Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমেন্দ্র মিত্র এক পাতা গল্প884 Mins Read0

    ধুলো

    বার্মুডা, না বাহামা?

    বেনেপুকুর বোধহয়!

    সেই সেকালের বটতলা উপন্যাসের ভাষায় বর্ণনা করা যেতে পারত যে কোনও এক বর্ষণক্ষান্ত সন্ধ্যায় একটি জীর্ণপ্রায় বাড়ির দ্বিতলের একটি নাতিপ্রশস্ত প্রকোষ্ঠে কয়েকটি অপরিণত যুবক ও জনৈক অনির্দিষ্ট বয়সের কিঞ্চিৎ শীর্ণ ব্যক্তির মধ্যে উল্লিখিত কথোপকথন হইতেছিল।

    কিন্তু যত প্যাঁচ করেই বলি, একথা কি কেউ সহজে বিশ্বাস করবে যে প্রথম উক্তিটি স্বয়ং ঘনাদার আর দ্বিতীয়টি আমাদের?

    ঘনাদা তাঁর মৌরসি আরামকেদারায় বসে নিজে থেকে বার্মুডা কি বাহামা, কোথায় শিশিরের জোগানো সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে তাঁর গল্পের গুল ছাড়বেন ভাবছেন, আর আমরা বেতালা বিদ্রুপের খোঁচায় তাঁর মুখ বোজাতে চাইছি।

    এ-ও কি সম্ভব?

    অন্য দিন হলে ওই বেনেপুকুর নামটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে গল্প শোনার আশা ভরসা তাইতেই ড়ুবত নিশ্চয়, কিন্তু আজ ঘনাদা যেন কানে তালা আর পিঠে কুলো বেঁধে বসেছেন।

    ফ্লোরা কি ভোরার দেখা অবশ্য তখনও পাইনি, বলে তুচ্ছ বেনেপুকুর-মার্কা বিদ্রুপ গ্রাহ্যই না করে ঘনাদা স্মৃতির ভাঁড়ার ঘটা করে ঘাঁটাতে বসে গেছেন আমাদের সামনে।

    আর তা সত্ত্বেও পোশাকের ওপর ওয়াটারপ্রুফ চড়িয়ে মাথায় তার হুড-এর বোম লাগাতে লাগাতে পেলে কী কেলেঙ্কারি-ই হত বলে আমরা মুখ টিপে হাসছি!

    এমন কখনও হতে পারে বলে ভাবা যায়?

    অমৃতে কি অরুচি হয়?

    হয়।

    হয়, অসময়ে যদি অমৃতও কেউ মুখে ঢেলে দেয় জোর করে!

    ধরো, দারুণ তেষ্টা পেয়েছে, ছাতি ফেটে যাচ্ছে তেষ্টায়, সে সময়ে এক ভাঁড় রাবড়ি কেউ মুখে ধরলে কেমন লাগে?

    কিংবা খেলার মাঠে সকাল থেকে লাইন দিয়ে কোনও মতে ঢুকে পাক্কা দুটি ঘণ্টা খোলা গ্যালারিতে ছাতা বিহনে রামভেজা ভিজে হঠাৎ বিপক্ষ দল মাঠে নামবে না বলে ঘোষণায় প্রাণটা পর্যন্ত জল হয়ে যাবার পর গেটের পয়সা ফেরত নিতে আর এক দফা ভিজে ন্যাতা হয়ে এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত ছুটে এসে এক কাপ গরম চায়ের জন্য দোকানে যখন হামলে গিয়ে পড়তে যাচ্ছি, তখন যদি কেউ দরদ দেখিয়ে বাজে জায়গায় চা খাওয়ার বিপদ থেকে বাঁচাতে এয়ারকন্ডিশনড় কোনও রেস্তোরাঁয় নিয়ে গিয়ে ঢুকিয়ে আইসক্রিম সোডার অর্ডার দেয়, কী রকম মনে হয় তখন?

    ঠিক এতটাই না হোক, সেদিন যা হয়েছে তা প্রায় তা-ই।

    খেলার মাঠের ওই রাগ আর হতাশায় ব্লেন্ড করা মেজাজ নিয়ে ভিজে সপসপে হয়ে চৌরঙ্গির ধারের এক দোকানে সবে চায়ে চুমুক দিতে যাচ্ছি এমন সময় দুই মূর্তিমানের সঙ্গে দেখা।

    দুই মূর্তিমান আর কে? শিশির আর গৌর।

    আমরা সারা দুপুর মাঠের মাঝখানে ভিজে আমসত্ব হয়েছি আর ওঁরা দুজনে দিব্যি মেসে বসে জানলা থেকে বর্ষার শোভা দেখে, আর সেই সঙ্গে রামভুজকে দিয়ে কোন

    দুটো অন্তত পাঁপড় ভাজিয়ে তাই দাঁতে কাটতে কাটতে অর্ধেক বিকেলটা পার করে বৃষ্টি ধরে যাবার পর সেজেগুঁজে এসপ্ল্যানেডে একটু টহল দিতে এসেছেন।

    যে খেলা দেখার জন্য আমাদের হয়রানি তার ওপর তো ওঁদের দুজনের কারওই কোনও টান নেই। খেলা বলতে ওঁরা বোঝেন শুধু ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান। আর সব ওঁদের কাছে ছেলেখেলা।

    ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের জন্য জান দিতে যাঁরা প্রস্তুত, অন্য খেলার দিন তাঁরা মাঠের ধার মাড়ান না।

    দুই মূর্তিমানের ওই সাজাগোজা ফিটফাট হাওয়া-খেতে বার-হওয়া চেহারা দেখেই তো মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছে, তার ওপর ওদের বদান্যতায় আরও।

    আরে! এখানে চা খাচ্ছিস কী! পেটের ভেতরটা ট্যান হয়ে যাবে। চল চল, বলে যে সব জায়গার নাম ওরা করেছে সেগুলি কলকাতার সব সেরা রেস্তোরাঁ হলেও পেটের ট্যানিং বাঁচাতে সেখানে এই অবস্থায় গিয়ে ঢুকলে বুকে নির্ঘাত নিউমোনিয়া।

    শিশির গৌরের উদার নিমন্ত্রণ শুধু সেইজন্যই অবশ্য প্রত্যাখ্যান করিনি। একসঙ্গে এই দুজনের ঘাড় ভাঙবার এমন একটা মৌ-কার জন্য শিবু আর আমি, নিউমোনিয়ার ঝক্কিও অন্য সময় হলে হয়তো নিয়ে ফেলতাম। কিন্তু আমাদের আরেক গরজ তখন অনেক বেশি জবর।

    কোনও রকমে মেসে ফিরে জামা-কাপড়টা শুধু বদলেই আমাদের না ছুটলে নয়।

    শিবু সেই কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে গৌর-শিশিরকে।

    এখন রেস্তোরাঁয় যাব কী! পাইকপাড়া যেতে হবে না?

    পাইকপাড়া? সেখানে আবার কেন? গৌর-শিশির যেন আকাশ থেকে পড়েছে।

    একেই বলে জেনেশুনে ন্যাকা সাজা। পাইকপাড়া কোথায়, কী, কেন, সব যেন ভুলে গেছেন দুজনে।

    ওদিকে বুকের ভেতরটা তো চড় চড় করছে। নিজেরা যেখানে দেউড়ি দিয়ে পা বাড়াতে না বাড়াতে পত্রপাঠ বিদায়, সেখানে আমরা সাতমহলের ছটা মহল পেরিয়ে এবার খাসমহলে ঢুকতে যাচ্ছি! মনের ভেতর সেই দুঃখই পাক খাচ্ছে, আবার বলে কিনা, পাইকপাড়! সেখানে আবার কেন?

    তা ওরা যদি ডালে ডালে চলে তো আমরা যাই পাতায় পাতায়।

    যেন বলবার মতো কিছু নয় এমনই ব্যাপারটা তুচ্ছ করে আমি বলেছি,এমন কিছু। ওই একটু খেলতে যাব দুজনে।

    খেলতে যাবে! শিশির-গৌরের যেন কথাটা হতভম্ব হয়ে দুবার আওড়াবার পর খেয়াল হয়েছে, ও, আজ তো সেই ব্রিজ কমপিটিশনের খেলা। হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোরা যেন কোন রাউন্ডে উঠেছিস?

    রাউন্ডে আর নেই! পয়লা রাউন্ডেই যারা খসে পড়েছে তাদের গায়ে চিডবিডিনি ধরাবার এমন সযোগ আর ছাড়ি। উঠেছি সেমিফাইনালে।

    ওঃ, সেমিফাইন্যালে! তাচ্ছিল্য করবার চেষ্টা করলে কী হবে, গৌরের গলাটা আফশোসে মিয়োনো।

    শিশির হঠাৎ আমাদের স্বাস্থ্যের জন্যই ভাবিত হয়ে উঠেছে। কিন্তু এত ভিজেছিস, আবার এই বৃষ্টির মধ্যে অতদূর যাবি! বাসে ওঠাই তো এখন দায়।

    বাসে যদি না হয় তাহলে ট্যাক্সিতে যাব। শিবু যেন একটানা মুখস্থ-পড়া পড়ে গিয়েছে, ট্যাক্সি না জোটে, রিকশ নেব। আর তাও যদি না পাই, হেঁটে যাব পাইকপাড়া। জোকার ক্লাবের অল বেঙ্গল ব্রিজ কমপিটিশনের শিল্ডটা আমাদের বাহাত্তর নম্বরের বসবার ঘরে মানাবে বলেই তো মনে হয়।

    শেষ কথাগুলো হয়েছে ট্যাক্সিতে যেতে যেতে। মতি শীলের গলির ভাঁড়ের চা পেটে-ছ্যাঁকা-লাগানো দুটো করে চুমুকে শেষ করে মেট্রোর সামনে থেকে ট্যাক্সি ধরে তখন আমরা এসপ্ল্যানেড থেকে বনমালি নস্কর লেনে চলেছি।

    ও! দেয়ালে শিল্ড টাঙাবার পেরেক পুঁতেই ফেলেছিস বুঝি! গৌর একটু বিদ্রুপ করবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু খোঁচাটাই ভোঁতা।

    শিশির অন্য রাস্তা নিয়েছে। বাহাত্তর নম্বরের সামনে নেমে ট্যাক্সির ভাড়াটা নিজেই চুকিয়ে দিয়ে ভেতরে যেতে যেতে বলেছে, কিন্তু আজ হয়তো মিছিমিছি যাবি! খেলাই হয়তো আজ বন্ধ!

    কেন? রেনি-ডে বলে! ওপরের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আমি উপযুক্ত জবাব দিয়েছি, এ কি স্কুল পেয়েছিস? রেনি-ডে বলে ছুটি হবে কী? রেনি-ডে হলেই তো খেলা বেশি জমে। গিয়ে পৌঁছতে যে পারবে না সে দল বাতিল।

    শিশির-গৌর আর একটা ছুতো পেয়ে গেছে এবার। গৌর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই চোখ বন্ধ করে নাকটা একটু তুলে গঙ্গদ স্বরে বলেছে, আঃ! গন্ধটা পাচ্ছিস?

    শিশির ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছে, রামভুজ ডালপুরি বানাচ্ছে যে! এ যা পাচ্ছিস, এ তো শুধু ওর স্পেশ্যাল সবজির গন্ধ। এরপর যখন ডালপুরি ভাজবে তখন তো তর হয়ে যাবি। আর বড় জোর আধঘণ্টা লাগবে। তারপরেই গরমাগরম!

    ততক্ষণে দোতলায় পৌঁছে নিজেদের ঘরের দিকে চলেছি। শিবু একেবারে বৈরাগী বিবাগীদের মডেল হয়ে বলেছে, গরমাগরম তোমরাই সেঁটো ভাই। আমাদের লোভ নেই।

    নিজেদের ঘরের দিকে যেতে যেতে বসবার ঘরটার দিকে একবার চোখ না ঘুরিয়ে পারিনি অবশ্য।

    বেশ একটু তাজ্জবই হতে হয়েছে, অস্বীকার করব না।

    স্বয়ং ঘনাদা সেখানে তাঁর মৌরসি কেদারা দখল করে বসে আছেন।

    তা থাকুন! মুনির মন টলতে পারে, কিন্তু আমাদের আজ টলায় দুনিয়ায় এমন কোনও কিছু নেই।

    শুধু জোকার ক্লাবের কপিটিশনে যাওয়ার জেদ তো নয়—শিশির-গৌরের সঙ্গে এ এক মোক্ষম মনের জোরের পাঞ্জা লড়া।

    অল বেঙ্গল ব্রিজ কমপিটিশনের শিল্ডটা আমরা জিতে নিয়ে আসব, আবার এই আসর-ঘরের দেওয়ালেই আমাদের কীর্তি দিনের পর দিন মনে করিয়ে দেবার জন্য তা চোখের ওপর ঝুলবে এতটা কি সহ্য হয়!

    তাই যা করে তোক আমাদের ব্রিজ খেলতে যাওয়াটা বন্ধ করতেই হবে।

    বাহাত্তর নম্বরে ডালপুরির জোগাড় জেনেও শিশির-গৌরের আগবাড়িয়ে এ সময়ে এসপ্ল্যানেড টহল দিতে যাওয়ার মানেটা কি আর এতক্ষণে বুঝিনি!

    ওখান থেকেই বাগড়া দেওয়া যাতে শুরু করা যায় সেই আশাতেই ওই টহলদারি। ওখানে না পেলে মেসে এসে পর পর চালবার সাজানো খুঁটি তো আছেই। এখন যা চালছে।

    যে প্যাঁচই খাটাক, আমরা কেটে বার হবার জন্য তৈরি।

    বসবার ঘরটা পেরিয়ে যাবার সময় একটু বেকায়দায় অবশ্য পড়তে হয়েছে।

    আরে! শিবু সুধীর যে! তপস্যা করে যাঁকে পাওয়া যায় না সেই ঘনাদা নিজে থেকে সেধে ডেকেছেন,কোথায় ছিলে এতক্ষণ! আসর ঠাণ্ডা হয়ে যায় যে! শিগগির এসে তাতাও।

    হ্যাঁ, তাতাচ্ছি এই যে! মনে মনে বলেছি। শিবুর সঙ্গে চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে মুখে বলেছি, হ্যাঁ, আসছি কাপড় ছেড়ে।

    ছেড়ে আসতে মিনিট কয়েক মাত্র লেগেছে। শুধু পোশাক বদলেই নয়, গায়ে ওয়াটারপ্রুফগুলো গলাতে গলাতে হুড দুটো হাতে করে নিয়ে আসরঘরে ঢুকেছি।

    তা, একটু চমকে দিতে পেরেছি বইকী! আমাদের ডাকছিলেন তখন? বেশ, একটু শুকনো গলায় জিজ্ঞাসা করে নেহাত যেন অনিচ্ছাভরে ঘরে এসে দাঁড়াবার পর আর সকলের তো বটেই, ঘনাদারও ভুরু দুটো একটু যে উঠেছে তা লক্ষ করেছি।

    নাসারন্ধ্র দুবার একটু নীরবে বিচ্ছুরিত করে তিনি বলেছেন, তোমরা বেরুচ্ছ এখন।

    উক্তিটা বিস্ময়ধ্বনিও নয়, প্রশ্নও না।

    শিবু আর আমি ততক্ষণে ওয়াটারপ্রুফ দুটো গায়ে গলিয়ে ফেলে বোতাম পর্যন্ত এঁটে ফেলেছি।

    না, বেরিয়ে আর করি কী! এদিক ওদিক কিছু একটা খোঁজার জন্য তাকিয়ে একটু অন্যমনস্কভাবেই ঘনাদাকে জবাব দিয়ে আবার বলেছি, একটা ছাতা শুধু খুঁজছিলাম!

    ছাতা! একটু আশার আলো পেয়ে গৌরের গলায় সহানুভূতি উথলে উঠেছে যেন, সত্যিই তো, ছাতা একটা না হলে আজকের এই বৃষ্টি শুধু ওয়াটারপ্রুফে কি আটকায়! কিন্তু বাহাত্তর নম্বরে ছাতা কোথায়? সেই উল্টো নামের শ্রীমান সুশীলের ছাতা ঘনাদা রাস্তায় দান করে আসার পর থেকে বাহাত্তর নম্বরে ছাতা আর কেউ কি দেখেছে?

    কিন্তু ছাতা একটা না হলে তোরা বেরুবি কী করে? শিশির গৌরের চেয়েও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে।

    এই—এমনই করে! বলে হুডগুলো এবার মাথায় চাপিয়েছি।

    ঘনাদা যেন হঠাৎ আমাদের কথা ভুলেই গেছেন। তাঁকে ঘিরে যারা বসেছে তাদের দিকে চেয়ে স্মরণশক্তিটা উসকে নেবার চেষ্টায় বলেছেন, হ্যাঁ, কী যেন বলছিলাম?

    তখন আমি ঠিক কোথায়, তাই না? বার্মুডা, না বাহামা?

    বাইরে না হোক, মনে মনে আমরা ঘনাদার মতোই নাসিকাধ্বনি করেছি। এসব পুরনো প্যাঁচ আমাদের খুব জানা আছে। এতেই কাবু হবার মতো কাঁচা ছেলে ভেবেছে নাকি আমাদের?

    ঘনাদার কথার পিঠে চটপট চিমটিটুকু কেটেছি তাই।

    ঘনাদার যেন কানে তুলো গোঁজা এমনইভাবে তিনি নতুন কী প্যাঁচ ছেড়েছেন তা তো আগেই বলেছি।

    ঘনাদা যেন নিজের স্মৃতির ড়ুবুরি হয়ে হেঁয়ালির জট তুলেছেন, ফ্লোরা কি ভোরার দেখা অবশ্য তখনও পাইনি!

    শিবু আর আমি এ ওর মাথায় বর্ষাতি ঘোমটার বোম এঁটে দিতে দিতে হেসে বলেছি, পেলে কী কেলেঙ্কারিই হত!

    ঘনাদার কানটা হঠাৎ কী করে শুধরে গেছে কে জানে! আমাদের কথাটা এবার নির্ভুল শুনে তাতেই জোরের সঙ্গে সায় দিয়েছেন, কেলেঙ্কারি বলে কেলেঙ্কারি!

    ওদের কারও সঙ্গে দেখা হওয়া মানে একেবারে দফা রফা!

    ঘনাদার কথায় আর কান দেবারই দরকার কী? শিবুকে তাই ধাক্কা দিয়ে বলেছি, চল! চল!

    দুজনে দরজার দিকে পা বাড়াবার সঙ্গে শিশিরের ভয়ে কাঁপা গলা শুনতে পেয়েছি, ওই ডোরা আর ফ্লোরা যা নাম করলেন, ব খুব সাংঘাতিক মেয়ে বুঝি!

    তা সাংঘাতিক মেয়ে ছাড়া আর কী বলবে? দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে এসেও ঘনাদার কথাটা কানে এল, ডোরারটা ঠিক হিসেব নেই, কিন্তু ফ্লোরার হাতে গেছে অন্তত সাত হাজার একশো তিরেনব্বই জন।

    সাত হাজার একশো তিরেনব্বই জন খুন! গৌরের শিউরে-ওঠা আধা-চিৎকারটা বারান্দা দিয়ে সিঁড়ির মুখটা পর্যন্ত আমাদের পিছু নিয়েছে, রাক্ষুসি নাকি?

    রাক্ষুসি ছাড়া আর কী? ঘনাদার গলাটা স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি, দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরের দ্বীপে ট্রিনিডাডের মাথার ওপর দিয়ে এসে গলা বাড়ানো হাইতির ছোট মুণ্ডুটা মাড়িয়ে কিউবার পুব কোণটা একটু ছুঁয়ে উত্তরমুখো হয়ে নিরুদ্দেশ হবার মধ্যেই ওই সাত হাজার একশো তিরেনব্বই জনকে সাবাড় করেছে। ফ্লোরা।

    শিবুকে এবার ধমক দিতে হয়েছে, হাঁ করে আবার থমকে দাঁড়ালি কেন সিঁড়ির

    মাথায়?

    না, দাঁড়ালাম কোথায়?

    শিবু সিঁড়িতে এক ধাপ নামতেই আমায় বলতে হয়েছে—দাঁড়া, দাঁড়া, কী যেন একটা ফেলে এলাম মনে হচ্ছে।

    গৌর গলা ছেড়ে তখন জিজ্ঞাসা করছে শুনতে পাচ্ছি—নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে বলছেন, তার মানে ওই রাক্ষসি খুনে মেয়ে দুটোকে কেউ ধরতেও পারেনি!

    সাধ্য কি তাদের কেউ ধরে! আর শুধু কি দুটো—ঘনাদা যেন সেই সর্বনাশী মেয়েদের কথা ভাবতেই খানিক গুম হয়ে গেছেন।

    কই, কী ভুলে গেছিস মনে পড়ল? শিবু আমায় খোঁচা দিয়েছে সেই ফাঁকে।

    ওঘরে না গেলে মনে তো পড়বে না ঠিক! বেশ ব্যাজার মুখেই বলেছি, কিন্তু গেলেই সে ভাববে লোভে লোভে ফিরে এসেছি!

    ভাবুক না যা খুশি। শিবু বেপরোয়া হয়ে আমায় সাহস দিয়েছে, আমরা কারও ভাবনার পরোয়া করি নাকি? দরকার থাকলেও টিটকিরির ভয়ে ও-ঘরে যাব না?

    আলবত যাব। আমি বীরবিক্রমে এগিয়ে গেছি।

    পেছনে শিবু।

    খোঁচার বদলে পাল্টা খোঁচার সঙ্গিন উঁচিয়ে তৈরি হয়েই আসরঘরে ঢুকেছি। কিন্তু কই, টিটকিরি তো দূরের কথা, কেউ যেন খেয়ালই করেনি।

    ঘনাদা তখনও বুঝি তাঁর সর্বনাশীদের ধ্যানে ভোম মেরে আছেন। গৌর তা ভাঙবার জন্যই তখন বলছে, স্তম্ভিত গলায়, দুটো নয় কী বলছেন! আরও আছে?

    আছে না? ঘনাদা দুঃখের হাসি হেসে আবার একটু চুপ।

    শিবু তখন খালি একটা চেয়ারে বসেই পড়েছে।

    বললাম, বসলি যে?

    চাপা গলাতেই বলেছি অবশ্য।

    তা বসলামই বা! শিবুও গলা নামিয়ে বলেছে, তুই তো এখন কী ভুলে গেছিস মনে করবি!

    শিবুর যুক্তির বিরুদ্ধে কলবার কিছু নেই। কী ভুলে যাচ্ছি ভাববার জন্য আমাকেও একটু বসতে হয়েছে।

    চেয়ার আর নেই, কিন্তু হোট চৌকিটায় গৌর নিজে থেকেই নীরবে একটু সরে বসেছে জায়গা করে দেবার জন্য।

    যা হোক একটু জায়গা হলেই হল। কতটুকুই বা আর বসব! শুধু ভুলটা মনে পড়ার ওয়াস্তা।

    কিন্তু ঘনাদা বসে বসেই ঘুমোলেন নাকি!

    আর যারা সব তারাও ওই ফ্লোরার মতোই খুনে? শিশির ঘনাদার চটকা ভাঙতে নাড়া দিয়েছে।

    কম যায় না বড়ো! ঘনাদা বাহামা না বার্মুডা থেকে বনমালি নস্কর লেনে ফিরে এসে বলেছেন, ফ্লোরা খতম করেছে সাত হাজারের ওপর তেষট্টি সালে আর তার আগে উনিশশো আটাশ-এ আর একজনের হাতে সাবাড় হয়েছে চার হাজার। তার আবার নামও কেউ জানে না। নামই হয়নি হয়তো। নামকরাদের মধ্যে হ্যাটি, ডোনা, হিল্ডা, হেজেল-শতমারির নীচে কেউ নয়। হেজেল দফা নিকেশ করেছেন এক হাজার একশো পঁচাত্তর জনের, হিল্ডা পঞ্চান্নতে ছশো, ডোনা ষাটে একশো পঁয়ষট্টি আর হ্যাটি একষট্টিতে দুশো পঁচাত্তর। এ ছাড়া ক্লিও, অড্রে আর ছোটখাটো আরও তো আছে। মানুষকে প্রাণে যারা কম মেরেছে তারা সুদ সুদ্ধ পুষিয়ে নিয়েছে ধনে। ডোনা এমনিতে ওদের দলে যাকে বলে লক্ষ্মী মেয়ে বলা যায়। জান নিয়েছে মাত্র একশো পঁয়ষট্টি জনের, কিন্তু যেখান দিয়ে গেছে সেখানে কমসে কম সাতশো কোটি টাকার ধন দৌলত লোপাট!

    এত খুনোখুনি লুটপাটের কথার মধ্যে মাথা ঠাণ্ডা করে কিছু ভাবা যায়! কী ভুলে গেছি মনেই করতে পারিনি এতক্ষণে। ডোেরা ফ্লোরার জন্য আমার কীসের মাথাব্যথা! নেহাত বিদঘুটে আলোচনাটা থামাবার জন্যই বলতে হয়েছে, ওই খুনে মেয়েগুলো সব বুঝি আপনি যেখানে ছিলেন সেই বার্মুডা, না বাহামার?

    বার্মুডা নয়, ছিলাম তখন বাহামায়। এখন মনে পড়েছে। ঘনাদা আমায় খুশি মুখেই জবাব দিয়েছেন, আর ওরা সবাই ঠিক বাহামার না হলেও, ওই অঞ্চলের বলা যায়। ছোট অ্যান্টিলিজ দ্বীপপুঞ্জের পুবদিকে উত্তর আটলান্টিক সমুদ্র। সেখান থেকে এসেছে অনেকে। কারও কারও আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ-এর দক্ষিণে ক্যারিবিয়ান সাগরেই জন্ম। উনিশশো সাতান্নতে তিনশো নব্বই জনকে যমালয়ে পাঠিয়ে অন্তত একশো কোটি টাকার সম্পত্তি যে লোপাট করে দেয়, সেই অড্রে তো দূর-দূরান্তর কোথাও থেকে আসেনি। মেক্সিকো উপসাগর থেকে মাত্র আমেরিকার লুইসিয়ানা স্টেট-এর সীমানা ছাড়িয়ে মিসিসিপির চৌকাঠ পর্যন্ত পৌঁছেই অড্রে নিপাত্তা। কিন্তু ওইটুকুর মধ্যে যেখানে সে চোখ দিয়েছে সেখানেই শ্মশান।

    একটু থেমে, পুরনো স্মৃতির একটু চমকেই যেন শিউরে উঠে ঘনাদা বলেছেন, কিন্তু ফ্লোরা, হিল্ডা, হেজেল, অড্রে এরা সব তো পাহাড়ি বিচ্ছুর কাছে ডেয়ো পিঁপড়ে! একেবারে ঠিক সময়ে না সামলালে লরা যে কী করত তা ভাবতেও গায়ে কাঁটা দেয়। আমেরিকার নিউ অরলিন থেকে নিউইয়র্ক পর্যন্ত বংশে বাতি দিতে কাউকে বোধহয় রাখত না।

    অ্যাঁ! এমন ভয়ংকর মেয়েএ লরাকে সময়মতো সামলেছিল কে? শিবুটা প্রথমে খানিক হাঁ করে থেকে, পরে আহাম্মকের মতো জিজ্ঞেস করে বসেছে, আপনি?

    ঘনাদার বাঁকানো ঠোঁটে অসীম ধৈর্য আর ক্ষমার একটু হাসি। টেনজিং নোরকে-কে যেন কে প্রথম এভারেস্ট-এর চূড়ায় উঠেছে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, প্রথমে কে একটানা প্লেনে আটলান্টিক পার হয়েছে জানতে চাওয়া হয়েছে লিন্ডবার্গ-এর কাছে!

    শিবুর আহাম্মকিতে ঘনাদা চটুন না চটুন, আমার কী আসে যায়? আমরা তো যাচ্ছি জোকার ক্লাবে! নেহাত কী ভুল হয়েছে ভাববার জন্য একটু বসেছি, তাই শিবুকে একটু ধমক দিতে হয়েছে, জিজ্ঞেস করতে লজ্জা করল না তোর? ঘনাদা নয় তো লরাকে আর কে সামলাবে, শুনি?

    শিবু অধোবদন হবার পর ঘনাদাকেই জিজ্ঞেস করেছি, ও মুণ্ডমালিনীকে কেমন করে সামলালেন, ঘনাদা?

    কেমন করে? ঘনাদা তাচ্ছিল্যভরে বলেছেন, একটু ধুলো দিয়ে!

    ধুলো দিয়ে! আমার শুধু একার নয়, আসরে যে যেখানে ছিল সবার চোখই ছানাবড়া। হ্যাঁ,  ঘনাদা ব্যাখ্যা করেছেন, লরার চোখে একটু ধুলো দিতেই কাম ফতে হয়ে গেল।

    চোখে ধুলো দিয়ে কাম ফতে? আমাদের হাঁ মুখ আর বুজতে চায়নি! হ্যাঁ, লরার অর্ধেক শয়তানি জারিজুরি তাতেই চোখের জলে গলে গেল বলতে পারো—ঘনাদা আর একটু বিশদ হয়েছেন—তারপর যাকে বলে কানা হয়ে দ্বিগ্বিদিক ভুলে আতলান্তিকের ওপরই উধাও হয়ে কোথায় মুখ থুবড়ে মরেছে কে জানে! কারি তাই বলত—দাস, কোথায় ছিলে তুমি উনিশশো চুয়ান্নতে? এক হাজার একশো পঁচাত্তর জনকে নিকেশ করার বদলে এই বাহামার মায়ামা দ্বীপে পৌঁছোবার আগেই হেজেল নিজে কাবার হয়ে যেত?

    হেজেল বুঝি মায়াগুমা দ্বীপে হানা দিয়েছিল? জিজ্ঞাসা করেছে শিশির।

    শুধু কি মায়াগুমা দ্বীপ! ঘনাদা দুঃখের হাসি হেসেছেন—ওইখানে তো তার উৎপাত সবে শুরু। সেখান থেকে সাগর পেরিয়ে আমেরিকার উইলমিংটন শহরের পাশ দিয়ে ফিলাডেলফিয়াকে ডাইনে রেখে সোজা সেই অনটারিও হ্রদ পর্যন্ত।

    সত্যি, আপনি থাকলে তো আর এ সব হয় না! গৌর আফশোস করেছে ঠিকই বলত তো ওই, কী নাম বললেন যেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ কারি। ওই কারি কে?

    কারি আমার বন্ধু একজন কংক। ব্যাখ্যা করেছেন ঘনাদা—তার সঙ্গে স্ত্রমবস গাইগাস, মানে, পঞ্চমুখী শাঁখের খোঁজে তখন বেল দ্বীপে একটা সুলুপে থাকি, আর সেই সুলুপেরই একটা ডিঙি নিয়ে তাতে কারি আর আমি পঞ্চমুখী শাঁখ খুঁজে ফিরি সমুদ্রের তলায়। ডিঙিতে আমার হাতে থাকে তলায় কাচ আঁটা একটা বালতি আর কারির হাতে হাল। কাচ আঁটা বালতির মতো চোঙটা সমুদ্রের জলের ভেতর ড়ুবিয়ে ধরে আমি তার ভেতর দিয়ে কোথায় অ্যালজির ওপর পঞ্চমুখী চরে বেড়াচ্ছে দেখি, আর দেখতে পেলে আঁকশি লগি দিয়ে তা বোটে তুলে নিই। আমার লোভ পঞ্চমুখী শাঁখের ওপর, কারির লোভ শাঁখের শাঁসালো মাংসে। শাঁখের শাঁসই তাদের প্রধান খাদ্য বলে এই শাঁখ শিকারিদের একটা নাম কংক। বেশির ভাগ শাঁখ শিকারিই নিগ্রো বলে তাদের এ নামটা অবজ্ঞাভরেই দেওয়া হয়েছে।

    যারা তা দিয়েছে একজন কংক-এর দৌলতেই কত বড় ভয়ংকর পরিণাম থেকে যে তারা রক্ষা পেয়েছে তা কোনওদিন বোধহয় জানবে না।

    চোখে ধুলো দিয়ে কানা করে লরার জারিজুরি আমি ভেঙে দিয়েছি ঠিকই, কিন্তু কারি আমার সঙ্গে না থাকলে লরা কখন কোথায় যে রাক্ষুসি মূর্তি ধরছে তা আমি জানতেও পারতাম না।

    কারিরা প্রায় চৌদ্দপুরুষ ধরে বাহামাতেই আছে। বাহামার মাটি-জল-হাওয়ার সঙ্গে তাদের নাড়ির যোগ। কারির আবার একটা আশ্চর্য ক্ষমতা এই যে, সাইজমোগ্রাফে যেমন ভূমিকম্প, ব্যারোমিটারে যেমন হাওয়ার চাপ, কারি তেমনই তার হাড়ের ভেতরে ঝড়-তুফানের সব হদিস আগে থাকতে টের পায়।

    সারাদিন শাঁখ শিকারের পর রাত্রে সুলুপের ডেক-এ তারার আলোয় ঝলমল আকাশের তলায় শুয়ে গল্প করতে করতে হঠাৎ কারি ধড়মড় করে তার বিছানায় উঠে বসেছে সেদিন।

    কী হল, কারি? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি যেন ভূত দেখলে মনে হচ্ছে!

    ভূত নয়, ডাকিনী! ধরা গলায় বললে কারি, আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছি, সে জাগছে। হাজার বুদ্ধিমান বিচক্ষণ হলেও বাহামায় শাঁখ শিকার করে জীবন কাটিয়েছে। আমি তাই ব্যাপারটা কারির অন্ধ কুসংস্কার ভেবেছি। বিশ্বাস করিনি। তাকে শুধু ক্ষুণ্ণ না করার জন্য জিজ্ঞেস করলাম, জাগছে কোথায়?

    এই কাছেই! কারি সভয়ে বলল, প্রভিডেন্স প্রণালীতে।

    এবার একটু হেসে ঠাট্টা করে বললাম, কী বলছ কী, কারি? প্রভিডেন্স প্রণালীতে ডাকিনী জাগছে আর তুমি এখানে শুয়ে শুয়ে তা টের পেলে! ও তোমার গেটে বাত-টাত হবে। কাল অমাবস্যা—তাই একটু চাগাড় দিয়েছে।

    না, না, বাত নয়, দাস! কারি ব্যাকুল হয়ে উঠল আমায় বোঝাতে, আমি সত্যি আমার হাড়ের ভেতর এসব টের পাই। হেজেল-এর বেলা ঠিক এই রকম টের পেয়েছিলাম। তখন জানাবার কেউ ছিল না। তুমি আছ বলে তাই জানাচ্ছি। এ ডাকিনী হেজেল-এর চেয়ে শতগুণ সর্বনাশী। প্রভিডেন্স প্রণালীতে কাল ভোরের আগেই জেগে উঠে সৃষ্টি ছারখার করে দেবে।

    এবার আর হাসতে পারলাম না। গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ভোরের আগেই প্রভিডেন্স প্রণালীতে পৌঁছোতে পারবে?

    কারি বললে, পারব।

    সুলুপে একটা হারপুন ছোড়ার বন্দুক আছে না? জিজ্ঞাসা করলাম তারপর।

    হ্যাঁ, আছে। কারি অবাক হয়ে বললে, কিন্তু হারপুন ছুড়ে এ ডাকিনীকে তুমি ঘায়েল করবে?

    করব। জোর দিয়ে বললাম, তবে শুধু হারপুন ছুড়ে নয়, হারপুনের কামানে এ ডাকিনীর চোখ নিশানা করে ধুলো ছুড়ে তাকে কানা করে।

    কী বলছ কী, দাস! কারি মাথা নেড়ে বললে, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে! নিশ্বাসে যে প্রলয় ঘটায় সেই তুফানকে তুমি ধুলো ছুড়ে জব্দ করবে!

    তোমার হাড়ের খবর যদি ভুল না হয়, আর ভোরের আগে প্রভিডেন্স প্রণালীতে যদি পৌঁছে দিতে পারো এ সুনুপে, তা হলে চেষ্টা করে তো একবার দেখতে পারি। এবার ইচ্ছে করেই সুরটা একটু নামিয়ে বললাম, এ সব তুফানের একটা এবং একটিমাত্র চোখ থাকে, জানো তো?

    জানি। কারি আমার কৌশলটা বোঝবার চেষ্টা করে বলল, সে চোখ তোমায় দেখাতেও পারব।

    তা হলেই হবে। তাকে আশা দিলাম।

     

    হলও তাই। প্রভিডেন্স প্রণালীতে পৌঁছোলাম ভোর হবার আগেই।

    তুফান ডাকিনী তখন থমথমে সমুদ্রে ঘূর্ণি হাওয়ার সঙ্গে জাগতে শুরু করেছে।

    কারি সভয়ে বলল, এখন হালকা কথার সময় নয়। তবু ওই ঘূর্ণি দেখে আমার লরা বলে এক নাচিয়ে মেয়ের কথা মনে পড়ছে। সে-ও সর্বনাশী মেয়ে হাজার বুক ভেঙেছে।

    বেশ, তা হলে এ ডাকিনীর নামও থাক লরা। আমি হেসে বললাম, এবার তৈরি থাকো হারপুন কামান নিয়ে। আমি ধুলোয় ঠাসা গোলা তাতে ভরে রেখেছি।

    দেখতে দেখতে লরা ভয়ংকরী হয়ে উঠল। আর তার চোখ তাগ করে ছুড়লাম সেই ধুলো-ভরা গোলা!

    ব্যস! খানিকক্ষণের মধ্যেই অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ধারায় ঝরে পড়া লরা নেতিয়ে পড়ে কাত।

    ঘনাদা থামলেন।

    এক-একজনের মুখে তখন এক-এক রকম বিস্মিত প্রশ্ন।

    ও! লরা ফ্লোরা মানে সব তুফান-ঝড়?

    ঘনাদা একটু মুচকে হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

    কিন্তু ধুলোর গোলা যে ছুড়লেন, সে ধুলোটা কী?

    হলদে রঙের একরকম ধুলোর মতো গুঁড়ো।—ঘনাদা ব্যাখ্যা করলেন—তার চিহ্ন হল English, আর নাম সিলভার আইওডাইড!

    সিলভার আইওডাইড!—এবার আমি মৌ-কা পেয়ে চেপে ধরলাম—কিন্তু সে তো বৃষ্টি নামাবার জন্য সাধারণ মেঘের ওপর ছড়ানো হয়। তাতেও তেমন কাজ হয় না। সিলভার আইওডাইডে ফ্লোরা-ডোরার মতো প্রলয়ঙ্করী হ্যারিকেন থামানো যায়?

    কাকে বলছি?

    ঘনাদা তখন ঘরের দরজা দিয়ে তাঁর টঙের ঘরের দিকেই চলেছেন। হাতে তাঁর গোটা একটা সিগারেটের টিন। এখনও খোলাই হয়নি।

    এটা যেন ঘুষ মনে হল!

    শিশির গৌরের দিকে চাইলাম। তাদের মুখে যেন দুষ্টু দুষ্টু হাসি। বলল, বোসো, ডালপুরি আসছে।

    ডালপুরি তোমরাই খেয়ো। যথাসাধ্য গলায় অবজ্ঞা ফোটাবার চেষ্টা করে শিবুর দিকে ফিরে বললাম, কই, ওঠ!

    তাড়া দিয়ে শিবুকে ওঠালাম। গেলামও সেই পাইকপাড়ায় কাদা-জল ভেঙে। লাভ হল না।

    সময়ে না পৌঁছোবার দরুন কমপিটিশন থেকে আমাদের দলের নাম কাটা গেছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray
    Next Article ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    Related Articles

    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }