Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প77 Mins Read0
    ⤷

    খবরটা এনেছিল মাধব ঘোষের বিধবা শালীর সেই আধাহাবা ছেলেটা। যে ছেলেটাকে আর যে শালীকে নিয়েই মাধব ঘোষের সংসার।

    বাড়িওলার আদরের পুষ্যি, তবু ছেলেটাকে কেউ মানুষের দরে গণ্য করে না। আর বাইরে থেকে এক একটা খবরের ঢেউ বয়ে এনে হাঁফানোলাফানোই তো কাজ তার! কে শুনবে সে খবর? মাধব ঘোষের বাসার ভাড়াটের মধ্যে কারই বা এত সময় আছে যে গালগল্প করবে বসে?

    তাই সে যখন হাঁফিয়ে তোলামি করে আর হাত মুখ নেড়ে বলছিল, ও বাবা, সে কি রক্ত! যেন এক কুড়ি পাঁঠা কেটেছে—তখন নিতান্ত কৌতূহলী দুএকজন রান্নার চালা থেকেই মুখ বাড়িয়ে জিগ্যেস করেছিল, কোনখানে রে?

    কেউ কিছু জিগ্যেস করলেই ছেলেটা আরও ভোলা হয়ে যায়। উত্তর পেতে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে, তাই ওরা বাড়ানো মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আপন মনে বলেছিল, ভগবান পৃথিবীর ভার কমাচ্ছে। এই সেদিন ওখানে একটা গরু কাটা পড়ল।

    তা একটা অচেনা অজানা মানুষের সঙ্গে একটা গরু-মোষের পার্থক্য কি? গরু বরং ভগবতী। কাটা পড়েছে শুনে মেয়ে মানুষের মন একবার শিউরে উঠতে পারে। মানুষ একটা রেলে কাটা পড়েছে, এ খবরের নতুনত্ব কোথায়?

    পৃথিবীতে দৈনিক হাজার হাজার মানুষ এক্সিডেন্টে মরছে না?

    তখন ভর দুপুর।

    বাড়ির জোয়ান পুরুষরা সকলেই কাজের ধান্দায় বাইরে। মেয়েরা কেউ কেউ সকালের পাট সেরে রাতের রান্না সারতে বসেছে। কেউ কেউ ইস্কুল ফেরত ছেলেমেয়েদের জন্যে রুটি গড়ে রাখছে, আর ছোটো সংসারের কেউ কেউ ভাতের কঁসি নিয়ে বসেছে। খেয়ে উঠে ছাই মাটি শালপাতা আর পোড়া কড়া নিয়েও বসেছে এক আধ জন।

    মাধব ঘোষের বাসায় তেরো ঘর ভাড়াটের ঘরে তেরো রকম কাজ চলছিল তখন। আধাহাবা মদনার সঙ্গে রেলেকাটা দেখতে ছুটবে, এত উৎসাহ কারুর আসেনি।

    হোক না বাড়ির কাছাকাছি, খেটে পিটে ক্লান্ত সবাই। হ্যাঁ, নিজেদের বাড়ির পুরুষরা বাড়ি থাকত, তা হলেওবা তাদের ছায়ায় ছায়ায় গিয়ে না হয় উঁকি দেওয়া যেত।

    তাও এসব হ্যাঙ্গাম হুজুতে উঁকি দেবার সখ পুরুষদেরও বড়ো থাকে না। কে জানে বাবা, আবার পুলিশের নজরে পড়ে যেতে হবে কি না, সাক্ষী দিতে যেতে হবে কি না।

    কাজেই মদনা, যতই হেই হেই করে বলুক দেখবে তো চল। এখনও পড়ে আছে কেউ গ্রাহ্য করেনি। বরং অজিতের বউ মলিনা কয়লা ভাঙতে ভাঙতে একবার হাতের শব্দ থামিয়ে কথাটা শুনে নিয়ে বিরক্তিতে মুখ বাঁকিয়ে বলেছিল,—এ ছোঁড়ার কাজের মধ্যে কাজ যত হাড়হাবাতে উনচুটে খবর বাড়িতে নিয়ে আসা।

    মদনার মা সুখদা শুধু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিগ্যেস করেছিল ছেলেকে। হারে মেয়ে না বেটাছেলে? …বেটাছেলে? জোয়ান? মুণ্ডুটা একেবারে থেঁতলে গেছে? তা কি বলছিল লোকে? নেহাত অপঘাত লো আত্মহত্যে?

    সুখদার ছাছোলা গলার প্রশ্ন কিছু কিছু শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল, কিন্তু তোলা মদনার উত্তর আর কারুর বোধগম্য হচ্ছিল না।

    তারপর মদনার মা ছেলেকে রোদে ঘোরার জন্যে বকে, হাতে মুখে জল দিয়েই তার মেশোর কাছে শুইয়ে রেখে গেল।

    মাধব ঘোষের ঘরে একটা ঘাড়-নড়া টেবিল ফ্যান আছে, সেই সুখের আস্বাদের ভাগ সুখদা নিজের ছেলেকে না দিয়ে ছাড়ে না। আর কাজকর্ম সারা হলে, নিজেও এসে মেঝেটায় গড়াগড়ি দেয়।

    তা কাজকর্ম তাকেও নিজের হাতেই করতে হয়, বাড়িওলার শালী বলে যে বাসন মাজতে ঝি রেখেছে তা নয়। রাখতেই বা দেবে কেন মাধব ঘোষ? একাধারে ঝি, রাঁধুনী, ঘরগুছুনি পাওয়া যাবে বলেই না দু দুটো মানুষকে ভাত কাপড় দিয়ে পোষা।

    মাধব ঘোষের বাসার এই ভাড়াটেরাও সে হিসাব জানে। তাই সুখদা নিজে যতই আস্ফালন করুক, বাড়িওলির মর্যাদা তাকে কেউ দেয় না।

    এই যে ও তখন উঠোনের দড়িতে ভিজে কাপড় মেলে দিতে দিতে গলা বাড়িয়ে জিগ্যেস করল—”কি গো মলিনা, একদিনে কত কয়লা ভাঙছ? তখন কি মলিনা ভালো করে উত্তর দিল?

    দিল না।

    বেজার মুখে বলল, দাসদাসীতো নেই যে তাদের পিতেসে ফেলে রাখব? মাসের কয়লা একবারেই ভেঙে তুলছি।

    সুখদাও বেজার মুখে বলল, তা তো বেশ করছ, কাজের সুসার করছ। বলি একটা বুড়োমানুষ যে একটু চোখ বুজেছে সেটাও তো ভাবতে হয়।

    মাধব ঘোষের প্রসঙ্গে সুখদা সব সময় বুড়োমানুষ শব্দটা ব্যবহার করে। অথচ মাধবের বয়েস মাত্র একান্ন বাহান্ন হতে পারে। তাই ওই বুড়োমানুষে কেউ সহানুভুতিতে উছলে পড়ে না। মলিনাও পড়ল না। আরও জোরে জোরে হাতুড়ি ঠুকতে ঠুকতে ভারী গলায় বলল,-”তা আর কী করা যাবে? মাস মাস ভাড়াটি ঘরে তুলতে হলে এসব উৎপাত তো একটু সইতেই হবে।

    মলিনার এই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভাবের জন্যে সুখদা বেশি কথা এগোতে পারে না। আর মলিনারা জাতে বামুন বলে মাধব ঘোষও একটু সমীহ করে। কাজেই সুখদা রণে ভঙ্গ দিল।

    মলিনা সব কয়লাগুলো ভেঙে তুলল, গুঁড়োগুলো চেলে গুল পাকাবার জন্যে আলাদা করে রাখল, একেবারে বিকেলের রান্নার উনুনটা সাজিয়ে ফেলল, তারপর সাবান নিয়ে কলতলায় ঢুকে গেল।

    অজিত অন্য আর সকলের থেকে ভাড়া বেশি দেয়, তাই মাধব ওদের জন্যে আলাদা একটা কলতলা করে দিয়েছে। ছাচা বেড়ার দেওয়াল, টিনের চাল, আর কর্পোরেশনকে লুকিয়ে একটা বাড়তি ট্যাপ—এই ঐশ্বর্য।

    সেই ঐশ্বর্যের গর্বেই মলিনা নিজেকে ওই বারো ভূতেদের থেকে বিশিষ্ট ভাবে। রাত্তিরে পুরো রান্নাও এ বাড়িতে একা মলিনাই করে। আর সকলে কেউ কেউ ডাল তরকারি বেঁধে রাখে, রাত্রে শুধু ভাতটা রাঁধে কি রুটি দুখানা গড়ে নেয়। কেউ বা উনুন জ্বালার পাটই করে না, সব কিছুই সেরে রাখে।

    মলিনাই মুখ বাঁকিয়ে বলে, সকালের তরকারি? মুখে তুলবে ও? হুঁ! তা হলে তো বেঁচে যাই। তোমাদের মতন একটা বেলা তবু জিরিয়ে বাঁচি। তা হবার জো নেই।

    জো আছে কি নেই—কে জানে, তবে হওয়ায় না মলিনা। বিকেলে পরিপাটিটি হয়ে দাওয়ায় বসে তোলা উনুনে রাঁধে। ডিমের ডালনা, আলু পেঁয়াজের চচ্চড়ি, রুটি কি দালদার পরোটা।

    উঠোন ঘিরে দাওয়া আর দাওয়া ঘিরে যত ঘর, মলিনার এই রন্ধনলীলা সবাই দেখতে পায়। এবাড়ি ওবাড়ির ছেলেপুলেরা বলে বেশ বাস বের করেছে বামুন কাকি! তোমরা কেবল ছাইয়ের রান্না রাঁধে।

    তাদের মায়েরা বিরক্তিতে নাক কুঁচকে বলে, আমাদেরও যদি তোদের বামুন কাকির মতন আপনি আর কোপনির সংসার হত, বাস বেরোনো রান্না বাঁধতাম। তোমাদের ব্রহ্মাণ্ড ভরাতেই যে–

    আজও মলিনা সেই সুবাস বেরোনো রান্না রাঁধতে বসেছিল।

    আজকের সেই দুপুরে সাবান দিয়ে গা ধুয়ে এসে চুল বেঁধে পরিপাটি হয়ে একটা সেলাই নিয়ে বসেছিল।

    কল চালাতে জানে, কিন্তু কল নেই। তাই হাতেই একটা সায়া সেলাই করে ফেলে, সাজানো উনুনটায় আগুন ধরিয়ে যখন রাঁধতে বসল, তখন সন্ধে হয় হয়।

    সেলাইয়ের ঝেকে বেলা গড়িয়ে ফেলে মনটা ধড়ফড় করছিল। অজিত এসে পড়লেই মুশকিল। এলেই রান্না কামাই দিয়ে চা বানাতে হবে, পাঁপড় কি দুখানা বেগুনী ভেজে দিতে হবে। সব গড়িয়ে যাবে।

    মাসের প্রথম দিক বলে রান্নার উপকরণেও বাহুল্য ছিল। একটা ডালনা, একটা চচ্চড়ি, আবার দুরকম ভাজাও। ব্যস্ত হাতে সারতে সারতে হঠাৎ খেয়াল হল মলিনার, অজিতের ফেরার সময়টা যেন পার হয়ে গেছে।

    ভাবল, দেখ—আমি কোথায় দেরী হয়ে গেছে বলে ধড়ফড়িয়ে মরছিলাম, আর আজই ও দেরী করছে।

    মাখা ময়দা ঢেকে রেখে উনুনে কুচো কয়লা দিয়ে বসে রইল অনেকক্ষণ, অজিত এলে গরম পরোটা ভেজে দেবে বলে, কিন্তু ক্রমশ উনুন ঝিমিয়ে এল। মনটাও তখন অস্থির হয়ে উঠেছে। কোনোরকমে পরোটা কখানা বেলে ফেলে ভেজে রাখল, আর তারপর ঘরবার করতে লাগল।

    এত দেরী কিসের?

    কই এত দেরী তো করে না কোনোদিন।

    কাজ করে অজিত একটা কবরেজী ওষুধের দোকানে। তবে কবরেজী ওষুধের চেয়ে গন্ধতেলের ব্যবসাটাই তাদের চলে ভালো। আমলার তেল আর কুন্তল বিলাস এই দুটোর ভীষণ কাটতি।

    মলিনার চুলে কুন্তল বিলাসের গন্ধও মলিনাকে এ বাড়িতে আর একটু বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। অজিতের কাজ হচ্ছে প্যাক করা। গুনে গেঁথে হিসেব মিলিয়ে দিতে হয়। তবু মলিনার জন্যে এসে যায় কোনো ফাঁকে কুন্তল বিলাস, আমলার তেল।

    অজিত বলে, হুঁ হুঁ বাবা, অমনি না। হোমিওপ্যাথির শিশি রাখি কাছার খুঁটে, আর কোম্পানির শিশিতে তেল ভরবার সময় একটু একটু করে কম ভরে খানিকটা সরাই।

    দাঁতের মাজন, হজমের ওষুধ সবই সরায় অজিত।

    মলিনা ভাবল, সেই রকম সরানো টরানো কিছু ধরা পড়ে গিয়ে গোলমাল বাধেনি তো? মালিক আটকে রাখেনি তো? কিন্তু কতক্ষণ আটকে রাখবে? লঘুপাপে কি গুরুদণ্ড দেবে? রাত যে দশটা বাজল!

    যে মানুষ পাঁচটা সাড়ে পাঁচটায় আসে!

    সামনের ঘরের স্বপনের মা মলিনার কার্যকলাপ লক্ষ করছিল। মলিনার উনুনে কয়লা দেওয়া, আবার নিভন্ত আগুনে যেমন তেমন করে খাবারটা করে নেওয়া সবই দেখেছে।

    এখন ওর অস্থিরতাও দেখল।

    ডাক দিয়ে বলল, অ মলিনা দি, অজিতবাবু ফেরেননি?

    মলিনার বুকের মধ্যে তোলপাড় করছিল, এই প্রশ্নে উছলে কান্না এল তার। সেই কাঁদো কাঁদো গলাতেই বলল, না ভাই, ভেবে মরছি। কী হল কিছু বুঝি না। এমন তো কোনোদিন করে না।

    কথাটা সত্যি।

    বাড়ি ফিরে চা টা খেয়ে আবার বরং বেরিয়ে রাতটাত করে কোনো কোনোদিন অজিত, কিন্তু কাজ ফেরত সোজাই বাড়ি আসে।

    স্বপনের মা চিন্তিত গলায় বলল, বলে যাননি কিছু?

    না, কিছু না।

    তাইতো!

    রাত দশটার নিশুতি হয়ে আসা উঠোনে এই প্রশ্নোত্তর যেন একটা গা ছমছম বিপদের ইসারা নিয়ে এল। আর সঙ্গে সঙ্গে সব ঘরের দোর থেকেই উদ্বিগ্ন প্রশ্ন এসে এসে আছড়ে পড়তে লাগল। মেয়ে পুরুষের গলা।

    অজিতবাবু আসেননি? …অজিতবাবু আসেননি?…সে কি? কোথাও যাবার কথাটথা ছিল না?

    ছোটো ছেলে মেয়েরা সকলেই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, বড়োরা কেউ খাবে, কেউ খেতে বসেছে। সকলেই চঞ্চল হয়ে উঠল।

    একটা মানুষ, নিয়মী মানুষ, সে হঠাৎ কাজ থেকে বাড়ি ফিরল না, এ যে বড়ো সর্বনেশে কথা!

    অহঙ্কারী মলিনা, যে নাকি কখনও নিজের দাওয়া থেকে ভিন্ন অন্যের দাওয়ায় এসে কথা বলে না, সে একবার স্বপনদের দাওয়ায়, একবার ডোম্বলদের দাওয়ায়, একবার নগেনবাবুর দাওয়ায় এসে কাতর হয়ে বলতে লাগল, কি হবে ভাই! খবর পাবার কী হবে? মন যে ধৈর্য মানছে না। রাত তো ক্রমশঃই গম্ভীর হয়ে এল। বুকের মধ্যে হিম হয়ে আসছে আমার।

    সকলেই উদ্বিগ্ন গলায় সহানুভূতি জানাতে লাগল। কিন্তু এত রাত্তিরে খবর পাবার প্রশ্নটায় গা করল না কেউ। কেন কোথায় খবর?…ওর সেই দোকান কি আর ভোলা আছে এখন?

    সাড়া শব্দে—বুড়ো মানুষ মাধব ঘোষও সুখশয্যা ছেড়ে উঠে এসে জিগ্যেসাবাদ করতে লাগলেন।

    সুখদা টিপে টিপে বলতে লাগল, ওমা, এতক্ষণ কি তুমি ঘুমোচ্ছিলে মলিনা? মানুষটা আসে সন্ধেবেলা, আর এখন এই রাত্তির এগারোটা! এখন তুমি তোক জানাজানি করছ বাড়ি আসেনি বলে। সময়ে টের পেলে তো–পাঁচজনে একটা বিহিত করতে পারতো!

    মলিনার এখন দুঃসময়।

    তাই মলিনা চট করে মুখে মুখে উত্তর দিল না। নইলে কি, না বলে ছাড়তো, একদণ্ড দেরী দেখেই যদি ডাক ছেড়ে লোককে উত্যক্ত করি, তাহলেও তো দুষতে গো!

    এখন বলল না।

    এখন মাধব ঘোষের কথার উত্তর দিল। যেমন যায় তেমনিই গিয়েছিল। শরীর তো ভালোই ছিল। এখন খবর নেবার কি হবে বলুন?

    মাধব ঘোষ নীরস গলায় উত্তর দেয়, এখন আর এই রাতদুপুরে কি বলব বাছা?

    মলিনা নয় বিপদেই পড়েছে। তবে স্বভাবটা কি একেবারে যাবে? যে স্বভাব না কি মরলেও যায় না।

    তাই সে-ও বিরস গলায় বলে ওঠে, তা আপনার বাড়ির ভাড়াটে, দায়িত্ব তো আপনারই, একটা যদি বিপদ আপদ ঘটে থাকে, থানা পুলিশ হয়, আপনাকেই আগে ধরবে।

    থানা পুলিশের কথাটাই মনে আসে মলিনার। কারণ, ওর মনে সেই চুরির কথাই পাক খাচ্ছে। কি জানি, অজিত শুধুই বাড়িতে এক আধ ছিটে আনে, না সরিয়ে ফেলে বাইরে মোট মোট বেচে। এমন তো কত শোনা যায়, তলে তলে মনিবকে ফাঁক করে কর্মচারীতে।

    মানুষকে বিশ্বাস নেই।

    স্বামী বলেই যে অজিতকে মলিনা সত্যসন্ধ পুরুষ ভাববে তার মানে নেই।

    কিন্তু থানা পুলিশের কথায় মাধব ঘোষ শিউরে উঠল, থানা পুলিশ কেন? থানা পুলিশ কেন? তেমন সন্দ আছে তাহলে?

    মলিনার সেই কান্না ভাবটা কমে এখন ঝগড়াটে মূর্তি ফুটে ওঠে। সে-ও সমানে সমানে বলে, কেন, শুধু চুরি ডাকাতি করলেই থানা পুলিশ হয়? পথে বিপদ হলে হয় না? এমন কিছু খোকা নন আপনি যে জানেন না। এতগুলো পুরুষ বাড়িতে থাকতে, বাড়ির একটা মানুষ বেঘোরে হারিয়ে যাবে? খোঁজ হবে না?

    এতক্ষণ যারা সহানুভূতিতে বিগলিত হচ্ছিল, তারা সহসা মলিনার এই রূপান্তরে অন্যমূর্তি নেয়। বিরূপ মন্তব্যের ফিসফিসিনি ওঠে। মাধব ঘোষের সঙ্গে লাগছিল, বেশ হচ্ছিল। বাড়িওলাকে কেউ দুচক্ষে দেখতে পারে না। এই ছুতোয় ও একটু অপদস্থ অপমানিত হয় তোক।

    কিন্তু হঠাৎ এ আবার কি!

    কেউটে যে ল্যাজে ছোবল মারতে এল আর তবে কে সহানুভূতিতে গলবে?

    নগেনবাবুর স্ত্রী গলা তুলে বললেন, বুঝলাম তো সবই। কিন্তু চারদিকের বাস ট্রাম বন্ধ হয়ে এল, লোকে কে কি করবে? যা করবার সকাল হলে করা হবে।

    একথায় হঠাৎ আবার মলিনার ভেতরের কান্নার সমুদ্র উথলে উঠল। কেঁদে উঠেই বলল, মেয়েমানুষ হয়ে একথা কোন প্রাণে বললেন মাসিমা? এই সারারাত আমি কি ভাবে কাটাব, তা ভাবছেন না?

    নগেনবাবুর স্ত্রী কি উত্তর দিতেন কে জানে, ঠিক এই সময় সুধানাথ ফিরল কাজ থেকে। সুধানাথের চাকরি হচ্ছে, সিনেমার টিকিট চেকারি। তাই লাস্ট শো সেরে ফিরতে ওর প্রায় বারোটা বাজে। বাইরে থেকে খেয়েই ফেরে।

    ও যখন ফেরে তখন বাড়ি নিশুতি হয়ে যায়, উঠোনের ছোটো দরজাটা ভেজানো থাকে। নিঃশব্দে ঢুকে আস্তে দরজাটায় খিল লাগিয়ে নিজের কোণের দিকের ঘরটার সামনে দাঁড়ায়, চারিদিকের ভিতর থেকে বন্ধ ঘরগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে দেখে, হয় তো বা একটা নিশ্বাস ফেলে। তারপর নিজের বাইরে থেকে তালা লাগানো ঘরটা আস্ত একটি চাবির মোচড় দিয়ে খুলে ঢুকে পড়ে।

    আলো-টালো জ্বালে না, টর্চটা টিপে একবার দেখে যেন, তারপর বাইরের উঠোনের মস্ত চৌবাচ্চাটার তলায় ঠেকা এক ছিটে জল মগ ঠুকে ঠুকে তুলে হাত মুখ ধুয়ে, ঘরে এসে বাইরের জামা-পোশাক বদলে শুয়ে পড়ে।

    ঘরের মধ্যেই টাঙানো দড়িতে লুঙ্গিটা শুকোতে দিয়ে যায় সকালে, সেটাই ওর রাত কাপড়।

    বিছানা কোনোদিন ভোলা হয় না, অতএব পাতার কথাও ওঠে না। তিন-চার মাস অন্তর এক আধদিন সকালে বিছানার চাদরটাকে নিয়ে কাচতে দেখা যায় সুধানাথকে।

    সকালের দিকে আর একটা কি যেন কাজ করে। খাওয়াটা সেখানে জোটে। বোধহয় কোনো মাড়োয়ারি গদিতে খাতা-পত্তর দেখে। সেখানে কর্মচারীদের জন্যে রান্না হয়। মাছ মাংস নয়, সাত্ত্বিক।

    সকালে ওই সাত্ত্বিক খানা, রাত্তিরে রেস্টুরেন্টে রুটি মাংস। এই চালিয়ে চলেছে সুধানাথ যতকাল মা মরেছে তার।

    বউ?

    না, বউ বস্তুটা আর কপালে জোটেনি তার। কে দেখেশুনে দেয়, এইজন্যেই হয়ে ওঠেনি। তারপর তো মেঘে মেঘে বেলা যাচ্ছে। বন্ধুবান্ধবরা কিছু বললে বলে, বেশ আছি বাবা! সুখের চেয়ে সোয়াস্তি ভালো।

    কিন্তু রাত্রে বাসায় ফিরে ঘরে ঘরে বন্ধ দরজা দেখে নিশ্বাস পড়াটাকে আটকাতে পারে না। নিজের ঘরটাকে একটা ঘৃণ্য জায়গা বলে মনে হয় তার।

    আজও যথারীতি টর্চ টিপে টিপে গলিটা পার হয়ে এসেছিল সুধানাথ, দরজা ঠেলতেই চমকে উঠল।

    সব ঘরের দরজা খোলা, আলো জ্বালা, আর ঘরের মালিকরা সকলেই প্রায় ঘরের বাইরে।

    মাঝখানে নাক উঁচু মলিনা বসে কঁদছে। বাসার কারও সঙ্গেই খুব একটা ঘনিষ্ঠতা নেই সুধানাথের। সম্পর্ক তো মাত্র সেই সকাল বেলা ছটা থেকে সাতটা অবধি। যেটুকু সময় জল আর কল নিয়ে বচসা।

    তবে মলিনার আলাদা কলঘর আছে বলে, আর মলিনা সেই কলঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাঁচজনের সামনে দাঁতে বুরুশ করে বলে, সুধানাথ ওকে দেখতে পারে না। মনে মনে নাম দিয়েছে–উঁচুনাকী।

    কিন্তু হঠাৎ কী হল?

    উঁচুনাকী কান্না জুড়েছে কেন? নিশ্চয় বিপদ আপদ ঘটে গেছে কিছু।

    টর্চটা নিভিয়ে ফেলে বলল, কী ব্যাপার ঘোষ মশাই?

    ঘোষ মশাই তাঁর বাসার এই ভাড়াটেটিকে একটু প্রীতির চক্ষে দেখেন। কারণ বউ ছেলের ঝামেলা নেই, অভিযোগ অনুযোগের বালাই নেই। সারাদিন তালা ঝোলানো ঘরটার জন্যে মাসে মাসে পুরোদস্তুর ভাড়াটি দেয়। এবং সকলের আগেই দেয়। দোসরা ভিন্ন তেসরা হয় না। যেটা তার এই বাকি তেরো ঘরের কাছে আশাই করা যায় না।

    সুধাকে নিয়ে মাধব ঘোষের চৌদ্দ ঘর ভাড়াটে। সুধাই সেরা।

    তাই সুধার প্রশ্নে মাধব ঘোষ যেন জজকে সামনে পেল। নালিশের সুরে বলে উঠল, এই দেখুন মশাই, অজিতবাবু সময়ে বাসায় ফেরেননি বলে অজিতবাবুর পরিবার আমাকে থানা পুলিশের ভয় দেখাচ্ছেন।

    থানা পুলিশ!

    মাধবকে ভীতি প্রদর্শন?

    ব্যাপারটা বুঝতে কিছু সময় লাগল সুধানাথের। তারপর–অনেকের অনেকরকম কথা, সুখদার চিপটেন এবং মলিনার কান্না থেকে সবটা বুঝে নিল পরিষ্কার করে।

    অজিত যে নিত্য সন্ধ্যা ছটায় ফেরে, এবং আজ এখনও ফেরেনি এটা শুনে সত্যিই চিন্তা হল তার। উড়িয়ে দেবার মতো কথা নয়।

    রাত্তিরভোর ঘুমিয়ে সকালে যা হয়, করা যাবে এটাও যেন অসংগত ঠেকল তার কাছে। তাই প্রশ্ন করল, তা উনি কাজটা করেন কোথায়?

    মলিনা ভাঙা গলায় বলল, কুন্তল বিলাসের অফিসে।

    কুন্তল বিলাস? বড়ো অফিস? টেলিফোন আছে?

    তা, জানি না–মলিনা কাতর কণ্ঠে বলে, তবে আপিস মস্ত বড়ো। অনেক রাত অবধি এই সব ওষুধ পত্তর তেল টেল তৈরি হয়—

    অনেক রাত অবধি হয়–

    সুধানাথ বলে, আচ্ছা দেখি, যদি অবনী ডাক্তারের ডাক্তারখানাটা এখনও খোলা থাকে, টেলিফোন করার সুবিধে হয়।

    নগেনবাবু আগ বাড়িয়ে বলেন, সে কথা কি আর আমরা ভাবিনি হে? ভেবেছি। কিন্তু ডাক্তারখানা কখন বন্ধ হয়ে গেছে।

    সুধানাথের অবশ্য বুঝতে দেরী হয় না, ভাবনাটা নগেনবাবু এখনই ভাবলেন। তাই মনে মনে হেসে বলে, আচ্ছা দেখি চেষ্টা করে। যদি ভোলাতে পারি। কম্পাউন্ডারটা তো শুয়ে থাকে ভেতরে।

    কম্পাউন্ডার দীনবন্ধুর সঙ্গে ভাব আছে সুধানাথের। দীনবন্ধু একই রেস্টুরেন্টে খেতে যায় মাঝে মাঝে। সুধানাথ বিনা টিকিটে সিনেমা হলেও ঢুকিয়ে দেয় কখনও সখনও বন্ধু দীনবন্ধুকে। ছবি যখন মরে আসে, ভীড় হয় না, তখন দামী-সিটেই বসিয়ে দেয়।

    সেই যোগসূত্রের ভরসায় বেরিয়ে পড়ল সুধানাথ।

    যারা সকাল দেখাচ্ছিল, তারা সুধানাথের এই অর্বাচীনতাকে ব্যঙ্গ করে খেতে শুতে গেল, মাধব ঘোষ আবার সুখ-শয্যায় অঙ্গ ঢাললো গিয়ে।

    শুধু সুখদা দাওয়ায় পা ছড়িয়ে বসে রইল, শেষ মজা দেখবার জন্যে। বসে রইল মদনাকে কাছে বসিয়ে। গোলমালে ঘুম ভেঙে উঠে এসেছে সে। মায়ের গায়ে ঠেকা দিয়ে বসে বসে হাই তুলছে।

    আর মলিনা নিজের দাওয়ায় উঠে গিয়ে এখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কঁদছে।

    প্রতীক্ষার প্রহর অনন্ত!

    মলিনার মনে হয়, সে বুঝি সারারাত ধরে কাঁদছে। মনে হয়, ওই ইয়ার ছোঁকরাটা নির্ঘাত মজা দেখতে থাকে বৃথা আশ্বাস দিয়ে আর কোথাও শুতে চলে গেল।

    নইলে অবনী ডাক্তারের বাড়ি আবার কতদূর!

    কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সুধানাথ যতটা সম্ভব দ্রুত গেছে। জানলায় টোকা দিয়ে দীনবন্ধুকে তুলিয়ে ডিরেক্টরি দেখে কুন্তল বিলাসের অফিসে এবং সেখানে সাড়া শব্দ না পেয়ে মালিকের বাড়িতে ফোন করে তথ্য সংগ্রহ করে, ছুটে ছুটে এসেছে।

    ওকে ঢুকতে দেখেই, মলিনা চোখের কাপড় নামিয়ে ডুকরে ওঠে, খবর কিছু পেলে ঠাকুরপো?”

    জীবনে কোনোদিন সুধানাথকে ঠাকুরপো বলেনি মলিনা। কথাই কয়েছে কি না সন্দেহ। পরস্পরের সঙ্গে কথা চালনার যে প্রধান কারণ—জল কল, সে কারণ মলিনার নেই। তাই কথাও নেই বড়ো একটা কারও সঙ্গে।

    কিন্তু আজকের কথা স্বতন্ত্র। আজ মলিনা কারে পড়েছে। তাই ঠাকুরপো সম্বোধনে অন্তরঙ্গ হতে চাইছে তার সঙ্গে, যে তার বিপদে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে।

    ছেলেটার মধ্যে মনুষ্যত্ব আছে—ভেবেছে মলিনা।

    কই, একটা মানুষও তো এক পা বেরিয়ে এক তিল চেষ্টা করতে এগোয়নি? তখন তবু সময় ছিল। এখন তো সত্যিই অসময়। এই মনুষ্যত্বযুক্ত মানুষটাকে তাই অসহায়তার দুঃখময় মুহূর্তে নিকট সম্পর্কের সম্বোধনে আঁকড়াতে ইচ্ছে করল মলিনার।

    নতুন এই সম্বোধনটা সুধানাথের কানেও মিষ্টি ঠেকল। কিন্তু এখন তো ভালো লাগালাগির সময় নয়। এখন যে বড়ো দুঃসময়। কুন্তল বিলাসের মালিক যা বললেন, সে তো আরও চিন্তার কথা।

    মাত্র ছঘণ্টাই তাহলে সমাজে অনুপস্থিত নয় অজিত ভটচায, তেরো চৌদ্দ ঘণ্টার হিসেব মিলছে না।

    রাত দুপুরে ফোন আসাতে ক্রুদ্ধ বড়োলোক বিরক্ত ভাবে জানিয়েছেন, অজিতের অসততায়। বিরক্ত হয়ে তিনি আজ তাকে কাজে জবাব দিয়েছেন। বেলা এগারোটার সময় তার অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে অজিত ভটচায়। তারপর তার আর কোনো খবর তিনি জানেন না। বাড়ি ফেরেনি? স্ত্রী কান্নাকাটি করছে? কি করবেন। দুঃখিত।

    কটাস করে কেটে দিয়েছিলেন কানেকশান।

    অসততার কথাটা উল্লেখ করল না সুধানাথ, শুধু বলল, কী যেন বচসা হওয়ায় মালিক নাকি কাজে জবাব দিয়ে দিয়েছিলেন সকাল বেলাই। বেলা এগারোটার সময় অফিস থেকে বেরিয়ে গেছেন।

    ও ঠাকুরপো, কোথায় সে গেছে তবে? সারাদিন কোথায় আছে? চাকরি যাওয়ার ঘেন্নায় কিছু ঘটিয়ে বসেনি তো?

    বলে, মলিনা চেঁচিয়ে ওঠে।

    আর ঠিক সেই মুহূর্তে যমরাজের চরম পত্রের মতো ভয়ঙ্কর বাণীটি ঘোষণা করে বসে, সুখদার হাবা ছেলে মদনা।

    ত্যাখন অ্যা—অ্যা অ্যাতো করে বললাম, দে–দেখবে তো চল। অহঙ্কার করে ব-বসে থাকা হল। এ্যা-এ্যাখন বো-বোঝ। আ-আমি তো-তোকে নিখখাত বলছি মা, ওই রে রে রেলেকাটাটা বামুন কাকা।…তে-তেমনিতর নীঃ নীঃ নীল শার্ট ছিল পরনে!…উঃ সে কী রক্ত! মু-মুখটা এ্যা… এ্যাকেবারে ছেঁচে–

    আর শোনবার ধৈর্য থাকে না মলিনার, হঠাৎ দাওয়া থেকে গড়িয়ে উঠোনে পড়ে। ঠাঁই ঠাই করে কপাল ঠুকতে থাকে আর পরিত্রাহি চিৎকার করতে থাকে,—”ওগো, আমি কী কাজ করেছি গো! ওগো, কেন দেখতে যাইনি গো! সেই তো ভরদুপুর সময়, চাকরি খুইয়ে বাড়ি ফিরছিল সে। নিশ্চয় মনের ঘেন্নায় লাইনে ঝাঁপ দিয়েছে–

    নিজের কপাল ঘেঁচে রক্তগঙ্গা করে মলিনা।

    এরপরে আর মহিলাকুল রাগ করে ঘরে বসে থাকতে পারেন না। মলিনাকে টেনে তোলবার চেষ্টা করেন সমবেত চেষ্টায়। এবং কারুরই আর সন্দেহমাত্র থাকে না, সেই রেলেকাটা হতভাগ্যই—অজিত ভট্টচার্য্।

    মিলে তো যাচ্ছে ঠিক ঠিক।

    নীল শার্ট।

    বেলা এগারোটা।

    চাকরি খোয়ানো মন।

    আর প্রমাণের দরকারটা কি?

    সকলেই হায় হায় করতে থাকে, তখন একবার দেখতে না যাওয়ার জন্যে, এবং পুরুষরা যাঁরা নাকি স্ত্রীদের হুজুগে নাচা একেবারে দেখতে পারেন না, তারা অভিযোগ করতে থাকেন—এই তিন লাফের রাস্তা, একবার গেলে না কি বলে? ধন্যি, নিশ্চিন্দি মন! বলি, এ যদি আমরা হতাম!

    কিন্তু এখন কোথায় সেই দ্বিখণ্ডিত দেহ, যেখানে ছুটে গিয়ে শনাক্ত করতে যাওয়া হবে?

    উন্মাদ চিৎকার আর উন্মত্ত আচরণ এক সময় স্থির হয়। মলিনাকে টেনে দাওয়ায় তুলে চোখে মুখে জল দিয়ে একজন পাখা নেড়ে বাতাস করতে থাকে।

    এবং সমস্ত মহিলাকুল আপন আপন ঘর ত্যাগ করে সেই দাওয়ায় জটলা করে বসে আলোচনা করতে থাকেন, ইতিপূর্বে তাদের জ্ঞান-গোচরে আর কোথায় কোথায় এই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল।

    এমন বিনা মেঘে বজ্রাঘাত সচরাচর তো দেখতে পাওয়া যায় না।

    এঁদের দাপটে সুধানাথ সরে গিয়েছিল।

    কিন্তু চোখে তার ঘুম আসছিল না। কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে বসেছিল নিজের কোটরে, চৌকিটার ওপর।

    আর কেমন যেন মনে হচ্ছিল সুধানাথের, আগামী সকালের সমস্ত দায়িত্বই বুঝি তার। সেই রেলেকাটার খোঁজ করতে হবে, মলিনাকে নিয়ে গিয়ে শনাক্ত করতে হবে এবং তারপর মলিনার এই অসহায় অবস্থার উপায় চিন্তা করতে হবে।

    কিন্তু সে লাশ কি ওরা রেখেছে?

    হয়তো ফটো তুলে রেখে জ্বালিয়ে দিয়েছে। ফটো দেখে কি বোঝা যাবে?

    আচ্ছা! এই বা কী আক্কেল অজিত ভট্টচাযের? বাড়ির দোরে লাইনে কাটা পড়তে এল!

    কিম্বা হয়তো আত্মহত্যা নয়।

    মন প্রাণ খারাপ ছিল, অসতর্কতায় হয়ে গেছে। গেট নামিয়ে দেওয়ার পরও মাথা গলিয়ে গলিয়ে লাইন পারাপার হওয়ার অভ্যাস তো সকলেরই।

    শহরতলীতে যাদের বাস করতে হয় তারাই জানে, ও অভ্যাস না করতে পারলে কী অবস্থা!

    যমে কামড়ানো রাতও একসময় ভোর হয়।

    এ বাড়িতেও হল।

    মলিনা উঠে কাঠের মতো দাওয়ার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে আছে, গিন্নিরাও ঠিক করতে পারছেন না, মলিনার এখন কিংকর্তব্য।

    লাশ তো চোখে দেখেনি এখনও, দেখতে পাবে তারও ঠিক নেই। সৎকার করার প্রশ্নও তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

    তবে? তার স্ত্রীর বিধবা হওয়া চলে কি? অথচ বামুনের মেয়ে। যা তা করলেও চলবে না।

    নগেন গিন্নি বললেন, সিঁদুরটা নয় এক্ষুনি মুছে কাজ নেই, নোয়াগাছটা ফেলে দিক। একবার মাথাটা ডুবিয়ে, কাপড় ছেড়ে একঘটি জল মুখে দিক। কাল থেকে একা কেঁদে কেঁদে আহা মুখের দিকে চাওয়া যাচ্ছে না।

    তা সত্যি, সেই প্রবল কান্নার দাপটে এবং মাথা খোঁড়ায় মলিনার মুখটা বীভৎস দেখাচ্ছিল। কপালে কালসিটে, শুকনো রক্তের দাগ, এবং দু তিনটে উঁচু উঁচু ঢিবি। মুখটা ফুলো ফুলো, মুখের চামড়াটা শুকনো। মাথায় কাপড়ও ছিল না মলিনার।

    ঘরের জানালা থেকেই দেখতে পাচ্ছিল সুধানাথ। কিন্তু খুব ভোরে করণীয় কি আছে? একটু বেলা না হলে তো কোথাও কাউকে পাওয়া যাবে না?

    সকালের চাকরিটায় আজ আর গেল না সুধানাথ, অপেক্ষায় রইল একটু পরে ওই ওখানকার গুমটি ঘরে গিয়ে খোঁজ নেওয়ার।

    কিন্তু মলিনার কী হবে?

    ওই মেয়েমানুষগুলো কি ওকে জ্যান্ত রাখবে?

    ⤷
    1 2 3 4 5 6
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ভালোবাসা চিরকালীন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }