Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শব্দযাত্রা লেখক সংঘ – জুবায়ের আলম

    জুবায়ের আলম এক পাতা গল্প333 Mins Read0

    শব্দযাত্রা লেখক সংঘ – ১

    ১০১

    রাত দশটা বাজতে পারে। আবার এগারটাও বাজতে পারে।

    আশেপাশে দোকানের শাটারগুলো নামতে শুরু করেছে অনেকক্ষণ আগেই। হু হু করে রাতের বাতাস বয়ে যাচ্ছে প্রকাশনী পাড়ার সরু গলিগুলোর ভেতর দিয়ে। সেই বাতাসে বইয়ের গন্ধ। ইনসমনিয়ায় ভোগা ল্যাম্পপোস্টের আলো মাড়িয়ে দু’একজনকে এখনও দেখা যাচ্ছে। কেউ চায়ের দোকানদার, দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরছে; কেউ প্রুফ রিডার, বইয়ের শেষ অক্ষরটা পড়ে বাড়ি ফিরছে; কেউ পুরনো বইয়ের দোকানদার, নিজের বস্তির নোংরা ঘরটাতে ফিরছে; আবার কেউ অনেক বড় কোন প্রকাশনীর প্রকাশক, শব্দদেরকে দুই মলাটে বন্দী করে ফিরে যাচ্ছেন নিজের বাড়িতে।

    রাস্তায় মানুষের চলাচল আছে। পাশেই প্রেসপাড়া। সেদিকটা এখনও সরগরম। কিন্তু প্রেসপাড়ার চেয়ে বইপাড়ায় রাত নেমে আসে একটু আগেভাগেই।

    কিন্তু ঢ্যাঙ্গা ছায়ামূর্তিটাকে দেখে অবশ্য মনে হল না যে সে এই বাড়ি ফেরা লোকগুলোর দলে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে ‘কালের কলম’ প্রকাশনীর অফিসের আলোকিত জানালাটার দিকে তাকিয়ে আছে সে। ঠিক একটা শিকারী অনেকক্ষণ ধরে শিকারকে পর্যবেক্ষন করে, ঠিক সেভাবে।

    আলোকিত জানালায় একটা ছায়া এসে দাঁড়ালো। কায়সার আবেদীনের ছায়া। জানালাটা চারতলায়। এত উঁচুতেও জ্বলন্ত সিগারেটের লাল বিন্দুটা চোখ এড়াল না ছায়াটার। চোখ এড়াল না জানালার পাশ দিয়ে নেমে যাওয়া পানির পাইপটা। সিগারেট শেষ হতেই কায়সার আবেদীন সরে গেলেন জানালা থেকে।

    মনে মনে হিসাব কষে নিল ছায়াটা। কাজটা শেষ করে দ্রুত প্রেসপাড়া দিয়ে বের হয়ে যেতে হবে। প্রেসপাড়া পার হলে সোজা তলস্তয় সরণী। সেখান থেকে সিটি সার্ভিসের বাস পাওয়া যাবে।

    ছায়াটা রাস্তা পার হল। গার্ডদের শিফট বদল হয়ে গিয়েছে। এখনও গার্ড আসেনি। তবে কিছুক্ষণের ভেতরেই এসে পড়বে। যতটা কম সময়ে কাজটা করা যায় ততই ভালো।

    পুরনো কলাপসিবল গেটটা খুললেই অন্ধকার সিঁড়ি; সরু আর খাড়া। একটা একটা করে ধাপ ভেঙে উঠতে শুরু করল ছায়াটা। প্রতিটা নিঃশ্বাস যেন এক একটা ঘণ্টা। খুব ধীর, মাপা মাপা

    চারতলায় ওঠার আগেই ছায়াটা হাতে ক্লিনিক্যাল গ্লাভস দুটো পরে নিল। ওগুলো রেডিয়াম মেশানো থাকায় অন্ধকারে মৃদু সবুজাভ আলো নিয়ে জ্বলতে লাগল।

    ওই তো, দরজাটা। হালকা খোলা আছে। সরু সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামা করা মৃদু মন্দ বাতাসে ভোঁতা শব্দে বাড়ি খাচ্ছে একটু পর পর।

    বুক ভরে একটা শ্বাস নিল ছায়াটা। প্যান্টের পেছনের পকেট থেকে বের করে আনলো একটা কলমের কেস। চকচকে বেগুনী রঙের কেস। কেসটা খুলে একটা কলম বের করে আনলো ছায়াটা, ঢাকনাটা খুলে বাম হাতে নক করল দরজায়। অন্ধকারের অন্ধকার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল দরজার সামনে।

    কে?

    ভেতর থেকে প্রশ্ন করলো কায়সার আবেদীন।

    কে? “মনসুর আসছো নাকি?” প্রশ্ন করতে করতে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন কায়সার।

    দরজাটা খুলতেই অন্ধকার থেকে একটা হাত কায়সারের গলা বরাবর একটা কলম বসিয়ে দিল। মৃদু ‘ফট’ করে একটা শব্দ হল। বিঁধে যাওয়া কলমটা নিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন কায়সার। ফ্যাস ফ্যাস করে শব্দ বের হতে শুরু করল ফুটো হয়ে যাওয়া গলা দিয়ে। তার মানে কণ্ঠনালী বরাবরই আঘাতটা করা হয়েছে- নিজেকে নিজেই বলল ছায়াটা। চিৎকার করার রাস্তাটা বন্ধ

    ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করল। চোখ ভর্তি বাঁচার আকুতি আর অবিশ্বাস নিয়ে দুই হাত দিয়ে বিঁধে থাকা কলমটা বের করার চেষ্টা করতে লাগল কায়সার। ছায়াটা অফিসঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল। বাম পা দিয়ে ঠেলে লাগিয়ে দিল দরজা। বিদ্যুৎবেগে কলমটা গলা থেকে টেনে বের করে নিয়ে একেবারে কায়সারের ডান চোখে বসিয়ে দিল সেটা। কায়সার আবেদীনের বোবা চিৎকারে ভারি হয়ে উঠল ঘরের বাতাস।

    এর পরের কাজটুকু সহজ, জানে ছায়াটা। কলমটা বের করে কায়সারের গলাটা আরেকপ্রস্থ খুঁচিয়ে দিল সে। মানুষের জীবন, এত সহজে কি আর হার মানে? হাত পা ছুঁড়তে লাগল একটু অক্সিজেনের আশায়। ছিন্ন বিচ্ছিন্ন শ্বাসনালি সেই আশা আর পূরণ করতে পারল না। আঁকড়ে বেঁচে থাকার কি আকুতি।

    অস্ফুট গোঙানি কিছুক্ষণ, আর মেঝের ওপরে হাত পা আছড়ানোর শব্দ। তারপরে সব চুপচাপ।

    উষ্ণ রক্তের ছিটায় ভিজে যাওয়া ছায়াটা এবার রুমের কাগজপত্রের দিকে মন দিল। বিশেষ একটা কাগজ খুঁজতে লাগল ছায়াটা। খুব বেশি পরিশ্রম করতে হল না। টেবিলের ওপরেই ছিল। ফাইলটা উল্টে পাল্টে কয়েকবার দেখল ছায়াটা। পকেট থেকে ছোট্ট একটা চিরকুট বের করে টেবিলের ওপরে রাখল।

    হঠাৎ কলাপসিবল গেট টানার শব্দ। গার্ড চলে এসেছে।

    ছায়াটা দ্রুত ফাইলটা ভাঁজ করে প্যান্টের ভাঁজে ঢুকিয়ে নিল। তারপর দরজাটা ভেতর থেকে লাগিয়ে দিল। জানালার থাইগ্লাসটা খুলে ফেলতে মিনিট দুয়েকের বেশি সময় লাগল না। তারপর পাইপ বেয়ে অবলীলায় নেমে গেল নিচে রাস্তায়।

    দরজায় ততক্ষণে নক করা শুরু করে দিয়েছে গার্ড মনসুর, “ছার, ছার কি আছেন? ছার? ও ছার।”

    জনৈক ভূত লেখক

    কটা পৃষ্ঠা উল্টালো। হলুদ আলো তার চেক শার্টটা আলোকিত করতে করতে বুকের কাছে এসে থেমে গিয়েছে। বুক থেকে বাকিটুকু অন্ধকার। মুখমন্ডল তাই দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে লোকটা বলে উঠল, “সুখী মানুষদের দিয়ে লেখালেখি হয় না। দুঃখ আর একটু হারানোর বেদনা- দুটো জিনিস একজন লেখককে অবশ্যই সব সময় তার ব্যাগে রাখতে হবে। যাতে করে সে মৃত্যুর কাছাকাছি যেতে পারে। লেখকদের উচিৎ মৃত্যুর কাছে নিজেকে শপে দেওয়া। যদি মৃত্যু তাকে ফিরিয়ে দেয়, তাহলেই একমাত্র সে কালজয়ী কিছু একটা লিখতে পারবে। আর যদি মৃত্যু তাকে গ্রহন করে, তাহলে সেই হয়ে যাবে অন্য কোন লেখকের লেখার উপজীব্য।”

    ****

    গোল, বিশাল আর ঘোলাটে ঝলসানো রুটিটা ঝুলছিল আকাশে।

    তাকাবে না তাকাবে না করেও ঝলসানো রুটির ওপরে চোখ পড়ল সুকান্তের। সাথে সাথে ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেল; সচরাচর যা হয়। আর চোখ সরানো গেল না। মূর্তির মত ঝলসানো রুটিটার দিকে তাকিয়ে থাকল। জ্বলজ্বল করে জ্বলছে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা দুইটা ভবনের মাঝখানে।

    ঝলসানো রুটির নিজের কোন আলো নেই। সূর্যের আলোতেই এটা জ্বলজ্বল করে। বদলে সূর্য অবশ্য তেমন কিছুই পায় না; চায়ও না। কিন্তু আফসোস, সূর্যের চাইতে ঝলসানো রুটিগুলোই বেশি প্রশংসা কুড়ায়। সূর্যকে নিয়ে কেউ কাব্য কবিতা তেমন একটা লেখে না যতটা না ঝলসানো রুটিটাকে নিয়ে লেখে।

    এরকম অনেক ঝলসানো রুটিকে সুকান্ত এনে দিয়েছে যশ, খ্যাতি। কিন্তু সূর্যের মত নিঃস্বার্থ সে না। বদলে সে গুনে নিয়েছে মোটা অংকের টাকা। যশ আর খ্যাতির মোহ ভুলে সে নিজের লেখাগুলোকে বিক্রি করে একেবারে অচেনা অজানা কিছু মানুষের কাছে। আবার অন্যের হয়ে সে লিখেও দেয় অনেক কিছু, যা তারা চায় আর কি।

    একজন লোকের সাথে ধাক্কা লাগতেই সুকান্তের সংবিৎ ফিরল; সচরাচর যেমন ফেরে। লোকটা একটা বইয়ের বান্ডিল কাঁধে করে ভিড় ঠেলে সামনে চলে গেল, কুলি। আশেপাশের হৈ চৈ চেঁচামেচি কানে স্পষ্ট হল। এতক্ষণ যেন এই পৃথিবীতে সুকান্ত আর ঐ ঝলসানো রুটিটা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

    জায়গাটা প্রেস পাড়া। অক্ষর আর বইদের জন্মস্থান। ছাপাযন্ত্রের ঘটাং ঘটাং শব্দ। সীসার হরফভর্তি কাগজ বের হয়ে আসার চাপা শোঁ শোঁ শব্দ। পেপার ফোল্ডার মেশিনের ফর ফর করে পাতা ওলটানোর শব্দ। কাগজে জলছাপ মারার ধপ ধপ শব্দ। চায়ের দোকানের ‘এছিছটেন’ রতনের হাতে খালি চায়ের কাপের ঠোকাঠুকির শব্দ। আর এলোমেলো কণ্ঠের বেসুরো কোলাহল। সব মিলিয়ে জায়গাটায় এতটুকু নীরবতা নেই। নবজাতক মানবশিশুর আঁতুড়ঘরের মতই জায়গাটা ঘিঞ্জি আর নোংরা।

    এখানকার বাতাসে সীসা, নিকোটিন, ঘাম আর চায়ের গন্ধ মিলে একটা অদ্ভুত গন্ধ তৈরি হয়। একটা দম আটকানো গন্ধ। সুকান্তেরও দম আটাকাতো। এখন অবশ্য অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। হীরার খনি আর ছাপা খানায় কাজ করা একই কথা। হীরার খনিতে যেমন বিষ থাকে; কার্বন মনক্সাইড, তেমনই ছাপাখানার বাতাসেও বিষ থাকে, সীসার বিষ। নিঃশ্বাসে ফুসফুসে যায় কয়লা। সেখান থেকে ক্যানসার। তাই ছাপাখানার কর্মী বেশিদিন বাঁচে না। আর বাঁচলেও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। শিকাগোর ‘ম্যাড হ্যাটার’দের মত। যারা দাঁত দিয়ে হ্যাটের কার্ণিশে বের হয়ে থাকা অতিরিক্ত সুতা কাটতে কাটতে খুব অল্প বয়সেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলত। কারণ সুতার রঙে থাকত খুব উচ্চ মাত্রায় সীসা। সীসার বিষক্রিয়া মারাত্মক। বইয়ে ছাপা কালো অক্ষরে লেখকের মস্তিষ্ক উদ্গীরত রক্তিম মেধার সাথে নিভৃতে মিশে থাকে এইসব কর্মীদের খানিকটা আত্মত্যাগ।

    সুকান্ত সব জানে। শুধু জানেই না, মেনেও নিয়েছে। বেছে নিয়েছে ছাপাখানায় টাইপিস্টের পেশা। যদিও আজকাল টাইপিস্টদের চাহিদা কমে আসছে। এখন আর লেখকরা হাতে লিখে পাণ্ডুলিপি পাঠান না। নিজেরাই টাইপ করে পাঠান। বিশেষ কোন প্রয়োজন না পড়লে তাই টাইপিস্টদের কেউ খুব একটা দ্বারস্থ হয় না।

    কিন্তু ভূত লেখক হিসাবে যা আসে পকেটে, সুকান্তের চলে যায়। ভালো মত চলে যায়।

    দুইপাশের সারি সারি বাইন্ডিং ঘর আর ছাপাখানাগুলো পেরিয়ে সুকান্ত সামনে যেতে থাকে। একটু কুঁজো হয়ে কোন এক দোকানে ঝোলানো ঘড়ি থেকে দেখে নেয় কয়টা বাজে।

    রাত দশটা সাঁইত্রিশ। সুকান্তের শিফট শেষ হয়ে পঁচিশ মিনিট পেরিয়ে গিয়েছে।

    সরু গলিটা পেরিয়ে বড় রাস্তায় বের হতেই বসন্তের বেপরোয়া বাতাস তাকে জড়িয়ে ধরল। আহ! ছাপাখানার ভেতরটা কি গুমোট গরম! যেন হাবিয়া থেকে মুক্তি পেয়ে একটু দারুল মাকামের বাতাস গায়ে এসে লাগল। আসলেই ছাপাখানার ভেতরটা ভ্যাপসা গরম। সুকান্ত বুক ভরে দম নেয়। খুলে দেয় পরণের সস্তা শার্টের ওপরের দুটো বোতাম।

    রাত আটটার পরে এমনিতেই এদিককার প্রকাশনীর অফিসগুলো বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। তাই বড় রাস্তায় কোলাহল কম। সুকান্ত হাঁটতে থাকে। একটু হাঁটলেই সামনে তলস্তয় সরণী। ওখান থেকে সিটি সার্ভিসের বাস ধরে শহরতলী। ‘অতিথি’ নামের একটা তিনতলা বাড়ির চিলেকোঠায় থাকে সে। বাড়িওয়ালা অবসরপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। তার একমাত্র মেয়ে নোভাকে সে অনিমিয়তভাবে টিউশনি দেয়। নোভা এবার ক্লাস টেনে উঠবে। এই বয়সের মেয়েকে টিউশনি পড়ানো উচিৎ না। এরা বিপজ্জনক হয়। কোন ছেলের সাথে পালিয়ে গেলে মার খেতে হবে তাকেই। না পড়ানোর সিদ্ধান্ত সুকান্ত অনেক আগেই নিয়ে ফেলেছে। কিন্তু শুধু ‘না’ বলতে পারার অপারগতার কারণে সেই সিদ্ধান্ত আর বাস্তবায়ন হয়নি। যদিও ওদের পরিবারের সাথে একটা অন্যরকম সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে, তারপরও এই সম্পর্কের ফলাফল শেষমেষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে জানে না সুকান্ত। তাই শুধু টিউশনিটাই না, বাসাটাই ছেড়ে দিতে হবে। নতুন বাসা পাওয়া কঠিন, কিন্তু উপায় নেই।

    কি মনে করে একবার পেছনে তাকালো সে। হঠাত করেই কেন যেন মনে হল, কেউ তাকে অনুসরণ করছে। সারা শরীর ছমছম করে উঠল। কিন্তু পেছনে ব্যস্ত প্রেস পাড়ার সরু গলি। কুলি মজুর আর বস্তা মোড়া বইয়ের চাঁই রাখা ভ্যানের আড়ালে এমন কাউকেই পাওয়া গেল না যাকে দেখে মনে হয় যে সে অনুসরণ করছে।

    ধূর! তাকে কে অনুসরণ করবে? প্রেসের কম্পোজার। একজন সামান্য প্রেসের কম্পোজারকে অনুসরণ করার কোন কারণ থাকার কথা না। সুকান্ত নিজেকে প্রবোধ দিল। কিন্তু মনের ভেতরে একটা খচখচানি থেকেই গেল। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বারবার বলতে লাগল, কেউ অনুসরণ করছে।

    মাথার ভেতরে ঝলসানো রুটি ঘুরপাক খাচ্ছে। তাই ষষ্ঠ ইন্দ্ৰিয় খুব একটা সুবিধা করতে পারল না। কিছুক্ষণের ভেতরেই সুকান্ত অনুসরণের ব্যাপারটা ভুলে গেল। ব্যস্ত হয়ে গেল ঝলসানো রুটি নিয়ে। রুটিটার দিকে তাকানো উচিৎ হয়নি সুকান্তের। ঝলসানো রুটিটা যতক্ষণ ঘুরপাক খাবে ততক্ষণ মাথা ভারি হতে থাকবে। তারপর কপাল আর দুই চোখ জুড়ে শুরু হবে অসহনীয় ব্যথা। কত মানুষকে সে টাকার বিনিময়ে উপন্যাস আর ছোট গল্প লিখে দিয়েছে? কত মানুষকে সে ঝলসানো রুটি বানিয়েছে? হিসাব নেই। সুকান্ত ইচ্ছা করেই রাখেনি। ‘ভূত লেখক’ হয়ে শুধু টাকাটা গুনে নিয়েছে। খ্যাতি বিসর্জন দিয়েছে। যাদের হয়ে সে বই লিখে দেয় তাদের কারো সাথে সামনাসামনি পরিচয় হয়নি সুকান্তের। তাই কাদের হয়ে বই লিখল আর কেই বা সেই লেখা নিজের নামে ছেপে ‘কালজয়ী লেখক’ উপাধি পেয়ে গেল- এসব কিছুই দেখে না সে। মাঝে-মধ্যে দু-একটা বই তার হাতে আসে কাকতালীয়ভাবে। উল্টে-পাল্টে যখন দেখে যে এটা তারই লেখা উপন্যাস- তখন নিজের বিক্রি করা সন্তানটাকে বুকের ভেতরে জড়িয়ে ধরে সে। কার নামে বইটা ছাপা হয়েছে সেটা আর দেখে না। দেখার প্রয়োজনবোধ করে না। প্রথম প্রথম সুভাষদার কাছে ধরনা দিতে হত কন্ট্রাক্টের জন্য। অভাব বেশি হলে সুভাষদার হাতে পায়েও ধরতে যেত। এখন আর ধরনা দিতে হয় না। সুভাষদাই তার কাছে কন্ট্রাক্ট নিয়ে আসেন। কিন্তু সুকান্ত কবে থেকে ভূত লেখক হয়ে গেল? কেন সে যশ খ্যাতির লেখক সুলভ মোহ ছেড়ে টাকার বিনিময়ে নিজের সন্তানের মত সাহিত্যকর্ম বিক্রি করতে শুরু করল? দারিদ্র্য? উঁহু। সে এক নোংরা ইতিহাস। সে কথা আর মনে করতে চায় না সুকান্ত। কিন্তু ওই যে, ঝলসানো রুটিটার দিকে তাকালেই সেই অতীত মনে পড়ে যায়। সেই অতীত, যা তাকে ভূত লেখক হতে বাধ্য করেছিল।

    তীব্র হর্ন বাজিয়ে প্রাইভেট কারটা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। জানালা খুলে একটা গালিও দিয়ে গেল আরোহী। আর একটু হলেই ওটার ধাক্কায় দু তিন হাত ছিটকে যেত সুকান্ত! মাথা ফেটে ঘিলু বেরিয়ে যেত আধ সেদ্ধ পুডিঙের মত। কখন যে তলস্তয় সরণির মোড়ে পৌঁছে গিয়েছে খেয়ালই করেনি সুকান্ত।

    বুক থেকে একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল।

    রাস্তার উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকা সিটি সার্ভিসের বাসটা চোখে পড়ল। এলোমেলোভাবে সেদিকে পা বাড়াল। এমন আনমনা হয়ে হাঁটা যাবে না আর। ঝলসানো রুটির দিকেও তাকানো যাবে না।

    তেল চিটচিটে টেবিলের ওপাশে এক কিশোর বসে ছিল। “একটা উপশহরের টিকিট দাও তো”- সুকান্ত বুক পকেটে রাখা খুচরা টাকা হাতড়াতে হাতড়াতে বলল। তারপর একটা পনের টাকার নোট বাড়িয়ে ধরল ছেলেটার দিকে। ছেলেটা ফরাত করে একটা টিকিট ছিঁড়ে সুকান্তের দিকে ঠেলে দিল।

    সাথে সাথে সুকান্তের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আবার খোঁচাতে লাগল- কেউ তাকে অনুসরণ করছে। যে অনুসরণ করছে তার উদ্দেশ্য ভালো না। এটা অবশ্য ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় না বললেও চলত। সুকান্ত জানে, অনুসরণ করা শিকারীর লক্ষণ। যত দক্ষ শিকারী, তত দক্ষ অনুসরণকারী।

    সুকান্ত আড়চোখে পেছন দিকটা দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু রাস্তার উল্টো দিক, যেখানে সে একটু আগে দাঁড়িয়ে ছিল, সেই জায়গাটা ফাঁকা। আশেপাশে লুকানোর মতও কিছু নেই যার আড়ালে অনুসরণকারী লুকাবে। কি হল আজ? বারবার এমন কেন মনে হচ্ছে?

    বিরক্তি আর বিভ্রান্তি নিয়ে সুকান্ত বাসের পেছনের দরজা দিয়ে বাসে উঠে পড়ল। বসে পড়ল তেল চিটচিটে নোংরা সিটগুলোর একটাতে।

    সুকান্তের অগোচরে বাসে উঠল আরো একজন যাত্রী; বাসের সামনের দরজা দিয়ে।

    ***

    “দেহি টিকিট্টা”- টিকিট চেকারের ডাকে ঘুম ভাঙল সুকান্তের। আধ বোজা চোখে বুক পকেট হাতড়ে টিকিট খুঁজতে পাগল। দেরি হচ্ছে দেখে টিকিট চেকার জিজ্ঞাসা করল, “লামবেন কুথায়?”

    ঠোঁট জোড়া জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে সুকান্ত বলল, “কেয়া ক্লিনিকের মোড়ে”। পকেট থেকে দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া টিকিটটা চেকারের দিকে বাড়িয়ে ধরল। টিকিটটা ছিঁড়ে দিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

    বাসের ভেতরটা আবছা আলোয় আলোকিত। সামনের দিকের দুটো লাইট জ্বলছে। মাঝখানের কয়েকটা লাইট জ্বলছে না। আবার শেষের একটা লাইট জ্বলছে। পুরো বাসটার ভেতরে একটা আবছায়া তৈরি হয়েছে। সামনের সিটের খোলা জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস আসছে। রাতের বাতাস সুকান্তের ঘুম মাখা মুখে ঝাপটা দিয়ে যাচ্ছে। বাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকা লালা মুছল সে। তারপর এদিক ওদিক তাকালো।

    সহযাত্রী বলতে মোট পাঁচজন। দুজন সামনে, তিনজন পেছনে। প্রত্যেককেই মনে হল অফিস ফেরত ক্লান্ত চাকর। ঘুমে ঢুলছে, আর বাসের তালে তালে দুলছে। সুকান্ত আবার জানালায় হেলান দিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আবার তাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিল। বাস থেকে নেমে যেতে হবে তাড়াতাড়ি। যে তাকে অনুসরণ করছে সে এই বাসেই আছে। খুব কাছেই আছে। সে মানুষ না। সে অন্য কিছু।

    গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল সুকান্তের। তন্দ্রা কেটে গেল মুহূর্তের ভেতরে। আশেপাশের সহযাত্রীদের দিকে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিল। নাহ। সবাই আগের মতই আছে। জানালা খুলে সে দেখার চেষ্টা করল কতদুর আসল বাসটা। সারি সারি বন্ধ দোকানগুলো আর আলোকিত সাইনবোর্ড দেখে বোঝা গেল এখনও শহরের ভেতরেই আছে।

    নাহ। নামা যাবে না। যা হবে বাসের ভেতরেই হোক।

    বাস ‘দ্য মুন’ হোটেলের সামনে থামল। দুজন যাত্রী নেমে গেল। বাকি থাকল তিনজন। সুকান্তের হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল যেন তিনগুন। তিনজনের কাউকেই তো দেখে ‘শিকারী’ বলে মনে হচ্ছে না। তাহলে কেন তার বার বার মনে হচ্ছে যে আজ রাতই তার জীবনের শেষ রাত? তার অপরাধ কি? সে ভূত লেখক এই কী অপরাধ? নাকি?

    বাস চলতে থাকল। নামা-থাকার দোলাচালে কেটে গেল বেশ কিছুটা সময়। একজন যাত্রী ঘুম ভেঙে চিৎকার করে উঠতেই আঁতকে উঠল সুকান্ত। চমকে তাকালো লোকটার দিকে। “ওই, ওই নামব। থামাও।” চিৎকার করে উঠল লোকটা। ওহ! এই ব্যাপার। কড়া ব্রেক করে বাস থামল। নেমে গেল লোকটা।

    বাকি থাকল আর দুইজন। উপশহর আর কতদূর? ঢোঁক গিলল সুকান্ত। প্রতিদিনের চেনা রাস্তাটাও যেন অচেনা মনে হচ্ছে তার। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েও বুঝতে পারছে না বাসটা ঠিক কোথায়। বার বার আড়চোখে পেছনে বসে থাকা সহযাত্রী দুজনকে দেখতে লাগল সে। মূর্তির মত বসে আছে দুইজন। যদি দুইজনের ভেতরে একজন তাকে ‘কিছু’ করতে আসে, দ্বিতীয়জন কি তাকে বাঁচাতে আসবে না? নাকি দুইজনই আততায়ী? কুলকুল করে ঘামতে শুরু করল সে।

    নিজের মনের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। সুকান্ত বারবার নিজেকে বোঝাতে লাগল, কিচ্ছু হয়নি। কেউ তাকে অনুসরণ করছে না। মানসিক অস্থিরতা বাড়তে লাগল।

    “উপোষর উপোষর” হেলপার ছেলেটা চিৎকার করে উঠল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সুকান্ত। হাপরের মত ওঠা নামা করতে লাগল বুক। এত তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে ভাবতেও পারেনি। কাঁপা হাতে সিট ধরে উঠে দাঁড়াল সে। সামনের দরজাটা খুব বেশি দূরে না।

    “চালু করেন, চালু করেন, চালু কইরা লাবেন।” হেল্পার ছেলেটা তাড়া দিল। সুকান্ত নেমে পড়ল বাস থেকে।

    সুকান্ত আশা করেছিল, পেছন পেছন আরো কেউ নামবে। নামল না। কেউ তাকে খুন করার জন্য এগিয়ে এল না। ঘড় ঘড় করে সিটি সার্ভিসের ক্লান্ত বাসটা অন্ধকারে হারিয়ে গেল। ঘন ঘন শ্বাস প্রশ্বাসই প্রমাণ করে দিল, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ভুল বুঝিয়েছে সুকান্তকে।

    কিন্তু আজকেই কেন হঠাত ভুল বোঝাল?

    ঝলসানো রুটিটা ততক্ষণে দূরের ঝিঁ-ঝিঁ ডাকা দেবদারু গাছের সারির আড়ালে লুকিয়েছে।

    পাছাখানার ভূত

    জিভ দিয়ে দিয়ে ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে নিলেন, তারপর নিঃশব্দে পাতা উল্টালেন ভদ্রলোক। বললেন, ‘মানুষ কি ভাববে, মানুষে কি বলবে’- এটা লেখকরা এড়িয়ে যেতে পারে না। তার প্রতিটা কথায়, প্রতিটা কাজে মানুষ কী প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে- সেটা লেখককে গায়ে মাখতে হবে। এতে দুটো উপকারিতা আছে। প্রথমত, মানুষটার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানা যাবে। দ্বিতীয়ত, মানুষটার ভালো বা খারাপ কথায় লেখক প্রভাবিত হবে। লেখকদেরকে প্রভাবিত হতে হয়। দেশভাগের সময়কার অস্থিতিশীলতায় যদি সাদাত হোসেন মান্টো প্রভাবিত না হতেন, তাহলে তিনি টোবাটেক সিং’ নামের ছোট গল্পটা লিখতে পারতেন না। এভাবেই, জীবনের প্রতিটা অভিজ্ঞতা দ্বারা লেখককে প্রভাবিত হতে হবে। প্রিয়জন বিচ্ছেদ, বন্ধুবিয়োগ, প্রেম, নস্টালজিয়া- সব কিছু যেন লেখককে প্রভাবিত করতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। লেখকরা সাধারণ কেউ নন। তারা দেবতাদের মত স্বার্থপর আর অসুরদের মত হিংস্ৰ।

    ****

    খট খট খট খট খটাখট ক্ল্যাক ক্ল্যাক খট খটাখট খটাখট খট খট

    আঙুলগুলো কিবোর্ডের বোতামের ওপরে দৌড়ে বেড়াচ্ছে সুকান্তের। চোখের মনি একবার ডান দিকে রাখা ক্লিপ বোর্ডে আটকানো কাগজের দিকে যাচ্ছে আর একবার কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে যাচ্ছে। পাশের পার্টিসনের ওপাশে ঘড় ঘড় করে ছাপা খানার মেশিনগুলো চলছে। হৈ চৈ হচ্ছে। কিন্তু সুকান্ত মূর্তির মত বসে আছে। চলছে শুধু তার চোখের মনি আর হাতের আঙুল।

    সকাল দশটায় শিফট শুরু হয় তার। আজকেও তাই হয়েছে। দশটার দিকে বইপাড়ার প্রকাশনীর অফিসগুলোর ওদিকে জটলা দেখেতে পেয়েছে। কয়েকটা পুলিশের গাড়িও ছিল। সুকান্তের কৌতূহল কম, তাই উঁকি দেয়নি। একবার ভাবল, রতনকে ডেকে জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে। কিন্তু কাজের মধ্যে ডুব দিতেই সব ভুলে গিয়েছে।

    বেশ কিছুক্ষণ পরে কিবোর্ডের পাশে রাখা শূন্য চায়ের কাপটা নিতে নিতে রতন বলল, “সুবাসদা আইছে। আপনেরে খোজতেছে।” স্ক্রিন থেকে চোখ না সরিয়েই সুকান্ত মাথা নাড়ল। আরো কয়েকটা অক্ষর লিখে উঠে দাঁড়ালো। সুভাষদা আসা মানেই নতুন কোন কন্ট্রাক্ট।

    পল সুভাষ সরকার, এক নাম করা প্রকাশনীর প্রুফ রিডার। অশীতিপর। আগে মোহাম্মদপুরের কোন বেসরকারী স্কুলে বাংলার শিক্ষক ছিল। রিটায়ারের পরে এখন প্রুফ রিডিং-এর কাজ করে। কিন্তু তার মুখের উচ্চারণ ভঙ্গি দেখে মোটেই মনে হয় না কোনো এক সময় স্কুলে বাংলা শিক্ষা দিত। বিভিন্ন প্রকাশনীতে নাম করা লোকেদের ‘আবদার’ আসলে সে সেই আবদার মেটানোর আবদার নিয়ে সুকান্তের কাছে ছুটে আসে। পুরো ব্যাপারটাই হয় গোপনীয়তার সাথে। গরীব দেশে মেধা স্বত্ব আইনের বালাই নেই। কিন্তু ক্লায়েন্টের মান সম্মানের দিকটা বিবেচনা করা এই গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়। পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়ে গেলে সুভাষ ক্লায়েন্টকে জানিয়ে দেয়। ক্লায়েন্ট টাকা পরিশোধ করলেই সুকান্ত পাণ্ডুলিপি দিয়ে দেয় সুভাষের হাতে।

    প্রেসের পেছন দিকে পুরনো আর গর্দ্দা কাগজের মোটা মোটা বান্ডেল জমা করা থাকে। সেই বান্ডিলগুলোর একটার ওপরে সুভাষ বসে আছে, মনোযোগ সামনে ধরা খবরের কাগজে। সুকান্ত এসে আরেকটা বান্ডিলের ওপরে বসলেও সুভাষের মুখের সামনে থেকে খবরের কাগজটা নামল না। সুকান্ত বলল, “কাজ পড়ে আছে সুভাষদা। একটু তাড়াতাড়ি।”

    সুভাষ কাগজ নামিয়ে গম্ভীর মুখে বলল, “কাল রাতে কি হইছে শুনছিস?”

    “না। কেন? কি হয়েছে?”

    “সকালে এত পুলিশ টুলিশ আইসা পড়ল তাও জানিস না কিছু?”

    “দেখো সুভাষদা, আমাকে আন্ডারকভারে থাকতে হয়। যেখানে সেখানে আমি উঁকি দিতে পারি না। জরায়ু ভাড়া দেওয়ার মত আমাকে আমার মেধা ভাড়া দিতে হয়। কৌতূহল জিনিসটা তাই আমার সাথে যায় না। তাছাড়া পুলিশ সব খানেই আসে। বিশেষ কিছু হলে আমি যদি নাও জেনে থাকি সেটা অস্বাভাবিক কিছু না।”

    “চটছিস ক্যান? কাল রাতে কালের কলম প্রকাশনীর প্রকাশক কাল রাতে খুন হইছে ব্যাটা।”

    “মানে কায়সার আবেদীন!”

    “হয়।”

    কিছুক্ষণ লাগল নিজেকে গুছাতে। তারপর সুকান্ত জিজ্ঞাসা করল, “কীভাবে খুন হল কিছু জানা গেছে?”

    “কলম দিয়ে খুচায়া মারছে। “বল কি!”

    “হ্যাঁ। চাকুর মত ব্যবহার করছে কলমটারে। প্রথম খোঁচাটা সম্ভবত গলায় দিছে। তারপর চোখে, তারপর আবার কয়েকটা খোঁচা গলাতেই বসাইছে। তারপর-

    “তুমি দেখেছ?”

    “নাহ। শুনলাম। তাছাড়া পেপারেও আসছে। এই যে দেখ।”

    পেপারেও চলে এসেছে? মনে মনে ভাবল সুকান্ত। হাত বাড়িয়ে পেপারটা নিল। সুভাষদা বেশি কথা বলে। তাই দু একটা কথা বানিয়ে বলে ফেলে। পেপারে হয়ত সঠিকটা জানা যাবে।

    “রাতে খুন হল আর সকালেই পেপারে চলে আসল?”

    “আরে কাল রাতে নাইট গার্ড মনসুর রাত দশটার সময় গেটে তালা দিতে গিয়ে দেখতে পাইছে কায়সার সাহেবের অফিসরুমে আলো জ্বলা। এত রাইতে আলো জ্বলে ক্যান? সে নিচের ইন্টারকম থেকে কয়েকবার কায়সার সাহেবকে ফোন করছে। অনেকবার ফোন ধরার পরেও যহন মনে কর ফোন ধরে নাই, তহন সে কায়সার সাহেবের অফিসের দরজায় গিয়া নক করছে। কোন উত্তর না পাইয়া আশেপাশের বিল্ডিং-এর আরো কয়েকজন গার্ডকে ডাইকা নিয়া দরজা ভাইঙ্গা দেখে, কায়সারের লাশ পইড়া আছে ফোলোরের পার।”

    “তারমানে খুন রাত দশটার আগে হয়েছে?”

    “হয়। তা নাইলে মনসুর রাত দশটায় দেখল ক্যামনে? দেখ ত কান্ড। কায়সার সাহেবের মত ভদ্রলোক হাতে গোনান যায়। অনেক পোকাশক দেখছি। মাটি থাইকা দু পা শূন্যে তুইলা চলে। লেখকরে মানুষ মনে করে না। বইয়ের দুকানদাররে পারলে দুইটা চড় দিতে পারলে শান্তি পায়। কায়সার সাহেব এক্কিরে আলাদা মানুষ ছিলেন। কি লেখক, কি পোকাশক আর কি পেরেসের অপারেটর- সবাসসাথে হাসি মুখে কথা বলতে দেখছি উনারে। কত্ত পড়াশুনা জানা মানুষ ছিল, ইশশিরে মানুষটা।”

    পকেট থেকে একটা গোল্ড লিফ সুইচ বের করে সুকান্তের দিকে ইশারা করল সুভাষ। সুকান্ত আনমনে মাথা নাড়ল। কাল রাতে যখন সে প্রেস থেকে বের হয় তখন রাত দশটা সাঁইত্রিশ বাজছিল। তার একটু পর থেকেই তার মনে হতে থাকে কেউ তাকে অনুসরণ করছে। তাহলে আসলেই কি কেউ তাকে অনুসরণ করছিল? আর যে অনুসরণ করছিল, সে-ই কি কায়সার আবেদীনের আততায়ী? কিন্তু সেই খুনী তাকে কেন অনুসরণ করবে? ভ্রু কুঞ্চনের সাথে সাথে বাড়তে লাগল চিন্তার গভীরতা।

    “যা হোক” হাতের সিগারেটটা মেঝেতে ফেলে সস্তা স্যান্ডেলের তলা দিয়ে ভালো করে ডলতে ডলতে সুভাষ বলল, “ওসব মাতায় নিস না। যে কারণে আসা। এট্টা কন্ট্রাক্ট আসছে। মন দিয়ে শোন।”

    সুকান্ত জোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে মাথা নাড়ল।

    সুভাষ বলল, “এবারকাট্টা ফিকশন না। নন- ফিকশন মতন।”

    “আমি নন ফিকশন লিখি না, সুভাষদা।” সুকান্ত বলল।

    “একটু টিরাই মার। কিলায়েন্ট সব তথ্য টথ্য দেবে বলছে। তোকে শুধু সেইটারে ফিকশনের মত করে গুছায়া লিখতে হবে। আর হ্যাঁ, এট্টু তাতাড়ি করতে হবে। যতটা তাতাড়ি পারা যায়। ও হ্যাঁ ভালো কথা, শুনেছিস, এবার রাইটো-এড্রেনালিন থ্রিলার পুরস্কার কে পাচ্ছে শুনেছিস?”

    রাইটো-এড্রেনালিন পুরস্কারের কথা সুকান্ত শুনেছে। বেশ কয়েকবার শুনেছে। রওশন ভাই বেশ কয়েকবার পুরস্কারের কথাটা বলেছেন। একটা ভুঁইফোড় প্রকাশনী ক্রিমসন। তিন বছরও হয়নি বয়স। গত দুবছর এই ক্রিমসন পাবলিশার্সের পক্ষ থেকে এই পুরস্কারটা দেওয়া হয়। থ্রিলার প্রকাশনীর মধ্যে অপ্রতিরোধ্য ক্রিমসন। এই প্রকাশনীর লেখকরাই সাধারণত এই পুরস্কারটা পায়। পক্ষপাতিত্ব? নাহ। আসলেই এই প্রকাশনীর লেখকেরা চমৎকার থ্রিলার লেখেন। বর্ণনা, কাহিনী, লেখনী- সব কিছু মিলিয়ে একেবারে পাঠককে সত্যিকারের রোমাঞ্চ উপহার দেন। কেউ যদি বলে ক্রিমসন পক্ষপাতিত্ব করে এই পুরষ্কার দেয়, তাহলে বুঝতে হবে সে ক্রিমসনের প্রকাশিত কোন বই পড়েনি। বইয়ের জগতে রাইটো-এড্রেনালিন থ্রিলার পুরষ্কার ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। পার্শ্ববর্তী দেশের অনেক লেখক এখন ক্রিমসনের মলাটে একটা বই ছাপানোর জন্য নিজের কীবোর্ড কুরবান করে ফেলেছে প্রায়।

    “কিরে কি হল? শুনেছিস? কে পাচ্ছে?” সুভাষদা জিজ্ঞাসা করলেন।

    সুকান্ত আনমনে হ্যাঁ হু করল। তারপর নেতিবাচক মাথা নাড়ল।

    “হিরণ পাশা। নাম শুনেছিস না? ওই যে ‘যীশুর অশ্রু’ লিখসে যে। আসলেই জবরদস্ত লেখে লোকটা বুঝলি। তুই আবার এইটা কাউকে বলবার যাস না। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানলাম। আমার এক পুরান দোস্ত কইল। যাই হোক, তুই কিন্তু কন্ট্রাক্টটা ঠিকঠাক মত করিস।”

    সুকান্ত উসখুস করতে লাগল। কন্ট্রাক্টে তার মন নেই। কাল রাতের ঘটনা আর আজকের খুনটা তার ভেতরে পাঞ্জা লড়ছে। কেন জানি মনে হচ্ছে, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে ভুল বোঝায়নি। আসলেই তাকে কাল রাতে কেউ অনুসরণ করেছিল।

    “ক্লায়েন্ট পয়সাওয়ালা মানুষ। টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তা করতে মানা করছে। তুই ফার্স্ট ক্লাস একটা পাণ্ডুলিপি রেডি কইরা দিবি। ক্লায়েন্ট তথ্যগুলো দিলেই তোরে দিয়া যাব। ঠিক আছে?” সুভাষ বলল। সুকান্তকে আনমনা দেখে একটু বিরক্তও হল। “ওই সুকান্ত, শুনলি কি বললাম?”

    “ও হ্যাঁ। হুম। আচ্ছা আপনি ক্লায়েন্টের কাছ থেকে ইনফরমেশানগুলা নিয়ে আসেন। আমি দেখব।” সুকান্ত বলল।

    “খুনের ব্যাপারটা আপাতত মাথা থেকে সরা। কন্ট্রাক্টে মন দে।” বলেই সুভাষ চলে গেল।

    সুকান্ত পা বাড়াল নিজের কাজে। হঠাত চোখ পড়ল প্রেসের সিলিং-এ ঝোলানো উনিশ ইঞ্চি টিভিটার দিকে।

    “গতকাল আনুমানিক রাত আটটার দিকে আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন ‘কালের কলম’ প্রকাশনীর প্রকাশক এবং বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক কায়সার আবেদীন। বল পয়েন্ট কলম দিয়ে নির্দয়ভাবে খুচিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে একটা ছোট চিরকুট উদ্ধার করা হয়েছে, যেখানে লেখা আছে, পাছাখানার ভূতকে ঘাটিও না। আশেপাশের ভবন থেকে কোন সাক্ষী পাওয়া যায়নি। তবে নাইট গার্ডদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এই ঘটনায় নিহতের ছোট বোন বাদী হয়ে লালবাগ থানায় মামলা করেছেন। লাশ সুরতহালের জন্য পাঠানো হয়েছে। সুরতহালের রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না বলে ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মাজেদুল খন্দকার জানিয়েছেন।”

    পাছাখানার ভূত! আনমনে নিজেই কথাটা আওড়ালো সুকান্ত। সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল।

    সুকান্ত পুরাণ

    “ভগবান সব থেকে বড় লেখক, যার প্রতিটা চরিত্রের ভেতরেই তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়। আর তাঁর রচিত প্রতিটি দূর্যোগেই তাঁর অভিপ্রায় পরিলক্ষিত হয়। তিনি তাঁর সৃষ্ট চরিত্রসকলকে তাঁর অভিপ্রায় দূর্যোগ ও দুঃসময়ের মধ্যে দিয়েই ব্যক্ত করেন। যে চরিত্র সে অভিপ্রায় বোধে সক্ষম হয়, সে-ই সফলকাম।” বাণীতে শ্রীমান রমাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। জাতে ব্রাহ্মণ, পেশায় জেলা দায়রা আদালতের মুহুরী। তার দুই পুত্র। জ্যৈষ্ঠ পুত্রের নাম লক্ষমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। কনিষ্ঠ পুত্রের নাম সুকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। কনিষ্ঠ পুত্রের জন্মের সময় তার স্ত্রী শ্রীনিতা বন্দ্যোপাধ্যায় মৃত্যবরণ করেন। তাই তার পরিবার বলতে ছিল এই দুই পুত্র।

    খুব ভোরে উঠতেন। বিষ্ণুর সামনে দু হাত জোড় করে দিন শুরু হত তার। স্বপাক রন্ধন করে দুই ছেলেকে খাইয়ে স্কুলে বের করে দিয়ে নিজেও বের হতেন কোর্টের উদ্দেশ্যে। পরণে থাকত ধুতি আর পাঞ্জাবী। হাতে থাকত সেকেলে ফিলিপসের টাইপরাইটারের বাক্স।

    বাবা কিংবা বড় ভাই, দুজনের কাউকেই উচ্চাকাঙ্খা পোষন করতে দেখেনি সুকান্ত। ভিড় বাঁচিয়ে চলা, নিজেকে গুছিয়ে চলা, অর্থ লালসা না করা, নিজেকে জাহির না করা- এ সব সে তার বাবা আর বড় ভাইয়ের কাছ থেকেই শিখেছে। “অর্থাপেক্ষা জ্ঞান শ্রেয়”- এ কথা সে তার বাবার কাছ থেকে শুনেছে বহুবার। এভাবেই তার বেড়ে ওঠা। উচ্চাকাঙ্খাহীন নিস্তরঙ্গ জীবন। স্কুলে যখন সবাইকে জিজ্ঞাসা করা হত যে তারা কি হবে। বেশির ভাগই উত্তর দিত কেউ ডাক্তার হবে, কেউ ইঞ্জিনিয়ার হবে, কেউ উকিল হবে; যা সচরাচর বলে আর কি। সুকান্তকে এই প্রশ্ন করলে সুকান্ত হা করে তাকিয়ে থাকত। কারণ কেউই বলে দেয়নি তাকে কি হতে হবে।

    অর্থ কম তো পাপ কম। রমাকান্ত সেটাই বিশ্বাস করতেন আর সেটাই তার ছেলেদেরকে শিখিয়েছেন। অর্থ কম থাকলে জীবনে কম ‘অপশন’। যত কম অপশন, তত কম লোভ। আর যত কম লোভ, তত কম পাপ। আর যত কম পাপ তত বেশি শান্তি।

    সুকান্ত ভালো ছাত্র ছিল। অন্তত প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার মাপকাঠিতে তার অবস্থান ছিল ওপরে। রোল নাম্বার ছিল এক। কিন্তু এই এক রোল নাম্বার দিয়ে কী করবে তা সে জানত না।

    রমাকান্ত তার ছেলেদেরকে কখনও কোন উপদেশ দেননি। কোন আদেশও কখনও করেননি। কিন্তু লক্ষমন্ত আর সুকান্ত তাকেই অনুসরণ করেছে। লক্ষমন্ত ডাক্তারিকে পেশা হিসাবে বেছে নেওয়ার পরেও রমাকান্তের ভেতরে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। দুজনের সৎ, অনাসক্ত আর নির্বিকার জীবনধারা সুকান্তের ভেতরেও প্রবাহিত হয়েছে ধীরে ধীরে।

    সুকান্তের জীবন ততদিন পর্যন্ত নিস্তরঙ্গ ছিল যতদিন পর্যন্ত নীহারিকার সাথে পরিচয় হয়নি। নীহারিকা ছিল সুকান্তের শান্ত পুকুরের পানিতে একটা মস্ত বড় ঢিল। তখন নীহারিকার স্কুল জীবনের ইতি প্রায়। সুকান্ত তখন স্থানীয় কলেজের ডিগ্রী দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। নীহারিকার বাবা ওই কলেজের বাংলার শিক্ষক ছিলেন। সুকান্ত গণিতে ভালো ছিল বলে নীহারিকার বাবার অনুরোধে নীহারিকাকে গণিত পড়াতে শুরু করে সে। গঞ্জের বাজার থেকে পশ্চিম দিকে দু’মিনিট হাঁটলেই দোতলা বাড়ি। সামনে মাধবীলতার ঝাড়। সদর দরজার দুপাশে মস্ত একটা বুড়ো কড়ই গাছ।

    নীহারিকা শান্ত মেয়ে ছিল। কৈশোরজনিত অস্থিরতা ছিল অনুপস্থিত। সুকান্ত সপ্তাহে চারদিন বিকালবেলা নীহারিকাদের বাসায় গিয়ে তাকে গণিত শেখানো শুরু করল।

    নারী আর অর্থাসক্তিমুক্ত জীবন থেকে সরে যেতে শুরু করল সুকান্ত। পড়াতে পড়াতে একটু হাতের ছোঁয়া। একটু চোখে চোখ পড়া। নীহারিকার ঘামে ভেজা কপাল। মাথায় দেওয়া পাতলা ওড়নার ঘোমটা। সব কিছু বলতে যেয়েও নীহারিকা সবটা বলত না, বলতে পারত না সুকান্ত। সেই না বলতে পারাটায় কোন অপূর্ণতা ছিল না। বরং সেই না বলা কথাগুলোই যেন ছিল মধুর অভিজ্ঞতা।

    সুকান্তকে কি কেউ বলে দিয়েছিল যে একটা মেয়েকে কেন ভালো লাগবে? কেন একটা মেয়ের হাতের উল্টো পিঠের দিকে তাকালে আনমনা হয়ে যেতে হবে? নাহ। কেউ সুকান্তকে বলে দেয়নি। সুকান্ত তাহলে জানল কি করে? নাকি এগুলো সবই সৃষ্টিকর্তা তার জন্মের আগে কানে কানে বলে দিয়েছেন? এই যে সুকান্তের গায়ের লোমে কাঁপুনি, নীহারিকার শরীরের ওই অদ্ভুত গন্ধতেই শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ। এগুলো কি সৃষ্টিকর্তার বলে দেওয়া?

    সুকান্তের বেঁচে থাকার যদি কোন মানে থাকে, তাহলে সেটা নীহারিকা।

    সুকান্তদের মত নীহারিকারা ব্রাহ্মণ ছিল না। কাজেই স্পর্শ পাপের ভয় ছিল। কিন্তু ভালোবাসা মনে হয় সব থেকে আদিম অনুভূতি। তাই এর কাছে মনুষ্য সৃষ্ট যে কোন নিয়মই অকেজো হয়ে যায়। তাই, বড় ভাই অকৃতদার থাকলেও সুকান্ত ঠিক করল, নীহারিকাকে বিবাহ করার সিদ্ধান্ত সে বাবাকে জানাবে। কেউ সুকান্তকে বলে দেয়নি, তারপরেও সুকান্ত জানে, নীহারিকা সবার থেকে আলাদা। সবার থেকে ব্যতিক্রম। কিন্তু আমাকে বা আপনাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হত, হয়ত আমরা ওই ব্যতিক্রমটা ধরতে পারতাম না। আহামরি কি আছে নীহারিকার? অন্যান্য মেয়েদের মতই তো। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা যার জন্য যাকে সৃষ্টি করেছেন, তার কাছে সেই মানুষটাই ব্যতিক্রম।

    নীহারিকাও সুকান্তের দূর্বলতা বুঝেছিল। বুঝেছিল মানুষটা খুব সাধাসিধে। গা বাঁচিয়ে চলা মানুষ। ভিড়ে মিশে থাকা মানুষ। নিজেকে অন্যতম প্রমাণ করার অসুস্থ প্রতিযোগীতার প্রতিযোগী না সে। সে সাধারণ, আছে এবং থাকতে চায়। মানুষটার জন্য বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করাটাই যেন ছিল তার সারাদিনের একমাত্র কাজ। সুকান্তের মনে তার জন্য একটা ‘সফট কর্নার’ সৃষ্টি হচ্ছিল। কিন্তু তার আর একটু সময় লাগত।

    সৃষ্টিকর্তার হাতে অত সময় ছিল না। তিনি পরীক্ষা না করে কাউকে কিছু দেন না। তার জগতে কোন কিছুই বিনামূল্যে পাওয়া যায় না। নাথিং ইজ ফ্রি।

    একদিন সন্ধ্যাবেলা রমাকান্ত বাড়ি ফিরলেন মেঘলা মুখে। কারণ কী?

    রমাকান্ত চাপা স্বভাবের মানুষ। নিজের সমস্যা নিয়ে তিনি কারো সাথে কথা বলতেন না। কিন্তু এই সমস্যাটা তিনি চাপা রাখতে পারলেন না। লক্ষমন্তকে বললেন, “তুই একটু সাবধানে থাকিস।” লক্ষমন্ত বাবাকে কখনও পাল্টা প্রশ্ন করেনি। তাই মাথা নেড়ে জানালো যে সে সাবধানে চলবে। কেন চলবে? সেটা তার না জানলেও চলবে।

    কিন্তু সুকান্ত কৌতূহল দমাতে পারল না। নতমস্তকে জিজ্ঞাসা করল, “বাবা, তোমাকে অস্থির লাগছে। কিছু হয়েছে?” রমাকান্ত নিরুত্তর। ঠাকুরঘরে গিয়ে পূজা পাঠ শেষ করে এসে সুকান্তকে যা বললেন তার সারাংশ হল এই যে, তানভীর আজাদ নামের এক প্রভাবশালী ভদ্রলোক তাকে একটা জাল দলিল তৈরি করে দিতে বলেছে। মূলত শহরে তার গার্মেন্টসের ব্যবসা আছে। তখন গার্মেন্টস শিল্প নতুন। তাই পসার ভালো। তানভীরের উদ্দেশ্য, গঞ্জ থেকে তুলা কিনে এখানেই একটা জমি কিনে এখানেই সুতার কারখানা তৈরি করবেন। তাহলে তাকে বাইরে থেকে আর সুতা কিনতে হবে না। গঞ্জের ভেতরেই তার একটা জমি তার খুব মনে ধরেছে। জমিটার একটা জাল দলিল তাকে করে দিতে হবে।

    জমিটা নীহারিকাদের।

    সুকান্ত কিছুক্ষণের জন্য বোধশক্তি হারিয়ে ফেলল। নীহারিকাদের জমি এইভাবে দখল হয়ে গেলে ওরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তার কিছুক্ষণ পরেই নিজেকে আশ্বস্ত করল এই বলে যে তার বাবা ঋষিতুল্য মানুষ। এইরকম কাজ তিনি কখনও করবেন না। বাবা ইতিমধ্যে তাদেরকে না করে দিয়েছেন- এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। শহর থেকে এরকম অনেকেই এমন আবদার নিয়ে আসে। এটা কোন ব্যাপার না।

    কয়েকদিনের ভেতরে সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে গেল। লক্ষমন্ত সাইকেলে করে রোগী দেখতে বের হয়ে যায়। রমাকান্ত বের হয়ে যান কোর্টের উদ্দেশ্যে। সুকান্ত বের হয়ে যায় কলেজে।

    ঠিক এক সপ্তাহ পরে, সন্ধ্যেবেলা, লক্ষমন্তের লাশ নিয়ে ফিরলেন রমাকান্ত। বিকালের দিকে পাশের গ্রামে রুগী দেখে ফিরছিল লক্ষমন্ত। কে বা কারা শাবল জাতীয় কিছু দিয়ে মাথায় মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু। সাইকেলটা হয়ত তারাই চুরি করেছে। স্থানীয় লোকজন এসে লক্ষমন্তের লাশ উদ্ধার করে।

    রমাকান্ত পাথরের মত বসে থাকলেন। লক্ষমন্তের শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে হল সুকান্তকে একা। খুনী কে, খুনীর উদ্দেশ্য কি- সব পরিষ্কার। রমাকান্ত জাল দলিল করে দিতে না চাওয়াতেই এই প্রাণহানি। কিন্তু সামান্য ডিগ্রি পড়ুয়া ছেলের কি করার থাকতে পারে?

    মাঝরাতে বড়ভাইয়ের শেষকৃত্য সম্পন্ন করে একা একাই বাড়ি ফিরল সুকান্ত।

    রমাকান্ত পরদিন থেকে কোর্টে যাওয়া বন্ধ করলেন। বেশিরভাগ সময় কাটাতে লাগলেন বারান্দায় রাখা আরাম কেদারায় বসে। শূন্যদৃষ্টি। মাঝে মাঝে ঠাকুর ঘরে গিয়ে বিষ্ণুমূর্তির সামনে চুপচাপ বসে থাকেন। সুকান্ত সাহস করে একদিন জিজ্ঞাসা করল, “বাবা অফিস যাবা না?”

    রমাকান্ত বলল, “আমি তোকে হারাতে পারব না।”

    সুকান্ত জানতে পারে, অন্য মুহুরীকে ধরে জাল দলিল তৈরি করে ফেলেছে তানভীর আজাদ। নীহারিকাদের বাড়িতে নোটিশও চলে এসেছে। ‘বেআইনীভাবে ভোগদখল’ এর অপরাধে নীহারিকার বাবার নামে মামলা হয়ে গেল। নিজের জমিতেই তিনি হয়ে গেলেন উদ্বাস্তু।

    স্থানীয় পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করল সুকান্ত। ‘জ্যোতিষ্ক হালদার’ নামে অনেকগুলো চিঠি লিখল স্থানীয় পত্রিকায়। সেগুলো ছাপা হল। ‘অন্যায়ভাবে কলেজ শিক্ষকের সম্পত্তি দখলঃ মিথ্যা মামলা’, ‘শিক্ষকের জমি দখলের পাঁয়তারা’ নামে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রতিবেদনও বের হতে লাগল। ধীরে ধীরে জাতীয় দৈনিক পর্যন্ত গড়াল পুরো ব্যাপারটা। ম্যাজিস্ট্রেট এসে হাজির হলেন। কোর্টে দলিলের সত্যতা যাচাই হল। যে মুহুরী জাল দলিল বানিয়েছিল, তার জেল জরিমানা হল। তানভীর আজাদের তেমন কিছুই হল না। শুধু সরকারের পক্ষ থেকে ‘মানহানির মামলা’ হল। কিন্তু কে এই জ্যোতিষ্ক হালদার? কেউ জানতো না।

    ‘আমি তোকে হারাতে পারব না’ কথাটা তার পরিচয় গোপন রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল। যেদিন নীহারিকা তাকে বলল যে চেনে না জানে না এই উপকারী মানুষটাকে সে ভালোবেসে ফেলেছে, তখন সুকান্ত কিছুই বলতে পারেনি। তাকে যেকোন একটা হাত ধরতে হত। হয় নীহারিকার হাত না হয় বাবা রমাকান্তের হাত।

    সুকান্ত রমাকান্তের হাতটাই ধরল।

    ততদিনে অবশ্য মামলা মোকদ্দমা মিটে গিয়েছে। তানভীর আজাদ কয়েকজন উকিল মোক্তার ধরে মামলা মীমাংসা করে নিয়েছে। আদালত পর্যন্ত গড়ায়নি ব্যাপারটা। নীহারিকাদের বাড়িটা আগের মতই থেকে গেল। আগের মতই রইলো সেই বুড়ো কড়ই গাছ। নীহারিকার বাবা জগততারিনীর মন্দিরে পূজো দিয়ে কথা দিয়ে এলেন, নীহারিকার বিবাহ হবে ‘জ্যোতিষ্ক’ নামের কোন ছেলের সাথে। জাত পাতের মিল-অমিল নগণ্য।

    রমাকান্ত ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সুকান্তর পড়াশোনা মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেল। নীহারিকার বিয়ে ঠিক হওয়ার পরে টিউশনিটা হাতছাড়া হয়ে গেল। গঞ্জের আড়তে সে ঘুরঘুর করতে লাগল চাকরির জন্য। সংসারে দুজন মানুষ। রমাকান্ত বৈষয়িক মানুষ না। ছেলেদের জন্য জমি জমা তেমন কিছুই রাখেননি। থাকলে সেগুলো দু একটা বেঁচে হয়ত সুকান্তের ডিগ্রীটা কোনরকমে শেষ হত।

    নীহারিকাদের বাড়ির সামনে সুকান্ত কখনও কি যায়নি? গিয়েছে। কখনও এক গ্লাস পানি খাওয়ার অজুহাতে। কখনও ‘স্যারের সাথে একটু দরকার আছে’ অজুহাতে। কখনও শুধু একটু ‘কেমন আছ নীহারিকা’ বলার অজুহাতে। কিন্তু দরজায় কড়া নাড়ার সাহসটুকু তার আর হয়নি। কতবার ‘নীহারিকা, আমিই জ্যোতিষ্ক, আমিই তোমাদের জন্য কাগজে লিখেছিলাম’ বলতে গিয়ে যে ফিরে এসেছে, সেটা শুধু সুকান্ত জানে আর জানে ওই বুড়ো কড়ইটা।

    সুকান্ত একটা চাকরি জুটিয়ে ফেলল চালের আড়তে। সব কিছু মেনে নিল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কোথায় যেন বিদ্রোহের বীজ বোনা ছিল।

    সেটাই বিস্ফোরিত হল নীহারিকার বিয়ের দিন। রাত দশটায় লগ্ন। সুকান্তকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি সংগত কারণেই। তারপরও সুকান্ত সেখানে উপস্থিত হল অনাহূতের মত। লোকজনের ভেতরে চিৎকার করে বলতে লাগল যে সে-ই জ্যোতিষ্ক। মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে বেশ কয়েকবার তাকে থামতে বলার পর যখন সে কাঁদতে কাঁদতে বিয়ের বেদীতে বধূবেশে বসে থাকা নীহারিকার দিকে দিকে ছুটে গেল, তখন পুলিশ ডাকতে হল।

    সুকান্তকে চার পাঁচদিন হাজতে রাখা হল। এর মধ্যে কয়েকজন কয়েদী এসে ঘুর ঘুর করল। সুকান্তকে বারবার জিজ্ঞাসা করল, সে আসলেই জ্যোতিষ্ক কি না। সুকান্ত বলেছে, না। সুকান্ত ‘হ্যাঁ’ বললে হয়ত গল্পটা কিছুটা অন্যরকম হত। তানভীর কয়েকজনকে পাঠিয়েছিল, যদি ‘লোকটা’ আসলেই জ্যোতিষ্ক হয়, তাহলে তাকে গরাদের ওপাশেই যেন শেষ করে দেওয়া হয়। কিন্তু, সুকান্তের ‘আমিই জ্যোতিষ্ক’কে সবাই প্রলাপ হিসাবেই নিয়েছিল। তিনদিন পরে অফিসার ইনচার্জ মিষ্টি কিছু উপদেশ দিয়ে তাকে ছেড়ে দিলেন। সুকান্ত বাড়ি ফিরে দেখে, বাড়ি ফাঁকা। বাবা নেই। কোথায় গিয়েছে কেউ বলতে পারে না। গঞ্জের বাজার-টাজার ঘুরে সুকান্ত খালি হাতে ফিরল। আড়তের চাকরিটা হারালো। জেলের ঘুঘুকে তারা চাকরিতে রাখবে না।

    আজ যদি হাতে দুটো টাকা বেশি থাকত তাহলে এই দুর্দিন হয়ত তাকে দেখতে হত না। রমাকান্তের ‘অর্থে অনাসক্তি’র চিন্তাধারা ভেঙে পড়তে শুরু করল। সুকান্ত বিশ্বাস করতে শুরু করল, পৃথিবী মহাকর্ষের আকর্ষণে ঘোরে না, ঘোরে অর্থের আকর্ষণে।

    দুদিন, তিন দিন, চার দিন। রমাকান্ত ফিরে এলেন না। সুকান্ত ভবঘুরের মত গঞ্জের বাজারে ঘুরল এক মাস। বাবার জন্য অপেক্ষা করল। একটু আশা, যদি বাবা ফিরে আসেন।

    বাবা ফিরে আসেননি। কোন এক ভোরবেলা দরজায় তালা দিয়ে সুকান্তও নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅন্যমনস্ক – জুনায়েদ ইভান
    Next Article প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্প – জুবায়ের আলম

    Related Articles

    জুবায়ের আলম

    প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্প – জুবায়ের আলম

    August 14, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.