যারা ভোর এনেছিল – ৪৫
৪৫.
১৯৫০-এর ঢাকা ছিল প্রধানত সদরঘাট, নবাবপুর, আরমানিটোলা, মাহুতটুলি থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিস্তৃত। বুড়িগঙ্গা বেয়ে সদরঘাট থেকে লঞ্চ বা স্টিমার ছাড়ত, কেউ সন্ধ্যার পর সিটি বাজাত না, পাছে আহসান মঞ্জিলের নবাব পরিবারের আদমিদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে।
শিল্পী আব্বাসউদ্দীন থাকতেন পাতলা খান লেনে। তারপর এসে ওঠেন পুরানা পল্টনে, ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসের পেছনের কানাগলিতে। কলকাতা থেকে এসে তিনি হয়েছেন পূর্ব বাংলা সরকারের প্রচার বিভাগের অতিরিক্ত সংগীত প্রচারণা কর্মকর্তা। আব্বাসউদ্দীনকে পল্টনবাসী দেখতে পায় সাইকেলের ওপরে। তাদের ধারণা হয়, তিনি সারাক্ষণ সাইকেলেই থাকেন, দুটো পায়ের অতিরিক্ত তাঁর দুটো চাকাও আছে। সারাক্ষণ ঘোরে সেটা। লোকে জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন আছেন?’ তিনি সাইকেলের গতি শ্লথ করে বলেন, ‘ভালো।’ এবার প্রশ্নকর্তার সম্পূরক প্রশ্ন, ‘বাড়ির সবাই ভালো?’ তিনি সাইকেল থামান। ক্যাচ করে শব্দ হয়। একদিকে একটা পা নামিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনি তো আচ্ছা লোক সাহেব, বাড়িতে আমার স্ত্রী আছে, তিন ছেলেমেয়ে আছে, একসঙ্গে সবাই ভালো থাকবে, এমন আশা করেন কী করে?’ তারপর আবার সাইকেলে প্যাডেল মারেন। প্রশ্নকর্তা তাঁর প্রস্থানের দিকে বিমূঢ় তাকিয়ে থাকে।
আনিসুজ্জামান তখন স্কুলের ছাত্র। নাইনে পড়েন। কলকাতা থেকে এসেছেন ‘৪৭-এর পর, খুলনা হয়ে ঢাকায়। থাকেন শান্তিনগরে। ঘুরে বেড়ান সাহিত্য সম্মেলনে। আব্বাসউদ্দীনকে দেখলে সালাম দেন। বাপ রে, এত বড় গায়ক!
একদিন আব্বাসউদ্দীন সাইকেল থামিয়ে আনিসুজ্জামানকে বলেন, ‘বুঝলে, আল্লাহ যে আছেন, তার চূড়ান্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে।’
‘কীভাবে?’ আনিসুজ্জামান মাথা চুলকে জানতে চান।
‘তা ছাড়া পাকিস্তান চলছে কী করে?’ বলে সাইকেল চালিয়ে তিনি হীরামন মঞ্জিল নামের তাঁর বাড়ির দিকে চলে যান, যেখানে মাঝেমধ্যে বসে সাহিত্য আর সংগীতের আসর, কিশোর আনিসুজ্জামানও মাঝেমধ্যে সেসব আসরে উঁকিঝুঁকি মারেন।
শান্তিনগরে তখন বিদ্যুৎ ছিল না, পানির সরবরাহ ছিল না, কিন্তু শান্তি ছিল। চারদিকে গাছপালা। পাতার গন্ধ, ফুলের গন্ধ। পাখির ডাক, ঝিঁঝির রব। রাতে শিয়ালও ডাকে। আনিসুজ্জামানের বড় ভালো লাগে।
শান্তিনগরে অশান্তির কোনো কারণ ঘটত না। কবি গোলাম মোস্তফাও থাকতেন শান্তিনগরে। তাঁর শ্যালিকারা আসতেন সেখানে। আনিসুজ্জামানরা তখন ওই কবির বিখ্যাত কবিতা থেকে আবৃত্তি করতেন, ‘দেখেশুনে করিলাম তালিকা, সবচেয়ে সুমধুর ছোট শ্যালিকা।’
গোলাম মোস্তফার ছেলে মুস্তাফা মনোয়ার ওরফে মন্টু। তিনিও পড়েন ক্লাস নাইনে। তাঁরও ছিল একখানা সাইকেল। ছবি আঁকা, গান করা আর রসিকতা করা—মন্টুর গুণের অভাব ছিল না।
আনিসুজ্জামানকে নিয়ে সাইকেলের সামনে বসিয়ে সে ঘুরত পাড়াময়। তখন এক সাইকেলে দুজন ওঠা নিষিদ্ধ, পারলে পুলিশ এই অপরাধে সাইকেল আরোহীকে আটকও করতে পারে। মন্টু যথারীতি আরেকজনকে তাঁর সাইকেলে বসিয়ে চলেছেন প্যাডেল ঠেলে, ক্রিং ক্রিং ঘণ্টি বাজিয়ে, পথে পুলিশ হাঁক ছাড়ল, ‘দো আদমি কিঁউ?’
‘আওর এক নেহি মিলা’, বলে মন্টু অবলীলায় চলে গেলেন তাঁর গন্তব্যের দিকে।
সাইকেলে বাতি থাকাও তখন বাধ্যতামূলক ছিল। মন্টুর সাইকেলে বাতি ছিল না। আরেকবার পুলিশ তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘সাইকেল মে বাত্তি নেহি হ্যায় কিঁউ?’
মন্টু সাইকেলের গতি দিলেন বাড়িয়ে, আকাশে তখন জ্বলজ্বল করছে চাঁদ। সেদিকে আঙুল তুলে মন্টু বললেন, ‘আল্লাহ মিয়া এত্তা বাত্তি দিয়া, সাইকেল মে বাত্তি জরুরত নেহি হ্যায়।’
কবি জসীমউদ্দীন ছিলেন গায়ক আব্বাসউদ্দীনের অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
তিনি শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের বন্ধু।
ফজলুর রহমান ঢাকায় এসেছেন। সংবাদ সম্মেলন করলেন, বললেন, ‘বাংলা লেখা হবে আরবি বর্ণমালা দিয়ে। তাহলেই সব প্রদেশের মধ্যে বিভেদ দূর হবে। আর আরবি লেখা সহজ। এই ভাষায় টাইপরাইটার আছে। সিন্ধুর ভাষা সিন্ধি, কিন্তু তার হরফ আরবি। পশ্চিম পাঞ্জাবের ভাষা উর্দু, তবে তার হরফ নাসতালিক। সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের ভাষা পশতু, সেও তো বহুলাংশে আরবি। এখন শুধু বাংলা ভাষাটা যদি আরবিতে লেখা যায়, তাহলেই হয়ে যায়। কারণ, আরবি হচ্ছে হরফুল কোরআন।’
জসীমউদ্দীন সাহেবের কানে গেল এই প্রেস কনফারেন্সের কথা। তাঁকে লোকজন বলাবলি করতে লাগল, ‘আপনার বন্ধু ফজলুর রহমান তো পাগল হয়ে গেছে। কী বলছে সে এসব?’
জসীমউদ্দীন গেলেন ফজলুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে সরকারি অফিসে, তখন তিনি সরকারি লোকজন আর পার্টির দর্শনার্থীদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছেন। জসীমউদ্দীন বললেন, ‘আমি আপনার সাথে বর্ণমালা বদলের ব্যাপারে কথা বলতে চাই।’
ফজলুর রহমান বললেন, ‘আজ রাত আটটার পরে আপনি মওলা মিয়ার বাড়ি আসবেন।
মওলা মিয়ার বাড়ি ফুলবাড়িয়ায়। রাত সাড়ে সাতটার দিকে জসীমউদ্দীন ঘোড়ার গাড়িতে উঠলেন ফুলবাড়িয়া যাবেন বলে। ঘোড়ার গাড়ি চলছে। অশ্বখুরের আওয়াজ উঠছে খটখট। বাতাস বইছে মৃদুমন্দ। সেই বাতাস জসীমউদ্দীনের চুল উড়িয়ে নিচ্ছে।
জসীম ভাবছেন, এ আমি কার কাছে চলেছি। ফজলুর রহমান? সে তো এক কৌতূহলোদ্দীপক চরিত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন, ‘৪৭-এর আগে, তিনি ছিলেন সেই বিরল মানুষদের একজন, যাঁরা আহসান মঞ্জিলের খান্দানের বাইরে নেতৃত্বের গুণ দেখিয়ে অনেকেরই প্রশংসাভাজন হয়েছিলেন। ছাত্র হিসেবে ভালো ছিলেন না বলেই হল সংসদের নির্বাচনে দাঁড়াতেন না। কারণ, ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের হল সংসদের নির্বাচনে ছাত্ররা ভালো ছাত্রদেরকেই ভোট দিত। নবাব না হয়েও, গ্রাম থেকে এসেও, ছাত্রদের আকৃষ্ট করার ক্ষমতা দেখিয়ে ফজলুর রহমান রাজনীতিতে নতুন একটা পথের সন্ধান দিতে পেরেছিলেন। তিনি অবশ্য ওকালতিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে গিয়েছিলেন। ওকালতি জীবনের শুরুতেই তিনি হোঁচট খান। সরকারি উকিলের নথি থেকে কাগজ সরাতে গিয়ে তিনি ধরা পড়েন। সিনিয়র উকিল তাঁর পক্ষ থেকে ক্ষমা চান, ‘একেবারে আনকোরা নতুন উকিল, ও জানে না, কোন নথির কাগজ কোথায় রাখতে হয়। ভুল করে ফেলেছে, মাফ করে দিন।’ আদালত তাঁকে মাফ করে দেন, কিন্তু তাঁর ওকালতি জীবনের সেখানেই পরিসমাপ্তি ঘটে। অতএব, তিনি পেশা হিসেবে বেছে নেন রাজনীতিকেই। জনসমক্ষে তিনি বক্তৃতা করতে পারতেন না, আলাপ-আলোচনাতেও কোনো শালীনতা দেখাতে পারতেন না। কারণ, কি ইংরেজি, কি বাংলা—কোনো ভাষাই তিনি ভালোভাবে রপ্ত করতে পারেননি। তিনি একটু খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। যখন রাজনীতি শুরু করেন, তাঁর পকেট ছিল খালি; তাঁর ছিল না কোনো রাজনৈতিক গুরু। গ্রামের সম্পত্তি সব তাঁর ভাই আত্মসাৎ করায় তিনি ছিলেন কপর্দকহীন। বাবুবাজারের মেসে থাকতেন, বন্ধুরা টিফিন ক্যারিয়ারে করে তাঁর খাবার পাঠিয়ে দিত। বাবুবাজার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ঘোড়ার গাড়ির ভাড়া ছিল দুই আনা, সে পয়সাও তাঁর খরচ করার সাধ্য ছিল না। তিনি তাঁর প্রতিবন্ধিতা জয় করে হেঁটে হেঁটে আসতেন। বন্ধুরা তাঁর জন্য সবকিছু করতে পারত, তিনিও পারতেন বন্ধুদের জন্য যেকোনো কিছু করতে। আর তাঁর ছিল এক অভূতপূর্ব সাংগঠনিক দক্ষতা। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৭, ঢাকার মুসলিম লীগ রাজনীতিতে যে তরুণেরা সক্রিয় ছিল—শামসুল হক, আজিজ আহমেদ, খন্দকার মোশতাক, এমনকি কামরুদ্দীন আহমদ—সবাই তাঁর ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন।
কিন্তু কেন্দ্রে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে এই ফজলুর রহমান তো নিজের নামটা হাস্যকর করে তুলেছেনই, পুরো বাংলার নামও তিনি ডোবাবেন।
ফুলবাড়িয়া গিয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে দুই আনা পয়সা গুনে দিলেন কবি জসীম। ঘরের ভেতরে আলো জ্বলছে, বারান্দা অন্ধকার। দরজা খোলা। তিনি পর্দা ঠেলে গলা খাঁকারি দিয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলেন, শিক্ষাসচিব ফজলে করিম আর অধ্যাপক সাহিত্যিক সৈয়দ আলী আহসান বেতের সোফায় বসে আছেন। মন্ত্রী এঁদের আগেই ডেকে এনেছেন, যাতে কবির সঙ্গে তর্কে জিততে পারেন। জসীমউদ্দীন মনে মনে হিসাব কষলেন।
মন্ত্রী ভেতরের ঘর থেকে পায়জামায় গিঁট দিতে দিতে প্রবেশ করলেন। কুশল বিনিময়ের পরে জসীমউদ্দীন বললেন, ‘আপনি কী করছেন? আপনি কি চান, বাঙালিরা পশ্চিমাদের কাছে জীবনের সব ক্ষেত্রে সংগ্রামে হেরে যাক? বাংলার পরিবর্তে উর্দু হরফ, আরবি হরফ—এসব কী শুনছি?’
ফজলুর রহমান সাহেব সোফায় বসে দুই পা নাচাতে নাচাতে বললেন, ‘বাঙালি জাতি সম্পর্কে আপনার দেখছি বড়ই খারাপ ধারণা! বাঙালিরা সব পারে। তারা খুব দ্রুত উর্দু বর্ণমালা শিখে নিয়ে পশ্চিমা ছাত্রদের হারায়া দিবে।’
সৈয়দ আলী আহসান বললেন, ‘ঠিক, বাঙালিরা সব পারে।
ফজলে করিম, যিনি এরই মধ্যে মন্ত্রীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে হরফুল কোরআন বিষয়ে একজন স্কুল মৌলভির লেখা বইকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে নিজের নামে প্রকাশ করেছেন, তিনি জোর গলায় মন্ত্রীর বক্তব্য সমর্থন করলেন।
জসীমউদ্দীন বললেন, ‘আপনার এই কথা আমি সমর্থন করি না। এখনই আমাদের দেশে ছাপাখানা নাই, কাগজ নাই, প্রকাশনা নাই। এর মধ্যে আমাদের অতীতকালের যেসব সাহিত্যিক তাঁদের অমর অবদান রেখে গেছেন, তা উর্দুতে রূপান্তরের সাধ্য সরকারের নেই। উর্দু অক্ষর বা আরবি অক্ষর করলে আমাদের ছাত্ররা সেই সাহিত্য উপভোগ করতে পারবে না।
ফজলুর রহমান বললেন, ‘সরকার ইচ্ছা করলে কী না পারে। কামাল পাশা অল্প দিনের মধ্যেই তুরস্কের বর্ণমালা বদলে দিয়েছেন।’
জসীমউদ্দীন ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘কামাল পাশার মতো বড় প্রতিভা তো আমাদের দেশে নাই।’
মন্ত্রী সটান দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন, ‘কে বলল নাই। এই দেখেন, আপনার সামনে কে দাঁড়ায়া আছে। আমিই এই কাজ করব। দেখেন, বাংলা ভাষায় কোনো লাইনো টাইপ মেশিন নাই, টাইপরাইটার নাই, উর্দু ভাষায় আছে। উর্দু হরফে লেখা হলে আমরা এসব মেশিনের সাহায্য পাব।’
জসীম বললেন, ‘উর্দুর অনেক আগে থেকে পশ্চিমবঙ্গে বাংলা লাইনো টাইপ মেশিন ও টাইপরাইটার আছে।’
ফজলে করিম বললেন, ‘আপনি ভারতের দিকে অত তাকাচ্ছেন কেন?’ সৈয়দ আলী আহসান তাঁর দাড়ি নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘এখন আমরা আজাদ। সবকিছুতে আর পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকালে চলবে না। সারা পৃথিবীর মুসলিম সভ্যতার দিকে তাকাতে হবে। আরবি শিখলে সেটা সহজেই সম্ভব।’
জসীমউদ্দীন বললেন, ‘সৈয়দ আলী আহসান, তুমি কথা বলছ কেন। আমি এসেছি আমার বন্ধু ফজলুর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে। তোমাদের সঙ্গে তো কথা বলতে আসিনি।’
সৈয়দ আলী আহসান চুপ করে গেলেন।
ফজলে করিম থামার পাত্র নন। তিনি বললেন, ‘আপনি মুসলিম সভ্যতায় বিশ্বাস করেন না?’
জসীমউদ্দীন স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন, ‘মুসলিম সভ্যতা বলে কিছু আছে কি না, জানি না। তবে পারস্য সভ্যতা আছে, আরব সভ্যতা আছে; বাঙালি সভ্যতাও তেমনি আছে।’
শুনে ফজলে করিম আর সৈয়দ আলী আহসান হেসে উঠলেন, যেন এইমাত্র ভারি একটা কৌতুকের কথা শ্রবণ করলেন।
জসীম সেদিকে না তাকিয়ে ফজলুর রহমানকে বললেন, ‘আপনি উর্দু, আরবি বর্ণমালা প্রবর্তন করতে চেয়ে বাঙালি সন্তানদের এক চোখ কানা করে দিচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আধুনিক কাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে যে অপূর্ব সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে আমাদের ছেলেমেয়েরা বঞ্চিত হবে।’
ফজলুর রহমান প্রায় লাফিয়ে উঠলেন, ‘আমিও তো তা-ই চাই। পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের প্রতি যেন বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা আকৃষ্ট না হয়। তাহলে তারা আর বিশ্বাসঘাতক হতে পারবে না।
জসীম বললেন, ‘তাহলে আজ থেকে আমি আপনার বিরোধিতা করতে শুরু করলাম।’
ফজলুর রহমান বললেন, ‘তাহলে সেই কাজ তোমাকে একাই করতে হবে। কেউ তোমার পাশে দাঁড়াবে না।
‘যদি না দাঁড়ায়, তবে আমি একলাই দাঁড়াব। যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।’
জসীমউদ্দীন একাই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
সৈয়দ আলী আহসান আর ফজলে করিম মন্ত্রী-সন্নিধানে বসেই রইলেন।
তখন অনেক রাত। ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে ট্রেন আসছে। শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এখন কোনো ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। জসীমউদ্দীনকে একা অনেকটা পথ যেতে হবে।
ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে গেলে রিকশা পাওয়া যাবে। তিনি সেদিকেই পা বাড়ালেন।
.
মাঘ মাস পেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এক মাঘে শীত যায় না। তরুছায়ায় ঘেরা ঢাকা শহরে ভীষণ শীত। এত ঠান্ডা কেন? কামরুদ্দীন সাহেব তাঁর জিন্দাবাহারের বাসায়।
শীতে তিনি ঠকঠক করে কাঁপছেন। ৩৮ বছর বয়সী এই উকিল রাজনীতিকের শরীর এতটা বুড়ো হয়নি যে তিনি শীতে কাঁপবেন।
আসলে তাঁর শরীর কাঁপছে ভয়ে, দুশ্চিন্তায়, উত্তেজনায়।
তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন বিপরীত দিকে অবস্থিত হারমোনিয়ামের দোকানের মালিক রসিক দাসের মেয়ে আর জামাই।
সকালবেলা, তখনো কুয়াশা কাটেনি পথে, তখনো সূর্য পুরোপুরি দখল নেয়নি আকাশের। এরই মধ্যে এই কাণ্ড।
কামরুদ্দীন সাহেব তাঁদের বাড়ির ভেতরে লুকিয়ে রাখলেন। পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গা বেধেছিল আগেই। এখন ঢাকায় লেগে গেছে।
মেয়েটি শাঁখা-সিঁদুর পরা, তাকে কামরুদ্দীন সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবা এল না?’
মেয়েটি মাথায় কাপড় টেনে দিয়ে বলল, ‘বাবারে কইছিলাম আইতে। বাবা কইল, আমি এইহানে এতু বছর, আমারে এই পাড়ার হকলে চিনে। আমারে কেউ মারব না, মা। তুই যা। জামাইরে লগে লইয়া যা।’
‘আচ্ছা, তোমরা থাকো।’ ওদের নিচতলার ঘরে বসিয়ে বাইরের লোহার শক্ত দরজাটা ঠিকমতো লাগিয়ে কামরুদ্দীন সাহেব দোতলায় উঠলেন।
এত ঠান্ডা কেন।
তিনি কাঁপছেন আর আবহাওয়াকে দুষছেন।
গুন্ডারা এল হইহই-রইরই করতে করতে। হরিদাসের বাড়িটা ঠিক উল্টো দিকেই। তারা এসে তাঁর দরজা ধাক্কা দিতে লাগল।
কামরুদ্দীন সাহেব জানালা দিয়ে দেখতে লাগলেন, ঘটনা কী!
ওরা গেটটায় ধাক্কা মারছে। বড় ইট এনে বাড়ি মারছে দরজায়। শাবল-খুন্তি দিয়ে নানা কসরত করছে। সত্যি, দরজাটা ভেঙে ফেলল যে!
রসিক দাস কী করবে এখন। সে পেছনের জানালা দিয়ে মারল এক লাফ। তারপর দৌড়াতে শুরু করল।
গুন্ডারা টের পেল একটু পরেই। তারাও দৌড়াতে শুরু করল রসিক দাসের পেছন পেছন। গুন্ডারা দৌড়াচ্ছে। ভয়ে, উত্তেজনায়, আতঙ্কে কামরুদ্দীন সাহেবের শরীর হিম হয়ে আছে।
ইশ্, রসিক দাস পড়ে গেল হোঁচট খেয়ে।
একটা গুন্ডা এত্ত বড় একটা ছুরি ওর পেটের মধ্যে…ও মা গো… বীরপুরুষেরা আবার এসে ঢুকল তাঁর বাড়িতে। ঢুকে দেখল, মেয়েটি নেই। এত বড় শিকার হাতছাড়া!
হায়, হায়, তারা এসে যে এই বাড়ির দরজাতেই ধাক্কা মারতে লাগল। রসিক দাসের মেয়ে আর জামাই দোতলায় এসে কামরুদ্দীন সাহেবের পায়ে পড়ল। ‘দরজা খুলবেন না, ওরা আমাদের মেরেই ফেলবে।
গুন্ডারা ছুরি উঁচিয়ে এ বাড়ি লক্ষ করে চেঁচাচ্ছে।
গুন্ডারা রাস্তা ছাড়ছে না।
এত শীত। পৃথিবীর সব শৈত্য এসে যেন জিন্দাবাহার লেনের এই বাড়িতে আছড়ে পড়ছে। বিকল শরীর নিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন কামরুদ্দীন।
তাঁর স্ত্রী নিজের ঘরে লুকিয়ে রেখেছেন ওই মেয়ে আর তার বরকে।
ঘণ্টা খানেক পরে গুন্ডারা চলে গেল। আবার আসবে না তো!
গেছে, দরজায় আবার ধাক্কা।
আরও খানিক পরে, তখন সূর্য আরেকটু তেজি হয়েছে, কুয়াশা খানিকটা কেটে গেছে, দরজায় আবার ধাক্কা।
উফ! এইভাবে বাঁচতে পারা যায়!
কামরুদ্দীন জানালার কাছে এসে উঁকি দিলেন। অলি আহাদ।
তাড়াতাড়ি গেট খুলে তাঁকে ভেতরে আনলেন কামরুদ্দীন সাহেব।
অলি আহাদ বললেন, ‘দেখেছেন, কী পরিস্থিতি। দাঙ্গা বেধে গেছে। চলেন পার্টি অফিসে। আমাদের কর্তব্য ঠিক করতে হবে। আলোচনা করতে হবে।’
কামরুদ্দীন বললেন, ‘আমার প্রথম কর্তব্যটা কী, আমি জানি।’
‘কী?’
‘আমার ঘরে একটা হিন্দু মেয়ে আর তার জামাই আশ্রয় নিয়েছে। ওর বাবা রসিক দাসকে একটু আগে গুন্ডারা খুন করেছে। ওকে আগে আমি নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠাব। তারপর অন্য কাজ। আপনি এক কাজ করেন। পার্টি অফিস থেকে কয়েকজন ছেলেকে পাঠান। খুব বিশ্বস্ত ছেলে হতে হবে। আমি আগে ওদের নিরাপদ স্থানে সরাব। সূত্রাপুরের দিকে হিন্দুপাড়ায়।’
অলি আহাদ চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে এল কয়েকজন যুবক। তারা বলল, তাদের অলি আহাদ পাঠিয়েছেন।
কামরুদ্দীন তাঁর বাড়ির দেয়ালের পেছনের দিকটা ভাঙতে লাগলেন যুবকদের সহায়তায়। তারপর একটা ফোকর বেরোলে সেই পথে রসিক দাসের মেয়ে আর জামাতা যুবকদের প্রহরায় বিদায় নিল।
কামরুদ্দীন সাহেব সেদিন আর পার্টি অফিসে যাওয়ার সাহসই পেলেন না।
সন্ধ্যায় এলেন তাজউদ্দীন সাহেব।
২৫ বছর বয়সী এই যুবকের বোধ করি শীত লাগে না। বিকেলের দিক থেকে একটু একটু বৃষ্টি হচ্ছে আর সঙ্গে বইছে ঝোড়ো বাতাস। কামরুদ্দীন সাহেব পায়ে মোজা পরে লেপের নিচে ঢুকেও শরীর থেকে শীত তাড়াতে পারছেন না। এর মধ্যে শীতকালের বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তাজউদ্দীন এলেন। ‘কী করেছেন?’ একটা গামছা এগিয়ে দিতে দিতে বললেন কামরুদ্দীন, ‘এমন দুর্যোগের দিনে একা একা এলেন…’
‘শহর দেখতে বেরিয়েছিলাম কামরুদ্দীন সাহেব। মনটা খুব খারাপ। নবাবপুর, সদরঘাট, পাটুয়াটুলী, ইসলামপুর, সিদ্দিকবাজার, ইংলিশ রোড, চকবাজার—সব ঘুরে ঘুরে এলাম। সবখানে ধ্বংসের চিহ্ন। আগুন জ্বলছে হিন্দুদের দোকানপাটে। রাস্তার ধারে লাশ পড়ে আছে।’
‘পুলিশ নাই? ১৪৪ ধারা না জারি করা হয়েছিল দিনের বেলা? ‘বিহারি পুলিশরা আরও উৎসাহ দিচ্ছে। যারা এসব করছে, তারা সবাই মুহাজের। থাকার জায়গা নেই। হিন্দু তাড়িয়ে বাড়িঘর দখল করতে চাচ্ছে। আর পেছন থেকে উসকানি দিচ্ছে মুসলিম লীগের বদমাশ নেতাগুলো।’
‘কিন্তু বাঙালি মুসলমানরা কেউ প্রতিবাদ করছে না?’
না, বাঙালিরা চুপচাপ দেখছে,’ তাজউদ্দীন মাথা মুছতে মুছতে বললেন, ‘রেডিওটা অন করুন তো! কী বলে শুনি।’
রেডিওতে বলা হচ্ছে, ‘কারফিউ জারি করা হয়েছে। কারফিউয়ের মেয়াদও বাড়ানো হলো। বিকেল পাঁচটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।’
কামরুদ্দীন লুঙ্গি আর শার্ট এনে দিলেন তাজউদ্দীনকে। ভেজা কাপড় ছেড়ে সেসব পরে নিলেন তাজউদ্দীন। আজ রাতে আর হলে ফেরা হবে না।
‘অলি আহাদ এসেছিলেন। পার্টি অফিসে ডেকেছিল শান্তির পক্ষে কিছু একটা করা যায় কি না। আজ আমার এখানেই যা ঘটেছে, তারপর…’ সবিস্তারে ঘটনা বর্ণনা করলেন কামরুদ্দীন আহমদ। বললেন, ‘আমার তো ভয় করছে, গুন্ডারা না এবার আমাকেই আক্রমণ করে বসে। আপনি রাতটা থাকেন। কিছুটা সাহস পাই। খুব ঠান্ডা পড়েছে তাজউদ্দীন সাহেব। খুব ঠান্ডা!’
তাজউদ্দীন পরের দিন হলে ফিরলেন সকাল সকাল। তারপর গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্লাস হলো না। শান্তি রক্ষার পক্ষে একটা সভা হলো। তাতে ছেলেমেয়ে খুব বেশি উপস্থিত হলো না। তাজউদ্দীন হতাশা বোধ করলেন। মানুষ মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবে না বিপদে দুর্যোগে দুর্বিপাকে?
৪৬.
জয়নুল আবেদিন বিয়ে করতে যাবেন। বরযাত্রা করবে সাংবাদিক লেখক আবু জাফর শামসুদ্দীনের কলতাবাজারের বাসা থেকে।
জয়নুল ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্রপারের ছেলে। বাবা পুলিশ বিভাগের নিম্নপদস্থ কর্মচারী। নরমাল স্কুলের কাছে তাঁর নিজের বাড়ি, ওপরে ঢেউটিন, পাশে তরজার বেড়া। কায়ক্লেশে সংসার চলে, কারণ বৃদ্ধ পিতা অবসর নিয়েছেন।
তিনি আসতে পারবেন না বিয়েতে। বরকর্তা আবু জাফর শামসুদ্দীনই। তখন তাঁর বয়স ৪০-এর মতো।
জয়নুলের বয়স ৩৬।
জয়নুলের পায়জামা-পাঞ্জাবি নেই। টুপিও নেই। আচকানের তো প্রশ্নই আসে না। আবু জাফর তাঁকে পায়জামা-পাঞ্জাবি ধার দিলেন।
পাত্রী পড়ে ক্লাস টেনে।
পাত্র ড্রয়িংয়ের শিক্ষক। সরকারি হাইস্কুলে ছবি আঁকা শেখান।
তিনি ছিলেন কলকাতা আর্ট স্কুলের খ্যাতিমান শিক্ষক। সর্বভারতীয় চিত্র প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে পেয়েছিলেন সোনার মেডেল। ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের ছবি এঁকে কলকাতা তো কলকাতা, পৃথিবীরই টনক দিয়েছিলেন নড়িয়ে। ‘৫০-এর সেই কুখ্যাত দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকেছিলেন মোটা তুলির দ্রুত টানে, পথের ধারে পড়ে থাকা নিরন্ন কঙ্কালসার নারী-পুরুষ আর কাক তাঁর তুলিতে মূর্ত করে তুলেছিল ওই মানবিক বিপর্যয়কে, জাগিয়ে দিয়েছিল মূঢ় বিবেককেও।
এখন সেই আলোড়ন সৃষ্টিকারী শিল্পী ঢাকায় পরিণত হয়েছেন গরিব এক স্কুলশিক্ষকে। কিন্তু তাতে তাঁর মুখের হাসি এতটুকুন ম্লান হয়নি। হাসিমুখে রুমাল চাপিয়ে তিনি চললেন বিয়ে করবেন বলে। স্বজনহীন, বন্ধুবান্ধবহীনভাবে। তবু আকবর বাদশার সঙ্গে তাঁর কোনো তফাত নেই যেন।
আবদুল হাদি লেনে তাঁর শ্বশুরবাড়ি। সেখানেই বিয়ে পড়ানো হবে। ঘোড়ার গাড়ি ডাকা হলো। বর জয়নুল ও বরযাত্রী আবু জাফরকে নিয়ে গাড়ি চলতে শুরু করল।
৪৭.
‘হুজুর, আপনে আসাম গেলেন, ওই সব দিনের গল্প একটু করেন না?’ শেখ মুজিব তাঁর চোখ মুছতে মুছতে প্রশ্ন করেন। মুজিবের চোখ সমস্যা করছে। চোখ দিয়ে অবিরাম পানি পড়ছে।
মওলানা ভাসানী, বয়স ৬৫ কি ৭০, মাথায় বেতের টুপি, তোবড়ানো গালে লম্বা সাদা দাড়ি, পরনে লুঙ্গি, হাসেন। ‘মজিবর, সেই সব দিনের কথা শুনবার চাও?’
‘জি, বলেন।’
কারাগারের ভেতরে তাঁরা বসে আছেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ঘরে। কেন্দ্রীয় কারাগারের দোতলায় আশ্রয় পেয়েছেন এই বন্দী। নিচে একটা কক্ষে থাকেন শেখ মুজিব, আরেকটায় কমিউনিস্ট নেতা হাজী দানেশ।
শেখ মুজিব আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক। ভাসানী সভাপতি। দুজনের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে কারাগারে।
ভাসানীর জন্ম ঠিক কবে, কে জানে, হয়তো ১৮৮০ থেকে ১৮৮৫ সালের কোনো এক সময়। শৈশবে মা মারা যান। তারপর নানা ঘাটের পানি খেয়েছেন। পড়াশোনা করেছেন দেওবন্দ মাদ্রাসায়। সিরাজগঞ্জের ছেলে আবদুল হামিদ কলকাতা, পাঁচবিবি, টাঙ্গাইল নানা জায়গায় ঠাঁই গাড়েন। চরমপন্থী দলের সঙ্গে যুক্ত থাকেন কিছুদিন। কিছুদিন টাঙ্গাইলের কাগমারীতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। কংগ্রেসে যোগ দেন। জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে বাংলা থেকে বহিষ্কৃত হন। আসামে গিয়ে আশ্রয় নেন। সব সময়ই পীর-ফকিরে আস্থা ছিল। আসামেও গিয়েছিলেন পীরের মুরিদ হিসেবেই। মুজিব তাঁর কাছে জানতে চান সেই সময়ের কথা।
‘শুনবা মিয়া? পথের ধারে বাঘ শুইয়া থাকে। দিনের বেলাও হাতে হাতিয়ার নিয়া পথ চইলতে হয়। অস্ত্রশস্ত্র নিয়া আগুনের বোন্দা জ্বালায়া তারপর না রাইতে বাইর হইতে হয়। সাপের কামুড়ে দৈনিক মানুষ মরে। মশা একেকটা এত বড়—মশার পায়ে সুতা বাইন্দা রাখতে পারবা চড়াই পাখির মতন। ডেঙ্গুজ্বর, কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া—সব জ্বরই ওই দেশে আসল রাজা। মরণ-বাঁচন কোনো ঠিকঠিকানা নাই। রাইতের বেলা পাহাড় থাইকা মহিষ নামে, হরিণ নামে, হাতি নামে। খেতের ফসল ব্যাবাক সাফ কইরা ফেলায়। হাতির পায়ের নিচে ঘরদুয়ার ভাইঙা তছনছ হয়। একেকটা জোঁকের সাইজ ধরো আধা হাত। রক্ত চুইষা খায় তিন পোয়া। বিরান পাথার। পাঁচ-সাত মাইল পরপর বসতি। তা-ও হাতেগোনা। এমন দেশে গিয়া খড়ের ছাউনি দিয়া ঘর বাইন্ধলাম। মবলগে খরচ এক টাকা চইদ্দ আনা।’
হাজী দানেশ এসে এই আড্ডায় যোগ দেন।
মওলানা ভাসানী বলে চলেন, ‘আসামে পরথম আসছিলাম কোনো রাজনীতি করতে না, সামাজিক মিশন লইয়াও না। পীরের সাথে তালেবে এলেম হইয়া আসছিলাম। পীরের বোঁচকা-বুচকি বওয়া, ফুট-ফরমাশ খাটা, আর প্যাটটা ভইরা দাওয়াত-জিয়াফত খাওয়া—এই আছিল কাম। পীর ভাইদের সাথে মিইশা দেখলাম, আখেরাতের সুখ বহুত দূর। ইহকালের দোজখের জ্বালা বড়ই নজদিক। রোজ দোজখের জ্বালা। লাইন প্রথা আর বঙ্গাল খেদার জ্বালায় হাজার হাজার বনি আদমের ঘর-সংসার ছারখার হইয়া যাইতেছে। তাই আমার নজর পরকালের তরিকার চায়া ইহকালের বাঁইচা থাকার উপরেই পড়ল বেশি। লাইন প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করলাম। বঙ্গাল খেদার বিরুদ্ধে আন্দোলন করলাম। মোল্লা মানুষ হইলাম রাজনীতির মানুষ। ধুবড়ির ভাসানে গিয়া ভাষণ দিছিলাম, আসামের লোক আমার নাম দিল মওলানা ভাসানী।
এরই মধ্যে হাজী দানেশের সঙ্গে মওলানা ভাসানীর খুব খাতির হয়েছে।
হাজী দানেশ কমিউনিস্ট, আর ভাসানী গরিব মানুষ ভূমিহীন মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখেন। যদিও ইসলামের প্রতি তাঁর আস্থা অগাধ। পীর হিসেবে গ্রামেগঞ্জে মানুষকে পানি-পড়া দেন।
ভাসানী বলেন, ‘হাজী সাহেব, এইবার ছাড়া পাইলে আমরা একসাথে রাজনীতি করুম।’
হাজী দানেশ বলেন, ‘মওলানা সাহেব, আপনার সাথে আমাদের মিলবে না। আমরা তো আসলে সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাস করি।
মওলানা ভাসানী বলেন, ‘আমরা ইলেকশনে সব কিষান মজুর গরিব মানুষরে নমিনেশন দিব। তাইলে তো অ্যাসেম্বলিতে গরিব মানুষই আইন বানাইব।’
‘আপনি তো কৃষক শ্রমিক প্রতিনিধি পাঠিয়ে আইন পাস করলেন। কিন্তু এক্সকিউশন করবে কে? সব আমলাই তো একই রকম।’
ভাসানী বলেন, ‘তাইলে কি আমগোরেও সশস্ত্র লাইন নিতে হইব? মজিবর কী কও?’
শেখ মুজিব বলেন, ‘আপনি যা বলেন, হুজুর। আপনি হইলেন আমাদের পার্টির সভাপতি।’
‘না, আমি একলা সিদ্ধান্ত দিব নাকি।’
এরপর তাঁরা পরিকল্পনা করেন, কীভাবে সশস্ত্র সংগ্রাম করা যায় খাজা-লিয়াকত মুসলিম সরকারের বিরুদ্ধে। তাঁরা নানা স্বপ্ন বুনে চলেন। তাঁদের পার্টির সদর দপ্তর হবে মধুপুরের জঙ্গলে। ওখানেই অস্ত্রের প্রশিক্ষণ হবে। শেখ মুজিবের রক্ত গরম হয়ে ওঠে।
চীনে কমিউনিস্ট পার্টির নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। তাদের সামনে একমাত্র বাধা কুওমিনতাং বাহিনী। একদিন ভাসানী খবর পেলেন, কুওমিনতাং বাহিনীও পরাজিত হয়েছে। তিনি তাড়াতাড়ি হাজী দানেশকে ডেকে নিলেন দোতলায়। তাঁর মুখে হাসি। ‘হাজী সাহেব, কমিউনিজম তো আইসা গেল। বাড়ির পাশে চীন পর্যন্ত আইছে।’
হাজী দানেশের মুখেও হাসি। তিনি বললেন, ‘তাহলে তো আপনার দাড়ি কামাতে হবে।’
ভাসানী সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘কামাইতে হইলে হইব। মানুষ তো খাইতে পারব। পরতে পারব। হাজী সাহেব, শুনেন, আমার ইসলাম যদি সত্য হয়, তাইলে হাজারটা কমিউনিস্টও ইসলামরে ঠেকায়া রাখতে পারব না।’
৪৮.
শেখ মুজিব চিঠি লিখতে বসেছেন। ফরিদপুর কারাগারে এখন তিনি। কনকনে শীত পড়েছে। ১৯৫০-এর ডিসেম্বর। সূর্যের আলো যেন কারাগারে ঢুকতেই পারছে না। কুয়াশাও খুব বেশি।
মুজিব জেলখানায় উবু হয়ে বসে চিঠি লিখছেন তাঁর নেতা সোহরাওয়ার্দীকে।
এর মধ্যে একটা মামলায় তাঁর তিন মাসের কারাবাসের শাস্তি হয়েছিল। সেই শাস্তির মেয়াদ দিন দশ আগে পেরিয়েও গেছে। তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। বরং গোপালগঞ্জের আরেকটা মামলার জন্য গোপালগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
গোপালগঞ্জে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন রেনু। আব্বা তো ছিলেনই। আর ছিল তাঁর দুই ছেলেমেয়ে, তিন বছরের হাসু আর এক বছরের কামাল। টুঙ্গিপাড়া থেকে নৌকায় এসেছিল তারা। গোপালগঞ্জে তাদের বাসা, আদালতপাড়াতেই।
আদালতেই মাকে দেখলেন মুজিব। মা তাঁর মাথায় হাতও দিলেন। রেনু ছেলেমেয়ে দুটোকে টেনে আনলেন তাদের বাবার কাছে। হাসিনা তাঁকে যেন লজ্জা পাচ্ছে। তিনি বললেন, ‘কী রে হাসু, কাছে আয়।’
হাসিনা কাছে এল। ‘মাশাল্লাহ মা, বড় হয়ে গেছ। চুলও তো অনেক লম্বা হলো।’
হাসু বলল, ‘আরও বড় হতো। মা কেটে দিছল!’
কামালকে এক কোলে আর হাসুকে আরেক কোলে নিলেন মুজিব। ঠিকমতো কথা কি আর বলা যায় কারও সঙ্গে?
তাঁকে দেখতে ভিড় হয়ে গেছে পুরো গোপালগঞ্জের আদালতপাড়ায়। পুরো গোপালগঞ্জই যেন ভেঙে পড়ছে তাঁকে দেখতে।
পুলিশ কী করবে বুঝে উঠতে পারে না।
ভিড়ের মধ্যে আর রেনুর সঙ্গে ভালো করে কথা হলো না।
মুজিব বললেন, ‘রেনু, শক্ত থেকো। আমি তো এই জালিম সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালায়াই যাব।’
রেনু চোখ তুলে বললেন, ‘আমি শক্তই আছি। তুমি তোমার শরীর- স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাইখো।’
এরই মধ্যে পুলিশের বাঁশি। তাঁর আওয়ামী মুসলিম লীগের থানা কমিটি, মহকুমা কমিটি, ইউনিয়ন কমিটি—সব চলে আসতে চাইছে তাঁকে দেখতে।
এই অবস্থায় শুনানিই বা হবে কী করে। সরকারি উকিল বললেন, তাঁরা প্রস্তুত নন আজ। তারিখ পেছানো হোক। তারিখ পেছানো হয়েছে।
গোপালগঞ্জ উপকারাগারে স্থানসংকুলান হবে না। তাই তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছে ফরিদপুর কারাগারে।
মুজিব লিখে চলেছেন, ইংরেজিতে :
শেখ মুজিবুর রহমান
নিরাপত্তাবন্দী,
জেলা কারাগার
ফরিদপুর,
পূর্ব বাংলা।
২১/১২/ ৫০
এই পর্যন্ত লিখে মুজিব ‘পূর্ব বাংলা’ শব্দ দুটোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। বাংলা শব্দটা দেখলেই তাঁর বুকটা ভরে ওঠে। তিনি কখনো পূর্ব পাকিস্তান কথাটা বলেনও না, লেখেনও না।
জনাব সোহরাওয়ার্দী সাহেব,
আপনার প্রতি আমার সালাম। জেনে খুশি হয়েছি যে মওলানা সাহেব কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছেন। তিনি উচ্চ রক্তচাপ আর হৃদরোগে ভুগছিলেন। গত নভেম্বরে আমাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে হাজিরা দেওয়ার জন্যে গোপালগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে আমাকে আবার ফরিদপুর জেলে আনা হয়েছে। কারণ, গোপালগঞ্জে নিরাপত্তাবন্দীদের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। আমাকে গোপালগঞ্জের আদালতে সব হাজিরা দিতে যেতে হয় ফরিদপুর কারাগার থেকে। ফরিদপুর থেকে গোপালগঞ্জ একবার যেতেই ৬০ ঘণ্টা লেগে যায়। যে পথ আর যে বাহনে যেতে হয়, তা যারপরনাই ক্লান্তিকর। আমি জানি না এই মামলা কত দিন চলবে। যা-ই হোক না কেন, আমি এসবকে পাত্তা দিই না। জনাব আবদুস সালাম খান আমাকে দেখতে ফরিদপুর কারাগারে এসেছিলেন। তিনি আমার হেবিয়াস করপাস মামলা পরিচালনা করবেন হাইকোর্টে। গোপালগঞ্জের মামলায় সালাম সাহেবও একজন আসামি। এটা পাকিস্তানের ইতিহাসে একমাত্র ঘটনা, যেখানে পুলিশ মসজিদের মধ্যে ঢুকে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য পিটিয়েছিল। দয়া করে আমার জন্য ভাববেন না। আমি জানি, যারা মহৎ লক্ষ্য অর্জনের জন্য মরণকেই বেছে নেয়, তাদের কেউ পরাজিত করতে পারে না। বড় জিনিস অর্জিত হয় বড় আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে। আল্লাহ যেকোনো কারও চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান, আর আমি তাঁর কাছেই কেবল ন্যায়বিচার চাই।
এই পর্যন্ত লিখে মুজিব একটু থামেন। এই কথাগুলো কেবল কথার কথা নয়। এগুলো তাঁর মনের কথা। তিনি সত্যি বিশ্বাস করেন, নিজের জীবনটাকে তিনি দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, আদর্শের জন্য বিলিয়ে দিতে পারেন। মরতে তিনি ভয় পান না। আর এ-ও বিশ্বাস করেন, মহৎ আদর্শ অর্জনের জন্য যে মরতে প্রস্তুত, তার বিজয়ও অবশ্যম্ভাবী।
একদিন বিজয়ী হবেন তিনি, তাঁর বিজয় মানে তাঁর একার বিজয় নয়, সবাইকে নিয়ে, পূর্ব বাংলার সবার বিজয়, কী এক স্বপ্নদৃশ্য তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সেটা যে ঠিক কী, তিনি ধরতে পারেন না। একধরনের ভালো লাগায় তাঁর হৃদয় আচ্ছন্ন হয়। চোখের কোণে জল আসে।
তিনি চশমা খোলেন। সোনালি ফ্রেমের চশমা। ফুলহাতা শার্টটা দিয়ে চোখের জল মোছেন।
আবার তিনি লিখতে থাকেন :
আপনার দিনকাল কেমন যাচ্ছে? আমি অনুভব করতে পারি, আপনি খুবই ব্যস্ত। দয়া করে মওলানা নিয়াজি, জনাব গোলাম মোহাম্মদ খান, নওয়াবজাদা জুলফিকার আর আমার অন্য বন্ধুদের সালাম জানাবেন। আমি সব সময়ই তাদের ভালোবাসা ও স্নেহের কথা স্মরণ করি। তাঁদের বলবেন, যদি আবার কখনো সুযোগ পাই, আমি অবশ্যই তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে লাহোর যাব।
গত অক্টোবরে যখন আপনার সঙ্গে আমার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকে দেখা হয়েছিল, আপনি দয়া করে কথা দিয়েছিলেন, আমার জন্য কিছু বই পাঠাবেন। আমি এখন পর্যন্ত কোনো বই পাই নাই। আপনার ভুলে গেলে চলবে না যে আমি একা আর বইপুস্তকই হচ্ছে আমার একমাত্র সঙ্গী। যা-ই হোক, আমার দিন চলে যাচ্ছে। দয়া করে শরীরের প্রতি যত্ন নেবেন।
ইতি আপনার স্নেহের মুজিবুর
তিনি এই চিঠিটা ডাকে ফেলার জন্য জেল কর্তৃপক্ষকে দিলেন।
তাঁকে না জানিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ সেটা গোয়েন্দাদের হাতে দিয়ে দিল, আর চিঠিটা চিরদিনের জন্য বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল।
মুজিবের শরীরটা ভালো নয়। কাশির গমক উঠছে। বুকে মনে হয় ইনফেকশন হয়েছে। একবার ফরিদপুর থেকে গোপালগঞ্জ যেতে লাগে ৬০ ঘণ্টা। আড়াই দিন। ফিরতে লাগে আরও আড়াই দিন।
মুজিব এরই মধ্যে পূর্ব বাংলার ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেলকে চিঠি লিখেছেন। বলেছেন, ‘আমার প্রতি আর আমার মামলাটার প্রতি সুবিচার করতে হলে একটা কাজ করুন—শাস্তির মেয়াদ যেদিন শেষ হবে, মানে ১৯৫০ সালের ১১ ডিসেম্বর, সেদিন আমাকে হয় মুক্তি দিন। মুক্তি যদি দেওয়া না যায়, তাহলে আমাকে গোপালগঞ্জ থানা চত্বরেই আটক করে রাখুন। এই দুটো বিকল্পের একটাও যদি সম্ভব না হয়, তাহলে আমাকে খুলনা নয়তো বরিশাল জেলে পাঠিয়ে দিন, যেখান থেকে গোপালগঞ্জ যাওয়া-আসাটা সহজতর।’
এই তিনটা বিকল্পের তিন নম্বরটা সরকারের পছন্দ হয়েছে। মুজিবকে খুলনা কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
খুলনা কারাগারে মুজিবের সঙ্গে কথা বলতে আসেন গোয়েন্দা বাহিনীর এক সদস্য।
তিনি তাঁকে বলেন, ‘শেখ সাহেব, আপনাকে আমরা মুক্তি দেব। আপনার শরীরটা ভালো না। বুকে কফ জমে গেছে দেখতে পাচ্ছি। কাশি দিচ্ছেন। আপনি কেন কষ্ট করছেন। আপনি এক কাজ করেন। এই কাগজটাতে একটা সাইন করেন। তার পরই আপনার মুক্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’
মুজিবের মুখ কঠিন হয়ে যায়। তিনি একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেন, ‘এই কাগজটা কী, আমি জানি। এটা একটা মুচলেকা। আমি আর কোনো দিনও পাকিস্তানের রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করিব না। শোনেন সাহেব, আমার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। বন্ড দিয়ে আমি শেখ মুজিবুর রহমান নুরুল আমিনের কাছে মুক্তি চাই না। বন্ডে সাইন করতে রাজি হলে তো আমাকে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকেই বার করে দিতে পারত না। বন্ডে সাইন করতে রাজি হলে আমি অনেক আগেই ছাড়া পেতাম।’
‘না, মানে শেখ সাহেব। সবাই তো বন্ডে সাইন করেই মুক্তি পাচ্ছে। আপনি একা কেন কষ্ট করবেন। মওলানা ভাসানী সাহেব বাইরে, শামসুল হক সাহেব বাইরে।’
‘আমি জানি। ভাসানী মওলানা বন্ডে সাইন করে মুক্তি নেবেন, এটা আমি কল্পনাও করি না। আমিও বন্ড দিব না। শোনেন। আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। আমাকে ডিটেনশন দিয়ে যদি মেরেও ফেলেন, তবু আমি বন্ড দিয়ে মুক্তি নেব না। কারণ, আমি মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করছি। কোন মানুষ, পূর্ব বাংলার গরিব মেহনতি মানুষ। যাদের ত্যাগের মধ্য দিয়ে এই পাকিস্তান সম্ভব হয়েছে।
‘শোনেন, এই পাকিস্তানের জন্য পূর্ব বাংলার মানুষ সংগ্রাম করেছে। তারা ভোট দিয়েছে বলে মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল ইলেকশনে। সেই ইলেকশনে আমি প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছি। আমার নেতা সোহরাওয়ার্দী সাহেব করেছেন। মওলানা ভাসানী না থাকলে সিলেটে জিততে পারতাম আমরা? এই বাংলার গরিব-দুঃখী মানুষ পাকিস্তান এনেছে, আর অযোগ্য মুসলিম লীগ সরকার এই গরিব মানুষকে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। আমি সেই গরিব মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য সংগ্রাম করছি।
‘আর সংবিধানের মৌলিক নীতি কমিটির রিপোর্ট যেটা জমা দেওয়া হয়েছে এটা কী? এটা তো পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তাব্যক্তিরা বাংলাকে তাদের কলোনি বানাতে চায়। এটা আমরা মানব না।
‘পাঞ্জাবে নির্বাচন হচ্ছে। ওই নির্বাচনে মুসলিম লীগ অল্প মার্জিনে জিতে যাবে। কিন্তু সাহস থাকে তো বাংলায় নির্বাচন দিতে বলেন। আমরা আওয়ামী মুসলিম লীগ একতরফাভাবে জিতে যাব। মুসলিম লীগের ভরাডুবি হবে। আদৌ যদি পূর্ব বাংলায় নির্বাচন হয়।
‘যান, আপনার নুরুল আমিন খাজাকে বলে দেন মুজিবুর রহমান এই সব কথা বলেছে। লিখে দেন। আর ওই বন্ডের কাগজ আমার চোখের ত্রিসীমানাতেও আনার চেষ্টা করবেন না। যান।’
গোয়েন্দা সদস্যটি, যার বয়স ৪০-এর কোঠায়, চুল ছোট করে ছাঁটা, গাল বসানো, মুজিবকে বললেন, ‘আপনি কি বুঝছেন আপনার এই সব কথা আমাকে লিখে ওপরওয়ালাকে জানাতে হবে।’
‘বললাম তো, নুরুল আমিনকে জানান। খাজাকে জানান। অন্যায় করে, অত্যাচার করে আওয়ামী লীগের হাজার হাজার কর্মীর ওপরে অত্যাচার করে তারা গদিতে থাকতে পারবে না। বাংলার মানুষের মুক্তি আমি আদায় করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’
গোয়েন্দা সদস্যটি বিদায় নিয়ে চলে যান। তাড়াতাড়ি নিজের অফিসে গিয়ে বসেন। ভুলে যাওয়ার আগেই পুরো আলোচনাটা তাঁকে লিখে ফেলতে হবে। তিনি লিখতে শুরু করেন, ‘আই ইন্টারভিউড দ্য সিকিউরিটি প্রিজনার শেখ মুজিবুর রহমান ইন খুলনা জেইল অন ২২-২- ৫১।’ তিনি পুরো কথোপকথনের একটা সংক্ষিপ্ত কিন্তু স্পষ্ট বর্ণনা লেখেন দক্ষতার সঙ্গে। তাঁর রিপোর্টের শেষ দুটো লাইন হলো : ‘হি ওয়াজ নট উইলিং টু এক্সিকিউট অ্যানি বন্ড ফর হিজ রিলিজ ইভেন ইফ দ্য ডিটেনশন উড কজ হিম টু ফেইস ডেথ। হিজ অ্যাটিচুড ওয়াজ ভেরি স্টিফ।’
এরপর শেখ মুজিবকে কী করা হবে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক, পুলিশ, গভর্নর অফিস, কারাগার কর্তৃপক্ষ তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। একবার নির্দেশ আসে তাঁকে অবিলম্বে খুলনা থেকে বরিশাল কারাগারে নেওয়া হোক। তারপর বলা হয়, তাঁকে ছেড়ে দিয়ে আবার গ্রেপ্তার করা হোক।
চৈত্র মাসে তাঁকে ফরিদপুর জেলা কারাগারে নিয়ে গিয়ে মুক্তি দেওয়া হয়। কারাগারের ফটকে তাঁকে বরণ করে নিতে ভিড় জমে যায়। তিনি সেখানেই সমবেত জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিতে শুরু করেন।
তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-যুবকেরা মিছিল বের করে, ফরিদপুরের পথেঘাটে জনতা আওয়াজ তোলে ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’। গোপালগঞ্জে পরের দিন হরতাল পালিত হয়।
গোয়েন্দা কর্মকর্তার পাঠানো প্রতিবেদন আর তাঁর সঙ্গে শেখ মুজিবের আগের কার্যকলাপের সব গোয়েন্দা প্রতিবেদন মিলিয়ে দেখেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, তারপর ‘যেহেতু এই বন্দীর মনোভাব অনড় এবং যেহেতু ভবিষ্যতেও তিনি আরও অপকর্ম ঘটানোর সম্ভাবনা ধারণ করেন, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর ডিটেনশন বা আটকাদেশ আরও ছয় মাসের জন্য বাড়িয়ে দেওয়ার সুপারিশ করছেন।
গোয়েন্দা বিভাগের ডিআইজি তাই চূড়ান্ত সুপারিশ করেন, ‘আমি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে একমত পোষণ করি এবং সুপারিশ করছি, এই বন্দীর আটকাদেশ নিরাপত্তা আইনে আরও ছয় মাস বৃদ্ধি করা হোক।
মো. এ খালেক, ডিআইজি, আইবি, ২৮-৩-৫১।
গভর্নর সেই আদেশই দান করেন।
৪৯.
ফেব্রুয়ারি মাসে মুজিবের কাছে মুচলেকা আদায়ের জন্য গিয়েছিলেন গোয়েন্দা সদস্য, সেটা ছিল খুলনা কারাগারে।
১৯৫১ সালের মে মাসের ২২ তারিখে ফরিদপুর কারাগারে আসেন আরেক গোয়েন্দাকর্তা। উদ্দেশ্য, শেখ মুজিবকে মুচলেকায় স্বাক্ষর দেওয়ানো, তাঁকে সরকারের কাছে নতিস্বীকার করানো, তাঁকে নমনীয় করা।
গোয়েন্দা সদস্য তাঁকে বলেন, ‘শেখ সাহেব, ভাসানী মুক্তি পেলেন, শামসুল হক মুক্তি পেলেন। আপনি কি মুক্তি চান না?’
শেখ মুজিব বলেন, ‘অবশ্যই মুক্তি চাই। আমার পার্টির প্রেসিডেন্টকে সরকার মুক্তি দিল, সাধারণ সম্পাদককে মুক্তি দিল, আমি তো তিন নম্বর লোক, যুগ্ম সম্পাদক, আমাকে কেন মুক্তি দেওয়া হচ্ছে না, আমি বুঝছি না।’
‘আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। আপনি বন্ড সই করেন। বলেন, এই ধরনের সরকারবিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী কাজে আপনি আর জড়িত হবেন না। আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে।’
মুজিব বলেন, ‘অসম্ভব। বন্ড দিয়ে আমি মুক্তি নেব না।’
‘আপনি যা করেছেন, তার জন্য কি আপনি অনুতপ্ত নন?’
‘মোটেও না। আমি যা করেছি বাংলার মানুষের ভালোর জন্য করেছি। প্রতিটা দেশপ্রেমিক মানুষের এখন এই সরকারের বিরুদ্ধে পথে নামাটাই কর্তব্য।’
‘আপনি কি মুক্তি পেলে এসব রাষ্ট্রবিরোধী কাজ থেকে সরে দাঁড়াবেন?’
‘মোটেও না। আমি আমার কাজ চালায়া যাব।’
‘আপনার পরবর্তী কর্মসূচি কী?’
‘সেটা আমি আপনাকে বলব না।
‘মওলানা ভাসানীকে ছাড়া হয়েছে। শামসুল হককে ছাড়া হয়েছে। আপনাকেও তো ছাড়া হবে। আপনি বলেন, আপনি ভুল করেছেন।’
‘আমি এটা বলব না। আমার যা হয় হবে। দেশের জন্য আমি নিজেকে কোরবানি করে দিয়েছি।’
মে মাসের ২২-এর পরে জুলাইয়ের ১৪। আবারও ফরিদপুর জেলে ডিআইবি পুলিশ শেখ মুজিবের কাছে যায়। তাঁকে একই প্রকারে মুক্তির প্রলোভন দেখানো হয়। কিন্তু মুজিব মুসলিম লীগ সরকারের তীব্র সমালোচনা করা, জেল থেকে মুক্তি পেলে আরও সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করার কথা বলা থেকে বিরত থাকলেন না। মুচলেকা দিতে বরাবরের মতোই অস্বীকৃতি জানালেন।
বরাবরের মতোই কর্মকর্তারা, সে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটই হোক, আর ডিআইবির উপমহাপরিচালকই হোক, তাঁর আটকাদেশের মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়িয়ে দেওয়ার সুপারিশ করেন।
এভাবে অন্তত ছয়বার মুজিবের কাছে যান গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা। তাঁকে নোয়ানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু মুজিব অনমনীয়। তিনি ভাঙবেন, তবু মচকাবেন না। তিনি মুচলেকায় স্বাক্ষর করলেনই না। মুক্তি তাঁকে দেওয়াও হচ্ছে না। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের নব্য উপনিবেশের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তব্য দেওয়াও বন্ধ করলেন না। প্রত্যেকবার কর্তৃপক্ষ তাঁর আটকাদেশের মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়ানোর জন্যই সুপারিশ করল।