Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    লোহার গরাদের ছায়া

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প157 Mins Read0
    ⤷

    ১. তিনটে মানুষ সারারাত জেগে

    কাল রাত্তিরে এ বাড়ির তিন তিনটে মানুষ সারারাত জেগে কাটিয়েছে। তারা উঠেছে বসেছে, জল খেয়েছে, জানলায় দাঁড়িয়েছে, হয়তো আবার বিছানায় শুয়ে পড়ে জোর করে ঘুমের চেষ্টা করেছে, এবং শেষ অবধি ব্যর্থ হয়ে ঘরে পায়চারি করে বেড়িয়েছে।

    তিনটে মানুষ তিনটে ঘরে, তবু ওদের অস্থিরতার ভঙ্গি প্রায় এক। কারণ ওদের অস্থিরতার কারণও একই।

    ওদের ভঙ্গিতে একটা অসহায়তারও ছাপ।

    যেন এই রাতটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে এমন একটা কিছুর মুখোমুখি হতে হবে ওদের, যেটা আনন্দের আতঙ্কের, তা বুঝে উঠতে পারছে না। অথচ সেই মুখোমুখি হতেই হবে।

    তাই ভয়ানক একটা স্নায়ুচাঞ্চল্যে ছটফট করছে এ বাড়ির তিনটে মানুষ।

    ভবানী রায়, অপর্ণা রায় আর চন্দ্রা রায়।

    ভবানী রায় আর অপর্ণা রায়ের তবু পাশাপাশি ঘর, ওঁরা পরস্পরকে দেখতে পাচ্ছেন, এক একবার একে অপরকে ডেকে বলছেন, জেগে আছো এখনও? ঘুম আসছে না? পাখাটা বাড়িয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ো।

    চন্দ্র রায়ের ঘর নির্জন।

    আর বাইরের কোনও জানলা, কোনও দরজা থেকে তার ঘরের ভিতরে চোখ ফেলার পথ নেই। সে কী করছে, কেউ টের পাচ্ছে না।

    তবু ঘুম না-আসা রাতে অন্য আর কী করতে পারে মানুষ? কী করে?…ওঠে বসে, জল খায়, জানলায় দাঁড়ায়, সংলগ্ন বারান্দা থাকলে দরজা খুলে বেরিয়ে এসে হাঁফ ফেলে।

    চন্দ্রার ঘরটা তিনতলায়।

    চন্দ্রার ঘরের সংলগ্ন বারান্দা নেই।

    শুধু খুব চওড়া চওড়া জানলা আছে, যেখানে এসে দাঁড়ালে আকাশের অনেকটা দেখা যায়।

    পাড়াটা অভিজাতদের তালিকায় পড়ে না, পুরনো পাড়া, শহর প্রতিষ্ঠিত হবার আমল থেকে এই পাড়া চালু হয়েছে। কিন্তু বাড়িটায় আভিজাত্য আছে। একতলা দোতলাটা সাবেকি ধরনের, তার মধ্যে সৌন্দর্য আর গাম্ভীর্যের সংমিশ্রণ।

    তিনতলাটা একটু বেশি আধুনিকতার গা-ঘেঁষা। তার গঠনে হালকা ভাব, জানলার গ্রিলে সৌকুমার্য, মেঝের মোজাইকের ডিজাইনে হালের চাকচিক্য, এবং সব ঘরগুলিরই সঙ্গে যুক্ত আছে সংলগ্ন স্নানাগার।

    তিনতলা ভবানী রায়ের দুই ছেলের, অথবা দুই পুত্রবধূর। যাদের মধ্যে ছোটজনের নাম চন্দ্রা।

    চন্দ্র রায়।

    যে মেয়ে গতরাত্তিরটা অনিদ্রার শিকার হয়ে ছটফট করেছে।

    বড়জন রমলার ঘর থেকে কোনও অশান্ত নিশ্বাস উঠছে না। ধরে নেওয়া যায়, সে হয়তো তার স্বামীপুত্রকে নিয়ে ঘুমিয়েই কাটিয়েছে।

    চন্দ্র রায়ের সঙ্গে ঘুমের আগে তার যে কথা হয়েছিল, মানে রমলা যেটা বলেছিল, সেটা একটু বোকার মতোই হয়েছিল।

    নিজের ঘরে ঢোকার আগে প্যাসেজটা দিয়ে যেতে যেতে চন্দ্রার ঘরের দরজা তখনও খোলা দেখে একটু দাঁড়িয়ে পড়ে বলেছিল, খোকা ঘুমোচ্ছ?

    প্রশ্নটা অনাবশ্যক, দোলা খাটের ফেলা মশারিটা নট নড়নচড়ন, নট কিচ্ছু হয়ে রয়েছে। চন্দ্রা ওই অনাবশ্যক কথাটার উত্তর দেয়নি। শুধু হাতের বইখানা মুড়ে রেখে বালিশের থেকে মাথাটা তুলে বসেছিল।

    রমলা বলেছিল, তুমিও বাবা এই সময় একটু ঘুমিয়ে নাও। ছেলে উঠলে তো ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দেবে। তারপর চোখটায় একটু কৌতুকের ছোঁয়া লাগিয়ে সেই বোকার মতো কথাটা বলে মরেছিল।

    মানে আগামী রাতের প্রস্তুতি হিসেবে! কালকের রাত্তিরে তো আর ঘুম হবে না।

    নতুন বরকনেকে কৌতুক করার মতো এই ভাষাটাই ব্যবহার করল রমলা।

    রমলার এই কৌতুকটা যেন দেয়ালে মুখ করে দাঁত খিঁচোনো হাসি হল। চন্দ্রা তার বড় বড় কালো চোখ দুটো তুলে একবার বড়জায়ের চোখের দিকে তাকাল। তাকিয়েই রইল।

    রমলার মনে হল, তার ছোটজা যেন তার শরীরের কোনওখানে দুড্যালা আগুন চেপে ধরল।

    তাড়াতাড়ি পালাল রমলা। যাই বাবা ওষুধটা খেতে হবে।…সকাল করে তো ঘুমোবার কথা, ঘুম কি আর আজ আসবে ছাই।

    না, চন্দ্রা এ কথাটা শুনে চেঁচিয়ে উঠল না, ওঃ! হৃদয়বতী মহিলা, তোমার ঘুম আসবে না? আর আমায় ঘুমিয়ে নেবার পরামর্শ দিয়ে গেলে?

    চেঁচাল না।

    চেঁচাবে না! চন্দ্রা ওই রমলা নামের মহিলাটিকে মানুষ বলে গণ্যই করে না। বোকাদের চন্দ্রা দুচক্ষে দেখতে পারে না, মানুষ বলে ভাবে না। আর রমলা তো হাড়বোকা।

    অথচ রমলা আপন পরিমণ্ডলে দিব্যি সুখে আছে নিজেকে পরম বুদ্ধিমতী ভেবে।

    রমলা সর্বদাই অসুস্থ থাকতে ভালবাসে। বারো মাস ওর জন্যে ডাক্তার আসে, ওষুধ আসে। অথচ রমলা যথেষ্ট খায়দায়, যথেচ্ছ বেড়িয়ে বেড়ায়, আর সক্কলকে ধরে ধরে শোনায়, ডাক্তার তাকে কী কী নিষেধ করেছে, কী কী নির্দেশ দিয়েছে।

    ঘুম হবে না বলে চলে গিয়ে তৎক্ষণাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিল রমলা।

    সুশীল কি করেছিল কে জানে।

    ভবানী রায়ের বড় ছেলে সুশীল রায়।

    রমলার স্বামী।

    তারও কি নার্ভ উত্তেজিত হচ্ছিল?

    বোঝা যায়নি।

    চাপা স্বভাবের লোকেদের চিন্তা দুশ্চিন্তা বোঝা যায় না, সুশীল চাপা স্বভাবের।

    কিন্তু ভবানী রায়ের ছোট ছেলে সুনীল রায়?

    যার সূত্রে চন্দ্রা রায় নামের মেয়েটা ভবানী রায়ের তিনতলার ঘরে পালঙ্কে শুয়ে নিশ্বাস ফেলছে, উঠছে বসছে, জল খাচ্ছে, জানলায় দাঁড়াচ্ছে।

    সুনীল রায়ের স্বভাব তো তার দাদার মতো চাপা নয়।

    তবু আজ তার কথা ঠিক বলা যাচ্ছে না।

    কারণ তাকে এখন আদৌ দেখাই যাচ্ছে না।

    সে এখনও ভারী তালা ঝোলান জেলখানার ঘরে বন্দি আছে।

    রাত পোহানোর সঙ্গে সঙ্গে মুক্তি পাবে সে, এইরকম আশ্বাস আছে।

    আশ্বাস আছে, তবুও যেন বিশ্বাস নেই।

    আড়াই বছর ধরে সে ওই অবিশ্বাসটিকে মনের মধ্যে বাড়তে দিয়েছে। না গত রাত্রিতেও তার বিশ্বাস ছিল না আবার সে পৃথিবীর বাসিন্দা হবে, আবার সে সমাজজীবনে ফিরে যাবে, আবার মনোহরপুকুরের ভবানী রায়ের সেই মস্তবড় বাড়িটার তিনতলার সেই একখানি ছবির মতো ঘরে মুখোমুখি বসে তাকিয়ে থাকবে একখানি জীবন্ত ছবির দিকে।

    অবশ্য ওর থেকেও অনেক আনন্দময় আর ঐশ্বর্যময় একখানি ঘরের ছবি স্মৃতির পটে আছে।

    কিন্তু সত্যিই কি আছে? সে তো ঝাপসা হতে হতে প্রায় মিলিয়ে গেছে।

    সেই ঘরটার সঙ্গে এই জেলখানার ঘরটার কোথায় যেন একটা যোগসূত্র আছে।

    আশ্চর্য, সুনীল রায়ের জেল হয়ে গিয়েছিল।

    না, জেলটাকে রদ করা যায়নি।

    ছেলের জন্যে অবশ্যই চেষ্টার কিছু ত্রুটি করেননি ভবানীবাবু। অনেক ছুটোছুটি করেছিলেন, অনেক ঝুলোঝুলি করেছিলেন, টাকাকে খোলামকুচির মতো খরচ করেছিলেন, স্বর্গমর্ত্য এক করে উকিল ব্যারিস্টার লাগিয়েছিলেন। এবং ওদিকে অপর্ণা-ও তেমনি ছুটোছুটি ঝুলোঝুলি করেছিলেন আরও ওপরওলার কাছে।

    ভগবান এক, প্রাণপণে ডাকলেই সব হয়, এ জ্ঞান থাকলেও মায়ের প্রাণ তো স্থির থাকতে পারে না? তাই অপর্ণা ডিপার্টমেন্টে ডিপার্টমেন্টে ধর্না দিয়েছেন, পুজো চড়িয়েছেন, আরও চড়া ঘুষের প্রলোভন দেখিয়েছেন।

    তথাপি শেষরক্ষা হয়নি।

    জেল রদ হয়নি সুনীলের।

    অথচ এ কথাটা কে বিশ্বাস করতে পেরেছিল সুনীলের মতো ছেলে কোম্পানির টাকা মেরে নেবার দায়ে গ্রেফতার হয়েছে!

    সুনীলকে যারা জানে, সুনীলকে যারা একবারও দেখেছে, তারা খবরটা শুনে অসম্ভব বলে একেবারে উড়িয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, কারুর ষড়যন্ত্রে এমনটা হয়েছে, এ কেস টিকবে না।

    কিন্তু টিকলো।

    বলতে হবে সেই ষড়ন্ত্রের জাল খুবই গভীর জটিল। তাই তার থেকে আর উদ্ধার হল না সুনীল নামের নির্মল চরিত্রের ছেলেটা। যার হাসির আলোয় বাড়ি আলোয় বাড়ি আলোকিত থাকত, যার কথার ছটায় সবাই মোহিত হত। সত্যি এমন হাসিখুশি প্রাণবন্ত ছেলে, এমন হৃদয়বান এবং বিচক্ষণ ছেলে দুর্লভ।

    সুনীলের ঠাকুমা বলতেন, আমার সুনীলের গুণে পথের শত্রু ফিরে চায়।

    পাড়ার লোকেও বলেছে, আহা এমন ছেলে হয় না, পাড়ার সেরা ছেলে।

    শুধু শুধু তো আর বলেনি?

    ভবানীবাবুর বাড়ি গাড়ি দেখেও বলেনি।

    তা যদি বলত তো সুশীলের কথাতেই বলতে পারত। ভবানীবাবুর বড় ছেলে সুশীলকে পাড়ার অনেকে ভাল করে চেনেই না। সুশীল গম্ভীর স্বল্পবাক, যার জন্যে তাকে পাড়ায় উন্নাসিক বলেই মনে হয়।

    সুনীল দাদার একেবারে উলটো।

    আর লেখাপড়াতে ও তো রত্ন।

    যাকে বলে হিরের টুকরো ছেলে।

    তেমনি ধাপে ধাপে সাফল্যের উচ্চ চূড়ায় উঠেও গিয়েছিল।

    টপাটপ সসম্মানে পাশ করেছে, রবার টেকনোলজিতে না কিসে যেন বিশেষ পারদর্শী হয়ে ভাল কোম্পানীতে উচ্চপদে চাকরি পেয়েছে, এবং আরও উচ্চপদের সম্ভাবনায় প্রায় নিশ্চিন্ত থেকেছে।

    এদিকে, বিয়েও হয়েছে যথাযথ।

    সাত তাড়াতাড়ি প্রেমে পড়তে যায়নি, যাতে আখের ঘোচে। সেটাও গুণ বইকী! সুনীলের নিজেরই ভাগ্নে, বড়দির ছেলে, সুনীলের থেকে চার বছরের ছোট, সে ফার্স্ট ইয়ার থেকেই প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খেয়ে, পার্ট টুতে ফেল করে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে একটি রোগা হাড়গিলে কালো দাঁড়কাকের মতো প্রায় সমবয়েসি মেয়েকে সকলের অমতে বিয়ে করে বসে কোন এক বন্ধুর আশ্রয়ে পড়ে আছে।

    এদিকে–মা যাই বলুক, বাপ একেবারে কাঠকবুল ও ছেলেকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। দুঃখে পড়ুক, বুঝুক কত ধানে কত চাল। দেখুক গোঁফ গজাতে না গজাতে প্রেমে পড়ার মজা।…

    সুনীলের বড়দি বেতারি একে ওকে দিয়ে লুকিয়ে উপহারের ছলে ছেলে বউকে এটা ওটা পাঠাচ্ছে। আর স্বামীর মন গলাবার অপেক্ষায় দিন গুনছে।

    আর সুনীল? ওরই মাতুল?

    লোকে তো বলে রাণাং মাতুলক্রম। বাজে কথা, যে যা হবার হয়।

    সুনীল তার অধ্যয়ন নিয়েই মশগুল থেকেছে, হৃদয়বৃত্তির চর্চা করতে বসেনি।… অথচ আবার অভিভাবকবর্গ যখন বলেছেন, বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে কাজ, এবার একটি বউ দরকার, বিয়ের ঠিক করছি–তখন ন্যাকামি করে না নাও করেনি।

    তাঁরা যা করেছেন মেনে নিয়েছে।

    অবিশ্যি তাঁরাই কি যা-তা ধরে দিয়েছেন? একটি সুন্দরী বিদুষী ভাগ্যবানের ঘরের মেয়ে এনেই বিয়ে দিয়েছেন। বউয়ের মতো বউ চন্দ্রা।

    বরের সঙ্গে তার কোয়ার্টার্সে গিয়ে এমন নিপুণভাবে সংসার করছিল যে,ধন্যি ধন্যি করার মতো। জায়গাটার যে বিশেষ কোনও আভিজাত্য নেই, ত্রিবেণী না অমনি কী একটা, তাতেও তার অপছন্দ ছিল না। দুজনে স্রেফ সুখের সাগরেই ভাসছিল।

    এসব কথা বলার মানে হচ্ছে সুনীল নামের ওই অসাধারণ গুণসম্পন্ন ছেলেটি এযাবৎকাল কেবল স্বাভাবিকের পথেই এগিয়েছে, আর প্রশংসা কুড়িয়েছে।

    এমনকি কোম্পানিরও প্রায় নয়নমণি হয়ে উঠেছিল। ডিরেক্টর প্রধান মাথুর সাহেব তো ছেলের মতন ভালবাসতেন সুনীলকে।

    এই পরম সাফল্যের শুভ্র ছবির উপর যেন কে কোথা থেকে এক দোয়াত কালি ঢেলে দিল।

    শত্রুপক্ষ অবশ্য (শত্ৰু কি আর নেই? ঈর্ষা নামের একটা জিনিস নেই জগতে?) বলে বেড়িয়েছে, কে আবার ঢালবে, নিজেই ঢেলেছে। লোভ বড় ভয়ানক জিনিস। তা ছাড়া বড়লোকের মেয়ে বিয়ে করে, আরও বড়লোক হবার শখ হয়েছিল। আর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে বিশ্বাসভঙ্গ করা, এ তো আর নতুন নয়? জগতে অহরহও ঘটছে।… সুনীল রায়ও কিছু জগৎ ছাড়া নয়।

    কিন্তু সেটা বলেছে সামান্য কজন।

    যারা ভবানী রায়ের সোনা দিয়ে বাঁধানো ভাগ্য দেখে তপ্তশ্বাস ফেলত।

    বেশিরভাগ লোকেই বলেছে, এ কোনও ষড়যন্ত্রের ব্যাপার। নতুন গিয়েই উত্তরোত্তর উন্নতি করল, বড়কর্তার সুনজরে পড়ল, পুরনোদের সহ্য হল না।

    আর সুনীল নিজে?

    কেস চলার সময় আত্মপক্ষ সমর্থন করতে একটিমাত্রই কথা বলেছে সে, সত্য একদিন প্রকাশিত হবেই।

    কিন্তু এ কথা আর কোন আসামিটা না বলে? বিপক্ষের উকিল ব্যঙ্গহাসি হেসে বলেছে, কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে খুনি আসামিও দার্শনিক উক্তি করে স্যর।

    ওদিকের আইনজ্ঞরা জোরালো।

    আর প্রতিজ্ঞায় জোরালো হয়ে থেকেছিলেন সেই পরম স্নেহবান মাথুর সাহেব। তিনি তাঁর ওই প্রিয় ছেলেটিকে জেলে পাঠাবার জন্যে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিলেন। যে শক্তিটা হচ্ছে একটা প্রবল শক্তি।

    এমন শক্তিমানেরা চেষ্টা করলে বিনা প্রমাণে একেবারে নিরপরাধীকেও জেলে ঠেলতে পারে, আর এত প্রমাণ টমাণ রয়েছে।

    অতএব শাস্তিটা অনিবার্য।

    হয়তো এটাই স্বাভাবিক, বড় বেশি বিশ্বাস আর ভালবাসা আরোপ করেছিলেন বলেই সেই বিশ্বাসভঙ্গে যাকে বলে খেপে উঠেছিলেন।

    তাঁর চোখে যখন ধরা পড়ল ভয়ানক একটা প্রতারণার ঘটনা চলছে ফ্যাক্টরিতে, মাল খারাপ, অতএব কোম্পানির নাম খারাপ করে, তলে তলে বেশ কিছু লাভের কারবার চালাচ্ছে বিশ্বাসভাজন কর্মচারীরা, এবং তাদের মধ্যে সুনীল রায়ই আসল পাপী, তখন প্রায় তাকে গুলি করতেই ছুটে যাচ্ছিলেন।

    তাকে ডেকে একবার জিজ্ঞেস করতেও প্রবৃত্তি হয়নি মাথুর সাহেবের।

    ঘটনার চেহারাটি এমন যে, সুনীল রায়কে তার থেকে ভাসিয়ে তুলে আনা যায় না, অথবা সুনীল রায় তার থেকে নিজেকে ভাসিয়ে তুলে আনতে পারে না।

    ফ্যাক্টরিতে তৈরি জিনিসের গুণাগুণ পরীক্ষায় প্রধান পরীক্ষকই তো ওই বিশেষজ্ঞ সুনীল রায়।

    সে যদি ন্যাকা সেজে আকাশ থেকে পড়ে বলে, এসব রদ্দি মালের খবর আমি রাখি না। কীভাবে কখন তৈরি হয়েছে এবং কখন সাপ্লাই হয়েছে, তার বিন্দুবিসর্গও জানি না–কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই তাকে সন্দেশ খাওয়াতে বসবে না।

    অতএব সুনীলের জেল রদ করা যায়নি।

    কালী দুর্গা বিশ্বনাথ তারকেশ্বর সবাই অপর্ণার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।

    একদিন নয়, আধদিন নয়, আড়াই বছরের মেয়াদ!

    আদালতে রায় বেরোনোর পর ভবানী রায় বাড়ি ফিরে হাহাকার করে বললেন, ভগবান তুমি কি সত্যিই অন্ধ? সত্যি মিথ্যে দেখতে পাও না তুমি?

    আর অপর্ণা মাথা ঠুকলেন, হে ঠাকুর এত ডাক এত কান্না কিছু শুনতে পেলে না?

    অপর্ণার বড় ছেলে সুশীলের বউ তাড়াতাড়ি এসে পাখার স্পিড বাড়িয়ে দিয়ে শাশুড়ির কাছে নীরবে বসে থাকল, আর স্বল্পভাষী সুশীল মাকে বলে গেল, কেঁদেকেটে শরীর খারাপ করে কোনও লাভ আছে?

    যেন অপর্ণা এখন লাভ লোকসানের হিসেব কষতে বসেছেন। অপর্ণা যে সর্বস্বান্ত হয়ে গেলেন, সে কি ওই বড় ছেলে বুঝবে? ও তো চিরদিনই দূরদূর পরপর। যেন বাড়িতে একটা ভাগ্নে-ভাইপো আছে।

    আর সুনীল?

    বুকভরা ছেলে, বুকজুড়নো ছেলে।

    তার মা ডাকটুকুও যেন আলাদা স্বাদের। মেয়েরা আছে, বড় ছেলে আছে, তবু ওই ছোট্ট ছেলেটির উপরই নির্ভরতা, নিশ্চিন্ততা, আশ্রয়।

    মেয়েরা অবিশ্যি মার কোলের খোকা বলে ঠাট্টা করে, কিন্তু তাদেরও তো ওই ছোট ভাইটি প্রাণতুল্য। যতদিন কেস চলেছে, তাদেরও আহার নিদ্রা ছিল না।

    জামিন দেবার জন্যেও সবাই এগিয়ে এসেছে।

    বড় ভগ্নীপতি একজন কেষ্টবিষ্টু। আবার মামাও একজন নামকরা লোক।

    কিন্তু জামিনে মুক্তি পায়নি ওই পরম পাপী। কেস এমনই ঘোরালো। দীর্ঘ চার মাস ধরে কেস চলেছে, আর ছেলেটা হাজতে পচেছে।

    তারপর তো জেলেই পচতে থাকল।

    কাগজে কাগজে ফলাও করে খবর বেরিয়েছে, দেশে রাজ্যে জানতে কারও বাকি থাকেনি এই মুখরোচক খবর।

    ভবানী রায়ের পাড়ার মস্তান ছেলেরা যারা সুনীলদাকে দুরে থেকে সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে দেখেছে, সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দিয়েছে এবং সুনীল যাদের দেখে কখনও ওর দাদার মতো অবজ্ঞার দৃষ্টিতে না তাকিয়ে ডেকে কথা কয়েছে, তারা কেস চলাকালে বলে বেড়িয়েছে, দূর দেখিস সুনীলদার কি হবে না। ধর্মের কল বাতাসে নড়বে।…এ আর কিস্যু না কর্তারাই যোগসাজসে এইটি করে, লুঠের মাল ভাগ করে নিয়ে অনেস্ট লোকটাকে ফাঁসিয়ে গা বাঁচাবার তালে আছে, অত চালাকি ধোপে টিকবে না, কোর্টে জেরার মুখে চালাকি বেরিয়ে যাবে। সুনীলদা এ কাজ করতেই পারে না।

    তামা তুলসী গঙ্গাজল আনবার কথাও বলেছে তারা।

    রায় বেরোবার পর তারা বলেছে, শালার জজ, আর ওই রাঘববোয়ালগুলোকে একধার থেকে দাঁড় করিয়ে চাকু মেরে ভুড়ি ফাঁসিয়ে দিতে প্রাণ চাইছে।…কেরিয়ারটাই নষ্ট করে দিল।

    ভবানীবাবুর কাছে এসেও বলেছিল।

    স্যার যদি অনুমতি দেন ওই শালার মাথুরটাকে–

    ভবানীবাবু হাতজোড় করেছিলেন।

    যে হতভাগারা ছিল দুচক্ষের বিষ, ভবানীবাবু যাদের মনিষ্যি বলেই গণ্য করতেন না, তখন তাদেরই ওঁর খুব আপনলোক মনে হয়েছে।

    অপর্ণাও বলেছেন, আহা বেকার বাউণ্ডুলে হয়ে বেড়ায় তাই। ওরা আমার খোকাকে বড় ভক্তি ছেদ্দা করে।

    সুনীলের বউ চন্দ্রা অবশ্য এ পটভূমিকায় ছিল না। যদিও সুনীল বলে গিয়েছিল যদি কে আমার বিরুদ্ধে যায়, তুমি নিউ আলিপুরে থেকো না, মনোহরপুকুরের এখানে এসে থেকো–তবু চন্দ্রা নিউ আলিপুরেই ছিল।

    চন্দ্রার মনে হয়েছিল স্বামীর উপস্থিতিবিহীন শ্বশুরবাড়ি, এর চাইতে কষ্টকর আর কী আছে?

    তা ছাড়া তার দাদা উকিল।

    যতদিন কেস চলেছে, দাদা বীরবিক্রমে অভয়বাণী বর্ষণ করেছে, এবং গাড়ি চাপিয়ে চাপিয়ে বোনকে সঙ্গে করে এনে কোর্টে বসিয়ে রেখেছে।

    এসেছেন ভবানীবাবুরাও।

    চন্দ্রা ফিরে যাবার সময় দেখা করেছে, প্রণাম করেছে, আর এই নতমুখী বিষণ্ণবদনাকে দেখে শ্বশুরশাশুড়ির প্রাণ ফেটে গেছে। তবু সাহস করে বলতে পারেননি, আমাদের কাছে গিয়ে থাকবে চলো।

    চন্দ্রা তো বলতে গেলে এখনও কুটুমের মতোই ছিল। বড়লোকের মেয়ে তিন ভাইয়ের এক বোন একটিমাত্রই মেয়ে, বিয়ের পরে যেটুকু আসা যাওয়া করেছে, তার মধ্যে থাকার দিনকটি বোধহয় আঙুলে গোনা যায়। এসেছে, আদরআহ্লাদ খেয়েছে, হাসিখুশিতে বাড়িতে প্রাণের হাওয়া বইয়েছে, আবার চলে গেছে। বউ এসে দুচার দিন থাকলে এঁরা যেন কৃতার্থ হয়েছেন।

    কিন্তু বউয়েরই বা দুচার দিনের বেশি থাকতে ভাল লাগবে কেন? বর তো নেই শ্বশুরবাড়িতে? সে তো কোয়াটার্সে। ফ্যাক্টরির কাজে ছুটিও যৎসামান্য। সেই যৎসামান্যটুকু নিয়ে যখন আসে, ওদিক থেকে টানাটানি পড়ে।

    পড়বেই তো।

    তাদেরও তো একটা মাত্রই জামাই।

    তারপর তো চন্দ্রাও সুনীলের সঙ্গে ত্রিবেণীতে চলে গেল। সেই প্রায় কুটুম বউকে সাহস করে বলা যায় কি তুমি আমাদের কাছে গিয়ে থাকবে চলল।

    ওদের ওই বউয়ের মুখ দেখে কেবলই মনে হয়েছে, রাহুগ্রস্ত শশী।

    তবু তখনও সমানেই বিশ্বাস ছিল, সত্য একদিন প্রকাশিত হবেই।

    কিন্তু সত্য আবৃতই রয়ে গেল।

    সুনীলের আড়াই বছরের জন্যে জেল হয়ে গেল।

    যাবার আগে সুনীল বউয়ের সঙ্গে দেখা করার কালে বলেছিল, তুমি যদি মনোহরপুকুরের ওখানে গিয়ে থাকতে, মা বাবার একটু

    চন্দ্রা সে আদেশপত্রে স্বাক্ষর করেনি, কেঁদে ভেঙে বলেছিল, ওবাড়িতে তুমি নেই আমি আছি, ভাবতেই পারছি না। এ তবু পুরনো জায়গা, কুমারী কালকে মনে আনবার চেষ্টা করব।

    সুনীল নিশ্বাস ফেলেছিল।

    সুনীলের ধারণা হয়েছিল পিতৃগৃহে চন্দ্রাকে অগৌরবের মধ্যে কাটাতে হবে। জেলে আসামীর স্ত্রীকে মা বাপ ছাড়া আর কে সমীহর চক্ষে দেখবে?

    তবু তখনও সুনীল জানে না চন্দ্রার মধ্যে একটি নতুন প্রাণের সূচনা দেখা দিয়েছে।

    সুনীল কেন, চন্দ্রাই তো নিজে তখনও সেভাবে অনুভব করতে পারেনি।

    করলেও, বলবার মতো নিশ্চিত হতে পারেনি।

    তাছাড়া–এত আনন্দের আর এত লজ্জা গৌরব মিশ্রিত খবরটি দেবার লগ্ন কি এই?

    সেই তার আপন সাম্রাজ্যে, আপন উজ্জ্বল কেন্দ্রে মহারানির ভূমিকা নিয়ে যে খবরটি জানাবার কথা মধুর মদির কৌতুক, আর গভীরতার গোপন সুরে, সে খবরটা জানিয়ে দেবে চন্দ্রা মানুষটা গারদে ঢোকবার প্রাককালে?

    তাও তো চন্দ্রা তখন তেমন নিশ্চিত নয়।

    নিশ্চিত হল যখন মা ধরলেন।

    মা অনিন্দিতা দেবী জামাইয়ের ব্যাপারটার যবনিকাপাতের কয়েক দিন পরে বললেন, চন্দ্রা আজ বিকেলে ডাঃ অনীতা বসুকে একটা কল দিয়েছি, তোমায় একবার দেখে যাবেন।

    চন্দ্রা থতমত খেয়ে বলল, আমাকে?

    মা শান্ত গলায় বললেন, হ্যাঁ, তোমাকে, একবার দেখিয়ে নিশ্চিত হতে চাই। অবশ্য আমি ঠিকই বুঝতে পারছি একজন আসছে

    চন্দ্রা হঠাৎ কেঁদে ফেলে দুহাতে মুখ ঢেকে বলে, এখন এসব কেন মা? আমি চাই না চাইনা, এখন কিচ্ছু চাই না। এখন কাউকে আসতে হবে না।

    মার চোখও শুকনো থাকে না, তবু দৃঢ়গলায় বলেন, ছিঃ চন্দ্রা, ও কথা বলিস না। বলতে নেই! বরং বল যে ভগবানের আশীর্বাদ। এই হুহু করা শূন্য প্রাণের জ্বালা জুড়োবার একটু তবু

    চন্দ্রা আবেগের গলায় বলল, জুড়াবে না মা, আরও বাড়বে। তুমি অনীতা বোসকে বলে দিও এখন এই অগৌরবের মধ্যে কেউ আসুক, এ আমি চাই না, উনি তার ব্যবস্থা করুন।

    মা ধমক দিয়েছিলেন।

    বলেছিলেন, এরকম ভয়ংকর অবাস্তব আর সর্বনেশে চিন্তা যেন না করে চন্দ্রা। আর মনে মনে ভেবেছিলেন, মা হয়ে আর বলব কোন মুখে, মনের মধ্যেই রাখছি। আড়াই বছর সময়টা কম নয়। চিরদিন সুখে লালিত শরীরে ওই জেলের ভাত খেয়ে, টিকবে কী না টিকবে কে বলতে পারে? তখন কী হবে? তখন? তখন তুই আর এ বস্তু পাবি?

    স্পষ্ট করে বলেননি, তবু সেই অনুচ্চারিত সাবধানবাণী চন্দ্রার মর্মমূলে প্রবেশ করেছিল। চন্দ্রা আবেগপ্রবণ, কিন্তু চন্দ্রা বোকা নয়।

    চন্দ্রা শিউরে চুপ করে গিয়েছিল।

    খবরটা যখন অপর্ণা শুলেন, শুনলেন ভবানীবাবু, অনিন্দিতা দেবীর কাছ থেকে টেলিফোনের মাধ্যমে, তখন ওঁরা শুধু ভগবানকে ডাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলেন না। আর তো বলার উপায়ও রইল না বউমা আমাদের কাছে এসে থাকুন।

    ভবানীবাবু অবস্থাহীন নয়, কিন্তু! চন্দ্রার বাবা সেন সাহেবের মতো অধিক অবস্থাপন্ন নয়। আর অবস্থাপন্নের ঘরে দৌহিত্রসন্তান, বিশেষ করে প্রথমটি তো আসে সমারোহ সহকারেই।

    সেন সাহেবের বাড়িতে মেয়ের জন্যে সপ্তাহে সপ্তাহে নামকরা ধাত্রীবিদ্যাবিশারদ ডাক্তার অনীতা বসু তো আসবেনই, তা ছাড়াও ওদের পারিবারিক চিকিৎসক বিবেক সেনও দেখে যাবেন মাঝে মাঝে।

    দুঃখে বেদনায় মন গুমরে থাকায় প্রাণের মধ্যে উন্মোষিত নতুন প্রাণের অঙ্কুরটির যে ক্ষতি হতে পারে, এটা তো সকলেরই জানা, তবু বাপের বাড়িতে একটু সহজ থাকতে পারে।

    আর এও সত্যি, মেয়েকে যথাযথ যত্ন করার ব্যাপারে অনিন্দিতা দেবীর যতটা ক্ষমতা, অপর্ণা দেবীর কি ততটা হবে বউয়ের ব্যাপারে।

    অপর্ণার বয়েস অনেক বেশি, অপর্ণা খানিকটা রুগ্নও, এবং এখন অপর্ণ চূর্ণ হয়ে আছেন।

    অনিন্দিতা দেবীও কি কষ্ট পাননি? তাঁরও কি সমাজে মুখ হেঁট হয়নি?

    দুঃখ বেদনা লজ্জা অপমান তাঁরই কি কম? তবু ছেলে আর জামাই।

    অনেক তফাত! অনেক অনেক।

    চন্দ্রার ও বাড়িতে থাকাই ভাল।

    তবু যে বাড়িতে হালকা হাওয়া সে বাড়িতে অহরহ নিজের দুর্ভাগ্যের কথা মনে পড়বে না।

    না না, চন্দ্রার উপর কোনও দাবি করবেন না ভবানীবাবুরা, চন্দ্রা ওখানেই থাক। দুচার দিনের জন্যে এলেই ধন্য হয়ে যাবেন এঁরা।

    তবে সুশীলের বউ রমলা বলেছিল, এত রকম ভাববারই বা আছে কী? প্রথমবার তো মায়ের কাছেই থাকে।… আমি চলে যাইনি কানপুরে মার কাছে? ছমাস থেকে আসিনি?

    রমলার সঙ্গে কথা বাড়াতে ভালবাসেন না অপর্ণা, তাই বলেননি, সে থাকা আর এ থাকায় অনেক তফাত বউমা।

    চাকরি হয়ে ইস্তক কবছর সুনীল বাড়ি ছেড়ে কোয়ার্টার্সে চলে গিয়েছিল, তবু সমস্ত বাড়িখানা যেন সুনীলকে দিয়েই ভরা ছিল।

    বাড়ি অগোছালো থাকলে ছোটদাদাবাবু বকবে, এ কথা ভেবে তটস্থ থাকত চাকরবাকর। তা সে মাসে একদিন এলেও।

    সুনীল যা যা খেতে ভালবাসে, সেই একদিনেই সব রাঁধতে ইচ্ছা করত অপর্ণার।

    সুনীলের শখের জিনিসের নিদর্শন এখানে সেখানে, সুনীলের ফেলে রেখে যাওয়া জিনিস সর্বত্র। সুনীলের বইয়ের শখ ছেলেবেলা থেকে। বাড়ির একখানা ঘর তো প্রায় লাইব্রেরি বানিয়ে ফেলেছিল।

    মাঝে মাঝে (যখন আসত) দুপাঁচখানা নিয়ে যেত, আবার ফিরিয়ে এনে ঠিক জায়গায় রেখে দিত।

    বইয়ের বড় যত্ন সুনীলের।

    আর কর্মস্থানের সেই আস্তানাটি?

    আজ যা চন্দ্রার কাছে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি আর স্মৃতি গিয়ে ঘেরা?

    তার কথা অহরহ ভেবেছে চন্দ্রা, দিনে রাতে সকাল সন্ধ্যায়। সেই চিন্তার জ্বালার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল সদ্য গর্ভের অবসাদ অবসন্নতা। বিছানাটাই আশ্রয় হয়ে গিয়েছিল চন্দ্রার। চন্দ্রার মা মেয়েকে টেনে তুলতে পারতেন না, চন্দ্রার বউদিরা সাধ্যসাধনা করে হার মানত।

    তারপর ডাক্তারকে দিয়ে বললেন অনিন্দিতা।

    অনীতা বোস এ বাড়ির অনেক দিনের ডাক্তার, চন্দ্রাকে ছেলেবেলা থেকে দেখেছেন। তিনি এসে আচ্ছা করে ধমক লাগালেন। বললেন, এরকম করলে তো চলবে না। তোমার মধ্যে যে নিজেকে তৈরি করে নিচ্ছে, তুমি কি তার অনিষ্ট করতে চাও? পেটের বাচ্চাটার কথা ভাববে না তুমি…মন সর্বদা প্রফুল্ল রাখবে, বেড়াবে ঘুরবে

    মন সর্বদা প্রফুল্ল?

    চন্দ্রা অনীতা বোসের চোখের দিকে চেয়ে বলে, মন সর্বদা প্রফুল্ল রাখতে বলছেন?

    অনীতা বোস জোর দিয়ে বললেন, হ্যাঁ বলছি। এটা তোমার নিজের জন্যে নয়, তোমার ভবিষ্যৎ সন্তানের জন্যে।

    আমার কোনও ভবিষ্যৎ নেই মিস বোস।

    অনীতা বোস আবার ধমক দিলেন। ওসব সেন্টিমেন্টের কথা রাখো। জীবনের পথে সব সময় ভেলভেট বিছোনো থাকে না। কখনও কাঁটাবনও আসে। সবকিছুকেই সমান ভাবে মেনে নিয়ে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। …আমি বলছি–তোমায় উঠতে হবে, হাঁটতে হবে, হাসতে খেলতে হবে। মন প্রফুল্ল রাখতে হবে।

    বললেন জোর দিয়ে দিয়ে, আর অনিন্দিতাকে বলে গেলেন, আপনারা ওকে নিয়ে বেড়াতে যান, থিয়েটারে সিনেমায় নিয়ে যান, ওকে নানা আমোদ প্রমোদে ব্যাপৃত রাখুন।…এ কী? সারাক্ষণ বিছানায় পড়ে আছে আর কাঁদছে, এটা কি ঠিক? না না আপনাদেরও ভাবতে হবে।

    অতঃপর অনিন্দিতা, সেন সাহেব, তাঁর ছেলেরা, বউরা সবাই ভাবতে লাগল কী করে প্রফুল্ল রাখা যায় চন্দ্রা নামের ওই মেয়েটাকে।

    যে মেয়ের সৎ সাধু নির্মলচরিত্র স্বামী বিনা দোষে জেলে পচছে, যে মেয়ে তার মহারানিত্ব হারিয়ে নিরুপায়ের ভূমিকায় পিতৃগৃহে পড়ে আছে।

    .

    একদা যার আবির্ভাব আগমন এ বাড়িতে ছিল উৎসবের মতো, সে আবর্তিত হচ্ছে এখানের নিরুত্তাপ কর্মছন্দে। যার নিজের একটা আস্ত সংসার ছিল, ছিল পদ প্রতিষ্ঠা গাড়ি বাড়ি দাস দাসী, অপরের ঈর্ষার জোগানদার জীবন, তার এখন নিজের বলতে শাড়ি জামা গয়নাগুলো ছাড়া কিছুই নেই।

    অবশ্য মনোহরপুকুরের ভবানী রায়ের বাড়িতে নিজের বলতে অনেক কিছুই আছে তার, কিন্তু সে বাড়িতে তো ওর আসল বস্তু প্রাণটাই নেই। তাই সেখানের কোনও কিছুই তাকে আমার জিনিসের স্বাদ দেয় না।

    তিনতলার সেই ঘরটা।

    সেটা কি ওর আমার মনে হয়, যদি সুনীল না থাকে?

    রমলা অপ্রতিহত দাবিতে সব কিছু আমার ভাবতে পারে, চন্দ্রা পারে না।

    তাহলে?

    নিঃস্ব ছাড়া আর কী হবে চন্দ্রা।

    কিন্তু ডাক্তার বলছে প্রফুল্ল থাকতে হবে।

    কারণ?

    কারণ সেই অনাগত শিশুটি।

    যাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, টিকিয়ে রাখতে হবে।

    চন্দ্রা যদি তার পরম আশ্রয় বিছানায় পড়ে থেকে বালিশে মুখ গুঁজে ভাবে কিন্তু কেন? কেন বাঁচিয়ে রাখতে হবে? জেলখাটা আসামির সন্তান, এই পরিচয় বহন করতে? সে ভাবনার সাক্ষী তো শুধু ওই বালিশটা। সে ভাবনার ভাবলেশটুকু মাত্র তো প্রকাশ করার নয়?

    তাই সেই অনাগতের কল্যাণকল্পে চন্দ্রাকে ওর বাবার সঙ্গে খেলা দেখতে যেতে হয়, মায়ের সঙ্গে থিয়েটার দেখতে যেতে হয়, বউদিদের সঙ্গে সিনেমা, আর দাদাদের সঙ্গে মার্কেটে যেতে হয়।

    চন্দ্রার উকিল দাদা অবশ্য ওসবের মধ্যে নেই, অন্তত ছিল না কখনও, এখন হঠাৎ বলছে, এই চন্দ্রা তোর যদি কিছু কেনাকাটার দরকার থাকে তো বেরুতে পারিস আমার সঙ্গে।

    চন্দ্রা বলে, আমার দরকার? আমার আর কোনও দরকার নেই দাদা।

    দাদা অপ্রতিভ মুখটাকে অতি সপ্রতিভ করে বলেন, এই দেখো! মেয়েদের কখনও মার্কেটিঙের দরকার ফুরোয়?…তোর বউদি তো

    বউদিকেই নিয়ে যাও—

    তখন বউদি রঙ্গমঞ্চে এসে অবতীর্ণ হন। বলেন, এই শোন, আমার ছোট বোনের জন্মদিন আসছে না? একটা শাড়ি তো দিতে হবে? চল না দুজনে দেখে কিনি। প্রেজেনটেশানের জিনিস কিনতে পরামর্শের সঙ্গী একটা থাকলে ভাল হয়।

    অতএব যে জন্মদিনটা আসতে হয়তো তখনও অনেকগুলো দিন বাকি, সেই জন্ম দিনের উপহার কিনতে বেরোনো হয়। অত নিবন্ধাতিশয্য দেখে চন্দ্রা নিজের জেদ বজায় রাখতে পারে না।

    আর মেজদা?

    তার তো জীবনের একমাত্র লক্ষ্যই কেনাকাটা।

    মেজদা যে কী কেনে আর কী না কেনে! ঘর সাজাবার জিনিসে তার সব বোঝাই, সিঁড়ির কোনাগুলো থেকে দেয়াল অবধি সব ভর্তি। বউ বরং রেগে যায়। বলে, পুরুষমানুষের এত শখ দেখিনি বাবা। জায়গা কোথায় তার ঠিক নেই, তবু জিনিস এনে বোঝাই করছে।

    বাড়ি বড়?

    তা অবশ্য সত্যি।

    কিন্তু জঞ্জালের স্তূপ যদি আরও বেশি হয়ে ওঠে?

    মেজদা দেবেশ সে কথা মানে না।

    ও বলে, পুরনোগুলো বাতিল করে দাও না।

    বলে, চল তো চন্দ্রা, দুভাইবোনে ওকে জ্বালাতে আরও কিছু জঞ্জাল এনে জড়ো করি।

    বলে, কার্পেট চাদর বেডকভার পরদা, এসব কখনও বেশি হয়? কী অদ্ভুত একটা কার্পেট দেখে এলাম–

    অনেক সময় মেজদার উপর মায়া করেই যেতে হয়।

    আগেও হত, আহ্লাদের সঙ্গে যেত। এখন অনিচ্ছুক মন নিয়ে যায়। তবে বাজার দোকান এমন জিনিস যে, পাথর-মনকেও খানিকটা আকর্ষণ করে।

    চন্দ্রা প্রথমে উদাসীন চিত্তে তাকিয়ে দেখে, তারপর আস্তে আস্তে দুটো মন্তব্য করে, আবার ক্রমশ গুণাগুণ বিচারে তৎপর হয়।

    অবশ্য তৎপরতার কালও আবার ফুরোলো।

    সুনীল নামের হতভাগা ছেলেটা জেলখানায় বসে শুনল তার প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে।

    .

    পুত্রসন্তান!

    তার মনের মধ্যে যে কোন ভাবের তরঙ্গ উঠল কে জানে, সাক্ষী তো শুধু বোবা দেয়াল।

    যে ঘটনাটা মাত্র বছরখানেক আগে হলে দু দুটো বাড়িতে উল্লাসের উত্তাল ঢেউ উঠত, আর নবজাতকের ভূমিকা হত রাজপুত্রের, সেই ঘটনায় দুটো সংসারে নতুন করে উত্তাল হল বেদনার ঢেউ।

    অপর্ণা বললেন, যদি ছেলে না হয়ে মেয়েও হত!

    এর নিহিতার্থ হচ্ছে অন্তত প্রথম পুত্রসন্তান জন্মের আনন্দোল্লাসটার ভাগীদার হত তাঁর নিজের শেষ সন্তানটি।

    আশ্চর্য! ছেলেই হল।

    অনিন্দিতাও কি এ বেদনা অনুভব করেননি? করেছেন। কিন্তু তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আবার আলাদা।

    তিনি ভাবছেন, তবু রক্ষে যে ছেলেটুকু হয়েছে। একে আর অবহেলা করতে পারবেনা চন্দ্রা। নইলে মেয়ের যা ভাব। মা হয়ে কত অকথা কুকথাই বলে বসে।

    একদিন তো ফট করে বলে বসল, এত সাবধান হতে আমার দায় পড়েছে। আসছে তো নির্ঘাত একটা অপয়া লক্ষ্মীছাড়া

    আর একদিন বলল, প্রথমবারে হতে গিয়ে কত কীই দুর্ঘটনা ঘটে। আমি সুদ্ধ যদি শেষ হয়ে যাই, আপদ চুকে যায়।

    এসব কথায় অবশ্য অনিন্দিতা খুব রেগে যান, মেয়েকে তিরস্কার করেন, জামাই ফিরে এসে যদি দেখে তার যা কিছু অনিন্দিতার কাছে রেখে গিয়েছিল, অনিন্দিতা তা হারিয়ে ফেলেছেন, জামাইয়ের কাছে তাঁর মুখটা কেমন থাকবে, সে প্রশ্ন করেন, কিন্তু মেয়ে যেন প্রতিজ্ঞা করেছে কারও সঙ্গে মায়ামমতা রেখে কথা বলবে না।

    আবার মার সঙ্গেই যেন বেশি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলে।

    .

    তিন চারদিন তো ছেলের মুখ দেখল না চন্দ্রা,নার্সেরা যখন সামনে নিয়ে এসে বলেছে, দেখুন তো কী সুন্দর বাচ্চা হয়েছে আপনার, তখন চোখে হাত চাপা দিয়ে বলেছে, ওকে আমার সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে যান।

    অনীতা বসুর সঙ্গে অ্যাটাচড এই নার্সিং হোমের সকলেই চার জীবনের ইতিহাস জানে, কাজেই বেশি কিছু বলতে সাহস পায় না।

    তবে আড়ালে এসে ঠোঁট উলটে সমালোচনা করে, কত কত বাচ্চা পেটে থাকতে বিধবা হয়ে যাওয়া মেয়ে দেখলাম, তারাও তো এমন করে না। এঁর সবই বাড়াবাড়ি। ক্রিমিনাল স্বামীরই অভাব আছে নাকি সংসারে? তা বলে বাচ্চাকে এরকম করবে?

    নার্স সন্ধ্যা দাস এক খুনি আসামির গল্প ফাঁদে। যে লোকটা অকারণ স্ত্রীকে সন্দেহ করে তার মামাতো ভাইকে খুন করে ফাঁসিতে ঝুলেছিল। অবস্থাপন্ন ঘরের কাণ্ড!

    তার স্ত্রীও তো এমন করেনি বাবা! মেয়ে বাচ্চা হল, তবু তাকে দেখেছে আর কেঁদেছে। বরং মেয়েটাকে কাছছাড়া করতেই চাইত না, কেবল বলত ওকে আমার এখানেই রেখে যান না।… আর ইনি? অদ্ভুত!

    নার্সিং হোমে বদনাম কিনল চন্দ্রা। যেমন জেদি, তেমনি খামখেয়ালী, তেমনি রুক্ষভাষিণী।

    মাকে পর্যন্ত কীরকম করেন দেখেছ? বরং বউদিদের সঙ্গে একটু ভাল ব্যবহার করেন।

    হয়তো এও একটা মনস্তত্ত্ব।

    যার উপর জোর চলে, তাকে নিপীড়িত করা।

    বউদিদের সঙ্গে শুধুই ভদ্রতা সম্পর্ক, মার সঙ্গে অন্তরের সম্পর্ক।

    তাই মা যখন বোঝাতে এলেন, ছেলে সন্তান, তাকে অমন অবহেলা করিসনে চন্দ্রা, ভগবান ছল খুঁজে বেড়ান–

    তখন চন্দ্রা মার মুখের উপর অনায়াসে বলে বসল, ছল খুঁজে আর আমার কতটা ক্ষতি করতে পারবেন তোমার ভগবান? বোঝার উপর শাকের আঁটি। কোনও দুঃখ নেই।

    মা শিউরে উঠে ষাট ষাট করলেন।

    হয়তো সুনীল অকস্মাৎ কোনও দুর্ঘটনায় মারা গেলে এর চাইতে অনেক সান্ত্বনা পেত চন্দ্রা। তাতে দুঃসহ শোক থাকত, এমন দুরপনেয় জ্বালা থাকত না।

    জ্বালা।

    অপমানের জ্বালা। অভিমানেরও জ্বালা।

    চন্দ্রার আকাশে ঠেকা মাথাটাকে বিশ্বসংসারের কৌতুক কৌতূহলী দৃষ্টির সামনে একেবারে ধূলোয় লুটিয়ে দিয়েছে সেই হতভাগ্য হতবুদ্ধি লোকটা।

    হতবুদ্ধি ছাড়া আর কী?

    আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও পথ খুঁজে পেলি না? শুধু ধর্মের মুখ চেয়ে বসে থাকলি?

    সত্য একদিন প্রকাশিত হবেই।

    বড় কথা বললেন।

    কেন? তোর বুদ্ধির ছুরিতে ওই বদলোকগুলোর ষড়যন্ত্রের জাল কেটে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারলি না?

    সত্য প্রকাশের জন্যে কি শুধুই ধর্ম থাকে? প্রমাণ থাকে না?

    তোর উপর যে অন্যায় অভিযোগ এসেছিল তা খণ্ডন করবার ক্ষমতা হল না তোর? বড্ড যে বিদ্যে বুদ্ধির মহিমা ছিল? তবে তোর থেকে কম বুদ্ধিমান ভোঁ ভোঁতা লোকগুলো তোকে ফাঁসালো কী করে?

    মনের মধ্যে এই ভাষাই উথলে ওঠে, ছাই, ছাই, ছাই বিদ্যে!..নিজে তো জেলের মধ্যে ঢুকে গিয়ে বসে আছিস, লোকলোচনের অন্তরালে। কিন্তু একবারও কি ভাবছিস চন্দ্রা নামের মেয়েটা কোন মুখ নিয়ে লোকসমাজে মুখ দেখাচ্ছে? তুমি তার মুখখানায় চুনকালি মাখিয়ে দিয়ে চলে গেলে, সেই কলঙ্কিত মুখটা নিয়ে সে বেঁচে রইল তোমার সন্তানকে সুশৃঙ্খলে পৃথিবীতে আনতে।…তার জন্যে চন্দ্রাকে ভাল খেতে হচ্ছে, ভালভাবে থাকতে হচ্ছে, প্রফুল্লতা বজায় রাখতে হচ্ছে।… চন্দ্রাকে মন ভাল রাখতে বাইরের জগতে মুখ দেখাতে হচ্ছে।

    কেন? কেন? চন্দ্রাকে এত কষ্ট সইতে হবে কেন? চন্দ্রা কোন দোষে দোষী?

    মনের অগোচর পাপ নেই, মাঝে মাঝে আবার আর একটা তীক্ষ্ণ কাঁটার খোঁচা একেবারে মর্মের মূলে জ্বালা ধরায়।

    ভগবান জানেন আর তুমি জানো, সবটাই তোমার শত্রুপক্ষের সাজানো কিনা। অথবা ওই সাজানোটা তোমারই কিনা। লোভ বড় ভয়ানক জিনিস। হয়তো পাপ লোভ তোমাকে গ্রাস করে বসেছিল—

    অনেক চেষ্টা করে এই ভয়ানক মর্মান্তিক চিন্তাটাকে মন থেকে দূর করে ফেলতে, কিন্তু এক এক সময় যেন চিন্তাটা পেয়ে বসে।

    তখন চন্দ্রা স্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়ে তন্নতন্ন করে সেই দিনগুলি তুলে তুলে দেখতে বসে।

    আচ্ছা

    অতর্কিত ওই অভিযোগের আক্রমণটা এসে পড়ার আগের দিনগুলো কেমন ছিল? সুনীল রায় নামের সেই দেবদূতের মতো নির্মল চেহারার মানুষটার চোখে মুখে চেহারায় কোনও পরিবর্তনের ছাপ পড়েছিল কী?

    যেদিন সুনীল ফ্যাক্টরি থেকে আর কোয়ার্টার্সে ফিরল না, টেলিফোনে খবর এল–হি হ্যাঁজ বীন অ্যারেসটেড।

    তার আগের দিনে?

    তারও আগের দিনে?

    চন্দ্রা যেন হাত-আয়নাখানা মুখের সামনে খুলে ধরে।…

    সেই আগের দিনেও চন্দ্রা ভোরবেলা বরের ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দিয়েছিল রাত্রে পরা রাত্রিবাসটাই পরে।

    ছটার সময় ফাক্টরিতে গিয়ে হাজির হতে হয়, তার আগে ব্রেকফাস্ট সেরে নেওয়া।

    মমতাশীল আর শান্তিপ্রিয় সুনীল বলত, চাকর-টাকরকে আর অত ভোরে ডেকে তুলে কাজ নেই বাবা, তোমাকেও ঘুম ভেঙে ওই নাইটি পরে ঘুরঘুর করতে হবে না। মালপত্তরগুলো যদি ঠিক করা থাকে, দুখানা টোস্ট, দুটো ডিম সেদ্ধ আর এক কাপ হরলিক্স আমি খুব তৈরি করে নিতে পারব।

    চন্দ্রা বলত, জানি, তুমি খুব করিঙ্কর্মা। তাই নিয়ে আর এত মহিমা ফলাতে হবে না।

    সুনীল বলত, তার মানে নিজের মহিমাটি খর্ব করতে চাও না, কেমন? সেই যে সবির কথা বসুমতী কেন তুমি এতই কৃপণা?..বসুমতী উত্তর দিলেন, বিনা-চাষে শস্যটস্য সাপ্লাই করা আমার কাছে কিছুই না, তবে আমার গৌরব তাতে সামান্যই বাড়ে, তোমার গৌরব তাহে একেবারে ছাড়ে এও অনেকটা সেইরকম।

    চন্দ্রা রেগেমেগে বলত, দিন নেই, রাত নেই, সব সময় সব কথায় কবিকথাকোট করা। খুব তুমি পড়ুয়া বুঝলাম। আমার অত পড়া নেই, মুখস্থ নেই, বুঝতে দেরি লাগে।

    আহা পোড় পোড়ো! স্বর্গীয় আহ্লাদের স্বাদ পাবে।

    .

    কিন্তু শেষ দিন?

    সেদিন এত কথা হয়নি, সেদিন বোধহয় সুনীলের একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল ঘুম ভেঙে উঠতে। বলল, এই দ্যাখো কী দেরি করে ফেললাম। তোমার তো দেখছি নাইটি পরে ঘুরঘুরনি শুরু হয়ে গেছে।

    চন্দ্রা চোখে মধুর কটাক্ষ হেনে বলল, হবেই তো। বেশ করব, আমার ঘরে আমি নাইটি পরে ঘুরে বেড়াব। ইচ্ছে হলে কিছু না পরেও ঘুরতে পারি।

    অত ব্যস্ততার মধ্যেও সুনীল চট করে এগিয়ে এসে বলে উঠেছিল, আহাহা, সেই ইচ্ছেটা একটু প্রকাশ করো না। অলৌকিক দৃশ্যটা দেখে শুভযাত্রা করে বেরিয়ে পড়ি।

    শুভযাত্রা? অসভ্য কোথাকার।

    চন্দ্রা হেসে গড়িয়ে পড়ল।

    দেখো দেখো,সুনীল হাঁ হাঁ করে উঠল, গরম জলের কেটলি হাতে! সাবধান।

    আচ্ছা, সুনীল আর কিছু না বলে শুভযাত্রা শব্দটা উচ্চারণ করল কেন? কই, ও কথা তো বলতে শুনিনি কোনও দিন?…তবে কি সেদিন ওর মনের মধ্যে কোনও আশঙ্কা ছিল? তাই শুভযাত্রা কথাটা মনের মধ্যে পাক খাচ্ছিল? যাতে তাতে একটা বাজে কথায় বলে বসল।

    শুভযাত্রা। শুভযাত্রা।

    এটা তো একটা অপ্রচলিত শব্দ। কেন ওর মুখে এল? হ্যাঁ ওই দিনটাই তো শেষ দিন।

    আচ্ছা তার আগের দিন? যখন সুনীল দুপুরে লাঞ্চ খেতে এল?

    কোনও তারতম্য ছিল তার ব্যবহারে?

    কোনও পার্থক্য মুখের চেহারায়?

    কই? কিছু না তো। না না কিছু না। যেমন অন্যদিন, তেমনি সেদিন।

    চন্দ্রা যখন বলে উঠল, আঃ আবার তুমি তোমার ওই ফ্যাক্টরির নোংরা পোশাকে আমার ঘাড়ে পড়তে এলে?

    সুনীল সোজা চন্দ্রাকে তুলে উঁচু করে ধরে বলে উঠল, ঘাড়ে পড়তে এলাম? না, ঘাড়ের উপর তুলতে এলাম?

    তোমায় কিছু করতে হবে না, চটপট চান করে নাও তো।

    হচ্ছে বাবা হচ্ছে! একটু চোখ মেলে দেখতে দাও।

    কী দেখবে শুনি?

    কী দেখব?

    সুনীল একটু গভীর চোখে চেয়ে বলল, এই আমার স্বর্গভূমি! এই আমার হৃদয়দেবী—

    চন্দ্রা চেয়ারে বসে পড়ে বলল, তবে দেবী এই বসলেন। দেখো যতক্ষণ প্রাণ চায়।

    ওরে সর্বনাশ!

    সুনীল লাফিয়ে উঠল, এক্ষুনি বেরোতে হবে। চটপট দিয়ে দিতে বল।

    কেন, চোখ মেলে দেখবে না?

    দেখব, দেখব। সেই নিভৃত অবসরে–সেই স্বর্গীয় মূর্তিতে।

    সুনীলের চোখের কোনায় কৌতুক ছটা।

    চন্দ্রা বলে উঠল, দেখ, তুমি দিন দিন বড় অসভ্য হয়ে যাচ্ছ–

    সুনীল লড়াইয়ের ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়াল, তার মানে? অসভ্য আমি হয়ে যাচ্ছি না নিজে হয়ে যাচ্ছ? কী বলেছি আমি শুনি? স্বর্গীয় মানে কী, অভিধান খুলে দেখ। নিজেই সব কথার মধ্যে থেকে গভীর অর্থ আবিষ্কার করে—

    আমি আবিষ্কার করি? আর কিছু নয়। নিজে যে চালাকের রাজা। কথা তো শুধু মুখেই বলল না, অনেক কথা যে চোখ দিয়েও বলল।

    তবে আর কী করা? চোখের ভাষা পড়তে তোমায় কে মাথার দিব্যি দিয়েছে?

    তারপর?

    তারপর চান করে এল সুনীল।

    তারপর খেতে বসল।

    খেতে বসে কী কী কথা বলল, সব মুখস্থ আছে চন্দ্রার। চন্দ্রা সেদিন কী কী রান্না করিয়েছিল, তাও মনে আছে।…মনে করতে বসলে ছবির মতো মনে পড়ে যায়। এমনকী আবার বেরোবার সময় চাকরের চোখ বাঁচিয়ে চট করে যে কেমন একটা

    সব মনে আছে।

    সব।

    মনে থাকত না, যদি ওই দিনটার পর আরও দিন গড়িয়ে যেত একই ছাঁচে, একই ছন্দে।

    তা হলে কি খেয়াল থাকত, খেতে বসে সুনীল বলে উঠেছিল, আসার সময় রোজ ভাবতে ভাবতে আসি আজ টেবিলে নতুন কী সারপ্রাইজ।

    চন্দ্রা মুখে ওর নিজস্ব ভঙ্গির লাবণ্য ঝংকার তুলে বলেছিল, আহা! আর কিছু ভাবতে ভাবতে আসেন না উনি, ভাবতে ভাবতে আসেন টেবিলে কী চমকপ্রদ বিস্ময়কর অপেক্ষা করছে। ভারী খাইয়ে মানুষ!

    আহা খাইয়ে নাই বা হলাম, জিনিসটার মর্ম বুঝি তো? এই যে তুমি সারা সকাল ধরে

    চন্দ্রা কথাটা থামিয়ে দিয়েছিল, আচ্ছা অনেক হয়েছে, এখন খাও তো

    সুনীল হাসল।

    সুনীল তারপর খেতে খেতে বলল, আমার সুখে অনেকের হিংসে, বুঝলে?

    চন্দ্রা বলল, কেন? কী এমন সুখের সাগরে ভাসছ তুমি শুনি? কুলি কামিনের মতন খেটে পিটেই তো খাচ্ছ।

    সে কথা নয়, হিংসে তোমায় নিয়ে।

    আমায় নিয়ে?

    হু। কেনই বা নয়। এই তো চ্যাটার্জি বলছিল, তোমার ভাগ্যটি রায়, ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো। একদিকে অমন ধনবান বাবা, বাবার বাড়ি, গাড়ি, ওদিকে আরও বিত্তবান শ্বশুর, এবং কন্যাটি একমাত্র! তার উপর এই চাকরি! আর স্ত্রীটি শুধুই সুন্দরী নয়, বিদুষী, গৃহকর্মনিপুণা, সংগীতজ্ঞা, মানে একেবারে পাত্রী চাইয়ের বিজ্ঞাপন।

    চন্দ্রা, অবোধ চন্দ্রা তখনও সে কথার গুরুত্ব বোঝেনি! বোঝেনি হিংসে করা মানে কী?

    চন্দ্রা হেসে হেসে বলেছিল, দেখো, সাবধান! আবার লুঠ করে নিয়ে না যায়।

    অবোধ চন্দ্রা তখন জানত না সেই হিংসুটেরা সত্যিই সুনীল নামের মানুষটার সব কিছুই লুঠ করে নেবে। সুনীলের সেই ভাগ্য, যা নাকি তারা ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখবার যোগ্য বলে মনে করত তা লুঠ করবারই মতলব আঁটছিল ও।

    ওই চ্যাটার্জিটা।

    ওটাই।

    হ্যাঁ ওটাই সুনীলের সব শেষ করে দিয়েছে। ধ্বংস করে দিয়েছে তার জীবনটাকে। অথচ ওই সাংঘাতিক সর্বনেশে লোকটাই বেশি বেশি আসত সুনীলের বাসায়। সন্ধেবেলার আড্ডাটি সুনীলের বাসাতেই প্রধান, অনেকে আসত।

    অফিসারদের আড্ডা।

    অধিকাংশ গল্পই অফিসকেন্দ্রিক।

    একের কথা অপরের কাছে, অসাক্ষাতে সমালোচনা, ডিরেক্টরদের মুণ্ডপাত, আড্ডার চেহারা প্রায়শই এই।

    ওরা চলে গেলে সুনীল বলে, আশ্চর্য এদের জগৎটা শুধু ওই রবার কোম্পানির গণ্ডিতেই আবদ্ধ, আর কোনও কথা জানে না, আর কিছু ভাবতে জানে না, আর কোনও স্বপ্ন দেখে না।

    চন্দ্রা ঠোঁট উলটোয়, তবু তো মশাই ওদের নিয়েই মশগুল!

    মশগুল না হয়ে উপায় আছে? ওরা যদি বুঝে ফেলে এ পাখিটার পাখার পালক অন্য রঙের, তা হলে ঠুকরে শেষ করে ফেলবে না? অতএব ওদের রঙের পালক চুবিয়ে

    বাজে কথা! ওই সব অসার লোকগুলোই তোমার সব, সন্ধেটা ওরাই খেয়ে দিয়ে যায়। তার সঙ্গে খায় টিনের বিস্কুট, ভাঁড়ারের চা–

    আহা হা তবু তো আসল জিনিসটা এখানে পায় না।

    আসল জিনিস? ওঃ বোতল?

    হু। ওটি দেখ গে ঘোষালের বাসায়, চ্যাটার্জির বাসায়—

    তা সেখানেই সবাই গেলে পারে? মনের আনন্দে আসল জিনিস নিয়ে বসে থাকবে। এখানে এসে জোটে কেন?

    জোটে কেন?

    সুনীল হাসে, ঘোষাল চ্যাটার্জি, তা বলে এত বোকা নয় যে, রোজ আজ্ঞা বসিয়ে বোতলের হরির লুঠ দেবে। ভয়ে নিজেরাই কেটে পড়ে বাড়ি থেকে।

    এইসব বিচ্ছিরি মদখাওয়া বন্ধু তোমার!

    বন্ধু? বন্ধু মানে! বলল সহকর্মী।

    তার মানেই সহধর্মী।

    সুনীল গম্ভীর হয়ে বলে, আমাকে তোমার ওদের দলের বলে মনে হয়?

    চন্দ্রা অনায়াস ভঙ্গিমায় বলে, কেন, হবে না? দিব্যি তো হাহা হিহি চালিয়ে যাও।

    চালাতে হয় হে মহারানি। এসব জায়গায় এইটাই বিরাট অসুবিধে। এখানে কলকাতার মতো তুমি তোমার নিজের ইচ্ছেমতো হয়ে থাকতে পারো না। তোমাকে দলে মিশতেই হবে। পরনিন্দা পরচর্চায় যোগ দিতেই হবে, নেহাত না পারলে কান পেতে শুনতেও হবে।…ঘুরেফিরে ওই ফ্যাক্টরি আর অফিসের গল্পই সার করতে হবে।

    তবে তো বড় চাকরির বড় সুখ।

    সুনীল ওকে কাছে টেনে নিয়ে গভীর সুরে বলেছে, সুখ জিনিসটা তো নিজের কাছে। ওসব তো বহিরঙ্গ। ওরা আমার বিরক্তিকর হতে পারে, সুখের হন্তারক হতে পারে না।

    এইসব কথা ভাবতে গেলেই চন্দ্রা মনে মনে ডুকরে ওঠে, তুমি বোকা, তুমি অবোধ, তাই ওই ভেবে নিশ্চিন্ত ছিলে।

    কই, সুখ জিনিসটাকে নিজের কাছে রাখতে পারলে না? ওরা হন্তারক হয়ে তোমার জীবনের সব সুখ কেড়ে নিল না?

    ভবিষ্যতেও কি আর কোনওদিন তুমি তোমার নিজের কাছে রাখা সুখটি কৌটো খুলে বার করে ভোগ করতে পারবে?

    অনবরত যত সব কেচ্ছাকাহিনী শুনতে শুনতে কাতর হয়েই বোধহয় সুনীল তাস পাড়ত। বলত হয়ে যাক দু দান।

    চন্দ্রা আগে তাস খেলতে জানত না।

    সুনীল শিখিয়ে দিয়েছিল।

    চন্দ্রাকেও ওদের পার্টনার হতে হত।

    আর ওই চ্যাটার্জিটা সব সময় সবাই চলে যাবার পরও থেকে যেত।

    আর আসত তো সকলের আগে।

    বসে বসে বকবক করেই যেত।

    ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একঘেয়ে গল্প।

    আর একঘেয়ে প্রশস্তি।

    রায় তোমার বাড়িটা সব সময় এমন ছবির মতো রাখো কী করে বলো তো?…রায় তোমার বাগানে এত ফুল ফোঁটাও কী করে বলো তো?

    সুনীল বলত, ওসব শ্ৰীমতীর সিক্রেট।

    চ্যাটার্জি চলে গেলে চন্দ্রা কতদিন বলেছে, ওকে বরং তোমার সংসারের মেম্বার করে নাও, এখানেই পড়ে থাকুক। তোমার বাসা থেকে নড়তে তো আর ইচ্ছে করে না ভদ্রলোকের।

    সুনীল হেসে হেসে বলেছে, কী করে ইচ্ছে করবে? এখানের আকর্ষণটা ভাবো।

    তুমি ভাবো! আমার ভাল লাগে না।

    আরে বাবা ফুলের বনে মৌমাছিরা এসে জুটবেই।

    তবে আমায় কলকাতায় রেখে এসো।

    আশ্চর্য! এত রাগ! লোকটা তোমার এত কী ক্ষতি করছে?

    সারাদিনের পরে যখন নিজেরা একা থাকতে ইচ্ছে করছে, তখন ওই একজন তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি। বিশি! আর সবাই তবু খানিকক্ষণ থেকে উঠে যায়, ও আর উঠতেই চায় না।

    তাহলে নির্ঘাত তোমার প্রেমে পড়েছে।

    চন্দ্রা বলে উঠত, ঠিক আছে তাই পড়ুক। তুমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখো।

    আহা দৃশ্যটা কি কম মজার? তবে হ্যাঁ, তুমি যদি ওর প্রেমে পড়তে যাও, তা হলে আলাদা কথা!

    চন্দ্রা একেবারে গাঁইয়া মেয়ের মতো বলত, কেন, আমার কি গলায় দিতে দড়ি জুটবে না?

    তবু চ্যাটার্জি আসত। কেউ কিছু বলতে পারত না।

    শুধু শেষের সন্ধেটা আসেনি।

    আসবে কেন? সেদিন তো জাল গোটাবার শেষ লগ্ন।

    নিভৃতে বসে অহরহ এই সবই ভেবেছে চন্দ্রা।

    কখনও ভেবেছে লোকটা যদি হঠাৎ ভয়ানক কোনও রোগে আক্রান্ত হয়ে যোবাকালা হয়ে যেত। যদি স্ট্রোক হয়ে প্যারালিসিস্ হয়ে যেত। যদি পক্স হয়ে অন্ধটগ্ধ হয়ে যেত।

    হ্যাঁ। এইরকম ভয়ংকর নারকীয় কথাও ভেবেছে চন্দ্রা।

    মনের গভীরে কার যে কী থাকে, কে টের পায়?

    চন্দ্রা যখন চোখের উপর হাতচাপা দিয়ে এইসব ভাবত, তখন সবাই ভাবত, আহা স্বামীর কথা ভাবছে। জেলে স্বামীর কত কষ্ট হচ্ছে সেই ভেবে বুক ভেঙে যাচ্ছে ওর।

    যখন সেই স্বামীকে উদ্দেশ করে চন্দ্রা মনে মনে যা ইচ্ছে তাই বলেছে, তখনও লোকে ভেবেছে মন কেমন করছে তাই অমন ফুলে ফুলে উঠছে।

    ভিতরটা কে বুঝতে পারে?

    চন্দ্রা তো হঠাৎ হঠাৎ ভেবে ফেলে, আচ্ছা ওই পাজি লোকটাকে সুনীল এত প্রশ্রয়ই বা দিত কেন? ওই অসহ্য লোকটাকে সহ্য করত কেন?

    তবে কি সুনীলও ছিল ওই পাপচক্রে?

    শুধু সুনীল বোকা বলেই ওকে আগুনের মুখে ঠেলে দিয়ে তারা নিজেরা গা বাঁচিয়ে দিব্যি রাজতক্তে রয়ে গেল?

    সন্দেহ! সন্দেহ মাথাচাড়া দেয় এক এক সময়।

    অনেকদিন না দেখে সুনীল যেন ক্রমশই ধূসর হয়ে যাচ্ছে।

    প্রথম প্রথম চন্দ্রা তাকে দেখতে যেত, কিন্তু ক্রমশই শরীর ভারী হয়ে উঠল, তারপর নার্সিংহোমে, তারপর বিশ্রামের টাইম, যাওয়াটা বন্ধ হয়ে গেল।

    আর সেই না দেখার ধূসরতর জাল আচ্ছন্ন করে ফেলছে বিশ্বাসের স্থির সূর্যকে।

    ক্রমশই কী জানি! কী জানি!

    আর এই কী জানিটা যেন চন্দ্রার এই পরিমণ্ডলেও গুগুন্ করতে শুরু করল ক্রমশ।

    যারা সতেজে বলেছে এ হতেই পারে না, অসম্ভব! তাদেরই মুখের রেখায় রেখায় যেন এই কথা ধ্বনিত হচ্ছে, ভগবান জানেন।

    একদিন চন্দ্রার মেজদার শালা কথাপ্রসঙ্গে বলে উঠল, রেখে দাও না ওসব বাজে কথা। উনি প্রভু ভাজা মাছখানি উলটোতে জানেন না! হুঁ! যাদের সঙ্গে কারবার চালাচ্ছিলেন, তারা আরও ঘুঘু, তাই উনি একাই ফাঁসলেন।… আরে বাবা, একটি সাইনের উপর যদি লাখ লাখ টাকার কারবার চালানো যায় কেউ ছাড়ে? আমার অমন সুযোগ থাকলে আমিই ছাড়তাম নাকি?

    চন্দ্রা খাবার ঘরে ছিল, ওরা, মানে মেজবউদি আর তার দাদা হয়তো জানত না সেটা।

    চন্দ্রা অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল, অনেকবার ভাবতে চেষ্টা করল, এ অন্য কার কথা। কিন্তু সে ভাবনা টিকল না। চন্দ্রা টের পেল, সুনীল ক্রমশই সকলের বিশ্বাস হারাচ্ছে।

    চন্দ্রা বাড়ির চাকরবাকরদের সামনে মুখ তুলে তাকাতে পারত না বলেই জোর করে বেশি তম্বি করত, হুকুম চালাত, সেই কুমারীবেলার মতো, কিন্তু সেটা ধোপে টিকল না।

    চন্দ্রা একদিন শুনতে পেল পুরনো ঝি রাসুর মা বলছে, আহা ওর কথায় দোষ নিওনি তোমরা। সোয়ামী যার গারদে পচছে, তার কি মাতার ঠিক থাকে?

    তার মানে রাসুর মা চন্দ্রাকে করুণা করল।

    চন্দ্রা শুন্যে মাথা ঠুকে ঠুকে বলতে লাগল, তবু আমায় বেঁচে থাকতে হবে, লোকের সামনে মুখ দেখাতে হবে। তার কারণ তোমার সন্তানকে আলোর মুখ দেখাবার দায়িত্ব আমার।…তুমি অন্ধকারের অতলে তলিয়ে বসে থাকলে, আর আমি, আমি এই ঘৃণার নরককুণ্ডে বসে তপস্যা করছি কবে তোমার সন্তানকে আলোর মুখ দেখাব।

    অহরহই এই শূন্যে মাথা ঠোকা চলছিল। অবশেষে অবশ্যই এল সে দিন।

    ছেলে আলোর মুখ দেখল, চন্দ্রা ছেলের মুখ দেখল না।

    চন্দ্রার বাবা সেন সাহেব যিনি সর্বদাই তাঁর বিজনেস নিয়ে আর এটা সেটা নিয়ে মগ্ন। পারিবারিক জীবনের সঙ্গে যোগসূত্র কম, তিনিও পরদিন নাতির মুখ দেখতে নার্সিংহোমে এলেন। দশখানা একশো টাকার নোট নিয়ে নাচাতে নাচাতে বললেন, কই দেখি সে শালাকে। দেখি আমার চেয়ে ফরসা কিনা। রূপের খ্যাতি শুনতে শুনতে কান কালা হয়ে যাচ্ছে।

    সাধারণত এ ধরনের কথা শোনা যায় না সেন সাহেবের মুখে, এটা খানিকটা অভিনয়ই; আর সেটা বুঝতে দেরি হয় না চন্দ্রার।

    তার মানে এও এক রকমের করুণা।

    এখন চন্দ্রার আর এই জগৎ থেকে করুণা ছাড়া অন্য কিছু প্রাপ্য নেই।

    তবু চন্দ্রা বাবাকে মার মতো তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে সাহস করে না, বলে উঠতে পারে না, গিনিটিনি না দিয়ে এক হাজার টাকা কেন বাবা? হতভাগাকে ভিক্ষে দিচ্ছ?

    কথাটা তো মুখের আগায় এসেছিল।

    নার্সরা তাড়াতাড়ি ছেলে এনে সামনে ধরল। সেন সাহেব আলতোভাবে একটু ছুঁয়ে বললেন, নাঃ! শালা রূপের দেমাক করতে পারবে। কই, তুই একবার গণেশ জননী হয়ে বোস দিকিন দেখি।

    চন্দ্রা বোঝে এসব পরিকল্পিত, চন্দ্রা নির্লিপ্ত গলায় বলে, অতটুকু ছেলেটেলে দেখলে আমার কেঁচো কেন্নোর মতো লাগে।

    এই দেখো! নার্স, এ মেয়ে কী বলে? আর কোনও মা বলে এসব?

    নার্স আর কী বলবে? চুপ করে থাকে। সাহস ফলিয়ে জোর করে চন্দ্রার কাছে বাচ্চাকে দিতে পারে না। কে জানে ফট করে খাট থেকে ঠেলে দেবে কিনা।

    সেন সাহেবের পরিকল্পনা অভিনয় সবই বৃথা হল, তিনি শুধু নার্সদের সন্দেশ খেতে এক মুঠো টাকা দিয়ে বিদায় নিলেন।

    .

    খবর পাওয়া মাত্র মনোহরপুকুর থেকেও সবাই এসেছিল।

    ভবানীবাবু, অপর্ণা, সুশীল, রমলা, সুশীলের ছেলে শঙ্খ, মেয়ে রুবি।

    কিন্তু সেদিন তো চন্দ্রার চেতনা ছিল না।

    ওঁরা আবারও এলেন, সেদিন চন্দ্রা হঠাৎ অসময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

    আবারও আসছেন ভবানীবাবু আর অপর্ণা।

    বেয়াই বাড়ি এমনভাবে সহজ হয়ে বারবার যাওয়া যায় না, যে কদিন নার্সিংহোমে থাকে, সেই কদিনই সুবিধে। তবু

    ওঁরা আসেন যেন চোরের মতো।

    যেন ওই ছেলেটার উপরও ওঁদের কোনও দাবি নেই। শুধু একটু দেখতে পেয়েই কৃতার্থ।

    ভবানীবাবুর ব্যবহারে সেন সাহেবের মতো বাঁচালতা ছিল না। থাকবার কথাও নয়।

    তিনি এসে বসলেন, প্রায় ইশারাতেই নার্সের কাছে আবেদন জানালেন, আর নার্স যখন নিয়ে এল, নিজের হিরের বোম সেটা মুঠো থেকে বার করে ফেলে দিলেন ওর বুকের উপরে। কী আশীর্বাদ করলেন কে জানে, শুধু ঠোঁট দুটো কাঁপল থরথর করে।

    হয়তো হাতটাও।

    একটা ছেলেমানুষ নার্স বলে উঠল, ও কী দাদু বোম সেট? পরতে শিখতে তো অনেক বচ্ছর লাগবে?

    ভবানীবাবু কেমন ভাবহীন চোখে, তাকিয়ে বললেন, এখন পরতে পারবে না বলছ? তা বটে। আসলে ওর বাবা ঠাট্টা করে বলত, এটা তুমি আমার ছেলেকে দেবে।

    নার্সটা চুপ করে গেল।

    মৃত্যুশোক নয়, তবু মৃত্যুশোকেরই তুল্য যেন।চন্দ্রা যেন একটু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।

    ভবানীবাবুও নার্সদের মিষ্টি খেতে টাকা দিয়ে গেলেন, কিন্তু সেন সাহেবের মতো সমারোহ করে নয়। নীরবে।

    অপর্ণা তো আগেই দিয়েছেন।

    অপর্ণা সোনার হার দিয়ে মুখ দেখেছিলেন, তখন চন্দ্রা মন্তব্য করেছিল, হার? পৃথিবীতে তো সর্বত্রই ওর হার, আবার ও হার?

    অপর্ণা আস্তে বললেন, এটাকে তো মালাও বলা যায় ছোটবউমা।

    তাই বলুন।

    বলেছিল চন্দ্রা।

    তারপর রোজই আসেন অপর্ণা, হাত ভর্তি করে ফল খাবার নিয়ে আসেন, দুএকটি কুশল প্রশ্ন করেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে উঠে যান।

    চন্দ্রা সেইদিকে তাকিয়ে থাকে, কেমন একরকম অপ্রতিভ দৃষ্টি মেলে। চন্দ্রার ইচ্ছে হয় ওঁর সঙ্গে একটু ভাল করে কথা বলতে, কিছুতেই যেন পেরে ওঠে না।

    অথচ আগে যখন সুনীলের সঙ্গে ত্রিবেণী থেকে এক-আধদিনের জন্যে এসেছে কত কথা বলেছে। নিজের ছেলেটিকে বেশি খাওয়াচ্ছেন, নিজের ছেলেটিকে বেশি ভালবাসেন, পরের মেয়ের দিকে তাকিয়েও দেখছেন না বলে শৌখিন আবদারের ঝড় তুলেছে। ত্রিবেণীতে যাদের সঙ্গে চেনাটেনা হয়েছে, তাদের কারও কারও সম্পর্কে মজার সমালোচনাও করেছে কত।

    কিন্তু এখন কেমন আড়ষ্টতা এসে গেছে। হয়তো ক্রমশই একটা অপরাধবোধ জন্ম নিচ্ছে চন্দ্রার মধ্যে। যেন চন্দ্রা ওঁদের সঙ্গে যথোচিত ব্যবহার করছে না। এই ছেলেটা যে ওঁদের সম্পত্তি, এমন একটা চেতনাই কি চন্দ্রার মধ্যে এই অপরাধবোধের সৃষ্টি করেছে?

    তবু চন্দ্রা হঠাৎ করে মা বলে ডেকে কোনও কথা বলতে পারে না অপর্ণাকে।

    কিন্তু নার্সিং হোমের দিন তো ফুরোলো।

    আবার সেই নিউ আলিপুরের বাড়ি।

    সেই আহা আহা সেই চেষ্টাকৃত হাসি ঠাট্টা, সেই অনীতা বোসের সর্দারি।

    চন্দ্রার অন্তরাত্মা বিদ্রোহী হতে চাইছে।

    অথচ চন্দ্রা হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে।

    অনিন্দিতার দুঃখ ও বোঝে বইকী।

    তাঁর হঠাৎ হঠাৎ আক্ষেপের মধ্যে সে দুঃখ ধরা পড়ে।

    ষষ্ঠী পুজোর দিন নাপিত বউকে টাকা আর কাপড় দিয়ে বললেন, সাধ ছিল খুকুর ছেলে হলে সাধ মিটিয়ে দেখিয়ে দেব ঘটা কাকে বলে। তা ভগবান বাদী!

    নাপিত বউও বলল, আমাদেরও তো চাইবার মুখ নেই মা। জামাইবাবু খালাস হয়ে ফিরুক, তখন আমোদ আহ্লাদ করব।

    বাড়ির চাকরবাকরদের বখশিশ-টখশিশ সবই দিলেন, মলিনভাবে। তারাও নিল কুণ্ঠিতভাবে।

    আর ক্ষণে ক্ষণেই অনিন্দিতার অসতর্ক কণ্ঠের উক্তি শুনতে পাওয়া যাচ্ছে, কী সাধেই বাদ সাধল আমার।

    এই বাদ সাধার আসামি কে?

    ভগবান?

    না সুনীল রায় নামের মুখ্যুটা?

    বাদ সেধেছে।

    তবু হচ্ছেও সব।

    সেন সাহেবের প্রথম দৌহিত্রের জন্যে মখমলের বিছানা এসেছে, দামি ফার্নিচারের দোকান থেকে পালিশ চকচকে দোলনা খাট এসেছে, রাশি রাশি জামা টুপি মোজা এসেছে, সুশিক্ষিত আয়া নিয়োজিত হয়েছে, এবং একজন শিশু চিকিৎসকের হাতে ছেলেকে এই জন্মকাল থেকেই সমর্পণ করা হয়েছে।

    অনুষ্ঠানের ত্রুটি নেই।

    তবে অনুষ্ঠানে প্রাণ নেই।

    ওদিকে ভবানী রায়ের বাড়ি থেকে তাঁর নবজাতক পৌত্রের জন্য যা সব উপঢৌকন এসেছে এবং আসছে, তাও বড় কম নয়! চন্দ্রা ন মাসে সাধ খাওয়ার বিরুদ্ধে এমন কঠিন বিদ্রোহ করেছিল যে, কিছুই করা যায়নি, এখন ষষ্ঠীপুজোর ছুতোয় ভাল শাড়িটাড়ি দেওয়া যাচ্ছে।

    চন্দ্রার মাসি-পিসি-খুড়ি সবাই ওই পথই ধরেছেন। ছেলের মুখ দেখার সঙ্গে মায়েরও শাড়ি গয়না।

    চন্দ্রা বাদ প্রতিবাদ না করে কঠিন মুখে বসে থেকেছে। আর যখন সবাই ঘর থেকে চলে গেছে, বালিশে মাথা ঠুকে ঠুকে বলেছে, তুমি আমার নারী জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সুখের সময়ের সুখ থেকে বঞ্চিত করলে। কী করেছি আমি? কী করেছিলাম তোমার?…

    আবার বলে, কী দরকার ছিল তোমার যাবার আগে আমায় জব্দ করে যাবার? কী শত্রুতা ছিল আমার সঙ্গে তোমার?

    ওকে মন খারাপ করে শুয়ে থাকতে দেখলেই ছুটে আসছেন মা, ছুটে আসছে আয়া।

    বলছে, বাচ্চা মাকে চাইছে।

    না, অপয়া ছেলের মুখ দেখব না এ প্রতিজ্ঞা শেষ পর্যন্ত রাখা যায়নি। সমগ্র সংসার একদিকে, আর চন্দ্রা একদিকে, কত আর লড়বে চন্দ্রা?

    কিন্তু বিষ! বিষ! সব বিষ লাগছে।

    সন্তান যতদিন আলোর মুখ দেখেনি, ততদিন যেন চন্দ্রারও জেলের মেয়াদ চলছিল, চন্দ্রা প্রাণপণে সেই শান্তির মেয়াদ বহন করে চলছিল।

    কিন্তু এখন?

    এখন তো চন্দ্রার সব কর্তব্য ফুরিয়েছে, তবে এখন কেন চন্দ্রা সকলের শাসন সহ্য করবে?

    চন্দ্রা হঠাৎ আর এক মূর্তি ধরল।

    চন্দ্রা যখন ইচ্ছে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, যত দেরি করে ইচ্ছে ফেরে, জিজ্ঞেস করলে ব্যঙ্গ হাসি হেসে বলে, বলে যাওয়া উচিত ছিল? কেন বাবা, আমিও কি জেলখানার বন্দি আসামি?

    চন্দ্রা লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে থাকে, চন্দ্রা নিজের কলেজ জীবনের দু-তিনটি বান্ধবীকে বেছে বেছে খুঁজে বার করেছে, যার একজন বিধবা, একজন বিবাহ বিচ্ছেদের নায়িকা, আর একজন চিরকুমারী।…তাদের কাছে গিয়ে গিয়ে বসে থাকে।

    সুখী দম্পতি আর দেখতে পারছে না চন্দ্রা।

    নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে থাকতে চাইছে না।

    কিন্তু চন্দ্রার ছেলে?

    সে তো আয়ার আর অনিন্দিতার সম্পত্তি।

    কোনও কোনওদিন দেরি করে ফিরলে যদি আয়া অনুযোগ করে, চন্দ্রা হেসে হেসে বলে, ওকে তোমায় দান করে দিচ্ছি মালতী! তুমি ওকে নিয়ে নিতে পারো!

    অনিন্দিতা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, তুই দান করবার মালিক?

    কেন নয়? চন্দ্রা তীক্ষ্ণ হাসি হেসে বলে, আমি ছাড়া আর তো কাউকে দেখতে পাই না।

    হ্যাঁ এইভাবেই বিষ ছড়িয়ে সংসার অশান্তিময় করে তুলছিল চন্দ্রা, অথচ কেন, তার কারণ নেই। মা বাপ ভাই ভাজ আর কত করতে পারে? অসহ্য জ্বালা সহ্য করে করে ভাজেদের তো হার্টের অসুখ ধরে যাচ্ছে।

    শ্বশুরের অগাধ সম্পত্তি, তাই তারা রাগ করে চলে যেতে পারছে না, শ্বশুরের মেয়ের সঙ্গে কথা বন্ধ করতে পারছে না। তবু শেষরক্ষা হল না।

    যে ছেলেকে এত অবহেলা চন্দ্রার, সেই ছেলেকে কেন্দ্র করেই ঝড় তুলল একদিন।

    অথচ তার বড়বউদি কথাটা বলেছিল ঠাট্টা করেই। বলেছিল, বাবাঃ আয়ার মাইনে দুশো টাকা। মা তাঁর একটি নাতির জন্যে যত করছেন, চারখানা নাতনির জন্যে বোধহয় তার অর্ধেকও করেননি।

    চারখানাই সত্যি।

    দুই বউয়ের সাকুল্যে দুজোড়া মেয়ে।

    একজনের তিনটি–একজনের একটি।

    তা সে যাক, কথা তো ঠাট্টারই, কিন্তু সেইদিনই জেদ ধরে বসল চন্দ্রা, আয়াকে ছাড়িয়ে দিতে হবে। গরিবের ছেলের এত বড়মানুষি শোভা পায় না।

    এ কী কথা!

    এ কী নির্লজ্জতা।

    এ কী অসভ্যতা।

    এতেও লোকে ছি ছি করবে না? বলবেনা, সাধে কি আর লোকে বলে,মেয়েসন্তান ভিন্ন গোত্রের মাটিতে গড়া!

    তা হয়তো লোকে যা বলে তাই ঠিক।

    আর বিধাতাই যদি মেয়েসন্তানকে এইভাবে গড়ে রেখে থাকেন তো চন্দ্রার দোষ কী, যদি চন্দ্রা তার কদিন পরে বলে বসে, আমি মনোহরপুকুরের ওখানে গিয়ে থাকব।

    .

    চন্দ্রার সংকল্প শুনে নিউ আলিপুরের সেন সাহেবের বাড়িতে হয়তো অলক্ষিতে মলয় বাতাস বইল, তবু লক্ষিত জগতে অনুরোধ উপরোধ আর মিনতির ঝড় উঠল। এমনকী তার বড়বউদি ক্ষমা পর্যন্ত চাইতে এল।

    কিন্তু চন্দ্রা সংকল্পে অটল।

    অনিন্দিতা কেঁদে ফেলে বললেন, খোকাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব?

    চন্দ্রা হেসে উঠে বলল, কী যে বলো মা। ছেড়ে থাকতে পারব না এ আবার একটা কথা নাকি?…ধরো আমি এখন হঠাৎ মরে গেলাম! তুমি থাকবে না?

    মা স্তব্ধ হয়ে গেলেন।

    অতঃপর সেন সাহেব শেষ চেষ্টা করলেন।

    বললেন, অন্তত সেই হতভাগাটা ফিরে আসা পর্যন্ত এখানে থাকলে হত না?

    চন্দ্রা অবলীলায় বলল, সে তো আর ফিরে এখানে আসবে না বাবা?

    তবু তার জিনিস তার হাতে তুলে দিয়ে আমি

    চন্দ্রা এ আবেগকে নস্যাৎ করে দিয়ে আরও অবলীলায় বলল, তার স্ত্রী-পুত্রকে তুমি যে কী রাজার হালে রাখলে এতদিন তা কি আর সে টের পাবে না বাবা?

    এর পরে আর কে কী বলবে?

    এর পরে আর কে না আছে যে ছি ছি করবে না চন্দ্রাকে?

    তার মানে এতদিন ধরে মেয়ের দুঃখ ভোলাতে যা কিছু করে এলেন এঁরা সবই ভষ্মে ঘি ঢালা হল। জলের মতন খরচ করলেন, সর্বদা ওর তালেই তাল দিলেন, সব বৃথা হল। জামাইয়ের জন্যে ভাবেন না, আর কি সেই জামাই আছে, যাকে দেখিয়ে সুখ?

    .

    চন্দ্রা মনোহরপুকুরে এসে থাকতে চায় শুনে ভবানী রায় হাতে চাঁদ পেলেন, হাতে চাঁদ পেলেন অপর্ণা….

    এই তো কটা দিন আগে ওঁরা যখন বলেছিলেন খোকার অন্নপ্রাশনের জন্যে একটা দিন দেখছি, ওদের একবার নিয়ে এসে

    সেন সাহেব বলেছিলেন, হবে না বেয়াই মশাই, মেয়ে একেবারে বেঁকে বসছে। বলছে, যার ছেলে, সে পড়ে পড়ে ঘানি টানছে, আর ছেলের অন্নপ্রাশন? আর লোক হাসিও না তোমরা

    শান্তপ্রকৃতি ভবানীবাবু চুপ করে গিয়েছিলেন। তিনি যেন ওই মেয়েটার কাছে অপরাধী। আর তিনি বুঝি ওর জ্বালাটাও সত্যি বোঝেন।

    তাই অপর্ণা যখন বউয়ের ব্যবহারবিধি নিয়ে সমালোচনায় তীব্র হয়েছেন, ভবানীবাবু বলেছেন, ওর কষ্ট তোমরা বুঝবে না।

    আর আমাদের কষ্ট নেই?

    অনেক তফাত। আমরা যেখানে ছিলাম সেখানেই আছি, যেমন ছিলাম তেমনিই রইলাম, যেখানে আগুন জ্বলছে, সেখানটা তো কেউ দেখতে পাচ্ছে না।…কিন্তু ও যে ঘর পুড়ে সর্বস্বান্ত হয়ে গেল। আর সেটা পৃথিবীসুন্ধু সবাই দেখছে।

    অপর্ণা নাতির যথাসময়ে অন্নপ্রাশন করাতে না পেরে এতই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে, ওই বউকে সমর্থন করায় আরও জ্বলে উঠলেন। বললেন, কেন? এই বাড়িঘর ওর নয়? এতে ওর অধিকার নেই? ও যদি অগ্রাহ্য করে সর্বস্ব ছেড়ে দিয়ে অসহায়ের মতন বাপের বাড়িতে পড়ে থাকে, কার দোষে?

    ভবানীবাবু একটু হাসলেন।

    ক্ষুব্ধ হাসি।

    বললেন, নিজে মেয়েমানুষ হয়ে এই কথাটা বলছ? মেয়েমানুষের ঘর মানে কি ইট কাঠ-ঘেরা একটা খুপরি?

    তারপর একটু থেমে বললেন, বেয়াই মশাই নিজের মেয়ে সম্বন্ধেই অনেকরকম কথাই বলে গেলেন।…তা সে যদি খামখেয়ালি বা স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠে থাকে তাতে দোষ দিতে পারি না, আর তাতে ওনাদেরও অবদান আছে। শুধু প্রশ্রয় দিয়েই মানুষ করে এসেছেন।…কিন্তু সে যাক, ছোটবউমা যে ভাবেই চলুন, বেশি কিছু মন্তব্য কোরো না। হতভাগাটা ফিরে আসা পর্যন্ত একটু সয়ে যাও। ভয় হয় কোনওদিন না কিছু করে বসেন! নিরুপায় জ্বালার যেটা শেষ আশ্রয়।

    হ্যাঁ এই একটা ভয় ভবানীবাবুর প্রথম থেকেই। হয়তো এই ভয়টা থেকেই উনি পুত্রবধূর উপর কোনও দাবি খাটাতে যাননি। এক লজ্জার নিদারুণ জ্বালায় জ্বলছেন, আবার যেন এক দারুণ লজ্জায় ধুলোয় মিশতে না হয়।

    চন্দ্রার এই হঠাৎ এখানে চলে আসার সংকল্পে প্রথমটায় কেঁপে উঠেছিলেন ভবানীবাবু। হয়তো সে পিতৃগৃহে কোনও কারণে ক্ষুব্ধ হয়েছে, নিজেকে অসম্মানিত মনে করেছে, হতে পারে অকারণই, অন্তত সেনসাহেবের নিবেদনে তাই মনে হল। যে সেনসাহেব মেয়ের শ্বশুরবাড়ির দরজা চেনেন না বললেই হয়, তিনি উজিয়ে এসে এত কথা বলে গেলেন প্রায় কৈফিয়তের মতোই। তাই চলে আসতে চেয়েছে আর একটা আশ্রয়ে।

    কিন্তু হঠাৎ যদি এখানেও তেমন কারণ আবিষ্কার করে বসে সে?

    তা হলে?

    কে বলতে পারে তালে সেই শেষ আশ্রয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বসবে কিনা। দুঃখ শোকের কথা বাদ দিলেও, সুনীলকে তিনি কী জবাব দেবেন?

    অপর্ণা বেজার গলায় বললেন, বেশি কিছু কেন, কোনও কিছুই বলব না আমি তোমার ছোট বউমাকে। আসছেন, হাতে স্বর্গ পেয়েছি। তবু তো আমার নীলুর খোকাকে একটু চোখে দেখতে পাব।

    নাড়তে চাড়তে পাব, এমন কথা বলতে পারলেন না। কে জানে বউ তার বাপের বাড়ির সেই আয়াকে সঙ্গে নিয়ে আসবে কিনা। আয়ার হাতের বাচ্চার গায়ে দিদিমা ঠাকুমার তো হাত দেবার অধিকার থাকে না।

    দেখছেন তো অনেক।

    কিন্তু ওঁদের সব আশঙ্কা অমূলক করে দিল চন্দ্রা।

    শ্বশুরবাড়িতে এসে আশ্চর্য রকমের শান্ত হয়ে গেল সে। শত্রুতেও বলতে পারবে না সে মেজাজি, খামখেয়ালি!

    আয়ার প্রশ্নও নেই।

    চন্দ্রা ছেলেকে বুক দিয়ে আগলাচ্ছে, ছেলের সব কাজ নিজের হাতে করছে। চন্দ্রার তাতে পটুতার অভাব দেখা যাচ্ছে না।

    চন্দ্রার মধ্যে যে এই পটুতা ছিল তা যেন চন্দ্রা নিজেও জানত না, তাই নিজেও আশ্চর্য হচ্ছে, হয়তো পুলকিতও হচ্ছে।

    একটা শিশুর মধ্যে যে এত আনন্দের স্বাদ থাকে তা তো এতদিন অনুভব করেনি চন্দ্রা। ছোট্ট একটা শিশুকে চান করাতে, খাওয়াতে, সাজাতে, ঘুম পাড়াতে যে এত ভাল লাগে, এ কথা কেউ যেন এতদিন জানতে দেয়নি চন্দ্রাকে।

    চন্দ্রা নিজের ব্যবহারের অসঙ্গতির কথা মনে করে না, ওর মনে হয় এতদিন যেন ও মস্ত একটা প্রাপ্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

    তবে কি ভিতরে এইটাই চাইছিল চন্দ্রা? অথচ অনুভব করতে পারছিল না কী সে চাইছে।…তাই তার ব্যবহারে অমন অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছিল, অমন রুক্ষ আর খ্যাপাটে হয়ে যাচ্ছিল সে। ইচ্ছে করে অন্যের প্রতি নিষ্ঠুর হচ্ছিল, আর নিজেকে স্বেচ্ছাচারিতার পথে ছেড়ে দিয়ে কার উপর যেন প্রতিশোধ নিচ্ছিল।

    অথচ, সে বাড়িতে, সেই পরিবেশে ছেলের দিকে একটু তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে হলেও লজ্জা করত। ছেলে আয়ার কোলে বসে হাসিতে ঘর মুখর করে তুললে, চন্দ্রাকে নিজের প্রেসটিজ বজায় রাখতে বলতে হত, ওকে এখান থেকে নিয়ে যাও। বই পড়ছি, ডিসটার্ব হচ্ছে।

    ছেলের দিকে একদার বিমুখ মন যে সেই ছেলেটাকেই বুকে চেপে ধরবার জন্যে লালায়িত হয়ে উঠছে, এটা প্রকাশ হওয়া–প্রেসটিজের হানি বইকী!

    এখানে সে লজ্জা নেই।

    এখানে চন্দ্রার পূর্ব ব্যবহারের সাক্ষী নেই।

    এখানে চন্দ্রা স্বাভাবিক মা হতে পেয়ে বাঁচল।

    আর একবার এখানে এসে চন্দ্রা যেন ওই ভবানী রায় নামের মানুষটিকে নতুন দেখল, যেন এই প্রথমই পরিচয় পেল।

    এর আগে যা দেখেছে, বাড়ির আর পাঁচজনের একজন হিসেবে। গুরুজন হিসেবে আসতে যেতে দুটো প্রণাম করেছে, আর কথা বলছেন, তাই সে কথার উত্তর দিয়েছে, এই পর্যন্ত।

    শান্তশিষ্ট শ্বশুরকে এর বেশি আর কে কোন চক্ষে দেখে?

    তা ছাড়া–তখন চন্দ্রার সমস্ত জগৎটাই তো আচ্ছন্ন ছিল সেই একটা মানুষকে দিয়ে। চন্দ্রা কি তার বাইরের কিছু ভাল করে দেখতে পেত?

    চন্দ্রা যে তখন এ বাড়িতে দু একবেলার বেশি থাকতে পারত না, বাপের বাড়িতে পালাত, তার কারণও এ বাড়িতে সুনীলকে সম্পূর্ণ করে পেত না বলে।

    এখানে যেন সুনীল ভাগ হয়ে যেত।

    ভাগ হয়ে যেত ছোটবড় নানা অংশে।

    সুনীলের অনেকখানি ভাগ থাকত এই ভবানী রায় আর অপর্ণা রায়ের জন্যে। সেখানে চন্দ্রা যেন ফালতু, চন্দ্রা যেন অবান্তর।

    এমনও হয়েছে, রাতে খাওয়াদাওয়ার পর মায়ে-ছেলেতে এত গল্প চলেছে, অথবা বাবার কাছে বসে সুনীল এমন নিমগ্ন হয়ে গেছে যে, চন্দ্রা রাগ করে ঘুমিয়েই পড়েছে।

    তেমন অবস্থাটা অসহ্য।

    পরে অবিশ্যি সুনীল বউয়ের ঘুম আর রাগ ভাঙিয়ে আদরে ডুবিয়ে দিয়েছে, কৈফিয়ত দিয়েছে। ত্রিবেণীতে তো আমি শুধুই তোমার, এখানে–মা বাবা সারা মাস প্রত্যাশা করে থাকেন দুএকটা দিনের জন্যে।

    চন্দ্রা বলত, তবে তুমি ওঁদের প্রত্যাশা ষোলো আনা পূর্ণ করে বসে বসে, আমাকে নিউ আলিপুরে রেখে এসো।

    নিউ আলিপুরের সেই বাড়িটা চন্দ্রার কুমারীজীবনের অভ্যস্ত পরিবেশ, সেখানে বরকে বাদ দিয়ে তবু দুদণ্ড টেকা যায়।

    অবিশ্যি ওই দুদণ্ডই।

    তার মধ্যেই টেলিফোনে গল্প চলে, সেন সাহেবের বাড়ি থেকে, জামাইয়ের নেমন্তন্ন আসে।

    …সুনীল তাতে লজ্জিত হত, ভেবে দেখত না ওঁরাও প্রত্যাশা করে থাকেন। ওঁদেরও মাত্র একটা জামাই।

    ওঁদের দিকটাই চন্দ্রার চোখে বেশি পড়ত। কিন্তু সুনীল তত বুঝত না।

    সুনীলের আরও ছোট ছোট অংশ ভাগ করা ছিল। যেমন দাদার জন্যে, বউদির জন্যে, ভাইপো ভাইঝিদের জন্যে, এমনকী পুরনো চাকরটার জন্যেও।

    চন্দ্রার এসব বাড়াবাড়ি মনে হত।

    চন্দ্রা পালাত এ বাড়ি থেকে, এদের ভাল করে চিনতেই চাইত না।

    চন্দ্রা এখন তার শ্বশুর ভবানীবাবুকে চিনছে। চন্দ্রা লজ্জিত হচ্ছে, নম্র হচ্ছে, শ্রদ্ধায় অবনত হচ্ছে।

    হ্যাঁ। সেন সাহেব ভবানীবাবুর স্তর থেকে অনেক তফাতে।

    যদিও সেন সাহেব তাঁর মেয়ের শ্বশুরের সেকেলে চাল দেখে ব্যঙ্গহাসি হাসেন, বেশভূষা দেখে ঠাট্টা করেন, এবং বলেন, পয়সা যে কিছুই নেই এমন নয়, তবু জীবন যাপনের স্ট্যান্ডার্ড নেই। পয়সা থাকলেই হয় না, রুচি থাকা চাই।

    চন্দ্রাও শুনে শুনে তাই ভাবত।

    চন্দ্রা এখন শুনছে না, দেখছে। এখন তাই অন্য কথা ভাবছে।

    কিন্তু অপর্ণা?

    চন্দ্রা যে তার ছেলেকে যত্ন করতে পারছে, এতে অপর্ণা নিশ্চিন্ত, কিন্তু সুখী কী?

    অপর্ণার যেন অন্য প্রত্যাশা ছিল।

    যেন আশা ছিল অপটু মায়ের হাত থেকে একটা বুকভরা ঐশ্বর্য চলে আসবে অপর্ণার হাতে।

    অপর্ণা তাকে নেড়েচেড়ে সুনীলের বিচ্ছেদদুঃখ ভুলবেন।

    কিন্তু তা ঠিক হল না।

    অপর্ণা দিন গোনেন বড়লোকের মেয়ের ওই খেয়ালটা কবে ঘুচে যাবে। ছেলেকে যত্ন করার শখ মিটে যাবে।

    কিন্তু অপর্ণার দিনগুলো আর হাতের মুঠোয় এসে যায় না।

    রমলা বলে, খুব দেখালি বটে চন্দ্রা! এই শুনতাম দুশো টাকার আয়া ছিল, বাকিটা তোর মা করতেন, তুই ছেলেকে আঙুল দিয়েও ছুঁতিস না। এ তো দেখছি দিব্যি পারছিস।

    চন্দ্রা অবশ্য কথার উত্তর দেয় না।

    রমলা মুচকি হেসে বলল, বুঝেছি বাবা? ঠাকুরপো এসে যাতে খুঁতটি না ধরতে পারে, তার সাধনা চলছে।

    আবার রমলা আলোচনা করতে বসে, ছেলে বাপের মতো দেখতে হয়েছে না মায়ের মতো।

    এইগুলোই চন্দ্রার দুচক্ষের বিষ!

    সুনীলের নামটা হেলাফেলা ভাবে উচ্চারিত হতে দেখলে ওর মাথা জ্বলে যায়।

    অথচ রমলা করবেই উচ্চারণ।

    খোকা যখন নতুন নতুন বিদ্যে প্রকাশ করতে থাকে, যখন নেচেকুঁদে হেসে হাসিয়ে বাড়িতে প্রাণের সাড়া তোলে, অপর্ণা ভুলে যান তাঁর কোনও দুঃখ আছে, ভবানীবাবুর বিষণ্ণ মুখ আলোয় ভরে ওঠে, ঠিক তখনই হয়তো রমলা বলে বসে, আহা। সব ভাল সময়টুকু চলে যাচ্ছে, ঠাকুরপো কিছুই দেখতে পেল না। যখন আসবে, তখন দাঁত গজগজে কথা বলে বেড়ানো ছেলে!

    চন্দ্রা সেখান থেকে উঠে যায়, অপর্ণার চোখ জলে ভরে ওঠে, আর ভবানীবাবুর মুখের সেই আলোটা হঠাৎ দপ করে নিভে যায়।

    হঠাৎই মনে হয় ওঁর, উনি যেন খুব স্বার্থপরের মতো একটা ভাল জিনিস ভোগ করে নিচ্ছেন, জিনিসটার আসল মালিকের অসাক্ষাতে।

    ভবানীবাবুর বুকের মধ্যেই হু হু করে ওঠে, ভবানীবাবু ছোট্ট ছেলেটাকে বুকে চেপে ধরেন। যেন শিশুর কোমল গায়ের স্পর্শে ভিতরের সেই জ্বালাটার লাঘব হবে।

    খোকা এখন এটা ওটা ধরে দাঁড়াতে শিখেছে, কোনও সময় ভবানীবাবুর খাটের উপর থেকে বইটা কাগজটা টেনে নামায়, চন্দ্রা সব ভুলে উচ্ছ্বসিত গলায় বলে ওঠে, বাবা বাবা, দেখুন, আপনার জিনিসপত্রের ওপর বর্গীর হামলা। এবার থেকে সাবধান হোন।

    ভবানীবাবুও এসে চোখের চশমা নাকে নামিয়ে ভরাটি সুখের গলায় বলেন, কাগজ নেওয়া হচ্ছে? পড়বি? দেশে কী ঘটছে না ঘটছে জানা দরকার তোর, কেমন?

    ওমা, কোথা থেকেই যে এইসব সময় রমলা এসে হাজির হয়, আর বলে ওঠে, একেই বলে শিশু সকল শোকদুঃখের ওষুধ। চন্দ্রার মুখে হাসি দেখলাম আজ। যা একেবারে দুর্লভ।

    বলা বাহুল্য, চন্দ্রার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়, চন্দ্রা খোকার মুঠো থেকে মুঠোয় চেপে ধরা কাগজখানা ছাড়িয়ে নিয়ে তাকে কোলে তুলে নিয়ে তিনতলায় উঠে যায়।

    এই ঘরটা চন্দ্রার অনেক অশ্রুজলের সাক্ষী।

    ইদানীং ও বাড়িতে থাকতে কাঁদত না চন্দ্রা, শুধু জ্বলত, বোধ করি কাঁদতে পেত না বলেই। চন্দ্রা একটু একা কোথাও গিয়ে বসলেই চারদিক থেকে তার হৃদয়বেদনা দূর করতে লোক এসে যেত।

    অনিন্দিতার খাস-ঝি উষাকে নির্দেশই দেওয়া ছিল দিদিমণিকে চোখে চোখে রাখতে।

    কে জানে হয়তো বা অনিন্দিতারও ভবানীবাবুর মতোই লুকনো একটা ভয় ছিল।

    তা সেই ভয়ের খবর চন্দ্রা রাখত না, চন্দ্রা শুধু দেখত একা বসে একটা নিশ্বাস ফেলবারও সুবিধে নেই তার।

    হয়তো অনিন্দিতা বলবেন, বারান্দায় এসে বসলি? এখানে কি হাওয়া আছে? ঘরে চল তবু পাখার হাওয়া খাবি।

    নয়তো মেজবউদি এসে বলত, তাস খেলবে চন্দ্রা? খেলার জন্যে মনটা উসখুস করছে।

    নিদেন ভাইঝিরা এসে কাছ ঘেঁষে বলত, পিসিমণি তোমার মাথা ধরেছে?

    ওরা যে প্রেরিত দূত তা বোঝা যেত।

    কাঁদতে না পেয়ে চন্দ্রার প্রাণ হাঁপিয়ে উঠেছিল, এখানে কাঁদার সুযোগটা আছে।

    তিনতলাতেই অবশ্য রমলার ঘর, তবে চন্দ্রা যদি নিজের ঘরে ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে, রমলার কিছু করার নেই।…এ ঘরটা চন্দ্রার একান্ত আশ্রয়। অথচ এটাই এতদিন টের পায়নি চন্দ্রা।

    তবে খোকার এ ঘরটা পছন্দ নয়।

    খোকা যেন বুঝে ফেলেছে এ ঘরে এলেই মা তাকে চেপে ধরে কাঁদতে বসবে। তাছাড়া খোকার ক্রমশ পা হচ্ছে, সে টলতে টলতে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াতে চায়।…সিঁড়ি ওঠারও দিব্যি একটা কায়দা শিখে ফেলেছে। রেলিং ধরে ধরে ঠিক ওঠে নামে।

    হয়তো বামুনঠাকুরের ময়লা বিছানায় গিয়ে জাঁকিয়ে বসে, হয়তো ভবানীবাবুর ঘরে গিয়ে টু করে হেসে ওঠে।

    নতুন কিছুই করে না অবশ্য, এই বয়েসের শিশু ঠিক যা যা করে, তাই করে। তবে ব্যাপারটা চিরনতুন।

    খোকা এখন শেষ রাত্তির থেকে মাকে পাগল করে, দাদু দাবো।

    খোকা সেতুর অর্থাৎ জেঠুর ঘরেও মাঝে মাঝে ঢুকে পড়ে, দাদা দিদির সঙ্গে খেলা করে।

    কোলের শিশু আর কোলে থাকছে না।

    চন্দ্রা হঠাৎ একসময় অনুভব করে, আবার একটা শূন্যতা যেন তাকে গ্রাস করতে আসছে।

    আড়াইটা বছর সময় কি এত দীর্ঘ?…দিনগুলো কি আটচল্লিশ ঘণ্টার? বছরগুলো কি তিরিশ মাসের? এ যে ঠেলে শেষ হচ্ছে না।

    চন্দ্রা এক এক সময় অবাক হয়ে ভাবে, অথচ ত্রিবেণীতে চন্দ্রা সাড়ে তিন বছর ছিল। কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! ভাবলে মনে হয়, যেন কয়েকটা দিন মাত্র।

    কদিন বা তারা বেশি রাত্রে সেই অদ্ভুত সুন্দর বারান্দাটায় এসে বসে থেকেছে অনুভূতির গভীরতায় ডুবে? কদিন তারা সেই লনটায় নেমে বেতের চেয়ারে বসে চা খেয়েছে?…কদিনই বা ফ্রিজ খুলে আইসক্রিম বার করে খাইয়েছে সুনীলকে, কটা নতুন রান্নাই বা করেছে? সুনীল একদিন চন্দ্রার হাতের কেক খেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিল, বাড়িতে যে এমন সত্যিকারের কেক তৈরি করা যায়, আমার জানাই ছিল না।

    কথাটা সত্যি।

    অপর্ণা গোকুল পিঠে করতে জানেন, চন্দরপুলির ছাঁচ তুলতে পারেন, কচুরি শিঙাড়া নিমকি ছানার জিলিপি বানিয়ে ফেলতে পারেন, কেক পুডিং ভাবতেই পারেন না।

    সেন সাহেবের কথাই সত্যি আর কি।

    পয়সা আছে, রুচি নেই।

    তবে সেন সাহেবের জামাই কোনওদিন নিজেদের বাড়ির ওই রুচির অভাবটা অনুধাবন করতে পারেন। শুধু বউয়ের হাতের কেক খেয়ে অকপটে স্বীকার করেছিল, বাড়িতে যে এমন সত্যিকারের কেক তৈরি করা যায়, জানাই ছিল না।

    কিন্তু আর কি সেই জিনিসটা তৈরি করে সুনীলকে খাইয়েছিল চন্দ্রা?

    ভাবতে গেলেই–যে স্নায়ুগুলোয় প্রাণ নামের বস্তুটা বাঁধা থাকে, সেই স্নায়ুগুলো মুচড়ে মুচড়ে ওঠে।

    আর হয়ে ওঠেনি।

    এমনিই হয়ে ওঠেনি। করব করব ভেবেছে।

    জীবন্ত চলন্ত মুহূর্তে কে কবে ভাবতে পারে, এই চলাটার হয়তো এইখানেই শেষ!

    কিন্তু সুনীল তো মারা যায়নি, তবে চন্দ্রার ভিতরটায় এমন সব শেষ হয়ে যাবার মতো হাহাকার ওঠে কেন?

    এই প্রশ্নটা চন্দ্রা নিজেই নিজেকে শতবার করে।

    কেন? কেন আমি এমন অলক্ষুনে চিন্তা করছি? আড়াই বছর সময়টা সত্যিই তো অনন্তকাল নয়, একদিন তো শেষ হবেই। তখন তো

    ওইখানেই কেমন সব গোলমাল হয়ে যায়।

    ওই তখনটার পর যেন একটা নিরালম্ব শূন্যতা। যেন পা রাখবার জায়গা নেই। যেন কোনওদিকে কোনও দেয়াল নেই, মাটি নেই।

    তবে কোনখানটায় জীবনটাকে আবার স্থাপন করবে চন্দ্রা?

    জোর করে ভাবতে চেষ্টা করে ত্রিবেণীর সেই ফ্যাক্টরিটা ছাড়া জগৎসংসারে কি আর কোনও কর্মভূমি নেই? অনেক অনেক দূরে কোনও এক পাহাড়ের কোলে, নয়তো বা দিগন্ত-ছোঁয়া ভোলা মাঠের মাঝখানে, কিংবা সমুদ্রের কিনারে। কোনও একটা কাজ জুটবে না ওর?

    যতরকম পরিবেশ জানা আছে চন্দ্রার, সবই ভাবতে চেষ্টা করে, কিন্তু কোথাও কোনওখানে সুন্দর দুখানা বেতের চেয়ার মুখোমুখি করে পাতবার জায়গা খুঁজে পায় না।…ঝাপসা হয়ে যায়, তলার মাটিটা, যেন নামতে নামতে কোন অতলে তলিয়ে যায়, আর মুখোমুখি বসবার মুখটাকেও যেন আস্ত করে দেখতে পায় না।

    কখনও কপালটা, কখনও চিবুকের কাছটা, কখনও চোয়ালের দৃঢ়তাটুকু। চন্দ্রা পাগল হয়ে ওঠে ওই টুকরো টুকরো অংশগুলো জোড়া দিয়ে আস্ত একটা মুখ গড়ে ফেলতে, কিছুতেই পারে না।

    চন্দ্রা তখন পাথরের মতো হয়ে যায়।

    খুব আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করে, আমি কি তবে তোমার মুখটা ভুলে যাচ্ছি?

    .

    ⤷
    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসেই রাত্রি এই দিন
    Next Article এই তো সেদিন

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }