যারা ভোর এনেছিল – ৫০
৫০.
২৫-২৬ বছর বয়সী যুবক তাজউদ্দীন আজ ভেতরে ভেতরে কিছুটা উত্তেজিত। ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠেছেন তিনি। অথচ এত ভোরে না উঠলেও চলত। আজ ১১ মার্চ, আজ রাষ্ট্রভাষা দিবস। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ এই দিনে ছাত্র-জনতা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সাধারণ ধর্মঘট ডেকেছিল, মিছিলে ব্যারিকেডে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল, তারও পরে আক্রমণ চালিয়েছিল খাজা নাজিম উদ্দিনের পুলিশ বাহিনী। তিন বছর পর, এই ১৯৫১ সালে, সেই দিনটাকে আবার বিশেষভাবে স্মরণ করা দরকার।
১৯৪৯ সালে দিনটা তেমন করে পালিত হতে পারেনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ধর্মঘটের সমর্থনে আন্দোলন চলছিল তখন। গত বছর এই সময়টাতে চলছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। কলকাতার দাঙ্গার ঢেউ আছড়ে পড়ে ঢাকায়। তারপর ঢাকার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে, গ্রামগঞ্জে।
ফজলুল হক হলের কমনরুমে পত্রিকা পড়তে পড়তে তাজউদ্দীন সেসব কথাই ভাবছিলেন। ঢাকায় যেসব অবাঙালি শরণার্থী এসেছিল, দাঙ্গায় তাদের উৎসাহ ছিল বেশি। কারণ, ঢাকায় থাকার মতো বাড়িঘর পাওয়া যাচ্ছিল না, এমনকি বাসা ভাড়াও পাওয়া যায় না। হিন্দু পরিবার তাড়িয়ে তারা সেই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছিল। সারা দেশেও একই কারণে দাঙ্গা তথা গুন্ডামি ছড়িয়ে পড়ল। এটা ছিল হিন্দুদের জোতজমি, হালের গরু দখল করার একটা মোক্ষম উপলক্ষ।
এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বা ১৫০ মোগলটুলিকেন্দ্রিক ছাত্র-যুবারা আগে থেকেই সচেষ্ট আর সচেতন। তারা এবার ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করবে।
আজকের পত্রিকায় পশ্চিম পাকিস্তানের বেশ কিছু উত্তেজনাকর খবর আছে। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, যিনি আবার প্রতিরক্ষামন্ত্রীও, তাঁর নির্দেশে মেজর আকবর খান, ব্রিগেডিয়ার লতিফ, মিসেস আকবর খান, পাকিস্তান টাইমস-এর সম্পাদক কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে দুদিন আগে। আজ খবরের কাগজে আছে সেই খবরটা।
সামনে যুব কনভেনশন। মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ প্রমুখের সঙ্গে তাজউদ্দীনও এই যুব সম্মেলন সংগঠিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। গত রাতেও তাঁরা পশ্চিম ব্যারাকে গিয়ে যুব সম্মেলনের জন্য চাঁদা তুলেছেন। কাল রাতে শুতে শুতে তাই সোয়া ১১টা বেজে গিয়েছিল।
সামনে পরীক্ষাও। হল অফিস থেকে প্রবেশপত্র তুলেছেন গতকাল। খবরের কাগজ পড়ে নিজের রুমে এলেন তাজউদ্দীন। পরীক্ষার পড়া খানিকটা পড়ে রাখা ভালো। সামনের দিনগুলোয় তাঁর কাজ আরও বাড়বে। রাজনীতির কাজ। পড়াশোনা যতটা পারা যায়, এগিয়ে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। অর্থনীতি নিয়ে পড়ছেন তিনি। তাঁর রুমমেট মোজাফফর আলীও পড়ছেন অর্থনীতি নিয়ে।
রুমমেট একই বিষয়ের ছাত্র হওয়ায় তাজউদ্দীন আহমদের সুবিধা হয়েছে। তিনি নিজে সারা দিন ব্যস্ত থাকেন রাজনীতি নিয়ে। আজকাল অবশ্য তাঁর নিজের এলাকা কাপাসিয়ার বন বিভাগের সঙ্গে কী একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছেন। বন বিভাগের কর্মচারীরা যেসব অপকর্ম ও দুর্নীতি করে, তাজউদ্দীন তার প্রতিবাদ করছেন। তাদের ধরিয়ে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ফন্দিফিকির করছেন। প্রায়ই তাঁকে বন বিভাগের ঢাকা অফিসের উচ্চতর কর্মকর্তাদের কাছে যেতে হচ্ছে।
রুমমেট মোজাফফর আলীর পারিবারিক অবস্থা তেমন সচ্ছল নয়। বলা যায়, তিনি একজন সহায়-সম্বলহীন মানুষ। টিউশনি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চালান। উল্টো তাঁকে গ্রামে টাকা পাঠাতে হয়। তাজউদ্দীন আহমদ নিজেই গিয়ে দেখা করলেন প্রভোস্ট ড. এম এন হুদার সঙ্গে। তাজউদ্দীনকে অবশ্য প্রভোস্ট এম এন হুদা কিংবা হাউস টিউটর বি করিম খুবই পছন্দ করেন। ছেলেটা কথা বলে কম, কিন্তু কাজ করে যায় নীরবে। বোঝা যায়, চিন্তাভাবনা করে পথ চলে। তিনি যে ছাত্রনেতাদের মধ্যে অগ্রগণ্য, সেটা এই শিক্ষকেরা বোঝেন এবং তাঁর কথাকে মূল্য দেন।
এম এন হুদাকে তাজউদ্দীন বললেন, ‘স্যার, মোজাফফর আলীর ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড একটু বিবেচনা করতে হবে। ওর ইকোনমিক অবস্থা তো খুবই খারাপ। টিউশনি করে টাকা আয় করে। আবার বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয়। গত মাসে তো যা টিউশনি করে পেল, তার চেয়ে বেশি টাকা তাকে বাড়িতে পাঠাতে হয়েছে। আমাদের কাছে ধারকর্জ করতে হচ্ছে তাকে। আপনি স্যার ওর হলের ডাইনিং চার্জটা যদি মওকুফ করে দিতেন।’
এম এন হুদা তাকালেন তাজউদ্দীনের দিকে। ছেলেটার চোখ উজ্জ্বল। কিন্তু চশমা ঢাকা চোখেমুখে পড়াশোনার ছাপ। আজকালকার ছাত্রনেতারা সাধারণত অদ্ভুত অদ্ভুত দাবিদাওয়া নিয়ে আসে। এই ছেলেটা এসেছে তার রুমমেটের জন্য।
তিনি বললেন, ‘তুমি এক কাজ করো। মোজাফফরকে বলো আমার সঙ্গে দেখা করতে। একটা পিটিশন করতে হবে। আমি ওর সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি।’
তাজউদ্দীন এসে বললেন মোজাফফরকে, ‘আপনি প্রভোস্টের সঙ্গে দেখা করেন। আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলে এসেছি। আপনি গেলেই হবে।’
মোজাফফর আলী নিয়মিত ক্লাস করেন। সুন্দর করে নোট তুলে রাখেন। রাত নটা-দশটার দিকে তাজউদ্দীন হলে ফিরে এসে মোজাফফরকে বলেন, ‘কী কী পড়লেন একটু বোঝান দেখি।’
মোজাফফর যা পড়েছেন, তা থেকে যা বুঝেছেন, তা-ই বিবৃত করেন। তাজউদ্দীন মন দিয়ে শোনেন। মাঝেমধ্যে প্রশ্ন করেন। এইভাবে রাত ১১টা-১২টা পর্যন্ত একসঙ্গে পড়াশোনা করেন দুজন। পড়াশোনা কথাটা তাঁদের দুজনের বেলায় আক্ষরিক অর্থেই সত্য, মোজাফফর পড়েন, তাজউদ্দীন শোনেন।
আজ মোজাফফর বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু ক্লাস হবে না, রাষ্ট্রভাষা দিবসের ধর্মঘট, আমি একটু যাই। টিউশনিটা সারি। আমার ছাত্রের ম্যাট্রিক পরীক্ষা। মোজাফফর চলে গেলেন।
নিজের পড়াটা একটু এগিয়ে নিলেন তাজউদ্দীন। অর্থনীতি পড়তে তাঁর ভালো লাগে। তিনি অর্থনীতি বিষয়টা বেছে নিয়েছেন। কারণ তিনি জানেন, রাজনীতির ক্ষেত্রে অর্থনীতিটাই চালিকাশক্তি। অর্থনীতিটা বুঝতে হবে। তাহলেই দেশের মানুষের মুক্তির জন্য কী ধরনের রাজনীতি দরকার, সেটা বোঝা যাবে।
কুহু কুহু। কোকিলের ডাক শোনা যাচ্ছে। বসন্তকাল। জানালা দিয়ে বসন্তের বিখ্যাত দখিনা বাতাসও এসে ঢুকে পড়ছে ঘরে।
তাজউদ্দীনের একটুখানি উদাসমতো লাগে। এমনিতেই প্রচণ্ড গরম। শরীর ঘর্মাক্ত। এর মধ্যে এই বাতাসটা এসে যখন শরীরে ঝাপ্টা দেয়, খুবই আরাম লাগে।
নাহ। ওঠা যাক। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যাওয়া যাক।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট চলছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রসভা। আমগাছের ছায়ায় সমবেত হয়েছে ছাত্ররা। বসন্তের বাতাসে পাতারা নড়ছে। নড়ছে ছায়াও। তবু প্রচণ্ড গরম, সেটা মানতেই হবে। ছাত্রদের অবশ্য গরম-ঠান্ডা এই সব দিকে মোটেও খেয়াল নেই।
সভাপতিত্ব করলেন মুসলিম ছাত্রলীগের খালেক নেওয়াজ খান। হাবিবুর রহমান শেলী, বদিউর রহমান, মোহাম্মদ আলী বক্তৃতা করলেন। তাজউদ্দীন একটু মুখচোরা স্বভাবের। তিনি এসব সভায় বক্তৃতা করেন না সাধারণত।
বক্তাদের বক্তব্য বিষয় মোটামুটি এই রকম : ১৯৪৮ সালে খাজা নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়ে যে একটা চুক্তি হয়েছে, সেটা কেন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। নুরুল আমিন সরকার যদি এই চুক্তি বাস্তবায়ন না করার কথা ভাবে, তাহলে তার পরিণতি হবে ভয়ংকর। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করবে, তাদেরও ইতিহাস ক্ষমা করবে না। সারা দেশে যে অরাজকতা চলছে, দেশের মানুষ যে দুঃখ-কষ্ট ভোগ করছে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠা না করে আরবি অক্ষরে বাংলা লেখানোর যে অপপ্রয়াস চলছে, এসবের জন্য দায়ী অযোগ্য মুসলিম লীগ সরকার। তার প্রতিবাদে প্রাদেশিক আইন পরিষদের সব সদস্যের উচিত একযোগ পদত্যাগ করা।
আবদুল মতিন এক কোণে সভার শ্রোতাদের ভিড়ের মধ্যে বসে ছাত্রনেতাদের ভাষণ শুনছেন। তাঁর কোনো ভাষণই ভালো লাগছে না। তিনি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। ‘মাননীয় সভাপতি, আমি কিছু বলতে চাই।’
সভাপতি আবদুল মতিনকে কথা বলার অনুমতি দিলেন।
আবদুল মতিন বলতে লাগলেন, ‘শোনেন, কিছুদিন আগে ফজলুল হক হলের পশ্চিম-দক্ষিণ ব্যারাকে চায়ের দোকানে বসে ছিলাম। আমার পাশে টুলে বসে আছেন দুই ব্যক্তি, কথাবার্তা শুনে বেশভূষা দেখে আমি বুঝতে পারলাম, তারা সচিবালয়ের কর্মচারী। তাদের একজন আরেকজনকে বলছে, “ছাত্রদের আন্দোলন থেমে গেল। বাংলা আর রাষ্ট্রভাষা হচ্ছে না, উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হয়ে যাবে। আমরা উর্দু পড়তে পারি না। লিখতে পারি না। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে আমাদের তো খুব অসুবিধা হবে। কী আর করি। আমরা চাকরি করে খাই। আমরা তো আর আন্দোলন করতে পারব না। আন্দোলন করতে গেলে আমাদের চাকরি চলে যাবে। আন্দোলনে নামা তো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ছাত্ররা ছিল আশা-ভরসা। তারাও ঠান্ডা হয়ে গেল।”
‘সত্যি কি আমরা ঠান্ডা হয়ে যাইনি! মাননীয় সভাপতি, এইভাবে সভা করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা যাবে? আপনারা যা কিছু করছেন সবই তো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এতে কোনো কাজ হবে না। যদি বাংলা ভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান, তবে রাস্তায় আন্দোলনে নামুন। আপনারা সংগঠন গড়ে তুলুন।’
উপস্থিত ছাত্ররা বিপুল করতালিতে অভিনন্দিত করল এম এ মতিনের ভাষণ।
ছাত্ররা বলল, ‘পরে নয়, এখনই একটা কমিটি করুন।’
তখন একটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হলো। এম এ মতিনকেই আহ্বায়ক করা হোক, ছাত্ররা আওয়াজ তুলল। এম এ মতিনই আহ্বায়ক হলেন। তাজউদ্দীন আহমদকে ওই কমিটির একজন সদস্য রাখা হলো।
সভা শেষ হলে তাজউদ্দীন গেলেন মধুর দোকানে। গিয়ে দেখেন, সেখানে গন্ডগোল বেধে গেছে। কেউ ক্লাস করছে না। এ অবস্থায় চারজন ক্লাসে ছিল। এরা সবাই অবাঙালি। চারজনের মধ্যে আবার তিনজন বেরিয়ে এসেছে ক্লাস থেকে। কিন্তু জুবায়ের নামে একজন কিছুতেই ক্লাস থেকে বেরোবে না। সে আবার ড. শাদানির ভাগনে, তারই তেজ দেখাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখন সেও এসেছে মধুর চায়ের দোকানে।
ওয়াদুদ খেপে গেছে। সে জুবায়েরকে পারলে মারে। চিৎকার- চেঁচামেচি শুরু হলো, জুবায়েরও চিৎকার করছে। ক্লাসে এসেছি ক্লাস করতে। আমগাছতলায় গিয়ে আড্ডা মারতে তো আসিনি। ধর্মঘট করা তোমাদের অধিকার। না করা আমার অধিকার। এবার সব বাঙালি ছেলে যদি জুবায়েরকে মারতে আরম্ভ করে ও তো ছাতু হয়ে যাবে। তাজউদ্দীন প্রমাদ গুনলেন। তাড়াতাড়ি তিনি দাঁড়ালেন দুই পক্ষের মধ্যখানে।। শিক্ষকেরাও এলেন। একটা সম্ভাব্য খণ্ডযুদ্ধ এড়ানো গেল।
৫১.
দুই দিন পর এই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির বৈঠক বসল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাজউদ্দীন যোগ দিলেন তাতে।
বসন্তের এই দিনগুলো এই রকমই যাচ্ছে তাজউদ্দীনের। আজ এই সভা, কাল ওই সভা। মেডিকেল স্কুলের ছাত্ররা আন্দোলন করছে, তিনি ছুটে যাচ্ছেন সেখানে। আবার ফজলুল হকের বার্ষিক মিলাদ হবে, আবুল হাশিম সাহেব, কামরুদ্দীন আহমদ সাহেবকে অতিথি করে সেখানে আনার কাজটাও তিনি করছেন।
আবুল হাশিম সাহেব এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে চলে এসেছেন ঢাকায়। দাঙ্গার সময় তাঁর বর্ধমানের বাড়িঘর ভস্মীভূত হয়েছে। ইদানীং তিনি পুরোপুরি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে বর্ধমান ছাড়েন তিনি। কলকাতায় একসময় ছিল দোর্দণ্ড প্রতাপ। কত তাঁর ভক্ত-অনুসারী ছিল। পাকিস্তান হওয়ার পর মুসলিম লীগাররা তো সব পূর্ববঙ্গে চলে এসেছে। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির যাঁরা তাঁর ভক্ত ছিলেন, তাঁরাও কেউ তাঁকে আশ্রয় দিলেন না। আবার ফিরে গেলেন বর্ধমানে। এইখানে তাঁদের আছে বংশগত ঐতিহ্য। গ্রামের নাম ছিল কাশিয়ারা, আবুল হাশিমের বাবার নাম অনুসারে সেটা হয়েছে কাশিমনগর। গ্রামের গরিব প্রজারা বলল, ‘কর্তা, আপনি থেকে যান, আমরা থাকতে কেউ আপনার গায়ে হাত দিতে পারবে না।’ এই কথাতেই নাকি হাশিম সাহেব বেশি দুঃখ পেয়েছেন। এত দিন যাঁদের তাঁরা রক্ষা করে এসেছেন, এখন তাঁরাই তাঁকে অভয়বাণী দিচ্ছে। তাঁর সামন্ত অভিজাততান্ত্রিক মনে এটাই নাকি বেশি ব্যথা দিয়েছে।
আবুল হাশিম সাহেব, কামরুদ্দীন সাহেব তো মিলাদে এসেছিলেন, এসেছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও।
আবার একদিন দুপুরবেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলো বিশ্ববিদ্যালয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা। সভাপতিত্ব করলেন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান শেলী। খসড়া কমিটি একটা স্মারকলিপি পেশ করল। এই স্মারকলিপি সব এমএলএ আর এমসিএর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তাজউদ্দীন আহমদ হাতে নিলেন খসড়াটি। ইংরেজিতে রচিত :
সমীপেষু
সদস্য, গণপরিষদ
করাচি, পাকিস্তান।
জনাব,
আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যারা তিন বছর আগে পূর্ব বাংলায় ভাষার জন্য আন্দোলন শুরু করেছিলাম তারা বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে সেই লক্ষ্য অর্জনের বেশি দৃঢ়সংকল্প। আমরা সেই সব ছাত্র আপনাদের সবার করাচিতে একত্র হওয়ার উপলক্ষকে সামনে রেখে আরও একবার আমাদের ন্যায়সংগত দাবি পূরণের জন্য আপনাদের তাগাদা দেব।
.
অনেক বড় হয়েছে স্মারকলিপিটি। আরেকটু ছোট হলে ভালো হতো, তাজউদ্দীন ভাবলেন। যা-ই হোক, ছোটখাটো সংশোধনী শেষে খসড়াটা অনুমোদিত হলো।
পয়লা বৈশাখ পেরিয়ে গেল। বসন্তের বাতাস এখন পরিণত হচ্ছে কালবৈশাখীতে। গতকালও সারা দিন ধূলিঝড় হয়েছে। গরম খুব। আজ অবশ্য বাতাস বইছে মৃদুমন্দ। কিন্তু গরম কমছে না।
তাজউদ্দীন ফজলুল হক হলের ৭৬ নম্বর রুমে বসে ঘামছেন। হাতে একটা কাগজ। সেটা নেড়ে নেড়ে বাতাস করছেন। রুমে আরও কয়েকজন উপস্থিত। আবারও বসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা। আজ সভাপতিত্ব করছেন তাজউদ্দীন নিজে।
ইদানীং তাজউদ্দীন কথা বলতে শুরু করেছেন। একটু একটু করে সামনে আসছেন। যুবলীগের কমিটিতেও তাঁকে রাখা হয়েছে।
গত মাসে যুব সম্মেলনে এই কমিটি হয়। সম্মেলনের প্রস্তুতির জন্যও বেশ পরিশ্রম করেছেন তাজউদ্দীন। সম্মেলন হওয়ার কথা বার লাইব্রেরি মিলনায়তনে। কিন্তু সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। মিটিং করা যাবে না। রাতের মধ্যে সবাইকে খবর দেওয়া হলো জিঞ্জিরা বাজারে আসার জন্য। দুপুরে সভা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সন্ধ্যার পর সভা শুরু হয়। আসলে উদ্যোক্তারা পুলিশি হামলার আশঙ্কা করছিলেন। তাই বিকল্প ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত ছিলেন। কনভেনশনের উদ্বোধন করলেন ডেইলি অবজারভার-এর সভাপতি আবদুস সালাম। সভাপতিত্ব করেন সিলেটের মাহমুদ আলী। তিনি যথারীতি শেরওয়ানি আর পায়জামা পরে এসেছেন। তিনি আসলে ভক্ত মওলানা ভাসানীর। ভাসানী মুসলিম লীগ ছেড়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেছেন, মাহমুদ আলীও মুসলিম লীগ ছেড়ে দিয়েছেন।
পুলিশের লোকজন গিজগিজ করছে।
রাত ১০টায় সভা থেকে বেরিয়ে প্রতিনিধিরা আলাদা আলাদা চারটা নৌকায় উঠলেন। পুলিশ কিছু বুঝতে পারল না। মাঝনদীতে গিয়ে চার নৌকা একত্র হলো। একসঙ্গে বাঁধা হলো নৌকা চারটাকে। ১৪৪ ধারা ফাঁকি দিয়ে চাঁদের আলোর নিচে বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসতে ভাসতে অনুষ্ঠিত হলো যুবলীগের প্রতিনিধি সম্মেলন। রাত ১১টায় এ সম্মেলন শুরু হলো। একটা করে জাহাজ যায়। পানিতে ঢেউ ওঠে। নৌকা ওঠে দুলে। আলোচনার গাম্ভীর্য আর গুরুত্ব তাতে একটুখানি টলে না।
খসড়া গঠনতন্ত্র অনুমোদিত হলো। মাহমুদ আলীকে সভাপতি আর অলি আহাদকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠন করা হলো এর কমিটি। তাজউদ্দীনকেও রাখা হলো এই যুবলীগের কার্যকরী পরিষদের সদস্য হিসেবে।
নৌকাগুলো ভাসতে ভাসতে চলে গেল অনেকটা ভাটিতে। আবার উজানপথে চলতে শুরু করল বোটগুলো। আলোচনাও চলতে লাগল উজানপথে পূর্ব বাংলার মানুষের দাবিদাওয়াগুলো কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে, তা নিয়ে।
রাত আড়াইটায় নৌকা ভিড়ল মিটফোর্ড ঘাটে। সহকর্মীদের সঙ্গে নেমে পড়লেন তাজউদ্দীনও। ঘোড়ার গাড়ি করে এলেন ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে। চা খেলেন।
তারপর ফিরে এলেন হলে।
সে রাতে তাজউদ্দীনের আর কিছু খাওয়া হলো না। ভোরবেলা শুতে গেলেন।
সে রাতে তিনি হলেন যুবলীগের সদস্য, আজ তিনি সভাপতিত্ব করছেন রাষ্ট্রভাষা কমিটির সভায়।
তাজউদ্দীনের মনে হচ্ছে, এর আগে যে স্মারকলিপি এমএলএ আর এমসিএদের পাঠানো হয়েছিল, সেটা বেশি বড় হয়ে গিয়েছিল। এ ধরনের ব্যস্ত মানুষের জন্য স্পষ্ট কথা সংক্ষেপে পেশ করা ভালো। এর একটা সহজ উপায় আছে। তা হলো, সবাইকে টেলিগ্রাম পাঠানো। তাতে আসল কথাটা তাঁদের কাছে দ্রুত গিয়ে পৌঁছাবে। টেলিগ্রাম বলে তাঁরা ফেলেও দেবেন না, পড়ে দেখবেন।
এই প্রস্তাবই তিনি পেশ করলেন এই সভায়।
তাঁর প্রস্তাব গৃহীত হলো।
টেলিগ্রামের একটা খসড়াও তৈরি করে ফেলা হলো :
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আপনাদের কাছে জরুরি আবেদন জানাচ্ছে যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে শর্ট নোটিশ প্রশ্ন উত্থাপন করুন।’
টেলিগ্রামটা পাঠানোর দায়দায়িত্ব ভাগ করে দিয়ে সেদিনের মতো সভার কাজ শেষ হয়।
৫২.
তাজউদ্দীন আহমদ ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে পৌঁছে দেখলেন, মওলানা ভাসানী আগেই পৌঁছে গেছেন। ভোরবেলা। ছয়টা পাঁচ মিনিটে ট্রেন। বৈশাখ মাস শেষে জ্যৈষ্ঠ আসি আসি। কাল প্রচণ্ড রোদ ছিল। আজ সকালটা মেঘলা মেঘলা। মনে হয়, একটু পরে বৃষ্টি হবে।
আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকও এসেছেন। এরই মধ্যে আরও কয়েকজন কর্মী তাঁদের ঘিরে ধরেছেন।
তাজউদ্দীন আহমদ ভাসানীকে সালাম জানালেন।
‘ট্রেন ঠিক সময়ে ছাড়ব তো? খোঁজ নিছ?’ ভাসানী বললেন।
তাজউদ্দীন একজন কর্মীকে পাঠালেন স্টেশনমাস্টারের কাছে।
এই সময় একজন অপরিচিত লোক এসে ভাসানীকে সালাম দিলেন। বললেন, ‘হুজুর, আমার ওপরে অর্ডার হইছে, আপনার মৈশনের মিটিং আমিই রিপোর্ট করব।’
মওলানা বললেন, ‘করো। তোমার কাম তুমি করবা, আমার কাম আমি করব।’
লোকটা হাত কচলে কাচুমাচু ভঙ্গিতে বললেন, ‘আপনাদের সঙ্গে আমার যাওয়ার আর ফেরার ব্যবস্থা করে দিয়েন।’
মওলানা বললেন, ‘তুমি মিয়া তোমার পা দিয়া যাইবা, আমরা যামু আমগো পা দিয়া। ব্যবস্থা তো আল্লাহতালাই কইরা রাখছে। তাজউদ্দীন, দেখো, কী ব্যবস্থা করতে পারো। ডিআইবির লোক। আমাগো সঙ্গে যাওনের ডিউটি পড়ছে বেচারার ওপরে।’
ট্রেন ছাড়ল যথাসময়েই।
মওলানার এই জনসভাটা তাজউদ্দীনই আয়োজন করেছেন। তাঁদের এলাকার কাছে হবে জনসভাটা। এলাকার লোকজন এসে ধরেছিল, তারা ভাসানীকে তাদের এলাকায় মিটিংয়ের জন্য নিয়ে যেতে চায়। তাজউদ্দীনই ভাসানীর কাছে নিয়ে গেছেন তাদের। জনসভার তারিখ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এমনকি লিফলেট লিখে দিয়েছেন। শামসুল হককেও তিনিই বলেছেন। মুজিব ভাই বাইরে থাকলে তাঁকেও বলতেন জনসভায় যেতে। মুজিব ভাই ভাষণটা খুব ভালো দেন।
ট্রেন ঠিক ছয়টা পাঁচ মিনিটেই ছাড়ল। ভাসানীকে উঠিয়ে দিয়ে শামসুল হক সাহেবের পেছন পেছন তাজউদ্দীন উঠে পড়লেন ট্রেনে। আর সবাই উঠল। ডিআইবির সদস্যও উঠে পড়লেন। ট্রেন টঙ্গী পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই শুরু হলো প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি। টঙ্গী স্টেশনে ট্রেন থামল। শামসুল হক বললেন, ‘আমি নেমে যাব।’
তাজউদ্দীন বললেন, ‘নেমে যাবেন মানে?’
শামসুল হক বললেন, ‘আমি ফিরতি ট্রেনে ঢাকা ফিরে যাব।’
‘কেন?’
‘দরকার আছে।’
‘কী দরকার।’
‘আছে।’ বলে তিনি ট্রেন থেকে সত্যি সত্যি নেমে গেলেন।
তাজউদ্দীন বিস্মিত। ইদানীং শামসুল হকের ভাবভঙ্গি একটু ছাড়া ছাড়া। একটু ধার্মিক হয়ে পড়ছেন। আবুল হাশিম সাহেবও খেলাফতে রাব্বানি নামের দল করার কথা বলছেন। বর্ধমানে বাড়ি পোড়ার পর ভিটেমাটি ছেড়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে মানুষের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া এই একদা বামপন্থী বলে পরিচিত লোকটা এখন রবের খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য বইপুস্তক লিখছেন। শামসুল হক আগে থেকেই তাঁর ভক্ত ছিলেন। সত্যি বলতে কি, আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম দিনের ইশতেহারে আবুল হাশিমের এই সব আধ্যাত্মিক লাইনের তত্ত্ব অনেকটাই প্রতিফলিত হয়েছিল।
শামসুল হকের আরেকটা পিছুটান আছে। তা হলো তাঁর স্ত্রী। তিনি ইডেন কলেজের ইংরেজির শিক্ষিকা। আফিয়া খাতুন। আফিয়া খাতুনের বাবা নরসিংদীর সেকান্দর মাস্টার। আফিয়া খাতুন নবাবপুর রোডে বাসা নিয়েছেন। তাঁদের একটা মেয়ে হয়েছে।
কামরুদ্দীন সাহেব তাজউদ্দীনকে বলেন, ‘আফিয়া খাতুনকে বিয়ে করায় শামসুল হকের অর্থনৈতিক অসুবিধা কমে গেছে। কিন্তু স্বাধীনতাও কমছে সেই সঙ্গে। কারণ আফিয়া চান, তাঁর স্বামী সংসারের দায়িত্ব পালন করুন। তিনি চান, শামসুল হক উকিল হোক। টাকাপয়সা আয় করুক। সমাজে পরিচয় দেওয়ার মতো একটা অবস্থানে আসুক। সব রাজনীতিবিদই তো আইন ব্যবসায় ভালো, সোহরাওয়ার্দী সাহেব, ফজলুল হক সাহেব, আতাউর রহমান খান, কামরুদ্দীন সাহেব—শুধু শামসুল হক কেন কিছু করবেন না। এই পিছুটানে শামসুল হক কিছুটা দিশেহারা। অন্যদিকে দেখো, শেখ মুজিবের স্ত্রী। তিনি কোনো দিনও মুজিবকে পেছনের দিকে টানেননি। স্বামীর সব কাজেই তিনি হ্যাঁ বলে দিয়ে রেখেছেন।’
শ্রীপুর স্টেশনে নামলেন সবাই। তখন কেবল সাড়ে সাতটা। তাঁরা ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের বাংলোয় গিয়ে উঠলেন বৃষ্টিভেজা পথ বেয়ে। লুঙ্গি তুলে ভাসানী হাঁটছেন। তাঁর এসব কর্দমাক্ত পথে হাঁটার দিব্যি অভ্যাস আছে।
বেলা ১১টা পর্যন্ত তাঁরা ওই ডাকবাংলোতেই অপেক্ষা করলেন। কারণ, আগে থেকে গাড়ির কোনো ব্যবস্থা করে রাখা হয়নি। তাজউদ্দীন ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন গাড়ির ব্যবস্থা করতে। সাড়ে ১২টার দিকে তিনটা মোষের গাড়ি এল। মওলানাসহ ঢাকা থেকে আগত নেতা-কর্মীদের গাড়িতে তুলে দিলেন তাজউদ্দীন। গাড়ি রওনা হলো। আর নিজে চললেন হেঁটে।
আড়াইটায় তাঁরা পৌঁছালেন গোসিংগা। সেখান থেকে সাড়ে চারটায় মোষের গাড়ি পৌঁছাল দেওনা কাচারি। এরপর আর গাড়ি যাবে না। মওলানাও নামলেন। প্রায় ৬৫ কি ৭০ বছর বয়স মওলানার। হাঁটতে লাগলেন সবার আগে। এক ঘণ্টা হেঁটে তাঁরা পৌঁছালেন মৈশনের মিয়াবাড়ি। এখানেই তাঁদের জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিকেল সাড়ে চারটায় তাঁরা দুপুরের খাবার খেলেন।
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় শুরু হলো জনসভা। মাইক্রোফোনে আওয়াজ হচ্ছে দারুণ। সকাল ১০টার পরে ঝড়বৃষ্টিও গেছে থেমে। আবহাওয়া অতি মনোরম। তাজউদ্দীন মাইকে ঘোষণা দিলেন, এবার বক্তব্য রাখবেন মজলুম জননেতা, সংগ্রামী জননেতা অনলবর্ষী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী…
ভাসানী সারা দিনের ধকলের পর দাঁড়িয়ে মাত্র দেড়টা ঘণ্টা একটানা ভাষণ দিলেন। মুসলিম লীগের দুঃশাসন যেন পুড়ে ছাই হয়ে যাবে মওলানার অগ্নিবচনের উত্তাপে। সমস্ত জনসভা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনল তাঁর বক্তৃতা।
রাত্রিবাস হলো ওখানেই। পরের দিন মিয়াবাড়িতে নাশতা করে সবাই মিলে রওনা দিলেন হেঁটে। সকাল আটটার দিকে। তাজউদ্দীন আহমদের বাড়ি পৌঁছাতে লাগল আড়াই ঘণ্টা।
দই খেয়ে আধঘণ্টা জিরিয়ে নিয়ে মোষের গাড়িতে করে তাঁরা রওনা দিলেন শ্রীপুর স্টেশনের দিকে।
৫৩.
চার কি পাঁচ বছরের হাসু যেন একটা বিশাল খেলাঘর পেয়ে গেছে। ফ্রকের কোনা ধরে আঙুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে সে তাকায় গোপালগঞ্জের থানা চত্বরের দিকে। লাল রঙের ইটের দালান, লাল রঙের টিনের ছাদ। এটা ঠিক যেন একটা পুতুলের বাড়ি। বাড়িটা একটু বড়, এই যা! পুতুলগুলোকেও তো তাহলে বড় হতে হবে। কত বড় পুতুল হলে এত বড় ঘরবাড়িগুলোয় মানিয়ে যাবে। মাঠটাও কত বড় আর সবুজ। গাছপালাগুলোও পুতুলের বাড়ির গাছপালা। তাদের টুঙ্গিপাড়ার বাড়ির সামনেও মাঠ আছে, গাছপালা আছে। কিন্তু তাদের বাড়ির গাছগুলোর নিচটা তো এমন সাদা রং করা নয়।
মা বললেন, ‘হাসু, আমরা গোপালগঞ্জ যাচ্ছি। তোমার আব্বার সাথে দেখা করতি।’
হাসুর মনের মধ্যে তখন গোপালগঞ্জের একটা কল্পনার ছবি আঁকা হয়ে যায়। এর আগেও সে গোপালগঞ্জ গেছে, সেবারও আব্বাকেই দেখতে। কিন্তু তখন সে ছিল খুব ছোট, তার কিচ্ছু মনে নেই। এবার তার মনে হয়েছিল, টুঙ্গিপাড়ার বাইগারখালের পাড়ে, একটা কঞ্চি হাতে নিয়ে যখন সে ছাগলছানাগুলোর পেছনে ছুটছিল, ছাগলছানার গলায় ঘুঙুর পরানো ছিল বলে ঝুমঝুম আওয়াজ হচ্ছিল, সেই আওয়াজ থেকে তার মনটাকে সরিয়ে নিল তার চোখ। একটা ঝলমলে হলদে-কালো প্রজাপতি ওই মধুর গাছের সাদা সাদা ছোট ফুলের ওপরে ছটফটে পাখা মেলে ওড়াউড়ি করছে। হাসু তার পিছু নিল, সেখান থেকে তার চোখ পড়ল গিয়ে চোরকাঁটায় ভরা দূর্বা ছাওয়া মাঠটাতে। তার বন্ধু, সমবয়সী রানু বলল, ‘হাসু দেখ দেখ, এইখানে ফড়িংয়ের বাজার বসছে, এই বাজার গোপালগঞ্জ টাউনের বাজারের সমান।’
তখনই হাসুর মনে পড়ল, তারা গোপালগঞ্জ যাচ্ছে, আব্বাকে দেখতে। তার মনে হলো, গোপালগঞ্জের সবকিছু পোড়ামাটির তৈরি—বাড়িঘরগুলো পোড়ামাটির, রাস্তাঘাটগুলো পোড়ামাটির, যেমন পোড়ামাটিতে হয় কলসি, হাঁড়িকুড়ি, শানকি, তেমন। এইটা মনে হওয়ার কারণ, গোপাল নামের একজন কুমার তাদের বাড়ি বাঁক বয়ে নিয়ে আসত লাল লাল মাটির হাঁড়ি। নৌকায় করে টুঙ্গিপাড়া থেকে আসার পথে, খাল থেকে নদীতে পড়ার সময়ে শাপলার ফুল ধরে হাসু টান দিয়েছিল। দাদা লুৎফর রহমান আঁতকে উঠেছিলেন, ‘হাসি, পইড়ে যাবি তো! মাঝখানে বস।’ মা হাসুকে টেনে কোলের কাছে নিয়েছিলেন। আর ছোট্ট কামাল, শাপলার সাদা দল দেখে মুগ্ধ। বারবার ওই দিকে আঙুল তুলে বলছে, ‘ফুল দেও, ফুল দেও।’ দাদি তাকে কোলে ধরে রেখেছেন। চঞ্চল ছেলে আবার পানিতে পড়ে না যায়।
দাদা-দাদি, মা, হাসু—সবাই মিলে তারা চলেছে গোপালগঞ্জে— আব্বাকে দেখতে।
গোপালগঞ্জে তাদের বাসা আছে, আদালতপাড়াতেই। কাজেই তাদের কোনো অসুবিধা হবে না।
আব্বা থানার মধ্যে একটা ঘরে বসে আছেন। বারান্দায় পুলিশ, ভিড় ঠেলে সামলাতে পারছে না। মুজিব ভাই এসেছে, আজকে তাঁর মামলার তারিখ পড়েছে, শুনেই কর্মীর দল আর সাধারণ মানুষ ভিড় করছে তাঁকে একটা নজর দেখার জন্য। মুজিবের বয়স ৩২-এর মতো। তিনি পরে আছেন ফুলহাতা শার্ট আর পায়জামা।
হাসুকে হাতে ধরে আর কামালকে কোলে নিয়ে হাসুর মা রেনু ঢোকেন ওই ঘরে। পুলিশ আর গোপালগঞ্জের আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতারা তাদের এগিয়ে দেন। পেছনে পেছনে মাথায় লম্বা ঘোমটা দিয়ে আসেন হাসুর দাদি। দাদা একটু পিছে পড়েছেন। ছেলে তার ছোটবেলায় খুব সল্টেড বিস্কুট খেতে পছন্দ করত, যখন সে ছিল এই গোপালগঞ্জে, আর পড়েছে মিশন স্কুলে, তখন তাকে অনেক দিন তিনি সল্টেড বিস্কুটের প্লাস্টিকের প্যাকেট কিনে দিয়েছেন। লুৎফর রহমান দুটো বিস্কুটের প্যাকেট কিনে আনেন। ছেলেরা যে বড় হয়ে যায়, বাবা-মা অনেক সময় সেটা বুঝতেও পারেন না।
রেনু বলে, ‘এই যে দেখো তোমার কামাল, কত বড় হয়েছে। কত কথা বলে। নেও, কোলে নেও।’ কামালকে মুজিব কোলে নেন। চুমু দিয়ে গালটা নেড়ে বলেন, ‘কেমন আছো, বাবা।’
এর মধ্যে হাসু কাছে আসে, ‘বলে, আব্বা, এখানে গাছগুলোর নিচে সাদা কেন?’
মুজিব তখন হাসুর দিকে তাকান। ‘আরে, আমার মেয়েটা তো অনেক বড় হয়ে গেছে।
আসলেই মুজিব অনেক দিন হাসুকে দেখেন না। প্রায় দুই বছর। এর মধ্যে হাসুর বয়স ডাবল হয়ে গেছে।
হাসু বলে, ‘আব্বা, আপনিও বড় হয়ে গেছেন।’
রেনু বলেন, ‘আম্মাও এসেছেন। কথা বলো। আম্মা ঘোমটাটা একটু সরান। আপনার ছেলে আপনার মুখ দেখবে না!’
‘মা কাছে আসো।’ মুজিব ডাকেন মাকে। এগিয়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরেন।
সায়রা খাতুন, মুজিবের মা, ছেলেকে হাতের মধ্যে পেয়ে অশ্রু সংবরণ করতে পারেন না। একবার অস্ফুট কণ্ঠে তিনি বলতে পারলেন, ‘খোকা, ভালো আছিস বাবা?’
রেনু কিন্তু কাঁদবেন না। তিনি শক্ত হয়ে থাকবেন। মুজিবের সঙ্গে তাঁর এইটাই চুক্তি। তিনি বলেছেন, ‘তুমি শুধু আমার জন্য ভাববা না, তুমি সারা দেশের জন্য ভাববা। মানুষের জন্য কাজ করবা।
এখন চোখের জল ফেলে মুজিবকে সেই ব্রত থেকে সরাবেন না রেনু। তিনি শক্ত হয়ে থাকেন।
মুজিব বলেন, ‘রেনু, কেমন আছো?’
‘ভালো আছি আল্লাহর ইচ্ছায়। তোমার স্বাস্থ্য দেখি খুব খারাপ হয়ে গেছে।’
একটা কাশি দিয়ে মুজিব বলেন, ‘আরে না, একটু ঠান্ডা লেগেছে। মুজিব আসলে সত্য গোপন করছেন। তাঁর কাশিটা বেশ মারাত্মক। ব্রঙ্কাইটিসের মতো হয়েছে তাঁর। শুকনো কাশির সঙ্গে রক্তও পড়ছে। এসব কথা তিনি এখন বলবেন না। রেনু মন খারাপ করবে, মা আরও কাঁদবেন।
ভিড় বাড়ে। হাসু আর কামাল চলে যায় পাশের টিনে ছাওয়া ভবনটার বারান্দায়। কী বড় মাঠ। আর দিঘির জলটা কত শান্ত। দেখলেই শরীরটা ঠান্ডা হয়ে যায়। আরে আশ্চর্য, সেই হলুদ-কালো প্রজাপতিটা টুঙ্গিপাড়া থেকে কী করে এল গোপালগঞ্জে।
হাসু অবাক হয়ে ভাবে, গোপালগঞ্জটা মোটেও তার কল্পনার মতো নয়। এখানে পোড়ামাটি দিয়ে বানানো ঘরদোর, রাস্তাঘাট নাই।
কামাল আর হাসু মিলে প্রজাপতির পেছনে পেছনে ছুটে বেড়ায়। নীলচে সবুজ কতগুলো কাঁটাগাছ। তার ডগায় হলুদ ফুল। প্রজাপতি একটা নয়, কয়েকটা। তারা ফুলের গায়ে বসছে, কিন্তু ধরতে গেলেই উড়ে যাচ্ছে।
থানার এই ভবনটার পিড়িলি ঘেঁষে পরাটার গাছ। ছোট ছোট পানপাতার মতো পাতা। পুঁতির মতো গোল গোল সবুজ তার ডগার দিকটা। ওই পাতায় চাপ দিলে তেলের মতো বেরোয়। তাই বাচ্চারা ওটাকে বলে পরাটার গাছ।
সেই গাছ থেকে পাতা তুলতে তুলতে হাসু বলে, ‘কামাল চল, রান্নাবাটি খেলি।’
তারা রান্নাবাটি খেলার জন্য নানা ধরনের ফুলপাতা, কলসির কানা, ইটের গুঁড়ো নিয়ে জমা করে বারান্দার লাল মেঝেতে।
পাশের দেয়াল বেয়ে সার বেঁধে যাচ্ছে কালো পিঁপড়ের দল।
‘আচ্ছা চল, কামাল, আবার আব্বাকে দেখে আসি।’
‘চলো।’
ওই সবুজ মাঠের মধ্যে দৌড়ে আবার তারা দুই ভাইবোন ওঠে সেই ঘরের বারান্দায়, যেখানে আব্বা আছেন।
হাসু বাবার কাছে যায়, ‘আব্বা আব্বা, আমরা রান্নাবাটি খেলি।’ কামালও বলে, ‘রান্নাবাটি খেলি।’
‘খেলো মা, যাও।’ মুজিব সালাম খান সাহেবের সঙ্গে কথা বলেন। সালাম খানও এই মামলার আসামি। আবার তিনি অ্যাডভোকেটও।
হাসু আর কামাল ফের চলে আসে তাদের বিশাল খেলাঘরটার বারান্দায়। ‘যা কামাল, তুই নদীতে ডুব দিয়ে আয়, ওই সিঁড়িটা হলো নদী, সেখানে গিয়া বল হাপুস, এই তো একটা ডুব হলো…আমি রান্না করি, এইটা তো ভাত, ওইটাতে মাছ, এইটা, এই লাল ইটের টুকরা হলো গোশত…’
আরেকটু খেলে হাসু বলে, ‘কামাল, চল, আবার যাই আব্বাকে দেখে আসি।’
কামাল বলে, ‘হাসু আপা, তোমার আব্বাকে একটু আব্বা বলে ডাকি…’ হাসু বিস্মিত হয় না। তার এই দুই-আড়াই বছরের ভাইটা আব্বাকে তো কমই দেখেছে। আব্বাকে সে বাসায় কোনো দিনও পায়নি। আব্বা সব সময়ই জেলখানায়। আব্বাকে তো আব্বা বলে ডাকার সুযোগই পায়নি।
হাসু বলে, ‘চল চল। উনি কি খালি আমার আব্বা নাকি? পাগল। তোরও তো আব্বা।’
তারা দৌড়ে যায় মুজিবের কাছে। হাসু বলে, ‘আব্বা, কামাল কী বলে জানো, কামাল বলে’, দৌড়ানোর কারণে হাসু হাঁপাচ্ছে, ‘কামাল বলে, হাসু আপা, তোমার আব্বাকে একটু আব্বা বলে ডাকি।’
আব্বা উঠে কামালকে লুফে কোলে তুলে নেন। আব্বা বলেন, ‘কামাল আব্বা, আমাকে দেখো নাই তুমি, আমি বাড়ি আসি না, আমি তো তোমারও আব্বা…’
অনেক চুমু দেন তিনি ছেলেকে।
হাসু গিয়ে বাবার জামার কোনা ধরে। ‘বলছি না আব্বা তোমারও আব্বা, ডাকো আব্বা বলে, বলো, আব্বা আমরা এখন খেলতে যাই?’
কামাল ছোট মুখে লজ্জা ফুটিয়ে বলে, ‘আমরা খেলতে যাই…’, আব্বা সে বলতেই পারে না।
মুজিব বলেন, ‘বাবা, আমি তোমার আব্বা হই। বলো, আব্বা।’
কামাল বলে, ‘আব্বা।’
মুজিব তাকে কোলে তুলে নেন।
তখন আকাশে একখণ্ড সাদা মেঘ সূর্যকে এক লহমার জন্য ঢেকে দেয় আর একটা ছায়া গোপালগঞ্জ থানার ওপরে একবার পাখা বিস্তার করে পরক্ষণেই রোদের ঝলক বইয়ে দেয়। কামাল কোল থেকে নেমে যায়।
মুজিব চশমা খোলেন। রুমাল হাতে নেন। চশমার কাচ ঘোলা হয়ে এসেছে। তিনি কাচ মোছেন।
হাসু আর কামাল আবার সবুজ মাঠের মধ্যে খেলতে থাকে।
৫৪.
ঢাকা কারাগারের ভেতরে জেল হাসপাতালের বেডে বসে শেখ মুজিব চিঠি লিখছেন। একটা চড়ুই পাখি তাঁর সেলের ভেতরে ঢুকে কিচিরমিচির করল খানিক। শেখ মুজিব পাখিটার দিকে তাকালেন। পাখিটা মনের সুখেই গান গাইছিল বোধ হয়। এবার টের পেল, সে বন্দী। তার বেরোনোর পথ জানা নাই। পাখিটা কোন দিক দিয়ে ঢুকেছিল, শেখ মুজিব খেয়াল করেন নাই। জানালায় একটা পর্দা লাগানো। চড়ুইটি কি সেই পর্দা পেরোনোর পথ পাচ্ছে না। শেখ মুজিব উঠে পর্দাটা টেনে ফাঁকা করে দিলেন। একঝলক আলো এসে ঢুকল প্রকোষ্ঠের ভেতরে।
চড়ুইটা উড়ে চলে গেল।
মুক্তির আনন্দ!
শেখ মুজিবকে কিছুতেই ছাড়ছে না সরকার।
ফরিদপুর কারাগার থেকে তাঁকে ঢাকা আনা হয়েছে। কারণ, তাঁর শরীরটা খুবই খারাপ। কাশি, সর্দি এসব তো আছেই। তার ওপর তাঁর বুক ব্যথা করে। হৃৎপিণ্ডে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না, আল্লাহ জানেন। হৃদযন্ত্রের ব্যাধিতে কি তিনি এই কারাগারেই মরে পড়ে থাকবেন? মরতে তিনি ভয় পান না। আল্লাহ যেদিন মরণ লিখে রেখেছেন, তার আগে তো আর মৃত্যু আসবে না। কিন্তু তাঁর ভয় হলো, তাঁর কাজগুলো তাঁকে শেষ করে যেতে হবে। কাজ শেষ না করে তিনি মরতে পারেন না।
পার্টির সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের স্ত্রী আফিয়া খাতুন তাঁকে কয়েকটা চিঠি লিখেছেন। তিনি উত্তর দেননি। শরীরটা ভালো নয়। তার ওপর এত টানাহেঁচড়া। একবার ফরিদপুর থেকে গোপালগঞ্জ, গোপালগঞ্জ থেকে ফরিদপুর করলে ছয় দিন শুধু যাতায়াতেই চলে যায়। যা-ই হোক, অনেক লেখালেখি করে অবশেষে তাঁকে ফরিদপুর থেকে ঢাকা কারাগারে আনা হয়েছে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে। তাঁর চোখের ব্যারাম বেড়েছে। সারাক্ষণ চোখ দিয়ে পানি পড়ে।
তিনি শামসুল হককে চিঠি লিখতে বসেন :
এস এম রহমান
সিকিউরিটি প্রিজনার
সেন্ট্রাল জেল
ঢাকা। ১২/৯/৫১
হক সাহেব,
আমার আদাব নেবেন। ভাবির চিঠি মাঝে মাঝে ফরিদপুরে পাইতাম। সকল সময় উত্তর দিতে পারা যায় না, তাহা আপনি বুঝতে পারেন। গোপালগঞ্জের মামলা আজও শেষ হয় নাই। তবে চিকিৎসার জন্য ঢাকা এনেছে। রোগমুক্ত হলেই আবার যেতে হবে। যাহা হউক, ভাবিকে বলেন শীঘ্রই চিঠির উত্তর দিব, তাহাকে ভাবতে নিষেধ করবেন। ভয়ের কোনো কারণ নাই। আমি জানি, আমি মরতে পারি না, বহু কাজ আমার করতে হইবে। খোদা যাহাকে না মারে মানুষ তাহাকে মারতে পারে না।
নানা কারণে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি, আমার কোনো কিছুর দরকার নাই। যদি দুই-একখানা ভালো ইতিহাস বই অথবা গল্পের বই পাঠাতে পারেন সুখী হব।
বহুদিন মওলানা সাহেবের কোনো সংবাদ পাই নাই, এখন কেমন আছেন এবং কোথায় আছেন জানালে সুখী হব। আপনার শরীর কীরূপ, বন্ধুবান্ধবদের আমার সালাম দিবেন, কোনোরকম ভয়ের কারণ নাই, তাদের জানাবেন। আমি শীঘ্রই আরোগ্য লাভ করব বলে আশা রাখি, বাকি খোদা ভরসা। কলেজটা চলছে জেনে সুখী হলাম। মানিক ভাই ও ইয়ার মোহাম্মদের ওপর কলেজের ভার সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়ে আপনি অন্য কাজ করবেন, তাহা হইলে ভালো হবে।
ভাবিকে চিঠি দিতে বলবেন।
ইতি
আপনার মুজিবুর
এনবি: গোপালগঞ্জ মামলার তারিখ ১৯ অক্টোবর। শরীর ভালো হলে পাঠাবে আর ভালো না হলে পাঠাবে না। তবে ঐ তারিখেই সমস্ত সাক্ষী আসবে বলে মনে হয়। কারণ, তিন মাস পরে তারিখ পড়েছে। কোর্ট সকল কিছুর বন্দোবস্ত না করে আর তারিখ ফেলে নাই। চিঠিটা মানিক ভাইকে দিবেন।
এই চিঠিটা লিখে মুজিব আরেকটা চিঠি লিখতে বসেন তফাজ্জল হোসেন মানিককে।
ঢাকা জেল
ঢাকা।
১২-৯-৫১
মানিক ভাই,
আমার সালাম নিবেন। আমার মনে হয়, আপনারা সকলে আমার জন্য একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। চিন্তার কোনো কারণ নাই। আমি জেল হাসপাতালে ভর্তি আছি।
চিকিৎসার চেষ্টা খুবই হইতেছে। হাসপাতালে কিছুদিন থাকতে হবে বলে মনে হয়। কারণ, শরীরের অবস্থা এখনো উন্নতির দিকে যায় নাই।
আতাউর রহমান সাহেব দেখা করতে এসেছিলেন। ফেডারেল কোর্ট করা যায় কি না আর করিবে কি না? জনাব সুরাওয়ার্দি সাহেব তো পিন্ডি মামলা নিয়া ব্যস্ত। কে মামলা পরিচালনা করিবেন। আপনি সুরাওয়ার্দি সাহেবের কাছে চিঠি লেখে জানুন, তিনি করতে পারবেন কি না আর তা না হলে অন্য কাহাকে দিয়া মামলা পরিচালনা করার কোনো অর্থ হবে বলে আমার মনে হয় না। আপনারা বাহিরে আছেন, ছালাম সাহেব, আতাউর রহমান সাহেব ও অন্যান্য সকলের সাথে পরামর্শ করে যাহা ভালো বোঝেন, তাহাই করিবেন। আমার কিছু বলার নাই।
শুনে সুখী হবেন, সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। কারণ, কত দিন বাবার পয়সার সর্বনাশ করা যায়। আর শরীরের অবস্থাও ভালো না। কারণ, হঠাৎ ঢাকা জেলে আসার পর থুতুর সাথে পরপর তিন দিন রক্ত পড়ে, তবে সে রক্ত সর্দি শুকাইয়াও হতে পারে, আবার হাঁচি খুব বেশি হয় বলে অনেক সময় গলা দিয়ে রক্ত পড়তে পারে আর কাশের সাথেও হতে পারে। তাই নিজের থেকেই হুঁশিয়ার হওয়া ভালো। কতকাল থাকতে হয় ঠিক তো নাই। এক্স-রে করার কথা বলেছি। তবে সরকারের কাছে সকল সময়ই খুব সময় লাগে। কবে এক্স-রে করে বলা যায় না। তবে যাহাতে তাড়াতাড়ি হয়, তাহার চেষ্টা করিব।
ঢাকা জেলের সুপার সাহেব খুব ভালো ডাক্তার, তাই শীঘ্রই ভালো হয়ে যাব বলে আশা করি। চিন্তার কোনো কারণ নাই। জেলখানায়ও যদি মরতে হয় তবে মিথ্যার কাছে কোনো দিন মাথা নত করব না। আমি একলা জেলে থাকতে আপনাদের কোনো অসুবিধা হবে না। কাজ করে যান, খোদা নিশ্চয়ই সাহায্য করবে। আমার জন্য কিছুই পাঠাবেন না। আমার কোনো কিছুরই দরকার নাই। নূতন চীনের কিছু বই যদি পাওয়া যায়, তবে আমাকে পাঠাবেন। চক্ষু পরীক্ষার পর আপনাকে খবর দিব, কারণ চশমা কিনতে হইবে। নিজেই দরখাস্ত করে আপনার সাথে দেখা করতে চেষ্টা করব।
আপনার ছোট ভাই মুজিব
দুটো চিঠি ভাঁজ করে একই খামে পুরে শামসুল হকের নামে ৯৪ নবাবপুর রোডের আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য জমা দেন মুজিব।
সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ দুটো চিঠিই আটকে রাখে। শেখ মুজিব তা জানতেও পারেন না।