Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বুকের ভিতর আগুন – জাহানারা ইমাম

    জাহানারা ইমাম এক পাতা গল্প58 Mins Read0

    উপক্রম

    উপক্রম

    রাত্রে ঘুমের মধ্যে একবার যেন মনে হয়েছিল কীসব কথাবার্তা চলাফেরার শব্দ শোনা যাচ্ছে; কিন্তু শান্টুর ঘুম যা গাঢ়। ওই মনে হওয়াটাই মাত্র। চেতনার কিনারায় একবার ভুস করে মাথা তুলেই আবার সে তলিয়ে গিয়েছিল ঘুমের গহিনে। শান্টুর মা বলেন, ঘরে গরুমোষ জবাই করে ফেললেও শান্টু টের পাবে না। শান্টুর এতে ভয়ানক আপত্তি। একটা গরু বা মোষকে পাঁচ-সাতজন লোক মাটিতে পেড়ে ফেলার সময় যে-রকম ধুন্ধুমার শব্দ ওঠে, তাতেও ঘুম ভাঙবে না, এমন বিচ্ছিরি রকমের ঘুম শান্টুর নয়। কিন্তু কে শোনে তার আপত্তি। মা কথাটা বলামাত্র আর সবাই তাতে এমন মজা পেয়ে যায় আর এতবার করে সবাই সেটার পুনরুক্তি করে যে, কথাটা এখন বাড়িতে প্রবাদ-কথার মতো হয়ে গেছে। কিন্তু কাল রাত্রে কখনই ও-রকম গরুমোষ জবাই করার মতো হৈ-হল্লা হয়নি। কারণ শান্টুর ঘুম যখন পাতলা হয়ে এসেছিল, সে কারো কোনো উচ্চকণ্ঠ, হাঁকহাক শোনেনি। দরজার শিকল ধরে ঝনঝন করার শব্দের সঙ্গে ফিসফিস কণ্ঠে কথা, লণ্ঠনের ফিতে উস্‌কে দরজা খুলে উঠোনে নামা, আবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করা, কাউকে ফিসফিস করে কিছু বলা, তারপর লণ্ঠনের বাতি কমে যাওয়া— এর বেশি কিছু হয়নি। তাই তার ঘুমটাও পুরোপুরি ভাঙবার অবকাশ পায়নি। এখন সকালে চোখ মেলতেই সব মনে পড়ে গেল এবং সে বিদ্যুৎবেগে বিছানার ওপর উঠে বসে ঘরের চারদিকে তাকাল।

    বিরাট লম্বা টিনের ঘরটার ওইপাশে বাবা-মার বিরাট পালং। ওখানে শোয় তার দুই বোন, ছোট ভাই আর মা। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল, তার দুপাশে বেঞ্চি। ঘরের একপাশের দেয়াল ঘেঁষে দুটো চৌকি। টেবিলের দিকের চৌকিতে বাবা শোয়, দেয়ালের দিকেরটায় সে। এই দেয়ালে একটা দরজা, সেটা দিয়ে পাশের ঘরে যাওয়া যায়। সে-ঘরে দুটো চৌকিতে শোয় তার বড় দুইভাই। পালঙ্কের দিকে তাকিয়ে দেখল মশারির মধ্যে ছোটভাইটা এখনো ঘুমিয়ে আছে। বোন দুটো, মা সবাই দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেছে। বাবাও ঘরে নেই। সে উঠে মশারির একটা দিক তুলে বিছানার বাইরে এল। বড় ভাইয়ের ঘরের দরজা দিয়ে উঁকি দিল। তখনই বুঝল মাঝরাত্রে কোনো অতিথি এসেছে। তার শিকল নাড়ার শব্দে বাবা ঘুম ভেঙে লণ্ঠন উস্‌কে দরজা খুলেছিলেন, আবার ভেতরে এসেছিলেন। ঐ অতিথি এখন মেজভাইয়ের চৌকিতে শুয়ে আছে। মেজভাই বড়ভাইয়ের সঙ্গে তার চৌকিতে ঘেঁষাঘেঁষি করে এখনো ঘুমন্ত।

    শান্টু সরে এসে ঘরের মাঝখানে দাঁড়াল। খোলা দরজা দিয়ে উঠোনটা দেখা যাচ্ছে। উঠোনের শেষপ্রান্তে রান্নাঘর, রান্নাঘরের বাঁ-পাশে একটা স্থলপদ্মের গাছ। সেই গাছের পাশ দিয়ে পেছনবাড়িতে যাবার রাস্তা। অন্যপাশে রান্না করার চেলাকাঠ রাখার জন্য একটা চালাঘর। সেই ঘরের সামনে তার বড়বোন সাহেরা হাঁসমুরগিকে খাবার দিচ্ছে। আর ওগুলো কঁককঁক, কোয়াক কোয়াক শব্দ করতে করতে খুদকুঁড়োর সানকি দুটোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

    সে দরজার চৌকাঠ ডিঙিয়ে, চওড়া বারান্দা পেরিয়ে, তিনটে সিঁড়ির ধাপ মাড়িয়ে, উঠোনে নেমে সোজা রান্নাঘরে চলে গেল। মা চুলোর ওপর বসানো কড়াইতে কিছু-একটা নাড়ছেন। দেখে সুজি মনে হচ্ছে। মেজবোন তাহেরা চুলোর কাছাকাছি মেঝেতে বসে পরোটা বেলছে। তার মানে নির্ঘাত কোনো বিশেষ মেহমান। নইলে রোজকার বরাদ্দ মুড়ি-গুড় বা আটার রুটি-আলুভাজি বাদ দিয়ে পরোটা-হালুয়া হয়! এর মধ্যে সাহেরা দুটো ডিম হাতে ঘরে ঢুকল। ‘আজ এই দুটোই পেলাম মা’ অর্থাৎ মুরগির ঘর থেকে সদ্য-পাড়া দুটো ডিম কুড়িয়ে আনল সে। মা বললেন, ‘রাখ, ওতেই হবে। চট করে দুটো পেঁয়াজ আর কাঁচামরিচ কুঁচিয়ে দে’। শান্টু মার পাশে মেঝেতে উবু হয়ে বসে অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কে এসেছে মা?’

    মা এতক্ষণ খুন্তি দিয়ে সুজি ভাজছিলেন। এবার একটা ঝকঝকে কাঁসার ঘটি থেকে ভাজা সুজির ওপর পানি ঢালতেই ছাঁ-আঁ-আঁ— করে শব্দ উঠতে থাকল খানিকক্ষণ। একহাতে পানি ঢালার সঙ্গেসঙ্গে অন্যহাতে খুন্তি দিয়ে সাবধানে দ্রুত নাড়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়াতে মা তক্ষুনি শান্টুর কথায় জবাব দিতে পারলেন না। তবে প্রশ্নটা মনে ছিল। সুজি নেড়েচেড়ে যখন সুন্দর মোহনভোগ তৈরি হয়ে গেল, তখন তিনি ছেলের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘তোর বড়খালার ছেলে—’। মার মুখ থমথমে, দেখে মনে হয় ভোরবেলা কেঁদেছেন। সাহেরা-তাহেরা কেমন শুকনোমুখে কাজ করে যাচ্ছে। খালাতো ভাই বাড়ি এলে যে-রকম খুশিখুশি ভাব হওয়া উচিত, সে-রকমটি দেখা যাচ্ছে না। তবে এই খালাতো ভাইটি তাদের তেমন পরিচিত নয়। তারা অনেক দূরে সে-ই রাজশাহীতে থাকে। বোনদের নিরুৎসাহের কারণ হতে পারে, কিন্তু মায়ের মুখ কান্নাফোলা হবে কেন? মা একটা বড় রেকাবিতে মোহনভোগ ঢেলে ঘি-মাখানো আঙুল দিয়ে চেপে চুপে সমান করে তারপর হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলেন, ‘তোর খালা-খালু দুজনকেই মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে। তাদের ছেলেমেয়েদেরও গুলি করে শেষ করে দিয়েছে। কেবল এই ছোট ছেলেটা কী করে যেন ভাঁড়ারঘরের চৌকির নিচে সেন্দিয়ে ছিল, তাই বেঁচে গেছে।’

    ‘ব- ল -কি!’ শান্টু দুইচোখ বড় বড় করে মাটির মেঝেতে থেবড়ে বসে পড়ে। তার মুখটাও কাঁদো-কাঁদো হয়ে যায়। বড়খালার বাড়ি তাদের খুব একটা যাওয়া হয় না বটে, তবে বড়খালা দু-তিনবছর পরে একবার করে আসতেন। তাঁর তিন ছেলে, এক মেয়ে। সবচেয়ে ছোটটি শান্টুর সমবয়সী। ছেলেটির সঙ্গে তার মোটেও বনত না। ওইটুকু বয়সেই তার ভয়ানক নাক উঁচু ছিল। অন্তত শান্টুর তাই মনে হত। খালার অন্য ছেলেমেয়েরা কিন্তু তাকে খুব আদর করত। সেই চমৎকার ছেলেমেয়েগুলো মিলিটারির গুলিতে মরে গেছে? আর বেঁচে আছে ঐ অহংকারী ছেলেটা?

    হঠাৎ মনে মনে জিভ্ কাটল শান্টু। একী যা-তা কথা ভাবছে সে! আহা! বাবা-মা, ভাই-বোন সব হারিয়েছে সে, তার সম্বন্ধে এরকম নির্দয় চিন্তা করা শান্টুর মোটেই উচিত হচ্ছে না। শান্টুর বাবা-মা, ভাই-বোন সবই আছে— তার এখন উচিত ঐ সর্বহারা এতিম ছেলেটিকে ভালোবাসা, তার মনে শান্তি দেওয়ার চেষ্টা করা। মা চোখ মুছে বললেন, ‘ওকে ডাকিস না। যতক্ষণ পারে, ঘুমোক। তোরা হাতমুখ ধুয়ে নাশতা খেয়ে নে।’

    শান্টু বলল, ‘ও আমাদের গ্রাম চিনে এল কী করে? সেই রাজশাহী থেকে কম দূর তো নয়।’

    মা বললেন, ‘ও প্রথমে ঢাকা চলে গিয়েছিল ওর চাচার কাছে। ঢাকারও অবস্থা ভালো নয়। ওর চাচাতো ভাইরা জানে বাঁচবার জন্য গ্রামে লুকিয়েছিল। ও বয়সে ছোট, ওদের সঙ্গে রাখার অসুবিধে ছিল, তাই ওর কাছে আমাদের ঠিকানা জেনে ওকে আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে কাল মাঝরাতে।’

    শুনে শান্টু খানিকক্ষণ থম ধরে বসে থাকে। ছেলেটার চাচাতো ভাইদের খুব সাহস আছে বলতে হবে। নিজেদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ওকে মাঝরাতে হলেও ঠিকমতো পৌঁছে দিয়েছে বটে। সে উঠে বেরিয়ে এল রান্নাঘর থেকে। স্থলপদ্ম গাছটার পাশ দিয়ে পেছনবাড়িতে চলে গেল। এখানে আছে তাদের গোটাকতক ধানের গোলা, ধান শুকোবার জন্য একটা মাঝারি সাইজের পাকা উঠোন, মেয়েদের গোসল করার জন্য একটা পাকাঘর। তারপাশে টিপ-কল। তার চারপাশটা বাঁধানো—কাপড়-কাচা এবং পুরুষদের গোসল করার জন্য। একেবারে শেষপ্রান্তে পাকা পায়খানা। তার পাশেই সীমানা-বেড়ার গায়ে একটা টিনের দরজা। এটা দিয়ে বাইরে গেলেই দেখা যায় বেশ বড়সড় একটা পুকুর। পুকুরটা ওদেরই। তবে পাড়ার সবাই ব্যবহার করে।

    শান্টু আজকে আর কল-তলায় গেল না মুখ ধুতে। নিমের দাঁতনে দাঁত ঘষতে ঘষতে পুকুরপাড়ে চলে গেল। পুকুরের চার পাড় ঘিরে প্রচুর গাছগাছালি। শান্টুদের দিকের ঘাট শান-বাঁধানো। ধাপে-ধাপে বেশ কয়েকটা সিঁড়ি নেমে গেছে পুকুরের পানির ভেতর। বর্ষায় পুকুর যখন ভরে ওঠে, তখন মাত্র দুটো কি তিনটে সিঁড়ি দেখা যায়। শীতের শেষে পুকুরের পানি কমতে কমতে বেশ অনেকগুলো সিঁড়ি বেরিয়ে পড়ে। পুকুরের অন্য তিনদিকেও ঘাট আছে, তবে সেগুলো গাছের কাটা গুঁড়ি দিয়ে বানানো। পাড়ার অন্যসব বাড়ির লোকেরা ব্যবহার করে ঐ ঘাটগুলো।

    শান্টু ঘাটের সিঁড়িতে বসে অনেকক্ষণ ধরে দাঁতন ঘষল। আকাশটা মেঘলা হয়ে রয়েছে। কেমন যেন ভিজে ভিজে একটা বাতাস দিচ্ছে, পুকুরের পানিতে ঝিরঝির করে তরঙ্গ উঠছে। শান্টু একদৃষ্টে চেয়ে রইল সেই ঝিরঝির করে বয়ে যাওয়া পানির দিকে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মাথাটা আস্তেআস্তে ঘুরতে থাকে। মনে হয়, সে যেন একটু-একটু করে পানির ঐ সরু-সরু চুড়ির মতো তরঙ্গমালার ভেতরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে।

    হঠাৎ সে চমকে উঠল। তার ছোটভাই রান্টু তাকে ডাকতে ডাকতে আসছে। সে তাড়াতাড়ি দু-তিনটে সিঁড়ি নেমে হাতের তালুতে পানি নিয়ে কুলি করতে লাগল। রান্টু ঘাটের ওপরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে রাগতস্বরে বলল, ‘ডাকতে ডাকতে গলা ভেঙে গেল, ধ্যানে বসেছিলে নাকি?’

    শান্টু হুসহুস করে কয়েক আঁজলা পানি চোখেমুখে কপালে ছিটিয়ে দুইহাতের তালু দিয়ে মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়াল, ‘কথা বলার ছিরি কি! এত ডাকাডাকির কী হয়েছে? বাড়িতে ডাকাত পড়েছে নাকি?’

    ‘ডাকাত না পড়লে বুঝি ডাকাডাকি করা চলে না? ওদিকে সবার নাশতা খাওয়া হয়ে গেল, শুধু তুমিই উধাও। মা কতকক্ষণ নাশতা আগলে বসে থাকবে? বাড়িতে আর কাজ নেই?’

    শান্টু জানে, মা মোটেই নাশতা আগলে বসে নেই। শান্টুর খালিপেটে পিত্তি পড়বে এই ভয়েই মায়ের ডাকাডাকি। তিনি তার নাশতা সরপোষ ঢাকা দিয়ে রেখে সংসারের কাজে লেগে গেছেন। তবু সে খেঁকিয়ে উঠল, ‘নাশতা টেবিলে ঢেকে রাখলেই তো হয়। তার জন্য কাজ বাকি থাকবে কেন? তোকে ডাকতে বলা হয়েছে, ডেকে চলে যা। এত কথা বলার দরকার কী?’

    আসলে রান্টু তখনই রাইট-এ্যাবাউট-টার্ন করে বাড়ির দিকে চলে গেছে, শান্টুর খেঁকানি শোনার জন্য দাঁড়িয়ে নেই। শান্টুর তাতে রাগ আরো বেড়ে গেল। বকুনিটা রান্টু শুনলই না! খুব আস্পর্ধা বেড়েছে ছেলেটার। শান্টুকে একদম মানতে চায় না। আগে তো শান্টু বলেই ডাকত। মা অনেক বকেঝকে এখন সেজভাই ডাকটা রপ্ত ‘করিয়েছেন। তাও মেজাজ চটে গেলে সে শান্টু বলে ফেলে।

    বাড়ির দিকে যেতে-যেতে শান্টু টের পেল, পেটের মধ্যে খিদেটাও বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। সে দুদ্দাড় বড়ঘরে ঢুকে টেবিলের সামনে দরজার দিকের লম্বা বেঞ্চিটায় বসে পড়ল। ওইপাশের বেঞ্চে তখনো বাবা, বড় ভাই আর ঐ ছেলেটা বসে আছে। এপাশ থেকে মা, বোনেরা উঠে গিয়ে কোথায় যেন অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে। শান্টুর নাশতা টেবিলের ওপর সরপোষ দিয়ে ঢাকা। শান্টু এসে বসতেই বাবা নীরব তিরস্কারপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। শান্টু একনজর তাঁর দিকে তাকিয়েই মাথা নিচু করে ফেলল। তার মুখে ফুটে উঠল নীরব মিনতি। বাবা যেন তাকে এখন ঐ ছেলেটার সামনে না বকেন। বাবা সত্যিই মুখে কিছু বললেন না, সেও যে ঐ মেহমান ছেলেটার জন্যই, তাও শান্টু বুঝল।

    খেতে খেতে সে ছেলেটির মুখের দিকে তাকাল। ছেলেটি শান্টুর মাথার ওপর দিয়ে খোলা দরজার দিকে কেমন উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ঘরের কারো দিকে তার খেয়াল নেই। কয়েক বছর আগে দেখা সেই গোলগাল নধর ছেলেটার সঙ্গে এই ছেলেটার কোনো মিলই খুঁজে পচ্ছে না শান্টু। রংটা শ্যামলাই ছিল, এখন রোদে পুড়ে কালো দেখাচ্ছে। দুইগাল বসে গেছে, চোখের নিচে কালি। ফুলহাতা বুশসার্টের জন্য বোঝা যাচ্ছে না গায়ে-গতরে কতখানি রোগা হয়েছে। এই ক’বছরে বেশ লম্বা হয়ে উঠেছে। খোঁচা দাড়ি-গোঁফের আভাস। শান্টু অবাক হল। তারই-তো বয়সী ছেলেটা, শান্টুর গোঁফ-দাড়ির নাম-নিশানা নেই, আর ওর দুইগালে কালচে আভা! ও এর মধ্যেই শেভ করা ধরেছে নাকি? ওর নামটা যেন কী ছিল? শান্টু এখন কিছুতেই মনে করতে পারছে না। তারই আপন খালাতো ভাই অথচ তেমন যোগাযোগ ছিল না। তার বাবা এই গ্রামের বড় জোতদার, গঞ্জেও তাঁর ধানচালের আড়ত আছে। বিষয়-আশয় নিয়ে তিনি সারা বছরই এমন ব্যতিব্যস্ত থেকেছেন যে, কয়েকদিনের জন্যও সেসব ছেড়ে বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যাবার মতো সময় বের করে উঠতে পারেননি কখনোই। আসলে তিনি একটু ঘরকুনোও বটে। বড় খালু রেলের কী যেন চাকরি করতেন, পাস পেতেন, তাই পুরো পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসতে পারতেন। তাও অবশ্য তিন, চার কি পাঁচবছর পর একবার। শেষ এসেছিলেন ছয়-সাত বছর আগে। তারপরেই খালু বদলি হয়ে গেলেন রাজশাহীতে। সুদূর উত্তরবঙ্গে যাবার পর আর তাঁদের এদিক পানে বেড়াতে আসা হয়নি। বড় খালা যখনই আসতেন, তাদের সবার জন্য জামাকাপড়, খেলনা কত কী আনতেন। অমন চমৎকার মমতাময়ী মানুষটি আর বেঁচে নেই? নিষ্ঠুর খানসেনার হাতে গুলি খেয়ে মারা গেছেন। যে খালাতো ভাই-বোনগুলি তাকে এত আদর করত, তারাও আর বেঁচে নেই। অকালে বুলেটের ঘায়ে ঝরে পড়েছে।

    শান্টুর মনের মধ্যে খুব কষ্ট হতে লাগল। চোখ ভিজে উঠল। প্রাণপণ চেষ্টায় চোখের পানি ঠেকিয়ে সে খাওয়া শেষ করল। বারান্দায় বেরিয়ে বদনা থেকে পানি ঢেলে হাত ধুল, কুল্লি করল। তারপর লুঙির তলার দিকে ভিজে-হাত মুছে আবার ঘরে এল। বাবা বললেন, ‘শান্টু, মোহনকে নিয়ে একটু পুকুরপাড়ে বেড়িয়ে আয়।’

    ছেলেটার নাম তাহলে মোহন। কী সুন্দর নাম! তার কী বিচ্ছিরি একটা নাম! শা-ন্টু! নামটা একদম পছন্দ নয় তার। যদিও এটা তার ডাকনাম, তবু ডাকনামই তো সদা-সর্বদা সবার কণ্ঠে শোনা যাচ্ছে। ভালো নামটা যত ভালো হোক, সেটা তো কখনোই উচ্চারিত হয় না। শান্টু ঠিক করল মোহনকে সে তার ভালো নামটা আগে বলবে। সে মোহনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এসো ভাই—’ মোহন উঠে দাঁড়াল, কিন্তু তার হাতটা ধরল না। ধীরগতিতে ঘরের দরজার দিকে পা ফেলল। শান্টুর মনটা সঙ্গেসঙ্গে চুপসে গেল। মোহন তার প্রসারিত-হাত ধরল না! কিন্তু সে-ভাবটা সে মুখে ফুটতে দিল না। যেন সে আদপেই হাত বাড়ায়নি, এমনিভাব করে হাতটা পাশে ঝুলিয়ে মোহনের সঙ্গেসঙ্গে পা ফেলে পেছন-বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। মোহন চারদিকটা তাকিয়ে দেখছিল। শান্টু খুব আলগোছে বলল, ‘আমার নাম মাহবুব তোমার?’

    ‘মোহন।’

    ‘না, না ডাকনাম নয়, ভালো নাম।’

    ভালো নাম? মোহন এমনভাবে শান্টুর দিকে তাকাল, যেন কথাটার মানে সে জানে না।

    শান্টু একটু বিব্রতবোধ করল,— ভালো নাম মানে যে-নামটা স্কুলের খাতায় লেখা হয়—মানে ঐ যাকে বলে পোশাকি নাম—

    ‘ও— মাহবুব।’

    ‘মাহবুব!’ শান্টু যেন হঠাৎ বোকা হয়ে যায়। অবাক দৃষ্টিতে মুহূর্তখানেক তাকিয়ে থেকেই সামলে নেয়, ‘ধুস্! ও তো আমার নাম।’

    মোহন ভ্রুকুটি করে বলল, ‘ওটাই আমার নাম। মাহবুবে রব্বানী। তোমার নামের শেষ অংশ কী?

    শান্টুর বেজায় খারাপ লাগতে লাগল, সে ব্যাজার মুখে বলল, ‘আলী।’

    ‘তোমার ডাক নাম কী?’এবার শান্টুর মেজাজ বিগড়ে গেল, সে বলতে চাইল তার কোনো ডাকনাম নেই। হঠাৎ মনে হল মিথ্যে বলে লাভ কী? বাবা, মা, ভাই-বোনেরা কেউ একবার ডাকলেই তো সব গোমর ফাঁক হয়ে যাবে। সে গোমড়া মুখ করে বলল, ‘শান্টু।’

    ‘বাহ্, ভারি চমৎকার নাম তো।’

    ‘চমৎ-কার!’ শান্টুর মুখ হা হয়ে গেল। সে বলে দুইচোখে দেখতে পারে না তার এই নামটা, আর মোহন বলে কিনা চমৎকার?

    ‘হ্যাঁ, বেশ একটা টগবগে ভাব আছে নামটায়। আমার ডাকনামটা খুব বাজে লাগে, কেমন যেন মিইয়ে পড়া, মিনমিনে। ভাবছি নামটা বদলে তোমার নামের সঙ্গে মিল করে রাখব। ভালো নামও যখন এক –’

    শান্টু উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। মোহনকে তার খুব ভালো লেগে যায়। সে মুচকি হেসে বলে, ‘মেলাও দেখি।’

    মোহনের কালচে মুখেও যেন একটুখানি হাসির আভা ফুটে ওঠে– ‘তুমিই বল না কী রাখা যায়।

    শান্টু বেশ মুরুব্বিয়ানা সুরে বলল, ‘আমার বড় দুই ভায়ের ডাকনাম মন্টু আর ঝন্টু। ছোটটার নাম রান্টু তাহলে আর থাকল কী?’ বলে হি-হি করে হেসে উঠল সে, ‘আমরা চার ভাই-ই সব নিয়ে নিয়েছি।’

    মোহন বেশ মজা পেয়ে গেল, যেন ধাঁধার জবাব দিচ্ছে, এমনিভাবে বলল, ‘পান্টু, নান্টু, লান্টু—’

    শান্টু হেসে কুটিপাটি হল, ‘দূর! পান্টু, লান্টু জন্মেও শুনিনি। নান্টু হতে পারে বটে’—

    ‘হ্যাঁ, নান্টু শোনাচ্ছে ভালো। বেশ, তাহলে নান্টুই হল আমার নাম। আমি তোমার আরেকটা ভাই।’

    শান্টুর বুক দুলে ওঠে মমতায়, সহমর্মিতায়। তার ইচ্ছে হয় মোহনের হাত দুটো ধরে তাকে বুকের কাছে টেনে নেয়। কিন্তু সাহস হয় না। কি জানি, মোহন যদি আবারো হাত না বাড়ায়!

    কথা বলতে বলতে ওরা পুকুরঘাটে চলে এসেছে। পুকুর দেখে মোহন খুশি হয়ে উঠল। শান্টু একবার জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, রাজশাহীতে পুকুর ছিল কিনা; কিন্তু কপাল ভালো, বাক্যের প্রথম শব্দটি ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বেরোবার আগেই সেটাকে চেপে ফেলতে পারল। সর্বনাশ করতে যাচ্ছিল আর কী। মোহন কেবল একটুখানি সহজ হয়ে উঠেছে, এই সময় রাজশাহীর কথা তুললে তার মন নির্ঘাত খারাপ হয়ে যেত। মোহন ছোটবাচ্চার মতো পায়ে শব্দ তুলে দু-তিনটে সিঁড়ি ডিঙিয়ে একবারে পানির কিনারায় গিয়ে বসল। বলল, ‘পুকুর দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। রাজশাহীতে আমাদের বাড়ির পেছনে একটা পুকুর ছিল—’

    এইরে সেরেছে! মোহন নিজেই রাজশাহীর কথা তুলেছে। কিন্তু শান্টু অবাক হয়ে দেখল, মোহনের মুখভাবের কোনো পরিবর্তন হল না। সে বেশ সহজ গলাতেই বলল, ‘আমাদের পুকুরটায় ছিপ দিয়ে মাছ ধরতাম। তোমাদের ছিপ আছে নিশ্চয়ই?’

    শান্টু হেসে উড়িয়ে দিল, ‘দুর, ছিপ দিয়ে মাছ ধরে সুখ আছে? না, সময় আছে কারো?’ তার কণ্ঠস্বরে বেশ একটু গর্বের ভাব ফুটল, ‘আমরা মাছ ধরি জাল ফেলে। তুমি জাল ফেলতে পার? আমি কেবল শিখেছি।’

    মোহন মৃদু হেসে বলল, ‘আর কী কী শিখেছ তুমি?’

    মোহনের কণ্ঠস্বরে কী একরকম রহস্য আর কৌতুক মেশানো। শান্টু হচকিয়ে বলল, ‘আর কী কী মানে?’

    ‘এই মানে—’ মোহন হঠাৎ চেপে গেল, ‘নাহ্, ঠাট্টা করছিলাম।’ তারপর প্রশ্নটা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাদের এদিকে মিলিটারি আসেনি?’

    ‘না, কপাল ভালো আমাদের গ্রামটাতেই শুধু ঢোকেনি। আমাদের পাশের গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল মে মাসে। তখন ঐ গ্রামের অনেক লোক পালিয়ে আমাদের গ্রামে এসেছিল। আমাদের বাড়িতেই তো ছিল প্রায় পনের-কুড়ি জন।’

    ‘চিন্তা নেই, তোমাদের গ্রামে আসার সময় ফুরিয়ে যায়নি।’

    ‘তার মানে?’ শান্টু ভয়ানক রকম চমকে ওঠে। মোহনের মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনে হয়, মোহন ওর সমবয়সী নয়— ওর চেয়ে বয়সে এবং অভিজ্ঞতায় অনেক বড় সে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠল, ‘কী যে অলক্ষুণে আবোল-তাবোল কথা কও!

    ‘অলক্ষুণে নয়, আবোল-তাবোলও নয়, এইটেই খাঁটি সত্য কথা। জানোয়ারগুলো এদেশের সব গ্রামই একে-একে জ্বালিয়ে দেবে, দুদিন আগে বা দুদিন পরে। জানো না, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কী বলেছে? ওরা এই পূর্ব-বাংলার মানুষ চায় না, চায় এদেশের মাটি। তাইতো সব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিচ্ছে, মানুষ মেরে সাফ করছে। ওদের যদি এখন থেকেই বাধা দেওয়া না যায়, তাহলে কেউই বাঁচবে না, কিছুই বাঁচবে না।’

    শান্টু স্তব্ধ হয়ে মোহনের মুখের দিকে চেয়ে রইল। কী বলে ছেলেটা! মোহন হঠাৎ সোজাসুজি শান্টুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি মুক্তিযোদ্ধাদের খবর রাখ?’

    শান্টু ভেতরে-ভেতরে কুঁকড়ে গেল, সর্বনাশ! মোহন যে একেবারে ভিমরুলের চাকের দিকে থাবা বাড়িয়েছে! বাবা-মা পইপই করে নিষেধ করে দিয়েছে, জান গেলেও কাউকে একটি কথা যেন না বলে এ বিষয়ে। আবার মোহনের সামনে ‘জানিনা’ বলতেও পৌরুষে বাঁধছে। মোহন তাহলে কী ভাববে তার সম্বন্ধে? তাকে ইতস্তত করতে দেখে মোহন বলল, ‘হয় তুমি একটা হাবাগঙ্গারাম, নাহয় স্রেফ চেপে যাচ্ছ। তোমার বড় দুভাই যে মুক্তিযোদ্ধা, তা জানো তুমি?

    শান্টু ভয়ার্ত গলায় বলে উঠল, ‘না, না, কে বলল, মোটেই না। ওরা তো ধানচালের ব্যবসা করে। গঞ্জে বাবার আড়ত আছে। ওরা রোজ সকালে নাশতা খেয়ে সেইখানে যায়—’

    তার মুখের কথা কেড়ে মোহন বলল, ‘আর রাতদুপুরে লক্ষ্মী ছেলের মতো বাড়ি ফিরে চৌকিতে শুয়ে ঘুমোয়।’ সে খুক খুক করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই আবার বলল, ‘সবাইকে যে মেশিনগান হাতে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে হবে, তার কী মানে? আড়তে বসেও যুদ্ধ করা যায়। ওই ধানচালের আড়তই তো একটা যুদ্ধক্ষেত্র। নিরীহ মুখ করে আড়তে বসে ধান-চাল বেচে, শ-য়ে শ-য়ে খদ্দের এসে সওদা করে যায়- তার মধ্যে কে গেরস্ত, কে মুক্তিযোদ্ধা, তা কি মুখে লেখা থাকে? তুমি বলতে চাও তুমি কিচ্ছুটি জানো না?

    শান্টুকে মনে-মনে স্বীকার করতেই হয়, মোহন সত্যিসত্যিই তার চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান, অনেক বেশি পরিপক্ব। সে ছোটবেলা থেকেই প্রখর মেধা-সম্পন্ন ছিল, পরীক্ষায় সবসময় প্রথম হত, বৃত্তিপরীক্ষায় খুব ভালো ফল করে বৃত্তি পেয়েছিল—এগুলো শান্টু জানত। কিন্তু তা সত্ত্বেও এতটা মানসিক পরিপক্বতা? এমন প্রখর বিশ্লেষণ-ক্ষমতা? সন্দেহ নেই, মোহনের জীবনের মর্মন্তুদ দুর্ঘটনাই তাকে এত তাড়াতাড়ি সাবালক করে দিয়েছে। শান্টুর মনে হল এর কাছে কিছু গোপন করা উচিত হবে না। সে দ্বিধাজড়িত স্বরে বলল, ‘না, মানে, আমাদের ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান লোকটা ভালো নয় কিনা। বাবা পইপই করে বারণ করে দিয়েছে আমি যেন কোথাও কারো কাছে টু-শব্দটি না করি। বাড়িতে ডাগর দুটো বোন রয়েছে। সেইজন্যই তো বড়ভাই, মেজভাই বাড়ি ছেড়ে যায়নি। আড়তে বসেই যদ্দুর পারে, করে। কিন্তু, তুমি বুঝলে কী করে?’

    ‘আমার চাচাতো ভাইরা মুক্তিযোদ্ধা। তারা এপ্রিল মাসেই সীমান্ত পার হয়ে চলে গিয়েছিল। দুই নম্বর সেক্টরে ট্রেনিং নিয়ে আবার ফিরে এসেছে। এখন দেশের ভেতরেই গেরিলা অপারেশন করছে। ওরা কখনো একজায়গায় থাকে না। গ্রামে গ্রামে ওদের কাজ-কারবার। ঢাকা থেকে তোমাদের এই গ্রামে আসতে আমার একমাস লেগেছে—’

    একমা-স! শান্টু হঠাৎ বুঝতে পারে না কেন একমাস লাগতে পারে। তাই সে বলে ফেলে, ‘ঢাকা থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত বাসে তো তিনঘণ্টা, তারপর রিকশা করে—’

    মোহন আবার হাসে, ‘আমরা তো সোজা বাসে আসিনি। ভাইরা যেখানে যেখানে গেছে, অপারেশন করেছে, তাদের সঙ্গেসঙ্গে ছিলাম। তাই সব দেখেছি, সব শুনেছি। আমি ওদের সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার শরীর খুব খারাপ হয়ে গেছে তো, প্রায়-প্রায় জ্বর, আমাশা লেগেই রয়েছে— তাই ওরা তোমার বাবার আড়তে আমাকে নিয়ে আসে। ওদের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারি তোমার ভাইরাও এর মধ্যে আছে।’

    শান্টু চুপ। কী বলবে সে! এই অসাধারণ বুদ্ধিমান ছেলেটি সবই জানে, সবই বোঝে। তার কাছে ভান করে লাভ নেই। তার মনের ভার নেমে যায়। যাক্, এর সঙ্গে তাকে আর মিথ্যে বলে-বলে না-জানার অভিনয় করতে হবে না। সেইসঙ্গে তার নিজেরও যে মুক্তিযুদ্ধে যাবার প্রবল ইচ্ছেটা … যেটা বাবার নানা যুক্তিজালে ও মায়ের অশ্রুপূর্ণ কাকুতি-মিনতির কারণে মনের মধ্যে চাপা দিয়ে রাখতে হয়েছে—সেটা নিয়ে এর সঙ্গে মন খুলে কথা বলা যাবে। সে মমতা-মাখা স্বরে বলল, ‘এখানে থাকো কিছুদিন, খাও-দাও, বেড়াও, ঘুমোও, দেখবে দু-মাসের মধ্যেই শরীর সেরে গেছে।

    মোহন পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর মৃদুস্বরে যে-কথাগুলি বলল, শান্টুর মনে হল বোমার মতো সেগুলি তার কানের পর্দায় এসে ফাটল যেন। মোহন বলল, ‘অতদিন দেরি করতে পারব না। দিন পনের বিশ্রাম করেই যুদ্ধে চলে যাব। মেশিনগান দিয়ে নিজের হাতে খানসেনাদের মারব, তারপর আমার শান্তি।’

    শান্টু হাঁ-ক্ করে শব্দ করে বলে উঠল, ‘ওরেব্বাপরে! কী অসম্ভব কথা বলছ! তোমার কি যুদ্ধ করার বয়স হয়েছে?’

    ‘আমার বিশ-বাইশ বছরের ভাইদের, আমার আঠার বছরের বোনের কি মরবার বয়স হয়েছিল? আমার মার কি মরার বয়স হয়েছিল? আমার বাবার?’

    শান্টু চমৎকৃত হয়ে মোহনের মুখের দিকে চেয়ে রইল। সত্যি, মোহনের তুলনা হয় না। শান্টুর মা যখন কাঁদতে কাঁদতে শান্টুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘তুই যে এত ছোট। তোর কি যুদ্ধে যাবার বয়স হয়েছে?’ তখন শান্টু তো মার যুক্তি খণ্ডন করে এমনধারা কোনো কথা বলতে পারেনি!

    মোহন হঠাৎ শান্টুর হাত চেপে ধরল, ‘ভাই, আমার একটা উপকার করবে? মুক্তিযুদ্ধের একজন কমান্ডারের কাছে নিয়ে যাবে আমায়?’

    ভয়ে এবং বিস্ময়ে শান্টু প্রায় লাফিয়ে ওঠে, ‘ওরেব্বাপরে! আমি কী করে নিয়ে যাব? আমি কি কাউকে চিনি?’

    ‘কেন কাউকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারবে না? তোমার ভাইদের?’

    ‘হ্যাঁ, তাহলেই হয়েছে আর কী! ভাইদের জিজ্ঞেস করলে উলটো হবে। বাবা-মাকে বলে দেবে আর আমাদের আরো কড়া পাহারায় রাখবে।’

    মোহন অসহিষ্ণু গলায় বলল, ‘কিন্তু কেন? আমরা কী এমন ছোট? ষোল বছর বয়স তো যথেষ্ট বড় বয়স। আমি তো অনেক কিছু পারি। আধমণী একটা চালের বস্তা ঘাড়ে তুলে অনেকটা পথ হাঁটতে পারি, পুকুর থেকে বড় বালতি বোঝাই করে পানি বইতে পারি, কুড়ুল দিয়ে কাঠ চেলা করতে পারি। আমার চাচাতো ভাইদের সঙ্গে থাকার সময় এসব আমি করেছি। এসব তো আগে জীবনে কখনো করিনি। এসব যদি একমাসে শিখে ফেলেতে পারি, তাহলে যুদ্ধ করতে পারব না কেন?’

    শান্টু মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, তাও তো বটে। সেও তো কোরবানির সময় একটা খাসি একলাই পেড়ে ফেলতে পারে। করে না বটে, তবে তার গায়ে যা জোর— তাতে সেও আধমণী ধানের বস্তা, পানি-ভরা বড় বালতি বইতে পারে। তাহলে যুদ্ধ করতে পারবে না কেন? সে বুকটা একটু টান করে বসল। খানিক ভেবে বলল, ‘ভাইদের বলে লাভ হবে না। এখন কিছুদিন আড়ি পেতে ওদের কথাবার্তা শুনব। তাহলে কিছু শুলুক-সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। তারপর আমরা নিজেরাই একদিন না-বলে লুকিয়ে পালিয়ে যাব বাড়ি থেকে।’

    মোহন মাথা নাড়ল, ‘না, পালিয়ে আমি যাব না। এর মধ্যে লুকোছাপার ব্যাপার কিছু নেই। যারা আমার বাবা-মা, ভাই-বোন পুরো ফ্যামিলিটাকে এমনভাবে শুধু-শুধু অকারণে মেরে ফেলেছে, যারা সারাদেশের সব জায়গাতেই মানুষ মারছে, গ্রাম জ্বালাচ্ছে— তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নামা তো আমি ফরজ বলে মনে করি। ধরো কালই যদি মিলিটারি এসে এই গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, তোমার বাবা-মা-ভাইদের মেরে ফেলে, বোনদের বেইজ্জত করে, তখন তুমি কী করবে? তখন তো নিশ্চয় উন্মাদের মতো যুদ্ধ করতেই ছুটবে। তাই না? তাহলে সেটা তোমার পরিবারে না-ঘটা পর্যন্ত চুপ করে বসে থাকবে? অন্যদের পরিবারে ঘটছে বলে এক্ষুনি যুদ্ধে যাবে না?’

    শান্টু সম্মোহিতের মতো মোহনের মুখের দিয়ে চেয়ে রইল। যেন তারই বয়সী মোহন কথা বলছে না, যেন তার স্কুলের মাস্টারসাহেব ক্লাশে পড়া বোঝাচ্ছেন। তারই বয়সী, অথচ মোহন এমন গুছিয়ে কথা বলতে পারে; শান্টু তার ক্লাসের ফার্স্ট বয় হওয়া সত্ত্বেও তো পারে না। শান্টু বলল, ‘উহ্, মোহন, তোমার সঙ্গে কথায় পারা মুশকিল।’

    মোহন হাসল, দুষ্টুমি করে বলল, ‘পারবে কী করে? আমি-যে স্কুলে ডিবেটিং চ্যাম্পিয়ান ছিলাম।’

    .

    নির্ভয়পুর সাবসেক্টরের কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহবুব অনেকক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইলেন। এত কম বয়স ছেলে দুটির! এখনি যুক্তিযুদ্ধে ভর্তি হতে চায়! অবশ্য মাথায় বেশ লম্বা আছে। হঠাৎ ঠাহর করা যায় না যে বয়স মাত্র ষোল। একজন একটু রোগা, কিন্তু খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, তীব্র দৃষ্টি, গম্ভীর মুখ — সব মিলিয়ে বড় বড় ভাব। পাশের ছেলেটার স্বাস্থ্য ভালো হলেও তাকেই বরং কমবয়সী লাগে। কিন্তু মন্টু বলেছে ওরা দুজনেই একবয়সী।

    ছেলেদুটি সেই তখন থেকে এ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মন্টু আগেই ওদের কথা বলে রেখেছিল, আজ নিয়ে এসে শুধু পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে গেছে। তার আড়ত ফেলে বেশিদিন বাইরে থাকার উপায় নেই, গঞ্জের লোকেদের সন্দেহ হতে পারে।

    ক্যাপ্টেন মাহবুব জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী নাম তোমাদের?’

    শান্টু বলল, ‘শান্টু’।

    মোহন বলল, ‘নান্টু।’

    ‘তোমাদের ইচ্ছে আর সাহস দেখে খুব খুশি হয়েছি। তবে জানো তো, এখানে জীবন ভয়ানক কঠিন। এ তো রেগুলার আর্মির যুদ্ধক্ষেত্র নয়, এ হল গেরিলার গুপ্ত যুদ্ধক্ষেত্র। এখানে শত্রু শুধু সামনেই থাকে না, এখানে শত্রু চারপাশে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখন তোমাকে ধরিয়ে দেবে, বোঝবার আগেই দেখবে ধরা পড়ে গেছ।’

    ক্যাপ্টেন মাহবুব আরো অনেকক্ষণ ধরে গেরিলা-জীবনের বিপজ্জনক ঝুঁকি ও নিদারুণ কষ্ট, মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা, জীবনের অনিশ্চয়তা ইত্যাদি বিষয় বেশ লোমহর্ষকভাবে বলে গেলেন। শুনতে-শুনতে শান্টু মাঝেমাঝে শিউরে উঠছিল, কিন্তু মোহন অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখের পাতাও বুঝিবা পড়ছিল না। সে স্থিরদৃষ্টিতে ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল, আর মনে-মনে জবাব দিচ্ছিল, ‘জীবনটা তো দেবার জন্যই এসেছি। শত্রুর শেষ না- দেখা পর্যন্ত ছাড়ব না। এত কথার দরকার কী? যা-যা শেখাবেন, সব নির্ভুল শিখব। যা যা নির্দেশ দেবেন, সব অক্ষরে অক্ষরে পালন করব

    1 2 3
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবিদায় দে মা ঘুরে আসি – জাহানারা ইমাম
    Next Article সাতটি তারার ঝিকিমিকি – জাহানারা ইমাম

    Related Articles

    জাহানারা ইমাম

    একাত্তরের দিনগুলি – জাহানারা ইমাম

    August 13, 2025
    জাহানারা ইমাম

    নিঃসঙ্গ পাইন – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    সাতটি তারার ঝিকিমিকি – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    বিদায় দে মা ঘুরে আসি – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    বীর শ্রেষ্ঠ – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    নয় এ মধুর খেলা – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }