যারা ভোর এনেছিল – ৬৫
৬৫.
শেখ মুজিব জানেন না, ঢাকায় কী হচ্ছে। ঢাকা থেকে ফরিদপুর যেতে লাগে দুদিন। ঢাকার কাগজ ফরিদপুরে এসে পৌঁছায় পরের দিন সন্ধ্যায়।
কিন্তু তাঁর কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগে।
এমনিতেই তাঁর শরীর খুব খারাপ। তিনি হৃদরোগ, চোখের রোগে ভুগছিলেন বলেই তাঁর চিকিৎসা চলছিল। তিনি অনশন করবেন, এই ঘোষণা দেওয়ার পরে তাঁকে তড়িঘড়ি ফরিদপুর জেলে আনা হয়েছে। এখানে এসেই তিনি আর মহিউদ্দিন আহমদ অনশন শুরু করে দিয়েছেন।
তাঁর আশা ছিল, ২১ ফেব্রুয়ারির আগেই তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তাহলে তিনি রাষ্ট্রভাষা দিবসের সাধারণ ধর্মঘট আর আন্দোলনে অংশ নিতে পারবেন। কিন্তু নুরুল আমিন চালাকি করে তাঁকে ঢাকার বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। ঢাকায় যে কী হচ্ছে, তিনি জানেন না। মওলানা ভাসানী, শামসুল হক কি পারবেন আওয়ামী মুসলিম লীগকে নিরাপস সংগ্রামের ধারায় এগিয়ে নিতে? মওলানা হয়তো পারবেন, কিন্তু তাঁর দরকার একজন যোগ্য মাঠসৈনিক। শামসুল হক ঠিক তা নন। মুজিব মনে করেন, তাঁর এখন ঢাকায় থাকা খুব দরকার ছিল।
তিনি অনশন চালিয়ে যান।
১৯ ফেব্রুয়ারিতে ডাক্তার তাঁর রিপোর্টে লেখেন :
মৌলভি মুজিবুর রহমান :
তার হৃৎপিণ্ড ও চোখের সমস্যার কারণে মারাত্মক ফোলা রোগের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। তার জন্যে অনশন ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়া নিরাপদ না-ও হতে পারে। যা তার হৃৎপিণ্ডের ক্ষতি করতে পারে। বর্তমান অবস্থা গুরুতর নয়।
একুশে ফেব্রুয়ারিতে মুজিব অস্থির হয়ে পড়েন ঢাকার খবর জানার জন্য। আকাশবাণীর খবর সূত্রে ফরিদপুরের লোকমুখে নানা কথা ভাসে, কিংবা টেলিগ্রামে আসে কিছু ঢাকার খবর। সেই ভাসা ভাসা খবরের কোনো কোনোটা এসে কারাগারের মধ্যে পৌঁছায়। ছাত্রমিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয়েছে শুনে তিনি তাঁর অনশনের কারণ হিসেবে তাঁর মুক্তি দাবির সঙ্গে ঢাকায় গুলিবর্ষণের প্রতিবাদ কথাটা যুক্ত করে দেন।
তিনি ব্যবস্থা করেন, তিনি যে ঢাকার রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে গুলি, জুলুম, নিপীড়ন, হত্যা, গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে অনশন করছেন, সেই খবরটা টেলিগ্রামের মাধ্যমে যাতে ঢাকায় পৌঁছায়।
২৩ ফেব্রুয়ারি। যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক আনিসুজ্জামানের বাসায় টেলিগ্রাম পৌঁছে দেয় ডাকপিয়ন। তাঁকে তেমনই বলা ছিল, যেন সে যুবলীগ অফিসের নামে আসা ডাক আনিসুজ্জামানের বাসাতেই পৌঁছে দেন।
আনিসুজ্জামান টেলিগ্রামটা হাতে পান। দেখতে পান, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ও তার বিচার চেয়ে শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন আহমদ ফরিদপুর জেলে অনশন করছেন।
আনিসুজ্জামান সেই টেলিগ্রামের ভিত্তিতে একটা খবর তৈরি করে পৌঁছে দেন দৈনিক আজাদ অফিসে।
দুর্বল স্বাস্থ্য নিয়েও শেখ মুজিব অনশন চালিয়ে যেতে থাকেন।
২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ জেল সুপার লিখছেন :
শেখ মুজিবুর রহমান : তার ওজন খুব দ্রুত কমে যাচ্ছে। হৃদযন্ত্রের অবস্থা সন্তোষজনক নয়। মায়োকার্ডিয়াল দুর্বলতার লক্ষণ খুব স্পষ্ট।
.
২৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে আরও পাঁচজন নিরাপত্তাবন্দী অনশন ধর্মঘট শুরু করেন।
এদিকে তাঁদের অনশনের খবর ঢাকার কাগজে নিয়মিত বেরোতে থাকে। স্থানে স্থানে তাঁদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ হতে থাকে। ২০ ফেব্রুয়ারিতে পরিষদ সদস্য আনোয়ারা খাতুন শেখ মুজিবের অনশনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে পরিষদের অধিবেশন নিয়মিত আলোচনা করে শেখ মুজিবের অনশন নিয়ে আলোচনার দাবি তোলেন।
জবাবে নুরুল আমিন বলেন, এ ধরনের কোনো অনশনের খবর তাঁর জানা নাই। আর শেখ মুজিব যদি তা করেও থাকেন, সেটা তাঁর জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না, তাঁর সমর্থকদের জন্যও নয়। ‘কেউ যদি আত্মহত্যা করতে চায়, আর আমরা যদি সেই খবর পাই, তাহলে কি আমরা পরিষদের নির্ধারিত কর্মসূচি স্থগিত করব?’
কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন সারা বাংলায় বিস্ফোরণ সৃষ্টি করেছে। এই অবস্থায় শেখ মুজিবের কিছু হয়ে গেলে পরিস্থিতি যে আর সামলানো যাবে না, সেটা নুরুল আমিন সরকার ঠিকই বুঝতে পারে।
২৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে জানানো হয়, তাঁর মুক্তির আদেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি অনশন ভঙ্গ করেন।
এর দুদিন পরে কারাগারের হাসপাতাল থেকে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।
শেখ মুজিব তাঁর দুর্বল শরীর নিয়ে বের হচ্ছেন কারাগার থেকে। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছেন তিনি। তাঁকে আর চেনাই যায় না। তিনি হাঁটতেও পারছেন না।
তিনি ঠিক করেছেন, ফরিদপুর থেকে টুঙ্গিপাড়া যাবেন। তিনি বড় ক্লান্ত। কিছুদিন থাকবেন বাড়িতে। আব্বা, আম্মা, রেনু, হাসু, কামালের সান্নিধ্যে।
তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ফটকের দিকে।
সেখান দিয়ে তিনি যাবেন জেলারের অফিসে। স্বাক্ষর করে, তাঁর জিনিসপাতি বুঝে নিয়ে তারপর বেরোবেন প্রাচীরের বাইরে, মুক্ত আকাশের নিচে
সামনে লোহার গেট।
দুজন প্রহরী সেটা পাহারা দিচ্ছে।
একজন জেলকর্তা তাঁকে একজন জমাদারের প্রহরায় বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন।
বড় গেটটা বন্ধ।
বড় গেটের ভেতরে একটা ছোট গেট।
কারাগার-কর্তা সেই ছোট গেটটা দিয়ে মাথা নিচু করে বের হয়ে গিয়ে ঘুরে মুজিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আসেন।’
মুজিব তাঁর রোগা দেহ থেকে বাঘের গর্জন বের করে বললেন, ‘বড় গেটটা খোলেন।’
কর্তা বললেন, ‘বড় গেটের চাবি তো এখন আমার কাছে নাই।’
মুজিব বললেন, ‘যার কাছে আছে তার কাছ থেকে আনেন। শেখ মুজিবুর রহমান কোনো দিনও মাথা নিচু করে কারাগার থেকে বার হয় নাই। আমার নাম শেখ মুজিবুর রহমান, আমি মাথা নিচু করি না।’
তাঁর কণ্ঠস্বরে একটা অমোঘতা ছিল। মন্ত্রতাড়িতের মতো কারাগার- কর্তা ছুটে গেলেন বড় গেটের চাবি আনতে। মুজিব ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন অসুস্থ শরীর নিয়ে।
ঘড়ঘড় করে বড় দরজার পাল্লা খুলে গেল।
বাইরে তাঁকে বরণ করে নেওয়ার জন্য শত শত মানুষ জমা হয়ে কিন্তু গেছে। মিষ্টির খবর কী করে পিঁপড়ারা পায়, সেটা রহস্যজনক, ঠিকই মিষ্টির পাশে ভিড় জমায় পিঁপড়ার দল। শেখ মুজিব বের হয়ে আসছেন, এই খবর কোত্থেকে পেল মানুষ, তারাই জানে, কিন্তু কারাগারের ফটকে স্লোগান ওঠে: ‘শেখ মুজিব শেখ মুজিব, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ। শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’।
শেখ মুজিবুর রহমান কারাপ্রাচীরের অন্তরাল থেকে বের হয়ে এলেন মাথা উঁচু করে।
***
প্রথম পর্ব সমাপ্ত
দ্বিতীয় পৰ্ব – ঊষার দুয়ারে