Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    যৌবনজ্বালা

    অন্নদাশঙ্কর রায় এক পাতা গল্প21 Mins Read0

    যৌবনজ্বালা

    ডিনার শেষ হলে মহিলারা উঠে গেলেন বসবার ঘরে! আমার স্ত্রী চলে যাচ্ছেন দেখে অন্যমনস্কভাবে আমিও তার পদাঙ্ক অনুসরণ করছি, এমন সময় পিছন থেকে আমার কোট ধরে টানলেন গৃহকর্তা ব্যারিস্টার মৌলিক। কানে কানে বললেন, ‘কথা আছে।’

    আমি থমকে দাঁড়ালুম। ‘কী কথা!’

    তিনি মুখ টিপে মুচকি হাসলেন। কথাটা আর কিছু নয়, এটিকেটের ভুল। বলতে হল না যে মহিলারা কিছুক্ষণ নিরালায় থাকবেন, সে-সময় পুরুষদের যাওয়া বারণ। তাঁর হাসি থেকে অনুমান করলুম কী কথা। চোরের মতো চুপি চুপি ফিরে এলুম খানা কামরায়। একটা ফাঁড়া কেটে গেল।

    ইতিমধ্যে জনা চারেক অভ্যাগত মিলে জটলা শুরু করে দিয়েছিলেন। হাতে পানপাত্র, মুখে চুরুট। আমার তো ওসব চলে না, আমি এক পেয়ালা কফি হাতে ওঁদের সঙ্গে ভিড়ে গেলুম। ভিড় দেখলেই ভিড় বাড়ে। যে যার চেয়ার টেনে নিয়ে ঘিরে বসল চার ইয়ারকে। কেউ কেউ টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল।

    প্রফেসর মণিমোহন দে বলেছিলেন ইঞ্জিনিয়ার প্রদোষকুমার সেনকে, ‘তুমি অসম থেকে আসছ। তুমিই বলতে পারবে আসলে কী হয়েছিল। আমরা তো নানা মুনির নানা বয়ান শুনেছি। কেউ বলে শিকার করতে গিয়ে দৈব দুর্ঘটনা। কেউ বলে স্রেফ আত্মহত্যা।’

    প্রদোষ মাথা নাড়লেন। ‘না, অ্যাক্সিডেন্ট নয়।’

    সকলে বুঝতে পারল বিকল্পে কী! তবু মুখ ফুটে জিজ্ঞাসা করল বীরেশ্বর ঘোষাল—ব্যারিস্টার। ‘তা হলে কী?’

    ‘সুইসাইড।’

    ‘সুইসাইড!’ ঘোষাল উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘আমি বিশ্বাস করিনে। স্বয়ং যুধিষ্ঠির এসে হলফ করে বললেও আমি বিশ্বাস করব না যে বিশ্বজিৎদা আত্মহত্যা করেছে। বিলেতে থাকতে আমাকে রক্ষা করেছিল কে? কাকে আমি বিবেকের মতো ভয় করতুম? জিতেন্দ্রিয়, চরিত্রবান, সত্যনিষ্ঠ—’

    আমি বুঝতে পেরেছিলুম যাঁর কথা হচ্ছিল তিনি আমার কলেজের বিখ্যাত খেলোয়াড় বিশ্বজিৎ সিংহরায়। বাংলার রাজপুত। ছ-ফুট লম্বা, সুশ্রী চেহারা, মুখচোরা প্রকৃতি। খুব কম ছেলের সঙ্গেই মেশেন, যাদের সঙ্গে মেশেন তারা বলে মনটা সাদা, যাদের সঙ্গে মেশেন না তারা বলে মাথাগরম। আমি ছিলুম বয়সে অনেক ছোটো, দূর থেকে দেখতুম আর শ্রদ্ধা করতুম।

    ‘কিন্তু কথাটা কি সত্য?’ আমি চেঁচিয়ে বললুম ঘোষালকে বাধা দিয়ে।

    ‘চুপ। চুপ।’ গৃহকর্তা আমার পিঠে টোকা মেরে সাবধান করে দিলেন যে, ও-ঘরে মহিলারা রয়েছেন।

    ঘোষাল তখনও গজগজ করছিল। ‘কিন্তু কেন? কোন দুঃখে আত্মহত্যা করবেন বিশ্বজিৎদার মতো লোক। একটা নষ্ট মেয়েমানুষের জন্যে?’

    প্রদোষ দপ করে জ্বলে উঠলেন, ‘নষ্ট মেয়েমানুষ কাকে বলছ?’

    ‘তুমি জান কাকে বলছি। শি ইজ এ বিচ।’

    ‘চুপ চুপ।’ বলে মৌলিক তার মুখ চেপে ধরলেন।

    প্রদোষ বললেন, ‘যে বিচ নয় তাকে বিচ বলে ভুল করেছিল বিশ্বজিৎ। সেইজন্যে এ ট্র্যাজেডি! কিন্তু আগে দরজাগুলো ভেজিয়ে দেওয়া হোক। এসব কথা মেয়েদের জন্যে নয়।’ এই বলে প্রদোষ আরেকটা সিগার ধরালেন।

    আমরা যে যার চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠে দরজাগুলো ভেজিয়ে দিয়ে এলুম। কে জানে, মেয়েরা যদি শুনতে পায় তাহলেই হয়েছে। গৃহকর্তা সবাইকে দিয়ে গেলেন যার যা অভিরুচি। আমি নিলুম আর এক পেয়ালা কফি। প্রদোষ বলতে আরম্ভ করলেন।

    দুই

    ঘোষালকে পাপের হাত থেকে রক্ষা করবার জন্যে ছিল বিশ্বজিৎ, কিন্তু বিশ্বজিৎকে ভ্রান্তির হাত থেকে রক্ষা করবার জন্যে ছিল না তেমন কেউ। বিশ্বজিৎ হচ্ছে সেই জাতের মানুষ যারা রামধনুর সাতটা রং দেখতে পায় না, যাদের চোখে দুটি মাত্র রং। সাদা আর কালো। মেয়েদের সে দু-ভাগে বিভক্ত করেছিল। ভালো আর মন্দ।

    জান তো মেয়েরা কত বিচিত্র প্রকৃতির। কোনো দুজন মেয়ের প্রকৃতি এক নয়। এমনকী কোনো একজন মেয়ের প্রকৃতি সবসময় একরকম নয়। সকালে বিকালে শাড়ির রং বদলায় কেন জান? মনের রং বদলায়। এই আশ্চর্য প্রাণীকে নিয়ে প্রাণে বাঁচতে হলে সাত-সাতটা রঙের জন্যে চোখ থাকা চাই। যারা রংকানা তাদের উচিত নয় বেশি বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত থাকা। বিশ্বজিতের বাবা তার বিয়ে না দিয়ে তাকে বিলেত পাঠিয়েছিলেন এই ভরসায় যে বিশ্বজিতের নীতিবোধ নির্ভরযোগ্য। তিনি জানতেন না যে ওই ধরনের পুরুষরাই মরে সকলের আগে। মেয়েদের ওরা চিনতে পারে না। ভুল করে। ভুলের মাশুল মৃত্যু।

    বিশ্বজিতের ধারণা ছিল সেই মেয়েরাই ভালো যারা পুরুষদের সঙ্গে মেশে না। যারা পুরুষদের সঙ্গে মেশে তারা খারাপ। যারা যত বেশি মেশে তারা তত বেশি খারাপ। ওদের বাড়িতে ওরা কড়া পর্দা মানত। বাড়ির মেয়েদের সম্বন্ধে ওরা ছিল পুরোদস্তুর রক্ষণশীল। অথচ বাইজির নাচ না হলে ওদের বাড়ির কোনো উৎসব পূর্ণাঙ্গ হত না। সাদা আর কালো, ভালো আর মন্দ, এর বাইরে যে আর কোনো রং বা রীতি থাকতে পারে বিশ্বজিতের সে-শিক্ষা হয়নি দেশে থাকতে। বিদেশে গিয়ে হতে পারত, কিন্তু ওই যে বললুম তেমন কেউ ছিল না যে শেখাবে।

    বিশ্বজিৎ পাপের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল তা ঠিক। তিন বছর বিলেতে কাটিয়েও সে মেয়েদের সঙ্গে খেলা করেনি, নাচেনি, অন্যান্য পুরুষের অসাক্ষাতে কথা বলেনি। মেয়েরা পর্দা মানে না বলে ও নিজে একপ্রকার পর্দা মানত। মেয়েদের সামনে বড়ো-একটা বেরোত না, ট্রামে-বাসে, টিউব ট্রেনে গা ঘেঁষে বসত না দাঁড়াত না। ওর জন কয়েক ভক্ত ছিল, যেমন ঘোষাল। তাদের কারও সঙ্গে তরুণী বান্ধবী দেখলে ও তাকে বয়কট করত। শেষপর্যন্ত ওর ওই একমাত্র ভক্তই অবশিষ্ট ছিল। এবং সেটিও একটি ভন্ড। মাফ কোরো ঘোষাল। নয়তো হাটে হাঁড়ি ভাঙব।

    দেশে ফিরে বিশ্বজিৎ বিয়ে করলে পারত, কিন্তু ওর এক ধনুর্ভঙ্গ পণ ছিল। যতদিন-না নিজের পয়সায় মোটর কিনেছে ততদিন ও নিজেকে ওর শ্বশুরকুলের সমকক্ষ মনে করবে না। সমকক্ষ না হয়ে পাণিগ্রহণ করবে না। ও ফরেস্ট সার্ভিসে যোগ দিয়ে অসমে চাকরি নিল। চাকরির গোড়ার দিকে যে মাইনে দেয় তাতে মোটর কেনার প্রশ্ন ওঠে না। বিয়ের প্রস্তাব এলে মোটরের অভাব বলে ও সে-প্রস্তাব বানচাল করে দেয়। অবশ্য যারা মেয়ে দিতে চায় তারা মোটর দিতেও রাজি। কিন্তু তাহলে সমকক্ষতার গৌরব থাকে না।

    শিকারের শখ ওর ছেলেবেলা থেকে ছিল। ফরেস্ট অফিসার হয়ে ওটা হয়ে উঠল ওর একমাত্র শখ। বনজঙ্গল পরিদর্শন করতে গিয়ে ও শিকার করে বেড়াত মাসের মধ্যে পনেরো-বিশ দিন। যতরকম বুনো জানোয়ার ওর খপ্পরে পড়ত তাদের সহজে নিস্তার ছিল না। নিজেও বিপদে পড়ত কোনো কোনো বার। ওকে দেখলে মনে হত না যে ও ঠিক সামাজিক মানুষ। অথচ লোক অতি অমায়িক। শত্রু বলতে কেউ ছিল না ওর। কাউকে মাংস, কাউকে চামড়া, কাউকে শিং উপহার দিয়ে ও সবাইকে খুশি রেখেছিল।

    এমনসময় ওখানে শিকারের খোঁজে এলেন হায়দরাবাদের এক সামন্ত রাজা ও তাঁর রানি। এঁরা কিছুদিন থেকে শিলঙে বসবাস করছিলেন। ইউরোপে এঁরা পড়াশোনা করেছেন, ইউরোপের প্রাকৃতিক দৃশ্য এঁদের ভালো লাগে, সেদিক থেকে শিলং ভারতে অদ্বিতীয়। শিকার উপলক্ষ্যে এঁরা মাঝে মাঝে বনেজঙ্গলে ঘোরেন, ফরেস্ট বাংলোয় ওঠেন। ফরেস্ট অফিসারদের সাহায্য নেন। অফিসাররাও এঁদের সঙ্গ পেয়ে কৃতার্থ বোধ করেন। হায়দরাবাদের সামন্ত রাজাদের ধনের প্রসিদ্ধি আছে। অফিসারদের কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়ে এঁরা গলা থেকে মণিমুক্তার হার খুলে দেন। যারা নেয় না তারাও মুগ্ধ হয়ে যায়।

    বিশ্বজিৎ নিল না, মুগ্ধ হল। রাজা রানি দুজনে তাকে সনির্বন্ধ নিমন্ত্রণ জানালেন, সে যেন শিলঙে তাঁদের অতিথি হয়। বিশ্বজিৎ বার কয়েক ‘না না, তা কি হয়’ ইত্যাদি বলার পর কেমন করে এক বার ‘আচ্ছা’ বলে ফেলল। লোকটা সত্যনিষ্ঠ। ‘আচ্ছা’ যখন বলেছে তখন শিলং তাকে যেতেই হবে, ছুটি তাকে নিতেই হবে, রাজরাজড়ার অতিথি তাকে হতেই হবে, যদিও সে তাঁদের সমকক্ষ নয়। ওঁরা তাকে ক্লাবে নিয়ে গিয়ে হোমরাচোমরাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, গভর্নমেন্ট হাউসে নিয়ে গেলেন কল করতে। ওঁরা ওর পরিচয় দিলেন এই বলে যে বাঘ ভালুকের এত বড়ো শত্রু অসম প্রদেশে আর নেই। এর ফলে লাটসাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারি তাকে ধরে বসলেন তাঁর জন্যে যেন শিকারের আয়োজন করা হয়।

    বিশ্বজিৎ যখন শিলং থেকে ফিরল তখন তার অন্তরে ঝড়ের মাতন। এক এক সময় তার মনে হচ্ছে কাজটা সে ভালো করল না। রাজঅতিথি হবার মতো যোগ্যতা তার কই! তারপরে মনে হচ্ছে, যা-ই বলো এমন সৌভাগ্য আর কোনো ফরেস্ট অফিসারের হয়নি। লাটসাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারিকে গোটা দুই বাঘ মারিয়ে দিতে পারলে স্বয়ং লাটসাহেব এসে হাজির হবেন। তারপরে প্রমোশন কে ঠেকায়!

    প্রাইভেট সেক্রেটারি নিজে আসতে পারলেন না, এলেন তাঁর মেমসাহেব। আর কে এলেন শুনবে? রানিসাহেব। এবার রাজাসাহেব অন্য কাজে ব্যাপৃত ছিলেন। দুই ভদ্রমহিলার পার্শ্বচর হল বিশ্বজিৎ। তার মাথাটা একটু ঘুরে গেল। যদিও সে তাঁদের সমকক্ষ নয় তবু সে-ই একমাত্র অফিসার যাকে তাঁরা এই সম্মানের উপযুক্ত বিবেচনা করেছেন। বিদায়কালে দুজনেই তার আকাশস্পর্শী প্রশংসা করলেন। রানি তো সোজাসুজি বলে বসলেন, ‘আর কারও সঙ্গে শিকার করে আমি এমন আনন্দ পাইনি। যতদিন অসমে আছি ততদিন আর কারও সঙ্গে শিকার করব বলে মনে হয় না।’

    এসব হল সামাজিকতার অঙ্গ। কিন্তু বিশ্বজিৎ লোকটা অসামাজিক তথা সত্যনিষ্ঠ। তাই অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করল। ও বোধহয় আশা করেছিল এরপর লাটসাহেব আসবেন অরণ্যবিহারে। সেরকম কোনো খবর কিন্তু এল না। কিছুদিন আনমনা থেকে সে একাই বেরিয়ে পড়ল সফরে। একমাস তাঁবু ঘাড়ে করে নানা দুর্গম স্থলে ঘুরল। তারপরে সদরে ফিরে অবাক হয়ে গেল যখন দেখল রানি তার জন্যে সারকিট হাউসে অপেক্ষা করছেন। এবারেও রাজা সময় পাননি। কোনো মহিলাও নেই তাঁর সঙ্গে, অবশ্য পরিচারিকা বাদে।

    এ এক পরীক্ষা। বিশ্বজিৎ প্রশ্নপত্রের উত্তর খুঁজে পেল না। মাইনের টাকা তুলে, বিল মিটিয়ে, জমে ওঠা ফাইল পরিষ্কার করে দু-এক দিনের মধ্যেই আবার রওনা হল রানির সঙ্গী হয়ে। খুব যে তার ভালো লাগছিল তা নয়। একে ক্লান্ত, তার উপর সন্দিগ্ধ। যে মেয়ে পরপুরুষের সঙ্গে শিকারে যায় সে কি শুদ্ধ? সে কি নিষ্পাপ? এ কী ভীষণ পরীক্ষা তার জীবনে! এরপরে কে সহজে বিশ্বাস করবে যে সে নিজে অপাপবিদ্ধ! রানিকে ‘না’ বলার মতো মনের জোর তার ছিল না। বলতে পারল না যে পরস্ত্রীর সঙ্গে শিকার করতে যাওয়া তার বিবেকবিরুদ্ধ। কিংবা তার শরীর ভালো নেই, কোমরে ব্যথা, ডাক্তার বিশ্রাম নিতে বলেছে। অথচ সমস্তক্ষণ অশুচি বোধ করল, অপরাধী বোধ করল।

    রানি বিলেতে পড়াশুনা করেছেন, পুরুষমানুষের সঙ্গে মেলামেশায় অভ্যস্ত। বিশ্বজিৎ বিলেতে ছিল শুনে তিনি ওকে নিজের সেটের একজন বলেই ধরে নিয়েছিলেন। অন্তরঙ্গতার ছলে কখনো বলেন ‘ডিয়ার’, কদাচিৎ ‘ডারলিং’। এসব মুখের কথা, মনের কথা নয়। কিন্তু বিশ্বজিতের তো অভিজ্ঞতা নেই। সে ভাবল এসব মনের কথা। রানি কি তাহলে তার প্রেমে পড়েছেন? এ কি কখনো সম্ভব? তার মতো সামান্য লোকের সঙ্গে প্রেম! ভাবনায় পড়ল বিশ্বজিৎ। ওদিকে আবার প্রেম কথাটার ওপরে তার বিরাগ ছিল। জিনিসটা ভালো নয়। যার সঙ্গে তার বিয়ে হয়নি তার সঙ্গে প্রেম তো রীতিমতো পাপ। বিশ্বজিৎকে এই পাপের হাত থেকে রক্ষা করবে কে?

    একবার শিকার থেকে সে যখন ফিরল তখন তার অন্তরে সাগরমন্থনের মতো একটা ব্যাপার চলছিল। সেও প্রেমে পড়ল নাকি! পরস্ত্রীর সঙ্গে প্রেম! এর চেয়ে মরণ শ্রেয়। রানি চলে গেলেন বহুসংখ্যক জন্তুজানোয়ার মেরে। জানতে পেলেন না যে আরও একটি প্রাণীকেও মেরে রেখে গেলেন। এরকম আলোড়ন সে আর কখনো অনুভব করেনি। তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না যে মেয়েটা খারাপ। কিন্তু সে নিজে কোন ভালো? কী করে সে তার ভাবী বধূকে বোঝাবে যে তার হৃদয়ে লেশমাত্র অনুরাগ জন্মায়নি! নিজের ওপর তার যে অবিচল বিশ্বাস ছিল তা যেন একটু নড়ল। সে কি সত্যি সচ্চরিত্র, না সেও ডুবে ডুবে জল খায়? তার কি উচিত ছিল না রানির সঙ্গে সব সম্পর্ক ছেদ করা? কিন্তু সে তা পারল কই? রানি যখন জানতে চাইলেন, ‘আবার কবে শিলং আসছেন বলুন,’ সে উত্তর দিল, ‘আপনাদের অসুবিধা হবে।’ রানি সকৌতুকে বললেন, ‘আমরা কি বাঘ ভালুক যে আপনার জ্বালায় অসম ছেড়ে পালাব? ওয়েল, ডিয়ার। ডু কাম জাস্ট ফর এ ডে!’

    অগত্যা এক দিনের জন্যে বিশ্বজিতের শিলংযাত্রা। একদিনের জায়গায় তিন দিন হল, তবু কেউ তাকে ছেড়ে দেয় না। রাজা ডাকেন টেনিস খেলতে, রানি নিয়ে যান সমাজে পরিচয় করাতে। যে-ছেলে কোনোদিন মেয়েদের সঙ্গে মেশেনি সে রানির সঙ্গে পাশাপাশি আসনে বসে রানির মোটর চালনা দেখে ও মাঝে মাঝে স্টিয়ারিং ধরে। যে-মানুষ কোনোদিন বড়োকর্তাদের খোশামোদ করেনি সে একদিন দুপুরে সেক্রেটারিয়েটে গিয়ে ছুটির দরবার করে আসে। দিন পনেরো ছুটি না হলে নয়। সে মোটর চালাতে শিখেছে কথাটা সত্যি। যেমন সত্যি অশ্বত্থামা হত ইতি গজঃ। অথচ এটা মিথ্যা। এমন মিথ্যা যে বলতে গেলে সারা মুখ লাল হয়ে ওঠে। বুক ঢিপঢিপ করে। চোখ আপনি নত হয়। ভয় হয়, ধরা পড়ে গেছে।

    ওদিকে তার বিবেক তাকে এক মুহূর্ত ছুটি দেয় না। পনেরো দিনের ছুটি তো দূরের কথা। যে-মেয়ে পরপুরুষের সঙ্গে মোটরবিহার করে সে কি ভালোমেয়ে? কিন্তু যে-ছেলে পরস্ত্রীর সঙ্গে মোটরে করে ঘুরে বেড়ায় সেই-বা কেমন ছেলে? একদিন তো সে বিয়ে করবে। সেদিন কি তার স্ত্রী তাকে বিশ্বাস করবেন? ভবিষ্যতের জন্যে কী গভীর অশান্তির খাদ কেটে রাখছে সে! সমস্ত বিবাহিত জীবনটাই খাদে পড়ে চুরমার হবে, যদি সময়মতো ব্রেক না কষে। পনেরো দিন ছুটি নিলেও প্রত্যেক দিন সে উপায় খোঁজে পালাবার, কিন্তু পারে না পালাতে। বাইরে থেকে বাধা নেই, পাহারা নেই। কেউ তাকে ধরে রাখবে না। একবার মুখ ফুটে বললেই হল, ‘আমার কাজ পড়ে আছে। আমাকে যেতে হবে রানি।’ কিন্তু ওটুকু বলার মতো ইচ্ছাশক্তি লোপ পেয়েছিল। কিছুতেই সে মুখে আনতে পারে না ও-কথা। বাজে বকে। ভাবে মোটর চালানো তো শিখছে। এও কি একটা কাজ নয়!

    আসল কারণটা তার অবচেতন মনে নিহিত ছিল। সেখানে তার ইচ্ছাশক্তিকে অবশ করে রেখেছিল মন্ত্রশক্তি। খারাপ মেয়ে, এই দুটি শব্দের যেন একটা মন্ত্রশক্তি ছিল। উচ্চারণ করলেই মন্ত্রশক্তির ক্রিয়া শুরু হত। মনে মনে উচ্চারণ করলেও নিস্তার নেই। খারাপ মেয়ে, খারাপ মেয়ে, খারাপ মেয়ে জপ করতে করতে বিশ্বজিৎ তার নিজের অজ্ঞাতসারে মন্ত্রমুগ্ধ ভুজঙ্গের মতো পরবশ হয়েছিল। এরজন্যে দায়ী কে? দায়ী তার ওই রংকানা চোখ। যে-চোখ রামধনুর সাতটা রং দেখে না। রং বলতে বোঝে সাদা আর কালো। সাদা দেখতে না পেলে কালো দেখে।

    সে-সময় বিশ্বজিতের যদি কোনো সুহৃৎ থাকত তাহলে তাকে তার নিজের ভুলের হাত থেকে বাঁচাত। নিজের ভুলের হাত থেকে বাঁচলে পরে সে নিজের গুলির হাত থেকেও বাঁচত। কিন্তু তেমন কোনো সুহৃৎ ছিল না তার। আমি হলে বলতুম, যাকে তুমি খারাপ মেয়ে ভাবছ সে খারাপ নয়। ওটা তোমার আত্মপ্রতারণা। খারাপ মেয়ে ভেবে তুমি ওর কাছে যা আশা করছ, কামনা করছ, কোনোদিন তা পূর্ণ হবে না। বিশ্বজিৎ অবশ্য রাগ করত, অস্বীকার করত যে তার কোনো কামনা আছে। কিন্তু অস্বীকার করলে হবে কী? পুরুষ মাত্রেই অবচেতন মনের গুহায় যেসব অন্ধ কামনা নিহিত রয়েছে খারাপ মেয়ের গন্ধ পেলেই তারা চরিতার্থতার জন্যে ফাঁদ পাতে। সে যদি খারাপ মেয়ে না হয়ে থাকে তবে নিজের ফাঁদে নিজেকেই পড়তে হয়। তখন মরণ অনিবার্য, যদি-না কেউ সময়মতো উদ্ধার করে।

    শিলং থেকে ফিরে বিশ্বজিৎ সফরে বেরিয়ে পড়বে এমন সময় টেলিগ্রাম এল রানি আবার আসছেন। আতঙ্ক ও উল্লাস দুই পরস্পরবিরোধী ভাব তার বুক জুড়ে তান্ডব বাঁধিয়ে দিল। একবার সে পালাবার কথা ভাবে, পালিয়ে গিয়ে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকবে। একবার ভাবে পালিয়ে যাওয়া তো কাপুরুষের কাজ, পুরুষের কাজ বিপদের সম্মুখীন হওয়া। একবার মনে করে মিথ্যা বলাই এক্ষেত্রে সত্য বলা। পালটা টেলিগ্রাম করা উচিত আমি অসুস্থ। একবার মনে করে সাহস থাকে তো সত্য বলাই উচিত। তুমি খারাপ মেয়ে, আমি তোমার সঙ্গে শিকারে যাব না। আমার বউ রাগ করবে, যখন বিয়ের পর শুনবে।

    পালটা টেলিগ্রাম করা হল না। পালিয়ে যাওয়া হল না। স্টেশনে গিয়ে রানিকে অভ্যর্থনা করল অন্যান্য অফিসারের সঙ্গে বিশ্বজিৎ। এবারে সে স্থির করেছিল শিকারে যাবার সময় আরও দু-এক জন অফিসারকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে। তাঁরাও রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু যাত্রাকালে দেখা গেল কারও ছেলের অসুখ, কারও মেয়ের অসুখ, কারও স্ত্রীর অসুখ। অর্থাৎ কর্ত্রীর হুকুম নেই। কোনো মহিলা তাঁর স্বামীকে বিশ্বাস করে পরস্ত্রীর সঙ্গে শিকারে ছেড়ে দেবেন না। অগত্যা বিশ্বজিতের আর দোসর পাওয়া গেল না। হাতির পিঠে বসতে হল রানির সঙ্গে তাকেই। পাশাপাশি বসে অঙ্গের সুরভি পায়। কেবল সুরভি নয়, পরশ। অমন অবস্থায় পড়লে মুনিঋষিদেরও মন টলে। বিশ্বামিত্র মুনি হলেও বিশ্বজিৎ মুনির চেয়ে জিতেন্দ্রিয় হতেন না, এ আমি বাজি রেখে বলতে পারি। বিশ্বজিৎ মুনি বহুকষ্টে আত্মসংবরণ করলেন। হাতির পিঠে চড়েছ কখনো? চড়াই-উতরাই করেছ? তখন পাশের লোকটিকে পাশবালিশ বলে ভুল করা স্বাভাবিক। কখনো পড়ে যাবার ভয়ে, কখনো আচমকা ধাক্কা খেয়ে, কখনো হাতির অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে পাল্লা রেখে হেলে-দুলে কত বার যে মানুষ মানুষের গায়ে টলে পড়ে তার হিসাব নেই। এরজন্যে অবশ্য কেউ লজ্জিত হয় না। মাফ চায় না। এটা স্বাভাবিক।

    তিন

    হাল কামরা ও খানা কামরার মাঝখানের দরজাগুলো ভেজানো ছিল বলে আমরা নিশ্চিন্ত মনে গল্প শুনছিলুম। হঠাৎ মণিমোহন বলে উঠলেন, ‘সর্বনাশ! কোনার দরজাটা ফাঁক দেখছি যে!’

    ঘোষাল পা টিপে টিপে গেল দরজার কাছে। ছুটে এসে বলল, ‘মেয়েদের বিশ্বাস নেই। বিশ্বাসো নৈব কর্তব্যঃ।’

    ষড়যন্ত্র করবার সময় হাতেনাতে ধরা পড়লে যেমন চেহারা হয় আমাদের সকলের চেহারা হল সেইরকম। মুখে কথা নেই, চোখে পলক নেই, হাতের গ্লাস হাতে, কেবল চুরুটের ধোঁয়া উঠছে চিমনির ধোঁয়ার মতো অন্তরিক্ষ জুড়ে। তাহলে অন্তরাল থেকে ওঁরা সমস্ত শুনেছেন।

    ভিজে বেড়াল সেজে আমরা একে একে হাল কামরায় চললুম। আরও আগে যাওয়া উচিত ছিল, দেরি হয়ে গেছে বলে ক্ষমা প্রার্থনা করলুম। গল্পটার খেই হারিয়ে গেল বলে মনে মনে মুন্ডুপাত করলুম। কে একজন হেসে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে হাসির রোল উঠল। হালকা হয়ে গেল ঘরের আবহাওয়া।

    ‘বাস্তবিক, মেয়েরা না শুনলে গল্প বলে আরাম নেই,’ বানিয়ে বললেন প্রদোষ। ‘এরা কি গল্প শুনতে জানে, না ভালোবাসে! যে যার পানাহার নিয়ে ব্যস্ত। শুনুন আপনারা, বাকিটুকু বলে শেষ করি। আমাকে আরেক জায়গায় যেতে হবে।’

    গল্প আবার শুরু হলে আমাদের মুখের হাসি মুখে মিলিয়ে গেল। গল্পটা তো হাসির গল্প নয়। আমরা প্রত্যেকেই বুঝতে পেরেছিলুম ট্র্যাজেডির বীজ বোনা হয়েছে, যা হবার তা হবেই। সেইজন্যে আমাদের কারও মনে সুখ ছিল না।

    প্রদোষ বলতে লাগলেন—

    এতক্ষণ আমি গল্প বলছিলুম বেপরোয়াভাবে। পুরুষের কাহিনি পুরুষালি ধরনে। এখন আমাকে ভদ্রতার মুখোশ পরতে হবে। নয়তো মহিলারা মনে করবেন আমি তাঁদের গায়ে পড়ে অপমান করছি। না না, আপনারা মুখ ফুটে কিছু বলবেন না, কিন্তু গল্পের মাঝখানে উঠে চলে যাবেন। যাক, উপায় নেই। শেষ করতে তো হবে।

    বেচারা বিশ্বজিৎ! আসুন আমরা সকলে মিলে তার জন্যে চোখের জল ফেলি। আমাদের চোখের জলের তর্পণ পেলে তার আত্মা তৃপ্ত হবে। বেচারা বিশ্বজিৎ! তার সব ছিল, কিন্তু এমন একজন বন্ধু ছিল না যে তাকে সৎ পরামর্শ দিয়ে রক্ষা করতে পারত। আমি থাকলে বলতুম, আগুন নিয়ে খেলতে চাও খ্যালো, কিন্তু আগুনকে খারাপ বলে ভুল কোরো না। যে-মেয়ে খারাপ নয় তাকে খারাপ মেয়ে ভাবলে বিপদে পড়বে। এমনকী যে-মেয়ে সত্যি সত্যি খারাপ তাকেও খারাপ ভাবতে নেই। খারাপ ভাবলে খারাপ দিকে মন যাবে। কিছুতেই মনটাকে ফেরাতে পারবে না। এমনকী পালিয়ে গিয়েও বাঁচবে না। বাঁচতে যদি চাও তো জপ করো—ভালো মেয়ে, সহজ মেয়ে, স্বাভাবিক মেয়ে। তাহলে মন্ত্রশক্তি ঠিক পথে চালিয়ে নিয়ে যাবে। সে-পথ বাঁচবার পথ।

    ও যে আত্মসংবরণ করতে গিয়ে দারুণ কষ্ট পাচ্ছিল রানি তা জানতেন না, জানলে শিকারের শখ সংবরণ করে বিদায় নিতেন। তাঁর ছিল শিকারের নেশা। মনের মতো শিকারি সাথি পেলে এ নেশা যেন মিটতেই চায় না। তিনি বয়সে বড়ো। তাঁর এমন কোনো অপূর্ণ কামনা ছিল না যারজন্যে বিশ্বজিৎকে তাঁর প্রয়োজন। তিনি ভাবতেই পারেননি যে তাঁর সঙ্গে মিলেমিশে একজন বিলেতফেরত সম্ভ্রান্ত যুবক এতদূর বিভ্রান্ত হতে পারে। একথা তাঁর মনে উদয় হয়নি যে তিনি খারাপ মেয়ে বলেই সঙ্গদোষে বিশ্বজিৎও খারাপ ছেলে হয়ে উঠেছে। যা সম্ভব নয় তাকেই সম্ভব মনে করে সে কষ্ট পাচ্ছে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, আপনি ভালো তো জগৎ ভালো। তাঁর সম্বন্ধে জগৎ কী ভাবছে সেদিকে তাঁর ভ্রূক্ষেপ ছিল না।

    রানি যে রূপসি ছিলেন তা বোধহয় বলতে ভুলে গেছি। দাক্ষিণাত্যের রূপের আদর্শ উত্তরাপথের সঙ্গে মেলে না। আমরা যদি সংস্কারমুক্ত হয়ে নিরীক্ষণ করি তাহলে দাক্ষিণাত্যের রূপ আমাদের নয়নরোচক হবে। অজন্তার গুহাচিত্র কার না মনোহরণ করে! দাক্ষিণাত্যে আমি যত বার গেছি দক্ষিণী মেয়েদের রূপ আমাকে মুগ্ধ করেছে। আপনারা অমন উশখুশ করবেন না। বিয়ে যখন করব তখন বাঙালিই করব। আপাতত যে ক-দিন স্বাধীন আছি সে ক-টা দিন ত্রৈলঙ্গ ললনাদের রূপ-গান করি। যেমন কালো তাঁদের রং তেমনি কালো তাঁদের কেশ, তেমনি কালো তাঁদের চোখ, আর তেমনি কালো তাঁদের কালো চোখের কাজল। নানা রঙের ফুল তাঁদের অলকে, নানা রঙের শাড়ি তাঁদের অঙ্গে, নানা রঙের মণিমাণিক্য তাঁদের আভরণে। কালোকে পরাস্ত করার জন্যে আর সব ক-টা রং যেন চক্রান্ত করেছে। তাঁদের দেখে মনে হয় তাঁরা রঙ্গিণী। চিকনকালা বলে কৃষ্ণের যে বর্ণনা আছে তাঁদেরও সেই বর্ণনা। কৃষ্ণের মতোই আশ্চর্য তাঁদের আকর্ষণ। আমাদের রানি মহাভারতের কৃষ্ণার মতো রূপসি। কয়েকটি বিশেষণ এলোমেলোভাবে আমার মনে আসছে। উত্তপ্ত, মদির, মায়াময়, সুঠাম, বিলোল।

    থাক, আর না। রানি যদি দেখতে খারাপ হতেন বিশ্বজিৎ অতটা উদ্দীপ্ত হত না। খারাপ মেয়ে যদি দেখতে সুন্দর হয়, সুন্দর মেয়ের যদি স্বভাব খারাপ হয়, তাহলে তার যে সম্মোহন তা দুরন্ত ঘোড়ার মতো দুর্বার। বিখ্যাত ঘোড়সওয়ার বিশ্বজিৎ কত দুরন্ত অশ্বের টানে উদ্দাম হয়েছে! সে সব ছিল ফাস্ট হর্স। আর এ হল, মহিলারা মাফ করবেন, আমার বিচারে নয়, বিশ্বজিতের বিচারে ফাস্ট উওম্যান। এর যে টান তা প্রলয়ংকর।

    ফরেস্ট বাংলোয় দুজনের দুখানা ঘর। মাঝখানে খাবার ঘর দুজনের এজমালি। খাওয়াদাওয়ার পরে তারা বারান্দায় ইজিচেয়ার পেতে গল্প করত। তারপর যে যার ঘরে শুতে যেত। গল্প করতে করতে বেশ একটু রাত হয়ে যেত। রানি বলতেন, ‘ওয়েল, ডিয়ার, আমি আর জেগে থাকতে পারছিনে। কাল খুব ভোরে উঠতে হবে, মনে থাকে যেন।’ বিশ্বজিৎ বলত, ‘বেয়ারাকে বলা আছে, রাত থাকতে ডাকবে।’ তখন রানি বলতেন, ‘সুনিদ্রা হোক, সুখস্বপ্ন দেখো।’ বিশ্বজিৎ বলত, ‘তুমিও।’ রানি হেসে বলতেন, ‘আমি? আমি স্বপ্ন দেখব আমার নূতনতম বাঘকে।’ বিশ্বজিৎ আমতা আমতা করে বলত, ‘আর আমি? আমি স্বপ্ন দেখব আমার…’ কিছুতেই তার মুখ দিয়ে বেরোত না, ‘বাঘিনিকে।’ তারপর চলে যেত নিজের ঘরে।

    শিকার করতে যারা যায় তারা জানে একদিন হয়তো বাঘের হাতে জান যাবে। বিশ্বজিতেরও সে-জ্ঞান ছিল। কিন্তু সে কেয়ার করত না। এরপরে তার মনে হতে থাকল, বাঘের হাতে নয়, বাঘিনির হাতে। সে কেয়ার করল না। জীবনে তার এক সন্ধিক্ষণ উপস্থিত হয়েছিল। ভবিষ্যতের কথা সে আর ভাবতে চায় না, ভাবতে চায় শুধু বর্তমানের কথা। বর্তমানে তার কর্তব্য কী? যে সুযোগ তার মুঠোর মধ্যে এসেছে সে-সুযোগ কি ছাড়া উচিত না ভোগ করা উচিত? ভোগ করতে গিয়ে হয়তো বিয়ে করাই হবে না। আর কাউকে বিয়ে করা অন্যায় হবে। অথচ ভোগ না করে যদি হাতছাড়া করে তবে এল কেন এ সুযোগ তার জীবনে? কেন এল? কে আসতে বলেছিল? সে তো শিলং থেকে ফেরবার সময় আমন্ত্রণ জানায়নি। পরিষ্কার ভাষায় বলেছিল, গুড বাই। তা সত্ত্বেও যদি আসে তবে কেন আসে? এ কি কেবল শিকারের জন্যে আসা?

    খারাপ মেয়ে, সুন্দর মেয়ে, কেন তোমার আসা! সুন্দর মেয়ে, খারাপ মেয়ে, কেন তোমার থাকা! বেশ বুঝতে পারছি বিয়ে এ জীবনে ঘটবে না, অদৃষ্টে নেই। কেউ আমাকে বিয়ে করতে চাইবে না, যখন শুনবে আমার কীর্তিকাহিনি। আমার ভবিষ্যৎ আমি তোমার জন্যে বিসর্জন দিলুম। তুমি কি আমাকে নিরাশ করবে? নিরাশ করলেও আমি মরেছি, না করলেও মরেছি। বাঘিনির হাতেই আমার জান যাবে। তুমি যদি আমাকে শিকার কর তাহলে আমার বেঁচে থাকাও মরে থাকা!

    একদিন বিশ্বজিৎ নিজের ইজিচেয়ার থেকে নেমে রানির কোলে মাথা রেখে বারান্দার উপর পা ছড়িয়ে বসল। তিনি তার মাথা টিপে দিতে দিতে বললেন, ‘মাথা ধরেছে না পুওর ডারলিং?’ সে তাঁর একখানি হাত নিজের হাতের ভিতর টেনে নিল। তারপর কী মনে করে ছেড়ে দিল। রানি বুঝতে পারলেন এ ব্যথা মাথাব্যথা নয়, যৌবন বেদনা। এরকম যে হবে এ তিনি কল্পনা করেননি। অথচ না হওয়াই বিচিত্র। রানি তাঁর হাত সরিয়ে নেবার চেষ্টা করলেন না, পাছে বিশ্বজিৎ দুঃখ পায়। নিজের সর্বনাশ না করে বন্ধুকে যেটুকু সুখ দেওয়া সম্ভব সেটুকু দিতে তাঁর অনিচ্ছা ছিল না। তার বেশি তিনি কেমন করে দেবেন? বিশ্বজিৎ বিয়ে করে না কেন? তিনি কি বাধা দিচ্ছেন?

    এসব কথা খোলাখুলি বলে ফেললেই ভালো করতেন রানি। কিন্তু মেয়েলি লজ্জা তাঁকে নির্বাক করেছিল। ফলে বিশ্বজিৎ এক এক করে অনেক কিছু পেল। একদিনে নয়, অনেক দিনে। সব সুখ যখন পেয়েছে তখন চরম সুখ কেন বাকি থাকে? এই হল তার অনুক্ত জিজ্ঞাসা। এর উত্তরে পেল অনুচ্চারিত উত্তর। তা হবার নয়। সে বিশ্বাস করল না যে যিনি আর-সব দিয়েছেন তিনি ওটুকু দিতে পারেন না। ইচ্ছা থাকলে উপায় থাকে। ইচ্ছা নেই, তাই বলো। কী করে থাকবে, আমি তো রাজরাজড়া নই। অসমকক্ষ।

    একথা শুনে রানি বললেন, ‘তুমি যখন বিয়ে করবে তখন আপনি বুঝবে যে তোমার স্ত্রী এ জিনিস আর কাউকে দিতে পারে না। এ কেবল স্বামীর জন্যে।’

    নির্ভুল উত্তর। বিশ্বজিতের স্ত্রী যদি এ জিনিস আর কাউকে দেন তবে সে তার নিজের হাতে তাঁকে গুলি করবে। এ জিনিস তো দূরের কথা, কোনো জিনিস না। সে স্বীকার করল যে রানি যা বলছেন তা ঠিক। অথচ তার শিরায় শিরায় যে আগুন জ্বলছিল তারও তো নির্বাণ চাই। তখন তার এমন অবস্থা যে সে আর আত্মসংবরণ করতে পারে না, যদিও জানে এবং মানে তার আত্মসংবরণ করা উচিত।

    বিশ্বজিতের অভ্রান্ত বিশ্বাস ও-মেয়ে খারাপ মেয়ে। সে নিজেও কিছু কম খারাপ নয়। তাহলে তাদের দুজনের সম্পর্কের ন্যায়সঙ্গত পরিণতি কী? যেটা ন্যায়শাস্ত্রে বলে সেইটেই তো হবে। না যেটা ধর্মশাস্ত্রে বলে সেইটে?

    প্রজ্বলিত অনলে দগ্ধ হতে হতে এমন এক মুহূর্ত এল যখন না ভেবেচিন্তে বিশ্বজিৎ বলল, ‘রানি, কাল আমি বাঘশিকার করতে গিয়ে নিজেকেই গুলি করব। তুমি সে-দৃশ্য সইতে পারবে না। লোকে হয়তো তোমাকেই দোষ দেবে। সময় থাকতে তুমি সদরে চলে যাও।’

    রানি তা শুনে স্তম্ভিত হলেন। বললেন, ‘তুমি কি পাগল হয়েছ! এত তুচ্ছ কারণে কেউ আত্মহত্যা করে? চলো, তুমিও সদরে চলো। তোমাকে আমি শিলং নিয়ে গিয়ে তোমার মনের মতো একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেব।’

    বিশ্বজিৎ ও-কথা কানে তুলল না। আলটিমেটাম দিল—‘আমি যা চাই তা আজ রাত্রেই পাব, নয়তো কোনোদিন পাব না।’ কাতর স্বরে বলল, ‘এখন তোমার হাতে আমার জীবন-মরণ।’

    রানি তার মুখের দিকে তাকাতে পারছিলেন না। পায়ের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ঝরালেন। মৌনং সম্মতিলক্ষণং ভেবে সে তাঁকে কাছে টেনে নিল! তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললেন, ‘বন্ধু, তুমি কি আমার সর্বনাশ করবে? এই কি তোমার মনে ছিল?’

    বিচলিত হয়ে বিশ্বজিৎ বলল, ‘রানি, আমি কি তোমার সর্বনাশ করতে পারি? এক বার আমার দিকে তাকাও। আমাকে দেখে কি মনে হয় যে কারও সর্বনাশ করতে পারি? তুমি কাল সদরে চলে যেয়ো। আমার কপালে যা থাকে তাই হবে।’

    তিনি তার বুকে মাথা রেখে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। কিন্তু কিছুতেই তাকে দিয়ে বলাতে পারলেন না যে সেও তাঁর সঙ্গে সদরে যাবে। দুজনের একজনেরও চোখে ঘুম ছিল না। অবশেষে বিশ্বজিৎ বলল, ‘যাই, আমাকে ভোরবেলা জাগতে হবে, জীবনের শেষ ঘুম ঘুমিয়ে নিই।’

    রানি তার কপালে চুমো দিয়ে বললেন, ‘কাল আমি তোমাকে চোখে চোখে রাখব। কোথাও যেতে দেব না।’

    পরের দিন ভোর হবার আগেই বিশ্বজিৎ বেরিয়ে পড়ল জঙ্গলে। রাত্রে তার ঘুম আসেনি। সারা অঙ্গে যৌবনজ্বালা। শীতল জল এত কাছে, তবু এত দূরে। তবে কি এ জল নয়, মরীচিকা! খারাপ মেয়ে, সুন্দর মেয়ে, আমি কি তোমাকে চিনতে পারিনি? সুন্দর মেয়ে, খারাপ মেয়ে, তুমি কি আমাকে ভুল বুঝতে দিয়েছিলে? কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেছে। আমি যা মুখে বলি তা কাজে করি। তুমি সে-দৃশ্য সইতে পারবে না। বিদায়।

    রানি তাঁর প্রসাধন শেষ করে বাইরে এসে শুনলেন বিশ্বজিৎ রওনা হয়ে গেছে। তাঁর চা খাওয়া হল না। তিনি হাতির খোঁজ করলেন। হাতি ছিল তাঁকে সদরে নিয়ে যাবার জন্যে। তিনি হুকুম দিলেন, সদরে নয়, সাহেব যে পথে গেছেন সেই পথে চালাও। সে-পথ কারও জানা ছিল না। সাহেব তো কাউকে বলে যাননি। ঘুরতে ঘুরতে রানির বেলা হয়ে গেল। দূর থেকে কানে এল বন্দুকের আওয়াজ। দিকনির্ণয় করে তিনি হাতি ছুটিয়ে দিলেন। পৌঁছে দেখলেন জীবনদীপ নিভে গেছে।

    এমনি করে তার যৌবনজ্বালার অবসান হল। বেচারা বিশ্বজিৎ! রানিকে বাঁচাবার জন্যে সে একখানা চিঠি লিখে রেখে গিয়েছিল তার ঘরে। ফিরে এসে রানি সেখানা আবিষ্কার করলেন। জানিনে কী ছিল সে-চিঠিতে। রানি সেখানা কুটিকুটি করে ছিঁড়ে আগুনে ফেলে দিলেন।

    চার

    প্রদোষের জবানবন্দি শেষ হল যখন, তখন মেয়েদের সকলের চোখে জল। পুরুষদের কারও মুখে কথা ছিল না। ঘোষাল তো ছোটো ছেলের মতো গালে হাত রেখে শুনছিল। বোধহয় ভাবছিল অমন মানুষের এমন পরিণাম কি সত্যি!

    ‘সেই রানি তারপরে কী করল?’ জানতে চাইলেন মিসেস মৌলিক।

    ‘রানি তারপরে সন্ন্যাসিনী হয়ে গেলেন। তাঁর গলার গোলকোণ্ডার হিরের হার খুলে দিলেন সিভিল সার্জনের মেমসাহেবকে। তাঁর পাঁচ রকমের মণি-বসানো পাঁচ আঙুলের আংটি পরিয়ে দিলেন পুলিশ সুপারিন্টেণ্ডেন্টর মেমসাহেবকে। তাঁর প্ল্যাটিনামের ব্রেসলেট দিয়ে দিলেন ফরেস্ট কনজারভেটরের মেমসাহেবকে। তা বলে বিশ্বজিতের অধস্তন কর্মচারীদের স্ত্রীদের বঞ্চিত করলেন না। তাঁদের বিলিয়ে দিলেন নাকে ও কানে পরবার যতরকম অলংকার। আর শাড়িগুলো খয়রাত করলেন চাকরবাকরদের জানানাদের।’

    ‘তারপরে?’ প্রশ্ন করলেন মৌলিকের বোন মিসেস ঘোষাল।

    ‘তারপরে? ডেপুটি কমিশনারের তো মেমসাহেব নেই। তিনি চিরকুমার। তিনি হইচই বাধিয়ে দিলেন। তখন রানি গিয়ে মোলাকাত করলেন লাটসাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারির মেমসাহেবের সঙ্গে। খবর এল ডেপুটি কমিশনার জয়েন্ট সেক্রেটারি হয়েছেন, অযাচিত পদবৃদ্ধি।

    এরপরে মহিলাদের কৌতূহল লক্ষিত হল না। মণিমোহন বললেন, ‘সেন, তোমার ওই রানিটি মোটেই ভালোমেয়ে নয়। যা দিতে পারে না তার আশা দিয়ে ছেলেটাকে বাঁদরনাচ নাচিয়েছে। ছেলেটা যে মারা গেল তারজন্যে দায়ী তোমার রানি।’

    ‘আমার রানি! বেশ ভাই বেশ!’ প্রদোষ মহিলাদের দিকে তাকালেন। ‘কিন্তু রানি যদি খারাপ মেয়েই হত, যা দেবার নয় তাও দিত। তাহলে এই ট্র্যাজেডি ঘটত কি?’ তিনি আপিল করলেন।

    দেখা গেল রানির বিরুদ্ধে রায় দিলেন একজন কি দুজন বাদে আর সব পুরুষ। আর বিশ্বজিতের বিরুদ্ধে মহিলারা সবাই।

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরূপ দর্শন
    Next Article পরির গল্প

    Related Articles

    অন্নদাশঙ্কর রায়

    বাংলার রেনেসাঁস

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    আর্ট ও বাংলার রেনেসাঁস – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    পথে প্রবাসে ও নির্বাচিত প্রবন্ধ – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    আগুন নিয়ে খেলা – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    পুতুল নিয়ে খেলা – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    অন্নদাশঙ্কর রায়

    পুতুল নিয়ে খেলা – অন্নদাশঙ্কর রায়

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.