Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    জলপদ্ম – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প114 Mins Read0
    ⤷

    ০১. রিকশা থেকে নামার সময়

    রিকশা থেকে নামার সময় ইলা লক্ষ্য করল তার হাত-পা কাঁপছে। বুক ধকধক করছে। হাতের তালু ঘামছে। এত ভয় লাগছে কেন তার? ভয় কাটানোর জন্যে কিছু একটা করা দরকার, কি করবে বুঝতে পারছে না। বাড়িওয়ালার ভাগ্নে হাসান একতলার গেটের কাছে দাঁড়িয়ে। ইলা তার দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাসে ভঙ্গিতে হাসল। কারো দিকে তাকিয়ে হাসলে খুসির জবাব দিতে হয়, কিন্তু হাসান কখনো তা করে না। আজও করল না। চা ফিরিয়ে নিল। এই ছেলে কখনো চোখে চোখে তাকায় না। সব সময় মাথা নিচু করে থাকে। সে যদি ইলার দিকে তাকিয়ে একটু হাসত তাহলে ইলার ভয় খানিকটা কম। অল্প জ্বলে যাওয়া হলুদ রঙ্গের ফুল হাওয়াই শার্ট পরা, ফ্যাকাসে চেহারার এই ছেলে কখনো তা করবে না।

    চার টাকা ভাড়া ঠিক করা। ইলা রিকশাওয়ালাকে পাঁচ টাকার একটা নোট দিল। একটাকা ফেরত নেবার নেয়ার অপেক্ষা করল না। এত সময় নেই। অতি দ্রুত তাকে তিনতলার ফ্ল্যাটে উঠতে হবে। তার মন বলছে–ভয়ংকর কিছু ঘটে গেছে। খুব ভয়ংকর। যদিও সে জানে কিছুই ঘটে নি। দিনে দুপুরে কি আর ঘটবে? ফ্ল্যাটে অন্তু মিয়া আছে। তাকে বলা আছে যেন সে কিছুতেই দরজা না খোলে। আগে জিজ্ঞেস করবে, কে? পরিচিত কেউ হলে বলবে–বিকালে আসবেন। বাসায় কেউ নেই।

    অন্তু মিয়ার বয়স সাত বছর। এত বুদ্ধি কি তার আছে? কলিং বেলের শব্দ হতেই সে বোধহয় দরজা খুলে দিয়েছে। গত মঙ্গলারে তাদের পেছনের বাড়ির তিনতলা 6/B ফ্ল্যাটে এ রকম হল। ভদ্ৰচেহারার দুটি ছেলে এসে কলিং বেল টিপেছে। ভদ্রমহিলা দরজার কাছে আসতেই একজন বলল, আপা, আমি মিটার চেক করতে এসেছি। ভদ্রমহিলা দরজা খুললেন ছেলে দুটি শান্তমুখে ঢুকল। চশমা পর ছেলেটি মিষ্টি গলায় বলল, আপা, চেঁচামেচি করবেন না। এক মিনিট সময় দিচ্ছি। গয়না এবং টাকা-পয়সা রুমালে বেঁধে আমাকে দিন। আমার সঙ্গে পিস্তুল আছে। বলেই সে হাসিমুখে পিস্তল বের করল। ভদ্রমহিলা একবার শুধু তাকালেন পিস্তলের দিকে, তারপরই অজ্ঞান। ভাগ্যিস, জ্ঞান হারিয়েছিলেন নয়ত টাকা পয়সা, গয়না–টয়া সব যেত। নিজেই স্টীলের আলমিরা খুলে সব বের করে দিতেন। জ্ঞান হারানোর জন্যে কিছু করতে পারলেন না। ওরাও চাবি খুঁজে না পেয়ে টেলিভিশনটা নিয়ে চলে গেল।

    সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ইলার মনে হল নিশ্চয়ই তাদের ফ্ল্যাটে এরকম কিছু হয়েছে। অন্তু মিয়াকে খুন করে জিনিসপত্র সব নিয়ে চলে গেছে। রক্তে ঘর ভেসে যাচ্ছে। অন্তুর মুখের উপর ভনভন করে উড়ছে নীল রঙের মাছি। এই মাছিগুলিকে সাধারণত দেখা যায় না, শুধু পাকা কাঁঠাল এবং মৃত মানুষের গন্ধে এর উড়ে আসে। ছিঃ এসব কি ভাবছে ইলা!

    ফ্ল্যাটের দরজার কাছে ইলা থমকে দাঁড়াল। ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। পর্দা ঝুলছে। ইলার ঢুকতে সহিস হচ্ছে না। এমনভাবে বুক কাঁপছে যে মনে হচ্ছে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়বে। সে দরজা ধরে নিজেকে সামলাল, ভয়ে ভয়ে ডাকল, অন্তু, অন্তু মিয়া। কেউ জবাব দিল না। ইলা নিঃশ্বাস বন্ধ করে পর্দা সরিয়ে ঘরে উঁকি দিল। সোফায় পা তুলে বিরক্তমুখে জামান বসে আছে। এত সকালে সে কখনো অফিস থেকে ফেরে না। রোজই ফিরতে সন্ধ্যা হয়। জামান গম্ভীর গলায় বলল, কোথায় গিয়েছিলে?

    ইলা জবাব দিল না। তার নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয় নি। এখনো বুক ধড়ফড় করছে। এটা বোধহয় এক ধরনের অসুখ। নয়তু শুধু শুধু সে এত ভয় পাবে কেন? জামান বলল, কথা বলছ না কেন? ছিলে কোথায়?

    নিউ মার্কেট গিয়েছিলাম।

    দুপুরবেল হুটহাট করে নিউ মার্কেটে যাবার দরকার কি? দুদিন আগে 6/B ফ্ল্যাটে এত বড় একটা ঘটনা ঘটল। নিউ মার্কেটে গিয়েছিলে কেন?

    উল কিনতে।

    উল দিয়ে কি হবে?

    একটা সোয়েটার বানাব।

    সোয়েটার টায়েটার আজকাল কেউ ঘরে বানায় না। শুধু শুধু সময় নষ্ট। বাজারে সস্তায় পাওয়া যায়। দেখি ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দাও।

    পানি আনতে গিয়ে ইলা লক্ষ্য করল অন্তু ভেতরের বারান্দায় রেলিংয়ের দিকে মুখ করে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর পর শরীর ফুলে ফুলে ফুলে উঠছে তাতে মনে হচ্ছে কাঁদছে। জামান কি কিছু বলেছে অন্তুকে? থাক, এখন জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। পরে জিজ্ঞেস করা যাবে।

    জামান পানির গ্লাস হাতে নিতে নিতে বলল, অন্তুকে তুমি কি বলে গিয়েছিলে? সে কিছুতেই দরজা খুলবে না। যতবারই বলি–আমি, দরজা খোল ততবারই সে বলে–কেডা? চড় লাগিয়েছি।

    ইলা বলল, আহা মারলে কেন? ছোট মানুষ।

    ছোট হলে কি হবে, ঝাড়ে বংশে বজ্জাত। খুব কম করে হলেও আধ ঘণ্টা দরজা ধাক্কিয়েছি। সে বুঝতে পারছে আমি, তারপরেও দরজা খুলবে না। দেখি পরিষ্কার একটা রুমাল দাও তো। বেরুব।

    কোথায় যাবে?

    জয়দেবপুর। ফিরতে দেরি হবে। রাত বারটা—একটা বেজে যাবে। বাড়িওয়ালাকে বলবে দয়া করে যেন গেটটা খোলা রাখে। ব্যাটিা উজবুক, দশটা বাজতেই গেট বন্ধ করে দেয়। এটা যেন মেয়েদের হোস্টেল।

    ইলা ক্ষীণ গলায় বলল, আমি কি মার বাসা থেকে একবার ঘুরে আসব? শুনেছি ভাইয়ার জ্বর। ভাইয়াকে দেখে আসতাম।

    সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় ফিরে আসতে পারলে যাও। এত রাতে একা ফেরার প্রশ্নই উঠে না। শহরের অবস্থা যা মেয়েদের তো ঘর থেকে বের হওয়াই উচিত না।

    একা ফিরব না। ভাইয়া পৌঁছে দেশে।

    একটু আগে না বললে ভাইয়ার জ্বর, রোগী দেখতে যাচ্ছি। যাকে দেখার জন্যে যাচ্ছ সে-ই তোমাকে পৌঁছে দেবে এটা কেমন কথা। যা বলরে লজিক ঠিক রেখে বলবে।

    জামান উঠে দাঁড়াল। বিরক্তমুখে বলল, অপুর ঠোঁট বোধহয় কেটে গেছে। ঘরে ডেটল আছে। ডেটল লাগিয়ে দিও আমি চললাম। দরজা ভাল করে বন্ধ কর।

    অন্তুর ঠোঁট ভয়াবহভাবে কেটেছে। দুভাগ হয়ে গেছে। রক্তে তার শার্ট ভিজেছে। যেখানে বসে আছে সেই মেঝে ভিজেছে। রক্ত এখনো বন্ধ হয় নি। চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। সমস্ত মুখ ফুলে চোখ দুটা ছোট ছোট হয়ে গেছে। অন্তুকে ভয়ংকর দেখাচ্ছে। ইলা হতভম্ব হয়ে গেল।

    ঠোঁট কাটল কিভাবে? পড়ে গিয়েছিলি?

    হুঁ।

    কিভাবে ঠোঁট কাটল?

    অন্তু জবাব দিল না। এতক্ষণ সে কাঁদে নি। এইবার কাঁদতে শুরু করেছে। এ বাড়ির পুরুষ মানুষটাকে সে যমের মত ভয় পায়। তার সম্পর্কে নালিশ করতে ভয় লাগে বলে সে নালিশও করছে না। নয়ত বলত, চড় খেয়ে মেঝেতে পড়ে গিয়ে ঠোঁট কেটে গেছে।

    ব্যথা করছে অল্প?

    হুঁ।

    খুব বেশি?

    হুঁ।

    চুপ করে বসে থাক। তোকে এক্ষুণি ডাক্তারের কাছে পাঠাব। এই কাপড়টা ঠোঁটের উপর চেপে ধরে রাখ তো। রক্ত বন্ধ হোক। আমি বাড়িওয়ালার ভাগ্নেটাকে ডেকে নিয়ে আসি।

    চিন্তিত মুখে ইলা বসার ঘরে ঢুকল। সে ভেবে পাচ্ছে না, দরজা খোলা রেখে সে নিজেই একতলায় যাবে, না অন্তুকে পাঠাবে। অন্তুর যে অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে না সে একা একা নিচে যেতে পারবে। কিন্তু দরজা খোলা রেখে সে-ই বা যাবে কিভাবে? অন্তু এখন কাঁদছে শব্দ করে। ইলার মনটাই খারাপ হয়ে গেলি। আট নবছরের বাচ্চা একটা ছেলে। এরকম ব্যথা পেলে তার মা তাকে কোলে নিয়ে হাঁটত।

    অন্তু মিয়া।

    হুঁ।

    দরজা বন্ধ করে বসে থাক, আমি নিচ থেকে আসি। যাব আর আসব। মুখ থেকে কাপড়টা সরা তো–দেখি রক্ত বন্ধ হয়েছে কি না।

    রক্ত বন্ধ হয় নি। ক্ষীণ ধারায় এখনো পড়ছে। অন্তু মাঝে মাঝে জিভ বের করে রক্ত চেটে চেটে দেখছে। ইলা বলল, রক্ত চেটে খাচ্ছিস কেনরে গাধা? রক্ত কি খাবার জিনিস? ইলা চিন্তিত মুখে নিচে গেল। হাসানকে পাওয়া গেল না। বাড়িওয়ালার স্ত্রী সুলতানা বললেন, গাধাটাকে এক কেজি চিনি আনতে বলেছিলাম। চল্লিশ মিনিট হয়ে গেছে, ফেরার নাম নেই। কখন হুজুরের ফিরতে মর্জি হবে কে জানে? আসুক, আসলে পাঠায়ে দিব।

    ইলা বলল, খালা, গেটটা আজ একটু খোলা রাখতে হবে। ও জয়দেবপুর গেছে, ফিরতে রাত হবে।

    হাসানকে বলে দিও। গেটের চাবি তার কাছে থাকে। আর তোমাকেও একটা কথা বলি, দিনকাল খারাপ–তোমার বয়স অল্প। একা একা থাক–এটা ঠিক না। কখন কি ঘটে যায়। পিছনের বাড়ির টেলিভিশন নিয়ে গেছে বলে যা শুনেছ সব ভুয়া। রেপ কেইস। তিনটা ছেলে ঢুকেছে। ঢুকেছে ১২ টার সময়, গেছে তিনটায়। কতক্ষণ হল? তিন ঘণ্টা। একেক জনের ভাগে এক ঘণ্টা। বুঝতে পারলে? সুলতানা চোখ ছোট করে রহস্যময় ইংগিত করলেন। ইলা চমকে উঠল–এমন কুশ্রী ইংগিত এমনভাবে কেউ করে?

    খালা, আমি যাই।

    আহা দাঁড়াও না। বিস্তারিত শুনে যাও। এরা আসল ঘটনা চাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। চাপা দিলেই কি চাপা দেয়া যায়। বলে কি টেলিভিশন নিয়ে গেছে। টেলিভিশন নিয়ে গেলে বাড়িতে ডাক্তার আনা লাগে? ঐ বাড়িতে দুনিয়ার আত্মীয়স্বজন এসে উপস্থিত হয়েছে। মরাকান্না। ব্ল্যাক এণ্ড হোয়াইট টেলিভিশন এমন কি জিনিস যে গুষ্টিসুন্ধা মরাকান্না কাঁদবে। তুমি আমাকে বল।

    খালা, অন্তু একা আছে। আমি যাই।

    যাই যাই করছ কেন? ঘটনা শুনে যাও–মেয়েটার হাসবেন্ডকে দেখলাম দুজনে ধরাধরি করে বেবিটেক্সিতে তুলল। একটা টেলিভিশন নিয়ে গেলে এই অবস্থা হয়। তুমিই বল। আমি কি ভুল বললাম?

    জ্বি-না।

    তোমার বয়স কম। নতুন বিয়ে। খুব সাবধানে থাকবে। পারতপক্ষে বারান্দায় যাবে না। তোমার আবার বিশ্রী স্বত্ব বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করা। এইসব রেপিস্টদের নতুন বিয়ে হওয়া মেয়েগুলির দিকে নজর থাকে বেশি–সাবধান। খুব সাবধান–। চা খাবে?

    জ্বি-না।

    খাও না।

    আরেকদিন এসে খেয়ে যাব।

    আসবে–নিজের বাড়ি মনে করে আসবে। বাড়িওয়ালা-ভাড়াটে সম্পর্ক আমার না। আমার বাড়িতে যে এসে উঠবে–সে আমার আপনা মানুষ। তার ভাল আমার ভালমন্দ। মাসের শেষে টাকা নিয়ে দায়িত্ব শেষ–এই জিনিস আমাকে দিয়ে হবে না। সবাইকে দিয়ে সব জিনিস হয় না।

    সুলতানা হাঁপাতে লাগলেন। শরীরে অতিরিক্ত মেদ জমে যাওয়ায় একনাগাড়ে বেশিক্ষণ কথা বলতে কষ্ট হয়। কষ্ট হলেও তিনি কথা বলেন। ধর্ষণ জাতীয় খবরে তিনি বড় মজ্জা পান। এইসব খবর আগে শুধু কাগজে পড়তেন। এখন বাড়ির কাছে ঘটে যাওয়ায় বড় ভাল লাগছে।

    ইলা আবার বলল, আসি খালা। বলে আর দাঁড়াল না। তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এল। সুলতানা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। ইলা মেয়েটা অতিরিক্ত রকমের সুন্দর। তাঁর বড় ছেলের জন্যে তিনি অনেকদিন ধরে একটা সুন্দর মেয়ে খুঁজছেন। পাচ্ছেন না। সুন্দর মেয়েগুলি গেল কোথায়? যে কটাকে পাওয়া যায় সব কটার বিয়ে হওয়া। মায়ের পেট ঘেঁকে পড়েই এরা বিয়ে করে ফেলে না-কি? কোন মানে হয়?

     

    আশ্চর্য, অন্তুর ঠোঁট থেকে এখনো রক্ত পড়ছে।

    অন্তু, বেশি ব্যথা করছে?

    হুঁ।

    হাসান এসেই তোকে নিয়ে যাবে। এক্ষুণি আসবে, খবর দিয়ে এসেছি। শুয়ে থাকবি খানিকক্ষণ? বিছানা করে দেই?

    অন্তু ঘাড় কাত করল। এবং কেন জানি প্রবল কষ্টের মধ্যেও হাসার চেষ্টা করল। অন্তুর বিছানা বলতে ভাঁজ করা একটা মাদুর। একটা বালিশ পর্যন্তু ছেলেটার নেই। ইলা জামানকে একবার বলেছিল, একটা বালিশ নিয়ে এসো। বেচারা বালিশ ছাড়া ঘুমায়। জামান গম্ভীর গলায় বলেছে–এদের বালিশ দরকার হয় না। খামোকা বড়লোকি শেখাতে হবে না। ইলা ঠিক করে রেখে এবার মার বাসায় গেলে একটা বালিশ আর একটা কাঁথা নিয়ে আসবে।

    মাদুর বিছাতে গিয়ে ইলা দেখল, মেঝেতে কার্পেটের উপর জামানের মানিব্যাগ। পেটমোটা কালো রঙের মানিব্যাগ। যখন চেয়ারে বসেছিল ভুখন নিশ্চয়ই পকেট থেকে পড়ে গেছে। মানিব্যাগ পকেট থেকে পরে যাবে, জামান টের পাবে না, এরকম হবার কথা না। টাকা-পয়সার ব্যাপারে সে খুব সাবধানী। মানিব্যাগে বেশ কিন্তু পাঁচ শ টাকার নোট রাবার বেল্ড দিয়ে বাঁধা। কতগুলি নোট? গুনে দেখতে ইচ্ছে করছে।

    জামান নিশ্চয়ই খুব দুশ্চিন্তা করছে। এতগুলি টাকা। দুশ্চিন্তা করারই কথা। সে কি বুঝতে পেরেছে মানিব্যাগ হারিয়েছে? নিশ্চয়ই খুব ঝামেলা হয়েছে। রিকশা থেকে নেমে রিকশা ভাড়া দিতে গিয়ে হঠাৎ দেখল মানিব্যাগ নেই। এইসব ক্ষেত্রে রিকশাওয়ালারা বিশ্বাস করতে চায় না যে মানিব্যাগ হারিয়েছে। তারা খুব যন্ত্রণা করে। ইলা, নিজে একবার এ রকম যন্ত্রণার মধ্যে পড়েছিল। যাত্রাবাড়ি থেকে বার টাকা রিকশা ভাড়া ঠিক করে সে আর রুবা এসেছে বায়তুল মুকাররমে। কিছু কেনার নেই–এম্নি ঘুরার জন্যে আসা। রিকশা থেকে নেমে ব্যাগ খুলে দেখে পুরানো ছেঁড়াখোঁড়া একটা এক টাকার নোট ছাড়া কোন টাকা নেই। কি বিশ্রী কাণ্ড! রিকশাওয়ালার সরল সরল মুখ, কিন্তু সে এমন হৈচৈ শুরু করল যে তাদের চারদিকে লোক জমে গেল। লোকগুলি ভাবল, ইচ্ছা করেই ইলা রিকশাওয়ালাকে টাকা দিচ্ছে না। রুবা অসন্তু ভীতু। সে ইলার বাঁ হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল–এখন কি হবে আপা? এখন কি হবে? ইলা রিকশাওয়ালাকে বলল, আপনি আমাদের সঙ্গে যাত্রাবাড়ি চলুন। আপনাকে চব্বিশ টাকা দেয়। রিকশাওয়ালা থু করে থুথু ফেলে বলল, যাত্রাবাড়ি যামু ক্যান? আমার কি ঠেকা?

    আপনার কোন ঠেকা না, আমাদের ঠেকা। প্লীজ চলুন।

    ইলার আবেদনে কোন লাভ হল না বরং রিকশাওয়ালাটা আরো প্রশ্রয় পেয়ে গেল। সে আরো কিছু রিকশাওয়ালা জুটিয়ে ফেলল এবং সরল সরল মুগ্ধ করে মিথ্যা কথা বলা শুরু করল–এই মাইয়া দুইটা আমারে ভাড়া দেয় না। আবার উল্টা গালি দিতাছে। আমারে বলে তুই ছোটলোকের বাচ্চা।

    রুবা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আপা ব্যাগে তোমার যে কলমটা আছে ঐ কলমটা ওকে দিয়ে দাও। কলম নিয়ে চলে যাক।

    কলম দিয়া আমি করমু কি? কলম ধুইয়া খামু? কলম খাইলে ফেড ভরব?

    আর ঠিক তখন মাঝবয়েসী এক ভদ্রলোক এসে গম্ভীর গলায় বললেন–কত হয়েছে ভাড়া?

    রুবা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, বার টাকা।

    ভদ্রলোক একটা বিশ টাকার নোট বাড়িয়ে বললেন, এটা রাখ। সঙ্গে কলম আছে? আমার ঠিকানা লিখে রাখ। এক সময় ফেরত দিয়ে যেও।

    তাদের চারপাশের ভিড় তুলুও কমে না। যেন নাটকের শেষ দৃশ্যটি এখনো বাকি আছে। এর শেষটা না দেখে যাবে না। ইলা ঠিকানা লিখছে–ভদ্রলোক বলছেন–লেখ বি. করিম। এগার বাই এফ, কলাবাজার। দোতলা।

    ভিড়ের মধ্যে একজন বলল, টাকা ফেরত দিতে হবে না। টাকার বদলে অন্য কিছু দিলে আরো ভাল হয়।

    একসঙ্গে সবাই হেসে উঠল। রুবার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। একজন সঙ্গে সঙ্গে বলল, আবার দেহি কান্দে।

    আবারো সবাই হেসে উঠল। সময় সময় কোন কারণ ছাড়াই মানুষ খুব নির্মম হয়। মধ্যবয়স্ক ঐ ভদ্রলোক চলে গেলেন না। ভিড় থেকে তাদের বের করে আনলেন। রুবার দিকে তাকিয়ে বললেন–নাম কি?

    রুবা। দিলরুবা খানম।

    শোন দিলরুবা খানম–কাঁদছ কেন? কাঁদার মত ঘটনা কি ঘটল? টাকাপয়সা সঙ্গে না নিয়ে বাড়ি থেকে বের হও কেন? যাও, বাড়ি যাও।

    ভদ্রলেঞ্চ লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেলেন। একবার পেছনে ফিরে তাকালেনও না। মোটা মোটা ভারিক্কি ধরনের এই মানুষটাকে ধন্যবাদ পর্যন্ত দেয়া হল না।

     

    হাসান নিঃশব্দে এসে পর্দার ওপাশে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে নিজের পায়ের নখের দিকে। গভীর মনোযোগে নখের শোভা দেখছে হয়ত। ইলা নিজ থেকে কিছু না বললে সে চুপ করেই থাকবে। কিছুই বলবে না। অদ্ভুত ছেলে!

    হাসান, তুমি অন্তুকে একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে? দেখ না ওর ঠোঁটের অবস্থা।

    হাসান এক পলকের জন্যে তাকাল। তার কোন ভাবান্তুর হল না। তবে কথা বলল। মেঝের দিকে তাকিয়েই বলল, ভাবী, মনে হচ্ছে সেলাই লাগবে। আর এটি এস দিবে। কিছু হলেই ওরা এটিএস দেয়।

    দাঁড়াও, তোমাকে টাকা দিয়ে দি। কত লাগবে বল তো?

    বুঝতে পারছি না ভাবী, গোটা ত্রিশেক দিন।

    আশ্চর্যের ব্যাপার, ভাংতি টকি ধরে নেই। কি করা যায়! ভাংতি কেন, কোন টাকাই নেই। জামানের মানিব্যাগ থেকে একটা পাঁচশ টাকার নোট কি দিয়ে দেবে? জামান জানতে পারলে খুব রাগ করবে। আর জানতে যে পারবে তাও নিশ্চিত। টাকা না শুনেই সে বলে দিতে পারবে–পাঁচশ টাকার একটা নোট কম।

    ইলা অস্বস্তির সঙ্গে বলল, একটা পাঁচশ টাকার নোট দেব?

    দিন। আমি ভাঙিয়ে নেব।

    তুমি মাটির দিকে তাকিয়ে কী বলছ কেন হাসান?

    হাসান জবাব দিল না। চোখ তুলে তাকালও না। ইলা তাকে পাঁচশ টাকার একটা নোট দিল। অন্তু ছোট ছোট পা ফেলে যাচ্ছে। অন্তুর পা দুটি শরীরের তুলনায় ছোট। কেমন হেলেদুলে হাঁটে, মনে হয় পড়ে যাবে।

    পাঁচশ টাকার নোট মোট কতগুলি আছে? ইলার গুনে দেখতে ইচ্ছা করছে। টাকা দেখলেই সব মানুষেরই বোধহয় গুনতে ইচ্ছা করে। ইলার যা ভাগ্য, গুনার সময়ই হয়ত জামান এসে উপস্থিত হবে। থাক, গোনার দরকার নেই। আন্দাজে মনে হচ্ছে একশটার মত হবে। তার মানে পঞ্চাশ হাজার টাকা। কি সর্বনাশ! গা ঝিম ঝিম করে। এতগুলি টাকা একটা মানুষ পকেটে নিয়ে ঘুরে? যদি সত্যি সত্যি হারিয়ে যেত। ইলা টাকা গুনতে বসল। একশ বারটা পাঁচশ টাকার নোট। তার মানে ছাপান্ন হাজার। কি সর্বনাশ!

    ইলা দরজা বন্ধ করে আলনার দিকে গেল। ঘরে পরার একটা শাড়ি নেবে। বাথরুমে গিয়ে গা ধুবে। প্রচণ্ড গরম লাগছে। গা কুটকুট করছে। বাথরুমে গিয়ে হয়ত দেখা যাবে পানি নেই। বিকেলের দিকে এ বাড়িতে পানি থাকে না। জামানকে একটা বড় বালতি কিনতে বলেছিল। জামান বিরক্ত হয়ে বলেছে–খামোকা একটা বড় বালতি কেনার দরকার কি? দুজন মাত্র মানুষ–বালতি-ফালতি কিনে বাড়ি ভর্তি করার জাস্টিফিকেশন নেই। শুধু ঝামেলা। কি কিনতে হবে, কি কিনতে হবে না-–তা আমাকে বলার দরকার নেই। আমার চোখ-কান খোলা, আমি জানি কি দরকার–কি দরকার নী। শখন যা দরকার হবে, আমি ঠিকই কিনব।

    কি অদ্ভুত মানুষ! টাকা আছে, অর্থ খরচ করবে না। বিয়ের প্রথম এক মাস ইলা কিছু বুঝতে পারে নি। সে ভেবেছিল, মানুষটার আর্থিক অবস্থা বোধহয় তাদের মতই। টাকা-পয়সা নেই। যদিও থাকছে সুন্দর একটা ফ্ল্যাটে। বসার ঘরে কাপেট আছে, সোফা আছে, টিভি, ফ্রী আছে। তবে হাতে হয় নগদ টাকা নেই। বিয়ে উপলক্ষে জিনিসপত্র কিনেই সব শেষ করে ফেলেছে। লোকটার উপর খুব মায়া হয়েছিল। মায়া হয়েছিল বলেই বিয়ের তিন দিনের দিন সে বলেছিল–আমার কাছে সাতশ টাকা আছে। তোমার যদি দরকার হয় তুমি নিতে পার।

    কোথায় পেলে সাতশ টাকা।

    ভাইয়া আমাকে এক হাজার টাকা দিয়েছিল। বিয়েতে কিছু দিতে পারে নি এই জন্যে এক হাজার টাকা দিল। আমি নিতে চাই নি …।

    এক হাজার থেকে সাতশ আছে, বাকি তিনশ কি করলে?

    ইলা বিস্মিত হয়ে বলল, খরচ করেছি।

    গরীব ঘরের মেয়ে। খরচের এই হাত তো ভুলি না। দেখি, এই সাতশ টাকা। আমাকে দিয়ে দাও। কোন কিছুর প্রয়োজন হলে বলবে। একটা কথা মন দিয়ে শোন–ইলা এই জীবনে অনেক কিছুই কিনতে ইচ্ছা করবে। কিনতে ইচ্ছা করলেই কিনতে নেই। টাকা-পয়সা অনেকেরই থাকে–খুব কম মানুষই থাকে যারা টাকা জমাতে পারে। হাতের ফাঁক দিয়ে টাকা বের হয়ে যায়। বুঝতে পারে না। বুঝতে পারছ?

    ইলা শুকনো গলায় বলল, পারছি। তার মনটা বেশ খারাপ হল। মানুষটা তাহলে কৃপণ। বেশ ভাল কৃপণ। ইলা লক্ষ্য করল মানুষটা শুধু কৃপণ না, মন ছোট। কৃপণ মানুষের মন এম্নিতেই ছোট থাকে–তুবে তারা গোপন রাখতে চেষ্টা করে। এই লোকটা তা করে না। বরং চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

    বিয়ের পরপর রুবা এসেছে, বড় বোনের সঙ্গে কয়েকদিন থাকবে। জামান হাসিমুখে গল্পটল্প করছে, তবু এক ধরনের গম্ভীর গভীর ভাব। সারাক্ষণ ভুরু কুঁচকানো। মিলি এমন কমছে কেন ইলা কিছুতেই অতে পারে না। তৃতীয় দিনের দিন রাতে ঘুমুতে যাবার সময় জামান হাই তুলতে তুলতে বুলল, রুবা কদিন থাকবে?

    ইলা হাসিমুখে বলল, এস. এস. সি, পরীক্ষা হয়ে গেছে। এখন তো ছুটি। চলে যেতে চেয়েছিল, আমি জোর করে রেখে দিয়েছি।

    জামান গম্ভীর গলায় বলল, জোর করে রাখার দরকার কি? জোর জবরদস্তি ভাল না। হয়ত এখানে থাকতে ভাল লাগছে না।

    ভাল লাগছে না কে বলল। ভাল লাগছে–দেখ না ক হাসিখুশি।

    সারাক্ষণ দেখি টিভির নব টেপাটেপি করছে। এইসব সেনসিটিভ ইনস্টমেন্ট। হুট করে নষ্ট করে দেবে।

    ইলা হতভম্ব হয়ে গেল। কি বলছে এই মানুষটা? জামান সহজ স্বাভাবিক ভুলিতে স্বলল, ঐ দিন দেখি ফ্রীজের দরজা ধড়াম করে বন্ধ করল। ট্রাকের দরজাও এমন করে কেউ বন্ধ করে না। ফ্রীজের দরজা নিয়ে কুস্তি করার দরকার কি?

    ইলা বলল, আচ্ছা, কাল সকালে ওকে যাত্রাবাড়িতে রেখে এস।

    সকালে পারব না, কাজ আছে। দেখি বিকেলে না হয় রেখে আসব।

    না সকালেই রেখে আস।

    রাগ কর না-কি? ফালতু ব্যাপার নিয়ে আমার সঙ্গে রাগারাগি করবে না। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে বেশি মাখামাখি কচলাকচলি আমার পছন্দ না। তারা থাকবে তাদের মত। আমরা থাকব আমাদের মত। বুঝতে পারছ?

    পারছি।

    বিয়ের পর সুখী হবার একমাত্র উপায় হচ্ছে বাপের বাড়ি দ্রুত ভূলে যাওয়া। ভুলে যাবার চেষ্টা কর।

    চেষ্টা করব।

    জামান সত্যি সত্যি সকালে রুবাকে নিয়ে যেতে চাইবে, ইলা ভাবে নি। অমনি তাই কয়ল। ইলার চেয়ে অবাক হল রুবা। রুবা বলল, দুলাভাই, আমার তো আরো তিনদিন থাকার কথা। আমি যাব কেন?

    থাকতে চাইলে তিনদিন খাক, অসুবিধা কি! তোমার আপা বলে রেখে আসতে।

    রুবা গেল ইলার কাছে। বিস্মিত হয়ে বলল, দুলাভাই আমাকে যাত্রাবাড়িতে রেখে আসতে চাচ্ছে–ব্যাপার কি?

    ব্যাপার কিছু না।

    তোমাদের মধ্যে ঝগড়া-টগড়া হয়েছে?

    না।

    এমন গম্ভীর মুখে না বলছ কেন? আচ্ছা শোন, মা যদি শুনে তোমাদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে–মা খুব মন খারাপ করবে।

    আমাদের মধ্যে কোন ঝগড়া হয় নি। আমার প্রচণ্ড মাথাধরা। এই জন্যেই বোধহয় গম্ভীর হয়ে আছি। তোর থাকতে ইচ্ছা হলে থাক।

    না আপা, এখন যাই। দুলাভাই বলছিলেন তিনি ভিসিআর কিনবেন। কেনা হোক, তখন এসে অনেকদিন থাকব। রোঞ্জ পাঁচটা করে ছবি দেখব। তোমরা টেলিফান করে নিবে আপা? এত সুন্দর বাড়ি–টেলিফোন ছাড়া মানায় না।

    টেলিফোনের অনন্য অ্যাপ্লিাই করেছে। এসে যাবে শিগগির।

    দুলাভাইয়ের কি অনেক টাকা আপা?

    জানি না।

    ইলা আসলেই জানে না। মানুষটা সম্পর্কে জানে না। তবু তরি সঙ্গে সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জীবন যাপন করে।

     

    অন্তুর পেছনে মাত্র উনিশ টাকা খরচ হয়েছে। হাসান বাসে করে তাকে মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেছে। ডাক্তার দুটি স্টিট দিয়েছেন। এসিএস এবং কমবায়োটিক ইনজেকশন শুধু কিনতে হয়েছে। হসান পাঁচশ টাকার নোটটা ভাঙায়নি। ফেরত এনেছে। ইলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মানিব্যাগে রেখে দিলেই হবে। জামান কিছুই জানতে পারবে না।

    তোমাকে আমি সকালে টাকাটা দিয়ে দেব।

    জ্বি আচ্ছা।

    বস একটু, টা খাও।

    আমি চা খাই না।

    চা না খেলে শরবত খাও। আমি লেবু দিয়ে শরবত বানিয়ে দি। ভাল লাগবে।

    কিছু লাগবে না ভাবী।

    তুমি বস তো দেখি।

    হাসান জড়সড় হয়ে সোফায় চেয়ারে বসল। এখনো মুখ তুলে তাকানা। কার্পেটের ডিজাইন দেখছে। পুরুষ মানুষ এমন হয় কখনো? কি বিশ্রী মেয়েলী স্বভাব!

    কি পড় তুমি?

    বি, এ পড়ি। এ বহুর পরীক্ষা দেব।

    তাই নাকি? কখন পড়? আমি তো সব সময় তোমাকে বারান্দায় বসে খুঁকিতে দেখি।

    নাইট সেকশনে পড়ি। জন্নাথ কলেজে। ও আচ্ছা।

    ডে সেকশনে ভর্তি হতাম। চান্স পেয়েছিলাম। চাচা নিষেধ করলেন। চাচা বললেন–দিনে অনেক কাজকর্ম আচ্ছে। তাই…

    চাচা কে? আমাদের বাড়িওয়ালা?

    জ্বি। আমি শুনেছিলাম তিনি তোমার মামা।

    জ্বি-না, চাচা। বাবার ফুপাতো ভাই।

    দিনের বেলায় কি কাজ কর?

    বাজার করি। তারপর প্রেসে যাই। চাচার একটা প্রেম আছে মগবাজারে। কম্পোজ সেকশন।

    ও, তাই নাকি?

    জ্বি।

    তুমি আমার অনেক উপকার করলে ভাই, নাও, শরবত খাও। ঘরে আর কিছু নেই।

    হাসান এক নিঃশ্বাসে শরবতের গ্লাস শেষ করেই উঠে পড়ল। ইলার মনে হল শরবতের বদলে চা দিলে গরম চ-ও হয়ত সে এভাবে এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ফেলত।

    ভাবী যাই?

    তুমি আরেকদিন এসে আমাদের সঙ্গে চারটা ডাল-ভাত খাবে। আর শোন, তুমি আমাকে এত লজ্জা পাচ্ছি কেন? মুগ্ধ তুলে তাকাও। রাস্তায় কখনো দেখা হলে আমি তোমাকে চিনতে পারব না। এখনো আমি ভালমত তোমার মুখ দেখি নি।

    হাসান মুখ তুলে তাকাল। এই প্রথম সে হাসল। লাজুক ধরনের সুন্দর একটা ছেলে। কচি মুখ। সে আবার বলল, ভাবী যাই?

    আচ্ছা যাও।

    আর শোন, তুমি আমাকে ভাবী ডাকবে না। আপা ডাকবে। ভাবী ডাকটা শুনতে ভাল লাগে না।

    জ্বি আচ্ছা।

    আজ রাতে গেটটা একটু খোলা রাখতে হবে। এর ফিরতে দেরি হয়ে। এগারটা যারটা বেজে যাবে।

    জ্বি আচ্ছা।

     

    অন্তুর জ্বর এসেছে। বেশ ভাল জ্বর। রাতে সে কিছুই খেল না। ইলা বসার ঘরে মাদুর পেতে অন্তুকে শুইয়ে দিল। বেচারা মরার মত শুয়ে আছে। গালে মশা বসেছে, সেই মশা তাড়াবারও চেষ্টা করছে না। ছেলেটার জন্যে একটা মশারি কিনতে হবে। জামানকে বলে দেখলে হয়। রাজি হতেও তো পারে। মশারি কোন অপ্রয়ােজনীয় জিনিস নয়। প্রয়োজনের জিনিস।

    ইলা অন্তুর হাতে একটা পাঁচ টাকার নোট দিল। সে টাকা পেয়ে খুব খুশি। হাসার চেষ্টা করছে। ইলা বলল, খবর্দার, হাসবি না। হাসলে ঠোঁটে টান পড়বে। ব্যথা পাবি।

    অন্তু ব্যথা পাচ্ছে। তবু হাসছে। এরা কন্তু অল্পতে খুশি! ঠোঁটের ব্যথার কথা এখন আর তার মনে নেই। মনে থাকলেও ব্যথা অগ্রাহ্য করে সে ঘুমুবে। ভোরবেলা ওঠে কাজকর্ম করবে। টাকাটা লুকানো থাকবে গোপন কোন জায়গায়। বারবার কাজ ফেলে দেখে অসবে নোটটা ঠিকমত আছে কি না।

    অন্তু। দুধ খাবি? এক কাপ দুধ এনে দেই?

    দুধ গন্ধ করে।

    থাক তুহিলে। গন্ধ করলে খেতে হবে না। ঘুমিয়ে পড়।

    বাধ্য ছেলের মত অন্তু চোখ বন্ধ করল। ঘুমিয়ে পড়ল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে।

    ছেলেটার বাবা-মা কোথায় আছে ইলা জানে না। অন্তু নিজেও জানে না। জানলে খবর দিত।

    জামান রাত এগারটায় ফিরল। কোন কথা না বলে গম্ভীর মুখে তোয়ালে হাতে বাথরুমে ঢুকল। সেখান থেকেই চেঁচিয়ে বলল, খেয়ে এসেছি। এক কাপ চা করে দাও।

    আশ্চর্যের ব্যাপার! হারানো মানিব্যাগের কথা সে কিছুই বলছে না। ইলা ভেবেছিল ঘরে ঢুকে সে জিজ্ঞেস করবে, মানিব্যাগ পেয়েছ? এতলি টাকা মানিব্যাগে। জিজ্ঞেস করাই তো স্বাভাবিক। যে কোন মানুষ করবে। জামানের মত সাবধানী মানুষ আরো বেশি করবে। জিজ্ঞেস করছে না কেন?

    খালি গায়ে বারান্দায় বসে ড্রামান চা খাচ্ছে। বারান্দায় বাতি নেভানো। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। তবু সে যে খুব চিন্তিত, এটা বোঝা যাচ্ছে। কেমন কুঁজো হয়ে বসেছে। একটু পরপর শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলছে। ইলা ঠিক করল, রাতে শোবার সময় সে বলবে মানিব্যাগ ঘরে পাওয়া গেছে। তুমি ফেলে গিয়েছিলে। এত চিন্তা করার কিছু নেই।

    ইলা চায়ের কাপ জামানের দিকে বাড়িয়ে ধরল। জামান শান্ত গলায় বলল, বিরাট একটা লোকসান হয়েছে।

    কি লোকসান?

    পকেট মার হয়েছে।

    বল কি?

    হারামজাদা মানিব্যাগ নিয়ে গেছে।

    সত্যি নিয়েছে?

    এটা আবার কি রকম কথা? সত্যি না তো কি? আমি তোমার সঙ্গে ঠাট্টা-ফাজলেমি করছি?

    ইলা কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। জামান চায়ের কাপ নামিয়ে উঠে দাঁড়াল। নিজের মনেই বলল, কোত্থেকে নিয়েছে তাও জানি। কলাবাগানে রিক্সা থেকে নামলাম। ঠিক তখন একটা লোক ঘাড়ে পড়ে গেল। মানিব্যাগ যে তখনি পাচার হয়ে গেছে আমি বুঝতে পারি নি। রিকশা ভাড়া দিতে গিয়ে বুঝলাম। এর মধ্যে হারামজাদা হাওয়া।

    মানিব্যাগ পকেটে ছিল?

    মানিব্যাগ পকেটে থাকবে না তো কোথায় থাকবে? অনাবশ্যক কথা বল কেন? কি বিশ্রী অভ্যাস।

    কত টাকা ছিল?

    ছিল কিছু। ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দাও, আর পানি দাও। দেশটা চোরে ভর্তি হয়ে গেছে।

    জামান ঘুমুতে এল খবরের কাগজ হাতে। বিছানায় বসে মানুষটা ভুরু কুঁচকে কাগজ পড়ছে। ইলা বুঝতে পারছে জামান আসলে কাগজ পড়ছে না। নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছে। ইলা শুয়ে আছে। তাকিয়ে আছে জামানের দিকে। বড় মায়া লাগছে।

    ইলার ঠিক মাথার নিচেই প্রায় একশ বারটা পঁচিশ টাকার নোট বোঝাই মানিব্যাগ। না একশ বার না, তের। হাসানের ফেরত দেয়া নোটটাও সে রেখে দিয়েছে। সে এক সময় ক্ষীণ স্বরে বলল, এই, একটা কথা শোন।

    জামান বিরক্ত স্বরে বলল, এখন ঘুমাও তো। কোন কথা শুনতে পারব না। কখাবার্তা যা সকালে বলব। দুপুর রাতের জন্যে জমা করে রাখবে না।

    ঘুমুবে না?

    কেন যন্ত্রণা করছ? তোমার ঘুম তুমি ঘুমাও।

    টাকা হারানোয় খুব খারাপ লাগছে?

    না, খারাপ লাগছে না। খুব আনন্দ পাচ্ছি।

    জামান খবরের কাগজ ভাঁজ করে মেঝেতে খুঁড়ে ফেলল। এটি তার স্বজ্জাবের বাইরে। সে খুব গোছালো। এমন কাজ কখনো করবে না। ইলা বলি, বাতি নিভিয়ে দেব?

    দাও।

    ইলা বাতি নিভিয়ে দিল। অন্তু মিয়া কুঁ-কুঁ শব্দ করছে, জ্বর বোধহয় আরো বেড়েছে। জ্বর বাড়লে কি করতে হবে ডাক্তার কি তা বলেছে? ঘরে একটা থার্মোমিটার নেই। তাদের যাত্রাবাড়ির বাসায় থার্মোমিটার আছে। রুবার দখলে থাকে। রুবার একটা কাঠের বাক্স আছে। সেই বাক্সে শুধু যে থার্মোমিটার আছে তাই মা–ডেটল আছে, তুলা আছে, বার্নল আছে। বাক্সের গায়ে বড় বড় করে লেখা–আরোগ্য নিকেতন।

    ইলা ক্ষীণ গলায় বলল, ঘুমুচ্ছ?

    জামান জবাব দিল না। তবে সে যে এম্বনে ঘুমায় নি তা বোঝা যাচ্ছে।

    ইলা আর কিছু বলল না। আর ঘুম আসছে। প্রায়ই তার এরকম হয়। জ্বের্গে ক্লেগে রাত পার করে দেয়। নানান কথা ভাবে। রাত জেগে ভাবতে তার বড় ভাল লাশে।

    জামান বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। ইলা খুব সাবধানে বিছানা থেকে নামল। ফ্যানের নিচেও খুব গরম লাগছে। বারান্দায় এসে সে কিছুক্ষণ বসবে। এটও নতুন কিছু নয়। প্রায়ই বসে। অন্ধকারে একা একা বসে থাকার মধ্যে এক ধরনের আনন্দ আছে।

    ইলা বারান্দায় চেয়ারে বসতে বসতে ভাবল, মানিব্যাগটা ফিরিয়ে না দিলে কেমন হয়? সে নিজে বুঝতে পারছে, এটা খুবই অন্যায় চিন্তা। কিন্তু কিছুতেই মাথা থেকে দূর করতে পারছে না। এক বান্ডিল পাঁচশ টাকার নোট। এত টাকা এক সঙ্গে সে নিজে কখনো দেখে নি। টাকাটা কি সে নিজের জন্যে রেখে দিতে পারে না? যদি রাখে তাহলে কি খুব বড় পাপ হবে?

    অন্তু আহ-উহ করছে। ইলা উঠে গিয়ে তার কপালে হাত রাখল। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। মাথায় পানি ঢালা দরকার। এত রাতে পানি ঢালাঢ়ালির ব্যবস্থা করলে জামানের ঘুম ভেঙে যাবে। সে খুব বিরক্ত হবে। ইলা অসহায় ভঙ্গিতে অন্তুর মাথার পাশে বসে রইল।

    তার নিজের পানির পিপাসা হচ্ছে, কিন্তু উঠে যেতে ইচ্ছা করছে না। একজন কেউ যদি হাতের কাছে থাকত এবং বলা মাত্র গ্লাস ভর্তি বরফ শীতল পানি নিয়ে আসত তাহলে চমৎকার হত।

    অন্তু!

    উঁ!

    তোর অসুখ সারলে তোকে আমি মার বাসায় রেখে আসব। সেখানে খুব আরামে থাকবি।

    আচ্ছা।

    এ বাড়িতে তোর কি ভয় লাগে?

    হুঁ।

    ইলা মনে মনে বলল, আমারো ভয় লাগে। পানির পিপাসা ক্রমেই বাড়ছে। উঠে যেতে ইচ্ছা করছে না। এখন যদি জামান ঘুমের ঘোরে বল, পানি দাও। সে পানি নিয়ে আসবে। অন্তু চাইলেও আনবে। অথচ নিজের জন্যে পানি আনতে যাবার সামান্য কষ্টটাও করবে না।

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসেরা কিশোর গল্প – হুমায়ূন আহমেদ (অসম্পূর্ণ)
    Next Article কে কথা কয় – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }