জেলনামা – ১
আর্থার রোড জেল
জেকব সার্কেল- মুম্বাই
মহারাষ্ট্র
মার্চ ২০২১
ঠিক সকাল এগারোটা নাগাদ, আর্থার রোড জেলের ভিতরের লাউডস্পিকার থেকে একটা সাইরেন বেজে উঠল। বাছাই করা সাঁইত্রিশ জন আসামীকে লাল গেটের কাছে জড়ো হতে বলেছিলেন জেল কর্তৃপক্ষ। জেলের মূল পাঁচিল আর ভেতরকার ব্যারাকগুলোর মাঝামাঝি এই লাল-গেট এলাকা। সাঁইত্রিশ জনের এই দলটা আওরঙ্গাবাদ আর্মস স্মাগলিং কেসে জড়িত। এদের তিনভাগে ভাগ করে কোলহাপুর, নাগপুর আর রত্নাগিরির জেলে পাঠানোর কথা। এর কারণ দুটো। এক— আর্থার রোড জেল ওভার ক্রাউডেড, আটশ চারজন কয়েদির জন্য নির্ধারিত জায়গায় আড়াই হাজার কয়েদি ঠুসে ঠুসে রাখা হয়েছে। দুই – জেল সুপারিনটেন্ডেন্ট কেদার সাঠে এই দলটাকে ভেঙে দিতে বদ্ধপরিকর। আর্থার রোড জেল থেকে মাত্র কয়েকশো মিটার দূরে সেশন কোর্টে চলা এই কেসটার ট্রায়ালে আপাতত সুপ্রিম কোর্ট স্টে-অর্ডার দিয়েছেন। কাজেই এদের আলাদা আলাদা জেলে পাঠাতে আইনত বাধা নেই। সেই মত সাঠে, গত সাত তারিখ পুলিশ হেডকোয়ার্টারে স্পেশাল স্কোয়াডের জন্য রিকুইজিশন পাঠিয়েছিলেন। আজ সকাল দশটা নাগাদ বারোজন পুলিশ এসকর্টস এসে পৌঁছেছেন জেলে।
গণেশ হুঁই গত দেড় ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছে। মুম্বাই এ.টি.এস হাতে একটা খাবারের প্লাস্টিক ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল যাওয়ার আগে। ভাত, বেগুনচচ্চড়ি আর মহারাস্ট্রিয়ান কড়হি। কাল রাতের রান্না। গণেশ খায়নি, প্রবৃত্তি হয়নি। ভ্যানেই ফেলে আসছিল, এ.টি.এসের এক অফিসার নামার সময় হাতে আবার হাতে গুঁজে দিয়েছে। প্যাকেটটা থেকে একটা বিশ্রী বোঁটকা গন্ধ বেরোচ্ছে। গণেশ পাহারারত কনস্টেবলের দিকে তাকাল। লোকটা সামনের দিকে সোজা তাকিয়ে আছে। জেল সুপারের চেয়ার বহুক্ষণ ফাঁকা।
জেল চত্বরে খবর বাতাসে ওড়ে। এই দেড়ঘণ্টায় উড়ো কিছু কথাবার্তা কানে আসাতে ব্যাপারটা সম্পর্কে ধারণা করার চেষ্টা করছিল গণেশ। সাঁইত্রিশ জন আসামীর মধ্যে মাত্র উনিশ জন বিনা বাক্যব্যয়ে রত্নাগিরির জন্য নির্দিষ্ট গাড়িতে উঠে গেলেও, বাকি আঠারো জন কোর্ট অর্ডার দেখতে চেয়েছে। সাঠে এসবের মুডে ছিলেন না। একবার একটা হুংকার ছুঁড়ে সাবধান করেছেন, “মি তুমহালা আপলেয়া পায়ামবড় যাউ দেনার নাহি! হেঁটে ভ্যানে ওঠার ক্ষমতা থাকবে না তোদের, মাদারচোত!” ধমকিতে কাজ না হওয়ায়, সাঠে সাইরেন বাজানোর নির্দেশ দিয়েছেন। সাইরেন বাজার অর্থ সবাই জানে। পরবর্তী আধঘণ্টায় সিচ্যুয়েশন আন্ডার কন্ট্রোল চলে আসবে। পদ্ধতিটাই যা প্রোটোকলের বাইরে হবে।
ঠিক সকাল এগারোটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে সাঠে যখন তাঁর অফিসে ঢুকলেন, তখন লাঠি আর বেল্টের মারে তিন জন আসামী, শোয়েব, ইরফান আর রামনের শরীরের প্রত্যেকটা ইঞ্চি ফুলে উঠেছে। বাকিরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও এরা তিনজন শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিল। ক্লিনশেভেন ফর্সা মুখটা রুমালে মুছতে মুছতে সাঠে কনস্টেবলকে বললেন, “ডক্টর পাটিল লা কল করা।”
গণেশ হুঁইয়ের আরও কুড়ি মিনিট লাগল। এ.টি.এসের আন্তঃরাজ্য নেটওয়ার্কিং এর ফলে ওয়েস্ট বঙ্গাল থেকে ধরা পড়া এই বিশেষ আসামীর জন্য ফর্মালিটির দিস্তে দিস্তে কাগজ সই করানোর পর সাঠে যখন গণেশকে ছাড়লেন, তখন জেলের ডাক্তার রমেশ পাটিল সুপারের ঘরে ঢুকছেন। ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে গণেশ, কেদার সাঠের গলার আওয়াজ শুনতে পেল, “বসা, ডক্টর পাটিল, বসা। মেডিক্যাল সার্টিফিকেট মধে মলা কাহি চুকি চলনার নাহি। ডিক্লেয়ার দেম অল ফিট বিফোর দে লিভ, ওকে?”
***
জেলে আসার পর রুটিন মেডিক্যাল চেক-আপের সময়, গায়ে হাত পায়ে কোনো টাটকা ক্ষত আছে নাকি ভালো করে পরীক্ষা করা হয়। গণেশ হুঁইয়ের গা হাত-পায় বেশ ক’জায়গায় কালশিটে। সেগুলো রেজিস্টারে নথিভুক্ত হল না। নিরুত্তাপ কণ্ঠে কনস্টেবল নীতিশ পাণ্ডে রুটিন ইনস্ট্রাকশন দিল, “প্যান্ট অউর শার্ট উতার।” পুরুষ কয়েদিরা পাছার ভাঁজে ব্লেড নিয়ে জেলে ঢোকে। গণেশের পাছার ভাঁজ আর ফুটো ভালো করে পরীক্ষা করার পর, জামাকাপড়ের লাইনিং পরীক্ষা করল নীতিশ পাণ্ডে। গণেশ একটা সাদা গেঞ্জি আর ছাই কালারের প্যান্ট পরে কলকাতা থেকে মুম্বাইগামী ট্রেনে উঠেছিল, আপাতত আগামী বেশ কটা দিনের জন্য একই জামা প্যান্ট পরে কাটাতে হবে। জুডিশিয়াল কাস্টডির আসামীদের জন্য জেল কোনো ইউনিফর্ম দেয় না।
গণেশ দুজন সেমি-অফিসিয়ালের সঙ্গে জেলের ভিতর ঢুকল। এরা বহুদিনের সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী, কিঞ্চিৎ পড়াশুনা জানার সুবাদে এরা খুচরোখাচরা কাজে জেলের কনস্টেবলদের সাহায্য করে। নীতিশ পাণ্ডে গণেশের ঠিকানা বলে দিয়েছে আগেই। ব্যারাক টুয়েল্ড- সি, জেল নাম্বার ফোর। সেমি-অফিসিয়াল দুজন গণেশ হুঁইকে ব্যারাকের ভিতরে ঢুকিয়ে তালা দিয়ে দিল। ব্যারাকের ভিতর এত ভিড়, যে পাশাপাশি দুজন বসলে মধ্যে মাছি গলার জায়গা পাওয়া যায় না। গণেশ ঘরের কোণে কাঠের তক্তার তৈরী একটা শেল্ফের নিচে মাথা গুঁজে বসল। নীতিশ পাণ্ডে বাদামি রঙের অদ্ভুত দেখতে একটা জিনিস ধরিয়েছে গণেশের হাতে; স্ক্রচব্রাইটের মত খসখসে, এক মিমি পুরু, বিষাক্ত দুর্গন্ধযুক্ত মালটা পেতে শুতে হবে। গণেশের চোয়াল শক্ত হল।
এই ওয়ার্ডটার একটা বিশেষ নাম আছে। মুলাইজা ওয়ার্ড। প্রথমবারের জন্য জেলে আসলে মুলাইজা ওয়ার্ডে জায়গা হয়। যারা আসে, প্রথম দু-মাসের পর হয় তাদের জামিন হয়ে যায় বা অন্য ওয়ার্ডে ট্রান্সফার। গণেশ হিসাব করে দেখল, তিরিশ মিটার বাই পাঁচ মিটার লম্বা ঘরটায় দুশ জন ঠাসাঠাসি। শুতে গেলে সবার জায়গা হবে না। রাতে নিশ্চয়ই পালা করে শোওয়ার ব্যবস্থা আছে। রাগে, ক্ষোভে গণেশের শরীর অবশ হয়ে আসছিল। পাক্কা বাহাত্তর ঘণ্টা কেটে গেছে, ইঁদুরকলে ধরা পড়া ইঁদুরের মত গণেশ ছটফট করেছে। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার এমন অসহায় লাগছে। প্রথমবার যখন এমন লেগেছিল, তখন নতুন একটা কথা শিখেছিল গণেশ। দুনিয়া যদি তোমার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট না করে, তবে তুমিই বাকি দুনিয়ার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে নাও। এতগুলো বছর ধরে গণেশ সেই কাজটাই করে এসেছে। অ্যাডজাস্টমেন্ট যখন করতেই হবে, তবে নিজের বানানো নিয়মেই হোক। এতগুলো বছর পরে কেউ নতুন নিয়মে আঁক কষাতে এলে গণেশ হুঁই অঙ্কটাই বদলে দেবে, সে ক্ষমতা ওর আছে।
প্রতিটা ওয়ার্ডের মত মুলাইজা ওয়ার্ডেও একজন লিডার আছে। গয়ারাম দুবে এই ওয়ার্ডের লিডার। দুপুর দুটোর সময়, রোজকার অভ্যেস মত সে হাঁক পারল, “খানা খালো সব কোই। জলদ করা।” দুশ জনের খাবার যখন প্রায় শেষের পথে, তখন গয়ারাম দুবের শাকরেদ তার কানে কানে বলল, “নতুন মুর্গা দাঁতে দানা পানি কাটেনি।” দুবে আড় চোখে তাকাল ঘরের কোণে। নতুন মুর্গা, তন্দরুস্ত মুর্গা; বয়স হলেও দিব্যি হাট্টা কাট্টা আছে। দুবে সয়াবিন আর আলুর ঝোলের বালতিটা দোলাতে দোলাতে লোকটার সামনে উপস্থিত হল। গণেশ তখন হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে ছিল। দুবে খরখরে গলায় বলল, “এ লাটসাবকা অওলাদ, খানা নেহি খায়েগা?” গণেশ হুঁই কোনো উত্তর দিল না, হাঁটু থেকে মাথাও তুলল না। দুবে দ্বিতীয়বার নিজের কথাগুলো বলল। গণেশ সামান্য বিরক্ত হয়ে ডান কনুইতে বসা রক্তচোষা মশাটাকে মেরে আবার হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে দিল। দুবের আর সহ্য হল না। সয়াবিন, আলু ঝোল সহ সম্পূর্ণ বালতি ও উপুড় করে দিল গণেশের মাথার উপর। মাত্র দু সেকেন্ডের ব্যবধান; গণেশ লাফ দিয়ে উঠে চুঁটি টিপে ধরল দুবের। দুবের চারজন শাকরেদ ছুটে এসে প্রথমে গণেশের মুঠো থেকে দুবেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না দেখে, ওর মুখে আর বুক লক্ষ করে দমাদম ঘুষি চালাতে শুরু করল। গণেশের কপাল আর চোয়াল দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছিল। হাত দিয়ে চোখের উপর গড়িয়ে নেমে আসা রক্তের স্রোত মুছতে মুছতে ও সামনের লোকগুলোকে টার্গেট করে এলোপাথাড়ি হাত চালাল। কিন্তু চারজন খুব সহজেই গণেশকে মাটিতে পেড়ে ফেলল। পেটের উপর বেশ কয়েকটা কিল ঘুষি খেতে খেতে গণেশ হিসহিসিয়ে বলে উঠল, “বহেনচোত, চুতিয়া, হারামি শালা! দম আছে তো একজন একজন করে আয়! তোরা জানিস না, আমি…” গয়ারাম দুবে এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল, গণেশের কথায় ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মুখ থেকে চুক চুক শব্দ করে বলল, “ইয়েথুন হলবা রে বিক্রম। আবে এ রাকেশ, ছোড় দে বুড্ডে কো। উসকো একিচ আদমি মাংতা।”
দম নিতে নিতে গণেশ তাকাল দুবের দিকে। দুবে ফিক ফিক করে হাসছিল। নিজের গেঞ্জির ভিতরে হাত ঢুকিয়ে একটা প্লাস্টিকের ছোট্ট এয়ারটাইট প্যাকেট বার করে আনল ও। প্যাকেটের মুখটা খুলে গণেশের মুখের সামনে ধরল। গণেশ মুখ সরিয়ে নিল ঘেন্নায়। প্যাকেটটায় কী আছে ও জানে। জেলের ভাষায় একে বলে কিমা-পাও। মাংসের কিমা আর পাউরুটি নয়, মানুষের মল শুকিয়ে রাখা আছে প্যাকেটটায়। বেতরিবত নতুন কয়েদিদের তরিবত শেখানোর জন্য গালে গলায় ফুঁসে দেওয়া হয় কিমা-পাও।
ওদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য গণেশ এবার সর্বশক্তি প্রয়োগ করল। রিং-এ কর্ণার হয়ে যাওয়া বক্সারের মত ফিরে আসার চেষ্টা করল ও। ভারী শরীরটা মাটি থেকে টেনে হিঁচড়ে তোলার চেষ্টা করল এবার। একবার আধশোয়া হয়ে বসে দুবের ঘাড় ধরে কায়দা করে ওর শরীরটাকে বাগে আনতে পারলেই ওর গলাটা টিপে দিতে পারবে। গণেশকে ছটফট করতে দেখে দুদিক থেকে দুজন ওর হাত চেপে ধরল। দুবে প্যাকেটের মাল গণেশের মুখে ভরে দেওয়ার জন্য লোহার মত আঙুলগুলো দিয়ে গণেশের চোয়াল ধরেছিল। গণেশ পা চালাল, লাথিগুলো বাতাসে গোঁত খেল। ওর মুখ থেকে গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরোচ্ছিল। আর ঠিক তখনই বাইরে একটা হুটপাট আওয়াজ হল। বাকি কয়েদি, যারা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল, তারা বাইরের রোদটা আটকে রেখেছিল। বেশিরভাগ সময়েই, কয়েদিদের অধিকাংশ ব্যারাকের ভিতরে মারপিটে নির্বাক দর্শক হয়ে মজা লোটে। জেলের একটাই নিয়ম— নিজের লড়াই নিজে লড়ো। আজ একটু ব্যতিক্রম হল, ভিড়টা মাঝখান থেকে সামান্য ফাঁকা হয়ে জায়গা করে দিল একজনকে। দীর্ঘদেহ লোকটা হাঁফাতে হাঁফাতে এসে দাঁড়াল ওদের সামনে। দূরের ব্যারাক থেকে ছুটে আসার কারণে ওর সারা শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছিল। সামনের দিকে ঝুঁকে দম নিতে নিতে ও বলল, “ত্যালা সোড়, ছোড় ইসকো। হে মদন ভাউকা আদমি আহে। গণেশ নাম হ্যায় না ইসকা?”
