যারা ভোর এনেছিল – ২৫
২৫
টুঙ্গিপাড়া থেকে মুজিব এসে দেখেন ঢাকা মোটামুটি গরম হয়ে আছে। ১৫০ মোগলটুলীর লীগ অফিসে তিনি হাজিরা দিচ্ছেন নিয়মিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হয়েছেন এরই মধ্যে।
মুজিবের হিসাব বলছে, রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নেই ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীরা এখন বিচলিত। কিছুদিনের মধ্যেই ব্যাপারটা বিক্ষোভে পরিণত হবে। না হওয়ার কোনো কারণ নাই। কেন্দ্রে লিয়াকত আর প্রদেশে খাজা নাজিম উদ্দিনরা যা শুরু করেছে। স্টাম্পে, দলিলে, টাকায় সবখানে উর্দু, বাংলার চিহ্নমাত্র নাই। এরা নিজেদের কী ভাবছে! ব্রিটিশ শাসক? আমরা কি লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান বলে জানবাজি রেখে শেষে আরেকটা প্রভু পেলাম! মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিল এই বাংলায়। ভোটের সময় মুসলিম লীগ জয়লাভ করেছিল কেবল এই বাংলাতেই। এখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এই বাংলারই। অথচ ওরা আমাদের শাসন করতে চায়!
বর্ধমান হাউসে খাজা নাজিম উদ্দিনের সরকারি বাসভবনে বসেছে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভা। মুজিব আজ সেখানে যাবেন ছাত্রদের মিছিল নিয়ে। তমদ্দুন মজলিসের নেতারা গতকাল হাজার হাজার লোকের স্বাক্ষরসংবলিত স্মারকলিপি এই ওয়ার্কিং কমিটির সভায় দিয়ে এসেছেন।
কয়েক দিন ধরেই চলছে স্বাক্ষর সংগ্রহ। দাবি একটাই—পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে হবে বাংলাকে। সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাক্ষর করছেন। করবেই বা না কেন? দিন পনেরো আগে পাকিস্তানের প্রথম সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার সার্কুলার এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ৩১টি বিষয়ে পরীক্ষা দেওয়া যাবে। এর মধ্যে নয়টা ভাষা। নয়টা ভাষার মধ্যে বাংলার জায়গা হলো না?
আজ শুধু স্বাক্ষর নয়, জ্যান্ত মানুষের মিছিল যাবে। মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যান। ছেলেদের জড়ো করেন। তারপর বক্তৃতা করা শুরু করেন : ‘বাংলা ভাষাকে করতে হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন, আদালতের ভাষা, অফিসের ভাষা। কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা হবে দুটো, বাংলা আর উর্দু। তবে তৃতীয় ভাষা হিসাবে ইংরেজি থাকতে পারে। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ, আমরা বাঙালিরাই পাকিস্তান গড়েছি, আজকে আমাদেরকে দাবায়া রাখার চক্রান্ত শুরু হয়ে গেছে। ভাইয়েরা আমার, আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সংগ্রাম করতে হবে।’
খুব শীত পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমগাছের পাতায় পাতায় আলোর নাচন। এই আলো ছাত্রদের শরীরের জড়তা কাটাতে পারছে না। পায়জামা আর হাওয়াই শার্ট পরা বেশির ভাগ ছাত্র। তাদের কয়েকজনকে নিয়ে মিছিল শুরু করলেন মুজিব : ‘রাষ্ট্রভাষা রাষ্ট্রভাষা, বাংলা চাই বাংলা চাই’। মিছিল বড় হতে শুরু করেছে। এর মধ্যে তমদ্দুন মজলিসের নেতা অধ্যাপক আবুল কাসেমও এসে গেছেন। এসেছেন সাংবাদিক আবুল কাশেম। মুজিব স্লোগান ধরেছেন। ছাত্ররা স্লোগানের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাচ্ছে। তাদের হাত উঁচু হচ্ছে, আওয়াজ উচ্চতর। তাদের শরীরের শৈত্য দূর হয়ে গেছে। বরং কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মিছিল ক্যাম্পাস পরিক্রমণ করল। এবার তাঁরা যাচ্ছেন বর্ধমান হাউসের দিকে। তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও করবেন।
খাজা নাজিম উদ্দিনের সভাপতিত্বে চলছে ওয়ার্কিং কমিটি। তাঁরা বাড়ির গেটে মিছিল করছেন। মিছিল বড় হয়েছে। মওলানা আকরম খাঁ বেরিয়ে এলেন। ছাত্ররা তাঁকে দেখে আরও জোরে আওয়াজ তুলল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। তিনি প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি। দৈনিক আজাদ-এর সম্পাদক। বয়স্ক মুরব্বি মানুষ। তাঁর সঙ্গে আছেন আবু জাফর শামসুদ্দীন, সাংবাদিক আর লেখক। ৩৪ বছর বয়সী ছিপছিপে এক তরুণ। তিনি কাজ করেন দৈনিক আজাদ-এ। কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছেন। এখন আজাদ-এর ঢাকা প্রতিনিধি। সাংবাদিক হিসেবে তিনি এসেছেন এই সভার খবর সংগ্রহ করতে।
আবু জাফর শামসুদ্দীন মওলানার কোনো কোনো গোপন খবর জানেন। যেমন মওলানা পেশাব করার পর পানি ব্যবহার করেন না। মওলানার পাশের ঘরে থাকতেন আবু জাফর। এই নিয়ে জাফর সাহেবের স্ত্রী প্রশ্ন তুলেছিলেন। বলেছিলেন, নামাজ-রোজা এই সব বিষয়েও তো মওলানা উদাসীন। জাফর সাহেব তাঁর সম্পাদককে বাঁচানোর জন্য বলেছিলেন, ‘মওলানা সাহেব কোনো একটা তরিকাপন্থী মানুষ। তাঁর তরিকায় এই সব লাগে না। একজন দরবেশ আছেন, তিনি কাপড় পরেন না। তাঁকে বলা হয়েছিল, “দরবেশ সাহেব, এত মানুষের সামনে আপনি কাপড় ছাড়া।” তিনি বলেছিলেন, “আমি তো আমার চারপাশে কোনো মানুষ দেখি না”।’ শুনে জাফর সাহেবের স্ত্রী খানিকটা প্রবোধ মেনেছিলেন।
এখন মওলানা আকরম খাঁ এসেছেন। এখন তিনি ছাত্রদের উত্তেজিত মিছিলের সামনে। তিনি ঘোষণা করলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা ছাড়া আর অন্য কোনো ভাষা চাপানোর চেষ্টা করা হলে পূর্ব পাকিস্তান বিদ্রোহ ঘোষণা করবে এবং সেই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেব আমি।’ এ কথা বলা মওলানার পক্ষে সম্ভবপর ছিল। আজ থেকে ৩০ বছর আগে সেই ১৯১৮-তেই তিনি লিখেছিলেন, ‘দুনিয়ায় অনেক রকম অদ্ভুত প্রশ্ন আছে। বাঙ্গালী মুছলমানের মাতৃভাষা কি? উর্দু না বাঙ্গালা? এই প্রশ্নটা তাহার মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা অদ্ভুত। বঙ্গে মুছলমানের ইতিহাসের সূচনা হইতে আজ পৰ্য্যন্ত বাঙ্গালা ভাষাই তাঁহাদের লেখ্য ও কথ্য মাতৃভাষারূপে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে এবং ভবিষ্যতেও মাতৃভাষারূপে ব্যবহৃত হইবে।’
কিন্তু ছাত্র-শিক্ষকদের বিক্ষোভ এখানেই থেমে গেল না। বরং, রটে গেল যে করাচিতে পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী (ওদের ভাষায় উজিরে তালিম) ফজলুর রহমান বলেছেন যে উর্দুকেই লিংগুয়া ফ্রাংকা করা হবে।
পরের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উত্তেজনায় কাঁপছে। তমদ্দুন মজলিসের আবুল কাশেম ছুটে গেলেন মুনীর চৌধুরীর কাছে। কী করা যায়? শিক্ষক মুনীর চৌধুরী বললেন, আজকে প্রতিবাদ সভা করতে হবে। ঠিক হলো, বেলা দুটোয় বেলতলায় সমাবেশ।
শেখ মুজিব সমাবেশ সফল করার জন্য কাজ করতে লাগলেন। তিনি মিছিল বের করলেন, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, আজকের সমাবেশে যোগ দিন’। দুপুর হতে না হতেই বেলতলা ভরে গেল হাজার তিনেক বিক্ষুব্ধ ছাত্রের উপস্থিতিতে। সভায় সভাপতিত্ব করলেন অধ্যাপক আবুল কাশেম, বক্তব্য রাখলেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সহসভাপতি ফরিদ আহমদ প্রমুখ।
শেখ মুজিব তাঁদের এক পাশে দাঁড়িয়ে স্লোগান ধরছেন।
তাজউদ্দীনও যোগ দিলেন সেই সভায়। সভা শেষে তাজউদ্দীন গেলেন বলিয়াদি ছাপাখানায়। তিনি তাঁদের প্রস্তাবিত পার্টির ঘোষণাপত্র ছাপা নিয়ে ব্যস্ত।
শেখ মুজিব আর কোথাও গেলেন না। তিনি যোগ দিলেন মিছিলে। মিছিল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে বেরিয়ে রওনা দিল সচিবায়ের দিকে। শেখ মুজিব হাঁটছেন মিছিলের সঙ্গে সঙ্গে। ‘উর্দু জুলুম চলবে না, পাঞ্জাবিরাজ বরবাদ’ ধ্বনি উঠতে লাগল। সেখান থেকে মিছিল গেল আরও দুই মন্ত্রীর বাসভবনে। শেষে গেল মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনের বাসভবনে। ‘উর্দুওয়ালা বরবাদ’ স্লোগান দিয়ে এবার মিছিলের লক্ষ্য হলো মর্নিং নিউজ পত্রিকা। কারণ, মর্নিং নিউজ-এ সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে বাংলা ভাষার বিপক্ষে, উর্দুঅলাদের পক্ষে। মর্নিং নিউজ অফিসের সামনে ছাত্ররা স্লোগান ধরল, ‘মর্নিং নিউজ ধ্বংস হোক, উর্দুঅলা বরবাদ’। সেক্রেটারিয়েটে মন্ত্রীরা, বর্ধমান হাউসে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধি—সবাই ছাত্রদের আশ্বাস দিলেন, বাংলা অবশ্যই প্রদেশের রাষ্ট্রভাষা হবে, তারাও বাংলারই পক্ষে।
কিন্তু আগুনে ঘি পড়ছিল নানাভাবে।
ঢাকার উর্দুভাষীরাও তৎপরতা শুরু করল খাজার উসকানিতে। এ কে এম ফজলুল হকের সভাপতিত্বে সিরাজউদ্দৌলা পার্কে এক সভা হওয়ার কথা। জনা পঞ্চাশেক কুট্টি গেল সেখানে। তারা বলল, এই সভা হচ্ছে হিন্দুদের সহযোগিতায়। পাকিস্তান ধ্বংস করা এই সভার উদ্দেশ্য। তারা চেয়ারে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সভা পণ্ড করে দিল, ক্ষোভ প্রকাশ করল ছাত্রদের বিরুদ্ধে। ছাত্ররা পাকিস্তান ধ্বংস করতে চাচ্ছে—এই হলো তাদের অভিমত। ছাত্রদের ওপরে তাদের খুবই রাগ।
এই রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটল দিন পাঁচেক পর। বাসে ও ট্রাকে করে জনা পঞ্চাশেক ভাড়া করা লোক বেরিয়ে পড়ল মিছিল নিয়ে। তারা চায়, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হোক। এই সন্ত্রাসীরা হামলা পরিচালনা করল মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। এখানে সংঘর্ষ বেধে গেল আক্রমণকারী আর ছাত্রদের মধ্যে। সরকারি কর্মচারীরাও উর্দুঅলাদের আক্রমণের শিকার হলো। পুলিশ লাঠিপেটা করল আক্রমণকারীদের, গুলিও হয়েছে বলে কেউ কেউ বললেন।
এই খবর পাওয়ামাত্রই দৌড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চলে এলেন শেখ মুজিব। সমস্ত ক্যাম্পাসে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। আবুল কাশেমের নেতৃত্বে মিছিলে যোগ দিলেন তিনি। পলাশী ব্যারাকের কাছে প্রথম সমাবেশে মিলিত হলো ছাত্ররা। মিছিল গেল শিক্ষামন্ত্রীর বাড়িতে। মিছিলকারীদের দাবির মুখে শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদ লুঙ্গি পরা অবস্থাতেই মিছিলে যোগ দিলেন। তিনি বললেন, বাংলা ভাষার দাবি ন্যায্য, তিনি এই দাবির সঙ্গে আছেন। মিছিল চলল সচিবালয়ের দিকে। আবদুল হামিদ লুঙ্গি পরে হেঁটে মিছিলের সঙ্গে সচিবালয়ে গেলেন। সেখানে কৃষিমন্ত্রী মোহাম্মদ আফজালকে পাকড়াও করে বিক্ষোভকারীরা। দুই মন্ত্রী লিখিতভাবে জনতার দাবির সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন।
উর্দুর পক্ষে মিছিলকারীরা ট্রাক থেকে একটা লিফলেট ছেড়েছে। তাতে বলা হয়েছে, উর্দু মুসলমানদের ধর্মীয় ভাষা। এ ভাষার বিরুদ্ধে যে কথা বলবে, সে কাফের। এ ধরনের কাফের বা বিধর্মীদের শায়েস্তা করতে হবে। আর উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।
এই লিফলেট ছাত্রজনতার বিক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দিল। পরের দিন সচিবালয়ে ছিল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ধর্মঘট। ধর্মঘটের কারণ ছিল কর্মচারীদের নিজস্ব দাবি-দাওয়া। তবে পলাশীতে তাদের ওপর উর্দুঅলাদের আক্রমণ ধর্মঘটে নতুন মাত্রা যোগ করল।
তাজউদ্দীন আহমদ সংঘর্ষে আহত ছাত্রনেতা নাঈমউদ্দিন সাহেবকে দেখতে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলেন।
সরকার এরই মধ্যে ভাষা প্রশ্নে সূচিত এই আন্দোলনকে ভারতের চক্রান্ত, হিন্দুদের চক্রান্ত বলতে শুরু করে দিয়েছে। ১৪৪ ধারা জারি হলো। আর পূর্ববঙ্গে ভারতীয় পত্রিকা, যেমন—দৈনিক ইত্তেহাদ, অমৃতবাজার, যুগান্তর, আনন্দবাজার পনেরো দিনের জন্য প্রবেশ নিষিদ্ধ করে আদেশ জারি করল সরকার। দৈনিক আজাদও সুর পাল্টে ফেলল। তারা এখন রাষ্ট্রভাষা উর্দু আর পূর্ববঙ্গে লেখাপড়ার ভাষা বাংলা—এই সুরে গান ধরেছে।
বর্ষাকালের শেষ দিকে, বলা যায় শরতের শুরুতে, পাকিস্তান কায়েম হলো। শরৎ যেতে না যেতেই শুরু হয়ে গেল বিক্ষোভ মিছিল। হেমন্তে জারি করতে হলো ১৪৪ ধারা, আর পূর্ব বাংলার মানুষের প্রতিটা ক্ষোভ- বিক্ষোভ-দীর্ঘশ্বাসের পেছনে খোঁজা হতে লাগল হিন্দু আর হিন্দুস্তানের চক্রান্ত, একেবারে প্রথম দিন থেকেই।
২৬.
পৌষের শীতকাতর রাত। আজ সারা দিন আকাশ মেঘলা ছিল, তাই হয়তো কুয়াশাভাবটা কম। এখন উত্তুরে হাওয়া বইতে শুরু করেছে। চলন্ত রিকশার যাত্রীদের কানে-মুখে বিঁধছে শীত-হাওয়ার সুচ। কোথাও একটা কামিনী ফুলের ঝাড় থেকে আসছে মাদকতাপূর্ণ গন্ধ। কাচারি এলাকার সিনেমা হল মুকুলে সেকেন্ড শো ভাঙল। ছ্যাকরা গাড়িগুলো ছুটতে লাগল হলভাঙা দর্শকদের নিয়ে। রিকশাঅলারা ক্রিং ক্রিং শব্দে মুখর করে তুলল রাতের নীরব গলি-উপগলিগুলো। ‘আমি বনফুল গো’ বলে গান গেয়ে উঠল কোনো কোচোয়ান। একটা বাড়ির রেডিওতে বেজে উঠল খুরশিদ খানের কণ্ঠে তানসেন ছবির গান— ‘বরষো বরষো…’। কাচারির ঘড়িতে ১২টার ঘণ্টা বাজল। শেখ মুজিব নামলেন রিকশা থেকে। যাবেন তাঁর মেসে।
সারাটা দিন বড় ধকল গেছে।
কয়েক দিন থেকেই পরিকল্পনা চলছিল। তাজউদ্দীন, কামরুদ্দীন সাহেব, কাদের সরদার, আতাউর রহমান খান—অনেকেই পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আজ মুসলিম লীগের এমএলএদের মধ্যে যাঁরা সরকারবিরোধী, তাঁদের সঙ্গে একটা সভা ছিল শেখ মুজিবদের। এমএলএদের মধ্যে প্রায় ১৬ জন উপস্থিত ছিলেন। বলিয়াদি ভবনে অনুষ্ঠিত হলো এই সভা। বেলা তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত চলল এই সভা। এমএলএদের কাছে শেখ মুজিবদের প্রশ্ন ছিল, ভবিষ্যতে নেতা কে হবেন? সোহরাওয়ার্দী সাহেব নাই, আবুল হাশিম সাহেব আসবেন না, বামপন্থী মুসলিম লীগ এমএলএদের মধ্যে কাকে নেতা হিসেবে গণ্য করবেন তাঁরা? তাঁরা বলেছেন, দুদিনের মধ্যেই সেটা জানাবেন।
সভা শেষ করে তাঁরা একটা গাড়ি জোগাড় করে বেরিয়ে গেলেন। শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন, মহিউদ্দিন, শওকত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হল, নীলক্ষেত ব্যারাক, এফএইচএম হল, ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল হোস্টেল, নিমতলী মেস—ঘরে ঘরে গিয়ে তাঁরা কলকাতা থেকে আসা দৈনিক ইত্তেহাদ বিলি করলেন। দৈনিক ইত্তেহাদ এই দেশে নিষিদ্ধ। প্রধানত সোহরাওয়ার্দীর সমর্থক এই পত্রিকা। পূর্ব বাংলার সোহরাওয়ার্দী- আবুল হাশিমপন্থীদের আন্দোলনের খবর, বাংলা ভাষার পক্ষে নানা ধরনের লেখা এই কাগজে ছাপা হয়। এই কারণেই সরকার এটা নিষিদ্ধ করেছে, আর এই কারণেই মুজিব-তাজউদ্দীন একসঙ্গে বেরিয়ে পড়েছেন সেটা বিলি করার জন্য। কাজটা ঝুঁকিপূর্ণও বটে। যে কাগজ এই দেশে নিষিদ্ধ, সেই কাগজ বিলিবণ্টন করা। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ কে করবে, যুবক শেখ মুজিব ও তরুণ তাজউদ্দীনরা ছাড়া। ছাত্রদের সঙ্গে তাঁরা কথা বললেন। ছাত্রদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিলেন। বোঝা গেল, সরকারের ওপর এরই মধ্যে সবাই বিরক্ত ও হতাশ। এই হতাশা দিন দিন বাড়ছে।
মুজিব মেসে ফিরলেন। ঘরদোর সব অন্ধকার। তাঁর ঘরের দরজায় মৃদু আলো ছড়াচ্ছে একটা হারিকেন। হারিকেনটা হাতে তুলে নিয়ে চাবি ঘুরিয়ে আলো বাড়ালেন। এক হাতে হারিকেনের হাতল, আরেক হাত দিয়ে চাবি ঘুরিয়ে দরজার তালা খুললেন। ঘরের ভেতরে গিয়ে দেখলেন, টেবিলে ভাত ঢেকে রাখা।
হাতমুখ ধুয়ে এসে গামলার ওপর থেকে থালা সরালেন। ঠান্ডা ভাত। ঠান্ডা তরকারি। বাটিতে ডাল। হারিকেনের আলোয় দেখা যাচ্ছে, ডালের পানির খুব নিচে কিছু তলানি জমে আছে।
তিনি ভাত খেতে শুরু করলেন।
অন্যমনস্কভাবে। খাওয়ার দিকে তাঁর মন নাই। আগামীকালের কাজ কী হবে, ভাবছেন। কাল বর্ধমান হাউসে এমএলএদের সভা। সেখানে একবার যেতে হবে। কামরুদ্দীন সাহেবের সঙ্গেও দেখা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ছাত্রদের সংগঠিত করতে হবে। ছাত্রলীগ শাহ আজিজের দখলে। এটাকে এই ডানপন্থীদের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে। নতুন দেশ। পুরোনো নিখিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগকে তো পুনর্গঠিত করা দরকার। একটা কাউন্সিল দিলেই শাহ আজিজরা অপসারিত হয়ে যাবেন। তাঁকে ধরতে হবে, যেন তিনি কাউন্সিল ডাকেন।
.
পরের দিন আকাশে ছিল মেঘ। শীত-সকালের আকাশ মেঘে ঢাকা। এমন দিনে কি বাইরে যেতে মন চায়?
শেখ মুজিবের মধ্যে আলস্য নাই। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। ফজলুল হক হলে গেলেন তিনি। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই তাঁর ভক্ত হয়ে গেছে। তিনি যাওয়ামাত্রই তাঁকে ছেলেরা ঘিরে ধরে। তিনি বললেন, ‘একটা সভা হবে। সবাইকে ১২টায় জড়ো করো।’ তিনি বক্তৃতা দিতে শুরু করলে ভিড় হয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘আমরা পাকিস্তান পেয়েছি। একে উন্নত করতে হবে। এ জন্য দরকার একটা শক্তিশালী ছাত্রসংগঠন। চলেন, আমরা শাহ আজিজের কাছে যাই। তাকে বলি, নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগকে নতুন করে গড়ে তুলতে। যাতে একটা শক্তিশালী সংগঠন আমরা গড়ে তুলতে পারি।’
তখনই শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ছাত্ররা চলল শাহ আজিজকে ধরতে। তাঁকে পাওয়া গেল।
শেখ মুজিব বললেন, ‘ছাত্রলীগের কাউন্সিল ডাকেন। সেই যে ৪৪ সালে কাউন্সিল হয়েছে, এরপর আর কাউন্সিল হয় নাই। এর মধ্যে পাকিস্তান হয়ে গেছে। নিখিল বাংলা ছাত্রলীগের নাম বদলে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান রাখার মানে কী? এখন তো পশ্চিম বাংলা আমাদের সাথে নাই। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অবশ্যই কাউন্সিল ডাকতে হবে।’
শাহ আজিজ ছিলেন অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির লোক। তিনি বুঝে ফেললেন, এখন কাউন্সিল ডাকা হলে তাঁর সাধারণ সম্পাদকের পদ হারাতে হবে। তিনি বললেন, ‘না, এখন কাউন্সিল ডাকা হবে না।’
মুজিব বললেন, ‘আপনি নিখিল বাংলা মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নন। এটা তো বৈধ হয় না।’ শাহ আজিজ বললেন, ‘এখন মুসলিম ছাত্রলীগের সম্মেলন ডাকা হবে না।’
মুজিব বললেন, ‘গঠনতন্ত্র অনুযায়ী গত চার বছরে আটবার সম্মেলন ডাকার কথা। আপনি সেটা ডাকেননি। আপনারা অনেকেই আর ছাত্রও না। কাজেই আপনাদের নিখিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এরই মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।’
শাহ আজিজ বললেন, ‘আপনারা চাইলে আলাদা ছাত্রলীগ গঠন করতে পারেন।’
‘আচ্ছা, তা-ই হবে।’ মুজিবের নেতৃত্বে ছাত্ররা ফিরে এল।
মুজিব এটাই চাইছিলেন। তিনি গেলেন মোগলটুলীতে। ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের ছাত্রনেতাদের সবাইকে ডাকলেন। বললেন, ‘৪ জানুয়ারি সবাই ফজলুল হক হলে আসেন। শাহ আজিজ কাউন্সিল ডাকবে না। আমাদের পথ আমাদেরই খুঁজে নিতে হবে।’
ফজলুল হক মিলনায়তনে নেতৃস্থানীয় ছাত্রকর্মীরা সবাই উপস্থিত। ঠিক হলো, নতুন সংগঠন হবে। নাম কী হবে?
প্রস্তাব এল, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ।
উপস্থিত ছাত্রনেতা অলি আহাদ বললেন, ‘আমরা অসাম্প্রদায়িক সংগঠন করতে চাই। মুসলিম শব্দটা বাদ দিয়ে শুধু ছাত্রলীগ নাম রাখা হোক।’
মোহাম্মদ তোয়াহা এই মত সমর্থন করলেন।
মুজিব বললেন, ‘নীতিগতভাবে আমি এই মত সমর্থন করি। কিন্তু বাস্তবে কৌশলগত কারণে আমরা এখনই এটা না করে কিছুদিন পরে করতে পারি। এখন যদি আমরা মুসলিম শব্দটা বাদ দিই, সরকার আমাদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে। আমাদেরকে ইন্ডিয়ার দালাল বা কমিউনিস্ট বলবে। স্থানীয় মানুষদেরও আমাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেবে। আপাতত মুসলিম শব্দটা থাকুক। সময় ও বাস্তবতা বুঝে আমরা পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক নাম নিয়ে আত্মপ্রকাশ করব।’
তখন সবার মত চাওয়া হলো। শেখ মুজিবের মতকেই সমর্থন জানালেন বেশির ভাগ কর্মী। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামটাই গৃহীত হলো।
তোয়াহা মন খারাপ করলেন। ভবিষ্যতে তিনি আর এই সংগঠনের সঙ্গে নিজেকে জড়াবেন না বলে ঠিক করলেন।
রাজশাহীর নাইমুদ্দিন আহমেদকে আহ্বায়ক করে ১৫ সদস্যের একটা আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হলো। শেখ মুজিবও সেই কমিটির একজন হিসেবে থাকলেন।
ফজলুল হক হল থেকে বেরিয়ে মুজিব দেখলেন, সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। কীভাবে যে বিকেলটা দ্রুত ফুরিয়ে গেল। তিনি হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় এলেন। সঙ্গে রইল জনা কয়েক ছাত্রনেতা।
রাতের খাবার খেতে হবে। নিজের খাবার তো মেসে থাকবেই। ঠান্ডা হলেও খাওয়াটা নিশ্চিত। আসলে দরকার সঙ্গীদের সঙ্গে একত্রে খাওয়া। তাঁরা হাঁটতে হাঁটতে গুলিস্তানের একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে পৌঁছালেন।
.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমগাছে বসে ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি মনের ভাব বিনিময় করছে ঠোঁটে ও কণ্ঠে, কথায় কথায়।
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘শেখ মুজিব কিন্তু তাঁর লক্ষ্যের দিকে একধাপ আগায়া গেল। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন কইরা ফেলল।’
ব্যাঙ্গমা বলল, ‘তা ঠিক। কিন্তু এ আর এমন কী?’
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘তুমি সব জানো, তাও আমারে দিয়ে কথা কওয়াইতে চাও। এই মুসলিম ছাত্রলীগই একসময় ছাত্রলীগ হইব।’
ব্যাঙ্গমা যেন কিছুই বোঝে না এমন ভাব করে বলল, ‘তা যখন হইব, তখন হইব। এখন কী?’
ব্যাঙ্গমি হেসে বলল, ‘এই যে শুরু হইল মুসলিম লীগের ছাত্রলীগের পতন। এর পরে শাহ আজিজের দল আস্তে আস্তে জনপ্রিয়তা হারাইব। সলিমুল্লাহ হলে ছাত্র সংসদের নির্বাচনে শাহ আজিজের নিখিল মুসলিম লীগের প্রার্থী হারব বিরোধী প্রার্থী সৈয়দ নজরুল ইসলামের কাছে। সৈয়দ নজরুলরে মনে রাইখো। ২৩ বছর পর তারে অনেক বড় দায়িত্ব পালন করতে হইব। ফজলুল হক হলেও প্রগতিশীল মো. তোয়াহা জয়লাভ করব।’
ব্যাঙ্গমা হেসে বলল, ‘কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে সভাপতি না হয় হইল বাবু অরবিন্দ ঘোষ, সাধারণ সম্পাদক কে হইল? গোলাম আযম। এইটা যে কও না?’
ব্যাঙ্গমি কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘ক্যান কই না, তুমিও জানো, আমিও জানি। এই বেটারেও দেইখা রাখো, ভবিষ্যতে এ-ও কম যন্ত্রণা দিব না।
ব্যাঙ্গমা বলল, ‘কলকাতায় দক্ষিণ এশীয় যুব সম্মেলনে কে যাইব? শাহ আজিজ, নাকি বিরোধীরা?’
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘বিরোধী ছাত্রলীগ থাইকাই দলনেতা হইল। আবদুর রহমান চৌধুরী। যুবলীগ থাইকা শামসুল হক সাহেব, ছাত্র ফেডারেশন থাইকা শহীদুল্লা কায়সার আর লিলি খান, লুলু বিলকিস বানু ও গায়িকা লায়লা আর্জুমান্দ বানু। শাহ আজিজ খুব মন খারাপ করব।’
ব্যাঙ্গমা বলল, ‘না, করব না। কলিকাতা যাত্রা তো! করাচি হইলে করত!’
২৭.
শেখ মুজিবের সঙ্গেই বিকেলটা কাটিয়েছেন তাজউদ্দীন। মুসলিম লীগ অফিসে। সন্ধ্যার পর কামরুদ্দীন সাহেবের সঙ্গে দেখা করার জন্য গেছেন ক্যাপ্টেন শাহজাহান সাহেবের বাসায়। এই ভদ্রলোকেরও রাজনীতি নিয়ে অনেক উৎসাহ। তিনি প্রায়ই কামরুদ্দীন সাহেবের কাছে আসেন। কামরুদ্দীন সাহেবও যান তাঁর কাছে। ক্যাপ্টেন সাহেবের দোতলা বাড়ি। নিচতলায় বসার ঘর। সেখানেই বসে আছেন তাজউদ্দীন। ওপরতলায় কামরুদ্দীন সাহেব আছেন। বোধ করি শাহজাহান সাহেবের সঙ্গে গল্পগুজব করছেন। ঢাকার বেশির ভাগ বাড়িতে বৈদ্যুতিক সংযোগ না থাকলেও এই বাড়িতে আছে। মাথার ওপর জ্বলছে বিদ্যুৎ বাতি। তারই হলুদ আলোয় চমৎকার করে সাজানো ঘরটায় তাজউদ্দীন বসে আছেন আত্মমগ্ন।
হঠাৎই একজন এসে বলল, ‘খবর শুনেছেন, গান্ধীজিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।’
তাজউদ্দীন একটা তীব্র-তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে উঠলেন। যেন রাতের কালো বুকের মধ্যে কে যেন বিদ্ধ করল একটা শব্দের বল্লম।
গৃহকর্তা ক্যাপ্টেন শাহজাহান দোতলা থেকে উঁকি দিলেন। কী হয়েছে? তাজউদ্দীনের মুখ থেকে কথা সরছে না। তাঁর সমস্ত শরীর বিকল, হাত-পা বিবশ। প্রায় তিন মিনিট তিনি যেন স্তম্ভিত, চেতনারহিত হয়ে রইলেন। তারপর কোনো রকমে বললেন, ‘যা সত্যি, তা কি ঠিক? গান্ধীজি…’
‘হ্যাঁ। গান্ধীজিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।’
তাজউদ্দীনের শরীরে বল ফিরে আসছে না। তাঁর মাথায় কোনো কিছু কাজ করছে না। কোনো দুখের অতলে তাঁকে কেউ নিক্ষেপ করল যেন! তিনি ডুবে যাচ্ছেন আর ডুবে যাচ্ছেন।
কামরুদ্দীন আহমদ নেমে এলেন দোতলা থেকে। নুরজাহান বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এলেন তাঁরা।
বেচারাম দেউরিতে এসে রেডিওতে নিজের কানে সেই দুঃসংবাদটা শুনলেন তাজউদ্দীন। বুকের ভেতর ক্ষরণ হচ্ছে তাঁর। সেই ক্ষরণ কিছুতেই বাঁধ মানছে না।
ফজলুল হক হলে গেলেন সাইকেল চালিয়ে। শীতরাতের কুয়াশামাখা অন্ধকার পথ পেরিয়ে। সেখান থেকে গেলেন ঢাকা হলে। রেডিও বাজছে। ছেলেরা সব রেডিও ঘিরে ধরে আছে। পণ্ডিত নেহরু আর সর্দার প্যাটেল ভাষণ দিলেন।
তাজউদ্দীন মন দিয়ে ভাষণ শুনলেন। তাঁর বুকের ক্ষত সারল না। সব জানা গেল। বিকেলবেলা গান্ধীজি অন্য দিনের মতোই দিল্লির প্রার্থনামঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। একটা লোক উঠে দাঁড়াল। সে পিস্তল বের করে তিনটা গুলি করল। একটা গুলি ভেদ করে গেল মহাত্মার বুক। দুটো বিদ্ধ হলো তাঁর তলপেটে। রক্তে ভেসে গেল চারপাশ।
.
বিরলা ভবনে নেওয়া হলো তাঁকে। ৩০ মিনিটের মধ্যেই এক মহান আত্মা দেহখাঁচা ছেড়ে চলে গেল।
হত্যাকারীকে জনতা সঙ্গে সঙ্গেই ধরে ফেলেছে। তার নাম নাথুরাম গডসে। বোম্বের অধিবাসী এই লোক একজন মারাঠি। সে হিন্দু রাষ্ট্র পত্রিকার সম্পাদক।
ঘরে ফিরে এলেন তাজউদ্দীন। নিমতলী মেসের ঘর।
কিন্তু মনের মধ্যে তাঁর অস্থিরতা। যেন একটা গলা কাটা মোরগ তাঁর বুকের মধ্যে তড়পাচ্ছে।
এত কষ্ট কেন হচ্ছে তাঁর? এই জীবনে প্রথম কোনো মৃত্যুশোক অনুভব করছেন তাজউদ্দীন। অথচ মৃত্যু সব সময়ই তাঁর কাছে একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। এর আগে কোনো দিন কারও মৃত্যুতে তিনি শোক প্রকাশ করেছেন বলে তাঁর মনে পড়ে না। বড় ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছিল তিন বছর আগে। অল্প বয়সে। সেই মৃত্যুতে তাঁর মনে কোনো দুঃখবোধই জাগেনি। গত বছর বাবা মারা গেছেন। তাজউদ্দীন তখন কলকাতায়। বাবা চেয়েছেন, তাজউদ্দীন যেন কলকাতা না যায়। তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাজউদ্দীন কলকাতা গিয়েছিলেন। বাবার মৃত্যুর খবর যখন পেলেন, তার ১৫ মিনিট পর তিনি চারটা পরোটা আর এক বাটি মাংস খেয়েছিলেন, তা এখন দিব্যি মনে পড়ছে। তার পরের রাতে বাবা যে বিছানায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন, সে বিছানায় শুয়ে তিনি গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর বিন্দুমাত্র অসুবিধা বোধ হয়নি।
শুধু একটাই বোধ তাঁর মধ্যে এসেছিল, পারিবারিক বোঝাটা তিনি নিজের কাঁধের ওপর টের পাচ্ছিলেন।
কিন্তু গান্ধীজির মৃত্যুটা কেন তিনি সহজভাবে নিতে পারছেন না? কেন এই দুর্বলতা? দুর্বলতাকে তো প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। তিনি মন শক্ত করতে চাইছেন। কিন্তু পারছেন না। তিনি অনুভব করলেন, এটা দুৰ্বলতা নয়। এ হচ্ছে বিষাদ। জগৎপ্লাবী বিষাদের নিচে তিনি ডুবে আছেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাত ১২টায় তিনি খাবার খেলেন। তারপর ঘুমানোর জন্য শরীর সমর্পণ করলেন বিছানায়। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না। সমস্ত চেতনা আপ্লুত করে রেখেছেন গান্ধীজি। স্নায়ু বিবশ হয়ে এল। তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেন। কিন্তু তবু ওই তন্দ্রার ভেতরই গান্ধীজি তাঁকে আপ্লুত করে রাখলেন।
তাঁর মনে হতে লাগল, বিগত দিনগুলোয় এই গান্ধীজির বিরুদ্ধেই তিনি কত কথা উচ্চারণ করেছেন। অন্তরের বিশ্বাস থেকে সেসব করেননি, করেছেন রাজনীতির খাতিরে। কারণ, মুসলিম লীগের শক্তি ছিল কংগ্রেসের দুর্বলতায়। আর তিনি ভাবতেন, কংগ্রেসকে দুর্বল করার উপায় হলো মহাত্মা গান্ধীকে ছোট করা। কংগ্রেসের আত্মাই তো ছিলেন গান্ধীজি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শোকসভায় যোগ দিলেন তাজউদ্দীন। সূর্য একটু হেলে পড়লে গেলেন ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে খবরের কাগজের সন্ধানে। লোকে খবরের কাগজ কেনার জন্য দৌড়াচ্ছে, পত্রিকার হকারকে ঘিরে ধরছে চাক ঘিরে থাকা মৌমাছির মতো, মানুষের ওপর মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। সিনেমা হলে থার্ড ক্লাসের টিকিট কেনার জন্যও এত ভিড় হয় না। একের পায়ের নিচে চাপা পড়ছে অন্যজন। শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে। তবু চেষ্টা করছে খবরের কাগজের একটা টুকরা কেউ পেতে পারে কি না। সেখানে যদি পাওয়া যায় মানুষটার একটুখানি খবর? তাজউদ্দীন বিস্মিত, ঢাকার লোক সত্যি মহাত্মাকে এত গভীরভাবে ভালোবেসেছিল। কোনো কিছু পাওয়ার জন্য মানুষের এত প্রতীক্ষা, এত আকুলতা তিনি আর কখনো দেখেননি। কাগজের দামও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বহুগুণ। তবু মানুষ কাগজ কিনতে চাচ্ছে। একজন মানুষের কপালে একটা কাগজ জুটছে না বলে ভাগ করে অনেকে মিলে একটা কাগজ কিনছে। দ্রুত সব কাগজ বিক্রি হয়ে গেল। তবু লোকেরা সরছে না। তারা কি আশা করে আছে পরের ট্রেনে কাগজ আসবে?
তাজউদ্দীনের মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহাপ্রয়াণের দিনটির কথা। সেদিনও সংবাদপত্রের চাহিদা আর দাম এমনিভাবে বেড়ে গিয়েছিল। তবু তাজউদ্দীন যাহোক একটা কাগজ জোগাড় করতে পেরেছিলেন গোটা। কিন্তু আজ পুরো কাগজ নয়।
তিনি বেরোলেন স্টেশন থেকে।
আজ পুরো শহরে হরতাল। কেউ ডাকেনি এই হরতাল, তবু পালিত হলো। এ এক অভাবিতপূর্ব দৃশ্য।
তাজউদ্দীন গেলেন নাজির লাইব্রেরিতে। অল ইন্ডিয়া রেডিও শুনলেন। মহাত্মার শেষকৃত্যের ধারাবিবরণী হচ্ছে।
ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে শোক মিছিল বেরিয়েছে। করোনেশন পার্কে হলো শোকসভা আর মৌন প্রার্থনা।
তাজউদ্দীনের মনে হচ্ছে, সূর্য অস্তমিত হলো। অস্ত গেল মানবতার পথের দিশারি আলোকবর্তিকা। তাহলে এর পরে কী? অন্ধকার। আলো এবং অন্ধকার। অন্ধকার এবং আলো। দিনের পরই তো আসে রাত। আর দিন আসে রাতের অন্ধকার তাড়াতেই।
এত অন্ধকার কেন চারদিকে? এই অন্ধকারের অবসান হবে না। অমাবস্যার পর আসে ক্ষীণ তনু চাঁদ। তারপর একসময় তো পূর্ণিমা ও হয়। হতাশার শেষে আশা কি আসবে না? সংকটময় এই মুহূর্ত কি একদিন পরিণত হবে না বিস্মৃত অতীতে?
তিনি নিজেকে প্রবোধ দেন, জগৎ থেমে থাকে না। আশা-নিরাশার এই চক্র অনিঃশেষ ও অনিবার্য।
যে মানুষটির শোকে আজ তিনি মুহ্যমান, সে লোকটিও দীর্ঘ অমানিশা পেরিয়ে তবে পৌঁছেছিলেন আলোর দুয়ারে। তাঁকেও অন্ধকারে উদ্বিগ্ন হতে হয়েছে আলোর অন্বেষণে! অথচ কী বিস্ময়, তিনি তো নিজেই ছিলেন আলোকবর্তিকা! আলোককে কি তুমি ধ্বংস করতে পারো! আলোক কণিকা আমাদের থেকে বহুদূরে অবস্থান করতে পারে, কিন্তু তাতে কী! ধ্রুবতারা পৃথিবী থেকে কতদূরে, কিন্তু মরুভূমির পথহারা পথিককে সে ঠিকই পথ চিনিয়ে দেয়!
গান্ধীজির চোখের জ্যোতিকণাও এই পৃথিবীকে বহু শতাব্দীজুড়ে পথ চেনাবে। তাহলে আর বেদনা কেন? আমরা তাঁর ফেলে যাওয়া পায়ের চিহ্ন ধরে অগ্রসর হব। তিনি শান্তি লাভ করুন। আমিন। তাজউদ্দীন নিজের মনে বলেন।
রেডিওতে শুনেছেন মহাত্মার শেষকৃত্যের ধারাবিবরণী। সেই সব কথা মনে হয়।
হঠাৎ মনে হলো, আজ দুদিন তিনি মাথার চুলে চিরুনি দেননি। তাঁর এই একটাই বিলাস। চুল আঁচড়ানো। হোক সামান্য, তবু এই তাঁর বিলাস। আজ তিনি গোসল করেননি। একবার, তাঁর মনে আছে, ১০ মহররমে মুখে স্নো মেখেছিলেন বলে মুসলিম লীগ অফিসে তাঁকে তিরস্কার করেছিলেন তাঁর এক সহকর্মী। সেদিন তিনি তাঁকে বলেছিলেন, দুখের এমন প্রকাশে আমি বিশ্বাসী নই। কিন্তু এখন যে তিনি তার চেয়েও ঢের বেশি করছেন। দুদিন চুলও আঁচড়াচ্ছেন না!
২৮.
৬২ বছর বয়সী কুমিল্লা নিবাসী পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত করাচি শহরে নামলেন উড়োজাহাজ থেকে। করাচিতে এখন নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। পূর্ব বাংলার তুলনায় একটু ঠান্ডা। পূর্ব বাংলায় এখন ফাল্গুন এসে গেছে, চলছে বিখ্যাত বসন্তকাল। দীর্ঘদিন স্বদেশি আন্দোলন করেছিলেন, গান্ধীর ভক্ত ছিলেন, স্বদেশি করতে গিয়ে এই আইনজ্ঞ বারবার জেলে গেছেন। ১৯৩৭ সালে বাংলার সাধারণ আসনে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে কুমিল্লা থেকে এমএলএ নির্বাচিত হন। ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটার পর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে অনেক কংগ্রেস নেতাই ভারতে চলে যান। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত করাচিতে প্রথম পাকিস্তানের গণপরিষদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সেদিন একটা অপূর্ব ভাষণ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘যা-ই হোক না কেন, পাকিস্তান কখনোই এমন একটা ধর্মরাষ্ট্রে পরিণত হবে না, যা কিনা ধর্মযাজকেরা পারলৌকিক মিশন নিয়ে শাসন করে থাকে। আমাদের আছে অনেক অমুসলিম—হিন্দু, খ্রিষ্টান, পারসি; কিন্তু তারা সবাই পাকিস্তানি। তারা অন্যদের মতো সমান অধিকার ও সুযোগ ভোগ করবে এবং পাকিস্তান বিষয়ে তাদের অধিকারপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। পৃথিবীতে এখনো এমন রাষ্ট্র আছে, যেখানে কোনো একটা শ্রেণীর ওপর বৈষম্য ও বাধা আরোপ করা হয়েছে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিন, আমরা সেই যুগে আর নাই। আমরা শুরু করছি এমন একটা কালে, যখন কোনো বৈষম্য নাই, কোনো একটা সম্প্রদায়ের তুলনায় আরেকটা সম্প্রদায়কে আলাদা করা হয় না, বর্ণের কারণে, গোত্রের কারণে কারও প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা হয় না। আমরা শুরু করতে যাচ্ছি এই মৌল নীতি অবলম্বন করে যে আমরা সবাই একটা রাষ্ট্রের নাগরিক এবং সম-অধিকারসম্পন্ন নাগরিক।’
এই বক্তৃতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে আশ্বস্ত করেছে। তিনি আর পূর্ব বাংলা ত্যাগ করেননি।
তিনি আজ করাচি বিমানবন্দরে নেমেছেন গণপরিষদের অধিবেশনে যোগদানের উদ্দেশ্যেই। কিন্তু কী বলবেন, এই বিষয়ে তাঁর বিশেষ একটা প্রস্তুতি আছে। তিনি এবার পার্লামেন্টে কথা বলবেন বাংলা ভাষার পক্ষে।
পূর্ব বাংলায় এরই মধ্যে বাংলা ভাষার পক্ষে আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে, তিনি জানেন। জানেন যে এই দাবিতে ছাত্ররা মিছিল-মিটিং করছে, বুদ্ধিজীবীরা সভা করছেন, বহু বছর থেকেই পত্রপত্রিকায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে প্রবন্ধ ছাপা হচ্ছে।
তিনি বাঙালিদের এই দাবির কথাই তুলে ধরবেন পার্লামেন্টে।
তিনি গণপরিষদের অধিবেশনে যোগ দিলেন।
পার্লামেন্টে একটা বিধি প্রস্তাব করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, গণপরিষদে সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজির সঙ্গে উর্দুও বিবেচিত হবে।
এই প্রস্তাবে একটা ছোট্ট সংশোধনী দেওয়ার নোটিশ দিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। দুদিন পর তাঁকে ফ্লোর দেওয়া হলো সংশোধনী উপস্থাপনের জন্য।
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট, স্যার, আমার সংশোধনী : ২৯ নম্বর বিধির ১ নম্বর উপবিধির ২ নম্বর লাইনে ‘ইংরেজি’ শব্দের পর ‘অথবা বাংলা’ শব্দটি যুক্ত করা হোক।’
তিনি ব্যাপারটা খুব সুন্দর করে ব্যাখ্যা করলেন। বললেন, ‘আমি এই সংশোধনীটা ক্ষুদ্র প্রাদেশিকতার মানসিকতা থেকে উত্থাপন করিনি। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যা ছয় কোটি নব্বই লাখ। এর মধ্যে চার কোটি ৪০ লাখ কথা বলে বাংলায়। তাহলে, স্যার, দেশের রাষ্ট্রভাষা কোনটি হওয়া বাঞ্ছনীয়!’
যে ভাষায় দেশের বেশির ভাগ লোক কথা বলে, নিশ্চয়ই সে ভাষাই হওয়া উচিত রাষ্ট্রভাষা বা লিংগুয়া ফ্রাংকা।
‘আমি জানি, স্যার, ইংরেজি ভাষার একটা আন্তর্জাতিক সম্মানজনক স্থান আছে। কিন্তু, স্যার, ২৯ নম্বর বিধিতে যেখানে বলা হয়েছে,
সেখানে পরিষদের বিবরণী শুধু ইংরেজি অথবা উর্দুতে বিধিসম্মত হবে, দেশের চার কোটি ৪০ লাখ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলা কেন ২৯ নম্বর বিধির আওতায় একই ধরনের সম্মানজনক স্থান পাবে না?
‘স্যার, এই জন্য আমি সারা দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর মনোভাবের পক্ষে সোচ্চার হয়েছি। বাংলাকে একটা প্রাদেশিক ভাষা হিসাবে গণ্য করা যাবে না। এই বাংলা ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গণ্য করতে হবে।’
পূর্ববঙ্গের সাধারণ সদস্য প্রেমহরি বর্মণ এই প্রস্তাবকে সমর্থন করলেন।
এরপর উঠলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। তিনি বললেন, ‘পাকিস্তান একটা মুসলিম রাষ্ট্র এবং এ জন্য মুসলিম জাতির ভাষাকেই (উর্দু) এই রাষ্ট্রের লিংগুয়া ফ্রাংকা করতে হবে। … কাজেই আমি এই সংশোধনী মেনে নিতে পারলাম না। এই সংশোধনীর উদ্দেশ্যই হলো পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা। এই সংশোধনীর উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে অন্তর্নিহিত শক্তি মুসলমানদের মধ্যে ইস্পাতকঠিন একতার সৃষ্টি করেছে, সেই শক্তিকে অপসারণ করা।’
পূর্ববঙ্গের আরেক সদস্য ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত দাঁড়িয়ে বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বেছে বেছে এমন কিছু মন্তব্য করেছেন, যা তিনি না করলেও পারতেন।’
খাজা নাজিম উদ্দিন, পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, বললেন, ‘আমি নিশ্চিত, দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী।’ পূর্ববঙ্গের শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র—এই কথাটা পরিষদের নেতার মুখে শোনার পর খুবই দুঃখ পেয়েছি। এত দিন পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল, পাকিস্তান গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র, আর এই রাষ্ট্রে মুসলিম ও অমুসলিমদের সমান অধিকার রয়েছে।’
পরিষদে সভাপতিত্ব করছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনি প্রস্তাবটা কণ্ঠভোটে দিলে তা বাতিল হয়ে যায়। অথচ এই পরিষদে ৭৯ জন সদস্যের মধ্যে ৪৪ জনই ছিলেন পূর্ব বাংলার।
বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, এই খবর পূর্ব বাংলায় ছড়িয়ে পড়ল বিদ্যুতের বেগে।
ফাল্গুনের এই সকালটায় আকাশ ছিল উজ্জ্বল, রোদ ছিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার মাঠের ঘাসে, বাড়ির ছাদে, গাছের পাতায়। বাতাস ছিল মৃদুমন্দ। ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছে অন্য দিনের মতোই।
হঠাৎই দক্ষিণা সমীরণ বয়ে নিয়ে এল পশ্চিমের সংবাদ। করাচিতে গণপরিষদে বাংলাকে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি আরেকটা সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। আর খাজা নাজিম উদ্দিন বলেছেন, পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষ বাংলা চায় না, চায় উর্দু।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল আর কলেজ থেকে ছাত্ররা মিছিল করে স্লোগান দিতে দিতে বেরিয়ে আসতে লাগল।
মিছিল বড় হতে লাগল। তারা স্লোগান দিতে লাগল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। উর্দুঅলা বরবাদ’। মিছিল পুরো রমনা এলাকা প্রদক্ষিণ করে এসে ঢুকল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। তমদ্দুন মজলিস ও তাঁদের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ, যেটা এরই মধ্যে তাঁরা গঠন করেছেন, তার এক নম্বর ব্যক্তি অধ্যাপক আবুল কাশেমের সভাপতিত্বে বসল প্রতিবাদ সভা। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নাইমুদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ তোয়াহা গণপরিষদের সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করলেন। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষ উর্দুর পক্ষে, খাজা নাজিম উদ্দিনের এই বক্তব্যের জবাবে তাঁরা বললেন, শতকরা ৯৯ জন মানুষই বাংলার পক্ষে।
তাজউদ্দীন ব্যস্ত রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে এক পৃষ্ঠার একটা প্রচারপত্র রচনায়। তাঁকে এটা করতে বলেছেন ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নাইমুদ্দিন।
ছাত্রলীগ ব্যস্ত তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে এক হয়ে ১১ মার্চ ১৯৪৮ হরতাল কর্মসূচি প্রণয়নের কাজে। বাংলা ভাষাকে গণপরিষদের অফিশিয়াল ভাষার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। মুদ্রা আর ডাকটিকিট বেরিয়েছে। তাতে বাংলা ভাষার জায়গা হয়নি। নৌবাহিনীর
ভর্তি পরীক্ষায় বাংলায় অংশগ্রহণের সুযোগ নাই। এসবের প্রতিবাদে এই হরতাল। সর্বত্র ছাত্রলীগ কর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হলো, তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করার জন্য।
শেখ মুজিব ব্যস্ত ছাত্রলীগের এই সব সাংগঠনিক কাজে।
এখন তাঁর হাতে একটা বিবৃতি।
মুজিব সেটা পড়ছেন। তাঁর পাশে আছেন তমদ্দুন মজলিসের নেতৃবৃন্দ আর ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ।
‘তমদ্দুন মজলিসের রাষ্ট্রভাষা সাব-কমিটির এক যুক্ত অধিবেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র সাধারণ ধর্মঘট/ হরতাল ঘোষণা করা হয়েছে—…আমরা পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত দেশপ্রেমিক গণনেতা, ছাত্র ও যুবকর্মীদের সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি, ধর্মঘট হরতালকে সম্পূর্ণভাবে সফল করার জন্য যেন তাঁরা এখন থেকে প্রস্তুত হতে থাকেন।…আমরা পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও যুব সমাজের কাছে আবেদন জানিয়ে বলি, ওঠো, জাগো, এই ষড়যন্ত্রকে তোমাদের নিজ শক্তিবলে চুরমার করে দাও। দেশব্যাপী এমন আন্দোলন গড়ে তোলো, যার ফলে বাংলাকে অবিলম্বে আমাদের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করতে সরকার বাধ্য হয়।’
মুজিব চশমাটা খুলে পাঞ্জাবির কোনা দিয়ে মুছলেন। তারপর আবার পড়তে লাগলেন। পড়া শেষে তিনি স্বাক্ষর করলেন দ্বিতীয় স্থানে। ওপরের জায়গাটা তিনি ছেড়ে দিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেমের জন্য। তারপর স্বাক্ষর করলেন নাইমুদ্দিন আর আবদুর রহমান চৌধুরী।
পরের দিন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনটাকে সর্বদলীয় চেহারা দেওয়ার জন্য একটা সভা ডাকা হলো। কামরুদ্দীন আহমদ সভাপতি। তাজউদ্দীন তাতে যোগ দিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক ছাত্ররাও এবার এতে যুক্ত হলেন। শুধু তমদ্দুন মজলিস আর ছাত্রলীগ নয়, এবার রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনটা সব দলের, সব মতের আন্দোলন হয়ে উঠল।
তাজউদ্দীন এইভাবে প্রতিটা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যোগ দিচ্ছেন। আবার রোজ সকালে, দুপুরে—যখনই সময় পাচ্ছেন, নিজের পরীক্ষার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। এবার তিনি সলিমুল্লাহ কলেজ থেকে প্রাইভেটে আইএ পরীক্ষা দেবেন। মাস দুয়েক আগে কলেজে গিয়ে প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করে ফরম ফিলআপ করে এসেছেন। সামনে তাঁর পরীক্ষা। তিনি পরীক্ষার পড়া করছেন, একই সঙ্গে ভাষা আন্দোলন, খাজা নাজিম উদ্দিন-সরকারবিরোধী আন্দোলনও করছেন। সঙ্গে কামরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গণ-আজাদি লীগ বা পিপলস ফ্রিডম লীগটাকে গড়ে তোলার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন।
আগামীকাল হরতাল। মুজিবের রক্তের ভেতর অস্থিরতা। তিনি আন্দোলন-সংগ্রাম করা মানুষ। প্লেটোর মতো তাঁর চোখ আকাশের দিকে স্থির নয়, অ্যারিস্টটলের মতো তাঁর মুখ মাটির দিকে বাঁকানো—প্রায়ই বলেন কামরুদ্দীন আহমদ। ১০ মার্চ ফজলুল হক হলের প্রস্তুতি সভায় যোগ দিয়েছেন নেতারা। মুজিবও আছেন। সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়কসহ কয়েকজন নেতার মনে দ্বিধা। সরকার এরই মধ্যে ১৪৪ ধারা জারি করেছে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা উচিত হবে কি হবে না।
হঠাৎ একটি জলদগম্ভীর কণ্ঠ বজ্রপাতের মতো আওয়াজ করে উঠল, ‘আমরা অবশ্যই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করব। সরকার আমাদের দাবি মেনে নেয়নি। বরং একটা ন্যক্কারজনক বিবৃতি দিয়েছেন নাজিম উদ্দিন। স্পষ্ট করে বলেছেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রের একটা ভাষা হবে। এবং সেটা হবে উর্দু। কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা হবে উর্দু আর প্রদেশের সঙ্গে সংবাদ আদান- প্রদানের ভাষাও হবে উর্দু। এই কথা আরও একবার বিবৃতি দিয়ে বলার পরেও কেন আমাদের মনে দ্বিধা? আগামীকাল ধর্মঘট হবে। পিকেটিং হবে। সেক্রেটারিয়েটের সামনে পিকেটিং করব আমি।’
সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন ছাত্রনেতা অলি আহাদ। বললেন, ‘আমি এই প্রস্তাব সমর্থন করি। সরকারের বিধিনিষেধ মেনে আন্দোলন হয় না। শেখ মুজিবের সঙ্গে আমিও থাকব সেক্রেটারিয়েটের গেটে পিকেটিং করতে।’
তোয়াহা, শওকত, শামসুল হক সমর্থন করলেন এই বক্তব্য। এরপর দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়। কে কোন জায়গায় পিকেটিংয়ের নেতৃত্ব দেবে, কাগজে লিখে তা টাঙিয়ে দেওয়া হয় দেয়ালে।
ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। বাড়ির ছাদের ওপর তখন কাকগুলো ডাকতে শুরু করেছে। বসন্তের ভোরে হাওয়া বইছে শরীর ও মনজুড়ানো। শত শত পুলিশ এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন এলাকার আমতলায় অবস্থান নেয়। তাদের পরনে হাফ প্যান্ট, হাতে বন্দুক, সচিবালয় ঘিরেও তারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো।
.
নটার মধ্যেই ইডেন সেক্রেটারি ভবনের ১ নম্বর গেটে হাজির হলেন শেখ মুজিব, অলি আহাদসহ কয়েকজন। একটু পর সেখানে এলেন তরুণ জননেতা শামসুল হকসহ বেশ কয়েকজন কর্মী। সচিবালয়ের কর্মকর্তা- কর্মচারীরা তখনো দপ্তরে আসতে শুরু করে নাই।
সিদ্ধান্ত হয়ে আছে, চার-পাঁচজনের একটা করে দল কর্মচারীদের সচিবালয়ে ঢুকতে নিষেধ করবে। তাদের যদি গ্রেপ্তার করা হয়, পরের দলটা এসে সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়বে।
সাড়ে নটা থেকে দশটার মধ্যে কর্মচারীরা আসতে শুরু করল। শেখ মুজিব স্লোগান ধরলেন, ‘রাষ্ট্রভাষা রাষ্ট্রভাষা, বাংলা চাই বাংলা চাই। আজকের হরতাল, সফল করুন, সফল করুন’।
সবাই মিলে মুজিবের কণ্ঠে কণ্ঠ মেলাল।
পুলিশ তৎপর হয়ে উঠল।
লাঠি চালানোর নির্দেশ এল ওপর থেকে।
সঙ্গে সঙ্গে চলল নেতাদের গ্রেপ্তার করা। প্রথমে গ্রেপ্তার হলেন শামসুল হক। আর তাঁর গ্রুপের কর্মী কয়েকজন।
সচিবালয়ের গেটে এগিয়ে গেলেন শেখ মুজিব। আর সঙ্গের কর্মীরা এগোলেন। তাঁরা বাধা দিলেন কর্মকর্তাদের সচিবালয়ে ঢুকতে
পুলিশ তাঁদেরও গ্রেপ্তার করল।
এবার এগিয়ে গেলেন অলি আহাদ ও তাঁর দল। পুলিশ মহা খাপ্পা। লাঠি চালাল হরতালকারীদের ওপর। অলি আহাদ লাঠির আঘাতে লুটিয়ে পড়লেন পথে। তাঁকে ওই অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন চত্বরে সকাল থেকেই বিভিন্ন স্কুল- কলেজের ছাত্ররা সমবেত হচ্ছিল। ছাত্রীরাও এসেছিল দল বেঁধে। স্লোগানে স্লোগানে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলছিল তারা।
মেডিকেল কলেজ আর ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দেয় দলে দলে।
খণ্ড খণ্ড মিছিল মিলিত তৈরি করে এক বিশাল মিছিল। সেই মিছিলের নেতৃত্ব দেন অধ্যাপক আবুল কাশেম।
মিছিল এগোতে থাকে সচিবালয়ের দিকে।
.
তাজউদ্দীন আহমদ ঘুম থেকে ওঠেন সকাল সকাল। সকাল সাতটার মধ্যে তিনি হাজির হন ফজলুল হক হলে। তোয়াহা আর তিনি যান রমনা ডাকঘরের সামনে পিকেটিং করতে। পুলিশের প্রহারে তোয়াহা মারাত্মক আহত হন। তাঁকে গ্রেপ্তারও করা হয়। তাজউদ্দীন গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হলেন। তিনটার পর বিক্ষোভকারীরা সবাই একে একে চলে গেলে তাজউদ্দীন গেলেন কেন্দ্রীয় কারাগার, কোতোয়ালি ও সূত্রাপুর থানা ও হাসপাতালে। আটককৃত ও আহতদের দেখতে।
সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রথম দলটা প্রবেশ করল। তারা সবাই লাঠ্যাহত। ফজলুল হক হলের কাওয়ালি পার্টি। মানে গান গায় দল বেঁধে, ভাষার জন্য মিছিলে যায়, কিন্তু খুব রাজনীতি করিয়ে কেউ নয়। জীবনে প্রথম কারাগারের অভ্যন্তর দর্শন। এই নিরীহ বিদ্যান্বেষীদের একটু কাতর করেছিল, যদিও তারা আগে থেকেই কাতরাচ্ছিল পুলিশের মৃদু লাঠিবর্ষণের বিপুল অভিঘাতে। পুলিশের তাড়া খেয়ে তারা ফজলুল হক হলের বিখ্যাত পুকুরে আশ্রয় খুঁজেছিল, কিন্তু মাতা পুকুর তাদের আগলে রাখতে পারেনি, পুলিশের ভ্যানে উঠতেই হলো অনেককে। সেখান থেকে যখন তাদের কেন্দ্রীয় খোঁয়াড়ে ঠেলা হলো, তারা মানল যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম কারাগার প্রবেশের অমোচনীয় রেকর্ড তারা অর্জন করে ফেলেছে। তবু এই তরুণদের আর্তনাদ কমছিল না। দুপুরে তাদের জন্য বরাদ্দ হলো টিনের থালায় কিছু কাঁকর ও ফাঁকে ফাঁকে মোটা চালের ভাত, আর টিনের বালতি থেকে আহৃত এক হাতল করে অড়হড়ের ডাল। এর নামই বুঝি জেলের ভাত খাওয়া। ছেলেদের পিঠের মার পেটের ভাত বুঝি সইয়ে দেবে।
এমন সময় একটা বিরাট দল এসে ঢুকল স্লোগান দিতে দিতে। সেই স্লোগানের মূল কণ্ঠস্বর যাঁর, তাঁর নাম শেখ মুজিব। যেমন তাঁর গলা, তেমন তাঁর উচ্চতা। ছেলেরা এরই মধ্যে তাঁকে চিনে ফেলেছে। অনেকেই এরই মধ্যে তাঁর ভক্ত হয়ে পড়েছে।
সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমগাছে বসে দুই পাখি—ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি সারা দিনের ঘটনা নিয়ে কথা বলছিল।
নিচে পুরো চত্বরে তখন শত শত ইটপাটকেলের টুকরা। ছেলেদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে দফায় দফায়। তারই চিহ্ন বহন করে আছে এলাকাটা।
ব্যাঙ্গমা বলল, ‘মুজিব তাঁর কাজ আর দিশা খুঁইজা পাইছে। আপসহীনতার এই পথই তাঁরে একদিন লইয়া যাইব তাঁর মঞ্জিলে।’
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘তাজউদ্দীনও গ্রেপ্তার এড়াইতে পারছে। এইটাই ইঙ্গিত দিতাছে ভবিষ্যতের।’
.
কেন্দ্রীয় কারাগারে ভাষা আন্দোলনবন্দীদের তৃতীয় রাত। শেখ মুজিব একটা সেলের মধ্যে একটা বিছানায় বসে কয়েকজন সহবন্দীর সঙ্গে কথা বলছেন। অপেশাদার ছাত্রবন্দীরা বসে আছে সারে সারে, ছোবড়ার তোশকে। এখন তাদের গোনা হবে। গুনতির পর বাতি নিভিয়ে দেওয়া হবে। গোনার দায়িত্ব পালন করছে কারাগারের এক নতুন কর্মচারী। তার পাশে দুই তিনজন সশস্ত্র প্রহরী।
ছেলেরা ভাবল, একটু মজা করা যাক।
এক কাতার গোনা শেষ হওয়ার পর সেই কাতার থেকে দু-চারজন চুপিসারে উঠে অন্য কাতারে গিয়ে বসে। গোনা হয়, কিন্তু হিসাব মেলে না। আবার প্রথম থেকে গুনতে শুরু করে কর্মচারীটি। আবার একই দুষ্টুমি। অধৈর্য হয়ে একজন অবাঙালি সেপাই একটা অশ্লীল গালি দিয়ে বসল।
আর যায় কোথায়! অমনি ছাত্ররা উঠে ঘিরে ধরল তাকে।
তাদের হট্টগোলে বেশ সরগরম হয়ে উঠল ওয়ার্ডটা।
হকচকিত প্রহরীরা বাঁশি বাজিয়ে দিল। উঁচু প্রাচীরের ওপর থেকে বেজে উঠল পাগলাঘণ্টি।
পাগলাঘণ্টির বাজা মানে ভয়ংকর কিছু ঘটা।
দলে দলে পুলিশ রাইফেল বাগিয়ে আসতে লাগল, তারা সিঁড়ি দাপিয়ে উঠতে লাগল দোতলায়, যেখানে এই ভাষাবন্দীদের ওয়ার্ড। পুলিশদের বুটের আওয়াজে প্রকম্পিত জেলখানা।
শেখ মুজিব মুহূর্তেই তাঁর কর্তব্য ঠিক করে ফেললেন। তিনি চলে গেলেন ওয়ার্ডের গেটে। সঙ্গে দু-চারজন সঙ্গী। তিনি দুই হাত প্রসারিত করে গেট আগলে ধরে বললেন, ‘খবরদার, কেউ ভেতরে ঢুকতে পারবা না। সব ঠিক আছে, যাও তোমাদের জেলারকে ডেকে আনো।’
রাইফেল বাগানো পুলিশ এসে রাইফেলের নল ধরল মুজিবের বুক বরাবর। তবু অকম্পিত মুজিব। অনড় তাঁর অবস্থান।
ছেলেরা এরই মধ্যে ভীতি-বিহ্বল জেল কর্মকর্তা আর সেপাইগুলোকে পাঠিয়ে দিয়েছে গেটের ওই পারে।
জেলার এলেন।
মুজিব বললেন, ‘সব ঠিক আছে, ওদের নিয়ে যান।’
এতগুলো ছেলে সেদিন বেঁচে গেল নিশ্চিত প্রলয়ের হাত থেকে।
.
১১ মার্চ ধরা হয়েছিল মুজিবকে। ১৫ তারিখেই ছেড়ে দেওয়া হলো। কারণ, এর পর প্রতিদিন ধর্মঘট চলছিল সমস্ত শিক্ষাঙ্গনে। প্রতিদিন ছেলেরা মিছিল বের করছিল, স্লোগানে স্লোগানে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল সারা দেশের আকাশ-বাতাস। প্রতিদিনই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হচ্ছিল ছাত্রদের। আহতদের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছিল। রাস্তাঘাট হয়ে পড়ছিল অচল, জীবনযাত্রা ব্যাহত। শাহ আজিজপন্থী ও উর্দুঅলা গুন্ডারা আক্রমণ করছিল বিক্ষোভকারীদের, কিন্তু রাজপথে প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছিল নতুন নতুন মুখ, জলের কাতারে যুক্ত হচ্ছিল যেন জল, বন্যার বিপদাশঙ্কায় কাঁপছিল শাসকেরা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ছাত্র গ্রেপ্তার অব্যাহত ছিল। এর প্রতিবাদে এসএম হল সংসদের সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে একটা সভাও অনুষ্ঠিত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সামনেই, কয়েক দিন পর, কায়েদে আজম আসবেন ঢাকায়। তাঁর আগমনের প্রাক্কালে ঢাকা শহর অশান্ত হয়ে থাকুক, তা চাচ্ছিলেন না খাজা নাজিম উদ্দিন। তিনি তাই বারবার বার্তা পাঠাচ্ছিলেন কামরুদ্দীন সাহেবকে, আবুল কাশেমকে, একটা আপস-মীমাংসায় পৌঁছাতে। তিনি আশ্বাসও দিয়েছিলেন, বিক্ষোভকারীদের সব দাবি মেনে নেওয়া হবে।
নেতারা গেলেন মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়ে। ৮ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। ভাষা আন্দোলনের সব বন্দীকে মুক্তি দেওয়া ও তাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার, পুলিশি অত্যাচারের তদন্ত, প্রদেশে সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলার ব্যবহার শুরু করা, আর কেন্দ্রে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব উত্থাপন, ভাষাকর্মীরা দেশশত্রু নয় বলে নাজিম উদ্দিনের স্বীকারোক্তি—এই সব ছিল সেই চুক্তিতে। চুক্তির এই সব দফা নিয়ে কারাগারে গেলে আবুল কাশেম ও কামরুদ্দীন, শেখ মুজিব আর অলি আহাদকে দেখানো হলো সেসব। তাঁরা অনুমতি দিলেন। সে রাতেই ভাষাবন্দীদের ছেড়ে দেওয়া হলো।
রাতের বেলায় মুজিব যোগাযোগ করলেন মুসলিম লীগের বিরোধী এমএলএদের সঙ্গে। তাঁরা বললেন, ‘তোমরা কাল আসো, কাল আমরা খাজার গদি উল্টে দেব।
পরের দিনই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গেলেন মুজিব। বেলতলায় অনুষ্ঠিত হলো এক ছাত্রসভা, তাতে তিনি সভাপতিত্ব করলেন এবং বললেন, ‘চুক্তিতে অসামঞ্জস্য আছে, যেমন পুলিশি নির্যাতনের তদন্ত সরকার বা পুলিশ করলে চলবে না, করাতে হবে নিরপেক্ষ কাউকে দিয়ে,’ বললেন, ‘বাংলার গণপরিষদ সদস্যদের অঙ্গীকার করতে হবে যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব যদি গণপরিষদে পাস করাতে তাঁরা না পারেন, তাহলে তাঁরা পদত্যাগ করবেন। এই প্রতিশ্রুতি এখনই আদায় করতে হবে, চলুন, এখন আমরা পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ ঘেরাও করি।’ মিছিল তাঁর বক্তৃতায় উত্তেজিত হয়ে উঠল। জঙ্গি মিছিল ছুটল এসএম হলের কাছেই যে আইন পরিষদ ভবন, সেই দিকে। বিক্ষোভকারীরা ভবনের গেটে তালা দিল, এমএলএদের ‘ধর ধর’ বলে তাড়া করল।
‘তবে আরেকটা ঘটনা ঘটছে,’ ব্যাঙ্গমা বলল, ‘ক্যান্টনমেন্ট থাইকা জিওসি আইছিল আইন পরিষদ ভবনে, এই আর্মি অফিসারের নাম আইয়ুব খান। তারেও তুমি মনে রাইখো।’
‘তুমি রাখো, আমার আরও কাম আছে।’ ব্যাঙ্গমি মুখ ফেরায়। ‘কাজ না কাম?’ ব্যাঙ্গমা দুষ্টু হাসি দেয়।
ব্যাঙ্গমি বলে, ‘খালি বদমাইশি, আইয়ুব খান আইছেন, কারণ, খাজা তারে ডাইকা আনছেন, বলছেন, ফজলুল হক ছাত্র লেলায়া দিছে, বগুড়ার মোহাম্মদ আলী যদি সরকারের ওপর থাইকা সমর্থন প্রত্যাহার করে, তাইলেই খাজা সরকারের পতন আর ওই দিকে ছাত্ররাও তার আইন পরিষদ ভবন ঘেরাও কইরা রাখছে, আইয়ুব খান আর্মির একটা কোম্পানি রেডি কইরা রাখলেন মেজর পীরজাদার আন্ডারে, তারপর খাজারে কইলেন আপনি বাড়ি যান, খাজা কয় আমি জরুরি ভাষণ দিতেছি। আইয়ুব খান কয়, আরে রাখেন মিয়া মিটিং, আগে বাঁচেন, খাজারে পাকঘরের ভিতর দিয়া গাড়িতে তুইলা তিনি পার করেন। পুলিশরে তিনি কন, তোমরা অ্যাকশন লও না কেন। ছাত্রগুলানরে পিটায়া তুইলা দেও। পুলিশ কয়, লিখিত অর্ডার দেওন লাগব, মুখের অর্ডারে পিটন দিব, কাইলকা তদন্ত কমিটি করা হইব পুলিশের বাড়াবাড়ি নিয়া। তখন আইয়ুব খান মোহাম্মদ আলী বগুড়া নামের এমএলএরে কয়, ওই মিয়া, গুলি খাইতে চান? বুলেট লাগব, যান, বাড়ি যান। বগুড়া বাড়ি না গিয়া গেছে খাজার কাছে, আমারে আর্মি দিয়া ভয় দেখাও, আমি সাপোর্ট উইথড্র করলাম।’
‘খাজা আইয়ুব খানরে কইব, ওই মিয়া দিলা আমারে উল্টায়া। আইয়ুব খান মোহাম্মদ আলীরে জড়ায়া ধইরা কইব, বগুড়া সাব, আপনি ইয়ারকিও বুঝেন না।’
পুলিশ অ্যাকশনে চলে গেল। লাঠিচার্জ হলো। গুলিও হলো। আহত হলো অনেক ছাত্র। কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল পুরো এলাকা। একসময় ছাত্ররা রণে ভঙ্গ দিল।
একদিন পরে ‘কায়েদে আজম’ আসছেন এই শহরে। শামসুল হকের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ আন্দোলন কর্মসূচি স্থগিত করে জিন্নাহকে স্বাগত জানিয়ে তাঁর কাছেই দাবি-দাওয়া পেশ করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল।
২৯.
সে দিন বিকেলে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল খুব। ঘণ্টা আধেকের বৃষ্টি তছনছ করে দিল কায়েদে আজমের জন্য ঢাকার রাস্তায় বানানো তোরণগুলো। ভিজিয়ে দিল খাজার জড়ো করা পথের দুপাশে দাঁড়ানো নিরীহ জনতাকে। বৃষ্টি থামলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে করাচি থেকে বহন করে নিয়ে আসা বিশেষ উড়োজাহাজটা অবতরণ করল। তিনি নামলেন তেজগাঁও বিমানবন্দরে। আকাশ পরিষ্কার, তিনি বাতাসে জলকণার গন্ধ পেলেন। জলজংলার দেশ, জিন্নাহ ভাবলেন।
এরই মধ্যে বিমানবন্দরকে তটস্থ করে মারছে গভর্নর জেনারেলের নিরাপত্তারক্ষীরা। তারা কিছুতেই কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না মুসলিম লীগ আর মুসলিম ছাত্রলীগ নেতাদের। এমনকি এমএলএরাও ধাওয়া খাচ্ছে নিরাপত্তারক্ষীদের। কিন্তু নেতারা হতাশ হয়ে দেখলেন, মুখ্য সচিব আজিজ আহমদের নেতৃত্বে আমলারা সবাই ঠিকই স্যুট-প্যান্ট-টাই পরে আর দুই পাটি দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ডান হাত বাড়িয়ে। তারাই অভ্যর্থনা জানাবে এই মহান নেতাকে। মুসলিম লীগ করলাম আমরা, পাকিস্তান বানালাম আমরা, আর জাতির জনকের কাছেও ঘেঁষতে পারছি না, তাকে ভালোবাসার জন্য বুক পেতে দেব বলে এসে ঘাড়ে ধাক্কা খাচ্ছি রক্ষীদের। হায় আল্লাহ, তুমি মোমেনদের আর কত ইমানের পরীক্ষা নেবে!
জিন্নাহ বেরোলেন আজিজ সমভিব্যাহারে, উঠলেন গাড়িবহরে। দেখতে পেলেন দুধারের জনতার মাথাগুলো ভিজে আছে কাকের মতো, কাপড়চোপড়ও ভেজা। জিন্নাহ জিজ্ঞেস করলেন আজিজকে, ‘লোকগুলো সব ভেজা কেন?’
আজিজ বললেন, ‘বৃষ্টি এই দেশে রহমতের লক্ষণ। আপনি এসেছেন, আল্লাহর রহমত বর্ষিত হচ্ছে।’
গাড়িবহর চলল সচিবের বাসার দিকে, মিন্টো রোড হেয়ার রোড এলাকায়।
তাজউদ্দীন, শেখ মুজিবসহ কয়েকজন ছাত্রকর্মী সেই বিকেলে দাঁড়িয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে।
তাজউদ্দীন আর নাইমুদ্দিন গেলেন হেয়ার রোডে, পাশ দিয়ে আনুষ্ঠানিক মোটর শোভাবহরে গেলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তাজউদ্দীন খেয়াল করলেন, সরকার বিপুল মানুষের সমাবেশ ঘটানোর চেষ্টা করলেও মানুষের মধ্যে কোনো উচ্ছ্বাস নাই। কেউ নেতার নামে কোনো স্লোগান দিচ্ছে না। মাত্র দুদিন আগেই ভাষার প্রশ্নে এত বড় আন্দোলন হয়ে গেল। এরপর উচ্ছ্বাস অবশ্য না থাকাই স্বাভাবিক।
আজিজ আহমদ ঠিক বলেন নাই। জিন্নাহ বাংলার জন্য রহমত নিয়ে আসেন নাই। তিনি এনেছেন পাকিস্তানের ধ্বংসের বীজ।
রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দিতে উঠেছেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। সাদা কোট, সাদা প্যান্ট। গলায় টাই। মাথায় সাদাকালো ছোপ ছোট মোটা কাপড়ের কিস্তি টুপি। জনসভায় বিপুল লোকসমাগম হয়েছে।
জিন্নাহ বক্তব্য দিচ্ছেন খুবই দৃঢ়কণ্ঠে। জানিয়ে দিলেন, ‘প্রদেশের ভাষা কী হবে, তা প্রদেশ ঠিক করবে, কিন্তু কেন্দ্রের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং একমাত্র উর্দু। পাকিস্তানের শত্রুদের পাল্লায় পড়বেন না। আপনাদের মধ্যে পঞ্চম বাহিনী ঢুকে পড়েছে। আমরা পাকিস্তানের শত্রুদের সহ্য করব না। আমরা ঘরের শত্রুদের সহ্য করব না।’ স্পষ্ট ইংরেজিতে জানিয়ে দিলেন জিন্নাহ।
তমদ্দুন মজলিস আর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ছেলেরা মঞ্চের পেছনের এক কোনা থেকে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল, কিন্তু প্রতিবাদ ঠিক জমে উঠল না।
সবাই খুবই মন খারাপ করে ফিরলেন জনসভা থেকে। তাজউদ্দীন আহমদ ভাবছেন, ‘লোকটা তো আমাদের দেশের শত্রু বলে আখ্যায়িত করল সরাসরি। আশ্চর্য তো! এই লোকটাও তাঁর দলের ওপরে উঠতে পারল না! ‘উর্দুর বিরুদ্ধে যারা কথা বলবে, তারা পাকিস্তানের শত্রু, তাদের ক্ষমা নাই।’ তাজউদ্দীন এই কথা শুনছেন আর রেসকোর্স ময়দানের কাদায় তাঁর এক পায়ের স্যান্ডেল ডুবে গেছে টের পেয়ে তিনি সেটা বের করার জন্য পা চালালেন, প্রথম দফায় ব্যর্থ হয়ে তাঁর মুখ দিয়ে অলক্ষে বেরিয়ে গেল, ‘দূর ছাই, জুতা।’ পাশের লোক উৎসাহিত বোধ করে বলল, জুতা জুতা…
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন হচ্ছে কার্জন হলে। স্নাতকরা সেখানে উপস্থিত। জিন্নাহ তাঁর ভাষণে বললেন, ‘উর্দু অ্যান্ড উর্দু শ্যাল বি দি অনলি স্টেট ল্যাংগুয়েজ অব পাকিস্তান।’ ছাত্ররা ‘নো’
‘নো’ বলে চিৎকার করে উঠল।
জিন্নাহ এই প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি থতমত খেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর আবার তাঁর বক্তৃতা চালিয়ে গেলেন।
তাজউদ্দীন গেছেন জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করতে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে জিন্নাহ বসতে চেয়েছেন। অধ্যাপক আবুল কাশেম, শামসুল হক, নাইমুদ্দিন আহমেদ, কামরুদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহাও আছেন দলে। এটা পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মুখ্য সচিব আজিজ আহমদ সাহেবের সরকারি বাসভবন। বাড়িটা মিন্টো রোডে। ঢোকার আগে শরীর তল্লাশি করল নিরাপত্তারক্ষীরা। তাঁরা করিডর পেরিয়ে বৈঠকখানার দিকে যাচ্ছেন। দেশ গরিব হলেও বাড়িটায় দারিদ্র্য নয় বরং সৌকর্যের চিহ্ন। আশ্চর্য এই রকম প্রাসাদোপম বাড়িতে থাকেন মুখ্য সচিব! আর তাঁরই হাত দিয়ে চলে দেশ। এ নিশ্চয়ই সরল সোজা লোক খাজা নাজিম উদ্দিনকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়।
জিন্নাহ পরে আছেন সাদা কাবুলি আর সালোয়ার। একটা কাঠের গোল চেয়ারে তিনি বসে। তাঁর পাশে আজিজ আহমদ। আর মিলিটারি সেক্রেটারি। সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিরা বসেছেন তাঁর মুখোমুখি, একটা টানা চেয়ারে। তাঁদের সামনে একটা ছোট টেবিল। টেবিলে টেবিল ক্লথ। কায়েদে আজম কথা বলছেন আঙুল উঁচিয়ে।
জিন্নাহ বললেন, ‘একাধিক রাষ্ট্রভাষা দেশের সংহতি বিনষ্ট করবে।’
কামরুদ্দীন আহমদ বললেন, ‘সুইজারল্যান্ড, কানাডায় একাধিক রাষ্ট্রভাষা আছে। তা তাদের সংহতি বাড়িয়েছে।’
কায়েদে আজম অসহিষ্ণু গলায় বললেন, ‘আমি ইতিহাস জানি, আমাকে ইতিহাস শেখাতে এসো না। পাকিস্তানের সংহতির স্বার্থে দরকার হলে তোমাদের মাতৃভাষা বদল করতে হবে।’
তাজউদ্দীন আহমদ বিস্মিত। প্রতিনিধিরা হতবাক। এই লোক বলে কী?
অলি আহাদ বললেন, ‘এক ভাষা হলেই এক জাতি হয় না। ব্রিটেন, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার ভাষাও এক, ধর্মও এক, ওরা এক জাতি নয়। আরবরা সবাই একই ভাষায় কথা বলে, সবার ধর্মও এক, কিন্তু তাহলে জাতি কেন এতগুলো?’
নামাজের আজান দিয়েছে। শামসুল হক সাহেব বললেন, ‘স্যার, নামাজের সময় হয়ে গেছে।’
আলোচনা তবু চলছে।
কায়েদে আজম আলোচনা করেই যাচ্ছেন।
শামসুল হক আবার বললেন, ‘স্যার, নামাজের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।’ কায়েদে আজম বিরক্তির সঙ্গে বললেন, ‘তোমার নামাজের সময় হয়ে গেলে তুমি বাইরে যাও, আর নামাজ পড়ে আসো। আমাদের বিরক্ত করছ কেন।
আলাপ আর তেমন জমল না। শামসুল হকের দিকে আঙুল তুলে তিনি বললেন, ‘আমি তোমাকে চিনি।’
চেনারই কথা। দিল্লিতে মুসলিম লীগের যে কাউন্সিলে লাহোর প্রস্তাবের একাধিক মুসলিম রাষ্ট্রের কথাটা সংশোধন করে একটা মুসলিম রাষ্ট্র বানানোর প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়, আবুল হাশিম সাহেবের সঙ্গে মিলে শামসুল হক তার তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন।
বিদায়ের আগে প্রতিনিধিরা তাঁদের স্মারকলিপিটা দিয়ে এলেন কায়েদে আজমের হাতে। তাতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে অখণ্ডনীয় সব যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে।
কায়েদে আজম সেটা পড়ে দেখারও প্রয়োজন মনে করলেন না।
.
জিন্নাহর জাদুকরি ব্যক্তিত্ব পূর্ব বাংলার ওপরও ক্রিয়াশীল বলেই মনে হলো। কিছুদিনের মধ্যেই পূর্ব বাংলার আইনসভায় বাংলাকে পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা, আদালতের ভাষা আর শিক্ষার মাধ্যম করার প্রস্তাব গৃহীত হলো।
কিন্তু কেন্দ্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিটা ওই মুহূর্তে চাপা পড়ে গেল। খাজা নাজিম উদ্দিন বললেন, কায়েদে আজম, যাঁকে জাতির পিতা বলা যায়, তিনি বলে গেছেন উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। এরপর আর কথা বলা মানে তাঁকে অসম্মান করা।
খাজা দায়িত্ব চাপালেন জিন্নাহর ওপর। জিন্নাহ মৃত্যুর আগে যক্ষ্মারোগে ভুগতে ভুগতে তাঁর চিকিৎসকের কাছে বলেছিলেন, ‘পূর্ব বাংলার নেতারা তো আমাকে বলেছিলেন ওই প্রদেশের সবাই উর্দু জানে। ফজলুর রহমান আর খাজা নাজিম উদ্দিন আমাকে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছিল।’
সেই বিভ্রান্তি আর দূর হয়নি। যক্ষ্মার চিকিৎসা হয়নি ঠিকমতো।
ওই সময় জিন্নাহর নির্দেশে বলিয়াদি ভবনে বিরোধী দলের যে এমএলএরা একত্র হয়েছিলেন মুজিব-তাজউদ্দীন-কামরুদ্দীন সাহেবদের সঙ্গে, খাজা তাঁদের টোপ গেলাতে পারলেন। মোহাম্মদ আলী বগুড়া হলেন বার্মার রাষ্ট্রদূত। আরও দুজনকে লোভনীয় পদ দেওয়া হলো।
আন্দোলন মিইয়ে গেল তখনকার মতো।
জিন্নাহ মারাই গেলেন।
জিন্নাহ মারা গেলেন। আহা! কী ব্যক্তিত্ব ছিল তাঁর। নিজের মেয়েকে পর্যন্ত কাছে ভিড়তে দিতেন না। একবার জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাহকে ধরে মেয়েটি বাবার কাছে আসে। জিন্নাহ নির্দিষ্ট সময়ে বৈঠকখানায় আসেন, নিজের আসনে বসেন। মেয়েটি তাঁর বিপরীতে বসে কাঁদতে লাগল। জিন্নাহ একটা কথাও বললেন না।
এক মিনিট পর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে গেলেন।
.
জিন্নাহর যক্ষ্মা হয়েছিল। সেটা তিনি গোপন করে রেখেছিলেন। এবং তাঁর চিকিৎসাও ঠিকমতো হয়নি।
সবাই জানত, লোকটা মরে যাচ্ছে। বেলুচিস্তানের কোয়েটা শহরের এক নির্জন গৃহে তিনি একাকী জীবন যাপন করতেন। যে লোকটা মরেই যাবে, তা-ও তখনকার দিনে শিয়োর সাকসেস রোগ যক্ষ্মায়, কে তার কাছে ভিড়বে। তাঁর সঙ্গীরা তখন ব্যস্ত তাঁর অবর্তমানে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠার দৌড়ে। পাকিস্তানের জাতির জনক মরে পড়ে রইলেন, তাঁর কফিন পড়ে রইল করাচির দ্রিঘ রোড সামরিক বিমানবন্দরে। তাঁর লাশটা পাহারা দেওয়ার মতোও তখন কেউ ছিল না। সেপ্টেম্বর ’৪৮-এর প্রচণ্ড গরমে আত্মাহীন দেহটা সেদ্ধ হতে লাগল।
ঢাকায় শাহ আজিজ গ্রুপের মুসলিম ছাত্রলীগারদের শোক পরিণত হলো শক্তিতে। শক্তি গিয়ে আছড়ে পড়ল কমিউনিস্টদের ওপর। এসএম হলে মুনীর চৌধুরীকে আক্রমণ করল তারা, তেমনি রুমে রুমে খুঁজতে লাগল—কোথায় কমিউনিস্ট।
যেন মহান কায়েদে আজমের মৃত্যুর জন্য যক্ষ্মার জীবাণু নয়, নয় তাঁর চিকিৎসায় সরকারের অবহেলা, দায়ী মার্ক্স ও অ্যাঙ্গেলসের ভূত।
এক মাঘে শীত যায় না।
চার বছর পর আরেকটা মাঘ এল, মাঘের শেষে এল ফাল্গুন, আটই ফাল্গুন। সেটা আরেকটু পরের কথা।