Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    হলুদ বসন্ত –বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প131 Mins Read0
    ⤶

    ১৩-১৬. সবাই স্বপ্ন দেখে

    সবাই স্বপ্ন দেখে কি না জানি না, তবে অনেকে দেখে। আমিও দেখি। আমার ধারণা সবাই স্বপ্ন দেখতে শেখেনি।

    স্বপ্ন মানে–খুব যে একটা বিরাট কিছু তা নয়। অল্প একটু জমি, এই কাঠা দশেক হলেই চলে–তাতে একটি ছোট বাংলো প্যাটার্নের একতলা বাড়ি। ইটালিয়ান ধাঁচের পোর্টিকোওয়ালা। ঘর থাকবে মোটে তিনটি–চারপাশে কাঁচ থাকবে শুধু কাঁচ। প্রচুর জায়গা নিয়ে একটি স্টাডি। চতুর্দিকে বই। বই—বই–রাশীকৃত বই। এক কোনায় ছোট একটা কর্নার টেবল–তাতে একটি সাদা টেবল-ল্যাম্প থাকবে। সেখানে বসে আমি লিখব। ফার্নিচার বেশি থাকবে না। পাতলা একরঙা পার্শিয়ান কার্পেট থাকবে মেঝেতে। একেবারে সাদা ধবধবে টাইলের মেঝে হবে। প্রতি ঘরে ঘরে রোজ ফুল বদলানো হবে। চারিদিকে চওড়া ঘোরানো বারান্দা থাকবে। থোকা থোকা বুগেনভেলিয়া লতায় চারদিক ভরা থাকবে। গেটের দু’পাশে দুটি গাছ থাকবে–কৃষ্ণচূড়া নয়, রাধাচূড়া। কৃষ্ণচূড়া বিরাট বড়–ওই ছোট্ট বাড়িতে বিরাট কিছু মানাবে না। বারান্দায় রেলিং থাকবে। সাদা। রট আয়রনের। বাথরুমটা বেশ বড় হবে, যাতে নয়না গান গেয়ে গেয়ে ঘুরে ঘুরে শাওয়ারের নীচে চান করতে পারে।

    অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন

    বসন্তকালে লনের চেরি গাছের নীচে বেতের চেয়ারে বসে চা খাব আমরা।আমি আর নয়না। কোনও ভিজে, সোঁদা-সোঁদা-গন্ধ-দিনে চাপা ফুলের গন্ধবাহী হাওয়ার সঙ্গে যখন ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি পড়বে তখন সেই স্টাডিতে বসে বইয়ের পাতা ওলটাতে ওলটাতে, কি কিছু লিখতে লিখতে আমি কফি খাব–আর নয়না একটা কালো মডার্ন ফ্রেমের চশমা নাকে দিয়ে বেশ ভারিক্কি গলায়, যেন শাসন করছে এমনভাবে, আমাকে বলবে–অত কফি খেয়ো না, লিভারটার কি বারোটা বাজাবে?

    কিংবা কোনও গ্রীষ্ম-সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে চেরি গাছের তলায় পায়জামা পাঞ্জাবি পরে বসব। আমার নয়না স্নান করে, চুড়ো করে চুল বেঁধে সুগন্ধি স্নিগ্ধ ঠান্ডা শরীর নিয়ে পাশে এসে বসবে। সুন্দর ছোট্ট ট্রে-তে করে আমাদের চাকর (একমাত্র চাকর; একটু কমবয়েসি, মানে ১৫-১৬ হলে ভাল হয়, খুব চটপটে হবে) চা নিয়ে আসবে। ট্রে-তেও একটি ছোট্ট ফুলদানি থাকবে, স্যান্ডউইচের প্লেট পাইপের টোব্যাকো, অ্যাশট্রে সবকিছু। শেষ সূর্যের ম্লান আলো এসে নয়নার গ্রীবা ছোবে। নয়নাকে ভীষণ সুন্দর দেখাবে। মেয়েদের সুন্দর না দেখালে আমার খারাপ লাগে। অসহ্য লাগে। নয়না একটু হাসবে। আমি বলব, তোমাকে দারুণ দেখাচ্ছে তো। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটি তুলে নয়না তখন সম্পূর্ণভাবে হাসবে। আমি ওর দিকে অপলক চেয়ে থাকব। দু’জনে দু’জনের চোখের দিকে চুপ করে চেয়ে থাকব। ঝিরঝিরে হাওয়ায় রাধাচূড়ার ফিনফিনে পাতারা লনের ঘাসে নরম নিভৃত নিরুপদ্রবতার বাহন হয়ে ছড়িয়ে পড়বে।

     

     

    স্বপ্ন ভেঙে গেল। ফোনটা বেজে উঠল। অফিসে বসে স্বপ্ন দেখাটা খুব খারাপ। সব বুঝি, তবু অবাধ্য মনটা বোঝে না। ছোট ছেলের মতো স্বপ্ন দেখে, কল্পনার লাল নীল লালিপপ চুষে চুষে খায়।

    হ্যালো।

    ঋজু বোসের সঙ্গে কথা বলতে পারি? জড়ানো-জড়ানো গলায় কে যেন বলল।

    কথা বলছি।

    আমি যতি।

    কী ব্যাপার? এত উত্তেজনা কীসের?

    উত্তেজিত হয়ে আছি তাই। ‘অপারেশন চাইনিজ’ সাকসেসফুল।

    মানে?

     

     

    মানে, ছ’দিন চাইনিজ খাওয়া অর্জন করলাম। আধ ঘণ্টা আগে লাভ ইন দ্য আফটারনুনের সঙ্গে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে আমার জিপ নিয়ে মুখোমুখি লড়ে গেলাম। জিপ নিয়ে বনেটের উপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে উইন্ডস্ক্রিন ভেঙে একেবারে সামনের সিটের নরম চামড়ার কুশানে।

    উদবিগ্ন গলায় বললাম, ড্রাইভারের কী হল?

    কী আবার হবে? হাসপাতালে নিয়ে গেছে। বেশি আর কী হবে? মরে যাবে। তার বেশি তো আর কিছু নয়। তবে ও জাগুয়ার গাড়ি বিধুমুখীর এ জন্মে আর চড়তে হবে না। যতিটা একটা পাজি। এমনভাবে বলছে যেন সত্যি সত্যিই ড্রাইভারের জন্য ওর কোনও ভাবনাই নেই।

    তবু, খুশি হলাম। কেবল চাইনিজ নয়–তোমায় আর যা কিছু খেতে চাও খাওয়াব। তোমার কিছু হয়নি তো?

    বিশেষ কিছু নয়। পেছনের পাটির দু’খানা দাঁত ভেঙে গেছে। ভালই হয়েছে। ও দুটো সঁতে পোকা বড় জ্বালাতন করত। তা ছাড়া মাথা একটু কেটে গেছে তিনটে স্টিচ করেছে। আমার জন্য ভেবো না। ফাইন আছি।

     

     

    যাক, তাও বাঁচোয়া, অল্পের উপর দিয়ে গেছে। কাল রাতেই চলো–বাইরে খাওয়া যাক।

    কাল যেতে পারব না। আমি তো অ্যারেস্টেড। জামিনে খালাস পেয়েছি। এসব ঝামেলা পুইয়ে নিই–তারপর দিল খুস করা যাবে।

    বললাম, শোনো। এসব খরচা-খরচের একটা হিসেব-টিসেব রেখো। রঞ্জন কী বলছে?

    সে তো ন্যাকামি করছে এখন। বলছে, কী দরকার ছিল এত বাড়াবাড়ি করার? ড্রাইভারটা যদি মরে যায়? আচ্ছা তুমিই বলো, একটি দেড় লাখ টাকার গাড়ি ধসাতে একটি লোক মরবে তাতে ন্যাকাকান্নার কী আছে? আমি যে প্রাণে বেঁচে গেলাম–সে কথাটা একবারও বলছে না এখন।

    বললাম, ও নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না, ও একটু নার্ভাস টাইপের–নিজেই হুজুগ তুলে এখন নিজেই পস্তাচ্ছে। যো হুয়া সো হুয়া। যো হুয়া আচ্ছাই হুয়া।

    কাজ প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের অফিস সাড়ে পাঁচটায় ছুটি। তা ছাড়া এই খবরটা শোনামাত্র বেশ খুশি-খুশি লাগছিল মনটা। হাতটাকে মুঠো করলাম জোরে–আনন্দ হল–শালা! রোজ রোজ আমরা ভাঙা অ্যাম্বাসাডরে চড়ব, আর তুমি রোজ লাখ টাকার গাড়ি এনে ফুটুনি মারবে–ননির পুতুল–বিধুমুখী আমার! বেশ হয়েছে। বড় আনন্দ হয়েছে।

     

     

    এই আনন্দ কীভাবে সেলিব্রেট করব বুঝতে পারছি না। নয়নাকে একটা ফোন করলে হয়। জাগুয়ারের ড্রাইভারটাকে একবার দেখতে যাওয়া দরকার। ওর চিকিৎসাপত্রর যেন কোনও ত্রুটি না হয়। মনে হচ্ছে মরবে না। মনে হচ্ছে যখন, তখন নিশ্চয়ই মরবে না।

    নয়নার সঙ্গে কোথাও বেড়াতে গেলে বেশ হয়। এই কলকাতায় কোন চুলোতেই বা আর বেড়াব। যেখানে যাব সেখানেই তো ফুচকাওয়ালা আর ট্রানজিস্টার আর কদাকার কদাকার মহিলারা। যাচ্ছেতাই যাচ্ছেতাই। তার চেয়ে নয়নাকে নিয়ে কোনও ভাল ছবি দেখতে গেলে হয়। নয়নাকে এই ঘটনা বা দুর্ঘটনা যাই হোক–এর কথা বলতেই হবে এবং এ কথা ওকে আজই–এক্ষুনি বলতে হবে। বললেই ও প্রথমে চোখ বড় বড় করে শুনবে, কৌতুকভরে বলবে, সত্যি? তারপরই বকবে–ভীষণ বকবে। বলবে–ছিঃ ছিঃ, লেখাপড়া জানা বড় বড় ছেলেরা যে এরকম কাজ করতে পারে ভাবতে পারিনি। আপনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন না। আমাকে এক্ষুনি গাড়ি থেকে নামিয়ে দিন। এ তো মানুষ খুন করার শামিল। এরকম যদি আপনারা করতে পারেন, তো আরও অনেক কিছু করতে পারেন। ইস, ভাবা যায় না। আপনার মতো ছেলেও…। ইত্যাদি ইত্যাদি।

    ওকে শান্ত করতে নিঃসন্দেহে বেগ পেতে হবে। তবু আমার বিশ্বাস আছে ও শেষকালে ক্ষমা করবে। যতি ও রঞ্জনকে ও চেনে না–ওদের ক্ষমা করবে কি না জানি না–কিন্তু আমার বিশ্বাস আছে যে, অবশেষে ও আমায় ক্ষমা করবে।

     

     

    ফোনটা ডায়াল করলাম। সুজয়ের ওয়েস্ট জার্মানিতে যাওয়া ঠিক। কয়েক মাসের মধ্যেই যাবে। আজকাল বাড়িতে একটু-আধটু থাকে–ওরকম দিবারাত্রি আড্ডা মারা ছেড়েছে। ও-ই ফোনটা ধরল। বলল, নয়না তো নেই রে। নীতীশ কাল সকালের প্লেনে শিলং চলে যাচ্ছে–তাই নয়না আর ও সিনেমাতে গেছে। এলে কিছু বলব?

    বললাম, নাঃ, এমনি। ছেড়ে দাও। তোমার সঙ্গে পরে দেখা করব। বলেই, ঘটাং করে ফোন ছেড়ে দিলাম।

    নীতীশ। নীতীশ সেন। এই নামটা শুনলেই আমার শোণিতস্রোত উলটো ঘুরতে শুরু করে। মি. সিধুর গাড়ি না ভেঙে ওকে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিতে পারলে সবচেয়ে খুশি হতাম। কোনও শটগানে, এল-জি ভরে একটি ক্লিন নেশট; অথবা, পয়েন্ট টু টু রাইফেল দিয়ে কানে মারা। মজা বুঝবে। ন্যাকা, মেয়েলি ভাল ছেলে, অসহ্য।

    অফিস থেকে বেরুলাম। চৌরঙ্গির মোড় পেরুলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল–মেট্রোর সামনে নয়না আর নীতিশ রাস্তা পার হচ্ছে। মেট্রোয় যাবে। আলোতে ওদের দু’জনকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। নীতীশ একটা কালো সুট পয়েছে। বেশ হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে।

    নয়না নীতীশের একেবারে গায়ের সঙ্গে ঘেঁষে চলেছে।

     

     

    নয়না বোধহয় কোনও দোকানে খোঁপা বেঁধেছিল সেদিন। একটি কমলারঙা সম্বলপুরি সিল্কের শাড়ি এবং লো কাট ব্লাউজে ওর গ্রীবাটি অন্য সব দিনের চেয়েও সুন্দর দেখাচ্ছিল। ওই ঝলমলে আলোয় ওকে চিৎকার আকাশের আসন্ন সন্ধ্যায় উড়ে-চলা ফ্লেমিংগো পাখি বলে মনে হচ্ছিল। আমার মাথায় খুন চেপে গেল। কী হল জানি না। কেমন করে হল জানি না। স্টিয়ারিংটাকে শক্ত করে দু’হাতে ধরে যত জোরে পারি অ্যাকসিলারেটরে সমস্ত জোর দিয়ে চাপ দিলাম–গাড়িটা চৈত্র মাসের হাওয়ার মতো হুহু করে এগিয়ে চলল। দু’জনকে একসঙ্গে চাপা দেব–গুঁড়িয়ে ফেলব–চাপ চাপ গাঢ় রক্ত লেগে থাকবে রাস্তায়–কালো সুট আর কমলারঙা শাড়ি রক্তে লাল হয়ে যাবে। ফ্লেমিংগো পাখি ঘাড় মটকে পড়ে থাকবে কমলারঙা শাড়িতে পৌঁছে গেছি–পৌঁছে গেছি–আর এক মুহূর্ত–হঠাৎ একটা হ্যাঁচকা টানে নীতীশ নয়নাকে সরিয়ে নিয়ে গেল আমার আওতা থেকে কিন্তু অত অল্প সময়ে ব্রেক কষা সম্ভব হল না–গিয়ে পড়ল গাড়ি সামনের গাড়ির উপরে–সে গাড়ি লাফিয়ে গিয়ে ধাক্কা মারল তার সামনের গাড়িতে। দু’গাড়িরই দু’ড্রাইভার নেমে এল। এসে আমাকে গালাগালি করতে লাগল। দোষ সম্পূর্ণই আমার। উচিত ছিল চুপচাপ থাকা। আমি উলটে ওদের গালাগালি দিলাম–চেঁচিয়ে বললাম, keep your bloody mouth shut. বলতেই, সামনের লোকটা আমার কলার ধরল। কলার ধরতেই মাথা ঠিক রাখতে পারলাম না–টেনে মারলাম এক আপার কাট। লোকটা হেঁচকি তুলে সরে গেল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাদের সমবেত সমর্থকবৃন্দ আমাকে চাঁদা করে মারতে আরম্ভ করল। একজন সার্জেন্ট না এসে পড়লে কী হত জানি না। কে যেন খুব জোরে একটা ঘুষি মারল আমার রগের উপর, কপালে–তারপর দেখলাম একটি একটি করে আলোগুলি নিভে যেতে লাগল–ঠান্ডা লাগতে লাগল–মনে হল ঘাড়ের কাছে কেউ যেন ওডিকোলনের শিশি উপুড় করে দিয়েছে। সমস্ত মাথার মধ্যে অনেকগুলো কটকটি ব্যাং ডাকতে লাগল। আর কানের মধ্যে ঝনঝন করতে লাগল নয়নার গলা–কী অসভ্য ড্রাইভার! নীতীশও চেঁচিয়ে কী একটা বলেছিল। শুনতে পাইনি। ভাগ্যিস ওরা কেউ আমায় চিনতে পারেনি।

     

     

    সার্জেন্ট আসাতে সামনের ভিড় কমল। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে থানায় গিয়ে ডাইরি করতে হবে। সবকিছু করতে হবে। কিন্তু কিছুই করতে ইচ্ছে করল না। ইচ্ছে করল ঘুমোই।

    গাড়ি স্টার্ট করে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলোম। জামার বোতাম ছিঁড়ে গেছে। টাই ধরে টানাটানি করাতে গলায় খুব লেগেছে। জল পিপাসা পাচ্ছে খুব। বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছিল না এই অবস্থায়।

    পার্ক স্ট্রিটে এসে দাঁড়ালাম। কোথাও বসে এক কাপ কফি খেলে বেশ হত। রুমাল দিয়ে ঠোঁটটা ভাল করে মুছলাম। ঠোঁটের কোনাটা কেটে গেছে। ওরা খুবই মেরেছে; তবু দুঃখ নেই তার জন্যে। আসলে আপশোস, নয়না আর নীতীশকে আমার জীবন থেকে মুছে ফেলতে পারলাম না!

    একটা কোনা কফি নিয়ে সায়ান্ধকারে একটি কোনায় বসে বসে অনেক পুরনো দিনের কথা–অনেক টুকরো ঘটনা চোখের উপর সারি সারি ভেসে-ওঠা ছবির মতো দেখছিলাম। সেসব ছবি দেখতে দেখতে বর্তমানের সবকিছু মন থেকে উবে গেল।

    একদিন খুব বৃষ্টি পড়ছিল। ট্রাম স্ট্রাইক ছিল, শুধু বাস চলছিল। প্রচণ্ড ভিড়। অফিসে বসে হঠাৎ আমার মনে পড়ল নয়নার কলেজ ছুটি হবে। ওই সময় ট্যাক্সি পাবে না–ওই ভিড়ে বাসেও উঠতে পারবে না। বৃষ্টিতে ভিজবে এবং নির্ঘাত জ্বরে পড়বে। পরশুদিন ফোনে কথা বলার সময় ও ঘং ঘং করে কাশছিল। অতএব অফিস পালিয়ে ওর কলেজের চারপাশে ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর কনকনে হাওয়ায় চক্কর মেরে বেড়াতে লাগলাম। কলেজ থেকে বেরুনো অন্যান্য মেয়েরা এবং হয়তো পথচারীরাও ভাবল যে, আমার উদ্দেশ্য শুভ নয়। ওরা কী করে জানবে যে, ওদের মধ্যে সুন্দরীশ্রেষ্ঠা যে, তার সম্বন্ধেও আমার বিন্দুমাত্র ঔৎসুক্য নেই। আমি কেবল আমার নয়নার খোঁজে এসেছি। পাছে সে বৃষ্টিতে ভেজে, পাছে তার কষ্ট হয়, পাছে ভীষণ ভিড়ের বাসে তার সুন্দর পায়ের পাতা কোনও বদখত নোক কাদাসুদ্ধ জুতো দিয়ে মাড়িয়ে দেয়–আমি তাই অফিস পালিয়ে পাগলের মতো কুড়ি মিনিট হল দণ্ডি কাটছি। আমার ভাগ্যদেবীর হাতে দণ্ডিত হচ্ছি। সেদিন দেখা হয়নি নয়নার সঙ্গে। কারণ ওর ক্লাস সেদিন আগে শেষ হয়ে গিয়েছিল।

     

     

    আরেক দিনের কথা মনে পড়ল। পাইপটা ধরালাম। কিছু খেলে হয়। মার খেয়ে বেশ খিদে পেয়েছে। একটা হ্যামবার্গার নিলাম।

    একবার নয়নার সামান্য জ্বর হয়েছিল। অফিস থেকে ফিরে রোজ ওকে দেখতে যেতাম। বেণি এলিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে ও শুয়ে থাকত। গেলে ও খুশি হত। কিন্তু তার চেয়ে আমি খুশি হতাম অনেক বেশি। বোধহয় ওকে আমার নিজের জীবনের চেয়েও ভালবাসি বলে, ওকে অসুস্থ, অসহায় দেখলে আমার ভাল লাগত। মনে হত, ওর জন্যে কিছু করি। ওর কাছে বসে ওকে একটু ভাললাগা দিয়ে, নিজে সার্থক হতাম। ভাবতাম, ওর জন্য কিছু করার একটি সুযোগ মিলল।

    ওকে অনেকদিন বলতাম আমি–তোমার বেশ বড় কোনও অসুখ হোক। তোমার যাতে অনেকদিন নার্সিং হোমে থাকতে হয়। অনেকদিন। প্রথম প্রথম আত্মীয়স্বজন, তোমার দেখানো-হিতাকাঙ্ক্ষীরা, বন্ধু বান্ধবেরা খুব ভিড় করবে। তোমায় দু’বেলা দেখতে যাবে। তারপর আস্তে আস্তে কেউ আর সময় করে উঠতে পারবে না। সকলেরই কিছু না কিছু জরুরি কাজ পড়ে যাবে। এমনকী সুজয় পর্যন্ত তোমাকে দেখতে আসার সময় করে উঠতে পারবে না। তখন আমি প্রতি সন্ধ্যায় অফিস-ফেরতা তোমার কাছে যাব। তোমার কেবিনে বসে থাকব। রোজ তোমার জন্যে ফুল নিয়ে যাব। মাঝে মাঝে ক্যাডবেরিও নিয়ে যাব নার্সকে লুকিয়ে, ভেঙে-ভেঙে, টুকরো করে তোমার ঠোঁটে দেব। তোমাকে একটুও বিরক্ত করব না। কিচ্ছু করব না–শুধু তোমার ঘামে-ভেজা গরম দুখানি হাতে হাত রেখে, তোমার শুকতারার মতো চোখে চোখ রেখে, আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকব। তোমাকে যদি সবাই কোনওদিন ত্যাগ করে–সবাই তোমাকে ভুল বোঝে–একমাত্র সেদিনই তুমি জানতে পারবে আমি তোমার জন্য কতটুকু করতে পারি। আমি তোমার কে।

     

     

    এরকম গড়গড় করে পাগলের মতো বলতাম, একটু থামতাম, একটু ভাবতাম; আর নয়না কনুইয়ে ভর করা হাতের পাতায় মুখ রেখে বড় বড় চোখ মেলে উৎসুক হয়ে শুনত–তারপর অত্যন্ত নিস্পৃহ গলায়, যে এতক্ষণ কিছুই শোনেনি–এমনিভাবে বলত–ইস। কল্পনাও করতে পারেন আপনি। একটি জলজ্যান্ত মেয়েকে মাসের পর মাস নার্সিংহোমে শুইয়ে রাখবেন–কেবল আপনি আমার কে তা বোঝাবার জন্য? সত্যি! আপনাকে নিয়ে চলে না। আপনার মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে।

    জানি না, হয়তো তাই গেছে।

    কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, শিশুর কাছে মার স্তনের মতে, প্রথম কৈশোরের নিশ্বাসের মতো, প্রথম যৌবনের স্বপ্নভরা আম্রমুকুলিত দিনগুলোর মতো নয়না আমার অন্তরের অংশ হয়ে উঠেছে। ও যে সত্যি আমার কে, তা ওকে কোনওদিনই আমি বোঝাতে পারব না। ও কোনওদিন বুঝতে চায়ওনি–চাইবেও না।

    অথচ এইটুকু সহজ অঙ্ক কখনও আমার মাথায় ঢোকে না। কানা ষাঁড়ের মতো কেবলই আমি লাল কাপড়ের দিকে ছুটে যাই–আর কোনও তরুণ, দৃঢ় মাতাদোরের মতো নয়না আমাকে প্রতিবারই ওর অবজ্ঞা ও ঔদাসীন্যের ছোরা দিয়ে ক্ষতক্ষিত ও রক্তাক্ত করে তোলে।

     

     

    জানি না, সত্যি সত্যি আমি কী চাই নয়নার কাছে? ভাল ব্যবহার, এমনকী মৌখিক ভালবাসা তাও সে আমাকে দিয়েছে। সে আমাকে অনেকানেক ব্যাপারে অনুপ্রেরণাও জোগায়। এর জন্যেই–মানে ও যা দিয়েছে তা নিয়েই ওর কাছে আমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। অথচ, তবু আমি সর্বদা ছটফটিয়ে মরি। তা হলে কি শরীর–আমি কি তা হলে শরীরটাকেই চাই? তার রজনীগন্ধার মতো প্রস্ফুটিত ছিপছিপে শরীরটাই কি চাই তা হলে?

    পাইপের টোব্যাকোটা তেতো তেতো লাগতে লাগল। থুথু ফেললাম অ্যাশট্রেতে। নীতীশের মুখে ফেললে ভাল হত। কোনওরকমে নয়নার উপর প্রতিশোধ নিতে পারলে ভাল হত। কিন্তু এ যদি শুধু শরীরই হয় তবে এত ব্যথা কীসের? এত যন্ত্রণা কীসের? যৌবনের সোনার সময়কে এমনি করে মোমের মতো বিনা প্রয়োজনে ক্ষয় করাই বা কীসের জন্য?

    কিন্তু ভয় করতে লাগল। শুনেছি, ছোটবেলা থেকে শুনেছি যে এই পাড়া, এদিক-ওদিক গলি-ঘুচি, আলো-অন্ধকার সব কিছুই অর্থবাহী। পয়সা থাকলে নাকি পাওয়া যায় না এমন আনন্দ নেই কলকাতায়।

    গাড়িটা ওখানেই থাকল। চোরের মতো, লাথি-খাওয়া ঘেয়ো কুকুরের মতো প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে, লেজ গুটিয়ে ফ্রি-স্কুল স্ট্রিট ধরে পা-টিপে পা-টিপে হাঁটতে লাগলাম। একটু এগোতেই, একটি বড় ফ্ল্যাট বাড়ির ফটকের সামনে, পানের দোকানের পাশে, একটা শিয়ালে-খাওয়া কইমাছের চেহারার লোক সোজা আমার চোখের মণি লক্ষ্য করে তাকাল। আমার কান গরম হয়েছিল। আমি সঁতে দাঁত চেপে ছিলাম। মাথা নোয়ালাম। লোকটা পচা-মাংস-চিবানো হায়নার মতো দাঁত বের করে হাসল, হাত তুলে সেলাম করল, ফিসফিস করে বলল, কেয়া চাহিয়ে সাহাব? পাঞ্জাবি, পারসি, অ্যাংলো, যযা কহিয়েগা। ইকদম বেহেতরিন চিজ।

     

     

    আমি উত্তরে বেশ কেটে কেটে বললাম, মুঝে বাঙ্গালি লা-দো। বলেই, নয়নার চেহারার হুবহু বর্ণনা দিলাম–ওকে একটু অন্ধকারে টেনে দিয়ে।

    ও বলল, আপ বেফিকর রহিয়ে–জেরা টাইমকা বাত হ্যায়–মগর ম্যায় লায়গা জরুর।

    এর আগে আমার মতো আনাড়ি মুরগি এই ধানখেতে কখনও যে ধান খায়নি, তা ওর চোখ দেখেই বুঝলাম।

    লোকটা আমায় ভিতরের চত্বরে একটু হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে একটা সোফা-সাজানো ঘরে বসাল। সে ঘরের দেওয়ালময় উগ্র অঙ্গভঙ্গিমায় নানারকম মেয়েদের “আয়না-দেখি” গোছের ছবি।

    লোকটি বলল, ম্যায় চলে হুজুর। মগর পঁচাশ রুপেয় লাগেগা।

    আমি বললাম, রুপেয়াকা ফিক্কর মত করো।

    ওই ঘরে বসে বসে একা আমার ভয় করতে লাগল। যদি কোনও চেনা লোক দেখে ফেলে? যদি বলে, আরে ঋজু? এখানে কী করছ? যদি কেউ দেখে ফেলে, যদি কেউ একান্ত দেখে ফেলেই, তা হলে কাটা-ঠোঁট দেখিয়ে, মার-খাবার দাগ দেখিয়ে বলব–তাকে বলব যে, দ্যাখো আমার নয়না আমাকে কী করেছে। তাই তার উপর আমি প্রতিশোধ নিতে এসেছি। আমার বিশ্বাস, যে-কেউ আমার কথা বুঝবে।

    তারপর কতক্ষণ সময় কেটে গেল জানি না। একটা গুন্ডা প্রকৃতির লোক–বেঁটে-সেঁটে তেল-চুকচুকে কালো–এসে বলল, রুপেয় অ্যাডভান্স দিজিয়ে–কামরাকা কেরায়া দিজিয়ে। হাম দোনোকো বকশিশ দিজিয়ে। তারপর শুধোল, মামুলি কামরা লিজিয়েগা, না এয়ারকন্ডিশনড়? কেউ ভেজিটারিয়ান না নন-ভেজিটারিয়ান শুধোলে যেমনভাবে উত্তর দিই, তেমন করে বললাম, এয়ার কন্ডিশনড। আলবত এয়ারকন্ডিশনড। এই কলকাতার ধুয়ো কালিতে আমি আমার নয়নামোনার সঙ্গে মিলিত হতে পারব না। তার সঙ্গে আমি এই প্রথমবার মিলিত হব–শুধু তাই বা কেন? জীবনে এই প্রথমবার কোনও নারীর সঙ্গে মিলিত হব। তা ছাড়া জীবনের এসব স্মরণীয় দিনগুলোতে কার্পণ্য যে করব না, তা ছোটবেলা থেকেই ভেবে এসেছি।

    আজকে নয়নার সমস্ত গর্ব আমি ভেঙে দেব। ও আমাকে যত ব্যথা দিয়েছে, সব ব্যথা আমি সুদে আসলে ফিরিয়ে দেব। আমার অনভ্যস্ত ও অনিয়ন্ত্রিত আরতিতে নয়নার ধূপের গন্ধের মতো আর্তি আমি তিল তিল করে উপভোগ করব।

    সেই গুন্ডাটা হিসাব-নিকাশ করে আমার কাছ থেকে সবসুদ্ধ একশো কুড়ি টাকা নিয়ে নিল। বলল, সাব, হুইস্কি-উইস্কি কুছ নেহি পিজিয়েগা?

    আমি বললাম, কুছ নেহি।

    ও চলে গেল। আমার ঠোঁট থেকে এখনও রক্ত ঝরছে। আমার নিজের নোনা রক্ত আমি চেটে চেটে খাচ্ছি–সমস্ত শরীরের রক্ত এখন টগবগিয়ে ফুটছে–। নেশায় আমি এখন আলাউদ্দিন খাঁ-র সরোদের মতো বাজছি। তোমরা এখন শুধু আমার নয়নাকে নিয়ে এসো।

    হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল। সেই গুন্ডামতো লোকটির সঙ্গে একটি ছিপছিপে অল্পবয়সি মেয়ে ঘরে ঢুকল। অবাক হলাম। বেশ দেখতে তো। কে বলবে যে, মাত্র পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে এ কোহিনুর হিরে বিকোবে। কিন্তু গায়ের রংটা অসম্ভব ফরসা। ঠিক নীতীশের মতো। হ্যাঁ–নীতীশ সেনের মতো ফরসা।

    মেয়েটি কাছে এল। ছোটবেলায় চিড়িয়াখানায় উদবেড়ালের চৌবাচ্চায় সিংগি মাছ ফেলে যেমন চোখে আমরা চেয়ে থাকতাম–ভাবটা, কী করে গিলে ফেলে, দেখি–মেয়েটি তেমন চোখে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমরাও যেমন বুঝতাম, লেজের দিকে আগে কামড়াবে না মাথার দিকে, তেমনি অবুঝের মতো না বুঝে মেয়েটি আমার দিকে চেয়ে হাসতে লাগল। তারপর বলল, চলুন, ঘরে যাই।

    এবার উজ্জ্বল আলোয় মেয়েটির মুখের দিকে ভাল করে তাকালাম। কই? সে চোখ কই? যে চোখে চাইলে আমার সমস্ত সত্তা জলতরঙ্গের মতো বেজে ওঠে, ভাল লাগায় আমি সজনে ফুলের মতো কাঁপতে থাকি, সে চোখ কই? এ তো চোখ নয়, যেন মরা ভেটকির কোল। এ চোখে চাওয়া যায় না। এ শরীরে যাওয়া যায় না। এ তো আমার নয়না নয়, এ কাকে এরা এনে দিল আমায়? এর শুধু গড়নই নয়নার মতো, এমনকী, বুক চিবুক সবকিছু–কিন্তু আর কিছুই যে নয়নার মতো নয়। সেই বুদ্ধি কই? সেই দুষ্টুমিভরা হাসি কই? এ আমার নয়না নয়। আমি যে কেবল নয়নাকেই চেয়েছিলাম–তার সব কিছু মিলিয়ে আমি যে একমাত্র তাকেই চেয়েছিলাম। আমার তো অভিমান শুধুনয়নার উপরে, পৃথিবীর অন্য কোনও মেয়ের উপর তো আমি প্রতিশোধ নিতে চাইনি। আমি কেবল তাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম; বোঝাতে চেয়েছিলাম; কী যে বোঝাতে চেয়েছিলাম তা আমি নিজেও জানি না।

    এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালাম। মেয়েটি অবাক চোখে তাকাল। এমন উদবেড়াল সে জীবনে দেখেনি। বলল, কী হল? আমি বুঝি দেখতে খারাপ?

    আমি বললাম, তাড়াতাড়িতে, ভয় পেয়ে তোতলাচ্ছিলাম, বললাম–তা নয়, তা নয়, এখানে আমি একজনকে খুঁজতে এসেছিলাম ভাই। তাকে পেলাম না।

    মেয়েটি আরও অবাক হল। বলল, সে কী? কে সে? নাম কী? মিলি?

    আমি বললাম, না। অন্য একজন। সে হারিয়ে গেছে।

    এবার মেয়েটির মুখ সম্পূর্ণ বদলে গেল, কী এক কান্না কান্না, নিষ্পাপ ভাব তার প্রসাধিত মুখে ছড়িয়ে গেল—উদ্‌বিগ্ন গলায় শুধাল, পাকিস্তানে বুঝি দেশ ছিল?

    বললাম, না। শিলঙের এক গুন্ডা তাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। তারপর খুঁজে পাচ্ছি না। চলি। বলেই ঘর ছেড়ে চত্বরে নামলাম। মেয়েটা দরজা থেকেই বলল, শুনছেন; এই যে শুনছেন–

    আর পেছন ফিরে তাকালাম না। আমার ভীষণ কান্না পেতে লাগল। নিজের জন্যে। নয়নার জন্যে। এবং নাম-না-জানা এই মেয়েটির জন্যেও।

    সোজা ক্লাবে এলাম।

    আমি ভীরু নই। কার সঙ্গে লড়তে হবে জানলে আমি লড়তে পারি কি না দেখাতাম। কিন্তু নিজের সঙ্গে নিজে আমি লড়তে শিখিনি কোনওদিন। পারি না। নয়না কোনওদিন আমাকে একবারের জন্যেও বলেনি কী করলে আমি ওর যোগ্য হতে পারি। নীতীশ যে কেন এবং কী বাবদে আমার চেয়ে ভাল, এ কথার জবাব কোনওদিন জানতে পাব না। হয়তো অনেক প্রশ্ন আছে যার জবাব কেউ দেয় না। যার জবাব কালের স্রোতে, জোয়ারে-ভাসা কুটোর মতো হয়তো এমনিই ভেসে আসে। ভালবাসলে কী করতে হয় আমি জানি না। নয়নাও একদিন বলেছিল, জানে না। কেউ জানে কি, তাও জানি না।

    ঠিক এই মুহূর্তে আমার আর কোনও ইচ্ছে নেই। নয়নার মুখটা শুধু আমার চেতনা থেকে, আমার অবচেতন থেকে মুছে ফেলতে চাই। তার প্রশান্ত কপাল, তার উজ্জ্বল চোখ দুটি আমি যেন আর্তনাদ করেও, সমস্ত রকমে চেষ্টা করেও, কখনও মনে না আনতে পারি। কোনওদিন কোনওদিন, কোনওদিন মনে না আনতে পারি।

    হুইস্কি লাও। বেয়ারা, হুইস্কি লাও।

    .

    ১৪.

    লাইট হাউসের সামনের বইয়ের দোকানে বই দেখছিলাম। দুটো বই অর্ডার দেওয়া ছিল। ওরা সে দুটো প্যাক করে দিচ্ছিল। বই দুটি নিতেই এসেছিলাম।

    অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন

    আজ শনিবার। এখন চারটে বাজে। অফিস থেকে বেরিয়ে এই এসেছি। বইগুলো নাড়ছি-চাড়ছি। এমন সময় আমার বাহুতে আঙুল ছুঁইয়ে কে যেন বলল, এই!

    ঘাড় ফেরাতেই দেখি নয়না।

    প্রথমে ঠিক করলাম, কথাই বলব না। কিন্তু নিজের অজান্তেই পরক্ষণেই আমার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললাম, কী?

    অসভ্য।

    অসভ্য কেন?

    কতদিন আসেন না বলুন তো। কত বছর?

    বললাম, বছর তো নয়, দুয়েক মাস মাত্র। এমনিতেই যাই না। বড় হবার চেষ্টা করছি। তা ছাড়া গেলে তোমার পড়াশুনার অসুবিধে হয়।

    বুঝলাম। কিন্তু ফোন করলেও কি অসুবিধে হত?

    একটু শক্ত গলায় বললাম, হত বই কী। ওই একই অসুবিধে হত।

    আমার গলার স্বর শুনে ও আমার চোখে চোখ মেলে সম্পূর্ণভাবে চাইল–তারপর মুখ নিচু করে বলল, আপনার দেরি হবে? আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল।

    অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন

    ভাবলাম বলি যে, তুমি যেতে পারো। তোমার সঙ্গে আমার কোনও কথা নেই! থাকবেও না কোনওদিন।

    কিন্তু মুখ ফুটে তা বলতে পারলাম না। নয়না যদি এ জীবনে কখনও কোনও সময়ে, এমনকী যখন আমার ভুরু সাদা হয়ে যাবে, চুল ধবধব করবে, তখনও যদি কখনও আমার চোখে তাকিয়ে বলে, ঋজুদা, আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল– তখনও আমার সব কাজ ফেলে আমাকে ওর কথা শুনতে হবে। কারণ It is my des tiny. পূর্বজন্মের কোনও অজানা ঋণের বোঝা আজীবন আমায় শোধ করতে হবে নয়নার কাছে। শোধ করতেই হবে। আমার মুক্তি নেই।

    বললাম, একটু দাঁড়াও। দুটি বই অর্ডার দিয়েছিলাম। বেঁধে দিচ্ছে।

    ও ঘাড় হেলিয়ে বলল, আচ্ছা!

    অনেকদিন পরে নয়নাকে দেখলাম। এতদিন ওকে বড় দেখতে ইচ্ছে করেছে–বড় কথা বলতে ইচ্ছে করেছে ওর সঙ্গে। তবু, খাঁচায় বন্ধ বাঘের মতো লোহার শিকে আছড়ে, মাথা কপাল রক্তাক্ত করেছি। তবু ওর সঙ্গে দেখা করিনি, কথা বলিনি। যদি কেউ আমার মতো করে কখনও কাউকে ভালবেসে থাকে তবে কেবলমাত্র সে-ই বুঝতে পারবে–এতদিন পর নয়নাসোনাকে দেখে আমার কতখানি ভাল। লাগছিল। এই শীত-শেষের বিকেলে বড় ভাল লাগছে। একটা চাপারঙা কার্ডিগান পরেছে নয়না, চাপারঙা কাশ্মীরি সিল্কের শাড়ির উপর। অনেকদিন পরে দেখছি বলে কি না জানি না মনে হচ্ছে এ মাসে ও যেন অনেক বড় ও আরও অনেক বেশি সুন্দরী হয়ে গেছে। আরও অনেক বেশি ব্যক্তিত্বসম্পন্না।

    বললাম, তুমি এখানে কী করছিলে?

    অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন

    আমি? এই একটু কেনাকাটা করতে মার্কেটে এসেছিলাম।

    বইটা নিয়ে বললাম, বলো কোথায় যাবে।

    আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন।

    মনে হচ্ছে ফাঁসির আসামির ইচ্ছাপূরণের মতো আজ তুমিও আমার ইচ্ছাপূরণে বদ্ধপরিকর।

    যা বলুন।

    তোমার হাতে সময় আছে তো?

    আছে। রাত এগারোটা অবধি। ছটার শোতে সুমিতা সিনেমার টিকিট কেটেছিল। রাতে ওদের বাড়ি খাওয়ার নেমন্তন্নও ছিল। একটু আগে জানলাম, মানে বাড়ি থেকে বেরুনোর পর, যে দুটোই ক্যানসেল। সুমিতার এক মামার হঠাৎ স্ট্রোক হয়েছে–তাই। অথচ বাড়িতে বলে এসেছি। তাই এগারোটা অবধি চিন্তা করবে না কেউ।

    দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে ফেরাজিনিতে এসে বসলাম। গাড়ি রেখেছিলাম লাইট হাউসের সামনে। গাড়ি ওখানেই থাকল। কোণের একটি টেবলে–দু’জনে বসলাম। আজ বহুদিন বাদে নয়না আমার সঙ্গে কোনও রেস্তোরাঁয় ঢুকল। ওর হাতে–ঝোলানো কালো চামড়ার ব্যাগ থেকে একটি ছোট প্যাকেট বের করে আমার হাতে দিল।

    অবাক হয়ে শুধোলাম, কী?

    আপনার জন্যে দুটি টাই ও দুটি মোজা কিনেছিলাম।

    রীতিমতো অভিভূত হয়ে পড়লাম। বললাম, কেন? কী ব্যাপার?

    ও হাসল। বলল, ব্যাপার কিছু নয়। অনেক দিন থেকে ইচ্ছা ছিল, আমাকে যে আপনি স্নেহ করেন তার স্বীকৃতি হিসেবে, যেদিন নিজে রোজগার করব, সেদিন আপনাকে কিছু কিনে দেব।

    এই ‘স্নেহ’ কথাটাকে আমি ঘেন্না করি–আমি ওকে কোনওদিন ছোটবোনের মতো ভালবাসতে পারিনি চাইনি–আজও চাই না–অথচ ও সব সময় আমাকে শ্রদ্ধা দেখায়, দাদার মতো দেখে।

    বললাম, তুমি চাকরি আরম্ভ করে দিয়েছ নাকি?

    না! একটি বাটিকের শাড়ি বানিয়েছিলাম। তার সম্মানী পেয়েছি ষাট টাকা।

    আর সেই টাকার প্রায় সবটাই খরচ করে ফেললে একটা লোকের জন্যে যে তোমাকে কেবল জ্বালালই চিরদিন।

    নয়না চোখ তুলে বলল, আপনি ভীষণ খারাপ। অমন করে বলবেন না। আমার ভাল লাগে না।

    বেয়ারা এসে অর্ডার নিয়ে গেল।

    আমি বললাম, তারপর? তোমার কী খবর বলো? নীতীশ সেন কেমন আছে?

    নয়না আমার চোখে একবার চাইল। যেন ও বলতে চাইল–নীতীশকে আমার এত অপছন্দ কেন?

    ও কিছু বলার আগেই–ওই নামটা উচ্চারণ করতেই জ্ঞানত আমার গলার স্বরটা সম্পূর্ণ বদলে গেল–মাথায় আবার সেদিনকার সেই যন্ত্রণাটা, যেদিন এক কল্পিত নয়নার উপর আমার সমস্ত ইচ্ছা আরোপ করার দুরাশায় একটা ঘৃণিত অভিজ্ঞতার চৌকাঠে পা দিয়ে ফিরে এসেছিলাম, সেটা ফিরে এল।

    নয়না ঠান্ডা গলায় চোখ নিচু করে বলল, নীতীশদা ভালই আছে কলকাতা আসছে আবার সামনের দোলে। আপনি বোধহয় জানেন না, নীতীশদার বিয়ে হয়ে গেছে। অবশ্য বেশিদিনের কথা নয়। এই তো দিন পনেরো আগে ওরা শিলং ফিরল।

    নাঃ, আজকেও নয়না দেখছি আমায় হারিয়ে দেবে।

    আমি খুব ঠান্ডা গলায় আমার সমস্ত উত্তাপ ঢেকে বললাম, শুনিনি তো! কোথায় বিয়ে করল?

    নিজেই পছন্দ করে করেছে।

    খুব বড়লোকের মেয়ে বুঝি?

    খুব না হলেও বেশ বড়লোকের মেয়ে। বেশ সুন্দরী। নীতীশদা যে কোম্পানিতে কাজ করে সে কোম্পানির একজন ডিরেক্টরের মেয়ে। বিয়ে অবশ্য কলকাতাতেই হয়েছিল, বরযাত্রী যেতে বলেছিল আমাকে।

    তুমি গেছিলে নাকি?

    বাঃ নেমন্তন্ন করল, যাব না? গিয়েছিলাম।

    ঘরের কোনায় নিচু গ্রামে বাজনা বাজছিল। চাঁপারঙা পোশাকে সেই প্রায়ান্ধকারে নয়নাকে কোনও জঙ্গলাকীর্ণ উপত্যকার বিশীর্ণা শুকনো চাঁপাফুল বলে মনে হচ্ছিল। কৃশাঙ্গী, সুগন্ধি, তেজস্বিনী, করুণ কোনও ক্যাথলিক নান-এর মতো। এতদিন ওর চোখে চেয়ে ওর চোখের পাতায় চুমু খেতে ইচ্ছে করেছে–আজ হঠাৎ মনে হল ওর চোখেমুখে কোথাও কোনও দেবীমহিমা আরোপিত হয়ে গেছে, যা আগে। কখনও লক্ষ করিনি।

    অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকলাম।

    আমি ভেবেছিলাম, মানে একটু আগেও ভাবছিলাম যে, আমার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী আত্মহত্যা করাতে আমি ওয়াকওভার পেয়ে যাব। এবার আমি আমার জয়ধ্বজা ওড়াব, সেলিব্রেট করব, কিন্তু নয়নার মুখে চেয়ে আমি ওসব কথা আর ভাবতে পাচ্ছি না। হঠাৎ আমি বুঝতে পারলাম, এখন নয়নার বুকের ভিতর কী হচ্ছে। অথচ বাইরে তার আভাসমাত্র পৌঁছোচ্ছে না।

    বললাম, নীতীশ বেশ ভাল ছেলে।

    কেন বললাম জানি না।

    নয়না বলল, নিশ্চয়ই। খুব ভাল ছেলে।

    ও তো বলবেই–। ও যে ভালবাসে–মানে ভালবাসত। আর কেউ না বুঝুক আমি তো ওকে বুঝতে পারি। শালা নীতীশ। এই নাকি ভাল ছেলে। একটা মেয়ে, যে কোমল স্বর্ণলতার মতো একটা সজীব সবুজ মনোমত গাছকে আঁকড়ে মনে মনে লতিয়ে উঠেছিল সকালের সোনালি আলোয়, তাকে কিনা সে নিজে হাতে নিষ্ঠুরের মতো আঁকশি দিয়ে নিড়িয়ে দিল একটানে। ছিঁড়ে ফেলে দিল। তবুও নয়না বলবে, নীতীশ ভাল ছেলে। এসব ছেলেকে মড়িতে-হাজির বাঘের ঘাড়ে মাচা থেকে ফেলে দিতে হয়। অবশ্য নয়নার কদর ও কী করে বুঝবে? ওর তো শুধু টাকা আছে। শুধু টাকা দিয়ে ভাল ইলিশ মাছ কেনা যায়, কিন্তু ভালবাসা চেনা যায় না। যে ছেলে বড়লোকের পিয়ানো-বাজানো গিমলেট-গেলা কোনও ইনসিপিড মেয়ের বিনিময়ে নয়নার মতো মেয়েকে হারাল–সে আজীবন পা ছড়িয়ে বসে কাদবে। কঁদতে কঁদতে তার চোখ অন্ধ হয়ে যাবে।

    কতক্ষণ চুপচাপ করে কাটল জানি না। বোধহয় অনেকক্ষণ। নয়না পেয়ালায় চা ঢালছিল। বাঁ হাতে একটি মাত্র কাঁকন পরেছে। কার্ডিগানটির হাতাটি গুটিয়ে তুলে নিয়েছে। ডান হাতে রিস্টওয়াচ। ওর স্বপ্নিল আঙুলে ও চামচে ধরে সুগারকিউব, পেয়ালায় ফেলে চিনি মিশোচ্ছে। অর্কেস্ট্রাতে বেলাফন্টের গান বাজাচ্ছে ওরা। নিচু গ্রামে–। মনে হচ্ছে কোনও একটা দমবন্ধ যন্ত্রণা কোনও গভীর শীতল পাতকুয়ো থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে উঠে আসছে। নয়নার চোখের দিকে চাইতে পারছি না।

    সত্যি কথা বলতে কী, এক মুহূর্ত আগেও আমি যা কল্পনাও করতে পারিনি–নয়নার হেলানো বিষণ্ণ মুখে তাকিয়ে হঠাৎ আমার তাই মনে হল। নীতীশ নয়নাকে বিয়ে করলে আমি সবচেয়ে সুখী হতাম। নিজের মাথার চুল হয়তো টেনে ছিঁড়ে ফেলতাম–হয়তো শটগানের মাজল গলায় ঠেকিয়ে পা দিয়ে ঘোড়া টেনে দিতাম কিন্তু তবু, আমি হয়তো এখনকার চেয়ে সুখী হতাম।

    নয়নাকে যে ঠিক এতখানি ভালবাসি তা একটু আগেও আমি বুঝতে পারিনি। পরম কামনায় কঁকিয়ে-কেঁদেও যে যন্ত্রণা পাইনি–আজ নয়নার ব্যথায়-ভরা চোখে চেয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি যন্ত্রণা পেতে লাগলাম। নয়নার দিকে তাকাতে পারলাম না।

    ফেরাজিনি থেকে বেরিয়ে, নয়না যেন কেমন হঠাৎ প্রগ, সস্তা হয়ে গেল। ও যা কোনওদিন ছিল না, ও তাই হয়ে গেল। গাড়িতে আমার খুব কাছ ঘেঁষে বসল। আমার বাঁ কাঁধে দু’-দু’বার মাথা নুইয়ে রাখল।

    বললাম, কী হল সোনা?

    নয়না ফিসফিস করে বলল, আপনার চিঠিগুলোর কথা ভাবছিলাম। এত সুন্দর চিঠি লেখেন কী করে আপনি?

    বললাম, সকলকে লিখতে পারি না। তুমি তো সে কথা জানো যে, চিঠি লিখিয়ে নেবার ক্ষমতা সকলের থাকে না। চিঠি লেখবার ক্ষমতার চেয়ে চিঠি লিখিয়ে নেবার ক্ষমতা অনেক বড়। সে ক্ষমতা তোমার আছে। তাই হয়তো তোমাকে ভাল চিঠি লিখতে পারি।

    ও অস্ফুটে বলল, জানি না।

    বললাম, এবার কোথায়?

    ও বলল, আমি জানি না।

    আমার এগারোটা অবধি ছুটি–আপনি আমাকে যেখানে খুশি নিয়ে যান–।

    ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে গাড়ি রেখে দু’জনে নামলাম। বললাম, চলো একটু হাঁটি–তারপর ফিরপোয় গিয়ে ডিনার খেয়ে সকাল সকাল তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেব।

    শেষ শীতের সন্ধ্যায় কুয়াশায় বাতিগুলো গলে গলে পড়ছে। নুড়িগুলো ভিজে রয়েছে। নয়না হয়তো স্বপ্ন দেখছে। ঠিক আমি যেমন করে দেখি। এই শীতের সন্ধ্যার কুয়াশা ওর চোখ থেকে মুছে গিয়ে শিলঙের পাইন-ভরা হেঁয়ালি-মাখা সন্ধ্যা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছে। লাইটমুকরার কোনও পাহাড়ের মাথায় ছোট্ট কটেজ। ভিতরে গোলাপি ল্যাম্পশেডে আলো জ্বলছে–পেলমেট থেকে ভারী সুন্দর সুন্দর পরদা ঝুলছে জানলায় জানলায়। নীতীশ বোধহয় এখুনি অফিস থেকে ফিরল। মুখ-হাত ধুয়েছে। ওরা ছোট্ট খাবার ঘরে দু’জনে চা খেতে বসল। নয়না চিংড়ির কাটলেট বানিয়েছে–গরম গরম। বলল, তোমাকে একটু চিলি সস দিই? নীতীশ বলল, দাও; একটু দিয়ো।

    আদরে টি-কোজির গায়ে হাত দিয়ে, কেটলি থেকে তুলে নয়না চা বানাল, চা ঢেলে দিল। সুরেলা রাত গড়িয়ে চলল।

    এমন সময় একটি রবারের বল এসে নয়নার গায়ে লাগল। আমার অথবা নয়নার। স্বপ্ন ভেঙে গেল। একটি দুরন্ত দুষ্টু গাবলু-গুবলু তিন বছরের ছেলে সুন্দর কালো সার্জের পোশাক পরে দৌড়ে এসে নয়নাকে বলল, আমার বল দাও। নয়না বলটি নিজে হাতে তুলে দিল। তারপরে ছেলেটির দিকে তাকাল। ধবধবে ফরসা ছেলেটি। নীতীশের মতো ফরসা। নয়নার সমস্ত স্বপ্ন ধীরে ধীরে কোনও জাপানি চিত্রকরের ওয়াশের কাজের মতো একটা হালকা এক-রঙা অপস্রিয়মাণ ছবিতে গড়িয়ে গেল। সব মুছে গেল। কিছুই আর বাকি রইল না।

    অনেকক্ষণ আমরা হাঁটলাম। নয়নার হাবভাব দেখে আমার ভাল মনে হচ্ছিল না। এখন ও একেবারে চুপ করে ছিল। সেখান থেকে বাইরে এলাম। তারপর আটটা নাগাদ ফিরপোতে এসে একটি ছোট টেবিলে বসলাম।

    হাত দিয়ে টেবল-ক্লথটা সমান করতে করতে নয়না বলল, আচ্ছা ঋজুদা, খাওয়ার পর আমরা কোথায় যাব?

    কেন? বাড়ি! তুমি অন্য কোথাও যেতে চাও?

    না। মানে, না। কিচ্ছু না।

    কিছুক্ষণ চুপচাপ।

    বেয়ারা সুপ দিয়ে গেল। সুপ খেতে খেতে নয়না বলল, ঠান্ডাটা বেশ প্লেজেন্ট লাগছে, না?

    হুঁ।

    আপনাকে এই সুটটা পরে কিন্তু ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে, ঋজুদা।

    তাই বুঝি? কাপড়টা তো তুমিই পছন্দ করে দিয়েছিলে, মনে নেই?

    হ্যাঁ। মনে আছে।

    বললাম, নয়না, তোমার কাছে আমার যে চিঠিগুলো আছে, সেগুলো এক জায়গা করে রেখো। আমি একদিন গিয়ে নিয়ে আসব।

    নয়নার চোখ দুটি জ্বলে উঠল। বলল, কেন? ও চিঠিতে আপনার কী অধিকার? ও চিঠি তো আমার চিঠি।

    বললাম, তা ঠিক। কিন্তু এগুলো আমার মনের অসংবদ্ধ প্রলাপ ছাড়া আর তো কিছুই নয়–আমার ডাইরিও বলতে পারো। তা ছাড়া চিঠিগুলোর দাম যখন কিছুই নেই।

    ও উত্তেজিত গলায় বাধা দিয়ে বলল, অনেক দাম, অনেক দাম। আপনি কী বুঝবেন? দাম ফেরত দিতে পারি না বলে কি দাম বুঝতেও পারি না ঋজুদা! আমাকে এত হীন ভাবেন কেন?

    এরপর আর কোনও কথা চলে না।

    পুডিঙের প্লেটে চামচ দিয়ে কাটাকুটি করতে করতে নয়না বলল, মনে আছে ঋজুদা, একদিন আমি আপনাকে শুধিয়েছিলাম, ভালবাসলে কী করতে হয়? উত্তরে আপনি বলেছিলেন, জানি না। তখন আমিও বলেছিলাম, আমিও জানি না। অথচ আমরা দুজনেই জানতাম যে, দু’জনেই মিথ্যা কথা বলছি। বলুন? সত্যি না?

    আমি বললাম, হয়তো সত্যি। কিন্তু তাতে কী? সে তো অনেক পুরনো কথা।

    নয়না বলল, উঠুন।

    চলো।

    ফিরলোর গালচে-ঢাকা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মাঝ বরাবর এসে দুপাশে ক্যাবারে ড্যান্সারদের ছবি যেখানে আছে, সেখানে নয়না থমকে দাঁড়াল। বলল, ওরাও নিশ্চয়ই কারও না কারও ভালবাসা পেয়েছে। না?

    বললাম, হয়তো পেয়েছে।

    ও বলল, ইস–ওদেরও কেউ-না-কেউ ভালবাসে, অথচ আমাকে কেউ ভালবাসে না।

    আমার ভালবাসাটা ও ধর্তব্যের মধ্যেই ধরে না কোনওদিন, তা ভালভাবে জেনেও সেই মুহূর্তে ওর হাতটা মুঠি করে ধরে বললাম, তোমাকেও অনেকে ভালবাসে। আমিও তোমাকে ভালবাসি। ওদের সঙ্গে তোমার নিজেকে তুলনা করার দরকার কী? তুমি যেন কী হয়ে যাও মাঝে মাঝে।

    বলতেই, ধুলো-মাখা চড়াইয়ের মতো ও ফুলে দাঁড়াল; বলল, দরকার নেই? কেন দরকার নেই? আমাকে যে কেউ ভালবাসে না তার প্রমাণ আমি পেয়েছি, কিন্তু

    আমাকে যে কেউ ভালবাসে তারই প্রমাণ পাইনি।

    গাড়িতে উঠে নয়না বলল, গঙ্গার ধারে চলুন। এখনও হাতে অনেক সময় আছে। আপনার সঙ্গে ছিলাম জানলে মা রাগ করবেন না।

    গঙ্গার ধারে রাতে বিশেষ লোকজন নেই, দুটো-একটা গাড়ি এখানে-ওখানে পার্ক করানো আছে। জাহাজে আলো জ্বলছে। এখন জোয়ার। কুলকুল করে জল এসে পাড়ে লাগছে।

    গাড়িটা একটা নিরিবিলি জায়গা দেখে দাঁড় করাতেই নয়না সরে এসে আমার গায়ে ঝুঁকে পড়ে অস্বস্তি-ভরা গলায় আমাকে বলল, এই! আপনার হাতটা আমার হাতে রাখুন।

    অবাক হলাম।

    একদিন আমি ওর হাতটি আমার হাতে ধরতে চেয়েছিলাম। সেদিন ও ঠাট্টা করে বলেছিল, আজ বুঝি বাংলা ছবি দেখে এসেছেন? নইলে এত ঢং কীসের? সেদিন ও বোঝেনি, জানেনি যে, যাকে কেউ সত্যিকারের ভালবাসে তার হাতে হাত রাখার মতো মহৎ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

    কোনও কথা বললাম না।

    আমার বাঁ হাতটি ওর কোলে রাখলাম।

    ও ওর দু’হাতের পাতায় আমার হাতটি নিয়ে বসে থাকল। মাথাটি আমার কাঁধে হেলিয়ে রাখল।

    পাশ দিয়ে হেডলাইট জ্বেলে একটি গাড়ি গেল।

    ভাবলাম, লজ্জা পেয়ে ও এবার সরে বসবে।

    কিন্তু পরক্ষণেই একটি অভাবনীয় ব্যাপার ঘটে গেল। নয়না আমার বুকে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। ফুলে ফুলে কিন্তু প্রায় নিরুচ্চারে কাঁদতে লাগল।

    আমি কী করব জানি না। আমি সাধারণ। যে নয়নাকে আমি আমার অস্তিত্বের সর্বস্বতা দিয়ে, ভিখিরির মতো, কাঙালের মতো এতদিন চেয়ে এসেছি–যাকে ভুলে থাকার চেষ্টায় নিজেকে তিল তিল করে ক্ষইয়ে ফেলেছি–মনোসংযোগ নষ্ট করেছি, শরীর নষ্ট করেছি, আত্মঘাতী আর্তিতে অনুক্ষণ অনন্ত অস্বস্তি পেয়েছি–সেই নয়না আজ আমার বুকে থরথরিয়ে কেঁপে মরছে। ভবিষ্যতের স্বপ্নভরা কুঠুরির চাবিকাঠি এখন আমার হাতের মুঠোয়।

    এখন আমি কী করি?

    আমার সাদা জামায় ওর লিপস্টিকের টিপ লেগে একাকার হয়ে গেছে। কপালের টিপটি ধেবড়ে গেছে। রুক্ষ শ্যাম্পু করা চুলগুলো এলোমেলো। নাক দিয়ে গরম নিশ্বাস বইছে, চোখের পাতা ভেজা। নয়না কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ঋজুদা, আমি একদম ফুরিয়ে গেছি–-একদম ফুরিয়ে গেছি ঋজুদা। ওর মতো শান্ত, সংযত স্বল্পবাক বুদ্ধিমতী মেয়ে যে এমন হয়ে যেতে পারে তা না দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না।

    গাড়িটা স্টার্ট করে খুব আস্তে আস্তে চালাতে লাগলাম। মাঝে মাঝে এক এক ঝলক ঝিরঝিরে হাওয়া দিচ্ছে, মনে পড়িয়ে দিচ্ছে, দোলের আর দেরি নেই। মনে মনে অনেকদিন ভেবেছিলাম, নয়নাকে নিয়ে মণিপুরে একবার দোল-পূর্ণিমায় যাব–ওকে ঝুলন দেখাব। লকটাক হ্রদের পাশে দু’জনে, একেবারে দু’জনে-সঙ্গে আর কাউকে না নিয়ে–পিকনিক করব; থৈবীখাম্বার নাচ দেখব। দোল আসছে। দেখতে দেখতে একটা বছর ঘুরে গেল।

    মনে হল, নয়না যেন সংবিৎ ফিরে পেয়েছে। সরে বসল। সরে বসে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইল। চুপটি করে। সাদার্ন অ্যাভিনিউতে গাড়িটা দাঁড় করালাম। আয়নাটা ঘুরিয়ে দিলাম ওর দিকে। গাড়ির ভেতরের আলোটা জ্বালিয়ে দিলাম। পকেট থেকে রুমাল বের করে ওকে বললাম, নাও তো লক্ষ্মী মেয়ে, মুখটা আর কপালটা ভাল করে মুছে নাও তো। বাড়িতে বলবে কী? ছিঃ ছিঃ। সঙ্গে চিরুনি আনতে ভুলে গেছ বুঝি?

    বাচ্চা মেয়ের মতো ও মাথা নাড়ল।

    আমি আমার পার্স থেকে বের করে ছোট চিরুনিটা ওকে দিলাম। চুপ করে ও রুমাল দিয়ে চোখ মুছল, মুখ মুছল, চিরুনি দিয়ে কপালে-পড়া চুল আর এলোমেলো অলকগুলোকে ঠিক করে নিল।

    হঠাৎ ওর চিবুকে হাত ছুঁইয়ে ওর মুখটা আমার দিকে ঘুরিয়ে বললাম, দেখি? খুকি হাসো তো একটু?

    কান্না-ভেজা চোখে আমার পাগলামিতে ও ফিক করে হেসে উঠল–বলল, অসভ্য কোথাকার!

    বললাম, আমি অসভ্য?

    বলতেই, ও আবার কাঁদতে লাগল।

    আমি বললাম, আবার কাঁদলে কিন্তু এখানেই থাকতে হবে সারারাত। ছিঃ ছিঃ ছিঃ বোকা মেয়ে। এই নাকি তুমি আমার এত গর্বের নয়নাসোনা? একটা বাজে ছেলের কাছে তুমি হেরে যাবে? নীতীশ তোমার পায়ের নখের যুগ্যি নয়। তোমাকে ব্যথা দিয়েছে বলে বলছি না। সত্যি সত্যিই বলছি। তোমার যোগ্য ছেলে যে নেই তা নয়, অনেক আছে এবং একদিন না একদিন এত বড় কলকাতা শহরে তাদের কারও না কারও সঙ্গে তোমার দেখা হয়ে যাবেই। ইয়াং, হ্যান্ডসাম, বুদ্ধিমান, মদ-খায়না-একটুও; ঠিক যেমনটি তুমি চাও। শুধু তুমি নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ো না।

    ওর কান্না ঝরা চোখের মণিতে ও যেন কোনও নতুন ঋজুদাকে আবিষ্কার করল, যাকে ও কোনওদিন জানেনি–আমিও কি ছাই এই–আমিকে চিনতাম?

    নয়নাকে বাড়িতে পৌঁছে দিলাম। নয়না গাড়ি থেকে নামবার সময় আমার বাঁ হাতটি ওর হাতে নিল। তারপর কান্না কান্না গলায় বলল, আপনি যদি না আসেন, কিংবা ফোন না করেন, তা হলে ভীষণ খারাপ হবে বলে দিচ্ছি।

    বললাম, আসব পাগলি মেয়ে, নিশ্চয়ই আসব। একশো বার ফোন করব।

    .

    ১৫.

    ক্লাবে সপ্তাহে তিনদিন বুকিং করেছি। রাতে মার্কারের সঙ্গে প্র্যাকটিস করি। অফিস করি, গরমে পুলোভার পরে টেনিস খেলি, তারপর বাড়ি এসে চান করে ঘুমোই। বন্ধু বান্ধবেরা আমায় প্রায় অনেকদিন হল ত্যাগ করেছে–এক জঙ্গলের বন্ধুরা ছাড়া। শহরের বন্ধুদের তো কোনও সময়ই দিতে পারি না–তাই ওরাও অনেকদিন আমার জন্যে অপেক্ষা করে করে, অবশেষে আমায় পুরোপুরি ত্যাগ করেছে। ওদের দোষ দিই না।

    আজকে বিয়াঙ্কারের সঙ্গে বাজি ছিল, যদি ও আমাকে হারাতে পারে তো ওকে একদিন লাঞ্চ খাওয়াতে হবে। জিততে পারলাম না। হেরে গেলাম। কবে কোন প্রতিযোগিতাতেই বা জিতেছি? ওর সার্ভিসটা খুব জোরালো আর ব্যাকহ্যান্ডে ক্রসকোর্ট যা মার মারে তা বলার নয়। দারুণ দারুণ মার আছে ওর হাতে।

    ভাবলাম, ক্লাবেই চান করে, কিছু খেয়ে, রাত ন’টার শোয়ে কোনও সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরব।

    অন্ধকারে হার্ড-কোর্টগুলো পেরোচ্ছি, এমন সময় মনে হল ওপাশ থেকে সুজয় আসছে।

    ওকে দেখে বিয়াঙ্কার বলল, হ্যালো চাডরি। হ্যাভ সিন ইউ সিন্স এজেস। সুজয় কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ইয়া ম্যান, আই ওজ টু বিজি। আই অ্যাম ফ্লাইং দ্য ডে আফটার টুমরো।

    জানতাম ও যাচ্ছে, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে যাচ্ছে জানতাম না। অনেকদিন ওদের বাড়ি যাই না। নয়নার সঙ্গেও দেখা বা কথা হয় না। অতএব জানার সুযোগও হয়নি। অবাক হলাম। একটু লজ্জিতও হলাম।

    সুজয় বলল, ঋজু, তোর সঙ্গে আমার কথা আছে।

    বিয়ান্দ্‌কার, সি ইউ এগেন বলে চলে গেল।

    বললাম, কী কথা রে?

    ও বলল, সময় লাগবে। চল। লনে গিয়ে বসি।

    ক্লাবের লনে বেতের চেয়ার পাতাই ছিল। আমরা গিয়ে বসলাম।

    কিছু খাবি?

    ও বলল, নাঃ, থ্যাঙ্কস।

    ও যেন কেমন ইচ্ছে করে ফর্মাল হয়ে যাচ্ছে। এরকম ও ছিল না।

    মনে হল সুজয় এমন কিছু একটা বলবে আমাকে, যার জন্যে আমি মনে মনে প্রস্তুত নই। ওর মুখটা দেখে ও যে আমার কলেজের বন্ধু সুজয়, তা মনে হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল ওকে আমি চিনি না। অন্তত, ও আমার বন্ধু নয়।

    সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে ও বলল, সোজাসুজিই বলি কথাটা। দ্যাখ ঋজু, অন্য কোনও ছেলে হলে আমি হয়তো কিছু ভাবতাম না, কিন্তু তোর এমন কীর্তি? ভাবতে পারি না।

    চমকে উঠলাম আমি।

    বললাম, কী কীর্তি?

    কী, তা তুই জানিস না! নয়নাকে তুই ভালবেসে চিঠি লিখিস। তোর লজ্জা করে না?

    আমি চুপ করে থাকলাম।

    ওকে বলতে পারতাম যে ভালবাসি, ব্যস। ওই পর্যন্ত। তার জন্যে আমার নিজের ছাড়া অন্য কোনও ক্ষতিই কারও আমি করিনি। নয়নারও না। কিন্তু ভালবাসি।

    এটা অস্বীকার করতে পারি না। ভেবে দেখলাম, এসব কথা সুজয় বুঝবে না। গত তিন-চার বছর হল ওর বন্ধু বান্ধবের দল সব অন্যরকম হয়ে গেছে। ও আমার কথা বুঝতে পারবে না। বোঝাতে চাইলেও বুঝবে না।

    একেবারে বদলে গেছে সুজয়। ও কিছুতেই আমার কথা শুনবে না। তাই চুপ। করেই রইলাম।

    ও রেগে গেল। বলল, কী? চুপ করে আছিস যে?

    বললাম, কী জানতে চাস বল?

    জানবার কিছু তো বাকি নেই। তোর জন্যে নীতীশ নয়নাকে রিফিউজ করেছে। তুই আমাদের পরিবারের শনি। আমার পরিচয়ে আমাদের বাড়ি গিয়ে কি তুই আমাদের এই উপকার করলি? নীতীশকে তুই কী বলেছিস নয়নার নামে, বল!

    বললাম, কিছুই বলিনি।

    ও ধমকে বলল, মিথ্যা কথা।

    অনেকদিন আমি অত রেগে যাইনি। আমার সারা গা থরথর করে কাঁপতে লাগল, বললাম, তুই আমার কাছে মার খাবি সুজয়। ভদ্রভাবে ও বুঝেসুঝে কথা বল।

    ও বেশ চেঁচিয়ে বলল, তা হলে কি তুই বলতে চাস, নয়না খারাপ? আমার বোনই খারাপ?

    বললাম, তোর বোন খারাপ নয়। তোর চেয়ে অন্তত অনেক ভাল।

    সুজয় বলল, দ্যাখ ঋজু, তোর কাছে আমি তত্ত্বকথা শুনতে আসিনি। তোর সঙ্গে কথা বলাও বৃথা। তুই একটা ইডিয়ট। ফার্স্টক্লাস ইডিয়ট। একটা কথা শোনো, আমি কলকাতা থেকে যাবার আগে তোমাকে কথা দিয়ে যেতে হবে আমায়।

    কীসের কথা?

    তুমি আমাদের বাড়ি যাবে না, আমাদের বাড়ি ফোন করবে না এবং আমার বোনকে চিঠি লিখবে না। যদি তুমি এ কথা না দাও, তা হলে খারাপ হবে।

    খারাপ হবে মানে?

    মানে, অনেক কিছু হতে পারে।

    কী ভাবে সুজয়টা আমাকে? কী ভাবে ও? তখন আমার রাগ আর নেই। দুঃখে, অপমানে, নয়নার উপর অভিমানে, আমার তখন কান্না পাচ্ছিল।

    সুজয় বলল, তুই জানিস? তোর চিঠি নয়না সকলকে পড়ায়? টেবিলের উপর রেখে দেয়, খোলা-ড্রয়ারে রাখে। যে আসে সেই পড়ে। তোকেও আমি ভালবাসি ঋজু। অন্তত ভালবাসতাম। এতে তোর জন্যেও কষ্ট হয়। তোর কি মানসম্মান বলে কিছুই নেই? ও আমার বোন হোক আর যেই হোক, ও কী এমন মেয়ে যে, তুই ওর পায়ে চুমু খেতে চাইবি, পা ধরতে চাইবি? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তোর কি মানসম্মানবোধ সব লোপ পেয়ে গেছে? তোর জন্যে আমার মাথা কাটা যায়। এটুকু তুই জানিস যে, নয়না তোকে ভালবাসে না, কোনওদিন ভালবাসেনি। বাসবেও না কোনওদিন।

    চুপ করে রইলাম।

    কী? কথা বলছিস না যে?

    বললাম, জানি তা।

    চেঁচামেচিতে বেয়ারা দৌড়ে এল। সুজয় মুখ রক্ষা করার জন্যে স্মার্টলি বলল, দোগো, কোকাকোলা লাও।

    আমি আর কোনও কথা বললাম না।

    নয়নার নিজের হাতে অনেক অপমান সয়েছি। আজ সুজয়ের কাছেও অপমানিত হয়ে আমার অপমানের ঝুলি পূর্ণ হল। সুজয় আমার কাছে যে কথা চেয়েছিল, তা তাকে দিলাম।

    সুজয় আমাকে আরও অনেক কথা বলল। বলল যে, নীতীশ খুব ভাল ছেলে–নিছক আমার ভালবাসাটা স্মেল করেই ও অন্যত্র বিয়ে করতে বাধ্য হল। আরও আরও আরও অনেক কথা বলল। তা আমার কানে গেল না। আমি তখন বসে বসে অনেক কিছু ভাবছিলাম। অনেক পুরনো কথা। ভাবছিলাম, ও নয়নার কথাটা একবারও ভাবছে না। নয়না কি সুজয়ের রিস্টওয়াচ যে, ও যাকে খুশি তার হাতে তাকে পরিয়ে দেবে? নয়নার কি নিজের মন বলে কোনও জিনিস নেই? নীতীশ যদি নয়নাকে রিফিউজ করে থাকে, তাতে নয়নার হার হয়নি কোনও। তা ছাড়া আমার এতে কী করার ছিল? উত্তীয় যেমন করে শ্যামাকে ভালবাসত আমি তো নয়নাকে তেমনি করেই ভালবেসেছি। নিজের মৃত্যু ছাড়া আমার তো অন্য কিছু পাওয়ার ছিল না। নীতীশ ওকে বিয়ে করলেও ছিল না। এখনও নেই। কোনওদিনও থাকবে না। আমার সঙ্গে সুজয় এমন করে নোংরা ভাষায় কথা বলছে কেন?

    তা ছাড়া নয়না আমার সঙ্গে এ কী করল? আমার চিঠিগুলি কি এতই মূল্যহীন? ওর চোখে আমার সবকিছুই কি এতখানি সস্তা হয়ে গেছে? আমার এক্ষুনি গিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করল, কী এমন আমি অন্যায় করেছি, ওর কাছে, নীতীশের কাছে, মাসিমার কাছে যে, সুজয় আমাকে ওদের পরিবারের শনি বলে ভাবতে পারে? ওদের সকলের জন্যে, নয়নার জন্যে, এই ক’বছর যত কল্যাণকামনা, যত মঙ্গলকামনা করেছি, তার একভাগও নিজের জন্যে করলে আমি আজ এমন ভাবে সুজয়ের মতো ছেলের হাতে অপমানিত হতাম না।

    বুঝতে পারিনি, নয়নাকে আমি চিনতে পারিনি, হয়তো কোনওদিনও চিনতে পারব না। আমি ওকে কুটিল, নীচ, নোংরা, নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন বলে কোনওদিন চিনতে চাই না। তার চেয়ে আমার চোখে ও অপরিচিতই থাকুক। আমার চোখের অপরিচয়ের সায়ান্ধকারে ও যে মহিমাময়ী মূর্তিতে বিরাজ করছে সেই মূর্তিতেই বিরাজ করুক। আমার সব দুঃখ আমি সইতে পারব, কিন্তু মনে মনে যে নয়নাকে চিনি সে নয়নাকে আমি কোনওদিন অন্য নয়না বলে ভাবতে পারব না।

    নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছিল, কিছু হয়েছিল; যে কারণে ৪ আমার চিঠিগুলির এমন অসম্মান করেছে। কোনওদিন জানতে পারব না, কী ঘটেছিল।

    কানের কাছে সুজয়ের গলাটা কেবল ঝমঝম করছিল—

    ঋজু, তুই একটা ইডিয়ট; একটা ফার্স্টক্লাস ইডিয়ট।

    সুজয় অনেক কথা বলছিল, হাত নাড়ছিল; আমার কানে কিছুই যাচ্ছিল না।

    সুজয় একসময় উঠল। ক্লাবের ভাউচার সই করল। আমার কাঁধে হাত রাখল। বলল, চলি রে।

    বললাম, আয়। ক্লাব থেকে সোজা বাড়ি এলাম। এসে খেলার জামাকাপড় না-ছেড়েই ড্রয়ার ঘেঁটে ঘেঁটে নয়নার সেই চিঠিটি বের করলাম। সেই দিনে সে চিঠিটির বিশেষ ভূমিকা ছিল।

    অনেকদিন আগে লেখা চিঠি। একটি ইনল্যান্ড লেটার।

    ঋজুদা,

    এবারে আর Romanticism চলে না। বাড়িতে ফিরে এসেই ব্যাগ খুলে দেখলাম যে, আর একটি চিঠি রয়েছে।

    প্রথমে বলতে ইচ্ছা করল–”আহা কী পাইলাম..ইত্যাদি…।” কিন্তু যখন দেখলাম যে, সেই পুরনো চিঠিটা নেই, আপনি চুরি করেছেন, তখন খুব মন খারাপ হয়ে গেল। আপনার ওই চিঠিটা আমার এত ভাল লাগত যে আমি সঙ্গে নিয়ে বেড়াতাম। লাইব্রেরিতে বসে সময় পেলে পড়তাম। বারবার পড়তাম। আমার আশা যে, আপনি চিঠিটা আমাকে ফেরত দিয়ে দেবেন।

    আজকের চিঠিতে আপনি লিখেছেন যে, আপনি আমাকে আর চিঠি দেবেন না–আর, কেন দেবেন না তাও লিখেছেন। কিন্তু আপনি ওই সামান্য ব্যাপারের জন্য যদি আমাকে চিঠি দেওয়া বন্ধ করেন তবে সেটা আমারই দুর্ভাগ্য বলে মেনে নিতে হবে।

    কিন্তু আজকে আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে আপনার চিঠি আমি আর কাউকে দেখাব না।

    এর পরেও আমি আর আপনাকে চিঠি দেবার জন্য অনুরোধ জানাব না, শুধু এইটুকুই বলি যে, আপনার চিঠি পেতে আমার খুব ভাল লাগে–যার জন্যেই হয়তো ইডিয়টের মতো সকলকে তা দেখিয়ে বেড়াই।

    সবশেষে বলি, আপনার ধারণা হয়েছে যে, ভবিষ্যতে কোনওদিন আমিই নাকি আপনাকে ইডিয়ট বলে প্রতিপন্ন করব, আর এ কথা আপনাকে নাকি আমার দাদাই বলেছে। দাদাই বলুক আর যেই বলুক–আপনি যদি এ কথা মেনে নেন–তবে বলব যে, আপনি এখনও আমাকে ঠিক চিনতে পারেননি।

    শেষ করি।

    নয়না।

    .

    ১৬.

    আজ দোল-পূর্ণিমা।

    সারা সকাল বাইরে যাইনি। দুপুরেও না। বিকেল থেকে বাগানের বেতের চেয়ারে বসে আছি। একটি সর্বপ্রকাশী হলুদ চাঁদ আকাশ ছেয়ে উঠেছে। রঙ্গনের ডালে একজোড়া বুলবুলি পাখি ডেকে ডেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। আকাশে বাতাসে এক আদিগন্ত ভাললাগা। অথচ আমার কোনও ভাগ নেই এতে।

    সকালে বাড়িতে অনেকে আবির খেলতে এসেছিলেন। চতুর্দিকে, দেওয়ালে, মেঝেতে, বাগানে আবিরের দাগ। লনেও আবির পড়ে রয়েছে। তার উপরে খালি পায়ে, মিনুর পাঁচ বছরের মেয়ে মিয়া ঘুরে ঘুরে কাঁপা কাঁপা গলায় গাইছে–

    “ও আমার চাঁদের আলো, আজ ফাগুনের সন্ধ্যাকালে ধরা দিয়েছ পাতায় পাতায় ডালে ডালে…ও আমার…”

    চুপ করে বসে বসে ওকে দেখছি। আমার অনেক কিছু ইচ্ছে ছিল, এ জন্মে তার কিছুই পূরণ হল না। মিঠুয়াকে আমি নয়নার মতো অনন্যা করে বড় করে তুলব। নয়নার মতো সেও কম কথা বলবে, চোখ দিয়ে হাসবে, অমনি সংযতা হবে, নয়নার মতন করে ব্যথা পেতে জানবে এবং ব্যথা দিতে জানবে না। মিনুর কাছ থেকে মিঠুয়াকে আমি চেয়ে নেব। তারপর একটি একটি করে আমার অপূর্ণ ইচ্ছাগুলিকে ওর মধ্যে আমি পুঁটিলেখা ফুলের পাপড়ির মতো ফুটিয়ে তুলব। তারপর, মিঠুয়া যখন বড় হবে, তখন একদিন প্রৌঢ়া নয়নার কাছে ওকে নিয়ে গিয়ে বলব, এই দ্যাখো, তোমার পুরনো-তুমিকে আমি ফিরিয়ে এনেছি। তখন নয়না হয়তো লজ্জিত হবে, বিব্রত হবে, ওর হ্যান্ডসাম এক্সিকুটিভ স্বামীর সামনে অপ্রতিভ হবে, বলবে: কী ছেলেমানুষি করছেন ঋজুদা?

    দিনের আলোর গভীরে রাতের কোনও তারাই থাকে না। ও সব মিথ্যে কথা; বানানো কথা। আমার নয়না আমাকে একেবারে ভুলে যাবে। যা হবার তা হয়ে গেছে এ জন্মের মতো।

    কতক্ষণ বসে ছিলাম জানি না। যতীন এসে বলল, দাদাবাবু, তোমার ফোন।

    চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরে গেলাম।

    ইয়েস। ঋজু কথা বলছি।

    ঋজুদা? আমি নয়না।

    কোনওদিন নয়না আমাকে নিজে ফোন করেনি। মানে, নিজে থেকে। দায়টা। বরাবর আমারই ছিল। তাই আশ্চর্য হলাম।

    বললাম, কী ব্যাপার?

    কী ব্যাপার? এতদিন তো দেখাই নেই, আজও এলেন না। ভেবেছিলাম সকালে আসবেন। বেলা একটা অবধি আপনার জন্যে চান না করে বসে ছিলাম।

    সত্যি কিছু মনে কোরো না। কোথাওই যাইনি। তারপর একটু থেমে বললাম, তোমরা বুঝি খুব মজা করলে?

    কীসের মজা?

    তোমার বন্ধু বান্ধবীরা আসেনি এবার?

    এসেছিল। ওরা সবাই এসেছিল। খুব হইহই হয়েছিল। কিন্তু মজা হয়নি।

    কেন?

    জানি না।

    জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরময়। সমস্ত কলকাতা শহরটা দোল-পূর্ণিমার হাসনুহানা রাতে একটি হাসিনী হলুদ বেলুনের মতো হাওয়ায় উড়ছে। আমার ঘর এমনিতে আজ অন্ধকার। বাধ্বটা কেটে গেছে। আকাশের হলুদ ঝাড়লণ্ঠন নিভে গেলে হয়তো অন্ধকারেই থাকবে। হয়তো আলো জ্বলবে না আর।

    নয়না বলল, কী হল? কথা বলুন?

    কী কথা বলব? সব কথাই তো আমার বলে ফেলেছি। তাই চুপ করেই রইলাম।

    কী হল?

    বললাম, পড়াশুনা করছ তো? ফার্স্টক্লাস পেতে হবে কিন্তু। মনে থাকে যেন।

    পেয়ে কী হবে?

    কী হবে তা জানি না। অন্তত নিজে সার্থক হবে।

    কেবলমাত্র নিজের জন্যেই যারা সার্থক হতে চায় তারা কিন্তু স্বার্থপর।

    তুমিও?

    জানি না। হয়তো আমিও। ভাল করে ভেবে দেখোনি কখনও।

    তুমি ফার্স্টক্লাস পেলে আমার কিন্তু খুব গর্ব হবে।

    জানি আমি। যদি পাই তো সেটা হয়তো পাওয়ার একটা কারণ হবে।

    কিছুক্ষণ চুপচাপ।

    জাস্টিস মুখার্জির বাড়ির গাড়োয়ালি দারোয়ান বাঁশি বাজাচ্ছে। বাঁশির বেদনার সুর কেঁপে কেঁপে হাওয়ায় ঘুরপাক খেয়ে বেড়াচ্ছে। যেন নীল আকাশে সাঁতার কেটে উপরে পৌঁছে চাঁদের হলুদ লণ্ঠনকে ব্যথায় নীল করে দেবে।

    কতদিন পরে নয়নার সঙ্গে কথা বলছি। কী যে ভাল লাগছে!

    আপনি যেন কেমন হয়ে গেছেন ঋজুদা!

    কেন?

    আগের মতো করে কথা বলছেন না তো আমার সঙ্গে!

    আসলে আমি ভুলে গেছি, আগে তোমার সঙ্গে কী করে কথা বলতাম। তুমি কী শাড়ি পরে আছ আজ?

    বলব না।

    কেন?

    খুশি।

    বোকামি কোরো না নয়না। কোনওদিন কি আমি বড় হব না?

    না। আপনাকে আমি কোনওদিন বড় হতে দেব না।

    আমি চুপ করে রইলাম।

    কই? তবু কথা বলছেন না যে?

    আমাদের এখানে দারুণ চাঁদ। আমার ঘরে আজ আলো জ্বলেনি। চাঁদের আলোয় ঘর হলুদ হয়ে আছে।

    তা হলে আপনার হলুদ বসন্ত পাখিকে সে ঘরে ডাকছেন না কেন? এই নামের জন্যে কিন্তু আমার ভারী গর্ব, ঋজুদা। অন্য কাউকে আপনি এ নামে ডাকতে পারবেন না। এ আমার একান্ত নাম।

    কোনও জবাব দিলাম না।

    কী? কিছু বলবেন? না ফোন ছেড়ে দেব?

    এই তো ভাল। তোমার কথা শুনতে ভাল লাগছে। তুমিই বলো।

    হঠাৎ কী মনে পড়ে যাওয়াতে ও বলল, মনে পড়ে গেল পাখির কথায়; বলুন তো এই লাইন দুটি কার? বলেই সুর করে টেনে টেনে আবৃত্তি করল–

    “সুখ নেইকো মনে,
    নাকছাবিটি হারিয়ে গেছে
    হলুদ বনে বনে…”

    কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, কী? জানেন না তো?

    বললাম, পঙ্‌ক্তি ক’টি দারুণ। তবে কার লেখা জানি না।

    অনেকক্ষণ ও চুপ করে রইল, তারপর বলল, আপনি কিছুই জানেন না। আপনি নিজেকে জানেন?

    বললাম, আমি নাই বা জানলাম। তুমি তো জানো।

    ও বলল, জানি। মুখে বলি না বলে কি ভাবেন জানি না? আমি সব জানি। এমন অনেক কথা আছে যা না বললেই অনেক স্পষ্ট করে বলা হয়। আপনি হয়তো বিশ্বাস করেন না। কিন্তু আমি করি। আসলে আজকাল আপনি আমাকে দেখতে পারেন না। একটুও ভালবাসেন না, কিচ্ছু না; খারাপ।

    আমার জবাবের আগেই শুনতে পেলাম ও রিসিভারে মুখ রেখেই উঁচু গলায় বলল–যাচ্ছি মা।

    তারপরই বলল, ঋজুদা, কারা যেন এসেছেন, মা একা আছেন, আমায় ডাকছেন। আজকে রাখি, হ্যাঁ?

    রিসিভার রাখতে রাখতে তাড়াতাড়ি বলল, বলুন কবে আসবেন? এবার থেকে রোজ আসতে হবে।

    বললাম, আসব, দেখো ঠিক আসব।

    সত্যি?

    সত্যি।

    নয়না একদিন বুঝতে পারবে যে, আমি আমার ভিক্ষাপাত্র নিয়ে আর কোনওদিন ওর কাছে গিয়ে নির্লজ্জের মতো কাঙালপনা করব না। এতদিন তো ভিখিরির মতোই ভালবেসেছি–কিন্তু সেদিন আমায় যে রাজমুকুট ও নিজে হাতে পরিয়ে দিয়েছিল সে মুকুট খুলে ফেলার মতো এত বড় হীন আমি কী করে হব? রাজার অভিনয় করে আমি আমার অনন্যা নয়নার সমকক্ষ হব। ও একদিন সবই জানবে। সবই জানতে পাবে। কিন্তু ও কোনওদিন জানবে না যে, আমার এই বুকভরা আর্তি থাকবেই। ওর সঙ্গে দেখা হলেই ভিতরের ভিখিরিটা রাজার মুখোশ ছিঁড়ে ফেলে হাঁটু গেড়ে বসে ভিক্ষা চাইবেই।

    এই ভাল। দেখা না হওয়াই ভাল। কথা না হওয়াই ভাল। তার চেয়ে আমার দুরন্ত লোভগুলি আমার বুকের ভিতরেই ঘুমিয়ে থাকুক অথবা বুকের ভিতরেই ঘুম-ভেঙে উঠে আমার সমস্ত অস্তিত্বকে ক্যান্সারের মতো কুরে কুরে খেয়ে ফেলুক; তবু নয়না আমার সুখে থাকুক, খুশি থাকুক। আমার অশেষ আর্তি তার সুখকে কোনওদিন যেন বিঘ্নিত না করে।

    ⤶
    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleহাজারদুয়ারি – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article স্বগতোক্তি – বুদ্ধদেব গুহ

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }