Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    স্বভূমি – নবনীতা দেবসেন

    নবনীতা দেবসেন এক পাতা গল্প104 Mins Read0

    স্বভূমি – ১

    লালী নিকলসন

    আমি এখন চুল ধুচ্ছি। খুব নোংরা হয়েছে চুলটা। বাবা নীচে। রান্নাঘরে কফি বানাচ্ছে। মাকে রওনা করে দিয়ে কাল অনেক রাত্রে ফিরেছি আমরা, টোরোন্টো থেকে কিছু বাজার—টাজার সেরে। এয়ারপোর্ট কি কম দূর নাকি এখান থেকে? ঘণ্টা দুয়েকের রাস্তা। আমাদের বাড়িটা তো শহরের বাইরে সাবার্বে। দোকানেও ঘুরেছি বেশ খানিকক্ষণ। বাবা গজগজ করছিল। যতক্ষণে আমরা বাড়িতে পৌঁছুব ততক্ষণে তোমার মা লন্ডনে নেমে কফি খাচ্ছে। আমি ভাবছিলাম, উঃ এই শুরু হল বাবার গজগজ করা। মা ইন্ডিয়া থেকে যতদিন না ফিরবে বাবার মেজাজ খারাপ হতেই থাকবে। এবার অবশ্য আমরাও যাচ্ছি, দাদু—দিদার গোল্ডেন ওয়েডিংয়ের মস্ত পার্টি হচ্ছে কলকাতাতে। বাবার ক্লাস বন্ধ হলেই চলে যাব আমরা। বাবা কয়েকটি সামারকোর্স করাচ্ছে, এই ট্রিপটার টাকা তুলতে হবে তো?—বাবা খুব উৎসাহিত—আমার অবশ্য ইন্ডিয়া যেতে ভালো লাগে না, বিশেষ করে এই সামারে। ওঃ কী গরম! কী নোংরা! আর কী দুর্গন্ধ কলকাতাতে। দিল্লি আমার খারাপ লাগে না ততটা। মা’র সঙ্গে তো এই নিয়েই আমার ঝগড়া। বাংলা বলতে হবে, শাড়িও পরতে হবে, কলকাতাকে ভালবাসতেই হবে—এ কী জুলুম? এ যে অত্যাচার! তোমার সেটা জন্মভূমি হতে পারে আমার তো নয়। তুমি ইন্ডিয়াকে ভালবাসো, তুমি নিজে ইন্ডিয়ান। আমি তো নই? আমি ক্যানেডিয়ান। আমি ক্যানাডাকে ভালবাসি। টোরোন্টোকে ভালবাসি, আমাদের এই সাবার্বান গ্রামটাকে ভালবাসি। আমার বাবা বেচারি লুজিয়ানার লোক, সে ভালবাসে শহরটাকে। যদিও সেটা বাড়ি নয়। এ তো জবরদস্তির ব্যাপার নয়! মা শুনবে না। লাভ মি, লাভ মাই সিটি। আশ্চর্য! এই বাঙালিগুলো সববাই তাই। আমি কক্ষনও ভুলেও ইন্ডিয়ান বিয়ে করব না। বাঙালি তো নয়ই। ওরা বেজায় এঁড়ে তর্ক করে। মা যেমন বলে—’আমিও তো টোরান্টোকে ভালবাসি! টোরোন্টোকে যেমন ভালবাসি তেমনি কলকাতাকেও বাসি। তোর বাবাকে ভালবাসি, আমার বাবাকে—এতে গোলমালটা কোথায়? তুই কেন পারিস না কলকাতাকে ভালবাসতে?’ মাকে বোঝানো যাবে না যে টোরান্টো ইজ আ লাভেবল সিটি—টেরোন্টোর লোক না হলেও টোরান্টোকে ভালবাসা যায়, কেন না সে পরিচ্ছন্ন, রূপসী, ধনবতী, গুণবতী। কিন্তু কলকাতার লোক না হলে কুশ্রী, রুগণ, গরিব, নোংরা কলকাতাকে ভালবাসা খুব শক্ত। তা ছাড়া মা তো এখন টোরান্টোরই লোক। মার ঘর—গৃহস্থালি, স্বামী—সন্তান সবই এখানে—তবুও যে মা বাঙালিদের এত ভালবাসে, এত যোগ রাখে,—এটাই আশ্চর্য। বাবার প্রশয়েই এটা হয়েছে।

    বাবা যে বাঙালি কালচারের একনিষ্ঠ ভক্ত! কোথায় মাথায় ঝুঁটিবাঁধা তাপ্পিমারা ম্যাক্সিগাউন পরা তারের বাদ্যি বগলে ফোকসিংগার এল, বাবা তাকে ‘বেঙ্গলি সোলসিংগার’ বলে ডেকে এনে কলেজে স্পেশাল শো করে টাকা তুলে দিয়ে তাকে বাড়িতে রেখে, এক কাণ্ড। অবশ্য গানটান সে হয়তো ভালই লেগেছিল, বাঙালিরা তো অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল। আমার ওর নাচটা ভাল লাগলেও গানা তত ভাল লাগেনি। ইন্ডিয়ান ফোকসংটা আমার খারাপ অবশ্য লাগে না। বাবাও ক্যানেডিয়ান নয়, মা—ও ক্যানেডিয়ান নয়, কিন্তু আমি ক্যানেডিয়ান। আমরা এক পরিবারের তিনজন তিন দেশের লোক, তিন দেশের পাসপোর্ট আমাদের। এটা সত্যি একটা স্পেশাল ব্যাপার! তবে মা ভাবছে ক্যানাডিয়ান পাসপোর্টের আবেদন করবে। ওই ভারতীয় পাসপোর্টের জন্যে মাকে ভয়ানক ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয়। সবাই বলে পঁচিশ বছর এদেশে, অথচ এখনও ক্যানেডিয়ান হওনি? দেশ থেকে বেরুতেও ঝামেলা করে, ঢুকতেও ঝামেলা করে, ইন্ডিয়াতেও ঝামেলা করে। ক্যানেডিয়ান পাসপোর্ট হলে নাকি ইন্ডিয়াতেও সুবিধা, ইংল্যান্ডেও সুবিধা। বাবার ইউ এস পাসপোর্ট মা ইচ্ছে করলে তাও কবেই পেতে পারত, ইউ এস—এর গ্রিনকার্ডের জন্যে ইন্ডিয়ানরা সব হন্যে হয়ে যায়, দেখতে তো পাচ্ছি—অথচ আমার মা? আশ্চর্য! কী যে ওর আনন্দ ওই ইন্ডিয়ান পাসপোর্টটি জিইয়ে রেখে, মা—ই জানে!

    আজ ল্যারি যায়নি এয়ারপোর্টে—ল্যারি বেচারির উপায় ছিল না, ওর বস ওদের ডেকেছে আজকে। ল্যারিকে বিয়ে করা মা’র—বাবার কারুরই পছন্দ নয়, অথচ ল্যারিকে এমনিতেও খুব ভালবাসেন ওঁরা। ব্যাপারটা বোঝা কঠিন। আজ সকালেই গুডবাই করে গেছে ল্যারি মা’র দু’গালে দুটো চুমু খেয়ে। মা এটা খুব পছন্দ করে। এত দুষ্টু না মা, সেদিন বলেছে বাবাকে ”ভাগ্যিস, লালীর বয়ফ্রেন্ডরা আসছে সব, তাই তো কুড়ি—বাইশ বছরের ছেলেগুলো এত চুমু খাচ্ছে আমাকে! তোমার কপালে আর হল না। ছেলে তো নেই আমাদের, যে তার প্রেমিকারা এসে তোমাকে চুমু খাবে?” বাবাও তেমনি। তক্ষুনি বলে দিল—”কুড়ি—বাইশবছুরি কন্যেরা তো আমার জন্যেই আমাকে চুমু খাবে, আলো! কিন্তু তুমি যে তারপর তাদের টুকরো টুকরো করে ফেলবে।”

    —”তা ফেলব” মা বললে—”দেখুক না কেউ চুমুটুমু খেয়ে!” মা—বাবাতে সত্যি খুব ভাব। এরকমটা আমাদের বন্ধুবান্ধবদের বাবা মার মধ্যে বড় একটা দেখিনি। বেশিরভাগের বাবামাই অন্তত একবার ডিভোর্সড। বাকিরা দিনরাত ঝগড়া করছে। নতুবা অন্যত্র প্রেম করে। শুধু আমার মা—বাবাই চমৎকার। আমি সত্যিই ওদের নিয়ে গর্বিত। হ্যাঁ, হতে পারে, এটা হয় তো আমার মায়ের ইন্ডিয়ান হিন্দু ট্রাডিশনাল ব্যাক গ্রাউন্ডেরই একটা সুফল।

    মা’র ‘ঠাকুরঘর’ একটা ফ্যানটাস্টিক ব্যাপার। ট্রাডিশনাল রুটস খুঁজতে হলে ওখানে যেতে হয়। ও বাবা! সে একটা—দারুণ জিনিস। মা যদিও ওটাকে মেডিটেশন রুম বলতেই ভালবাসে, কিন্তু তাতে ছোট্ট ছোট্ট সব সুইট গডস অ্যান্ড গডেসেস আছে, খেলনা পুতুলের মতো তাদের থালা বাটিও আছে। মা তাদের জল দেয়, সুগার কিউব দেয়। তারা খায় না কোনওদিনই। ছোটবেলায় আমিই গিয়ে খেয়ে নিতাম। সারাদিন সুন্দর ধূপের গন্ধ ভরে থাকে ঘরটাতে। রোজ বাবা ছোট্ট এক গুচ্ছ ফুল তুলে মাকে দেয়—’ফর ইয়োর ব্লেসেড ঠাকুরস—” বলে। মা হাসে, ”থ্যাংকিউ ফ্রেডি হানি, আরনটিউ সুইট।” ফুলগুলো নিয়ে মা ঠাকুরঘরে একটা ফুলদানিতে সাজিয়ে আসে। মা বলে গন্ধহীন ফুল ঠাকুরঘরে দিতে নেই। তাই কেবল গোলাপ, লাইল্যাক, জ্যাসমিন, এইসব সুগন্ধী ফুল তুলে দেয় বাবা মা’র জন্যে। ঠাকুরঘরটা মা’র খেলার জায়গা বলে ভাবতুম আমি ছোটবেলায়। সব ঠাকুরের মধ্যে গণেশঠাকুরকে আমার সবচেয়ে ভাল লাগে। কী সুইট। আমার ঘরেই তিন—চার রকমের গণেশঠাকুর ম্যান্টলপিসে আছে। আমি তাদের সামনে ধূপ জ্বেলে দিই। ফুলও দিই। গণেশঠাকুর হচ্ছে গড অফ সাকসেস, সোজা কথা! সরস্বতীঠাকুর হচ্ছে গডেস অব নলেজ—বাবার স্টাডিতে দারুণ একটা সরস্বতীর ছবি আছে! বাবা অবশ্য তাতে ধূপ জ্বালে না। ফুলও দেয় না। লক্ষ্মীঠাকুর গডেস অব প্রসপ্যারিটি—ঠাকুরঘরে একটা পেতলের ঠাকুর পেতলের চমৎকার কারুকাজ করা সিংহাসনে বসে থাকত এতদিন। গতবছর ইন্ডিয়া থেকে মা একটি রুপোর ঠাকুর আর ছাতাওয়ালা ছোট্ট একটা রুপোর সিংহাসন নিয়ে এসে তার পাশে বসিয়েছে। বেচারি পেতলের ঠাকুর। রুপো কত সস্তা ইন্ডিয়াতে! ভাবা যায় স্টার্লিং সিলভারের সিংহাসন! তাতে কী অপূর্ব স্টার্লিং সিলভারের লক্ষ্মী। তার মাথায় সোনার মুকুট, কত সোনার গয়নাগাঁটি। আর রোজ নতুন নতুন ছোট্ট বেনারসি শাড়ি পরায় তাকে মা। ঠিক যেন মা’র পুতুল। আবার একটা কালো পাথরের শিবলিঙ্গ আছে। দেখলেই লজ্জা করে। এমন প্রকট নগ্ন ফ্যালিক সিম্বলকে যে কী করে একটা সভ্য জাতি সভ্য দেশ ওপেনলি পুজো করে? আবার তার নামও লিঙ্গ। যার নাকি মানেই হচ্ছে প্লেন অ্যান্ড সিম্পল মেল অরগান! আশ্চর্য বাবা! বাবা ক্রিশ্চান হলেও ঠিক ধার্মিক ক্রিশ্চান নয়। চার্চে যায় না। আমিও বোধহয় ক্রিশ্চান নই। ব্যাপটাইজড হইনি কোনওদিন।

    আমি কি হিন্দু? হিন্দুদের ব্যাপটিজম আছে কিনা জানি না, থাকলে সেও আমার হয়নি। তবে ছোট থেকে মা’র ঠাকুরঘরের বাসনগুলো নিয়ে খেলা করেছি। চার্চেও অবশ্য গেছি, মা’র সঙ্গেই। মা মিডমাইট মাস—এ যেতে খুব পছন্দ করে খ্রিসমাসের সময়। বাড়িতে খ্রিসমাস ট্রিও সাজায় মা। পুতুল দিয়ে নোটিভিটি—সিন তৈরি করে কী সুন্দর। মস্ত খ্রিসমাস পার্টিও দেয়। কত গিফট কেনে। দারুণ একটা খ্রিসমাস ডিনার রাঁধে। টার্কি, ক্র্যানবেরি সস, খ্রিসমাস পুডিং, এগনগ সবসুদ্ধ। অথচ মা তো হিন্দু। বাবা খ্রিশ্চান বলেই যে মা এতসব করে, তাও না। কেন না বাবা এসবের ধারও ধারে না। তবে গ্র্যাম্মা তো আসে খ্রিসমাসে, গ্র্যাম্মা খুব খুশি হয়। গ্র্যাম্মা খুব ধার্মিক খ্রিশ্চান। আমি সত্যি মায়ের ব্যাপারটা বুঝি না। কেন বড়দিন করে? আর বুঝি না, আমি নিজে কী। যখনই কোনও ফর্মে ভরতি করতে হয় ‘রিলিজিয়ান’, আমি লিখে দিই বাবার মতো ‘অ্যাগনস্টিক’। অথচ ‘অ্যাগনস্টিক’ শব্দটার দার্শনিক অর্থ আমি ঠিকমতো জানি না। মাঝে মাঝে মনে হয় হিন্দুধর্মটা মন্দ নয়, মাঝে মাঝে মনে হয় যিশুর মতো কেউ নেই, মাঝে মাঝে ভাবি দূর ছাই ল্যারিই ঠিক বলে ভগবান টগবান কিচ্ছু নেই। সবই মানুষের দুর্বলতা ঢাকবার জন্যে বানানো আশ্রয়। যে শক্ত স্বভাবের লোক হয়, তার ওসব ভগবান টগবান লাগে না। যেমন আমার বাবা। বাবা অবশ্য ভগবান আছে কি নেই—কিছুই বলে না। আমি প্রায়ই বাবাকে জিজ্ঞেস করতুম চোদ্দো—পনেরো বছর বয়েসে, ”আছে নাকি কোনও ভগবান?” প্রত্যেকবারই বাবা বলত—”থাকতেও পারে। আমি তো কই এখনও দেখিনি। তোমার মা মনে করে, আছে। আমি অবশ্য তার অস্তিত্বের গ্রহণযোগ্য প্রমাণই পাইনি। তবে অন্যের মতামতকে সহ্য করে চলা উচিত। তাই তুমি নিজেই বড় হয়ে বুদ্ধি দিয়ে যাচাই করে বুঝে নিয়ো ভগবান আছে কি নেই। এটা আমি তোমাকে বলে দিতে পারছি না।”—আর মাকে জিজ্ঞেস করলেই মা বলত—”বারে? ভগবান নেই? না থাকলে এতবড় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটা চালাচ্ছে কে? কে তোমার মাথায় এই প্রশ্নটা ঢোকাল? মনুষ্য—মগজ নামক এই অসামান্য কম্পিউটারটাই বা বানাল কে? ঘাসে ঘাসে ফুল ফোটায় কে? পাখিদের পথ চিনিয়ে আলাস্কা থেকে ফ্লোরিডা পাঠিয়ে দেয় কে? শীতের পর বসন্ত আনে কে? তোমার বাবার মতো স্বামী, তোমার মতো সন্তান আমাকে দিয়েছে কে? অবশ্যই ভগবান আছে—হিন্দু—মুসলমান—খ্রিশ্চান—ইহুদি যে ধর্মেই তাকে খোঁজো, ঠিক দেখতে পাবে। সব ধর্মে ভগবানের নাম আলাদা। তাকে ডাকার আইনকানুন আলাদা, কিন্তু ভগবানটি একই। ধরো না, জলের যেমন—ওয়াটার, দ্য লো, ভাসের, পানি, আকোয়া কত ভাষায় কত রকমের নাম—তেমনই এক এক ধর্মের এক এক ভাষায় ভগবানেরও নাম এক এক রকমের হয়। ভগবানটা কিন্তু একই। জল যেমন একই। বুঝলে তো?”—খুব বুঝতাম। বুঝতে অসুবিধে হত না। মা খুব ভালো এক্সপ্লেইন করতে পারে সবকিছু। মা যদি পড়াত, খুব ভালো মাস্টার হত। কিন্তু মা তো নিজের পড়াই শেষ করতে পারেনি। এখন অবশ্য সেটা শেষ করেছে। মার রিসার্চ কমপ্লিট—থিসিস রেডি হয়ে এসেছে। এই তো মা ইন্ডিয়াতে গেল কানপুরে একটা কনফারেন্সে পেপার দেবার জন্যে। তারপর দাদু—দিদার কাছে কলকাতায় যাবে, দাদু—দিদার গোল্ডেন ওয়েডিংয়ের পার্টির ব্যবস্থা করতে। কার্ড ছাপাবে, মেনু ঠিক করবে, নেমন্তন্ন করবে, কত কাজ। তারপর বাবা আর আমি যাব। মামা যাবে, মায়া আন্টি যাবে, পিউ, মউ, জয়—সব্বাই যাবে। দারুণ মজা হবে একত্রিশে জুলাই। ততদিনে কলকাতায় মনসুনও এসে যাবে, গরমটা কমবে। হোপফুলি! বাব্বাঃ! সোজা কথা নাকি গোল্ডেন ওয়েডিং? বিয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হওয়া? এ একমাত্র ইন্ডিয়াতেই সম্ভব। এদেশে কারুর গোল্ডেন ওয়েডিং হলে টেলিভিশনে তাদের ইন্টারভিউ নিয়ে নেবে। কীভাবে তোমরা একসঙ্গে মানিয়ে চালালে? পরস্পরের প্রতি কী কী আচরণ করতে? যত বোকা বোকা প্রশ্ন! দাদু—দিদাতে খুব ভালবাসা আছে সত্যি। আশা করি আমার বাবা—মা’রও গোল্ডেন ওয়েডিং হবে। পঁচিশ তো হতে চলল। অলরেডি তেইশ হয়েছে।

    জীবনে অত পুজোটুজো আছে বলেই বোধহয় ইন্ডিয়াতে ডিভোর্সের তেমন চল নেই। আমার মায়ের আত্মীয়দের মধ্যে তো একজনেরও ডিভোর্স হয়নি এখনও—ঈস। আমার বন্ধুদের বললে তারা কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না। বলে অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ বলে নিশ্চয় ডিভোর্স আন ল্য—ফুল, তাই ডিভোর্স নেই। যত বলি—ডিভোর্স ল্য ভারতবর্ষেই অনেক সহজ, সরল, মামা আমাকে বলেছে, অনেক বেশি প্রগতিশীল, তবুও ডিভোর্সের দরকার হয় না, তখন বলে—”ডিভোর্স হবে কেন? ব্রাইড—বারনিং হয়।” একটা যাচ্ছেতাই টিভি প্রোগ্রাম দেখিয়েছিল আমেরিকান টি.ভিতে ইন্ডিয়ার ব্রাইড—বারনিং বিষয়ে। মা তো সেটা দেখে খেপে উঠেছে। মা কেস করবেই ওই চ্যানেলটার নামে। মামাকে ফোন করে—ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশানের পক্ষ থেকে কেস করাবার জন্য চেষ্টা করল। কী কাণ্ডটাই মা যে করল! শেষ অবধি কেসটেস কিচ্ছুই হল না। বাবা আর মামা মিলে মাকে ঠান্ডা করল। ব্রাইড—বারনিং নিয়ে সেই টিভি শো—টা কিন্তু সত্যি সত্যি খুব ক্ষতি করেছে। ইন্ডিয়ার ইমেজটা নষ্ট করেছে এখানে। যদিও ইন্ডিয়া আমার দেশ নয়। তবু মা’র দেশ তো? একটু—আধটু গায়ে তো লাগেই আমারও। আমার বন্ধুদেরও দোষ নেই। টিভি ডকুমেন্টারিটা খুব পাওয়ারফুল ছিল। ওটা যে দেখেছে, যে যদি ইন্ডিয়াতে না গিয়ে থাকে, তা হলে ইন্ডিয়া সম্পর্কে তার ধারণা খারাপ হতে বাধ্য। আর ঘটনাগুলোও মিথ্যে নয়, সত্যি। এতত বিশাল দেশটা। আর কততই যে তার বৈচিত্র্য! সত্যি বাবা, ইন্ডিয়াতে যত অশান্তি, যত দারিদ্র, ততই দীর্ঘ ইতিহাস। ততই কালচারাল হেরিটেজ, অদ্ভুত একটা গোলমেলে জবড়জঙ্গ সভ্যতা, আমার ভয় করে। আমার এই ঝাড়াঝাপটা দুশো বছরের ইতিহাস, ক্যানেডিয়ান সভ্যতাই ভাল বাবা—প্রায় কিছুই নেই।

    না অশান্তি না দারিদ্র। না দীর্ঘ ইতিহাস, না সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য—আছে সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, তৃপ্তি, শান্তি আরাম। আমি এইই চাই। এই আমার ভাল বাবা! কানাডাতেও ইন্ডিয়ানগুলো এসে যত ঝামেলা বাঁধাচ্ছে। শিখেরা এখানে কী রায়টই না বাধাল গোল্ডেন টেম্পল দখলের সময়ে। টোরোন্টোতে পুলিশ হিমসিম খেয়ে গেছে। আবার দ্যাখো ইউনাইটেড স্টেটসে শিখেরা কী সব করছিল। রাজীব গান্ধীকেও নাকি মারবার ষড়যন্ত্র করছিল। তার মাকে তো মেরেই ফেলেছে। রাজীবের জন্য আমার দুঃখ হয়। অমন গ্ল্যামারাস মা—টা মারা গেল। খুন হল। রাজীবের অবশ্য আমার ডবল বয়েস। আমার মায়েরই সমবয়সি সে—তবুও! আমার ইন্দিরাকে দারুণ লাগে, এখানে এসে টিভি—তে ট্রুডোর সঙ্গে ফ্রেঞ্চে কথা বলল। বক্তৃতা দিল ফ্রেঞ্চে। আর কী এলিগ্যান্টলি ড্রেস করে। কী ইয়াং! আমার দিদার বয়সি কে বলবে? রাজীবের জন্যে আমার কষ্ট হয়। মাতৃহারা হল তো? আমার মা নেই, আমি আছি—এ আমি ভাবতেই পারি না। যদিও দু’বেলা ঝগড়া করছি মা’র সঙ্গে। মাতৃহারা হবার চেয়ে বড় দুঃখ নেই। দেখছি তো বিলকে!—বাবারা কখনওই মায়ের স্থান নিতে পারে না। বিল এত ভাল ছেলে, অথচ ওর কোনও আত্মবিশ্বাস নেই। মা ছিল না বলে ভেতরে ভেতরে ও শিকড়হীন, রুটলেস। ওকে দেখে আমি ভাবতাম কখনও কোনও মাতৃহীন ছেলের বউ হবে না। অথচ ল্যারির তো মা নেই। কিন্তু দিদিমা আছে, মা’র মতোই। ল্যারি তারই যত্নে এমন চমৎকার সুস্থ স্বাভাবিক ছেলে হয়েছে। বিলের দিদিমা ঠাকুমা কিছুই ছিল না। বাবার কাছে মানুষ। ইন্ডিয়াতে মায়েরা নাকি ছেলে—বউয়ের সংসার নষ্ট করে দেয়। পিউ মউ বলছিল ইন্ডিয়াতে বরেদের মা না থাকাই ভাল। কিন্তু এখানে তো করে না? এখানে মায়েরা বরং হেলপ করে। বেবি সিটিং—টিটিং করে দেয় তো দেখি। মাথায় আমার এই যে কালো লম্বা চুল, এর জন্যে আমি ইন্ডিয়ার কাছে কৃতজ্ঞ। ঠিক মায়ের মতো চুল হয়েছে আমার। মায়ের মতোই মুখটাও—অথচ চোখদুটো পেয়েছি ঠাকুরদার মতো, ঘন নীল। রংটাও হয়েছে ঠাকুরদার মতো—বাবার মতোও বলতে পারি। কিন্তু বাবার চোখ ব্রাউন, কপালগুণে আমার নীল চোখ, কালো চুলের কম্বিনেশনটা খুব স্ট্রাইকিং হয়েছে—সবাই মনে করে আমি বুঝি ডাকসাইটে সুন্দরী। আসলে ওটা ইলিউশান একটা। খুঁটিয়ে দেখলে আমি বিশ্বসুন্দরী নই, বেশ একটু বাঙালি বাঙালি ভাবও আছে। গতবার ইন্ডিয়াতে গিয়ে নাকফুটো করে একটা হিরের নাকছাবি পরে এসেছি—বাব্বাঃ, কী কাণ্ডই শুরু করে দিল স্কুলে সকলে মিলে। হোয়াট আ ফ্যাবুলাস নোজ—পিন, হোয়াট ফ্যাবুলাস ফেস।

    যেন মুখখানাও নতুন! মা’র নাকেও একটা হিরের নাকছাবি আছে। তাই এখন আমার মুখটা ভীষণ মা’র মতন দেখায় ওই নাকছাবিটা পরার পর থেকে। দেখতে আমাকে ভালই, কিন্তু আমার মাকে আমি আমার চেয়ে ঢের সুন্দরী বলে মনে করি। মার গায়ের রংটাই কী সুন্দর। হরিণের মতো রং। চোখদুটোও মা’র নাকি হরিণের মতোই। একদিন মায়া আন্টি বলেছিল, হরিণের মতো চোখ হওয়াটা আবার ইন্ডিয়াতে ক্লাসিকাল সৌন্দর্যের লক্ষণ। আমি তো বাবা হরিণে আর গোরুতে চোখের পার্থক্য দেখি না। আর গোরুর মতো নির্বোধ চোখ হওয়াটা মোটেই সৌন্দর্য বলে মনে হয় না আমার। মা’র চোখ তো বুদ্ধিদীপ্ত, ঝকঝকে—মা বাবা দুজনেরই তাই। আমারই বরং চোখটা একটু কম উজ্জ্বল, বেশি রোম্যান্টিক। তবে ল্যারির চোখদুটো আরও বেশি রোম্যান্টিক—আমার তো মনে হয়—ও কী? বাবা ডাকলেন না? হ্যাঁ। বাবাই তো। বাবা অত চিৎকার করে উঠলেন কেন?—”লালী। লালী ডার্লিং।” ব্রেকফাস্ট রেডি বলে? অত জোরে বাবাকে তো আমি কোনওদিন চেঁচাতে শুনিনি?

    ”—বাবা? কী হয়েছে তোমার বাবা? আমি চুলটা শুকোচ্ছি—ওপরে এক্ষুনি ধুলাম—অ্যাঁ;—কী?—কী বললে—; ওহ নো!! মাই গড—বাবা! কী বলছ তুমি?”

    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএকটি ইতিবাচক প্রেমকাহিনী – নবনীতা দেবসেন
    Next Article অ্যালবাট্রস – নবনীতা দেবসেন

    Related Articles

    নবনীতা দেবসেন

    মায়া রয়ে গেল – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    নবনীতা দেবসেনের গল্প

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    ভ্রমণ সমগ্র ১ – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.