Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    অ্যাম্পায়ার অব দ্য মোঘল : রাইডারস ফ্রম দ্য নর্থ – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড

    লেখক এক পাতা গল্প802 Mins Read0
    ⤷

    ১.১ প্রথম খণ্ড – তৈমূরের উত্তরাধিকারী

    অ্যাম্পায়ার অব দ্য মোঘল – রাইডারস ফ্রম দ্য নর্থ
    মূল : অ্যালেক্স রাদারফোর্ড
    অনুবাদ : সাদেকুল আহসান কল্লোল

    উৎসর্গ : রাকিবুল হাসান

    .

    প্রধান চরিত্রসমূহ বাবরের পরিবার আর আত্মীয়স্বজন আহমেদ, সমরকন্দের সুলতান, বাবরের চাচাজান এসান দৌলত, বাবরের নানীজান জাহাঙ্গীর, বাবরের সৎ-ভাই। খানজাদা, বাবরের বড়বোন। খুতলাঘ নিগার, বাবরের আম্মিজান উমর শেখ, বাবরের আব্বাজান, ফারগানার সুলতান

    বাবরের স্ত্রীরা আয়েশা, মাঙ্গলিঘ গোত্রের প্রধানের কন্যা মাহাম, হুমায়ূনের মা এবং বাবরের প্রিয়তম স্ত্রী গুলরুখ, কামরান আর আসকারীর মা বিবি মুবারক, ইউসুফজাই গোত্রপ্রধানের কন্যা দিলবার, হিন্দালের মা

    বাবরের পুত্র হুমায়ূন। কামরান। আসকারী হিন্দাল

    বাবরের আত্মীয় সম্পর্কীয় ভাইয়েরা আজাদ খান, ফারগানার অভিজাত ব্যক্তি মাহমুদ, কুন্দুজের সুলতান মির্জা খান, ফারগানার এক গোত্রপতি তামবাল, ফারগানার অভিজাত ব্যক্তি

    বাবরের বিশ্বস্ত পারিষদবর্গ বাবুরী, বাজারে বড় হওয়া এক ছেলে এবং বাবরের বিশ্বস্ত বন্ধু বাইসানগার, সমরকন্দের এক সেনাপতি, পরবর্তীতে বাবরের বিশ্বস্ত অধিনায়ক এবং তৎপরবর্তীকালে বাবরের শ্বশুর কাশিম, বাবরের অন্যতম রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং তার হয়ে প্রায়শই দৌত্যের দায়িত্ব পালনকারী ওয়াজির খান, তার পিতার দুধ-ভাই, বাবরের পরামর্শদাতা এবং বাল্যকালে আর সুলতান হবার প্রথম দিকে বাবরের অভিভাবক আবদুল মালিক, ব্যক্তিগত চিকিৎসক

    ফারগানা বাবা কাশক, শাহী মহাফেজ বাকি বেগ, শাহী জ্যোতিষ ফাতিমা, প্রধান খিদমতগার কামবার আলী, উজির রেহানা, এক বৃদ্ধা যার দাদা তৈমূরের সাথে দিল্লী আক্রমণে অংশ নিয়েছিল রোক্সানা, বাবরের পিতার রক্ষিতা এবং জাহাঙ্গীরের মা ওয়ালিদ বাট্ট, এসান দৌলতের খিদমতগার ইয়াদগার, ফারগানার বেশ্যালয়ে বাবরের প্রিয় গণিকা ইউসুফ, কোষাধ্যক্ষ

    বাবরের অনুগত উপজাতীয় গোত্রপতি আলী দোস্ত, পশ্চিম ফারগানার এক গোত্রপতি আলী ঘোসত, বাবরের প্রধান অশ্ব-পালক এবং পরবর্তীতে প্রধান রসদ সরবরাহকারী আলি মজিদ বেগ, শাহরুখিয়ার জমিদার বাবা ইয়াসাভাল, হিরাটের নিকটবর্তী কোনো স্থানের যোদ্ধা হুসেনি মজিদ, আলি মজিদ বেগের সম্পর্কীয় ভাই এবং গোত্রপতি

    মধ্য এশিয়ায় বাবরের প্রধান শত্রু সাইবানি খান, শক্তিশালী উজবেক দলপতি এবং বাবরের গোত্রের আর তৈমূরের বংশধরদের এক পরাক্রমশালী শত্রু

    পারস্য পারস্যের শাহ ইসমাইল মোল্লা হুসাইন, শাহ ইসমাইলের অধীনস্ত এক শিয়া মোল্লা

    তূর্কী আলি কুলী, ওস্তাদ-গোলন্দাজ

    কাবুল বাহলুল আইয়ুব, গ্রান্ড উজির হায়দার তকী, রাজকীয় সিলমোহরের রক্ষক। মুহাম্মাদ-মুকাঈম আর্গহান, হাজারাদের প্রধান ওয়ালি গুল, রাজকীয় কোষাগারের রক্ষক

    হিন্দুস্তান বুয়া, ইবরাহিম লোদীর মা। ফিরোজ খান, হিন্দুস্তানী জমিদার গোয়ালিয়রের রাজপরিবার, বিখ্যাত কোহ-ই-নূর, পর্বতের আলো, হীরক খণ্ডের মালিক রানা সাঙগা, রাজপুত রাজ্য মেওয়ার রাজা সুলতান ইবরাহিম লোদী, দিল্লী সালতানাতের সুলতান এবং হিন্দুস্তানের অধিরাজ রোশান্না, বুয়ার খিদমতগার

    বাবরের পূর্ব–পুরুষ চেঙ্গিস খান। তৈমূর, পশ্চিমে যাকে তৈমূর লঙ বলা হয়

    .

    আলোর পর্বত

    কোনো অভিযোগ জানাতে আমি লেখনীর আশ্রয় নেইনি; আমার উদ্দেশ্য ছিলো সত্য বয়ান। নিজের প্রশংসা করাও আমার অভিপ্রায় ছিলো না, কেবল ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ছিলো আমার অভীষ্ট। এই ইতিহাসে আমি সত্যের আশ্রয়ে সবকিছু লিপিবদ্ধ করতে চেয়েছি। তার ফলশ্রুতিতে আব্বাজান, আত্মীয় বা আগন্তুকের ভিতরে যা কিছু ভালো বা মন্দ দেখেছি তার সবই আমি লিপিবদ্ধ করার প্রয়াস নিয়েছি। পাঠক আমার সীমাবদ্ধতা ক্ষমা করবেন…
    —বাবরনামা, মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা

    .

    প্রথম খণ্ড – তৈমূরের উত্তরাধিকারী

    ০১.

    গেরোবাজের চবুতরায় সংহনন

    ১৪৯৪ সালের গ্রীষ্মকাল, মধ্য এশিয়ার এক ধূলিময় দূর্গের পোড়া-মাটির প্রাকারবেষ্টিত সমতল ছাদ, দিনের আলোয় যা হাতির চামড়ার মত ধূসর দেখায়, সূর্যাস্তের সময় বাবরের চোখের সামনে এখন সেটাই গোলাপী বর্ণ ধারণ করে। অনেক নিচে জাক্সারটেস নদী ক্রমশ অন্ধকার হয়ে উঠা ভূখণ্ডের দিকে বয়ে যাবার সময়ে একটা স্লান লাল আভার জন্ম দিয়ে যায়। পাথুরে ধাপের উপরে বাবর নড়েচড়ে দাঁড়ায় এবং তার বাবা, এই দূর্গের সুলতানের প্রতি আবার মনোযোগ দেয়। দূর্গের সমতল ছাদে এই মুহূর্তে তিনি তার পরনের আলখাল্লার ফিরোজা রঙের কোমরবন্ধনীতে দু’হাত দৃঢ়মুষ্ঠি করে পায়চারী করছেন। তার বারো বছরের ছেলে আগে বহুবার যে গল্প শুনেছে, সেটা আবার তিনি নতুন করে বলতে শুরু করলে তার চোখে মুখে উত্তেজনার ছন্দ ফুটে উঠে। বাবরের কিন্তু মনে হয় গল্পটা বারবার শুনবার মতো। সে, গল্পটা নতুন করে বলার সময় এর সাথে প্রতিবার যে আনকোরা উপাদান যোগ হয়, সেটা শোনার জন্য কান খাড়া করে থাকে। তার বাবা। গল্পের পরিণতির দিকে এগিয়ে আসলে, সে বাবার কথা বলার সাথে ঠোঁট মেলায়-গল্পের এই একটা অংশ কখনও বদলায় না, তেজোদীপ্ত প্রতিটা শব্দ অলঙ্নীয়ভাবে প্রতিবার উচ্চারিত হয়।

    “এবং অবশেষে ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় যে, আমাদের পূর্বপুরুষ মহান তৈমূর যোদ্ধা তৈমূর, যার নামের মানে ‘লোহা’ আর পৃথিবীর উপর দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে দাবড়ে যাবার সময়ে তার অশ্বপালের গা থেকে ঘামের মত রক্ত ঝরতো- একটা বিশাল সাম্রাজ্য জয় করেন। যুবক বয়সে যদিও মারাত্মকভাবে জখম হবার কারণে তার এক পা অন্য পায়ের চেয়ে লম্বা হয়ে গিয়েছিল এবং হাঁটবার সময়ে তিনি সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। তিনি তারপরেও দিল্লী থেকে ভূমধ্যসাগর, সমৃদ্ধ পার্সিয়া থেকে ভলগার অরণ্যভূমি পর্যন্ত একটা বিশাল এলাকা জয় করেছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো সেটা কি তৈমূরের জন্য যথেষ্ট ছিলো? প্রশ্নই ওঠে না! তার শরীর তখনও। শক্তিশালী আর প্রাণবন্ত, পাথরের মত শক্ত তার দেহ আর অফুরন্ত তার আকাঙ্ক্ষা, জীবনের আরো অনেকগুলো বছর তার তখনও উপভোগ করা বাকী। নব্বই বছর আগে চীনের বিরুদ্ধে অভিযানই ছিলো তার শেষ অভিযান। দু’লক্ষ অশ্বারোহী বাহিনীর নির্ভরতার বরাভয়ে তিনি অভিযানে বেরিয়েছিলেন এবং অবশ্যই বিজয় তার পদচুম্বন করতো, যদি আল্লাহতালা তাকে বেহেশতে নিজের সান্নিধ্যে ডেকে না। নিতেন। কিন্তু তৈমূর, মহান যোদ্ধাদের ভিতরে মহানতম- এমন কি তোমার আরেক পূর্বপুরুষ চেঙ্গিস খানের চেয়েও মহান- কিভাবে এসব সম্ভব করেছিলেন? বাছা, তোমার চোখে আমি এই প্রশ্নটাই ভাসতে দেখছি, এবং তোমার অধিকার আছে সেটা জিজ্ঞেস করবার।”

    পরম মমতায়, সুলতান তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, তার দিকে বাবরের টানটান মনোযোগ খেয়াল করেন। তারপরে তিনি আবার বলতে শুরু করেন, কুশীলবের পারঙ্গমতায় তার কণ্ঠস্বরে তখন আবেগ খেলা করতে থাকে।

    “তৈমূর ছিলেন সাহসী আর ধূর্ত কিন্তু তার বড় পরিচয় তিনি ছিলেন একজন জাত নেতা। আমার দাদা আমাকে বলেছিলো তার চোখ ছিলো মোমবাতির আলোর মত দূতিহীন, নিষ্প্রভ। মানুষেরা স্তব্ধ আলোর সেই ফাটলের দিকে একবার তাকালে আর চোখ ফিরিয়ে নিতে পারতো না। এবং তৈমূর তাদের আত্মার দিকে তাকিয়ে সেই গৌরবের কথা শোনাতেন শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে যার প্রতিধ্বনি শোনা যাবে এবং পৃথিবীর বুকে তাদের থেকে যাওয়া দেহাস্থির প্রাণহীন ধূলোয় ঘূর্ণি তুলবে। চকচকে সোনা আর দূতিময় রত্নের কথা তিনি শোনাতেন। তার রাজধানী সমরকন্দের দাসবাজারে রেশমের মত কালো চুলের যেসব নিটোল গড়নের মেয়েদের তারা দেখেছে, তিনি তাদের কথা বলতেন। এসব ছাড়াও তিনি তাদের জন্মগত অধিকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন। পৃথিবীর অধিশ্বর হবার বকেয়া অধিকারের কথা তাদের মনে করিয়ে দিতেন। তাদের চারপাশে তৈমূরের মন্দ্র কণ্ঠস্বর বয়ে গিয়ে, তাদের মানসপটে সেইসব দৃশ্যের অবতারণা করতো, যা কেবল তাদের পদানত হবার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে আর শীঘ্রই তারা নরকের জ্বলন্ত তোরণের নিচে তার অনুগামী হতো।

    “বাছা, তাই বলে তাকে বর্বর ভেবো না।” সুলতান প্রচণ্ড ভঙ্গিতে মাথা নাড়লে তার লালচে-খয়েরী রঙের সিল্কের পাগড়ীর সঞ্জাব এপাশ ওপাশ দুলতে থাকে। “না। তিনি ছিলেন একজন সংস্কৃতিবান মানুষ। তার প্রিয় সমরকন্দ ছিলো রুচি আর সৌন্দর্য, জ্ঞান আর পৃষ্ঠপোষকতার শহর। কিন্তু তৈমূর একটা কথা খুব ভালো করে জানতেন যে, একজন বিজয়ীর সামনে কোনো কিছুই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। অভিযান সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত নির্মমতা তার মনপ্রাণ অধিকার করে রাখতে এবং যতবেশি মানুষ সেটার পরিচয় পেতো ততোই মঙ্গল।” তিনি নিজের চোখ বন্ধ করেন এবং পূর্বপুরুষের বিস্ময়কর গৌরবময় দিনগুলো যেনো মানসপটে দেখতে পান। গর্ব আর উত্তেজনার এমন তীব্র একটা রেশ তাকে জারিত কমে যে, তার কপালে স্বেদবিন্দু দেখা দেয়। একটা হলুদ রুমাল বের করে তিনি কপালের ঘাম মোছেন।

    বাবর তার বাবার বাচনশৈলীতে সৃষ্ট দৃশ্যকল্পে বরাবরের মতই উল্লসিত হয়ে উঠে। তার দিকে তাকিয়ে হাসে, দেখাতে চায় একই হর্ষোৎফুল্ল গর্বের সেও সমান অংশীদার। কিন্তু সে তাকিয়ে থাকা সত্ত্বেও তার বাবার মুখের অভিব্যক্তি বদলে যায়। তার গভীর চোখে জন্ম নেয়া ঐকান্তিক আলো ম্লান হয়ে আসে এবং সেখানে হতাশার জন্ম হয়। সেখান থেকে আসে বিষণ্ণতা। বাবরের হাসি আড়ষ্ঠ হয়ে উঠে। তার বাবার গল্প সচরাচর তৈমূরের বন্দনার ভিতর দিয়ে শেষ হয়, কিন্তু আজ যেন সুলতানকে কথায় পেয়ে বসেছে। তিনি কথা চালিয়ে যান তার কণ্ঠের উদ্দীপনা মিলিয়ে গিয়ে সেখানে বিষণ্ণ নিরানন্দভাব ফুটে উঠে।

    “কিন্তু আমি যদিও আমি মহান তৈমূরের উত্তরপুরুষ-আমার কি আছে? কেবল ফারগানা। এমন একটা রাজ্য যা টেনেটুনে দুইশ মাইল লম্বা বা একশ মাইল চওড়া। চারদিকে তাকিয়ে দেখো- তিনদিকে পাহাড়বেষ্টিত একটা উপত্যকা, যেখানে কেবল ভেড়া আর ছাগলের গলার ঘণ্টার আওয়াজ শোনা যায়।” মেঘাবৃত বেস্তর পর্বতের সুউচ্চ চূড়ার দিকে তিনি হাত তোলেন। “অথচ পশ্চিমে তিনশ মাইল দূরে আমার ভাইয়েরা স্বর্ণমণ্ডিত সমরকন্দের শাসক। আর দক্ষিণে হিন্দুকুশের ওপারে আমার অন্য ভাইয়েরা সমৃদ্ধ কাবুল কজা করে রেখেছে। গরীব আত্মীয় হিসাবে আমি তাদের অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্যের পাত্র। যদিও আমার ধমনীতে- তোমার ধমনীতেও তাদের মত একই রক্ত প্রবাহিত।”

    “আব্বাজান-”

    “আমরা সবাই যদিও তৈমূর বংশের শাহ্জাদা।” আবেগের আতিশয্যে তাকে থামিয়ে দিয়ে সুলতান বলতে থাকেন, তার সাথে আমাদের কাকে তুলনা করবে? তার বিশাল সাম্রাজ্যের ক্ষুদ্র ভূখণ্ড নিজেদের আয়ত্ত্বে রাখতে আমরা মামুলি গোত্রপতিদের মতো নিজেদের ভিতরে তুমুল ঝগড়ায় ব্যস্ত। বাকি সবার মতো আমিও একই দোষে দোষী।” তার কণ্ঠস্বরে এবার ক্রোধের রেশ পরিষ্কার টের পাওয়া যায়। “তৈমূর যদি আজ জীবিত থাকতেন তবে এই মূর্খতার কারণে আমাদের মুখ দর্শন করতেন না। মির্জা বলে নিজেদের পরিচয় দিতে আমরা গর্ববোধ করি, ‘আমিরের বংশধর, তাকে আমাদের পূর্বপুরুষ হিসাবে উল্লেখ করতে ব্যগ্র হয়ে থাকি, কিন্তু তিনি কি আমাদের নিজের বংশধর বলে স্বীকার করতেন? নিজেদের মহত্ত্ব আর উত্তরাধিকার খুইয়ে ফেলার কারণে কি আমাদের তার সামনে নতজানু হয়ে করুণা ভিক্ষা করা উচিত না?”

    সুলতান কঠোর হাতে বাবরের কাঁধ এতো জোরে আঁকড়ে ধরেন যে সে ব্যথা পায়। “বোঝার মতো বয়স তোমার এখন হয়েছে। আমি সে কারণেই এসব কথা তোমাকে বলছি। আমরা তৈমূরের কাছে ঋণী। বাছা আমার, তিনি ছিলেন একজন মহান মানুষ। তোমার ধমনীতে তার রক্তই বইছে। এটা কখনও ভুলে যেয়ো না। যদি পার তারমতো হতে চেষ্টা করবে। তোমার নিয়তির প্রত্যাশা যেনো পূর্ণ হয়, আর সেটা যেনোনা হয় আমার চেয়ে বড়।”

    “আব্বাজান আমি চেষ্টা করবো… আমি কথা দিলাম।”

    বাবরের চোখের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে সুলতান কিছু একটা দেখতে চান। তারপরে সন্তুষ্টচিত্তে, একটা অব্যক্ত শব্দ করে তিনি ঘুরে দাঁড়ান। বাবর সেখানেই চুপ করে বসে থাকে। তার বাবার অপ্রত্যাশিত আবেগ বোধহয় তাকেও স্পর্শ করেছে। তিনি এইমাত্র যা বলে গেলেন সেটা আত্মস্থ করার ফাঁকে, সে তাকিয়ে দেখে যে সূর্য প্রায় অস্তমিত হয়েছে। অন্যান্য দিনের সন্ধ্যার মত, গোধূলির শেষ আলোয় সে দেখে উঁচু-নিচু দৃশ্যপট আবছা হয়ে এসেছে। আধো-অন্ধকার প্রেক্ষাপটের ভেতর থেকে বের হয়ে এসে রাখাল বালকের দল তাদের ভেড়া আর ছাগলের পাল নিয়ে গ্রামের দিকে ফিরে যায়। সেইসাথে কবুতরের ব্যগ্র জোরাল ডাক ভেসে আসে। তার বাবার প্রিয় সাদা পায়রার দল চবুতরায় ফিরে ডানা ঝাপটাচ্ছে।

    তার বাবার ঠোঁট থেকে একটা মৃদু দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসবার শব্দ বাবরের কানে আসে, যেন সে স্বীকার করে যে জীবনের প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির হিসাব মেলানো এখনও বাকী আছে। সে সুলতানকে তার কোমরে ঝোলান চামড়ার ছোট বোতল থেকে একঢোক পানি পান করতে দেখে এবং মুখাবয়বে আবার প্রশান্তির ভাব ফুটে উঠতে, তিনি ঘুরে দাঁড়ান এবং দেয়ালের শীর্ষভাগে অবস্থিত চোঙাকৃতি কবুতরের বাসার দিকে ছাদের উপর দিয়ে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে যান, যা নিচের শুষ্ক গিরিখাদের উপরে আংশিক ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। পোড়া মাটির মেঝেতে তার পায়ের সোনার জরি দেয়া লাল মখমলের নাগরার শব্দ শোনা যায় এবং তার প্রিয় কবুতরকে উড়ে এসে হাতে বসার আমন্ত্রণ জানিয়ে আর তাদের নধর গলায় প্রেমিকের কোমলতায় হাত বুলিয়ে দেবার অভিপ্রায়ে তিনি ইতিমধ্যে দু’হাত প্রসারিত করে দিয়েছেন। বাবর পুরো বিষয়টার ভিতরে কোনো আকর্ষণ খুঁজে পায় না। নধর মাংসের উড়ন্ত দেহ। তাদের জন্য শ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা হলো পালক ছাড়িয়ে নিয়ে আখরোট গুঁড়ো আর ডালিমের আখনিতে হাল্কা আঁচে জ্বাল দেয়া।

    বাবরের কল্পনায় আবার তৈমূর আর তার পরাক্রমশালী বাহিনী ফিরে আসে। সারা পৃথিবী তোমার, এমন অনুভূতির আমেজটা কেমন? কোনো শহর দখলের পরে শহরের সুলতানকে তোমার পায়ের কাছে কাতরাতে দেখা? তার বাবার কথাই ঠিক। ছোট্ট এই ফারগানার শাসক হবার থেকে কি আলাদা সে অভিজ্ঞতা। আব্বাজানের দরবারের তুচ্ছ রাজনীতির মারপ্যাঁচ দেখে সে বিরক্ত। প্রধান উজির কামবার-আলী যার ঘামে ভেজা আলখাল্লা থেকে সবসময়ে বুড়ো খচ্চরের মত দুর্গন্ধ বের হয়। হলুদ হয়ে যাওয়া লম্বা দাঁতের কারণে তাকে অবশ্য সেরকমই দেখায়। আর সবসময়েই সে বিপদের আঁচ পাচ্ছে। রক্তলাল চোখে সে সবসময়ে ব্যগ্র কেউ তাদের কথা শুনছে কি না খুঁজতে। তার বাবার কানের কাছে অনবরত ফিসফিস করে কথা বলে চলেছে। তৈমূর এই কুৎসিত নির্বোধটার মাথা বিন্দুমাত্র ভাবনার অবকাশ না দিয়ে ধড় থেকে আলাদা করে দিতেন। বাবর ভাবে, অচিরেই, যখন সে সুলতানের পদে অভিষিক্ত হবে, সম্ভবত সে নিজেই সেটা করবে।

    শীঘ্রই নামাযের ওয়াক্ত হবে আর তারপরে জেনানামহলে খেতে যাবার সময়। সে সিঁড়ির ধাপ থেকে লাফিয়ে নামে। ঠিক সেই মুহূর্তে প্রচণ্ড শব্দে সে কিছু একটা ভেঙে পড়তে শোনে, তার পায়ের নিচে ছাদের মেঝে কেঁপে উঠে। কয়েক লহমা পরে কিছু একটা ধ্বসে পড়ার ভেতা আওয়াজ ভেসে আসে। একহাত দিয়ে দেয়াল ধরে সে নিজেকে আগে ধাতস্থ করে এবং বুঝতে পারে চোখে কিছু দেখছে না। এসব কিসের আলামত? মাঝে মাঝে দূর্গকে যা কাঁপিয়ে তোলে সেরকম আরেকটা ভূমিকম্প? না, এবারের শব্দটার ধরণ আলাদা ছিলো। অভিঘাতের উত্তেজনায় সে নিজের অজান্তেই শ্বাসরোধী ধূলিকণা বুকে টেনে নেয় আর চোখ ছাপিয়ে পানির ধারা নেমে আসে দৃষ্টি স্বচ্ছ করার অভিপ্রায়ে। সহজাত প্রবৃত্তিতে বাবর মাথা আর মুখ আড়াল করে। এমন সময়ে সে দ্রুত কারো দৌড়ে আসবার শব্দ শুনতে পায়। এবং টের পায় একজোড়া শক্ত হাত তাকে আঁকড়ে ধরে এবং তুলে পেছনে নিয়ে আসে। “শাহজাদা, আপনি এখন নিরাপদ।”

    ভারী কণ্ঠস্বরটা তার পরিচিত। তার বাবার দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধান ওয়াজির খানের কণ্ঠ। “কি বলতে চান আপনি…?” কথা বলতে তার রীতিমত কষ্ট হয়: মুখের ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ আর কেমন কাঁকড়ময় একটা অনুভূতি এবং জিহ্বার আকৃতি যেনো সহসা মুখের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। তার কথা কেমন জড়ান আর দুর্বোধ্য শোনায় এবং সে আবার বলতে চেষ্টা করে। “কি হয়েছিলো…?” অনেক কষ্টে সে বলে। “ভূমিকম্প ছিল না, তাই না?”

    প্রশ্নটা করে বাবর নিজেই অনেক কষ্টে তার পানিপূর্ণ চোখের পাতা খুলে এবং উত্তরটা নিজের চোখেই দেখতে পায়। ছাদের যেখানে পায়রার চবুতরা ছিল সেখানের একটা বিশাল অংশ বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে, যেনো কোনো অতিকায় হাত পিঠার একটা কোণা ভেঙে নিয়েছে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে শুষ্ক আর ফাটল ধরা অংশটা আর ভার বহন করতে পারেনি। কবুতরের দল বাতাসে তুষারকণার মত উড়াউড়ি করছে।

    দীর্ঘকায় সৈনিকের নিরাপদ বাহুর বেষ্টনী থেকে মোচড় খেয়ে মুক্ত হয়ে বাবর সামনের দিকে এগিয়ে যায়। বাবাকে আর দেখতে পাবে না এই অনুভূতিটা সহসা তার পেটের ভেতরে একটা বিশাল শূন্যতার জন্ম দেয়। সুলতানের ভাগ্যে কি ঘটেছে? “সুলতান, অনুগ্রহ করে পিছনে সরে আসেন।”

    বাবর ধবংসস্তূপে পরিণত হওয়া ছাদের টিকে থাকা অংশের উপর দিয়ে সন্তপণে এগিয়ে গিয়ে নিচের গিরিখাতের দিকে উঁকি দিতে তার কপালে শীতল ঘামের সৃষ্টি হয়। ধীরে ধীরে থিতিয়ে আসা ধূলোর কুয়াশার ভিতর দিয়ে সে কবুতরের চবুতরা আর দেয়ালের ভেঙে পড়া অংশটুকু নিচের পাথুরে ভূমিতে শতধাবিভক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে দেখতে পায়। সেখানে তার বাবার কোনো চিহ্ন সে খুঁজে পায় না। তারপরে বাবর পাথরের ফাটলে জন্ম নেয়া একটা ঝোঁপের ডালে তার বাবার লালচে-খয়েরী রঙের পাগড়িটা কাত হয়ে ঝুলে থাকতে দেখে। চবুতরার সাথে সে নিশ্চয়ই নিচে আছড়ে পড়েছে। ভেতর থেকে উঠে আসা ভয়ের একটা কাঁপুনি দমন করে বাবর ভাবে, সুলতান ধ্বংসস্তূপের নিচে আহত অবস্থায় চাপা পড়েছেন এবং সম্ভবত মৃত।

    সে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এমন সময় দূর্গের পাদদেশে অবস্থিত তোরণ থেকে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে সৈনিকেরা বেরিয়ে এসে পাথরের উপর দিয়ে দ্রুত গিরিখাদের ভেতরে নামতে শুরু করে।

    “অপদার্থের দল, জলদি করো!” ওয়াজির খান বাবরের পাশে এসে তাকে পুনরায় নিরাপদ বেষ্টনীর মধ্যে নিয়ে সৈনিকদের লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে ওঠে। তারা দুজনে নিরবে সন্ধ্যার ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে সৈনিকদের মশালের কমলা আভায় তাদের ধবংসস্তূপ সরিয়ে খুঁজতে দেখে। একজন একটা মৃত কবুতর খুঁজে পায় এবং ক্ষুদ্র নিথর দেহটা অপাংক্তেয়ভাবে একপাশে ছুঁড়ে ফেলে। কোথা থেকে একটা বাজপাখি এসে- ছো মেরে মৃত কবুতরটা নিয়ে আবার আকাশে উড়ে যায়।

    “আব্বাজান…” বাবর তার দেহের কাঁপুনি কিছুতেই থামাতে পারে না। নিচের গিরিখাদে উদ্ধারকারী দল পাথর আর মাটির একটা বড় চাই সরাতে সে তার নিচে কাপড়ের টুকরোর মত কিছু একটা দেখতে পায়। বাবার আলখাল্লার অংশ। কিছুক্ষণ আগেই সেটার রঙ ছিল ধুসর আকাশী। এখন রক্তে ভিজে সেটা লাল আর নীলের মিশ্রণে রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। আরও কিছু অধীর মুহূর্ত অতিক্রান্ত হয়। সৈনিকেরা তার বাবার দেহ ধবংসস্তূপের নীচ থেকে বের করে নিয়ে আসে। উপর থেকে বাবরের কাছে সেটা কবুতরের নিথর দেহের মত দোমড়ানো প্রাণহীন মনে হয়। সৈনিকেরা এবার উপরে দাঁড়িয়ে থাকা সেনাপতির দিকে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে নির্দেশের জন্য তাকায়।

    ওয়াজির খান ইশারায় সুলতানের দেহটা তাদের দূর্গের অভ্যন্তরে নিয়ে আসতে বলে। আদেশটা দিয়ে সে বাবরকে আরও ভেতরের দিকে নিয়ে এসে আলতো করে তার দৃষ্টি ধ্বংসযজ্ঞের দিক থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে। তার চোখে-মুখে এখন কঠোর অভিব্যক্তি, সেই সাথে বাবরের দিকে তাকাতে সেখানে বুঝি চিন্তার ঝিলিক দেখা যায়। তারপরে সে হাঁটু ভেঙে মাটিতে বসে সেজদার ভঙ্গিতে কপাল মাটিতে ঠেকায়। “মির্জা বাবর ফারগানার নতুন সুলতানের জয় হোক। আপনার পিতার রুহ্ পাখির মত উড়ে যেন বেহেশতের দ্বার অতিক্রম করে।”

    বাবর একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন সে এইমাত্র যা বলেছে সেটা বুঝতে চেষ্টা করে। তার পিতা- কিছুক্ষণ আগেও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর একটা মানুষ- ফারগানার সুলতান, এখন মৃত। সে আর কখনও তার কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে না, বা মাথায় তার ভারী হাতের উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করবে না, বা ভালুকের প্রবলতায় বাবা আর কখনও তাকে আলিঙ্গন করবে না। ফারগানার উপত্যকায় শিকারের অভিযানে সে আর কখনও তার সঙ্গী হবে না। তাঁবুর আগুনের সামনে তার পাশে গুটিসুটি হয়ে বসে রাতের বাতাসে সৈন্যদের গানের গুনগুন শব্দ মিশে যেতে শুনবে না। বাবর নিরবে কাঁদতে শুরু করে। তারপরে পেটের গভীর থেকে উঠে আসা তীক্ষ্ণ বিলাপে তার কিশোর দেহ কেঁপে কেঁপে উঠে।

    কান্নার ভিতরেই সন্দেহ আর অনিশ্চয়তা, সেই সাথে তীব্র শোক তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এখন সে সুলতান… তার বংশগৌরব, মৃত্যুর আগ মুহূর্তে বাবার বলে যাওয়া আশা কি সে পূরণ করতে পারবে? কোনো অব্যক্ত কারণে তার বাবার মুখাবয়বের বদলে সেখানে কৃশ আরো বৃদ্ধ একজনের মুখ, যার চোখের নিম্নাংশের হাড় বেশ বেঁকে নেমে এসেছে এবং শীতল আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চোখে “দীপ্তিহীন মোমের আলো”র মত দৃষ্টি ভেসে উঠে। আর সেটা ভেসে উঠতে সে যেনো তার বাবার মন্ত্রগুপ্তির মতো আউড়ানো কথাগুলো শুনতে পায়: “তৈমূরের রক্ত আমার ধমনীতে প্রবাহিত।” নিজের অজান্তে সে কথাটার পুনরাবৃত্তি শুরু করে, প্রথমে আস্তে আস্তে পরে সেখানে প্রত্যয়ের বরাভয় বেশ অনুভব করা যায়। তৈমূর আর তার বাবা দু’জনের প্রত্যাশাই সে সফল করবে। বুক টান করে দাঁড়িয়ে ধূলিধূসরিত অশ্রুসিক্ত মুখ আলখাল্লার হাতায় মুছে নিয়ে সে ঘুরে দাঁড়ায়। “এইমাত্র এখানে যা ঘটে গেছে সেটা আমিই আম্মাজানকে বলবো।”

    ***

    উত্তেজিত হওয়া সত্ত্বেও কামবার আলি স্পষ্ট টের পান তার অল্প বয়সী সুন্দরী স্ত্রী ফরিদা আজ অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি যন্ত্রবৎ সহবাসের দাম্পত্য দায়িত্ব পালন করছে। নানা কারণে প্রধান উজিরের মন আজ বিক্ষিপ্ত অশান্ত হয়ে রয়েছে। সুলতানের আকস্মিক অসাধারণ শাহাদাতবরণ তাকে গভীর চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। আর এ থেকে লাভবান হতে চাইলে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য তার হাতে সময় খুবই কম। বারো বছরের এক বালক সুলতান হবে? হতে পারে… কিন্তু আবার না হলেই বা কি ক্ষতি। কুঁচকিতে দ্রুত পানির ছিটে দিয়ে সে জরির কাজ করা ঘন নীল রঙের আলখাল্লা গায়ে কোনোমতে জড়িয়ে নিয়ে পেছনে একবারও না তাকিয়ে ফরিদার কামরা থেকে বের হয়ে যায়।

    দপদপ করে জ্বলতে থাকা তেলের প্রদীপে আলোকিত দূর্গের আভ্যন্তরীণ গলিপথের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যাবার সময়ে শাহী হারেম থেকে ভেসে আসা বিলাপের ধ্বনি সে শুনতে পায়। বাবরের মা আর নানিজান, আঁদরেল দুই মহিলা, তাদের যুগল কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে সামান্য যেটুকু সংশয় অবশিষ্ট ছিল সেটাও দূর হয়। আনুষ্ঠানিক শোকপ্রকাশ তাহলে শুরু হয়েছে। এই দুজনের ব্যাপারে সর্তক থাকতে হবে। তারা শোকে এতটা দিশেহারা হবে না যে, বাবরের স্বার্থ কিংবা নিরাপত্তার বিষয়ে তাদের কোনো খেয়াল থাকবে না।

    প্রধান উজির রাজকীয় দরবারের দিকে এগিয়ে যায়, যেখানে সে অন্যান্য রাজকীয় অমাত্যদের ডেকে পাঠিয়েছে। দরবারের সবুজ চামড়ার উপরে পিতলের গজাল আটকানো দরজা দু’জন প্রহরী ভেতরে প্রবেশের জন্য খুলে ধরতে, সে দেখে তিনজন রাজ-কর্মচারি ইতিমধ্যে সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছে: ইউসুফ, রাজকীয় কোষাগারের নির্ভীক কোষাধ্যক্ষ, কোষাগারের সোনালী চাবি একটা লম্বা চেনের সাহায্যে তার চওড়া গলায় ঝুলছে; বাকি বেগ, রাজ-জ্যোতিষী, যার রুগ্ন অস্থির আঙ্গুল তসবী জপছে; এবং লোমশ ভ্রর পাকানো তারের মত শরীরের বাবা কাশক রাজকীয় বাজার সরকার। ওয়াজির খান কেবল অনুপস্থিত।

    শূন্য সিংহাসনের নিচে সুন্দর নকশা করা পুরু লাল গালিচার উপরে অসম দর্শন তিনজন আসন-পিঁড়ি হয়ে বসে অপেক্ষা করছে। অধিকার শূন্য বিধায় সিংহাসনটাকে ছোট, গুরুত্বহীন আর মলিন দেখায়, সোনার গিল্টিতে হাল্কা দাগ পড়েছে। আর লাল মখমলের সোনার টাসেলযুক্ত কুশনে সময় আর ব্যবহারের ছাপ স্পষ্ট বোঝা যায়।

    “বেশ,” কামবার আলী উপস্থিত লোকদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, “এমন ঘটতে পারে কে আর আগে থেকে ভেবেছিলো?” আরো কিছু বলবার আগে সে চুপ করে তাকিয়ে থেকে তাদের চোখের ভাষা পড়তে চেষ্টা করে।

    “আল্লাহতা’লার মর্জি বোঝা ভার।” বাকি বেগ নিরবতা ভেঙে বলে উঠে।

    “কি পরিতাপের কথা তুমি নিয়তির গর্ভে কি লুকিয়ে আছে দেখতে পাওনি। অন্তত একবারের জন্য হলেও তারকারাজি তাদের রহস্য তোমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে পেরেছে।” বাবা কাশক বলেন।

    রাজজ্যোতিষী বাজার সরকারের বিদ্বেষপূর্ণ বাক্যবাণে ক্ষিপ্ত হয়ে ক্রুদ্ধ চোখে তার দিকে তাকায়। “ঈশ্বর চান না যে মানুষ সবসময়ে তার নিয়তির কথা জানতে পারুক- বিশেষ করে একজন সুলতান, যে তার প্রজাদের কাছে ঈশ্বরের মতোই প্রতাপশালী আর তার মতই তাদের দণ্ডমুণ্ডের হর্তাকর্তা।”

    “আমি তোমাকে ক্ষিপ্ত করতে চাইনি, কিন্তু সুলতান যদি নিজের মৃত্যুর কথা আগে জানতে পারতেন, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি বারো বছরের বালককে তার উত্তরাধিকারী হিসাবে মনোনীত করতেন না,” বাবা কাশক মুদুস্বরে কথাটা বলে আক্ষেপের সাথে মাথা নাড়ে।

    কামবার আলীর নাড়ীর স্পন্দন সহসা বেগবান হয়ে উঠে। “বটেই তো। রাজ্য আর রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে শক্তিশালী, পরিণত নেতার প্রয়োজন। সুলতানের মৃত্যু সংবাদ শুনতে পেলে সাইবানী খান আর তার মোঙ্গল বর্ণসংকরের দল আমাদের সীমান্তের কাছে এসে হাঁকডাক শুরু করবে। তৈমূরের বংশের সুলতানদের চোখ উপড়ানো কাটা মুণ্ড দিয়ে সে একটা মিনার তৈরি করবে বলে শপথ নিয়েছে। একটা পুঁচকে ছোকরা তার কবল থেকে ফারগানাকে বেশি দিন স্বাধীন রাখতে পারবে না।”

    সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়, সবার মুখে বিষণ্ণতার মুখোশ আঁটা। যেনো ফারগানার কল্যাণই তাদের একমাত্র বিবেচ্য বিষয়।

    “উজবেকরাই কেবল আমাদের একমাত্র ভয়ের কারণ না। আমাদের মরহুম সুলতান তার নিজের পরিবারেই অনেক শত্রুর জন্ম দিয়েছেন- সমরকন্দের সুলতান, তার জ্ঞাতী ভাইয়ের রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল দখলে তার অভিযানের কথা নিশ্চয়ই তিনি এখনও ভুলে যাননি।”

    “অবশ্যই সমরকন্দের সুলতান নিজে একজন শক্তিমান যোদ্ধা।” কামবার আলী মৃদু কণ্ঠে মনে করিয়ে দেয়। “মোঘুলিস্তানের খানও কম শক্তিশালী না।” শেষবার ফারগানা সফরে এসে খান স্বর্ণমুদ্রায় ঠাসা বেগুনী মখমলের একটা থলে তার লোভী হাতে গুঁজে দিয়েছিল, সেই স্মৃতি মুহূর্তের জন্য উজিরের মনে ভেসে উঠে। খানের কথা তার মনে আছে: “ফারগানায় যদি কখনও আমার প্রয়োজন অনুভূত হয়, আমাকে কেবল সংবাদ পাঠাবে এবং ঝড়ের বেগে আমি উপস্থিত হব।” সিংহাসন উপহার হিসাবে পেলে খান তাকে নিশ্চয়ই আরো উদারভাবে পুরস্কৃত করবে।

    “আরো আছে কাবুলের শাসনকর্তা তিনিও তৈমূরের বংশধর, আমাদের প্রয়াত সুলতানের জ্ঞাতী ভাই।” বাবা কাশক এবার সরাসরি উজিরের চোখের দিকে তাকায়। “তিনি নিশ্চয়ই ফারগানাকে রক্ষা করবেন…”।

    কামবার আলী, মাথা নুইয়ে ভদ্রতাসূচক সম্মতি প্রকাশ করে। তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয় আজ রাতেই উত্তরের পাহাড়ী পথে মোঘুলিস্তানের উদ্দেশ্যে দূত পাঠাবে নতুবা দেরি হয়ে যাবে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, তাড়াহুড়ো করলে আমরা হোঁচট খেতে পারি।” কণ্ঠস্বরে গভীর চিন্তার ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে সে বলে। “শাহজাদা বাবরের স্বার্থ যাতে বিঘ্নিত না হয় সেজন্য আমাদের ভাবনা চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রাপ্তবয়স্ক হলে তিনিই হবেন সিংহাসনের যোগ্য হকদার। আর ততোদিন পর্যন্ত ফারগানাকে নিরাপদ রাখতে আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের ভেতর কাউকে রাজপ্রতিভূ নিয়োগ করতে পারি।” বাবরকে এ জীবনে আর তাহলে সিংহাসনে বসতে হবে না, সে মনে মনে ভাবে। একটা ছোট দূর্ঘটনা ঘটতে আর বেশি দেরি নেই। ঘটনাটা সাধারণভাবে সাজাতে হবে যে…

    দরবারে ওয়াজির খান প্রবেশ করতে তারা চারজন উঠে দাঁড়ায়। তাকে ক্লান্ত দেখায় এবং তামাটে মুখের উপরে আড়াআড়ি গোলাপী ক্ষত চিহ্নটা- এক যুগ আগে চালানো তরবারির ছোবল যা তার ডানচোখের জ্যোতি ছিনিয়ে নিয়েছিল। এখন ফুলে থাকায় মনে হয় আঘাতটা যেন সপ্তাহখানেকের পুরানো। “মুরুব্বীগণ, দেরি। হবার জন্য আমাকে মার্জনা করবেন।” সে তার ডান হাতের তালু দিয়ে নিজের বুক স্পর্শ করে এবং কামবার আলী উজির পদে আসীন থাকায় তিনি তাদের ভিতরে প্রধান সেটা প্রকাশ করতে তাকে মাথা নত করে অভিবাদন জানায়। “আমি দূর্গের চারপাশে পাহারা দ্বিগুণ করেছি কিন্তু এখন পর্যন্ত সবকিছু শান্তই আছে। সুলতানের মরদেহ গোসল দেয়া হয়েছে এবং আগামীকালের জানাজার সব ইন্তেজাম করা হয়েছে।”

    “ওয়াজির খান আমরা আপনার কাছে ঋণী থাকলাম। আমি খুশি হয়েছি।”

    “আপনারা ফারগানায় রাজপ্রতিভূ নিয়োগের ব্যাপারে আলাপ করছিলেন?” ওয়াজির খান কামবার আলীর পাশে বসে এবং উজিরের দিকে নিজের ভাল চোখ দিয়ে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে সে তিক্ততা অনুভব করে।

    “আমরা আলোচনা করছিলাম। রাজ্যের দায়িত্ব সামলাবার তুলনায় শাহজাদা বাবরের বয়স অল্প। আর উজবে কুকুরের দল আমাদের হুমকী দিচ্ছে।” উজবেকদের নাম উচ্চারণের সময়ে উজির থুতু ফেলার ভঙ্গি করে।

    “শাহজাদার বয়স অল্প সেটা সত্যি, কিন্তু তিনি আমাদের প্রয়াত সুলতানের একমাত্র জীবিত সন্তান এবং রাজ্য পরিচালনার জন্য অল্পবয়স থেকেই তাকে প্রস্তুত করা হয়েছে। এটাই তার নিয়তি আর তার পিতা আমাদের মরহুম সুলতানের সেটাই ইচ্ছা ছিলো। বাবর সাহসী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আর দ্রুত সবকিছু রপ্ত করতে পারে। আমি নিজে তার সাক্ষী। সুলতানের অনুরোধে, বিশেষ করে বাবরই তার একমাত্র উত্তরাধিকারী এ বিষয়টা নিশ্চিত হতে, আমি তাকে অসি চালনা, তীরন্দাজি, কিভাবে বর্শা ব্যবহার করতে আর রণকুঠার ছুঁড়তে হয়, এসব কিছু যথেষ্ট সময় নিয়ে শিখিয়েছি। বাবর তার বয়সের অন্য ছেলেদের তুলনায় অনেক পরিণত, বিচক্ষণ। আমি নিশ্চিত আমাদের পাঁচজনের পরামর্শ তাকে এই বৈরী সময় অতিক্রম করতে সহায়তা করবে।” ওয়াজির খান নিরাসক্ত কণ্ঠে বলে।

    “বন্ধু ওয়াজির খান, বিষয়গুলো যদি এত সহজ হত।” উজির ম্লান হেসে বলে। “শান্তিপূর্ণ সময়ে তোমার পরিকল্পনা অনুসারে কাজ হত, কিন্তু উজবেকদের আকাক্ষার কোনো সীমা পরিসীমা নেই। তারা যে মুহূর্তে শুনবে ফারগানার সুলতান তার অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেকে সিংহাসনে রেখে মারা গেছেন, তারা আমাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে, পেট চিরে আমাদের নাড়িভূড়ি বের করবে আর আমাদের রমণীদের অসম্মান করবে।”

    “মহামান্য উজির, আপনি কি বলেন?”

    “শাহজাদা বাবর প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত আমরা মরহুম সুলতানের কোনো আত্মীয়কে মসনদ রক্ষার দায়িত্ব দিতে পারি। কিন্তু প্রশ্নটা হলো আমরা কাকে অনুরোধ করবো…”

    “আমি বুঝেছি। উত্তম প্রস্তাব। আমি মামূলি একজন সৈনিক আর আজ রাতে আমার আরও কাজ আছে। রাজনৈতিক বিষয়ে আপনারা আমার চেয়ে অনেক অভিজ্ঞ। আমাদের রাজ্যের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে আল্লাহতালা আপনাদের হেদায়েত করুন।” ওয়াজির খান উঠে দাঁড়ায়, মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে ধীর পায়ে দরবার ত্যাগ করে। দরবার থেকে বের হয়ে এসেই তার পায়ের গতি বৃদ্ধি পায়। মাঝের আঙ্গিনা অতিক্রম করে দূর্গের অপর প্রান্তে অবস্থিত শাহী হারেমের দিকে সে এগিয়ে যায়।

    ***

    বাবর তার আম্মিজান, খুতলাঘ নিগারের পাশে বসে আছে। তার লম্বা কালো চুলে স্বস্তির পরশ পেতে মায়ের আঙ্গুল বিলি কাটে। বাবর ইতস্তত ভঙ্গিতে শোকসংবাদটা জানাবার পরেই তার মায়ের চেহারা এতোটাই ফ্যাকাশে হয়ে যায় যে তার ভয় হয় আম্মিজান বুঝি অজ্ঞান হয়ে যাবে এবং খবরটা শোনার পরে তিনি অন্ধ মহিলার মত শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাস্তবতা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরে, সে জিকির করার মত দুলতে শুরু করে। তার ভেতর থেকে তীব্র শোকের তীক্ষ্ণ ভয়ঙ্কর পরিদেবন বিষাদের মাত্রা সঞ্চয় করে বের হয়ে আসে। সুলতানের যদিও অনেক রক্ষিতা ছিলো কিন্তু তিনিই ছিলেন তার একমাত্র স্ত্রী। তাদের ভিতরে মহব্বতের সম্পর্কটা বেশ দৃঢ় ছিলো।

    সে তাকিয়ে তার নানিজান, এসান দৌলতকে, আনমনে বীণার তারে টোকা দিতে দেখে। বীণার বিষণ্ণ সুর শরণ সন্ধানী পাখির মত কামরার ভেতরে প্রতিধ্বনি তুলে ভাসতে থাকে। তার মাথার সাদা চুল, যা অল্প বয়সে বেশ ঘন ছিলো কিংবা সেরকমই তিনি দাবি করেন, কাঁধের উপরে বেণী করা। তার কিশমিশের ন্যায় চোখ লালচে হয়ে আছে কিন্তু তিনি নিজেকে সামলে নিয়েছেন। বাবরকে একটু আগেই তিনি কান্না চেপে স্থিরসংকল্প কণ্ঠে বলেছেন, তিনি একজন খানিম, চেঙ্গিস খান, মানুষ যাকে মহাসাগরসম শাসক বলতো, তৈমূরের জন্মের দু’শো বছর আগে চেনা পৃথিবীর অর্ধেকটা যিনি অভিহরণ করেছিলেন, তার সাক্ষাৎ বংশধর।

    বাবর তার নানীজানের মুখের দিকে তাকাতে, কে ছিলেন মহান যোদ্ধা- চেঙ্গিস খান নাকি তৈমূর, সেটা নিয়ে বাবার সাথে নানীজানের নিরন্তর তর্কের কথা তার মনে পড়ে যায়। জন্মের সময় বাবরের মাথা বড় থাকায়, আম্মিজানের যন্ত্রণাদায়ক দীর্ঘস্থায়ী গর্ভাবস্থার কথা এসান দৌলত সবসময়ে গল্প করেন। পুরোটা সময় তিনি তার মেয়েকে আশ্বাস বাণী শুনিয়েছিলেন যে, চেঙ্গিসের মতই বাবরও তার ক্ষুদ্র হাতের মুঠোয় রক্তের দলা নিয়ে তার যোদ্ধা নিয়তির প্রতীক- জন্ম নেবে। কিন্তু তার ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণিত হয়। অবশ্য এতে বিন্দুমাত্র হতাশ না হয়ে তিনি বলতে থাকেন, “সে নিশ্চয়ই একজন মহান শাসক হবে!”

    এসান দৌলত যেনো তার চোখের দৃষ্টি অনুভব করে। তিনি বাবরের দিকে তাকালে সে নানীজানের চোখে এমন কিছু একটা দেখে যা আগে কখনও দেখেনিঃ অনিশ্চয়তা। তিনি এবার বীণাটা নামিয়ে রাখেন। “খানজাদা, কাউকে বলো বরফ দিয়ে শরবত দিতে,” তিনি তার মোল বছরের নাতির দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলেন।

    বাবর দেখে তার লম্বা অপূর্ব সুন্দরী বোন দ্রুত উঠে দাঁড়ায়, পরিচারিকাকে আদেশ দেয়। সে কামরার প্রবেশপথের কাছে পৌঁছাতে যেখানে প্রদীপের আলোর আগ্রাসন সবচেয়ে ক্ষীণ, সে আরেকটু হলেই হারেমের প্রধান পরিচারিকা ফাতিমার সাথে ধাক্কা খেত। বেচারীর চওড়া, ভোতা মুখ অশ্রুসিক্ত। “মালিক,” খানজাদা বরফ দেয়া শরবতের কথা বলার আগে সেই বলতে শুরু করে, “মালিক, ওয়াজির খান আপনার মহামহিম আম্মিজান আর নানীজানের সাথে দর্শন প্রার্থনা করেছে।”

    “আগামীকাল সকাল পর্যন্ত সে অপেক্ষা করতে পারবে না? তারা শোকাবিভূত এবং তাদের বিশ্রামের প্রয়োজন।

    “সে বলেছে ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ।” ফাতিমা হাত দিয়ে অনুনয়ের ভঙ্গি করে যেন তার হয়ে মিনতি করছে।

    খানজাদা তার আম্মিজান আর নানীজানের দিকে তাকিয়ে তাদের ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করতে দেখে। তারপরে খুতলাঘ নিগার বলেন, “আমরা তার সাথে দেখা করবো। বাবর, তুমি অনুগ্রহ করে এখন যেতে পার।”

    “কিন্তু কেননা? আমি থাকতে চাই।”

    “আমি যা বলছি তাই করো।” তার আম্মা এবার উঠে বসেন।

    “না।” এসান দৌলত এবার হস্তক্ষেপ করেন, “সে ফারগানার নতুন সুলতান। ওয়াজির খান যা বলতে এসেছে তা আমাদের চেয়ে বেশি তাকে প্রভাবিত করবে। তাকে থাকতে দাও।”

    খুতলাঘ নিগার তার কিশোর ছেলের স্থিরসংকল্প কচি মুখের দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মনুস্থির দিকে তাকায় এবং মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। তিন রমণী নিজেদের সামলে নিয়ে তাদের মুখের নেকাব টেনে দেয়। বয়োজ্যেষ্ঠ রমণী তার একপাশে মেয়ে অন্যপাশে নাতিনকে নিয়ে দাঁড়াতে, বাবর তাদের কাছ থেকে দূরে সরে আসে। নানিজানের কথায় তার ভিতরে কিছু একটা বদলে গিয়েছে। সে আশঙ্কিত কিন্তু সেইসাথে উত্তেজিতও বটে।

    ওয়াজির খান নিচু সরদলের নিচে দিয়ে ঝুঁকে ভেতরে প্রবেশ করে গভীর শ্রদ্ধায় নিজেকে তাদের সামনে প্রণত করে। “এত রাতে অনাহূত সাক্ষাৎ প্রার্থনার জন্য আমাকে মার্জনা করবেন, মালিক।”

    “কি হয়েছে?” নেকাবের উপর দিয়ে এসান দৌলত বিচক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে তার মুখ খুটিয়ে দেখে।

    “বিষয়টা আমাদের মহামান্য সুলতানকে নিয়ে।” ওয়াজির পলকের জন্য আঁধারে দাঁড়িয়ে থাকা বাবরের দিকে তাকায়। তিনি এখানে একটুও নিরাপদ নন। আমরা এখন এখানে যখন আলাপ করছি, কুচক্রীর দল তখন তার কাছ থেকে মসনদ কেড়ে নিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের ষড়যন্ত্র করছে।”

    “তোমাকে আরও খুলে বলতে হবে। কে ষড়যন্ত্র করছে?” এসান দৌলত জানতে চান। তার চোখের রঙ বদলে গেছে এবং চোখের নিচের উঁচু হাড়ে লাল রঙের ছোপ দেখা যায়।

    “আমরা তোমাকে বিশ্বাস করি।” খুতলাঘ নিগার মৃদুকণ্ঠে বলেন। “তুমি ছিলে মরহুম সুলতানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সেনাপতি। তারচেয়েও বড় কথা, আমার স্বামীকে শিশুকালে তোমার আপন মা স্তন্যদুগ্ধ দ্বারা লালন করেছেন, যা তোমাকে সুলতানের দুধ-ভাইয়ের সম্মান দান করেছে। রক্তের মত অচ্ছেদ্য একটা বন্ধনে তোমাকে আবদ্ধ করেছে। সামনের অনাগত দিনগুলোয় আমি দেখতে চাই তুমি সেই বন্ধনের সম্মান রক্ষা করো… আমার সন্তানকে তুমি ঠিক তার আব্বাজানের মতো আগলে রাখবে… দয়া করে সব খুলে বলো। তুমি কি শুনেছো?”

    “অসহিষ্ণু, রাজবৈরী, কুটিল স্বভাবের লোকেরা আপনাদের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে। উজির আর দরবারের অন্য সদস্যরা মসনদে অন্য আরেকজনকে অভিষিক্ত করার পরিকল্পনা আঁটছে- তারা ভেবেছে আমি তাদের কথোপকথনের শেষ অংশটুকু শুনেছি। কিন্তু তারা জানে না দরবারের বাইরে নিভৃতে দাঁড়িয়ে আমি তাদের পুরো আলোচনা শুনেছি। তারা রাজ্যের মঙ্গলের উসিলায় কাজটা হাসিল করতে চায়। আপনাদের সন্তান শাসনকার্য পরিচালনার পক্ষে নিতান্ত অল্পবয়সী এবং তাকে সিংহাসনের অধিষ্টিত করলে ফারগানায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, যদি তারা শাহজাদা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠা পর্যন্ত কোনো রাজপ্রতিভূ নিয়োগ না করে। মুশকিল হল, আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর শাসকদের কাছে অনেক আগেই তারা নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছে। প্রত্যেকে নিজ নিজ প্রভুর স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে। রাজ্যে শীঘ্রই তাদের প্ররোচণায় অশান্তি শুরু হবে। তাদের লোভের কারণে, মসনদের জন্য প্রতিপক্ষের ভিতরে যুদ্ধ শুরু হবে। একটা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ আরেকটা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের জন্ম দেবে। আর সবশেষে যেই বিজয়ী হোক, আপনার ছেলে তততদিন জীবিত থাকবে না। যতোদিন সে বেঁচে আছে- সবাই তাকে একটা হুমকি হিসাবেই দেখবে।”

    “এটা অসম্ভব। সনাতন মর্যাদার স্মারক তৈমূর বংশের শাহজাদাদের অলঙ্ঘনীয় নিরাপত্তা দিয়েছে…” খুতলাঘ নিগারের কণ্ঠস্বর হোঁচট খায়।

    “আমাদের এখন কি করণীয়?” এসান দৌলত ওয়াজির খানের বাহু আঁকড়ে ধরে জিজ্ঞেস করে। হাড়সর্বস্ব অবয়ব সত্ত্বেও তার ভিতরে একটা যুদ্ধংদেহী শক্তি লুক্কায়িত রয়েছে। এসান দৌলত ধমনীতে চেঙ্গিস খানের রক্ত আর চেতনায় তার আত্মাকে ধারণ করেন।

    “হ্যাঁ, এখন আমাদের কি করণীয়?” বাবর অন্ধকার ছেড়ে বের হয়ে এসে জানতে চায়। দেয়ালের কুলঙ্গিতে রক্ষিত প্রদীপের নিভুনিভু আলোয় তার মুখের স্থির সংকল্প আর সিদ্ধান্ত প্রতিফলিত হয়।

    “আমাদের দ্রুত কাজ করতে হবে। আমাদের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।” ওয়াজির খান সংক্ষেপে কেবল এটুকুই বলে। “আগামীকাল আপনার আব্বাজান আমাদের মরহুম সুলতানের নামাজে জানাজার ঠিক অব্যবহিত পরেই দূর্গের শাহী মসজিদে আমরা আপনাকে সুলতান হিসাবে ঘোষণা করবো। মোল্লা একবার আপনার নামে খুবা পাঠ করার পরে কেউ যদি আপনার বিরোধিতা করে তবে সে চক্রান্তকারী হিসাবে চিহ্নিত হবে। আর আমাদের খেয়াল রাখতে হবে আমাদের শুভাকাক্ষিরা যেন এ সময় প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে উপস্থিত থাকে। আমার প্রহরীরা সবাই বিশ্বস্ত। ফারগানার অনেক অভিজাত ব্যক্তিও আমাদের পক্ষে রয়েছেন। বিশেষ করে আপনি যদি তাদের বিশ্বস্ততার প্রতিদান দেবার প্রতিশ্রুতি দেন।”

    “আমাকে কাগজ, দোয়াতদানি আর পালক এনে দাও,” এসান দৌলত তার নাতিনকে আদেশ করে। “আজ রাতটা আমরা কেবল শোক পালনে কাটাবো না, আমাদের নিরুদ্বেগ আরও বড় বিপর্যয় আমাদের উপরে আপতিত করবে। আমি খুব ভালো করেই জানি কাদের উপরে আমরা বিশ্বাস রাখতে পারি আর কারা কপট, অবিশ্বাসী। সবাই মনে করে আমি কিছুই বুঝতে পারি না, কিন্তু চারপাশে কি ঘটছে আমি খুব ভালোই লক্ষ্য করি। এইসব গুরুত্বপূর্ণ চিঠি লেখার দায়িত্ব আমি কোনো খুশনবিশকে দিতে চাই না, চিঠিগুলো আমি নিজে লিখবো। ওয়াজির খান তোমার উপরে প্রতিটা চিঠি নিরাপদে আপন আপন গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব রইল। চিঠিগুলো কেন পাঠান হচ্ছে জিজ্ঞেস করবার ধৃষ্টতা কেউ দেখালে তাকে বলবে মরহুম সুলতানের জানাজা উত্তর ভোজের আমন্ত্রণপত্র। কথাটা আংশিক সত্যি কিন্তু সেগুলো একই সাথে মসজিদে বাবরের অভিষেকের আমন্ত্রণপত্রও বটে। আকশীর আশেপাশে ঘোড়ায় অর্ধদিনের দূরত্বে বসবাসকারী সব বিশ্বস্ত গোত্রপতিকে আমি ডেকে পাঠাচ্ছি। আমি তাদের অনুরোধ করবো জানাজা শেষে ভোজসভা আরম্ভ হবার পরে গোপনে আর নিঃশব্দে তারা যেন মসজিদে প্রবেশ করে। বাবর বেটা, আমার পাশে এসে তেলের প্রদীপটা একটু উঁচু করে ধরো।”

    রাত গভীর হবার সাথে সাথে তাদের চারপাশে দূৰ্গটা নিরব হয়ে আসে। বাবর অপলক তাকিয়ে দেখে নানীজান অক্লান্তভাবে লিখে চলেছেন। মাঝে মাঝে কেবল পালকের মাথা তীক্ষ্ণ করতে বা কালি শেষ হয়ে গেলে লেখায় সাময়িক বিরতি দেন। অবিশ্বাস্য ব্যাপার, সে ভাবে, রক্তের বৈরীতা আর তিক্ত শত্রুতার কথাই নানীজান কেবল জানে না, চেঙ্গিস খানের সময় থেকে গোত্রসমূহের ভিতরে চলে আসা জটিল বৈবাহিক সম্পর্ক আর ব্যক্তিগত বিশ্বস্ততার গভীর সম্পর্কের বিষয়েও তার অসীম জ্ঞান। এই প্রথম সে তার প্রতি কৃতজ্ঞবোধ করে তাকে জোর করে গোত্রপতিদের ভিতরে কারা বন্ধু আর কে কে শত্রু সে বিষয়ে নানীজান তাকে ধৈর্য ধরে শিখিয়েছেন বলে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- এর পেছনের কারণগুলো সম্পর্কেও তিনি তাকে বলেছেন। তার মুখের সূক্ষ্ম ভাঙাচোরা দাগের দিকে তাকিয়ে বাবর স্বস্তি বোধ করে যে এসান দৌলত তার মিত্র, শত্রু নন।

    সবগুলো চিঠি লেখা শেষ হতে- কাগজের উপরে তুর্কী লিপির এলোমেলো বিন্যাস সেগুলো ভাজ করে লাল মোম দিয়ে সীল করে একজন বিশ্বস্ত লোক দিয়ে চিঠিগুলো পৌঁছে দেবার জন্য ওয়াজির খানকে দেয়া হয়। বাইরের প্রাঙ্গণে দূর্গ থেকে বের হয়ে যাওয়া ঘোড়ার খুরের শব্দ প্রতিধ্বনি তোলে। সুবেহসাদিকের সময়ে ফজরের নামাজের আজানের ধ্বনি ভেসে আসবার পরেই কেবল এসান দৌলত তার লেখনী বন্ধ করেন।

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার : অ্যাম্পেয়ার অব দ্য মোগল – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড
    Next Article গথ – অৎসুইশি

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }