Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    রূপবতী – জসীম উদ্দীন

    জসীম উদ্দীন এক পাতা গল্প42 Mins Read0

    রূপ

    রূপ

    বড় দুটোকে নিয়ে গোড়া থেকেই বাপ-মা যেমন নিশ্চিন্ত, ছোটটাকে নিয়ে তেমনি তাদের ভাবনা। তাদের স্বস্তি আর ভাবনার খবর তিন মেয়েও রাখে। তিন মেয়ের মধ্যে বয়সের ফারাক দেড়-দুবছর করে। বড় মেয়ে রমলা সুন্দরী, মেজ মেয়ে শ্যামলী রূপসী, ছোট মেয়ে কাজল ওদের থেকে বেখাপ্পা রকমের বিপরীত। ছোট মেয়ে কালো, ঢ্যাঙা-নাক মুখ চোখের শ্রীও তেমন নয়, চাল-চলনেও তেমনি কমনীয়তার অভাব। রমলা আর শ্যামলীর বিশ্বাস, ভগবান ওকে হেলে করে পাঠাতে গিয়ে ভুল করে মেয়ে করে পাঠিয়ে বসেছে।

    মাকে ছোটর উদ্দেশ্যে কত সময় দুঃখ করতে শুনেছে, এই মেয়েটা যে কোত্থেকে এলো! আর তার ভাবনাতেই বাপের অনেক তপ্ত নিশ্বাস পড়তে দেখেছে। নতুন। পরিচিতেরা এই তিন মেয়েকে একসঙ্গে দেখে আর সম্পর্কের কথা শুনে সংশয়। কাটানোর জন্য মুখ ফুটে জিজ্ঞাসাই করে বসেছে-ও নিজের বোন তোমাদের?

    এ-রকম প্রশ্ন শুনলে বড় দুই বোন লজ্জা পায় আর যার সম্পর্কে কথা সে আড়ালে গিয়ে কুৎসিত ভেঙচি কাটে।

    ফলে ছেলেবেলা থেকেই ছোট মেয়ে কাজল বড় দুই বোনের ওপর হাড়ে চটা। পিঠোপিঠি তিন বোন, ঝগড়া-ঝাটি ছেড়ে মারামারিও একটু-আধটু লেগে যেত। কিন্তু বড় দুই বোন একত্র হয়েও ছোটর সঙ্গে পেরে উঠত না। ফলে কালী পেত্নী বলে গাল দিয়ে ভ্যা করে কেঁদে ফেলত দুজনেই। মা এসে ওই ছোটকেই সব থেকে বেশি শাসন করতেন, চুলের ঝুঁটি টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চাইতেন। আর একটু বড় হবার পর মা গায়ে অত হাত তুলতেন না, মুখে গালাগাল দিতেন, তোর বাইরেটা যেমন ভেতরটাও তেমনি–কোনদিকে যদি তাকানো যেত!

    ছোটকে নিয়ে বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তা দিনে দিনে বাড়তেই থাকল। পাড়ার বখাটে ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে, লজ্জাসরমের মাথা খেয়ে হাসাহাসি করে কোমর বেঁধে। ঝগড়াও করে। চৌদ্দ ছাড়িয়ে পনেরোয় পা দিল, মারধরের শাসন আর কতদিন চলে? তাছাড়া চেহারা যেমন হোক, ওই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে গায়ে একটু মাংস লেগেছে, এক ধরনের ছাঁদছিরি এসেছে। ফ্রক ছেড়ে মা আগেই শাড়ি ধরিয়েছেন ওকে। দেখলে আঠেরোর কম মনে হয় না বয়েস। মেয়ের নিজেরই একটু সমঝে চলা উচিত–তা না ধিঙ্গিপনা!

    বাবার টাকার জোর কম। বে-সরকারী আপিসের সুপারিনটেনডেন্ট হয়েছেন। –তাও বেশি বয়সে। ভবিষ্যৎ ভেবেই মেয়েদের ভালো করে লেখাপড়া শেখানোর ইচ্ছে ছিল। রমলা আর শ্যামলীর বিয়ে হয়ে গেল বি, এ, পাশ করার আগেই। কিন্তু বাবা মায়ের সে জন্য একটুও খেদ নেই। কুড়ি না পেরুতে রমলার অবিশ্বাস্য ভালো বিয়ে হয়েছে। শিক্ষিত সুপুরুষ ছেলে, বাপ আর কাকার হার্ড-অ্যায়ারের ব্যবসা নিজেদের বাড়ি, গাড়ি। ছেলের বাপ আর কাকা সেধে সম্বন্ধ নিয়ে এলেন একদিন। দাবি-দাওয়ার প্রশ্ন নেই। আগে থাকতে খবর দিয়ে মেয়ে দেখতে এলেন, দেখে দিন। তারিখ ঠিক করার তাগিদ দিয়ে গেলেন।

    ব্যাপার দেখে মেয়েদের বাবা-মা ভেবাচাকা। তাই দেখে আড়াল থেকে শ্যামলী আর কাজল মিটিমিটি হাসে। রমলা ওদের চোখ পাকিয়ে ঠাণ্ডা রাখতে চেষ্টা করে। অর্থাৎ খবরদার, বাবা-মাকে কিছু বলবি না!

    কিছু না বললেও তাঁরা আঁচ করে নিলেন। শ্যামলী আর কাজল ছমাস আগে থেকেই বাবা-মায়ের মুখে এই হাসি দেখার প্রত্যাশায় ছিল। একই প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে আর একই বিল্ডিংয়ের দুই শাখার একদিকে কলেজ, একদিকে স্কুল। বাড়ি এসে এই দুই মেয়েকে দিদি কেন ফিরল না সে-সাফাই অনেক দিন গাইতে হয়েছে বাবা-মায়ের কাছে। বি, এ, পরীক্ষা আসছে, পড়ার চাপ বাড়ছে, দিদি বিনেপয়সায় ছুটির পর প্রোফেসারদের বাড়ি পড়তে যায়, কখনো বা স্পেশাল টিউটোরিয়ালের জন্য কলেজেই আটকে যায়, ইত্যাদি। মেয়ে কলেজ, মেয়ে প্রফেসার, অতএব বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। বড় মেয়ের হঠাৎ পড়াশুনার একাগ্রতা দেখে মনে মনে বরং খুশিই। তাঁরা। সেই মেয়ে বিয়ের পরেই কলেজের সঙ্গে সম্পর্ক হেঁটে দিল সেটাই বিস্ময়। মা বলেছিলেন এত পড়াশুনা করলি, এত কষ্ট করলি, পরীক্ষাটা দিয়েই ফেল না!

    রমলা বলেছে, ভালো লাগে না।

    বড় মেয়ের ভালো লাগা-না-লাগাটা বাবা-মা এখন আর ছোট করে দেখেন না। মা বলেন থাক তা হলে।

    কাজল একটু ঝামটা মেরে বলে বসেছিল, কষ্টের ফল তো পেয়েই গেছে, আবার কেন!

    শ্যামলী সশঙ্ক দৃষ্টিতে ভেঁপো বোনের দিকে তাকিয়েছে। সে ইদানীং দিদিকে বেশ একটু তোয়াজ তোষামোদ করে। রমলা ছোটর কাছেও তা-ই আশা করে। আড়ালে টেনে এনে কাজলকে শাসিয়েছে, তোর বড় বাড় বেড়েছে, না?

    কাজলেরও তেমনি জবাব, যা যা, ওই ছোড়দি তোকে পটে বসিয়ে হাতজোড় করে থাকবেখন, আমাকে চোখ দেখাতে আসিস না!

    চার মাস না যেতে কাজল মায়ের কাছে আর একটা বোস উক্তি করে ফেলেছিল। বলেছিল, ছোড়দিরও শিগগিরই খুব ভালো বিয়ে হয়ে যাবে দেখো!

    মায়ের মনে সংশয়, চোখে ভয়।-তুই কি করে জানলি?

    –দেখে নিও। কাজল আর বিস্তারের ধার ধারে না।

    সেই বিকেলেই শ্যামলী একেবারে আগুন ওর ওপর।-মাকে বলতে গেলি, তোর লজ্জা করে না, হিংসুটে কোথাকার! ভিতরটাও হিংসেয় একেবারে কালি হয়ে আছে, কেমন?

    কাজল পাল্টা রুখে উঠেছে, আছেই তো। বেশ করেছি বলেছি–আমি বাইরে কালো, ভিতরে কালো, আমার সব কালো। তুই তোর ভদ্রলোককে রূপ ধুয়ে জল খাওয়াগে যা।

    আরো মাসকয়েক যেতেই ছোট মেয়ের উক্তির সার বুঝতে কষ্ট হয়নি মায়ের। রমলা প্রায়ই শ্যামলীকে নিজের বাড়িতে ধরে নিয়ে যায়। ছুটি থাকলে দুই-এক দিন আটকেও রাখে। ছোট বোনের চেহারা যেমনই হোক, তাকে অবজ্ঞা করতে দেখে। মায়ের মনে লাগত। কিন্তু বড় মেয়ের আসল উদ্দেশ্যটা বোঝা গেল যখন মাঝে। মাঝে ওর খুড়শ্বশুরের ছেলের এ-বাড়িতে পদার্পণ ঘটতে লাগল। শ্বশুর আর খুড় শ্বশুরের যুক্ত ব্যবসা, তবে একান্নবর্তী পরিবার নয়। জামাই বিমানের মতো, রঞ্জনও ওই ব্যবসার পদস্থ লোক একজন। সেও সুশ্রী, শিক্ষিত-বিমানের থেকে আট-নমাসের

    রমলার কাছে সৌভাগ্যের আভাস পেয়ে আশায় আনন্দে মুখে কথা সরে না। মায়ের। মনে মনে বড় মেয়ের বুদ্ধির কত যে প্রশংসা করেছেন তারপর ঠিক নেই।

    না, আশা এবং আনন্দ ব্যর্থ হয়নি মায়ের। রঞ্জনের সঙ্গে শ্যামলীরও নির্বিঘ্নে বিয়ে হয়ে গেছে। আনন্দের হাট একেবারে।

    তিন মাস না যেতে মা এবার দুই কৃতী জামাইকেই মুরুব্বি ধরেছেন। ছোটর জন্য এবারে একটা ভালো ছেলে দেখে দাও বাবারা–চেহারা যেমনই হোক, তোমরা থাকতে ওর বিয়ে হবে না?

    কাজল মায়ের ওপর রাগে জ্বলছে। বিমান আর রঞ্জন দুজনেই শাশুড়ীকে আশ্বাস দিয়েছে–বিয়ে হবে না কেন, সবে তো হায়ার সেকেণ্ডারি দিল–এত ব্যস্ত হচ্ছেন। কেন?

    শাশুড়ী আড়াল হতেই প্রায় সমবয়সী খুড়তুতো-জাঠতুতো দুই ভাই কাজলের পিছনে লেগেছে। বিমান বলে, হারে রমা, আর তো হাতের মুঠোয় ভাই-টাই নেই আমাদের–এটাকে আমরাই ভাগাভাগি করে নিয়ে নিই, কি বলিস?

    রঞ্জন সায় দেয়, আপত্তি কি, মা যে কেন ওর চেহারার খোঁটা দেন বুঝি না–আমার তো বেশ লাগে।

    কাজল ভেঙচি কেটে চেঁচিয়ে জবাব দেয়, নিজের নিজের বউকে শো কেস-এ সাজিয়ে রেখে দেখে দেখে চোখ জুড়োও গে যাও না–আমার পিছনে কেন!

    এমন গলা ছেড়ে এই গোছের কথা বলে যে দু ভাই-ই চুপ করে যায়। দুবোন ভ্রূকুটি করে তাকায় ছোট বোনের দিকে। ওকে আড়ালে ডেকে ধমকায়, তোকে পছন্দ করে বলেই ও-রকম ঠাট্টা করে, তা বলে তুই যা মুখে আসে তাই বলবি! বাড়িতে সক্কলে কত সমীহ করে ওদের, জানিস?

    -তোরা যে যার পাদোদক ধুয়ে জল খা গে যা, আমার পিছনে লাগতে আসে কেন?

    একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে কাজল অনেক সময় অবাক হয়েছে। বিয়ের আগে পর্যন্ত যে দুভাই হ্যাংলার মতো দিদিদের পিছনে ঘুরেছে, কলেজে এসে হাজির হয়েছে বেহায়ার মতো, চোরের মত লুকিয়ে সিনেমায় নিয়ে গেছে–বিয়ের কিছুদিন না যেতে সেই মানুষদের ভিন্ন মূর্তি-রাশভারী হোমরা-চোমরা মানুষের মতো হাব-ভাব। দিদির না হয় দেড় বছর হতে চলল বিয়ে হয়েছে, বিমানদার মনমেজাজ বুঝে চলে, কিন্তু ছোড়দির তো বিয়ে পাঁচ মাসও হয়নি, এরই মধ্যে রঞ্জনদার কথায় ওঠে বসে, তোয়াজ করে চলে তাকে–আর সর্বদাই ভয়, এই বুঝি বকুনি খেতে হল।

    যাক, কাজলকে নিয়েই এ বাড়ির যা-কিছু অশান্তির সূত্রপাত। দুদুটো মেয়ের অত ভালো বিয়ে হওয়ায় বাবা-মায়ের ওর জন্য আরো বেশি দুশ্চিন্তা। কিন্তু আচার আচরণে মেয়ে যেন আক্রোশবশতই তাদের দুশ্চিন্তা আরো বাড়িয়ে চলেছে।

    …একদিন দুপুরে বাপেরবাড়ি আসার সময় রমলা দেখে মোড়ের ও-ধারে একটা বাবরি-চুল লোকের সঙ্গে কাজল হেসে হেসে কথা কইছে। লোকটাকে এরা সকলেই চেনে। নাম সনৎ ঘোষ, সকলে সোনা ঘোষ বলে ডাকে। কোন এক অ্যামেচার ক্লাবের হয়ে থিয়েটার করে বেড়ায়। সেই থিয়েটারও রমলারা দুই-একটা দেখেছে। টাইপ রোল-এ মন্দ করে না অবশ্য, কিন্তু রমলারা দুচক্ষে দেখতে পারে না ওকে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকত–আর হরদম বিড়ি টানত।

    সিনেমা থিয়েটার দেখার ব্যাপারে তিন বোনের মধ্যে কাজলেরই নেশা বেশি। তা বলে এরকম একটা লোকের সঙ্গে তার বোন রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলবে, হাসাহাসি করবে!

    পিত্তি জ্বলে গেল. রমলার। এসেই মাকে নিয়ে পড়ল। ড্রাইভারও নাকি দেখেছে। আর তাইতে লজ্জায় আরো বেশি মাথা কাটা গেছে রমলার।

    মায়ের বুকে ত্রাস। বললেন, ও আমাদের মুখ পুড়িয়ে ছাড়বে, তোরা কিছু বল

    কাজল বাড়িতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি, বকাবকি। কাজল ব্যাপারখানা বুঝে নিল। সরোষে একবার দিদির দিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। কিন্তু রমলা ছাড়বার পাত্র নয়। ঘরে ধাওয়া করল। বি, এ, পড়ছিস আর এই রুচি তোর, অ্যাঁ? এ-রকম একটা থার্ডক্লাস লোকের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলিস, হাসাহাসি করিস?

    কাজল গম্ভীর শ্লেষে জবাব দিল, তোদের মতো ফার্স্টক্লাস লোক আর কোথায় পাব ব–আমার জুটলে থার্ডক্লাসই জুটবে!

    রমলা ঝলসে উঠল, লজ্জাও করে না মুখ নেড়ে কথা বলতে! তোর জামাইবাবু যদি কোন দিন এই কাণ্ড দেখে, কক্ষণো কোথাও তোর জন্যে চেষ্টা করতে রাজি হবে?

    সঙ্গে সঙ্গে কাজলের ধৈর্য গেল। পাল্টা ঝাজে বলে উঠল, তুই আর তোর বরও এই কাণ্ড করে উতরে গেছিসতোদের বেলায় দোষ নেই কেন? গায়ের চামড়া সাদা বলে আর বিমানদার টাকা আছে বলে?

    রমলা চিৎকার করে উঠেছে, মা–কাজল আমাকে অপমান করছে, আমি আর এ বাড়িতে আসব না বলে দিলাম কিন্তু!

    মা আঁ-হাঁ করে ছুটে এলেন, আর তারপর যা মুখে আসে তাই বলে কাজলকে আর একপ্রস্থ গালাগালি।

    মাসখানেকের মধ্যে এর থেকে দ্বিগুণ হুলুস্থুল বাড়িতে। ছুটির দিনে ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কেটে বিমান আর রঞ্জন সস্ত্রীক সিনেমা দেখতে গেছল। হাফটাইমের আলো জ্বলতে রঞ্জনের চোখে পড়ল, সামনের সস্তার টিকিটের সারিতে একটা লোকের পাশে বসে আছে কাজল। দুজনে হাসছে, গল্প করছে। গায়ে খোঁচা মেরে শ্যামলীকে দেখালো রঞ্জন, শ্যামলী দিদির গা-টিপে সামনের দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ফলে বিমানেরও দেখতে বাকি থাকল না।

    চারজনেই সারাক্ষণ গম্ভীর তারপর। রমলা আর শ্যামলীর ছবি দেখা মাথায় উঠল। সোনী ঘোষকে ওরা দুজনেই চেনে। কিন্তু বিমান আর রঞ্জন জিজ্ঞাসা করতে দুজনেই মাথা নেড়েছে–চেনে না।

    শো ভাঙার পর বিমান আর রঞ্জনের ছোট শালীর জন্য অপেক্ষা করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু রমলা আর শ্যামলীর এত মাথা ধরেছে যে তারা আর এক মুহূর্তও দাঁড়াতে পারছে না। ব্যাপার বুঝেই দুভাই আর গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করল না। বাড়ি ফিরে। ছোট শালীকে নিয়ে গম্ভীর টিকাটিপ্পনী শুরু করল।

    রাত্রিতে একসঙ্গে দুবোনই বাপেরবাড়ি এসে হাজির। বাবাও বাড়িতে তখন। সমাচার শুনে বাবা-মায়ের মাথায় বজ্রাঘাত। তার ওপর রমলা শ্যামলী স্পষ্ট জানিয়ে দিল, এ রকম বিচ্ছিরি ব্যাপার হতে থাকলে তাদের আর বাপেরবাড়ি আসতেই দেবে না।

    ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে পায়ের থেকে চটি খুলে ছোট মেয়েকে মারতে গেছলেন। বাবা। মেয়েরাই অবশ্য আটকেছে। আর মা আঁশবটি দিয়ে কুটতে চেয়েছেন তাকে। ঘেন্নায় ওই আঁস্তাকুড়-মার্কা মুখে থুথু ছিটোতে চেয়েছেন।

    বিমান আর রঞ্জন বাড়ি এলে কাজল এরপর নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করেছে। তারা ডাকা সত্ত্বেও আসেনি। দিদিরা তার ফলেও ভয়ানক অপমান বোধ করেছে।

    বাপেরবাড়ির এই অশান্তির সংসারে দুর্দিন ঘনালো হঠাৎ। বলা নেই, কওয়া নেই, হার্ট-অ্যাটাকে মা হঠাৎ চোখ বুজলেন। বোনেরা তারস্বরে আক্ষেপ করল, কাজলই মা-কে মেরে ফেলল।

    পাঁচ মাস না যেতে বাবাও গাড়িচাপা পড়ে মায়ের পথ ধরলেন। বড় দুই বোন। এবারেও আছাড়ি-বিছাড়ি করে কাঁদল। সেই একই আক্ষেপ। ছোট বোনের চিন্তাতেই বাবা অহরহ অন্যমনস্ক থাকতেন। অতএব এই মৃত্যুর জন্যেও সে-ই দায়ী।

    শোকের ব্যাপার চুকেবুকে যেতে ওই দিদিদের আশ্রয়েই আসতে হল কাজলকে। কর্তব্যবোধে দিদিরাই টেনে নিয়ে এল অবশ্য। কিছুদিন বড়দি রাখল তাকে, কিছুদিন ছোটদি। ওর অবস্থানের ফলে দুই দিদিই স্বামীদের কাছে সংকুচিত। সর্বদাই চাল-চলন সম্পর্কে উপদেশ দেয় বোনকে। আর মেজাজ বুঝে বোনের বিয়ের চেষ্টার অনুরোধ জানায়।

    তারা কখনো চুপ করে থাকে, কখনো বিরক্ত হয়। বলে, সবুর করো, চেষ্টা হচ্ছে, বললেই তো আর বিয়ে হয় না-বোনের রূপ তো জানো!

    পাশের ঘর থেকে বিমানদার এই কথা নিজের কানে শুনেছে কাজল। তার ধারণা, রঞ্জনদাও ছোড়দিকে এই কথাই বলে।

    দিদির ততদিনে একটি ছেলে হয়েছে, আর ছোটদিরও হব-হব করছে। স্বামীদের তারা আরো অনুগত হয়ে পড়েছে। নির্বাক কাজল বাড়িতে দুজনেরই গুরুগম্ভীর ব্যক্তিত্ব অনুভব করে। কাজলের সঙ্গে তারা যে একেবারে কথা বলে না তা নয়। দুভাই একসঙ্গে হলে ঠাট্টাও করে, আমাদের দুজনের মধ্যে সেই ভাগাভাগিই হল দেখছি

    বিমানদা জিজ্ঞাসা করে, পড়াশুনার ইচ্ছে থাকে তো বলো, আবার ব্যবস্থা করে। দিই!

    দিদি উষ্ণ ঝুঁজ দেখায়, আর পড়াশুনায় কাজ নেই, বিয়ের চেষ্টা দেখো।

    রঞ্জন সকলের সামনেই জ্ব-ভঙ্গি করে খুঁটিয়ে দেখে কাজলকে।–তোমরা যা-ই বলো, কাজল দেবীর মধ্যে একটা বলিষ্ঠ ভাব আছে যা তোমাদের নেই ছেলেগুলোর চোখে পড়ে না কেন বুঝি না।

    শ্যামলী হেসে বলে, তোমাকে আর চাটুকারিতা করতে হবে না!

    দুই ভাইয়ের খুব ভাব। তারা একত্র হলেই শুধু এই গোছের একটু-আধটু হাসি-ঠাট্টা হয়।

    এরই মধ্যে একটা কাণ্ড ঘটে গেল একদিন। কাজল তখন রমলার কাছে। বাড়ির ঝি এসে জানালো, একটা লোক মাসিমণির খোঁজ করছে।

    মাসিমণি অর্থাৎ কাজল। বিমান কাজে বেরোয়নি তখনো। সেও শুনল খবরটা। রমলা আর বিমান দুজনেই দরজার বাইরে এসে দেখল কে লোক। দেখামাত্র রমলা চাপা ঝাজে বলে উঠল, তাড়িয়ে দাও! ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দাও!

    অদূরে দাঁড়িয়ে আছে সেই বাবরি-চুল সোনা ঘোষ।

    কিন্তু তাড়ানো বা ঘাড়ধাক্কা দেওয়ার ফুরসত মিলল না। ওদিকের ঘর থেকে তাকে দেখেই কাজল পায়ে পায়ে এগিয়ে গেছে। সামনে এসে দাঁড়াল। পাঁচ সাত মিনিট দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই দুজনের কি কথা হল এদিকের কেউ জানল না। রমলা আর বিমান লোকটাকে বিমর্ষ মুখে চলে যেতে দেখল।

    বিমান জিজ্ঞাসা করল, কে?

    রমলা শুকনো গলায় জবাব দিল, সোনা ঘোষ… বাজে লোক একটা।

    –কি করে?

    –থিয়েটার।

    লোকটা চোখের আড়াল হতেই রাগে গজরাতে গজরাতে বোনের কাছে এলো রমলা।-ও এখানে এসেছে কোন সাহসে? কোন আক্কেলে?

    কাজল মুখ তুলে তার দিকে তাকালো শুধু। দিদির পিছনে বিমানদা দাঁড়িয়ে।

    দিদি আরো অসহিষ্ণু।–আমি জানতে চাই, ও কেন এসেছে এখানে?

    কাজল ঠাণ্ডা জবাব দিল, আমাকে দেখতে।

    এরকম জবাব পাবে রমলা আশা করেনি। রাগে সমস্ত মুখ রক্তবর্ণ। কিন্তু সে ফেটে পড়ার আগেই বিমান জিজ্ঞাসা করল, তোমাকে দেখতে ও কি আরো এখানে এসেছে, না এই প্রথম?–

    কাজল নিরুত্তরে তাকাল শুধু। জবাব দিল না।

    -দেখো কাজল দেবী, বিমানের গলার স্বর আদৌ উঁচু পর্দায় উঠল না, অথচ কঠিন শোনালো, এ বাড়ির ডিসিপ্লিন আর রীতিনীতি একটু অন্যরকম, সেটা এতদিনে তোমার বোঝার কথা–এটা মনে রেখো।

    বিকেলেই ফোন করে শ্যামলীকে আনিয়েছে রমলা। ওদিকে বিমানের মুখে রঞ্জনও খবর শুনছে। আপিসের পর সেও সোজা এখানেই এসেছে। আর তারপর সকলে মিলে কঠিন উপদেশই দিয়েছে কাজলকে।

    কাজল নির্বাক। সে-ও তার একটা বাড়তি অপরাধ যেন। আসলে সে যে সোনা ঘোষকে এখানে আসতে সাফ নিষেধ করে দিয়েছে, সেটা জানার কেউ দরকার বোধ করল না।

    পরদিন দিবানিদ্রা সম্পন্ন করে রমলা কাজলকে দেখতে পেল না। কোথাও না। শ্যামলীকে ফোন করল। সেও আকাশ থেকে পড়ল, অর্থাৎ তার ওখানেও যায় নি।

    দুই-এক দিন নয়, দুই-এক মাস নয়–টানা তিন বছর কেউ আর তার হদিস পেল না।

    .

    কোনো এক অ্যামেচার ক্লাবের অভিনেত্রী কাজল মিত্রর নাম ছড়াতে লাগল একটু একটু করে। তারপর সে-নাম আর দিদিদের ভগ্নীপতিদের কানেও এলো। তারা সাগ্রহে দুই একটা থিয়েটার দেখে এলো। অভিনয় সকলেরই ভালো লেগেছে, কিন্তু সকলেই গম্ভীর।

    বোনেরা খবর সংগ্রহে সচেষ্ট হল।… অ্যামেচার ক্লাবের অভিনেত্রী হলেও ভালো রোজগার করে কাজল মিত্র। কলকাতা এবং কলকাতার বাইরে থেকেও ডাক পড়ে তার।

    আরো এক বছরের মধ্যে ওই নামের চটক চারগুণ বেড়ে গেল। সিনেমা থিয়েটারের পত্র-পত্রিকায় তার ছবি আর খবর বেরুতে লাগল। বড় কাগজের কলা বিভাগগুলোতেও। শহরে সব থেকে বড় পেশাদার নাট-মঞ্চ মোটা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে দু-বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ করেছে তাকে।

    সেই দু বছরে তার তিনটে নাটকের সফল অভিনয় খেল দিদি-ভগ্নীপতিরা। মুগ্ধ হবার মতোই অভিনয় বটে। পেন্টিংয়ের ফলে স্টেজে দমতো রূপসী দেখায়। তাকে। মাঝের ঐতিহাসিক এক নাটকে তো রাজেন্দ্রাণীর ভূমিকায় তারই জয়জয়কার। সেই অভিনয় দেখেও দিদিরা হতবাক। হাবভাব চাউনি চলন বলন সবই মিষ্টি অথচ দৃপ্ত রাজেন্দ্রাণীর মতোই।

    তৃতীয় বছরের শেষেই পত্র-পত্রিকার বিমর্ষ খবর, প্রতিভাসম্পন্না অভিনেত্রী কাজল মিত্রকে পেশাদার নাটমঞ্চ আর চুক্তিবদ্ধ রাখতে সক্ষম হলেন না। অচিরে নিজেই তিনি একটি নিজস্ব প্রতিষ্ঠান চালু করবেন। ইতিমধ্যে চিত্রজগতের দুজন খ্যাতিমান। পরিচালক তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। দুটি বড় ছবিতে কে নায়িকার ভূমিকায় দেখা যাবে। তবে আশার কথা, কাগজের প্রতিনিধিদের তিনি বলেছেন, রঙ্গমঞ্চই তার প্রাণ, এটি তিনি ছাড়বেন না, ছায়াচিত্রের কাজটাই বরং সাময়িক।

    ছোট বড় সব কাগজেই চিত্র এবং নাটমঞ্চের পাতায় কাজল মিত্রর ছবির ছড়াছড়ি। কাজল মিত্র গাড়ি ড্রাইভ করছেন। নীল চশমা পরে-কাগজে এমন ছবিও বেরিয়েছে। আর কাজল মিত্রর নিজস্ব প্রতিষ্ঠান চালু হবার সংবাদও।

    আর নিস্পৃহ থাকা সম্ভব হল না দুই বোনের। পরামর্শ করে এক দুপুরে বাড়ির গাড়ি না নিয়ে ট্যাকসিতে চেপে দুজনে বেরিয়ে পড়ল। সিনেমার কাগজে বাড়ির ঠিকানার হদিস মিলেছে–কিন্তু গাইড হাতড়ে ফোননম্বর পায়নি। অতএব কপাল ঠুকে রওনা হয়েছে।

    শহর থেকে অনেক দূরে ছোট একটা ছিমছাম একতলা বাড়ি। সামনে ছোট একটু বাগান।

    কড়া নাড়তে কাজলই দরজা খুলে দিল। তারপর দুই চক্ষু বিস্ফারিত। মুখে কথা সরে না খানিক।–কি ভাগ্যি কি ভাগ্যি–তোরা! আঁ, আমি জেগে আছি না ঘুমুচ্ছি? আয় আয় আয়

    খুশিতে আটখানা একেবারে। আদর করে তাদের টেনে এনে বসালো। তারপর লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি শুরু করে দিল একেবারে।

    গোড়ায় খানিক দুই বোনেরই বিব্রত মুখ। তারপর রমলা বলল, আর বেশি খাতির দেখাস না, বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনটে বছর-সোজা ভাবিয়েছিস?

    কাজল হাসল একচোট। তারপর বলল, তিন বছর পরে তো আরো তিনটে বছর কেটে গেল, তার মধ্যে তো একটা-বার খবর নিতে এলি না!

    শ্যামলী বলল, আমাদের আসা কি সহজ কথা নাকি, কোন রাজ্যের পারে এসে আছিস–তাছাড়া সেদিন মাত্র তো তোর ঠিকানা জানলাম।

    কাজল হাসছে তাদের দিকে চেয়ে। ঝকঝকে দাঁতের একটু একটু দেখা যাচ্ছে। এমনিই নিঃশব্দ অথচ জীবন্ত হাসি রাজেন্দ্রাণীর ভূমিকায় নাটকেও দেখেছিল দুই বোনের মনে পড়ল। আর মনে হল মেয়েটার সেই চেহারা সেই রং সেই নাক মুখ চোখই আছে–কিন্তু তার মধ্যেই কেমন একটু শ্ৰী এসেছে বেশ যা চোখে পড়েই।

    ফুর্তিতে কাজল নিজের হাতে চা বানালো, খাবার এনে সামনে রাখল, আর গল্প করতে লাগল। কিন্তু দিদিরা অন্য গল্প ছেড়ে শুধু সিনেমা আর থিয়েটার রাজ্যের গল্প শুনতে চায়। কাজলের ওই গল্পে আবার উৎসাহ কম, জিজ্ঞাসা করলে জবাব দেয়।

    অনেকক্ষণ বাদে ওর সিথির দিকে চোখ গেল রমলার। বলল, বিয়ে-থা করলি না এখনো, আর কবে করবি! বয়েস তো সাতাশ গড়ালো!

    কাজল হাসিমুখে সোজা উত্তর দিল, বিয়ে করেছি বলতে পারিস, আবার করিওনি বলতে পারিস। তবে পাকা অনুষ্ঠান এবারে একটা শিগগিরই সেরে ফেলব ভাবছি…নেমন্তন্ন করলে আসবি?

    আগেরটুকু শুনে রমলা আর শ্যামলীর মুখ লাল। কিন্তু জবাব দেবার আগেই বাইরে থেকে আর একজনের পদার্পণ ঘটল। সেই বাবরি-চুল সোনা ঘোষ, পরনে সেই রকমই পাজামা আর টুইলের শার্ট তবে একটু মোটার দিকে ঘেঁষেছে। ওকে দেখে বোনেরা সচকিত।

    সোনা ঘোষ থমকালো একটু। তারপর একগাল হেসে বলল, দিদিরা যে! খবর ভালো?

    রমলা আর শ্যামলী চুপ।

    সোনা ঘোষ কাজলের দিকে ফিরল।–জলপাইগুড়ির সেই পার্টি ঠায় আপিসে বসে আছে, কন্ট্রাকট সই না করে নড়বেই না।

    কাজল ভুরু কুঁচকে ভাবল একটু।–কবে নিতে চায়?

    –এই মাসে হলেই সুবিধে হতো বলছে।

    –উঁহু, এ মাসে হবে না, শুটিং আছে–সামনের মাসে গোড়ার দিকে হতে পারে। সব খরচখরচা বাদ দিয়ে চার হাজার টাকা দিতে রাজি থাকে তো কন্ট্রাকট সই করে। দাও।

    দিদিদের দিকে আর একবার কৌতুক-মাখা চোখ বুলিয়ে সোনা ঘোষ চলে গেল। কাজল আলতো করে জিজ্ঞাসা করল, ভগ্নীপতি পছন্দ হল তোদের?

    ওরা দুজনেই আঁতকে উঠল একেবারে। রমলা বলেই ফেলল, ওই লোফারটাকেই শেষ পর্যন্ত বিয়ে করবি তুই!

    কাজল হাসছে। বলল, লোফারই বটে… গোড়ায় গোড়ায় অভিনয় রপ্ত করতে না পারলে চড়চাপড় পর্যন্ত বসিয়ে দিত, বুঝলি?

    রাগত মুখে শ্যামলী বলল, তোর রুচি আর বদলালো না।

    কাজল হাসছে।–যা বলেছিস, আর এত টাকাপয়সা নাড়াচাড়া করছে তবু রুচি ওই লোফারেরও বদলালো না!…অথচ কতই তো দেখছি, কত রকমের প্রস্তাব নিয়ে কত লোক আসছে–আর কত উদার সব! ভালো কথা, নিজস্ব প্রতিষ্ঠান করব খবরটা কাগজে বেরুবার পর চেকবই পকেটে করে বিমানদা আর রঞ্জনদাও ছোটাছুটি করে এসেছিল। কাজল হাসছে।–আলাদা আলাদা অবশ্য–টাকার দরকার নেই বোঝার পরেও আসার কামাই নেই–হাজার হেক, শালী তো–টান যাবে কোথায়! শেষে এত বেশি আসতে লাগল যে তোদের কথা ভেবে আমিই একদিন নিষেধ করে দিলাম–তোরা ফিরে গিয়ে বেচারাদের ওপর আবার রাগারাগি করিস না!

    কাজল হাসছে। সেই সামান্য দাঁত-চিকানো নিঃশব্দ হাসি। এখন মেক-আপ নেই, পেন্ট নেই, তবু ওই মুখ ওই চাউনি আর ওই হাসি রাজেন্দ্রাণীর মতোই লাগছে।

    রক্তশূন্য পাংশু বিবর্ণ মুখে মেলা ও শ্যামলী যাবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েও সেইটুকু দেখে নিচ্ছে।

    Previous Lesson
    Back to Book

    রহস্য সমগ্র – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

    বিকেলের মৃত্যু

    কাপুরুষ

    ঋণ

    আলোয় ছায়ায়

    সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে

    প্ৰজাপতির মৃত্যু ও পুনর্জন্ম

    কালো বেড়াল, সাদা বেড়াল

    পদক্ষেপ
    রূপ
    মারীচ

    ঈগলের চোখ

    এভারগ্রিন বাংলা লোগো
    Previous Lesson
    Next Lesson

    রূপ

    রহস্য সমগ্র – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়  রূপ

    বেশিদিন নয়। বছর খানেক।

    কীরকম আলাপ?

    জাস্ট হাই, হ্যালো।

    আলাপটা কীভাবে হয়েছিল?

    ঠিক ডিটেলসে মনে নেই। সোশ্যাল কোনও গ্যাদারিং-এ বোধহয়।

    আপনার মেমরি কি খুব খারাপ?

    না তো! এ কথা কেন বলছেন?

    সঞ্জিত এমন একজন লোক যার সঙ্গে আলাপ হওয়াটা ভুলে যাওয়ার মতো ঘটনা নয়।

    আমার সঙ্গে তো কত লোকেরই আলাপ হয়েছে রোজ, সব কি মনে থাকে?

    আপনার স্মৃতিটা একটু জাগিয়ে দিতে পারি কি?

    সেটা কি খুব দরকার?

    দেখুন যদি মনে পড়ে।

    তার দরকার নেই। আমাদের আলাপ হয়েছিল একটা ডিনারে।

    এই তো মনে পড়েছে। ডিনারটা হয়েছিল একটা বিউটি কনটেস্টের পর।

    হ্যাঁ।

    সেই কনটেস্টে আপনিও একজন প্রতিযোগী ছিলেন, তাই না।

    ছিলাম। সেটা কি দোষের কিছু?

    দোষের কথা উঠছে না। শুধু বলছি আপনি একজন কনটেস্ট্যান্ট ছিলেন।

    হ্যাঁ।

    এবং আপনি নম্রতা শা নামে একটা মেয়ের কাছে হেরে যান।

    হ্যাঁ।

    অথচ সেই কনটেস্টে আপনারই বিউটি কুইন হওয়ার কথা। আর হলে আপনি মডেলিং এর একটা খুব লোভনীয় কনট্রাক্ট পেতেন। সেই সঙ্গে হয়তো ফিল্মের রোলও।

    এখন ওসব কথা উঠছে কেন? যা হয়নি তা নিয়ে ভেবে কী হবে।

    ক্যাশ প্রাইজ, সোনার মুকুট এবং উপহারের পরিমাণটাও খুব কম ছিল না।

    আমি এসব নিয়ে ভাবি না।

    আপনি কিন্তু সেই কনটেস্টে রানার আপও হননি। আপনি হয়েছিলেন চতুর্থ বা পঞ্চম।

    হ্যাঁ।

    অথচ সবাই জানত রানার আপ বা বিউটি কুইন কেউই আপনার ধারে কাছে আসার মতো ছিল না।

    বলছি তো, ওসব আমি ভুলে গেছি।

    আপনার কি রাগ হয়নি?

    হয়তো হয়েছিল।

    কার ওপর?

    কারও ওপর নয়। ভাগ্যের ওপর।

    ভাগ্য ছাড়া অন্য কোনও ফ্যাক্টর ছিল না?

    তা আমি কী করে জানব?

    জানেন না?

    না। আমি কিছু জানি না।

    নম্রতা শা-কে আপনি চিনতেন?

    আগে আলাপ ছিল না। কনটেস্টে গিয়ে আলাপ হয়েছিল।

    তার পরিচয় জানেন?

    খুব ভাল করে জানি না। শুনেছি বড়লোকের মেয়ে।

    বড়লোক বললে কিছুই বলা হয় না। নম্রতা শা হল বিমলাপ্রসাদ শার মেয়ে। বাড়ি ইউ পি। বিমলাপ্রসাদ এক্সপোর্ট বিশেষজ্ঞ। খ্রিস্টান এবং চামড়া চালান দিয়ে কোটি কোটি টাকা বছরে আয়।

    ও, তা হবে।

    ওরকম তাচ্ছিল্য প্রকাশ করলেন, তার মানে বিমলাপ্রসাদের টাকাটা আপনাকে বোধহয় ইমপ্রেস করল না।

    অন্যের টাকা আছে, তাতে আমার কী যায় আসে বলুন?

    অবাক হওয়ার ব্যাপারও একটা আছে। শুনবেন?

    আপনি পুলিশের লোক, শোনালে শুনব।

    না মিস মিত্র, আমি জোর করে শোনাতে চাইছি না কিন্তু। তবে শুনলে হয়তো আপনার ধাঁধা কেটে যাবে।

    আমার কোনও ধাঁধা নেই তো! এক বছর আগে একটা বিউটি কনটেস্টে হেরে গিয়েছিলাম তো কী হয়েছে? সেসব নিয়ে কি আমি ভাবি নাকি? কেন যে আপনি সেইসব পুরনো কথা খুঁচিয়ে তুলেছেন।

    আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন?

    না-না, বিরক্ত হব কেন? আসলে আমাকে নিয়ে কথা উঠলে আমার খুব অস্বস্তি হয়।

    কথাটা আপনাকে নিয়ে তো হচ্ছে না। হচ্ছে নম্রতাকে নিয়ে।

    তাকে নিয়েই বা কেন?

    আমি পুলিশের লোক এবং অন ডিউটি। আপনার কি মনে হয় আমি শুধু গালগল্প করতে এসেছি?

    ছিঃ ছিঃ, আমি তাই বললাম বুঝি! আসলে আমি প্রসঙ্গটা ধরতে পারছি না যে!

    প্রসঙ্গটা যাতে আপনি ধরতে পারেন সেইজন্যই তো পুরনো এবং মৃত অতীতকে পুনর্নির্মাণের এই চেষ্টা। নইলে কবর খুঁড়ে কঙ্কাল বের করার লাভ কী বলুন!

    আমি ক্ষমা চাইছি। যা বলছিলেন বলুন।

    আরেঃ ক্ষমা চাইছেন কেন? পুলিশের কাছে ক্ষমা চাইতে নেই। তারা এতই অভদ্র যে ক্ষমা চাইলে ক্ষমা জিনিসটাকেই অপমান করা হয়।

    গার্গী একটু হেসে বলল, আপনাকে অভদ্র বলিনি কিন্তু।

    বলার সময় যায়নি। আমার ভদ্রতার মুখোশ এখনও খুলে ফেলিনি কিনা।

    আমি কিন্তু এবার একটু একটু ভয় পাচ্ছি।

    আগেই ভয় পাবেন না। কিছুটা জানার পর ভয় হলেও হতে পারে।

    জানাটা বিশেষ দরকার কি?

    হ্যাঁ।

    তা হলে বলুন।

    কনটেস্টের দিনটা মনে পড়ে?

    পড়ে।

    জাজেরা প্রত্যেকেই আপনার ফেবারে ছিল সেদিন। আপনি তা বুঝতে পেরেছিলেন?

    না বুঝবার কী!

    তিনজন বিচারকের স্কোরশিটেই আপনার নামের পাশে মোটা মোটা নম্বর জমা হচ্ছিল। হাসছেন যে?

    ভাবছি আপনি এত সব জানলেন কী করে? আমি তো জানি না।

    অনেক পরিশ্রম করে জানতে হয়েছে।

    একটা বাজে ব্যাপারে অনেক সময় নষ্ট করেছেন।

    ব্যাপারটা যদি বাজে বলেই মনে হয়ে থাকে আপনার তা হলে বিউটি কনটেস্টে নাম দিতে গেলেন কেন?

    হুজুগে। আমার এক মামা ইমপ্রেশারিও। তিনিই একরকম জোর করে নামিয়েছিলেন। এই কনটেস্ট থেকে নাকি মিস ইন্ডিয়া কনটেস্টে পাঠানো হয়। আরও অনেক লোভনীয় প্রস্তাব ছিল।

    মাত্র এক বছরের মধ্যেই কি আপনার মোহভঙ্গ হয়ে গেছে?

    হ্যাঁ। আমার আর এসব ব্যাপারে কোনও ইন্টারেস্ট নেই।

    মোহভঙ্গ কীভাবে হল?

    সেটাও কি বলতে হবে?

    কোনও জবরদস্তি তো নেই। ইচ্ছে হলে বলবেন।

    ওই কনটেস্টেই আমার মোহভঙ্গ হয়েছিল।

    আমি একজন পুলিশ, আমার মতামতের হয়তো দাম নেই। তবু বলছি, আপনি চেষ্টা করলেই মিস ইন্ডিয়া হতে পারেন। আপনি তো দারুণ সুন্দরী।

    প্লিজ, আর ওকথা বলবেন না। এখন এই সুন্দরী শব্দটা শুনলে আমার রিপালশন হয়। সুন্দর হওয়ার যে কী ঝামেলা তা তো আপনি বুঝবেন না।

    আপনি আমাকে খুবই অবাক করলেন। মেয়েরা তো কমপ্লিমেন্ট পছন্দই করে।

    আমি করি না। লোভী পুরুষদের অনেক অ্যাডভানসেস আমাকে সহ্য করতে হয়েছে। আমার অভিজ্ঞতা খুব ঘিনঘিনে। এমনকী আমার এক জেঠতুতো দাদা অবধি আমাকে বিয়ে করার জন্য পাগল। এসবের ফলে আমার সৌন্দর্য জিনিসটার ওপরেই আকর্ষণ চলে গেছে। এতটাই চলে গেছে যে, আমি একবার ন্যাড়া হওয়ার জন্য একটা সেলুনে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম।

    বলেন কী?

    গার্গী হাসতে হাসতে বলে, তা হলেই বুঝুন। কিন্তু নাপিতটা আমার প্রস্তাব শুনে হাত গুটিয়ে বলল, আপনার মাথা চেঁছে দিলে আমার হাতে কুষ্ঠ হবে দিদি। কিছুতেই ন্যাড়া করতে রাজি হল না।

    আমার হিসেব মতো আপনার বয়স মাত্র কুড়ি। এই বয়সেই এরকম যোগিনী হয়ে যাওয়ার কথা তো নয় আপনার। আপনি কি একটু পিউরিটান?

    আমার বাবা খুব পিউরিটান। মা আবার ঠিক উলটো। আমি পিউরিটান না হলেও আমার আর ওসব ভাল লাগে না। আপনি যেন কী বলছিলেন শবরবাবু!

    ও হ্যাঁ। আশ্চর্যের বিষয় হল বিমলাপ্রসাদ শার পরিবারও কিন্তু ভীষণ পিউরিটান। ওদের বাড়ির কোনও মেয়ে বিউটি কনটেস্টে নামছে এটা ভাবাই যায় না।

    তবে নম্রতা নামল কেন?

    নম্রতা ইজ রেবেল। কলকাতায় পড়তে এসে খুব অল্প বয়সেই সে একটি বাঙালি ছেলেকে বিয়ে করে। ছেলেটির তেমন কোনও গুণ নেই। তবে ভেরি হ্যান্ডসাম। ওরকম সুপুরুষ খুব কম দেখা যায়। এই বিয়ের ব্যাপারে শা পরিবারে খুব অশান্তি হয়েছিল। ছেলেটি ওদের স্বজাতি তো নয়ই, উপরন্তু বাপে তাড়ানো মায়ে খেদানো ভ্যাগাবন্ড টাইপের। বউয়ের ভরণপোষণের ভার নেওয়ার যোগ্যতা ওর ছিল না।

    এই গল্পটাও কি আমার শোনা দরকার?

    না চাইলে নয়। বলেছি তো শুধু গল্প করতে আমি আসিনি।

    তা হলে বলুন।

    নম্রতা এ ছেলেটাকে বিয়ে করায় শা পরিবার রেগে গেলেও তাদের কিছু করার ছিল না। বিমলাপ্রসাদ মেয়ে-জামাইকে তার কলকাতার বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়িটা দিয়েছিলেন এবং জামাইকে তার অফিসে একটা মোটা মাইনের চাকরিতেও বহাল করেন। ছেলেটার অবশ্য চাকরিতে কোনও মন ছিল না। সারাদিন মদ খেত আর বাড়ির সুইমিং পুলের ধারে বসে থাকত। বিয়েটা অবশ্য সুখের হয়নি। নম্রতার সঙ্গে তার বর বিজিত রায়চৌধুরীর প্রায়ই প্রবল ঝগড়া হত। শোনা যায় মারপিট অবধি গড়াত ব্যাপারটা। অথচ নম্রতা বিজিতকে ডিভোর্স করার কথাও ভাবতে পারত না। লাভ-হেট রিলেশনই হবে বোধহয়। প্রচণ্ড আক্রোশ, আবার প্রচণ্ড ভালবাসা। কিন্তু এর একটা সাইকোলজিক্যাল রিঅ্যাকশনও আছে। নম্রতা অসম্ভব ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকে মাঝে মাঝে। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছেও যেতে হয়েছিল তাকে। বিজিত তার প্রতি ফেথফুল কি না তা নিয়েও সে ভয়ংকর সন্দেহ বাতিকে ভুগত। সুইসাইডাল টেন্ডেন্সিও ছিল। যাই হোক, ছেলেমেয়েদের কাছে ডাকসাইটে বাবা-মাও জব্দ হয়ে যায়। বিমলাপ্রসাদের মতো গোঁড়া, রক্ষণশীল মানুষও মেয়ের এই অবস্থা দেখে সে যখন যা বায়না করত তখনই তা মেটাতেন। বিউটি কনটেস্টে নামার ব্যাপারেও বাবা কোনও আপত্তি তোলেননি। আপনি কিন্তু আর কোনও প্রশ্ন করছেন না।

    আমি শুনছি তো!

    হ্যাঁ। কিন্তু নম্রতা তেমন সুন্দরী না হয়েও বিউটি কনটেস্টে কেন নামতে গেল তা জানার কৌতূহল নেই?

    নম্রতা সুন্দরী নয় বুঝি! আমার তো তা মনে হয়নি! ওর ফিগার খুব ভাল, মুখশ্রীও চমৎকার।

    একটা শ্বাস ফেলে শবর বলে, আপনি সত্যিই একটু অদ্ভুত আছেন। নম্রতা জাস্ট সো সো, বিউটি কনটেস্টে নামবার মতো চটক বা গ্ল্যামার ওর নেই। যাক গে, ও কেন নেমেছিল জানেন? জাস্ট টু মেক বিজিত জেলাস। নম্রতার সব প্রবলেম বিজিতকে নিয়ে। বিজিতকে ও পুরোপুরি গ্রাস করতে চায়। বিজিতের চোখে ও সর্বোত্তমা নারী হয়ে থাকতে চায়। এক ধরনের পাগলাটে অবসেশন। কনটেস্টে জয়ী হওয়া ওর কাছে খুবই জরুরি ব্যাপার ছিল। বিমলাপ্রসাদকে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট সাবধান করে দিয়েছিলেন, ওঁর মেয়ের যা অবস্থা তাতে ইগোতে আঘাত লাগলে ম্যাসিভ নার্ভাস ব্রেকডাউন হতে পারে। সুতরাং বিমলাপ্রসাদ ওঁর মেয়ের হয়ে কলকাঠি নেড়েছিলেন। কনটেস্টের মাঝপথে যখন সবাই বুঝতে পেরেছে যে গার্গী মিত্র নামে মেয়েটি তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে তখনই তিনজন বিচারকের কানে কানে কিছু বলে দেওয়া হল এবং কয়েকটা মুখ আঁটা মোটা খামও হল হাতবদল। বুঝেছেন?

    গার্গী হাসছিল। বলল, বুঝেছি।

    কিন্তু নম্রতা শা বিউটি কুইন হওয়ার পর দর্শকদের মধ্যে থেকে কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। আপনার কি মনে আছে একজন যুবক বিচারকদের পিছন থেকে উঠে চিৎকার করে বলেছিল যে, এটা সম্পূর্ণ জালি ব্যাপার, সাজানো জিনিস, জোচ্চুরি ইত্যাদি। ছেলেটা রেগে জাজদের শিটও কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সিকিউরিটির লোকেরা তাকে ধরে বাইরে নিয়ে যায়।

    হ্যাঁ। একটা গোলমাল হয়েছিল শুনেছি। সেই সময় আমাদের র‍্যাম্প থেকে সরিয়ে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমার খুব লজ্জা করছিল।

    যে ছেলেটা ওরকম রি-অ্যাক্ট করেছিল সে কে জানেন?

    না।

    নম্রতার হাজব্যান্ড বিজিত রায়চৌধুরী।

    তা হবে।

    এবার আমার প্রশ্ন, বিজিতকে কি আপনি চেনেন?

    গার্গী একটু চুপ করে থেকে বলল, একথার জবাব দেওয়া কি খুব জরুরি? নিজস্ব সুত্রে আপনি বোধহয় সব খবরই রাখেন।

    শবর দাশগুপ্ত একটু হাসল, আমি কিন্তু সবজান্তা নই। আমার খবর সবই সেকেন্ড হ্যান্ড। সেগুলো যাচাইয়ের অপেক্ষা রাখে। বিজিতের কথা থাক। সঞ্জিত চৌধুরীর প্রসঙ্গে যদি কিছু প্রশ্ন করি জবাব দেবেন কি?

    গার্গী একটা শ্বাস ফেলে বলে, গোপন করার কিছু তো নেই।

    তাকে আপনি কতটা চেনেন?

    বললাম তো, ওই হ্যালোর বেশি নয়।

    সঞ্জিত একজন ডাক্তার। বেশ ভাল গায়নোকোলজিস্ট। বেহালায় একটা নার্সিং হোম খোলার জন্য চেষ্টা করছে। প্রচুর টাকার দরকার তার। সেদিন বিউটি কনটেস্টে সে ছিল তিনজন বিচারকের একজন। খুব অন্যায়ভাবে তিনজন বিচারকই আপনাকে বঞ্চিত করে নম্রতা শা-কে বিউটি কুইন করে দিয়েছিল বটে, কিন্তু সঞ্জিতের বোধহয় একটু বিবেকদংশন হয়েছিল। কী বলেন?

    হতেই পারে।

    ডিনারে আপনি ছিলেন সঞ্জিতের পাশে। ঠিক তো! এবং সেদিন সঞ্জিত আপনাকে কিছু বলেছিল। কথাগুলো কী তা আমরা হয়তো কোনওদিনই জানতে পারব না, যদি আপনি তা প্রকাশ না করেন। কথাগুলো অবশ্য ইম্পর্ট্যান্ট নয়। ইম্পর্ট্যান্ট হল সঞ্জিতের অ্যাপোচ। অ্যাপ্রোচটা কীরকম ছিল মিস মিত্র?

    গার্গী খুব মিষ্টি করে একটু হাসল। তারপর বলল, উনি আমার ওপর একটু ডাক্তারি করতে চেয়েছিলেন। আমাকে দেখে নাকি ওঁর মনে হয়েছিল আমার কিছু শারীরিক প্রবলেম আছে। উনি ওঁর চেম্বারে যেতে বলেছিলেন।

    আপনি গিয়েছিলেন কি?

    না। তবে উনি মাঝে মাঝে আমাকে ফোন করতেন এবং যেতে বলতেন।

    তবু আপনি যাননি।

    কেন যাব বলুন। আমার কোনও প্রবলেম আছে বলে তো আমার মনে হয়নি।

    তারপর কি উনি উপযাচক হয়ে আপনার কাছে আসেন?

    গার্গী মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ।

    এই বদান্যতা দেখেও আপনি খুশি হননি?

    আমাকে তো এভাবেই বেঁচে থাকতে হয়। যেচে কত লোকই যে আমার উপকার করতে চায়।

    সেই ডিনার পার্টিতে একটা ঘটনা ঘটেছিল। মাতাল বিজিত রায়চৌধুরী ডিনারে আমন্ত্রিত ছিল বটে, কিন্তু তাকে প্রথমে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু শেষ দিকে সে জোর করে ঢোকে এবং প্রচণ্ড চেঁচামেচি করে। সে জাজদের ওপরেও হামলা করেছিল।

    হ্যাঁ, বিশ্রী ব্যাপার।

    সঞ্জিত চৌধুরীর সঙ্গে তার একটা হাতাহাতিও হয়েছিল। সঞ্জিত বিজিতকে বোধহয় ঘুষিটুষি মারে।

    আমি দেখিনি। গণ্ডগোল শুরু হতেই আমি ঘর থেকে পালিয়ে যাই। আমি খুব ভিতু মেয়ে।

    কিন্তু সেইঘুষির রি-অ্যাকশন ভাল হয়নি। বিজিত যে কান্ডই করে থাকুক সে বিমলাপ্রসাদের জামাই। তার গায়ে হাত তোলা বিমলাপ্রসাদ নিশ্চয়ই পছন্দ করেননি। আর নম্রতা বিকেম ফিউরিয়াস। বিজিতকে মারার ফলে নম্রতা এসে বাঘিনির মতো সঞ্জিতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সঞ্জিত প্রচণ্ড রেগে যায়। চিৎকার করে সবাইকে শুনিয়ে কীভাবে নম্রতাকে জেতানো হয়েছে তা প্রকাশ করে দেয়। ইট ওয়াজ আ রিয়েল প্যান্ডোমোনিয়াম।

    হ্যাঁ শুনেছি। সঞ্জিত চৌধুরী আমাকে টেলিফোনে সব বলেছিলেন পরদিন। হি ট্রায়েড টু বি এ হিরো।

    আপনি তার হিরোইজমকে বোধহয় খুব একটা মূল্য দেননি।

    গার্গী ফের মৃদু হেসে বলল, আমি আমার চারদিকে রোজই এত হিরো দেখতে পাই যে এখন আমার তেমন রি-অ্যাকশন হয় না। গতকালও আমাকে দোতলার বারান্দায় দেখতে পেয়ে একজন হিরো তার সাইকেলটা এত জোরে চালাতে লাগল যে, শেষে একটা রিকশার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে রক্তারক্তি কাণ্ড, বেচারা।

    তা হলে কি ধরে নেব ব্যক্তিগত জীবনে আপনার কোনও হিরো নেই?

    কী মনে হয় আপনার পুলিশসাহেব?

    পুলিশরা হৃদয়ের খবর কী করে রাখবে, বলুন? তবে হৃদয় থেকে সেটা যদি খুনোখুনিতে দাঁড়ায় তখন পুলিশকে খবর রাখতে হয়। ইন ফ্যাক্ট পৃথিবীতে হৃদয়ঘটিত খুনোখুনির সংখ্যা খুবই বেশি। আপনি কি তা জানেন?

    না। আমি খবরের কাগজ অত মন দিয়ে পড়ি না।

    ভালই করেন। পৃথিবীতে যত ময়লা আর গাদ আছে খবরের কাগজ তা সযত্নে তুলে সকালবেলায় আমাদের সামনে সাজিয়ে দেয়। যে দেশে খবরের কাগজ নেই সেই দেশের লোক বোধহয় খুবই সুখী। এবার দু’-একটা কথা।

    হ্যাঁ, বলুন।

    সঞ্জিত চৌধুরীকে আপনি তা হলে পাত্তা দেননি, এই তো।

    আমি তো তা বলিনি! পাত্তাটাত্তা নয়, আমি জাস্ট তার চেম্বারে যাইনি।

    সঞ্জিত আপনার সঙ্গে কোথায় দেখা করে?

    এখানে, আমাদের বাড়িতে ও একদিন সকালে এসে হাজির। যে চেয়ারে আপনি বসে আছেন ওখানেই বসেছিলেন তিনি। বড় একজন ডাক্তার এসেছেন শুনে আমার বাবা আর মা-ও তার সঙ্গে এসে কথাটথা বলে যান।

    তারপর?

    তিনি বেশ কথাবার্তা বলতে পারেন। দারুণ স্মার্ট, চেহারাটাও রীতিমতো ভাল।

    সঞ্জিত কী বলতে এসেছিল?

    বিউটি কনটেস্টে আমার হেরে যাওয়া নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করাটা তার মধ্যে ছিল। আর বারবার আমার শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আমার মা বাবাকে বলে যান যেন তারা মেয়েকে একবার তার চেম্বারে পাঠান।

    আপনি বোধহয় তবুও রাজি হননি।

    না। তবে বলেছিলাম প্রয়োজন হলেই যাব।

    একটু ইন্টারাপ্ট করছি। বিজিত রায়চৌধুরী ঠিক কবে আপনাকে অ্যাপ্রোচ করে?

    গার্গী মুখটা নামিয়ে নিল। তারপর ফের মুখটা তুলে বলল, এত খবর যে কে আপনাকে সাপ্লাই করেছে।

    ইনস্টিংক্ট।

    বিজিত এ বাড়িতে হানা দেয়নি, সে একদিন আমাকে ফোন করে। দেখা করতে চায়। আমি বিরক্ত হয়ে বলি যে আমার ইচ্ছে নেই। সে ফোন রেখে দেয়। তবে সে বারবার ফোন করত, রোজ। আমি ফোন রেখে দিতাম। তারপর একদিন একটা বড় কোম্পানির মডেলিং টেস্টের জন্য তাদের এজেন্ট আমাকে ফোন করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়। আমি জানতাম না যে সেটা বিজিতেরই পাতা ফাঁদ। যাই হোক, সেখানে অর্থাৎ সেই এজেন্টের অফিসে বিজিতের সঙ্গে আমার দেখা হয়।

    কী বলেছিল বিজিত?

    কী বলতে পারে বলে আপনার মনে হয়?

    প্রেম ভালবাসার কথা তো!

    পুরুষরা তো তাই বলে। অ্যান্ড হি ওয়াজ ম্যাড অ্যাবাউট দ্যাট। সে পরিষ্কার বলেছিল নম্রতাকে সে ভালবাসে না, সে আমাকে চায়।

    আপনি কী করলেন?

    করুণ হেসে গার্গী বলল, আমার ফের ন্যাড়া হয়ে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল।

    একজন বড় ডাক্তার আর একজন বড়লোকের জামাই। দু’জনেই পাওয়ারফুল এবং দু’জনেই মরিয়া। আপনার বেশ বিপদই গেছে, তাই না?

    নিজের চেহারার জন্য তাই আজকাল আমার লজ্জা হয়।

    কিন্তু দোষটা তো আপনার নয়, সৃষ্টিকর্তার, তাই না? ভাল কথা, আপনি কি মডেলিং এর কন্ট্রাক্টটা পেয়েছিলেন শেষ অবধি?

    হ্যাঁ।

    বিগ অফার?

    হ্যাঁ, মোটামুটি ভাল অফার।

    গত আট মাসে আমার হিসেব মতো আপনি অন্তত আটটা কোম্পানির হয়ে ভিডিও মডেলিং করেছেন। তা ছাড়া খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন, প্রোডাক্ট লেবেল এবং পোস্টারিং তো আছেই। টিভি সিরিয়ালে আপনার মুখ খুব সম্প্রতি দেখা দিতে শুরু করেছে।

    এসব তো আর গোপন খবর না। সবাই জানে।

    ঠিক কথা মিস মিত্র। কিন্তু সবাই যা জানে তার আড়ালে গোপন খবরও কি কিছু তৈরি হয় না?

    ঠিক বুঝতে পারলাম না।

    আপনার হয়তো জানা থাকতেও পারে যে, সেই বিউটি কনটেস্টের তিন মাস পর ডাক্তার সঞ্জিত চৌধুরীর স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। হেপাটাইটিস ই। কীভাবে রোগটা হয়েছিল তা খুবই রহস্যময়। কেউ জানে না। আমিও না। কিন্তু অনেক অনুসন্ধান করে শুধু এটুকু জেনেছি যে, ক্রনিক সর্দি কাশির জন্য তিনি একটা বিদেশি অ্যান্টিজেন ইঞ্জেকশন নিচ্ছিলেন। হতে পারে সেটা থেকে ইনফেকশনটা আসে।

    তো?

    মাথা নেড়ে শবর বলল, ব্যাখ্যা দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। ইট ওয়াজ এ ভেরি ন্যাচারাল ডেথ।

    গার্গী চুপ করে রইল।

    কিছু ভাবছেন?

    ভাবছি আমার কিছু ভাবা উচিত কি না।

    আরে না মিস মিত্র, আপনাকে চিন্তায় ফেলার জন্য কথাটা বলিনি। আসলে ঘটনাগুলিকে একটা পরম্পরায় বা কার্যকারণসূত্রে বিন্যস্ত করা যায় কি না সেটাই দেখছিলাম। কিন্তু না, মিসেস চৌধুরীর আকস্মিক মৃত্যু কোনওভাবেই পচা ইঁদুরের গন্ধ ছড়াচ্ছে না।

    তা হলে কথাটা উঠল কেন?

    পুলিশের মন হল সন্দেহ পিশাচ। বিউটি কনটেস্টের ছয় মাসের মাথায় যে নার্সিংহোমে ডাক্তার চৌধুরী অ্যাটাচড ছিলেন সেখানে তার এক পেশেন্টের মৃত্যু হয় এবং রুগির বাড়ি আর পাড়ার লোক এসে এমন হামলা করে যে নার্সিংহোমে প্রচণ্ড ভাঙচুর হয়েছিল। ডাক্তার চৌধুরীও উন্ডেড হয়েছিলেন।

    জানি। শুনেছিলাম। এটাও কি অস্বাভাবিক ঘটনা?

    না। কলকাতায় এরকম প্রায়ই হয়।

    তা হলে?

    একটা শাস ফেলে শবর বলে, ব্যাপারটা বাইরে থেকে দেখলে একটা আবেগজনিত ঘটনা মাত্র। কিন্তু তদন্ত করতে নেমে দেখা গিয়েছিল হামলাকারীরা কেউই পেশেন্টের বাড়ির বা পাড়ার লোক ছিল না। তারা কারা তাও জানতে পারা যায়নি। তবে যেটুকু জানা গেছে তা হল, এরা ছিল পেশাদার বা ভাড়াটে গুন্ডা।

    কেন যে আমাকে এসব শোনাচ্ছেন।

    শবর একটু হেসে বলল, সঞ্জিত চৌধুরী একজন বড় ডাক্তার। কীভাবে তার স্ত্রীর হেপাটাইটিস ই হয়েছিল তা আমরা না জানলেও তিনি অবশ্যই জানবেন। আমরা শুধু জানতে চাই, কেন হয়েছিল? একটা বিশেষ সময়ে সঞ্জিত চৌধুরীর স্ত্রীর মরাটা কি প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছিল?

    আমি কিছু বুঝতে পারছি না যে!বুঝতে যে আমিও পারছি, তা নয়। শুধু এটুকু বলতে পারি যে, একজন ডাক্তারের পক্ষে কারও মৃত্যুর আয়োজন করা খুব শক্ত ব্যাপার নয়।

    ও মা! আপনি কি বলতে চান ওটা খুন?

    এখনও বলিনি। কারণ প্রমাণ নেই। তবে মোটিভ হয়তো আছে।

    কী মোটিভ?

    ডাক্তার চৌধুরীর সঙ্গে তার স্ত্রীর বিয়ে হয় প্রায় ছয় বছর আগে। তাদের একটি বছর তিনেকের মেয়েও আছে। মোটামুটি একটা সেট পরিবার। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে খুব একটা ঝগড়া বিবাদেরও ব্যাপার ছিল না। কিন্তু তাঁদের মধ্যে হঠাৎ একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং শুরু হয়েছিল বলে বাড়ির দু’জন কাজের লোক আমাদের জানিয়েছে। ভদ্রমহিলা অসুস্থ হয়ে পড়বার আগে নাকি একদিন দু’জনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয় এবং ভদ্রমহিলা নাকি বলেছিলেন, তুমি ডিভোর্স করতে চাও? তোমাকে আমি নাকে খত দিইয়ে ছাড়ব। ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপরেই হঠাৎ অসুখ এবং মৃত্যু।

    শুধু ঝগড়া থেকেই কি কেউ কাউকে খুন করে?

    না ম্যাডাম। দেখতে হবে ঝগড়ার উৎসে কী আছে। সেইটেই আসল। পৃথিবীতে স্বামীরা যখনই স্ত্রীকে হত্যা করেন তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় হত্যার পিছনে আর একটি স্ত্রীলোক রয়েছেন। তবে আগেই বলেছি আমাদের হাতে প্রমাণ নেই। আরও একটা কথা হল, ডাক্তার চৌধুরী একজন গায়নোকোলজিস্ট। মহিলাদের সঙ্গেই তাঁর নিত্য কাজ। সুতরাং মহিলাদের সম্পর্কে একটা ইমিউনিটি তৈরি হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার, যদি কোনও এক্সট্রা অর্ডিনারি মহিলার সঙ্গে ইনভলভমেন্ট ঘটে।

    আমি আবার এক গলা জলে।

    আমিও। ডাক্তার চৌধুরী তার স্ত্রীকে খুন করেছেন এমন সন্দেহ কেউ করেনি। প্রশ্নটাও ওঠেনি। কোনও মহিলার সঙ্গে তার সম্পর্কের কথাও কেউ জানে না।

    তা হলে?

    তা হলেও একটা কথা আছে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর দেখা যায় ডাক্তার চৌধুরী রাত জেগে কাউকে অনেকক্ষণ ধরে লম্বা ফোন করতেন। একজন বিশেষ কাউকে। সে সময়ে তার মুখ চোখ অন্যরকম হয়ে যেত। কিছুদিন পরেই নার্সিংহোমে তার ওপর হামলা হয়। এর মধ্যেও কেউ কোনও কার্যকারণসূত্র খোঁজেনি।

    শুধু আপনিই খুঁজেছেন?

    হ্যাঁ। এই হামলাটা একজন বিশেষ কেউ করেছিল। যার সঙ্গে সেই পেশেন্টের সম্পর্ক ছিল না।

    সে কে?

    সেটা বলা আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ার মতো হয়ে যাবে। তবে এমন কেউ যে পাওয়ারফুল, স্ট্রং মোটিভ আছে এবং বেপরোয়া। এসব ঘটনা যখন ঘটে তখন আমি পিকচারে ছিলাম। কোনও তদন্তের ভারও আমাকে দেওয়া হয়নি এবং এসব ঘটনা যে ঘটছে তাও আমার জানার কথা নয়। আমি এই এত সব ঘটনা জেনেছি মাত্র সাত দিন আগে। যখন আমাকে ডাক্তার সঞ্জিত চৌধুরীর বাই দি বাই, আপনি কি জানেন যে সঞ্জিত চৌধুরী মারা গেছেন?

    অবাক গার্গী তার বিস্ফারিত চোখে চেয়ে বলল, মারা গেছেন! কই, জানি তো!

    চিন্তিত শবর তার মুখের দিকে চেয়ে বলে, জানেন না!

    না।

    ও, আপনি তো আবার খবরের কাগজ পড়েন না।

    না, পড়ি না।

    খবরটা অবশ্য তেমন গুরুত্ব দিয়ে ছাপাও হয়নি। সঞ্জিত চৌধুরী মারা যান একটি মোটর অ্যাক্সিডেন্টে।

    ইস। দুঃখের খবর!

    সব মৃত্যুই দুঃখের। আমি–শবর দাশগুপ্ত কোনও মৃত্যুই পছন্দ করি না।

    কেউই করি না শবরবাবু। কিন্তু তবু মৃত্যু তো আছেই তাই না?

    হ্যাঁ মিস মিত্র, মৃত্যু আছেই আমাদের পেছনে। কত সুন্দর মুখ, কত সুন্দর শরীর, কত প্রতিভা, কত মেধা, কত অতৃপ্ত বাসনা, কত লোভ, কত আসক্তি মৃত্যুতে শেষ হয়ে যায়।

    হ্যাঁ। ব্যাপারটা ট্র্যাজিক, কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নেই।

    শবর মাথা নেড়ে বলে, সঞ্জিত চৌধুরীর মৃত্যু না হলে এত ঘটনা আমার জানা হত না, আপনার সঙ্গেও পরিচয় হত না। মোটর দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলেও তার মধ্যে কিছু অসংগতি থাকায় তদন্তে আমার তলব পড়ে। দুর্ঘটনা ঘটেছিল বেশি রাতে বোধহয় বারোটা বা তারও পরে। ওঁদের নার্সিংহোমে একজন ভি আই পির স্ত্রী ভরতি ছিলেন। রাত বারোটায় হঠাৎ ফোন আসে যে রোগীর অবস্থা খারাপ, ডাক্তার চৌধুরীকে এক্ষুনি যেতে হবে। চৌধুরী তাড়াতাড়ি তার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। নিউ আলিপুরের নির্জন রাস্তায় একটা লোহা বোঝাই ট্রাক তার গাড়িকে প্রায় পিষে দেয়। ইনসিডেন্টালি গাড়িটা পরীক্ষা করে দেখা গেছে তাতে ব্রেক অয়েল ছিল না। অর্থাৎ বিপদের সময় চৌধুরীর গাড়ির ব্রেকও কাজ করেনি। লরিটা তাকে মেরে পালিয়ে যায়।

    ইস রে।

    ঘটনাটা এমনিতে উপেক্ষা করা যেত। কিন্তু তদন্তে নেমে দেখেছি নার্সিংহোম থেকে কোনও ফোন করা হয়নি এবং রুগির অবস্থা সেই রাতে ভালই ছিল।

    ও মা! তা হলে?

    শবর একটু হাসল, আপনি বুদ্ধিমতী, বুঝে নিন।

    ইজ ইট মার্ডার এগেন?

    খুব ছক কষে হিসেব করে চৌধুরীকে মারা হয়েছিল।

    কে মারল তাকে?

    আপনি কিছু অনুমান করতে পারেন?

    না তো! আমি কী করে অনুমান করব?

    মাপ করবেন। ভুল প্রশ্ন করেছি বোধহয়। আচ্ছা আপনার কি কোনও মোবাইল ফোন আছে?

    না তো!

    চৌধুরীর ছিল, বিজিতের ছিল, নম্রতার আছে।

    কেন জিজ্ঞেস করছেন?

    ডাক্তার চৌধুরীর মোবাইল ফোনের রেকর্ড চেক করে দেখা যাচ্ছে উনি একটা নম্বর খুব ফেবার করতেন। সেই নম্বরটা আপনার।

    হ্যাঁ। বলেছি তো, উনি মাঝে মাঝেই আমাকে ফোন করতেন।

    কী বলতেন তিনি আপনাকে?

    খুব ইম্পর্ট্যান্ট কথা কিছু নয়। গল্প করতেন।

    কখনও কখনও রাত বারোটাতেও?

    আমার অত খেয়াল নেই।

    একটু ভেবে বলুন।

    বোধহয় এক-আধবার বেশি রাতেও করেছেন।

    অত রাতে ফোন করার কি বিশেষ কারণ ছিল?

    একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গার্গী বলল, উনি পাগলামি করতেন।

    কীরকম পাগলামি?

    বিয়ে করার কথা বলতেন। অনেক কিছু প্রমিজ করতেন। লোভ দেখাতেন বিদেশে নিয়ে যাওয়ার।

    আপনি কি তাকে প্রশ্রয় দিতেন?

    প্রশ্নই ওঠে না। আমাকে তো ওরকম প্রস্তাব কতজন কতভাবেই দিয়েছে। প্রশ্রয় দেওয়ার কথা উঠছে কেন পুলিশসাহেব?

    কারণ, কোনও কোনও ফোন কলের ডিউরেশন আধঘণ্টা বা তারও বেশি ছিল।

    বললাম তো উনি অনেক কথা বলে যেতে। আমি তার কিছুটা শুনতাম, কিছুটা শুনতাম। তবে অভদ্রতা করে ফোনটা নামিয়েও রাখতে পারতাম না।

    ঠিক আছে মিস মিত্র।

    কোনও দোষ হয়নি তো।

    আরে না, না। দোষের কী আছে। আমি শুধু জেনে নিচ্ছি।

    আর কী জানতে চান?

    বেশি কিছু নয়। আপনি কি জানেন যে, গত পরশু রাতে নষতার বাড়ির সুইমিং পুলে ডুবে বিজিত রায়চৌধুরী মারা গেছে?

    ও মা! সত্যি বলছেন?

    মিস মিত্র, গুজব ছড়ানো আমার কাজ নয়।

    সুইমিং পুলে?

    হ্যাঁ। ঘোর মাতাল অবস্থায়। সাক্ষ্য প্রমাণাদি বলে, নম্রতা আর বিজিত অনেক রাত অবধি সুইমিং পুলের ধারে বসে ছিল। তাদের মধ্যে রোজকার মতোই ঝগড়াঝাটিও হয়। তারপর নম্রতা শুতে চলে যায়। ভোরবেলা বিজিতের মৃতদেহ সুইমিং পুলের মধ্যে পাওয়া যায়।

    স্যাড।

    হ্যাঁ, স্যাড। বিজিত আপনার সঙ্গে টেলিফোনে অনেক কথা বলত, তাই না?

    হ্যাঁ, আমার মডেলিং-এর ব্যাপারে উনি হেল্প করতেন।

    কেন?

    হি হ্যাড এ ক্র্যাশ অন মি। পুরুষদের তো ওইটাই দোষ। আমি তো কিছু লুকোইনি শবরবাবু।

    না। আপনি এ পর্যন্ত তেমন কিছু লুকোননি। লুকোবার দরকারও আপনার নেই। আপনি এই কুড়ি বছর বয়সেই পুরুষদের সম্পর্কে বেশ হতাশ হয়ে পড়েছেন দেখছি।

    একটু হতাশা তো হতেই পারে, তাই না?

    হ্যাঁ। তা তো ঠিকই। ডাক্তার চৌধুরী যদি তার স্ত্রীকে খুন করে থাকেন তবে তার পেছনে তার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল, নার্সিংহোমে হামলা করে মারধর যে করেছিল তারও একটা বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। হয়তো ডাক্তার চৌধুরীকে ভয় দেখিয়ে নিরস্ত করার জন্য। ডাক্তার চৌধুরী নিরস্ত হননি। ফলে তাকে খুন করার প্রয়োজন দেখা দিল। যে খুনটা করেছিল তারও একটা উদ্দেশ্য ছিল। সে হয়তো বিশেষ একজনকে খুশি ও নিষ্কণ্টক করার জন্য; হয়তো তারই অনুরোধে চৌধুরীকে খুন করায়। দ্বিতীয় লোকটা পাওয়ারফুল, প্রচুর টাকার মালিক, পিছনে শাঁসালো শশুর।

    আপনি কি বিজিতের কথা বলছেন?

    অনুমান মাত্র। সত্যি কি না কে বলবে?

    আমার অবশ্য অনুমান হল নম্রতা একদিন জানতে পারে যে তার স্বামী বিজিত কোনও বিশেষ একজনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। আমার সন্দেহ যার প্রেমে সে পড়েছিল সেই নম্রতাকে জানিয়ে দেয়। না জানালে বিজিত তার জীবন বিষময় করে দিত। ক্রমশ বিজিত নানা লোভনীয় কন্ট্রাক্ট তাকে দিয়ে ফেলছিল। ওই জাল কেটেনা বেরোতে পারলে মেয়েটির রক্ষে ছিল না। আর আপনি জানেন নম্রতা কেমন মেয়ে। পজেটিভ, রাগী, খেয়ালি, জেলাস এবং ক্রুয়েল। বিজিত তার একার জিনিস। বিজিতের সামান্য বেচাল সে সহ্য করতে পারে না।

    দৃপ্ত মুখে গার্গী বলে ওঠে, মিস্টার দাশগুপ্ত, আপনি কি এসব নোংরা ঘটনায় আমাকে জড়াতে চাইছেন?

    শবর দাশগুপ্ত একদৃষ্টে কিছুক্ষণ গার্গী মিত্রের দিকে চেয়ে রইল। গার্গীর চোখ ধীরে ধীরে নেমে গেল কোলের ওপর।

    শবর মৃদু হেসে বলে, আপনাকে দেবীপ্রতিমার মতো দেখাচ্ছে। না, আপনার দুশ্চিন্তা করার মতো কিছু নেই। শুধু বলি, আমার কল্পনাশক্তি একটা ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করছে। সুইমিং পুলের ধারে হতচেতন মাতাল বিজিত বসে আছে। অনেক রাত। অন্ধকারে দ্রুত পায়ে একটি ছিপছিপে মেয়ে তার কাছে এল। মেয়েটি নম্রতা। সম্ভবত মদের সঙ্গে ঘুমের ওষুধও দেওয়া হয়েছিল বিজিতকে। নম্রতা তাকে সুইমিংপুলে চেয়ারসুদ্ধ ফেলে দেয়। তারপরে জলে নেমে মায়াভরে বিজিতের মাথাটা জলের নীচে চেপে ধরে রাখে কিছুক্ষণ। তারপর ঘরে ফিরে যায়। ইট ওয়াজ অ্যাজ ইজি অ্যাজ দ্যাট।

    তা হলে আপনার তো নম্রতার কাছেই যাওয়া উচিত। তাকেই তো অ্যারেস্ট করার কথা আপনার।

    হাত তুলে শবর বলে, ধীরে, মিস মিত্র, ধীরে। এখনও বিজিতের অটোপসি রিপোর্ট আমার হাতে আসেনি। কোনও সাক্ষী নেই, প্রমাণ নেই। তার ওপর বিমলাপ্রসাদের মেয়ের টাকা আর কানেকশানের জোর এত বেশি যে, সামান্য পুলিশের পক্ষে তাকে ফাঁসানো প্রায় অসম্ভব। সম্ভবত তাকে ধরলেও বেনিফিট অব ডাউট-এ মুক্তি পেয়ে যাবে। কারণ, বিজিতের মৃত্যুটা খুন না অ্যাকসিডেন্ট সেটাই তো বিরাট প্রশ্ন। সুইমিং পুল তার প্রিয় জায়গা ছিল, সে মাতাল ছিল, অ্যাকসিডেন্ট তো হতেই পারে।

    কেন যে আমার কাছে এলেন।

    শুধু এই কথাটা জানাতে যে এইসব ঘটনার কোথাও আপনি নেই। আপনি সম্পূর্ণ নিষ্কলঙ্ক। দেবীপ্রতিমার মতোই দেখাচ্ছে আপনাকে।

    কেন একথা বলছেন? আমার যে কেমন লাগছে।

    কেমন লাগছে মিস মিত্র? খারাপ। কিন্তু এসব ঘটনার একটা ভাল দিকও তো আছে। বিউটি কনটেস্টের তিনজন অসাধু বিচারকের একজন অন্তত চরম শাস্তি পেয়েছে। অন্যায়ভাবে যে আপনাকে হারিয়ে বিউটি কুইন হয়েছিল সে নিজের হাতে তার প্রিয়তম পুরুষটিকে খুন করে উন্মাদের মতো দেওয়ালে মাথা ঠুকে প্রলাপ বকছে। এ তো প্রকৃতিরই প্রতিশোধে–তাই না? আপনি যদি সেই প্রক্রিয়াটাকে একটুখানি সাহায্য করেই থাকেন তা হলেও ইন্ডিয়ান পেনাল কোড আপনাকে ছুঁতেও পারবে না। অভিনন্দন মিস মিত্র, অভিনন্দন।

    গার্গী মিত্র হঠাৎ দু’হাতে তার মুখ চাপা দিল।

    আমি চলি মিস মিত্র। আপনি বরং একটু কাঁদুন। কাঁদলে মন হালকা হয়ে যায়।

    1 2 3 4 5
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসকিনা – জসীম উদ্দীন
    Next Article রাখালী – জসীম উদ্দীন

    Related Articles

    জসীম উদ্দীন

    এক পয়সার বাঁশী – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    জলের লেখন – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    ধান ক্ষেত – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    নকশী কাঁথার মাঠ – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে – জসীম উদ্দীন

    August 12, 2025
    জসীম উদ্দীন

    রঙিলা নায়ের মাঝি – জসীম উদ্দীন

    August 11, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }