Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জেমস বন্ড সমগ্র – ইয়ান ফ্লেমিং

    ইয়ান ফ্লেমিং এক পাতা গল্প2380 Mins Read0

    ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ (পার্ট ১)

    ফ্রম রাশিয়া উইথ লাভ

    Red গ্রান্ট

    সুইমিং পুলের সামনে নগ্ন হয়ে যে লোকটি মুখ গুঁজে শুয়ে ছিল, মনে হয় সে আর বেঁচে নেই। বোধ হয় পানিতে ডুবে মরেছে। পুকুর থেকে তুলে তাকে শুকোবার জন্য খাদের ওপর শুইয়ে রাখা হয়েছে। অপেক্ষা করা হচ্ছে যতক্ষণ পুলিশ বা লোকটির নিকট-আত্মীয় কেউ না আসে। মাথার কাছে ঘাসের ওপর টুকিটাকি জিনিসগুলো সাজানো। জিনিসগুলো এমনভাবে রাখা হয়েছে যাতে কেউ সন্দেহ না করে যে, তাকে যারা তুলেছে তারা কোন জিনিস হাতিয়েছে।

    সব টুকিটাকি জিনিসগুলো দেখলে সহজেই বোঝা যায়–লোকটা ছিল ধনী। জিনিসগুলোর মধ্যে আছে বড়লোকদের ক্লাবের মেম্বারশিপ ব্যাজ, শ চারেক টাকা দামের সোনার তৈরি নোটের তাড়া রাখার ক্লিপ। তার মধ্যে অজস্র নোট, সোনার বোম, সোনার সিগারেট কৌটা, নীলকান্তমণি খচিত কারুকার্যময় গড়ন দেখলেই বোঝা যায় সেটা ফার্জ কোম্পানির তৈরি। আর ছিল একটা বই, রাধো বুককেস থেকে যেটা নিয়ে বাগানে বেড়াতে বেরোয়। একটা লিটন নাগেট–পি.জি. উডহাউসের আগেকার বই। আরো ছিল সোনার একটা ভারি রিস্টওয়াচ, তার বেল্ট চামড়া দিয়ে তৈরি। সেকেন্ডের কাঁটাটা এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে। তার নিচে দুটো ছোট্ট ছোট্ট গর্ত যেগুলো দিয়ে মাস, তারিখ, চন্দ্রকলার কথা জানা যায়, তারিখ ১৫ই জুন, সময় দুপুর তিনটা, আর চন্দ্রকলা দ্বাদশীতে পড়েছে। যে বাগানে লোকটা শুয়ে, সেটার আয়তন কয়েক মিটার। ভারি ছিমছাম জায়গা, তিন দিকে ঘন গোলাকার। অন্যদিক থেকে মৌমাছিদের একটানা গুনগুনানি ভেসে আসছে।

    সবে তখন বিকেল। কোন দিকে কোন পথে একটা মোটর গাড়ির শব্দ শোনা গেল। গাড়ির দরজা বন্ধ হওয়ার ঝনঝনানি শব্দ, তারপর থামল গাড়িটা। দু বার দরজা বন্ধ হওয়ার ঝনঝনানি শব্দে সুইমিং পুলের পাশে নগ্ন লোকটা নড়াচড়া করল। দরজা খোলার ঘন্টা আর গাড়ি চলে যাবার শব্দ শুনে চোখ মেলে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ল সে শুয়ে আছে, দিনটা কোন বার এবং শব্দগুলো কোথা থেকে আসছে সে বুঝতে পারল। নীল চোখ দুটো ধীরে ধীরে বুজে এল, ঠোঁটে হাসি। বিরাট একটা হাই তুলল। ঘাসের ওপরেই সে অপেক্ষা করতে লাগল।

    কাঁচের দরজা খুলে একটি তরুণী উঠোন পেরিয়ে সেই লোকটির দিকে এগিয়ে এল। তার পরণে সুতির শার্ট আর স্কার্ট। হাঁটার ভঙ্গিতে পুরুষালী ছাদ। তার হাতে ঝোলানো ব্যাগ। লোকটার কয়েক গজ দূরে ঘাসের ওপর বসে ধুলো মাখা জুতা জোড়া খুলে, দাঁড়িয়ে তার শার্ট এবং স্কার্ট খুলে ব্যাগের পাশে রাখল। পরনে সাঁতার কাটার পোশাক। উরুদ্বয় নিটোল। সর্বাংশে স্বাস্থ্য উপছে পড়ছে যেন। তারপর ব্যাগ খুলে বার করল একটা পুরনো সোডার বোতল। তার মধ্যে এক গাঢ় বর্ণহীন তরল পদার্থ ভরা। লোকটার পাশে হাঁটু গেড়ে সে বসল। তরল পদার্থটা পাতলা অলিভ তেল। তাতে গোলাপ ফুলের গন্ধ। লোকটার ঘাড়ের পাশের মাংসপেশীর ওপর সে তেল রগড়াতে লাগল।

    এই মালিশ করার কাজটা সহজ নয়। মানুষটা ভীষণ তাগড়া। সমস্ত শরীরের শক্তি দিয়ে ও লোকটার ঘাড়ের নিরেট মাংসপেশীগুলো একেবারে দাবানো যায় না বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে। লোকটাকে মালিশ করতে করতে সে ঘেমে ভিজে যায়। তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে সুইপিং পুলের পানিতে। তারপর উঠে গাছের ছায়ায় এসে ঘুমোয় যতক্ষণ না গাড়ি আসে তাকে নিতে।

    গত দু বছর ধরে যে কথাটা সে ভেবে এসেছে আবার সেই কথাটাই তার মনে হল, কেন এই লোকটার নিখুঁত শরীরটাকে সে ঘৃণা করে।

    হাত দুটোকে বিশ্রাম দেবার জন্য মেয়েটি থেবড়ে বসল। তার শরীরের সুন্দর উপরভাগ ঘামে চিকচিক করছে। হাত দিয়ে কপাল মুছে সে তেলের শিশিটা থেকে প্রায় এক চামচ তেল লোকটার শিরদাঁড়ায় ঢেলে আবার আঙ্গুল দিয়ে ঘষতে লাগল।

    এই লোকটার সবকিছুই আলাদা, কেমন যেন ভূতুড়ে ধরনের। গোড়া থেকেই মনে হচ্ছে একটা জড় মাংসপিণ্ড। গত দু বছরে মেয়েটির সঙ্গে একটি কথাও বলেনি সে। তার পিঠে মালিশ করার পর মেয়েটি তার কাঁধে টোকা দিতেই চুপচাপ ঘুরে চিৎ হয়ে শুলল। আধবোজা চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে হাই তুলতে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তার দেহে প্রাণ আছে।

    মালিশওয়ালী দাঁড়িয়ে উঠে ধীরে ধীরে কাঁধ ঝাঁকাল। হাত দুটোকে মাথার ওপর তুলে ধরল যাতে সেখান থেকে রক্ত নিচে নেমে আসে। তারপর সে তার ব্যাগের কাছে গিয়ে তোয়ালে বার করে মুখ আর শরীরের ঘাম মুছল।

    লোকটার দিকে দেখল। লোকটা এক হাতে মাথা রেখে অন্য হাতটি ঘাসের ওপর রেখে তার জন্য অপেক্ষা করছে। এগিয়ে গিয়ে হাতের তেলের অনেকটা তেল ঘষে, লোকটার হাত তুলে নিয়ে, তার আধখোলা বেঁটে মোেটা আঙুলগুলো রগড়াতে লাগল।

    কানাঘুষায় শোনা যায় এটা পুলিশের বাগানবাড়ি। যে দুজন চাকর আছে, তারা প্রহরী এবং রান্না আর বাড়ির সব কাজ করে। প্রতিমাসেই লোকটা নিয়মিত বাইরে যায়। মেয়েটিকে তখন আবার মাঝে দু এক সপ্তাহ আসতে বারণ । করে। এরকম এক একটা অনুপস্থিতির পর দেখা যায় লোকটার গলা আর শরীরের ওপরটা ক্ষতবিক্ষত। একবার দেখা গিয়েছিল তার পাজরার কাছে এক ফুট সার্জিক্যাল প্লাস্টারের নিচে প্রায় শুকিয়ে আসা একটা ক্ষতের লাল দাগ। যখন তাকে প্রথম এই বাড়িতে পাঠান হয়, চাকরদের মধ্যে একজন তাকে বলেছিল যা সে দেখবে, সে কথা বলাবলি করলে তাকে হাজতে পাঠানো হবে। হাসপাতালের চীফ সুপারিনটেনডেন্ট আগে কখনো তার অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। তিনিও মেয়েটিকে একই কথা বলেছিলেন।

    মেয়েটির বরাবরের ধারণা এটা একটা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ব্যাপার। হয়ত সে কারণেই এই চমৎকার শরীরটার ওপর তার বিতৃষ্ণা।

    এবার সে তার মুখটা মালিশ করার জন্য তেলের শিশি নিল। লোকটার চোখ বোজা ছিল। মেয়েটির আঙুল সবে চোখ দুটো দুয়েছে এমন সময় বাড়ির টেলিফোন বেজে উঠল। সাথে সাথে লোকটা এক মুহূর্তে হাঁটু মুড়ে উঠে পড়ল, যেন একজন দৌড়বাজ। বন্দুকের সংকেতধ্বনির জন্য অপেক্ষা করছে। একটা অস্ফুট কণ্ঠস্বর শোনা গেল। বিনীত কণ্ঠস্বর–মনে হয় যেন কিছু আদেশ গ্রহণ করছে। কণ্ঠস্বর থামল। একজন চাকর দরজায় দাঁড়িয়ে ইঙ্গিতে ওকে কিছু বলে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল। বেরিয়ে এসে লোকটা যেন তাকে না ভাবে সে আড়ি পেতে কথা শুনছিল। উঠে সে সুইমিং পুলের পাড়ে গিয়ে চমৎকার ডাইভ দিল।

    যে লোকটার শরীর মেয়েটি ম্যাসাজ করত তার পরিচয় খানিকটা আঁচ করলেও সে জানত না। তাই সে বিশেষ বিচলিত হয়নি।

    লোকটার আসল নাম জেনোভান গ্রান্ট অথবা Red গ্রান্ট। কিন্তু গত দশ বছর ধরে জ্বাসনো গ্রানিৎঙ্কি নামেই সে পরিচিত, তার সাংকেতিক নাম গ্রনিট। নোকটা কুখ্যাত গুপ্ত সংস্থা SMERSH -এর প্রধান ঘাতক। SMERSH হলো রাশিয়ার সর্বোচ্চ গুপ্তচর সংঘ MGB-র এক অঙ্গ। শত্রুপক্ষের বিপজ্জনক গুপ্তচরদের নির্মূল করাই হচ্ছে SMERSH -এর কাজ। গ্রান্ট এখন সরাসরি টেলিফোন মারফত মস্কোয় সংস্থার সদর দফতর থেকে নির্দেশ নিচ্ছিল।

    .

    গোলাপ বিছানো পথ

    ধীরে ধীরে টেলিফোনটা রেখে বসে পড়ে গ্রান্ট সেটার দিকে তাকিয়ে রইল।

    বুলেটের মত মাথাওয়ালা এক প্রহরী তার পাশে দাঁড়িয়েছিল। সে বলল, চটপট তৈরি হয়ে নাও।

    কি করতে হবে সে কথা কিছু ওরা বলেছে। গ্রান্ট রুশভাষা খুব ভাল বলে, শুধু একটু ভারি গলায়। সোভিয়েতের যে কোন বলটি এলাকার বাসিন্দা বলে তাকে চালান যায়। তার গলার স্বর চড়া আর নিষ্প্রাণ।

    না। শুধু বলেছে মস্কোয় তোমার ডাক পড়েছে। প্লেন আসছে। আধঘণ্টার মধ্যে এখানে পৌঁছবে। তেল ভরতে আধঘন্টা আর তারপর তিন-চার ঘণ্টা, যদি খারকোতে নামো। মাঝ রাতে মস্কোতে পৌঁছবে। গাড়ি আসছে, জিনিসপত্র প্যাক করে নাও।

    নার্ভাস পায়ে গ্রান্ট উঠে দাঁড়াল, নিচ্ছি। তোমার কথাই ঠিক। কিন্তু কোন জরুরী কাজ কিনা তার কি আভাস দেয়নি? এটা তো নিরাপদ লাইন।

    এবার তা দেয়নি।

    কাঁচের দরজা দিয়ে গ্রান্ট ধীরে ধীরে লনে এল। মেয়েটির দিকে না তাকিয়েই নিচু হয়ে বইটা তুলে নিল, সেই সঙ্গে সোনার জিনিসগুলো। তারপর নিজের শোবার ঘরে ঢুকল।

    নিচু হয়ে খাটের তলা থেকে একটা জরাজীর্ণ ইটালিয়ান ফাইবারের সুইকেস গ্রান্ট বার করল, তারপর আলমারী থেকে ইস্ত্রি করা সস্তা দরের অথচ মোটামুটি ভাল পোশাক বেছে নিয়ে সেটায় ভরল। তারপর সুগন্ধী সাবান মেখে ঠাণ্ডা পানিতে গা ধুয়ে ফেলল।

    বাইরে একটা গাড়ির শব্দ শোনা গেল। যে রকম একটা পোশাক প্যাক করেছে সেই ধরনের ধূসর রঙের বৈচিত্র্যহীন একটা পোশাক তাড়াতাড়ি গায়ে গলিয়ে, ঘড়ি পরে, টুকিটাকি জিনিস পকেটে ভরে সুটকেসটা নিয়ে এল।

    সদর দরজা খোলা। একটা ছন্নছাড়া ZIS গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে তার দুজন গার্ডকে কথা বলতে দেখে সে মনে ভাবল ব্লডি ফুল। লোকগুলো নিরুত্তাপ অবজ্ঞার চোখে গ্রান্টের দিকে তাকাল। রান্নাঘরের দরজার হুক থেকে এক গাদা কোর্টের থেকে নিজের ইউনিফর্মটা বের করল–ধূসর রঙের একটা রেনকোট আর সোভিয়েট কর্মচারিরা যে টুপি পরে থাকে সে রকম একটা টুপি। সেগুলো পরে, সুটকেসটা নিয়ে ড্রাইভারের পাশে এসে বসল। গাড়িতে ওঠার সময় তার কাঁধের ধাক্কায় সরিয়ে দিল তার একজন গার্ডকে। ত্রিমপারফুলের এয়ারপোর্টে পোঁছতে দেড় ঘন্টা লাগল। পথে কোন গাড়ি ছিল না। আঙুর ক্ষেতের মধ্যে যে সব গরুর গাড়ি আসছিল তারা মোটরের হর্ন শুনে নেমে পড়ল পাশের খানাখন্দরে। রাশিয়ার সর্বত্র লোকে জানে মোটর গাড়ি মানে সরকারী কাজ। তার সেখানে বিঘ্ন ঘটানো মানেই বিপদ।

    সিভিল এয়ারপোর্টের পাশ কাটিয়ে, উঁচু একটা দেওয়ালের পাশ দিয়ে সামরিক বিমান বন্দরের দিকে তারা চলল। দু জন টমি গানধারী প্রহরীকে ড্রাইভার তার পাশ দেখাল। সেখানে নানা প্লেন দাঁড়ান। ক্যামোফ্লেজ করা সামরিক মালবাহী প্লেন, ট্রেনিংয়ের জন্য দু ইঞ্জিনওয়ালা ছোট ছোট প্লেন। দুটো নেভি হেলিকপ্টার। ওভারঅপরা একটা লোককে ড্রাইভার প্রশ্ন করল, গ্রান্টের প্লেনটা কোথায়? সঙ্গে সঙ্গে কনট্রোল টাওয়ার থেকে লাউডস্পিকারের শব্দ বয়ে। অনেক বায়ে। নম্বর V.BO. ।

    নির্দেশ অনুযায়ী ড্রাইভার টাৰ্মাক দিয়ে যখন গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে, আবার সেই শব্দ; থাম। সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভার ব্রেক কষল। মাথার ওপরে কানে তালা ধরানো কর্কশ শব্দ শুনে দুজনে মাথা গুজরে বসে পড়ল। সূর্যাস্তের দিক থেকে চার ঝাক MIG 17 যুদ্ধবিমান তাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। একের পর এক বিরাট রানওয়ের ওপর প্লেনগুলো নিচে ধোয়া ছেড়ে নামল।

    চলতে শুরু কর।

    একশ গজ দূরে তারা একটা প্লেনের কাছে পৌঁছাল। তাতে লেখা : VBO। প্লেনটা দু ইঞ্জিনের ইলুশিন-১৩। কেবিনের দরজায় যে এলুমিনিয়ামের মই ঝুলছে তার পাশে গাড়িটা থামাল। একজন ক্রু এসে ড্রাইভারের পাশ আর গ্রান্টের পরিচয় পত্র দেখে গ্রান্টকে তার পেছনে পেছনে প্লেনে ওঠার নির্দেশ দিল। সুটকেসটা নিয়ে গ্রান্ট ওঠবার পর মইটা তুলে কু সশব্দে দরজা বন্ধ করে কপিটের দিকে এগিয়ে গেল।

    কুড়িটা খালি সিট ছিল। দরজার সবচেয়ে কাছের একটা সিটে গ্রান্ট তার সিট বেল্ট আঁটল। কনট্রোল টাওয়ার থেকে কতকগুলো কর্কশ কথা শোনা গেল, তারপর ইঞ্জিন দুটো গর্জে উঠল।

    সিট বেল্ট খুলে সোনালী মুখওয়ালা একটা ব্রয়কা সিগারেট ধরিয়ে আরাম করে অতীত আর ভবিষ্যতের কথা ভাবতে লাগল গ্রান্ট।

    এক পেশাদার জার্মান ভারত্তোলনকারী এবং এক হোটেলের দক্ষিণ আইরিশ ওয়েট্রেসের অবৈধ সন্তান জেনোভান গ্রান্ট। বেলফাস্টের বাইরে এক সার্কাস তাঁবুর পেছনে ভিজে ঘাসের ওপর মিনিট পনেরোর জন্য তার পিতামাতার মিলন। তারপর তার বাবা তার মাকে আধ ক্রাউন দেয় এবং মা খুশি হয়ে রেলস্টেশনের কাছে একটা কাফের রান্নাঘরে তার বিছানায় শুতে যায়। সন্তান সম্ভাবনার সময় তার মা গ্রামে তার খুড়ির কাছে যায়। একটি বার পাউন্ড সন্তানকে জন্ম দিয়ে সে সূতিকা রোগে মারা যায়। মরার আগে তার সন্তানের নাম দেয় জেনোভান এবং গ্রান্ট, যেটা ছিল মেয়েটির নিজের নাম।

    সেই খুড়ি নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাচ্চাটাকে মানুষ করে। ছেলেটা তাগড়া হয়ে ওঠে। কিন্তু ভারি চাপা প্রকৃতির। তার কোন বন্ধু ছিল না। কারোর কোন জিনিস সে ঘুষির জোরে নিত। স্থানীয় স্কুলে কেউ তাকে ভালবাসতো না, বরং ভয় করত। আশেপাশের গ্রামাঞ্চলে বক্সিং আর কুস্তি প্রতিযোগিতায় সে খুব নাম করেছিল।

    এই সময় থেকেই সে নিজের শরীরের মধ্যে পূর্ণিমার সময় একটা তীব্র হিংস্রতা অনুভব করতে থাকে, যেটা সে দমন করতে পারে না। তার মোল বছর বয়সে অক্টোবর মাসে অসহ্য আবেগ তাকে ভর করে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে একটা বেড়ালকে ঘাড় মটকে খুন করে। তারপর পুরো একমাস স্বস্তিতে কাটায়। নভেম্বরে আবার ঘাড় মটকে বিরাট একটা পাহারাদার কুকুরকে খুন করে। এবং বড়দিনের মাঝরাতে একটা গরুর টুটি চিরে ফেলে। এগুলো করে। সে তৃপ্তি পায়। সে বোকা নয়। তাই কেউ যাতে বুঝতে না পারে সেজন্য সে একটা বাইসাইকেল কিনে মাসে একবার। আশে পাশের গ্রামে গিয়ে তার রক্ত লালসা চরিতার্থ করত। দুমাস পরে এক ঘুমন্ত ভবঘুরে লোকের গলা কাটে সে। রাতে স্বভাবতঃই পথগুলো জনবিরল। ক্রমশ সে সকালে বেরোতে লাগল। দূর-দূরান্তের গ্রামে সে গোধূলির সময়। পৌঁছয়–যখন একলা মানুষ বাড়িতে ফেরে কিংবা কোন মেয়ে চলে তার গোপন প্রেমিকের কাছে।

    মেয়েদের সে হত্যা করত, কিন্তু তাদের ওপর কোন অত্যাচার করত না। খুন করাটাই তার কাছে ছিল চমকপ্রদ ব্যাপার। সেটা করতে পারলেই তার পরিপূর্ণ তৃপ্তি।

    তার সতের বছরের শেষে আশেপাশের প্রতিটি গ্রামের সর্বত্র নানা ভয়ংকর গুজব ছড়িয়ে পড়ে। প্রকাশ্য দিবালোকে একটি মহিলার ঘাড় মটকে খড়ের গাদায় ফেলে দেবার ঘটনায় দারুণ আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। গ্রামে খবরদারী দল সংগঠিত হয়, পুলিশ-কুকুর নিয়ে আসে এবং চান্দ্র হত্যাকারীর নানা কাহিনী শুনে বহু সাংবাদিকও আসে। বাইসাইকেলে ঘোরার সময় একাধিকবার তাকে থামিয়ে নানা প্রশ্ন করা হয়। কিন্তু অঘম্যাকলয় গ্রামের লোকেরা তার প্রবল অনুরাগী। সে তখন তার গ্রামের গর্ব। উত্তর আয়ার্ল্যান্ড লাইট-হেভিওয়েট বক্সিং চ্যামপিয়নশিপের সে প্রতিযোগী।

    তার সহজাত বুদ্ধিতে অষম্যাকলয় ছেড়ে সে আসে বেলফাস্টে এবং আশ্রয় নেয় এক বৃদ্ধ বক্সিং শিক্ষকের কাছে। বৃদ্ধের জিমনেশিয়ামের নিয়ম ছিল খুব কড়া। তাই গ্রান্টের শিরায় শিরায় আবার খুনের নেশা চাপে। সে তখন তার অনুশীলনকারী বক্সিং জুড়িকে প্রায় আধমরা করে ছাড়ে।

    ১৯৪৫ সালে আঠার বছর বয়সে গ্রান্ট চ্যামপিয়ন হয়। তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় সৈন্যবাহিনীতে। রয়্যাল কোর অব সিগন্যালস -এ সে ড্রাইভার হিসেবে নিযুক্ত হয়। ইংল্যান্ডে ট্রেনিং-এর সময় সে খানিকটা ধাতস্থ হয়ে ওঠে– অর্থাৎ সেই অনুভূতি যখন চাড়া দিত সে তখন খুব সাবধানী হয়ে পূর্ণিমার সময় খুনের বদলে ড্রিঙ্ক করত। অল্ ডারশট-এর অরণ্যে হুইস্কি নিয়ে ঢকঢক করে গিলে শান্তভাবে নিজের ওপর তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করত। তারপর ভোরে টলতে টলতে ক্যাম্পে ফিরত। তৃপ্তি তার হত না কিন্তু তখন সে আর বিপজ্জনক নয়। প্রহরী তাকে ধরলে বলত কম্যান্ডিং অফিসার তার মেজাজ ভাল রাখতে চান–যাতে সে চ্যামপিয়ন হয়।

    রুশদের সঙ্গে রাজনৈতিক গণ্ডগোলের সময় গ্রান্টের পরিবহন বিভাগকে ঝট করে বার্লিনে পাঠানো হয়। বার্লিনে থাকাকালীন সে রুশদের নিষ্ঠুরতার কথা, ছলাকলার কথা শুনেছিল। তার ভাল লেগেছিল বলে স্থির করল সে সেখানেই। যাবে। কিন্তু যাবে কি করে? কি তাদের দিতে পারবে? কি চায় তারা।

    BAOR বক্সিং চ্যামপিয়নশিপ-এ লড়তে গিয়ে সে জানতে পারে কিভাবে বিপক্ষ দলে সে যোগ দেবে। রয়্যাল কোর দলের হয়ে পূর্ণিমার রাতে গ্রান্ট লড়ছিল। ক্রমাগত বেল্টের তলায় বে-আইনী করে মারার জন্য তাকে সাবধান করা হয়। কিন্তু সে কথা না শোনার জন্য তাকে বক্সিং রিং থেকে বের করে দেওয়া হয়। রিং থেকে বেরোবার সময় দর্শকরা, এমনকি, তার রেজিমেন্ট পর্যন্ত তাকে টিটকিরি দেয়। পরের দিন তার কম্যান্ডিং অফিসার তাকে বলে রয়্যাল কোর দলের সে লজ্জা। পরের দলের সঙ্গে সহকারী ড্রাইভার হিসেবে তাকে পাঠানো হয় কভেন্ট্রিতে। কিন্তু কেউ তাকে নিয়ে গাড়ি চালাতে রাজি নয় তাই তাকে বদলি করা হয় তার আকাক্ষিত মোটর সাইকেল ডেসপ্যাঁচ সার্ভিসে।

    এটাই চেয়েছিল গ্রান্ট। তারপর স্থানীয় সামরিক গোয়েন্দা হেডকোয়াটার্স থেকে এক সন্ধ্যেয় বিলি করার চিঠিপত্র নিয়ে সোজা যায় রুশ এলাকায়।

    প্রহরীদের ঘরে তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এক অফিসার প্রশ্ন করে–কি চায় সে গ্রান্ট বলে, রুশ গোয়েন্দা বিভাগকে আমার দরকার। সেখানকার বড় কর্তাকে।

    যে সব সৈনিক গ্রান্টকে এনেছিল, তারাই আবার তাকে টেনে বাইরে আনার চেষ্টা করে। অনায়াসে এক ঝটকায় সে তাদের সরিয়ে দেয়। এক সৈনিক তার দিকে টমিগান তোলে।

    গ্রান্ট বলে, অনেক গোপনীয় নথিপত্র আছে আমার কাছে–বাইরে মোটর সাইকেলের চামড়ার ব্যাগে। সেই নথিপত্রগুলো তোমাদের গোয়েন্দা বিভাগে না পৌঁছলে তোমাদের দারুণ ফ্যাসাদে পড়তে হবে।

    অফিসার ভাঙা ভাঙা ইংরেজীতে বলল, আমাদের কোন গোয়েন্দা বিভাগ নেই। বসো। এই ফর্মটায় লেখ। গ্রান্ট একটা দীর্ঘ ফর্মে নাম, ঠিকানা, কেন যেতে চায় ইত্যাদি লিখল। অফিসার তখন নিচু গলায় সংক্ষেপে টেলিফোনে কথা বলছিল।

    গ্রান্টের ফর্ম লেখা শেষ হলে আরো দু জন নিম্নপদস্থ সৈনিক অফিসার ঘরে এল। মাথায় রঙচটা সবুজ টুপি। খাকি ইউনিফর্মে সবুজ ব্যাজ দেখেই তাদের পদমর্যাদা জানা যায়। সীমান্ত অফিসার তাদের একজনের হাতে ফর্মটা দিল। গ্রান্টকে তারা বাইরে নিয়ে, মোটর সাইকেল সমেত একটা বন্ধ ভ্যানে তুলে দরজায় কুলুপ এঁটে দিল। মিনিট পনের ধরে গাড়িটা তীর বেগে ছুটে একটা বিরাট নতুন বাড়ির সামনে থামল। বাড়িটার মধ্যে গিয়ে একটা লিফট দিয়ে ওপরে গিয়ে তাকে একটা ছোট কামরায় আনা হল। একটা লোহার বেঞ্চি ছাড়া কিছুই নেই। একঘণ্টা পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হল একটা সাজানো গোছানো অফিস ঘরে। সেখানে এক অফিসার, তার পোশাকে তিন সারি সম্মান চিহ্ন এবং কর্নেলের সোনার মেডেল। আর ডেস্কে একটা ফুলদানিতে গোলাপ ফুল। দশ বছর পরে তার প্লেনের জানালা দিয়ে। কুড়ি হাজার ফুট নিচেকার জায়গা দেখে অনুমান করল গ্রান্ট এটা খারকোভ। গ্রান্ট একটু হাসল কিন্তু হাসির মধ্যে আনন্দের ছিটেফোঁটা ছিল না।

    গোলাপ ফুল। সেই মুহূর্ত থেকে জীবনে তার গোলাপ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। গোলাপ আর গোলাপ সমস্ত পথ গোলাপ বিছানো।

    .

     SMERSH-এর প্রধান জল্লাদ

    মিস্টার গ্রান্ট, তুমি তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়নে কাজ করতে চাও।

    আধঘণ্টা পরে MGB-র কর্নেল তাকে প্রশ্ন করল। কর্নেল ভাবল প্রয়োজনীয় সবরকম খুঁটিনাটি সামরিক তথ্য এই কদাকার ব্রিটিশ সৈনিকের কাছ থেকে সে নিংড়ে বার করে নিয়েছে। লোকটার ব্যাগে যে সব গোপনীয় তথ্য পাওয়া গেছে তার জন্য লোকটাকে মামুলি ধন্যবাদ জানিয়ে তারপর পাঠানো হবে হাজতে। তারপর তাকে পাচার করা হবে দূরের কোন এক শ্ৰম শিবিরে।

    হ্যাঁ, আপনাদের কাছে কাজ করতে চাই।

    কি কাজ তুমি করতে পার, মিস্টার গ্রান্ট? আমাদের সুদক্ষ শ্রমিক, ট্রাক ড্রাইভার সবই আছে। বক্সিং লড়বার অনেক লোক আছে।

    মানুষ খুন করার কাজে আমি এক্সপার্ট। খুন করতে আমার ভাল লাগে।

    লোকটার কথা শুনে কর্নেল ভাবল যে, সে মনের কথাই বলছে। শ্রম শিবিরে এর জন্য খাবার নষ্ট করার চেয়ে গুলি মারাই ভাল।

    আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? এখানে আপনাদের হয়ে খুনোখুনি কাজ কে করে? রুশীদের মার্ডার স্কোয়াডের একটা দল আছে। তাদের সঙ্গে আমাকে কথা বলতে দিন। তাদের হয়ে যে কোন লোককে খুন করতে আমি প্রস্তুত, এখুনি।

    তার দিকে বিতৃষ্ণা ভরা চোখে তাকাল কর্নেল। অপেক্ষা কর বলে কর্নেল পাশের ঘরে এল, ঘরের ডেস্কে তিনটে ফোন। মস্কোর সঙ্গে MGB-র ডিরেক্ট লাইনের রিসিভারটা সে তুলল। সামরিক অপারেটার সাড়া দিলে সে বলল, SMERSH SMERSH। উত্তর দিলে সে বড়কর্তার সঙ্গে কথা বলতে চাইল।

    দশ মিনিট পরে সে রিসিভারটা নামিয়ে রাখল। কি সৌভাগ্য! এই ইংরেজ ছোকরা সফল হলে তো কথাই নেই। সে বিফল হলে পাশ্চাত্য এলাকা প্রচুর ঝামেলা দেখা দেবে ঝামেলা ব্রিটিশদের, কারণ গ্রান্ট তাদের লোক। ঝামেলা জার্মানদের। কারণ গ্রন্টের প্রচেষ্টায় তাদের বহু গুপ্তচর আতঙ্কিত হবে। ঝামেলা আমেরিকানদের। কারণ বগার্ডেন চক্রকে অধিকাংশ অর্থ সাহায্যই তারা করেছিল। খুশি হয়ে অফিসে ফিরে গ্রান্টের সামনে বসল।

    তুমি যা বললে সে-কথা সত্যি?

    নিশ্চয়ই।

    তোমার স্মৃতিশক্তি ভাল?

    হ্যাঁ।

    ব্রিটিশ এলাকায় ডাঃ বগার্টেন নামে এক জার্মান আছে। সে থাকে ২২ নং কুরফুরস্টেন্ড ম্যানে ৫ নং ফ্ল্যাটে, জায়গাটা চেন?

    হ্যাঁ?

    আজ রাতে তোমাকে মোটর সাইকেল সমেত ব্রিটিশ এলাকায় ফেরত পাঠানো হবে। তোমার মোটর সাইকেলের নম্বর প্লেট পালটে দেওয়া হবে। ডাঃ বগার্টের কাছে তুমি একটা খাম নিয়ে যাবে, বলবে চিঠিটা গোপনীয়। তুমি ডাঃ বগাটেনের সঙ্গে একা দেখা করবে। তারপর তাকে খুন করবে, পারবে? কর্নেল জ কুঁচকে বলল।

    দৃঢ়স্বরে গ্রান্ট বলল, পারব। এ ধরনের আরো কাজ আমাকে দেবেন।

    কর্নেল বলল। আগে দেখা দরকার তুমি কতটা কি পার। কাজটা শেষ করে সোভিয়েত এলাকায় ফিরে কর্নেল বোরিসের সঙ্গে দেখা করতে চাইবে। ঘণ্টা বাজাতে সাদা পোশাকের একজন ঘরে এল। কর্নেল বলল, এই লোকটি তোমাকে খাবার দেবে। পরে সেই খাম আর আমেরিকান তৈরি ধারাল ছোরা দেবে, গুডলাক।

    আবেগভরা গলায় গ্রান্ট বলল, ধন্যবাদ স্যার।

    পশ্চিম জার্মানির এক অতিশয় নামকরা গুপ্তচরকে নিখুঁতভাবে খুন করার পর সীমান্ত পেরিয়ে সে কর্নেল বোরিসের সঙ্গে তাকে সাদা পোশাকে আর বৈমানিকের হেলমেট পরিয়ে খালি একটা MGB প্লেনে তুলে সোজা মস্কোতে পাঠানো হয়।

    তারপর এক বছর ধরে তাকে আধা হাজতে বাস করতে হয়। এই সময় গ্রান্ট নিজেকে কর্মক্ষম রেখে আর রুশ ভাষা শিখে কাটায়। প্রশ্নকারী মনস্তাত্ত্বিক আর ডাক্তারের দল তাকে দেখতে আসত। ইতিমধ্যে ইংল্যান্ডে আর উত্তর আয়ার্ল্যান্ডের সোভিয়েত গুপ্তচররা তার অতীত সবকিছু খুটিয়ে তদন্ত করে। ইংরেজ ও আমেরিকান প্রশ্নকারীরা, ডাক্তার ও মনস্তাত্ত্বিকরা সবাই একমত যে পৃথিবীর কোন রাজনীতি অথবা সামাজিক বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সে অতিমাত্রায় উন্মাদ, বিষণ্ণ মেজাজের লোক, পূর্ণিমার সময় তার উন্মত্ততা চরমে পৌঁছায়। গ্রান্ট স্বকামী (narcissist) ও অযৌন ব্যক্তি। তার দৈহিক স্বাস্থ্য নিখুঁত এবং শিক্ষার মান নিচু হলেও শেয়ালের মতই সে ধূর্ত। সবাই এক বাক্যে বলল যে সামাজিক জীব হিসেবে গ্রান্ট অতীব বিপজ্জনক এবং তাকে খতম করাই উচিত।

    MGB-র পারসোনাল ডিপার্টমেন্টের প্রধানের কাছে তার দলিলগুচ্ছ (dossiar) এলে তিনি লিখতে যাচ্ছিলেন। লোকটিকে মেরে ফেল। হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি আসে।

    সোভিয়েত ইউনিয়নে বহু মানুষকে হত্যা করতে হয়। তার কারণ এই নয় যে সাধারণ রুশী মানুষ নিষ্ঠুর। এই হত্যাকাণ্ড তাদের রাষ্ট্রনীতির এক হাতিয়ার। যারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণ করে তারাই রাষ্ট্রের শত্রু। গত দুই বৃহত্তম ব্যাপক নরমেধের সময় দশ লক্ষ লোককে হত্যা করা হয়েছিল। যদি আবার সেরকম বছরে দশ লক্ষ লোককে হত্যা করতে হয় তাহলে সমস্যা হবে জল্লাদের অভাব। জল্লাদদের জীবন সংক্ষিপ্ত। হত্যা করতে করতে তাদের অন্তরাত্মা পীড়িত হয়ে ওঠে। দশ, কুড়ি, একশ জনের মৃত্যু আর্তনাদ শোনার পর সে যত বড় অমানুষই হোক না কেন তারা ভীষণ মনমরা হয়ে পড়ে। একটা ভয়ংকর অবসাদে তাদের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। শরীরের ক্ষিপ্রতা কমে আসে, নিশানায় ভুল করে। নিয়োগকর্তা তখন সেই জল্লাদকে হত্যা করে তার জায়গায় অন্যজনকে নিয়োগ করে।

    MGB-র পারসোনাল ডিপার্টমেন্টের প্রধান এই সমস্যা সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন। তাই তিনি দেখলেন গ্রান্ট এমন একটা মানুষ যে উভয় রকম হত্যাকাণ্ডে পারদর্শী।

    পারসোনাল ডিপার্টমেন্টের প্রধান গ্রান্টের নথিপত্রের ওপর একটি সংক্ষিপ্ত, পিপূর্ণ মন্তব্য লিখে সেগুলোকে OUT লেখা ট্রের ওপর ফেললেন।

    SMERSH-এর ২নং ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব কাজ চালু করা এবং কাজ সম্পাদন করা (Operation and executions). জেনোভানকে তারা ডেকে নিয়ে তার নাম গ্রানিৎস্কি রেখে, তার নামটা তাদের খাতায় তুলল।

    পরের দুটো বছর খুব কষ্টে কাটে। তাকে একটা স্কুলে যেতে হত। তখন তার মন কেমন করত সেই স্কুলের জন্য যার করোগেটেড লোহার শেডের মধ্যে ছিল নানান ছুরি দেয় নানা না কাটার ডেস্ক, বাচ্চা ছেলেদের গন্ধ আর নীলচে মাছিদের তন্দ্রালু গুনগুনানি। কিন্তু এখানে লেনিনগ্রাদের বাইরে বিদেশীদের জন্য যে গুপ্তচর স্কুল রয়েছে, সেখানে জার্মান, চেক, পোল, বল্ট, চীনে আর নিগ্রোর দল। সবাই কেমন গম্ভীর। সর্বদা নোট বইতে তাদের কলম খসখস করে। সব কিছু তার কাছে নতুন মনে হয়।

    কিন্তু সে টেকনিক্যাল বিষয়, সংকেত লিপি এবং গুপ্তলিখনের মূল সূত্রগুলো চটপট বুঝততা। ফিল্ডওয়ার্কও সে ভাল বরত। সবশেষে যখন পরীক্ষা নেওয়া হয়–সতর্ক, প্রহরা বিচার বুদ্ধি, আত্মরক্ষা, প্রত্যুৎপন্নমতিতু, সাহস ও স্থির মস্তিষ্ক নিয়ে সে টিমের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নম্বর পায়।

    বছরের শেষে SMERSH-এর কাছে রিপোর্ট যায়, তার শেষে ছিল রাজনৈতিক শূন্য, ব্যবহারিক অসামান্য।

    বছরের পর বছর কাটে কয়েক শ রুশী আর মাত্র দুজন বিদেশী ছাত্রের সঙ্গে মস্কোর বাইরে কুচিনোর Terror and Diversion স্কুলে। জুড়ো, বক্সিং, খেলাধুলা, ফটোগ্রাফির এবং রেডিওর ব্যাপারে গ্রান্ট অসাধারণ কৃতিত্ব দেখায়। এ সব তদারকির দায়িত্বে ছিলেন বিখ্যাত কর্নেল আর্কাডি ফতোয়ে। রিভলভার-রাইফেল ইত্যাদি শিক্ষা লাভ করে লেফটেন্যান্ট কর্নেল নিকোলাই গডলোভস্কির কাছে। সে বছর আগে না জানিয়ে একটা MGB গাড়ি এসে পূর্ণিমার রাতে তাকে নিয়ে যায় মস্কোর জেলে। সেখানে ছড়ি, কুড় ল, সাবমেশিন গান এই সব অস্ত্র দিয়ে তাকে হত্যাকাণ্ড করতে দেওয়া হত। এই ঘটনার আগে ও পরে, এবং ঘটনার সময় তার কার্ডিওগ্রাম ও রক্তের চাপ নেওয়া হত। এর কারণ ও ফলাফল তাকে জানানো হত না।

    ১৯৪৯ এবং ৫০ সালে রুশের নানান বন্ধুদেশে ছোটখাটো কাজে গ্রান্টকে যেতে হত। Mobile Group-এর (সচল দল) সঙ্গে, রুশ ভাষায় যাকে Avampost বলে। যে সব রুশী গুপ্তচর এবং গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বলে সন্দেহ হয়, তাদের মারধর করা এবং হত্যা করা ছিল তার কাজ। এসব ডিউটি গ্রান্ট করত নিখুঁতভাবে। তার কাছে যেরকম উঁচুদরের কাজ আশা করা হয়েছিল, তার একচুলও এদিক ওদিক হয়নি। পূর্ণিমার সময় তাকে বাগ মানানো যাবে না। তার নিজের ওপরেও শাসন থাকবে না। তাই পূর্ণিমার সময়টা নির্দিষ্ট থাকত তার হাজতে জল্লাদগিরির জন্য।

    ১৯৫১ ও ৫২ সালে আরো সরকারি ও পরিপূর্ণভাবে গ্রান্টের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার হয়। বিশেষ করে বার্লিনে খুব ভাল কাজের জন্য তাকে সোভিয়েত নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। ১৯৫৩ সালে তার বেতন বেড়ে পরিমাণ দাঁড়ায় মাসে পাঁচ হাজার রুবল এবং মেজরের পদ তাকে দেওয়া হয়। কর্নেল বোরিদের সঙ্গে যোগাযোগ হলে তাকে পেনশন দেওয়া হবে স্থির হয়। ক্রিমিয়ার বাগানবাড়িটাও তাকে দেওয়া হয়। তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দুজন দেহরক্ষী তাকে দেওয়া হয়। MGB-র ভাষায় এই প্রাইভেট হওয়া মানে বিদ্রোহ ঘোেষণা করা। মাসে একবার পূর্ণিমার রাতে নিকটতম জেলে গিয়ে যতগুলো মানুষ মেলে তাদের হত্যা করার সুযোগ দেওয়া হত তাকে।

    স্বভাবতঃই গ্রান্টের কোন বন্ধু ছিল না। তার শুধু তাদের ওপরেই কৌতূহল ছিল যাদের সে হত্যা করত। তার বাকি জীবনটা ঠাসা ছিল তার নানা উত্তেজনাপূর্ণ চিন্তা নিয়ে।

    তাছাড়া তার অবশ্য ছিল SMERSH। এই SMERSH যার পক্ষে, সোভিয়েত ইউনিয়নে সে রকম কারোরই বন্ধুর জন্য মাথা ব্যথা নেই। তার একমাত্র দুর্ভাবনা–যাতে এই SMERSH-এর কালো ডানা তার ওপর চেপে না বসে।

    গ্রান্ট ভাবছিল তার নিয়োগকর্তারা তাকে কি চোখে দেখে। এমন সময় প্লেনটা নিচে নামতে শুরু করল। দক্ষিণে লাল আলোর ঝলক মস্কো। গ্রান্ট এখন তার যশের তুঙ্গে। SMERSH-এর সে এখন প্রধান জল্লাদ। অতএব এখন তার কি কাম্য? আরো উচ্চ পদ? আরো অর্থ? আরো টুকিটাকি সোনার জিনিসপত্র? আরো ভাল হত্যাকৌশল?

    মনে হল সত্যিই তার আর কোন কাম্য নেই। নাকি কোন এক দেশে এমন কোন ব্যক্তি আছে যাকে হত্যা করতে পারলে সে পৃথিবীর অদ্বিতীয় জল্লাদ হতে পারবে।

    .

    গুপ্তচরদের মৃত্যুদণ্ড

    SMERSH হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়নের সরকারী হত্যা প্রতিষ্ঠানের নাম। দেশে ও বিদেশে এই প্রতিষ্ঠান কাজ করে। ১৯৫৫ সালে এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করত ৪০,০০০ নরনারী। SMIERT SPIONEM -এর সংক্ষিপ্ত নাম SMERSH, যার অর্থ গুপ্তচরদের মৃত্যুদণ্ড। এই নামটা ব্যবহার করত শুধু এই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারি ও সোভিয়েত অফিসাররা।

    SMERSH-এর সদর দপ্তর হচ্ছে স্ট্রেতেংকা উনিৎসার এক বিরাট কুৎসিত আধুনিক আকৃতির বাড়িতে। এই চওড়া, নিরানন্দ পথে বাড়িটার নম্বর ১৩। বাড়িটার প্রশস্ত সিঁড়ি লোহার দরজায় পৌঁছেছে। সাব মেশিনগান হাত সেই সিঁড়ির দু পাশে দু জন প্রহরী দাঁড়িয়ে। তাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় পথচারীরা মাটির দিকে চোখ নামিয়ে চলত। বাড়ির তিনতলা থেকে SMERSH এর যাবতীয় নির্দেশ জারি করা হত। দোতলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘরটা বিরাট। দরজাটা শব্দরোধী। তার উল্টো দিকে দুটো প্রশস্ত জানালা, মেঝেতে সবচেয়ে ভাল জাতের কার্পেট। ঘরের বাঁ দিকের কোণে বিরাট এক ডেস্ক।

    ডেস্কের মাঝখানে আড়াআড়িভাবে একটা কনফারেন্স টেবিল। দুটোকে মিলিয়ে T-এর মত দেখতে। এই টেবিলের কাছে আটখানা চেয়ার।

    দেওয়ালে সোনালী ফ্রেমে বাঁধানো বিরাট চারটে ছবি। ১৯৫৫ সালে দরজার ওপরকার ছবিটা ছিল স্তালিনের, দুটো জানালার মাঝে ছিল লেনিনের এবং অন্য দুটো দেওয়ালে মুখোমুখি ছিল বুলগানিন এবং আর্মি জেনারেল ইভান আলেকসান্দ্রোভিচ সেরভের। ১৯৫৪ সালের ১৩ই জানুয়ারি পর্যন্ত সেরভের জায়গায় ছিল বেরিয়ারের ছবি।

    জেনারেল সেরভের ছবির নিচে ছিল একটা বুককেস। বুককেসটার পাশের দেয়াল ঘেষে সরু আর লম্বা একটা টেবিল। তার ওপর রয়েছে এক ডজন চামড়া বাঁধানো অ্যালবাম। সেগুলোর ওপর সোনালি অক্ষরে তারিখ স্ট্যাম্প করা। যে সব সোভিয়েত নাগিরক ও বিদেশীদের SMERSH হত্যা করেছে তাদের ছবি এই সব অ্যালবামে আছে।

    রাত ১১-৩০-এর খানিক আগে গ্রান্ড টুশিলনা বিমান বন্দরে ল্যান্ড করল। এই টেবিলটার সামনে দাঁড়িয়ে ১৯৫৪ সালের অ্যালবামের পাতা ওলটাচ্ছিলেন পঞ্চাশ বছরের এক শক্তসমর্থ গাট্টাগোট্টা লোক।

    SMERSH-এর কর্তার নাম জেনারেল বোজোবোয়সূচিখোভ। এই বাড়িতে তার নাম G। তার পরনে একটা খাকি টিউনিক, কলারটা উঁচু। গাঢ় নীলরঙের ট্রাউজারের নিচে নরম চকচকে কালো চামড়ার রাইডিং বুট। টিউনিকের বুকে রিবন দিয়ে তিন সারি মেডেল ঝুলছে। তার ওপরে ঝুলছে হিরো অফ দি সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বর্ণ-তারকা।

    মুখটা চওড়া ও হিংস্র। মুখশ্রী কঠোর আর একরোখা। তার মধ্যে ফুটে উঠেছে এক কর্তৃত্বের ছাপ।

    ডেস্কের একটা টেলিফোন বেজে উঠল। তিনি ধীরে পদে গিয়ে যে সাদা রিসিভারে vch লেখা সেটা তুললেন।

    কে?

    ডেরভ বলছি। আজ সকালে প্রেসিডিয়ামের মিটিং এরপর কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

    কমরেড জেনারেল, কয়েক মিনিটের মধ্যে এখানে মিটিং ডাকছি–তাতে যোগ দিচ্ছে RUMID, GRU এবং MGB। তারপর সবাই একমত হলে আমি আমার হেড অফ অপারেশন এবং হেড অফ প্ল্যান -এর সঙ্গে মিটিং এ বসব। খতম করার অনুমানে আমি আগে থেকেই মস্কোতে উপযুক্ত অপারেটিভকে এনেছি। একেবারে চাই না–শয়তানও সে কথা জানে। প্রথম মিটিং এরপর আমাকে টেলিফোন করবেন।

    নিশ্চয়ই ফোন করব, কমরেড জেনারেল।

    রিসিভার নামিয়ে G তার ডেস্কের তলায় একটা বোতাম টিপলেন। সেই সঙ্গে টেপ রেকর্ডারের সুইচ টিপলেন। তার পার্শ্বচর ঘরে এল। MGB-এর সে একজন ক্যাপটেন।

    সবাই পৌঁছেছে।

    হ্যাঁ, কমরেড জেনারেল।

    তাদের নিয়ে এস।

    কয়েক মিনিটের মধ্যে ছ জন ঘরে ঢুকে কনফারেন্স টেবিলের সামনে যে যার নিজের জায়গায় বসল। তাদের পাঁচজনের পরনে ইউনিফর্ম। তাদের মধ্যে তিনজন সিনিয়র অফিসার, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে একজন করে পার্শ্বচর।

    টেবিলের একপাশে বসেছিল লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্নাভিন। GRU-এর সে বড়কর্তা। তার পাশে এক কর্নেল পদস্থ ব্যক্তি। টেবিলের শেষ প্রান্তে বসেছিল RUMID-এর লেফটেন্যান্ট। জেনারেল ভজদভিশেনস্কি। এটা হচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রকের গুপ্তচর বিভাগ। তার পাশে সাদা পোশাকে একজন মাঝবয়েসী লোক। দরজার দিকে পেছন করে বসেছিল রাষ্ট্র নিরাপত্তার কর্নেল নিকিতিন–MGB-র রাশিয়ার সর্বোচ্চ গুপ্তচর সংস্থার বড়কর্তা। তার পাশে একজন মেজর।

    গুড ইভনিং, কমরেডস্।

    তিনজন সিনিয়র অফিসারের মুখ থেকে মৃদু সতর্ক অস্ফুট শব্দ বের হল। তারা প্রত্যেকেই জানত শব্দ ধরার জন্য : ঘরে তারের জাল আছে এবং প্রত্যেকই ভাবতো সেই একা কথাটা জানে।

    ধূমপান করা যাক। জেনারেল এক প্যাকেট মাকে ভোলগা সিগারেট বার করলেন আর আমেরিকার জিপো লাইটারে ধরালেন। তারপর জেনারেল G কাটাকাটাভাবে বললেন ।

    কমরেডস! আমরা এখানে মিলিত হয়েছি কমরেড জেনারেল সেরভের নির্দেশে। প্রেসিডিয়ামের তরফ থেকে জেনারেল সেরভ আমাকে আদেশ দিয়েছেন আপনাদেরকে রাষ্ট্রনীতির কতকগুলো বিষয় জানাতে। আমাদের পরামর্শ করে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে যা রাষ্ট্রের পক্ষে অত্যন্ত গুরুতুপূর্ণ।

    এবার G থামলেন তাদের ভাববার জন্য। যে তিনজন সিনিয়র অফিসার ছিল তারা ঘাবড়ে গেল। তারা রাষ্ট্রের গোপনীয় কথা জানতে চলেছে। এই জানাটা একদিন হয়ত তাদের চরম সর্বনাশ ডেকে আনবে।

    জেনারেল G বললেন, তিন মাসের মধ্যে শক্ত এলাকায় একটা প্রচণ্ড রকম সন্ত্রাসমূলক কাজ করা সম্বন্ধে আমাদের সিদ্ধান্তে নিতে হবে। চেয়ারে হেলান দিয়ে G বলে চললেন, কমরেডস, রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতি এক নূতন পর্যায়ে পৌঁছেছে। আগে সেটা ছিল কঠোর নীতি। নীতিটা কাজের হলেও পাশ্চাত্যে একটা চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি করছিল। বিশেষ করে আমেরিকায়। আমাদের গোয়েন্দা বিভাগের রিপোর্ট, রাশিয়ার ওপর অঘোষিত এক পারমাণবিক আক্রমণের কিনারে তাদের আমরা ঠেলে এনেছি। লড়াই যদি করতেই হয় তবে আমরাই স্থির করব কখন করত হবে।

    কয়েকজন শক্তিশালী আমেরিকান আমাদের হার্ড পলিসির সাফল্য দেখে পারমাণবিক আক্রমণের পরিকল্পনা করছিল। তাই নতুন এক কূটনীতি স্থির করা হয়েছে যার নাম কঠিন-কোমল নীতি। জেনিভায় এই নীতির শুরু। কয়েকটি দেশকে আবার চীন ভয় দেখাচ্ছে। দেখালে আমরা কঠোর বহু সাংবাদিক, অভিনেতা ও শিল্পীদের কাছে আমরা আমাদের সীমান্ত খুলে দিয়েছি, যদিও তাদের মধ্যে অনেকেই গুপ্তচর। কমরেড বুলগানিন ও ক্রুশ্চেভ এবং কমরেড জেনারেল সেরভ ভারত প্রাচ্য সফরে গিয়ে ইংরেজদের মুণ্ডপাত করে। ফিরে এসে লন্ডনে আগামী শুভেচ্ছা। মূলক সফর সম্বন্ধে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপ আলোচনা করে। এইভাবেই চলে গরম ও নরমের পালা। পাশ্চাত্যের কাছে সবকিছু গুলিয়ে যায়। উত্তেজনা বাড়বার আগেই শিথিল হয়ে আসে, আমাদের শত্রুদের মধ্যে এলোমেলোভাবে প্রতিক্রিয়া হয়।

    টেবিলের সবাইকার মুখে মৃদু মৃদু হাসি ফোটে। কি চমৎকার কৌশল। পাশ্চাত্যের লোকেদের আমরা কি বোকাই না বানাচ্ছি।

    অন্যদের আনন্দ দিতে পেরে জেনারেল G-র মুখেও হাসি ফুটল। সেই সঙ্গে চুপিচুপি সবকিছু আমরা এগিয়ে নিয়ে চলেছি-মরক্কোতে বিপ্লব, ইজিপ্টকে অস্ত্র সাহায্য, যুগোস্লাভিয়ায় বন্ধুত্ব, সাইপ্রাসে গণ্ডগোল, তুরস্কে দাঙ্গা, ইংল্যান্ডে স্ট্রাইক, ফ্রান্সে বিরাট রাজনৈতিক জয়লাভ।

    জেনারেল G দেখলেন যে এবার তাদের বুঝিয়ে দেবার সময় হয়েছে নতুন পলিসির দায় দায়িত্ব। মৃদুস্বরে বললেন, কিন্তু কমরেড, রাশিয়ার রাষ্ট্রনীতি কোথায় ব্যর্থ হয়েছে। আমরা যখন গরম হতে চেয়েছিলাম তখন কারা নরম হয়েছিল? রাষ্ট্রের অন্যবিভাগের যখন জয় জয়কার তখন কোন বিভাগের হার হয়েছে। কারা বোকার মত ভুল করেছে। কারা বিশ্বের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের মুখ পড়িয়েছে। কারা?

    তিনি প্রায় চিৎকার করে উঠলেন। কনফারেন্স টেবিলের সবাই-র মুখ ফ্যাকাশে দেখে ডেস্কের ওপর সজোরে ঘুষি মারলেন G।

    কমরেডস্! সেটা সোভিয়েত ইউনিয়নের সমস্ত গুপ্তচর বিভাগ। তার স্বর উত্তেজনায় ফেটে পড়ে। আমরাই হচ্ছি কুঁড়ে। আমরাই অন্তর্ঘাতক। আমরাই বিশ্বাসঘাতক! সোভিয়েত ইউনিয়নের মহান ও গৌরবময় সংগ্রামে আমরা আমাদের কর্তব্য করতে পারিনি। আমরা! আমরা! ঘরের সবার দিকে তিনি হাত ঘোরালেন। আমরা সবাই! আবার তার স্বর স্বাভাবিক হল, কমরেডস্! রেকর্ডটা দেখুন। হতভাগা সুনিশি তার রেকর্ড দেখুন! প্রথমে আমরা হারাই গুঁজেঙ্কোকে আর সেই কানাডায় আমাদের পুরো গুপ্তচর চক্র বরবাদ হয়ে যায়। তারপর টোকায়েভের মত লোককে আমরা হারাই। তারপর খোকনভের লজ্জাজনক ঘটনা, যার জন্য আমাদের দেশের দারুণ ক্ষতি হয়। তারপর অস্ট্রেলিয়ার পেত্ৰভ আর তার স্ত্রী–সবকিছু বিশ্রী ভুলে ভরা। এই তালিকার শেষ নেই-পরাজয়ের পর পরাজয়।

    জেনারেল G একটু থেমে নরম গলায় আবার বললেন, কমরেডস্! আপনাদের জানাতে হচ্ছে যে আজ রাতে গুপ্তচরবৃত্তির ক্ষেত্রে বিরাট একটা জয় কিভাবে হতে পারে সে সম্বন্ধে। আমরা যদি কোন সুপারিশ অনুমোদিত হলে সেই মত কাজ আমরা করতে না পারি, তাহলে ঘোরতর বিপদ।

    এই ভীতি প্রদর্শনের কথা স্পষ্ট করে না বলে ঘুরিয়ে জেনারেল বললেন, তাহলে অসন্তোষের কারণ ঘটবে।

    .

    ষড়যন্ত্র

    জেনারেল G বুঝলেন–ঘরের লোকদের বেশ জুৎসই করে চাবকানো হয়েছে। তাদের ক্ষত লেহন করার জন্য কয়েক মিনিট দেওয়া হল।

    নিজের পক্ষ নিয়ে কেউ টু শব্দটি পর্যন্ত করল না। সোভিয়েত গুপ্তচর বিভাগের যে অসংখ্য জয়। এবং হারের সংখ্যা নগণ্য–একথা পর্যন্ত কেউ বলল না। এই অপরাধের ভাগ SMERSH-এর কারও প্রাপ্য। সে বিষয়ে কেউ উচ্চবাচ্যও করল না। জেনারেল G যা বললেন সেগুলো খোদ সরকারের কথা, জেনারেলকে দিয়ে বলানো। তিনি সরকারের প্রিয়পাত্র এবং গোয়েন্দা বিভাগের সর্বেসর্বা।

    টেবিলের শেষ প্রান্তে বসেছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি লেফটেন্যান্ট জেনারেল ভজুভিশেনস্কি। নিজের লম্বা কাজবেক সিগারেটের ধোঁয়ার কুণ্ডলীর দিকে তাকিয়ে মনে পড়ল বেরিয়ার মৃত্যুর পর মলোট তাকে বলেছিলেন যে জেনারেল G খুব উন্নতি করবেন। G-কে বেরিয়া অপছন্দ করত। রাষ্ট্র নিরাপত্তা দপ্তরে তাকে সামান্য ক্ষমতার চাকরি দিয়েছিল। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত G ছিলেন নগণ্য একজন ডেপুটি। সেই পদ বিলুপ্ত হওয়ার পর পরম ক্ষমতাশালী

    জেনারেল সেরভের গোপন নির্দেশে বেরিয়ার পতনের জন্য ও উঠেপড়ে লাগেন। সেরভের রেকর্ড এত ভাল যে বেরিয়া তাকে স্পর্শ করতে পারেনি।

    দলবলসমেত বেরিয়ার ফাঁসি হয়। পুরস্কার হিসেবে G-কে দেওয়া হয় SMERSH। সেরভ, বুলগানিন এবং ক্রুশ্চেভ এখন রাশিয়া শাসন করেন। একদিন একাই হয়ত সে শীর্ষে পৌঁছবেন।

    G কঠিন তামাটে চোখে তাকাল ভজুভিশেনস্কির দিকে, ভাবলেন, লোকটা ভারি ধূর্ত। লোকটাকে দিয়ে কথা বলানো যাক।

    তিনি বলে চললেন, কমরেডস্। আমাদের খুব হতাশ হবার কারণ নেই। সবেচেয়ে উঁচু গাছও কুড় লের কোপে লুটিয়ে পড়ে। আমরা কখনও ভাবিনি যে আমাদের বিভাগগুলো এমন সাফল্য অর্জন করেছে যে তা সমালোচনার ঊর্ধ্বে। আপনাদের যে কথা বলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা শুনে আমরা কেউ অবাক হব না। তাই আসুন, আমরা নির্ভিকভাবে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে কাজ শুরু করি।

    G আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে বলে চললেন?

    আমি বলেছি গুপ্তচর বৃত্তির ক্ষেত্রে আমাদের একটা সন্ত্রাসমূলক কাজের সুপারিশ করতে হবে। সেই কাজটা সম্পাদনা করতে হবে কোন একটি বিভাগকে নিঃসন্দেহে আমার বিভাগকে।

    টেবিলের সবাইকার স্বস্তির নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। যাক, দায়িত্বটা তাহলে SMERSH-এর ঘাড়ে।

    কিন্তু একটা শিকার বেছে নেওয়া সহজ নয়। এই বাছাই ব্যাপারে যাতে ভুল না হয় সেই গুরুদায়িত্ব আমাদের সবাইকার।

    এটা কোন বাড়ি উড়িয়ে দেওয়া বা কোন প্রধানমন্ত্রীকে গুলি করা নয়। এ ধরনের কোন বুর্জোয়া নাটুকেপনার কথা চিন্তাই হয়নি। কাজটা অত্যন্ত সূক্ষ্ণ ধরনের।

    একটু থেমে G RUMID-এর প্রতিনিধির দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, যে প্রতিষ্ঠানকে আমরা আঘাত হানব, এখন সেটা স্থির করা দরকার। তারপর স্থির করতে হবে সেই প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট শিকার। কমরেড লেফটেন্যান্ট জেনারেল ভজভিশেনস্কি, আপনি নিঃসন্দেহভাবে বিদেশের গোয়েন্দা বিভাগের ওপর নজর রাখেন। আপনার মতামত আমরা জানতে চাই। তারপর যেটা সবচেয়ে বিপজ্জনক এবং যেটার সবচেয়ে ক্ষতি করতে চাই সেটাকে আমরা বেছে নেব।

    G তার সখা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে প্রধানত বিদেশে গোয়েন্দাগিরি করে সে কাটিয়েছে। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সে একজন পেশাদার গুপ্তচর। যে সব প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে আজীবন সে লড়ে এসেছে তাদের সম্বন্ধে মতামত জানাতে তার কোন দ্বিধা নেই।

    তার পার্শ্বচর কিন্তু অস্বস্তি বোধ করল। RUMD এভাবে কোণঠাসা হচ্ছে দেখে সে ঘাবড়ে গেল। তাদের কি করা উচিত সে বিষয়ে কোন নির্দেশ দেয়নি। প্রতিটি কথা শোনার জন্য সে কান খাড়া করে রইল।

    জেনারেল ভজদভিশেনাস্কি সাবধানে বলতে লাগল। প্রত্যেক দেশেই ভাল গুপ্তচর আছে। সবসময় সবচেয়ে বড় দেশেই যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বা ভাল গুপ্তচর থাকবে তা নয়। কিন্তু গুপ্তচর বিভাগের অনেক খরচ, ছোট ছোট দেশ সে খরচ চালাতে পারে না যেমন, নথিপত্র জাল করার বিভাগ। নানা রেডিও বিভাগ, এজেন্টদের নানা রিপোর্ট পড়ে সেগুলো তুলনা আর মূল্যায়ন করার বিভাগ। যতক্ষণ না আমরা সুইডেনে পৌঁছচ্ছি। বহু শতাব্দী ধরে আমাদের ওপর তারা গোয়েন্দাগিরি করে আসছে। এমনকি ফিনল্যান্ড কিংবা জার্মানির চেয়েও বালটিক সম্বন্ধে তারা অনেক বেশি খবর রাখে। তারা বিপজ্জনক। তাদের ক্রিয়া কলাপ আমি বন্ধ করতে চাই।

    G বাধা দিয়ে বললেন, কমরেড, সুইডেনে গুপ্তচর নিয়ে কেলেঙ্কারী লেগেই আছে। কেলেঙ্কারির সংখ্যা আর একটা বাড়লে কিছুই হবে না। দয়া করে বলে চলুন।

    ইটালিকে বাদ দেওয়া যায়। তারা চালাক এবং কাজের। কিন্তু আমাদের কোন ক্ষতি তারা করে না। স্পেন সম্বন্ধেও একই কথা, যদিও তাদের প্রতি গুপ্তচর বৃত্তি পাটির পক্ষে বিরাট বাধা। এই ফ্যাসিস্টদের হাতে আমরা বহুলোককে হারিয়েছি। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কাজ করতে গেলে সম্ভবত আরো অনেক লোক আমরা হারাব-লাভ কমই হবে আমাদের। এখন তারা বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হয়নি। ফ্রান্সে অধিকাংশ গোয়েন্দা বিভাগে আমরা মাথা গলিয়েছি। তবু এখনো Deuxieme Bureau খুব দক্ষ আর বিপজ্জনক। তার বড়কর্তার নাম মাথিল। শিকার হিসাবে লোকটি লোভনীয়। ফ্রান্সে কাজ করাও সহজ। G মন্তব্য করল। ফ্রান্সে নিজের দেখাশুনা নিজেই করছে। কিন্তু ইংল্যান্ডের কথা একেবারে আলাদা। আমরা মনে হয় তাদের গুপ্তচর বিভাগকে আমরা শ্রদ্ধা করি। সে বলে চলল, তাদের গুপ্তচর বিভাগ খুবই ভাল। ইংল্যান্ড একটা দ্বীপ। তাই তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা সহজ। তারা শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান লোকেদের চাকরি দেয়। বহু ক্ষেত্রে তারা জয়ী। তাদের এজেন্টরা ভারি দক্ষ। তাদের বেতন সামান্য তবুও তারা শ্রদ্ধার সঙ্গে কাজ করে। এরা বিশেষ একটা সুযোগ সুবিধে পায় না। অবসর গ্রহণের আগে তাদের কোন মানপত্র দেওয়া হয় না। তা সত্ত্বেও তারা বিপজ্জনক কাজ করে যায়। অবশ্য তাদের এক অদ্ভুত বিশ্বাস আছে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আর নিজেদের গুপ্তচর সংস্থার ওপর। তাদের ভয় পাবার কিছুই নেই। কিন্তু তাদের এই অলীক বিশ্বাসটা ভাঙা দরকার। কিন্তু আমেরিকানদের বেলায়? G প্রশ্ন করলেন। আমাদের শত্রুদের মধ্যে আমেরিকানরাই প্রধান। রেডিও আর অস্ত্রশস্ত্র তাদের শ্রেষ্ঠ। কিন্তু তারা কাজটা ভাল বোঝে না। ওদের টাকা আছে তাই ভাল গুপ্তচরেরা শুধু টাকার জন্য কাজ করে না।

    G নরম স্বরে বললেন। কমরেড় অনেক ক্ষেত্রে তারা কিন্তু জিতেছে। আপনি তাদের উচিত কদর দিচ্ছেন না।

    জেনারেল ভজদভিশেনস্কি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, কমরেড জেনারেল, কয়েকটি ব্যাপারে তারা জিততে পারে। হাজারটা বীজ ছড়ালে অন্তত একটা আলু ফলবেই। আমি মনে করি না আমেরিকানদের নিয়ে এই সভায় আলোচনার দরকার। জেনারেল স্লাভিন বলল, কমরেড জেনারেল ভজ্বদিভশনস্কির কথাগুলো শুনে আমার আর কিছু বলার নেই। রাষ্ট্র নিরাপত্তা দপ্তরের কর্নেল নিকিতিন বলল, ইংরেজ দফতর বিভাগকেই আমি শিকার হিসেবে সুপারিশ করছি। ডেস্কে তার লাইটার আস্তে ঠকে G বললেন, কমরেডস এ বিষয়ে সবাই তা হলে একমত? ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগের। বিরুদ্ধে আমাদের কাজ করতে হবে?

    টেবিলের সবাই সাবধানে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। এ বিষয়ে আমিও একমত। এখন ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগের কোন লোক আমাদের শিকার হবে। কমরেড জেনারেল ভজদভিশেনস্কি আমাদের একটি লোকের কাহিনী বলেছিল, যার ওপর ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগের সমস্ত শক্তি নির্ভর করে। সেটাই এখন প্রশ্ন–এ লোকটা কে? সে কি তাদের বড়কর্তা? ব্রিটিশ গুপ্তচর দফতরের বড়কর্তা কে?

    কর্নেল নিকিতিন বলল, লোকটি একজন অ্যাডমিরাল। লোকে তাকে M নামে জানে। খুব সামান্য তথ্য নিয়ে তার একটা ফাইল আমাদের আছে। সে বিশেষ মদ খায় না। মেয়ে মানুষের ওপর লোভের বয়েস নেই। সাধারণ লোকে তার অস্তিত্ব জানে না। তার মৃত্যু নিয়ে কেলেঙ্কারি জাহির করা কঠিন। সে বিদেশেও বেশি যায় না। তাকে খুন করা শক্ত। লন্ডনের পথে তাকে গুলি করে মারা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

    G বললেন, আপনার কথাই ঠিক। কিন্তু আমরা এখানে এসেছি এমন একটা শিকার খোঁজার জন্য, যে আমাদের সব চাহিদা মেটাতে পারবে। তাদের হিরো হবার কি এই প্রতিষ্ঠানে কেউ নেই? হিরোদের নিয়েই গল্প কথা ওঠে। সে ধরনের কোন লোক তাদের মধ্যে কে হতে পারে? MGB-র কর্নেল নিকিতিন বললেন, এ ধরনের একজন লোক আছে। তার নাম বন্ড।

    .

     ডেথ ওয়ারেন্ট

    G চেঁচিয়ে উঠলেন, সত্যি-ই বন্ড নামে একটা লোক আছে–জেমস্ বন্ড। কি অবাক কান্ড, আমার পর্যন্ত তার নামটা মনে পড়েনি, গুপ্তচর বিভাগের সমালোচনাটা মিথ্যে নয়।

    ভজদভিশেনস্কি নিজের বিভাগকে সমর্থন করে বলল, কমরেড জেনারেল, সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক শত্রু আছে। এই বন্ড লোকটার নাম আমার জানা। বহুবার সে আমাদের বেকায়দায় ফেলেছে। কিন্তু যারা আমাদের অস্বস্তির কারণ শুধু তাদের নামগুলোই আমার মাথায় ঘুরছে। ফুটবল আমার খুব ভাল লাগে। কিন্তু আমাদের জিনামা ক্লাবের বিরুদ্ধে যে সব বিদেশীরা যোগ দিয়েছে তাদের নাম আমার মনে নেই।

    G বললেন, কমরেড তামাশা করবেন না। এটা একটা গুরুতর বিষয়। এই কুখ্যাত এজেন্টের নাম আমার মনে থাকা দরকার ছিল। কমরেড কর্নেল নিকিতিন নিশ্চয়ই আমাদের আরো নানা কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। এই বন্ড লোকটা অন্তত দুবার SMERSH-এর প্ল্যান বানচাল করে দিয়েছিল। মানে, আমি তখন এই বিভাগে ছিলাম না।

    ফ্যান্সের ক্যাসিনো রয়্যালে ল্য শিফরে নামে একটা লোক ফ্রান্সে আমাদের পাটির খুব ভাল নেতা ছিল। নিজের বোকামীর জন্য সে টাকার টানাটানিতে পড়ে। এই বন্ড বাদ না সাধলে টাকার অসুবিধে সে কাটিয়ে উঠতে পারত। আমাদের ডিপার্টমেন্ট চটপট শিফরেকে খতম করতে বাধ্য হয়। তখনই এই ইংরেজটাকেও মেরে ফেলা উচিত ছিল। তারপর হারলেমে আমাদের দলের সেই নিগ্রোটার ব্যাপার। দারুণ লোক। আমরা যেসব বড় বড় বিদেশীদের চাকরি দিয়েছি সে তাদেরই একজন। ক্যারিবিয়ানে কিছু ধনদৌলতের ব্যাপার ছিল। ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগ ঐ ইংরেজকে পাঠায়। সমস্ত দলটাকে সে ভেঙে চুরমার করে দেয়, আমাদের এজেন্টকে খুন করে। আমাদের দারুণ ক্ষতি হয়। এই ইংরেজ গুপ্তচরকে সরাসরি মেরে ফেলাই উচিত ছিল।

    কর্নেল নিকিতিন বললেন, ঐ ধরনের অভিজ্ঞতা আমাদেরও আছে। সেই জার্মান আর মুনরেকরা রকেটের ব্যাপারটা। কমরেড, নিশ্চয়ই সে ঘটনা আপনার মনে আছে। সমস্ত ব্যাপারটা সার্থক হলে ভাল লাভ হত। কিন্তু আবার এই বন্ড সবকিছু বানচাল করে দেয়। সেই জার্মানটা মারা পড়ে।

    GRU-এর জেনারেল স্ন্যাভিনের মনে হল তারও কিছু বলা দরকার। রকেটের ব্যাপারটা সামরিক বিভাগের। সেটা ব্যর্থ হবার দোষ GRU-এর ঘাড়ে চাপানো হয়। নিকিতিন ব্যাপারটা ভাল করেই জানতেন। যথা নিয়মে MGB চেষ্টা করছিল এইভাবে অতীতের কথা তুলে GRU-কে ফ্যাসাদে ফেলতে।

    নীরস স্বরে সে বলল, কমরেড কর্নেল, আমরা বলেছিলাম আপনার ডিপার্টমেন্ট লোকটার যেন একটা ব্যবস্থা। করে। আমাদের অনুরোধমত কাজ হলে আজ আর ঐ লোকটাকে নিয়ে মাথা ব্যথা হত না।

    কর্নেল নিকিতিন প্রচণ্ড রাগ সামলে নিয়ে তীব্র ব্যঙ্গ স্বরে বলল, কমরেড জেনারেল সবিনয়ে জানাচ্ছি, ওপর মহল থেকে GRU-এর অনুরোধের সমর্থন আসেনি। ইংল্যান্ডের সঙ্গে আরো বেশি গণ্ডগোল পাকানো কাম্য নয়। হয়ত কথাটা আপনি ভাবেননি। যদি হোক, MGB-র কাছে সে রকম কোন অনুরোধ এসে থাকলে অ্যাকশনের জন্য SMERSH-কে কথাটা জানাত।

    তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, আমার ডিপার্টমেন্ট সে রকম কোন আদেশ পায়নি। পেলে এই লোকটাকে চটপট সাবাড় করে দেওয়া হত। এই লোকটার সাম্প্রতিক কাজকর্মের কথা MGB আমাদের বলুন।

    পার্শ্বচরের সঙ্গে কর্নেল নিকিতিন তাড়াতাড়ি ফিসফিস করে আলোচনা করলেন। তারপর বললেন, বিশেষ আর নতুন খবর নেই। আমাদের বিশ্বাস হীরে নিয়ে চোরা কারবারের কোন-একটা ব্যাপারে সে জড়িত ছিল। সেটা গত বছরের কথা। ব্যাপারটা আফ্রিকা আর আমেরিকার মধ্যে। ফাইলে হয়তো আরো খবর আছে আমি আর খবর জানি না।

    G মাথা নাড়লেন। সবচেয়ে কাছের টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে, সেন্ট্রাল ইনডেক্সঃ জেনারেল বোজাবয়শ্চিকভ কথা বলছি। ইংরেজ গুপ্তচর বন্ডের ফাইল। বিশেষ জরুরি। রিসিভারটা নামিয়ে সবাইর দিকে কর্তৃত্বের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, কমরেডস, নানা দিক দিয়ে মনে হচ্ছে টার্গেট হিসাবে এ লোকটাই সবচেয়ে উপযুক্ত। আমাদের রাষ্ট্রের বিপজ্জনক শক্ত, তাকে, খতম করলে আমাদের সব গুপ্তচর বিভাগ উপকৃত হবে। তাই না? কনফারেন্স থেকে একটা ঘড়ঘড় শব্দ হল।

    লোকটা মরলে ইংল্যান্ডের গুপ্তচর বিভাগের খুব ক্ষতি হবে। তার চেয়ে বেশি কিছু কি হবে? তার সম্বন্ধে চলতি যে সব গল্প-গুজব সেটা কি ধ্বংস হবে লোকটা কি তার দেশ আর প্রতিষ্ঠানে হিরো?

    জেনারেল ভজদভিশেনস্কি বুঝলেন প্রশ্নটা তার উদ্দেশ্যে, তিনি বললেন, ফুটবল বা ক্রিকেট খেলোয়াড় কিংবা জকি না হলে ইংরেজরা কাউকে হিরো বলে স্বীকার করে না। গুপ্তচর বিভাগের মধ্যে হিরো হতে হলে, নির্ভর করে তার চেহারা আর ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের ওপর। লোকটা দেখতে যদি মোটা তেল চুকচুকে আর কদাকার হয় তাহলে কেউ তাকে হিরো বলে মনে করে না, তা সে যতই কাজের ক্ষেত্রে সফল হোক না কেন।

    বাধা দিয়ে নিকিতিন বললেন, যে সব ইংরেজ গুপ্তচরদের আমরা ধরেছি তারা এই লোকটার প্রসংশায় পঞ্চমুখ। তাদের গুপ্তচর বিভাগের সবাই তাকে শ্রদ্ধা করে। সবাই বলে, মানুষটা খুব ধূর্ত, একলা কাজ করে, চেহারাটাও খুব সুন্দর।

    অফিসের নিজস্ব টেলিফোন বাজলে G সেটা তুলে বললেন, নিয়ে এস। দরজায় টোকা দিয়ে তার পার্শ্বচর একটা ফাইল নিয়ে এল। G-র সামনে ডেস্কের ওপর ফাইলটা রেখে দরজা বন্ধ করে চলে গেল।

    ফাইলের মলাটটা চকচকে কালো। ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত কোণাকুণি সাদা ডোরাকাটা। ওপরের বাঁ দিকে দুটো সাদা অক্ষর s s –অর্থাৎ অত্যন্ত গোপনীয়। মাঝখানে সাদা অক্ষরে লেখা : জেমস বন্ড। তার নিচে লেখা? ANGLISK SPION অর্থাৎ ইংরেজ গুপ্তচর।

    G ফাইল খুলে ফটোগ্রাফ ভরা বড় একটা খাম বের করলেন। ডেস্কের ওপরকার কাঁচের ওপর সেগুলো ঢাললেন। তারপর একটা একটা করে খুটিয়ে দেখলেন, মাঝে মাঝে একটা ম্যাগ্নিফাইং গ্লাস দিয়ে। নিজের দেখা হলে ছবিগুলো নিকিতিনকে দিলেন। নিকিতিন তার পাশের জনকে, এভাবে ছবিগুলো সবার হাত ঘুরে চলল।

    প্রথম ছবিটা ১৯৪৬ সালের। ছবিটা এক যুবকের। একটা কাফের বাইরের টেবিলের সামনে রোদে সে বসে রয়েছে। টেবিলে একটা লম্বা কাঁচের গ্লাস আর সোডার পানির সাইফন। ডান হাত টেবিলের ওপর আর আঙুলের ফাঁকে একটা সিগারেট। পা দুটো এমন ভঙ্গীতে ভাঁজ করা যা ইংরেজরাই করে থাকে। বাঁ হাত দিয়ে ডান পায়ের গাঁটটা সে চেপে ধরেছে, ভঙ্গীটা অমনযোগীর। লোকটা টের পায়নি যে তার ফটো তোলা হচ্ছে।

    পরের ছবির তারিখ ১৯৫০। ছবিটায় দেখা যাচ্ছে শুধু মুখ আর কাঁধ, কিন্তু ছবিটা একই লোকের। ছবিটা ক্লোজ আপ। চোখ কুঁচকে সতর্কভাবে বন্ড কিছু একটা দেখছে।

    তৃতীয়টার তারিখ ১৯৫১। খুব কাছে বাঁ দিক থেকে তোলা। সেই একই লোক। পরনে কালচে স্যুট, একটা চওড়া পথ দিয়ে হেঁটে চলেছে। ওপাশে একটা বন্ধ দোকান। লোকটার খুব তাড়া, ভাবভঙ্গি বিপজ্জনক। G ভাবলেন ছবিটা কোন গাড়ি থেকে তোলা।

    চতুর্থ এবং শেষ ছবিটা তোলা ১৯৫৩-তে। ছবিটা এনলার্জ করা। কোন সীমান্তে বা কোন হোটেলের দ্বাররক্ষীর কাছে বন্ড যখন তার পাসপোর্ট দাখিল করছে তখন তোলা। ৫ ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে ছবিটা খুব খুটিয়ে দেখলেন।

    লোকটার মুখ সুগঠিত। তার ডান গালের রোদে-পোড়া চামড়ার ওপর তিন ইঞ্চি পরিমাণ একটা সাদা ক্ষতের দাগ। সোজা কালো দীর্ঘ ভুরুর নিচে চোখ দুটো স্থির। তার ঘন কালো চুল বাঁ-দিকে সিথি করে এলোমেলোভাবে বুরুশ। করা। নাকটা টিকলো। ওপরকার ঠোঁট চাপা। দুটো ঠোঁটই সুন্দর, কিন্তু নিষ্ঠুর ধরনের। তার চোয়ালের গড়ন দৃঢ়।

    G ছবিটা দেখে বুঝলেন দৃঢ় সংঙ্কল্প, কর্তৃত্ব আর নিষ্ঠুরতার ছাপ। লোকটার চরিত্রের আর কোন বৈশিষ্ট্য নিয়ে তিনি মাথা ঘামালেন না। টেবিলের অন্যদিকের কাছে ছবিটা এগিয়ে দিয়ে ফাইলের পাতাগুলো দ্রুতহাতে উলটে চললেন।

    ফাইলের এক জায়গায় আঙুল রেখে গম্ভীরস্বরে তিনি বললেন, দেখে মনে হচ্ছে লোকটা দুর্দান্ত। তার সম্বন্ধে ফাইলের কয়েকটা অংশ পড়ে শোনাচ্ছি, তারপর কি কর্তব্য আমাদের স্থির করতে হবে। প্রথম পাতাটা খুলে তিনি পড়লেন?

    প্রথম নাম জেমস্। লম্বা ও ১৮৩ সেন্টিমিটার। ওজন : ৭৬ কিঃ গ্রাম। চেহারা ছিপছিপে। চোখ ও নীল। চুল কালো। ডান গাল আর বা কাঁধে ক্ষত-চিহ্ন। ডান হাতের পেছনে প্লাস্টিক সার্জারীর চিহ্ন (পরিশিষ্ট A দ্রষ্টব্য); সবরকম অ্যাথলেটিক্স নিপুণ। পিস্তল চালানো, বক্সিং আর ছুরি ছোড়বার ব্যাপারে অত্যন্ত দক্ষ। ছদ্মবেশ গ্রহণ করে না। ফরাসী আর জার্মানী ভাষা জানে, খুব সিগারেট খায় (বিশেষ দ্রষ্টব্য ও বিশেষ করে খায় সোনালি তিন-ফিতে-লাগানো সিগারেট); দোষ মদ্যপান, কিন্তু অতিরিক্ত নয় এবং মেয়ে মানুষ। ঘুষ নেয় বলে শোনা যায়নি।

    পাতা উলটিয়ে G আবার পড়তে লাগলেন, লোকটা তার বাঁ হাতে সর্বদাই একটা খাপে ভরা .২৫ বেরেটা অটোমেটিক পিস্তল নিয়ে ঘোরে। শোনা যায় তার বাঁ বাহুতে স্ট্র্যাপ দিয়ে আঁটা ছুরি থাকে। তার জুতার সামনের অংশটা ইস্পাতের। তার জুজুৎসুর প্রাথমিক জ্ঞান আছে। সে মরীয়া হয়ে পড়ে এবং প্রচণ্ড কষ্ট সহ্য করে (পরিশিষ্ট B দ্রষ্টব্য)।

    G আবার পড়লেন? নানা এজেন্টদের রিপোর্টের কাটা কাটা অংশগুলো। শেষের পৃষ্ঠার নিচে তিনি পড়লেন? উপসংহার–এই লোকটা একজন সর্বনেশে পেশাদার সন্ত্রাসবাদী গুপ্তচর। ১৯৩৮ সাল থেকে সে ব্রিটিশ গুপ্তচর বিভাগে কাজ করছে। বর্তমানে সেই বিভাগের গোপন 007 নম্বরের সে অধিকারী। এই ডবল জিরো (০০) নম্বরের অর্থ, গুপ্তচরের কাজ করার সময় অতীতে সে মানুষ খুন করেছে এবং ভবিষ্যতে কাজ হাসিল করার জন্য সে মানুষ খুন করতে পারবে। আর দুজন ব্রিটিশ এজেন্টের এই অধিকার আছে। ১৯৫৩ সালে এই গুপ্তচরকে CMG খেতাব দেওয়া হয়েছিল। গুপ্তচর বিভাগ থেকে অবসর গ্রহণ করার সময়েই সাধারণতঃ এই খেতাব দেওয়া হয়। কিন্তু সে খেতাবটা আগেই পায়। তাই বোঝা যায় লোকটার কদর কতখানি। কর্মক্ষেত্রে তার সম্মুখীন হলে খবর সদর দপ্তরে জানাতে হবে।

    G ফাইলটা বন্ধ করে সশব্দে তার মলাটে হাত চাপড়ালেন। কমরেডস্-আমরা তাহলে একমত?

    জোর গলায় নিকিতিন বললেন, নিশ্চয়ই।

    ক্লান্ত স্বরে স্নাভিন বললেন, হ্যাঁ।

    ভজদভিশেনস্কি বললেন, হ্যাঁ-মানে, ইয়ে–সেটাই ভাল।

    অফিসের নিজস্ব টেলিফোনের রিসিভার তুলে কড়াস্বরে পার্শ্বচরকে তিনি বললেন, জেমস বন্ড-এর নামে ডেথ ওয়ারেন্ট (মৃত্যুর পরোয়ানা) তৈরি কর। পরিচয় ও ইংরেজ গুপ্তচর। অপরাধ–আমাদের রাষ্ট্রের শত্রু। রিসিভার নামিয়ে তিনি বললেন, এবার উপযুক্ত একটা চক্রান্ত খুঁজে বার করা। এমন একটা চক্রান্ত যেটা বিফল হবে না। তার মৃদু হাসির মধ্যে একটা ভয়ংকর হিংস্র ভাব ফুটে উঠল। বললেন, আমরা চাই না খোকনভ ব্যাপারের মত আর একটা কেলেঙ্কারি ঘটে।

    দরজা খুলে একটা উজ্জ্বল হলদে কাগজ নিয়ে পার্শ্বচর এল। G-র সামনে সেটা রেখে বেরিয়ে গেল। কাগজটায় তিনি লিখলেন হত্যা করতে হবে। MGB-র প্রতিনিধির হাতে কাগজটা দিলেন। পড়ে সে লিখল, খুন করুন– নিকিতিন। কাগজটা এল GRU-এর বড়কর্তার হাতে। তিনিও লিখলেন, খুন করুন।–স্লাভিন। RUMID-এর প্রতিনিধির পাশে সাদা পোশাকের যে প্রতিনিধি বসেছিল, একজন পার্শ্বচর কাগজটা তার হাতে দিল। ভজদভিশেনস্কি কাগজটা খুঁটিয়ে পড়ে G-র দিকে তাকাল। G-তাকে লক্ষ করছিল। চোখ না নামিয়ে অন্যদের সই-এর নিচে সে লিখল। খুন করুন। আর নিজের নাম। সে উঠে দাঁড়িয়ে কমরেড জেনারেল, আর কোন কাজ আছে। চেয়ারটা পেছনে ঠেলে দিল।

    খুশি হলেন G। তার ধারণা ঠিক। নিজের সন্দেহের কথা সেরভকে জানাতে হবে। তিনি বললেন, একটু অপেক্ষা করুন, কমরেড জেনারেল। এই ওয়োরেন্টে কয়েকটা কথা আমাকে যোগ করে দিতে হবে।

    কাগজটা নিয়ে তিনি আগের লেখাগুলো কেটে লিখলেন : এমনভাবে তাকে হত্যা করতে হবে যাতে তার সম্মানহানি হয়।

    তিনি মধুর হেসে বললেন, ধন্যবাদ কমরেডস্। এখন আর কিছু করার নেই। আমাদের সুপারিশের ওপর প্রিসিডিয়ামের সিদ্ধান্তের কথা আপনাদের জানাব। গুড নাইট।

    সভার লোকজন বেরিয়ে গেলে G উঠে ডেস্কের সামনে বসে টেপরেকর্ডারের সুইচ বন্ধ করে ঘন্টা বাজিয়ে পার্শ্বচরকে ডাকলেন। হলদে কাগজটা তার হাতে দিয়ে G বললেন, এখুনি এটা জেনারেল সেরভকে পাঠাও। ক্রনস্টিনকে খুঁজে বার করে গাড়িতে এখানে নিয়ে এস। ঘুমিয়ে থাকলে বিছানা থেকে তুলে আনবে। তাকে আসতেই হবে। ২নং বিভাগ জানে সে কোথায় আছে। দশমিনিটের মধ্যে কর্নেল ক্লেব-এর সঙ্গে আমি দেখা করব।

    ঠিক আছে, কমরেড জেনারেল, লোকটা বলল।

    vch রিসিভার তুলে জেনারেল সেরভকে চাইলেন G, নিচু গলায় পাঁচ মিনিট ধরে কথা বললেন তিনি। শেষে বললেন, কাজের ভারটা আমি কর্নেল ক্লেব আর প্ল্যানার ক্রনস্টিনকে দিচ্ছি। একটা উপযুক্ত চক্রান্তের খসড়া নিয়ে আমরা আলোচনা করব। কাল তারা খুঁটিয়ে আমাকে তাদের প্ল্যানের কথা জানাবে। কমরেড জেনারেল, এটাই ঠিক তো?

    জেনারেল সেরভের শান্তস্বর শোনা গেল, ঠিক আছে। লোকটাকে খুন করুন। কিন্তু কাজটা যেন ভালভাবে হয়। সকালে প্রিসিডিয়াম এই সিদ্ধান্তের সরকারী অনুমোদন জানাবে।

    লাইনটা স্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর অফিসের টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলে G বললেন। ঠিক আছে। রিসিভারটা রাখার সঙ্গে সঙ্গে পার্শ্বচর বড় দরজাটা খুলে ঘোষণা করলে, কমরেড কর্নেল ক্লেব।

    ব্যাঙের মত চেহারার একজন ডেস্কের কাছে এগিয়ে এল। পরনে তার জলপাইয়ের মত সবুজ রঙের ইউনিফর্ম তার ওপর অর্ডার অফ লেনিনের একটি মাত্র লাল ফিতে।

    মুখ তুলে কনফারেন্স টেবিলের সবচেয়ে কাছের চেয়ারটা দেখিয়ে G বললেন, গুড ইভিনিং কমরেড়। মোটা হোঁতকা লোকটা হেসে বলল, গুড ইভনিং জেনারেল। SMERSH-এর ২ নং বিভাগের প্রধান নিজের স্কার্টটা খানিক তুলে চেয়ারে বসল। এই মহিলাটির ওপরেই পরিকল্পনা এবং কার্যসিদ্ধির সম্পূর্ণ দায়িত্ব।

    .

    গুপ্তচরের কাম লালসা

    দাবার ঘড়িটার দুটো মুখে বিভিন্ন সময়। ক্রনস্টিনের ঘড়িতে একটা বাজতে কুড়ি মিনিট। তার ঘড়ির পেণ্ডুলামটা দুলছে–পার হচ্ছে এক একটি মুহূর্ত। তার প্রতিদ্বন্দ্বীর ঘড়িটা স্তব্ধ। সাধারভের ঘড়িতে একটা বাজতে পাঁচমিনিট। খেলার মাঝখানে সে সময়টা নষ্ট করেছিল। তার হাতে এখন পাঁচ মিনিট সময় মাত্র। ক্রনস্টিন কোন ভুল না করলে তার সমূহ বিপদ, তার হার অবধারিত। ক্রনস্টিন যে সে রকম ভুল করবে সেটা কল্পনার অতীত।

    তোতা পাখির মত থমথমে ক্রনস্টিন পিঠ খাড়া করে স্থির হয়ে টেবিলের উপর কনুই দুটো রেখে বসে। তার চাপা ঠোঁটে ফুটে উঠেছে ঔদ্ধত্য আর তাচ্ছিল্যের ভাব। ভুল চাল দেবার আতঙ্ক তখনো তার টুটি চেপে ধরে রয়েছে। কিন্তু সাখারভ আর দর্শকদের কাছে তখনো সে জাদুকর। তার খেলাকে মাছ খাবার সঙ্গে তুলনা করা হয়। প্রথমে সে ছাল ছাড়ায়, তারপর কাটা বাছে, তারপর মাছটা খেয়ে নেয়। গত দু বছর ধরে সে মস্কোর চ্যাম্পিয়ন। এবার তৃতীয়বার সে ফাইনালে উঠেছে। এবার জিতলে গ্রান্ড মাস্টার প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে পারবে সে।

    টেবিল দড়ি দিয়ে ঘেরা। শুধু কনস্টিনের ঘড়ির শব্দ ছাড়া সব নিস্তব্ধ। সাখারভের মত আম্পায়ার দুজনও বুঝেছে এই চালে নিশ্চয়ই বাজিমাত হবে। ২৬-এর চাল পর্যন্ত সাখারভ পাল্লা দিয়েছিল। কিন্তু সেই চালে সে ভুল করে। হয়ত আবার ভুল করব ৩১ আর ৩৩ চালে। কে বলতে পারে?

    ক্রনস্টিন গাল থেকে ডানহাত নামিয়ে চাল দিল। দর্শকদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন এবার বাজিমাত। ক্রনস্টিন চেয়ারে হেলান দিয়ে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাখারভ জর্জিয়ার চ্যাম্পিয়ান-এর দিকে তাকাল।

    তখন সাদা পোশাকের একজন লোক দড়ির তলা দিয়ে এসে আমপায়ারকে কি যেন ফিসফিসিয়ে বলল আর তাকে একটা সাদা খাম দিল। আমপায়ার মাথা নাড়িয়ে ঘড়ির দিকে দেখল, একটা বাজতে তিন মিনিট। আমপায়ার গোমড়া মুখে হাত ঘণ্টা বাজিয়ে মাইক্রোফোনে ঘোষণা করল, কমরেড ক্রনস্টিনের একটা জরুরি ব্যক্তিগত বার্তা আছে। তাই তিন মিনিট খেলা বন্ধ থাকবে।

    হল ঘরের মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন শোনা গেল। অন্যদের মত ক্রনস্টিনও দারুণ বিরক্ত হলেন। কিন্তু আমপায়ার যখন তার হাতে একটা খাম দিল, তার মুখ তখন ভাবলেশহীন। খামের ভেতরে একটা বেনামা কাগজে বড় বড় হরফে টাইপ করে লেখা, এই মুহূর্তে তোমাকে দরকার। কোন সই বা ঠিকানা নেই। কাগজটা ভাজ করে সাবধানে বুক পকেটে রেখে দিল। হরফগুলো তার সুপরিচিত ছিল। সাদা পোশাকের লোকটা অসহিষ্ণু ও আদেশ ভরা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। খেলা শেষ হবার এই তিন মিনিটের মধ্যে সে কিছুতেই ইস্তফা দেবে না। সেটা করা জাতীয় খেলার প্রতি অপমান। আমপায়ারকে সে ইঙ্গিতে জানাল খেলা চলুক কিন্তু তার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল।

    আবার ঘন্টা বাজল। খেলা চলুক।

    কনস্টিনের বুকের কাঁপুনি কমলো না। সে যা করল সেটা SMERSH বা যে কোন রাষ্ট্রীয় সংস্থার কর্মচারির পক্ষে অশ্রুতপূর্ব। তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট হবে। কর্তব্যে অবহেলা। ফলটা কি দাঁড়াবে? খুব কমপক্ষে G তাকে ধমকাবেন, তার ফাইলে কালো দাগ পড়বে। আর খুব খারাপ হলে ক্রনস্টিন সে কথা চিন্তা করতে পারল না। বিজয় উল্লাস তার কাছে তিক্ত হয়ে উঠল।

    সাখারভের ঘড়িতে তখন পাঁচ সেকেণ্ড বাকি। সংক্ষেপে মাথা নামিয়ে অভিবাদন করে সে আত্মসর্মপণ করল। হলঘরের সকলের হাততালির শব্দে তালা ধরে যায়।

    ক্রনস্টিন দাঁড়িয়ে উঠে ঝুঁকে পড়ে অভিবাদন করল তার প্রতিদ্বন্দ্বী, আমপায়ার আর দর্শকদের। তারপর দড়ির বেষ্টনীর তলা দিয়ে গলে তার অসংখ্য অনুরাগীদের ঠেলেঠুলে বেরিয়ে এল, তার পেছনে সাদা পোশাকের লোকটা।

    টুর্নামেন্ট হলের বাইরে, যথারীতি একটা কালো বেনামা ZIK সেলুন গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। সেটার ইঞ্জিন চালু। গাড়ির পেছনে উঠে দরজা বন্ধ করল। সাদা পোশাকের লোকটা লাফিয়ে সামনের সীটে উঠল। তীর বেগে গাড়িটা ছুটল।

    ক্রনস্টিন ভাবতে থাকে কিভাবে সে আত্মপক্ষ সমর্থন করবে। সম্ভবত তর্ক করে সে নিস্তার পেতে পারে। হাজার হলেও SMERSH-এর প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্টের সে প্রধান, তার পদ পুরোপুরি অবৈতনিক কর্নেলের।

    ক্রনস্টিনকে G-র পার্শ্বচরের কাছে পৌঁছে গার্ড তার হাতে একটুকরো কাগজ দিল। কাগজটায় চোখ বুলিয়ে কোন কথা না বলে ভ্রু কুঁচকে কাঁধ ঝাঁকিয়ে অফিসের টেলিফোন তুলে তার আসার কথা জানাল।

    তারা বড় ঘরটায় এল। ইঙ্গিতে ক্রনস্টিনকে চেয়ার দেখানো হল। কর্নেল ক্লেব মৃদু হাসল। পার্শ্বচর যে কাগজটা G-র হাতে দিলে, সেটা পড়ে G কটমট করে তাকাল কনস্টিনের দিকে। পার্শ্বচর চলে গেলে G বললেন, ব্যাপার কি, কমরেড

    ক্রনস্টিন শান্ত কর্তৃত্বের স্বরে বলল, কমরেড জেনারেল, জনসাধারণের কাছে আমি একজন পেশাদার দাবা খেলোয়াড়। আজ রাতে পর পর তিন বছর আমি মস্কোর চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। যখন মাত্র তিন মিনিট বাকি তখন যদি শুনতাম আমার স্ত্রীকে টুর্নামেন্ট হলের বাইরে খুন করা হচ্ছে তা হলেও তাকে বাঁচাবার জন্য একটা আঙুলও তুলতাম না। তখন চারদিকে গুজবের ঝড় বইতে। রহস্য আবিষ্কারের জন্য আমার ওপর লোকে নজর রাখতো। রাষ্ট্র নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার স্বার্থে আদেশ পালন করার তিন মিনিট আগে আমি অপেক্ষা করেছিলাম। তা সত্ত্বেও আমার তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে আসার জন্য নানা মন্তব্য আসবে। আমাকে বলতে হবে আমার সন্তানের অসুস্থতার জন্য। কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হবার জন্য, আমার এক সন্তানকে সপ্তাহের জন্য হাসপাতালে রাখতে হবে, আদেশ পালন দেরির জন্য আমি ক্ষমা চাইছি।

    G চিন্তা করল যে, লোকটা অপরাধ করেছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু স্বপক্ষের যুক্তিগুলো তার ভাল। G সেই কাগজটা বার করে লাইটার দিয়ে পুড়িয়ে ডেস্কোর কাঁচের ঢাকার ওপর রেখে ফুঁ দিয়ে ছাইগুলো মেঝেয় ফেললেন। নজিরটা পুড়িয়ে ফেলার জন্য ক্ৰনস্টিনের কাছে যথেষ্ট। এখন তার ফাইলে আর কিছুই যুক্ত হবে না। জেনারেল গভীর ক্ষমাশীলতা দেখিয়েছেন। ক্রনস্টিন তার সমস্ত বুদ্ধি প্রয়োগ করে উপযুক্ত প্রতিদান দেবে।

    G বললেন, কমরেড কর্নেল, ফটোগুলো এগিয়ে দিল, ব্যাপারটা এই…

    G কথা বলে চললেন। ঐনস্টিন ফটোগুলো দেখতে দেখতে ভাবলেন, তাহলে আর একটা হত্যাকাণ্ড ঘটতে চলেছে। পাসপোর্ট ফটো থেকে এনলার্জ করা ছবিটার কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে G-র কথা থেকে প্রধান তথ্যগুলো সংগ্রহ করলেন, ইংরেজ গুপ্তচর। বিরাট কেলেঙ্কারি প্রচার করা দরকার। হত্যাকাণ্ডে লোকটা এক্সপার্ট। মহিলাদের প্রতি দুর্বলতা। সুরাশ (মাদকদ্রব্যের কোন নাম উল্লেখ নেই)। ঘুষ নেয় না, খরচের পরোয়া নেই। সব গুপ্তচর বিভাগ থেকে সব রকম সাহায্য পাওয়া যাবে, তিন মাসের মধ্যে পরিকল্পনা করে সাফল্য পাওয়া চাই।

    G কর্নেল ক্লেবের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে, কমরেড কর্নেল, এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?

    মহিলার স্বরটা কর্কশ ফোঁসফেঁসে ও নীরস স্বরে বলতে লাগল, …কয়েক দিক দিয়ে গৌনলজেনবার্গ কেসের সঙ্গে মিল আছে কমরেড জেনারেল। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, সেটাও ছিল একটা সুনাম হানি ও প্রাণ হানির ব্যাপার। সেবার ব্যাপারটা সহজ ছিল, সেই গুপ্তচরের কাম লালসা ছিল বিকৃত ধরনের।

    ক্রনস্টিন আর জানা ঘটনা শুনলেন না। তিনি ভাবলেন এই ভয়ঙ্কর মহিলা আর কতদিন বহাল থাকবে আর কতদিন এই মহিলার সঙ্গে কাজ করতে হবে?

    ভয়ঙ্কর? মানুষ সম্বন্ধে ক্রনস্টিনের কোন উৎসাহ নেই এমন কি নিজের সন্তানদের প্রতিও নয়। তার কাছে ভাল মন্দ বলে কিছু নেই। তার কাছে সব মানুষই দাবার খুঁটি। একটা খুঁটি সরলে অন্য খুঁটিগুলোর ওপর কি প্রতিক্রিয়া হয়– শুধু সে বিষয়েই তার কৌতূহল।

    ক্রনস্টিন আবার মহিলাটির কথা ভাবলেন। রোজা ক্লেবের টিকে থাকার ইচ্ছে প্রবল। তা না হলে রাষ্ট্রের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী মহিলাদের অন্যতম সে হত না। SMERSH-এর অপারেশনস্ ডিপার্টমেন্টের সে প্রধান।

    ক্রনস্টিন ভাবতে লাগলেন ক্লেবের উন্নতির প্রধান কারণ হচ্ছে তার অদ্ভুত ধরনের যৌনপ্রবৃত্তি। কারণ রোজা ক্লেব ছিল ক্লীব–যৌন টাইপের মধ্যে যেটা অত্যন্ত দুর্লভ। তার কাছে যৌন আকাঙ্ক্ষা নেহাৎই কৌতূহল–তার বেশি নয়। এই মনস্তাত্ত্বিক আর শারীরিক উদাসীনতার দরুন বহু মানবিক আবেগ, ভাবপ্রবণতা ও কামনা বাসনা থেকে সে একেবারে মুক্ত।

    রোজা ক্লেবের বয়েস পঞ্চাশের কাছাকাছি। লম্বায় পাঁচফুট চার ইঞ্চি। হাত দুটো বেঁটে আর মোটা। ঘাড়ে গর্দানে চেহারা। খাকি মোজার ভেতর দিয়ে তার মোটা পা দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসছে। মহিলার পক্ষে চেহারাটা ভারি শক্তিশালী।

    ধন্যবাদ কর্নেল কমরেড। আপনার কথাগুলো খুব দামী। কমরেড ক্রনস্টিন আপনার আর কিছু বলার আছে? দয়া করে সংক্ষেপে বলুন। এখন রাত দুটো। কাল আমাদের অনেক কাজ। ক্ৰনস্টিনের দিকে তাকালেন G, বেশি কথা বলার লোক সে নয়। কিন্তু তার প্রত্যেকটি কথা বাকি সবার বক্তৃতার চেয়ে মূল্যবান।

    ক্রনস্টিন অত্যন্ত মৃদু স্বরে বলতে শুরু করল, কমরেড জেনারেল, ফুঁসে নামক এক ফরাসী ভদ্রলোক বলেছিলেন– কোন লোককে শুধু হত্যা করে লাভ নেই, যদি-না তার সুনামকে নষ্ট করা হয়। এই বন্ড নামে লোকটাকে খুন করা শক্ত নয়। কিন্তু এ কাজের দ্বিতীয় অংশটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কঠিন–লোকটার সুনাম নষ্ট করা। কাজটা করা দরকার ইংল্যান্ডের বাইরে যেখানে প্রেস ও রেডিওর ওপর আমাদের প্রভাব আছে। এখন প্রশ্ন হল, লোকটাকে কি করে সেখানে নিয়ে যাওয়া যায়। যে টোপটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হবে, যা কেবল ঐ লোকটাই ধরতে পারে, তাহলে সে যেখানেই থাকুক না কেন, টোপ ধরার জন্য তাকে পাঠান হবে।

    ক্রনস্টিন থেমে মাথা নামালেন যাতে G-র ঠিক কাঁধের ওপর তার দৃষ্টি পড়ে। নীরস গলায় বললেন, এমন একটা ফাঁদের কথা আমি ভেবে বার করব। বর্তমানে শুধু এটুকু বলতে পারি ফাঁদটা যদি তার শিকারকে আকর্ষণ করতে সফল হয়, তাহলে, এমন একজন গুপ্তঘাতকের দরকার, যার ইংরেজিতে দখল আছে। আমাদের আরো দরকার একটি পরমাসুন্দরী মেয়ে।

    .

    সুন্দরে টোপ

    নিজের ঘরের জানালায় বসে রাষ্ট্র নিরাপত্তার কর্পোরাল তাতিয়ানা রোমানোভার মনে হল–এর চেয়ে সুখী জীবনে আগে কখনো সে হয়নি।

    সাদোভায়া-চের্নোগ্রিয়াজঙ্কে উনিৎসার বিরাট ফ্ল্যাটে বাড়ির মধ্যে এ ঘরটা ছোট একটা বাক্সের মত। এই পথে রাষ্ট্র নিরাপত্তা বিভাগের মহিলা কর্মীদের নানা ব্যারাক। এই সুন্দর আটতলা বাড়িতে দু হাজার ঘর। উচ্চতর তলা উচ্চতর পদস্থ কর্মীদের। কর্পোরাল রোমানোভা প্রথমে ছিলেন সার্জেন্ট। ধাপে ধাপে তিনি উঠেছেন লেফটেন্যান্ট, ক্যাপটেন, মেজর এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল। একদিন কর্নেল হয়ে তিনি আটতলার স্বর্গে পৌঁছবেন।

    কিন্তু এখন তিনি সম্পূর্ণ তৃপ্ত। মাসে তার বেতন ১২০০ রুবল, নিজস্ব একটা ঘর। বাড়ির একতলার দোকান থেকে খাবার আর পোশাক, ব্যালে আর অপেরার জন্য মাসে মিনিস্ট্রির অন্তত দুটো টিকিট বরাদ্দ, বছরে দুসপ্তাহের পুরো বেতনের ছুটি এবং সর্বোপরি মস্কোতে এমন একটা চাকরী যেখানে ভবিষ্যত আছে।

    খাবারের কথা মনে পড়তে কর্পোরাল রোমানোভা জানালার পাশে চেয়ার থেকে উঠে পাত্রের সুপটা পরীক্ষা করলেন, তাতে আছে কয়েক কুচি মাংস আর খানিক ওঁড়ো মাশরুম। সুন্দর গন্ধ ভুরভুর করছে। স্টোভটা নিভিয়ে তিনি হাত-পা-মুখ ধুতে গেলেন।

    হাত মুছতে মুছতে ওয়াশট্যান্ডের ওপরকার বড় আয়নার নিজেকে দেখলেন।

    তার প্রথম জীবনে এক ছেলে বন্ধু বলেছিল তাকে দেখতে তরুণী গ্রেটা গার্বোর মত। এবার সে খাবার খেতে বসল। আসলে কর্পোরাল তাতিয়ানা রোমানোভা ভারি সুন্দরী মেয়ে। তিনি দীর্ঘাঙ্গী, মজবুত শরীর, হাঁটার ভঙ্গী অত্যন্ত লালিত্যপূর্ণ। লেনিনগ্রাদের স্কুলে তিনি নাচ শিখেছিলেন। সেখানেই তিনি সাবলীলভাবে হাঁটতে ও দাঁড়াতে শিখেছিলেন। ফিগারস্কেটিং-এ তার ভারি ঝোঁক। ডিনামোর বরফ স্টেডিয়ামে বার বছর তিনি অনুশীলন করেন। তাই দেখলে মনে হয় তার সর্বাঙ্গ দিয়ে যেন স্বাস্থ্য উপছে পড়ছে। ব্যায়াম করার দরুণ তার নিতম্বের পেশীগুলোর একটু বেশি কঠিন পুরুষালি ভাব।

    মহিলাটি একটি ছোট চীনেমাটির বাটিতে ঘন সুপ ঢেলে তার মধ্যে খানিকটা কালো রুটি ফেলে জানালার পাশে বসে চকচকে একটা সুন্দর চামচ দিয়ে খেতে লাগলেন। কয়েক সপ্তাহ আগে এক সন্ধ্যেয় মসক হোটেলে এক উৎসব মুখর পার্টিতে গিয়ে চামচেটা তার ব্যাগের মধ্যে হাতিয়ে এনেছিল।

    খাওয়া শেষ হলে নিজের চেয়ারে ফিরে এসে তিনি সিগারেট ধরালেন। এমন সময়ে টেলিফোন বেজে উঠল। তিনি রিসিভারটা তুলে নিলেন।

    কর্পোরাল রোমানোতা?

    স্বরটা তার প্রিয় প্রফেসর ডিনিকিনের। কিন্তু তিনি তো অফিসের বাইরে সর্বদাই তাকে তাতিয়ানা বা তানিয়া বলে ডাকেন। এর মানে কি?

    মেয়েটি চাপা উত্তেজনায় বলল, হ্যাঁ, কমরেড প্রফেসর।

    লাইনের ওপাশের স্বরটা অস্বাভাবিক। পনের মিনিটের মধ্যে, ঠিক সাড়ে আটটায়, ২ নং বিভাগের কমরেড কর্নেল ক্লেবের সঙ্গে তোমাকে দেখা করতে হবে। তোমার বাড়ির আটতলায় তার অ্যাপার্টমেন্ট নং ১৮৭৫-এ যাবে। বুঝলে?

    কিন্তু, কমরেড, কেন? কি ব্যাপার?

    তার প্রিয় প্রফেসর অস্বাভাবিক আড়ষ্ট স্বরে বলল, কমরেড কর্পোরাল, ব্যস। আর কোন খবর নেই।

    মেয়েটি অত্যধিক জোরে উত্তেজিতভাবে রিসিভার চেপে ধরল, হ্যালো! হ্যালো! কিন্তু কিছু না…ধীরে ধীরে নিচু হয়ে রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।

    ভয়ে মেয়েটি ফাঁকা দৃষ্টিতে কালো যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটি জানে যে সব ফোন বাড়িতে কিংবা বাড়ির বাইরে যাচ্ছে তার প্রতিটি শব্দ হয় কেউ শুনছে নয় রের্কড করে নেওয়া হয়। তাই কেউ প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলে না। এটাই রাষ্ট্রের ব্যাপার। এ ধরনের খবর লোকে যত তাড়াতাড়ি পারে আর যত কম কথায় সম্ভব সেটা পাঠিয়ে হাত ধুয়ে ফেলে।

    মেয়েটি ভাবনার জগতে পড়ে গেল। কিসের জন্য তার ডাক পড়েছে কি সে করেছে। কাজে কি দারুণ ভুল করেছে হাল ছেড়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে সে সবচেয়ে ভাল ইউনিফর্মটা বের করার জন্য আলমারির কাছে গেল। এ ধরনের ব্যাপারে SMERSH কাউকে ডাকে না। নিশ্চয়ই ব্যাপারটা অনেক বেশি গুরুতর।

    সে ভিজে চোখে ঘড়ির দিকে তাকাল। আর মাত্র সাত মিনিট বাকি। নতুন একটা আতঙ্কে সে সিঁটিয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি প্যারেডের ইউনিফর্মটা বার করল। এর ওপর যদি আবার যেতে দেরি হয়?

    পোশাক পরতে পরতে, মুখ ধুতে ধুতে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে এই অশুভ রহস্যটার কথা সে ভেবেই চলল।

    তার অপরাধ যাই হোক না কেন, SMERSH-এর ক্লেদাক্ত সংস্পর্শে আসার কথা চিন্তাই করা যায় না। এই ভয়ঙ্কর প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যেটা জঘন্যতম তার নাম ২ নং বিভাগ যন্ত্রণা ও মৃত্যুর বিভাগ। তার প্রধান যে মহিলা, রোজা ক্লেব, তার সম্বন্ধে লোকে ফিসফিস করে বলাবলি করে। সেগুলো তাতিয়ানা দুঃস্বপ্ন। দিনের বেলায় ভুলে যায় কিন্তু এখন সেগুলো মনে পড়ল।

    জনরব, তার অবর্তমানে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য লোকের ওপর নিষ্ঠুর উৎপীড়ন চালাতে রোজা দিত না। তার অফিসে ছিল রক্তের দাগধরা একটা গাউন আর নিচু একটা টুলে। বাড়ির ভূগর্ভস্থ পথে সেই গাউনটা পরে টুল হাতে নিয়ে তাকে দ্রুতপায়ে যেতে দেখলে কথাটা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ত। এমন কি SMERSH এর কর্মচারিরাও গলা নামিয়ে ঝুঁকে পড়ত তাদের কাগজপত্রের ওপর। যতক্ষণ না সে ফিরে আসত ততক্ষণ ইষ্টনাম জপত।

    লোকে ফিসফিস করে বলত, জেরার টেবিল থেকে ঝুঁকে পড়া পুরুষ বা নারীর মুখের নিচে টুলটা রেখে তার ওপর ধপ করে বসে সেই মুখের দিকে তাকিয়ে ক্লেব শান্তগলায় বলত ১ নং অথবা ১৫ নং বা ২৫ নং । জেরাকারীরা বুঝত তার কথার মানে। তারা সেই মত কয়েক ইঞ্চি দূরে থেকে ক্লেব লক্ষ্য করত তাদের চোখ, তাদের আর্তনাদ ভরা শ্বাস-প্রশ্বাসের ঘ্রাণ এমনভাবে সে নিত যেন সৌরভ নিচ্ছে। চোখগুলোর ভাবান্তর দেখে সে বলত–এখন ৩৬ নং অথবা এখন ৬৪ নং । জেরাকারীরা তখন শুরু করত অন্য ধরনের মার। চোখের সাহস আর সহ্যশক্তির চাউনি মিলিয়ে গেলে, লোকেরা দুর্বল গলায় কাকুতি মিনতি শুরু করলে সে মধুর স্বরে বলত, সোনা মানিক আমার, আমাকে কথাগুলো বল। তাহলেই এটা থামবে। আমি জানি মানিক, খুব কষ্ট হচ্ছে। মা তোমার পাশে রয়েছে যন্ত্রণাটা থামার অপেক্ষায়। তোমার জন্য ভারি সুন্দর নরম বিছানা পেতে রেখেছে। তাতে তুমি ঘুমোবে আর সবকিছু ভুলে যাবে। কথাগুলো বল। তারপর ফিসফিস করে স্নেহমাখানো গলায় বলত, কথাগুলো বললেই তুমি শান্তি পাবে, আর কোন যন্ত্রণা থাকবে না। মানিক, তুমি কিন্তু ভারি বোকামি করছ। সোনা আমার, কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে তোমার মাকে আর একটু ৮৭ নং চেষ্টা করতে হবে। জেরাকারীরা কথাগুলো শুনে তাদের যন্ত্রপাতি আর লক্ষ্যস্থল বদলাতো।

    কিন্তু শোনা যায় ক্কচিৎ কখনো লোক SMERSH-এর যন্ত্রণা বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারত, শেষ পর্যন্ত সহ্য করার তো কথাই ওঠে না। তার সেই মিষ্টি স্বর যখন শান্তির প্রতিশ্রুতি দিত প্রায় সময়ই সেটা হত সফল। কারণ, কিভাবে যেন রোজা ক্লেব মায়ের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠে, মিষ্টি কথা বলে তাদের মন গলাত।

    তারপর সেই সন্দেহজনক লোকের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করে টুলটা হাতে নিয়ে অফিসে ফিরে রোজা ক্লেব তাজা রক্তে ভেজা গাউন খুলে নিজের কাজে বসত। ব্যাপারটা চুকে গেছে খবর এলে আমার স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু হত।

    নিজের চিন্তায় ভয়ে সিটিয়ে তাতিয়ানা আবার ঘড়িটা দেখল। আর মাত্র চার মিনিট বাকি। ইউনিফর্মের ওপর হাত বুলিয়ে আর একবার আয়নায় তাকাল। তার প্রিয় পরিচিত ছোট্ট ঘরের কাছে মনে মনে বিদায় নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল।

    লম্বা করিডোর দিয়ে সোজা হেঁটে গিয়ে সে লিফটে ঢুকল। কাঁধ ঝাঁকিয়ে মুখ তুলে এমনভাবে সে ঢুকল যেন সেটা গিলোটিনের তক্তা।

    মেয়ে অপারেটরকে সে বলল, আটতলা। শৈশবের পর থেকে সে যা করেনি তাই করল। মনে মনে বারবার বলতে লাগল। হে আল্লাহ–হে আল্লাহ্।

    .

    মৃত্যু প্রণয়

    দরজাটা ক্রিম রঙের। তার ওপর কোন নাম লেখা নেই। ঘরের ভেতরকার গন্ধ তাতিয়ানার নাকে এল। নীরস গলায় কে যেন তাকে ভেতরে আসতে বলল। দরজাটা সে খুলল। আবার সেই গন্ধ। ঘরের মাঝখানে আলোর নিচে একটা টেবিল। তার পেছনে এক মহিলা বসে। তাতিয়ানার দিকে এক জোড়া হলুদ রংয়ের চোখ, যে চোখ শুধু অপরকে দেখে, যাচাই করে। কিন্তু নিজের কথা কিছু জানায় না। ক্যামেরার লেন্সের মত চোখদুটো তার ওপর ঘুরতে লাগল।

    ক্লেব বলল, কমরেড কর্পোরাল, তুমি ভারি সুন্দরী। ঘরের মধ্যে কয়েকবার পায়চারি কর। এই মিষ্টি-মিষ্টি কথাগুলোর অর্থ কি? এই মহিলার কুখ্যাত রুচির কথা তাতিয়ানার জানা আছে। তাতিয়ানা পায়চারি করতে শুরু করল।

    জ্যাকেটটা খোলো। চেয়ার রাখো। মাথার ওপরে হাত তোলো। আরো ওপরে। এবার নিচু হয়ে বসে পায়ের বুড়ো আঙুল ছোঁও। খাড়া হয়ে দাঁড়াও। চমৎকার। বস ডাক্তারের মত কথা বলছিল ক্লেব। তার টেবিলের সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে তারপর সে ফাইলে ঝুঁকে পড়ল।

    এটা নিশ্চয়ই আমার ব্যক্তিগত ফাইল, তাতিয়ানা ভাবল। নিজের সম্বন্ধে কি সব সেখানে লেখা জানবার কৌতূহল হলে অবাক চোখে খোলা ফাইলটার দিকে তাকাল।

    ফাইলের পাতাগুলো ফরফর করে উলটে ক্লেব মলাট বন্ধ করল, কমরেড কর্পোরাল রোমানোভা, তোমার কাজের আমি ভাল রিপোর্ট পেয়েছি। রেকর্ড তোমার খুবই ভাল ডিউটিতেও। খেলাধুলোতেও। আমাদের রাষ্ট্র তোমার ওপর খুব খুশি।

    নিজের কানকে তাতিয়ানা বিশ্বাস করতে পারল না। এই অপ্রত্যাশিত কথা শুনে তার মাথা ঘুরে উঠল। তারপরে ধরা-ধরা কাটা কাটা স্বরে বলল। ক-কমরেড কর্নেল, আ-আমি ভারি কৃতজ্ঞ।

    তোমার কাজ খুবই ভাল তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজের জন্য তোমাকে বাছাই করা হয়েছে। তোমার পক্ষে এটা ভারি সম্মানের ব্যাপার। বুঝলে?

    হ্যাঁ, কমরেড কর্নেল, বুঝেছি।

    এই কাজের অনেক দায়িত্ব। এর পদমর্যাদাও উঁচু। কমরেড কর্পোরাল, কাজটা হাসিল করার পর তুমি রাষ্ট্র নিরাপত্তার ক্যাপ্টেন পদে প্রমোশন পাবে। তোমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।

    চব্বিশ বছরের মেয়ের পক্ষে এটা অভাবনীর ঘটনা। তাতিয়ানা যেন একটা বিপদের আঁচ পেল। মাংসের টুকরোর তলায় ইস্পাতের ফাঁদ দেখলে জন্তুরা যে রকম সিঁটিয়ে ওঠে সেই রকমই সিঁটিয়ে উঠল সে, কমরেড কর্নেল, নিজেকে আমি অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করছি। তার স্বর অত্যন্ত সতর্ক।

    রোজা ক্লেবের গলা থেকে একটা অর্থহীন ঘড়ঘড় স্বর বেরুল। এই জরুরি তলব শুনে মেয়েটির মনোভাব যে কি হয়েছিল। তারপরেই সদাশয় অভ্যর্থনা, সুসংবাদে মানসিক নিশ্চিতা, তারপরেই আবার ভয় পাওয়া। এখন তাকে স্বাভাবিক করার জন্য ক্লেব মধুর স্বরে বলল, দেখেছ কি রকম আমার ভুলো মন! তোমার পদোন্নতির সম্মানে নিশ্চয়ই এক গ্লাস মদ খাওয়া দরকার। তুমি কক্ষনো ভেবো না, আমরা, যারা সিনিয়র অফিসার তারা অমানুষ। একসঙ্গে আমরা ড্রিঙ্ক করব। এক বোতল ফরাসী শ্যামপেন খোলার এটা খুব ভাল অজুহাত।

    রোজা ক্লেব আলমারির কাছে গেল, এই একটা চকোলেট চেখে দেখ। ততক্ষণ আমি বোতলের ছিপিটা খুলি। শ্যাম্পেনের ছিপি খোলার কাজে আমাদের পুরুষের সাহায্যের দরকার–তাই না?

    তাতিয়ানার সামনে এক বাক্স চকোলেট রেখে রোজা ক্লেব বকবক করতে লাগল। চকোলেটগুলো সুইটজল্যান্ড থেকে এসেছে। সেখানকার সবচেয়ে ভাল চকোলেট। তাতিয়ানা একটা গোল চকোলেট তুলে নিল। শ্যামপেন দিয়ে চকোলেট গেলা আরও সহজ।

    রোজা ক্লেব পাশে এসে খুশি মনে মুখে তুলে ধরল তার গ্লাসটা, বলল, আন্তরিক ধন্যবাদ কমরেড তাতিয়ানা।

    রোজা ক্লেব সাথে সাথে তার গ্লাসটা ভরল। কমরেড, এবার তোমার নতুন ডিপার্টমেন্টের শুভ কামনা করছি। SMERSH-এর শুভ হোক।

    গ্লাস ভরা-শ্যামপেন তুলে তাতিয়ানা বলল, SMERSH-রে শুভ কামনা করছি। শ্যামপেনটা গিলতে গিয়ে সে বিষম খেল।

    ক্লেব তাকে মোটেই সময় দিল না। তার সামনে টেবিলে হাত রাখল সে, কমরেড, এবার কাজের কথা পাড়ি। সামনে অনেক কাজ। কমরেড, বিদেশ যাবার কথা কখনো ভেবেছ সেখানে যাবার, থাকবার কথা?

    না, কমরেড। মস্কোতেই আমি খুব ভাল আছি। বিদেশে থাকার কথা কখনো ভাবনি সেখানকার ভাল ভাল পোশাক, জ্যাজ এর বাজনা, আরো কত আধুনিক জিনিসপত্রের কথা?

    না, কমরেড, তাতিয়ানা সত্যিই তার মনের কথা বলল।

    আমাদের রাষ্ট্র যদি তোমাকে বিদেশ পাঠাতে চায়?

    তাহলে নিশ্চয়ই যাব।

    স্বেচ্ছায় যাবে?

    রাষ্ট্রের আদেশ সবাইকে মানতে হয়।

    রোজা ক্লেব খানিক চুপ করে মেয়েলি আন্তরিকতার সুরে প্রশ্ন করল, কমরেড, তুমি কি এখনো, যাকে বলে কুমারী?

    হে আল্লাহ, তাতিয়ানা ভাবল। না, কমরেড কর্নেল।

    রোজা ক্লেবের ভিজে ঠোঁট চকচক করে উঠল, কজন পুরুষ?

    সাহস করে তাতিয়ানা ক্লেবের হলদেটে চোখের দিকে তাকিয়ে, কমরেড কর্নেল, এসব প্রশ্নের মানে কি?

    ক্লেবের গলার স্বর চাবুকের মত তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল, কমরেড, ভুলে যাচ্ছ তুমি কে? প্রশ্ন করার অধিকার তোমার নেই। ভুলে যাচ্ছ কার সঙ্গে কথা কইছ। আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।

    তাতিয়ানা শিউরে উঠল, তিন জন পুরুষ, কমরেড কর্নেল।

    কবেকার কথা? তখন তোমার বয়স কত?

    তাতিয়ানার চোখে পানি নিয়ে বলল, স্কুলে। আমার বয়েস তখন সতের। তারপর ইস্টিটুট অফ ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজে, তখন বাইশ বছর। স্কেটিং করার সময় তার সঙ্গে আমার আলাপ।

    একটা পেনসিল আর প্যাড নিয়ে ক্লেব বলল, নাম?

    হাত দিয়ে মুখ ঢেকে তাতিয়ানা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল, না, তাদের নাম কখনো বলব না। এই প্রশ্ন করার অধিকার আপনার নেই।

    ধমকে উঠল রোজা ক্লেব। ন্যাকামো করো না। পাঁচ মিনিটের মধ্যে তাদের সব খবর তোমার থেকে বের করে নিতে পারি। কমরেড, তুমি খুব বিপজ্জনক খেলা খেলছ। যাক, কাল তুমি তাদের নাম জানিও। তাদের কিছু হবে না শুধু তোমার সম্বন্ধে তাদের কয়েকটা প্রশ্ন করা হবে। এখন কান্না থামাও, চোখ মোছ।

    রোজা উঠে তাতিয়ানার পাশে গিয়ে মধুর স্বরে বলে, ব্যাস। আর কান্নাকাটি নয়। আমাকে বিশ্বাস কর। আর একটু শ্যামপেন খাও। তোমাকে যা বললাম সে সব কথা ভুলে যাও। আমাদের বন্ধুর মত মিলেমিশে কাজ করতে হবে। তানিয়া, আমি তোমার মায়ের মত। নাও, আর একটু শ্যামপেন খেয়ে নাও।

    তাতিয়ানা কাঁপা হাতে শ্যামপেনের গ্লাসে চুমুক দিল। সবটা খেয়ে ফেল।

    তাতিয়ানা সবটা খেল। ভারি ক্লান্ত সে। কোন রকমে আলোচনা সেরে সে গিয়ে ঘুমোতে চায়।

    রোজা ক্লেব তাতিয়ানাকে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করে বলল, মানিক আমার, আর একটা শুধু গোপন প্রশ্ন, মেয়েতে মেয়েতে যেমন কথা বলে। প্রেম করতে তোমার ভাল লাগে? খুব ভাল লাগে?

    তাতিয়ানা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে চাপা স্বরে বলে, হ্যাঁ কমরেড কর্নেল। ভালবাসলে পর… কথাটা সে শেষ করতে পারল না। আর কি সে শুনতে চায়?

    আর ধর, যাকে ভালবাস না? সে রকম লোকের সঙ্গে প্রেম করতে তোমার ভাল লাগবে?

    কমরেড কর্নেল–লোকটা কেমন তার ওপর নির্ভর করছে…

    খুব বুদ্ধিমতীর মত উত্তর দিয়েছ। ক্লেব ড্রয়ার থেকে একটা ফটো বার করে তাতিয়ানাকে দিল, ধর। এ-লোকটা যদি হয়?

    ছবিটা সুন্দর অথচ নিষ্ঠুর মুখটাকে সে দেখল, কমরেড কর্নেল। বলতে পারছি না। মানুষটির চেহারা ভাল…যদি নিষ্ঠুর না হয়– ছবিটা সে ফিরিয়ে দিতে গেল।

    না না, ছবিটা তোমার কাছে রাখ। তোমার বিছানার পাশে রেখে লোকটার কথা চিন্তা কর। তোমার নতুন যেটা কাজ তার সম্বন্ধে আরো কিছু জানতে পারবে। তোমার নতুন কাজটা কি জাতের জানতে চাও? যে কাজের জন্য রাশিয়ার সব মেয়েদের ভেতর থেকে তোমাকে বাছাই করা হয়েছে।

    সত্যি জানতে ইচ্ছে করে, কমরেড কর্নেল।

    রোজা ক্লেব বলল, কমরেড কর্পোরাল। কাজটা খুব সহজ। কাজটা হচ্ছে প্রেমে পড়া। পারবে? নিশ্চয়ই পারবে। ব্যস। তার বেশি কিছু নয়।

    কিন্তু লোকটা কে? তাকে যে আমি একেবারে চিনি না?

    ক্লেব বলল, লোকটা একজন ইংরেজ স্পাই।

    তাতিয়ানার তখন সামান্য নেশা ধরেছে। সে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, হা আল্লাহ্। আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে নেই। সে কি বেফাঁস কথা বলল? শিউরে উঠল তার সর্বশরীর।

    নিজের কথার প্রতিক্রিয়া দেখে রোজা খুব খুশি। যা, লোকটা ইংরেজ গুপ্তচর। খুব সম্ভব তাদের পয়লা নম্বরের। এখন থেকে লোকটার প্রেমে পড়তে হবে। পারবে তো? এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আর এর সমস্ত দায়িত্ব তোমার ওপর। খানিক থেমে তীক্ষ্ণ স্বরে ক্লেব বলল, বোকার মত মুখে হাত দেবে না। হাতটা সরাও। পাঠার মত তাকিও না। সোজা হয়ে বস। মন দিয়ে শোন। কথাটা কানে না গেলে তোমার ভয়ঙ্কর বিপদ। বুঝলে।

    সাথে সাথে খাড়া হয়ে বসে, বুঝলাম, কমরেড কর্নেল। এটা ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়, এটা রাষ্ট্রের কাজ। নিজের দেশের জন্য তাকে কাজ করতে হবে খুব ভাল করে। তাই মন দিয়ে সে ক্লেবের কথা শুনল।

    এখন সংক্ষেপে বলছি। পরে খুটিনাটি আরো জানতে পারবে। আগামী কয়েক সপ্তাহ ধরে তোমাকে শেখানো হবে কখন কি অবস্থায় কি ব্যবহার করতে হবে। বিদেশী লোকেদের আচার ব্যবহার তোমাকে শেখানো হবে। তোমাকে খুব সুন্দর পোশাক আশাক দেওয়া হবে। তারপর তোমাকে পাঠানো হবে ইউরোপে। সেখানে এই লোকটার সঙ্গে তোমার পরিচয় হবে। তোমাকে তার মন ভোলাতে হবে। মনে রেখ তোমার শরীরটা আমাদের রাষ্ট্রের সম্পত্তি। তোমার শরীরটাকে আমাদের রাষ্ট্রের জন্য কাজ করতে হবে। সব পুরোপুরি বুঝলে?

    তাতিয়ানা বুঝল। নিজেকে তার মনে হল তার রাষ্ট্রের এক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।

    রোজা ক্লেব বেশ খুশি হয়ে বলল, কাজের কথা সব শেষ। এখন, এস আমরা আরাম করি। আমি পরিপাটি হয়ে আসছি এবার গল্প করব। চকলেটগুলো খাও।

    তাতিয়ানা খাড়া হয়ে বসল। কাজটা সহজ। মিছি মিছি সে ভয় পেয়েছিল। তাতিয়ানার মত তখনো খুব ভাল। এমন সময় শোবার ঘরের দরজাটা খুলল, কেমন দেখাচ্ছে

    রোজা ক্লেবের পরনে একটা স্বচ্ছ গাউন। তার নিচে গোলাপী রঙের ব্রা।

    তাকে দেখাচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত বুড়ি বেশ্যার মত।

    আলোটা নেবাও। আমার পাশে এসে বোস।

    দরজার কাছে গিয়ে তাতিয়ানা আলো নেভাল। তারপর দরজা বন্ধ করে ঊর্ধ্বশ্বাসে করিডোর দিয়ে ছুটল।

    .

    শেষ প্রস্তুতি

    পরের দিন সকাল।

    SMERSH এর ভূগর্ভে কর্নেল ক্লেবের সদর দপ্তর। ঘরটা বড়। নিজের টেবিলের সামনে ক্লেব বসেছিল।

    ক্লেবের ফোলা-ফোলা গোমড়া মুখ। সেখানে অনেক অত্যাচার অনাচারের ছাপ। চোখের তলায় যেন ফোস্কা। পড়েছে। চোখের সাদা অংশে ঠিকরে উঠেছে লাল লাল শিরা।

    তার পাশের তিনটে টেলিফোনের একটা মৃদু শব্দ করে বাজল। ক্লেব রিসিভার তুলে বলল, লোকটাকে পাঠিয়ে দাও।

    ক্লেব ক্রনস্টিনের দিকে তাকাল। ক্ৰনস্টিন বসে চিন্তিতভাবে দাঁত খুটছিলেন। গ্রানিং স্কি।

    ঘরে এসে রেড গ্রান্ট সাবধানে দরজা বন্ধ করল। টেবিলের কাছে এসে বিনীতভাবে মাথা নামিয়ে তার কম্যান্ডিং অফিসারের দিকে তাকাল। ঠাণ্ডা চোখে রোজা তার দিকে তাকিয়ে, কাজের জন্য তুমি তৈরি?

    হ্যাঁ, কমরেড কর্নেল।

    দেখি তোমাকে কেমন দেখাচ্ছে। জামা কাপড় ছাড়। রেড গ্রান্ট অবাক না হয়ে কোটটা খুলল। তারপর নির্বিকারভাবে অন্য সব জামাকাপড় ছেড়ে জুতা জোড়া লাথি মেরে ছুঁড়ে ফেলল। খুব সহজ ভঙ্গিতে গ্রান্ট দাঁড়াল।

    রোজা ক্লেব কাছে গিয়ে গ্রান্টের শরীরটা এমনভাবে টিপে টিপে দেখল যেন সে একটা ঘোড়া কিনছে। পেছনে গিয়ে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা চকচকে ধাতু বার করল।

    ঘুরে এসে ক্লেব লোকটার পেটের কাছে দাঁড়াল। তার ডান হাতটা নিজের পেছন দিকে। লোকটার দিকে তাকাল কেব। তারপর ধা করে অসম্ভব জোরে পেতলের ধুলো ঝাড়া বুরুশটা দিয়ে তার তলপেটে মারল।

    উফ!

    যন্ত্রণায় ভ্যাবাচাকা খেয়ে গ্রান্ট ঝাঁকিয়ে উঠল। মুহূর্তের জন্য তার হাঁটু জোড়া কুঁকড়ে গেল। আবার সে খাড়া হয়ে দাঁড়াল। দারুণ যন্ত্রণা মুহূর্তের জন্য সে চোখ বুজল। তারপর চোখ মেলে কটমট করে তাকাল ক্লেবের হলদেটে চোখের দিকে। তার বুকের হাড়ের নিচে একটা জায়গা শুধু টকটকে লাল হয়ে উঠল। সেটা ছাড়া এই নির্মম আঘাতের আর কোন প্রতিক্রিয়া তার শরীরে দেখা গেল না। সাধারণত এই প্রচণ্ড আঘাতে যে কোন লোক মাটিতে পড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করত।

    মৃদু একটা শুকনো হাসি হাসল রোজা ক্লেব। পেতলের বুরুশটা পকেটে ভরে নিজের টেবিলে এসে ক্ৰনস্টিনের দিকে তাকিয়ে সগর্বে বলল, লোকটা বাস্তবিকই খুব তাগড়া।

    ক্রনস্টিন কথাটা মেনে নিলেন।

    বিবস্ত্র মানুষটা খুশি হয়ে ধূর্ত হাসি হাসল। নিজের হাত দিয়ে নিজের পেট রগড়াতে লাগল।

    ক্লেব চিন্তিত চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে। কমরেড গ্রনিৎ কি! তোমাকে একটা খুব দরকারি কাজ করতে হবে। এরকম কাজ তুমি আগে করনি। এই কাজের জন্য তুমি একটা মেডেল পাবে।

    গ্রান্টের চোখ দুটি চকচক করে উঠল।

    যাকে খতম করতে হবে সে ভারি সর্বনেশে লোক। বিদেশে যেতে হবে তোমাকে। তোমাকে সাহায্য করার কেউ থাকবে না। বুঝলে?

    বুঝলাম, কমরেড কর্নেল। গ্রান্ট উত্তেজিত হয়ে বলল।

    তোমার শিকার হচ্ছে একজন ইংরেজ গুপ্তচর। কোন ইংরেজ গুপ্তচরকে খুন করতে চাও?

    খুব চাই, কমরেড কর্নেল।

    অনেক সপ্তাহ ধরে তোমাকে তালিম নিতে হবে। ইংরেজ এজেন্টের ছদ্মবেশে কাজটা করতে হবে তোমাকে। তোমার হাবভাব ও চেহারা কুৎসিত। এখানে এক ইংরেজ ভদ্রলোকের কাছে তোমার দ্র ব্যবহার এবং অন্যান্য শিক্ষা নিতে হবে। তিনি আগে লন্ডনের পররাষ্ট্র বিভাগের কর্মচারি ছিলেন। তার কাজ হবে তোমাকে এমনভাবে গড়ে পিটে তৈরি করা যাতে লোকে ভাবে তুমি একজন ইংরেজ গুপ্তচর। ইংরেজরা নানা ধরনের লোককে কাজে বহাল করে। তোমাকেও সেরকম একজন বানাবে। কাজটা করতে হবে আগস্টের শেষের দিকে। অনেক অনেক কাজ। পোশাক পরে আমার পার্শ্বচরের কাছে যাও। বুঝলে?

    বুঝলাম, কমরেড কর্নেল। গ্রান্ট চটপট পোশাক পরে নিল। জ্যাকেটে বোম আটকাতে আটকাতে দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে সে বলল, ধন্যবাদ, কমরেড কর্নেল।

    রোজা ক্লেব এই সাক্ষাঙ্কারের ওপর নোট লিখছিল। গ্রান্ট চলে গেলে ক্লেব বলল, কমরেড ক্রনস্টিন। পুরোপুরি কাজ শুরু করার আগে আর কোন বিষয়ে নিয়ে আলোচনার দরকার আছে। আপনাকে জানাচ্ছি প্রিসিডিয়াম শিখার মনঃপুত করে মৃত্যুর পরোয়ানার অনুমোদন জানিয়েছে। কমরেড জেনারেল এবোজায় চিকভকে আপনার প্ল্যানের মোটামুটি কাঠামোটা জানিয়েছি। তিনি তাতে সম্মত আছেন। কাজ হাসিল করার পুরো প্ল্যানিং আর অপারেশনের মিলিত কর্মীদের বাছাই করা হয়েছে। তারা এখন অপেক্ষায় আছে। কমরেড, নতুন আর কিছু কি আপনি ভেবেছেন? ক্রনস্টিন বললেন, এই গ্রানিৎস্কি লোকটা বিশ্বাসী? তাকে বিদেশে পাঠিয়ে বিশ্বাস করতে পারবেন। সেখানে সে নিজের খুশি মত কাজ করবে না তো?

    লোকটাকে প্রায় দশ বছর ধরে পরীক্ষা করা হয়েছে। পালাবার বহু সুযোগ সে পেয়েছিল। তার সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। লোকটার অবস্থা অনেকটা মাদকাসক্ত লোকের মত। সে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছেড়ে যেতে চায় না। কোকেন খোররা যেমন ছাড়তে চায় না কোকেন দেশ। লোকটা সবচেয়ে বড় জল্লাদ। ওর চেয়ে ভাল জল্লাদ আর নেই।

    আর এই রোমানোভা মেয়েটি–সেকি কাজের উপযুক্ত।

    অনিচ্ছাসত্ত্বেও ক্লেব বলল, মেয়েটা দারুণ রূপসী। তাকে দিয়ে কাজ হাসিল হবে। সে কুমারী নয়, কিন্তু তার মধ্যে শালীনতার ভাব প্রবল। তাছাড়া যৌন চেতনাও এখনো পুরোপুরি জাগেনি। তাকে উপযুক্ত নানা নির্দেশ দেওয়া হবে। সে ইংরেজী খুব ভাল বলে। তাকে বলেছি, সে সহযোগী হয়ে কাজ করতে রাজী। কর্তব্যে কোন অবহেলার লক্ষণ দেখলে উপযুক্ত ব্যবস্থা আমরা নেব। তার কয়েকজন আত্মীয়ের ঠিকানা আমাদের কাছে আছে। তার মধ্যে কয়েকটি শিশু। তার ভূতপূর্ব প্রেমিকদের নামও জোগাড় করব। দরকার হলে কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এইসব লোকেদের জামিন হিসেবে আটক রাখা হবে। কিন্তু তার স্বভাব স্নেহশীল। সে কোন গণ্ডগোল করবে বলে আমি মনে করি না।

    এই বন্ড লোকটার হদিশ জানা গেছে। ক্রনস্টিন বললেন।

    হ্যাঁ। ইংল্যান্ডের MGB দপ্তর জানিয়েছে সে এখন লন্ডনে। দিনে তার সদর দপ্তরে যায়। রাতে লন্ডনের চেলসি এলাকায় নিজের ফ্ল্যাটে ঘুমায়।

    এটা ভাল খবর। আশা করি পরের কয়েক সপ্তাহ সেখানেই থাকবে। তার মানে তার হাতে এখন কোন কাজ নেই। ইংরেজরা আভাস পেলেই আমরা যে টোপ ফেলেছি তার খোঁজে পাঠাবে। কালো চিন্তিত চোখে ক্রনস্টিন ছাদের একটা জায়গায় তাকিয়ে বললেন, বিদেশের কোন জায়গাটা উপযুক্ত ইতিমধ্যে সেটা আমি বিচার করে দেখেছি। আমি স্থির করেছি ইস্তামবুলে প্রথম যোগাযোগ হওয়াই দরকার। সেখানে আমাদের সংগঠন খুব ভাল। ইংরেজ গুপ্তচর বিভাগের অফিসটাও ছোট। শুনেছি সেই স্টেশনের যে প্রধান, সে লোকটা খুব কাজের। তাকে লোপাট করে দেওয়া হবে।

    জায়গাটা আমাদের পক্ষে সুবিধের। লন্ডন থেকে বেশ খানিকটা দূরে। যেখানে বন্ডকে খুন করা হবে, সে জায়গা আর মেয়েটির সঙ্গে তার দেখা হবার পর কিভাবে সেখানে তাকে আনা হবে সে সম্বন্ধে আমি প্ল্যান করছি। সেটা ফ্রান্স নয়তো তার কাছাকাছি কোন জায়গা। ফরাসি প্রেসকে খুব ভাল করে চাপ দেবার হাতিয়ার আমাদের আছে। এ ধরনের গল্প তারা ফলাও করে ছাপবে। এ্যানিৎস্কি ঠিক কখন কাজে নামবে সেটাও স্থির করতে হবে। ক্যামেরাম্যান এবং অন্যান্য অপারেটিভদের এখন ইস্তামবুলে চালান করা বিশেষ দরকার। সেখানে আমাদের কাজকর্ম যাতে লোকের নজরে না পড়ে সে বিষয়েও আমাদের বিশেষ সাবধান হতে হবে। সব বিভাগকে সাবধান করে দিতে হবে, তুরস্কের সঙ্গে বেতারে খবরাখবর আদান প্রদান যেন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রাখা হয়। যে সব ব্রিটিশ কর্মচারি আড়ি পেতে বেতারের খবর শোনে তাদের মধ্যে সন্দেহ জাগাতে চাই না। SPEKTOR মেশিনের খোলটা তাদের দিলে নিরাপত্তার দিক দিয়ে কোন আপত্তি হবে না বলে আমাদের সংকেত বিভাগ জানিয়েছে। তাদের পক্ষে এটা দারুণ লোভের ব্যাপার।

    ক্রনস্টিন থামলেন। ধীরে ধীরে ছাদ থেকে চোখ নামিয়ে চিন্তিতভাবে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, কমরেড, এই মুহূর্তে আর কিছু ভাবতে পারছি না। অনেক সমস্যা দেখা দেবে। দৈনন্দিন সেগুলো সমাধান করতে হবে। আমার মতে কাজটা এখন নির্বিঘ্নে শুরু করা যেতে পারে।

    কমরেড, আমিও আপনার সঙ্গে একমত। প্রয়োজনীয় নির্দেশ আমি জারি করছি। আপনার সহযোগিতার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।

    ধন্যবাদের বিনিময়ে নস্টিন এক ইঞ্চি মাথা নামালেন। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

    রোজা টেলিফোনে এক নাম্বার ডায়াল করল।

    অপারেশন রুম, পুরুষের গলা শোনা গেল।

    কর্নেল ক্লেব বলছি। ইংরেজ গুপ্তচর বন্ডের বিরুদ্ধে চক্রাতের কাজ এখন থেকে শুরু হবে।

    .

    মসৃণ জীবন

    মসৃণ জীবনের তৈলাক্ত হাত দুটো বন্ডের গলায় জড়িয়ে ধীরে ধীরে শ্বাসরোধ করে আনছিল। সে যোদ্ধা লোক। দীর্ঘকাল যুদ্ধ না থাকলে ভারি মনমরা হয়ে পড়ে। তার কর্মস্থলে প্রায় এক বছর ধরে শান্তি বিরাজ করছে। এই শান্তির আবহাওয়ায় তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল।

    ১২ই আগস্ট, বৃহস্পতিবার, সকাল সাড়ে সাতটায় কিংস রোডের কাছে তার সুন্দর ছিমছাম ফ্ল্যাটে বন্ডের ঘুম ভাঙল। দারুণ একঘেয়েমিতে ভরে উঠল তার মন। ঘণ্টা বাজিয়ে তার অতিশয় নিপুণা স্কটল্যান্ডীয় গৃহকর্মীকে ব্রেকফাস্টের কথা জানিয়ে দিল। তারপর ঝট করে চাদরটা সরিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল।

    একঘেয়েমি কাটাবার জন্য ধীরে ধীরে কুড়িবার বুক ডন দিল সে, করে চলল ছাতির আর হাতের ব্যায়াম। শেষে এই শারীরিক পরিশ্রমের দরুন হাঁপিয়ে বাথরুমে গিয়ে প্রথমে খুব গরম তারপর কনকনে ঠাণ্ডা পানির শাওয়ারে দাঁড়িয়ে। পাঁচ মিনিট ধরে গোসল করল।

    দাড়ি কামিয়ে গাঢ় নীল রঙের সুতির শার্ট আর ট্রপিক্যালের ট্রাউজার পরে, কালো চামড়ার চপ্পলে খালি পা দুটো গলিয়ে শোবার ঘরের মধ্যে দিয়ে এল বসার ঘরে। অন্তত সাময়িকভাবে নিজের শরীর থেকে একঘেয়েমি ভাবটা ঝেড়ে ফেলে সে এখন তৃপ্ত।

    গৃহকর্মী বয়স্কা মহিলা। চুলে পাক ধরলেও মুখটা সুদর্শন। ঘরে এসে জানালার পাশের টেবিলে সে নামাল খাবারের ট্রে আর একটা খবরের কাগজ–The Times, এটা ছাড়া বন্ড কোন কাগজ পড়ে না। তাকে সুপ্রভাত জানিয়ে বন্ড ব্রেকফাস্ট খেতে বসল। বন্ড কাগজের মাঝের পাতা যখন খুলল, সে বলল, টেলিভিশন বিক্রি করার জন্য সেই লোকটা গতকাল রাতে এসেছিল।

    হেডলাইনের ওপর চোখ বোলাতে বোলাতে বন্ড প্রশ্ন করল, কোন্ লোকটা?

    যে লোকটা জুন মাস থেকে বার বার এসে জ্বালাচ্ছে। ঐ জঘন্য জিনিসটা দেখে প্রথমে যা বলেছিলাম, ভেবেছিলাম সে আর টেলিভিশনটা আমাদের কাছে বিক্রি করবে না। এখন বলে কিনা কিস্তিতে কিনতে।

    সেলসম্যানেরা ভারি নাছোড়বান্দা, বন্ড কাগজটা নামিয়ে কফির পাত্র নিল।

    গত রাতে তাকে খুব কড়কে দিয়েছি। খাবার সময় মানুষকে বিরক্ত করা। জিজ্ঞেস করেছিলাম তার সঙ্গে কোন পরিচয় পত্র আছে কিনা।

    মনে হয় তাতেই কাজ হয়েছিল। বন্ড তার বড় কফির পেয়ালায় কানায় কানায় কালো কফি ঢালল।

    মোটেই না। বুক ফুলিয়ে তার ইউনিয়নের কার্ডটা আমাকে দেখাল। ইলেকট্রিশিয়ানদের ইউনিয়ন। ওরা কমিউনিস্ট, তাই না, স্যার?

    হ্যাঁ, অন্যমনস্কভাবে বন্ড বলল। মনে মনে অত্যন্ত সজাগ সে। ওরা কি তার ওপর নজর রাখছে বন্ড বলল, সে, লোকটা ঠিকঠিক কি বলেছিল?

    বলেছিল অবসর সময়ে সে টেলিভিশন সেট বিক্রি করে। প্রশ্ন করেছিল, সত্যিই কি আমরা কিনতে চাই না? সে বলেছিল এই চকের বাসিন্দাদের মধ্যে একমাত্র আমাদের টেলিভিশন নেই। সবসময়েই প্রশ্ন করে আপনি বাড়ি আছেন কিনা। থাকলে আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করবে। লোকটা আস্পর্ধা দেখুন। আপনার গতিবিধির কোন কথাই অবশ্য বলিনি। লোকটা অমন যদি নাছোড়বান্দা না হত তাহলে তাকে নম্র, ভদ্র বলা যেত।

    বন্ড ভাবল, হয়ত তার ওপর নজর রাখা হচ্ছে। মনে হয় এবার তোমার ধমকে কাজ হবে। লোকটা আর আসবে না।

    হয়তো হবে, স্যার, সন্দিগ্ধস্বরে সে বলল।

    বন্ড খেতে লাগল। অন্য সময় হলে যে লোকটা কমিউনিস্ট ইউনিয়ন থেকে বার বার তার বাড়িতে আসছে তার রহস্য না জানা পর্যন্ত সে স্বস্তি পেত না। কিন্তু অনেক মাসের আলস্যে বন্ডের মানসিক সতর্কতা ঢিলে হয়েছে।

    দিনের মধ্যে ব্রেকফাস্টই তার সবচেয়ে প্রিয়। লন্ডনে থাকার সময়ে ব্রেকফাস্ট খেত চিনি না দিয়ে দু পেয়ালা কালো কড়া কফি আর সাড়ে তিন মিনিট ধরে একটা সিদ্ধ ডিম।

    মধু দিয়ে ব্রেকফাস্ট শেষ করে সে তার বর্তমান জড়িমা আর মনমরা ভাবের কারণ খুঁজল বন্ড। প্রথমে সেই তিফানির ব্যাপারটা। অনেক দিন একসঙ্গে মহানন্দে কাটাবার পর প্রেমিকা তাকে ছেড়ে চলে যায় আমেরিকায়। তার জন্য এখন মন কেমন করে। একঘেয়ে রুটিন মাফিক কাজ করে নিজের সেক্রেটারি আর সহকর্মীদের সঙ্গে তিক্ত আর নীরস গলায় কথা বলে তার সময় কাটছে।

    এমন কি M-ও তার অধীনস্থ বদ মেজাজী খাঁচায় বন্দী বাঘের ওপর অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন। সেই সপ্তাহের সোমবার একটা কড়া নোটে বন্ডকে তিনি জানালেন পে-মাস্টার ক্যাপ্টেন ট্রপের অধীনে এক তদন্ত কমিটিতে তাকে নিয়োগ করা হয়েছে। নোটে তিনি জানালেন, গুপ্তচর বিভাগের একজন সিনিয়র অফিসার হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সমস্যার দিকে মন দেবার সময় বন্ডের হয়েছে। সদর দপ্তরে কাজের লোকের অভাব এবং ০০ সেকশনের হাতে এখন কোন কাজ নেই। সেদিন দুপুরে আড়াইটেতে ৪১২ নম্বর ঘরে বন্ডকে হাজির হতে হবে।

    সিগারেট ধরিয়ে বন্ড ভাবল তার বর্তমান অসন্তোষের কারণ টুপ নামে লোকটা, সবাইকে সে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারে।

    প্রত্যেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানে এমন একজন স্বেচ্ছাচারী শাসক থাকে যাকে সবাই জুজুর মত ভয় করে। মনে প্রাণে অপছন্দ করে। সাধারণত সেই লোকটা হয় জেনারেল ম্যানেজার, নয় শাসন বিভাগের প্রধান। তাকে বাদ দিয়ে অফিসের কাজ অচল।

    প্রত্যেক সুপরিচালিত প্রতিষ্ঠানে এরকম একজন করে লোক থাকে। গুপ্তচর দপ্তরে সেই পদের অধিকারী হচ্ছে পে মাস্টার ক্যাপ্টেন টুপ। নৌবাহিনীর অবসর প্রাপ্ত অফিসার আপাতত প্রশাসন বিভাগের প্রধান। তার কাজ সবকিছু পরিপাটি রাখা।

    ক্যাপটেন ট্রপের ডিউটি এমনি জাতের, যাতে এই প্রতিষ্ঠানের সবার সাথে তার সম্পর্কটা বিরোধের পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে। এই কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে টুপ ছাড়া M-এর মাথায় যে আর কোন নাম আসেনি–সেটা বিশেষ দুঃখজনক।

    গুপ্তচর বিভাগে বুদ্ধিজীবিদের নিয়োগ করা নিয়ে ট্রপের সঙ্গে বন্ডের খিটিমিটি লেগে গেল। বন্ড প্রস্তাব করল M 15 এবং গোয়েন্দা পারমাণবিক যুগের বুদ্ধিজীবি গুপ্তচরদের সঙ্গে সত্যিকারের লড়তে হলে সে কাজ ভারতীয় আর্মির অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের দিয়ে হবে না।

    ট্রুপ অত্যন্ত ঠাণ্ডা গলায় বলল, আপনার প্রস্তাব তাহলে আমাদের প্রতিষ্ঠানে লম্বা চুলওলা বিকৃতকামদের নিয়োগ করা। নিঃসন্দেহে এটা একটা মৌলিক মত। আমার ধারণা ছিল এ বিষয়ে আমরা সবাই একমত যে নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে সমকামী মানুষ। আমি কল্পনা করতে পারছি না সেন্টে ভেজা ঝাকড়া চুল এ ধরনের মেয়েলী পুরুষদের হাতে আমেরিকানরা ভুরি ভুরি পারমাণবিক গোপন তথ্য তুলে দেবে কি করে।

    সব বুদ্ধিজীবীরাই সমকামী নয়। তাদের অনেকের মাথাতেই বড় বড় টাক। আমি শুধু বলতে চাই যে…এইভাবে তিনদিন ধরে তর্ক বিতর্ক চলছিল। কমিটি অন্যান্য সদস্যরা মোটামুটি ট্রপের স্বপক্ষে। আজ তাদের সুপারিশের রিপোর্ট লিখতে হবে। সংখ্যালঘুদের রিপোর্টে নাম স্বাক্ষর করে অধিকাংশ লোকের-বিরাগ ভাজন হবে কিনা বন্ড ভাবছিল।

    সকাল নটায় তার ফ্ল্যাটের সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিজের গাড়িতে উঠতে ভাবছিল–গোটা প্রশ্নটা নিয়ে তার সত্যিকারের মাথাব্যথা কতটুকু? একলা সে বিরোধিতা করবে? সেকি একঘেয়েমির দরুন এতই ক্লান্ত যার জন্য নিজের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবার বিরাগ ভাজন হবে? ভেতরে সে অস্থির হয়ে উঠল। তার বেনটলির সেলফ-স্টার্টারে চাপ দিল। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটার দুটো এগজস্ট গর্জে উঠল। আর সেই সঙ্গে বন্ডের মনে পড়ল অদ্ভুত সেই প্রচলিত লাইনটা–আল্লাহ যাকে ধ্বংস করতে চান প্রথমে তাকে তিনি ফেলেন মানসিক একঘেয়েমির মধ্যে।

    .

    ভারী মিষ্টি কাজ

    ঘটনাচক্রে কিন্তু চূড়ান্ত রিপোর্টে বন্ডকে সই করতে হল না।

    তার সেক্রেটারীকে গ্রীষ্মের নুতন ফ্রকটার জন্য অভিনন্দন জানিয়ে রাতে যে সব সাংকেতিক বার্তা এসেছিল সেই ফাইলের অর্ধেকটা যখন সে শেষ করেছে এমন সময় লাল টেলিফোনটা ঝনঝন করে উঠল। তার অর্থ হয় M, নয় বড়সাহেব ফোন করেছেন।

    রিসিভার তুলে বন্ড বলল। 007

    আসতে পারবে? বড়সাহেবের স্বর।

    M?

    হ্যাঁ। মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা চলবে। ট্রুপকে বলে দিয়েছি কমিটির মিটিং-এ তুমি যেতে পারবে না।

    ব্যাপার কি কিছু আঁচ করতে পেরেছেন?

    চিফ অফ স্টাফের মৃদু হাসি শোনা গেল, সত্যি বলতে কি, পেরেছি। কিন্তু তার কাছ থেকেই শোনা ভাল। শুনলে খাড়া হয়ে বসবে।

    কোটপরে করিডোরে যাবার সময় বন্ড সজোরে দরজাটা বন্ধ করল। কেন জানে না। তার নিশ্চিত ধারণা হল । স্টার্টারের বন্দুক থেকে গুলি ছুটছে–শেষ হয়েছে একঘেয়েমির দিনগুলো। M-এর প্রাইভেট সেক্রেটারি মিস মানিপেনির চোখে সেই পুরানো উত্তেজনা আর গোপন রহস্যের আভাস। মৃদু হেসে সে ইন্টার কমের সুইচ টিপল।

    007 এসেছেন স্যার।

    তাকে পাঠিয়ে দাও, একটা ধাতব স্বর শোনা গেল। তার দরজার ওপরে লাল বাতি জ্বলল, যার অর্থ আর কেউ যেন ভেতরে না আসে।

    দরজা দিয়ে ভিতরে এসে বন্ড ধীরে ধীরে সেটা বন্ধ করল।

    M তার লাল চামড়ায় ঢাকা ডেস্কের উলটোদিকের একটা চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করল। বসে বন্ড তাকালো সেই প্রশান্ত নাবিকের মুখের মত রেখাবহুল মুখের দিকে। যেটিকে সে ভালবাসত ও শ্রদ্ধা করত, যার আদেশ সে পালন করত।

    একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করলে কিছু মনে করবে, জেমস

    অধীনস্থ কর্মচারিদের M কখনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতেন না। তাই বন্ড ভাবল ব্যক্তিগত প্রশ্নটা কি হতে পারে?

    না, স্যার।

    তামার বড় ছাইদান থেকে পাইপটা নিয়ে চিন্তিতভাবে M তামাক ভরতে ভরতে নীরস গলায় বলে চললেন, জান, কথাটা তোমার বন্ধু মিস কেস সম্বন্ধে। তুমি জান এ ধরনের ব্যাপার নিয়ে আমি বড় একটা মাথা ঘামাই না। কিন্তু শুনেছি সেই হীরে সংক্রান্ত ঘটনার পর তোমরা খুব ঘন-ঘন দেখা করছ। শোনা যাচ্ছে হয়ত তোমরা বিয়েও করবে। বন্ডের দিকে তাকিয়ে M আবার চোখ নামালেন। তামাক-ঠাসা পাইপটা মুখে তুলে আগুন ধরিয়ে তিনি বললেন, আপত্তি না থাকলে ব্যাপারটা কি বলবে?

    এরপর M কি বলবেন বন্ড ভেবে পেল না। অফিসের গুজবের নিকুচি করেছে। সংক্ষিপ্তভাবে সে বলে চলল, হ্যাঁ স্যার আমাদের মধ্যে বোঝাঁপড়া মোটামুটি ভালই ছিল। বিয়ের কথাও আমরা ভেবেছিলাম। কিন্তু তারপর আমেরিকান। দূতাবাসে মিস কেসের সঙ্গে একজনের আলাপ হয়। মিলিটারি অ্যাটাশের কর্মচারি। নৌ-বাহিনীর মেজর। শুনেছি তাকেই সে বিয়ে করবে। তারা দুজনেই আমেরিকায় ফিরে গেছে। হয়ত ভালই হয়েছে মিশ্রিত বিয়ে প্রায়ই সফল হয় না। শুনেছি লোকটা নাকি ভাল। সম্ভবত লন্ডনে থাকার চেয়ে সেটাই বেশি পছন্দ। বাস্তবিকই এখানে সে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারত না। মেয়েটি চমৎকার, সামান্য পাগলাটে। আমাদের খুব ঝগড়া হত। হয়ত আমারই দোষ। থাকগে, সব চুকেবুকে গেছে।

    M এমন সংক্ষিপ্তভাবে হাসলেন যে তার মুখের চেয়ে চোখেই সেটা ধরা পড়ল। বললেন, তোমাদের মধ্যে বোঝাঁপড়ার ভুল হয়ে থাকলে আমি দুঃখিত, জেমস। M-এর স্বরে কিন্তু কোনরকম সান্ত্বনার আভাস ছিল না। মেয়েদের সঙ্গে বন্ডের অতিরিক্ত মেলামেশা তিনি অপছন্দ করতেন। কিন্তু বন্ডের কর্তা হিসেবে কখনই তিনি চাইতেন।

    বন্ড চিরকালের জন্য কোন মেয়ের আঁচলে বাঁধা পড় ক। হয়ত এটাই সবচেয়ে ভাল। এই কাজে কোন পাগলাটে মেয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার অনেক অসুবিধে। যে-হাতে গুলি চালাও সেই হাত ধরে তারা ঝুলে থাকে। জানি না কথাটা বুঝলে কিনা। তোমাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করার জন্য ক্ষমা করো। হাতে যে কাজ এসেছে সেটা বলার আগে তোমার উত্তরটা জানা দরকার ছিল। ব্যাপারটা ভারি গোলমেলে। তুমি বিয়ে করলে–এ-ব্যাপারে তোমাকে জড়িয়ে ফেলা কঠিন।

    মাথা নাড়িয়ে ব্যাপারটা শোনার জন্য বন্ড অপেক্ষা করতে লাগল।

    চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পাইপে দ্রুত কয়েকটা টান দিয়ে M বলতে লাগলেন, ঘটনাটা এই–গতকাল ইস্তাম্বুল থেকে একটা দীর্ঘ খবর এসেছে। মনে হয় মঙ্গলবার আমাদের তুরস্কৃস্থিত গুপ্তচর কেন্দ্র, অর্থাৎ T স্টেশনের প্রধান নাম ঠিকানাহীন টাইপ করা একটা উড়োচিঠি পান। তাতে তাকে বলা হয়েছে। সন্ধে আটটার ফেরি স্টিমারে গালাটা ব্রিজ থেকে বসফরাসের মুখ পর্যন্ত একটা টিকিট কাটতে। আর কোন কথা ছিল না। T-এর প্রধান দুঃসাহসী প্রকৃতির লোক। স্টিমারটায় চড়ে ডেকের রেলিং ধরে তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন। মিনিট পনের পর একটা মেয়ে এসে তার পাশে দাঁড়ায়। মেয়েটি রুশী। পরমা সুন্দরী। প্রাকৃতিক দৃশ্য ইত্যাদি টুকিটাকি ব্যাপার নিয়ে খানিক আলোচনার পর, তাঁকে মেয়েটি এক ভারি আশ্চর্য কাহিনী বলে।

    পাইপটা আবার ধরাবার জন্য M থামলেন। বন্ড বলে উঠল, T-এর প্রধান কে, স্যার? তুরস্কে আমি কখনো কাজ করিনি।

    তার নাম করিম, ডার্কোম করিম। তুর্কি বাবা, ইংরেজ মা। অসাধারণ মানুষ। লড়াই-এর আগে থেকেই T-এর প্রধান। আমাদের সবচেয়ে দক্ষ লোকদের একজন। অদ্ভুত ভাল কাজ করেন। কাজটা তিনি ভালবাসেন। খুব বুদ্ধিমান। নিজের হাতের উটো পিঠের মত পৃথিবীর সব জায়গা জানেন। পাইপটা নাড়িয়ে করিমের প্রসঙ্গ M বাদ দিলেন। মেয়েটির কাহিনী এই–সে MGB-র কর্পোরাল ছিল। স্কুল ছাড়ার পর থেকে সেখানে সে কাজ করছে। সম্প্রতি সংকেত বিভাগের অফিসার হিসাবে ইস্তাম্বুলে বদলি হয়েছে। নানা বুদ্ধি করে এই বদলির চাকরিটা সে জোগাড় করেছে। কারণ সে রাশিয়া থেকে পালাতে চেয়েছিল। সে এখানে আসতে চায়।

    বন্ড বলল, ভাল কথা। তাদের গোপন সংকেত জানা মেয়ে কর্মচারি আমাদের কাজে লাগতে পারে। কিন্তু এখানে আসতে চায় কেন?

    টেবিলের ওপাশ থেকে বন্ডের দিকে তাকালেন M। কারণ সে প্রেমে পড়েছে, M সামান্য থেমে মৃদু স্বরে বললেন, মেয়েটি বলছে তোমার প্রেমে পড়েছে সে।

    আমার প্রেমে পড়েছে?

    হ্যাঁ, তোমার প্রেমে। তাই তো সে বলছে। তার নাম তাতিয়ানা রোমানাভো। নামটা শুনেছ?

    জীবনে শুনিনি, স্যার। বভের মুখে বিহ্বল ভাব দেখে M মৃদু হাসলেন। কিন্তু মেয়েটির কথার মানে কি? আমার সঙ্গে কখনো তার দেখা হয়েছিল। আমার কথা কি করে সে জানলে?

    M বললেন, সমস্ত ব্যাপারটাই হাস্যকর। কিন্তু ব্যাপারটা এমন ধরনের পাগলামো যে সত্যি হতে পারে। মেয়েটির বয়েস চব্বিশ। MGB-তে যোগ দেবার পর থেকে Central Index-এ সে কাজ করছে যেটা আমাদের তথ্য বিভাগের অনুরূপ। সেখানকার ইংরেজি বিভাগে সে ছ বছর ধরে কাজ করছে। তাকে যে ফাইলগুলো নিয়ে কাজ করতে হয়। তার মধ্যে একটা হচ্ছে তোমার।

    আমি মেয়েটিকে দেখতে চাই, বন্ড মন্তব্য করল।

    তার গল্পটা এই–তোমার ফটোগুলো তাদের কাছে আছে। প্রথমে সেগুলো দেখে সে মুগ্ধ হয়। তোমার চেহারাটা তার মনে ধরে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তোমার সব কীর্তিকাহিনী সে পড়েছে। তার ধারণা হয়েছে তোমার মত মানুষ হয় না।

    বন্ড চোখ নামাল। M–এর মুখ নির্বিকার।

    এ ধরনের উদ্ভট গল্প আমি কখনো শুনিনি, স্যার। নিশ্চয়ই T-এর প্রধান এটা বিশ্বাস করেননি।

    এক মুহূর্ত সবুর কর, M-এর স্বর খিটখিটে হয়ে উঠল। আগে কখনো যেটা ঘটেনি সেটা ঘটেছে বলে চটপট কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছিও না। ধর, এই কাজে না থেকে যদি তুমি কোন ফিল্ম স্টার হতে? পৃথিবীর সব জায়গায় মেয়েদের কাছ থেকে নানা পাগলাটে ধরনের চিঠি পেতে, যাতে থাকত তোমাকে ছাড়া তারা বাঁচতে পারবে না ধরনের হাবিজাবি কত কি কথা–সৃষ্টিকর্তাই জানেন। এই বোকা মেয়েটি মস্কোতে সেক্রেটারির কাজ করে। সম্ভবত তাদের ডিপার্টমেন্টে সবাই মেয়ে–আমাদের মত। তাকাবার মত ঘরে একটা পুরুষও নেই। তার কাছে ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটা ফাইল আসছে যাতে, কি বলে, তোমার তেজস্বী চেহারার ছবি। তাতে, যাকে বলে, তার মুণ্ডু ঘুরে যায়, পৃথিবীর সর্বত্র যেমন পত্রিকার ছবি দেখে সেক্রেটারিদের মাথা ঘোরে, এ ধরনের ভয়াবহ মেয়েলী স্বভাবের কথা তিনি কিছুই জানেন না, বোঝাবার জন্য M পাইপটা নাড়ালেন। সৃষ্টিকর্তা জানেন, এ ধরনের ব্যাপার সম্বন্ধে আমার জ্ঞান সামান্যই। কিন্তু তোমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, এ-ধরনের ঘটনা ঘটে।

    বন্ড মৃদু হাসল, এখন স্যার বুঝতে পারছি, রুশী মেয়েদের ইংরেজ মেয়েদের মত বোকা না হবার কোন কারণ নেই। কিন্তু মেয়েটি যা করেছে তাতে স্বীকার করতে হয় তার বুকের পাটা আছে। T-এর প্রধান কি জানিয়েছেন, মেয়েটি জানে ধরা পড়লে তার ফলাফল কি হবে?

    M বললেন, মেয়েটি দারুণ ঘাবড়ে আছে। স্টিমারে সর্বক্ষণ এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল তাকে কেউ লক্ষ্য করছে কিনা দেখার জন্য। কিন্তু এক মিনিট সবুর কর। গল্পের অর্ধেকটাও এখনো শোননি। M তার পাইপে টান দিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়লেন।

    মেয়েটি করিমকে বলেছে তোমার প্রতি তার আকর্ষণ ক্রমশ বিতৃষ্ণা ধরায় রুশীদের ওপর। ক্রমশ সেই ঘৃণা গিয়ে পড়ে রুশ সরকারের ওপর। তাদের জন্য যে কাজ সে করেছিল, সে কাজটা তোমার বিরুদ্ধে। তাই সে বিদেশে বদলির জন্য দরখাস্ত করে। ভাষার জ্ঞান তার খুব ভাল বিশেষ করে ইংরেজি আর ফরাসি। যথাসময়ে ইস্তাম্বুলে সংকেত বিভাগে একটা চাকরির প্রস্তাব তার কাছে আসে। সে-চাকরির বেতন কম।

    তারপর যা ঘটে সংক্ষেপে সেটা এই : ছমাস ট্রেনিং-এর পর তিন সপ্তাহ আগে সে ইস্তাম্বুলে আসে। তারপর খোঁজ করে করিমের খবর সে পায়। করিম সেখানে বহুকাল আছেন। তাই তুরস্কে সবাই এখন জানে তার কাজটা কি।

    তাই মেয়েটি করিমের কাছে টাইপ করা নোটটা পাঠিয়েছিল। এখন মেয়েটি জানতে চায় করিম তাকে সাহায্য করতে পারবে কিনা। থেমে চিন্তিতভাবে পাইপে কয়েক টান দিয়ে M বলে চললেন, তোমার মতই করিম প্রথমে সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠেন। এর পেছনে কোন একটা চক্রান্ত আছে কিনা তিনি খুব ভাল করে বিবেচনা করে দেখেন। কিন্তু আমাদের কাছে এই মেয়েটিকে পাঠিয়ে কি লাভ কিছুতেই তিনি ভেবে পান না। এই আলাপ-আলোচনার সময় স্টিমারটা বসফরাসের দিকে যাচ্ছিল, খানিক পরেই ইস্তাম্বুলের দিকে ফেরার কথা। করিম যত জেরা করতে থাকেন, মেয়েটি তত মরিয়া হয়ে ওঠে। তারপর, বন্ডের দিকে তাকিয়ে M-র চোখ চকচক করে উঠল, মোক্ষম কথাটা তাতিয়ানা বলে।

    M-এর ধূসর ঠাণ্ডা চোখ চকচক করে উঠলে বন্ড তাঁর উত্তেজনা টের পায়।

    মেয়েটি তার হাতের শেষ তাসটা খেলে। সে জানত তাসটা তুরুপের টেক্কা। সে বলে–আমাদের কাছে আসতে পারলে সে তার সাইফার মেশিনটা নিয়ে আসবে। সেই মেশিনটার জন্য আমরা যে কোন চড়া দাম দিতে রাজি।

    হে আল্লাহ, মৃদু স্বরে বলল বন্ড। এ রকম অসাধারণ ব্যাপার কল্পনার বাইরে। SPEKTOR মেশিন, সব দেশের সবচেয়ে গোপনীয় সাংকেতিক বার্তা যে-যন্ত্রটা বলে দিতে পারে। সেটা খোয়া গেছে জানলে রুশীরা নিশ্চয়ই পৃথিবীর সর্বত্র তাদের এমব্যাসি এবং গুপ্তচর কেন্দ্র থেকে মেশিনটাকে বাতিল করে দেবে। তবু সেটা হাতাতে পারলে দারুণ একটা জিৎ। নিরাপত্তার জন্য বন্ড সাংকেতিক লিপি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানত না–যাতে ধরা পড়লে সে সম্বন্ধে কোন কথা তার কাছ থেকে বের করে নেওয়া না যায়। তবু এটুকু জানত SPEKTOR মেশিন হারানো রুশী গুপ্তচর বিভাগের পক্ষে একটা চরম সর্বনাশ।

    মেয়েটির কথাগুলো দারুণ পাগলাটে ধরনের। তা সত্ত্বেও M বিশ্বাস করেছেন। কোন রুশী তাদের জন্য এই উপহার আনছে, তার জন্য চরম সর্বনাশকেও সে পরোয়া করে না–এর মানে কি? মেয়েটির কথা সত্যি হতে পারে, মিথ্যেও হতে পারে। কিন্তু এই জুয়াখেলার বাজিটা এমনি চড়া দরের, যে সেটাকে উপেক্ষা করা যায় না।

    বন্ডের চোখের দিকে তাকিয়ে তার উত্তেজনা খুব স্পষ্ট করেই বুঝতে পারলেন। মৃদু স্বরে বললেন 007,–কথাটা বুঝলে?

    বন্ড প্রশ্ন করল, কি করে কাজটা হাসিল করবে সে সম্বন্ধে মেয়েটি কিছু বলেছে?

    সোজাসুজি কিছু বলেনি। কিন্তু করিম জানিয়েছেন, কাজটা হাসিল করা সম্বন্ধে মেয়েটির মনে কোন রকম সংশয় নেই। সপ্তাহে কয়েক রাত সে একা থাকে। অফিসে ক্যাম্পখাটে ঘুমায়। মেয়েটি জানে তার প্ল্যানের কথা ঘুণাক্ষরে জানা গেলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। আমার কাছে করিম তার কথা জানাবে বলেও সে উদ্বিগ্ন। করিমকে দিয়ে সে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছে লিখে তাকে পাঠাতে হবে এবং সেই খবরের কোন প্রতিলিপি তিনি রাখবেন না। স্বভাবতঃই করিম তা করবেন বলে কথা দেন। SPEKTOR-এর কথা শোনামাত্র করিম বুঝতে পেরেছিলেন যুদ্ধের পর এটাই সবচেয়ে বড় গুপ্ত খবর।

    তারপর কি হল, স্যার?

    ওটাকোয় নামে একটা জায়গার কাছে স্টিমারটা তখন আসছিল। মেয়েটি বলে সেখানে সে নামবে। করিম কথা দেয় সেই রাতেই সাংকেতিক ভাষায় খবরটা আমাদের জানাবে। মেয়েটি তার সঙ্গে একেবারেই কোন যোগাযোগ রাখবে না বলে জানায়। শুধু জানায় আমরা আমাদের কথা রাখলে, সে-ও তার কথা রাখবে। গুডনাইট বলে জেটির ভীড়ে সে মিলিয়ে যায়।

    হঠাৎ সামনে ঝুঁকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে বন্ডের দিকে তাকিয়ে M বললেন, কিন্তু আমরা যে তার কথামত কাজ করব সে সম্বন্ধে মেয়েটিকে কোন গ্যারান্টি করিম দেননি।

    বন্ড চুপ করে রইল। সে জানে এর পর M কি বললেন।

    M-এর চোখের তারা সঙ্কুচিত হয়ে উঠল, মেয়েটি একটিমাত্র শর্তে এ-কাজটা করবে বলেছে। শর্তটা এই : তোমাকে ইস্তাম্বুলে গিয়ে মেশিন সমেত তাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে আসতে হবে।

    বন্ড কাঁধ ঝাঁকাল। কাজটা ভারি সহজ। কিন্তু…M-এর দিকে সরল দৃষ্টিতে সে তাকাল। এটা তো ভারি মিষ্টি সহজ কাজ। শুধু একটা খটকা লাগছে। মেয়েটি শুধু আমার ফটো দেখেছে, আমার সম্বন্ধে অনেক উত্তেজনাপূর্ণ কাহিনী শুনেছে। কিন্তু, ধরুন আমাকে সশরীরে দেখলে তার স্বপ্নটা যদি ভেঙ্গে যায়?

    গভীর সুরে M বললেন, সেটাই তোমার কাজ–তার স্বপ্নটা যেন না ভাঙ্গে। তাই মিস্ সে সম্বন্ধে তোমাকে প্রশ্ন করছিলাম।

    .

    প্রাচ্যদেশের যাত্রী

    লন্ডন এয়ারপোর্ট ছেড়ে, সাড়ে দশটায় BEA ফ্লাইট নম্বর ১৩০ তীর বেগে ছুটল রোম, এথেন্স, ইস্তাম্বুলের দিকে। দশ মিনিটের মধ্যে প্লেনটা উঠল কুড়ি হাজার ফুট উঁচুতে। বন্ড তার সিট বেল্ট খুলে একটা সিগারেট ধরাল। অ্যাটাচিকেসটা তুলে তার ভেতর থেকে একটা বই বের করে আবার সেটা নামিয়ে রাখল বন্ড। হোট দেখতে হলে কি হবে দারুণ ভারি সেটা। বন্ড ভাবল, লন্ডন এয়ারপোর্টের টিকিট ক্লার্ক ওভারনাইট ব্যাগ হিসেবে সেটাকে ছেড়ে না দিয়ে যদি ওজন করত তা হলে কি অবাকটাই না হত।

    Qব্রাঞ্চ এই সুন্দর দেখতে ছোট্ট ব্যাগটার চামড়া আর লাইনিং-এর মধ্যে পঞ্চাশটা 3.25 পিস্তলের গুলি আর দুটো ধারাল ছোরা ভরে দিয়েছিল। বন্ড ঠাট্টা করে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করা সত্তেও Q-এর কারিগররা কেসটার হ্যাঁন্ডেলের মধ্যে সায়ানাইডের একটা মৃত্যু বড়ি ভরে দিয়েছিল, বিশেষ একটা জায়গায় চাপ দিলেই যেটা বন্ডের হাতের তালুর মধ্যে বেরিয়ে আসবে (কেসটা নেবার পরেই বন্ড বাথরুমে গিয়ে বড়িটা কমোডে ফেলে ফ্লাশ টেনে দিয়েছিল)। নিরীহ চেহারার স্পঞ্জ-ব্যাগে পামঅলিভ শেভিং ক্রিমের মোটা টিউবটা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেটার মধ্যে তুলোয়-মোড়া ছিল বন্ডের বেরেটা পিস্তলের সাইলেন্সর। প্রয়োজনমত নগদ টাকার জন্য কেসটার ডালায় ছিল পঞ্চাশটা সোনার মোহর।

    প্লেনে বারজন যাত্রী ছিল। তাকে নিয়ে তের। কথাটা জানলে তার সেক্রেটারি ললায়েলিয়া পনুসনবির আতংকের কথা ভেবে বন্ড মৃদু হাসল। গতকাল M-এর ঘর থেকে বেরিয়ে সে তার অফিসে গিয়েছিল ফ্লাইটের খুঁটিনাটি ব্যবস্থা পাকা করতে। শুক্রবার তের তারিখে যাবে শুনে তার সেক্রেটারি ঘোরর প্রতিবাদ জানিয়েছিল।

    বন্ড বলেছিল, যাত্রার পক্ষে তের তারিখটাই সবচেয়ে ভাল। যাত্রীর সংখ্যা তখন খুব কম থাকে, আরামে যাওয়া যায়। পারলে সব সময়েই তের তারিখ আমি বেছে নিই।

    হাল ছেড়ে দিয়ে পসনৃবি বলেছিল, তোমার সর্বনাশ কে ঠেকাতে পারবে? আমি কিন্তু সেদিনটা ভারি দুশ্চিন্তায় কাটাব, আর দোহাই তোমার, আজ বিকেলে মই-এর তলা-টলা দিয়ে হেঁটো না। ভেবো না সব সময় বরাত-জোরে বেঁচে যাবে। কেন তুরস্কে যাচ্ছ জানি না। জানতেও চাই না। আমি হাড়ে হাড়ে সেটা খানিক আঁচ করেছি।

    তাকে খেপিয়ে বন্ড বলেছিল, কি কাণ্ড! তোমার ঐ সুন্দর হাড়গুলোর মধ্যে যে রাতে ফিরব সে রাতেই ঐ সুন্দর হাড়গুলোকে নিয়ে যাব।

    পনসনবি ঠাণ্ডা গলায় বলেছিল, মোটেই না। তারপর হঠাৎ আবেগভরে তাকে চুমু খেয়েছিল। আর বহুবার যে কথাটা ভেবেছে আবার সেই কথাটা ভেবেছিল বন্ড–তার সেক্রেটারির মত মেয়ে হয় না। তবে কেন সে অন্য কোন মেয়েদের নিয়ে মাথা ঘামায়?

    প্লেনের একটানা মৃদু গুঞ্জন। নিচে সাদা মেঘের অনন্ত সমুদ্র। দূরে মেঘের ফাটলের মধ্যে ঝাপসা নীল রঙ প্যারিস। ঘন্টা খানেক ধরে তারা ফ্রান্সের পোড়া ক্ষেতের ওপর দিয়ে উড়ে চলল।

    লাঞ্চ এল। বইটা বন্ধ করল বন্ড। সেই সঙ্গে তার ভাবনাগুলোকেও। খেতে খেতে সে নিচে তাকিয়ে দেখল আয়নার মত জেনিভার হ্রদ। সুন্দর আল্পস্-এর পাইনের অরণ্য বরফ ছুঁয়েছে। তার মনে পড়ল অতীতে ছুটির দিনে স্কি করার কথা। ম ব্লা পাহাড়ের চুড়ো ঘুরে প্লেনটা ছুটছে। মনে পড়ল কৈশোরের কোমরে দড়ি জড়িয়ে পাহাড়ে ওঠার কথা।

    আর এখন? প্লেনের জানালার শার্শিতে নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে বন্ড মৃদু হাসল। সেই তরুণ জেমস বন্ড এখন যদি পথে এসে তার সঙ্গে কথা বলে–সেকি সেই সতের বছরের ছেলেটির নিষ্পাপ মুখটি চিনতে পারবে? সেই কিশোর কি চিনতে পারবে এই গুপ্তচরকে, বয়স্ক জেমস বন্ডকে বহু বছরের প্রতারণা, নিষ্ঠুরতা আর আতঙ্ককে বর্তমান লোকটির জীবন কলুষিত। তার চোখের দৃষ্টি ঠাণ্ডা আর উদ্ধত। ডান গালে ক্ষতচিহ্ন। বাঁ বগলের নিচে একটা গুপ্ত অস্ত্র।–যে দুর্দান্ত গুপ্তচর পৃথিবীর ওপর দিয়ে এখন ছুটে চলেছে একটা নতুন আর অত্যন্ত রোমান্টিক ভূমিকা নিয়ে, ইংল্যান্ডের অবৈধ প্রণয়ের দালাল সেজেতার সম্বন্ধে সেই কিশোর ছেলেটি কি ভাববে?

    বন্ড তার মৃত যৌবনের চিন্তা মন থেকে সরিয়ে দিল। কখনো পেছন দিকে তাকাতে নেই। কি হতে পারত চিন্তা করা সময়ের অপব্যবহার। নিজের নিয়তির অনুসরণ কর। তাই নিয়ে তৃপ্ত হও।

    রৌদ্রোজ্জ্বল জেনোয়া আর ভূমধ্যসাগরের শান্ত নীল পানির দিকে তাকিয়ে মন থেকে অতীতের চিন্তা মুছে আসল ভবিষ্যতের কথা ভাবতে লাগল বন্ড। ভাবতে লাগল সেই কাজটার কথা, মনে মনে তিক্তভাবে যেটার সে নাম দিয়েছিল, ইংল্যান্ডের অবৈধ প্রণয়ের দালালি।

    একটি মেয়েকে খুব তাড়াতাড়ি ফুসলিয়ে নিয়ে আসতে হবে যাকে কখনো সে দেখেনি, যার নাম মাত্র গতকাল প্রথম শুনেছে। T-এর প্রধান বলেছে মেয়েটি ভারি রূপসী। কিন্তু যত রূপসীই সে হোক না কেন-বন্ডের মাথায় একটা মাত্রই চিন্তা ও সে দেখতে কেমন সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা বিয়ের যৌতুক হিসেবে কি সে আনবে। কাজটা অনেকটা অর্থের জন্য কোন ধনী মেয়েকে বিয়ে করার মত। গোপন চিন্তা বাদ দিয়ে তার মন কি নিজের দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পারবে নিখুঁতভাবে প্রেম করতে বিছানায় কেমন ভাবে তোক প্রেম করে, যখন সমস্ত মনটা পড়ে থাকে ব্যাংকে মেয়েটির কত টাকা আছে তার হিসেবের ওপর? হয়ত একটা সোনার থলিকে ধর্ষণ করার মধ্যে একটা যৌন উত্তেজনা আছে। কিন্তু এক সাইফার মিশনকে।

    রোম এল আর গেল। ইটালির ওপর দিয়ে আবার ছুটে চলল প্লেনটা। যে সাক্ষাৎকারের ব্যাপার ঘণ্টা তিনশ মাইল বেগে এগিয়ে আসছে তার তুচ্ছতম খুঁটিনাটি কথা বন্ড ভাবতে লাগল।

    এটা কি MGB-র এমন একটা জটিল প্ল্যান যার চাবিকাঠি তার হাতে? এমন একটা ফাঁদে সে পা দিতে চলেছে। যার কথা M-এর দুর্ধর্ষ মগজেও ধরা পড়েনি। এ রকম একটা ফাঁদের কথা ভেবে M নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন। প্রত্যেকটি প্রামাণ্য নজিরের স্বপক্ষে আর বিপক্ষে সবকিছু খুঁটিয়ে দেখেছেন M–শুধু একা তিনি নন, তার অফিসের সমস্ত বিভাগের বড়কর্তারা। কিন্তু রুশীদের মতলব কি হতে পারে কেউ তার হদিস করতে পারেনি। তারা কি বন্ডকে চুরি করে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে? প্রতিহিংসার জন্য বন্ডকে খুন করতে চায়। তাই যদি চায় তা হলে তো লন্ডনের পথে তাকে গুলি করে মারতে পারত। কিংবা তার ফ্লাটে বা তার গাড়িতে বোমা ফেলেও কাজ সমাধা করতে পারত।

    বন্ড যখন চিন্তায় মগ্ন তখন স্টুয়ার্ডেস বলল, প্লিজ বেল্টটা বাঁধুন। সঙ্গে সঙ্গে তীরবেগে প্লেনটা নামতে শুরু করল। জানলায় তখন বৃষ্টি আছড়াচ্ছে। ভূম্যসাগরীয় বিদ্যুঝঞ্ঝা কোনমতে পেরিয়েছে প্লেনটা।

    বন্ড যেন বিপদের গন্ধ পেল। আবার জানলায় বিদ্যুতের ঝলকানি। প্লেনটা কি মুখ থুবড়ে পড়বে নাকি তেরজন যাত্রী। শুক্রবারের তের তারিখ। লোয়েলিয়া পবি–র কথাগুলো বন্ডের মনে পড়ল। সে কি শেষ পর্যন্ত ইস্তাম্বুলে পৌঁছতে পারবে?

    প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কেবিনের বাতিগুলো জ্বলল। জানলায় বৃষ্টির শব্দ আর নেই। সে স্বস্তির একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে একটা সিগারেট ধরাল।

    প্লেনটা নামল।

    সামান্য যে কটা যাত্রী তারা সবাই চুপচাপ, মুখ ফ্যাকাশে। বন্ড তাদের সঙ্গে নেমে ট্রানসিট লাউঞ্জ দিয়ে সোজা বারের দিকে গিয়ে Ouzu মদের অর্ডার দিল। মদে জ্বলে উঠল তার গলা আর পেট। তবু ভাল লাগল বলে আরেক গ্লাস মদের অর্ডার দিল সে।

    লাউডস্পিকারে তার নাম যখন ঘোষণা হল তখন গোধূলী। আকাশের অনেক উঁচুতে ভারি পরিষ্কার আধখানা চাঁদ। বাতাসে ফুলের সুগন্ধ। ঝি ঝি ডাকছে। এখান থেকে ইস্তাম্বুল মাত্র নব্বই মিনিটের উড়ো পথ।

    প্লেনটা অবশেষে পৌঁছল সুন্দর আধুনিক ইয়েসিনকায় বিমান বন্দরে। সেখান থেকে মোটরে এক ঘণ্টার পথ ইস্তাম্বুল। স্টুয়ার্ডের্সকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার ছোট্ট ভারি অ্যাটাচিকেসটা নিয়ে পাসপোর্ট চেক পোস্টের ভেতর দিয়ে কাস্টমস অফিসে পৌঁছে সুইকেসটা ফ্রি করল বন্ড।

    এরাই তা হলে আধুনিক তুর্কী ছিমছাম পোশাক পরা কালো কুৎসিত চেহারাগুলোর দিকে তাকিয়ে বন্ড ভাবল। লোকগুলোর চোখ উজ্জ্বল। কটমটে আর নিষ্ঠুর, অবিশ্বাসী আর সতর্ক।

    কাস্টমস-এর বাইরে ছায়ার ভিতর থেকে একটি লোক বেরিয়ে এল। কৃশ, দীর্ঘ চেহারা। কালো ঝোলা গোফ। পরনে ছিমছাম ওয়েস্ট কোট, মাথায় সোফারের টুপি। সে স্যালুট করল। তারপর বন্ডের নাম না জেনেই তার সুটকেসটা নিয়ে চলল একটা দারুণ সম্ভ্রান্ত পুরনো মডেলের কালো রোলস রয়েসের দিকে। গাড়িটা নিশ্চয়ই বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে কোন কোটিপতির জন্য বানানো হয়েছিল–বণ্ড ভাবল। বিমানবন্দর থেকে বেরুবার পর। ড্রাইভার ঘাড় ফিরিয়ে ভাবে বিশুদ্ধ ইংরেজিতে বন্ডকে বলল, করিম বে-র ধারণা আজ রাতে আপনি বিশ্রাম করবেন। কাল সকাল নটায় আপনার কাছে আমাকে আসতে হবে। কোন হোটেলে আপনি থাকবেন, স্যার?

    ক্রিস্টাল প্যালেস।

    ঠিক আছে, স্যার। গাড়িটা হু-হুঁ করে ছুটল।

    পেছনে, বিমানবন্দরের ছায়ায় ঢাকা পার্কিং প্লেসে বন্ড অস্পষ্ট শুনল একটা মোেটর স্কুটারের স্টার্ট দেবার ঘড়ঘড় শব্দ। হেলান দিয়ে বসে সে এই মোটর ভ্রমণ উপভোগ করতে লাগল।

    .

    ডার্কো করিম

    ক্রিস্টাল প্যালেসের খুপরি ঘরে খুব ভোরে তার ঘুম ভাঙল।

    বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে পৃথিবী বিখ্যাত অন্যতম সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে লাগল সেডান দিকে গোল্ডেন হর্নের শান্ত পানি, বাঁ দিকে বসফরাসের নৃত্যময় ঊর্মিমালা।

    ঘরে ফিরে বন্ড টেলিফোনে ইংরেজিতে তার ব্রেকফাস্ট পাঠাবার অনুরোধ করল। হোটেলের লোক বুঝল না। ফরাসিতে বলতে বুঝল। ঠাণ্ডা পানিতে দাড়ি কামাতে কামাতে সে ভাবল যে খাবারগুলো যেন অখাদ্য না হয়। খাবার দেখে সে হতাশ হল না। নীল চীনেমাটির বাটিতে ঘন দই, তার সঙ্গে ক্রিম। পাকা রসাল ডুমুর। কুচকুচে কালো। টার্কিশ কফি অত্যন্ত তৃপ্তির সঙ্গে বন্ড খেল।

    কাঁটায় কাঁটায় নটার সময় এসে সেই রোলস রয়েস তাকে নিয়ে এল বিরাট একটা সরকারি বাড়িতে। দারোয়ান দরজা খুলে ইঙ্গিতে বন্ডকে অনুসরণ করতে বলল। তাকে এক কেরানির কাছে নিয়ে গেল। তারপর কেরানি তাকে নিয়ে একটা ঘরের দরজায় টোকা দিল। তারপরেই দরজা খুলে বন্ডকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করল।

    আসুন দোস্ত,–আসুন, আসুন, ক্রিম রঙের তসরের সুন্দর ছাটের স্যুট পরা বিরাট চেহারার একটি লোক মেহগনি ডেস্কের পেছন থেকে এসে তার দিকে হাত বাড়াল।

    তার স্বরের কর্তৃত্ব আভাস শুনেই বন্ড বুঝল ইনিই হচ্ছেন T-স্টেশনের প্রধান। এবং সে এখন এই এলাকায় এই মানুষটির অধীনে।

    ডার্কো করিমের করমর্দন আন্তরিকতায় ভরা। আর এমন জোরাল যে, অতি সহজেই অনুমান করা যায়, যার সঙ্গে করমর্দন করছেন তার আঙ্গুলের হাড় অনায়াসে তিনি গুঁড়িয়ে দিতে পারেন।

    বন্ড লম্বায় ছ ফুট। এ মানুষটি তার চেয়েও অন্তত দু ইঞ্চি লম্বা। চেহারায় বন্ডের দ্বিগুণ। মুখ তামাটে। নাকটা ভাঙা। চোখ দুটো হাসি হাসি, টলটলে, নীল–সেখানে লালচে শিরা। সেই চোখ দেখেই বন্ড বুঝল নানা অত্যাচারে অনাচারে তিনি জীবনটা অপচয় করে চলেছেন। মুখটা বেদেদের মত। ডান কানে সোনার রিং। বন্ডের মনে হল এ রকম প্রাণবন্ত মুখ সে আগে দেখেনি।

    বন্ড বলল, গত রাতে আপনি গাড়ি পাঠিয়েছিলেন বলে ধন্যবাদ।

    হো-হো করে হেসে করিম বলল, আপনি-টাপনি ছাড়। আমাদের বন্ধুদেরও তোমার ধন্যবাদ জানান উচিত। দু পক্ষই তোমাকে আনতে গিয়েছিল। আমার গাড়ি বিমানবন্দরে গেলেই তারা অনুসরণ করে।

    সেটা কি ভেস্পা না লাম্‌ব্রেটা?

    তুমি লক্ষ্য করেছিল? সেটা লামব্রেটা। ক্ষুদে ক্ষুদে লোকগুলোর জন্য ও ধরনের বহু গাড়ি তাদের আছে। লোকগুলোকে আমি বলি, মুখহীন মানুষ। তাদের সবাইকে দেখতে হুবহু এক। এখনো আমি তাদের চিনে উঠতে পারিনি। ক্ষুদে ডাকাতের দল। অধিকাংশই বুলগানিন। শত্রুপক্ষের জঘন্য কাজগুলো এরাই করে। কিন্তু লোকটা অনেক পেছনে ছিল। একবার আমার শোফার হঠাৎ ব্রেক কষে খুব জোরে ব্যাক করে। গাড়িটার রঙ চটে যায়, চাকায়। আর কলকজায় রক্তের দাগ ধরে। তারপর থেকে তারা রোলস্টার থেকে দূরে থাকে। উচিত শিক্ষা হয়েছে।

    করিম নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে আর একটা চেয়ারে বন্ডকে ইঙ্গিতে বসতে বললেন। তারপর এগিয়ে দিলেন। চ্যাপটা সাদা এক বাক্স সিগারেট। চেয়ারে বসে বন্ড একটা সিগারেট নিয়ে ধরাল। সিগারেটটা অদ্ভুত ভালভারি কোমল আর মিষ্টি, তুর্কি তামাক দিয়ে তৈরি।

    নিকোটিনের দাগ-ধরা হাতির দাঁতের হোলডারে করিম একটা সিগারেট ভরলেন। সেই অবসরে বন্ড ঘরটাকে ভাল করে দেখে নিল। রঙ আর বার্নিশের তীব্র গন্ধ–যেন সম্প্রতি নতুন করে সাজানো হয়েছে। ঘরটা চৌকো আর বড়। ঝকঝকে মেহগনি কাঠের প্যানেল বসানো। করিমের চেয়ারের পেছনে ছাদ থেকে একটা প্রাচ্যদেশের নশা পর্দা ঝুলছে।

    করিম সিগারেট ধরিয়ে পর্দাটার দিকে তাকিয়ে সহজভাবে বললেন, আমাদের বন্ধুরা গতকাল এসে দেয়ালের বাইরে একটা টাইম-বম্ব বসিয়েছিল। ফিউজটা এমনভাবে ঠিক করেছিল যাতে ডেস্কে বসার সময় আমি মারা পড়ি। সৌভাগ্যবশত আমি তখন এক রুমানিয়ান তরুণীর সঙ্গে আরাম করি। মেয়েটার এখনো বিশ্বাস প্রেম করার বিনিময়ে লোকে তাকে গোপন খবর জানাবে। চরম মুহূর্তে বোমাটা ফাটে। আমি তাতে একটুও উত্তেজিত হইনি। কিন্তু মেয়েটা দারুণ ঘাবড়ে যায়। তাকে যখন ছেড়ে দিই, সে হিস্টিরিক হয়ে পড়ে। মনে হয় তার ধারণা আমার প্রেম করার ধরনটা প্রচণ্ড রকমের। তারপর ক্ষমা চাওয়ার সুরে বললেন, তোমার অভ্যর্থনার জন্য ঘরটাকে খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে মেরামত করতে হয়েছে। এই হঠাৎ শান্তিভঙ্গের কারণটা কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না। ইস্তাম্বুলে আমাদের সবাইকার মধ্যে খুব সদ্ভাব। আমার সহকর্মীদের হঠাৎ এভাবে যুদ্ধ ঘোষণার কথা আগে শোনা যায়নি। ব্যাপারটা খুবই উদ্বেগজনক। এতে ফ্যাসাদে পড়বে আমাদের রুশী বন্ধুরা। যে এ কাজ করেছে তার নামটা জানলে তাকে আমি ধমকাতে বাধ্য হব। ব্যাপারটার মাথামুণ্ড কিছু বুঝছি না। আশা করি আমাদের কেসের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই।

    কিন্তু আমার এই আসবার খবর সবাইকে জানানোর কি দরকার ছিল? মৃদু স্বরে বন্ড বলল। তোমাকে এ ব্যাপারের সঙ্গে মোটেই আমি জড়াতে চাই না। এয়ারপোর্টে রোলটা কেন পাঠিয়েছিলে? তাতে স্পষ্ট বোঝা যায় আমার সঙ্গে তুমিও আছ।

    হো-হো করে হেসে করিম বললেন, কতগুলো কথা তোমাকে বলি। সেগুলো তোমার জন্য দরকার। সব হোটেলেই আমাদের রুশীদের আর আমেরিকানদের ভাড়াটে লোক আছে। এখানকার গোয়েন্দা পুলিশের সদর দপ্তরের এক অফিসারকে আমরা সবাই ঘুষ দিই। প্লেনে, ট্রেনে বা জাহাজে প্রত্যহ যে সব বিদেশী এখানে পৌঁছাচ্ছে তাদের নামের লিস্ট একটা কার্বন কপি করে আমাদের সবাইকে সে পাঠায়। আর কয়েকটা দিন হাতে পেলে আমি তোমাকে গ্রীক সীমান্ত দিয়ে লুকিয়ে আনতে পারতাম। কিন্তু তাতে লাভ হত কি? তুমি যে এসেছ সেটা অন্যপক্ষের জানা দরকার; যাতে আমাদের বান্ধবী তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। তোমার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার শর্ত করিয়ে নিয়েছে। হয়ত আমাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থার ওপর তার বিশ্বাস নেই। তার মনের কথা কে বুঝবে? কিন্তু একটা ব্যাপারে মেয়েটি নিশ্চিত। আমাকে বলেছিল তুমি পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে তাদের দপ্তর খবরটা জানতে পারবে।–কথাটা আমি যেন জানি না। করিম তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, তাই মেয়েটির কাজ কঠিন করে তোলবার দরকার কি? আমি শুধু চাই তুমি যতদিন এখানে আছ ততদিন অন্তত যেন আরামে থাক।

    বন্ড হেসে বলল, ব্যাপারটা জানা ছিল না। জানলে প্রশ্ন করতাম না। এখানে আমি তোমার অধীনে, তোমার কথামত আমাকে চলতে হবে। যা বলবে তাই করব।

    করিম অন্য বিষয়ে কথা পাড়লেন। তোমার কথায় আসা যাক। তোমার হোটেলটা কেমন? প্যালেস হোটেল ঠিক করেছ জেনে আমি অবাক হয়েছিলাম। জায়গাটা ভারি নোংরা। তাছাড়া রুশীদের আড্ডা। অবশ্য তাতে কিছু আসে যায় না।

    হোটেলটা খুব একটা খারাপ নয়। ইস্তাম্বুল হিলটন কিংবা ঐ জাতের কোন শৌখিন হোটেলে থাকতে আমি চাইনি।

    টাকার দরকার। একটা ড্রয়ার খুলে করিম এক তাড়া নতুন নোট বার করলেন। এই নাও এক হাজার টার্কিশ পাউন্ড। এগুলোর আসল কালো বাজারী রেট এক পাউন্ডে কুড়ি। সরকারি রেট সাত। এগুলো শেষ হলে বলবে। যত চাও দেব। খেলাটা শেষ হলে হিসেবপত্র করা যাবে। আর কি দরকার? সিগারেট। শুধু এই সিগারেটগুলো খেয়ো। তোমার হোটেলে কয়েক শ প্যাকেট পাঠিয়ে দেব। কাজের কথা পাড়ার আগে আর কোন কথা আছে? তোমার খাবার। আর অবসর সময় কাটানোর চিন্তা কর না। এ দুটো ব্যাপারেই আমি দেখাশোনা করব। আর একটা কথা–কিছু মনে করো না–যতদিন এখানে আছ ততদিন আমি তোমার কাছাকাছি থাকব।

    বন্ড বলল, আর কিছু চাই না। একদিন শুধু লন্ডনে এস।

    দৃঢ়স্বরে করিম বললেন, কখনো না। সেখানকার আবহাওয়া আর মেয়েরা ভারি ঠাণ্ডা। যাকগে, তুমি এখানে এসেছ বলে আমি গর্বিত। লড়াইয়ের সময়কার কথা আমার মনে পড়ছে। ডেস্কের উপরকার ঘন্টা বাজিয়ে প্রশ্ন করল, কি রকম কফি পছন্দ কর–চিনি দেওয়া, না না-দেওয়া? কফি কিংবা রাকি না হলে তুরস্কে আমরা কাজের কথা বলতে পারি না। এখনো রাকির সময় হয়নি।

    চিনি না দেওয়া।

    বন্ডের পেছনের দরজাটা খুলল। করিম হুঙ্কার ছেড়ে অর্ডার দিলেন। করিম ডেস্কের ড্রয়ার থেকে একটা ফাইল বের করে বললেন, দোস্ত, এই কেসটা সম্বন্ধে কি বলব তোমাকে ভেবে পাচ্ছি না। আমাদের কাজটা ফিল্ম স্যুটিং-এর মত। বহুবার সবাইকে লোকেশনে নিয়ে ক্যামেরা চালাতে শুরু করার ঠিক আগে নানা বাধা। হয় খারাপ আবহাওয়া নয় অভিনেতার গণ্ডগোল, নয় অ্যাকসিডেন্ট। আর একটা জিনিস যেটা দুজন স্টারের প্রেমে পড়া। এই কেসে আমার কাছে সেটাই বেশি গোলমেলে ব্যাপার। কল্পনায় তোমার কথা ভেবে এই মেয়েটি কি সত্যই তোমার প্রেমে পড়েছে? তুমিও কি তাকে এমন ভালবাসতে পারবে যাতে সে তোমার সঙ্গে ইংল্যান্ডে পালাতে রাজি হবে?

    বন্ড কোন মন্তব্য করল না। দরজায় টোকা দিয়ে হেড ক্লার্ক সোনালি কাজ করা চীনেমাটির পেয়ালায় তাদের কফি দিয়ে গেল। এক চুমুক দিয়ে বন্ড দেখল সেটা ভাল কফি। এক ঢোকে নিজের পেয়ালা শেষ করে হোল্ডারে একটা সিগারেট ভরে করিম সেটা ধরালেন। তারপর তিনি বললেন, এই প্রেমের ব্যাপার নিয়ে আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। কিন্তু ইতিমধ্যে আরো নানা ঘটনা ঘটেছে।

    হঠাৎ তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ আর ধূর্ত হল, দোস্ত, আমাদের শত্রু শিবিরে নানান তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। সেখানে চলছে। নানা লোকের আসা যাওয়া। দারুন একটা ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছি। নিজের নাকে হাত বুলিয়ে, এই নাকটা আমার খুব ভাল বন্ধু। এটাকে আমি বিশ্বাস করি। বাজিটা যদি খুব চড়া দরের না হয় তা হলে বলব, দোস্ত দেশে ফিরে যাও। এখানকার আবহাওয়া এখন ভাল না, কেটে পড়াই ভাল।

    করিম তার উত্তেজনা কাটিয়ে হো-হো করে হাসলেন, কিন্তু আমরা বুড়ি মেয়ে মানুষ নই। এটা আমাদের ডিউটি। প্রথমতঃ এমন কি খবর দিতে পারি যেটা তুমি জান না? আমি খবর পাঠাবার পর থেকে মেয়েটির কোন হদিশ নেই। কিন্তু আমাদের দেখা হওয়া সে সম্বন্ধে হয়ত তোমার কিছু প্রশ্ন আছে।

    বন্ড বলল, আমার প্রশ্ন, মেয়েটির সম্বন্ধে তোমার কি ধারণা? তোমার কি বিশ্বাস হয় আমার সম্বন্ধে ওর কথাগুলো? আমার সম্বন্ধে তার খেপাটে ধরনের মোহজন্মে না থাকে তাহলে বুঝতে হবে সমস্ত ব্যাপারটাই বুজরুকি–MGB-র এমন একটা জটিল প্লট, যেটা আমরা বুঝতে পারছি না। এখন বল–মেয়েটির কথাগুলো কি বিশ্বাসযোগ্য?

    করিম বললেন, দোস্ত। এই প্রশ্নটা তো আমরাও। কিন্তু মেয়েদের মনের কথা কে বলতে পারে? তার চোখ দুটো জ্বলজ্বলে, ভারি সুন্দর নিষ্পাপ চোখ। তার স্বরের মধ্যে ছিল আকুলতা আর আতঙ্ক। স্টিমারের রেলিং খুব জোরে চেপে ধরায় আঙুলের গাঁটগুলো ফ্যাকাশে হয়েছিল। কিন্তু তার মনে কি ছিল? সে কথা সৃষ্টিকর্তাই জানেন। বন্ডের দিকে তাকিয়ে, কোন মেয়ে তোমাকে সত্যিই ভালবাসে কিনা সেটা অভিজ্ঞ না হলে কেউ বুঝতে পারবে না। দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বন্ড বলল, তা ঠিক। কি বলতে চাইছ বুঝেছি। সেটা একমাত্র জানা যায়–বিছানায়।

    .

    গুপ্তচরের পরিবেশ

    আবার কফি এল। তারা দু জন চুলচেরা আলোচনা করার সময় ঘরের মধ্যে সিগারেটের ধোঁয়া ঘন হল। এক ঘণ্টা আলোচনার পরও তারা কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারল না। এই মেয়েটির সমস্যা বন্ডকেই সমাধান করতে হবে। তার কথা বিশ্বাস হলে মেশিন সমেত মেয়েটিকে বের করতে হবে এদেশ থেকে।

    যাবতীয় ব্যবস্থার ভার নিলেন করিম। টেলিফোনে তিনি তার ট্রাভল এজেন্টকে আগামী সপ্তাহের জন্য দৈনিক সমস্ত প্লেনে দুটো করে সিট রিজার্ভ করে রাখতে বললেন–BEA, এয়ার ফ্রান্স, SAS এবং টার্কেয়ার-এ।

    এবার তোমার পাসপোর্টের ব্যবস্থা করতে হয়। একটা হলেই চলবে। মেয়েটি তোমার স্ত্রী হিসাবে যেতে পারবে। আমার একজন কর্মচারি তোমার ফটো তুলবে আর মেয়েটির ফটো অন্য কোনভাবে জোগাড় করবে। আসলে গার্বোর কোন পুরানো ছবি দিয়েই চলবে এদের দুজনের চেহারায় মিল আছে। ফাইল থেকে সেরকম একটা ছবি জোগাড় করা যাবে। কনসাল জেনারেলের সঙ্গে আমি কথা বলব। খাসা মানুষ। রোমাঞ্চকর স্পট তার ভারি পছন্দ। আজ সন্ধ্যের মধ্যেই পাসপোর্টটা রেডি হবে। কি নাম নিতে চাও?

    যে কোন একটা নাম বালাও না।

    সমারসেট। আমার মায়ের দেশ। তোমার নাম হবে ডেভিড সমারসেট। পেশা–কোম্পানি ডিরেক্টর। আর মেয়েটির নাম হবে ক্যারোলিন। ছিমছাম ইংরেজ দম্পতি। দেশ ভ্রমণের শখ। ফিনান্স কন্ট্রোল ফর্ম? সে দায়িত্ব আমার। তাতে লেখা থাকবে ট্রাভলার্স চেকে আশি পাউন্ড। আর ব্যাংকের একটা রসিদ–তাতে উল্লেখ থাকবে তুরস্কে থাকার সময় পঞ্চাশ পাউন্ড তুমি ভাঙিয়েছিলে। কাস্টমস? তারা কিছুই পরীক্ষা করে দেখে না। এ দেশে কেউ কিছু কিনলেই তারা খুশি। যদি খুব চটপট এদেশ ছাড়তে চাও তা হলে তোমার হোটেলের বিল আর মালপত্র আমার জিম্মায় দিও। প্যালেস হোটেলের লোকেরা আমাকে খুব ভালভালো চেনে। আর কিছু আছে?

    আর তো কিছু মনে পড়ছে না।

    করিম ঘড়ি দেখলেন, বারোটা, গাড়িতে হোটেলে ফেরার সময় হয়েছে। সেখানে তোমার কোন সংবাদ থাকতে পারে। তোমার জিনিসপত্রগুলো পরীক্ষা করে দেখ কেউ হাতড়েছে কিনা।

    ঘণ্টা বাজিয়ে করিম তার হেড ক্লার্ককে কি সব নির্দেশ দিলেন, তারপর বন্ডের সঙ্গে দরজার কাছে এগিয়ে এলেন। আবার সেই আন্তরিক করমর্দন। গাড়িটা তোমাকে লাঞ্চের জন্য নিয়ে আসবে। স্পাইস বাজারে ছোট্ট একটা জায়গা। তোমার সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে আমার ভাল লাগছে।

    করিমের হেডক্লার্ক বন্ডকে একটা সর্বাধুনিক ধরনের ডার্ক-রুম আর ল্যাবরেটরির মধ্যে নিয়ে এল। দশ মিনিট পরে বন্ড বেরিয়ে এল পথে। রোলসটা এগিয়ে এল।

    ক্রিস্টাল প্যালেসে এখন নতুন দ্বাররক্ষী। দু হাত প্রসারিত করে সে বলল, ক্ষমা করবেন, স্যার। আমার সহকর্মী আপনাকে একটা খুব বাজে ঘর দিয়েছে। সে জানত না আপনি করিম-বের বন্ধু। ১২ নম্বর ঘরে আপনার জিনিসপত্র রাখা হয়েছে। এ ঘরটা হোটেলের সবচেয়ে ভাল ঘর। এ ত্রুটির জন্য ক্ষমা করবেন, স্যার।

    বন্ড বলল, চল, এই নতুন ঘরটা দেখি। যে ঘরে ছিলাম সেটা তো বেশ ভালই।

    নিশ্চয়ই দেখবেন, মাথা নিচু করে সে বন্ডকে লিফটের কাছে নিয়ে এল। দ্বাররক্ষী দরজা খুলে সরে দাঁড়াল।

    বন্ডকে মানতেই হল ঘরটা খুবই ভাল। বড় বড় দুটো জানালা, ওপাশে একটা ঝুল বারান্দা। মেঝেতে চমৎকার বোখারো কার্পেট, ঝাড় লণ্ঠন ঝুলছে। বিরাট খাট। ঘরটা বন্ড নেবে বললে দ্বাররক্ষী সকৃতজ্ঞভাবে মাথা নিচু করে অভিবাদন জানিয়ে বেরিয়ে গেল।

    বন্ড ঘরটা খুটিয়ে দেখল। ঘরটা সে নেবে না কেন? সেখানে মাইক্রোফোন আর গুপ্ত দরজা রেখে কি লাভ?

    ছোট আলমারির ওপর তার স্যুটকেসটার তলায় কোন আঁচড়াবার দাগ নেই। হাতলটার ওপর সামান্য তুলোর রোয়া সে লাগিয়েছিল সেটাও ঠিক আছে। সুটকেস খুলে ছোট অ্যাটাচিকেসটা দেখে বুঝল কেউ সুটকেস ঘটেনি।

    এবার সে মুখ হাত ধুয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামল। তার কোন খবর আসেনি জানিয়ে দ্বাররক্ষী তাকে অভিবাদন জানিয়ে রোলস-এর দরজাটা খুলল। লোকটার চোখে কি যেন একটা ষড়যন্ত্রের আভাস। খেলা যে জাতেরই হোক না কেন খেলে যেতেই হবে। এই ঘর বদলে নিয়ে খেলাটা শুরু হয়েছে।

    গাড়ি ছুটছে আর বন্ড ভাবল ডার্কো করিমের কথা। স্টেশন T-র প্রধান হিসেবে মানুষটা কেমন যেন বেমানান। নিজের বিপুল প্রাণশক্তি তার কাছে অন্যদের টেনে আনে। সবার বন্ধু হয় সে। কোথা থেকে লোকটা এসেছে? গোয়েন্দা দপ্তরে কি করে ঢুকল?

    সরু গলিপথ দিয়ে সোফার তাকে নিয়ে এল পাথর বাঁধানো একটা সিঁড়ির সামনে। বলল, স্যার, বাঁ দিকের শেষের ঘরটায় করিম বে আছেন। তার নাম করলেই যে কেউ তার কাছে আপনাকে নিয়ে যাবে।

    ঠাণ্ডা সিঁড়ি ভেঙে বন্ড ছোট ঘরে পৌঁছল। ওয়েটার তাকে করিমের কাছে নিয়ে গেল। করিম দরাজ গলায় বন্ডকে স্বাগত জানালেন। তার হাতে বরফ কুচি দেওয়া সাদা তরল পদার্থে ভরা একটা গ্লাস।

    দোস্ত, এসে গেছ! এক্ষুনি এক গ্লাস রাকি খাও। ঘুরে বেড়িয়ে নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত হয়েছ।

    চেয়ারে আরাম করে বসার পর ওয়েটার বন্ডের হাতে ছোট একটা গ্লাস দিল। করিমের দিকে গ্লাসটা তুলে শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে বন্ডের গ্লাস ভরে দিল ওয়েটার।

    এবার লাঞ্চের অর্ডার দেওয়া যাক। তুরস্কে দুর্গন্ধ জলপাই তেলে রাধা জন্তু জানোয়ারের নাড়িভুড়ি ছাড়া লোকে আর কিছু খায় না। কিন্তু রান্না ভাল।

    মৃদু হেসে ওয়েটার কয়েকটা খাবারের নাম করল।

    করিম বললেন, ছোকরা বলছে আজকের কাবাবটা খুব ভাল হতে পারে, যদিও ওর কথা বিশ্বাস হচ্ছে না। সুগন্ধী চাল দিয়ে কাঠ কয়লার আঁচে রান্না কচি ভেড়ার মাংস। তার মধ্যে প্রচুর পেঁয়াজ কুচি আছে। নাকি তোমার অন্য কিছু-ঝাল ঝাল পোলাও পছন্দ? প্রথমে সার্ডিন দিয়ে শুরু করা যাক। ওয়েটারকে খেঁকিয়ে অর্ডার দিলেন করিম। বন্ডের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই হতভাগা লোকগুলোর সঙ্গে ঐভাবে কথা বলা দরকার। গণতন্ত্রের ভুয়া কথা শুনতে শুনতে এদের গলা কাঠ হয়ে গেছে। এরা চায় সুলতান আর লড়াই, নারী ধর্ষণ আর স্ফূর্তি। যাকগে, কোন খবর আছে?

    বন্ড মাথা নাড়াল।

    এক গ্লাস রাকি শেষ করে করিম বললেন, খেলাটা কোন জায়গা থেকে শুরু করা দরকার। আমি কয়েকটা চাল চেলেছি। লাঞ্চের পর শত্রু এলাকায় আমরা একটা ছোটখাটো হানা দেব। অবশ্যই আমাদের কেউ দেখতে পাবে না। মাটির তলা দিয়ে আমরা হানা দেব। এখন বল তুরস্ক তোমার কেমন লাগছে?

    কাঁটায় বিধিয়ে এক টুকরো মাংস খেয়ে তারপর আধ গ্লাস রাকি। একটা সিগারেট ধরিয়ে মৃদু হেসে বললেন, আলোচনায় অন্য কোন বিষয় নেই তাহলে নিজের কথায় আসি। নিশ্চয়ই ভাবছ, এই তাগড়া পাগলা লোকটা কি করে গোয়েন্দা দপ্তরে এল। সংক্ষেপে বলি, একঘেয়ে লাগলে বলবে।

    একটা ডিপ্লোমা সিগারেট ধরিয়ে বন্ড বলল, চমৎকার। শুরু করে দাও।

    করিম বলে চললেন, আমি ট্রেবিজোন্ডের লোক। আমাদের ছিল বিরাট সংসার, অনেক জন মা। আর বাবা ছিলেন বিখ্যাত জেলে। কৃষ্ণসাগরে তার খ্যাতি ছিল। তিনি ধরতেন তরোয়াল মাছ। এই মাছ ধরা শক্ত, এই মাছের সঙ্গে লড়াই করা কঠিন। মানুষটা ছিলেন লম্বা চওড়া, রোমান্টিক ধরনের। তাই যে কোন মেয়েকে চাইতেন, পেতেন। স্বভাবতঃই তার ছিল বহু সন্তান। আমরা এক বিরাট পোভড়া বাড়িতে থাকতাম যেটাতে আমাদের সৎ-মা ভর্তি। আসলে এই সৎ-সার দল ছিলেন একটা হারেম–বাবার বিয়ে করা না করা বৌ। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ইস্তাম্বুলের ইংরেজ গভর্নেস। একটা সার্কাস দেখতে গিয়ে বাবা তাকে দেখেন। দুজনেই দুজনকে পছন্দ করে। সেই সন্ধ্যেয় তাকে নিজের মাছ ধরার নৌকায় তুলে তিনি বসফোরাসে যান। ফেরেন ট্রেবিজোডে। বাবাকে ছাড়া সারা দুনিয়ার সব কথা নেই ইংরেজ গভর্নেস ভুলে যায়। লড়াই-এর ঠিক পরেই তিনি মারা যান। তখন তার বয়েস ষাট। আমার আগের যে সন্তান তার মা ছিলেন ইটালিয়ান। তার ছেলের নাম ছিল বিয়াঙ্কো, সে ছিল ফর্সা আর আমি ছিলাম কালো, তাই লোকে আমাকে ডার্কো বলে ডাকত। ছেলেবেলাটা আমরা পনেরজন ভাইবোন মিলে বেশ মজায় কাটাতাম। সম্মাদের মধ্যে প্রায়ই চুলোচুলি বাধত। জায়গাটা ছিল অনেকটা জিপসিদের শিবিরের মত। শিবিরের কর্তা ছিলেন আমরা বাবা। বেশি ঝামেলা বাধলে তিনি সবাইকে ঠেঙাতেন–ছেলেদেরও, সৎ মায়েদেরও। কিন্তু শান্তিতে থাকলে তার ব্যবহার খুব ভাল। এ ধরনের পরিবারের কথা বুঝতে পার?

    যেভাবে বর্ণনা করছ তাতে পারি।

    বাবার মতই লম্বা চওড়ায় আমি হই, শুধু তার চেয়ে বেশি শিক্ষিত। মা লেখাপড়া আর বাবা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা শিখিয়েছেন। কুড়ি বছর বয়সে আমার নিজের নৌকোয় রোজগার করতে শিখলাম। কিন্তু আমি ছিলাম বেপরোয়া। আমি বাড়ি ছেড়ে সমুদ্র তীরে দুটো ঘর নিয়ে থাকতাম। এমন সব জায়গায় বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা করতাম যাতে কেউ টের না পায়। হঠাৎ একবার বরাত খারাপ হল। আমি বান্ধবীদের মধ্যে এক বেসারবিয়ান মেয়ে–ভারি দজ্জাল, ইস্তাম্বুলের পাহাড়গুলোর পেছনে কতকগুলি জিপসির সঙ্গে মারপিট করে মেয়েটাকে জিতে নিই। তারা আমাকে ধাওয়া করে। মেয়েটিকে আমার নৌকায় তুলে নিই। আগে অবশ্য মাথায় বাড়ি দিয়ে তাকে অজ্ঞান করতে হয়।

    ট্রেবিজোন্ডে যখন ফিরি তখনো সে আমাকে খুন করার চেষ্টা করছিল। তাই আমার ডেরায় নিয়ে সমস্ত জামা-কাপড় খুলে একেবারে উলঙ্গ করে টেবিলের নিচে শেকল দিয়ে তাকে বেঁধে রাখি। যখন খেতাম টেবিলের নিচে খাবারের টুকরো ছুঁড়ে দিতাম কুকুরকে যেমন দেয়। তার শেখা দরকার মনিব কে। আমার মা একদিন হঠাৎ আমার ডেরায় হাজির। তিনি বলতে এসেছিলেন বাবা আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। মেয়েটাকে দেখে রেগে আগুন হয়ে আমাকে নানা গালাগালি দিলেন। বাড়ি থেকে নিজের কিছু জামা-কাপড় এনে মেয়েটাকে পরিয়ে দেন এবং বললেন মেয়েটাকে তার আত্মীয়দের কাছে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু যাবার সময় হলে মেয়েটা কিছুতেই যেতে চাইল না। হো-হো করে হেসে উঠলেন করিম।

    দোস্ত মেয়েদের অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব কে বুঝবে? মেয়েটাকে নিয়ে মা যখন ব্যস্ত আর জিপসি ভাষায় গালি শুনছিলেন– আমি তখন বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাই। মেয়েটার কথা আমার মা কখনো জানাননি। বাবার কাছে তখন আরেকজন লোক ছিলেন। লম্বা ও শান্ত চেহারার এক ইংরেজ। তার একটা চোখে কালো ঠুলি। রুশীদের সম্বন্ধে তারা আলোচনা করছিলেন। ট্রেবিজোন্ড থেকে মাত্র পঞ্চাশ মাইল দূরে, বাটুমে, তাদের বিরাট তেল কারখানা আর নৌঘাটিতে কি সব ব্যাপার চলছে। বললেন, খবরের জন্য ভাল টাকা দেবেন। ইংরেজি আর রুশী দুটো ভাষাই জানতাম। বাবা স্থির করেছিলেন সেই ইংরেজ ভদ্রলোকের হয়ে আমাকে কাজ করতে হবে। দোস্ত, সেই ইংরেজ ভদ্রলোকটির নাম মেজর ড্যানসে। আমার আগে এই স্টেশনের কর্তা ছিলেন তিনি। বাকিটা তুমি অনুমান করে নিতে পারবে।

    কিন্তু তোমার পেশাদার পালোয়ান হবার কি হল?

    করিম বললেন, সেটা শুধু লোককে ভাওতা দেবার ব্যাপার। সীমান্তের মধ্য দিয়ে ভ্রাম্যমান সার্কাস দলের তুর্কীদের শুধু যেতে দেওয়া হত। সার্কাস দেখে রুশীরা বাঁচতে পারে না। আমি শেকল ভাঙতুম। দড়ি কামড়ে দাঁত দিয়ে ভারি ভারি ওজন তুলতাম। রাশিয়ার গ্রামে গ্রামে পালোয়ানদের সঙ্গে কুস্তি লড়ে জিততাম। তারপর মদ খাবার সময় অনেক গল্পগুজব করতাম। আমি বোকার ভান করে থাকতাম আবার বোকার মত প্রশ্ন করতাম, তারা হাসত।

    লাঞ্চের দ্বিতীয় কোর্স এল, তার সঙ্গে এক বোতল মদ, সুস্বাদু কাবাব। করিম খেলেন ডিমের কুসুম দিয়ে মাখা লঙ্কা কুচি দেওয়া কাঁচা মাংস। সেটার এক চামচ বন্ডকে খাওয়ালেন। বন্ড জানাল সেটা ভারি সুস্বাদু।

    সাগ্রহে করিম বললেন, রোজ এটা তোমার খাওয়া উচিত। যারা প্রেমিক তাদের পক্ষে ভারি উপকারী। আর তোমার কতকগুলি বিশেষ ব্যায়াম করা দরকার। বাবার মতই আমিও প্রচুর নারীদেহ ভোগ করি। কিন্তু তিনি মদ খেতেন না, ধূমপান করতেন না–যেগুলো আমি বেশি করি। কিন্তু এই অভ্যেসগুলো ভাল নয়। তাতে রক্ত মাথায় চড়ে যায়। কিন্তু জীবনের ওপর আমার বড় লোভ। সব সময় সব কিছু আমি খুব বেশি করে থাকি। বাবার মত আমিও একদিন হার্টফেল করব। আমার কবরের ওপরকার স্মৃতিপাথরে হয়ত লেখা থাকবে–খুব বেশি রকম বেঁচে এই মানুষটা মরেছে।

    বন্ড হেসে বলল, খুব চটপট মরো না ডার্কো, M অসন্তুষ্ট হবেন। তোমার সম্বন্ধে তার উঁচু ধারণা।

    তাই নাকি? তাহলে এখন মরব না। খাওয়া যাক, জেমস। আমার ডিউটির কথা মনে করিয়ে ভাল হয়েছে। নষ্ট করার মত সময় নেই। প্রতিদিন দুপুর আড়াইটের সময় রুশীদের যুদ্ধমন্ত্রণা সভা বসে। আজ তুমি আর আমি হাজির থাকব।

    .

    ইঁদুরের সুড়ঙ্গ

    ঠাণ্ডা অফিস ঘরে ফিরে তারা কফির জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। করিম একটা দেওয়াল আলমারি খুলে ইঞ্জিনিয়ারদের নীল ওভারঅলের দুটো সেট বের করলেন। করিম ও বন্ড দুজনেই পোশাক বদলাল।

    কফির সঙ্গে একজোড়া জোরাল টর্চ এনে হেড ক্লার্ক টেবিলে রাখল। ক্লার্ক চলে গেলে করিম বললেন, ও আমার বড় ছেলে। সোফার আর দারোয়ান আমার খুড়ো। অফিসের সব কেরানিরাই আমার ছেলে। একই বংশের লোকেরা অফিসের নানা কাজে থাকাটা নিরাপত্তার দিকে ভাল। মশলার কারবারটা আমাদের একটা মুখোশ। M এটা আমাকে জুটিয়ে দেন। এখন তুরস্কে আমিই প্রধান মশলা ব্যবসাদার । M যে টাকা আমাকে ধার দেন অনেকদিন আগেই আমি তা শোধ করে দিয়েছি। এই ব্যবসায় আমার সন্তানেরা শেয়ার হোল্ডার। যখন কোন গুপ্তচরের কাজের জন্য দরকার হয় তখন সবচেয়ে উপযুক্ত ছেলেকে আমি বেছে নিই। তাদের সবাইকেই আমি তৈরি করে নিয়েছি। তারা আমার আর M-এর জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত। ছেলেদের বলেছি সৃষ্টিকর্তার ঠিক পরেই M-এর স্থান। এবার তুমি নিশ্চয়ই বুঝেছ যে তোমার ভার উপযুক্ত আর ভাল লোকের হাতে রয়েছে।

    সে কথা আমি জানি।

    একটা টর্চ বন্ডের হাতে দিয়ে করিম বললেন, এবার কাজ শুরু করা যাক।

    কাঁচ লাগানো বই-এর আলমারির পেছনে করিম হাত দিয়ে খুট করে একটা শব্দ করলেন। আলমারিটা বাঁ দিকে সরে একটা দরজা বেরিয়ে গেল। একপাশে চাপ দিতেই সেটা ভেতর থেকে খুলে গেল। অন্ধকার সুড়ঙ্গ আর পাথরের সিঁড়ি, আর সঁাৎসঁাত অস্পষ্ট একটা দুর্গন্ধ।

    করিম বললেন, আগে তুমি যাও। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে অপেক্ষা কর, আমি দরজাটা বন্ধ করে আসি।

    টর্চ জ্বালিয়ে বন্ড সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামল। টর্চের আলোয় বন্ড দেখল রাজমিস্ত্রীর সাম্প্রতিক কাজ আর কুড়ি ফুট নিচেকার চকচেক পানি। নিচে নেমে বন্ড দেখল এক প্রাচীন পাথরের সুড়ঙ্গের মাঝখানের নর্দমা ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। বন্ড অনুমান করল সেটা গোল্ডেন হর্নের নিচে বেরিয়েছে।

    বন্ডের আলোর বাইরে শোনা গেল চাপা খুটখুট শব্দ। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে অসংখ্য বিন্দুর মত লাল আলোর স্ফুলিঙ্গ। বন্ডের দু পাশে কুড়ি গজের মধ্যে হাজার হাজার ইঁদুর বন্ডের গন্ধ শুকছিল।

    হঠাৎ করিম তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, অনেকটা চড়াই পথ। যেতে পনের মিনিট লাগবে। আশা করি, জন্তু-জানোয়ার তুমি ভালবাস। সুড়ঙ্গের মধ্যে করিমের বিকট হাসির শব্দে ইঁদুরগুলো ছুটতে লাগল।

    খাড়া চড়াই পথ ধরে তারা উঠতে লাগল। ইঁদুর আর বাদুড়ের বোটকা গন্ধ। ছাদ থেকে বাদুড় ঝুলছে। তাদের মাথার সংস্পর্শে তারা কিচকিচ্ শব্দ করে চেঁচিয়ে উঠল। মাঝে মাঝে করিম টর্চ ফেলতে লাগলেন। আলো দেখে তারা ভয় পায়। তারা দুজনেই টর্চের আলো বন্দুকের গুলির মত পেছন দিকে ফেলতে লাগল। পনের মিনিটে তারা গন্তব্যস্থলে পৌঁছল–একটা চোরা কুঠরি। ছাদ থেকে ত্রিপল জড়ানো কি-একটা ঝুলছে।

    করিম বললেন, একদিন এই ইঁদুরগুলো মরতে শুরু করবে তখন ইস্তাম্বুলে আবার প্লেগ দেখা দেবে। এ সুড়ঙ্গটার

    কথা কর্তৃপক্ষ জানলে তারা পরিষ্কার করতেন। কিন্তু যতদিন রুশীরা এখানে আছে ততদিন জানাতে পারব না।

    ছাদের দিকে, তারপর নিজের ঘড়ির দিকে তাকালেন, আর পাঁচ মিনিট। এবার চেয়ার টেনে নিজেদের কাগজপত্র। পরীক্ষা করতে শুরু করবে ওরা। MGB-র তিনজন স্থায়ী প্রতিনিধি সেখানে থাকবে। তাদের মধ্যে হয়ত-বা একজন। GRU অর্থাৎ সামরিক গোয়েন্দা দফতরের একজন। হয়ত আরো তিনজন থাকবে। দিন পনের আগে একজন গ্রীস, অপরজন ফরাসি এসেছে। আর একজন এসেছে সোমবারে। মাঝে মাঝে তাতিয়ানা নামে মেয়েটা এখানে সাংকেতিক বার্তা নিয়ে আসে। তাকে দেখলে তুমি মুগ্ধ হবে।

    চোর কুঠরির ছাদ থেকে ঝুলন্ত ত্রিপলে ঢাকা সাবমেরিনের ঝকঝকে পেরিস্কোপের একটা অংশ করিম টেনে নামালেন।

    মৃদু হেসে বন্ড বলল, ডার্কো, এটা কোথা থেকে জোগাড় করলে?

    টার্কিশ নেভি। লড়াইয়ের বাড়তি মাল। লন্ডনের ব্রাঞ্চ এখন চেষ্টা করছে এটার সঙ্গে তার লাগিয়ে কথা শোনার জন্য। এটার ওপরের লেন্সটা সিগারেট-লাইটারের চেয়ে বড় নয়। তুললে এটা তাদের ঘরের মেঝে পর্যন্ত উঠে উঁকি মারে। ঘরের কোণে ওঠে এটা। সেখানে আমরা একটা ইঁদুরের গর্ত করেছি। একবার দেখতে গিয়ে নজরে পড়ে এক। টুকরো পনীর আটকানো বড়সড় ইঁদুর ধরার একটা কল। কিন্তু লেন্সটা পাশে শব্দ ধরার সূক্ষ্ম কোন যন্ত্র বসাবার জায়গা। নেই। পাবলিক ওয়ার্কস মিনিস্ট্রিতে আমার কয়েকজন বন্ধু আছে। তাদের সাহায্যে কয়েকদিনের জন্য রুশীদের সরিয়ে যন্ত্রটা আমি বসিয়েছিলাম। তাদের বলা হয়েছিল, পাহাড়টার ওপরে ওঠার সময় ট্রামগুলো নানা বাড়ির ভীকে বড় বেশি নাড়া দেয়। তাই একটা জরিপ করা দরকার। তার জন্য কয়েকশ পাউন্ড ঘুষ দিতে হয়। পাবলিক ওয়াকর্স -এর লোকেরা দু পাশের বাড়ি পরীক্ষা করে জানায়, জায়গাটা নিরাপদ। ততদিনে আমি নির্মাণের কাজ শেষ করে ফেলি। রুশীরা ফিরে এসে কোন মাইক্রোফোন বা বোমা লুকানো আছে কিনা খুঁজেছিল। ০ ব্রাঞ্চ নতুন কোন মতলব না করতে পারলে রুশীদের ওপর নজর রাখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারব না। হয়ত এমন কাউকে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করবে যার সম্বন্ধে আমরা কৌতূহলী।

    এই চোর কুঠরির ছাদে পেরিস্কোপের পাশে ফুটবলের দ্বিগুণ আকৃতির ধাতুনির্মিত গোলাকার একটা জিনিস ছিল। বন্ড বলল, ওটা কি?

    একটা বড় বোমার তলার অর্ধেক অংশ। আমার কোন বিপদ ঘটলে কিংবা রাশিয়ার সঙ্গে যদি লড়াই বাঁধে তাহলে অফিস থেকে রেডিও কন্ট্রোলে ঐ বোমাটা ফাটানো হবে। তাতে বহু নিরীহ লোক মারা পড়বে। কিন্তু রক্ত গরম হলে মানুষ প্রকৃতির মতই নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। পেরিস্কোপের হ্যাঁন্ডেলের পাশে চোখ লাগানোর আই পীস জোড়া পরিষ্কার করে করিম তাকিয়ে ইশারায় বন্ডকে ডেকে বললেন, ওখানে সেই ছ জনই রয়েছে।

    বন্ড সরে এসে হ্যান্ডেল ধরল।

    করিম বললেন, ওদের ভাল করে চিনে রাখ। টেবিলের শেষপ্রান্তে রেসিডেন্ট ডিরেক্টর। বাঁ দিকে তার দু জন। কর্মচারি। তাদের উল্টো দিকে তিনজন নবাগত। সবচেয়ে শেষে যে এসেছে সে ডিরেক্টরের ডানদিকে বসে। নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা ছাড়া আর কিছু করলে আমাকে বোলো।

    আই পীসের মধ্য দিয়ে প্রথমে বন্ডের নজরে পড়ল অনেকগুলো পা। তারপর সেই পায়ের মালিকদের মাথাগুলো। ডিরেক্টর আর দুজন সহকর্মীকে স্পষ্ট দেখা গেল–গম্ভীর রুশীমুখ।

    কিন্তু নবাগত তিনজন পিঠ ফিরিয়ে বসেছিল বলে তাদের দেখতে পেল না। সবচেয়ে যে কাছে ছিল তার চুলগুলো কদম ছাঁট, বয়সে সবচেয়ে ছোট। তার পাশের লোকের মাংসল মসৃণ কাঁধে একটা দগদগে ফোঁড়া। রেসিডেন্ট ডিরেক্টরের ডান পাশের নবাগত লোকটি কথা বলতে শুরু করল। ঘরের মধ্যে একজন সিগারেট টানছিল, বন্ডের মনে হল মস্কো থেকে তাকে পাঠানো হয়েছে। ক্লান্ত হয়ে বন্ড আই পীস থেকে সরে চোখ রগড়াতে লাগল।

    বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়িয়ে করিম বললেন, ওদের কথাগুলো হীরের মত দামী, যদি শুনতে পেতাম।

    বন্ড বলল, শুনতে পেলে অবশ্য বহু সমস্যার সমাধান হত। কিন্তু ডার্কো, এই সুড়ঙ্গটা কি করে আবিষ্কার করলে? কেনই-বা এটা বানানো হয়েছিল?

    করিম বললেন, হল অফ পিলার্সের এটা একটা লুপ্ত নালা। সেখানে এখন টুরিস্টরা শুধু যায়। সেটা আমাদের মাথার ওপরে সেন্ট সেফিয়ার কাছে। হাজার বছর আগে এই জলাশয় বানানো হয়েছিল, যাতে দশ লক্ষ গ্যালন পানি ধরে। চারশ বছর আগে গিলিয়াস নামে একজন আবার সেটা আবিষ্কার করে। একদিন আমি তার আবিষ্কারের কাহিনীটা পড়েছিলাম। সে বলেছিল, শীতকালে জলাশয়টা ভরা হত বিরাট একটা পাইপ দিয়ে। আমার ধারণা শহরটা শত্রুর কবলে পড়লে চটপট জলাশয়টা খালি করার জন্য নিশ্চয় আরেকটা বিরাট পাইপ কোথাও আছে। হল অফ পিলার্সে গিয়ে সেখানকার প্রহরীকে ঘুষ দিই, তারপর সারারাত ধরে আমরা এক ছেলের সঙ্গে রবারের নৌকায় থামগুলোর মধ্যে ঘুরে বেড়াই। দেওয়ালগুলোতে আমরা হাতুড়ি ঠুকে দেখি। এক জায়গায় ফাঁপা একটা শব্দ ভেসে আসে। পাবলিক ওয়ার্কসের মন্ত্রীকে আমি আরো ঘুষ দিই। পরিষ্কার করার জন্য এক সপ্তাহের জন্য জায়গাটা সে বন্ধ রাখে।

    আমার দলবল কাজ শুরু করে দেয়। পানির ওপরে সেই ফাপা দেয়ালটা খুঁড়ে আমরা একটা খিলানের ওপর পৌঁছাই। সেই খিলানটা ছিল একটা সুড়ঙ্গের মুখ। সেই সুড়ঙ্গে ঢুকে আমরা নিচের দিকে নেমে যাই। সুড়ঙ্গটা সোজা চলে গিয়েছিল পাহাড়ের নিচে স্ট্রিট অফ বু -এর তলায়, যেখানে রুশীরা থাকে। তারপর বেরিয়েছিল গালাটা ব্রিজের পাশে, গোল্ডেন হর্নে জায়গাটা আমাদের গুদামের কয়েক গজ দূরে। তাই হল অফ পিলার্সে গর্তটা বুজিয়ে আমার দিক দিয়ে খুঁড়তে শুরু করি। রুশীদের অফিসের নিচে পৌঁছতে আমাদের প্রচুর জরিপের কাজ করতে হয়। এক বছর সময় লাগে। করিম হেসে বললেন, হয়ত কিছুদিনের মধ্যে রুশীরা তাদের অফিস বদলাবে। আশা করি, তখন T-র প্রধান অন্য কেউ হবে।

    রবারের আই পীসে করিম চোখ রাখলেন। তারপর উত্তেজিত হয়ে বললেন, দরজা খুলছে। শিগ্‌গির এস, এখানে চোখ রাখ। মেয়েটি আসছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদ্য পিরামিড – ইসমাঈল কাদরী
    Next Article অদ্বৈতপ্রকাশ – ঈশান নাগর
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.