Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    একটুখানি বিজ্ঞান – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল এক পাতা গল্প204 Mins Read0
    ⤷

    ০১. বিজ্ঞান

    একটুখানি বিজ্ঞান – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    উৎসর্গ
    প্রফেসর আনিসুজ্জামান
    যাকে সব সময় মনে হয়েছে
    আমাদের আপনজন।

    ভূমিকা

    আমার বিরুদ্ধে আমার পাঠকেরা যেসব অভিযোগ করে থাকেন তার মাঝে এক নম্বর অভিযোগটি হচ্ছে আমি বিজ্ঞানের বই লিখি না। আমি যে লিখতে চাই না তা নয়, এক দু’বার যে লিখি নি তাও নয় কিন্তু তার পরেও বিজ্ঞান কল্পকাহিনী যতগুলো লিখেছি বিজ্ঞানের বই লিখেছি তার চাইতে অনেক কম। কারণটি খুব সহজ, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লিখতে দরকার একটুখানি বিজ্ঞান এবং অনেকখানি কল্পনা। বিজ্ঞানের বেলায় তা নয়, কল্পনাটাকে বাক্সবন্দি করে তখন শুধু বিজ্ঞান নিয়ে বসতে হয়। তার জন্যে যেটুকু সময় দরকার কীভাবে জানি সেটুকু সময় কখনোই হয়ে উঠে না।

    তারপরেও একটুখানি বিজ্ঞান নামে এই নাদুস-নুদুস বইটি দাঁড়া হয়ে গেছে তার কারণ শ্রদ্ধেয় প্রফেসর আনিসুজ্জামান। তিনি কালি ও কলমের প্রতি সংখ্যায় আমাকে বিজ্ঞান নিয়ে লিখতে রাজি করিয়েছিলেন, সেই একটু একটু করে লিখতে লিখতে আজকের এই একটুখানি বিজ্ঞান। যেসব বিষয় নিয়ে লেখা হয়েছে পাঠকেরা সেখানে একবার চোখ বুলালেই বুঝতে পারবেন যে তার মাঝে খুব একটা মিল নেই, যে বিষয়গুলো আমার ভালো লাগে সেগুলোই বারবার উঠে এসেছে। তবে সান্ত্বনা এটুকু, বিজ্ঞানের যে বিষয়গুলো সবচেয়ে রহস্যময় আমার সেগুলোই সবসময় সবচেয়ে ভালো লাগে।

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    ১ সেপ্টেম্বর ২০০৬
    বনানী, ঢাকা

    .

    ০১. বিজ্ঞান

    1. বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানচর্চা

    পৃথিবীর মানুষ আজকাল যে ধরনের বিজ্ঞানচর্চায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে সেটি কিন্তু তুলনামূলকভাবে বেশ নূতন। আগে খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ কিছু একটা বলতেন অন্য সবাই তখন সেটাকেই মেনে নিতো। অ্যারিস্টটল তাঁর সময়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন জ্ঞানীমানুষ ছিলেন, তিনি বলেছিলেন ভারী জিনিস হালকা জিনিস থেকে তাড়াতাড়ি নিচে পড়ে (১)—কেউ কোনো রকম আপত্তি না করে সেটা মেনে নিয়েছিলেন। দুই হাজার পর একজন বিজ্ঞানী (গ্যালেলিও গ্যালিলি) ব্যাপারটা একটু পরীক্ষা করতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন বিষয়টি সত্যি নয়, ভারী এবং হালকা জিনিস একই সাথে নিচে এসে পড়ে। বিজ্ঞানের একটা ধারণাকে যে গবেষণাগারে পরীক্ষা করে তার সত্য মিথ্যা যাচাই করে দেখা যায় সেই চিন্তাটি মোটামুটিভাবে বিজ্ঞানের জগৎটাকেই পাল্টে দিয়েছিল। এই নূতন পদ্ধতিতে বিজ্ঞানচর্চায় কৃতিত্বটা দেয়া হয় নিউটনকে (আইজাক নিউটন)। বর্ণহীন আলো যে আসলে বিভিন্ন রংয়ের আলোর সংমিশ্রণ সেটা নিউটন প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন। সেই সময়ের নিয়ম অনুযায়ী এই তত্ত্বটা প্রকাশ করার পর সকল বিজ্ঞানীদের সেটা নিয়ে আলোচনা করার কথা ছিল, কারো কারো এর পক্ষে এবং কারো কারো এর বিপক্ষে যুক্তিতর্ক দেয়ার কথা ছিল। নিউটন এইসব আলোচনার ধারে কাছে গেলেন না, একটা প্রিজমের ভিতর দিয়ে বর্ণহীন সূর্যের আলো পাঠিয়ে সেটাকে তার ভিতরের রংগুলিতে ভাগ করে দেখালেন। শুধু তাই না, আবার সেই ভাগ হয়ে যাওয়া রংগুলোকে দ্বিতীয় একটা প্রিজমের ভেতর দিয়ে পাঠিয়ে সেটাকে আবার বর্ণহীন সূর্যের আলোতে পাল্টে দিলেন। পরীক্ষাটি এত অকাট্য যে তার তত্ত্বটা নিয়ে কারো মনে এতটুকু সন্দেহ থাকার কথা নয়। সেই সময়কার বিজ্ঞানীরা কিন্তু এই ধরনের বিজ্ঞানচর্চায় অভ্যস্ত ছিলেন না এবং নিউটন যে তার তত্ত্ব নিয়ে তর্কবিতর্ক করার কোনো সুযোগই দিলেন না সে জন্যে তার ওপরে খুব বিরক্ত হয়েছিলেন, তাদের মনে হয়েছিল নিউটন যেন কোনোভাবে তাদের ঠকিয়ে দিয়েছেন!

    সেই সময়কার বিজ্ঞানীরা ব্যাপারটাকে যত অপছন্দই করে থাকুন না কেন বর্তমান বিজ্ঞানচর্চা কিন্তু এভাবেই হয়। বিজ্ঞানীরা আমাদের চারপাশের জগৎটাকে বোঝার চেষ্টা করেন, প্রকৃতি যে নিয়মে এই জগৎটিকে পরিচালনা করে সেই নিয়মগুলোকে যতদূর সম্ভব স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। গণিতের ভাষা থেকে নিখুঁত আর স্পষ্ট ভাষা কী হতে পারে? তাই বিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রকৃতির সূত্রগুলোকে গাণিতিক কাঠামো দিয়ে ব্যাখ্যা করা। “বস্তুর ভর আসলে শক্তি” না বলে বিজ্ঞানীরা আরো নিখুঁত গাণিতিক ভাষায় বলেন, “বস্তুর ভরের সাথে আলোর বেগের বর্গের গুণফল হচ্ছে শক্তি” (২)। বিজ্ঞানের এই সূত্রগুলো খুঁজে বের করা হয় পর্যবেক্ষণ কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে। মাঝে মাঝে কেউ কেউ শুধু মাত্র চিন্তাভাবনা করে একটা সূত্র বের করে ফেলেন অন্য বিজ্ঞানীদের তখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেটার সত্য মিথ্যা খুঁজে বের করতে হয়।

    পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানের কোনো রহস্য বুঝে ফেলার একটা উদাহরণ তৈরি করেছিলেন কোপার্নিকাস। যারা চন্দ্র এবং সূর্য কিংবা অন্য গ্রহ নক্ষত্রকে আকাশে উদয় এবং অস্ত হতে দেখেছে তারা ধরেই নিয়েছিল সবকিছুই পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে। নিজের চোখে সেটা দেখছেন অস্বীকার করার উপায় কী? কিন্তু কোপার্নিকাস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু লক্ষ করলেন এবং বুঝতে পারলেন আসলে ব্যাপারটি অন্যরকম–সূর্য রয়েছে মাঝখানে, তাকে ঘিরে ঘুরছে পৃথিবী এবং অন্য সবগুলো গ্রহ। প্রায় সাড়ে চারশ’ বছর আগে কোপর্নিকাস প্রথম যখন ঘোষণাটি করেছিলেন তখন সেটি তেমন সাড়া জাগাতে পারে নি। একশ’ বছর পর গ্যালেলিও যখন সেটাকে গ্রহণ করে প্রমাণ করার চেষ্টা করতে লাগলেন তখন ধর্মযাজকরা হঠাৎ করে তার পিছনে লেগে গেলেন। তাদের ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে পৃথিবী সবকিছুর কেন্দ্র, সেই পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে ঘুরছে ঘোষণা করা ধর্মগ্রন্থকে অস্বীকার করার মতো। ভ্যাটিকানের পোপেরা সে জন্যে তাকে তখন ক্ষমা করেন নি। ব্যাপারটি প্রায় কৌতুকের মতো যে গ্যালেলিওকে ভ্যাটিকান চার্চ ক্ষমা করেছে মাত্র 1992 সালে। তাদেরকে দোষ দেয়া যায় না–ধর্মের ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস, কাজেই ধর্মগ্রন্থে যা লেখা থাকে সেটাকে কেউ কখনো প্রশ্ন করে, গভীর বিশ্বাসে গ্রহণ করে নেয়। বিজ্ঞানের বিশ্বাসের কোনো স্থান নেই। বিজ্ঞানের যে কোনো সূত্রকে যে-কেউ যখন খুশি প্রশ্ন করতে পারে, যুক্তি-তর্ক, পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে সেই সূত্রের সত্যতা তখন প্রমাণ করে দিতে হবে। কাজেই কেউ যদি বিজ্ঞান ব্যবহার করে ধর্মচর্চা করে কিংবা ধর্ম ব্যবহার করে বিজ্ঞানচর্চা করার চেষ্টা করে তাহলে বিজ্ঞান বা ধর্ম কারোই খুব একটা উপকার হয় না। গবেষণা করে দেখা গেছে যে, চতুরতার সাথে দুর্নীতি করা হলে আইনের সাথে কোনো ঝামেলা ছাড়াই বড় অংকের অর্থ উপার্জন করা সম্ভব। এ-রকম একটি “বৈজ্ঞানিক তথ্য” উপস্থিত থাকার পরও আমরা কিন্তু সব সময়েই সবাইকে সত্তাবে বেঁচে থাকার একটি “অবৈজ্ঞানিক” উপদেশ দিই এবং নিজেরাও অবৈজ্ঞানিকভাবে সৎ থাকার চেষ্টা করি। পৃথিবীতে বিজ্ঞান একমাত্র জ্ঞান নয়, যুক্তিতর্ক, পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রমাণ করা যায় না এ-রকম অনেক বিষয় আছে, আমরা কিন্তু সেগুলোর চর্চাও করি। বিজ্ঞানের পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য-দর্শন এ-রকম অনেক বিষয় আছে এবং সব মিলিয়েই সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডার এবং পৃথিবীর সভ্যতা। কাজেই সবকিছুকে বিজ্ঞানের ভাষায় ব্যাখ্যা করতে হবে সেটিও সত্যি নয়।

    কোপার্নিকাস গ্রহ-নক্ষত্র এবং চন্দ্র-সূর্যকে পর্যবেক্ষণ করে একটি বৈজ্ঞানিক সূত্রে উপস্থিত হয়েছিলেন, বিজ্ঞানীরা সব সময় এ-রকম পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভর করেন না। যেটা পর্যবেক্ষণ করতে চান সম্ভব হলে সেটি গবেষণাগারে তৈরি করে সেটাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকেন। একসময় মনে করা হতো সমস্ত বিশ্বজগৎ, গ্রহ, নক্ষত্র সবকিছু ইথার নামক অদৃশ্য এক বস্তুতে ডুবে আছে, পানিতে যেরকম ঢেউ তৈরি করা হয় আলো সেরকম ইথারের মাঝে তৈরি করা ঢেউ। বিজ্ঞানীরা তখন একটি চুলচেড়া পরীক্ষা করতে শুরু করলেন, পরীক্ষার উদ্দেশ্য ইথারের মাঝে দিয়ে পৃথিবী কত বেগে ছুটে যাচ্ছে সেটা বের করা। মাইকেলসন (আলবার্ট এ মাইকেলসন) এবং মোরীর (এডওয়ার্ড ডাব্লিউ মোরলী) এর পরীক্ষায় দেখা গেল ইথার বলে আসলে কিছু নেই। (অনেক কবি সাহিত্যিক অবশ্যি এখনো সেই খবরটি পান নি, তারা তাদের লেখালেখিতে এখনও ইথার শব্দটি ব্যবহার করে যাচ্ছেন!) ইথারের মতো এ-রকম গুরুত্বপূর্ণ একটা ধারণা বিজ্ঞানীরা যেরকম একটা পরীক্ষা করে অস্তিত্বহীন করে দিয়েছিলেন ঠিক সেরকম আরও অনেক ধারণাকে পরীক্ষা করে সত্যও প্রমাণ করেছেন। পৃথিবীর নূতন বিজ্ঞান এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপরে নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে, তাই বিজ্ঞানচর্চার একটা বড় অংশ এখন গবেষণাগারের উপর নির্ভর করে। তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক বিজ্ঞান এখন একটি আরেকটির হাত ধরে অগ্রসর হচ্ছে, একটি ছাড়া অন্যটি এগিয়ে যাবার কথা আজকাল কেউ কল্পনাও করতে পারে না।

    পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াও অবশ্যি বিজ্ঞানীরা সব সময়েই যুক্তিতর্ক ব্যবহার করে প্রকৃতির রহস্যকে বুঝতে চেষ্টা করেন। বড় বড় বিজ্ঞানীদের এক ধরনের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থাকে, সেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে তারা অনেক কিছু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন যা হয়তো সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারেন না। মাইকেলসন এবং মোরলী একটি চুলচেড়া পরীক্ষা করে ইথার নামক বস্তুটিকে অস্তিত্বহীন করে দিয়েছিলেন, বিজ্ঞানী আইনস্টাইন সেই একই কাজ করেছিলেন সম্পূর্ণ অন্যভাবে। ইলেকট্রো ম্যাগনেটিজমের কিছু সূত্রকে সমন্বিত করার জন্যে তিনি তার জগদ্বিখ্যাত আপেক্ষিক সূত্র বের করেছিলেন, পুরাপুরি চিন্তা-ভাবনা এবং যুক্তিতর্ক দিয়ে। তার আপেক্ষিক সূত্র সরাসরি ইথারকে বাতিল করে দিয়েছিল এবং মাইকেলসন মোরলীর পরীক্ষাটি ছিল তার প্রমাণ।

    কাজেই বলা যেতে পারে আমাদের আধুনিক বিজ্ঞানচর্চা এখন পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা যুক্তিতর্ক এই তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। বিজ্ঞান ব্যাপারটি আমরা সবাই সরাসরি দেখতে পাই না কিন্তু বিজ্ঞানের ব্যবহার বা প্রযুক্তি (টেকনোলজি)-কে কিন্তু বেশ সহজেই দেখতে পাই। এটি এখন আর অস্বীকার করার উপায় নেই প্রযুক্তির মোহ আমাদের অনেক সময় অন্ধ করে ফেলছে, আমরা অনেক সময় কোনটা বিজ্ঞান আর কোনটা প্রযুক্তি সেটা আলাদা করতে পারছি না। বিজ্ঞানের কৃতিত্বটা প্রযুক্তিকে দিচ্ছি, কিংবা প্রযুক্তির অপকীৰ্ত্তির দায়ভার বহন করতে হচ্ছে বিজ্ঞানকে।

    ভোগবাদী পৃথিবীতে এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিকে আলাদা করে দেখা–তা না হলে আমরা কিন্তু খুব বড় বিপদে পড়ে যেতে পারি।

    —–
    ১. ভারী বস্তু এবং হালকা বস্তু যে একই সাথে নিচে পড়বে সেটা কোনো পরীক্ষা না করে শুধুমাত্র যুক্তিতর্ক দিয়েই বের করা সম্ভব। ধরা যাক ভারী বস্তু তাড়াতাড়ি এবং হালকা বস্তু ধীরে ধীরে নিচে পড়ে। এখন একটি ভারী বস্তুর সাথে হালকা বস্তু বেঁধে দিলে হালকা বস্তুটি ভারী বস্তুটিকে তাড়াতাড়ি পড়তে বাধা দিবে, কাজেই দুটি মিলে একটু আস্তে পড়বে। কিন্তু আমরা অন্যভাবেও দেখতে পারি ভারী এবং হালকা মিলে যে বস্তুটা হয়েছে সেটা আরো বেশি ভারী কাজেই আরো তাড়াতাড়ি পড়া উচিৎ। একভাবে দেখা যাচ্ছে আস্তে পড়বে অন্যভাবে দেখা যাচ্ছে দ্রুত পড়বে। এই বিভ্রান্তি মেটানো সম্ভব যদি আমরা ধরে নিই দুটো একই গতিতে নিচে পড়বে।

    ২. আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্র E = mc^2

    .

    2. বিজ্ঞান বনাম প্রযুক্তি

    মা এবং সন্তানের মাঝে তুলনা করতে গিয়ে একটা খুব সুন্দর কথা বলা হয়, কথাটা হচ্ছে। “কুপুত্র যদিবা হয়, কুমাতা কখনো নয়।” সন্তানের জন্যে মায়ের ভালোবাসা দিয়েই একটা জীবন শুরু হয় তাই মায়ের উপর এত বড় একটা বিশ্বাস থাকবে বিচিত্র কী? কুপুত্র এবং কুমাতা নিয়ে এই কথাটা একটু পরিবর্তন করে আমরা বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির জন্যে ব্যবহার করতে পারি, কথাটি হবে এরকম, “কু-প্রযুক্তি যদি বা হয়, কু-বিজ্ঞান কখনো নয়।” যার অর্থ বিজ্ঞানটা হচ্ছে জ্ঞান আর প্রযুক্তিটা হচ্ছে তার ব্যবহার, জ্ঞানটা কখনোই খারাপ হতে পারে না, কিন্তু প্রযুক্তিটা খুব সহজেই ভয়ংকর হতে পারে। আইনস্টাইন যখন তার আপেক্ষিক তত্ত্ব নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে করতে লিখলেন E = mc^2 তখন তার বুক একবারও আতঙ্কে কেঁপে উঠে নি। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষের দিকে যখন হিরোশিমা আর নাগাসাকি শহরে নিউক্লিয়ার বোমা এক মুহূর্তে কয়েক লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলল তখন সারা পৃথিবীর মানুষের বুক আতঙ্কে কেঁপে উঠেছিল। এখানে E = mc^2 হচ্ছে বিজ্ঞান আর নিউক্লিয়ার বোমাটা হচ্ছে প্রযুক্তি–দুটোর মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব।

    প্রযুক্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রথমেই একটা কুৎসিত উদাহরণ দিয়ে সবার মন বিষিয়ে দেয়ার আমার কোনো ইচ্ছা নেই। কিন্তু মানুষ ক্রমাগত বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিকে গুলিয়ে ফেলে কাজেই দুটো বিষয়কে একটু জোর করে হলেও আলাদা করে রাখা ভালো। বিজ্ঞানের একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে, আজকালকার ধর্মের বইগুলো দেখলেই সেটা বোঝা যায়। ধর্মীয় কোনো একটা মতকে সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যে ফুটনোটে লেখা হয় “ইহা বিজ্ঞান মতে প্রমাণিত।” বিজ্ঞানের এই ঢালাও গ্রহণযোগ্যতাকে ব্যবহার করে প্রযুক্তি যদি ছদ্মবেশে আমাদের জীবনের মাঝে জোর করে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করে তার থেকে আমাদের একটু সতর্ক থাকা উচিৎ।

    এটি কেউ অস্বীকার করবে না, প্রযুক্তির কারণে, আমাদের জীবন অনেক সহজ হয়ে গেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা ধরা যাক, প্লেন গাড়ি জাহাজ করে আমরা চোখের পলকে এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে যাই। একসময় প্রকৃতির সাথে আমাদের যুদ্ধ করতে হতো আজকাল আমরা তার অনেকটাই আমাদের দখলে নিয়ে এসেছি। আজকাল আমদের দেশেই উচ্চবিত্ত মানুষেরা গরমের দিনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে শীতল হিমেল বাতাসে শরীরকে জুড়িয়ে রাখতে পারেন। এ-রকম উদাহরণের কোনো শেষ নেই, জীবনকে সহজ করার জন্যে চমৎকার সব প্রযুক্তি, এর বিরুদ্ধে কারো কী কিছু বলার আছে? একটু খুটিয়ে দেখলে কেমন হয়?

    প্লেন-গাড়ি-জাহাজ (কিংবা কলকারখানায়) আমরা জ্বালানী তেল বা গ্যাস ব্যবহার করি, সেটাকে পুড়িয়ে তার থেকে শক্তি বের করে এনে সেই শক্তিটাকে ব্যবহার করি। এই শক্তিটাকে ব্যবহার করার জন্যে আমাদের একটা মূল্য দিতে হয়। সেই মূল্যটার নাম হচ্ছে কার্বন ডাই অক্সাইড। যখনই বাতাসে আমরা কিছু পোড়াই তখনই আমরা কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস তৈরি করি। এটি কোনো বিচিত্র গ্যাস নয়, আমরা নিশ্বাসের সময় ফুসফুসে অক্সিজেন টেনে নিয়ে প্রশ্বাসের সময় কার্বন ডাই অক্সাইড বের করে দিই। পৃথিবীর সব জীবিত প্রাণী নিশ্বাসে নিশ্বাসে অক্সিজেন টেনে নিয়ে, কিংবা কলকারখানা গাড়ি প্লেনের ইঞ্জিনে জ্বালানী তেল পুড়িয়ে একসময় পৃথিবীর সব অক্সিজেন শেষ করে ফেলবে তার আশঙ্কা নেই। তার কারণ পৃথিবীর জীবিত প্রাণীর জন্যে প্রকৃতি খুব সুন্দর একটা ব্যবস্থা করে রেখেছে, আমরা নিশ্বাসে যে অক্সিজেন খরচ করে কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি করে ফেলি, সুবজ গাছপালা সেই কার্বন ডাই অক্সাইডকে সালোকসংশ্লেষণের ভেতর দিয়ে তাদের খাবার তৈরি করার জন্যে ব্যবহার করে। তাদের খাবার আসলে আমাদেরও খাবার, শুধু যে খাবার তাই নয় সালোকসংশ্লেষণের সেই প্রকিয়ার ভেতর দিয়ে সবুজ গাছপালা কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে সেই অক্সিজেনটা আবার আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় অক্সিজনের জন্যে আমরা সবুজ গাছপালার কাছে অসম্ভব রকম ঋণী। সবুজ পৃথিবী শুধু যে দেখতে সুন্দর তা নয় (আমাদের চোখের রেটিনা সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল এই সবুজ রংয়ে) আমাদের নিশ্বাসের নিশ্চয়তা আসে এই সবুজ গাছপালা থেকে।

    পৃথিবীতে বেশি বেশি জ্বালানী পোড়ানোর কারণে অক্সিজেন কমে যাবে এবং কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়ে যাবে সেটি অবশ্যি এখনো দুশ্চিন্তার বিষয় নয়, দুশ্চিন্তার কারণ আসলে অন্য একটি বিষয়, যারা পৃথিবীর খোঁজখবর রাখেন তারা নিশ্চয়ই সেই বিষয়টির কথা জানেন, বিষয়টি হচ্ছে গ্রীন হাউস এফেক্ট। গ্রীন হাউস জিনিসটির আমাদের দেশে সেরকম প্রচলন নেই। আমাদের দেশে তাপমাত্রা কখনোই খুব একটা বেশি কমে যায় না তাই শীতে গাছপালা বাঁচিয়ে রাখার জন্যে (বা সবুজ রাখার জন্য) গ্রীন হাউস তৈরি করতে হয় না। শীতের দেশে গ্রীন হাউসের প্রচলন আছে, সেখানে বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা থাকলেও গ্রীন হাউসের ভেতরে গাছপালাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে থাকে এটা একটা আরামদায়ক উষ্ণতা। গ্রীন হাউস ব্যাপারটি আসলে খুব সহজ–একটা কাচের ঘর। সূর্যের আলো কাচের ভেতর দিয়ে গ্রীন হাউসে ঢুকে কিন্তু বের হতে পারে না, তাপটাকে ভেতরে ধরে রাখে। প্রশ্ন উঠতে পারে কাচের ভেতর দিয়ে যেটা ঢুকে যেতে পারে–সেটা তো বেরও হয়ে যেতে পারে তাহলে ভেতরে আটকে থাকে কেন? তার কারণ আলো হিসেবে যেটা কাচের ভেতর দিয়ে গ্রীন হাউসে ঢুকে যায় সেটা ভেতরকার মাটি দেয়াল বা গাছে শোষিত হয়ে যায়। তারপর সেগুলো যখন বিকিরণ করে তখন সেটা বিকিরণ করে তাপ হিসেবে। আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ছোট, সেগুলো কাচের ভেতর দিয়ে চলে যেতে পারে; তাপের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য লম্বা, সেগুলো কিন্তু কাচের ভেতর দিয়ে এত সহজে যেতে পারে না। তাই আলো হিসেবে শক্তিটুকু গ্রীন হাউসের ভেতরে ঢুকে তাপ হিসেবে আটকা পড়ে যায়।

    মানুষ অনেকদিন থেকেই তাদের ঘরে বাড়িতে নার্সারীতে এ-রকম ছোট ছোট গ্রীন হাউস তৈরি করে এসেছে, কিন্তু গত এক শতাব্দীতে তারা নিজের অজান্তেই বিশাল একটা গ্রীন হাউস তৈরি করে বসে আছে। এই গ্রীন হাউসটি হচ্ছে আমাদের পৃথিবী এবং সেখানে কাচের ঘর হচ্ছে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস। কাচ যেভাবে গ্রীন হাউসের ভেতরে সূর্যের আলোটাকে তাপে পরিণত করে সেটাকে আটকে রাখে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসও হুবহু সেই একই উপায়ে পৃথিবীতে তাপ আটকে রাখে। তাই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে যদি কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যায় তাহলে পৃথিবীর তাপমাত্রাও বেড়ে যায়। বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন মানুষের জ্বালানী ব্যবহার করার কারণে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ প্রায় 14 শতাংশ বেড়ে গেছে। তার কারণে এই শতাব্দীর শেষে পৃথিবীর তাপমাত্রা যেটুকু হওয়া দরকার তার থেকে দুই কিংবা তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি হয়ে যাবার আশঙ্কা করছেন। মনে হতে পারে এটি আর এমন কী! কিন্তু আসলে এই দুই তিন ডিগ্রিই পৃথিবীর অনেক কিছু ওলট-পালট করে দিতে পারে। পৃথিবীর মেরু অঞ্চলে বিশাল পরিমাণ বরফ জমা হয়ে আছে, পৃথিবীর তাপমাত্রা অল্প একটু বাড়লেই সেই বরফের খানিকটা গলে গিয়ে নিচু অঞ্চলকে প্লাবিত করে দেবে। সবার আগে পানির নিচে তলিয়ে যাবে যেই দেশটি তার নাম হচ্ছে বাংলাদেশ তার কারণ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই দেশটির গড় উচ্চতা মাত্র বিশ ফুট । প্লেন গাড়ি জাহাজ আর বড় বড় কলকারখানায় জ্বালানী পুড়িয়ে বিলাসী জীবনযাপন করবে পাশ্চাত্তের বড় বড় দেশ আর তার জন্যে পুরো দেশকে পানির নিচে তলিয়ে দেবার মূল্য দেবে বাংলাদেশ, তার থেকে বড় অবিচার আর কী হতে পারে? প্লেন-গাড়ি-জাহাজ চালানোর মতো নিরীহ একটা প্রযুক্তি পৃথিবীতে কত বড় সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে কেউ কী খেয়াল করে দেখেছে?

    জীবনকে আরামদায়ক করার কথা বলতে গিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের কথা বলা হয়েছিল। শুধু যে ঘর তা নয়, ইরাকযুদ্ধের সময় আমরা জেনেছি সাজোয়া বাহিনীর জীপ ট্যাঙ্ক সবকিছুই এখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, যুদ্ধ করার সময় সৈনিকদের আর গরমে কষ্ট করতে হয় না। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের জন্যে যে যন্ত্রপাতি তৈরি করা হয় কিংবা এরোসলে থাকে যে গ্যাস তার নাম ক্লোরোফ্লোরোকার্বন সংক্ষেপে সি.এফ.সি.। নিরীহ নামের সি.এফ.সি. গ্যাস কিন্তু মোটেও নিরীহ নয়, মানুষের তৈরি এই বিপজ্জনক গ্যাসটি ধীরে ধীরে বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ছে তারপর উপরে উঠে বায়ুমণ্ডলে আমাদের প্রতিরক্ষার যে ওজোন আস্তরণ রয়েছে। সেটাকে কুড়ে কুড়ে খেতে শুরু করেছে। ওজোন আমাদের পরিচিত অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে তৈরি। আমরা বাতাসের যে অক্সিজেনে নিশ্বাস নেই সেই অনুটি তৈরি হয়েছে দুটি অক্সিজেনের পরমাণু দিয়ে, আর ওজোন তৈরি হয়েছে তিনটি অক্সিজেনের পরমাণু দিয়ে। অক্সিজেন না হলে আমরা এক মুহূর্ত থাকতে পারি না কিন্তু ওজোন আমাদের জন্যে রীতিমতো ক্ষতিকর। কলকারখানা বা গাড়ির কালো ধোঁয়া থেকে অল্প কিছু ওজোন আমাদের আশপাশে আছে কিন্তু পৃথিবীর মূল ওজোনটুকু বায়ুমণ্ডলে 12 থেকে 30 মাইল উপর। ওজোনের খুব পাতলা এই আস্তরণটি সারা পৃথিবীকে ঢেকে রেখেছে, সূর্যের আলোতে যে ভয়ংকর আলট্রাভায়োলেট রশি রয়েছে ওজোনের এই পাতলা আস্তরনটুকু সেটা শুষে নিয়ে আমাদেরকে তার থেকে রক্ষা করে। ওজোনের এই পাতলা আস্তরণটা না থাকলে আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে পৌঁছে আমাদের সর্বনাশ করে ফেলতো।

    কিন্তু সেই সর্বনাশটিই ঘটতে যাচ্ছে সি.এফ.সি দিয়ে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল দিয়ে ভেসে ভেসে সি.এফ.সি যখন ওজোন আস্তরণে পৌঁছায় তখন একটা ভয়ংকর ব্যাপার ঘটে। আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি সি.এফ.সি-কে ভেঙে তার ভেতর থেকে ক্লোরিন নামের একটা গ্যাসকে যুক্ত করে দেয়। এই ক্লোরিন গ্যাস ওজোনের সাথে বিক্রিয়া করে সেটাকে অক্সিজেনে পাল্টে দেয়। যে ওজোন আমাদের আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি থেকে রক্ষা করতো সেটা না থাকার কারণে পৃথিবীতে সেই ভয়ংকর রশ্মি এসে আঘাত করতে শুরু করেছে। এক শতাংশ ওজোন কমে গেলে পৃথিবীতে দুই শতাংশ বেশি আলট্রাভায়োলেট রশ্মি পৌঁছাবে আর পৃথিবীর মানুষের ত্বকে ক্যান্সার হবে পাঁচ শতাংশ বেশি। শুধু যে ক্যান্সার বেশি হবে তা নয়, মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে–ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড এ ধরনে রোগ হবে আরো অনেক বেশি। গাছপালাও দুর্বল হয়ে যাবে, সহজে বড় হতে চাইবে না। পৃথিবীতে ভয়াবহ একটা দুর্যোগ নেমে আসবে।

    বিজ্ঞানীরা দেখেছেন ওজোনের আস্তরণটুকু ভয়াবহভাবে কমতে শুরু করেছে। শুধু যে কমতে শুরু করেছে তা নয় এন্টার্টিকার উপর ওজনের আস্তরণটি রীতিমতো ফুটো হয়ে গেছে–সেটি ছোট-খাটো ফুটো নয়, তার আকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমান। কী ভয়ংকর কথা! আমাদের জীবনযাত্রার একটু বাড়তি আরামের জন্যে এমন একটা প্রযুক্তি বেছে নিয়েছি যেটা পৃথিবীতে প্রাণী জগতের অস্তিত্বকে নিয়েই টান দিয়ে বসেছে। কেউ যেন মনে না করে এটিই একমাত্র উদাহরণ–এ-রকম উদাহরণ কিন্তু আরো অনেক আছে, দিয়ে শেষ করা যাবে না।

    বিজ্ঞান নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না কিন্তু প্রযুক্তি নিয়ে বড় বড় সমস্যা হতে পারে তার একটা বড় কারণ হচ্ছে বিজ্ঞানকে বিক্রি করা যায় না কিন্তু প্রযুক্তিকে বিক্রি করা যায়। আইনস্টাইন E = mc^2 বের করে একটি পয়সাও উপার্জন করেন নি (তার নোবেল প্রাইজটি এসেছিল ফটো ইলেকট্রিক এফেক্টের জন্যে) কিন্তু নিউক্লিয়ার বোমা বানানোর প্রতিযোগিতায় সারা পৃথিবীতে কত বিলিয়ন ডলার হাতবদল হচ্ছে সেটা কেউ চিন্তা করে দেখেছে? প্রযুক্তি যেহেতু বিক্রি করা যায় তাই সেটা নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসায়ীরা, বহুজাতিক কোম্পানিরা। পৃথিবীতে বহু উদাহরণ আছে যেখানে ব্যবসায়ীরা (বা কোম্পানিরা) তাদের টাকার জোরে একটা বাজে প্রযুক্তিকে মানুষের জীবনে ঢুকিয়ে দিয়েছে। মাত্র কিছুদিন হলো আমরা ভিসিডি ডিভিড়ি দিয়ে ভিডিও দেখতে শুরু করেছি। এর আগে ভিডিও দেখার জন্যে আমরা ভিডিও ক্যাসেট প্লেয়ারে ভি.এইচ.এস, ক্যাসেট ব্যবহার করতাম। প্রথম যখন এই প্রযুক্তিগুলো বাজারে এসেছিল তখন দু ধরনের ভিডিও ক্যাসেট ছিল। একটা হচ্ছে বেটা যেটা ছিল আকারে ছোট, আধুনিক এবং উন্নত। অন্যটি হচ্ছে ভি.এইচ.এস. যেটা আকারে বড়, অনুন্নত এবং বদখত । কিন্তু ভি.এইচ.এস, ক্যাসেটটি ছিল শক্তিশালী বহুজাতিক কোম্পানির এবং রীতিমতো জোর করে বাজারে ঢুকে সেটা উন্নত বেটা প্রযুক্তিটিকে বাজার ছাড়া করে ফেলল। প্রযুক্তির বেলায় দেখা যায় কোনটি উন্নত সেটি বিবেচ্য বিয়য় নয়, কোন কোম্পানির জোর বেশি সেটাই হচ্ছে বিবেচ্য বিষয়।

    ব্যবসায়িক কারণে শুধু যে নিচু স্তরের প্রযুক্তি বাজার দখল করে ফেলে তা নয়, অনেক সময় অনেক আধুনিক প্রযুক্তিকেও ইচ্ছে করে বাক্সবন্দি করে রাখা হয়। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণটি টেলিভিশনকে নিয়ে। বর্তমান পৃথিবীতে টেলিভিশন দেখে নি সেরকম মানুষ মনে হয় একজনও নেই। সবারই নিশ্চয়ই টেলিভিশন নিয়ে একটা নিজস্ব মতামত আছে। তবে টেলিভিশনের যে বিষয়টি নিয়ে কেউ বিতর্ক করবেন না সেটি হচ্ছে তার আকারটি নিয়ে। টেলিভিশনের আকারটি বিশাল। টেলিভিশনের ছবি দেখা যায় সামনের স্ত্রীনটিতে, তাহলে শুধু সেই স্ক্রীনটাই কেন টেলিভিশন হলো না তাহলে সেটা জায়গা নিতো অনেক কম এবং আমরা ছবির ফ্রেমের মতো সেটাকে ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখতে পারতাম। যারা এসব নিয়ে একটু-আধটু চিন্তা-ভাবনা করেছেন তারা জানেন টেলিভিশনের প্রযুক্তিটি তৈরি হয়েছে কেথড রে টিউব দিয়ে। এই টিউব পিছন থেকে টেলিভিশনের স্ক্রীনে ইলেকট্রন ছুঁড়ে দেয়, বিদ্যুৎ এবং চৌম্বক ক্ষেত্র দিয়ে সেই ইলেকট্রনকে নাড়া চাড়া করে টেলিভিশনের স্ক্রীনে ছবি তৈরি করা হয়। ইলেকট্রনকে আসার জন্যে স্ক্রীনের পিছনে অনেকখানি জায়গা দরকার, টেলিভিশনটা তাই ছোট হওয়া সম্ভব নয়।

    কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বৎসর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর.সি.এ. টেলিভিশন কোম্পানির একজন প্রযুক্তিবিদ একটা নূতন ধরনের টেলিভিশন আবিষ্কার করেছিলেন, সেখানে কেথড রে টিউব ব্যবহার করা হয় নি বলে টেলিভিশনটি ছিল পাতলা ফিনফিনে, ইচ্ছে করলেই দেওয়ালে ছবির ফ্রেমের মতো ঝুলিয়ে রাখা যেত। যুগান্ত কারী এই নূতন প্রযুক্তিটি মান্ধাতা আমলের অতিকায় টেলিভিশনগুলোকে অপসারণ করার কথা ছিল, কিন্তু সেটি ঘটে নি। আর.সি.এ. কোম্পানি ভেবে দেখল যে তারা প্রচলিত ধারার টেলিভিশন তৈরি করার জন্যে কোটি কোটি ডলার খরচ করে বিশাল ফ্যাক্টরি তৈরি করেছে। এখন এই নূতন ধরনের পাতলা ফিনফিনে টেলিভিশন তৈরি করতে হলে শুধু যে আবার কোটি কোটি ডলার দিয়ে নূতন ফ্যাক্টরি বসাতে হবে তা নয় সাথে সাথে আগের ফ্যাক্টরিটি অচল হয়ে যাবে। তারা ইতোমধ্যে প্রচলিত টেলিভিশনের একটা বাজার দখল করে রেখেছে সেটাও হাতছাড়া হয়ে যাবে–ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক রকম অর্থনৈতিক ঝামেলা। সবকিছু। চিন্তাভাবনা করে প্রযুক্তির এত চমৎকার একটা আবিষ্কারকে তারা আক্ষরিক অর্থে বাক্সবন্দি করে আবার আগের মতো পুরানো ধাঁচের টেলিভিশন তৈরি করতে লাগল। সেই বিজ্ঞানী ভদ্রলোকের কেমন আশাভঙ্গ হয়েছিল আমি সেটা খুব পরিষ্কার বুঝতে পারি ।

    প্রায় দুইযুগ পরে সেই নূতন প্রযুক্তিটি আবার নূতন করে আবিষ্কার করা হয়েছে, আমরা সেটা ল্যাপটপ কম্পিউটারের স্ক্রীনে দেখতে শুরু করেছি। আগামী কিছুদিনের ভিতরে সেটি আবার টেলিভিশন আকারেও দেখতে পাব, তবে সময়ের বহু পরে।

    এতক্ষণ পর্যন্ত আলোচনাটি হয়েছে একচক্ষু হরিণের মতো। প্রযুক্তি সম্পর্কে শুধু নেতিবাচক কথাই বলা হয়েছে কিন্তু কেউ যেন মনে না করে সেটাই একমাত্র কথা, অর্থাৎ বিজ্ঞানের তুলনায় প্রযুক্তিটি এত তুচ্ছ যে আমরা সব সময় সেটিকে শুধুমাত্র উপহাসই করব। প্রথমত, আমাদের বর্তমান এই সভ্যতাটি হচ্ছে প্রযুক্তির দেয়া একটি উপহার। বিজ্ঞানের গবেষণা করতে এখন প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হয়, শুধু তাই নয় কিছুদিন আগে পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার বিজ্ঞানীদের সাথে সাথে একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারকে দেয়া হয়েছিল। তার কারণ যে যন্ত্রটি দিয়ে পরীক্ষাটি করা হয়েছে তিনি তার যান্ত্রিক সমস্যাটির সমাধান করে দিয়েছিলেন বলে পরীক্ষাটি করা সম্ভব হয়েছিল।

    আমাদের চারপাশে প্রযুক্তির এত চমৎকার উদাহরণ আছে যে তার কোনো তুলনা নেই। আমরা সবাই ফাইবার অপটিক কথাটি শুনেছি। কাচ দিয়ে তৈরি চুলের মতো সূক্ষ্ম অপটিক্যাল ফাইবারের কোরটুকু এত ছোট যে সেটা মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখতে হয়, এই ক্ষুদ্র একটিমাত্র কোরের ভেতর দিয়ে কয়েক কোটি মানুষের টেলিফোনে কথাবার্তা একসাথে পাঠানো সম্ভব। এই অসাধ্য সাধন তো প্রযুক্তিবিদেরাই করেছেন। অপটিক্যাল ফাইবারের ভেতর দিয়ে তথ্য পাঠানোর জন্যে আলোকে ব্যবহার করা হয়। আলোটি যেন কাচের ভেতরে শোষিত না হয়ে যায় সেজন্যে প্রযুক্তিবিদদের কাঁচটাকে স্বচ্ছ করতে হয়েছে। প্রথমে যখন শুরু করেছিলেন তখন এক কিলোমিটারে আলো শোষিত হতে 1000 ডিবি। প্রযুক্তিবিদরা পরিশোধন করে সেটাকে এত স্বচ্ছ করে ফেললেন যে এখন এক কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবারে আলো শোষিত হয় মাত্র 0.25 ডিবি। কাঁচকে কতগুণ পরিশোধিত করতে হয়েছে সেটা যদি সংখ্যা দিয়ে লিখতে চাই তাহলে 1 এর পরে চারশত শূন্য বসাতে হবে! ( 1 এর পরে পাঁচটা শূন্য বসালে হয় লক্ষ, সাতটা শূন্য বসালে হয় কোটি কাজেই আমি যদি এটাকে কথায় বলতে চাই তাহলে বলতে হবে দশ কোটি কোটি কোটি কোটি … মোট সাতান্নবার!) পৃথিবীর ইতিহাসে এ-রকম আর কোনো উদাহরণ আছে বলে আমার জানা নেই!

    কাজেই প্রযুক্তিকে বা প্রযুক্তিবিদদের কেউ যেন হেনা-ফেলা না করে। আমাদের নূতন পৃথিবীর সভ্যতাটুকু তারা আমাদের উপহার দিয়েছেন। কেউ যেন সেটা ভুলে না যায়। শুধু মনে রাখতে হবে পৃথিবীতে লোভী মানুষেরা আছে, অবিবেচক মানুষেরা আছে তারা অপ্রয়োজনীয় প্রযুক্তি কিংবা অমানবিক প্রযুক্তি দিয়ে পৃথিবীটাকে ভারাক্রান্ত করে ফেলতে পারে, জঞ্জাল দিয়ে ভরে তুলতে পারে।

    পৃথিবীটাকে জঞ্জালমুক্ত করার জন্যে আবার তখন আমাদের বিজ্ঞানী আর প্রযুক্তিবিদদের মুখের দিকেই তাকাতে হবে। কারণ শুধু তারাই পারবেন আমাদের সত্যিকারের পৃথিবী উপহার দিতে।

    .

    3. বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের ভাষা–গণিত

    ধরা যাক একজন মানুষ কাজ করে প্রথম দিন এক টাকা উপার্জন করে এনেছে (আমরা জানি টাকার পরিমাণটা বেশি নয় কিন্তু যে ব্যাপারটা আলোচনা করতে যাচ্ছি সেখানে টাকার পরিমাণটা গুরুত্বপূর্ণ নয়)। সেই মানুষটা দ্বিতীয় দিনে এনেছে 2 টাকা, তৃতীয় দিনে 3 টাকা। এভাবে চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম দিনে এনেছে যথাক্রম 4, 5, 6 ও 7 টাকা। এখন আমরা যদি প্রশ্ন করি মানুষটি অষ্টম দিনে কত টাকা বাসায় এনেছে তাহলে মোটামুটি সবাই বলবেন আট টাকা। এটি যুক্তিসঙ্গত একটা উত্তর। তার টাকা উপার্জনে একটা প্যাটার্ন আছে, সেই প্যাটার্নটি কী আমাদের বলে দেয়া হয় নি কিন্তু তার উপার্জনের ধারাটি থেকে সেটা আমরা অনুমান করতে পারি। এটাই হচ্ছে বিজ্ঞান, পর্যবেক্ষণ করে পিছনের প্যাটার্নটি অনুমান করার চেষ্টা করা। যথেষ্ট পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করা না হলে এই প্যাটার্ন বা নিয়মটি আমরা পুরাপুরি ধরতে পারি না, ভুলত্রুটি হতে পারে। বিজ্ঞান সেটি নিয়ে খুব মাথা ঘামায় না কারণ বিজ্ঞানের একটা সূত্র ঐশ্বরিক বাণীর মতো নয়, প্রয়োজনে সেটা পরিবর্তন করা যেতে পারে–প্রতিনিয়তই তা করা হচ্ছে।

    আমাদের এই মানুষটির টাকা উপার্জনের বিষয়টি যদি একজন গণিতবিদকে বলে তাকে জিজ্ঞেস করা হতো তাহলে তিনি কিন্তু চট করে উত্তর দিতেন না। সম্ভবত ভুরু কুচকে বলতেন, “এর উত্তর আমি কেমন করে দেব? প্রথম সাতদিনের বিষয়টি আমাকে জানিয়েছ, প্রমাণ করেছ। অন্যগুলো তো কর নি!” আমরা সম্ভবত গলার রগ ফুলিয়ে তর্ক করতে চেষ্টা করব, বলব, “দেখতেই পাচ্ছি যতদিন যাচ্ছে তত টাকা উপার্জন করছে। কাজেই দিনের সংখ্যা যদি হয় n তাহলে টাকা উপার্জনের পরিমাণও হচ্ছে n” গণিতবিদ মৃদু হেসে বলতে পারেন, “কেন টাকা উপার্জনের পরিমাণ তো n + (n-1)(n-2)(n-3)(n-4)(n-5)(n-6)(n-7) হতে পারে।” আমরা তখন অবাক হয়ে আবিষ্কার করব এই ফর্মুলাটি প্রথম সাতদিন যথাক্রমে 1 থেকে 7 দিলেও অষ্টম দিনে দেবে 5048, আমার কথা কেউ বিশ্বাস না করলে n এর জন্যে সংখ্যাগুলো পরীক্ষা করে দেখতে পারে। এটাই হচ্ছে গণিত এবং বিজ্ঞানের পার্থক্য, নূতন নূতন পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যাবেক্ষণ দিয়ে বিজ্ঞানের পরিবর্তন হতে পারে, গণিতের সেই সুযোগ নেই। আমরা গণিতকে সব সময় পূর্ণাঙ্গভাবে প্রমাণ করতে চাই যেটা একবার প্রমাণিত হয়ে থিওরেম হিসেবে গৃহীত হয়েছে সেটাকে কেউ আর অপ্রমাণিত করতে পারবে না। গণিতের উপরে সে জন্যে আমাদের এত ভরসা আর বিজ্ঞানকে বোঝার জন্যে ব্যাখ্যা করার জন্যে তাই আমরা গণিতকে এত সাহস নিয়ে ব্যবহার করি।

    গণিতের বেলায় যখনই কিছু প্রমাণ করা হয় সেটি সব সময়েই একটা পূর্ণাঙ্গ এবং নিখুঁত প্রমাণ কিন্তু বিজ্ঞানের সূত্র সে-রকম নয়। সেটি অল্প কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ থেকে এসেছে, নূতন পর্যবেক্ষণ, নূতন পরীক্ষা-নিরীক্ষা কিংবা নূতন চিন্তাভাবনা থেকে বিজ্ঞানের একটা সূত্র পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। এটা কি বিজ্ঞানের একটা দুর্বলতা? আসলে সেটি মোটেও দুর্বলতা নয়, সীমাবদ্ধতা নয় বরং সেটাই হচ্ছে এর সৌন্দর্য বা শক্তি। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন প্রকৃতি যে নিয়মে চলছে সেই নিয়মটি সব সময়েই সহজ এবং সুন্দর, বারবার তারা সেটি দেখেছেন এবং তা বিশ্বাস করতে শিখেছেন। তারা সেই নিয়মটি খুঁজে বেড়াচ্ছেন, অল্প কিছু পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে বিশাল একটি অজানা জগৎকে ব্যাখ্যা করে ফেলছেন সেটি যে পৃথিবীর মানব সম্পদায়ের জন্যে কত বড় একটি ব্যাপার সেটি অনুভব করা খুব সহজ নয়।

    গণিতের সূত্রকে প্রমাণ করার কিছু চমৎকার পদ্ধতি আছে তার একটা হচ্ছে কন্ট্রাডিকশন পদ্ধতি, ইংরেজি কন্ট্রাডিকশন শব্দটির বাংলা অর্থ হচ্ছে অসঙ্গতি এবং এই পদ্ধতিটি আসলেই গণিতের সূত্রকে প্রমাণ করার জন্যে অসঙ্গতিকে ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে কোনো একটা সূত্রকে প্রমাণ করার জন্যে প্রথমে কিছু একটা ধরে নেয়া হয়; সেখান থেকে যুক্তিতর্ক দিয়ে অগ্রসর হয়ে একটা অসঙ্গতির মাঝে হাজির হওয়া হয়–তখন বলা হয় প্রথমে যেটি ধরে নেয়া হয়েছে। সেটি নিশ্চয়ই ভুল তাই এই অসঙ্গতি! আমার মনে হয় একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি বোঝা সহজ হবে।

    1 থেকে বড় যে পূর্ণ সংখ্যাকে 1 ছাড়া অন্য কোনো সংখ্যা দিয়ে পুরাপুরি ভাগ করা যায় না সেই সংখ্যাগুলোকে বলে প্রাইম সংখ্যা। 2, 3, 5, 7, 11, 13, 17… এগুলো হচ্ছে প্রাইম সংখ্যার উদাহরণ। 2 হচ্ছে সবচেয়ে ছোট প্রাইম সংখ্যা এবং সেটা একমাত্র জোড় প্রাইম। এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে বড় প্রাইম সংখ্যাটিতে প্রায় দুই কোটি ডিজিট রয়েছে, ছোট ছোট ছাপাতে লিখলেও পুরো সংখ্যাটি লিখতে প্রায় দশ হাজার পৃষ্ঠা লেগে যাবে। তবে এই প্রাইম সংখ্যার একটা বিশেষ বিশেষত্ব থাকায় এটাকে খুব ছোট করেও লেখা যায়, তাহলে সেটা হবে (2^32,582,657)-1, নিঃসন্দেহে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত একটা রূপ! গণিতবিদ এবং অন্যান্য উৎসাহী মানুষেরা ক্রমাগত নূতন নূতন প্রাইম সংখ্যা বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সংখ্যা যত বড় হয় প্রাইম সংখ্যা পাবার সম্ভাবনা তত কমে আসে কিন্তু তাই বলে প্রাইম সংখ্যা কখনই কিন্তু শেষ হয়ে যাবে না। ইউক্লিড দুই হাজার বছরেরও আগে এটা প্রমাণ করে গেছেন। কন্ট্রাডিকশন পদ্ধতির এই প্রমাণটি এত সহজ যে, যে কোনো মানুষই এটি বুঝতে পারবে। প্রমাণটি শুরু হয় এভাবে : ধরা যাক আসলে প্রাইম সংখ্যাগুলো অসীম সংখ্যাক নয়–অর্থাৎ, আমরা যদি সবগুলো প্রাইম সংখ্যা বের করতে পারি তাহলে দেখব একটা বিশাল প্রাইম সংখ্যা আছে এবং তার চাইতে বড় কোনো প্রাইম সংখ্যা নেই। সর্ববৃহৎ এবং সর্বশেষ এই প্রাইম সংখ্যাটি যদি Ph হয় তাহলে আমরা একটা মজার কাজ করতে পারি। পৃথিবীর যত প্রাইম সংখ্যা আছে তার সবগুলোকে গুণ করে তার সাথে 1 যোগ করে আমরা একটা নূতন সংখ্যা P তৈরি করতে পারি যেটা হবে:

    P=P1xP2xP3x…..Pn+1

    একটু লক্ষ করলেই আমরা বুঝতে পারব যে এই নূতন সংখ্যাটিকে কিন্তু কোনো সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা যাবে না। যে কোনো প্রাইম সংখ্যা Pi, P, P; দিয়ে ভাগ করলে ভাগশেষ হবে 1। যেসব সংখ্যা প্রাইম নয় সেগুলো দিয়ে ভাগ করার প্রয়োজন নেই কারণ সেই সংখ্যাগুলোও আসলে প্রাইম দিয়েই তৈরি (যেমন 14=2×7, 30=2x3x5, 32=2x2x2x2x2)। যে সংখ্যাকে 1 ছাড়া অন্য কোন সংখ্যা দিয়েই ভাগ দেওয়া যায় না সেটা হচ্ছে প্রাইম সংখ্যা, কাজেই ইউক্লিড দেখিয়ে দিলেন যে যদি আসলেই সর্ববৃহৎ এবং সর্বশেষ একটা প্রাইম সংখ্যা থাকে তাহলে তার থেকেও বড় একটা প্রাইম সংখ্যা তৈরি করা যায়। সরাসরি একটা কন্ট্রাডিকশন বা অসঙ্গতি! এই অসঙ্গতি দূর করার জন্যে বলা যায় যে প্রথমে যে জিনিসটি ধরে আমরা শুরু করেছিলাম সেটিই ভুল অর্থাৎ সর্ববৃহৎ প্রাইম সংখ্যা বলে কিছু নেই। অর্থাৎ প্রাইমের সংখ্যা অসীম।

    গণিতের আরো এক ধরনের প্রমাণ আছে যাকে বলা হয় ইনডাকশন পদ্ধতি। এই পদ্ধতি কীভাবে কাজ করে সেটা বলার আগে পৃথিবীর একজন সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ কার্ল ফ্রেডারিক গাউস নিয়ে একটা গল্প বলা যায়। জনশ্রুতি আছে যে, এই গণিতবিদ কথা বলতে শুরু করার আগে গণিত করতে শুরু করেছিলেন। স্কুলে তাকে নিয়ে একটা বড় বিপদ হলো, তাকে যে অংকই করতে দেয়া হয় তিনি চোখের পলকে সেটা করে ফেলেন, শিক্ষকের আর নিশ্বাস ফেলার সময় নেই। একদিন আর কোনো উপায় না দেখে তার শিক্ষক তাকে বললেন খাতায় 1 থেকে 100 পর্যন্ত লিখে সেটা যোগ করে আনতে। তার ধারণা ছিল এটা দিয়ে গাউসকে কিছুক্ষণ ব্যস্ত রাখা যাবে–এতগুলো সংখ্যা খাতায় লিখতেও তো খানিকটা সময় লাগবে! গাউস কিন্তু চোখের পলকে উত্তর লিখে নিয়ে এলেন 5050! শিক্ষকের চক্ষু চড়কগাছ–জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কীভাবে করলে?” গাউস বললেন, “1 থেকে 100 যোগ করার সময় প্রথম 1 এবং শেষ 100 যোগ করলে হয় 101 দ্বিতীয় শুরু সংখ্যা 2 এবং দ্বিতীয় শেষ সংখ্যা 99 যোগ করলেও হয় 101, এ-রকম সবগুলো সংখ্যার জন্যেই সত্যি। তার অর্থ এখানে রয়েছে 50টি 101 অর্থাৎ, 50×101=5050, সেটাই হচ্ছে যোগফল”। শুনে শিক্ষকের নিশ্চয়ই আক্কেল গুড়ুম হয়ে গিয়েছিল!

    এবারে আমরা সমস্যাটি নিজেদের করে দেখতে পারি। যদি 1 থেকে 100 পর্যন্ত যোগ করে 73 পর্যন্ত যোগ করি তাহলে যোগফল কত? কিংবা 1 থেকে 2083 পর্যন্ত যোগ করলে যোগফল কত? শেষ সংখ্যাটিকে যদি n ধরা হয় তাহলে যোগফল হচ্ছে n(n+1)/2, এটা যে সত্যি সেটা ছোটখাটো সংখ্যার জন্যে পরীক্ষা করে দেখতে পারি কিন্তু এটা যে সব সময়েই সত্যি, বিশাল সংখ্যার জন্যেও সত্যি তার কী প্রমাণ আছে? এটা যে সত্যি সেটা প্রমাণ করার জন্যে তাহলে কী একটা একটা করে সবগুলো সংখ্যার জন্যে প্রমাণ করতে হবে?

    আসলে সব সংখ্যার জন্যে প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই n(n+1)/2 যে যে-কোনো n এর জন্যে সত্যি সেটি প্রমাণ করলেই যথেষ্ট। 1 থেকে n পর্যন্ত যোগ করলে যদি আমরা পাই n(n+1)/2 তাহলে 1 থেকে n+1পর্যন্ত যোগ করলে আমরা নিশ্চয়ই পাব (n+1)(n+2)/2 এবারে একই জিনিস অন্যভাবেও আমরা দেখতে পারি, যেহেতু 1 থেকে n পর্যন্ত যোগ করে n(n+1)/2 পাওয়া গেছে, তার সাথে আরো n+1যোগ করলেই আমরা 1 থেকে n+1 পর্যন্ত যোগফল পেয়ে যাব, সেটা হচ্ছে n(n+1)/2+(n+1)ছোট একটু এলজেবরা করলে দেখানো যায় সেটা হচ্ছে (n+1)(n+2)/2 অর্থাৎ, ঠিক আমাদের ফরমূলা। কাজেই আমাদের ফরমূলাটি যে সত্যি সত্যি ইনডাকশান পদ্ধতি দিয়ে সেটা দেখানো হয়েছে।

    গণিতের সূত্র প্রমাণ করার এ-রকম পদ্ধতিগুলো আক্ষরিক অর্থে হাজার হাজার বছর থেকে গড়ে উঠেছে কিন্তু 1976 সালে এই পদ্ধতিতে একটা বড় ধাক্কা লেগেছিল, সেই ধাক্কাটি এখনো পুরাপুরি সামলে নেয়া যায় নি।

    ব্যাপারটি শুরু হয়েছিল 1852 সালে যখন একজন হঠাৎ করে প্রশ্ন করলেন ম্যাপে রং করতে কয়টা রং দরকার? ম্যাপে পাশাপাশি দেশকে ভিন্ন রং দিয়ে আলাদা করা হয়, এবং সেই ম্যাপ যত জটিলই হোক না কেন দেখা গেছে সেটা রং করতে কখনোই চারটার বেশি রংয়ের প্রয়োজন হয় না (3.3নং ছবি) কিন্তু আসলেই কি তার কোনো প্রমাণ আছে?

    1976 সালে কেনেথ এপিল এবং ওলফগ্যাং হেকেন নামে দুই আমেরিকান গণিতবিদ প্রমাণ করলেন যে চারটি রং দিয়েই যে কোনো ম্যাপ রং করা সম্ভব এবং তখন সারা পৃথিবীতে ভয়ানক হইচই শুরু হয়ে গেল প্রমাণটির কারণে নয় যে প্রক্রিয়ায় প্রমাণ করেছেন তার কারণে। সমস্যাটির একটা বড় অংশ তারা যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রমাণ করেছেন, কিছু অংশ যেটা যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব না সেগুলো তারা কম্পিউটার দিয়ে প্রমাণ করে ফেললেন! পৃথিবীর গণিতবিদরা পড়লেন বিপদে। গণিতের সূত্র প্রমাণ করার জন্যে হাজার হাজার বছর থেকে যে পদ্ধতিগুলো দাঁড়িয়েছে তাকে পাশ কাটিয়ে কম্পিউটার ব্যবহার করে প্রমাণ করা–এটা কোন ধরনের পাগলামো? তারা সেটা গ্রহণ করবেন, নাকি করবেন না?

    গণিতবিদরা অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের পর সেটি কিন্তু গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবার একটি গাণিতিক সূত্রের প্রমাণে মানুষের পাশাপাশি একটা যন্ত্রকে স্থান দিতে হয়েছিল। ভবিষ্যতে কি কোনো একটা সময় আসবে যখন এই যন্ত্র মানুষকে পুরাপুরি অপসারণ করবে?

    সেই উত্তর কেউ জানে না, যদিও প্রচলিত বিশ্বাস এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে ‘না’!

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগাব্বু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    Next Article ইস্টিশন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    Related Articles

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    ছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সাদাসিধে কথা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মেকু কাহিনী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    আমার বন্ধু রাশেদ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সায়েন্স ফিকশান সমগ্র ১ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    টুনটুনি ও ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }