যারা ভোর এনেছিল – ৩৫
৩৫.
শেখ মুজিবের মন খারাপ। বস্তুত ১৫০ মোগলটুলির ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের সবারই মন খারাপ। হাশিমপন্থী বা সোহরাওয়ার্দীপন্থী বা মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের অনেকেই আজ বিষণ্ন। সোহরাওয়ার্দীর গণপরিষদের সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছে।
কেবল সোহরাওয়ার্দীর পরিষদ সদস্যপদ বাতিল করার জন্য গণপরিষদের সদস্যপদে থাকার যোগ্যতার বিধি সংশোধন করা হয়। এ আইন যেদিন করাচিতে পাস হয়, সেদিন মাঘের সেই শীতার্ত দিনটিতে সোহরাওয়ার্দী নিজে উপস্থিত ছিলেন অধিবেশনে। বিতর্কে তিনি অংশও নিয়েছিলেন।
গণপরিষদে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ‘মাননীয় স্পিকার, জীবন থাকতে কোনো ব্যক্তির নিজের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত থাকার অথবা নিজের শোকসভায় ভাষণ দেওয়ার সুযোগ হয় না।…সম্ভবত এই আমার শেষ ভাষণ। বলা হচ্ছে যে আরও ব্যাখ্যা প্রয়োজন। তাই আইনের এই সংশোধনীগুলো করা হচ্ছে। এই আইন মানুষের কাছে পরিষ্কার। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের কাছে অস্পষ্ট। আমার মতো একজন নিরীহ ব্যক্তিকে গণপরিষদ থেকে বাদ দেওয়ার জন্য উপস্থাপিত এইরূপ বিবরণ বিশ্বাস করতে আমি অস্বীকার করছি। যে রাষ্ট্র পৃথিবীর ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোর প্রধান হতে চায়, যেখানে ন্যায়বিচার ও সহিষ্ণুতা থাকবে, সে রাষ্ট্র তার আইনবিষয়ক ক্ষমতা, তার দলীয় শক্তি, তার সরকার, তার দলীয় শৃঙ্খলা পরিচালিত করবে কেবল একজন মাত্র ব্যক্তিকে দূর করার জন্য, যার একমাত্র অপরাধ হলো এ গণপরিষদে সংখ্যালঘুর পক্ষে কথা বলা।’
স্পিকার প্রস্তাবটি ভোটে দিলেন। কী প্রস্তাব? যে ব্যক্তি পাকিস্তানের স্থায়ী বাসিন্দা নন, গত ছয় মাসেও যিনি পাকিস্তানের স্থায়ী বাসিন্দা হতে পারেননি এবং যিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন না, তিনি সদস্য থাকতে বা নির্বাচিত হতে পারবেন না।
একে একে সদস্যরা উঠে ভোট দিতে গেলেন। কেউ সোহরাওয়ার্দীর মুখের দিকে তাকাতে পারছেন না। কারণ, সোহরাওয়ার্দী কিছুদিন আগেও ছিলেন এঁদেরই মুখ্যমন্ত্রী, এঁদেরই নেতা। তিনি ২৭টা বছর আইনসভায় সদস্য ছিলেন। এই সদস্যদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে তাঁর কাছে ঋণী। তিনি একাকী একটা চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর মুখে স্মিত হাসি।
স্পিকার ভোটের ফল ঘোষণা করলেন।
আইনটি পাস হলো।
পরের দিন গণপরিষদের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে প্রচার করা হলো, সরকার এইচ এস সোহরাওয়ার্দীর গণপরিষদের আসন শূন্য ঘোষণা করছে। সেটা করা হলো আইন প্রণয়নের মাস খানেক পরে, ২ মার্চ ১৯৪৯। সেই খবর ঢাকা এসে পৌঁছায়।
শেখ মুজিব চিৎকার করে ওঠেন, ‘এই পরিষদে বহু সদস্য আছেন যাঁদের পাকিস্তানে বাড়ি নাই। কারও সদস্যপদ বাতিল হলো না, আর শুধু আমার লিডারের পদ বাতিল হলো! এই সাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রবিরোধী খাজা-লিয়াকত সরকারের বিরুদ্ধে আজ থেকে শুরু হলো আমার ডাইরেক্ট অ্যাকশন।’
মোগলটুলির কর্মীরা যে যাঁর বিছানা ছেড়ে এসে মুজিবকে ঘিরে ধরেন। ৫ মার্চ সোহরাওয়ার্দী কলকাতা ছেড়ে করাচিতে চলে আসেন। ওঠেন তাঁর ভাই শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর বাসায়।
শুধু সোহরাওয়ার্দী নন, এর আগে মওলানা ভাসানীর পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার সদস্যপদও গভর্নর এক নির্দেশবলে বাতিল করে দেন।
তিনি ঢাকার ১৫০ মোগলটুলিপন্থীদের নির্দেশ দেন বিরোধী দল গঠন করতে। কামরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ কাজ খুঁজে পান।
৩৬.
১৫০ মোগলটুলির ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের বিছানায় শুয়ে মুজিব ছটফট করছেন। তাঁর চোখে ঘুম নেই। এ রকম সাধারণত হয় না। সারা দিনের মিছিল-মিটিং শেষে ঘরে ফিরে ক্লান্ত মুজিব চোখ বন্ধ করলেই ঘুমের অতলে তলিয়ে যান। আজ রাতে তা হচ্ছে না। এমনিতেই চৈত্র মাস। খুব গরম পড়েছে। হাতপাখা ঘোরাতে ঘোরাতে হাত ব্যথা হওয়ার জোগাড়। গরম তো অন্য রাতেও পড়ে। তখন তো হাতপাখা ঘোরাতে হয় না। ঘুমিয়ে পড়লে গরমই কী আর ঠান্ডাই কী।
একটা সিদ্ধান্ত তাঁর নেওয়া দরকার। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে একটা বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। তাঁকে ১৫ টাকা জরিমানা দিতে হবে। আর মুচলেকা দিতে হবে, এর থেকে তাঁর আচরণ ভালো করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল এই নোটিশ দিয়েছে।
তিনি নোটিশটা আবার বের করেন। পকেটে থাকতে থাকতে ঘামে ভিজে কাগজের ভাঁজ প্রায় ছেঁড়া ছেঁড়া হয়ে গেছে। টেবিলের ওপর হারিকেন তুলে আলো বাড়ান। বিড়বিড় করে পড়তে থাকেন :
…that the following attached students be fined Rs. 15 / – each and be allowed to continue as attached students to the condition that they furnish individually a guarantee of good conduct endorsed by their gurdians in the prescribed form to the relevant provost on or before the 17th April, 1949.
1. Sk. Mujibur Rahman II year LLB Roll 166 SMH
২৭ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এঁদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক দবিরুল ইসলাম, অলি আহাদসহ ছয়জনের শাস্তি হয়েছে চার বছরের বহিষ্কারাদেশ; ডাকসুর ভিপি অরবিন্দ বসুসমেত ১৫ জনের বিভিন্ন হল থেকে জরিমানা; নাইমুদ্দিন আহমেদ, ওই সময়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্রিয় ও তুখোড় ছাত্রীকর্মী নাদেরা বেগমসমেত শেখ মুজিবের ১৫ টাকা জরিমানা; আর একজন ছাত্রী লুলু বিলকিস বানুর ১০ টাকা জরিমানা। সে হিসাবে মুজিবের শাস্তিই হয়েছে কম। একটা মুচলেকা আর ১৫টা টাকা দিয়ে দিলেই সবকিছু ঠিক থাকে। সবকিছু ঠিক থাকবে? মুজিবুর রহমান মুচলেকা দিয়ে পড়াশোনা করবেন? সদাচরণের জন্য মুচলেকা দিতে হবে? তার মানে কি তিনি এত দিন যা করে এসেছেন তা অসদাচরণ?
কী করেছিলেন তাঁরা?
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভুক কর্মচারীরা অনেক দিন ধরেই তাঁদের দাবিদাওয়া আদায়ের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে আসছিলেন। আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ায় তাঁরা ধর্মঘটে যান। তাঁদের সমর্থনে ছাত্ররাও ক্লাস বর্জন শুরু করেন। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ছাত্রধর্মঘটের ডাক দেয়। মিছিল, সভা, সমাবেশে যোগ দিতে থাকেন ছাত্ররা। দণ্ডপ্রাপ্ত ছাত্ররা ছিলেন সেই আন্দোলনের সংগঠক। নিম্ন বেতনভুক কর্মচারীদের অবস্থা আসলেই ছিল মানবেতর। ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তিত বেতনকাঠামোয় তাঁরা ঠিক মানুষের মর্যাদাভুক্ত ছিলেন না। যেকোনো মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষই এই কর্মচারীদের দাবিদাওয়ার প্রতি সমর্থন জানাবে।
কিন্তু সরকারের আসল ভয় ছিল আসন্ন বাজেট অধিবেশন। ওই অধিবেশন চলার সময় যেন কোনো ছাত্রবিক্ষোভ হতে না পারে, তাই সরকার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। তা-ই হয়। ডাইনিং বন্ধ করে দেওয়া হয় হলে হলে। বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী হল ছেড়ে চলে যান। তখন প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন। সব কলকাঠি আসলে পেছন থেকে নাড়ছিলেন তিনি। এই নুরুল আমিনের ধমকে মুজিবুর রহমান মুচলেকা দেবেন?
তখনই মনে পড়ে যায় আব্বার মুখ। তিনি আশা করে আছেন ছেলে জজ-ব্যারিস্টার না হোক, অন্তত অ্যাডভোকেট হবে। মনে পড়ে যায় রেনুর মুখ। তিনিও আশা করে আছেন, মুজিব পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াবেন, হাসু আর তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসবেন। তাঁদের নিজেদের সংসার হবে।
না। একবার আপস করলে আর ঘুরে দাঁড়ানো যাবে না। ছাত্রকর্মীদের মন ভেঙে যাবে। তাঁর মিশন তো কেবল অ্যাডভোকেট হওয়া নয়। তিতুমীর, ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন আর সুভাষ বোসের জীবনকাহিনি তো এই পরামর্শ দেয় না। একবার পেছাতে শুরু করলে পেছাতে থাকতেই হবে।
সবচেয়ে ভালো হলো আন্দোলন দুর্বার করে তোলা। অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স। আন্দোলনের তোড়ে ভেসে যাবে সব শাস্তিনামা।
মুজিব সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি মুচলেকা দেবেন না। যা হয় হবে। মনে পড়ল, রেনু তাঁকে বলেছেন, পারিবারিক পিছুটানের কারণে তিনি যেন তাঁর নিজের মিশন পরিত্যাগ না করেন।
ছাত্রনেতারা বসলেন সবাই। ১৭ এপ্রিল ছাত্রধর্মঘট ও ছাত্রসভা আহ্বান করা হলো। মুজিব তাঁর বড় সংগঠক। সঙ্গে আছেন অলি আহাদ। কিন্তু এর মধ্যে অনেকেই, গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন ছাত্রনেতা মুচলেকাপ জমা দিয়ে কৃতকর্মের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে গেছেন। এটা আন্দোলনের ক্ষতি করল। তবু মুজিব টলবেন না।
বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দিন ধর্মঘট পালিত হলো। সভায় ছাত্র ও কর্মচারীরা যোগ দিলেন বিপুল সংখ্যায়। সেই সভা থেকে মিছিল; সেই মিছিল নিয়ে শেখ মুজিব, অলি আহাদ প্রমুখ গেলেন উপাচার্যের বাসভবনে। সরকারের, শিক্ষা বিভাগের, বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কর্তাব্যক্তিরা বসলেন ছাত্রনেতাদের সঙ্গে। আলোচনা আশাব্যঞ্জক বলেই মনে হচ্ছিল।
কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, যেন এই শাস্তি মওকুফ না করা হয়।
শেখ মুজিব সব বুঝতে পারলেন। তিনি অলি আহাদকে আহ্বায়ক বানালেন ছাত্র কর্মপরিষদের। এর আগের আহ্বায়ক এরই মধ্যে আত্মসমর্পণ করে ফেলেছেন। ২০ এপ্রিল ঢাকা শহরে ছাত্রধর্মঘট, ২৫ এপ্রিল দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হলো।
শেখ মুজিব বললেন, ‘চাপ কমানো চলবে না। আমরা অবস্থান ধর্মঘট করব ভিসির বাড়ির সামনে।’
অবস্থান ধর্মঘট আর হরতালের খবরে ভিসির বাড়ির আশপাশ পুলিশে ভরে গেল। গোয়েন্দা বিভাগের লোকজনও ঘোরাফেরা করতে লাগল চারদিকে। শেখ মুজিবের ঘ্রাণেন্দ্রিয় এসব ব্যাপারে অতি শক্তিশালী। তিনি বুঝলেন, এর পরের পর্ব হবে গ্রেপ্তার অভিযান। অলি আহাদকে ডেকে বললেন, ‘শোনো, তুমি ছাত্র কর্মপরিষদের আহ্বায়ক। তোমার অ্যারেস্ট হওয়া চলবে না। খবরদার, গ্রেপ্তার হবা না! সাবধানে থাকবা। রাতে হলে থাকবা না। তুমি অ্যারেস্ট হওয়া মানে কিন্তু আন্দোলন শেষ হয়ে যাওয়া।’ অলি আহাদ মুজিবের চেয়ে বয়সে আর অভিজ্ঞতায় ছোট, বললেন, ‘জি আচ্ছা, মুজিব ভাই।’
১৯ এপ্রিল। সকাল থেকেই চলছে অবস্থান ধর্মঘট। বিভিন্ন স্থান থেকে মিছিল এসে ভরে তুলছে ভিসির বাড়ির সম্মুখভাগ। ধর্মঘটীদের উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছেন মুজিবুর রহমান।
সেখান থেকেই পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে গাড়িতে তোলে।
প্রথমে গোয়েন্দা অফিসে, তারপর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে।
৫ নম্বর ওয়ার্ডে ঠাঁই হলো মুজিবের। কারাগারে যাওয়ার তাঁর অভ্যাস আছে। এটা নতুন কিছু নয়। পরের দিন সকালবেলা তিনি জেল কর্মচারীদের বললেন খাম, কাগজ, কলম দিতে। তিনি চিঠি লিখবেন।
তাঁর গ্রেপ্তার হওয়ার খবরটা আব্বা আর রেনুকে জানানো দরকার। জানানো দরকার যে তিনি ভালো আছেন।
বিকেল হতে না হতেই ৫ নম্বর ওয়ার্ডে এসে হাজির অলি আহাদ।
মুজিব তাঁকে দেখেই বকাবকি করতে লাগলেন, ‘অলি আহাদ, এইটা কোনো কাজ করলা! মিয়া, তোমাকে না বললাম অ্যারেস্ট হবা না। তুমি অ্যারেস্ট হয়ে চলে আসলা! এখন আন্দোলনের কী হবে?’
অলি আহাদ বললেন, ‘আরে, আমি ইচ্ছা করে অ্যারেস্ট হয়েছি নাকি! চারদিকে গোয়েন্দা। কাল রাতটা তো ওদের চোখে ধুলা দিতে পেরেছি। আজ পুলিশের সঙ্গে আমাদের সংঘর্ষ হয়েছে। জিমনেসিয়াম মাঠে আমরা সভা করেছি। তারপর মিছিল। মিছিল ঢাকা হলের দিকে যাওয়ার পথেই পুলিশ আক্রমণ করে বসল। লাঠিচার্জ করল। কাঁদানে গ্যাস ছুড়ল। আমার সঙ্গে তো রীতিমতো হাতাহাতি ধস্তাধস্তি। ওইখান থেকেই আমাকে অ্যারেস্ট করেছে। কিছু করার আছে? আমার কোনোই দোষ নাই।’
মুজিব বললেন, ‘এখন আন্দোলন পরিচালনা করবে কে? লিডার লাগবে না? একজনকে বাইরে থাকতে হয়। আমি ভেতরে, তুমি বাইরে, এইটা হলে না হয় আন্দোলন হয়!’
.
‘ঠিক। দুইজনে কারাগারে থাকলে আন্দোলন হয় না।’ ব্যাঙ্গমা বলল, কলাভবনের সামনের আমগাছে বসে, ‘ওই সময় অলি আহাদের সঙ্গে মুজিবের বনতেছিল ভালো।
ওই বছরের জানুয়ারিতে মুসলিম ছাত্রলীগ, যাকে মোগলটুলির ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের সদস্যরা সমর্থন করতেন, হল ছাত্রসংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে। সলিমুল্লাহ হলের ১২ নম্বর কক্ষে তাদের সভা বসে। ওইটা ছিল অর্গানাইজিং কমিটির সভা। তাতে অলি আহাদ প্রস্তাব করেন, ‘মুসলিম লীগকে অসাম্প্রদায়িক সংগঠন করা দরকার। মুসলিম ছাত্রলীগ থাইকা ‘মুসলিম’ শব্দটা বাদ দেওন দরকার। তাইলে সব ধর্মের ছেলেমেয়েরা এই সংগঠনে আসতে পারব।’ কিন্তু সেই প্রস্তাব পাস হয় না। শেখ মুজিব কইলেন, ‘অহনও সময় হয় নাই।’
তখন রাগ কইরা অলি আহাদ পদত্যাগপত্র লেইখা জমা দেন। শেখ মুজিব সেই পদত্যাগপত্রটা নিয়া ছিঁড়া ফেলেন।
অলি আহাদ কইলেন, ‘মুজিব ভাই, খালি আপনার ভালোবাসা, আমার প্রতি দুর্বলতা আর দরদের কারণে আমি এইটা উইথড্র করতেছি।’
শেখ মুজিব তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। আবেগমথিত কণ্ঠে বললেন, ‘তোমরা আমাকে ভালোবাসো, এই জন্যই তো আমি তোমাদের মুজিব ভাই।’
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘মুজিব তহন এই আন্দোলনে অলি আহাদরে বাইরে রাখতে চাইছিল। অলি আহাদ বাইরে থাকলে আন্দোলন হইত। সেইটা আমরা ইতিহাসে পরে দেখুম। মুজিব জেলে আছিল, তাজউদ্দীন জেলের বাইরে। স্বাধীনতাসংগ্রাম সফল হইছিল।
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘অহন মুজিবও জেলে, অলি আহাদও জেলে, বাকিরা মুচলেকা দিয়া দিছে, ২৫ এপ্রিলের হরতাল ভালো হইল না। ২৭ এপ্রিল থাইকা ইউনিভার্সিটির ক্লাসও তাই চলতে লাগল ঠিকঠাক
ব্যাঙ্গমা বলল, ‘আর মুজিবের ছাত্রত্ব গেল ঘুইচা।’
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘সেইটা ভালোই হইল। পরে কামরুদ্দীন আহমদ লিখব, ‘জরিমানা দিতে অস্বীকার করায় তার আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হলো না।’ আমার নিজের ধারণা, তাঁর ওই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত বাস্তব আর সময়োপযোগী হয়েছিল। তিনি তখন জননেতা হওয়ার পথে—তাঁর আর ছাত্র থাকা শোভা পাচ্ছিল না।’
৩৭.
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৫ নম্বর ওয়ার্ডটিতেই জায়গা হলো এই রাজবন্দীদের, যাঁদের কারাগারের লোকেরা ডাকত সিকিউরিটি বলে, আইনের ভাষায় সিকিউরিটি প্রিজনার। এর আগে সিকিউরিটি বলতে এই কারাগারের সেপাই-পাহারাদার-কর্তারা আর হাজতি ও কয়েদি বন্দীরা বুঝত কমিউনিস্টদের, যাদের শরীর হবে দড়ি-পাকানো, হাড্ডিসার, পরনে থাকবে জেলের তৈরি হাফহাতা শার্ট আর পায়জামা, পায়ে থাকবে জেলের তৈরি কাঁচা চামড়ার বেঢপ স্যান্ডেল এবং পাকিস্তান তথা ইসলামের শত্রু যাদের বেশির ভাগ সময়েই আটকে রাখা হবে বদ্ধ ঘরে। কিন্তু এখন যাঁরা আসছেন, শেখ মুজিব, অলি আহাদ, বাহাউদ্দিন চৌধুরী, আবদুল মতিন, মাজহারুল ইসলাম, মফিজউল্লাহ—আরও অনেকে, এঁরা সবাই ছাত্র-যুবা। এঁরা কমিউনিস্ট নন, অন্তত সবাই নন, এঁরা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করতে চান, মুসলিম লীগই করতেন একসময়, এখন মুসলিম ছাত্রলীগের সরকারবিরোধী অংশের নেতা-কর্মী। এঁরা দেখতে ঠিক কমিউনিস্টদের মতোও নন।
শেখ মুজিব প্রথমবারের মতো বন্দী হওয়া ছাত্র-যুবকর্মীদের ডাকলেন। বললেন, ‘শোনো, জীবনের প্রথম জেল তো তোমাদের। তোমাদের জেলের কিছু কিছু নিয়ম-কানুন শিখায়া দিই। প্রথমেই তোমাদের ওজন নিতে আসবে। সবাই যেইটা করো, পকেটে ইটের টুকরা, পাথর, যা পাও, ভরায়া লও, ওজনটা বেশি দেখাইতে হবে। ১৫ দিন পরে যখন ওজন নিতে আসবে, তখন আর পকেটে ইট রাখবা না। যে ওজনটা কমবো সেইটা পূরণ করার জন্য ডাক্তার তখন এক্সট্রা স্পেশাল ডায়েট দিবে।’
সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। ‘আর তোমাদের খাওয়া-দাওয়া বা অন্য কোনো অসুবিধা যাতে না হয় সেইটা আমি দেখতেছি
মুজিব প্রত্যেক কর্মীর নাম জানেন। তাদের নাম ধরে ধরে ডাকেন। এখন সব বন্দীর নামও তিনি মুখস্থ রাখছেন। সবার খোঁজখবর রাখছেন। নুরুল আমিন সরকারের কারাগারমন্ত্রী মফিজউদ্দিন আহমদ এলেন কারাগার পরিদর্শনে। তিনি এলেন ৫ নম্বর ওয়ার্ডে।
‘কী খবর, মুজিবর সাহেব, আপনার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?’ মন্ত্রী বললেন।
শেখ মুজিব তাঁর চোখ থেকে চশমাটা খুলে বললেন, ‘হচ্ছে। খাওয়া- দাওয়ার অসুবিধা।’
জেলারসহ সব কর্মকর্তা এ ওর মুখের দিকে তাকালেন। মুজিবের খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধা ঘটানোর সাহস কারাগারে তো কারও হওয়ার কথা না! ‘না স্যার, আপনাকে তো আমরা…’ জেলারের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মুজিব বললেন, ‘আমার ছেলেরা কম খেয়ে, না খেয়ে থাকবে আর আমি একা একা ভালো খাব ভালো থাকব, এইটা তো হয় না। আমার সব ছেলেকে প্রথম শ্রেণীর কয়েদির মর্যাদা দিতে হবে। ১৯৪০ সালের সিকিউরিটি প্রিজনারস রুল অনুসারে রাজবন্দীদের যেসব সুবিধা দেওয়া হতো, জালেম মুসলিম লীগ সরকার সেসব মানছে না। বেশির ভাগ রাজবন্দীকে তৃতীয় শ্রেণীর হাজতির স্ট্যাটাস দেওয়া হচ্ছে। অখাদ্য- কুখাদ্য খেয়ে এরা তো সব মারা যাবে! আর একটা রাজবন্দীর যদি কিছু হয়, মুজিবুর রহমান সেটা সহ্য করবে এটা যেন নুরুল আমিন সাহেব না ভাবে।’
মন্ত্রী বললেন, ‘ওয়েল, মুজিবর সাহেব। আমি আপনার কর্মীদের সবাইকে ফার্স্ট ক্লাস স্ট্যাটাস দেওয়ার অর্ডার দিচ্ছি। ওনাদের খাওয়া- দাওয়া, পেপার-পত্রিকা, চিঠিপত্র আর যেসব ব্যাপার আছে, জেলার সাহেব, আপনি সব দেখবেন।’
কারাগারে পত্রিকা আসে সেন্সরড হয়ে। পত্রিকার পাতার কোনো কোনো অংশ কাঁচি দিয়ে কাটা থাকে। যে অংশ থাকে না, তা জানার জন্য বন্দীদের হৃদয় আঁকুপাঁকু করে।
চিঠিপত্র আসে, তা-ও সেন্সরড।
রেনুর একটা চিঠি এসেছে। তাতে রেনু লিখেছেন, ‘আল্লাহর রহমতে তুমি আবার পিতা হইতে চলিয়াছ। এখন ছয় মাস চলিতেছে। হাসু এখন অনেক কথা বলে। বাবা বলা শিখিয়াছে। আমরা সকলে ভালো আছি। আব্বা ও আম্মার শরীর ভালো। তুমি আমাদের লইয়া চিন্তা করিবা না।
এই পর্যন্ত চিঠিটা আনসেন্সরড ছিল। এর পরে কালি মেরে কয়েক লাইন ঢেকে দেওয়া হয়েছে। কারাগারবাসে অভিজ্ঞ মুজিব জানেন, এই লাইনগুলোয় আছে অনুপ্রেরণাদায়িনী কথামালা। হয়তো রেনু লিখেছেন, ‘তুমি এই জালিম সরকারের জুলুমের বিরুদ্ধে লড়ছো, তাতে আমাদের মাথা উঁচু হইয়াছে। দেশের জন্য লড়িতেছ, তাহা আমাদের গৌরবেরই ব্যাপার। তুমি বন্ড দিবা না!’
কী জানি, কী লিখেছেন রেনু! পড়া তো আর যাচ্ছে না। ওই লাইন কটা পড়ার জন্য মুজিবের হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে উঠল। তিনি কাগজে তেল লাগালেন। তারপর রোদের উল্টো দিকে ধরে পড়ার চেষ্টা করলেন। এমনিতেই চোখে কম দেখেন, তার ওপর আবার এই জ্বালা।
হঠাৎ কানে এল কোকিলের ডাক। বৈশাখ মাসে কোকিল ডাকছে কোত্থেকে! তিনি এদিক-ওদিক তাকান। ওই যে বাইরের উঁচু প্রাচীর। তার ওপারে আর কিছু দেখা যায় না। প্রাচীরের ওই পারে গাছ আছে কিছু। তার কোনোটিতে বসেই কি কোকিল ডাকছে?
রেনু আবার সন্তানসম্ভবা। এ সময় তাঁকে কি একবার দেখতে যাওয়া মুজিবের উচিত ছিল না?
আজ মুজিবের ‘দেখা’ আসবে। মানে তাঁর কাছে আসবে দর্শনার্থী। অনেকেই আসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। এরই মধ্যে ঢাকা শহরে তিনি কম ভক্ত-সমর্থক তৈরি করেননি।
তাঁদের ওয়ার্কার্স ক্যাম্পে তিনজন আছেন নেতৃত্ব দেওয়ার মতো। শামসুল হক, ফজলুল কাদের চৌধুরী আর শেখ মুজিব। ফজলুল কাদের চৌধুরী মন দিয়েছেন ব্যবসার কাজে। ফলে রাজনীতির নেতৃত্ব দেওয়ার দৌড়ে তিনি আর নাই। সামনে আছেন শুধু শামসুল হক সাহেব। তিনি আগেই ছাত্রত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। এখন রাজনীতি করে চলেছেন। তাঁর নেতৃত্ব শক্ত হওয়ার পথে।
কিন্তু ভক্ত-সমর্থক মুজিবেরই বেশি। এর কতগুলো কারণ আছে। মুজিব সবাইকে আপন করে নিতে জানেন। সবার সুখদুখের খবর রাখেন। সবার নামধাম তাঁর মুখস্থ। একবার কারও সঙ্গে পরিচয় হলে তাকে ভোলেন না। আর তিনি বাস্তবধর্মী। কোনো আকাশকুসুম চয়নের স্বপ্ন তাঁর মধ্যে নাই। তিনি জানেন, আজকের সমস্যাটা সমাধানের জন্য আজকের লড়াইটা করতে হবে। মিছিলে যেতে হবে, সভা ডাকতে হবে, ভাষণ দিতে হবে, লড়াই করতে হবে। লাঠির বাড়ি, টিয়ারগ্যাস খেতে হবে। ভয় পেলে চলবে না। ভয় পেয়ে নিজের স্বার্থ, নিজের সুখ, নিজের পারিবারিক বন্ধনকে বড় করে দেখলে আর যা-ই হওয়া যায়, নেতা হওয়া যায় না। নেতা মানে যে-সে নয়। নেতা তিনি, যিনি সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত আছেন, যিনি মৃত্যুকে ভয় পান না।
ফলে তাঁর গুণগ্রাহী অনুসারীরা তাঁকে দেখতে আসেন প্রায়ই।
কিন্তু আজ ভিজিটরস রুমে গিয়ে দেখলেন লুৎফর রহমান সাহেব বসে আছেন। তাঁর পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি, চোখে চশমা।
আব্বার সামনে দাঁড়াতে মুজিবের একটু দ্বিধাই হচ্ছিল। কারণ আব্বা সেদিনও বলেছেন তাঁর স্বপ্নের কথা। তিনি চান মুজিবুর এলএলবি পড়াটা শেষ করুক। কিন্তু এরই মধ্যে ওই ঝামেলা চুকেবুকে গেছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেননি। মুচলেকা দেননি। ফলে তিনি এখন আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নন।
আব্বা খাবার এনেছেন। মা দুধ-নারকেল দিয়ে পিঠা বানিয়ে দিয়েছেন।
‘বাবা, খোকা। কেমন আছো, খোকা?’
‘ভালো আছি, আব্বা। আপনারা কেমন আছেন?’
‘আল্লাহর রহমতে সবাই ভালো আছে।’
‘নাসের কেমন আছে? হেলেন?’
‘ভালো আছে, বাবা। সবাই ভালো আছে।’
‘মার শরীরটা ঠিক আছে তো?’
‘হ্যাঁ, বাবা, আছে।’
‘রেনু কেমন আছে?’
‘ভালো আছে।’
‘হাসু কথা বলতে পারে?’
‘হ্যাঁ। সারাক্ষণ দাদা দাদা বলে ডাকে। আমি যখন বাড়ি যাই আমার কোল থেকে নামতে চায় না
‘আব্বা, আপনার কাছে আমার একটা ক্ষমা চাওয়ার আছে। আমি ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দিয়েছি। এলএলবি পড়া বোধ হয় আর হলো না। ওরা আমাকে বন্ডসই দিতে বলে। আপস করতে জানলে তো আমাকে জেলে ও আসতে হয় না। আপনাদেরও এত কষ্ট দিতাম না।’
‘বাবা, খোকা। আমরা শুধু চাই তুমি ভালো থাকো। তোমার জানি কোনো কষ্ট না হয়। তোমার যেটা সুবিধা হয় তুমি সেটা করবা। তোমার অন্তরে যেটা চায় সেটা করবা। শুধু ন্যায়ের পথে থাকবা। অন্যায় করবা না। তাইলেই আমরা সুখী।’
‘আব্বা, দোয়া করবেন আব্বা। মাকে বলবেন যেন বেশি পরিশ্রম না করে।’
‘দেখা’র সময় ফুরিয়ে আসে। লুৎফর রহমানকে বিদায় নিতে হয়।
মুজিব হাসিমুখে ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে পিতাকে বিদায় জানান। আব্বা যাওয়ার আগে ছেলের হাতে গুঁজে দেন কিছু টাকা। ছেলেও সেটা অলজ্জিত ভঙ্গিতে নিয়ে নেন।
টিফিন ক্যারিয়ারের বাটি ভেতরে চলে যায়। মুজিব ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সবাইকে ডেকে বাটি দিয়ে দেন। ‘সবাই মিলে খাও।’
‘মুজিব ভাই, খাবার এসেছে আপনার কাছে। আপনার মা রান্না করে পাঠিয়েছেন। মায়ের হাতের রান্না অবশ্যই আপনার আগে মুখে দিতে হবে।’ আবদুল মতিন বলেন।
মুজিব সেই পিঠাটার একটা অংশ ভেঙে মুখে দেন। তাঁর হঠাৎই টুঙ্গিপাড়ার কথা মনে পড়ে। রেনুর কথা, মার কথা। এই যে দুধ- নারকেলের পিঠা, এই নারকেল পাড়াতে হয়েছে গাছ থেকে, কুরতে হয়েছে। কে করেছে, হয়তো রেনুই। তখন হয়তো হাসু তার কোলের মধ্যে বসা। উঠোনে বসে এই গ্রীষ্মের গরমে ওরা কাজ করছে। ওদিকে ঢেঁকিতে শব্দ উঠছে একটানা, নরম চালের ওপরে ঢেঁকি পড়ছে, আটা বেরোচ্ছে সাদা সাদা, মা সেই আটা ঢেঁকির মুখ থেকে সরিয়ে নিচ্ছেন…
কী জানি কেন, মুজিবের মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা, যেদিন তিনি—বালকবেলায়—মধুমতী নদী পেরিয়ে তাঁর মিতা খোকা কাজীসমেত চলে গিয়েছিলেন মোল্লার হাট থানার বড়বাড়িয়ায়। আব্বাসউদ্দীন গান করবেন মুসলিম লীগের সভায়। সভায় স্পিকার তমিজউদ্দিন খান ছিলেন। আব্বাসউদ্দীন গান করবেন। ঘোষণা হলো। এক মাওলানা সাহেব তাঁর পাগড়িটা খুলে ভালোমতো কানে পেঁচালেন, যাতে গানের সুর তাঁর কানে প্রবেশ না করে। প্রথমে আব্বাসউদ্দীন গাইলেন ‘বাজান চল যাই চল মাঠে লাঙ্গল বাইতে…’, পরের গান তিনি ধরলেন ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে তুই…’ গানের মাঝে তিনি ‘আল্লাহ’
‘আল্লাহ’ বলে জিকিরের মতো করতে লাগলেন। মাওলানা সাহেব তখন কান থেকে পাগড়ি সরালেন।
সেই তমিজউদ্দিন খান এখন স্পিকার, তাঁরই সভাপতিত্বে পরিষদের বৈঠকে লিডার সোহরাওয়ার্দীর সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছে।
তবে লিডার পাকিস্তানে চলে এসেছেন। ভাইয়ের বাসায় উঠেছেন। ঢাকায়ও এসেছিলেন একটা ব্যারিস্টারির কাজে। মুজিব ছাড়া পেয়েই লিডারের সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়বেন বিরোধী রাজনীতি সংগঠনের কাজে।
শেখ মুজিবের কাছে কারাগারের ভেতরেই আজ একটা বিচার এসেছে। বিচারপ্রার্থী বাহাউদ্দিন আহমদ। তরুণ এই কর্মীটি একটু বেশিই বামঘেঁষা। কিন্তু তাঁর বাবা বরিশালের উলানিয়ার বিখ্যাত জমিদার। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের আদরের সন্তান। এখন নিম্ন বেতনভুক কর্মচারীদের দাবি আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে কারাবাসী।
বাহাউদ্দিন বললেন, ‘মুজিব ভাই, খুব একটা সমস্যা হয়েছে। মা আমার সঙ্গে ‘দেখা’র দিন বরফি মোরব্বা—সব তাঁর নিজ হাতে বানানো—বিদেশি বিস্কুটের কৌটা দিয়ে গিয়েছিলেন; সবই আমার মাথার কাছে রাখা ছিল। জানেনই তো আমার ঘুমটা একটু বেশি। ঘুম থেকে উঠে দেখি কৌটা, টিফিন ক্যারিয়ার সব খালি। এখন নাশতা করব। উঠে দেখি সামান্য কিছু রেখেছে। বেশির ভাগটাই নাই।’
মুজিব বললেন, ‘এই তোমার ঘুম থেকে ওঠার আর নাশতা করার সময়। ১০টা বেজে গেছে না?’
‘জি, মুজিব ভাই। আপনি জানেন আমার ঘুম বেশি।’
‘কে নিতে পারে?’
‘সব তো ভদ্র বন্দী। ওয়ার্ড তালা মারা। বাইরের ওয়ার্ডের কেউ এসে ঢুকবে তারও উপায় নাই।’
মুজিব মাথা চুলকাচ্ছেন। এ তো প্রায় ভুতুড়ে কাণ্ড!
সবাই মাথা নিচু করে আছে। এ-ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। হঠাৎই আতাউর রহমান হেসে উঠলেন 1
মুজিব বললেন, ‘কী রহমান, হাসো কেন?
‘অলি আহাদকে জিজ্ঞেস করেন,’ বলে রহমান যতই হাসি রোখার চেষ্টা করছেন, ততই তাঁর হাসি ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে।
‘অলি আহাদ!’ মুজিব তাঁর দিকে তাকালেন।
অলি আহাদ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললেন, ‘মুজিব ভাই। শোনেন। ছোটবেলায় আমার কালাজ্বর হয়েছিল। বহু কিছু খাওয়া বারণ ছিল। কিন্তু ছোট মানুষ কি বারণ শুনতে পারে! ফলে ছোটবেলা থেকেই খাবার চুরি করে খাওয়া আমার অভ্যাস। একবার চিংড়ি মাছ চুরি করে খেতে গিয়ে মায়ের হাতে বমাল ধরা পড়েছিলাম।
মুজিব বললেন, ‘এই তো ভূত ধরা পড়ছে।’
‘মুজিব ভাই, আমি একা নই। ওরাও সবাই আমার সঙ্গে ছিল। আর পুরাটা তো খালি করি নাই। আমার কুম্ভকর্ণ বন্ধুটির জন্যও কিছু রেখে দিয়েছি।’
সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
অলি আহাদ বললেন, ‘এই যে কারাগারের মধ্যে প্রাণ খুলে হাসতে পারছেন, এ জন্য তো আপনাদের উচিত আমাকে ধন্যবাদ দেওয়া
৩৮.
তাজউদ্দীনের ঘুম নাই, খাওয়া-দাওয়ার ঠিক নাই। তাঁর সঙ্গের কারই বা আছে! এই যাঁরা, মোগলটুলির ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের যুবকেরা, টাঙ্গাইলে এসে শামসুল হকের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারকাজ চালাচ্ছেন! এই আসনটা ছিল মওলানা ভাসানীর। খাজা-লিয়াকত আর নুরুল আমিনরা চান না ভাসানীকে রাজনীতিতে সক্রিয় রাখতে। তাই তাঁরা সেটাকে শূন্য ঘোষণা করেন। সরকার আর মুসলিম লীগের প্রার্থী করটিয়ার বিখ্যাত জমিদার খোরম খান পন্নী। আর মোগলটুলিকেন্দ্রিক বিরোধী রাজনীতির প্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয় শামসুল হককে। শামসুল হক সাধারণ কৃষকের ছেলে। পন্নীদের প্রজা। তাঁর টাকাপয়সা বলতে কিছু নাই। এমনকি তাঁদের কোনো দলও নাই।
তার ওপর নুরুল আমিন এখন মুখ্যমন্ত্রী, টাঙ্গাইল তাঁরই এলাকা।
তাজউদ্দীনরাই এখন শামসুল হকের ভরসা। ঢাকা থেকে এসেছেন খন্দকার মোশতাক, শামসুজ্জোহা, শওকাত আলী, আজিজ আহমেদ এমনি আরও অনেকে। তাঁরা উঠেছেন খোদাবক্স মোক্তারের বাড়িতে।
এর মধ্যে কামরুদ্দীন সাহেব এলেন। তিনি ৫০০ টাকা নিয়ে এসেছেন বিভিন্ন জনের কাছ থেকে জোগাড় করে। যাক, কিছু টাকা তো লাগেই। আলমাস সাহেবের কাছ থেকে পাওয়া গেল আরও ৮০০। শামসুল হকের ভাই নুরুল হক কয়েক মণ চাল দিয়ে গেলেন। যাক, এটা দিয়ে কর্মীদের, যারা অন্তত ঢাকা থেকে এসেছে, তাদের খাওয়াটা চলবে।
কিন্তু এ যে হাতির সঙ্গে পিঁপড়ার যুদ্ধ!
নুরুল আমিন মুখ্যমন্ত্রী, গরুর গাড়ি বোঝাই করে চাল পাঠাচ্ছেন নির্বাচনী এলাকায়।
তাজউদ্দীন বললেন, ‘কামরুদ্দীন সাহেব, এইভাবে ভোটারদের কিনে ফেললে শামসুল হক সাহেব জিতবেন কী করে?’
কামরুদ্দীন বললেন, ‘না, আমি পথে শুনে এলাম, লোকে বলছে, সারা দেশে দুর্ভিক্ষ অবস্থা, লোকে খেতে পাচ্ছে না, কর্ডন করে রাখা হয়েছে জেলাগুলো, রাস্তায় মানুষ তার বিরুদ্ধে মিছিল করছে, আর এত চাল ইলেকশনের এলাকায় যাচ্ছে, ব্যাপার কী? তার মানে, সরকারের গুদামে চাল আছে। সরকার ইচ্ছা করে আমাদের না খাইয়ে মারছে।’
তাজউদ্দীন মাথা নাড়লেন, ‘হ্যাঁ, এটা সরকারের জন্য হিতে বিপরীত হবে। আচ্ছা, রণদাপ্রসাদ সাহার কাছ থেকে আমরা সাহায্য পেতে পারি না? উনি তো আমাদেরই সমর্থন করবেন, এটা স্বাভাবিক। আপনার সঙ্গেও না ভালো সম্পর্ক?’
কামরুদ্দীন সাহেব এক হাতের আঙুল আরেক হাতের আঙুলের ফাঁকে ঢোকাতে ঢোকাতে বললেন, ‘আরেক মিনিস্টার এসে উঠেছেন আর পি সাহার বাসায়। হামিদুল হক চৌধুরী। আমার একটা সোর্স বন্ধ হয়ে গেল।’
নির্বাচনের খেলা জমে উঠল। হাতি আস্তে আস্তে কাদায় পড়তে লাগল। তাজউদ্দীন একটা লিফলেট পড়ে খুবই অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। পন্নীর স্ত্রী লিফলেট ছেড়েছেন। বলছেন, ‘আমি তাঁর স্ত্রী, কিন্তু তিনি আমার সঙ্গে না থেকে তাঁর আপন বোনের সঙ্গে থাকেন।’ সবাই এই লিফলেট নিয়ে কথা বলতে বেশি উৎসাহী। তাজউদ্দীন নন। তিনি মানুষকে বোঝান সরকার কীভাবে সব দিক থেকে মানুষকে শোষণ করছে, পাকিস্তান কীভাবে নতুন ঔপনিবেশিক শক্তি হয়ে উঠছে, জমিদাররা কীভাবে গরিবদের শোষণ করে।
হামিদুল হক চৌধুরীও বিপদে পড়লেন। মর্নিং নিউজ-এ খবর উঠেছে, ভারতের ডালমিয়ার যে ড্রামগুলো পাকিস্তানে আটকা পড়েছিল, সেসব ভারতে যেতে দেওয়ার অনুমতি দেওয়ার জন্য চৌধুরী ঘুষ খেয়েছেন।
এটা নিয়ে জনগণ তাঁকে নানা প্রশ্ন করতে লাগল।
এদিকে হযরত আলী আসাম থেকে ফিরে এসেছেন। তিনি দেখা করেছেন সেখানে ধুবড়ি কারাগারে আটক মওলানা ভাসানীর সঙ্গে। তাঁর কাছ থেকে স্বাক্ষর করিয়ে এনেছেন টাঙ্গাইলের এই নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের উদ্দেশে লিখিত আবেদনপত্র। মওলানা বলেছেন শামসুল হককে ভোট দিন।
সেটা নিয়ে সবাই উত্তেজিত। কামরুদ্দীন সাহেব সেটা দেখে বললেন, ‘এটা দিয়ে কোনো কাজ হবে না।
হযরত আলী বললেন, ‘কেন?’
কামরুদ্দীন বললেন, ‘এতে জেলের সিকিউরিটি অফিসারের সিল নাই। এটা প্রচার করা হবে আইনের পরিপন্থী।’
‘আরে, তাতে কী? এতে আইন ভঙ্গ হলে মওলানা ভাসানীর হবে, শামসুল হকের তো হবে না। আমরা এই আবেদনপত্র ছাপাব। বিলি করব। শামসুল হক জয়লাভ করবে। কারণ আকরম খাঁ, নুরুল আমিন আর ইউসুফ আলী চৌধুরী মিলে পন্নীর পক্ষে ভোট চেয়ে প্রচারপত্র বিলি করছে।’
‘না, তা করা উচিত হবে না।’ কামরুদ্দীন বললেন।
কামরুদ্দীন সাহেব আইনজীবী মানুষ। সামনে তাঁর বড় একটা মামলা পরিচালনা করতে হবে। দুই জমিদারের মধ্যে জমি নিয়ে গোলযোগে ১৯ জন খুন হয়েছে। খুব বড় মামলা। কামরুদ্দীন আহমদ টাঙ্গাইল ছাড়লেন।
শামসুল হকের একটা সাইকেল ছিল। সেটা নিয়ে তিনি প্রত্যেক ভোটারের বাড়ি যেতে লাগলেন। ভাসানীর আবেদনটাও ছাপা হয়ে বিলি হতে লাগল।
২৬ এপ্রিল, ১৯৪৯ নির্বাচন। সকাল থেকে তাজউদ্দীন ভোটের কেন্দ্রে কেন্দ্রে যাচ্ছেন শামসুল হকের সঙ্গে সঙ্গে। তিনিও একটা সাইকেল জোগাড় করে নিয়েছেন।
ভোটাররা সব শামসুল হককে ঘিরে ধরছেন। বোঝাই যাচ্ছে, জনমত শামসুল হকের দিকে।
ভোট গণনা হলো সারা রাত। সকালবেলা জানা গেল, পিঁপড়ার কাছে হাতি ধরাশায়ী হয়েছে। সামান্য প্রজার কাছে হেরে গেছেন জমিদারপ্রবর। নির্দলীয় প্রার্থীর কাছে হেরেছেন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের প্রার্থী। মুখ্যমন্ত্রী আর মন্ত্রীর প্রার্থী হেরেছেন কতগুলো যুবক ছেলের দলহীন দলের কাছে।
এই উপনির্বাচনে হারার পর ভয়ে মুসলিম লীগ ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে আর কোনো নির্বাচন দেয়নি।
শামসুল হক ঢাকায় ফিরবেন কিছুদিন পর। তাজউদ্দীন ঢাকায় ফিরে এলেন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর নিজেকে অচেনা লাগছে। একি হাল তাঁর চেহারার! ধূলিধূসরিত সমস্ত শরীর। গায়ের চামড়া রোদে পুড়ে তামা হয়ে গেছে।
তিনি তবু হাসলেন।
এই দেশে সামন্ততন্ত্রের পতন শুরু হয়েছে।
জমিদার হেরে গেছে সাধারণ প্রজার কাছে।
ঢাকায় ফিরেও কাজের বিরাম নাই।
একটা বিরোধী দল গঠন করা হবে। রোজ গার্ডেনের বাড়িতে সমমনা রাজনীতিকদের আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। কামরুদ্দীন সাহেব সেই কাজে ব্যস্ত। তাঁর একান্ত সহযোগী তাজউদ্দীন আহমদ আর তাঁর সাইকেল।
৩৯.
মওলানা ভাসানীকে একটা কম্বল দিয়ে পেঁচানো হয়েছে। ৬৫-৭০ বছর বয়স এখন তাঁর। আষাঢ়ের গরমে তিনি সেদ্ধ হচ্ছেন। তাঁকে একটা ঘোড়ার গাড়িতে বসানো হয়েছে। পাশে বসেছেন শওকত আলী। ঘোড়ার গাড়ি ছুটছে মোগলটুলি থেকে। রোজ গার্ডেন নামের বাড়ির দিকে। বাড়িটা গোপীবাগে। বাড়ির মালিক কাজী মোহাম্মদ বশির হুমায়ুন। রোজ গার্ডেন নামের বাড়িটা যেন সত্যি গোলাপের বাগান। দোতলায় হলঘর। সেখানে ঠাঁই নিতে পারে শ চারেক মানুষ।
ঢাকায় সিমেন্টের তৈরি পাকা বাড়ি কম। বেশির ভাগ বাড়িঘর কাদাসুরকি দিয়ে গড়া, এগুলোকে বলা হয় গঙ্গা-যমুনা গাঁথুনি। ছাত্রদের ইকবাল হল মুরলি বাঁশের তৈরি। সে তুলনায় রোজ গার্ডেন সত্যিই একটা ব্যতিক্রম।
মওলানা ভাসানীকে ওই বাড়িতে রাখা হলো। তাঁর বাইরে বেরোনো নিষেধ। কারণ, পুলিশের ভয়।
মওলানা সম্প্রতি কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে এসেছেন আসামের ধুবড়ি থেকে। তিনি ছিলেন আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি। পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকারের কাছে তিনি অবাঞ্ছিত। এক বছর আগে আইনসভার বাজেট অধিবেশনে বক্তৃতা করার সময় মওলানা আইনসভায় ইংরেজিতে বক্তৃতা না করে বাংলায় করার আহ্বান জানান। বলেন, ‘জনাব সদর সাহেব, এখানে যাঁরা সদস্য আছেন, তাঁরা সবাই স্বীকার করবেন যে এটা বাংলা ভাষাভাষীদের দেশ, এই অ্যাসেম্বলির যিনি সদর, তিনিও নিশ্চয়ই বাংলাতেই বলবেন। আপনি কী বলেন, আমরা তো কিছুই বুঝতে পারি না…আশা করি, আপনি বাংলায় রুলিং দেবেন।’ এরপর তিনি সরকারের প্রচণ্ড সমালোচনা করতে শুরু করেন। এ কারণেই সরকার তাঁর সদস্যপদ বাতিলের অজুহাত খুঁজতে থাকে। তিনি নির্বাচনী আয়-ব্যয়ের হিসাব দাখিল করেননি, এই অজুহাতটা পাওয়া যায়। অবশ্য ওই হিসাব কেউ-ই জমা দেননি, তাতে কী, এখন মওলানা ভাসানীর সদস্যপদ নিয়ে কথা হচ্ছে, আগে তাঁরটা বাতিল করা হোক।
তো, মওলানা ভাসানীকে পাওয়া গেছে ঢাকায়। মাঝখানে আসামে গিয়ে তিনি কিছুদিন জেল খেটে এসেছেন। ওদিকে সোহরাওয়ার্দীও কিছুদিন আগে ঢাকা এসেছিলেন মামলা পরিচালনার কাজে। তিনি পরামর্শ দেন, ঢাকায় আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম দিয়ে একটা বিরোধী সংগঠন খোলা হোক। মওলানা ভাসানীকে করা যেতে পারে তার সভাপতি। শামসুল হকের কাছে পন্নীর পরাজয়ে সবাই খুবই উৎসাহিতও আছে। মোগলটুলির কর্মীরা তাই উৎসাহভরে কাজ করছে একটা নতুন দল গঠনের জন্য।
মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ, যারা আবুল হাশিম আর সোহরাওয়ার্দীর সমর্থক, তাদের সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। হলঘর গমগম করছে ২৫০-৩০০ লোকের উপস্থিতিতে।
তাজউদ্দীন আহমদ এতে উপস্থিত আছেন। হাজির হয়েছেন অলি আহাদও।
আতাউর রহমান খান এসেছেন। ফজলুল হক খানিকক্ষণ থেকে বক্তৃতা দিয়েই চলে যান। শামসুল হকের নেতৃত্বে মোগলটুলি ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের সবাই এতে যোগ দেন।
সভায় ৪০ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কমিটি গঠন করা হয়। সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। সহসম্পাদক খন্দকার মোশতাক আহমদ। সদ্য কারামুক্ত ছাত্রনেতারা একযোগে শেখ মুজিবের নাম প্রস্তাব ও সমর্থন করায় তাঁকে একমাত্র যুগ্ম সম্পাদক করা হয়।
খন্দকার মোশতাক একটু মন খারাপ করলেন। তাঁকে মুজিবের পরে রাখা হলো কেন? মওলানা ভাসানীকে কাল রাতে কম্বল পেঁচানোর সময় তিনি কি তাঁকে প্রায় জড়িয়ে ধরেননি? শামসুল হকের সঙ্গে টাঙ্গাইল গিয়ে তাঁর পক্ষে অমানুষিক শ্রম স্বীকার করেননি? শেখ মুজিবের চেয়ে তিনি কি বয়সে এক বছরের বড় নন?
.
শেখ মুজিব কারাগারে বসে জানতে পারেন, তিনি এই নবগঠিত দলের যুগ্ম সম্পাদক হয়েছেন। সম্পাদক হয়েছেন শামসুল হক।
শেখ মুজিব নিজের পদমর্যাদা নিয়ে চিন্তিত হলেন না। বরং তাঁর ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হলো, সেটি নিয়েই তিনি বেশি ভাবিত। এখন তিনি একটা দল পেয়ে গেছেন। কারাগার থেকে বেরিয়েই তাঁকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে দল আর মানুষকে সংগঠিত করার কাজে।
পরের দিন, ২৪ জুন, ১৯৪৯। আরমানিটোলা ময়দানে নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের জনসভা। প্রথম জনগণের সামনে আসা।
বিকেলবেলা। একটু পরে জনসভা শুরু হবে। হাজার চারেক লোক এরই মধ্যে উপস্থিত। হঠাৎই হামলা করে বসে মুসলিম লীগের গুন্ডারা। তারা মঞ্চ ভেঙে ফেলে, চেয়ার-টেবিল তছনছ করে।
মঞ্চ দখল করে মঞ্চের ওপর সবচেয়ে বেশি যে লাফায় তার নাম শাহ আজিজ। এখন মুসলিম লীগের নেতা।
শেখ মুজিব কারাগারে, তা না হলে শাহ আজিজকে তিনি মনে করিয়ে দিতে পারতেন কুষ্টিয়া সম্মেলনের মুষ্ট্যাঘাতটার কথা।
ওই টর্নেডো চলে গেলে আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতারা আবার মঞ্চে ওঠেন। মওলানা ভাসানী তাঁর ভাষণে লীগ সরকারের ২২ মাসের অপকীর্তি তুলে ধরেন।