Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শেষ বিকেলের মেয়ে – জহির রায়হান

    জহির রায়হান এক পাতা গল্প115 Mins Read0

    ০১. শেষ বিকেলের মেয়ে

    শেষ বিকেলের মেয়ে

    আকাশের রঙ বুঝি বারবার বদলায়। কখনো নীল। কখনো হলুদ। কখনো আবার টকটকে লাল। মাঝে মাঝে যখন সাদা কালো মেঘগুলো ইতি-উতি ছড়িয়ে থাকে আর সোনালি সুর্যের আভা ঈষৎ বাঁকা হয়ে সহস্ৰ মেঘের গায়ে লুটিয়ে পড়ে তখন মনে হয়, এর রঙ একটি নয়, অনেক।

    এখন আকাশের কোন রঙ নেই।

    আছে বৃষ্টি।

    একটানা বর্ষণ।

    সেই সকাল থেকে শুরু হয়েছে। তবু থামবার কোন লক্ষণ নেই। রাস্তায় এক হাঁটু পানি জমে গেছে। অতি সাবধানে হাঁটতে গিয়েও ডুবন্ত পাথর-নুড়ির সঙ্গে বারিকয়েক ধাক্কা খেয়েছে কাসেদ। আরেকটু হলে একটা সরু নর্দমায় পিছলে পড়তো সে। গায়ের কাপড়টা ভিজে চুপসে গেছে। মাথার চুলগুলো বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরছে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে যখন বাসায় এসে পৌঁছলো কাসেদ, তখন জোরে বাতাস বইতে শুরু করেছে।

    বোধ হয় ঝড় উঠবে আজ।

    প্ৰচণ্ড ঝড়।

    ভেজান দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে কাসেদ দেখলো, ছোট্ট একখানা পিঁড়ির ওপরে বসে চুলোয় আঁচ দিচ্ছে নাহার, মা তসবিহ হাতে পাশে দাঁড়িয়ে কি নিয়ে যেন আলাপ করছেন ওর সঙ্গে।

    ভেতরে আসতে অনুযোগভরা কণ্ঠে মা বললেন, দেখো, ভিজে কি অবস্থা হয়েছে দেখো। কি দরকার ছিলো। এই বৃষ্টিতে বেরুবার?

    কাসেদ কোন উত্তর দেবার আগেই মা আবার বললেন, ঠাণ্ডা লেগে তুমি একদিন মারা যাবে। এই বলে দিলাম দেখো, তুমি একদিন বৃষ্টিতে ভিজেই মারা যাবে।

    কেন মিছেমিছি চিন্তা করছে মা। ভেজাটা আমার গা স’য়া হয়ে গেছে। দেখো কিছু হবে না।

    না হবে না। যেদিন অসুখ করবে। সেদিন টের পাবে। সহসা কি মনে পড়তে খানিকক্ষণ চুপ থেকে মা শুধোলেন, ছাতাটা করেছে কি শুনি? তাইতো মা, ছাতাটা! কাসেদ ইতস্ততঃ গলায় জবাব দিল, ওটা সেদিন অফিস থেকে এক ভদ্রলোক নিয়ে গেছেন, তার কাছ থেকে আর আনা হয় নি।

    যা ভেবেছিলাম, নাহারের দিকে এক নজর তাকিয়ে নিয়ে মা বিরক্তির সঙ্গে বললেন, তোর দিন যাবে কি করে আমায় বলতো? আজি এটা, কাল সেটা তুই শুধু মানুষকে বিলোতে থাকিবি। রাজত্বি থাকতো না হয় বুঝতাম। টানাটানির সংসার।

    নিজের ঘরে এসে ভেজা কাপড়গুলো দড়ির ওপর ঝুলিয়ে রাখলো কাসেদ। আলনা থেকে একটা গেঞ্জি টেনে নিয়ে পরলো। তারপর উনুনের পাশে এসে বললো, বিলোচ্ছি কে বললো মা, ছাতাটা ভদ্রলোক কিছুক্ষণের জন্য চাইলেন। তাই দিলাম। ওটা তো চিরকালের জন্য দেই নি, কাল আবার চেয়ে নিয়ে আসব।

    মা এই অবসরে তসবিহ গুণছিলেন আর মনে মনে কি যেন পড়ছিলেন। তিনি। থেমে বললেন, আনবি যে তা আমি জানি। ক’দিন কাঁটা জিনিসি দিয়ে তুই ফেরত এনেছিস শুনি? এইতো, গেলো শীতে তোর বাবার কম্বলটা যে নিয়ে কোন এক বন্ধুকে দিলি, আর কি হলো?

    কি আর হবে মা। একদিন সে নিজেই এসে ফেরত দিয়ে যাবে।

    হ্যাঁ, দিয়ে যেতে ওর বয়ে গেছে। অমন জিনিস কেউ পেলে আর হাতছাড়া করে? লোকটাকে তুমি শুধু শুধু সন্দেহ করছে মা। ও বড় ভালো লোক। হাতজোড়া উনুনের উপর ছড়িয়ে দিলো কাসেদ। একটু গরম হয়ে নিতে চায় সে। মা বললেন, তুই তো দুনিয়া শুদ্ধ লোককে ভালো বলিস। আজ পর্যন্ত একটা লোককে খারাপ বলতে শুনলাম না। সেদিন মুদী এসে যাচ্ছে-তা’ গালাগাল দিয়ে গেলো, তাকে একটা কথা বলেছিলি তুই?

    মা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন ছেলের দিকে।

    কাসেদ নীরবে আগুন পোহাতে লাগলো।

    নাহার এতক্ষণে একটা কথাও বলে নি। চুপচাপ মা-ছেলের ঝগড়া দেখছিলো। সহসা উনুন থেকে মুখখানা তুলে আস্তে করে বললো, তোমার নামাজের সময় হয়ে গেলো মা। মা বললেন, তাই তো! বলে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন তিনি। চুলোর ওপরে চালগুলো ততক্ষণে ফুটতে শুরু করেছে। ঢাকনিটা তুলে পানির পরিমাণটা দেখে নিলো নাহার।

    কাসেদ তখনও চুপ করে আছে।

    নীরবে কি যেন ভাবছে সে।

    নাহার এক সময় বললো, জাহানারা এসে আজ অনেকক্ষণ বসেছিলেন।

    কখন এসেছিল সে? গলাটা যেন সহসা কেঁপে উঠলো তার। নাহার মৃদু গলায় বললো, সকাল বেলা।

    কিছু কি বলে গেছে তোমায়? কাসেদের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।

    নাহার বললো, না, একখানা চিঠি রেখে গেছে।

    চিঠিটা কোথায়?

    আপনার টেবিলের ওপর রাখা আছে। ঘাড় নিচু করে আবার আপনি কাজে মন দিল নাহার। চোখ জোড়া তুলে এক নজর কাসেদের দিকে তাকালে সে হয়তো দেখতে পেতো সারা মুখ তার লাল হয়ে গেছে।

    উনুনের উপর থেকে হাতখানা সরিয়ে এনে পরীক্ষণে উঠে দাঁড়ালো কাসেদ। দ্রুতপায়ে নিজের কামরায় এসে টেবিলের দিকে তাকালো সে। চিঠিখানা একটা বইয়ের নিচে চাপা। দিয়ে রাখা। মুহুর্তে অনেকগুলো প্রশ্ন এসে ভিড় জমালো। চিঠিতে কি লিখেছে জাহানারা? আর কেনই বা এসে এতক্ষণ বসেছিলো সে? কাল বিকেলে নবাবপুরে দেখা হয়েছিলো ওর সঙ্গে। অনেকক্ষণ কথাও বলেছিলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। ভোর না হতে আবার সে বাসায় আসলো কেন? বাসায় অবশ্য প্ৰায় আসে জাহানারা? কাসেদ না থাকলে মায়ের সাথে বসে। বসে গল্প করে। কথা বলে। খামের ভিতর থেকে কাগজের টুকরোটা বের করে নিয়ে আগ্রহের সঙ্গে পড়লো কাসেদ।

    জাহানারা লিখেছে–

    অনেকক্ষণ বসেও আপনাকে না পেয়ে অবশেষে চলে যাচ্ছি। বিশেষ প্রয়োজন ছিলো।

    সময় করে একবার বাসায় আসবেন কিন্তু। আপনাকে আমার বড় দরকার।

    চিঠিটা বারিকয়েক পড়লো কাসেদ। বিশেষ করে শেষের লাইনটা। সেখানে যেন একটু অন্তরঙ্গতার ছোয়া রয়েছে। আন্তরিকতার স্পর্শ। কাগজটা আবার ভঁাজ করে বইয়ের মধ্যে রেখে দিল সে। তারপর নীরবে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো।

    বাইরে এখনাে কুপকূপ বৃষ্টি পড়ছে।

    সরু গলিটায় একটা মানুষও নেই।

    সবাই ঘরে খিল এঁটে ঘুমোবার আয়োজন করছে এখন। কিম্বা, বিছানায় বসে বসে গল্প করছে, রূপকথার গল্প।

    কাসেদ ভবলো আকাশটা পরিষ্কার হয়ে গেলে এখনই সে জাহানারাদের ওখানে যেতে পারতো। প্রয়োজনটা জেনে নেয়া যেতো। ওর কাছ থেকে। নইলে রাতটা বড় উৎকণ্ঠায় কাটবে।

    কেন যেতে লিখেছে জাহানারা?

    জানালার পাশ থেকে সরে এসে বিছানায় বসলো কাসেদ।

    ওর মনে এখন রঙের ছোয়া লেগেছে। দু’চোখে স্বপ্নের আবির ছড়িয়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে।

    একদিন জাহানারাকে বিয়ে করবে। কাসেদ।

    অর্থের প্রতি তার লোভ নেই। একগাদা টাকা আর অনেকগুলো দাসীবাদীর স্বপ্নও সে দেখে না।

    ছোট্ট একটা বাড়ি থাকবে তার, শহর নয়, শহরতলীতে, যেখানে লাল কাকরের রাস্তা আছে আর আছে নীল সবুজের সমারোহ। মাঝে মাঝে দু’পায়ে কাঁকর মাড়িয়ে বেড়াতে বেরুবে ওরা।

    সকাল কিম্বা সন্ধ্যায়। রাস্তায় লোকজনের ভিড় থাকবে না। নিরালা পথে মন খুলে গল্প করবে ওরা, কথা বলবে।

    আজকের বিকালটা বড় সুন্দর, তাই না?

    কালও এমনটি ছিলো।

    চিরকাল যদি এমনটি থাকে?

    তাহলে বড় একঘেয়ে লাগবে। সহসা শব্দ করে হেসে উঠবে জাহানারা। হয়তো বলবে, একটানা সুখ আমি চাই না, মাঝে মাঝে দুঃখেরও প্রয়োজন আছে; নইলে সুখের মূল্য বুঝবো কেমন করে?

    ওরা কথা বলবে।

    আরো অনেক কথা।

    কখনো কানে কানে, কখনো মনে মনে, কখনো নীরবে।

    তারপর রাত নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাসায় ফিরে আসবে ওরা।

    সামনের বাঁকানো বারান্দায় বেতের টেবিলের ওপর দু’কাপ চা রাখা। গরম চায়ের উত্তাপ যেন বার বার দেহকে স্পর্শ করছে এসে।

    বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দেবে ওরা। কি ভাবছো?

    কিছু না।

    আমার কি মনে হচ্ছে জানো?

    কি?

    তোমার কপালে যদি একটা তারার টিপ পরিয়ে দিতে পারতাম।

    কাসেদ লক্ষ্যও করেনি কখন নাহার এসে বিছানার পাশে দাঁড়িয়েছে।

    ওর হাতের চুড়ির শব্দে সহসা যেন সন্বিত ফিরে পেলো সে।

    নাহার বললো, উঠুন চাদরটা ভালো করে বিছিয়ে দিই।

    ও। সরে এসে টেবিলের সামনে বসলো কাসেদ।

    এলোমেলো চাদরটা তুলে নিয়ে ভালো করে বিছিয়ে দিচ্ছে নাহার। ছিপছিপে দেহ ময়লা রঙ আর মিষ্টি চেহারার নাতিদীর্ঘ মেয়েটি বড় কম কথা বলে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি কথাও কোন সময় মুখ দিয়ে বেরুবে না। তার। আচ্ছা নাহার, ও এখানে কতক্ষণ বসেছিল?

    কে? নাহার অবাক চোখে তাকালো।

    কাসেদ অপ্ৰস্তৃত স্বরে বললো, জাহানারার কথা বলছি।

    নাহার অস্পষ্ট গলায় বললো, অনেকক্ষণ!

    অনেকক্ষণ! কাসেদ চুপ করে গেলো?

    পাশের ঘর থেকে মায়ের কোরান শরীফ পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। টেনে টেনে সুর করে পড়ছেন তিনি। রোজ পড়েন। সকালে, দুপুরে আর রাতে। মাসে একবার করে কোরান শরীফ খতম করা চাই, নাইলে উনি শান্তি পান না। রাতে ভাল করে ঘুমও হয় না তাঁর।

    মাঝে মাঝে কাসেদ বলে, মা, এত পুণ্য দিয়ে তুমি করবে কি শুনি?

    মা হেসে জবাব দেন, একি শুধু আমার নিজের জন্যে-রে, তোদের জন্যে নয়? বলতে গিয়ে সহসা মায়ের মুখখানা স্নান হয়ে আসে। হয়তো মৃত স্বামীর কথা সে মুহুর্তে মনে পড়ে তাঁর। বাবা ছিলেন একেবারে উল্টো মেরুর মানুষ। ভুলেও কোনদিন ধর্ম-কর্মের ধার ধারতেন না তিনি। একবেলা নামাজ কিম্বা একটা রোজাও কখনো রাখেন নি।

    মা কিছু বলতে গেলে উল্টো ধমকে উঠতেন, বলতেন ওসব বাজে কাজে সময় ব্যয় করার ধৈৰ্য আমার নেই।

    মা আহত হতেন। কিন্তু সাহস করে আর কিছু বলতেন না।

    বাবা মারা গেছেন, আজ কতদিন। আজও রাত জেগে মা বাবার জন্যে প্রার্থনা করেন। কান্নাকাটি করেন। খোদার কাছে। বলেন, ওকে তুমি মাফ করে দিও খোদা, ওর সব অপরাধ তুমি ক্ষমা করে দিও।

    চারপাশে তাকিয়ে দেখলো, বিছানাটা সুন্দর করে বিছিয়ে দিয়ে নাহার ইতিমধ্যে সরে পড়েছে। রান্নাঘরে বোধ হয় খাওয়ার আয়োজন করছে সে এখন।

    বইটা খুলে জাহানারার চিঠিখানা আবার বের করলো কাসেদ।

    হাতের লেখাটা বেশ পরিষ্কার আর ঝকঝকে।

    জাহানারা, আমি তোমাকে ভালবাসি জাহানারা!

    জাহানারা নীরব।

    চোখজোড়া মাটিতে নামিয়ে নিয়ে কি যেন গভীরভাবে ভাবছে সে।

    সারা মুখে ঈষৎ বিস্ময়।

    সারা দেহ উৎকণ্ঠায় কাঁপছে তার। সন্দেহ আর সম্ভাবনার দোলায় দুলছে তার মন!

    কাসেদ ভয়ে ভয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি আমায় ভালবাস না জাহানারা?

    জাহানারার ঠোঁটের কোণে এতক্ষণে এক টুকরো হাসি জেগে উঠলো।

    ধীরে ধীরে সে হাসি চোখে আর চিবুকে ছড়িয়ে পড়লো তার। লজ্জায় মাথাটা নত হয়ে এলো। মুখখানা অন্য দিকে সরিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে সে বললো, তুমি কি কিছুই বোঝ না?

    কাসেদ নীরব।

    মুহুর্তের আনন্দে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে। দীর্ঘ সময় ধরে সে দিনে রাতে যাকে নিয়ে অশেষ কল্পনার আলপনা বুনতো, সে আজ তার কাছে ধরা দিয়েছে।

    জাহানারা! মিষ্টি করে সে ডাকলো।

    বলো। চোখ তুলে তাকাতে সঙ্কোচ বোধ করছে মেয়েটি।

    কাসেদ বললো, তুমি আমাকে আজ বড় অবাক করলে।

    কেন?

    আমি ভাবতেও পারিনি তুমি আমাকে ভালবাসতে পারো।

    অমন করে ভাবতে গেলে কেন?

    জানি না। শুধু জানি এ প্রশ্ন বার বার আমাকে যন্ত্রণা দিতো। আরো কি যেন বলতে যাচ্ছিলো সে। জাহানারা কাছে সরে এসে একখানা হাত রাখলো ওর নরোম তুলতুলে চুলের অরণ্যে। তারপর ধীরে ধীরে সিঁথি কাটতে কাটতে মৃদু গলায় সে বললো, থাক। ওসব কথা এখন থাক, অন্য কিছু বলো।

    কাসেদ ওর চোখে চোখ রেখে আস্তে করে শুধালো, কি বলবো?

    কিরে বিড়বিড় করে কি-সব বকছিস তুই? মায়ের কণ্ঠস্বর তীরের ফলার মত কানে এসে বিঁধলো তার। কাসেদ চমকে উঠে বসলো।

    মা ওর মাথার ওপর একখানা হাত রেখে আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আজকাল আমন করে তুই কি ভাবিস বলতো?

    কাসেদ ইতস্ততঃ করে বললো, ও কিছু না মা, চলো ভাত দেবে এখন, বড় ক্ষিধে পেয়েছে।

    মা ভৎসনা করে বললেন, ক্ষিধে পেয়েছে এতক্ষণ বলিস নি কেন, চল, খাবি চল। ওঠ, মুখহাত ধুয়ে নে। বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

    রান্না ঘরে নাহার এখন খাবার সাজাচ্ছে। বাইরে বৃষ্টি এখনাে থামে নি।

    বাতাস বেড়েছে আরো।

    পরদিন বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পথে জাহানারাদের বাসায় গেলো কাসেদ।

    বাসাটা ওদের পুরানা পল্টনে। একতলা বাড়ি সদ্য চুনকাম দে’য়া।

    সামনে বাগান। বসে বিকেলে ওরা চা খায়, গল্প করে।

    পথে যেতে যেতে কাসেদ ভাবলো, জাহানারা হয়তো তার অপেক্ষায় এতক্ষণে অধীর হয়ে আছে। ঘর ছেড়ে বারবার বারান্দায় বেরিয়ে আসছে। সে। চেয়ে চেয়ে দেখছে লোকটা আসছে কিনা। সে কি আসবে না। আজ? পাতলা কপালে সরু সরু রেখা ঐকে শোবার ঘরে সরে গেলো জাহানারা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারাখানা দেখলে সে। বড় স্নান মনে হচ্ছে আজ। কিছুই ভাল লাগছে না। মন বসতে চাইছে না কোন কাজে। বিকেল হয়ে গেলো, কাসেদ এখনো আসছে না। কেন? ভাবতে বড় ভালো লাগলো। ওরা। মনটা খুশীতে ভরে গেলো। জাহানারা কি সত্যি ওকে ভালবাসে?

    বাসার কাছে এসে কাসেদ দেখলো সামনের বাগানে অনেক লোকের ভিড়। ছেলেবুড়ো-মেয়ে। দেখে অবাক হলো সে। সবার পরনে সদ্য ধোয়ান কাপড়। হাসছে। কথা বলছে। মাঝে মাঝে চানাচুর আর ডারমুটি খাচ্ছে। একখানা পিরিচ হাতে অনেকগুলো মেয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে জাহানারা। আজ সুন্দর করে সেজেছে সে। পরনে হালকা নীল রঙের শাড়ি। চুলগুলো খোপায় বাধা। চারপাশে তার সাদা ফুলের মালা জড়ানো। কপালে কুমকুমের টিপ। কাসেদকে দেখতে পেয়ে ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এলো জাহানারা।

    আপনি এলেন তাহলে?

    একমুখ হেসে বললো সে।

    হাসলে ওকে আরো সুন্দর দেখায়।

    সরু সরু দাঁতগুলো মুক্তোর মত চিকচিক করে ওঠে।

    কাসেদ শুধালো, না আসার কোন হেতু ছিলো কি? যাক্‌গে, বাড়িতে এত অতিথির ভিড় কেন?

    জাহানারা জিভ কেটে বললো, ওমা আপনি জানেন না বুঝি, আজ আমার জন্মদিন।

    জানবো কি করে বলুন। কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলো কাসেদ।

    জাহানারা পরীক্ষণে বললো, তাইতো আপনাকে বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম আমি। কিছু মনে করেন নি তো?

    না, এতে মনে করার কি আছে? নিজেই যেন লজা পেলো কাসেদ। জাহানারা বললো, আসুন কিছু মুখে দিন, চা খাবেন, না কোন্ড ড্রিঙ্ক? কথাগুলো কাসেদের কানে পৌঁছালো কি-না, বোঝা গেলো না। মুহুর্তে সে বিব্রত বোধ করলো।

    চারপাশে তাকিয়ে দেখলো, অনেকগুলো চােখের দৃষ্টির মাঝখানে সে দাঁড়িয়ে।

    জাহানারা আবার বললো, দাঁড়িয়ে কেন, আসুন।

    কাসেদ ইতস্ততঃ করে শুধালো, আমায় ডেকেছেন কেন বললেন না তো? ভ্রূজোড়া তুলে জাহানারা বললো, ও হ্যাঁ, সে পরে আলাপ করা যাবে। আগে কিছু খেয়ে নিন। অফিস থেকে এসেছেন, চেহারা দেখে মনে হচ্ছে পথে কিছু খান নি, তাই না?

    কাসেদের মুখখানা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো, কিছু বলতে চেষ্টা করলে সে, প্রারলো না। দু’টি মেয়ে দলছাড়া হয়ে জাহানারার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো আর অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখছিলো তাকে।

    জাহানারা মৃদু হেসে বললো, আসুন। এদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। আপনার। মিলি চৌধুরী। আমার অনেক কালের বান্ধবী, ইডেনে পড়ে। আর এর নাম শিউলি, আমার কাজিন।

    আর ইনি হলেন কাসেদ আহমেদ। নাম হয়তো শুনে থাকবে তোমরা, কবিতা লেখেন।

    মিলি আর শিউলি হাত তুলে আদাব জানালো। পরিমিত হাসলো দু’জনে। মিলি জানতে চাইলো, আপনি কি ধরনের কবিতা লেখেন?

    কাসেদ বললো, লিখি না, লিখতাম এককালে।

    ইতিমধ্যে জাহানারা সরে গেছে সেখান থেকে। অদূরে কয়েকটি ছেলে-মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে সে।

    শিউলি শুধালো, আপনার কোন বই বেরিয়েছে?

    কাসেদ সংক্ষেপে বললো, না।

    মিলি বললো, আসুন বসা যাক।

    বাগানের এক কোণে তিনখানা বেতের চেয়ার টেনে গোল হয়ে বসলো। ওরা।

    কাসেদ নীরব।

    মিলি আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখছে।

    শিউলি মিটমিটি হাসছে।

    দোহারা গড়ন। ময়লা রঙ। লম্বা মুখের উপর নাকটা বড় ছোট হলেও বেমানান মনে হয় না। চােখের নিচে সরু একটা কাটা দাগ। ভ্রতে সুরমা টানা। কাসেদের মুখের ওপরে চঞ্চল চোখজোড়া মেলে ধরে হাসছে সে। অস্বস্তিতে মুখখানা অন্যদিকে সরিয়ে নিলো কাসেদ।

    আড়চোখে মেয়েটিকে আরেকবার দেখলো সে।

    এখনো তাকিয়ে মেয়েটি।

    এখনো।

    সহসা মিলি শুধালো, আপনি কোথায় থাকেন, কাসেদ সাহেব?

    কাসেদ মৃদু গলায় বললো, কলতাবাজারে।

    বাসায় কে আছেন। আপনার?

    মা আছেন আর এক দূরসম্পৰ্কীয়া বােন।

    শিউলি হাসছে, হাসুক।

    জাহানারা এখনো এলো না। একদল ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলছে সে। ওদের কথা যেন ফুরোবে না কোনদিন।

    মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো কাসেদ।

    এ কি বলছেন। আপনি? জাহানারা অবাক চোখে তাকালো ওর দিকে।

    মৃদু গলায় বললো, আপনাকে ভালবাসার কথা কোনদিন ভুলেও ভাবিনি আমি।

    কোনদিনও না জাহানারা? কাতর কণ্ঠে শুধালো সে।

    কিন্তু কেন, কেন বলতে পাের? সহসা তার কণ্ঠস্বর দৃঢ় শোনালো। সামনে ঝুঁকে পড়ে কাসেদ বললো, যাকে এত কাছে ঠাঁই দিয়েছে, তাকে আরো কাছে টেনে নিতে এত ভয় কিসের?

    ভয়? আমি তো ভয়ের কথা বলিনি।

    তবে কেন তুমি ভালবাসবে না আমায়?

    ভালো লাগে না বলে।

    সহসা সুরেলা কণ্ঠে হেসে উঠল জাহানারা।

    না জাহানারা নয়, শিউলি। শিউলি হাসছে এখনো, আপনি মনে মনে এতক্ষণ কার সঙ্গে কথা বলছিলেন কাসেদ সাহেব? শিউলি শুধালো।

    কাসেদ অপ্ৰস্তুত গলায় বললো, কই, নাতো। আপনি কি করে বুঝলেন কথা বলছি।

    আমি সব বুঝি। আস্তে করে বললো সে। বলে অন্য একটা টেবিলে সরে গেল সে।

    মিলি তার ব্যাগ থেকে কাঁটা আর উল বের করে আপন মনে মোজা বুনছে। কাসেদের চােখে চােখ পড়তে মৃদু গলায় বললো, মেয়ের জন্য।

    আপনার মেয়ে আছে বুঝি? বোকার মত প্রশ্ন করে বসলো কাসেদ।

    মিলির মুখখানা লজ্জায় লাল হয়ে গেলো, হ্যাঁ বড্ড দুষ্ট। খালি পায়ে হেঁটে কেবল ঠাণ্ডা লাগায়।

    আবার মোজা বোনায় মন দিলো মিলি।

    কাসেদ নীরব।

    এই একা বসে থাকতে বড় বিরক্তি লাগছে ওর।

    চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো কাসেদ।

    ওর দিকে চোখ পড়তে জাহানারা দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো সামনে।

    একি, আপনি চলে যাচ্ছেন নাকি?

    বসে বসে আর কি করবো বলুন। জাহানারাকে চুপ থাকতে দেখে কাসেদ আবার বললো, কেন ডেকেছিলেন বললেন না তো?

    ও হ্যাঁ, জাহানারা মুদু হেসে বললো, আমি সেতার শিখবো ঠিক করেছি। একজন মাস্টার দেখে দিতে পারেন?

    কাসেদ বোকার মত ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।

    এই বুঝি জাহানারার একান্ত প্রয়োজনীয় কথা? এরই জন্যে বাসায় যাওয়া আর অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকা।

    কাসেদ হতাশ হলো।

    জাহানারা বললো, চুপ করে রইলেন যে।

    কাসেদ বললো, না ভাবছিলাম আপনার হঠাৎ সেতার শেখার সখ হলো কেন?

    জাহানারা বললো, এমনি।

    কাসেদ বললো, বেশ মাষ্টার না হয় আপনাকে ঠিক করে দেবো, কিন্তু–কিন্তু কি?

    কিছুদিন পরে আবার ছেড়ে দেবেন না তো?

    দেখুন, সারা দেহে দৃঢ়তা এনে জাহানারা বললো, আমি এক কথার মেয়ে।

    কাসেদ মৃদু হেসে বললো, বেশ শুনে সুখী হলাম। এখন চলি তা হলে। আবার দেখা হবে।

    জাহানারা বললো, যাবেন? আচ্ছা বলে আবার সেই ছেলেমেয়েদের জটলার দিকে এগিয়ে গেল সে।

    কাসেদ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ। চারপাশে তাকিয়ে দেখলো, জন্মদিনের আসরে আগত ছেলেদের, মেয়েদের, বুড়ো বুড়ীদের। তারপর যখন সে বাইরে বেরুতে যাবে এমনি শিউলি পেছন থেকে ডাকলো। চলে যাচ্ছেন বুঝি?

    কাসেদ ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো,

    হ্যাঁ। শিউলে ঠোঁট কেটে বললো, যাবার আগে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়া উচিত ছিলো। তাই নয় কি?

    কাসেদ লজ্জা পেলো। ইতস্ততঃ করে বললো, বড় ভুল হয়ে গেছে, আর আপনারাও সবাই কথা বলছিলেন। কিনা, তাই। আচ্ছা এখন চলি।

    দাঁড়ান। কাসেদকে অবাক করে দিয়ে শিউলি পরীক্ষণে বললো, আমিও বাসায় ফিরবো ভাবছি। চলুন। এক সঙ্গে যাওয়া যাবে। দুহাতে পরনের শাড়িটা আলতো করে গুটিয়ে নিলো শিউলি। খোপাটা দেখলো ঠিক আছে কিনা, তারপর কাসেদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো সে। কিছুদূর পথ ওরা নীরবে হেঁটে এলো পাশাপাশি। শিউলি কোথায় যাবে কাসেদ জানে না। কোথায় বাসা ওদের সে প্রশ্নও করে নি সে। শুধু জানে, জাহানারার কাজিন শিউলি।

    শিউলি আজ বিকেলে ওর সঙ্গে পথ হাঁটছে।

    আরো অনেক পথ পেরিয়ে এসে সহসা কাসেদ শুধালো, আপনি কোন দিকে যাবেন?

    কেন, যেদিকে আপনি যাচ্ছেন। শিউলি নির্লিপ্ত।

    কাসেদ ঢোক গিলে বললো, আমি এখন বাসায় যাবো।

    বেশ তো চলুন না। দু’চোখে হাসি ছড়িয়ে শিউলি বললো, আমাকেও বাসায় ফিরতে হবে। একটুকাল থেমে সে আবার যোগ করলো, আপনাদের খুব কাছাকাছি থাকি।

    কাসেদ অবাক হলো, তাই নাকি? কই, বলেন নি তো?

    এইতো পরিচয় হলো, বলবার সুযোগ দিলেন কোথায়? শিউলে মুখ তুলে তাকালো ওর দিকে।

    কাসেদ কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেলো।

    ওরা তখন ষ্টেডিয়ামের কাছাকাছি এসে গেছে।

    রাত নামছে ধীরে ধীরে।

    বিজলী বাতিগুলো জুলছে মিটমিটি।

    চারপাশের দোকানগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় বাড়ছে।

    খেলার মাঠের সামনেকার গোল চত্বরটিতে লোকজন বসে বসে গল্প করছে। খেলার গল্প। সিনেমার গল্প। আর মাঝে মাঝে চিনেবাদাম কিনে খাচ্ছে ওরা।

    সহসা হেসে বললো শিউলি, আচ্ছা আমরা এভাবে হাঁটছি কেন বলুন তো?

    একটা রিক্সা নিয়ে চলে গেলেই তো পারি।

    একটু পরে একখানা রিক্সায় চড়ে বসলো ওরা।

    একটি অপরিচিত মেয়ের সঙ্গে রিক্সায় চড়ার অভিজ্ঞতা ওর এই প্ৰথম। তাই বারবার অস্বস্তি বােধ করছিলো কাসেদ। কপালে মৃদু ঘাম জন্মছিলো এসে; বারবার ওর কাছ থেকে সরে বসার চেষ্টা করছিলো সে। ওর অবস্থা লক্ষ্য করে শিউলি ঠোঁট টিপে হাসলো, আপনি ভয় পাচ্ছেন বুঝি?

    কাসেদ অপ্ৰস্তুত গলায় বললো, কই, নাতো?

    তাহলে আমন করছেন কেন?

    না, এমনি। লজ্জা কাটিয়ে ওর সঙ্গে সহজ হবার চেষ্টা করলো কাসেদ।

    আপনার বাবা বেঁচে আছেন?

    আছেন।

    মা?

    আছেন।

    বাবা কি করেন?

    সহসা শব্দ করে হেসে উঠলো শিউলি। অতসব জানতে চাইছেন কেন বলুন তো?

    বিয়ের সম্বন্ধ পাঠাবার চিন্তা করছেন বুঝি?

    শিউলি ঝুঁকে তাকালো ওর মুখের দিকে।

    ওর কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক হলো কাসেদ।

    হঠাৎ সে ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেলো।

    শিউলি আস্তে করে বললো, রাগ করলেন তো? করুন। এমনি সবাই আমার ওপর রাগ করে। আপনি অবশ্য ওদের সবার মত কিনা জানি না। ক্ষণকাল থেমে শিউলি আবার বললো, জানেন, আমি অনেক লোকের সঙ্গে মিশেছি। ওরা অনেকেই আপনার বয়েসি। কেউবা ছোট। কেউ আরো বড়ো। ওদের সঙ্গে বন্ধু হিসেবেই মিশতাম। আমি। আপনি হয়তো বলবেন, এ দেশে পুরুষে মেয়েতে বন্ধুত্ব চলতে পারে না। আমি বলবো, ওটা ভুল। ওটা আপনাদের মনের সংস্কার ছাড়া আর কিছু নয়। এই যে আমরা দু’জন এক রিক্সায় চড়ে বাসায় ফিরছি। লোকে দেখে কত কিছুই না ভাবতে পারে। কিন্তু আমি জানি, আমাদের মনে কোন দুর্বলতা নেই।

    কাসেদ নড়েচড়ে বসলো।

    শান্ত শিশুর মত নীরবে শিউলির কথাগুলো শুনছে সে। গাল বেয়ে মুদু ঘাম ঝরছে তার।

    বড় রাস্তা পেরিয়ে রিক্সাটা গলির মধ্যে ঢুকলো।

    শিউলি বললো, জানেন? ওরা কেউ আমার বন্ধুত্বের মূল্য দিতে পারে নি। কিছুদিন মেলামেশার পরেই ওদের ব্যবহার যেন কেমন পাল্টে যেতো। আমার চোখেমুখে চেহারায় কি যেন খুঁজে বেড়াতো। ওরা। আমি দেখে ঠিক বুঝতে পারতাম না। তারপর–। বলতে গিয়ে আবার হেসে উঠলো শিউলি। তারপর যা আশঙ্কা করতাম। তাই হতো। ওরা প্ৰেম নিবেদন করে বসতো আমায়। কি বিশ্ৰী ব্যাপার দেখুন তো। কাসেদের মুখের দিকে তাকালো শিউলি। ওর চেহারায় কি প্রতিক্রিয়া হলো তাই হয়তো লক্ষ্য করছিলো সে।

    কাসেদ নীরব।

    হঠাৎ সে প্রশ্ন করলো, আপনার বয়স কত?

    মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই। ওরা বিব্রত বোধ করে। কিন্তু শিউলির চোখেমুখে কোন ভাবান্তর দেখা গেলো না। যেন এমনি প্রশ্নের সঙ্গে সে বহুদিন থেকে পরিচিত। বহুবার তাকে এর জবাব দিতে হয়েছে। তাই পরীক্ষণে শিউলি বললো, অত্যন্ত সহজভাবেই বললো, বয়স জানতে চাইছেন কেন, ভাবছেন বুঝি আমি অল্প বয়সে পেকে গেছি?

    কাসেদ বললো না, ঠিক তার উল্টো। বয়স হলে কি হবে। আপনি আসলে এখনও বাচ্চা রয়ে গেছেন।

    শিউলি মুহুর্ত কয়েক স্থির চােখে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। যেন এর আগে এমনি উত্তর সে শোনে নি কোনদিন।

    ওকে চুপ থাকতে দেখে কাসেদ জিজ্ঞেস করলো, চুপ করে গেলেন যে? কি ব্যাপার, রাগ করেন নি তো?

    রাগ? অপূর্ব ভঙ্গি করে শিউলি জবাব দিলো, আপনি আমার কে যে আপনার উপর রাগ করবো?

    কাসেদ বেশ বুঝতে পারলো, এ মেয়ের সঙ্গে কথা বলায় সে পেরে উঠবে না। তবু শিউলিকে ভাল ভাগলো। ওর।

    বেশ মেয়ে।

    বড় সরল মেয়ে শিউলি।

    কিছুক্ষণের পরিচয়ে বড় সহজ হয়ে এসেছে সে। যে কথাগুলো সকলকে বলা যায় না, তাও সে বলেছে ওকে।

    জাহানারা যদি শিউলির মত হতো? কাসেদ ভাবলো নীরবে।

    শিউলি বললো, আমার আর সব বন্ধুরা যদি আপনার মতো হতো তাহলে বড় ভালো হতো, তাই না কাসেদ সাহেব?

    কাসেদ বললো, আমি আপনার বন্ধুদের কোনদিন দেখিনি সুতরাং তাদের সম্পর্কে কোন মন্তব্য করতে পারছিনে। তবে, আমাকে কেন যে আপনি আদর্শ বন্ধু বলে ভাবছেন তাও ঠিক বুঝতে পারলাম না। একি আপনার উচিত হচ্ছে।

    নিশ্চয়ই হচ্ছে। অত্যন্ত জোরের সঙ্গে জবাব দিলো শিউলি। আজকাল আর মানুষ চিনতে আমার ভুল হয় না। আপনাদের মত পুরুষের চোখের দিকে তাকালেই মনের ভাষা পড়ে নিতে পারি। আমি। বুঝতে পারি, লোকটা কেমন।

    শিউলি থামালো।

    কাসেদ মৃদু হেসে বললো, অল্প বয়সে দেখছি অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে আপনার।

    অভিজ্ঞতা কম বেশি সবারই হয়। শিউলি গম্ভীর গলায় জবাব দিলো। তবে কেউ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়, কেউ নেয় না।

    আপনি কোন দলে?

    শিউলি বলল, প্রথমোক্ত।

    কাসেদ বলল, তাহলে নতুন কোন পুরুষের সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব না করাই উচিত।

    তারপর বন্ধু বানানো উচিত।

    আমাকে যাচাই করেছেন কি?

    অবশ্যই।

    কখন করলেন?

    আপনার অজান্তে। মুখ টিপে হাসল শিউলি। আমার বাসা এসে গেছে। এখানে নামতে হবে। আমায়।

    রিক্সাটা থামিয়ে ছাই রঙের একটা দোতলা বাড়ির সামনে নেমে পড়লো শিউলি। বাড়ির বারান্দায় উঠে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকালো সে। বললো, আবার দেখা হবে। সময় করে একবার আসুন আমাদের বাসায়। কাল কিম্বা পরশু।

    কাসেদ সংক্ষেপে বলল, আসবো।

    রিক্সা থেকে মুখ বের করে ওদের বাসাটা ভালো করে দেখে নিলো সে। দেখলো একটা বুড়ো দোতলার বারান্দায় নীরবে দেখছে ওদের।

    বাসায় এসে একবার জাহানারা ও শিউলির কথা ভাবলো কাসেদ। দুটি মেয়েতে কি আশ্চৰ্য ব্যতিক্রম।

    জাহানারাকে সে আজ অনেক দিন ধরে চেনে।

    কতদিন সে গেছে ওদের বাসায়।

    সেও এসেছে এখানে।

    সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেছে ওরা, তর্ক করেছে ইকবালের দর্শন নিয়ে। রবি ঠাকুরের কবিতা নিয়ে।

    মাঝে মাঝে ব্যক্তিগত আলোচনার আশেপাশে এলেও গভীরে যায়নি কোনদিন। ইচ্ছে করেই যেন এড়িয়ে গেছে জাহানারা।

    হ্যারিকেনের আলোটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে টেবিলের উপর থেকে একটা খাতা টেনে নিয়ে বসলো কাসেদ। কবিতা লিখবো। বহুদিন কিছু লেখা হয় নি।

    পাশের ঘরে ছোট খালুর সঙ্গে কথা বলছেন মা।

    তাদের কথাগুলো এখান থেকে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে কাসেদ।

    মা বললেন, ওদের দু’জনকে নিয়েই তো আমার যত দুশ্চিন্তা। নিজের জন্যে ভাবিনে। বুড়ো হয়ে গেছি। কাল বাদে পরশু একদিন কবরে যেতে হবে।

    খালু বললেন, ‘সব বুড়ো-বুড়িদেরই ওই এক চিন্তা বড়বু’, ছেলেমেয়েদের একটা কিছু হিল্লে হােক। দু’পয়সা রুজি-রোজগার করে নিজের পায়ে দাঁড়াক ওরা। আরো কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন তিনি।

    মা কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে হঠাৎ বললেন, নাহারের জন্যে একটা ছেলে দেখে দাও না। বয়স তো ওর কম হলো না।

    খালু বললেন, ‘আজকাল ছেলে পাওয়া বড় ঝকমারি বড়বু’। ম্যাট্রিক পাশ করা ছেলে, সেও আবার ম্যাট্রিক পাশ মেয়ে চায়, বুঝলেন না?

    মা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর অস্পষ্ট গলায় বললেন, মেয়ে আমার ম্যাট্রিক পাশ নয়। সত্যি, কিন্তু ঘরকন্নায় ওকে কেই হার মানাতে পারবে না। ক্ষণকাল নীরব থেকে মা আবার বললেন, কি যে হয়েছে আজকাল কিছু বুঝিনে, আমাদের জামানায় লোকে দেখতো মেয়ে কেমন রান্নাবান্না করতে পারে।

    ‘সে জামানা পুরোনো হয়ে গেছে বড়বু’। এখন লোকে লেখাপড়া না জানা বউ-এর কথা চিন্তাও করতে পারে না।

    খালু থামলেন।

    অনেকক্ষণ ওদের কোন কথাবার্তা শোনা গেল না।

    হয়তো এখনো মনে মনে নাহারের কথা চিন্তা করছেন মা।

    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআরেক ফাল্গুন – জহির রায়হান
    Next Article দামেস্কের কারাগারে – এনায়েতুল্লাহ্ আলতামাশ

    Related Articles

    জহির রায়হান

    আরেক ফাল্গুন – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    হাজার বছর ধরে – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    আর কত দিন – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    একুশে ফেব্রুয়ারী – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    কয়েকটি মৃত্যু – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    তৃষ্ণা – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.