Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আঁধার রাতের বন্ধু – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত এক পাতা গল্প113 Mins Read0
    ⤷

    বিকেলের আলোয়

    আজ নিয়ে ঠিক নব্বই দিন হল, গোমেজ ফিরল না-মনে মনে এই কথা বলে, পকেট থেকে রুমাল বের করে চশমার কাচ মুছে লাঠি হাতে আবার হাঁটতে শুরু করলেন জনদাদু৷ পথের দু-পাশে সার সার সমাধি৷ তার মধ্যে কয়েকটির বয়স কয়েকশো বছর৷ সমাধির উপর শ্বেতপাথরের চাদরগুলো ভেঙেচুরে গিয়েছে, তার নীচে থেকে ইটগুলো উঁকি মারছে৷

    সন্ধ্যে নামবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে৷ বেরিয়াল গ্রাউন্ডের উঁচু প্রাচীরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে পড়ন্ত সূর্যের আলো এসে পড়েছে সমাধির উপর দাঁড়িয়ে থাকা ক্রসগুলোর গায়ে৷ চারদিকে শান্ত পরিবেশ৷ ব্রিটিশরা যখন এদেশে এসেছিল, সেই আমলের সমাধি এটি৷ জনদাদুর পিতা-পিতামহ, এ গ্রামের চেনা-অচেনা অনেক মানুষই আজ ঘুমোচ্ছেন ওই সমাধির তলায়৷ জায়গাটা বড়ো প্রিয় জনদাদুর, এখানে এলে মনে হয়, তাঁর চেনা যেসব মানুষ ঘুমোচ্ছেন ওই সমাধির নীচে, তাঁদের সান্নিধ্য যেন উপভোগ করতে পারেন তিনি৷ কত মুখ, কত স্মৃতি ভেসে ওঠে ঘষা কাচের আড়ালে ঢাকা জনদাদুর চোখে৷ তা ছাড়া এখানেই একটা ছোট্ট ঘরে বাস করেন জনদাদুর সত্তর বছরের পুরোনো বন্ধু বৃদ্ধ গোমেজ৷ বিশেষত, তাঁর টানেই অনেক বছর ধরে রোজ বিকেলে এখানে হাজির হন জনদাদু৷ তিনি চলে যাওয়ার আগের দিনও প্রতিদিনের মতো বিকেল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত এখানে ঘুরে বেড়িয়েছেন তাঁরা৷

    যাওয়ার আগে তিনি বলে গিয়েছিলেন, সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই গোয়া থেকে ফিরে আসবেন৷ কিন্তু এখনও তিনি ফেরেননি৷ সমাধিক্ষেত্রে ঢোকার পর ডান পাশে যে ছোট্ট ঘরটা আছে, রোজ বিকেলে এসে সে ঘরটার দরজার দিকে বড়ো আশা নিয়ে তাকান জনদাদু৷ কিন্তু সে ঘর তালাবন্ধ থাকে৷ মনে মনে একবার হিসেব করে নেন ঠিক কতদিন হল, তারপর আবার হাঁটা শুরু করেন৷ সন্ধ্যে নামার আগে পর্যন্ত তিনি একলাই ঘুরে বেড়ান বিরাট এই সমাধিক্ষেত্রের চারপাশে৷ তারপর এই আশা নিয়ে ফিরে যান, নিশ্চয়ই কাল বন্ধুর সঙ্গে দেখা হবে৷ গোয়ায় ভাইপোর বাড়ি থেকে নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন তিনি৷

    সেদিনও একলাই হাঁটতে লাগলেন জনদাদু৷ সমাধিক্ষেত্রের মাঝখান দিয়ে রাস্তা চলে গিয়েছে সামনের দিকে৷ ক-দিন হল বর্ষা নেমেছে, এর মধ্যেই লম্বা লম্বা ঘাস জন্মে গিয়েছে রাস্তার পাশে আর সমাধিক্ষেত্রের ফাঁকে৷ গোমেজ নেই, তাই ঘাসগুলো পরিষ্কার করার লোকও নেই৷ গোমেজই এই সমাধিক্ষেত্রের রক্ষক৷ তিনি সমাধিক্ষেত্রের মাটি খোঁড়েন, এই স্মৃতির বাগানে যেসব ছোটো-বড়ো গাছ আছে তাদের পরিচর্যা করেন, জঙ্গল সাফ করেন, এককথায় তিনিই হলেন এখানকার সব কিছু৷

    হাঁটতে হাঁটতে জনদাদু এসে হাজির হলেন সমাধিক্ষেত্রের শেষ প্রান্তে৷ প্রাচীরের ধারে দুটো বিরাট দেবদারু গাছ কয়েক হাত দূরত্বে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে৷ তাদের বয়স মনে হয় জনদাদুর চেয়েও বেশি৷ ছেলেবেলা থেকেই গাছ দুটোকে একইভাবে দেখে আসছেন তিনি৷ পাশাপাশি ওই গাছ দুটোর নীচেই ঘুমোবেন দুই বন্ধু৷ এ-ব্যাপারটা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন তাঁরা৷ বয়স তো দু-জনেরই কম হল না৷ আশি পেরিয়ে গিয়েছে, দিন তো শেষ হয়ে এল৷ সেখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন জনদাদু৷ তাকালেন গাছগুলোর নীচে৷ একটা গাছের নীচে রয়েছে কাঠের পাটাতন৷ তার তলায় খোঁড়া রয়েছে একটা সমাধির গর্ত৷ গোমেজ আগেভাগে তাঁর নিজের জন্য খুঁড়ে রেখেছেন গর্তটা৷ এই বয়সেও তিনি এত সুন্দর গর্ত খোঁড়েন যে, এ তল্লাটে এ কাজ তাঁর মতো কেউ করতে পারে না৷ মাস চারেক আগে তিনি এই গর্তটা খুঁড়ছিলেন৷ সেদিন জনদাদু তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোমার কাজটা যে আগেভাগেই সেরে রাখছ বড়ো!’

    তাঁর কথা শুনে গোমেজ বলেছিলেন, ‘যদি তুমি আগে যাও তাহলে তোমারটা নয় আমি খুঁড়ে দেব৷ কিন্তু আমি যদি আগে যাই তাহলে আমারটা কে খুঁড়বে শুনি? তাই আমার কাজটা নিজেই এখন সেরে রাখছি৷ তেমন হলে শুধু উপর থেকে মাটি ফেলে দেবে৷’

    এ-কথাটা মনে পড়ে গেল জনদাদুর৷ তিনি গিয়ে দাঁড়ালেন পাটাতন ঢাকা সমাধিক্ষেত্রের সামনে৷ বর্ষার জলে ভেজা কাঠে উই ধরেছে৷ হাতের লাঠি দিয়ে জনদাদু উইয়ের বাসাগুলো ভাঙতে লাগলেন৷ হঠাৎ কেন জানি মনে হল, গোমেজের সঙ্গে হয়তো তাঁর আর দেখা হবে না৷ রাত হলেই ইদানীং তাঁর বুকের ব্যথাটা আবার বাড়ছে৷ ডাক্তার বলে দিয়েছেন, ওষুধপত্তরে আর তেমন কাজ হবে না৷ রক্তমাংসের হলেও বুকের ভিতর যেটা দিনরাত ধুকপুক করে, সেটা তো আসলে একটা যন্ত্রই৷ বহু ব্যবহারে জীর্ণ৷ পুরোনো ঘড়ির মতো টিকটিক করে চলতে চলতে একদিন থেমে যাবে৷ একবার থেমে গেলে এ ঘড়ি আর সারানো যায় না৷

    উইয়ের বাসাটা ভাঙতে ভাঙতে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল জনদাদুর৷ সত্যিই কি আর দেখা হবে না বন্ধুর সঙ্গে? ছেলেবেলা, কৈশোর, যৌবনের কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে তাঁর সঙ্গে৷ সেই কোন ছেলেবেলায় গোয়া থেকে কীভাবে যেন এখানে এসে হাজির হয়েছিলেন গোমেজ৷ তারপর এখানেই তিনি জীবনটা কাটিয়ে দিলেন৷ একদিনের জন্যও যিনি এ-গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও যাননি, তিনি কিনা তিন-তিনটে মাস ধরে নিখোঁজ! তিনি কি ভুলে গেলেন তাঁর সত্তর বছরের পুরোনো বন্ধু জনকে? উইয়ের বাসাটা ভাঙা হয়ে যেতে আরও কিছুক্ষণ বিষণ্ণ মনে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন জনদাদু৷ সূর্য ডুবে গিয়েছে, আকাশে ছড়িয়ে আছে তার লাল আভা৷ চারপাশে যে বড়ো বড়ো গাছ আছে, দিনের শেষে সেখানে নিজেদের বাসায় ফিরে আসছে পাখির দল৷ জনদাদু ফেরার জন্য এর পর হাঁটতে শুরু করলেন৷ ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে যখন তিনি প্রায় গেটের কাছে এসে পড়েছেন, তখন তাঁর কানে এল টমের ডাক, ‘দাদু, তুমি কোথায়? সন্ধ্যে হয়ে গেল, এবার ফিরে চলো৷’

    টম নিতে এসেছে তাঁকে৷ বছর চোদ্দো বয়সের টম, দাদুর একমাত্র নাতি৷ খুব ভালোবাসে সে দাদুকে৷ রোজ বিকেলে সে মাঠে খেলতে যাওয়ার সময় দাদুকে এখানে দিয়ে যায়৷ ঘণ্টা খানেক পর খেলা শেষে ফেরার পথে দাদুকে বাড়ি নিয়ে যায়৷ আজ অবশ্য সে স্কুল থেকে দেরি করে বাড়ি ফেরায়, দেরিতেই এখানে এসেছিলেন জনদাদু৷ টমের গলা শুনে জনদাদু বললেন, ‘এই যে আমি এসে গিয়েছি৷’

    পাথরের স্তম্ভের উপর ছাদ-বসানো জীর্ণ ফটক দিয়ে বাইরে বের হওয়ার আগে আরও এক বার গোমেজের ছোট্ট ঘরের বন্ধ দরজার দিকে তাকালেন জনদাদু৷ একটা বড়ো লোহার তালা ঝুলছে দরজায়৷ জল পড়ে মরচে ধরতে শুরু করেছে গায়ে৷ সেদিকে তাকিয়ে এক বার দু-পাশে মাথা নাড়লেন জনদাদু৷ তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফটক পেরিয়ে সমাধিক্ষেত্রের বাইরে বেরিয়ে এলেন৷ তাঁকে দেখেই টম জিজ্ঞেস করল, ‘কী, গোমেজদাদু ফিরলেন?’

    জনদাদু বিষণ্ণ মনে বললেন, ‘না৷’

    টম দাদুকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলল, ‘দেখো, আজ নাহয় কাল ঠিক ফিরে আসবেন৷’

    রোজই একথা বলে টম দাদুর মন ভালো করার চেষ্টা করে৷ কিন্তু গোমেজের ঘরের তালাটা বন্ধই থাকে৷ তার কথা শুনে জনদাদু বললেন, ‘তাই হবে হয়তো!’

    এরপর দাদু আর নাতি মিলে হাঁটা শুরু করলেন বাড়ি ফেরার জন্য৷ দাদুকে নিয়ে টমের বাড়ি ফিরতে আধঘণ্টা সময় লাগে৷ বর্ষাকাল, সমাধিক্ষেত্রের বাইরে বেরিয়ে একটু এগোবার পরই হঠাৎ কোথা থেকে যেন কালো মেঘ এসে আকাশ ঢেকে ফেলল৷ তার মিনিট দশেকের মধ্যেই বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি নামল৷ দাদু আর নাতি যখন বাড়ি ফিরলেন, তখন তাঁরা একদম ভিজে চুপসে গিয়েছেন৷

    সেদিন রাতেই খুব জ্বর এল জনদাদুর৷ তার সঙ্গে বুকে ব্যথা৷ টমের ঠাকুরমা অনেক বছর আগেই মারা গিয়েছেন৷ সারারাত তাঁর শিয়রে জেগে বসে রইলেন টমের বাবা-মা৷ পরদিন সকাল বেলা ডাক্তারবাবুর এসে দাদুকে দেখে বললেন, তাঁর আর কিছু করার নেই৷

    বেলা বাড়ার সঙ্গেসঙ্গে জনদাদুর অবস্থা আরও খারাপ হতে শুরু করল৷ সংজ্ঞা হারালেন তিনি৷ দুপুরের দিকে মিনিট খানেকের জন্য একবার জ্ঞান ফিরে এল তাঁর৷ সেই সময় অস্ফুট স্বরে তিনি একবার বললেন, ‘গোমেজ, কবে ফিরে এলে তুমি?’ তার পরেই আবার তিনি চোখ বুজলেন৷ বিকেল হওয়ার আগেই সবাইকে কাঁদিয়ে এই গ্রাম, এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অজানার উদ্দেশে যাত্রা করলেন জনদাদু৷

    বিকেল বেলা টমদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে জটলা করছিল গ্রামেরই একদল ছেলে৷ তাদের কেউ টমের সমবয়সি, কেউ-বা টমের চেয়ে বয়সে কিছু বড়ো৷ সমস্ত জোগাড়যন্ত্র করতে করতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে, তাই আর আজ জনদাদুকে সমাধি দেওয়া যাবে না৷ সে কাজ শেষ করতে হবে কাল সকাল বেলা৷ এই নিয়েই ছেলের দল নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল৷ তাদের মধ্যে একজন হঠাৎ বলল, ‘গোমেজদাদু তো নেই, সমাধিটা যখন আমাদেরই খুঁড়তে হবে, তখন কাজটা আজকেই সেরে রাখলে হয় না? সন্ধ্যে নামতে তো এখনও ঘণ্টা খানেক দেরি আছে৷’

    তার কথা শুনে অন্য ছেলেরা রাজি হল, ‘হ্যাঁ, কাজটা এখনই সেরে রাখা উচিত!’

    এর কিছুক্ষণের মধ্যে তারা বেরিয়ে পড়ল কোদাল গাঁইতি নিয়ে৷ বাড়িতে জনদাদুকে ঘিরে কান্নাকাটি চলছে৷ কেঁদে কেঁদে টমের চোখও ফুলে গিয়েছে৷ তার বাড়িতে থাকতে ভালো লাগছিল না৷ বাবা-মার অনুমতি নিয়ে টমও চলল ছেলেদের দলের সঙ্গে৷ কিন্তু তারা সমাধিক্ষেত্রে পৌঁছোবার আগেই গতদিনের মতোই হঠাৎই বর্ষার মেঘে ঢেকে গেল আকাশ৷ কেউ যেন কালি ঢেলে দিল আকাশের গায়ে৷

    তারা যখন সমাধিক্ষেত্রের সামনে পৌঁছোল তখনই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল৷ বৃষ্টির হাত থেকে মাথা বাঁচাবার জন্য সকলে দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নিল প্রবেশ-তোরণের ছাদের নীচে৷ জনা আটেক ছেলে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পরস্পরের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়াল বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচার জন্য৷ বৃষ্টি কিন্তু ক্রমশই বাড়তে লাগল, তার সঙ্গে শুরু হল ঝড় আর আকাশের বুক চিরে বিদ্যুতের ঝলকানি৷ গুম গুম শব্দে বাজ পড়তে লাগল৷ প্রচণ্ড বাতাসে ভিতরের বড়ো বড়ো গাছ পাগলের মতো মাথা নাড়তে লাগল৷ যেন চারপাশে শুরু হল মহাপ্রলয়৷ ছাদের তলায় দাঁড়িয়ে থাকলেও ছেলেরা পুরোপুরি বাঁচাতে পারল না নিজেদের৷ বাতাসে বৃষ্টির ছাঁট উড়ে এসে লাগতে শুরু করল তাদের গায়ে৷ তারা যে কাজ করার জন্য এখানে এসে হাজির হয়েছে, সে কাজ যে আর করা যাবে না, তা বুঝতে পারল সবাই৷ কিন্তু বৃষ্টি না থামলে আর বাড়ি ফেরার উপায় নেই৷ বিশেষত, যেভাবে বাজ পড়ছে তাতে তাদের আর কারও খোলা আকাশের নীচে যেতে সাহস হল না৷ সময় এগিয়ে চলল৷ বিকেল গড়িয়ে কখন যে সন্ধ্যে নামল তা কেউ বুঝতেই পারল না৷ ঠক ঠক করে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বৃষ্টি থামার প্রতীক্ষা করতে লাগল তারা৷ সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগল, আর টম চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল দাদুর কথা৷ রোজ দাদুকে বিকেল বেলায় এখানে দিয়ে যেত, নিয়ে যেত টম৷ কাল বিকেল থেকে এ কাজ আর করতে হবে না৷

    ঘণ্টা তিনেক পর একসময় বৃষ্টি ধরে এল৷ যদিও মাঝে মাঝে কালো আকাশের বুক চিরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে৷ হয়তো একটু পরেই আবার বৃষ্টি নামবে৷ অন্ধকারের মধ্যে তো আর মাটি খোঁড়া সম্ভব নয়, কাজেই বৃষ্টি নামার আগে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে৷ চারপাশে জল জমে গিয়েছে৷ তার মধ্যে দিয়ে ছপ ছপ করতে করতে টম অন্যদের সঙ্গে পা বাড়াল সমাধিক্ষেত্রের বাইরে যাওয়ার জন্য৷

    ঠিক সেই সময় সমাধিক্ষেত্রের ভিতর দিক থেকে একটা অস্পষ্ট শব্দ ভেসে এল টমের কানে৷ শব্দটা কানে গিয়েছিল টমের পাশে হাঁটতে থাকা একটা ছেলেরও৷ দু-জনে থামকে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ ও কীসের শব্দ? দু-জনকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে অন্যরাও থেমে গেল৷ তাদের একজন টমকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল!’

    টম বলল, ‘কেমন একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছি!’

    তার কথা শুনে কান খাড়া করল সকলে৷ হ্যাঁ, একটা শব্দ ভেসে আসছে সমাধিক্ষেত্রের শেষ প্রান্ত থেকে! শব্দটা কীসের তা বোঝার চেষ্টা করতে লাগল সকলেই৷ এত রাতে অন্য কীসের শব্দ হতে পারে এখানে? দলের মধ্যে যে দু-এক জন একটু ভিতু গোছের ছেলে ছিল তারা হাত দিয়ে বুকে ক্রস আঁকল৷ এক জন হঠাৎ বলল, ‘সমাধি-চোরের দল ঢোকেনি তো এখানে? গত মাসেই তো পাশের গ্রামের সমাধিক্ষেত্রের একটা গর্ত খুঁড়ে কারা যেন হাড়গোড় তুলে নিয়ে গিয়েছে বলে শুনেছি৷’

    এ খবরটা ছেলেদের মধ্যে আরও কয়েক জনের জানা৷ কাজেই সমাধি-চোরের কথাটা বাকিরা কিন্তু উড়িয়ে দিতে পারল না৷ শব্দটা হয়েই চলেছে! এক জন বলল, ‘তাহলে চল, দেখা যাক না ব্যাপারটা কী!’

    অন্য এক জন বলল, ‘কিন্তু যদি চোরের কাছে হাতিয়ার থাকে?’

    আর-এক জন একথা শুনে বলল, ‘আমাদের কাছেও তো গাঁইতি-কোদাল আছে, এত ভয়ের কী আছে?’

    মিনিট দুয়েক আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত তারা সিদ্ধান্ত নিল, এক বার দেখে নেওয়া যাক ব্যাপারটা৷ সন্তর্পণে কোদাল-গাঁইতি নিয়ে অন্ধকারে তারা এগোতে লাগল শব্দের দিকে৷ টমের বাড়ি ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু অগত্যা সে-ও সকলের পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করল৷ প্রচণ্ড বৃষ্টিতে মাটি ভিজে গিয়েছে৷ পা বসে যাচ্ছে কাদামাটিতে৷ দু-পাশের ছোটোখাটো গাছ-ঝোপজঙ্গল নুয়ে পড়েছে পথের মধ্যে৷ চারপাশে জমাট অন্ধকার, শুধু মাঝে মাঝে যখন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে তখন তার আলোয় আবছা ফুটে উঠছে সমাধিক্ষেত্রের মাথার উপর জেগে থাকা সাদা পাথরের ক্রসগুলো৷

    জলকাদা আর ঘাসের জঙ্গল ভেঙে টমেরা এগোতে লাগল৷ কিছুক্ষণ পর তারা বুঝতে পারল, শব্দটা ভেসে আসছে সমাধিক্ষেত্রের শেষ প্রান্তে যে দেবদারু গাছ দুটো আছে, তার কাছ থেকে৷ ওই জায়গাতেই তো জনদাদুর সমাধির গর্ত খোঁড়ার কথা! আরও কয়েক পা সেদিকে এগোবার পর তারা এ-ও বুঝতে পারল, শব্দটা আসলে মাটির উপর কোদাল চালানোর শব্দ৷ ঝপ ঝপ শব্দে দ্রুত মাটি কেটে চলেছে কেউ৷ কে ওখানে! ধীরে ধীরে এগিয়ে, সকলেই গিয়ে দাঁড়াল একটা গাছের মোটা গুঁড়ির আড়ালে৷ অন্ধকারের মধ্যে দেবদারু গাছের নীচে একটা অস্পষ্ট অবয়ব চোখে পড়ল টম আর তার সঙ্গীদের৷ যে দেবদারু গাছের নীচে জনদাদুর জন্য গর্ত কাটার কথা, সেখানেই মাটি খুঁড়ে চলেছে লোকটি৷ গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সবাই ভাবতে লাগল, লোকটি কে? টমদের দিকে পিছন ফিরে মাটি কাটছে সে৷ হঠাৎ একটা ঘটনা ঘটল, একটা ছেলে ভালো করে দেখার জন্য একটু সরে দাঁড়াতে গিয়ে কাদামাটিতে পা পিছলে ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল৷ আর তার সঙ্গেসঙ্গে থেমে গেল মাটি কাটার শব্দ৷

    টমের মনে হল, যেন ফিরে দাঁড়াল লোকটি৷ ঠিক সেই মুহূর্তে অন্ধকার আকাশের বুক চিরে বিদ্যুৎ চমকাল৷ তার আলোয় মুহূর্তের জন্য সামনের অন্ধকার কেটে গেল৷ টমেরা দেখতে পেল, তাদের দিকে তাকিয়ে আছে কোদাল হাতে দীর্ঘদেহী একজন লোক৷ তার মাথার চুলগুলো শনের মতো সাদা৷ ঘাড় থেকে হাঁটুর নীচ পর্যন্ত নেমে আসা কালো কোটটা বৃষ্টিতে ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপটে আছে৷ একটা মুহূর্ত মাত্র৷ কিন্তু তার মধ্যেই টম চিনে ফেলল তাঁকে৷ সে বলে উঠল, ‘আরে, ইনি যে গোমেজদাদু!’

    টমের কথা শেষ হতে-না-হতেই কাছেই কোথায় যেন প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল৷ কেঁপে উঠল ছেলের দল৷ টম এবার চিৎকার করে বলল, ‘গোমেজদাদু, কবে ফিরলেন আপনি?’

    তার কথার কোনো উত্তর এল না, শুধু অন্ধকারের মধ্যে মাটির উপর কোদাল চালাবার শব্দ শুরু হল আবার৷ টম আবারও একই প্রশ্ন করল, কিন্তু এবারও সে কোনো উত্তর পেল না৷ কিছুক্ষণ অন্ধকারের মধ্যে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সকলেই৷ আবার বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পড়তে শুরু করল৷ বৃষ্টি বাড়লে আর বাড়ি ফের যাবে না, তা ছাড়া গোমেজদাদু যখন ফিরে এসেছেন, তখন আর কোনো চিন্তা নেই৷ কাজেই সকলে এর পর বাড়ি ফেরার জন্য পা বাড়াল৷

    বাড়ি ফিরে টম খবর দিল, ‘গোমেজদাদু ফিরে এসেছেন৷’

    সেদিন মাঝরাতে ঘুম ভাঙতে একলা ঘরে খাটের উপর উঠে বসল টম৷ পাশের ঘরে তখন জনদাদুর মৃতদেহের কাছে বসে তন্দ্রায় ঢুলছেন অবসন্ন টমের বাবা-মা৷ বাইরে আকাশে তখন মেঘ কেটে গিয়েছে৷ খোলা জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরের মেঝেয়৷ খাটে উঠে বসে জানলার বাইরে তাকাল টম৷ আর তখনই সে দেখতে পেল তাঁকে৷ জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে বাইরেটা৷ সেই আলোয় টমদের বাড়ির বাইরে কয়েক হাত দূরে ছোট্ট কাঠের বেড়ার ওপাশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন গোমেজদাদু৷ তাঁর পরনে সেই লম্বা চুলের কোট, চাঁদের আলোয় তার মাথা-ভরতি সাদা চুল যেন আরও বেশি সাদা দেখাচ্ছে৷ তিনি চেয়ে আছেন টমদের বাড়ির দিকে৷ এত রাতে ওভাবে ওখানে তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন? ঘরের ভিতর থেকে তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল টম৷ গোমেজদাদু একইভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন৷ মিনিট খানেকের মধ্যে টমের চোখের পাতা আবার বুজে এল৷ বিছানায় শুয়ে পড়ল টম৷

    পরদিন বেলা দশটা নাগাদ জনদাদুর কফিন নিয়ে শবযাত্রা রওনা হল সমাধিক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে৷ ভোর বেলায় একজন লোককে সমাধিক্ষেত্রে পাঠিয়েছিলেন টমের বাবা৷ সে ফিরে এসে খবর দিয়েছে যে, দেবদারু গাছের নীচে সুন্দরভাবে একটা গর্ত খুঁড়ে রাখা আছে৷ কিন্তু সে গোমেজদাদুকে সমাধিক্ষেত্রের ভিতর কোথাও দেখতে পায়নি৷ শবযাত্রা একসময় এসে পৌঁছোল সমাধিক্ষেত্রে৷ ফটক দিয়ে ভিতরে ঢুকতে টমের নজর পড়ল গোমেজদাদুর ঘরের দরজায়৷ ভারী লোহার তালাটা সেখানে একইভাবে ঝুলছে৷ বর্ষার জলে মরচে ধরেছে তালায়৷

    কফিন নিয়ে সকলেই এসে হাজির হল দেবদারু গাছ দুটোর নীচে৷ সামনেই সুন্দরভাবে কেটে রাখা গর্ত৷ এ গর্ত গোমেজদাদুরই হাতের কাজ তাতে সন্দেহ নেই৷ এত নিখুঁত গর্ত তিনি ছাড়া আর কাটবেনই বা কে? কিন্তু তিনি গেলেন কোথায়? কয়েক জন তাঁকে খুঁজতে শুরু করল সমাধিক্ষেত্রের চারপাশে৷ না, তাঁকে পাওয়া গেল না৷ বেশ কিছুক্ষণ তাঁর জন্য অপেক্ষা করল সকালে৷ যদি তিনি শেষবারের জন্য দেখতে আসেন কফিনে শায়িত তাঁর বন্ধুকে৷ একসময় আকাশের কোনায় আবার মেঘ জমতে দেখা গেল৷ আর অপেক্ষা করা যাবে না, বৃষ্টি নামলেই সব কাজ পণ্ড হয়ে যাবে৷ কাজেই জনদাদুকে শেষবারের মতো দেখে নিয়ে কফিনের মুখে ঢেকে দেওয়া হল৷ সকলের চোখের জলের সঙ্গে কফিন ধীরে ধীরে নেমে গেল মাটির গভীরে৷ এর পর ঝপাঝপ শব্দে মাটি পড়তে লাগল গর্তের ভিতর৷

    আকাশ ক্রমেই কালো হয়ে আসছে৷ শবযাত্রার সঙ্গে যারা এসেছিল তাদের অধিকাংশই রওনা হয়ে গেল বাড়ি ফেরার জন্য৷ শুধু রয়ে গেল টম, আর যারা গর্তে মাটি ভরাট করছে, তারা৷

    তখন কাজ প্রায় শেষ৷ গর্ত ভরাট হয়ে গিয়েছে৷ সমাধির উপর মাটি লেপার কাজ করছে দু-তিন জন, আর অন্যরা ঘিরে দাঁড়িয়ে কাজ দেখছে৷ হঠাৎ কীভাবে যেন এক জনের পা পড়ে গেল জনদাদুর সমাধির কয়েক হাত দূরে, কাঠের পাটাতন ঢাকা সেই সমাধির গর্তটার উপর৷ বৃষ্টিতে ভিজে পচে যাওয়া কাঠের পাটাতনে ছেলেটির পা পড়ার সঙ্গেসঙ্গেই সেটা মচ করে ভেঙে গর্তের মধ্যে ঢুকে গেল৷ ছেলেটিও পড়ে যাচ্ছিল গর্তের মধ্যে৷ পাশের এক জন শক্ত হাতে কোনো রকমে ধরে ফেলল তাকে৷ গর্তের মুখটা ফাঁক হয়ে গিয়েছে, বৃষ্টির জলে অর্ধেক ভরতি হয়ে আছে গর্তটা৷ তার মধ্যে তাকিয়ে হঠাৎ একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল সকলের৷ গর্তের ভিতর জলের মধ্যে জেগে আছে একটা মাথার খুলি৷ জিনিসটা চোখে পড়া মাত্রই সকলে ভালো করে দেখার জন্য ঘিরে দাঁড়াল৷ দেখে বোঝা যাচ্ছে কফিনবাক্স ছাড়াই শরীরটাকে শোয়ানো হয়েছিল গর্তের মধ্যে৷ দাঁতের পাটিগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে৷ টম একটা জিনিস লক্ষ করল, তার উপরের পাটির সামনের দুটো দাঁত সম্ভবত সোনা দিয়ে বাঁধানো৷ জলে ধুয়ে সেগুলো মৃদু চিকচিক করছে৷ কিন্তু এ গর্ত তো গোমেজদাদু নিজের জন্য খুঁড়ে রেখেছিলেন! এ মৃতদেহটা এখানে এল কী করে?

    নিজেরা আলোচনা করে শেষ পর্যন্ত মনে হল, ফাঁকা সমাধি দেখতে পেয়ে অন্য কোনো জায়গার লোকজন হয়তো সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েছে৷ মৃত ব্যক্তির হয়তো তেমন কোনো লোকবল ছিল না৷ কাজেই যারা সমাধি দিতে এসেছিল তারা দায়সারাভাবেই কাজটা করে গিয়েছে৷ অথবা অন্য কোনো জরুরি কাজ ছিল তাদের, তাই কোনো রকমে মাটি দিয়েই সমাধির উপর কাটের পাটাতন আগের মতো চাপা দিয়ে গিয়েছে, যাতে বাইরে থেকে কেউ কিছু বুঝতে না পারে৷ কিন্তু এভাবে তো সমাধিটাকে খোলা ফেলে রাখা যায় না! জনদাদুর সমাধির উপর মাটি লেপার কাজ শেষ করে, সঙ্গে আনা পাথরের ক্রসটা সমাধির উপর পুঁতে দিয়ে সকলে মিলে তাই লেগে গেল জল-ভরতি সমাধিটাকে বোজাবার জন্য৷ আবার অন্ধকার হয়ে আসছে, বৃষ্টি নামল বলে৷ পাশ থেকে মাটি কেটে দ্রুত সমাধি বোজাতে লাগল সকলে৷ টম শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল৷ গোমেজদাদু যখন ব্যাপারটা জানতে পারবেন তখন কত দুঃখ পাবেন তিনি৷ দুই দাদুর খুব সাধ ছিল পাশাপাশি ঘুমোবেন৷ সে সাধ আর পূর্ণ হল না৷ কোনো রকমে সমাধিটা বোজানো শেষ হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি নামল৷ ক্লান্ত শরীরে ভিজতে ভিজতে সকলে পা বাড়াল বাড়ি ফেরার জন্য৷

    সেদিনের পর মাঝে আরও একটা দিন কেটে গেল৷ তার পরদিন বিকেল বেলা মা-র ধাক্কায় ঘুম ভেঙে বিছানার উপর উঠে বসল টম৷ মা বললেন, ‘তাড়াতাড়ি উঠে পড়, দাদুর সমাধিতে মোমবাতি জ্বালিয়ে আসতে হবে তো! সন্ধ্যে বেলার আগেই বাড়িতে লোকজন আসতে শুরু করবে কিন্তু!’

    আজ সন্ধ্যে বেলা তাদের বাড়িতে জনদাদুর জন্য তিন দিনের প্রার্থনাসভা হবে৷ বেশ কিছু আত্মীয়-প্রতিবেশী আসবেন তাদের বাড়িতে৷ সামান্য কিছু আপ্যায়নের ব্যবস্থাও করা হয়েছে তাঁদের জন্য৷ টম বাবার সঙ্গে সারা সকাল ব্যস্ত ছিল সেই কাজে৷ শেষ দুপুরে সে বিছানায় এসে শুয়ে ছিল৷ মা-র কথা শুনে বিছানা ছেড়ে নেমে পড়ল টম৷ মুখ-হাত ধুয়ে, মা-র কাছ থেকে একটা বড়ো মোমবাতি নিয়ে বাড়ি ছেড়ে রওনা হল সমাধিক্ষেত্রের উদ্দেশে৷

    দু-তিন দিন টানা বৃষ্টির পর আজ সকাল থেকে আর বৃষ্টি হয়নি৷ বৃষ্টির পর গাছের পাতাগুলো বিকেলের আলোয় আরও সবুজ বলে মনে হচ্ছে৷ পথের পাশে ঝোপঝাড়গুলো থেকে বুনো ফুলের মিষ্টি এসে লাগছে টমের নাকে৷ এই পথ ধরেই রোজ বিকেলে টম দাদুকে পৌঁছে দিত সমাধিক্ষেত্রে৷ আজ সে চলেছে একা, দাদুর সমাধিতে বাতি জ্বালাতে৷ এই পথ দু-পাশের গাছপালা, বিকেলের আলো, পাখির ডাক, সবকিছুই একই রকম আছে৷ নেই শুধু জনদাদু৷

    মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল টমের৷ তার কাছে কয়েকটা পয়সা ছিল৷ রাস্তার পাশে একটা দোকানে গিয়ে দেশলাই কিনল টম৷ দোকান ছেড়ে বেরিয়ে প্যান্টের পকেটে দেশলাইটা রাখতে গিয়ে পকেটের ভিতর কী একটা জিনিসে হাত ঠেকল টমের৷ কী এটা? টম পকেট থেকে বের করে আনল একটা খাম৷ খামটা দেখেই টমের মনে পড়ে গেল, আজ সকালেই পোস্টম্যান এসে দিয়ে গিয়েছিল সেটা৷ তখন টম কী একটা কাজে বাড়ির বাইরে যাচ্ছিল, খামটা সে পকেটে রেখে দিয়েছিল৷ তারপর আর খেয়াল ছিল না খামের কথা৷ হাঁটতে হাঁটতে খামটা আবার পকেটে ঢোকাতে গিয়েও হঠাৎ একটা জিনিস চোখে পড়ায় থেমে গেল টম৷ আরে, এ চিঠি যে জনদাদুর উদ্দেশে লেখা! কে লিখেছে চিঠিটা? তাঁর নামে তো কোনো চিঠি আসে না! টম কৌতূহলী হয়ে পথের পাশে দাঁড়িয়ে পড়তে শুরু করল চিঠিটা৷ চিঠির তারিখটা মাস দুয়েক আগের৷ তাতে খুদে হস্তাক্ষরে লেখা-

    প্রিয় জনখুড়ো,

    আশা করি ঈশ্বরের কৃপায় আপনি কুশলে আছেন৷ অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আপনাকে জানাচ্ছি যে, আমাদের গোমেজখুড়ো, আপনার প্রিয় বন্ধু আর আমাদের মধ্যে নেই৷ তিন দিন আগে তিনি প্রয়াত হয়েছেন৷ এখানে আসার পর তিনি সুস্থই ছিলেন৷ কয়েক সপ্তাহ আগে তিনি স্থানীয় এক দাঁতের ডাক্তারের কাছে গিয়ে সোনা দিয়ে দুটো দাঁত বাঁধান৷ এর পরই তাঁর এখান থেকে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু দাঁত বাঁধানোর পরই হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি৷ ডাক্তারের চেষ্টা সত্ত্বেও ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যান তিনি৷ মৃত্যুশয্যায় বারবার বলছিলেন আপনার কথা৷ তাঁর শেষ ইচ্ছে ছিল, মৃত্যুর পর তাঁর দেহ যেন আপনাদের গ্রামের সমাধিক্ষেত্রে সমাধি দেওয়া হয়৷ দূরত্ব ও আর্থিক অসুবিধের কারণে সে কাজ আমাদের পক্ষে করা সম্ভব ছিল না৷

    অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, এখানেও তাঁর মরদেহ আমরা সমাধি দিতে পারিনি৷ ব্যাপারটা সংক্ষেপে এইরকম, তিন দিন আগে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি আর সেইসঙ্গে সমুদ্রে প্রবল জলোচ্ছ্বাস হয়৷ সমুদ্রের জল ঢুকে পড়ে সমাধিক্ষেত্রে৷ তার হাত থেকে বাঁচার জন্য আমরা কফিন নামিয়ে রেখে সমাধিক্ষেত্রের এক কোনায় একটা ঘরের মধ্যে আশ্রয় নিই৷ কিছুক্ষণ পর ঝড়বৃষ্টি একটু কমলে আমরা ফিরে গিয়ে দেখি, কফিনবাক্সটা কাত হয়ে পড়ে থাকলেও গোমেজখুড়োর শরীর আর তার মধ্যে নেই৷ চারপাশেও আর তাঁর সন্ধান পাইনি আমরা৷ আমার ধারণা, সমুদ্র অন্য কোথাও ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে তাঁর শরীর৷

    গোমেজখুড়োর চলে যাওয়ার দুর্ভাগ্যজনক সংবাদ আপনাকে জানাতে হল বলে আমাকে মার্জনা করবেন৷ ঈশ্বরের কাছে আপনার নিরোগ দীর্ঘায়ু কামনা করি৷

    ইতি

    হতভাগ্য স্টিফেন গোমেজ

    ওল্ড চার্চ রো, গোয়া৷

    চিঠিটা পড়ার পর কিছুক্ষণ রাস্তার পাশে থমকে দাঁড়িয়ে রইল টম৷ তার মনে পড়ে গেল, জনদাদুর সমাধির পাশে গোমেজদাদুর জন্য খুঁড়ে রাখা গর্তের জলকাদার মধ্যে ভেসে থাকা সেই মুখটার কথা৷ কয়েক মুহূর্ত কী যেন চিন্তা করল টম৷ তারপর সে আবার দোকানে ফিরে গেল৷ সে আর-একটা মোমবাতি কিনল সেখান থেকে৷ আর-একটু দড়িও চেয়ে নিল দোকানির কাছ থেকে৷ তারপর পা বাড়াল সমাধিক্ষেত্রের দিকে৷

    সমাধিক্ষেত্রে আর কোনো মানুষ নেই৷ শুধু মাঝে মাঝে ভেসে আসছে পাখির ডাক৷ টম প্রথমে গিয়ে হাজির হল দেবদাদু গাছ দুটোর কাছে৷ কিছু দূরে বুনো গোলাপের ঝাড় থেকে মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে৷ মোমবাতি-দেশলাই মাটিতে নামিয়ে রেখে একটু দূরের একটা গাছ থেকে শক্ত দুটো ছোটো ডাল ভেঙে আনল সে৷ ডাল দুটোকে আড়াআড়ি করে ক্রসের মতো বেঁধে সে পুঁতে দিল জনদাদুর পাশের সমাধির মাটির ঢিপির উপর৷ তারপর কিছু বুনো গোলাপ তুলে এনে তার পাপড়ি ছড়িয়ে দিল সমাধি দুটোর উপর৷ শেষে মোমবাতি দুটো জ্বালিয়ে একটা একটা করে বসিয়ে দিল সমাধি দুটোর সামনে৷ কাজ মিটে যাওয়ার পর সমাধি দুটোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে মাথা নীচু করে টম কয়েক মুহূর্ত শ্রদ্ধা জানাল মাটির গভীরে শুয়ে থাকা মানুষ দুটোর প্রতি৷ তারপর পা বাড়াল ফিরে যাওয়ার জন্য৷

    ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে টম এসে হাজির হল সমাধিক্ষেত্রের বাইরে যাওয়ার তোরণের সামনে৷ বাইরে পা রাখার আগে সে শেষবারের জন্য একবার ফিরে তাকাল দূরের দেবদারুগাছ দুটোর দিকে৷ বাতাসে মৃদু মৃদু দুলছে গাছ দুটো৷ তাদের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে আসা শেষ বিকেলের আলোয় গাছ দুটোর নীচে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছেন দু-জন বৃদ্ধ মানুষ৷ তাঁরা যেন হাসছেন টমের দিকে তাকিয়ে৷ টম তাঁদের দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রণাম জানাল, তারপর খুশি মনে হাঁটতে শুরু করল বাড়ির পথে৷

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসূর্যমন্দিরের শেষ প্রহরী – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
    Next Article জাদুকর সত্যচরণের জাদু কাহিনি – হিমাদ্রি কিশোর দাশগুপ্ত

    Related Articles

    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    নেকড়ে খামার – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    December 10, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র ১ – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    December 10, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র ২ – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    December 9, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    জাদুকর সত্যচরণের জাদু কাহিনি – হিমাদ্রি কিশোর দাশগুপ্ত

    December 9, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    সূর্যমন্দিরের শেষ প্রহরী – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    December 9, 2025
    হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

    অ্যাডভেঞ্চার ভয়ংকর – হিমাদ্রিকিশোর দাসগুপ্ত

    December 9, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }