Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জীবন-স্বাদ – আশাপূর্ণা দেবী

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প125 Mins Read0

    ১. বদলী করে দিয়েছে

    জীবন-স্বাদ – উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী

    বদলী করে দিয়েছে, নতুন অফিসের কর্মভার গ্রহণের তারিখ নির্দেশ করে দিয়েছে, দেয়নি শুধু বাসার আশ্বাস।

    বাঙালীর ছেলে পাঞ্জাব-সীমান্তের একটি মফঃস্বল শহরে, যেখানে অন্তত তিনশ মাইলের মধ্যে কোনও আত্মীয়ের ছায়ামাত্র নেই, সেখানে হঠাৎ গিয়ে পড়ে যথাসময়ে কাজে যোগ দেবার অসুবিধেটা কতদূর সেকথা বোঝবার দায় সরকারের নয়।

    চাকরি নেবার সময় বন্ডে সই করনি তুমি, যে-কোন জায়গায় যেতে প্রস্তুত? মনে নেই সেকথা?

    সরকার কি বন্ডে সই করেছিল, যখন যে দেশে পাঠাবে তোমাকে, তোমার জন্যে ঘর সাজিয়ে রাখবে? তুমি তো তুমি নেহাৎ চুনোপুঁটি না হও চিংড়ি-চিতলের চাইতে বেশিও নও। বলে কত রুই-কাতলাই বদলী হয়ে পরের বাসায় নাক খুঁজে থেকে দিন কাটাচ্ছে, কাপড়ের তাঁবুতে স্ত্রী-পুত্র-পরিবার নিয়ে সংসার পেতে বসেছে!

    তবু তো তুমি প্রভাত গোস্বামী, ঝাড়া-হাত-পা মানুষ। না স্ত্রী, না পুত্র, না ডেয়ো, না ঢাকনা। একটা সুটকেস, একটা বেডিং, একটা জলের কুঁজো, একটা টিফিন-কেরিয়ার, সর্বসাকুল্যে এই তো তোমার সম্পত্তি। এতেই ভাবনায় অস্থির?

    তা সত্যি বলতে প্রভাত একটু বেশিই ভাবছে। তার কারণ এযাবৎ নিজের ব্যবস্থা নিজে করে নেওয়ার অবস্থা ওর কখনো ঘটেনি। হাওড়ায় দেশের বাড়ীতে বাড়ীর ছোটছেলের প্রাপ্য পাওনা পুরোদস্তুর ভোগ করেছে, চাকরির প্রথম কালটা কাটিয়ে এসেছে লক্ষ্ণৌতে কাকার বাড়ী। কাকাই চাকরির জোগাড়দার। তিনি কী অফিসে, কী বাসাতে সদাসতর্ক দৃষ্টি রেখে আসছিলেন ভাইপোর সুবিধে স্বাচ্ছন্দ্য সম্পর্কে। কিন্তু বিধি হল বাদী।

    বদলীর অর্ডার এল।

    প্রভাতের মা অবশ্য খবরটা শুনে ভেবে ঠিক করে ফেললেন, এ নিশ্চয় ছোট বৌয়ের কারসাজি, বরকে বলে-কয়ে ভাসুরপোর বদলীর অর্ডার বার করিয়ে দিয়েছে, কারণ–

    কারণ আর নতুন কি, বলাই বাহুল্য, পর নিয়ে ঘর করায় অনিচ্ছে। কিন্তু আসলে তা নয়।

    খুড়ি বরং চেষ্টা করছিলেন, সামনে পূজোর ছুটিতে নিজের বিয়ের যুগ্যি বোনঝিটিকে নিজের কাছে আনিয়ে নেবেন, এবং অদূর ভবিষ্যতে দিদির কাছে ঘটকীবিদায় আদায় করবেন।

    কিন্তু হল না।

    জগতের বহুবিধ সাধুইচ্ছের মত সে ইচ্ছেটা আপাতত মুলতুবি রাখতে বাধ্য হতে হল তাকে। বদলিটা পূজো পর্যন্ত ঠেকানো গেল না। পূজোর ছুটিতে চলে আসবার জন্যে বারবার অনুরোধ জানিয়ে কাকা-কাকী বিদায় দিলেন। প্রভাত সেই বিষণ্ণ আদ্রতার ছোঁয়ার সঙ্গে নিজের অসহায়তার ভয়াবহতা মিশিয়ে চিত্তকে বেশ ঘনতমসায় আবৃত করে গাড়ীতে উঠল।

    আর বেচারা হতভাগ্যের ভাগ্যে সঙ্গে সঙ্গেই সুরু হয়ে গেল প্রবল বর্ষণ।

    সারারাত্রি ঠায় জেগে কাটিয়ে দিল প্রভাত, বন্ধ কামরার মধ্যে বৃষ্টির শব্দের প্রচণ্ডতা অনুভব করতে করতে। গাড়ীতে আরও তিনজন আরোহী ছিলেন, তাঁদের প্রতি ঈর্ষাকুটিল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রভাত নিশ্চিত হল আর যাই হোক, ওরা কেউ বদলী হয়ে যাচ্ছে না।

    তবে বৃষ্টির আওয়াজ একটু উপকার করল প্রভাতের। তিন দিক থেকে তিনটি নাকের আওয়াজ তার কর্ণকুহরকে শিহরিত করতে ততটা পেরে উঠল না। কানের থেকে মনটাই তার কাছে প্রধান হয়ে রইল।

    স্টেশনে যখন নামল প্রভাত তখন বৃষ্টি নেই, কিন্তু শেলেটপাথরের মত আকাশের নীচে পৃথিবীটা যেন শোকগ্রস্তের মত জড়পুটুলি হয়ে পড়ে আছে।

    ভেবেছিল কুলিও পাওয়া যাবে কিনা। কিন্তু আশঙ্কা অমূলক, কুলি যথারীতি গাড়ী থামবার আগেই গাড়ীর মধ্যে ঢুকে পড়ে প্রভাতের অনুমতি ব্যতিরেকেই তার জিনিসপত্র টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে ফেলল এবং কোথায় যাবেন ও গাড়ী হবে কিনা শুধিয়ে মুখপানে তাকিয়ে রইল।

    আর ঠিক এই মুহূর্তে–এই ভয়াবহ সঙ্গীন মুহূর্তে ঘটে গেল এক অদ্ভুত অঘটন।

    সেই অঘটনের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ প্রভাতকে স্বীকার করতেই হল কলিতে ভগবান নেই, এটা ভুল সিদ্ধান্ত। ভগবান আছেন, এবং আর্তের আকুল আবেদন তার কানে এক-আধ ক্ষেত্রেও অন্তত পৌঁছায়।

    আর পৌঁছালে আত্রাণকল্পে দূতও পাঠান তিনি।

    সেই দূত হিসাবে এসে দাঁড়ালেন একটি আধবয়সী ভদ্রলোক, ও অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, একটি রীতিমত রূপসী তরুণী। খুব সম্ভব পিতা-কন্যা।

    প্রভাতের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক দরাজগলায় বলে উঠলেন, কোথায় উঠবেন?

    প্রভাত প্রথমটা থতমত খেলো। এমন পরিচিত ভঙ্গীতে যিনি প্রশ্ন করলেন, তিনি পূর্বপরিচিত কিনা স্মরণ করতে চেষ্টা করল, তারপর সচকিত হল। পরিচিত নয়। কিন্তু একটি রূপসী তরুণীর সামনে বুদ্ধ বলে চুপ করে থাকার লজ্জা বহন করা চলে না। তাই মৃদু হেসে বললে, ঠিক এই মুহূর্তে নিজেকেই ওই প্রশ্ন করছিলাম!

    বুঝেছি। সবজান্তার ভঙ্গীতে মাথা নেড়ে ভদ্রলোক কন্যার দিকে দৃষ্টিপাত করে হেসে বলেন, বলিনি তোকে? মুখ দেখেই বুঝেছি বাসার ব্যবস্থা হয়নি! নতুন বদলী হয়ে এলেন বোধহয়? ওপরওলাদের আক্কেল দেখছেন তো? বদলী করেই খালাস। সে ওঠে কোথায়, খায় কি, তার দায়িত্ব নেই। পাঁচ বছর ধরে শুনছি মশাই, গভর্ণমেন্ট কোয়ার্টার্স তৈরী হবে। তা সে শোনাই সার। ছেলেবেলায় শুনতাম আঠারো মাসে বছর, এখন দেখছি ছাব্বিশ মাসে–

    ভদ্রলোকের কথার মাঝখানে ফাঁক পাওয়া সম্বন্ধে হতাশ হয়ে, ফাঁকটা একরকম করে নিয়েই বলে ওঠে প্রভাত, তা আপনি তো এখানকার সব জানেন শোনেন–বলুন দিকি, সুবিধেমত কোনও মেস বা হোটেল কোথায় পাওয়া যেতে

    বিলক্ষণ! বিলক্ষণ! আমি তবে নাহোক আপনাকে দাঁড় করিয়ে সময় নষ্ট করছি কেন? মল্লিকা, শোন! কথা শোন ভদ্রলোকের! আমার নিজের আস্তানা থাকতে আমি সন্ধান দিতে যাব কোথায় মেস আছে, কোথায় হোটেল আছে! চলুন চলুন, এই গরীবের গরীবখানায় গিয়ে উঠুন তো। তারপর বুঝবেন থাকতে পারবেন কি, না পারবেন!

    প্রভাত ব্যাকুল স্বরে বলে, না না, সে কি, আপনার বাড়ীতে গিয়ে উৎপাত করব কেন, আপনি শুধু যদি

    আহা-হা, উৎপাত কি! এ তো আমার ভাগ্য। আপনাদের মত অতিথি পাওয়া পরম ভাগ্য। আজ ভালো লোকের মুখ দেখে উঠেছিলাম মল্লিকা, কি বলিস? চলুন চলুন, এই যে গরীবের একখানা হাঁটুভাঙা পুষ্পরথও আছে।

    অদূরে অবস্থিত একটি টাঙ্গার দিকে চোখ পড়ে প্রভাতের। ভদ্রলোক কুলিটাকে চোখের ইশারা করেন এবং মুহূর্তে সে কর্তব্য পালন করে। আর প্রভাত এক নজরে দেখে এইটুকু অবশ্য অনুভবই করে, গাড়ীর ব্যাপারে ভদ্রলোক অতিবিনয়ী নয়, গাড়ীটা হাঁটুভাঙাই বটে।

    সেই গাড়ীতেই যখন ভদ্রলোক প্রভাতকে উঠিয়ে দিয়ে সকন্যা নিজে উঠে পড়েন, তখন প্রভাত সভয়ে না বলে পারে না, ভেঙে যাবে না তো?

    আশপাশ সচকিত করে হেসে ওঠেন ভদ্রলোক। হাসির দাপটে দুলে দুলে বলেন, না মশাই, সে ভয় নেই, দেখতে যেমনই হোক ভেতরে মজবুত।

    কিন্তু আপনি ওদিকে কেন? প্রভাত তারস্বরে প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে, আপনি এদিকে আসুন। আমিই কোচম্যানের পাশে

    কিন্তু ততক্ষণে বিশ্রী একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ী চলতে সুরু করেছে।

    ভদ্রলোক ওদিক থেকে বলেন, না মশাই, আমার আবার উল্টোদিকে ছুটলে মাথা ঘোরে।

    অতএব পরিস্থিতিটা হল এই, টাঙ্গার পিছনের সিটে প্রভাত আর মল্লিকা। প্রতিমুহূর্তে ঝাঁকুনি খেতে খেতে আর পরস্পরের গায়ে ধাক্কা লাগাতে লাগাতে উল্টোমুখো ছুটতে লাগল তারাই দুজনে।

    যতটা সম্ভব সঙ্কুচিত হয়েও প্রভাত সেই দুরূহ অবস্থা থেকে আত্মরক্ষায় সক্ষম হল না, আর মনে মনে বলতে বলতে গেল, মাথা ঘোরাবার ব্যবস্থাটা তাহলে আমার জন্যেই বহাল হল!

    এও ভাবল, ভদ্রলোক বাংলাদেশ থেকে বহুদূরে আত্মীয়সমাজের বাইরে থাকেন বলেই এমন মুক্তচিত্ত!

    যাই হোক, আপাতত যে প্রবাসে বাঙালী লাভ হল, এ বহুজন্মের ভাগ্য। অন্তত আজকের মত মালপত্র রেখে অফিসটা তো দর্শন করে আসা যাবে। তারপর কালই একটা কোনো ব্যবস্থা করে নিতে হবে। সরকারী অফিস যখন আছে, মেস বোর্ডিং কোথাও না কোথাও যাবেই জুটে।

    আবার ভাবল, এ যুগেও তাহলে এরকম অতিথিবৎসল লোক থাকে! ভদ্রলোক যদি একা হতেন, হয়তো প্রভাত কিঞ্চিৎ দ্বিধাগ্রস্ত হত, হয়তো ভাবত এতই বা আগ্রহ কেন? মতলব খারাপ নয় তো? কোনো গুণ্ডার আড্ডায় তুলে নিয়ে গিয়ে টাকাকড়ি কেড়ে নেবে না তো!

    কিন্তু সকল সন্দেহ মূক করে দিয়েছে মল্লিকার উপস্থিতি বুঝে ফেলেছে, আর কিছুই নয়, বাঙালীহীন দেশে বাঙালী-পাগলা লোক!

    কিন্তু মেয়েটা একটাও কথা কয়নি কেন? বোবা নাকি? বাপ তো বারবার ডেকে ডেকে সালিশ মানছেন। যার জন্যে নামটা জানা হয়ে গেছে। বোবাকে কি কেউ ডেকে কথা কয়?

    প্রভাত একবার চেষ্টা করে দেখবে নাকি? আচ্ছা কী কথা বলা চলে? এখানের আবহাওয়া? কতদিন এদেশে আছেন? নাকি আপনাদের বাসা আর কতদূরে?

    আলাপ জমাতে গেলে ভদ্রলোক বিরক্ত হবেন? নাঃ, তা নিশ্চয়ই নয়। মেয়েকে যখন এভাবে বসতে দিয়ে নিজে নিশ্চিন্ত হয়ে সোজামুখো ছুটছেন, তখন মাথার পিছনে কান খাড়া করে রেখেছেন বলে মনে হয় না।

    ত্রিভঙ্গঠামে হলেও টাঙ্গাটা ছুটছিল ভালই। দুপাশে নীচু জমি, সেখানে সবুজের সমারোহ, মাঝখানে সরু আলরাস্তা চড়াই উত্রাইয়ের বৈচিত্র্যে লোভনীয়।

    ক্ষণে ক্ষণে ঝাঁকুনি। তা সেটা অস্বস্তিকর হলেও তেমন বিরক্তিকর তো ঠেকছে না কই! অনেকক্ষণ চলার পর, প্রভাত যখন অনুমান করছে লোকালয়ের বাইরে চলে এসেছে, তখন দূর থেকে কয়েকটা ছোট ছোট কটেজ দেখা গেল। ওদেরই একটা নিশ্চয়ই! প্রভাত এবার মনের জোর সংগ্রহ করে ধাঁ করে বলে ফেলল, আর বেশিদূর আছে নাকি?

    মল্লিকা চমকালো না। বরং মনে হল যেন একটা কোনো প্রশ্নের জন্যে প্রস্তুতই হচ্ছিল। কারণ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, ওই তো দেখা যাচ্ছে।

    কথা বাড়াবার জন্যেই বলে প্রভাত, ওদের মধ্যে কোনটা?

    সবগুলোই।

    সবগুলো!

    হ্যাঁ। তাও তো কুলিয়ে উঠছে না, আরও বাড়ী তৈরীর কথা হচ্ছে।

    বিস্ময় বোধ না করে পারে না প্রভাত।

    পরিবার বড় হলে বাড়ী বড় করে তৈরী করে লোকে, আলাদা আলাদা কটেজ, এটা কি রকম! তবু বলে, খুব বড় জয়েন্ট ফ্যামিলি বুঝি?

    হঠাৎ মল্লিকা অনুচ্চ একটু হেসে ওঠে। ঘাড়টা একটু ফিরিয়ে সামনে-ছোটা ভদ্রলোককে একবার দেখে নেয়, তারপর বলে, এখনো পর্যন্ত বুঝতে পারেন নি? কী ছেলেমানুষ আপনি?

    বুঝতে পারবে! কী বুঝতে পারবে প্রভাত!

    ঠিক হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না, কোনদিন থেকে বুঝতে চেষ্টা করতে হবে। মল্লিকাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করতেও লজ্জা করছে। তাই ওই কটেজগুলোর মধ্যেই বোধগম্য কিছু আছে কিনা দেখবার জন্যে অনবরত ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে থাকে।

    বেশিক্ষণ অবশ্য সন্দেহদোলায় দুলতে হল না। টাঙ্গাটা ঝড়াং করে থেমে গেল। এবং ভদ্রলোক নেমে পড়ে বললেন, এই যে এসে গেছি। সাবধানে নামুন প্রভাতবাবু।

    প্রভাতবাবু!

    নাম জানাজানিটা কখন হল? প্রভাত সবিস্ময়ে বলে, আমার নামটা জানলেন কি করে?

    কি করে! একটু হেসে বললেন, হাত দেখে। সুটকেসের ওপর টিকিট এঁটে রেখে নিজেই ভুলে যাচ্ছেন মশাই? আসুন, এই গরীবের গরীবখানা। এই সামনের ছোট্টখানি নিয়ে সুরু করেছিলাম। আপনাদের পাঁচজনের কল্যাণে আশেপাশে–আস্তে আস্তে সাবধানে। পাথরটার ওপর পা দিয়ে আসুন। সারারাত বৃষ্টি পড়ে কাদা-মল্লিকা, তুই গণেশকে পাঠিয়ে দিগে যা। জিনিসপত্রগুলো নামিয়ে নিক। প্রভাতবাবু সাবধান, শুধু এই পাতা পাথরের ওপর দিয়ে

    .

    সাবধানে পা টিপে টিপে এসে প্রথম কটেজটার সামনে দাঁড়ায় প্রভাত, আর সাইনবোর্ডটা চোখে পড়ে।

    আরাম কুঞ্জ। সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য মডারেট চার্জে আহার ও বাসস্থান। প্রোঃ এন কে চ্যাটার্জি।

    কী বোঝা উচিত ছিল, এতক্ষণে বুঝতে পারে প্রভাত। জলের মত পরিষ্কার।

    লোকালয়ের বাইরে বহুবিস্তৃত জমি নিয়ে চ্যাটার্জির আরাম কুঞ্জ। ঘরের পিছনে বারান্দা। সরু একফালি, তবু তাতেই দুখানি বেতের চেয়ার, একটি ছোট টেবিল।

    চায়ের ট্রে-টা চাকরেই দিয়ে যায়, তবে তত্ত্বাবধানে আসে মল্লিকাই। হেসে একটা বেতের চেয়ার টেনে নিয়ে বলে, এতক্ষণে বুঝেছেন বোধ হয়?

    নতুন বাড়ি, ছবির মত সাজানো ঘর, পিছনের এই বারান্দা থেকে যতদূর চোখে পড়ে, উন্মুক্ত প্রান্তর। প্রান্তরের সীমায় আকাশের কোলে পাহাড়ের নীলরেখা। মেঘমেদুর আকাশের বিষণ্ণতা কেটে আলোর আভাস উঁকি দিচ্ছে। সৌন্দর্য-মোহগ্রস্ত প্রভাত এতক্ষণ মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল সেইদিকে, চা এবং মল্লিকা, দুটোর চাঞ্চল্যে চোখ ফিরিয়ে হেসে বলে, একটু একটু।

    আপনি একটু বেশি সরল।

    তার চাইতে বলুন না কেন, একটু বেশি নির্বোধ!

    বলাটা ভদ্রতা নয়, এই যা।

    কিন্তু কি করে জানব বলুন? ভাবলাম প্রবাসে বাঙালী মল্লিকা হেসে ওঠে।

    প্রভাত ভাবে, ঠোঁটে রঙের প্রলেপ বলেই কি দাঁতগুলো অত সাদা দেখাচ্ছে? কিন্তু তাতে সাদাই দেখাবে, অমন মুক্তোর মত নিখুঁত গঠনভঙ্গী হবে?

    জায়গাটা বড় সুন্দর।

    হ্যাঁ। মল্লিকা ঈষৎ হাসির সঙ্গে বলে, নামটা যখন আরাম কুঞ্জ! কিন্তু হাসির সঙ্গে মুখটা এমন কঠিন হয়ে ওঠে কেন ওর?

    বাস্তবিক সার্থকনামা। কিন্তু আমাকে তো এখুনি বেরুতে হবে। আমার অফিসটা কতদূরে, উত্তরে কি দক্ষিণে, পূর্বে কি পশ্চিমে কিছুই জানি না। এখানের ব্যবস্থাটাই বা কি রকম হবে–মানে আপনার বাবাকে তো আর দেখতে পাচ্ছি না!

    পাবেনও না। মল্লিকা হেসে ওঠে, ওই একবার যা স্টেশনে দর্শনের সৌভাগ্য। আবার গেছেন লোক ধরতে–কিন্তু উনি আমার বাবা নন, মামা।

    প্রভাত যেন একটু বিমূঢ় হয়ে পড়ে।

    ভদ্রলোক তাহলে স্রেফ হোটেলের আড়কাঠি! আর এই সুসজ্জিতা সুবেশা রূপসী তরুণী তার মেয়ে না হলেও ভাগ্নী!

    তবে আসল মালিক বোধ হয় এর বাবা! শালাকে লাগিয়ে রেখেছেন তোক ধরে আনতে! কিন্তু সারাক্ষণ লোক কোথায়? ট্রেন তো আর বারবার আসে না!

    সেই সন্দেহই ব্যক্ত করে প্রভাত।

    মল্লিকা বলে, ওসব অনেক সিক্রেট! বুঝবেন না।

    তা না হয় বুঝলাম না, কিন্তু এখানে থাকার ব্যবস্থা কি, চার্জ কি রকম, এখান থেকে অফিস যাওয়া সম্ভব কিনা, এগুলো তো বুঝতে হবে?

    আমার কাছে সবই জানতে পারেন।

    আপনিই কর্ণধার?

    মল্লিকা হঠাৎ চোখ তুলে কেমন যেন একরকম করে তাকাল। তারপর বলল, দেখাশোনা করি। চা-টা খান। এখুনি তত বেরুবেন বলছেন, ভাত–

    না না, ওসব কিছু না। এই এতবড় ব্রেকফাস্ট করে আবার ভাত! চার্জটা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হলে ঠিক স্বস্তি পাচ্ছি না!

    মল্লিকা হেসে ওঠে।

    আচ্ছা ভীতু লোক তো আপনি! মারাত্মক কিছু একটা নয়! চলুন দেখাই গে খাতাপত্তর।

    চার্জ? না, এমন কিছু মারাত্মক সত্যিই নয়। ব্যবস্থার তুলনায় তো নয়ই।

    ব্যবস্থা যে এত উত্তম হতে পারে, এটা প্রভাতের ধারণার মধ্যে ছিল না। আরাম কুঞ্জের শুধু যে নিজস্ব একটা টাঙ্গা আছে তাই নয়, একখানা জীপও আছে। এবং সেই জীপখানা বোর্ডারদের জন্যে সর্বদা খাটে, নিয়ে যায় শহরের মধ্যস্থলে, অফিসপাড়ায়, কর্মকেন্দ্রে।

    নইলে আপনারা গরীবের আস্তানায় থাকবেন কেন? এ আপনার গিয়ে খোলা বাতাসটাও পেলেন, আবার কাজকর্মেরও অসুবিধে হল না–

    প্রোঃ এন কে চ্যাটার্জি বলেন, আপনার আশীর্বাদে যিনি একবার পায়ের ধুলো দিয়েছেন, তিনি বারে বারে পায়ের ধুলো দেন।

    হ্যাঁ, চ্যাটার্জির দর্শন আর একবার মিলেছে। কোনও রকম অসুবিধে হচ্ছে কিনা জানবার জন্যে এসেছেন। বারে বারে প্রশ্ন করছেন।

    প্রভাত হেসে বলে, অসুবিধে কি মশাই, বরং সুবিধেটাই এত বেশি হয়ে যাচ্ছে যে ভয় হচ্ছে, এরপর আর কোথাও

    এরপর আর কোথাও মানে? হাঁ হাঁ করে ওঠেন চ্যাটার্জি, আবার কোথায় যাবেন? নিজের ঘরবাড়ীর মতন থাকবেন। ওইজন্যেই যার টানা লম্বা ঘরদালান না করে ছোট ছোট কটেজ করা।

    প্রভাত কুণ্ঠিত হাস্যে বলে, কিন্তু এই পাণ্ডববর্জিত দেশে এত লোক আসে?

    বলেন কি মশাই? হা হা করে হেসে ওঠেন ভদ্রলোক, দেখতে নিরীহ হলে কি হবে, জায়গাটা কতবড় বিজনেস ঘাঁটি? অবিশ্যি একদিক থেকে বলেছেন ঠিকই, বাঙালী কমই আসেন। মানে, বিজনেসের ব্যাপারে তো বুঝতেই পারছেন!

    কতদিন আছেন আপনি এখানে?

    ওঃ, সে কি আজ? রাগ করে বাড়ী থেকে পালিয়ে এসেছিলাম। বলেছিলাম ধুত্তোর বাংলা দেশ! তারপর কোথা দিয়ে যে কি হল? এখানেই

    দেশে আর কখনো যাননি?

    চ্যাটার্জি একবার তীব্র কটাক্ষে প্রভাতের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেন। নিছক সরল কৌতূহল, না আর কিছু?

    নাঃ, সরল বলেই মনে হচ্ছে। বোকা প্যাটার্নের ছেলেটা!

    বলেন, গিয়েছিলাম। একবার বাপ মরতে গিয়েছিলাম, আর একবার বিধবা বোনটা মরতে বাচ্চা ভাগ্নিটিকে কুড়িয়ে নিয়ে চলে এসেছি। ব্যস, সেই অবধি।

    প্রভাত হাসে, কিন্তু এমন নিখুঁত বাঙালী রয়ে গেছেন কী করে বলুন তো? এতদিন বাইরে থাকলে লোকে তো

    বলেন কি মশাই, বাঙালীর ছেলে বাঙালী থাকব না? যাক, তাহলে অসুবিধে কিছু নেই?

    না না, মোটেই না। আপনার বোর্ডিংয়ের নামকরণ সার্থক!

    চ্যাটার্জি একটু মিষ্ট-মধুর হাসেন, হাঁ, সকলেই অনুগ্রহ করে ওকথা বলে থাকেন। ক্রমশই বুঝবেন, কেন নিজের এত গৌরব করল চ্যাটার্জি। এ তল্লাটে আরাম কুঞ্জ বললে চিনবে না এমন লোক নেই। আর ওই যা বললাম, একবার যিনি পায়ের ধুলো দিয়েছেন

    প্রভাত সসঙ্কোচে বলে, কিন্তু আমাকে যে এখানে স্থায়ীভাবে থাকতে হবে। মানে যতদিন না ফের বদলি হচ্ছি।

    কি আশ্চর্য! থাকবেন তার চিন্তার কি আছে? চ্যাটার্জি মুচকে হাসেন, দেখবেন, এখান থেকে আর বদলি হতেই চাইবেন না। তবে শুনুন চ্যাটার্জি চুপি চুপি বলেন, স্থায়ী বোর্ডারদের চার্জ অনেক কম। ব্যবসা করেছি বলে তো আর আক্কেলের মাথা খেয়ে বসিনি মশাই। বিবেচনাটা আছে। দেখবেন ক্রমশ চ্যাটার্জির বিবেচনায় ত্রুটি পাবেন না।

    .

    স্থায়ী বোর্ডারদের চার্জ অনেক কম– এই আশ্বাসবাণীটি হৃদয়ে মধুবর্ষণ করতে থাকে। হৃষ্টচিত্তে প্যাড টেনে নিয়ে চিঠি লিখতে বসে প্রভাত।

    মাকে লেখে, কাকাকে লেখে।

    মাকে লেখে–মা, তোমাদের কাছ থেকে আরও অনেক দূরে চলে এসেছি। আসবার সময় মনটা বড় খারাপ হয়ে গিয়েছিল। অজানা জায়গা–কোথায় থাকব, কি করব। কিন্তু ভাগ্যক্রমে স্টেশন থেকেই ব্যবস্থা হয়ে গেল। একটি বাঙালীর হোটেল পেয়েছি, বাঙালী রান্নাও খেলাম। ঘর নতুন, সুন্দর সাজানো, বাড়ীটি ছবির মতন, আর জায়গাটা এত চমৎকার যে, ইচ্ছে হচ্ছে তোমাদের সকলকেই দেখাই। ঘরের পিছনের বারান্দায় বসলে যতদূর চোখ চলে, যাকে বলে মুক্ত প্রান্তর, আর তার ওপারে পাহাড়। পরে আবার চিঠি দেব। প্রভাত।

    কাকাকে লিখল, কাকা, তোমাদের কাছ থেকে এসে মন-কেমন করছে, একথা লিখতে গেলে ছেলেমানুষী হবে, তাই আর লিখলাম না। থাকার খুব ভালো ব্যবস্থা হয়ে গেছে। পরে আবার

    চিঠি দিচ্ছি। তুমি ও কাকীমা প্রণাম জেনো। আমার সম্পর্কে নিশ্চিন্ত থেকো। কাকীমাকে বলো, জায়গাটা খুব সুন্দর।
    ইতি–প্রভাত।

    দুজনকেই জানাতে উদ্যত হচ্ছিল, মল্লিকার মত একটি মেয়েকে এরকম জায়গায় দেখতে পাওয়ার বিস্ময় বোধটা কিন্তু কিছুতেই ভাষাটা ঠিকমত মনে এল না। ভাবল, যাকগে, কী আর এমন একটা খবর!

    ভাবল কিন্তু সেই কী আর এমনটাই মনের মধ্যে একটা খবরের মত কানাকানি করতে থাকল!

    সত্যি, আশ্চর্য! এ ধরনের বাঙালী পরিবার পরিচালিত হোটেল, এখানে দেখতে পাওয়া অভাবনীয়। পুরীতে কাশীতে রাঁচিতে এখানে সেখানে দেখেছে প্রভাত, যতটুকু যা বেড়িয়েছে। অথচ ঠিক এ রকমটি কিন্তু দেখেনি। পাঞ্জাবের এই দূর সীমান্তে, শহর ছাড়ানো নির্জনতায়!

    কিন্তু রাত্রে যেন নির্জনতাটা তেমন নির্জন রইল না। সারাদিনের ক্লান্তি আর গত রাত্রের ট্রেনের রাত্রিজাগরণ দুটো মিলিয়ে প্রভাতকে তাড়াতাড়ি বিছানা নেবার প্রেরণা দিচ্ছিল, তাই গণেশকে ডেকে প্রশ্ন করল, এখন খেতে পাওয়া যাবে কিনা।

    গণেশ মৃদু হেসে জানাল, এখানে পাওয়া যাবে কিনা বলে কোনও কথা নেই। রাত দুটো তিনটেতেও লোক আসে, খাওয়া-দাওয়া করে।

    প্রভাত সবিস্ময়ে প্রশ্ন করে, অতরাত্রে লোক? তখনও কোনো ট্রেন আসে নাকি?

    গণেশ আর একটু ব্যঞ্জনাময় হাসি হেসে বলে, ট্রেন আসে কিনা জানি না বাবু। লোক আসে তাই জানি। তেমন হলে আমাদের তো আর রাতে ঘুমোবার জো থাকে না। শীতের রাতে হি হি করতে করতে

    ওরে বাবা! এখানের শীত! প্রভাত পুনঃপ্রশ্ন করে, তুমি তো বাঙালী?

    তা হবে।

    তা হবে! কৌতুক অনুভব করে প্রভাত গণেশের কথায়। বলে, তা হবে মানে? নিজে কোন্ দেশের লোক জানো না?

    জানার কি দরকার বাবু! ভূতের আবার জন্মদিন! আপনার খাবার আনছি।

    প্রভাত ভাবল খাবার কি গণেশই আনবে? অন্তত তার সঙ্গে আর কেউ আসবে না?

    নাঃ, এলও না।

    গণেশ এল। তার সঙ্গে একজন অবাঙালী বয়।

    পরিষ্কার কাঁচের পাত্রে, পরিষ্কার ন্যাপকিন। আহার্যের সুবাসে যেন ক্ষিদে বেড়ে ওঠে প্রভাতের।

    কাকার বাড়ীর নিত্য ডালরুটির ব্যবস্থার পরই এই রাজকীয় আয়োজনটা প্রভাতকে একটু ঔদারক মনে হতে পারে, কিন্তু সত্য অস্বীকার করে লাভ নেই।

    তবু খেতে খেতে একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে যেতে লাগল প্রভাত, ইচ্ছে করে একটু দেরি করে খেতে লাগল। যদি তদ্বিরকারিণী একবার এসে উদয় হয়।

    না, প্রভাতের আশা সফল হল না!

    অদৃশ্য একটা কর্মজগতের উপর কেমন একটা সূক্ষ্ম ঈর্ষা অনুভব করল প্রভাত। এত কাজ! বাবাঃ!

    বিছানায় পড়তে না পড়তেই ঘুম আসবার কথা, কিন্তু কিছুতেই যেন সে ঘুমটা আসছে না। উঁকি দিয়েই পালিয়ে যাচ্ছে।

    কত রকমের শব্দ! কত জুতোর শব্দ, কত কথার শব্দ, কত গ্লাস প্লেট পেয়ালার ঠুং ঠাং শব্দ….কত লোক আসে এখানে? আর আসে কি রাত্রেই বেশি?

    কেন?

    অচেনা পরিবেশে রাত্রির এই মুখরতায় একটু যেন ভয়-ভয় করল প্রভাতের, গা-টা সির সির করে উঠল। তাড়াতাড়ি উঠে দেখল, ছিটকিনি লাগিয়েছে কিনা।

    তারপর ঘড়ি দেখল। মাত্র এগারোটা। তখন লজ্জা করল প্রভাতের।

    নিজে সন্ধ্যা আটটায় শুয়ে পড়েছে বলেই মনে করছে কি না জানি গভীর রাত! এই সময় লোকজন বেশি হওয়াই তো স্বাভাবিক!

    পাখী সারাদিন আকাশে ওড়ে কিন্তু সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরে!

    এইসব বিজনেসম্যানেরা সারাদিন অর্থের ধান্ধায় কোথায় খায়, কোথায় থাকে, কিন্তু রাত্রে আস্তানায় ফেরে, খায়-দায় আড্ডা জমায়। মদই কি আর না খায়? ভাবল প্রভাত।

    আমাদের বিবেচনাশীল প্রোপাইটার মশাই অবশ্যই সে ব্যবস্থা রেখেছেন। আবার ভয় এল।

    কেউ মাতাল-টাতাল হয়ে গোলমাল করবে না তো! মাতালে বড় ভয় প্রভাতের।

    কিন্তু না। শব্দ ক্রমশ কমে এল। ঘুমিয়ে পড়ল প্রভাত।

    পরদিন চায়ের টেবিলে মল্লিকার আবির্ভাব। গত কালকের মত প্রসাধনমণ্ডিত নয়, একটু যেন ঢিলেঢালা। সদ্য স্নান করেছে, খোলা ভিজে চুল।

    প্রভাতের মনে হল, এ আরও অনেক মনোরম।

    কাল ভেবেছিল রূপসী। আজ ভাবল সুন্দরী! কাল মনে করেছিল মনোহর। আজ মনে করল মনোরম। .

    বয়সের ধর্ম, প্রভাত একটু অভিমান দেখাল, কাল তো আর আপনার দর্শনই মিলল না!

    মল্লিকা দুটো চেয়ারের একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। মধুর হাসি হেসে বলল, দেবীদর্শন এত সুলভ নাকি?

    হ্যাঁ, তাই ভেবেই মনকে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম। আর আজও প্রত্যাশার পাত্র উপুড় করে রেখেছিলাম।

    উঃ কী কাব্যিক কথা! চা ঠাণ্ডা হয়ে গেল!

    চোখ ঠাণ্ডা হলে, চা চুলোয় গেলেও ক্ষতি হয় না।

    মল্লিকার মুখটা সহসা একটু কঠিন হয়ে ওঠে। চাচাছোলা টানটান মুখটায় এই সামান্য পরিবর্তনটাই চোখে পড়ে।

    সেই কঠিনমুখে বলে মল্লিকা, কমবয়েসী মেয়ে দেখলেই কি এরকম কাব্যি জেগে ওঠে আপনার?

    মুহূর্তে অবশ্য প্রভাতের মুখও গম্ভীর হয়ে যায়। চায়ের পেয়ালাটা তুলে নিয়ে সে বলে, ধৃষ্টতা মার্জনা করবেন।

    রাগ হয়ে গেল?

    রাগ নয়, চৈতন্য।

    অত চৈতন্যদেব না হলেও ক্ষতি নেই। আমি শুধু একটু কৌতূহল প্রকাশ করেছি। কারণ কি জানেন, আমি আপনাকে সাধারণ পুরুষদের থেকে আলাদা ভেবেছিলাম।

    প্রভাত এবার চোখ তুলে তাকায়।

    একটি বদ্ধ গভীর দৃষ্টি ফেলে বলে, হয়তো আপনার ধারণা ভুল ছিল না। এটা ব্যতিক্রম। কিংবা হয়তো আমি নিজেই নিজেকে জানতাম না। কোনও অনাত্মীয় মেয়ের সঙ্গে আলাপের সুযোগও তো আসেনি কখনো।

    ওঃ, বুঝেছি। মল্লিকা হেসে ওঠে, একেবারে গৃহপোষ্য। তাই সোনা কি রা চিনতে শেখেনু নি এখনো!

    তার মানে?

    মানে নেই। খান, খেয়ে ফেলুন।

    কিন্তু দেখুন সকালে এত খাওয়া! এখুনি তো আবার অফিস যেতে হবে ভাত খেয়ে–

    না তো! মল্লিকা বিস্মিত দৃষ্টিতে বলে, তাই অভ্যাস নাকি আপনার? কাল যে বললেন–ইয়ে আমরা তো আপনার লাঞ্চটা টিফিনক্যারিয়ারে ভরে জিপে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।

    বলেন কি! এ যে ধারণার অতীত।

    কেন?

    বাঃ। বাড়ীতেও তো এমন ব্যবস্থা সবসময় হয়ে ওঠে না।

    মল্লিকা হঠাৎ একটা দুষ্টহাসি হেসে বলে, বাড়ীতে বউ নেই বোধহয়? বুড়ো মা-পিসিকে দিয়ে আর কত

    প্রভাতের মুখে একটা পরিহাসের কথা আসছিল, মুখে আসছিল–বৌ তো কোনখানেই নেই! কিন্তু মল্লিকার ক্ষণপূর্বের কাঠিন্য মনে করে বলল না।

    শুধু বলল, নাঃ, আপনাদের ব্যবস্থা সত্যিই ভালো।

    শুনে সুখী হলাম। কিন্তু উত্তরটা পাইনি।

    উত্তর? কিসের উত্তর?

    ঘরে বৌ আছে কিনা?

    জেনে আপনার লাভ? লাভ?

    আপনি বুঝি প্রতিটি কথাও খরচ করেন লাভ-লোকসানের হিসেব কষে?

    তা পৃথিবীর নিয়ম তো তাই।

    হুঁ। পৃথিবীর নিয়মটা খুব শিখে ফেলেছেন দেখছি। কাল তো সন্ধ্যাবেলাই শয্যাশ্রয় করলেন। নতুন জায়গায় ঘুম হয়েছিল?

    প্রভাত হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়েছিল সেই উদার উন্মুক্ত প্রান্তরের দিকে। আজ আর মেঘলা নেই। সকালের নির্মল আলোয় ঝকঝক করছে। মল্লিকার প্রশ্নে সচকিত হয়ে বলে, ঘুম? সত্যি বলতে প্রথম দিকটায় কিছুতেই ঘুম আসছিল না। এত রকম শব্দ!

    শব্দ! কিসের শব্দ? একটু যেন উত্তেজিত দেখায় মল্লিকাকে।

    প্রভাত বিস্ময় বোধ করে হেসে ওঠে, ভয় পাবার কিছু নেই, বাঘের গর্জনের শব্দ নয়। মানুষের পায়ের, বাসনপত্রের, টুকরো কথার

    আর কিছু নয়? মল্লিকার দৃষ্টি প্রখর হয়ে ওঠে।

    প্রভাত ভাবে, মেয়েটার তো মুহূর্তে মুহূর্তে খুব ভাব পরিবর্তন হয়। কিন্তু কেন হয়? মুখে বলে, না তো! আর কি হবে?

    মল্লিকা নরম হয়ে যায়। সহজ হয়ে যায়। বলে, তাই তো! আর কি হবে! তবে বাঘের গর্জনও অসম্ভব নয়।

    অসম্ভব নয়! বাঘ আছে! প্রভাত প্রায় ধসে পড়ে।

    আর মল্লিকা হেসে ওঠে, ভয় পাবেন না, পাহাড়ের ওদিকে বাঘ ডাকে। তবে বাঘের চাইতে ভয়ঙ্কর তিন-তিনটে কুকুর রাত্রে পাহারা দেয় এখানে। চেন খুলে রাখা হয়। বাঘও ভয় পায় তাদের।

    কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। তারপর আস্তে বলে প্রভাত, সন্ধ্যেবেলা আপনি খুব খাটেন, তাই না?

    শুধু সন্ধ্যেবেলা? সর্বদাই। অহোরাত্র। কেমন একটা ব্যঙ্গ হাসির সঙ্গে বলে মল্লিকা।

    প্রভাত বলে, এত কী কাজ? লোকজন তো রয়েছে?

    লোকজনকে দিয়ে কি সব হয়? অতিথির আদর অভ্যর্থনা নিজেরা না করলে চলে?

    শুনে সহসা প্রভাতের সংস্কারগ্রস্ত গৃহস্থমন বিরূপ হয়ে ওঠে আর অধিকার অনধিকারের প্রশ্ন ভুলে বলে ফেলে সে, এটা আপনার আপত্তি করা উচিত।

    মল্লিকা নিরীহভাবে বলে, কোনটা অন্যায়? কিসে আপত্তি করা উচিত?

    এই, যে আসে তার আদর অভ্যর্থনার দায়িত্ব আপনার নেওয়া! কতরকমের লোক আসে, আর এইসব অঞ্চলের নানা জাতের ব্যবসায়ীরা যে কী ধরনের লোক হয়, জানেন না তো?

    মল্লিকা আরও নিরীহভাবে বলে, আপনি জানেন?

    এর আর জানাজানির কি আছে! প্রভাত সবজান্তার ভঙ্গীতে বলে, কে না জানে! না না, আপনি ওসব দিকে যাবেন না।

    বাঃ, মামার ব্যবসার দিকটা তো দেখতে হবে?

    দেখতে হবে! প্রভাত চটে উঠে বলে, মামার ব্যবসাটাই বড় হল? নিজের মান-সম্মানটা কিছু নয়?

    কে বললে মানসম্মানের হানি হয়? আবার উত্তেজিত হয় মল্লিকা।

    হয় না? আপনি বলছেন কি? প্রভাত উত্তেজিত ভাবে বলে, এমন কিছু কম বয়স আপনার নয় যে জগতের কিছু বোঝেন না! এ থেকে আপনার ক্ষতি হতে পারে, এ আশঙ্কা নেই আপনার?

    মল্লিকা গম্ভীর হয়ে যায়। বিষণ্ণভাবে বলে, আশঙ্কা থাকলেই বা কি! আমার জীবন তো এইভাবেই কাটবে!

    প্রভাত এই বিষণ্ণ কথার ছোঁয়ায় একটু থতমত খেয়ে গিয়ে বলে, বাঃ তাই বা কাটবে কেন? মেয়েদের জীবনে তো মস্ত একটা সুবিধে আছে, বিয়ে হলেই তারা একটা নতুন পরিবেশে চলে যেতে পায়!

    হুঁ, সুবিধেটা মস্ত সন্দেহ নেই। কিন্তু কথা হচ্ছে, বিয়ে না হলে?

    বিয়ে না হলে! প্রভাত দুর্বলভাবে বলে, না হবে কেন?

    সেটাই স্বাভাবিক। মল্লিকা হেসে ওঠে, মা-বাপ-মরা মেয়ে, মামার কি দায়!

    প্রভাত বোধ করি আবার ভুলে যায় সে কে, কী তার অধিকার, তাই রীতিমত চটে উঠে বলে, দায় অবশ্যই আছে। এদিকে তো বাঙালীয়ানার খুব বড়াই করলেন আপনার মামা, বাঙালী সংসারে বাপ-মরা ভাগ্নীর বিয়ে দেবার দায় থাকে না? তা থাকবে কেন, আপনাকে দিয়ে দিব্যি সুবিধে সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে—

    মল্লিকা তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে ওঠে, খুব তত বড় বড় কথা বলছেন, আপনি আমার বিষয়ে কতটুকু জানেন? জানেন, মামা আমাকে দিয়ে কি কি সুযোগ সুবিধে পাচ্ছেন?

    বেশি জানবার কিছু নেই। নিজের চক্ষেই তো দেখলাম, খাতা লিখছেন হিসেবপত্তর দেখছেন, বোর্ডারদের সুবিধে-স্বাচ্ছন্দ্য দেখছেন, নিজে মুখেই তো বললেন, অহোরাত্র খাটছেন। এই যথেষ্ট, আর বেশি না জানলেও চলবে। আমি বলব আপনার মামার এটা রীতিমত স্বার্থপরতা। আর আপনার উচিত এর প্রতিবাদ করা।

    সত্যি! হঠাৎ বেদম খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে মল্লিকা। আর নেহাত বাঁচাল মেয়ের মত বলে ওঠে, মনে হচ্ছে, আমার ওপর আপনার বড় মায়া পড়ে গেছে! লক্ষণ ভালো নয়।

    উপহাস করছেন?

    আহত কণ্ঠে বলে প্রভাত।

    কে বললে? মল্লিকা হাসি থামিয়ে বলে, খাঁটি সত্য কথা। কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখেছেন কি, মামা এরকম স্বার্থপর না হলে আপনিই বা আমার জন্যে এত দুশ্চিন্তা করবার অবকাশ পেতেন কোথায়? আপনার সঙ্গেও তো সেই একই সম্পর্ক, মামার বোর্ডার!

    প্রভাত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, আরক্ত মুখে বলে, মাপ করবেন। নিজের পোজিশানটা হঠাৎ ভুলে গিয়েছিলাম।

    .

    আরাম কুঞ্জের ডানপাশের রাস্তায় জিপগাড়ীটা প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়েছিল, প্রভাত অফিসের সাজে সজ্জিত হয়ে এসে দেখল ভিতরে আরও দুজন ইতিমধ্যেই আসীন।

    গতকাল একাই গিয়েছিল, এবং আজও সেইরকম ধারণা নিয়েই আসছিল, সহযাত্রীযুগলকে দেখে মনটা অপ্রসন্ন হয়ে উঠল।

    তা প্রভাত কি কুনো? মানুষ ভালবাসে না সে?

    ঠিক তাও নয়। সত্যিকথা বললে বলতে হয়, প্রভাত একটু প্রাদেশিকতা-দোষদুষ্ট। সহযাত্রীরা বাঙালী হলে সে যে পরিমাণ প্রসন্ন হয়ে উঠত, সেই পরিমাণ অপ্রসন্ন হল ওদের দেখে।

    বিদেশী পদ্ধতিতে একটু সৌজন্যসূচক সম্ভাষণ করে প্রভাত গম্ভীর মুখে উঠে বসল। দেখল পায়ের কাছে তিনটা টিফিনকেরিয়ার বসানো এবং তাদের হাতলে এক-একটা সূতো বেঁধে অধিকারীর নামের টিকিট লটকানো।

    মিঃ গোস্বামী, মিঃ ট্যাণ্ডন, মিঃ নায়ার। প্রভাত ভাবল সর্বধর্ম সমন্বয়। ভাবল চ্যাটার্জি লোকটা ঝুনো ব্যবসাদার বটে!

    গাড়ী উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলল, তিনটি যাত্রী কেউ কারও সঙ্গে আলাপের চেষ্টা করলে না। শুধু প্রভাতের মনে হল, অন্য দুজন যেন অনবরত তার দিকেই লক্ষ্য করছে।

    মনের ভ্রম? না কি সম্পূর্ণ সাধারণ ব্যাপার?

    প্রভাতও তো বারবারই ওদেরই দেখেছে।

    .

    আজও সন্ধ্যায় গণেশ ও সেই অপর একজন খাবার নিয়ে এল। এবং যথারীতি মল্লিকার দেখা মিলল না।

    সকাল থেকে অকারণেই প্রভাতের মনটা বিষ হয়ে ছিল। সকালের সেই লোকদুটো এ বেলাও সহযাত্রী হয়েছে। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে এই ব্যবস্থাই চলতে থাকবে। জিপের ব্যবস্থা দেখে কাল খুসি হয়েছিল, আজ বিরক্তি বোধ করছে।

    কম্পাউণ্ডের মধ্যে এদিক ওদিক দুচারখানা প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেছে। ওর মনে হচ্ছে, জগতের সকলেরই প্রভূত টাকা আছে। নেই শুধু প্রভাতের।

    নিজের একখানি কার চালিয়ে যথেচ্ছ বেড়াতে পাওয়াটাই প্রভাতের মতে আপাতত জগতের শ্রেষ্ঠ সুখের অন্যতম মনে হতে লাগল। জিপের জন্যে আলাদা চার্জ দিতে হবে, অথচ কেমন যেন দয়া-দয়া ভাব। নিজেকেও দয়ার ভিখিরীর মত লাগছে।

    গণেশকে প্রশ্ন করল, গাড়ীতে আর যে দুজন ভদ্রলোক ছিল ওরা এখানে বরাবর থাকে?

    গণেশ গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলে, কি জানি!

    কি জানি মানে? তুমি জানো না?

    আজ্ঞে না বাবু, আমাদের কিছু জানবার আইন নেই।

    ব্যাপার কি বল তো? এখানে কিছু রহস্য-টহস্য আছে নাকি? প্রভাত উত্তেজিত ভাবে বলে, তোমাদের মালিক যখন স্টেশন থেকে নিয়ে এলেন, তখন যেরকম ভেবেছিলাম, সেরকম তো দেখছি না।

    গণেশ এদিকে ওদিকে তাকিয়ে বলে, বেশি ভাবাভাবির দরকার কি বাবু? আছেন থাকুন। কোনও অসুবিধে হয় জানাবেন, চুকে গেল।

    গাড়ীতে যারা গেল, তাদের আমার ভালো লাগে নি।

    তা বিশ্বসুন্ধু লোককে ভালো লাগবে তার কি মনে আছে? গণেশ ঝাড়নে হাত মুছতে মুছতে বলে, রেলগাড়ীতে কত লোক পাশে বসে যায়, সবাইকে আপনার ভালো লাগে? আপনি বাঙালী, আপনার ভালোর জন্যেই বলছি বাবু, নিজের তালে থাকুন সুখে থাকবেন। অন্যদিকে নজর দিতে গেলে বিপদ আছে।

    গণেশ চলে যায়।

    প্রভাতের মনে হয়, লোকটা নেহাৎ সামান্য চাকর নয়। কথাবার্তা বড্ড বেশি ওস্তাদমার্কা।

    আজও দেরি করে করে খেলো প্রভাত, আর হঠাৎ মনে করল এখানে থাকব না। চ্যাটার্জির আরামকুঞ্জ ছাড়া সত্যিই কি আর জায়গা জুটবে না? অফিস অঞ্চলে চেষ্টা দেখব।

    .

    পিছনের বারান্দার দিকটা অন্ধকার, তার নীচেই সেই সুবিস্তীর্ণ জমি, জানালাগুলোয় শিক নেই, শুধু কাঁচের শার্সি সম্বল।

    নাঃ, চলেই যাবে। অস্বস্তি নিয়ে থাকা যায় না।

    খাওয়ার পর চিঠি লিখতে বসল,–শ্রীচরণেষু কাকিমা, আশা করি কাকাকে লেখা আমার পৌঁছানো সংবাদ পেয়েছেন। লিখেছিলাম বটে থাকার জায়গা খুব ভালো পেয়েছি, কিন্তু একটা মস্ত অসুবিধে, অফিস অনেক দূর। রোজ যাতায়াতের পক্ষে বিরাট ঝামেলা। তাই ভাবছি, অফিস অঞ্চলে একটা ব্যবস্থা করে নেব। নতুন ঠিকানা হলেই জানাব। ইতি।

    আজও ভাবল কাকিমাকে মল্লিকার কথাটা লিখলে হত।

    কিন্তু লিখতে গিয়ে ভাবল কথাটাই বা কী, এখানে একটি মেয়ে আছে, নাম মল্লিকা,–তার পর?

    এটা কি একটা কথা?

    অথচ কথাটা মন থেকে তাড়ানো যাচ্ছে না।

    .

    চিঠিখানা কাল পাছে পোস্ট করতে ভুলে যায়, তাই অফিসের কোর্টের পকেটে রেখে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই অবাক হয়ে গেল প্রভাত।

    দরজায় দাঁড়িয়ে চ্যাটার্জি।

    পর্দা সরিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন স্থির হয়ে। প্রভাতের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বিনয়ে একেবারে গলে গিয়ে নীচু হয়ে বলল, এই দেখতে এলাম আপনার কোনও অসুবিধে হচ্ছে কিনা।

    প্রভাত ভুরুটা একটু কুঁচকে বলল, কই, আমাকে তো ডাকেন নি মিস্টার চ্যাটার্জি।

    আহা-হা ডাকব কেন, ডাকব কেন? তন্ময় হয়ে চিঠি লিখছিলেন–স্ত্রীকে বোধহয়! চ্যাটার্জির গোঁফের ফাঁকে একটু হাসি ঝলসে ওঠে।

    প্রভাতের গতকাল এই বিনয়-নম্র লোকটাকেই ঈশ্বরপ্রেরিত মনে হয়েছিল, কিন্তু আজ ওর এই অতি বিনীত ভাবটাতে গা জ্বলে গেল। তাছাড়া মনে পড়ল, মল্লিকার মামা–তাই ঈষৎ কঠিন স্বরে বলে উঠল, স্ত্রী ছাড়া জগতে আর কাউকে কেউ চিঠি লেখে না? আহা লিখবে না কেন? আর একটু ধূর্তহাসি হাসেন চ্যাটার্জি, লেখে পোস্টকার্ডে, দুপাঁচ লাইন। আর এত তন্ময় হয়েও লেখে না। আমরা তো মশাই এটাই সার বুঝি।

    আপনারা যা বোঝেন, হয়তো সেটাই সব নয়। চিঠি আমার কাকিমাকে লিখেছি। বলে কথায় উপসংহারের সুর টেনে দেয় প্রভাত।

    কিন্তু চ্যাটার্জি উপসংহারের এই ইঙ্গিত গায়ে মাখেন না। একটা অভব্য কৌতুকের হাসি মুখে ফুটিয়ে বলে ওঠেন, কা-কি-মা-কে! আপনি যে তাজ্জব করলেন মশাই! কাকিমাকে চিঠি, তাও এত ইয়ে! তা কী লিখলেন?

    প্রভাত আর শুধু ভুরু কুঁচকেই ক্ষান্ত হয় না, প্রায় ক্রুদ্ধ গলায় বলে, প্রশ্নটা কি খুব ভদ্রতাসঙ্গত হল মিস্টার চ্যাটার্জি?

    আহা-হা, চটছেন কেন? চটছেন কেন? এমনি একটা কথার কথা বললাম। বারোমাস যত নবেঙ্গলী নিয়ে কারবার, দুটো খোলামেলা কথা তো কইতে পারি না। আপনি বাঙালী বলেই–যাক, যদি রাগ করেন তো মাপ চাইছি।

    এবার প্রভাতের লজ্জার পালা।

    ছি ছি, বড় অসভ্যতা হয়ে গেল! হয়তো লোকটা ভাগ্নীর কাছে গিয়ে গল্প করবে। কী মনে করবে মল্লিকা তা কে জানে!

    আসলে লোকটা মুখ। তাই ভাবভঙ্গিতে কেমন অমার্জিত ভাব। নেহাৎ পদবীটা চ্যাটার্জি তাই, নইলে নেহাৎ নীচু ঘরের মনে হত!

    তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, না না, রাগের কথা নয়। লক্ষ্ণৌতে কাকা-কাকিমার কাছেই ছিলাম এতদিন, এসে চিঠিপত্র না দিলে ভালো দেখায়? তা লিখছিলাম কাকিমাকে চিঠি, বললেন স্ত্রীকে-মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। মাথা নেই তার মাথাব্যথা!

    তাই নাকি? হা-হা-হা! ভারি মজার কথা বলেন তো আপনি! চ্যাটার্জি হেসে ঘর ফাটান।

    .

    চ্যাটার্জি চলে গেল, প্রভাত ভাবতে থাকে, অকারণ বিরূপ হচ্ছি কেন? না না, এটা ঠিক নয়। সন্দেহের কিছু নেই। রহস্যই বা কি থাকবে! লোকটা ঝুনো ব্যবসাদার, এই পর্যন্ত। জিপের সহযাত্রীরা বাঙালী নয়, এতে বিরক্তির কি আছে? অফিসে তো সে ছাড়া আর একজনও বাঙালী নেই! যাচ্ছে না প্রভাত সেখানে?

    গণেশটার কথাবার্তাই একটু বেশি কায়দার। যেন ইচ্ছে করে রহস্য সৃষ্টি করতে চায়। ওর সঙ্গে আর কথা বেশি বলার দরকার নেই।

    আর–

    আর মল্লিকার সঙ্গেও দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। কী দরকার প্রভাতের, কার মামা তার ভাগ্নীর প্রতি অন্যায় ব্যবহার করছে কি ন্যায় ব্যবহার করছে, তার হিসেব নিতে যাওয়া!

    সিদ্ধান্ত করলে, খাবে, ঘুমোবে, কাজে যাবে, ব্যস।

    মনটা ভালো করে দরজা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল প্রভাত।

    ঘড়িতে দেখল রাত পৌনে দশটা।

    কিন্তু প্রভাতের নিশ্চিন্ততার সুখ যে ঘণ্টাকয়েক পরেই এমনভাবে ভেঙে যাবে, তা কি সে স্বপ্নেও ভেবেছিল? ঘণ্টা কয়েক!

    কঘণ্টা? পৌনে দশটার পর শুয়ে কতক্ষণ ঘুমিয়েছে প্রভাত? ঘুমের মধ্যে সময় নির্ণয় হয়, তবু প্রভাতের মনে হল ঘণ্টা তিন-চার পার হয়েছে।

    হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, জানলার কাছে খুব দ্রুত আর জোরে একটা টকটক শব্দে। পিছনের খোলা বারান্দার দিকের জানলা।

    ভয়ে বুকটা ঠাণ্ডা মেরে গেল প্রভাতের, ঝপ করে বেডসুইচটা টিপে আলোটা জ্বেলে ফেলে কম্পিত বক্ষে সেই দিকে তাকাল।

    কে ও?

    চোর ডাকাত? খুনে গুণ্ডা?

    জানলা ভেঙে ফেলবে? অশরীরী যে একটা আতঙ্ক তাকে পেয়ে বসেছিল সেটা তাহলে ভুল নয়!

    নাকি সেই বাঘের চাইতে ভয়ঙ্কর কুকুরগুলোরই কোনও একটা কচ আঁচড়াচ্ছে!

    কিন্তু তাই কি? এ তো নির্ভুল মানুষের আওয়াজ! যেন সাঙ্কেতিক!

    কাঁচ ভেদ করে গলার শব্দ আসে না, তাই বোধহয় ওই শব্দটাই অবলম্বন করেছে।

    শব্দ মুহুর্মুহু বাড়ছে। টকটক! টকাট খটখট!

    কেউ কোন বিপদে পড়েনি তো! দেখবে নাকি! না দেখলেও তো বিপদ আসতে পারে। ঈষৎ ইতস্তত করে প্রভাত বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গিয়ে পর্দাটা সরাতে গিয়েই চমকে উঠল।

    কী সর্বনাশ এ যে মল্লিকা!

    কোনো বিপদে পড়েছে তাহলে!

    মল্লিকা এতক্ষণ ব্যাকুল আবেদন জানাচ্ছে, আর প্রভাত বোকার মত বিছানায় শুয়ে ভয়ে কাঁপছে? কী বিপদ! কুকুরে তাড়া করে নি তো?

    কী ভাবে যে জানলার ছিটকিনিটা খুলে ফেলেছিল প্রভাত তা আর মনে নেই, শুধু দেখতে পায় জানলা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই মল্লিকা উদ্ভ্রান্তের মত ঝুপ করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে জানলাটা ফের বন্ধ করে দিয়ে আর পর্দাটা টেনে দিয়ে প্রভাতের বিছানার ধারে বসে হাঁফাচ্ছে।

    প্রভাত চিত্রার্পিত পুত্তলিকাবৎ! এ কী! এর মানে কী!

    হাঁফানো থামলে মল্লিকা কাতর বচনে বলে, মিস্টার গোস্বামী, আমায় ক্ষমা করুন, দয়া করে আলোটা নিভিয়ে দিন।

    প্রভাত প্রায় অচেতনের মত এই অভূতপূর্ব ঘটনার সামনে দাঁড়িয়েছিল। রাত দুটোর সময় তার বিছানার উপর একটি বেপথু সুন্দরী তরুণী।

    এ স্বপ্ন? না মায়া?

    কথা কইলে বুঝি এ স্বপ্ন ভেঙে যাবে, এ মায়া মুছে যাবে!

    ভেঙে গেল স্বপ্ন, মুছে গেল মায়া। প্রবল একটা ঝাঁকুনি খাওয়ার মত চমকে উঠল প্রভাত, কী বলছে বেপরোয়া মেয়েটা!…

    দয়া করে আলোটা নিভোন!

    প্রভাত প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, কী বলছেন আপনি?

    মিস্টার গোস্বামী, কী বলছি, তার বিচার পরে করবেন, যদি আমাকে বাঁচাতে চান–

    হঠাৎ নিজেই হাত বাড়িয়ে আলোটা নিভিয়ে দেয় মল্লিকা। বিছানার উপর ভেঙে পড়ে চাপা কান্নায় উদ্বেল হয়ে ওঠে।

    আর সেই অন্ধকার ঘরের মাঝখানে প্রভাত বাকশক্তিহীন ভূতের মত দাঁড়িয়ে থাকে।

    কতক্ষণ?

    কে জানে কতক্ষণ! হয়তো বা কত যুগ!

    যুগ-যুগান্তর পরে কান্নার শব্দ স্তিমিত হয়, অন্ধকারেও অনুভব করতে পারে প্রভাত, মল্লিকা উঠে বসেছে।

    কান্নাভেজা গলায় আস্তে কথা বলে মল্লিকা, মিস্টার গোস্বামী, আপনি হয়তো আমাকে পাগল ভাবছেন!

    ভূতের মুখে বাক্য ফোটে, আপনাকে কি নিজেকে, তা ঠিক বুঝতে পারছি না!

    আপনি ধারণা করতে পারবেন না মিস্টার গোস্বামী, কী অবস্থায় আমি এভাবে আপনাকে উত্ত্যক্ত করতে এসেছি!

    অবস্থাটা যদি এত ভয়াবহ না হত, শুধু স্নায়ু নয়, অস্থিমজ্জা পর্যন্ত এমন করে সিঁটিয়ে না উঠত, তাহলে হয়তো প্রভাত সহানুভূতিতে গলে পড়ত, কী ব্যাপার ঘটেছে জানবার জন্যে ব্যাকুলতা প্রকাশ করত। কিন্তু অবস্থাটা ভয়াবহ। তাই প্রভাতের কণ্ঠ থেকে যে স্বর বার হয়, সেটা শুকনো, আবেগশূন্য।

    সত্যিই ধারণা করতে পারছি না। কিন্তু দয়া করে আলোটা জ্বালতে দিন, অবস্থাটা অসহ্য লাগছে।

    না না না! মল্লিকা প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে, চলে যাব, ভোর হলেই চলে যাব আমি। শুধু ঘণ্টা কয়েকের জন্যে আশ্রয় দিয়ে বাঁচান আমাকে।

    কিন্তু মল্লিকা দেবী, আপনার এই বাঁচা-মরার ব্যাপারটা তো কিছুতেই বুঝতে পারছি না আমি!

    পারবেন না। সে বোঝবার ক্ষমতা আপনাদের পুরুষদের থাকে না। তবু কল্পনা করুন, বাঘে তাড়া করেছে আমাকে।

    বাঘে!

    অস্ফুট একটা আওয়াজ বার হয় প্রভাতের মুখ থেকে। ভাষার অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করবার আগেই পিছনের সেই পাহাড়ের কোল পর্যন্ত প্রসারিত অন্ধকার তৃণভূমির দৃশ্যটা মানশ্চক্ষে ভেসে ওঠে তার, আর অস্ফুট ওই প্রশ্নটা উচ্চারিত হয়।

    অন্ধকারে অসহনীয় ধাক্কাটা বুঝি ক্রমশ সহনীয় হয়ে আসছে, ভেন্টিলেটার দিয়ে আসা দূরবর্তী কোনও আলোর আভাস ঘরের চেহারাটা পরিস্ফুট করে তুলছে। হাসির শব্দটা, লক্ষ্য করে অনুমান করতে পারছে প্রভাত, মল্লিকার মুখে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের রেখা। সেই রেখার কিনারা থেকে উচ্চারিত হল, হ্যাঁ বাঘই! শুধু চেহারাটা মানুষের মত!

    স্তব্ধতা। দীর্ঘস্থায়ী একটা স্তব্ধতা।

    তারপর একটা নিশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারিত হয়, এরকম পরিবেশে এইরকম ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বলতে পারেন, এত রাত্রে আপনি নিজের ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়েছিলেন কেন?

    আবার মিনিটখানেক নিস্তব্ধতা, তারপর মল্লিকার ক্লান্ত করুণ স্বর ধ্বনিত হয়, এই আমার ললাটলিপি মিস্টার গোস্বামী! চাকরবাকর শুয়ে পড়ে, আমাকে তদারক করে বেড়াতে হয়, আগামী ভোরের রসদ মজুত আছে কিনা দেখতে! হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়ে মনে পড়ল, স্টোরে সকলের ব্রেকফাস্টের উপযুক্ত ডিম নেই। তাই মুরগীর ঘর তল্লাস করতে গিয়েছিলাম। মিস্টার গোস্বামী, কেন জানি না আমার হঠাৎ মনে হল আপনার ঘরটাই নিরাপদ আশ্রয়!

    অদ্ভুত মনে হওয়া! মল্লিকা দেবী, আমিও একজন পুরুষ, এটা বোধ করি আপনি হিসেবের মধ্যে আনেন নি!

    এনেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে এটাও স্থির করেছিলাম, আপনি মানুষ!

    আপনার এমন বিশ্বাসের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু এটা কেন ভাবছেন না, হঠাৎ যদি কারও চোখে পড়ে আপনি আমার ঘরে, এবং আলো নিভানো ঘরে, তাহলে অবস্থাটা কি হবে? আমার কথা থাক, আপনার দুর্নাম সুনামের কথাই ভাবুন!

    ভাবছি। বুঝতে পারছি। মল্লিকা আরও ক্লান্ত গলায় বলে, কিন্তু তবু সে তো মিথ্যা দুর্নাম। সত্যিকার বিপদ নয়, বাঘের কামড় নয়!

    অন্ধকারেই জিনিসপত্র বাঁচিয়ে বারকয়েক পায়চারি করে প্রভাত তারপর দৃঢ়স্বরে বলে, কিন্তু সেই বদলোকটা যে কে, আপনার চেনা দরকার ছিল। আপনার মামাকে তার স্বরূপ চিনিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।

    মামাকে! আমার মামাকে! মল্লিকা আর একবারও কান্নায় ভেঙে পড়ে, আমার মামাকে আপনি চেনেন না তাই বলছেন! মামা তার খদ্দেরকে খুসি করতে, নিজেই আমাকে বাঘের গুহায় ঠেলে দিতে চান–

    মল্লিকা দেবী!

    তীব্র একটা আর্তনাদ ঘরের স্তব্ধতাকে খানখান করে ফেলে।

    .

    না!

    সে আর্তনাদের শব্দ কারও কানে প্রবেশ করে ভয়ঙ্কর একটা কেলেঙ্কারির সৃষ্টি করে নি। মোটা কাপড়ের পর্দা ঘেরা কাঁচের জানালা ভেদ করে কারও নিশ্চিন্ত ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় নি।

    এখন সকাল। এখন প্রভাত এসে দাঁড়িয়েছে সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর প্রকৃতির দৃশ্যের সামনে। গত দুদিন শুধু সামনেই তাকিয়ে দেখেছে মুগ্ধ দৃষ্টিতে। আজ দুপাশে যতদূর দৃষ্টি চলে দেখতে থাকে। ডানদিকে নীচু জমিতে ওই চালাঘরটা তাহলে মুরগীর ঘর। ওর জালতির দরজাটা সন্দেহের নিরসন করছে।

    রাত দুটোর সময় ওইখানে নেমেছিল মল্লিকা ডিমের সন্ধানে?

    মল্লিকা কি পাগল?

    কথাটা কি বিশ্বাসযোগ্য? ও কি একটা গল্প বানিয়ে বলে গেল?

    কিন্তু তা কি কখনও সম্ভব?

    চিরদিন সাধারণ ঘর-গেরস্থীর মধ্যে মানুষ নিঃসন্দিগ্ধচিত্ত প্রভাতের ওই সন্দেহটাকে সম্ভব বলে মনে করতে বাধে।

    তবে চ্যাটার্জির যে রূপ উদঘাটিত করলো মল্লিকা, সেটাকে অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেবে, এত অবোধ সরলও নয় প্রভাত। জগতের ভয়াবহ রূপ প্রত্যক্ষ না দেখুক, জানে বৈকি।

    স্বার্থের প্রয়োজনে স্ত্রী কন্যা বোনকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দেয়, জগতে এমন পুরুষের অভাব নেই একথা প্রভাত জানে না এমন নয়। এই দণ্ডে এই পিশাচ লোকটার আশ্রয় ত্যাগ করে চলে যেতে ইচ্ছে করছে তার।

    কিন্তু

    কিন্তু কী এক অমোঘ অদৃশ্য বন্ধনে বাঁধা পড়ে গেল সে। তাই ভাবছে, মল্লিকাকে সে কথা দিয়েছে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। এই নরক থেকে, এই হিংস্র জানোয়ারের গুহা থেকে।

    অথচ জানে না কেমন করে রাখবে সেই প্রতিজ্ঞা!

    কাল নিরীক্ষণ করে দেখার দরকার হয়নি, আজ দেখছে। দেখছে সমস্ত সীমানাটা কাটা তারের বেড়ায় ঘেরা, সেই ব্যাঘ্ৰসদৃশ কুকুরগুলো চোখে দেখেনি বটে, কিন্তু রাত্রে তাদের গর্জন মাঝে মাঝেই কানে এসেছে।

    রাতে যাওয়া হয় না। তাছাড়া যানবাহন কোথা? সেই চ্যাটার্জির জিপগাড়ীই তো মাত্র ভরসা। এক যদি মল্লিকা শহরের দিকে যাবার কোনও ছুতো আবিষ্কার করতে পারে।

    কিন্তু মল্লিকা বলেছে, অসম্ভব।

    কিন্তু তুমি তো মামার সঙ্গে রোজ স্টেশনে যাও লোক ধরতে! বলেছিল প্রভাত।

    হ্যাঁ, মামার সঙ্গে! মল্লিকা মৃদু তীক্ষ্ণ একটু হেসেছিল।

    তবু তাকে আশ্বাস দিয়েছে প্রভাত।

    প্রভাত নয়, প্রভাতের শিরায় শিরায় প্রবাহিত পুরুষের রক্ত। যে রক্ত পুরুষানুক্রমে মধ্যবিত্ত জীবনের দায়ে স্তিমিত হয়ে গেলেও একেবারে মরে যায়নি। আশ্বাস দিয়েছে সেই রক্ত। আশ্বাস দিয়েছে তার যৌবন।

    চায়ের সময় হয়ে গেছে।

    প্রভাত এখনো নিজেকে প্রস্তুত করে নেয় নি। আকাশে আলো ফুটতে ফুটতেই বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে।

    এখন ফের ঘরে এল। সাবান তোয়ালে টুথব্রাশ নিয়ে সংলগ্ন স্নানের ঘরের দিকে এগোতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাকিয়ে দেখল বিছানাটার দিকে।

    রাত দুটোর পর আর শোয়া হয়নি প্রভাতের। শোবার সময় হয়নি, হয়তো বা সাহসও হয়নি। এখন তাকিয়ে দেখছে কোথায় বসেছিল সেই ক্রন্দনবতী। কোনখানটায় আছড়ে পড়ে চোখের জলে সিক্ত করে তুলেছিল।

    সত্যিই কি এসেছিল কেউ? নাকি প্রভাতের স্বপ্নকল্পনা? চমকে বিছানার কাছে এগিয়ে এল। বালিশের গায়ে একগাছি লম্বা চুল।

    ঈশ্বর রক্ষা করেছেন!

    এখুনি চাকরবাকর বিছানা ঝাড়তে আসবে। এ দৃশ্য যদি তাদের চোখে পড়ত! চারিদিকে সন্ধানীদৃষ্টি ফেলে ফেলে দেখল আর কৈাথাও আছে কিনা।

    নেই। নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।

    কিন্তু?

    সমস্ত নিশ্চিন্ততা ছাপিয়ে মল্লিকার একটা কথা মাথার মধ্যে কাটার মত বিধছে। সে কাটা বলছে–একথা কেন বলল মল্লিকা?

    কথাটা আবার মনের মধ্যে স্পষ্ট পরিষ্কার উচ্চারণ করল প্রভাত। নতুন করে আশ্চর্য হল।

    প্রতিজ্ঞা! প্রতিজ্ঞা করছেন? পুরুষের প্রতিজ্ঞা! কিন্তু আপনি কী সত্যি পুরুষ? তীব্র তীক্ষ্ণ ছুরির ফলার মত একটু হেসেছিল মল্লিকা এই প্রশ্নের সঙ্গে।

    কোন কথার পিঠে এ প্রশ্ন উঠেছিল তা মনে পড়ছে না প্রভাতের। বোধ করি প্রভাতের প্রতিজ্ঞামন্ত্র পাঠের পর। নাকি তাও নয়?

    না, তা নয়। বোধহয় চলে যাবার আগে। হ্যাঁ তাই। চলে যাবার আগে ফিরে দাঁড়িয়ে বলে উঠেছিল, প্রতিজ্ঞা করছেন? পুরুষের প্রতিজ্ঞা? কিন্তু আপনি কি সত্যি পুরুষ!

    এ কিসের ইঙ্গিত?

    মল্লিকার করুণ অভিব্যক্তি আর ভয়াবহ ভাগ্যের পরিচয়ের সঙ্গে ওই হাসি আর প্রশ্নের সামঞ্জস্য কোথায়?

    যথারীতি গণেশ এল।

    প্রভাত বিনা প্রশ্নে চায়ের ট্রে-টা কাছে টেনে নিল। কিন্তু তবু চোখে না পড়ে পারল না কেমন একরকম তাকাচ্ছে আর মিটিমিটি হাসছে গণেশ।

    কেন, ওরকম করে হাসছে কেন ও? ও কি ঘরে ঢুকেছিল? দীর্ঘ বেণী থেকে খসেপড়া কোনও দীর্ঘ অলক আর কোথাও কি চোখে পড়েছে ওর?

    কোন বাক্যবিনিময় হল না অবশ্য। কিন্তু গণেশের ওই চোরা ব্যঙ্গের চাউনিটা গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিয়ে গেল।

    আর একদণ্ডও এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না।

    .

    কী হয়, ওই অফিস যাবার মুখেই যদি প্রভাত বিল মিটিয়ে দিয়ে মালপত্র নিয়ে চলে যায় ওবেলা আর আসব না বলে?

    ভালোমন্দ যাই হোক হোটেল একটা জুটবেই। এরকম হিংস্র সুন্দরে তার দরকার নেই।

    এর অন্তরালে কোথাও যেন বিপদের চোরা গহুর, এর শিরায় শিরায় যেন ভয়াবহ রহস্যের জাল পাতা।

    চ্যাটার্জি লোকটা নোংরা নীচ ইতর কুৎসিত!

    চ্যাটার্জির খদ্দেররা সৎ নয়। নির্ঘাৎ রাত্রে এখানে মাতলামি চলে, নোংরামি চলে, জুয়ার আড্ডা বসে। হয়তো বা কালোবাজারের হিসেবনিকেশ হয়, হয়তো খাদ্যে আর ওষুধে কী পরিমাণ ভেজাল দেওয়া সম্ভব, তারই পরিকল্পনা চলে।

    চ্যাটার্জি এদের পালক, পোষক।

    কী কুক্ষণেই স্টেশনে চ্যাটার্জির কবলে পড়েছিল প্রভাত! একবার ভেবেছিন্তে দেখল না, যার সঙ্গে যাচ্ছি, সে লোকটা কেমন!

    কী নির্বোধ আমি!

    কিন্তু শুধু কি ওইটুকু নির্বুদ্ধিতা! কী চরম নির্বুদ্ধিতা দেখিয়েছে কাল রাত্রে!

    তুমি প্রভাত গোস্বামী, বিদেশে এসেছ চাকরি করতে। কী দরকার ছিল তোমার নারীরক্ষার নায়ক হতে যাবার? কোন সাহসে তুমি একটা অসহায় বন্দিনী মেয়েকে ভরসা দিতে গেলে বন্ধন মোচনের? যে মেয়ের রক্ষকই ভক্ষক!

    জগতে এমন কত লক্ষ লক্ষ মেয়ে পুরুষের স্বার্থের আর পুরুষের লোভের বলি হয়েছে, হচ্ছে, হবে। যতদিন প্রকৃতির লীলা অব্যাহত থাকবে, ততদিনই এই নিষ্ঠুর লীলা অব্যাহত থাকবে।

    প্রভাত কজনের দুরবস্থা দূর করতে পারবে? তবে কেন ওই মেয়েটাকে আশ্বাস দিতে গেল প্রভাত চরম নির্বোধের মত?

    চলে যাবে। আজই। জিনিসপত্র নিয়ে।

    তাকিয়ে দেখল চারিদিক।

    কীই বা! এই তো সুটকেস, বিছানা, আর আলনায় ঝোলানো দুএকটা পোশাক! দুমিনিটে টেনে নিয়ে গুছিয়ে ফেলা যায়। টিফিন বাক্সটা তো জিপেই আছে।

    মল্লিকা তো চোখের আড়ালে।

    মল্লিকার সঙ্গে তো জীবনে আর চোখাচোখি হবে না।

    .

    আলনার জামাটায় হাত দিতে গেল, আর মুহূর্তে অন্তরাত্মা ছি ছি করে উঠল।

    প্রভাত না মানুষ? ভদ্ররক্ত গায়ে আছে না তার?

    অফিসে গিয়ে মনে হল, কাকিমার চিঠিটায় মল্লিকা সম্পর্কে দুলাইন জুড়ে দিয়ে পোস্ট করবে।

    পকেট থেকে বার করতে গেল, পেল না। কী আশ্চর্য, গেল কোথায় চিঠিটা? নিশ্চিত মনে পড়ছে, কোটের পকেটে রেখেছিল।

    কিছুতেই ভেবে পেল না, পড়ে যেতে পারে কি করে?

    কোটটা হ্যাঙ্গার থেকে তুলে নিয়েছে, গায়ে চড়িয়েছে, গাড়ীতে উঠেছে, গাড়ী থেকে নেমে অফিসে ঢুকেছে। এর মধ্যে কী হওয়া সম্ভব?

    চিঠিটা তুচ্ছ, আবার লিখলেই লেখা যায়, হারানোটা বিস্ময়কর।

    কিন্তু আরও কত বিস্ময় অপেক্ষা করছিল প্রভাতের জন্য, তখনও জানে না প্রভাত। সে বিস্ময় তাকে স্তব্ধ করে দিল খাবারের কৌটো খোলার পর।

    সিপাহী বিদ্রোহের সময় নাকি চাপাটি হয়ে উঠেছিল সঙ্কেত প্রেরণের মাধ্যম। ইতিহাসের সেই অধ্যায়টাই কি মল্লিকা কাজে লাগালো?

    রুটির গোছর নীচে শাদা একটা কাগজের মোড়ক।

    টেনে তুলল। খুলে পড়ল। স্তব্ধ হয়ে গেল।

    দয়া করে রাত্রে জানলাটা খুলে রাখবেন।

    অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে ছিঁড়ে ফেলল টুকরোটা। না না না! কিছুতেই না!

    এ কী কুৎসিত জালে জড়িয়ে পড়ছে সে!

    মল্লিকা কী? ও কি সত্যি বিপন্ন, না মায়াবিনী?

    ভদ্র মেয়ের এত দুঃসাহস হয়?

    কিন্তু সেই কান্না? সে কী মায়াবিনীর কান্না?

    রাত্রে প্রতিজ্ঞা করল, তবু বিচলিত হবে না সে। জানলা খুলে রাখবে না। কে বলতে পারে বিপদ কোন পথ দিয়ে আসে? তার কি মোহ আসছে?

    মায়ের মুখ স্মরণ করল।

    প্যাড টেনে নিয়ে চিঠি লিখতে বসল মাকে। লেখা চিঠিটা আজ আর কোটের পকেটে রাখল না, নিজের অফিসের ব্যাগে রেখে দিল।

    নিশ্চিন্ত হয়ে শুলো।

    কিন্তু ঘুমের কি হল আজ?

    কিছুতেই যেন শান্তির স্নিগ্ধতা আসছে না! কী এক অস্বস্তিতে উঠে বসতে ইচ্ছে করছে!

    পাখার হাওয়াটা যেন ঘরের উত্তাপে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। বিছানায় উঁচ ফুটছে। মাথাটা ঝ আঁ করছে। জানলাটা একবারের জন্যে খুলে দিয়ে এই উত্তপ্ত বাতাসটা বার করে দিলে ক্ষতি কি?

    মনস্থির করে উঠে বসল। জানলাটার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে মুহূর্ত চিন্তা করে খুলে ফেলল ছিটকিনিটা, ঠেলে দিল কপাটটা।

    হু হু করে স্নিগ্ধ বাতাস এসে ঢুকছে, জুড়িয়ে যাচ্ছে শরীর, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঘুম এসে যাচ্ছে যেন।

    আশ্চর্য, অন্য অন্য কটেজগুলোর জানলা সব খোলা! ওদের ভয় করে না? চোর, ডাকাত, বন্য জন্তুর?

    প্রভাত ভাবল ওরা সকলেই অবাঙালী। ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে বাক্সর মধ্যে ঘুমানোর কথা ভাবতেই পারে না ওরা।

    প্রভাত কী ভীতু? থাক খোলা, কী হয় দেখাই যাক না!

    কিন্তু কী দেখতে চায় প্রভাত?

    দেখা গেল কিছুক্ষণ পরে।

    আর প্রভাতের মনে হল, মল্লিকা কি জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকতে অভ্যস্ত?

    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদোলনা – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article জহুরী – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }