Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    টারজান রচনা সমগ্র – এডগার রাইস বারুজ

    এডগার রাইস বারুজ এক পাতা গল্প1300 Mins Read0

    বাঁদরদলের রাজা টারজান (টারজান অফ দি এপস)

    বাঁদরদলের রাজা টারজান (টারজান অফ দি এপস)

    উপনিবেশসংক্রান্ত সরকারি নথিপত্র ও এক মৃত লোকের ডায়েরী থেকে আমরা জানতে পারি যে লর্ড গ্রেস্টোক বা জন ক্লেটন নামে জনৈক ইংরেজ সামন্তকে একবার আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলবর্তী এক ব্রিটিশ অধিকৃত অঞ্চলে এক জটিল অনুসন্ধান কার্যের জন্য পাঠানো হয়।

    আফ্রিকার ইংরেজ বাসিন্দারা প্রায়ই বলাবলি করত সেই ইউরোপীয় জাতির লোকেরা ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে সেখানকার আদিম অধিবাসীদের ধরে নিয়ে গিয়ে ক্রীতদাস করে রাখে।

    এই অত্যাচার বন্ধ করার জন্যই ব্রিটিশ উপনিবেশ দপ্তর ব্রিটিশ-অধিকৃত পশ্চিম আফ্রিকার এক নতুন পদ সৃষ্টি করে সেই পদে জন ক্লেটনকে নিযুক্ত করে। তবে তাকে গোপনে এই নির্দেশ দেওয়া হয় যে সে যেন কোন এক ইউরোপীয় মিত্রশক্তি পশ্চিম আফ্রিকার কৃষ্ণকায় ব্রিটিশ প্রজাদের উপর যে অত্যাচার করছে তার এক পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে।

    নিয়োগপত্র পেয়েই একই সঙ্গে আনন্দিত আর দুঃখে অভিভূত হয়ে উঠল ক্লেটন। কিন্তু অন্য দিকে এ কাজের কথা ভেবে ভয় পেয়ে গেল সে, কারণ মাত্র তিন মাস হলো সে সুন্দরী তরুণী এ্যালিস রাদার ফোর্ডকে বিয়ে করেছে। এই সুন্দরী তরুণী স্ত্রীকে আফ্রিকার নির্জন প্রদেশে নিয়ে যেতে হবে ভেবে সত্যিই ভয় পেয়ে গেল সে।

    এ্যালিসের খাতিরে সে একাজের দায়িত্বভার প্রত্যাখ্যান করে নিয়োগপত্র বাতিল করে দিতে পারত। কিন্তু এ্যালিসই জেদ ধরল, একাজের ভার নিয়ে তাকে বিদেশে যেতেই হবে এবং তাকেও তার সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।

    ১৮৮৮ সালের মে মাসের কোন এক উজ্জ্বল সকালে জন ক্লেটন বা লর্ড গ্রেস্টোক লেডী এ্যালিসকে সঙ্গে নিয়ে ডোভার থেকে আফ্রিকার পথে রওনা হয়।

    এক মাস পর তারা পৌঁছল ফ্রীটাউনে। সেখানে তারা ফুবালদা নামে জাহাজে চাপে। এই জাহাজই তাদের নিয়ে যাবে তাদের গন্তব্যস্থানে। কিন্তু গন্তব্যস্থানে পৌঁছবার আগেই তাদের যাত্রাপথে এই জাহাজ থেকে লর্ড গ্রেস্টোক ও লেডী এ্যালিস কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায় চিরদিনের মত তা পৃথিবীর কেউ কোনদিন জানতে পারেনি।

    ফ্রীটাউন থেকে ক্লেটনরা যাত্রা করার ছ’মাস পর তাদের সেই ছোট্ট জাহাজটার খোঁজে ছ’টা ব্রিটিশ যুদ্ধ জাহাজ দক্ষিণ আতলান্তিকের সমগ্র অঞ্চলটা চষে বেড়ায়। কিন্তু অনুসন্ধানকার্য শুরু করার কিছু পরেই সেন্ট হেলেনা দ্বীপের উপকূলে একটা জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। ফলে সেখানেই অনুসন্ধানের ব্যাপারটার সমাপ্তি ঘটে। ধরে নেয়া হল ফুবালদা নামে সেই ছোট্ট জাহাজটা তার সমস্ত যাত্রী ও নাবিকসহ ঢেউ-এর আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ডুবে যায় সমুদ্রগর্ভে।

    ওদিকে ফুবালদা জাহাজের বিদ্রোহী নাবিকরা জাহাজের অফিসারদের সব মেরে ফেলার পর তারা পথে জঙ্গলাকীর্ণ একটা ভূ-খণ্ডে নামিয়ে দিয়ে যায় ক্লেটন আর তার স্ত্রীকে।

    ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বিপদ আর তার মাঝে তাদের অসহায়তার কথা ভেবে ভয়ে শিউরে উঠল ক্লেটন। তবু ঐ বিশাল বনভূমির অন্ধকার গভীরে যে দুর্ভাগ্য তাদের জন্য প্রতীক্ষা করে আছে ঈশ্বরের অনুগ্রহে তা সে দেখতে পেল না ঠিকমত। ফলে ভাগ্যের উপর আত্মসমর্পণ করে চুপ করে রইল।

    পরদিন সকালে জাহাজ থেকে একটা ছোট নৌকায় ক্লেটনদের সব মালপত্র নামিয়ে দেওয়া হলো। মাইকেল নিজে তদারক করতে লাগল, ক্লেটনদের কোন জিনিস যেন জাহাজে না থাকে।

    উপকূলে ওদের নামিয়ে দিয়ে নদী থেকে বেশ কিছু পানীয় জল ভরে নিয়ে নৌকা নিয়ে আবার জাহাজে ফিরে এল।

    মাইকেলদের নৌকাগুলো যখন উপসাগরের শান্ত জলের উপর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ফুবালদার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তাদের পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ক্লেটন আর তার স্ত্রী। আসন্ন বিপদ আর নিবিড় হতাশার অনুভূতিতে তোলপাড় হতে লাগল তাদের বুক দুটো। দেখতে দেখতে ফুবালদার জাহাজটাও যখন ধীরে ধীরে চোখের আড়াল হয়ে দূর দিগন্তে মিলিয়ে গেল তখন এ্যালিস ক্লেটনের গলাটা দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। অবরুদ্ধ আবেগ আর চেপে রাখতে পারল না বুকের মধ্যে।

    অবশেষে সে তার স্বামীকে বলল, ও জন, কী ভয়ঙ্কর কথা! এখন আমরা কি করব?

    কাজ। এখন আমাদের একমাত্র উচিত কাজ করা, এখন কাজই আমাদের মুক্তির একমাত্র উপায়। বেশি চিন্তা করলে আবার পাগল হয়ে যেতে হবে।

    ক্লেটনের প্রথম চিন্তা হলো রাত কাটাবার মত এমন একটা আশ্রয় বা আস্তানা গড়ে তুলতে হবে যেটা হবে বন্য জন্তুর নাগালের বাইরে।

    যাই হোক, বাক্স খুলে আগে রাইফেল দুটো ও কিছু গুলি বার করল ক্লেটন যাতে আকস্মিক কোন আক্রমণ হতে আত্মরক্ষা করতে পারে তারা। তারপর দুজনে মিলে রাত্রির আস্তানা গড়ে তোলার জন্য জায়গা দেখতে লাগল।

    সমুদ্রের বেলাভূমি থেকে একশো গজ দূরে একটুখানি ফাঁকা জায়গা দেখতে পেল ওরা। ওরা ঠিক করল ঐখানে একটা ঘর তৈরি করবে স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য। কিন্তু তার আগে রাত্রিবাসের জন্য একটা আশ্রয় চাই।

    গাছের উপর একটা মাচা তৈরি করার জন্য চারটে বড় গাছ বেছে নিল ক্লেটন। মাটি থেকে দশ ফুট উঁচুতে চারটে গাছের উপর আয়তক্ষেত্রাকার এমন একটা মাচা তৈরি করল সে যেটাকে লাফ দিয়েও ধরতে পারবে না কোন জন্তু।

    কুড়াল দিয়ে গাছের ডাল কেটে আর জাহাজ থেকে আনা মোটা দড়ি দিয়ে মাচা তৈরির কাজ তখনি শুরু করে দিল ক্লেটন। চারটে মোটা ডালের ঘেরা দিয়ে ছোট ছোট ডাল দিয়ে পাটাতন তৈরি করল মাচার উপর। সেই পাটাতনের উপর ঢালা ঢালা অনেক পাতা বিছিয়ে দিয়ে বিছানার মত নরম করল। মাথার উপরেও অনুরূপভাবে একটা ছাউনি তৈরি করল ক্লেটন। তারপর পালের মোটা কাপড় দিয়ে মাচাটার চারদিকে ঘিরে দিল। সবশেষে এ্যালিসের ওঠা-নামার জন্য একটা মই তৈরি করল।

    সন্ধ্যা হবার কিছু আগেই ওদের কম্বল ও বিছানা আর কিছু হালকা জিনিসপত্র মাচার উপর তুলে ফেলল ক্লেটন। তারপর দুজনে উঠে পড়ল মাচার উপর।

    সারাদিনের মধ্যে ওরা শুধু নানা জাতের অসংখ্য পাখি ছাড়া আর কোন বড় জন্তু জানোয়ার দেখতে পায়নি। পাখি ছাড়া কিছু বাঁদর দেখেছে। পাখি আর বাঁদরের কিচিমিচি ছাড়া আর কোন জন্তুর ডাক শুনতে পায়নি।

    ওরা মাচার উপর বিছানা পেতে বসল। তখন গরম ছিল বলে ক্লেটন পাশের কাপড়গুলো ছাদের উপর তুলে দিল। তখন অন্ধকর ঘনিয়ে আসছিল।

    সহসা ক্লেটনের একটা হাত জড়িয়ে ধরে এ্যালিস বলল, দেখ দেখ ওটা কি মানুষ?

    অন্ধকারে ভাল দেখা না গেলেও ক্লেটন দেখল সমুদ্রের ধারে উঁচু জায়গাটার উপর বিরাটকায় একটা মানুষের মূর্তি দাঁড়িয়ে যেন কি শুনছে তাদের পানে তাকিয়ে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর পিছন ফিরে চলে গেল মূর্তিটা।

    ক্লেটন গম্ভীরভাবে বলল, অন্ধাকারে ঠিক বুঝতে পারছি না।

    এ্যালিস বলল, না জন, ওটা মানুষ নয়, কিম্ভুতকিমাকার এক জন্তু। আমার কিন্তু ভয় পাচ্ছে।

    এ্যালিসের কানে কানে অনেক সাহস আর ভালবাসার কথা বলে তাকে শান্ত করল ক্লেটন। তারপর দু’জনে শুয়ে পড়ল।

    যাই হোক, তার হাতের কাছে একটা রাইফেল আর একটা রিভলভার রেখে দিল ক্লেটন।

    ঘুমে তাদের চোখ দুটো সবেমাত্র জড়িয়ে এসেছে এমন সময় একটা বিরাট সিংহের ডাক শুনতে পেল ওরা। সিংহটা ক্রমশই এগিয়ে এসে ওদের মাচার তলায় দাঁড়িয়ে গাছের উপর আঁচড় কাটতে লাগল। একঘণ্টা ধরে সিংহটা সেখানে থাকার পর চলে গেল। ক্ষীণ চাঁদের আলোয় ক্লেটন দেখল একটা বিরাট জন্তু ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে।

    সেরাতে ভাল ঘুম হল না ওদের।

    সকাল হতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ওরা। রাতটা নিরাপদে কাটিয়ে ওরা বেশকিছুটা স্বস্তি অনুভব করল।

    কোনরকমে প্রাতরাশটা সেরে নিয়েই ঘর তৈরির কাজে মন দিল ক্লেটন।

    কাজটা খুবই কঠিন এবং এ কাজ শেষ করতে কিছু কম একটা গোটা মাসই লেগে গেল। এক মাসের চেষ্টায় মাত্র একটা ছোট ঘর তৈরি করল ক্লেটন। মোটা মোটা কাঠের গোটাকতক খুঁটি দিয়ে ঘরটাকে দাঁড় করিয়ে সরু কাঠের ছিটে-বেড়া দিয়ে দিল। তার উপর কাদা-মাটি লাগিয়ে দিল পুরু করে। ঘরের এক পাশে ঘাট থেকে কতকগুলো নুড়ি পাথর এনে উনোন তৈরি করল একটা। সরু সরু শক্ত কাঠ দিয়ে ঘরটার মধ্যে একটামাত্র জানালা করল। ক্লেটন যাতে কোন জন্তু চাপ দিলেও তা ভেঙ্গে না যায়। কাঠের। ফাঁক দিয়ে হাওয়া বইবে, আলো আসবে, অথচ তাদের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ হবে না কোনভাবে।

    কেবিনটা দেখতে হলে ঠিক ইংরাজি ‘এ’ অক্ষরের মত। ঘরের ছাদটা লম্বা লম্বা বুনো ঘাস আর। তালপাতা দিয়ে ছাইয়ে দিয়ে উপরে আবার কাদামাটি দিয়ে লেপে দিল। প্যাকিং বাক্সের কাঠগুলোকে একটার পর একটা রেখে পেরেক পিটিয়ে দুটো দরজার কপাট তৈরি করল ক্লেটন। দরজাটা এমন ভারী আর মজবুত হলো যে সে একা সেটা তুলে বসাতে পারছিল না। ঘরের ছাদটা তৈরি হয়ে যেতেই বাক্স পেটরা চেয়ার টেবিল সব ঘরের মধ্যে গুছিয়ে রাখল ওরা।

    দ্বিতীয় মাসের শেষের দিকে স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধল ওরা ওদের নতুন কেবিনটায়। বন্য জন্তুদের আক্রমণের ক্রমাগত আশঙ্কা আর ভয়ঙ্কর অন্তহীন নির্জনতা ছাড়া ওদের মনোকষ্টের আর কোন কারণ ছিল না।

    এমন কি ওদের চারপাশে সারাদিন ধরে যেসব পাখি আর বাঁদর দেখত তারা, ওদের সঙ্গে যেন পরিচিত হয়ে উঠছিল। ওদের কাছে আসতে আর ভয় পেত না তারা।

    সেদিন বিকেলবেলায় ক্লেটন তাদের কেবিনটার পাশে আর একটা ঘর তৈরি করার জন্য কাজ করছিল। তার ইচ্ছা ছিল পাশাপাশি আরও কয়েকটা ঘর সে তৈরি করবে। হঠাৎ এক ঝাঁক পাখি আর বাঁদর উঁচু ঢিবিটা থেকে ছুটে এসে ক্লেটনদের চারপাশে ভিড় করে কিচমিচ করতে লাগল জোরে।

    ওদের চেঁচামেচিতে মুখ তুলে তাকাল ক্লেটন। এতক্ষণে যাকে ছোট ছোট বাঁদরগুলো সবচেয়ে বেশি ভয় করে সেই বিরাটকায় মানবাকৃতি জীবটাকে স্বচক্ষে ভাল করে দেখল ক্লেটন। দেখল সেটা ডালপালা ভেঙ্গে গর্জন করতে করতে তার দিকেই এগিয়ে আসছে।

    ক্লেটন তখন তার কেবিন থেকে একটু দূরে একটা গাছ কাটছিল। প্রায় দু’মাস যাবৎ এখানে আসার পর থেকে কোন বিপদের মুখে না পড়ায় আত্মরক্ষার সম্বন্ধে ক্রমশই উদাসীন হয়ে উঠেছিল ক্লেটন। তার রাইফেল ও রিভলবার সব কেবিনের ভিতরে রেখে গিয়েছিল। তাই যখন দেখল জানোয়ারটা এমনভাবে দ্রুত তার দিকে আসছে যে ছুটে গিয়ে কেবিন থেকে অস্ত্র আনা সম্ভব হবে না তখন চরম ভয়ের একটা শিহরণ খেলে গেল ওর সর্বাঙ্গে।

    ক্লেটন দেখল তার হাতে একটা কুড়াল ছাড়া আর কোন অস্ত্র নেই এবং সামান্য এই অস্ত্র দিয়ে রাক্ষসের মত এই বিরাট জন্তুটার সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব নয়।

    তবু একবার চেষ্টা করে দেখল ক্লেটন। সে উধ্বশ্বাসে কেবিনের দিকে ছুটতে লাগল। চীৎকার করে এ্যালিসকে সাবধান করে দিল।

    কেবিন থেকে একটু দূরে তখন বসেছিল এ্যালিস। ক্লেটনের চীৎকারে সে মুখ ফিরিয়ে দেখল। বনমানুষের মত একটা বিরাট জন্তু তার স্বামীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য এগিয়ে আসছে জোর গতিতে। তা দেখে সঙ্গে সঙ্গে কেবিনের মধ্যে ছুটে গিয়ে ঢুকে গেল সে। যাবার সময় পিছন ফিরে তাকিয়ে একবার দেখল তার স্বামী তার হাতের কুড়ালটা দিয়ে সেই ভয়ঙ্কর বিরাটকায় জন্তুটার সঙ্গে লড়াই করছে।

    ক্লেটন একবার চীৎকার করে বলল, কেবিনের দরজাটা বন্ধ করে ভিতের থাক এ্যালিস। আমি এই কুড়াল দিয়েই একে শেষ করে ফেলব।

    সেই বিরাট পুরুষ বাঁদর-গোরিলাটার ওজন হবে প্রায় তিনশো পাউন্ড। তার চোখগুলো ঘৃণায় ও হিংসায় জ্বলছিল। তার বড় বড় দাঁতগুলো বার করে হাঁ করে গর্জন করছিল ক্লেটনের সামনে।

    ক্লেটন দেখল সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে তার কেবিনটা মাত্র কুড়ি পা দূরে। সে যখন দেখল কেবিন থেকে তার স্ত্রী হাতে একটা রাইফেল নিয়ে বেরিয়ে আসছে তখন এক ভয়ের শিহরণ খেলে গেল তার সর্বাঙ্গে।

    সাধারণত আগ্নেয়াস্ত্রকে ভয় করে চলত এবং কখনো খুঁত না যেন। কিন্তু আজ সে স্বামীকে বিপদাপন্ন। দেখে শাবকবৎসলা এক সিংহীর মত নির্ভীকতার সঙ্গে ছুটে এল বাঁদর-গোরিলার দিকে।

    ক্লেটন চীৎকার করে উঠল, ফিরে যাও এ্যালিস। ঈশ্বরের নামে বলছি।

    কিন্তু এ্যালিস গেল না। বাঁদরটা এবার ক্লেটনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ক্লেটনও তার কুড়ালটা দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঘোরাতে লাগল তার চারদিকে। কিন্তু জন্তুটা তার বলিস্ট বিরাট হাত দুটো দিয়ে কুড়ালটা ধরে ক্লেটনের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ফেলে দিল সেটা একধারে।

    এবার এক বিকট চীৎকার করে বাঁদরটা যেমনি ক্লেটনের গলাটা দু’হাত দিয়ে ধরতে গেল অমনি এ্যালিসের রাইফেল থেকে বেরিয়ে আসা একটা গুলি বাঁদর-গোরিলাটার পিঠটাকে বিদ্ধ করল।

    সঙ্গে সঙ্গে ক্লেটনকে ছেড়ে দিয়ে জন্তুটা তার নতুন শত্রু এ্যালিসের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু রাইফেলটাতে আর গুলি না থাকায় চেষ্টা করেও আর গুলি করতে পারল না সে। জন্তুটা এবার হাত বাড়িয়ে ধরতেই তার সামনে মূর্হিত হয়ে পড়ে গেল এ্যালিস। সঙ্গে সঙ্গে জন্তুটাও তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

    ক্লেটন তখন তার স্ত্রীর অচেতন দেহটা থেকে সরিয়ে দেবার জন্য জন্তুটাকে পিছন থেকে টানতে লাগল।

    একটু টানতেই জন্তুটা টলতে টলতে পড়ে গেল। তার পিঠে লাগা বুলেটের ক্রিয়াটা সম্পূর্ণ হলো এতক্ষণে।

    ক্লেটন তার স্ত্রীর দেহটা তাড়াতাড়ি পরীক্ষা করে দেখল দেহের উপর কোন ক্ষতচিহ্ন নেই। সে বুঝল জানোয়ারটা এ্যালিসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায়।

    ধীরে ধীরে এ্যালিসের অচেতন দেহটা তুলে ধরল ক্লেটন। কেবিনের মধ্যে নিয়ে গেল। কিন্তু পুরো দু’ঘণ্টার আগে জ্ঞান ফিরল না এ্যালিসের।

    কিন্তু জ্ঞান হওয়ার পর এ্যালিস প্রথমে যা বলল তা শুনে ভয় পেয়ে গেল ক্লেটন। জ্ঞান ফিরে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ্যালিস কেবিনটার চারদিকে তাকাল পরম বিস্ময়ের সঙ্গে। তারপর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ও জন, সত্যি সত্যি ঘরে থাকাটা কত আরামদায়ক! আমি একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখেছি।

    ক্লেটন তার স্ত্রীর কপালে হাত বুলিয়ে বলল, ঠিক আছে। ঘুমিয়ে পড়। দুঃস্বপ্ন নিয়ে মাথা ঘামিও না।

    সেই রাত্রিতেই একটি পুত্র সন্তান প্রসব করল এ্যালিস। সেই আদিম জঙ্গলের মাঝে ছোট কেবিনটাতে শিশুটির জন্ম হলো যখন তখন দরজার বাইরে একটা চিতাবাঘ ডাকছিল এবং উপকূলবর্তী সেই ঢিবিটার উপর হতে একটা সিংহের গর্জন ভেসে আসছিল।

    তার শিশু সন্তানের জন্মের পর পুরো একটা বছর বেঁচে ছিল লেডী গ্রেস্টোক, কিন্তু সেই বাঁদর গোরিলার আকস্মিক আক্রমণ থেকে যে আঘাত সে পেয়েছিল সেই আঘাতের প্রকোপটা জীবনে কোনদিন সামলে উঠতে পারেনি। তবে যতদিন বেঁচেছিল ততদিন সে সেই কেবিনটার বাইরে একটিবারের জন্যও বার হয়নি অথবা একথা সে কোনদিন বুঝতে পারেনি। যে সে আর ইংল্যান্ডে নেই।

    তাদের শিশুটির জন্মের এক বছর গত হতেই কোন এক রাতে নীরবে পৃথিবী থেকে চিরদিনের মত চলে গেল লেডী এ্যালিস। তার মৃত্যুটা ঘটে এমনই নীরবে ও নিঃশব্দে যে ক্লেটন বুঝতেই পারেনি প্রথমে।

    বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই ক্লেটনের দুঃখটা এক অন্তহীন বিশালতায় প্রকট হয়ে উঠল তার সামনে। তার দুগ্ধপোষ্য শিশুসন্তানটির সমস্ত দায়িত্ব কিভাবে পালন করবে সে কথা ভাবতে গিয়ে কোন কূল কিনারা খুঁজে পেল না।

    এ্যালিসের মৃত্যু ঘটে যে রাতে তার পরদিন সকালে শেষবারের মত ডায়েরী লেখে ক্লেটন। এক অন্তহীন দুঃখ আর হতাশায় সকরুণ হয়ে ওঠে তার প্রতিটি কথা।

    বিছানার পাশে একটা চেয়ারে বসে এই কথাগুলো ডায়েরীতে লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে হাত দুটো টান করে বিছানার উপর ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল ক্লেটন। তার হাত থেকে কলমটা পড়ে যায়। স্ত্রীর মৃতদেহটা তখনও পড়েছিল বিছানায়।

    উপকূলভাগ হতে এক মাইল দূরে অরণ্যের মধ্যে বাঁদর-গোরিলাদের প্রধান কার্চাক সেদিন রাগের মাথায় এক তাণ্ডব শুরু করে দিয়েছিল তার দলের মধ্যে।

    কালা নামে একটা মেয়ে বাঁদর-গোরিলা তার একটা কোলের বাচ্চাকে নিয়ে আহারের সন্ধানে দূরে গিয়েছিল। কার্চাকের তাণ্ডবলীলার কথা জানত না সে। হঠাৎ একসঙ্গে অনেকগুলো বাদরের চীকারে হুঁশ হলো তার। বুঝল কাৰ্চাক নিশ্চয় পাগল হয়ে গেছে এবং এই মুহূর্তে সেখানে গিয়ে পড়লে তার জীবন। বিপন্ন হবে।

    নিরাপত্তার খোঁজে কালা এগাছ ওগাছ করতে লাগল। কাৰ্চাক এক সময় তাকে ধরতে গিয়ে তার এত কাছে চলে এল যে কালা একটা উঁচু গাছের মাথা থেকে লাফ দিল জোরে। কালা অন্য একটা গাছের ডাল ধরল। কিন্তু তার কোলের বাচ্চাটা তিরিশ ফুট নিচে পড়ে গেল। কালা তখন একটা আর্তনাদ করে কার্চাকের সব ভয় ভুলে গিয়ে তার বাচ্চাটার কাছে গিয়ে তাকে মাটি থেকে তুলে নিল। কিন্তু তার আগেই তার প্রাণটা বেরিয়ে গেছে তার দেহ থেকে।

    দলের বাঁদর-গোরিলাগুলো যখন দেখল কাৰ্চাক শান্ত হয়ে উঠেছে তখন তারা নিরাপদ আশ্রয় থেকে বেরিয়ে এসে আপন আপন কাজে মন দিল।

    এইভাবে ঘণ্টাখানেক কেটে যাওয়ার পর তার দলের সব বাঁদরদের এক জায়গায় ডেকে তাকে অনুসরণ করতে বলল কাৰ্চাক।

    প্রথমেই তারা ফাঁকা মাঠের উপর দিয়ে কিছুক্ষণ গেল। তারপর হাতিচলা বনপথের মধ্য দিয়ে যেতে লাগল। এরপর গাছগুলোর ডাল ধরে ধরে খুব দ্রুত এগিয়ে চলল তারা। কালাও তার মরা বাচ্চাটা আঁকড়ে ধরে এগিয়ে চলতে লাগল তাদের সঙ্গে।

    দুপুরের কিছু পরে সমুদ্রের বেলাভূমির কাছে পৌঁছল যেখানে সেই ঢিবিটার পাশে কেবিনটা ছিল, এই কেবিনটাই ছিল কাৰ্চাকের লক্ষ্য।

    আসলে কার্চাকের লক্ষ্য ছিল দুটো। কার্চাকের প্রথম লক্ষ্য হলো কালো বাটওয়ালা সেই রাইফেলটা যার মুখ থেকে বেরোন গুলি থেকে অনেক বাঁদর-গোরিলার মৃত্যু হয়েছে।

    সম্প্রতি আর এদিকে আসত না কাৰ্চাক। কারণ যখনি তার দলবল নিয়ে কেবিনটার দিকে এগিয়ে যেত অথবা আক্রমণ করার চেষ্টা করত তখনি সেই কালো বাটওয়ালা বস্তুটা গর্জন করে উঠে তাদের দলের কারো না কারো মৃত্যু ঘটাত।

    আজ কিন্তু সেই সাদা লোকটার কোন পাত্তা নেই। কাৰ্চাক দূর থেকে দেখল কেবিনের দরজাটা খোলা রয়েছে। কোনরূপ চেঁচামেচি বা তর্জন গর্জন করল না। কালো লাঠির মত সেই ভয়ঙ্কর বস্তুটার ভয়ে নিঃশব্দ পদক্ষেপে এগিয়ে আসতে লাগল।

    সবার আগে ছিল কাৰ্চাক। তার পিছনে ছিল দু’জন পুরুষ বাঁদর আর তাদের পিছনে ছিল কালা। কালার কোলে তখনো ছিল সেই মরা বাচ্চাটা।

    কাৰ্চাক দেখল ঘরটার মধ্যে সেই আশ্চার্য সাদা লোকটা টেবিলের উপর ঝুঁকে হাত দুটো টান করে শুয়ে আছে। বিছানার উপর একটা নিস্পন্দ দেহ কাপড়ে ঢাকা অবস্থায় শুয়ে আছে। আর ঠিক সেই সময়ে ঘরের একপাশে দলে থাকা একটা দোলনা থেকে একটা শিশু সকরুণ সুরে কেঁদে উঠল।

    নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে ঢুকে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হতেই জেগে উঠল ক্লেটন। চমকে উঠল কাৰ্চাকদের দিকে তাকিয়ে।

    দরজার দিকে তাকিয়ে ক্লেটন যা দেখল তাতে তার দেহের সব রক্ত হিম হয়ে জমে গেল। সে দেখল তার পিছনে তিন-চারটে পুরুষ বাঁদর কখন চুপিসারে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের পিছনে আরো কত বাঁদর আছে এবং সংখ্যায় কত হবে তার কিছু জানতে পারল না ক্লেটন। দেখল কাৰ্চাক তার লোমশ হাত দুটো বাড়িয়ে তাকে ধরতে আসছে।

    ক্লেটনের দেহটাকে সামান্য একতাল মাংসে পরিণত করে তাকে যখন ছেড়ে দিল কাৰ্চাক ঠিক তখনি তার দৃষ্টি পড়ল দোলনার শিশুটার উপর।

    কাৰ্চাক তাকে ধরার আগেই কালা ছুটে গিয়ে শিশুটাকে তুলে নিয়ে তার জায়গায় তার কোলের মরা শিশুটাকে রেখে দিল। তারপর সেই মানব-শিশুটাকে কোলে নিয়ে লাফ দিয়ে একটা উঁচু গাছের উপর উঠে গেল। সেই জীবন্ত মানব-শিশুর কান্না তার বুকের মধ্যে তার মাতৃত্বকে জাগিয়ে তুলল।

    গাছটার অনেক উঁচু একটা ডালে বসে কালা সেই মানবশিশুটাকে বুকে চেপে ধরে আদর করতে লাগল। কালা পশুমাতা হলেও তার সহজাত মাতৃত্ববোধ মানবশিশুর অর্ধস্পষ্ট বোধশক্তির মধ্যে মাতৃস্নেহের এক আশ্চর্য রূপ ধারণ করল। ফলে সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে গেল শিশুটি। কোন ইংরেজ লর্ড পরিবারের সন্তান কালা নামে এক বাদরীর বুকে মানুষ হতে লাগল।

    প্রথমেই কার্চাকের নজর পড়ল দেয়ালের উপর টাঙ্গানো ক্লেটনের রাইফেলটার উপর। বজ্ৰদণ্ডটা করায়ত্ত করার জন্য বহুদনি ধরে কামনা করে আসছে কাৰ্চাক তার মনের মধ্যে। কিন্তু আজ সেই বস্তুটা হাতের কাছে পেয়েও সেটাকে হাত দিয়ে ধরতে সাহস পাচ্ছে না সে।

    কার্চাক রাইফেলটা হাতে নিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল। তারপর একসময় ট্রিগারটার উপর হাত পড়তেই গর্জনের মত জোর শব্দ হলো একটা। শব্দটা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঁদরগুলো পালাতে গিয়ে এ ওর ঘাড়ের উপর মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।

    কাৰ্চাকও ওদের মত ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু সে রাইফেলটা না ছেড়ে সেটা হাতে ধরেই পালিয়ে যাবার জন্য দরজার দিকে এগিয়ে গেল। কেবিন থেকে বেরিয়ে সে রাইফেলটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

    পরম যত্নের সঙ্গে শিশুটাকে মানুষ করে যেতে লাগল কালা। কিন্তু এত সেবা যত্ন করেও ঠিকমত বাড়ে না বা গায়ে বল পায় না শিশুটা। প্রায় এক বছর হয়ে গেল শিশুটা তার হাতে এসেছে। তবু এখনো সে অন্যান্য বাঁদরশিশুর মতো একা একা হাঁটতে বা গাছে চড়তে পারে না। এ কথাটা প্রায়ই এক নীরব বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবতে থাকে কালা।

    কালার স্বামী তুবলাতেরও বিরক্তির অন্ত ছিল না এ বিষয়ে। কালা যদি সব সময় শিশুটাকে নজর না রাখত তাহলে তুবলাত অনেক আগেই তাকে সরিয়ে দিত পৃথিবী থেকে।

    এরপর কালার বিরুদ্ধে নালিশ জানাবার জন্য একদিন কাৰ্চাকের কাছে গেল তুবলাত। কাৰ্চাক যেন তুবলাতের কথামত চলার জন্য বাধ্য করে কালাকে। কালা যেন তার দ্বারা বাধ্য হয়ে ত্যাগ করে ঐ মানবশিশুটাকে।

    কিন্তু কাৰ্চাক যখন কালাকে ডেকে কথাটা তুলল তার কাছে তখন কালা তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিল যদি তারা এই শিশুটাকে নিয়ে শান্তিতে থাকতে না দেয় তাকে তাহলে সে দল ছেড়ে চলে যাবে চিরদিনের মত।

    কালার কুড়িয়ে পাওয়া শিশুটার গায়ের চামড়া সাদা বলে ওরা সবাই মিলে ওর নামকরণ করেছিল টারজান। টারজান কথাটার মানেই হলো সাদা চামড়া।

    দিনে দিনে বেড়ে উঠতে লাগল টারজান। তার বয়স যখন দশ বছর হলো তখস সে ভালভাবে গাছে চড়তে শিখল। গাছে গাছে ঘুরে বেড়াতে পারত সে। মাটির উপরেও সে এমন সব মজার মজার খেলা দেখাত যা কেই পারত না।

    অনেক বিষয়েই অন্যান্য বাঁদরশিশুদের সঙ্গে তফাৎ ছিল টারজনের।

    অন্যান্য বাঁদর শিশুদের থেকে টারজনের বুদ্ধি অনেক বেশি থাকলেও তার আকৃতি আর শক্তি তাদের থেকে ছিল অনেক কম। দশ বছর বয়সে বাঁদর-শিশুরা এক একটা বাঁদরে পরিণত হয়। কিন্তু টারজান আজও পর্যন্ত একটা অপরিণত বালকই রয়ে গেছে।

    কিন্তু বালক হলেও সাধারণ বালক ছিল না সে। শৈশব থেকেই তার হাত দিয়ে গাছের ডালে ডালে ঝুলত টারজান। এই ঝোলার কায়দাটা সে শিখেছিল তার মা কালার কাছ থেকে। তারপর যতই বড় হয়ে উঠতে লাগল ততই সে অন্যান্য বাঁদরশিশুদের সঙ্গে গাছে গাছে লাফিয়ে খেলা করে বেড়াত।

    একটা গাছ থেকে শূন্যে লাফ দিয়ে কুড়ি ফুট শূন্যতা অতিক্রম করে অন্য একটা গাছের ডাল অভ্রান্তভাবে ধরতে পারত টারজান।

    টারজনের বয়স দশ বছর পার হবার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য বাদরশিশুদের সঙ্গে তার দেহগত তফাক্টা প্রকট হয়ে উঠল তার কাছে। তার গায়ের সাদা চামড়াটা রোদে পুড়ে পুড়ে তামাটে হয়ে গিয়েছিল। তা হোক। কিন্তু তার সবচেয়ে দুঃখ ও লজ্জার কারণ হলো এই যে অন্যান্য বাঁদরদের মতো কোন লোম ছিল তার গায়ে। এই লজ্জাটা ঢাকার জন্য অনেক সময় গোটা গায়ে কাদা মেখে থাকত। কিন্তু কাদাগুলো শুকিয়ে গেলেই ঝরে পড়ত আর তা ছাড়া বড় অস্বস্তি লাগত। তাই শেষে কাদা মাখা ছেড়ে দিল। অস্বস্তি থেকে মুক্তি পাবার জন্য লজ্জাকেই বরণ করে নিল।

    ঘুরতে ঘুরতে একদিন জলাশয়ের স্বচ্ছ জলে জীবনে প্রথম তার মুখের প্রতিবিম্ব দেখল টারজান।

    টারজান সেখানে গিয়েছিল কালার এক সন্তান অর্থাৎ তার ভাইয়ের সঙ্গে। সেখানে জলের ধারে দাঁড়িয়ে জলের উপর ঝুঁকে তাকাতেই দু’জনের মুখের ছায়া ফুটে উঠল হ্রদের শান্ত জলের উপর। কোন এক ভয়ঙ্কর বদর যুবকের কদাকার মুখের পাশে অতি সুন্দর এক মানবযুবকের মুখ।

    সে মুখ দেখে এক পুলকিত বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল টারজান। তার গায়ে লোম না থাক কিন্তু কী সুন্দর মুখ! তার মুখগহ্বরটা কত ছোট, তার দাঁতগুলো কত সাদা আর ছোট। তার বাঁদরভাইদের মোটা মোটা ঠোঁট আর বড় বড় দাঁতগুলোর পাশে কত সুন্দর দেখাচ্ছিল সেগুলো। তার নাক আর নাসারন্ধ্র দুটো কত ছোট। অবশেষে সে ভাবল এমন সুন্দর আকৃতি পাওয়া সত্যিই কত ভাল।

    কিন্তু তার চোখ দুটোকে খুব ভয়ঙ্কর বলে মনে হলো। সাদায় কালোয় মেশা একটা গোলাকার পদার্থ। কি বিশ্রী! সাপদেরও চোখগুলো এমন ভয়ঙ্কর নয়।

    নিজের চেহারাটা খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে তন্ময় ও অভিভূত হয়ে পড়েছিল টারজান।

    হঠাৎ ওরা দুজনেই দেখতে পেল ওদের থেকে মাত্র তিরিশ হাত দূরে একটা বিরাট সিংহী, লেজ নাড়তে নাড়তে এগিয়ে আসছে। তার পেটটা প্রায় মাটি স্পর্শ করছিল। একটা বিরাট বিড়ালের মত নীরবে নিঃশব্দে তার শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্যোগ করছিল সে।

    সিংহীটার গর্জনে সচকিত হয়ে টারজান দেখল তার এক দিকে সামনে হ্রদের বিস্তৃত জলরাশি আর একদিকে নিশ্চিত মৃত্যু।

    সিংহীটার কবল থেকে আত্মরক্ষার আর কোন উপায় না পেয়ে হ্রদের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। সাঁতার না জানলেও হাত পা নেড়ে কোনরকমে জলের উপর মাথাটা বার করে তার দলের বাঁদরদের উদ্দেশ্যে চীৎকার করতে লাগল। দেখল সিংহীটা ততক্ষণে তার সঙ্গীর নিথর দেহটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে আর তার দিকে তাকাচ্ছে। ভাবছে সে জল থেকে উঠলে তাকেও ধরবে।

    টারজনের বিপদসূচক চীঙ্কার শোনার সঙ্গে সঙ্গে চল্লিশ পঞ্চাশটি বড় বড় বাঁদর বিদ্যুৎবেগে গাছের ডালে ডালে ঘটনাস্থলে এসে হাজির হলো। সে দলে কালাও ছিল। টারজনের গলার স্বর সে ভালই চিনত।

    এতগুলো বিরাটকায় বাঁদরের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রবৃত্ত হওয়া যুক্তিযুক্ত নয় ভেবে সিংহীটা টারজনের সঙ্গীর মৃতদেহটা ছেড়ে রাগে গর্জন করতে করতে একটা ঝোপের মধ্যে ঢুকে গেল।

    সাহস পেয়ে জল থেকে শুকনো ডাঙ্গায় এসে উঠল টারজান। শীতল জলে গাটা ডুবিয়ে আজ জীবনে প্রথম এক অনাস্বাদিতপূর্ব আরামবোধ করল। এরপর থেকে সে রোজ একবার জলে গা ডুবিয়ে স্নান করত।

    যে বাঁদরদলটার সঙ্গে টারজান বাস করত সে দলটা সমুদ্র-উপকূল থেকে পঁচিশ মাইল জুড়ে বনের মধ্যে ঘুরে বেড়াত। তারা কয়েক মাস করে এক একটা জায়গায় থাকত। পরে আবার অন্য এক জায়গায় বনের মধ্যে চলে যেত। আহার সংগ্রহ, আবহাওয়ার অবস্থা আর বিপজ্জনক বন্য জন্তুদের অবস্থিতি-এই সবকিছু বিবেচনা করেই স্থান পরিবর্তন করত তারা।

    সারাদিন আহারের সন্ধানে ঘুরে বেড়িয়ে রাত্রির অন্ধকার ঘন হয়ে উঠলেই বাঁদরদলের সবাই কেউ মাটির উপর, কেউ বা গাছের উপর ঘুমিয়ে পড়ত। টারজান ঘুমোত কালার কোলের উপর।

    মাঝে মাঝে কালার অবাধ্য হলে টারজানকে কালা দু-এক ঘা মারত। কিন্তু কোনদিন সে নিষ্ঠুর বা খুব কঠোর হতে পারেনি তার উপর। বরং সে তাকে তিরস্কারের থেকে আদরই করত বেশি।

    কালার স্বামী তুবলাত এজন্য ঘৃণার চোখে দেখত টারজানকে। কতবার সে রাগের মাথায় টারজনের জীবনের অবসান ঘটাবার চেষ্টা করেছে।

    টারজানও যখনি সুযোগ পেয়েছে তখনি সে তুবলাতের প্রতি তার ঘৃণার ভাবটা জানিয়ে দিয়েছে। কখনো কালার কোলের নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে অথবা কখনো গাছের মাথায় সরু সরু ডাল থেকে। তুবলাতকে ভেংচি কেটে অপমান করেছে।

    ছোটবেলা থেকে দড়ি তৈরি ও দড়ি নিয়ে মজার মজার খেলায় পটু হয়ে ওঠে টারজান। বন থেকে লম্বা লম্বা ঘাস তুলে তাই দিয়ে লম্বা লম্বা দড়ি তৈরি করত সে। তারপর সেই দড়ির ফাঁস তৈরি করে তার খেলার সাথীদেরও মাঝে মাঝে তুবলাতের গলায় আটকে দিত।

    এই ধরনের খেলায় খুব মজা পেত বাঁদরগুলো। কোন খেলার সাথী গাছের তলা দিয়ে ছুটে কোথাও গেলে টারজান তখন উপর থেকে দড়ির ফাঁসটা নামিয়ে তার গলায় লাগিয়ে দিত আর সে হটাৎ থেমে যেতে বাধ্য হত। তাতে সবাই মজা পেত।

    তুবলাতের গলায় একদিন এই দড়ির ফাঁসটা আটকে যাওয়ায় সে কিন্তু এটাকে বড় ভয়ের চোখে দেখত।

    এর জন্য কালাকে একবার শাস্তি দিল তুবলাত। কার্চাকের কাছে নালিশ করল। কাৰ্চাকও সাবধান করে দিল কালাকে ও টারজানকে। কারো কোন কথা শুনত না টারজান। সুযোগ পেলেই সে তর দড়ির ফাসটা অতর্কিতে আটকে দিত তুবলাতের গলায়।

    আর তখন তুবলাতের সেই দুরবস্থা দেখে অন্যান্য বাদরগুলো মজা পেত। কারণ ভাঙ্গা নাকওয়ালা তুবলাতকে দলের কেউ ভাল চোখে দেখত না।

    দিনের বেলায় আহারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ানোর সময় বাঁদরের দলটা প্রায়ই উপকূলভাগের কাছে মৃত ক্লেটনের সেই কেবিনটার কাছাকাছি এসে পড়ত। আর সেই জায়গাটায় ওরা এসে পড়লেই কেবিনটার কাছে এসে প্রায়ই জানালাগুলোর পর্দা সরিয়ে ভিতরে উঁকি মেরে দেখত টারজান। এক একবার ছাদের উপর উঠে চিমনি দিয়ে উঁকি মারত। ভিতরে কি আছে তা দেখার জন্য এক অদম্য কৌতূহলে ফেটে পড়ত সে।

    একদিন একাই কেবিনটার কাছে চলে এল টারজান। আসার সঙ্গে সঙ্গেই কেবিনটার দরজার উপর চোখ পড়ল। এতদিন এই দরজাটাকে দেওয়ালের একটা অংশ বলে দেখে এসেছে এবং তাই তার মনে হয়েছে। কিন্তু আজ তার মনে হলো বাইরে দেওয়ালগুলোর অংশ বলেই মনে হলেও এটা একটা স্বতন্ত্র বস্তু এবং এটা ঘরে ঢোকার পথ।

    ক্লেটনের মৃত্যুর পর হতে পর পর দশটি বছর কেটে গেছে। তবু এই কেবিনটার ভিতরে কালো বাটওয়ালা সেই ভূতুড়ে জিনিসটার প্রতি কাৰ্চাক ও তার দলের লোকদের ভয় আজও যায়নি তাদের মন থেকে। কেবিনটাতে একদিন কি ঘটনা ঘটেছিল সেকথা তারা বলেনি টারজানকে। তাছাড়া তারা সব ভুলে গেছে এতদিনে।

    একমাত্র কালা শুধু মাঝে মাঝে টারজানকে বলত তোর বাবা ছিল অদ্ভুত ধরনের সাদা বাঁদর। কিন্তু সেকথার মানে বুঝতে পারত না টারজান। তার বাবা যেই হোক, কালা তার মা নয় একথা কখনো ভাবতে পারত না সে।

    আজ প্রথম কেবিনের দরজাটা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে পরীক্ষা করতে লাগল টারজান। তার প্রতিটি অংশ খুঁটিয়ে দেখল। অবশেষে ঠিক জায়গায় হাত পড়ে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে তার বিস্ময়বিমূঢ় চোখের সামনে সশব্দে খুলে গেল দরজাটা।

    দরজাটা খুলে গেলেও সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মধ্যে ঢুকতে পারল না টারজান। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে ঘরের মধ্যে তাকিয়ে থাকার পর ভয়টা ভেঙ্গে গেল তার। তারপর ঢুকে পড়ল ঘরের মধ্যে।

    টারজান দেখল ঘরের মাঝখানে মেঝেতে একটা কঙ্কাল পড়ে আছে। ঘরের মধ্যে যে একটা খাট ছিল তার উপর আর একটা কঙ্কালকেও পড়ে থাকতে দেখল। দুটো কঙ্কালের মধ্যে মাংসের কোন চিহ্ন নেই। ঘরের একধারে যে একটা দোলনা ছিল তার মধ্যেও একটা ছোট্ট কঙ্কাল ছিল, মনে হলো সেটা যেন কোন শিশুর কঙ্কাল।

    এরপর ঘরের মধ্যেকার অন্যান্য জিনিসপত্রের দিকে নজর দিল টারজান। ঘরের মধ্যে যেসব যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্র, বইপত্র, পোশাক-আকাশ এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিল সেগুলো একে একে পরীক্ষা। করে দেখতে লাগল সে। বন্য আবহাওয়ার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে কালের আঘাত সহ্য করতে করতে এই সব বস্তু বিবর্ণ ও বিকৃত হয়ে গেছে অনেকখানি। কিন্তু টারজান একটা সিন্দুক আর একটা আলমারি খুলে দেখল তার মধ্যে যে সব জিনিস ছিল সেগুলো সব ভাল অবস্থায় আছে। সেই সব জিনিসগুলো ঘাঁটতে ঘাটতে একটা ছুরি দেখতে পেল টারজান। ছুরিটা শিকারের সময় ব্যবহার করত ক্লেটন। ছুরিটার ফলাটায়। দারুণ ধার থাকায় তার আঙ্গুলের এক জায়গায় কেটে গেল। এরপর সে ছুরিটাকে খেলনার মত ব্যবহার করতে করতে চেয়ার ও টেবিলের ধারগুলো কাটতে লাগল।

    এইভাবে ছুরিটা নিয়ে কিছুক্ষণ খেলা করার পর আলমারির ভিতরকার বইগুলো ঘাঁটতে গিয়ে। ছবিওয়ালা একটা ছোটদের বই দেখতে পেল। বইটাতে ছবির মাধ্যমে বর্ণমালা শেখানো হয়েছে। শিশুদের। যেমন ‘এ’ অক্ষরটার পাশে আছে একটা তীরন্দাজের ছবি আর ‘বি’ অক্ষরের পাশে আছে। একটা বালকের ছবি। এম’ অক্ষরের কাছে কতকগুলো ছোট ছোট বাদরের ছবিও দেখতে পেল টারজান।

    বই-এর মধ্যে যে সব মানুষ বা জীবজন্তুর ছবি দেখছিল টারজান প্রথম প্রথম সেগুলো জীবন্ত মনে হচ্ছিল তার। তাই সে বই থেকে তুলতে যাচ্ছিল সেগুলোকে। কিন্তু পরে বুঝল সেগুলো জীবন্ত নয়।

    বইটার মাঝখানে একজায়গায় তার শত্রু সিংহী আর একটা সাপের ছবি দেখল টারজান। ওদের বাঁদরদলের ভাষায় সিংহীকে স্যাবর আর সাপকে হিস্তা বলে।

    বইটা আবার আলমারিতে রেখে দিল টারজান। তারপর ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর হতে।

    যাবার সময় ঘরের মেঝে থেকে সেই ছুরিটা তুলে নিয়ে সঙ্গে নিয়ে গেল। এগুলো সে বাঁদরগুলোকে দেখাবে।

    কেবিন থেকে বেরিয়ে দশ পা এগিয়ে যেতে না যেতেই টারজান দেখল পাশের একটা ঝোপ থেকে বেরিয়ে এক বিরাটকায় বাঁদর-গোরিলা তার সামনে এসে হাজির হলো। টারজান প্রথমে ভেবেছিল গোরিলাটা তাদেরই দলের কেউ হবে। কিন্তু পরে দেখল গোরিলাটা তাদের গোড়া শক্ত বোলগানি।

    টারজান দেখল তাদের ঘোর শত্রু বোলগানির সামনাসামনি সে যখন পড়ে গেছে তখন সে তাকে ছাড়বে না। সে তার কাছ থেকে পালিয়ে যেতেও পারবে না।

    বোলগানিকে দেখে কোন ভয় জাগল না টারজনের অন্তরে। বরং এক দুঃসাহসিক অভিযানের আনন্দে ও উত্তেজনায় তার হৃৎপিণ্ডটা লাফাতে লাগল। সুযোগ পেলে অবশ্যই পালাত সে। কারণ সে বুঝতে পেরেছিল বোলগানির সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে পেরে উঠবে না সে।

    টারজানই প্রথমে একটা ঘুষি মারল বোগলানির গায়ে। কিন্তু ঘুষিটাকে হাতির উপর একটা মাছির আঘাত বলে মনে হলো। হঠাৎ কি মনে হলো কেবিন থেকে নিয়ে আসা ধারাল ছুরিটা বোলগানি তাকে কামড়াতে এলেই তার বুকে সজোরে বসিয়ে দিল। যন্ত্রণায় চীৎকার করতে করতে টারজানকে বার বার কামড়ে তার ঘাড় ও হাত থেকে কিছুটা করে মাংস তুলে নিল। তারপর টারজানকে নিয়ে সে মাটিতে পড়ে গিয়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল। এই অবসরে বোলগানির বুক থেকে ছুরিটা তুলে নিয়ে আবার কয়েকবার ছুরিটা সেই বুকে বসিয়ে দিতে লাগল। অবশেষে বোলগানির দেহটা নিথর নিস্পন্দ হয়ে উঠল আর টারজানও জ্ঞান হারিয়ে ফেলল আঘাতের যন্ত্রণায়।

    কার্চাকের বাঁদরদলটা ছিল সেখান থেকে প্রায় মাইলখানেক দূরে। হঠাৎ বোলগানির বিকট চীৎকার শুনে সচকিত হয়ে ওঠে কাৰ্চাক। তার দলের সবাইকে ডেকে দেখল সবাই উপস্থিত আছে কি না। কারণ সে জানত বোলগানি তাদের দলের শত্রু এবং সে দলের কাউকে একা পেলে সে কখনই ছাড়বে না।

    কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল টারজান দলের মধ্যে নেই। তখন ওরা বুঝল নিশ্চয়ই বোলগানির কবলে পড়েছে।

    কালা কিন্তু অনেকক্ষণ থেকে খুঁজছিল টারজানকে। তার কোন বিপদের আশঙ্কায় তার মায়ের প্রাণ কাতর হয়ে উঠেছিল। তাই সে গাছের উপর উঠে খোঁজ করতে করতে এগিয়ে গেল।

    অবশেষে ঘুরতে ঘুরতে কালা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখল মরার মত রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত দেহে পড়ে আছে টারজান। সঙ্গে সঙ্গে বুকে কান পেতে দেখল তখনও দেহে তার প্রাণ আছে। ধীর গতিতে ধুক ধুক করছে হৃৎপিণ্ডটা। আরও দেখল অদূরে বোলগানির প্রাণহীন বিরাট দেহটা পাথরের মত শক্ত হয়ে পড়ে আছে।

    টারজনের অচৈতন্য দেহটা কাঁধে তুলে তার দলের আড্ডায় বয়ে নিয়ে এল কালা। তার ক্ষতস্থানগুলোকে জিব দিয়ে চেটে পরিষ্কার করে দিল। প্রবল জ্বরে কাতর হয়ে ছটপট করতে লাগল। টারজান। বার বার জল চাইতে লাগল। কালা তখন মুখে করে নদী থেকে জল এনে তাকে দিতে লাগল। এইভাবে বেশ কয়েকদিন ধরে অক্লান্তভাবে সেবাযত্ন করে টারজানকে সারিয়ে তুলল কালা।

    অসুখের সময়টা টারজনের খুব দীর্ঘ হলেও ধীরে ধীরে সেরে উঠতে লাগল টারজান। এক মাসের মধ্যেই সে আবার হেঁটে বেড়াতে লাগল। আবার সে আগের মত গায়ে বল পেয়ে কর্মঠ হয়ে উঠল।

    একদনি সন্ধ্যাবেলায় একা একা বেরিয়ে পড়ল সে। প্রথমে ছুরিটার খোঁজে সেদিনকার সেই ঘটনাস্থলের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। সেখানে গিয়ে সে ঝরা পাতায় ঢাকা বোলগানির কঙ্কালটা পড়ে থাকতে দেখতে পেল। সেখানে পাতায় ঢাকা তার ছুরিটাকেও দেখতে পেল সে। ছুরিটার গায়ে লেগে থাকা গোরিলাটার রক্ত শুকিয়ে যাওয়ায় মরচে ধরে গেছে সেটাতে। তাই আগেকার মত তার মুখটাতে আর চকচকে ধার নেই। তবু সেই ছুরিটাকে কাছে রেখে দিল টারজান।

    এরপর সোজা কেবিনটায় চলে গেল সে।

    আজ ঘরটার সবকিছু খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে প্রথমে বইগুলো তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। এই বইগুলো এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করল তার মনে যে সে আর কিছুই দেখতে চাইল না। আর কোন দিকে মন গেল না।

    একটা প্রাথমিক পাঠের বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে তারই মত একটা ছেলের ছবি দেখতে পেল সে। টারজান দেখল ছেলেটা তার মত নগ্নদেহ নয়। তার হাত আর মুখ ছাড়া লোমের তৈরি জ্যাকেটে ঢাকা তার। দেহটা। ছবির তলায় বালক’ এই কথাটা শুধু লেখা আছে। আরো দেখল যে সব অক্ষরগুলো দিয়ে এই কথাটা লেখা রয়েছে সেই সব অক্ষরগুলো আলাদা করেও বিভিন্ন জায়গায় লেখা আছে।

    পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আর এক জায়গায় দেখল আর একটা ছবির তলায় লেখা রয়েছে একটি বালক ও একটি কুকুর। এইভাবে সে কোন অক্ষর বা লিখিত ভাষার জ্ঞান ছাড়াই অক্ষর পরিচয়ের চেষ্টা করতে লাগল ধীরে ধীরে।

    এইভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে নিজে নিজে শিখে যেতে লাগল সে। বিভিন্ন ছবির তলায় অক্ষরগুলো দেখে দেখে তাদের সম্বন্ধে একটা অস্পষ্ট ধারণা জাগল তার মনে।

    টারজনের বয়স যখন বারো তখন একদিন কেবিনটার মধ্যে ঢুকে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা কাঠের পেন্সিল নিয়ে টেবিলের উপর ক’টা আঁচড় কাটতে কতকগুলো কালো রেখার সৃষ্টি হলো। হিজিবিজি দাগ কেটে পেন্সিলের সীসটা ক্ষয় করে ফেলল। তারপর কি মনে হতে আর একটা পেন্সিল নিয়ে সেই ছবির বইয়ের অক্ষরগুলো লেখার চেষ্টা করতে লাগল।

    অনেক চেষ্টার পর সে বই-এর অক্ষরগুলো লিখতে পারল। অক্ষরগুলো দেখে দেখে লিখতে গিয়ে সে সংখ্যাও শিখতে লাগল। তার হাতের আঙ্গুলগুলো গুণতে শিখল। এইভাবে লেখা শুরু হলো তার। বিভিন্ন শব্দের মধ্যে যে সব অক্ষরগুলো ঘুরে ফিরে ব্যবহৃত দেখল সেগুলো সাজিয়ে একটা বর্ণমালা খাড়া করল টারজান।

    এইভাবে টারজনের বয়স সতের হয়ে উঠল। তখন সে প্রাথমিক পাঠের বইটা পুরো পড়তে পারল।

    মাঝে মাঝে বাঁদরদলটা বাসস্থান পরিবর্তন করার জন্য কেবিনে গিয়ে পড়াশুনো করার কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে লাগল টারজনের। তবু সে পথের কোথাও কোন গাছের বড় পাতা বা ফাঁকা জায়গায় মাটি দেখতে পেলেই তার উপর ছুরি দিয়ে তার শেখা অক্ষরগুলো লিখত টারজান।

    টারজান যখন প্রথম বাদরদলে আসে তখনকার থেকে দলটা এখন অনেক বেড়ে গেছে। কার্চাকের নেতৃত্বে তাদের দলের সদস্যসংখ্যা বেড়েছে। তাছাড়া বনের অন্যান্য জন্তুর আক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যাও কম। তাদের দলে খাদ্যেরও কোন অভাব হয় না। দলের ছোট ছোট পুরুষ বাঁদরগুলো বড় হয়ে সবাই কার্চাকের প্রভুত্ব মেনে নিয়ে তার সঙ্গে শান্তিতে বাস করছে।

    বাঁদর দলের মধ্যে টারজনের একটা বিশেষ স্থান ছিল। তারা তাকে তাদের দলেরই একজন হিসাবে দেখত। প্রবীণ পুরুষ বাঁদরগুলো উপেক্ষা করত অথবা ঘৃণার চোখে দেখত। টারজনের আশ্চর্য বুদ্ধি, শক্তি ও সাহস আর কালা না থাকলে অনেক আগেই টারজানকে মেরে ফেলত তারা।

    কালার স্বামী তুবলাত ছিল টারজনের ঘোর শত্রু। তবে টারজনের বয়স যখন তের তখন একদিন তুবলাতের মধ্যস্থতাতেই টারজনের উপর দলের পক্ষ থেকে সব পীড়ন বন্ধ হয়ে যায় এবং ঠিক হয় দলের কেউ টারজানকে ঘাটাবে না বা তার উপর কোনভাবে পীড়ন চালাবে না, খেলার ছলেও কেউ কিছু করবে না। সে সম্পূর্ণ একা একা থাকবে।

    দলের মধ্যে টারজান যেদিন প্রতিষ্ঠা লাভ করে সেদিন বনের মধ্যে ফাঁকা একটা জায়গায় সমবেত হয় দলের সবাই। জায়গাটা ঠিক কোন রঙ্গালয়ের মত। সে জায়গার মাঝখানে কতকগুলো মাটির ঢাক আনা হলো কোথা থেকে। গাছের উপর থেকে প্রায় একশোটা বাঁদর-গোরিলা নেমে এসে সমবেত হলো সেই জায়গায়। চাঁদ উঠেছে আকাশে। চাঁদের আলো ঝরে পড়া সেই নৈশ বনভূমিতে আজ দমদম নাচ নাচবে ওরা। আজ ওদের অদ্ভুত এক উৎসব।

    সহসা কার্চাক গলা ফাটিয়ে গর্জন করে পর পর তিনবার তার লোমশ বুকটা চাপড়াল তার দুটো থাবা দিয়ে। এরপর জায়টার মাঝখানে পড়ে থাকা বাঁদর-গোরিলার মৃতদেহের পানে তার রক্তলাল চোখ দুটো দিয়ে তাকিয়ে সেটাকে একবার প্রদক্ষিণ করল।

    তারপর দলের অন্যান্য পুরুষ বাঁদরগুলোও একে একে গলা ফাটিয়ে একবার করে গর্জন করে মৃতদেহটাকে সেইভাবে প্রদক্ষিণ করল। তাদের সেই বিরাট গর্জনে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল সমস্ত বনভূমি। এই গর্জনের অর্থ হলো শত্রুপক্ষের প্রতি সদম্ভ আহ্বান।

    এবার পুরুষ বাঁদরগুলো সার দিয়ে নাচিয়েদের সঙ্গে দাঁড়াল। এরপর শুরু হল মৃতদেহের প্রতি আক্রমণ। এক জায়গায় অনেকগুলি লাঠি গাদা করা ছিল। কাৰ্চাক প্রথমে সেই গাদা থেকে একটা বড় লাঠি তুলে নিয়ে মৃতদেহটার উপর জোরে আঘাত করল এবং সেই সঙ্গে সেইরকম যুদ্ধের আহব্বন জানিয়ে গর্জন করল। মারের সঙ্গে সঙ্গে ঢাক বাজতে লাগল আর নাচ শুরু হলো। সেই বাজনা আর নাচের সঙ্গে সঙ্গে পালাক্রমে একজন করে পুরুষবাদর লাঠি দিয়ে মৃতদেহটাতে আঘাত করতে লাগল।

    এইভাবে মৃত্যুর যে নৃত্যোৎসব চলছিল তাতে টারজানও যোগদান করেছিল। জোরে জোরে তালে তালে পা ফেলতে, লাফ দিতে ও এক ভয়ঙ্কর ক্ষিপ্রতার সঙ্গে আক্রমণ ও আঘাত করতে সে ছিল সবার চাইতে বেশি তৎপর।

    ক্রমে তালে তালে ঢাকের বাজনার বেগ বেড়ে যেতে লাগল।

    পুরো আধঘণ্টা ধরে এই উন্মত্ত নাচ চলতে লাগল। তারপর এক সময় কাৰ্চাক ইশারা করতেই নাচ ও বাজনা একমুহূর্তে থেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সবাই একযোগে সেই মৃতদেহটার দিকে ছুটল। অসংখ্য লাঠির আঘাতে মৃতদেহটা একতাল মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়েছিল, সবাই তাতে তার দাঁত বসিয়ে তার থেকে এককামড় করে মাংস ছিঁড়ে নিয়ে খেতে লাগল। যাদের গায়ের জোর বেশি তারা কামড় দিয়ে বেশি মাংস তুলে নিচ্ছিল।

    অন্যদের মত টারজনেও মাংসের দরকার ছিল। কিন্তু এ সব কাড়াকাড়ির মধ্যে থেকে তার প্রয়োজনীয় মাংস ছিনিয়ে আনার মত শক্তি তার ছিল না। কিন্তু সেই ধারাল ছুরিটা তার কোমরে তারই হাতে তৈরি করা একটা খাপের মধ্যে ছিল। সেই ছুরিটা নিয়ে মৃতদেহটার কাছে গিয়ে তার একদিকের বগল থেকে বড় একতাল মাংস কেটে নিল টারজান। কাঁচাক তখন অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল বলে এটা সে দেখতে পায়নি। টারজান তার কাছ দিয়েই নিঃশব্দে সবার থেকে একটু দূরে চলে গলে।

    তাকে অন্য কেউ লক্ষ্য না করলেও একজন করল। সে হলো তুবলাত। তুবলাত প্রথম দিকেই একতাল মাংস ছিঁড়ে এনে ভিড় থেকে একটু দূরে নির্জনে বসে খাচ্ছিল তা। পরে আর একতাল মাংস আনার মতলব করছিল যখন তখন হঠাৎ দেখতে পেয়ে গেল টারজানকে। দেখল বড় একটা মাংসের তাল নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে টারজান।

    তার রক্ত-লাল চোখগুলো বড় বড় করে ঘৃণাভরে টারজনের পানে তাকিয়ে তাকে তেড়ে গেল তুবলাত। তখন মারামারি বা ঝগড়া বিবাদ করার কোন প্রবৃত্তি ছিল না টারজনের। সে তাই মাংস নিয়ে মেয়েদের দলে গিয়ে লুকোবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তুবলাত খুর দ্রুত তার দিকে ছুটে যাওয়ায় লুকোতে পারল না সে। লুকোতে না পেরে সে একটা গাছের ডাল ধরে তার উপরে উঠে পড়ল। মাংসটা দাঁতে কামড়ে ধরে গাছটার সবচেয়ে উপরের ডালে উঠে গেল। কিন্তু দেহটা অত্যধিক ভারী হওয়ার জন্য বৃদ্ধ তুবলাত সেখানে উঠতে পারল না।

    তুবলাত তখন রাগে গর্জন করতে করতে ক্ষেপে গিয়ে গাছ থেকে মাটিতে নেমে এল। সে তখন পাগল হয়ে গেছে। মেয়ে-বাঁদর ও শিশুগুলোকে অতর্কিতে আক্রমণ করে তাদের অনেকের ঘাড়ে দাঁত বসিয়ে একতাল করে মাংস তুলে নিয়েছে। তার ভয়ে তখন মেয়ে পুরুষ ও শিশুবাঁদরগুলো সবাই যে যেখানে পারল ছুটে পালাতে লাগল। সবাই গাছে উঠে পড়ল।

    কিন্তু একজন তখনো কোন গাছে উঠতে পারেনি। সে হলো কালা। তুবলাত তখন কালাকে হাতের কাছে পেয়ে তাকেই আক্রমণ করল। কালা একটা গাছের নিচু ডাল ধরে তুবলাতের মাথার উপর উঠে পড়ল। কিন্তু ডালটা অশক্ত থাকায় সঙ্গে সঙ্গে ভেঙ্গে পড়তেই তুবলাতের ঘাড়ের উপর পড়ে গেল কালা।

    গাছের উপর তুবলাতের প্রচণ্ড পাগলামির সবকিছুই দেখছিল টারজান। এবার আর সে থাকতে পারল না। সে তীব্র গতিতে গাছ থেকে নেমে তুবলাত মাটি থেকে উঠে কালাকে আক্রমণ করার আগেই কালা আর তুবলাতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল বীরবিক্রমে।

    তুবলাত এবার তার আকাঙ্খিত শত্রুকে পেয়ে গেল এতক্ষণে। সে তখন বিজয়গর্বে দাঁত বার করে ঝাঁপিয়ে পড়ল টারজনের উপর। কিন্তু টারজান তাকে সুযোগ না দিয়ে এক হাতে তার গলাটা ধরে অন্য হাত দিয়ে ছুরিটা ধরে সেই ছুরি বারবার বসিয়ে দিতে লাগল তুবলাতের বুকে। অবশেষে টারজান দেখল তুবলাতের অসার নিষ্প্রাণ দেহটা জড়পিণ্ডের মত ঢলে পড়ল মাটির উপর।

    এবার বাঁদরদলের সকলেই একে একে নেমে এল গাছের আড়াল থেকে। টারজান আর তার ঘোরতর শত্রুর মৃতদেহটার চারদিকে গোল হয়ে দাঁড়াল। টারজান তখন তুবলাতের মৃতদেহের উপর একটা পা রেখে চাঁদের দিকে মুখ তুলে গলা ফাটিয়ে চীৎকার করে তার প্রভুত্ব ঘোষণা করল। তারপর সে দলের সবাইকে লক্ষ্য করে বলল, শোন তোমরা, আমি হচ্ছি টারজান। শত্রুদের যম। আমাকে আর আমার মা কালাকে তোমরা সবাই মান্য করবে। আমার মত শক্তিমান তোমাদের মধ্যে আর একজনও নেই। একথা যেন আমার শত্রুরা মনে রাখে।

    কার্চাকের রক্তচক্ষুর দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার বুকটা চাপড়ে আর একবার চীৎকার করল টারজান।

    তুবলাতের মৃতদেহটা সেখানে সেই উৎসবস্থানেই পড়ে রইল। কারণ ওরা নিজেদের দলের কারো মৃতদেহ খায় না।

    মার্চ মাসটা ওদের আহারের সন্ধানে ঘুরে ঘুরে কেটে গেল। কোন কোন গাছের পাতা, বুনো আতাফল, কিছু জীবজন্তু, পাখি, পাখির ডিম, সরীসৃপ জাতীয় কিছু জীব আর পোকামাকড় খেয়ে গোটা মাসটা কাটাল তারা।

    সেদিন টারজান একটা গাছের নিচু ডালে বসেছিল। তার নিচেই ছিল একটা সিংহী, টারজান তাকে রাগাবার জন্য একটা আতাফল ছুঁড়ে দিল তার গায়ের উপর। সিংহীটা রেগে গিয়ে মুখ বার করে গর্জন করে উঠল। সে টারজনের চোখে চোখ রেখে তাকাল ভয়ঙ্করভাবে। টারজানও তখন তর স্বরের অনুকরণ করে চীৎকার করল। সিংহীটা তখন ধীরে ধীরে বনের মধ্যে ঢুকে গেল।

    কিন্তু সিংহীটাকে বধ করার একটা সংকল্প জাগল টারজনের মাথায়। তার প্রধান কারণ সিংহীটাকে বধ করে তার চামড়া দিয়ে তার নগ্নতাকে ঢাকার জন্য একটা আচ্ছাদন তৈরি করবে সে। কেবিনে সেই ছবির বইটা দেখার পর হতে সে আর বাঁদর-গোরিলাগুলোর মত উলঙ্গ হয়ে থাকতে চায় না।

    তাই সিংহীটাকে বধ করার বাসনা এতে বেড়ে গেল তার। কিন্তু টারজনের অস্ত্র বলতে একটা ছুরি আর সেই ফাঁসের দড়ি।

    দড়িটা তৈরি হয়ে গেল একদিন নদীর কাছাকাছি একটা পথের ধারে একটা গাছের ডালে শিকারের সন্ধানে গা-ঢাকা দিয়ে বসে রইল টারজান।

    অবশেষে পাশের একটা ঝোপ থেকে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে সিংহীটা এসে দাঁড়াল সেই গাছটার তলায়।

    এদিকে ফাঁসের দড়িটা শক্ত করে হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে স্থিরভাবে একটা ব্রোঞ্জমূর্তির মত বসেছিল টারজান। এবার ফাঁসের দড়িটা সিংহীটার মাথার উপর প্রথমে ঝুলিয়ে দিল সে। দড়িটা সাপের মত ঝুলতে থাকায় সিংহীটা মুখ তুলে সেই দিকে তাকিয়ে সেটা কি তা ভাবতে লাগল। এমন সময় ফাঁসটা উপর থেকে কায়দা করে সিংহীর গলায় আটকে দিল টারজান। তারপর তার হাতের দড়ির শেষ প্রান্তটা একটা ডালে শক্ত করে বেঁধে দিল।

    ফাসটা গলায় আটকে যাওয়ার পর সিংহীটা উপর দিকে মুখ তুলে দেখতে পেল টারজানকে। তাকে ধরার জন্য লাফ দিল সিংহীটা। গর্জন করতে লাগল প্রবলভাবে। কিন্তু টারজান আরও উপর ডালে উঠে গেল। তার ইচ্ছা ছিল দড়িটা ধরে উপর থেকে টেনে সিংহীটাকে শুন্যে ঝোলাবে। কিন্তু টারজান এরপর দড়িটা আরও টেনে বাঁধতে গেলে সিংহীটা তখন তার বড় বড় থাবা দিয়ে দড়িটা ছিঁড়ে দিল। তবে তার গলায় ফাসটা শুধু আটকে রইল।

    টারজনের আশা সবটা পূরণ হলো না তবু সিংহীটার গলায় ফাঁস লাগাতে পারার জন্য গর্ব অনুভব করতে লাগল। সে দলের কাছে ফিরে গিয়ে সবার সামনে কথাটা বলল। কথাটা শুনে তার ঘোর শত্রুরাও মুগ্ধ হয়ে গেল তার সাহস আর বীরত্বে। বিশেষ করে কালা আনন্দ ও গর্বের আতিশয্যে নাচতে লাগল।

    সে সময় কার্চাকের গোরিলাদলটা কেবিনের কাছাকাছি বনাঞ্চলটায় বাস করছিল।

    অনেকে বলত একটা হাতির সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল টারজনের। হাতিকে বাঁদর দলের সবাই ‘ট্যান্টর’ বলত। সিংহীকে তারা যেমন বলত ‘স্যাবর’ আর সিংহকে বলত নুমা’। অনেকে নাকি চাঁদের আলোঝরা বনভূমিতে একটা হাতির পিঠে পেচে বেড়াতে দেখেছে টারজানকে। কিন্তু কিভাবে সে বন্ধুত্ব হলো তা কেউ বলতে পারেনি। সেই হাতিটা ছাড়া বনের অন্য জন্তু শত্রু ছিল না তার। তবে অবশ্য তার বাঁদর দলের মধ্যে এখন আর কেউ বিশেষ কোন শত্রুতা করে না তার সঙ্গে।

    টারজান আঠারো বছর বয়সে পড়তেই কেবিনে যেসব বই ছিল তা গড় গড় করে পড়তে পারত। সে তাড়াতাড়ি লিখতেও শিখে ফেলল। মুখে উচ্চারণ বা ইংরাজি শব্দ পড়তে না পারলেও সে মনে মনে। ইংরাজি পড়ে বুঝতে ও লিখতে পারত।

    কিন্তু একদিন টারজান যখন তার বাবার কেবিনটার মধ্যে বই পড়ায় ব্যস্ত ছিল তাদের বাসস্থানের পূর্ব প্রান্তে পঞ্চাশজন কৃষ্ণকায় সশস্ত্র নিগ্রো কোথা থেকে এসে হাজির হয়। তাদের কপালে ছিল তিনটে করে রঙীন সমান্তরাল রেখার উল্কি আর বুকে ছিল তিনটে করে বৃত্ত। তাদের হাতে ছিল বর্শা আর তীর ধনুক। আসলে তারা আগে থাকত একটা দূর গাঁয়ে। সেই অঞ্চলে একদল শ্বেতাঙ্গ কিছু নিগ্রোসেনা নিয়ে রবার আর হাতির দাঁতের খোঁজে তাদের সেই গাঁ আক্রমণ করে। তখন তারা একজন শ্বেতাঙ্গ অফিসার আর কিছু নিগ্রো সেনাকে নিহত করে। কিন্তু পরে শ্বেতাঙ্গদের এক বিরাট সেনাদল এসে পড়ায় তারা। তাদের সেই গা ছেড়ে আরও ভিতরে চলে এসে এক নতুন বস্তী গড়ে তোলে ওরই মধ্যে একটা ফাঁকা। জায়গায়। সেখানে কাছাকাছি রবার গাছ না থাকায় নিশ্চিন্তে বসতি স্থাপন করে সেখানে।

    এই নিগ্রোদলের রাজা ছিল মবঙ্গা। একদিন মবঙ্গার ছেলে কুলঙ্গা শিকারের সন্ধানে বর্শা আর তীর ধনুক নিয়ে একাই তাদের বস্তী থেকে পশ্চিম দিকের ঘন জঙ্গলে বেরিয়ে পড়ে। সেদিন রাত্রিতে একটা গাছের উপর শুয়ে রাত কাটায় কুলঙ্গা। সেখান থেকে পশ্চিমে তিন মাইলের মধ্যে কাৰ্চাক তার দলবল নিয়ে বাস করত।

    পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই পশ্চিম দিকে আবার যাত্রা শুরু করল। তখন টারজান একা একা দল ছেড়ে কেবিনের দিকে চলে গেল। আর দলের সবাই দু’তিনজন করে এক একটি দলে বিভক্ত হয়ে আহার সংগ্রহের জন্য এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে লাগল। কালা তখন একা একা খাবার জন্য পুরনো পচা কাঠ আর পোকামাকড় সংগ্রহ করতে করতে কিছুটা পূর্ব দিকে গিয়ে পড়েছিল।

    হঠাৎ অদ্ভুত একটা শব্দ শুনে সচকিত হয়ে উঠল কালা। দেখল তার সামনে পায়ে চলা বনপথটার প্রান্তে একটা ভয়ঙ্কর মূর্তি ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। আসলে লোকটা ছিল কুলঙ্গা। এই ধরনের মানুষের মূর্তি এর আগে তারা দেখেনি কখনো।

    কালা কিন্তু সেখানে আর না দাঁড়িয়ে পিছনে তার দলের কাছে ফিরে যাবার জন্য পা বাড়াল। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারল না কালা। কুলঙ্গার হাত থেকে ছাড়া একটা বর্শার বিষাক্ত ফলক তার পাশ দিয়ে চলে গেল। কালা তখন ঘুরে তার আক্রমণকারীকে আক্রমণ করল। তার চীৎকারে তার দলের সবাই ছুটে এল তার কাছে।

    এদিকে কুলঙ্গার নিক্ষিপ্ত বর্শাটা ব্যর্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে একটা বিষাক্ত তীর তার ধনুক থেকে ছুঁড়ে দিল। তীরটা কালার বুকে এসে লাগলে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে করতে তাদের দলের সকলের। সামনেই পড়ে গেল কালা।

    বাঁদর-গোরিলাগুলো কুলঙ্গাকে দেখতে পেরে তাড়া করল একযোগে। কিন্তু সে হরিণের মত তীব্র বেগে ছুটে পালিয়ে গেল। তাদের চোখ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল মুহূর্তে। ফলে কিছুক্ষণ পর বাঁদরগুলো ব্যর্থ হয়ে ফিরে এল। কালার প্রাণবায়ু তখন তার দেহ ছেড়ে চলে গেছে।

    এদিকে বাঁদরদলের বিরাট চেঁচামেচির সঙ্গে আর্তনাদের মত একটা ধ্বনি শুনতে পেয়ে টারজান তার কেবিন থেকেই বুঝতে পেরেছিল একটা বিপদ ঘটেছে তার দলে। তাই সে উধ্বশ্বাসে ছুটে এল তাদের কাছে। এসে দেখল কালার মৃতদেহটার চারদিকে সবাই দাঁড়িয়ে আছে ভিড় করে।

    শোক আর দুঃখের সীমা পরিসীমা রইল না টারজনের।

    দুঃখের প্রথম আঘাতটা কোনরকমে কাটিয়ে উঠে কালার মৃত্যু সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে লাগল টারজান। কে মেরেছে, হত্যাকারী কোনদিকে পালিয়েছে তা জেনে নিয়ে আর না দাঁড়িয়ে গাছের উপর উঠে ডালে ডালে এগিয়ে চলল টারজান সেই পলাতক হত্যাকারীর সন্ধানে। তার কোমরে ছিল কেবিনে পাওয়া সেই ছুরিটা আর তার কাঁধের উপর ঝোলানো ছিল সেই ফাঁসের দড়ি।

    গাছে গাছে অনেক দূর যাওয়ার পর টারজান একটা ছোট নদীর ধারে মাটির উপর একবার নামল। মাটির উপর পায়ের দাগ দেখে বুঝতে পারল পলাতক হত্যাকারী তারই মত মানুষ এবং একটু আগে সে এখান থেকে গেছে।

    এইভাবে মাইলখানেক যাবার পর টারজান গাছের উপর থেকে অদূরে একটা ফাঁকা জায়গায় তীর ধনুক হাতে কৃষ্ণকায় একটা লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। তার সামনে দাঁত বার করে তাকে আক্রমণ করার উদ্যোগ করছিল একটা বনশুয়োর, ওরা যাকে ‘হোর্তা বলে।

    জীবনে প্রথম একজন মানুষ দেখল টারজান। কিন্তু কালো চকচকে এমন জীবন্ত মানুষ দেখেনি কখনো।

    শুয়োরটা মারা গেল। কুলঙ্গা তখন গাছ থেকে নেমে তার কোমর থেকে একটা ছোরা বার করে মৃত শুয়োরটার গা থেকে মাংস ছাড়িয়ে আগুন জ্বেলে তা পুড়িয়ে খেতে লাগল ইচ্ছামত। তারপর বাকি মাংসওয়ালা মৃতদেহটা সেখানে ফেলে রেখেই চলে গেল সেখান থেকে।

    টারজান গাছের উপর থেকে সবকিছু নীরবে নিঃশব্দে দেখে গেল। সে কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে আক্রমণ করল না কুলঙ্গাকে।

    কুলঙ্গা চলে গেলে টারজানও গাছ থেকে নেমে এসে বেশ কিছুটা মাংস কাঁচাই খেয়ে নিল। তারপর আবার গাছে উঠে অনুসরণ করে যেতে লাগল কুলঙ্গাকে। সে ভাবল লোকটা যখন বিষাক্ত তীর আর ধনুক পাশে রেখে বিশ্রাম করবে সেই অবসরে তাকে বধ করবে।

    সারাদিন ধরে গাছে গাছে এক প্রতিচ্ছায়ার মত কুলঙ্গাকে অনুসরণ করে যেতে লাগল টারজান। দেখল কুলঙ্গা আরও দুবার তার সেই বিষাক্ত তীর দিয়ে একটা হায়েনা আর একটা বাঁদরকে মারল। টারজান ভাবতে লাগল ঐ তীরটার ফলায় নিশ্চয় এমন কিছু রহস্যময় বিষ মাখানো আছে যা কোন জীবের রক্তে লাগার সঙ্গে সঙ্গে তার মৃত্যু ঘটবে।

    সে রাত্রিতে একটা গাছের তলায় রাত কাটাল কুলঙ্গা। আর সেই গাছের উপরেই একটা উঁচু ডালে ওৎ পেতে বসে রইল টারজান।

    সকালে ঘুম থেকে উঠেই কুলঙ্গা দেখল তার তীর ধনুক নেই। আপেশাশে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও না পেয়ে ভয় পেয়ে গেল। কালাকে মারতে গিয়ে বর্শটা আগেই হারিয়েছে। এবার তীর ধনুকটাও গেল। আছে শুধু একটা ছুরি। তাই সে ভয়ে তার গায়ের দিকে পা চালিয়ে দিল।

    টারজান দেখল আর দেরী করা উচিৎ হবে না।

    কুলঙ্গাকে অনুসরণ করে টারজান গাছের ডালে ডালে এগিয়ে চলল। অবশেষে কুলঙ্গার মাথার উপর এসে পড়ল টারজান। এবার হাতের মুঠোয় ফঁসের দড়িটা শক্ত করে ধরল। কুলঙ্গাদের গাঁটা দেখতে পাচ্ছিল। বনটার প্রান্তে একটা মাঠ আর মাঠের ওধারে গাঁ। আর মোটেই দেরী করলে চলবে না।

    কুলঙ্গা বন থেকে বার হবার আগেই তার প্রান্তসীমায় একটা গাছের উপর থেকে একটা ফঁসের দড়ি ঝুলতে ঝুলতে তার গলায় এসে আটকে গেল।

    তার গলায় ফাঁসটা আটকে যেতেই টারজান এমন কায়দা করে দড়িটা গাছের উপর টেনে ধরল যে কুলঙ্গা মোটেই চীৎকার করতে পারল না। এবার তার দড়িটা গাছের একটা মোটা ডালের সঙ্গে বেঁধে দিয়ে নিজে নেমে গেল। তারপর তার কোমর থেকে ছুটিরা বার করে সেটা কুলঙ্গার বুকের উপর আমূল বসিয়ে দিল। এইভাবে তার মা কালার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিল সে।

    কিন্তু কুলঙ্গার মৃতদেহ থেকে ছুরি দিয়ে মাংস কাটার জন্য উদ্যত হয়েও তা কাটতে পারল না টারজান।

    যাই হোক, কুলঙ্গার মৃতদেহটা ফেলে রেখে গাছে উঠে ফাঁসের দড়ি খুলে দড়িটা হাতে নিয়ে সেখান থেকে গাছের ডালে ডালে পা চালিয়ে চলে গেল টারজান।

    একটা উঁচু গাছের উপর থেকে কুলঙ্গাদের গাঁ-টা ভাল করে দেখল টারজান। দেখল বন আর গাঁয়ের মাঝখানে একটা মাঠ থাকলেও বনের দিকটা পাশ দিয়ে গিয়ে স্পর্শ করেছে গাটাকে। সেই গাঁয়ে যারা থাকে তারাও কুলঙ্গার মত মানুষ। সেই সব মানুষদের জীবনযাত্রা জানার এক কৌতূহল অনুভব করল টারজান।

    বনের যেদিকটা মাঠটার পাশ দিয়ে গায়ের কাছ পর্যন্ত চলে গেছে, বনের সেই দিকটা দিয়ে মবঙ্গাদের গায়ের কাছে চলে গেল টারজান।

    বনটার শেষ প্রান্তে একটা বিরাট বড় গাছের উঁচু ডালের উপর বসে গা-টা দেখতে লাগল টারজান।

    উলঙ্গ শিশুরা গায়ের পথে পথে খেলা করে বেড়াচ্ছিল। মেয়েদের অনেকে শুকনো কলাগাছগুলো পাথরে পেষাই করছিল। অনেকে আবার ময়দা থেকে কেক তৈরি করছিল।

    শুকনো ঘাস দিয়ে তৈরি একধরনের মাদুরের মত জিসিন মেয়েদের কোমর থেকে হাঁটুর উপর পর্যন্ত ঢাকা ছিল। তাদের পায়ে হাতে বুকের উপর পিতল আর তামার গয়না ছিল। গলায় ছিল তারের হার। অনেক মেয়ের নাকে আবার আংটির মত একটা গয়না ছিল।

    জীবনে এই প্রথম মেয়ে মানুষ দেখল টারজান।

    টারজান দেখল নারীরাই একমাত্র কাজ করছে। মাঠে চাষের কাজ এবং ঘর সংসারের কাজ সব মেয়েরাই করছে। পুরুষের কোথাও সে কাজ করতে দেখল না।

    এরপর টারজান দেখল যে গাছের উপর সে চেপেছিল তার ঠিক তলায় একটা মেয়ে কি করছিল। তার পাশে অনেকগুলো তীর ছিল। তার সামনে জ্বলন্ত আগুনের উপর কড়াইয়ে লালমত কি এক জিনিস ফুটছিল। মেয়েটি একটি করে তীর তুলে নিয়ে তার সূচলো মুখটা সেই কড়াইয়ের মধ্যে একবার করে ডুবিয়ে পাশে এক জায়গায় রেখে দিচ্ছিল।

    এবার টারজান সামান্য একটা তীর কিভাবে ছোঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে জন্তুর মৃত্যু ঘটায় তার রহস্যটা বুঝতে পারল।

    বিষমাখা ঐ সব তীরের কয়েকটা নিয়ে যাবার ইচ্ছা হলো টারজনের। টারজান যখন এবিষয়ে একটা করিকল্পনা খাড়া করার চেষ্টা করছিল, এমন সময় হঠাৎ একটা জোর চীৎকার শুনতে পেল সে। যেদিক। থেকে চীৎকারের শব্দটা আসছিল সেদিকে তাকিয়ে সে দেখল যে গাছের তলায় সে কুলঙ্গাকে মেরেছিল সেইখানে একটা নিগ্রো যোদ্ধা দাঁড়িয়ে তার মাথার উপর বর্শাটা সঞ্চালিত করতে করতে খুব জোরে চীৎকার করছে।

    মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত গা-টায় হৈ-চৈ পড়ে গেল। টারজান দেখল গাঁয়ের কুঁড়েঘরগুলোর ভিতর থেকে অসংখ্য সশস্ত্র যোদ্ধা ফাঁকা মাঠটা পার হয়ে ছুটে যেতে লাগল সেই গাছতলাটার দিকে। তাদের পিছনে যেতে লাগল গায়ের যতসব বৃদ্ধ, নারী আর শিশু।

    টারজান বুঝল এতক্ষণে ওরা কুলঙ্গার মৃতদেহটা দেখতে পেয়েছে। এবার নিকটবর্তী একটা কুঁড়ে ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখল ঘরের দরজাটা খোলা। ভিতরে কি আছে তা দেখার একটা কৌতূহল জাগল তার মনে। তাই সে নিঃশব্দে ঘরটার দরজার সামনে গিয়ে একবার দাঁড়াল। কান পেতে শুনল ঘর থেকে কোন শব্দ আসছে কি না। তারপর সে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ল। দেখল ঘরটার দেওয়ালে বর্শা, অদ্ভুত আকারের ছোরা প্রভৃতি অনেক অস্ত্র আর ঢাল সাজানো আছে। ঘরের কোণে অনেক ঘাস আর কতকগুলো মাদুর আছে। ঐগুলো হলো ওদের বিছানা।

    একটা লম্বা বর্শা নেবার ইচ্ছা হলো টারজনের। কিন্তু সে অনেকগুলো বিষমাখা তীর নিয়ে যাবে বলে এখন আর বর্শা নিয়ে যেতে পারবে না। দেওয়াল থেকে একে একে অস্ত্রগুলো নামিয়ে ঘরের মাঝখানে সেগুলো রেখে তার উপর রান্নার পাত্রটা রেখে তার উপর মড়ার খুলিটা রাখল। সবশেষে কুলঙ্গার মাথার পোশাকটা চাপিয়ে দিল তার উপর। নিজের কাজ দেখে নিজেই হাসল টারজান।

    এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে সেই গাছতলায় এসে হাজির হলো।

    গাছের পাতার আড়ালে এক নিরাপদ আশ্রয়ে বসে ওদের ব্যাপারটা দেখতে লাগল টারজান। দেখল চারজন লোক কুলঙ্গার মৃতদেহটা গাঁয়ের পথ দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

    টারজান দেখল জনাকতক লোক ঘরের মধ্যে ঢুকেই সবকিছু দেখে ভয়ে ও বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কি সব বলাবলি করতে লাগল। মবঙ্গা কি বলতেই কয়েকজন লোক কার খোঁজে গোটা গা খুঁজে তোলপাড় করতে লাগল। এমন সময় সেই গাছতলাটায় ওদের নজর পড়ল। ওরা দেখল। সেই বিষমাখা তীরগুলোর মধ্যে দু’ একটা তীর আছে আর বাকিগুলো রহস্যজনকভাবে উধায় হয়ে গেছে। তার উপর কড়াইটা উল্টোন।

    এবার সত্যি সত্যিই ভয় পেয়ে গেল গাঁয়ের লোকেরা। ঘরের কাছে কুলঙ্গার আকস্মিক মৃত্যু, তার ঘরের মধ্যে রহস্যময় রসিকতা, এতগুলি তীরের অপহরণ-একসঙ্গে এই ঘটনাগুলি প্রায় একই সঙ্গে পর পর ঘটে গেছে। অথচ এই সব ঘটনার কোন কারণ তারা অনেক ভেবেও খুঁজে পেল না।

    এদিকে তখন বেলা প্রায় দুপুর। সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি তার। তাই গাছের উপর দিয়ে ডালে ডালে তাদের ডেরার দিকে ফিরে যেতে লাগল টারজান। পথের মাঝখানে একবার কুলঙ্গার হাতে মারা সেই শুয়োরটার অবশিষ্ট মাংসটুকু খাবার জন্যও কুলঙ্গার যে তীর ধনুক একটা গাছের উপর লুকিয়ে রেখেছিল তা নেবার জন্য থেমেছিল।

    তার দলের কাছে টারজান যখন ফিরে এল তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। টারজান যখন কাৰ্চাক আর তার দলের সকলের সামনে অনেক তীর ও একটা ধনুক নামিয়ে তার দুঃসাহসিক অভিযানের কথা বলল তখন তার নিজের বুক গর্বে ও গৌরবে ফুলে উঠল।

    তার এই সব গৌরবের কথা শুনে একমাত্র দলনেতা কাৰ্চাকই ক্ষুব্ধ হয়ে মুখ ফিরিয়ে চলে গেল।

    পরের দিন তার তীর ধুনক নিয়ে তীর ছোঁড়া অভ্যাস করতে লাগল টারজান। কিন্তু এইভাবে অভ্যাস করতে গিয়ে তার সব তীরগুলো চলে গেল।

    টারজনের বাদর দল কেবিনটার আশেপাশে সমুদ্র উপকূলের কাছাকাছি তখন শিকারের সন্ধানে ঘুরে বেড়াত। ফলে টারজান কেবিনটায় ঢুকে নিশ্চিন্তে অনেকক্ষণ কাটাতে পারত। একদিন কেবিনে একটা আলমারির পিছনে একটা ছোট বাক্স পেয়ে গেল টারজান।

    বাক্স খুলতেই তার মধ্যে এক যুবকের ছবির সঙ্গে হীরকখচিত একটা সোনার হার আর একটা চিঠি পেল টারজান। ছবিটা ভাল করে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল টারজান। সে জানত না ওটা তার বাবার ছবি। তবে তার মুখের হাসিটা খুব মিষ্টি লাগছিল। লকেটওয়ালা সোনার হারটা দেখেও খুব ভাল লাগল তার। তাই সে তার গলায় সেই সোনার হারটা পরে ফেলল।

    এরপর চিঠিটা দেখতে লাগল টারজান। চিঠির অক্ষরগুলো সে চিনতে পারলে জানতে পারত যে ওটা কোন চিঠি নয়, তার বাবার লেখা ডায়েরী। ঐ ডায়েরীর মধ্যে তার জন্মের সমস্ত বৃত্তান্ত লেখা আছে। তার জীবনের সব রহস্য জানতে পারত তার মধ্যে। ডায়েরীটা ফরাসী ভাষায় লেখা।

    যাই হোক, সেই ডায়েরীর রহস্য তখন ভেদ করতে না পারলেও একটা সংকল্প তার মনের মধ্যে রয়ে গেল। সে রহস্য একদিন সে ভেদ করবেই।

    বর্তমানে তার হাতে এখন গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ আছে। তার তীর সব ফুরিয়ে যাওয়ায় আবার তাকে মবঙ্গাদের সেই গাঁয়ে গিয়ে কিছু তীর চুরি করে আনতে হবে।

    পরের দিন সকালেই বেরিয়ে পড়ল টারজান। তারাতাড়ি পা চালিয়ে সেই মাঠটার কাছে পৌঁছে গেল সে। তখনো দুপুর হয়নি। সেদিনকার মত আবার তেমনি করে গাছের উপর ওৎ পেতে লুকিয়ে বসে রইল।

    কখন গাঁয়ের লোকেরা সবাই ঘরে চলে যাবে এবং কখন মেয়েটা গাছতলা থেকে চলে যাবে তার সুযোগ খুঁজতে লাগল টারজান। এই সুযোগের অপেক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে গাছের উপর চুপচাপ বসে রইল।

    অবশেষে দিন গিয়ে সন্ধ্যা হলো। মাঠের কাজ সেরে মেয়েরা একে একে ঘরে চলে গেল। গাছতলা থেকে মেয়েটাও গাঁয়ের ভিতরে চলে গেল। গায়ের গেট বন্ধ হয়ে গেল। টারজান দেখল গাঁয়ের ভিতরে প্রতিটি কুঁড়ের সামনে মেয়েরা নানারকম খাবার তৈরি করছে।

    হঠাৎ একটা গোলমালের শব্দ শুনতে পেল টারজান। দেখল একদল শিকারী দেরী করে ফিরেছে। তাই বন্ধ গেটের বাইরে চীৎকার করছে। সঙ্গে সঙ্গে গেট খুলে গেল আর তারা ভিতরে ঢুকে পড়ল। টারজান দেখল ওদের সঙ্গে একজন বন্দী ছিল। বন্দীটাকে শিকারদের সঙ্গে দেখতে পেয়েই গাঁয়ের নারী পুরুষ সকলে এক পৈশাচিক আনন্দে চীৎকার করতে লাগল। মেয়েরা লাঠি আর পাথর দিয়ে আঘাত করতে লাগল লোকটাকে। ওদের পাশবিক নিষ্ঠুরতা দেখে অবাক হয়ে গেল টারজান। সে দেখল তার মত যারা মানবজাতি তারাও সিংহী আর চিতাবাঘের মতই নিষ্ঠুর। মানবজাতির প্রতি ঘৃণা হতে লাগল টারজনের।

    এবার টারজান দেখল বন্দীকে গায়ের মাঝখানে এক জায়গায় মবঙ্গার ঘরের সামনে একটা লম্বা খুঁটি পুঁতে তার সঙ্গে বেঁধে রাখল গাঁয়ের লোকেরা। তারপর বন্দীকে ঘিরে ছুরি বর্শা প্রভৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে এক নাচের উৎসবের আয়োজন করতে লাগল। মেয়েরা পুরুষ যোদ্ধাদের পিছন থেকে ঢাক বাজাতে লাগল। এই উৎসবের প্রস্তুতি দেখে বাঁদর- গোরিলাদের দমদম উৎসবের কথা মনে পড়ে গেল টারজনের। এরপর কি হবে তা বুঝতে পারল। এরপর বন্দীটাকে ওরা পালাক্রমে আঘাত করবে বিভিন্ন অস্ত্র দিয়ে।

    হঠাৎ একজনের হাত হতে একটা বর্শা বন্দীর দেহের একটা অংশকে বিদ্ধ করল। তার মানে এটা হলো সংকেত। এরপর পঞ্চাশটা বর্শা বন্দীর কান, নাক, চোখ, হাত, পা প্রভৃতি সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিদ্ধ করল একে একে। বন্দীটার মধ্যে তখনো কিছু চেতনা অবশিষ্ট ছিল। তবু ভয়ঙ্করভাবে পীড়ন চালিয়ে যেতে লাগল তারা তার উপর।

    টারজান যখন দেখল গাঁয়ের যত সব সমবেত নরনারীর দৃষ্টি বন্দীটার উপর নিবদ্ধ তখন সে গাছ থেকে বিষমাখানো সব তীরগুলো একটা দড়িতে বেঁধে সেইখানেই রেখে দিল। তারপর তার উপস্থিতিটা তাদের জানিয়ে দেবার জন্য মতলব আঁটতে লাগল।

    হঠাৎ কি মনে হতে সেদিন যে কুঁড়েটাতে গিয়েছিল সেই ঘরটাতে চুপি চুপি সকলের অলক্ষ্যে অগোচরে গিয়ে হাজির হলো। অন্ধকার ঘরখানার মধ্যে সে ঢুকতেই একটা মেয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে একটা রান্নার পাত্র নিয়ে গেল। টারজান একটা দেওয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর মেয়েটা বেরিয়ে গেলে সে একটা নারকেল নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

    আবার সেই গাছতলাটায় গিয়ে পৌঁছল টারজান। তারপর তীরের বান্ডিলটা নিয়ে গাছের একটা উঁচু ডালের উপর উঠে বসল। তারপর যখন দেখল মেয়েরা রান্নার জন্য জল গরম আর লোকগুলো মৃত বন্দীটার মাংস তৈরি করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তখন সে সেই নারকেল সজোরে ওদের মাঝখানে। ছুঁড়ে দিল। নারকেলটা ভিড়ের মধ্যে একটা লোকের মাথায় লাগতেই সে মাটিতে পড়ে গেল।

    সমবেত জনতা এতে দারুণ ভয় পেয় সকলে ছুটে পালিয়ে গেল আপন আপন ঘরে। আকাশ থেকে অকস্মাৎ একটা নারকেল পড়ায় তাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মন ভয়ে অভিভূত হয়ে গেল। পরে যখন তারা দেখল বিষমাখানো তীরগুলো কে নিয়ে গেছে আর কড়াইটা সেদিনকার মত উল্টোন অবস্থায় পড়ে আছে তখন তাদের ভয় আরও বেড়ে গেল। তারা ভাবল হয়ত জঙ্গলের দেবতাকে রুষ্ট করেছে কোন ভেবে। তাই তাঁকে তুষ্ট করার জন্য কিছু পূজা উপাচার দিতে হবে। সেই থেকে গাছতলাটায় রোজ কিছু খাবার রেখে দিত সেই বনদেবতার উদ্দেশ্যে।

    সেই রাতটা টারজান সেই গাছটা হতে কিছু দূরে কাটাল। তারপর সকাল হতেই সে তাদের ডেরার দিকে রওনা হলো। হঠাৎ টারজান দেখল তার থেকে কুড়ি পা দূরে একটা সিংহী দাঁড়িয়ে আছে। তার হলুদ জ্বলজ্বলে চোখ দুটো টারজনের উপর নিবদ্ধ ছিল।

    টারজান এই সুযোগ অনেকদিন ধরে খুঁজছিল। ফাঁসের দড়িটা তার ঘাড়ের উপর ছিল। কিন্তু এবার ফাঁসের দড়ির কোন প্রয়োজন নেই। এবার সে ধনুকে একটা তীর লাগিয়ে ছুঁড়ে দিল সিংহীটা লাফ দেবার আগেই। টারজান পাশে সরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আর একটা তীর ছুঁড়ে দিল। তীরটা সিংহীটার পাছায় লাগল সিংহীটা গর্জন করে ঘুরে টারজানক আক্রমণ করল। টারজান আবার একটা তীর ছুঁড়ল। এই তৃতীয় তীরটা সিংহীটার একটা চোখে লাগল। চোখটা তীরবিদ্ধ হওয়ায় সিংহীটা ক্ষেপে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। টারজনের উপর। টারজান সিংহীটার তলায় পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার ছুরিটা বার করে সিংহীটার পেটে বসিয়ে দিল। ক্রমে টারজান দেখল সিংহীটার দেহটা নিথর হয়ে ঢলে পড়ল।

    তার উপর পড়ে থাকা সিংহীটার মৃতদেহ সরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে একটা পা মৃতদেহের উপর রেখে বিজয়ী পুরুষ বাঁদর-গোরিলার মত উল্লাসে চীৎকার করে উঠল টারজান।

    সিংহীর মাংসটা খেতে ভাল নয়। শক্ত আর কেমন বিদঘুঁটে গন্ধ। তবু ক্ষিদের জ্বালায় বেশ কিছুটা খেয়ে চামড়াটা ছাড়িয়ে নিল। তারপর রোদে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল গভীরভাবে। পরের দিন উঠতে দুপুর হয়ে গেল।

    কিছুক্ষণ ধরে বনের মধ্য দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ একটা হরিণ দেখতে পেল পথে। হরিণটা টারজানকে দেখতে পাবার আগেই তার একটা বিষাক্ত তীর এসে তার বুকে বিঁধল। সঙ্গে সঙ্গে হরিণটা মরে পড়ে গেল ঝোপের ধারে। আবার পেট ভরে হরিণের মাংস খেল টারজান। কিন্তু এবার আর ঘুমোল না। সোজা ডেরার দিকে এগিয়ে চলল।

    দলের সামনে টারজান গিয়েই সিংহীর চামড়াটা তাদের গর্বের সঙ্গে দেখাল। তারপর বলল, শোন কার্চাকের দলের বাদরেরা, দেখ দেখ, বিরাট হত্যাকারী টারজান কি করেছে। তোমাদের মধ্যে নুমাদের দলের কাউকে মারতে পেরেছে? টারজান তোমাদের সব বাঁদরদের মধ্যে শক্তিশালী। টারজান হচ্ছে-’মানুষ’ এ কথাটা বলতে গিয়েও বলল না, কারণ মানুষ কাকে বলে তা বাদরেরা জানে না।

    বাদরদলের সবাই টারজনের চারপাশে সমবেত হয়ে তার শক্তির কথা সব মন দিয়ে শুনতে লাগল। একমাত্র কার্চাকে সরে গিয়ে টারজনের প্রতি তার ঘৃণা আর বিদ্বেষটাকে লালন করতে লাগল।

    হঠাৎ কার্চাকের মাথায় একটা কুবুদ্ধি খেলে গেল। ভয়ঙ্করভাবে গর্জন করতে করতে তার দলের অনেকগুলো বাদরের উপর একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের কামড়াতে শুরু করে দিল। কয়েকজনকে মেরে ফেলল। তারপর তার প্রধান শত্রু টারজনের খোঁজ করতে লাগল। দেখল টারজান একটা গাছের নিচু ডালে বসে রয়েছে।

    কার্চাক তখন সদম্ভে আহ্বান জানাল টারজানকে। বলল, নেমে এস টারজান। শক্তিশালী যোদ্ধারা কখনো শত্রুর ভয়ে গাছে উঠে থাকে না।

    ধীরে ধীরে গাছ থেকে নেমে পড়ল টারজান। কার্চাক তার দিকে এগিয়ে যেতেই দলের সবাই গাছের উপর এক একটা নিরাপদ জায়গা থেকে দেখতে লাগল। সাত ফুট লম্বা কাৰ্চাকের বিশাল দেহটার উপর তার ছোট মাথাটা একটা গোলাকার বলের মত দেখাচ্ছিল। হাঁ করে দাঁতগুলো বার করে সে গর্জন করতে লাগল।

    টারজনের হাতে তখন একমাত্র ছুরি ছাড়া আর কোন অস্ত্র ছিল না। তার তীর ধনুকটা একটু আগে কিছুটা দূরে নামিয়ে রেখেছে। কারণ সে তখন সিংহীর চামড়াটা সবাইকে দেখানোর জন্য ব্যস্ত ছিল।

    যাই হোক, খাপ থেকে ছুরিটা বার করে এগিয়ে আসা কার্চাকের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল টারজান। কার্চাক দুটো হাত বাড়িয়ে তাকে ধরতে এলে সে একটা হাত ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে তার ছুরিটা আমূল বসিয়ে দিল কার্চাকের বুকের উপর হৃৎপিণ্ডটার একটু নিচে। কিন্তু ছুরিটা তার বুক থেকে তুলতে পারল না টারজান। সেটা তেমনি বুকের উপর গাঁথাই রয়ে গেল। কারণ কাৰ্চাক তখন দাঁত বার করে টারজনের ঘাড়ের উপর একটা কামড় বসাতে যাচ্ছিল। দু’জনে পরস্পরকে বধ করার জন্য প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছিল।

    কিন্তু টারজনের ছুরিটা কাৰ্চাকের বুকে আমূল তখনো বসে থাকায় কার্চাকের শক্তি প্রায় কমে আসছিল। সে যতবার দু’হাত দিয়ে টারজনের দেহটাকে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিল, ততবারই টারজান ঘুষি মেরে সরিয়ে দিচ্ছল কাৰ্চাককে। অবশেষে কাৰ্চাকের দেহটা শক্ত হয়ে বুকে ছুরি সমেত লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

    টারজান তখন কার্চাকের বুক থেকে ছুরিটা বার করে তার মৃতদেহের উপর একটা পা তুলে দিয়ে তার বিজয়োল্লাসের দ্বারা সমস্ত বনভূমিকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত করে তুলল সে। এইভাবে প্রথম যৌবনেই বদর দলের রাজা হয়ে উঠল টারজান।

    দলের মধ্যে আর একজন ছিল যে ‘টারজনের প্রভুত্বকে মানতে চাইত না। সে হলো তুবলাতের ছেলে টারজ। কিন্তু টারজনের ধারাল চকচকে ছুরিটাকে দারুণ ভয় করত সে।

    টারজান জানত কাৰ্চাকের মত টারজও সুযোগ খুঁজছে তার উপর প্রতিশোধ নেবার জন্য। সুযোগ পেলেই প্রভুত্বটা ছিনিয়ে নেবে তার কাছ থেকে।

    একমাত্র দলপতির পরিবর্তন ছাড়া কয়েক মাস ধরে আর কোন ঘটনা ঘটেনি দলের মধ্যে। প্রায় দিন রাত্রিতে টারজান তার দলের সবাইকে দলপতি হিসাবে সেই নিগ্রোদের গায়ের সামনের মাঠটায় নিয়ে যেত। সেখানে গিয়ে বাঁদরগুলো পেট ভরে ফসল খেত।

    এই সময় টারজানও মাঝে মাঝে সেই গাঁয়ের ধারে গাছতলাটায় গিয়ে বিষমাখানো তীর চুরি করে নিয়ে আসত। গাছতলায় জঙ্গলের দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত যা খাবার থাকত টারজান তার কিছুটা খেত।

    গাঁয়ের লোকেরা যখন দেখত গাছতলায় নামানো খাবার রাতের মধ্যে এসে খেয়ে গেছে, তখন তারা ভাবত নিশ্চয়ই দেবতা স্বয়ং এসেছিল। ভাবত রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যাওয়া তীরগুলোও সেই দেবতাই হয়ত নিয়ে যায়। তখন তাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনে ভয়ের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। দলপতি মবঙ্গা তখন ভয়ে অন্য কোথাও সরে যাবার কথা ভাবে।

    কিছুকাল সমুদ্রের উপকূলের ধারে বাঁদর-দলটা বাস করতে লাগল। কারণ তাদের দলপতি টারজান কেবিনটার কাছাকাছি থাকতে ভালবাসত। কিন্তু একদিন যখন তারা দেখল একদল কৃষ্ণকায় লোক কোথা থেকে এসে সেখানে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপনের জন্য কতকগুলো কুঁড়েঘর তৈরি করছে তখন তারা আবার এমন এক নতুন জায়গায় চলে গেল যেখানে মানুষ যায় না।

    সেই গাঁ থেকে শিকারের জন্য তীর চুরি করে আনা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ল টারজনের পক্ষে। কারণ আগে যেখানে তীর রাখত প্রায়ই তীর চুরি হওয়ার জন্য সেখানে আর তীর রাখে না তারা। অন্য এক গোপন জায়গায় কোন ফসলের স্তূপের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। তার জন্য টারজান একদিন সমস্তক্ষণ একটা গাছের উপর পাতার আড়ালে লুকিয়ে রইল। তীরগুলোতে বিষ মাখিয়ে কোথায় তারা রাখে তা দেখে নিল।

    এরপর দু’বার রাত্রিকালে সেই গায়ে একটা কুঁড়ে ঘর থেকে বেশকিছু তীর চুরি করে নিয়ে এল। গাঁয়ের সশস্ত্র যোদ্ধাগুলো সবাই তখন ঘুমোচ্ছিল। যে ঘরে তীর ছিল সে ঘরেও কিছু লোক ঘুমোচ্ছিল। টারজান নিরাপদে সেখান থেকে তীর নিয়ে বেরিয়ে এলেও সে বুঝল এ কাজ বিপজ্জনক এবং বার বার তা করা উচিত নয়। তাই সে আর রাত্রিতে গাঁয়ের ভিতরে তীর চুরি করতে না গিয়ে পথে কোন নিগ্রো শিকারীকে দেখতে পেলে গাছের উপর থেকে তার গলায় ফাঁস লাগিয়ে তাকে বধ করে তার অস্ত্রগুলো সব কেড়ে নিত। অনেক সময় সেই সব মৃতদেহগুলো গলায় ফাঁস লাগা অবস্থায় গাঁয়ের পথে ফেলে রেখে দিত।

    টারজনের কেবিনের কাছাকাছি যেসব নিগ্রোরা অন্য জায়গা থেকে এসে বসতি স্থাপন করে তারা কেবিনটাকে দেখতে পায়নি। তবু টারজান প্রায়ই ভয় করত, তারা যে কোন সময়ে কেবিনটাকে দেখতে পেলেই তার ভিতরকার জিসিনপত্র সব লুটপাট করে নিয়ে যাবে। এজন্য সে দল ছেড়ে প্রায়ই কেবিনের ভিতরে অথবা তার কাছে কাছে থাকত। ফলে দলপতি হিসাবে তার কাজকর্মে অবহেলা হতে লাগল। বাঁদর-দলের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়াঝাটি হয়, বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং দলপতিকেই তা মেটাতে হয়। কিন্তু টারজান প্রায়ই অন্যত্র থাকায় দলের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ সব অমীমাংসিত রয়ে যায়। এ নিয়ে একদিন দলের কয়েকজন প্রবীণ সদস্য টারজনের কাছে অভিযোগ জানাল। তাদের কথা মেনে নিয়ে একটা মাস টারজান দলের সঙ্গে সঙ্গে থেকে কাটাল।

    একবার ট্যানা নামে একটা মেয়ে-বাঁদর এসে তার স্বামী গান্টোর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাল টারজনের কাছে। গান্টো তাকে মেরেছে, কামড়ে দিয়েছে। গান্টোকে ডাকল সে এসে বলল ট্যানা বড় কুঁড়ে, সে তার স্বামীকে মোটেই দেখে না, ফল-মাকড় এনে দেয় না। টারজান দু’পক্ষের কথা শুনে বিচার করে তাদের দুজনকেই তিরস্কার করল। গান্টো যেন তার স্ত্রীকে আর না মারে, মারলে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে তাকে আর ট্যানাও যেন কর্তব্যকর্ম ঠিকমত করে চলে।

    এই সব ছোটখাটো ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকে দলের মধ্যে। টারজান এতে বিরক্তি বোধ করে। তার কেবলি মনে হয় দলের অধিপতি হয়ে দলের সঙ্গে সঙ্গে সব সময় থাকা মানেই তার ব্যক্তিস্বাধীনতাকে খর্ব করে ক্ষুণ্ণ করে চলা। তাছাড়া তার কেবিনটা আর আশপাশের জায়গাটাকে বড় ভাল লাগল তার। নির্জন উপকূল, সূর্যালোকিত সমুদ্রের অনন্ত জলরাশি, কেবিনটার ভিতরের পরিচ্ছন্নতা, তারপর অসংখ্য বই-এর এক বিস্ময়কর জগৎ–এই সব কিছুর জন্য মনটা তার ব্যাকুল হয়ে থাকত সব সময়।

    একদিন সমুদ্রের ধারে শুয়ে ছিল টারজান। টারজনের কাছ থেকে কিছু দূরে টারক তাদের দলের একটা বুড়িকে তার চুলের মুঠি ধরে খুব জোর মারছিল আর বুড়িটা চীৎকার করছিল।

    টারজ যখন দেখল টারজান তার তীর ছাড়াই শুধু হাতেই এগিয়ে আসছে তার দিকে, তখন সে তার প্রভুত্বকে অস্বীকার করে ইচ্ছা করে আরো বেশি করে বুড়িটাকে পীড়ন করতে লাগল।

    তারপর জোর লড়াই চলতে লাগল দু’জনের মধ্যে। টারজ তার বুকে আর মাথায় অনেকগুলো ছুরির আঘাত খেল। আর টারজও তার দাঁত আর নখ দিয়ে টারজনের দেহের অনেক জায়গায় ক্ষত করে দিল। তার মাথার নিচে কপালের কাছে অনেকখানি চামড়া কেটে গিয়ে চোখের উপর ঝুলতে লাগল এমনভাবে যে সে ভাল করে দেখতে পাচ্ছিল না। এক সময় দু’জনে গড়াগড়ি খেতে লাগল। অবশেষে। টারজান টারকজের পিঠের উপর বসে তাকে বেকায়দায় ফেলে তার মাথাটা ধরে তার বুকের উপর। নোয়াতে লাগল আর একটু চাপ দিলে তার ঘাড়টা ভেঙ্গে যেত এবং টারজ মারা যেত।

    টারজান অনেক ভেবে টারজকে বাঁচিয়ে উচিত শিক্ষা দেবার জন্য তার ঘাড়টা বুকের উপর নুইয়ে বলল কা গোদা? তার মানে তুমি এবার হার মানছ?

    এক ভয়ঙ্কর যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল টারকজ। বলল, ‘কা গোদা। অর্থাৎ হার মানছি।

    এবার চাপ কিছু কমিয়ে দিল টারজান। কিন্তু একেবারে মুক্তি দিল না টারজকে। বলল, শোন আমি হচ্ছি বাদরদলের রাজা, বিরাট শিকারী, বিরাট যোদ্ধা। সারা জঙ্গলের মধ্যে আমার চেয়ে বড় আর কেউ নেই। তুমি হার মেনেছ আমার কাছে। দলের সবাই তা শুনেছে। আর কখনো তোমার রাজার সঙ্গে বা দলের আর কারো সঙ্গে ঝগড়া করো না। যদি তা করো তাহলে এর পরের বার তোমাকে মেরে ফেলব। বুঝলে?

    টারজ বলল, হুঁ।

    এবার বাঁদরদলের দিকে তাকিয়ে টারজান বলল, তোমরা এতে সন্তুষ্ট?

    সকলেই সমবেতভাবে উত্তর দিল, হুঁ।

    টারজান এবার টারজকে ধরে তুলে দিল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সকলে যে যার কাজে চলে গেল। যেন কিছুই হয়নি।

    কিন্তু বাঁদরদলের সকলের মনে এই বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে রইল যে টারজান এক বিরাট যোদ্ধা আর এক অদ্ভুত প্রাণী। শত্রুকে বধ করার ক্ষমতা তার থাকা সত্ত্বেও তাকে ছেড়ে দিয়েছে।

    সেদিন সন্ধ্যার কিছু আগে দলের পুরুষ বাঁদরদের সকলকে এক জায়গায় ডেকে টারজান বলল, আজ তোমরা সকলে নিজের চোখে দেখেছ টারজান তোমাদের সবার থেকে বড়, সবচেয়ে শক্তিশালী।

    তারা একবাক্যে সবাই বলল, হুঁ। টারজান সত্যিই মহান।

    টারজান আরও বলল, টারজান কিন্তু তোমাদের মত বাঁদর নয়। তার জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ আলাদা। সে তার জাতির লোকদের খোঁজে দূরে চলে যাবে সমুদ্রের ধার দিয়ে। তোমরা তোমাদের রাজাকে বেছে নাও দলের ভিতর থেকে। কারণ টারজান আর ফিরবে না।

    এইভাবে শ্বেতাঙ্গদের সন্ধানে একা বেরিয়ে পড়ল যুবক টারজান।

    বেশ কয়েকদিন ধরে কেবিনটাতেই সব সময় থেকে বিশ্রাম করতে লাগল টারজান।

    দশ দিন পরেই সুস্থ হয়ে উঠল টারজান। শুধু চোখের কাছে কপালের ক্ষতটা রয়ে গেল।

    টারকজের সঙ্গে লড়াইয়ে আহত হবার পর আবার দেহে শক্তি ফিরে পেয়েছে।

    একদিন টারজান দেখল কতকগুলো কৃষ্ণকায় লোক বনের ভিতর দিয়ে উধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে পালাচ্ছে। কিন্তু তারা দেখতে পেল না টারজান কখন তাদের গতিপথে মাথার উপর একটা গাছের ডালের উপর উঠে ওৎ পেতে বসে আছে।

    টারজান প্রথম দু’জনকে গাছের তলা দিয়ে চলে যেতে দিল। কিন্তু তৃতীয় লোকটাকে গাছের তলায় এলেই তার দড়ির ফাঁসটা লোকটার গলায় আটকে দিয়ে তাকে গাছের উপর তুলতে লাগল। লোকটার সঙ্গীরা পিছন ফিরে তা দেখে ভয়ে পালিয়ে গেল। টারজান তখন তাড়াতাড়ি লোকটাকে বধ করে তার অস্ত্র ও গয়নাগুলো নিয়ে নিল। তারপর তার কোমর থেকে হরিণের চামড়াটা ছাড়িয়ে নিয়ে নিজে পরল। তাকে সত্যিই মানুষের মত সুন্দর দেখাচ্ছে। এবার তার ইচ্ছে হলো তার এই পোশাকটা বাঁদরদলের সবাইকে দেখায়।

    টারজান এবার মৃতদেহটাকে কাঁধে করে গাঁয়ের গেটটার কাছে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিল। তারপর সে সেই গাছতলাটায় গিয়ে অনেকগুলো তীর নিয়ে বনদেবতার উদ্দেশ্যে রেখে দেওয়া খাবার খেয়ে চলে এল। এই ভাবে তার কাজ হাসিল করে কেবিনে ফিরে এল টারজান।

    সেদিন কেবিনে ফিরে এসে সমুদ্রের ধারে অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখল টারজান। দেখল স্থল দিয়ে তিন দিকে ঘেরা এক প্রাকৃতিক পোতাশ্রয়ের মত জায়গাটায় সমুদ্রের শান্ত জলের উপর একটা বড় জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। আর বেলাভূমির কাছে দাঁড়িয়ে আছে একটা নৌকা। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হলো এই যে একদল শ্বেতাঙ্গ বেলাভূমি আর তার কেবিনটার মাঝখানে ঘোরাফেরা করছে। টারজান একটা গাছের উপর উঠে পাতার আড়াল থেকে লক্ষ্য করতে লাগল ওদের।

    শ্বেতাঙ্গ লোকগুলো সংখ্যায় দশজন।

    রিভলবারের গুলির আওয়াজ জীবনে প্রথম শুনে আশ্চার্য হয়ে গেল টারজান। কিন্তু কোনরকম ভয় পেল না।

    টারজান দেখল, দৈত্যাকার লোকটা একজনের গুলিতে মরে যাবার পর বাকি লোকগুলো নৌকায় করে সেই জাহাজটায় গিয়ে উঠল। জাহাজের ডেকেও আরো কতকগুলো লোক ঘোরাফেরা করছিল।

    এই অবসরে টারজান গাছ থেকে নেমে কেবিনে গিয়ে দেখল কারা তার ভিতরে ঢুকে সব জিনিসপত্র তচনচ করে দিয়ে গেছে। তার হঠাৎ কি মনে পড়তেই ছুটে গিয়ে আলমারিটা খুলে দেখল টিনের বাক্সটা ঠিকই আছে। সেই ছোট টিনের বাক্সটাতে ক্লেটনের একটা ফটো আর তার ডায়েরী ছিল যে ডায়েরীর লেখাগুলো সে পড়ে বুঝতে পারেনি।

    টারজান কেবিনের জানালা দিয়ে দেখল জাহাজ থেকে একটা নৌকা নামিয়ে আর একদল লোককে চাপানো হচ্ছে তার উপর।

    টারজান বুঝতে পারল ওরা নিশ্চয় তীরে এসেই এই কেবিনটায় আশ্রয় নেবে। হঠাৎ সে একটা কাগজ আর পেন্সিল দিয়ে একটা নোটিশের মত লিখে দরজার উপর টাঙ্গিয়ে দিল। তারপর সেই টিনের বাক্সটা, অনেকগুলো তীর আর কাটা নিয়ে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে।

    দুটো নৌকায় করে কুড়িজন লোক মালপত্র নিয়ে বেলাভূমির রূপালি বালির স্তূপের উপর নামল। ওদের মধ্যে পনেরজন ছিল নাবিক। তাদের মুখগুলো ছিল শয়তানের মত দেখতে। বেশ বোঝা যাচ্ছিল তারা নোংরা প্রকৃতির আর রক্তপিপাসু। বাকি পাঁচজন ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। এই পাঁচজনের মধ্যে একজন ছিল বয়োবৃদ্ধ। তার মাথার চুলগুলো ছিল সাদা ধবধবে। বৃদ্ধের পিছনে ছিল লম্বা চেহারার এক যুবক, তার পরনে ছিল সাদা পোশাক। আর পিছনে ছিল আর একজন বয়োপ্রবীণ লোক। তার কপালটা খুব উঁচু এবং তার চালচলনের মধ্যে একটা উত্তেজনার ভাব ছিল। ওদের পিছনে ছিল একজন মোটাসোটা চেহারার নিগ্রো মহিলা। জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তার চোখগুলো ঘুরছিল। নাবিকগুলো যখন তাদের বাক্সপেটরাগুলো নৌকা থেকে নামাচ্ছিল নিগ্রো মহিলাটি তখন তাদের পানে তাকিয়েছিল। সবশেষে নামল উনিশ বছরের এক তরুণী। লম্বা চেহারার যুবকটি তাকে ধরে শুকনো বালির উপর নামিয়ে দিলে মেয়েটি তাকে ধন্যবাদ দিল।

    এই পাঁচজনের দলটি নীরবে বেলাভূমি থেকে কেবিনের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। মনে হলো এই কেবিনে এসে ওঠার ব্যাপারটা আগেই ঠিক হয়েছিল। নাবিকরা তাদের মালপত্রগুলো সব কেবিনটার মধ্যেই রেখে দিল।

    সহসা দরজার উপর টাঙ্গানো নোটিশটার উপর একজন নাকিবের চোখ পড়তেই বলল, এ আবার কি? এটা ত একটু আগে ছিল না।

    তখন অন্যান্য নাবিকরাও সেখানে জড়ো হয়ে ঘাড় উঁচু করে নোটিশটা দেখতে লাগল। বৃদ্ধ অধ্যাপক নোটিশটা জোরে চীৎকার করে পড়তে লাগল। এই বাড়িটা টারজনের। টারজান বহু পশু আর কৃষ্ণকায় ব্যক্তির হত্যাকারী। টারজনের কোন জিনিসপত্র নষ্ট করবে না। সে সবকিছু লক্ষ্য রাখছে। বাঁদর-দলের রাজা টারজান।

    নাবিকটা তখন বলে উঠল, কে এই শয়তান টারজান?

    যুবকটি বলল, সে নিশ্চয় কোন ইংরেজ।

    তরুণী মেয়েটি বলল, কিন্তু বাদর দলের রাজা টারজান কথাটার মানে কি?

    যুবকটি বলল, তা ত জানি না মিস পোর্টার। আপনি কি বলেন অধ্যাপক পোর্টার?

    অধ্যাপক আর্কিমেদিস পোর্টার চশমাটা ঠিক করে বললেন, খুবই উল্লেখযোগ্য ব্যাপার। কিন্তু আমি যা বলেছি তার বেশি ত কিছু বলতে পারব না ঘটনাটা ব্যাখ্যা করে।

    তরুণীটি বলল, কিন্তু বাবা, তুমি ত কিছুই বলনি এ বিষয়ে।

    অধ্যাপক পোর্টার বললেন, থাম থাম বাছা। এই সব সমস্যামূলক ব্যাপার নিয়ে তোমার ছোট্ট মাথাটা ঘামিও না।

    এই বলে তিনি তাঁর পায়ের তলার মাটিটার দিকে তাকিয়ে তাঁর পিছনের দিকে কোটের কোণটা ধরলেন।

    ইঁদুরমুখো নাবিকটা তখন বলল, এই বুড়োটা আমাদের থেকে বেশি কিছুই জানে না।

    নাবিকটার অপমানজনক কথায় রেগে গিয়ে যুবকটি বলল, তুমি যদি অধ্যাপক পোর্টার আর মিস পোর্টারের সঙ্গে দ্র ব্যবহার না করো তাহলে আমার হাতে বন্ধুক না থাকলেও তোমার ঘাড়টা শুধু হাতে ভেঙ্গে দেব।

    নাবিকটা এবার যুবক ক্লেটনের পিছন দিকে তাকিয়ে তার রিভলবারের ঘোড়াটার উপর হাত রাখল।

    এতক্ষণ ওরা কেউ দেখতে পায়নি ওদের সকলের অলক্ষ্যে অগোচরে একজন অদূরে একটা গাছের উপর পাতার আড়ালে বসে ওদের সব কাজকর্ম লক্ষ্য করছে। টারজান যখন প্রথম দেখে একটা নাবিক রিভলবার থেকে গুলি করে একজন লম্বা শ্বেতাঙ্গকে হত্যা করে তখনই সে নাবিকটার এই বর্বর আচরণে রেগে যায়। তারপর যখন দেখল সেই নাবিকটা আবার ক্লেটন নামে এক সুদর্শন শ্বেতাঙ্গ যুবককে হত্যা করার জন্য তার রিভলবারে হাত দিয়েছে তখন আর থাকতে পারল না।

    টারজান তখন তার হাতের বর্শাটা সেই উদ্ধত নাবিকটাকে লক্ষ্য করে সজোরে ছুঁড়ে দিল। বর্শাটা গিয়ে নাবিকটার একটা কাঁধ গভীরভাবে বিদ্ধ করল।

    ইঁদুরমুখো নাবিকটা যখন তার রিভলবারটা অর্ধেক বার করে গুলি করতে যায় এবং যখন অন্যান্য নাবিকরা তার পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তখনি অকস্মাৎ ঘটে যায় ঘটনাটা। বর্শার তীক্ষ্ণ ফলকের আঘাতে নাবিকটা পড়ে যায় মাটিতে।

    অধ্যাপক পোর্টার তখন তাঁর সহকারী সম্পাদক স্যামুয়েল ফিলান্ডারকে নিয়ে বনের ভিতরে ঘুরতে চলে গেছেন। নিগ্রো মহিলা এসমারাণ্ডা তখন কেবিনের ভিতর মালপত্রগুলো গুছিয়ে রাখছিল। নাবিকটা ক্লেটনের পিঠ লক্ষ্য করে গুলি করতে গেলে মিস পোর্টার ভয়ে চীৎকার করে ওঠে। এমন সময় টারজনের বর্শাটা নাবিকটার ডান কাঁধটাকে বিদ্ধ করতে সে পড়ে যায়। তার রিভলবার থেকে তখন গুলিটা বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু কারো গায়ে লাগেনি।

    সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য নাবিকরা এসে তার চারদিকে ভিড় করে দাঁড়ায়। অনেকে অস্ত্র হাতে বনের যেদিক থেকে বর্শাটা নিক্ষিপ্ত হয় সেদিকে তাকায়। কিন্তু কাউকে দেখতে না পেয়ে ভয় পেয়ে যায়। ক্লেটনও তখন ভিড়ের মাঝে এসে নাবিকের হাত থেকে পড়ে যাওয়া রিভলবারটা সকলের অলক্ষ্যে তুলে নিয়ে পকেটে রাখে।

    জেন পোর্টার নামে তরুণীটি তখন বলে ওঠে, কে বর্শা ছুঁড়ল?

    ক্লেটনও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বনের দিকে তাকাল। তারপর বলল, আমি জোর গলায় বলতে পারি বাদরদলের রাজা টারজান আমাদের লক্ষ্য করছে। বুঝেছি কাকে লক্ষ্য করে সে বর্শাটা ছোড়ে। তা যদি হয় তাহলে বুঝতে হবে সে আমাদের বন্ধু। কিন্তু তোমার বাবা ও ফিলান্ডার কোথায়? যেই হোক, জঙ্গলের মধ্যে সশস্ত্র একজন কেউ আছে।

    অধ্যাপক পোর্টার ও ফিলান্ডারের নাম ধরে জোরে ডাকতে লাগল ক্লেটন। কিন্তু কোন সাড়াশব্দ পেল না। তখন উদ্বেগে বিহ্বল হয়ে ক্লেটন বলল, এখন কি করা উচিত মিস পোর্টার? আমি তোমাকে এই সব গলাকাটা লোকগুলোর কাছে একা রেখে যেতে পারি না। জঙ্গলেও আমার সঙ্গে যেতে পারবে না। অথচ তোমার বাবার অবশ্যই খোঁজ করা উচিৎ। এই গভীর জঙ্গলে আমাদের সকলেরই জীবন বিপন্ন। কিছু মনে করো না, তোমার বাবা ফিরে এলে আমাদের বিপদাপন্ন অবস্থার কথাটা বুঝিয়ে দিতে হবে তাঁকে।

    জেন পোর্টার বলল, আমি মোটেই কিছু মনে করব না। এ বিষয়ে আমি তোমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।

    ক্লেটন আবার জেনকে বলল, তুমি রিভলবার ব্যবহার করতে পার? আমার কাছে একটা আছে। এইটা নিয়ে তুমি আর এসমারান্ডা কেবিনের মধ্যে অপেক্ষাকৃত নিরাপদে থাকতে পারবে। আমি ততক্ষণে ওঁদের খোঁজ করে আসি।

    ক্লেটনের কথামত কেবিনের মধ্যে চলে গেল জেন। ক্লেটন তখন নাবিকদের কাছে গিয়ে একটা রিভলবার চাইল। সে বনের ভিতরে যাবে। আহত নাবিকটা তখনো মরে নি। সে তার সঙ্গীদের বলল, ওকে অস্ত্র দিও না। সেই দীর্ঘদেহী শ্বেতাঙ্গ অফিসারকে খুন করার পর এই নাবিকটাই এখন তাদের ক্যাপ্টেন আর নাবিকদলের নেতা হয়েছে। অন্যান্য নাবিকরা তার বিরোধিতা করতে সাহস পায় নি।

    রিভলবারটা না পেয়ে মাটির উপর পড়ে থাকা বর্শাটা হাতে নিয়ে জঙ্গলের ভিতর চলে গেল ক্লেটন। এদিকে জেন আর এসমারাল্ডা কেবিনের দরজা বন্ধ করে ভিতরটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। হঠাৎ ঘরের মধ্যে নিটে নরকঙ্কাল দেখতে পেয়ে ভয়ে চীৎকার করে উঠল এসমারাল্ডা।

    জেন ভাবতে লাগল এই কঙ্কালগুলো কাদের, কিভাবেই বা তারা এখানে আসে এবং কোন্ অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে এরা নিহত হয়।

    ক্লেটন জঙ্গলের মধ্যে চলে গেলে ‘এ্যারো’ নামে অপেক্ষমান জাহাজের বিদ্রোহী নাবিকরা সকলে সেই দুটো নৌকায় করে জাহাজে চলে গেল।

    আর টারজান জীবনে এক নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। আজ সে অল্প সময়ে এতকিছু দেখেছে যে তার মাথা ঘুরছিল। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যজনক যে বস্তু সে দেখেছে তা হলো সুন্দরী তরুণী জেন পোর্টারের মুখখানা। টারজান বুঝল এই দলের মধ্যে যে সব শ্বেতাঙ্গরা রয়েছে তারা তারই মত মানুষ। তাছাড়া তাদের হাতে কোন অস্ত্র নেই; সুতরাং এর থেকে বোঝা যায় তারা কাউকে খুন করেনি। এবং নাবিকগুলোর মত তারা অন্তত নিষ্ঠুর নয়। অবশ্য সে যদিও দেখেছে যুবকটি তার হাত থেকে রিভলবারটা তরুণীটিকে দিয়েছে তবু তার যুবকটিকে ভাল লেগেছে এবং নিগ্রো মহিলাটি সুন্দরী তরুণীর সঙ্গিনী বলে তাকেও তার ভাল লাগছে।

    টারজান যখন দেখল দুবৃত্ত নাবিকগুলো জাহাজে চলে গেছে এবং জেনরা তার কেবিনের মধ্যে নিরাপদে আছে তখন যুবকের অনুসরণ করতে লাগল সে। যুবক কি জন্য বনের মধ্যে গেছে, বৃদ্ধ দু’জনই বা কেন গেছে তা সে কিছুই জানে না। তবু তারা বিপদে পড়তে পারে এই ভেবে গাছের উপর উঠে তাদের খোঁজ করতে গেল।

    গাছের ডালে ডালে এগিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই ক্লেটনের দেখা পেল টারজান। দেখল একটা গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে ক্লান্ত হয়ে মুখের ঘাম মুছছে ক্লেটন। আর তার অদূরে শীতা বা একটা চিতাবাঘ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। চিতাবাঘটাকে দেখতে পায়নি ক্লেটন। মাঝে মাঝে সে দু’জন লোকের নাম ধরে চীৎকার করে ডাকছিল। টারজান বুঝল সে সেই দু’জন বৃদ্ধের খোঁজ করছে। চিতা বাঘটাকে দেখতে না পেলে টারজান নিজেই সেই বৃদ্ধের খোঁজ করতে চলে যেত।

    শীতা বা চিতাবাঘটা ক্লেটনের উপর ঝাঁপ দেবার জন্য লাফ দিতে না দিতে বাঁদর-গোরিলাদের মত ভয়ঙ্কর একটা চীৎকার করে উঠল টারজান। সেই গর্জন শুনে চিতাবাঘটা লেজ গুটিয়ে একটা ঝোপের মধ্যে ঢুকে পড়ল।

    ক্লেটন তা শুনে চমকে উঠল ভয়ঙ্করভাবে। তার গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। এমন বিকট চীৎকার জীবনে সে কখনো শোনেনি।

    প্রথমে ক্লেটন বুঝে উঠতে পারল না এমন অবস্থায় কি সে করবে।

    কিন্তু টারজান বুঝল ক্লেটন ভুল পথে যাচ্ছে। এই পথে গেলে মবঙ্গাদের গায়ে গিয়ে উঠবে সে। বুঝল ক্লেটনের মত একজন শ্বেতাঙ্গ সামান্য একটা বর্শা হাতে নিয়ে সেখানে গেলে মৃত্যু তার অবধারিত।

    টারজান এবার কি করবে তা ভেবে পেল না। যদি সে তাকে কেবিনে যাবার সঠিক পথ দেখিয়ে না দেয় তাহলে এই জঙ্গলে মৃত্যু তা অনিবার্য। তাছাড়া তার ডান দিকে অল্প কিছু দূরেই একটা নুমা বা সিংহ তার উপর ঝাঁপ দেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। সিংহটা গর্জন করতেও শুরু করে দিয়েছে এবং তা শুনে ভয়ে সচকিত হয়ে বর্শাটা উঁচু করে ধরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্লেটন।

    হঠাৎ তার মাথার উপর একটা অদ্ভুত চীৎকার শুনতে পেল ক্লেটন। একটু আগে সে এই চীৎকারই শুনেছিল। সঙ্গে সঙ্গে ক্লেটন দেখল গাছের উপর থেকে একটা তীর এসে সিংহের গাটাকে বিদ্ধ করল। ক্লেটন একটু সরে গেল। সিংহটা তখন আবার তাকে আক্রমণ করার জন্য লাফ দিল। এবার ক্লেটন আশ্চর্য হয়ে দেখল দৈত্যাকার এক নগ্নদেহ মানুষ গাছ থেকে সিংহটার ঘাড়ের উপর লাফিয়ে পড়ল। এরপর যে দৃশ্য ক্লেটন দেখল তা সে জীবনে ভুলতে পারবে না কখনো। দৈত্যাকার সেই শ্বেতাঙ্গ মানুষটা সিংহটার কেশর ধরে খানিকটা উপর দিকে তুলে ডান হাত দিয়ে সিংহের ঘাড়টা জড়িয়ে ধরে ছুরিটা বা দিকের ঘাড়ের উপর বারবার আমূল বসিয়ে দিতে লাগল। টারজান এই আক্রমণের কাজটা এত দ্রুত সেরে ফেলল যে সিংহটা প্রতিআক্রমণের কোন সুযোগ পেল না।

    এবার তার সামনে সেই অদ্ভুতদর্শন দৈত্যাকার মানুষটাকে দেখতে লাগল ক্লেটন। কোমরে একটা পশুর চামড়া ছাড়া গায়ে আর কোন পোশাক-আশাক বলতে কিছুই নেই। গায়ে ও পায়ে রয়েছে আদিম অধিবাসীদের মত কতকগুলো গয়না। গলায় হীরকের লকেটওয়ালা একটা সোনার হার। গায়ের রংটা তারই মত আর বয়সে সে তারই মত যুবক।

    টারজান এবার শিকারের ছুরিটা খাপের মধ্যে ঢুকিয়ে তার ফেলে দেয়া তীর ধনুকটা কুড়িয়ে নিল। ক্লেটন ইংরেজি ভাষায় তাকে ধন্যবাদ দিল তার জীবন রক্ষার জন্য। কিন্তু টারজান লিখতে জানলেও উচ্চারণ না জানায় কোন কথা বলতে পারল না। এরপর ছুরি দিয়ে সিংহের মৃতদেহটা থেকে কিছুটা মাংস কেটে খাবার সময় ক্লেটনকেও ডাকল। কিন্তু ক্লেটন কাঁচা মাংস খেতে পারে না বলে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

    খাওয়া হয়ে গেলে টারজান ইশারায় ক্লেটনকে অনুসরণ করার জন্য অনুরোধ করল। কিন্তু ক্লেটন ভাবল লোকটা হয়ত তাকে জঙ্গলের গভীরে নিয়ে যাবে। সেজন্য সে তার সঙ্গে যেতে চাইল না। ক্লেটন একবার ভাবল এই হচ্ছে বাদরদলের টারজান। কিন্তু নাবিকের কাগজে ইংরেজি লেখা দেখে ভেবেছিল টারজান যে-ই হোক ইংরেজি জানে। কিন্তু এই লোকটা ইংরেজিতে কথা বলতে না পারায় সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারল না ক্লেটন।

    এদিকে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। টারজান তাকে পথ দেখিয়ে কেবিনে নিয়ে যাবে একথা ইশারায় ক্লেটন বললেও ক্লেটন তার সঙ্গে যেতে না চাওয়ায় তার জামার কলার ধরে তাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল টারজান।

    এদিকে কেবিনের মধ্যে সেই বেঞ্চটায় বসে এসমারাল্ডা ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। জেন তার পাশেই বসে ছিল। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। জানা অজানা কত সব জন্তু জানোয়ারের ডাক শোনা যাচ্ছে। অথচ তাদের তিনজন লোকই জঙ্গলের কোথায় কি করছে তার কিছুই ঠিক নেই।

    সহসা দরজার বাইরে কিসের একটা শব্দ শুনতে পেয়ে চমকে উঠল জেন।

    তার মনে হলো কোন একটা জন্তু তার ভারী দেহটা দিয়ে দরজায় চাপ দিচ্ছে। তার কিছু পরেই কেবিনের জানালার গরাদের ফাঁক দিয়ে বাইরে একটা সিংহকে দেখতে পেল। সিংহটা এবার জানালার গরাদের ভিতর দিয়ে মুখটা ঢোকাবার চেষ্টা করতে লাগল। তখন আকাশে চাঁদ থাকায় চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল সিংহটাকে।

    সিংহের মুখটা দেখে আর তার ডাক শুনে এমারাল্ডা মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে গেল মেঝের উপর।

    হঠাৎ জেনের মনে পড়ল ক্লেটন তাকে একটা রিভলবার দিয়ে গেছে। এবার সে সিংহের মুখের কাছে রিভলবার নিয়ে গিয়ে একটা গুলি করল। সঙ্গে সঙ্গে সিংহটাও নেমে গেল জানালার গরাদ থেকে।

    সিংহটা মরেনি। গুলি তার ঘাড়ের কাছে একটু লেগে যায়। গুলির কর্ণবিদারক শব্দে আর চোখ ধাঁধানো ঝলকানিতে ভয় পেয়ে কিছুটা সরে যায় সিংহটা। পর মুহূর্তেই সে নতুন উদ্যমে ও প্রচণ্ড রাগে আবার জানালার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু এবার ঘরের দু’জন বাসিন্দাই নীরব হয়ে শুয়ে আছে। আর কোন বাধা না পেয়ে এবার সে গরাদের ফাঁক দিয়ে তার মুখ আর কাঁধ দুটো একটু একটু করে ঢোকাতে লাগল। আর একটু হলেই সে তার গোটা দেহটা ঢুকিয়ে দেবে।

    জেন সহসা চোখ মেলে এই দৃশ্যই দেখতে পেল।

    পথ চলতে চলতে ক্লেটন একটা গুলির শব্দ শুনে ভয় পেয়ে যায়। জেনের জন্য শঙ্কা বেড়ে যায় তার।

    অবশেষে তারা উপকূলের কাছে ফাঁকা জায়গাটায় এসে পড়ল। টারজান ক্লেটনকে নিয়ে একশো ফুট উঁচু একটা গাছের উপর থেকে নেমে পড়ল। ওরা মাটিতে নেমেই দেখল কেবিনের জানালার উপর একটা সিংহ দাঁড়িয়ে গরাদের ভিতর দিয়ে ভিতরে মুখটা ঢুকিয়ে ঢুকবার চেষ্টা করছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে টারজান দ্রুত গতিতে সেখানে গিয়ে সিংহটার পিছনের পা দুটো ধরে টানতে লাগল। ক্লেটনও গিয়ে তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করতে লাগল।

    টারজান ক্লেটনকে বলল তার পিঠের তূণ থেকে একটা বিষাক্ত তীর আর কোমর থেকে ছুরিটা বার করে সেগুলো সিংহটার পিঠের উপর যেন সে বসিয়ে দেয়। কিন্তু ক্লেটন তার কথা বুঝতে পারল না। এদিকে টারজান সিংহটাকে ছাড়তেও পারছিল না।

    ওদিকে জেন চেতনা ফিরে পেয়ে যখন দেখল সিংহটা এবার ঘরে ঢুকবেই এবং তাদের দুজনের জীবন্ত দেহ থেকে মাংস ছিঁড়ে খাবে। তখন সে ঘরের মেঝে থেকে রিভলবারটা তুলে নিয়ে গুলি করে তাদের দুজনকেই হত্যা করার কথা ভাবছিল যাতে সিংহটা তাদের জীবন্ত ধরতে না পারে। এমন নময় সে দেখল বাইরে থেকে দু’জন লোক সিংহটাকে টেনে জানালা থেকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

    ক্লেটন এবার কেবিনের মধ্যে তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে জেনকে দরজা খুলতে বলল। জেনও তাড়াতাড়ি দরজা খুলে ক্লেটনকে ভিতরে ঢুকিয়ে নিল। বলল, ঐ বিকট চীৎকারটা কিসের।

    ক্লেটন বলল, যে ব্যক্তিটি সিংহীটাকে মেরে তোমার প্রাণ বাঁচিয়েছে এ চীৎকার তারই।

    এবার ক্লেটনের সঙ্গে বাইরে গিয়ে মরা সিংহীটাকে একবার নিজের চোখে দেখল জেন। কিন্তু টারজানকে দেখতে পেল না ওরা। তার আগেই অদৃশ্য হয়ে গেছে সে কোথায়। ওরা আবার ঘরের মধ্যে এসে দরজা বন্ধ করে দিল। জেন বলল, কী বিকট চীৎকার! এ চীঙ্কার কোন মানুষের হতে পারে না।

    ক্লেটন বলল, হ্যাঁ মিস পোর্টার। আমি দেখেছি। তবে সে হয় মানুষ অথবা কোন বনদেবতা।

    এরপর বনের মধ্যে যা যা ঘটেছিল, টারজান কিভাবে তার প্রাণ বাঁচায় তার সব কথা একে একে বলল জেনকে। সেই সঙ্গে বাদামী রঙের চামড়া, সুন্দর মুখ, অমিত আশ্চর্য শক্তি আর অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিসম্পন্ন সেই মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধা জানাল ওরা দুজনেই।

    ক্লেটন বলল, প্রথমে ভেবেছিলাম ঐ লোকটাই হলো টারজান। কিন্তু পরে দেখলাম ও ইংরেজি ভাষা বোঝে না, কথা বলতেও পারে না। সুতরাং ও কখনই টারজান নয়।

    জেন বলল, ও যেই হোক, ওর কাছে আমরা আমাদের জীবনের জন্য ঋণী। ঈশ্বর ওর মঙ্গল করুন। ওর জঙ্গলজীবন নিরাপদ করুন।

    কেবিন থেকে কয়েক মাইল দূরে বালুকাময় এক বেলাভূমির উপর দু’জন বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে ছিল। দু’জনে কোন একটা বিষয় নিয়ে তর্ক করছিল।

    প্রায় প্রতি মুহূর্তেই বন্য জীবজন্তুর গর্জন শোনা যাচ্ছিল। কেবিনটাতে ফিরে যাবার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে তারা। মাইলের পর মাইল ধরে বহু বনপথ পার হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই ভুল পথে এগিয়ে গেছে।

    এখান তাদের সামনে একমাত্র সমস্যা কিভাবে তাদের শিবিরে ফিরে যাবে। কোন পথে গেলে কেবিনটাকে খুঁজে পাবে। এরই উপর নির্ভর করছে তাদের জীবনমৃত্যু।

    ফিলান্ডার ঝোপের দিকে তাকিয়ে বলল, ঈশ্বরের নামে বলছি অধ্যাপক, বোধ হয় একটা সিংহ।

    অধ্যাপক পোর্টার বললেন, হ্যাঁ, খারাপ ভাষায় যদি বল তাহলে ওটা সিংহ। কিন্তু আমি বলছিলাম

    সিংহটা আমাদের অনুসরণ করছে। এই বলে ফিলান্ডার ছুটতে লাগল।

    অধ্যাপক পোর্টার তখন বললেন, থাম থাম ফিলান্ডার। এইভাবে ছোটাটা আমাদের মত শিক্ষিত লোকের কখনো শোভা পায় না।

    কিন্তু এবার অধ্যাপক নিজে পিছনে ফিরে তাকিয়ে সিংহটার হলুদ চোখদুটো আর আধ খোলা মুখের দাঁতগুলো দেখে ফিলান্ডারের পিছু পিছু তিনিও ছুটতে লাগলেন।

    অদূরে একটা গাছ থেকে একজোড়া চোখ তাদের সবকিছু লক্ষ্য করছিল। সে চোখ হচ্ছে টারজনের। টারজান তাদেরই খোঁজ করতে করতে এখানে এসে পড়ে।

    টারজান যখন দেখল ফিলান্ডার ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে তখন যে গাছে সে বসেছিল সেই গাছের নিচু ডালটা থেকে তার জামার কলার ধরে গাছের উপরে উঠিয়ে নিল তাকে। তারপর অধ্যাপক পোর্টার সেই গাছের তলায় এলে তাকেও তুলে নিল টারজান। নুমা বা সিংহটা তখন তার শিকার হাতছাড়া হয়ে যেতে হতবুদ্ধি হয়ে একটা লাফ দিয়ে গর্জন করে উঠল একবার।

    এদিকে টারজনের গর্জন শুনে হঠাৎ চমকে উঠে ফিলান্ডার পড়ে যাচ্ছিল গাছের ডাল থেকে। তার উপর অধ্যাপক পোর্টার ঢলে পড়ায় সে টাল সামলাতে না পারায় দু’জনেই দু’জনকে জড়াজড়ি করে পড়ে গেল গাছ থেকে।

    কিছুক্ষণ তারা দুজনেই চুপ করে মরার মত শুয়ে রইল। ভাবল তাদের হাত পা হয়ত ভেঙ্গে গেছে।

    কিছুক্ষণ পর প্রথমে দু’হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন অধ্যাপক পোর্টার।

    ফিলান্ডার এবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। দেখল তারও হাত পা ভাঙ্গেনি এবং দেহের সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গই অক্ষত আছে। এমন সময় নগ্নদেহ টারজনের দৈত্যাকার মূর্তিটা দেখে অধ্যাপক পোর্টারের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। অধ্যাপক পোর্টার দেখল সত্যিই তাদের সামনে একটা কৌপীন আর কতকগুলো ধাতুর গয়না পরা একটা নগ্নদেহ দৈত্য দাঁড়িয়ে আছে।

    অধ্যাপক টারজানকে অভিবাদন করে বলল, শুভ সন্ধ্যা স্যার।

    তার উত্তরে টারজান তাকে অনুসরণ করার জন্য ইশারা করল।

    ফিলান্ডার বলল, আমার মনে হয় ওকে অনুসরণ করাই আমাদের উচিত।

    অধ্যাপক পোর্টার বললেন, কিছু আগে তুমি আমাকে বুঝিয়েছিলে আমাদের শিবিরটা দক্ষিণ দিকে অবস্থিত এবং সেই মত আমরা এগোচ্ছিলাম। সুতরাং আমাদের দক্ষিণ দিকেই যেতে হবে।

    কিন্তু এ বিষয়ে ওদের তর্কবিতর্ককে আর এগোতে দিল না টারজান। সে তার দড়িটা দিয়ে ওদের দু’জনের ঘাড় দুটোকে বেঁধে ওদের টেনে নিয়ে যেতে লাগল। তখন দু’জনেই আর বাধা না দিয়ে স্বেচ্ছায় অনুসরণ করতে লাগল টারজানকে। যেতে যেতে অধ্যাপক পোর্টার একবার ফিলান্ডারকে বললেন, থাম থাম ফিলান্ডার, এই সব জোর জবরদস্তিমূলক কৌশলের কাছে আমাদের আত্মসমর্পণ করা উচিত নয়। কিন্তু সে বাধা টেকেনি।

    এইভাবে টারজনের সঙ্গে অনেকক্ষণ যাওয়ার পর ওরা ওদের সামনের কেবিনটাকে দেখতে পেল। কেবিনের কাছে এসে ওদের গলা থেকে দড়ির বাঁধনটা খুলে দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল টারজান।

    অধ্যাপক পোর্টার তখন বললেন, এখন দেখছ ফিলান্ডার, আমি যা বলেছিলাম তাই ঠিক। তোমার গোঁড়ামির জন্য কত বিপদে পড়তে হলো আমাদের।

    এরপর কেবিনে গিয়ে সকলের সঙ্গে মিলিত হয়ে সকাল পর্যন্ত তারা তাদের ভয়ঙ্কর কত সব অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে লাগল।

    সব শুনে এসমারাল্ডা বলল, ও মানুষ নয় যেন এক দেবদূত। ঈশ্বর একে আমাদের উদ্ধারের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন।

    ক্লেটন রসিকতার সুরে হেসে বলল, যদি তুমি মরা সিংহের কাঁচা মাংস খেতে স্বচক্ষে দেখতে এসমারাল্ডা তাহলে বলতে ও এই মর্ত্যেরই দেবদূত।

    গতকাল সকাল থেকে ওদের কারো কিছু খাওয়া হয়নি। তাই এবার ওরা খাবার তৈরির কথা ভাবল। নাবিকরা ওদের এখানে নামিয়ে দেবার সময় ওদের পাঁচজনের জন্য কিছু শুকনো মাংস, ময়দা, শাকসজি, বিস্কুট, চা, কফি প্রভৃতি দিয়ে যায়। কিন্তু তাতে ওদের ক্ষিদে মিটবে না।

    কিন্তু যা হোক কিছু খাওয়ার পরই ওদের এই কেবিনটাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে তাকে বসবাসযোগ্য করে তুলতে হবে। তবে ঠিক হলো প্রথমেই ঘর থেকে কঙ্কালগুলো সরাতে হবে। অর্থাৎ মাটি খুঁড়ে কবর দিতে হবে।

    অধ্যাপক পোর্টার কঙ্কালগুলো পরীক্ষা করে বললেন, বড় কঙ্কাল দুটো কোন এক শ্বেতাঙ্গ পুরুষ আর এক শ্বেতাঙ্গ নারীর। ছোট কঙ্কালটা অবশ্যই এই হতভাগ্য দম্পতির ছেলের। ক্লেটন পুরুষ কঙ্কালটার হাতের আঙ্গুলে একটা আংটি দেখতে পেল। আশ্চর্য হয়ে সে দেখল আংটিটাতে তাদের গ্রেস্টোক পরিবারের চিহ্ন রয়েছে।

    এমন সময় জেন একটা বই খুলে তার প্রথম পাতাতেই দেখল, ‘জন ক্লেটন, লন্ডন’ এই কথাগুলো লেখা রয়েছে। আর একটা বইয়ে শুধু গ্রেস্টোক এই নামটা লেখা আছে।

    জেন আশ্চর্য হয়ে ক্লেটনকে বলল, এর মানে কি মাস্টার ক্লেটন? এখানে তোমাদের পরিবারের লোকজনের নাম এল কোথা থেকে?

    ক্লেটন গম্ভীরভাবে উত্তর করল, আমার কাকা জন ক্লেটন নিখোঁজ হবার পর গ্রেস্টোক পরিবারের এই আংটিটা পাওয়া যাচ্ছিল না। আমরা জানতাম আমার কাকা সমুদ্রে ডুবে যান।

    জেন আবার বলল, কিন্তু এই আফ্রিকার জঙ্গলে কি করে এলেন তাঁরা?

    হয়ত সমুদ্রে জাহাজ ডুবিতে তাদের মৃত্যু ঘটেনি, এই কেবিনেই তাদের মৃত্যু হয়। মেঝের উপর পড়ে থাকা তার ঐ কঙ্কালই তার প্রমাণ।

    জেন বলল, তাহলে ঐ কঙ্কালটা হলো তাঁর স্ত্রী লেডী গ্রেস্টোকের।

    ক্লেটন বলল, সুন্দরী লেডী এ্যালিসের রূপগুণের কত কথাই না বাবা মার কাছ থেকে ছোটবেলায় শুনেছি। হায় হতভাগিনী মহিলা।

    যথাযোগ্য শ্রদ্ধা ও মর্যাদার সঙ্গে কঙ্কালগুলোকে সমাহিত করল ওরা কেবিনের পাশে। দুটো কবরের মাঝখানে একটা ছোট কবরে সমাহিত করা হলো কালার মৃত শিশুর কঙ্কালটাকে। এই শিশুর কঙ্কালটাকে কবরের ভিতর রাখতে গিয়ে ফিলান্ডার আশ্চর্য হয়ে একবার অধ্যাপক পোর্টারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, কারণ এতবড় লম্বা চওড়া কোন মানবশিশু সে কখনো দেখেনি।

    টারজান দূর থেকে একটা গাছের উপর থেকে সমস্ত ব্যাপারটা দেখতে লাগল।

    কবরে মাটি চাপা দেওয়ার কাজটা হয়ে গেলেই কেবিনের মধ্যে ফিরে এল ওরা।

    হঠাৎ সমুদ্রের উপর চোখ পড়তেই চমকে উঠল এসমারাল্ডা। ঐ দেখ, এ্যারো নামে জাহাজটা আমাদের এখানে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে।

    ক্লেটন বলল, ওরা বলেছিল আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে যাবে আমাদের হাতে।

    জেন বলল, এটা হচ্ছে স্নাইপ নামে সেই পাজী লোকটার কাজ। কিং নামে যে লোকটাকে ওরা মেরে ফেলল সে থাকলে আমাদের আত্মরক্ষার জন্য উপযুক্ত অস্ত্র দিয়ে যেত।

    অধ্যাপক পোর্টার বললেন, যাবার আগে আমাদের সঙ্গে দেখা না করে ওরা চলে যাওয়ায় আমি দুঃখিত। আমি ভেবেছিলাম আমার ধনরত্ন যা আছে ওদের কাছে তা আমাদের দিয়ে যেতে বলব। তা না হলে আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে।

    জেন তার বাবার পানে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর বলল, ওদের সেকথা বললেও তাতে কোন ফল হত না বাবা। কারণ ঐ ধন-রত্নের জন্যই ওরা অফিসারকে খুন করে আমাদের এখানে ফেলে রেখে গেছে।

    অধ্যাপক পোর্টার হাত দুটো জড়ো করে পিছনে কোমরের উপর রেখে জঙ্গলের দিকে একাই চলে গেলেন।

    জাহাজটার গতিবিধি লক্ষ্য করে সমুদ্রের ধারে গাছের উপর দিয়ে এগিয়ে চলল টারজান।

    টারজান দেখল জাহাজটা মৃদুমন্দ বাতাসে ধীর গতিতে কূলের দিকে আবার এগিয়ে আসছে। একটা নৌকা জাহাজ থেকে নামানো হলো। তাতে একটা বড় সিন্দুক চাপানো হলো। নৌকাটা কূলে এসে, ভিড়তেই কয়েকজন লোক সিন্দুকটা কূলের উপর নামাল।

    এবার স্নাইপ নামে সেই ইঁদুরমুখো নাবিকটা নৌকা থেকে অন্য সব লোকজনদের ডাকতেই তারা কোদাল গাঁইতি প্রভৃতি নিয়ে মাটি খোঁড়ার জন্য এগিয়ে এল।

    স্নাইপ প্রভুত্বের সুরে তাদের হুকুম করতে একজন নাবিক বলে উঠল, তুমি কি করবে?

    স্নাইপ বলল, আমি এখন ক্যাপ্টেন। ক্যাপ্টেন হয়ে আমি তোমাদের সঙ্গে মাটি খুঁড়ব, এটা নিশ্চয় তোমরা চাও না?

    স্নাইপ তাদের রিভলবারের ভয় দেখাতে টারান্ট নামে একজন নাবিক কুড়াল দিয়ে অতর্কিতে স্লাইপের। মাথায় আঘাত করল। সঙ্গে সঙ্গে শ্লাইপের মাথাটা দু’ফাঁক হয়ে গেল এবং সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

    তারপর তারা সকলে মিলে মাটি খুঁড়ে অনেকটা খাল করে সিন্দুকটা বসিয়ে তার উপর স্লাইপের মৃতদেহটা শুইয়ে দিল। স্নাইপর কাছে যেসব অস্ত্র, পোশাক আর লোভনীয় জিনিস ছিল তা সব তারা নিয়ে নিল।

    কাজ সেরে নাবিকরা সবাই নৌকায় করে জাহাজে গিয়ে জাহাজ ছেড়ে দিল। জাহাজটা ধীর গতিতে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।

    গাছ থেকে নেমে পড়ল টারজন্। দেখল একটা কোদাল পাশের ঝোপের মধ্যে ফেলে রেখে গেছে নাবিকরা। সেই কোদালটা দিয়ে সে কবরটার নরম মাটিগুলো আবার খুঁড়তে লাগল। তারপর সিন্দুকটা বার করে স্লাইপের মৃতদেহটা তার মধ্যে রেখে আবার মাটি চাপা দিয়ে দিল। তারপর কোদালটা দড়ি দিয়ে বেঁধে পিঠে ঝুলিয়ে সিন্দুকটা অনায়াসে কাঁধে নিয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে পায়ে হেঁটে এগিয়ে চলল। জঙ্গলের গভীরে সে এমন একটা ফাঁকা জায়গা খুঁজল যেখানে সে এটা পুঁতে রাখতে পারবে। লোহার সিন্দুকটায় ভারী তালা লাগানো থাকায় সে এটা বুঝতে পেরেছে যে এর মধ্যে নিশ্চয় কোন মূল্যবান বস্তু আছে।

    কয়েক ঘণ্টা পথ চলার পর একদিন সেখানে তার দলের বাঁদর-গোরিলারা দমদম নাচের উৎসব করেছিল সেখানে গিয়ে হাজির হলো সে। তারপর সেই ফাঁকা জায়গাটায় কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ে অনেকটা খাল করে সিন্দুকটা পুঁতে রাখল। অবশেষে কাজ সেরে গাছের উপর দিয়ে যখন কেবিনের কাছটায় গিয়ে পৌঁছল তখন প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেছে।

    কেবিনের কাছে গিয়ে টারজান দেখল ভিতরে আলো জ্বলছে। জেন টেবিলের উপর কাগজ রেখে কি লিখছিল আর এসমারাল্ডা পুরু ঘাস বিছিয়ে তার উপর বিছানা পেতে ঘুমোচ্ছিল।

    টারজান দেখল ঘরটা হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল। সে তখন জানালা দিয়ে একটা হাত বাড়িয়ে জেনের পাণ্ডুলিপিটা তুলে নিয়ে সে তার তুণের মধ্যে ভরে রেখে বনের মধ্যে চলে গেল।

    পরের দিন সকালে উঠেই টারজান কুড়ি মিনিট ধরে ক্রমাগত চেষ্টা করে যেতে লাগল লেখাগুলো পড়ার জন্য। অবশেষে দুই একটা শব্দ এখানে ওখানে বুঝতে পারল। তার অন্তরটা আনন্দে লাফিয়ে উঠল। আরো এক ঘণ্টা চেষ্টা করার পর সে সব লেখাগুলো পড়তে পারল। কাগজটাতে লেখা ছিলঃ

    আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল, ১০° দক্ষিণ অক্ষাংশ।
    ফেব্রুয়ারি ৩, ১৭০৯।

    প্রিয় হেজেল,
    নির্বোধের মত এ চিঠি লিখছি তোমায়, কারণ এ চিঠি তুমি কোনদিন পাবে কি না তা জানি না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এ্যারো জাহাজে করে ইউরোপ থেকে রওনা হবার পর থেকে যে সব ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা লাভ করেছি সেই সব অভিজ্ঞতার কথা কাউকে না বলে পারছি না। যদি আমরা সভ্য জগতে আর না। ফিরি এবং তারই সম্ভাবনা বেশি, তাহলে যে সব ঘটনাবলী আমাদের সকরুণ পরিণতির দিকে নিয়ে যায় তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ অন্তত এই চিঠির মধ্যে পাওয়া যাবে।

    তুমি জান, আমরা এক বৈজ্ঞানিক অভিযানে ইউরোপ থেকে কঙ্গো প্রদেশের পথে রওনা হই। আমার বাবার বিশ্বাস এক অতি প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন কঙ্গো উপত্যকার গর্ভে নিহিত আছে। কিন্তু সমুদ্র। পথে আসার সময় এক আসল সত্যের সন্ধান পাই আমরা।

    বাল্টিমোরের এক বইপোকা পাঠক একখানা বই ঘাটতে ঘাটতে ১৫৫০ সালে স্প্যানিশ ভাষায় লেখা একটি চিঠি আবিষ্কার করেন। তাতে লেখা ছিল স্পেন থেকে দক্ষিণ আমেরিকাগামী একটি স্প্যানিশ জাহাজের বিদ্রোহী একদল নাবিক প্রচুর ধনরত্নের অধিকারী হয়। তবে যতদূর মনে হয় জলদস্যু হিসাবেই এই ধনরত্ন অধিকার করে তারা।

    পত্র লেখক এই প্রসঙ্গে আরও লেখে স্পেন থেকে একটি জাহাজে করে রওনা হবার এক সপ্তাহ পরেই সে জাহাজের নাবিকরা বিদ্রোহী হয়ে উঠে জাহাজের সব অফিসার ও সুযোগ্য নাবিকদের হত্যা করে। ফলে এতে তাদেরই ক্ষতি হয়। কারণ জাহাজ চালাবার মত কোন সুযোগ্য নাবিক আর কেউ ছিল না। তাদের মধ্যে।

    কোন না কোনভাবে উদ্ধার হবার আশায় তিন বছর সেখানে বাস করে ঐ দশজন নাবিক। পরে নানারকম রোগে ভুগতে ভুগতে মাত্র একজন ছাড়া সকলেই মারা যায় একে একে। এই জীবিত নাবিকটিই চিঠিখানি লেখে।

    সৌভাগ্যক্রমে সে উত্তর দিকেই যাচ্ছিল এবং সপ্তাহখানেকের মধ্যেই স্পেন দেশীয় এক পণ্যবাহী জাহাজের সঙ্গে পথে দেখা হয়ে যায় তার সঙ্গে। জাহাজটি তখন পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে স্পেনে। যাচ্ছিল। জাহাজটি তাকে সেই নৌকা থেকে তুলে নিয় তাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। সেই জাহাজের ক্যাপ্টেন তার সব কথা শুনে তাকে বলে যে দ্বীপে সে ছিল এবং যে দ্বীপ থেকে এসেছে সে দ্বীপটি হল ১৬ বা ১৭° উত্তর অক্ষাংশে অবস্থিত আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলের অন্তর্গত কেপ ভার্দে ছাড়া আর কিছু নয়।

    পত্র লেখক সেই দ্বীপটি এবং যে জায়গায় ধনরত্ন ভরা সিন্দুকটি পুঁতে রাখা হয় তার কথা বিস্তারিতভাবে লেখে এবং তার সঙ্গে জায়গাটার একটা মানচিত্রও জুড়ে দেয়।

    ৩৭ প্রথমে আমি ভেবেছিলাম আমরা এক বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে যাচ্ছি। কিন্তু বাবা যখন তাঁর আসল উদ্দেশ্যের কথা আমাকে বললেন তখন আমি দমে গেলাম। যখন শুনলাম তিনি এই সন্ধানকার্যের জন্য রবার্ট ক্যানলারের কাছ থেকে আরও দশ হাজার ডলার ঋণ নিয়েছেন তখন বুঝলাম আরও তিনি ঠকবেন। এই ঋণের ব্যাপারে আমার দুঃখ ও উদ্বেগ আরো বেড়ে গেল। বাবা সেই চিঠি আর মানচিত্রটার জন্য ঐ দশ হাজার ডলারই খরচ করেন।

    ক্যানলার তার টাকার জন্য কোন সুদ বা নিরাপত্তাসূচক কোন বন্ধকী জিনিস চায়নি। কিন্তু বাবা সে টাকা শোধ দিতে না পারলে আমার ভাগ্যে কি ঘটবে তা আমি জানি। লোকটাকে আমি সত্যিই দারুণ ঘৃণা করি।

    দীর্ঘ কাহিনীটাকে এবার সংক্ষিপ্ত করা যাক। আমরা মানচিত্রে নির্দিষ্ট দ্বীপ আর বহু আকাঙ্ক্ষিত ধনরত্ন ভরা সিন্দুকটা পেয়ে যাই যথাসময়ে। লোহার সিন্দুকটা অনেকগুলো পালের কাপড় দিয়ে জড়ানো ছিল। সেটাকে দেখে মনে হচ্ছিল যে দু’ হাজার বছর ধরে মাটির ভিতর পোঁতা আছে সেটা। সিন্দুকটা ছিল শুধু অসংখ্য স্বর্ণমুদ্রায় ভরা এবং এত ভারী যে চারজন লোকে সেটা বয়ে নিয়ে যেতে পারে না। এত ধনরত্নে ভরা সিন্দুকটা সত্যিই কি ভয়ঙ্কর বস্তু। এ সিন্দুক যখন যেখানেই যায় সেখানেই এসে জোটে যত দুর্ভাগ্য আর হানাহানির ব্যাপার।

    তুমি হয়তো ক্লেটনকে জান। সে লর্ড গ্রেস্টোকের একমাত্র পুত্র। ভবিষ্যতে সেই একদিন পিতার সব ভূ-সম্পত্তি আর সম্মানের উত্তরাধিকারী হবে। তাছাড়া ওর নিজেরও প্রচুর ধনসম্পত্তি আছে।

    এখানে অবতরণ করার পর থেকেই কত সব অদ্ভুত অদ্ভুত অভিজ্ঞতা লাভ করছি আমরা।

    কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো এক আশ্চর্য ব্যক্তির আবির্ভাব যে আমাদের সকলকে সব বিপদ থেকে উদ্ধার করে একে একে। আমি তাকে এখনো দেখিনি। কিন্তু বাবা, ফিলান্ডার আর ক্লেটন তাকে দেখেছে।

    এখন আমি খুবই ক্লান্ত। ক্লেটনের আনা একরাশ ঘাস দিয়ে তৈরি এক অদ্ভুত বিছানায় শুতে যাচ্ছি। আমি। এরপর আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যা যা ঘটে তা সব জানাব।–ইতি জেন পোর্টার।

    চিঠিখানা পড়ে একমনে ভাবতে লাগল টারজান। এ চিঠিতে এত সব কথা আছে যে কথা ভাবতে গিয়ে তার মাথা ঘুরছিল। একটা জিনিস এর থেকে বুঝল টারজান। টারজান আর সাইনবোর্ডে স্বাক্ষরকারী বাদরদলের টারজান যে একই ব্যক্তি তা ওরা জানে না। একথাটাই সে তাদের অবশ্যই বলবে।

    টারজনের কাছে একটা পেন্সিল ছিল। তাই দিয়ে সে জেনের স্বাক্ষরের তলায় চিঠিটার উপর ‘আমিই হচ্ছি বাঁদরদলের টারজান।’ এই কথাগুলো লিখে দিল।

    টারজান ভাবল তাদের মন থেকে সন্দেহ দূর করার পক্ষে এটাই যথেষ্ট। পরে জেনের এই চিঠিটা কেবিনে ফিরিয়ে দিয়ে আসবে এক সময়। তারপর ভাবল খাদ্য সম্বন্ধে তাদের দুশ্চিন্তার কোন কারণ। নেই। যে তাদের মাংস জুগিয়ে দেবে।

    পরের দিন সকালে জেন তার দুদিন আগে হারানো চিঠিটা ঠিক সেই জায়গাতেই পেয়ে গেল। টেবিলটার যেখানে সে রেখেছিল সেটাকে। আশর্য হয়ে গেল সে। কিন্তু চিঠিটার তলায় টারজনের স্বাক্ষরটা দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হিমশীতল একটা রোমাঞ্চ খেলে গেলে তার গোটা মেরুদণ্ডটা জুড়ে। সে চিঠিটা দেখাল ক্লেটনকে।

    জেন বলল, মনে হলো সেই ভূতুড়ে মানুষটা আমি চিঠি লেখার সময় সর্বক্ষণ আমাকে দেখছিল। একথা ভাবতেও ভয়ের একটা শিহরণ জাগে আমার সর্বাঙ্গে।

    ক্লেটন তাকে আশ্বাস দিয়ে বলল, সে কিন্তু আমাদের বন্ধু।

    তারপর থেকে রোজই কোন একটা মরা জীব জন্তু বা ফলমাকড় তাদের দরজার সামনে রাতের অন্ধকারে রেখে যেত টারজান। কোনদিন হরিণ, কোনদিন শুয়োর বা চিতাবাঘ, আবার কোনদিন পাশের গাঁ থেকে চুরি করে আনা কিছু রান্না খাবার বা চালডোর পিঠে তাদের জন্য রেখে দিয়ে যেত সে। একদিন একটা সিংহের মৃতদেহও রেখে দিয়ে যায়।

    এইভাবে একটি মাস কেটে গেল। একদিন বিকেলবেলায় ওদের সঙ্গে দেখা করার জন্য কেবিনে চলে গেল টারজান। গিয়ে দেখল ওরা তখন কেউ কেবিনে নেই।

    টারজান যখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল জেনের জন্য তখন তার অপরিচিত একটা শব্দ শুনে চমকে উঠল সে। বুঝল একটা বাঁদর-গোরিলা এইমাত্র একটা গাছে উঠল একটা শব্দ করে। আর ঠিক সেই সঙ্গে টারজান স্পষ্ট শুনতে পেল এক নারী কণ্ঠের ভয়ার্ত চীৎকার।

    ক্লেটন, অধ্যাপক পোর্টার ও ফিলান্ডার এই চীৎকার একই সঙ্গে শুনতে পায়। শুনতে পেয়েই তাড়াতাড়ি কেবিনের কাছে চলে আসে সকলে। কিন্তু এসে দেখে জেন বা এসমারাল্ট কেবিনের মধ্যে কেউ নেই।

    সঙ্গে সঙ্গে তারা তিনজনে জঙ্গলে গিয়ে জেনের নাম ধরে ডাকতে লাগল। কিন্তু ওদের দুজনেরই কোন সাড়াশব্দ শুনতে পেল না। হঠাৎ ঘুরতে ঘুরতে ক্লেটন এক জায়গায় দেখতে পেল এসমারাল্ডা মূর্হিত অবস্থায় পড়ে আছে।

    ক্লেটন দেখল এসমারান্ডা ভয়ে শুধু অচৈতন্য হয়ে পড়েছে।

    অধ্যাপক পোর্টার বললেন, আমি কি করব ক্লেটন বলতে পার? ঈশ্বর এমন নিষ্ঠুরভাবে আমার মেয়েটাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলেন?

    ক্লেটন বলল, দাঁড়ান, আগে এসমারাল্ডাকে জাগিয়ে দেখি, কি ঘটেছে ওর কাছ থেকে শুনি।

    এসমারাল্ডাকে জোর নাড়া দিয়ে জাগাল ক্লেটন। বলল, কি ঘটেছে বল। মিস পোর্টার কোথায়?

    এসমারান্ডা উঠে বসে বলল, হা ভগবান, আমি মরতে চাই। জেন এখানে নেই? তাহলে তাকে নিয়ে গেছে।

    ক্লেটন বলল, কে তাকে নিয়ে গেছে।

    এসমারান্ডা বলল, সারা দেহে লোমে ঢাকা দৈত্যের মত একটা জন্তু।

    মিস্টার ফিলান্ডার বলল, একটা গোরিলা?

    গোরিলার নাম করতেই সকলে ভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল।

    ক্লেটন একবার চারদিকে তাকিয়ে দেখল। কিন্তু চারদিকে ঘন জঙ্গলের মধ্যে কিছুই দেখতে পেল না। কিছুই বুঝতে পারল না।

    তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে। ওরা হতাশ হয়ে কেবিনে ফিরল। কেবিনের মধ্যে ওরা চুপচাপ বসে রইল।

    টারজান দল থেকে চলে যাবার পর টারজ সেই দলের অধিপতি হয়। কিন্তু তারপর থেকে দলের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ বেড়ে যায়। তখন টারজনের উপদেশের কথা স্মরণ করে একদিন টারজকে চার পাঁচজন মিলে আক্রমণ করে। টারজ পালিয়ে যায়।

    কয়েকদিন ধরে টারজ একা একা ঘুরে বেড়িয়ে তার দলের বাঁদরদের উপর প্রতিশোধ নেবার কথা ভাবতে থাকে। ঘুরতে ঘুরতে একদিন সে দুটো মেয়েকে বনের মধ্যে দেখতে পায়। দলপতি হিসাবে তার যে সব স্ত্রী ছিল দলের লোকেরা তাদের আটকে রেখে দিয়েছে তাকে তাড়িয়ে দিয়ে। তাই টারজ তার স্ত্রী করার জন্য এক নতুন মেয়ে বাঁদর-গোরিলার খোঁজ করছিল। জেনকে দেখে লোমহীন এক সাদা মেয়ে-বাঁদর ভেবে তাকে কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে গাছের উপর দিয়ে জঙ্গলের গভীরে পালাতে থাকে সে।

    এদিকে টারজান জেনের প্রথম চীৎকার শুনে ছুটে এসমারা যেখানে পড়ে ছিল সেখানে এসে হাজির হলো। তারপর গাছের উপর উঠে জেনের খোঁজ করতে লাগল। এসমারাল্ডাকে পড়ে থাকতে দেখে সে বেশ বুঝতে পারল তার সঙ্গিনী জেনকে কোন কিছুতে নিশ্চয় ধরে নিয়ে গেছে। তার তীক্ষ্ণ ঘ্রাণশক্তির সাহায্যে বাতাসে গন্ধ শুঁকে শুঁকে এগিয়ে যেতে লাগল গাছের উপর দিয়ে। বাদরদলের কাছ থেকে এক পশুসুলভ ঘ্রাণশক্তির অধিকারী হয় টারজান। তাই দিয়ে সে বুঝল কোন বাঁধর-গোরিলা গাছের উপর দিয়ে ধরে নিয়ে গেছে জেনকে কিছুক্ষণ আগে।

    ওদিকে টারকজও বুঝতে পেরেছিল তার পিছনে কেউ তাকে অনুসরণ করছে। এই ভেবে তার গতিবেগ বাড়িয়ে দিল। কিন্তু যখন দেখল অনুসরণকারী অনেক কাছে এসে পড়েছে তখন সে গাছ থেকে নেমে পড়ে জেনকে ধরে রইল। সে ভাবল তার প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করবে দরকার হলে, সে পালিয়ে যাবে না। এইভাবে তিন মাইল গাছে গাছে যাবার পর টারজান টারকজের সামনে চিতা বাঘের মত লাফিয়ে পড়ল।

    টারকজ যখন টারজানকে দেখল তখন ভাবল এই মেয়েটা টারজনের। তখন তার পুরনো শত্রুতা। এবং ঘৃণা আবার জেগে উঠল নতুন করে। তখন সে জেনকে ছেড়ে দিয়ে টারজনের সঙ্গে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হলো। টারজানও তার ছুরিটা শক্ত করে ধরে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর। টারজ তার ধারাল দাঁত বার করে টারজনের গায়ে কামড় দেবার আগেই টারজান বার বার তার ধারাল ছুরিটা বসিয়ে দিতে লাগল টারকজের বুকে। অবশেষে টারকজের রক্তাক্ত দেহটা নিষ্প্রাণ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই জেন। দু’হাত বাড়িয়ে টারজানকে জড়িয়ে ধরল।

    টারজানকে দেখে জেনও বুঝতে পেরেছিল এই লোকই তার বাবা ও ক্লেটনকে উদ্ধার করে এবং তাকে উদ্ধার করার জন্য সে এগিয়ে এসেছে। কিন্তু মানুষ হয়ে টারকজের মত এক ভয়ঙ্কর বাঁদর গোরিলার সঙ্গে কিভাবে পেরে উঠবে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল তার। অবশেষে বাঁদর- গোরিলাটার মৃত্যু ঘটতে সে টারজনের শক্তিতে আশ্চর্য হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে।

    কিন্তু সে প্রেমের আবেগটা কেটে যেতেই হুঁস হয় তার। সে টারজানকে সরিয়ে দেয় দু’হাত দিয়ে। টারজান আবার তার কাছে সরে আসতে এবারও সে তাকে সরিয়ে দেয়। তার প্রতি জেনের এই প্রবল। ঘৃণা দেখে তার মন বদলে গেল। সে জেনকে দুহাত দিয়ে ধরে জঙ্গলের গভীরে নিয়ে গেল।

    পরদিন সকালে কেবিন থেকে কামানের গোলার একটা শব্দ শুনে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল ক্লেটন। দেখল সমুদ্রের উপর দুটো জাহাজ উপকূলের খুব কাছাকাছি এসে ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছে। জাহাজ দুটোর মধ্যে একটা এ্যারো আর একটা ফরাসী যুদ্ধ জাহাজ। সে ফরাসী জাহাজটার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সেই উঁচু জায়গাটায় স্তূপাকৃত কাঠে আগুন ধরিয়ে দিয়ে তার একটা শার্ট ধরে নাড়াতে লাগল। তা দেখে ফরাসী যুদ্ধ জাহাজটা এগিয়ে এসে একটা নৌকা নামিয়ে দিল। এক যুবক অফিসার কয়েক জন সৈন্য নিয়ে নৌকায় করে বেলাভূমিতে এসে নামল।

    যুবক অফিসারটি এগিয়ে এসে ক্লেটনকে বলল, আপনিই মঁসিয়ে ক্লেটন না?

    ক্লেটন বলল, অবশেষে তুমি এসেছ? ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। খুব একটা দেরী হয়ে যায়নি।

    যুবক অফিসার বলল, এ কথার কি মানে উঁসিয়ে?

    ক্লেটন তখন তাকে জেনের অপহরণের কথা সব বলল। বলল, এখন তার অনুসন্ধানের জন্য সশস্ত্র লোকের দরকার।

    অফিসার বলল, হা ভগবান! গতকাল? তাহলে এখনো সময় আছে। খুবই ভয়ঙ্কর কথা।

    কিভাবে তারা এখানে এসে হাজির হয় এ বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে যুদ্ধ জাহাজের কমান্ডার ক্যাপ্টেন দানে জানাল কয়েক সপ্তাহ আগে ‘এ্যারো’ জাহাজটা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে তাদের জাহাজ থেকে সরে যাওয়ার পর তার খোঁজ করতে থাকে তারা। তারপর কয়েকদিন আগে দেখে সেটা সমুদ্রের বুকে ভেসে চলেছে। দূর থেকে মনে হলো জাহাজে যেন কোন লোক নেই। শুধু একজন লোক রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে তাদের কাছে যাবার জন্য ডাকছে।

    অবশেষে এমনি ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে পড়ি আমরা। আমরা গতকাল সন্ধ্যার সময় এসেই একটা কামান দাগি। কিন্তু তা আপনারা শুনতে পাননি। তারপর আজ সকালে আবার একটা কামান দাগি।

    গত সন্ধ্যায় ওরা বনের মধ্যে জেনের খোঁজে ব্যস্ত থাকায় কামানের গোলার শব্দ শুনতে পায়নি।

    এদিকে ততক্ষণে জাহাজ থেকে রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র এসে পড়ায় অধ্যাপক পোর্টার আর ক্লেটনের সঙ্গে ফরাসী সেনাদের একটি দল ততক্ষণাৎ রওনা হয়ে গেল জেনের খোঁজে।

    টারজান এবার বন পথ ছেড়ে গাছের উপর দিয়ে যেতে লাগল। জেন বুঝল এই ভীষণ অরণ্যে টারজনের কোলে সে সবচেয়ে নিরাপদ।

    তখন সবেমাত্র বিকেল হয়েছে। ভাবতে ভাবতে কয়েক মাইল পথ অতিক্রম করে অবশেষে সেই দমদম নাচের উৎসবের ফাঁকা জায়গাটার কাছে এসে পড়েছে তারা। গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে বিকেলের রোদ এসে লুটোপুটি খেলছিল সেই ফাঁকা জায়গাটায়।

    টারজান গাছ থেকে নেমে নরম ঘাসে ঢাকা একটা জায়গায় নামিয়ে দিল জেনকে। এক শান্ত স্বপ্নবেশে মনটা আচ্ছন্ন হয়ে উঠল জেনের। তার সামনে টারজনের দৈত্যাকার চেহারাটা দেখে তার নিরাপত্তাবোধ গম্ভীর হয়ে উঠল আরো।

    টারজান এক সময় ফাঁকা জায়গাটা পার হয়ে বনের ভিতরে চলে গেল।

    কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে টারজান তার পিছনে এসে দাঁড়াল। টারজনের পায়ের শব্দে ভয় পেয়ে পিছনে ফিরতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল জেন। টারজান তাকে ধরে ফেলল।

    একবার হাসতে হাসতে জেন বলল, তুমি ইংরেজিতে কথা বললে ভাল হত।

    টারজান নীরবে মাথা নাড়ল। জেন তখন ফরাসী ও জার্মান ভাষায় কথা বলল। কিন্তু তাও বুঝতে পারল না টারজান।

    এক সময় টারজনের গলায় সোনার চেন দিয়ে ঝোলানো হীরের লকেটটার দিকে তাকিয়ে সেটার দিকে হাত বাড়াল জেন। টারজান সেটা গলা থেকে খুলে জেনের হাতে দিল।

    জেন এবার টারজনের দিকে তাকিয়ে ভাল করে দেখল। দেখে মনে হলো মূর্তির পুরুষটি হয় টারজনের ভাই অথবা বাবা। টারজানও লকেটের ভিতরকার মূর্তি দুটো অপার বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতে লাগল। সে কখনো এই মূর্তি দুটো দেখেনি। লকেটটা যে ভোলা যায় এবং তার মধ্যে এই দুটো মূর্তি আছে তা সে ভাবতেও পারেনি।

    জেন ভেবে পেল না এই হীরের লকেটটা এই সুদূর আফ্রিকার জঙ্গলে এল কি করে।

    টারজান এবার তার পিঠের তৃণ থেকে তীরগুলো সরিয়ে তার তলা থেকে একটা ফটো বার করে জেনের হাতে দিল। ফটোটি লকেটপড়িহিত সেই পুরুষ মূর্তিটির। জেন মূর্তি দুটোর পানে টারজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। কিন্তু টারজান মাথা নেড়ে কি বোঝাতে চাইল। তারপর ফটোটা জেনের হাত থেকে নিয়ে আবার সেটা তূণের ভিতরে পুরে রাখল।

    জেন লকেটের পুরুষটার দিকে তখনো তাকিয়ে ভাবতে লাগল। পরে সে এই রহস্যের একটা সমাধান খুঁজে পেল। সে ভাবল এই লকেটটা আসলে লর্ড গ্রেস্টোকের। পরে তাঁর কেবিন থেকে টারজান সেটা ঘটনাক্রমে পেয়ে যায়। আর ঐ নারীমূর্তিটা লেডী এ্যালিসের। কিন্তু টারজনের চেহারা ও চোখ মুখের সঙ্গে ঐ মূর্তির সাদৃশ্যের কারণ কি তা বুঝতে পারল না অনেক ভেবেও।

    টারজান এবার লকেটসমেত চেনটা জেনের কাছ থেকে নিয়ে আবার জেনের গলাতেই পরিয়ে দিল। জেনকে এতে অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে উঠতে দেখে হাসতে লাগল।

    দেখতে দেখতে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসতে তারা আবার কিছু ফল খেল। তারপর টারজান জেনকে নিয়ে তার বিছানায় দিয়ে এল। তার নিজের ছুরিটা তার হাতে দিল। তারপর ডালপালার বেড়া দিয়ে ঘেরা তার বিছানাটা হতে বেরিয়ে এসে সেটার বাইরে ঘাস দিয়ে নিজের জন্য একটা বিছানা তৈরি করে শুয়ে পড়ল।

    সকালে ঘুম ভাঙতে জেন দেখল তখন রোদ উঠে গেছে।

    ফল দিয়ে প্রাতরাশ করার পর টারজান ইশারায় অনুসরণ করতে বলল জেনকে। তারপর জেনকে কাঁধে নিয়ে গাছের উপর উঠে পড়ল। জেন বুঝল টারজান তাকে কেবিনে নিয়ে যাচ্ছে।

    পথে যেতে যেতে মাঝখানে একবার একটা নদীর ধারে নেমে কিছু ফল আর জল খেয়ে নিল ওরা। কেবিনের কাছাকাছি এসে একটা লম্বা গাছের তলায় এসে টারজান হাত বাড়িয়ে কেবিনটা দেখিয়ে দিল জেনকে।

    কেবিনের পথে পা চালিয়ে দিল জেন। তখন গোধূলির অন্ধকার হয়ে উঠেছিল বেশ। ফিলান্ডার কেবিনের বাইরে ছিল। এসমারাল্ডা ছিল কেবিনের ভিতরে। ফিলান্ডারের দৃষ্টিশক্তিটা ছিল বড় ক্ষীণ। দূরের জিনিস নজর যায় না।

    হঠাৎ সামনে জেনকে দেখতে পেয়ে ফিলান্ডার আশ্চার্য হয়ে বলল, জেন তুমি! কোথা থেকে আসছ? কোথায় ছিলে?

    জেন হেসে বলল, দয়া করুন মিস্টার ফিলান্ডার, কি করে এক সঙ্গে এত প্রশ্নের উত্তর দেব?

    ফিলান্ডার বলল, তোমাকে নিরাপদ দেখে একই সঙ্গে এতদূর আনন্দিত ও বিস্মিত হয়েছি যে কি করছিলাম তা আমি নিজেই জানি না। এখন ভিতরে এস, যা যা ঘটেছিল সব বলবে আমায়।

    জেনের খোঁজে লেটন্যান্ট দার্ণ আর লেক্টন্যান্ট শার্পেন্তিয়েরের নেতৃত্বে সশস্ত্র দলটি বনের মধ্যে এগিয়ে যেতে যেতে বুঝল তাদের কাজটা ক্রমশই কঠিন হয়ে উঠছে। কিন্তু অধ্যাপক পোর্টার আর ক্লেটনের হতাশ মুখ দুটোর পানে তাকিয়ে ফিরে যেতে পারছিল না তারা। তাছাড়া দার্ণৎ ভাবছিল জেন আর বেঁচে নেই। এতক্ষণ তাকে কোন বন্যজন্তু খেয়ে ফেলেছে। এবং তার কঙ্কালটাই হয়তো পড়ে আছে। কোথাও।

    হঠাৎ প্রায় পঞ্চাশ জন নিগ্রো যোদ্ধা দার্ণকে ঘিরে ফেলতেই সে চীৎকার করে উঠল। সে তার রিভলবার থেকে গুলি করার আগেই তাকে তুলে নিয়ে পালাল জনকতক নিগ্রো। বাকিগুলো পথের ধারে ঝোপেঝাড়ে লুকিয়ে রইল।

    দার্ণতের চীৎকার শুনতে পেয়ে সৈন্যরা ছুটে গিয়ে রাইফেল থেকে গুলি করতে লাগল। এমন সময় বনের ভিতর থেকে একটা বর্শা এসে একজনের বুকে বিদ্ধ করতে সে সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল। অনেকগুলো তীর এসেও তাদের জনাকতকের গায়ে লাগল। ওরা তখন বন লক্ষ্য করে এগিয়ে গিয়ে নিগ্রোদের দেখতে পেয়ে জোর গুলি চালাতে লাগল। নিগারা তখন ভয়ে পালিয়ে গেল।

    কুড়িজন সৈন্যের মধ্যে চারজন ঘটনাস্থলে মারা যায়, প্রায় বারোজন আহত হয় এবং দার্ণৎ নিখোঁজ হয়।

    শার্পেন্তিয়ের তখন একটা ফাঁকা জায়গা দেখে শিবির স্থাপনের হুকুম দিল। শিবিরের সামনে আগুন জ্বেলে পালা করে প্রহরা দিয়ে রাতটা কাটাল ওরা।

    এদিকে দার্ণৎকে নিয়ে একজন নিগ্রো একেবারে গাঁয়ের মধ্যে চলে গেল। এক শ্বেতাঙ্গ বন্দীকে দেখতে পেয়ে গায়ের সব নারী পুরুষেরা ছুটে এল। আফ্রিকার একদল মানুষখেকো আদিম অধিবাসীদের মধ্যে একজন শ্বেতাঙ্গ বন্দী হিসেবে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলো দার্ণৎ। প্রথমে মেয়েরা লাঠি দিয়ে ও পাথর ছুঁড়ে মারতে লাগল দার্ণকে।

    দার্ণাৎ তখন অর্ধচেতন হয়ে পড়েছিল। এমন সময় কয়েকটা বর্শা তার গায়ের কয়েকটা জায়গা বিদ্ধ করল। তার গা থেকে তাজা গরম রক্ত ঝরতে লাগল।

    এদিকে টারজান জেনের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গুলির শব্দ শুনে মবঙ্গাদের গায়ের দিকে ছুটে যেতে থাকে। মবঙ্গাদের গায়ের দিকে গুলির আওয়াজ পেয়ে বিপদের আভাস পায় সে।

    অবশেষে গায়ের কাছে গিয়ে একটা গাছ থেকে টারজান দেখল একজন শ্বেতাঙ্গ বন্দী খুঁটিটায় বাঁধা আছে আর তার গায়ে খোঁচা মারা হচ্ছে। তবে তার মৃত্যু ঘটেনি তখনো।

    এমন সময় এক দুর্ধর্ষ পুরুষ গোরিলার মত গাছের উপর গর্জন করে উঠল টারজান। মুহূর্তে টারজান তার ফঁসের দড়িটা ছুঁড়ে দিয়ে একজন নিগ্রোকে টেনে তুলে নিল গাছের উপরে। নিগ্রোরা তাদের চোখের সামনে দেখল তাদেরই একজনের দেহটা গলায় ফাসবদ্ধ অবস্থায় শুন্যে ঝুলতে ঝুলতে একটা গাছের উপর ঘন পাতার মধ্যে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল কোথায়। তারা ভয়ে বিস্ময়ে হতবুদ্ধি ও অভিভূত হয়ে প্রথমে দাঁড়িয়ে রইল। কয়েক মুহূর্ত। তারপর উধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে যে যার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

    দার্ণৎ একা সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। সে দেখল গাছের উপর পাতার মধ্যে দেহটা কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। তার পরমুহূর্তেই সেই কৃষ্ণকায় দেহটা গাছের তলায় মাটির উপর সশব্দে পড়ে গেল। নিথর নিস্পন্দ দেহটা পড়ে রইল মাটিতে। এবার দেখল গাছ থেকে এক দৈত্যাকার শ্বেতাঙ্গ সোজা নেমে এসে তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।

    দার্ণৎ ভাবল লোকটা হয়তো তাকে নতুনভাবে পীড়ন করে হত্যা করার জন্য আসছে। কিন্তু তার মুখে নিষ্ঠুরতার কোন চিহ্ন খুঁজে পেল না। লোকটা এসেই তার বাঁধন কেটে দিয়ে তাকে মুক্ত করে দিল। দার্ণৎ তখন দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। তার ক্ষত-বিক্ষত দেহটা কাঁপছিল। কিন্তু টারজান তাকে ধরে ফেলে কাঁধের উপর তুলে নিল। দার্ণৎ এবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

    এদিকে ফরাসী সৈন্যদের শিবিরে সকাল হতেই লেফটন্যান্ট শার্পেন্তিয়ের কেবিনে ফিরে যাবে ঠিক করল।

    ওরা যখন কেবিনে গিয়ে পৌঁছল তখন বিকেল হয়ে গেছে। শোকে দুঃখে ওদের অন্তরগুলো ভারী হয়ে থাকলেও কেবিনে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে সব শোক, দুঃখ দূর হয়ে গেল মুহূর্তে। যে জেনের জন্য এত কাণ্ড সেই জেন কেবিনের সামনে দাঁড়িয়েছিল। জঙ্গল থেকে বেরিয়েই জেনকে দেখতে পেলেন অধ্যাপক পোর্টার আর ক্লেটন। জেন ছুটে এসে তার বাবার গলাটাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। তার চোখ থেকে জল ঝরে পড়ছিল। অধ্যাপক জেনের কাঁধের উপর মুখটা রেখে শিশুর মত ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।

    জেন তার বাবাকে হাত ধরে কেবিনে নিয়ে গেল। ফরাসী সৈন্যরা শার্পেন্তিয়েরের সঙ্গে বেলাভূমি থেকে নৌকায় করে জাহাজে চলে গেল। ক্লেটনও প্রথমে ওদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে গিয়ে কেবিনে। ফিরে এসে জেনের সঙ্গে দেখা করল।

    জেনকে দেখেই ক্লেটন আবেগের সঙ্গে বলে উঠল, জেন. ঈশ্বরের কি অসীম দয়া, তিনি তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন আমাদের। কিন্তু কেমন করে উদ্ধার পেলে?

    জেন কিছুটা গম্ভীর হয়ে বলল, মিস্টার ক্লেটন, আমি আপনাকে আমার বাবার প্রতি বীরোচিত শ্রদ্ধা ও আনুগত্য দেখে ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না।

    একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা না করে পারল না। বলল, যে তোমাদের রক্ষা করেছিল সেই বনের মানুষটির খবর কি? সে আর আসেনি?

    ক্লেটন বলল, কার কথা বলছ বুঝছি না।

    জেন বলল, যে তোমাকে এবং আমাকে ও আমাদের প্রায় প্রত্যেককেই মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছে।

    ক্লেটন বিস্মিত হয়ে বলল,ও বুঝেছি এবার। তোমাকেও তাহলে সে-ই উদ্ধার করে? তুমি এখনো কিন্তু সে সব কথার কিছুই বলনি। বল সে কথা।

    জেন বলল, সে আমাকে গতকাল কেবিনের কাছে ফাঁকা জায়গাটায় পৌঁছে দিয়ে জঙ্গলের ভিতর গুলির শব্দ শুনেই ছুটে চলে গেল। তারপর থেকে তাকে দেখতে পাইনি। আমার মনে হয় সে তোমাদের সাহায্যেই ছুটে যায়।

    শান্ত কণ্ঠে ক্লেটন বলল, তার দেখা আমরা পাইনি। সে হয়তো উপজাতিদের দলেই যোগ দিয়েছে।

    সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফারিত চোখে ক্লেটনের দিকে তাকিয়ে জেন বলল, না, কখনই তা হতে পারে না। উপজাতিরা নিগ্রো আর সে শ্বেতাঙ্গ এবং ভদ্র।

    ক্লেটন প্রথমে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। পরে বলল, সে একজন বন্য অর্ধবর্বর লোক মিস জেন। আমি তার বিষয়ে কিছুই জানি না। সে কোন উইরোপীয় ভাষাই জানে না। তাছাড়া তার গায়ের গয়নাগুলোও পশ্চিম আফ্রিকার আদিম অধিবাসীদের মত। এখান থেকে শত শত মাইলের মধ্যে কোন ভদ্র ও সভ্য মানুষ নেই। সেও হয়ত উপজাতিদেরই একজন এবং সেও একজন মানুষখেকো।

    জেন আবার জোর দিয়ে বলল, একথা আমি বিশ্বাস করি না। দেখো, নিশ্চয় সে ফিরে এসে প্রমাণ করে দেবে তোমার ধারণা ভুল। আমি বলছি সে একজন ভদ্রলোক।

    পরদিন সকালে দুশো ফরাসী সৈন্যের এক সশস্ত্র দল আবার দার্ণতের খোঁজে রওনা হলো। ওরা সরাসরি মবঙ্গাদের গায়ে গিয়ে গাটাকে আক্রমণ করবে। দার্ণৎকে নিগ্রোরা সেই গায়েই নিয়ে যায়। লেক্টন্যান্ট শার্পেন্তিয়ের গেল দলের নেতা হিসেবে। ‘

    দুপুর হতেই তারা সেই জায়গাটায় গিয়ে পৌঁছল যেখানে নিগ্রোদের সঙ্গে তাদের লড়াই হয়। পথটা তাদের চেনা বলে পৌঁছতে কষ্ট হলো না। সেখান থেকে সোজা গায়ের কাছে মাঠের ধারে জঙ্গলের শেষ প্রান্তে গিয়ে থামল। শার্পেন্তিয়ের একদল সৈন্যকে বনের পাশ দিয়ে কাঁটার পিছন দিকে পাঠিয়ে দিল। তারা প্রথম গুলি করে আক্রমণ শুরু করলেই ওরাও আক্রমণ শুরু করবে।

    প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে শার্পেন্তিয়ের তার সেনাদল নিয়ে ঘন জঙ্গলে গা-ঢাকা দিয়ে রইল। মাঠে তখন কিছু লোক কাজ করছিল। গাঁয়ের পথে অনেক লোক ঘোরাঘুরি করছিল। অবশেষে গুলির শব্দ শুনেই শার্পেন্তিয়ের তার দল নিয়ে গুলি করতে করতে গেটের কাছে এগিয়ে যেতে লাগল। মাঠ থেকে লোকেরা ছুটে গাঁয়ের ভিতর পালিয়ে গেল। গাঁয়ের লোকেরা অস্ত্র হাতে বেরিয়ে গায়ের পথে পথে লড়াই করতে লাগল।

    অতর্কিতে আক্রমণের জন্য গ্রামবাসীরা প্রস্তুত না থাকায় খুব একটা বাধা দিতে পারল না ফরাসী সৈন্যদের। বেশ কিছু ফরাসী সেনা আহত ও নিহত হলেও অনেক নিগ্রো যোদ্ধা গুলি খেয়ে মারা গেল। অনেক বন্দী হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে গোটা গাঁটা ওরা দখল করে ফেলল। নারী ও শিশুদের তারা অব্যাহতি দিল। অবশ্য কোন নারী তাদের আক্রমণ করলে আত্মরক্ষার খাতিরে মারতে হচ্ছিল।

    এবার দার্ণৎ সম্বন্ধে বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে দিল শার্পেন্তিয়ের। কয়েকজন গ্রামবাসীর পরনে দার্ণতের পোশাকের কিছু কিছু অংশ দেখে তার সন্দেহ গাঢ় হলো। ওরা হয়তো দার্ণৎকে হত্যা করে তার মাংস খেয়েছে। কিন্তু ওদের কথা নিগ্রো গ্রামবাসীদের কেউ বুঝতে পারল না। তারা শুধু ভয়ে অদ্ভুত রকমের অঙ্গভঙ্গি করে কি সব বোঝাতে চাইল।

    অবশেষে দার্ণতের কোন খোঁজ না পেয়ে হতাশ হয়ে রাত্রির মত গায়ের মধ্যেই শিবির স্থাপন করল শার্পেন্তিয়ের। রাতটা শিবিরে কাটিয়ে প্রত্যাবর্তনের সময় ওরা গাঁটা পুড়িয়ে দেবার মনস্থ করল। কিন্তু বন্দী গ্রামবাসীরা কান্নাকাটি করতে থাকায় তা করল না। তাহলে ওদের মাথা গোঁজার মত কোন ঠাই থাকবে না।

    ক্লেটন আর শার্পেন্তিয়ের সেনাদলের আগে আগে যেতে লাগল। সবশেষে আহতদের নিয়ে ঠেলাগাড়িগুলো আসছিল। শার্পেন্তিয়ের দুঃখে সান্ত্বনা দেবার মত কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না ক্লেটন। শার্পেন্তিয়ের খুবই দুঃখ পেয়েছে, কারণ দার্ণৎ ছিল তার ছেলেবেলাকার বন্ধু এবং সহকর্মী। শার্পেন্তিয়েরের দুঃখটা আরো বেশি করে বোধ করছিল এই কারণে যে দার্ণৎ বৃথাই বর্বর আদিবাসীদের হাতে প্রাণ দিল এবং সে প্রাণ দেবার আগেই জেন উদ্ধার পেয়ে ফিরে আসে।

    আহত ও মৃতদের নৌকায় করে জাহাজে নিয়ে যাওয়া হলো। ক্লেটন কয়েকদিন ধরে জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। সে কেবিনে গিয়ে শুয়ে পড়ল। কেবিনে ঢুকতে যাবার সময় জেনের সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেল। জেন দুঃখের সঙ্গে বলল, আহা বেচারা লেফটন্যান্টের কোন খোঁজই পেলে না।

    ক্লেটনও দুঃখের সঙ্গে জানাল, আমাদের যেতে দেরী হয়ে গেছে মিস পোর্টার।

    জেন আবার জিজ্ঞাসা করল, ওরা তাকে খুব পীড়ন করেছিল?

    ক্লেটন উত্তর করল, তাকে হত্যা করার আগে কি করেছিল তা আমরা জানতে পারিনি।

    জেন বলল, তাকে হত্যা করার আগে এই কথাটা কেন বললে?

    ক্লেটন বলল, হ্যাঁ মিস পোর্টার, ওরা নরখাদক।

    এমন সময় টারজনের প্রতি তার ঈর্ষাটা নতুন করে জেগে উঠল, বলল, তোমার বনদেবতা তোমার কাছ থেকে গিয়ে নিশ্চয় ওদের ভোজসভায় যোগদান করে।

    দার্ণৎ জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখল সে বনের মধ্যে একটা পুরু ঘাসের বিছানার উপর শুয়ে রয়েছে। তার চারদিকে দুর্ভেদ্য জঙ্গলের প্রাচীর।

    পূর্ণ চেতনা ফিরে পাবার পর দার্ণৎ অসংখ্য আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত দেহটায় সর্বত্র ব্যথা অনুভব করতে লাগল। সে বুঝল পায়ের উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াবার বা হাঁটা চলার ক্ষমতা তার নেই। বুঝতে পারছিল না সে কোথায় আছে- শত্রুদের না মিত্রদের কবলে।

    চেতনা হারাবার আগে যা যা ঘটেছিল তা সব একে একে মনে করার চেষ্টা করতে লাগল দার্ণৎ। তখন সেই দৈত্যাকার শ্বেতঙ্গের কথা মনে পড়ে গেল তার। মনে পড়ে গেল তারই কোলের মধ্যে চেতনা হারিয়ে ফেলে। সে জানে না তার ভবিষ্যৎ কি, তার ভাগ্যে কি আছে। বনের অসংখ্য পোকামাকড় আর ঝিঁঝির ডাক, পাখি আর বাঁদরদের কিচিরমিচির, গাছের পাতা নড়ার শব্দ, সব মিলিয়ে এ এক আশ্চর্য জগৎ। লোকালয় বা মানুষের সমাজ থেকে কত দূরে। দার্ণৎ আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

    বিকেলে ঘুম ভাঙ্গলে দার্ণৎ দেখল তার পায়ের কাছে তার দিকে পিছন ফিরে একজন দৈত্যাকার লোক বসে আছে। তার পিঠটা দেখতে তামাটে রঙের হলেও সে শ্বেতাঙ্গ।

    দার্ণৎ তাকে ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকল। লোকটি তার পাশ দিয়ে মাথার কাছে এসে তার কপালে তার ঠাণ্ডা হাতটা রাখল। দার্ণৎ তাকে ফরাসী ভাষায় কি বলল।

    দার্ণৎ দেখল লোকটি ইংরেজি জানে। সে মুখে বলল হ্যাঁ, আমি ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারি। এবার আমরা তাহলে কথা বলে আলাপ করতে পারি। প্রথমে তুমি আমার জন্য যা করেছ তার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি তোমায়।

    দার্ণৎ ছালটার উপর পেন্সিল দিয়ে লিখল, আমার নাম দার্ণ। আমি ফরাসী সেনাবাহিনীর একজন লেফটন্যান্ট। তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ। তুমি আমার জন্য যা যা করেছ তার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। আমার যা কিছু আছে তা তোমার। তবে কেন তুমি ইংরেজিতে কথা বলতে পার না তা জানতে পারি কি?

    টারজান তার উত্তরে লিখল, আমি যে কাৰ্চাকের বাঁদরদলের মধ্যে ছিলাম তাদের ভাষা আর কিছু বন্য জীবজন্তুর ভাষা ছাড়া আর কোন ভাষা বুঝতে পারি না। আমি কোন মানুষের সঙ্গে কখনো কথা বলিনি। একমাত্র আমেরিকান মেয়ে জেন পোর্টারের সঙ্গে ইশারায় কিছু কথা বলেছিলাম। জেনকে একটা বাঁদর গোরিলা ধরে নিয়ে পালিয়ে যায়।

    দার্ণৎ আবার লিখে জানতে চাইল, জেন পোর্টার কোথায়? অন্ধকারের মধ্যে যেন একটা আলো খুঁজে পেল দার্ণ।

    টারজান লিখল, এখন সে কেবিনে তার সঙ্গীদের কাছে আছে।

    দার্ণৎ আবার জানতে চাইল, সে তাহলে মরেনি? কোথায় সে ছিল? কি কি ঘটেছিল?

    টারজান জানাল, সে মরেনি। টারজ নামে একটা বাঁদর-গোরিলা তাকে তার বউ করার জন্য ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। তারপর টারজান টারককে হত্যা করে তাকে উদ্ধার করে। এই বনের কেউ টারজনের সঙ্গে লড়াই করে পেরে ওঠে না। আমিই হচ্ছি সেই বিরাট যোদ্ধা ও শিকারী বাঁদরদলের টারজান।

    দু’দিন পর দার্ণৎ একটু সুস্থ হলো। সে সেই ফাঁকা জায়গাটায় একটু হাঁটতে লাগল। সে যাতে পড়ে যায় তার জন্য টারজান তাকে ধরে রইল। এবার কিছু কথাবার্তা বলার জন্য টারজান তাকে পেন্সিল আর গাছের ছাল দিল। দার্ণৎ লিখল, তুমি আমার জন্য অনেক কিছু করেছ, আমি কিভাবে তোমার ঋণ শোধ করতে পারি।

    টারজান লিখল, তুমি আমাকে সেই ভাষা শিখিয়ে দাও যার মাধ্যমে আমি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারি।

    সেই দিন থেকেই টারজানকে ফরাসী ভাষায় কথা বলতে শেখাতে শুরু করে দিল দার্ণ। কারণ সে। ভাবল এটা তার নিজের মাতৃভাষা এবং এই ভাষাটা শেখানো সহজ হবে তার পক্ষে।

    প্রথমে শব্দ ও তারপর দুদিনের মধ্যে ছোট ছোট বাক্য উচ্চারণ করতে শিখল টারজান। এইভাবে তিন দিন শেখার পর টারজান দার্ণকে লিখে জানতে চাইল সে এখন বেশ সুস্থ বোধ করছে কি না এবং সে তাকে কেবিনের কাছে বয়ে নিয়ে গেলে তার কোন কষ্ট হবে কি না। দার্ণতেরও যাবার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল। তবু সে লিখল, কিন্তু এই এতখানি পথ বনের মধ্য দিয়ে কিভাবে আমাকে বয়ে নিয়ে যাবে?

    টারজান হাসল।

    দার্ণৎকে কাঁধে করে রওনা হয়ে পড়ল টারজান।

    ভর দুপুরে তারা কেবিনের সামনে সেই ফাঁকা জায়গাটার কাছে এসে পৌঁছল। গাছ থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে টারজনের অন্তরটা লাফিয়ে উঠল। জেনকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল সে।

    কিন্তু তারা দেখল কেবিনে কোন লোক নেই। দার্ণৎ দেখল দুটো জাহাজের কোনটাই নেই। এক নির্জন নীরবতা নিঃসীম শূন্যতায় খাঁ খাঁ করছে সমস্ত উপকূলভাগ জুড়ে।

    কেউ কোন কথা বলল না। টারজানই প্রথমে কেবিনের দরজা খুলল। ভিতরে কেই নেই দু’জনেই দুজনের পানে তাকাল। দার্ণৎ ভাবল তার দলের লোকেরা ভেবেছে সে মারা গেছে।

    টারজান যখন কেবিনের মধ্যে দাঁড়িয়ে তখন দার্ণ ঘরে ঢুকল। দেখল অনেক কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তার জন্য রেখে গেছে তারা। বেশ কিছু খাবার, রান্নার বাসনপত্র, একটা খাট, দুটো চেয়ার, একটা রাইফেল, অনেকগুলো আর পত্রপত্রিকা।

    টেবিলের দিকে এগিয়ে দার্ণৎ তার উপর দুটো চিঠি দেখতে পেল। দুটো চিঠিই বদরদলের টারজানকে লেখা। একটা চিঠি পুরুষের লেখা এবং সেটার মুখ খোলা, আর একটা চিঠি মেয়ে মানুষের হাতে লেখা এবং সেটির মুখ আঁটা। দার্ণৎ দরজার দিকে এগিয়ে টারজানকে বলল, তোমার দুটো চিঠি আছে। কিন্তু দেখল টারজান নেই, কোথায় চলে গেছে।

    দার্ণৎ বাইরে বেরিয়ে গিয়ে দেখল টারজান কোথাও নেই। সে তাহলে তাকে এখানে একা ফেলে রেখে বনে চলে গেল। কেবিনটা শূন্য দেখার সঙ্গে সঙ্গে টারজনের মুখে আহত হরিণীর মত এক সকরুণ ভাব ফুটে উঠতে দেখে দার্ণৎ।

    তাহলে ওরা আর কোনদিন ফিরে আসবে না। চিঠিখানা পড়েই হতাশ হয়ে খাটটার উপর বসে পড়ল দার্ণৎ। এক ঘণ্টা পরে দরজায় কিসের শব্দ শুনে চমকে উঠল সে। কে যেন দরজা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করছে। তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। কেবিনের ভিতরটা অন্ধকার। দাৎ দেখল খিলটা খুলে গেল এবং দরজাটার মধ্যে একটু ফাঁক হলো। মনে হলো একটা মানুষ যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে বাইরে। রাইফেলটা হাতে নিয়ে ঘোড়াটা টিপে দিল দার্ণৎ।

    সেদিন দার্ণৎকে না পেয়ে শার্পেন্তিয়ের ও ক্লেটন ফিরে এলে ফরাসী যুদ্ধ জাহাজের ক্যাপ্টেন দাফ্রেন জাহাজ ছেড়ে দেওয়ার মনস্থ করল। ঐ জাহাজে ক্লেটনরাও যাবে। কিন্তু একমাত্র জেন ছাড়া আর সকলেই রাজী হল কথাটায়। এখানে শুধু শুধু বসে থাকার কোন যুক্তি খুঁজে পেল না কেউ।

    এরপর দু’দিন গত হতেই ক্যাপ্টেন দানে ঘোষণা করল, পরের দিন সকালেই জাহাজ ছাড়বে। আর অপেক্ষা করে লাভ নেই।

    এবার আর কোন আপত্তি করল না জেন। কিন্তু সে একটা চিঠি লিখে খামটা এঁটে রেখে গেল টারজনের জন্য।

    তবু পরের দিন সকালে তার দলের সকলে কেবিন থেকে বেরিয়ে নৌকায় গিয়ে উঠলেও বিভিন্ন তুচ্ছ অজুহাতে কেবিন থেকে বের হতে দেরি করল সে। তারই অনুরোধে কেবিনে ব্যবহারযোগ্য কিছু জিনিসপত্র রেখে যাওয়া হয় দার্ণৎ আর কেবিন মালিক টারজুনের জন্য। যাবার সময় ঈশ্বরের কাছে তার সেই বনদেবতার জন্য প্রার্থনা করে জেন।

    কেবিনের দরজাটা ফাঁক করে একটা লোক ঢুকতে গেলেই তাকে লক্ষ্য করে রাইফেল থেকে একটা গুলি করল দার্ণৎ। সঙ্গে সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে ঘরের মেঝের মধ্যে পড়ে গেল লোকটা। দৰ্ণাৎ আবার একটা গুলি করতে যাচ্ছিল। কিন্তু প্রথম সন্ধ্যার পাতলা অন্ধকারে দার্ণৎ দেখল লোকটা শ্বেতাঙ্গ। পরমুহূর্তেই জানল সে তার পরম বন্ধু এবং রক্ষাকর্তা টারজানকে গুলি করেছে।

    সঙ্গে সঙ্গে একটা বেদনার্ত চীৎকার করে নতজানু হয়ে বসে টারজনের মাথাটা কোলের উপর তুলে নিল দার্ণৎ। তার বুকে কান পেতে দেখল হৃদস্পন্দন ঠিক আছে। একটা আলো জ্বেলে দেখল টারজনের মাথার একটা দিকের মাংস ছিঁড়ে দিয়েছে গুলিটা। মাথার খুলির হাড় ভাঙ্গেনি। সে তখন জল দিয়ে টারজনের ক্ষতটা ধুয়ে দিল। আঘাতটা গুরুতর হয়নি। ঠাণ্ডা জলের স্পর্শে চোখ মেলে তাকাল টারজান। চোখ খুলেই দার্ণৎকে দেখতে পেল। একটা কাপড় ছিঁড়ে তাই দিয়ে মাথাটাকে বেঁধে দিল দার্ণৎ। তারপর কাগজ কলম নিয়ে টারজানকে লিখে জানাল সে না জেনে টারজানকে গুলি করে চরম ভুল করেছে এবং আঘাতটা মারাত্মক হয়নি দেখে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে।

    লেখাটা পড়ে টারজান হেসে ফরাসী ভাষায় বলল, এটা এমন কিছু না।

    দার্ণৎ এবার ক্লেটন আর জেনের লেখা চিঠি দুটি তার হাতে দিল। ক্লেটনের চিঠিটা পড়ার পর মুখে একটা বিষাদ ফুটে উঠল তার। দার্ণ খামটা খুলে দিলে টারজান পড়তে লাগল।

    জেন লিখেছে, ক্লেটনের সঙ্গে আমিও এই কেবিনটা আমাদের ব্যবহার করতে দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি তোমায়। তবে জেনে রেখো আমি তোমার চিরদিনের বন্ধু।

    চিঠিটা পড়ে বিষণ্ণভাবে মাটির দিকে তাকিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা বসে রইল টারজান। ভাবল সবচেয়ে দুঃখের কথা, আমি আর বাঁদরদলের টারজান একই ব্যক্তি তা জেন জানে না।

    আর কথা না বলে জেনের ঘাসের বিছানাটাতেই শুয়ে পড়ল টারজান। দার্ণ আলোটা নিভিয়ে দিয়ে খাটের উপর শুয়ে পড়ল।

    সেই থেকে কেবিনেই দু’জনে রয়ে গেল। দার্ণ এক সপ্তাহ ধরে টারজানকে ফরাসী ভাষা শেখাল। তারপর টারজান ফরাসী ভাষায় তার সঙ্গে ভালভাবেই কথাবার্তা বলতে লাগল। একদিন রাত্রিবেলায় বিছানায় শুয়ে টারজান হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, আমেরিকা কোথায়?

    দার্ণৎ বলল, এখান থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে সমুদ্রের ওপারে হাজার হাজার মাইল দূরে।

    টারজান তৎক্ষণাৎ আলমারি থেকে একটা মানচিত্র এনে দার্ণকে বলল, আমাকে কোথায় কি আছে বুঝিয়ে দাও। আমি এসব কিছু বুঝি না।

    দার্ণৎ তাকে দেখিয়ে দিল তারা আজে আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে আর জেনের দেশ আমেরিকা সেখান থেকে কত দূরে। টারজান কিন্তু বুঝতে পারছিল না মানচিত্রে যেটা এত কাছে আসলে সেটা এত দূরে কেন। দার্ণৎ অনেক কষ্টে বুঝিয়ে দিল তাকে মানচিত্রে কোন জায়গার দূরতু কিভাবে মাপতে হয়।

    টারজান এবার জিজ্ঞাসা করল, আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ বস্তি আছে?

    দার্ণৎ উত্তর দিকে দেখিয়ে বলল, হ্যাঁ আছে।

    টারজান আবার জিজ্ঞাসা করল, সমুদ্র পার হবার মত কোন নৌকা বা জাহাজ তাদের আছে?

    দার্ণৎ বলল, হ্যাঁ আছে।

    টারজান বলল, তাহলে কালই আমরা সেখানে যাব।

    দার্ণৎ হেসে বলল, সেখানে আমরা পায়ে হেঁটে যেতে গেলে সেখানে পৌঁছবার আগেই আমরা মরে যাব।

    টারজান বলল, তাহলে তুমি এখানেই চিরকাল থাকবে?

    দার্ণৎ বলল, না।

    টারজান বলল, তাহলে কাল আমরা দুজনেই রওনা হব। এখানে থাকলে আমি মরে যাব।

    দার্ণৎ বলল, আমারও এখানে থাকতে আর ভাল লাগছে না। আমিও মরে যাব এখানে বেশি দিন থাকলে।

    দার্ণং বলল, যাবার টাকা পাবে কোথায়?

    টাকা কি টারজান জানে না। দার্ণৎ অনেক করে বোঝাল টাকা কিভাবে রোজগার করতে হয়।

    টারজান বলল, আমিও টাকার জন্য খাটব। খেটে রোজগার করব।

    দার্ণৎ বলল, ওখানে আমাদের দুজনের যাবার জন্য যা টাকা লাগবে সে টাকা আমার আছে।

    পরদিন সকালেই দু’জনে রওনা হলো। দু’জনে একটা করে বিছানা, একটা করে রাইফেল, বেশ কিছু গুলি, কিছু খাবার আর রান্নার বাসনপত্র সঙ্গে নিল। টারজান বাসনপত্রগুলো ফেলে দিল।

    ওরা সমুদ্রের উপকূল বরাবর এগিয়ে যেতে লাগল উত্তর দিকে। পথে কোন বাধা পেল না। যেতে যেতে সভ্য জগৎ সম্বন্ধে দার্ণতের কাছ থেকে অনেক কিছু জেনে নিল টারজান। দার্ণৎ তাকে কাঁটা চামচ দিয়ে কিভাবে খেতে হয় তা দেখিয়ে দিল। বলল, সভ্য জগতে দ্রভাবে খেতে হবে।

    কথায় কথায় টারজান লোহার সিন্দুকটার কথা বলল। বলল সে সেটা তুলে নিয়ে বনের সেই ফাঁকা জায়গাটায় পুঁতে রেখে দিয়েছে।

    দার্ণৎ বলল, সেখান থেকে আমরা তিন সপ্তার পথ হেঁটে এসেছি। সেখানে গিয়ে ফিরে আসতে এক মাসের উপর লেগে যাবে। তাছাড়া যে সিন্দুকটা চারজন নাবিক বইত তা আমরা কি করে নিয়ে পথ চলব? তার চেয়ে কোন জনপদে গিয়ে আমরা একটা নৌকা ভাড়া করে সেখানে গিয়ে সহজেই সেটা নিয়ে আসব।

    টারজান বলল, ঠিক আছে, খুব ভাল কথা। আমি সিন্দুকটা একা গিয়ে নিয়ে আসতে পারতাম একপক্ষ-কালের মধ্যেই। কিন্তু তোমাকে একা রেখে যেতে পারছি না।

    কথায় কথায় টারজান বলল, আমার মা হচ্ছে কালা নামে এক মেয়ে বাঁদার-গোরিলা।

    দার্ণৎ বলল, তোমার বাবা কে?

    টারজান বলল, আমার মা কালা বলত আমার বাবা একজন সাদা বদর যার গায়ে লোম নেই। অনেকটা আমারই মত।

    দার্ণং বলল, তোমার মা কখনই বাঁদর হতে পারে না। আচ্ছা, কেবিনের মধ্যে কোন লেখা পাওনি যাতে তোমার জন্ম সম্বন্ধে কোন হদিস পাওয়া যেতে পারে?

    টারজান তার তূণের তলা থেকে সেই ডায়েরীটা বার করে দার্ণতের হাতে দিল। বলল, এটা হয়ত তুমি পড়তে পারবে। ভাষাটা ইংরেজি নয় বলে পড়তে পারিনি।

    দার্ণৎ জোরে পড়তে লাগল ডায়েরীটা আর মাঝে মাঝে টারজনের দিকে তাকাতে লাগল। একজায়গায় লেখা ছিল, আজ আমাদের ছোট্ট পুত্র সন্তানটি ছ’মাসে পড়ল। আমি যে টেবিলে লিখছি তার পাশে এ্যালিসের কোলে সে বসে আছে। হাসিখুশিতে ভরা সুন্দর স্বাস্থ্যবান ছেলে। আমি চাই সে বড়। হয়ে উঠুক, জগতের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়াক, হয়ে উঠুক দ্বিতীয় ক্লেটন, গ্রেস্টোক বংশের গৌরব বৃদ্ধি করুক। সে আবার আমার কলমটা হাত থেকে ধরে আমার ডায়েরীতে হিজিবিজি কাটছে, তার ছোট ছোট আঙ্গুলগুলোর ক’টা ছাপও ফেলেছে।

    পড়া শেষ করে দার্ণৎ টারজানকে বলল, বুঝতে পারছ না তুমিই লর্ড গ্রেস্টোক?

    টারজান মাথা নেড়ে বলল, না ওঁদের একটামাত্র সন্তানের কথা লিখেছেন কিন্তু কেবিনের মধ্যে ওঁদের কঙ্কালের সঙ্গে একটি শিশুর কঙ্কালও পাওয়া যায়। অধ্যাপক পোর্টাররা কেবিনে সেই কঙ্কালগুলোকে সমাহিত করেন। আমিও প্রথমে এই কেবিনটাকে আমার জন্মস্থান ভাবতাম। পরে বুঝেছি এটা ভুল।

    দার্ণৎ তবু একথা মেনে নিতে পারল না। তার বিশ্বাস টারজানই জন ক্লেটনের ছেলে।

    পথ চলতেচলতে ওরা বনের ধারে একটা গাঁয়ের প্রান্তে এসে দাঁড়াল। একজন নিগ্রো তাদের দেখে ছুটে গিয়ে গায়ের লোকদের খবর দিল। সবাই ছোটাছুটি করে বেড়াতে লাগল। এমন সময় একজন শ্বেতাঙ্গ একটা রাইফেল হাতে করে এগিয়ে এল। দার্ণৎ চীৎকার করে তাকে জানাল, তারা তাদের শত্রু নয়, মিত্র।

    তখন সেই শ্বেতাঙ্গ বলল, তাহলে দাঁড়াও।

    দার্ণৎ টারজানকে বলল, থাম টারজান। উনি ভাবছেন, আমরা শত্রু।

    এবার তারা দু’জনে শ্বেতাঙ্গের দিকে এগিয়ে গেল। তারা কাছে এলে শ্বেতাঙ্গ ফরাসী ভাষায় বলল, কোন জাতীয় মানুষ তোমরা?

    দার্ণৎ বলল, আমরা শ্বেতাঙ্গ। জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলেছি।

    শ্বেতাঙ্গ লোকটি তার রাইফেলটি নামিয়ে তার হাত বাড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাল। তারপর বলল, আমি হচ্ছি ফরাসী মিশনের ফাদার কনস্তানতাইন।

    দার্ণৎ বলল, ইনি মঁসিয়ে টারজান আর আমি পল দার্ণৎ, ফরাসী নৌবাহিনীতে কাজ করি।

    টারজান তার হাতটা ফাদারের দিকে বাড়িয়ে দিল। এইভাবে জীবনে সর্বপ্রথম সভ্য জগতের সংস্পর্শে এল টারজান। ওরা এক সপ্তা সেই গায়েই ফাদার কনস্তানতাইনের কাছে রয়ে গেল।

    সেখান থেকে আবার যাত্রা শুরু করে পরের মাসে ওরা একটা বড় নদীর মুখের কাছে একটা শহরে এসে হাজির হলো। শহরটাতে অনেক বড় বড় বাড়ি ছিল। নদীটার মুখে অনেক নৌকা বাঁধা ছিল। টারজান এখন দার্ণতের মত সাদা ধবধবে পোশাক পরে ভদ্র হয়ে উঠেছে। সে এখন কাঁটা চামচের সাহায্যে ভদ্রভাবে রান্না করা খাদ্য খেতে শিখেছে।

    নদীর তীরবর্তী সেই শহরটাতে পৌঁছেই দার্ণৎ তাদের দেশের সরকারি কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিল, সে নিরাপদে আছে এবং সেই সঙ্গে তিন মাসের ছুটি চাইল। ছুটি সঙ্গে সঙ্গে মঞ্জুরও হলো। এরপর সে তার দেশের ব্যাঙ্কে কিছু টাকা চেয়ে পাঠাল। কারণ সিন্দুকটা আনার জন্য নৌকা ভাড়া করতে হবে।

    এদিকে শহরের যে অঞ্চলের একটা হোটেলে টারজানরা ছিল সে অঞ্চলের শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণকায় নিগ্রো অধিবাসীদের সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়ে গেল। ক্রমে তারা টারজনের শৌর্যবীর্যের পরিচয়ও পেল। একদিন একটি হোটেলে টারজানরা যখন বসেছিল তখন এক নিগ্রো মাতাল হঠাৎ পাগলের মত একটা ছুরি নিয়ে চারজন লোককে তাড়া করে। তারা তখন ছুটে পালিয়ে গেলে সে টারজানকে ছুরি মারতে যায়। কিন্তু টারজান শুধু একটা হাত বাড়িয়ে তার ছুরিধরা হাতটা ধরে সেটা এমনভাবে মুচড়ে দেয় যে তার হাড় ভেঙ্গে যায়। মাতালটা যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে করতে তার গায়ে পালিয়ে যায়।

    আর একদিন রাত্রিতে সেই হোটেলে সিংহ নিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে তর্ক হচ্ছিল। একজন বলল, সিংহ পশুরাজ হলেও আসলে ভীরু, গুলির আওয়াজে পালিয়ে যায়।

    টারজান বলল, সব মানুষ যেমন সাহসের দিক থেকে সমান নয় তেমনি সিংহদের মধ্যেও স্বভাবের তারতম্য আছে। একটা সিংহ হয়তো পালিয়ে যেতে পারে তোমার ভয়ে আবার অন্য সিংহের দ্বারা তুমি প্রাণ হারাতে পার।

    তখন একজন বলল, যদি তুমি নগ্নদেহে একটা মাত্র ছুরি নিয়ে একটা সিংহ শিকার করতে পার তাহলে আমি তোমাকে পাঁচ হাজার ফ্ৰা দেব।

    টারজান বলল, ঠিক আছে, একটা দড়ি চাই।

    দার্ণৎ বলল, দশ হাজার ফ্রা চাই।

    লোকটি বলল, তাই দেব।

    টারজান সেই মুহূর্তে তার ঘর থেকে একটা দড়ি আর ছুরি নিয়ে এল। শহরের শেষ প্রান্তে বনের ধারে গিয়ে টারজান তার পোশাক খুলে রেখে যাবার জন্য প্রস্তুত হলো। তখন সেই লোকটি বলল, তোমাকে যেতে হবে না, আমি তোমাকে দশ হাজার ফ্রা দেব। শুধু শুধু প্রাণ দিয়ে লাভ নেই।

    কিন্তু টারজান শুনল না সে কথা। সে জঙ্গলের মধ্যে চলে গেল। দশজন লোক সেখান থেকে ফিরে এসে কেবিনের বারান্দায় পায়চারি করতে লাগল।

    এদিকে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকেই গাছের উপর চড়ে ডালে ডালে এগিয়ে চলল সিংহের সন্ধানে।

    কিছুক্ষণের মধ্যেই বাতাসে একটা সিংহের গন্ধ পেল টারজান। তারপর সিংহটা গাছের তলায় আসতেই সে ফাঁসটা ঝুলিয়ে দিতেই সেটা সিংহের গলায় আটকে গেল। এবার সে গাছের ডালে দড়িটা বেঁধে রেখে দিলে সিংহটা মুক্ত হবার জন্য যখন ছটফট করছিল তখন টারজান তার ঘাড়ের উপর লাফিয়ে পড়ল। তারপর ছুরিটা তার পিঠের উপর বারবার আমূল বসিয়ে দিতে লাগল। অবশেষে সিংহটা মরে গেলে তার মৃতদেহের উপর দাঁড়িয়ে বিজয়ী বাঁদর-গোরিলার মতো গর্জন করে উঠল টারজান।

    এদিকে সেই দশজন লোক আবার হোটেল থেকে বনের সেই প্রান্তে এসে দাঁড়াল। তারা টারজনের সেই গর্জন শুনতে পেয়েছিল। তা শুনে দার্ণতের আশা হয়। এমন সময় হঠাৎ টারজান বনের মধ্যে থেকে মৃত সিংহটা নিয়ে ফিরে এলে তাদের বিস্ময় চরমে ওঠে। তারা এক বাক্যে তার শক্তি ও বীরত্বের প্রশংসা করতে থাকে।

    কিন্তু টারজনের এতে প্রশংসা করার কিছুই নেই। কোন গরু মারার জন্য যেমন একটা কসাইকে বাহবা দেবার কিছু নেই তেমনি তার এই সিংহ শিকারের জন্যও তার প্রশংসা করার কিছু নেই, কারণ আগে সে এমন বহু সিংহ বধ করেছে।

    যাই হোক, লোকটা তার কথামত দশ হাজার ফ্ৰা দিল। দার্ণৎ টারজানকে বলল, টাকাটা রেখে দাও।

    কিন্তু টারজান জোর করে অর্ধেক টাকা দার্ণকে দিয়ে দিল।

    পরদিন সকালেই দার্ণ একটা নৌকা ভাড়া করল। ওরা সমুদ্রের ধার ঘেঁষে নৌকায় করে রওনা হয়ে। পরদিন সকালেই সেই কেবিনের কাছে উপকূলভাগে পৌঁছল। টারজান একটা কোদাল নিয়ে একা সিন্দুকটা আনতে চলে গেল। পরদিন সে সিন্দুকটা একাই ঘাড়ে করে ফিরে এল। তাদের নিয়ে নৌকা আবার উত্তর দিকে যাত্রা শুরু করল সেই শহরের দিকে।

    তখন থেকে তিন সপ্তার মধ্যেই একটা ফরাসী জাহাজে করে দার্ণৎ টারজানকে সঙ্গে করে প্যারিসের পথে যাত্রা করল।

    প্যারিসে দার্ণতের অতিথি হিসাবে রয়ে গেল টারজান। এখান থেকে সে আমেরিকা যাবে। কিন্তু তার আগে একদিন দার্ণৎ তার আঙ্গুলের ছাপ পরীক্ষার অন্য এক পুলিশ অফিসারের কাছে নিয়ে গেল। এইভাবে সে টারজনের জন্মরহস্যের সমাধান করতে চায়। কিন্তু টারজানকে প্রথমে সেকথা বলল না। সে আগে নিজের আঙ্গুলগুলোর ছাপ দেবার পর টারজানকেও তার আঙ্গুলের ছাপ দিতে বলল।

    পুলিশ অফিসার বলল, মানুষের আঙ্গুলের ছাপ বয়সের ব্যবধানে পাল্টায় না, শুধু আকারে বড় হয়। সুতরাং ছোট বয়সের কারো আঙ্গুলের ছাপ বড় বয়সের আঙ্গুলের ছাপের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে তাকে চেনা যায়।

    দার্ণৎ বলল, কোন আঙ্গুলের ছাপ দেখে নিগ্রো বা শ্বেতাঙ্গ লোকের ছাপ কিনা তা জানা যায়?

    পুলিশ অফিসার বলল, তা ঠিক যায় না, তবে সাধারণত নিগ্রোদের হাতের ছাপে জালের মত অনেক জটিল চিহ্ন দেখা যায়।

    ক্লেটনের ডায়েরীর যে পাতায় তার ছয় মাসের ছেলের আঙ্গুলের ছাপ ছিল সেটা অফিসারকে দেখাল দার্ণৎ।

    অফিসার একটা কাঁচ দিয়ে ভাল করে দুটো ছাপ খুঁটিয়ে দেখে মিল দেখে আশ্চর্য হয়ে হাসল।

    টারজান এবার সব ব্যাপারটা বুঝতে পারল। বুঝল দার্ণৎ তার জন্মরহস্য ভেদ করতে চায়।

    পুলিশ অফিসার বলল, ঠিক আছে। তবু আমাদের বিশেষজ্ঞ দেসকার্ককে দেখিয়ে তার মতামত নেওয়া উচিত।

    দার্ণৎ বলল, তিনি ত এখন নেই। কিন্তু মঁসিয়ে টারজান আগামীকালই আমেরিকা চলে যাচ্ছেন।

    অফিসার বলল, তাহলে দেসকার্ক ফিরে এলে ব্যাপারটা জেনে ওঁকে টেলিগ্রাম করে সপ্তা দুইয়েকের মধ্যেই জানিয়ে দেবেন।

    বাল্টিমোর শহরের শেষ প্রান্তে একটি পুরনো আমলের বাড়ির সামনে একদিন একটি ট্যাক্সি এসে থামল। চল্লিশ বছরের বলিষ্ঠ ও সুগঠিত চেহারার একটি লোক ট্যাক্সি থেকে বেরিয়ে এসে ড্রাইভারকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে তাকে বিদায় দিল।

    বৃদ্ধ অধ্যাপক পোর্টার এগিয়ে গিয়ে বলল, ও মিস্টার ক্যানলার।

    আগন্তুক লোকটি হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, শুভ সন্ধ্যা অধ্যাপক।

    ক্যানলার বলল, ক্লেটন নামে এক যুবক মাসের পর মাস অপেক্ষা করে রয়েছে। জেন অবশ্য তাকে গ্রাহ্য করে না। কিন্তু সে নাকি তার বাবার তরফ থেকে মোটা রকমের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হচ্ছে এবং শেষ পর্যন্ত তার পক্ষে জেনকে লাভ করা খুব একটা অসম্ভব নয়।

    অধ্যাপক বললেন, সে বলছিল এখনি কাউকে বিয়ে করতে সে রাজী নয়। উত্তর ইউসকনসিনে তার মা তাকে যে একটা খামারবাড়ি দিয়ে গেছে সেইখানে গিয়ে বাস করার কথা বলছে। পরের সপ্তার প্রথম দিকেই আমরা সেখানে যাব। ফিলান্ডার আর ক্লেটন সেখানে সব ব্যবস্থা করার জন্য চলে গেছে।

    ক্যানলার কি বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু জেন সহসা এসে পড়ায় সে থেমে গেল।

    জেন বলল, ও আপনি? মাফ করবেন। আমি ভেবেছিলাম, বাবা একা আছেন।

    অধ্যাপক পোর্টার তখনি বেরিয়ে গেলেন। ক্যানলার জেনকে বলল, এভাবে আর কত দিন চলবে জেন?

    জেন বলল, আপনি কি বুঝতে পারছেন না আপনি কিছু ডলারের বিনিময়ে আমাকে কিনছেন? আপনি যখন বাবাকে গুপ্তধন উদ্ধারের জন্য টাকা ধার দিয়েছিলেন শুধু হাতে তখন কোন উদ্দেশ্যেই। দিয়েছিলেন। কোন না কোন একটা লাভের আশাতেই দিয়েছিলেন।

    ক্যানলারের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বলল, তুমি যখন সবই জান তখন তুমি যাই ভাব, তোমাকে আমার চাই।

    জেন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

    পরের দিন বিয়ে না করেই ট্রেনে চড়ে ইউসকনসিন স্টেশনে চলে গেল জেন। স্টেশনে ফিলান্ডার আর ক্লেটন একটা বড় গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য।

    পরের দিন সকালে ক্যানলার শহরে চলে গেল। সেদিন সকাল থেকে পূর্ব দিকের বনে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু বাতাসটা উল্টো দিক হতে বইতে থাকায় ধোয়াটা আসছিল না। দুপুরের দিকে জেন। একাই একবার বের হলো। ক্লেটন তার সঙ্গে যেতে চাইলে সে তাকে সঙ্গে নিল না।

    জেন বড় রাস্তাটা ফেলে রেখে পূর্ব দিকের জঙ্গলে কোথায় আগুন লেগেছে তা দেখার জন্য আনমনে এগিয়ে যেতে লাগল। তার মনে তখন ছিল এক চিন্তা। ক্যানলারের কবল থেকে পরিত্রাণ পাবার আর কোন উপায় নেই।

    এমন সময় জেনের হঠাৎ নজর পড়ল তার চারদিকেই আগুন জ্বলছে। বড় আস্তাটায় যাবার কোন উপায় নেই। সে তখন বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল। একটা দিকে কিছু গাছপালা ছিল। সেদিকটায় আগুন কিছুটা কম। কিন্তু সেদিক থেকেও ধোয়া আসছিল। হঠাৎ গাছের উপর থেকে দৈত্যাকার এক শ্বেতাঙ্গ যুবক লাফিয়ে পড়ে জেনকে গাছের উপর তুলে নিল। তারপর গাছে গাছে বাঁদরের মত লাফিয়ে তাকে এক নিরাপদ জায়গায় নিয়ে গেল। জেনের মনে পড়ল আফ্রিকার জঙ্গলের সেই বনবাসী লোকটি একদিন এইভাবেই তাকে এক বদর-গোরিলার কবল থেকে উদ্ধার করে।

    লোকটি নিরাপদ জায়গায় গিয়ে জেনকে বলল, রাস্তায় আমার গাড়ি আছে।

    জেন বলল, তুমি কে?

    লোকটি বলল, আমি সেই বাঁদর-দলের টারজান।

    জেন আশ্চর্য হয়ে বলল, তুমি এখানে কি করে এলে?

    টারজান বলল, দার্ণৎকে আমি উদ্ধার করি। সে-ই আমাকে এখানে আসার পথ বলে দেয়। তোমরা আসার সময় আমাকে যে চিঠি লিখে রেখে এসেছিলে কেবিনে তার একটিতে তোমাদের বাড়ির ঠিকানা ছিল।

    এখন এস, আমার গাড়িতে গিয়ে চাপবে। তোমার বাবা এখন হয়ত খামারের কাছে অপেক্ষা করছেন তোমার জন্য। আমি তোমাদের শহরের বাড়িতে ও পরে খামারবাড়িতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ক্লেটন আমাকে চিনতে পারেনি।

    গাড়িতে যেতে যেতে টারজান বলল, তুমি তোমার চিঠিতে লিখেছিলে তুমি অন্য একজনকে ভালবাস। তুমি হয়ত আমার কথাই বলেছিলে?

    জেন বলল, হয়ত তাই।

    টারজান বলল, কিন্তু বাল্টিমোরে আমি যখন তোমাদের খোঁজ করছিলাম তখন সেখানকার লোকেরা বলল, তোমার এখানে বিয়ে হবে।

    হ্যাঁ।

    তুমি তাকে ভালবাস?

    না।

    ওরা দু’জনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। রাস্তাটা সমতল না হলেও ডানদিকের আগুনটা বেড়ে যাওয়ায় গাড়ির গতিটা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল টারজান।

    ক্রমে বিপদসীমাটা পার হয়ে গাড়ির গতিটা কমিয়ে দিল টারজান। বলল, আমি যদি ক্যানলারকে তোমার জন্য বলি?

    জেন বলল, অপরিচিত ব্যক্তির কথা শুনবে না, বিশেষ করে যে ব্যক্তি আমাকে চায়।

    কিছুক্ষণ আবার ওরা চুপ করে রইল। টারজান প্রথমে কথা বলল। বলল, তুমি আমাকে বিয়ে করবে?

    সঙ্গে সঙ্গে কথাটার উত্তর দিতে পারল না জেন। সে ভাবতে লাগল, যে অদ্ভুত লোকটি তার পাশে বসে রয়েছে সে কে? কি তার পরিচয়? সে নিজেই বা তার নিজের সম্বন্ধে কতটুকু জানে? তার পিতামাতাই বা কে? কি তার পরিচয়?

    টারজান এবার শান্তভাবে বলল, আমি বুঝতে পেরেছি। আর তোমাকে চাপ দেব না। আমি তোমার সুখটাকেই বড় করে দেখতে চাই। বুঝেছি একটা বাঁদরের সঙ্গে সুখী হতে পার না।

    গাড়িটা ক্লেটনের কাছে এসে পৌঁছতে জেনকে দেখতে পেয়ে সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। অধ্যাপক পোর্টার জেনকে দেখতে পেয়েই জড়িয়ে ধরলেন। প্রথমে টারজানকে কেউ দেখতে পায়নি। পরে ক্লেটন তাকে গাড়ির ভিতর বসে থাকতে দেখে হাত বাড়িয়ে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলল, কি বলে ধন্যবাদ দেব তোমায়? তুমি আমাদের সকলকে উদ্ধার করলে। তুমি খামারবাড়িতে গিয়ে আমার নাম ধরে ডেকেছিলে, কিন্তু আমি তোমাকে চিনতে পারিনি। তাছাড়া তোমাকে এ বেশে দেখে চেনাই যায় না।

    টারজান হেসে বলল, ঠিক বলেছ মঁসিয়ে ক্লেটন।

    ক্লেটন বলল, কিন্তু তুমি কে?

    আমি বাঁদর-দলের সেই টারজান।

    কথাটা শুনে চমকে উঠল ক্লেটন।

    তাদের পুরনো জঙ্গলের বন্ধুকে এবার চিনতে পেরে অধ্যাপক পোর্টার ও ফিলান্ডারও এগিয়ে এসে ধন্যবাদ দিল টারজানকে।

    তারা সকলে এবার খামারবাড়িতে গিয়ে উঠল। ক্লেটন তাদের সকলের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করল। এমন সময় একটা মোটর গাড়ির আওয়াজ শুনে চমকে উঠল তারা।

    এমন সময় ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকল ক্যানলার। বলল, আমি কি ভয়ই না করেছিলাম। আমি ত একবার আসতে আসতে আগুনে পথ না পেয়ে শহরে ফিরে গিয়েছিলাম। এখানে পৌঁছতে পারব ভাবতেই পারিনি।

    কেউ তার কথাটা গ্রাহ্য করল না। টারজান একবার ক্যানলারের দিকে তাকাল, সিংহী যেমন তার শিকারের দিকে তাকায়।

    জেন ক্যানলারকে বলল, ইনি হচ্ছেন আমাদের পুরনো বন্ধু মঁসিয়ে টারজান।

    ক্যানলার তার হাতটা বাড়িয়ে দিল। কিন্তু টারজান শুধু ভদ্রতার খাতিরে মাথাটা নোয়াল। ক্যানলারের হাতটা ধরল না।

    ক্যানলার আবার বলল, আমাদের বিয়েটা এখনি সেরে ফেলতে হবে জেন্ন, যাতে আমরা মধ্য রাতের ট্রেনটা ধরতে পারি।

    টারজন এবার ব্যাপারটা বুঝতে পারল। সে শুধু একবার জেনের দিকে তাকাল।

    জেন বলল, আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করলে হয় না মিস্টার ক্যানলার। আমার মাথা ঠিক নেই। আজ সারাটা দিন যা বিপদ গেছে।

    তার প্রতি উপস্থিত সকলের বিরুদ্ধভাব দেখে রেগে গেল ক্যানলার। বলল, আমি অনেকদিন অপেক্ষা করেছি। তুমি আমাকে বিয়ে করবে বলে কথা দিয়েছ।

    এই বলে জেনের একটা হাত ধরে এগোতেই ক্যানলারের গলাটা একটা হাত দিয়ে ধরে তাকে শূন্যে তুলে ধরল টারজান।

    জেন ভয়ে টারজনের দিকে ছুটে গেল। টারজানকে কাতর মিনতি জানিয়ে বলল, দয়া করে আমার খাতিরে ওকে ছেড়ে দাও। তোমার হাতে ওকে মরতে দিতে পারি না। আমি চাই না তুমি খুনের অপরাধে অপরাধী হও।

    এবার ক্যানলারের গলাটা ছেড়ে দিয়ে টারজান তাকে বলল, বল, ওকে তুমি তার প্রতিশ্রুতি থেকে মুক্তি দিলে। তা না হলে তোমাকে তোমার জীবন দিতে হবে।

    ক্যানলার হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, হ্যাঁ।

    টারজান আবার বলল, বল, তুমি চলে যাবে এবং আর কখনো ওকে বিরক্ত করবে না?

    এবারও ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল ক্যানলার।

    টারজান তাকে ছেড়ে দিল। ক্যানলার টলতে টলতে একমুহূর্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

    টারজান ক্লেটনকে বলল, কিছুক্ষণের জন্য নির্জনে তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?

    টারজান জেনকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু অধ্যাপক পোর্টার এই ঘটনায় বিশেষ বিব্রত হয়ে বললেন, কোন অধিকারে তুমি আমার মেয়ে আর ক্যানলারের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করলে? আমি তাকে। কথা দিয়েছিলাম তার সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দেব।

    টারজান বলল, আমি হস্তক্ষেপ করেছিলাম এই জন্য যে আপনার মেয়ে তাকে ভালবাসে না।

    অধ্যাপক পোর্টার বললেন, তুমি জান না তুমি কি করেছ। আর ও বিয়ে করতে চাইবে না এরপর।

    টারজান জোর দিয়ে বলল, না করবে না। তাছাড়া আপনার সম্মানে আঘাত লাগবে বলে আর ভয় করার কিছু নেই। আপনি এবার ওকে ঋণের টাকা শোধ করে দিতে পারবেন।

    অধ্যাপক পোর্টার বললেন, থাম থাম স্যার। একথার মানে কি জান?

    টারজান বলল, আপনার হারানো ধন সব পাওয়া গেছে।

    অধ্যাপক পোর্টার বললেন, থাম থাম স্যার। তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?

    টারজান বলল, আমি লুকিয়ে দেখছিলাম নাবিকরা সিন্দুকটা কোথায় পুঁতে রাখে। তারপর সেটা কার এবং তাতে কি আছে তা না জেনেই সেটা সরিয়ে নিয়ে গিয়ে অন্য এক জায়গায় সেটা পুঁতে রাখি। তারপর দার্ণতের সঙ্গে সেটা ফ্রান্সে নিয়ে আসি। সিন্দুকটা এখানে বয়ে আনা কষ্টকর হবে ভেবে তার মধ্যে যেসব ধনরত্ন ছিল তা দার্ণৎ কিনে নিয়ে একটা চেক দিয়েছে। তার মোট দাম হয়েছে দু’লক্ষ একচল্লিশ হাজার ডলার।

    পকেট থেকে চেকটা বার করে বিস্মিত অধ্যাপক পোর্টারের হাতে দিল টারজান।

    অধ্যাপক পোর্টার আবেগকম্পিত কণ্ঠে বললেন, আজ আমার মান-সম্মান সব রক্ষা করলে তুমি।

    ক্লেটন এমন সময় ঘরে ঢুকে বলল, শুনছি আগুনটা এই দিকে এগিয়ে আসছে। এখানে থাকা আর নিরাপদ নয় আমাদের পক্ষে। এখনি আমাদের শহরে চলে যেতে হবে।

    ফিলান্ডার আর টারজান একটা গাড়িতে চাপল। ক্লেটনের গাড়িটাতে বাকি সবাই চাপল।

    গাড়িতে যেতে যেতে ক্লেটন জেনকে বলল, এখন তুমি স্বাধীন। এবার কি তুমি আমাকে বিয়ে করতে রাজী হতে পার না?

    জেন চুপি চুপি বলল, হ্যাঁ।

    সেদিন স্টেশনের বিশ্রামাগারের একটি ঘরে টারজান জেনকে ডেকে বলল, এখন তুমি স্বাধীন। আমি তোমাকে পাবার জন্য সুদূর আফ্রিকা হতে কত সমুদ্র পার হয়ে এখানে এসেছি। বল, তুমি আমাকে বিয়ে করবে কি না।

    জেন বলল, ক্লেটনকে জবাব দিতে পারছি না টারজান। ক্লেটনও আমায় ভালবাসে। লোক হিসেবেও সে ভাল। তার দেয়া আমার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা উচিত হবে না। তুমি আমাকে এ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে সাহায্য করবে।

    সহসা স্টেশনের একজন কর্মচারী ঘরে ঢুকে টারজানকে খোঁজ করতেই তার চিন্তায় বাধা পড়ল। লোকটি বলল, আঁসিয়ে টারজনের নামে প্যারিস থেকে একটা টেলিগ্রাম এসেছে।

    টারজান বলল, আমিই মসিয়ে টারজান।

    টারজান টেলিগ্রামটা খুলে দেখল দার্ণ সেটা পাঠিয়েছে। তাতে লেখা আছে, আঙ্গুলের ছাপ এই কথাই প্রমাণ করে যে তুমিই লর্ড গ্রেস্টোক। তোমাকে অভিনন্দন জানাই। ইতি দার্ণ।

    টারজনের পড়া শেষ হতেই ক্লেটন ঘরে ঢুকল। টারজানকে বলল, তুমি আমাদের জন্য যা করেছ তার জন্য ঠিকমত ধন্যবাদ জানাতে পারিনি। তুমি আমাদের সকলকে উদ্ধার করেছ। আমি তোমার কথাই ভাবছিলাম। তুমি এখানে আসায় আমি দারুণ খুশি। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না তোমার মত লোক কি করে আফ্রিকার জঙ্গলে গিয়ে পড়লে?

    টারজান শান্তভাবে বলল, আমি সেখানেই জন্মেছিলাম, আমার মা ছিল এক বাঁদর-গোরিলা। আমার জন্ম সম্বন্ধে কোন কথা সে বলে যেতে পারেনি। আমার বাবা কে আমি জানি না।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleলাল মৃত্যুর মুখোশ – এডগার অ্যালান পো – (অনুবাদক : চিত্তরঞ্জন মাইতি)
    Next Article The Gringos – Edith Nesbit
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.