাগত। হাঁটতে হাঁটতে দূরে কুসুমভার মাটির ঘরগুলি চোখে পড়ত। পুরনো নিমগাছটি। বনদেওতার থানের বটগাছটি। নয়াতালাও-এর উঁচু পাড়।

    কাড়ুয়া ছাগল চরাত গ্রামের সীমানায়। টিকি দুলিয়ে দৌড়ে আসত। ওর ভাই আশোয়া আসত। নাগেশ্বরোয়ার ঘরে, নিমগাছের তলায় আমাদের আস্তানা হত।

    পুরনো রাস্তা বেয়ে আমরা জিপে করে যাচ্ছি। রাস্তা অবশ্য খুবই খারাপ। তবু, যে সময়ে আমরা এখানে হেঁটে আসতাম, সে সময়ে কোনও গাড়ি যে এখানে আদৌ আসতে পারবে তা ভাবাই যেত না। এখন গ্রামের অনেক উন্নতি হয়েছে বটে, কিন্তু সে, প্রশান্তি যেন আর নেই। নেই সেই নিস্তব্ধ নিরুপদ্রবতা। কেমন শহর-শহর ভাব হয়ে গেছে। নাগেশ্বরোয়ার ছেলে একটি ছাতার কাপড়ের কালো ড্রেইন পাইপ পরে নিজেকে শাম্মি কাপুর মনে করে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে। ভয় হল, এক্ষুনি না হাত পা

    “ও হাসিনো জুল্‌পোওয়ালো যানে যাঁহা–
    ম্যায়ফিল্‌ ম্যায়ফিল্‌ হ্যায় শামা,
    ম্যায়ফিল্ ম্যায়ফি হ্যায় শামা…”

    গান না জুড়ে দেয়।

    সেই চিৎকারে হয়তো চবুতরার সব কবুতর চটপটিয়ে উড়ে যাবে। যে এক জোড়া রাজঘুঘু ঘুঘুর-ঘু করে ঘুমের গানের নূপুর বাজাচ্ছিল, উদাসী শিশিরভেজা হাওয়ায়–তারা ভয় পেয়ে যাবে। নয়াতালাও থেকে সবক’টি সল্লি হাঁস-সরসরিয়ে দ্রুত পায়ে জল সরাতে সরাতে, শরবনের আড়ালে মুখ লুকোবে। মানে, আমাদের সেই পুরনো কুসুমভা হারিয়ে যাবে।

    তবু ভাল লাগে। কলকাতাটা যে কী কাঁটকেটে নাইলন শাড়ি-পরা, ঠোঁটে রংমাখা মেয়ের মতো অন্তঃসারশূন্যা, দরিদ্র, তা জঙ্গলে না এলে বোঝা যায় না। কুসুম আমার সেই পুরনো সুরাতীয়া–আমার নয়নার মতো। যার কাছে এলেই নিজেকে স্নিগ্ধ, সুস্নাত মনে হয়।

    কুসুমভায় এলেই, রাত কাটালেই আমি সুন্দর সুন্দর সব মৌসুমি ফুলের মতো স্বপ্ন দেখি। আমার ইচ্ছে করে আমার মতো নয়নাও স্বপ্ন দেখুক, ঘুমের মধ্যে কথা বলুক; মাঝরাতের টুঙি পাখির মতো ভাললাগায় শিউরে উঠে, ও পিটি-টু পিটি-টুঙ করে ঘুমের মধ্যে শিস দিয়ে উঠুক।

    কুসুমভাতে দু’দিন হয়ে গেল।

    দুপুরে ছুলোয়া শিকার হল। কালি-তিতির, মুরগি, আসকল, তিতির, বটের, ঘরগোশ অনেক কিছু মারা হল। আমি কিন্তু মারিনি।

    নয়না আমাকে বারণ করেছিল। অনেকদিন থেকে ও এ বাবদে আমার সঙ্গে ঝগড়া করে আসছে। পাখি মারা নিয়ে। বলেছিল, আপনি যে-পাখিই মারুন, জানবেন আপনি হলুদ বসন্ত পাখিকে মারলেন। তারপর থেকে নিজে পাখি মারতে পারিনি আর।

    সুগত বলেছিল, তুমি একটি ফার্স্টক্লাস হিপোক্রিট।

    আমি ওকে বোঝাতে পারিনি।

    আমি কখনও কারও কাছে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে পারিনি। নিঃসংকোচে আত্মপ্রকাশ করা হয়ে ওঠেনি। সুগতর মতো দু-একজন তাদের চোখে, তাদের বুদ্ধির প্রদীপ জ্বেলে আমায় আংশিকভাবে আবিষ্কার করেছে মাত্র। চিলকার ছড়-পরিয়ায় একবার থার্টি-ও-সিক্স রাইফেল দিয়ে একটি কৃষ্ণসার হরিণ মেরেছিলাম। দূর থেকে। গুলিটি মেরুদণ্ডে লেগেছিল। হরিণটি ঝাউবনের বালিতে পড়ে ছটফট করছিল–কিন্তু উঠতে পারছিল না। কাছে দৌড়ে যেতেই দেখলাম দুপুরের রোদে রক্তমাখা হরিণটি খাবি খাচ্ছে। দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমেছে।

    কী হল জানি না। নিজের উপর বড় ধিক্কার জন্মাল। জলের বোতল খুলে তার মুখে গবগব করে জল ঢালতে লাগলাম। ঘৃণায় কি অপারগতায় তা জানি না, সে আমার হাতের জল খেল না।

    এমন সময় স্থানীয় উড়িয়া শিকারি, মার্কণ্ড এল–এসে আমায় ঠেলা দিয়ে সরিয়ে শটগান দিয়ে হরিণটির গলায় গুলি করল। একটু কেঁপে উঠে হরিণটি নিশ্চল হয়ে গেছিল।

    তখনও সুগত আমাকে বলেছিল যে, আমি ভণ্ড। হয়তো ভণ্ড। কারণ, যে নিজের মনের সম্পূর্ণ নিষ্ঠুরতায় আস্থাবান নয়, তার এমন আংশিক নিষ্ঠুরতায় ভর করে প্রাণী হত্যা করা ঠিক নয়। আংশিক ভণ্ডামির চেয়ে সর্বৈব ভণ্ডামি শ্রেয়।

    জানি না। আমি সত্যি সত্যি ভণ্ড কি না জানি না। তবে যখন উড়ে-যাওয়া তিতির কি আসকলের দিকে বন্দুক তুলি–নয়নার মুখটি মনে পড়ে যায়, সেই হলুদ কটকি শাড়িপরা চেহারা–হলুদ বসন্ত পাখির কথা মনে পড়ে। গুলি করতে পারি না। আমার আবাল্য অভ্যাস, আমার বাহাদুরি-প্রবণতার, প্রশস্তি-প্রাপ্তির সমস্ত প্রয়াস, তখন অসার্থক হয়। বন্দুকের দু’ব্যারেলের মাছির দু’পাশে নয়নাসোনার কালো চোখদুটি ভেসে ওঠে। ট্রিগারে আঙুল ছোঁয়াতে পারি না। কিছুতে পারি না। আর বোধহয় কোনওদিন আমি পাখি হরিণ মারতে পারব না। সুগতরা আমায় ওদের দল থেকে তাড়িয়ে দেবে। ওরা আমার কথা বুঝতে পারে না–আমায় ঠাট্টা করে–বলে, নবদ্বীপে গিয়ে বোষ্টম হও। ওরা যে কেউ আমার মতো করে ভালবাসেনি কাউকে– কোনওদিন। আমায় তাই বোঝে না।

    সন্ধে হয়ে গেছে। আগামী কাল কোজাগরী পূর্ণিমা। ফুটফুটে জ্যোৎস্না উঠেছে। একা একা পানুয়ানা-টাঁড়ের দিকের জংলি পথ বেয়ে হেঁটে আসছি। বেশ ঠান্ডা। দূরে গোন্দা বাঁধের উঁচু পাড় একটি পাহাড়ের মতো দেখা যাচ্ছে। একদল নাকটা হাঁস মাথার উপর দিয়ে চিঁউই-চিঁউই করতে করতে আকাশ সাঁতরে কোনাকুনি উঠে গেল। তাড়াতাড়ি যাচ্ছে ওরা গোন্দা বাঁধের জলে—ঝুরক্‌ঝারির ঝিল থেকে উড়ে আসছে। একটি টি-টি পাখি টিটিরটি-টিটিরটি করতে করতে পথের ডানদিকের জঙ্গলে ডেকে ডেকে উড়ছে। চিতা-টিতা দেখে থাকবে।

    আজ টস করা হয়েছে। মাচায় বসবে যতি আর সুগত। সকালে জঙ্গলে একটি হরিণের ন্যাচারাল কিল খুঁজে পেয়েছি আমরা। চিতায় মেরেছে হরিণটিকে কাল রাতে। বিকেল থাকতে ওরা গিয়ে মাচায় বসেছে। রঞ্জন ভাল রাঁধুনে। মুরগি রান্নার তত্ত্বাবধানে রয়েছে ও কুসুমভাতে।

    পথটি একটি টিলার উপর দিয়ে গড়িয়ে এসে বুরহি করমের নদী পেরিয়ে সিরকার দিকে চলে গেছে। নদীর কালভার্টের উপর বসলাম। পাইপটা ধরালাম।

    চমৎকার দুধলি রাত, সুগন্ধি রাত, নিরুপম নির্জনতার রাত। ভাবলাম এমন রাতে নয়নাকে ক্ষমা করা যায়। নয়না শুধু খুশি হোক। আমার মতো সামান্য অকিঞ্চিৎকর ছেলে এর চেয়ে বেশি কী আশা করতে পারে নয়নার মতো মেয়ের কাছ থেকে?

    কালভার্টের তলা থেকে একটি বড় গিরগিটি বলে উঠল, ঠিক ঠিক ঠিক। অমনি টি-টি পাখিটা কোত্থেকে জঙ্গল কুঁড়ে ডাকতে ডাকতে কাঁপতে কাঁপতে আমার দিকে উড়ে আসতে লাগল। চিতাটা কি আমার দিকে আসছে? আমি ভয় পেলাম। হঠাৎ আমার মনে হল এ কোনও শরীরী চিতা নয়, এ আমার ছদ্মবেশী অশান্ত কামনা। আমার এই মুহূর্তের সমস্ত মহত্ত্ব ও উদারতাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে বলে সে আমার দিকে এগিয়ে আসছে ছায়ার আড়ালে আড়ালে। নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে। ও আমাকে মহৎ হতে দেবে না। ও আমাকে বরাবর এমনি একজন সস্তা, সামান্য, হীন, সাধারণ মানুষ করে রাখবে। আমি কোনওদিন নয়নার ভালবাসার যোগ্য করে তুলতে পারব না নিজেকে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleহাজারদুয়ারি – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article স্বগতোক্তি – বুদ্ধদেব গুহ

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }