যারা ভোর এনেছিল – ৫৫
৫৫.
গোপালগঞ্জের সাইদুর রহমান ওরফে চাঁদ মিয়া, বয়স ৩২, কুষ্টিয়া থানার কৃষি অফিসার, পড়ে আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের পোস্ট অপারেটিভ রুমে। অচেতন। তাঁর হাতে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। হাতের হাড় ভেঙে গিয়েছিল কুষ্টিয়াতে, বর্তমানে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে জার্মান চিকিৎসক অধ্যাপক নোবাকের চিকিৎসাধীন। তিনি কতক্ষণ অজ্ঞান ছিলেন, জানেন না। আস্তে আস্তে তাঁর জ্ঞান ফিরতে থাকে। তিনি নানা কিছু স্বপ্নদৃশ্যের মতো দেখতে থাকেন। গোপালগঞ্জের মধুমতী নদী, লঞ্চঘাট, কাদাভরা পথঘাট তাঁর মনের পর্দায় ভেসে উঠতে থাকে। তারপর তিনি দেখেন, তিনি আকাশে মেঘের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছেন আর একজন আলোয় তৈরি মানুষ তাঁর হাত ধরে তাঁকে মেঘের ওপর দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
আস্তে আস্তে জ্ঞান পুরোপুরি ফিরে এলে তিনি বোঝেন যে তিনি হাসপাতালে, আর তাঁর হাত কে একজন ধরে আছে।
দৃষ্টি পুরোপুরি পরিষ্কার হয় না। তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘কে, কে আমার হাত ধরে আছে?’
‘মজিবর।’
‘শেখ মজিবর?’
‘হ্যাঁ, আমি শেখ মজিবর।’
আস্তে আস্তে পুরো ব্যাপারটা সাইদুর রহমান ওরফে চাঁদ মিয়ার ধাতস্থ হয়। তিনি কুষ্টিয়া থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছেন হাতের হাড় ভাঙার চিকিৎসা নিতে। তাঁর অপারেশন হয়ে গেছে, আর শেখ মুজিবকে আনা হয়েছে পুলিশ প্রহরাধীনে, তিনি কারাগার থেকে এখানে এসেছেন চোখের চিকিৎসা করাতে। পুলিশ সারাক্ষণ তাঁকে পাহারা দিয়ে রাখে।
শেখ মুজিব শুনতে পেলেন, গোপালগঞ্জের চানমিয়া, যিনি কিনা কলকাতায় ভেটেরিনারি কলেজে পড়ার সময় তাঁর মিছিলে এসে যোগ দিতেন, পাশের ওয়ার্ডেই আছেন আর তাঁর অপারেশন হয়ে গেছে, তিনি তাঁর পাশে এসে বসেছেন।
‘মুজিব ভাই, আপনি ভালো আছেন?’
‘কথা বোলো না। চুপচাপ থাকো। আমি ভালো আছি।’
পুলিশ আসে। মুজিবকে বলে, ‘স্যার, আপনি আপনার ওয়ার্ডে যান। এখানে কতক্ষণ থাকবেন!’
মুজিব বলেন, ‘চানমিয়া, আমি ওয়ার্ডে যাচ্ছি। তোমার কোনো অসুবিধা হলে বলবা, আমাকে খবর দিবা। শেখ মুজিবকে খবর দাও বললেই সবাই খবর দিবে।’
কথা সত্য। শেখ মুজিবকে সবাই চেনে। তাঁর পেছনে গোয়েন্দারা সর্বদা লেগে রয়েছে, তাদের আহার-নিদ্রা হারাম হয়ে গেছে। নভেম্বর ১৯৫১ সালে করাচি আওয়ামী মুসলিম লীগের সংগঠক আকতার আহাদ মুজিবকে জেলখানার ঠিকানায় এক চিঠি লেখেন। সেটা গোয়েন্দারা আটক করেছে। তার মধ্যে যা আছে, তা বোমার চেয়েও ভয়ংকর। আকতার আহাদ লিখেছেন, ‘জালিম সরকারকে উচ্ছেদ করতে বড়জোর আর দেড় বছর লাগবে। করাচির এক সভায় সোহরাওয়ার্দী বলেছেন, তাঁর যদি শেখ মুজিবের মতো পাঁচটা মুজিব থাকত, তাহলে সারা দেশ তাঁর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেত। এই রকম একটা বন্দীকে যেমন ছেড়ে দেওয়া যায় না, তেমনি তিনি যখন মেডিকেল কলেজে থাকেন, তখন সবাই জানে যে, কে এই বন্দী-রোগী।’
সোহরাওয়ার্দী ঢাকা আসেন ফেডারেল মামলা পরিচালনার কাজে। তিনি ছুটে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজে। তাঁর প্রিয়তম কর্মীটির সঙ্গে দেখা করতে। ডিসেম্বরের সেই বিকেলটা ছিল শীতে কাতর। সোহরাওয়ার্দী সঙ্গীসাথিসমেত চলে আসেন মুজিবের শয্যাপাশে। মুজিবের স্বাস্থ্য অনেকটাই খারাপ হয়ে গেছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি কথা দেন, মুজিবের জন্যে তিনি হেবিয়াস করপাস মামলা লড়বেন। প্রতিদিনই পরিদর্শক আসে এই বন্দীর কাছে। নিরাপত্তার দায়িত্বে পুলিশ আর কতজনকে আটকাবে। এই এমএলএ আনোয়ারা বেগম আসছেন, তো ফের আসছেন মানিক মিয়া।
গোয়েন্দারা এই সব সাক্ষাৎকারের ওপরে প্রতিবেদন জমা দেয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে।
ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ তৎপর হয়ে ওঠে। কর্তারা সভা করেন। বিশেষ নোটিশ জারি করেন। হুঁশিয়ার। হুঁশিয়ার। শেখ মুজিবের সঙ্গে কেউ দেখা করতে পারবে না প্রয়োজনীয় অনুমতি ছাড়া। কেউ তাকে কোনো চিঠি বা জিনিস দিতে পারবে না। এর সঙ্গে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা জড়িত। হুঁ হুঁ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমগাছে বসে ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি কথা বলে :
শোনো শোনো ব্যাঙ্গমা গো, শোনো দিয়া মন…
মন তো দেওয়াই আছে, দিব কি জীবন?
রসিকতা নয় ওগো কথা হলো ভারি,
মুজিবর মেডিকেলে প্রসঙ্গটা তারি।
যদিও শীতের দিন, গোয়েন্দারা ঘামে,
চারদিক উন্মাতাল শেখ মুজিবের নামে।
শোনো শোনো ব্যাঙ্গমি গো, বাতাসের বেগ।
মুজিবের স্বাস্থ্য নিয়া চারদিকে উদ্বেগ ॥
মুক্তি চেয়ে সভা হয়, আসে বিবৃতি।
মুক্তির দাবিতে যেন সোচ্চার প্রকৃতি ॥
‘প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন।
শেখ মুজিবরে তিনি না দেন জামিন ॥
গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
নরসিংদী ইস্টিশনে জনতা ঘিরিয়া
ধরল তাকে আচানক, তিনি তো ঘেরাও,
বলেন, তোমরা বলো, কী চাও কী চাও।
হাতে ধরে লোকে বলে, শোনেন হুজুর,
শেখ মুজিবরের কষ্ট করতে হবে দূর।
দয়া করে মুক্তি দিন শেখ মুজিবরে,
না হলে জ্বলবে অগ্নি প্রতি ঘরে ঘরে।’
ব্যাঙ্গমা বলে,
শেখ মুজিবরের বয়স একত্রিশ মাত্র,
জনতার কাছে তিনি অতি প্রিয়পাত্র।
ব্যাঙ্গমি বলে,
আরও তো সময় আছে, আছে ভবিষ্যৎ,
যেতে হবে বহু দূর সামনে কত পথ।
কতবার তার মুক্তি চাইবে বাঙালি,
তার নামে কতজন রক্ত দেবে ঢালি।
সেসব ভবিষ্যতে তিনি আপাতত
বন্দী রোগী হয়েও পান মনোযোগ যত।
৫৬.
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লিয়াকত আলী খান। তিনি সোহরাওয়ার্দী সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ভারতের লেলিয়ে দেওয়া কুকুর।’ আর প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ পূর্ববঙ্গের নেতাদের ‘শির কুচল’ বা মস্তক চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবেন।
কথাটা বারবার মনে হচ্ছে তরুণ সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দীনের। সেদিন সন্ধ্যা। শরতের শেষ, হেমন্তের শুরু। আকাশে চাঁদ উঠেছে। চমৎকার নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। আজাদ অফিসে ঢোকার মুখেই আবু জাফর শামসুদ্দীনকে পিয়ন ফরিদ আলী বলল, ‘স্যার, শুনছেন, লিয়াকত আলী শির কুচল হইয়া গেছে গা।’
‘মানে কী!’
আবু জাফর শামসুদ্দীন আজাদ অফিসে ঢোকার পর কিছুটা জানতে পারেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি রাওয়ালপিন্ডির এক জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। এই সময় এক লোক তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। মিলিটারি হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি মারা যান। উন্মত্ত জনতা সৈয়দ আকবর নামের ওই ঘাতককে পিটিয়ে পায়ে পিষে সঙ্গে সঙ্গেই মেরে ফেলে।
কার শির কে কুচল করে।
আবু জাফর শামসুদ্দীন ভাবেন।
তাঁর ভাবনা দুর্ভাবনায় পরিণত হয়, যখন তিনি শুনতে পান, খাজা নাজিম উদ্দিন এখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্ৰী।
জিন্নাহর মৃত্যুর পর খাজা পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হয়েছিলেন। তার আগে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্ৰী।
সেই সময় আবু জাফর শামসুদ্দীনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল খাজা নাজিম উদ্দিনকে কাছে থেকে দেখার।
আবু জাফর শামসুদ্দীন কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছেন। পাকিস্তান নামটার মধ্যেই পাক কথাটা আছে। কাজেই এই দেশ থাকবে পাক- পবিত্র, তিনি ভেবেছিলেন।
পবিত্রতা আর পরিচ্ছন্নতার মহড়া তিনি দেখতে পান সেক্রেটারিয়েটে।
.
কী সেটা?
মধ্য বয়সী সরকারি কর্মচারীরা মূত্রত্যাগের পর শুধু পানি ব্যবহার করে খুশি নন। তারা শৌচাগারে মূত্রত্যাগের পর অফিসের মধ্যেই লুঙ্গি বা পায়জামার নিচে হাত ঢুকিয়ে পুরুষাঙ্গে মাটির ঢেলা ধরে চল্লিশ কদম হাঁটেন। টয়লেটে মাটির ঢেলা স্তূপ করে রাখা।
নিজের শরীরকে পাক-পবিত্র রাখার কাজে যারা এত ব্যস্ত, তাদের মধ্যে একজন অফিসার যদি নাপাক কাজ করে, তা কি সহ্য করা যায়?
অফিসার লোকটা দুর্নীতিবাজ। পাকিস্তানের পবিত্রতা নষ্ট করতে তিনি একাই যথেষ্ট। তিনি একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। হিন্দুদের ফেলে রেখে যাওয়া বাড়িঘর বরাদ্দ করার জন্য খোলা হয়েছে অফিস। এই রকম একটা কঠিন দায়িত্ব যার ওপরে, সেই অফিসার কিনা মদ্যপ ও জুয়াড়ি। রোজ দিনের বেলা ঢাকা ক্লাবে মদ্যপান করে আর রাতের বেলা আরমানিটোলা জমিদার বাড়িতে গিয়ে জুয়া খেলে।
আজাদ-এর বার্তা সম্পাদক মোহাম্মদ মোদাব্বেরও ঢাকায়। আবু জাফর তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করলেন। কী করা যায়? ‘চলুন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে দেখা করি। তাকে বলি…
তাঁরা দুজন চললেন বর্ধমান হাউজে, মুখ্যমন্ত্রী খাজার কাছে।
‘স্যার, আপনার অফিসার লোকটা দুর্নীতিবাজ। শুধু ঢেলা-কুলুপ নিলে তো পাকিস্তান পবিত্র হবে না। সরকারি অফিসে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।’
‘অফিসার দুর্নীতিবাজ? প্রমাণ কী?’ খাজা বললেন।
‘তিনি কত টাকা বেতন পান? পাঁচ শ টাকা। কিন্তু রোজ মদের পেছনে খরচ করেন অন্তত পঞ্চাশ টাকা আর জুয়া খেলে উড়িয়ে দেন শত টাকা। পাঁচ শ টাকা বেতনের একজন লোক এত টাকা ওড়াচ্ছে। পাচ্ছে কোথায়?’
খাজা বললেন, ‘ইয়েস, আই নো হি গোস ফর হাইস্টেক, বাট…’
বাট বলার পর তিনি থেমে গেলেন। আর কিছু বললেন না। আর কোনো ব্যবস্থাও নিলেন না।
আরেক দিনের ঘটনা। দৈনিক আজাদ-এর জন্য পছন্দমতো জমি পাওয়া যাচ্ছে না। দৈনিক আজাদ মুসলিম লীগেরই মুখপত্র। কাজেই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গেলেন আবু জাফর শামসুদ্দীন। বর্ধমান হাউজেই অনুষ্ঠিত হলো সেই সাক্ষাৎকার।
‘আপনি দৈনিক আজাদ-এর জন্য একটা ভালো জমি বরাদ্দ করতে বলে দিন।’
খাজা বলেন, ‘হাম সিধেসাধে আদমি হো, সিধেসাধে বাতাইন সমঝাতে, ইয়ে বহুত সখত মামলা হায়, আপলোগ হামিদুল হক সাহেবকা পাছ যাইয়ে।’
বলেন কী তিনি। এইটা একটা কঠিন মামলা।
এটাই ছিল খাজা নাজিম উদ্দিনের শাসনপদ্ধতি। তিনি সব কাগজ জমা করে রাখতেন অফিসের টেবিলে। কোনোটাতেই স্বাক্ষর করতেন না। সমস্যা যদি বড় হয়, সমাধানও আপন আপনিই হয়ে যাবে, এই ছিল তার দর্শন।
সেই খাজা নাজিম উদ্দিন এখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী।
তিনি আসছেন ঢাকায়।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রথম সফর।
ঢাকায় এসে পল্টনে জনসভা করলেন তিনি। সেখানে তিনি বললেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। পরীক্ষামূলকভাবে একুশটি কেন্দ্রে আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। জনগণ নিজ উদ্যোগে আরও কেন্দ্র খুলছে।’
আবু জাফর শামসুদ্দীন সেই জনসভায় উপস্থিত। এ কথা শোনার পর তাঁর মনে হলো, যে লোক সাধেসিধে বাত ছাড়া বোঝে না, সে কী করে একটা কঠিন বিষয় নিয়ে কথা বলে ফেলল। এর পরিণতি মোটেও ভালো হবে না।
৫৭.
শীতের দিন। তবে ঠান্ডা কম। বাতাসে জলীয়বাষ্প আছে মনে হচ্ছে।
ব্যাঙ্গমা বলে,
ব্যাঙ্গমি, বল তো দেখি, ঠান্ডা কেন কম?
শীতকালে শীত নাই, কেন এ রকম?
ব্যাঙ্গমি জবাব দেয়,
নাজিম উদ্দিন খাজা বুদ্ধি কম তার,
শীতের বিকেলে দিল উষ্ণ উপহার,
উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা বলেছেন যেই,
গরম হয়েছে মাঠ, শীত বিকেলেই।
চারদিক তপ্ত আজি, মিছিলে সকলে,
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, বলে দলে দলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিটিং আজিকে,
ক্ষোভ বার্তা রটে যায় মুহূর্তে চৌদিকে।
তারা তাকিয়ে দেখে, মাঠে ছাত্ররা জড়ো হয়েছে। তাদের মুখে স্লোগান, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। আরবি হরফে বাংলা লেখা চলবে না। ভাষা নিয়ে ষড়যন্ত্র চলবে না।
ব্যাঙ্গমা বলে, ‘এই যে শুরু হইল, নতুন ইতিহাস লেখার যাত্রা।’
ব্যাঙ্গমি বলে, ‘আরও কত কী ঘটব, এই আমতলাতেই।’
ব্যাঙ্গমা বলে, ‘আমতলা থেকে বটতলা, বটতলা থেকে সারা পূর্ব বাংলায় কত কিছুই না ঘটব, আরও কত কিছুই না আমগো দেখতে হইব।’
৫৮.
এম আর আখতার মুকুলের প্যান্ট ছিঁড়ে যায়।
মুকুল এক হাতে প্যান্ট ধরে আছেন।
আর হাত তার উত্তোলিত আমগাছের ডগার দিকে। ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি সেই দৃশ্য দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ে।
মুকুল দাঁড়িয়ে আছেন টেবিলের ওপরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় এই টেবিলটা এনেছেন গাজীউল হক, মুকুল প্রমুখ।
৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে খাজা নাজিম উদ্দিন বলে গেছেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’ তার পর থেকে ছাত্ররা ফুঁসছে। ঘরে ঘরে পোস্টার লেখা হচ্ছে, কার্টুন আঁকা হচ্ছে, সবটাতেই প্রকাশিত এক দাবি : রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। ৩০ জানুয়ারিতেও ঢাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা হয়েছে, মিছিল হয়েছে। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী সেই মিছিলে অংশ নিয়েছে। সেদিনের সভাতেই ঘোষিত হয়েছে, আজ ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রধর্মঘট আর সমাবেশ। ঢাকার প্রতিটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুবলীগের কর্মীরা যোগাযোগ করে সবাইকে প্রস্তুত করে রেখেছে। আনিসুজ্জামান গেছেন পোগোজ স্কুল ও সেন্ট যোসেফ স্কুলে ধর্মঘট করাতে। এইভাবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গেছেন বিভিন্নজন।
৩০ জানুয়ারি সভা শেষে মিছিল করার কথা যখন উঠেছিল, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ তাতে বাধা দিয়েছিল। যদিও সভাপতিত্ব করেছিলেন ছাত্রলীগের সভাপতি খালেক নেওয়াজ নিজেই। খালেক নেওয়াজ ৩০ তারিখে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে যে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, তাতেও আছেন। আওয়ামী মুসলিম লীগসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠনের দুজন করে প্রতিনিধি নিয়ে ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরিতে গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ। সেই সভাতেই সিদ্ধান্ত হয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ ধর্মঘট, সভা ও বিক্ষোভ মিছিল হবে। বিক্ষোভ মিছিল যাবে জগন্নাথ হলে, যেখানে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার বাজেট অধিবেশন বসবে।
কিন্তু আজ যেন খালেক নেওয়াজ সভাপতিত্ব করতে না পারেন, তারই ফন্দি এঁটে এসেছেন যুবলীগের কর্মীরা। এম আর আখতার মুকুলের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তিনি সভার সভাপতি হিসেবে নাম প্রস্তাব করবেন গাজীউল হকের। তাঁকে সমর্থন করবেন কমরুদ্দীন শহুদ।
টেবিল আনা হয়েছে, খালেক নেওয়াজ অপেক্ষা করছেন চেয়ার কখন আসে। তাহলে তিনি সেই চেয়ারে বসে পড়ে সভাপতিত্ব করতে পারবেন। সামনে হাজার হাজার শিক্ষার্থী অপেক্ষা করছে।
কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ছোট্ট শরীরটি নিয়ে এম আর আখতার মুকুল উঠে গেলেন টেবিলের ওপরে। ঘোষণা করলেন, ‘ভাইসব, রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবিতে আয়োজিত এই সভার সভাপতিত্ব করবেন গাজীউল হক।’
অমনি মুসলিম ছাত্রলীগের এক কর্মী মুকুলের প্যান্ট ধরে মারলেন টান। মুকুলের প্যান্টের বোতাম ছিঁড়ে গেল পট করে। প্যান্টটাও নিচে নেমে গেল খানিক। কিন্তু সেই প্যান্ট এক হাতে টেনে ধরে আরেক হাত ঊর্ধ্বমুখে তুলে ধরে মুকুল তাঁর ঘোষণা সমাপ্ত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ছয় ফুট উঁচু কমরুদ্দীন শহুদ পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে মাথা উঁচু করে বললেন, ‘আমি এই প্রস্তাব সমর্থন করছি।’
গাজীউল হকও আর চেয়ারের জন্য অপেক্ষা করলেন না। উঠে পড়লেন টেবিলের ওপরে। দুই মিনিটের বক্তৃতা শেষে ঘোষণা করলেন কর্মসূচি, এবার আমরা মিছিল নিয়ে সারা শহর প্রদক্ষিণ করব।
মিছিল শুরু হলো। ২১ ফেব্রুয়ারি সারা বাংলায় ধর্মঘট। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। মিছিল শহরের রাস্তা প্রদক্ষিণ করছে। বিশাল মিছিল।
মুকুল সেই মিছিল ধরে হাঁটছেন। আজ নিজেকে তাঁর মনে হচ্ছে বিশাল। সমুদ্রের জলে যখন নদী মেশে, নদীর তখন যেমন লাগে মুকুলের মনে হচ্ছে, তিনি ছিলেন পুকুর, হয়ে পড়েছেন সমুদ্র।
তাঁর কোমরের বোতামের সমাধান বের করা গেছে। কোমরের একটা বেল্ট তাঁকে খুলে দিয়েছেন তাঁদের এক মিছিলবন্ধু। সেইটা তিনি কোমরে বেঁধেছেন কষে। প্যান্ট আর নিচে নামার চেষ্টা করছে না।
‘রাষ্ট্রভাষা রাষ্ট্রভাষা…’
মুকুল জোরে আওয়াজ ধরেন, ‘বাংলা চাই বাংলা চাই’। নুরুল আমিনের বাসভবন বর্ধমান হাউজের সামনে দিয়ে যাচ্ছে মিছিল। পাশেই রেসকোর্স ময়দান। পথে অনেক গাছ। গাছের ডালে পাখিদের সমাবেশ। মুকুলের মনে হয়, তাঁদের চিৎকারের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে গাছের ডালে বসা সব পাখপাখালি ও।
৫৯.
ব্যাঙ্গমা বলে,
শোনো শোনো ব্যাঙ্গমি গো, শোনো হে খবর,
ফরিদপুরের জেলে শেখ মুজিবর।
ব্যাঙ্গমি বলে,
বাতাস বইছে দেখো শনশনশন,
মুজিবর রহমান করে অনশন।
‘হ, আমি জানি। শেখ মুজিবুর রহমানরে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল থাইকা ফরিদপুর কারাগারে পাঠানো হইছে।’
‘কেন পাঠানো হইছে?’ ব্যাঙ্গমা লেজ তুলে শুধায়।
‘কারণ তিনি হুমকি দিছেন, তাঁরে সমেত বিনা বিচারে আটক সব রাজবন্দীকে মুক্তি দেওয়া না হইলে তিনি অনশন ধর্মঘট করবেন। তাঁর সাথে আছেন আরেক নিরাপত্তা বন্দী মহিউদ্দিন আহমদ। তাঁরা বলছেন, ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তাঁদের মুক্তি দিতে হবে। তা না হইলে ১৬ ফেব্রুয়ারি তাগো ধর্মঘট শুরু হইব। মুজিব মুক্তি চান, কারণ তিনি জানেন, ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে। ওই দিন অ্যাসেম্বলি বসবে। সেটা ঘেরাও করা দরকার। আওয়ামী লীগের এখন মুজিবরে দরকার।
‘অলি আহাদ আর যুবলীগের নেতারা আর ছাত্রনেতারা মুজিবরের লগে দেখা করতে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রিজন সেলে গেছিল। শেখ মুজিব অলি আহাদকে জানায়া দিছেন তাঁর পরিকল্পনার কথা। তিনি অনশন ধর্মঘটে যাইতেছেন।’
‘হেই কথা শুইনা সরকারের লোকজনের মাথা খারাপ হইবার উপক্রম হইছে। এমনিতেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা ফুটতাছে, এর মধ্যে যদি শেখ মুজিব অনশনে যায় আর হাসপাতালের বেডে এত দিন ধইরা শুইয়া থাকা লোকটার একটা কিছু যদি ঘইটা যায়, পরিস্থিতি আর নিয়ন্ত্রণ করা যাইব না, এই হলো তাগো ভাবনা।’
‘পরিস্থিতি তো এমনিতেই সামলাইতে পারব না, অমনিতেই পারব না। খালি মুজিবররে জার্নির কষ্টটা দিব।’
দিব না? সারা বাংলায় শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে কী রকম আওয়াজ উঠছে। পেপারে প্রতিদিন কত কিছু ছাপা হইতেছে, মানুষ শেখ মুজিবের মুক্তি চায়। এইখানে-ওইখানে মিছিল আর জনসভা হইতাছে না?’
‘১৪ ফেব্রুয়ারিতে অর্ডার হইছে, অহনই শেখ মুজিবর আর মহিউদ্দিন আহমদরে ফরিদপুর জেলে পাঠাও। একজন হেড কনস্টেবল আর দুজন কনস্টেবল তাগো য্যান গোয়ালন্দ হইয়া ফরিদপুর লইয়া যায়।
তার পরের দিন সকাল সাড়ে দশটাতেই মুজিব আর মহিউদ্দিনকে জেল থাইকা বাইর করা হইল। ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে নিয়া গিয়া তোলা হইল নারায়ণগঞ্জের রেলগাড়িতে।’
‘নারায়ণগঞ্জ স্টেশন আর স্টিমারঘাটেও দেখছ কেমুন ভিড় জইমা গেল শেখ মুজিবরে দেখার লাইগা। নারায়ণগঞ্জের নেতারা তার লগে দেখা করেন। যুবলীগ নেতা শামসুজ্জোহা ও শফি হোসেনরে মজিবর কইয়া দিলেন, ‘আমারে বদলি কইরা অরা আমার ধর্মঘট থামাইতে পারব না। আমি অনশন করুমই’।
‘হ। অনশন তো সে করতাছেই। দুদিন পর তাঁরা ফরিদপুর কারাগারে পৌঁছাইলেন। তার পরের দিন থাইকাই তাঁরা জেলখানায় অনশন ধর্মঘট শুরু কইরা দিলেন।
‘ওই দেখো, আমগো গাছতলাতে সভা হইতাছে। রাজবন্দীদের মুক্তি চাই।’
‘হ। অরা রাজবন্দীগো মুক্তির লাইগা কমিটি পর্যন্ত বানায়া ফেলল।’
‘বাতাসে আওয়াজ ওঠে, ফট ফট ফট,
মুজিবুরে করে অনশন ধর্মঘট।