Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    দেরি হয়ে গেছে – প্রচেত গুপ্ত

    প্রচেত গুপ্ত এক পাতা গল্প171 Mins Read0

    ০১. বাইরে চোখ পড়তে

    ০১.

    বাইরে চোখ পড়তে থমকে গেল যামিনী। সামান্য চমকেও উঠল। দেবনাথ রিকশা থেকে নামছে। রিকশা কেন! দেবনাথ তো চট করে রিকশায় ওঠে না। চিন্তিত যামিনী গ্রিলের ওপর ঝুঁকে স্বামীর মুখ দেখতে গেল। পারল না। দেবনাথের মুখ উলটো দিকে ফেরানো।

    যামিনীর চিন্তার কারণ আছে। কিছুদিন হল দেবনাথের বাঁ-হাতে একটা ব্যথা শুরু হয়েছে। কনুইয়ের ওপর থেকে মাঝেমধ্যে টানের মতো ধরে। বাজারের ভারী ব্যাগ ধরলে ব্যথা বাড়তে পারে এই ভেবে যামিনী রিকশার কথা বলেছিল। দেবনাথ হেসে উড়িয়ে দেয়।

    যামিনী বলল, হাসার কী হয়েছে! ভারী ব্যাগ নিয়ে এতটা পথ হেঁটে আসো তাই রিকশার কথা বললাম। হাতের ব্যথাটা বাড়তে পারে। রিকশা নিলে সময়ও কম লাগবে।

    দেবনাথ গম্ভীর গলায় বলল, সময় লাগার জন্যই তো হাঁটি যামিনী। আগে ঘোষবাগানের মধ্যে দিয়ে শর্টকাট করতাম, এখন সেটাও বন্ধ করে দিয়েছি।

    সকালবেলা হেঁটে শরীর ভালো করতে চাও তো ঝাড়া হাত পায়ে হাঁটো। কে বারণ করেছে? বাজার-ভরতি ব্যাগ নিয়ে হাঁটার দরকার কী? ব্যথা বাড়লে তো আমাকেই সেবা করতে হবে। রাগ দেখায় যামিনী।

    বাজারের ব্যাগ নিয়ে হাঁটারই দরকার আছে। ওই সময়টায় আমি বেগুন, আলু, ঝিঙে পটলের সঙ্গে গল্প করতে করতে আসি। ব্যাগের ভেতর থেকে ওরা আমার সঙ্গে কথা বলে।

    যামিনী দেবনাথের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

    তাই নাকি! কী বলে ওরা?

    দেবনাথ সহজ ভঙ্গিতে বলল, এমন কিছু নয়, হালকা- পলকা কথা সব। দেশের খবর, রাজনীতির খবর জানতে চায়। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে বলে সেদিন খুব দুশ্চিন্তা করছিল। বলল, স্যার, আপনাদের চারজনের সংসার, কীভাবে যে ম্যানেজ করেন! নেহাত ম্যাডাম স্কুলে পড়ান তাই চলছে। না হলে হালুয়া টাইট হয়ে যেত। সবার অবস্থাই তো দেখছি। আপনার মাইনেটাইনের অবস্থা তো মোটে ভালো নয়। সামনে কোনও প্রোমোশন আছে বলেও মনে হচ্ছে না। শুনেছি ইউনিয়নকে তেল মারতে পারেন না, প্রোমোশন হবে কী করে! যাক, ম্যাডামকে সাবধানে চলতে বলবেন। ওঁর আবার খরচাপাতির হাত বেশি। এরকম করলে চলবে না, টেনে চলতে হবে। ছেলেমেয়ে দুটো এখন ছোট বলে চলে যাচ্ছে, বড় হলে চাপ বাড়বে। দিনকাল ভালো নয়।

    যামিনী চোখ বড় করে, গলায় মেকি বিস্ময় ফুটিয়ে বলল, তোমার ঝিঙে-পটলরা তোমাকে জ্ঞানও দেয়? বাপরে! এ তো শিক্ষিত ঝিঙে পটল দেখছি!

    দেবনাথ গলায় আবেগ এনে বলল, জ্ঞান বলছ কেন যামিনী? অ্যাডভাইস বলো। বন্ধুকে বন্ধুর অ্যাডভাইস।

    যামিনী আর পারে না, হেসে ফেলে। বলল, থাক, তোমাকে রিকশা চাপতে হবে না, তুমি হেঁটেই এসো। আমার বলাটাই অন্যায় হয়েছে। তোমার ঝিঙে-পটল রাগ করবে।

    দেবনাথের রসিকতার স্বভাব যামিনী গোড়া থেকেই চিনেছে। বিয়ের সময় থেকেই। ফুলশয্যার রাতে এই লোক তাকে ফিসফিস করে বলেছিল, একটা গোপন কথা আছে। যদি কখনও ফাস না করে বলতে পারি। এই কথা আমি কাউকে বলিনি।

    সম্বন্ধ করে বিয়ে। মানুষটার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় মাত্র কয়েকদিনের। কথা হয়েছে মেরেকেটে পাঁচদিন। তা-ও তিনদিন টেলিফোনে, দুদিন মুখোমুখি। সেই মুখোমুখির আবার ভাগ ছিল। প্রথমদিন সঙ্গে বাড়ির লোক ছিল। ছেলের বউদি। দ্বিতীয়দিন দুজনে একা একা। ফলে চেনা হয়নি প্রায় কিছুই। তার ওপর ফুলশয্যা-রাতের আড়ষ্টতা। যামিনী কথা না বলে শুধু চোখ তুলেছিল। একটু ভয়ও পেয়েছিল। গোপন কথা আবার কী রে বাপু! অসুখবিসুখ আছে নাকি? মালবিকার এরকম হয়েছিল। ফুলশয্যার রাতে ছেলে দরজা বন্ধ করেই কান্নাকাটি শুরু করল– আমি পারি না, আমার অসুখ আছে। আমায় তুমি ক্ষমা করে দাও। এ-ও সেরকম নয় তো! পুরোনো প্রেম? গল্প-উপন্যাসে এরকম পড়েছে। এইসব সময় নতুন স্বামী দুম করে অন্য মেয়ের গল্প বলে বসে। প্রথম প্রেমে ব্যথা পাওয়ার গল্প। হাত চেপে ধরে যাত্রামার্কা থরথর গলায় বলে, তুমি কিন্তু একাজ করো না, তা হলে আমি মরে যাব সোনা।

    দেবনাথ সে সব কিছুই বলল না। স্মার্ট ভঙ্গিতে সরাসরি প্রশ্ন করল, আমি তোমাকে কেন বিয়ে করলাম জানো যামিনী?

    যামিনী চুপ করে রইল। একথার সে কী উত্তর দেবে? ফুলশয্যার পরীক্ষায় যাতে মোটামুটি পাস করতে পারে তার জন্য বন্ধুদের কাছ থেকে কিছু প্রশ্নের উত্তর শিখে এসেছে। থিওরিটিক্যাল, প্র্যাকটিকাল দুটোই। তাতে এই প্রশ্ন ছিল না। তবু লাজুক গলায় বলল, পছন্দ হয়েছে তাই।

    দেবনাথ ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল। হাতটা মাথার পিছনে রেখে বালিশে শুয়ে পড়ল ধপাস করে। তারপর সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে উদাসীন গলায় বলল, অনেকে ভাববে সুন্দরী এবং ভালো মেয়ে বলে তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। কথাটা ঠিক নয়। আমি একবারই মেয়ে। দেখতে গেছি, আর সেটা তোমাকেই। ফাস্ট অ্যান্ড ফাইনাল। তুমি যদি এটা শুনে খুশি হও, তা হলে বিরাট বোকামি করবে। কিছু মনে কোরো না, তোমার বদলে সেদিন যদি অন্য কাউকে দেখতে যেতাম, তা হলেও রাজি হয়ে যেতাম। আমার পক্ষে আর দেরি করা সম্ভব ছিল না। কারণ আমি বিয়ে করেছি বউয়ের জন্য নয়, ভূতের জন্য!

    এবার আর চুপ করে থাকতে পারল না যামিনী। বলল, ভূতের জন্য! মানে?

    দেবনাথ শোয়া অবস্থাতে বাঁ-পায়ের হাঁটুর ওপর ডান পা তুলে নাড়তে লাগল। বলল, আমার খুব ভূতের ভয় যামিনী। রাতে ঘুম ভাঙলেই খুটখাট আওয়াজ পাই। ছোটবেলায় ছিল না, বয়েস হওয়ার পর শুরু হয়েছে। মনে হয়, কে যেন পাশে এসে বসল! মাথার বালিশটা ঠিক করে গায়ের চাদরটা টেনে দিল! ঠান্ডা লাগলে ফ্যানের রেগুলেটর কমিয়ে দেয়। ওরে বাবা! প্রায়ই আমার ঘুমের দফারফা হয়ে যায়।

    যামিনী মজা পায়। ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি এনে বলল, কেন?

    দেবনাথ ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসে। কোলের ওপর বালিশ টেনে স্ত্রীর দিকে বড় চোখে তাকিয়ে চাপা গলায় বলে, কেন কী গো! ঘরে ভূত নিয়ে ঘুমোব? তুমি কি খেপেছ? বাকি রাত জেগে, চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকি। কথাটা কাউকে বলতেও পারি না। ধেড়ে লোক ভূতের ভয় পায় শুনলে সকলে হাসবে। ভাবতাম, ইস রাতে কেউ যদি আমার সঙ্গে শুত! এই জন্যই বিয়ে। আবার শুয়ে পড়ল দেবনাথ। হাসিমুখে বলল, তুমি এসে গেছ আর চিন্তা রইল না। এবার নিশ্চিন্তে, নাক ডেকে ঘুমোব। আমার কী মনে হয় জানো যামিনী? মনে হয়, আমার মতো অনেকেই আছে যারা স্রেফ ভূতের হাত থেকে বাঁচতে বিয়ে করে। লজ্জায় মুখ ফুটে বলে না।

    যামিনী মুখে হাত চাপা দিয়ে হেসে ফেলল। তার খুব ভালো লাগে। বিয়ের আগে অল্পস্বল্প কথা বলে বুঝেছিল, মানুষটা ভালো, কেয়ারিং। সম্ভবত এইরকম একজন পুরুষের জন্যই সে অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু মানুষটার মধ্যে যে উইট আছে সেটা বুঝতে পারেনি। এটা বাড়তি পাওনা হল। ছ্যাবলা হওয়া খারাপ, তা বলে গোটা জীবন একটা গোমড়ামুখো মানুষের সঙ্গে কাটানো আরও ভয়ঙ্কর।

    সেদিন রাতে আলো নেভানোর পর যামিনী যখন স্বামীর গা-ঘেঁষে আসে, দেবনাথ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করেছিল, কে? ভূত নাকি?

    যামিনী দেবনাথের কানের পাশে মুখ এনে বলল, না, পেত্নি!

    দেবনাথ স্ত্রীর দিকে ঘন হয়। বলে, পেত্নি এত জামাকাপড় পরে নাকি? খসখসে বেনারসি?

    যামিনী লজ্জা পায়। বলল, আমি জানি না।

    দেবনাথ হাত বাড়িয়ে যামিনীর ব্লাউজের বোতাম খুঁজতে খুঁজতে বলে, আমি জানি।

    পরদিন সকালে সবাই যখন যামিনীকে চেপে ধরেছিল, যামিনী মুচকি হেসে বলল, পরে বলব, সে একটা ভূতের গল্প।

    এই লোক যে বাজারের আলু-পটল নিয়ে রসিকতা করবে সে আর আশ্চর্য কী?

    যামিনী চায়ের জল বসিয়ে দিল। স্বামী হিসেবে যামিনীর কাছে দেবনাথের যে ছোটখাটো অল্প কয়েকটা চাহিদা আছে, তার মধ্যে একটা বাজার থেকে ফিরলেই চা দিতে হবে। গরম চা। তবে সেই চা সঙ্গে সঙ্গে খাবে না দেবনাথ। গরম চা সে খেতে পারে না। হাতে কাপটা ধরে খবরের কাগজ খুলে বসবে। সময় নিয়ে কাগজ পড়বে। চা ঠান্ডা হলে চুমুক দেবে। বিয়ের পর এই অদ্ভুত স্বভাব দেখে যামিনী অবাক হয়েছিল।

    এ আবার কী! খাবে না তো এত হুটোপুটি করো কেন? আমি অন্য সব ফেলে চা নিয়ে পড়ি।

    দেবনাথ বলছিল, খবরের কাগজ পড়ার সময় গরম কিছু হাতে না ধরলে মজা পাই না। তাই গরম কাপ নিয়ে বসি। তবে আজকাল কাগজগুলোতে গরম যেভাবে বাড়ছে তাতে আর চায়ের কাপে হবে বলে মনে হচ্ছে না। ডাইরেক্ট আগুন হাতে বসতে হবে। তুমি একটা কাঠকয়লা পুড়িয়ে রাখবে, আমি বাঁ-হাতের চেটোতে রেখে নেতা-মন্ত্রীর ভাষণ পড়ব আর উঃ আঃ করব। হা হা। প্রাণ খুলে হাসে দেবনাথ।

    যামিনী ঠোঁট বেঁকায়। মজা পেলেও বুঝতে দেয় না। গলায় বিরক্তি এনে বলে, থামো তো, সবসময় তোমার এই হ্যাঁ-হ্যাঁ হি-হি ভালো লাগে না।

    এখন দেবনাথ বাজার থেকে ফেরার আগেই মোটামুটি একটা হিসেব করে চায়ের জল বসিয়ে রাখে যামিনী। হিসেব কাছাকাছি ঠিকই হয়। এতদিনে আরও অভ্যেস হয়ে গেছে। আসলে গুছিয়ে বাজার করলেও, দেবনাথ কখনও রাস্তায় সময় নষ্ট করে না। কারও সঙ্গে দেখা হলে আড্ডায় দাঁড়িয়ে যাওয়ার স্বভাব তার নেই। দু-একটা কথা বলেই সরে পড়ে। শুধু বাজার নয়, কোথাও গেলেও বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করে। নেমন্তন্ন বাড়িতে পৌঁছেই খেয়ে নিতে চায়। ট্রেন-বাসের বাহানা তোলে।

    ভাই, শুনছি মেনু যেরকম লম্বা করেছ তাতে খেতে অনেকটা সময় লাগবে। লাস্ট ট্রেনটাও মিস হয়ে যাবে। তোমাদের মতো কলকাতাতে তো থাকি না। হয় মেনু কাটছাঁট করো, না হয় এখনই বসিয়ে দাও।

    বিয়ের পর পর পুরুষমানুষ বাড়ির ফেরার জন্য তাড়াহুড়ো করলে বন্ধুরা ঠাট্টা করে। সেই ঠাট্টার মধ্যে আদিরস থাকে। দেবনাথের বেলায় সেরকম কিছু হয়নি। পরিচিতরা সকলেই জানে মানুষটা এরকমই। হোমসিক, ঘরকুনো। খানিকটা যেন অলস টাইপের। যামিনী বুঝেছে, অলস বা ঘরকুনো নয়, তার স্বামীর কাছে বাড়িটাই সবথেকে স্বস্তির জায়গা। রোজ কলকাতা পর্যন্ত চাকরি করতে গিয়ে অনেকটা সময় যাতায়াতেই চলে যায়। এরপর আর বাইরেটা ভালো লাগে না। আর যদি ঘরকুনো হয় তাতেই বা ক্ষতি কী? উড়নচণ্ডী স্বামীর থেকে ঘরকুনো স্বামী ভালো। স্ত্রীর সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা বেশি হয়। তা ছাড়া যখন খুশি সংসারের পাঁচটা পরামর্শও করা যায়। এটা খুব দরকার। যারা স্বামীকে পায় না, তারা বোঝে কত দরকার। তার ওপর দেবনাথের মস্ত গুণ হল, এমনি যতই হাসিঠাট্টা করুক, কাজের সময় সিরিয়াস। কোনও একটা সিদ্ধান্ত নিতে হলে ভেবেচিন্তে নেয়, কিন্তু নেওয়ার পর কখনও দোনামোনা করে না। কনফিডেন্সের সঙ্গে কাজটা করে। বলে, একবার যখন ঠিক করে ফেলেছি, দ্যাট ইজ ফাইনাল। যদি ভুল হয় হবে। বাড়ির পুরুষমানুষ এরকম হলে সুবিধে। যামিনী ভরসা পায়।

    .

    স্কুলের স্টাফরুমে ঘর সংসার, ছেলেমেয়ে নিয়ে সবসময়েই আলোচনা চলছে। এতবছর পরেও দেবনাথের স্বভাব নিয়ে কথা ওঠে। হিস্ট্রির বিশাখা ভারি সুন্দর মেয়ে। নরম মন। যামিনীকে পছন্দ করে খুব। যামিনীদি, যামিনীদি করে। সে-ও দেবনাথকে নিয়ে মজা করে। বিশাখার চার বছর হল বিয়ে হয়েছে। প্রেম করে বিয়ে। হিন্দোল চমৎকার ছেলে। পছন্দ করার মতোই ছেলে। চাকরিটা ভালো, তবে বাইরে বাইরে ঘুরতে হয়। প্রথম প্রথম বিশাখার কোনও সমস্যা হয়নি। সব ঠিকঠাক ছিল। শ্বশুরবাড়িতে নানারকম জটিলতা দেখা দিল। এদিকে ছেলে বড় হচ্ছে। তার হাজারটা ঝামেলা। বিশাখাকে একা হাতে ঘর-বাইরে সব সামলাতে হয়। কাজের লোক দিয়ে পুরোটা হয় না, শ্বশুরশাশুড়ির সেবাযত্নের ওপর নিজে নজর না রাখলে তাদের মুখ হাঁড়ি হয়ে যায়। এমন অনেক সমস্যা আসে যেগুলোর ডিসিশন চট করে একা নেওয়া কঠিন। হিন্দোলের সঙ্গে পরামর্শের দরকার হয়। কিন্তু তাকে পাবে কোথায়? হিন্দোলকে বললে সে অবাক হয়।

    কেন! মোবাইলে পাবে। মোবাইল তো সবসময় খোলা।

    রেগে যায় বিশাখা। বলে, ঠিকই বলেছ। সুন্দর দেখতে একটা মোবাইল ফোনকে বিয়ে করলেই পারতে। দরকারে অদরকারে তোমার সঙ্গে কথা বলত, গানও শোনাত। আজকাল চমৎকার সব রিং টোন পাওয়া যায়।

    সেদিনই স্টাফরুমে বিশাখা বলল, যামিনীদি, আই ফিল জেলাস ফর ইউ। তোমার জন্য হিংসে হয়; একটা বর পেয়েছে বটে! বোতল-দৈত্যের মতো সারাক্ষণ গিন্নির সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছে, কী করতে হবে প্রিয়তমা? একবার শুধু হুকুম করো।

    কথাটা বলতে বলতে হাতজোড় করে দেখায় বিশাখা। সবাই হেসে ওঠে। যামিনী চোখ পাকিয়ে হেসে বলল, অ্যাই, নজর দিচ্ছিস কেন? আমি সুখে আছি সহ্য হচ্ছে না বুঝি?

    বিশাখা জিভ কেটে, হেসে বলল, ছি ছি নজর দেব কেন? চিরকাল তোমরা এরকম ভাবে থাক। যখন পৃথিবীর দাম্পত্য- ইতিহাস লেখা হবে তোমাদের নাম থাকবে সবার ওপরে।

    যামিনী হাসতে হাসতে বলল, তুই তো হিস্ট্রির ছাত্রী, তুই লেখ না!

    অঙ্কের আরতিদি বিষয়টা কোনওদিনই ভালো চোখে দেখে না। মহিলা টিপিক্যাল পুরোনো-দিনের দিদিমণি টাইপ। খিটখিটে স্বভাব থেকে যতটা না বেরোতে পারে, তার থেকে বেশি বেরোতে চায় না। ব্যক্তিগত জীবনও গোলমেলে। দুটো বিয়ে। প্রথমজন ডিভোর্স করে সরে গেছে। দ্বিতীয়জন বিয়ের সময় খুব আহা উঁহু করেছিল। এখন সে-ও নাকি পালাতে পারলে বাঁচে। সকাল হতে না হতে বেরিয়ে পড়ে, বাড়িতে ঢোকে গভীর রাতে। উপায় কী? কয়েকবছর হল, আরতিদির সন্দেহবাতিক অসুখ দেখা দিয়েছে। সবসময় সন্দেহ। বাড়িতে স্বামী থাকলে কাজের লোককে পর্যন্ত একা ছেড়ে বেরোতে চায় না। স্কুলে এসে তাকে নীচু গলায় মাঝেমধ্যে এসব বলেও। যামিনী শুনতে চায় না, তা-ও জোর করে।

    তুই জানিস না যামিনী, লোকটা খুব পাজি। মেয়েমানুষ দেখলেই উসখুস করে।

    যামিনী চোখ-মুখ কুঁচকে বলে, উফ আরতিদি, আবার শুরু করলে? পশুপতিদার নামে তুমি মিছিমিছি এ সব বল।

    মিছিমিছি! একদিন আমার সঙ্গে থাকলে বুঝতে পারতিস তোদের পশুপতিদা কত বড় দুশ্চরিত্র।

    যামিনী হাত তুলে বাধা দেয়। বলে, ঠিক আছে, তোমার কথাই মেনে নিলাম। এবার চুপ কর দেখি।

    আরতিদি চুপ করে না। বলে, সেদিন উমা ঘর মুছছিল। গায়ে কাপড়চোপড় ঠিক ছিল না। তোর পশুপতিদা দেখি মেয়েটার বুকের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি নিশ্চিত, আড়ালে ওই লোক উমার গায়ে হাত দেয়।

    কাজের লোক ছাড়িয়ে দিলেই হয়!

    আরতিদি ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে। বলে, লোক কম ছাড়িয়েছি? কোনও লাভ হয়নি। আমার বিশ্বাস পাশের বাড়ির বউটার সঙ্গেও ওর লটঘট আছে। বউটা কাপড় শুকোতে দেওয়ার সময় ওকে ছাদে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে দেখেছি। বউটা বদ। হাত তুলে বগল দেখায়!

    যামিনী চোখ-মুখ কুঁচকে বলে, উফ থামবে? এবার কিন্তু আমি উঠে যাব। আরতিদি থামে না। বলতেই থাকে। আমার বোনের সঙ্গেও চেষ্টা করে। হেসে হেসে কথা বলে। ঢলানি করে। যামিনী এবার হেসে ফেলল। বলল, শালির সঙ্গে হেসে কথা বলবে না তো কী করবে? কেঁদে কথা বলবে? এর সঙ্গে চরিত্রের কী সম্পর্ক আরতিদি!

    আরতিদি হাসে না, গম্ভীর গলায় বলল, সম্পর্ক আছে। বোনকে বলেছি, আমি না থাকলে বাড়িতে আসবি না।

    ক্লাসের ঘণ্টা বেজে যায়। যামিনী চক-ডাস্টার নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মাথা নামিয়ে বলে, তুমি এবার মাথার ডাক্তার দেখাও। নইলে প্রবলেম বাড়বে।

    সেই আরতিদি বিশাখার কথায় ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, অত আদিখ্যেতা ভালো নয়। এ আবার কী! পুরুষমানুষ সারাক্ষণ বউয়ের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে বসে থাকবে? ইস মাগো! অসহ্য।

    যামিনী বলল, সারাক্ষণ কোথায়? কাজকর্ম করে না বুঝি? অফিস যায় না? সকাল আটটা বাজতে না বাজতে সেই কলকাতায় ছোটে।

    আরতিদি বলে, ওই একই হল। বেটাছেলে সন্ধের পর একটু-আধটু বাইরে না থাকলে মানায় না। একটু তাস-পাশা, একটু মেয়েমানুষ, একটু নেশাভাঙ করবে তবেই না পুরুষ!

    বিশাখা মুখ টিপে হাসে। কিছু একটা বলতে চায়। যামিনী চোখের ইশারায় বারণ করে। পাগলকে সাঁকো নাড়ানোর মানে হয় না।

    তবে যে যা-ই বলুক, যামিনী খুশি। দেবনাথের সংসারের দায়দায়িত্ব যে খুব কিছু ভাগ করে নিয়েছে এমন নয়, সত্যি সে কিছুটা অলস প্রকৃতির। ছেলেমেয়ের পড়াশোনা থেকে শুরু করে ঘরদোর সামলানোর প্রায় পুরোটাই যামিনীর ম্যানেজমেন্ট। বাসন মাজা, কাপড় কাঁচার লোক আছে। গনাইয়ের মা করিতকর্মা মহিলা। আটটা বাজতে না বাজতে কাজ গুছিয়ে চলে যায়। তারপর রান্নার জন্য বিজলি আসে। বাড়িতে থাকলে দেবনাথের কাজ হল, চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টিভিতে খবর দেখা, ম্যাগাজিন উলটানো। সিডি চালিয়ে কখনও গান শোনে। চাপাচাপি করলে মেয়েকে অঙ্ক দেখিয়ে দেয়। মেয়েটা অঙ্কে কাঁচা। তবে বাবার নেওটা। বাবা বাবা করে। হাতের কাছে পাওয়ার কারণে মানুষটাকে দিয়ে যে সবসময় বিরাট কোনও কাজের কাজ হয় এমন নয়। কিন্তু তার উপস্থিতিটাই এই বাড়ির পক্ষে স্বস্তিদায়ক। অভ্যেস হয়ে গেছে।

    .

    জানলার দিকে এক পা এগিয়ে গেল যামিনী। দেবনাথ রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিচ্ছে। মুখটা এবার দেখা যাচ্ছে। শরীর খারাপের কিছু নেই, বরং মুখ হাসি-হাসি। যামিনী নিশ্চিন্ত হল, আবার অবাকও হল। সাতসকালে রিকশাওলার সঙ্গে হাসাহাসি কীসের! এই লোক কি না হেসে পারে না! জানলা থেকে ফিরে রাগ-রাগ মুখে চায়ের কাপে মন দিল যামিনী।

    ভাড়া বাড়িতে রান্নাঘর মাপে ছোট হয়। অনেক সময় একেবারে এক চিলতে। বাতাস চলাচলের ব্যাপার থাকে না। দিনেরবেলাতেও অন্ধকার। সবসময় মনে হয়, বাইরে মেঘ করেছে, এখনই শুকোতে দেওয়া জামাকাপড় তুলতে হবে। সেই তুলনায় এই জানলা যথেষ্ট বড়। যামিনীর পছন্দের। পছন্দ জানলার মাপের জন্য নয়, পছন্দ জানলা থেকে বাড়ির গেট পর্যন্ত দেখা যায় সেই কারণে। রান্নাঘরে কাজ করতে করতে বাড়িতে কে আসছে যাচ্ছে জানা যায়। এটা একটা অ্যাডভান্টেজ। ছেলেমেয়ে দুজনেই স্কুলে পড়ে। স্কুলে পড়ে মানে অবশ্য একেবারে ছোটও নয়। নীলাদ্রি এ বছর হায়ার সেকেন্ডারি দেবে। কিঙ্কিনির ক্লাস সেভেন শেষ হতে চলল। দুজনের কারওরই আতুপুতুর বয়স নেই। তবু তারা বাড়ি থেকে বেরোলে চিন্তা হয়। আগে এতটা ছিল না। তখন ছেলেমেয়েরা সত্যি-সত্যি বেশ ছোট ছিল। গুট-গুট করে বাড়ির কাছে স্কুলে যেত। রিকশাতে ষোলো-সতেরো মিনিটের পথ। রেলগেটে আটকে পড়লে আরও খানিকটা বাড়তি সময় লাগত। তবে সে তো আর রোজ নয়, যেদিন লেট হত সেদিন। আসলে শহরটাই ছোট। একপাশে রেলস্টেশন, অন্যপাশে হাইওয়ে। তার ওপর এখানে দেখতে দেখতে অনেকটা দিন থাকা হয়ে গেল। কিঙ্কিনির যখন দু-বছর বয়েস তখন এসেছিল। এতদিনে কম বেশি প্রায় সকলেই মুখ চেনা হয়ে গেছে। আর পাঁচটা ছোট মফসল শহরের চেহারা যেমন হয়। শহর বাড়ছে। দোকান বাজার, ফ্ল্যাটবাড়ি, সাইবার কাফে হয়েছে। যামিনীর ছেলেমেয়ে দুজনেই এখন দূরের স্কুলে যায়। ছেলে যায় ট্রেনে। চারটে স্টেশন পেরোতে হয়। মেয়েও তিন বছর হয়ে গেল হাইওয়ের ধারে নতুন স্কুলে গেছে। স্কুলের বাস আছে। বাস অবশ্য বাড়ির সামনে পর্যন্ত আসে না। গলি থেকে বেরিয়ে মিনিট দশ হাঁটতে হয়। ব্যবস্থা সব ঠিকঠাক হলেও ছেলেমেয়েদের নিয়ে যামিনীর উদ্‌বেগ কমে না। চাকরি করতে গিয়েও চিন্তা করে। রাতে শোয়ার সময় দেবনাথকে বলে, বাচ্চাদের নিয়ে আমার টেনশন হয়। অতটা সময় স্কুলে থাকি। ওরাও বাইরে। তোমার তো কোনও খেয়াল নেই। আজ কী শুনলাম জান?

    কী শুনলে?

    বাসবীদির মেয়ের একটা বিচ্ছিরি কাণ্ড হয়েছে।

    বাসবীদিটা কে? দেবনাথ অবাক হয়ে বলল।

    আমার কলিগ, সায়েন্সের টিচার।

    কাণ্ডটা কী হয়েছে?

    ট্রেনে একটা ছেলে চিঠি দিয়েছে। হাতে গুঁজে দিয়ে পালিয়েছে। আতঙ্কিত গলায় বলল যামিনী।

    দেবনাথ আওয়াজ করে হেসে উঠল। যামিনী রেগে গিয়ে বলল, হাসছ! হাসছ কেন?

    দেবনাথ হাসতে হাসতে বলল, হাসব না! একটা মেয়েকে একটা ছেলে চিঠি দেবে না তো কাকে দেবে? আমরাও দিয়েছি। মনে আছে নুপুর বলে একটা মেয়েকে চিঠি দিয়েছিলাম।

    চুপ কর। একটা ক্লাস এইটে পড়া মেয়েকে প্রেমপত্র দেবে! ছি ছি।

    দেবনাথ স্ত্রীর দিকে ফিরে বলল, শুনে বেশ ভালোই লাগছে যামিনী। আজকাল এসব হাতে লেখা চিঠি এখনও আছে তা হলে, আমি তো জানতাম উঠেই গেছে! মফস্সল বলে। চলছে। কলকাতা হলে এস এম এস আর চ্যাট হত। এখানেও কদিন পরে আর থাকবে না।

    যামিনী ঝাঁঝিয়ে ওঠে, থামো তো। আমার নীল আর কিঙ্কিকে নিয়ে ভয় করছে আর উনি চিঠির ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে গবেষণা করছেন!

    দেবনাথ স্ত্রীর গায়ে হাত দিয়ে বলল, আরে বাবা, ওরা তো বড় হচ্ছে, সব সময় চোখ। পেতে রাখলে হবে? এবার একটু নিজের মতো থাকতে দাও, ওদের শিখতে হবে না?

    যামিনী বিরক্ত গলায় বলে, কী বলছ যা-তা? নিজের মতো থাকবে কথাটার মানে কী? এই বয়সটাই গোলমেলে। ছেলেমেয়ে দুজনের জন্য আলাদা-আলাদা করে গোলমেলে। বাইরে হাজারটা হাতছানি। এখনই তো বাবা-মায়ের বেশি করে নজর রাখার সময়। আজ বাদে কাল ছেলের ফাইনাল পরীক্ষা, একবার মন অন্যদিকে চলে গেলে কী হয় জান না? ফুলদির ননদের ছেলেটার কী হল? রাত করে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে, পরে জানা গেল নেশা করে।

    দেবনাথ বিদ্রুপের গলায় বলল, তুমি দেখছি চিড়ে-মুড়ি সব এক করে ফেললে যামিনী। মনে রাখবে চিড়ে ইজ চিঁড়ে, মুড়ি ইজ মুড়ি। তোমার দিদির হাজব্যান্ডটি কেমন সেটা তো দেখবে। সারাদিন ব্যবসা আর সন্ধের পর পার্টি। মধ্যরাতে মদ্যপান করে বাড়ি ফেরা। বাবাকে দেখে ছেলেও বখে যাচ্ছে। আমাদের নীলকে নিয়ে ওসব চিন্তা কোরো না। তার বাবার লাইফ স্টাইলে কোনও ইনিডিসিপ্লিন নেই। অফিসের পর হাওড়ায় গিয়ে ছটা দশের গাড়ি ধরে কাটায় কাটায় আটটা চল্লিশে ইন। নটার মধ্যে বাড়ির ডোরবেলে আওয়াজ। টিং টং, টিং টং। আওয়াজ পাও কিনা?

    কথাটা সত্যি। স্বামীকে নিয়ে চিন্তা নেই যামিনীর। বিয়ের পর থেকেই নেই। ঝড়বৃষ্টি, ট্রেনের সমস্যা বা কলকাতায় ঝামেলা কিছু না হলে দেবনাথের বাড়ি ফেরা ঘড়ি ধরে। সেরকম কিছু হলে খবর দেয়।

    দেবনাথ এবার গাঢ় গলায় বলল, ছেলেমেয়ে নিয়ে অকারণে চিন্তা করলে মুখে ছাপ পড়বে, দেখতে বিচ্ছিরি হয়ে যাবে।

    যামিনী রাগী গলায় বলল, বুড়ো বয়েসে আদিখ্যেতা কোরো না তো।

    দেবনাথ ভুরু কুঁচকে বলল, কী আদিখ্যেতা করলাম?

    যামিনী সরে গিয়ে বলল, জানি না।

    দেবনাথ দু-হাতে স্ত্রীকে জড়িয়ে টানতে যায়। ফিসফিস করে বলল, জানি না বললে ছাড়ব কেন?

    যামিনী বলল, অ্যাই ছাড়ো, ছেলেমেয়ে জেগে আছে। আওয়াজ পাবে।

    ঠিক আছে, আওয়াজ হবে না। সাইলেন্ট মুভি।

    যামিনী স্বামীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে করতে বলল, বুড়ো বয়েসে শখ গেল না। অসভ্য! তাড়াতাড়ি করো।

    দেবনাথ দ্রুত হাতে যামিনীর নাইটি খুলতে খুলতে বলল, শখ যাবে কী করে? বউ এরকম সুন্দরী থাকলে মরার সময়েও শখ যাবে না।

    কথাটা মিথ্যে নয়। দুই সন্তানের মা হলেও যামিনীর শরীর এখনও নষ্ট হয়নি। হিসেব মতো এতদিনে একটা ছাড়া-ছাড়া ভাব এসে যাওয়ার কথা। যামিনীর বেলায় এখনও আঁটোসাঁটো রয়েছে। পেটে মেদ জমেনি। বুকদুটো আজও অল্পবয়সিদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। এই বয়েসে গায়ের চামড়া ঠিক রাখাটা বিরাট সমস্যা। ঘরে-বাইরে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। যামিনীর হাতে-পায়ে বা নাকের পাশে কোথাও চামড়া এতটুকু কোঁচকায়নি। রাতে মেয়ের কাছে শোয় যামিনী। ছেলেমেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে সপ্তাহে দু-তিনদিন দেবনাথের কাছে আসে। মুখে বিরক্তি দেখালেও আসতে ভালো লাগে। এই দিনগুলোর জন্য মনে মনে অপেক্ষা করে। মাঝেমাঝে। যামিনী অবাকও হয়। এই বয়েসে স্বামীর আদর এত কেন ভালো লাগবে! শরীরের কারণে? নাকি ভালোবাসা?

    বাজারের ব্যাগ রান্নাঘরে নামিয়ে দেবনাথ বলল, ঝটপট চা দাও। তখনও তার মুখে হাসি হাসি ভাব। যামিনী আড়চোখে তাকিয়ে বলল, রিকশা করে এলে যে? ব্যথা বেড়েছে?

    আরে না না, আজ একটা মজার কাণ্ড হয়েছে।

    যামিনী চুপ করে রইল। দেবনাথের মজার গল্প শোনার মতো সময় তার নেই। মেয়ে। স্কুলে চলে গেছে। ছেলে এখনই বেরোবে। আজ তার কেমিস্ট্রি না ফিজিক্স প্র্যাকটিকাল। নীল বলে ল্যাব আছে। তাকেও কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সময় স্কুলে ছুটতে হবে। আজ থেকে স্কুলে হাফইয়ারলি শুরু। টানা সাতদিনের ঝামেলা। কামাই চলবে না। এদিকে কিঙ্কিনির পরীক্ষা শুরু হবে পরের সপ্তাহ থেকে। পরীক্ষার আগের কটাদিন মেয়েটার পাশে না বসলে হয় না। ঘ্যানঘ্যান করে।

    চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দেবনাথ বলল, মজার কথাটা শুনবে?

    না, শুনব না, তোমার মজা শোনার সময় নেই। তুমি এই উইকটা ছুটি নাও। কিঙ্কির পরীক্ষা। আমি কামাই করতে পারব না।

    দেবনাথ বলল, আচ্ছা সে দেখা যাবে। ঘটনাটা শোনো তো আগে।

    যামিনী না শুনতে চাইলেও দেবনাথ রসিয়ে ঘটনা বলতে শুরু করল–

    আমি বাজারে যাচ্ছি, দেখি মলয়বাবু হন্তদন্ত হয়ে আসছেন। একেবারে মুখোমুখি পড়ে গেলাম। ভাবলাম, এই রে, মলয়বাবু মানেই সময় নষ্ট। বুড়োমানুষ একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একশোবার বলবে। পালাতেও পারব না। পুরোনো বাড়িওলা বলে কথা। প্রথম যখন এখানে আসি, কিছু চিনি না, আমাকেও কেউ চেনে না, কেউ চট করে ভাড়া দিতে চায় না, তখন ঘর দিয়ে মানুষটা উপকার করেছিল। সেই মানুষকে পাশ কাটিয়ে যাই কী করে? বুঝলাম, আজ বিপদ কেউ ঠেকাতে পারবে না। মলয়বাবু টানতে টানতে চায়ের দোকানে ঢোকাবেন। আগেও উনি এই কাজ করেছেন। গাদাখানেক সময় নিয়ে তবে ছেড়েছেন। আশ্চর্যের কথা কী জানো যামিনী, ভদ্রলোক আজ সেরকম কিছুই করলেন না। আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। বেচারা ধরনের হাসি। বললেন, আজ চলি কেমন? দেরি হয়ে গেছে। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে মনে বললাম, বেশ হয়েছে। তোমার দেরি না হলে আজ আমার ঝামেলা হত। তারপর মন দিয়ে বাজার করলাম। ভালো ইলিশ এসেছে। মাঝারি দেখে একটা নিয়েছি। মিলিয়ে বেগুন নিয়েছি, কুমড়ো নিয়েছি। বহুদিন কুমড়ো, বেগুন দিয়ে ইলিশমাছের হালকা ঝোল খাওয়া হয় না।

    .

    দেবনাথ বেশি খেতে পারে না, কিন্তু খাদ্যরসিক। তার থেকে বলা ভালো বাজার এক্সপার্ট। মিলিয়ে মিলিয়ে বাজার করতে ওস্তাদ। মোচা কিনলে নারকেল, ছোলা কেনে। লাউ নিলে সঙ্গে ধনেপাতা আনতে ভোলে না। ছুটির দিন খেতে বসে ছেলেমেয়েকেও বলে, আচ্ছা, নীল বল তো, কই মাছের সঙ্গে কোন আনাজ ভালো যায়?

    নীলাদ্রি মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকায়। সেই তাকানোয় একইসঙ্গে বিরক্তি এবং বিস্ময়। তারপর মাথা নামিয়ে আবার খাওয়ায় মন দেয়।

    যামিনী বলে, আহা, ও এসব জানবে কী করে?

    দেবনাথ ভাত মাখতে মাখতে বলে, শিখবে। শুধু লেখাপড়া শিখলেই তো হবে না খাওয়া দাওয়াও শিখতে হবে। আমি বুড়ো হলে কী হবে? বাজার করবে কে? সেইজন্যই তো ইজি দিয়ে শুরু করেছি। আচ্ছা কিঙ্কি, এবার তুমি বল, লাউয়ের ঘন্টে কোন মাছ দিলে মুখে জল আসে? এটা কিন্তু তোমার পারা উচিত। ভেরি ইজি।

    কিঙ্কিনি মুখ না তুলে বলে, বাবা, তুমি ঠাকুমার কাছে রান্না শিখেছ না?

    দেবনাথ হো হো আওয়াজে হেসে ওঠে। বলে, দুর, রান্নার আমি কী জানি? আমাকে। কখনও রান্নাঘরে ঢুকতে দেখেছিস? এসব নিজে নিজেই শিখতে হয়। তোরাও শিখবি। এই ধর না তোর মা, রান্নার কিস্যু জানত না। এখন কত কী পারে। কেন পারে জানিস? আমরা কী খেতে ভালোবাসি সেটা বুঝে গেছে। রান্নাটা বড় কথা নয়, নিজের লোক কী ভালোবাসে এটা জানাই বড় কথা। জানলে রান্নাও আসে ভালো হবে।

    যামিনী বলে, উফ তুমি লেকচার থামাবে? খেতে বসে বকবক!

    ছেলেমেয়ে বাবার এই স্বভাব পছন্দ করে না। মায়ের কাছে বিরক্তি দেখায়। নীলাদ্রি বলে, যতসব ব্যাকডেটেড ব্যাপার। খাওয়া নিয়ে বাবার এসব বাড়াবাড়ির কোনও মানে হয় না। পেট ভরাতে একটা কিছু খেয়ে নিলেই হল।

    কিঙ্কিনি বলে, আমি পেট ভরাতেও চাই না। ভাত খেতেই আমার জঘন্য লাগে। মাছ তো হরিবল। ইস মাছ খাওয়া কে যে আবিষ্কার করল। আমি দুপুরে শুধু স্যান্ডুইচ খেতে চাই। যামিনী শাসন করে। বলে, ছিঃ, বাবার সামনে এসব বোলো না। দুঃখ পাবে। আমাদের সকলের জন্য মানুষটা কত যত্নে বাজার করে, সেটা তো দেখবে।

    নীলাদ্রি মুখ ঘুরিয়ে বলল, মায়ের সবসময় বাবাকে সাপোর্ট।

    কিঙ্কিনি মাথার চুল ঝাঁকিয়ে বলল, ঠিক বলেছিস। আমাদের ফ্যামিলিতে দুটো দল। বাবা-মা একদিকে, আমরা দুজন অন্যদিকে।

    যামিনী হেসে ফেলে। বলে, থাক, অনেক পাকা পাকা কথা হয়েছে। এবার কাজে যাও।

    .

    ইলিশ, বেগুনের ফিরিস্তি শোনার পর যামিনী রাগী গলায় বলল, এই তোমার মজার কথা!

    দেবনাথ চায়ের কাপে চুমুক দিল। বলল না, এটা মজার কথা নয়। মজার কথা অন্য। বাজার সেরে বাড়ির পথে পা বাড়াতেই হঠাৎ খেয়াল হল, আরে, মলয়বাবুর কথাটা মাথায় ঢুকে গেছে! ঢুকে ঘুরপাক খাচ্ছে। দেরি হয়ে গেছে, দেরি হয়ে গেছে, দেরি হয়ে গেছে…। বোঝে কাণ্ড! একটা অতি সাধারণ কথা, দিনের মধ্যে চোদ্দোবার বলি, আজ হঠাৎ খচ করে মাথায় ঢুকে যাবে কেন! আমি অন্য কথা ভাবতে শুরু করলাম। বাজারে কেমন ঠকলাম, মেয়েটার অঙ্কের জন্য একজন ভালো টিউটর দিলে কেমন হয়, ছেলেটাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে কত টাকা লাগবে? ব্যাঙ্ক লোন পাব? এখন থেকেই খোঁজখবর নেওয়া দরকার। ঠিক করলাম, কোন্নগরে দাদার কাছে দু-একদিনের মধ্যেই যাব, এক মাসেই বাড়ি বিক্রির ব্যাপারটা ফাইনাল করব। টাকা পেলেই ফ্ল্যাট কিনব। ভাড়া বাড়ি থেকে বিদায় নেব। কিন্তু তাতেও দেখলাম লাভ হল না। মলয়বাবুর দেরি হয়ে গেছের ভূত ঘাড় থেকে নামছে না। শুধু তা-ই নয় যামিনী, একটু পরে দেখি, আমার নিজেরও একইরকম মনে হতে শুরু করেছে! দেরি হয়ে গেছে। কীসের দেরি, কেন দেরি কিছু বুঝতে পারছি না, কিন্তু মনে হচ্ছে দেরি হয়ে গেছে! তাড়াতাড়ি একটা রিকশা ডেকে উঠে বসলাম। তারপর থেকেই হাসছি। ঘটনা মজার না?

    কথার উত্তর না দিয়ে যামিনী রান্নাঘরে ছুটল। এখন প্রতিটা মুহূর্তই জরুরি। ঘড়ির কাটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দৌড়োতে হবে। একটু এদিক-ওদিক হলেই কেলেঙ্কারি। সংসার নিখুঁত ভাবে চালানো সোজা কথা নয়।

    সারাদিন সবকিছু নিখুঁত ভাবেই চলল। নীলাদ্রি, কিঙ্কিনি স্কুল শেষ করে, কোচিং থেকে পড়ে বাড়ি ফিরল সন্ধের মুখে। যামিনী জলখাবার বানিয়ে দিল। মেয়েকে জিওগ্রাফির ম্যাপ দেখিয়ে দিল। সাউথ আফ্রিকার নদ-নদী। টিভিতে সিরিয়াল দেখল। কোন্ননগরে জা-কে ফোন করল। ভাশুরের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। প্রেশারের সমস্যা। বিজলি সকালেই সব বেঁধে গেছে। তবু যামিনী রান্নাঘরে গেল। সামান্য রান্না করল। একেবারেই সামান্য। বেসন মাখিয়ে কটা আলু ভাজল। দেবনাথ পছন্দ করে। মেয়েটাও চায়। কিঙ্কিনি বাবার মতো হয়েছে।

    সবই ঠিকঠাক চলল, শুধু দেবনাথ অফিস থেকে বাড়ি ফিরল না। যামিনী, নীলাদ্রি, কিঙ্কিনি অপেক্ষা করে রইল। একদিন, দুদিন, তিনদিন…। দেবনাথ বাড়ি ফিরল না।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপঞ্চাশটি গল্প – প্রচেত গুপ্ত
    Next Article দশটি রহস্য উপন্যাস – প্রণব রায়

    Related Articles

    প্রচেত গুপ্ত

    পঞ্চাশটি গল্প – প্রচেত গুপ্ত

    September 18, 2025
    প্রচেত গুপ্ত

    ধুলোবালির জীবন – প্রচেত গুপ্ত

    September 18, 2025
    প্রচেত গুপ্ত

    রুপোর খাঁচা – প্রচেত গুপ্ত

    September 18, 2025
    প্রচেত গুপ্ত

    মাটির দেওয়াল – প্রচেত গুপ্ত

    September 18, 2025
    প্রচেত গুপ্ত

    নুড়ি পাথরের দিনগুলি – প্রচেত গুপ্ত

    September 18, 2025
    প্রচেত গুপ্ত

    নিষাদ – প্রচেত গুপ্ত

    September 18, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }