যারা ভোর এনেছিল – ৪০
৪০.
আজ মুজিবকে কারাগার থেকে আদালতে নেওয়া হবে। তোলা হলো প্রিজনার্স ভ্যানে। শেভ করে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে মুজিব ধীরেসুস্থে উঠলেন ভ্যানে।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। গরমও পড়েছে। ভ্যান থেকে নেমে মুজিব ইচ্ছা করেই খানিকটা দাঁড়িয়ে রইলেন। বৃষ্টির পানি তাঁর চুল, পাঞ্জাবি ভিজিয়ে দিচ্ছে। তিনি তা-ই চান। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে এই বৃষ্টির পানির স্পর্শটুকু তাঁর খুব ভালো লাগে।
আদালতে ভিড় করলেন কর্মীরা। বিশেষ করে ছাত্ররা। ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের কর্মীরা তো বটেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-কর্মচারীরাও। তাঁদের মধ্যে থেকে তাঁদের দাবিদাওয়া আদায় করতে গিয়ে মুজিব গ্রেপ্তার হয়েছেন। আর চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে তাঁর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা। মুজিব ভাইকে আজ কোর্টে তোলা হবে, শুনে তাঁরা তাই এসেছেন দল বেঁধে।
মুজিব প্রত্যেকের নাম ধরে ডেকে কুশল জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। ‘এনামুল কেমন আছো?’
‘আসগর আলী, শফিকুর রহমান?’
বারান্দায় ভিড় জমে যায়। সেই ভিড়ের মধ্যেই হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ে একজন শার্ট পরা সৌম্যদর্শন মানুষের ওপর। আরে, মানিক ভাই এখানে! ‘মানিক ভাই! এই ছাত্র ভাইরা, একটু সরো। আমার ভাইকে একটু কাছে আসতে দাও।’
ভিড় সরে যায়। তফাজ্জল হোসেন মানিক এগিয়ে আসেন।
বরিশালের ভান্ডারিয়ার ছেলে মানিক ভাই। পিরোজপুর স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে বিএ। সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মুখ তো মুখ নয়, যেন বন্দুকের নল। সরকারের বিরুদ্ধেই তা থেকে নানা ধরনের গোলা বের হতো। কাজেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে চললেন কলকাতা।
তাঁর সঙ্গে মুজিবের পরিচয় বছর ছয়েক আগে, সেই কলকাতায়। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের বাসায়। দুজনই সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ভক্ত। ভক্ত থেকে তাঁরা হয়ে গেলেন সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য। একই নেতার দুই শিষ্য, যেন এক পিতার দুই সন্তান। মানিক ভাইকে মুজিবের মনে হয় নিজের বড় ভাইয়ের মতো। তাঁর চেয়ে বছর নয়-দশেকের বড়ই হবেন মানিক মিয়া।
মানিক মিয়া কলকাতা থেকে প্রকাশিত সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কাগজ ইত্তেহাদ-এ কাজ করতেন। ব্যবস্থাপনার কাজ।
সাতচল্লিশের পরপর যে তিনি কলকাতা ছেড়েছেন, তা নয়। ইত্তেহাদ কলকাতা থেকে বের করা হচ্ছিল। সেখান থেকেই ঢাকা আসত। শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন তা ঢাকায় বিলিও করেছেন। কিন্তু খাজা নাজিম উদ্দিন পূর্ব বাংলায় ইত্তেহাদ প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিলেন। ফলে পত্রিকাটার প্রচারসংখ্যা গেল কমে, আর্থিকভাবে সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হলো।
মানিক মিয়া সোহরাওয়ার্দীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ঢাকায় চলে এসেছেন। মুজিব, মানিক—দুই ভাই আবার এক শহরে।
মানিক দেখলেন, মুজিবের মাথায় বিন্দু বিন্দু জল। তিনি পকেট থেকে রুমাল বের করে জল মুছে দিলেন। তারপর আরেক পকেট হাতড়ে বের করলেন একটা কাগজ। ‘দেখো।’
‘কী এটা?’
‘আমাকে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য দপ্তরের ডেপুটি সেক্রেটারি। করাচিতে পোস্টিং। আপনি কী বলেন, যাব?’
‘আপনি না এখানে একটা সাপ্তাহিক কাগজ বের করার চেষ্টা করছেন?’
‘করছি তো। কিন্তু সাধ্যে তো কুলাচ্ছে না। চারদিকে বিরূপ পরিবেশ। সোহরাওয়ার্দীর লোক আমরা। এখানে কেউ আমাদের বাসাটা পর্যন্ত ভাড়া দিতে চায় না।’
‘তা তো আমি জানি। কিন্তু মানিক ভাই, আমাদের তো একটা মিশন আছে। গণতন্ত্র, গভর্নমেন্ট বাই দ্য পিপল ফর দ্য পিপল অব দ্য পিপল। আপনি কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি নিয়ে চলে গেলে আমাদের সেই মিশনের কী হবে?’
‘যাব না বলছেন?’
‘লিডারের আদর্শের পক্ষে এত দিন কাজ করলেন, আর আজ করাচি যাবেন খাজার চাকরি করতে?’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। ছেলেপুলে নিয়ে পানের দোকানদারি করে খাব। সেও ভালো। তবু ওদের চাকরি নয়
আদালত বসছে। মুজিব এজলাসের দিকে এগোলেন। অধৈর্য পুলিশ তাঁকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল।
‘মানিক ভাই, আপনার ছোট ভাই মুজিব বেঁচে থাকলে আপনার স্বপ্ন সাপ্তাহিক কাগজ অবশ্যই বের হবে। ইয়ার মোহাম্মদ আমার দোস্ত। আপনি তাঁর কাছে যান। আমার কথা বলেন।’ বলতে বলতে মুজিব এজলাসের ভেতর ঢুকে গেলেন।
৪১.
আওয়ামী মুসলিম লীগের কাজ চলছে সারা প্রদেশে। মওলানা ভাসানী ঘুরে বেড়াচ্ছেন জেলা থেকে জেলায়। শামসুল হক তৎপর। কিন্তু কাগজে তাঁদের কথা প্রকাশ হয় না। আজাদ ঢাকায় এসেছে, এটা তো খাজাসমর্থক কাগজ। অবজারভারও তা-ই।
একমাত্র উপায় হলো নিজেদের কাগজ বের করা। মানিক মিয়ার সাধ আছে সাধ্য নাই।
মানিক মিয়া গেলেন ইয়ার মোহাম্মদের কাছে। ইয়ার মোহাম্মদের বাবা ছিলেন ঢাকার বড়লোকদের একজন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে বিমানবন্দর নির্মাণের ঠিকাদারি করে তিনি বিশাল ধনী হয়েছিলেন। ইয়ার মোহাম্মদ যখন স্কুলে পড়েন, তখন তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। ইয়ার মোহাম্মদ অগাধ সম্পত্তির মালিক হন। তখন থেকেই তিনি রাজনীতিসচেতন, সমর্থন করতেন মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম গ্রুপটাকে।
এরই মধ্যে শেখ মুজিবের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে মওলানা ভাসানী আর তাঁর আওয়ামী মুসলিম লীগকে তিনি তাঁর নিজের বাড়িতে তুলেছেন। তাঁর কারকুন লেনের বাড়িতেই মওলানা ভাসানী থাকেন। এটাই আওয়ামী মুসলিম লীগের অফিস। ইয়ার মোহাম্মদের স্ত্রী বয়স্ক মওলানার সেবাযত্ন করতেন। সারাক্ষণ পার্টির নেতা-কর্মীতে বাড়ি গমগম করত। পারিবারিক গোপনীয়তা বলতে তাঁদের আর কিছুই রইল না। ইয়ার মোহাম্মদের স্ত্রী-সন্তানদের সমাজের নানা কথা শুনতে হতো, বৈরী সরকারের জুলুমের ভয় তো ছিলই।
ইয়ার মোহাম্মদকে মানিক মিয়া তাঁর ইচ্ছার কথা জানালেন। ‘সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করতে চাই। শেখ মুজিব আপনার কাছে আমাকে আসতে বলেছেন।’
‘আচ্ছা, এসেছেন যখন, মুজিব ভাই যখন বলেছেন, হবে।’
এদিকে সরকারি কাগজগুলোয় শুধু সরকারের পক্ষের খবর ছাপে; বিরোধী আওয়ামী মুসলিম লীগের খবর ছাপে না। মওলানা ভাসানী যারপরনাই বিরক্ত। তিনি উদ্যোগী হলেন।
ঢাকা বার লাইব্রেরিতে গেছেন তিনি। আইনজীবীরা তাঁকে ঘিরে ধরলেন। মওলানা বললেন, ‘আমি একটা পত্রিকা প্রকাশ করতে চাই। আপনারা আমাকে সাহায্য করেন।’
আইনজীবীরা সঙ্গে সঙ্গে চাঁদা তুলতে আরম্ভ করলেন। ৪০০ টাকা চাঁদা উঠে গেল তখনই
মুজিব মুক্তি পেলেন কারাগার থেকে। কারাগারের গেটে ভিড় লেগে গেল। মুজিব খোলা আকাশের নিচে আসামাত্রই তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন শামসুল হক। ইয়ার মোহাম্মদ খান এগিয়ে এলেন। বললেন, ‘জিপগাড়ি এনেছি। আপনি ওঠেন। আপনার আব্বা এসেছেন। কথা বলেন। চাচা, চাচা, আপনি আসেন।’
লুৎফর রহমান সাহেব ভিড়ের চাপে মুজিবের কাছেই ঘেঁষতে পারছেন না।
মুজিব ‘আব্বা’ বলে এগিয়ে গেলেন। জড়িয়ে ধরলেন পিতাকে। ভিড়ের চাপে কি কথা বলা যায়।
জিপ চালাবেন ইয়ার মোহাম্মদ। তাঁর পাশে বসলেন শামসুল হক, তাঁর পাশে লুৎফর রহমান। পেছনের সিটে বাম পাশে বসলেন মুজিব।
ভিড়ের চাপে জিপ এগোতেই পারছে না।
.
কারাগার থেকে বেরিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মুজিব। একটার পর একটা মিছিল করছেন। সমাবেশ করছেন।
ইত্তেফাক বের করতে হবে। টাকা দরকার। শেখ মুজিব চাঁদা তুললেন কিছু
মওলানা ভাসানী প্রতিষ্ঠাতা, ইয়ার মোহাম্মদ খান প্রকাশক আর মুদ্রাকর, সাপ্তাহিক ইত্তেফাক বের হতে লাগল। প্রথম দিকে খুবই কষ্ট করতে হয়েছে সাপ্তাহিক ইত্তেফাককে। শুধু ডিক্লারেশন বাঁচিয়ে রাখার জন্য মাসে দুই পাতা বের করা হতো।
তখন এগিয়ে এলেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। তিনি মওলানা ভাসানীকে বললেন, ‘ইত্তেহাদ-এ আমি ছিলাম সুপারিনটেনডেন্ট। কাগজ কী করে বের করতে হয়, এটা আমি জানি। আমি পারব। দায়িত্বটা আমার ওপর ছাড়েন।’
মানিক মিয়ার ওপর দায়িত্ব দেওয়ার পরে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক সজীব হয়ে উঠল।
আওয়ামী মুসলিম লীগ তার খবর প্রকাশের একটা মাধ্যম খুঁজে পেল। বাংলার মানুষও পড়ার মতো একটা কাগজ পেয়ে গেল। পত্রিকাটা জনপ্রিয়তা পেতে লাগল দ্রুতই। তাতেই টনক নড়ে গেল সরকারের। তারা ছাপাখানার মালিকদের ভয়ভীতি দেখাতে লাগল কেউ যেন ওই কাগজ না ছাপে। মালিকেরা সরকারের ভয়ে ইত্তেফাক ছাপতে অস্বীকৃতি জানাতে লাগল।
একটার পর একটা ছাপাখানা বদল করতে হলো পত্রিকাটিকে।
৪২.
শেখ মুজিবের সঙ্গে সরকারের পুলিশ, পুলিশের গোয়েন্দাদের চলছে ইঁদুর-বিড়াল খেলা। মুক্তি পেয়েও মুজিবের শান্তি নাই। তিনি গোপালগঞ্জ যান। আবদুস সালামও তাঁর সঙ্গে আছেন। মুজিব জনসভা করবেন। চোঙামাইকে প্রচার চলেছে। এরই মধ্যে থানায় থানায়, ইউনিয়নে ইউনিয়নে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হচ্ছে। চারদিকে ব্যাপক সাড়া। স্টিমার থেকে গোপালগঞ্জ ঘাটে মুজিব যখন নামছেন, তখনই ঘাটে ভিড়।
সরকার ভয় পেয়ে গেল। প্রশাসন আর মুসলিম লীগ নেতাদের টনক গেল নড়ে। কী করা যায়? তারা ১৪৪ ধারা জারি করল। অর্থাৎ সভা করা যাবে না।
শেখ মুজিব ওই বান্দা নন যে প্রশাসন তাঁকে বাধা দিল, আর গ্রেপ্তারের ভয়ে তিনি তাঁর আহূত জনসভা থেকে বিরত থাকবেন।
তিনি কোর্ট মসজিদে মিলাদের কর্মসূচি দিলেন। সবাই হাজির হলো মসজিদ প্রাঙ্গণে। শেখ মুজিব মিনারে উঠে বক্তৃতা শুরু করলেন। এই এলাকাটাও ১৪৪ ধারার অধীনে আছে, মসজিদের ভেতর মিলাদ পড়া যাবে, কিন্তু বাইরে সভা করা যাবে না।
মুজিব বললেন, ‘আমি গ্রেপ্তার বরণ করার জন্য প্রস্তুত আছি। তবু আমার কণ্ঠস্বর কেউ স্তব্ধ করতে পারবে না।’
হাজার হাজার মানুষ চিৎকার করে উঠল ‘শেখ মুজিবের কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’।
পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে গ্রেপ্তার করল না, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে আইন ভঙ্গের অভিযোগে মামলা করে দিল।
পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ সেসব তথ্য প্রতিবেদন আকারে পাঠাল তাদের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে।
.
রাতের বেলা মুজিব হাজির হলেন তাঁদের গোপালগঞ্জের বাসায়।
বাবা বললেন, ‘খোকা, বাড়ি যাবা না? বউমার তো যখন-তখন অবস্থা?’
মুজিব বললেন, ‘যাব, কাল সকালেই রওনা দেব। পুলিশ আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ১৮৮ ধারা।’
গোপালগঞ্জ থেকে নৌপথে রওনা হলেন মুজিব, টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশে।
.
হাসুর বয়স সামনের মাসে দুই বছর পুরো হবে। সে এখন অনেক কথা বলে। প্রথম প্রথম আব্বার কোলে উঠতে চাইত না। পরে ঠিকই উঠল বাপের ঘাড়ে মাথা গুঁজে দিল। মুজিব তাঁকে নিয়ে চললেন খালের পাড়ে।
খালটা ছোট, কিন্তু খাড়া। ভেতরে বড় বড় নৌকা। জোয়ার-ভাটা হয় নিয়মিত। তিনি বাচ্চা কোলে হাঁটেন, তাঁর এলাকার বন্ধুবান্ধব সব হাজির হন তাঁর কাছে। তরুণ-কিশোরেরাও আসে। মিয়া ভাই এসেছেন, তারা তাঁকে দেখতে চায়। এর মধ্যে মিয়া ভাইকে যে পুলিশ আটক করেছিল, তিনি যে আবারও কারাগার থেকে ঘুরে এসেছেন, এলাকার মানুষ জানে।
তাঁরা তাঁকে কত প্রশ্ন করেন!
‘মিয়া ভাই, চাউলের দাম যে খালি বাড়তিছে, এই আজাদির কী মানে হইল?’
‘মিয়া ভাই, সুরাবার্দী সাবরে মিনিস্টার বানাবি না?’
‘খোকা, মাওলানা ভাসানী কেন আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হইল? সরওয়ার্দী সাব নাইলে এ কে ফজলুল হক তো হইতি পারত!’
বিকেল বেলা! আকাশে মেঘ। বৃষ্টি হবে নাকি আবার! মেয়েকে কাঁধে নিয়ে মুজিব চললেন বাড়ির দিকে। পেছনে পেছনে চললেন দর্শনার্থীরাও। মুজিব বললেন, ‘হেলেন, চিড়ামুড়ি কী আছে, দাও দিকিনি। এরা কি খালি মুখে যাবে?’
রেনু বললেন, ‘আমি উঠছি। আমি দেখতিছি।’
তিনি বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে ছিলেন। তাঁর পেটটা এবার বেশ উঁচু।
মুজিব বললেন, ‘না না, তুমি উঠো না। তুমি বসে থাকো। আমি দেখতেছি। ওরাও দেখবে নে।’
ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি এল। রেনু ঘরে গিয়ে বসলেন। অসময়ে এই শরীরে বৃষ্টির ছাট লাগানো ঠিক হবে না। মুজিব হাসুকে দিয়ে দিলেন তাঁর মায়ের কোলে।
হাসু দাদির কোলে উঠে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরল।
‘দাদি’ ‘দাদি’ বলে কী যে একটা হাসি হাসল বাচ্চাটা!
মুজিব বারান্দায়। কিন্তু তাঁকে দেখতে আসা ছেলেপুলের দল উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। তারা যে বৃষ্টিতে ভিজছে তাতে তাদের কোনোই আপত্তি নেই।
মুজিব ভাবলেন, এই লোকগুলো নিচে উঠোনে ভিজবে, আর তিনি বারান্দার উঁচুতে টিনের চালের নিচে মাথা বাঁচিয়ে রাখবেন, তা হয় না।
তিনি নিজেই নেমে গেলেন উঠোনে। শ্রাবণের ধারা তাঁকেও ভিজিয়ে দিতে লাগল।
ছেলেপুলের দল হইহই করে উঠল মিয়া ভাইকে তাদের মধ্যে পেয়ে।
হইহই করতে করতে তারা বাড়ির খুলিতে গেল।
বাড়ির সামনে জামরুলগাছ। এই জামরুলগাছের জামরুল কত খেয়েছেন ছোটবেলায়! সব গাছে উঠতে পারতেন। এমনকি নারকেলগাছেও। এই যে দিঘি, এই দিঘিতে কত সাঁতার কেটেছেন! নদীপারের ছেলে, কখন যে সাঁতার শিখে গেছেন আপনা-আপনি, কে আর আলাদা করে খেয়াল রাখে।
রাতের বেলা ভাত খেতে বসেছেন মুজিব। শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন রেনু। মা ভাত তুলে দিতে লাগলেন।
মা বললেন, ‘খোকা, বউমার তো মনে হয় এবার পোলা হবি। পেটটা তো বেশি উঁচা দেখা যায়।’
মুজিব হাসলেন। লন্ঠনের আলোয় তাঁর মুখের হাসিটা কী যে অপূর্ব লাগছে! মা তাঁর দিকে তাকিয়ে ‘মাশাল্লাহ’ বলে উঠলেন, যেন নজর না লাগে।
মুজিব কাঁসার গেলাস তুলে পানি খেলেন।
মা বললেন, ‘খাওয়ার সময় পানি খায় না, বাবা।’ তারপর জানতে চাইলেন, ‘জেলখানায় কী খাতি দেয়, বাবা?’
মুজিব বললেন, ‘আমাদের তো ভালো ভালো খাবার দেয়, মা। আমরা তো সিকিউরিটি। ডাক্তার দেখে যায়, ওজন কমলে স্পেশাল ডায়েট দেয়। তখন বাড়তি ডিম-দুধ। আমরা সব খেয়ে শেষ করতে পারি না। অন্য ওয়ার্ডে পাঠায়া দেই।’
মা বললেন, ‘খোকা, পিঠা পাঠিয়েছিলাম, পাইছিলা?’
‘জি, মা, তোমার পিঠার তো সবাই খুব প্রশংসা করল। এত ভালো পিঠা নাকি কেউ খায়নি কোনো দিন। আমি বললাম, আমার মায়ের হাতের পিঠা, সবার চেয়ে মিঠা।’
.
রাতের বেলা রেনু বললেন, ‘মাকে কেন বলতি গেলা সবাইরে তুমি পিঠা দিয়েছ? মা তো আশা করে আছেন সবটাই তুমি খেয়েছ!’
মুজিব হাসলেন, ‘তুমি কী করে বুঝলা?’
‘তুমি যখনই বললা সবাই খুব প্রশংসা করেছে, মার মুখখানা সঙ্গে সঙ্গে আঁধার করে এল, তাতেই ঝুঝলাম।
হাসু নড়ে উঠল। রেনু তার গায়ে আস্তে আস্তে চাপড় দিয়ে তাকে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিলেন।
তারপর বললেন, ‘আমার কিন্তু ডেলিভারির সময় হয়ে এসেছে। তুমি থেকে যাবা তো কত দিন! বাচ্চা দেখে যাবা না?’
মুজিব বললেন, ‘রেনু, আমার যে অনেক কাজ। মানিক ভাই পত্রিকা করছেন। তাঁর পাশে আমার থাকতে হবে। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। মুসলিম লীগ সরকার অনেক অন্যায়-অত্যাচার করতেছে, সেসবের একটা বিধান করতে হবে। আর তা ছাড়া এক জায়গায় থাকলে পুলিশই এসে ধরে নিয়ে যাবে। তার চেয়ে যাওয়া ভালো। আমি একটু করাচি যেতে চাই। লিডারের সঙ্গে পরামর্শ আছে।
রেনু দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললেন, ‘তোমাকে আমি আটকাব না। তুমি যাও। খালি নিজের যত্ন নিয়ো।
দুজনই জেগে রইলেন অতঃপর। চুপচাপ
রেনু বললেন, ‘সবাই বলছে ছেলে হবি। তুমি ছেলে চাও, না মেয়ে চাও?’
মুজিব বললেন, ‘আল্লাহ যেটা দেন। আমি স্বামী হিসেবেও ভালো না। বাবা হিসেবেও না। আমার কি ছেলে না মেয়ে বেছে নেওয়ার কথা বলা সাজে! আর তা ছাড়া আল্লাহ যা দেন আমি তাতেই আল্লাহর কাছে হাজার শোকর করব। শুধু চাই তুমি সুস্থ থাকো। বাচ্চা সুস্থ থাকুক।’
রেনু বললেন, ‘ছেলে হলে কী নাম রাখবেন?’
মুজিব বললেন, ‘জেলে বসে আমি এই কথাটা অনেক ভেবেছি। তুর্কি বীর কামাল পাশার নামে নাম রাখব। তুমি কী বলো! ছেলে হলে নাম রাখব ‘শেখ কামাল’।’
রেনু বললেন, ‘সুন্দর নাম।’ তিনি উঠে বসে পান সাজাতে লাগলেন। শেখ মুজিব বিদায় নিলেন পরের দিনই। তার সাত দিন পর রেনু একটা ছেলের জন্ম দিলেন। তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান।
শ্রাবণের সেই দিনটায় খুব বৃষ্টি হচ্ছিল।
বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ ভেদ করে ‘শেখ কামাল’ নামের সদ্যোজাত শিশুটা তার জন্ম ঘোষণা করল। দাদা শেখ লুৎফর রহমান উপস্থিত ছিলেন। তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আজান দিতে লাগলেন : আল্লাহু আকবর।
বৃষ্টির শব্দ ভেদ করে তাঁর আজানের ধ্বনি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
ঢাকায় গিয়ে মুজিব উঠলেন ৯ পাতলা খান রোডে। তাঁর নেতাকে চিঠি লিখলেন।
জনাব,
আপনার প্রতি আমার সালাম। আপনি সব খবর পাবেন মানিক ভাইয়ের চিঠিতে। আপনাকে দেখার জন্য আমি আকুল হয়ে আছি। আর আপনার সঙ্গে আওয়ামী লীগ আর পার্লামেন্টের ব্যাপারে আমার জরুরি কিছু কথা আছে। দয়া করে আমাকে লিখবেন, সব ধরনের দিকনির্দেশনা দেবেন। আপনি কেমন আছেন?
আপনার স্নেহের মুজিবুর
বিশেষ দ্রষ্টব্য :
আমাকে এক মাসের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের ব্যাপারে আপনার দেওয়া নির্দেশ প্রতিপালন করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের হাতে কোনো তহবিল নাই। যা-ই হোক না কেন, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। খোদা হাফিজ।
মুজিবুর
ইংরেজিতে লেখা এই চিঠিটা তিনি মি. এইচ এস সোহরাওয়ার্দীর নামে ১৩এ কাচারি রোড, করাচির ঠিকানায় পৌঁছানোর আশায় খামে ভরে ডাকে দিয়ে দিলেন।
মুজিব জানলেনও না যে তাঁর এই চিঠি গোয়েন্দা পুলিশ আটক করল। এই চিঠি তার প্রাপকের হাতে আর কোনো দিনও পৌঁছাবে না।
সময় দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু লিডারের কাছ থেকে কোনো বার্তা আসছে না। মানিক ভাইয়ের চিঠিতে বিস্তারিত জানানো হয়েছে ঢাকার পরিস্থিতি। সাপ্তাহিক ইত্তেফাক-এর জন্যও তহবিল দরকার।
চিঠি পাঠানোর ১৫ দিনের মাথাতেও কোনো উত্তর না পেয়ে মুজিব আবার চিঠি লিখতে বসলেন তাঁর নেতাকে।
ইংরেজিতে তিনি লিখলেন :
১৫০, মোগলটুলি, ঢাকা,
২১/৮/৪৯
জনাব,
আশা করি মানিক ভাইয়ের চিঠির সঙ্গে পাঠানো আমার চিঠিটা পেয়েছেন। আমরা সবাই ওই চিঠিতে আমাদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর ব্যাপারে আপনার উত্তরের জন্য উদ্বেগের সঙ্গে অপেক্ষা করছি। আপনি নিশ্চয়ই বর্তমান শাসকদের হীন মনোভাব উপলব্ধি করছেন। দমন-নিপীড়নের হেন উপায় নাই তারা অবলম্বন করছে না। কথায় কথায় ১৪৪ ধারা জারি, আমাদের কর্মীদের গ্রেপ্তার আর হয়রানি হয়ে দাঁড়িয়েছে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এসব সত্ত্বেও আমাদের সাংগঠনিক কাজ চলেছে অপ্রত্যাশিত রকম দ্রুতগতিতে। কিন্তু একটা সংগঠন হিসেবে আমাদের সব কর্মকাণ্ড প্রকাশিত হতে পারে না। আগের দিন আমরা আরমানিটোলা ময়দানে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে একটা জনসভার আয়োজন করেছিলাম। সরকারি দল আমাদের জনসভা ভণ্ডুল করে দেওয়ার জন্য যত ধরনের হীন কৌশল আছে অবলম্বন করেছিল। তা সত্ত্বেও তাদের হীন কৌশল ব্যর্থ করে দিয়ে আমাদের জনসভাটি খুবই সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। সভায় ৫০ হাজারের মতো মানুষ যোগ দিয়েছিল। কিন্তু আমাদের পক্ষে কোনো প্রচার নাই। এই কারণে আমাদের অনেক অসুবিধা হচ্ছে। তা ছাড়া আপনি অন্য অসুবিধাগুলোর কথাও জানেন। মফস্বলে আমাদের কর্মীদের যারপরনাই হেনস্তা করা হচ্ছে। আজ রাতেই আমি গোপালগঞ্জ আর বরিশাল রওনা হয়ে যাব। আমাদের কর্মীদের ওখানে নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের শিকার হতে হয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সম্মেলনের তারিখ ঠিক হয়েছে ১৬, ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯। আপনি কি দয়া করে একটু দেখবেন মিয়া মোনজোরাল আলম, আবদুস সাত্তার খান, নিয়াজি (প্রাক্তন এমএলএ, পাঞ্জাব) আর পশ্চিম পাঞ্জাবের গোলাম নবীকে সম্মেলনে পাওয়া যাবে কি না? আপনার কাছ থেকে শোনার পরই আমরা তাঁদের আমন্ত্রণপত্র পাঠাতে পারব।
আপনি কবে ঢাকা আসবেন? আমরা সবাই উদ্বেগের সঙ্গে আপনাকে আমাদের মধ্যে পেয়ে নানা বিষয়ে আলোচনা করার জন্য অপেক্ষা করছি। মানিক ভাই খুব অস্থির অবস্থায় আছেন। তা সত্ত্বেও আমরা তাঁকে অনুরোধ করেছি আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় অফিসটার দায়িত্ব নিতে।
শ্রদ্ধাসহ
আপনার স্নেহের
মুজিবুর রহমান।
আপনার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা আমরা করেছিলাম। এমনকি তিন দিন আগে আমরা গভীর রাতে বসে থেকে আপনাকে ফোন করি। করাচি এক্সচেঞ্জ জানায়, আপনি রাত দুটোতেও বাসায় নাই।
মু. র.
শেখ মুজিব চিঠি লিখছেন তাঁর লিডারকে। সেটা গোয়েন্দারা আটকে ফেলছে। শেখ মুজিব ফোন করছেন। করাচি এক্সচেঞ্জ বলছে সোহরাওয়ার্দী বাসায় নাই। রাত দুটোতেও সোহরাওয়ার্দী বাসায় থাকেন না!
ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের সাব-ইন্সপেক্টর এই চিঠিটা ২৬ তারিখে তাদের যথাযথ ফাইলে জমা দেয়।
৪৩.
ছোট্ট একটা পুতুল পেয়েছে হাসু। সারাক্ষণ মায়ের কোল ঘেঁষে থাকে তার ছোট ভাইটি। হাসু তার দুই বছরের জবানে আধো আধো বোল ফুটিয়ে বলে, ‘কোলে দেও। আমার কোলে দেও।’
রেনু হাসুকে জলচৌকির ওপরে বসান। তারপর তার কোলে ২৫ দিন বয়সী কামালকে তুলে দেন। হাসু দিব্যি তাকে কোলে নেয়। মা দুজনকেই ধরে রাখেন। উঠোনে মুরগি চরছে। বরইগাছে কাঁচা বরইয়ে ঢিল দিচ্ছে পাড়ার ছেলের দল। বিকেলের আলো পড়েছে উঠোনে। ছোট্ট বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামাতেই চায় না হাসু। রেনু তবু তার কাছ থেকে বাচ্চাটাকে নিজের কোলে তুলে নেন।
‘যাও তো দেখো দাদি কী করতিছে?’ রেনু বলেন।
‘হাসু, এদিকে আয়,’ দাদি হাঁক পাড়েন।
হাসু থপথপ করে ছোট্ট পা ফেলে দাদির দিকে যায়। একটা মুরগি অনেকগুলো ছানা দিয়েছে। উঠোনে তারা চরছে। হাসু দেখে,
কী সুন্দর হলুদ রঙের একেকটা মুরগির বাচ্চা! সে সেদিকে হাত বাড়াতে চায়। মা- মুরগি তেড়ে আসে কক কক শব্দ করে। রেনুর বুকটা কেঁপে ওঠে। এই বুঝি হাসুকে ঠোকর মারে। তিনি মুখে শব্দ করে ওঠেন।
কোলের বাচ্চা কাঁদে। তাকে আবার আঁচলের নিচে নেন।
বাচ্চাদের আব্বার দেখা নাই। তিনি গোপালগঞ্জ যাচ্ছেন। বরিশাল যাচ্ছেন। একবারও আসতে পারেন না টুঙ্গিপাড়ায়।
ছেলেটার মুখটাও কি তিনি একটু দেখবেন না?
এর মধ্যে বাড়িতে পুলিশ এসেছিল। তাঁকে খুঁজে গেছে। তাঁর বিরুদ্ধে মামলার অন্ত নাই। গোপালগঞ্জে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
আবার যেকোনো দিন গ্রেপ্তার হবেন। জেলে যাবেন। রেনুর বুকটা কেঁপে ওঠে। হাসু আবার এসেছে তাঁর কাছে, ‘মা, কোলে দেও।
মা-মুরগিটার মতোই পক্ষ বিস্তার করে রেনু তাঁর আঁচলের নিচে হাসু- কামাল দুজনকেই টেনে নেন।
এ সময় ঘাটে নৌকা এসে ভেড়ে। বরিশাল থেকে ফেরার পথে মুজিব টুঙ্গিপাড়ায় নেমেছেন।
পাড়ায় হইহই শোনা যায়।
মিয়া ভাই এসেছে। মিয়া ভাই এসেছে।
রেনুর বুকটা আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। সত্যি কি সে এসেছে?
‘কই, আমার পোলা কই?’ মুজিবের ভরাট গলার আওয়াজ পাওয়া যায়।
মুজিবের মা ছুটে যান বাইরে। ‘খোকা, এসেছ বাবা! আসো। ওই যে তোমার পোলা।
রেনুর মুখের দিকে তাকান মুজিব। শেষ বিকেলের সোনালি রোদ পড়েছে রেনুর মুখে। রেনুকে একটা পিতলের মূর্তির মতো দেখা যাচ্ছে। সেই মুখে ফুটে উঠেছে অপূর্ব হাসি।
মুজিব এসেই বলেন, ‘দেও, পোলারে কোলে দেও।’
রেনু বলেন, ‘তুমি জার্নি করে এসেছ। যাও, আগে হাতমুখ ধুয়ে নেও। কাপড় পাল্টাও। এত ছোট বাচ্চা, আ-ধোয়া হাতে ধরতে নাই।’
রেনু মুজিবের কোলের কাছে বাচ্চাটাকে ধরেন। মুজিব ছেলের কপালে চুম্বন করেন। হাসু গিয়ে তাঁর পায়ে পড়লে তিনি তাকে কোলে তুলে নিয়ে বলেন, ‘হাসু মাকে কোলে নিতে নিশ্চয়ই মানা নাই। আমি আসতেছি হাতমুখ ধুয়ে।
‘কিন্তু কাপড় আর বদলাব না। আজ রাতেই আমি ঢাকা চলে যাব। অনেক কাজ। দেশে দুর্ভিক্ষ। লোকে না খেয়ে আছে। এর মধ্যে লিয়াকত আলী খান আসতেছে ঢাকায়।’ মুজিব একমনে বলতে বলতে চললেন বারান্দার দিকে। এরই মধ্যে বালতি-বদনায় পানি এসে গেছে।
রেনুর মুখের হাসিটা নিভে আসে। মুজিব আজই চলে যাবে? তাহলে আসার দরকারই বা কী ছিল?
মুজিব সেটা লক্ষ করেন। হাত-পা ধুতে আরম্ভ করলে রেনু তাঁর পাশে গামছা নিয়ে দাঁড়ান।
তিনি গামছা দিয়ে হাতমুখ মুছে গামছাটা তারে ঝুলিয়ে কামালকে কোলে নেন।
রেনু বলেন, ‘বলো তো ও দেখতে কার মতো হয়েছে?’
মুজিব দেখেন, হুবহু একটা ছোটবেলার মুজিব তাঁর কোলে। কিন্তু রেনুকে খুশি করার জন্য তিনি বলেন, ‘না, ধরতে পারতেছি না। তোমার চোখই তো পেয়েছে মনে হচ্ছে।’
রেনু হাসেন। বলেন, ‘ওর দাদি বলে ছোটবেলায় খোকা একদম এই রকমই ছিল দেখতে
মুজিব বলেন, ‘আজকা রাতে আর তাহলে যাই না। কাল যাব। ভোরবেলা উঠেই যাওয়া লাগবে। লিডারের কোনো খবর পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে আমার করাচি যাওয়া লাগবে।
.
মুরগি ধরা হচ্ছে। বাড়ির রাখাল-মাঝি সব উঠোন ঘিরে ধরেছে। তারা একটা লাল মোরগ টার্গেট করেছে। ওটার ওপর এখন ঝাঁপিয়ে পড়া হবে। হায়দার আলী তার খ্যাপ মারা জালটা নিয়ে এক কনুইতে মেলে ধরে দুহাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। মোরগের ওপরে জাল নিক্ষেপ করা হবে।
জাল ছোড়া হলো বটে, কিন্তু লাল মোরগটা উড়ে গিয়ে উঠে গেল ঘরের চালে। তাই দেখে হাসু হাততালি দিয়ে ওঠে।
.
ভোরবেলাতেই নৌকায় ওঠেন মুজিব। গৃহকর্ম তাঁর কাজ নয়। রেনুও হাসিমুখেই তাঁকে বিদায় দেন ঘাটে এসে। হাসু আর কামালকে চুমু দিয়ে মুজিব উঠে পড়েন নৌকায়।
নৌকা চলতে শুরু করে। বাইগারি খাল থেকে কাটা গাঙ, তারপর মধুমতী। ভোর হচ্ছে। শরতের ভোর। পুব আকাশ ফরসা করে সূর্য উঠছে। এক ঝাঁক বক এসে বসছে নদীর ধারে। নদীর ধারে ধানখেত। আমন ধানে শিষ আসছে। মাছরাঙা রঙিন পাখা মেলে পুরো প্রভাতটাকেই রঙিন করে তুলেছে।
মুজিব বাংলা মায়ের এই রূপ দেখে মুগ্ধ হন—আপন মনেই বিড়বিড় করতে থাকেন :
‘চলিতে চলিতে পথে হেরি দুই ধারে,
শরতের শস্যক্ষেত্র নত শস্যভারে
রৌদ্র পোহাইছে।’
কবিতাটার কথা মনে করে মুজিব আশ্চর্য হলেন। এই কবিতায় রবিবাবু যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার সবই মিলে গেছে তাঁর আজকের বিদায়পর্বটির সঙ্গে।
গিয়েছে আশ্বিন। পূজার ছুটির শেষে
ফিরে যেতে হবে আজি বহুদূর দেশে
সেই কর্মস্থানে। ভৃত্যগণ ব্যস্ত হয়ে
বাঁধিছে জিনিস-পত্র দড়াদড়ি লয়ে—
হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি এ ঘরে, ও ঘরে।
ঘরের গৃহিণী, চক্ষু ছলছল করে,
ব্যথিছে বক্ষের কাছে পাষাণের ভার—
তবুও সময় তার নাহি কাঁদিবার
একদণ্ড-তরে। বিদায়ের আয়োজনে
ব্যস্ত হয়ে ফিরে, যথেষ্ট না হয় মনে
যত বাড়ে বোঝা।
সত্যি, কী কী সব যে দিয়েছে রেনু বোঝা বেঁধে! মায় চুলকানির ওষুধ পর্যন্ত। নারকেল, সরষের তেল, পাটালি গুড়, গব্যঘৃত।
তারপর রেনুও হাসিমুখে বিদায় দিচ্ছেন। মা-ও বলছেন, ‘ভালো থেইকো, বাবা’, তখন হাসু, যে কথাই বলতে শেখেনি ভালোমতো, বলে উঠল, ‘আব্বা যাবে না। আব্বা যাবে না।
ওরে মোর মূঢ় মেয়ে,
কে রে তুই, কোথা হতে কী শকতি পেয়ে
কহিলি এমন কথা এত স্পর্ধাভরে
‘যেতে আমি দিব না তোমায়’! চরাচরে
কাহারে রাখিবি ধরে দুটি ছোটো হাতে
গরবিনি, সংগ্রাম করিবি কার সাথে…
যেতে তবু দিতে হয়েছে হাসুকে।
এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত ছেয়ে
সব চেয়ে পুরাতন কথা, সব চেয়ে
গভীর ক্রন্দন ‘যেতে নাহি দিব’। হায়,
তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।
‘কর্তা, হাওয়া ছেইড়েছে ভালো, পাল তুলে দিব।’ সমীর মাঝি বলে। মুজিব সংবিৎ ফিরে পান। তাঁর চোখে জল। তিনি চশমা খুলে চোখ মোছেন। ‘দাও, পাল তুলে দাও।’
.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনের আমতলায় বসে ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বলাবলি করে, দুই বছরের হাসু যেতে দিতে চায়নি তার আব্বাকে, আর সেই মেয়েটিকেই আর একটি মাত্র ছোট বোনসমেত একদিন বহন করে চলতে হবে পুরো পরিবারকে যেতে দেওয়ার বেদনার পাষাণভার। সে আজ থেকে ২৬ বছর পরে। তারপর তার বাকিটা জীবন।
৪৪.
আশ্বিন বিদায় নেয়। কার্তিক আসে। রমনার ঘাসের ডগায় শিশির জমে ভোরবেলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শিরীষ গাছগুলোর শীর্ষে বসে থাকা গগনচিলের পাখায় শেষ শরতের আলো পড়ে। শিশির আর শিউলিপতনের শিরশির শব্দ শোনা যায় স্বামীবাগে, চামেলিবাগে। শিশির জমে ধোলাইখালের পাড়ে ঢোলকলমির ঝাড়ে, পল্টনের আল বিছানো পথের ধারে চোরকাঁটার ডগায়। শিশির টলমল করে ধানমন্ডিতে সবুজ ধানের ডগায়। শান্তিনগর থেকে নবাবপুর রওনা হওয়ার আগে লোকে বিদায় নেয়, দোয়া করবেন, ঢাকা যাচ্ছি, পানা পুকুরের কচুরিপানার বেগুনি ফুলের পাপড়ি শিশিরের আর্দ্রতায় রোদের আদরে পথিককে মাথা নেড়ে বিদায় জানায়।
হাতি ঠেলা যায়, কার্তিক তো ঠেলা যায় না। বিশাল বাংলাকে ঢেকে দেয় যেন এক শকুনির পাখার ছায়া, তার নাম আকাল, তার নাম খাদ্যাভাব। পুরো উত্তরবঙ্গে মঙ্গার করালগ্রাস। দক্ষিণবঙ্গজুড়ে হা-অন্ন রব।
জিনিসপত্রের দাম বেশি, তার ওপর পাওয়াও যায় না। খাজা নাজিম উদ্দিন গভর্নর জেনারেল করাচিতে, লিয়াকত আলী খান প্রধানমন্ত্রী, ওদের ভাষায় উজিরে আলা, পূর্ব পাকিস্তানে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন—তাঁরা কর্ডন প্রথা করেছেন, এক জেলার উদ্বৃত্ত খাদ্য আরেক জেলায় তাঁরা যেতে দেবেন না, এর প্রতিবাদে প্রদেশজুড়ে কত মিছিল-মিটিং!
খুলনা জেলাতেই মারা গেছে ২০ হাজার মানুষ, আওয়াজ উঠেছে। শেখ মুজিবের মাথা গরম হয়ে যাওয়ার উপক্রম। বাংলার মানুষ কি কেবল দুঃখই পাবে, কষ্ট স্বীকার করে যাবে! আর পাঞ্জাবি লিয়াকত খান প্রধানমন্ত্রিত্ব ফলাতে আসবেন ঢাকায়? ফুড কনফারেন্স করবেন?
চার মাস আগে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী জনসভা ডেকেছেন আরমানিটোলা ময়দানে। খাদ্যসংকটের প্রতিবাদে এ জনসভা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে এ জমায়েত।
সরকার-সমর্থক দৈনিক আজাদ লেখে, খাদ্যসংকট যখন প্রায় দূরীভূত হয়েছে, এমতাবস্থায় উজিরে আলা নবাবজাদা লিয়াকত আলী খানের পূর্ববঙ্গ সফরে বিঘ্ন সৃষ্টিই ওই দলের ওই জনসভার উদ্দেশ্য।
এর আগে যতবার আওয়ামী মুসলিম লীগ বা সোহরাওয়ার্দী-সমর্থক মুসলিম লীগ জনসভা আয়োজনের চেষ্টা করেছে, পুরান ঢাকার স্থানীয় উর্দুভাষী গুন্ডাদের লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিংবা শাহ আজিজের নেতৃত্বে মুসলিম লীগাররা এসে সভামঞ্চ ভাঙচুরের চেষ্টা চালিয়েছে।
শেখ মুজিব এখন কারাগারের বাইরে। তিনি যখন কারাগারে ছিলেন, সে সময় আরমানিটোলা ময়দানে আয়োজিত ভাসানীর জনসভার চেয়ার- টেবিল ইত্যাদি ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করে মঞ্চে উঠে বাঁদরনাচ নেচে গেছে শাহ আজিজ। সেদিন মুজিব কারান্তরালে ছিলেন, তাই শাহ আজিজ এই স্পর্ধা দেখাতে পেরেছিল। আজ আসুক দেখি!
মুজিব আজ প্রস্তুতি নিচ্ছেন আরমানিটোলার জনসভা সফল করতে। বাধা আসবে যেখানে, লড়াই হবে সেখানে। সোহরাওয়ার্দী-সমর্থক মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মীদের মুজিব আগে থেকেই প্রস্তুত থাকতে বলে দিয়েছেন। সকাল থেকেই বিপুলসংখ্যক কর্মী প্রস্তুত হয়ে আছে মঞ্চের চারদিকে। তাদের বলেছেন, হাতে পোস্টার রাখবে। পোস্টারে লেখা থাকবে, অন্ন দাও, বস্ত্র দাও, নইলে গদি ছেড়ে দাও। পোস্টারগুলো বাঁধা থাকবে গজারি কাঠের শক্ত লাঠির মাথায়। আক্রমণ এলে পোস্টারগুলো সব লাঠি হয়ে যাবে। মুজিবের চোয়াল শক্ত, বাহুর পেশি টানটান। গোপালগঞ্জের চরের লাঠিয়ালদের ঘূর্ণমান লাঠির শনশন আওয়াজ তাঁর মাথার মধ্যে গুঞ্জরণ তুলেছে। কুষ্টিয়ায় মুসলিম ছাত্রলীগের সম্মেলনে শাহ আজিজকে যে মুষ্ট্যাঘাতটা করেছিলেন, সেটা মনে করেন। ফরিদপুরে মুসলিম লীগের সম্মেলনে কিংবা কলকাতায় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্মেলনে বহুত গুন্ডার মোকাবিলা করেছেন মুজিব। এসব গুন্ডাদলের মনোবল বলতে কিছুই থাকে না। একবার তুমি বুক চিতিয়ে দুই বাহু বিস্তার করে রুখে দাঁড়াও, ‘খবরদার’ বলে হুংকার ছাড়ো, দেখবে, সব কুকুরের মতো লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছে।
মোল্লা জালাল উদ্দিন এখন ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। তিনি বিষয়টি বুঝে নিয়েছেন। আজকের জনসভা কিছুতেই ভণ্ডুল করতে দেওয়া যাবে না শাহ আজিজ ও তার গুন্ডাদলকে। তাদের রুখতে হবে। ছাত্রলীগের কর্মীরা প্রস্তুত হও।
মন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী গুন্ডা ভাড়া করেছেন জনসভায় আক্রমণ করার জন্য। খবর আসে। কর্মীরা ঘিরে আছে পুরো মাঠ।
সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়তে থাকে। আর পুব দিকে নিজেদের ছায়া ফেলে আসতে থাকে মানুষ, বিক্ষুব্ধ মানুষ, কষ্টভোগী মানুষ, একে একে। জনসভা শুরুর আগেই ময়দান লোকে ভরে যেতে লাগল। গুন্ডারা এল সেই সময়, যখন আরমানিটোলা মাঠের ধারের লম্বা পাকুড়গাছটার ছায়া হলুদ রোদে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। তার নিচে এরই মধ্যে হাজার খানেক লোক উপস্থিতও হয়েছে।
গুন্ডাদের দেখেই লাঠিতে বাঁধা পোস্টারগুলো হাতে নিয়ে ছাত্রকর্মীর দল স্লোগান ধরল ‘গণবিরোধী লিয়াকত খান, ফিরে যাও পাকিস্তান’। সেই স্লোগানে কণ্ঠ মেলাল উপস্থিত জনতা। গুন্ডারা দেখল, এখানে হামলা করতে গেলে হাড্ডি আর মাংস আলাদা করে নিয়ে তারা বাড়ি ফিরতে পারবে না। তারা কেটে পড়ল।
মাথায় বেতের টুপি, পরনে লুঙ্গি, গায়ে পাঞ্জাবি—ভাসানী এলেন। সঙ্গে আচকান পরা আওয়ামী মুসলিম লীগের সহসভাপতি আতাউর রহমান খান, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। মুজিবুর রহমান এলেন তখনই, যেন শূন্য থেকে, জাদুকরের হাতের কারসাজিতে যেমন শূন্য থেকে বেরিয়ে আসে কবুতর, ফুলের গুচ্ছ, রঙিন ছাতা। তিনি আসলে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে চলেছেন। তিনি যেখানেই যান, সরকারের বিরুদ্ধে বক্তৃতা করতে শুরু করেন, লোক জমে যায়, তিনি মিছিল করতে শুরু করেন, পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে তাঁর মিছিল প্রতিরোধ করতে যায়। তাঁর বিরুদ্ধে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের একাধিক মামলা পড়েছে এরই মধ্যে। মুজিবুর রহমানের গায়ে শার্ট, কলারওয়ালা, দুই পকেট, পরনে পায়জামা।
সভার কাজ শুরু হলো।
শামসুল হক, আতাউর রহমান খান ভাষণ দিলেন। কিন্তু জনতা ‘শেখ মুজিব’, ‘শেখ মুজিব’ বলে চিৎকার করতে লাগল। শেখ মুজিব এরই মধ্যে প্রবল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। তিনি যেখানে যান, সেখানেই ভিড় লেগে যায়। এর মধ্যেই জনতা জেনে গেছে, এই ২৯-৩০ বছর বয়সী যুবক ভাষণ দেন চমৎকার। ভাসানী বললেন, ‘ঠিক আছে, এবার শেখ মুজিবুরের ভাষণই তাইলে শোনেন।’
শেখ মুজিব বললেন, ‘একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে খুন করলে কী হয়? খুনির ফাঁসি হয়। এখন নুরুল আমিন দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছেন, হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছেন দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে? তাহলে তাঁর শাস্তি কী হওয়া উচিত?’
জনতার মধ্য থেকে চিৎকার ওঠে, ‘নুরুল আমিনকে এই মাঠে এনে গুলি করা উচিত।’
শেখ মুজিব বলেন, ‘শোনেন নুরুল আমিন, জনতার রায়। লজ্জাশরম কিছু থাকলে এখনই পদত্যাগ করেন।’
জনতা চিৎকার করে ওঠে ‘নুরুল আমিন গদি ছাড়ে।, ভাত দাও কাপড় দাও, নইলে গদি ছেড়ে দাও’।
মুজিবের ভাষণ শেষে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ভাষণ দিতে শুরু করেন।
তাঁর ভাষণে বাংলার নিরন্ন মানুষের হাহাকার ধ্বনিত হতে থাকে ময়দানজুড়ে। শকুনির ছায়া দেখতে পায় প্রত্যেক মানুষ। মানুষের শোককে তিনি অচিরেই পরিণত করেন ক্ষোভে। ঘোষণা করেন, ‘এবার আমরা মিছিল করে যাব গভর্নর হাউসের দিকে, লিয়াকত আলী খানকে ঘেরাও করব।’
মিছিল শুরু হয়। ভাসানী, শামসুল হক, মুজিব সামনে। এরই মধ্যে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে গভর্নর হাউসের আশপাশের এলাকায়।
মিছিল নাজিরাবাজার রেলক্রসিংয়ের কাছে এলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে শুরু করে। লাঠিচার্জ করে। মওলানা ভাসানী আর শামসুল হককে গ্রেপ্তার করে।
মুজিব জানতেন, তাঁর ওপর হুলিয়া আছে। পুলিশ যেকোনো সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারে। তিনি মুহূর্তেই সেখান থেকে সটকে পড়েন। রাতে যান মোগলটুলির পার্টি অফিসে। অনেকেই পুলিশের লাঠির আঘাতে মারাত্মক আহত। ডাক্তার করিমকে ডেকে আনা হয়। তিনি আহতদের ব্যান্ডেজ করেন। ওষুধ দেন।
মুজিব জানেন, ভাসানী গ্রেপ্তার হয়েছেন। শামসুল হকও। এ অবস্থায় যুগ্ম সম্পাদকের ধরা দেওয়া চলে না।
তিনি দুজন কর্মীকে দায়িত্ব দেন বাইরে সার্বক্ষণিক নজর রাখার। পুলিশ দেখলেই তারা আওয়াজ দেবে। ভোরবেলা সবে যখন এই পরিশ্রান্ত কর্মীদের চোখ একটু ধরে এসেছে, তখনই প্রহরারত কর্মীদ্বয় এসে মুজিবের শরীরে ধাক্কা মারে, ‘মুজিব ভাই, ওঠেন ওঠেন। আইয়া পড়ছে।’ দোতলার বারান্দা থেকেই পাশের বাড়ির ছাদে যাওয়ার পথ তাঁরা দেখেই রেখেছিলেন। শেখ মুজিব, আবদুল মতিন, শওকত আলী, এমনকি গ্রেপ্তার এড়াতে এখানে এসে আশ্রয় নেওয়া ইয়ার মোহাম্মদ সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির পেছনের বারান্দা থেকে প্রথমে পাশের বাড়ির ছাদে, সেখান থেকে দেয়াল টপকে চলে যান মৌলভীবাজারের দিকে।
পুলিশ বাড়িতে আসে। বাড়ি তল্লাশি করে শেখ মুজিব আর শওকতের খোঁজে। না পেয়ে তারা চলে যায়।
দিনের বেলা পুলিশ রিপোর্ট লেখে :
‘একটা সূত্র থেকে খবর পেয়ে ১৫০ মোগলটুলির ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম লীগ অফিস ভোর চারটা ৩০ মিনিটের দিকে তল্লাশি করা হয়। পার্টির দুজন জঙ্গি সদস্য শেখ মুজিব ও শওকত আলীকে গ্রেপ্তারের উদ্দেশ্যে এ তল্লাশি পরিচালিত হয়। তারা দীর্ঘদিন ধরে গ্রেপ্তার এড়িয়ে যাচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মামলা আছে, সেখানে তাদের পাওয়া যায়নি। কোনো কিছু জব্দও করা যায়নি।’
শেখ মুজিব আশ্রয় নেন ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোল্লা জালাল উদ্দিনের খাজে দেওয়ান নামের আস্তানায়। আবদুল হামিদ চৌধুরী, মোল্লা জালাল উদ্দিন আর অলি আহাদ মিলে বসেন পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে।
সবাই মিলে সাব্যস্ত করা হয়, মুজিব লাহোরে চলে যাবেন। যাবেন লিডার সোহরাওয়ার্দীর কাছে। পরামর্শ করবেন। দিকনির্দেশনা আনবেন। পার্টির খরচ পরিচালনার জন্য তহবিল সংগ্রহও করতে হতে পারে।
পূর্ব বাংলার পুলিশ আর তাঁকে খুঁজে পায় না।
এর পরের রিপোর্ট আসে লাহোর পুলিশের কাছ থেকে, ওখানে শেখ মুজিব কী করছেন না করছেন, পুলিশ রিপোর্ট করতে থাকে।
দুই মাস পশ্চিম পাকিস্তানে থেকে সেখানকার সরকারবিরোধী নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন মুজিব। এমনকি তিনি সেখানে সংবাদ সম্মেলনও করেন। পূর্ব বাংলার দুরবস্থার কথা তুলে ধরেন সাংবাদিকদের সামনে। পাকিস্তানি রাজনীতিটা বুঝতে ওই সফর তাঁকে সাহায্য করেছিল।
১৯৫০ সাল। পয়লা জানুয়ারি। শুভ নববর্ষে পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ একটা চমৎকার উপহার তুলে দিতে পারে সরকারকে।
শেখ মুজিব ঢাকায় গ্রেপ্তার হন।
খাজা তাঁর গানের আসরে বসে সেই খবর লাভ করে খুশিতে নিজেই নাচতে থাকেন। নুরুল আমিন বহুদিন পর আরাম করে ঘুমোন। তাঁদের জানের দুশমন ধরা পড়েছে।
আন্দোলনে ভাটা পড়ে। ভাসানী, শামসুল হক, শেখ মুজিব—তিন গুরুত্বপূর্ণ নেতা জেলে। এখন আন্দোলন পরিচালনা করতে পারেন সহসভাপতি আতাউর রহমান খান, যুগ্ম সম্পাদক খন্দকার মোশতাক। তাঁরা দুজন একটা জুটি বাঁধেন। ওকালতির জুটি। তাঁরা আটঘাট বেঁধে ওকালতি করতে শুরু করলেন।