Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কন্ট্রোল (বেগ-বাস্টার্ড ৭) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এক পাতা গল্প399 Mins Read0
    ⤷

    কন্ট্রোল – ১

    মুখবন্ধ – বিচ্ছিন্ন ঘটনা

    বহুদিন পর বাইক চালাচ্ছে। মহাসড়ক দিয়ে ছুটে যাবার সময় সেই পুরনো অনুভূতিটা ফিরে এসেছে আবার, বাইক চালাতে গেলে সব সময় যেটা হয়।

    প্রায় এক শ” কিলোমিটারের পথ, প্রথমে ভেবেছিল গাড়িতে করেই যাবে কিন্তু যে কাজটা করতে যাচ্ছে তার জন্য বাইকের বিকল্প নেই। এরকম দূরত্ব পাড়ি দেবার অভিজ্ঞতা আছে তার, সেটা অবশ্য এক যুগ আগের ঘটনা।

    নিজের এই বাইকটার কথা বেমালুম ভুলে গেছিল। সেই কবে মোহাম্মদপুরে বাচ্চুর গ্যারাজে রেখে এসেছিল, তবে বেশ যত্ন করেই রেখেছিল ছেলেটা, মাঝেমধ্যে চালিয়ে ইঞ্জিনটা সচল রেখেছে। হয়তো ধরে নিয়েছিল সে আর আসবে না তাই অনেকদিন পর তাকে দেখে অবাক হয়েছিল বাচ্চু।

    “আমি তো ভাবছিলাম এই জিন্দেগিতে আর আইবেন না,” হাসিমুখেই বলেছিল মেকানিক। “কিন্তু কওন তো যায় না কহন আহেন, তাই সার্ভিস করতাম রেগুলার…পুরা ফিট আছে, দেহেন।”

    ছেলেটাকে জোর করে কয়েক হাজার টাকা দিয়েছে সে।

    “তিন লিটার ভরা আছে.” টাকাগুলো হাতে নিয়ে বলেছিল বাচ্চু। “আপনের কাম হইয়া যাইবো।”

    “অনেক দূর যাবো…লম্বা জার্নি,” মুচকি হেসে বলেছিল সে। “আড়াই শ কিলোমিটারের মতো যেতে হবে।”

    “ওহ্,” একটু অবাক হয়েছিল মেকানিক। “তাইলে আমি ভইরা দিতাছি।” গ্যারাজে রাখা গ্যালনের জার থেকে কয়েক লিটার ভরে দেয়, এরপর একটা হেলমেট নিয়ে আসে। “এইটা রাখেন। এহন খুব কড়াকড়ি, হেলমেট না থাকলে জায়গায় বেজায়গায় আটকাইবো, ফাইন করবো পুলিশ।”

    বাস্টার্ডও এটা জানে। তবে সত্যিটা হলো, মাথায় হেলমেট চাপিয়ে বাইক চালিয়ে মজা পায় না।

    মহাসড়ক থেকে কুমিল্লা জেলার ভেতরে ঢুকতেই হেলমেটটা খুলে ফেলল, বুক ভরে নিশ্বাস নিলো সে। তার ছোটো ছোটো করে ছাটা চুলগুলো না উড়লেও বাতাসের পরশ ভীষণ ভালো লাগছে চোখেমুখে আর সারা শরীরে।

    মুরাদনগর উপজেলার জনাকীর্ণ এক বাজারে এসে থামলো বাস্টার্ড। পকেট থেকে ফোনটা বের করে হোয়াটসঅ্যাপে লোকেশনটা দেখে নিলো-আরো দুই কিলোমিটার দূরে তার গন্তব্য।

    সব ঠিকঠাক আছে। আর সবকিছু যখন ঠিকঠাক থাকে তখন অন্য রকম এক অনুভূতি হয় তার।

    অচিরেই ইটের রাস্তা ছেড়ে তার বাইকটা উঠে এলো মাটির তৈরি কাঁচা রাস্তায়। লোকেশন জানা সত্ত্বেও কয়েক জায়গায় থেমে লোকজনের কাছ থেকে জেনে নিলো সেলিম বেপারির ফার্ম হাউজে কিভাবে যাবে।

    তিতাস নদীর তীর ঘেষে চলে গেছে একটা কাঁচা রাস্তা, ডান দিকে থাকা বিস্তীর্ণ ক্ষেতি জমি আর ডোবা-নালা। রাস্তার বাঁ-দিকে বয়ে যাওয়া তিতাস নদীটি একটু সরু হয়ে চলে গেছে আরো সামনের দিকে। কিছুটা পথ এগোতেই দুই দিকে দুটো পিলার আর গ্রিলের একটা গেট দেখতে পেলো, হাট করে খোলা রাখা হয়েছে। গেটটা আসলে নামেমাত্র, এর দু পাশে থাকা সামান্য কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে যে কেউ ভেতরে ঢুকে যেতে পারবে।

    কিন্তু মনে হয় না সেটা কেউ করে।

    গেটের পরে সরু রাস্তাটা চলে গেছে অনেক দূরে। রাস্তার শেষে সাদা রঙের চমৎকার তিনতলা একটি নতুন ভবন দাঁড়িয়ে আছে। গেট দিয়ে ঢুকে পড়ার আগে গতি কমালো সে, ডান দিকে বড় একটা গাছের দিকে তাকালো। মাথায় সানক্যাপ পরা, ব্যাকপ্যাক নিয়ে এক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে কেবল চোখাচোখি হলো কয়েক মুহূর্তের জন্য, তারপরই বাইকটার গতি বাড়িয়ে ছুটে গেল ফার্ম-হাউজের দিকে।

    সাদা রঙের তিনতলা বাড়িটার সামনে বিশাল খালি একটা চত্ত্বর, সেখানে একটা পাজেরো জিপ আর প্রাইভেট কার পার্ক করে রাখা আছে।

    দু-তিনজন যুবক সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল, তাকে দেখামাত্র সামনে এগিয়ে এলো একজন।

    “সেলিম সাহেবের সঙ্গে মিটিং আছে,” যুবক কিছু বলার আগেই বলল সে।

    “হুন্ডাটা এইখানে রাইখ্যা ভিরে চইল্যা যান,” ছেলেটা বলল। “ওই সুমইন্যা …হেরে দোতলায় লইয়া যা।”

    জিন্সপ্যান্ট আর টি-শার্ট পরা বাকিদের চেয়ে কম বয়সি এক ছেলে তাকে বাইরের একটা সিঁড়ি দিয়ে ভবনের দোতলায় নিয়ে এলো।

    বিশাল একটি হলরুম, দেখে মনে হবে কোনো কমিউনিটি সেন্টারের ফ্লোর। কমপক্ষে এক শ”জন মানুষের বসার ব্যবস্থা আছে। বুঝতে পারলো এখানেই প্রাইভেট আদালত বসায় ভবনের মালিক। তবে এই মুহূর্তে প্লাস্টিকের চেয়ারগুলো একটার উপরে আরেকটা রেখে ঘরের এককোণে রেখে দেয়া হয়েছে।

    তিন জোড়া সোফা পাতা আছে ঘরে। ছেলেটা তাকে একটা সোফায় বসতে বলে চলে গেল। চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিলো বাস্টার্ড। যেহেতু প্রাইভেট আদালত বসায়, সিসিক্যাম থাকার কথা নয়। সেরকম কিছু দেখতেও পেলো না।

    একটু পরই ঘরের পশ্চিম দিকের ডুপ্লেক্স-সিঁড়িটা দিয়ে তিনতলা থেকে নেমে এলো সাদা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরা মাঝবয়সি এক লোক। মাঝারি উচ্চতা, গাঢ় শ্যামবর্ণ, স্বাস্থ্যও মোটামুটি, মুখে গোঁফ আছে। ছোটো ছোটো করে ছাটা চুলগুলো পরিপাটী করে আঁচড়ানো। লোকটার ঠোঁট বিচ্ছিরি রকমের কালো। সম্ভবত চেইন স্মোকার।

    উঠে দাঁড়ালো বাস্টার্ড, নিঃশব্দে সালাম দিলো।

    খুশি হলো সেলিম সাহেব। স্মিত হেসে হাত নেড়ে বসতে বলল তাকে, নিজে বসলো বিপরীত দিকের একটা সোফায়।

    “আপনার নামটা যেন কী?”

    পকেট থেকে একটা বিজনেস কার্ড বের করে দিলো বাস্টার্ড। “সেলিম চৌধুরী।” এখানে আসার আগেই এই লোকের ঘনিষ্ঠ এক লোকের মাধ্যমে আজকের এই অ্যাপয়েন্টমেন্টটা নিয়ে রেখেছিল।

    কার্ড হাতে নিয়ে চওড়া হাসি দিলো। “আমার নামেই নাম।”

    “গ্রিন অ্যাগ্রো নামে আমাদের একটা ফার্ম আছে, আমরা ফ্রোজেন ফুডের ব্যবসা করি।”

    “হুম,” কার্ড থেকে চোখ সরালো সেলিম সাহেব। “কয়জন মালিক?”

    “আমরা তিনজন।”

    “আচ্ছা…তাইলে বলেন, আমার কাছে কী কাম?”

    “এখানে আমাদের ফার্মের জন্য জমি কিনতে চাই…দশ-বারো বিঘার মতোন।”

    “নতুন ফার্ম দিবেন?”

    “জি।”

    ভুরু কুঁচকে গেল সেলিমের। “এত জায়গা থাকতে এইখানে ক্যান?” প্রসন্ন হাসি দিলো বাস্টার্ড। “আমাদের নদীর পাড়ের জায়গা লাগবে।”

    “নদীর পাড় তো ঢাকা-গাজীপুরেও আছে…এইখানে, এত দূরে জমি কিনতে চাইতাছেন ক্যান?”

    “এই জায়গাটা আগরতলা-ত্রিপুরার খুব কাছে, তাই।”

    সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সেলিম বেপারি।

    “এখানকার প্রোডাক্টগুলো আমরা আগরতলা, মানে ত্রিপুরায় এক্সপোর্ট করতে চাচ্ছি।”

    “ওহ্,” এবার বুঝতে পারলো ভূমিদস্যু লোকটি।

    “ফার্মটা এখানে হলে অনেক সুবিধা হবে আমাদের।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো সেলিম। “জায়গা টায়গা দেখছেন এইখানে?”

    মাপা হাসি দিলো বাস্টার্ড। “আমরা নিজেরা তো দেখিনি, তবে ইউনুস নামের এক জমির দালাল একটা জায়গার খোঁজ দিয়েছে, সব শুনে আমাদের পছন্দও হয়েছে কিন্তু ও বলল, এখানে জমি কিনতে হলে আপনার সঙ্গে কথা বলতে হবে, আপনি এখনাকার মা-বাপ।

    প্রশংসাটা উপভোগ করলো এলাকার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা “আরে না, ওই রকম কিছু না, লোকজন মাইন্য করে, বিশ্বাস করে তাই ওগোরে একটু হেল্প করি। জমিজমা বেচা-কেনা খুবই ঝামেলার কাম,” কথাটা বলেই বাইরের সিঁড়ির দিকে তাকালো। “ওই মাহাবুব? দুই কাপ চা দিস এইহানে।”

    “চিনি ছাড়া দিতে বলেন, আমি আলগা চিনি খাই না।”

    “একটা চিনি ছাড়া দিস,” জোরে বলল কথাটা। “আপনের ঐ ইউনুস কি এই গেরামেই থাকে? এই নামের কোনো দালালের কথা শুনি নাই।”

    “তা জানি না,” বলল বাস্টার্ড। “আসলে ও খুব ভালো জমির দালাল, সারা দেশের খবর থাকে ওর কাছে কিন্তু ও এখানকার কি না আমার জানা নেই।”

    “হুম,” মাথা নেড়ে সায় দিলো সেলিম। “কুন জায়গাটার কথা বলছে সে?”

    “সুনীল বর্মনের ভিটেটা,” আস্তে করে বলল বাস্টার্ড।

    সেলিম বেপারির মুখের অভিব্যক্তি পাল্টে গেল, শক্ত হয়ে গেল চোয়াল। সামনে বসা নিজের মিতার দিকে স্থিরচোখে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “আপনের দালাল এই জমিটার কথা কইছে?”

    “জি। বলেছে, জমিটা নদীর পাড়ে, প্রায় দশ বিঘার মতো হবে।”

    “ওইটা দশ বিঘা না, আট বিঘার,” চোয়াল শক্ত করে বলল সেলিম। “ঐ জমি আমি বহু আগেই কিইন্যা নিছি!”

    হতভম্ব হবার ভাণ করলো বাস্টার্ড। “বলেন কী!”

    “ঐ লোক আপনেরে ভুল জায়গার খোঁজ দিছে।”

    “ইউনুস আমাদেরকে এমন জমির খোঁজ দেবে, বিশ্বাস হচ্ছে না। ও আমাদের অনেক পুরনো লোক।”

    “তাইলে মনে হয় আপনের ঐ জমির দালাল এইখানকার না,” সেলিম বলল। “লোকাল না হইলে যা হয় আর কী।”

    একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে সায় দিলো বাস্টার্ড করে।

    এমন সময় মাহাবুব নামের যুবকটি এসে দু কাপ চা দিয়ে গেল ট্রেতে নিজের কাপটা হাতে তুলে নিলো সেলিম। “লন, চা খান।”

    বাস্টার্ড চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চুমুক দিলো।

    পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালো সেলিম বেপারি। “চলবো?”

    “নো, থ্যাঙ্কস…আমি স্মোক করি না।”

    সিগারেটে লম্বা করে টান দিলো এই এলাকার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। “সুনীল হেরে মিছা কইছে…বাইনচোদটা গেরাম ছাড়া, অনেকের কাছ থিকা জমির বায়নার ট্যাকা লইয়া ভাগছে। এক জমি দশজনের কাছে বেচে! এই মালোয়ানগুলারে চিনেন না, ইন্ডিয়ায় যাওনের আগে চৌদ্দজনের কাছ থিকা বায়নার ট্যাকা লইয়া ভাগে, যতো ভেজাল তখন বায়না পার্টিগুলার মধ্যে লাগে।”

    বিস্মিত হয়ে চায়ে চুমুক দিলো বাস্টার্ড।

    “ওয় বহুত আগেই আমার কাছে ওর জমিটা বেইচ্যা দিছে…তার বাদে কতোজনের কাছ থিকা যে বায়নার ট্যাকা নিছে, ঠিক নাই। এইটা নিয়া সালিশ বইছিল…হারামজাদা ভাগছে। হুনছি, ঢাকায় আছে।”

    গম্ভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো বাস্টার্ড। “তাহলে তো আপনার কাছে এসে ভালোই করেছি। আমার কাছেও বায়নার টাকা চেয়েছিল, দেইনি। বলেছি, সরেজমিনে গিয়ে সব দেখে তারপর বায়না করবো।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো সেলিম। সিগারেটে টান দিয়ে চায়ে চুমুক দিলো।

    “আসলে যতো বিশ্বাসীই হোক জমির দালালদেরকে পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না,” আক্ষেপে বলল বাস্টার্ড। “ভেজাল জমি গছিয়ে দেয় অনেক সময়ই। যদিও আমরা জমি না দেখে, কাগজপত্র যাচাই না করে কিনতাম না।”

    “হুম। জমি-জমা বহুত সাবধানে কিনতে হয়,” গম্ভীর কণ্ঠে বলল সেলিম সাহেব। এখনও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সামনে বসা শিল্পপতিকে।

    “আপনার নামে কি জমিটা রেজিস্ট্রি করা হয়ে গেছে?”

    প্রশ্নটা শুনে কপালে ভাঁজ পড়লো ফার্ম-হাউজের মালিকের। “হ…অনেক আগেই হইছে। ক্যান?”

    “আমাদের ফার্মে একজন লিগ্যাল অ্যাডভাইজার আছেন, অ্যাডভোকেট আর কি…উনি খোঁজ নিয়ে আমাকে বলেছিলেন, এই জমিটা এখনও সুনীল মল্ল বর্মনের নামেই রেকর্ডে আছে।”

    “ভুল বলছে আপনের লোক!” একটু তেতে গেল এবার। “পুরানা কাগজ দেখছে, নতুন কাগজ জোগাড় করতে পারে নাই। নতুন কাগজে আমার নামই আছে।”

    “এত টাকার বেতন দিয়ে রাখি, এরকম ভুল-ভাল ইনফর্মেশন দিলে হবে?” আপন মনেই বলল বাস্টার্ড।

    সেলিম সাহেব চায়ের কাপটা রেখে দিলো। তাকে আগের চেয়েও বেশি সন্দিগ্ধ দেখাচ্ছে এখন।

    “যাকগে, সুনীলের জমিটা কি আপনি আমাদের কাছে বিক্রি করবেন?” মাথা দোলালো সেলিম। “নাহ্…ওইটা আমি আমার ফার্মের জমির লগে জোড়া দিমু, ফার্মটা বড় করুম।”

    বাস্টার্ড কিছু বলতে যাবে অমনি মাহাবুব নামের ছেলেটা হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলো আবার। “ভাই, খামার বাড়ির উরে একটা দোরোন চক্কর দিতাছে!”

    কথাটা শুনে ভুরু কুঁচকে গেল সেলিমের।

    “মাই গড! ড্রোন চক্কর দিচ্ছে!” চিন্তিত মুখে বলল বাস্টার্ড। “এখানে আসার সময় আমি এক লোককে দেখেছিলাম গেটের সামনে, হাতে মাইক্রোফোন…কী যেন একটা চ্যানেলের…ওই লোকই তাহলে এটা করেছে!”

    “শুয়ারের বাচ্চারা আবার আইছে!” বিড় বিড় করে বলল সেলিম।

    “ড্রোনটা থাকলে তো এখান থেকে বের হতে পারবো না। আমি চাই না সাংবাদিকেরা দেখুক আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি আমি। বুঝতেই পারছেন, রেপুটেশন শেষ করে দেবার হুমকি দেবে, টাকা-পয়সা চাইবে।”

    হাত তুলে তাকে আশ্বস্ত করলো লোকটা তারপর ছেলেটার দিকে তাকালো। “কে উড়াইতাছে, দ্যাখ! আর ওইটারে ফালানোর ব্যবস্থা কর্! তয় সাংবাদিকরে মারিস-টারিস না…বাইন্ধ্যা রাখবি, পুলিশে দিমু এইবার।”

    “আইচ্ছা, ভাই,” মাহাবুব দৌড়ে চলে গেল।

    “বন্দুক দিয়ে গুলি না করলে কিন্তু ওই জিনিস নিচে নামানো সহজ হবে না।”

    মাথা দোলালো সেলিম। “চিন্তা কইরেন না, ওরা নামায়া ফেলবো।”

    “কিন্তু এর আগে তো নামাতে পারেনি!”

    কথাটা শুনে ভুরু কুঁচকে গেল লোকটার। “আপনে কী কইতে চাইতাছেন?!”

    “এক টিভি চ্যানেলের কথা বলছিলাম,” স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল সে, তার ঠোঁটে স্মিত হাসি। “আপনাকে নিয়ে একটা রিপোর্ট করেছিল, ওটা আমি দেখেছি।”

    সেলিমের শ্বাস প্রশ্বাস বেড়ে গেল। “আপনে কে? কী চান?”

    লোকটাকে হাত তুলে আশ্বস্ত করলো ঢাকা থেকে আসা একই নামের আগন্তুক। “আপনি যেটা ভাবছেন সেটা না,” তারপর একদম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে টি-শার্টটা তুলে কোমর থেকে সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল বের করে তাক করলো সামনের দিকে। “আওয়াজ করলেই গুলি করে দেবো।”

    এমন শান্ত ভঙ্গিতে পিস্তল তাক করতে দেখে সেলিম সাহেব হতবুদ্ধিকর হয়ে গেল, মুখ দিয়ে কথা বের হলো না। তার ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে ঢাকা থেকে একজন এসে তার ডেরায় ঢুকে পিস্তল দিয়ে গুলি করার হুমকি দিচ্ছে!

    “আমি সরকারি লোক না। আপনার কোনো শত্রুও আমাকে পাঠায়নি,” একটু থামলো বাস্টার্ড। সামনে বসা লোকটার দিকে ভালো করে তাকালো সে। একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছে।

    “আ-আপনে এইভাবে পিস্তল বাইর কইরা কী চান? অ-ঐ জ্-জমিটা নিতে চাইতাছেন?!” বিস্ময়ের সাথে কিন্তু অস্ফুট স্বরে বলল সেলিম।

    “জমি-জমা নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই,” মাথা দুলিয়ে শান্তকণ্ঠে বলল।

    “তাইলে আপনে কী চান আমার কাছে?” বিস্ফারিত চোখে জানতে চাইলো

    “আমি চাই এখানকার কিছু লোকজন তাদের নিজের ভিটায় আবার ফিরে আসুক, একটু শান্তিতে থাকুক।”

    ভুরু কুঁচকে গেল ভূমিদস্যুর।

    “কিন্তু আপনার মতো জালিম থাকলে এটা সম্ভব হবে না।”

    অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইলো সেলিম।

    “আপনাকে যে লোকে আড়ালে আবডালে জালিম বলে, জানেন তো?”

    ঢোক গিলল সেলিম বেপারি। “আপনে আসলে কে?”

    কাঁধ তুলল বাস্টার্ড। “আপনার সেটা না জানলেও চলবে,” কথাটা বলে আর সময় নিলো না, সোজা ট্রিগার চেপে দিলো। থুপ্ করে একটা শব্দ হলো কেবল।

    খুব কাছ থেকে গুলিটা করেছে বলে প্রায় কপালের মাঝখানেই লাগলো, আরেকটা গুলি করলো-এবার গলার দিকে।

    একটা অদ্ভুত গোঙানি দিয়ে এই এলাকার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা সেলিম সোফাতে এলিয়ে পড়লো। ঘোৎ ঘোৎ করে সামান্য শব্দ করলো কেবল।

    রক্তে ভেসে গেল তার মুখ আর বুক।

    উঠে দাঁড়ালো বাস্টার্ড। যতোটা সহজ ভেবেছিল আদতে কাজটা তার চেয়ে অনেক বেশি সহজে করা গেছে। এমনটা যে হবে, এখানে ঢুকতেই বুঝে গেছিল।

    বাইরে থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ ভেসে আসছে। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো, দেখতে পেলো সেলিমের ছেলেপেলেরা ড্রোনটা নামানোর চেষ্টা করছে। বাইকে উঠে স্টার্ট দিলো সে। এক যুবক পাখি শিকারের বন্দুক দিয়ে নিশানা করার চেষ্টা করছে মাথার উপরে চক্কর দিতে থাকা সাদা রঙের ড্রোনটাকে।

    “আরেকটু উপরে,” সেই যুবকের পাশ দিয়ে যাবার সময় বলল বাস্টার্ড। তার দিকে তাকালো ছেলেটা। “টু শুটার যেহেতু পর পর দুটো গুলি করো, লেগে যাবে।”

    যুবক একটু রেগেমেগে তাক্ করলো আকাশের দিকে। ড্রোনটা মাথার উপরে উড়ছে।

    বাইক নিয়ে নির্বিঘ্নে মেইন গেটের সামনে চলে এলো সে। ওখানে দেখতে পেলো তিনজন ছেলে কাউকে খুঁজছে। গাছের নিচে তাকালো, কেউ নেই। থাকার কথাও না। আবারো গতি বাড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল বাস্টার্ড, এমন সময় বন্দুকের গুলির শব্দটা শোনা গেল।

    একটু পর আরেকটা।

    ফার্ম-হাউজ থেকে সোজা চলে এলো সেই বাজারে। তাকে দেখে রমেশ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার নামের এক মিষ্টির দোকান থেকে বেরিয়ে এলো মৃদুল। মুখে তার মিষ্টি, আর সেই মিষ্টি মুখে নিয়েই হাসি দেবার চেষ্টা করলো সে।

    ছেলেটা তার পেছনে উঠে বসতেই দ্রুত সেখান থেকে বাইক নিয়ে চলে গেল। মৃদুল জানতেও চাইলো না কাজটা হয়েছে কি না।

    গত পরশু দিনের কথা, হুট করেই সে ঠিক করেছিল এই কাজটা করবে।

    নকল ব্ল্যাক রঞ্জুর পর্ব শেষ হবার পর পরই অমূল্যবাবু তাকে সাভারে পাঠিয়ে দেয়, ওখানে একটা বাংলোতে আছে মাসখানেক ধরে। নন্দর বাবা ওখানে এক রিয়েল-এস্টেট প্রজেক্টে তদারকির কাজ করে, এখন সেই বাংলোর পাশেই থাকে সপরিবারে। প্রতি সপ্তাহে নন্দ আসে বাবা-মাকে দেখতে।

    অমূল্যবাবুকে সে বলেছিল, হোমিসাইডের জেফরি বেগ সম্ভবত তার পিছু নেবে না কিন্তু বাবু তার কথাটা আমলেই নেয়নি। রায় ঘোষণা করার মতো করে বলেছিল, কয়েকটা মাস তাকে সাভারেই থাকতে হবে। এটা হলো এক ধরণের সতর্কতা। যতো বয়স বাড়ছে, বাবু ততো বেশি সতর্ক হয়ে উঠছে-নিজের বেলায় না, অন্যের বেলায়!

    জায়গাটা সুন্দর। বেশ নিরিবিলি। নন্দর বাবা খুব খেয়াল রাখে তার। নন্দর মায়ের রান্না করা খাবার খায় তিনবেলা। একটা পারিবারিক আবহ আছে, যদিও সে না চাইলে ওদের কেউ তার বাংলোর ধারে কাছে ঘেষে না।

    পরশু দিনের আগের দিন নন্দর বাবা যথারীতি দুপুরের খাবার নিয়ে এসেছিল বাংলোতে, খাবারগুলো রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল গোবেচারা লোকটি।

    “কিছু বলবেন?”

    “পার্থিবদা…” নন্দর বাবা ইতস্তত করে বলেছিল। “কিছু মনে না করলে একটা কথা কইতাম।”

    “বলে ফেলুন,” আশ্বস্ত করেছিল লোকটাকে I

    “আমার এক পিসাতো দাদা…” হাত কচলাতে কচলাতে বলতে শুরু করেছিল। “…বহুত বিপদে পড়ছে…যাওনের জায়গা নাই, সক্কাল সক্কাল আমার এইখানে আইস্যা উঠছে।”

    “সমস্যা কি?…থাকবে।”

    “না…মাইনে…বাবু এইটা জানবার পারলে অনেক রাগ করবেন।”

    বাস্টার্ডও সেটা জানে। এখানে যেহেতু সে থাকে বাইরের কাউকে ঢুকতে নিষেধ করা আছে। “আচ্ছা, আমি উনাকে বলবো না।”

    “আপনি না বললেও উনি জাইন্যা যাইবেন,” মলিন কণ্ঠে বলেছিল নিরীহ লোকটি।

    মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল বাস্টার্ড। কথাটা মিথ্যে নয়। বাবুর চোখ অনেক জায়গায় আছে। এখানে কেউ এসে থাকতে শুরু করলে অচিরেই সেটা জেনে যাবে।

    “আমি উনারে ম্যানেজ করবো…চিন্তার কিছু নেই।”

    একটু খুশি হয় নন্দর বাবা। “আসলে এইরাম বিপদে না পড়লে আমি আপনেরে এইটা বলতাম না…অনেক বড় বিপদে পড়ছে, জীবন নিয়া টানাটানি।”

    “কী হয়েছে আপনার ঐ ভাইয়ের?” খুবই হালকা চালে জানতে চেয়েছিল সে।

    “ওয় তো এলাকা ছাড়া। ওইখানে থাকলে মরবো…জমি তো গেছে, জীবনটাও যাইবো।”

    “সমস্যাটা কী নিয়ে?” নিতান্তই কৌতূহল থেকে জানতে চেয়েছিল তখন।

    এরপরই নন্দর বাবা যা বলে শুনে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল প্রথমে কিন্তু এমন ঘটনা এ দেশে খুব একটা অস্বাভাবিক নয় :

    কুমিল্লার তিতাস নদীতীরবর্তী প্রত্যন্ত এক গ্রামে নন্দর বাবার পিসাতো ভাই সুনীলদের পৈতৃক ভিটে-বাড়ি। সাতচল্লিশ, পঞ্চাশ, পয়ষট্টি, একাত্তুর গিয়ে নব্বইর দাঙ্গায়ও তারা সেই ভিটেবাড়ি ছেড়ে কোথাও যায়নি। কিন্তু কয়েক বছর আগে, দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় থেকে সেলিম বেপারি নামের এক লোক গ্রামে ফিরে আসার পর সেখানকার অনেকেরই ঘুম হারাম হয়ে গেছে। লোকটা প্রথমে নগদ টাকায় কিছু জমিজমা কেনে, এরপর ক্ষমতাসীন দলে যোগ দেয়, শুরু করে রাজনীতি। নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে অন্যের জমিজমা আত্মসাৎ করতে শুরু করে।

    মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে সেলিম হয়ে উঠেছে এলাকার ত্রাস। থানা- পুলিশ সব তার পকেটে চলে গেছে। ডিসি-এসপিও তার কথায় উঠে বসে। স্থানীয় এমপির ঘনিষ্ঠ এই লোকের কথার বাইরে গিয়ে আশেপাশের দশ গ্রামের কেউ থাকতে পারে না। তিতাস পাড়ে শত শত বিঘা জমি দখল করে নিয়েছে সে, বানিয়েছে খামার বাড়ি। সেই বাড়িতে নিয়মিত তার প্রাইভেট আদালত বসে। সাক্ষী-প্রমাণের বালাই নেই, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নেই, সেলিমের ইচ্ছা-ই বিচারের রায়। গরু চুরির মতো অপবাদ দিয়ে দশ- বারো লাখ টাকা জরিমানা করে সে। সেই অভিযোগও মিথ্যে। প্রবাসী হলে কথাই নেই, ঠুনকো কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত করে ত্রিশ-চল্লিশ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। না দিলে ভিটেবাড়ি ছাড়া করে, এলাকায় আর থাকতে দেয়া হয় না। তার কথার বরখেলাপ করা হলে এমন কি বাড়িতে যাবার একমাত্র রাস্তাও কেটে ফেলে। থানা-পুলিশের কাছে সেলিমের নামে জিডি পর্যন্ত করা যায় না, মামলা তো দূরের কথা। করতে গেলে উল্টো পুলিশ মিথ্যে মামলা দিয়ে দেয়।

    তিতাস পাড়ে এই সেলিম এখন গড়ে তুলেছে সুরম্য এক অট্টালিকা, পাশে তার বিশাল ফার্ম-হাউজ। এই ফার্মের পাশের জমিটাই সুনীলদের। প্রথমে তাকে মিথ্যে মামলা দিয়ে এলাকা ছাড়া করা হয়, এরপর তার অনুপস্থিতিতে বিচার করে পঞ্চাশ লাখ টাকার জরিমানা করে সেলিম। সুনীল যেহেতু প্রাণভয়ে পালিয়ে গেছে সেজন্যে তার পৈতৃক ভিটেসহ আট বিঘার জমিটা গ্রাস করে নিয়েছে এই ভূমিদস্যু।

    নন্দর বাবার কাছ থেকে সবটা শুনে বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিল তার। কোন দেশে আছে মানুষ! কারা চালায় এই দেশ?

    পরক্ষণেই পরিহাসের হাসি ফুটে উঠেছিল তার ঠোঁটে। উত্তরটা অবশ্য তার চেয়ে বেশি কেউ জানেও না-একদল লুটেরা হার্মাদ! পার্থক্য কেবল এক জায়গায়-হার্মাদগুলো বাংলাতেই কথা বলে, মুখে থাকে দেশপ্রেমের বুলি।

    ঐদিন বিকেলে খোদ সুনীলের কাছ থেকে আবারো সবটা শুনে নেয় সে। নন্দর বাবা মোবাইলফোন বের করে ইউটিউবে একটা ভিডিও দেখায় তাকে। কয়েক মাস আগে এক টিভি চ্যানেল সেলিমের এইসব অপকর্ম নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন করেছিল। রিপোর্টার বেশ ভালো মানের ইনভেস্টিগেশনই করেছে। সেলিমের ফার্ম-হাউজে ঢুকতে পারেনি বলে ড্রোন দিয়ে ছবি তুলেছে উপর থেকে। সেই ছবিতে ধরা পড়েছে সেলিমের লোকজনও তারা ড্রোনটাকে নিচে নামিয়ে ফেলার জন্য বন্দুক দিয়ে গুলি করছিল। শেষের দিকে সেলিমের একটা ইন্টারভিউও দেখানো হয়েছে। লোকটা সব অভিযোগ অস্বীকারও করেনি। জোর দিয়ে বলেছে, এই এলাকার লোকজন তাকে মানে, সে তাদের গার্জিয়ান হিসেবে সালিশ-টালিশও করে মাঝেমধ্যে। আর জমি কেনার ব্যাপারে বলেছে, এটা তার নেশা। তবে সে কারোর জমি দখল করেনি, সবার কাছ থেকে নিয়ম মেনেই কিনে থাকে!

    সেলিমের ফার্ম-হাউজের ভেতরকার স্টিল ছবিও কিভাবে জানি ঐ সাংবাদিক জোগাড় করেছিল। ড্রোন শটগুলোসহ স্টিল ছবিগুলো ভালোমতো দেখেছে বাস্টার্ড। তার মনে হয়েছে, নিজের রাজ্যে অনেকটাই নির্ভার থাকে এই লোক।

    ঐদিন রাতে ঘুমানোর সময় বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভেবেছিল, এরকম একটা রিপোর্ট করার পরও ঐ এলাকায় “জালিম” নামে পরিচিত লোকটির কিছুই হয়নি, বহাল তবিয়তে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে এখনও। ওখানকার এতগুলো মানুষের জীবন বেঁচে যেতে পারে মাত্র একজন লোকের অনুপস্থিতিতে!

    এ জীবনে অনেক কাজ করেছে সে, সেগুলোর বেশিরভাগই ছিল মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে করা। একটা কাজ না হয় সমাজসেবার অংশ হিসেবেই করলো!

    পরদিন সকালে উঠেই পুরান ঢাকার নবাবপুরে শুটার সামাদের সঙ্গে তার আড়াই তলায় দেখা করে। অনেকদিন পর তাকে দেখে ভীষণ খুশি হয়েছিল লোকটা।

    “ব্ল্যাক রঞ্জু ধরা পড়েছে, জানো তো?”

    মুচকি হেসেছিল বাস্টার্ড। “পত্রিকায় পড়েছি।”

    ভুরু সামান্য কপালে উঠে গেছিল সামাদের। “তুমিও পত্রিকায় পড়েছো!”

    তবে এ নিয়ে আর কিছু বলেনি। সাবেক এই শুটার এখন আর অস্ত্রের ব্যবসা করে না। বয়স হয়েছে, ঝুঁকিও বেড়ে গেছে এই পেশায়। তাছাড়া আগের মতো এখন ঢাকায় সংঘবদ্ধ গ্যাং কালচার নেই, রাজনীতিকেরা সেগুলো আত্মসাৎ করে ফেলেছে। খুব বেশি অবৈধ অস্ত্রেরও প্রয়োজন পড়ে না আজকাল। অপরাধের ধরণও পাল্টে গেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনির সহায়তায় কিংবা রাজনৈতিক নেতারাই যাবতীয় অপরাধ করে নিজেদের লাইসেন্স করা অস্ত্র দিয়ে। তবে এখনও সামাদের সংগ্রহে রয়ে গেছে বেশ কিছু অস্ত্র, সেখান থেকে তাকে একটা দিয়ে দেয় সাইলেন্সারসহ। সামাদের আড়াই তলা এখন তার অবসর কাটানোর জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। নিচতলায় যে হার্ডওয়্যারের দোকানটা আছে, এখন সেটাই তার একমাত্র ব্যবসা।

    সামাদের কাছ থেকে পিস্তলটা নিয়ে এরপর সে চলে যায় মোহাম্মদপুরে বাচ্চুর গ্যারাজে। আগের দিন মৃদুলের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফোনে, জানতে পারে সে এখন ঢাকায় আছে তার মায়ের চিকিৎসা করাতে, মাসখানেক থাকবে এখানে। ছেলেটাকে তার পরিকল্পনা জানিয়ে দিলে সে পরদিনই একটা ড্রোন জোগাড় করে ফেলে, এরপর নীলক্ষেত থেকে একটা নিউজ চ্যানেলের সাংবাদিক পরিচয়পত্র বানিয়ে নেয়, আর তার জন্য বানিয়ে দেয় একটা বিজনেস কার্ড।

    সুনীল বর্মনের কাছ থেকে সেলিমের এক ঘনিষ্ঠ লোকের ফোন নাম্বার নিয়ে নিয়েছিল সে এই বলে, ঐ লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার সমস্যাটার সমাধান করার চেষ্টা করবে। এরপর ফোন করে নিজেকে একজন উঠতি শিল্পপতির পরিচয় দিয়ে ঐ লোকের সঙ্গে দেখা করার সময়টা নিয়ে নিয়েছিল।

    আজ সকাল সকাল সংবাদকর্মি “সালেহ আহমেদ”কে নিয়ে সাভার থেকে বাইকে করে রওনা দেয় কুমিল্লার উদ্দেশ্যে-নতুন একটি সংবাদ সৃষ্টি করার জন্য!

    অধ্যায় ১

    অন্যদিনের চেয়ে আজকে একটু বেশি সময় জগিং করলো জেফরি বেগ।

    গত মাসের সাফল্য তার মধ্যে প্রাণশক্তি আরেকটু বাড়িয়ে দিয়েছে। ক্যারিয়ারের কথা বিবেচনায় নিলে এই সাফল্যকে কোনোভাবেই অন্য কিছুর সঙ্গে তুলনা করা যায় না। ইদানিং বেশ ফুরফুরে মেজাজে থাকে। সহকর্মিরাও তাকে আগের চেয়ে বেশি সম্ভ্রম করে। গত সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে রাষ্ট্রপতির পদক পেতে যাচ্ছে সে। তালিকায় তার নাম রয়েছে সবার উপরে।

    জেফরি বেগ অবশ্য তার চেয়ে বড় পদক পেয়ে গেছে মানুষের কাছ থেকে। অনেকেই ইমেইল করে, চিঠি লিখে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে ব্ল্যাক রঞ্জুকে জীবিত ধরার জন্য। অনেকে এ-ও বলেছে, রঞ্জু যেন কোনোভাবেই আইনের ফাঁক গলে বের হয়ে না যায়, সে যেন সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখে। বিচার ব্যবস্থার উপরে জনগণের ভয়াবহ আস্থাহীনতা না থাকলে রঞ্জুর মতো সন্ত্রাসীর বেলায়ও এমন আশঙ্কা তৈরি হবার কথা নয়-সেটা যদি বিচারকেরা বুঝতো!

    তবে জেফরির ধারণা, ব্ল্যাক রঞ্জু এতটাই নোংরা আর জঘন্য যে তার জন্যে কেউ কিছু করার ঝুঁকি নেবে না-বিশেষ করে একজন পঙ্গু আর অথর্ব সন্ত্রাসীর জন্য কিছু করাটাকে ফালতু আর ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ হিসেবেই দেখবে সবাই।

    ঐ সন্ত্রাসী এখন কারাগারের চারদেয়ালের ভেতরে তড়পাচ্ছে। দিনে কতো বার যে নিজেকে ঝন্টু হিসেবে দাবি করে, ইয়ত্তা নেই। যদিও এ নিয়ে কোনো প্রমাণ জোগাড় করতে পারেনি তার আইনজীবী। বেচারা উকিল পড়েছে মহা ফাঁপড়ে। ব্ল্যাক রঞ্জু আর তার বিশ্বস্ত ঝন্টুর নামে আগে থেকেই চার-পাঁচটি মামলায় যাবজ্জীবনসহ দশ-বারো বছরের সাজার রায় হয়ে আছে, সেই সঙ্গে ত্রিশটির মতো হত্যা আর শত শত চাঁদাবাজির মামলা অপেক্ষা করছে তাদের দুজনের জন্য। রঞ্জুর জায়গায় ঝন্টু হলে বাড়তি একটাই সুবিধা পাওয়া যাবে দশ বারের জায়গায় মাত্র তিন-চার বার ফাঁসি হবে!

    কথাটা ভাবতেই মুচকি হাসি ফুটে উঠল জেফরির ঠোঁটে। এটাকেই বোধহয় বলে ত্রিশঙ্কু অবস্থা!

    জগিং শেষে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে যথারীতি হকারের কাছ থেকে পত্রিকা কিনে পড়তে শুরু করলো হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটর। গুরুত্বপূর্ণ কোনো সংবাদ নেই প্রথম পৃষ্ঠায়, সেজন্যেই বুঝি সিমেন্টের বিজ্ঞাপনে ঢেকে দেয়া হয়েছে লজ্জাহীন মুখটা। বিরক্ত হয়ে ভেতরের পাতায় চলে গেল সে, দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলো। অবশেষে শেষ পৃষ্ঠার নিচে, ডান দিকে একটা দুই কলামের খবর চোখে পড়লো তার : কুমিল্লার মুরাদ নগরে সেলিম নামের এক ভূমিদস্যু খুন হয়েছে গতকাল। ধারণা করা হচ্ছে স্থানীয় রাজনৈতিক কোন্দলের জেরে ঘটেছে হত্যাকাণ্ডটি। তবে প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানিয়েছে, খুনি ঢাকার একজন ব্যবসায়ি পরিচয়ে সেলিমের ফার্ম হাউজে দেখা করতে গিয়েছিল, সুযোগ বুঝে খুন করে বাইক নিয়ে নির্বিঘ্নে কেটে পড়ে।

    ঢাকা থেকে বাইকে করে কুমিল্লার প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে স্থানীয় এক গডফাদারকে তার নিজের ফার্ম-হাউজে খুন করে নির্বিঘ্নে সটকে পড়তে পারলো এভাবে?!

    স্মার্ট খুনি-কোনো সন্দেহ নেই। অনেকটা বাবলুর মতো!

    পত্রিকাটা ট্র্যাশ-বিনে না ফেলে হকারকে দিয়ে দিলো জেফরি বেগ। আরেক বার বিক্রি করতে পারবে এটা।

    পার্কের সামনে থেকে হেঁটে নিজের ফ্ল্যাটের দিকে পা বাড়ালো সে। বাবলু এমন একটা লিগ্যাসি তৈরি করে ফেলেছে, স্মার্ট কোনো খুনির কথা পড়লে ওর নামটাই সবার আগে মাথায় চলে আসে। জেফরি নিশ্চিত, অমূল্যবাবু তাকে নতুন পরিচয় দিয়ে এনআইডি বানিয়ে,

    নতুন পাসপোর্ট করিয়ে বাইরে কোথাও পাঠিয়ে দেবে।

    বাবুর একমাত্র সন্তান পার্থিব রায় চৌধুরী!

    বাঁকা হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। থাকুক বাইরে! ওর সঙ্গে দেখা করার কোনো ইচ্ছে নেই তার। ওদের দুজনের পথ আলাদা। ভিন্ন জগতের মানুষ ওরা। দীর্ঘদিন ওর পেছনে লেগে ছিল, দু”বার ধরেওছিল। এই চোর- পুলিশ খেলায় হাঁপিয়ে গেছে এখন। ওকে ধরলেও পর্দার পেছন থেকে অমূল্যবাবু কলকাঠী নেড়ে ঠিকই বের করে ফেলে।

    বাবলুর বেলায়ও একই কথা খাটে-হাঁপিয়ে গেছে। সেই ভোরে, উত্তরার পথে তার নির্বিকার আর নির্ভার হাঁটার দৃশ্যটা এখনও চোখে ভাসে। ছেলেটা ভালো করেই জানতো পেছনে কে আছে কিন্তু ধরেই নিয়েছিল সে তার পিছু নেবে না।

    রাস্তার বাঁ-দিকে পামরোজ ভিলা নামে সুরম্য এক ভবনের সামনে পুলিশের একটা ভ্যান দেখে সেদিকে তাকালো জেফরি বেগ। ভ্যান থেকে নামছে লোকাল থানার এক পুলিশ অফিসার। দূর থেকেও চিনতে পারলো তাকে বনানী থানার এসআই বশির। তার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সহাস্যে এগিয়ে এলো।

    “স্লামালেকুম, স্যার।”

    “এত সকালে এখানে?…কী হয়েছে?” নিঃশব্দে সালামটা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো।

    পেছনের ভবনের দিকে চকিতে তাকালো এসআই। “এক মেয়ে থাকে এখানে…একা…রাত থেকে রেসপন্স করছে না। ওর বড় বোন থানায় রিপোর্ট করেছে, দেখি কী কাহিনি।”

    “সুইসাইড কেস নাকি?”

    “মনে হয় না, স্যার। মেয়েটার বড় বোন যা বলছে, অন্যকিছু মনে হচ্ছে।” আশেপাশে তাকিয়ে সতর্ক দৃষ্টি হানলো বশির। “ভিআইপি কেস, স্যার,” কথাটা প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল।

    “মডেল, নাকি মুভিস্টার?”

    মাথা দোলালো এসআই। “মেয়েটার কথা বলছি না, স্যার।” অবাক হলো হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটর।

    “এই মেয়ে জাহান গ্রুপের সিইও”র প্রেমিকা… কী নাকি ঝামেলা চলছিল ক-দিন ধরে।”

    জাহান গ্রুপ হলো এই দেশের সেই সব ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম, যাদের বিরুদ্ধে সরকারও কিছু করতে দশবার চিন্তা করে। “তোমাকে কে বলল?”

    “মেয়েটার বড় বোন ঢাকার বাইরে থেকে রাতেই ফোন করে বলেছিল তার বোন ফোন-টোন ধরছে না…একটা জিডি করতে চাইছিল কিন্তু ফোন করে বলেছিল বলে জিডি নেওয়া হয়নি।”

    খুব একটা অবাক হলো না হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর। আইনে আছে এ দেশের যেকোনো নাগরিক রাষ্ট্রপতি আর প্রধানমন্ত্রি বাদে যে কারোর বিরুদ্ধে জিডি কিংবা মামলা করতে পারে কিন্তু ফোনে জেনারেল ডায়রি করার নিয়ম নেই। এরকম নিয়ম থাকা উচিত কি না নিশ্চিত হতে পারলো না।

    “থানা থেকে আমাকে পাঠানো হয়েছে ঘটনাটা খতিয়ে দেখার জন্য।” বশিরের পিঠে আলতো করে চাপড় মারলো জেফরি বেগ। “চলো তাহলে, দেখি কী অবস্থা।”

    এসআই বশির অবশ্য খুশিই হলো এমন কথা শুনে। “আপনি থাকলে তো খুবই ভালো হয়, স্যার।”

    দুজন কন্সটেবল নিয়ে বশির এবং জেফরি বেগ ঢুকে পড়লো ভবনের ভেতরে।

    “রিপোর্ট করেছে কখন?” লিফটের কাছে এসে জানতে চাইলো হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটর।

    “কাল রাত পৌণে একটার দিকে প্রথমে ফোন করেছিল মেয়েটার বড় বোন,” লিফটের বাটন প্রেস করলো বশির। “আজকে ভোরে গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় চলে এসেছে ঐ মহিলা। এখানে এসে অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কাধাক্কি করেছে কিন্তু সাড়াশব্দ পায়নি।” লিফটের দরজা খুলে গেলে তারা সবাই ঢুকে পড়লো ভেতরে, ৫ নাম্বার বোতাম টিপে দিলো বশির।

    “তুমি কাল রাতে ডিউটিতে ছিলে?”

    “জি, স্যার। এখন শেষ হওয়ার কথা কিন্তু কাউকে না পেয়ে আমাকে পাঠিয়েছে ওসিস্যার।”

    “মেয়েটার বড় বোন কোথায় এখন? উনার তো এখানে থাকা উচিত ছিল।”

    “থানায় আছেন…ওসিস্যার উনাকে আমার সঙ্গে আসতে দেননি।”

    লিফটের দরজা খুলে যেতেই দেখা গেল মাঝবয়সি এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে, সঙ্গে আছে রোগাপটকা আর গোবেচারা টাইপের এক ভদ্রলোক। মহিলার পরনে নাইটি। খুবই বেঢপ আর আটোসাঁটো। চুলগুলো বব-কাট।

    “অনেক ধাক্কাইসি খোলে নাই,” পুলিশ দেখেই বলল বব-কাটের মহিলা। পেছনে রোগা-পটকা লোকটি চিন্তিত মুখে মাথা নড়লো। “আল্লায়ই জানে বিষ-টিশ খাইলো কি না।”

    “আপনি কে?”

    স্পোর্টস ট্রাউজার আর টি-শার্ট পরা জেফরি বেগের দিকে ভালো করে তাকালো মহিলা

    “ইনি হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের চিফ ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ, এসআই বশির পরিচয়টা দিয়ে দিলো।

    সমীহের দৃষ্টিতে তাকালো রোগাপটকা পুরুষটি। মহিলার ভাবভঙ্গিও একটু বদলে গেল। “এইটা আমার ফ্ল্যাট।”

    বশির তার এক কনস্টেবলকে ইশারা করলো দরজা ধাক্কা দিতে।

    “ধাক্কা দিয়া লাভ নাই,” ফ্ল্যাটের মালেকিন বলল। …অনেকক্ষণ ধইরা ধাক্কাইসি আমি!”

    “তাহলে তো দরজা ভাঙতে হবে,” জেফরি বেগ বলল এসআইকে।

    “না, না,” মহিলা একটা চাবি বের করে বাড়িয়ে দিলো। “আমার কাছে স্পেয়ার চাবি আছে কিন্তু ওর বড় বোনরে আমি চাবি দেই নাই…বলছি,

    পুলিশ ছাড়া দরজা খুলবো না…কী না কী ঝামেলা হয়!”

    এসআই বশির চাবিটা নিয়ে দরজা খুলে ভেতরে পা রাখলো। সুনশান নিরব ফ্ল্যাটের ড্রইংরুমটা পেরিয়ে বেডরুমের দিকে এগিয়ে গেল তারা। দরজাটা সামান্য ফাঁক হয়ে আছে, আস্তে করে সেটা খুলতেই দৃশ্যটা দেখতে পেলো : বিছানার উপরে, সিলিং ফ্যান থেকে এক তরুণীর নিথর দেহ ঝুলছে!

    অধ্যায় ২

    রোজকার মতো ঘুম থেকে উঠে বাড়ির সামনের রাস্তায় একটু হাঁটাহাঁটি করে এসেছে অমূল্যবাবু। নাস্তা করার পর এখন ড্রইংরুমে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছে আর মহাকাল পড়ছে। সকাল দশটা পর্যন্ত সে মৌনব্রত পালন করে, এত দিনে নন্দ সেটা বুঝে গেছে। এ সময়টায় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সে-ও কথা বলে না।

    পত্রিকার পাতায় খবর পড়তে থাকলেও তার মাথায় ঘুরছে অন্য একটা চিন্তা। সাভার থেকে খবর পেয়েছে, গত পরশু হুট করেই বাবলু বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছিল, ফিরে এসেছে কাল বিকেলে। এর আগে আরেকটা ঘটনা ঘটেছে, নন্দর বাবার কাছে তার এক পিসাতো ভাই এসে উঠেছে। গ্রামের বাড়িতে কী জানি একটা সমস্যা হয়েছে তার।

    বাবলু আচমকা বাড়ির বাইরে কেন গেল, কী প্রয়োজনে গেল, সেটা বুঝতে পারছে না। ছেলেটাকে ফোন করলে কিংবা দেখা হলে জেনে নেবে, তাতে করে সত্যটা জানতে পারবে কি না সন্দেহ। তার ধারণা, ছেলেটা তার কাছ থেকে লুকাবে। তাকে না বলে বাড়ির বাইরে যাওয়া, পরদিন ফিরে আসাটা-ই বলে দেয়, সে এমন কিছু করেছে যেটা তাকে জানতে দিতে চায় না।

    গভীর করে শ্বাস নিয়ে পত্রিকা পড়ায় মন দিলো অমূল্যবাবু, আর সঙ্গে সঙ্গে টের পেলো চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। ছোটো ছোটো অক্ষরগুলো পড়তে সমস্যা হচ্ছে তার। চশমা খুলে রুমাল দিয়ে চোখটা মুছে নিলো।

    পত্রিকার ফ্রন্ট পেইজে কোনো আগ্রহ পেলো না। যেসব রাজনৈতিক খবর ওখানে আছে তার প্রায় সবগুলোই আগে থেকে জানে সে। ঢাকা ক্লাবে যার নিত্য যাতায়াত, ক্ষমতার কেন্দ্রে যার বসবাস, পত্রিকার প্রথম পাতা তার কাছে বড্ড বেশি বাসি লাগবে, সেটাই স্বাভাবিক।

    প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতায় চলে গেল। মফশ্বলের সংবাদ, খেলার পাতা কিংবা বিনোদন সংবাদে কোনো কালেই তার আগ্রহ ছিল না। শেষ পৃষ্ঠার নিচের ডান দিকে একটা সংবাদে চোখ আটকে গেল : কুমিল্লার তিতাস পাড়ে এক ভূমিদস্যু নিহত।

    পুরো রিপোর্টটা শেষ করার পর কয়েক মুহূর্ত চুপ মেরে বসে রইলো অমূল্যবাবু। সাভার থেকে খবরটা পেয়েই নন্দকে ডেকে জেনে নিয়েছিল, তার বাবার এক পিসাতো ভাই আছে, দুয়েক বার দেখেছে তাকে, কুমিল্লার তিতাস নদীর পাড়ে থাকে, কয়দিন আগে লোকটা সাভারে এসেছে।

    পত্রিকার রিপোর্ট বলছে, ভূমিদস্যু এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা সেলিম বেপারি সেখানে নিজের রাজত্ব কায়েম করেছিল। অন্যের জমি দখল করা, বিচার সালিশ করাসহ সবই করতো। স্থানীয় প্রশাসন বলতে গেলে তার কব্জায় ছিল। কেউ তার বিরুদ্ধে টু শব্দটিও করতো না। এমন ক্ষমতাবান লোকটির সঙ্গে গতকাল ঢাকা থেকে এক ব্যবসায়ি দেখা করতে গিয়েছিল। সেই লোক এক ফাঁকে খুন করে নির্বিঘ্নে চলে গেছে বাইকে করে।

    অমূল্যবাবু পুরোপুরি নিশ্চিত, কাজটা বাবলু করেছে। কিন্তু কেন করেছে, কার হয়ে করেছে বুঝতে পারছে না। নিশ্চয়ই নন্দর বাবার সেই পিসাতো ভাই তাকে বলেনি। ঐ লোক তো দূরের কথা, নন্দর বাবা-ই বাবলু সম্পর্কে কিছু জানে না। সে শুধু জানে, পার্থিব রায় চৌধুরী হলো তার একমাত্র সন্তান, দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিল, আবারো চলে যাবে কিছুদিন পর।

    হিসেব মেলাতে পারলো না অমূল্যবাবু। মৌনব্রত ভেঙে বাবলুকে ফোন দিলো। দুবার রিং হবার পর কলটা ওপাশ থেকে ধরলো কিন্তু স্বভাব অনুযায়ী আগে থেকে কিছুই বলল না। সতর্কতার এই স্বভাব এখনও অটুট আছে দেখে সন্তুষ্ট হলো বাবু।

    “কুমিল্লায় গেছিলে?” আস্তে করে বলল।

    জবাব দিতে কয়েক মুহূর্ত সময় নিলো বাবলু। “হুম।”

    “কার কন্ট্রাক্ট ছিল?”

    “কারোর না।”

    ভুরু সামান্য কুঁচকে গেল বাবুর। “নামটা বলতে চাইছো না?”

    “আপনাকে না বলার কিছু নেই,” শান্ত কণ্ঠে বলল। “আসলেই কারোর কন্ট্রাক্ট ছিল না।”

    “তাহলে কেন করলে?”

    ফোনের ওপাশে থাকা বাবলু চুপ করে রইলো। তার মানে সত্যিটা সে বলতে চাচ্ছে না, আবার মিথ্যে বলতেও অনীহা আছে।

    “সমাজ সেবা শুরু করলে নাকি?” একটু শ্লেষের সঙ্গে বলল বাবু।

    “ধরে নিতে পারেন সেরকমই কিছু।”

    এবার অমূল্যবাবুর ভুরু কপালে উঠে গেল।

    “একটা লোকের জন্যে অনেকগুলো মানুষের জীবন-”

    “ব্যাখ্যা করতে হবে না.” কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলল। সচরাচর এমনটা সে করে না কিন্তু যখন করে, বুঝে নিতে হবে অসন্তুষ্ট হয়েছে কোনো কারণে। “আমাকে না জানিয়ে আর কিচ্ছু করবে না, ঠিক আছে?”

    ফোনটা রেখে দিয়ে গভীর করে শ্বাস নিলো বাবু। চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে দেখলো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কাপটা রেখে দিলো সামনের কফি টেবিলের উপরে। বাবলুর এমন অ্যাডভেঞ্চার বিপদ ডেকে আনতে পারে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে, ওখানকার কোনো গুণ্ডা-বদমাশকে খুন করাটা সহজ কাজ নয়। তারপরই মনে পড়ে গেল, এই ছেলে দেশের বাইরে গিয়ে এর চেয়েও বিপজ্জনক লোকজনকে ঘায়েল করে এসেছে। বুঝতে পারলো বয়স হয়েছে তার, দিনকে দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে স্মৃতিশক্তি।

    বার কয়েক গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিজের ভেতরে যে অসন্তোষের জন্ম হয়েছে সেটার নিরসন করলো। সিংহকে সিংহের মতোই থাকতে দেয়া উচিত। খাঁচায় ভরে রাখলে সিংহ নিরাপদে থাকে ঠিকই কিন্তু সমস্ত আভিজাত্য হারিয়ে বড়সড় বেড়াল হয়ে পড়ে থাকে।

    অধ্যায় ৩

    “হায় আল্লাহ!”

    নারী কণ্ঠটা শুনে পেছনে ফিরে তাকালো জেফরি বেগ। ফ্ল্যাটের মালেকিন মুখে হাতচাপা দিয়ে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ঝুলন্ত নিথর দেহটার দিকে। স্ত্রীর পেছন পেছন চলে আসা তার দুর্বল চিত্তের স্বামী দৃশ্যটা দেখে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে গেল।

    একুশ কি বাইশ বছরের এক তরুণী, উচ্চতা পাঁচ ফিট তিন ইঞ্চির মতো হবে, সিলিংফ্যান থেকে ঝুলে আছে। তার পা দুটো প্রায় স্পর্শ করে আছে বিছানা। ঝুলন্ত পা দুটোর পাশে একটা চামড়ায় বাঁধানো গোলাকৃতির মোড়া পড়ে আছে।

    “এটা ক্রাইমসিন,” স্থানীয় থানার এসআইকে বলল জেফরি। “প্রটেক্ট করতে হবে।”

    এসআই বশির সঙ্গে সঙ্গে তার কন্সটেবলদের একজনকে বলে দিলো ফ্ল্যাটের বাইরে পাহারা বসাতে, কাউকে যেন ঢুকতে দেয়া না হয়। “কেউ কিচ্ছু ধরবা না।” এরপর ফিরে তাকালো ফ্ল্যাটের মালেকিনের দিকে। “আপনি বাইরে যান, প্লিজ।”

    মহিলাকে দ্বিতীয় বার বলতে হলো না, চুপচাপ ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে গেল।

    সামনের দিকে এগিয়ে গেল জেফরি। লাশের একটা পা ধরে পরখ করে দেখলো সে। “অনেক আগেই মরে গেছে…” গভীর করে শ্বাস নিয়ে নিলো।

    “লাশটা তাহলে নামানোর ব্যবস্থা করি, স্যার?”

    লাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মাথা দোলালো হোমিসাইডের অভিজ্ঞ ইনভেস্টিগেটর। কিছু একটা খটকা লাগছে তার কিন্তু সেটা যে কী ধরতে পারছে না। সে জানে, দীর্ঘদিন কোনো কিছু নিয়ে কাজ করে গেলে এমনটা হয়-কোনো রকম প্রচেষ্টা ছাড়াই অনেক কিছু এসে পড়ে, ধরা পড়ে!

    “এটা সুইসাইড না!”

    জেফরির দিকে তাকালো এসআই বশির। হোমিসাইডের আলোচিত ইনভেস্টিগেটর ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে নিথর দেহটার দিকে তাকিয়ে আছে। এক ঝলক দেখে কী করে এমন কথা বলল তার মাথায় ঢুকছে না।

    “স্যার, অস্বাভাবিক কিছু খুঁজে পেয়েছেন কি?”

    ঘুরে দাঁড়ালো জেফরি বেগ কিন্তু এসআই”র দিকে মনোযোগ না দিয়ে ঘরের চারপাশটায় নজর দিলো। টিপিক্যাল লাক্সারি ফ্ল্যাটের মতোন নয়, আসবাবের সংখ্যা খুবই নগণ্য। একটা বেড, ক্লোজিট আর ড্রেসিং টেবিল। অনেকটা ফার্নিড অ্যাপার্টমেন্টের মতো। ঘরের এককোণে মিনি-ফ্রিজ আছে। ফ্রিজটার কাছে গিয়ে খুলে দেখলো বিয়ার আর ওয়াইনে পূর্ণ

    বনানী থানার এসআই ঘরের এককোণে গিয়ে থানার কাউকে খবরটা জানিয়ে দিতে লাগলো- সম্ভবত অফিসার ইন-চার্জকে।

    বুক ভরে ধীরে ধীরে নিশ্বাস নিলো জেফরি। সিগারেটের প্রচ্ছন্ন গন্ধটা নাকে টের পেলো। অধূমপায়ি হিসেবে এই বাড়তি সুবিধাটুকু সব সময় পায়-সিগারেটের গন্ধ তার নাকে আসবেই। সে অবশ্য নিশ্চিত হতে পারলো না স্মোকটা কে করেছিল-ভিক্টিম নাকি অন্য কেউ।

    খুনি?

    আস্তে করে হেঁটে দরজার দিকে গিয়ে ভালো করে দেখলো। ছোট্ট একটা জিনিস তার চোখে পড়েছে একটা স্ক্রু। হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো এবার, হাতে তুলে নিলো জিনিসটা, তারপরই দেখতে পেলো ছিটকিনির আঙটার মতো যে অংশটা চৌকাঠে লাগানো থাকে সেটার দুটো স্ক্রু”র একটা নেই আর আঙটাটা ঝুলছে একটা মাত্র স্কুতে।

    “এটা কী, স্যার?” ফোনে কথা বলা শেষ করে জেফরির কাছে এসে জানতে চাইলো বশির।

    “স্ক্রু। দরজাটার এই ছিটকিনি ভেতর থেকে লাগানো ছিল না, “ এসআইকে ব্যাখ্যা করলো সে। “দরজাটা চাবি দিয়ে খোলা হয়েছে অথচ ছিটকিনির এই অংশটা খুলে আছে!”

    “বুঝতে পেরেছি, স্যার!” আতিশয্যে বলে উঠল এসআই বশির।

    তার দিকে তাকালো হোমিসাইডের জেফরি বেগ।

    “খুনি ইচ্ছে করে ছিটকিনিটা এইভাবে খুলে রেখেছিল, যাতে মনে হয় ভিক্টিম ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে রেখেছিল!” খুবই উত্তেজিত দেখাচ্ছে ছেলেটাকে।

    প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। “একদম ঠিক ধরেছো,” উঠে দাঁড়ালো সে। “তুমি অনেক শার্প!” প্রশংসার সুরে বলল। “তোমার মতো ছেলেদের উচিত ইনভেস্টিগেশনে আসা।”

    সাব-ইন্সপেক্টর বশির রীতিমতো আরক্তিম হয়ে উঠল। “থ্যাঙ্কু, স্যার।” ছেলেটার পিঠে চাপড় মারলো আস্তে করে। “খুনি বা খুনির দল জানতো না ফ্ল্যাটের মালেকিনের কাছে এক্সট্রা চাবি আছে আর সেটা দিয়ে কেউ দরজা খুলতে পারে।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো বশির। চট করেই সে ধরতে পেরেছে চালাকিটা। দরজা ভেঙে ঢোকা হলে কারো পক্ষে এটা ধরা সম্ভব হতো না। ছিটকিনির আঙটাটা ওভাবে ঝুলে থাকার কারণে ধরে নিতো ভেতর থেকে লাগানো ছিল, দরজা ভেঙে খোলার সময় ছুটে গেছে।

    “এটা একটা ভাইটাল আলামত,” বলল জেফরি। “ডেড-বডির ছবি তুলে রাখতে হবে,” নিজের ফোনটা বের করে লাশের কয়েকটা ছবি তুলে রাখলো, তারপর কল দিলো হোমিসাইডের নাইট ডিউটিতে যারা ছিল তাদের একজনকে। সে জানে ওদের ডিউটি এখনও শেষ হয়নি।

    “মনীষ?” কলটা রিসিভ হতেই বলল। “রমিজ কি আছে?” ওপাশ থেকে শুনে গেল। “আমি তোমাকে একটা জিপিএস লোকেশন পাঠাচ্ছি, এভিডেন্স ভ্যানটা নিয়ে রমিজ যেন চলে আসে,” কলটা শেষ করেই জিপিএস লোকেশনটা দু দুটো হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে পাঠিয়ে দিলো- তার মধ্যে একটা সহকারি জামানের।

    মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে ঝুলন্ত তরুণীর দিকে তাকালো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। সালোয়ার-কামিজ পরা, আর সেটা মোটেও সাধারণ পোশাক নয়—যেমনটা পরে এই বয়সি মেয়েরা বাড়ির যায়, তেমন। সবকিছু বিবেচনায় নিলে মেয়েটার পরনে শোবার পোশাক থাকার কথা। নিদেনপক্ষে ক্যাজুয়াল আউটফিট।

    নিথর দেহটার দিকে তাকালো। মেয়েটার ফর্সা ত্বক কালচে হতে শুরু করেছে, বিশেষ করে হাত আর মুখের দিকে। শরীরে দৃশ্যমান কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। কিন্তু এটাও ঠিক, জামার নিচটা না দেখে নিশ্চিত হওয়া যাবে না।

    “অনেক আলামত থাকতে পারে…” লাশের দিকে তাকিয়েই বলল জেফরি। “রমিজ আসুক তার টিম নিয়ে তারপর লাশটা নামানো যাবে,” বশিরের দিকে তাকালো। “আমার কাছে এটা পরিস্কার হোমিসাইড…” দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা দিলো সে। “ভিক্টিমের বোনকে থানা থেকে এখানে আসতে বলো। এই কেসটা আমরা তদন্ত করবো।”

    অধ্যায় ৪

    “লাশটা এখনও ঝুলতাছে ক্যান?”

    কণ্ঠটা শুনে জেফরি বেগ ফিরে দেখলো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মাঝবয়সি এক পুলিশ অফিসার, বুকপকেটের উপরে নেমপ্লেটে লেখা : হাসমত।

    “তাড়াতাড়ি নামানোর ব্যবস্থা করো!” রাগে গজ গজ করে বলল সে।

    “আমাদের ওসিস্যার,” লোকটার দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগে এসআই বশির বলল জেফরিকে, তারপর পেছনে ফিরে তাকালো, “স্যার, উনি হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর… জেফরি বেগ।”

    তিক্তমুখে স্যালুট দিলো ওসি। পদমর্যাদায় জেফরি তার কয়েক ধাপ উপরে।

    হাত বাড়িয়ে দিলো ইনভেস্টিগেটর, হাসমত সাহেব যন্ত্রের মতো হাত মেলালো তার সঙ্গে। যদিও তার এতে খুশি হবার কথা। পুলিশ বিভাগে সাধারণত উর্ধ্বতনেরা অধস্তনদের সঙ্গে করমর্দন করে না। কিন্তু জেফরি সব সময় এই নিয়মটার ব্যত্যয় ঘটায়।

    “আপনে এইখানে?!” বিস্ময় আর বিরক্তিটা লুকাতে পারলো না ওসি। “এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম জগিং শেষ করে, তখন দেখলাম ওকে…” বশিরের দিকে চোখ গোল গোল করে তাকালো ওসি হাসমত। কাচুমাচু খেলো এসআই। “লাশটা নামাও …দাঁড়ায়া দাঁড়ায়া কী দেখতাছো!”

    বশির কী করবে বুঝতে পারলো না।

    “আমাদের ফরেনসিক টিম না আসা পর্যন্ত নামানো যাবে না,” জেফরি বেগ বলল। “আমি হোমিসাইডে খবর দিয়েছি, আমাদের এভিডেন্স ভ্যান চলে আসবে এক্ষুণি।”

    “হোমিসাইড?!” ভুরু কুঁচকে গেল ওসি হাসমতের। “আরে এইটা সুইসাইড কেস…আর এইটা লোকাল থানার জুরিডিকশনের মইধ্যে পড়ে।”

    “আমার তা মনে হচ্ছে না…এটা মার্ডার।”

    জেফরির দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো ওসি। “কী বলেন! দেখতেই তো পারতাছেন গলায় ফাঁস দিয়া ঝুলতাছে।”

    “দেখেই যদি সব বোঝা যেত তাহলে কি পোস্টমর্টেম, ফরেনসিক এসবের দরকার হতো?”

    ওসি কী বলবে ভেবে পেলো না। তাকে বেশ অস্থির দেখাচ্ছে।

    “এদিকে আসুন,” বলেই ফ্ল্যাটের মেইন দরজার দিকে চলে গেল, তার পেছন পেছন ওসি আর এসআই বশির। “এটা দেখেছেন?” দরজার বাঁ- দিকের চৌকাঠটা দেখিয়ে বলল।

    একটু ঝুঁকে ভালো করে দেখলো ওসি হাসমত। “হুম…দরজা ভাইঙ্গা ঢুকছেন, ছিটকিনি তো খুইল্যা-ই থাকবো, নাকি?”

    মাথা দোলালো জেফরি বেগ। “আমরা দরজা ভেঙে ঢুকিনি।”

    ভুরু কুঁচকে গেল ওসির। “তাইলে কেমনে ঢুকলেন?”

    “ফ্ল্যাটের মালিক এই বিল্ডিংয়েই থাকেন, ভদ্রমহিলার কাছে এক্সট্রা চাবি আছে, সেটা দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকেছি।”

    বুঝতে পারলো না ওসি। “তাইলে ছিটকিনি খুইল্যা আছে ক্যান?”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো ইনভেস্টিগেটর, বশিরের দিকে তাকালো সে।

    “স্যার, খুনি নিজেই ছিটকিনিটা এভাবে খুলে রেখে গেছে যেন মনে হয় দরজাটা ভেতর থেকে লাগিয়ে রেখেছিল ভিক্টিম।”

    এসআই”র দিক থেকে চোখ সরিয়ে জেফরির দিকে তাকালো ওসি। “এই একটা জিনিস দেইখ্যা শিওর হইয়া গেলেন এইটা খুন?”

    মাথা দোলালো জেফরি বেগ। “এটা সামান্য জিনিস না, ভাইটাল এভিডেন্স। এটাই প্রমাণ করে ঘটনাটা আসলে খুন।”

    ওসি হাসমত ঢোক গিলল, কিছু বলতে যাবে অমনি একটা নারী কণ্ঠের চিৎকারে প্রকম্পিত হলো ফ্ল্যাটটা।

    “সনুরে! আমার সনু!”

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবর্ন আইডেন্টিটি – রবার্ট লুডলাম
    Next Article অগোচরা – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    Related Articles

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    অরিজিন – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেমেসিস (বেগ-বাস্টার্ড – ১) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    কন্ট্রাক্ট (বেগ-বাস্টার্ড ২) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেক্সাস (বেগ-বাস্টার্ড ৩) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }