Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঠাকুর-বাড়ির আঙিনায় – জসীম উদ্দীন

    জসীম উদ্দীন এক পাতা গল্প180 Mins Read0

    ০১. রবীন্দ্র-তীর্থে

    রবীন্দ্র-তীর্থে

    এতদিন পরে কিছুতেই ভালমত মনে করিতে পারিতেছি না, কোন সময়ে প্রথম রবীন্দ্রনাথের নাম শুনি। আবছা একটু মনে পড়িতেছে, আমাদের গ্রামের নদীর ধারে দুইটি ভদ্রলোক কথা বলিতেছিলেন।

    একজন বলিলেন, “অমুক কবি কবিতা লিখে এক লক্ষ টাকা পেয়েছেন।” সেই এক লক্ষ টাকার বিরাট অঙ্কের পিছনে কবির নামটি ঢাকা পড়িয়াছিল। তারপর কবির সঙ্গে মনের পরিচয় হইল ‘প্রবাসী’তে তাহার জীবন-স্মৃতি পড়িয়া। অল্প বয়সের সেই কিশোর বেলায় আর একজন কিশোর কবির প্রথম জীবনের কাহিনীর ভিতর দিয়া সেদিন যে মিলন-লতাটি রচিত হইল, তাহাতে ফুল ফুটিয়া গন্ধ ছড়াইয়া আমার সমস্ত জীবন অমোদিত করিয়াছে। কবি কোথায় রেলগাড়িতে বেড়াইতে গিয়াছিলেন, জানালার পথে দৃষ্টি মেলিয়া পথের পাশের প্রতিটি দৃশ্যকে কি ভাবে তিনি সমস্ত অন্তর দিয়া অনুভব করিয়াছিলেন, কোথায় অবস্থান কালে সকাল হইতে দুপুর দুপুর হইতে সন্ধ্যা সেখানকার প্রতিটি গাছ লতা পাতার দিকে কবি চাহিয়া থাকিতেম, পদ্মানদীতে বোটে বসিয়া মাত্র একবাটি দুধ পান করিয়া সারাদিন তিনি লিখিয়া যাইতেন, এই সব কত যে একনিষ্ঠ ভাবে অনুকরণ করিতাম সে কথা ভাবিলে আজ হাসি পায়।

    তারপর বুঝিয়া না বুঝিয়া কবির বইগুলি যেখান যেখানে পাইয়াছি পড়িয়া গিয়াছি। সব বুঝিতে পারি নাই, কিন্তু ভাল লাগিয়াছে। হয়ত কবির রচনায় যে অপূর্ব সুরের মাদক আছে, তাহারই পরশ আমার অবচেতন মনে প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। এখন রবীন্দ্রনাথের কবিতা পূর্বাপেক্ষা অধিক বুঝিতে পারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হইয়া কয়েক বৎসর কবির কবিতা ছাত্রদের পড়াইলাম, কিন্তু আগের মত কবিতার মাদকতার স্বাদ এখন পাই না। কিছু বোঝা যায় কিছু বোঝা যায় না—যে সব কবিতায় এই আলো-আঁধারীর ছায়ামায়া থাকে—বোধ হয় সেগুলিতে রসউপভোগের একটি অপূর্ব আস্বাদ থাকিয়া যায়।

    তারপর বহুদিন কাটিয়া গিয়াছে। আমার বন্ধুর কলিকাতায় রবীন্দ্রনাথের ‘ফানী’ ‘অচলায়তন’ প্রভৃতির অভিনয় দেখিয়া আসিয়া আমার কাছে গল্প করিয়াছেন। আমি : একান্ত মনে সেই সব গল্প শুনিয়াছি। কতবার যে কবিকে স্বপ্নে দেখিয়াছি তাহার ইয়ত্তা নাই। এই ভাবে বহুদিন কাটিয়া গিয়াছে।

    পল্লীগ্রাম ছাড়িয়া একবার কলিকাতা আসিয়াছি। পল্লী-বালকের কল্পনাও সেই কলিকাতা অপূর্ব রহস্যে জীবন্ত হইয়া রহিয়াছে। শুনিতে পাইলাম, ঠাকুরবাড়িতে ‘শেষ বর্ষণ’ অভিনয় হইবে। আমি আট আনা দিয়া সর্বনিম্নের একখানা টিকিট কিনিয়া নির্দিষ্ট আসনে গিয়া উপবেশন করিলাম। তখনও অভিনয় আরম্ভ হয় নাই।

    অভিনয়-মঞ্চটি একটি কালো পর্দায় ঘেরা। তাহার সামনে প্রকাণ্ড হলঘরে দর্শকেরা বসিয়াছে। এই গৃহের সব কিছুই আমার কাছে অপূর্ব রহস্যময় বলিয়া মনে হইল। সামনে পিছনে, এধারে ওধারে, যে দিকে চাহি, আমার মনে হয়, আমি যেন কোন অপূর্ব স্বর্গরাজ্যে আসিয়াছি। আমার সামনের আসনগুলিতে নানা সাজ সজ্জায় সজ্জিত হইয়া চারিদিক নানা গন্ধচুর্ণে আমোদিত করিয়া কলিকাতার অভিজাত শ্রেণীর মেয়েরা যে কলগুঞ্জন করিতেছিল—আমার মনে হইল, ইহার চাইতে আকর্ষণীয় কিছু আমি আর কোথাও দেখি নাই। সকলের পিছনে বসিয়াছিলাম বলিয়া আমার আর ও ভাল লাগিতেছিল। পিছন হইতে আমি সকলকেই দেখিতে পাইতেছিলাম। যদি বেশী দামের টিকিট কিনিয়া সামনের আসনে বসিতাম, সেদিন হয়ত আমি কিছুতেই এত খুশী হইতাম না।

    বহুক্ষণ পরে সামনের মঞ্চের পর্দা উঠিয়া গেল। বর্ষাকালের যত রকমের ফুল সমস্ত আনিয়া মঞ্চটিকে অপূর্বভাবে সাজান হইয়াছে। সেই মঞ্চের উপর গায়ক-গায়িকা পরিবৃত হইয়া রবীন্দ্রনাথ আসিয়া যখন উপবেশন করিলেন, তখন আমার সামনে উপবিষ্টা সেই রহস্যময়ীরা চাদের আলোতে জোনাকীদের মতো একেবারে স্নান হইয়া গেল। গানের পরে গান চলিতে লাগিল। সে কী গান। পুরুষকণ্ঠে মেয়ে কণ্ঠে, কখনও উচ্চগ্রামে উঠিয়া কখনো একেবারে অস্পষ্ট হইয়া সুরের উপরে সুর বর্ষণ হইতে লাগিল। মাঝে মাঝে গানের বিষয়বস্তু অনুসরণ করিয়া মূক অভিনেতারা মঞ্চের উপর দিয়া চলিয়া যাইতেছিল। সুর ছবি আর পুষ্পগন্ধের অপূর্ব সমন্বয়। শ্রবণ-নয়ন-মন মুগ্ধকর অপূর্ব অভিনয়। তখনও ভদ্রঘরের মেয়েরা মঞ্চে দাঁড়াইয়া নৃত্য করিতে অভ্যস্ত হয় নাই। দুটি মেয়ে মাঝে মাঝে দাঁড়াইয়া হাত নাড়িয়া গানের বিষয়বস্তুটি জীবন্ত করিয়া তুলিতেছিল।

    শেষবারের মত একটি মেয়ে শুকতারা হইয়া মঞ্চে আসিয়া দাঁড়াইল। কী অপূর্ব তাহার চেহারা! গানের সুর বাজিয়া উঠিল, “শুকতারা ঐ উঠিল আকাশে।” তারপর ধীরে ধীরে শুকতারা মঞ্চ হইতে চলিয়া গেল। একটি মনোমুগ্ধকর স্বপ্ন-জগৎ যেন আমার সামনে দিয়া চলিয়া গেল।

    এই ভাবে অভিনয় শেষ হইল। দর্শকেরা কেহই হাতে তালি দিল না। যে যাহার এত নীরবে আসন হইতে উঠিয়া চলিয়া গেল। কবি মঞ্চের উপর দাঁড়াইলেন। অনেকে আগাইয়া গিয়া কবিকে প্রণাম করিল। আমিও তাহাদের সঙ্গে এক পাশে আসিয়া দাঁড়াইলাম। কিন্তু কবিকে প্রণাম করিলাম না। এই রবীন্দ্রনাথ আমারই রবীন্দ্রনাথ। আর দশজনের মত তাঁহাকে প্রণাম জানাইয়া পথের দশজনের মধ্যেই আবার মিশিয়া যাইব, কবির সঙ্গে আমার সম্পর্ক তো এমন নয়। আমি শুধু বদ্ধদৃষ্টিতে কবির মুখের দিকে চাহিয়া রহিলাম। কবি সমাগত ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়দের সঙ্গে দু-চারিটি কথা বলিতেছিলেন, কিন্তু তাহার মন যেন কোন সুদূর ধ্যানলোকে মগ্ন। এই দৃশ্য ভাবিতে ভাবিতে আমি আমার আশ্রয়স্থানে ফিরিয়া আসিলাম।

    ইহার পরে কি করিয়া কবির ভ্রাতুষ্পুত্র অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার পরিচয় হইল, তাহা পরে বলিব। আমি এম. এ. পড়িতে কলিকাতা আসিয়া ওয়াই, এম,সি এ হোস্টেলে আশ্রয় লইলাম। আমার রাখালী’ আর ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ বই দুইখানি ইহার বহু পূর্বেই প্রকাশিত হইয়াছে। কিছু কিছু কবিখ্যাতিও লাভ করিয়াছি। মাঝে মাঝে আমি অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করিতে জোড়াসাঁকো যাই। এই উপলক্ষে ঠাকুর পরিবারের প্রায় সকলের সঙ্গেই আমার পরিচয় হইয়াছে। অবনীন্দ্রনাথের পাশের বাড়ি রবীন্দ্রনাথের। তিনি এখানে আসিয়া মাঝে মাঝে অবস্থান করেন। শান্তিনিকেতন হইতে গানের দল আসে। তাঁহাদের গানে অভিনয়ে সমস্ত কলিকাতা সরগরম হইয়া উঠে। আমার জানা-অজানা কতলোক আসিয়া কবির সঙ্গে দেখা করিয়া যায়। আমি কিন্তু একদিনও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করি না। আমার কবিতার বই দুইখানি বহু অখ্যাত বিখ্যাত সাহিত্যিককে উপহার দিয়াছি। মতামত জানিবার জন্য কতজনের দ্বারস্থ হইয়াছি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে বই পাঠাই নাই।

    তখনকার দিনে রবীন্দ্রনাথ বাংলা দেশের তরুণ সাহিত্যিকদের সমালোচনা করিয়া একটি প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন। তাহাদের পক্ষ লইয়া শরৎচন্দ্র ইহার উত্তর দিয়াছিলেন। নজরুল হইতে আরম্ভ করিয়া বহু সাহিত্যিক নানা প্রবন্ধ লিখিয়া নিজেদের সদম্ভ আবির্ভাব ঘঘাষণা করিয়াছিলেন। বন্ধুবর অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত কবিতা করিয়া লিখিলেন, সামনে যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পথ রুধিয়া দাঁড়ান তবু আমরা আগাইয়া যাইব। এই আন্দোলনের মাঝখানে রবীন্দ্রনাথ শৈলজানন্দ প্রভৃতি কয়েকজন লেখককে প্রতিভাবান বলিয়া স্বীকৃতি দান করিলেন।

    ইহার কিছুদিন পরে দিলীপকুমার, বুদ্ধদেব বসু রচিত কয়েকটি কবিতা কাঁচি-কাটা করিয়া রবীন্দ্রনাথকে পাঠাইলেন। রবীন্দ্রনাথ সেগুলির প্রশংসা করিলেন। আমি যদিও কল্লোল-দলের একজন, আমার লেখা লইয়া কেহই উচ্চবাচ্য করিলেন না। মনে অভিমান ছিল, আমার সাহিত্যের যদি কোন মূল্য থাকে তবে রবীন্দ্রনাথ একদিন ডাকিয়া আমাকে আদর করিবেন। ইতিমধ্যেই আমি রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুস্পুত্র অবনীন্দ্রনাথের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হইয়াছি। রবীন্দ্রনাথের সামনে উপস্থিত হওয়া এখন আমার পক্ষে সব চাইতে সহজ, তবু ইচ্ছা করিয়াই ভঁহার সামনে উপযাচক হইয়া উপস্থিত হই নাই। কিন্তু আড়াল হইতে যতদূর সম্ভব তাহার খবর লইতেছি।

    সেবার রবীন্দ্রনাথের খুব অসুখ হইল। সারা দেশ কবিব জন্য উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল। শঙ্কাকুল দেশবাসী অতি আগ্রহের সহিত প্রতিদিন খবরের কাগজে কবির স্বাস্থ্যের খবর লক্ষ্য করিতে লাগিল। জাতির সৌভাগ্য, কবি রোগমুক্ত হইলেন। আরোগ্য লাভ করিয়া কবি কলিকাতা ফিরিয়া আসিলেন। সেটা বোধ হয় ১৯৩০ সন।

    তখন আমার মনে হইল, বয়োবৃদ্ধ এই কবির সম্পর্কে অভিমান করিয়া দূরে থাকিলে জীবনে হয়তো তাঁহার সঙ্গে পরিচয় হইবে না। ক্ষণকালের অতিথি কখন যে ওপারের ডাক পাইয়া আমাদের এই পৃথিবী ছাড়িয়া চলিয়া যাইবেন তাহা কেহ জানে না।

    অবনীন্দ্রনাথের দৌহিত্র মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায় আমার বন্ধু। দুই জনে অনেক জল্পনা-কল্পনা করিয়া একদিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করিতে রওনা হইলাম।

    অবনীন্দ্রনাথের বাড়ি হইতে রবীন্দ্রনাথের ঘর তিন মিনিটের পথও নয়। এই এতটুকু পথ অতিক্রম করিতে মনে হইল যেন কত দূরের পথ যাইতেছি। আমার বুক অতি-আনন্দে দুরুদুরু করিতেছিল। ঘরের সামনে আসিয়া আমাকে অপেক্ষা করিতে বলিয়া মোহনলাল ভিতরে প্রবেশ করিল। আমি দরজার সামনে দাঁড়াইয়া কত কথা ভাবিতে লাগিলাম। আমি যেন কোন অতীত যুগের তীর্থযাত্রী। জীবনের কত বন্ধুর পথ অতিক্রম করিয়া আজ আমার চির-বাঞ্ছিত মহামানবের মন্দিরপ্রান্তে আগমন করিয়াছি। ছবির উপরে ছবি মনে ভাসিয়া আসিতেছিল। এতদিন এই কবির বিষয়ে যাহা ভাবিয়াছি, যাহা পড়িয়াছি, যাহা শুনিয়াছি সব যেন আমার মনে জীবন্ত হইয়া কথা কহিতেছিল। অনেকক্ষণ পরে মোহনলাল আসিয়া আমাকে ভিতরে লইয়া গেল। স্বপ্নাবিষ্টের ন্যায় আমি যেন কোন কল্পনার জগতে প্রবেশ করিলাম। সুন্দর কয়েকখানি ছবি দেওয়ালে টাঙানো। এখানে সেখানে সুন্দর সুপরিকল্পিত চৌকোণা আসন। তাহার উপরে নানা রঙের ডােরাকাটা বস্ত্র-আবরণ। সেগুলি বসিবার জন্য না দেখিয়া চোখের তৃপ্তি লাভের জন্য কে বলিয়া দিবে! এ যেন বৈদিক যুগের কোন ঋষির আশ্রমে আসিয়াছি।

    তখন বর্ষাকাল। কদমফুলের গুচ্ছ গুচ্ছ তোড়া নানা রকমের ফুলদানীতে সাজান। আধ-ফোটা মোটা মোটা কেয়াফুলের গুচ্ছ কবির সামনে দুইটি ফুলদানী হইতে গন্ধ ছড়াইতেছিল। বেলীফুলের দু-গাছি মালা কবির পাশে পড়িয়া রহিয়াছে। মনে হইতেছিল, বাংলা দেশের বর্ষাঋতুর খানিকটা যেন ধরিয়া আনিয়া এই গৃহের মধ্যে জীবন্ত করিয়া রাখা হইয়াছে। চারিধার হইতে সব কিছুই মূক ভাষায় আমার সঙ্গে কথা বলিতেছিল। কবি যদি আমার সঙ্গে কোন কথাই না বলিতেন তবু আমি অনুতাপ করিতাম না। এই গৈরিক বসন পরিহিত মহামানবের সামনে আসিয়া আজ আমার সমস্ত অন্তর ভরিয়া গিয়াছে। সালাম জানাইয়া কম্পিত হস্তে আমি নক্সীকাঁথার মাঠ আর রাখালী’ পুস্তক দুইখানি কবিকে উপহার দিলাম। কবি বই দুইখানি একটু নাড়িয়া চাড়িয়া আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আমার মনে হচ্ছে তুমি বাংলা দেশের চাষী মুসলমানদের বিষয়ে লিখেছ। তোমার বই আমি পড়ব।”

    প্রথম পরিচয়ের উত্তেজনায় সেদিন কবির সঙ্গে আর কি কি আলাপ হইয়াছিল, আজ ভাল করিয়া মনে নাই।

    ইহার দুই-তিন দিন পরে দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের মধ্যম ছেলে অধ্যাপক অরুণ সেন আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, “তুমি কবিকে বই দিয়ে এসেছিলে। আজ দুপুরে আমাদের সামনে কবি অনেকক্ষণ ধরে তোমার কবিতার প্রশংসা করলেন। এমন উচ্ছ্বসিতভাবে কারো প্রশংসা করতে কবিকে কমই দেখা যায়। কবি অভিপ্রায় প্রকাশ করেছেন, তিনি তোমাকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যাবেন।”

    পরদিন সকালে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আসিয়া আমি কবির সঙ্গে দেখা করিলাম। কবি আমার বই দুইখানির প্রশংসা করিলেন। বলিলেন, “আমি শান্তিনিকেতনে গিয়েই তোমার বই দু’খানার উপর বিস্তৃত সমালোচনা লিখে পাঠাব। তুমি শান্তিনিকেতনে এসে থাক।

    ওখানে আমি তোমার একটা বন্দোবস্ত করে দেব।”

    আমি বিনীতভাবে উত্তর করিলাম “এখানে আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম, এ, পড়ছি। শান্তিনিকেতনে গেলে তো পড়া হবে না।”

    কবি বলিলেন, “ওখান থেকে ইচ্ছে করলে তুমি প্রাইভেটে এম, এ, পরীক্ষা দিতে পারবে। আমি সে বন্দোবস্ত করে দেব।”

    আমি উত্তরে বলিলাম “ভাল করে ভেবে দেখে আমি আপনাকে পরে জানাব।”

    কলিকাতায় আমার সব চাইতে আপনার জন দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করিলাম। তিনি আমাকে কলিকাতা ছাড়িয়া শান্তিনিকেতনে যাইতে নিষেধ করিলেন। তিনি বলিলেন, “কবি যদি এত বৃদ্ধ না হতেন তবে আমি ওখানে যেতে বলতাম। কিন্তু কবি কতকাল বেঁচে থাকবেন, বলা যায় না। এখান থেকে এম, এ, পাশ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা কর। ওখানকার আশ্রয় পাওয়ার সৌভাগ্য দীর্ঘ কাল তোমার না-ও হতে পারে।”

    আমার শান্তিনিকেতন যাওয়া হইল না। ইহার পর কবি আরও বার বৎসর বাঁচিয়াছিলেন। আজ অনুতাপ হইতেছে, এই সুদীর্ঘ বার বৎসর যদি কবির সান্নিধ্য লাভ করিতে পারিতাম, তবে জীবনে কত কি শিখিতে পারিতাম।

    কবি শান্তিনিকেতনে চলিয়া গেলেন। প্রায়-দুই মাস চলিয়া গেল। কবি আমার বই-এর সমালোচনা পাঠাইলেন না। কিন্তু কি ভাষাতেই বা কবিকে তাগিদ দিয়া পত্র লিখিব। বহু চেষ্টা করিয়াও কবিকে লিখিবার মত ভাষা খুঁজিয়া পাই না। মোহনলালকে দিয়া কবিকে পত্র পাঠাইলাম। তখন কবি শান্তিনিকেতনে কি-একটা অভিনয় লইয়া ব্যস্ত। কবি একটা ছোট্ট চিঠিতে মোহনলালকে লিখিয়া পাঠাইলেন, “জসীমউদ্দীনের কবিতার ভাব ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। প্রকৃত হৃদয় এই লেখকের আছে। অতি সহজে যাদের লেখবার শক্তি নেই, এমনতর খাঁটি জিনিস তারা লিখতে পারে না।”

    কবির এই কথাগুলি বই-এর বিজ্ঞাপনে ছাপাইয়া সেই সময় মনে মনে খুবই বাহাদুরী অনুভব করিয়াছিলাম। নক্সীকাঁথার মাঠ ছাপা হইলে বাংলা দেশের বহু সাহিত্যিক ইহার প্রশংসা করিয়াছিলেন। যাঁহার বিরুদ্ধ সমালোচনা করিতে প্রস্তুত হইতে ছিলেন, রবীন্দ্রনাথের এই প্রসংসার পরে তাঁহারা আর সে বিষয়ে সাহসী হইলেন না। সাপ্তাহিক সম্মেলনীতে একজন প্রবীণ সাহিত্যিক নক্সীকাঁথার মাঠ’-এর সমালোচনার মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রতি কিছু কটাক্ষপাত করিয়াছিলেন, কিন্তু বইখানি যে খারাপ এ কথা বলিতে সাহস পান নাই।

    ইহার পরে রবীন্দ্রনাথ যখনই কলিকাতা আসিয়াছেন, অবসর পাইলেই আমি গিয়া দেখা করিয়াছি। আমাকে দেখিলে কবি তাঁর বিগত কালের পদ্মাচরের জীবন লইয়া আলোচনা করিতেন।

    তখন আমি বালুচর’ বইয়ের কবিতাগুলি লিখিতেছি। ইহার অধিকাংশ কবিতাই ত্রিপদী ছন্দে লিখিত। মাসিকপত্রে ইহার অধিকাংশ কবিতা ছাপা হয়। সমালোচকেরা বলিতে লাগিলেন, “তোমার কবিতা একঘেয়ে হইয়া যাইতেছে। ছন্দ পরিবর্তন কর।”

    একদিন কবিকে এই কথা বলিলাম। কবি বলিলেন, “ওসব বাজে লোকের কথা শুনো না। যে ছন্দ সহজে এসে তোমার লেখায় ধরা দেয়, তাই ব্যবহার কর। ইচ্ছে করে নানা ছন্দ ব্যবহার করলে তোমার লেখা হবে তোতাপাখির বোলের মত। তাতে কোন প্রাণের স্পর্শ থাকবে না।”

    ‘বালুচর’ বইখানা ছাপা হইলে কবিকে একখানি পাঠাইয়া দিলাম। সঙ্গে পত্র লিখিয়া অনুরোধ করিলাম, পড়িয়া আপনার কেমন লাগে অনুগ্রহ করিয়া লিখিয়া জানাইবেন। কবি এ পত্রের কোনও উত্তর দিলেন না। তিনি কলিকাতা আসিলে দেখা করিলাম। কবি বলিলেন, “তোমার বালুচর’ পড়তে গিয়ে বড়ই ঠকেছি হে। ‘বালুচর’ বলতে তোমাদের দেশের সুদূর পদ্মাতীরের চরগুলির সুন্দর কবিত্বপূর্ণ বর্ণনা আশা করেছিলাম। কেমন চখাচখি উড়ে বেড়ায়, কাশফুলের গুচ্ছগুলি বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু কতকগুলি প্রেমের কবিতা দিয়ে তুমি বইখানাকে ভরে তুলেছ। পত্রে এ কথা লিখলে পাছে রূঢ় শোনায় সে জন্য এ বিষয়ে কিছু লিখি নি। মুখেই বললাম।”

    ইহার পরে রবীন্দ্রনাথ যখন বাংলা কবিতার সংকলন বাহির করেন, তখন এই বালুচর’ বই হইতেই ‘উড়ানীর চর’ নামক কবিতাটি চয়ন করিয়াছিলেন।

    ‘রাজারানী, নাটকখানি নূতন করিয়া লিখিয়া রবীন্দ্রনাথ ইহার ‘তপতী’ নামকরণ করিলেন। একদিন সাহিত্যিকদের ডাকিয়া তাহা পড়িয়া শোনাইলেন। সেই সভায় আমিও উপস্থিত ছিলাম। একই অধিবেশনে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরিয়া কবি সামনে নাটকখানা পড়িয়া গেলেন। বিভিন্ন চরিত্রের মুখে বিভিন্ন সংলাপগুলি কবির কণ্ঠে যেন জীবন্ত হইয়া উঠিতেছিল। এই নাটক মহাসমারোহে কবি কলিকাতায় অভিনয় করিলেন। কবি রাজার ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিলেন। সত্তর বৎসর বয়সের বৃদ্ধ কি করিয়া প্রেমের অভিনয় করিবেন, তাঁহার সাদা দাড়িরই বা কি হইবে, অভিনয়ের পূর্বে এই সব ভাবিয়া কিছুই কূলকিনারা পাইলাম না। কিন্তু অভিনয়ের সময় দেখা গেল, দাড়িতে কালো রঙ মাখাইয়া মুখের দুই পাশে গালপাট্টা তুলিয়া দিয়া কবি এক তরুণ যুবকের বেশে মঞ্চে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তপতী’ নাটকে রাজার ব্যর্থ প্রেমের সেই মর্মান্তিক হাহাকার কবির কণ্ঠমাধুর্যে আর আন্তরিক অভিনয়নৈপুণ্যে মঞ্চের উপর জীবন্ত হইয়া উঠিয়াছিল। এই নাটকে রাজার ভূমিকাটি বড়ই ঘোরালো। নাটকের সবগুলি চরিত্র রাজার বিপক্ষে। সেই সঙ্গে সাধারণ দর্শক-শ্রোতার মনও বাহির হইতে দেখিতে গেলে রাজার উপর বিতৃষ্ণ। রাজা যে রানীর ভালবাসা পাইল না, তারই জন্য যে রাজার সব কাজ নিয়ন্ত্রিত হইতেছিল, একথা সাধারণ দর্শক শ্রোতা সহজে বুঝিতে পারে না। হয়ত সেইজন্য ইহা বাংলার সাধারণ রঙ্গমঞ্চে বেশীদিন টিকিল না। কিন্তু যাঁহারা গভীরভাবে এই নাটকটি আলোচনা করিয়াছেন, তাঁহারা লক্ষ্য করিবেন, রাজার ব্যর্থ জীবনের হাহাকারের মধ্যে নাটকলেখকের দরদী অন্তর ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। এই ব্যাপারটি কবির অভিনয়ে জীবন্ত হইয়া উঠিয়াছিল।

    এই নাটক অভিনয়ের সাত-আট দিন আগে কবি দলবল লইয়া শান্তিনিকেতন হইতে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আগমন করিলেন। প্রতিদিন মহাসমারোহে নাটকের মহড়া চলিল। বন্ধু মোহনলালের সঙ্গে লুকাইয়া আমি এই নাটকের মহড়া দেখিতে যাইতাম। তাহাতে লক্ষ্য করিতাম’ নাটকটি অভিনয়ের উপযোগী করিতে কবি বিভিন্ন ভূমিকাগুলিকে কেবলই বদলাইয়া চলিয়াছেন। কবির নাটকে যাঁহারা অভিনয় করিতেন তাহাদিগকে বড়ই বিপদে পড়িতে হইত। যে পর্যন্ত অভিনেতা মঞ্চে গিয়া না দাঁড়াইতেন, সে পর্যন্ত ভুমিকার পরিবর্তন হইতে থাকিত। মোহনলালের নিকট শুনিয়াছি, কোন অভিনেত্রী তাহার নির্দিষ্ট ভূমিকা বলিতে মঞ্চে প্রবেশ করিতেছেন, এমন সময় কবি তাহাকে ডাকিয়া বলিয়া দিলেন, “দেখ, এইখানটিতে এই কথাটি না বলে ওই কথাটি বলবে।”

    ‘তপতী’ নাটক পরে শিশিরকুমার ভাদুড়ী মহাশয় সাধারণ রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করেন। এই অভিনয়ের চার-পাঁচ দিন আগে কবি শিশির কুমারকে টেলিগ্রামে শান্তিনিকেতনে ডাকাইয়া লইয়া গিয়া নাটকের কয়েকটি অংশ বদলাইয়া দিলেন। কবির সৃজনীশক্তি কিছুতেই পরিতৃপ্ত হইতে জানিত না। বিধাতা যেমন তাহারা অপুর্ব-সৃষ্টিকাব্য ধরণীর উপর আলো ছড়াছয়া আঁধার ছড়াইয়া নানা ঋতুর বর্ণসুষমা মাখাইয়া উহাকে নব নব রূপে রূপায়িত করেন, তেমনি কবি তাঁর রচিত কাব্য উপন্যাস ও নাটকগুলিকে বারম্বার নানাভাবে নানা পরিবর্তনে উৎকর্ষিত করিয়া আমাদের জন্য রাখিয়া গিয়াছেন। ‘রাজারানী’ নাটকের ‘তপতী’-সংস্করণক বির এই সৃষ্টিধমীমনের অসন্তুষ্টির অবদান।

    রবীন্দ্র-জয়ন্তীর সময় ছাত্র-ছাত্রীদের তরফ হইতে রবীন্দ্রনাথের ‘নটীর পূজা’ নাটকের অভিনয় হয়। শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েরা অনুষ্ঠান সাফল্যমণ্ডিত করিয়া তোলেন। আমার যতদূর মনে পড়ে, এই অভিনয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রম্পট করিয়াছিলেন। শেষ দৃশ্যে যেখানে নটীর মৃত্যুর পর ড্রপসিন পড়ার কথা –অর্ধেক ড্রপসিন পড়িয়া গিয়াছে, হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ গায়ে একটা মোটা কম্বল জড়াইয়া মঞ্চে আসিয়া নটীর মৃতদেহের উপর দুই হাত শূন্যে তুলিয়া ‘ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি’ এই মন্ত্র উচ্চারণ করিয়া গেলেন। তখন হইতে নটীর পূজা শেষ দৃশ্যে এই পাঠটি প্রবর্তিত হইয়া আসিতেছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতার খাতা দেখিয়াছি। তাহাতে এত পরিবর্তন ও এত কাটাকুটি যে দেখিয়া অবাক হইতে হয়। রবীন্দ্রনাথের সৃজনীশক্তি কিছুতেই যেন তৃপ্ত হইতে জানিত না। আজীবন তিনি গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন, তাহার প্রত্যেকখানিতে তাহার মনের একান্ত যত্নের ছাপ লাগিয়া রহিয়াছে। লিখিয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি অপরকে দিয়া নকল করান নাই। যতবার নকল করিতে হয় নিজেই করিয়াছেন এবং প্রত্যেক বারেই সেই রচনার ভিতর তাঁহার সূজনী-শক্তির অপূর্ব কারুকার্য রাখিয়া গিয়াছেন।

    তপতী’র পরে নাটক রচনার নেশা রবীন্দ্রনাথকে পাইয়া বসিয়াছিল। তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে গিয়া আমি পাড়াগাঁয়ের লোকনাট্য আসমান সিংহের পালার উল্লেখ করিলাম। কবি আমাকে বলিলেন, “তুমি লেখ না একটা গ্রাম্য নাটক।” আমি বলিলাম, “নাটক আমি একটা লিখেছি। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ পড়ে বললেন, নাটক লেখার শক্তি তোমার নেই।” কবি জোরের সঙ্গে বলিলেন, “অবন নাটকের কি বোঝে? তুমি লেখ একটা নাটক তোমাদের গ্রাম দেশের কাহিনী নিয়ে। আমি শান্তিনিকেতনের ছেলে মেয়েদের দিয়ে অভিনয় করাব।”

    আমি বলিলাম, “একটা প্লট যদি দেন তবে আর একবার চেষ্টা করে দেখি।”

    কবি বলিলেন, “আজ নয়। কাল সকালে এসো।”

    পরদিন কবির সামনে গিয়া উপস্থিত হইলাম। একথা-সেকথার পরে আমার নাটকের প্লট দেওয়ার কথা কবিকে মনে করাইয়া দিলাম।

    কবি হাসিয়া বলিলেন, “তুমি দেখছি, ছাড়বার পাত্র নও। চোরের মন বোচকার দিকে।” নিকটে আরও দু-একজন ভদ্রলোক ছিলেন। তাঁহারা হাসিয়া উঠিলেন। কবি প্লট বলিতে লাগিলেন—

    “ধর, তোমাদের পাড়াগাঁয়ের মুসলমান মোড়লের ছেলে কলকাতায় এম, এ, পড়তে এসেছে। বহু বৎসর বাড়ি যায় না। এম, এ, পাশ করে সে বাড়ি এসেছে। বাবা মা সবাই তাদের পুরনো গ্রাম্য রীতিনীতিতে তাকে আদর যত্ন করলেন। কিন্তু ছেলের এসব পছন্দ হয় না। সে বলে, তোমরা যদি আমাকে এমন করে আদরঅভ্যর্থনা না করতে তবেই ভাল হত। আদর করেই তোমরা আমাকে অপমান করছ।

    “ছেলেটির সঙ্গে গ্রামের অন্য একজন মোড়লের মেয়ের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। বিয়ের কথা বাপ বলতেই ছেলে রেগে অস্থির। অমুকের মেয়ে অমুক—সেই ছোট্ট এতটুকু মেয়ে তাকে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না। গ্রাম্য চাষী হবে তার শশুর!

    “মেয়েটির তখন অন্যত্র বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেল। পাকাদেখার দিন ছেলেটা মেয়ের বাড়িতে কি উপলক্ষে গিয়ে তাকে দেখে এলো। ছেলেবেলায় যাকে সে একরত্তি এতটুকু দেখেছিল আজ সে পরিপূর্ণ যুবতী। ছেলের মনে হল, এমন রূপ যেন সে আর কোথাও দেখেনি।

    “বাপ ছেলেকে বড়ই ভালবাসেন। বাপ দেখলেন কিছুতেই ছেলের মন টিকছে না, তখন তিনি ছেলেকে গিয়ে বললেন, “দেখ, অনেক ভেবে দেখলাম, দেশে থাকা তোর পক্ষে মুশকিল। তুই কলকাতায় চলে যা। এখানকার জলবায়ু ভাল না। কখন অসুখ করবে কে জানে। মাসে মাসে তোর যা টাকা লাগে, আমি পাঠিয়ে দেব। তুই কলকাতায় চলে যা।।

    “তখন ছেলে এক মস্ত বক্তৃতা দিল। কে বলে, এ গ্রাম আমার ভাল লাগে না? ছেলেবেলা থেকে আমি এখানে মানুষ। এ গাঁয়ের গাছপালা লতাপাতা সব আমার বালককালের খেলার সঙ্গী।

    “বাপ তো “বাক। হঠাৎ ছেলের মন ঘুরে গেল কি করে? ছেলের কোন বন্ধুর মারফৎ বাপ জানতে পারলেন, যে-মেয়েটির সঙ্গে তার বিয়ের কথা স্থির হয়েছিল তাকে দেখেই সে পাগল। তখন বাপ ছুটলেন মেয়ের বাপের উদ্দেশে। কিন্তু মেয়েটির অন্য জায়গায় বিয়ের কথা পাকা। মেয়ের বাপ কথা বল্লাতে রাজি নয়।

    “এবার গল্পটিকে ট্রাজেডিও করতে পার, কমেডিও করতে পার। যদি ট্রাজেডি করতে চাও,লেখ, বিয়ের পরে মেয়েটির সঙ্গে আবার একদিন ছেলেটির দেখা। মেয়েটি ছেলেকে বলল, আমাদের যাকিছু কথা রইল মনে মনে। বাইরের মিলন আমাদের হল না কিন্তু মনের মিলন থেকে কেউ আমাদের বঞ্চিত করতে পারবে না।”

    কবির এই প্লট অবলম্বন করিয়া আমি নাটক রচনা করিয়াছিলাম দুই-তিনবার অদলবদল না করিয়া কোন লেখা আমি প্রকাশ করি না। কবি জীবিত থাকিতে তাহাকে তাই নাটক দেখাইতে পারি নাই। ‘পল্লীবধূ’ নাম দিয়া নাটকটি কয়েক বৎসর পূর্বে প্রকাশিত হইয়াছে। ঢাকা বেতারে এই নাটক অভিনীত হইয়া শত শত শ্রোতার মনোরঞ্জন করিয়াছে। আজ যদি রবীন্দ্রনাথ বাঁচিয়া থাকিতেন, এই নাটক তাহাকে উপহার দিয়া মনে মনে কতই না আনন্দ পাইতাম।।

    অবনীন্দ্রনাথের বাড়িতে মাঝে মাঝে নন্দলাল বসু আসিতেন গুরুর সঙ্গে দেখা করিতে। সেই উপলক্ষে শিল্পী নন্দলালের সঙ্গে আমার পরিচয়। নন্দলাল শুধুমাত্র তুলি দিয়া মনের কথা বলেন, গুরুর মত কলমের আগায় ভাষার আতসবাজী ফুটাইতে পারেন না। কিন্তু তার সঙ্গে আলাপ করিতে আমার খুব ভাল লাগত। আর্টের বিষয়ে ছবির বিষয়ে তিনি এত সুন্দর সুন্দর কথা বলিতেন যা লিখিয়া রাখিলে সাহিত্যের অপূর্ব সম্পদ হইত।

    কয়েকটি কথা মনে আছে। এখানে লিখিয়া রাখিল। “গাছের এক এক সময়ে এক এক রূপ। সকাল সন্ধ্যা দুপুর রাত্রি কত ভাবেই গাছ রূপ-পরিবর্তন করছে। শান্তিনিকেতনে আমার ছাত্রেরা গভীর রাত্রিকালে জেগে উঠে গাছের এই রূপ-পরিবর্তন লক্ষ্য করে।”

    সুদূর মাদ্রাজ হইতে আসিয়াছিল নন্দলালের এক ছাত্র। আর্ট ইস্কুলে পাঁচ-ছয় বৎসর ছবি আঁকা শিখিয়া বাড়ি ফিরিবার সময় দুঃখ করিয়া নন্দলালকে বলিল, “আমি চলেছি আমাদের পাড়াগাঁয়ে, সেখানে আমার আর্ট কেউ বুঝবে না। বাকি জীবনটা আমাকে নির্বাসনে কাটাতে হবে।” নন্দলাল ছাত্রকে আদর করিয়া কাছে ডাকিয়া বলিলেন, “তুমি গ্রামে গিয়ে দেখতে পাবে এক রাখাল-বালক হাতে ছুরি নিয়ে তার লাঠির উপরে ফুলের নক্সা করছে। তার গরু হয়তো তখন পরের ক্ষেতে ধান খাচ্ছে, এজন্য তাকে বকুনি শুনতে হবে। কিন্তু সেদিকে তার কোন খেয়াল নেই। সে একান্ত মনে তার লাঠিতে ফুল তুলছে। আরও দেখবে, কোন এক গাঁয়ের মেয়ে হয়ত কাঁথা সেলাই করছে কিম্বা রঙ-বেরঙের সুতো নিয়ে সিকা বুনছে। তার উনুনের উপর তরকারি পুড়ে যাচ্ছে, কিম্বা কোলের ছেলেটি মাটিতে পড়ে আছাড়িপিছাড়ি কান্না কাঁদছে। কোন দিকে তার খেয়াল নেই। সে সুতোর পর সুতো লাগিয়ে কাঁথার উপর নতুন নক্সা বুনট করছে। সেই রাখাল ছেলে সেই গ্রামের মেয়ে এরাই হবে তোমার সত্যিকার শিল্পীবন্ধু। এদের সঙ্গে যদি মিতালি করতে পার তবে তোমার গ্রাম্য জীবন একঘেয়ে হবে না। চাই কি, তাদের সৃজন-প্রণালী যদি তোমার ছবিতে প্রভাব বিস্তার করে, তুমি শিক্ষিত সমাজের শিল্পে নতুন কিছু দান করতে পারবে।”

    খেলনা-পুতুলের বিষয়ে তিনি বলিতেন, “কৃষ্ণনগরের খেলনা পুতুল রিয়ালিটিক। এক অংশ ভেঙে গেলে সেগুলো দিয়ে আর খেলা করা যায় না। আমাদের গ্রামদেশী পুতুল আইডিয়ালিটিক, এক অংশ ভেঙে গেলেও তা দিয়ে খেলা করা যায়। এমনি বহু সুন্দর সুন্দর কথা শুনিতাম নন্দলালের কাছে। আজ নন্দলাল অসুস্থ হইয়া শান্তিনিকেতনে অবস্থান করিতেছেন। কোন ছাত্র যদি তার সঙ্গে তার শিল্পী-জীবনের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করিয়া তাহা লিপিবদ্ধ করেন, তবে উহা সমস্ত বাঙালীর সম্পদ হবে। নন্দলাল আমার ‘বালুচর’ পুস্তকের জন্য একখান। সুন্দর প্রচ্ছদপট আঁকিয়া দিয়াছিলেন। ‘রাখালী’র বর্তমান সংস্করণ নন্দলালের আঁকা একটি প্রচ্ছদপটে শোভা পাইতেছে।

    সেবার নন্দলালের সঙ্গে শান্তিনিকেতন গেলাম। যে কয়দিন ছিলাম শিল্পীর পত্নী অতি যত্নের সঙ্গে আমার আহারাদির ব্যবস্থা করিলেন। পানিবাসে আমার থাকার ব্যবস্থা হইল। পান্থনিবাসের ঘরের ছাতের উপর নন্দলাল কতকগুলি মাছের ছবি আঁকিয়া রাখিয়াছেন। সেগুলির দিকে চাহিয়া পথিকের মনে জলের

    শীতলতা আনিয়া দেয়। নন্দলাল গর্বের সঙ্গে বলিতেন, সাঁওতালের পথ দিয়া যাইতে যাইতে মাঝে মাঝে তাঁহার আঁকা ছবিগুলির দিকে চাহিয়া দেখে। এই ব্যাপারটি তার শিল্পী-জীবনের একটি বড় সার্থকতা বলিয়া তিনি মনে করিতেন।

    পান্থনিবাসে আসিয়া দেখা হইল পাগলা নিশিকান্তের সঙ্গে। নিশিকান্ত ছবি আঁকে। সে ছবির সঙ্গে অন্য কারো ছবির মিল নাই। নিশিকান্ত কবিতা লেখে, সে কবিতার সঙ্গে কারো কবিতার মিল নাই। এমন অদ্ভুত ভাব-পাগল। অবনীন্দ্রনাথের বাড়ীতে আগেই তাহার সঙ্গে পরিচয় হইয়াছিল। এবার সে পরিচয় আরও নিবিড় হইল। নিশিকান্তের বন্ধু সান্ত্বনা গুহ। সুতরাং সে আমারও বন্ধু হইল। অনেক রাত পর্যন্ত তিন বন্ধুতে গল্পগুজব করিলাম। শেষরাত্রে শান্তিনিকেতনের বৈতালিকদল, ‘আমার বসন্ত যে এলো’ গানটি গাহিয়া সমস্ত আশ্রম পরিক্রমা করিতেছিল। সুমধুর কণ্ঠস্বর শুনিয়া ঘুম ভাঙিয়া গেল। যেন এক স্বপ্ন-জগতে জাগিয়া উঠিলাম। তখন ভোরের আলোকে চারিদিক পরিষ্কার হয় নাই। আলো-আঁধারী ভোরের বাতাসে পাখির সঙ্গে বৈতালিকদের গান আম্র শুরুর শাখায় শাখায় আনন্দের শিহরণ তুলিতেছিল। বসন্ত যে আসিয়াছে তাহা এখানে আসিয়াই বুঝিতে পারিলাম।

    সকালে নিশিকান্ত, সান্ত্বনা আর তাদেরই মত যত পাগলাটে ছেলেদের আশ্রয়স্থল শান্তিনিকেতনের গ্রন্থাগারিক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি আসিয়া হাজির হইলাম। সেখানে প্রভাত কুমারের স্ত্রী সুধা-দিদি হাসিমুখে আমাদিগকে গ্রহণ করিলেন। তাঁর ছোট ঘোট দুই ছেলে, সুপ্রিয় দেবপ্রিয় আব প্রভাত কুমারের ভাইঝি হাসু আসিয়া আমাদের সমনে দাঁড়াইল। সুতরাং আমাকে আর পায় কে! গল্পের উপরে গল্প চলিল। কবিতার উপরে কবিতা আবৃত্তি হইতে লাগিল। আমি আর নিশিকান্ত, নিশিকান্ত আর আমি দুইজনে পালা করিয়া মনের সাধ মিটাইয়া গল্প বলিয়া চলিলাম। পাশের ঘরে বইপুস্তক লইয়া প্রভাতদা মশগুল হইয়াছিলেন। আমাদেয় এই হৈ-হুল্লোড় যখন চরমে উঠিতেছিল তিনি মাঝে মাঝে আমাদের দিকে চাহিয়া মৃদু হাসিতেছিলেন।

    সুধা-দি আমাকে বিকালে চায়ের নিমন্ত্রণ করিলেন। সকালে আমরা গল্প বলিয়া, কবিতা আবৃত্তি করিয়া ছোটদের আকর্ষণ করিয়াছি। এইবার তাদের পালা। হাসু, হাসুর বন্ধু মমতা, হাসুর দিদি অনু আরও ছোট ছোট কয়েকটি ছেলেমেয়ে হাত ধরাধরি করিয়া এমন সুন্দর নাচ দেখাইল! সুধাদি তাঁর এস্রাজ বাজাইয়া সেই নাচের আবহসংগীত পরিবেশন করিলেন। মনে হইল এইসব ছেলেমেয়েরা যেন কতকাল আমার পরিচিত। তখনও আমার ছেলেমেয়ে হয় নাই। মনের বাৎসল্যসুধা তাই পরের ছেলেমেয়ে দেখিলে উৎসারিত হইয়া উঠিত।

    প্রভাতদার ভাইঝি হাসুর বয়স তখম পাঁচ-ছয় বছর। তার মুখখানা এমন করুণ মমতা মাখানো! কাছে ডাকিয়া আদর করিলে আদর করিতে দেয়। আমার হৃদয়ের সুপ্ত বাৎসল্য-স্নেহ এই ছোট্ট মেয়েটিকে ঘিরিয়া গুঞ্জন করিয়া উঠিল। হাসুকে কাছে ডাকিয়া বলিলাম, “তোমার সঙ্গে আমার খুব ভাব। না দিদি?” ডাগর ডাগর চোখ দুটি মেলিয়া হাসু চাহিয়া রহিল। বিদায়ের দিন তাকে ডাকিয়া বলিলাম, “হাসু! কলকাতা গিয়ে আমি তোমাকে চিঠি লিখবো। তুমি উত্তর দেবে তো? হা ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইল। এই ভাবে সারাদিন এখানে ওখানে ঘুরিয়া শান্তিনিকেতনের ছেলেদের সঙ্গে হৈ-হুল্লোড় করিয়া সন্ধ্যার আগে প্রভাতদার বাসায় আসিলাম। বার-তের বছরের ছোট একটি মেয়ে প্রভাতদার বাড়িতে আসিয়া আমার সঙ্গে দেখা করিল। তার কবিতার খাতাটি আমাকে দেখাইল। ছন্দের হাতটি তখনো পাকা হয় নাই। আমি তাহাকে খুব উৎসাহ দিলাম। সুধাদি বলিলেন, ‘মেয়েটি ভাল গান করে, ওর গান শুনবে?’

    মেয়েটি অনেক কষ্টে লজ্জা কাটাইয়া অতুলপ্রসাদের রচিত একটি গান গাহিল। “ওগো, সাথী, মম সাথী, আমি সেই পথে যাব তব সাথে।’ সে কি গান, না দূর-দূরান্তর হইতে ভাসিয়া-আসা কোন নাম-না-জানা পাখীর কণ্ঠস্বর! গান শেষ-করিয়া মেয়েটি সুন্দর হাত দুইটি তুলিয়া আমাকে নমস্কার করিয়া চলিয়া গেল। পাতলা একহারা চেহারা, গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম। নতুন ধানের পাতার সমস্ত বর্ণসুষমা কে যেন তাহার সমস্ত গায়ে মাখাইয়া দিয়াছে। মনে হইল, এমন গান কোনদিন শুনি নাই। এমন রূপও বুঝি আর কোথাও দেখি নাই। আজও তার গানের রেশ আমার কানে লাগিয়া আছে। আমার সোজন বাদিয়ার ঘাট’ পুস্তকে নায়িকার রূপ বর্ণনা করিতে আমি এই মেয়েটিকে মনে মনে কল্পনা করিয়াছিলাম। পুস্তকের দুইটি অংশ প্রত্যেক অংশের আগে অতুলপ্রসাদের এই গানটি আমি উদ্ধৃত করিয়া দিয়াছিলাম। মেয়েটি আজ কোথায় আছে জানি না। হয়ত কোন সুন্দর স্বামীর ঘরণী হইয়া ছেলেমেয়ে লইয়া সুখে আছে। সে কোনদিনই জানিতে পারিবে না

    যে তার সেই ক্ষণিকের দর্শন আর সুমধুর গান আমাকে সুদীর্ঘ সোজন বাদিয়ার ঘাটের কাহিনী লিখিতে সাহায্য করিয়াছিল। আমার এই পুস্তক সে হয়ত অপর দশজনের মতই বাজার হইতে কিনিয়া পড়িয়াছে, অথবা পড়ে নাই। নিজে তাহাকে এই বই উপহার দিয়া তাহার মতামত জানিবার সুযোগ কোনদিনই হইবে না। লেখকজীবনে এমনি বেদনার ঘটনা প্রায়ই ঘটিয়া থাকে।

    চার-পাঁচ দিন শান্তিনিকেতনে থাকিয়া কলিকাতা চলিয়া আসিলাম। বিদায়ের দিন হাসুকে কাছে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, হাসু, তোমাকে আমি চিঠি লিখব—কবিতা করে ছড়া কেটে চিঠিতে চিঠিতে তোমার সঙ্গে কথা বলব। তুমি উত্তর দেবে তো? ঘাড় নাড়িয়া হাসু জানাইল, সে উত্তর দিবে।

    এর আগে আমি ছোটদের জন্য কবিতা লিখি নাই। কলিকাতা আসিয়া হাসুকে খুসি করিবার জন্য ছোটদের উপযোগী কবিতা লেখায় হাত দিলাম। আমার যেন দিনরাত্রের তপস্যা হইল, ওই একরত্তি ছোট্ট মেয়েটিকে খুসি করা। ছড়া কাটিয়া নানা ছন্দে ভরিয়া হাসুকে পত্র লিখিতে লাগিলাম। ছোট্ট মেয়ে। তার সমবয়সীদের সঙ্গে খেলাধুলায় সময় কাটায়। আমার এই অসংখ্য পত্রের উত্তর দেওয়ার সময় কোথায়? তবু মাঝে মাঝে আকাবাঁকা হাতের ছোট্ট এক একখানা চিঠি সে আমাকে পাঠাইত। সেই সব পত্র পাইয়া আমি যেন সাত রাজার ধন হাতে পাইতাম। চিঠি অবলম্বন করিয়া মনে মনে কল্পনার রথকে উধাও ছুটাইতাম। ইহাতেও মনের আশা মিটিত না। অবসর পাইলেই শান্তিনিকেতনে গিয়া উপস্থিত হইতাম। যাইবার আগে কোন্ কোন্ গল্প বলিয়া হাসু আর তার বন্ধুদের খুসি করিব, বারবার মনে আওড়াইয়া লইতাম। সেখানে গিয়া সুধাদির বাড়িতে পূর্বের মতই আমার গল্পের আসর বসিত। মাঝে মাঝে কলিকাতা হইতে ছোটদের জন্য লেখা বই কিনিয়া হাসুকে পাঠাইতাম। উপহার-পৃষ্ঠায় গবাদাকে দিয়া অথবা প্রশান্তকে দিয়া রঙ-বেরঙের ছবি আঁকাইয়া লইতাম।

    একবার হাসু গড়াইতে আসিয়াছিল যাদবপুরে তাদের আত্মীয় ডাঃ হীরালাল রায়ের বাড়িতে। সেখানে গিয়া হাসুর সঙ্গে দেখা করিলাম। শ্রীমতি রায় আদর করিয়া আমাকে গ্রহণ করিলেন। তার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হারই মত আমার আপন হইয়া উঠিল। তাদের সঙ্গে নিয়া গল্প গুজব করিয়া সারাদিন কাটাইয়া আসিলাম।

    এইভাবে দিনের পর দিন বছরের পর বছর ঘুরিয়া চলিল। ছয় মাস পরে, এক বছর পরে, সুযোগ পাইলেই আমি শান্তিনিকেতনে আসি। হাসুর সঙ্গে দেখা হয়।

    সেবার সিভিল-ডিস্‌ওবিডিয়েন্স আন্দোলনে ইস্কুল-কলেজ বন্ধ হইয়া গেল। আমি মাসখানেকের জন্য শান্তিনিকেতনে গিয়া উপস্থিত হইলাম। হাসু বড় হইয়াছে। ডাকিলে কাছে আসিতে চায় না। সে যে বড় হইয়াছে, একথা আমি যেন ভাবিতেই পারি না। রবীন্দ্রনাথের কাবুলীওয়ালা’র মত আজ আমার মনের অবস্থা। বুঝিলাম বীণা-যন্ত্রের কোন অজ্ঞাত ‘তার যেন ছিড়িয়া গিয়াছে। সুধাদি কত ডাকিলেন হাসুর মা সুন্দরদি কত ডাকিলেন। অনেক ডাকাডাকির পর হাসু আসিয়া সামনে দাঁড়াইল। সেই মমতা-মাখানো মুখখানি তেমনি আছে। আজ আদর করিয়া তাহাকে কাছে ডাকিতে পারি না। ছড়ার ঝুমঝুমি বাজাইয়া তাহাকে খুশি করিতে পারি না। হাসুর বন্ধুরা সকলেই আসিল। মমতা আসিল-অনু, মিনু আসিল, কিন্তু গল্পের আসর যেন তেমন করিয়া জমিল না। নিজের আস্তানায় আসিয়া কোন্ সাত সাগরের কান্নায় চোখ ভাসিয়া যাইতে লাগিল। কেন ও বড় হইল? কেন ও আগের মত ছোটটি হইয়া রহিল না? এমনি প্রশ্নমালায় সমস্ত অন্তর মথিত হইতে লাগিল। এই মেয়েটি যদি আসিল—আমার বোনটি হইয়া আসিল না কেন! আমার কোলের মেয়েটি হইয়া আসিল না কেন! যে কার অভিশাপে চিরজন্মের মত পর হইয়া গেল।

    কলিকাতা আসিয়া পলাতক’ নামে একটি কবিতা লিখিলাম। হাসু নামে ছোট্ট একটি খুকু আজ যে কোথায় পলাইয়া গিয়াছে! খেলাঘরের খেলনাগুলি তেমনি পড়িয়া রহিয়াছে। এখানে সে আর খেলা করিতে আসিবে না। সে যে পলাইয়া গিয়াছে তা তার বাপ জানে না, মা জানে না, তার খেলার সাথীরা জানে না, সে নিজেও জানে না। কোন সুদূর তেপান্তরের বয়স তাহাকে আজ কোথায় লইয়া গিয়াছে। কোনদিনই সে আর খেলাঘরে ফিরিয়া আসিবে না। কবিতাটি শেষ করিয়াছিলাম একটি গ্রাম্য ছড়া দিয়া—

    এখানটিতে খেলেছিলাম ভাঁড়-কাটি সঙ্গে নিয়ে
    এখানটি রুধে দে ভাই ময়নাকাঁটা পুতে দিয়ে।

    কবিতাটি ‘আহেরিয়া’ নামে একটি বার্ষিক কাগজে ছাপা হইলে হাসুকে একখানি বই পাঠাইয়াছিলাম। হাসু একটি সংক্ষিপ্ত পত্রে উত্তর দিয়াছিল—‘জুসীদা, তোমার কথা আমি ভুলি নাই। আমার শিশুকালে তুমি গল্প-কবিতা শুনিয়েছ, ছোট বয়সের স্মৃতির সঙ্গে তোমার কথাও আমি কোনদিন ভুলব না।

    হাসুকে লেখা কবিতাগুলি দিয়া আমার হাসু পুস্তকখানি সাজাইলাম। ভাবিয়াছিলাম, এই পুস্তক রবীন্দ্রনাথের নামে উৎসর্গ করিব। কারণ তাঁহারই আশ্রমকা হাসুর উপরে কবিতাগুলি লিখিয়াছি। পরে ভাবিয়া দেখিলাম, রবীন্দ্রনাথকে তে কত লেখকই বই উৎসর্গ করে। এ বই পড়িয়া সব চাইতে খুশি হইবেন আমার জননীসম সুধাদি আর হাসুর মা সুন্দরদি। বইখানি ইহাদের নামে উৎসর্গ করিলাম। সুধাদির কথা ভাবিলে আজও আমার নয়ন অশ্রুভারাক্রান্ত হইয়া আসে। এই সর্বংসহা দেবীপ্রতিমা কত আধপাগলা, ক্ষ্যাপা, স্নেহপিপাসু ভাইদের ডাকিয়া আনিয়া তাঁর গৃহের স্নেহ-ছায়াতলে যে আশ্রয় দিয়াছেন,তাহার ইয়ত্তা নাই।

    আমি হাসুকে বেশী আদর করিতাম। তার জন্য কলিকাতা হইতে বই-পুস্তক পাঠাইত; সুধাদির ছোট ছোট ছেলেদের জন্য কিছুই পাঠাইতাম না। ছেলেরা কিন্তু হিংসা করিত না, সুধাদিও বিরক্ত হইতেন না। সুধাদি ছাড়া যে কোন ছেলের মা এমন অবস্থায় আমার জন্য গৃহ দ্বার বদ্ধ করিতেন। সুধাদি—আমার এমন সুধাদির কথা বলিয়া ফুরাইতে চাহে না। কতদিন সঁহাদের সহিত জানাশুনা নাই। সুধাদি এখন কেমন আছেন জানি না। কিন্তু আমার মনের জগতে সুধাদি প্রভাতদা তাঁদের দুই ছেলে সুপ্রিয় দেবপ্রিয়, আর হালু হাত ধরাধরি করিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়।

    প্রভাতদার মত অত বড় পণ্ডিত ব্যক্তি সামান্য বেতনে শান্তিনিকেতনের আশ্রমে গ্রন্থাগারিকের কাজ করিতেন। সংসারের অবস্থা স্বচ্ছল ছিল না। তাই সুধাদিকেও শিক্ষকতার কাজ করিতে হইত। ঘরসংসারের কাজকরিয়া ছেলেদের দেখাশুনা করিয়া শিক্ষকতার কাজ করিয়া তার উপরেও দিদি হাসিমুখে আমাদের মত ভাইদের নানা স্নেহের আবদার সহ করিতেন। ডাকিয়া এটা-ওটা খাওয়াইতেন। তাঁর হাসিমুখের ‘ভাই’ ডাকটি শুনিয়া পরাণ ভরিয়া যাইত। প্রভাতদা অন্যত্র এখানকার বহুগুণ বেতনে চাকুরীর ‘অফার পাইয়াছিলেন, কিন্তু কবিগুরুর আদর্শকে রূপায়িত করিতে সাহায্য করিতেছেন বলিয়া তিনি অন্যত্র যান নাই।

    শান্তিনিকেতনে আরও কয়েকজন প্রতিভাবান ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের আদর্শবাদের রূপায়ণে তিলে তিলে নিজদের দান করিয়া গিয়াছেন। একজন জগদানন্দ রায়—গ্রহ-নক্ষত্রের কথা, বিজ্ঞানের কথা এমন সুন্দর করিয়া সহজ করিয়া লিখিবার লোক আজও বাঙালীর মধ্যে হইল না। তার বইগুলি বাজারে দুষ্প্রাপ্য। বাঙালীর ছেলেমেয়ে দের এর চাইতে দুর্ভাগ্যের আর কিছু নাই। চেহারায় ব্যবহারে একেবারে কাঠখোটা মানুষটি, কিন্তু দুরূহ বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলিকে তিনি জলের মত সহজ করিয়া লিখিতে পারিতেন। আরও একজনের নাম করিব—স্বর্গীয় ক্ষিতিমোহন সেন। এমন মধুর কথকতা করিতে বুঝি আর কোথাও কাহাকে পাওয়া যাইবে না। তার গবেষণা বিষয়ে আমার মতানৈক্য আছে, কিন্তু তাঁর ব্যবহারে কথায় বার্তায় যেন শ্বেতচন্দন মাখানো ছিল। তাঁর সঙ্গে ক্ষণিক আলাপ করিলেও সেই চন্দনের সুবাস সারাজীবন লাগিয়া থাকিত।

    একবার রংপুরে গিয়াছি গ্রাম্য-গান সংগ্রহ করিতে। শুনিলাম ক্ষিতিমোহন আসিয়াছেন সেখানে বক্তৃতা করিতে। গিয়া দেখা করিলাম। তিনি সস্নেহে আমাকে গ্রহণ করিলেন। গ্রাম্য-গান সংগ্রহের বিষয়ে তাঁর কাছে উপদেশ চাহিলাম। তিনি সাধক রজবের একটি শ্লোক উদ্ধৃত করিয়া তার ব্যাখ্যা করিলেন। সাধনের কথা সেই যেন জিজ্ঞাসা করে যে নিজের হাতে নিজের ছের কেটে এসেছে। তোমার আত্মীয়স্বজন বলবে, এইভাবে তুমি কাজ কর যাতে তোমার খ্যাতি হয়। অর্থাগম হয়। তোমার দেশবাসী বলবেন, এইভাবে কাজ কর—আমরা তোমাকে যশে উচ্চ শিখরে নিয়ে যাব। তোমার লৌকিক ধর্ম বলবে, এইভাবে কাজ কর—তোমাকে স্বর্গে নিয়ে যাব। তোমার দৈহিক অভাব-অভিযোগ বলবে, এইভাবে কাজ করলে তোমার অর্থাগম হবে—কোন দুঃখ-দরিদ্র থাকবে না। এই সমস্তকে অতিক্রম করে তুমি তোমার আত্মার যে ধর্ম তারই পথ অনুসরণ করে চলবে। মনে মনে ভাববে, কি তোমার করণীয় কি করতে তুমি এসেছ। রাজভয়, লোকভয়, আত্মপরিতৃপ্তি কিছুই যেন তোমাকে তোমার পথ হতে বিভ্রান্ত করতে পারে না। ছের কেটে দিয়ে তবে তোমার সাধনের পথে অগ্রসর হতে হবে।

    ক্ষিতিমোহনের এই উপদেশ আজও আমার অন্তরে ধ্বনিতপ্রতিধ্বনিত হইতেছে।

    শান্তিনিকেতনে থাকিয়া এখানে ওখানে ঘুরিয়া সময় কাটাই। পরিচয় হইল শান্তিদেব ঘোষের সঙ্গে। তখন তার কৈশোরকাল। এমন মধুর কণ্ঠ! তাকে ডাকিয়া লইয়া খোয়াই নদীর ধারে বসি। আকাশের শূন্য পথে দু-একটি পাখী উড়িয়া যায়। নদীর ওপারে সাঁওতালমের গ্রামে দিনের আলো ম্লান হইয়া আসে। শান্তি গানের পর গান গাহিয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের গান কলিকাতায় বহু লোকে মুখে শুনিয়াছি। কিন্তু শান্তির কণ্ঠে রবীন্দ্র-সংগীতের যে ঢংটি ফুটিয় ওঠে, এমন আর কোথাও পাই না। সে গানের সুরকে কণ্ঠের ভিত লইয়া ঘষিয়া ঘষিয়া কেমন যেন পেলব করিয়া দেয়। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ণ সুরের বুনোট-কার্য শূন্য বাতাসের উপর মেলিয়া ধরিয়া শান্তি গান গাহিয়া চলে। গানের কথা-সুরের অপূর্ব কারুকারিতা যেন রামধনুকের রেখা লইয়া মনের উপর রঙের দাগ কাটতে থাকে মনে হয়, জীবনে যা-কিছু পাই নাই—যার জন্য দুঃখের আর জ্বালাইয়া সুদীর্ঘ বেঘুম রজনী জাগিয়া কাটাইয়াছি, সেই বেদনা কাহিনী বুঝি সুরের উপর মেলিয়া, ধরিয়া ক্ষণিকের তৃপ্তিলাভ বলা যায়। দুই চোখ বহিয়া ধারার পর ধারা বহিতে থাকে। শান্তি অবাক হইয়া গান বন্ধ করে। আবার তাহাকে সাধ্যসাধন করিয়া গান গাওয়াই। বহুকাল পরে এবার বোম্বাই রবীন্দ্র-শতবার্ষিকীতে শান্তি আসিয়াছিল গান গাহিতে। কণ্ঠস্বরটি তার আগের মতই সুন্দর আছে। দুই বন্ধুতে মিলিয়া একদিন প্রায় সারারাত্রি নানা রকমের গানের সুর-বিস্তারের উপর আলোচনা করিলাম। শুধু কি তাই—মাঝে মাঝে আমাদের বিগত জীবনের সেই খোয়াই নদী তীরের কাহিনী কি আসিয়া মনকে দোলা দিল না?

    সেবার শান্তিনিকেতনে আরও দুইটি মেয়ের গান শুনিলাম। খুকু আর নুটুদির গান। মলিন চেহারার মেয়ে খুকু। গান গাহিতে বলিলেই গান গাহে, সাধ্যসাধনা করিতে হয় না। ওর হৃদয়ে যেন কোন ক্রন্দন লুকাইয়া ছিল। গান গাহিতে বলিলেই সেই ক্রন শ্রোতার মনে ঢালিয়া দিয়া সে হয়ত তৃপ্তি পাইত। খুকু আর ইহজগতে নাই। অতি অল্প বয়সে সে তার শ্রোতাদের নিকট হইতে চিরবিদায় গ্রহণ করিয়া হয়ত কোন দেবসভায় মরধামের গান বিতরণ করিতেছে।

    নুটুদির গান শুনিলাম বর্ষামঙ্গলের মহড়ায়। গানের মহড়ায় বাইরের লোক যাওয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু দিনুদাকে (দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর) বলিতেই তিনি সহাস্যে অনুমতি দিলেন। নুটুদির মুখে যাহারা রবীন্দ্রসংগীত না শুনিয়াছেন, তাহাদের দুর্ভাগ্য। গানের কোন কোন স্থানে সুরকে তিনি এমন সরু করিয়া লইতেন যেন তা বোঝা যায় কি যায় না। রবীন্দ্র-জয়ন্তীর সময় কখনো দিলে পরায়ে গোপনে ব্যথার মালা—বিরহ মালা’ গানটি তিনি বড় সুন্দর করিয়া গাহিয়াছিলেন, তেমন আর কোথাও শুনি নাই। নুটুদির বিবাহ হইল বন্ধুবর সুরেন করের সঙ্গে। তাঁর আঁকা ‘সাথী’ ছবিটি জগৎ-বিখ্যাত। সেই ছবি তিনি হাসিমুখে আমার রাখালী’ পুস্তকের কভারে ব্যবহার করিবার অনুমতি দিয়াছিলেন। শুনিলাম সন্তান-সম্ভাবনার সময় নুটুদি মারা গিয়াছেন। সে কালের রবীন্দ্রসংগীত গাহিবার জন্য বোধ হয় এক শান্তিদেব ঘোষই আছে। একদিন রবীন্দ্রনাথ দিনুদাকে বলিতেছেন, শুনিয়াছিলাম, শান্তির উপর একটু বেশি নজর দিস। আমাদের পরে ওই ত আমার গানের ভাণ্ডারী হবে।

    এইভাবে গান শুনি–নিশিকান্ত আর সান্ত্বনার সঙ্গে আড্ডা জমাই সেই বয়সটায় কথার অভাব হয় না। ঘরের কথা, পরের কথা, হাটের কথা, ঘাটের কথা—সমস্ত কথা মিলাইয়া কথার সরিৎসাগর জমাই। শান্তিনিকেতনের শিক্ষকেরা দেখা হইলে হাতজোড় করিয়া অভিবাদন জানান, কুশলপ্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। সবাই আমার উপর তুষ্ট। কোথাও কোন আবিলত নাই। নিশিকান্ত বলে, ‘জসীম তুমি এখানে একটা মাস্টারি নিয়ে থেকে যাও। আমিও কতকটা নিমরাজি হই। ইস্কুল-কলেজ বন্ধ। কবে বিশ্ববিদ্যালয় খুলিবে কে জানে। মন্দ কি! কিছুদিন মাস্টারি করিলে ক্ষতি কি। দুই বন্ধু আমার জন্য দরবার করে।

     

    রবীন্দ্র-জয়ন্তীর পরে কবি কিছুদিন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অবস্থান করেন। এই সময় আমি প্রায়ই কবির সঙ্গে দেখা করিতে যাইতাম। একদিন কবিকে গিয়া বলিলাম, “আমরা আপনাকে মনে মনে কি ভাবে কল্পনা করি তা হয়ত আপনার জানতে ইচ্ছা করে। আপনার উপর নতুন ছন্দে একটি কবিতা লিখেছি। যদি বলেন তো পড়ে শুনাই।”

    কবি বলিলেন, ‘কবিতাটি আমাকে দাও। আমি নিজেই পড়ি।’

    আমি বলিলাম, আমার হাতের লেখা আপনি পড়তে পারবেন না।

    কবি বলিলেন, “তুমি দাও, আমি ঠিক পড়ব।”

    কম্পিত হস্তে তাঁকে কবিতাটি দিলাম। কবি মনে মনে কবিতাটি পড়িতে লাগিলেন। আমার মনে হইল, পড়ায় বিশুদ্ধ উচ্চারণ হইবে না মনে করিয়াই তিনি আমাকে পড়িতে দিলেন না। কারণ, তিনি এতটুকু উচ্চারণ-দোষ সহ্য করিতে পারিতেন না। কবির নিজের নাটকে যাহার পাঠ লইতেন, কবির নিকট সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম উচ্চারণ শিখিতে তাহাদের প্রাণান্ত হইত। কবিতাটি পড়া শেষ হইলে তিনি বলিলেন, ‘বেশ হয়েছে।’

    আমি বলিলাম, ‘কবিতাটিতে ত্রিপদী ছন্দ একটু নতুন ধ্বনিতে রূপান্তরিত করতে চেষ্টা করেছি।’

    তিনি লেখাটিতে কিছুক্ষণ চোখ বুলাইয়া উত্তর করিলেন, ‘তা এটিকে নতুন ছন্দ তুমি বলতে পার।’

    রবীন্দ্রনাথ আমাকে দেখিলেই হিন্দু-মুসলমান সমস্যা লইয়া আলোচনা করিতেন। তিনি বলিতেন, দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে দিলেই যে ঘরে আগুন লাগে, তার কারণ সেই ঘরের মধ্যে বহুকাল আগুন সঞ্চিত ছিল। যাঁরা বলতে চান, আমরা সবাই মিলমিশ হয়ে ছিলুম ভাল, ইংরেজ এসেই আমাদের মধ্যে আগুন ধরিয়ে দিল–তাঁরা সমস্যাটিকে এড়িয়ে যেতে চান।

     

    একদিন বন্দেমাতরম্ গানটি লইয়া কবির সঙ্গে আলোচনা হইল। কবি বলিলেন, বন্দেমাতরম্ গানটি যে ভাবে আছে, তোমরা মুসলমানেরা তার জন্য আপত্তি করতে পার। এ গানে তোমাদের ধর্মমত ক্ষুণ্ণ হওয়ার কারণ আছে।

    এর পরে ‘বন্দেমাতরম্ গান লইয়া হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে খুব বিবোধ চলিতেছিল। কলিকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউটে ‘বন্দেমাতরম্’ গান লইয়া মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে এক প্রতিবাদসভা বসে। সেই সভার কথা শুনিয়া শ্বীমতী হেমপ্রভা মজুমদার সাম্প্রদায়িক মিলনের উপর এক সুন্দর বক্তৃতা করেন। মুসলমান ছাত্রেরা শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁহার বক্তৃতা শোনে এবং তাহাদের প্রতিবাদের বিষয়টিও তাহাকে বুঝাইয়া বলে। সেই সভায় আমি খুব অভিমানের সঙ্গেই বলিয়াছিলাম, আজ ‘বন্দেমাতরম গান নিয়ে আমাদের দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রকাণ্ড বিরোধের উপক্রম হয়েছে। কখন যে এই বিরোধ অগ্নি-দাহনে জ্বলে ওঠে, কেউ বলতে পারে না। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই গান নিয়ে আমার দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। কবি এ কথা স্বীকার করেছিলেন, বন্দেমাতরম্ গানে আপত্তি করবার মুসলমানদের কারণ আছে। কিন্তু আজ জাতি যখন এই ব্যাপার নিয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে, তখন কবি কেন নীরব আছেন? তিনি কেন তার মতামত ব্যক্ত করছেন না?

    আমার বক্তৃতার এই অংশটি কোন পত্রিকায় উদ্ধৃত করিয়া উহার সম্পাদক আমাকে সাম্প্রদায়িক বলিয়া প্রমাণ করিতে ও রবীন্দ্রনাথের বিরাগ উৎপাদন করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন।

    ইহার অল্প দিন পরে কলিকাতায় সর্বভারতীয় জাতীয় মহাসভার কার্যকরী সমিতির অধিবেশন বসে; তখন ‘বন্দেমাতরম্’ গান লইয়া তুমুল আন্দোলন হয়। সেই সময়ে একদিন বন্ধুবর সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলিলাম, রবীন্দ্রনাথ নিজে স্বীকার করেছেন, বন্দেমাতরম গানে মুসলমানদের আপত্তির কারণ আছে। আজ সারা দেশ এই গান নিয়ে বিরাট সাম্প্রদায়িক কলহের সম্মুখীন হচ্ছে। এখন তো কবি একটি কথাও বলছেন না।

    সৌম্যেন্দ্রনাথ বলিলেন, “জহরলাল নেহেরু গানটি রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠিয়েছিলেন। কবির পরামর্শের ফলে এ গানে তোমাদের আপত্তিজনক অংশটি কংগ্রেসের কোন অনুষ্ঠানে আর গীত হবে না”।

    রবীন্দ্র-জয়ন্তীর পর কবি কিছুদিন অসুস্থ হইয়া পড়েন। এই অসুস্থ অবস্থার মধ্যে কবি শিল্পীদলের অভিদন্দন গ্রহণ করেন। অভিনন্দন-সভা ঠাকুরবাড়ির হলঘরে বসিয়াছিল। ‘নন্দলাল প্রমুখ। শিল্পীরা প্রত্যেকে কবিকে এক একখানা করিয়া চিত্র উপহার দিয়াছিলেন। উহার পর কিছুদিনের জন্য কবি আর কোন অনুষ্ঠানে যোগদান করেন নাই। এই সময়ে আমি প্রায়ই কবির সঙ্গে দেখ করিতে যাইতাম। আমাকে দেখিলেই কবি সাম্প্রদায়িক ব্যাপার লইয়া আলোচনা করিতেন। বলিতেন কেন যে মানুষ একের অপরাধের জন্যে অপরকে মারে! ও-দেশের মুসলমানেরা হিন্দুদের মারল, তাই এদেশের হিন্দুরা এখানকার নিরীহ মুসলমানদের মেরে প্রতিবাদ জানাবে এই বর্বর মনোবৃত্তির হাত থেকে দেশ কি ভাবে উদ্ধার পাবে বলতে পার? কী সামান্য ব্যাপার নিয়ে মারামারি হয়—গরু-কোরবানী নিয়ে, মসজিদের সামনে বাজনা নিয়ে। একটা পশুকে রক্ষা করতে মানুষ মানুষকে হত্যা করেছে।”

    এই সব আলোচনা করিতে কবি মাঝে মাঝে বড়ই উত্তেজিত হইয়া উঠিতেন। একদিন আমি কবির সঙ্গে দেখা করিতে যাইতেছি, কবির পুত্র রথীন্দ্রনাথ আমাকে একান্তে ডাকিয়া বলিলেন, এখন বাবার শরীর অসুস্থ। আপনাকে দেখলেই তিনি হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। মাঝে মাঝে তাতে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। অসুস্থ শরীরে এই উত্তেজনা খুবই ক্ষতিকর। আপনি কিছুদিন বাবার সঙ্গে দেখা করবেন না।

    তখনকার মত আমি কবির সঙ্গে দেখা করিলাম না।

    মুসলমানদের প্রতি কবির মনে কিছু ভুল ধারণা ছিল। তিনি সাধারণত হিন্দু পত্রিকাগুলিই পড়িতেন। মুসলমানি পত্রিকার একআধ টুকরা মাঝে মাঝে কবির হাতে পড়িত।

    কবির ভুল ধারণার প্রতিবাদ করিয়া উপযুক্ত কারণ দেখাইলেই কবি তাঁহার ভুল সংশোধন করিয়া লইতেন। কবির মনে একদেশদর্শী হিন্দুত্বের স্থান ছিল না। মুসলমানদের মধ্যে যাঁহারা স্বাধীন মতবাদ লইয়া ধর্ম ও সমাজ-ব্যবস্থার সমালোচনা করিতেন, তাহাদের প্রতি কবির মনে প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল। কিন্তু কবির নিকটে যাঁহারা আসিতেন, কবি শুধু তাহাদিগকেই জানিতেন। এই বয়সে ইহার বেশি খবরাখবর লওয়া কবির পক্ষে সম্ভবও ছিল না।

    একদিন কবি বলিতে লাগিলেন, দেখ, জমিদারির তদারক করতে সাজাদপুরে যেতাম। আমাদের একজন বুড়ো প্রজা ছিল। যৌবনকালে সে অনেক ডাকাতি করেছে। বুড়ো বয়সে সে আর ডাকাতি করতে যেত না। কিন্তু ডাকাতরা তাকে বড়ই মানত। একবার আমাদের এক প্রজা অন্য দেশে নৌকা করে ব্যবসা করতে যায়। ডাকাতের দল এসে নৌকা ঘিরে ধরল। তখন সে আমাদের জমিদারির সেই বুড়ো প্রজার নাম করল। তারা নৌকা ছেড়ে চলে গেল। এই বলে চলে গেল, ও তোমরা অমুক দেশের অমুকের গাঁয়ের লোক—যাও, তোমাদের কোন ভয় নেই। সেই বৃদ্ধ মুসলমান আমাকে বড়ই ভালবাসত। তখন নতুন বয়স। আমি জমিদারির তদারক করতে এসেছি। বুড়ো প্রায় পাঁচশ প্রজা কাছারির সামনে ডেকে নিয়ে এসেছে। আমি বললাম, এত লোক ডেকে এনেছ কেন? সে উত্তর করল, ওরা আপনাকে দেখতে এসেছে। ওরে তোরা দেখ। একবার প্রাণভরে সোনার চাঁদ দেখে নে। আমি দাঁড়িয়ে হাসতে লাগলাম।

    কবি বাংলা কবিতার একটি সংকলন বাহির করিবেন। আমাকে বলিলেন, তোমার সংগ্রহ থেকে কিছু গ্রাম্য গান আমাকে দিও। আমার বইয়ে ছাপাব।

    আমি কতকগুলি গ্রাম্য গান কবিকে দিয়ে আসিলাম। তাহার চার-পাঁচ দিন পর প্রশান্ত মহলানবীশের গৃহে কবির সঙ্গে দেখা করিলাম। শ্রীযুক্ত ও শ্রীমতী মহলানবীশ তখন কবির কাছে ছিলেন। কবি আমাকে দেখিয়া বলিলেন, “ওহে, তোমার সংগ্রহকরা গানগুলি পড়লাম। আমাদের দেশের রসপিপাসুরা ওগুলোর আদর করবে। কিন্তু আমি বইটি সংকলন করছি বিদেশী সাহিত্যিকদের জন্যে। অনুবাদে এগুলির কিছুই থাকবে না। ময়মনসিংহগীতিকা থেকে কিছু নিলাম, আর ক্ষিতিমোহনের সংগ্রহ থেকেও কিছু নেওয়া গেল?

    আমি বলিলাম, ‘ময়মনসিংহ-গীতিকার’ গানগুলি শুধুমাত্র কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বইয়ে পাওয়া যায়। ময়মনসিংহে সাত আট বৎসর গ্রাম হতে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছি, কোথাও এই ধরনের মাজাঘষা সংস্করণের গীতিকা পাওয়া যায় না। গ্রাম-গাঁথার একটা কাঠামো সংগ্রহ করে চন্দ্রকুমার দে তার উপর নানা রচনা-কার্যের বুনট পরিয়ে দীনেশবাবুকে দিয়েছেন। তাই পল্লীর অশিক্ষিত কবিদের নামে চলে যাচ্ছে।

    কবি বলিলেন, কিন্তু ময়মনসিংহ-গীতিকায় কোন কোন জায়গায় এমন সব অংশ আছে যা চন্দ্রকুমার দে’র রচিত বলে মনে হয় না।

    আমি উত্তর করিলাম, এ কথা সত্য। এই অংশগুলি প্রচলিত ছোট ঘোট গ্রাম্য গান। চন্দ্রকুমারবাবু এগুলি সংগ্রহ করে সেই প্রচলিত পল্লীগীতিকার কাঠামোর মধ্যে ভরে দিয়েছেন। ময়মনসিংহগীতিকার সেই অংশগুলিই দেশ-বিদেশের সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তা ছাড়া পল্লীগীতিকার কাহিনীর যে কাঠামোর উপরে এই ধরনের বুনট-কার্য হয়েছে, সেই গল্পাংশেরও একটা মূল্য আছে।

    কবি বলিলেন, আমাদের ক্ষিতিমোহনের সংগ্রহগুলি তো চমৎকার।

    আমি উত্তর করিলাম, ক্ষিতিমোহনবাবুর সংগ্রহগুলি আমি দেখি নাই। প্রবাসীতে ‘বাউল’ নামক প্রবন্ধে চারুবাবু কতকগুলি গ্রাম্য গান প্রকাশ করেছেন। সেগুলি নাকি ক্ষিতিমোহনবাবুর সংগ্রহ হতে নেওয়া। তার থেকে কয়েকটি লাইন আপনাকে শুনাই—

    কমল মেলে কি আঁখি, তার সঙ্গে না দেখি
    তারে অরুণ এসে দিল দোলা রাতের শয়নে,
    আমি মেলুম্ না, মেলুম না নয়ন
    যদি না দেখি তার প্রথম চাওনে।

    আপনি কি বলবেন, এসব লাইন কোন অশিক্ষিত গ্রাম্য বাউলের রচিত হতে পারে। আপনার কবিতার ভাষা ও প্রকাশভঙ্গিমার সঙ্গে যাদের পরিচয় নেই, এমন লাইন তারা রচনা করতে পারে? ক্ষিতিমোহনবাবুর আরও একটি গানের পদ শুনুন–

    ও আমার নিঠুর গরজী,
    তুই মানস-মুকুল ভাজবি আগুনে।

    এই মানস-মুকুল কথাটি কি কোন অশিক্ষিত গ্রাম্য লোক জানে? এই গানটি কি আপনার ‘তোর কেউ পারবি না রে পারবি না ফুল ফোটাতে’ মনে করিয়ে দেয় না?

    কবি খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। তারপর উত্তর করিলেন, তাইত ভাবি, এঁরা যদি আগেই এরূপ লিখে গেলেন, তবে আমাদের পরে আসার কি সার্থকতা থাকল?

    আমি কবিকে বলিলাম, আপনি কি কোন প্রবন্ধে এইসব তথাকথিত গ্রাম-গানগুলির বিষয়ে আপনার অভিমত লিখবেন? আপনি যদি লেখেন, তবে দেশের বড় উপকার হবে। যারা খাঁটি গ্রাম্য-গান সংগ্রহ করেন, তাদের সংগ্রহের আদর হবে।

    কবি উত্তর করিলেন, “দেখ, ক্ষিতিমোহন আমার ওখানে আছে, তার সংগ্রহ-বিষয়ে আমি কিছু বিরুদ্ধ মত দিয়ে তার মনে আঘাত দিতে চাই নে।”

    প্রশান্তবাবু আমাকে বলিলেন, আপনি এ বিষয়ে প্রবন্ধ লেখেন না কেন? আমি বলিলাম, দীনেশবাবু আমার জীবনের সব চাইতে উপকারী বন্ধু। কত ভাবে যে তিনি আমাকে সাহায্য করেছেন তার ইয়ত্তা নাই। আমি যদি এ বিষয়ে প্রবন্ধ লিখি, তিনি বড়ই ব্যথা পাবেন। পূর্বের কথাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমি কবিকে বলিলাম, আপনার সংকলন-পুস্তকে যদি এই সব গান গ্রাম্য-সাহিত্যের নামে চলে যায়, তবে এর পরে যারা খাঁটি গ্রাম-গান সংগ্রহ করবেন, তাদের বড়ই বেগ পেতে হবে। কারণ এই সব সংগ্রহের সঙ্গে প্রচলিত আধুনিক সাহিত্যের মিশ্রণ আছে বলে সাধারণ পাঠকের দৃষ্টি এদিকে আকৃষ্ট হয়। তারা এগুলি পড়ে বলে, দেখ দেখ, অশিক্ষিত গ্রাম্য কবিরা কেমন আধুনিক কবিদের মত লিখেছে। যারা বহু পরিশ্রম করে খাঁটি গ্রাম্য-গান সংগ্রহ করেন, তাদের সংগ্রহ পড়ে বিশেষজ্ঞরা পর্যন্ত বলেন, অমুকের সংগ্রহের চাইতে তোমার সংগ্রহ অনেক নিম্নস্তরের।

    এই সময়ে প্রশান্তবাবু বলিলেন, আচ্ছা, এক কাজ করলে হয় না। আপনি তথাকথিত গ্রাম-গানগুলির বিষয়ে বিস্তৃত প্রবন্ধ লিখে গুরুদেবের নিকট দাখিল করুন। গুরুদেব ওর উপরে মন্তব্য লিখে দিলে লেখাঁটি গুরুদেবের মন্তব্য সহ সীল করে রাখা হবে। এর পর বহু বৎসর পরে প্রয়োজন হলে গুরুদেবের মন্তব্য সহ প্রবন্ধটি সাধারণের দরবারে হাজির করা যাবে।

    এই প্রস্তাবে কবি রাজি হইলেন। ইহার পর নানা কাজের ঝাটে আমি প্রবন্ধটি লিখিয়া কবিকে পাঠাইতে পারি নাই।

    কবির সংকলন-পুস্তক ইহার কিছুদিন পরেই বাহির হয়। এই সংকলনে কবি ময়মনসিংহ-গীতিকা হইতে অংশবিশেষ গ্রহণ করিয়াছেন। ক্ষিতিমোহনবাবুর সংগ্রহ হইতেও কিছু কিছু লইয়াছেন।

    রিপন কলেজে বাংলা ভাষার অধ্যাপকের পদ খালি হইল। এই পদের জন্য আমি দরখাস্ত করি। তখন রিপন কলেজের কার্য-পরিষদের সভাপতি ছিলেন শ্রীযুক্ত জে, চৌধুরী। শুনিতে পাইলাম, রবীন্দ্রনাথ এই পদের জন্য একজনকে সমর্থন করিয়া জে, চৌধুরীর নিকট সুপারিশ পত্র দিয়াছেন। চৌধুরী মহাশয় কলিকাতা ল-রিপাের্টর সম্পাদক ছিলেন হাইকোর্টের বিদায়ী প্রধান বিচারক শ্রদ্ধেয় এফণিভূষণ চক্রবর্তী মহাশয় তখন তরুণ এডভোকেট, শ্রীযুক্ত চৌধুরীর সহকারী। তিনি আমাকে বড়ই ভালবাসিতেন। আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে গ্রাম্য-গান লইয়া আলোচনা করিতেন। রিপন কলেজের এই কাজটি যাহাতে আমার হয়, সেজন্য তিনি অশেষ চেষ্টা করিয়াছিলেন। আমি এম. এ. পাশ করিলাম ১৯৩১ সনে, কিন্তু ১৯৩৭ সন পর্যন্ত কোথাও কোন চাকুরী পাইলাম না। কোনও বাংলার ভাল পদ খালি হইলে সেই পদের সঙ্গে কিছু সংস্কৃত পড়ানোর কাজও জুড়িয়া দেওয়া হইত। সুতরাং কোন গভর্নমেন্ট-কলেজে চাকুরী পাইবার দরখাস্ত করার সুযোগ মিলিত না। বেসরকারী কলেজে বাংলা পড়ানোর পদ খালি হইলে তাহারা অভিজ্ঞ শিক্ষকের জন্য বিজ্ঞাপন দিতেন। শিক্ষাকার্যে অভিজ্ঞতা অর্জন করারও আমি কোন সুযোগ পাইলাম না। তা ছাড়া কোন কলেজের চাকুরীর তদ্বির করার মত আমার কোন অভিভাবকও ছিল না। কিন্তু রিপন কলেজের চাকুরীর জন্য ফণীবাবু ও ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় আমার জন্য বহুভাবে তদ্বির করিয়াছিলেন। একদিন ফণীবাবু আমাকে বলিয়াদিলেন, তুমি যদি রবীন্দ্রনাথের নিকট হইতে শ্বীযুক্ত চৌধুরীর নামে কোন সুপারিশ-পত্ব আনিতে পার, তবে এখানে তোমার চাকুরী হইতে পারে। এই বিষয়ে আমি ধূর্জটিবাবুর সঙ্গে আলাপ করিলাম। তিনি আমাকে বলিলেন, তুমি শান্তিনিকেতনে গিয়া রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা কর। নিশ্চয় তিনি তোমাকে সুপারিশ পত্র দিবেন। আমি শান্তিনিকেতনে রওনা হইলাম।

    রবীন্দ্রনাথ তখন শ্যামলী নামক গৃহে অবস্থান করিতেছিলেন। শিল্পী নন্দলাল মাটি দিয়া কবির জন্য এই সুদৃশ্য গৃহটি নির্মাণ করিয়া দিয়াছিলেন।

    কবি অনেকগুলি কাগজপত্র বিছাইয়া লেখাপড়ার কাজে নিমগ্ন ছিলেন। হাসিয়া সস্নেহে আমাকে গ্রহণ করিলেন। কুশলপ্রশ্নের পর আমি কবিকে আমার আগমনের কারণ বলিলাম। কবি উত্তর করিলেন, দেখ, আমার চিঠিতে কারো কোন কাজ হয় না। তুমি মিছামিছি কেন আমার চিঠির জন্য এতদূর এসেছ? আমি সবিনয়ে উত্তর করিলাম, এই কাজের জন্য আপনি অপরকে সুপারিশপত্র দিয়েছেন। আমার যদি এখানে কাজ না হয় তবে মনে করব, আপনার চিঠির জন্যই এখানে আমার কাজটি হল না।

    কবি আমার কথার কোনই উত্তর দিলেন না। তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিভাষার জন্য কতকগুলি ইংরেজী শব্দের বাংলা তর্জমা করিতেছিলেন। তাহা হইতে দুই একটি শব্দের বাংলা আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন। সৌভাগ্যক্রমে আমি তাহার সঠিক উত্তর দিতে পারিলাম। তখন কৌশলে আমি আবার সেই ব্যক্তিগত পত্রের কথা উল্লেখ করিলাম। কবিকে বলিলাম, অতদূর থেকে আপনার কাছে এসেছি। আপনি সমুদ্র। এখানে এসে আমি শূন্য হাতে ফিরে যাব, এ দুঃখ আমার চির-জীবন থাকবে। কবি একটু হাসিয়া তাঁহার প্রাইভেট সেক্রেটারী অনিল চন্দকে ডাকিয়া বলিলেন, দেখ, মাইল্ড গোছের একটি চিঠি লিখে এনে দাও। ও কিছুতেই ছাড়বে না।

    অনিলবাবু ইংরেজীতে একটি চিঠি লিখিয়া আনিলেন, তাহাতে আমার গুণপনার পরিচয় দিয়া লিখিলেন, আমার উপর যেন সুবিচার করা হয়। যদিও ঐটি ব্যক্তিগত পত্র, তবু এখানে আমার জন্য বিশেষ কোন সুপারিশ করা হইল না। তাই কবিকে ধরিলাম, এখানে বাংলা করে লিখে দিন, জসীমউদ্দীনের যদি এখানে কাজ হয় আমি সুখী হব। কবি হাসিতে হাসিতে তাহাই লিখিয়া দিলেন। রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথও আমার জন্য সুপারিশ করিয়া শ্বীযুক্ত চৌধুরীর নামে একটি ব্যক্তিগত পত্র লিখিয়া দিলেন। সেই পত্র আনিয়া শ্বীযুক্ত চৌধুরী মহাশয়কে দিলাম।

    রিপন কলেজে সেবার আমার চাকুরী হইল না। রবীন্দ্রনাথ আগে যাহাকে ব্যক্তিগত পত্র দিয়াছিলেন, তাহার চাকুরী হইল। শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের পত্রের জন্য তাহার চাকুরী হয় নাই। তাহার চাকুরী হইল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় তাহার স্থান আমার উপরে ছিল বলিয়া। তবে আমার মত সাহিত্যিক খ্যাতি তাহার তখনও হয় নাই। ধুর্জটিপ্রসাদ এবং ফণীবাবুর চেষ্টায় এবং রবীন্দ্রনাথের পত্রের গুণে রিপন কলেজের কর্তৃপক্ষ আমার প্রতি খুবই আকৃষ্ট হইয়াছিলেন। তাঁহারা আমাকে আপাতত রিপন ইস্কুলের একটি মাস্টারী দিতে চাহিলেন এবং বলিলেন, এর পরে নতুন কোন পদ খালি হইলে আপনাকে আমরা কলেজের সামিল করিয়া লইব। আমি তাহা গ্রহণ করি নাই।

    কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সেবার গবেষক নিয়োগ করা হয়। সেটা বোধ হয় ১৯৩২ সন। তখন রবীন্দ্রনাথ বাংলা বিভাগের প্রধান কর্তা। শুনিলাম, পাঁচজনকে নিয়োগ-পত্র দেওয়া হইবে। রবীন্দ্রনাথ তাহার শান্তিনিকেতনের দুইজন ছাত্রের জন্য সুপারিশ করিবেন। বাকি তিনজনের মধ্যে অন্যান্য কর্তাব্যক্তিদের নিজস্ব লোক রহিয়াছে।

    সুতরাং আমার সেখানে সূচ্যগ্ব-প্রবেশেরও আশা নাই। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মুকুটহীন রাজা। আমি গিয়া রবীন্দ্রনাথকে ধরিলাম। গ্রাম্য-গান নিয়ে আমি কিছু কাজ করেছি। গবেষকের কাজটি যদি পাই, আমার সেই অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ করিতে পারি।

    কবি হাসিমুখে আমার জন্য শ্যামাপ্রসাদকে একখানা সুপারিশ-পত্র লিখিয়া দিলেন।

    রবীন্দ্রনাথের পত্রের গুণে এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহৎপ্রাণ মিণ্টো-প্রফেসার ডাঃ প্রমথনাথ ব্যানার্জী ও স্যার হাসান সারওয়ার্দীর চেষ্টায় আমি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-গবেষক নিযুক্ত হইলাম। নিয়োগপত্র পাইয়াই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করিয়া বলিলাম, “আপনার পত্রের জন্যে আমি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ পেয়েছি।”

    কবি বলিলেন, ‘তুমি আমাকে বড়ই আশ্চর্য করে দিলে হে। আমার কাছে কেউ কোন উপকার পেয়ে কোন দিন তা স্বীকার করে না।’

    তখনকার দিনে দেশের সর্বত্র সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াইয়া ছিল। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে তার এতটুকুও প্রভাব বিস্তার করিতে পারে নাই। যখনই যেজন্য তাহার নিকটে গিয়াছি, তিনি হাসিমুখে তাহা করিয়া দিয়াছেন। মুসলমান বলিয়া তিনি আমাকে দূরে সরাইয়া রাখেন নাই। এখানে একটি দৃষ্টান্ত দিব।

    স্যার এফ রহমান সাহেব তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইসচ্যান্সেলার। তিনি আমাকে বলিলেন, রবীন্দ্রনাথ অথবা অন্য কোন নামকরা লোকের কাছ থেকে যদি কোন ব্যক্তিগত পত্র আনতে পার, তবে এখানে বাংলা-বিভাগে তোমার জন্য কাজের চেষ্টা করতে পারি। এম, এ, পাশ করিয়া তখন বহুদিন বেকার অবস্থায় চাকুরীর জন্য ঘুরিয়া বেড়াইতেছি। আমি তৎক্ষণাৎ কলিকাতা চলিয়া আসিলাম।

    কলিকাতা আসিয়া বাংলা-সাহিত্যের দুইজন দিকপালের সঙ্গে দেখা করিলাম। তাঁহারা কেহই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার নিয়োগ সমর্থন করিয়া কোন পত্র দিতে চাহিলেন না। একজন তো স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দিলেন, ‘দেখ, আজকাল সাম্প্রদায়িকতার দিন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শত্রুর অভাব নাই। হয়ত কোন হিন্দু এই কাজের জন্য চেষ্টা করছে। তোমাকে ব্যক্তিগত পত্র দিলে হিন্দু কাগজগুলি আমাকে গাল দিয়ে আস্ত রাখবে না।

    আমার তখন দুঃখে ক্ষোভে কাঁদিতে ইচ্ছা হইল। এরা আমাকে এত ভালবাসেন। আমি বেকার হইয়া চাকরীর জন্য কত ঘুরিয়া বেড়াইতেছি এরা একটা চিঠি দিলেই আমার কাজ হইয়া যাইত। অথচ যে হিন্দু প্রার্থীকে এরা চেনেন না, তারই সমর্থনে আমার ব্যক্তিগত পত্র দিলেন না। একবার ভাবিলাম, রবীন্দ্রনাথের কাছে যাই। তিনি হয়ত আমাকে ব্যক্তিগত পত্র দিবেন। আবার ভাবিলাম, হয়ত তিনিও এদেরই মত আমাকে প্রত্যাখ্যান করিবেন। কী কাজ তাঁহার নিকটে গিয়া!

    স্রোতে-পড়া লোক তৃণের আশাও ছাড়িতে চাহে না। আশার ক্ষীণ সূত্রটি কিছুতেই মন হইতে টুটিতে চাহে না। কে যেন আমাকে ঠেলিয়া শান্তিনিকেতনে লইয়া চলিল।

    সকালবেলা। কবি বারান্দায় বসিয়াছিলেন। পূর্ব গগনে রঙ্গিলা ভোর মেঘে মেঘে তার নক্সার কাজ তখনও বুনট করিয়া চলিয়াছে। সামনের বাগানে পাখির গানে ফুলের রঙে আর সুবাসে আড়াআড়ি চলিয়াছে। সালাম জানাইয়া কবির সামনে গিয়া দাঁড়াইলাম। কুশলপ্রশ্নের উত্তর দিয়া কবিকে আমার আগমনের কথা বলিলাম। কবি তৎক্ষণাৎ তার প্রাইভেট-সেক্রেটারী অমিয় চক্রবর্তী মহাশয়কে আমার জন্য একখানা সুপারিশপত্র লিখিয়া আনিতে নির্দেশ দিলেন। তখন আমি কবিকে সমস্ত কথা খুলিয়া বলিলাম। কলিকাতার দুইজন সাহিত্যের দিকপাল শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক কারণে আমাকে যে সুপারিশ-পত্র দেন নাই, এ কথাও বলিলাম। সমস্ত শুনিয়া কবি মনঃক্ষুণ্ণ হইলেন।

     

    বন্ধুবর অজিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিচের তলায় কয়েকখানি কুঠরী ভাড়া লইয়া আমি প্রায় বৎসর খানেক ঠাকুরবাড়িতে ছিলাম। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ কলিকাতা আসিলে প্রায়ই তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে যাইতাম। তখন কোন দিন কবির সঙ্গে কী আলাপ হইয়াছিল, স্পষ্ট মনে নাই। কয়েকটি টুকরো কথা উজ্জ্বল উপলখণ্ডের মত মনের নদীতে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। তাহা এখানে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখি।

    একদিন কথা প্রসঙ্গে কবি বলিলেন, দেখ, আমার বিষয়ে লোকে যখন তখন যা-কিছু লিখতে পারে। কেউ কোন উচ্চবাচ্য করে না।

    আমি বলিলাম, ‘আপনি কবি, সাহিত্যিক,—আপনাকে নিন্দা করেও সাহিত্য তৈরী হয়। তাই আপনার নিন্দা করা সহজ। কিন্তু একথা নিশ্চয় জানবেন, দেশের শতসহস্র লোক আপনার কবিতা পড়ে আনন্দ পায়—আপনাকে শ্রদ্ধা করে। শ্রদ্ধা অন্তরে অনুভব কববার বস্তু। নিন্দার মত শ্রদ্ধা বাহিরে তত মুখর নয়। আপনাকে যারা শ্রদ্ধা করে আপনি তাদের দেখেন নি।’

    কবি অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, পরে উত্তর করিলেন, দেখ মহাত্মা গান্ধীকে ত কেউ নিন্দা করতে সাহস করে না।

    আমি বিনীতভাবে উত্তর করিলাম, ‘মহাত্মা গান্ধী বিশিষ্ট ব্যক্তি হলেও তাঁকে নিন্দা করলে সাহিত্য তৈরী হয় না। আপনার সঙ্গে আপনার নিন্দুকেরাও কিছুদিন বেঁচে থাকতে চায়। ছুছুন্দরী কাব্যের লেখকের নাম আজ কে মনে রাখত যদি মাইকেলের অমর কাব্যের সঙ্গে এই কাব্য জড়িত না থাকত?

    এই আলোচনার পরে দেশে এমন দিনও আসিয়াছিল, যে জনতা গান্ধীজীকে মহাত্মা না বলিলে ক্ষেপিয়া যাইত, তাহারাই তাহার গায়ে ইষ্টক নিক্ষেপ করিয়াছে—তাহার গাড়ি আক্রমণ করিয়াছে। পরিশেষে সেই জনতার একজনের হাতেই গান্ধীজীকে জীবন পর্যন্ত দিতে হইল।

    ঠাকুর-বাড়িতে থাকিলে এপ্রিল মাসের প্রথম তারিখে আমরা অনেক আজব কাণ্ড করিতাম। এই সুখী পরিবার কোনকিছু উপলক্ষ করিয়া হাসিতামাসার সুযোগ পাইলে তাহা ছাড়িত না। আমার কোন কবিবন্ধুকে ঠাট্টা করিয়া কবিতায় একটি পত্র লিখিয়াছিলাম। ভাবিয়াছিলাম, কোন কৌশলে তাহা বন্ধুবরের পকেটে রাখিয়া আসিব। ঠাকুরবাড়ির একটি ছোট ছেলে ছো মারিয়া সেটা লইয়া গিয়া এনভেলপে ভরিয়া রবীন্দ্রনাথের ঠিকানা লিখিয়া কবিকে দিয়া আসিল। আমি ত ভয়ে বাঁচি না। একে কবিতাটি রচনা হিসেবে একেবারে কাঁচা, তাহা ছাড়া বন্ধুকে লইয়া যে বিদ্রুপ করিয়াছি শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে লইয়া তাহা পারা যায় না। কবি না জানি আমাকে কি বলিবেন? আমার শিল্পীবন্ধু ব্বতীন্দ্রনাথ ঠাকুর গিয়া কবিকে সকল কথা খুলিয়া বলিলেন। কবি আমাকে ডাকাইয়া লইয়া বলিলেন, এতে তুমি এত মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছ কেন? আমি কিছু মনে করি নি, বরঞ্চ বেশ আনন্দ পেয়েছি। তারপর যাহাতে এজন্য আমার মনে লেশমাত্র অনুতাপ না থাকে—কবি সস্নেহে আমার সঙ্গে অনেক গল্প করিলেন। অতি-আধুনিক কবিদের বিষয়ে আলোচনা হইল। আমি বলিলাম, আজকাল একদল অতি-আধুনিক কবির উদয় হয়েছে। এরা বলে, সেই মান্ধাতার আমলের চাঁদ, জোছনা ও মৃগনয়নের উপমা আর চলবে না; নতুন করে উপমা-অলঙ্কার গড়ে নিতে হবে। গদ্যকে এরা কবিতার মত করে সাজায়। তাতে মিল আর ছন্দের আরোপ বাহুল্যমাত্র। এলিয়টের আর এজরা পাউণ্ডের মত করে এরা লিখতে চায়। বলুন ত একজনের মতন করে লিখলে তা কবিতা হবে কেন? কবির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য যদি না থাকল তার প্রকাশে, তাকে কবি বলে স্বীকার করব কেন? দিনে দিনে এদের দল বেড়ে যাচ্ছে। এরা অনেকেই বেশ পড়াশুনো করে। বিশেষ করে ইংরেজী-সাহিত্য। তারই দৌলতে এরা নিজের দলের স্বপক্ষে বেশ জোরাল প্রবন্ধ লেখে।

    কবি বলিলেন, ‘এজন্য চিন্তা করো না। এটা সাময়িক ঘটনা। মেকির আদর বেশী দিন চলে না। একথা জেনো, ভাল লেখকদের সংখ্যা সকল কালেই খুব কম। আর মন্দ লেখকেরা সংখ্যায় যেমন বেশী, শক্তির দাপটে তেমনি অজেয়। কিন্তু কালের মহাপুরুষ চিরকালই সেই অল্পসংখ্যক দুর্বল লেখকদের হাতে জয়পতাকা তুলে দিয়েছেন।’

    আজ বহুদিন পরে মনের অস্পষ্ট স্মৃতি হইতে এইসব কথা লিখিতেছি। উপরের কথাগুলি কবি ঠিক এইভাবেই যে বলিয়াছিলেন, তাহা হলপ করিয়া বলিতে পারি না।

    তখনকার দিনে রবীন্দ্রনাথের গানের তেমন আদর হয় নাই। রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড হইলে দুই-শ আড়াই-শর বেশি বিক্রয় হইত না। একদিন কবির সঙ্গে তার গানের সুরের বিষয়ে আলোচনা হইল। আমি বলিলাম, ‘আজকাল আধুনিক গায়কেরা আপনার গান গাইতে চায় না। আপনার গানের ভিতরে যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কারুকার্য আছে, তা আমাদের অবচেতন মনে প্রভাব বিস্তার করে। সাধারণ গায়কেরা সেই সূক্ষ্ম কারুকার্যের আদর করিতে জানে না। তারা গানের সুরে স্থূল ধরনের কারুকার্য চায়। যা হলে শ্রোতারা বাহবা দিতে পারে। তাই দখতে পাই, আপনার গানের ভাষার অনুকরণে যারা গান লেখে, সেই সব গানে স্থূল ধরনের সুর লাগিয়ে তারা আসর সরগরম করতে চায়। কবি অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, ‘এটাও একটা সাময়িক ব্যাপার। এগুলোর আদর বেশী দিন টিকবে না।’

    একবার কথাপ্রসঙ্গে কবিকে বলিলাম, ‘আপনার কবিতার ভাষায় এমন অপূর্ব ধ্বনিতরঙ্গ তোলে—কোথাও এমন একটি শব্দ আপনি ব্যবহার করেন নি, যেটাকে বদলিয়ে আর একটি বসান যায়। এত লখেছেন, কোন লেখার একটি শব্দও মনে হয় না অস্থানে পড়েছে। আপনার ঐ যে গান–

    গ্রামছাড়া ওই রাঙ্গামাটির পথ
    ওরে, আমার মন ভুলায় রে—

    কী সুন্দর রহস্যলোকে মন উধাও হয়ে যায় শব্দের আর সুরের পাখায়। কিন্তু যেখানটিতে আপনি লিখেছেন,

    সে যে আমায় নিয়ে যায় রে
    নিয়ে যায় কোন চুলায় রে—

    এখানে চুলায় কথাটি শুনতে কল্পনার আকাশখানি যেন মাটিতে পড়ে যায়।’

    কবি কৃত্রিম কোপ প্রকাশ করিয়া বলিলেন, ‘তা চুলোয় বলছি তো হয়েছে কি? কথাটি তোদের বাঙাল দেশে হয়ত তেমন চলে না। অথবা অন্য ভাবে আছে।’

    কবির সঙ্গে তাঁর আরও কোন কোন কবিতার আলোচনা করিতে চাহিয়াছিলাম। কবি আমাকে বলিলেন, যা, এখন যা। আমার অনেক কাজ আছে। আগে তুই প্রফেসর হ, তখন এসব

    তোকে বলব।

    ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ ছাপা হইলে কবিকে পড়িতে দিলাম।

    পড়িয়া তিনি খুব প্রশংসা করিলেন। আমি বলিলাম, “আপনি যদি এই বই-এর বিষয় কিছু লিখে দেন, আমি ধন্য হব”।

    শান্তিনিকেতনে গিয়া কবি পত্র লিখিলেন—‘তোমার সোজন বাদিয়ার ঘাট অতীব প্রশংসার যোগ্য। এ বই যে বাংলার পাঠকসমাজে আদৃত হবে সে বিষয়ে আমার লেশমাত্র সন্দেহ নাই।’

    কবির ঐ ভবিষ্যৎবাণী সার্থক হইয়াছে। বই খুব জনপ্রিয় হইয়াছে। ইউনেস্কো হইতে ইংরাজি অনুবাদও শীঘ্র বাহির হইবে।

    আমার পাশ্ববর্তী গ্রামের একটি মুসলমান চাষী ভাল বাঁশী বাজাইতে জানিত। কতদিন তাকে ডাকিয়া আনিয়া আমাদের পদ্মাতীরের বাড়িরধারে বাঁশঝাড়ে সারারাত জাগিয়া বাঁশী শুনিয়াছি। ঝাড়ের বাঁশ কাটিয়া নিজের ইচ্ছামত ছিদ্র তৈরি করিয়া সে তার হাতের বাঁশী তৈরি করিয়াছিল। হারমোনিয়ামের সা-রে-গা-মা-র সঙ্গে বাঁশীর ছিদ্রগুলির কোনই মিল ছিলনা। কিন্তু বিচ্ছেদ, বারমাসী ও রাখালী সুরের সবখানি মধু বাঁশীতে সে ঢালিয়া দিতে পারিত। গভীর রাত্রিকালে সে যখন বেহুলাসুন্দরীর গান ধরিত, তখন যেন স্পষ্ট দেখিতে পাইতাম, আমাদেরই পদ্মা নদী দিয়া কলার মান্দাসে অভাগিনী বেহুলা লক্ষ্মীন্দরকে লইয়া ভাসিয়া চলিয়াছে।

    নিজের বাড়িতে সে বাঁশী বাজাইতে পারিত না। বাড়ির মেয়েরা বাঁশীর সুরে উদাসী হইয়া যাইবে বলিয়া গ্রামবাসীরা তাহাকে ধরিয়া মার দিত। গভীর রাতে যখন সকলে ঘুমাইয়া পড়িত, তখন সে গ্রাম হইতে বাহিরে আসিয়া মাঠের মধ্যস্থলে বসিরা বাঁশী বাজাইত। তাহার বাঁশীতে ‘জল ভর সুন্দরী কন্যা’ গানটি শুনিয়া কোন যুবতী নারী নাকি একদিন ঘরের বাহির হইয়া আসিয়াছিল।

    এই গুণী লোকটি ছিল আমার আত্মার আত্মীয়। দেশে গিয়া প্রায়ই তাহাকে ডাকিয়া তাহার বাঁশী গুনিতাম। মনে হইল, এমন গুণী লোককে কলিকাতা লইয়া গেলে সেখানকার লোকে নিশ্চয় উহার বাঁশী শুনিয়া তারিফ করিবে।

    কালা মিয়াকে কলিকাতা আনিয়া গ্রামোফোন কোম্পানিগুলিতে অনেক ঘোরাঘুরি করিলাম। কেউ তার বাঁশী রেকর্ড করিতে চাহিল না। নাট্টাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ীকে একদিন তার বাঁশী শুনাইলাম। গুণীজনের সমাদর করিতে তাঁর মত আর কেহ জানিত না। বাঁশী শুনিয়া তিনি মুগ্ধ হইলেন। তার অর্কেস্ট্রাতে কালা মিয়াকে বাজাইবার হুকুম দিলেন। কিন্তু দিলে কি হইবে? অর্কেস্ট্রার বাজিয়েদের সুরের সঙ্গে বাঁশীর সুরের পর্দা মেলেনা। কারণ অর্কেস্ট্রার একটি পদ খালি হইলেই বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনকে আনিয়া বসাইতে পারে, তাই তারা আপদবিদায় হইলে বাঁচে। যদি তারা সময় দিত, এই গ্রাম্য যুবকটিকে স্নেহমমতার সঙ্গে তাহাদের যন্ত্রের সঙ্গে পরিচিত করাইত, সে হয়ত পরিণামে তাহাদের সুরের সঙ্গে সুর মিলাইয়া বাঁশী বাজাইতে পারিত। বাঁশী বাজিয়ে অভিযোগ করিতে লাগিল। শিশিরবাবু বিরক্ত হইরা তাহাকে ছাড়াইয়া দিলেন।

    অবনীন্দ্রনাথকে এই বাঁশী আগেই শুনাইয়াছি। তিনি খুব তারিফ করিয়াছেন। কিন্তু তাহাদের জমিদারী তখন কোর্ট অফ ওয়ার্ডসে যাইতেছে। টাকা-পয়সার দিক দিয়া তিনি কোনই সাহায্যকরিতে পারিবেন না। আগেকার দিন হইলে এককথায় হাজার ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিতেন। ভাবিলাম, রবীন্দ্রনাথকে বাঁশী শুনাইব। যদি তাহার ভাল লাগে, হয়ত তিনি তাকে শান্তিনিকেতনে লইয়া যাইবেন।

    আমার সকল নাট্যের কাণ্ডারী মোহনলালের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া কবিকে এই বাঁশী শুনাইবার এক অভিনব পন্থা আবিষ্কার করিলাম। রবীন্দ্রনাথ তখন থাকিতেন পূবের দোতলায়। অবনীন্দ্রনাথের বাড়ির উত্তরের গাড়ি-বারান্দার দোতালায় কালা মিয়াকে বসাইয়া বাঁশী বাজাইতে বলিলাম। কালা মিয়া বাঁশীতে সুর দিয়া বাজাইয়া চলিল—“রাধা বলে ভাইরে সুবল আমি আর কত বাজাব বাঁশী। আমরা নিচে দাঁড়াইয়া রবীন্দ্রনাথের আনাগোনা লক্ষ্য করিতে লাগিলাম। বাঁশী শুনিয়া কবির ভাবান্তর জানিবার জন্য মোহনলালের দাদামশাই সমরেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আগেই রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছিল। কালা মিয়া আবার বাঁশীতে গান ধরিল :

    জাইত গেল বাইদার সাথে
    জাইত গেল কুল গেল ভাঙল সুখের আশা
    ওরে, রজনী পরভাতের কালে পাখী ছাড়ল বাসা রে—

    বিলম্বিত সুরের মুর্ছনা আকাশ-বাতাস আছড়াইয়া কাঁদিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে আসিয়া বারান্দার উপর দাঁড়াইলেন। কয়েক মিনিট থাকিয়া ঘরে ফিরিয়া গেলেন। সমরেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের ঘর হইতে ফিরিয়া আসিলেন। আমরা জানিতাম, এই বাঁশী শুনিয়া কবি খুবই খুশি হইবেন। সেই কথা শুনিবার জন্য তাঁহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইলাম। সমরেন্দ্রনাথের কাছে শুনিলাম, রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন, দেখ ত কে আমাকে এই সকালবেলা এমন একঘেয়ে করুণ সুরের বাঁশী শুনায়। সকালবেলা কি এই সুর শোনার সময়? এই কথা শুনিয়া মনে মনে খুবই ব্যথা পাইলাম। বুঝিলাম এই বাঁশী শোনার মনোভাব কবির তখন ছিল না। অন্য সময় যদি শুনাইতে পারিতাম, কবি হয়ত বাঁশী পছন্দ করিতেন। কালু মিয়া দেশে ফিরিয়া গেল। কলিকাতার কোন গুণগ্রাহী এই মহাগুণীর আদর করিল না। দেশে গিয়া সে রিক্সাচালকের কাজ করিত। অমানুষিক পরিশ্রম ও অল্প আহারে যক্ষ্মা-রোগগ্রস্ত হইয়া সে চিরকালের মত ঘুমাইয়াছে। তাহার মত অমন মধুর বাঁশীর রব আর কোথাও শুনিতে পাইব না।

    আজ পরিণত বয়সে বুঝিতেছি যে, কবি কোন দিনই এই বাঁশী শুনিয়া আমাদের মতন মুগ্ধ হইতেন না। কবি যখন সাহিত্য আরম্ভ করেন, তখন সমস্ত দেশ পল্লীগানে মুখর ছিল। কালা মিয়ার চাইতে সহস্রগুণের ভাল বাঁশী-বাজিয়ের সুর তিনি শুনিয়াছিলেন। লোক-সাহিত্যের উপর কয়েকটি প্রবন্ধ লেখা ছাড়া তাহাদের সুর বা কৃষ্টি রক্ষা করিতে তিনি বিশেষ কিছুই করেন নাই। ইংরেজ-আগমনের সময় আমাদের বাংলা সাহিত্য ছিল জনসাধারণের। বিদেশি সাহিত্যের ভাবধারা আর প্রকাশ-ভঙ্গিমার উপর পল্লব মেলিয়া নব্য বাঙালিরা যে সাহিত্য তৈরি করিলেন, রবীন্দ্রনাথের হাতে পড়িয়া সে সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যে পরিণত হইল। পরলোকগত চিত্তরঞ্জনের অনুগামীরা ছাড়া সমস্ত দেশ বিস্ময়ে এই মহাস্রষ্টার পায়ে প্রণামাঞ্জলি রচনা করিল। সমস্ত কথা বলিবার সময় এখনো আসে নাই। আর ধান ভানিতে শিবের গীত গাহিয়াই বা কি হইবে। আমি রবীন্দ্রস্মৃতিকথা লিখিতেছি। একবার গ্রাম-গানের বিষয়ে কবির সঙ্গে আলাপ হইল। কবি বলিলেন, “দেখ, তোমাদের গ্রাম্যগানের সুর হুবহু শেখার সুযোগ আমার হয় নি। যা একটু সুরের কাঠামো পেয়েছি, তার সঙ্গে আমার সুর মিশে অন্য একটা কিছু তৈরি হয়েছে।’

    আমি বলিলাম, ‘সেই জন্যই আপনার বাউল-সুরের গানগুলির অনুরূপ সুর আমি কোথাও খুঁজে পাইনে।’

    কবি বলিলেন, ‘তুমি কিছু খাঁটি গ্রাম্য সুর আমার শান্তিনিকেতনের মেয়েদের শিখিয়ে দিও। তাদের কাছ থেকে আমি শুনব।’

    তখন আমার মনে হইয়াছিল, পাছে আমি নিজেই আমার হেড়ে গলায় কবিকে গান শুনাইতে চাহি সেইজন্য কবি আগেভাগে আমাকে সতর্ক করিয়া দিলেন। অভিনয়ে সংগীতে আবৃত্তিতে তিনি সর্বসুন্দর ছিলেন। আর্টের এতটুকু দুর্গতি তিনি সহ্য করিতে পারিতেন না। আজ মনে হইতেছে, তিনি হয়ত সত্যসত্যই গ্রাম্যগানের একটি ক্ষুদ্র দল তাঁর গায়িকাদের নিয়ে পড়তেন। যেমন তিনি ওস্তাদি গান নিয়ে পড়েছিলেন।

    কবি যখম আমার সঙ্গে কথা বলিতেন, মনে হইত, তিনি যেন কোন শিশুর সঙ্গে কথা বলিতেছেন। কখনো তুমি বলিতেন, কখনো তুই বলিতেন। কবির কাছ হইতে যখন ফিরিয়া আসিতাম, মনে হইত কোন মহাকাব্য পাঠ করিয়া এই ক্ষণে উঠিয়া আসিতেছি। সেই মহাকাব্যের সুরলহরী বহুদিন অন্তরকে সুখস্বপ্নে ভরিয়া রাখিত। তার নিকট হইতে আসিলেই মনে হইত, কী যেন অমূল্য সম্পদ পাইয়া ফিরিয়া আসিয়াছি। আপন-পরের জ্ঞান তার থাকিত না। তাঁর ভক্তেরা দিন-রজনী পাহারা দিয়াও কবির নিকটে পর-মানুষের আসা ঠেকাইয়া রাখিতে পারি না। কেহ দেখা করিতে আসিয়া ফিরিয়া গিয়াছে জানিলে কবি বড়ই মনঃক্ষুণ্ণ হইতেন। সেইজন্য তাঁহার ভক্তগোষ্ঠী দিনে দিনে বাড়িত। পুরাতনেরা নূতনকে বাধা দিতে পারিত না। কবির অসুখবিসুখ হইলে তাহার শুভানুধ্যায়ীরা সর্বদা সন্ত্রস্ত থাকিতেন, অভ্যাগত কেহ আসিলে পাছে কবি তাহা জানিয়া ফেলেন। কারণ ডাক্তারের নিষেধ কবির সঙ্গে যেন কেহ দেখা না করে। এত যে ব্যস্ত থাকিতেন তিনি, কিন্তু প্রত্যেকখানা পত্রের উত্তর দিতেন। আমাদের বিবাহের আগে কবিকে নিমন্ত্রণ করিলাম। কবি একটি সুন্দর আশীর্বাদপত্র রচনা করিয়া পাঠাইলেন।

    অনেক সময় কবির কাব্য আর কবিকে ভাবি। আমার মনে হয়, কবির জীবনে কিছু শক্তি আর অর্থের অপচয় ঘটিয়াছে তার শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী পরিগঠনে। এ কাজ কবি না করিলেও অপরে করিতে পারিত। এই দুটো প্রতিষ্ঠান না থাকিলে কবি হয়ত আরও অনেক সাহিত্যিক দান রাখিয়া যাইতেন। সারা পাকভারতে আজ রবীন্দ্রনাথের কোন উত্তরাধিকারী নাই। এমন সাহিত্যপ্রতিভা কোথাও দেখি না যে রবীন্দ্রনাথের ধারেকাছেও যাইতে পারে। বিশ্বভারতী আর শান্তিনিকেতনের কাজে কবির বহু সময় ব্যয় হইয়াছে। সেই সময় হয়ত তিনি তার সমধর্মী সাহিত্যিকদের জন্য দিতে পারিতেন। সমালোচনা করিয়া ভুলত্রুটি দেখাইয়া সংশোধন করিয়া তাহাদিগকে তিনি বড় সাহিত্যিক রূপে গড়িয়া তুলিতে পারিতেন। যেমন করিয়াছিলেন তিনি তাহার প্রথম যৌবনে।

    যাহা হয় নাই, তাহার জন্য দুঃখ করিয়া লাভ নাই।

    কবি চলিয়া গিয়াছেন সুদীর্ঘকাল। বহু ব্যক্তি বহুভাবে কবির সাহচর্য লাভ করিয়াছেন। কবির মৃত্যু নাই একথা সত্য কিন্তু কবির সংস্পর্শে আসার সুযোগ যাহাদের হইয়াছে, তাহাদের মনের শুন্যতা কেহ কোনদিন পূরণ করিতে পারিবে না।

    1 2 3
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবোবা কাহিনী – জসীম উদ্দীন
    Next Article হাসু – জসীম উদ্দীন

    Related Articles

    জসীম উদ্দীন

    এক পয়সার বাঁশী – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    জলের লেখন – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    ধান ক্ষেত – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    নকশী কাঁথার মাঠ – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    রঙিলা নায়ের মাঝি – জসীম উদ্দীন

    August 11, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }