Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আলোর স্বাক্ষর – আশাপূর্ণা দেবী

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প140 Mins Read0
    ⤷

    ১. কমলা চুপ

    কমলা চুপ করে জানলায় বসেছিল।

    এইমাত্র কেষ্টমোহিনী যাচ্ছেতাই করে গেছে। স্পষ্ট বলে গেছে কমলার এই সৌখিন পেশার উপর ভরসা রেখে আর চলতে রাজী নয় সে। সোজাপথের মানুষ কেষ্টমোহিনী, সহজ সোজা পথটাই বোঝে। ঘুরপথের ঘূর্ণিকে বিশ্বাস কি? মানুষ ঠকিয়ে বেড়িয়ে যে উপার্জন, তার ওপর আবার নির্ভর! গতর খাটাও, ঘরে টাকা তোল! আর কমলা যদি একবার সে পথে নামে, তাহলে তো বাঁকের ওজনে টাকা তুলবে ঘরে! শুধুই যে বয়েস আছে তা তো নয়, ভগবানের দেওয়া মস্ত একটা ঐশ্বয্যি রয়েছে কমলার। পরীর মতন রূপ। সে রূপ কি ওই হতভাগা ননীর কুঁড়েঘর আলো করে বসে থাকবার জন্যে?

    আর যে আশায় বুক বেঁধে কমলাকে খাইয়ে পরিয়ে এত বড়টি করে তুললো কেষ্টমোহিনী, সে আশায় ছাই ঢেলে দিয়ে, গেরস্থর বৌটি হয়ে নিজের সংসারটি পাততে সরে পড়াই কি ধর্ম হবে কমলার?

    কমলা অবশ্য কেঁদে ফেলে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল,কমলার যদি সংসার হয়, সে সংসারে কি কেষ্টমোহিনীর ঠাই হবে না? কেষ্টমোহিনী সে কথা ব্যঙ্গহাসি হেসে তুড়ি দিয়ে উড়িয়েছে। হুঁ, বলে অমন সবাই! এ যুগে বলে পেটের ছেলেমেয়ের সংসারেই বুড়িদের ঠাই হয় না, তার আবার পাতানো বোনঝির সংসারে! কেষ্টমোহিনী কমলাকে খাইয়ে পরিয়ে বড়টি করেছে, এ মান্য দেবে ননী? মানবে সে কথা? বলে জন্মদাতা পিতার ঋণই মানতে চায় না এখনকার ছেলেরা! ওসব ঘেঁদো কথায় ভোলবার পাত্রী কেষ্টমোহিনী নয়। তাছাড়া ননী যে তাকে কী দুচক্ষের বিষ দেখে সে কথা কি জানতে বাকী আছে কেষ্টমোহিনীর?

    না–কমলার কাতরতায় আর কান দেবে না কেষ্টমোহিনী, লক্ষ্মীছাড়া ননীকেও আর এ বাড়িতে ঢুকতে দেবে না।

    .

    ঘণ্টাখানেক ধরে বুঝিয়ে জপিয়ে, খিঁচিয়ে শাসিয়ে, ভয়ংকর একটা দিব্যি গেলে, ঘটি-গামছা নিয়ে এই খানিক আগে গঙ্গায় গেল কেষ্টমোহিনী। কিছুদিন থেকে এই এক বাতিক হয়েছে তার, নিত্য গঙ্গাস্নান। তা বাতিকটা হয়ে ভালই হয়েছে, ঘণ্টা তিনেকের মত নিশ্চিন্দি। গঙ্গাস্নানে গিয়ে ফোঁটা-তেলক কাটবে কেষ্টমোহিনী, পাঁচটা সখী-সঙ্গিনীর সঙ্গে আলাপ-সালাপ করবে, যত দেব দেবী, শিবশিলা আছেন আশেপাশে, তাদের মাথায় জল ঢালবে, গঙ্গার ঘাটে যে বাজার বসে, সেখান থেকে দেখে শুনে দরাদরি করে রোজের বাজারটা সারবে, তারপর এক হাতে মাছ তরকারি, আর-এক হাতে ঘটি-গামছা নিয়ে রৈ রৈ করতে করতে বাড়ি ঢুকবে। ইত্যবসরে যদি কমলা সময়ের তা বুঝে উনুনের আঁচটা না ধরিয়ে রাখলো, তাহলে অবশ্য রক্ষে নেই। রৈ রৈ কাণ্ডর মাত্রা তাহলে চরমে উঠবে।

    সময়ের তাক বুঝতে দশমিনিট অন্তর ঘড়ি দেখতে হয় কমলাকে। তবু যেইমাত্র বেরিয়ে যায় কেষ্টমোহিনী, কমলা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। খানিকক্ষণের জন্যে যেন বুকের পাষাণভার নামে। একটুক্ষণ আপনার মন নিয়ে বসে থাকতে পায়।

    আর এইটুকুই তো ননীর সময়।

    .

    কেষ্টমোহিনী যতই গালমন্দ করুক, আজও ননী এল। ঘরে ঢুকে বলে উঠল, বিরহিণী রাইয়ের মতন বসে আছিস যে? মাসির রান্নার জোগাড় করছিস না?

    কমলা জানলা থেকে নেমে এসে চৌকির ওপর বসে বলে, এই মাত্তর গেল!

    এই মাত্তর? কেন, বেলা তো অনেক হয়েছে!

    এতক্ষণ আমার মুণ্ডপাত করছিল।

    উঃ, কবে যে বুড়িটার হাত থেকে রেহাই পাবি।

    রেহাই আর পেয়েছি! কমলা নিশ্বাস ফেলে বলে, এ জীবন থাকতে নয়। একদিন এসে দেখবে কমলি ওই কড়িকাঠে ঝুলছে!

    মেজাজ খারাপ করে দিসনি কমলি, ননীও চৌকিটায় কমলার গা ঘেঁষে বসে পড়ে বলে, কড়িকাঠ আমারও আছে, আছে রেললাইন, দোতলা বাস, মালের লরী-বুঝলি?

    ওঃ, ভারী মহিমা দেখানো হচ্ছে! বেটাছেলে, উনি এসেছেন আত্মহত্যের ভয় দেখাতে! লজ্জা করে না?

    লজ্জা! ননী ম্লান হেসে একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, সে কথা আর বলে লাভ কি বল্? তার যখন কোনও প্রমাণ দিতে পারছি না? সেই দুঃখেই তো মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় বিষ খাই কি রেললাইনে কাটা পড়ি! পারি না শুধু

    পারো না শুধু আমার জন্যে, কেমন? কমলা ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে, আমাকে আর তুমি কাব্যিকথা শোনাতে এসো না ননীদা, ঢের হয়েছে। কেন, পৃথিবীতে আর কোথাও একটা চাকরি জোটাতে পারো না? পালাতে পারো না আমাকে নিয়ে?

    চাকরি জোটানো যে কী বস্তু তা যদি জানতিস, তাহলে এমন কথা বলতিস না।

    জানবো না আর কেন, হাড়ে হাড়েই জানছি। দেখছি তো প্রত্যক্ষ, যেমন পদের চাকরিতে বিয়ে করবার সাহস হয় না, বৌকে দুটো ভাত দেবার ভয়ে তেমন চাকরি ছাড়তেও যখন এত আতঙ্ক, তখন আবার বুঝতে বাধা কি যে, চাকরি হচ্ছে আকাশের চাঁদ! তাই তো বলছি ননীদা–ধরে নাও কমলি মরেছে। হঠাৎ একঝলক জল উপচে ওঠে কমলার ভাসাভাসা চোখদুটোয়। বোধ করি এ জল নিজেরই মৃত্যুশোকে।

    .

    ননী কিছুক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, আর একটা চান্স নে কমলি, তারপর দেখিস যে করে পারি তোকে এই নরকপুরী থেকে উদ্ধার করবো।

    ও রকম প্রতিজ্ঞা তো অনেকবার করলে।

    তা বটে! ননী একটু চুপ করে থেকে ফের একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ছবিটা এনেছিলাম রেখে যাই। সত্যিই বলেছিস, হতভাগা লক্ষ্মীছাড়া গরিবের আবার প্রতিজ্ঞে!

    ওঃ, বাবুর অমনি রাগ হয়ে গেল?

    রাগ নয়রে কমলি, ধিক্কার। মাসি তো আজ আমাকে জুতো মারতেই বাকী রেখেছে শুধু। বলেছে, ফের এ বাড়িতে এলে সত্যি জুতো মারবে।

    বলেছে এই কথা? ঠিকরে দাঁড়িয়ে ওঠে কমলা।

    প্রায় ওই কথাই।

    তবু তুমি এলে?

    এলাম তো!

    সত্যিই গলায় দড়ি দেওয়া উচিত তোমার ননীদা। যাও বলছি এখুনি।

    তুইও তাড়াচ্ছিস?

    নয় তো কি, মাসি এলে আর একপালা রামায়ণ গান শুনবো বসে বসে? আমি তো বলেছি। ননীদা, তোমার যখন মুরোদ নেই তখন আর আমার চিন্তা করে করবে কি? আমার আত্মহত্যে ছাড়া গতি নেই। আর যদি তুমি হুকুম করো, মাসির হুকুমই মানি, তাহলে

    কমলি! আচমকা একটা ধমক দিয়ে ওঠে ননী।

    আর কমলি! কমলাও নিশ্বাস ফেলে।

    মাইরি বলছি কমলি, এই শেষ চান্সটা নে। এরা খুব বড়লোক, তা ছাড়া বাবু হচ্ছেন দেশোদ্ধারী নেতা, একটা অপবাদ অপকলঙ্ক হলে আর মুখ দেখাতে পারবে না, দেশোদ্ধারের গয়াপ্রাপ্তি ঘটবে। সেই ভয়ে মুখবন্ধ করতে মোটা ঘুষ-ই দেবে মনে হচ্ছে।

    আর যদি সেই মল্লিকবাবুদের মতন থানা-পুলিস করে?

    আহা-হা, সে হলোগে একটা দৈবের ঘটনা। সেদিন পড়েছিলি একেবারে বাঘা কর্তার মুখে। একটু বুঝে সমঝে যেতে হবে।

    মাসি আর রাজী হবে না।

    সে ভয়ও আছে। এবারটার মতন বলেকয়ে রাজী করা। কিন্তু মাইরি বলছি তোকে কমলি–কেন কে জানে এবারের ছবিটা তুলে অবধি প্রাণের মধ্যে যেন কুলকাঠের আগুন জ্বলছে।

    কেন বল তো? কৌতুক কৌতূহলে প্রশ্ন করে কমলা।

    ওই তো বললাম, কেন কে জানে! বাবুটার সঙ্গে তোকে বড্ড বেশী ম্যাচ্‌ করেছে বলেই বোধ হয়!

    বাবুটার সঙ্গে আমার, না ছবিটার সঙ্গে ছবির? বলেই সমস্ত দুঃখ ভুলে হঠাৎ খিলখিল করে হেসে ওঠে কমলা। বয়সের ধর্মই এই, সহসা কোনও কৌতুকে সব দুঃখ ভুলে হাসতে পারা।

    তা বললে কি হয়, দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।

    কমলা তেমনি হাসিহাসি মুখে বলে, নিজেই তো বার করেছ বুদ্ধি, নিজেই তো করছে সব কৌশল।

    করেছি কি আর সাধে! ননী উঠে দাঁড়ায়, দাঁড়িয়ে কমলার একগোছা চুলে টান মেরে বলে, যা এখন চুলোয় আগুন ধরাগে যা, নইলে তো আবার মাসি এসে এখন তোর মুখে আগুন ধরাবে!

    চলে যাচ্ছিল ননী। হয়তো বা ভুলে, হয়তো বা ইচ্ছে করে কমলা বলে ওঠে, তা কই, সে ছবি কই? যা নিয়ে তোমার এত হিংসে!

    ও, ভুলেই যাচ্ছি! পকেট থেকে একটা খাম বার করে ননী। সন্তর্পণে তার থেকে একখানা বড় সাইজের ফটো বার করে। আর করবার সঙ্গে সঙ্গেই চোখটা যেন দপ্ করে জ্বলে ওঠে তার। মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে বলে, নে দেখ, দেখে চক্ষু সার্থক কর!

    চক্ষু সার্থক মানে?

    মানে আর কি, যুবরাজের পাশে যুবরানীর মতন দেখাচ্ছে তাই বলছি।

    ধন্যি হিংসে বটে! তবু যদি সত্যি হতো!… আচ্ছা ননীদা, এত বেমালুম মেলাও কি করে। বল তো? বলে কমলা ছবিখানা চোখের সামনে তুলে ধরে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

    একটি উজ্জ্বলদৃষ্টি সুকান্তি যুবকের মুখের পাশাপাশি একখানি ওড়নাটাকা নববধূর মুখ। সে মুখ কমলার নিজের। গলায় ফুলের মালা, কপালে টিলি, মুখে চন্দনরেখা।

    কনে সাজলে এত সুন্দর দেখায় কমলাকে? আর পাশের মুখখানা বর না সেজেও কী সুন্দর! এযাবৎ এত লোককে ঠকিয়েছে কমলা, কিন্তু এত সুন্দর কাউকে নয়। মনটা মায়ায় ভরে ওঠে, ভারাক্রান্ত হয়ে আসে অপরাধ-বোধের ভারে।

    সত্যি বল না ননীদা, এত পরিষ্কার মেলাও কি করে?

    ওইটুকুই কৌশল! এতদিন যাবৎ ফটোগ্রাফের দোকানে কাজ করে আর ফটোগ্রাফি শিখে ওইটুকুই বিদ্যে হয়েছে।

    কমলা আবারও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে ছবিটা।

    ননী ভুরু কুঁচকে তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে ওঠে, দেখে দেখে যে আর আশ মিটছে না রে কমলি!

    ধেৎ! কমলা ফটোখানা চৌকিতে ফেলে রেখে বলে, তোমার দেখছি আজ মেজাজ বড় খারাপ।

    তা হবে। যাক চলি। ভাল কথা। বাবুর ঠিকানাটা রাখ। বলে ছেঁড়া চটিটা ফটফট করতে করতে চলে যায় ননী। জামার পিঠের সেলাইটা যেন নির্লজ্জভাবে দাঁত খিঁচিয়ে থাকে কমলার দিকে, যতক্ষণ দেখা যায়।

    খানিকক্ষণ গুম্ হয়ে বসে থাকে কমলা, তারপর হঠাৎ একসময় চা ভেঙে উঠে পড়ে উনুনে আঁচ দিয়ে আসে। আর এসে ফের সেই ছবিখানাই তুলে নেয় হাতে।

    সত্যি কমলা কি অভাগিনী! এমন দেবতার মত মুখওলা মানুষটার নামে মিথ্যে কলঙ্ক দিতে হবে তাকে।

    ভারী রাগ আসে ননীর ওপর। কিছুতেই কেন কোন উপায় করতে পারছে না ননী? কমলার কেবলই মনে হয় ননী যদি তেমন চেষ্টা করতো, তা হলে বুঝি একটা উপায় হতো। বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ছবিটাই দেখতে থাকে কমলা।

    .

    যথারীতি রৈ রৈ করতে করতে এল কেষ্টমোহিনী। হালা কমলি, উনুনটা যে জ্বলে পুড়ে খা হয়ে যাচ্ছে, ডালটা বসিয়ে দিতে পারিসনি?

    কমলা অপ্রতিভ ভাবে বলে, আগুন ধরে গেছে?

    গেছে না তো কি মিছে বলছি? বলি করছিলি কী এতক্ষণ?

    করবো আবার কী!

    কেষ্টমোহিনী ঘরে-ঢুকে পড়ে সন্দিগ্ধভাবে এদিক ওদিক তাকিয়েই চৌকির ওপর পড়ে-থাকা বড় খামটাকে দেখতে পায়। সেই ফটোর খাম। এ জিনিস তার পরিচিত। দেখেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে কেষ্টমোহিনী–ছোঁড়াটা আবার এসেছিল বুঝি? ধন্যি বলি বেহায়া, এত গালমন্দ দিলাম, তবু লজ্জা নেই গো!

    কমলা ম্লানভাবে বলে, বলে গেল, এই ফটো, এই ঠিকানা।

    বলে গেল তো কেতাৰ্থ করলো! আমি তো তোকে ঝাড়া জবাব দিয়েছি কমলি, ও সবের মধ্যে আর নেই আমি। এ ঝুঁকি নিতেই বা যাব কেন?

    আমার মুখ চেয়ে, আর কেন!

    তোর মুখ চেয়ে চেয়ে এতদিন গেল। বাসার সবাই আমার গালে মুখে চুন দিচ্ছে। বলে কুড়ি বছরের ধাড়ীকে তুই এখনো ভাতকাপড় দে পুষছিস কেষ্ট? বলি ওর একটা কর্তব্য নেই তোর প্রিতি?…বলবে নাই বা কেন? ক্ষীরির মেয়েটা তোর চাইতে কোন্ না পাঁচ বছরের ছোট, সে-ও তো কবে থেকে মায়ের হাতে ট্যাকা তুলে দিচ্ছে।

    মাসি! কমলা ছলছল চোখে বলে, আমাকে দিয়েও তো টাকা হচ্ছে তোমার।

    আরে বাবা সে হলোগে ঝুঁকির টাকা! সকল দায় আমি মাথায় করে, হাজার মিথ্যে কথা কয়ে…তবে না? বলতে গেলে ও ট্যাকা তো আমার উপার্জন!…ও আর আমার ভাল লাগে না–বড়লোকের দেউড়ি ডিঙোতে বুক কাঁপে। ছিঁড়ে ফেলে দিগে যা ফটো। আমি আজই সেই মেডো ছোঁড়ার সঙ্গে কথা কয়ে আসব। সে বলেছে বিয়ে করবে।

    কমলার বুকটা ঢিপ ঢিপ করে ওঠে ভয়ংকর একটা ভয়ে। এ পল্লীতে বিয়ে বস্তুটা যে কী, তা আর তার জানতে বাকী নেই। তাই কাতরকণ্ঠে বলে, আর একবারের মতন দেখ মাসি!

    না না। বলি আর একবারের মতন দেখলেই বা আমার কি ক্ষতি লাভ হবে? ওই ননে হারামজাদার সঙ্গে তোর বে দেব ভেবেছিস তুই?

    বেশ বাপু, দিও না।

    তাহলে? তাহলে কি ধর্মের ষাঁড় হয়ে থাকবি? তোর ওজর-আপত্তি আর শুনছিনে আমি।

    হঠাৎ দপ করে জ্বলে ওঠে কমলা। বলে, আমার অনিচ্ছেয় তুই আমায় দিয়ে যা খুশি করাতে পারিস ভেবেছিস?..পুলিসে গিয়ে যদি শরণ নিই, তোর কী দশা হবে জানিস?

    কমলার দপ করে জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দপ্ করে নিভে যায় তার মাসি। আমতা আমতা করে বলে, তা বলবি বৈকি, এই তো কলির ধর্ম! বুড়ি মাসিকে পুলিসে ধরিয়ে দিয়ে ভাল প্রিতিদানই দিবি! হবে না কেন? কুবুদ্ধি তো হবেই, বুদ্ধিদাতা শনি যে জুটে বসে আছেন! সাধে কি আর ননেকে ঢুকতে দিতে চাইনে? বংশের ছেলে, এল গেল কি দুটো হাসি মশা করলো, তাতে কিছু বলতাম না। এ যে ক্রমশ আমার মটকায় আগুন লাগাচ্ছে। বলে কিনা পুলিসে খবর দেবো!…দে দে, তাই যদি তোর ধর্মে হয় তো দে! যা এখুনি যা, ডেকে আন পুলিস; হাতে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাক পাড়ার বুকের ওপর দিয়ে।

    কমলা হেসে ফেলে। দুঃখের মধ্যেও হেসে ফেলতে পারে সে, এই তার স্বভাব। হেসে বলে, এখুনি যাবো তা তো বলিনি। বেশি যদি জ্বালাতন করো তবেই।…কী দরকার আমাদের বেশি টাকায় মাসি?

    আহা লো! ন্যাকা এলেন আমার! বলে ঝটকান মেরে চলে যায় কেষ্টমোহিনী। আর আশ্চর্যের বিষয়, কমলা সেই ছবিখানাই দেখতে থাকে আবার।

    নিজেকে দেখতে এত ভাল লাগে কেন, কেন এমন নেশা লাগে? কেন দেখে দেখেও আশ মিটতে চায় না? কিন্তু শুধুই কি নিজেকে? আচ্ছা–এই ছবিটা মুছে ফেলে এখানে ননীর মুখটা সেঁটে দিলে কেমন হয়?… অনেকবার ভাবতে চেষ্টা করলো কমলা নিজের সেই হাসি-ঢলঢল কনেসাজা মুখখানার পাশে ননীর মুখটা বসাতে। কিছুতেই মনে ধরাতে পারলো না।

    ননীর মুখটা পৃথিবীর।

    এ মুখটা আকাশের।

    কিন্তু কমলার এই মুখখানা? এ মুখটা পৃথিবীর মাটির আদল ভুলে এমন আকাশের হয়ে উঠলো কোন মন্ত্রে?

    .

    নীহারকণা লেস বুনছিলেন। সায়ার লেস।

    বিধবা নীহারকণা নিজে লেসদার সায়া পরেন না, বাড়িতে দ্বিতীয় আর মেয়েমানুষও নেই, তবু অবকাশ হলেই সায়ার লেস বোনেন তিনি। হা এই একটা বুনুনিই শিখেছিলেন নীহারকণা, কবে যেন কার কাছে, আর তদবধি তিনি অবিরত এই একটি কাজ করে চলেছেন, ভাল ভাল রেশমী সুতো আনিয়ে। আর মাদুর গোটানোর মত করে গুটিয়ে গুটিয়ে বাক্স ভরতি করে জমিয়ে তুলছেন সেই লেসের পাহাড়।

    কেন? বিরাট এক আশার পাহাড় গড়া আছে যে নীহারকণার মনের মধ্যে।

    ফুটফুটে সুন্দর একটি বৌ আসবে এ ঘরে, সব সময় শুধু সেজেগুজে হেসেখেলে বেড়াবে। সে, আর নীহারকণা তার জন্যে রাশি রাশি লেস-বসানো সায়া তৈরি করবেন। কেনা জিনিস দিয়ে বাক্স ভরানো যায়, মন ভরানো যায় কি?

    কিন্তু কোথায় সেই বৌ? বৌ আসার আশা ক্রমশই যেন ঝাপ্সা হয়ে আসছে। যাকে নিয়ে বৌ আনার স্বপ্নসাধ, নীহারকণার এই সাধে সে বাদ সাধছে। বিয়ে করতে আদৌ রাজী নয় সে।

    আর যতই সে তার প্রতিজ্ঞায় অটল হয়, ততই নীহারকণা চোখ ঠিকরে লেস বোনেন।

    .

    আজও সেই লেস বুনছিলেন।

    চাকর জগবন্ধু এসে দাঁড়ালো, পিসিমা!

    নীহারকণা চোখ না তুলেই বললেন, কেন, কী দরকার?

    দুটো মেয়েছেলে আপনার খোঁজ করছে।

    মেয়েছেলে!

    নীহারকণার একাগ্রতা ভঙ্গ হলো, কী রকম মেয়েছেলে?

    মানে আর কি…ইয়ে মতন।

    জগবন্ধু বোধ করি যাচ্ছিল ঘর মুছতে, হাতে জলের বালতি। মুখটা বেজার বেজার। সেই বেজার মুখটা আরও বেজার করে বলে, এই যারা সব ভিক্ষে সাহায্য চাইতে আসে, তেমনি ধারা। একটা গিন্নীমতন, একটা কমবয়সী।

    নীহারকণা বিরক্তভাবে বললেন, তবে আবার ঘটা করে বলতে এসেছিস কেন? ভাগাতে পারিসনি?

    বললো সাহায্য চায় না, শুধু দেখা করতে চায়।

    সাহায্য চায় না। শুধু দেখা করতে চায়!-কেন?

    নীহারকণা ভুরু কুঁচকে বিরক্ত মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বলেন, শুধু দেখা করে আবার তার কি চতুর্বর্গ লাভ হবে? কই কোথায় তারা?

    জগ হাতের জলের বালতিটা দুম করে নামিয়ে গম্ভীর চালে বলে, ওই যে মাঝ-সিঁড়িতে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। আপনাকে না বলে তো আর হুট করে কাউকে ওপরে তুলতে পারিনে পিসিমা।

    পারিসনে বুঝি? তবু ভাল! নীহারকণা বলেন, তাহলে তো দেখছি আশী বছর না হতেই সাবালক হয়ে গেছিস তুই! নে ডাক দিকি, কাকে কোথায় দাঁড় করিয়ে রেখেছিস! সাহায্য চায় না, শুধু দেখা করবে? হুঁ! ও আর এক রকম চালাকি, বুঝলি? অনেক বাড়িতে তো সাহায্য চাইলে দেখাই করে না কিনা! ওই যে বলছিস সঙ্গে কমবয়সী মেয়ে রয়েছে, নিশ্চয় ওই মেয়ের বিয়ের ছুতো করে টাকা চাইবে!

    হরিবোল হরি, কী বলেন গো পিসিমা! মেয়ের মাথায় যে টকটক করছে সিঁদুর, সঙ্গে একটা এইটুকুনি বাচ্চা। মনে নিচ্ছে, অন্য কোন বিপদে পড়ে এসেছে। আচ্ছা ডাকি-ই না বাপু, হাতে পাঁজি মঙ্গলবারে কাজ কি?

    হরেকেষ্ট! এই যে এঁরা উঠেই এসেছেন! ওগগা বাছা এই ইনিই হচ্ছেন বাড়ির গিন্নী, বুঝলেন? ওই যে পিসিমা বলছিলাম না–নান, দেখা করিয়ে দিলাম। জগ আবার জলভরা বালতিটা তুলে নিয়ে দুমদুম করে চলে যায়। আর পিসিমা থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন হাঁ করে।

    না, এহেন ভদ্রমহিলার আবির্ভাব আশা করেননি তিনি। ভেবেছিলেন আধা-ভিখিরী গোছেরই কেউ হবে। জগর মুখে আপনি শুনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থতমত খেয়ে গেলেন।

    আধা-বয়সী একটি শুভ্র থান পরিহিতা বিধবা, জীর্ণ হলেও পরিচ্ছন্ন একখানি সিল্কের চাদর গায়ে, নিরাভরণ দুখানি হাত জড়সড় করে বুকের কাছে রাখা, মুখের রেখায় রেখায় একটি ক্লান্ত বিষণ্ণতা। তারই পিছনে একটি সুশ্রী সুঠাম তরুণী মেয়ে, নিতান্ত সাদাসিধে সাজ, নিটোল সুগোল মণিবন্ধে একগাছি করে সরু বালা মাত্র। তার মুখের চেহারা আরো বিষণ্ণ, আরো ক্লান্ত, আরো স্তব্ধ। মাথাটা ঈষৎ নিচু করে দাঁড়ানোর দরুনই বোধ করি অপরাহের আলোতে সরু সিঁথির উপর টানা সিঁদুরের রেখাঁটি এত স্পষ্ট হয়ে চোখে পড়ছে। এক হাতে মেয়েটির একখানা হাত শক্ত করে ধরে আর অন্য হাতের আঙুলগুলো মুখের মধ্যে পুরে দাঁড়িয়ে আছে একটি বছর দেড়েকের রোগা গড়নের ফর্সা ছেলে।

    পথে পথে ঘুরে কেঁদে পড়ে সাহায্য চেয়ে যারা বেড়ায়, এরা যে সে শ্রেণীর নয়, তা এক নজরেই বোঝা যায়।…কিন্তু তাহলে কি?

    তাহলে কেন এই ম্লান বিষণ্ণ স্তব্ধ ভঙ্গি?

    .

    কে গা বাছা তোমরা? স্বভাববহির্ভূত নরম গলায় বলেন নীহারকণা।

    সত্যি, নরম গলায় কথা বলা নীহারকণার প্রায় কুষ্ঠিতেই লেখে না। বড়লোকের মেয়ে, নিতান্ত অল্পবয়সে বিধবা। চিরদিনই কেটে গেল পিত্রালয়ের আরাম-ছায়ায়। আর ষোল আনা দাপট করেই এলেন চিরকাল। স্নেহময় বাপ বিধবা মেয়ের হৃদয়ের শূন্যতা পূর্ণ করতে বরাবর তাঁকে দিয়ে এসেছিলেন সংসারের একাধিপত্য কর্ত্রীত্ব।

    এখন বাপ গেছেন, কিন্তু অনুগত ভাই আছেন। বুড়ো হয়ে গেলেন, এখনো চন্দ্রনাথ দিদির কথায় ওঠেন বসেন, দিদির চোখেই জগৎ দেখেন, দিদিকে যমের মত ভয় করেন।

    কেন তা জানেন না চন্দ্রনাথ। আশৈশব দেখে আসছেন দিদির ইচ্ছেই সংসারে শেষকথা। দিদিকে মান্য করে চলা ছাড়া অন্য কিছু সম্ভব, একথা চন্দ্রনাথ জানেন না।

    বালবিধবা নীহারকণার ভাগ্যটা এ বিষয়ে এমনই জোরালো যে, যে-মানুষটা চন্দ্রনাথের এই দিদিভক্তিতে জ্বলে পুড়ে মরতে, বাড়িসুদ্ধ লোকের নীহারকণার প্রতি এই অকারণ বাধ্যতায় থেকে থেকে বিদ্রোহ করে বসতো, সে বেচারা আস্ত মানুষ হয়ে ওঠবার আগেই মরে গেল। নগরে উঠতে না উঠতেই বাজারে আগুন লাগলো চন্দ্রনাথের। দুবছরের মাতৃহীন ছেলেটাকে নিয়ে আরো বেশি করে দিদির মুখাপেক্ষী হয়ে পড়লেন চন্দ্রনাথ।

    যাক, সে অনেক দিনের কথা।

    সেই ছেলে এখন বিদ্বান হয়েছে, কৃতী হয়েছে। রাজপুত্রের মত রূপবান স্বাস্থ্যবান ছেলে। তবে তার উপরও সমান দাপট নীহারকণার, কাজেই নরম গলায় কথা নীহারকণা দৈবাৎ কন। আজ কেন কে জানে এদের দেখে নীহারকণার কেমন একটা অস্বস্তি হল, গা-টা কেমন ছমছম করল, ওই বিষণ্ণ দুটি মুখ দেখে কেমন সমীহ হল। বললেন নরম গলাতেই, আমার কাছে কী দরকার তোমাদের বাছা?

    বিধবা মহিলাটি স্নান গলায় বলেন, আমি–মানে ইন্দ্রনাথের মা-র সঙ্গে একটু দেখা করতে চাইছিলাম।

    ইন্দ্রনাথের মা! নীহারকণা সচকিতে তাকিয়ে তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলেন, ইন্দ্রনাথ! ইন্দুকে, ইয়ে, ইন্দ্রকে তুমি জানো নাকি?

    জানি। মাথাটা আর একবার হেঁট করেন মহিলাটি।

    জানো? বলি কেমন ভাবে জানো? কী সুবাদে? নিজস্ব কণ্ঠের প্রশ্ন এবার নীহারকণার।

    মহিলাটি যেন অসতর্কে একবার পশ্চাদ্বর্তিণীর দিকে চকিতদৃষ্টি ফেলে বলেন, সে কথা ইন্দ্রনাথের মা-র কাছেই বলতাম।

    বটে! নীহারকণার মুখে একটি তিক্ত-কঠিন হাসি ফুটে ওঠে। সেই হাসি হেসে বলেন, তা খুব জরুরী কথা বোধ হয়? তাড়াতাড়ি বলতে হবে?

    যত তাড়াতাড়ি হয়! মহিলাটি কম্পিত স্বরে বলেন, ঈশ্বর জানেন যে করে এসেছি!

    বেশি তাড়াতাড়ি থাকলে নীহারকণা গম্ভীরকণ্ঠে বলেন, শীগগির কাজ দেয় এরকম খানিকটা বিষ এখুনি খেয়ে ফেলতে হয়, যাতে চটপট তার কাছে পৌঁছে যেতে পার! এ ভিন্ন আর কোন উপায় দেখি না।

    হ্যাঁ, নীহারকণার কথার ধরনই এই রকম।

    মহিলাটি এই অদ্ভুত কথায় প্রথমটা চমকে গেলেন, তারপর অর্থটা বুঝে ফেলে কালিবর্ণ মুখে বলেন, ওঃ, তিনি নেই বুঝি?

    যাক বাছা, তবু বুঝলে! বলি ইন্দ্রনাথকে জানো, আর দুবছর বয়সে তার মা মরেছে–তা। জানো না? তোমাদের রকম-সকম আমি বুঝতে পারছি না বাপু!

    এবারে তরুণীটি মুখ তোলে। আর তার সেই অশ্রুছলছল চোখ দেখে নীহারকণা আর একবার একটু থতমত খান।

    তরুণীটি মুখ তোলে বটে, কিন্তু কথা কয় নিজের মা-র উদ্দেশেই, মা, উনি পিসিমাকেই মা বলতেন!

    হ্যাঁ, তা অবশ্য বলে ইন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে। সাধ করে বলে। নীহারকণাও জানেন। কিন্তু সে কথা চুলোয় যাক,উনি মানে!

    মেয়েটার মুখের এই উনি শব্দটা নীহারকণার কানে বিষবাণের মত লাগল।

    এদের ভাবভঙ্গিতে কী যেন একটা ভয়ংকরতার আভাস। তাই সহসা সবলে নিতান্ত কঠোর হয়ে উঠলেন নীহারকণা। রূঢ় স্বরে বললেন, ইন্দু পিসিকে মা বলে, কি খুড়োকে মেসো বলে, সে কথা তোমার কানে ধরে কে বলতে গেছে বল তো বাছা?

    মেয়েটি ফের মাথা নিচু করল। গালের উপর গড়িয়ে পড়ল দুটি মুক্তার ধারা।

    বিধবা ভদ্রমহিলাটিও এবার একটু কঠিন হলেন। কঠিন না তোক দৃঢ়। বললেন, কে বলতে গেছে, সেইটুকু বলতেই তো আসা দিদি। বলতেই হবে আমাকে। নইলে শুধু শুধু আপনাকে জ্বালাতন করতে আসবো কেন? কিন্তু সে কথা তো এই সদরে দাঁড়িয়েই বলবার নয়।

    নীহারকণা রুক্ষভাবে বলেন, সদরের লোক সদরে দাঁড়িয়েই কথা কওয়ার রীত, খামোকা অন্দরেই বা নিয়ে যাবো কেন তোমাদের?

    মহিলাটি বোধ করি এবার বিচলিত হলেন। বিচলিত স্বরেই বললেন, খামোকা অকারণ সে আবদার আমি করবোই বা কেন বলুন? নেহাৎ নিরুপায় বলেই এই মেয়ে নাতি নিয়ে ছুটে এসেছি। তবে দরকার শুধু একা আমারই নয়, আপনাদেরও। তাই বলছি–মাথা ঠাণ্ডা করে সব শুনতেই হবে আপনাকে।

    শুনতেই হবে। তবে আর কথা কি আছে! নীহারকণা বলেন, শুনতেই যখন হবে, তখন এসো আমার ঘরে। কিন্তু তোমাদের মতলব আমি বুঝতে পারছিনে বাপু। ঘরের দিকে এগিয়ে যান নীহারকণা।

    মহিলাটিও পিছু ধরে ঘাড় ফিরিয়ে মেয়েকে উদ্দেশ করে বলেন, আয়।

    আমি এখানেই থাকি না মা! মেয়েটির কণ্ঠে অসহায় মিনতি।

    ওখানে আবার একা দাঁড়িয়ে থাকবি কোথা? চারদিকে চাকর-বাকর ঘুরছে–চলে আয়!

    মার্জিত খোলসের ভিতর থেকে যেন চকিতে একটা অমার্জিত স্থূলতা উঁকি মারে। নীহারকণা নীরস ভাবে বলেন, থাকতে ইচ্ছে হয় থাকো, আসতে ইচ্ছে হয় এসো। আমার বাড়ির চাকর বাকর এমন জানোয়ার নয় যে, তোমাকে একলা দেখলেই অমনি গিলে ফেলবে!

    চাকর-বাকর তেমন নয়? মহিলাটির মুখে একটি সুক্ষ্ম ব্যঙ্গ হাসি ফুটে ওঠে,–তবু ভাল!

    নীহারকণার চোখ এড়ায় না এ হাসি, তিনি বিরক্ত ভাবে বললেন, হাসবার কী হলো বাছা! তোমার তো কথার ধরন-ধারণ ভাল নয়!

    মহিলাটি কিন্তু দমেন না, তেমনি ব্যঙ্গের ভঙ্গিতেই বলেন, ভাল ভাল কথা আর শিখবো কোথা থেকে বলুন? আর শিখতে পারলেই বা গরিবের মুখে সেকথা মানাবে কেন? ভাল ঘরের মানুষরাই গরিব মজাবার জন্যে ভাল ভাল কথার চাষ করে থাকেন। আর সেই কথার ফাঁদে পড়ে গরিবকে আবার সেই আপনাদের দরজাতেই ছুটে আসতে হয়!

    চিরনির্ভীক নীহারকণা সহসা যেন ভয় পান। এ কোন ধরনের কথা? কে এই মেয়েমানুষটা? কিসের সাহসে ওর মুখে ওই ব্যঙ্গের হাসি? আর নীহারকণাই বা সাহস পাচ্ছেন না কেন ওই ধৃষ্ট মেয়েমানুষটাকে দারোয়ান দিয়ে দূর করে দিতে? কোন্ অদৃশ্যলোক থেকে–কে নিয়ন্ত্রণ করেছে নীহারকণাকে?

    নীহারকণা ভয় পেয়েছেন, তবু স্বভাবগত বাচনভঙ্গি ঠিকই বজায় রয়েছে। ভুরু কুঁচকে বলে ওঠেন তিনি, হেঁয়ালি থাক বাছা, যা বলতে চাও বলে ফেল চটপট।

    চটপট বলে ফেলবার কথা হলে তো বলেই ফেলতাম, কিন্তু তা নয় বলেই আপনাকে কষ্ট দেওয়া।…একটু অন্তরালে যেতে হবে।

    অন্তরালে! নীহারকণার বুকটা কেঁপে ওঠে। আশ্চর্য!…এমন করে ভয় পেয়ে বসলো কেন। তাঁকে? তবু তিনি মুখে সাহস দেখিয়ে ফের ভুরু কোঁচকালেন,–অন্তরালে মানে?

    মানে বলেছিই তো, দরদালানে দাঁড়িয়ে বলবার মত কথা নয়, তাই।

    নীহারকণা বলতে পারলেন না, তবে যাও বিদেয় হও। প্রথমেই এসে ইন্দ্রনাথের নাম করে এরা যেন কাবু করে ফেলেছে তাকে। তাই নীরস স্বরে বললেন, তবে চল ঘরের মধ্যে। এমন অনাছিষ্টি আবদারও শুনিনি কখনো।

    .

    এঁরা ঘরে ঢোকেন, ছোট ছেলেটার হাত ধরে মেয়েটিও অগত্যাই যেন মার পিছন পিছন ঢোকে।

    ঘরে ঢুকে নীহারকণা কী ভেবে একটু ইতস্তত করে দরজার পর্দাটা টেনে দিলেন।

    কে জানে কোন্ রহস্য উদঘাটিত হবে সেই পর্দার ওপিঠে!

    .

    তার মানে? ইন্দ্রনাথ গায়ের ভারী পোশাকগুলো খুলে ছুঁড়ে ফেলতে ফেলতে বলে, ভায়া জগবন্ধু, তুমি যে রহস্য হয়ে উঠছ! পিসিমা আবার ঘরে পর্দা টেনে কার সঙ্গে গোপন পরামর্শ করছেন?

    জানিনে দাদাবাবু। জগ ছড়ানো পোশাকগুলো কুড়িয়ে জড়ো করতে করতে সন্দিগ্ধভাবে বলে, মনে হচ্ছে কিছু একটা ব্যাপার ঘটছে।

    তোর মনের মধ্যে তো সর্বদাই যত সব ব্যাপার ঘটছে! ইন্দ্রনাথ ধপাস্ করে ডাক্লপের গদি-দেওয়া বিছানাটার ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে পা নাচাতে নাচাতে বলে, আপাতত চায়ের ব্যাপারটি ঘটাও দেখি। যতদূর দেখছি, পিসিমাকে এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। নির্ঘাত ওঁর সেই সইয়ের মায়ের গঙ্গাজলের বোনপো বোয়ের বকুলফুলটুল এসেছে। একজন বুড়ি, একজন মেয়েমানুষ আর একটা বাচ্চা বললি না?

    আজ্ঞে হ্যাঁ, দাদাবাবু।

    ব্যস্ ব্যস্, ঠিক আছে। সদাহাস্যময় ইন্দ্রনাথ গুনগুন করে এককলি গান গেয়ে বলে ওঠে, এ আর কেউ নয়, সেই বোনপো বোয়ের কদমফুল আর তার ছেলে-মেয়ে। পিসিমা আজ একেবারে গেলেন! আর কিছু নয়, বুঝলি জগ, নিশ্চয় কিছু বাগাতে এসেছে। নইলে দশ পাঁচ বছর পরে কেউ কখনো খুঁজে খুঁজে পুরনো আলাপীর বাড়ি আসে?

    পুরনো আলাপী-টালাপী কিছু না, জগবন্ধু ইন্দ্রনাথের খাটের বাজুগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, পিসিমা সাতজন্মেও চেনে না ওদের। তাছাড়া সাহায্য-টাহায্য চায় না তেনারা।

    চেনা নয়! সাহায্য নয়! ইন্দ্রনাথ হেসে উঠে বলে, তবে বোধহয় আমার বিয়ের সম্বন্ধ করতে এসেছে!

    তা হতে পারে! জগ লাফিয়ে ওঠে, ঠিক বলেছেন। হা হা, তাই সম্ভব।

    এতক্ষণে যেন দম নেয় জগ। আর পরক্ষণেই মনে মনে জিভ কাটে, সর্বনাশ! তাই যদি হয়, তাহলে তো জগ মরেছে। মাঝসিঁড়িতে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল ওদের জগ। ছি ছি! কে জানে যদি এরপর ওনাদের সঙ্গেই কুটুম্বিতে হয়! জগ তার এই কেলে মুখখানা তাহলে লুকোবে কোথায়?

    .

    ইন্দ্রনাথ স্নান সেরে পরিপাটি পরিচ্ছন্ন হয়ে চায়ের টেবিলে বসে বলে, বাবা এখনো ফেরেননি রে জগ?

    না। বাবু যে আজ বলে গেছেন শিবপুর যাবেন, দেরি হবে।

    তাই নাকি! তা পিসিমার সেই গঙ্গাজল না গোলাপফুল চলে গেল, না এখনো বসে আছে দেখগে দিকি।

    বসে আছে, এই তো দেখে এলাম ঘরে পর্দা ফেলা।

    স্ট্রেঞ্জ! বলে আপন মনের অকারণ আনন্দে গান গাইতে গাইতে খাবারের থালা শেষ করতে থাকে ইন্দ্রনাথ। স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে না পিসিমার ঘরে কী নাটকের অভিনয় চলছে।

    খেয়েদেয়ে গুন গুন করতে করতে বেরিয়ে গেল সে, যথারীতি যথাবিধি।

    .

    দিদি, কী বলছো তুমি? চন্দ্রনাথ কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন।

    নীহারকণা ভাইয়ের এই বিপর্যস্ত ভাব দেখে ব্যস্ত হলেন। এ অন্য ব্যাপার নয় যে মুখঝামটা দিয়ে বলবেন, মেয়েলিপনা করিসনে চন্দর। ব্যাটাছেলে, তবু দশহাত কাপড়ে কাছা নেই!

    কিন্তু এ একেবারে ধারণাতীত ব্যাপার।

    নীহারকণা নিজেই কি কম বিপর্যস্ত হয়েছিলেন? যারা এই বিপর্যয়ের কারণ, একবার তাদের দোয়ান দিয়ে বার করে দিতে চেয়েছেন, তখুনি তাদের মিনতি করেছেন গোলমাল না করতে। একবার বলেছেন, তোমাদের মত মেয়েমানুষ ঢের দেখা আছে আমার। এখানে জোচ্চুরি করে পার পাবে না, হাতে দড়ি দিয়ে ছাড়বো। আবার তখুনি তার আঁচলে জোর করে নোটের গোছা বেঁধে দিয়েছেন মিষ্টি খেও বলে।

    প্রত্যয় আর অপ্রত্যয়ের যুগল রঞ্জুর দোলায় দুলতে দুলতে শেষ পর্যন্ত রক্তাক্ত হৃদয়ে প্রত্যয়ের দড়িটাকেই মুঠিয়ে ধরেছেন নীহারকণা।

    এখন চিন্তা,…অতঃপর কী? মাথা খুঁড়ে মরতে পারলেই বুঝি সবচেয়ে ভাল হতো তাঁর।

    ছি ছি ছি! যা কল্পনার অতীত, ধারণার অতীত, বিশ্বাসের অতীত, তাই সংঘটিত হয়েছে তারই বড় আদরের, বড় স্নেহের, বড় বিশ্বাসের ইন্দুকে দিয়ে!

    ওই সরলতার ছদ্মবেশী আধারে এত গরল!

    নীহারকণার হৃদয়কক্ষে তাঁর ইষ্টদেবতা বালগোপালের মূর্তিরও উপরে যার মূর্তি প্রতিষ্ঠিত, নিষ্পাপ নির্মল দেবমূর্তির মতই যে মূর্তিখানি, সেই মূর্তির মধ্যে লুকোনো আছে–এই শয়তান বদমাইশ! ফুলের মধ্যে সাপ!

    ইন্দ্র মস্ত একটা ভুল করে ফেলেছে, কি ভয়ানক একটা কুকর্ম করে ফেলেছে বলে যতটা মর্মাহত হয়েছেন নীহারকণা, তার চাইতে শতগুণ মর্মাহত হয়েছেন এই দেখে যে, সেই পাপ সে এই দীর্ঘকাল ধরে নীহারকণার কাছে পর্যন্ত গোপন করে এসেছে।

    যতবার ভাবছেন ইন্দু তাকে ঠকিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে ঠকিয়ে আসছে, ততই বুকটা ফেটে যাচ্ছে নীহারকণার। ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে, নিজের চুলগুলো মুঠিয়ে ধরে ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে, ইচ্ছে করছে সেই মহাপাতকী আসামীটাকে দুহাতে ধরে সজোরে নাড়া দিয়ে দিয়ে বিষ তীব্র তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করতে–ওরে তোর মনে এত ছলনা? তোর মনে এত কালকূট? বংশের মুখে চুনকালি লেপে, বাপ-পিসির গালে চড় মেরে এই কীর্তিটা করে দিব্যি বুক বাজিয়ে আহ্বাদে গোপাল সেজে মায়া কাড়িয়ে বেড়াচ্ছিস? ওরে হতভাগা, এতটা বুকের পাটা তুই পেলি কোথায়?

    কিন্তু আপাতত সেই পাপিষ্ঠকে হাতের কাছে পাওয়া যাচ্ছে না। বাবু নাকি চাকরবাকরদের বলে গেছে ফিরতে দেরি হবে ক্লাবে ফাংশন আছে। কখনো তা নয়, নীহারকণা মনে মনে যেন বাতাসের উদ্দেশেই কটুক্তি করেন,..ফাংশন না হাতী! বুঝি না কিছু আমি? নিশ্চয় টের পেয়েছিস তুই হাটে হাঁড়ি ভেঙেছে। তাই মনে করেছিস–যত দেরি করে ফিরতে পারি, কেমন? কিন্তু সে আশা ছাড় তুমি। সমস্ত রাতও যদি বাড়ি না ফেরো, তোমার এই দজ্জাল পিসিটি সমস্ত রাত জেগে বসে পাহারা দেবে। হেস্তনেস্ত তো করতেই হবে একটা।

    যাক, আপাতত সে না থাকুক তার বাপ আছে।

    চন্দ্রনাথ ভয়ে ভয়ে বলেন, দিদি, আমার মনে হয় এসব কোন ষড়যন্ত্র। ইন্দ্র এলে তাকে জিগ্যেস করে—

    নীহারকণা গম্ভীরভাবে বলেন, ইন্দ্র এলে তাকে জিগ্যেস করতে হবে, এ কথা আর তুই আমাকে শেখাতে আসিসনে চন্দর। জিগ্যেস করা কাকে বলে, জেরা করা কাকে বলে, সে আমি বাছাধনকে বুঝিয়ে ছাড়বো। তবে অবিশ্বাসের আর কিছু নেই। গোড়ায় আমিও ভেবেছিলাম ষড়যন্ত্র। তাদের গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু মেয়েটা যখন ইন্দু হতভাগার ফটোখানা বার করে দেখাল, তখন আর অবিশ্বাসের রইল কী! মাথা হেঁট হয়ে গেল আমার। আদর করে তার সঙ্গে আবার নিজের ফটো তোলা হয়েছে। কিন্তু ভাবছি, আজকালকার ছেলেপুলে কী সর্বনেশে চীজ! এদের যে চিনতে পারবে, সে এখনো তার মাতৃগর্ভে আছে। কচি ছেলেটার মতন হাবভাব তোর, এখনো পিসি বলে কোল ঘেঁষে বসিস, আর তুই কিনা তলে তলে এই কীর্তি করেছিস!…বিয়ে করেছিস, ছেলের বাপ হয়েছিস, এতগুলো দিন সেসব কথা লুকিয়ে রেখেছিস! ওরে বাবারে!… ভাবছি আর বিষ খেয়ে মরতে ইচ্ছে করছে আমার!

    চন্দ্রনাথ ভয়ে ভয়ে বলেন, দিদি, চাকর-বাকররা শুনতে পাবে।

    তারা শুনতে পাক, এ বাসনা অবশ্য নীহারকণারও নেই, তবু জেদের সুরে বলেন, পাক না। এরপর যে জগৎ শুনবে। কার শুনতে বাকি থাকবে? ওই বৌ নাতিকে মাথায় করে নিয়ে এসে বরণ করে ঘরে তুলতে হবে না?

    চন্দ্রনাথ বোধ করি মরিয়া হয়েই আজ দিদির প্রতিবাদ করে ফেলেন। বলেন, কী যে বলল দিদি! এখন রাগের মাথায় যা নয় তাই বলছো বলেই কি আর

    যা নয় তাই মানে? নীহারকণা বজ্রগর্ভ স্বরে বলেন, নীহারকণা কখনো যা নয় তাই বলে না চন্দর। যা হয়, তাই বলে। রেজেস্টারী-মেজেস্টারী নয়, অগ্নি-নারায়ণ সাক্ষী করে স্বজাতির মেয়ের সঙ্গে বামুন-পুরুত ডেকে বিয়ে, এ তো আর রদ হবার নয়? বৌকে গ্রহণ করতেই হবে।…তার ওপর পেটে একটা জন্মেছে!

    চন্দ্রনাথ কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন, কিন্তু আমি ভাবছি দিদি, এ কখনো সত্যি হতে পারে? এ কাজ ইন্দ্র করতে যাবে কেন?

    কেন? নীহারকণা ভয়ংকরী মূর্তিতে বলেন, কেন, তা কি আবার তোকে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে চন্দর? বিয়ের বয়েস পার হতে চললো ছেলের, তুই বাপ, এখনো নাকে সর্ষে তেল দিয়ে বসে আছিস। উড়ুক্কু মন নিয়ে এদিক-ওদিক ঘোরে, অসাবধানে ডাকিনীর ফাঁদে পা দিয়ে বসে আছে। আগে বলিনি তোকে আমি, ছেলের এত পরোপকারে মতিগতি কেন চন্দর? সামলা ওকে!..বাপের পয়সা আছে, নিজে তিন-চারটে পাস করে মোটা মাইনের চাকরি করছিস, হাসবি খেলবি গাইবি বাজাবি, ডানাকাটা পরী খুঁজে এনে বিয়ে দেব, ঘর-সংসার করবি, তা নয়, কোথায় বুড়ো দামড়াদের জন্যে নাইট ইস্কুল করছে, কোথায় যত রাজ্যের কলোনি-মলোনিতে ঘুরে ঘুরে দেখে বেড়াচ্ছে–কে ঘর পাচ্ছে না, কে রোগে ওষুধ পাচ্ছে না, কে জলকষ্টে মরছে। কেন? সুখে থাকতে এ ভূতের কিল খাওয়া কেন বাপু? তা না, বাপ হয়ে তুই তখন দিব্যি গা • এলিয়ে দিলি আহা করছে করুক, সৎকাজ। এখন বোঝ সৎকাজের ঠ্যালা! চিরকেলে কথায় কাছে–ঘি আর আগুন!

    চন্দ্রনাথ শেষবারের মত সন্দেহ ব্যক্ত করেন, যতই হোক, এ আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না দিদি ইন্দ্র লুকিয়ে বিয়ে করবে! আর সে কথা তোমার কাছে সুষ্ঠু গোপন করে রাখবে।

    হঠাৎ প্রবল আলোড়নে এক ঝলক অশ্রু এসে পড়ে নীহারকণার জ্বলন্ত চোখ দুটোয়। এতক্ষণে গলাও ধরে আসে, সেই দুঃখেই গলায় দড়ি দিয়ে মরতে ইচ্ছে করছে রে চন্দর। করলি করলি আমায় কেন জানালি না? হোক গরিব, হোক বিধবার মেয়ে, না হোক তেমন সুন্দরী, তবু আমি তত্ত্বতালাশ করে পানপত্তর পাকাঁদেখা করে তোক জানিয়ে বিয়ে দিতাম। না হয়। আত্মকুটুম্বকে বলতাম, গরিবের মেয়ে উদ্ধার করছি। এ আমাকে ভয় করতে গিয়ে যে আমারই গালে মুখে চুনকালি দিলি!

    কত দিন এ কাজ হয়েছে? মরমে মরে গিয়ে বলেন চন্দ্রনাথ।

    মাগী তো বললো দুতিন, বছর। ছেলেটাও তো দিব্যি বড়সড়, কোন না বছরখানেকের হবে।

    চন্দ্রনাথ নিশ্বাস ফেলে বলেন, কলকাতা শহরে কত ঠগজোচ্চোর আছে। তাই বলছি ছেলেটাকে কি ইন্দ্রর বলে মনে হলো দিদি? মেয়েমানুষের মতই কাপড়ের খুঁটে চোখ মোছেন চন্দ্রনাথ।

    অবিকল চন্দর, অবিকল! নীহারকণা রায় দেন, ঠিক ইন্দু ছোটবেলায় যেমনটি ছিল। রোগা রোগা ফরসা ফরসা। ঠিক তেমনি একমাথা চুল।

    আর সন্দেহের কী আছে?

    চন্দ্রনাথ যেন কথা খুঁজে না পেয়েই অন্যমনস্কভাবে বলেন, মেয়েটা কি খুব সুন্দর?

    বললাম তো সবই। রূপ আছে কিন্তু অমন রূপসী কি আমার ইন্দুর জুটতো না?

    কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা।

    চন্দ্রনাথ কতক্ষণ ইতস্তত করে বলে ফেলেন, আচ্ছা দিদি, এমনও তো হতে পারে, ঝেকে পড়ে দৈবাৎ একটা দোষঘাট করে ফেলেছিল ইন্দ্র, তাই এরা কায়দায় পেয়ে…মানে আর কি…বিয়েটা হয়তো হয়নি!

    নীহারকণা প্রবল বেগে মাথা নাড়েন, ছি ছি, ও কথা বলিসনে চন্দর! এ কথা ভাবলে ইন্দুর ওপর আরও অবিচার করা হবে। ইন্দু যত অকাজই করে থাকুক, এতবড় মহাপাতকীর কাজ কখনো করবে না।…না না, সে ডাকিনীদের চক্রে পড়ে বিয়েই করে বসেছে। তারপর ভয়ে কাঠ হয়ে বাড়িতে বলতে পারেনি।…হুঁড়ির সিঁথেয় ডগড়গ করছে সিঁদুর!

    কিন্তু এতদিন কেন তাহলে ওরা নীরব ছিল? চন্দ্রনাথ যেন যুক্তি হাতড়ে বেড়ান।

    আহা, বললাম তো সবই। প্রথম প্রথম নাকি ইন্দু আসা-যাওয়া করছিল, তারপর অনেকদিন অবধি মাসোহারাও দিয়েছে, এখন আর খোঁজ-উদ্দিশ করে না। বাচ্চাটাকে নিয়ে ছুঁড়ি এখন উপোস করতে বসেছে। তাই মা মাগী ধরে-করে নিয়ে এসেছে।..হুঁড়ি তো আসতে চায়নি, বলেছিল বুঝি তার এই ফটোখানা বুকে করে ঘরে পড়ে শুকিয়ে মরবো সেও ভাল। কিন্তু ওই যে পেটের শত্রুর! ওর জন্যেই আবার

    চন্দ্রনাথ তার ঊষর টাকে হাত বুলোত বুলোতে ঘরে পায়চারি করছিলেন, এখন আবার দিদির কাছে সরে এসে যেন নিজের মনেই বলেন, কিন্তু মাসোহারা বন্ধ করে দেবে ইন্দ্র!..ইন্দ্রর দ্বারা এমন কাজ সম্ভব?…যে ছেলে রাজ্যের দীনদুঃখী গরিব ফকিরকে মাসোহারা দিয়ে বেড়ায়। যতই হোক, যখন বলছো নিজের স্ত্রী-সন্তান!

    আহা, বুঝছিস না? নীহারকণা চোখের কোণটা কুঁচকে, ঠোঁট টিপে বলেন, ওই ছুঁড়ি কি আর ইন্দুর যুগ্যি? দয়ার শরীর ওর, গরিব দেখে দয়ায় পড়ে করে ফেলেছে কাজটা। এখন আর ভাল লাগছে না। এখন ঘাড় থেকে নামাতে চাইছে।…এখন সমযুগ্যি মেয়ে দেখে বিয়ে করতে সাধ হয়েছে নিশ্চয়।

    হঠাৎ যেন বিনামেঘে বজ্রপাত হয়।

    সুস্থির বসুমতীর বুক থেকে ভূমিকম্প ওঠে। চিরদিনের মিনমিনে চন্দ্রনাথ চিৎকার করে ওঠেন, এত অধর্ম–আমি সইবো না।… তাকে আমি ত্যেজ্যপুত্তুর করবো।…ওকে আমি বাড়ি থেকে বার করে দেব।…আমার যথাসর্বস্ব রামকৃষ্ণ মিশনে দিয়ে দেব।…ওই কুলকলঙ্ক ছেলের মুখ আমি আর দেখবো না…।

    ইন্দ্রনাথ যখন ফিরলো তখন অনেক রাত। আজ তাদের সমাজকল্যাণ সঙ্রে প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে বার্ষিক সম্মেলন ছিল। অনুষ্ঠানটা ভালই হলো। সভাপতি আর প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন সাহিত্যিক প্রবোধ ঘোষ আর কবি সুজিত দত্ত।

    সমাজকল্যাণের নানা নতুন ব্যাখ্যা শোনালেন তাঁরা, আলোচনা করলেন নানা দিক থেকে। বললেন, সমাজকল্যাণের মূল বনেদ হচ্ছে মানবতাবোধ। মানুষ যেদিন সমস্ত মানুষকে মানুষ বলে স্বীকৃতি দিতে শিখবে, তখন আর আলাদা করে সমাজকল্যাণ সঙ্ গড়তে হবে না। সেই মানবতাবোধ আর সেই সমবোধের ভিত্তিতে যে সমাজ গঠিত হবে, সে সমাজে অকল্যাণের স্পর্শ থাকবে না।…ইত্যাদি ইত্যাদি। ধীরে সুস্থে চমৎকার করে বললেন। অথচ এদিকে প্রবোধ ঘোষ ভারী ব্যস্তবাগীশ। নিজের ভাষণটুকু শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সভা ত্যাগ করলেন, কারণ পর পর নাকি আরও দুটো সভা আছে। একটা কোন ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানের, আর একটা কোন মহারাজজীর তিরোধান-দিবসের স্মৃতি-বার্ষিকী।

    তিনটি সভা তিন জাতের। কিন্তু তিনটেতেই সমান ভাষণ-নৈপুণ্য প্রকাশ করবেন প্রবোধ ঘোষ। আশ্চর্য!

    কী করে যে পারে এরা!

    কবি সুজিত দত্তর কথাগুলিতে একটু বেশী মাত্রায় ভাবোচ্ছাস। কথার চাইতে কথার ফেনাই বেশি। তবু শুনতে ভাল।

    অবিশ্যি যারা কান পেতে শুনতে চাইবে তাদের কাছে। নইলে বক্তৃতা আর কান দিয়ে শোনে কে? কখন পশ্চাদ্বর্তী আকর্ষণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি শুরু হবে, শ্রোতারা তার জন্যে ছটফট করতে থাকে। বক্তারা সময় একটু বেশি নিয়ে ফেললেই মনে মনে তাদের মুণ্ডপাত করতে থাকে। হাসে, টিটকিরি দেয়, অলক্ষ্যে বক দেখায়।

    ইন্দ্ররা তো সবই জানে–সবই দেখে।

    ওই জন্যেই তো অধ্যাপক সুকুমার বন্দ্যোর নাম উঠেও ভোটের অভাবে বাতিল হয়ে গেল। সঙ্রে অন্যেরা বললে, ও সর্বনাশ! সুকুমার! তার তো সেই ধরলে কথা থামায় কে! সুকুমারকে এনে মাইকের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে আজকের ফাংশনই মাটি। তিনি স্থান-কাল পাত্র, ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান, সব কিছু বিস্মৃত হয়ে তার প্রাণের যত কথা, হৃদয়ের যত বক্তব্য সব প্রকাশ করতে বসবেন।

    কোন একটি বিখ্যাত মহিলাকে আনার ইচ্ছে ছিল সবাইয়ের, জোগাড় হলো না। মহিলাদের যে আবার মান বেশি। অনুরোধ উপরোধ করতে করতে প্রাণ যায়। তা ছাড়া আনতে যাও, রাখতে যাও–মহা ঝামেলা।

    হঠাৎ একটা কথা মনে এসে বেদম হাসি পেয়ে গেল ইন্দ্রর। আচ্ছা, পিসিমাকে যদি কোন স্টেজে তুলে মাইকের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়? ভাবতে গিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে হেসেই ফেললো ইন্দ্র। কথার তোড়ে একেবারে সভা ভাসিয়ে দিতে পারবেন পিসিমা। হ্যাঁ, সে ক্ষমতা তিনি রাখেন। যে কোন সাবজেক্টেই হোক, পিসিমা হারবেন না।

    ঠাকুরদা যদি লেখাপড়া শেখাতেন পিসিমাকে তো উনি হয়তো ম্যাজিস্ট্রেট হতে পারতেন, পারতেন দেশনেত্রী হতে। হয়তো দ্বিতীয় সরোজিনী নাইডু হতে পারতেন। কিন্তু কিছুই হলেন na। অল্পবয়সে বিধবা হয়ে একটি গৃহগণ্ডীর মধ্যেই নিজেকে ক্ষয় করে ফেললেন।

    আমাদের দেশে জীবনের কী অপচয়!

    আমাদের সমাজে মানুষ কী মূল্যহীন!

    .

    বাড়ির মধ্যে কী তুফান উঠেছে, নীহারকণা আর চন্দ্রনাথ কোন্ যন্ত্রণায় ছটফট করছেন, সে খবর নিচের মহলে পৌঁছয়নি। তাই নিত্য নিয়মে সব কাজ মিটিয়ে জগ, দারোয়ান আর ঠাকুর বাইরের দিকে প্যাসেজটার সামনে বসে তাস খেলছিল। ইন্দ্রনাথের ফিরতে রাত প্রায়ই হয়, তার খাবার ঢাকাই থাকে, এলে গরম করে দেওয়া হয়। যদিও এ সমস্ততে ইন্দ্রনাথের আপত্তি–সে বলে, কত লোকের পান্তাভাতই জোটে না, আর একটু ঠাণ্ডা খাবারে এত ইয়ে! কিন্তু তাহলে হয়তো পিসিমা বাড়িসুষ্ঠু সবাইকে না খাইয়ে সারা বাড়ি সজাগ করিয়ে রাখবেন। তার চাইতে এই রফা। খেয়ে নেবে সবাই, শুধু ইন্দ্রনাথ এলে তার আহার্য বস্তু গরম করে দেবে।

    ইন্দ্রনাথ গাড়িকে একেবারে গ্যারেজে তুলে রেখে বাড়ি ঢোকে, গাড়ির চাবি নাচাতে নাচাতে মৃদুগুঞ্জনে গান গাইতে গাইতে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।

    ওকে দেখেই চাকররা উঠে দাঁড়ালো। তাসটা অবশ্য চাপা দেওয়া গেল না। ইন্দ্র এক নজর দেখে হেসে উঠল–কী বাবা, জুয়াটুয়া চালাচ্ছো নাকি? দেখো সাবধান! যা দেখছি, একেবারে ত্রিশক্তি সম্মেলন। একটি বঙ্গজ, একটি বেহারী, একটি উড়িষ্যা নন্দন। তা জুয়া চালাচ্ছিস তো?

    কী যে বল খোকাবাবু, জুয়া খেলতে যাবো কেন?

    খেলতে যাবি কেন? হাঃ হাঃ হাঃ! সারা পৃথিবীটাই তো জুয়া খেলছে বে! ভগবান যে ভগবান, তিনিও মানুষগুলোকে নিয়ে জুয়া খেলছেন! নাঃ, এসব দার্শনিক ব্যাখ্যা তোদর মাথায় ঢুকবে না। চলহে ঠাকুরচন্দ্র তোমার ডিউটি সারতে! ভীষণ অবস্থা, ঘর বাড়ি ইট পাটকেল খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে!

    ঠাকুর এস্তে এগোতে গিয়ে আবার কী ভেবে দাঁড়িয়ে পড়ে।

    আর জগ অপ্রসন্নভাবে তাসগুলো গোছাতে গোছাতে বলে, সঙ্ঘে যে এত ঘটাপটা হয়, তা কেউ কিছু খেতে দেয় না?

    খেতে? বলিস কী? সে কি একটা-আধটা লোক? কাকে খাওয়াবে?

    আহা রাজ্যিসুন্দুকে কি আর গেলাবে? হচ্ছে তোমার কথা। তুমি হলে গে সেক্রেটারি!–নাও, এখন চটপট সেরে নাও গে। পিসিমা রেগে আছে।

    রেগে আছেন? তুই বুঝি বলিসনি আমার দেরি হবে?

    জগ গম্ভীরভাবে বলে, বলবো আবার কখন? সেই মেয়েছেলে দুটো চলে যাওয়া ইস্তক পিসিমা কি ঘর থেকে বেরিয়েছে? এই এ্যাতত বড় মুখ করে ঘরের মধ্যে বসে আছে! তারপর বাবুর সঙ্গে কত কথা, কত সলা-পরামর্শ!

    ইন্দ্রনাথের সন্ধ্যার ঘটনার কথা মনে ছিল না। তাই অবাক হয়ে বলে, মেয়েছেলে আবার কে?.

    আহা, সন্ধ্যেবেলা যাদের নিয়ে দোরে পর্দা ঝুলিয়ে দুঘণ্টা কথা হলো পিসিমার!

    ও আই সি! ইন্দ্রনাথ বলে, কে তারা? পিসিমার শ্বশুরবাড়ির কেউ নাকি?

    কে জানে বাবু! বলে ফের তাস ভাঁজতে শুরু করে জগ।

    আর ঠাকুর জানায়, পিসিমার ঘরে দাদাবাবুর খাবার ঢাকা আছে।

    খাবার ঢাকা! ব্যাপার কী! পিসিমা ঠাণ্ডা খাবার খাওয়াবেন ইন্দ্রকে!

    কিন্তু আজ আর খাবার ঠাণ্ডার জন্য পিসিমার কোন আক্ষেপ নেই। কারণ আজ তিনি এই তুচ্ছতার অনেক উর্ধ্বে।

    ইন্দ্র বাড়ি আসবার আগে ভেবেছিল তার দেরির জন্যে পিসিমার রাগ এককথায় জল করে দেবে। কিন্তু বাড়ি ঢুকে জগর আর ঠাকুরের মারফত রিপোর্ট পেয়ে কিঞ্চিৎ দ্বিধাগ্রস্ত, কিঞ্চিৎ চিন্তিত হয়ে ওপরে উঠল। আর নীহারকণার ঘরে ঢুকে ভয়ানক রকমের অবাক হয়ে গেল। ইন্দ্রর মনে হল তার জীবনে সে আর কখনো পিসিমার মুখের এরকম চেহারা দেখেনি।

    এ চেহারা কি রাগের, না অভিমানের? না, তাও তো নয়। নীহারকণার চিরদিনের একরঙা মুখে অদ্ভুত এক ভাবব্যঞ্জনা। সে মুখে নানারঙের ছাপ–রাগের, দুঃখের, ক্ষোভের, হতাশার, বেদনার, এবং আহত আত্মাভিমানের।

    কিন্তু কেন? এই অভূতপূর্ব ভাবব্যঞ্জনার কারণ যে ইন্দ্র নিজেই, একথা ইন্দ্র ভাবতে পারলে না। তাই কাছে গিয়ে আস্তে প্রশ্ন করলো,-পিসিমা এভাবে বসে যে?

    নীহারকণা এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শান্ত গম্ভীরভাবে বললেন, হাত মুখ ধোওয়া হয়েছে?

    হ্যাঁ।

    খেয়ে নাও। সংক্ষিপ্ত স্নেহহীন এই নির্দেশটুকু দিয়ে নীহারকণা ইন্দ্রর জন্য রক্ষিত আহার্যগুলি গুছিয়ে টেবিলে দিয়ে দেন।

    .

    ইন্দ্র খেতে বসে বলে, বাবার খাওয়া হয়েছে?

    না, সে আজ খায়নি। নীহারকণার স্বর উদাস।

    খাননি? কেন? অসুখ করেছে?

    নীহারকণা উদ্বেলিত আবেগ-তরঙ্গ কোন রকমে চেপে রেখে বলেন, অসুখ? হ্যাঁ, তা অসুখ বৈকি। বলবো সবই, বলতে তো হবেই। আগে খেয়ে নাও।

    পিসিমার মুখে তুমি সম্বোধন! হঠাৎ বুকটা কেমন হিম হিম হয়ে আসে ইন্দ্রর। আর সঙ্গে সঙ্গে থালার কাছে বাড়ানো হাতটা গুটিয়ে নিয়ে বলে, শোনবার আগে তো খাবো না!

    নীহারকণা আরো উদাস, আরো শান্তভাবে বলেন, খাবার আগে তো শোনাব না।

    পিসিমা, কী হয়েছে বল না? কেউ কোথাও মারা গেছে নাকি?

    নাঃ, মরতে আর পারা গেল কই! নীহারকণা তিক্ত ব্যঙ্গের ভঙ্গিতে বলেন, শুধু মরার বাড়া হয়ে পড়ে থাকা!

    ইন্দ্র এবার ব্যাকুল হয়ে ওঠে, দোহাই পিসিমা, সবাই মিলে এমন রহস্য হয়ে উঠো না তোমরা।… জগাটাও কী যে সব মাথামুণ্ডু বললো। সন্ধ্যাবেলা এসেছিল কারা সব?

    আর চলে না। আর ধৈর্য ধরে থাকা যায় না। আর অপেক্ষা করা সম্ভব হয় না পরম স্নেহের ভাইপোর খাওয়া সাঙ্গ হওয়া পর্যন্ত।

    ফেটে পড়লেন নীহারকণা, ঢের ছলনা করেছিস ইন্দু, আর ছলাকলা করিসনে! মানুষের সহ্যের একটা সীমা আছে!

    ছলনা!…ইন্দু!…সহ্যের সীমা!

    ইন্দুই কি আজকের এই দুর্বোধ্য রহস্য-নাটকের নায়ক নাকি?

    কিন্তু ব্যাপার কী?

    ইন্দ্রনাথও সংহারমূর্তি ধরতে জানে। তাই চেয়ারটা ঠেলে খাবার টেবিল থেকে উঠে পড়ে বিরক্ত কণ্ঠে বলে, যাক, জানো তাহলে মানুষের সহ্যের একটা সীমা আছে। কিন্তু সেটা সব মানুষের পক্ষেই প্রযোজ্য পিসিমা। ঈশ্বর জানেন কী ঘটেছে তোমাদের সংসারে,…পরমাত্মীয় কেউ মরে গেছে, না নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে, নাকি তোমাদের ব্যাঙ্ক ফেল হয়ে গেছে, না মামলায় সর্বস্বান্ত হয়েছ তোমরা! কিন্তু তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী? এমন ভাবে কথা বলছো যেন আমিই কি অপরাধ করেছি! মানে কী এর?

    মানে কী এর?

    মানে জানো না তুমি ইন্দ্রনাথবাবু? মানে বোঝবার ক্ষমতা হচ্ছে না তোমার? নীহারকণা যেন ধাপে ধাপে ফেটে পড়তে থাকেন আরো বেশি–আরো বেশি।

    মানে বুঝছো না, তোমাকে কেন অপরাধী করা হচ্ছে?…লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করবার ক্ষমতা হয়েছে, বিয়ে হতে হতেই ছেলের বাপ হবার ক্ষমতা হয়েছে, এতবড় একটা কুকীর্তি করে দিব্যি গা ঝেড়ে ফেলে খোকা সেজে বেড়াবার ক্ষমতা হয়েছে, আর এটুকু বোঝবার ক্ষমতা হচ্ছে না যে, পাপ কখনো চাপা থাকে না! ধর্মের কল বাতাসে নড়ে!

    ইন্দ্ৰনাথ নিষ্পলক দৃষ্টিতে পিসির মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শোনে সমস্ত। তারপরই হঠাৎ পাখার রেগুলেটারটা শেষ প্রান্তে ঠেলে দিয়ে, বারান্দায় মুখ বাড়িয়ে চেঁচিয়ে ডাকে–জগ, জগ, শীগগির খানিকটা বরফ নিয়ে আয় তো!

    বরফ! নীহারকণা ছিটফিটিয়ে ওঠেন–ঢের সহ্য করেছি ইন্দু, আর না। খোলস ভেঙে স্বমূর্তি বেরিয়ে পড়েছে তোমার। এখন আমাকে মাথায় বরফ চাপিয়ে পাগল সাজিয়ে রাঁচী পাঠিয়ে দিলেই কি পার পাবে?..রাগে দুঃখে ঘেন্নায় লজ্জায় চন্দর তোমাকে ত্যেজ্যপুত্তুর করেছে!

    চমৎকার! বাবাও এর মধ্যে আছেন? ইন্দ্রনাথ একটু ব্যঙ্গহাসি হেসে বলে, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমরা যেন আদিকালের জমিদারতন্ত্রের মধ্যে বাস করছি! তেজ্যপুত্তুর! বাঃ বাঃ! তা শূলে চড়ানো বা কেটে রক্তদর্শনের হুকুমটাই বা হয়নি কেন?

    এখনো বাকচাতুরী করে দোষ ঢাকতে চাস তুই? নীহারকণা যেন ক্রমশ আগুন হারিয়ে ছাই হয়ে যাচ্ছেন, এখনো স্বীকার পাবি না তুই? মুখের চেহারা নিভন্ত অঙ্গারের মত হয়ে আসে।

    পিসিমা, বোস। ইন্দ্রনাথও কী ভেবে সহসা শান্তভাব ধারণ করে। ঠাণ্ডা গলায় বলে, হঠাৎ ক্ষেপে গেলে কিসে, শুনতে দাও আমাকে। তড়বড় করে এমন কতকগুলো কথা বললে, যার বিন্দুবিসর্গ অর্থও আমার মাথায় ঢুকলো না।…কী হয়েছে কী? কে তোমাকে কী বলে ক্ষেপিয়ে গেছে?

    নীহারকণা স্তিমিত ভাবেই বলেন, হঠাৎ ক্ষেপবার মেয়ে আমি নই ইন্দু। তুই আজ আমাকে নতুন দেখছিস না। উপযুক্ত প্রমাণ দেখিয়েছে, তবেই বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি।

    কিন্তু বিশ্বাসটা কী নিয়ে? সে কথা তো বলতে বাকি রাখিনি ইন্দু।–তুই ধর্মের নামে শপথ করে বল, তিন বছর আগে অরুণা বলে কোথাকার কোন কলোনির একটা মেয়েকে বিয়ে করিসনি?… বল্ তোর মরা মায়ের ছবি ছুঁয়ে, সে মেয়ের গর্ভে তোর সন্তান হয়নি?..বল, বছরখানেক তুই তাদের মাসোহারা দিয়ে–এখন মাসোহারা বন্ধ করিসনি?

    .

    মুহূর্তকাল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ইন্দ্রনাথ। তারপর নিতান্ত শান্ত, নিতান্ত স্থির স্বরে বলে, আমার মরা মা-র ছবি ছুঁয়ে কোন শপথ আমি করবো না পিসিমা।…না, নিজেকে বাঁচাবার জন্যেও না। বুঝতে পারছি কোথাও কিছু একটা ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার হয়েছে, আমার সুনাম নষ্ট করে হয়তো কারো কোন স্বার্থসিদ্ধি হবে। কিন্তু সে চুলোয় যাক। তুমি এবং বাবা সেকথা বিশ্বাস করেছ, এইটাই হচ্ছে আমার জীবনের পরম সত্য?

    আমার মরা মায়ের ছবি ছুঁয়ে শপথ করতে বলছিলে পিসিমা? কী এসে যেত তাতে?…আমার জীবনে ওই ছবির মা তো চিরদিনই মৃত। আমার নিজের মা বেঁচে থাকলে কখনোই আমায় এই অসম্মান করতে পারতেন না। পারতেন না কোন একটা ইতরলোকের কথাকে বিশ্বাস করে আমাকে অবিশ্বাস করতে।…আচ্ছা ঠিক আছে?

    হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘরের বাইরে পা বাড়ায় ইন্দ্রনাথ। মুহূর্তে যেন কী এক পরম মুক্তির আনন্দ অনুভব করে সে। বুঝি ঠিক মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তেই এ রকম মুক্তির স্বাদ পায় মানুষ। ভালই হল! ভালই হল! খসে পড়ল মিথ্যা ভালবাসার জীর্ণ খোলস! খসে পড়ল দাবিহীন আশ্রয়ের আশ্রয়!

    কিন্তু নীহারকণা চমকে ওঠেন। এ কী! চলে যায় যে! এ যুগের সর্বনেশে ছেলে এরা, সব পারে! এখুনি পারে চিরকালের মত সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করে চিরদিনের মত চলে যেতে।

    ইন্দু! ছুটে এসে পিছন থেকে ইন্দ্রনাথের পাঞ্জাবির কোণটা চেপে ধরেন নীহারকণা। সর্বনাশা ছেলে, মুখের খাবার ফেলে যাচ্ছিস কোথায়?

    ফিরে দাঁড়িয়ে ইন্দ্রনাথ একটু হাসে, যাচ্ছি যেখানে মুখের কাছে খাবার এসে জোটে না!

    আমাদের ত্যাগ করে চলে যাচ্ছিস তুই?

    ত্যাগ! আমি! আর একটু হাসে ইন্দ্রনাথ, সে তো অনেক আগে তোমরাই আমাকে করেছ!

    নীহারকণা কেমন একটা হতাশ অসহায় মুখে বলেন, তোর মা-র কথা তুলে তুই আমাকে খোঁটা দিয়েছিস ইন্দু, আমার কথা আর আমি বলবো না, কিন্তু তোর বাবার সঙ্গে দেখা না করে যেতে পারবি তুই?

    বাবা তো রীতিমত অনশনব্রত করে আমাকে ত্যেজ্যপুত্র করেছেন পিসিমা, আমি তো মুক্ত!

    কিন্তু কিন্তু সব অপবাদই যদি মিথ্যে, সে কথা তুই পষ্ট করে বোঝবি না?

    না।

    চিরদিনের দুর্জয় অভিমানিনী নীহারকণা অনেকক্ষণ যুঝেছেন, আর পারবেন কি করে? তাই মুঠোয়-ধরে-থাকা জামার খুঁটটা ছেড়ে দিয়ে গম্ভীর ভাবে বলেন, গঙ্গায় যতক্ষণ জল আছে ইন্দু, আমাকে কেউ কিছুতেই ভয় পাওয়াতে পারবে না, ভাবনা শুধু চন্দরের জন্যে –য়াক, তার ভাবনা ভগবান ভাববেন। তবে একটা কথা তোকে শুনে যেতেই হবে। ঈশ্বর জানেন, কার দোষ কার ভুল, তবু রক্তমাংসের মানুষ আমরা, ঈশ্বরের চোখ দিয়ে তো দেখতে পাই না, এই রক্তমাংসের চোখ দিয়েই দেখি। অরুণা বলে যে মেয়েটা এসেছিল তার ছেলে নিয়ে মাকে সঙ্গে করে, দেখেছি তার চোখের জল, দেখেছি তার ছেলের মুখ-চোখ-রং-গড়ন, দেখেছি তার কাছে ফ্রেমে বাঁধানো ফটো। তোর আর তার দুজনের পাশাপাশি ফটো। সবই যদি আমার চোখের ভ্রম, সবই যদি আমার বোঝবার ভুল, বলছবি সে পেল কোথায়?

    পাশাপাশি ফটো! কবে কোথায় কার সঙ্গে পাশাপাশি ফটো তুলল ইন্দ্র? বিমূঢ়ভাবে ইন্দ্র বলে, কী বললে? পাশাপাশি ফটো?

    হ্যাঁ। নীহারকণা এবার আত্মস্থতায় ফিরে আসেন,–ওই ফটো দেখেই আমার জোঁকের। মুখে নুন পড়লো। নইলে আমিই কি আগে তাদের পুলিসে ধরিয়ে দিতে চাইনি?…ফটো তো আর মিছে কথা বলে না?

    ফটোও মিছে কথা বলে পিসিমা। এই বিজ্ঞানের যুগে গাছ, মাটি, নদী, পাহাড় সকলকে দিয়েই মিছে কথা বলানো যায়! সত্যি-মিথ্যের বিচার নিজের বিবেকের কাছে। আমায় যদি কেউ এমন ফটো দেখাতে যে তুমি কারুর বুকে ছুরি বসাচ্ছো, আমি সে ছবিকে বিশ্বাস করতাম কি? তবে বুদ্ধির কাজ করতে, যদি সে ফটোটা আমাকে দেখাতে পারতে! দেখতাম কার এই ষড়যন্ত্র? কিন্তু না, সে বুদ্ধি তোমাদের নেই, সে ধৈর্যও নেই। আমায় অবিশ্বাস করাটা সহজ, সেটাই করেছ?

    ওরে নেমকহারাম ছেলে, সে চেষ্টা কি আমি করিনি? দিশেহারা হয়ে নিজের গলা থেকে ইষ্টদেবতাম কবচসুষ্ঠু হারছড়াটা খুলে দিতে গেলাম ওই ফটোর বদলে। দিল না। চোখের জলে ভাসতে লাগলো ছুঁড়ি, মা বললো আর তো কোন সম্বল নেই ওর, ওইটুকু সম্বল। কোন্ প্রাণে : বলবো ওটুকু হাতছাড়া করতে?

    – দেখ পিসিমা, সব যেন ধোঁয়ার মত লাগছে, মনে হচ্ছে কোন ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়ছি। আচ্ছা যাক, এ রহস্য কোন একদিন ভেদ হবেই।চললাম। হেঁট হয়ে নীহারকণাকে প্রণাম করে ইন্দ্রনাথ।

    চললাম! আবার চললাম কি? নীহারকণা চেঁচিয়ে ওঠেন, চললাম মানে কি?

    মানে বুঝতে কষ্ট হচ্ছে বুঝি? তা হতে পারে। মা-মরা ছেলেকে মানুষ-টানুষ করলে এতদিন ধরে। কিন্তু পিসিমা, বুঝলাম মানুষ করেছ, এ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে কিছুই করোনি। শুধু পালনই করেছ। ভেবেছ শুধু খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখছি, আবার কি! যাক্, সে ঋণ তো শোধ হবার নয়, রইলই সে ঋণের বোঝ।

    .

    নিচে চাকর-বাকররা চমকে উঠল নীহারকণার গগনভেদী চিৎকারে।

    ওরে, ওরে সর্বনেশে ছেলে, সত্যি চলে যাচ্ছিস মুখের খাবার ফেলে?..চন্দর, অচন্দর, কী কাল ঘুম ঘুমোচ্ছিস তুই হতভাগা! ওরে কী করতে কী হলো,…ইন্দু যে আত্মঘাতী হতে গেল! ওমা, কি কালনাগিনীরা এসেছিল রে! ওরে আমি কেন আত্মঘাতী হচ্ছি না!

    কথাগুলো কোনখান থেকেই স্পষ্ট শোনা যায় না, শুধু বামুন-চাকর-দারোয়ান তিনটে লোক হাতের তাস ফেলে দোতলায় উঠবার সিঁড়ির দিকে দৌড়তে থাকে, ওদিকে তিনতলায় চন্দ্রনাথ সদ্য-ঘুম-ভাঙা বিপর্যস্ত দেহে দৌড়তে থাকেন দোতলায় নামবার সিঁড়ির ওপর।

    ইন্দ্রনাথ চাকর-বাকরগুলোর পাশ কাটিয়ে তরতর করে নেমে যায়,– এই শিগগির ওপরে যা, পিসিমার মাথা গরম হয়ে গেছে। আমি ডাক্তার আর বরফ আনতে যাচ্ছি।

    অবস্থাটা খুবই স্বাভাবিক। তাড়াতাড়ি ডাক্তারের দরকার হলে অমনি করেই নেমে যায়। কে ভাবতে পারবে বাড়ির প্রাণের প্রাণ, সোনার কৌটোয় রাখা সাতশো রাক্ষসের একপ্রাণ দাদাবাবু অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল চিরদিনের মত!

    তারা স্ফুর্তিসেই ছুটল।

    পিসিমা মাথা গরম করে চেঁচাচ্ছে, এ যে একটা মজাদার খবর!

    ⤷
    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleউত্তরণ – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article আর এক ঝড় – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }