Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025

    পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি ২ – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025

    বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ড্রাগন – ক্লাইভ কাসলার

    ক্লাইভ কাসলার এক পাতা গল্প490 Mins Read0
    ⤷

    ০১. ডেনিংস ডেমনস

    ড্রাগন – মূল : ক্লাইভ কাসলার
    অনুবাদ : মখদুম আহমেদ

    উৎসর্গ

    এনায়েত নগর

    আমি যেতে চাই সবুজ সুন্দরে; যেখানে বহুকাল আগে গিয়েছিলাম আমি।
    আমি স্বপ্নহীন, নিরাবেগ, অক্লান্ত, ক্লিব ওই তালগাছটাকে আবারো দেখতে চাই;
    দেখতে চাই তার পরিচর্যা-না-করা-ময়লা-সবুজ পাতারা কেমন গাঢ় দেখায়
    অন্ধকার রাতে।
    আমার জানালা ছুঁয়ে হাত বাড়িয়ে রেখেছিলো সেই পাতারা, যেনো
    কবাটের শিক গলে ঢুকতে চাইছিলো ভেতরে।
    আশ্রয়ের জন্যে নয়; আমি জানি, এ হীন আশ্রয় তাকে টানে না।
    সম্ভবত আমাকে একটু পবিত্র করে দিতে চাইছিলো সে
    তার দীর্ঘ পাতার ছোঁয়ায়।
    আমি দেখতে চাই সেই চাঁদ; রূপালি-ঘোলাটে চাঁদ,
    প্রেমহীন-কামহীন-নিপ্রভ
    অথচ
    কী সুতীব্র আলোয় আলোয়
    আলোয় আলোয় স্নান করে যখন ঘুমন্ত চরাচর,
    কেবল আমি জাগবো সেখানে।
    দিনের আলোর স্পর্শ বাঁচিয়ে আমি জাগবো মধ্যরাতে,
    গাঢ় ছায়ারা যখন খেলা শুরু করে ধনাগোদা নদীর বুকে।

    .

    .

    ডেনিংস ডেমনস্

    ৬ আগস্ট, ১৯৪৫।
    শেমাইয়া আইল্যান্ড, আলাস্কা।

    ডেনিংস ডেমনস্
    শয়তান তার বাম হাতে একটা বোমা আঁকড়ে ধরে আছে, মুখে বোকা বোকা হাসি। চোখ দুটো আধখানা চাঁদ আকৃতির, ঘন ভুরু, চেহারায় ভাড়সুলভ একটা ভাব এনে দিয়েছে। চিরাচরিত লাল স্যুট পরে আছে শয়তান, ডগার দিকে দ্বিধাবিভক্ত লম্বা লেজ, মাথায় বাঁকা শিং। পা দুটো থাবার মত, একটা সোনালি দাঁড়-এ দাঁড়িয়ে আছে সে, থাবার নখগুলো পেঁচিয়ে ধরেছে দাঁড়টাকে। দাঁড়ের গায়ে লেখা রয়েছে 24K.

    ছবিটা একটা বৃত্তের ভেতর, বি-টোয়েনটিনাইন বোমারুর ফিউজিলাজে আঁকা। বৃত্তের ওপর ও নিচে লেখা রয়েছে ডেনিংস ডেমনস।

    ভৌতিক একটা নিঃসঙ্গ কাঠামোর মত বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্লেনটা। ওটার নাম রাখা হয়েছে কমান্ডারের নাম অনুসারে এবং তার ক্রুদের কথা মনে রেখে। পোর্টেবল কয়েকটা ফ্লাডলাইটের আলোয় পেটের নিচটা আলোকিত, চকচকে অ্যালুমিনিয়াম কাঠামোর চারপাশে কিম্ভুতকিমাকার ছায়া ফেলছে গ্রাউন্ড ক্রুরা। বৃষ্টি, বেরিং সী থেকে ছুটে আসা জোরাল বাতাস, তার সঙ্গে ঘন ঘন বজ্রপাত পরিবেশটাকে আরও ভৌতিক করে তুলেছে।

    স্টারবোর্ড ল্যান্ডিং গিয়ার-এর জোড়া টায়ারের একটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেজর চার্লস ডেনিংস, হাত দুটো লেদার ফ্লাইট জ্যাকেটের পকেটে ঢোকানো, শান্ত ও নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে নিজের চারপাশের কর্মচাঞ্চল্য লক্ষ্য করছে। গোটা এলাকায় সশস্ত্র এমপি ও কে-নাইন সেন্ট্রিদের কড়া পাহারা। ক্যামেরা ক্রুদের ছোট একটা দল রেকর্ড করছে ঘটনাটা। অস্বাভাবিক মোটা বোমাটা দেখে ভয়ে শিরশির করে উঠল তার শরীর, উইঞ্চের সাহায্যে বি-টোয়েনটিনাইনের সংস্কার করা বম্ববেতে ভোলা হচ্ছে ওটা। বোমারুর নিচে ফাঁকা জায়গা বেশি নয়, তার তুলনায় বোমাটা অনেক বড়, সেজন্যে একটা গভীর গর্ত থেকে তোলা হচ্ছে ওটাকে।

    ইউরোপে দুবছর বোমারু পাইলট হিসেবে কাজ করেছে ডেনিংস, হামলায় অংশ নিয়েছে চল্লিশবার, কিন্তু এ ধরনের ভয়ঙ্কর জিনিস জীবনে কখনও দেখেনি সে। বোমাটাকে প্রকাণ্ড ফুটবলের মত লাগল তার, এক ধারে বাক্স আকৃতির খোপের ভেতর কয়েকটা ফিন ওটার কাঠামোটাকে আরও যেন বিদঘুটে করে তুলেছে। গোলাকার ব্যালিস্টিক কেসিং হালকা ধূসর রঙ করা, ওটাকে ধরে রাখার জন্যে মাঝখানে ব্যবহার করা হয়েছে কয়েকটা ক্ল্যাম্প, দেখে মনে হবে বিশাল একটা যিপার।

    ওটাকে তার তিন হাজার মাইল বয়ে নিয়ে যেতে হবে, ভাবতেই শিউরে উঠল ডেনিংস। লস আলামোসের বিজ্ঞানীরা বোমাটাকে বেঁধেছেদে প্লেনে তোলার কাজ যারা তদারক করছেন, কাল বিকেলে ডেনিংস ও তার ক্রুদের ব্রিফ করেছেন। ট্রিনিটি টেস্ট এক্সপ্লোসন-এর সচল ছবি দেখানো হয়েছে তরুণ ক্রুদের। অবিশ্বাসে দম বন্ধ করে রেখেছিল সবাই। একটা মাত্র বোমার বিস্ফোরণ এমন ব্যাপক ধ্বংসকাণ্ড ঘটায় কিভাবে। একটা পুরো শহর নিশ্চিহ্ন করে দিতে একটা বোমাই যথেষ্ট হয় কি করে।

    আরও আধ ঘণ্টা পর বম্ব-বের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আর্মড অর্থাৎ বিস্কোরনের জন্যে প্রস্তুত করা হয়েছে অ্যাটম বোমাটা, ব্যবস্থা করা হয়েছে নিরাপদে রাখার; ফুয়েল ভরা হয়েছে প্লেনে, টেকঅফ করার জন্যে সম্পূর্ণ তৈরি।

    নিজের প্লেনকে দারুন ভালোবাসে ডেনিংস। বাতাসে একবার ডানা মেলতে পারলে এই বিমান আর তার শরীর যেনো এক হয়ে যায়। এ এমন একটা মিলন যা তারপক্ষে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। প্রতিবার মিলিত হবার মুহূর্তে রোমাঞ্চ অনুভব করে সে, অথচ আজ তার ভয় করছে, অজানা আশঙ্কায় কাঁপছে বুকটা।

    মন থেকে অশুভ চিন্তা ঝেড়ে ফেলে একটা ঘরের দিকে ছুটল ডেনিংস, ক্রুদের শেষবারের মত ব্রিফ করবে। ভেতরে ঢুকে ক্যাপটেন বম্বারডিয়ার হার্ব স্ট্যানটনের পাশে বসল। গোলগাল আকৃতির হাসিখুশি লোক স্ট্যানটন, দেখার মত চওড়া গোঁফ আছে মুখে।

    স্ট্যানটনের আরেক পাশে বসে আছে ক্যাপটেন মর্ট স্টম্প, ডেনিংসের কো পাইলট। হালকা-পাতলা গড়ন তার, একটু চঞ্চল টাইপের। ঠিক তার পিছনে বসে আছে লেফটেন্যান্ট জোসেফ আর্নল্ড, নেভিগেটর। তার পাশে বসেছে নেভী কমান্ডার হ্যাঁঙ্ক বায়ারনেস, উইপনস এঞ্জিনিয়ার। প্লেন চলার সময় বোমার ওপর নজর রাখবে সে, দায়িত্ব পালন করবে মনিটরিং-এর।

    ডিসপ্লে বোর্ডের পাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন ইন্টেলিজেন্স অফিসার, বোর্ডে দেখানো হয়েছে টার্গেটের এরিয়াল ফটোগ্রাফ। ওসাকার শিল্পাঞ্চল প্রধান টার্গেট। আকাশে ভারী মেঘ থাকলে টার্গেট বদলে যাবে, বোমাটা তখন ফেলতে হবে ঐতিহাসিক নগরী কাইয়োটায়। দুটো পথই ম্যাপে দেখিয়ে দেয়া হলো। শান্তভাবে নোট নিল ডেনিংস।

    আবহাওয়া দফতরের একজন কর্মকর্তা ওয়েদার চার্ট সটলেন বোর্ডে। উল্টোদিক থেকে হালকা বাতাস থাকবে, থাকবে ছড়ানো-ছিটানো মেঘ। উত্তর জাপানের দিকে বাতাসের তীব্রতা সম্পর্কে ডেনিংসকে সতর্ক করে দিলেন তিনি। সাবধানের মার নেই ভেবে একজোড়া বি-টোয়েনটিনাইনকে এক ঘণ্টা আগেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, ফ্লাইট ফুটের ওপরে আবহাওয়ার অবস্থা ও টার্গেট পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, ফ্লাইট রুটের ওপরে আবহাওয়ার অবস্থা ও টার্গেট দুটোর ওপর মেঘের অবস্থা দেখে রিপোর্ট করবে তারা।

    পোলারাইজড ওয়েল্ডার গগলস দেয়া হলো সবাইকে। তারপর ক্রুদের সামনে দাঁড়াল ডেনিংস। গা-গরম করা বক্তৃতা আমার আসে না, বলল সে, লক্ষ করল স্বস্তিসূচক নিঃশব্দ হাসি ফুটল তার ক্রুদের মুখে। এক বছরের ট্রেনিং মাত্র এক মাসে সারতে হয়েছে আমাদের, তবে আমি জানি যে এই মিশনে সফল হবার যোগ্যতা আমরা রাখি। কোন রকম গর্ব না করেও বলতে পারি যে এয়ার ফোর্সে তোমরাই সেরা ফ্লাইট ক্রু। আমরা যদি যে যার কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে পারি, এই অভিশপ্ত যুদ্ধটা থামতে পারে। কথা শেষ করে ধর্মযাজকের দিকে তাকাল সে। মিশনের নিরাপত্তা ও সাফল্যের জন্যে প্রার্থনা করেন তিনি।

    প্লেনের উদ্দেশে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ক্রুরা, ডেনিংসের সামনে এসে দাঁড়ালেন জেনারেল হারল্ড মরিসন। পাইলটের চোখের চারধারে ক্লান্তির ছাপ, তবে চোখ দুটো উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে। ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন জেনারেল। গুড লাক, মেজর।

    “থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার। কাজটা আমরা ভালভাবে শেষ করব।

    মুহূর্তের জন্যেও সন্দেহ করি না, মরিসন বললেন, চেহারায় জোর করে ফুটিয়ে তুললেন দৃঢ় আত্মবিশ্বাস। পাইলট কিছু বলবে, সেই আশায় অপেক্ষা করে থাকলেন তিনি। কিন্তু ডেনিংস চুপ করে থাকল।

    অস্বস্তিকর কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেল। তারপর নিস্তব্ধতা ভাঙল ডেনিংস। আমরা কেন, জেনারেল?”

    মরিসনের মুখে হাসি দেখা গেল কি গেল না। তুমি পিছু হটতে চাও, মেজর?

    না। কাজটা আমরা করব। কিন্তু দায়িত্বটা আমরা কেন পেলাম? দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করল ডেনিংস। কথাটা বলার জন্যে ক্ষমা করবেন, জেনারেল, তবে এ বিশ্বাস করা কঠিন যে গোটা এয়ার ফোর্সে শুধু আমরাই এ কাজের জন্যে যোগ্য ও বিশ্বস্ত বিবেচিত হয়েছি। প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর দিয়ে আরও অনেক পাইলট প্লেন নিয়ে যাওয়া-আসা করছে, একটা অ্যাটম বোমা বয়ে নিয়ে যাওয়ার মত লোক তাদের মধ্যে নেই? বোমাটা ফেলতে হবে জাপানের মাঝখানে, তারপর ল্যান্ড করতে হবে ওকিনাওয়া-য়, এ-ও তেমন কঠিন কোন কাজ নয়, যদিও ল্যান্ড করার সময় ফুয়েল ট্যাংকে খানিকটা ফেনা ছাড়া আর কিছু থাকার কথা নয়।

    এত কথার উত্তরে জেনারেল মরিসন শুধু বললেন, যতটুকু তোমরা জানো তার বেশি না জানাই তোমাদের জন্যে ভাল।

    যাতে আমরা ধরা পড়লে টপ সিক্রেট ইনফরমেন ফাঁস করতে না পারি?

    গম্ভীর হলেন জেনারেল মরিসন। তুমি ও তোমার ক্রুরা অশুভ পরিণতি সম্পর্কে জানো। তোমাদের প্রত্যেককে একটা করে সায়ানাইড ক্যাপসুল দেয়া হয়েছে। তবে আমি জানি তোমাদের মিশনের শুভ সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে।

    বলা হয়েছে, শত্রু এলাকায় প্লেন ক্যাশ করার পর কেউ বেঁচে থাকলে ক্যাপসুলটা গিলে ফেলতে হবে, বলল ডেনিংস। আচ্ছা, বোমাটা সাগরে ফেলে দিলে অসুবিধে কোথায়? তাতে অন্তত নৌ-বাহিনী আমাদেরকে উদ্ধার করার একটা সুযোগ পাবে।

    চেহারায় গাম্ভীর্য ও বিষণ্ণতা, মাথা নাড়লেন জেনারেল। অস্ত্রটা শত্রুদের হাতে পড়ার সামান্য সম্ভাবনার কথাও আমরা ভাবতে পারি না।

    আচ্ছা, বিড়বিড় করল ডেনিংস। সে জন্যেই আমাদের বিকল্প হলো, জাপানের মেইনল্যান্ডের ওপর আকাশে থাকার সময় আমরা যদি গুলি খাই, যতটা সম্ভব নিচে নেমে বোমাটা ফাটিয়ে দিতে হবে।

    মরিসন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। এটা সুইসাইডাল মিশন নয়। তোমার ও তোমার ক্রুদের নিরাপত্তার জন্যে সম্ভাব্য সমস্ত দিক বিবেচনায় রেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আমার ওপর বিশ্বাস রাখো। ওসাকায় “মায়ের নিঃশ্বাস” ফেলা আসলে পানির মত সহজ একটা কাজ।

    মুহূর্তের জন্যে হলেও, জেনারেলের কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো ডেনিংসের। কিন্তু তাঁর চোখে বিষণ্ণতার ছায়া দেখে নিজের ভুলটা বুঝতে পারল সে। মায়ের নিশ্বাস, ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল, বেসুরো গলায়, যেন কল্পনাতীত কোন আতঙ্ক তাকে গ্রাস করতে যাচ্ছে। কে সে, বোমাটার এ ধরনের একটা কোড নেম কার মাথা থেকে বেরুল?

    সামান্য কাঁধ ঝাঁকিয়ে জেনারেল বললেন, সম্ভবত প্রেসিডেন্টের মাথা থেকে।

    .

    সাতাশ মিনিট পর উইন্ডস্ক্রীনের সচল ওয়াইপারের দিকে তাকাল ডেনিংস। বৃষ্টির বেগ বেড়েছে, আবছা ও ভেজা অন্ধকারে মাত্র দুশো গজ সামনে পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে সে। এঞ্জিনগুলোকে দুহাজার দুশো আরপিএম পর্যন্ত তুলল, দুটো পা-ই চেপে রেখেছে ব্রেকের ওপর। ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ার সার্জেন্ট মোসলে রিপোর্ট করল, চার নম্বর আউটবোর্ড এঞ্জিন পঞ্চাশ আরপিএম কম গতিতে কমে থাকার জন্যে, সন্দেহ নেই, ভেজা বাতাসই দায়ী। এটল টেনে এঞ্জিনগুলোকে শান্ত করল সে, তবে সচল রাখল।

    কো-পাইলট জানাল, টাওয়ার থেকে টেকঅফের ক্লিয়ার্যান্স পাওয়া গেছে। থ্রাপস নিচু করল সে। ফ্ল্যাপ সেটিং ঠিক আছে, রিপোর্ট করল দুজন ক্রু। হাত বাড়িয়ে ইন্টারকমের সুইচ অন করল ডেনিংস। ওকে, বন্ধুরা, আমরা রওনা হলাম।

    থ্রটলটা আবার ধীরে ধীরে সামনে বাড়াল সে। তারপর ব্রেক রিলিজ করল।

    প্লেনটার ধারণ ক্ষমতা আটষট্টি টন। সাত হাজার গ্যালন ফুয়েল থাকায় ট্যাংকগুলো কানায় কানায় ভরে আছে। প্লেনের ফরওয়াড়র্প বম্ব-বেতে রয়েছে ছয় টন ওজনের বোমাটা। সব মিলিয়ে ক্রুর সংখ্যা বারো। প্লেন এগোতে শুরু করল। প্রায় সতেরো হাজার পাউন্ড অতিরিক্ত বোঝা বহন করছে।

    চারটে রাইট সাইক্লোন এঞ্জিন, প্রতিটি তিন হাজার তিনশো পঞ্চাশ কিউবিক ইঞ্চি। ১৬.৫ ফুট প্রপেলারগুলোকে ঘোরাচ্ছে আট হাজার আটশো বর্স পাওয়ার। বিশাল বোমারুটা সগর্জনে অন্ধকারের ভেতর ছুটল।

    আতঙ্ককর অলস একটা ভঙ্গিতে গতি বাড়ছে ওটার। সামনে লম্বা হয়ে আছে রানওয়ে, পাথর কেটে তৈরি করা, শেষ মাথায় কিছু নেই, পাহাড়ের খাড়া গা ঝাঁপ করে নেমে গেছে আশি ফুট নিচের সাগরে। ডান দিক থেকে বাম দিকে ছুটন্ত বিদ্যুতের একটা চোখ ধাঁধানো চমক উজ্জ্বল নীল আলোয় ভাসিয়ে দিল রানওয়ের দুপাশে ফাঁক ফাঁক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ফায়ার ট্রাক ও অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে। প্লেনের গতি এখন আশি নট, হুইলটা শক্ত করে চেপে ধরল ডেনিংস, প্লেনটাকে আকাশে তোলার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

    পাইলটদের সামনে, বাইরের দিকে বেরিয়ে থাকা নাকের অংশে বম্বারডিয়ার হার্ব স্ট্যানটন দেখতে পাচ্ছে দ্রুত ছোট হয়ে আসছে রানওয়ে। ছটফটে মর্ট স্টম্প সিট ছেড়ে প্রায় দাঁড়িয়ে পড়ল, অন্ধকার ভেদ করে রানওয়ের কিনারাটা দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করছে সে।

    চার ভাগের তিন ভাগ রানওয়ে পিছনে ফেলে এসেছে ওরা। এখনও মাটি কামড়ে রয়েছে প্লেন। সময় যেন আঙুলের ফাঁকগলে বেরিয়ে যাচ্ছে। একই অনুভূতি হলো সবার, ওরা যেন অতল শূন্য গহ্বরে ঢুকে পড়ছে। তারপর রানওয়ের শেষ মাথার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জফগুলোর আলো বৃষ্টির পর্দা ভেদ করে অকসাৎ ঝলসে উঠল।

    গড অলমাইটি! গুঙিয়ে উঠল স্ট্রম্প।প্লেনটাকে তোলো!

    আরও তিন সেকেন্ড অপেক্ষা করল ডেনিংস, তারপর শান্তভাবে হুইলটাকে নিজের বুকের দিকে টেনে আনল। বি-টোয়েনটিনাইনের চাকা মাটি ছাড়ল। পিছিয়ে পড়ল রানওয়ের কিনারা, মাত্র ত্রিশ ফুট ওপরে উঠে এসেছে প্লেন।

    .

    রাডার ঘর থেকে বেরিয়ে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন জেনারেল মরিসন, তাঁর। পিছনে স্টাফরাও দাঁড়িয়ে। ডেনিংস ডেমনসের টেকঅফ যতটা না চোখ দিয়ে দেখলেন তিনি তার চেয়ে বেশি দেখলেন কল্পনায় সাহায্যে।

    হাত দিয়ে কান ঢেকে এঞ্জিনের আওয়াজ শুনলেন মরিসন, অন্ধকারের ভেতর দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। শব্দে একটা ছন্দপতন ঘটছে, তবে তা খুবই অস্পষ্ট। অভিজ্ঞ ফ্লাইট মেকানিক বা একজন এয়ারক্রাফট এঞ্জিনিয়ার ছাড়া আর কেউ ধরতে পারবে না। সামরিক জীবনের শুরুতে এই দুই পেশাতেই দক্ষতা অর্জন করেছেন জেনারেল।

    একটা এঞ্জিন সামান্য বেসুরো আওয়াজ করছে। আঠারোটার মধ্যে এক বা একাধিক সিলিন্ডার ঠিকমত কাজ করছে না। মনে আতঙ্ক, কান পেতে থাকলেন। জেনারেল, এমন একটা লক্ষণ পেতে চাইছেন যা থেকে বোঝা যাবে প্লেনটা টেকআপ করবে না। টেকআপ করার সময় ডেনিংস ডেমনস বিধ্বস্ত হলে দ্বীপটার সমস্ত কিছু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ছারখার হয়ে যাবে।

    তারপর রাডার ঘরের দরজা থেকে অপারেটর চিৎকার করে বলল, আকাশে উঠে গেছে।

    নিঃশ্বাস ফেলার সময় থরথর করে কেঁপে উঠল জেনারেলের শরীর। ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি, ফিরে যাচ্ছেন ঘরে। এখন আর তার কিছু করার নেই, ওয়াশিংটনে জেনারেল গ্রোভসকে শুধু একটা মেসেজ পাঠাতে হবে, জানাতে হবে যে মায়ের নিঃশ্বাস জাপানের পথে রওনা হয়ে গেছে। সবাইকে এখন অপেক্ষা করতে হবে। থাকতে হবে ভয় মেশানো আশা নিয়ে।

    জেনারেল মরিসন ঘরের ভেতর পায়চারি শুরু করলেন। ডেনিংসকে তিনি চেনেন। জেদি লোক, একটা এঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দিলে ফিরবে না সে। পিঠে করে বয়ে নিয়ে যেতে হলেও ডেমনসকে ওসাকায় নিয়ে যাবে।

    ঈশ্বর সাহায্য কর, বিড়বিড় করলেন জেনারেল, যদিও জানে যে এই অপারেশনে তার যে ভূমিকা, ঈশ্বর তাঁর প্রার্থনা কবুল করবেন না।

    গিয়ার আপ, নির্দেশ দিল মেজর ডেনিংস।

    শব্দগুলো শুনে আগে কখনও এত আনন্দ লাগেনি, বলে লিভারটা সরাল স্ট্রম্প। গিয়ার মটর গুঞ্জন তুলল, তিন সেট চাকা ঢুকে পড়ল নাক আর ডানার নিচে খোপের ভেতর। গিয়ার আপ অ্যান্ড লক।

    এয়ারস্পীড বাড়ল, ফুয়েল বাঁচানোর জন্যে থ্রটল সেটিং নামিয়ে আনল ডেনিংস। এয়ারস্পীড দুশো নটে পৌঁছল, এবার ধীরে ধীরে আকসামের আরও ওপরে তুলল প্লেনটাকে। স্টারবোর্ডের দিকে রয়েছে অ্যালুসিয়ান দ্বীপমালা, যদিও দেখা যাচ্ছে না। আড়াই হাজার মাইলের মধ্যে আর কোন মাটিই ওরা দেখতে পাবে না। চার নম্বর এঞ্জিনের খবর কি? জানতে চাইল সে।

    নিজের দায়িত্ব ঠিকমতই পালন করছে, তবে একটু বেশি গরম বলে মনে হচ্ছে, জবাব দিল মোসলে।

    পাঁচ হাজার ফুটে উঠি, ওটার কিছু আরপিএম কমিয়ে আনব।

    ক্ষতি নেই, মেজর, মন্তব্য করল এঞ্জিনিয়ার মোসলে।

    ডেনিংসকে একটা কোর্স জানাল আরনল্ড, নেভিগেটর। এই কোর্স ধরে আগামী সাড়ে দশ ঘণ্টা ছুটবে প্লেনটা। চার হাজার নয়শো ফুটে উঠে কো-পাইলটের হাতে কন্ট্রোল ছেড়ে দিল ডেনিংস। সীটে হেলান দিয়ে পেশী শিথিল করল সে, কালো আকাশের দিকে তাকাল। কোথাও একটা তারা নেই। ঘন মেঘের ভেতর দিয়ে ছুটছে ওরা। প্লেন ঝাঁকি খাচ্ছে দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে বাতাসের দাপট ক্রমশ বাড়ছে।

    ঝড়ের প্রবল মারমুখী অংশটা থেকে বেরিয়ে এল প্লেন, এতক্ষণে সেফটি বেল্ট খুলে সিট থেকে উঠল ডেনিংস। শরীরটা মুচড়ে ঘুরল সে, পোর্টসাইডের একটা জানালা দিয়ে প্লেনের কোমর ও লেজের দিকটা দেখতে পেল। রিলিজ মেকানিজমে ঝুলন্ত বোমাটার অংশবিশেষ চোখে পড়ে গেল তার।

    টানেলে ঢুকে বম্ব-বেকে পাশ কাটাল ডেনিংস, অপরদিকে পৌঁছে লাফ দিয়ে নিচে নামল। ছোট্ট, এয়ারটাইট দরজা খুলে ঢুকে পড়ল ভেতরে। লেগ পকেট থেকে টর্চলাইট বের করে জ্বালল, ক্যাটওয়াক ধরে হাঁটছে। দুটো বম্ববে জোড়া লাগিয়ে এক করা হয়েছে, ক্যাটওয়াকটা তারই ওপর। দাঁড়াল সে, এক সেকেন্ড ইতস্তত করে বোমাটায় হাত রাখল। আঙুলের ডগায় ইস্পাতের গা বরফের মত ঠাণ্ডা। মাত্র এক সেকেন্ডের মধ্যে লাখ লাখ মানুষকে ছাই করতে পারে এই বোমা? বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো তার। শুধু তাই নয়, পরবর্তী সেকেন্ডগুলোয় মারা পড়বে আরও লাখ লাখ মানুষ হয় পুড়ে, নয়তো রেডিওশেনে আক্রান্ত হয়ে। সাদা-কালো মুভি ফিল্মে ট্রিনিটি টেস্ট দেখলেও, শক ওয়েভের থার্মোনিউক্লিয়ার টেমপারেচার অনুভব করা সম্ভব নয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডেনিংস ভাবল, আমি কোন অপরাধ করছি না কারণ আমি চাই যুদ্ধটা বন্ধ হোক, চাই নিজের দেশের লাখ লাখ মানুষকে বাঁচাতে।

    ককপিটে ফিরে এসে বায়ারনেসের সঙ্গে গল্প শুরু করল সে। বোমার ডিটোনেশন সার্কিট দেখছে বায়ারনেস, হাতে একটা ছক কাটা নকশা। মাঝে মধ্যেই সামনে রাখা ঘোট কনসোল-এর দিকে মুখ তুলে তাকাচ্ছে অর্ডন্যান্স এক্সপার্ট।

    ওখানে পৌঁছানোর আগেই ফেটে যেতে পারে, এমন কোন সম্ভাবনা আছে নাকি? জানতে চাইল ডেনিংস।

    বাজ পড়লে ফাটতে পারে, জবাব দিল বায়ারনেস।

    আঁতকে ওঠে তার দিকে তাকাল ডেনিংস। কথাটা অনেক দেরি করে বলছ, নয় কি? সেই মাঝ রাত থেকে একটা বিদ্যুৎ বহুল ঝড়ের ভেতর রয়েছি আমরা।

    মুখ তুলে নিঃশব্দে হাসল বায়ারনেস। বাজ তো আঘাত করতে পারত আমরা যখন মাটিতে ছিলাম তখনও। কি আসে যায়, আমরা তো প্রায় পৌঁছে গেছি, তাই না?

    সবার চেয়ে ভালভাবে জানেন। তিনি তো অ্যাটমিক বম্ব প্রজেক্টে শুরু থেকেই জড়িত।

    শিউরে উঠল ডেনিংস, ঘুরে দাঁড়াল। এ স্রেফ পাগলামি, ভাবল সে। গোটা অপারেশনটাই আসলে পাগলামি। এই পাগলামির কথা বলার জন্যে ওরা যদি কেউ বেঁচে থাকে, সেটা হবে নেহাতই মিরাকল।

    .

    ইতোমধ্যে চাচ ঘণ্টা উড়ে ২০০০ হাজার গ্যালন ফুয়েল খরচ করেছে প্লেনটা। বি টোয়েনটিনাইনকে ১০০০০ ফুটে সিধে করল ডেনিংস। পুবের আকাশে ভোরে ম্লান আলো ফুটতে ক্রুরা একটু নড়েচড়ে বসল। ঝড়টা ওদের অনেক পিছনে রয়েছে, ছড়ানো-ছিটানো সাদা মেঘের নিচে উত্তাল সাগর দেখতে পাচ্ছে ওরা।

    অলস ভঙ্গিতে, ২২০ নটে, দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে যাচ্ছে ডেনিংস ডেমনস। লেজে হালকা একটু বাতাস পাচ্ছে ওরা, সেজন্যে খুশি সবাই। দিনের আলো ফোঁটার পর উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল শূন্যতা দেখতে পেল ওরা। মনে হলো গোটা পৃথিবীতে, সাগর আকাশের মাঝখানে, একা শুধু তারাই আছে।

    জাপানের প্রধান দ্বীপ, হনশু থেকে তিনশো মাইল দূরে এসে ধীরভঙ্গিতে আকাশের আরও ওপরে উঠতে শুরু করল ডেনিংস। ৩২০০০ ফুটে উঠে যাবে সে। ওসাকায় পৌঁছে এই উচ্চতা থেকেই বোমাটা ফেলবে হার্ব স্ট্যানটন। নেভিগেটর আরনল্ড জানাল, নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে বিশ মিনিট এগিয়ে আছে তারা। বর্তমান গতিবেগের হিসেবে এখন থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর ওকিনাওয়ায় ল্যান্ড করবে প্লেন।

    ফুয়েল গজের দিকে তাকাল ডেনিংস। হঠাৎ খুশি হয়ে উঠল মনটা। বাতাস অনুকূল থাকায় চারশো গ্যালন ফুয়েল অবশিষ্ট থাকতেই গন্তব্যে পৌঁছে যাবে ওরা।

    সবাই তার মত খুশি নয়। এঞ্জিনিয়ারের প্যানেলের সামনে বসে চার নম্বর এঞ্জিনের টেমপারেচার গজ পরীক্ষা করছে মোসলে। প্রতি মুহূর্তে আরো গম্ভীর হয়ে উঠছে তার চেহারা। নিয়মিত টোকা দিয়ে যাচ্ছে সে।

    লার ঘরে পৌঁছে থরথর করে কাঁপছে কাঁটাটা। টানেল দিয়ে ক্রল করে সামনে এগোল মোসলে, একটা পোর্ট দিয়ে এঞ্জিনের তলায় তাকাল। এঞ্জিনের বহিরাবরণ তেলে ভিজে আছে, ধোঁয়া বেরুচ্ছে এগজস্ট থেকে। ককপিটে ফিরে এসে পাইলট ও কো-পাইলটের মাঝখানে হাঁটু গেড়ে উঁচু হলো সে। খবর খারাপ, মেজর, বলল সে। চার নম্বর এঞ্জিন বন্ধ করতে হবে।

    আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা ওটাকে চালু রাখা যায় না? জানতে চাইল ডেনিংস।

    না, স্যার একটা ভালব গিলে ফেলতে পারে, যে-কোন মুহূর্তে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে।

    আমিও বলি, কিছুক্ষণ বন্ধ রেখে চার নম্বরকে ঠান্ডা করা হোক, বলল কো পাইলট স্ট্রম্প।

    দ্রুত একটা হিসাব করল ডেনিংস। এই মুহূর্তে ১২০০০ ফুটে রয়েছে ওরা। ওভারহিটিং হবার আশঙ্কা আছে, কাজেই তিনটে সচল এঞ্জিন নিয়ে আরও ওপরে ওঠা উচিত হবে না। চার নম্বর ঠাণ্ডা হোক, আবার ওটা চালু করা হবে ৩২০০০ ফুটে ওঠার সময়। গ্যাবনের দৃষ্টি আকর্ষণ করল সে। নেভিগেটর আরনল্ড বোর্ডের দিকে ঝুঁকে ফ্লাইট পাথ ট্রেস করছে। ডেনিংস জানতে চাইল, জাপান আর কত দূরে?

    গতি সামান্য কমেছে, সেঁটা টুকে নিয়ে দ্রুত একটা হিসাব করল আরনল্ড, জানাল, মেইনল্যান্ডে পৌঁছতে লাগবে এক ঘণ্টা একশ মিনিট।

    মাথা ঝাঁকাল ডেনিংস। ঠিক আছে, আপাতত আমরা চার নম্বর বন্ধ করে দেব।

    পাইলটের কথা শেষ হয়নি, তার আগেই এটল বন্ধ করে ইগনিশন সুইচ অফ করে দিল স্ট্রম্প, তারপর এনগেজ করল অটোমেটিক পাইলট।

    পরবর্তী আধঘণ্টা সবাই সতর্ক একটা চোখ রাখল চার নম্বরের ওপর। টেমপারেচার কমছে, একটু পরপরই ওদেরকে জানাল মোসলে।

    মাটি দেখতে পাচ্ছি, এক সময় বলল আরনল্ড। নাক বরাবর বিশ মাইল সামনে একটা দ্বীপ।

    চোখে দূরবীন তুলে তাকাল স্ট্রম্প। যেন সাগর ফুড়ে বেরিয়ে আছে একটা স্যান্ডউইচ।

    আরনল্ড বলল, খাড়া পাথুরে পাঁচিল। কোথাও সৈকত দেখা যাচ্ছে না।

    কি নাম দ্বীপটার? জানতে চাইল ডেনিংস।

    ম্যাপে ওটা নেই।

    প্রাণের কোন চিহ্ন দেখতে পাচ্ছ? জাপানিরা হয়তো অফ-শোর ওয়ার্নিং স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করছে।

    উঁহু, দেখে মনে হচ্ছে একদম ফাঁকা ও নির্জন।

    আপাতত নিরাপদ বোধ করল ডেনিংস। এখন পর্যন্ত শত্রুপক্ষের কোন জাহাজ চোখে পরেনি। জাপানি তীর থেকে অনেক দূরে রয়েছে ওরা, শত্রুদের কোন ফাইটার এতটা দূরে বাধা দিতে আসবে না। নিজের সীটে বসে সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকল সে।

    কফি আর স্যান্ডউটচ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল সবাই। খুদে একটা বিন্দুর অস্তিত্ব। সম্পর্কে কেউই সচেতন নয়। ওদের পোর্টউইং-এর ডগা থেকে সাত হাজার ফুট ওপরে ওটা। দশ মাইল দূরে।

    ডেনিংস ডেমনরা জানে না, আর মাত্র কয়েক মিনিট বেঁচে আছে ওরা।

    .

    লেফটেন্যান্ট জুনিয়র গ্রেড সাতো ওকিনাগা তার অনেক নিচে মুহূর্তের জন্যে কি যেন একটা ঝিক করে উঠতে দেখেছে। আকাশে কিছু ঝিক করে উঠতে পারে শুধু রোদ লাগলে, কাজেই আরও কাছ থেকে দেখা দরকার জিনিসটা কি। ডাইভ দিল সে। সন্দেহ নেই, ওটা একটা প্লেন। সম্ভবত অন্য কোন পেট্রল-এর প্লেন। রেডিও অন করার জন্যে হাত বাহিরেও থেকে গেল সে। আর কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে দেখলে ক্ষতি নেই। রেডিও অন করার আগে প্লেনটা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া দরকার।

    তরুণ ও অনভিজ্ঞ পাইলট হলেও, সাতো ওকিনাগা ভাগ্যবান বটে। তাদের ব্যাচে বাইশজন ছাত্র ছিল, ট্রেনিং শেষ করার পর তিনজন বাদে বাকি সবাইকে পাঠানো হয়েছে সুইসাইড স্কোয়াড্রনে। ওদের তিনজনকে উপকূল পাহারা দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

    এ ধরনের প্রায় ঝুঁকিবিহীন দায়িত্ব পেয়ে দারুণ হতাশ হয়েছে ওকিনাগা। সম্রাটের জন্যে প্রাণ বিসর্জন দেয়ার একটা ব্যাকুলতা ছিল তার মধ্যে। কিন্তু হুকুম হুকুমই, তার ওপর কথা চলে না। আপাতত এই একঘেয়েমিতে ভরা দায়িত্ব পালন করলেও, তার আশা কিছুদিনের মধ্যে আরও বড় কোন কাজের জন্যে ডাকা হবে তাকে।

    নিঃসঙ্গ প্লেনটা ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছে আকারে, সেই সঙ্গে অবিশ্বাসে বড় হচ্ছে ওকিনাগার চোখ দুটো। ভুল দেখছে নাকি? চোখ রগড়াল সে। একটু পরই পালিশ করা ৯০ ফুট অ্যালুমিনিয়াম ফিউজিলাজ, বিশাল ১৪১ ফুট ডানা, তিনতলা বিশিষ্ট খাড়া স্ট্যাবিলাইজার চিনতে পারল সে। ওটা একটা আমেরিকান বি টোয়েনটিনাইন, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

    হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল সে। উত্তর পূর্বে দিকের খালি একটা সাগর থেকে উড়ে আসছে প্লেনটা, কমব্যাট সিলিঙের ২০০০ ফুট নিচ দিয়ে। উত্তরবিহীন প্রশ্নগুলো ভিড় করল তার মনে। কোত্থেকে এল ওটা? একটা এঞ্জিন বন্ধ রেখে কেন ওটা মধ্য জাপানের দিকে যাচ্ছে? ওটার মিশন কি হতে পারে?

    অযথা সময় নষ্ট করা উচিত হবে না তার। বিশাল ডানাসহ বোমারুটা সামনে ঝুলে রয়েছে। মিতসুবিশি এসিক্স এম, জিরো প্লেনটার থ্রটল বিরতিগুলোয় না থামিয়ে টানল সে, বৃত্ত রচনার সঙ্গে সঙ্গে ডাইভ দিল নিচের দিকে।

    ফাইটারটাকে দেরিতে দেখতে পেল গানার, যদিও দেখার সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার করল সে। দেরি করল না ওকিনাগাও, জিরোর দুটো মেশিনগান ও একজোড়া টোয়েনটি মিলিমিটার কামান গর্জে উঠল।

    ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম ও মানুষের মাংস দলা পাকিয়ে একাকার হয়ে গেল। জিরোর ট্রেসারগুলো ডানা ভেঙে ভেতরে ঢুকল, বি-টোয়েনটিনাইনের তিন নম্বর এঞ্জিনটাকে আঘাত করল। একাধিক গর্ত থেকে হড়হড় করে বেরিয়ে এল ফুয়েল। তারপরই আগুন ধরে গেল এঞ্জিনটায়। মুহূর্তের জন্যে শূন্যে ইতস্তত করল বোমারু, তারপর চিৎ হয়ে গেল, ডিগবাজি খেতে খেতে নামতে শুরু করল সাগরে। লেফটেন্যান্ট ওকিনাগা একটা ডানার ওপর খাড়া করল জিরোকে। আহত বি টোয়েনটিনাইনকে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে। কালো ধোয়া আর কলা শিখা মোচড় থেকে খেতে উঠে আসছে আকাশে। প্লেনটাকে সাগরে পড়তে দেখল সে, লাফ দিয়ে উঠল সাদা পানি।

    আরও কিছুক্ষণ চক্কর দিল সে, কেউ বেঁচে আছে কিনা জানতে চায়। আবর্জনা ছাড়া কিছুই তার চোখে পড়ল ন। উল্লাসে অধীর হয়ে আছে ওকিনাগা, ফাইটার পাইলট হিসেবে এটাই তার প্রথম সাফল্য। ধোয়ার দিকে শেষ একবার তাকিয়ে নিজের এয়ারপোর্টের দিকে ফিরে চলল সে। রিপোর্ট করতে হবে।

    .

    ডেনিংসের বিধ্বস্ত প্লেন যখন এক হাজার ফুট পানির নিচে সাগরের তলায় স্থির। হচ্ছে, অপর একটা বি-টোয়েনটিনাইন অন্য এক টাইম জোন-এ ছয়শো মাইল দক্ষিণ পূর্বে; একই ধরনের একটা বোমা নিয়ে চুটে চলেছে কর্নেল পল টিবেটস রয়েছে কন্ট্রোলে, তার এনোপলা গে জাপানি শহর হিরোশিমার ওপর পোঁছে গেছে।

    ডেনিংস ও টিবেটস, দুজন কমান্ডার কেউই পরস্পরের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন নয়। দুজনেরই ধারণা, শুধু তার প্লেন ও তার ক্রুরাই যুদ্ধ থামানোর জন্যে দুনিয়ার বুকে প্রথম অ্যাটম বোমা ফেলতে যাচ্ছে।

    ডেনিংস ডেমনস তার গন্তব্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলো। সাগরের তলায় এক সময় স্থির হয়ে গেল বিধ্বস্ত প্লেনটা। ঘটনাটার কথা দুনিয়ার লোককে জানানো হলো না। গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে সমস্ত তথ্য চেপে যাওয়া হলো।

    .

    প্রথম পর্ব

    বিগ জন্

    ৩ অক্টোবর, ১৯৯১,
    পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর।

    ০১.

    প্রচণ্ড টাইফুন থেমে গেছে। সাগরের সেই উন্মত্ততা এখন আর নেই, তবে ঢেউগুলো এখনও জাহাজের বো-র নাগাল পেতে চাইছে, মাঝে মধ্যেই লাফ দিয়ে উঠে পড়ছে ডেকে, পিছনে রেখে যাচ্ছে একরাশ সাদা ফেনা। ঘন কালো মেঘে ভাঙন ধরল, বাতাসের তেজ কমে দাঁড়াল ত্রিশ নটে। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে একটা সুড়ঙ্গের মত খাড়া হয়ে নিচে নামল রোদ, ফুলে-ফেঁপে থাকা ঢেউগুলোর ওপর এঁকে দিল নীল একটা বৃত্ত।

    নরওয়ের রিনডাল লাইনস্ প্যাসেঞ্জার-কার্গো লাইনার নারভিকের ডেকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ক্যাপটেন আর্নি কোরভোল্ড, চোখে দূরবীন, ঢেউ ও সাদা ফেনার মাথায় নৃত্যরত বিশাল একটা জাহাজের ওপর চোখ বুলাচ্ছেন। চেহারা দেখে মনে হলো, ওটা একটা জাপানি অটো ক্যারিয়ার ব্রিজ আর আপার ডেকে ক্রুদের কোয়ার্টার ছাড়া আর কোথাও কোন পোর্ট বা জানালা নেই।

    জাহাজটা দশ ডিগ্রির মত কাত হয়ে আছে, ঢেউয়ের ধাক্কায় সেটার মাত্র দাঁড়াচ্ছে বিশ ডিগ্রি। চিমনি থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে, জীবনের চিহ্ন বলতে ওইটুকুই। একটা লাইফবোটও দেখা যাচ্ছে না, তার মানে নামানো হয়েছে ওগুলো। গম্ভীর হয়ে উঠল ক্যাপটেন কোরভোন্ডের চেহারা। অশান্ত সাগরের কোথাও কোন লাইফবোটের চিহ্নমাত্র নেই। দূরবীন ঘুরিয়ে জাহাজটার নাম আরেকবার পড়লেন তিনি। জাপানিরা সাধারণত ইংলিশ নাম রাখে তাদের জাহাজের, এটাও তার ব্যতিক্রম নয়।

    জাহাজটার নাম ডিভাইন স্টার।

    বাতাস ও পানির ঝাপটা থেকে সেন্টাল ব্রিজে ফিরে এলেন কোরভোল্ড, কমিউনিকেশন রূমে উঁকি দিয়ে জানতে চাইলেন, এখনও কোন সাড়া নেই?

    মাথা নাড়ল রেডিও অপারেটর। না, স্যার। আমরা ওটাকে দেখার পর থেকে ওরা কোন শব্দই করছে না। ওটার রেডিও নিশ্চয়ই বন্ধ করে রাখা হয়েছে। কোন সাহায্য না চেয়ে জাহাজ খালি করে চলে গেছে সবাই, এ অবিশ্বাস্য।

    ব্রিজের জানালা দিয়ে নিঃশব্দে জাপানি জাহাজটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন ক্যাপটেন কোরভোল্ড, নারভিকের স্টারবোর্ড রেইল থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে ওটা। নরওয়েতে জন্ম, ক্যাপটেন কোরভোন্ড অত্যন্ত ধীরস্থির প্রকৃতির মানুষ, তাড়াহুড়া করে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া তার স্বভাব নয়। ছাব্বিশ বছর সাগরে আছেন তিনি, প্যাসেঞ্জার ও ক্রুরা তাকে সম্মান করে। কাঁচা-পাকা ছোট দাড়িতে হাত বুলালেন তিনি, চিন্তা করছেন। কোরিয়া থেকে সান ফ্রান্সিসকোয় যাচ্ছে নারভিক, ঝড়ের মধ্যে পড়ে শিডিউল থেকে পিছিয়ে পড়েছে দুদিন। গত আটচল্লিশ ঘণ্টা ব্রিজ থেকে নড়েননি ক্যাপটেন, প্রচণ্ড ক্লান্তি অনুভব করছেন। পরিবেশ একটু ভাল হয়ে আসার পর ভাবছিলেন এবার একটু বিশ্রাম নেয়া যেতে পারে, ঠিক এই সময় ডিভাইন স্টারকে দেখতে পেয়েছেন তারা।

    ডিভাইন স্টারের লাইফবোটগুলোকে এখন খুঁজতে হবে। এটা আসলে মানবিক একটা দায়িত্ব, এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। আবার, নিজের প্যাসেঞ্জারদের কথাও ভাবতে হবে তাঁকে সবাই তারা সী সিকনেসে ভুগছে। কোন উদ্ধার অপারেশনে তারা উৎসাহি হবে বলে মনে হয় না।

    ওটায় এটা বোর্ডিং পার্টি পাঠাবার অনুমতি দেবেন, ক্যাপটেন?

    চীফ অফিসার অসকার স্টিন-এর দিকে তাকালেন ক্যাপটেন। হালকা-পাতলা গড়ন চীফ অফিসারের, নীল চোখে বৃদ্ধির দীপ্তি। সঙ্গে সঙ্গে জবাব না দিয়ে ব্রিজের একটা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন কোরভোন্ড, দুই জাহাজের মাঝখানে ঢেউগুলোর দিকে তাকালেন। একেকটা ঢেউ তিন থেকে চার মিটার উঁচু। আমি কোন ঝুঁকি নিতে চাইনি, অসকার। এসো, বরং আরও খানিকটা অপেক্ষা করি, সাগর আগে শান্ত হোক।

    এর চেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে বোট নিয়ে পানিতে নেমেছি আমরা, ক্যাপটেন, মনে করিয়ে দিলেন চীফ অফিসার।

    তাড়াহুড়োর কি আছে। ওটা তো একটা মরা জাহাজ, মর্গে পড়ে থাকা লাশের মত। দেখে মনে হচ্ছে ওটার কার্গো কাত হয়ে পড়ছে, পানিও ঢুকছে। ওটাকে বাদ দিয়ে আমাদের উচিত লাইফবোটগুলোর খোঁজ করা।

    ওখানে আহত মানুষ থাকতে পারে, যুক্তি দেখালেন চীফ অফিসার।

    মাথা নাড়লেন কোরভোল্ট। জাহাজ খালি করার সময় কোন ক্যাপটেন তার আহত ক্রুদের ফেলে যাবে না।

    হ্যাঁ, যদি তার মাথার ঠিক থাকে। কিন্তু ভেবে দেখুন, ঘণ্টায় পঁয়ষট্টি নট ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে কোন ডিসট্রেস সিগন্যাল না দিয়ে অক্ষত একটা জাহাজ থেকে বোটে করে যাকে পালাতে হয়, তার কি মাথা ঠিক থাকার কথা?

    হ্যাঁ, একটা রহস্য বটে একমত হলেন কোরভোল্ড।

    ওটার কার্গোর কথাও বিবেচনা করতে হবে, বললেন চীফ অফিসার অসকার স্টিন। ওয়াটার লাইন বলে দিচ্ছে, জাহাজটা পুরোপুরি লোড করা। দেখে মনে হচ্ছে সাত জাহাজের বেশি বইতে পারে ওটা।

    চোখ কুঁজকে চীফ অফিসারের দিকে তাকালেন ক্যাপটেন। তুমি স্যালভেজ এর কথা ভাবছ, অসকার?

    জ্বী, স্যার, ভাবছি। আমরা যদি কার্গোসহ জাহাজটাকে কোন বন্দরে নিয়ে যেতে পারি, ওটার দামের অর্ধেক হবে আমাদের স্যালভেজ ক্লেইম। কোম্পানি ও কুরা ভাগ করে নিতে পারে ছয়শো মিলিয়ন ক্রোনার।

    কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলেন ক্যাপটেন কোরভোল্ড। লোভ ও অজানা একটা ভয়, দুটোর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলো। জিতল লোভই। ঠিক আছে, বোর্ডিং ক্রু বেছে নাও, সাথে যেন অ্যাসিস্ট্যান্ট এঞ্জিনিয়ার থাকে। ফানেলে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে, তার মানে ওটার মেশিনারি কাজ করছে বলেই মনে হয়। একটু বিরতি নিয়ে বললেন, তবে পানি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই ভাল বলে মনে করি আমি।

    অত সময় আমরা পাব না, চীফ অফিসার বললেন। আর একটু বেশি কাত হলে ডুবে যাবে।

    একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ক্যাপটেন কোরভোন্ড। শুভবুদ্ধির বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি, তবে এ-কথাও তাঁর মনে হলো যে ডিভাইন স্টারের অবস্থা একবার প্রচার হলে হাজার মাইলের মধ্যে প্রতিটি স্যালভেজ টাগ ফুলস্পীড়ে ছুটে আসবে। অবশেষে কাঁধ ঝাঁকালেন তিনি। গিয়ে যদি দেখো যে জাহাজে কেউ নেই, এবং ওটাকে চালানো যাবে, সাথে সাথে রিপোর্ট করবে আমাকে, লাইফবোটগুলোর খোঁজে সার্চ শুরু করব আমি।

    ক্যাপটেন তার কথা শেষ করেননি, তার আগেই ব্রিজ থেকে বেরিয়ে গেলেন চীফ অফিসার অসকার স্টিন। দশ মিনিটের মধ্যে বোটে লোক নামালেন তিনি। বোর্ডিং পার্টিতে নিজে তো থাকলেই চারজন সীম্যানকেও নেয়া হলো, আরও থাকল অ্যাসিস্ট্যান্ট চীফ এঞ্জিনিয়ার ওলাফ এন্ডারসন; কমিউনিকেশন অপারেটর ডেভিড সাকাগাওয়া, নারভিকয় একমাত্র সেই জাপানি ভাষা বলতে পারে। সীম্যান চারজন জাহাজটায় তল্লাশি চালাবে, ওলাফ এন্ডারসন পরীক্ষা করতে এঞ্জিনরুম। চীফ অফিসার অসকার আনুষ্ঠানিকভাবে অটো ক্রারিয়ারে দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন, যদি ওটা খালি অবস্থায় পাওয়া যায়।

    হেলমে থাকলেন অসকার নিজে, লঞ্চটা অশান্ত পানি কেটে এগিয়ে চলল। প্রতিবার ঢেউয়ের মাথা থেকে নামার সময় মনে হলো, এবার বুঝি তলিয়ে যাবে লঞ্জ, যদিও পরবর্তী ঢেউ এসে আবার সেটাকে তুলে নিল মাথার ওপর।

    ডিভাইন স্টার থেকে একশো মিটার দূরে এসে জানতে পারল, আশপাশে ওরা একা নয়। কাত হয়ে পড়া জাহাজটাকে ঘিরে একদল হাঙর চক্কর মারছে। হিংস্র প্রাণীগুলো কিভাবে যেন বুঝতে পেরেছে জাহাজাটা ডুবে যাবে, আর ডুবে গেলে মুখরোচক কিছু খাদ্য পাওয়া গেলেও যেতে পারে।

    ডিভাইন স্টারের বো একবার উঁচু, একবার নিচু হচ্ছে। অনেক কষ্টে অ্যালুমিনিয়াম এ্যাপলিং হুকসহ একটা লাইলন বোডিং ল্যাডার বোর একপাশে, রেইলিঙে আটকানো গেল, তিনবার চেষ্টা করার পর। রশির মই বেয়ে প্রথমে উঠে গেলেন চীফ অফিসার অসকার। তার পিছু নিল এন্ডারসন ও বাকি সবাই। প্রকাণ্ড অ্যাঙ্কল উইঞ্চ-এর সামনে জড়ো হল সবাই, ওদেরকে নিয়ে একটা সিঁড়ির দিকে এগোলেন অসকার, সিঁড়িটা দেখতে অনেকটা আয়ার এস্কেপ-এর মত জানালাবিহীন ফরওয়ার্ড বাঙ্কহেডের গায়ে লেগে আছে। পাঁচ ডেক ওপরে ওঠার পর বিরাট একটা ব্রিজে এসে ডুকলেন অসকার, পনেরো বছর সাগরে থাকা সত্ত্বেও এত বড় ব্রিজ আগে কখনও দেখেননি তিনি। মাঝখানে, ছোট একটা জায়গায়, এক গাদা অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক ইকুইপমেন্ট সাজানো রয়েছে।

    ভেতরে কোন মানুষ নেই, তবে চার্ট, সেক্সট্যান্ট, অন্যান্য নেভিগেশনাল ইকুইপমেন্ট চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। বুঝতে অসুবিধে হয় না, খোলা কেবিনেট-এর ভেতর থেকে বের করা হয়েছে ওগুলো। একটা কাউন্টারে দুটো খোলা ব্রীফকেস পড়ে রয়েছে, ওগুলোর মালিক যেন কিছুক্ষণের জন্যে বাইরে গেছে, যে-কোন মুহূর্তে ফিরে আসবে। সবাই যে খুব আতঙ্কিত অবস্থায় পালিয়েছে, বোঝ যায়।

    মেইন কনসোলটা পরীক্ষা করলেন অসকার। জাহাজটা পুরোপুরি অটোমেটেড, এন্ডারসনকে বললেন তিনি।

    এঞ্জিনিয়ারের চোখে মুগ্ধ দৃষ্টি। ওয়ান্ডারফুল। ভয়েস অপারেটেড কন্ট্রোল। কোন লিবার ধরে টানা-হেঁচড়া করতে হয় না, হেলমসম্যানকে দিতে হয় না কোর্স ইট্রাকশন।

    অসকার পাশে দাঁড়ানো সাকাগাওয়ার দিকে তাকালেন। এটাকে তুমি অন করতে পারবে? দেখো তো, কথা বলতে পারো কিনা।

    কমপিউটরাইজড কনসোলের দিকে ঝুঁকে কয়েক সেকেন্ড নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকল সাকাগাওয়া। তারপর দ্রুত হাতে দুটো বোতামে চাপ দিল। কনসোল আলোকিত হয়ে উঠল, শোনা গেল মৃদু যান্ত্রিক গুঞ্জন। ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি নিয়ে ভেনসমের দিকে তাকাল সে। আমার জাপানি মরচে ধরা, তবে এটার সাহায্যে কমিউনিকেট করতে পারব বলে মনে হয়।

    জাহাজের স্ট্যাটাস রিপোর্ট করতে বলো।

    ছোট একটা রিসিভারের দিকে মুখ নামিয়ে কথা বলল সাকাগাওয়া, তারপর প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষায় থাকল। কয়েক মুহূর্ত পর একটা পুরুষ কণ্ঠ, স্টষ্টভাবে সাড়া দিল। জবাব শেষ হতে চীফ অফিসারের দিকে তাকাল সাকাগাওয়া, চেহারায় হতভম্ব ভাব। কমপিউটর বলছে সী ককগুলো খোলা, এঞ্জিনরূপে ফ্লাড লেভেন দুমিটার ছুঁই ছুঁই করছে।

    বন্ধ করার নির্দেশ দাও! কঠিন সুরে বললেন অসকার স্টিন।

    অল্প কিছুক্ষণ বাক্য বিনিময়ের পর মাথা নাড়ল সাকাগাওয়া। কমপিউটর বলছে, সী কক আটকে গেছে, ইলেকট্রনিক কমান্ডের সাহায্যে ওগুলো বন্ধ করা যাবে না।

    এন্ডারসন বলল, আমি বরং নিচে নেমে গিয়ে দেখি ওগুলো বন্ধ করা যায় কিনা। ব্যাটা বোরটকে বলল, পানি সেচতে শুরু করুক। দুজন সীম্যানকে নিয়ে কম্পানিয়নওয়ে ধরে ছুটল সে, এঞ্জিন রামের দিকে যাচ্ছে।

    বাকি সীম্যানের একজন অসকার স্টিনের কাছে এসে দাঁড়াল, অবিশ্বাস ও বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে আছে চোখ দুটো, মুখের রঙ কাগজের মত সাদা। স্যার… আমি একটা লাশ পেয়েছে। সম্ভবত রেডিওম্যান…।

    দ্রুত কমিউনিকেশন রুমে চলে এলেন অসকার। রেডিও ট্রান্সমিটার প্যানেলের দিকে ঝুঁকে চেয়ারে সময় হয়তো মানুষই ছিল সে, কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে মানুষ বলার কোন উপায় নেই। শরীরের কোথাও কোন চুল নেই। যেখানে ঠোঁট ছিল সেখানে সবগুলো বেরিয়ে থাকা দাঁত না থাকলে অসকার বলতে পারতেন না আকৃতিটা সামনে তাকিয়ে আছে নাকি পিছনে। বীভৎস একা দৃশ্য, দেখে মনে হলো, ফোঁসকা পড়ার পর গায়ের সমস্ত চামড়া গলে গেছে, নিচের মাংসও খানিকটা পুড়ে ও খানিকটা গলে গেছে।

    অথচ আশপাশে কোথাও সামান্যতম উত্তাপ বা আগুনের চিহ্নমাত্র নেই। লোকটার গায়ের কাপড় এত পরিস্কার ও এত সুন্দর ভাঁজ করা, যেন এইমাত্র ইস্ত্রি করার পর পরেছে।

    লোকটা যেন তার শরীরের ভেতরকার উত্তাপে পুড়ে গেছে।

    .

    ০২.

    উৎকট দুর্গন্ধে বমি পেল চীফ অফিসারের। নিজেকে সামলাতে পুরো এক মিনিট সময় নিলেন তিনি। তারপর চেয়ারসহ লাশটাকে একপাশে সরিয়ে ঝুঁকে পড়লেন রেডিওর দিকে। কয়েকবার ভুল করার পর নির্দিষ্ট সুইচটা খুঁজে পেলেন, যোগাযোগ করলেন নারভিকের ক্যাপটেন কার্নি কোরভোল্ডের সাথে।

    কোরভোন্ড জানতে চাইলেন, কি দেখলে বলল, অসকার।

    এখানে মারাত্মক কিছু একটা ঘটে গেছে, ক্যাপটেন। শুধু একটা লাশ ছাড়া এখনও আর কাউকে দেখিনি আমরা। জাহাজটা পরিত্যক্ত। লাশটা রেডিওম্যানের। পোড়া, চেনা যায় না।

    তার মানে কি আগুন ধরেছিল?

    আগুনের কোন চিহ্ন পর্যন্ত নেই। কমপিউটারাইজড অটোমেটেড কন্ট্রোল সিস্টেমের স্ক্রীনে, ফায়ার ওয়ার্নিং লেখাটার নিচে সবুজ আলো জ্বলছে।

    এমন কোন লক্ষণ দেখছ যাতে বোঝা যায় কি কারণে লাইফবোট নিয়ে চলে গেছে ক্রুরা? কোরভোন্ড জানতে চাইলেন।

    সেরকম কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু বোঝা যায়, তাড়াহুড়ো করে পালাবার সময় জাহাজটা ডুবিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে গেছে।

    ফোন ধরা হাতের গিটগুলো সাদা হয়ে গেল, গম্ভীর হলেন ক্যাপটেন কোরভোন্ড। আবার বলো।

    সী ককগুলো খোলার পর এমনভাবে আটকানো হয়েছে যে কমপিউটার ওগুলো বন্ধ করতে পারছে না। বন্ধ করা যায় কিনা হাত দিয়ে চেষ্টা করে দেখছে। এন্ডারসন।

    কয়েক হাজার গাড়ি বহন করছে। এটা একটা অক্ষত জাহাজ, কেন ওটাকে ডুবিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হবে? বেসুরো গলায় জিজ্ঞেস করলেন কোরভোন্ড।

    কিছুই বুঝতে পারছি না, স্যার। এখানে অস্বাভাবিক কিছু একটা আছে। রেডিও অপারেটরের লাশটা বীভৎস। তাকে যেন আগুনে ঝলসানো হয়েছে।

    তুমি চাও আমাদের ডাক্তারকে পাঠাব?

    পোস্টমর্টেম ছাড়া এখানে তার কিছু করার নেই, স্যার।

    বুঝলাম। স্টেশনে আরও ত্রিশ মিনিট আছি, তারপর নিখোঁজ বোটগুলো সার্জ করতে বেরুব।

    কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করেছেন, স্যার?

    ক্রুদের কেউ বেঁচে থাকলে আমাদের স্যালভেজ ক্লেইম চ্যালেঞ্জ করতে পারে, এ কথা ভেবে অপেক্ষা করছি। তল্লাশি চালিয়ে দেখো, সত্যিই যদি জাহাজটা পরিত্যক্ত হয়, আমাদের কোম্পানির ডিরেক্টরকে মেসেজ পাঠিয়ে জানিয়ে দেব যে ডিভাইন স্টারের দখল নিতে যাচ্ছি আমরা।

    এঞ্জিনিয়ার এন্ডারসন সী কক বন্ধ করছে, পাম্প করে পানিও বের করে দেয়া হচ্ছে। পাওয়ার সাপ্লাই ঠিক আছে, কাজেই কিছুক্ষণের মধ্যে রওনা হতে পারব আমরা।

    যত তাড়াতাড়ি করতে পারো ততই ভাল, কোরোল্ড বললেন। তোমরা একটা ব্রিটিশ ওশেনোগ্রাফিক সার্ভে ভেসেল-এর দিকে ভেসে যাচ্ছে। ওরা স্থির একটা পজিশনে রয়েছে।

    কতদূরে?

    প্রায় বারো কিলোমিটার।

    তাহলে ওরা নিরাপদ দূরত্বেই আছে।

    বলার মত আর কিছু খুঁজে পেলেন না ক্যাপটেন কোরভোন্ড। অবশেষে শুধু বললেন, গুড লাক, অসকার। আমি চাই বন্দরে নিরাপদে পৌঁছুবে তোমরা। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

    রেডিও থেকে মুখ তুললেন চীফ অফিসার অসকার, চেয়ারে বসে থাকা গলা লাশটার দিকে তাকালেন না। ভয়ে একা ঠাণ্ডা স্পর্শ অনুভব করলেন তিনি, শিরশির করে উঠল গা। পরিত্যক্ত জাহাজের মত ভৌতিক আর কিছু হয় না, ভাবলেন তিনি। সাকাগাওয়াকে নির্দেশ দিলেন, জাহাজের লগ খুঁজে বের করো, দেখো অনুবাদ করতে পারো কিনা। অবশিষ্ট দুজন সীম্যানকে অটো ডেক সার্চ করতে পাঠালেন, নিজে রওনা হলেন ক্রুদের কোয়ার্টার পরীক্ষা করতে। তাঁর মনে হলো, তিনি যেন একটা পোড়াবাড়ির ভেতর হাঁটছেন।

    কিছু কাপড়চোপড় এলোমেলোভাবে পড়ে আছে, সেগুলো ছাড়া বাকি সবকিছু দেখে মনে হলো ক্রুরা যে-কোন মুহূর্তে ফিরে আসতে পারে। কোথাও কোন অসঙ্গতি চোখে পড়ল না, যেখানে যা থাকার সবই ঠিকমত আছে। ক্যাপটেনের কোয়ার্টারে একটা ট্রের ওপর দুটো চায়ের কাপ রয়েছে, কিভাবে যেন ঝড়ের মধ্যে ছিটকে পড়েনি। বিছানার পড়ে রয়েছে একটা ইউনিফর্ম। কার্পেটে মোড়া ডেকে পাশাপাশি রাখা হয়েছে পালিশ করা দুপাটি জুতো। পরিচ্ছন্ন ডেস্কের উপর পড়ে রয়েছে একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি নাবালক তিনটে বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক মহিলা।

    ডেস্কের নিচে কিছু একটা পড়ে ছিল, পায়ে লাগল। পিছিয়ে এসে ঝুঁকলেন অসকার, জিনিসটা তুলে নিলেন। একটা নাইন-মিলিমিটার, পিস্তল। ট্রাউজারের ওয়েস্ট ব্যান্ডে ঢুকিয়ে রাখলেন তিনি।

    সার্চ শেষ করে ব্রিজে ফিরে এলেন অসকার। চার্টরুমে বসে রয়েছে সাকাগাওয়া, পা দুটো ছোট একটা কেবিনেটে তুলে দিয়ে জাহাজের লগ পড়ছে। পেরেছ তাহলে? জানতে চাইলেন তিনি।

    খোলা একটা ব্রীফকেসে, লগের প্রথম দিক থেকে পড়তে শুরু করল। সাকাগাওয়া। ডিভাইন স্টার, সাতশো ফুট, ১৬ মার্চ ১৯৮৮-তে ডেলিভারি। সুশিমো স্টীমশিপ কোম্পানি লিমিটেড-এর জাহাজ, হেড অফিস কোবে। চলতি ভয়েজে আমরা সাত হাজার দুশো অষ্টাশিটা মূরমোটো অটোমোবাইল বহন করে সান ফ্রান্সিসকোয় নিয়ে যাচ্ছি।

    ক্রুরা জাহাজ ছেড়ে চলে গেল কেন, কোন সূত্র পেয়েছ? জানতে চাইলেন অসকার।

    মাথা নাড়ল সাকাগাওয়া। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মহামারী, বিদ্রোহ কিছুই বলা হয়নি। ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে কোন রিপোর্ট নেই। শেষ এন্ট্রিটা একটু অদ্ভুত।

    পড়ো।

    নিজে আরেকবার পড়ে নিল সাকাগাওয়া, অনুবাদে যাতে ভুল না হয়। তারপর বলল, আমি যতটুকু অর্থ করতে পারছি আবহাওয়ার অবস্থা খারাপের দিকে। ঢেউয়ের উচ্চতা বাটুছে। ক্রুরা অজ্ঞাত রোগে ভুগছে। ক্যাপটেনসহ সবাই অসুস্থ। সন্দেহ করা হচ্ছে ফুড পয়জনিং। আমাদের প্যাসেঞ্জার, মি. সুমা, কোম্পানি ডিরেক্টরদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, উন্মাদের মত আচরণ করছেন। তার বক্তব্য, জাহাজ ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত আমাদের, জাহাজটা ডুবিয়ে দেয়া দরকার। ক্যাপটেন বলছেন, মি. সুমা নার্ভাস ব্রেকডাউনে ভুগছেন; নির্দেশ দিয়েছেন তাকে যেন তার কোয়ার্টারে আটকে রাখা হয়। এ থেকে আমি তো কিছুই বুঝলাম না, স্যার।

    ভাবলেশহীন চেহারা, অসকার জানতে চাইলেন, ব্যাস, আর কিছু নেই?

    না, স্যার, আর কিছু নেই।

    তারিখ?

    পয়লা অক্টোবর।

    তার মানে দুদিন আগের ঘটনা।

    মাথা ঝাঁকাল সাকাগাওয়া, অন্যমনস্ক। এরপরই বোধহয় জাহাজ ছেড়ে চলে যায় ওরা। আশ্চর্য লগটাও ওরা সাথে করে নিয়ে যায়নি।

    শান্ত পায়ে কমিউনিকেশন রুমের দিকে এগোলেন অসকার, গভীরভাবে চিন্তা করছেন। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি, নিজেকে স্থির রাখার জন্যে হাত বাড়িয়ে দরজার চৌকাঠটা ধরে ফেললেন। পুরো ঘরটা তার চোখের সামনে মনে হলো যেন। দুলছে। বমি বমি একটা ভাবও অনুভব করলেন।

    গলা বেয়ে তরল পদার্থ উঠে আসছে, বুঝতে পেরে ঢোক গিলে নিচে পাঠিয়ে দিলেন সেটাকে। হামলাটা হঠাৎ যেমন শুরু হয়েছিল, তেমনি হঠাৎ করেই থেমে গেল।

    এলোমেলো পা ফেলে রেডিওর সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি, নারভিকের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। দিস ইজ ফাস্ট অফিসার অসকার কলিং ক্যাপটেন কোরভোল্ড। ওভার।

    বলো, অসকার, জবাব দিলেন ক্যাপটেন কোরভোল্ড। কি খবর?

    সার্চ করার দরকার নেই, তাতে শুধু সময় নষ্ট হবে। ডিভাইন স্টারের লগে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় পুরোপুরি শুরু হবার আগেই জাহাজ ছেড়ে চলে গেছে ক্রুরা। চলে গেছে দুদিন আগে। ইতোমধ্যে বাতাস তাদেরকে দুশো কিলোমিটার দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে।

    যদি তারা বেঁচে থাকে?

    সম্ভাবনা কম।

    ঠিক আছে, অসকার। তোমার সাথে আমি একমত, আমরা সার্চ করলে কোন লাভ নেই। আমাদের যতটুকু করার করেছি আমরা। ইতোমধ্যে আমি মিডওয়ে আর হাওয়াই-এর আমেরিকান সী রেসকিউ ইউনিটগুলোকে সতর্ক করে দিয়েছি, আশপাশে যারা আছে তাদেরকেও। তোমরা সচল হলে আমরাও সান ফ্রান্সিমকোর কোর্স ধরব।

    ঠিক আছে, অসকার বললেন। অ্যান্ডারসন কতটুকু কি করতে পারল দেখার জন্যে আমি এখন এঞ্জিন রুমে যাচ্ছি।

    যোগাযোগ কেটে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে যাবেন তিনি, জাহাজের একটা ফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলে অসকার বললেন, ব্রিজ।

    মি, অসকার, দুর্বল একটা গলা ভেসে এল।

    হ্যাঁ, কি হয়েছে?

    সীম্যান আর্নি মিডগার্ড, স্যার। আপনি এখুনি একবার সি কার্গো ডেকে আসতে পারবেন? এখানে আমি একটা জিনিস পেয়েছি…।

    হঠাৎ ঠেকে গেল মিডগার্ডের গলা। সে বমি করছে, শুনতে পেলেন অসকার। আর্নি, তুমি অসুস্থ?

    প্লীজ, তাড়াতাড়ি করুন, স্যার! তারপরই যোগাযোগ কেটে গেল। সাকাগাওয়ার দিকে ফিরে চিৎকার করলেন অসকার, এঞ্জিন রূমের সাথে যোগাযোগ করতে হলে কোন বোতামটায় চাপ দেব?

    সাকাগাওয়া কথা বলল না। চাৰ্টরমে ফিরে এলেন অসকার। আগের মতই চেয়ারে বসে রয়েছে সাকাগাওয়া, তার মুখ মরার মত ফ্যাকাসে, ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। মুখ তুলে তাকাল সে, কথাও বলল, প্রতিবার দম নেয়ার সময় বাতাসের অভাবে হাঁসফাস করছে। চার নম্বর বোতামটা… এঞ্জিন রুমে…।

    কি হয়েছে তোমার? ব্যাকুলকণ্ঠে জানতে চাইলেন অসকার।

    জানি না… আমি… আমার খারাপ লাগছে… ভয়ানক অসুস্থ বোধ করছি… বমি করেছি দুবার…।

    শান্ত হও, ধমক দিলেন অসকার। সবাইকে ডাকছি আমি। এটা একটা ডেথ শিপ, নেমে যাব আমরা। ছো দিয়ে ফোন তুলে যোগাযোগ করলেন এঞ্জিন রুমের সাথে। কিন্তু এঞ্জিন রূম থেকে কেউ সাড়া দিল না। ভয়ে কুঁকড়ে গেল তার মন। অজানা একটা ভয়, তাদের ওপর হামলা করছে। তার মনে হলো গোটা জাহাজে ভেসে বেড়াচ্ছে মৃত্যুর একটা তীব্র গন্ধ।

    নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করলেন অসকার। রাণকহেডে বসানো একটা ডেক ডায়াগ্রাম-এর উপর চোখ বুলালেন। পরমুহূর্তে ক্যানিয়নওয়ে ধরে নিচে নামতে শুরু করলেন, প্রতিবারে ছয়টা করে ধাপ টপকে। প্রকাণ্ড হোল্ডগুলোর দিকে ছুটতে চাইছেন তিনি, যেখানে গাড়িগুলো আছে, কিন্তু বমির একটা ভাব তার পেটের পেশীগুলোকে কঠিন করে তুলল। প্যাসেজে দাঁড়িয়ে টলতে শুরু করলেন তিনি, দেয়ালে বাড়ি খেতে খেতে এগোচ্ছেন, যেন একটা বন্ধ মাতাল।

    অবশেষে হোঁচট খেতে খেতে সিকার্গো ডেকের দোরগোড়ায় পৌঁছালেন তিনি। বহুরঙা অটোমোবাইলের একটা সাগর যেন সামনে ও পিছন দিকে একশো মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। বিস্ময়করই বলতে হবে, এত বড় একটা ঝড়ের মধ্যে পড়েও গাড়িগুলো স্থানচ্যুত হয়নি।

    মিডগার্ড-এর নাম ধরে চিৎকার করলেন স্টিন, ইস্পাতের বাল্কহেডে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল তার কণ্ঠস্বর। কোন জবাব পেলেন না। তারপর ব্যাপারটা দেখতে পেলেন তিনি।

    একটা গাড়ির হুড তোলা।

    দীর্ঘ সারির মঝখান দিয়ে টলতে টলতে এগোলেন অসকার। দুপাশের গাড়ির দরজায় ও ফেন্ডারে ধাক্কা খাচ্ছেন, বেরিয়ে থাকা বাম্পারে লেগে ছিঁড়ে য চামড়া,। হুড খোলা গাড়িটার কাছাকাছি এসে চিৎকার করলেন আবার, এখানে কেউ আছ?

    এবার তিনি অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ শুনতে পেলেন। তাড়াতাড়ি এগোলেন তিনি, পৌঁছে গেলেন গাড়িটার কাছে। একটা টায়ারের পাশে মিডগার্ডকে পড়ে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন থমকে।

    ভেজা ঘামে ভরে গেছে মিডগার্ডের মুখ। রক্ত মেশানো ফেরা বেরুচ্ছে মুখের ভেতর থেকে। চোখ দুটো ভোলা, কিন্তু দৃষ্টি নেই। চামড়ার নিচে রক্তক্ষরন হচ্ছে, ফলে হাত দুটো হয়ে উঠেছে লাল। দেশে মনে হলো চীফ অফিসারের চোখের সামনে গলে যাচ্ছে সে।

    গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে স্থির হবার চেষ্টা করলেন অসকার, আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছেন তিনি। অসহায় বোধ করছেন, হতাশায় মাথাটা দুহাতে চেপে ধরলেন। হাত দুটো যখন শরীরের দুপাশে নামিয়ে আনছেন, দেখলেন আঙুলে উঠে জানতে চাইলেন। ফিসফিস করে। মিডগার্ডের চেহারায় নিজের মৃত্যু দেখতে পেলেন তিনি। কিসে মারা যাচ্ছি আমরা?

    .

    ০৩.

    ইনভিনসিবল ব্রিটিশদের একটা ওশেনোগ্রাফিক জলযান। ওটার বিরাট ক্রেন থেকে ঝুলছে ডীপ-সী সাবমারসিবল ওল্ড গার্ট। সাগর এখন অনেকটাই শান্ত হয়ে এসেছে, কাজেই পাঁচ হাজার দুশো মিটার পানির নিচে, সাগরের তলায় বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান চালাবার জন্যে সাবমারসিবলকে এবার নামানো যেতে পারে।

    সাবমারসিবলটা নতুন। অত্যাধুনিক ডিজাইন, তৈরি করেছে একটা ব্রিটিশ অ্যারোস্পেস কোম্পানি। মেনডোসিনো ফ্র্যাকচার জোন সার্ভে করার জন্যে এই প্রথম ওটাকে সাগরের তলায় পাঠানো হচ্ছে। প্রশান্ত মহাসাগরের মেঝেতে বিশাল একটা ফাটল আছে, নর্থ ক্যারোলিন উপকূল থেকে জাপানের দিকে অর্ধেক পথ পর্যন্ত বিস্তৃত, এই ফাটলটারই নাম মেনডোসিনো।

    অন্যান্য অ্যারোডাইনামিক সাবমারসিবলের ভেতরে চুরুট আকৃতির খোল থাকে, নিচে জোড়া লাগানো থাকে পেট ফোলা পড়, কিন্তু ওল্ড গার্টে রয়েছে ট্রান্সপারেন্ট টাইটেনিয়াম ও পলিমার দিয়ে তৈরি চারটে গম্বুজ, পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে গোলাকৃতি টানেল। একটা গম্বুজ জটিল ক্যামেরা ইকুইপমেন্টে ঠাসা, আরেকটায় রয়েছে এয়ার ব্যালাস্ট ট্রাঙ্ক ও ব্যাটারি। তৃতীয় গম্বুজে ভরা হয়েছে অক্সিজেন ইকুইপমেন্ট ও ইলেকট্রিক মোটর। চার নম্বর গম্বুজটা সবচেয়ে বড়, বাকি তিনটের উপরে বসে আছে, ক্রুরা সবাই এটাতেই থাকে। এই চার নম্বর থেকেই পরিচালিত হয় ওল্ড গার্ট।

    দুনিয়ার গভীরতম সাগরতলে পানির চাপ অত্যন্ত বেশি, সে চাপ সহ্য করার মত করেই তৈরি করা হয়েছে ওল্ড গার্টকে। ওটার সাপোর্ট সিস্টেমের সাহায্য নিয়ে একজন ক্রু আটচল্লিশ ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারবে। অন্ধকার ও ভেজা অতল পাতালে আট নট গতিতে ছুটতে পারে ওটা।

    ক্রেইগ প্লাঙ্কেট ওল্ড গার্ট-এর চীফ এঞ্জিনিয়ার ও পাইলট। সব কিছু চেক করে দেখার পর ফর্মে সই করলেন তিনি। পঞ্চাশ বছর বয়েস, টাক ঢাকার জন্যে কাঁচা পাকা চুলগুলো আড়াআড়িভাবে আচড়ানো। লালচে মুখ, প্রায় খয়েরি চোখ। ওল্ড গার্ট-এর ডিজাইন তৈরিতে সাহায্য করেছেন, ওটাকে এখন ব্যক্তিগত ইয়ট হিসেবে দেখেন তিনি। সাগরের তলায় খুব ঠাণ্ডা লাগবে, ভারী একটা উলেন সোয়েটার পরে নিলেন, পায়ে গলালেন একজোড়া নরম ফার দিয়ে কিনারা মোড়া মোকাসিন। বোর্ডিং টানেল থেকে নিচে নেমে বন্ধ করে দিলেন হ্যাঁচটা। এরপর চলে এলেন কন্ট্রোল গম্বুজে, বোতাম টিপে চালু করলেন। কমপিউটরাইজড লাইফ-সাপোর্ট সিস্টেম।

    জিওলজিস্ট ড. রাউল স্যালাজার এরই মধ্যে নিজের সীটে বসে একটা বটম সোনার পেনিট্রেটিং ইউনিট অ্যাডজাস্ট করছেন। রেডি হোয়েন ইউ আর, প্লাঙ্কেটকে বললেন তিনি।

    গম্বুজের ডানে খালি সীটের দিকে তাকালেন প্লাঙ্কেট। আমি ভেবেছিলাম স্টেসি চলে এসেছে।

    এসেছে, বললেন রাউল স্যালাজার। ক্যামেরা রুমে, ভিডিও সিস্টেম চেক করে দেখছে।

    ঝুঁকে টানেলের ভেতর তাকালেন প্লাঙ্কেট, ভেতরের গম্বুজে মোজা পরা একজোড়া মেয়েলি পা দেখতে পেলেন শুধু। বললেন, স্টেসি, আমরা তৈরি।

    মিষ্টি একটা নারীকণ্ঠ ভেসে এল, আর এক সেকেন্ড, আমার হয়ে এসেছে।

    নিজের কন্ট্রোল প্যানেলের নিচে পা দুটো লম্বা করে দিলেন প্লাঙ্কেট, এই সময় কন্ট্রোল গম্বুজে ফিরে এল স্টেসি ফক্স। মেঝের দিকে মাথা ঝুলিয়ে অনেকক্ষণ কাজ করেছে সে, ফর্সা মুখটা লালচে হয়ে আছে। তার রূপকে আগুন বলা যাবে না, তবে সুন্দরী বটে। সরল একরাশ সোনালি চুল মুখের চারপাশে ফুলে আছে, বারবার মাথা ঝাঁকিয়ে সরাতে হয়। রোগা-পাতলা গড়ন, মেয়ে অনুপাতে কাঁধ দুটো একটু বেশি চওড়া। ক্রুরা তার নিতম্ব ও স্তন সম্পর্কে শুধু কল্পনা করতে পারে, কারণ ওগুলোর আকার-আকৃতি সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা নেই ভোলা সোয়েটার ও ঢোলা স্কার্ট পরে স্টেসি, নিজের শারীরিক সম্পদ আড়াল করে রাখার ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক সে। তবে, মাঝে মধ্যে যখন সে হাই তোলে বা আড়মোড়া ভাঙে, বুকটা নিরেট ও ভরাট কিছু একটার আভাস দেয়।

    বয়স চৌত্রিশ, যদিও দেখে আরও অনেক কম মনে হয়। এক সময় ক্যালিফোর্নিয়া সৈকতে সোনালি মেয়ে বলে খ্যাতি অর্জন করেছিল সে, মডেল হিসেবে তার সাফল্য রীতিমত ঈর্ষা করার মতো। তখনই সৌখিন ফটোগ্রাফারদের দলে নাম লেখায়। লেখাপড়া শেষ করার পর একদল মেরিন ফটোগ্রাফারের সঙ্গে ওয়ার্ল্ড ট্যুরে বেরুল, পানির তলায় এমন সব জায়গার ছবি তুলবে যেখানে আগে কখনও কোন ক্যামেরা পৌঁছায়নি। ফটোগ্রাফার হিসেবে ওল্ড গার্টে তার উপস্থিতি আসলে একটা কাভার।

    গম্বুজের ডানদিকের সিটটায় বসল সে, সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে একটা বোতামে চাপ দিলেন প্লাঙ্কেট। ক্রেন অপারেটর ধীরে ধীরে পানিতে নামিয়ে দিল সাবমারসিবলকে।

    ঢেউগুলো এখন এক কি দেড় মিটার উঁচু। একটা ঢেউয়ের মাথায় নেমে নিচের দিকে কাত হয়ে পড়ল ওল্ড গার্ট। লিফট কেবল ইলেকট্রনিক সঙ্কেতের সাহায্যে রিলিজ করা হল। শেষবারের মতো বাইরে থেকে সাবমারসিবলকে চেক করল কয়েকজন ড্রাইভার।

    পাঁচ মিনিট পর জিমি নক্স, সারফেস কন্ট্রোলার, পাঙ্কেটকে রিপোর্ট করলেন, পানি নিচে এখন নেমে যেতে পারে ওল্ড গার্ট। ভরা হলো ব্যালাস্ট ট্রাঙ্ক, পানির ওপর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল সাবমারসিবল। শুরু হলো অভিযান।

    অত্যাধুনিক হলেও, পুরানো ও প্রচলিত পদ্ধতিতেই নিচে নামতে হয় ওল্ড গার্টকে ব্যালাস্ট ট্যাঙ্ক পানিতে ভরে। ওঠার সময় বিভিন্ন আকারের ভারী লোহা পানিতে ফেলে দেয়া হয়। অস্বাভাবিক গভীরতায় পানির চাপ এত বেশি যে চলতি পাম্প টেকনলজি কোন কাজে আসবে না।

    তরল জগতে দীর্ঘ পতন, সম্মোহন তুল্য একটা ঘোরের ভাব এনে দেয় স্টেসির মনে। সারফেসে ছড়িয়ে থাকা আলোয় প্রথম দিকে সব কয়টা রঙই দেখতে পাওয়া যায়, তারপর এক এক করে বিদায় নেয়, ওগুলো, থাকে শুধু নিখাদ কালো।

    গম্বুজের সামনে প্রত্যেকের আলাদা কন্ট্রোল কনসোল ছাড়াও, গম্বুজের বাইরের দৃশ্য একশো আশি ডিগ্রি পর্যন্ত দেখার জন্যে স্বচ্ছ পলিমার ও টাইটেনিয়াম মোড়া একটা জানালা রয়েছে। কালো পানিতে মাঝে মধ্যে দুএকটা আলোকিত মাছ দেখা যাচ্ছে, যদিও সেদিকে কোন খেয়াল নেই ড. স্যালাজারের। সাগরের তলায় কি দেখতে পারবেন, সেটাই তার একমাত্র চিন্তা। প্লাঙ্কেট গভীরতা ও লাইফ-সাপোর্ট ইন্সটুমেন। মনিটর করছেন। চাপ প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে, সেই সঙ্গে কমে যাচ্ছে তাপমাত্রা।

    জরুরি অবস্থার জন্যে ইনভিনসিবল-এ দ্বিতীয় কোন সাবমারসিবল নেই। সাগরের তলায় অনেক রকম বিপদ ঘটতে পারে। ওল্ড গার্ট পাথরের ফাটলে আটকা পড়তে পারে, যন্ত্রপাতিতে ত্রুটি দেখা দিতে পারে, সেক্ষেত্রে পানির ওপর উঠে আসতে পারবে না ওরা। এরকম কোন বিপদে পড়লে বাঁচার একমাত্র উপায় কন্ট্রোল গম্বুজটাকে ছাড়িয়ে আলাদা করে নেয়া, বিরাট একটা বুদ্বুদের মত ওপরে ভেসে উঠবে সেটা। তবে পদ্ধতিটা জটিল, হাইপ্রেশার কন্ডিশনে কখনও পরীক্ষা করে দেখা হয়নি। পদ্ধতিটা যদি কোন কারণে ব্যর্থ হয়, উদ্ধার পাবার কোনই আশা নেই, অক্সিজেনের অভাবে মারা যাবে সবাই।

    ঈলের মতো লম্বা একটা আলোকিত মাছ দেখে ভিডিও ক্যামেরা চালু করল স্টেসি। ভাবতে পারেন, বিশ ফুট লম্বা ওটা! খানিক পর বোতাম টিপে বাইরের আলো জ্বালাল সে, পালিয়ে গেল কালো অন্ধকার, তার জায়গায় সবুজ একটা আভা ছড়িয়ে পড়ল পানিতে। ওল্ড গার্ট-এর বাইরে গভীর সাগর সম্পূর্ণ খালি, প্রাণের কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। ব্যাটারির শক্তি বাঁচানোর জন্যে আলোটা নিভিয়ে দিল স্টেসি।

    গুম্বজের ভেতর ঠাণ্ডা লাগছে ওদের। হাতের রোম খাড়া হচ্ছে, দেখতে পেল স্টেসি। দুহাতে কাঁধ আঁকড়ে ধরে শীতে কেঁপে ওঠার একটা ভঙ্গি করল সে। সংকেতটা বুঝতে পেরে ছোট একটা হিটিং সিস্টেম চালু করলেন প্লাঙ্কেট, যদিও তীব্র শীত তাড়াবার জন্যে যথেষ্ট নয় ওটা।

    সাগরের তলায় পৌঁছাতে দুঘণ্টা লাগবে ওদের। যে যার কাজে ব্যস্ত না থাকলে সময়টা কাটানো কঠিন হত। সোনার মনিটর ও ইকো সাইন্ডারের দিকে তাকিয়ে আছেন, প্লাঙ্কেট, একটা চোখ রেখেছেন ইলেকট্রিক্রাল ও অক্সিজেন লেভেল গজ-এর ওপর। তলায় পৌঁছাবার পর কিভাবে অনুসন্ধান চালাবেন, তার একটা নকশা তৈরি করছেন ড. রাউল স্যালাজার। স্টেসি নিজের ক্যামেরা ইকুইপমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত।

    ইনভিনসিবল থেকে জিমি নক্স, সারফেস কন্ট্রোলারের গলা ভেসে এল আন্ডার ওয়াটার আকুটিকস টেলিফোনে, ভৌতিক লাগল ওদের কানে। দশ মিনিটের মধ্যে তলায় পৌঁছে যাবেন আপনারা, বললেন তিনি।

    হ্যাঁ, জবাব দিলেন প্লাঙ্কেট। সোনার তা বলছে।

    কাজ থেকে মুখ তুলে সোনার স্ক্রীনে তাকাল স্টেসি, তাকালেন স্যালাজারও। স্ত্রীন থেকে পানির দিকে, তারপর আবার স্ক্রীনের দিকে চোখ ফেরালেন প্লাঙ্কেট। সোনার ও কমপিউটারের ওপর বিশ্বাস আছে তার, তবে নিজের চোখের চেয়ে বেশি নয়।

    সাবধান হোন, সর্তক করে দিলেন জিমি নক্স। এটা ক্যানিয়ন ওয়াল-এর পাশে নামছেন আপনারা।

    দেখতে পেয়েছি, জানালেন প্লাঙ্কেট। পাঁচিলটা চওড়া একটা উপত্যকার দিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে। হাত বাড়িয়ে একটা বোতামে চাপ দিলেন, খালি হয়ে গেল একটা ব্যালাস্ট, ওদের নামার গতি খানিকটা কমল। তলা থেকে ত্রিশ মিটার উপরে রয়েছে, আরেকটা ব্যালাস্ট খালি করা হলো। প্রায় স্থির হয়ে গেল সাবমারসিবল।

    সাগরের তলা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো চোখের সামনে। ভাঙাচোরা, এবড়োথেবড়ো পাকটা ঢাল। যতদূর দৃষ্টি চলে ভাঁজ করা, মোচড় খাওয়া অদ্ভুত আকৃতির পাথর আর পাথর। আমরা একটা লাভা প্রবাহের পাশে নামছি, বললেন প্লাঙ্কেট। কিনারাটা প্রায় মাইল খানেক সামনে। তারপর তিনশো ফুট নেমে গেছে পাঁচিলের গা, নিচে উপত্যকার মেঝে।

    আই কপি, জবাব দিলেন জিমি নক্স।

    পোকার মত দেখতে, ওই পাথরগুলো কি? জানতে চাইল স্টেসি।

    পিলো লাভা, জবাব দিলেন ড. স্যালাজার। গুলো তৈরি হয়েছে জ্বলন্ত লাভা যখন ঠাণ্ডা সাগরে বেরিয়ে আসে। আউটার সেল ঠাণ্ডা হয়ে যায়, আকৃতি পায় টিউবের মতো, ভেতরে সচল থাকে তরল লাভা।

    অলটিচুড পজিশনিং সিস্টেম চালু করলেন, প্লাঙ্কেট, ফলে চালের মেঝে থেকে চার মিটার ওপরে থাকবে সাবমারসিবল। উঁচু-নিচু মালভূমির উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে ওরা।

    গেট রেডি, বললেন প্লাঙ্কেট। আমরা নিচে নামছি।

    কয়েক সেকেন্ড পর সাগরের তলা অদৃশ্য হলো, আবার সামনে দেখা গেল কালো অন্ধকার, নিচের দিকে নাক নামিয়ে আবার শুরু হলো ওল্ড গার্টের পতন, গিরিখাদের খাড়া পাঁচিল থেকে চার মিটার দূরত্ব বজায় রেখে।

    আন্ডারওয়াটার ফোন থেকে জিমি নক্সের গলা ভেসে এল। আপনাদেরকে আমি পাঁচ-তিন-ছয়-শূন্য মিটারে পাচ্ছি।

    ঠিক আছে, আমার লেখাও তাই বলছে, জবাব দিলেন প্লাঙ্কেট।

    আপনারা যেখানে নামছেন, এই উপত্যকার মেঝেতেই রয়েছে ফ্র্যাকচার জোন, জানালেন জিমি নক্স।

    বোধহয়, বিড়বিড় করলেন প্লাঙ্কেট, কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। ওল্ড গার্ট-এর নিচটা স্ত্রীনে দেখতে পাচ্ছেন তিনি। •

    বারো মিনিট পর সামনে সমতল একটা মেঝে দেখা গেল। এতক্ষণে সিধে হলো সব। গম্বুজের চারদিকে গভীর তলদেশের পদার্থ ঘুরপাক খাচ্ছে, হালকা স্রোতে তুষার কণার মতো দেখতে লাগল। আলো একটা গোলাকার বৃত্ত সৃষ্টি করেছে, ছোট ঢেউ খেলানো বালি দেখা গেল সামনে। বালির বিস্তৃতিটুকু কালি নয়; হাজার হাজার গোল জিনিস, কামানের গোলার মতো, সাগরের তলায় ছড়িয়ে রয়েছে।

    ম্যাঙ্গানিজ নডিউল, ব্যাখ্যা করলেন ড. স্যালাজার, যেন ছাত্রকে পড়াচ্ছেন। কিভাবে ওগুলো তৈরি হলো কেউ তা সঠিকভাবে বলতে পারে না, তবে সন্দেহ করা হয় যে হাঙরের দাঁত ও তিমির কানের হাড়ই নাকি দায়ী।

    ওগুলোর কোন দাম আছে? জানতে চাইল স্টেসি, ক্যামেরা চালু করল।

    ম্যাঙ্গানিজ ছাড়াও ওগুলোতে কিছুটা করে কোবাল্ট, কপার, নিকেল আর জিঙ্ক আছে। আমার ধারণা, ফ্র্যাকচার জোনের কয়েকশো মাইল জুড়ে পড়ে আছে ওগুলো। এক বর্গ কিলোমিটারে যতগুলো আছে, আমার হিসেবে তার দাম হবে আট মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

    নডিউল ছড়ানো বালির ওপর দিয়ে নিঃশব্দে এগোচ্ছে ওল্ড গার্ট, কোন দিকে যেতে হবে সে ব্যাপারে প্লাঙ্কেটকে পরামর্শ দিচ্ছেন ড. স্যালাজার। হঠাৎ ওদের পোর্টসাইডে কি যেন একটা চকচক করে উঠল। জিনিসটার দিকে তাড়াতাড়ি সাবমাসিবলকে কাত করলেন প্লাঙ্কেট।

    কি দেখছেন? জানতে চাইলেন ড. স্যালাজার, নিজের ইন্সট্রুমেন্ট থেকে মুখ তুলে।

    নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ল স্টেসি। এটা বল। তার গলায় অবিশ্বাস ও বিস্ময় প্রকাণ্ড একটা মেটাল বল, সাথে অদ্ভুত টাইপের গোঁজ রয়েছে। আমার ধারণা, দশ ফুট ডায়ামিটারের কম হবে না!

    প্লাঙ্কেট মন্তব্য করলেন, নিশ্চয়ই কোন জাহাজ থেকে পড়েছে।

    খুব বেশিদিন আগেও নয়, কারণ কোথাও মরচে ধরেনি এখনও বললেন ড. স্যালাজার।

    তারপর হঠাৎ করেই সাদা বালির চওড়া একটা বিস্তৃতি দেখতে পেলেন ওঁরা, কোথাও একটা নডিউল নেই। দেখে মনে হলো যেন বিরাট একটা ভ্যাকুম ক্লিনার মাঠের মাঝখানটা পরিষ্কার করে দিয়ে গেছে।

    সোজা ও সরল একটা কিনারা! বিস্ময় প্রকাশ করলেন ড. স্যালাজার। সাগরের তলায় এত লম্বা সোজা ও সরল কিনারা থাকতেই পারে না!

    স্টেসির চোখেও পলক পড়ছে না। এত নিখুঁত, এত পরিচ্ছন্ন, এ মানুষের তৈরি না হয়েই যায় না।

    মাথা নাড়লেন প্লাঙ্কেট। অসম্ভব, এই গভীরতায় সম্ভয় নয়। দুনিয়ার কোন এঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি সাগরের তলায় মাইনিং অপারেশন চালাবার ক্ষমতা রাখে না।

    এমন কোন জিওলজিক্যাল ডিসটার্বান্স-এর কথাও কখনও শুনিনি যার ফলে সীবেড়ে এরকম একটা চমৎকার রাস্তা তৈরি সম্ভব, দৃঢ়কণ্ঠে বললেন ড. স্যালাজার।

    প্লাঙ্কেট জানতে চাইলেন, কি ধরনের ইকুইপমেন্ট সাগরের তলা ঝাড় দিতে পারে?

    দানব আকৃতির একটা হাইড্রলিক ড্রেজ, পাইপের মধ্যে টেনে নিয়ে সারফেসে ভেসে থাকা একটা বার্জে খালি করবে নডিউলগুলো, বললেন ড. স্যালাজার। কয়েক বছর আগেই ধারণাটা বাতিল হয়ে গেছে।

    যেমন মঙ্গলগ্রহে মানুষ পাঠানোর ব্যাপারটাও বাতিল হয়ে গেছে, ওখানে পাঠানোর মতো রকেট এখনও তৈরি করা সম্ভব হয়নি। দানব আকৃতির কোন ড্রেজও আমরা তৈরি করতে পারিনি।

    ড. প্লাঙ্কেটের দিকে তাকাল স্টেসি। কোন ধারণা দিতে পারেন, ব্যাপারটা কবে ঘটেছে?

    কাঁধ ঝাঁকালেন ড. স্যালাজার। হয়তো গতকাল, হয়তো কয়েক বছর আগে।

    কিন্তু কে তাহলে? বিড়বিড় করে জানতে চাইল স্টেসি। এ ধরনের একটা টেকনলজি আবিষ্কার হয়ে থাকলে, কেউ কৃতিত্ব দাবি করেনি কেন?

    সাথে সাথে ওঁরা কেউ কিছু বললেন না। আবিষ্কারটা ওদের প্রচলিত বিশ্বাসের ওপর প্রচণ্ড এক আঘাত হেনেছে। চওড়া, পরিচ্ছন্ন বালির বিস্তৃতির দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলেন, অজানা একটা ভয়ে শিরশির করেছে গা।

    অবশেষে কথা বলে উঠলেন, প্লাঙ্কেট, মনে হলো তাঁর কণ্ঠস্বর অনেক দূর থেকে ভেসে এল। তারা যে-ই হোক, এ দুনিয়ার কেউ নয়। অন্তত মানুষ নয়।

    .

    ০৪.

    চেহারায় নগ্ন আতঙ্ক, নিজের হাত দুটোয় ফোঁসকা পড়তে দেখছেন অসকার স্টিন। প্রচণ্ড মানসিক আঘাত ও আকস্মিক পেট-ব্যথায় আধ পাগলা হয়ে উঠলেন তিনি, শরীরের কাঁপুনি থামাতে পারছেন না। সামনের দিকে ঝুঁকে বমি করলেন হাপরের মত হাঁপাচ্ছেন। চারদিক থেকে আক্রমণ শুরু হয়েছে। তাঁর হার্টবিট হঠাৎ করে ছন্দ হারিয়ে ফেলেছে। সারা শরীর পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে।

    সাংঘাতিক দুর্বল লাগছে, কমিউনিকেশন রুমে গিয়ে ক্যাপটেন কার্নি কোরভোল্ডকে সাবধান করা সম্ভব নয়। কোরভোল্ড সিগন্যাল পাঠিয়ে কোন সাড়া না পেলে কি ঘটেছে দেখার জন্যে আরও একটা বোর্ডিং পার্টি পাঠাবেন ডিভাইন স্টারে। অহেতুক আরও কিছু লোক মারা যাবে।

    ইতোমধ্যে ঘামে ভিজে গেছেন অসকার স্টিন। হুড তোলা গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি, অদ্ভুত এক ঘৃণায় চকচক করছে তার চোখ দুটো। অসাড় একটা ভাব গ্রাস করে ফেলেছে তাকে, তার বিপর্যস্ত মন ইস্পাত, লেদার চামড়ার ভেতর অবর্ণনীয় একটা অশুভ কিছু দেখতে গেল।

    যেন আত্মরক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে, নিষ্প্রাণ গাড়িটার ওপর হিংস্র হয়ে উঠলেন অসকার, ক্যাপটেনের কোয়ার্টার থেকে পাওয়া পিস্তলটা ওয়েস্টব্রান্ড থেকে বের করে গাড়ির সামনের দিকটায় একের পর এক গুলি করলেন তিনি।

    দুকিলোমিটার পূর্ব দিকে রয়েছে নারভিক, ব্রিজে দাঁড়িয়ে ডিভাইন স্টারের দিকে তাকিয়ে আছেন ক্যাপটেন কার্নি কোরভোল্ড, চোখে দূরবীন, এই সময় বিস্ফোরণের মাধ্যমে নিজের অস্তিত্ব হারালো জাপানি জাহাজটা। চোখের পলক পড়ল না, গোটা জাহাজটা যেন বাষ্প হয়ে উড়ে গেল।

    দানবীর আকৃতির একটা আগুনে বল লাফ দিয়ে উঠল, সেটার নীল উজ্জ্বলতা সূর্যের চেয়েও গাঢ়। এক পলকেই চার কিলোমিটার জুড়ে বিস্ফোরিত হলো উত্তপ্ত সাদা গ্রাস। আকাশে জন্ম নিল একটা হেমিস্ফোরিক কনডেনসেশন ক্লাউড, ছড়িয়ে পড়ল বিশাল ছাতার আকৃতি নিয়ে।

    সাগরের গা তিনশো মিটার জুড়ে ডেবে গেল গভীর একটা গামলার মতো। তারপর কয়েক মিলিয়ন টন পানিসহ আকাশের দিকে খাড়া হলো একটা থাম, থামের গা থেকে কয়েক হাজার পানির মোটা ধারা বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে এল, একেকটা এসটাডা লোভার চেয়েও বড় আকারে।

    আগুনে বলটা থেকে ছুটল শক ওয়েভ, শনিকে ঘিরে থাকা রিঙের মত, দ্রুত বড় হচ্ছে আকারে, প্রতি সেকেন্ডে পাঁচ কিলোমিটার গতিতে। নারভিকের আঘাত করল শক ওয়েভ থেতলে, মুচড়ে দলা পাকিয়ে আকৃতিহীন করে দিল জাহাজটাকে।

    ক্যাপটেন কার্নি কোরভোল্ট খোলা ব্রিজ উইং-এর দাঁড়িয়ে ছিলেন, ধ্বংসকাণ্ডটা দেখেননি। তাঁর চোখ ও মস্তিষ্ক ঘটনাটা রেকর্ড করার সময় পায়নি। থারমল রেডিয়েশনে এক মাইক্রো সেকেন্ডের মধ্যে কার্বনে পরিণত হয়েছে তিনি। তার গোটা জাহাজ পানি থেকে লাফ দিয়ে শূন্যে উঠল, ছিটকে পড়ল একধারে। প্রাইড অব ম্যানের ইস্পাত ও ধুলো তরল বৃষ্টিরমত ঝরে পড়ল নারভিকের বিধ্বস্ত ডেকে। ফাটল ধরা খোল থেকে বেরিয়ে এল আগুনের লেলিহান শিখা, গ্রাস করে ফেলল ভাঙাচোরা জাহাজটাকে। তারপর ভেতর দিকে বিস্ফোরণ ঘটল। কার্গো ডেকের কন্টেইনারগুলো চারদিকে ছুটে গেল ঝড়ের মুখে পড়া গাছের পাতার মত।

    যন্ত্রণাকাতর, কর্কশ চিৎকার দেয়ার সময়টুকুও পাওয়া গেল না। যারা ডেকে ছিল, দেশলাইয়ের কাঠির মত জ্বলে উঠল দপ করে, চড়চড় আওয়াজ তুলে পুড়ে ছাই হয়ে গেল হাড়, পরমুহূর্তে উবে গেল কর্পূরের মতো। দুশো পঞ্চাশ জন প্যাসেঞ্জার ও ক্রু চোখের পলকে নেই হয়ে গেল।

    ডিভাইন স্টার বাস্প হয়ে উড়ে যাবার প্রায় সাথে সাথে থেমে গেল ব্যাপারটা। আগুনে বলের ওপর ফুলকপি আকৃতির যে মেঘটা জমেছিল, ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল সেটা, সাধারণ মেঘের সাথে মিশে যাওয়ায় আলাদাভাবে চেনা গেল না। ধীরে ধীরে শান্ত হলো আলোড়িত পানি, ঢেউ বাদ দিলে সাগরের উপরটা এখন আগের মতই মসৃণ। বারো মাইল দূরে এখনও ভেসে রয়েছে ইনভিনসিবল। সার্ভেশিপে যখন আঘাত হানল, শক ওয়েভের অবিশ্বাস্য চাপ তখনও শক্তি হারাতে শুরু করেনি। ইনভিনসিবল-এর সুপারস্ট্রাকচার উপড়ে নিল ওটা, বাইরে থেকে ভেতরের বাল্কহেডগুলো দেখা যাচ্ছে। উপড়ে পানিতে পড়ল চিমনি, ফুটন্ত পানির সাথে ঘুরছে সেটা। চোখের পলক পড়ল না, অদৃশ্য হলো ব্রিজ, সাগরে ছড়িয়ে পড়ল ইস্পাত ও মাংস কণা।

    ইনভিনসিবল-এর মাস্তুল কাত হয়ে ভেঙে গেছে। ভেঙে গেছে বড় ক্রেনটা, যেটার সাহায্যে ওল্ড গার্টকে পানির উপর ভোলা হয়। খোলের প্লেটগুলো ভেঙে ঢুকে পড়েছে জাহাজের ফ্রেম ও লংগিচ্যুড়াইনাল বীমাগুলোর মাঝখানে। নারভিকের মতই, বুবার্ডকে চেনা যায় না, আকৃতি হারিয়ে ফেলেছে। কালো, তেলতেলে ধোয়া বেরিয়ে আসছে বিধ্বস্ত পোর্ট সাইড থেকে। যারা খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল, উত্তাপে পুড়ে গেছে সবাই। ডেকের নিচে এমন কেউ নেই যে আহত হয়নি।

    প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে একটা বাল্কহেডের গায়ে ছিটকে পড়লেন জিমি নক্স, বাল্কহেড থেকে ফুটবলের মত ড্রপ খেয়ে ফিরে এলেন মেঝেতে। বাতাসের তীব্র অভাবে দম আটকে মারা যাচ্ছেন তিনি। হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছেন, হা করে তাকিয়ে আছেন সিলিঙে সদ্য তৈরি একটা গর্তের দিকে।

    গর্তের ভেতর দিয়ে ব্রিজ আর চার্টরুম দেখতে পেলেন তিনি। ভেতরে কেউ নেই, কিছু নেই, ছাল-চামড়া পর্যন্ত গায়েব হয়ে গেছে। হুইলহাউস পরিণত হয়েছে পোড়া আর হাড়ি ভাঙা মানুষের একটা পে, গর্তের কিনার থেকে নিচের কমপার্টমেন্টে ঝর ঝর করে নেমে আসছে তাদের রক্ত।

    কাত হবার চেষ্টা করলেন জিমি নক্স, সাথে সাথে গুঙিয়ে উঠলেন তীব্র ব্যথায়? তিনটে ছাড় ভেঙেছে পাঁজরের, একটা পায়ের গোড়ালি মচকে গেছে, শরীরের অসংখ্য জায়গায় ছিঁড়ে গেছে চামড়া। কাটিয়ে উঠতেই ওল্ড গার্টে কথা মনে পড়ল তার। ক্রল করে ডেক পেরুলেন তিনি, থামলেন আন্ডারওয়াটার টেলিফোনের কাছে। ওল্ড গার্ট? ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলেন। ডু ইউ রিড?

    কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করলেন জিমি নক্স, কিন্তু কোন সাড়া পেলেন না। ড্যাম ইউ প্লাঙ্কেট। কথা বলুন।

    তারপরও কোন সাড়া পাওয়া গেল না। ইনভিনসিবল-এর সাথে ওল্ড গার্টে সমস্ত যোগাযোগ নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি যা ভয় করেছিলেন, তাই ঘটেছে। সার্ভেশিপ ভেঙে চুরে তুবড়ে যাবার পিছনে কারণ যা-ই হোক, সেই একই কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে পানির তলায় ওল্ড গার্টও। মারা গেছে ওরা, বিড়বিড় করলেন। ছাতু হয়ে গেছে সবাই।

    তারপর হঠাৎ সহকারী ও ক্রুদের কথা ভাবলেন তিনি। নাম ধরে চিৎকার শুরু করলেন। শুধু মানুষের গোঙানি আর মৃত্যুপথযাত্রী জাহাজের ধাতব কাতর ধ্বনি শুনতে পেলেন। খোলা দরজা দিয়ে তাকাতে দেখতে পেলেন, এলোমেলোভাবে পাঁচটা দেহ পড়ে রয়েছে, একটাও নড়ছে না।

    শোকে বিহ্বল, বিস্ময়ে দিশেহারা, নড়ার শক্তি পেলেন না জিমি নক্স। অনুভব করলেন, জাহাজের খিচুনি উঠে গেছে। ইনভিনসিব-এর পিছন দিকটা পাক খাচ্ছে, নেমে যাচ্ছে ঢেউয়ের ভেতর, যেন একটা ঘূর্ণিজলে ধরা পড়েছে জাহাজ। বুঝতে অসুবিধে হলো না, পানির নিচে তলিয়ে যাবে জাহাজটা।

    জাহাজের পিছন দিকটা ডুবে যাচ্ছে, উঁচু হচ্ছে বো। কয়েক মুহূর্ত ওভাবে থাকার পর ডুবে গেল জাহাজের পিছনটা পানির নিচে। তারপর পুরো জাহাজটাই।

    ইনভিনসিবল-এর ক্রুরা কেউ বাচল কিনা দেখার জন্যে চারদিকে তাকালেন জিমি। কোথাও কোন লাইফবোট নেই। পানিতেও কেউ সাঁতার কাটছে না। ব্যাখ্যাহীন বিয়োগান্তক ঘটনাটার তিনিই যেন একমাত্র সাক্ষী হয়ে বেঁচে রয়েছেন।

    .

    ০৫.

    পানির নিচে বৃত্তাকার শক ওয়েভের গতি ঘণ্টার কমবেশি সাড়ে ছয়হাজার মাইল, সেটার পথে পথে সমস্ত সামুদ্রিক প্রাণী ধ্বংস হয়ে গেল। গিরিখাদের আড়াল পাওয়ার ওল্ড গার্ট সাথে সাথে বিধ্বস্ত হলো না, তবে অবিশ্বাস্যা দ্রুতবেগে বারবার ডিগবাজি খেতে শুরু করল সেটা। একটা পড়-এ মেইন ব্যাটারি আর প্রোপালশন সিস্টেম রয়েছে, পাথরের শক্ত নডিউলের সাথে বাড়ি খেল সেটা, ভেঙে ডেবে গেল ভেতর দিকে। ভাগ্য ভাল যে সংযুক্ত টিউবের দুপাশের হ্যাঁচ কভার ভাঙল না, ভাঙলে কন্ট্রোল গম্বুজের তেলে পানি ঢুকে রক্তাক্ত ছাতু বানিয়ে ফেলত ওদের।

    বজ্রপাতের মতো বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে এল আন্ডারওয়াটার টেলিফোনে, প্রায় একই সাথে শোনা গেল শক ওয়েভের আওয়াজ, যেন সগর্জনে ছুটে আসছে একটা এক্সপ্রেস ট্রেন। তারপর নেমে এল ভৌতিক নিস্তব্ধতা। নিস্তব্ধতা আবার ভাঙল, শোনা গেল ইস্পাতের যন্ত্রণাকাতর কর্কশ আওয়াজ, অশান্ত পানির ওপর জাহাজটা টুকরো টুকরো হয়ে নেমে আসছে সাগরের তলায়।

    কি ঘটছে? চিৎকার করল স্টেসি, পড়ে যাওয়ার ভয়ে চেয়ারটা দুহাতে আঁকড়ে ধরে আছে।

    আতঙ্কেই হোক, কিংবা দায়িত্বের প্রতি শর্তহীন নিষ্ঠা, নিজের কনসোল থেকে চোখ তুললেন না ড. রাউল স্যালাজার। ভূমিকম্প নয়। কমপিউটার বলছে। সারফেস ডিসটাৰ্যান্স।

    ওল্ড গার্ট-এর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন ক্রেইগ প্লাঙ্কেট। নডিউল ভর্তি মাঠে অনবরত বাড়ি খাচ্ছে সাবমারসিবল, অসহায়ভাবে দেখা ছাড়া তার কিছু করার নেই। সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা ভুলে আন্ডারওয়াটার টেলিফোনে চিৎকার করছেন তিনি। সারাফেস কন্ট্রোলার, এখানে আমরা প্রচণ্ড একটা আলোড়নের মধ্যে পড়েছি। কারণটা বুঝতে পারছি না। থ্রাস্ট পথ হারিয়েছি। প্লীজ সাড়া দিন!

    জিমি নক্সের কথা শুনতে পাবার কথা নয়। বেঁচে থাকার জন্যে পানির সাথে যুদ্ধ করছেন তিনি।

    তখনও টেলিফোনে চিৎকার করছেন প্লাঙ্কেট, ডিগবাজি খাওয়া বন্ধ হলো ওল্ড গার্ট-এর। সাগরের তলায় ধাক্কা খেয়ে স্থির হলো সাবমারসিবল, ইলেকট্রিক্যাল ও অক্সিজেন ইকুইপমেন্ট ভরা গম্বুজটার উপর ভর দিয়ে।

    সব শেষ, বিড়বিড় করলেন ড. স্যালাজার, ঠিক কি বলতে চাইছেন নিজেও জানেন না, বিস্ময় ও আতঙ্কে মাথাটা ঠিকমত কাজ করছে না।

    কিসের শেষ! কর্কশ স্বরে বললেন প্লাঙ্কেট। ব্যালাস্ট ফেলে দিয়ে এখনও আমরা উপরে ভেসে উঠতে পারব। যদিও জানেন, পড়ে যে পানি ঢুকেছে তার চেয়ে আয়রন ব্যালাস্টের ওজন কমই হবে। তবু সুইচ অন করলেন তিনি, সাবমারসিবলের পেট থেকে কয়েকশো পাউন্ড বোঝা খসে পড়ল।

    কয়েক মুহূর্ত কিছুই ঘটল না, তারপর এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে সাগরের মেঝে থেকে ওপর দিকে উঠতে শুরু করল ওল্ড গার্ট।

    দশ ফুট ওপরে উঠেছি, ত্রিশ সেকেন্ড পর ঘোষণা করলেন প্লাঙ্কেট, যদিও মনে হলো সুইচ টেপার পর এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে।

    ধীরে ধীরে সিধে হলো সাবমারসিবল, এতক্ষণে আবার নিঃশ্বাস ফেললেন ওরা। জিমি নক্সের সাথে আবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন প্লাঙ্কেট।

    ডেপথ মিটারের দিকে এমন কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্টেসি তার মনে হলো ডায়ালের ওপর কাঁচটা ফেটে যাবে। গো…গো…, বিড়বিড় করে আবেদন জানাচ্ছে সে।

    দুঃস্বপ্নটা গ্রাস করল ওদেরকে বিনা নোটিশে। ইলেকট্রিক্যাল ও অক্সিজেন ইকুইপমেন্ট ভরা গম্বুজটা সাগরের মেঝেতে ধাক্কা খেয়ে তুবড়ে গিয়েছিল, পানির নির্দয় চাপে ডিমের মত ভেঙে পড়ল সেটা।

    ব্রাডি হেল! খসে পড়ল সাবমারসিবল, সাগরের মেঝেতে লেগে ঝাঁকি খেল। তারপরই একবার ইতস্তত করে নিভে গেল আলোটা। নিশ্চিদ্র অন্ধকার কি রকম আতঙ্ক সৃষ্টি করে তা একমাত্র অন্ধজনই বলতে পারে; প্রাঙ্কেটের মনে হলো, অন্ধকার জ্যান্ত একটা প্রাণী, চারপাশ থেকে তাকে পেঁচিয়ে ধরেছে।

    নিস্তব্ধতা ভাঙলেন ড. সালাজার, মাদার অভ জেসাস, আমাদের সত্যি কোন আশা নেই।

    কে বলেছে? ধমকের সুরে কথা বললেন প্লাঙ্কেট। কন্ট্রোল গম্বুজ আলাদা করে নিয়ে এখনও আমরা উপরে উঠে যেতে পারি। কনসোলে হাত বুলালেন তিনি, নির্দিষ্ট সুইচটা খুঁজে নিলেন। ক্লিক করে শব্দের সাথে ইমার্জেন্সি লাইট জ্বলে উঠল।

    স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে স্টেসি বলল, থ্যাঙ্ক হেভেন। আমরা অন্তত দেখতে পাচ্ছি। সামান্য একটু ঢিল পড়ল তার পেশীতে।

    জরুরি অবস্থা, উঠে যেতে হবে ওপরে, সেভাবে নির্দেশ দিয়ে কমপিউটারের প্রোগ্রাম সেট করলেন চীফ এঞ্জিনিয়ার প্লাঙ্কেট। রিলিজ মেকানিজম সেট করে স্টেসি ও ড. সালাজারের দিকে তাকালেন। শক্ত হয়ে বসতে হবে। উঠতে শুরু করলে কি ঘটে বলা যায় না।

    আমি তৈরি, ভয়ে ভয়ে বলল স্টেসি।

    রিলিজ হ্যান্ডেল থেকে সেফটি পেগ সরিয়ে নিলেন প্লাঙ্কেট, তারপর শক্ত হাতে ধরে টান দিলেন।

    কিছুই ঘটল না।

    নিয়ম ধরে তিনবার চেষ্টা করলেন প্লাঙ্কেট, কিন্তু সাবমারসিবলের মেইন সেকশন থেকে কন্ট্রোল গম্বুজ গোঁয়ারের মতো আলাদা হতে অস্বীকার করল। মরিয়া হয়ে উঠে কমপিউটরকে জিজ্ঞেস করলেন, কোথাও কোন যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা। দিয়েছে কিনা। চোখের পলকে উত্তর পাওয়া গেল স্ক্রীনে। সাগরের তলার সাথে ধাক্কা খাওয়ার সময় রিলিজ মেকানিজমস মুচড়ে বাঁকা হয়ে গেছে, মেরামতের অযোগ্য।

    আমি দুঃখিত, হতাশায় মুষড়ে পড়ে বললেন প্লাঙ্কেট। কেউ এসে উদ্ধার না করা পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে আমাদের।

    সম্ভাবনা কম, বিড়বিড় করলেন ড. স্যালাজার, স্কি জ্যাকেটের হাতা দিয়ে। মুখের ঘাম মুছলেন।

    অক্সিজেনের অবস্থা কি? জানতে চাইল স্টেসি।

    মেইন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেছে। তবে কন্ট্রোল গম্বুজে ইমার্জেন্সি সাপ্লাই থেকে যা পাওয়া যাবে তাতে দশ থেকে বারো ঘণ্টা টিকে থাকতে পারবে ওরা।

    প্লাঙ্কেটের জবাব শুনে মাথা নাড়লেন ড. স্যালাজার। দুনিয়ার সমস্ত গির্জা, মসজিদ ও মন্দিরে আমাদের জন্যে প্রার্থনা করা হলেও সময়মত আমরা উদ্ধার পাব না। সাইটে আরেকটা সাবমারসিবল নিয়ে আসতে সময় লাগবে বাহাত্তর ঘণ্টা। ওটা আনার পরও সন্দেহ আছে, ওরা আমাদেরকে সারফেসে তুলতে পারবে কিনা।

    আশাব্যঞ্জক কিছু শোনাবেন, এই আশায় প্লাঙ্কেটের দিকে তাকাল স্টেসি, কিন্তু তিনি কিছু বললেন না। তার নির্লিপ্ত চেহারা দেখে মনে হলো, অন্য কোন জগতে চলে গেছেন। তারপর, স্টেসির দৃষ্টি অনুভব করে, চোখ মিটিমিট করলেন, ফিরে এলেন বাস্তবে। বললেন, ড. স্যালাজার ঠিকই বলছেন। বলতে ঘৃণাবোধ করছি, তবে কথাটা সত্যি, মিরাকুলার কিছু একটা না ঘটলে কোনদিন আমরা আর বোদ দেখতে পাব না।

    কি বলছেন! ইনভিনসিবল আমাদের সন্ধানে সাগর তোলপাড় করে ফেলবে না! প্রতিবাদ জানাল স্টেসি।

    মাথা নাড়লেন প্লাঙ্কেট। সারফেসে নিদারুণ কিছু একটা ঘটেছে। শেষ যে শব্দটা আমরা শুনেছি, ওটা ছিল জাহাজ ভাঙার।

    কিন্তু আমরা যখন পানিতে নামি, আশপাশে আরও দুটো জাহাজ ছিল, বলল স্টেসি। কোনটা ভেঙেছে কে জানে।

    একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে চুপ করে থাকলেন প্লাঙ্কেট। গম্বুজের পরিবেশ হতাশায় ভারী হয়ে উঠল। জীবিত উদ্ধার পাবার যে-কোন আশা ফ্যান্টাসি ছাড়া কিছু নয়। শুধু ধরে নেয়া যায়, পরে হয়তো ওল্ড গার্ট এবং ওদের লাশগুলো উদ্ধার করা হবে।

    .

    ০৬.

    ডেইল নিকোলাস, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী, পাইপে ঘন ঘন টান দিয়ে গলগল করে ধোয়া ছাড়ছেন, রেইমন্ড জর্ডানকে অফিসে ঢুকতে দেখে চশমার ওপর দিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকালেন তিনি।

    তামাকেরও গন্ধ ও ধোঁয়া অপছন্দ করেন রেইমন্ড জর্ডান, নাক কুঁচকে হাসলেন তিনি, বললেন, গুড আফটারনুন, ডেইল।

    এখনও বৃষ্টি হচ্ছে? জানতে চাইলেন ডেইল নিকোলাস।

    ঝিরঝির করে। রেইমন্ড জর্ডান লক্ষ করলেন, ডেইল নিকোলাস উত্তেজনায় টানটান হয়ে আছেন। তাঁর কফিরঙা চুল এলোমেলো, কপালে চিন্তার রেখা।

    প্রেসিডেন্ট ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট অপেক্ষা করছেন, তাড়াতাড়ি বললেন ডেইল নিকোলাস। প্যাসিফিক ব্লাস্ট সম্পর্কে সর্বশেষ খবর জানার জন্যে অস্থির হয়ে আছেন তাঁরা।

    লেটেস্ট রিপোর্ট আমি নিয়ে এসেছি, শান্ত গলায় আশ্বাস দিলেন রেইমন্ড জর্ডান। অফিশিয়াল ওয়াশিংটনে যে পাঁচ ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাধর উনি তাঁদের অন্যতম হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ তাকে চেনে না। চেনেন না বেশিরভাগ বুরোক্র্যাট বা পলিটিশিয়ানরাও। জাতীয় নিরাপত্তা কমিশনের ডিরেক্টর হিসেবে ন্যাশনাল সিকিউরিট সার্ভিসেরও প্রধান তিনি, রিপোর্ট করেন সরাসরি প্রেসিডেন্টের কাছে।

    রেইমন্ড জর্ডানকে দেখে মনে হবে না যে তিনি প্রখর বুদ্ধির বা ফটোগ্রাফিক মেমোরির অধিকারী, সেই সাথে সাতটা ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন। আর দশজন সাধারণ মানুষের মতই চেহারা তার। মাঝারি আকৃতি, বয়স ষাটের কাছাকাছি, মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, নিরেট গড়ন, সামান্য একটা ভুঁড়ি আছে, চোখ দুটো শান্ত ও কোমল। বিয়ে করার পর সাঁইত্রিশ বছর ধরে স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত, তার দুই মেয়েই কলেজে মেরিন বায়োলজি পড়ে।

    ডেইল নিকোলাস যখন পথ দেখিয়ে ওভাল অফিসে নিয়ে এলেন রেইমন্ডকে, প্রেসিডেন্ট ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট তখন নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে আলাপ করছেন। পায়ের আওয়াজ পেয়ে সাথে সাথে তাকালেন তারা। রেইমন্ড জর্ডান লক্ষ করলেন, দুজনেই তারা ডেইল নিকোলাসের মতো উত্তেজিত হয়ে আছেন।

    এসেছ বলে ধন্যবাদ, রেই, বললেন প্রেসিডেন্ট। হাত বাড়িয়ে একটা সোফা দেখালেন, সোফার উপরে অ্যানড্র জ্যাকসন-এর পোর্টেট।

    কি ঘটছে?

    যে-কোন সঙ্কটে উদ্বিগ্ন রাজনীতিকদের সাথে কথা বলার সময় কৌতুক বোধ করেন রেই জর্ডান। তিনি যে বিপুল ক্ষমতার অধিকারী, এ কথা তারা জানা সত্ত্বেও স্বীকার করতে চান না। বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের ধারণাও সীমিত, অন্তত তাঁর কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে ছোট করে মাথা ঝাঁকিয়ে বসলেন তিনি, কোলের উপর ব্রীফকেসটা রেখে অসসভঙ্গিতে খুললেন। রেফারেন্স হিসেবে কাজে লাগতে পারে, তাই একটা ফাইল বের করে হাতে রাখলেন।

    আমরা কি একটা পরিস্থিতির মুখে পড়েছি? ধৈর্য হারিয়ে জানতে চাইলেন প্রেসিডেন্ট, এখানে পরিস্থিতি একটা সাঙ্কেতিক শব্দ, বেসামরিক জনসাধারণ ভয়ঙ্কর কোন হুমকির মুখে পড়লে ব্যবহার করা হয় যেমন, পারমাণবিক আক্রমণ।

    ইয়েস, স্যার, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি আমরা একটা পরিস্থিতির মুখে পড়েছি।

    কি দেখতে পাচ্ছি আমরা?

    ফাইলের দিকে তাকলেন না রেইমন্ড জর্ডান, রিপোর্টটা মুখস্ত হয়ে গেছে তার, পুরো ত্রিশটা পাতা। ঠিক এগারোটা চুয়ান্নতে মহাশক্তিশালী একটা বিস্ফোরণ ঘটেছে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে, মিডওয়ে দ্বীপ থেকে প্রায় নয়শো কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে। আমাদের একটা পিরামিড স্পাই স্যাটেলাইট ফ্ল্যাশ ও অ্যাটমস্কেরিক ডিসটার্ন্যান্স-এর ছবি তুলেছে, আর শক ওয়েভ রেকর্ড করেছে গোপন হাইড্রোফোনি বয়ার সাহায্যে। সমস্ত ডাটা সরাসরি ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সিতে পাঠানো হয়েছে বিশ্লেষণ করার জন্যে। আরও পাঠানো হয়েছে সিসমোগ্রাফিক রিডিং। ল্যাংলিতেও রিপোর্ট করা হয়েছে।

    উপসংহার?

    বিস্ফোরণটা যে পারমাণবিক, এ ব্যাপারে সবাই একমত, শান্তভাবে বললেন রেইমন্ড জর্ডান।

    আমরা কি ডেফকম অ্যালার্ট-এ রয়েছি? প্রশ্ন করলেন প্রেসিডেন্ট, অর্থাৎ জানতে চাইছেন পারমাণবিক আক্রমণ ঠেকাবার প্রস্তুতিতে কোন পর্যায়ে রয়েছেন তারা।

    মাথা ঝাঁকালেন রেইমন্ড জর্ডান। নিজের কাঁধে দায়িত্ব দিয়ে নোরাডকে নির্দেশ দিয়েছি, ডেফকম অ্যালার্ট থ্রী ঘোষণা করতে হবে, তৈরি থাকতে হবে ডেফকম অ্যালার্ট-টুর জন্যে নির্ভর করে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়ার ওপর।

    ডেইল নিকোলাস স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন জর্ডানের দিকে। আমরা কি আকাশে?

    নিশ্চিত হবার জন্যে, আরও তথ্য সংগ্রহের জন্যেও, বিশ মিনিট আগে এডওয়ার্ড এয়ার ফোর্স বেস থেকে একটা ক্যাপার এস আর-নাইনটি রেকন এয়ারক্রাফট টেক অফ করেছে।

    শক ওয়েভের জন্যে নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোশনই দায়ী, এটা কি নিশ্চিতভাবে জানা গেছে? জানতে চাইলেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট। পঞ্চাশ বছর বয়েস, মোটাসোটা ভদ্রলোক, ছয়বছর কংগ্রেসে ছিলেন। পানির নিচে ভূমিকম্প থেকেও সৃষ্টি হতে পারে, কিংবা আগ্নেয়গিরির…।

    মাথা নাড়লেন রেইমন্ড জর্ডান। তারপর তিনি ফাইল খুলে বিভিন্ন সায়েন্টেফিক রিপোর্টগুলো পড়ে শোনালেন। বললেন, আরও তথ্য পাবার পর বলা সম্ভব হবে কতটা শক্তিশালী ছিল বিস্ফোরণটা।

    অনুমান?

    দশ থেকে বিশ কিলোটন।

    শিকাগোকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট, মন্তব্য করলেন ডেইল। নিকোলাস।

    কে, কারা, কেন? কঠিন সুরে জানতে চাইলেন প্রেসিডেন্ট। আমাদের নিজেদের কোন নিউক্লিয়ার সাবমেরিন হতে পারে, কোন কারণে বিস্ফোরিত হয়েছে?

    চীফ অব ন্যাভাল অপারেশনস আমাকে জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের চারদিকে পাঁচশো কিলোমিটারের মধ্যে আমাদের কোন সাবমেরিন নেই।

    রাশিয়ান সাবমেরিন?

    না, রেইমন্ড জর্ডান বললেন। আমার রুশ প্রতিপক্ষ নিকোলাই গোলানভের সাথে কথা হয়েছে। তিনি বলছেন, তাঁদের সমস্ত নিউক্লিয়ার জলযান নিরাপদে আছে। স্বভাবতই বিস্ফোরণের জন্যে আমাদেরকে দায়ী করছেন তিনি। আমার ধারণা, আমাদের মতো তারাও অন্ধকারে রয়েছেন।

    নিকোলাই গোলানভ সত্যি কথা না-ও বলতে পারেন, সন্দেহ প্রকাশ করলেন ডেইল নিকোলাস।

    তাঁর দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন রেইমন্ড জর্ডান। নিকোলাইয়ের সাথে ছাব্বিশ বছরের সম্পর্ক আমার। পরস্পরকে ঘিরে আমরা প্রচুর নাচানাচি করলেও কেউ কখনও মিথ্যে কথা বলিনি।

    আমরা দায়ী নই, রাশিয়া দায়ী নয়, তাহলে কে? প্রেসিডেন্টের গলা আশ্চর্য নরম।

    আরও অন্তত দশটা দেশের হাতে অ্যাটম বোমা রয়েছে, বললেন ডেইল নিকোলাস। তারা কেউ টেস্ট করার জন্যে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।

    সম্ভাবনা কম, বললেন রেইমন্ড জর্ডান। গ্লোবাল ব্লক ও ওয়েস্টার্ন ইন্টেলিজেন্সকে লুবিকে প্রস্তুতি শেষ করার কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আমার ধারণা, শেষ পর্যন্ত জানা যাবে, এটা একটা দুর্ঘটনা। একটা নিউক্লিয়ার ডিভাইস, বিস্ফোরিত হবার কথা নয়, কিন্তু হয়েছে।

    কয়েক সেকেন্ড পর প্রেসিডেন্ট জানতে চাইলেন, এলাকায় যেসব জাহাজ ছিল, সেগুলোর পরিচয় জানা গেছে?

    সমস্ত তথ্য এখনও আসেনি, তবে জানা গেছে আশপাশে তিনটে জাহাজ ছিল। নরওয়ে একটা প্যাসেঞ্জার-কার্গো লাইনার, একটা জাপানি অটো-ক্যারিয়ার, একটা ব্রিটিশ ওশেনোগ্রাফিক শিপ গভীর সাগরে সার্ভে পরিচালনা করছিল ওরা।

    তার মানে অনেক মানুষ হতাহত হয়েছে।

    ঘটনার আগে ও পরের স্যাটেলাইট ছবি থেকে জানা গেছে, তিনটে জাহাজেই ডুবে গেছে বিস্ফোরণের সময় বা বিস্ফেরেণের পরপরই। কোন মানুষ বেঁচেছে বলে মনে হয় না। ফায়ার বল আর শক ওয়েভে যদি মারা নাও যায়, রেডিয়েশনে মারা গেছে।

    ধরে নিচ্ছি রেসকিউ মিশন পাঠানো হচ্ছে? ভাইস-প্রেসিডেন্ট বললেন।

    গুয়াম আর মিডওয়ের ন্যাভ্যাল ইউনিটকে অনুস্থলে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

    একদৃষ্টে কার্পেটের দিকে তাকিয়ে আছেন প্রেসিডেন্ট। ব্রিটিশরা আমাদেরকে কিছু না জানিয়ে বোমা টেস্ট করবে, এ আমি বিশ্বাস করতে পারি না।

    এ কথা নরওয়ে সম্পর্কেও বলা যায়, মন্তব্য করলেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট।

    কিংবা জাপান সম্পর্কে, বিড়বিড় করলেন প্রেসিডেন্ট। ওরা নিউক্লিয়ার বোমা বানাবার চেষ্টা করছে, এ ধরনের কোন রিপোর্ট আমরা পাইনি।

    ডিভাইসটা চুরি করাও হয়ে থাকতে পারে, বললেন ডেইল নিকোলাস। হয়তো গোপনে নরওয়ে বা জাপানের জাহাজে করে পাচার করা হচ্ছিল।

    কাঁধ ঝাঁকালেন রেইমন্ড জর্ডান। ওটা চুরি করা বলে মনে হয় না আমার। আমার ধারণা, নির্দিষ্ট একটা গন্তব্যে নিয়ে আসা হচ্ছিল ওটাকে তদন্তে সেটাই প্রমাণিত হবে।

    নির্দিষ্ট গন্তব্যে?

    ক্যালফোর্নিয়ার দুটো বন্দরের যে-কোন একটায়।

    ঠাণ্ডা, গভীর দৃষ্টিতে রেই ট্যাবলটের দিকে তাকালেন সবাই। গোটা ব্যাপারটার বিশালত্ব এতক্ষণে যেন উপলব্ধির মধ্যে ধরা দিতে যাচ্ছে।

    ডিভাইন স্টার সাত হাজার মুরমটো অটোমোবাইল নিয়ে কবে থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসে আসছিল, বললেন রেইমন্ড জর্ডান। নারভিক আসছিল কোরিয়ায়ৎর পুসান থেকে, বহন করছিল কোরিয়ান জুতো, কমপিউটার, কিচেন সরঞ্জাম ও একশো ত্রিশ জন প্যাসেঞ্জার। গন্তব্য ছিল সান ফ্রান্সিসকো।

    গুড গড! বিড়বিড় করলেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট। ভীতিকর একটা চিন্তা! বিদেশী এক জাহাজ যুক্তরাষ্ট্রে নিউক্লিয়ার বোমা নিয়ে আসছে।

    তোমার পরামর্শ, রেই? জানতে চাইলেন প্রেসিডেন্ট।

    এখুনি ফিল্ড টিম পাঠাতে হবে। নেভীর ডীপ-সী স্যালভেজ ভেসেল হলে ভাল হয়, তলিয়ে যাওয়া জাহাজগুলো সার্ভে করে জানতে চেষ্টা করবে কোন জাহাজে বোমাটা ছিল।

    প্রেসিডেন্ট ও ডেইল নিকোলাস দৃষ্টি বিনিময় করলেন, তারপর প্রেসিডেন্ট বললেন, ডীপ-ওয়াটার অপারেশনের জন্যে নুমার অ্যাডমিরাল স্যানডেকার আর তার কর্মীরা সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে করি আমি। তাকে ব্রিফ করার দায়িত্ব আমি তোমাকে দিতে চাই, রেই।

    মি. প্রেসিডেন্ট, এ ব্যাপারে আপনার প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই দ্বিমত পোষণ করি আমি, চেহারা গম্ভীর করে বললেন রেইমন্ড জর্ডান। এ ধরনের একটা অপারেশনে আমরা শুধু নেভীকে বিশ্বাস করতে পারি…।

    ক্ষীণ হাসি ফুটল প্রেসিডেন্টের ঠোঁটে। তোমার উদ্বেগ আমি বুঝতে পারি, রেই। কিন্তু আমার ওপর বিশ্বাস রাখো। কোন রকম নিউজ লিক ছাড়াই কাজটা করতে পারবে নুমা, আমি জানি।

    সোফা ছাড়লেন রেইমন্ড জর্ডান, অস্বস্তিবোধ করছেন, কারণ বুঝতে পেরেছেন যে নুমা সম্পর্কে এমন কিছু জানেন প্রেসিডেন্ট যা তিনি জানেন না। ডেইল যদি অ্যাডমিরালকে জানিয়ে রাখেন, তার অফিসের উদ্দেশ্যে এখুনি আমি বেরিয়ে পড়তে চাই।

    ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন প্রেসিডেন্ট। ধন্যবাদ, রেই। তুমি আর তোমার লোকজন অল্প সময়ের ভেতর অনেক কাজ করেছ।

    ওভাল অফিস থেকে জর্ডানকে বিদায় দেয়ার সময় আশাপাশে কেউ নেই দেখে ডেইল নিকোলাস নিচু গলায় জানতে চাইলেন, তোমার কি ধারণা, বোমাটা কারা পাচার করছিল?

    এক মুহূর্ত চিন্তা করলেন রেইমন্ড জর্ডান। আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাব। যে প্রশ্নটা আমাকে আতঙ্কিত করে তুলছে, সেটা হচ্ছে কি উদ্দেশ্যে পাঠানো হচ্ছিল বোমাটা?

    .

    ০৭.

    সাবম রসিবলের ভেতর পরিবেশ স্যাতসেতে ও ভ্যাপসা হয়ে উঠল। গম্বুজের দেয়াল ঘামছে, ঝরে পড়ছে ফোঁটায় ফোঁটায়। কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বিপজ্জনক হারে বাড়ছে। অক্সিজেন বাঁচাবার জন্যে কেউ নড়ছে না, কথা বলছে খুব কম। সাড়ে এগারো ঘণ্টা পর ওদের লাইফ-প্রিজারভিং অক্সিজেন সাপ্লাই প্রায় শেষ হয়ে গেল।

    ভয় ও আতঙ্কের জায়গা দখল করল হতাশা, হাল ছেড়ে দিয়েছে ওরা। ড. স্যালাজার পাথুরে মূর্তির মতো বসে আছেন নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে। মনে মনে নিয়তিকে মেনে নিয়েছেন তিনি, অপেক্ষা করছেন মৃত্যুর।

    ছেলেবেলায় ফিরে গেছে স্টেসি, কল্পনা করছে অন্য কোন জায়গায় অন্য কোন সময়ে রয়েছে সে। ভাইদের সাথে বাড়ির সামনে রাস্তায় ক্রিকেট খেলছে, ক্রিসমাসে উপহার পাওয়া সাইকেল চালাচ্ছে। এক সময় মাথাটা একদিক কাত করে কিছু শোনার চেষ্টা করল সে। প্রথমে সন্দেহ হলো, তার বোধহয় মাথা ঠিক নেই। তা না হলে কোরাস শুনতে পাবে কেন। চোখ মেলল সে। গম্বুজের ভেতর অন্ধকার, কাউকে দেখতে পেল না। গান গায় কে? ফিসফিস করে জানতে চাইল।

    আলো জ্বাললেন প্লাঙ্কেট। কি ব্যাপার? ওটা কিসের শব্দ?

    চোখ মেললেন ড. স্যালাজার, বিড়িবিড় করে বললেন, স্টেসি ভুল শুনছে।

    ভুল শুনছি মানে? তবে গাওয়া হচ্ছে ভুল একটা গান, আসলে গান ধরা উচিত ছিল উই মে সেবার পাস দিস ওয়ে এগেইন।

    স্টেসির দিকে তাকালেন প্লাঙ্কেট। হ্যাঁ, আমিও শুনতে পাচ্ছি…।

    তাহলে বলব, দুজনেই হ্যালুসিনেশনের শিকার, হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন ড. স্যালাজার। অক্সিজেনের অভাবে কষ্ট পাচ্ছেন তিনি। হঠাৎ প্লাঙ্কেটের একটা হাত চেপে ধরে বললেন, ফর গডস সেক, ম্যান! সিস্টেমটা বন্ধ করে ঝামেলা চুকিয়ে ফেলুন। দেখতে পাচ্ছেন না, স্টেসি কষ্ট পাচ্ছে। আমরা সবাই কষ্ট পাচ্ছি।

    বাতাসের অভাবে প্রাঙ্কেটের বুকটাও ব্যাখ্যা করছে। বাঁচার সম্ভাবনা একবোরেই নেই, তিনিও জানেন। কিন্তু তাই বলে মৃত্যুকে এগিয়ে আনার পক্ষপাতি তিনি নন। শেষ পর্যন্ত দেখব আমরা, ভারী গলায় বললেন। এমন হতে পারে, প্লেনে করে আরেকটা সাবমারবিসবল আনা হয়েছে ইনভিনসিবল-এ।

    আপনি একটা পাগল! সাত হাজার কিলোমিটারের মধ্যে দ্বিতীয় কোন ডীপ ওয়াটার সাবসারবিসবল নেই। তবু যদি একটা আনা হয়, আর ইনভিনসিবল যদি ভেসে থাকে, এখানে নামাতে আরও আট ঘণ্টা সময় লাগবে ওদের।

    আপনার সাথে তর্ক করব না। তবে আশা ছাড়তে রাজি নই আমি।

    আশ্চর্য, আপনি শুনতে পাচ্ছেন না? ড. স্যালাজারকে জিজ্ঞেস করল স্টেসি। শব্দটা আগের চেয়ে কাছে চলে এসেছে।

    চুপ! ধমক দিলেন প্লাঙ্কেট। আরও কি যেন শুনতে পাচ্ছি।

    গম্বুজের ওপর দিকে, অন্ধকারে তাকিয়ে থাকল স্টেসি, প্রাঙ্কেটের দেখাদেখি। ওল্ড গার্ট-এর ভেতরের আলোয় বাইরের খানিকটা দেখা যাচ্ছে। অদ্ভুত আকৃতির একটা জীব দেখতে পেল সে। ওটার কোন চোখ নেই, তবে গম্বুজটাকে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে বলে মনে হলো, সারাক্ষণ দুই সেন্টিমিটার দূরত্ব বজায় রেখে।

    হঠাৎ করে পানিতে কি যেন একটা চকচক করে উঠল। দূরে কি যেন একটা নড়াচড়া করছে, আভাস পাওয়া গেল দানবীর একটা আকৃতির। কালো অন্ধকার নীলচে হয়ে উঠল, সেই সাথে আরও স্পষ্ট ভাবে ভেসে এল গানের আওয়াজ।

    আতঙ্কিত বোধ করলেন প্লাঙ্কেট। অক্সিজেনের অভাবে উল্টোপাল্টা কাজ শুরু করেছে ব্রেন, অবাস্তব দৈত্যের জন্ম দিচ্ছে। ওদের দিকে কিছু একটা এগিয়ে আসছে বলে মনে হলো, তা সত্যি হতে পারে না। মনে মনে ঠিক করলেন, আরও কাছে আসুক, তারপর বাইরের আলোটা জ্বালবেন শুধু শুধু ব্যাটারি খরচ করার কোন মানে হয় না।

    ক্রল করে সামনে এগোল স্টেসি, গম্বুজের দেয়ালে ঠেকে গেল তার নাক। কানে ঢুকল অনেকগুলো গলা। কি, বলিনি? ফিসফিস করল সে। আমার কথাই ঠিক! শুনুন এবার, গান শুনুন!

    অনেক দূরে ও অস্পষ্ট তবু গানের কথাগুলো এবার শুনতে পেলেন প্লাঙ্কেট। মনে হলো, তিনি বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছেন। অক্সিজেনের অভাব ঘটলে মানুষ চোখে ভুল দেখতে পারে, কানেও ভুল শুনতে পারে। তবে নীল আলোটা আরও উজ্জ্বল হচ্ছে, গানটাও তিনি চিনতে পারছেন।

    ওহ হোয়াট এ টাইম আই হ্যাড উইথ মিনি দ্য মারমেইড।

    ডাউন অ্যাট দ্য বটম অভ দ্য সী।

    আই ফরগট মাই ট্রাবলস দেয়ার অ্যামাং দ্য বাবলস।

    জী; বাট শি ওয়াজ অফুলি গুড টু মি।

    বোতাম টিপে বাইরের আলোটা জ্বাললেন তিনি। এক মুহূর্ত স্থির হয়ে থাকলেন। সমস্ত শক্তি হারিয়ে নিঃশেষ হয়ে গেছেন তিনি, পৌঁছে গেছেন ক্লান্তির চরম সীমায়। কালো অন্ধকার থেকে যে জিনিসটা তার চোখের সামনে বেরিয়ে এল, সেটাকে বাস্তব বলে মেনে নিতে পারলেন না। জ্ঞান হারালেন সাথে সাথে।

    বিস্ময়ের আঘাতে অসাড় হয়ে গেল স্টেসি, গম্বুজের দিকে এগিয়ে আসা জিনিসটার ওপর থেকে চোখ দুটো সরাতে পারল না। দানবই বটে, তবে যান্ত্রিক দানব। নিচের দিকটা ট্র্যাক্টর-এর মত, গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে আসছে, মূল কাঠামো থেকে বেরিয়ে আছে আলাদা দুটো বাহু, সেগুলোও আকারে বিশাল। ওল্ড গার্টের আলোয় এসে থামল অদ্ভুত আকৃতির কাঠামোটা। ঝাপসা, মনুষ্য আকৃতির দিক যেন একটা বসে আছে বিদঘুটে মেশিনটার স্বচ্ছ নাকে, গম্বুজ থেকে মাত্র দুমিটার দূরে। চোখ বন্ধ করে আবার খুলল স্টেসি।

    ঝাপসা আকৃতিটা এবার পুরোপুরি মানুষের আকৃতি পেল। আসমানি রঙের জাম্পস্যুট পরে আছে লোকটা, সামনের দিকে আংশিক খোলা। মুখের গড়ন অত্যন্ত পুরুষালী, সুদর্শন; অসাধারণ সবুজ চোখ জোড়ার সঙ্গে ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠা হাসিটা দারুণ মানিয়েছে।

    স্টেসির দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা, দৃষ্টিতে কৌতুক। পিছন দিকে হাত লম্বা করে একটা ক্লিপবোর্ড টেনে আনল কোলের ওপর, একটা প্যাডে কি যেন লিখল। তারপর কাগজটা ছিঁড়ে উল্টো করে সেটে ধরল নিজের ভিউ উইন্ডোয়।

    শব্দগুলো পড়ার জন্যে চোখ কুঁচকে তাকাল স্টেসি। লেখা রয়েছে, সগি একর-এ স্বাগতম। অক্সিজেন লাইন জোড়া লাগাচ্ছি, ততক্ষণ টিকে থাকুন।

    কোত্থেকে এল লোকটা? মৃত্যুর সময় এরকমই হয় বুঝি, অবাস্তব সব দৃশ্য ভেসে ওঠে চোখের সামনে? স্টেসি অনেককে বলতে শুনেছে, মারা যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে নিকটাত্মীয়দের দেখতে পায় মানুষ। কিন্তু এ লোকটা তো সম্পূর্ণ অচেনা তার।

    ধাঁধার কোন উত্তর পেল না স্টেসি, জ্ঞান হারাল।

    .

    ০৮.

    বড় একটা বুদবুদ আকৃতির ঘরের মাঝখানে একা দাঁড়িয়ে রয়েছে ডার্ক পিট, হাত দুটো নুমার জাম্পস্যুটের পকেটে ঢোকানো, তাকিয়ে আছে ওল্ড গার্টের দিকে। মসৃণ ও কালো লাভা মোড়া মেঝেতে ভাঙা একটা খেলনার মতো পড়ে রয়েছে সাবমারসিবলটা। নির্লিপ্ত চেহারা, হ্যাঁচ বেয়ে ওপরে উঠে পাইলটের চেয়ারে বসল ও, কনসোলে সাজানো ইস্ট্রমেন্টগুলো পরীক্ষা করল।

    পিট লম্বা মানুষ; চওড়া কাঁধের শক্তিশালী শরীর ওর; সব সময় সতর্ক, নড়াচড়ায় চিতার ক্ষিপ্রতার আভাস। এমনকি একজন আগন্তুক পর্যন্ত প্রথম পরিচয়ে ওর মধ্যকার ধারালো ভাবটুকু টের পাবে, সরকারের কোনো মহলেই কোনোদিন। বন্ধুর অভাব হয় নি ওর। তার সততা এবং বুদ্ধিমত্তার জন্যে নাম কিনেছে পিট। মেয়েমহলে তার জনপ্রিয়তা তুলনাহীন, কিন্তু নারী নয় পিটের প্রথম প্রেম হলো সমুদ্র।

    নুমার বিশেষ প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে বেশিরভাগ সময়ই পানির উপর না হয়ে নিচে কাটে পিটের। প্রথমত, তার দায়িত্ব হলো ডাইভিং; জীবনে খুব কমই জিমে গিয়েছে ডার্ক। বহু বছর আগেই ধূমপান ছেড়েছে, অল্প সল্প পান করে, পরিমিত খাওয়া দাওয়া করে। কাজের কারণে দিনে পাঁচ মাইলেরও বেশি হাঁটতে হয় তাকে। পেশাগত চাকরির বাইরে সময় পেলে পানির নিচে ডুব দিয়ে পুরোনো জাহাজের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করা তার শখ।

    সাবমারসিবলের বাইরে, বৃত্তাকার দেয়াল ও ধনুক আকৃতির ছাদের নিচে মসৃণ মেঝে থেকে প্রতিধ্বনি তুলল পায়ের আওয়াজ। চেয়ারে ঘুরে বসল পিট, তাকাল নুমায় ওর পুরানো বন্ধু ও সহকর্মী অ্যাল জিওর্দিনোর দিকে। পিটের কাঁধ পর্যন্ত লম্বা সে, বলিষ্ঠ গড়ন, হাসিখুশি চেহারা। কি রকম দেখছ এটাকে? পিটকে জিজ্ঞেস করল সে। ব্রিটিশরা ভাল একটা জিনিস বানিয়েছে, প্রশংসার সুরে জবাব দিল। পিট, হ্যাঁচটা বন্ধ করে দিল অ্যাল জিওর্দিনো।

    বিধ্বস্ত গম্বজটার চারদিকে চোখ বুলাল অ্যাল, মাথা নাড়ল। ওরা ভাগ্যবান বটে। আর পাঁচ মিনিট দেরি হলে আমরা ওদের লাশ দেখতে পেতাম।

    কেমন আছে সবাই?

    দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছে, বলল অ্যাল। গ্যালিতে বসে আমাদের খাবার সাবাড়। করছে, বলছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সারফেসে ওদের জাহাজে পৌঁছে দিতে হবে। জানতে চাইছে, আমরা কারা, কোত্থেকে এলাম, সাগরের এত গভীরে বিলাসবহুল জীবনযাপনের এত সব সুবিধে কিভাবে পাচ্ছি ইত্যাদি।

    ওল্ড গার্টে চারদিকে আরেকবার তাকাল পিট, বলল, আমাদের এত বছরের গোপনীয়তা সব ভেস্তে গেল।

    সেজন্যে তুমি দায়ী নও।

    প্রজেক্ট গোপন রাখার স্বার্থে আমার বরং উচিত ছিল ওদেরকে মরতে দেয়া।

    আরে শালা, কাকে বোকা বানাবার চেষ্টা হচ্ছে? অ্যাল জিওর্দিনাকে? গলা ছেড়ে হেসে উঠল সে। তোমাকে আমি আহত কুকুরকে রাস্তা থেকে তুলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে দেখেছি। এমন কি ডাক্তারের বিল পর্যন্ত দিতে দেখেছি, যদিও কুকুরটাকে তুমি গাড়ি চাপা দাওনি। ইউ আর আর বিগ সফটি, মাই ফ্রেন্ড। কিসের গোপন অপারেশন! কুষ্ঠ বা এইডস থাকলেও ওদেরকে তুমি উদ্ধার করতে।

    ব্যাপারটা কি এতই পরিষ্কার?

    অ্যালের চেহারা থেকে বিদ্রুপাত্মক ভাবটুকু মুছে গেল। তোমাকে ছোট্ট বেলা থেকে চিনি আমি, ডার্ক। কেউ একবার মারলে তুমি তিনবার মেরে প্রতিশোধ নাও। ভেবেছ তোমাকে চিনতে ভুল করব আমি। বাইরে তোমাকে পাষাণ বলে মনে হতে পারে, ভেতরটা আসলে কাদা।

    তা হবে। তোমার জন্যে দুঃসংবাদ, একটা সাঙ্কেতিক মেসেজ এসেছে কমিউনিকেশন রুমে। ওয়াশিংটন থেকে আসছেন অ্যাডমিরাল, দুঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবে তাঁর প্লেন। একটা সাবকে নির্দেশ দিয়েছি, সারফেসে উঠে গিয়ে তাঁকে যেন নিয়ে আসে।

    ভুরু কুঁচকে তাকিলে থাকল পিট।

    আমার ধারণা, তাঁর আকস্মিক আগমনের কারণ হলো ওই বিদঘুটে ডিস্টাব্যান্স।

    ওল্ড গার্ট থেকে বেরিয়ে এসে গোলাকৃতি দরজাটার দিকে এগোল পিট, সাথে অ্যাল। কার্বন ও সিরামিক রিএনফোর্সড প্লাস্টিক দেয়ালগুলো সাগরের পাঁচ হাজার চারশো মাটির নিচেও সম্পূর্ণ নিরাপদ। সমতল মেঝেতে ওল্ড গার্ট ছাড়ও ট্রাক্টর এর মতো দেখতে বিশাল একটা ভেহিকেল রয়েছে, কাঠামোর উপর দিকটা চুরুট আকৃতির। পাশাপাশি রয়েছে আরও দুটো সাবমারবিসল, কয়েকজন লোক ওগুলো। সার্ভিসিং করছে।

    গোল একটা সরু টানেল দিয়ে বেরিয়ে এল পিট, গম্বুজ আকৃতির দ্বিতীয় চেম্বার। এটাকে ডাইনিং কমপার্টমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। লম্বা একটা টেবিল, কয়েকটা চেয়ার, সবই অ্যালুমিনয়ামের। অতিথিদের ওপর নজর রাখছে। নুমার দুজন কু, কিচেন ও টানেলের দরজা থেকে।

    টেবিলের এক ধারের তিনটে চেয়ারে বসে নিজেদের মধ্যে চাপাস্তরে আলোচনা করছেন ড. স্যালাজার, প্লাঙ্কেট ও স্টেসি ফক্স। ওদেরকে দেখে চুপ করে গেলেন সবাই।

    উল্টোদিকের একটা চেয়ারে বসে একে একে সবার দিকে তাকাল পিট। সবিনয়ে জানতে চাইল, হাউ ডু ইউ ডু। আমি ডার্ক। একটা প্রজেক্ট অপারেশন চলছিল, আপনাদের আমরা দেখতে পাই। প্রজেক্টটার আমিই হেড।

    থ্যাঙ্ক গড! কথা বলার মতো একজনকে পাওয়া গেল! স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন প্লাঙ্কেট।

    ভাষাটাও ইংরেজি! হাঁফ ছাড়লেনও ড. স্যালাজার।

    ইঙ্গিতে অ্যালকে দেখাল পিট। মি, অ্যাল জিওর্দিনো, চীফ অ্যাসিস্ট্যাট। ওই আপনাদের সব ঘুরিয়ে দেখাবে, কোয়ার্টার বরাদ্দ করবে, যা যা লাগে সব সাপ্লাই দেবে।

    পরিচয়, করমর্দন ইত্যাদি শেষ হলো। সবাইকে কফি দিতে বলল অ্যাল। ধীরে ধীরে শিথিল হলো তিন আগন্তুকের পেশী।

    সবার পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ, বললেন প্লাঙ্কেট। আমাদের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে।

    আমি আর অ্যাল খুশি, সময়মত আপনাদের দেখতে পাওয়ায়।

    আপনার উচ্চারণ শুনে মনে হচ্ছে আমেরিকান, স্টেসি বললো।

    সরাসরি মেয়েটার চোখে তাকালো ডার্ক। হ্যাঁ, এখানে আমরা সবাই আমেরিকান।

    হাবভাব দেকে মনে হলো, পিটকে যেন ভয় পাচ্ছে স্টেসি, একটা হরিণ যেমন পাহাড়ী সিংহকে ভয় পায়। অথচ প্রবল একটা আকর্ষণও বোধ করছে। জ্ঞান হারাবার আগে অদ্ভুত একটা সাবমারসিবলে আপনাকেই আমি দেখেছিলাম।

    ওটা ছিল ডিএসএমভি, ডীপ সী মাইনিং ভেসেল। আমরা ওটাকে বিগ জন বলি। সাগর থেকে জিওলজিক্যাল নমুনা সংগ্রহ করাই ওটার কাজ।

    এটা একটা আমেরিকান মাইনিং উদ্যোগ? গলায় অবিশ্বাস, জানতে চাইলেন প্লাঙ্কেট।

    হাসল পিট। অত্যন্ত গোপনীয় একটা উদ্যোগ–সাগরতলে মাইনিং এবং সার্ভে প্রজেক্ট, টাকা দিচ্ছে মার্কিন সরকার। প্রায় আট বছর হতে চললো প্রকল্পটার বয়স।

    নাম কি এই প্রকল্পের?

    আমরা বলি, সগি একর।

    এধরনের একটা প্রজেক্ট গোপন বা ক্লাসিফায়েড হয় কি করে? জানতে চাইলেন ড. স্যালাজার। সারফেসে নিশ্চয়ই আপনাদের সাপোর্ট ভেহিকের আছে স্যাটেলাইট বা আশপাশের জাহাজ থেকে ওটাকে দেখা যাবে।

    সাগরের তলায় সচল এই আবাসটি আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ, বলল পিট। হাই টেক লাইফ সাপোর্ট সিটে আমাদেরকে সাগরের পানি থেকে অক্সিজেন সাপ্লাই দিচ্ছে। ডিস্যালিনেশন ইউনিট যোগান দিচ্ছে সুপেয় পানি। হাইড্রোথারম্যাল ডেন্টস থেকে পাচ্ছি উত্তাপ। খাবার যোগান দিচ্ছে শামুক, চিংড়ি আর কাঁকড়া। আলট্রাভায়োলেট লাইটে গোসল করি, নিজেদের ধুয়ে নিই অ্যান্টিসেপটিক শাওয়ারে, ফলে জীবাণুমুক্ত থাকা কোন সমস্যা নয়। কোন সাপ্লাই বা ইকুইপমেন্ট আমরা নিজেরা যদি যোগাড় করতে না পারি, আকাশ থেকে সাগরে ফেলা হয় সেটা, সাগরের তলা থেকে সংগ্রহ করে নিই আমরা। সদস্যদের কাউকে যদি ফেরত পাঠাবার দরকার হয়, আমাদের একটা সাবমারসিবল সারফেসে উঠে যায়, সেখানে দেখা হয় জেট-পাওয়ারড ফ্লাইং বোটের সাথে।

    বিস্মিত হলেও, ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকালেন প্লাঙ্কেট। স্বপ্ন দেখতে ভালবাসেন তিনি, তাঁর জানার কথা এ-ধরনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়া অসম্ভব নয়।

    বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ রাখার জন্যে নিশ্চয়ই চমৎকার একটা পদ্ধতি আছে আপনাদের? জানতে চাইলেন ড. স্যালাজার।

    তার জড়ানো একটা সারফেস রিলে বয়া সাহায্য করে। আমরা ট্রান্সটি ও রিসিভ করি ভাষা স্যাটেলাইট।

    পানির নিচে কতদিন আছেন আপনারা?

    দুমাসের উপর হলো আমরা কেউ সূর্য দেখিনি।

    এত গভীরে রিসার্চ স্টেশন চালু করার মতো টেকনলজি আছে আমেরিকানদের, আমার ধারণা ছিল না। একদৃষ্টে কফির কাপে তাকিয়ে আছেন প্লাঙ্কেট।

    কাঁধ ঝাঁকাল পিট, কোন মন্তব্য করল না।

    সব মিলিয়ে কতজন ক্রু আপনার?

    উত্তর দেয়ার আগে কাপে চুমুক দিল পিট। বেশি নয়, বারোজন পুরুষ, দুজন মেয়ে।

    দেখতে পাচ্ছি এখানেও মেয়েদেরকে তাদের সেই পুরানো কাজই করতে হয়, কণ্ঠে সামান্য ব্যঙ্গ, গ্যালির দিকে তাকিয়ে বলল স্টেসি, ওদিকে একটি স্বর্ণকেশী মেয়ে তরকারি কাটাবাছা করছে।

    ক্রুরা সবাই ভলান্টিয়ার হিসেবে এসেছে, সারাও, বলল পিট। কমপিউটার সায়েন্সে মাস্টার ডিগ্রি আছে ওর, কমপিউটর সেকশনের দায়িত্বও পালন করে। আমরা সবাই একই সাথে দুটো করে দায়িত্ব পালন করি।

    অপর মেয়েটি বোধহয় চাকরানী ও ইকুইপমেন্ট মেকানিক?

    ক্ষীণ হাসল পিট। প্রায় ঠিক ধরেছেন। জিল আমাদের মেরিন ইকুইপমেন্ট এঞ্জিনিয়ার, আবার আমাদের রেসিডেন্ট বায়োলজিস্টও আর, আপনার জায়গায় আমি হলে, নারী স্বাধীনতা সম্পর্কে ওকে কোন উপদেশ দিতাম না। মিস কলোরাডো বডি-বিল্ডিং কমপিটিশনে প্রথম হয়েছে ও।

    একটা জিনিস ব্যাখ্যা করা হলে খুশি হব আমি, বললেন প্লাঙ্কেট। আপনারা জানলেন কিভাবে যে আমরা বিপদে পড়েছি বা কোথায় আমাদের পাওয়া যাবে?

    বিগ জন্ থেকে গোল্ড-ডিটেকশন সেনসর পড়ে গিয়েছিল কোথাও, সেটা খোঁজার জন্যে ফিরে আসছিলাম আমি আর অ্যাল, এই সময় আপনাদের আন্ডারওয়াটার ফোনের রেঞ্জে চলে আসি।

    অস্পষ্ট হলেও আপনাদের ডিসট্রেস কল শুনতে পাই আমরা, বলল অ্যাল।

    প্রথমে আপনাদেরকে অক্সিজেন সাপ্লাই দেই, বলল পিট, তারপর বিগ জনের ম্যানিপুলেটর আর্মস আপনাদের সাবমারসিবলের লিপট হুকে আটকাই, ওটাকে তুলে আনি আমাদের ইকুইপমেন্ট চেম্বারে, প্রেশার এয়ারলকের ভেতর দিয়ে।

    আপনারা আমাদের ওল্ড গার্টকে রক্ষা করেছেন? হঠাৎ বলে প্লাঙ্কেট।

    চেম্বারে গেলেই দেখতে পাবেন।

    বলুন তো, কত তাড়াতাড়ি আমাদেরকে সাপোর্ট শিপে পৌঁছে দেয়া যাবে? ঠিক প্রশ্ন নয়, যেন দাবি জানালেন ড. স্যালাজার।

    দুঃখিত, দেরি হবে, বলল পিট।

    আমাদের সাপোর্ট শিপকে জানানো দরকার যে আমরা বেঁচে আছি, বলল স্টেসি, প্রতিবাদের সুরে। নিশ্চয়ই আপনারা ওটার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন?

    অ্যালের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করল পিট। আপনাদেরকে উদ্ধার করতে আসার পথে একটা বিধ্বস্ত জাহাজকে পাশ কাটিয়ে এসেছি আমরা, সম্প্রতি নেমে এসেছে সাগরে তলায়।

    না, ওটা ইনভিনসিবল হতে পারে না!

    অ্যাল বলল, দেখে মনে হলো, প্রচণ্ড কোন বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হয়েছে। কেউ বেঁচেছে বলে মনে হয় না।

    আমরা যখন নিচে নামি, আশপাশে আরও দুটো জাহাজ ছিল, বললেন প্লাঙ্কেট। আপনারা সম্ভত ওই দুটোর একটাকে দেখেছেন।

    বলা কঠিন। পিটকে চিন্তিত দেখাল। ওপরে কিছু একটা ঘটেছে। গোটা মহাসাগর লাফিয়ে উঠেছিল। তদন্ত করার সময় পাইনি আমরা।

    শক ওয়েভটা আপনারাও নিশ্চয়ই অনুভব করেছেন? জানতে চাইলেন প্লাঙ্কেট। আপনাদের কাছ থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে, গিরিখাদের আড়ালে ছিলাম আমরা। শক ওয়েভের যতটুকু অবশিষ্ট ছিল, আমাদের উপর দিয়ে চলে যায়। সামান্য স্রোত ও আলোড়ন ছাড়া আর কিছু আমরা অনুভব করিনি।

    পিটের দিকে কটমট করে তাকাল স্টেসি। আপনাদের ইচ্ছেটা কি, আমাদেরকে বন্দী করে রাখবেন?

    বন্দী শব্দটায় আপত্তি আছে আমার। তবে প্রজেক্টটা ক্লাসিফায়েড তো, আপনারা কটা দিন আমাদের অতিথি হিসেবে থাকলে খুশি হব আমরা।

    কয়টা দিন বলতে কি বোঝাতে চান? সতর্ক সুরে জানতে চাইলেন ড. স্যালাজার।

    আরও দুমাস ওপরে ওঠার কোন প্রান নেই আমাদের, বলল পিট।

    স্তব্ধ হয়ে গেল পরিবেশ। ড. স্যালাজার, স্টেসি, তারপর পিটের দিকে তাকালেন প্লাঙ্কেট। ব্লাডি হেল! তিক্ত কণ্ঠে বললেন তিনি। দুমাস আপনি আমাদেরকে আটকে রাখতে পারেন।

    আমার স্ত্রী…, ঢোক গিলে বললেন ড. স্যালাজার, ভাববেন আমি মারা গেছি।

    আমার একটা মেয়ে আছে, কথাটা শেষ না করে পিটের দিকে তাকিয়ে থাকল স্টেসি।

    এত হতাশ হবার কিছু নেই, বলল পিট। আগে আমাকে জানতে হবে, উপরে কি ঘটেছে। তারপর আমাকে কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলতে হবে। একটা না একটা উপায় হবেই। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো পিট, দোরগোড়ায় কিথ হ্যারিসকে দেখে চুপ করে গেল। কিথ হ্যারিস ওদের সিসমোলজিস্ট, ইঙ্গিতে পিটকে ডাকছে।

    ক্ষমা চেয়ে নিয়ে দরজার দিকে এগোল পিট, লক্ষ করল হ্যারিসের চেহারায় উত্তেজনা। সমস্যা? কঠিন সুরে জানতে চাইল ও।

    ডিসটার্ব্যান্সটা সাগরের তলায় অনেকগুলো কাঁপন সৃষ্টি করেছে। এখন পর্যন্ত সেগুলো ছোট আর মৃদু, আমরা আসলে প্রায় অনুভবই করিনি। কিন্তু ওগুলোর শক্তি ও ব্যাপকতা বাড়ছে।

    রিডিং কি বলছে?

    আমরা এমন একটা পাথুরে স্তরে রয়েছি, প্রায় নড়বড়েই বলা যায়, বলল কিথ হ্যারিস। এলাকাটা ভলকানিকও বটে। ক্রাস্টাল স্ট্রেইন এনার্জি যে হারে রিলিজ হচ্ছে, সাঙ্গাতিক ভয় পাচ্ছি আমি। আমার ধারণা, একটা ভূমিকম্প হতে যাচ্ছে। সিক্স-পয়েন্ট-ফাইভ।

    আঁতকে উঠল পিট। তার মানে বাঁচার কোন উপায় থাকবে না। গম্বুজের মাথায় একটা পাথর ছিটকে এসে লাগলে পানির চাপে চিড়ে-চেপটা হয়ে যাবে সবাই।

    কতক্ষণ সময় পাব আমরা? জানতে চাইল ও।

    নিশ্চিত করে কিছু বলার উপায় নেই। তবে আমার আন্দাজ, বারো ঘণ্টা।

    সরে যাবার জন্যে যথেষ্ট সময়।

    আমার হিসেব ভুলও হতে পারে, বলল কিথ হ্যারিস, চেহারায় ইতস্তত একটা ভাব। প্রথমে সামান্য যে আলোড়ন আমরা অনুভব করব, সেটা আসল ভূমিকম্পের আগমন বার্তাও হতে পারে সেক্ষেত্রে মাত্র কয়েক মিনিট সময় পাব আমরা। আবার, আলোড়নটা থেকেও যেতে পারে।

    পিট কিছু বলার আগেই পায়ের নিচে মৃদু কাঁপুনি অনুভব করল ওরা, পিরিচের ওপর টুংটাং আওয়াজ তুলে নাচতে শুরু করল কাপগুলো।

    পিটের দিকে চোখ তুলে তিক্ত হাসল কিথ হ্যারিস। দেখা যাচ্ছে সময় আমাদের অনুকূলে নয়, ডার্ক।

    .

    ০৯.

    কাঁপনটা এত দ্রুত বাড়ছে যে আতঙ্ক বোধ করল ওরা। গুরুগম্ভীর একটা আওয়াজ আসছে দূর থেকে। তারপর ভেসে এল হুড়মুড় করে পাথর ধসের শব্দ গিরিখাদের ঢাল বেয়ে নামছে। সবাই ওরা মুখ তুলে তাকিয়ে আছে ইকুইপমেন্ট চেম্বারের ছাদের দিকে, পাথর ধসের আঘাতে যে-কোন মুহূর্তে ছাদ বা দেয়াল চুরমার হয়ে যেতে পারে। ছোট্ট একটা ফুটো হলেই যথেষ্ট, এক হাজার কামানের গর্জন তুলে ভেতরে ঢুকবে পানি।

    আতঙ্কিত হলেও, বাইরে তার প্রকাশ নেই। প্রজেক্টের কমপিউটার রেকর্ড ছাড়া কেউ কিছু বহন করছে না। ইকুইপেমন্ট চেম্বারে জড়ো হয়ে ডীপ-সী ভেহিকেলে উঠতে আট মিনিট সময় নিল ক্রুরা।

    পিট জানে, সবাইকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। দুটো সাবমারসিবলে খুব বেশি হয়ে চোদ্দজন লোককে জায়গা দেয়া যাবে। ওর দলের ওই চৌদ্দজনই রয়েছে। সমস্যা সৃষ্টি করবে ইনভিনসিবল-এর ক্রুরা।

    কাঁপনগুলো আগের চেয়ে শক্তিশালী, আসছেও আগের চেয়ে ঘন ঘন। সারফেসে পৌঁছে লোকজনকে নামিয়ে আবার ফিরে আসবে সাবমারসিবল, তা সম্ভব নয়, অত সময় পাওয়া যাবে না। যেতে-আসতে সময় লাগবে চার ঘণ্টা, অথচ খুব বেশি হলে সময় পাওয়া যাবে কয়েক মিনিট।

    ডার্কের থমথমে চেহারা দেখে অ্যাল বলল, এক ট্রিপে সম্ভব নয়, দুই ট্রিপ লাগবে। আমি বরং দ্বিতীয় ট্রিপের জন্যে অপেক্ষা করি…।

    দুঃখিত, দোস্ত, তাকে থামিয়ে দিল পিট। প্রথম সাবটা তুমি চালাচ্ছ, দ্বিতীয়টা নিয়ে তোমাকে অনুসরণ করব আমি। সারফেসে উঠে যাও, ইনফ্লেটেবল র‍্যাফটে প্যাসেঞ্জারদের নামাও, তারপর দ্রুত ফিরে এসে এখানে যারা রয়ে যাবে তাদের নিয়ে যাও।

    ফিরে আসার সময় পাব না।

    বেশ, এরচেয়ে ভাল একটা প্ল্যান দাও।

    পরাজয় স্বীকার করে মাথা নাড়ল অ্যাল। এখানে থাকবে কারা?

    ব্রিটিশ সার্ভে টিমের সদস্যরা।

    আড়ষ্ট হয়ে গেল অ্যাল। কাউকে সিন্ধান্ত নেয়ারও সুযোগ দেবে না? কেউ যদি ভলেন্টিয়ার হতে চায়? তুমি একটা মেয়েকে রেখে যেতে চাইছ, এ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

    প্রথমে আমি নিজের দলের লোকদের বাঁচাতে চাইব, ঠাণ্ডা সুরে বলল পিট।

    কাঁধ ঝাঁকাল অ্যাল, চেহারায় অসন্তোষ। এত কষ্ট করে বাঁচালাম ওদের, অথচ মৃত্যুর মুখে রেখে যাচ্ছি।

    আবার শুরু হলো কাঁপন, এবার অনেকক্ষণ স্থায়ী হলো, প্রায় দশ সেকেন্ড। সেই সাথে গুরুগম্ভীর একটা আওয়াজ ভেসে এল। তারপর আবার সব থেমে গেল, নিস্তব্ধ হয়ে গেল পরিবেশ।

    বন্ধুর চোখের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল অ্যাল। ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই সেখানে। পিটকে আশ্চর্য নির্লিপ্ত দেখল সে। তার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে পিট মিথ্যে কথা বলছে। দ্বিতীয় সাবের পাইলট হবার কোন ইচ্ছেই ওর নেই। ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সবাইকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে থেকে যাবে।

    কিন্তু এখন আর তর্ক করার সময় নেই। অ্যালকে ধরল পিট, প্রায় ধাক্কা দিয়ে প্রথম সাবমারসিবলের ভেতর ঢুকিয়ে দিল। অ্যাডমিরালকে আমার শ্রদ্ধা জানিও, বলল ও।

    পিটের কথা শুনতে পেল না অ্যাল, পাথর ধসের শব্দে চাপা পড়ে গেল। হ্যাঁচটা বন্ধ করে দিল পিট।

    সাবের ভেতর সাতজন মানুষ গাদাদাদি করে বসেছে। কেউ কথা বলল না, কেউ কারও দিকে তাকাল না। সবার কাঁধ ও ঘাড়ের ওপর দিয়ে সামনে এগোল অ্যালি, বসল পাইলটের সীটে। ইলেকট্রিক মটন স্টার্ট দিল সে, রেইল টপকে এয়ারলকে চলে এল সাব।

    রওনা হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে অ্যাল, ওদিকে দ্বিতীয় সাবে লোকজনকে তুলে দিচ্ছে পিট। ওর নির্দেশে নুমার মহিলা সদস্যরা প্রথমে ভেতরে ঢুকল। তারপর স্টেসির দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল ও।

    হ্যাচের সামনে পৌঁছে ইতস্তত করছে স্টেসি, প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল পিটের দিকে। আপনি মারা যাবেন, আমি আপনার জায়গা দখল করায়? নরম সুরে জিজ্ঞেস করল সে।

    হনলুলুর হেইলকালানি হোটেলে একটা টেবিল রিজার্ভ করে রাখবেন, সন্ধ্যের দিকে।

    উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিল স্টেসি, কিন্তু পিছনে দাঁড়ানো লোকটা তাকে ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে দিল ভেতরে। ঘুরল পিট, প্রজেক্টের চীফ ভেহিকেল এঞ্জিনিয়ার ডেভলওডেন সামনে দাঁড়াল।

    চশমাটা নাকে ভাল মত বসিয়ে নিয়ে পিটের দিকে ঝুঁকল। আপনি আমাকে কো-পাইলট হিসেবে দেখতে চাইছেন, ডার্ক?

    না, তুমি একাই ওটাকে নিয়ে যাবে, বলল পিট। অ্যাল ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করব আমি।

    চোখ থেকে বিষণ্ণ ভাবটা গোপন করতে পারল না ডেভ। আপনি কেন, আপনার বদলে আমিই বরং অপেক্ষা করি।

    তোমার সুন্দরী একটা বউ ও তিনটে বাচ্চা আছে। আমি একা। তাড়াতাড়ি ওঠো! তার দিকে পিছন ফিরে সামনে এগোল পিট, দাঁড়াল প্লাঙ্কেট আর ড. স্যালাজারের সামনে।

    প্লাঙ্কেটের চেহারাতেও ভয়ের লেশমাত্র নেই।

    মি, প্লাঙ্কেট, আপনি কি বিবাহিত? জানতে চাইল পিট।

    আমি? দূর, কনফার্মড ব্যাচেলর!

    নার্ভাস ভঙ্গিতে হাত দুটো কচলাচ্ছেন ড. স্যালাজার, চোখে ভয়ের ছায়া। মৃত্যু যে অবধারিত, এ ব্যাপারে তার মনে কোন সন্দেহ নেই।

    তখন বলছিলেন, আপনার বউ আছে, তাকে বলল পিট।

    একটা বাচ্চাও আছে, ঢোক গিলে জানালেন ড. স্যালাজার।

    আর একজনের জায়গা আছে। লাফ দিয়ে উঠে পড়ুন।

    আমাকে নিয়ে আটজন হবে, বললেন ড. স্যালাজার। কিন্তু আপনার সাবমারসিবলে জায়গা হবে সাতজনের।

    প্রথমটায় আমি মোটাসোটা লোকগুলোকে পাঠিয়ে দিয়েছি, বলল পিট। এটায় তুলেছি রোগা-পাতলা লোকদের ও তিনটে মেয়েকে। আপনার মতো ছোটখাট একজন মানুষ এখনও উঠতে পারবে।

    একটা ধন্যবাদও দিলেন না, তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন ড. স্যালাজার। হ্যাঁচটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল পিট।

    আপনি অত্যন্ত সাহসী মানুষ, ডার্ক। ঈশ্বরের ভূমিকায় এত ভাল অভিনয় করা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।

    দুঃখিত, আপনার জন্যে কোন ব্যবস্থা করতে পারলাম না।

    নো ম্যাটার। ভাল একজন মানুষের সাথে মরতে গর্ববোধ করব আমি।

    সামান্য বিস্মিত হয়ে প্রাঙ্কেটের দিকে তাকাল পিট। মৃত্যু সম্পর্কে কে কি বলল আপনাকে?

    আমাকে মিথ্যে অভয় দেবেন না, প্লীজ। সাগরকে আমি চিনি।

    মি. প্লাঙ্কেট, পাথর ধসের আওয়াজকে ছাপিয়ে উঠল পিটের কণ্ঠস্বর, আমার ওপর আস্থা রাখুন?

    পিটের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন প্লাঙ্কেট। এমন কিছু আছে যা আপনি জানেন, আমি জানি না?

    শুধু জেনে রাখুন, সগি একর থেকে সবার শেষে রওনা হচ্ছি আমরা।

    বারো মিনিট পর। বিরতিহীন হয়ে উঠল শক ওয়েভ। গিরিখাদের ঢাল থেকে টন টন পাথর নেমে এল, গোলাকার কাঠামোটাকে আঘাত করল নির্দয়ভাবে। অবশেষে মানুষের তৈরি সাগরতলের আশ্রয়টাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে ফেলল কয়েক বিলিয়ন লিটার হিমশীতল কালো পানি।

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleট্রেজার – ক্লাইভ কাসলার
    Next Article দ্য সলোমন কার্স – ক্লাইভ কাসলার ও রাসেল ব্লেক

    Related Articles

    ক্লাইভ কাসলার

    দ্য ফারাও’স সিক্রেট – ক্লাইভ কাসলার ও গ্রাহাম ব্রাউন

    August 5, 2025
    ক্লাইভ কাসলার

    পাইরেট – ক্লাইভ কাসলার / রবিন বারসেল

    August 5, 2025
    ক্লাইভ কাসলার

    দ্য সলোমন কার্স – ক্লাইভ কাসলার ও রাসেল ব্লেক

    August 5, 2025
    ক্লাইভ কাসলার

    ট্রেজার – ক্লাইভ কাসলার

    August 5, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025
    Our Picks

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাঙলাদেশের কৃষক – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025

    পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি ২ – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025

    বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা – বদরুদ্দীন উমর

    October 29, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }