Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প688 Mins Read0

    ১.১ বিনয় তাকিয়েই আছে

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    [এই উপন্যাস ‘কেয়াপাতার নৌকো’ ও ‘শতধারায় বয়ে যায়’- এর পরবর্তী পর্ব। কাহিনির মূল চরিত্র বিনয় পূর্ববাংলার উদ্বাস্তুদের সঙ্গে আন্দামানে চলে এসেছে। দক্ষিণ আন্দামানের দু- প্রান্তে এমন অঞ্চলে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়েছে যার চারদিকে গভীর অরণ্য আর সমুদ্র। জঙ্গলে রয়েছে এখানকার আদিম জনগোষ্ঠী জারোয়ারা, সমুদ্রে হিংস্র হাঙরের দল। রয়েছে কালাপনির সাজা নিয়ে যারা ব্রিটিশ আমলে আন্দামানে এসেছিল তাদের ছোট ছোট কলোনি। অরণ্য নির্মূল করে ছিন্নমূল মানুষ অনন্ত পরিশ্রমে গড়ে তুলছে তাদের নতুন বাসভূমি। বিনয় এদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। সে জেনেছে ঝিনুক অনেক দূরের মধ্য আন্দামানে। তাকেও খুঁজছে সে। অপরাজেয় মানুষের অনন্য সংগ্রামের কাহিনি ‘উত্তাল সময়ের ইতিকথা’। এখানে তার একটি অংশ প্রকাশিত হল।]

    *

    বিনয় তাকিয়েই আছে, তাকিয়েই আছে। পলকহীন। বুঝিবা শত বর্ষ ধরে।

    সামনের দিকে যতদূর চোখ যায়, ছোট বড় মাঝারি-চৌকো, তেকোণা, লম্বাটে, নানা আকারের কত যে দ্বীপ! সবই জনহীন, নিঝুম। একসময় ঝিনুকদের নিয়ে ‘স্টিমশিপ ‘চলুঙ্গা’ একটা দ্বীপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়।

    অগুনতি দ্বীপ, প্রতিটি দ্বীপে উঁচুনিচু পাহাড়। পাহাড়গুলোর গায়ে ডালপালাওয়ালা প্রাচীন মহাবৃক্ষের সারি। আকাশে উড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে সি-গাল। এত গাছ, এত পাখি, সমুদ্র থেকে মাথা তুলে থাকা এত দ্বীপ! তবু বিনয়ের মনে হয়, বিশাল সমুদ্র জুড়ে হঠাৎ অপার শূন্যতা নেমে এসেছে। আর সেই শূন্যতা তার বুকের ভেতরেও ছড়িয়ে পড়েছে।

    কতক্ষণ পর খেয়াল নেই, বিনয়ের চোখ চলে যায় পশ্চিমের দিকটায়। উপসাগর, যার নাম সেসোস্ট্রেস বে–তার ওপারে যে পাহাড়টা অন্য সব পাহাড়ের মতোই গাছ-গাছালি ঝোঁপঝাড়ে লতাপাতায় তীব্র সবুজ হয়ে আছে সেটাকে খুব চেনা চেনা হল। আন্দামানের মানচিত্রে এর ছবি দেখেছে বিনয়। নিশ্চয়ই মাউন্ট হ্যারিয়েট। একটা ধবধবে সাদা ক্রস ওটার চুড়োয় সটান দাঁড়িয়ে আছে। আবছাভাবে বিনয়ের মনে পড়ে, আঠারোশো বাহাত্তরে পরাধীন ভারতের ভাইসরয় লর্ড মেয়ো এই দ্বীপমালায় নির্বাসিত বন্দিরা কী ধরনের দুদর্শা আর নির্যাতনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, স্বচক্ষে দেখার জন্য এখানে এসেছিলেন। এক পাঠান কয়েদি, শের খান, মাউন্ট হ্যারিয়েটের তলদেশে, সমুদ্রের ধারে তাকে হত্যা করে। ক্রসটা বছরের পর বছর নীরবে সেই শোকের বার্তা ঘোষণা করে চলেছে।

    এদিকে ‘রস’ দ্বীপের ধার ঘেঁষে উপসাগরের জল ফুঁড়ে ফুঁড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে শ’য়ে শ’য়ে উড়ুক্কু মাছ। রুপোলি ঝিলিকের ম্যাজিক তৈরি করে পনেরো কুড়ি ফিট দূরে ফের সমুদ্রে ঝাঁপ দিচ্ছে। উড়ন্ত মাছেদের এই খেলাটা চলছে অবিরাম। ক্লান্তিবিহীন।

    বিনয় যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে বাঁ ধারে কোনাকুনি উপসাগরের ওপারে চড়াই-উতরাইতে ঢেউ খেলানো শহর পোর্ট ব্লেয়ার। তারই একটা উঁচু টিলার মাথায় সেলুলার জেল। আকাশ-ছোঁওয়া একটা টাওয়ার মাঝখানে রেখে সেটার গা থেকে পাঁচ দিকে পাঁচটা লাল রঙের বিশাল তেতলা উইং বা ইমারত চলে গেছে। এগুলোর প্রতিটি তলায় সেলের পর সেল। মোটামুটি সাত ফিট বা ছফিট মাপের একেকটা খুপরি। উনিশশো পঁয়তাল্লিশের আগে মোট উইং ছিল সাতটা। জাপানি বোমায় দু’টো পুরোপুরি ধংস হয়ে যায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পরই ইংরেজরা সাত সমুদ্র তেরো নদীর এপারের ভারতীয় কলোনি থেকে চাটিবাটি গুটিয়ে চলে গেছে। দেশ এখন স্বাধীন। তবু আদিগন্ত কালাপানির মাঝখানে দক্ষিণ আন্দামানের রুক্ষ, ভীতিকর, দমবন্ধ করা এই বন্দিশালার দিকে তাকালে বুকের ভেতরটা আমৃল কেঁপে যায়। কুখ্যাত এই জেলখানা ঘিরে হাড় হিম করা নানা ঘটনা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কারও জানতে বাকি নেই। ব্রিটিশ রাজত্বের অসীম দম্ভ এবং নির্যাতনের স্মৃতিস্তম্ভ এই সেলুলার জেল। আন্দামান নিয়ে যত বই বেরিয়েছে তার প্রায় সবগুলোতেই এর ছবি চোখে পড়বে। একেকটা শহরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চোখ ধাঁধানো প্রাচীন কোনও সৌধ বা অন্য কোনও ল্যান্ডমার্ক যা দেখলে লহমায় শহরটাকে চিনে নেওয়া যায়। প্যারিসের যেমন আইফেল টাওয়ার, লন্ডনের বিগ বেন, বম্বের গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া বা কলকাতার হাওড়া ব্রিজ। আন্দামানের তেমনি সেলুলার জেল।

    জেলখানাটার অনেকটা নিচে, উপসাগরের ধার ঘেঁষে আঁকাবাঁকা রাস্তা ডাইনে এবং বাঁয়ে বহুদূর চলে গেছে। সেখানে কিছু লোকজন চোখে পড়ছে। দূর থেকে ছোট ছোট পুতুলের মতো মনে হয়। যেন মানুষের বনসাই।

    উপসাগর থেকে হুহু করে উঠে আসছে তুমুল ঝোড়ো বাতাস; ‘রস’ আইল্যান্ডের সারি সারি নারকেল গাছগুলোর ঝুঁটি ধরে সমানে ঝাঁকিয়ে চলেছে।

    সমুদ্র, পাহাড় এবং হাজার হাজার বছরের মহা অরণ্য দিয়ে সাজানো এই দ্বীপপুঞ্জের চারিদিকে কত অবাক করা দৃশ্য, হাওয়ার। সাঁই সাঁই অবিরল শব্দ–কিছুই শুনতে বা দেখতে পাচ্ছেনা বিনয়। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায়, পাক খেয়ে খেয়ে নিরুদ্দেশে চলে যাওয়া অসংখ্য গলিখুঁজির গোলকধাঁধায়, কলকাতার সীমানা ছাড়িয়ে উদ্বাস্তুদের কলোনি আর রিলিফ ক্যাম্পগুলোতে ভোর হতে না হতেই উভ্রান্তের মতো ছুটে গেছে। পাগলের মতো খুঁজে বেড়িয়েছে ঝিনুককে। না, তাকে পাওয়া যায়নি। হতাশ, ব্যর্থ, হা-ক্লান্ত বিনয় ফিরে এসেছে সন্ধের পর। দিনের পর দিন। তারপর ধীরে ধীরে কবে যেন ঝিনুকের মুখ স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে গেছে। তার জন্য সারাক্ষণ যে আবেগে বুকের ভেতরটা উতরোল হয়ে থাকত তার তীব্রতা ক্রমশ জুড়িয়ে এসেছে। যে মেয়ে নিজের। ইচ্ছায় হারিয়ে গেছে তার জন্য কতকাল আর একইরকম ব্যাকুলতা টিকে থাকে? ‘নতুন ভারত’-এ চাকরি নেবার পর সে বিনয়ের জীবনের নতুন পরিধি থেকে দুরে, আরও দূরে সরে যাচ্ছিল।

    কিন্তু চকিতের জন্য সে দিন খিদিরপুরের বাইশ নম্বর ডেকে ঝিনুককে দেখার পর পুরনো ব্যাকুলতা বুকের গভীর স্তর খুঁড়ে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। জাহাজের খোলে হাজারটা ছিন্নমূল মানুষের ভেতর আতিপাতি করে তার সন্ধান করেছে। বিনয়। না, তাকে পাওয়া যায়নি। পরে বিনয় ভেবেছে, হয়তো চোখের ভুল, নেহাতই ক্ষণিকের বিভ্রম। হয়তো মুখের আদলে খানিকটা মিল আছে, তাই মনে হয়েছে ঝিনুক। বিনয় নিজেকে বোঝাতে চেয়েছে, সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আন্দামানেই যাবে কেন ঝিনুক? কার সঙ্গেই বা যাবে? কলকাতার মতো মহানগরে তার চেনাজানা এমন কেউ নেই যার সঙ্গে সে আন্দামানের জাহাজে উঠতে পারে।

    কিন্তু এই কিছুক্ষণ আগে বিনয়ের সব ভ্রান্তি কেটে গেছে। অন্য কেউ নয়, ঝিনুকই ইন্টার আইল্যান্ড সারভিসের ‘‘চলুঙ্গা’ জাহাজে পাঁচশো উদ্বাস্তুর সঙ্গে মিডল আইল্যান্ডে চলে গেল।

    কে বলে পুরনো আবেগ মরে যায়? তা-ই যদি হত, হৃৎপিণ্ড এ উথাল পাথাল হচ্ছে কেন? কেনই বা শিরাস্নায়ু ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছত্রখান হয়ে যাচ্ছে? একটা দম-আটকানো কষ্ট ডেলা পাকিয়ে গলার কাছে আটকে গেছে। তারই মধ্যে বিনয় ভাবছিল, যেমন করে তোক মিডল আন্দামানে ঝিনুকের কাছে তাকে যেতেই হবে। কাল হোক, পরশু হোক বা দশ বিশ দিন পরে। ঝিনুকের সঙ্গে দেখা তো করবেই, তাকে না নিয়ে কলকাতায় ফিরবে না। হঠাৎ দূর থেকে ভট ভট শব্দ কানে এল। চমকে বিনয় দেখতে পায়, সেলোস্ট্রেস বে আধখানা বৃত্তের আকারে বেঁকে যেখানে সেলুলার জেলের তলা দিয়ে ডাইনে বহু দূরে চলে গেছে সেখান থেকে দুটো বড় লঞ্চ এদিকে এগিয়ে আসছে।

    পেছন থেকে কেউ ডেকে ওঠে, ‘বিনয়বাবু, বিনয়বাবু–’’

    ঘাড় ফেরাতেই চোখে পড়ে–নিরঞ্জন। সে বলল, ‘আপনের মালপত্র গোছগাছ কইরা রেডি হন। লঞ্চ আইতে আছে। এইবার পোর্ট ব্লেয়ার টাউনে যামু—’

    মালপত্র আর কী। একটা চামড়ার স্যুটকেস, মাঝারি একটা হোল্ড-অলে তোশক, হাওয়া বালিশ, কম্বল, চাদর আর মশারি গুছিয়ে বেঁধে দিয়েছে ‘শান্তিনিবাস’ মেসের সুবল। সেগুলো গার্ডেন আমব্রেলা ধরনের মস্ত একটা ছাতার তলায় একধারে রেখে দিয়েছে বিনয়। সে অন্যমনস্কর মতো পা ফেলে ফেলে তেজি বোদ ঠেকাতে যেখানে গার্ডেন আমব্রেলাগুলো ডানা মেলে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে এগিয়ে গেল।

    এদিকে বিভাস এবং উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তরের চার পাঁচজন কর্মী মুখে টিনের চোঙা লাগিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে শরণার্থীদের সমানে তাড়া দিচ্ছিল। পোর্ট ব্লেয়ার যেতে হবে। পনেরো কুড়ি মিনিটের ভেতর সবাই যেন প্রস্তুত হয়ে নেয়। নিরঞ্জন বিনয়কে যা বলেছে, বিভাসরা ঠিক তা-ই বলছে উদ্বাস্তুদের।

    কলকাতা থেকে আসার পথে: সমুদ্রে সাইক্লোনের মুখে পড়েছিল কিনয়দের জাহাজ ‘এস এস মহারাজা’। তুমুল রোলিং জাহাজের খোলে হাজারখানেক উদ্বাস্তুকে অবিরল একবার ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে, পরক্ষণে নিচে আছড়ে ফেলে, দুমড়ে মুচড়ে তাদের শরীরগুলোকে ময়দা ঠাসার মতো তালগোল পাকিয়ে ছেড়েছিল। যা খেয়েছিল পাকস্থলী থেকে হড়হড় করে বমি হয়ে ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। পরে সমুদ্র শান্ত হলেও তারা এতটাই কাহিল হয়ে পড়ে যে খাওয়ার কোনওরকম ইচ্ছাই ছিল না; বাঙ্কে চোখ বুজে নির্জীব শুয়ে থেকেছে তারা।

    কিন্তু ‘রস’ আইল্যান্ডে পৌঁছবার পর পায়ের তলায় মাটি পেয়ে খিদেটা ফের ফিরে আসে। পেট জ্বলে যাচ্ছিল তাদের। যেন দাউদাউ আগুন জ্বলছে। জাহাজেই চানটান সেরে নিয়েছিল। ‘রস’-এ নেমে ভাত ডাল মাছ তরকারি দিয়ে গলা অবধি ঠেসে তবে শান্তি। খাওয়াদাওয়া চুকলে ভালো করে যে জিরিয়ে নেবে তেমন ফুরসত পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে ছ’ ছ’টা বিয়ে হল। তারপর শ’ পাঁচেক উদ্বাস্তু তুলে নিয়ে ‘চলুঙ্গা’ জাহাজ মিডল আন্দামানে চলে গেল। বাকি যারা রইল, এতসব ঘটনার পর অপার ক্লান্তিতে তাদের চোখ জুড়ে এসেছে। ঝাড়ালো প্যাডক কি চুগলুম গাছের ছায়ায়, কিংবা বিরাট বিরাট পাথরের চাঁইয়ের আড়ালে-যে যেখানে পেরেছে, শুয়ে পড়েছে।

    বিভাসদের হাঁকাহাঁকিতে তারা ধড়মড় করে উঠে বসে। তারপর কলকাতার রিলিফ ক্যাম্পগুলো থেকে পার্থিব সম্পত্তি বলতে–টিনের বেড়ানো বাক্স, কথাকানি, ছেঁড়া শতরঞ্চিতে জড়ানো বিছানা, হাতা খুন্তি কড়াই যে যেটুকু পেরেছে নিয়ে এসেছে, সব জড়ো করে নিল।

    এদিকে উপসাগরের জল তোলপাড় করে, গম্ভীর ভো বাজিয়ে সেই লঞ্চ দুটো রস আইল্যান্ডের জেটিতে এসে ভিড়ল। দুই লঞ্চেরই খালাসিরা লোহার শেকল দিয়ে জলযান দুটোকে জেটির মোটা মোটা লোহার থামের সঙ্গে বেঁধে ফেলল। তারপর রেলিং লাগানো চওড়া কাঠের পাটাতন ফেলে লঞ্চের সঙ্গে জেটি জুড়ে দিল। এই ছোট পুল দিয়ে লঞ্চে উঠতে হবে।

    বিভাস, নিরঞ্জন এবং রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের ছেলেরা দারুণ করিৎকর্মা। হাতে পায়ে তাদের যেন বিদ্যুৎ খেলতে থাকে। ছোটাছুটি এবং হাঁকডাক করে উদ্বাস্তুদের জেটির কাছে জড়ো করে একে একে তাদের লঞ্চে তুলতে লাগল। সমস্ত কাজটার মধ্যে রয়েছে নিখুঁত শৃঙ্খলা।

    একটা লঞ্চ বোঝাই হয়ে গেলে বিভাস সেটায় উঠে পড়ে। লঞ্চটার নাম ‘সিগাল’। ‘সিগাল’ আর দাঁড়াল না, জল কেটে কেটে পোর্ট ব্লেয়ারের দিকে চলে গেল।

    প্রথম লঞ্চটা চলে যাবার পর পরের লঞ্চ ‘‘নটিলাস’-এ একই প্রক্রিয়ায় উদ্বাস্তুদের তুলে ফেলল নিরঞ্জনরা। সবাই উঠলে আন্দামানের চিফ কনজারভেটর অফ ফরেষ্ট ব্রজদুলাল মণ্ডল, চিফ মেডিকেল অফিসার ডাক্তার চট্টরাজ, হারবার মাস্টার সোমনাথ সেন, ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেট ও রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের ইন-চার্জ বিশ্বজিৎ রাহা এবং আরও কয়েকজন বড় মাপের অফিসার।

    অফিসার এবং পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা ছাড়াও পোর্ট ব্লেয়ারের আরও অনেক পুরনো বাঙালি বাসিন্দা উদ্বাস্তুদের স্বাগত জানাতে এসেছিল। বোঝাতে চেয়েছিল বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে সুদুর এই দ্বীপপুঞ্জে পূর্ব পাকিস্তানের ছিন্নমূল মানুষগুলোকে নির্বাসনে পাঠানো হয়নি। এখানেও তাদের অগুনতি শুভাকাক্ষী রয়েছে। সবসময় আত্মীয় পরিজনের মতো এরা পাশে থাকবে। দুটো মোটরলঞ্চে এই আন্দামানবাসী বাঙালিদের জায়গা হয়নি। ‘রস’ আইল্যান্ডের জেটিতে একজোড়া মোর্টর বোট বাঁধা রয়েছে। ছোট জলযান দুটো তাদের নিয়ে আসবে।

    যে দুই স্টিম লঞ্চ উদ্বাস্তুদের নিয়ে সেসোস্ট্রেস বের জল কেটে কেটে এগিয়ে চলেছে তার একটার নাম ‘সি-গাল’, অন্যটা ‘‘নটিলাস’। এই তো সবে ইংরেজ রাজত্বের অবসান হল। তাদের দেওয়া লঞ্চের নামগুলো এখনও টিকে আছে।

    ‘‘নটিলাস’-এর দোতলার ডেকে রেলিং ধরে দূরমনস্কর মতো তাকিয়ে ছিল বিনয়। চারপাশের দৃশ্যাবলি ছাপিয়ে একটি মুখ স্থিরচিত্রের মতো চোখের সামনে কোনও অদৃশ্য ফ্রেমে আটকে আছে। পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠল, ‘ছুটোবাবু–’

    ঘুরে দাঁড়াতেই বিনয়ের চোখে পড়ল হলধর সূত্রধর। বুড়োটে, কুঁজো ধরনের লোকটার আদি বাড়ি ছিল রাজদিয়ার কাছাকাছি একটা গ্রাম-গিরিগঞ্জে। দেশে থাকতে মাঝে মাঝে হেমনাথের কাছে আসত সে। দেশভাগের পর কোথায় ছিটকে পড়েছিল, বিনয় জানে না। অনেক কাল বাদে এই সেদিন দমদমের এক ত্রাণশিবিরে তার সঙ্গে দেখা। তারপর স্টিমশিপ ‘মহারাজায়। তারপর ‘নটিলাস’ লঞ্চে।

    বিনয় জিগ্যেস করে, ‘কিছু বলবেন?’

    ‘হ—’ আস্তে মাথা নাড়ে হলধর।

    সামান্য কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকে বিনয়।

    হলধর বলে, ‘শুনাশুন একহান কথা কানে আইছে।’

    ‘কী?’

    ‘আমাগে নিকি (নাকি) পুট বিলাসে (পোর্ট ব্লেয়ার) রাখব না। মেলা (অনেক) দূরে জঙ্গলে লইয়া যাইব। হেগুলা (সেসব) কেমুন জাগা (জায়গা), কেঠা জানে।’

    খবরটা নতুন নয়। নিরঞ্জন আগেই বিনয়কে জানিয়েছে, পোর্ট ব্লেয়ার শহর থেকে তিরিশ-চল্লিশ মাইল পশ্চিমে উদ্বাস্তুদের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়েছে। বসানো হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। পূর্ব বাংলার ছিন্নমূল মানুষদের বাসস্থান। সেই এলাকাগুলো ঠিক কী ধরনের সে সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা নেই বিনয়ের।

    হলধর বলতে লাগল, ‘হোনলাম (শুনলাম) যেইহানে আমাগো লইয়া যাইব হের (তার) চাইর পাশে আলিসান আলিসান জঙ্গল। জংলি জারোরা (জারোয়ারা) কাছাকাছিই থাকে। বিষমাখা তির ফ্যাকে (ছোড়ে)।

    বিনয় রীতিমতো অবাক। গিরিগঞ্জের হলধর সূত্রধর, যে কোনওদিন স্কুলের ধারাকাছে ঘেঁষেনি, অক্ষরপরিচয়হীন বেজায় সাদাসিধে, দেশভাগের আগে বিক্রমপুরের চৌহদ্দির বাইরে কখনও কোথাও যায়নি, বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ‘রস’ আইল্যান্ডে পৌঁছেছিল। এখন স্টিমঞ্চ ‘নটিলাস’-এ পোর্টব্লেয়ার চলেছে। এই সময়টুকুর মধ্যে কত তথ্যই না সংগ্রহ করে ফেলেছে।

    হলধর থামেনি। ‘জারোরা নিকি কয়জন ‘রিফুজ’রে মাইরা ফালাইছে। ছুটোবাবু, ডরে বুক কাপে।’

    হলধরকে বিনয়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখে আরও পনেরো-কুড়িজন উদ্বাস্তু ডেকের নানা দিক থেকে চলে এসেছে। সবারই মুখ চেনা। দু-চার জনের নামও জানে বিনয়। দেশ থেকে উৎখাত হয়ে হলধরের সঙ্গে এরা দমদমের ত্রাণশিবিরে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছে। সবার চোখেমুখে গভীর উৎকণ্ঠার ছাপ। সৃষ্টিছাড়া আদিম অরণ্যে হিংস্র জারোয়াদের পাশাপাশি থাকতে হবে, হলধরের মতো এই খবরটা নিশ্চয়ই তারাও পেয়ে গেছে। এদেরই একজন মাখন রুদ্রপাল বলল, ‘জারোগো হাতে মারণের লেইগা কি গরমেন (গভর্নমেন্ট) আমাগো এই আন্ধারমান দ্বীপি লইয়া আইল ছুটোবাবু?’ হলধরের দেখাদেখি দমদম ক্যাম্পের আরও অনেকেই বিনয়কে ‘ছুটোবাবু’ বলে।

    ইন্ডিয়ার মেনল্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হাজার মাইল দূরের এই দ্বীপপুঞ্জে জঙ্গলের ভেতর এখানকার আদি বাসিন্দাদের তীরের মুখে শরণার্থীদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেখানেই হবে তাদের নতুন স্থায়ী বাসস্থান, ভাবতেই ভীষণ অস্বস্তি হতে থাকে বিনয়ের। দেশ ছেড়ে চলে আসার পর শিয়ালদা স্টেশনে আর ত্রাণশিবিরে কী নিদারুণ দুর্গতির মধ্যে যে এদের দিন কেটেছে। সেটাকে বেঁচে থাকা বলে না। ক্ষয়ে ক্ষয়ে তারা শেষ হয়ে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ভয়, দ্বিধা কাটিয়ে আন্দামানের জাহাজে উঠেছে। তাদের জানানো হয়েছে সমুদ্রের মাঝখানে তাদের যে নিজস্ব বাসভূমি হবে তা সম্পূর্ণ নিরাপদ, ঝাটমুক্ত। পূর্ব বাংলার গ্রামে গ্রামে যে জীবন তারা চিরতরে ফেলে এসেছে, ফের তা গড়ে তুলবে অসীম পরিশ্রমে অফুরান মমতায়। যা হারিয়েছে তার বহুগুণ ফিরে পাবে। সমস্ত অনিশ্চয়তা এবং ক্লেশের অবসান ঘটবে। কিন্তু আন্দামানে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে যে সব খবর হলধররা পেয়েছে। তাতে ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েছে।

    এই যে এতগুলো সর্বহারানো মানুষ ঘোর অনিচ্ছায় সমুদ্র পাড়ি দিয়ে চলে এসেছে সেজন্য বিনয়ও কম দায়ী নয়। সে হলধরদের বুঝিয়েছে, ত্রাণশিবিরে যৎসামান্য সরকারি খয়রাতের ওপর নির্ভর করে আমেরিকান টমিদের ফেলে যাওয়া ব্যারাকের ঘুপচি কামরায় কামরায় কষ্টে, গ্লানিতে বাকি জীবন কাটানো অসম্ভব। তা ছাড়া তাদের ছেলেমেয়েরা আছে। তাদের ভবিষ্যৎ আছে। এই সন্তান সন্ততিদের কথাও তো ভাবতে হবে। তারা কি চিরকাল ত্রাণশিবিরে নিজেদের গায়ে ‘রিফিউজি’ তকমা লাগিয়ে কাটিয়ে দেবে? আন্দামানে গেলে উর্বর জমি মিলবে। ধান বোনো, আনাজের চাষ করো, শস্যের লাবণ্যে ভরে যাবে মাঠ। সমুদ্রে আছে অফুরন্ত মাছ, জঙ্গলে হরিণ। একটু খাটলে আমৃত্যু খাদ্যের অভাব হবে না। তাছাড়া তাদের সাহায্য করার জন্য রয়েছে নানারকম সরকারি সাহায্য, অনুদান।

    বিনয়ের ধারণা ছিল, পোর্টব্লেয়ার শহরের আশেপাশে উদ্বাস্তুদের গ্রাম বসানো হচ্ছে। কিন্তু এখানে পৌঁছনোর পর অন্যরকম শোনা যাচ্ছে। যদি শরণার্থীরা বিপন্ন হয়ে পড়ে তাদের শেষ অবলম্বনটুকু ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। হঠাৎ মনে পড়ল, এর আগে চার-পাঁচ খেপে কয়েক হাজার শরণার্থীকে এখানে আনা হয়েছে। তারা কোথায় আছে, কেমন আছে, জানা নেই। যদি ভালো না থাকে, নিশ্চয়ই অভিযোগ শোনা যেত। পরক্ষণে খেয়াল হল, ওটা তো কলকাতা শহর নয় যে ভালো বা মন্দ সমস্ত খবর লহমায় লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে। পৃথিবীর জনারণ্য থেকে বহুদুরে দুর্গম জঙ্গলের খাঁজের ভেতর উদ্বাস্তুদের আদৌ কোনও সমস্যা হচ্ছে কিনা, হলে কী ধরনের সমস্যা–তা সহজে জানার উপায় নেই। বিনয়ের মনে কিছুটা ধন্দ দেখা দিয়েই চকিতে মিলিয়ে গেল। ছিন্নমূল মানুষগুলো তেমন কোনও সংকটে যদি পড়েই থাকে, সরকারি দপ্তর তার মতো একজন সাংবাদিককে নিশ্চয়ই আন্দামনে পুনর্বাসনের কাজকর্ম দেখাতে নিয়ে যেত না। কেননা, এখান থেকে সে যে প্রতিবেদন লিখে পাঠাবে, তাতে মেনল্যান্ডে সব জানাজানি হয়ে যাবে। পশ্চিমবঙ্গে এর মধ্যেই উদ্বাস্তুদের নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো টানাহ্যাঁচড়া শুরু করে দিয়েছে। রোজই কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় আর পার্কগুলোতে মিছিল, মিটিং, স্লোগান। আন্দামানে এসে শরণার্থীদের দুর্গতির শেষ নেই, সত্যিই যদি তেমনটা হয়ে থাকে আর তা জানাজানি হয়ে যায়, কলকাতায় আগুন জ্বলে যাবে। ত্রাণ শিবিরগুলোতে বা শিয়ালদায় বছরের পর বছর যারা পড়ে আছে তাদের একজনকেও আর আন্দামানের জাহাজে তোলা সম্ভব হবে না। এখানকার পুনর্বাসন প্রক্রিয়া পুরোপুরি বানচাল হয়ে যাবে।

    হলধররা একদৃষ্টে বিনয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। বিনয় বলল, আপনাদের মতো আমিও শুনেছি জারোয়ারা তাদের কাছাকাছি এলাকায় নতুন কারওকে দেখলে তির ছোড়ে। কিন্তু কলকাতা থেকে নিয়ে এসে আপনাদের বিপদের মধ্যে ফেলে দেওয়া হবে, তা তো আর হয় না। সরকার জারোয়াদের ঠেকাবার জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা কি আর করেনি?

    ঘুরিয়ে একরকম মিথ্যেই বলতে হল। উদ্বাস্তুদের নিরাপত্তার জন্য কোনওরকম বন্দোবস্ত করা হয়েছে কিনা, বিনয়ের জানা নেই। কিন্তু সত্যিটা বললে হলধররা আরও ভয় পেয়ে যাবে। পোর্ট ব্লেয়ারে নেমে হয়তো এমন বেঁকে বসবে যে জঙ্গলে যেখানে তাদের জন্য জমি ঠিক করে রাখা আছে তাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া যাবে না। তুমুল হইচই বাধিয়ে একটা বিশ্রী পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলবে।

    মাখন রুদ্রপাল চতুর লোক। হলধরের পাশ থেকে সে বলে ওঠে, মনে লয় (হয়), জারোগো ব্যাপারে সরকার কী ব্যাবোস্তা করছে, আপনে পুরাটা জানেন না। ডেকের অন্য দিকে, বেশ খানিকটা দূরে, সেনসাহেব, মণ্ডলসাহেব, ডাক্তার চট্টরাজ, বিশ্বজিৎ রাহা এবং আরও কয়েকজন অফিসার কিছু আলোচনা করছিলেন। তাদের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল মাখন। উই ছারেগো (স্যারদের) আমাগো কথা ইট্ট বুজাইয়া কইয়েন ছুটোবাবু। দ্যাশ ছাইড়া আহনের পর কত কষ্ট যে পাইছি হের (তার) লিখাজুখা (লেখাজোখা) নাই। আন্ধারমান দ্বীপি বড় আশা লইয়া আইছি। ওনারা য্যান দ্যাহেন আমাগো এইহানে মরতে না হয়।

    মাখন সার সত্যটা এর মধ্যেই বুঝে গেছে। বিশ্বজিৎ রাহা, মণ্ডলসাহেব, সেনসাহেবরাই তাদের আসল রক্ষাকর্তা। বিনয়ের বেশ মজাই লাগে। বলল, আপনারাই গিয়ে ওঁদের বলুন না

    হলধরের হয়তো মনে হল, বিনয় বিরক্ত হয়েছে। মাখন ফের কী বলতে যাচ্ছিল, গলার স্বর চড়িয়ে তাকে থামিয়ে দিল।–‘তুমি চুপ যাও। কারে কী কইতে হয় জানো না। ছুটোবাবু যা ভালা বুঝবেন হেয়া (তা) করবেন।’ বিনয়কে বলল, ‘আপনেই আমাগো বলভরসা। মাখনার কথায় কিছু মনে কইরেন না।’

    বিনয় একটু হাসল। সরকারি অফিসারদের কাছে তাদের হয়ে দরবার করার জন্য মাখন যে তাকে ধরেছে তাতে হলধর খুবই অসন্তুষ্ট এবং বিব্রতও। বিনয়ের ওপর তার অগাধ আস্থা। যা যা করলে এই অজানা দ্বীপপুঞ্জে তাদের নতুন জীবন হবে অবাধ, ভয়শূন্য আর নিশ্চিন্ত, রাজদিয়ার হেমকর্তার নাতি তাই করবে। সাউকারি করে মাখনের পরামর্শ দেবার দরকার নেই।

    হলধর বলল, ‘একহান কথা জিগামু ছুটোবাবু?’ আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়।-–‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।’

    দূরে বিশ্বজিৎ রাহাকে দেখিয়ে হলধর বলল, ‘তেনি তহন (তিনি তখন) পুট বিলাসে (পোর্ট ব্লেয়ার) তেনার বাড়ি আপনেরে থাকনের কথা কইলেন।’

    বিনয় অবাক। ‘রস’ আইল্যান্ডে মহারাজা’ জাহাজ থেকে নামার পর জগদীশ গুহঠাকুরতার চিঠি বিশ্বজিৎকে দেবার পর তিনি যে তাকে তার বাংলোতে থাকার কথা বলেছিলেন সেটা তাহলে লক্ষ করেছে হলধর!

    বিনয় বলল, ‘হ্যাঁ, বলেছেন তো—’

    হাতজোড় করে হলধর বলল, ‘আপনেরে কিলাম আমরা ছাড়ুম না ছুটোবাবু। আপনের ভরসাতেই আন্ধারমানে আইছি। আমাগো লগে আপনেরে জঙ্গল যাইতেই লাগব।নাইলে পুট বিলাস থিকা আমরা এক পাও লডুম (নড়ব) না।’

    তার সঙ্গীরা একই কথা বলে। এমনকী মাখনও।

    আন্দামানের বিজন অরণ্যে বিনয়ই তাদের একমাত্র অবলম্বন। খড়কুটোর মতো তাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে হলধররা। লহমার জন্য চোখের আড়াল করতে চায় না।

    যেখানে যেখানে উদ্বাস্তুদের বসতি গড়ে উঠছে সেইসব এলাকায় যাবার জন্যই বিনয়ের আন্দামনে আসা। বিশ্বজিতের সঙ্গে আলাপ হবার পর ভেবেছিল, দু-একদিন পোর্ট ব্লেয়ারে তার বাংলোয় থাকবে। এখানকার পুনর্বাসন সম্পর্কে তার কাছ থেকে নিশ্চয়ই প্রচুর তথ্য পাওয়া যাবে। কেননা রিহ্যাবিলিটেশনের বেশির ভাগ দায়িত্বই তার। কিন্তু হলধররা তাকে কিছুতেই ছাড়বে না। সে বিশ্বজিতের বাংলোয় গেলে ওদের মনোবল ভেঙে পড়বে। তার ওপর এত মানুষের এত বিশ্বাস তুচ্ছ করার বস্তু নয়।

    বিনয় বলল, ‘ঠিক আছে, আপনাদের সঙ্গেই যাব।’

    চারপাশের মুখগুলো থেকে উৎকণ্ঠার ছাপ ধীরে ধীরে মুছে যেতে থাকে। হলধররা আর দাঁড়ায় না। ডেকের অন্য প্রান্তে চলে যায়।

    এতক্ষণ হলধরদের নিয়ে ব্যস্ত ছিল বিনয়। ওরা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝিনুকের চিন্তাটা চারপাশ থেকে তার মাথায় ঝাঁপিয়ে পড়ে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগহনগোপন – প্রফুল্ল রায়
    Next Article শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    ছোটগল্প – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.