Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    যারা ভেবেছিল ওরা ফ্লাইওভারে ছিল – অভীক দত্ত

    লেখক এক পাতা গল্প93 Mins Read0
    ⤷

    খেলা ভাঙার খেলা

    খেলা ভাঙার খেলা

    ১।

    ঘুমের ওষুধ আছে।

    আহ!

    প্রিয়ম স্বস্তির শ্বাস ফেলল।

    সব দোকান তো দেয় না। কেউ কেউ এমন ভাবে তাকায় যেন সে ওষুধের পাতাটা কিনেই সব ওষুধ পেটের ভিতর নিয়ে নেবে। উল্টে পড়ে থাকবে। গ্যাঁজলা বেরোবে।

    ওষুধ ছাড়া কী করে ঘুমোবে সে?

    ঘুম বস্তুটাই তো একমাত্র সব কিছু ভুলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তাও যেমন তেমন ঘুম না। ঘুম হওয়া উচিত এমন, যা সব কিছু ভুলিয়ে দিতে পারে।

    ভাত ফুটছে। প্রিয়ম হাঁড়িটা নামিয়ে ফ্যান গালতে দিয়ে ঘিয়ের শিশিটা বের করল।

    এবার সমস্যাটা বুঝতে পারল।

    আগের রাতেই ঘি সবটা শেষ করে ফেলেছিল। এই জন্যই মনটা খুঁত খুঁত করছিল, “কী নেই, কী নেই” বলে।

    এর মানে তার কাছে ঘি ছিল না। আর সে ঘুমের ওষুধ নেই বলে চিন্তায় পড়ে যাচ্ছিল।

    বিস্কুট খেয়েছে অনেকগুলো সন্ধ্যায়। ভাত না খেলেও চলে।

    আলমারি থেকে টাকা বের করল।

    ফ্যান গলুক। প্রিয়ম বেরোল। পাড়ার দোকানে টিম টিম করে আলো জ্বলছে। দোকানের বাইরে বীরুদা বিড়ি ফুঁকছে। প্রিয়মকে দেখে বীরুদা বলল, “দশটা টাকা হবে নাকি ব্রাদার? খুব দরকার”।

    দশ টাকাই দিল সে। তার মনে হল, বীরুদার কাছে সে অনেক টাকা পায়। এভাবে দশ বিশ জমতে জমতে প্রচুর টাকা হয়েছে। কোন দিন শোধ দেয় না। লোকটা কেন যে এভাবে সবার থেকে টাকা ধার নিয়ে বেড়ায়, কে জানে। সারাদিন শুধু বিড়ি খাওয়া ছাড়া আর কোন কাজ নেই। বড় ধার না। কোন দিন পাঁচ, কোন দিন দশ, কোন দিন কুড়ি। এভাবে সবার কাছে বীরুদার টাকা বাড়তে থাকে। বীরুদা সবাইকেই বলে রেখেছে একদিন ঠিক শোধ করে দেবে।

    ভুটান দোকানে বসে মোবাইলে সিনেমা দেখছে। কানে হেডফোন।

    প্রিয়ম বলল, “ঘি দাও। ছোট শিশি”।

    ভুটান শুনল না।

    প্রিয়ম ভুটানের হাত ধরে নাড়াল, “ছোট শিশির ঘি দাও একটা”।

    ভুটান কেঁপে উঠল। তার দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে শিশিটা দিল।

    প্রিয়ম টাকা দিল।

    ভুটান বলল, “আর কিছু?”

    প্রিয়ম মাথা নেড়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল।

    পাড়ায় অনেক নতুন নতুন লোক এসছে। জমির দাম বাড়ছে। প্রোমোটারেরা অনেক বাড়ি চড়া দামে কিনে নিচ্ছে। প্রিয়ম অপেক্ষা করে আছে। বাপ ঠাকুরদার স্মৃতি জমিয়ে লাভ নেই। তার কাছে প্রস্তাব এলে সে নিয়ে নেবে।

    হাতে কিছু থোক টাকা এলে কয়েকটা দেশ ঘুরে আসা যাবে।

    স্বাতীর সঙ্গে বিদেশ ঘোরার লিস্ট বানাতো সে। এখনও ডায়েরীটা আছে।

    প্রথম দেশের নাম “বাংলাদেশ”।

    স্বাতী বলেছিল। ওদের বাড়ি ছিল রাজশাহী। স্বাতীর ইচ্ছা ছিল দেশের বাড়ি দেখতে যাবে।

    প্রিয়ম হাসত, বাংলাদেশ একটা ঘোরার জায়গা হল? কেন যাবে? যে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, অকারণ স্মৃতি ঘাঁটার ইচ্ছে হবেই বা কেন?

    স্বাতী অনেক কিছু বোঝাতে শুরু করত হাত পা নেড়ে। বিচ্ছেদের পর প্রিয়ম সবার আগে লিস্টে বাংলাদেশের নামটা কেটেছে।

    স্বাতী যে দেশগুলো ঘুরবে বলেছিল, সেগুলোর কোনটাই যাবে না সে।

    দরকার নেই যাবার।

    একা থাকার সমস্যাগুলো দিনের বেলা বোঝা যায় না। রাতে বোঝা যায়। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাতগুলো জটিল হতে শুরু করে।

    দরজার সামনে এসে প্রিয়ম দেখল একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। তার থেকে ছোটই হবেন। পাশের বাড়িতে নতুন ভাড়াটে এসেছে এই মঙ্গলবার। এই মহিলাকে ভুটানের দোকানে যেতে দেখেছে সে।

    প্রিয়ম বলল, “কোন দরকার আছে?”

    মহিলা বললেন, “দেখুন না, বাড়িওয়ালা কাকুরা বাইরে গেছে। আমার হাজব্যান্ডের ফোন পাচ্ছি না কিছুতেই। ওর সেই বিকেলে আসার কথা। এখনো এল না। এখন টিভিতে দেখছি একটা ফ্লাইওভার ভেঙে পড়েছে। এ পাড়ায় কাউকে চিনি না। ওকে দেখেছি আপনার সঙ্গে কথা বলতে। ওকে তো আপনি চেনেন। কী করব একটু বলবেন?”

    প্রিয়ম দেখল একবারে কথাগুলো বলে মহিলা কেঁদে ফেললেন। সে হতভম্ব হয়ে মহিলার দিকে তাকিয়ে রইল। ওর স্বামীকে সে চেনে বলতে যেটা বলছে ব্যাপারটা ঠিক সেটা না। একদিন ভদ্রলোক বেরোচ্ছিলেন, প্রিয়মকে দেখে হেসে বলেছিলেন পাড়ায় নতুন এসেছেন। লন্ড্রির দোকানটা কোথায় জানতে চাইছিলেন। সেই কথোপকথন দেখে ভদ্রমহিলা এতদূর ভেবে ফেলেছেন হয়ত।

    কী করবে? এখন কী করার থাকতে পারে? সে কী করবে? অদ্ভুত! এ মহিলা আর কোথাও যাওয়ার জায়গা পেলেন না? তার কাছেই আসতে হল?

    সে বলল, “আমি ভাতের ফ্যান গালতে দিয়েছি। আপনি কি একটু অপেক্ষা করতে পারবেন? এক কাজ করুন, আপনি তৈরী হয়ে আসুন। আমি দেখছি কী করা যায়”।

    মহিলা বললেন, “আমি তৈরী”।

    প্রিয়ম মেয়েটির ছটফটানিটা অনুভব করতে পারল। বলল, “ঠিক আছে। তাহলে পাড়ার বাকিদের খবর দিই?”

    মহিলা বললেন, “দেরী হয়ে যাবে, কাউকে চিনিও না তেমন। আমি ফোনে পাচ্ছি না ওকে। একা একা যেতে পারব না বলেই…”

    প্রিয়ম বলল, “ঠিক আছে। একটু দাঁড়ান”।

    খিদে পেয়েছিল।

    দরজা খুলে ঘরের ভিতরে ঢুকে ভাতের হাঁড়ি তুলে বাটিতে একটু ভাত তুলে ঘি মাখিয়ে দু মুঠো খেয়ে হাত মুখ ধুয়ে বাড়ির বাইরে এসে দরজায় তালা দিয়ে বলল, “চলুন”।

    মহিলাটি তার দিকে একটা ব্যাগ এগিয়ে দিলেন, “এখানে হাজার পাঁচেক টাকা আছে। যদি লাগে…”

    প্রিয়ম বলল, “ব্যাগটা আপনার কাছেই রাখুন। লাগলে নিচ্ছি”।

    তারা হাঁটতে শুরু করল।

    বীরুদা দোকানের সামনেই বিড়ি খাচ্ছিল। তাদের দেখে পিটপিট করে তাকাল।

    প্রিয়ম কিছু বলল না। ভদ্রমহিলা যেভাবে টেনশন করছেন, তাতে এখানে কিছু ব্যাখ্যা করতে দাঁড়ানোর অর্থ হল সময় নষ্ট করা।

    হাঁটতে হাঁটতে তারা বড় রাস্তায় এল।

    কয়েকটা ট্যাক্সি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

    ট্যাক্সি পাওয়া গেল যাওয়ার জন্য।

    ভদ্রমহিলা অস্থির হচ্ছিলেন। প্রিয়ম বুঝতে পারছিল সেটা। বলল, “আপনার বর কোথায় কাজ করেন?”

    ভদ্রমহিলা বললেন, “এসপ্ল্যানেডে। আমি সবটা জানি না”।

    প্রিয়ম বললেন, “আপনার শ্বশুরবাড়িতে কাউকে কিছু বলেছেন?”

    ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন, “কিছু বললেই ওরা বলে আমি বেশি চিন্তা করছি”।

    প্রিয়ম বলল, “তবু বলে রাখা ভাল”।

    ভদ্রমহিলা তার দিকে তাকালেন, “আগে খোঁজ পাই। আসলে আমাদের বিয়েটা ওরা ভাল চোখে দেখেন নি। অনেক কমপ্লিকেশন আছে”।

    প্রিয়ম বলল, “ওহ”।

    প্রিয়ম ঘড়ি দেখল। পৌনে দশটা বাজে।

    এলাকায় শহর বাড়ছে, একটার পর একটা ফ্ল্যাটবাড়ি উঠছে। তবু এখনও দশটা মানে এখানে রাতই।

    স্বাতী কী করছে এখন? বরের জন্য রান্না করে বসে আছে? এক একটা রাত এরকম অদ্ভুতভাবে আসে, গোটা দিন কীভাবে কেটেছে বোঝা সম্ভব হয় না। প্রিয়মের মাথাও তো আগের মত কাজ করে না। ধোঁয়া ভরে থাকে যেন মাথায়। এই ভদ্রমহিলা তার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছেন। ঠিক কী কী করা যেত? থানায় গেলে হত? যদি অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে থাকে… সে জিজ্ঞেস করল, “কখন ফ্লাইওভারটা ভেঙেছে?”

    ভদ্রমহিলা বললেন, “সন্ধ্যে সাতটায়”।

    প্রিয়ম আবার ভাবতে শুরু করল।

    রিহ্যাবে থাকাকালীন বেশি ভাবতে পারত না সে। কিছুই মাথায় আসত না। এখন যেটুকু আসছে, তাতে মনে হচ্ছে ভদ্রমহিলার স্বামীকে খুঁজতে সবার আগে অকুস্থলে যাওয়া দরকার। সেখানে গিয়ে খোঁজ নিতে হবে।

    ভদ্রমহিলা ট্যাক্সিতে উঠেই বললেন, “যেখানে ফ্লাইওভারটা ভেঙেছে, সেখানে চলুন”।

    ট্যাক্সি ড্রাইভার ক্যাব স্টার্ট করে লুকিং গ্লাসে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “ওখানে কেউ আটকে আছে নাকি?”

    ভদ্রমহিলা বললেন, “আমার হাজব্যান্ড। বাড়ি ফেরেনি। ফোনেও পাচ্ছি না”।

    ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল, “অনেক লোক চাপা পড়ে আছে শুনেছি”।

    ভদ্রমহিলা অনেক কষ্টে নিজেকে সামলেছিলেন এতক্ষণ। এবার কাঁদতে শুরু করলেন।

    প্রিয়ম কিছু বলল না। সে জানলার বাইরে তাকাল।

    তার মত রিহ্যাব ফেরত পাবলিক নিয়ে একজন নিখোঁজ মানুষের খোঁজ করতে বেরিয়েছেন ভদ্রমহিলা।

    ব্যাপারটা ভাবলে হাসি পাচ্ছে। এখন হাসা সম্ভব না।

    এটুকু বোঝার মত বুদ্ধি তার এখনো অবশিষ্ট আছে।

    ২।

    গাড়িতে এফ এম চলছে। হেল্পলাইন নাম্বার দেওয়া হয়েছে সরকারের তরফে। কত মানুষ আটকে আছে, এফ এমের আর জে নিজেও বুঝতে পারছে না। শহর জুড়ে হাহাকার যে শুরু হয়েছে, সেটা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে।

    বেশ কিছুক্ষণ কেঁদে ভদ্রমহিলা চুপ করে বসেছিলেন পাথরের মত। প্রিয়ম বলল, “এই হেল্পলাইনে ফোন করতে পারেন তো”।

    ভদ্রমহিলা তার দিকে বিহ্বল চোখে তাকালেন।

    প্রিয়ম বলল, “ঠিক আছে, আপনার স্বামীর নাম বলুন”।

    ভদ্রমহিলা বললেন, “সৌমিক দাস। আমার নাম অরুন্ধতী দাস। আপনি আমার হয়ে ফোন করে দেবেন?”

    হেল্পলাইনের নাম্বার বার বার এফ এমে বলছিল। প্রিয়মের তাও মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল।

    সমস্যাটা মনঃসংযোগের। কিছুতেই মনটা এক জায়গায় আসে না। এক জায়গায় না এলে দশ ডিজিটের নাম্বার মনে রাখা বড় সমস্যার ব্যাপার।

    মোবাইল বের করে তিন বার শোনার পরে দশটা ডিজিট পর পর লিখতে পারল প্রিয়ম। ডায়াল করতে এনগেজ টোন আসতে শুরু করল।

    প্রিয়ম বলল, “এনগেজ আসছে”।

    ড্রাইভার বলল, “পাবেন না দাদা। কতজন চেষ্টা করছে বলুন তো? আমার পরিচিত একজনেরও খোঁজ পাচ্ছি না। আমাদের সঙ্গেই ক্যাব চালায়। ওদিকেই ছিল। উপরের স্ল্যাবসুদ্ধ নিচে পড়েছে বলছে তো। খবর দেখছিলাম। ও দেখা যায় না”।

    প্রিয়ম চেষ্টা করে যেতে লাগল। পাওয়া যাচ্ছে না।

    হঠাৎ মনে হল, তার সঙ্গে স্বাতীর বিয়ে হলে ভদ্রমহিলার জায়গায় স্বাতী থাকলে এভাবেই চিন্তা করত? এখন ওর বরের জন্যও এভাবেই চিন্তা করে হয়ত। এই স্বামীর জন্য চিন্তায় ঠিক কতখানি ভালোবাসা আর কতখানি নিরাপত্তাহীনতা থাকে? যে মেয়ে চাকরি করে না, যার টাকার উৎস তার স্বামীর টাকা, সেখানে নিরাপত্তাহীনতা তো আসবেই।

    এতটা ভেবে প্রিয়ম নিজেই চমৎকৃত হল। এতটা সে নিজে ভাবল? মাথা খুলছে তাহলে? এটা কি বাইরে বেরনোর ফলে হল? ঘরে থাকার জন্যই তাহলে তার মাথা কাজ করছিল না।

    আরো খানিকটা ভাবার চেষ্টা করল সে। যে খানে ফ্লাইওভারটা ভেঙেছে, সেই থানায় যদি ফোন করা যায়? সে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, “ওটা কোন থানার মধ্যে পড়ছে?”

    ড্রাইভার থানার নাম বলতে প্রিয়ম থানার নাম্বার সার্চ করে সে নাম্বারে ফোন করল।

    ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল, “নমস্কার। বলুন”।

    প্রিয়ম বলল, “আমার এক রিলেটিভকে খুঁজে পাচ্ছি না। সম্ভবত ফ্লাইওভার ভেঙে পড়ার সময় ওদিকে ছিলেন। কোন খোঁজ পাওয়া যাবে স্যার?”

    “আপনি হেল্প লাইনে ফোন করুন”। ও পাশ থেকে যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

    প্রিয়ম বলল, “পাচ্ছি না তো। কিছুতেই পাচ্ছি না”।

    “ঠিক আছে। নাম বলুন আর আপনার ফোন নাম্বার দিন। খোঁজ পেলে জানাচ্ছি”।

    প্রিয়ম ভদ্রমহিলার স্বামীর নাম আর নিজের ফোন নাম্বার দিয়ে ফোন কাটল।

    ড্রাইভার বলল, “কী হচ্ছে অবস্থা দাদা। আমরা বাড়ি থেকে পেটের দায়ে বেরোচ্ছি। ফিরবো নাকি কেউ জানি না। ফ্লাইওভার ভেঙে পড়ছে, ভাবা যায় বলুন?”

    প্রিয়ম চোখ বুজল।

    অন্য দিন ঘুমের ওষুধ খেয়ে এতক্ষণে ঘুমের জন্য বিছানায় এপাশ ওপাশ শুরু হয়ে যেত। এখন ওষুধ না খেয়েও ঘুম আসছে।

    জ্যাম লেগেছে রাস্তায়। মারাত্মক জ্যাম।

    ড্রাইভার বলল, “দেখুন দাদা। এখনো পাঁচ কিলোমিটার বাকি। এখান থেকেই কী ঝামেলা শুরু হয়ে গেল বলুন”।

    অরুন্ধতী প্রিয়মের দিকে তাকাল, “আমরা নেমে যাই? পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে চলে যাব না হয়”।

    ড্রাইভার বলল, “লাভ নেই দিদি। অনেকটা রাস্তা। বসুন। অধৈর্য হবে না। ধীরে ধীরে ঠিক জ্যাম ছেড়ে দেবে”।

    ভদ্রমহিলা উশখুশ করতে লাগলেন।

    মানিব্যাগে পুরিয়া থাকত। খানিকটা টেনে নিলে শান্তি মনে হত। প্রিয়মের হঠাৎ মনে হতে লাগল এই সময় পুরিয়া ভীষণ কাজে দিত। রিহ্যাবে তাদের সকাল বিকাল কাউন্সেলিং করা হত। বোঝানো হত ড্রাগস কত খারাপ জিনিস। ছটফট করত প্রথম প্রথম। মায়ের টাকা জমানো থাকত ঠাকুরের পিছনে। সেখান থেকেও সে টাকা নিয়ে ড্রাগস কিনত একটা সময়। ওখানে গিয়ে দেখা গেল, সে একা নয়। অনেকেই তার মত ড্রাগস নিয়ে গিয়ে এভাবে চুরি করত। কেউ কেউ ছিনতাইও করেছে। নেশাটার জন্য সব কিছু করতে পারে মানুষ। খুনও। এই নেশা ছাড়তে বড় কষ্ট করতে হয়েছে তাকে।

    অতীতকে ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলা সম্ভব না। তাহলে জীবনে স্বাতী আসার পরের সময়টা সবটুকু ইরেজার দিয়ে মুছে দিত প্রিয়ম। মাথার ভিতরে পাউডারটার দাপাদাপি স্বাতীকে ভুলিয়ে দিতে পেরেছিল খানিকটা। রিহ্যাব থেকে ফিরে স্বাতী বার বার আসে। ওর কথা মনে পড়ে। নিজেকে সামলায় অনেক কষ্টে। সামলানোটাই আসল। সেটাই বলতেন মনোবিদ। আত্মনিয়ন্ত্রণ। এর থেকে বড় আর কিছু হতে পারে না।

    ট্যাক্সিটা খুব ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ হচ্ছে, মানুষ ফুটপাথ ধরে দৌড়চ্ছে দিশেহারা হয়ে। এরকম ভিড় তো দুর্গাপুজোর সময়েও থাকে।

    মানুষ মরে গেছে ফ্লাইওভারে চাপা পড়ে? কী সাংঘাতিক। অত বড় কিছু কারো মাথার উপর এসে পড়লে সে বাঁচবে কী করে? বেঁচে থাকা তো সম্ভব নয়। কিছুতেই নয়। এভাবেই মানুষ মারা যায় তাহলে? সেও তো কতভাবে মরে যাবার চেষ্টা করেছে এক কালে। হয় নি। মরতে ভীষণ সাহসের দরকার হয়। অত সাহস তার নেই। অনেক হিসেব করে দেখেছে স্বাতীর থেকে সে আদতে নিজেকেই বেশি ভালবাসে। স্বাতী চলে যাবার পর তার কষ্টটা যত না স্বাতী চলে যাবার জন্য হয়েছে, তার ঢের বেশি হয়েছে নিজের ইগোর পরাজয়ের জন্য। সে ভাবতেই পারে নি, তাকে স্বাতী ছেড়ে দিতে পারে। সে ভেবেছিল স্বাতী আর তার সম্পর্ক ভাঙবেই না। ঝগড়া, মন কষাকষি তো সব সম্পর্কে হয়। তাদের সম্পর্কেও হয়েছিল।

    একদিন যে স্বাতী আর সত্যিই ফিরবে না, সে বোঝে নি। এই ভদ্রমহিলার স্বামী যদি সত্যিই মারা যান, তাহলে ইনি কী করবেন? প্রিয়মের হঠাৎ অস্থির লাগতে শুরু করল। ওই লোকটা আমার কেউ না বলে তার জন্য চিন্তা করব না, চিন্তা করার কী দরকার, এই সব সে কোন কালে ভাবতে পারে না। এখন আরো পারছিল না।

    আচ্ছা, এটা কি কোন স্বপ্ন? না। নিশ্চয়ই স্বপ্ন নয়। স্বপ্নে তো স্বাতী আসে। তার সঙ্গে কখনো তুমুল ঝগড়া হবে, কখনো তারা খুব স্বাভাবিকভাবে সংসার করবে। স্বাতী তাকে জিজ্ঞেস করবে বাজার যাবে নাকি। মাছ আনতে হবে। ঘরে কোন খাবার নেই। এখানে স্বাতী নেই। তার মানে এটা কিছুতেই স্বপ্ন না।

    লেংড়ে লেংড়ে আরো খানিকটা যাবার পর গাড়ি এবার সত্যিই দাঁড়িয়ে পড়ল। পুলিশ ব্যারিকেড করে দিয়েছে।

    ট্যাক্সি চালক হতাশ গলায় বলল, “দাদা, আটকে দিয়েছে”।

    প্রিয়ম বলল, “ঠিক আছে”।

    ট্যাক্সি চালক বলল, “ফিরবেন কী করে দাদা?”

    শহরে এখনো মানুষের জন্য মানুষ ভাবে তাহলে!

    ৩।

    তারা ফুটপাথ ধরে হাঁটছে। কাতারে কাতারে মানুষ হাঁটছে। কেউ কাঁদছে। কেউ বিহ্বল হয়ে দৌড়চ্ছে। কতজনের কাছের মানুষ আজ বাড়ি ফেরে নি।

    অরুন্ধতী যতটা পারে জোরে হাঁটছে। প্রিয়ম হাঁটতে হাঁটতে চারদিক দেখছে। পুলিশ এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। ছয়লাপ হয়ে গেছে পুলিশে। অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ যেন মাথায় এসে মারছে। গ্যাস কাটার মেশিন নিয়ে ভ্যান যাচ্ছে। মাথার উপরের আকাশ ভেঙে পড়েছে। নাহ, আকাশ তো কংক্রিট হয়ে গেছিল। সে কংক্রিট ভেঙে এখন মানুষকে টেনে বের করতে হবে।

    মিডিয়ার লোকেরা পথ চলতি মানুষদের দিকে বুম এগিয়ে দিচ্ছে। তার দিকেও একজন এগোল, “আপনার কেউ আছে ফ্লাইওভারের ওদিকে? কেউ ছিল?”

    প্রিয়ম যন্ত্রের মত চোখে মিডিয়ার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার কেউ নেই। এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই”।

    মেয়েটা প্রিয়মকে কৌতূহলী আরেকজন মানুষ ভেবে ছেড়ে দিল। অরুন্ধতীর দিকে বুমটা এগিয়ে দিল।

    অরুন্ধতী বলল, “আমার স্বামী আছেন। নাম সৌমিক দাস। চেনেন ওকে? আমি ওর ফোন পাচ্ছি না। বাড়িতে ফেরে নি। চেনেন?”

    মিডিয়ার মেয়েটা উৎসাহ পেল। অরুন্ধতীকে বলল, “একটু দাঁড়িয়ে যাবেন? একটা বাইট নেবো আপনার”।

    অরুন্ধতী আবার বিহ্বল চোখে প্রিয়মের দিকে তাকাল।

    প্রিয়ম অরুন্ধতীর কনুই ধরে টান দিয়ে সামনের দিকে এগোতে থাকল।

    মিডিয়ার মেয়েটি পেছন পেছন আসছে, “শুনুন না, বেশিক্ষণ নেবো না। জাস্ট পাঁচ মিনিট। একটা এক্সক্লুসিভ নিউজ করতে হবে। আপনারা চাইলে আমরা পে করতে পারি”।

    প্রিয়ম এগোতে থাকল।

    মেয়েটা আরেকজনকে ধরেছে। মানুষের কান্না প্রাইম টাইমে টি আর পি বাড়াতে খুব উপযোগী। আরবে উটের দৌড়ে বস্তায় বেঁধে শিশুদের রাখা হয়। শিশুরা যত কাঁদে। উট ততো জোরে দৌড়োয়। এই টি আর পির খেলা এখন তাই হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ যত কাঁদবে, যত কষ্ট পাবে, তত নিউজ এক্সক্লুসিভ হবে। ততো টি আর পি বাড়তে থাকবে।

    ফ্লাইওভারের ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ল এতক্ষণে। প্রিয়ম থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

    কী ভয়ংকর! কী ভয়ংকর!

    মিডিয়া, পুলিশ, নেতা গিজগিজ করছে। গ্যাস কাটার দিয়ে কংক্রিটের চাই কাটা হচ্ছে। একটা বাসের একপ্রান্ত থেবড়ে গেছে। বেশ কয়েকজন মানুষকে উদ্ধার করা হয়েছে। তারা রাস্তার একদিকে পড়ে আছে। রক্তাক্ত দেহ।

    কেউই যেন মানুষ না। মাংস পিণ্ড!

    প্রিয়ম রাস্তায় দাঁড়িয়ে বমি করে ফেলল।

    যতটুকু ভাত খেয়েছিল ঘি দিয়ে, বেরিয়ে গেল।

    অরুন্ধতী দৌড়েছে। যে মাংস পিণ্ডগুলো পড়ে আছে, তাদের জামা দেখছে। নাহ, কাউকে চেনা লাগছে না। এক শিশুও আছে। অরুন্ধতী কিছু ভাবতে পারছে না। সে শুধু তার বরকে খুঁজছে।

    একজন পুলিশ অরুন্ধতীর দিকে এগিয়ে এলেন, “কাউকে খুঁজছেন?”

    অরুন্ধতী বলল, “আমার হাজব্যান্ড। এসপ্ল্যানেড চাকরি করে। ঘরে ফেরে নি। ফোনেও পাচ্ছি না। খুঁজছি”।

    একজন স্বেচ্ছা সেবিকা এগিয়ে এসে অরুন্ধতীকে ধরল।

    অরুন্ধতী বলল, “আমার স্বামীর নাম সৌমিক। লাল স্ট্রাইপ দেওয়া জামা পরে বেরিয়েছিল। দেখুন না এখানে আছে নাকি”।

    পুলিশ ভদ্রলোক বললেন, “অনেককেই হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখানে আমরা ক্যাম্প করেছি। আপনি বসুন। লিস্ট মিলিয়ে দেখে আমরা জানাচ্ছি”।

    অরুন্ধতী দিশেহারা চোখে চারদিকে দেখতে লাগল। প্রিয়মকে দেখে স্বেচ্ছা সেবিকার নাগাল থেকে বেরিয়ে ছুট লাগাল, “ওরা বলছে খুঁজছে”।

    প্রিয়ম পকেটে রুমাল পেল।

    মুখ মুছে বলল, “ঠিক আছে, অপেক্ষা করা যাক”।

    স্বেচ্ছাসেবিকা এসে প্রিয়মকে বলল, “আপনারা প্লিজ ক্যাম্পে এসে বসুন। সি এম আসবেন। এখানে অযথা ভিড় করবেন না”।

    অরুন্ধতী বলল, “ওর বাড়ির কেউ আছে কি? তাহলে উনি বুঝবেন কী করে আমার ভিতরে কী যাচ্ছে?”

    স্বেচ্ছাসেবিকে অরুন্ধতীকে বলল, “প্লিজ। আমার সঙ্গে আসুন। আসুন আপনারা”।

    চেয়ার পেতে রাখা হয়েছে রাস্তার একপাশে। তাদের বসানো হল। জলের পাউচ দেওয়া হল।

    প্রিয়ম দাঁত দিয়ে পাউচ ফুটো করে অনেকটা জল খেয়ে নিল ।

    অরুন্ধতী আবার তার বরের ফোন ট্রাই করে বলল, “আন অ্যাভেলেবল বলছে। আমাকে যেতে দেবে না ওই জায়গাটায়?”

    প্রিয়ম দেখল গোটা জায়গাটা আটকে দিয়েছে পুলিশ।

    সে বলল, “বসুন। এখানে অপেক্ষা করুন। দেখা যাক”।

    অরুন্ধতী শূন্য চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইল।

    ৪।

    কলেজ লাইফের নেশা আর তার পরবর্তী জীবনের নেশার মধ্যে অনেক তফাৎ থাকে।

    কলেজ জীবনের নেশা হয় নিজের বাহাদুরি দেখানোর জন্য। খানিকটা সঙ্গ দায়ী থাকে, আর অনেকখানি দায়ী থাকে হঠাৎ ছাড়া গরু হয়ে যাওয়াটা।

    প্রিয়ম কলেজ জীবনে কখনো মদ ছোঁয় নি। ড্রাগস নেয় নি। সিগারেট অবধি ছোঁয় নি।

    স্বাতী ছেড়ে দেওয়ার পর এসব শুরু হয়ে গেল।

    ভেবেছিল নেশা করলে সব ভুলে যাওয়া যায়। আদতে দেখা গেল, নেশায় ব্যথার তীব্রতা অনেক বেড়ে যায়। মাঝখান দিয়ে তৈরী হয়ে যায় এক মারাত্মক অভ্যাস। ড্রাগস না নিলে হাত পা কাঁপতে থাকে, সব কিছু ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করে।

    মানুষ মরণশীল। ড্রাগের নেশা নয়।

    ড্রাগ নেওয়ায় কোন বাহাদুরি নেই।

    আছে শুধু সুস্থ স্বাভাবিক জীবনকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেওয়ার উপায়।

    অ্যাম্বুলেন্স একটার পর একটা দেহ নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবার অরুন্ধতী উঠে যাচ্ছিল।

    প্রিয়মকে একজন স্বেচ্ছাসেবক কানে কানে এসে বলে গেল, “ওকে সামলান। আপনি যখন এসেছেন আপনাকেই সামলাতে হবে”।

    প্রিয়ম কী করবে বুঝতে না পেরে অরুন্ধতীর হাত ধরল। অরুন্ধতী বাধা দিল না।

    ঠান্ডা, বরফ শীতল একটা হাত। ভালোবাসাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে আতঙ্কগ্রস্থ একটা হাত।

    প্রিয়ম বলল, “আপনি বসে থাকুন। উঠে যাবেন না বার বার। আপনার স্বামীর খোঁজ পাওয়া গেলে ওরা ঠিক জানাবে”।

    অরুন্ধতী মাথা নাড়ল, “ঠিক আছে”।

    প্রিয়ম বলল, “আপনার শ্বশুরবাড়ির লোক আপনাকে মেনে নেয় নি?”

    অরুন্ধতী বলল, “না। ওদের অন্য মেয়ে পছন্দ ছিল”।

    প্রিয়ম বলল, “তবু, এখন মনে হয় ওদের জানানো দরকার”।

    অরুন্ধতী বলল, “আজ রাতটা যাক, কোন খবর না পেলে কাল সকালে জানাবো”।

    প্রিয়ম অরুন্ধতীর হাত ছাড়ল। এভাবে ধরে থাকাটা ঠিক সমুচীন মনে হচ্ছে না। প্রেম করার সময় সে মেট্রোতে কিংবা অটোতে কোন মেয়ের পাশে বসলেও তার প্রাণান্তকর চেষ্টা থাকত সে মেয়েটার ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলার। তার মনে হত মেয়েটাকে ছুঁলে স্বাতীকে ঠকানো হবে। স্বাতীকে এই কথাটা বলার পরে স্বাতী খুব হেসেছিল।

    এখন তো স্বাতী নেই। তবু প্রিয়মের মনে হল, অরুন্ধতী বিবাহিত। এতে সৌমিককে ঠকানো হবে। মাইকিং শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে।

    প্রিয়ম চোখ বন্ধ করল। মানুষের প্রাণের দাম দিন দিন শস্তা হয়ে যাচ্ছে।

    কী করে সব ঠিক হয়ে যাবে? এভাবে তো কিছু ঠিক হয় না।

    হওয়া সম্ভবও না। যে মানুষগুলো চাপা পড়ে মারা গেছে কিংবা যারা এর ফলে বিকলাঙ্গ হয়ে যাবে চিরদিনের মত, তাদের পরিবার বা তারা কীভাবে ঠিক হয়ে যাবে?

    এত সহজ না সব কিছু।

    একের পর এক মানুষ আসছে। এখন তারা যেখানে বসে আছে, অতটা অবধিও পুলিশ আসতে দিচ্ছে না। তার আগেই ব্যারিকেড করে দিয়েছে। যারা আছে, তাদেরকেও সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ তাদের কাছে এসে বলল, “আপনারা ওদিকে চলে যান। এখানে ভিড় করবেন না। আমরা খোঁজ পেলে জানাচ্ছি”।

    অরুন্ধতী আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল, প্রিয়ম বলল, “আপনি চলুন। ওদের কথাটা শোনা যাক। তর্ক করলে সমস্যা বাড়বে”।

    অরুন্ধতী পড়ে যাচ্ছিল। প্রিয়ম বুঝল টেনশন নিতে পারছে না আর। স্বেচ্ছাসেবকরা এসে অরুন্ধতীকে ধরল।

    চেয়ারে বসানো হল।

    জল দেওয়া হল।

    পুলিশ এসে আরেকবার তাড়া দিচ্ছিল, অরুন্ধতীর অবস্থা দেখে তাদের ছাড় দিল।

    আশে পাশের বাড়ি থেকে অসংখ্য কৌতূহলী চোখ সব কিছু দেখছে। নিউজ চ্যানেলেও নিশ্চয়ই সর্বত্র দেখানো শুরু হয়েছে। যাদের বাড়ির কেউ এর মধ্যে নেই, তারা কত ভাল আছে! নাকি আদৌ কেউ ভাল নেই?

    নিজেরা এতটা খারাপ আছে যে অন্যের খারাপ থাকাটা উপভোগ করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

    একজন নেতাগোছের মানুষ এসে হম্বি তম্বি করতে করতে স্পটে রওনা দিল।

    অরুন্ধতী সেটা দেখে বলল, “ওই তো, উনি যেতে পারলে আমি কেন পারব না?”

    প্রিয়ম বলল, “আপনি বসুন। আমি দেখছি”।

    অরুন্ধতী মাথায় হাত দিয়ে বসল।

    প্রিয়মও বসল। অরুন্ধতীকে গ্লুকোজ জল দেওয়া হল।

    অরুন্ধতী একটু খেয়ে রেখে দিল।

    প্রিয়ম বলল, “আপনি খেয়ে এসেছেন?”

    অরুন্ধতী বলল, “কী করে খাই? ও ফিরলে আমরা খেয়ে নি”।

    প্রিয়ম নিজের মনেই হাসল। এমনই তো কথা ছিল তাদের। সারাদিন যেখানেই থাকুক, রাতের খাবারটা সে আর স্বাতী একসঙ্গে খাবে। এদের সব কিছু ঠিক ঠাকই চলছিল। তা সত্ত্বেও তারা এখানে!

    একজন অফিসার এলেন। অরুন্ধতীকে বললেন, “আপনার হাজব্যান্ডের কোন আইডি প্রুফ এনেছেন?”

    অরুন্ধতী মাথা নাড়ল, “তাড়াহুড়োয় কিছু আনতে পারি নি। ওর নাম সৌমিক। লাল স্ট্রাইপ দেওয়া জামা পরেছিল”।

    অফিসার বললেন, “আমাদের লিস্টে এই নামে কেউ হসপিটালাইজড হন নি। আচ্ছা, আপনি একটু শুনুন”।

    অফিসার প্রিয়মকে ডাকলেন।

    অরুন্ধতী উঠতে যাচ্ছিল। অফিসার বললেন, “আপনি একটু বসুন। ওর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে”।

    অরুন্ধতী বসে দু হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢাকল।

    অফিসার প্রিয়মকে আলাদা করে সরিয়ে নিয়ে বললেন, “আপনি ওর কে হন?”

    প্রিয়ম বলল, “প্রতিবেশী। মানে চিনিও না। পাড়ায় ওরা নতুন এসেছেন। আজকেই আমাকে ডেকে নিয়ে এলেন। পাড়ায় কাউকে চেনেনও না ভদ্রমহিলা”।

    অফিসার বললেন, “দেখুন আমার মনে হয় আপনি ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যান। আপনারা কনট্যাক্ট নাম্বার দিয়ে যান। খবর পেলে জানাব। এখানে একটা মেস তৈরী হয়েছে। এই মেস কন্ট্রোল করা অসম্ভব। মন্দিরের সামনে একটা চাইয়ের তলায় একটা বাস চাপা পড়েছে। ওদিকে মনে হয় না কেউ বেঁচে আছে। শুধু শুধু এই পরিস্থিতিতে থাকলে উনি নার্ভাস হয়ে পড়বেন। আপনি বুঝতে পারছেন আমি কী বলতে চাইছি? সি এম নিজে দাঁড়িয়ে থেকে পরিস্থিতি দেখছেন অন্য দিকটায়। এখানে র‍্যাফ নামবে। ঝামেলায় কেন থাকবেন। মানুষ বেঁচে থাকলে ঠিকই খবর পাওয়া যায়, তাই না?”

    প্রিয়ম অরুন্ধতীর দিকে তাকাল। কেঁপে উঠছে থেকে থেকে। সে বলল, “বুঝতে পেরেছি অফিসার। সমস্যা হল ভদ্রমহিলাকে নিয়ে যাওয়াটা। আমার মনে হয় না উনি রাজি হবেন। জোর করলে সমস্যা বাড়তে পারে”।

    অফিসার বললেন, “আমি গাড়ির ব্যবস্থা করছি। উনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন এখানে থাকলে। প্লিজ আপনি দেখুন”।

    প্রিয়ম কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, “ঠিক আছে”।

    ৫।

    ড্রোন ক্যামেরা নিয়ে আসা হয়েছে। পুলিশের কুকুর নেমেছে। যত রাত বাড়ছে, ব্যারিকেডের বাইরে মানুষের ভিড় বাড়ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এসেছেন।

    বিরোধীরা সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্লোগান তুলছেন।

    প্রিয়ম চেয়ারে চোখ বুজে বসে ছিল।

    কত মানুষ আছে, সব অবস্থাতেই চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। সে এই ধরণের মানুষদের হিংসা করে। এটা এক দারুণ গুণ।

    প্রিয়ম পারে না। কয়েক সেকেন্ড পর পর চোখ খুলে যাচ্ছে। দুঃসহনীয় এক রাত পেরোচ্ছে ঢিমে তালে।

    অরুন্ধতী এক দৃষ্টিতে উদ্ধার কাজ দেখে যাচ্ছে। এ জায়গাটা জনবহুল। এরকম জায়গায় নির্মীয়মাণ ফ্লাইওভারের তলায় প্রচুর ছোট ছোট চায়ের দোকান বসে। আশ্রয়হীন মানুষেরা রাতে এখানেই শোয়। সেসব লোকেরাও এদিক সেদিক এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে পুলিশের তাড়া খেয়ে। গোটা এলাকাটা হাই অ্যালার্টে চলে গেছে। এক মহিলার স্বামীকে উদ্ধার করা গেছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দুজন পুলিশের কাঁধে ভর দিয়ে ভদ্রলোক ফিরলেন। হাউমাউ করে কাঁদছেন ভদ্রমহিলা। বেঁচে থাকা এতটা সুখকর? কারো বেঁচে থাকা মানুষের কাছে এতটা প্রয়োজনীয় হয়?

    প্রিয়ম ফ্যালফ্যাল করে দেখছিল।

    অরুন্ধতী জল খেল। তাকে বলল, “আচ্ছা ওরা তো ওর নাম জানে না। হয়ত উদ্ধার করেছে এমন অবস্থায়, কথা বলতে পারছে না। হতে পারে না? বলুন?”

    প্রিয়ম বলল, “হ্যাঁ, হতেই পারে। আচ্ছা আপনার বাড়ির কাউকে বলতে পারতেন না আপনি?”

    অরুন্ধতী বলল, “আমার বাবা মা দুজনেই হার্টের পেশেন্ট। কীভাবে বলি বলুন?”

    প্রিয়ম বলল, “ভাই বোন?”

    অরুন্ধতী বলল, “আমি একাই”।

    প্রিয়ম বলল, “ওহ”।

    অরুন্ধতী বলল, “আপনি একবার ওদের বলে দেখুন না। আমাকে একবার যেতে দিক। আমি ঠিক ওকে চিনে যাব। এখনো অনেকে বেঁচে আছে শুনলাম তো। চাপা পড়ে আছে”।

    প্রিয়ম উঠল।

    অফিসার তাকে দেখে বললেন, “এখন আর বলে লাভ নেই। গাড়ি পাওয়া যাবে না আর। তখন বললে ব্যবস্থা করা যেত। আপনারা তো যেতে চাইলেন না”।

    প্রিয়ম বলল, “আমি গাড়ির জন্য আসি নি। ভদ্রমহিলা বারবার বলছেন ওকে একবার ভিতরটা যেতে দিতে। বুঝতেই পারছেন কী মারাত্মক অ্যাংজাইটি থেকে বলছেন”।

    অফিসার মাথা নাড়লেন, “ইম্পসিবল। ওকে বোঝান। এমনিতেই আমরা ওর শারীরিক অবস্থার কথা ভেবে এখানে ওকে বসার পারমিশন দিয়েছি। এই আবদার কিছুতেই মেনে নিতে পারবো না”।

    প্রিয়ম মাথা নাড়ল, “বুঝেছি”।

    পকেট হাতড়ে একটা সিগারেট পাওয়া গেল।

    সেটা ধরাতে যেতে অফিসার বললেন, “প্লিজ এখানে স্মোক করবেন না। ওপেন রাস্তায় পুলিশের সামনে স্মোক করবেন, মিডিয়া দেখবে। আরেকটা স্কুপ নিউজ প্রচার করা শুরু করবে”।

    প্রিয়ম আবার মাথা নাড়ল, “ওকে, ওকে”।

    সে চুপ চাপ চেয়ারে এসে বসে অরুন্ধতীকে বলল, “হবে না। বাকিরা ঝামেলা করবে”।

    অরুন্ধতী ফোন বের করে আরেকবার সৌমিককে ফোন করল। বার বার নট রিচেবল শুনেও ফোন করে যেতে লাগল।

    প্রিয়মের মনে পড়ল সেও এভাবে স্বাতীর নাম্বারে ফোন করে যেত। স্বাতী সিম পাল্টে ফেলল শেষ মেশ।

    স্বাতীর ফোন যখন পাওয়া যেত না, মাথা খারাপ হয়ে যেত তার। দেওয়ালে ঘুষি মেরেছে, বাথরুমে জল ছেড়ে মেঝেতে খালি গায়ে শুয়ে শুয়ে কেঁদেছে। বার বার মনে হয়েছে তার এতটা কষ্ট হচ্ছে, স্বাতীর কেন হচ্ছে না? কেন স্বাতীর একবারও মনে হচ্ছে না তাকে ফোন করার কথা?

    এই শহরেই কোথাও সুখে সংসার করছে স্বাতী।

    একবারও ওর মনে হল না প্রিয়ম কতটা কষ্ট পেতে পারে। ভাবলই না। এই কথাগুলো ভাবলে অদ্ভুত একটা রাগ জন্ম নেয় প্রিয়মের ভেতরে। সব কিছু ভাংচুর করে দিতে ইচ্ছা করে।

    অরুন্ধতী ফিসফিস করে বলল, “পাওয়া যাচ্ছে না, ওর ফোন পাওয়া যাচ্ছে না”।

    প্রিয়ম বলল, “চলুন ফিরি। চলুন। এত রাতে এখানে আর থাকাটা সেফ না। যাবেন?”

    অরুন্ধতী বলল, “আপনাকে খুব কষ্ট দিচ্ছি বলুন? এক কাজ করুন। আপনি চলে যান”।

    প্রিয়ম বলল, “শুনুন। ওরা আপনাকে যেতেও দেবে না, আর আপনার স্বামীকে উদ্ধার করা গেলে ওরা ঠিকই যা ব্যবস্থা করার করবে। আপনি অকারণ এখানে বসে আছেন। চলুন”।

    অরুন্ধতী কয়েক সেকেন্ড মাথা নিচু করে বসে থেকে বলল, “এভাবে ওকে ছেড়ে চলে যাব?”

    প্রিয়ম বলল, “এখন চলুন। প্রয়োজন হলে কাল সকালে আসব? যাবেন?”

    অরুন্ধতী দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে মাথা নাড়ল, “না”।

    ৬।

    ভিড়ের মানুষজন কেউ হাহাকার করছে, কেউ হাপুস নয়নে কাঁদছে, কেউ তীব্র চিৎকার করে গালাগালি করছে। অফিসার ঠিকই বলেছিলেন, তুমুল নৈরাজ্য শুরু হচ্ছে আস্তে আস্তে। কিছুক্ষণ পরে পরিস্থিতি সত্যিই হাতের বাইরে চলে যাবে। একেই বোধ হয় নরক বলে। নরক আর কত খারাপ হবে?

    প্রিয়ম বলল, “জল কিনব?”

    অরুন্ধতী মাথা নাড়ল, “দরকার নেই। আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে না? সরি। এক্সট্রিমলি সরি। কিছু মনে করবেন না। আমি আর পারছি না”।

    প্রিয়ম বলল, “না না, ঠিক আছে। ওসব ভাববেন না”।

    অরুন্ধতী বলল, “ওর বাড়ি থেকে জানা মাত্র আমাকে অপয়া দাগিয়ে দেবে জানেন তো! বলবে আমার জন্যই ছেলেটা মরে গেল। এমনিতেই সারাক্ষণ বলে যাচ্ছে, আমার জন্যই ওদের ছেলে কোন রকম যোগাযোগ রাখে না। ওদের আমার উপর অনেক রাগ”।

    প্রিয়ম দেখল জনগণ ব্যারিকেড ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছে। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়তে পারে। ফায়ার ব্রিগেডও এসে দাঁড়িয়েছে। স্বজনহারা মানুষকে কাঁদানে গ্যাস দিয়ে ভয় পাওয়ানো সম্ভব হবে না।

    প্রিয়ম বেশি ভাবল না। বেশি ভেবে লাভ নেই। তার তো কেউ নেই। বেঁচে থাকাটাই তার কাছে একটা শাস্তির মত।

    দশ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়েছে। মাটিতে সাদা কাপড় চাপা দেওয়া হয়েছে তাদের শরীরে। লাল স্ট্রাইপের জামা তাদের কেউই পরে নি। চোখ মুখ থেতলে গেছে। পুলিশ আর হাসপাতালের চাকরির থেকে কষ্ট বোধ হয় আর কিছুতে নেই। সাধারণ মানুষ চাইলে এগুলো না দেখে থাকতে পারে, পুলিশ, ডাক্তার কিংবা নার্সদের এদের সঙ্গেই থাকতে হবে।

    প্রিয়ম মানিব্যাগ বের করল। প্রাণপণে মানিব্যাগের ভিতরের অংশটা শোঁকার চেষ্টা করল। কিচ্ছু পাওয়া গেল না। যা ছিল, সব বেরিয়ে চলে গেছে। এই সময়ে নেশার দরকার ছিল। নেশাগ্রস্থ মানুষ ছাড়া এই সময় পার করা সম্ভব না। মানুষকে নিয়ে চলে যাওয়া অ্যাম্বুলেন্সগুলো কিংবা মৃতের গাড়ির চালকদের রোবট বলে মনে হচ্ছে এখন।

    আবার একটা বুম সামনে এল তার, “আপনার কেউ আছে ওখানে? ফ্যামিলি মেম্বার? বন্ধু বান্ধব?”

    প্রিয়ম মরা চোখে সাংবাদিকের দিকে তাকাল। বলল, “এত রাতে কেউ টিভি দেখে? আমার ইন্টারভিউ কে দেখবে এখন?”

    সাংবাদিক তার দিক থেকে বুম সরিয়ে নিল।

    কে একজন ভিড়ের মধ্যে থেকে বলে উঠল, “লাশ সরিয়ে নিচ্ছে বুঝলি? লাশ পেলেই তো লজ্জার ব্যাপার হয়ে যাবে। এরা লাশ সরিয়ে নিচ্ছে। মরে গেলে কেউ জানতেও পারবে না। উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গেই সব লাশ চলে পাচার হয়ে যাচ্ছে”।

    প্রিয়ম চেষ্টা করল কথাটা কে বলেছে শোনার জন্য। অরুন্ধতীকে কি বলা দরকার? ভেবে উঠতে পারল না সে। তাকে দূরে দেখে অরুন্ধতী ছুটে তার কাছে এসে তার হাত ধরল। বলল, “আপনি কি চলে যাবেন?”

    প্রিয়ম বলল, “না না। আমি যাচ্ছি না, আপনি উঠলেন কেন? বসুন”।

    অচেনা অজানা এক মহিলা এসে এভাবে তার হাত ধরছে, অন্য সময় হলে কতটা অস্বাভাবিক মনে হত!

    এখন কিছুই অস্বাভাবিক লাগল না।

    অরুন্ধতীকে নিয়ে আবার বসাল প্রিয়ম।

    অরুন্ধতী জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। প্রিয়ম বলল, “আপনার হাই বা লো প্রেশার নেই তো?”

    অরুন্ধতী বলল, “কখনো চেক করি নি”।

    প্রিয়মের হাত ছাড়ে নি অরুন্ধতী। প্রিয়ম কিছু বলল না। এই পরিস্থিতিতে অরুন্ধতীর মানসিক অবস্থা আর কী হবে? রাত দুটো বাজতে চলল। একজন সাংবাদিক ক্যামেরার সামনে খুব লাফ ঝাঁপ দিয়ে চেয়ারে বসে চা খাচ্ছেন। ওয়্যারলেসে পুলিশ নিজেদের মধ্যে ক্রমাগত যোগাযোগ রেখে চলেছেন।

    প্রবল অস্বস্তির সঙ্গে প্রিয়ম লক্ষ্য করল, অরুন্ধতীর শরীর তাকে এর মধ্যে জাগিয়ে তুলছে। তার কনুই অরুন্ধতীর এক স্তনে লেগেছিল। এখন প্রবল উত্তেজনা হচ্ছে।

    সে তো ভাল ছেলে। প্রেমিকা ছেড়ে গেলে প্রবল নেশা করে রিহ্যাবে যেতে হয়। অচেনা নারীর স্পর্শে হঠাৎ এরকম হবে কেন?

    ৭।

    “হাই, আমি স্বাতীলেখা। তোমার গান শুনলাম সেদিন সোশ্যালে। খুব ভাল লাগল”।

    মেয়েটা হাত বাড়াল।

    প্রিয়ম ঘাবড়ে গেল প্রথমে। একটা জলজ্যান্ত মেয়ে তার গান ভাল বলছে? ওরে বাবা!

    মেয়েটা আবার বলল, “হাই। কী হয়েছে? এনি প্রবলেম?”

    প্রিয়ম এবার হাত বাড়াল, “না না। কোন প্রবলেম নেই। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ”।

    স্বাতী বলল, “চা খাও?”

    প্রিয়ম বলল, “হ্যাঁ”।

    স্বাতী বলল, “নাহ। চা ভাল না। মোমো খাও? রবীন্দ্রসদন মেট্রোর ওখানে দারুণ মোমো পাওয়া যায়। খাবে?”

    প্রিয়ম কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গেল।

    মেট্রো চড়ল দুজনে। স্বাতী কথা বলতে শুরু করল।

    প্রিয়ম কিছুটা কম।

    মোমো খাওয়ার পর দুজনে নন্দনের ভেতরে গিয়ে বসল। আড্ডা মেরে ফেরার পর সে রাতটা স্বপ্নের মত কেটেছিল। বাড়ি ফিরেই স্বাতীর মেসেজ। “হাই। কী খবর?”

    মা তখনও বেঁচে ছিল।

    সে সময়টা রাতের খাওয়া সেরে সারারাত ধরে স্বাতীর সঙ্গে গল্প করত। ঘুমোতে ঘুমোতে ভোর হয়ে যেত। আজে বাজে কথা। ভুল ভাল সব বিষয়ে দুজনে কথা বলে যেত।

    এরপরেই একদিন স্বাতীর আচমকা প্রস্তাব এল, “অ্যাই! ডায়মন্ড হারবার যাবে?”

    প্রিয়ম অবাক হয়ে গেছিল, “কেন? কী আছে সেখানে?”

    স্বাতী বলল, “রুম পাওয়া যায়”।

    প্রিয়ম বুঝল। হেসে ফেলেছিল।

    দুজনে কলেজ এক্সকারসানের নাম করে গেল।

    দরজা বন্ধ করার পর প্রিয়মের মনে হচ্ছিল তার হৃদয় বুঝি ফেটে বেরিয়ে যাবে।

    সে কী উত্তেজনা!

    স্বাতী শাড়ি পরে গেছিল। কিছুতেই ব্লাউজের হুক খুলতে পারছিল না প্রিয়ম।

    স্বাতী হাসতে হাসতে তাকে ফিসফিস করে বলল, “গাধা”।

    পরস্পরের ঠোঁটের স্বাদ গাঢ়তর হল। একে অপরের শরীরে প্রবেশ করল গভীর আবেগে।

    প্রিয়ম নিজের মধ্যে ছিল না।

    স্বাতীর নগ্ন শরীরটা তাকে পাগল করে দিচ্ছিল।

    সব কিছু হয়ে যাবার পর স্বাতী তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইল।

    আর প্রিয়মের শুধু মনে হতে লাগল, যদি পুলিশ চলে আসে!

    স্বাতীকে বলতে স্বাতী তার গলায় চুমু খেয়ে বলল, “ধুর ভীতু। শুয়ে থাকো। কিচ্ছু হবে না”।

    কিচ্ছু হলও না। তবু প্রিয়মের খুব ভয় হচ্ছিল। পুলিশে তার বড় ভয় ছিল। মাঝরাতে হোটেলের সামনের রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাবার শব্দেও প্রিয়ম বার বার জানলা দিয়ে গলা বের করে দেখে গেছে পুলিশের গাড়ি না তো?

    পরের দিন ভোরে হোটেল থেকে চেক আউট করে তবে শ্বাস ছেড়েছে! বাপ রে! কী চিন্তার ব্যাপার!

    স্বাতী খুব হেসেছিল। সারারাস্তা খিল খিল করে হেসেছে আর বলেছে, “ভিতুর ডিম কোথাকার”।

    বাড়ি ফেরার পর নিজের ঘরে শুয়ে বার বার ইচ্ছেটা আসতে শুরু করল। স্বাতীকে নগ্ন দেখার ইচ্ছা, স্বাতীর শরীরের প্রতিটি জায়গায় চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা। স্বাতী ভয় দেখালো, “ধ্যাত পাগল। এরকম করে না। সত্যি সত্যিই পুলিশ চলে আসবে, তখন বুঝবে”।

    পুলিশের নাম শুনে প্রিয়ম খানিকটা সিঁটিয়ে গেল বটে। ক’দিন পরে আবার শুরু করল।

    সিনেমা হলের অন্ধকারে শরীরের ক্ষিদে পুরো মেটে না। শুধু চুমু খেয়ে বাড়ি ফিরে ডায়মন্ড হারবারের সে রাতের কথা বার বার মনে হতে শুরু করে। রাত জুড়ে ঘ্যান ঘ্যান করা শুরু করল প্রিয়ম।

    অনেক সাধ্য সাধনার পর অবশেষে স্বাতী মেনে নিল…

    ঠিক আছে। আরেকবার, অন্য কোন হোটেলে, যাওয়া যেতেই পারে।

    #

    “শুনুন”।

    রাত তিনটে। বসে থাকতে থাকতে কখন চোখ লেগে এসেছিল বোঝে নি সে।

    আশ্চর্য ব্যাপার! অন্যান্য দিন হলে তো কিছুতেই ঘুম আসত না। ঘুমের ওষুধ না খেয়ে শুলে জানলার বাইরেটায় একটা সময় ভোরের আলো ফুটে উঠত। এখানে, এই এত কিছুর মধ্যে তার ঘুম এসে গেছিল?

    অরুন্ধতী ডাকছে তাকে। সে বলল, “বলুন”।

    অরুন্ধতী বলল, “এখানে কোথাও বাথরুমের ব্যবস্থা আছে?”

    প্রিয়ম চিন্তিত মুখে অরুন্ধতীর দিকে তাকাল।

    অরুন্ধতী বলল, “আচ্ছা থাক”।

    প্রিয়ম উঠল, “না। না। থাকবে কেন? আমি দেখছি”।

    ৮।

    “উড়ালপুলের গার্ডার কংক্রিটের ভার সামলাতে পারে নি। বাঁকের মুখে পিলার থাকায় ওজনের ফারাক হয়ে গেছিল। এছাড়া তো আর কোন কারণ দেখছি না”।

    রোশন শর্মা সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে দিল্লি থেকে উড়ে এসেছেন মাঝরাতে।

    তাকে দেখা মাত্র মিডিয়ার প্রতিনিধিরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

    “স্যার, আপনার কি মনে হয় এখানে কোন দুর্নীতি থাকতে পারে?” এক সাংবাদিক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল।

    রোশন বললেন, “আমি আলটপকা কোন মন্তব্য করতে চাই না। তদন্ত হবে। এত তাড়াতাড়ি কোন সিদ্ধান্তে চলে আসা আমার পক্ষে অসম্ভব”।

    “স্যার এই মুহূর্তে এই ঘটনায় দেশের অন্যান্য শহরও নিশ্চয়ই ভয় পাচ্ছে? এত এত ফ্লাইওভার উঠছে, সেগুলো যে এভাবে ভেঙে পড়তে পারে, কেউ তো ভাবে নি। আপনি কি নিশ্চয়তা দিতে পারেন যে ভবিষ্যতে এরকম কিছু হবে না?”

    রোশন উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ একটা চেনা মুখ দেখলেন।

    তিনি সাংবাদিকদের বললেন, “এক্সকিউজ মি”।

    সাংবাদিকরা কাতর সুরে “স্যার স্যার, লাস্ট কোয়েশ্চেন” বলতে লাগল, রোশন কান দিলেন না। পুলিশ সাংবাদিকদের আটকে দিল।

    রোশন দৌড়ে গিয়ে ধরলেন, “প্রিয়ম, এই যে ছোঁড়া, কেমন আছিস?”

    প্রিয়ম হাঁ করে রোশনের দিকে তাকাল। রোশন কাকা! বাবার বন্ধু ছিলেন। প্রায়ই তাদের বাড়ি আসতেন।

    সে বলল, “ভাল আছি কাকু। আপনি সেই কবে এসেছিলেন…”

    রোশন প্রিয়মের কাঁধে হাত রাখলেন, “আরে সে অনেক গল্প। তুই এখানে কী করছিস?” পরক্ষণেই সচকিত হলেন, “তোর ফ্যামিলির…? বউ… বিয়ে করেছিস?”

    প্রিয়ম হাসল, “না না। সেরকম কিছু না। আমার এক প্রতিবেশী। পাড়ায় নতুন এসেছেন। ওর বরের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না”।

    রোশন বললেন, “মাই গড! এটা আমাদের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য ওয়ার্স্ট নাইটমেয়ার। ভাবা যাচ্ছে না”।

    একজন পুলিশ অফিসার রোশনের কাছে এসে দাঁড়ালেন, “স্যার, আপনি রেড জোনে যাবেন?”

    রোশন বললেন, “আমি এসে তোর সঙ্গে কথা বলছি”।

    প্রিয়ম বলল, “কাকু, আপনি মেয়েটাকে ওখানে যাবার ব্যবস্থা করতে পারবেন?”

    রোশন মাথা নাড়লেন, “না। আমাকে সেন্ট্রাল থেকে পাঠিয়েছে। পলিটিকাল চাপান উতোর আছে অনেক। আমি কাউকে নিয়ে গেলে সেটা নিয়ে হাজার কথা উঠবে। তবে চিন্তা করিস না, আমি চেষ্টা করছি যেভাবে হোক ওর হাজব্যান্ডের ব্যাপারে খবর জোগাড় করার। আমাকে ছেলেটার নাম বল”।

    প্রিয়ম ভাবতে চেষ্টা করল। অরুন্ধতীর বরের নাম… কী বলেছিল যেন?

    সে “এক মিনিট” বলে দৌড়ে অরুন্ধতীর কাছে গেল। “আপনার হাজব্যান্ডের নামটা আরেকবার বলবেন?”

    অরুন্ধতী আশান্বিত হয়ে তার দিকে তাকাল, “কোন খোঁজ পাওয়া গেছে?”

    প্রিয়ম বলল, “না না। আপনি একবার ওর নামটা বলুন”।

    অরুন্ধতী মুহূর্তে নিভে গেল, “সৌমিক দাস। লাল স্ট্রাইপ দেওয়া জামা”।

    প্রিয়ম আবার দৌড়ে রোশনের কাছে গেল। “কাকু, সমীর দাস। লাল স্ট্রাইপ দেওয়া জামা”।

    রোশন প্রিয়মকে বললেন, “ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করছি। তুই ভাবিস না। ভাল থাক। অনেক দিন পরে তোকে দেখে ভাল লাগল। তোর বাবা মারা যাবার পর তো আর যাওয়া হল না। মা ভাল আছেন?”

    প্রিয়মের মুখ ফ্যাকাসে হল, “কাকু, মাও আর নেই”।

    রোশন সত্যিকারের দুঃখিত হলেন। “কীভাবে সব কিছু পাস্ট টেনস হয়ে যায়! ভাবা যায় না! ভাল থাকিস বাবু। বাই দ্য ওয়ে, তোর ফোন নাম্বারটা দে। আমি ফোন করে একদিন চলে যাবো না হয়”।

    প্রিয়ম তার ফোন বের করে বলল, “এ নাও। এটা থেকে তোমার নাম্বার ডায়াল করে নাও”।

    রোশন প্রিয়মের ফোন থেকে নিজের নাম্বার ডায়াল করে বললেন, “আমি এলাম। কনট্যাক্ট করিস। আর আমি দেখছি। সমীরবাবুর ব্যাপারে বলছি ওদের”।

    প্রিয়ম ঘাড় নাড়ল।

    রোশন ফ্লাইওভারের দিকে রওনা দিলেন।

    পুলিশ অফিসার প্রিয়মকে বললেন, “আপনি ওঁকে চেনেন নাকি?”

    প্রিয়ম বলল, “বাবার বন্ধু ছিলেন”।

    অফিসার বললেন, “খুব সেনসিটিভ ব্যাপার এটা। উনি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট থেকে এসেছেন। আজে বাজে কিছু বলে ফেলেন নি তো?”

    প্রিয়ম বলল, “না না। আমি সেরকম কিছুই বলি নি”।

    অফিসার অরুন্ধতীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “একটা জিনিস আপনাকে বলি। ওকে বোঝান। এভাবে বসে থেকে নিজের শরীর খারাপ হওয়া ছাড়া কিন্তু কিছু হবে না। পারলে ওকে নিয়ে যান। আপনি আমার নাম্বার রাখুন। উনি যেতে চাইলে বলুন, আমি ব্যবস্থা করে দেব। অসংখ্য ভিক্টিমের ফ্যামিলির লোক বাইরে অপেক্ষা করছে। উনি অসুস্থ হয়েছেন বলে এই জোনে ওকে বসতে অ্যালাউ করা হয়েছে। সমস্যা হল বেশিক্ষণ আমরা এটা অ্যালাউ করতে পারব না। প্রেস জানতে পারলে আরেক ঝামেলা শুরু করবে। আমি তো বলছি, আমি ব্যক্তিগত ভাবে ওর হাজব্যান্ডের ব্যাপারটা দেখছি”।

    প্রিয়ম বলল, “ঠিক আছে। আমি কথা বলছি”।

    অফিসার বললেন, “ঘটনাটার জাস্ট আধঘন্টা আগে আমি এখান থেকে গেছি। আরো কত মানুষ। কী করে সবাইকে আটকাই বলুন তো। ডিউটি করতে এসেছি। কিন্তু আমরাও তো মানুষ”।

    প্রিয়ম অরুন্ধতীর কাছে গিয়ে বলল, “ওরা আমাদের চলে যেতে বলছেন। কী করবেন?”

    অরুন্ধতী বলল, “এখানেই থাকব। আমি বাড়ি গিয়ে কী করব? প্লিজ থাকুন”।

    প্রিয়ম বলল “আচ্ছা”।

    ৯।

    “আমার ছেলে টিউশন পড়ে ফিরছিল। এই সময়েই ফেরে ও। ক্লাস এইটে পড়ে। ওর কাছে তো মোবাইলও নেই। কোন খোঁজ পাচ্ছি না”।

    এক মা কাঁদতে কাঁদতে বার বার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। তাকে নিয়ে এসে শুশ্রূষা করছে স্বেচ্ছাসেবকেরা। প্রিয়ম রাস্তাতেই বসে পড়েছে।

    জীবনটা একবারে শেষই হয়ে গেল তার। অথচ এরকম তো হবার কথা ছিল না। ভাল পরিবারের ছেলে, বাবা ভাল চাকরি করতেন। বছরে দুবার বাইরে বেড়াতে যাওয়া। বাবা চলে যাবার পর থেকেই সব কিছু কেমন ঘেঁটে গেল।

    মা দিশেহারা হয়ে গেলেন, প্রেশার সুগার সব হয়ে গেল। স্বাতীকে আঁকড়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল প্রিয়ম।

    প্রিয়ম স্বেচ্ছাসেবকদের দেখল। এদেরই মধ্যে একটা মেয়েকে অনুরোধ করায় অরুন্ধতীকে পরম মমতায় বাথরুমে নিয়ে গেছিল। কী ভাগ্যিস রাস্তার পাশের সুলভ শৌচাগারে কোন ক্ষতি হয় নি।

    স্বাতী বলত আর কিছু না হোক, শহরের সব ক’টা সুলভ শৌচাগার তার চেনা।

    দ্বিতীয়বার তারা ডায়মন্ড হারবারে যায় নি। শহরেরই একটা হোটেলে গেছিল।

    স্বাতী হোটেলের রুমে এসেই বলেছিল, “দেখলে, কীভাবে রিসেপশনিস্টটা দেখছিল? এই জন্য আমার ভাল লাগে না”।

    প্রিয়ম বলল, “দেখুক। কিছু যায় আসে না”।

    ডায়মন্ড হারবার থেকে ফেরার পর সে শুধু কল্পনা করে গেছিল স্বাতীর শরীরের বিভিন্ন অংশে আদর করছে। প্রবল আবেগে চুমু খাচ্ছে। তারা একসঙ্গে স্নান করবে। গোটা দিন একে অপরকে আদর করে যাবে। স্বাতীর শরীরে তার আঙুল দিয়ে ছবি আঁকবে।

    অনেক কিছু ভেবে এসেছিল।

    বাস্তবে সেটা পারল না। এলোপাথাড়ি চুমু খেতে শুরু করল।

    স্বাতী অংশগ্রহণ করল।

    পৃথিবীতে শুধু তারা দুজন আছে।

    আর কেউ নেই। থাকার দরকারও নেই।

    প্রিয়মের মনে হচ্ছিল সে পৃথিবী জয় করেছে। আদরে আদরে ভাসিয়ে দিচ্ছিল স্বাতীকে।

    হঠাৎই ছন্দপতন হল।

    কলিংবেল বেজে উঠল।

    সম্পূর্ণ নগ্ন দুজন।

    প্রিয়মের মনে হচ্ছিল তার হৃদপিন্ড ছিটকে বেরিয়ে যাবে।

    সে স্বাতীকে বলল, “দেখো”।

    স্বাতী বলল, “আমি কী দেখব? আমি বাথরুমে যাচ্ছি। তুমি যাও”।

    কোনমতে টাওয়েল জড়িয়ে প্রিয়ম বাইরে বেরিয়ে দেখল হোটেলের বয়। বলল, “স্যার কিছু খাবেন?”

    প্রিয়ম হাঁফ ছাড়ল, “না না। কিছু লাগবে না”।

    ছেলেটা চলে যেতে প্রিয়ম দরজা বন্ধ করে স্বাতীকে ডাকল।

    স্বাতী বেরিয়ে এসে বলল, “আমার ভাল লাগছে না। চল বেরিয়ে যাই”।

    প্রিয়ম হাসল, “আগের দিন আমি ভয় পাচ্ছিলাম, আর আজ তুমি? পাগল নাকি? কিছু হবে না”।

    স্বাতী বলল, “শোন, তুমি বা আমি একটা চাকরি পাই, আমরা বিয়ে করি, তাহলে তো এত ভয়ের কিছু থাকবে না। বল?”

    প্রিয়মের রাগ হচ্ছিল। সে স্বাতীর গলায় চুমু খেয়ে বলল, “আচ্ছা, তুমি যা বলবে তাই। শেষ বারের মত?”

    স্বাতী বলল, “আমি পারছি না। কেমনভাবে সবাই দেখছিল আমাদের। চল বেরিয়ে যাই”।

    প্রিয়ম হাল ছেড়ে দিল, “ঠিক আছে। চল”।

    প্রবল গরম ছিল সেদিন। রোদের মধ্যে রাস্তায় বেরোল দুজনে।

    মেট্রোতে চড়ল কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে। সারা রাস্তা তারা হাত ধরাধরি করে ঘুরল।

    স্বাতী বলল, “এভাবে না ঘুরে কারো ফ্ল্য্যট খুঁজলে হয় না?”

    প্রিয়ম বলল, “আমার কাছে আরও ভাল একটা আইডিয়া আছে”।

    স্বাতী বলল, “কী?”

    প্রিয়ম বলল, “আমরা চুপচাপ রেজিস্ট্রি করে নি। রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট থাকলে কেউ কিছু বলতে পারবে না। যে কোন হোটেলে যেতে পারব”।

    স্বাতী অবাক হয়ে প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাড়ির কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে নেব?”

    প্রিয়ম বলল, “হ্যাঁ। কী অসুবিধা আছে? তোমার কি এখনো ডাউট আছে? আমরা বিয়ে করব তো একদিন? সেটা এখনই করে নি। খোঁজ নিই?”

    স্বাতী ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “আমার কেমন ভয় ভয় লাগছে। এটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না?”

    প্রিয়ম শক্ত করে স্বাতীর হাত ধরল, “একবারে না”।

    ১০।

    “বাবান, এই বাবান”।

    সার দিয়ে মানুষের লাশ উদ্ধার হচ্ছে।

    কারো পা থেঁতলে গেছে, কারো মাথা। যারা বেঁচে আছে তারা অর্ধমৃত। বেঁচে থাকাটাও যাদের কাছে শাস্তি হয়ে যাবে জীবনের বাকিটা সময়।

    প্রিয়মের মলয়ের কথা মনে পড়ে গেল।

    তার মনে হচ্ছে মলয় এদের মধ্যেই আছে। তাকে প্রাণপণে ডাকছে বাঁচাবার জন্য, অথচ সে মলয়কে বাঁচাতে পারছে না।

    মলয়ের ক্যান্সার হয়েছিল। প্রচুর টাকার দরকার। সে তখন স্বাতী ছাড়া আর কিছুই দেখছে না।

    দেখা করে এসে সবে বাড়িতে শুয়েছে, অমলদা ডাকল। বেরিয়ে দেখল পাড়ার সবাই বেরিয়েছে মলয়ের জন্য টাকা তুলতে।

    টাকা দরকার। ওষুধের টাকা নেই।

    “দিতে পারবি বাবান কিছু টাকা?”

    প্রিয়ম বলেছিল দেখছে।

    সে জানত তার কাছে টাকা আছে।

    দেখছে বলে দেয় নি। সে তো জানত মলয় মরে যাবে। অকারণ টাকা দিয়ে কী লাভ? মানুষ যখন মরেই যাবে, তখন তার টাকা নষ্ট করার দরকার নেই। সে দেয় নি।

    দু হাজার টাকা ছিল। অনেক দিনের জমানো। কিন্তু সে দেয় নি। বলে দিয়েছিল তার কাছে টাকা নেই। সেই টাকাটা দিয়ে স্বাতীর সঙ্গে ঘুরেছে, মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখেছে, দেড়শো টাকায় দশ টাকার পপকর্ণ কিনে খেয়েছে, কিন্তু মলয়ের চিকিৎসার জন্য কোন টাকা দেয় নি।

    জ্ঞান হবার পর থেকে তারা যখন মাঠে খেলতে যেত, মলয়ের পিছনে লাগত সবাই। মলয় একটু সরল ছেলে ছিল। সে একবার মলয়কে স্ট্রাইকার ছুঁড়ে মেরেছিল ক্যারাম খেলতে গিয়ে। মলয় তাকে মারে নি। রাগও করে নি। নিজের ছোট ভাইয়ের মত দেখত।

    দুপুরে ঘুমিয়ে ওঠার পর বুঝতে পারা যায় না, সন্ধ্যা হয়েছে না ভোর হয়েছে। এরকম এক বিকেলে মলয় তার বাড়িতে এসেছিল। তারা বাজারে গিয়ে আলুর চপ খেল। সাইকেল চালানোটাও মলয়ই তাকে শিখিয়েছিল। দু বছর বড় ছিল মলয়। সবার বাড়িতেই অবাধ যাতায়াত। আর কোন মেয়ে দেখলেই অবধারিতভাবে তার প্রেমে পড়ে যাবে। তার কাছে এসে গল্প শোনাবে মেয়েটা কত ভাল।

    জীবনে প্রেমিকা চলে এলে বন্ধুরা দূর হয়ে যায়। সে শুনেছিল মলয় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে, জ্বর কমছেই না। তারপর টেস্ট করানোর পরে জানা গেল ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে। মলয়ের বাবা ক্লার্কের চাকরি করতেন, চিকিৎসার খরচ বেশিদিন টানতে পারলেন না। পাড়ার লোকের কাছে হাত পাততেই হত।

    সবাই কিছু না কিছু দিল। প্রিয়ম “দেখছি” বলে ভুলেও গেছিল। স্বাতীর শরীরের গন্ধ তাকে প্রবলভাবে টানছে তখন। পাগলের মত সে খুঁজে বেড়াচ্ছে কোথায় স্বাতীকে নিয়ে কয়েক ঘন্টা কাটানো যায়।

    একদিন সকালে খবর চলে এল। মলয় আর নেই। বাবা মার এক ছেলে ছিল।

    যে বাড়িতে দীপাবলি হলেই মলয় কোত্থেকে কোত্থেকে আলো এনে জ্বালাত্‌, পাড়ার সবাইকে গর্ব করে বলত সে এই আলোগুলো খুব খুঁজে নিয়ে এসেছে, সেবারে মলয়দের বাড়িটা ভুতুড়ে বাড়ির মত একা একা দাঁড়িয়ে রইল।

    মলয় আজকাল ঘুমের ওষুধ খাবার পরও মাঝে মাঝে স্বপ্নে আসে। “কী রে বাবান, ক্যারাম পিটাবি?”

    মলয়ের কাছে খেলা মানে ক্যারাম পেটানো, ফুটবল পেটানো, র‍্যাকেট পেটানো।

    শুইয়ে রাখা মৃতদেহগুলোর মতই মলয় শুয়ে ছিল নিশ্চয়ই একদিন।

    প্রিয়ম সেদিন স্বাতীকে নিয়ে বর্ধমানে গেছিল। স্বাতী মলয়ের খবরটা শুনে বলেছিল, “তুমি গেলে না দেখতে?”

    প্রিয়ম বলেছিল, “না। কষ্ট লাগে। মরে যাওয়ার পর দেখে লাভ আছে কোন?”

    স্বাতী আরো কিছু বলতে গেছিল। প্রিয়ম তাকে জড়িয়ে ঠোঁটে চুমু খাওয়ায় আর কিছু বলতে পারে নি।

    খোঁজ টোজ নিয়ে বিভিন্ন জায়গার হোটেলে নিয়ে যেত স্বাতীকে। যেখানে তাদের কেউ চেনে না। দেখা হলে বাড়িতে কেউ কিছু বলতে পারবে না।

    স্বাতী সময় চেয়েছিল। হুট করে রেজিস্ট্রি করলে তার বাড়ির লোক কষ্ট পেতে পারে। প্রিয়ম বার বার বুঝিয়ে গেছে।

    কেউ কষ্ট পাবে না। বাবা মা কেন আসবে ভালবাসার মাঝখানে?

    পৌনে চারটে বাজে। খানিকক্ষণ পরে ভোর হবে। তবু অন্ধকার তো কাটছে না। প্রিয়মের মনে হচ্ছে গোটা শহরটা আরো গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যেতে শুরু করেছে। প্রতিটা মৃতদেহ মলয়। প্রতিটা মৃতদেহ তাকে বলতে চাইছে, “দশটা টাকাও কি দিতে পারতি না বাবান?”

    ১১।

    প্রিয়ম ঘুমাচ্ছিল।

    দুপুর বেলা।

    কলিং বেল বেজে উঠল।

    প্রিয়ম উঠে দরজা খুলে অবাক হল। স্বাতী।

    স্বাতী ঘরের ভিতর ঢুকে বলল, “রিহ্যাব থেকে কবে এলে?”

    প্রিয়ম স্বাতীর দিকে তাকাল। ঝলমল করছে। খুব ভাল আছে নিশ্চয়ই।

    সে মানিব্যাগটা শোঁকার চেষ্টা করল।

    লাভ নেই।

    একটুই কিচ্ছু নেই।

    এখন ভীষণ দরকার ছিল।

    সব কিছু ভুলে যাওয়ার জন্য ভীষণ দরকার।

    স্বাতী বলল, “লজ্জাও লাগে না তোমার। এখন বুঝি আমার ডিসিশন ঠিকই ছিল। ঠিক করেছিলাম তোমাকে ছেড়ে দিয়ে”।

    প্রিয়ম শূন্য চোখে স্বাতীর দিকে তাকাল।

    কষ্ট হচ্ছে একটা।

    প্রবল কষ্ট।

    স্বাতী বলল, “যখন যেটা নিয়ে অবসেসড হও, তখন সেটা নিয়েই পড়ে থাকো। একটা সময় শুরু করলে হোটেল খোঁজা। এদিক সেদিক যেখানে পেতে, যাবার জন্য জোরাজুরি করতে। হাঁফিয়ে গেছিলাম আমি। তুমি ম্যানিয়াক হয়ে গেছিলে, বোঝো সেটা?”

    প্রিয়ম বলল, “ঘি ভাত খাই এখন। ভাল লাগে খেতে। খাবার বানাবার ঝঞ্ঝাটও নেই তেমন। খাবে?”

    স্বাতী বলল, “না। তোমাকে একটা খবর দিতে এলাম। দিয়ে চলে যাব। ফোন পাই নি তোমার। তাই ঠিক করলাম নিজে এসে দিয়ে যাবো। এসে দেখব আমার সিদ্ধান্ত কত ঠিক ছিল”।

    প্রিয়ম বলল, “বিয়ে করছো, তাই তো?”

    স্বাতী বলল, “শুধু বিয়ে কেন? অম্বরীশ তোমার মত না। আমার খোঁজ রাখে। প্রতিটা ছোট ছোট বিষয় নিয়ে খোঁজ রাখে আমার। তুমি একটা স্কাউন্ড্রেল। একটা সেলফিশ, স্বার্থপর। আদতে তোমার বাবা মা তোমাকে বড়ই করে উঠতে পারে নি। মাকেও তো বাঁচাতে পারলে না!”

    প্রিয়ম বলল, “তুমি মার খোঁজ নিয়েছিলে, আমি যখন ছিলাম না?”

    স্বাতী বলল, “না। কেন খোঁজ নিতে হবে? মরে বেঁচেছেন উনি”।

    প্রিয়ম বলল, “আচ্ছা। ভাল থাকো। কী নাম বললে ছেলেটার? অম্বরীশ? কী করে? এন আর আই?”

    স্বাতী বলল, “হ্যাঁ। এন আর আই। বিয়ে করে আমরা সুইডেনে চলে যাচ্ছি। আর কোন দিন তোমাকে দেখতে হবে না আমার। এটাই শান্তি”।

    প্রিয়ম টিভি চালাল। টিভিতে খবর দেখাচ্ছে। স্বাতী বলল, “এই তো। ভাল সঙ্গী পেয়ে গেছো। টিভি দেখো, বাবার জমানো টাকার সুদে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দাও আর ঘি ভাত খাও। আর কোন মেয়ের জীবন বরবাদ কোর না দয়া করে”।

    মানি প্ল্যান্ট গাছে আছে একটা তার ঘরে প্রিয়ম সেটার দিকে তাকাল। পাড়াতে একটা নার্সারি হয়েছে। ঘি কিনতে গিয়ে দেখতে গেছিল। দোকানদার বলল এই গাছটা ভাল। সে নিয়ে এল। বাড়ছে গাছটা একটু একটু করে। দেখতে দিব্যি লাগে।

    স্বাতী ব্যাগ থেকে একটা বিয়ের কার্ড বের করে তার দিকে এগিয়ে দিল। প্রিয়ম কার্ডটা হাত পেতে নিল।

    খুব সুন্দর কার্ডটা। লাল রঙের হৃদয়ের উপর স্বাতী আর অম্বরীশের নাম লেখা।

    প্রিয়ম বলল, “অনেক দিন বিয়ে বাড়ি খাই না। যাবো তবে”।

    স্বাতী বলল, “একদম না। কুকুর এবং তুমি, নট অ্যালাউড আমাদের বাড়ির চৌহদ্দীর মধ্যে। বাবা বলে দিয়েছে। আমি আজকে কেন এসেছিলাম জানো? নিজের মধ্যে যেটুকু সংশয় ছিল, সেটুকুও মেটাতে এসেছিলাম। সব কিছু শেষ করে দিয়েছিলে তুমি আমার। সারাক্ষণ সেক্স। ভালবেসেছিলে আদৌ? নাকি শুধু সেক্সটাই বড় হয়ে গেছিল?”

    প্রিয়ম বলল, “এখন ঠিক বলতে পারবো না”।

    স্বাতী বলল, “পারবে কী করে? এখন তো আর আমি তোমার অবসেশন না। ভুলেও কারো কথা শুনে বিয়ে টিয়ে করতে যেও না। একটা মেয়ের গোটা জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। বুঝেছো?”

    প্রিয়ম মাথা নাড়ল। “ঠিক আছে। বিয়ে করব না”।

    স্বাতী উঠে দাঁড়াল। “ঘেন্না মিশ্রিত করুণা হচ্ছে আমার তোমাকে দেখে। ছি ছি, কত বড় ভুল করে ফেলেছিলাম। ছিহ। ভাগ্যিস তোমার কথা শুনে রেজিস্ট্রিটা করতে যাই নি। তাহলেই সর্বনাশ হয়ে যেত। বেঁচে গেছি”।

    প্রিয়ম বলল, “বাড়ির পিছনে একটা ছোট্ট বাগান করেছি। দেখবে?”

    স্বাতী দাঁড়িয়ে গেল। “বাগান করেছো? তুমি? কই দেখি?”

    স্বাতী বাগান দেখতে গেল।

    প্রিয়মের আবার নিজের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হল।

    প্রবলভাবে নিজেকে সুস্থ রাখার যুদ্ধ…

    ১২।

    “ওরা ব্রাহ্মণ। ভীষণ কনজারভেটিভ। আমি অতোটাও বুঝি নি। সম্পর্কটা যখন শুরু হয়েছিল, আমাকে সেভাবে কিছু আলাদা করে বলে নি ও। পরে যখন বলল, ভয় পেতাম। ওর বাবা কিছুতেই মেনে নেন নি”।

    অরুন্ধতী বলল।

    আরেকটা লট ডেডবডি বের করা হচ্ছে।

    প্রিয়ম এবার আর মুখ ফিরিয়ে নিল না।

    অভ্যাস হয়ে গেছে।

    অরুন্ধতীর ফোন বাজছিল।

    প্রিয়ম বলল, “আপনার ফোন”।

    অরুন্ধতী ফোন কানে দিয়ে উঠে গেল। প্রিয়ম অবাক হল।

    তাহলে কি ওর বর ফিরে এসেছে?

    নইলে এত রাতে কে ফোন করবে।

    কয়েক মিনিট পরে অরুন্ধতী তার পাশে এসে বসল। প্রিয়ম বলল, “কে ফোন করেছিল?”

    অরুন্ধতী প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বলল, “গাঁড় মারাক। অনেক গল্প দিয়েছি। মেয়েটার লাশ কোথায় লুকিয়েছিস? সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না?”

    প্রিয়ম চমকে উঠল, বলল, “মানে? আ… আপনি কে?”

    অরুন্ধতী প্রিয়মের গালে সজোরে চড় কষাল একটা। বলল, “স্পেশাল ব্রাঞ্চ চল। তুই বলবি লাশটা কোথায় লুকিয়েছিস। তোকে এতক্ষণ বের করে নিয়ে এসেও কোন হদিশ পেল না কেউ”।

    প্রিয়মের মাথা ঘুরে গেল।

    সে মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ে গেল।

    অরুন্ধতী একজন পুলিশ অফিসারকে ডেকে তার আই কার্ড দেখিয়ে বলল, “এটা একটা সাইকো। সম্ভবত বাড়িতে ওর লাভারকে মেরে লুকিয়ে রেখেছে। মেয়েটার বাড়ি থেকে কেস ডায়েরী করেছিল। আজ সকালেই ভাবছিলাম কী করে এটাকে বাড়ি থেকে বের করে তল্লাশি চালানো যায়। ফ্লাইওভার কেসটা হল বলে গল্প দিয়ে নিয়ে এসেছি। তবু কিছু পাওয়া গেল না। গাড়ির ব্যবস্থা করুন। ইমিডিয়েটলি এটাকে নিয়ে যেতে হবে। অনেক অভিনয় করেছি। ভেবেছিলাম আজকেই পেয়ে যাবে। কিচ্ছু পাওয়া যায় নি। সামথিং ইজ ভেরি ফিশি”।

    প্রিয়মের মাথা কাজ করছিল না। কী বলছে অরুন্ধতী? সে স্বাতীকে খুন করেছে?

    অফিসার বললেন, “ও মাই গড! আমাকে আগে বলবেন তো। এর সঙ্গে আমি কত কথা বলে ফেললাম। শিট”।

    অরুন্ধতী বলল, “আপনাদের ইচ্ছা করেই বলি নি, ব্যাপারটা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছিলাম যাতে এর মনে বিন্দুমাত্র কোন সন্দেহের উদ্রেক না হয়”।

    অরুন্ধতীকে এখন চেনা যাচ্ছে না। দুজন কনস্টেবল জোগাড় হয়ে গেল।

    তাকে গাড়িতে তোলা হল।

    প্রিয়ম নির্জীবের মত গাড়িতে বসে রইল।

    বিড় বিড় করে যাচ্ছে, “কী আজে বাজে কথা! আমি নাকি স্বাতীকে খুন করেছি? স্বাতী তো এখন সুখে সংসার করছে। বর এলে নিশ্চয়ই রান্না করে খাওয়ায়”।

    অরুন্ধতী ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছে। ভোর হচ্ছে।

    প্রিয়ম বলল, “আপনার মনে হয় কোন ভুল হচ্ছে। স্বাতী তো সংসার করছে। এতদিনে বাচ্চাও হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। ওকে কেন খুন করতে যাব?”

    অরন্ধতী বলল, “তুই চুপ করে থাক। একটা কথা বলবি না। শালা ড্রাগ অ্যাডিক্ট। তোর জন্য সারা রাত জেগে রইলাম আমি। যে কোন দিন মেগা সিরিয়ালে অ্যাক্টিং করব মনে হচ্ছে এবার”।

    প্রিয়ম বলল, “আপনাদের কোন ভুল হচ্ছে”।

    অরুন্ধতী বলল, “ঠিক আছে। তুই চল। দেখছি কার ভুল”।

    ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে তার বাড়ির সামনে পুলিশের গাড়ি দাঁড়াল।

    পাড়ার লোক এই ভোরেও অবাক হয়ে দেখছে প্রিয়মের বাড়ি তল্লাশি চলছে।

    অরুন্ধতী গাড়ি থেকে নেমে বলল, “চল। চল”।

    ঠেলতে ঠেলতে প্রিয়মকে তার বাড়ির ভিতর নিয়ে যাওয়া হল।

    একজন অরুন্ধতীকে স্যালুট করে বলল, “গোটা ঘর খুঁজেছি ম্যাম। সব জায়গায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। কিচ্ছু পাই নি”।

    অরুন্ধতী বলল, “হতেই পারে না। লাস্ট সান ডে মেয়েটা এ বাড়িতে এসেছিল। তারপর থেকে আর ফেরে নি”।

    প্রিয়ম বলল, “স্বাতী সেই কবে ছেড়ে গেছে আমাকে। কতদিন দেখি না”।

    অরুন্ধতী তীক্ষ্ণ চোখে প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বলল, “কত দিন?”

    প্রিয়ম বলল, “তিন বছর হয়ে গেছে”।

    অরুন্ধতী প্রিয়মকে চেয়ার টেনে বসালো, “বস”।

    প্রিয়ম বসল।

    অরুন্ধতী বলল, “দ্যাখ, সারারাত অনেক কষ্ট গেছে। সত্যিটা বলে দে। নয়তো তোর কপালে অশেষ দুর্গতি আছে”।

    প্রিয়ম বলল, “আপনার বরের নাম সঞ্জয় দাস? লাল সাদা স্ট্রাইপ পরে ফ্লাইওভারের তলায় চাপা পড়েছে বললেন না?”

    অরুন্ধতী নিজের কপালে হাত দিয়ে বসল। উপর মহল থেকে কিছুতেই পারমিশন ছিল না। কাকতালীয়ভাবে ফ্লাইওভারটা ভেঙে পড়ল বলে অত্যন্ত রিস্ক নিয়ে বিনা ওয়ারেন্টে এই ঝুঁকিটা নিয়েছিল তারা।

    ওকে দেখে মনেও হচ্ছে না কিছু করতে পারে। সারাটা রাত অভিনয় করে করে ক্লান্ত হয়ে গেছে সে। ঠিক ছিল প্রিয়মকে বাড়ি থেকে দূরে রেখে মেয়েটাকে খোঁজা হবে।

    সারা রাত ওপেন নেট পেয়েও গোল করতে পারে নি সি আই ডির তিন দুঁদে গোয়েন্দা।

    অরুন্ধতী বিরক্ত গলায় বলল, “সৌমিক দাস। সঞ্জয় দাস না। সৌমিক। বুঝলি? লাল স্ট্রাইপ দেওয়া জামা! উফফ!”

    প্রিয়ম অরুন্ধতীর দিকে মাছের মত চোখে তাকিয়ে রইল।

    একজন এসে বলল, “ম্যাডাম। এবার কি তবে?”

    অরুন্ধতী বলল, “কোথায় কোথায় দেখেছো?”

    “সব ম্যাডাম। বাড়ির পেছনের জমিও খুঁড়েছি। স্যারকে বলে দিন ম্যাম। আমরা বেরিয়ে যাই এবার”।

    অরুন্ধতী দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

    স্যারকে বলা মানে মারাত্মক ঝাড় খেতে হবে। ছেলেটা কিছুদিন আগে রিহ্যাব থেকে ছাড়া পেয়েছে। শুধুমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে…

    বাকিরা বাড়ির বাইরে চলে গেল।

    অরুন্ধতী উঠে দাঁড়াল। বলল, “সরি”।

    প্রিয়ম শুনল নাকি বুঝল না অরুন্ধতী। সে বেরিয়ে গেল।

    প্রিয়ম উঠে দরজা বন্ধ করল। অনেক কৌতূহলী মুখ এই ভোরেও উঁকি দিচ্ছে।

    আলমারি খোলা। তালা ভেঙে ফেলা হয়েছে।

    খাটের তোষক তোলা।

    প্রিয়ম কোন মতে বিছানা করে খাটে শুয়ে পড়ল।

    সারারাত অনেক ঝক্কি গেছে।

    ফ্যানের দিকে তাকাল সে। ঘুমের ওষুধ খেয়ে এভাবেই ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।

    একসময় চোখ বন্ধ হয়ে আসে।

    ঘুম আসছে…

    তীব্র ঘুম।

    প্রিয়ম চোখ বুজল।

    দুপুর তিনটে নাগাদ ঘুম থেকে উঠে বসল সে।

    ক্ষিদে পেয়েছে।

    হাড়িতে গতরাতের ভাত লেগে আছে। সব ভাত ফেলে হাড়ি পরিষ্কার করে ভাত বসিয়ে দিল।

    ঘি ভাত খেতে হবে।

    ভাত বসিয়ে বাড়ির পিছনের দিকে গেল সে। মাটি খোঁড়া হয়েছে।

    খানিকটা জংলা জায়গা। পেছনে পাঁচিল।

    প্রিয়ম পাঁচিল ডিঙিয়ে হাঁটতে শুরু করল।

    বীরুদা বাড়ির সামনে বসে বিড়ি খাচ্ছে।

    তাকে দেখে হাসল, “সারারাত ভারি দৌড় করালো বল?”

    প্রিয়ম উত্তর না দিয়ে বীরুদার বাড়ি ঢুকে গেল।

    বীরুদা বাইরেই রইল।

    ঘরের ভেতরে একটা ট্রাঙ্ক রাখা। প্রিয়ম ট্রাঙ্ক খুলল।

    স্বাতীর মুখে কাপড় বেঁধে রাখা।

    তাকে দেখে ছটফট করতে লাগল।

    প্রিয়ম স্বাতীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “ফ্লাইওভার চাপা পড়ে মানুষ মারা যায় জানো স্বাতী? তাদের চিনতেও পারা যায় না। আমাকে ভালবাসবে না তো কাকে ভালবাসবে? এন আর আই বর চেয়েছিলে না? সারাজীবন এখানেই থাকো। ট্রাঙ্ক বউ হয়ে”।

    স্বাতীর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।

    প্রিয়ম বলল, “ক’টা দিন যাক। আমার কাছেই থাকবে। টিকটিকি লেগেছে তো। এখন একটু কষ্ট কর। আসি, কেমন?”

    প্রিয়ম ট্রাঙ্কটা বন্ধ করে দিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হল।

    কত কাজ এখনো।

    ভাত নামাতে হবে।

    ঘর পরিষ্কার করতে হবে।

    বীরুদা নিশ্চিন্ত মনে বিড়ি খেয়ে যেতে লাগল…

    ⤷
    1 2
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরাজকন্যের সন্ধানে – অভীক দত্ত
    Next Article অপারেশন জন্নত – অভীক দত্ত

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }