Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    যারা ভোর এনেছিল – আনিসুল হক

    লেখক এক পাতা গল্প363 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    যারা ভোর এনেছিল – ৬০

    ৬০.

    ফাল্গুনের বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর রেস্তোরাঁর দিকে যাচ্ছেন গাজীউল হক। কোকিল ডাকছে, মৃদুমন্দ দখিনা হাওয়া বইছে। রিকশার ক্রিং ক্রিং আওয়াজ আসে মাঝেমধ্যে। দূরে ঘোড়ার গাড়ি চলছে। ঘোড়ার খুরের ঠকঠক আওয়াজ ওঠে। মাঝেমধ্যে শোনা যায় ঘোড়ার ডাক। তিনি মধুর রেস্তোরাঁয় চেয়ার টেনে বসেন। রেস্তোরাঁ মানে পুরোটাই বারান্দা। সামনে টেবিলে। আরও আরও ছাত্র সেখানে উপস্থিত। সবার মধ্যে উত্তেজনা। এরা সবাই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জন্য কাজ করছেন। এখন তৈরি হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবকদের তালিকা। লম্বা রুল টানা কাগজে একটার পর একটা নাম লেখা হচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবক হতে উৎসাহী ছেলেমেয়ের অভাব নেই। কাল সাধারণ ধর্মঘটও ডাকা হয়েছে। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে পিকেটিং করতে হবে। তা ছাড়া সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মিছিল নিয়ে আসতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে। মেয়েদের কলেজ, স্কুল থেকেও আসবে মিছিল। মেয়েরাও খুবই সক্রিয় এই আন্দোলনে। আজ ৫০০ পোস্টার লিখে নিয়ে এসেছেন নাদিরা আর সাফিয়া। সাফিয়ার হাতে স্বেচ্ছাসেবক মেয়েদের তালিকা। ‘বাংলাবাজার গার্লস স্কুলে কে যাচ্ছে যেন’, সাফিয়ার কণ্ঠস্বর উঁচু হলো। সুফিয়া দুটো মেয়েকে ডেকে কাছে আনল সাফিয়ার। ও দিকে ব্যস্ত সারা, মাহফিল আরা, খোরশেদী। তাদের হাতে হাতে পোস্টার।

    এর মধ্যে ১২ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি পালন করা হয়েছে পতাকা দিবস। কাপড়ের পতাকায় কাগজের স্লোগান—রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, এটা ফেরি করে করে বিক্রি করা। উদ্দেশ্য যত না তহবিল সংগ্রহ, তার চেয়ে বেশি জনমত তৈরি।

    যুবলীগের পক্ষে আনিসুজ্জামান লিখেছেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কি ও কেন? নামের পুস্তিকা। সেটা বেনামে প্রকাশিত হয়ে বিলিবণ্টন হচ্ছে এখানে-ওখানে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদও একটা পুস্তিকা বের করে, বদরুদ্দীন উমর সেটা মুসাবিদা করে দিয়েছেন। যুবলীগ অফিস হয়ে উঠেছে ভাষা আন্দোলনের একটা কেন্দ্র। সেখান থেকে সারা দেশে সব যুবলীগ শাখায় পাঠানো হচ্ছে কেন্দ্রের নির্দেশ। সব সময় অফিসটায় একটা সরগরম ভাব। ঢাকা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলও হয়ে উঠেছে ছাত্রকর্মীদের আরেক আখড়া। হোস্টেল মানে পাকা বাড়ি নয়, সারি সারি ব্যারাক। সর্বত্র সাজ সাজ রব। ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস। ওই দিন একটা কিছু হবে।

    একটা কোকিল ডাকছে কোথাও। চারদিকে গাছগাছালি। রমনা এলাকায় পাখপাখালির কোনো ইয়ত্তা নেই। এর মধ্যে কোকিল তো ডাকতেই পারে। কিন্তু হঠাৎই ছাত্রদের কথোপকথন, কোকিলের ডাক ছাপিয়ে আসে মাইক্রোফোনের আওয়াজ। মাইকে ঘোষিত হচ্ছে সরকারি ঘোষণা, ‘আগামীকাল ২১ ফেব্রুয়ারি রমনা এবং ইহার আশে-পাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হইয়াছে। একসঙ্গে চারজনের বেশি মানুষ একত্রিত হইতে পারবে না। অন্যথায় কঠোর ব্যবস্থা লওয়া হইবে।’

    কী করা যায়। গাজীউল হকের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে।

    শুধু গাজীউল হক নয়, ছাত্রদের সবাই ভীষণ উত্তেজিত। ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে, সমাবেশ মিছিল করা যাবে না। আমরা মানি না। মানব না। সবার চেয়ে বেশি উঁচু মেয়েদের কণ্ঠস্বর, ‘আমরা ১৪৪ ধারা মানব না।’

    গুজবে মধুর রেস্তোরাঁর বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। হাসপাতালে অনেকগুলো বেড খালি করা হয়েছে। আগামীকাল যে-ই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবে, তাকেই হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। ট্যাংক-কামান নামানো হবে রাস্তায়, সৈন্য মোতায়েন করা হবে, এই সব কথা তো ছিলই।

    হলে হলে ছাত্ররা মিলিত হয় সভায়। ওই সব ছাত্রসভার এক আওয়াজ, ‘১৪৪ ধারা মানা চলবে না।’ সেই খবর এসে পৌঁছায় মধুর রেস্তোরাঁয়।

    ‘কী হবে তাহলে?’ গাজীউল হকের কাছে ছেলেমেয়েরা জানতে চায়। গাজীউল হকের চোখেমুখে উদ্বেগ। বুকের মধ্যে দুন্দুভি। এর মধ্যে খবর আসে, সন্ধ্যায় নবাবপুর আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদের সভা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কী করা কর্তব্য—এই হলো আলোচনার বিষয়।

    গাজীউল বলেন, ‘সন্ধ্যায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদের সভায় কী হয়, আমরা দেখি আগে।’

    ছেলেমেয়েরা চিৎকার করে ওঠে, ‘১৪৪ ধারা মানি না, মানব না’।

    সন্ধ্যার নবাবপুর। রাস্তায় দু-চারটে রিকশা, কয়েকটা ঘোড়ার গাড়ি। আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে অনেকেই উপস্থিত। রাষ্ট্রভাষা পরিষদের সদস্যরা তো আছেনই, এ কলেজ, ও কলেজের প্রতিনিধিরা অপেক্ষা করছেন উত্তেজনা নিয়ে। বাইরেও কর্মীরা উঁকিঝুঁকি মারছে। সভায় সভাপতিত্ব করছেন খেলাফতে রব্বানি পার্টির সভাপতি প্রবীণ আবুল হাশিম। মওলানা ভাসানী নেই, মফস্বলে গেছেন জনসভা করতে। আতাউর রহমান খান নেই, তিনি গেছেন ওকালতির কাজে, ময়মনসিংহে। অগত্যা আবুল হাশিমকে সভাপতিত্ব করতে হচ্ছে। উপস্থিত আছেন আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। আছেন যুবলীগ নেতা অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল মতিন।

    জ্যেষ্ঠ সদস্যরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে। শামসুল হক বলেন, ‘আমরা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করতে চাই। আমাদের আশঙ্কা, অন্যথায় সরকার পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলন গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য কঠোর দমননীতির আশ্রয় নেবে। আর সামনের বছর নির্বাচন হওয়ার কথা। মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায়, নির্বাচন হলেই তাদের ভরাডুবি হবে। এখন বড় গন্ডগোল হলে সরকার নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার অজুহাত পেয়ে যাবে।’ অলি আহাদ, মেডিকেল কলেজের ভিপি গোলাম মওলা, আবদুল মতিন—এঁরা সবাই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন। তাঁদের মত হলো, ‘যদি এবার প্রতিবাদ করতে না পারি, আর কোনো দিনও এই দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দাঁড়াবে না।’

    শামসুল হকের যুক্তি খণ্ডন করে অলি আহাদ বলেন, ‘১৯৪৯ সালের নির্বাচনে তো শামসুল হক সাহেব বিজয়ী হয়েছিলেন, তার পরও তাঁকে আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এমনকি টাঙ্গাইল নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর মুসলিম লীগ সরকার আর কোনো উপনির্বাচন দেয় নাই। আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য তারা ১৪৪ ধারা জারি করেছে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেই আমরা উপযুক্ত জবাব দেব। এখন যদি এই সরকারের জুলুম ও দমন নিপীড়নকে রুখতে না পারি, ভবিষ্যতে সামান্য প্রতিবাদও আর করতে পারব না।’

    তখন প্রস্তাবটা ভোটে দেওয়া হলো, ১৪৪ ধারার ভঙ্গ করা হবে কি হবে না, ভোট হোক।

    .

    কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের মনে হলো, মওলানা ভাসানী অনুপস্থিত, শেখ মুজিবুর রহমান কারারুদ্ধ, শামসুল হক জীবনযুদ্ধে পরিশ্রান্ত, স্ত্রী তাঁকে অসহযোগিতা করছে, দুই দুটি কন্যাসন্তান তাঁকে পিছে টানছে, প্রথম কন্যা শাহিন তো আছেই, সদ্য জন্ম নিয়েছে আরেকজন, সাকু। এ অবস্থায় সংগ্রামী নেতৃত্ব তাঁর কাছ থেকে আশা করা বাতুলতা। আবুল হাশিম সাহেবের খেলাফতে রব্বানি পার্টি তখনো সংগঠিত হয়নি, তার ওপরে আছে তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, এবং বাস্তবে সবকিছু হারিয়ে সর্বহারা হয়ে যাওয়া অবস্থা। তাঁর পক্ষে বিপ্লবী সিদ্ধান্ত প্ৰদান অসম্ভব। ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো, ১১-৪ ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার প্রস্তাব জয়লাভ করল।

    অলি আহাদ বলেন, ‘এই সিদ্ধান্ত আমরা মানি না। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাচ্ছি। আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্রসভা হবে, সেই সভা যদি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে রায় দেয়, তবে আমরাও ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে থাকব।

    আবদুল মতিন বললেন, ‘একটা সিদ্ধান্ত না নিয়ে এই সভা সিদ্ধান্ত নিক যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে আর বিপক্ষে—দুটো মতই এসেছে। আগামীকালের ছাত্রসভায় দুটো মতই প্রকাশ করা হবে। এর পর ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নেবে।

    তখন আবুল হাশিম বললেন, ‘আগামীকাল শামসুল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে ছাত্র জনসভায় বক্তব্য পেশ করবেন। তার পরও যদি ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙে, তাহলে এই কমিটি সঙ্গে সঙ্গেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’ সভার কার্যবিবরণীতে আবুল হাশিমের এই বক্তব্যও লিখে নেওয়া হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সেই খবর পৌঁছাল।

    সঙ্গে সঙ্গে সবাই উত্তেজিত। ‘এই সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া যায় না। আমরা অবশ্যই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করব।’

    গাজীউল হক বললেন, ‘আপনারা অধৈর্য হবেন না। একটা কিছু হবেই।’

    গভীর রাত। ফজলুল হক হল আর ঢাকা হলের মধ্যবর্তী পুকুরের সিঁড়ি। ১১ জন ছাত্র সেখানে উপস্থিত। এরা কেউ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কমিটির সদস্য নন। কিন্তু আন্দোলন এখন আর কেবল কমিটির হাতে নেই। এ আগুন ছড়িয়ে গেছে বহুজনের মাঝে। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান শেলী, মোহাম্মদ সুলতান, জিল্লুর রহমান, এম এ মোমিন, এস এ বারী এ টি, এম আর আখতার মুকুল, কমরুদ্দীন শহুদ, আনোয়ারুল হক খান, আনোয়ার হোসেন ও গাজীউল হক সেখানে উপস্থিত। আবহাওয়া অতি চমৎকার। সন্ধ্যার পর দখিনা বাতাস বইছে। দূর থেকে হলের বিদ্যুৎ বাতি এসে পড়ছে পুকুরের পানিতে।

    উপস্থিত সবার একটাই মত। রাত পোহালেই যে সকাল আসবে, যে দিন আসবে, একুশে ফেব্রুয়ারি, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমতলায় বৈঠক করে। শামসুল হক আসবেন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে কথা বলতে। তাঁর বক্তব্যের পর আবদুল মতিন ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে বলবেন। কাজেই এই সভাতেও সভাপতিত্ব করতে হবে গাজীউল হককেই। তিনি যদি গ্রেপ্তার হয়ে যান তাহলে এম আর আখতার মুকুল, তিনিও আটক হলে কমরুদ্দীন শহুদকে সভাপতিত্ব করতে হবে। মতিনের বক্তব্যের পর সভাপতি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখবেন এবং ঘোষণা করবেন যে, ‘১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত এই সভা গ্রহণ করল।

    তারপর মিছিল নিয়ে ছেলেমেয়েরা বেরোবে ক্যাম্পাস থেকে।

    মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান শেলী বললেন, ‘আমি থাকব সবার সামনে। আমাকে গ্রেপ্তার করা হলে আমি গ্রেপ্তার বরণ করব।’

    এম আর আখতার মুকুল বললেন, ‘নেতাদের গ্রেপ্তার হওয়া চলবে না। গাজীউল হক, মতিন—এরা যেন গ্রেপ্তার না হয়।’

    গাজীউল হক তাকালেন হাবিবুর রহমান শেলীর দিকে। ইতিহাসের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রদের একজন তিনি। লম্বা, একহারা, উজ্জ্বল চোখ, দিব্যকান্তি, উন্নত নাসা। তিনি যদি সত্যাগ্রহী দলের নেতৃত্ব দেন, তাহলে সেটা বাকিদের অনুপ্রাণিত করবে সহজেই।

    আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘ দেখা যাচ্ছে। তার ফাঁকে ফাঁকে নক্ষত্রের মিটিমিটি আলো। দূরে ঝোপে-ঝাড়ে জোনাকি জ্বলছে। হলগুলোর বারান্দায় বিদ্যুতের আলো। তারই প্রতিবিম্ব পড়েছে পুকুরের জলে। একটা মাছ বোধ হয় ঢেউ তুলল জলের গায়ে।

    ছাত্রদের রুমের বাতি বেশির ভাগই নিভে গেছে। একটা স্তব্ধতা যেন ঝড়ের পূর্বাভাস হয়ে নেমে আসছে ঢাকায়

    ‘আমরা সবাই কাল সকাল সকাল চলে আসব কলাভবনে। ঠিক আছে?’

    ‘হ্যাঁ, ঠিক আছে।’

    সবাই চলে যায় পুকুরপাড়ের সিঁড়ি থেকে। শুধু থেকে যান গাজীউল হক আর মৃদুভাষী যুবক আবদুল মোমিন।

    মোমিন বলেন, ‘আগামীকাল সকালে আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া চলবে না।’

    গাজীউল তাকান মোমিনের মুখের দিকে। ‘কেন?’

    ‘আপনাকে আজ রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে হবে। ভোরবেলা আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে গিয়ে গ্রেপ্তার হতে পারেন। কাজেই আজ শেষ রাতের মধ্যেই আপনাকে ঢুকে পড়তে হবে কলাভবন এলাকায়।’

    আকাশে অনেক তারা। আকাশ অনন্ত। আকাশে কিছু মেঘ। পুকুরপাড়ে নারকেলগাছ। সিঁড়িটা শীতল। জল স্থির। গাজীউল হক পুকুরের সিঁড়িতে শরীর এলিয়ে দেন। আকাশের দিকে তাকান। এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তিনি একটা ক্ষুদ্র সত্তা। তার পাশে আরেকজন সামান্য মানুষ। আগামীকাল তাঁদের সামনে একটা অনিশ্চিত যাত্রা। কী হতে যাচ্ছে কাল, তাঁরা কেউ জানেন না। কিন্তু তাঁরা জানেন, পেছনে ফেরার পথ নাই। লড়াই তাঁদের করে যেতেই হবে।

    তিনি বললেন, ‘মোমিন, তোমার কথা আমি মানলাম। আমি আজ রাতে আর হলে ফিরে যাচ্ছি না। আমি কলাভবনের বারান্দাতেই রাত কাটাব।’

    মোমিন বিদায় নিলেন। গাজীউল হক বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়ামের মধ্য দিয়ে এগোতে লাগলেন। মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়—এ দুটোর মধ্যখানে একটা ছোট্ট প্রাচীর। মধুর ক্যানটিনঘেঁষা সেই পাঁচিল টপকালেন দীর্ঘদেহী গাজীউল হক। নামলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন এলাকায়। কৃষ্ণপক্ষের একটা ক্ষীণতনু চাঁদ তখন তাঁর সঙ্গে লাফাতে থাকে।

    তিনি বারান্দায় দুটো পোস্টার বিছিয়ে তার ওপর শুয়ে পড়লেন। তাঁর মনে পড়ছে বন্ধুদের মুখ। মনে পড়ছে প্রতিজ্ঞাদীপ্ত ছাত্রীদের ‘১৪৪ ধারা মানি না’ স্লোগান। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান যদি গ্রেপ্তার হন, তাঁর ভবিষ্যৎ কী হবে? এতগুলো মেয়ে জড়িত আন্দোলনের সঙ্গে, মেয়েরা আসবে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে, তাদের নিরাপত্তার প্রশ্ন। কিন্তু তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন বাংলা ভাষার সম্মান।

    ভোর হচ্ছে। গাজীউল হক উঠে বসলেন। বারান্দায় হাঁটতে লাগলেন। মধুর রেস্তোরাঁর দিকে গেলেন। গেটের কাছে বড়সড় আমগাছ। মধুর রেস্তোরাঁ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। আমগাছের পূর্ব দিকে বেলতলায় ছোট্ট পুকুর। দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়কার দালান, আর্টস বিল্ডিং। পাঁচিল পেরোলেই মেডিকেল কলেজ। কলেজ হোস্টেল হলো বাঁশের তৈরি ব্যারাক। সবচেয়ে দক্ষিণে রেললাইন।

    ভোরবেলা শীতও পড়েছে বেজায়।

    ওই যে, গেট ঠেলে কে যেন আসছে। মোহাম্মদ সুলতান। তাঁর সঙ্গে এলেন এস এ বারী এ টি এবং আরও দুজন।

    এত ভোরে ওঁরা কী করবেন?

    তাঁরা ছোট ছোট কাগজের টুকরায় চিঠি লিখতে লাগলেন। চিরকুটের মতো একেকটা বার্তা। মোহাম্মদ সুলতান পোগোজ স্কুলের ছেলেদের উদ্দেশে লিখলেন, ‘ছোট ভাইয়েরা, সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেছে। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার জন্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তোমরা দুজন দুজন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এসো।’

    তক্ষণে একজন দুজন করে ছাত্ররা আসতে শুরু করেছে। অনেকেই এসেছে সাইকেল নিয়ে। তাদের হাতে হাতে চিরকুটগুলো পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন কলেজে, স্কুলে। নওগাঁর ছেলে মেডিকেল ছাত্র মঞ্জুর এসেছেন। তিনি গেলেন মেডিকেল কলেজের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে। একটা ছোট্ট মেয়ে এসেছে সাইকেল চালিয়ে। ‘কী নাম তোমার?’

    ‘আমার নাম জাহানারা লাইজু।’

    তুমি কেন এসেছ?

    ‘ওমা। আবার কেন? রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই না’?

    ‘তুমি একটা কাজ করতে পারবে? এই চিরকুটটা নিয়ে পৌঁছে দিতে পারবে মেয়েদের কলেজে?’

    ‘পারব।’

    লাইজু সাইকেল চালিয়ে বলাকার মতো যেন উড়ে চলে গেল।

    আটটার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরে ফেলল পুলিশ। তাদের পরনে হাফ প্যান্ট। হাতে বড় বড় লাঠি। অনেকের হাতেই বন্দুক। পুলিশের ভ্যান রাখা সারি সারি।

    বসন্তের সকালে চারদিক আলোকোজ্জ্বল। অনেক ছেলেমেয়ে এরই মধ্যে এসে গেছে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। তাদের ছায়া লম্বা হয়ে পড়েছে ক্যাম্পাসের সবুজ উঠোনে।

    কালো শেরওয়ানি গায়ে মাথায় জিন্নাহ টুপি চাপিয়ে এলেন শামসুল হক।

    তিনি গিয়ে বসলেন মধুর রেস্তোরাঁয়।

    উপস্থিত ছাত্রদের তিনি বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলেন, ‘১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা ঠিক হবে না। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা মেনে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনই আমাদের কাম্য।’

    ছাত্ররা উত্তেজিত। তারা তাঁকে নানা প্রশ্ন করতে লাগল। তিনি যথাসাধ্য ছাত্রদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

    হঠাৎ একজন ছাত্র চিৎকার করে উঠলেন, ‘ট্রেইটর’।

    তিনি শামসুল হককে লক্ষ্য করে এই বিদ্রূপবাণ ছুড়ে মারলেন।

    উত্তেজিত এই ছাত্রটির নাম হাসান হাফিজুর রহমান। তাঁকে থামানো যাচ্ছে না। তিনি শামসুল হকের দিকে ধেয়ে এলেন। তাঁর মাথার জিন্নাহ টুপি ছিনিয়ে নিয়ে ছুড়ে ফেললেন দূরে, শূন্যে। চিৎকার করে তিনি বলতে লাগলেন, ‘ইউ হ্যাভ নো রাইট টু স্পিক, গেট আউট।’

    পুরো পরিবেশ উত্তেজনাপূর্ণ। হইচই, চিৎকার-চেঁচামেচিতে কে শোনে কার কথা। আমানুল্লাহ খান নামের একজন দীর্ঘদেহী ছাত্র বেঞ্চির ওপরে বক্তৃতা দিতে শুরু করেন, ‘ভাইসব, আমরা ১৪৪ ধারা মানি না, মানব না…’

    অলি আহাদ এলেন। গাজীউল হককে ডেকে নিলেন আলাদা করে। বললেন, ‘আমি তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না, আর আমি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদের সদস্য, আমি কোনো ফরমাল ভাষণ দেব না। তবে ১৪৪ ধারা ভাঙতেই হবে।’

    গাজীউল হক বললেন, ‘আমরা কাল রাতে ফজলুল হক হলের পুকুরের পূর্ব ধারের সিঁড়িতে বসেছিলাম কয়েকজন। আমরা ১৪৪ ধারা ভাঙব, এই সিদ্ধান্ত নিয়েই রেখেছি।’

    একটা ছোট্ট চেয়ার নিয়ে রাখা হলো আমতলায়।

    তখন বেলা ১১টা সাড়ে ১১টা। রোদে ঝকঝক করছে চারপাশ। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী সমবেত হয়েছে আমতলায়, এরই মধ্যে।

    এম আর আখতার মুকুল আগের মতোই সভাপতি হিসেবে প্রস্তাব করলেন গাজীউল হকের নাম। তাঁকে সমর্থন করলেন কমরুদ্দীন শহুদ।

    সভাপতির চেয়ারে বসলেন গাজীউল। তিনি বললেন, প্রথমেই বক্তব্য রাখবেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদের পক্ষ থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক।

    কিছু ছাত্র ‘না না’ বলে চিৎকার করে উঠল।

    শামসুল হক অসাধারণ বাগ্মী। তিনি তাঁর ভাষণ শুরু করলেন। খাজা নাজিম উদ্দিন আর নুরুল আমিন সরকারের সমালোচনা করলেন তীব্র ভাষায়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে কথা বললেন। কিন্তু দাবি আদায়ের পন্থা হিসেবে তিনি যুক্তি দেখালেন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষে। একজন- দুজন ছাত্র তাঁর কথা সমর্থন করতে চাইলেও সমবেত প্রায় সবাই তাঁর বিরোধিতা করতে লাগল।

    এবার বক্তব্য দিতে দাঁড়ালেন বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির পক্ষে আবদুল মতিন। তিনি কথা বলতে লাগলেন ধীরে ধীরে, যুক্তি দিয়ে। বললেন, ‘আজ ১৪৪ ধারা যদি আমরা ভঙ্গ না করি, ভবিষ্যতে কোনো আন্দোলনই আমরা আর করতে পারব না। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আন্দোলন বর্তমান পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, এখন পিছিয়ে আসার আর কোনো উপায় নেই। আমরা কি ১৪৪ ধারার ভয়ে পিছিয়ে যাব?’

    জবাবে সকলে চিৎকার করে উঠল, ‘না না।’

    তখন একটা আপস ফর্মুলা এল। দশজন দশজন করে গেট থেকে বেরিয়ে পথে যাবে, তারপর যা হয় হবে। গাজীউল হক সভাপতির ভাষণ দিলেন। ‘নুরুল আমিন সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে পুলিশ মোতায়েন করেছে। ১৪৪ ধারা ভাঙা হলে নাকি গুলি করা হবে। আমরা নুরুল আমিন সরকারের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছি। আমরা দেখতে চাই নুরুল আমিন সরকারের বারুদাগারে কত বুলেট জমা আছে।’

    এই সময় আবদুস সামাদ চিৎকার করে বললেন, ‘আমরা যে ১৪৪ ধারা ভাঙব, কয়জন করে বাইরে যাব? আমার প্রস্তাব হলো, আমরা দশ জনের একটা করে দল করে গেটের বাইরে যাব।’

    ‘কে কে বাইরে যেতে চান, নাম লেখান। মোহাম্মদ সুলতান নাম লিখে নেবেন।

    হইচই পড়ে গেল। সবাই নাম লেখাতে চায়। সুলতান গেট বন্ধ করে সবার নাম ঠিকানা লিখে নিচ্ছেন, যাতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সহজেই তাদের নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়।

    এদিকে মুহুর্মুহু স্লোগান উঠছে, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, চলো চলো, অ্যাসেম্বলি চলো। পুলিশি জুলুম চলবে না’।

    গেট খুলে ছেলের দল বেরিয়ে পড়তে লাগল। হাবিবুর রহমান শেলী, আনোয়ারুল হক, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আজমল হোসেন…কে যে কার আগে বেরোবে, তারই প্রতিযোগিতা।

    বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করে ট্রাকে তুলে নিতে লাগল।

    তারপর পিলপিল করে আরও দশজন বেরিয়ে যেতেই শুরু হলো কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ আর লাঠিচার্জ।

    এবার তাহলে মেয়েদের দল যাক।

    সাফিয়া, সুফিয়া, রওশন আরা বাচ্চু, শামসুন নাহার, হালিমা খাতুন এগিয়ে এলেন। এগিয়ে গেল স্কুলের বালিকা সেতারা, পারুল, নুরী। গেটের পাশে বালতিতে করে পানি রাখা হয়েছে। সবাই রুমাল ভিজিয়ে নিল। সুরইয়া, শরিফা, সারাহ, জাহানারা লাইজু, জুলেখা, সুফিয়া, খালেদা ফেরদৌস, চেমন আরা—সবাই মিছিলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। প্রত্যেকের চোখে-মুখে প্রত্যয়ের ছাপ।

    মেয়েদের দল এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে কিছু ছেলেও যোগ দিল। তাদের এগিয়ে চলা একটা মিছিলের আকার নিয়েছে। পুলিশ লাঠিচার্জ করল। সুফিয়ার পেছনে একটা অল্প বয়সী ছেলে পুলিশের লাঠির আঘাতে শুয়ে পড়ল। আহত হলেন রওশন। তবু তাঁরা এগিয়ে যাচ্ছেন।

    কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়া হলো।

    চারদিকে কাঁদানে গ্যাস, গুডুম গুড়ুম শব্দ, লাঠিচার্জ, আর্তনাদ। স্লোগান, হইহই রব। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেও।

    ছাত্ররাও যা হাতের কাছে পাচ্ছে, তা-ই নিয়ে পুলিশের দিকে ছুড়ে মারতে শুরু করল। কাঁদানে গ্যাসে পুরো এলাকা ছেয়ে গেছে। কেউ চোখ খুলতে পারছে না। কাঁদানে গ্যাসের শেল এসে পড়ল সুফিয়ার সামনে। তিনি চোখে আর কিছুই দেখতে পারছেন না।

    ছাত্ররা সবাই পুকুরের পানিতে রুমাল ভিজিয়ে চোখ মুছছে।

    হাসান হাফিজুর রহমান ও আজহারকে পাঠানো হলো, ছাত্ররা যাতে পুলিশের দিকে ঢিল ছুড়ে না মারে, সেই চেষ্টা করতে।

    তিনি সেই উদ্দেশ্যে ছাত্রদের কাছে গেলেন এবং ইটের টুকরো নিয়ে নিজেই ঢিল ছুড়তে লাগলেন।

    শামসুল হক উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এলেন গাজীউল হকের কাছে। বললেন, ‘যখনই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, তখনই আমি সেই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি। আমি অবশ্যই এই সংগ্রামের সঙ্গে আছি।’

    কাঁদানে গ্যাসের শেল এসে লাগল গাজীউল হকের বুকে। তিনি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন। এম আর মুকুল তাঁকে ধরে দোতলায় নিয়ে গেলেন।

    ছাত্ররা তখন মেডিকেল কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যবর্তী পাঁচিল ভেঙে ফেলেছে। তারা মেডিকেলের দিকে এগোচ্ছে। কারণ, তারা অ্যাসেম্বলি ভবনের কাছাকাছি হতে চায়।

    মেডিকেল কলেজের গেট দিয়ে ছাত্ররা বেরোনোর চেষ্টা করছে। তখনই লেগে গেল সশস্ত্র পুলিশ ও নিরস্ত্র ছাত্রদের যুদ্ধ। ছাত্রদের অস্ত্র মেডিকেলের সামনে রাখা ইটের স্তূপ।

    খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ চলছে।

    গুলি হলো বেলা তিনটার দিকে।

    ৬১.

    ছাপাখানার গন্ধটা প্রথম প্রথম সহ্য হতো না রফিক উদ্দিন আহমেদ রফিকের। এই কালিঝুলি আর সিসার অক্ষর আর কেরোসিন আর স্পিরিটের গন্ধ। ঘরটাও গুমোট। ওদিকে গোলানো আটা আর তুঁতের দ্রবণটা মিলিয়ে যে আঠা, তারও একটা গন্ধ আছে। মানিকগঞ্জের সিংগাইরের মুক্ত প্রান্তরের বাতাস থেকে এই বদ্ধ ঘরে এসে তার মনটা টিকবে কেন। এই মাথার ওপরে ঝুলমাখা বাল্বের নিচে বসে ঘাড় গুঁজে সামনে প্রুফ দেখতে গিয়ে পায়ের নিচে গন্ধমূষিকের হঠাৎ দৌড়টা টের পেয়ে আরেকটা নতুন গন্ধ রফিকের নাকে এসে লাগে। বয়রা স্কুলের মাঠভরা ছিল চোরকাঁটা, ছোটবেলায় সে যখন দৌড়ে মাঠ পেরিয়ে বাড়ি ফিরত, তখন শোঁ শোঁ বাতাস এসে তার কানে লাগত। তারপর মোল্লাবাড়ির পেছনের জঙ্গলটা পেরোতে গেলে আতাফুল থেকে ভেসে আসত পাকা সবরি কলার গন্ধ। এখন এই গন্ধমূষিকের সঞ্চলন থেকে সে কথাটা তার মনে পড়ে অকারণে।

    বাবা তাকে এই ঢাকা শহরে এনে ছাপাখানার কাজে লাগিয়ে দিল, এটা সে মানতেই পারছিল না। সত্য বটে, দেবেন্দ্রনাথ কলেজের শিক্ষক প্রাণনাথ বাবু বাবাকে বলেছিলেন, রফিক তো কলেজ ফাঁকি দেয়। কিন্তু কলেজ ফাঁকি দিয়ে সে কী করে? নাটক করে। মানুদা নতুন নাটক লিখেছেন একটা, ক্ষুদিরামের ফাঁসি নিয়ে, এতে রফিকের ক্ষুদিরামের পার্ট করার কথা। তো, সেই কারণেই শেষের দিকে রফিক একটু বেশি সময়ই দিচ্ছিল তাদের উন্মেষ নাট্যদলের জন্য। আগের নাটক গলি থেকে রাজপথ-এ সে একটা সাইড ক্যারাক্টার করেছিল, কিন্তু অট্টহাস্য থেকে কান্নায় ভেঙে পড়ার সিনটায় সে এত ভালো করল যে সমস্ত ক্লাপস তার বরাতেই জুটেছিল। ভাগ্যিস, হ্যাজাক বাতির তীব্র আলোর টানে ছুটে আসা পোকাগুলোর একটা ওই সময়েই তার চোখে বাড়ি মেরেছিল। ফলে চোখ দিয়ে দরদর করে জল গড়াতে লাগল। সেদিনই নাটক শেষে মানুদা তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ক্ষুদিরামকে নিয়ে লিখছি রফিক, এবার তুমিই হবে ক্ষুদিরাম। ক্ষুদিরামের চেহারার সঙ্গেও তোমার মিল আছে।

    ব্যস্। রফিক হাওয়ায় ভাসতে শুরু করল। এরপর সে ক্ষুদিরাম! একেবারে সেন্ট্রাল ক্যারাক্টার। গলি থেকে রাজপথ নাটকটাই তার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। কারণ, পানুও ওই নাটক দেখতে গিয়েছিল বয়রা স্কুল মাঠে। রাহেলা খানম পানুর পরনে ছিল আকাশি শাড়ি, বিকেলের হলুদ আলোয় সেটা দেখাচ্ছিল সবুজ আর হ্যাজাক বাতির আলোয় সেটা অদ্ভুত একটা মেটে রং পেয়েছিল। নাটক শেষে যখন উইংসের পেছনে পর্দাঘেরা শামিয়ানা টাঙানো গ্রিনরুমে রফিক মেকআপ তুলছিল, মানুদার চোখেমুখে তখনো ভালো লাগার ঘোর, আর রফিকও বেশ ফুরফুরে মুডে গুনগুন করে গান গাইছে, মেকআপ তুলেই আবার লাগতে হবে মঞ্চ ভাঙতে, স্কুলের বেঞ্চগুলো যথাস্থানে রাখতে হবে, মঞ্চের টেবিলগুলোর বাঁধন খুলতে হবে, কলের গানঅলা তার সরঞ্জাম গোছাচ্ছে, এখনি তার পাওনা বুঝিয়ে দিতে হবে, এই সময় পানুর ছোট বোন শানু এসে হাজির, ‘ভাইজান, বুবু আপনেরে ডাকে।’

    পানু ডাকে? রফিকের বুকটা একটা কাকিলা মাছের মতো লাফ দিয়ে ওঠে। সেটা গোপন করে রফিক মেকআপ ঘষতে ঘষতে বলে, ‘পানু এখনো যায় নাই। রাইত বেড়ে যাচ্ছে, তোরা যাস নাই কেন?’

    ‘বুবু আপনেরে ডাকে।

    অগত্যা রফিককে পর্দার ঘের থেকে বাইরে আসতে হয়। হ্যাজাক লাইটগুলো এখন স্টেজ থেকে নামিয়ে মাটিতে রাখা হয়েছে, একটা লাল পর্দার ওপার থেকে আলো এসে পড়েছে পানুর মুখে, তাকে দেখাচ্ছে একটা টসটসে আমবেগুনের মতো। রফিক বলে, ‘কী, যাও নাই কেন বাড়ি?’

    পানু কিছু বলে না, তার নাকের দু’পাশটা বিস্ফারিত হতে থাকে, চোখ দিয়ে পানি গড়ায়, লালচে আলোয় সেই পানির ফোঁটা দুটোকে স্বর্ণবিন্দুর মতো লাগে।

    ‘কী হলো, তোমার চোখে কেন জল?’ নাটকের মুখস্থ সংলাপ ঝেড়ে দেয় রফিক।

    ‘তোমার দুঃখ দেইখা দুঃখ পাইছি। তুমি এই পার্ট কেন করছ?’

    ‘হা হা হা।’ রফিক হাসে। ‘এইটা তো সত্য না। নাটকের মধ্যে। নাটকের মধ্যে কারও পার্ট দেইখা যদি দর্শক কান্দে, তাইলে সে হইল সেরা অভিনেতা। আমার অভিনয় তার মানে ভালো হইছে।’ রফিক প্রাণ খুলে হাসে। আহ্। আজ তার কী আনন্দের দিন। ওই দিকে মানবেন্দ্র ওরফে মানুদা তারিফ করছেন, আর এদিকে পানু…আজ তার জীবন ধন্য।

    কম্পোজিটর কম্পোজ করছে বর্ণমালাগুলো। একটার পর একটা অক্ষর সাজাচ্ছে। এরপর প্রুফ তুলবে। রফিক প্রুফ দেখবে। কম্পোজও সে পারে কিছু কিছু। ‘ম’-এর পরে আকার দিলে ‘মা’ হয়, কী রকম জাদু না এই হরফগুলোতে।

    হরফের এই জাদুটাই ইদানীং তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলছে। নইলে মানিকগঞ্জ ছেড়ে সে ঢাকা শহরে এসে প্রেসের কাজে লাগে! তার থিয়েটার আর তার পানুকে ফেলে রেখে আসে সে?

    রাহেলা খানম পানু তাদের দুই ঘর দূরের প্রতিবেশী। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়েছে পানু। তারপর পড়া বন্ধ। ওই দিন, গলি থেকে রাজপথ নাটকের মঞ্চায়ন শেষে তারা বাড়ি ফিরেছিল একসাথে, রাতের পথে ছিল জ্যোৎস্না আর কুয়াশা আর শিশির। দূরে ঝোপঝাড় থেকে ভেসে আসছিল শিয়াল আর কুকুরের পালা দেওয়া ডাক। রফিক বলেছিল, ‘পানুরে, এর পরের নাটকে তো আমি ক্ষুদিরাম হব। আমার তো ফাঁসি হইয়া যাবে। এখন এই সামান্য পাগল হইয়া যাওয়ার সিন সহ্য করতে পারতেছ না, ক্ষুদিরাম সাইজা যখন ফাঁসিতে ঝুলব, গান গাব, ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’, তখন সহ্য করবা কেমনে?

    তোমার ক্ষুদিরাম করনের দরকার নাই, রফিক ভাই’, পানু রফিকের হাত ধরে বলেছিল। আর কী আশ্চর্য, ওই সামান্য একটা হাতের মুঠোয় রফিকের সমস্তটা অস্তিত্ব যেন বন্দী হয়ে গেল মুহূর্তে। তারপর রফিকের দিবস-রজনীজুড়ে শুধু ওই এক বালিকার মুখ। কেন এই রকম হয়।

    কিন্তু তাই বলে ক্ষুদিরাম নাটকের রিহার্সাল তো আর বাদ দেওয়া যায় না। কলেজ ফাঁকি দেওয়া শুরু করল সে। ওদিকে পানুর বাবা-মাও পানুর জন্য পাত্র খুঁজছেন। রফিক আর পানুর মেলামেশাটা নিয়ে কানাঘুষা শুরু হলে ওরা বলল, ‘তাইলে আর বাইরে বাইরে পাত্র খুঁজব কেন। পাত্র যখন ঘরের কাছেই আছে।’

    ওরা যখন মেলামেশা করছেই, সেইটাকে একটা স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যই ওদের পানচিনিও হয়ে গেছে। এই তো ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখে ওদের বিয়ে। আর যেহেতু সামনে বিয়ে, নতুন দায়িত্ব, নতুন জীবনের ভার, রফিক তাদের এই বর্ণমালা প্রিন্টিং প্রেসের কাজটায় ইদানীং মনও লাগিয়েছে বেশ।

    কিন্তু এর মধ্যে রফিকের মাথায় নতুন চিন্তা জট পাকাতে শুরু করেছে। যে ছাপাখানার গন্ধ তার অসহ্য বোধ হতো, সেটাই তাকে মেশকে আম্বরের মতো টানছে।

    ঘটনা ঘটল এইভাবে। বর্ণমালা প্রিন্টিং প্রেসের বৃদ্ধ কম্পোজিটর, চোখে বেশি পাওয়ারের গোল চশমা, কী একটা লিফলেট কম্পোজ করছেন, হঠাৎই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলেন, ‘এই বুড়া বয়সে বুঝি বেকার হইয়া যাইতে অইব। চাকরি বুঝি আর থাকে না!

    রফিক টেবিলে বসে আজ প্রেসের জন্য কী কী কিনতে হবে, কালি আর কাগজ ইত্যাদি, সেসবের ফর্দ বানাচ্ছিল। ফরিদ চাচার কথা শুনে সে মাথা না তুলে বলে, ‘কী কন, চাচা?’

    ‘হ। বুঝতাছ না চারদিকের বাতাস? লিফলেটে কী লেখছে। উর্দু নাকি এই দেশের ভাষা হইব। সরকারি কাম সব উর্দুতে হইব। তাইলে আমার এই বাংলা হরফ কী হইব। আমি তো এই বাংলা কম্পোজ ছাড়া আর কিছু জানি না। এখন এই বয়সে কি উর্দু কম্পোজ শেখনের টাইম আছে। তোমাগো প্রেস তো আর বন্ধ হইব না, ভাস্তা, তোমরা উর্দু টাইপ কিনা আনবা, উর্দু কম্পোজিটর আইব, আমি তো এই বয়সে তোমার চাচি আর অপগণ্ড পোলাপান ছয়টা লইয়া রাস্তায় ভিক্ষা করতে থালা হাতে বইয়া পড়ুম।’

    ওই লিফলেটটার প্রুফ কাটতে গিয়ে রফিকের মনে হলো, প্রুফের সঙ্গে কম্পোজিটর ফরিদ চাচার চোখের পানি লেগে গেছে। নইলে কাগজটার দুই জায়গায় ভেজা কেন। রফিক লিফলেটটা পড়ে, ‘কী কয়? রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। এটা সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিরা কেন মেনে নেবে? তাই তো ছাত্ররা ডাক দিয়েছে প্রতিবাদ সমাবেশ আর মিছিলের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হবে এই প্রতিবাদসভা।

    ছাপাখানার কাঠের খোপগুলো ভরা বিভিন্ন হরফ। একেকটা খোপে একেক বর্ণ। আবার বিভিন্ন পয়েন্টের অক্ষরের জন্য একেকটা সারি। রফিক এই টাইপগুলোর দিকে তাকায়। হাতে তুলে নেয় সিসার অক্ষরগুলো। সব উল্টা। এগুলো ছাপ দিলে সোজা হবে। এই অক্ষরগুলো সব ফেলে দিতে হবে। এর বদলে কিনে এনে রাখতে হবে উর্দু অক্ষর!

    রফিক বাংলা অক্ষরগুলোর প্রেমে পড়ে যায়। এই প্রিন্টিং প্রেসের কালিঝুলি, কেরোসিন, তারপিন, স্পিরিট, সিসা, লোহার পাত, তুঁতের গন্ধ তাকে আবিষ্ট করে তোলে।

    মধ্যখানে সিংগাইর বাড়ি থেকে ঘুরে আসে রফিক। পানুর সঙ্গে দেখা করা দরকার ছিল। সামনে বিয়ে। বিয়েতে কী কী খরচ করতে হবে, পানুর সঙ্গে একটু পরামর্শ করার জন্যই মূলত যাওয়া। পানু তো কিছুতেই মুখ খুলবে না। বলে, ‘তুমি কী দিবা, দেও। আমি কেন বলব।’ শেষে পানুর ভাবি মুখ খুলল, ‘আলতা, সাবান, চুড়ি, শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট, স্নো, পাউডার আর সোনার জিনিস যা দিবা…’

    আজ রফিক বেরোচ্ছে সেই কেনাকাটা করার জন্য। তার মামাতো ভাই মোশাররফকে সে ডেকে এনেছে বাড়ি থেকে। হবিবর তার ভ্রাতুষ্পুত্র বটে, কিন্তু তারা সমবয়সী, আর কেনাকাটার ব্যাপারে তার সুনামও আছে। দরাদরির ব্যাপারে মোশাররফের প্রতিভা জাদুকরি, সে দুই আনার জিনিস কিনে দুই পয়সা দিয়ে চলে আসে। দোকানদার হাসিমুখে বলে, ‘আবার আইসেন।’

    ফাল্গুন মাস। রোদটা চড়া। তবু শীতটা আছে বলে রোদটা মিষ্টিই লাগছে। দোকানে আজ ভিড় কম।

    রফিকের গায়ে হালকা নীল রঙের শার্ট, পরনে সাদা প্যান্ট, পায়ে নেভি নীল মোজা এবং ঝকঝকে ইংলিশ জুতা।

    সদরঘাট, নবাবপুর মার্কেট চষে মোশাররফ আর রফিক মিলে আলতা, সাবান, চুড়ি ইত্যাদি সস্তার জিনিসগুলো কিনে ফেলে ভেবেছিল শাঁখারিপট্টিতে ঢুকবে স্বর্ণালংকারের জন্য, কিন্তু এরই মধ্যে রিকশাঅলার মুখে শুনল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর মেডিকেল কলেজের মোড়ে লড়াই বেধে গেছে। ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে, মিছিল হবে না আজ আর-রফিক সেটাই জানত। তা না হলে সে কি আর মিছিলে যেত না। কিন্তু ছেলেরা যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে শুরু করেছে, আর লড়াইটাও যে জমে গেছে, সেটা শোনামাত্র রফিক বলল, ‘মোশাররফ, চল, মিছিলে যাইতে হইব। বুঝস না…’

    মোশাররফ ঠিক বুঝল কি বুঝল না, সেই জানে, কিন্তু সে-ও হাঁটা শুরু করে রফিকের পিছু পিছু।

    দূর থেকে শোনা যাচ্ছে স্লোগান, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই…’ রফিকের মাথার মধ্যে স্বরে অ স্বরে আ ক খ বর্ণগুলো লাফাতে শুরু করে। সে বলে, ‘মোশাররফ, জোরে হাঁট।’

    কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা মিছিলটা ধরে ফেলে আর মিছিলের সঙ্গে মিশে যায়।

    একবার তার পানুর কথা মনে পড়ে। যদি কোনো কারণে পানু শোনে যে রফিক মিছিলে গিয়েছিল, পানু কি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলবে। একদিন রিহার্সাল দেখাতে পানুকে নিয়ে গিয়েছিল রফিক। বয়রা স্কুলের ক্লাস ফাইভের ঘরে রিহার্সাল হচ্ছিল। রফিক যখন গানটা ধরল, একবার বিদায় দে মা ফিরে আসি…

    তখন পুরোটা ঘর, এমনকি জানালায় রিহার্সালদর্শী জনতাও নীরব হয়ে গিয়েছিল। এর ভেতরেই বাষ্পের উদ্‌গিরণের আওয়াজ। কেউ ফোঁপাচ্ছে। সে দিকে না তাকিয়েও রফিক বুঝতে পারছিল, এটা পানুই। রফিকের কোনো দুঃখ-কষ্ট, হোক না তা নাটকের কাল্পনিক জীবনে, পানু একদমই সহ্য করতে পারে না।

    আহা। আর মাত্র তিন দিন। তিন দিন পরই রফিকের ঘরে আসবে পানু। তার পর থেকে তাদের যৌথ জীবন। ছাপাখানাটা তাদের নিজস্ব তবু

    বিয়ের কার্ডটার ইম্প্রেশন কালকে পর্যন্ত হয়নি। আজ সন্ধ্যার মধ্যেই আমন্ত্রণপত্র বের করে ফেলতে হবে। রাতেই বিয়ের কার্ড আর খরচাপাতি নিয়ে তারা রওনা দেবে মানিকগঞ্জের পথে। কাল-পরশু কার্ডগুলো বিলিবণ্টন করতে হবে।

    ‘রাষ্ট্রভাষা রাষ্ট্রভাষা, বাংলা চাই, বাংলা চাই’—স্লোগানে কণ্ঠ মেলাতে মেলাতে রফিক এই সব ভাবে। সামনে পুলিশের ব্যারিকেড। রফিকের চোয়াল শক্ত হচ্ছে, গলার রগ ফুলে উঠছে, কণ্ঠস্বর আসমান বিদীর্ণ করতে চাইছে, হাতের মুঠো সূর্যকে ধরবে বলে লম্বা হচ্ছে…

    তখনই গুলির শব্দ। রেইনট্রি গাছগুলো থেকে গগনচিলগুলো উড়ে ওঠে, কাকের দল চিৎকার করতে থাকে।

    গুলি রফিকের কপালে লাগে। সিসা তার করোটি ভেদ করে মগজে প্রবেশ করলে সে পায় সিসার হরফের গন্ধ। ছাপাখানার গন্ধ।

    হাত থেকে বাজারের থলে পড়ে যায়। ভেঙে যায় আলতার শিশি। রফিকের শরীর ঢলে পড়ে। তার মাথা থেকে রক্ত আর মগজের ধারা আলতার ধারার সঙ্গে মিশে পথের ধুলোয় প্রবাহিত হয়। আর করোটির ফোকর দিয়ে বর্ণমালা প্রিন্টিং প্রেসের ১২ ফন্ট, ১৪ ফন্ট, ১৮ ফন্টের বাংলা বর্ণমালাগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে বেরিয়ে সটান দাঁড়িয়ে পড়ে, রফিক খোলা চোখে সেই বর্ণমালাগুলো দেখতে পায়। বর্ণমালা ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল রোদে যেন সোনা হয়ে উঠছে। আর কী যে ভালো লাগছে সেই সিসার গন্ধটুকুন।

    রাহেলা খানম পানুর হাতে পানচিনির আংটিটা, কুয়োর পাড়ে ওজু করতে করতে পানু সেটা একবার খুলে কনিষ্ঠায় পরে, তারপর হাত ধোওয়া হয়ে গেলে আবার পরে নেয় অনামিকায়। এ সময় তাদের বাঁশঝাড়ে একটা কাক কা কা কা বলে ডেকে উঠলে পানুর বুকটা কেন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। সে জানে না কেন, রিহার্সালের দিনে ‘একবার বিদায় দে মা’ বলে রফিক যখন টান ধরেছিল, রফিকের সেই মুখখানা পানুর হঠাৎ মনে পড়ে।

    একটা ঢিল ছুড়ে মেরে পানু কাকটাকে তাড়াতে চায়।

    ৬২.

    আবুল বরকত সকাল থেকেই ব্যস্ত ছিলেন মধুর রেস্তোরাঁয়। তাঁর হাতে ছিল পোস্টার। লম্বা মানুষটা হাতে পোস্টার নিয়ে ছোটাছুটি করছিলেন মধুর রেস্তোরাঁয়। মোহাম্মদ সুলতান তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পোস্টার নিয়ে ঘুরছ কেন বরকত?’

    বরকত বললেন, ‘আরে, আমার হাত লম্বা দেখে ওরা সবাই আমাকে পোস্টার লাগানোর দায়িত্ব দিয়েছে। দেখুন না, আমি কী রকম উঁচুতে পোস্টারগুলো লাগাচ্ছি। অল্প কটা বাকি আছে, লাগিয়ে দেই।’

    আবুল বরকত ছিলেন অস্বাভাবিক লম্বা। মুর্শিদাবাদের ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে তাঁদের পরিবারটির নামই ছিল ‘টল ফ্যামিলি’। তাঁর বাবা শামসুজ্জোহাও ভীষণ লম্বা। এত লম্বা যে বহু দরজায় ঢোকার সময় তাঁর মাথা চৌকাঠে আটকে যায়। তিনি মাথা নিচু করে দরজা পার হন। সেই টল ফ্যামিলির ছেলে আবুল বরকত বছর চারেক আগে চলে এসেছেন পূর্ব বাংলায়। পুরানা পল্টন লাইনে তাঁর মামা আবদুল মালিক থাকেন। বরকত থাকেন সেই মামার বাসা ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’য়। তিনি ভর্তি হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। পরীক্ষার ফলও তাঁর ভালো হচ্ছে। গত বছর অনার্স পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীতে চতুর্থ স্থান অধিকার করেছেন।

    রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়েন, আর আবুল বরকত ভাবেন, কাকে বলে রাষ্ট্র আর কাকে বলে দেশ। একটাই দেশ ছিল, মুর্শিদাবাদ, আর ঢাকা, সিরাজউদ্দৌলার মুর্শিদাবাদ আর শায়েস্তা খাঁর ঢাকা। ১৯৪৭-এ মাউন্টব্যাটেন কলম দিয়ে দাগ টানলেন, আর দেশটা দুই ভাগ হয়ে গেল। তাঁর মা থেকে গেলেন মুর্শিদাবাদে, আর তিনি এলেন ঢাকায়। কোনটা তাঁর দেশ, কোনটা তাঁর মাতৃভূমি?

    কিন্তু মাতৃভাষা কী, তা নিয়ে আবুল বরকতের কোনো দ্বিধা ছিল না। বাংলা ভাষার মর্যাদা তাঁর কাছে মায়ের মর্যাদারই সমান। তাঁর হাতের একটা পোস্টারে লেখা : ‘নাজিম, চুক্তি পালন কর, নইলে গদি ছাড়। রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম আমাদের জীবন-সংগ্রাম’।

    সাদা কাগজে লাল কালিতে লেখা। এ যেন আবুল বরকতেরই মনের কথা। রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম আর তাঁর জীবন-সংগ্রাম এখন একবিন্দুতে এসে মিলেছে।

    চুক্তিটা হলো সেই ‘৪৮ সালের চুক্তি। যেই চুক্তি প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম, কামরুদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামেরা করেছিলেন খাজা নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে, ৮ দফা চুক্তি, যার একটা ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন। যেই চুক্তি জেলখানায় শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ প্রমুখ অনুমোদন করেছিলেন।

    নীল রঙের হাফ শার্ট, খাকি প্যান্ট, পায়ে কাবুলি স্যান্ডেল-সদা বিনয়ী, এই ছেলেটার কর্মতৎপরতার দিকে আরেকবার প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকান মোহাম্মদ সুলতান।

    শামসুল হক রেস্তোরাঁর চেয়ারে বসে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে কথা বলছিলেন। তখন হাসান হাফিজুর রহমানের সঙ্গে আবুল বরকতও উত্তেজিত হয়েছিলেন।

    হাসান হাফিজুর রহমান কবিতা লেখেন। আবুল বরকতের সঙ্গে তাঁর বিশেষ রকমের বন্ধুত্বও আছে।

    তারপর আবুল বরকত হাজারো ছেলের ভিড়ে কোথায় হারিয়ে যান। না, আবুল বরকত হারান না। তিনি আমতলার সভায় যান। ‘আমরা কি ১৪৪ ধারার ভয়ে হার মানব?’ বক্তার এই প্রশ্নের জবাবে ‘না, না’ বলতে বলতে তিনি দু হাত তোলেন। তাঁর লম্বা শরীরের লম্বা হাত আমগাছের পাতা স্পর্শ করে।

    ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি সেই দৃশ্য দেখে হেসেই কুটিকুটি।

    তাদের মনে হয়, আবুল বরকতের এই প্রতিবাদী হাতের মুঠো আমগাছ ফুঁড়ে ওই আকাশটাকেই যেন স্পর্শ করবে।

    কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ শুরু হলে আরও অনেকের মতো আবুল বরকতও মধুর রেস্তোরাঁর পার্শ্ববর্তী দেয়াল টপকে মেডিকেল ক্যাম্পাসে ঢোকেন। সেখানে শুরু হয় ইষ্টক যুদ্ধ।

    ছাপরার তৈরি ব্যারাকের মতো ঘরে মেডিকেল ছাত্রদের হোস্টেল। আবুল বরকত গিয়ে সেইখানে অবস্থান নেন। অন্য ছেলেদের সঙ্গে তাঁরা ইট নিয়ে পুলিশের দিকে ছুড়তে ছুড়তে এগোন। আবার পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুরো এলাকাটাকে ধোঁয়ায় ছেয়ে ফেলতে ধরলে তিনিও পিছিয়ে ব্যারাকের দিকে আসেন। চোখের জ্বলুনি থেকে বাঁচার কৌশল ছাত্ররা আবিষ্কার করেছে। বালতি, ডেকচি, হাঁড়ি- কলসি—যা পাওয়া গেছে, তাতেই পানি ভরে রাখা হয়েছে। ছেলেরা বারবার করে চোখ ধুয়ে নিচ্ছে। কেউ বা গায়ের কাপড় খুলে পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে চোখ মুছছে। এখানে মেডিকেলের ছাত্র, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র, আর্টসের ছাত্র, সায়েন্সের ছাত্র—সবাই এসে মিলেছে। এটাই এখন প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় মঞ্চ। বাবুর্চিরা ইটের পালা থেকে ইট তুলে এনে ভেঙে ভেঙে ঢিল বানিয়ে স্তূপ করে রাখছে। সেখান থেকে ঢিল তুলে নিয়ে ছেলেরা ছুড়ে মারছে পুলিশের দিকে। আরও সাহসী ছেলেরা টিয়ার গ্যাসের শেল এসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটা ধরে পাল্টা ছুড়ে মারছে পুলিশের দিকেই। এবার পুলিশও কাঁদানে গ্যাসের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে।

    লড়াইয়ের একপর্যায়ে আবুল বরকত আর তাঁর কজন বন্ধু একটু পিছিয়ে ২০ নম্বর ব্যারাকের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থান নেন। একটুখানি জিরিয়ে নিয়ে আবার লড়াইয়ে নামতে হবে।

    আবুল বরকতের লম্বা হাতে ঢিল ছোড়ার কাজটা হয় খুব ভালো। বিশ্রামের সময় তো এখন নয়।

    মোহন মিয়া সেখানে এলেন। আবুল বরকতকে ডাকলেন, ‘আবাই। কী অবস্থা?’

    বরকত বললেন, ‘চলুন আবার যাই।

    ওরা কেবল উঠেছেন, এমন সময় গুলির শব্দ। পড়ে গেলেন আবুল বরকত।

    শফিকুর রহমান থাকেন ১৭ নম্বরে, এক বালতি পানি এনে ওর মাথায় চোখেমুখে ঢেলে দিলেন। তিনি ভাবছেন, টিয়ার গ্যাসের প্রতিক্রিয়া।

    ততক্ষণে রক্ত এসে মিশেছে পানির প্রবাহের সঙ্গে।

    মোহন মিয়া বললেন, ‘গুলি লেগেছে। ধরেন, হাসপাতালে নিতে হবে, ধরেন। চলেন।’

    মোহন মিয়া ধরলেন আবুল বরকতের মাথার দিকটা, শফিকুর ধরলেন পায়ের দিকটা। এত বিশাল বপুটাকে ওরা দুজনে ধরে নিতে পারেন! ভীষণ কষ্ট লাগছিল।

    আরও দু-তিনজন এসে ধরল আবুল বরকতের পড়ে যাওয়া শরীরটা। আবুল বরকত বললেন, ‘ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। বাঁচব না। বিষ্ণুপ্রিয়া ভবন, পুরানা পল্টনে সংবাদ পৌঁছে দেবেন।

    তাঁকে নিয়ে ওরা ছুটছেন জরুরি বিভাগের দিকে। রেডক্রস আঁকা ইমার্জেন্সির বারান্দায় উঠলেন তাঁরা। স্ট্রেচার কই। স্ট্রেচার।

    স্ট্রেচারে শোয়ানো হলো বরকতকে। স্ট্রেচার বেয়ে রক্ত পড়ছে মেঝেতে। টুপটাপ। তাঁর পেটের চামড়া ঝুলে আছে স্ট্রেচারের বাইরে। তিনি বলছেন, ‘পানি পানি।

    মোহন মিয়া তাঁর ভেজা রুমালটা দিলেন বরকতের মুখে। বললেন, ‘চোষো।’

    একজন নার্স সেই দৃশ্য দেখে পুলিশের উদ্দেশে বললেন, ‘কাপুরুষ।’ আর মোহন মিয়াদের বললেন, ‘আপনারা যান গেটে, প্রতিশোধ নেন। আমরা এনাকে দেখছি।’

    মোহন মিয়া প্রতিশোধের জন্যে যাচ্ছেন। তখনই আরেকটা দেহ স্ট্রেচারে আসছে। তার মাথার খুলি হাঁ করা। সেখান থেকে যেন বেরিয়ে আসছে রক্তাক্ত বর্ণমালা।

    মোহন মিয়া ফিরে তাকালেন। দেখলেন, আবুল বরকত স্ট্রেচার থেকে উঠে যাচ্ছে। তাঁর শরীর লম্বা হচ্ছে। তাঁর মাথা ফুঁড়ে গেল হাসপাতালের ছাদ।

    তাঁর শরীর আরও বড় হচ্ছে। তাঁর হাত আরও লম্বা হচ্ছে।

    আর তখন আকাশভরা নক্ষত্ৰ।

    নক্ষত্রগুলোর গায়ে গায়ে বর্ণখচিত। অ আ ক খ।

    আবুল বরকত হাসছেন আর একটা একটা করে বর্ণের গায়ে হাত বোলাচ্ছেন। সোনালি বর্ণগুলো লাল হতে শুরু করেছে।

    কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। তিনি বললেন, ‘পুরানা পল্টন লেইনে বিষ্ণুপ্রিয়া ভবনে খবরটা দিতে হবে। সাইকেল কই, সাইকেল…’

    মোহন মিয়া জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন।

    আবুল বরকত তখনো, ওই সন্ধ্যায়, আকাশের গায়ে নক্ষত্রে নক্ষত্রে স্পর্শ করে চলেছেন বাংলা বর্ণমালা …

    ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বলল, ‘যা ভেবেছিলাম তাই, এই ছেলের হাত আকাশ স্পর্শ করল।’

    আর মুর্শিদাবাদের বাবলা গ্রামে, জননী হাসিনা বেগম, হঠাৎ আকাশে তাকালেন। রাত তখন সাড়ে সাতটা, মুর্শিদাবাদে, ঢাকায় আটটা।

    তিনি দেখতে পেলেন, আকাশে নক্ষত্রগুলোয় যেন আগুন লেগেছে, সব এত লাল। তিনি কারণটা ধরতে পারলেন না।

    পরের দিন সন্ধ্যায় টেলিগ্রাম এল ঢাকা থেকে। আবুল বরকতের আব্বা শামসুজ্জোহা সেই বার্তা পড়ে স্তব্ধ হয়ে রইলেন। হাসিনা বেগম বুঝতে পারছেন না কী হয়েছে। ছেলের নিরাপত্তার জন্যে তাকে পাঠানো হয়েছে ওপার বাংলায়, কলকাতায় কিংবা মুর্শিদাবাদে কখন কী বিপদ ঘটে, সেই ভয়ে। তাহলে কী ঘটল আবুল বরকতের! পাকিস্তান কি মুসলমানদের জন্য নিরাপদ নয়?

    তিনি তাকিয়ে রইলেন আকাশে, তারার দলের দিকে, একই আকাশ, একই তারা, একই চাঁদের নিচে, দূরে কোথাও তাঁর ছেলে আছে। কেমন আছে সে?

    ৬৩.

    কামরুদ্দীন আহমদের বাসায় কড়া নাড়লেন তাজউদ্দীন আহমদ। বারান্দায় তেরসা করে এসে পড়েছে বিকেলের রোদ। তাজউদ্দীনের ছায়া পড়ে কবাটে। সেই কবাট খুললে তাঁর ছায়া গিয়ে পড়ে ঘরের ভেতরে।

    কামরুদ্দীন সাহেব দরজা খুলেই উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইউনিভার্সিটির কোনো খবর জানেন?’

    বাইরের আলো তাঁর মুখে পড়েছে, উদ্বেগের বলিরেখা কামরুদ্দীন আহমদের মুখে স্পষ্ট দেখা যায়।

    তাজউদ্দীন বললেন, ‘আমি গিয়েছিলাম দুপুরের পরে, জনসমাবেশ দেখলাম, শুনলাম কাঁদানে গ্যাসও ছোড়া হয়েছে। সেখান থেকে কাজে ডিপিআই অফিস এসডিও অফিস হয়ে আসছি।’

    ‘কী বলেন? কিছুই জানেন না?’

    ‘না, মানে আর কিছু কি ঘটেছে?’ তাজউদ্দীনের মুখটা বিব্রত দেখায়।

    ‘জানেন না গুলি হয়েছে? ছাত্র মারা গেছে।’

    ‘না তো!’

    ‘আপনি যে কোন জগতে থাকেন?’

    তাজউদ্দীন আহমদের মুখটা পাংশু হয়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তিনি দুপুরে গিয়েছিলেন, মিনিট কুড়ি ছিলেনও। সমাবেশ দেখেছেন, কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়েছে, শুনেছেনও, কিন্তু শ্রীপুরের ফাওগাঁও এমই স্কুলের দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয় দিন পনেরো আগে, তিনি সেই দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন এবং ওই স্কুলের উন্নতি কীভাবে ঘটানো যায়, তাই নিয়েই মগ্ন হয়ে ছিলেন। আজও তিনি ডিপিআই অফিসে ধরনা দিয়েছেন স্কুলের জন্য গ্রান্ট ইন এইডস পাওয়া নিয়ে। তারপর গেছেন এসডিও অফিসে, স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভা নিয়ে কথা বলতে। এর মধ্যে এত বড় ঘটনা ঘটে গেল, আর তিনি তার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারলেন না!

    তিনি ইতস্তত করতে লাগলেন।

    কামরুদ্দীন বললেন, ‘চলেন, আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে চলেন।’

    ‘চলেন।’

    কামরুদ্দীন আহমদ ও তাজউদ্দীন নবাবপুরে লীগ অফিসে গেলেন। তারপর সেখান থেকে কেমব্রিজ ফার্মেসি হয়ে ডা. করিমকে সঙ্গে নিয়ে তিনি রওনা হলেন মেডিকেল হাসপাতালের দিকে।

    মেডিকেল হাসপাতালে গিজগিজ করছে পুলিশ আর সামরিক বাহিনীর লোক। তারা কিছুতেই মর্গের আশপাশে ঘেঁষতে দিচ্ছে না। রফিক নামের এক প্রেসের মালিকের ছেলে মারা গেছেন। আবদুল জব্বার নামে একজনও মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। আবুল বরকত নামের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক ছাত্রের অপারেশন চলছে ওটিতে। আরও অনেক আহত। গুলিবিদ্ধ। শোনা যাচ্ছে, দশ জন মারা গেছে। শত শত আহত।

    কিন্তু হাসপাতালে আহত বা নিহতদের আশপাশে যাওয়া যাচ্ছে না। কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে মানুষ আর মানুষ। পুরান ঢাকার যে অধিবাসীরা চার বছর আগে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল, তারাই কস কী, ছাত্র মাইরা ফেলাইছে গুলি কইরা’ বলে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে ভিড় জমাল। এখানে-ওখানে রক্তের দাগ, গুলির খোসা। বাতাসে তখনো কাঁদানে গ্যাসের গন্ধ। হাজার মানুষের ভিড়ে পদধূলিতে ভারী চারপাশ।

    সালাম নামে আরেকজন মারা গেছে, শোনা গেল।

    মাইক্রোফোন এসে গেছে একটা। আনিসুজ্জামান লিখে দিচ্ছেন আর মোহাম্মদ তোয়াহা সেই লেখা দেখে ভাষণ দিচ্ছেন। শেষে লেখা ফুরিয়ে এলে মাইক্রোফোন তুলে নিলেন আনিসুজ্জামান। পুলিশের উদ্দেশে বললেন, ‘পুলিশ ভাইয়েরা, চার বছর আগে আপনারা যখন প্ৰতিবাদ করেছিলেন, তখন সেনাবাহিনীর সদস্য এনে আপনাদের ওপরে গুলি চালানো হয়েছিল, আর আপনারা গুলি করছেন আপনাদের ভাইয়ের ওপরে, যারা আপনাদের মায়ের ভাষার মর্যাদার জন্য লড়ছে?’

    এর মধ্যে অনেক বক্তা এসে গেছে। মাইক্রোফোন নিয়ে টানাটানি। সবারই প্রচণ্ড ক্ষোভ, ঘৃণা আগুনের গোলার মতো কণ্ঠ থেকে নিঃসরিত হচ্ছে। গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পরিষদ সদস্য আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ চলে এলেন পরিষদ থেকে পদত্যাগ করে। তিনি মাইক্রোফোনে জানালেন সে কথা। আবুল কালাম শামসুদ্দীন ছুটে এলেন আজাদ অফিস থেকে। আরও আরও পরিষদ সদস্য এলেন ছাত্রদের সঙ্গে সংহতি জানাতে।

    ফররুখ আহমদের নেতৃত্বে শিল্পীরা বেতারকেন্দ্র বর্জন করে চলে এলেন রাস্তায়।

    হাসান হাফিজুর রহমান চলে গেলেন ছাপাখানায়, ইশতেহার বের করতে।

    বাইরে মিলিটারি মোতায়েন করা হয়েছে। কারফিউয়ের ঘোষণা আসছে।

    রাত ১১টায় তাজউদ্দীন ফিরে এলেন যোগীনগরের বাসায়। আকাশে- বাতাসে চাপা উত্তেজনা। চারদিক থমথমে।

    যুবলীগের অফিসের সঙ্গেই তাজউদ্দীনের শোবার ঘর।

    রাত তিনটায় কিসের যেন শব্দে তাজউদ্দীনের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি বুঝলেন, পুলিশ এসেছে যুবলীগ কার্যালয়ে তল্লাশি করতে। অন্ধকারে দরজা খুলে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। ওই যে ওইখানে পুলিশের গাড়ি। তারা ঢুকছে যুবলীগ অফিসে। তাজউদ্দীন নিজের নিশ্বাসের শব্দ শুনছেন। একটার পর একটা বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে, বেড়া ঘেঁষে তিনি সরে যাচ্ছেন। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ওই বাড়ির বারান্দায় আলো। আলোর পাশ দিয়ে গেলে তাঁকে দেখা যাবে। আলোটা যেখানে পড়েনি, তত দূর পর্যন্ত সরে গেলেন তিনি।

    একটা বাড়ির বাগানে, একটা গাছের নিচে তিনি চুপ করে বসে রইলেন।

    ঝিঁঝির ডাক আসছে গাছটা থেকে? কী গাছ এটা? তিনি জানেন না। চুপ করে বসে রইলেন। মশা তাঁর পায়ে কামড় বসাচ্ছে, কিন্তু চাপড় মারা যাবে না। যদি শব্দ হয়। গত রাত পর্যন্ত খবর, চারজন মারা গেছে, তবে চারদিকে রব, শহীদের সংখ্যা ১০-১১ জন। আহত ৩০, জেলে নেওয়া হয়েছে ৬২ জনকে। এখন আবার গ্রেপ্তার অভিযানে বেরিয়েছে পুলিশ। অলি আহাদকে সাবধান করা দরকার।

    পুলিশ চলে গেল চারটার দিকে। তারপর আর ঘুমোনোর মানে হয় না। তিনি আবার মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের দিকে রওনা হলেন সাইকেল নিয়ে।

    ৬৪.

    আকিলা খাতুনের পেটে সাত মাসের বাচ্চা। উঠতে বসতে হয় সাবধানে। কোলে একটা বাচ্চা, চার বছরের শাহনাজ।

    সকাল সকাল আকিলা খাতুনকে গরম ভাত রান্না করতে হচ্ছে। কাঠের চুলা। একটা চোঙে ফুঁ দিচ্ছেন আকিলা। তাঁর মুখে চুলার আগুনের লাল আলো, সাদা ছাই এসে পড়ছে। মুখ ফুলিয়ে ফুঁ দিতে তাঁর কষ্ট হচ্ছে।

    তাঁর স্বামী শফিউর রহমান যাবেন কাজে। হাইকোর্টের কেরানি তিনি আবার বিএ পড়ছেনও।

    শফিউর রহমানের পরনে পায়জামা। গায়ে একটা হাফহাতা গেঞ্জি। তার ওপরে তিনি শার্ট চাপালেন। তার ওপরে চাপালেন কোট।

    তিনি বললেন, ‘এটা কোনো সভ্য দেশ হলো? সভ্য দেশে পুলিশ গুলি করার আগে সাবধান করে। সিগন্যাল দেয়। তার পরও লোকে কথা না শুনলে পায়ে গুলি করে। আর এ কি কাণ্ড! এভাবে গুলি করে ছাত্রদের মারল পুলিশ।’

    শফিউরের আব্বা বসেছিলেন পাশের ঘরে, বিছানায়। তাঁর বয়স ষাট, গালে দাড়ি, মাথায় টুপি। তিনি বললেন, ‘এই জন্য লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান বলেছিলাম! সে তো খালি মুখে বলি নাই রে, অন্তর থেকেই বলেছিলাম। তাই তো তোদের পাঁচটা ভাইকে নিয়ে সবকিছু পেছনে ফেলে চব্বিশ পরগনা থেকে ঢাকা চলে এলাম। ভাবলাম, আজাদ পাকিস্তানে আজাদিতে থাকব। এখন এসব কী শুনছি। এই এর পেছনে আবার হিন্দুস্তানের ষড়যন্ত্র নাই তো। মর্নিং নিউজ পত্রিকায় তো তা-ই লিখেছে দেখছি।’

    শফিউর বললেন, ‘আব্বা, সবকিছুর পেছনে হিন্দুস্তানের ষড়যন্ত্র খুঁজবেন না তো! ওগো তোমার ভাত হলো?’

    শাহনাজ বলল, ‘আম্মা, আব্বা ভাত চায়।’

    ‘এই তো হয়ে এল।’ আকিলা খাতুন ভাতের হাঁড়িতে চামচ ডুবিয়ে একটা ভাত তুলে সেটা টিপতে টিপতে বলেন।

    শফিউর বলেন, ‘আব্বা, আপনাকে বললাম, পাকিস্তান আর টিকবে না। কাল গুলির খবরে সারা দেশে সবাই খুবই খেপে গেছে। রাস্তায় রাস্তায় মিছিল বেরিয়েছে। হাজার হাজার লোক সেই সব মিছিলে যোগ দিয়েছে। মিছিলে কত লোক। এইভাবে কেউ মানুষ মারে। গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দিয়েছে।’

    শাহনাজ বলে, ‘আব্বা খুলি কী?

    ‘ভাত হয়ে গেছে। খেতে আসো। আব্বা, আপনিও বসেন।’ মেঝেতে পিঁড়ি বিছিয়ে ভাত বাড়ে আকিলা।

    শফিউর আর তাঁর পিতা মাহবুবুর রহমান খেতে বসেন। টিনের থালায় ভাত। টিনের মগে পানি। ভাত, ডাল, আলুর ভর্তা।

    বাইরে তখন স্লোগান উঠেছে, ‘নুরুল আমিনের ফাঁসি চাই। শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।

    শফিউর এক লোকমা ভাত মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে বলেন, ‘দেখলা, মিছিল এই আজাদ সিনেমা হলের কাছে পর্যন্ত চলে এসেছে। সবাই এখন মিছিলে অংশ নিচ্ছে।

    মাহবুবুর রহমান বললেন, ‘বাবা শফিউর, সাবধানে যেয়ো।’

    খাওয়া শেষে থালাতেই হাত ধুলেন শফিউর। লাল গামছায় হাত মুছে তিনি শাহনাজকে কোলে নিলেন। বললেন, ‘আসি আম্মা।’

    শাহনাজ বলল, ‘আব্বা, খুলি কী? গুলি কী?’

    তার গালে একটা চুমু দিয়ে কোল থেকে মেয়েকে নামিয়ে দিলেন শফিউর।

    উঠোনে সাইকেল। তিনি সাইকেলটা নিলেন। ‘আব্বা আসি। শাহনাজের আম্মা। সাবধানে থেকো। তোমার পেট যে রকম বড় হচ্ছে, এইবার নিশ্চয়ই ছেলে হবে।’ আব্বার কান ফাঁকি দিয়ে আকিলার কানে ফিসফিসিয়ে বললেন শফিউর।

    ৩৪ বছরের শফিউরকে দেখাচ্ছে রাজপুত্রের মতো। আকিলার মনে হয়।

    আকিলার বয়স ১৯ বছর। ৭ বছর আগে শফিউরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে আকিলার। তখন তাঁর বয়স ছিল ১২ বছর। ১৫ বছর বয়সে প্রথম মা হন। আকিলার বয়স হচ্ছে, বোঝার বয়স, ভালোবাসার বয়স। নিজের স্বামীর দিকে প্রেমপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকান তিনি। প্রথম সন্তান মেয়ে হয়েছে, পরেরটা যেন আল্লাহ ছেলে দেন।

    শফিউরকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেন আকিলা। শাহনাজও মায়ের সঙ্গে দরজার চৌকাঠ ধরে থাকে।

    সজনেগাছের তলায় সাইকেল। সজনেগাছের পাতা ঝরে পড়েছে সিটের ওপরে। অন্ধকার কোণটা থেকে সাইকেল বের করে রোদ্দুর পেরিয়ে গেটের কাছে আসেন শফিউর। ৬ নম্বর রঘুনাথ দাস লেনের গেটের দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে যান তিনি।

    শাহনাজ বলে, ‘আব্বা, বেল বাজান।’

    ক্রিং ক্রিং। শফিউর সাইকেলের ঘণ্টি বাজান।

    তারপর মিশে যান রোদ্দুরে।

    বেলা ১১টা কি সাড়ে ১১টা বাজে। কিছু গোছগাছ ধোয়ামোছা সেরে নিয়ে আকিলা প্রথমে শাহনাজকে খাওয়াবেন। তারপর নিজে খাবেন।

    শফিউর পথে নেমেই পড়েন মিছিলের পেছনে। বিশাল বড় মিছিল। তিনি সাইকেল থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে সাইকেল ঠেলে নিয়ে মিছিলের পেছনে হাঁটেন খানিকক্ষণ।

    রোদে যেন মিছিল জ্বলছে। ক্ষোভে যেন মিছিল পুড়ছে।

    ‘আমার ভাই মরল কেন, খুনি নুরুল আমিন জবাব চাই’।

    ‘খুনি নুরুল আমিনের ফাঁসি চাই’।

    ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।

    শফিউর সেই মিছিলের স্লোগানের সঙ্গে মনের অজান্তেই কণ্ঠ মেলালেন। পথচারীদের আর মিছিলকারীদের মুখ থেকেই শুনলেন, সংবাদ অফিসে আগুন দেওয়া হয়েছে, জনতার ক্ষোভের আগুনে ছাই হয়েছে মর্নিং নিউজ…

    তারপর তাঁর মনে হলো, অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। তিনি জোরে হেঁটে মিছিলটা অতিক্রম করলেন। তারপর উঠে পড়লেন সাইকেলে।

    রথখোলায় মরণচাঁদের মিষ্টির দোকানের সামনে তিনি, তাঁর পেছনে মিছিল, এই সময় গুলির শব্দ।

    গুলি এসে লাগল শফিউরের পিঠে।

    শফিউর তখনো সাইকেল চালাচ্ছেন।

    তাঁর পেছনে কোট ভেদ করে রক্ত ঝরছে।

    কিন্তু তিনি সাইকেল চালাচ্ছেন।

    সাইকেল চলছে।

    তিনি স্লোগান ধরলেন, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই…’

    সাইকেল এগিয়েই চলেছে।

    খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে এসে তিনি পড়ে গেলেন।

    তাঁকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

    আকিলার দরজায় জোরে জোরে আঘাত। দরজা খুললেন বৃদ্ধ মাহবুবুর রহমান। আকিলা শুনতে পেলেন, শফিউর রহমানের হাতে গুলি লেগেছে। তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

    তাঁরা পাগলের মতো ছুটে গেলেন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। শফিউর রহমানের এক ভাই তৈয়বুর রহমান, সন্তানসম্ভবা আকিলা, তাঁর মেয়ে শাহনাজ আর মাহবুবুর রহমান।

    আকিলার শাশুড়ি ছিলেন আরেক ছেলের বাড়িতে, তিনিও এসেছেন হাসপাতালে।

    তখনো শফিউর রহমানের জ্ঞান আছে। তিনি ইশারা করে ডাকলেন মাকে। মা তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। তাঁর শাড়িতে রক্ত লেগে গেল।

    তৈয়বুর এগিয়ে গেলেন। তাঁকেও জড়িয়ে ধরলেন।

    আকিলা ডুকরে কেঁদে উঠল।

    তা দেখে কেঁদে উঠল শাহনাজও। মাহবুবুর রহমান স্তব্ধ। আজাদ পাকিস্তান তাঁকে কী দিল?

    স্ট্রেচারে করে শফিউরকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হলো। তাঁর অপারেশন করেন ডাক্তার এলিনসন।

    তিনি বাইরে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘তাঁর লিভার পুরোটাই ছিঁড়ে গেছে। গড়কে ডাকুন।

    সন্ধ্যা সাতটায় ডাক্তাররা জানালেন, শফিউর আর নেই।

    আকিলা স্তব্ধ হয়ে রইলেন। তাঁর সাত মাস চলছে। মেয়েটার বয়স চার। তিনি কী নিয়ে বাঁচবেন। শফিউর তাঁর অনাগত সন্তানকে কোনো দিন দেখবেন না। এই বাচ্চাও কোনো দিন দেখবে না তার আব্বাকে!

    ঠিক তখন আবদুল জব্বারের দুই বছরের ছেলে নুরুল ইসলাম বাদল ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেঝেতে একা একা হাঁটছিল আর হামাগুড়ি দিচ্ছিল। সে এসেছিল ময়মনসিংহ থেকে। তার নানির অসুখ। তার মা আর বাবা আবদুল জব্বার নানিকে নিয়ে মেডিকেলে এসেছেন চিকিৎসার জন্যে।

    শাশুড়িকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে, স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে হাসপাতালে রেখে আবদুল জব্বার, ফাইভ পাস, ন্যাশনাল গার্ডের চাকুরে, বাইরে জনতার সঙ্গে মিশে যান। আগের দিন গুলি হয়েছে এই চত্বরে, ছাত্র মারা গেছে। আজও চলছে সকাল থেকে লড়াই। মেডিকেল হোস্টেল পরিণত হয়েছে আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে। মাইকে চলছে অবিরাম অনল বর্ষণ। বাইরে সশস্ত্র পুলিশ আর মিলিটারি, তারা কাঁদানে গ্যাস ছুড়ছে, লাঠিচার্জ করছে, একপর্যায়ে গুলি করেই বসে…

    আবদুল জব্বার গুলিবিদ্ধ হন।

    তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

    চোখেমুখে অনিশ্চয়তা নিয়ে বিলাপ করেন তাঁর স্ত্রী।

    তাঁর শিশুপুত্র নুরুল ইসলাম বাদল হাসপাতালের মেঝেতে হাঁটে, হামাগুড়ি দেয়, মেঝেতে পড়ে থাকা ময়লা তুলে মুখে দেয়।

    .

    সেখান থেকে সামান্যই দূরে, কলাভবনের আমতলায় ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় দু চোখ লাল করে পাতার আড়ালে মুখ লুকায়।

    ব্যাঙ্গমা বলে,

    জব্বারের ছেলে হলো ছোট্ট বাদল,
    হাসপাতালের ফ্লোরে ছুটছে চঞ্চল।
    মা তার পাথর যেন কর্তব্য জানে না,
    স্বামী তার মরে গেছে? মন যে মানে না।
    বাদল ঠিকই জানে, কর্তব্য যে তার,
    উনিশ বছর পরে করবে যা করার।
    প্রশিক্ষণ নিতে যাবে ভারত উদ্দেশে,
    স্বদেশে ফিরবে ফের যোদ্ধারই বেশে।
    ভাষার দাবিতে দেয় জব্বার জীবন,
    তার ছেলে মুক্তিযোদ্ধা লড়ে প্রাণপণ।

    ফজলুল হক হলের মিলনায়তনে ছাত্রসভা। সভাপতিত্ব করছেন তাজউদ্দীন আহমদ। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পরবর্তী গতিপ্রকৃতি কী হবে, তা নিয়ে আলোচনা হলো। সেখান থেকে বেরিয়ে অলি আহাদের সাইকেলের পেছনে চড়লেন তাজউদ্দীন। উদ্দেশ্য, মেডিকেল কলেজ হোস্টেল চত্বর। এটাই এখন আন্দোলনের অগ্নিমুখ।

    সারাটা দিন সাইকেলে চড়ে বাংলার মানুষের বদলে যাওয়া দেখেছেন তিনি। অলি আহাদের সাইকেলের পেছনে বসে ফাল্গুনের বাতাস কেটে এগিয়ে যেতে যেতে তা-ই ভাবছিলেন তাজউদ্দীন। হোস্টেলের বয়- বেয়ারা, নির্মাণশ্রমিক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, দোকানদার, পুরান ঢাকার অধিবাসী সবাই আজ নেমে এসেছে মিছিলে। মিছিলে যোগ দিয়েছে স্কুলের ছাত্রীরা। গায়েবানা জানাজা হয়েছে, এ কে এম ফজলুল হকসহ হাজার হাজার মানুষ যোগ দিয়েছে জানাজায়, যোগ দিয়েছেন আবুল হাশিম। আজও সারা দিন গুলি হয়েছে। কত জন শহীদ হয়েছেন, বাতাসে নানা গুজব। কেউ বলছে ১০-১২ জন শহীদ হয়েছেন, পুলিশ হাত-পা ধরে লাশ তুলেছে ট্রাকে, তাঁরা দেখেছেন। আহত হয়েছে বোধ হয় কয়েক শ।

    গতকাল গুলির সংবাদ শোনার এক ঘণ্টার মধ্যেই ফররুখ আহমদ, সিকান্দার আবু জাফর, সাইয়িদ সিদ্দিকী, আবদুল আহাদ, আবদুল লতিফ প্রমুখ রেডিওশিল্পী ধর্মঘট করে বেরিয়ে এসেছেন রেডিও অফিস থেকে। শহীদুল্লা কায়সার, কে জি মোস্তফা, গোলাম মাওলা, মাহবুব জামাল জাহেদি, আবদুল গফুর, মোহাম্মদ তোয়াহা, আবদুল মতিন, আনিসুজ্জামান—সবাই ব্যস্ত। আহমদ রফিক ও রফিকুল ইসলাম প্রাণান্ত খাটছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মুনীর চৌধুরী, মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী, পৃথ্বীশ চক্রবর্তী প্রমুখ প্রতিবাদ সভা করেছেন। বিধানসভায় গুলিবর্ষণের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন এবং বেরিয়ে এসেছেন আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ছাড়াও ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, শামসুদ্দীন আহমদ, মনোরঞ্জন ধর। আনোয়ারা বেগম আজ পরিষদে বলেছেন, ‘যে জাতি মাতৃজাতির সম্মান দিতে পারে না, তার ধ্বংস অনিবার্য। মিলিটারি মেয়েদের গাড়ি করে কুর্মিটোলা পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। যে মিনিস্ট্রির আন্ডারে মাতৃজাতি সম্মান পায় না, মেয়েদের ওপর এই সব অত্যাচার হয়, তাদের পতন অনিবার্য। পুলিশের লাঠিচার্জে মেয়েরা উন্ডেড হয়েছে। একজন হলেন ঢাকা হাইকোর্টের জাস্টিস ইব্রাহিম সাহেবের মেয়ে সুফিয়া ইব্রাহিম, আরেকজন মিস রওশন আরা, থার্ড ইয়ার, বিএ। মেয়েদের টোটাল উন্ডেড হলো আটজন। মন্ত্রিসভা এমন একটা আবহাওয়া সৃষ্টি করেছে যাতে মেয়েরা পর্যন্ত লাঞ্ছিত হয়।’

    আজিমপুর কবরস্থান থেকে শহীদদের রক্তাক্ত জামা উদ্ধার করে লাঠির ডগায় লাগিয়ে মিছিল হচ্ছে। পুরো ঢাকা আজ আগ্নেয়গিরি। জুমার নামাজের পর ঢাকার বহু মসজিদে গায়েবানা জানাজা হয়েছে, তারপর স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল ১৪৪ ধারার কথা ভুলে গিয়ে রাস্তা দখল করে ফেলেছে। মোহাম্মদ সুলতান, হাসান হাফিজুর রহমান, মুর্তজা বশীর কালো পতাকা উত্তোলন করেছেন কলাভবনের ছাদে। শিল্পী আবদুর রাজ্জাকের পরনের সাদা পায়জামায় রক্তের দাগ। রিকশাচালক আউয়াল আর নিষ্পাপ কিশোর অহিউল্লাহ শহীদ হয়েছে পুলিশের গুলিতে।

    বাংলা একটা আশ্চর্য জায়গা।

    ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে।

    অলি আহাদের সাইকেল মেডিকেল ক্যাম্পাসে এসে ঢুকল। তাজউদ্দীন ও অলি আহাদ মিশে গেলেন মেডিকেল হোস্টেল চত্বরের কন্ট্রোল রুমের অসংখ্য ভাষাসৈনিকের সঙ্গে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleউষার দুয়ারে – আনিসুল হক
    Next Article রক্তে আঁকা ভোর – আনিসুল হক

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }