Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প171 Mins Read0

    ১. নমস্কার, আমি রাজীব

    নিজেই নায়ক – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    ০১.

    নমস্কার, আমি রাজীব–রাজীব সরকার। আপনারা আমাকে চেনেন না, দ্যাখেননি। আমার নামটা আগে কখনও শুনেছেন কি? আপনাদের চোখ-মুখের কুঞ্চন দেখে টের পাওয়া যাচ্ছে–শোনেননি।

    আমি তো জনগনের নেতা অর্থাৎ লিডার-টিডার নই যে আমার নামে দেয়ালে দেয়ালে জাতির মুক্তিসূর্য রাজীব সরকার–যুগ যুগ জীও লেখা থাকবে। আমি আট দশ কি পনেরো লাখ টাকা দামের ফিল্মস্টারও নই বা গ্ল্যামারওলা একজন ক্রিকেট খেলোয়াড়, অথবা আন্তর্জাতিক চোরা চালানদার। এ সব হতে পারলে খবরের কাগজে আর রঙিন পস ম্যাগাজিনগুলোতে অনবরত ছবি বেরুত। আর ছবি যখন বেরোয় না এবং কেউ যখন রাজীব সরকার জিন্দাবাদ বলে চেঁচিয়ে আকাশ ফাটায় না তখন আমার নামটা আপনাদের শোনবার কোনও কারণই নেই।

    লিডার স্মাগলার চিত্রতারকা–এ সবের কিছুই যদি না হই তা হলে আমি কী? আমি যে ঠিক কী, নিজের মুখে আর বলতে চাই না। আমার নানারকম কীর্তিকলাপ দেখে আপনাদের তা বুঝে নিতে হবে।

    জানেন, কিছুদিন আগে আমার একবার দারুণ ইচ্ছা হয়েছিল সব গ্রেট ম্যানের মতো নিজের একখানা অটোবায়োগ্রাফি, মানে জীবন-চরিত লিখে ফেলি। শুনে আমার বিজনেস পার্টনার মেরী লতিকা বিশ্বাস বলেছে, তুমি কে হে যে লোকে তোমার বায়োগ্রাফি পড়বে! পিপলের সঙ্গে ইয়ার্কি দিতে যেও না, তার রেজাল্ট বিপজ্জনক। লতিকা বিশ্বাস কে, আমার কি জাতীয় বিজনেসের সে পার্টনার, এসব পরে বলছি, কিন্তু তার কথা শুনবার পর আমি রীতিমতো চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম এবং জীবন-চরিত লেখার বাসনাটাকে আপাতত স্থগিতও রেখেছি।

    লতিকার মতো আপনারাও হয়তো বলতে পারেন, তোমার সম্বন্ধে আমাদের কোনও ইন্টারেস্ট নেই। তবু পিপলকে মানে আপনাদের কাছে সবিনয়ে নিবেদন, এক কথায় আমাকে নাকচ করে দেবেন না। আপনারা আমার সঙ্গে সঙ্গে পা ফেলতে থাকুন; দেখবেন এক সময় সামনে অনেকগুলো অচেনা দরজা খুলে গেছে আর আমি আপনাদের এক দারুণ রহস্যময় ওয়ার্ল্ডে পৌঁছে দিয়েছি।

    আমার নামটা ইতিমধ্যেই আপনারা জেনে গেছেন। আপনাদের সুবিধার্থে নিজের সম্বন্ধে আরো দু-একটা ছোটখাটো খবর দিয়ে রাখছি।

    আমার বয়স ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ। যা বয়স, আমাকে ঠিক তা-ই দেখায়। আমার হাইট পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি; বাঙালিদের পক্ষে এই উচ্চতা খারাপ নয়। ঈষৎ কোঁচকানো চুল নিখুঁতভাবে ব্যাকব্রাশ করা; দাড়ি চমৎকার কামানো। গায়ের রঙ কালো আর ফর্সার মাঝামাঝি; অর্থাৎ বাদামি। চামড়া টান-টান মসৃণ; তাতে পালিশ করা চকচকে ভাব আছে। আমার কপাল বেশ চওড়া, চোখ মাঝারি, মুখ লম্বাটে, ভারী ঠোঁট, নাকটা মোটার দিকে। আমি কিঞ্চিৎ মদ্যপান করে থাকি; সেই সঙ্গে নিয়ম করে ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ। সেহেতু আমার চোখের তলায়, থুতনিতে বা পেটে অ্যালকোহল কোনও পলি জমাতে পারেনি। আমার বুকের মাপ প্রায় চল্লিশ ইঞ্চি, সরু কোমর, মাংসল শক্ত পায়ের গোছ। খুব সুন্দর না হলেও আপনারা আমাকে একজন বলিষ্ঠ এবং আকর্ষণীয় পুরুষমানুষ বলতে পারেন।

    পোশাক-টোশাকের ব্যাপারে আমি খুব শৌখিন নই। তবু কাজকর্ম বা প্রফেসান–যাই বলুন, তার খাতিরে আমাকে সর্বক্ষণ ফিটফাট থাকতে হয়। আমি দামি ইজিপসিয়ান কটনের শার্ট বা ট্রাউজার পরে থাকি, নতুবা স্মাগল-করা টেরিকটের পোশাক। যে আমেরিকান আর ফ্রেঞ্চ পারফিউম ব্যবহার করি তার গন্ধ আমাকে ঘিরে একশো গজ রেডিয়াসের বাতাসে ভুর ভুর করতে থাকে। কিন্তু এটা আমার বাইরের দিক। আমার একটা ভেতরের দিকও আছে। যাকে ইনার সেল্ফ বলে, তার কথাই বলছি। এই ইনার সেলফ ব্যাপারটা সব মানুষেরই থাকে। সে যা-ই হোক, বাইরের বা ভেতরের কোনও দিক সম্বন্ধেই আমি আর কিছু বলব না। আমার ভূমিকা এখানেই শেষ। এবার জনগণ, অর্থাৎ আপনারা আমার সঙ্গে সঙ্গে পা ফেলবেন কিনা সেটা আপনাদের বিবেচনার বিষয়। এ নিয়ে আপনারা ভাবতে থাকুন; আমি নিজের কাজ করে যাই।

    এই মুহূর্তে ট্যাক্সি থেকে নেমে থিয়েটার রোডের একটা একুশতলা স্কাই-স্ক্রেপারের সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার ডান হাতে এটা দামি ব্রিফ কেস। এখন প্রায় দুটো বাজে। ফেব্রুয়ারি মাসের আজ বাইশ তারিখ। অর্থাৎ শীত শেষ হয়ে সময়টা গরমের দিকে গড়াচ্ছে। গড়াচ্ছেই শুধু, গরমটা পুরোপুরি পড়েনি। শীতের ম্যাড়মেড়ে রোদ এখন অনেক ঝলমলে; তবে তাতে ধার নেই। দক্ষিণ দিক থেকে উল্টোপাল্টা হাওয়া দিচ্ছে; যে হাওয়া রীতিমতো আরামদায়ক। আকাশে ছিটেফোঁটা মেঘও নেই। পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশটা নীল আয়নার মতো দিগন্তের ফ্রেমে যেন আটকে আছে।

    আস্তে আস্তে পা ফেলে আমি সামনের বাড়িটার ভেতর ঢুকে পড়লাম। ঢুকলেই ডানদিকে পর পর চারটে লিফটু। এটা লিফট-বক্সে গিয়ে বোতাম টিপতেই সেটা হাউইয়ের মতো ওপরে উঠতে লাগল। আমি যাব এ-বাড়িরই ফোরটিনথ ফ্লোরে। ঝিঁঝির ডাকের মতো অটোমেটিক লিফটের একটানা মসৃণ শব্দ আমার কানে বেজে চলল।

    পুরো এক মিনিটও লাগল না, লিফটটা ফোরটিন্থ ফ্লোরে এসে দাঁড়িয়ে যেতে আপনা থেকেই দরজা খুলে গেল। আমি বাইরের লম্বা প্যাসেজে বেরিয়ে এলাম। প্যাসেজটা সোজা অনেক দূরে চলে গেছে। আর দু-ধারে পর পর অগুনতি ঘর।

    এই বিশাল একুশতলা বাড়ির সবগুলো ফ্লোর জুড়েই নানারকম সরকারি বেসরকারি অফিস, ব্যাঙ্ক, ফরেন এয়ার লাইন্স আর ট্রাভেল এজেন্সির সাজানো কাউন্টার।

    পিপল অর্থাৎ জনগণের কেউ কি আমার সঙ্গে সঙ্গে এসেছেন? এসে থাকলে বাঁদিকের পর পর তিনটে ঘর লক্ষ্য করুন।

    আপাতত তিনটে ঘরের মাথায় তিনখানা ঝকমকে সাইনবোর্ড রয়েছে। প্রথম ঘরটার সাইনবোর্ডে লেখা আছে : এইড-ইলেকসান কর্পোরেশন। দ্বিতীয় ঘরের সাইনবোর্ডটা এই রকম : ন্যাশনাল ডিটেকটিভ কনসার্ণ। তৃতীয়টি লেখা আছে? পার্সোনাল।

    আপাতদৃষ্টিতে এ তিনটে আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আসলে তা নয়। কেন নয় সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য।

    যাই হোক প্রতিটি সাইনবোর্ড থেকে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজকর্ম কী হতে পারে তার মোটামুটি একটা ধারণা করা যায়। তবু মাঝে মাঝে খবরের কাগজে এদের যে বিজ্ঞাপন বেলোয় তাতে বিশদভাবে অনেক কিছু লেখা থাকে। যেমন ধরুন, এইড ইলেকসান কর্পোরেশনের বিজ্ঞাপন থাকে; সিওর সাকসেস। সাকসেস গ্যারান্টেড নির্বাচনে জয়লাভ করতে হলে আমাদের সাহায্য নিন। ভাবী এম-এল-এ, এমপি, কর্পোরেশনের কাউন্সিলর এবং মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনারদের সুবর্ণ সুযোগ। ন্যাশনাল ডিটেকটিভ কনসার্নের বিজ্ঞাপনে থাকে যে কোনও অনুসন্ধানের কাজে আমরা সহায়তা করে থাকি। যোগাযোগ করুন। পার্সোনালের বিজ্ঞাপনে থাকে ও ব্যক্তিগত যে কোনও বিষয়ে আপনাদের সেবার জন্য সর্বদাই আমরা প্রস্তুত। প্রয়োজনে সবরকম গোপনীয়তা রক্ষা করা হবে।

    হে জনগণ, আপনাদের আগে-ভাগেই জানিয়ে রাখছি ওই সাইনবোর্ডগুলো কিন্তু চিরকাল এক রকম থাকে না। দু-মাস, চার মাস, এমনকী কোনও কোনও সময় পনেরো দিন বাদেও ওগুলো বদলে যায়। যেমন ধরুন, এইড-ইলেকসান কর্পোরেশন হয়ে যায় ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোলজিক্যাল ব্যুরো, ন্যাশনাল ডিটেকটিভ কনসার্ন হয়ে যায় এইড ক্লাব ফর ফ্লাড-অ্যাফেক্টেড পিপল ইত্যাদি ইত্যাদি। চারদিরে হাওয়া-টাওয়া বুঝে সাইনবোর্ড পাল্টে দেওয়া হয়; এই আর কি। কিন্তু এসব কথা পরে।

    প্রথম ঘরটা অর্থাৎ এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনের গা ঘেঁষে সরু একটা প্যাসেজ ভেতর দিকে চলে গেছে। সেখানে আছে মাঝারি মাপের একটা চেম্বার। আমি রাজীব সরকার প্যাসেজটা দিয়ে সোজা সেই চেম্বার চলে এলাম।

    চেম্বারটা সমান দু-অংশে ভাগ করা। মাঝখানে কাচের  পার্টিসান ওয়াল। ওয়ালের এধারে এবং ওধারে দুটো দিকই চমৎকার করে সাজানো। লাল কার্পেটে মোড়া মেঝে, গ্লাস-টপ সেক্রেটারিয়েট টেবল, ফোম-বসানো রিভলভিং চেয়ার, ঝকঝকে রঙিন টেলিফোন, ফাইল-টাইল রাখার জন্যে প্লাইউডের কাজ করা র‍্যাক, ছোট অথচ সুদৃশ্য বুক কেস। চেম্বারের পিছন দিকে ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় একটা এয়ার কুলারও রয়েছে; সেটা গোটা কামরার শীততাপ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

    কাচের  দেয়ালের একদিকে বসি আমি; অন্যদিকটা আমার বিজনেস পার্টনার মেরী লতিকা বিশ্বাসের।

    চেম্বারে আমার দিকটায় ঢুকতে ঢুকতে চোখে পড়ল লতিকা পার্টিসান ওয়ালের ওপাশে বসে আছে। আমাকে দেখে সে একটু হাসল; আমিও হাসলাম। তারপর হাতের ব্রিফকেসটা টেবলে রেখে কুপ করে শরীরটা রিভলভিং চেয়ারে ছেড়ে দিলাম।

    আমাদের এই চেম্বারের সামনের দিকে সমান্তরাল রেখার মতো আরেকটা সরু প্যাসেজ রয়েছে। তারপর সেই তিনটে অফিস অর্থাৎ এইড-ইলেকসান কর্পোরেশন, ন্যাশনাল ডিটেকটিভ কনসার্ন আর পার্সোনাল। ওই অফিসগুলোর পিছন দিকের দেয়ালের খানিকটা করে অংশ কাচের। লতিকা আর আমি আমাদের ঘরে বসে ওই তিনটে আফিসের ওপরই নজর রাখতে পারি।

    ওই অফিসগুলোও চমৎকার করে সাজানো। আমাদের এই চেম্বারের মতোই কার্পেট, টেলিফোন, রিভলভিং চেয়ার, এয়ার কুলার সবই সেখানে রয়েছে। তবে বসবার ব্যবস্থা এমনভাবে করা আছে যাতে ওই অফিস তিনটের কোনওটা থেকেই আমাদের চেম্বার দেখা যায় না। হে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের মহান জনগণ, রামায়ণে কে যেন মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থেকে তীর ছুড়ত-কী যেন ক্যারেক্টারটার নাম-ও, হ্যাঁ মেঘনাদ, আমরাও ঠিক তেমনি সবার চোখে ধুলো দিয়ে এই চেম্বারে বসে থাকি। আমরা সবাইকে দেখি কিন্তু আমাদের কেউ দেখতে পায় না।

    এই মুহূর্তে এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনের অফিসে বসে আছে সমরেশ, পার্সোনালে আছে রীতেশ আর ন্যাশনাল ডিটেকটিভ কনসানে মীনাক্ষী। ওদের বয়স পঁচিশ থেকে আটাশের মধ্যে। রীতেশ ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির কমার্স গ্র্যাজুয়েট, মীনাক্ষী যাদবপুর থেকে কম্পারেটিভ লিটারেচারে সেকেন্ড ক্লাস এম-এ, আর সমরেশ শিবপুরের বি-ই। পাশ-টাশ করে চাকরি-বাকরির জন্যে ছসাত বছর ওরা গোটা কলকাতা চষে ফেলেছে। কোথাও কিছু জোটাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত এখানে এসে ঠেকেছে।

    এয়ার কুলারটা পুরোদমে চালানোই ছিল। এক মিনিটের মধ্যে আমার ঘাম শুকিয়ে গায়ের চামড়া জুড়িয়ে গেল।

    লতিকা আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। বলল, আজ এত দেরি হল?

    যাতে পরস্পরের কথা শুনতে অসুবিধা না হয় সেজন্য কাচের  দেয়ালের এক জায়গায় একটা গোল ফুটো রয়েছে। সেই ফোকর দিয়ে বললাম, মেন্টাল হসপিটালে গিয়েছিলাম

    লতিকা চেয়ারটা আমার দিকে ঘুরিয়ে নিল। বলল, কী ব্যাপার? তাকে বেশ চিন্তিও আর উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে।

    লতিকার বয়স চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ; আমার চাইতে দু-তিন বছরের ছোট। তবে তিরিশের বেশি তাকে দেখায় না। দুর্দান্ত সুন্দরী নয় সে। মাঝারি চোখ, গায়ের রঙটা অবশ্য পাকা গমের মতো, নাকে-মুখে তেমন ধার নেই। তবে স্বাস্থ্য খুব ভালো; কোমল মসৃণ মাংসে তার কণ্ঠার হাড় ঢাকা। ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা বাদামি চুল, পাতলা রক্তাক্ত ঠোঁট। থুতনির তলায় মুসুর ডালের মতো লালচে একটা তিলও রয়েছে। এই তিলটা লতিকার চেহারায় এক ধরনের তীব্র আকর্ষণ এনে দিয়েছে। মোট কথা, সব মিলিয়ে সে দারুণ স্মার্ট আর ঝকঝকে মেয়ে। লতিকারা বাঙালি ক্রিশ্চান।

    বললাম, মার পাগলামিটা আবার বেড়েছে। সকালে হসপিটাল থেকে খবর পাঠিয়েছিল। তাই দেখে এলাম।

    সিরিয়াস কিছু?

    সিরিয়াস তো নিশ্চয়ই।

    লতিকার মুখে উৎকণ্ঠার ছায়াটা গাঢ় হল। সে জিগ্যেস করল, ডাক্তাররা কী করতে বলছে?

    আমাদের এইসব কেসে কিছুই করণীয় নেই। যা করবার হসপিটালই করবে। এনি ওয়ে, ডোন্ট ওরি। যা হবার তা হবেই; ভেবে কিছু লাভ নেই। বলে আমি হাসলাম। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের হে মহান জনগণ, আমি এমন একটি ক্যারেক্টার যে, যে-কোনও অবস্থায় হাসতে পারে। কাপড়-টাপড়ে যেমন মিলের ছাপ মারা থাকে তেমনি আমার মুখে সব সময় একটি পেটেন্ট হাসির স্ট্যাম্প মারা আছে। এই হাসিটা আমার ট্রেডমার্ক।

    লতিকা মায়ের বিষয়ে আর কোনও প্রশ্ন করল না। আমি এবার জিগ্যেস করলাম, এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনের কোনও খবর আছে?

    লতিকা মাথা নাড়ল, না।

    বলো কী! হোল কান্ট্রি জুড়ে ইলেকসানের সিজন আসছে; তবু কোনও ব্রাদার-ইন-ল মুখ দেখাচ্ছে না–স্ট্রেঞ্জ! এক কাজ করো-কাল ডেলি কাগজগুলোতে এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনের বিজ্ঞাপন লাগিয়ে দেবে। ভালো করে রাইট-আপ লিখে দিও–

    আচ্ছা।

    ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টও কেউ আসেনি?

    না।

    হোয়াট অ্যাবাউট পার্সোনাল?

    একই অবস্থা।

    ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের হে মহান জনগণ, কোনও কারণেই আমার মুখ থেকে হাসি মুছে যায় না; দুশ্চিন্তা-টুশ্চিন্তা আমার হাজার কিলোমিটারের মধ্যেও নেই। হেসে হেসেই লতিকাকে বললাম, এ সব বিজনেসে যে রকম রিসেশন চলছে তাতে রেড লাইট জ্বেলে দিতে হবে দেখছি। বাবা গণেশকে উল্টে আবার নতুন বিজনেস ফঁদতে হবে।

    আর কিছুদিন দেখো না-বলতে বলতেই হঠাৎ কী যেন মনে পড়ে গেল লতিকার। খানিকটা ব্যস্তভাবেই সে বলে উঠল, আরে একটা কথা বলতেই তোমাকে ভুলে গেছি।

    কী?

    একটি মহিলা পার্সোনাল ডিপার্টমেন্টে তিনবার ফোন করেছিলেন। মহিলা!

    রিভলভিং চেয়ারটা লতিকার দিকে ঘুরিয়ে নিলাম, কত বয়েস?

    গলা শুনে বয়স বোঝা যায় নাকি? লতিকার ভুরু কুঁচকে যেতে লাগল। যায় না বুঝি?

    হয়তো যায়; তবে আমি খেয়াল করিনি।

    না করারই কথা। মেয়েদের গলা সম্বন্ধে তোমার আর কী ইন্টারেস্ট!

    দ্যাটস ট্রু; ইন্টারেস্টটা তোমারই হওয়ার কথা। এবার থেকে মেয়েরা ফোন করলে বয়েস জিগ্যেস করে রাখব।

    দারুণ বলেছ। ব্যাপারটা কী জানো, কম বয়সের মেয়েরা ফোন করলে আনন্দ হয়। আমি হেসে ফেললাম, যাক গে, এখন বলো মহিলাটি কী চান?

    লতিকা বলল, উনি বলছিলেন ওঁর একটা ব্যক্তিগত কাজে আমাদের দেবেন; কাজটা যেমন পার্সোনাল তেমনি কনফিডেন্সিয়াল। এতে খুব স্ট্রিক্টলি গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে।

    বেশ। কাজটা কী?

    সেটা উনি টেলিফোনে বলতে চান না।

    ওঁকে আমাদের অফিসে আসতে বললে না কেন?

    বলেছিলাম। কিন্তু উনি এখানে আসতে চান না। উনি চাইছেন আমরাই ওঁর কাছে গিয়ে এ বিষয়ে কথাবার্তা বলি। আমদের সঙ্গে আলোচনা করে মহিলা যদি কনভিন্সড হন, কাজটা আমরা পাব।

    আচ্ছা

    লতিকা বলতে লাগল, আমি ওঁকে কোনও কথা দিইনি। যতবার ফোন করেছেন ততবারই ওঁকে বলেছি পরে ফোন করতে। তারপর তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি।

    তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলাম না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, তোমার কী মনে হয়, ডেকে নিয়ে গিয়ে কাঁদে ফেলবে?

    বুঝতে পারছি না। লতিকাকে রীতিমতো চিন্তিত দেখাল।

    দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আবার যদি মহিলা ফোন করেন দেখা যাবে।

    আমার কথা শেষ হবার আগেই ঘুঘুর ডাকের মতো শব্দ করে টেলিফোন বেজে উঠল। নিশ্চয়ই সেই মহিলার ফোন হবে।

    হে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জনগণ, পৃথিবীর কোনও ব্যাপারেই আমার কৌতূহল নেই। যা ঘটবার–ঘটবেই, যা হবার হবেই। আগে থেকে ব্যস্ত হয়ে বা হুড়োহুড়ি করে ব্লাড প্রেসারকে একটা বিপজ্জনক সীমানায় টেনে নিয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। লাইফকে আমি মোটামুটি এভাবেই নিয়েছি। ফলে আমার রক্তচাপ সব সময় নর্মাল। এদিক থেকে আপনারা আমাকে একজন নিরাসক্ত দার্শনিক ভাবতে পারেন। দার্শনিক! ফিলজফার। কথাটা শুনে নিশ্চয়ই আপনারা শার্টের হাতার নীচে নাক ঢেকে হাসছেন। হাসুন, আর যা-ই করুন আমি একজন ফিলজফারই।

    কোনও ব্যাপারেই আগে থেকে আমি মাথা ঘামাই না। তবু ওই মহিলার টেলিফোনটা সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আগ্রহ বোধ করলাম। ফোনটা তুলতে গিয়ে কী মনে হতে তাড়াতাড়ি ঘাড় ফেরাতে গিয়ে লতিকার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। লতিকা চোখ সামান্য কুঁচকে স্থির দৃষ্টিতে আমাকে লক্ষ্য করছে আর গালের ভেতর জিভটা খুব আস্তে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাসছে।

    আমিও চোখ টিপে হাসলাম। তারপর ফোনটা তুলে হ্যালো বলতেই সমরেশের মোটা খ্যাসখেসে গলা শোনা গেল, রাজীবদা, আপনাকে একটু আসতে হবে। ইন্টারনাল কানেকনে সামনের অফিস তিনটের সঙ্গে আমাদের চেম্বারের টেলিফোনে যোগাযোগ রয়েছে। কোনও ব্যাপারে আটকে গেলে বা জরুরি পরামর্শের দরকার হলে ওখানে যারা থাকে আমার সঙ্গে কথা বলে নেয়। আমি না থাকলে লতিকার সঙ্গে কথা বলে। এই মুহূর্তে এইড-ইলেকসান কর্পোরেশন থেকে সমরেশ আমার লাইনটা ধরেছে।

    অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স আর কাকে বলে! কোথায় একটি অচেনা মহিলার কণ্ঠস্বর শুনব, তা নয়। সমরেশ কথা বলছে! ছোকরা এমনিতে খুবই সুপুরুষ, চেহারাটা দেখবার মতো, কিন্তু গলার স্বর যাচ্ছেতাই। ছেলেবেলায় অনবরত ফ্যারেনজাইটিসে ভোগার ফলে গলাটা ওই রমক হয়ে গেছে।

    লতিকা তাকিয়েই আছে। টেলিফোনের মুখটা এক হাতে চেপে তাড়াতাড়ি লতিকাকে সেই কথাটা বলে নিলাম, অ্যান্টি-ক্লাইমেক্স। মহিলা নয়–আমাদের সমরেশ। বলেই হাত সরিয়ে সমরেশকে বললাম, কী ব্যাপার সমরেশ, যেতে হবে কেন?

    গলার স্বর যতটা সম্ভব নামিয়ে খুব সতর্কভাবে সমরেশ বলল, এক ভদ্রলোক এসেছেন, ম্যানেজ করতে পারছি না।

    খানিকটা ঝুঁকে এইড-ইলেকসন কর্পোরেশনের পিছন দিকের দেয়ালের কাঁচ দিয়ে দেখে নিলাম সমরেশের মুখোমুখি প্রকাণ্ড চেহারার মধ্যবয়সি একটি লোক বসে রয়েছে। বললাম, ঠিক আছে আমি যাচ্ছি। বলেই টেলিফোনটা ক্রেডলে নামিয়ে রেখে লতিকার দিকে তাকালাম।

    লতিকা জিগ্যেস করল, সমরেশ কী বলছে?

    আঙুল দিয়ে সমরেশের সামনাসামনি সেই বিশাল লোকটাকে দেখাতে দেখাতে বললাম, এইড-ইলেকসানের নেটে বোধহয় একটা মালদার শিকার ঢুকেছে; সমরেশ ঠিক খেলিয়ে তুলতে পারছে না। যাই, গিয়ে দেখি ক্যাচ-কট-কট করা যায় কিনা

    আমাদের চেম্বার থেকে বেরিয়ে সামনের সরু প্যাসেজটা দিয়ে ডানদিকের সেই করিডরে চলে এলাম। এখানে একটা ছোট দরজা আছে; যাকে সাইড-ডোর বলা হয় অনেকটা সেই রকম। দরজাটা ঠেলে এইড-কর্পোরেশনের ভেতরে চলে এলাম।

    আমাকে দেখে সমরেশ তার চেয়ার ছেড়ে দিয়ে অন্য একটা চেয়ারে গিয়ে বসল। আর আমি তার ফাঁকা চেয়ারটায় সেই লোকটির মুখোমুখি বসলাম। আমাকে দেখিয়ে সমরেশ সেই লোকটিকে বলল, আপনি এঁর সঙ্গে কথা বলুন

    এবার ভালো করে লোকটিকে লক্ষ্য করলাম। আমার চেম্বার থেকেই আন্দাজ করতে পেরেছিলাম–লোকটা মধ্যবয়সি। সারা গায়ে বোপ চর্বির স্তূপ। গোলাকার শরীর, গোল মুখে ছোট ছোট চোখ, চওড়া কপাল, চুলে কলপ-লাগানো। থুতনির তলায় তিনটে থাক পড়েছে লোকটার; অনেকটা গলকম্বলের মতো দেখায়। তার পরণে সিল্কের পাঞ্জাবি, আর মিলের ফিনফিনে ধুতি, পায়ে চকচকে পাম্প-সু। দু-হাতের মোটা মোটা আঙুলগুলোতে কম করে সাতটা আংটি, গলায় সোনার চেন, হাতে গোল্ডেন ব্যাণ্ডে বাঁধা দামি চৌকো ফরেন রিস্টওয়াচ। চেহারা-টেহারা দেখে বেশ শাঁসালো ক্লায়েন্টই মনে হচ্ছে।

    আমার সেই ট্রেড মার্ক নেওয়া পেটেন্ট হাসিটা সারা মুখে ছড়িয়ে দিয়ে বললাম, বলুন আপনার জন্যে কী করতে পারি–

    লোকটি বলল, আমার নাম হীরাচন্দ আগরওয়াল।

    নমস্কার।

    নমস্কার, দিন কয়েক আগে নিউজ পেপারে আপনাদের একটা বিজ্ঞাপন দেখেছি। ইলেকসানের ব্যাপারে আপনারা তো সাহায্য করে থাকেন।

    টেবলের ওপর ঝুঁকে বললাম, নিশ্চয়ই; ওটাই আমাদের বিজনেস।

    বিজ্ঞাপনটা দেখে কদিন ধরে ভাবছিলাম আপনাদের অফিসে আসব। শেষ পর্যন্ত চলেই এলাম।

    সো কাইন্ড অফ ইউ।

    হীরাচন্দ আগরওয়াল একটু ভেবে নিয়ে বলল, আমি এবার ইলেকসানে নামতে চাই। আপনারা আমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারেন, বলুন

    দু-ভাবে সাহায্য করে থাকি। অর্ডিনারি আর স্পেশ্যাল–দু-রকম ব্যবস্থা আছে। আমাদের কাস্টমাররা যেভাবে চাইবেন সেভাবেই সাহায্য করব।

    ব্যাপারটা যদি একটু বুঝিয়ে বলেন

    অবশ্যই

    আমি যা বললাম সংক্ষেপে এই রকম–স্পেশ্যাল ব্যবস্থায় আমরা নির্বাচন-প্রার্থীর জন্যে মিটিং-এর অ্যারেঞ্জমেন্ট করি, লোকজন জুটিয়ে প্রসেসান বার করি, ক্যান্ডিডেটের ছবি দিয়ে দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগাই, সিনেমা হলে স্লাইড দিই, মাইকে অষ্টপ্রহর সংকীর্তনের মতো দিনরাত ভোট ফর অমুক বলে ইলেকসানের আগে পর্যন্ত চেঁচিয়ে যাই। প্রার্থী চোর ভেজালদার-স্মাগলার-ফেরেব্বাজ যাই হোক না, দেশসেবক, দানবীর ইত্যাদি ইত্যাদি অ্যাডজেকটিভ জুড়ে তার একখানা জীবনী ছেপে বাড়ি বাড়ি বিলি করি। ক্যান্ডিডেট যা বক্তৃতা দেবে তার কপি লিখে রেগুলার রিহার্সাল দিইয়ে নিই। আর তার প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে নানারকম কুৎসা রটিয়ে ক্যারেক্টার অ্যাস্যাসিনেশন মানে চরিত্র হননের ক্যাম্পেন চালিয়ে যাই। আমাদের আরেকটা স্পেশ্যালিটি হল প্রতিটি মিটিং-এ একজন করে চিত্রতারকা কিংবা পপ-সিঙ্গার নিয়ে আসি। এতে সভার গুরুত্ব বাড়ে, লোকজনও বেশি হয়। মোদ্দা কথা, মাঝে মাঝে মিটিং আর প্রসেসানের সময় ক্যান্ডিডেটকে হাজির হলেই চলবে। নইলে বাকি সময়টা নিশ্চিন্তে নাকে তেল দিয়ে সে ঘুমোতে পারে। তবে এই স্পেশ্যাল ব্যবস্থার জন্য রেটটাও স্পেশ্যাল।

    হীরাচন্দ বলল, রেটটা যদি বলেন

    এম-পি-দের জন্যে পঞ্চাশ হাজার, এম-এল-এ-দের জন্যে পঁচিশ, কর্পোরেশনের কাউন্সিলারদের জন্যে দশ, আর মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনারদের জন্যে পাঁচ। ধন্যবাদ। অর্ডিনারি ব্যবস্থাটা কী রকম?

    এতে আমরা শুধু ডেস্ক-ওয়ার্ক করে থাকি; ফিল্ডে নামি না। যেমন ধরুন পোস্টার ডিজাইন থেকে বক্তৃতার কপি পর্যন্ত তৈরি করে দিই। কীভাবে মিটিং করতে হবে, প্রসেসান বার করতে হবে তার প্ল্যান ছকে দিই। সেই প্ল্যান অনুযায়ী কাজটা ক্যান্ডিডেটকে তার লোকজন দিয়ে করিয়ে নিতে হয়। অর্ডিনারি ব্যবস্থার রেট কেমন?

    হাফ।

    হীরাচন্দ আগরওয়াল এক মুহূর্ত কী চিন্তা করল। তারপর বলল, স্পেশ্যালটাই আমার বেশি পছন্দ। তাতে ঝামেলা নেই। একটু থেমে আবার বলল, আমি বিজনেসম্যান। বুঝতেই পারছেন ধান্দার পেছনে ছুটে ছুটে একেবারে সময় পাই না। কিন্তু ইলেকসানটা আমাকে জিততেই হবে। ওটা একটা প্রেস্টিজের ব্যাপারকী বলেন?

    সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় হেলিয়ে দিলাম, তা তো বটেই।

    দু-চারটে পয়সা রামজির কৃপায় আমার হয়েছে। এখন কিছু প্রেস্টিজ চাই আর পাওয়ার।

    তা তো বটেই।

    তা হলে আমার দায়িত্বটা আপনারাই নিন।

    এ তো আমাদের সৌভাগ্য। এখন বলুন আপনি কী হতে চান–এম-পি, এম-এল-এ, কর্পোরেশনের কাউন্সিলার না মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার?

    আমি এম-এল-এ হতে চাই।

    ভেরি গুড। প্লিজ এক মিনিট–আমার গা ঘেঁসেই সমরেশ বসে আছে। তাকে বললাম, রেজিস্ট্রি খাতাটা দাও তো

    সমরেশ বাঁধানো মোটা একটা খাতা আমার সামনে রাখল। সেটা খুলে পকেট থেকে পেন বার করতে করতে বললাম, আপনার বায়োডেটা বলে যান; আমাদের কাজের জন্যে দরকার হবে। আপনার নামটা তো জেনেছি। বাবার নাম? বলতে বলতে হীরাচন্দর নাম লিখে ফেললাম।

    সোনাচাঁদ আগরওয়াল

    সোনাচাঁদের ছেলে হীরাচাঁদ! আপনার বয়েস?

    বাহান্ন।

    বিজনেসম্যান তত বললেন। কীসের বিজনেস?

    ছোটখাটো দুটো লোহার কারখানা আর একটা সোপ ফ্যাক্টরি আছে। বড়বাজারে কাপড়ের গদিও আছে। আর শেয়ার মার্কেটে কিছু ধান্দা করি। টুকতে ঢুকতে বললাম, আপনাদের বংশে কেউ জেল-টেল খেটেছে?

    হীরাচন্দ নড়েচড়ে বসল। সন্দিগ্ধভাবে বলল, মানে?

    খেটেছে কিনা বলুন না

    খানিক্ষণ চিন্তা করে হীরাচন্দ বলল, আমার ঠাকুরমার ভাই চোরাই সোনা রাখার জন্যে দুমাস জেল খেটেছিল।

    ফাইন। ওই জেল খাটাটা আপনার ঠাকুরদার ওপর চাপিয়ে মেয়াদটা বাড়িয়ে দুবছর করে দেব। কেন বলুন তো?

    বুঝতে পারছি না।

    বুঝিয়ে দিচ্ছি। তার আগে বলুন আপনার ঠাকুরদার নাম কী?

    মোতিচন্দ।

    আমি বলতে লাগলাম, আপনার একটা জীবনচরিত লিখতে হবে তো। তাতে লিখব বৃটিশ আমলে নির্যাতিত দেশকর্মী মোতিচন্দ আগরওয়ালের পৌত্র হীরাচ আগরওয়ালকে ভোট দিন।

    হীরাচন্দ প্রায় লাফিয়ে উঠল, চোরাই সোনার জন্যে জেল-খাটাটাকে এভাবে কাজে লাগাবেন! আপনার জবাব নেই। মনে হচ্ছে ঠিক জায়গায় এসেছি, আমার এম-এল-এ হওয়া কেউ রুখতে পারবে না। বলুন–আপনাদের কাজ চালু করার জন্যে কী রকম অ্যাডভান্স দিতে হবে?

    আমাদের বাঁধা রেট-টোয়েন্টি পারসেন্ট অ্যাডভান্স নিয়ে থাকি

    তার মানে পাঁচ হাজার টাকা–এ পকেট ও পকেট হাতড়ে পঞ্চাশখানা একশো টাকার নোট বার করে আমাকে দিল হীরাচন্দ। তারপর হাতের ভর দিয়ে উঠতে উঠতে বলল, একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে গেলাম। আচ্ছা চলি-নমস্কার। আমায় আবার শেয়ার মার্কেটে ছুটতে হবে।

    আপনার রিসিটটা নিয়ে যান।

    কিছু দরকার নেই। আমি লোক চিনি–বিশাল চেহারা নিয়ে হেলেদুলে চলে গেল হীরাচন্দ আগরওয়াল।

    সমরেশ বলল, এ হে, একটা কথা জিগ্যেস করতে এক্কেবারে ভুলে গেছেন রাজীবদা।

    কী কথা? খাতাটা বন্ধ করতে করতে মুখ তুলে তাকালাম।

    কোন কনস্টিটিউয়েন্সি থেকে লোকটা দাঁড়াবে তা কিন্তু জেনে নেননি।

    নিশ্চিন্তে থাকো। ক্যাশ যখন দিয়ে গেছে তখন গরজা ওর। দু-একদিনের মধ্যে আবার ও আসবে। তখন কনস্টিটিউয়েন্সির খবরটা জেনে নিলেই চলবে। কিন্তু তার দরকার হবে কি? বলে চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে চোখ টিপলাম। সমরেশ হেসে হেসে মাথা নাড়তে লাগল অর্থাৎ দরকার হবে না।

    একটু পর নিজের চেম্বারে ফিরে এসে হীরাচরে সেই পাঁচ হাজার টাকা লতিকাকে দিতে দিতে বললাম, এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনের প্রথম ইনকাম, জয় মা ভোটেশ্বরী। একবার যখন ফাঁদে ইঁদুর পড়তে শুরু করেছে তখন আঁকা বেঁধে আরো অনেকেই এসে যাবে, না কী বলে?

    হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিতে নিতে লতিকা বলল, দেখা যাক।

    এ রকম গোটা পনেরো-কুড়ি হীরাচন্দ ক্যাঁচাকলে গলা ঢোকালেই এইড-ইলেকক্সন কর্পোরেশনকে লিকুইডেশনে দেওয়া যেতে পারে।

    পরের কথা পরে ভাবলেও চলবে। এখন বলল, এই টাকাটা কী করব?

    চার-পাঁচটা ছেলেমেয়ে আমাদের এখানে চাকরির জন্যে ঘোরাঘুরি করছে না?

    হ্যাঁ প্রায়ই আসছে। কিন্তু কোনও কাজকর্ম নেই–কী দেব?

    ঠিক আছে, এই টাকাটা থেকে আপাতত ওদের বেকারভাতা দিয়ে যাও।

    তারপর যদি কিছু বাঁচে রিজার্ভ ফান্ডে রেখে দেবে।

    আমার কথা শেষ হতে না হতেই টেলিফোন বেজে উঠল। ইন্টারনাল কানেকানে পার্সোনাল থেকে রীতেশের গলা ভেসে এল, বাইরের একটা লাইন আছে রাজীবদা–

    বললাম, দাও

    প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা মহিলার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, এটা কি পার্সোন্যালের অফিস?

    আজ্ঞে হ্যাঁ।

    এর আগেও আমি তিনবার ফোন করেছি।

    রিসিভারটা কানে রেখেই লতিকার দিকে ফিরে চোখ টিপলাম। লতিকা তাকিয়ে ছিল, আমার ইঙ্গিতটা বুঝে ফিসফিসিয়ে উঠল, সেই মহিলা নাকি? টেলিফোনের মুখটা হাত দিয়ে ঢেকে বললাম, মনে হচ্ছে; দেখা যাক–বলেই দ্রুত হাতটা সরিয়ে মহিলার সঙ্গে কথা শুরু করলাম, আজ্ঞে হ্যাঁ, শুনেছি আপনি ফোন করেছিলাম। বলুন, আপনার জন্যে কী করতে পারি।

    আপনাকে একটা ব্যক্তিগত কাজের দায়িত্ব দেব। সে বিষয়ে কথাবার্তা বলার জন্যে অনুগ্রহ করে একবার আমাদের বাড়ি আসতে হবে।

    মহিলার কণ্ঠস্বর ঈষৎ ভারী, তবে তাতে এক ধরনের সুরেলা মাদকতা আছে। এই মাদকতার ভাবটা ভেতরে ভেতরে আমাকে আকর্ষণ করতে লাগল। লতিকাকে যা বলেছিলাম মহিলাকেও ঠিক তাই বললাম, আপনার দরকারের কথাটা ফোনে বলা যায় না?

    ওধার থেকে মহিলার গলা ভেসে এল, না

    এক পলক চুপ করে থেকে বললাম, কবে আপনার সঙ্গে দেখা করতে হবে?

    আজই, সন্ধের দিকে চলে আসুন–সে অ্যাট সিক্স থার্টি।

    আসব। আপনার ঠিকানাটা

    মহিলা বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের একটা নম্বর দিলেন। ডায়েরিতে টুকে নিতে নিতে বললাম, আচ্ছা নমস্কার।

    মহিলাও প্রতি-নমস্কার জানিয়ে বললেন, সন্ধেবেলা আপনার জন্যে কিন্তু আমি অপেক্ষা করছি।

    ঠিক আছে-আমি টেলিফোন রেখে দিলাম। তারপর ঘাড় ফেরাতেই চোখে পড়ল লতিকা একদৃষ্টে আমাকে লক্ষ্য করছে। তার চোখে-ঠোঁটে-চিবুকে এক ধরনের চাপা কৌতুকের হাসি চকচকিয়ে উঠেছে। চোখাচোখি হতেই সে মজা করে বলল, তা হলে যাচ্ছ।

    বললাম, যেতেই হবে। আফটার অল এটা আমাদের প্রফেশন। তারপর সোজাসুজি লতিকার চোখের দিকে তাকিয়ে কাচের  পার্টিসান-ওয়ালটার দিকে অনেকখানি ঝুঁকলাম। নীচু গলায় বললাম, তোমার আপত্তি নেই তো?

    বিন্দুমাত্র না। প্রফেসান যখন, তখন যেতেই হবে।

    থ্যাঙ্ক ইউ-চোখ টিপে হেসে বললাম, নিশ্চিন্তে থাকো, আমি ফাঁসব না—

    স্মার্ট ঝকঝকে মেয়ে লতিকা বিশ্বাস গ্রাম্য বালিকার মতো বলল, আচ্ছা–

    .

    ০২.

    সাড়ে পাঁচটায় আমাদের অফিস ছুটি হয়ে যায়। এখন পাঁচটা চল্লিশ।

    সমরেশ, রীতেশ এবং মীনাক্ষী এইড-ইলেকসান কর্পোরেশন, ন্যাশনাল ডিটেকটিভ কনসার্ন আর পার্সোনালের ঘরে তালা লাগিয়ে চলে গেছে। ওদের তিন বেয়ারা রবীন, ভবতোষ আর শরদিন্দু নেই; ছুটি হবার সঙ্গে সঙ্গে ওরাও উধাও।

    অবশ্য আমাদের এখানে কেউ আলাদা ভাবে অফিসার বা বেয়ারা নয়। এখানে সবার স্ট্যাটাস সমান। রবীন-শরদিন্দু-ভবতোষও ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট। আপাতত ওরা বেয়ারা হয়ে আছে; কদিন বাদেই অফিসার হবে। তখন সমরেশদের গায়ে বেয়ারার উর্দি চড়বে। আমাদের অফিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন মোটামুটি এভাবেই চলছে। অর্থাৎ পালা করে এখানে সবাই অফিসার আর বেয়ারা সাজে।

    যাই হোক, দুটো-আড়াইটার সময় এইড-ইলেকসান কর্পোরেশনে সেই যে হীরাচন্দ আগরওয়াল এসেছিল তারপর আমাদের তিনটে কনসার্নের কোনওটাতেই একটা মাছি পর্যন্ত ঢোকেনি। বিজনেসের অবস্থা খুবই খারাপ।

    ছুটির পর সবাই চলে গেলেও আমি কিন্তু এখনও আছি। সাড়ে ছটায় বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে সেই মহিলাটির কাছে যাবার কথা। ঠিক করে রেখেছি সোয়া ছটা নাগাদ এখান থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরে চলে যাব। আগে বেরুলে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে সময়টা কাটাতে হবে। তাই অফিসেই আছি। আমি বেরুইনি বলে লতিকাও যায়নি; আমরা দুজন কাচের  দেয়ালের দুধারে যে যার চেম্বারে বসে আছি।

    আমরা এলোমেলো গল্প করছিলাম। মাঝে মাঝে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলাম। কথাবার্তার ফাঁকে একবার বললাম, এখনও আধ ঘণ্টার মতো আমাকে থাকতে হবে। তুমি শুধু শুধু আটকে আছ কেন? বাড়ি চলে যাও

    লতিকা বলল, এখন বাড়ি যাব না।

    কেন?

    সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না লতিকা। আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে তার টেবলের ওপর যে রঙিন পেপারওয়েটটা ছিল সেটা নাড়াচাড়া করতে লাগল। তারপর বিস্বাদ গলায় বলল, বাবা ফিরে এসেছে।

    খুবই চাপা ধরনের মেয়ে লতিকা। চার ঘন্টা আগে অফিসে এসেছি। এর মধ্যে একবারও বাবার কথাটা বলেনি। নেহাত বাড়ি যাওয়ার কথা বলেছিলাম; তাই বলল। আমি প্রায় চেঁচিয়েই উঠলাম, আবার!

    হ্যাঁ।

    কবে এল?

    আজই সকালে।

    লতিকার বাবার নাম যোসেফ গঙ্গাপদ বিশ্বাস। এই লোকটা লতিকার জীবনে এক চিরস্থায়ী সমস্যা। মজা করে বললাম, খুবই আনন্দের খবর।

    লতিকা বলতে লাগল, হা, আনন্দ আর ধরছে না। জানো, এবার একা আসেনি সে; সেই মেয়েছেলেটাকেও নিয়ে এসেছে। সঙ্গে দুটো বাচ্চা

    ফার্স্ট ক্লাস। তোমাদের জনবল বেশ বেড়ে গেল।

    লতিকা উত্তর দিল না; তার চোখে-মুখে ঘৃণা, রাগ, বিতৃষ্ণা–সব একাকার হয়ে যেতে লাগল।

    একটা কথা মনে পড়তে বললাম, মাস তিনেক আগে তোমার বাবা তোমার কাছ থেকে না দুহাজার টাকা নিয়ে গিয়েছিল? বলেছিল আর আসবে না?

    বলেছিল তো। অনেকবার টাকা নিয়ে গেছে, অনেকবার ওই এক কথা বলে গেছে। বলতে বলতে লতিকা হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠল, বাড়ির অবস্থাটা ভাবতে পারছ? আমার আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না।

    ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের হে মহান জনগণ, লতিকার বাবার কথা আমি পরে বলব। কেননা সামনের সুদৃশ্য ওয়াল-ক্লকটায় দেখতে পাচ্ছি এখন ছটা বেজে তেরো মিনিট। আর বসে থাকার উপায় নেই। এখনই উঠতে হবে।

    লতিকা আবার বলল, আমি কী করব, বলতে পারো?

    উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, পরে ভেবে যা হয় করা যাবে। এখন চলো, বেরুনো যাক। আর দেরি করলে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে সাড়ে ছটায় পৌঁছতে পারব না।

    লতিকা আর কিছু বলল না।

    তিন মিনিটের মধ্যে আমাদের চেম্বারে তালা লাগিয়ে দুজনে নীচে নেমে এলাম। নেমেই আমি একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। লতিকা আমার সঙ্গে ট্যাক্সিতে উঠল না। ওরা থাকে বেলেঘাটায়। হাঁটতে হাঁটতে সে চৌরঙ্গীর দিকে চলে গেল; ওখান থেকে বাস-টাস ধরে বাড়ি চলে যাবে।

    .

    সেই মহিলাট টেলিফোনে যে ঠিকানা দিয়েছিলেন কাটায় কাটায় সাড়ে ছটায় সেখানে পৌঁছে গেলাম।

    বিরাট কম্পাউন্ড-ওলা বাড়ি। আমি অবশ্য ট্যাক্সি নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম না। ভাড়া-টাড়া মিটিয়ে রাস্তা থেকেই ট্যাক্সিওলাকে ছেড়ে দিলাম। তারপর আস্তে আস্তে প্রকাণ্ড গেটটার কাছে চলে এলাম। ঝকঝকে উর্দি-পরা নেপালি দারোয়ান সেখানে অ্যাটেনসানের ভঙ্গিতে মেরুদণ্ড টান করে দাঁড়িয়ে ছিল। তার হাতে বন্দুক; গলা থেকে চামড়ার চওড়া বেল্টে টোটার মালা বুকের দিকে নেমে এসেছে।

    আমি সামনে যেতেই দারোয়ান বলল, সাড়ে ছে বাজে আপকো আনেকা বাত থা?

    মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ—

    অন্দর যাইয়ে। বড়া মেমসাব আপকে লিয়ে ইন্তেজার করতী হ্যায়–

    ভেতরে ঢুকলাম। প্রায় এক একর জায়গা জুড়ে কম্পাউন্ড; সেটা ঘিরে উঁচু দেয়াল। মাঝখানে অত্যন্ত মডার্ন আর্কিটেকচারের দোতলা বাড়ি। বাড়িটার সামনের দিকে একধারে টেনিস কোর্ট, আরেকধারে সবুজ কার্পেটের মতো ঘাসের লন। লনে বড় বড় অনেকগুলো রঙিন গার্ডেন আমব্রেলা রয়েছে। সেগুলোর তলায় ফ্যাশনেবল বেতের চেয়ার। লনটাকে ঘিরে নানারকম অর্কিডের কেয়ারি। আরেকধারে ফুলের বাগান, বেঁটে পামগাছের জটলা। আমার বাঁদিকে খানিকটা দুরে কম্পাউন্ড ওয়াল ঘেঁষে তারের জালের ভেতর অগুণতি হরিণ আর খরগোস চোখে পড়ল। তার পাশে আরেকটা প্রকাণ্ড জালে ট্রপিক্যাল কান্ট্রির নানা ধরনের পাখি।

    লন আর টেনিস কোর্টের মাঝখান দিয়ে সাদা নুড়ির পথ বাড়িটার দিকে চলে গেছে। আমি কী করব যখন ভাবছি, নুড়ির রাস্তাটা দিয়ে বাড়ির দিকে যাব না এখানেই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করব–সেই সময় কোত্থেকে একটা সাদা উর্দি-পরা বেয়ারা প্রায় মাটি খুঁড়েই আমার সামনে এসে দাঁড়াল। গেটের দারোয়ানটা যা জিগ্যেস করেছিল বেয়ারাটাও তাই জিগ্যেস করল। অর্থাৎ সাড়ে ছটায় আমার আসার কথা ছিল কিনা?

    আমি মাথা হেলিয়ে দিলাম।

    বেয়ারাটা বলল, আসুন আমার সঙ্গে

    সে আমাকে লনের শেষ মাথায় নিয়ে গেল। কী আশ্চর্য, আগে লক্ষ্য করিনি, এখন দেখলাম, একটা রঙিন ছাতার তলায় সাদা বেতের চেয়ারে একটি মহিলা বলে আছেন।

    কত বয়স হবে তার? দূর থেকে তিরিশ-বত্রিশের বেশি মনে হবে না। তবে কাছে এসে বোঝা যায় বয়সটা চল্লিশ পেরিয়েছে।

    তার গায়ের রঙ ঝকঝকে রৌদ্র ঝলকের মতো। কপাল থেকে নাকটা নেমে এসেছে; তার দুধারে আঁকা আই-ব্রোর তলায় দীর্ঘ চোখ; মুখটা ডিম্বাকৃতি, সরু থুতনি, ভরাট মসৃণ গলার তলায় অনেকখানি অংশ অনাবৃত। তারপর ব্রা-টাইপের ছোট্ট ব্লাউজ; তার তলা থেকে সুভীর নাভির নীচে এক ইঞ্চি জায়গা পর্যন্ত শরীরের মধ্যভাগটা আবার উন্মুক্ত। মহিলার কোমরের তলায় বিশাল অববাহিকা। তার ঠোঁটে গাঢ় রঙ; নখ ম্যানিকিওর-করা; মুখে এনামেল। বাদামি চুল ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা এবং সযত্নে কার্ল-করা। তবে দু-চোখেরই নীচের দিকটা তার ফোলা ফোলা। পেটে এবং গালে কিঞ্চিৎ মেদও জমেছে। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের হে মহান জনগণ, চোখের এই ফোলা ফোলা ভাব, পেটের এই চবি–এগুলো কীসের লক্ষণ আমি জানি; এবং আপনারাও জানেন। শিকারী বেড়ালের গোঁফ দেখলেই আমি টের পেয়ে যাই। মহিলা অ্যালকোহলটি বেশ ভালোই চালান।

    যাই হোক, তার পরনে এই মুহূর্তে দামি সিফন, গলায় বীভের হাড়, ডান হাতের কব্জিতে সোনার ব্যান্ডে ছোট্ট ওভাল সেপের এটা ঘড়ি। কোলে প্রচুর লোমওলা ধবধবে কুকুর। তাঁর লম্বা লম্বা সুন্দর আঙুল অলস ভঙ্গিতে কুকুরের লোমগুলোতে বিলি কেটে দিচ্ছিল।

    বেয়ারা ডাকল, মেমসাব

    মহিলা আমাদের দিকে ফিরলেন। বেয়ারা বলল, ইনি এসেছেন—

    মহিলা আমাকে বললেন, পার্সোন্যালের অফিস থেকে আসছেন তো?

    আজ্ঞে হ্যাঁ–আমি ঘাড় হেলিয়ে দিলাম, নমস্কার

    নমস্কার। বসুন—

    একটা বেতের চেয়ারে মহিলার মুখোমুখি বসলাম।

    আপনার নামটা তখন টেলিফোনে জেনে নেওয়া হয়নি। নাম জানলে কথাবার্তা বলতে সুবিধা হয়।

    নিজের আসল নামটা বলব কি বলব না, এক মুহূর্ত ভেবে নিলাম। তারপর নিজের অজান্তেই সেটা বলে ফেললাম।

    মহিলা বললেন, আমার নাম মনোবীণা সান্যাল। আপনি আমাকে মিসেস সান্যাল বলতে পারেন।

    এক পলক দ্রুত মনোবীণা সান্যালের সিঁথি এবং কপালটা দেখে নিলাম। মহিলা জানিয়েছেন তিনি মিসেস অর্থাৎ বিবাহিতা। কিন্তু সিঁদুর-টিদুর চোখে পড়ছে না। বাঙালি সুলভ রীতিনীতি সম্বন্ধে খুব সম্ভব এঁদের তেমন শ্রদ্ধা নেই। না থাক, আমার তাতে কী। আমি এসেছি আমার প্রফেসানের ব্যাপারে। বিবাহিত হয়েও কে সিঁদুর পরছে না, তা নিয়ে ভেবে ভেবে ব্লাড-প্রেসার চড়াবার কোনও মানে হয় না। বললাম, ধন্যবাদ। এখন বলুন, আমার ওপর কী দায়িত্ব দিতে চান

    তার আগে আপনাদের সম্বন্ধে আমার কিছু জানবার আছে।

    অত্যন্ত সতর্কভাবে মহিলাকে লক্ষ্য করতে করতে বললাম, কী জানতে চান?

    আপনাকে ফোনে পাবার আগে আপনাদের অফিসের এক মহিলার সঙ্গে আমার কিছু কথা হয়েছে।

    শুনেছি। ওই মহিলা আমার বিজনেস পার্টনার।

    ও, আচ্ছা। আমি ওঁকে বলেছিলাম আমার কাজটা অত্যন্ত গোপনীয়। আপনাদের দায়িত্ব দিলে জানাজানি হয়ে যাবে না?

    নিশ্চিন্ত থাকুন ম্যাডাম। আপনি যখন চাইছেন তখন কেউ জানতে পারবে না। গোপনীয়তা রক্ষা করা আমাদের প্রফেসানের একমাত্র ক্যাপিটাল। নইলে এই কনসার্ন কবে উঠে যেত।

    আরেকটা কথা। আপনাদের বিশ্বাস করতে পারি তো?

    সেটা আপনার ওপর নির্ভর করছে। এ ব্যাপারে নিজেদের সম্বন্ধে কোনও ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দিতে পারব না। তবে একটা কথা বলতে পারি, আমাদের কনসার্নটা পঁচিশ বছরের। কমাস আগে সিলভার জুবিলি হয়ে গেছে। মাননীয় ক্লায়েন্টদের খুশি করতে না পারলে এই কনসার্ন নিশ্চয়ই টিকত না। বলতে বলতে মনোবীণা সান্যালের দিকে তাকিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করতে লাগলাম। মুখ-চোখ দেখেই টের পাওয়া যাচ্ছে যে ফাঁদটি আমি পেতেছি মহিলা তাতে পা ঢুকিয়ে দিয়েছেন অর্থাৎ আমার কথা তিনি অবিশ্বাস করছেন না।

    হে মহান জনগণ, ভদ্রমহিলাকে বললাম বটে আমাদের প্রতিষ্ঠানটা পঁচিশ বছরের, আসলে তিন মাস আগেও ওটার অস্তিত্ব ছিল না। আফটার অল এ একটা প্রফেসান; প্রফেসানের খাতিরে কত কিছুই তো বলতে হয়, যে প্রতিষ্ঠানের আয়ু মোট তিন মাস তার সিলভার জুবিলিও ঘটাতে হয়।

    মনোবীণা সান্যাল বললেন, এবার তাহলে কাজের কথায় আসা যাক।

    আমি নড়ে-চড়ে মেরুদণ্ড টান করে বললাম। মনোবীণা শুরু করলেন, আজে বাজে কথা না বলে আমি শুধু কাজের কথাটুকুই বলব।

    উত্তর না দিয়ে আমি তাকিয়ে রইলাম।

    মনোবীণা বলতে লাগলেন, আমার একটি মেয়ে আছে; তার নাম শমিতা; ডাকনাম ডোরা। বয়েস চব্বিশ। প্রথমেই বলে রাখি শি ইজ এ প্রবলেম চাইল্ড। আমার ধারণা সে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। প্রচণ্ড হুইস্কি খায়, শি ড্রিংকস লাইক ফিশ। যার তার সঙ্গে সে মেশে; একবার বেরুলে কখন কবে বাড়ি ফিরবে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। এভাবে চলতে পারে না। আপনি বলুন, পারে কি?

    কেউ নিজের মেয়ের সম্বন্ধে এ রকম বলতে পারে, আমার ধারণা ছিল না। আমি প্রায় হকচকিয়ে গেলাম। কী উত্তর দেব ভেবে পেলাম না।

    মনোবীণা সান্যাল আমার উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করলেন না। একটু আগের প্রশ্নটা যদিও আমারই উদ্দেশ্যে, আসলে ওটা তিনি করেছিলেন নিজেকেই। মনোবীণা বলে যেতে লাগলেন, আমি চাই, ভোরা নর্মাল হোক। অন্য দশটা মেয়ের মতো সুস্থ স্বাভাবিক হোক ওর লাইফ।

    গলাটা ঝেড়ে নিয়ে বললাম, সব মা-ই তা চান!

    আপনি তাহলে আমার সঙ্গে একমত?

    নিশ্চয়ই।

    মনোবীণা সান্যাল চিন্তিতভাবে এবার বললেন, বুঝতেই পারছেন, আমার মেয়েটাকে নিয়ে ভয়ানক সমস্যায় পড়ে গেছি। কিছুতেই ওকে কনট্রোল করতে পারছি না। এদিকে ওর বাবা চোদ্দো বছর পর কানাডা থেকে ফিরে আসছেন। হি ইজ এ ডিফারেন্ট টাইপ; তিনি ফিরে আসার আগে মেয়েকে আমি নর্মাল করে তুলতে চাই। আমার এ ব্যাপারে সাহায্যের জন্যেই আমি আপনাকে ডেকেছি।

    খুব শান্তভাবে বললাম, কী সাহায্য চান বলুন

    ডোরা যেভাবে যেদিকে চলেছে সেটা খুবই বিপজ্জনক। যে কোনওদিন একটা ডিজাস্টার ঘটে যাবে। আমি চাই আপনি ওকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনুন। যদি মেয়েটাকে নর্মাল করে দিতে পারেন, আই শ্যাল রিমেন এভার গ্রেটফুল। বলতে বলতে একটা থামলেন মনোবীণা। কী যেন চিন্তা করে একটু পর আবার বললেন, একটা কথা জিগ্যেস করতে ভুলে গেছি–এ জাতীয় কাজের অভিজ্ঞতা আপনাদের আছে কি?

    নানা ধরনের মানুষ অদ্ভুত অদ্ভুত সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে আসে। কিন্তু এ রকম প্রবলেমের কথা আগে আর শুনিনি। পাছে এত বড় একটা ক্লায়েন্ট আঙুলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায় তাই ব্যস্তভাবে বলে উঠলাম, এর চাইতে অনেক বড় সমস্যা ট্যাল করার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন মিসেস সান্যাল।

    মনোবীণা বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ ফর ইওর অ্যাসুয়োরেন্স। এখন বলুন, এজন্য আপনাদের কী রেমুনারেসন দিতে হবে?

    রেমুনারেসনের কথাটা পরে বলছি। আগে আপনার মেয়ে শমিতাদেবীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিন।

    আলাপ করানো যাবে না।

    বিমূঢ়ের মতো বললাম, কেন?

    মনোবীণা বললেন, অসুবিধা আছে। ডোরা অদ্ভুত টাইপের মেয়ে। ও যদি টের পেয়ে যায়, আমি ওর পেছনের আপনাকে লাগিয়েছি, রেজাল্ট খুব খারাপ হবে।

    তা হলে?

    আমার মনোভাবটা বোধহয় বুঝতে পারলেন মনোবীণা। বললেন, ওকে যাতে চিনতে পারেন সে ব্যবস্থা করে রেখেছি। এই দেখুন–পাশে একটা ফ্যাসনেবল লেডিজ হ্যান্ডব্যাগ পড়ে ছিল। সেটা খুলে দুটো পোস্টকার্ড সাইজের ফোটোগ্রাফ সামনের টেবলটার ওপর রাখলেন মহিলা।

    ফোটোদুটোর দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরানো যাচ্ছিল না। সে দুটো একই তরুণীর দুটি আলাদা আলাদা ভঙ্গির ছবি। ফোটোর চেহারার সঙ্গে মনোবীণা সান্যালের আশ্চর্য মিল। কোনও অলৌকিক ক্ষমতায় মনোবীণার বয়সটা আচমকা কুড়ি-বাইশ বছর কমিয়ে ফেলতে পারলে এই রকমই দাঁড়াবে।

    মনোবীণা আবার বললেন, দেখা হয়েছে?

    আজ্ঞে হ্যাঁ–আমি ঘাড় হেলিয়ে দিলাম।

    কেউ দেখে-টেখে ফেলতে পারে। ফোটো দুটো আপনি ব্রিফকেসে নিয়ে নিন। কথামতো ফোটো দুটো আমার ব্রিফকেসে পুরে ফেললাম।

    মনোবাণী এবার বললেন, এর বেশি আমি আর কিছু দিতে পারব না। এখন কীভাবে ডোরার সঙ্গে আলাপ করবেন, কীভাবে ওকে নর্মাল লাইফে ফিরিয়ে আনবেন সেটা কমপ্লিটলি আপনার ব্যাপার।

    ঘাড় কাত করে বললাম, তা তো বটেই।

    এবার রেমুনারেসনটা ঠিক করে ফেলা যাক। কী পেলে আপনি হ্যাপি?

    আমি জানি এই সব অদ্ভুত টাইপের মহিলাদের কাছে টাকা পয়সার কথা বলতে যাওয়া বোকামি। হয়তো আমি যা চাইব, মনে মনে উনি তার তিন গুণ দেবার কথা ভেবে রেখেছেন। ব্যাপারটা পুরোপুরি ওঁর ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। বললাম, আমি কী বলব; সব কিছু কনসিডার করে আপনি যা দেবেন আমি তাতেই খুশি।

    মনোবীণা বললেন, এই তো বিপদে ফেললেন–বলে একটু থামলেন। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ইফ আই পে টেন থাউজেন্ড-খুব কম হবে কি?

    দশ হাজার! ফিগারটা আমার পক্ষে প্রায় অভাবনীয়। খুশিতে চেঁচিয়ে ওঠাই উচিত। কিন্তু কোথায় চেঁচাতে হয় আর কোথায় স্বরগ্রামকে নীচু ভাবে বেঁধে রাখা দরকার, আমি জানি। দশ হাজারের অঙ্কটা যেন কিছুই নয়, নেহাত দু-পাঁচ টাকার ব্যাপার, এই রকম মুখের চেহারা করে বললাম, ঠিক আছে, ওতেই হবে।

    কত অ্যাডভান্স দিতে হবে?

    আপনার যা ইচ্ছে—

    মনোবীণা খানিকক্ষণ ভেবে বলেন, এক হাজার দিই?

    বললাম, তাই দিন

    হ্যান্ডব্যাগ খুলে টাকা বার করতে করতে মনোবীণা বললেন, না, দুহাজার দিচ্ছি। আমার মেয়েকে তো চিনি। ওর পেছনে আপনাকে অনেক পয়সায় দৌড়ুতে হবে। দুহাজারই রাখুন।

    কুড়িখানা একশো টাকার নোট গুণে গুণে আমাকে দিলেন মনোবীণা। টাকাটা অবহেলার ভঙ্গিতে ব্রিফকেসে রেখে বললাম, ধন্যবাদ।

    আমার কাজ আপাতত শেষ। মনোবীণা সান্যালের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠতে যাব সেই সময় একটা দামি ইম্পোর্টেড গাড়ি সামনের বড় গেট দিয়ে ঢুকে টেনিস লনটার কাছে এস থামল। আর সেই গাড়িটা থেকে যিনি নামলেন তাঁর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। সাড়ে ছফুটের ওপর হাইট, প্রকাণ্ড বুক, পালিশ করা ব্রোঞ্জের মতো রঙ। এত বয়সেও গায়ের চামড়া টান টান, মসৃণ। ছড়ানো কাধ তার, পাতলা ভুরুর তলায় মাঝারি ধরনের বাদামি চোখ, বিস্তৃত কপালের ওপর থেকে ব্যাক ব্রাস করা লালচে চুল। চৌকো মুখ, দৃঢ় চোয়াল, পরনে স্টিল গ্রে কালারের ট্রাউজার আর শার্ট। কোটটা গায়ে নেই, হাতে ঝুলছে। সব মিলিয়ে তাকে কেমন যেন অভারতীয় মনে হয়।

    গাড়ি থেকে নেমে নুড়ির রাস্তার ওপর দিয়ে ভদ্রলোক আমাদের দিকেই এগিয়ে আসতে লাগলেন। মনোবীণা সান্যাল তার দিকে চোখ রেখে চাপা নীচু গলায় বললেন, আপনি কী জন্যে এসেছেন, ওঁর কাছে বলবেন না।

    আচ্ছা–আমি আস্তে করে মাথা নাড়লাম।

    আর আমি যা বলে যাব তাতে সায় দিয়ে যাবেন।

    ঠিক আছে।

    আর কিছু বলার সময় পেলেন না মনোবীণা; ভদ্রলোক আমাদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন। দ্রুত এক পলকে আমাকে দেখে নিয়ে বললেন, ইনি? মনোবীণা বললেন, ইনি একজন ইনটেরিয়র ডেকরেটর। আমাদের বাইরের ঘরটা ডেকরেসনের জন্য ওঁকে ডাকিয়েছি।

    ভদ্রলোক বললেন, ও—

    মনোবীণা এবার আমার দিকে ফিরে বললেন, উনি আমার স্বামী–অরিন্দম সান্যাল।

    আমি বিনীত ভাবে নমস্কারের ভঙ্গিতে হাতজোড় করলাম। অরন্দিম সান্যাল আমার দিকে আর ফিরেও তাকালেন না; একজন ইনটেরিয়র ডেকরেটর সম্বন্ধে তার কোনও কৌতূহল নেই। এমনকী সামান্য সৌজন্যও না। বড় বড় পা ফেলে ধবধবে সাদা নুড়ির রাস্তা দিয়ে তিনি বাড়ির দিকে চলে গেলেন।

    আর আচমকা বিদ্যুৎ চমকে যাবার মতো একটা কথা মনে পড়ে যেতে দ্রুত ঘাড় ফিরিয়ে মনোবীণার দিকে তাকালাম, কিন্তু

    আমার গলায় হয়তো কিছু উত্তেজনা ছিল, হয়তো কিন্তু শব্দটা খানিকটা জোর দিয়েই বলে ফেলেছিলাম। মনোবীণা কী বুঝলেন তিনিই জানেন, তর্জনী তুলে বসলেন, আস্তে। কী জানতে চাইছেন?

    আপনি তখন বললেন শমিতাদেবীর বাবা কানাডা থেকে আসছেন। কিন্তু আপনার স্বামী তো এখানেই আছেন–

    মনোবীণা আরেকবার তর্জনী তুলে আমাকে থামিয়ে দিলেন, বললেন, এ ব্যাপারে প্রশ্ন করবেন না। আপনাকে যে কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তার বাইরে কোনওরকম কৌতূহল প্রকাশ করেন–এটা আমি চাই না। আচ্ছা নমস্কার-সাদা সাদা ঝালরের মতো লোমলা সেই কুকুরটাকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মনোবীণা। বললেন, আপনার কাজ কী রকম এগুচ্ছে মাঝে মাঝে খবর দেবেন। আই থিঙ্ক ইট উইল টেক সাম টাইম।

    নমস্কার জানিয়ে যখন আমি গেটের বাইরে বেরিয়ে এলাম, তখন সন্ধে নামতে শুরু করেছে। পাতলা অন্ধকার উলঙ্গবাহার শাড়ির মতো কলকাতাকে জড়িয়ে আছে।

    বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের এদিকটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা আর নিরিবিলি। দেশভাগ, পপুলেশন এক্সপ্লোসান–এসব কোনও কিছুই কলকাতার এই অংশটাকে ছুঁতে পারেনি। তবে এ রাস্তায় পার্টিসনের পর ট্রাফিক বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। বালিগঞ্জ, সাদার্ন অ্যাভেনিউ, যোধপুর পার্কের দিকে যারা থাকে এই রাস্তাটা শর্ট কাট করে তারা চলে যায়।

    তখন সাতটার মতো বাজে। হুড় হুড় করে অগুনতি প্রাইভেট কার স্রোতের মতো নেমে আসছে। আমি রাস্তার ধার ঘেঁষে অন্যমনস্কর মতো লোয়ার সার্কুলার রোডের দিকে হাঁটছিলাম।

    আমার ব্রিফকেসে নগদ দুটি হাজার টাকা রয়েছে। সাধারণত সব ব্যাপারেই অ্যাডভান্সের টাকাটা হাতিয়ে নিয়ে ক্লায়েন্টের সঙ্গে আমরা সম্পর্ক চুকিয়ে দিই। অনেকগুলো ক্লায়েন্টের কাছ থেকে দু-এক হাজার টাকা করে অ্যাডভান্স নিতে পারলে মোটামুটি একটা ভালো অঙ্কই দাঁড়ায়। তখন আমরা করি কী, রাতারাতি কোম্পানির গণেশ উল্টে দিই। এবং সেই জায়গায় কলকাতার রাস্তায় নতুন নতুন শিবলিঙ্গর মতো আনকোরা নতুন একটা প্রতিষ্ঠানে গজিয়ে তুলি। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের হে মহান জনগণ, আমাদের প্রফেসানের এই হল ট্রেড সিক্রেট।

    মনোবীণা সান্যালের কাছ থেকে অ্যাডভান্সের টাকাটা যখন পাওয়া হয়ে গেছে তখন বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের দিকে আমি আর আসছি না। যেখান থেকে একবার কিছু আদায় হয়ে যায়, সেদিকে আমি আর তাকাই না।

    নো লুকিং ব্যাক। কিন্তু আমার এই ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ বছরের লাইফে ওয়ার্ল্ডের অনেকটাই তো দেখা হল, বহু ঘাটের জলও খাওয়া হল, আমাদের প্রফেসানে সেই সূত্রে অদ্ভুত অদ্ভুত সব মানুষের কাছে এসেছি। যাদের অনায়াসেই রেয়ার হিউম্যান স্পেসিমেন বলা যেতে পারে। এতকাল যা-ই দেখে থাকি না কেন, মনোবীণা সান্যালকে আগে আর কখনও দেখিনি। যতই তাকে ভুলে যেতে চেষ্টা করছি, তার ভাবনাটা টোকা দিয়ে ফেলে দিতে চাইছি ততই তিনি, এক মিনিটের জন্যে দেখা তার স্বামী অরিন্দম সান্যাল, যাকে নর্মাল লাইফে পুনর্বাসন দেবার দায়িত্ব কাঁধে ঝুলিয়ে এসেছি সেই শমিতা এবং এবং তার কানাডা প্রবাসী বাবা—সবাই তীব্রভাবে আকর্ষণ করতে লাগল।

    1 2 3 4 5
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleছোটগল্প – প্রফুল্ল রায়
    Next Article গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    ছোটগল্প – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.