Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সেই রাত্রি এই দিন

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প102 Mins Read0

    ১-১০. সেই ভয়ংকর ঝড়ের পর

    ০১.

    তারপর, সেই ভয়ংকর ঝড়ের পর সে রাত্রে বৃষ্টি শুরু হল। সেই বৃষ্টিও ভয়ংকর।

    বেড়েই চলেছে মুখরতা, বেড়েই চলেছে গর্জন। জল জল, অবিশ্রান্ত জল। যেন প্রলয়ের বর্ষণ, যেন ঘোষণা করছে পৃথিবীর আজ শেষ দিনে।

    বিছানার মানুষরা ঘুম থেকে জেগে আরও নিবিড় করে গায়ে জড়িয়ে নিচ্ছিল চাদর কম্বল কাপড়, আর ঘনিষ্ঠ হয়ে জড়িয়ে ধরছিল পার্শ্ববর্তী প্রিয়জনের কণ্ঠ, ক্রোড়বর্তী শিশুর দেহ। আর ভয়ে কেঁপে ভাবছিল, এ রাত আর শেষ হবে না। এই বৃষ্টিই পৃথিবীকে পৌঁছে দেবে শেষ দিনে।

    কিন্তু যারা বিছানায় ওঠেনি সে রাত্রে?

    যারা ঝড়ের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল? তারা?

    তারা বুঝি সেই আশাই করছিল,করছিল সেই প্রার্থনা। এ রাত যেন সকাল না হয়, এ বর্ষণ যেন শেষ না হয়। বাড়ুক গর্জন, বাড়ুক বেগ, বাড়ুক আক্রোশ। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক পৃথিবী, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক বিধাতার সৃষ্টির কলঙ্ক কালিমা।

    কলঙ্ক বইকী!

    বর্ষণটা প্রকৃতির, কিন্তু ঝড়ের তাণ্ডবটা যে মানুষের। অথবা পশুর, যে পশু বিধাতারই সৃষ্টি। হয়তো অনুতপ্ত বিধাতা ওই পশুত্বের দিকে তাকিয়ে, আপন সৃষ্টির গ্লানিতে লজ্জায় ধিক্কারে পৃথিবীর উপর যবনিকা টেনে দিতেই চাইছিলেন। হয়তো বা অবিশ্রান্ত বর্ষণে অসতর্কতার কলঙ্ক কালি মুছে দিতে চাইছিলেন। এমন একটা কিছু না হলে অমন ভয়ংকর সময়ে আকস্মিক এমন বৃষ্টি শুরু হবে কেন?

    আকস্মিকই।

    সন্ধ্যার মুহূর্তে জ্যোৎস্না উঠেছিল, দিঘির ধারে ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে বসে জ্যোতি বলেছিল, আজ কী তিথি গো?

    মৃণাল বলেছিল, কে জানে! পঞ্জিকার খবর কে রাখে? তবে পূর্ণিমার কাছাকাছি একটা তিথি হবে বোধহয়।

    বোধহয় চতুর্দশী। মা বলছিলেন কাল বাবা ভাত খাবেন না।

    মৃণাল হেসে বলল, মা বাবা এখানে এসে দিব্যি আছেন, কী বলো?

    আমরাও কিছু খারাপ নেই।

    আহা, আমরা তো ভাল থাকবই। আমাদের ভাল থাকাটা মারছে কে? কলকাতার সেই দশ ফুট বাই বারো ফুট ঘরটাতেই কি দিব্যি থাকি না আমরা? মা-বাবা ওই ঠাসা-গোঁজার মধ্যে কষ্ট পান।

    কষ্ট পান কে বললে?

    বলবার দরকার করে নাকি? রাতদিন ঝগড়াতেই মালুম।

    ঝগড়াটা কিছু নয়, জ্যোতি হেসে ওঠে, দেখতে হবে দুজনে দুজনের থেকে দূরে দূরে থাকছে। কিনা। সেটাই খারাপ। ঝগড়া ভাল জিনিস।

    তাই নাকি? তবে আমাদেরও তো চেষ্টা করে দেখলে হয়! হেসে ওঠে মৃণাল।

    জ্যোতিও হাসে, চেষ্টা করে হয় না। যথাকালে আসে। যেমন চুলে পাউডার ঘষে চুল পাকানো যায় না, পাক ধরলে তবে পাকে।

    অপ্রয়োজনীয় আর অবান্তর সব কথা। দুজনে দুজনের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে থাকবার জন্যে কথা। হয়তো বা অর্থহীনও। কথার জন্যে কথা।

    কে জানে ওই মগ্নতার অবকাশে কখন জ্যোৎস্না গেছে মুছে, কখন আকাশে উঠেছে মেঘ জমে। চমক ভেঙেছে হঠাৎ।

    এই দ্যাখো রাত হয়ে যাচ্ছে, আর বেশিক্ষণ বাইরে থাকলে বাবা বকবেন। জ্যোতি বলে উঠেছে।

    মনে হয় না বকবেন। মৃণাল বলে।

    মনে হয় না?

    উঁহু। আমরা যতক্ষণ বাইরে থাকব, ওঁরা ততক্ষণ দুজনে একলার সুখ উপভোগ করতে পাবেন।

    জ্যোতি এবার বকে ওঠে, এই দেখো, যা-তা বোলো না। গুরুজন না?

    মৃণাল অপ্রতিভ হয় না।

    মৃণাল সহজ গলায় বলে, তাতে কী? গুরুজন বলে কি প্রিয়জন নয়? তবে? প্রিয়জনের সুখ, খুশি, ভালবাসা দেখে খুশি হতে বাধা কোথায়? আমি তো লক্ষ করছি ওঁদের যেন এখানে এসে বয়েসের গা থেকে অনেকগুলো বছর ঝরে পড়েছে। সেদিন কী উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল বাবাকে, যখন মাকে বলছিলেন, এই উঠোনে দুধে-আলতা না কি সেই বসানো হয়েছিল, তুমি এসে প্রথম দাঁড়ালে, মনে পড়ে তোমার? দেখনি লক্ষ করে?

    জ্যোতি মৃদু হেসে বলে, করব না কেন? সে দিন তো আবার চুপি চুপি মা বাবাকে হেসে হেসে বলছিলেন, মনে পড়ে ঘরটাকে? আমাদের ফুলশয্যের ঘর! আমি যাচ্ছিলাম, পালিয়ে এলাম।

    .

    ভালবাসা কখনও বুড়ো হয় না। বলল মৃণাল। পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করল এতক্ষণে, বলল, খাব?

    জ্যোতি ঠেলে দিল ওকে, আহা, অনুমতি নেওয়া হচ্ছে।

    তা নেওয়াই তো উচিত।

    সিগারেটটা ধরিয়ে নিয়ে একটু বুঝি গম্ভীর গলায়, একটু বুঝি আবেগের গলায় বলে ওঠে, আমরা কিন্তু বুড়ো হয়ে পরে কোথাও দাঁড়িয়ে বলতে পারব না, দেখ, তোমার মনে পড়ে এই ঘরে আমাদের ফুলশয্যা হয়েছিল

    জ্যোতিও গম্ভীর হয়। তবু হালকা গলায় বলে, তা হলে সেই করুণাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ের বিল্ডিংটায় গিয়ে ঠেলে উঠতে হয়।

    যা বলেছ! সিগারেটটা শুধু হাতে জ্বলতে থাকে।

    জ্যোতি বলে, অথচ তোমাদের এতবড় বাড়ি রয়েছে। যাই বলল, বিয়েটিয়ে ভিটেয় এসে দেওয়াই উচিত। শুধু তো ঘটা করাই বিয়ে নয়! এই যে এখানে এসে মনে হচ্ছে সাতপুরুষ ধরে তোমার পূর্বপুরুষরা এখানে বাস করে গেছেন, তোমার পিতামহীরাও এই উঠোনে দুধে-আলতার পাথরে দাঁড়িয়েছেন, এই লক্ষ্মীর ঘরে বসে লক্ষ্মীর কথা শুনেছেন, এতে কীরকম যেন একটা রোমাঞ্চ রোমাঞ্চ লাগছে না?

    শুনে লাগছে বটে!

    না-শুনে কিছু মনে হচ্ছে না?

    মৃণাল হাসে, একেবারে কিছু না বলা চলে না। সত্যি বলতে, বাবার সেদিনের কথাটা শুনে ঈষৎ আক্ষেপ হচ্ছিল।…মনে হচ্ছিল স্মৃতির জায়গা একটু থাকা ভাল। কিন্তু দায়ী আমিই। বাবা একবার কথা তুলেছিলেন, বিয়ের আনুষঙ্গিক পুজো-টুজোগুলো ভিটেয় এসে হোক, আমি যখন একমাত্র ছেলে। আমিই উড়িয়ে দিলাম। বললাম, এত বচ্ছর দেশ-ছাড়া, এখন কিনা এই ভাঙা বাড়িতে–

    ভাঙা এমন কিছু না, তেমনি কী বিরাট! কত ঘর, কত বড় দালান, আর এই দিঘি, বাগান! যাই বলল, ভাবলে অবাক লাগে এসব তোমাদের নিজেদের।

    আমাদের শুধু? তোমার নয়?

    আচ্ছা বাপু না হয় আমাদেরই। অথচ আমরা সেই দুখানা ঘরের ফ্ল্যাটে পড়ে আছি। বাড়িটা যদি কোনও বৈজ্ঞানিক কলকৌশলে তুলে নিয়ে যাওয়া যেত

    মৃণাল হেসে ওঠে, চেষ্টা করে দেখলে হয়। বিজ্ঞান যা-সব কাণ্ড করছে। তবে নিয়ে গিয়ে স্থাপন করবে কোথায় সেই ভাবনা। এক যদি মাথায় করে বেড়াতে পারো।

    না না, তুমি যাই বলল, ভীষণ আক্ষেপ হচ্ছে আমার এই অপচয়ে। আচ্ছা তোমরা কতদিন আসনি?

    মৃণাল বলে, বহুকাল। সেই তো কবে ছেলেবেলায়! ওই আর কি, দেশ ভাগের বেশ আগে থেকে দেশ-ছাড়া। পরে বাবা এক-আধবার এসেছেন, আর মোটেই নয়। যা বর্ডারে, চলেই তো যাচ্ছিল প্রায় ওদিকে, নেহাত ভাগ্যের জোরে এ ভাগে পড়ল শেষ অবধি। তাও প্রথম দিকে ঝামেলা কম ছিল না। নেহাত এ-যাবৎ জ্যাঠামশাই ছিলেন, তাই বেদখল হয়নি, নয়তো হয়ে বসত। জ্যাঠামশাই মারা গেলেন, এখন

    এখন আমরা দখলে রাখব– জ্যোতি দৃঢ়স্বরে বলে, সত্যি বলব, বিয়ে হয়ে পর্যন্ত আমার ঝোঁক ছিল এখানে একবার আসবার। পাড়া-গাঁ কখনও দেখিনি।

    তা বলতে কী, তোমার জেদেই আসা হয়ে উঠল। এখন কিন্তু সত্যিই ভাল লাগছে, আর আফশোস হচ্ছে এতদিন না-আসায়।

    আর কদিন ছুটি আছে তোমার? জ্যোতি বলে আলগা গলায়।

    আর কবার জিজ্ঞেস করবে কথাটা? মৃণাল হেসে ওঠে, পরশুই তো যেতে হবে।

    আমরা আবার আসব কিন্তু।

    এলেই হয়। কতই বা দূর, কতই বা খরচ!

    অথচ কুড়ি বছর আসনি। তার মানে দেশকে ভালবাস না।

    দেখ জ্যোতি, ভালবাসি না বললে ঠিক বলা হয় না। কিন্তু অনেক ভালবাসা আমাদের মনের গভীরে ঘুমিয়ে থাকে, ব্যবহারিক জগতে টেনে না আনা পর্যন্ত তাকে চেনা যায় না।

    জ্যোতি হঠাৎ বলে ওঠে, না-ভালবাসাটাও হয়তো তাই। মনের গভীরে লুকিয়ে থাকে, ব্যবহারিক জগতে টেনে না আনলে বোঝা যায় না এটা আসলে না-ভালবাসা, এতদিন মনে করতাম বুঝি ভালবাসা।

    তোমার থিয়োরিতে আমি আপত্তি করছি। মনে হচ্ছে আমার কিছু ভয় করবার কারণ ঘটছে। হয়তো শুনব তোমার ভালবাসাটা স্রেফ না-ভালবাসা।

    ইস, তাই বইকী! জ্যোতি বলে উঠেছিল, ঢং রাখো! কিন্তু সত্যি, এই বাড়িটা নিয়েই এসব কথা মনে হচ্ছে আমার। বাবা যখন এ বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে আস্তে আস্তে হাত বুলোন, মেঝেয় পা ঘষে ঘষে পা ফেলেন, পুরনো জানলাগুলো আস্তে ঠুকে ঠুকে দেখেন, মনে হয় যেন বুকভরা ভালবাসা নিয়ে করছেন এসব। অথচ এতদিনে একবারও আসতে ইচ্ছে হয়নি, সারাতে ইচ্ছে হয়নি। আবার যখন কলকাতায় ফিরে যাওয়া হবে, হয়তো একেবারে ভুলে যাবেন এখানে ওঁর এতখানি ভালবাসার বস্তু পড়ে আছে। তার মানেই চোখের আড়ালে গেলেই মনের আড়ালে।

    সর্বনাশ! ইতিমধ্যেই এত.কথা ভাবা হয়ে গেছে? মৃণাল ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলে, ভাবনাটা একটু কম করো গিন্নি! মানুষ অবস্থার দাস, এইটাই হচ্ছে সার কথা! এখানে আনন্দ ছিল, সেই আনন্দটার উপর এসে চেপে বসল আতঙ্ক। সেই আতঙ্কই যে এদিকে তাকাতে দেয়নি। এখন আতঙ্কটা কিছু কমেছে, তাই আসা গেল। নইলে কেবলই তো জ্যাঠামশাইয়ের চিঠিতে পাড়াপড়শির গোরু চুরি আর জরু চুরির খবর বার্তা যেত।

    জ্যোতি এবার হেসে ফেলে, দুটো বস্তু প্রায় একই পর্যায়ের, কী বলে?

    যাদের ভাষা ওটা তাদের কাছে নিশ্চয়ই। আমাদের সভ্য বাংলা ভাষায় অমন কুশ্রী একটা উদাহরণ পাবে না।

    জ্যোতি গাঢ় গলায় বলে, আচ্ছা, এখনও কি আতঙ্ক আছে?

    মৃণাল হেসে ওঠে, কেন বলো তো, এখানেই বসবাস করবে ঠিক করছ নাকি?

    আহা, আমি যেন পাগল! আমার ইচ্ছে, এটাকে সারিয়ে-টারিয়ে আমাদের ছুটিতে চেঞ্জে আসবার জায়গা করব। মা-ও এ পরিকল্পনায় খুশি। বলেন, তোমরা এলে আমারও একটু আসা হয়। তবে বাবা কী বলছিলেন জানো?

    জ্যোতি হেসে ওঠে, বাবার উপমাটি বেশ। বলছিলেন, খরচপত্র করে সারিয়ে আর কী হবে বউমা, এসব জায়গা পড়ে আছে যেন বেড়ালের সামনে ঢাকনা খোলা মাছের মতো। কখন যে থাবা বসায়।

    মৃণাল বলে, তুমি বুঝি সারানোর জন্যে বায়না করেছ?

    করেছিই তো। এখানটা যে কী ভাল লেগেছে আমার! মনে হচ্ছে যেন এর সঙ্গে কী এক আকর্ষণে বাঁধা পড়ে গেছি!…মনে হচ্ছে–

    আচ্ছা কল্পনাময়ী, তোমার এই ভগ্নপ্রাসাদে এসে আরও কী কী মনে হচ্ছে পরে শোনা যাবে। রাত্রে তো আর ঘুমের পাট নেই? এখন চলল। জ্যোৎস্না তো কখন বিদায় নিয়েছে। খেলা করিনি, চলো, চলল।

    উঠে পড়েছিল মৃণাল। জ্যোতিও উঠেছিল।

    হঠাৎ নিথর নিস্তব্ধতার উপর আচমকা একটা গোলমালের ধাক্কা লাগল।

    একটা আর্তনাদ! অনেকটা উল্লসিত গর্জন! অশুভ শব্দ! অশুভ স্বর!

    কী এ!

    জ্যোতি ভয়ে মৃণালকে জড়িয়ে ধরে, কী! কী! কীসের হল্লা?

    মৃণালও ভয় পায় বইকী!

    এ হল্লা যে বহুবারের চেনা। তবু সাহসে ভর করে বলে, বুঝতে পারছি না, হঠাৎ কোথাও কেউ মারা-টারা গেল নাকি?

    ওরা ছুটতে থাকে দিঘির পাড় থেকে বাড়ির দিকে।

    আর শুনতে পায় একসঙ্গে দুটো গলা তারস্বরে ডাক দিচ্ছে–মৃণাল…বউমা!

    ভাঙা-ভাঙা ভয়-পাওয়া গলা।

    ভয়ই পেয়েছেন।

    ওঁরাও ওই আচমকা হল্লা আর আর্তনাদ শুনতে পেয়েছেন। ভক্তিভূষণ আর লীলাবতী। ওঁরা তাই ওঁদের একমাত্র অবলম্বন আর একমাত্র ভরসাকে ডাক দিচ্ছেন–মৃণাল..বউমা!

    .

    ০২.

    মৃণাল বলেছিল ভালবাসা বুড়ো হয় না। ওটা ওর ভুল ধারণা। ভালবাসাও বুড়ো হয় বইকী! সেই বার্ধক্য ধরা পড়ে চাঞ্চল্যে, উৎকণ্ঠায়, অস্থিরতায়। বুড়ো হয়ে যাওয়া ভালবাসা দুজনে একলা নিমগ্ন হয়ে থাকতে বেশিক্ষণ পারে না! আশেপাশে তাকায়, দেখে নেয় সব ঠিক আছে কিনা।

    লীলাবতীও দেখছিলেন।

    দুজনে পুরনো পালঙ্কে বসে পুরনো দিনের স্মৃতিরোমন্থন করতে করতেও উঠে উঠে দেখে আসছিলেন, রান্নাঘরের দরজায় শিকল নড়ার মতো শব্দ হল কেন? কোথায় একটা বেড়াল লাফাল যেন।…মৃণালের ঘরটা বন্ধ করে গেছে, না হাট করা পড়ে আছে? উঠোনের দড়ি থেকে শুকনো কাপড়গুলো তোলা হয়েছে কিনা।

    আর ভক্তিভূষণ বারবার সদরের কাছে ঘুরে আসছিলেন ওরা ফিরছে কিনা দেখতে।

    প্রত্যেকবারই ফিরে এসে বলেছেন, গেল কোথায়? বলে গেছে কিছু?

    বললাম তো–লীলাবতী উত্তর দিয়েছেন, বলে গেল, এই একটু চাঁদের আলোয় ঘুরে আসি। এত দেরি করবে কী করে জানব?

    চাঁদের আলোয় ঘুরে আসি! আশ্চর্য! অজানা-অচেনা জায়গা, সাপ-খোপ আছে কিনা ঠিক নেই, নাঃ, ভাবালে!

    লীলাবতী বারকয়েক বলেছেন, শুধু শুধু অত ভাবছ কেন? এই তো দুদিন গেলেই ছুটি শেষ! বেড়াতেই তো এসেছে। দিনের বেলা রোদের জ্বালায় বেশি বেড়াতে পারে না তো।…তাই ভাবছি কাল কত বদলায়! আমাদের আমলে ঘোমটা দিয়ে ভিন্ন ঠাকুরদালানে যাবার হুকুম ছিল না, রাস্তা তো দূরস্থান!

    তখন দেশে লোক কত! সাতটা বাড়িতে জ্ঞাতি-গুষ্টি ভরা।

    লীলাবতী একবার অতীতে নিমজ্জিত হন, মনে আছে তোমার, একবার তোমাতে আমাতে অনেক রাত্তিরে ছাতে উঠেছিলাম, তাই নিয়ে কী টি-টি!

    ভক্তিভূষণ অবশ্য মনে করতে পারেন না।

    বলেন, তা হবে। কিন্তু এরা তো দেখছি ভাবনায় ফেলল। বউমাটির তো সবই ভাল, বড্ড বেহুশ, এই দোষ।

    লীলাবতী বউয়ের সপক্ষে হন, ও ছেলেমানুষ, কখনও মাঠ-ঘাট বাগান-পুকুর দেখেনি, দেখছে আর বিগলিত হচ্ছে। মৃণালেরই উচিত।

    সহসা কথা থামালেন। সহসা কানখাড়া করলেন।

    চমকে বললেন, কী হল? কী ও? কোথায় গোলমাল?

    ভক্তিভূষণ আরও চমকালেন। ভক্তিভূষণ বাইরের দরজার দিকে ছুটে গেলেন। এই জীর্ণ প্রাসাদটার শূন্য ঘরগুলো থেকে যেন একটা ভয়ের ঝাপ্টা হা-হা করে বয়ে গেল। মিশে যেতে লাগল কোন এক নারকীয় কোলাহলের সঙ্গে।

    ভক্তিভূষণ দরজাটা খুলে ধরে চেঁচাতে লাগলেন, মৃণাল বউমা!

    বেরিয়ে যেতে পারলেন না। লীলাবতীকে একা ফেলে যাবার কথা ভাবতে পারলেন না। শুধু গলাটাকে যতটা সম্ভব বাড়িয়ে আর স্বরটাকে যতদূর সম্ভব চড়িয়ে ডাক দিতে লাগলেন, মৃণাল বউমা!

    লীলাবতীও সরে এসেছেন, স্বামীর কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছেন, আর্তনাদ করছেন, মৃণাল-বউমা!

    .

    ০৩.

    তারপর বাড়তে লাগল সেই আর্তনাদ।

    সংক্রামক রোগের মতো ছড়াতে লাগল সারা পাড়ায়, সমস্ত পাড়াটা জুড়ে আর্তনাদ যেন আছড়া-আছড়ি করতে লাগল।

    যেন পণ করেছে আকাশ বিদীর্ণ করবে, সমস্ত পৃথিবীকে জানাবে লুঠেরা এসেছে। লুঠ করছে জরু গোরু। লুঠ করছে সম্মান সম্ভ্রম, শান্তি শৃঙ্খলা।

    যারা নিশ্চিন্ত শান্তির নিশ্বাস ফেলে ভেবেছিল আর কোনও ভয় নেই, তাদের সেই নিশ্চিন্ততার উপর এসে পড়েছে জ্বলন্ত মশাল। কে জানে কোথায় কে সলতে জ্বেলে দিয়েছে বারুদঠাসা কামানে!

    কে বলতে পারে বারুদই বা ঠাসা থাকছে কেন কামানে?

    কেউ বলতে পারবে না, কেন এখনও এত আগুন, কেন অব্যাহত এই বর্বরতার নমুনা?

    কেউ জানে না, কী থেকে কী হয়। শুধু চোখ মেলে দেখে-ঘর জ্বলছে, শস্যের সম্বল জ্বলছে, জীবনের পরম সঞ্চয়গুলি জ্বলে যাচ্ছে।

    .

    ০৪.

    কিন্তু এ আগুন কি ইতিহাসের পাতায় কলঙ্করেখা এঁকে রাখবে?

    রাখবে না। অত বেশি পাতা নেই ইতিহাসের খাতায়। শুধু হয়তো খবরের কাগজের পাতার কোনও একটি কোণে ঠাঁই নেবে, স্থানীয় সংবাদদাতার পত্রে, সীমান্ত এলাকায় কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ব্যতীত অবস্থা শান্ত আছে।

    সেই বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলির তীক্ষ্ণ দাঁত কী কী ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করল, তা জানবার গরজ সংবাদদাতার নেই। কারই বা জানতে গরজ!

    মৃণালের জ্যাঠামশাই যখন মাঝে মাঝে পাড়ার লোকের জরু গোরু লুঠ হওয়ার সংবাদ দিতেন, মৃণাল কি জানতে উৎসুক হত কে তারা? কোথায় গেল তারা?

    শ্মশানে তো চিতা প্রত্যহই জ্বলে, উদয়াস্তই জ্বলছে, তার জন্যে কি সবাইয়ের বুক জ্বলছে? বিচ্ছিন্ন ঘটনা বিচ্ছিন্নই থাকে।

    জ্যোতি নামের একটুকরো আলো, একটুকরো ঔজ্জল্য যে খসে পড়ল মৃণাল নামের প্রাণটা থেকে, লীলাবতী আর ভক্তিভূষণের ভালবাসা দিয়ে গড়া একখানি ছবির মতো সংসার থেকে, এ শুধু ওরাই জানল।

    আরও অনেককে জানাবার জন্যে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে, তারও উপায় থাকল না। কারণ, তারপর, সেই ঝড়ের পর বৃষ্টি শুরু হল।

    অনুতপ্ত সৃষ্টিকর্তার অশ্রুজলের মতো!

    কিন্তু বিধাতার অনুতাপ বোধ করি মাতালের অনুতাপের মতোই অস্থায়ী। তাই যারা প্রার্থনা করছিল, আজকের রাত যেন আর শেষ না হয়, তাদের প্রার্থনাকে ব্যঙ্গ করে যথাসময়ে রাত্রি শেষ হল, আর নির্লজ্জ আকাশ দিব্য চোখ মেলে দেখতে লাগল অসহায় পৃথিবীটাকে কতখানি বিধ্বস্ত করা গেছে। দেখল–

    ভক্তিভূষণের জীর্ণ বাড়িখানা, যে নাকি এই কদিনের হাসি-আহ্লাদ আর আলো-রোদ্দুরের প্রসাদে ঝকমকিয়ে উঠেছিল, সে ওই পর্যাপ্ত বর্ষণে শোকাচ্ছন্ন ক্রন্দনাতুরের মতো পড়ে রয়েছে যেন ধূলিসাৎ হবার অপেক্ষায়। তার মধ্যে তিনটে প্রাণী বসে আছে মূক হয়ে, কেউ কারও দিকে না তাকিয়ে।

    বৃষ্টির গর্জনকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে যে নামটা উচ্চারণ করছিলেন লীলাবতী সারারাত ধরে, সে নামটা যেন কোন এক অলিখিত শাসনে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। দিনের আলোয় সে নাম আর উচ্চারণ করা চলবে না যেন। কেউ যেন না টের পায় ভক্তিভূষণ ঘোষ দুদিনের জন্যে পৈতৃক ভিটেয় বেড়াতে এসে সবচেয়ে দামি জিনিসটা খুইয়ে চোরের মতো পালিয়ে গেল।

    .

    ০৫.

    তোমরা চলে যাও। অন্যদিকে তাকিয়ে প্রেতাহতের মতো উচ্চারণ করে তিনজনের একজন, তা হলে কেউ সন্দেহ করতে পারবেনা। ভাববে সবাই চলে গেছে–গলা ঝাড়ল, থেমে বলল, শুধু আমি আছি, বাড়িটা দেখছি আরও কদিন।

    বলল না, ওকে কেন থাকতে হবে, তবু বোঝা গেল কেন থাকবে।

    বোঝা গেল, ও খুঁজবে, ও প্রতীক্ষা করবে।

    আর একজন অনেকক্ষণ পরে বলল, কে জানে আরও কার কী সর্বনাশ হয়ে গেল!

    বাকি জন বলল, জানা যাবে না। কেউ বলবে না। সর্বস্ব হারিয়ে সহজ হয়ে বেড়াতে চেষ্টা করবে, সেই হারানোর খবরটা লুকিয়ে ফেলবার জন্যে মিথ্যের পাঁচালি গাঁথবে।

    তিনজনই মনে মনে বলল, যেমন আমরা করতে চলেছি।

    আমি যাব না মৃণাল, আমি কোন প্রাণে তোকে ফেলে রেখে চলে যাব?

    বললেন লীলাবতী। বিকৃত বিদীর্ণ গলায়।

    ভক্তিভূষণ বললেন, আজ কারুরই যাওয়া চলে না।

    তারপর খানিকক্ষণ সেই কাদায়-হাঁটু বসে যাওয়া গ্রামের পথে পথে ঘুরে বেড়াবার মতো হাস্যকর পাগলামি করে ফিরে এল দুজনে।

    বাপ আর ছেলে। আধপোড়া কাঠের মতো দেখতে লাগছিল যাদের।

    দেখল, লীলাবতী চুপিচুপি বলছেন, বউমা, বউমা! নিয়তি তোমায় এখানে তাড়িয়ে নিয়ে এল, আমি কেন তখন বুঝতে পারলাম না? তোমার জেদ দেখে কেন ভয় পেলাম না?

    নিয়তি! এতক্ষণে যেন তীব্র ক্ষীণ একটা প্রশ্নের উত্তর পেল মৃণাল। নিয়তি! নিয়তি ছাড়া আর কে? নিয়তি ব্যতীত আর কে পারত বিশ বছর পরে মৃণালকে তার পরিত্যক্ত পিতৃভিটেয় টেনে আনতে? নিয়তি ছাড়া আর কার সাধ্য ছিল, অজানা এই জায়গায় অত রাত পর্যন্ত খোলা আকাশের নীচে বসিয়ে রাখতে মৃণালকে যুবতী স্ত্রীকে পাশে নিয়ে?

    মৃণাল কি জানত না, এখানে নিরাপত্তার অভাব? মৃণাল কি জানত না, ওদের এই গ্রামটা বেড়ালের থাবার সামনে পড়ে থাকা মাছের মতো?

    .

    ০৬.

    মৃণাল জানত সে সব।

    তবু মৃণাল ভয়ানক একটা দুঃসাহসের কাজ করেছে। অতএব নিয়তি! মৃণাল বুঝতে পারছে লীলাবতী আর ভক্তিভূষণ এখন ওর দিকে অভিযোগের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন না, কারণ এখন ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বুক ফেটে যাচ্ছে ওঁদের। কিন্তু তাকাবেন এর পরে।

    প্রথমে নীরব অভিযোগের দৃষ্টিতে, তারপর তীব্র তিরস্কারের রূঢ়তায়।

    ওঁরা বলবেন, তুই! তুই এর জন্যে দায়ী! তুই-ই এই কাজ করলি। তুই যদি রাতদুপুর অবধি বউ নিয়ে দিঘির ধারে বসে থাকতে না যেতিস!

    তখন মৃণাল কপালে হাত ঠেকিয়ে বলতে পারবে, নিয়তি!

    নইলে আত্মহত্যা না করে বেঁচে থাকবে কী করে?

    অথচ বেঁচে থাকতেই হবে।

    জ্যোতির জন্যেই বাঁচতে হবে। জ্যোতির জন্যে অপেক্ষা করতে হবে।

    অপেক্ষা করবে, সন্ধান করবে, আর সেই কলকাতার বাড়ির দশ ফুট বাই বারো ফুট ঘরের সেই জানলার ধারের বিছানাটা থেকে শুরু করে পর পর ঘটনাপঞ্জি সাজিয়ে নিয়ে নিয়তির অমোঘ নির্দেশ দেখবে।

    ঘর অন্ধকার ছিল।

    বালিশের উপর মাথাটা উঁচু করে রেখে জ্যোতি বলেছিল, আমার বাহাদুরির তারিফ করো। বাবাকে রাজি করে ফেলা হয়েছে।

    বাবাকে রাজি? মৃণাল বলেছিল, সে আর শক্ত কী? বউমার ইচ্ছে! এর ওপর তো আর দুবার অনুরোধের প্রশ্ন নেই।

    আহা রে! মোটেই তা নয়। ঢের তুতিয়ে-পাতিয়ে তবে, বুঝলে? বাবার ধারণা আমি নাকি সেখানের অসুবিধে সহ্য করতে পারব না। দেখিয়ে দেবার জন্যেই যেতে হবে আমাকে।

    মার মত করিয়ে নিয়েছ তো?

    মা? শোনো কথা! সে তো আগেই। মাকে মতে না আনিয়ে বাবাকে বলতে যাব?…ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে যাবার মতো বোকা নাকি আমি?

    অন্ধকারে ভাল করে মুখ দেখা যাচ্ছিল না, তবু বোঝা যাচ্ছিল আহ্লাদে মুখটা ঝলসাচ্ছে ওর।

    এ আহ্লাদ কার? অবশ্যই নিয়তির।

    লীলাবতীও তাই বলছেন, ওর আসবার জন্যে পাগলামি দেখে ভয় হচ্ছিল আমার। সত্যবন্দি করিয়ে নিয়েছিলাম পুকুরে চান করবে না। জলের ভয় করেছিলাম আমি, নিয়তি যে আগুন হাতে নিয়ে বসে ছিল তা তো ভাবিনি। আরও কত কথাই বলছিলেন লীলাবতী চাপা শোকের গলায়। কারণ লীলাবতী আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ভক্তিভূষণ কিন্তু তা দিচ্ছিলেন না, মৃণালও না।

    ওদের মাথার মধ্যে খেলছিল, কী ভাবে থানায় খবর দিতে হবে, কীভাবে কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে হবে, আর কীভাবে সন্ধান নিতে হবে কারা এসেছিল লুঠ করতে! কোন পর্যন্ত তাদের গতিবিধি!

    কিন্তু আশা কি সত্যিই ছিল? ওরা কি পৃথিবীকে দেখেনি? দেখছে না? দেখছে প্রতিনিয়তই।

    তবু ওরা জানে, বসে বসে বিলাপ করাটা ওদের পক্ষে বেমানান।

    অথচ আস্ত একটা মানুষ লুঠ হয়ে গেলে কী কী করা সঙ্গত, তা ওরা জানে না। ওরা দেখেনি কোনওদিন এ ঘটনা। ওরা শুধু শুনেছে।

    শুনে আহা করেছে, হয়তো বা শুনে শিউরে উঠেছে, কিন্তু তারপর তারা কী করেছে সেটা কান দিয়ে শোনেনি।

    তাই বুঝতে পারছে না এরপর কী কী করবে।

    .

    ০৭.

    ওই বৃষ্টিটাই কাল হয়েছিল। ভয়ানক একটা মুহূর্তে হঠাৎই প্রবল বিক্রমে এসে গেল, কে কোথায় ছিটকে গেল।

    তবু মৃণাল যখন ওর মা বাবার ডাকে ছুটে আসছিল তাঁদেরই কোনও বিপদ হল ভেবে, তখন ভেবেছিল, জ্যোতি বাড়ি পৌঁছে গেছে। ভেবেছিল, ছুটতে খুব ওস্তাদ তো, পৌঁছে গেছে বাড়িতে।

    এ ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না বলেই ভেবেছিল।

    মৃণালের কোনও ভাবনাই কাজে লাগল না।

    আরও তো কত কী ভেবেছে মৃণাল। ভেবেছে, বোধহয় ছুটে গিয়ে অন্য কারও বাড়ি ঢুকে পড়েছে, বোধহয় কোনও ঝোঁপ-জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে আছে, বোধহয় ভয়ে কোথাও অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।

    তারপর সব ভাবনা স্থির হয়ে যাচ্ছে।

    ক্রমশ পাথর হয়ে যাচ্ছে, নিথর হয়ে যাচ্ছে।

    শুধু বলছে, তোমরা যাও, আমি যাব না।

    লীলাবতী ভয়ে কাঁটা হচ্ছিলেন, যে ঝিটাকে এখানে এসে ঠিক করেছিলেন, সে এসে দাঁড়ালে কী বলবেন তাকে।

    যদি বলে ওঠে, মা, বউদিকে দেখছি না যে? কোন উত্তর জুগিয়ে রাখবেন সেই প্রশ্নের জন্যে?

    কিন্তু ঈশ্বর রক্ষা করলেন। মেয়েটা এলই না।

    অনেকক্ষণ পরে মনে পড়ল লীলাবতীর, আসবে কী করে? আসা অসম্ভব! গতকালের দুর্যোগে হয়তো তার চাল উড়ে গেছে, হয়তো সর্বস্ব নষ্ট হয়ে গেছে।

    তা হলে আসবে না।ভাবলেন লীলাবতী। ভেবে শান্তি পেলেন।

    অপর কারও চাল উড়ে গেছে অনুমান করে শাস্তি পেলেন।

    হয়তো নিজের চাল উড়ে গেলে এমনি নির্মম আর নির্লজ্জ হয়ে ওঠে মানুষ, তা নইলে এ কথাই বা লীলাবতী ভাবলেন কী করে, ভগবান, গ্রামে এত বউ-ঝি সবাইয়ের সব থাকল, যেতে আমারটিই গেল! দু দিনের জন্যে বেড়াতে এসেছিলাম আমি!

    তারপর আস্তে আস্তে সেই অভিযোগ জন্ম নিতে লাগল, ইচ্ছে করে ইচ্ছে করে এই বিপদ ডেকে আনা হল! ভয় নেই লজ্জা নেই, গুরুজনের সামনে সমীহ নেই, রাতদুপুর অবধি দিঘির ধারে বসে প্রেমালাপ! এত বড় বাড়ি, এত ঘর দালান বারান্দা, জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া অতবড় ছাত! কোনওখানে কুলোল না তোমাদের, দুঃসাহসেরও যে সীমা থাকা উচিত সে খেয়াল হল না!

    কিন্তু এ অভিযোগ কি মৃণালের বিরুদ্ধে?

    না! লীলাবতীর মনের মধ্যে যে অভিযোগ উত্তাল হয়ে উঠছে, সেটা ছেলের বিরুদ্ধে নয়। যে বউয়ের জন্যে তাঁর সমস্তটা জীবন ছিন্নভিন্ন ক্লেদাক্ত হয়ে গেল, যার জন্যে ভবিষ্যৎটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেল, আর কোথাও কোনওখানে মুখ দেখাবার পথ থাকল না, সেই বউয়ের বিরুদ্ধেই সমস্ত অভিযোগ।

    তাঁর নিজের ছেলেও যে ওই একই অপরাধী, আর বউটার থেকে যে বিদ্যায় বুদ্ধিতে বয়েসে সব দিক থেকেই বড়, সে কথা এখন আর খেয়ালে আসছে না লীলাবতীর, মনে হচ্ছে–ওই বউ! ওই বউটিই তাঁর যারপরনাই বেহুশ, অবুঝ, জেদি, আহ্লাদি!

    বউমানুষ হয়েও বউমানুষ-জনোচিত কোনও সংকোচ কুণ্ঠা ছিল না তার। তার উপর আবার অভিমানিনী।

    অথচ তা না হওয়াই উচিত ছিল।

    তিনকুলে কে ছিল যে এত আহ্লাদি হয়েছ? কোন বাল্যে মা মরেছে, তারপর বাপ। পিঠোপিঠি দুই ভাইবোন, একজন মানুষ হয়েছে মাসির বাড়ি, আর একজন পিসির বাড়ি। এই তো দশা!

    তবু এতটুকুতে মান অভিমান, মৃণালটা আমার যেন নাস্তানাবুদ! হ্যাঁ, এই সবই ভাবছেন এখন লীলাবতী, বউয়ের ভয়েই ছেলে আমার কাঁটা। নইলে এই সাপখোপের দেশে রাত্তিরবেলা দিঘির পাড়ে বসে থাকে?

    বরাবরই ওই!

    ঘরে বসে প্রেম হয় না বউয়ের, কেবল বাইরে বেরোনোর তাল। বলা হত কিনা–বাবাঃ, এই ছোট্ট ঘরটুকুর মধ্যে বসে থেকে থেকে মাথা গরম হয়ে গেল! একটু রাস্তায় ঘুরে আসি।

    মেয়েমানুষ, মাথা ঠাণ্ডা করতে চললেন রাস্তায়! কেন, লীলাবতীর মাথা বলে একটা জিনিস নেই? কই, লীলাবতী তো ও কথা বলতে যান না? হল তো এখন! নাও, এখন মাথায় কত হাওয়া লাগাবে লাগাও।

    ক্রমশই লীলাবতীর মনের মধ্যেকার ধারণা এমন চেহারা নিতে থাকে, যেন জ্যোতি ইচ্ছে করেই এটি ঘটিয়েছে।…ভাবছেন, ছেলের মুখের দিকে তাকাচ্ছেন, আর বুকটা হু হু করে উঠছে তাঁর।

    জ্যোতির হারিয়ে যাওয়াটা যদি আকস্মিক একটা মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হত, হয়তো লীলাবতী তাঁর সেই হারিয়ে-যাওয়া বউয়ের দোষগুলো সব ভুলে যেতেন। এবং তার কত দিকে কত গুণ ছিল, তারই ফিরিস্তি আওড়াতে বসতেন।

    কিন্তু জ্যোতি মৃত্যুর পবিত্রতার মধ্য দিয়ে হারায়নি। হারিয়েছে একটা পঙ্ককুণ্ডের মধ্যে। লীলাবতীর তাই তার উপর মমতার বদলে ঘৃণা আসছে, করুণার বদলে বিতৃষ্ণা।

    তবু শোকে দুঃখে লজ্জায় যেন মরে পড়ে আছেন লীলাবতী। লীলাবতীর ঘরের বউকে গুণ্ডায় লুঠ করে নিয়ে গেছে, এই ভয়ংকর অনুভূতিটা যেন প্রতি মুহূর্তে লীলাবতীকে করাত দিয়ে কাটছে।

    ছেলের কালিমেড়ে-যাওয়া উপবাস-ক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা তাঁর ফেটে গেলেও, গা হাত তুলে তার জন্যে খাবার জোগাড় করতে যেতে পারছেন না।

    শিকল দেওয়া রান্নাঘরটা, শিকল দেওয়াই পড়ে আছে। ওটা হাতে করে খুলতে পারছেন না লীলাবতী। যেন ওই ঘরটা খুললেই কেউ হা হা করে হেসে উঠবে। যেন লীলাবতীর গলা টিপে ধরতে আসবে রূঢ় কর্কশ মোটা মোটা আঙুল দিয়ে।

    সেই ঝড়ের সন্ধ্যার আগে ওই ঘরে বসে লুচি বেলেছিল জ্যোতিনামের মেয়েটা, এখন যেটা একটা ডেলা পাকানো ভয় হয়ে বসে রয়েছে। সেই লুচিগুলো ঢাকা দেওয়া পড়ে আছে ও ঘরে এখনও।

    ও ঘরের দরজাটা তবে কী করে খুলবেন লীলাবতী?

    তা ছাড়া আরও একটা কারণ, আর হয়তো বা সেটাই প্রধান কারণ, যা নাকি লীলাবতী এখন নিজেও প্রধান বলে টের পাচ্ছেন না, সে কারণটা হচ্ছে–যে ছেলের জন্যে মাথা তুলে রান্নাঘরে যাবেন, সেই ছেলে কী বলবে? সে কি মাকে ধিক্কারে ডুবিয়ে দিয়ে বলে উঠবে না, ছি ছি মা, জ্যোতি হারিয়ে গেল, অথচ তুমি আবার যথারীতি রান্নাঘরে ঢুকে তোড়জোড় করে রান্না লাগিয়ে দিয়েছ?

    যদি বলে, খেতে আমার প্রবৃত্তি নেই মা, খাবার ক্ষমতাও নেই, আমায় অনুরোধ করতে এসো না।

    তখন?

    ওই আতঙ্কই আরও লীলাবতীকে আটকে রেখে দিয়েছে। তাই লীলাবতী বুড়ো স্বামীর কথা ভাবতে গিয়ে থেমে যাচ্ছেন, ছেলের মুখের দিকে তাকাচ্ছেন না। মড়ার মতো পড়েই আছেন একধারে।

    কিন্তু সেই ঝড়ের সন্ধ্যাটা কবে গেছে?

    কত যুগ আগে?

    ক্যালেন্ডারের পাতা নাকি বলছে সেটা মাত্র পরশুর সন্ধ্যা।

    কিন্তু সত্যিই কি তাই?

    কত কত যুগ যেন কেটে গেছে মনে হচ্ছে যে!

    মাত্র তিনবেলা না খেলে এমন অবস্থা হয় মানুষের? লীলাবতীর কত বার-ব্রতের অভ্যাস আছে। লীলাবতীরই যদি এমন হয়, কী হচ্ছে মৃণালের, কী হচ্ছে ভক্তিভূষণের?

    অন্তত একটু চা

    চা ভাবতেই বুকটা হু হু করে উঠল লীলাবতীর, আর যে বউয়ের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ জমিয়ে তুলছিলেন, হঠাৎ তার মুখটা মনে পড়ে গিয়ে চোখের জলে ভেসে গেলেন।

    চা খেতে আর খাওয়াতে, দুটোই সমান ভালবাসত জ্যোতি। অসময়ে হেসে হেসে বলে উঠত, মা, নিশ্চয় এখন আপনার খুব ইচ্ছে করছে চা খেতে?

    লীলাবতী যদি বলতেন, নিজেরই ইচ্ছে হচ্ছে তাই বলল না বাছা?

    জ্যোতি হেসে বলত, সেটা বললে ভাল দেখাবে না।

    তারপর যত্ন করে নিয়ে আসত চা বানিয়ে। জ্যোতি এসে পর্যন্ত চা তৈরি ভুলেই গেছেন লীলাবতী।

    চায়ের সরঞ্জামগুলোর দিকে তাকানো যাচ্ছে না, তবু লীলাবতী চোখ মুছতে মুছতে সেই ভুলে যাওয়া কাজটাতেই হাত দিলেন। ভয়ে ভয়ে নিয়ে গেলেন দুটো স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা মানুষের দিকে।

    স্তব্ধ পাথর!

    এখানে সন্ধ্যার পর স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় কী? কিছু করবার উপায় কী? পথ কোথায়? থানা পুলিশ? কেলেঙ্কারি ছড়িয়ে পড়া ছাড়া আর কোন মহৎকর্ম হবে?

    কিন্তু চায়ের পেয়ালাটার ধাক্কায় সেই পাথর পাথর মানুষ দুটো কি সহসা সচেতন হয়ে উঠল? তারা কি লীলাবতীর হাত থেকে পেয়ালাটা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল?

    আর বলে উঠল, চা এনেছ? চা? লজ্জা করল না তোমার? লজ্জা?

    অদ্ভুত আশ্চর্য!

    মোটেই তা করল না ওরা।

    বরং যেন আগ্রহের সঙ্গে নিল হাত বাড়িয়ে।

    শুধু মৃণাল বলল, তোমার রেখেছ?

    গলাটা কি মৃণালের?

    লীলাবতীর মনে হল এ যেন আর কেউ কথা বলল।

    লীলাবতী ভাবলেন, আমার ছেলের জীবনটা তা হলে মিথ্যে হয়ে গেল। তারপর ভাবলেন, আমার ছেলের স্বভাবেই এমনটা ভাবতে হচ্ছে আমায়। নইলে একটা মেয়েমানুষের জন্যে কি আস্ত একটা পুরুষ মানুষের জীবন ফুরিয়ে যায়?

    এই কালিপড়া হারিকেনের আলো, এই ছায়া ছায়া বিরাট জীর্ণ অট্টালিকা, এই উড়ো উড়ো হু হু করা বাতাস, আর এই বাক্যহীন তিনটে পাথর হয়ে যাওয়া প্রাণী!

    এর মাঝখানে ওই ফুরিয়ে যাওয়া ভিন্ন অন্য কিছু ভাবতেই পারা যায় না।

    লীলাবতী ভাবলেন, ওই বউ-অন্ত-প্রাণ ছেলেকে কোন সান্ত্বনা দেব আমি? লীলাবতী ভাবলেন, কলকাতায় ফিরে গেলে হয়তো একটু সামলাতে। কিন্তু ওকে কি এখান থেকে নড়ানো যাবে?

    .

    ০৮.

    কাল ভোরের গাড়িতে চলে যাওয়া হবে। স্তব্ধ হয়ে থাকা ভক্তিভূষণ হঠাৎ ভাঙা ভাঙা গলায় যেন আদেশের ঘোষণা দিলেন, এখানে বসে থাকার কোনও মানে হয় না।

    ভক্তিভূষণ এমন আদেশের সুরে কথা কম বলেন। বলেনই না। তাই বাকি দুজন যেন চমকে উঠল। কিন্তু কেউ কথা বলল না।

    মৃণাল এতক্ষণ ওর নিজের শোয়ার ঘরে বসে ছিল, যেখানে পরশু রাত্রেও জ্যোতি ছিল পাশে। কোথা থেকে এক মুঠো আকন্দ ফুল এনে জানলার ধারে রেখে দিয়েছিল জ্যোতি একটা কাঁসার রেকাবিতে, সেই ফুলগুলো এখনও রয়েছে। আকন্দ ফুল সহজে শুকোয় না। মৃণাল ভাবছিল, কেন শুকোয় না? ওর মধ্যে বিষ আছে বলে?

    এই ঘরটায় ঢুকে প্রথমেই মনে হয়েছিল এইখানেই পড়ে থাকি। জ্যোতির হাতে গুছিয়ে রাখা বালিশ চাদরে হাত না দিয়ে মাটিতে কোথাও।

    আশ্চর্য, এত বড় ঝড় হয়ে গেল এই পৃথিবীটার উপর দিয়ে, অথচ বিছানার চাদরটা ঠিক পাতা থাকল! বেড়াতে যাবার আগে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে যে চাদরটা চোস্ত করে রেখে গিয়েছিল জ্যোতি।

    এই ঘরেই পড়ে থাকব, ভেবেছিল এ কথা, কিন্তু বেশিক্ষণ টিকতে পারল না। আবার বাবার ঘরে এসে বসল। সেই সময় ভক্তিভূষণ ওই ঘোষণাটি করলেন, কাল ভোরের গাড়িতে চলে যাওয়া হবে।

    চলে যাওয়া হবে!

    এখান থেকে চলে যাওয়া হবে!

    মৃণালের মনের মধ্যে যেন হাতুড়ির ঘা পড়ল। এখান থেকে চলে যাওয়া মানে জ্যোতিকে এখানে ফেলে রেখে যাওয়া!

    মৃণাল যেতে পারবে না।

    মৃণাল এখানে থেকে জ্যোতিকে খুঁজবে, খুঁজে বার করবে।

    কিন্তু মৃণাল কোনও কথা বলল না।

    ভক্তিভূষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমারও তো ছুটি ফুরিয়ে গেল!

    ছুটি!

    সেটা ফুরিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন!

    মৃণাল যেন বিস্ময়ে কুঁকড়ে যায়।

    বাবার এখন মনে পড়ছে মৃণালের অফিস আছে। তার ছুটি ফুরোনোর প্রশ্ন আছে। তার মানে মৃণাল কাল ভোরের গাড়িতে কলকাতায় ফিরে গিয়ে যথারীতি ছুটোছুটি করে অফিস যাবে, যথারীতি খাবে নাইবে ঘুমোবে!

    বাবার চিন্তায় এটা এত সহজ হয়ে গেল!

    অথচ মৃণাল ভাবতে পারছে না জীবনেও ওই সহজটা সম্ভব হবে কিনা।

    মৃণাল কিছু বলতে চেষ্টা করল, বলতে পারল না। লীলাবতী বললেন। বললেন, গিয়ে এক্ষুনি বাছা আমার কাজ করতে পারবে না। ছুটি বাড়িয়ে নিতে হবে।

    লীলাবতীর ওই বাছা আমার কথাটা মৃণালের কানে একটা অনিয়মের মতো লাগল। জ্যোতি নেই, অথচ মৃণালের মূল্য রয়েছে, এ হতে পারে না।

    ভক্তিভূষণ বললেন, এমনিতেই তো পাওনা ছুটি ছিল না।

    লীলাবতী বললেন, তা হোক। অবস্থা বুঝিয়ে দরখাস্ত করতে হবে।

    অবস্থা বুঝিয়ে!

    ভক্তিভূষণ একটা গভীর নিশ্বাস ফেলে বললেন, কোন অবস্থাটা বোঝাবে তুমি?

    লীলাবতী মাথা হেঁট করলেন। তাই তো বটে! কোন অবস্থাটা বোঝাবেন?

    জ্যোতি যদি এখানে এসে হঠাৎ একদিনের অসুখে মারা যেত, তা হলে অনেক শান্তি ছিল। সে কথা চেঁচিয়ে বলা যেত। সে শোকের ভাগ অপরকে দেওয়া যেত। অবস্থা বোঝানো যেত।

    জ্যোতির মা বাপ নেই, তবু দাদা বউদি আছে, তাদের কাছে কী বলা হবে?

    ওই কথাই বলতে হবে। ভাবলেন, আর তারপরই হঠাৎ মনে হল লীলাবতীর, বাড়িটা আবার তন্নতন্ন করে খোঁজা দরকার।

    যদি পরে এসে কোথাও লুকিয়ে বসে থাকে। যদি লজ্জায় মুখ দেখাতে না পারে?

    ধড়মড়িয়ে উঠে পড়লেন। ভক্তিভূষণ বললেন, কোথায় যাচ্ছ?

    ছাতের সিঁড়িটা আর একবার খুঁজে আসি।

    পাগলামি করছ কেন? বলল মৃণাল।

    লীলাবতী বললেন, যদি কোনও এক ফাঁকে এসে সেখানে গিয়ে বসে থাকে! যদি লজ্জায়

    লীলাবতীর গলাটা আর স্বাভাবিক ছিল না, খ্যাঁসখেসে ভাঙা ভাঙা সেই কণ্ঠস্বরটা কিন্তু সহসা। মৃণালের কানে একটা বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো বয়ে গেল।

    ঠিক, ঠিক তো! এ কথা তো আমারই ভাবা উচিত ছিল।

    এই প্রকাণ্ড বাড়িটার পাঁজরের খাঁজে খাঁজে কত ফোকর, মৃণাল তো জানে না সব।

    অবশ্য দেখা হয়েছে সেই খাঁজে খাঁজে চোখ ফেলে, কিন্তু সে তো একবার! যদি তারপরে এসে থাকে? মার সঙ্গে উঠে গেল মৃণাল।

    ভক্তিভূষণ বললেন, টর্চটা নিয়ে যাও।

    মৃণাল তারপর মার আগে আগে চলল। সিঁড়িটা দেখে এল। আরও কত জায়গা দেখল।

    তারপর হঠাৎ বলে উঠলেন লীলাবতী, গোয়ালটা দেখা হয়নি।

    গোয়াল!

    মৃণাল অবাক হয়ে তাকাল। ভাবটা এই, গোরু কোথায় যে গোয়াল? কিন্তু আছে সেটা।

    লীলাবতী বললেন, গোরু নেই বলেই ভাবছি যদি মানুষ এসে আশ্রয় নিয়ে থাকে–কথা শেষ করতে পারলেন না।

    একই তাপে তাপিত দুটো মানুষ পরস্পরকে বুঝতে পারছে, অথচ প্রাণ খুলতে পারছে না। প্রাণের সেই খোলা দরজাটায় আগল লাগিয়ে রেখে গেছে জ্যোতি নামের একটি প্রাণকণিকা।

    ওরা রান্নাঘরের পিছনের দরজা খুলল।

    বহুদিনের অব্যবহার্য গোরুহীন গোয়ালের দিকে চলে গেল।

    ভক্তিভূষণ গেলেন না। ভক্তিভূষণ কাল থেকে সহস্রবার দেখেছেন এই বাড়ির চারদিক। চাল-ভেঙেপড়া ওই গোয়ালটাই শুধু দেখেননি বলেই কি সেইখানে পাওয়া যাবে জ্যোতিকে?

    ভক্তিভূষণ উঠলেন না।

    ভক্তিভূষণ দেখলেন উঠোনের ওধার দিয়ে বেরিয়ে গেল ওরা।

    তারপরই, পরক্ষণেই একটা তীব্র চিৎকার শুনতে পেলেন ভক্তিভূষণ।

    মৃণালের গলা। ভক্তিভূষণকেই ডেকে উঠেছে।

    শুধু বলে উঠেছে, বাবা!

    ডাক, না আর্তনাদ?

    ভক্তিভূষণের ভাগ্যে কি এবার গোখরো বেরুল? পোডো গোয়ালের কোনও গহ্বর থেকে?

    তাই। তা ছাড়া আর কিছু নয়।

    প্রস্তুত হয়েই এগিয়ে যান ভক্তিভূষণ।

    শুধু ভাবতে ভাবতে যান, কাকে শুয়ে পড়ে থাকতে দেখবেন?

    মৃণালকে, না লীলাবতীকে?

    কিন্তু মৃণাল নয়, লীলাবতী নয়। অথচ আছে শুয়ে একজন ভাঙা গোয়ালের ভিজে কাঠ-বাঁশের ভূপের উপর। শাড়ির নীচের দিকটা কাদায় কালো, বাকি সমস্তটা কাদার ছিটেয় আরও ক্লেদাক্ত।

    ভক্তিভূষণও চেঁচিয়ে উঠলেন। বলে উঠলেন, ও কে? ও কে?

    যেন জিজ্ঞেস করলেন।

    .

    ০৯.

    কিন্তু যাদের জিজ্ঞেস করলেন, তারা কি জানে ও কে?

    তারা বেড়ার ফাঁক থেকে শাড়ির চিহ্ন দেখে ঝাঁপিয়ে গিয়ে পড়েছিল, তারপর মৃণাল আর্তনাদ করে উঠেছিল, বাবা!

    আর ভক্তিভূষণ বললেন, ও কে? ও কে?

    লীলাবতী ভাঙা গলায় বললেন, টর্চটা আর একবার ধর বাবা, দেখি আমার বউমা কিনা!

    কিন্তু মৃণাল টর্চ ধরল না। মৃণাল একটা নোনাধরা দেয়ালের ভিজে গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

    লীলাবতী তাকিয়ে দেখলেন না কোথায় বসছেন, বসে পড়ে হতাশ গলায় বললেন, ভগবান কি আমাদের ছলনা করছেন?

    এ প্রশ্নই বা কাকে করছেন তিনি? এখানে কি উত্তর আছে?

    এখানে তো শুধু ভয়ংকর একটা নিরুত্তর প্রশ্ন মাথা কুটে মরছে।

    ও কে? ও কোথা থেকে এল? ওকে নিয়ে এখন কী করব আমরা? ও কি বেঁচে আছে? ঈশ্বর কি ছলনা করছেন?

    অনেকক্ষণ পরে সেই ভয়ংকর প্রশ্নটা করলেন ভক্তিভূষণ, ওর কি প্রাণ আছে?

    প্রশ্ন। প্রশ্নই শুধু।

    কে দেখবে সাহস করে ওর প্রাণ আছে কিনা? ও কি জ্যোতি? ও কি এ বাড়ির সেই প্রাণপুতুলটি? তাই ওকে দেখামাত্র এ বাড়ির ছেলে ওকে বুকে তুলে নিয়ে চলে আসবে? ওর ওই অসাড় দেহে প্রাণ আছে কিনা দেখবে, প্রাণ আনবার চেষ্টায় উদভ্রান্ত হয়ে উঠবে? আর এ বাড়ির আর দুজন সদস্য তাদের সবখানি আকুলতা দিয়ে ওর গায়ে হাত বুলোবে, ওর মাথায় বাতাস করবে আর ডাকবে, বউমা! বউমা!

    ও জ্যোতি নয়, ও আর-একটা মেয়ে।

    তবু নিরুপায় হয়েই ওকে তুলে আনতে হল। এ বাড়ির ছেলেকেই বয়ে আনতে হল। যে নাকি শাড়ির একাংশ দেখে ঝাঁপিয়ে গিয়ে পড়েছিল, চিৎকার করে উঠছিল, আর তারপর পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।

    আর কে আনবে? আর কার সে শক্তি আছে?

    যে শক্তিটুকু ছিল, তারও তো আর কিছু অবশিষ্ট নেই।

    মৃণালেরই কি ছিল? তবু মৃণালকেই করতে হবে।

    যৌবনের একটা দায়িত্ব আছে। পারছি না শব্দটা তার জন্যে নয়।

    .

     ১০.

    প্রাণ নেই! দালানে এনে দেবার পর ভাবশূন্য গলায় উচ্চারণ করলেন লীলাবতী। প্রাণ নেই!

    তার মানে ভয়ংকর এক বিপদের উপর আরও ভয়ংকর এক বিপদ এসে চাপল।

    কী করবেন এখন ওই মৃতদেহটা নিয়ে?

    কাল ভোরের গাড়িতে রওনা দেবার কথা।

    যুদ্ধে আহত পরাজিত সৈনিকের মতে, ঝড়ে আহত ডানাভাঙা পাখির মতো, সেই দুখানা ঘরের ফ্ল্যাটে গিয়ে পড়বেন, আর জ্যোতিকে খোঁজা খোঁজা খেলা করবেন, এর বেশি তো আর কিছু ভাবেননি।

    তাতে বিশ্রামের আশ্বাস ছিল। তাতে শুধু ধূসর শূন্যতার স্বাদ ছিল।

    কিন্তু এ কী? এ কে?

    এ কেন মৃণালদেরই এই ভাঙা ভিটেয় মরে পড়ে থাকতে এল?

    কী রহস্য আছে এর অন্তরালে?

    মা, একটু গরম জল দিতে পারবে? আস্তে বলল মৃণাল।

    দাও বলতে বাধল। বলল, দিতে পারবে?

    দেখতে পাচ্ছে, লীলাবতীর হারিকেন ধরা হাতটা কাঁপছে!

    ভক্তিভূষণ কপালে একটা আঙুল ঠেকালেন। বললেন, কী হবে? অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।

    মৃণাল হাত তুলে নিষেধের মতো ভঙ্গি করল। ইশারায় বলল, এখনই ও কথা নয়। তারপর দাঁড়িয়ে উঠে বলল, মা, একটা শুকনো কাপড় পরিয়ে দিতে পারবে?

    লীলাবতী অস্ফুটে বললেন, আছে?

    মনে হচ্ছে।

    কাপড় আনছি। দ্রুত চলে গেলেন।

    হঠাৎ হাতে-পায়ে ব্যস্ততা এল লীলাবতীর। ওই দেহটা যে একটা মৃতদেহ নয়, এই আশ্বাস পেয়ে ভয়ানক একটা স্বস্তি বোধ করলেন। কৃতজ্ঞতা বোধ করলেন-করলেন ঈশ্বরের কাছে, মৃণালের। কাছে, ওই মেয়েটার কাছে।

    মুহূর্তে স্টোভ জ্বেলে জল বসিয়ে নিজের একটা শাড়ি আর শেমিজ নিয়ে এলেন, মৃণাল সরে এল। ভক্তিভূষণকে সরে আসতে দিলেন না, বললেন, মাথাটা একটু ধরো তুমি, আমার নাড়াচাড়া করতে ভয় করছে।

    বললেন, ওর কি কোনও সাড় আছে যে লজ্জা? তারপর কী ভেবে বললেন, তোমারই বা লজ্জা কীসের? মেয়ের মতো। বউমার বয়েসীই হবে

    যেন অসতর্কে ওই নিষিদ্ধ নামটা উচ্চারণ করে ফেললেন। টাল সামলাতে পারলেন না, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। সাবধানে ওকে ভিজে জামা কাপড় ছাড়িয়ে শুকনো কাপড়-জামা পরিয়ে দিলেন। অনুভব করতে পারলেন প্রাণ আছে!

    বিপদের পাহাড়টা সমতল মনে হচ্ছে। আর একটা যে পাহাড় আগে থেকে দাঁড়িয়ে ছিল, এই স্বস্তির হাওয়ায় সেটাও যেন হালকা হয়ে গেল।

    যেন একটিমাত্রই সমস্যা ছিল সংসারে, সে হচ্ছে এই দেহটা। যদি মৃতদেহ হয়, কী হবে সেটা নিয়ে?

    সেই সমস্যাটা চলে গেল। অতএব পাহাড়টা নেমে গেল।

    পরে ও বাঁচবে কিনা সেটা পরে ভাবলেও চলবে। এখন তো আছে বেঁচে। বেঁচে আছে, বুকটা ওঠা-পড়া করছে। কাদামাখা ভিজে কাপড়-ব্লাউজ থেকে বোঝা যাচ্ছিল না, শুকনো কাপড় পরানোর পর বোঝা যাচ্ছে সেই ওঠা-পড়া।

    মৃদু, মন্থর, অনিয়মিত। তবু চলছে কাজ।

    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদশটি উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article লোহার গরাদের ছায়া

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }