Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    সত্যজিৎ রায় এক পাতা গল্প9 Mins Read0

    শতদল সংস্থার সেক্রেটারি প্রণবেশ দত্ত বিস্ফোরক সংবাদটি ঘোষণা করবার পর উপস্থিত সদস্যদের মুখ দিয়ে প্রায় এক মিনিট কোনো কথা বেরোল না। ক্লাব ঘরে জরুরী মিটিং বসেছে নববর্ষের পাঁচদিন আগে। মিটিং-এর উদ্দেশ্য প্রণবেশ জানায়নি কাউকে, কেবল বলেছে আজ সকলের আসা চাই-ই, কারণ সংকটময় মুহূর্ত সমুপস্থিত।

    প্রথম মুখ খুলল জয়ন্ত সরকার।

    ‘আর ইউ অ্যাবসোলিউটলি শিওর?’

    জয়ন্ত লাগসই ইংরিজির হদিস পেলে বাংলা বলে না।

    ‘বিশ্বাস না হয় চিঠি দেখ,’ বলল প্রণবেশ। ‘এই ত। সমরকুমারের নিজের সই। আরো শিওরিটির দরকার আছে কি?’

    সমরকুমারের চিঠিটা হাত ঘুরে আবার প্রণবেশের কাছেই ফিরে এল। হ্যাঁ, সমরকুমারেরই সই বটে। ফিল্ম পত্রিকার দৌলতে এই সই কারুর চিনতে বাকি নেই—বিশেষ করে হ্রস্ব উ-এর ওই ডবল প্যাঁচ।

    ‘কারণটা কী বলছে?’ প্রশ্ন করল নরেন গুঁই।

    ‘শুটিং,’ বলল প্রণবেশ, ‘হঠাৎ আউটডোর পড়ে গেছে কালিমপঙে। অতএব ভেরি সরি।’

    ‘আশ্চর্য, বলল শান্তনু রক্ষিত। ‘লোকটা ইয়েস বলে স্রেফ নো করে দিল?’

    নরেন গুঁই বলল, ‘আমি ত গোড়াতেই বলেছিলাম—ওসব চিত্রতারকা-ফারকা বাদ দে। ওদের কথার কোনো ভ্যালু নেই।’

    ‘হোয়াট এ ক্যাটাসট্রফি!’ কপালের ঘাম মুছে বলল জয়ন্ত সরকার।

    ‘এর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা হয় না?’ প্রশ্ন করল চুনিলাল সান্যাল। চুনিলাল স্থানীয় বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউটে বাংলার শিক্ষক।

    ‘এই লাস্ট মোমেণ্টে আর কী বিকল্প ব্যবস্থা আশা করছ চুনিদা’, বলল সেক্রেটারি প্রণবেশ। ‘আর আমি ত চুপচাপ বসে নেই। এর মধ্যে দুবার ট্রাঙ্ককল করেছি কলকাতায়। নিমুর সঙ্গে কথা হয়েছে। বললাম গাইয়ে বাজিয়ে নাচিয়ে খেলুড়ে যা হয় একটা ধর। সম্বর্ধনা অ্যানাউন্স করা হয়ে গেছে, মানপত্র লেখা হয়ে গেছে। সম্বর্ধনা আমাদের দশ বছরের ট্র্যাডিশন, ওটা ছাড়া ফাংশন হবে না। নিমু বললে, নো চান্স। এক কলকাতাতেই সাত-সাতটা সংস্থা সম্বর্ধনার আয়োজন করেছে। ক্যানডিডেটের চয়েস ত বেশি নেই। নামকরা যে কজন আছে সবাই এংগেজ্‌ড। পল্টু ব্যানার্জিকে ত একদিন দু-জায়গায় সম্বর্ধনা নিতে হচ্ছে; তাও একই শহরে বলে পারছে। শ্যামল সোম, রজত মান্না, হরবিলাস গুপ্ত, দেবরাজ সাহা—সব বেটাকে এক ধার থেকে কোনো-না কোনো ক্লাব বুক করে রেখেছে।’

    ‘তুমি যে মানপত্রের কথা বললে’, বললেন ইন্দ্রনাথ রায়—যিনি এখানে সকলের বয়োজ্যেষ্ঠ—‘সমরকুমারের জন্য যে মানপত্র লেখা হয়েছে সেটা তুমি অন্যের ঘাড়ে চাপাবে কি করে?’

    ‘আপনি বোধহয় মানপত্রটা দেখেননি, ইন্দ্রদা,’ বলল প্রণবেশ।

    ‘না, দেখিনি।’

    ‘তাই। ওঁর কোথাও ফিল্মস্টার বা ফিল্মের কোনো কথা নেই। অ্যাড্রেস করা হয়েছে “হে সুধী” বলে। সুধী ত এনিওয়ান হতে পারে।’

    ‘দেখি মানপত্রটা।’

    দেরাজ থেকে একটা পুরু পাকানো কাগজ বার করে সেটা ইন্দ্রনাথ রায়ের হাতে দিয়ে দিল প্রণবেশ।—‘এটা লিখতে মনোতোষের ঝাড়া সাতদিন লেগেছে। ভাষাটা অবিশ্যি চুনিদার।’

    চুনিলাল খুক্‌ করে একটা কাশি দিয়ে তার অস্তিত্বটা জানান দিল।

    ‘ “তোমার প্রতি চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের সীমা নাই”—একি, একি—এ যে চেনা-চেনা মনে হচ্ছে!’

    পাকানো কাগজটা খুলে ধরেছেন ইন্দ্রনাথ। তাঁর কপালে খাঁজ, দৃষ্টি চুনিলালের দিকে।

    ‘তা ত হবেই,’ বলল চুনিলাল, ‘রবীন্দ্র-জয়ন্তীতে উৎসব কমিটির পক্ষ থেকে স্যার জগদীশ বোস-কবিগুরুকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। ভাষাটা শরৎচন্দ্রের। এটা তার প্রথম লাইন।’

    ‘সে লাইন তুমি বেমালুম লাগিয়ে দিলে?’

    ‘কোটেশনে আপত্তি কিসের ইন্দ্রদা? এ ত বিখ্যাত পংক্তি, শিক্ষিত বাঙালী মাত্রেই চিনবে। এর চেয়ে ভালো ধরতাই হয় না।’

    ‘আর কটা কোটেশন আছে এতে?’

    ‘আর নেই ইন্দ্রদা,’ বলল চুনিলাল। ‘বাকিটা সম্পূর্ণ মৌলিক।’

    মানপত্র টেবিলের উপর ফেলে দিয়ে একটা হাই তুলে ইন্দ্রনাথ বললেন, ‘তাহলে বোঝ এখন তোমরা কী করবে।’

    অক্ষয় বাগচীর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, মেজাজও বেশ ভারিক্কি। তিনি একটা উইল্‌স ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘নামের মোহটা যদি ত্যাগ করতে পার ত আমি একজনের নাম সাজেস্ট করতে পারি। সম্বর্ধনা ছাড়া যখন ফাংশন হবে না, তখন তার কথাটা তোমরা ভেবে দেখতে পার।’

    ‘নামের কথাটা যে এখন ভুলে যেতে হবে সে ত বুঝতেই পারছি’, বলল প্রণবেশ। ‘তবে তাই বলে ত আর রাস্তা থেকে লোক ডেকে রিসেপশন দেওয়া যায় না। কোনো একটা কনট্রিবিউশন ত থাকতে হবে লোকটার!’

    ‘আছে’, বললেন অক্ষয় বাগচী, ‘এঁর আছে।’

    ‘কার কথা বলছেন আপনি?’ ঈষৎ অসহিষ্ণুভাবে প্রশ্ন করল প্রণবেশ।

    ‘হরলাল চক্রবর্তী।’

    নামটা উচ্চারণ করার পরে ক্লাব ঘরে বেশ কয়েক মুহূর্তের নৈঃশব্দ্য। উপস্থিত সভ্যদের অনেকেই যে এ নামটা শোনেনি সেটা বোঝা যাচ্ছে। কেবল ইন্দ্রনাথ রায় কিছুক্ষণ ভ্রূকুঞ্চিত করে থেকে অক্ষয় বাগচীর দিকে চেয়ে বললেন, ‘হরলাল চক্রবতী মানে আর্টিস্ট হরলাল চক্রবতী?’

    ‘হ্যাঁ, আর্টিস্ট’, মাথা নেড়ে বললেন অক্ষয় বাগচী। ‘আমরা ছেলেবেলা থেকে তাঁর আঁকা ছবি দেখে এসেছি গল্পের বইয়ে। বেশির ভাগ পৌরাণিক ছবি। এককালে খুব পপুলার ছিলেন। ছেলেদের পত্রিকাতেও ছবি আঁকতেন রেগুলারলি। আমার মনে হয় তেলা মাথায় তেল দেওয়ার চেয়ে এইটে অনেক ভালো হবে।’

    ‘কথাটা মন্দ বলনি অক্ষয়’, সোজা হয়ে উঠে বসে বললেন ইন্দ্রনাথ। ‘আমি এ প্রস্তাব সমর্থন করছি। আমারও এখন পষ্ট মনে পড়ছে তাঁর আঁকা ছবি। আমাদের বাড়িতে কাশীদাসের একটা এডিশন ছিল, তাতে তাঁরই আঁকা ছবি ছিল।’

    ‘ভালো ছবি?’ প্রশ্ন করল জয়ন্ত সরকার। ‘মানে, যাকে দেওয়া হবে সম্বর্ধনা—ডাজ হি ডিজার্ভ ইট?’

    এবার নরেন গুঁই নড়েচড়ে বসল।—‘মনে পড়েছে। আমার বাড়িতে একটা হাতেমতাই ছিল। তার ছবিতে এইচ্‌ চক্রবতী সই ছিল। মনে পড়েছে।’

    ‘এনি গুড?’ জিগ্যেস করল জয়ন্ত সরকার।

    ‘বটতলার বাবা।’

    কথাটা বলে নরেন গুঁই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বয়োজ্যেষ্ঠদের দৃষ্টির আড়ালে সিগারেটে দুটো টান মেরে আসতে হবে।

    ‘ছবি ভালো কি মন্দ সেটা বড় কথা নয়,’ বললেন ইন্দ্রনাথ রায়। ‘লোকটা একটানা বহুকাল ধরে কাজ করে গেছে। অক্লান্ত কর্মী। চাহিদা যখন ছিল তখন নিশ্চয়ই পপুলারিটি ছিল। অথচ বাগচী যেটা বলল, যাকে বলে রেকগনিশন, সে জিনিস সে নিশ্চয় পায়নি! সেটা শতদল সংস্থা তাকে দেবে।’

    ‘আর সবচেয়ে বড় কথা,’ বললেন অক্ষয় বাগচী, ‘আর সুবিধের কথা—সে এই শহরেরই লোক। তার জন্য কলকাতা ছুটোছুটি করতে হবে না।’

    ‘আরেব্বাস,’ বলল প্রণবেশ, ‘এটা ত জানা ছিল না!’

    তথ্যটা উপস্থিত সকলের কাছেই নতুন বলে ক্লাব ঘরে একটা গুঞ্জন সুরু হয়ে গেছে।

    ‘কিন্তু তিনি কোথায় থাকেন…?’ প্রণবেশ অক্ষয় বাগচীর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিল।

    ‘আমি জানি,’ বললেন বাগচী। ‘কুমোরপাড়ার শেষ মাথায় যেখানে রাস্তা দুভাগ হয়ে গেছে, সেটা ধরে বাঁয়ে কিছুদূর গেলেই মন্মথ ডাক্তারের বাড়ি। তিনি একবার বলেছিলেন হরলাল চক্রবর্তী তাঁর প্রতিবেশী।’

    ‘আপনি তাঁকে চেনেন? হরলালকে?’

    ‘চিনি মানে, বছর পাঁচেক আগে একবার মুখুজ্যেদের বাড়িতে দেখেছিলাম। এক ঝলকের দেখা আর কি। বোধহয় ওদের বাড়ির জন্য কিছু ছবি আঁকছিলেন।’

    ‘কিন্তু’—প্রণবেশের মনে এখনো খট্‌কা।

    ‘কিন্তু কী?’ জিগ্যেস করলেন ইন্দ্রনাথ রায়।

    ‘না, মানে, নামটা ত অ্যানাউন্স করতে হবে যদি উনি রাজি হন সম্বর্ধনা নিতে।’

    ‘তাতে কী হল?’

    ‘লোকে যদি সে-নাম না শুনে থাকে, তাহলে…’

    ‘তাহলে ভাববে এ আবার কাকে সম্বর্ধনা দেওয়া হচ্ছে—তাই ত?’

    ‘হ্যাঁ, মানে—’

    ‘কিছু না। নামের আগে জুড়ে দেবে “প্রখ্যাত প্রবীণ চিত্রশিল্পী”—ব্যস্‌। যারা তাঁর নাম জানে না তারা জানুক। এটাও ত শতদল সংস্থার একটা দায়িত্ব, নয় কি?’

    ‘রেসকিউইং ফ্রম ওবলিভিয়ন,’ বললে জয়ন্ত সরকার। ‘ভেরি গুড আইডিয়া।’

    আইডিয়াটা যে ভেরি গুড সেটা মোটামুটি সকলেই মেনে নিল। উৎসাহের নিভু-নিভু আগুন ইন্ধন পেয়ে আবার হল্‌কে উঠল। সকলেই স্বীকার করল যে এতে শতদল সংস্থার প্রেস্টিজ বাড়বে বই কমবে না। তারা যেটা করতে চলেছে সেটা মামুলি সম্বর্ধনা নয়, সেটা একটা সামাজিক কর্তব্যও বটে! হয়ত এটাই হবে ভবিষ্যতের রেওয়াজ। বাঙলার যেসব কৃতী সন্তান অন্ধকারে পড়ে আছেন তাঁদের আলোতে তুলে ধরা।

    ঠিক হল অক্ষয় বাগচী নিজে যাবেন প্রণবেশ ও ক্লাবের আরেকটি সভ্যকে নিয়ে হরলাল চক্রবর্তীর বাড়ি। কাল সকালেই যাওয়া দরকার, কারণ আর সময় নেই। চক্রবর্তী মশাই রাজি হলে, ক্লাবের প্রেসিডেণ্টকে জানিয়ে পোস্টারে সমরকুমারের জায়গায় নতুন নামটা বসিয়ে দিতে হবে। নামের আগে অবিশ্যি ‘প্রখ্যাত প্রবীণ চিত্রশিল্পী’ কথাটা বাদ দিলে চলবে না।

    গোলাপী রঙের একতলা বাড়ির ফটকে ‘হরলাল চক্রবর্তী, আর্টিস্ট’ ফলক থাকায় কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেল। অক্ষয় বাগচী ভুল বলেননি; এই বাড়ির দুটো বাড়ি পরেই মন্মথ ডাক্তারের বাসস্থান। প্রণবেশ ও বাগচীমশাই ছাড়া সঙ্গে এসেছেন বাংলার শিক্ষক চুনিলাল সান্যাল।

    তিনজনে গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলেন।

    বাড়ির সামনে ছোট্ট একটা ফুলের বাগান, তাতে একটা আমড়া গাছ। পরিবেশ ছিমছাম হলেও সচ্ছলতার কোনো পরিচয় নেই। বোঝাই যাচ্ছে হরলাল চক্রবর্তীর ভাগ্যে যে শুধু খ্যাতিই জোটেনি তা নয়, অর্থোপার্জনের ব্যাপারেও তিনি তেমন সুবিধে করতে পারেননি।

    দরজায় টোকা দেবার আর দরকার হল না, কারণ পক্ক গুম্ফবিশিষ্ট চশমা-পরিহিত এক ভদ্রলোক, হয়ত জানালা দিয়ে আগন্তুকদের দেখেই, দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। পরনে লুঙ্গি করে পরা ধুতির উপর লাম্বাহাতা জালিদার গেঞ্জি।

    অক্ষয় বাগচী নমস্কার করে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘আপনার বোধহয় মনে নেই, বছর পাঁচ-সাত আগে ধরণী মুখুজ্যের বাড়িতে একবার আপনার সঙ্গে সামান্য আলাপ হয়েছিল।’

    ‘ও—’

    ‘একটা ইয়ে, মানে, কথা ছিল আপনার সঙ্গে,’ বলল প্রণবেশ। ‘একটূ বসা যায় কি?’

    ‘আসুন না।’

    দরজা দিয়ে ঢুকেই বাঁয়ে বৈঠকখানা। কিছু বাঁধানো পেন্টিং, তাতে ইংরিজিতে এইচ্‌ চক্রবতী সই সুস্পষ্ট। এ ছাড়া অনাড়ম্বর পরিবেশ। তক্তপোষ ও কাঠের চেয়ার মিলিয়ে সকলেরই বসার জায়গা হয়ে গেল।

    ‘আমরা আসছি শতদল সংস্থার পক্ষ থেকে,’ বলল প্রণবেশ।

    ‘শতদল সংস্থা?’

    মানপত্র

    ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। একটা ক্লাব। এখানের খুব নামকরা ক্লাব। বরদাবাবু—বরদা মজুমদার এম, এল, এ—আমাদের প্রেসিডেণ্ট।’

    ‘ও।’

    ‘আমরা প্রতি বছর পয়লা বৈশাখ একটা ফাংশন করি। একটু গান-বাজনা হয়, একটা একাঙ্ক নাটিকা, আর তার সঙ্গে, বাংলার সংস্কৃতির ব্যাপারে যাঁর কিছু অবদান আছে এমন একজনকে আমরা সম্বর্ধনা দিই। এবার আপনার কথাটাই মনে পড়ল। আপনি আমাদের শহরের লোক, অথচ, মানে, তেমন করে ত কেউ আপনাকে চেনে না…’

    ‘হুঁ—। পয়লা বৈশাখ?’

    ‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

    ‘সে ত আর মাত্র চারদিন।’

    ‘হ্যাঁ। মানে, একটু লেট হয়ে গেল। কতকগুলো—’ প্রণবেশ গলা খাঁক্‌রে নিল—‘অসুবিধা ছিল।’

    ‘বুঝলাম। তা, সম্বর্ধনা মানে…?’

    ‘কিছুই না। ছ’টা নাগাদ আমরা এসে আপনাকে নিয়ে যাব গাড়িতে করে। সন্ধ্যা ছ’টা। আপনার আইটেমটা একদম শেষে। আপনাকে একটা মানপত্র দেওয়া হবে, ইনি—মিস্টার বাগচী—আপনার সম্বন্ধে দুটো কথা বলবেন, আর শেষে আপনিও যদি দুকথা বলেন তাহলে ত কথাই নেই। ন’টার মধ্যে ফাংশন শেষ।’

    ‘হুঁ—।’

    ‘আপনার বাড়ির লোক, মানে, আপনার স্ত্রী…’

    ‘উনি ত বাতের রুগী।’

    ‘ও। তা আপনি যদি আর কাউকে নিয়ে যেতে চান…’

    ‘সেটা দেখা যাবে ’খন।’

    এবার অক্ষয় বাগচী একটা কাজের কথা পাড়লেন।

    ‘আপনার সম্বন্ধে একটা ইনট্রোডাকশন দিতে পারলে ভালো হত।’

    ‘ঠিক আছে। আমি কিছু তথ্য লিখে রাখব একটা কাগজে। আপনারা কাল যদি কাউকে পাঠিয়ে দেন—’

    ‘আমি নিজেই এসে নিয়ে যাব,’ বলল প্রণবেশ।

    শতদল সংস্থার তিন সদস্য উঠে পড়লেন। হরলাল চক্রবর্তী যেন এতক্ষণে ব্যাপারটা উপলব্ধি করেছেন। তাঁর চোখের কোণ চিক্‌চিক্‌ করছে বলে মনে হল প্রণবেশের।

    অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার যে সুনাম আছে শতদল সংস্থার, এই পয়লা বৈশাখেও সেটা অক্ষুণ্ণ রইল। হরলাল চক্রবর্তীর নাম শুনে ‘ইনি আবার কিনি’ বলে যে প্রশ্ন উঠেছিল, সম্বর্ধনার পরে সে প্রশ্ন আর কেউ করেনি। সরকারী আর্ট স্কুলে তাঁর ছাত্রজীবন, পেশাদারী শিল্পী হিসাবে আত্মপ্রতিষ্ঠার পিছনে তাঁর অক্লান্ত স্ট্রাগল, পৌরাণিকী সিরিজের ছাপ্পান্নখানা বই ও অজস্র শিশু পত্রিকার পাতায় তাঁর ছবি, রায়বাহাদুর এল. কে. গুপ্তর প্রশংসাপত্র, বর্ধমান মহারাজাধিরাজ কর্তৃক প্রদত্ত রৌপ্য পদক এবং সবশেষে ডান হাতের বুড়ো আঙুলে আরথ্রাইটিস রোগের আক্রমণ হেতু বাষট্টি বছর বয়সে চিত্রাঙ্কন থেকে অবসর গ্রহণ—এসবই তথ্য আজ এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলেই অবগত হলেন। হরলাল নিজে শতদল সংস্থার উদ্যমের প্রশংসা করে শুধু একটি কথাই বললেন—‘এই প্রশংসাপত্র আমার প্রাপ্য নয়।’ তাঁর বিনয়সূচক এই উক্তি অবিশ্যি সকলের মনেই গভীরভাবে রেখাপাত করল।

    পুষ্পমাল্য ও ফ্রেমে বাঁধানো মানপত্র নিয়ে হরলাল যখন ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেণ্ট নীহার চৌধুরীর গাড়িতে উঠছেন তখন তিনি বেশি খুশি না শতদল সংস্থার সভ্যরা বেশি খুশি তা বলা শক্ত। শেষ কথা বললেন ইন্দ্রনাথ রায়, ‘আগামী বছরের সম্বর্ধনা তোমরা বাগচীকেই দিও, প্রণবেশ ভায়া। সেই ত ক্লাবের মানটা বাঁচালো।’

    পরদিন সকালে সংস্থার আপিসে একটি লোক এসে সেক্রেটারির নামে একটি মোড়ক দিয়ে গেল। প্রণবেশ মোড়কটা খুলে ভারী অবাক হয়ে দেখল তাতে রয়েছে হরলাল চক্রবর্তীর মানপত্র। সঙ্গের চিঠি রহস্য উদ্‌ঘাটন করবে মনে করে সেটি খুলে প্রণবেশ যা পড়ল তা হল এই—

    শতদল সংস্থার সেক্রেটারি মহাশয় সমীপে সবিনয় নিবেদন—

    সেদিন আপনাদের কথায় মনে হয়েছিল আপনারা নেহাৎ বিপাকে পড়ে হরলাল চক্রবর্তীকে সম্বর্ধনা দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপনাদের ত্রাণকর্তার ভূমিকা পালন করতে পেরে আমি পুলক বোধ করছি। তবে মানপত্রটি ফেরত দিতে বাধ্য হলাম। তার কারণ, প্রথমত, পড়ে দেখলাম যে নাম ও তারিখ বদল করে এটি আপনারা স্বচ্ছন্দে আগামী বছর কাজে লাগাতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, এই মানপত্র সত্যিই আমার প্রাপ্য নয়। চিত্রশিল্পী হরলাল চক্রবর্তী আজ তিন বছর হল এই শহরেই দেহরক্ষা করেছেন। তিনি ছিলেন আমার দাদা। আমি কাঁথিতে পোস্টাপিসের সামান্য কর্মচারী। এখানে এসেছিলাম সাতদিনের ছুটিতে।

    ইতি ভবদীয়
    রসিকলাল চক্রবর্তী

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
    Next Article ঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    Related Articles

    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    ফেলুদা এণ্ড কোং – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বাক্স রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }