Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    ড্যান ব্রাউন এক পাতা গল্প600 Mins Read0

    ০১. রবার্ট ল্যাংডন ঘুম থেকে জেগে উঠলো

    অধ্যায় ১

    রবার্ট ল্যাংডন খুব ধীরে ধীরে ঘুম থেকে জেগে উঠলো।

    অন্ধকারে ফোন বাজছে ছোট্ট একটা অপরিচিত রিংয়ের শব্দ, যেনো বহু দূর থেকে ভেসে আসছে। সে বিছানার পাশে রাখা ল্যাম্পটার সুইচ হারে জ্বালিয়ে দিয়ে আড়চোখে চারপাশটা দেখে নিলো। একটা রেনেসা শোবার ঘর, ঘোড়শ সুইয়ের আমলের আসবাবপত্রে সাজানো, হাতে নক্সা করা দেয়াল আর সূক্ষ্ম কারুকার্য খচিত মেহগনি কাঠের বিছানা।

    আরে, কোথায় আমি?

    বিছানার পাশেই একটা বাথরোবের মনোগ্রামে লেখা : হোটেল রিজ প্যারিস।

    আস্তে আস্তে ধোয়াটে ভাবটা কাটতে শুরু করলে ল্যাংডন রিসিভারটা তুলে নিলো। হ্যালো?

    মঁসিয়ে ল্যাংডন? একটা পুরুষ কণ্ঠ বললো, আশা করি আপনার ঘুম ভাঙিনি আমি?

    বিরক্ত হয়ে ল্যাংডন বিছানার পাশে রাখা ঘড়িটার দিকে তাকালো। রাত ১২টা বেজে ৩২ মিনিট। মাত্র এক ঘণ্টা হলো সে ঘুমিয়েছে, কিন্তু তার মনে হলো অনেকক্ষণ ধরে মরে পড়েছিলো।

    আমি হোটেলের দ্বাররক্ষী বলছি, মঁসিয়ে। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চাই, কিন্তু আপনার কাছে একজন অতিথি এসেছেন। তিনি চাপাচাপি করছেন, ব্যাপারটা নাকি খুব জরুরি।

    ল্যাংডনের তখনও ঘুম ঘুম ভাবটা ছিলো। একজন অতিথি? বিছানার পাশে রাখা টেবিলের ওপরে অনেকগুলো কাগজ-পত্রের সাথে দোমড়ানো-মোচড়ানো একটা ফ্লাইয়ারের দিকে তার চোখ গেলো।

    আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব প্যারিস
    গর্বের সাথে উপস্থাপন করছে
    রবার্ট ল্যাংডন-এর সাথে একটি সন্ধ্যা
    প্রফেসর, ধর্মীয় প্রতীক বিদ্যা
    হারভার্ড ইউনিভার্সিটি

    ল্যাংডন একটা গভীর আর্তনাদ করলো। আজ রাতের বক্তৃতাটা–শাত্রের ক্যাথেড্রালে লুকানো পাথরের মধ্যে প্যাগান প্রতীকগুলোর ওপর একটা স্লাইড শো–বোধহয় কোন রক্ষণশীল শ্রোতাকে বিক্ষুব্ধ করেছে। তাদের মধ্যে কোন কোন ধর্মীয় পণ্ডিত তার পিছু পিছু বাড়ি পর্যন্ত এসে এ নিয়ে একচোট ঝগড়াও করে গেছে।

    আমি দুঃখিত, ল্যাংডন বললো, আমি খুবই ক্লান্ত আর–

    মেই, মঁসিয়ে, দ্বাররক্ষীটি একটু নিচু স্বরে খুব তাড়া দিয়ে বললো, তার কণ্ঠে জরুরি একটা ভাব আছে। আপনার অতিথি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।

    ল্যাংডনের খুব কমই সন্দেহ ছিলো। ধর্মীয় চিত্রকর্ম এবং কাল্ট প্রতীকের ওপর রচিত তার বইয়ের জন্য সে খুব অপ্রত্যাশিতভাবেই শিল্পজগতে একজন সেলিবৃটি হয়ে গেছে, আর গত বছরের ল্যাংডনের পরিচিতিটা শত সহস্রগুণ বেড়ে গেছে ভ্যাটিকানের সাথে বহুল আলোচিত একটি ঘটনায় জড়িয়ে পড়াতে। ব্যাপারটা মিডিয়াতে বেশ প্রচার পেয়েছিলো। তারপর থেকে, স্বঘোষিত ইতিহাসবিদ আর শিল্পবিশারদদের স্রোতধারা তার ঘরের দরজায় আছড়ে পড়তে শুরু করেছে বিরামহীনভাবে।

    আপনি যদি একটু দয়া করেন, ল্যাংডন বললো, ভদ্র থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো সে, আপনি কি তার নাম আর ফোন নাম্বারটা নিয়ে রাখতে পারবেন, তাকে বলবেন, আমি বুধবার প্যারিস ছাড়ার আগেই ফোন করে তার সাথে যোগাযোগ করবো। ধন্যবাদ, আপনাকে। দ্বাররক্ষী কোন কিছু বলার আগেই সে ফোনটা রেখে দিলো।

    এবার উঠে বসে ল্যাংডন তার পাশে রাখা গেস্ট রিলেশনস হ্যান্ড বুকএর দিকে ভূরু তুলে তাকালো, সেটার কভারে লেখা আছে : আলো ঝলমলে শহরে ঘুমান শিশুদের মতো। প্যারিস রিজ-এ ঘুমান। ঘরের এক পাশে রাখা প্রমাণ সাইজের আয়নার দিকে ক্লান্তভাবে সে তাকালো। যে লোকটা আয়না থেকে তার দিকে চেয়ে আছে তাকে তার অচেনা মনে হলো এলোমেলো আর পরিশ্রান্ত।

    তোমার একটু ছুটির দরকার, রবার্ট।

    বিগত দশ বছর তার ওপর দিয়ে বেশ খাটুনি গেছে। কিন্তু সে আয়নার অবয়বটাকে সাধুবাদ দিতে নারাজ। তার তীক্ষ্ণ্ণ নীল চোখ জোড়া আজ রাতে ঘোলাটে আর কুয়াশাচ্ছন্ন দেখাচ্ছে। খোঁচা খোচা দাড়িতে শক্ত চোয়াল আর টোল পড়া গালটা ঢেকে গেছে। মাথার চুল ধূসর হয়ে যাচ্ছে, আর সেটা হালকা পাতলা কালো চুলকে গ্রাস করতে শুরু করেছে। যদিও তার নারী সহকর্মীরা এটাকে তার পাণ্ডিত্যের প্রকাশভঙ্গী হিসেবেই চিহ্নিত করে থাকে, তবে ল্যাংডন ভালো করেই জানে সত্যিকারে কারণটি।

    বোস্টন ম্যাগাজিন যদি এখন আমাকে দেখতে পেতো। গত মাসে, ল্যাংডন সবচাইতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিলো যখন বোস্টন ম্যাগাজিন শহরের সবচাইতে কৌতূহলোদ্দীপক ব্যক্তি হিসেবে টপ টেনের তালিকায় তাকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলো— একটা সন্দেহজনক সম্মানের ফলে সে তার হারভার্ডের সহকর্মীদের কাছ থেকে সীমাহীন টিটকারি আর টিপ্পনির শিকার হয়েছিলো। আজ রাতে, তার নিজ দেশ থেকে

    তিন হাজার মাইল দূরে এই ব্যাপারটা এখানে এসে পৌঁছেছে। তার বক্তৃতার অনুষ্ঠানেও সেটা উঠে এসেছে। এখানেও সে এটার শিকার হলো।

    ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রমহোদয়গণ… উপস্থাপিকা প্যারিসের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাভিলিয়ন ডওফিন-এর হলভর্তি লোকজনের উপস্থিতিতে ঘোষণা দিলো, আজ রাতের আমাদের অতিথিকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার কোন দরকার নেই। তিনি অসংখ্য বইয়ের লেখক। দ্য সিম্বোলজি অব সিক্রেট সেক্ট, দ্য আর্ট অব দি ইলুমিনাতি, দ্য লস্ট ল্যাংগুয়েজ অব ইডিওগ্রামস, আর আমি যখন কথা বলছি তখন তিনি লিখছেন দ্য রিলিজিয়াস আইকোনোলজির ওপর একটি বই। আপনাদের অনেকেই তার লেখা পাঠ্য বই হিসেবে শ্রেণী কক্ষে পড়েছেন।

    উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে ছাত্ররা সানন্দে মাথা নেড়ে সায় দিলো। আমার একটা পরিকল্পনা ছিলো, আজ রাতে তাকে তার অসাধারণ পেশাগত পরিচয়টা তুলে ধরে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করবো, কিন্তু যেভাবেই হোক… মেয়েটা ল্যাংডনের দিকে সকৌতুক দৃষ্টিতে তাকালো। একজন শ্রোতা কিছুক্ষণ আগে আমার হাতে একটা জিনিস দিয়ে গেছে, বলা যায়… কৌতূহলোদ্দীপক একটি পরিচয়।

    বোস্টন ম্যাগাজিনর একটা কপি তুলে ধরলো মেয়েটা।

    ল্যাংডন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। এটা সে পেলো কোথেকে?

    উপস্থাপিকা প্রবন্ধটির নির্বাচিত কিছু অংশ পড়ে শোনাতে লাগলো। ল্যাংডনের মনে হলো সে তার চেয়ারের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। ত্রিশ সেকেন্ড পরে, দর্শক-শ্রোতারা প্রবল করতালি দিতে শুরু করলো। মেয়েটার মধ্যে এই ব্যাপারটা শেষ করার কোন চিহ্নই দেখা গেলো না। আর গতবছর মি. ল্যাংডনের সাথে ভ্যাটিকানের ওরকম ভূমিকার ব্যাপারে জনসমক্ষে কোন কিছু বলতে অস্বীকার করার কারণেই আমাদের কৌতূহলোদ্দীক মিটারের পয়েন্টে তিনি জয়ী হয়েছেন। উপস্থাপিকা শ্রোতাদের কাছে জিজ্ঞেস করলো, আপনারা কি আরো কিছু শুনতে চান?

    মেয়েটাকে কেউ থামাচ্ছে না কেন, সে আবার পড়তে শুরু করতেই ল্যাংডন আপন মনে বললো।

    যদিও প্রফেসর ল্যাংডন এখানে পুরস্কারপ্রাপ্ত তরুণদের মতো কেতাদূরস্ত হ্যান্ডসাম নন, কিন্তু চল্লিশোর্ধ এই পণ্ডিত ব্যক্তির পাণ্ডিত্য নির্ঘাত আবেদন সৃষ্টি করে।

    তার আকর্ষণীয় উপস্থিতি, নিচু স্বরের স্পষ্ট উচ্চারণের মাধুর্যময় কণ্ঠের কারণে আরো বাঙময় হয়ে ওঠে যা তার ছাত্রীরা বর্ণনা করে কানের চকোলেট হিসেবে। পুরো হলটা হাসিতে ফেটে পড়লো।

    ল্যাংডন জোড় করে একটা কাষ্ঠ হাসি দিলো। সে জানতো এর পরে কী হবে হ্যারিস টুইড পরিহিত হ্যারিসন ফোর্ড জাতীয় কিছু হাস্যকর লাইন কারণ আজকের সন্ধ্যায় সে পরে আছে হ্যারিস টুইড আর বারবেরি টার্টেলনেক টাই। সে ঠিক করলো একটা কিছু করতেই হবে।

    ধন্যবাদ তোমাকে, মনিকা, ল্যাংডন আগেভাগেই উঠে দাঁড়িয়ে পোডিয়ামে দাঁড়ানো মেয়েটার দিকে এগোতে এগোতে বললো, বোস্টন ম্যাগাজিন নিশ্চিত ভাবেই গল্প বানাবার রসদ পেয়ে গেলো। সে শ্রোতাদের দিকে ঘুরে বিব্রত হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আমি যদি খুঁজে পাই আপনাদের মধ্যে কে এই প্রবন্ধটি এখানে এনেছেন, তবে দূতাবাসে গিয়ে আমি তাকে তার দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেবো।

    শ্রোতারা সবাই হেসে উঠলো।

    তো, শ্রোতারা, আপনারা সবাই জানেন, আজ এখানে এসেছি প্রতীক বা সিম্বলের ক্ষমতা কী, সেটা বলতে…

     

    ল্যাংডনের হোটেলের ফোনটা নিরবতা ভেঙে আরেকবার বেজে উঠলো।

    অবিশ্বাসে গোঙাতে গোঙাতে সে ফোনটা তুলে নিলো। হ্যাঁ? যা ভেবেছে তা-ই, আবারো সেই হোটেলের দ্বাররক্ষী।

    মি. ল্যাংডন, আমি আবারো ক্ষমা চাচ্ছি। আমি আপনাকে ফোন করেছি এটা জানাতে যে, আপনার অতিথি আপনার কাছেই আসছে। আমার মনে হলো, এটা আপনাকে জানানো দরকার।

    ল্যাংডন কথাটা শুনেই পুরোপুরি ঘুম ছেড়ে উঠে গেলো। আপনি আমার ঘরে একজন লোককে পাঠিয়ে দিয়েছেন?

    আমি এজন্যে ক্ষমা চাইছি, মঁসিয়ে, কিন্তু এরকম একজন মানুষকে…থামানোর ক্ষমতা আমি রাখি না।

    ঠিক করে বলুন তো, লোকটা আসলে কে?

    কিন্তু ফোনের অপর প্রান্তে দ্বাররক্ষী ফোনটা ততক্ষণে রেখে দিয়েছে।

    প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ল্যাংডনের দরজায় জোড়ে জোড়ে ধাক্কা দেবার শব্দ হলো।

    কী করবে ঠিক ভেবে না পেয়ে ল্যাংডন বিছানা থেকে নেমে এলো, স্যালোয় কার্পেটে তার পা-দুটো ডুবে যাচ্ছে বলে মনে হলো। তড়িঘড়ি দরজার দিকে এগিয়ে গেলো সে। কে?

    মি. ল্যাংডন? আপনার সাথে একটু কথা বলার দরকার। লোকটার ইংরেজি উচ্চারণ একটু অন্যরকম, খুব পরিষ্কার, কিন্তু কর্তত্বপূর্ণ। আমার নাম লেফটেনান্ট জেরোমে কোলেত। পুলিশ জুডিশিয়ারের ডিরেকশন সেন্ট্রেইল থেকে এসেছি।

    ল্যাংডন একটু থেমে গেলো। জুডিশিয়াল পুলিশ? ডিসিপিজে হলো আমেরিকার এফবিআইর সমতুল্য।

    সিকিউরিটি চেইনটা লাগিয়ে ল্যাংডন দরজাটা একটু ফাঁক করলো। যে চেহারাটা তার দিকে চেয়ে আছে সেটা হাল্কা-পাতলা এবং ভাবলেশহীন, লোকটা সাংঘাতিক রকমের মেহদীন, নীল রঙের অফিশিয়াল পোশাক পরে আছে।

    ভেতরে আসতে পারি কি? লোকটা বললো।

    ল্যাংডন একটু ইতস্তত করলো, আগন্তুক তাকে নিরীক্ষণ করতে থাকলে সে একটু দ্বিধাগ্রস্তও হলো। হয়েছে কি?

    আমার ক্যাপ্টেনের একটু আপনার সাহায্যের দরকার, ব্যক্তিগত একটা ব্যাপারে।

    এখন? ল্যাংডন স্বাভাবিক হলো। মধ্যরাত তো পেরিয়ে গেছে।

    আজ রাতে লুভর মিউজিয়ামের কিউরেটরের সাথে আপনার সাক্ষাত করার কথা ছিলো, আমি কি ঠিক বলেছি?

    হঠাৎ করেই ল্যাংডনের খুব অস্বস্তি হতে লাগলো। বক্তৃতার শেষে আজ রাতে তার সাথে কিউরেটর জ্যাক সনিয়ের একটা সাক্ষাতের কথা ছিলো, কিন্তু সনিয়ে আর সেই সাক্ষাতের জন্য আসেননি। হ্যাঁ, আপনি সেটা জানলেন কি করে?

    আমরা আপনার নাম উনার দৈনিক পরিকল্পনার নোটবুকে পেয়েছি।

    আমার বিশ্বাস, খারাপ কিছু ঘটেনি?

    লোকটা একটা করুণ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দরজার ফাঁক দিয়ে পোলারয়েডে তোলা একটি ছবি তার দিকে বাড়িয়ে দিলো। ছবিটা দেখেই ল্যাংডনের পুরো শরীরটা কাটা দিয়ে উঠলো।

    ছবিটা একঘণ্টা আগে ভোলা হয়েছে। লুভরের ভেতরেই।

    অদ্ভুত এই ছবিটা দেখে ল্যাংডন আতৃকে উঠে রেগে গেলো। কে এরকম করলো!

    আমরা আশা করছি এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আপনার সাহায্যের দরকার রয়েছে। বিশেষ করে প্রতীকবিদ্যার ওপরে আপনার জ্ঞান এবং উনার সাথে সাক্ষাতের পরিকল্পনার কথাটা যদি বিবেচনা করেন।

    ল্যাংডন ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলো, এবার তার বিস্ময় কমে গিয়ে ভীতিতে রূপান্তরিত হলো। ছবিটা খুবই অদ্ভুত আর জঘন্য। ছবিটাতে এমন দৃশ্য দেখা যাচ্ছে যা তার কাছে একেবারেই অভাবনীয় বলে মনে হচ্ছে। এরকম দৃশ্য সে এর আগে একবারই দেখেছে, কিন্তু সেটা কাউকে বলে বোেঝাবার মতো নয়। একবছর আগে ল্যাংডন এ রকম একটি লাশের ছবি পেয়েছিলো আর তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য অনুরোধও করা হয়েছিলো। চব্বিশ ঘণ্টা পরে, সে ভ্যাটিকানের ভেতরে নিজের জীবনটা প্রায় খুইয়ে ফেলতে যাচ্ছিলো। এই ছবিটা একেবারেই অন্যরকম। তারপরেও দৃশ্যগত দিক থেকে কিছুটা মিলও রয়েছে বলে তার মনে হলো। লোকটা তার ঘড়িটা দেখে নিলো। আমার ক্যাপিতেন অপেক্ষা করছে, স্যার।

    মনে হলো ল্যাংডন তার কথা শুনতেই পায়নি। তার চোখ ছবিটার দিকে, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে।

    এখানের এই প্রতীকটা, তার শরীরটা যেরকম অদ্ভুতভাবে …

    অবস্থানটা? লোকটা তাকে বললো।

    ল্যাংডন মাথা নেড়ে সায় দিলো, লোকটার দিকে তাকাতেই তার কী রকম শীতল অনুভব হলো। আমি ভাবতেও পরছি না, কোন মানুষের সাথে কেউ এরকম করতে পারে।

    লোকটা চোখ কুচকে বললো, আপনি বুঝতে পারছেন না, মি. ল্যাংডন। ছবিতে আপনি যা দেখছেন… সে একটু বিরতি দিলো। মঁসিয়ে সনিয়ে নিজেই এমনটি করেছেন।

     

    ০২.

    এক মাইল দূরে, সাইলাস নামের প্রকাণ্ড শরীরের শ্বেতি লোকটা রুই লা ব্রুইয়ার বিলাসবহুল ব্রাউনস্টোনের অট্টালিকার সদর দরজা দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঢুকলো। কাঁটাযুক্ত সিলিস বেল্টটা সে তার ঊরুতে বেঁধে রেখেছে। সেটা তার ঊরুর মাংস কেঁটে ভেতরে ঢুকে গেছে, তারপরেও তার মন-প্রাণ ঈশ্বরের জন্য কাজ করতে পেরে সন্তুষ্ট হয়ে গান গাইছে।

    কষ্ট ভালো।

    তার লাল চোখ দুটো ঢোকার সময় বাড়ির লবির দিকে তীক্ষ্ণ্ণ দৃষ্টিতে একটু দেখে নিলো। কিছু নেই। নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো সে। তার সহযোগী কোন সদস্যকে ঘুম থেকে ওঠাতে চাচ্ছিলো না সাইলাস। তার শোবার ঘরের দরজাটা খোলাই রয়েছে। এখানে তালা লাগানো নিষিদ্ধ। ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো সে।

    ঘরটা একেবারে সাদামাটা শক্ত কাঠের জমিন, পাইন কাঠের একটা টেবিল আর একটা ক্যানভাস ম্যাট ঘরের এক কোণে, এটা সে বিছানা হিসেবে ব্যবহার করে। এই সপ্তাহটা এখানে সে একজন মেহমান হিসেবে এসেছে। এ ধরনের পরিবেশে দীর্ঘদিন ধরেই সে অভ্যস্ত, সেটা অবশ্য নিউইয়র্কে।

    ঈশ্বর আমাকে আশ্রয় দিয়েছে, আমার জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে দিয়েছে।

    আজ রাতে, শেষপর্যন্ত সাইলাসের মনে হলো, সে তার ঋণশোধ করতে শুরু করেছে। টেবিলের ড্রয়ারে লুকিয়ে রাখা সেল ফোনটা হাতে নিয়ে একটা ফোন করলো।

    হ্যাঁ? একটা পুরুষ কণ্ঠ জবাব দিলো।

    টিচার, আমি ফিরে এসেছি।

    বলো, কণ্ঠটা আদেশ করলো, এই কণ্ঠটা শুনতে পেয়ে আনন্দিত হলো সাইলাস।

    চার জনের সবাই শেষ। তিন জন সেনেক্য … আর গ্র্যান্ডমাস্টার।

    একটু বিরতি নেমে এলো, যেনো প্রার্থনা করছেন। তাহলে আমি অনুমান করতে পারি তোমার কাছে তথ্যটা আছে?

    চার জনের সবার কাছ থেকেই নিয়েছি। আলাদা আলাদাভাবে।

    তুমি তাদের কথা বিশ্বাস করেছো?

    তাদের সবার কথা এক হওয়াটা কাকতালীয় কোন ব্যাপার না। উত্তেজনাপূর্ণ একটা নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা গেলো ওপর পাশ থেকে। চমক্কার। আমার ভয় ছিলো ভ্রাতৃসংঘের গোপনীয়তা রক্ষার সুনামটি বোধ হয় এবারেও টিকে যাবে।

    মৃত্যুর দৃশ্যটা ছিলো খুবই অনুপ্রেরণামূলক।

    তো, আমার শিষ্য, সেই কথাটা বলো, যা শোনার জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে আছি।

    সাইলাস জানতে সে তার শিকারদের কাছ থেকে যে তথ্যটা পেয়েছে সেটা আশংকাজনক। টিচার, চার জনের সবাই ঐতিহাসিক কি-স্টোন ক্লেফ দ্য ভূত-এর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত করেছে।

    ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে নিঃশ্বাস নেবার যে শব্দটা শুনতে পেলো সেটা তার টিচারের উত্তেজনারই বহিঃপ্রকাশ। কি-স্টোন, ঠিক যেমনটি আমরা সন্দেহ করেছিলাম।

    লোককাহিনী মতে, ভ্রাতৃসংঘ পাথরের চোঙার ভেতরে একটা মানচিত্র তৈরি করেছে—একটা ক্লেফ দ্য ভূত… আথবা কি-স্টোন—খোঁদাই করা একটা চাকতি যা ভ্রাতৃসংঘের সেই অসাধারণ গোপনীয়তাকে, চূড়ান্ত শায়িত স্থানকে উন্মোচিত করে…তথ্যটা এতো বেশি শক্তিশালী যে, এটা রক্ষা করার কারণেই সৃষ্টি করা হয়েছে। ভ্রাতৃসংঘ।

    আমরা কখন কি-স্টোনটা হাতে পাবো, টিচার বললেন, আমরা আর মাত্র একধাপ দূরে আছি।

    আপনার ধারণার চেয়েও আমরা কাছাকাছি এসে পড়েছি। কি-স্টোনটা এখানেই আছে, এই প্যারিসে।

    প্যারিসে? অবিশ্বাস্য। তাহলে তো খুব বেশিই সহজ হয়ে গেলো।

    সাইলাস আজকের রাতের সমস্ত ঘটনাই বর্ণনা করলো…কীভাবে চারজন হতভাগ্য ব্যক্তি তাদের ঈশ্বরবিহীন জীবনটাকে শেষ মুহূর্তে রক্ষা করার জন্য তার বিনিময়ে সেই গুপ্ত ব্যাপারটি তার কাছে বলে গেছে। প্রত্যেকেই সাইলাসের কাছে ঠিক একই বর্ণনা দিয়েছে কি-স্টোনটা প্যারিসেরই কোন প্রাচীন গীর্জায়, নির্দিষ্ট কোন স্থানে অত্যন্ত সঙ্গোপনে লুকিয়ে রাখা হয়েছে এগুলি দ্য সেন্ট সালপিচ গীর্জায়।

    প্রভুর নিজের ঘরের ভেতরেই, টিচার বিস্ময়ে বললেন। তারা আমাদের সাথে কীভাবে ফাজলামি করেছে দ্যাখো।

    যেমনটা তারা শতশত বছর ধরে করে আসছে।

    টিচার একটু চুপ হয়ে গেলেন। যেনো এই মুহূর্তের বিজয়টাকে নিজের বিজয় হিসেবে পরিগণিত হবার সুযোগ করে দিচ্ছেন। শেষে তিনি বললেন, তুমি ঈশ্বরের জন্য একটি মহান কাজ করেছে। আমরা এজন্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অপেক্ষা করেছি। তুমি অবশ্যই আমার জন্য কি-স্টোনটা উদ্ধার করে দেবে। আজ রাতেই। বিপদটা সম্পকে তো তোমার সম্যক ধারণা আছেই।

    সাইলাস জানতো বেশুমার বিপদ রয়েছে এতে, আর টিচার এখন যে আদেশ দিয়েছেন সেটা মনে হচ্ছে খুবই অসম্ভব একটি ব্যাপার। কিন্তু গীর্জাটা তো একটা দূর্গ। বিশেষ করে রাতের বেলায়। আমি কিভাবে ভেতরে ঢুকবো?

    টিচার একজন অসামান্য প্রভাবশালী মানুষ, আত্মবিশ্বাসী কষ্ঠে তাকে সবিস্তারে বলে দিলো কি করতে হবে।

    সাইলাস ফোনটা নামিয়ে রাখতেই উত্তেজনায় তার চামড়া টান টান হয়ে গেলো।

    আর একঘন্টা। মনে মনে বললো। সে খুব কৃতজ্ঞ যে, টিচার ঈশ্বরের ঘরে ঢোকার আগে কী কী করতে হবে তার জন্য সময় দিয়েছেন। আজকের পাপের জন্য আমি অবশ্যই আমার আত্মাকে বিশুদ্ধ করে নেবো।

    আজকে যে পাপ করা হয়েছে সেটার উদ্দেশ্য ছিলো খুবই পবিত্র। ঈশ্বরের শত্রুদের বিরুদ্ধে শতাব্দী ধরেই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ক্ষমা পাওয়ার নিশ্চয়তা রয়েছে।

    তারপরও, সাইলাস জানতো, ধর্মের জন্য বলি দিতেই হয়।

    কাপড়চোপড় খুলে ফেলে সাইলাস ঘরের মাঝখানে হাটু গেঁড়ে বসে পড়লো। তার ঊরুতে বাঁধা সিলিস বেল্টটার দিকে তাকালো। দ্য ওয়ের সত্যিকারের সব অনুসারীই এই জিনিসটা পরে থাকে একটা চামড়ার বেল্ট তাতে লোহার কাঁটা লাগানো থাকে যা মাংসপেশীকে কেঁটে ভেদ করে যিশুর যন্ত্রণাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

    যদিও সাইলাস নিয়মানুযায়ী দুঘণ্টার চেয়ে অনেক বেশি সময় ধরেই আজ এটা পরে আছে, কারণ দিনটা কোন সাধারণ দিন নয়। বেল্টটা আরো আঁটোসাঁটো করে বেঁধে নিলো সে, যাতে মাংসপেশীতে সেটা আরো বেশি বেঁধে যায়। আস্তে আস্তে তার প্রার্থনা শুরু করলো সে। যন্ত্রণা ভালো। সাইলাস বিড়বিড় করে বললো। বারবার সব গুরু গুরু ফাদার হোসে মারিয়া এসক্রিভার পবিত্র মন্ত্রটা আওড়াতে লাগলো সে।

    যদিও এসক্রিভা ১৯৭৫ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন, তার প্রজ্ঞা আজো বেঁচে আছে, তাঁর শব্দ আজো সারা পৃথিবীর হাজার হাজার বিশ্বাসীরা হাটু গেঁড়ে প্রার্থনা করার সময় ব্যবহার করে থাকে। এই প্রার্থনাটি সবার কাছে কোরপোরাল মর্টিফিকেশন বা শারীরিক শাস্তি হিসেবে পরিচিত।

    সাইলাস এবার তার পাশে রাখা গিট পাকানো মোটা দড়িটার দিকে তাকালো। গিটগুলোতে ওকননা রক্ত লেগে আছে। নিজের যন্ত্রণাকে বিশুদ্ধ করার জন্য দ্রুত একটা প্রার্থনা সেরে নিলো। তারপর, দড়িটার এক মাথা মুঠোতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘাড়ের উপর দিয়ে পিঠে আঘাত করতে শুরু করলো। সে টের পেলো গিটগুলো তার পিঠে লাগছে। সে বার বার এটা করতে লাগলো। মাংসগুলো ফালা ফালা করে ফেললো। বার বার।

    কাঙিগো কোরপাস মেয়োম। অবশেষে, সে বুঝতে পারলো রক্ত ঝড়তে শুরু করেছে।

     

    ০৩.

    সিতরোঁ গাড়িটা দক্ষিণ প্রান্তের অপেরা হাউস অতিক্রম করে প্লেস ভোদোয়ায় এসে পড়তেই এপ্রিলের নির্মল বাতাসের ঝাঁপটা জানালা দিয়ে ভেতরে এসে লাগলো। গাড়িতে বসা রবার্ট ল্যাংডনের মনে হলো তার চিন্তাভাবনাগুলো পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। তড়িঘড়ি করে গোসল ও শেভ করার জন্য তাকে দেখতে খুব স্বাভাবিক মনে হলেও এটা তার উদ্বেগটাকে একটুও কমাতে পারেনি। কিউরেটরের ভয়ংকর ছবিটা তার মনে আঁটকে আছে।

    জ্যাক সনিয়ে মারা গেছেন।

    কিউরেটরের মৃত্যু ল্যাংডনের কাছে একটা বিরাট ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই না। পর্দার অন্তরালে থাকা সত্ত্বেও সনিয়ে একজন শিল্পবোদ্ধা এবং শিল্পের জন্য তাঁর অবদানের যে সুনাম আছে, সেটার জন্য একজন বিখ্যাত ব্যক্তিই হয়ে উঠেছিলেন। পুশিয়ান এবং তেনিয়ারের শিল্পকর্মের মধ্যে যে লুক্কায়িত কোড বা সংকেত রয়েছে সেটার ওপর রচিত তার বই ল্যাংডনের খুবই প্রিয় এবং সে এগুলো শ্রেণীকক্ষে পাঠ্য হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। আজকের সাক্ষাতের জন্য ল্যাংডন অধীর আগ্রহে ছিলো, কিন্তু কিউরেটর যখন কথা মতো আসতে পারলেন না তখন সে যারপর নাই হতাশ হয়েছিলো।

    আবার কিউরেটরের ছবিটা তার মনের পর্দায় ভেসে উঠলো। জ্যাক সনিয়ে নিজেই এরকম করেছেন? ছবিটা মন থেকে তাড়ানোর জন্য ল্যাংডন জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। বাইরে, শহরটা বাতাসের ঝাঁপটায় ফুরফুর করছে রাস্তার হকাররা তাদের টং গাড়িগুলো ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, ময়লা ফেলার লোকগুলো ময়লার ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে ডাস্টবিনের দিকে, একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা এই মধ্যরাতেও ঠাণ্ডা বাতাসের বিরুদ্ধে জড়াজড়ি করে উষ্ণতা খুঁজছে, বাতাসে জেসমিন ফুলের গন্ধ। সিতরোটা বেশ কর্তপূর্ণভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে, এটার দুই টোনের সাইরেনের আওয়াজ রাস্তার যানবাহনগুলোকে ছুরির ফলার মতো কেটে কুটে গাড়িটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

    আজ রাতে আপনি প্যারিসে আছেন দেখে লো ক্যাপিতেইন খুব খুশি হবেন, পুলিশের লোকটা হোটেল ছাড়ার পর এই প্রথম কথা বললো। কাকতালীয়ভাবেই এটা সৌভাগ্যের।

    ল্যাংডন সৌভাগ্য ছাড়া আর সবকিছুই ভাবছে। আর কাকতালীয় ব্যাপারটাকে সে পুরোপুরি বিশ্বাসও করতে পারে না, এরকম কোন ধারণায় সে বিশ্বাস করে না। যে কিনা সারা জীবন ব্যয় করেছে লুকানো প্রতীক, সংকেত আর বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস নিয়ে, সেই ল্যাংডন মনে করে পৃথিবীটা ইতিহাস আর ঘটনাসমূহের একটা জাল ছাড়া আর কিছুই না। সংযোগটা হতে পারে অদৃশ্য, সে প্রায়শই তার হারভার্ডের ক্লাসের ছাত্র ছাত্রিদের কাছে কথাটা বলে, কিন্তু সয়ময়ই সেগুলো থাকে মাটির নিচে।

    আমার অনুমান, ল্যাংডন বললো, প্যারিসের আমেরিকান ইউনিভার্সিটি আপনাদেরকে বলেছে আমি কোথায় আছি?

    গাড়ির চালক মাথা নাড়লো। ইন্টারপোল।

    ইন্টারপোল, ল্যাংডন ভাবলো। অবশ্যই। সে ভুলে গিয়েছিলো ইউরোপের সবগুলো হোটেলই তাদের অতিথির তালিকা ইন্টারপোলের অনুরোধের প্রেক্ষিতে সরবরাহ করে থাকে—এটাই নিয়ম। একটা নির্দিষ্ট রাতে সমগ্র ইউরোপে, কে কোথায় ঘুমাচ্ছে, সে সম্পর্কে একেবারে নিখুঁত তথ্য ইন্টারপোলের কাছে থাকে। রিজ হোটেলে যে ল্যাংডন অবস্থান করছে, সেটা ইন্টারপোলের জানতে পাঁচ সেকেন্ড সময় লেগেছে।

    সিতরোটা শহরের দক্ষিণ দিকে দ্রুতবেগে ছুটতেই আইফেল টাওয়ারটা দেখা গেলো। আকাশের দিকে তাক করে আছে, যেনো খোচা দিবে আকাশটাকে। এটা দেখেই ল্যাংডন ভাবলো ভিত্তোরিয়ার কথা, মনে পড়ে গেলো এক বছর আগে করা প্রতীজ্ঞাটা, ছমাস অন্তর অন্তর তারা দেখা করবে পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন রোমান্টিক জায়গায়। ল্যাংডনের মনে হলো আইফেল টাওয়ারটা তাদের তালিকায় অবশ্যই থাকতো। দুঃখের কথা, সে ভিত্তোরিয়াকে বিদায়ী চুম্বন দিয়েছিলো একবছর আগে রোমের এক কোলাহলপূর্ণ বিমানবন্দরে।

    আপনি কি তার ওপরে উঠেছেন? পুলিশের লোকটা জিজ্ঞেস করলে ল্যাংডন তার দিকে তাকালো, নিশ্চিতভাবে সে ভুল বুঝেছে।

    কি বললেন, বুঝতে পারলাম না।

    খুব সুন্দর, না? লোকটা আইফেল টাওয়ারের দিকে ঈশারা করে বললো। আপনি কখনও ওটার ওপরে উঠেছেন?

    ল্যাংডন তার দিকে চেয়ে বললো, না, আমি টাওয়ারে কখনও উঠিনি।

    এটা ফ্রান্সের প্রতীক। আমার মনে হয় সেটা ঠিকই আছে।

    ল্যাংডন উদাসভাবে মাথা নেড়ে সায় দিলো। সিম্বোলজিস্টরা প্রায়শই ফ্রান্সকে উল্লেখ করে মাচিসমো, মেয়েলীপনা এবং খর্বাকৃতির রাষ্ট্রনায়ক নেপোলিয়ন আর বামন পেপিনদের দেশ হিসেবে তারা হাজার ফুট উঁচু জাতীয় প্রতীক ছাড়া অন্যকিছু বেছে নিতে পারেনি।

    রুই দ্য রিভোলিতে এসে পড়তেই ট্রাফিক সিগনালের বাতিটা জ্বলে উঠলো, কিন্তু সিতরোটার গতি কমলো না। পুলিশের লোকটা গাড়িটা আরো জোড়ে চালিয়ে তুইলেরি

    গার্ডেনের উত্তর দিকের প্রবেশ পথ দিয়ে রুই কাস্তিলিওর দিকে চলে গেলো। এটা প্যারিসের সেন্ট্রাল পার্কের নিজস্ব সংস্করণ। বেশির ভাগ পর্যটকই এটাকে ভুল করে জারদিন দে তুইলেরি বলে ডাকে। তাদের ধারণা এখানে হাজার হাজার টিউলিপ ফোটে বলে এরকম নাম। কিন্তু তুইলেরি নামটা সত্যিকারের যে জিনিস থেকে এসেছে, সেটা অনেক কম রোমান্টিক। এই পার্কটা আগে প্যারিসীয় ঠিকাদারদের একটা ইট বানাবার কারখানা ছিলো। খনি থেকে পিট আর মাটি দিয়ে এখানে এক ধরনের লাল টাইলস বানানো হোতো, যা বাড়ি ঘরের ছাদে ব্যাপকহারে ব্যবহারে করা হতো—সেই টাইলসকেই ফরাসিরা বলে তুইলে।

    ফাঁকা পার্কটাতে ঢোকামাত্রই পুলিশের লোকটা সাইরেন বন্ধ করে দিলো। আচমকা নিরবতা নেমে আসাতে ল্যাংডন স্বস্তিবোধ করলো।

    ল্যাংডন সবসময়ই তুইলেরিকে পবিত্রস্থান বলে বিবেচনা করে। এইসব বাগানে বসেই ক্লদ মনে ফর্ম এবং রঙ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিলেন, আর এই জায়গাটিই ইপ্রেশনিস্ট আন্দোলনের জন্ম দিতে প্রেরণা দিয়েছে। আজ রাতে, এই জায়গাটিই অদ্ভুত এক অশরীরী অনূভূতির জন্ম দিচ্ছে।

    সিতরোটা বাম দিকে মোড় নিয়ে পার্কের সেন্ট্রাল বুলেভার্ডের পশ্চিম দিকে চলে গেলো। একটা গোল পুকুর পাড় ঘুরে ড্রাইভার ফাঁকা এভিনুতে এসে পড়লো। ল্যাংডন দেখতে পেলো তুইলেরি গার্ডেনের শেষ প্রান্তটি, একটা বিশাল পাথরের পথ দিয়ে সেটা শেষ হয়েছে।

    আর্ক দু কারুজেল।

    যদিও আর্ক দু কারুজেলে হৈ চৈ পূর্ণ অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, তারপরও চিত্রমোদীরা এই স্থানটিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি কারণে উল্লেখ করে থাকে। তুইলেরির শেষপ্রান্তে অবস্থিত বিশাল চত্বরটির চারদিকে পৃথিবীর চারটি সেরা জাদুঘর দেখতে পাওয়া যাবে… কম্পাসের প্রতিটি দিকে একটি করে অবস্থিত।

    ডানদিকের জানালা দিয়ে দক্ষিণ দিকে সিন নদী এবং কুয়ে ভলতেয়ার দেখা যায়। ল্যাংডন আড়ম্বরপূর্ণ আলোকজ্জল পুরাতন স্টেশনের চত্বরটি দেখতে পেলো—এটা এখন মিউজি দরসে। বাম দিকে তাকালে দেখা যাবে অত্যাধুনিক পশিদু সেন্টার, যা আধুনিক চিত্রকলার জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তার পেছনে, পশ্চিম দিকে, ল্যাংডন জানতো রামেসিসের প্রাচীন অবিলিস্কটা গাছপালার ওপর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই জায়গাটাতেই জো দ্য পমের জাদুঘর অবস্থিত।

    কিন্তু ঠিক সোজা, সামনের পূর্ব দিকে, ল্যাংডন দেখতে পেলো কারুকার্যময় রেনেসা প্রাসাদটিকে যা এখন বিশ্বের সবচাইতে বিখ্যাত জাদুঘর হিসেবে পরিচিত।

    মিউজি দু লুভর।

    ল্যাংডনের চোখ যখন বিশাল চত্বরটি দেখলো তখন অতি পরিচিত বিস্ময়ের আভা তার সমস্ত অনুভূতিতে ছড়িয়ে পড়লো। একটা বাড়তি বিশাল খোলা চত্বর সামনে, লুভরের সুবিশাল দূর্গ সদৃশ্য এলাকাটি প্যারিসের সবচাইতে মনোরম দৃশ্য। এটার আকৃতি বিশাল একটি অশ্বক্ষুরের মতো, লুভর ইউরোপের সবচাইতে দীর্ঘ ভবন। দৈর্যের দিক থেকে পাশাপাশি তিনটি আইফেল টাওয়ারের সম্মিলিত দৈর্ঘের সমান। এমনকি খোলা চত্বরের কয়েক মিলিয়ন স্কয়ার ফিটের রাজকীয় জায়গাটিও তার চেয়ে বেশি বড় নয়। ল্যাংডন একবার লুভরের পুরো এলাকাটি হেটে খুবই অবাক হয়েছিলো, তিন মাইলের মতো ছিলো ভ্রমণটা।

    এই দালানের ভেতরে রাখা ৬৫৩০০টি শিল্পকর্ম ভালো মতো দেখতে হলে পাঁচ সপ্তাহ লাগার কথা থাকলেও বেশিরভাগ পর্যটকই সংক্ষিপ্ত সফর বেছে নেয়, ল্যাংডন যাকে লুভর লাইট হিসেবে উল্লেখ করে তিনটি বিখ্যাত বস্তু দেখার মধ্য দিয়ে লুভর পরিক্রমা শেষ করা : মোনালিসা, ভেনাস দ্য মিলো, এবং উইংগ ভিক্টোরি। আর্ট বুচওয়াল্ড একবার বলেছিলেন যে, এই তিনটি মাস্টারপিস দেখতে তাঁর পাঁচ মিনিট পঞ্চান্ন সেকেন্ড লেগেছিলো।

    ড্রাইভার একটা ওয়াকিটকি হাতে নিয়ে ক্রমাগতভাবে ফরাসিতে কথা বলে যেতে লাগলো। মঁসিয়ে ল্যাংডন এ এরাইভ। দু মিনিত্‌স।

    ওয়াকি-টকিতে একটা নির্দেশ দেয়া হলো তাকে। যন্ত্রটা সরিয়ে রেখে পুলিশের লোকটা ল্যাংডনের দিকে ফিরলো। আপনি সদর দরজায় ক্যাপিতেনের সাথে দেখা করবেন।

    প্লাজার ট্রাফিক সিগনালের নিষেধাজ্ঞা বাতিটা অগ্রাহ্য করে ড্রাইভার গাড়ির গতি আরো বাড়িয়ে সিতরোটাকে প্লাজার পাথরের চত্বরে তুলে নিলে লুভরের মূল প্রবেশ পথটি দৃষ্টিগোচর হলো। দূর থেকে সেটাকে খুব উদ্যতভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। একটা বিশালাকৃতির ত্রিভুজ। জ্বলজ্বল করছে সেটা।

    লা পিরামিদ।

    প্যারিসের লুভরের নতুন প্রবেশ পথ, জাদুঘরটির মতোই বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। বির্তকিত, অতি-আধুনিক কাঁচের পিরামিডটি চায়নিজ বংশোদ্ভূত আমেরিকান স্থপতি আই এম পেইর নক্সা করা, আজো সেটা ঐতিহ্যবাদীদের দ্বারা সমালোচিত হয়ে আসছে, যারা মনে করে এটা বেঁনেসা ভবনের প্রাঙ্গণটির মর্যাদা নষ্ট করে ফেলেছে। গ্যোতে স্থাপত্যকলাকে জমে যাওয়া সঙ্গীত হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। আর পেইর সমালোচকরা এই পিরামিডকে ব্ল্যাকবোর্ডের ওপর ভাঙা নখ বলে উল্লেখ করে থাকে। প্রগতিশীল ভক্তরা অবশ্য পেইর একাত্তর ফুট উঁচু স্বচ্ছ এই পিরামিডকে প্রাচীন স্থাপনা এবং আধুনিক পদ্ধতির অসাধারণ সম্মিলন বলে মনে করে—পুরাতন এবং নতুনের মধ্যে একটা প্রতীকি যোগসূত্র লুভরকে নতুন সহস্রাব্দে প্রবেশ করতে সাহায্য করেছে।

    আপনি কি আমাদের পিরামিডটি পছন্দ করেন? পুলিশের লোকটি জিজ্ঞেস করলো।

    ল্যাংডন ভূরু কুকালো। মনে হয়, ফরাসিরা আমেরিকানদের এই কথাটা জিজ্ঞেস করতে পছন্দ করে। এটা একটা উভয় সংকটের প্রশ্ন, অবশ্যই পিরামিডটাকে ভালো লাগছে বলে মেনে নিলে আপনাকে একজন রুচিহীন আমেরিকান হিসেবে দেখা হবে, আর অপছন্দের কথা প্রকাশ করলে সেটা ফরাসিদেরকে অপমান করা হবে।

    মিতের একজন সাহসী মানুষ ছিলেন, ল্যাংডন জবাব দিলো, ভিন্ন পথে এগোলো সে। প্রয়াত ফরাসি প্রেসিডেন্ট যিনি পিরামিডটি স্থাপনে সম্মতি দিয়েছিলেন, বলা হয়ে থাকে তিনি ফেরাউনের জটিলতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। মিশরীয় অবিলিস্ক, চিত্র আর শিল্পকলায় প্যারিস ভরে ফেলার জন্য তাকে দায়ী করা হয়, সেই ফ্রাসোয়া মিতেরর মিশরীয় সংস্কৃতির ব্যাপারে দারুণ আগ্রহ এবং শ্রদ্ধা থাকার দরুণ তাঁকে এখনও স্ফিংস হিসেবে অভিহিত করা হয়।

    ক্যাপ্টেনের নাম কি? ল্যাংডন জিজ্ঞেস করলো। আলোচনাটা বদলে ফেললো সে।

    বেজু ফশে, পিরামিডের মূল প্রবেশ পথের দিকে এগোতে এগোতে ড্রাইভার বললো। আমরা তাকে বলি লো তাঊরু।

    ল্যাংডন তার দিকে তাকালো, ভাবলো, সব ফরাসিরই কি একটা করে জম্ভ জানোয়ারের নামে ডাক নাম রয়েছে কিনা।

    আপনারা আপনাদের ক্যাপ্টেনকে বৃষল, মানে ষাড় বলে ডাকেন?

    লোকটা চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালো। আপনার ফরাসি খুব ভালো, যতোটা আপনি স্বীকার করেন, তারচেয়েও বেশি ভালো, মঁসিয়ে ল্যাংডন।

    আমার ফরাসি খুব ভালো নয়, ল্যাংডন ভাবলো, কিন্তু আমার রাশিফলের প্রতীক সংক্রান্ত জ্ঞান বেশ ভালোই বলা যায়। তাউরাস মানে বৃষ, অর্থাৎ ষাড়। জ্যোতিষ বিজ্ঞানের প্রতীকগুলো সারা পৃথিবীতে প্রায় একই রকম।

    পুলিশের লোকটা গাড়িটাকে একটা জায়গায় থামিয়ে পিরামিডের পাশে একটা বড় দরজার দিকে ইঙ্গিত করলো।

    এটা হলো প্রবেশ পথ। গুডলাক, মঁসিয়ে।

    আপনারা আসছেন না?

    আপনাকে এই পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার নির্দেশই ছিলো আমার কাছে। আমার অন্য খানে কাজ রয়েছে।

    ল্যাংডন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো। এটা আপনার সার্কাস।

    পুলিশের লোকটা গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে চলে গেলো।

    গাড়িটা চলে যাওয়ার পর ল্যাংডের মনে হলো, ইচ্ছে করলে সে এখান থেকে খুব সহজেই উল্টো পথে চলে যেতে পারে। প্রাঙ্গন থেকে বেড় হয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে ঘুমাতে পারে। কিন্তু তার এও মনে হলো এই আইডিয়াটা সম্ভবত খুব বাজে একটা ব্যাপার হবে।

    ভেতরে ঢুকেই ল্যাংডনের মনে হলো একটা কাল্পনিক জগতে ঢুকে পড়ছে সে, অস্বস্তিকর লাগছে তার। রাতের পরিবেশটা স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। বিশ মিনিট আগে সে হোটেলে ঘুমিয়ে ছিলো। এখন দাঁড়িয়ে আছে একটা স্বচ্ছ পিরামিডের সামনে যেটা তৈরি করেছে একজন স্ফিংস আর সে অপেক্ষা করছে এক পুলিশের জন্য, যাকে সবাই ডাকে ষাড় বলে।

    আমি সালভাদোর দালির চিত্রকর্মের মধ্যে আঁটকা পড়ে গেছি। সে ভাবলো।

    ল্যাংডন মূল প্রবেশ পথের দিকে এগোতে লাগলো—একটা বিশাল ঘূর্ণায়মান দরজা। ভেতরের ফয়ারটা পেরিয়ে গেলে দেখা গেলো জায়গাটা আঁধো আলো অন্ধকার আর একেবারেই ফাঁকা। আমি নক করবো?

    ল্যাংডন অবাক হয়ে ভাবলো হারভার্ডের কোন ইজিপ্টোলজিস্ট কি কখনও কোন পিরামিডের দরজায় নক করে কোন জবাবের আশা করেছিলো কিনা। সে কাঁচের ওপর টোকা মারার জন্য হাত ওঠাতেই নিচের অন্ধকার থেকে একজন মানুষের অবয়ব আসতে দেখলো। লোকটা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসছে। দেখতে শক্তসামর্থ্য আর কালো, প্রায় নিয়ানডারথাল মানুষের মতো, পরে আছে কালো ডাবল ব্রেস্টের সুট যা তার চওড়া কাঁধটাকে ঢেকে রেখেছে। সে অগ্রসর হচ্ছে অভ্রান্ত কর্তৃত্বসহকারে, দৃঢ় পদক্ষেপে। লোকটা ফোনে কথা বলছে কিন্তু তার সামনে আসতেই ফোনটা ছেড়ে দিয়ে ল্যাংডনের দিকে তাকালো সে।

    আমি বেজু ফশে, ল্যাংডন ঘূর্ণায়মান দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই সে ঘোষণা দিলো। সেন্ট্রাল জুডিশিয়াল পুলিশের ক্যাপটেন। তার কণ্ঠ খুবই স্পষ্ট—গম গম করছে … যেনো আকাশে মেঘের গর্জন।

    ল্যাংডন হাত মেলাবার জন্য নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিলো। রবার্ট ল্যাংডন।

    ফশের বড়সড় হাতের পাঞ্জাটি ল্যাংডনের হাতটি সজোড়ে ধরে প্রচণ্ড জোড়ে চাপ দিলো।

    ছবিটা আমি দেখেছি। ল্যাংডন বললো, আপনার লোক আমাকে বলেছে জ্যাক সনিয়ে নিজেই এটি করেছেন–

    মি. ল্যাংডন, ফশের কঠিন কালো চোখ তার ওপর আঁটকে আছে। আপনি ছবিতে যা দেখেছেন তা সনিয়ে যা করেছে তার গুরু মাত্র।

     

    ০৪.

    ক্যাপ্টেন বেজু ফশে ক্রুব্ধ ষাড়ের মতো ফুঁসছে। তার চওড়া কাঁধটা একটু পেছনের দিকে হেলে থুতনিটা বুকের কাছে আঁটকে আছে। তেল দেবার জন্য কালো চুলগুলো চক্ করছে। কপালের সম্মুখভাগটি তীরের মতো উঁচিয়ে আছে, আর ভূরু দুটো যেনো সেটা বিভক্ত করে রেখেছে। কাছে আসতেই তার কালো চোখ দুটো আরো তীক্ষ্ণ্ণ হয়ে উঠলো। জ্বল জ্বল করা চোখ দুটো তার সুনামকে আরো বেশি প্রকট করে তুলেছে।

    কাঁচের পিরামিডের নিচ দিয়ে চলে যাওয়া বিখ্যাত মার্বেল সিঁড়ি দিয়ে আর্টিয়ামের ভেতরে ল্যাংডন ফশের পিছু পিছু চললো। তারা এগোতেই দুজন অস্ত্রধারী জুডিশিয়াল পুলিশের দেখা পেলো। তাদের হাতে রয়েছে মেশিনগান। ব্যাপারটা খুব পরিষ্কার : আজরাতে কেউ এখান থেকে ক্যাপ্টেন ফশের আশীর্বাদ ছাড়া ঢুকতে এবং বের হতে পারবে না।

    গ্রাউন্ড লেবেলের নিচে যেতে যেতে ল্যাংডন ক্রমাগত একটা কাঁপুনি থেকে নিজেকে বাঁচাতে লড়াই করলো। ফশের উপস্থিতি সুখকর নয়, আর লুকেও এই সময়টাতে প্রায় জীবন্ত কবর দেয়ার ভূগর্ভস্থ কবরখানা বলেই মনে হচ্ছে। সিঁড়িটা অন্ধকার সিনেমা হলের মতো। ল্যাংডন তার নিজের পায়ের শব্দ শুনতে পেলো। শব্দটা উপরের কাছে প্রতিফলিত হচ্ছে। সেখানে তাকাতেই ল্যাংডন দেখলো স্বচ্ছ কাঁচের ছাদটা। বাইরের আলো সেখানে মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

    আপনি কি এটা পছন্দ করেন? ফশে জিজ্ঞেস করলো, থুতনিটা একটু উপরের দিকে তুলে মাথা নাড়লো সে।

    ল্যাংডন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো, সে এসব খেলার জন্য খুব বেশিই ক্লান্ত। হ্যাঁ, আপনাদের পিরামিডটা সত্যি বিস্ময়কর।

    ফশে ঘোৎঘোৎ করে উঠলো। প্যারিসের চেহারায় এটা একটা কলঙ্কের দাগ।

    লেগেছে। ল্যাংডন বুঝতে পারলো তার সামনের লোকটাকে খুশি করা মোটেই সহজ কাজ নয়। সে ভাবলো, ফশের কি কোন ধারণা আছে যে, এই পিরামিডটা যা প্রেসিডেন্ট মিতেরর প্রচণ্ড দাবি ছিলো, সেটা নির্মিত হয়েছে একেবারে কাটায় কাটায় ৬৬৬টা স্প্যান দিয়ে একটা অদ্ভুত অনুরোধ ছিলো সেটা, যা সব সময়ই সমালোচক ও নিন্দুকদের কাছে গরম আলোচনার বিষয় হয়ে আছে, যারা দাবি করে ৬৬৬টি হলো শয়তানের সংখ্যা। ত

    ল্যাংডন সিদ্ধান্ত নিলো এই প্রসঙ্গটি তুলবে না।

    তারা যখন আরো নিচে নামতে লাগলো তখন অন্ধকার ভেদ করে জায়গাটা দৃষ্টির গোচরে চলে এলো। মাটি থেকে সাতান্ন ফিট নিচে তৈরি করা লুভরের নতুন স্থাপনা ৭০০০০ বর্গফুটের লবিটাকে মনে হবে অন্তহীন এক গুহা। উপরে লুভরের জমিন যে রকম মধু-রঙের পাথর দিয়ে তৈরি তার সাথে মিল রেখেই এ জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে উষ্ণতা নিরোধক মার্বেল পাথর। নিচের এই জায়গাটি সাধারণত সূর্যের আলো এবং পর্যটকদের পদভারে কম্পিত হয়। আজরাতে, অবশ্য লবিটা অন্ধকার আর ফাঁকা মনে হচ্ছে। আর এতে করে পুরো জায়গাটিতে এক ধরনের হিমশীতল পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

    মিউজিয়ামের নিয়মিত নিরাপত্তারক্ষীরা কোথায়? ল্যাংডন জিজ্ঞেস করলো।

    এঁ কোরাতোঁয়া, ফশে এমনভাবে জবাব দিলো যেনো ল্যাংডন ফশের দলটির কর্তব্যনিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। নিশ্চিতভাবেই, আজরাতে এখানে কেউ প্রবেশ করেছিলো যার এভাবে প্রবেশ করাটা ঠিক হয়নি। রাতের বেলায় লুভরের দায়িত্বে থাকা সব ধরনের লোককেই এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আমার লোকজন আজ রাতের জন্য লুভরের নিরাপত্তার ভার নিয়ে নিয়েছে।

    ল্যাংডন মাথা নেড়ে ফশের সাথে তাল মিলিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে চললো।

    জ্যাক সনিয়েকে আপনি কি রকম চেনেন? ক্যাপ্টেন জিজ্ঞেস করলো।

    সত্যি বলতে কী একদমই না। আমরা কখনও দেখা করিনি।

    ফশেকে দেখে মনে হলো খুব অবাক হয়েছে। আপনাদের প্রথম সাক্ষাতটি সম্ভবত আজরাতে হবার কথা ছিলো?

    হ্যাঁ। আমরা ঠিক করেছিলাম আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে আমার বক্তৃতা শেষ হবার পরপরই সেখানে মিলিত হবো। কিন্তু উনি আসেন নি।

    ফশে একটা নোটবইয়ে কিছু টুকে নিলো। তারা এগোতেই ল্যাংডনের চোখ পড়লো লুভরের লেজার হিসেবে পরিচিত পিরামিডের দিকে—লা পিরামিদ ইনভার্সি—একটা বিশাল উল্টো পিরামিড আকৃতির স্কাইলাইট, যা সিলিং থেকে ঝুলে আছে। প্রবেশ পথের টানেল দিয়ে যাবার জন্য ফশে ল্যাংডনকে ছোট্ট একটা সিঁড়ি দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে গেলো। সেই টানেলের প্রবেশ মুখের উপরে সাইনবোর্ডে লেখা আছে: ডেনন।

    ডেনন উইং হলো লুভরের প্রধান তিনটি সেশনে মধ্যে সবচাইতে বিখ্যাত।

    আজকের সাক্ষাতের জন্য কে অনুরোধ করেছিলো? ফশে আচমকা জিজ্ঞেস করলো। আপনি, নাকি উনি?

    প্রশ্নটিকে একটু অদ্ভুত মনে হলো। মি. সনিয়ে, ল্যাংডন টানেলে ঢুকতে ঢুকতে কথাটা বললো। উনার সেক্রেটারি ই-মেইলের মাধ্যমে আমার সাথে কয়েক সপ্তাহ আগে যোগাযোগ করেছিলেন। সে-ই আমাকে বলেছিলো যে কিউরেটর জানতে পেরেছেন আমি এ মাসে প্যারিসে একটা বক্তৃতা দেবো আর তখন তিনি আমার সাথে কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন।

    কিসের আলোচনা?

    আমি জানি না। মনে হয় চিত্রকলা সম্পকে। আমাদের আগ্রহ একই ধরনের বিষয়ে।

    ফশেকে দেখে মনে হলো সন্দেহপ্রবণ। সাক্ষাতের বিষয় সম্পর্কে আপনার কোন ধারণাই নেই?

    ল্যাংডনের কোন ধারণাই ছিলো না। সেই সময়ে সে খুব বেশি কৌতূহলী ছিলো এবং নির্দিষ্ট কোন বিষয়ে আলোচনা হবে সেটা জিজ্ঞেস করাটা তার কাছে সংগত মনে হয়নি। শ্রদ্ধেয় জ্যাক সনিয়ে নিজের একান্ত বিষয়ে গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য সুপরিচিত ছিলেন এবং খুব কম সাক্ষাতই অনুমোদন করতেন তাই ল্যাংডন তার সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়ে কৃতজ্ঞই ছিলো।

    মি. ল্যাংডন, আপনি কি অনুমান করতে পারেন, আমাদের খুন হওয়া ব্যক্তিটি আসলে কী বিষয় নিয়ে আপনার সাথে আজরাতে দেখা করতে চেয়েছিলেন? এটা জানা খুবই দরকারী।

    প্রশ্নটির ইঙ্গিত ল্যাংডনকে অস্বস্তিতে ফেলে দিলো।

    আমি আসলেই অনুমান করতে পারছি না। আমি জিজ্ঞেস করিনি। উনার সাথে যোগাযোগ হবে এই ভেবে আমি খুব সম্মানিত বোধ করেছিলাম। আমি মি. সনিয়ের কাজকে খুব শ্রদ্ধা করি। তার ভক্ত ছিলাম। উনার লিখিত বইপত্র প্রায়শই শ্রেণী কক্ষে ব্যবহার করতাম।

    ফশে তার নোট বইয়ে এইসব টুকে নিলো।

    দুজন লোক তখন ডেনন উইংসর প্রবেশ পথের টানেলের অর্ধেক পথে এসে পড়েছে। ল্যাংডন দেখতে পেলো পথের শেষ মাথায় এক জোড়া এসকেলেটর। দুটোই। থেমে আছে। ততা, আপনারা একই বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন? ফশে জিজ্ঞেস করলো।

    হ্যাঁ। সত্যি বলতে কী, গতবছরের বেশিরভাগ সময়ই আমি এমন একটি বিষয়ে বই লিখতে ব্যস্ত ছিলাম যে বিষয়ে মি. সনিয়ের বেশ দক্ষতা ছিলো। আমি উনার মাথা থেকে আরো কিছু জিনিস নিতে চাচ্ছিলাম।

    কথাটা বোধ হয় ফশে ঠিক বুঝতে পারলো না।

    আমি উনার চিন্তাভাবনা সমূহ সম্পর্কে জানতে চাইছিলাম আর কী।

    আচ্ছা। বিষয়টা কি ছিলো?

    ল্যাংডন দ্বিধান্বিত হলো, কীভাবে বলবে ঠিক বুঝতে পারছিলো না। লেখার বিষয় বস্তু ছিলো দেবীদের আইকনোগ্রাফি সম্পর্কিত-পবিত্র নারী, পূজা এবং তার সাথে চিত্রকলা আর প্রতীকের সংযোগ।

    ফশে তার চুলে আলতো করে আঙ্গুল চালালো। সনিয়ের এ ব্যাপারে খুব জানালোনা ছিলো?

    তাঁর চেয়ে বেশি কেউ জানতো না।

    বুঝেছি।

    ল্যাংডন বুঝতে পারলো ফশে আসলে কিছুই বোঝেনি। জ্যাক সনিয়েকে দেবী আইকনোগ্রাফির ব্যাপারে এ বিশ্বে একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শুধুমাত্র পূরাকীর্তি সংক্রান্ত দেবী পূজা, স্ত্রী পূজা, উইকা এবং পবিত্র নারী সম্পর্কে তাঁর ব্যক্তিগত আগ্রহের কারণেই নয়, বরং লুভরে বিশ বছর ধরে কিউরেটর হিসেবে থাকাকালীন সময়ে সনিয়ে লুভরে সারা পৃথিবীর দেবীদের চিত্রকলার এক বিশাল সংগ্রহ তৈরি করতে সাহায্য করেছিলেন লাবরিজ এর কুড়াল থেকে প্রাচীন গৃকের ডেলফির মন্দিরের নারী যাজকদের চিত্রকলা, স্বর্ণ কাচি ওয়ান্ডস, শত শত ইয়েত আখ, প্রাচীন মিশরে শয়তানের ক্ষমতা রহিতকরণের জন্য ব্যবহার করা এক ধরনের গোখরা সাপ এবং আইসিস দেবীর সেবায় রত হোরাসের বিস্ময়কর ভাস্কর্য।

    সম্ভবত জ্যাক সনিয়ে আপনার পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে জানতো?  ফশে বললো, তিনি আপনার বইয়ের জন্য তাঁর সাহায্যের ব্যাপরে সাক্ষাতের প্রস্তাব করেছিলেন।

    ল্যাংডন মাথা নেড়ে সায় দিলো। আসলে, এখন পর্যন্ত আমার পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। সেটা এখনও খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। আমি ওটা আমার সম্পাদক ছাড়া আর কাউকে দেখাইনি।

    ফশে চুপ মেরে গেলো।

    ল্যাংডন পাণ্ডুলিপিটা কেন অন্য কাউকে দেখায়নি সেটা অবশ্য বললো না। তিনশ পৃষ্ঠার খসড়া আকর্ষনীয় শিরোনাম সিম্বলস অব দি লস্ট স্যাকরেড ফেমিনিন–সমকালীন প্রতিষ্ঠিত ধর্মমতগুলোর আইকনোগ্রাফি সম্পর্কে কিছু নতুন ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে যা নিশ্চিত ভাবেই বির্তকিত হবে।

    এখন, থেমে থাকা এসকেলেটরের কাছে এগোতেই ল্যাংডনের মনে হলো ফশে তার পাশে নেই। লাংডন ঘুরে দেখে ফশে একটা লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

    আমরা লিফটে যাবো, লিফটের দরজাটা খুলতেই ফশে বললো। আমি নিশ্চিত, আপনি জানেন, গ্যালারিটি পায়ে হেটে যাওয়ার জন্য একটু বেশিই হয়ে যায়।

    যদিও ল্যাংডন জানতো যে লিফটে মাত্র দুতলা গেলেই ডেনন উইংস। সে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।

    কিছু হয়েছে কি? ফশে দরজায় হাত দিয়ে অধৈর্যের সাথে বললো।

    ল্যাংডন ক্লান্ত ভঙ্গীতে থেমে থাকা এসকেলেটরের দিকে তাকালো। কিছুই হয়নি, সে নিজের সাথে মিথ্যে বললো। লিফটের দিকে পেছন ফিরে রইলো সে। ছেলেবেলায় ল্যাংডন একটা পরিত্যাক্ত কুয়ায় পড়ে গিয়ে পানিতে ডুবে মরতে বসেছিলো—সেখানে একঘণ্টা আটকে ছিলো। তারপর মরে যাওয়ার আগেই তাকে উদ্ধার করা হয়েছিলো। এরপর থেকেই বদ্ধ কোন জায়গায় ঢুকলেই তার প্রচণ্ড ভয় করে—লিফট, ভূগর্ভস্থ পথ, স্কোয়াশ কোর্ট সসব জায়গায়। লিফট খুবই নিরাপদ একটা জায়গা, ল্যাংডন ক্রমাগত নিজেকে বলে চললো। অবশ্য এ কথা সে কখনও বিশ্বাস করে না। এটা একটা ছোট্ট লোহার বাক্স, বদ্ধ একটা জায়গায় ঝুলে আছে! বুকভরে নিঃশ্বাস নিয়ে সে লিফটের ভেতরে প্রবেশ করলো। অতি পরিচিত শিড়দাঁড়া বেয়ে শীতল একটা অনুভূতি টের পেলো সে।

    দুই তলা। দশ সেকেন্ড মাত্র।

    আপনি এবং মি. সনিয়ে, লিফটা চলতে শুরু করলে ফশে বলতে শুরু করলো, কখনও কথা বলেন নি? ই-মেইল আদান প্রদান করেননি?

    আরেকটা অদ্ভুত প্রশ্ন। ল্যাংডন মাথা নাড়লো। না, কখনও না।

    ফশে মাথাটা দোলাতে লাগলো যেনো এই কথাটা সে মনে মনে টুকে নিচ্ছে কিন্তু কিছুই বললো না, ঠিক সামনের ক্রোম দরজাটার দিকে চেয়ে রইলো। লিফটা চলতে শুরু করলে ল্যাংডন অন্য কিছুর দিকে না তাকিয়ে চার দেয়ালের দিকে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। লিফটের চঞ্চকে দরজার দিকে চেয়ে দেখলো সেখানে ক্যাপ্টেনের টাই বাঁধা দৃশ্যটা প্রতিফলিত হচ্ছে—একটা সিলভার ক্রুশ, সেই তেরোটি কালো অকীক মণির কারুকাজ খচিত। ল্যাংডনের কাছে এটা খুবই বিস্ময়কর বলে মনে হলো। সে অবাকই হলো বলা যায়। প্রতীকটি কুক্স জেমাতা হিসেবেই পরিচিত একটা ক্রুশ যাতে রয়েছে তেরোটি জেম বা পাথর বসানো—একটি বৃস্টিয় আদর্শ প্রতীক, যিশু এবং তার বারোজন শিষ্য। যাহোক, ল্যাংডন কোনভাবেই এটা আশা করেনি যে, ফরাসি পুলিশের কোন ক্যাপ্টেন তার ধর্মকে এরকম খোলাখুলিভাবে প্রচার করবে। তারপরও বলতে হয়, এটা ফ্রান্স; খৃস্টান ধর্ম এখানে জন্ম অধিকার হিসেবে খুব একটা স্বীকৃত নয়।

    এটা ক্রুক্স জেমমাতা, ফশে আচমকা কথাটা বললো। ল্যাংডন চমকে চেয়ে দেখে ফশের চোখ তার উপর। লিফটা থেমে গেলে দরজাটা খুলে গেলো।

    ল্যাংডন খুব দ্রুতই ভেতর থেকে বের হয়ে এলো, খোলামেলা বিশাল কোন স্থানের জন্য উদগ্রীব ছিলো সে। লুভরের বিখ্যাত গ্যালারির উঁচু সিলিংয়ের নিচে এসে হাফ ছেড়ে বাচলো। যে জায়গায় সে এসে পড়লো, সেটা আর যাই হোক তার কাছে প্রত্যাশিত ছিলো না।

    বিস্মিত ল্যাংডন থেমে দাঁড়ালো।

    ফশে তার দিকে তাকিয়ে বললো, মনে হয় মি. ল্যাংডন, আপনি কখনও বন্ধ হয়ে যাবার পর লুভর দেখেননি।

    মনে হয় না দেখেছি? ল্যাংডন ভাবলো, অন্যমনস্কতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করলো।

    যে লুভর সবসময় আলো ঝলমলে চোখ ধাঁধানো অবস্থায় থাকে সেই জায়গাটা আজরাতে কেমন অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখাচ্ছে। উপর থেকে সাদা ফ্লাড লাইট জ্বলা সত্ত্বেও একটা ছোট লালবাতির আভাই বেশি চোখে পড়ছে—লাল আলোর ছটা টাইলসের ফ্লোরে পড়াতে জায়াগাটাকে রহস্যময় মনে হচ্ছে।

    ল্যাংডন অন্ধকারাচ্ছন্ন করিডোরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো এই দৃশ্যটা প্রত্যাশা করাই উচিত ছিলো তার। বলতে গেলে প্রায় সব প্রধান প্রধান গ্যালারিতেই রাতের বেলায় লাল বাতি জ্বলিয়ে রাখা হয় বিশেষ বিশেষ জায়গায় এমন ভাবে এগুলো রাখা হয় যাতে এইসব নরম আর হালকা আলোতে কর্মচারীরা চলাফেরা করতে পারে। চিত্রকর্মগুলো তার চেয়েও বেশি অন্ধকারে রাখা হয়, কড়া আলোয় ছবিগুলোর ক্ষয় দ্রুত হয় সেজন্যে। আজরাতে মিউজিয়ামটি খুব বেশি অস্বস্তিকর বলে মনে হচ্ছে। সব জায়গায় দীর্ঘ ছায়া ছড়িয়ে আছে আর উঁচু উঁচু ছাদগুলো অন্ধকারে খুব বেশি নিচু লাগছে।

    এদিক দিয়ে আসুন, ফাশ বললো, ডানদিকে ঘুরে একাধিক গ্যালারির সংযোগস্থলের দিকে ইঙ্গিত করলো সে। ল্যাংডন তাকে অনুসরণ করলো, অন্ধকারে আস্তে আস্তে তার চোখ মানিয়ে নিতে শুরু করেছে। তার মনে হলো চারদিকের তৈলচিত্রগুলে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, অনেকটা ছবি তৈরির ডার্ক রুমে যেভাবে ছবিগুলো আস্তে আস্তে ফুটে ওঠে…সে সব চিত্রকর্মগুলো যেনো তাদেরকে চেয়ে চেয়ে দেখছে। সে জাদুঘরের চিরচেনা বাতাসের গন্ধটা টের পেলো সে—একটা শুষ্ক, হাল্কা কার্বনের গন্ধ-শিল্প-কারখানার মতো কোলফিল্টারটা সারাদিনের আগত দর্শনার্থীদের ত্যাগ করা কার্বন-ডাই-ওক্সইডকে শুষে নিচ্ছে।

    দেয়ালের খুব উঁচুতে, নিরাপত্তা ক্যামেরাগুলো দৃষ্টির গোচরে এলো। সেগুলো যেনো দর্শনার্থীদের কাছে একটা পরিষ্কার বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে : আমরা তোমাদের দেখছি। কোন কিছু স্পর্শ কোরো না।

    সবগুলোই কি আসল? ক্যামেরাগুলোর দিকে তাকিয়ে ল্যাংডন জিজ্ঞেস করলো।

    ফশে মাথা নাড়লো। অবশ্যই না।

    ল্যাংডন একটুও অবাক হলো না। এ রকম একটা বিশাল জাদুঘরে ভিডিও সার্ভিলেন্স করাটা অসম্ভব ব্যয়বহুল আর অকার্যকর। কয়েক একরের গ্যালারিতে নজর দারি করতে হলে শুধুমাত্র ক্যামেরার ছবি মনিটরিং করার জন্যই লুভরের দরকার হবে শত শত টেকনিশিয়ান। বড় বড় জাদুঘরগুলো বর্তমানে কনটেইনমেন্ট সিকিউরিটি ব্যবহার করে থাকে। চোরদেরকে বাইরে রাখার কথা ভুলে যাও। তাদেরকে ভেতরেই রাখো। অবরুদ্ধ করা, মানে কনটেইনমেন্ট সিস্টেমটা জাদুঘর বন্ধ হবার সাথে সাথেই চালু করা হয়। আর এখন যদি কোন অনুপ্রবেশকারী কোন একটা শিল্পকর্ম সরিয়ে ফেলে, তবে পুরো গ্যালারিটির বের হবার পথ সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাবে। চোর তখন পশিল আসার আগেই জেলখানার.গারদের ভেতরে নিজেকে আবিষ্কার করবে।

    মার্বেল পাথরের করিডোর থেকে মানুষের কণ্ঠস্বরের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয়ে আসতে লাগলো। শব্দগুলো সম্ভবত ডানদিকের নিচতলার কোন প্রকোষ্ঠ থেকে আসছে। হলওয়ের ওপর উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে আছে।

    এটা কিউরেটরের অফিস। ক্যাপ্টেন বললো।

    বারান্দা দিয়ে যাবার সময় ল্যাংডন হলওয়ের নিচের দিকে একটু তাকিয়ে দেখলো, সনিয়ের অভিজাত পড়ার ঘরটা উষ্ণ কাঠের তৈরি, পুরনো তৈলচিত্র আর বড়সড় একটা পুরনো আমলের ডেস্ক, যার ওপর দুই ফুট লম্বা বর্ম পরিহিত একটা নাইটের মূর্তি রাখা। ঘরটার ভেতরে কয়েকজন পুলিশ অফিসার, ফোনে কথা বলছে, নোট নিচ্ছে। তাদের একজন সনিয়ের ডেস্কে বসে ল্যাপটপে টাইপ করছে। প্রকারন্তরে কিউরেটরের ব্যক্তিগত কক্ষটি ডিসিপিজের আজ রাতের কমান্ড-পোস্ট হয়ে উঠেছে।

    মেঁসিয়ে, ফশে ডাক দিলে লোকটা তার দিকে ঘুরে তাকালো। নিনো দোরাঁগেজ পাস সু আঁক প্রিতেক্স। এঁতেদু?

    অফিসের সবাই কথাটা বুঝতে পেরে মাথা নাড়লো।

    ল্যাংডন নো পাস দোরাঁগেজ চিহ্নসম্বলিত কার্ড হোটেলের ঘরের বাইরে ঝুলিয়ে রাখে, সে ক্যাপ্টেনের কথার সারমর্মটা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারলো। ফশে আর ল্যাংডনকে কোন কারণে যেনো বিরক্ত করা না হয়।

    পুলিশের দলটাকে পেছনে রেখে ফশে ল্যাংডনকে নিয়ে আরো বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন হলওয়ের দিকে এগিয়ে গেলো। লুভরের সবচাইতে জনপ্রিয় গ্যালারিটা আর মাত্র ত্রিশ ফুট দূরে–লা গ্রঁ গ্যালারি—প্রায় এক অন্তহীন দীর্ঘ করিডোর, যেখানে রয়েছে লুভরের সবচাইতে মূল্যবান ইতালিয় মাস্টারপিসগুলো। ল্যাংডন এতোক্ষণে বুঝে গিয়েছে, সনিয়ের মৃত দেহটা এখানেই পড়ে আছে; গ্র্যান্ড গ্যালারির বিখ্যাত কাঠের নক্সা করা জমিনটা পোলারয়েড ক্যামেরায় অভ্রান্তভাবেই ফুটে উঠেছিলো।

    তারা এগোতেই ল্যাংডন দেখতে পেলো প্রবেশ পথটি বড় একটা লোহার গেট দিয়ে আঁটকানো আছে ; যেনো মধ্যযুগের রাজপ্রাসাদগুলো মারাউদিং সৈন্যদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য এসব ব্যবহার করছে।

    কনটেইনমেন্ট সিকিউরিটি, গেটের সামনে পৌঁছাতেই ফশে বললো।

    এমনকি অন্ধকারেও ঐ গেটটা দেখে মনে হলো সেটা একটা ট্যাংককেও আটকে দিতে পারবে। বাইরে থেকেই ল্যাংডন লোহার গৃলের ভেতর দিয়ে স্বল্প আলোর গ্র্যান্ড গ্যালারিটা দেখতে পেলো।

    আপনার সামনেই, মি. ল্যাংডন, ফশে বললো।

    ল্যাংডন ফিরে দেখলো। আমার সামনে, কোথায়?

    ফশে স্থির হয়ে গৃলের নিচে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। ল্যাংডনও নিচে তাকালো। অন্ধকারে সে খেয়াল করেনি। গৃলটা দুফুটের মতো উপরে উঠানো। তাতে করে নিচে কি আছে সেটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

    এই জায়গাটা এখনও লুভরের নিরাপত্তার বাইরে রয়েছে, ফশে বললো। আমার পুলিশ তেকনিক এ সাইস্তিফিক-এর দলটি একটু আগেই তাদের তদন্ত শেষ করেছে। সে গৃলের দিকে এগিয়ে গেলো। প্লিজ, নিচ দিয়ে আসুন।

    ল্যাংডন সেই সরু জায়গাটার দিকে তাকিয়ে বিশাল লোহার গৃলটার উপরের দিকে তাকালো। ঠাট্টা করছে, তাই না? লোহার গৃলের ব্যারিকেডটা দেখে মনে হচ্ছে একটা গিলোটিন, অনুপ্রকেশকারীর গলা কাটার জন্য অপেক্ষা করছে।

    ফশে ফরাসিতে বিড়বিড় করে কিছু বলে ঘড়ির দিকে তাকালো, তারপর হাটু গেঁড়ে গৃলের নিচ দিয়ে গড়িয়ে ভেতরে চলে গেলো। অন্যপ্রান্তে গিয়ে গৃলের ভেতর দিয়ে ল্যাংডনের দিকে তাকালো সে।

    ল্যাংডন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হাতের তালু পালিশ করা কাঠের জমিনে রেখে শুইয়ে পড়ে নিচ দিয়ে গড়িয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। নিচ দিয়ে যাবার সময় তাঁর হ্যারিস টুইড টাইটা আঁটকে গেলে ল্যাংডনের মাথাটা একটু পেছনের দিকে টান লাগলো। মাথাটা টুক করে লোহার গৃলের সাথে লাগলে ব্যথা পেলো সে।

    খুবই ভালো, রবার্ট, সে ভাবলো। একটু হোচট খেয়ে শেষ পর্যন্ত উঠে দাঁড়ালো। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতেই ল্যাংডনের এই আশংকা হতে শুরু করলো যে, আজকের রাতটা খুব দীর্ঘ হবে।

     

    ০৫.

    মুরে হিল–ওপাস দাইর নতুন বিশ্ব সদর দফতর এবং কনফারেন্স সেন্টার নিউইয়র্ক শহরের ২৪৩ লেক্সিংটন এভিনুতে অবস্থিত। ৪৭ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি টাকা ব্যয়ে নির্মিত, ১৩৩০০০ বর্গফুটের টাওয়ারটা লাল ইট আর ইন্ডিয়ানা লাইমস্টোন দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। মে এন্ড পিংসার নক্সায় করা এই দালানটাতে রয়েছে একশরও বেশি শোবার ঘর, ছয়টা ডাইনিং-রুম, লাইব্রেরি, বৈঠকখানা, মিটিং-রুম এবং অফিস ঘর। তৃতীয় অষ্টম এবং ঘোড়শ তলাগুলো গীর্জা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সেগুলো মিলওয়ার্ক এবং মার্বেল দিয়ে সাজানো। সতেরো তলাটি পুরোপুরি আবাসিক কাজে ব্যবহার করা হয়। পুরুষেরা এই ভবনে লেক্সিংটন এভিনুর দিকের প্রধান দরজাটা দিয়ে প্রবেশ করে আর মহিলারা প্রবেশ করে পাশের রাস্তা বরাবর একটা আলাদা দরজা দিয়ে। তাদেরকে এই ভবনে শাব্দিক এবং দৃশ্যগত। উভয় দিক থেকে সবসময়ই পৃথক করে রাখা হয়।

    আজকের রাতের প্রথম দিকে, নিজের এপার্টমেন্টের পবিত্র আবহাওয়ার মধ্যে বিশপ ম্যানুয়েল আরিজারোসা ছোট্ট একটা ট্রাভেলব্যাগ গোছগাছ করে ঐতিহ্যবাহী কালো পোশাক পরে তৈরি হয়ে গেলেন। সাধারণত তিনি কোমরে বেগুনি রঙের একটা সিনচুয়ার জড়িয়ে নেন, কিন্তু আজ রাতে তিনি জনসাধারনের মধ্যে যাতায়াত করবেন। তাই ঠিক করলেন কারোর মনোযোগ যাতে আকর্ষিত না হয় যে, তিনি একজন বিশপ। শুধুমাত্র অভিজ্ঞ চোখই তার হাতের ১৪ ক্যারেটের সোনার আংটিটা দেখে তাঁকে চিনতে পারবে। যাতে রয়েছে পার্পল অ্যামেথিস্ট, বড় একটা হীরা এবং হ্যান্ডটুল মিরে ক্রোজিয়ের এপলিক পাথর। ট্রাভেল ব্যাগটা কাঁধে ফেলে তিনি নিরবে একটা প্রার্থনা। সেরে নিয়ে নিজের এপার্টমেন্ট ত্যাগ করলেন। লবিতে তার ড্রাইভার তাকে বিমান। বন্দরে নিয়ে যাবার জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে।

    এখন, রোমের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়া একটা বাণিজ্যিক বিমানে বসে আরিঙ্গারোসা জানালা দিয়ে ঘন কালো আটলান্টিকের দিকে তাকালেন। সূর্য ইতিমধ্যে উদয় হয়েছে, কিন্তু অরিঙ্গাবোসা জানতেন তাঁর নিজের আকাশের তারা উঠে গেছে। আজ রাতে যুদ্ধ জয় হবে, ভাবলেন তিনি, বিস্ময়কর ব্যাপার যে, মাত্র এক মাস আগেও তার সাম্রাজ্য ধ্বংস হবার হুমকিটার বিরুদ্ধে তিনি খুব অসহায়বোধ করছিলেন।

    ওপাস দাইর প্রেসিডেন্ট-জেনারেল হিসেবে বিশপ আরিঙ্গাবোসা বিগত দশ বছর ধরে নিজের জীবন ব্যয় করেছেন ওপাস দাইর মাধ্যমে ঈশ্বরের কর্মীর বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। সংস্থাটি ১৯২৮ সালে স্পেনিয় যাজক হোসে মারিয়া এসক্রিভা গঠন করেছিলেন। রক্ষণশীল ক্যাথলিক মূল্যবোধে ফিরে যাওয়া আর সেটার পৃষ্ঠাপোষকতা করা এবং এর সদস্যদেরকে ঈশ্বরের কর্ম সম্পাদন করার জন্য আত্মত্যাগে উৎসাহ দেবার জন্য কাজ করে সংগঠনটি।

    ওপাস দাইর ঐতিহ্যবাহী দর্শনটি ফ্রাংকোর শাসনামলেরও আগে স্পেনে এর শিকড় প্রােথিত ছিলো। কিন্তু ১৯৩৪ সালে হোসে মারিয়া এসক্রিভার আধ্যাত্মিক বই দ্য ওয়ে প্রকাশ হবার পর থেকে এসক্রিভার বার্তা বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে দ্য ওয়ের চল্লিশ লক্ষেরও বেশি কপি বিয়াল্লিশটি ভাষায় অনূদিত আছে। ওপাস দাই বিশ্বব্যাপী একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এর আবাসিক হল, শিক্ষাকেন্দ্র এবং এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ পৃথিবীর প্রায় সব বড় বড় শহরগুলোতেই পাওয়া যাবে। ওপাস দাই সারা বিশ্বের ক্যাথলিক সংস্থাসমূহের মধ্যে সবচাইতে দ্রুত বর্ধনশীল এবং আর্থিকভাবে সুসংহত সংগঠন। দূভার্গ্যবশত, আরিঙ্গাবোসা বুঝতে শিখেছিলেন যে, ধর্মীয় সিনিসিজমের এই যুগে, ওপাস দাইর ক্রমবর্ধমান সম্পদ এবং ক্ষমতা বৃদ্ধি সম্পর্কে সন্দেহকে চুম্বকের মতোই টানবে।

    অনেকেই ওপাস দাইকে মস্তিষ্ক ধোলাইয়ের কারখানা বলে থাকে, সাংবাদিকরা প্রায়শই এমন চ্যালেঞ্জ করে থাকে। অনেকেই আপনাদেরকে অতিরক্ষণশীল একটি বৃস্টিয় গুপ্ত সমাজ বলে অভিহিত করে থাকে। আপনারা আসলে কোনটা?

    ওপাস দাই এসব কোনটাই না, বিশপ খুব ধৈর্যসহকারে জবাব দিতেন, এটি একটি ক্যাথলিক চার্চ। আমরা এমন একটি ক্যাথলিক সংগঠন যারা সত্যিকারের ক্যাথলিক বিশ্বাস নিজেদের দৈনন্দিন জীবনাচরণে পালন করা জন্য অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি।

    ঈশ্বরের কর্ম করার জন্য কি কুমার থাকার বা কৌমার্য ব্রত পালন করার সত্যি কোন দরকার আছে, নিজের শরীরকে কষ্ট দেয়া এবং সিলিসের মাধ্যমে তীব্র যন্ত্রণা পাওয়ার কি সংগত কোন কারণ আছে?

    আপনারা শুধুমাত্র ওপাস দাইর ক্ষুদ্র একটি অংশের বর্ণনা দিলেন, অরিঙ্গাবোসা বলেছিলেন। আমাদের এখানে অনেক ধরনের অংশগ্রহণ রয়েছে। হাজার হাজার ওপাস দাইর সদস্য বিবাহিত, তাদের পরিবার আছে এবং তারা নিজেদের সমাজে ঈশ্বরের কর্ম সম্পাদন করে থাকে। অন্যেরা আমাদের আবাসিক স্থানগুলোতে অধ্যাত্মবাদের জীবন বেছে নিয়েছে। এসব তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ। কিন্তু ওপাস দাইর সবাই একই উদ্দেশ্য পোষণ করে থাকে, ঈশ্বরের কর্মীর মাধ্যমে বিশ্বের আরো বেশি মঙ্গল সাধন করা। নিশ্চিতভাবেই এটি একটি প্রসংশনীয় প্রচেষ্টা।

    প্রচার মাধ্যম সবসময়ই কেলেংকারীর উপরই বেশি গুরুত্ব দেয়। আর ওপাস দাইরও অন্যসব বৃহৎ সংগঠনের মতোই, নিজেদের ভেতরে কিছু বিপথগামী সদস্য রয়েছে যাদের জন্য সংগঠনের সব সদস্যই বদনামের ভাগীদার হয়।

    দুমাস আগে, ওপাস দাইর মিডওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির একটি দল নতুন যোগ দেয়া সদস্যদেরকে দীক্ষিত করার জন্য এবং ধর্মীয় অনুভূতির আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা লাভের আশায় মাদক সেবনরত অবস্থায় হাতেনাতে ধরা পড়ে যায়। আরেকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাঁটা তারের সিলিস বেল্টটা নিয়মানুযায়ী দিনে দুঘণ্টা ব্যবহার না করে বেশি সময় ব্যবহার করে মারাত্মক ইনফেকশনের শিকার হয়ে প্রায় মরতে বসেছিলো। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, বোস্টনের এক মোহগ্রস্ত তরুণ ব্যাংকার তার নিজের সমস্ত ধন-সম্পত্তি ওপাস দাইর নামে লিখে দিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলো।

    বিপথগামী ভেড়া, আরিঙ্গাবোসা ভাবলেন, তাদের জন্য তাঁর হৃদয়ে কোন সহানুভূতি নেই।

    সন্দেহাতীতভাবেই সবচাইতে বিব্রতকর ব্যাপার ছিলো বহুল আলোচিত এবং ব্যাপক প্রচারণা পাওয়া এফবিআইর গুপ্তচর রবার্ট হানসেনের মামলাটি। সে ছিলো ওপাস দাইর খুবই নাম করা একজন সদস্য। দেখা গেলো সে আসলে যৌনবিকৃত ব্যক্তি, যে নিজের শোবার ঘরে একটা ক্যামেরা লুকিয়ে রেখে দিতো যাতে তার বন্ধু বান্ধবরা তার বউয়ের সাথে যৌনকর্মের দৃশ্য দেখতে পারে। এজন আত্ম উৎসর্গীকৃত ক্যাথলিকের জন্য সময়টা সত্যিই কঠিন, বিচারক মামলা চলাকালীন সময়ে মন্তব্যটি করেছিলেন।

    দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এইসব ঘটনা নতুন একটি পর্যবেক্ষক দল, যাদের নাম দি ওপাস দাই এওয়্যারনেস নেটওয়ার্ক (ওডিএএন), গঠনে সাহায্য করলো। দলটির জনপ্রিয় ওয়েবসাইট www.odan.org-ওপাস দাইর সাবেক সদস্যদের কাহিনী সম্প্রচার করতে শুরু করে, যেনো কেউ এই বিপজ্জনক সংগঠনে যোগ না দেয়। প্রচার মাধ্যমগুলো এরপর থেকে ওপাস দাইকে ঈশ্বরের মাফিয়া এবং যিশুর পূজারী বলে অভিহিত করতে থাকে।

    আমরা যা বুঝি না সেটাকে ভয় পাই, আরিঙ্গাবোসা ভাবলেন, তাঁর আক্ষেপ, এইসব সমালোচক যদি জানতো কতো লোককে ওপাস দাই নতুন জীবন দিয়েছে। দলটি ভ্যাটিকানের পুরোপুরি সমর্থন এবং আশীবাদপুষ্ট। ওপাস দাই স্বয়ং পোপেরই একটি মনোনীত সংস্থা।

    সাম্প্রতিক কালে, ওপাস দাই প্রচারমাধ্যমের চেয়েও বেশি শক্তিশালী একটি শক্তির হুমকির সম্মুখীন হয়েছে …একটি আচমকা শত্রুতা যা আরিঙ্গাবোসা কোনভাবেই লুকাতে পারেন না। পাঁচমাস আগে, ক্ষমতার অকেন্দ্রটি ঝাঁকুনি খেয়েছিলো, আর আরিগারোসা এখনও সেই আঘাতটি সামলে উঠতে পারেননি।

    তারা জানে না, তারা কোন্ যুদ্ধ শুরু করেছে, আরিজারোসা মনে মনে বললেন। বিমানের জানালা দিয়ে তিনি নিচের অন্ধকার সমুদ্রের দিকে তাকালেন। তখনই তাঁর চোব জানালার কাঁচে প্রতিফলিত হওয়া নিজের মুখের দিকে আঁটকে গেলো কালচে এবং পরিশ্রান্ত, লম্বা বাঁকানো নাক আধিপত্য করছে সেখানে, তরুণ মিশনারি হিসেবে স্পেনে থাকার সময় নাকটা একটা ঘুষিতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছিলো। সেই চিহ্নটা এখনও রয়ে গেছে তাঁর শরীরে। আরিঙ্গাবোসা আত্মার বিশ্বের মানুষ, রক্তমাংসের নয়।

    পর্তুগালের উপকূল দিয়ে জেট প্লেনটা অতিক্রম করতেই, পকেটে রাখা সেল ফোনটা কাঁপতে শুরু করলো। ফোনটার রিংটোন বন্ধ করে রাখা ছিলো। যদিও বিমান চলাকালীন সময়ে সেলফোন ব্যবহার করা নিষিদ্ধ, তারপরও আরিঙ্গাবোসা জানেন এই কলটা তিনি ছেড়ে দিতে পারেন না। এই ফোন নাম্বারটা শুধুমাত্র একজনের কাছেই আছে। সেই লোকই তাঁকে ফোন করেছে।

    উত্তেজিত বিশপ খুব শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন। হ্যাঁ?

    সাইলাস কি-স্টোনটার অবস্থান জানতে পেরেছে, লোকটা বললো। সেটা প্যারিসেই রয়েছে। সেন্ট সালপিচ চার্চের ভেতরে।

    বিশপ আরিঙ্গারোসা মুচকি হাসলেন। তাহলে আমরা খুব কাছাকাছি এসে গেছি।

    আমরা খুব দ্রুতই সেটা নিয়ে নিতে পারবো। কিন্তু আমাদের দরকার আপনার সাহায্যের।

    অবশ্যই। বলুন আমাকে, কি করতে হবে?

    আরিঙ্গাবোসা যখন ফোনটা বন্ধ করলেন তখন তার হৃদপিণ্ড লাফাচ্ছে। তিনি আবার বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকালেন। যা ঘটেছে তাতে তাঁর দারুণ এক সুখকর অনুভূতি হতে লাগলো।

    * * *

    পাঁচশো মাইল দূরে, সাইলাস নামের ধবল লোকটি একটা ছোট্ট পানির বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার পিঠের রক্ত পরিষ্কার করছে আর পানিতে লাল রক্তটা দেখতে কী রকম হয় সেটা পরখ করে দেখেছে। আমাকে শুদ্ধ করো, আমি শুদ্ধ হবো, সে বাইবেলের একটা প্রার্থনা সঙ্গীত আওড়ালো। আমাকে সাফ করো, আমি তুষারের চেয়েও বেশি সাদা হবো।

    সাইলাসের এমন এক অনুভূতি হচ্ছে যা তার আগে কখনও হয়নি। এটা বিদ্যুতায়িত এবং বিস্ময়কর, দুটোই মনে হচ্ছে তার কাছে। বিগত দশ বছর ধরে, দ্য ওয়ে অনুসরণ করে আসছে। নিজেকে পাপ থেকে পরিষ্কৃত করা…নিজের জীবনকে পুণঃনির্মাণ করা…আর অতীতের সহিংসতা মুছে ফেলা। আজ রাতে এসব কিছু আবার ফিরে এসেছে তার মধ্যে। সে খুব অবাক হলো এই ভেবে যে, কতো দ্রুত তার অতীত আবার উঠে আসছে। সেটা কাজ করবার জন্য বেশ উপযোগীই হবে।

    যিশুর বার্তা হলো শান্তির…অহিংসার…ভালবাসার। শুরুতে এইসব কথাই সাইলাস শিখেছিলো, সেসব কথা সে হৃদয়ে ধারণ করে আছে। আর এসবই যিশুর শত্রুরা ধ্বংস করার হুমকি দিচ্ছে। যারা ঈশ্বরকে শক্তির হুমকি দেয় তারা শক্তির মুখোমুখি হবে। অনড় এবং প্রচণ্ড দ্রুততার সাথে।

    দুহাজার বছর ধরে, খৃস্টিয় সৈনিকরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে যারা তাদের বিশ্বাসকে ধ্বংস করতে চায়। আজরাতে, সাইলাস একটা যুদ্ধের ডাক দিয়েছে।

    নিজের ক্ষত শুকিয়ে সে তার গোড়ালী সমান লম্বা আলখেল্লাটা পরে নিলো। সেটা এক রঙা উলের তৈরি, তার গায়ের এবং চুলের রঙের সাথে মিলিয়ে শাদা রঙের। কোমরে দড়িটা শক্ত করে বেঁধে নিয়ে সে তার মাথাটা ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিলো। চাকাটা ঘুরছে।

     

    ০৬.

    নিরাপত্তা দরজার নিচে চাপা খেয়ে ল্যাংডন এ্যান্ড গ্যালারির ভেতরে উঠে দাঁড়ালো। একটা গভীর গিরিখাদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। গ্যালারির দুদিকের দেয়ালই ত্রিশ ফিট উচ্চতা সম্পন্ন, অন্ধকারের মধ্যেও সেটা বোঝা যায়। লাল আলোর সার্ভিস লাইটগুলো দেয়ালের ওপরের দিকে লাগানো, সেগুলোর অতিপ্রাকৃত আলোতে দা ভিঞ্চি, তিতিয়ান এবং কারাজ্জিওর দূর্লভ সংগ্রহগুলো উদ্ভাসিত হয়ে আছে। ছবিগুলো ছাদের সাথে তার লাগিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। স্টিল লাইফ, ধর্মীয় দৃশ্য। এবং ল্যান্ডস্কেপের সাথে সঙ্গী হয়েছে খ্যাতনামা ব্যক্তি আর রাজনীতিবিদদের ছবি। যদিও গ্র্যান্ড গ্যালারি হলো লুভরের সবচাইতে বিখ্যাত ইতালিয় শিল্পকলার কক্ষ, তবে অনেক দর্শনার্থী মনে করে এখানকার সবচাইতে চিত্তাকর্ষক জিনিসটা হলো কাঠের নক্সা করা ফ্লোরটা। ওক গাছের বাকলের উপর অসাধারণ জ্যামিতিক নক্সার ফ্লোরটা এক ধরণের ক্ষণস্থায়ী দৃষ্টি বিভ্রম সৃষ্টি করে দর্শনার্থীদের মধ্যে এমন অনুভূতি তৈরি করে। যাতে তাদের মনে হয় তারা গ্যালারির ওপরে ভাসছে আর প্রতিটি পদক্ষেপে দৃশ্যসমূহ বদলে যাচ্ছে।

    জমিনের ওপর তাকাতেই ল্যাংডনের চোখ একটা অপ্রত্যাশিত জিনিসের দিকে আঁটকে গেলো। জিনিসটা কয়েক গজ দূরে মাটিতে পড়ে আছে, সেটার চারদিক পুলিশের ফিতা দিয়ে ঘেরাও করা। সে ফশের দিকে তাকালো। এটা কি… কারাজ্জিওর ছবি মাটিতে পড়ে আছে?

    ফশে তার দিকে না তাকিয়েই মাথা নেড়ে সায় দিলো। চিত্রকর্মটি, ল্যাংডন অনুমান করলো, দুই মিলিয়ন ডলারেরও বেশি দামের, আর সেটা কিনা একটা দোমড়ানো মোচরানো পোস্টারের মতো মাটিতে পড়ে আছে। এটা এভাবে মাটির ওপর পড়ে আছে!

    ফশে একটুও না নড়েচড়ে তার দিকে চোখ বড়বড় করে তাকালো। এটা অপরাধ সংঘঠিত স্থান, মি. ল্যাংডন। আমরা এখানকার কোন কিছুই স্পর্শ করিনি। ছবিটা কিউরেটর নিজেই দেয়াল থেকে টেনে ফেলেছেন। এভাবেই নিরাপত্তা। সিস্টেমটাকে সচল করেছেন তিনি।

    ল্যাংডন গেটের দিকে তাকালো, কী ঘটেছিলো তার একটা ছবি মনে মনে আঁকার চেষ্টা করলো।

    কিউরেটর তার অফিসেই আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। সেখান থেকে গ্র্যান্ড গ্যালারির দিকে দৌড়ে এসেছেন। আর সিকিউরিটি সিস্টেমটা সচল করেছেন দেয়াল থেকে এই ছবিটা টেনে ফেলে দিয়ে। সাথে সাথে লোহার গেটটা পড়ে সবগুলো প্রবেশ পথ বন্ধ করে দিয়েছে। এই গ্যালারিতে ঢোকা এবং বের হবার জন্য এটাই একমাত্র প্রবেশ পথ।

    ল্যাংডনকে খুব দ্বিধান্বিত দেখালো। তবে তো, কিউরেটর তাঁর আক্রমণকারীকে গ্র্যান্ড গ্যালারির ভেতরে আঁটকে ফেলতে পেরেছিলেন?

    ফশে মাথা নাড়লো, সিকিউরিটি গেটটা সনিয়ে এবং তার আক্রমণকারীকে পৃথক করে রেখেছিলো। খুনি গেটের বাইরে থেকে গৃলের ভেতর দিয়ে গুলি করেছে। যে লোহার গেটের নিচ দিয়ে তারা এইমাত্র এখানে এসেছে ফশে তার একটি শিকে কমলা রঙের ট্যাগের দিকে নির্দেশ করলো। পিটিএস দলটি বন্দুকের গুলি লাগার জায়গাটি খুঁজে পেয়েছে। খুনি গলের ভেতর দিয়েই গুলি করেছে। জ্যাক সনিয়ে এখানে একা একাই মৃত্যু বরণ করেছেন।

    ল্যাংডন সনিয়ের শরীরের ছবিটা কল্পনা করলো। তারা বলছে, তিনি নিজেই এরকম করেছেন। ল্যাংডন তাদের সামনের বিশাল করিডোরটার দিকে তাকালো। তো উনার মৃত দেহটা কোথায়?

    ফশে তার টাইপিনটা একটু ঠিক করে নিয়ে হাটতে শুরু করলো। সম্ভবত আপনি জানেন, গ্র্যান্ড গ্যালারিটা অনেক দীর্ঘ।

    ল্যাংডন খুব ভালো করেই এটার একদম সত্যিকারের দৈর্ঘের কথাটা মনে করতে পারলো, সেটা প্রায় পনেরো শ ফুট দীর্ঘ, তিন তিনটা ওয়াশিংটন মনুমেন্টের দৈর্যের সমান। করিডোরটির প্রশস্ততাও অবিশ্বাস্য রকমের, সেখানে খুব সহজেই পাশাপাশি দুটো প্যাসেঞ্জার ট্রেন চলাচল করতে পারবে।

    ফশে চুপ মেরে গেলো, হনহন করে করিডোরের বাম দিক দিয়ে ছুটে চললো। তার দৃষ্টি একেবারে সোজা সামনের দিকে। বিখ্যাত বিখ্যাত সব মাস্টার পিসগুলোর সামনে দিয়ে যাবার সময় কোন ধরনের বিরতি না দিয়ে, সেগুলোর দিকে না তাকিয়ে এভাবে হেটে যাওয়ায় ল্যাংডনের কাছে মনে হলো ছবিগুলোকে অসম্মান করা হচ্ছে।

    এরকম আলোতে কিছুই দেখতে পারবো না, সে ভাবলো।

    এরকম স্বল্প আলো দুভার্গ্যজনকভাবেই তাকে স্বল্প আলোর ভ্যাটিকানের গোপন আকাইভে ঘটনাটার কথা স্মরণ করিয়ে দিলো। সেটা আজকের রাতের মতোই রোমে তার প্রায় মরতে বসার ঘটনার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আবার ভিত্তোরিয়ার কথা মনের পর্দায় ভেসে এলো। গত এক মাস ধরে মেয়েটা তার স্বপ্নে অনুপস্থিত ছিলো। ল্যাংডন একদমই বিশ্বাস করতে পারছিলো না যে, রোমের ঘটনাটি এক বছর আগের ; তার মনে হচ্ছে কয়েক যুগ আগে সেটা ঘটেছে। অন্য আরেকটি জীবনে। ভিত্তোরিয়ার সাথে তার শেষ যোগাযোগ হয়েছিলো গত ডিসেম্বরে—একটা পোস্টকার্ডে এই কথা লেখা ছিলো যে, সে জাভা সাগরের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে তার এনটেঙ্গেলমেন্ট পদার্থ বিদ্যার গবেষণার জন্য…উপগ্রহ ব্যবহার করে মান্তা রশ্মির সন্ধান করার মতো একটা ব্যাপারে। ল্যাংডন কখনও এমন ভ্রান্ত মোহে আচ্ছন্ন ছিলো না যে, ভিত্তোরিয়ার মতো একজন মেয়ে তার সাথে কলেজ ক্যাম্পাসে থেকে সুখি হবে, কিন্তু রোমে তাদের মুখোমুখি দেখা হওয়াটা তার মনে এমনভাবে গেঁথে আছে যে, সে এমনটি কখনও কল্পনাও করতে পারেনি। তার চিরজীবন অবিবাহিত থাকার বাসনা আর সহজ সরল স্বাধীনতা যেভাবেই হোক প্রচণ্ড একটা ঝাকি খেয়েছিলো ….

    একটা অপ্রত্যাশিত একাকীত্ব মনে হচ্ছে সেই জায়গাটা দখল করেছে আর বিগত একবছর ধরে সেটা ক্রমাগত বেড়েই চলছে।

    তারা হনহন করে হাটতে লাগলো, এতোদূর এসেও ল্যাংডন কোন মৃতদেহ দেখতে পেলো না। জ্যাক সনিয়ে এতোদূর পর্যন্ত এসেছিলেন?

    মি. সনিয়ে পেটে গুলি খেয়েছিলেন। তিনি খুব ধীরে ধীরে মৃত্যুবরণ করেছেন। সম্ভবত পনেরো কিংবা বিশ মিনিট পরে। নিশ্চিতভাবেই তিনি ছিলেন একজন শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের মানুষ।

    ল্যাংডন অবাক হয়ে তাকালো। নিরাপত্তারক্ষীদের এখানে আসতে পনেরো মিনিট লেগেছে?

    অবশ্যই না। লুভরের নিরাপত্তা রক্ষীরা এলার্ম শুনেই সাথে সাথে এখানে চলে এসেছিলো, এসে দেখে গ্র্যান্ড গ্যালারির গেট বন্ধ। গৃলের ভেতর থেকে তারা করিডোরের শেষ প্রান্তের দিকে কারোর পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েছিলো, কিন্তু লোকটাকে দেখতে পায়নি। তারা চিৎকার করে ডেকেও কোন উত্তর পায়নি। ধারণা করেছিলো, সেটা অপরাধীই হবে। তাই তারা প্রটোকল অনুযায়ী জুডিশিয়াল পুলিশকে ঘটনাটা জানিয়ে দেয়। আমরা পনেরো মিনিটের মধ্যে এখানে এসে অবস্থান নিয়ে নেই। এখানে পৌঁছেই ব্যারিকেডটা একটু তুলে দিয়ে ভেতরে ডজনখানেক অস্ত্রধারী সৈনিক পাঠিয়ে দেই। তারা গ্যালারির ভেতরে অনুপ্রবেশকারীকে তন্নতন্ন করে খোঁজে।

    তারপর?

    ভেতরে কাউকেই পাওয়া যায়নি। শুধুমাত্র … হলের একটু দূরে ইঙ্গিত করলো সে। তাঁকে ছাড়া।

    ল্যাংডন ফশের আঙ্গুলের দিকে তাকালো। প্রথমে সে ভেবেছিলো ফুশে হলওয়ের মাঝখানে রাখা বিশাল একটা পাথরের মূর্তির দিকে ইঙ্গিত করছে। আরেকটু সামনে যেতেই ল্যাংডন মূর্তিটা অতিক্রম করে দেখতে পেলো ত্রিশ গজ দূরে, একটা স্ট্যান্ডের উপর স্পট লাইটটা জ্বলছে, সেটার আলো অন্ধকার গ্যালারির জমিনে পড়ে একটা আলোর বৃত্ত তৈরি করেছে। আলোর বৃত্তের মাঝখানে, অনেকটা মাইক্রোস্কোপের নিচে থাকা পোকা-মাকড়ের মতো কিউরেটরের মৃতদেহটা কাঠের নক্সা করা জমিনের ওপর সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় পড়ে রয়েছে।

    আপনি ছবিটা দেখেছেন, ফশে বললো, তাহলে তো, খুব বেশি অবাক হবার কথা নয়।

    মৃতদেহটার কাছে যেতেই ল্যাংডনের খুব হিমশীতল একটা অনুভূতি হলো। তার সামনে এমন অদ্ভুত ছবি ভাসছে, যা সে জীবনেও দেখেনি।

    জ্যাক সনিয়ের বিবর্ণ মৃতদেহটা কাঠের জমিনে এমনভাবে পড়ে আছে ঠিক যেমনটি সে ছবিতে দেখেছে। ল্যাংডন তীব্র আলোর মধ্যে মৃতদেহটার সামনে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে ভাবতে লাগলো সনিয়ে তাঁর শেষ কয়েকটি মুহূর্ত নিজের শরীরটাকে কত অদ্ভুতভাবেই না সাজিয়েছেন।

    সনিয়ে তাঁর বয়সের তুলনায় অসাধারণ সুস্থ আর সতেজ ছিলেন …তাঁর শরীরের পেশীগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তিনি তার ব্যবহার্য সব ধরনের পোশাকই খুলে সেগুলো সুন্দর করে পাশে রেখে দিয়েছেন। চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন করিডোরের মাঝখানের জমিনে। নিখুঁতভাবেই ঘরের অক্ষের সমান্তরালে দেহটা রেখেছেন। তার হাত-পা ঈগল পাখির ডানার মতো ছড়িয়ে আছে, অনেকটা শিশুদের তৈরি বরফের পরীর মতো অথবা, খুব স্পষ্ট করে বললে, কোন অদৃশ্য শক্তি কর্তৃক একজন মানুষকে আঁকা হলে যেমনটি হয়, সেরকম।

    সনিয়ের পাঁজরের হাড়ের নিচে একটা রক্তে আঁকা চিহ্ন, যেখানে বুলেটটা বিদ্ধ হয়েছিলো ঠিক সেখানেই। আঘাতটার ফলে খুবই ছোট্ট একটা ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, সেটা বিস্ময়করই বটে। শুধুমাত্র এক ফোঁটা কালচে রক্তের ছোট্ট একটা বৃত্ত।

    সনিয়ের বাম হাতের তর্জনীটাও রক্তাক্ত। নিজের রক্তকে কলমের কালি হিসেবে ব্যবহার করে আর নিজের পেটকে ক্যানভাস বানিয়ে সনিয়ে ছোট্ট একটা প্রতীক এঁকেছেন—পাঁচটা সরল রেখা দিয়ে একটা পাঁচ কোনা তারা।

    পেনটাকল।

    সনিয়ের নাভির মাঝখানে রক্তাক্ত তারাটা মৃতদেহটাকে একধরনের ভৌতিক রূপ দিয়েছে। যে ছবিটা ল্যাংডন দেখেছিলো সেটাও যথেষ্ট ভীতিকর ছিলো, কিন্তু এখন,

    স্বচক্ষে দৃশ্যটা দেখে ল্যাংডনের খুব গভীর অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি তৈরি হলো।

    তিনি নিজেই এটা করেছেন।

    মি. ল্যাংডন? ফশের গভীর কালো চোখ আবার তার ওপর স্থির হলো।

    এটা একটা পেনটাকল, ল্যাংডন বললো, তার কথাটা বিশাল ফাঁকা জায়গায় প্রতিধ্বনিত হলো। পৃথিবীর সবচাইতে প্রাচীন একটা প্রতীক। যিশুর জন্মের চার হাজার বছর আগেও এটা ব্যবহার করা হোত।

    এর মানে কি?

    এ ধরনের প্রশ্ন করা হলে ল্যাংডন সবসময়ই দ্বিধাগ্রস্ত হয়। একটা প্রতীকের মানে কি, এটা বলা মানে, একটা সঙ্গীত কেমন অনুভবের সৃষ্টি করবে সেই কথা বলা—এটা একেকজনের কাছে একেক রকম। সাদা রঙের একটা কু ক্লাক্স ক্লান মুখোশের ছবি যুক্তরাষ্ট্রে ঘৃণা এবং বর্ণবাদের প্রতীক, আর সেই একই জিনিস স্পেনে ধর্মীয় বিশ্বাসের অর্থ বহন করে।

    একেক জায়গায় প্রতীকের অর্থ একেক রকম হয়ে থাকে, ল্যাংডন বললো। সাধারণ অর্থে, পেনটাকল হলো একটি প্যাগান ধর্মীয় প্রতীক।

    ফশে মাথা নাড়লো। শয়তানের পূজা।

    না, ল্যাংডন শুধরিয়ে দিলো, পরক্ষণেই বুঝতে পারলো তার আরো পরিষ্কার করে বলা দরকার। তার শব্দ চয়ন আরো বেশি পরিষ্কার হওয়া উচিত।

    আজকাল প্যাগান শব্দটি শয়তান পূজার সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে—একটা জনপ্রিয় ভুল ধারণা। শব্দটির মূল এসেছে ল্যাটিন শব্দ প্যাগানাস থেকে, যার অর্থ গ্রামীন অধিবাসী। আভিধানিক অর্থে প্যাগান মানে অশিক্ষিত গ্রাম্য লোকজন, যারা প্রাচীন গ্রামীন প্রকৃতি পূজার অনুসারী। আসলে, যারা ভিলেজ, মানে গ্রামে বাস করে তাদের সম্পর্কে চার্চের অনেক ভীতি ছিলো, সেই গ্রামবাসী তথা ভিলেজার শব্দটি থেকেই ভিলেইন অর্থাৎ খল-এই নেতিবাচক অর্থটি আরোপিত হয়েছে।

    পেনটাকল, ল্যাংডন খুলে বললো, একটি প্রাক খৃস্টিয় প্রতীক যা প্রকৃতি পূজার সাথে সম্পর্কিত। প্রাচীন কালের মানুষেরা তাদের পৃথিবীকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দেখতো-নারী আর পুরুষ। তাদের দেব-দেবীরা শক্তির ভারসাম্য রক্ষা করতো। ইন। এবং ইয়াং। যখন নারী এবং পুরুষ ভারসাম্যপূর্ণ থাকতো, পৃথিবীতে তখন সম্প্রীতি বিরাজ করতো। আর যখন তারা ভারসাম্যহীন থাকতো, তখন নৈরাজ্য নেমে আসতো। ল্যাংডন সনিয়ের পেটের দিকে ইঙ্গিত করলো।এই পেনটাকলটা নারীর প্রতিনিধিত্ব করে, যারা পৃথিবীর সব কিছুরই অর্ধেক—এটা ধর্মীয় ইতিহাসবিদদের ধারণা, পবিত্র নারী অথবা স্বর্গীয় দেবী বলে ডাকা হয়। সনিয়ে সেটা জানতেন।

    সনিয়ে তার পেটে একটি দেবীর প্রতীক এঁকেছেন?

    ল্যাংডনকে স্বীকার করতেই হলো, যদিও এটা খুব অদ্ভুত মনে হচ্ছে। একেবারে নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, পেনটাকল ভেনাসেরই প্রতীক-যৌনতা, ভালোবাসা আর সুন্দরের দেবী।

    ফশে নগ্ন দেহটার দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করতে লাগলো।

    প্রথম দিকে ধর্মগুলো ছিলো প্রকৃতির স্বর্গীয় শৃঙ্খলার উপর ভিত্তি করে। দেবী ভেনাস এবং ভেনাস গ্রহ একই জিনিস। রাতের আকাশে দেবীর একটা অবস্থান আছে আর এটা অনেক নামেই পরিচিত ভেনাস, পূর্ব-তারা, ইস্টার, আস্টার্তে সবগুলো শক্তিশালী নারীর প্রতিভূ যা মাতৃদেবী পৃথিবীর সাথে সম্পর্কিত।

    ফশেকে আরো বেশি চিন্তিত মনে হলো এবার, যেনো সে প্রকৃতি পূজার ধারণাটিই বেশি পছন্দ করেছিলো।

    ল্যাংডন সিদ্ধান্ত নিলো পেনটাকল সম্পর্কিত সবচাইতে বিস্ময়কর তথ্যটি সে জানাবে না—ভেনাসের চিত্রের সত্যিকারের ঘটনাটি। একজন তরুণ জ্যোর্তিবিদ্যার ছাত্র হিসেবে ল্যাংডন এই তথ্যটি জেনে অবাক হয়েছিলো যে, ভেনাস গ্রহ প্রতি আট বছরে আকাশে যে অবস্থান বদল করে সেটা একটা নিখুঁত পেনটাকলরই আকৃতিতে। এই ঘটনাটা প্রাচীন মানুষকেও এতোটা বিস্মিত করেছিলো যে, তারা ভেনাস এবং পেনটাকলকে সুন্দর, নিখুঁত এবং যৌনজ ভালবাসার প্রতীক হিসেবে পরিণত করে ফেললো। ভেনাসের এই যাদুময়তাকে সম্মান প্রদর্শন করার জন্যই গৃকরা প্রতি আট বছর পরপর অলিম্পিক খেলার প্রচলন করে। আজকাল খুব কম সংখ্যক লোকই বুঝতে পারবে যে, বর্তমানের চার বছর অন্তর অন্তর অলিম্পিকটি আসলে ভেনাসের পরিক্রমার অর্ধ চক্র। এমনকি খুব অল্পসংখক লোক জানে অলিম্পিকের অফিশিয়াল প্রতীক হয়ে ওঠা পাঁচটা বৃত্ত আসলে শেষ মুহুর্তে পাঁচটা তারাকে বদলেই করা হয়েছে-ভেনাসের পাঁচটা তারাকে বদলে পাঁচটা বৃত্ত দিয়ে আধুনিক অলিম্পিকের সত্যিকারের চেতনা ও সম্প্রীতির একটি প্রতীক তৈরি করা হয়েছে।

    মি. ল্যাংডন, ফশে হরবর করে বললো। অবশ্যই পেনটাকল শয়তান সম্পর্কিত। আপনাদের আমেরিকান ভৌতিক চলচ্চিত্রগুলো এটা খুব স্পষ্ট করেই দেখায়।

    ল্যাংডন ভুরু তুললো। ধন্যবাদ হলিউড, তোমাকে। পেনটাকল, মানে পাঁচ মুখের তারা বর্তমানে চলচ্চিত্রে শয়তান ও সিরিয়াল খুনির প্রতীক হয়ে উঠেছে। কোন শয়তান বা পিশাচের ঘরের দেয়ালে সাধারণত অন্যান্য পিশাচ প্রতীকের সাথে এটা আঁকা থাকে। ল্যাংডন এই প্রতীকটাকে এরকমভাবে ব্যবহার করতে দেখলে খুবই মর্মাহত হয়; পেনটাকলর সত্যিকারের উৎস কিন্তু পুরোপুরি দেবতা সম্পৰ্কীয়।

    আমি আপনাকে আশ্বস্ত করছি, ল্যাংডন বললো, ছবিতে আপনি যা-ই দেখেছেন, পেনটাকলর এই রকম পিশাচ প্রতীকীকরণের ব্যাপারটা ঐতিহাসিকভাবেই ভুল। হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে পেনটাকলর প্রতীকটি বিকৃত করে তুলে ধরা হচ্ছে। আর আজকের ঘটনায়, এটা একেবারে রক্তপাতের মধ্য দিয়ে করা হয়েছে।

    আমি নিশ্চিত হতে পারছি না।

    ল্যাংডন ফশের ক্রুশর দিকে তাকালো, মনস্থির করতে পারছিলো না কীভাবে পরের কথাটা বলবে। চার্চ করেছে, স্যার। সব প্রতীকই দ্ব্যর্থবোধক, কিন্তু পেনটাকল বৃস্টিয় যুগের সূচনাতেই রোমান ক্যাথলিক চার্চ কর্তৃক পরিবর্তিত হয়ে যায়। ভ্যাটিকানের প্যাগান ধর্মের বিরুদ্ধে প্রচারণা এবং সেই ধর্মমত অনুসারীদেকে খৃস্ট ধর্মে দীক্ষা দেবার অংশ হিসেবে চার্চ প্যাগান দেব-দেবীদের বিরুদ্ধে একটি সর্বগ্রাসী অভিযান পরিচালনা করেছিলো। সেই সূত্রে তারা স্বর্গীয় প্রতীকগুলোকে শয়তানের চিহ্ন হিসেবে আখ্যায়িত করে।

    বলে যান।

    এরকম ঘটনা ঐ রকম অরাজক সময়ে খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার, ল্যাংডন আবারো বলতে শুরু করলো। একটি উদীয়মান নতুন শক্তি বিদ্যমান প্রতীকগুলো আত্মসাৎ করে নেয়, সেগুলোকে হেয় প্রতিপন্ন করে যাতে ধীরে ধীরে সেসব জিনিসের সত্যিকারের অর্থ মুছে যায়, বিস্মৃত হয়ে যায়। প্যাগান প্রতীক এবং খৃস্টিয় প্রতীকের মধ্যে লড়াইয়ে প্যাগানরা হেরে যায় ; পসাইডন দেবতার ত্রিশূল হয়ে ওঠে শয়তানের লাঠি, জ্ঞানী ক্রোনের লম্বা টুপিটা ডাইনীর প্রতীকে আর ভেনাসের পেনটাকল হয়ে যায় শয়তানের চিহ্ন। ল্যাংডন একটু বিরতি দিলো। দূর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীও পেনটাকলকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছে; এটা এখন আমাদের বেশির ভাগের কাছেই যুদ্ধের একটা প্রতীকে পরিণত হয়েছে। আমরা এটাকে আমাদের সবগুলো যুদ্ধ বিমানে এঁকে রাখি আর সব জেনারেলের কাঁধে লাগিয়ে রেখেছি।

    ভালোবাসা এবং সৌন্দর্যের দেবীদের জন্য একটু বেশিই হয়ে গেছে।

    মজার তো। ফশে হাত পা ছড়ানো মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বললো, আর এই দেহটার এই রকম অবস্থানের কারণ? এটার ব্যাপারে কি বলবেন?

    ল্যাংডন কাঁধ ঝাঁকালো। এই অবস্থাটা খুব সহজ করে বলতে গেলে পেনটাকল এবং পবিত্র নারীকেই ইঙ্গিত করছে।

    ফশের মুখভঙ্গী ছায়ায় পেঁকে গেলো। ক্ষমা করবেন, বুঝতে পারছি না?

    অনুকরণ। প্রতীকটা অনুকরণ করা হয়েছে যাতে দেখামাত্রই বোঝা যায়। জ্যাক সনিয়ে নিজেকে পেনটাকলর পাঁচটি মুখের আদলে নিজের শরীরটাকে সাজিয়েছেন। যদি একটা পেনটাকল ভালো হয়, তবে দুটো পেনটাকল অবশ্যই আরো ভালো।

    ফশে সনিয়ের দেহের পাঁচটি অংশ, হাত-পা, মাথার দিকে ভালো করে লক্ষ্য করে আবার নিজের তৈলাক্ত চুলে আঙুল চালালো। মজার বিশ্লেষণ। সে একটু থামলো। আর নগ্নতা? সে শব্দটা উচ্চারণ করার সময় একটু বিড়বিড় করলো। একজন বয়স্ক মানুষের নগ্ন দেহের দিকে তাকিয়ে এ কথাটা একটু অশ্লীলই শোনালো। তিনি কেন নিজের সমস্ত জামা-কাপড় খুলে ফেললেন?

    একেবারে মোক্ষম প্রশ্ন, ল্যাংডন ভাবলো। পোলারয়েড ক্যামেরার ছবিটা প্রথমবার দেখার পর থেকেই সে অবাক হয়ে এই কথাটি ভাবছিলো। তার সবচাইতে বেশি যে ব্যাখ্যাটি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে, সেটা হলো, নগ্ন মানুষের দেহ যৌনতার দেবী ভেনাসের প্রতিমূর্তিকেই ইঙ্গিত করে। যদিও আধুনিক কালে ভেনাসের স্ত্রী-পুরুষ মিলন সম্পর্কিত শাব্দিক অর্থটি মুছে ফেলা হয়েছে, তারপরও শব্দজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবে যে, ভেনাসের উৎপত্তি হয়েছে Venereal শব্দ থেকে, যার অর্থ যৌনসঙ্গম। ল্যাংডন ঠিক করলো এই প্রসঙ্গটি তুলবে না।

    মি. ফশে, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারবো না, কেন মি. সনিয়ে এই প্রতীকটি এঁকেছেন অথবা এভাবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন, কিন্তু আমি আপনাকে বলতে পারি সনিয়ের মতো একজন মানুষ পেনটাকল প্রতীকটিকে নারী দেবীর মূর্তি হিসেবেই বোঝাতে চেয়েছেন। এই প্রতীকটি এবং পবিত্র নারীর ধারণাটি শিল্পকলা বিষয়ক ইতিহাসবিদ এবং সিম্বোলজিস্টদের কাছে খুবই সুপরিচিত।

    চমৎকার। আর নিজের রক্তকে কালি হিসেবে ব্যবহার করাটা?

    অবশ্যই এ ছাড়া তাঁর কাছে লেখার জন্য অন্য কিছু ছিলো না।

    ফশে কিছুক্ষণ চুপ রইলো। আসলে, আমি বিশ্বাস করি তিনি লেখার জন্য রক্তের ব্যবহার করেছেন ফরেনসিক প্রমাণের সুবিধার্থে।

    বুঝলাম না?

    তার বাম হাতের দিকে তাকিয়ে দেখুন।

    ল্যাংডন কিউরেটরের অসাড় হাতটার আঙ্গুলের দিকে চাইলো, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলো না। সে মৃতদেহটা চারপাশ দিয়ে ঘুরে দেখলো, নিচু হয়ে তাকালো, অবাক হবার মতো কোন কিছু দেখতে পেলো না। শুধু দেখতে পেলো কিউরেটরের দেহের নিচে একটা মার্কার কলম চাপা পড়ে আছে।

    আমরা যখন এখানে আসি তখন সনিয়ে এটা হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছিলেন, ফশে বললো, একটু সরে গিয়ে কয়েক গজ দূরে রাখা একটা পোর্টেবল টেবিলের কাছে গিয়ে তদন্তকার্যে ব্যবহার্য কিছু যন্ত্রপাতি, তার এবং ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করলো। আপনাকে তো আগেই বলেছি, সে বললো, আমরা কিছুই স্পর্শ করিনি। আপনি কি এ ধরনের কলমের সাথে পরিচিত?

    ল্যাংডন হাটু গেঁড়ে বসে কলমটা আরো ভালো করে পরখ করে দেখলো।

    স্টাইলো দ্য লুমিয়ে নোয়ে

    সে অবাক হয়ে তাকালো।

    ব্ল্যাক লাইট কলম অথবা ওয়াটার মার্ক স্টাইলাস এমন এক ধরনের বিশেষ কলম, পুলিশ এবং জাদুঘরের ক্ষতিগ্রস্ত ছবি ঠিক করে যারা, তারা এই কলম ব্যবহার করে থাকে জালিয়াতি ধরতে মালপত্রের গায়ে অদৃশ্য দাগ দেবার জন্য। স্টাইলাস কলমে কালি হিসেবে ব্যবহার করা হয় এলকোহল জাতীয় ফুরোসেন্ট কালি, যা কেবলমাত্র ব্ল্যাক লাইটের প্রভাবেই এর কালির দাগ দৃষ্টিগোচর হয়। আজকাল, জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কর্মচারীরা এটা ব্যবহার করে থাকে প্রতিদিনকার টহলের সময় মেরামত করার জন্য বিবেচিত হওয়া ছবিকে চিহ্নিত করার কাজে।

    ল্যাংডন উঠে দাঁড়ালে, ফশে স্পটলাইটটার কাছে গিয়ে সেটা বন্ধ করে দিলে সাথে সাথে গ্যালারিটা আচমকা অন্ধকারে ডুবে গেলো।

    সাময়িক অন্ধকার হয়ে গেলে ল্যাংডনের মনে হলো তার ভেতরে অনিশ্চয়তার উত্থান ঘটছে। ফশে একটা বহনযোগ্য লাইট নিয়ে এলো, যেটা থেকে বেগুনি আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। আপনি হয়তো জানেন, ফশে বললো, তার চোখে বেগুনি আলোর ঝলকানি, পুলিশ অপরাধ সংগঠিত স্থানে ব্ল্যাক লাইট ব্যবহার করে রক্ত এবং অন্যান্য ফরেনসিক এভিডেন্স খুঁজে পেতে। সুতরাং আপনি আমাদের অবাক হবার ব্যাপারটা কল্পনা করতে পারেন… সাথে সাথেই সে লাইটটা মৃতদেহের উপর নিক্ষেপ করলো।

    ল্যাংডন দৃশ্যটা দেখেই চমকে গেলো।

    কাঠের ফ্লোরের ওপর এই আজব দৃশ্যটা দেখ তার হৃদপিণ্ড লাফাতে শুরু করলো। একটা হাতের লেখা জ্বলজ্বল করছে। কিউরেটরের শেষ কিছু কথা তাঁর মৃতদেহটার পাশেই লেখা আছে। সেই জ্বলজ্বল করতে থাকা লেখাটার দিকে তাকিয়ে ল্যাংডনের মনে হলো কুয়াশার যে চাদর সারাটা রাত জুড়ে ছিলো, সেটা ক্রমশ হালকা হয়ে উঠছে।

    ল্যাংডন লেখাটি পড়ে ফশের দিকে তাকালো, এই লোকটা করেছে কী!

    ফশের চোখ কেমন সাদা দেখাচ্ছে। মঁসিয়ে, এই কথার উত্তর দিতেই আপনাকে এখানে ডেকে আনা হয়েছে।

    * * *

    খুব বেশি দূরে নয়, সনিয়ের অফিসের অভ্যন্তরে, লেফটেনান্ট কোলেত লুভর থেকে ফিরে এসে একটা অডিও কনসোল নিয়ে সনিয়ের ডেস্কে বসে কাজ করছে একটা ভূতুরে পরিবেশে, যেখানে কিউরেটরের ডেস্কের উপর একটা নাইট-এর মূর্তি রাখা আছে আর সেটা যেনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপরও কোলেত খুব স্বাচ্ছন্দেই কাজ করে যাচ্ছে। সে তার একেজি হেডফোনটা ঠিক করে নিয়ে রেকর্ডিং সিস্টেমটা চেক্ করে দেখলো। সবকিছু ঠিক আছে। শব্দ শোনা যাচ্ছে খুবই পরিষ্কার।

    লো মোমেস্ত দ্য ভারিত, সে বিড়বিড় করে বললো। মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে বাকি কথপোকথন শুনতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। এইসব কথাবার্তা গ্র্যান্ড গ্যালারি থেকে ধারণ করে রেকর্ড করা হচ্ছে।

     

    ০৭.

    সেন্ট সালপিচ চার্চের ভেতরেই একটি ছিমছাম আবাস রয়েছে, সেটা চার্চের তিন তলায় কয়্যার বেলকনির বাম দিকে অবস্থিত। পাথরের ফ্লোর আর কম সাজসজ্জা সম্পন্ন দুই ঘরের এই সুটটা বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সিস্টার সানড়ন বাইলের আবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পাশের কনভেন্টটি তার আগের আবাস ছিলো। কেউ যদি তাঁকে প্রশ্ন করে তবে তিনি চার্চের ঘরটিই বেশি পছন্দ করেন বলে জানান। সেখানেই তিনি একটা বিছানা, টেলিফোন আর হট প্লেট নিয়ে বেশ নিরবে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করেন।

    চার্চের কনজারভারিস ডি এফেয়ার্স হিসেবে সিস্টার সানড়নই চার্চের সবধরনের ধর্মীয় বহির্ভূত কার্যকলাপের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সাধারণ ব্যবস্থাপনা, রক্ষণাবেক্ষণ, কর্মচারী নিযুক্ত করা ও ভাড়া করার নির্দেশনা দেয়া, পুরো বিল্ডিংয়ের নিরাপত্তা দেখাশোনা করা, বিশেষ করে চার্চ বন্ধ হবার পর, এবং কমিনিউন-এর জন্য প্রয়োজনীয় মদ ও পোশাক সরবরাহ করা তাঁর কাজের মধ্যে পড়ে।

    আজরাতে তিনি নিজের ছোট্ট খাটে ঘুমিয়ে ছিলেন, জেগে উঠলেন টেলিফোনের ঝংকারে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত সিস্টার ফোনটা তুলে নিলেন,সোয়ের সানড়ন। এগলিস সেন-সালপিচ।

    হ্যালো সিস্টার, লোকটা ফাসিতে বললো।

    সিস্টার সানড্রন উঠে বসলেন। ছয়টা বাজে? যদিও তিনি তাঁর বসের কণ্ঠটা ভালো করেই চেনেন, তবুও পনেরো বছরে কখনই তাঁর বস তাঁকে ঘুম থেকে ডেকে ওঠাননি। আব্বে একজন ঘুম কাতুরে লোক, যিনি মাস্ এর পরপরই বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।

    আমি যদি আপনাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে থাকি তার জন্যে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, সিস্টার, আব্বে বললেন, তাঁর কণ্ঠটা খুব কাটা কাটা শোনাচ্ছে। আপনাকে একটা কথা বলতে হচ্ছে। এই মাত্র আমি একজন প্রভাবশালী আমেরিকান বিশপের ফোন পেয়েছি। সম্ভবত আপনি তাকে চেনেন? ম্যানুয়েল আরিঙ্গাবোসা?

    ওপাস দাইর প্রধান? অবশ্যই তাকে আমি চিনি। এই চার্চের কে না তাঁকে চেনে? আরিঙ্গারোসার রক্ষণশীল সংগঠনটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খুব দ্রুত বর্ধনশীল করে অঙ্গসংগঠন, আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন

    হচ্ছে। সংগঠনটি হঠাৎ করেই শক্তিশালী ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যখন ১৯৮২ সালে পোপ জন পল দ্বিতীয় অপ্রত্যাশিতভাবে ঘোষণা দেন যে, তারা হলো পোপের ব্যক্তিগত অঙ্গসংগঠন, আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের সবধরনের কার্য কলাপই অনুমোদন করে দেয়া হয়। সন্দেহজনকভাবে ঐ একই বছরে সম্পদশালী ধর্মীয় সংগঠনটি প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ভ্যাটিকানের ধর্মীয় ইনস্টিটিউটে হস্তান্তর করে যা সর্বসাধারণের কাছে ভ্যাটিকান ব্যাংক হিসেবে পরিচিত বিব্রতকর দেউলিয়ার হাত থেকে ব্যাংকটিকে এভাবে রক্ষা করা হয়। এর পরবর্তী পদক্ষেপটি অনেকের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দেখা দেয়, পোপ ওপাস দাইর প্রতিষ্ঠাতাকে সেন্ট হবার তালিকায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন বলে। প্রায়শই যেটা একশ বছরের দীর্ঘ একটি ব্যাপার, সেটা খুব দ্রুত কমিয়ে বিশ বছরের আনুষ্ঠানিকতায় টেনে আনা হয়েছিলো। সিস্টার সানন এটা না ভেবে পারলেন না যে, রোমে ওপাস দাইর এতো ভালো অবস্থানের ব্যাপারটি অবশ্যই সন্দেহজনক, তবে তাদের ধর্মীয় আনুগত্যের ব্যাপারে কোন তর্ক চলে না।

    বিশপ আরিঙ্গাবোসা আমার কাছে একটা সাহায্য চেয়েছেন, আব্বে তাঁকে বললেন, তাঁর কণ্ঠটা খুবই নার্ভাস শোনা যাচ্ছে। উনার একজন শিষ্য আজ রাতে প্যারিসে আছেন …।

    সিস্টার সানন একটা অদ্ভুত অনুরোধ শুনে দোটানায় পড়ে গেলেন। আমি দুঃখিত, আপনি বলছেন ওপাস দাইর এই সদস্যটি আগামীকাল সকালে আসতে পারবেন না?

    হ্যাঁ, তা-ই। তার প্লেন খুব সকালেই ছাড়বে। তিনি সবসময়ই সেন্ট সালপিচ চার্চ দেখার স্বপ্ন দেখতেন।

    কিন্তু দেখার জন্য চার্চটা তো দিনের বেলায়ই বেশি আকর্ষণীয়। ছাদের কাঁচের ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো, আলো-আঁধারির ছায়া, এগুলোই তো চার্চের অনন্য বৈশিষ্ট্য।

    সিস্টার, আমি আপনার সাথে একমত, তারপরও আমি আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করছি উনাকে আজ রাতে চার্চে প্রবেশ করার অনুমতি দিন। তিনি আপনার এখানে ঠিক…একটা বাজে? তার মানে বিশ মিনিটের মধ্যে।

    সিস্টার সানভৃনের চোখ কপালে উঠলো। অবশ্যই। এটা আমার জন্য খুবই আনন্দের ব্যাপার।

    আব্বে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোনটা রেখে দিলেন। হতভম্ব হয়ে সিস্টার সানভৃন নিজের উষ্ণ খাটে কিছুক্ষণ বসে থেকে ঘুম ঘুম ভাবটা কাটাবার চেষ্টা করলেন। তাঁর পয়ষট্টি বছরের শরীরটা খুব দ্রুত ঘুম থেকে জেগে উঠতে পারে না। যদিও আজরাতের ফোনটা তাঁকে জেগে তুলেছে, তার সম্বিত ফিরেছিলো খুব দ্রুত। ওপাস দাই সব সময়ই তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। তাদের শরীরে কষ্ট দেয়ার অনুশীলটা বাদ দিলেও, নারীদের সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী খুবই আগ্রাসী। তিনি এটা জেনে খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন যে, ওখানকার মেয়ে সদস্যদেরকে জোর করে কোন রকম পারিশ্রমিক ছাড়াই পুরুষ সদস্যদের বাসস্থান পরিষ্কার করানো হয়। মেয়েরা শক্ত, খসখসে কাঠের পাটাতনে ঘুমায় আর পুরুষেরা ঘুমায় নরম ম্যাটে; মেয়েদেরকে শারিরীক কষ্টের অনুশীলনে একটু বাড়তি কিছু করানো হয় এবং সেটা করানো হয় জোর করে…এসবই করা হয় আদি পাপের শাস্তি ভোগের জন্য। মনে হয় ইভের আপেল খাওয়াটা নারী জাতির জন্য এক পারলৌকিক শাস্তি। দুঃখের বিষয় হলো, যেখানে বেশিরভাগ ক্যাথলিক চার্চ নারীদের বিষয়ে সঠিক পথে এগোচ্ছে, নারীদের অধিকারকে সম্মান করছে উত্তরোত্তর, সেখানে ওপাস দাই পুরো ব্যাপারটিকে উল্টো পথে চালানোর হুমকি দিচ্ছে। যাই হোক, সিস্টার সানড়ন একটা আদেশ পেয়েছেন।

    আস্তে আস্তে তিনি নিজের বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর খালি পায়ে ঠাণ্ডা জমিনের শীতলতা লাগলো। ঠাণ্ডাটা সমস্ত শরীর জুড়ে বয়ে গেলে তার একটা অপ্রত্যাশিত অনুভূতির সৃষ্টি হলো।

    নারীদের স্বজ্ঞা?

    ঈশ্বরের একজন অনুসারী হিসেবে, সিস্টার সানড়ন শিখেছেন নিজের আত্মার শান্ত কণ্ঠের মধ্যেই শাস্তি নিহিত থাকে। আজরাতে, সেইসব কণ্ঠস্বর, তাকে ঘিরে থাকা নিরব, ফাঁকা চার্চের মতোই নিশ্চুপ।

     

    ০৮.

    কাঠের ফ্লোরের জ্বলজ্বলে লেখাটির তীব্র আলোতে ল্যাংডনের চোখে পানি এসে গেলো। জ্যাক সনিয়ের শেষ বার্তাটি বিদায়ী বার্তা হিসেবে এতোটাই বেখাপ্পা যে, সে এটা কল্পনাও করতে পারেনি।

    বার্তাটি হলো :

    13-3-2-21-1-1-8-5
    Oh, Draconian devil!
    O’ Lame saint!

    যদিও ল্যাংডনের একটুও ধারনা ছিলো না এটার মানে কী, তবুও ফশে কেন এমন ধারণা করলো যে, পেনটাকল হলো শয়তান পূজার সাথে সংশ্লিষ্ট, সেটা সে বুঝতে পারলো।

    ও, ড্রাকোনিয়ান শয়তান।

    সনিয়ে শয়তানের উল্লেখ করে একটা লিখিত বক্তব্য দিয়ে গেছেন। সংখ্যাগুলোও লেখার মতোই সমান কিম্ভুতকিমাকার, দেখে মনে হচ্ছে একটা সংকেতের অংশ।

    হ্যাঁ, ফশে বললো। আমাদের ক্রিপটোগ্রাফাররা এ নিয়ে ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছে। আমাদের বিশ্বাস, কে তাঁকে খুন করেছে সেটা জানার জন্য এই সংখ্যাগুলোই মূল চাবিকাঠি হবে। হয়তো কোন ফোন নাম্বার, অথবা কোন সোশাল আইডি নাম্বার। এই সংখ্যাগুলো কি আপনার কাছে কোন প্রতীকি অর্থ বহন করে?

    ল্যাংডন সংখ্যাগুলোর দিকে আবারো তাকালো, বুঝতে পারলো এগুলোর ঠিক মতো প্রতীকি অর্থ বের করতে হলে কম পক্ষে এক ঘণ্টা সময় লেগে যাবে। অবশ্য, এ দিয়ে সনিয়ে যদি কিছু বুঝিয়ে থাকেন তো। ল্যাংডনের কাছে সংখ্যাগুলো একেবারেই এলোমেলো লাগছে। সে প্রতীকি ক্রমের ব্যাপারে জ্ঞাত, যা দিয়ে কিছু বোঝা যায়, কিন্তু এখানকার সবটাইপেনটাকল, লেখাগুলো, সংখ্যাগুলো মনে হচ্ছে মূলগত দিক থেকে একটার সাথে আরেকটার কোন মিলই নেই।

    আপনি শুরুতে বলেছিলেন, ফশে বললো, সনিয়ের এখানকার কাজকর্মগুলো এক ধরনের বার্তা দেয়ার চেষ্টা বলে মনে হচ্ছে…দেবী পূজা অথবা সেই রকম কিছু? এই বার্তাটি সেগুলোর সাথে কীভাবে খাপ খায়?

    ল্যাংডন জানতো প্রশ্নটা শুধুই বাগাড়ম্বরপূর্ণ। এই অদ্ভুত সব জিনিস নিশ্চিতভাবেই ল্যাংডনের বলা দেবী পূজার সাথে মোটেও খাপ খায় না।

    ওহ্, ড্রাকোনিয়ান শয়তান? ও ল্যাংড়া সেন্ট?

    ফশে বললো, এইসব লেখা-ঝোকা দেখে মনে হচ্ছে এগুলো একধরনের অভিযোগ। আপনি কি একমত নন?

    ল্যাংডন কল্পনা করতে চেষ্টা করলো গ্র্যান্ড গ্যালারির ভেতরে একা আঁটকে পড়া কিউরেটরের শেষ কয়েক মিনিটের সময়টার কথা, তিনি জানতেন মারা যাচ্ছেন। এটা যুক্তিপূর্ণই মনে হচ্ছে। নিজের খুনির বিরুদ্ধে অভিযোগ করাটা খুবই স্বাভাবিক, আমারও তাই মনে হয়।

    আমার কাজ হলো, লোকটার নাম বের করা। আপনাকে একটি প্রশ্ন করি মি. ল্যাংডন। আপনার চোখে এই সংখ্যাগুলো বাদে, এই বার্তাটিতে সবচাইতে অদ্ভুত জিনিসটা কি?

    সবচাইতে অদ্ভুত? একজন মরতে বসা লোক নিজেকে গ্যালারির অভ্যন্তরে আঁটকে রাখলেন, নিজে নিজে একটা পেনটাকল আঁকলেন এবং কাঠের ফ্লোরে একটি রহস্যময়, দূর্বোধ্য কিছু আঁকিবুকি করলেন। এসবের কোনটা অদ্ভুত নয়?

    ড্রাকোনীয় শব্দটি? সে একটু ঝুঁকি নিলো। ল্যাংডন একদম নিশ্চিত ছিলো যে, সেটা ড্রাকোকেই নির্দেশ করে—খৃস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী নিষ্ঠুর এক রাজনীতিক। ড্রাকোনীয় শয়তান মনে হচ্ছে একটা অদ্ভুত শব্দের ব্যবহার।

    ড্রাকোনীয়? ফশের কণ্ঠে একধরনের অধৈর্যের প্রকাশ দেখা গেলো। সনিয়ের শব্দ ব্যবহার করাটা এখানে তেমন বড় কোন বিষয় নয়।

    ল্যাংডন নিশ্চিত ছিলো না, ফশের মনে ঠিক কোন্ বিষয়টা ঘুরপাক খাচ্ছে।

    সনিয়ে একজন ফরাসি, ফশে উত্তাপহীন কণ্ঠে বললো। তিনি প্যারিসে থাকতেন। তারপরও তিনি এরকম একটি বার্তা বেছে নিলেন লেখার জন্য…

    ইংরেজিতে, ল্যাংডন বললো, বুঝতে পারলো ক্যাপ্টেনের কথার অর্থটি। ফশে মাথা নাড়লো, যথাযর্থই। কোন ধারণা আছে, কেন?

    ল্যাংডন জানতো সনিয়ে খুব নিখুঁত ইংরেজি বলতেন, তারপরও শেষ কথা হিসেবে লিখিত বার্তাটি লিখতে গিয়ে ইংরেজি ব্যবহার করাটা ল্যাংডন খেয়ালই করেনি। সে কাধ ঝাঁকালো।

    ফশে সনিয়ের পেটে আঁকা পেনটাকলের দিকে ঘুরলো। শয়তানের পূজার সাথে কোন সম্পর্ক নেই? আপনি কি এখনও নিশ্চিত?

    ল্যাংডন কোন কিছুর ব্যাপারেই নিশ্চিত নয়। প্রতীক বিদ্যা আর লিখিত কিছু মনে হচ্ছে কাকতালীয় নয়। আমি দুঃখিত, আমি এর চেয়ে বেশি সাহায্যে আসতে পারছি না।

    সম্ভবত এটা আরো পরিষ্কার করে দেবে, ফশে মৃতদেহটা থেকে সরে এসে ব্ল্যাক-লাইটটা আবার তুলে ধরলো, আলোটা আরেকটু বাড়িয়ে নিয়ে নিক্ষেপ করলো। এখন?

    ল্যাংডনের কাছে খুব বিস্ময়কর মনে হলো, কিউরেটরের শরীরের চারপাশে একটা বৃত্ত জ্বলজ্বল করছে। সনিয়ে আরো একটা চিহ্ন একেঁছেন। একটা বৃত্তের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করেছেন। এক ঝলকেই অর্থটা খুব স্পষ্ট হয়ে উঠলো।

    ভিটরুভিয়ান ম্যান, ল্যাংডন সখেদে বললো। সনিয়ে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির বিখ্যাত ছবির একটা প্রমাণ সাইজের অনুলিপি তৈরি করেছেন।

    এটাকে সেই সময়ে এনাটমিক্যালি দিক থেকে সবচাইতে শুদ্ধ ছবি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ভিঞ্চির ভিটরুভিয়ান ম্যান আধুনিক কালের একটি সাংস্কৃতিক আইকন হয়ে উঠেছে। পোস্টার, কম্পিউটারের মাউস প্যাড, টি-শার্ট, ইত্যাদিতে এই ছবি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ছবিটাতে দেখা যাবে একটা নিখুঁত বৃত্তের মধ্যে একজন নগ্ন পুরুষ… ডানা ছড়ানো ঈগল পাখির মতো তার হাত পা ছড়ানো।

    দা ভিঞ্চি। ল্যাংডনের ভেতরে একটা রোমাঞ্চ খেলে গেলো। সনিয়ের অভিপ্রায় খুবই স্পষ্ট, সেটা অস্বীকার করা যায় না। জীবনের শেষ মুহূর্তটায় কিউরেটর পরনের কাপড় চোপড় খুলে দা ভিঞ্চির ভিটরুবিয়ান ম্যানর অনুকরণে নিজেকে তুলে ধরেছেন।

    বৃত্তটা একটি অব্যাখ্যাত উপাদান। নারীত্বের রক্ষার প্রতীক, নগ্ন লোকটাকে ঘিরে থাকা বৃত্তটা দা ভিঞ্চির একটি ইঙ্গিতের অভিপ্রায় নারী পুরুষের সম্প্রীতি। এখন প্রশ্ন হলো, সনিয়ে কেন এ রকম বিখ্যাত একটি ছবিকে অনুকরণ করলেন।

    মি. ল্যাংডন, ফশে বললো, আপনার মতো একজন মানুষ নিশ্চিত করেই জানে যে, লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ডার্ক-আর্টের ব্যাপারে এক ধরনের ঝোঁক ছিলো।

    দা ভিঞ্চি সম্পর্কে ফশের জানাশোনা দেখে ল্যাংডন খুবই অবাক হলো। কিন্তু ক্যাপ্টেনকে এ ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা তেমন সুবিধার হবে না। তাকে বোঝানো যাবে না শয়তান পূজা সম্পর্কে তার সন্দেহের নিশ্চিত কোন ভিত্তি নেই। দা ভিঞ্চি সবসময়ই ইতিহাসবিদদের কাছে একটি জটিল চরিত্র। বিশেষ করে খৃস্টিয় ঐহিত্যে। এই দূরকল্পনাকারীর অসাধারণত্ব বাদ দিলেও তিনি ছিলেন একজন সমকামী এবং প্রকৃতির স্বর্গীয় শৃঙ্খলার পূজারী। এই দুইয়ের কারণেই তাকে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে পাপাচারের দোষে অভিযুক্ত করা হয়। তাছাড়া শিল্পীর অন্যান্য কাজকর্ম তাকে শয়তান সংশ্লিষ্ট রহস্যময়তায় বিবেচনা করা হয় : দা ভিঞ্চি এনাটমি করার জন্য মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করতেন; তিনি কিছু রহস্যময় এবং উল্টো করে লেখা পাণ্ডুলিপি রেখে গেছেন; তিনি বিশ্বাস করতেন তাঁর আয়ত্তে রয়েছে সেই এলকেমি শক্তি যা দিয়ে সীসাকে সোনায় রূপান্তর করা যায়। এমনকি ঈশ্বরকে ফাঁকি দিয়ে মৃত্যুকেও থামিয়ে দেয়া যাবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন; তার এমন কিছু ভৌতিক আর কল্পিত চিত্র রয়েছে যা তখন ছিলো একেবারেই অকল্পনীয়, পরে অবশ্য সেগুলোর বেশিরভাগই বাস্তবায়িত হয়েছে।

    ভুল বোঝাবুঝি অবিশ্বাসের জন্ম দেয়, ল্যাংডন ভাবলো। এমনকি দা ভিঞ্চির বিশাল খৃস্টিয় শিল্পকর্মের ভাণ্ডার থাকা সত্ত্বেও সেটা তাঁর আধ্যাত্মিক ভণ্ডামি হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে। ভ্যাটিকান থেকে শত শত শিল্পকর্ম তৈরির জন্য লোনীয় সুযোগ পেলেও, দা ভিঞ্চি বৃস্টিয় ছবিগুলো নিজের বিশ্বাসের প্রকাশ হিসেবে না নিয়ে বরং সেগুলোকে বাণিজ্যিক ব্যাপার হিসেবেই নিয়েছিলেন–বিলাস বহুল জীবন যাপন করার তহবিল তৈরির উদ্দেশ্যে। দা ভিঞ্চি ছিলেন একজন খামখেয়ালি মানুষ। তিনি তার হাতে আঁকা অনেক খৃস্টিয় শিল্পকর্মে এমন কিছু সিম্বল বা প্রতীক লুকিয়ে রাখতেন যা আর যাইহোক খৃস্টিয় কিছু নয়। ল্যাংডন এ সম্পর্কে লন্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারিতে একটি বক্তৃতাও দিয়েছিলো, যার শিরোনাম ছিলো : লিওনার্দোর গুপ্তজীবন্ত স্টিয় চিত্রকর্মে প্যাগান প্রতীক।

    আমি আপনার ব্যাপারটা বুঝতে পারছি, ল্যাংডন বললো, কিন্তু দা ভিঞ্চি কখনোই ব্ল্যাক আর্ট চর্চা করেননি। তিনি ছিলেন খুবই আধ্যাত্মিক একজন মানুষ, যার সাথে চার্চের সব সময়ই দ্বন্দ্ব লেগে থাকতো। কথাটা বলার সময় ল্যাংডনের মনে একটা অদ্ভুত চিন্তা খেলে গেলো। সে ফ্লোরের লেখাটার দিকে আরেকবার তাকালো। ওহ্, ড্রাকোনীয় শয়তান! ও, ল্যাংড়া সেন্ট।

    হ্যাঁ? ফশে বললো।

    ল্যাংডন খুব সর্তকভাবে বলতে শুরু করলো। এইমাত্র আমি ভাবছিলাম যে, সনিয়ে দা ভিঞ্চির সাথে অনেক আধ্যাত্মিক দর্শনই শেয়ার করতেন, তাঁর মধ্যে, আধুনিক ধর্মমতগুলো থেকে চার্চের পবিত্র নারী নির্মূল করার ব্যাপারটাও রয়েছে। হয়তো দা ভিঞ্চির বিখ্যাত ড্রইংটা অনুকরণ করে সনিয়ে, আধুনিক চার্চ কর্তৃক দেবীদেরকে ডাইনী বানাবার ব্যাপারে তাঁদের উভয়ের হতাশার কথাটাই বলতে চেয়েছেন।

    ফশের চোখ দুটো শক্ত হয়ে উঠলো। আপনার ধারণা সনিয়ে চার্চকে ল্যাংড়া সেন্ট এবং ড্রাকোনীয় শয়তান বলে অভিহিত করছেন?

    ল্যাংডনকে মানতেই হলো এটা অনেক বেশি দূরকল্পনা, তারপরও মনে হচ্ছে পেনটাকল এ ধরনের আইডিয়াকে কিছুটা হলেও অনুমোদন করে। আমি যা বলতে চাচ্ছি, সেটা হলো, মি. সনিয়ে তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন দেবীদের ইতিহাস গবেষণায়, আর ক্যাথলিক চার্চের চেয়ে অন্য আর কেউ এতো বেশি ইতিহাস মুছে ফেলেনি। এটা খুবই যুক্তিসঙ্গত মনে হচ্ছে যে, সনিয়ে হয়তো তার বিদায়ী সময়টাতে নিজের হতাশা আর অনুযোগের কথা বলাটাই বেছে নিয়েছিলেন।

    হতাশা? ফলে জিজ্ঞেস করলো, তাকে এখন শত্রু বলে মনে হচ্ছে। এইসব লেখা হতাশার চেয়ে রাগ-গোস্বা বলেই বেশি প্রতীয়মান হচ্ছে, আপনি কি তাই বলবেন না?

    ল্যাংডন তার ধৈর্যের শেষ সীমায় চলে এলো। ক্যাপ্টেন, আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন সনিয়ে কী বলতে চেয়েছেন সে সম্পর্কে আমার মতামতটা কি, আর আমি সেটাই আপনাকে বলছি।

    এটা চার্চের বিরুদ্ধে বিষোদগার? ফশের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো, দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বললো সে। মি. ল্যাংডন, আমি আমার কর্মজীবনে অনেক হত্যা-খুন দেখেছি, আমার কথাটা শুনুন। যখন একজন লোক আরেকজন লোক কর্তৃক খুন হয়, আমি বিশ্বাস করি না, তখন সেই লোকটা তার চূড়ান্ত কথা হিসেবে প্রহেলিকাময় ও অস্পষ্ট আধ্যাত্মিক কিছু কথা লিখে যাবে যা কেউই বুঝতে পারবে না। আমি বিশ্বাস করি তিনি একুটাই চিন্তা করছিলেন। ফশের ফিস্ ফিস্ কথাবার্তা বাতাসে বিশ্লিষ্ট হয়ে গেলো।

    লা ভেনজিনেস। আমার বিশ্বাস সনিয়ে এই লেখাটা লিখেছেন এটা বলার জন্য যে, কে তাকে খুন করেছে।

    ল্যাংডন চেয়ে রইলো। কিন্তু এসব দেখে তো তেমন কিছু একদমই মনে হচ্ছে।

    না?

    না, ক্লান্ত এবং বিমর্ষ হয়ে সেও পাল্টা বললো। আপনি আমাকে বলেছেন, সনিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন তাঁর নিজের অফিসে, এমন একজন লোকের দ্বারা, যাঁকে তিনি নিজেই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

    হ্যাঁ।

    তাহলে, স্পষ্টই মনে হচ্ছে, কিউরেটর তার আক্রমণকারীকে চিনতেন।

    ফশে মাথা নাড়লো। বলে যান।

    তো, সনিয়ে যদি জানতেন কে তাকে খুন করেছে, তাহলে এসবের মানে কি? সে ফ্লোরের দিকে ইঙ্গিত করলো। সংখ্যার কোড? ল্যাংড়া সেন্ট? ড্রাকোনীয় শয়তান? তার পেটে আঁকা পেনটাকলটা? এগুলোর সবটাই খুব বেশি রহস্যজনক বলে মনে হচ্ছে।

    ফশে এমনভাবে ভুরু তুললো যেনো এ ধারণাটি তার কখনোই মনে আসেনি। আপনার কথায় যুক্তি আছে।

    সবকিছু বিবেচনা করুন, ল্যাংডন বললো, আমার ধারণা, সনিয়ে যদি বলতে চাইতেন তাঁকে কে খুন করেছে, তবে তিনি কারোর নামই লিখতেন।

    ল্যাংডন এই কথাটা বলতেই এই প্রথমবারের মতো ফশের ঠোঁটে একটা মুচকী হাসি দেখা দিলো। যথার্থই, ফশে বললো। যথার্থই।

     

    আমি একজন ওস্তাদের কাজ প্রত্যক্ষ করছি, লেফটেনান্ট কোলেত কানে হেডফোন লাগিয়ে ফশের কথাবার্তা শুনতে শুনতে ভাবছিলো।

    ফশে এমন কিছু করবে, যা কেউ করতে সাহসও করবে না।

    কাজোলের সূক্ষ্ম শিল্পের দক্ষতা আধুনিক কালের আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এতে একজনকে প্রচণ্ড চাপের সময় অসাধারণ ভারসাম্য ধরে রাখতে হয়। খুব কম লোকেরই এই ধরনের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় মানসিক শক্তি থাকে। কিন্তু মনে হচ্ছে, এর জন্যই ফশের জন্ম হয়েছে। তার ধৈর্য আর মানসিক শক্তি রোবটের সমপর্যায়ের।

    আজ রাতে ফশের মূল আবেগটি মনে হচ্ছে, যেনো এই গ্রেফতারটি তার একান্তই ব্যক্তিগত একটি ব্যাপার। এক ঘণ্টা আগে ফশে তার এজেন্টকে যে বৃফিংটা দিয়েছে, তাতে মনে হয় সে একেবারেই নিশ্চিত, সাধারণত এমনটি কখনোই সে করে না। আমি জানি কে জ্যাক সনিয়েকে হত্যা করেছে, ফশে বলেছিলো। তুমি জানো কি করতে হবে। আজরাতে কোন ভুল করা যাবে না।

    আর এখন পর্যন্ত, কোন ভুলই করা হয়নি। কোলেতের কাছে এখনও এমন কোন প্রমাণ কিংবা ইঙ্গিত যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছে না, যাতে অপরাধীর ব্যাপারে ফশের নিশ্চিত জানাটাতে বিশ্বাস রাখা যায়। কিন্তু সে জানতো, খুবভালো করেই জানতো, এই বৃষলকে জিজ্ঞেস করার কোন দরকার নেই। ফশের অনুমান, অনেক সময়ই মনে হয় প্রায় আধ্যাত্মিক কিছু থেকে উৎসারিত হয়। ঈশ্বর তার কানে কথা বলে, একজন।

    এজেন্ট তার ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতার প্রমাণ পাওয়ার পর একথাটা বলেছিলো। কোলেতও  সেটা মেনে নিয়েছিলো, যদি কোন ঈশ্বর থেকে থাকে, তবে বেজু ফশে সেই ঈশ্বরের তালিকায় প্রথম দিকেই থাকবে। ক্যাপ্টেন মাস্ এবং কনফেশনে নিয়মিতই উপস্থিত থাকে—অন্যসব অফিসাররা যেমনটি করে থাকে শুধুমাত্র ভালো গণসংযোগের আশায়, মোটেও তেমনভাবে নয়। কয়েক বছর আগে পোপ যখন প্যারিসে এসেছিলেন, ফশে তখন সর্বশক্তি নিয়োগ করে তাঁর একজন শ্রোতার সম্মান অর্জন করতে পেরেছিলো। পোপের সাথে ফশের একটা ছবি বর্তমানে তার অফিসে টাঙানো আছে। পাপালের ষাড়, লোকজন আড়ালে আবডালে তাকে এ নামে ডাকে।

    কিন্তু কোলেতের কাছে এটা খুবই পরিহাসপূর্ণ বলে মনে হলো, যখন সে দেখতে পেলো ফশে আজকাল ক্যাথলিক চার্চের শিশু-যৌন-নির্যাতন কেলেংকারী সম্পর্কে বেশ প্রকাশ্যেই সমালোচনা করা শুরু করেছে। এইসব পাদ্রীদেরকে একবার নয়, দুবার ফাঁসিতে ঝোলানো উচিত। ফশে বেশ জোড়েশোরেই কথাটা বলে থাকে। একবার বাচ্চাদের সাথে এই অপরাধ করার জন্য, এবং আরেকবার ক্যাথলিক চার্চের সুনামকে হেয় করবার জন্য। কোলেতের অদ্ভুত ধারণা তৈরি হয়েছিলো যে, দ্বিতীয় কারণটার জন্যই ফশে বেশি রেগে আছে।

    তার ল্যাপটপ কম্পিউটারের দিকে ঘুরে কোলেত তার দ্বিতীয় কাজটি করতে লেগে গেলো জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম। কম্পিউটারে লুভরের পুরো এলাকাটির একটা স্ট্রাকচারাল ডিজাইন ভেসে এলো। গ্যালারি এবং হলওয়ের দিকে তার চোখ কী যেনো খুঁজতে লাগলো। অবশেষে কোলেত সেটা পেয়ে গেলো।

    গ্র্যান্ড গ্যালারির অভ্যন্তরে ছোট্ট একটা লাল বিন্দু জ্বলছে আর নিভছে।

    লা মার্ক।

    ফশে আজরাতে তার শিকারকে খুব শক্ত করেই ধরেছে। রবার্ট ল্যাংডন এ পর্যন্ত নিজেকে খুব ঠাণ্ডা মাথার মানুষ হিসেবে প্রমাণ করতে পেরেছে।

     

    ০৯.

    মি. ল্যাংডনের সাথে কথাবার্তায় যেনো বিঘ্ন না ঘটে সেটা নিশ্চিত করতে বেজু ফশে নিজের সেল ফোনটা বন্ধ করে রেখেছিলো। দূর্ভাগ্যজনকভাবে, সেটা ছিলো খুবই ব্যয়বহুল একটা যন্ত্র যেটার রয়েছে দ্বিমুখী রেডিও সুবিধা। তার নিষেধ সত্ত্বেও এখন যন্ত্রটা বেজে উঠছে, তার এক এজেন্টের করা কলে।

    ক্যাপিতেইন? ফোনটা সশব্দ হয়ে উঠলো ওয়াকি-টকির মতো। ফশে দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো প্রচণ্ড রাগে। সে কোনমতেই ভাবতে পারছে না, কোলেতের সার্ভিলেন্স করার কাজের চেয়ে আর কোন জরুরি বিষয় আছে কিনা বিশেষ করে এরকম একটি জটিল মুহূর্তে।

    সে ল্যাংডনের দিকে তাকিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিলো। ক্ষমা করবেন, এক মিনিট। বেল্ট থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে রেডিও ট্রান্সমিশনেরর সুইচটা চাপ দিলো।

    উই?

    ক্যাপিতেই, উঁ এজেন্ট দু দিপার্তমেস্ত দ্য ক্রিপ্টোগ্রাফি এস এরাইভ।

    ফশের রাগটা কিছুক্ষণের জন্য কমে গেলো। কিটোগ্রাফার? এই অসময়ে ফোন করলেও, সম্ভবত খবরটা ভালো। ফশে সনিয়ের ক্রিপটিক অর্থাৎ রহস্যময় লেখাগুলো খুঁজে পাবার পর, সেগুলোর সব ছবিই তুলে ক্রিপ্টোলজি ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়ে দিয়েছিলো এই আশায় যে, কেউ হয়তো বলতে পারবে সনিয়ে আসলে কী বলতে চেয়েছেন। যদি এখন কোন কোড ব্রেকার এসে থাকে, তার মানে, কেউ না কেউ সনিয়ের লেখার পাঠোদ্ধার করতে পেরেছে।

    এই মুহূর্তে আমি খুব ব্যস্ত আছি, ফশে ফোনে জবাব দিলো, ক্রিপ্টোগ্রাফারকে কমান্ড পোস্টে অপেক্ষা করতে বলো। আমার কাজ শেষ হলে লোকটার সাথে কথা বলবো।

    মহিলা, স্যার, কণ্ঠটা শুধরিয়ে দিলো, এজেন্ট নেভু।

    এই ফোনটা আসার পর থেকেই ফশের আশা একটু একটু করে দূরাশায় পরিণত হচ্ছে। সোফি নেভু ডিসিপিজের একটি মস্ত বড় ভুল। একজন প্যারিসবাসী তরুণী, যে ক্রিপ্টোগ্রাফি নিয়ে লেখাপড়া করেছে ইংল্যান্ডের রয়্যাল হলো ওয়েতে, দুই বছর আগে যখন নারীদেরকে পুলিশে আরো বেশি অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তার মন্ত্রণালয় সোফিকে নিয়োগ দেয় তখন থেকে মেয়েটা ফশের কাঁধে চেপে বসেছে। এ ব্যাপারে ফশে আপত্তি করেছিলো এই বলে যে, এতে ডিপার্টমেন্টটা দুর্বল হয়ে যাবে।  শুধুমাত্র শারীরিক সক্ষমতার অভাবের জন্যই নয়, নারীদের উপস্থিতি পুলিশের মাঠ পর্যায়ের পুরুষ সহকর্মীদের মনোযোগের বিচ্যুতি ঘটাবে। এটা হবে খুবই বিপজ্জনক। ফশে যতোটা আশংকা করেছিলো সোফি নেভু তার চেয়েও বেশি মনোযোগের বিচ্যুতি ঘটিয়েছে।

    বত্রিশ বছর বয়সের মেয়েটার দৃঢ়তা তার একগুয়েমীপনাকে পরিমিত করে রেখেছে। তার বৃটেনের নতুন ক্রিপ্টোলজিক পদ্ধতির ব্যবহার ক্রমাগতভাবে প্রখ্যাত ফরাসি ক্রিপ্টোগ্রাফারদেরকে ক্ষুব্ধ করে যাচ্ছে। তারচেয়েও বড় কথা, ফশের জন্য সবচাইতে বড় সমস্যা হলো সেই চিরন্তন সত্য কথাটি যা থেকে সে নিজেও বাচতে পারেনি, সেটা হলো, একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ মানুষের অফিসে, সুন্দরী, আকর্ষণীয় কোন তরুণী চোখের সামনে থাকলে, চোখ সারাক্ষণ সেদিকেই ঘোরে, হাতের কাজের দিকে নয়।

    ফোনে লোকটা বললো, এজেন্ট নেভু এই মুহূর্তেই আপনার সাথে কথা বলার জন্য চাপচাপি করছে, ক্যাপ্টেন। আমি তাকে থামাতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু সে গ্যালারির দিকে রওনা দিয়ে দিয়েছে।

    ফশে অবিশ্বাসে চিৎকার করে উঠলো প্রায়। এটা কোনমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমি খুব ভালো করেই বলেছিলাম

    কিছুক্ষণের জন্য ল্যাংডনের মনে হয়েছিলো বেজু ফশের স্ট্রোক করেছে বোধ হয়। কথার মাঝপথে ক্যাপ্টেনের চোয়াল শক্ত হয়ে চোখ দুটো ঠিকরে বের হয়ে যাচ্ছিলো। তার রক্তচক্ষু ল্যাংডনের কাঁধের পাশে কোথাও স্থির হয়ে গেলো। ল্যাংডন ঘুরে দেখার আগেই, শুনতে পেলো একটি নারী কণ্ঠ, তার পেছন থেকে রিনিঝিনি করে বলে উঠলো।

    এক্সুইজেজ মোয়ে, মেঁসিয়ে।

    ল্যাংডন ঘুরে দেখে একজন তরুণী এগিয়ে আসছে। করিডোর দিয়ে লম্বা-লম্বা পা ফেলে তাদের দিকেই আসছে সে…তার হাটার ধরণে নির্ঘাত শিকারের একটি ব্যাপার রয়েছে। হাটু পর্যন্ত ক্যাজুয়াল পোশাক পরিহিত, ঘিয়ে রঙের সোয়েটার, কালো রঙের পা-মোজা, দেখতে খুব আকর্ষণীয় আর বয়স ত্রিশের কোঠায় বলে মনে হচ্ছে। তার পাতলা এলোমেলো চুলগুলো কাঁধের উপর অবিন্যস্তভাবে পড়ে আছে। সেজন্যে মুখটার চারপাশ একটু ঢেকে গেছে। এই মেয়েটার রঙ-চঙহীন সৌন্দর্য আর অকৃত্রিমতা এক ধরনের দৃঢ় চরিত্রের দ্যুতি ছড়াচ্ছে।

    ল্যাংডনের কাছে খুব অবাক করার ব্যাপার হলো যে, মেয়েটা সরাসরি তার কাছে এসে বেশ ভাবেই হাতে বাড়িয়ে দিলো। মঁসিয়ে ল্যাংডন, আমি ডিসিপিজের ক্রিপ্টোগ্রাফার ডিপার্টমেন্টের এজেন্ট নেভু। তার উচ্চারণে এ্যাংলো-স্যাক্সন টান বেশ স্পষ্ট।

    আপনার সাথে পরিচিত হওয়া খুব আনন্দের ব্যাপার। তার নরম হাত ধরে ক্ষণিকের জন্য ল্যাংডনের মনে হলো তার চোখ মেয়েটার ওপর স্থির হয়ে আছে। মেয়েটার চোখ জলপাই সবুজ—প্রখর এবং স্পষ্ট।

    ফশের ভাবসাবে বিরক্তি ফুটে উঠলো।

    ক্যাপ্টেন, মেয়েটা বললো, খুব দ্রুত তার দিকে ফিরে একটা আক্রমণাত্মক কথা বললো, এজন্যে আমাকে ক্ষমা করবেন, কিন্তু সে নেস্ত পাস লো মোমেন্ত! ফশে খুব কাটা কাটাভাবে বললো।

    আমি আপনাকে ফোন করার চেষ্টা করেছিলাম, সোফি ইংরেজিতেই চালিয়ে গেলো ল্যাংডনের প্রতি সৌজন্যবশতায়। কিন্তু আপনার সেল ফোনটা বন্ধ।

    ফোনটা একটা কারণে বন্ধ করে রেখেছিলাম, ফশে গজ গজ করতে করতে বললো। আমি মি. ল্যাংডনের সাথে কথা বলছিলাম।

    আমি সংখ্যা-কোডটা উদঘাটন করতে পেরেছি, সে খুব সাদামাটাভাবেই কথাটা বললো।

    ল্যাংডনের মধ্যে একধরনের স্নায়ুবিক উত্তেজনা দেখা দিলো। সে কোডটার মমোৰ্দ্ধার করতে পেরেছে?

    ফশে কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে সে ব্যাপারে একটু দ্বিধাগ্রস্ত বলে মনে হলো।

    এটা ব্যাখ্যা করার আগে, সোফি বললো, মি. ল্যাংডনের জন্য আমার কাছে একটা জরুরি মেসেজ আছে সেটা বলে নেই।

    ফশে খুবই অবাক হলো বলে মনে হচ্ছে। মি. ল্যাংডনের জন্য?

    মেয়েটা মাথা নেড়ে ল্যাংডনের দিকে ফিরলো, আপনার এখনই ইউএস এ্যামবাসিতে যোগাযোগ করা দরকার, মি. ল্যাংডন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আপনার জন্য আসা একটা মেসেজ তাদের কাছে রয়েছে।

    ল্যাংডনও অবাক হলো, কোড-এর অর্থ জানার জন্য যে উত্তেজনাটা তার মধ্যে ছিলো, সেটা যেনো হঠাৎ করেই অন্য একটা বিস্ময়ে প্রতিস্থাপিত হলো। যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটা মেসেজ? সে অনুমান করতে চেষ্টা করলো, কে তাকে সেটা পাঠাতে পারে। তার সহকর্মীদের খুব কম সংখ্যকই জানে বর্তমানে সে প্যারিসে আছে।

    খবরটা শুনে ফশের চওড়া চোয়ালটা খুব শক্ত হয়ে গেলো। ইউএস এ্যামবাসি? সে প্রশ্ন করলো, তার কথায় সন্দেহের আভাস। তারা কীভাবে জানতে পারলো মি. ল্যাংডন এখানে আছেন?

    সোফি কাঁধ ঝাঁকালো। আসলে তারা মি. ল্যাংডনের হোটেলে ফোন করেছিলো, সেখান থেকে জানতে পেরেছে যে, মি. ল্যাংডনকে ডিসিপিজে তুলে নিয়ে গেছে।

    ফশেকে দেখে মনে হলো সে বিপদে পড়েছে। আর এ্যামবাসি তারপর ডিসিপিজের ক্রিপ্টোগ্রাফিতে যোগযোগ করেছে?

    না, স্যার, সোফি বললো, তার কণ্ঠ খুব দৃঢ়। আমি যখন ডিসিপিজের সুইচ বোর্ড থেকে আপনার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম তখন তারা আমায় বললো যে, মি. ল্যাংডনের কাছে একটা মেসেজ এসেছে, যদি আমি আপনাকে পেয়ে যাই তবে সেটা আমাকে পৌঁছে দিতে বললো তারা।

    ফশেকে খুব চিন্তিত দেখালো। সে কিছু বলার আগেই সোফি ল্যাংডনের দিকে ঘুরলো।

    মি. ল্যাংডন, সে তার পকেট থেকে একটা ছোট্ট কাগজ বের করে বললো, এটা আপনার এ্যামবাসির মেসেজ সার্ভিসের নাম্বার। তারা আপনাকে যতো দ্রুত সম্ভব ফোন করতে বলেছে। কাগজটা তার হাতে তুলে দেবার সময় সে চোখের একটু ইশারা করলো। আমি যখন মি. ফশেকে কোডের অর্থটা ব্যাখ্যা করতে থাকবো তখন আপনি ফোন করে নেবেন।

    ল্যাংডন কাগজটা দেখলো। এটাতে প্যারিসের ফোন নাম্বার এবং একটা এক্সটেনশন নাম্বার দেয়া আছে। ধন্যবাদ আপনাকে, সে বললো, তার খুব উদ্বিগ্ন বোধ হচ্ছে এখন। একটা ফোন কোথায় পেতে পারি?।

    সোফি তার সোয়টারের পকেট থেকে একটা ফোন বের করতে যেতেই ফশে তাকে ইশারা করে থামিয়ে দিলো। তাকে এখন মাউন্ট ভিসুভিয়াস মনে হচ্ছে, এক্ষুণি বোধ হয় অগ্নৎপাত হবে। সোফির দিক থেকে চোখ না সরিয়েই সে নিজের সেল ফোনটা বের করলো। এই লাইনটা ব্যবহার করাই বেশি নিরাপদ, মি. ল্যাংডন। আপনি এটা ব্যবহার করতে পারেন।

    ফশে কেন এই মেয়েটার উপর এত ক্ষেপে আছে সেটা ল্যাংডনের কাছে খুবই রহস্যময় মনে হচ্ছে। খুব অস্বস্তি লাগলেও সে ক্যাপ্টেনের ফোনটা গ্রহণ করলো। ফশে ফোনটা দিয়েই একটু দূরে দাঁড়ানো সোফির কাছে চলে গিয়ে চাপা গলায় কী যেনো বলতে শুরু করলো। ল্যাংডন ক্যাপ্টেনকে অপছন্দ করতে শুরু করেছে, তাদের এই অদ্ভুত কথাবার্তা থেকে নিজেকে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে সে ফোনটার সুইচ টিপলো। কাগজটা দেখে দেখে ল্যাংডন একটা নাম্বারে ফোন করলো।

    রিং বাজতে শুরু করেছে। একবার… দুবার….তিনবার… শেষে কলটা লাইন পেলো।

    ল্যাংডন এ্যামবাসির একজন অপারেটরকে আশা করেছিলো। কিন্তু তার পরিবর্তে সে একটা এন্সারিং মেশিনের আওয়াজ শুনতে পেলো। সবচাইতে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, টেপের কণ্ঠটা খুব পরিচিত। এটা সোফি নেভুরই।

    বজুঁখ, ভু এতে বুশেজ সোফি নেভু, নারী কণ্ঠটা বললো, জো সুই এবসেনতে পোটর লো মোমেন্ত, সেই…..

    কিছু বুঝে উঠতে না পেরে, ল্যাংডন সোফির দিকে তাকালো। আমি দুঃখিত, মিস্ নেভু? আমার মনে হয় আপনি আমাকে।

    না, এটাই ঠিক নাম্বার, সোফি খুব দ্রুতই মাঝপথে বাধা দিয়ে বললো। এ্যামবাসির একটা স্বয়ংক্রিয় এন্সারিং মেশিন আছে। মেসেজটা পেতে হলে আপনাকে আরেকটা এক্সটেনশন নাম্বার ডায়াল করতে হবে।

    ল্যাংডন চেয়ে রইলো। কিন্তু—

    আমি আপনাকে তিন সংখ্যার একটা কোড দিয়েছি, কাগজে।

    ল্যাংডন কিছু একটা বলতে যাবে, তখনই সোফি নিঃশব্দে চোখের ইশারা করলো। সেটা খুব অল্প সময়ের জন্য। তার সবুজ চোখ দুটো স্পষ্টতই একটা বার্তা দিয়ে দিয়েছে।

    কোন প্রশ্ন করবেন না। শুধু যা বলেছি তাই করুন। ল্যাংডন এক্সটেনশন নাম্বারটা চাপলো : ৪৫৪।

    সোফির মেসেজটা সাথে সাথেই বন্ধ হয়ে গেলো, আর তারপরই ল্যাংডন শুনতে পেলো একটা ইলেক্ট্রনিক কণ্ঠ, ফরাসিতে : আপনার জন্য একটা নতুন মেসেজ আছে। আসলে, ৪৫৪ নম্বরটি সোফিরই, সে যখন বাড়িতে না থাকে তখন তার মেসেজ পেতে এটি ব্যবহার করা হয়।

    আমি এই মেয়েটারই মেসেজ নিতে যাচ্ছি।

    ল্যাংডন এবার টেপটা শুনতে পেলো। আবারো, যে কণ্ঠটি কথা বলছে, সেটা সোফির নিজের।

    মি. ল্যাংডন, মেসেজটা একটা ভীতিকর ফিসফিস্ কণ্ঠে বলতে শুরু করলো। এই মেসেজটা পড়ে কোন ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না। মাথা ঠাণ্ডা রেখে শুনে যান। আপনি এখন খুব বিপদে আছেন। মনোযোগ দিয়ে আমার কথাগুলো শুনুন।

     

    ১০.

    সাইলাস কালো অদি গাড়িটার পেছনের সিটে বসে আছে, টিচার তার জন্য এই গাড়ির ব্যবস্থা করেছেন। সে বসে থেকে বাইরে বিখ্যাত চার্চ সেন্ট-সালপিচের দিকে তাকিয়ে আছে। নিচ থেকে ফ্লাড লাইটের আলোতে চার্চের দুটো টাওয়ারকে মনে হচ্ছে লম্বা দালানটার দুদিকে দুটো পাহাড়াদার।

    শয়তানের দল তাদের কি-স্টোনটা লুকানোর জন্য ঈশ্বরের ঘরকে ব্যবহার করেছে। আবারো ভ্রাতৃসংঘ তাদের রহস্য-প্রহেলিকা আর শঠতার ঐতিহাসিক সুনামটি বজায় রাখতে পেরেছে। সাইলাস কি-স্টোনটা খুঁজে পেলেই সেটা তার টিচারকে দিয়ে দেবে, যাতে ভ্রাতৃসংঘ যে জিনিসটা বিশ্বাসীদের কাছ থেকে চুরি করেছিলো সেটা তাঁরা ফিরে পায়।

    সেটা ওপাস দাইকে কত শক্তিশালীই না করবে।

    সেন্ট সালপিচের এক ফাঁকা জায়গায় অদিটাকে পার্ক করে সাইলাস বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো, নিজেকে সুধালো এই মুহূর্তের কাজের জন্য মাথাটা পরিষ্কার রাখতে হবে। তার প্রশস্ত পিঠটা আজ সকালের কোরপোরাল মরটিফিকেশন নামক শারিরীক শাস্তির একটি অনুশীলনের জন্য এখনও ব্যাথা করছে। এই যন্ত্রণাটা তার আগেরকার জীবনের যন্ত্রণার সাথেই তুলনীয়, ওপাস দাই তাকে তখনও সেই জীবন থেকে তুলে আনেনি।

    এখনও সেইসব স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।

    তোমার ঘৃণাকে ছেড়ে দাও, সাইলাস নিজেকে আদেশ করলো। তোমার বিরুদ্ধে যারা এসে যাবে, তাদেরকে মাফ করে দিও।

    সেন্ট সালপিচের পাথরের টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে, সাইলাসের মনে পড়ে গেলো অতিপরিত একটা দৃশ্যের কথা … যে আচরণের কারণে অনেক অনেক আগে তাকে জেলখানায় বন্দী করা হয়েছিলো, সেটা ছিলো তার তরুণ বয়সে। আত্মশুদ্ধির স্মৃতিটা তার মনে একটা ঝড় বয়ে আসার মতো করে আসলো…পচা, সোঁদা-সোঁদা গন্ধ, মৃত্যুর বিভীষিকা, মানুষের প্রস্রাবের। হতাশার কান্না, আছুঁড়ে পড়তো পিরেনিজর বাতাসের ওপর।

    এনদোরা, সে ভাবলো, অনুভব করলো তার পেশীগুলো আড়ষ্ট হয়ে আছে।

    অবিশ্বাস্যভাবে, সেটা ছিলো স্পেন আর ফ্রান্সের মাঝখানে নিষিদ্ধ একটা এলাকাতে, পাথরের নির্জন সেলে বসে কান্নাকাটি করতে করতে মরে যেতে চাইতো শুধু, সেই সাইলাসকে রক্ষা করা হয়েছিলো।

    সেই সময়ে সে এটা বুঝতে পারে নাই।

    বজ্রপাতের পরপরই আলোটা এসেছিলো।

    তখন তার নাম সাইলাস ছিলো না, যদিও সে তার বাবা-মার দেয়া নামেও নিজেকে পরিচয় দিতো না। সাত বছর বয়সে বাড়ি ছেড়েছিলো সে। তার মদ্যপ বাবা, জাহাজঘাটার একজন নগন্য শ্রমিক ছিল, ধবল একটি সন্তানকে দুনিয়ার আলো দেখানোর দায়ে তার মাকে প্রায় প্রতিদিনই রেগেমেগে নির্যাতন করতো। সন্তানের এরকম অবস্থার জন্য তাকে দায়ী করতো। যখন ছোট্ট সাইলাস মাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতো, তখন তাকেও বেদম মারা হতো। একরাতে, ভয়ংঙ্কর মারপিট হলো। মারের চোটে তার মা আর উঠে দাঁড়াতে পারলো না। ছোট্ট ছেলেটা নিথর-নিস্তব্ধ মার পাশে দাড়িয়ে মার এই অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী মনে করলো।

    এটা আমারই দোষ

    যেনো এক ধরণের অশুভ শক্তি তার শরীরটা নিয়ন্ত্রণ করছিলো। ছেলেটা রান্নাঘরে গিয়ে একটা কসাইর ছুরি হাতে তুলে নিলো। সম্মােহিতভাবে সোজা চলে গেলো। শোবার ঘরে, যেখানে তার বাবা মাতাল হয়ে পড়ে আছে। কোন কথা না বলেই, ছেলেটা বাবার পিঠে কোপ বসালো। তার বাবা চিৎকার দিয়ে গুটি গুটি মেরে গড়াগড়ি খেতে লাগলো, কিন্তু ছেলে আবারো কোপ মারলো। বারবার মারলো, যতোক্ষণ পর্যন্ত না ঘরটা নিথর-নিস্তব্ধ হয়ে গেলো।

    ছেলেটা বাড়ি ছাড়লো কিন্তু মার্সেইর পথঘাটকেও একই রকম শত্রুভাবাপন্ন হিসেবে পেলো সে। রাস্তাঘাটের অন্যান্য ঘর পালানো ছেলের দল তার অদ্ভুত চেহারার জন্য তাকে একঘরে করে রাখতো। তখন বাধ্য হয়েই একটা ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার ভূগর্ভস্থ ঘরে আশ্রয় নিলো সে, জাহাজঘাটার ফেলে দেয়া ফলমূল আর কাঁচা মাছ খেতো। তার একমাত্র সঙ্গী ছিলো আবর্জনায় ফেলে দেয়া পরিত্যাক্ত ম্যাগাজিন। নিজে নিজেই সে ওগুলো পড়তে শিখেছিলো। পরে খুব শক্ত-সামর্থ্য এক মানুষে পরিণত হলো সে। যখন তার বয়স বারো তখন আরেকজন ঘরপালানো ভবঘুরে—তার দ্বিগুণ বয়সের একটা মেয়ে-পথে-ঘাটে তাকে পরিহাস করতো শুধু আর তার খাবার চুরি করার চেষ্টা করতো। একদিন মেয়েটা নিজেকে আবিষ্কার করলো। ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায়। কর্তৃপক্ষ যখন ছেলেটাকে মেয়েটার উপর থেকে টেনে তুললো, তখন তারা তাকে আলটিমেটাম দিয়ে দিলো–মার্সেই ছাড়ো নয়তো কিশোর জেলখানায় যেতে হবে।

    ছেলেটা তুইলোর উপকূলের দিকে চলে গেলো। সময়ের পরিবর্তনে, যে ছেলেটা পথঘাটের করুণার পাত্র ছিলো, সে-ই হয়ে উঠলো ভীতিকর এক চরিত্রে। ছেলেটা প্রচণ্ড শক্তির এক যুবক হিসেবে বেড়ে উঠলো। যখন লোকজন তার পাশ দিয়ে যেতো, সে শুনতে পেতো, তারা একে অন্যকে ফিস্ ফিস্ করে বলছে, একটা ভূত, তার শাদা চামড়ার দিকে তাকিয়ে তাদের চোখ ভয়ে গোল গোল হয়ে যেতো। একটা ভূত, শয়তানের মতো চোখ!

    আর সেও নিজেকে ভূত মনে করতে শুরু করলো…স্বচ্ছ…সমুদ্রতীর থেকে সমুদ্রতীরে ভেসে বেড়ানো।

    মনে হতো মানুষজন তার শরীরের ভেতর দিয়ে সব কিছু দেখতে পেতো।

    আঠারো বছর বয়সে, এক বন্দর শহরে, একটা কার্গো থেকে শূয়োরের মাংসের টিনের কৌটা চুরি করবার চেষ্টা করলে দুজন খালাসি তাকে ধরে ফেললো। যে দুজন খালাসি তাকে মারতে শুরু করলো তাদের মুখ থেকে সে বিয়ারের গন্ধ পেয়েছিলো, যেমনটা তার বাবার মুখ থেকে পেতো। ঘৃণা এবং ভয়ের স্মৃতি তার ভেতর থেকে এমনভাবে উঠে এলো যেমন করে সুপ্ত অবস্থায় থেকে কোন দানব জেগে ওঠে। সেই যুবকটা একজন খালাসির ঘাড় মটকে দিলো খালি হাতেই, আর একই পরিণতি থেকে অন্য খালাসিটাকে পুলিশ এসে বাঁচাতে পেরেছিলো কোনমতে।

    দুমাস পরে, শেকল পড়া অবস্থায়, সে এনডোরার একটা বন্দীশালায় এসে পৌঁছালো।

    তুমি ভূতের মতোই শাদা, প্রহরীরা যখন তাকে পাহাড়া দিতো তখন তার সঙ্গীরা ঠাট্টাচ্ছলে এ কথা বলতো। তাকে ন্যাংটো করে ঠাণ্ডা শীতে রাখা হতো। মিরা এন এসপেত্রো! সম্ভবত ভূতটা এই দেয়াল ভেদ করে যেতে পারবে।

    বারো বছর বয়স থেকেই সে তার আত্মা এবং শরীরকে ভূতুরেই মনে করতে শুরু করেছিলো। ভাবতে শুরু করেছিলো সে স্বচ্ছ কাঁচে মতো হয়ে গেছে।

    আমি ভূত।

    আমি ওজনহীন।

    ইয়ো সোয় এসপেকত্রো…পালিদো কোমো উন ফ্যানতাসমা…কামিনাদো এতে মুন্দো এ সালাম, এক রাতে ভূতটা তার সহ-বন্দীদের চিৎকারে ঘুম থেকে উঠে গেলো। সে জানতো না, সে যে ফ্লোরে ঘুমিয়ে আছে, সেটা কোন অদৃশ্য শক্তিতে থর থর করে কাঁপছে। কোন মহা শক্তিশালী হাত পাথরের সেলটাকে কাঁপাচ্ছে। কিন্তু লাফ। দিয়ে দাঁড়াতেই যে জায়গাটাতে সে ঘুমিয়ে ছিলো সেখানে একটা বিশাল শৈলখণ্ড এসে আছড়ে পড়লো। সে দেখতে পেলো দেয়ালটাতে একটা বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে, আর সেই গর্ত দিয়ে সে দৃশ্যটা দেখতে পেলো, সেটা বিগত দশ বছর ধরে সে দেখেনি। একটা চাদ। মাটিটা যখন কাঁপছিলো, তখন ভূতটা একটা সরু টানেলের গিরিখাদে এসে পড়লো। জায়গাটা ঘন জঙ্গলে আচ্ছাদিত। সারাটা রাত ধরে সে ছুটে চললো নিচের দিকে, প্রচণ্ড ক্ষুধার আর ক্লান্তিকর ছিলো ব্যাপারটা।

    সম্বিত ফিরে পেতেই সে নিজেকে আবিষ্কার করলো বনের মধ্যে বুক চিড়ে চলে যাওয়া রেললাইনের পাশে। রেললাইন ধরে সে ছুটে চললো যেনো সে স্বপ্ন দেখছে। একটা খালি মালবাহি গাড়ি দেখতে পেলে হামগুড়ি দিয়ে সেটার কাছে গেলো, ওটার ভেতরে আশ্রয় নিলো একটু বিশ্রামের জন্য। জেগে উঠে দেখতে পেলো ট্রেনটা চলছে। কততক্ষণ? কতো দূরে? তীব্র যন্ত্রণা বোধ হলো তার। আমি মারা যাচ্ছি? সে আবারো। ঘুমিয়ে পড়লো। এবার তার ঘুম ভাঙলো অন্য কারোর ডাকাডাকিতে, চড় থাপড়ে, তাকে তুলে মালবাহি গাড়ি থেকে ফেলে দেয়া হলো। ক্ষতবিক্ষত অবস্থায়, রক্তমাখা শরীরটা নিয়ে সে একটা ছোট্ট গ্রামের বাইরে খাবারের আশায় ঘুর ঘুর করতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত তার শরীরটা এভোটা দুর্বল হয়ে গেলো যে, আর এক পা-ও এগোতে পারলো না। পথের পাশে অচেতন হয়ে পড়ে গেলো সে।

    আলোটা এসেছিলো ধীরে ধীরে। ভূতটা অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো কততক্ষণ ধরে সে মরে পড়ে আছে। একদিন? তিনদিন? তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না। তার বিছানাটা এতো নরম ছিলো যেনো সেটা মেঘের মতো কিছু। তার চার পাশের বাতাসটা ছিলো খুবই মিষ্টি আর মোমবাতিতে ভরা ছিলো পুরো ঘরটা। যিশুও সেখানে ছিলেন, তাঁর দিকে তাকিয়ে। আমি এখানে আছি, যিশু বললেন। পাথর গড়িয়ে পড়ে তোমার নতুন এক জন্ম দিয়ে গেছে।

    সে জেগে উঠে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। তার চিন্তাভাবনা ধোয়াচ্ছন্ন হয়ে রইলো। সে কখনও স্বর্গে বিশ্বাস করতো না, তারপরও যিশু তার দিকে চেয়ে আছে। তাকে দেখাশোনা করছে। তার বিছানার পাশে খাবার রাখা ছিলো। ভূত সেটা উদর পূর্তি করলো। তার মনে হলো খাবারগুলো তার শরীরে পুষ্ট হয়ে হাড়ে হাড়ে মাংস তৈরি করছে। সে বার বার ঘুমিয়ে পড়তো। যখন সে জেগে উঠলো, তখনও যিশুর মুখে হাসি লেগেই আছে। তিনি কথা বললেন। তুমি বেঁচে গেছে, বাছা। যে আমার পথ অনুসরণ করে সে-ই আশীর্বাদ পায়।

    আবারো সে ঘুমিয়ে পড়লো।

    একটা যন্ত্রণাকাতর চিৎকারে ভুতটা তার ঘর ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে এলো। চিৎকারটা যেখান থেকে এসেছিলো সেখানে ছুটে গেলো সে। একটা রান্নাঘরে ঢুকে দেখতে পেলো বিশাল দেহের এক লোক ছোটোখাটো একজনকে প্রহার করছে। কোন কিছু না জেনেই ভুতটা বিশালদেহী লোকটাকে জাপটে ধরে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। লোকটা তার হাত থেকে ছুটে পালালো। ভুতটা দাড়িয়ে রইলো পাদ্রীর দড়ি পড়া একজন যুবকের নিথর দেহের পাশে। পাদ্রীর নাকটা একেবারে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। ভূতটা তাকে তুলে নিয়ে একটা সোফায় শোয়ালো।

    ধন্যবাদ তোমাকে, আমার বন্ধু, পাদ্রী ভাঙাভাঙা ফরাসিতে তাকে বললো। দানের টাকা-পয়সা চোর-বাটপারের কাছে বেশি লোভনীয়। তুমি ঘুমের মধ্যে ফরাসিতে কথা বলছিলে। তুমি কি স্পেনিশে কথা বলতে জাননা?

    ভূতটা মাথা নাড়ালো।

    তোমার নাম কি? ভাঙা ভাঙা ফরাসিতেই বললেন।

    ভূতটা তার বাবা-মার দেয়া নামটা কোনভাবেই মনে করতে পারলো না। সে শুধু জেলের প্রহরীরা তাকে যে নামে ডাকতো তা-ই শুনেছে।

    পাদ্রী মুচকি হাসলেন। নো হেই প্রবলেমা। আমার নাম ম্যানুয়েল আরিঙ্গাবোসা। আমি মাদ্রিদের একজন মিশনারি। আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে ওরা দ্য ডিওর জন্য একটা গীর্জা বানাতে।

    আমি কোথায় আছি? তার কণ্ঠটা ভীতিকর শোনালো।

    অভিদোতে। স্পেনের উত্তরে।

    এখানে আমি কিভাবে এলাম?

    তোমাকে কেউ একজন আমার দরজার সামনে ফেলে রেখে গিয়েছিলো। তুমি খুব অসুস্থ ছিলে। আমি তোমাকে খাইয়েছি। তুমি এখানে অনেকদিন ধরেই আছে।

    ভূতটা তার যুবক রক্ষাকর্তার দিকে তাকালো। অনেক বছর যাবত কেউ তার প্রতি এরকম দয়া দেখায়নি। ধন্যবাদ, ফাদার।

    পাদ্রী তার রক্তাক্ত ঠোঁটটা স্পর্শ করলো। আমিই তোমাকে ধন্যবাদ দেই, বন্ধু আমার।

    যখন ভূতটা সকালে ঘুম থেকে উঠলো, তখন তার দুনিয়াটা স্পষ্ট হয়ে গেলো। সে তার বিছানার উপর থাকা কুশটার দিকে তাকালো। যদিও এটা তার সাথে কোন কথাই বলেনি তবুও তার মনে হলো এটার উপস্থিতিতে তার এক ধরনের আরাম বোধ হচ্ছে। উঠে বসে দেখে তার বিছানার পাশে একটা দৈনিক সংবাদপত্র রাখা আছে, সে খুব। অবাক হলো। লেখাটা ফরাসিতে ছিলো, এক সপ্তাহের পুরনো। যখন সে গল্পটা পড়লো, শিউরে উঠলো। এতে বলা আছে, একটা প্রচণ্ড ভূমিকম্পে পাহাড়ের পাদদেশের বন্দীশালা ধবংস হয়ে গেছে আর অনেক বিপজ্জনক কয়েদী পালিয়েছে। তার বুক ধরফর করতে লাগলো।পাদ্রী জানে আমি কে? তার যে ধরনের আবেগের সৃষ্টি হলো, সেটা এর আগে আর হয়নি। লজ্জা। অপরাধবোধ। তার সাথে ধরা পড়ার ভয়। সে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠলো। কোথায় পালাবো আমি?

    বুক অব এক্টস্, দরজার দিক থেকে কণ্ঠটা বললো। ভূতটা ঘুরে দেখে ভয় পেয়ে গেলো।

    তরুণ পাদ্রীটি ঘরে ঢুকলো হাসতে হাসতে। তাঁর নাক খুব বাজেভাবে ব্যান্ডেজ করা। তাঁর হাতে একটা পুরনো বাইবেল। আমি ফরাসিতে একটা বাইবেল খুঁজে পেয়েছি, তোমার জন্য। অধ্যায়গুলোতে দাগ দেয়া আছে।

    অনিশ্চয়তা বোধ থেকেই ভূতটা বাইবেল হাতে তুলে নিয়ে পাদ্রীর দাগ দেয়া অধ্যায়গুলোর দিকে তাকালো।

    এক্টস ১৬।

    পংক্তিটাতে বলা আছে সাইলাস নামের এক বন্দীর কথা যাকে নগ্ন করে সেলের ভেতরে ফেলে নির্যাতন করা হয়েছিলো। সে ঈশ্বরের স্তবক গাইছিলো। যখন ভূতটা ২৬ নাম্বার পংক্তিতে পৌঁছালো, সে আতকে উঠলো।

    …আর হঠাৎ করেই, সেখানে একটা প্রবল ভূমিকম্প হলো, তাতে বন্দীশালার ভিতটা কেঁপে উঠলো আর ভেঙ্গে পড়লো সবগুলো দরজা।

    তার চোখ পাদ্রীর দিকে নিক্ষিপ্ত হলো।

    পাদ্রী একটা উষ্ণ হাসি দিলেন। এখন থেকে, বন্ধু, যদি তোমার অন্য কোন নাম থেকে থাকে, আমি তোমাকে সাইলাস নামেই ডাকবো।

    ভূতটা মাথা নাড়লো। সাইলাস। তাকে রক্ত-মাংসের শরীর দেয়া হলো। আমার নাম সাইলাস।

    নাস্তা খাবার সময় হয়ে গেছে, পাদ্রী বললেন, যদি তুমি আমাকে এই গীর্জাটা বানাতে সাহায্য করো তবে তোমার খুব শক্তির দরকার রয়েছে।

     

    ভূমধ্য সাগর থেকে বিশ হাজার ফুট উঁচুতে, আলিতালিয়ার ১৬১৮ বিমানটা, শূন্যে একটু ঝাকি খেলে যাত্রীরা ঘাবড়ে গেলো। বিশপ আরিঙ্গাবোসা এগুলো লক্ষ্যই করলেন না। তার চিন্তাভাবনা ছিলো ওপাস দাইর ভবিষ্যত নিয়ে। তিনি জানতে উদগ্রীব ছিলেন প্যারিসের কাজটা কতোটুকু হলো, তার ইচ্ছে হলো সাইলাসকে একটা ফোন করতে। কিন্তু তিনি তা করলেন না। টিচার নিজে সেটা দেখছেন।

    এটা তোমার নিজের নিরাপত্তার জন্য, টিচার ব্যাখ্যা করেছিলেন। ফরাসি টানে ইংরেজিতে বলেছিলেন, আমি বেশ ভালো করেই জানি কীভাবে ইলেক্ট্রনিক যোগাযোগের যন্ত্রগুলো ইন্টারসেপ্ট করা হয়। ফলাফলটা তোমার জন্য খুবই ধ্বংসাত্মক হতে পারে।

    আরিঙ্গাবোসা জানতেন তিনি ঠিকই বলেছেন। টিচার হলেন খুবই সর্তক একজন মানুষ। তিনি আরিঙ্গারোসার কাছে নিজের পরিচয় দেননি, আর তিনি নিজেও প্রমাণ করেছেন যে, তিনি একজন বিশ্বস্ত লোক। হাজার হোক, তিনি খুবই গোপন একটা জিনিস জানেন। ভ্রাতৃ সংঘের শীর্ষ চার ব্যক্তির নাম! এজন্যেই বিশপের কাছে টিচারের এতো সমাদর।

    বিশপ, টিচার তাঁকে বলেছিলেন, আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। আমার পরিকল্পনা সফল করার জন্য আপনি অবশ্যই সাইলাসকে কয়েক দিনের জন্য আমার সাথে যোগাযোগ করার অনুমতি দেবেন। সে যেনো আমার কাছেই জবাবদিহি করে। আপনারা দুজন সেই সময়টাতে কোন কথা বলবেন না। আমি তার সাথে খুবই নিরাপদ চ্যানেল ব্যবহার করে যোগাযোগ করবো।

    আপনি তার সঙ্গে সম্মানের সাথে ব্যবহার করবেন?

    একজন বিশ্বাসী মানুষ তো সর্বোচ্চ সম্মানই আশা করে।

    চমৎকার। বুঝতে পেরেছি। এটা শেষ হওয়ার আগে সাইলাস এবং আমি কথা বলবো না।

    এটা আমি করবো আপনার পরিচয়টা রক্ষা করার জন্য। সাইলাসের পরিচয় এবং আমার বিনিয়োগ রক্ষা করতেও এর প্রয়োজন রয়েছে।

    আপনার বিনিয়োগ?

    বিশপ, যদি আপনার অতিরিক্ত কৌতূহল আপনাকে জেলে ভরে ফেলে তবে তো, আপনি আর আমার পারিশ্রমিকটা দিতে পারবেন না।

    বিশপ হাসলেন। চমৎকার যুক্তি। আমাদের দুজনের আকাঙ্খ একই, ঈশ্বরের জন্যই আমরা কাজ করি।

    বিশ মিলিয়ন ইউরো, বিশপ ভাবলেন, প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে। অঙ্কটা ইউএস ডলারের প্রায় সমপরিমাণ। খুব শক্তিশালী হবার জন্য যথার্থই বটে।

    তাঁর মনে হলো সাইলাস এবং টিচার ব্যর্থ হবে না। টাকা এবং বিশ্বাস খুবই শক্তিশালী জিনিস।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন
    Next Article রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    Related Articles

    ড্যান ব্রাউন

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    দ্যা লস্ট সিম্বল – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    অরিজিন – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    ইনফার্নো – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    ডিসেপশন পয়েন্ট – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    ডিজিটাল ফরট্রেস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.