Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    একা একা – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প74 Mins Read0
    ⤷

    ০১. রাত দুপুরে দুমদুম করে দরজায় কিল

    রাত দুপুরে দুমদুম করে দরজায় কিল পড়তে লাগল। সাংঘাতিক কিছু একটা হয়েছে নিশ্চয়ই। আগুনটাগুন লেগেছে কিংবা চোর এসেছে। চোর হবার সম্ভাবনাই বেশি। খুব চুরি হচ্ছে চারদিকে।

    আমরা দু জনের কেউই ঘুমাই নি। ঘর অন্ধকার করে বসে আছি। বাবুভাই তার শেষ সিগারেটটি ধরিয়েছে। সিগারেট হাতে থাকলে সে কোনো কথাবার্তা বলে না। কাজেই আমি গম্ভীর গলায় বললাম,  কে?

    দরজা খোল।

    বড়োচাচার গলা। ধরা যেতে পারে সাংঘাতিক কিছু হয় নি। এ বাড়িতে বড়োচাচার কোনো অস্তিত্ব নেই। কাজকর্ম কিছু করেন না। সে জন্যই তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে হৈ-চৈ করে বাড়ি মাথায় তোলেন। এক বার রাত তিনটায় এমন চেঁচামেচি শুরু করলেন যে পাহারাদার পুলিশ আমাদের গেটের কাছে বাঁশি বাজাতে লাগল। আমি এবং বাবুভাই দু জনে ছুটে গিয়ে দেখি ছোটচাচীর পোষা বেড়াল তাঁর ঘরে ঢুকে বিছানার উপর বমি করেছে। বড়োচাচার সে কী চিৎকার! যেন ভয়ংকর একটা কিছু হয়েছে।

    আজ রাতেও নিশ্চয়ই সে রকম কিছু হবে। হয়তো চাচীর বেড়াল তাঁর ঘরে গিয়ে কুকীর্তি করে এসেছে। আর এই নিয়ে ঘুমুবার সময়টায় তিনি লাফঝাঁপ শুরু করেছেন।

    দরজা খুলতে বললাম, কানো যায় না?

    ব্যাপারটা কী?

    চড় দিয়ে দাঁত খুলে ফেলব। লাটসাহেব কোথাকার। দরজা খোল।

    বাবুভাই সিগারেট ফেলে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, রাত দুপুরে কী শুরু করেছেন?

    কি শুরু করেছি মানে? একটা মানুষ মারা যাচ্ছে!

    কে মারা যাচ্ছে?

    বড়োচাচা তার উত্তর না দিয়ে প্রচণ্ড একটা লাথি কষলেন। দরজায়।

    বাবুভাই উঠে দরজা খুলল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, কে মারা যাচ্ছে?

    বড়োচাচা হুঁঙ্কার দিয়ে বললেন, সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকিস না, নিচে যা।

    হয়েছেটা কি বলবেন তো?

    বাবার অবস্থা বেশি ভালো না।

    স্ট্রোক হয়েছে নাকি?

    হতে পারে। অবস্থা খুব সিরিয়াস। খুবই সিরিয়াস।

    বড়োচাচাকে দেখে মনে হল না। তিনি খুব বিচলিত। বরঞ্চ এই উপলক্ষে হৈচৈ করার সুযোগ পাওয়ায় তাঁকে বেশ খুশিখুশিই মনে হল। অনেক দিন পর একটা দায়িত্ব পেয়েছেন।

    সবাইকে খবর দেওয়া দরকার। নিঃশ্বাস ফেলার সময় নাই এখন। উফ, কী ঝামেলা!

    তিনি ঝড়ের মতো নিচে নেমে গেলেন। তাঁর গলা অবশ্যি শোনা যেতে লাগল, ড্রাইভার কোথায়? ড্রাইভার? কাজের সময় সব কোথায় যায়? পেয়েছে কী?

    বারান্দার লাইট জ্বলিল। চটি ফট্‌ফটু করে কে যেন নামল। ছোটচাচা? এ বাড়িতে ছোটচাচাই একমাত্র ব্যক্তি যিনি চটি পরেন এবং শব্দ করে হাঁটেন। নিশ্চয়ই তিনি।

    বাবুভাই আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল। চিন্তিত স্বরে বলল, তুই চট করে দেখে আয় সত্যি সত্যি অবস্থা খারাপ কি না। আমার মনে হয় বাবা २भ२ 6bbाg5छ!

    নিচে গিয়ে দেখি সত্যি সত্যি খারাপ। দাদার ঘরে অনেক লোকজন। ছোটচাচা, বড়োচাচা, শাহানা, আমাদের ভাড়াটে রমিজ সাহেব। কম পাওয়ারের একটা বাতি জ্বলছে। তাঁর খাটটি সরিয়ে সিলিং ফ্যানের ঠিক নিচে নিয়ে আসা হয়েছে। রাখা হয়েছে আধশোওয়া করে। তিনি হাত দুটি ছাড়িয়ে নিঃশ্বাস নেবার জন্য ছটফট করছেন। পৃথিবীতে এত অক্সিজেন, কিন্তু তাঁর বৃদ্ধ ফুসফুসটাকে তিনি আর ভরাতে পারছেন না। তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

    শাহানা একটি হাতপাখা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে, তবু সে ক্রমাগত পাখা নেড়ে যাচ্ছে। তার মুখ হয়েছে পাংশুবর্ণ। লম্বাটে মুখ আরো লম্বা দেখাচ্ছে।

    দাদা কি একটা বলতে চেষ্টা করলেন। শ্লেষ্মা-জড়িত স্বর, কিছুই বোঝা গেল না। বড়োচাচী চেয়ারে বসে ছিলেন। তিনি চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, কী বলছেন রে?

    কি জানি কী?

    শাহানা, তুই কিছু বুঝতে পারলি?

    জ্বি-না মামী।

    দাদা এবার স্পষ্ট বলে উঠলেন, মিনু, ও মিনু।

    মিনু আমাদের সবচেয়ে বড়ো ফুফু। ন বছর বয়সে গলায় কি একটা ঘা (খুব সম্ভব ক্যানসোর) হয়ে মারা গিয়েছিল। অল্পবয়সে মৃত্যু হবে বলেই হয়তো রাজকন্যার মতো রূপ নিয়ে এসেছিল। আমাদের বসার ঘরে এই ফুফুর একটি বাঁধান ছবি আছে।

    দাদা আবার বিড়বিড় করে কী বললেন। তাঁর বুক হাঁপরের মতো ওঠানামা করতে লাগল। শাহানা আমার কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, বড়ো ভয় লাগছে।

    ভয়ের কী আছে?

    একটা মানুষ মরে যাচ্ছে, এটা ভয়ের না, কী বলছিস তুই?

    দাদা ছটফট করতে লাগলেন। এক জন মানুষ শ্বাস নেবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছে, আর আমরা এত সহজে নিঃশাস নিচ্ছি। আমার দাঁড়িয়ে থাকতে লজ্জাই লাগল।

     

    দাদা তাহলে সত্যি সত্যি মারা যাচ্ছেন। ইদানীং তাঁর সাথে আমার খুব একটা দেখাসাক্ষাৎ হত না। ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় তিনি ডাকতেন, কে যায়, বাবু? বাবু না? তাহলে কে, টগর? এ্যাই টগর এ্যাই। আমি না শোনার ভান করে দ্রুত বেরিয়ে যেতাম। কী কথা বলব তাঁর সাথে? দাদার নিজের কোনো কথা নেই বলার। আমারও নেই। এক জন বুড়ো মানুষ, যার স্মৃতিশক্তি নেই, গুছিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে, তাঁর কাছে দীর্ঘ সময় বসে থাকা যায় না।

    কিন্তু মানুষ শুধু কথা বলতে চায়। সর্বক্ষণ চায় কেউ না কেউ থাকুক তার পাশে। কে থাকবে এত সময় তাঁর কাছে? দাদা তা বোঝেন না। তাঁর ধারণা পৃথিবীর সবারই তাঁর মতো অখণ্ড অবসর। কাজেই তিনি কান খাড়া করে দরজার পাশে সারা দিন এবং প্ৰায় সারা রাত বসে থাকেন। কারো পায়ের শব্দ পাওয়া গেলেই ডাকেন, কে যায়? কে এটা, কথা বলে না যে, কে?

    বাধ্য হয়ে কোনো কোনো দিন যেতে হয় তাঁর ঘরে। তিনি গম্ভীর হয়ে বলেন,  কে তুই, বাবু?

    জ্বি-না, আমি টগর।

    তোর পরীক্ষা কেমন হয়েছে?

    কখন পরীক্ষা, কী পরীক্ষা, কিছুই তিনি জানেন না। কিন্তু সমস্ত কথাবার্তা তাঁর পরীক্ষা দিয়েই শুরু হয়। আমি ঝামেলা কমাবার জন্যে বলি, ভালোই।

    ডিভিসন থাকবে।

    জ্বি থাকবে? অঙ্ক ভালো হয়েছে? অঙ্কটাই আসল ডিভিসন হয় অঙ্ক আর ইংরেজিতে। ইংরেজি কেমন হয়েছে?

    ভালোই হয়েছে।

    আমি আসিতে আসিতে টেন ছাড়িয়া দিল,–এর ইংরেজি বল দেখি? দাদার সঙ্গে কথা বলার এই যন্ত্রণা। আমি এম-এস সি করছি বোটানিতে, কিন্তু তাঁর কাছে বসলেই একটা ইংরেজি ট্রানস্লেশান করতে হবে। মাসখানেক আগে এক বার বাবুভাইকে ডেকে এনে পাটিগণিতের অঙ্ক কষতে দিলেন। সে অঙ্ক আবার পদ্যে লেখা–অর্ধেক পঙ্কে তার, তোহাই সলিলে। নবম ভাগের ভাগ শৈবালের জলে–ইত্যাদি। বাবু ভাই বিরক্ত হয়ে বললেন, দাদা, আমি পাশটাশ করে ইণ্ডেন্টিংয়ের অফিস খুলেছি, এখন বসে বসে পাটিগণিত করব নাকি?

    তুই আবার পাশ করলি কবে?

    এম. এ. পাশ করলাম দুই বছর আগে।

    বলিস কি! কোন ক্লাস পেয়েছিস?

    আপনাকে নিয়ে তো মহা মুসিবত দেখি।

    দাদাকে নিয়ে মুসিবত শুরু হয়েছে বেশ অনেক দিন থেকেই। বছর তিন ধরে হঠাৎ করে তার মাথায় গণ্ডগোল হতে শুরু করে। ব্যাপারটা সাময়িক। দিন দশেক থাকে। আবার সেরে যায়, আবার হয়! মস্তিষ্কবিকৃতির সময়টা বাড়িসুদ্ধ লোককে তিনি অস্থির করে রাখেন। এই সময় তিনি কিছুই খান না। ভাত মাখাবার সময় তিনি নাকি দেখতে পান একটা কালো রঙের বেড়াল থাবা দিয়ে তাঁর সঙ্গে ভাত মাখছে। কাজেই তিনি ভাত খেতে পারেন না। এক জনকে তখন প্লেট উঁচু করে রাখতে হয় (যাতে বেড়ালে ভাত ছুতে না পারে}। অন্য এক জনকে ভাত মাখিয়ে মুখে তুলে দিতে হয়। তুলে দেওয়া ভাত ও বেশিক্ষণ খেতে পারেন না। দু-এক দল মুখে ভুলেই চেঁচাতে থাকেন, বেড়াল গা বেয়ে উঠছে। গা বেয়ে উঠছে। চেঁচাতে চেঁচাতে এক সময় বমি করে ফেলেন। কী কষ্ট, কী কষ্ট!

    অসুখের আগেও যে তাঁর সময় খব ভালো যাচ্ছিল তা নয়। দিনের বেশির ভাগ সময় বসে থাকতেন বারান্দায়। ইজিচেয়ারে আধশোওয়া হয়ে সমস্ত দিন একা একা পড়ে থাকা নিশ্চয়ই কষ্টকর ব্যাপার। ঠিক এই বয়সে, এই অবস্থায় এক জন মানুষ কী ভাবে।–কে জানে? বসার ভঙ্গিটা অবশ্য অপেক্ষা করার ভঙ্গি। যেন কোনোএকটি বড়ো কিছুর জন্যে অপেক্ষা। সেটা নিশ্চয়ই মৃত্যু। বারান্দার অন্ধকার কোণায় এক কালের এক জন প্রবল প্রতাপের মানুষ আধোজ্যগ্রত অবস্থায় মৃত্যুর অপেক্ষা করছে। চিত্রটি অস্বস্তিকর।

    এখন রাত এগারটা পঁচিশ। দাদার যা অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে এ জগতের জ্বালা-যন্ত্রণার অবসান হতে বেশি দেরি নেই। তাঁর বা চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। জীবনের সর্বশেষ যাত্রাটি সুসহ করা হল না কেন কে জানে?

    আকবরের মা প্রকাণ্ড একটা গামলাভর্তি ফুটন্ত পানি এনে হাজির করল। বড়োচাচী অবাক হয়ে বললেন, গরম পানি কি জন্যে?

    আমি কি জানি? আমারে আনতে কইছে আনছি।

    শাহানা, গরম পানির কথা কে বলেছে?

    আমি জানি না, মামী।

    কি যে এদের কাণ্ড! এই আকবরের মা, পানি নিয়ে যাও তো। কে বলেছে। তোমাকে পানির কথা?

    বড়ো মিয়া কইছেন।

    যাও, নিয়ে যাও।

    আকবরের মা পানি নিয়ে যেতে গিয়ে ইচ্ছে করেই অর্ধেক পানি ফেলে ঘর ভাসিয়ে দিল। আমি দাদার ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। বারান্দার এক প্রান্তে উগ্র মূর্তিতে বড়োচাচাকে দেখা গেল। তাঁর সামনে কালাম। কালামের মুখ পাংশুবর্ণ।

    আজকে তোর চামড়া খুলে ফেলব। মানুষ মারা যাচ্ছে বাড়িতে, আর তোর আজকে না ঘুমালে শরীর খারাপ করবে? লাটসাহেব আর কি।

    আমাকে দেখে বড়োেচাচার কাজের উৎসাহ আরো বেড়ে গেল। কালামের গালে প্রকান্ড একটা চড় কষিয়ে দিলেন। আমার দিকে তাকিয়ে মেঘম্বরে বললেন, তোকে যে বললাম সবাইকে খবর দিতে, দিয়েছিস?

    জ্বি-না, দিই নি। দেব।

    একটা কথা কত বার বলা লাগে?

    যাচ্ছি।

    যাচ্ছিটা কখন? নিজের চোখে অবস্থাটা দেখছিস না?

    চাচা, ডাক্তার আনতে কেউ গিয়েছে?

    রমিজ সাহেব গিয়েছেন। রমিজ এলে তুই গাড়ি নিয়ে যাবি। বাবুকে সঙ্গে নিস। সেই মাতবরটা কোথায়?

    উপরে আছে।

    যা, ডেকে নিয়ে আয়। অন্য বাড়ির লোকজন ছোটাছুটি করছে, আর নিজেদের কারোর খোঁজ নেই। আফসোস।

    অন্য বাড়ির লোক–অর্থাৎ রমিজ সাহেব। লম্বা কালো মোটাসোটা একটা মানুষ, যাদের দেখলেই মনে হয় এদের জন্ম হয়েছে অভাব অনটনে থাকবার জন্যে। তিনি আমাদের ভাড়াটে। একতলার চারটা কামরা নিয়ে আজ সাত বছর ধরে আছেন। এই সাত বছর কোনো ভাড়া বাড়ান হয় নি। কিন্তু তবু রমিজ সাহেব তাঁর নামমাত্র ভাড়াও নিয়মিত দিতে পারেন না। হাত কচলে চোখেমুখে দীন একটা ভাব ফুটিয়ে আমার বাবাকে গিয়ে বলেন, রহমান সাহেব, একটা বড়ো বিপদে পড়েছি।–আমার ছোট শালীর এক ছেলে–

    রামিজ সাহেবের বাড়িভাড়া না-দেওয়ার কারণগুলি সাধারণত বিচিত্র হয়ে থাকে, এবং তা শেষ পর্যন্ত শোনার ধৈর্য কারো থাকে না; বাবাকে এক সময় বিরক্ত হয়ে বলতে হয়, থাক, থাকা; একটু রেগুলার হবার চেষ্টা করবেন, বুঝলেন?

    জ্বি স্যার। আর দেরি হবে না।

    রেগুলার হবার কোনো রকম চেষ্টা অবশ্যি দেখা যায় না। তিনি নিজের অংশের একটা ঘর সাবলেট দিয়ে ফেলেন গোঁফ ওয়ালা বেটে একটা ভদ্রলোককে। আমাদের অবশ্য বলেন, তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, বিপদে পড়েছে, তাই দিন দশেক থাকবে। সেই লোক মাস দুয়েক থাকার পর আমরা ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। বড়োচাচা খুব রাগলেন। গলার রগ ফুলিয়ে বললেন, সব কটাকে ঘাতু ধরে বের করে দাও। ফাজলামি পেয়েছে? বেঁটে লোকটা খুব হরি-তথি শুরু করল, বললেই হয়, দেশে আইন-আদালত নাই? এভিকশন কি মুখের কথা? এতে বড়োচাচা আরো বেশি রেগে গেলেন এবং হুকুম দিলেন বাড়ির সব জিনিসপত্র বাইরে বের করে দিতে। আমাদের বাড়ির চাকর-ব্যাকররা অনেক দিন পর একটা উত্তেজনার ব্যাপার ঘটবার উপক্রম দেখে উৎসাহে সঙ্গে সঙ্গে আলনা, ট্রাঙ্ক, চেয়ার, টেবিল বাইরে এনে ফেলতে লাগল। আমি হৈ-চৈ শুনে বারান্দায় এসে দেখি রামিজ সাহেবের স্ত্রী রক্তশূন্য মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। অত্যন্ত বিশ্ৰী ব্যাপার। এই সময় বাবুভাই এল কোথেকে এবং সে খুব স্বাক হয়ে গেল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, এইসব কি?

    আকবরের মা একগাল হেসে বলল, বড়ো ভাই, এরারে বাড়ি থাইক্যা বাইর কইরা দিতেছি।

    রমিজ সাহেবের বড়ো মেয়েটা শব্দ করে ফুঁফিয়ে উঠল। বাবুভাই গম্ভীর মুখে বললেন, জিনিসপত্র সব ঘরে নিয়ে ঢোকাও, এইসব কি?

    বড়োচাচা কি একটা বলতে যাচ্ছিলেন। বাবুভাই তার আগেই এগিয়ে এসে কালামের গালে প্রচণ্ড একটা চড় কষিয়ে দিলেন। কালাম হৃষ্টচিত্তে একটা মিটসেফ ঠেলা ঠেলি করে আনছিল। সে কিছুই বুঝতে না পেরে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। বাবুভাই যেন কিছুই হয় নি এমনভাবে নিজের ঘরে চলে এলেন।

    সে-দিন আমি বেশ কিছু জিনিস প্রথম বারের মতন লক্ষ করলাম। যেমন–রামিজ সাহেবের চার মেয়ে। কোনো ছেলে নেই। রামিজ সাহেব এবং তাঁর স্ত্রীর চেহারা মোটামুটি ধরনের, কিন্তু তাদের চারটি মেয়েই দেখতে চমৎকার। সবচেয়ে বড়োটির (যার নাম নীলু) এমন মায়াকাড়া চেহারা। সব কটি বোনের মধ্যে একটা অন্য রকম স্নিগ্ধ ভােব আছে। তা ছাড়া বাচ্চাগুলি এম্নিতেও শান্ত। চিৎকার চেঁচামেচি কখনো শুনেছি বলে মনে পড়ল না।

    এর কিছু দিন পরই রমিজ সাহেব হাসিমুখে এক প্যাকেট লাডছু হাতে দোতলায় এলেন। বড়ো মেয়েটি তাঁর পেছনে। ব্যাপার কী? বড়ো মেয়ে, যার নাম নীলু, সে ক্লাস এইটে বৃত্তি পেয়েছে। রমিজ সাহেব সব কটি দাঁত বের করে হাসতে— হাসতে বললেন, ঘরের কাজকর্ম করে সময়ই পায় না। সময় পেলে স্যার আরো ভালো হত।

    বাবা অবাক হয়েই বললেন, কত টাকার বৃত্তি?

    মাসে চল্লিশ টাকা স্যার। আর বই কেনা বাবদ্র বৎসরে দুই শ টাকা।

    বাহ, বেশ তো!

    মেয়েটার জন্য দেয়া করবেন স্যার।

    নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।

    দোতলা থেকে তারা রওনা হল তিন তলায়। এই সময় দেখা হল আমার সঙ্গে।

    এই যে ভাই সাহেব, আমার এই মেয়েটা…

    শুনেছি, বাবাকে বলছিলেন। আমি বারান্দায় ছিলাম। খুব ভালো খবর!

    নীলু, কদমবুসি কর, টগর সাহেবকে।

    আমি আঁৎকে উঠলাম, আরে না-না।

    না-না কি? মুরুব্বির দোয়া ছাড়া কিছু হয় নাকি? এ্যাঁ?

    রামিজ সাহেব ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলেন। আজ আর তিনি দীন ভাড়াটে নন। আজ এক জন অহংকারী বাবা।

    আমি বললাম, তোমার নাম কী?

    নীলু।

    রামিজ সাহেব গর্জে উঠলেন, ভালো নাম বল।

    নীলাঞ্জনা।

    রামিজ সাহেব হৃষ্টচিত্তে বললেন, ওর মা-র রাখা নাম। আমি নাম দিয়েছিলাম জোবেদা খানম। সেটা তার মায়ের পছন্দ হল না। নামটা নাকি পুরানা। আরে ভাই আমি নিজেও তো পুরানা। হা-হা-হা।

    বাবা মেয়েটির জন্য একটা পার্কার কলম কিনে পাঠিয়ে দিলেন। সেই কলমের প্রসঙ্গ রামিজ সাহেব সময়ে–অসময়ে কত বার যে তোলেন তার ঠিক নেই। যেমন দিন সাতেক পর রিমিজি সাহেবের সঙ্গে নিউমার্কেটে দেখা হল। তিনি এক%াল হেসে বললেন, কাণ্ড শুনেছেন নাকি ভাই?

    কী কাণ্ড?

    পার্কার কলমটা যে দিয়েছেন আপনারা-নিলু স্কুলে নিয়ে গিয়েছিল। ক্লাস ছুটি হওয়ার পর আর পায় না। মেয়ে তো কাঁদতে কাঁদতে বাসায় আসছে। আমি দিলাম এক চড়। মেজাজ কি ঠিক থাকে, বলেন আপনি? শেষে তার ব্যাগের মধ্যে পাওয়া গেল। দেখেন অবস্থা। হা-হা-হা।

    নীলুর সঙ্গে আমার খানিকটা খাতিরও হল অন্য একটি কারণে। এক দিন দেখলাম দুপুরের কড়া রোদে সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। এক নয়, সঙ্গে আরো কয়েকটি মেয়ে। স্কুল-ড্রেস পরা থাকলে যা হয়–সব কটাকে অবিকল এক রকম লাগে। তবুও এর মধ্যে নীলুকে চিনতে পারলাম, এ্যাই নীলু।

    নীলু হকচকিয়ে এগিয়ে এল।

    যাচ্ছ কোথায়? এ লাইনে তো মিরপুরের বাস যায়।

    কল্যাণপুর যাচ্ছি। আমাদের এক বন্ধুর আজ গায়ে হলুদ, আমাদের যেতে বলেছে।

    ঐ ওরাও যাচ্ছে তোমার সাথে?

    জ্বি।

    উঠে পড় গাড়িতে। পৌঁছে দিই। যে ভিড়, এখন আর বাসে উঠতে পারবে না।

    নীলু ইতস্তত করতে লাগল। যেন আমার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হওয়ায় মস্ত অপরাধ হয়েছে। অন্য মেয়েগুলি অবশ্যি খুব হৈ-চৈ করে গাড়িতে উঠে পড়ল। তারা খুব খুশি।

    সারা দিন থাকবে তোমরা?

    নীলু জবাব দিল না। কালোমতো একটি মেয়ে হাসিমুখে বলল, আমরা সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকব। সবাই বাসায় বলে এসেছি। শুধু নীলু বলে আসে নি।

    কেন, নীলু বলে আস নি কেন?

    নীলু তারও জবাব দিল না। মাথা নিচু করে বসে রইল। কালো মেয়েটা বললো, নীলু। তার মার সঙ্গে ঝগড়া করেছে। দু দিন ধরে ওদের মধ্যে কথা বন্ধ।

    তাই বুঝি?

    জ্বি, ও যখন আজ সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরবে, তখন মজাটা টের পাবে।

    সব কটি মেয়ে খিলখিল করে হেসে ফেলল। ব্যাক ভিউ মিররে দেখলাম নীলুর চোখে জল এসে যাচ্ছে।

    সন্ধ্যার পর নীলুদের বাসায় সত্যি সত্যি দারুণ অবস্থা। রমিজ সাহেব কাঁদো। কাঁদো হয়ে বাবুভাইকে গিয়ে বললেন, ভাইসোব শুনেছেন, আমার মেয়েটা কিডন্যাপ হয়েছে।

    কী বলছেন এইসব?

    জ্বি ভাইসব, সত্যি কথাই বলছি। রমিজ সাহেব ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললেন। আমি বললাম, এসে পড়বে, হয়তো বন্ধুর বাড়িটাড়ি গিয়েছে।

    আমার মেয়ে না বলে কোথাও যাবে না। টগর সাহেব।

    নীলু সে রাতে বাড়ি এসে পৌঁছে রাত পৌণে আটটায়। ওর বন্ধুর বাড়ি থেকে মুরুরি কিসিমের এক ভদ্রলোক এসে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। কিন্তু ইতোমধ্যে আমাদের নিচতলায় প্রলয়ের মতো হয়ে গেল। রামিজ সাহেব কেঁদে গিয়ে পড়লেন। আমার বড়োেচাচার কাছে। বড়োচাচা একটা কাজ পেয়ে লাফ-ঝাঁপ দিতে শুরু করলেন–এই থানায় টেলিফোন করছেন, ঐ করছেন হাসপাতালে, এক বার শুনলাম অত্যন্ত গভীর ভঙ্গিতে কাকে যেন বলছেন, আরে ভাই, বলতে গেলে বাসার সামনে থেকে মেয়েটাকে ধরে নিয়ে গেছে। এই দেশে বাস করা অসম্ভব।

     

    আমি সিঁড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখলাম গাড়ি এসে ঢুকেছে। ডাক্তার চলে এসেছে। কোন জন এসেছে কে জানে? বড়ো রাস্তার মোড়ে এক জন ডাক্তার থাকেন, যাকে দেখেই যক্ষ্মারোগী বলে ভ্রম হয়। দাদার জন্যে তিনি হচ্ছেন ফুলটাইম ডাক্তার। তাঁর নাম প্রদ্যোত বাবু বা এই ধরনের কিছু। এর বিশেষত্ব হচ্ছে, তিনি এ্যালোপ্যাথির পাশাপাশি টোটকা অষুধ দেন। বাবুভাইয়ের এক বার টনসিল ফুলে বিশ্ৰী অবস্থা হল। কিছুই গিলতে পারেন না। এক শ দুই জ্বর গায়ে। প্রদ্যোত বাবু এসেই গম্ভীর মুখে বললেন বানরলাঠি গাছের ফল পিষে গলায় প্রলেপ দিতে। এটাই নাকি মহৌষধ।

    বাবুভাই দারুণ রেগে গেল। চিঁ চিঁ করে বলল, শালা মালাউন কবিরাজী শুরু করেছে।

    প্রদ্যোত বাবু (কিংবা পীযূষ বাবু), কিন্তু সত্যি সত্যি বানরলাঠি গাছের ফল যোগাড় করে পুলটিশ লাগিয়ে ছাড়লেন। অসুখ আরাম হল। যদিও বাবুভাইয়ের ধারণা, এম্নিতেই সারিত। শরীরের নিজস্ব রোগপ্রতিরোধের মেকানিজমেই সেরেছে।

    যাই হোক, প্রদ্যোত বাবুর আমাদের বাড়িতে মোটামুটি একটা সম্মানের আসন আছে। তিনি বাড়ি এলেই তাঁর জন্য দুধ-ছাড়া চা হয়, সন্দেশ আনান হয় এবং বাবা নিজে নেমে এসে কথাবার্তা। বলেন।

    এই যে ডাক্তার, যাওয়ার আগে আমার প্ৰেশারটা দেখে যাবে।

    বিনা কী-তে প্ৰেশার দেখা ছেড়ে দিয়েছি রহমান সাহেব। মেডিকেল এথিক্সের ব্যাপার আছে–হা-হা-হা।

    আজ দেখলাম আমাদের প্রদ্যোত বাবু ছাড়াও অন্য এক জন ডাক্তার নামলেন। সেই ভদ্রলোকের চোখেমুখে সীমাহীন বিরক্তি, যার মানে তিনি এক জন বড়ো ডাক্তার। পিজির কিংবা মেডিক্যালের প্রফেসর বা এসোসিয়েট প্রফেসর। ভদ্রলোকের বিরক্তি দেখি ক্রমেই বাড়ছে। গাড়ি থেকে নেমেই হাতঘড়ি দেখলেন। আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল দেখি ভদ্রলোক যে কতক্ষণ থাকেন তার মাঝে মোট কবার হাতঘড়ি দেখেন। কিন্তু এখন এসব এক্সপেরিমেন্টের ভালো সময় নয়। গাড়ি নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে আত্মীয়-স্বজনের খোঁজে যেতে হবে। যে দুই ফুফু ঢাকায় আছেন তাঁদেরকে বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে হবে।

    সিঁড়িতে পা দেওয়ামাত্র নীলু, ডাকল, টগর ভাই। এই মেয়েটি নিঃশব্দে চলাফেরা করে। আচমকা কথা বলে চমকে দেয়।

    দাদার অবস্থা কি বেশি খারাপ?

    মনে হয়। রাতের মধ্যেই কাম সাফ হবার সম্ভাবনা।

    টগর ভাই, আপনি সব সময় এইভাবে কথা বলেন কেন?

    আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি নীল হলুদ রঙের শাড়ি পরেছে। মেয়েটা চোখের সামনে বড়ো হয়ে যাচ্ছে। বড়ো হচ্ছে এবং সুন্দর হচ্ছে; মেয়েরা লতান লাউগাছের চারার মতো। এই দেখা যাচ্ছে ছোট্ট এক রাত্তি একটা চারা, কয়েকটা দিন অন্যমনস্ক থাকার পর হঠাৎ চোখে পড়লেই দেখা যাবে নিজেকে সে ছড়িয়ে দিয়েছে চারদিকে। সতেজ বলবান একটি জীবন।

    আচ্ছা, তুই এখন কি পড়িস যেন? (নীলুকে আমি তুই বলি। ওর সঙ্গে প্রায়ই আমার কথাবার্তা হয়। আমার সঙ্গে কথা বলার একটা গোপন অনুগ্রহ ওর আছে।)

    সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ি। বখশিবাজার কলেজে।

    সেকেণ্ড ইয়ারে আবার কবে উঠলি?

    নীলু, সে-কথার জবাব না দিয়ে মৃদুস্বরে বলল, আমাকে তুই-তুই করে বলেন কেন?

    সেদিনকার পুঁচকে মেয়ে, তোকে আবার আপনি-আপনি বলতে হবে নাকি?

    আমি দোতলায় চলে গেলাম। বাবুভাইয়ের ঘরের দরজা হাট করে খোলা। বারান্দায় আলো নেই। তার ঘরও অন্ধ-গর। আমি ঘরে ঢুকে সুইচ টিপলাম, আলো জ্বলল না। বাবুভাইয়ের গলা শোনা গেল, লম্বা হয়ে শুয়ে পড়, টগর।

    কী ব্যাপার? লাইট ফিউজ নাকি?

    উঁহু, বান্ধ খুলে ফেলেছি। ঘর অন্ধকার দেখলে কেউ আর খোঁজ করবে না। মনে করবের কাজেকর্মেই আছি।

    বারান্দাটারও খুলে ফেলেছি নাকি?

    হুঁ। কামেলা ভালো লাগে না। রাতদুপুরে এর বাড়ি যাও, ওর বাড়ি যাও।–বাল্ব খুলে জমাট অন্ধকার করে দিলাম।

    বাবুভাই সিগারেট ধরাল। লম্বা টান দিয়ে বলল, মরবার সময় হয়েছে মরবে, এত হৈ-চৈ কী জন্যে?

    আমি চুপ করে রইলাম। বাবুভাই বলল, শুয়ে শুয়ে এইসব কথাই ভাবছিলাম।

    কী-সব কথা?

    যেমন ধর মানুষ হচ্ছে একমাত্র প্রাণী, যে জানে এক দিন তাকে মরতে হবে। অন্য কোনো প্রাণী তা জানে না।

    বুঝলে কী করে, অন্য প্রাণীরা জানে না? কথা বলেছ তাদের সাথে?

    কথা না বলেও বোঝা যায়। অন্য কোনো প্রাণী মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নেয় না। মানুষ নেয়।

    আমিও সিগারেট ধরলাম। বাবুভাই বলল, বুড়োর অবস্থা কী?

    ভালো না।

    মৃত্যু ব্যাপারটা কুৎসিত। একসেপ্ট করা যায় না।

    যাবে না কী জন্যে? কুৎসিত জিনিস কি আমরা একসেপ্ট করি না? সব সময় করি।

    মৃত্যু স্বীকার করে নিই, কিন্তু একসেপ্ট করি না।

    আমার ক্ষীণ সন্দেহ হল বাবুভাই এক ফাঁকে তার টাঙ্ক খুলে ঐটি বের করে দু-এক ঢোক খেয়েছে। বাবুভাইয়ের এই অভ্যেসটি নতুন। যে ভাবে তা প্রথম শুরু হয়েছিল, তাতে আমার ধারণা হয়েছিল অভ্যেসটি স্থায়ী হবে না। কিন্তু মনে হচ্ছে স্থায়ী হয়েছে। আমি মৃদু স্বরে বললাম, তুমি কিছু খেয়েছ নাকি?

    হুঁ। বেশি না। আধা গ্লাসও হবে না। মৃত্যুর মতো একটি কুৎসিত ব্যাপার একসেপ্ট করতে হলে নাৰ্ভগুলিকে আংশিক অকেজো করে দিতে হয়। তুই এক ঢোক খাবি নাকি? ভালো জিনিস। ব্ল্যাক টাওয়ার। খাস জার্মান জিনিস। চমৎকার!

    এখন না।

    বাবুভাই বিছানা থেকে নেমে টাঙ্ক খুলল। আমি বললাম, আরো খাচ্ছ নাকি?

    জাস্ট এ লিটল।

    একটা কেলেঙ্কারি করবে শেষে।

    তুই পাগল হয়েছিস? কেউ টের পাবে না।

    বড়োচাচার পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। এ বাড়ির কারো পায়ের শব্দ আমি চিনি না, কিন্তু বড়োচাচার প্যায়ের শব্দ চিনি। তিনি কেমন যেন লাফিয়ে—লাফিয়ে চলেন বলে মনে হয়। থপথপ করে বানর হাঁটার মতো শব্দ হয়।

    বড়োচাচা বারান্দার মাঝামাঝি গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, লাইট কোথায় গেল? আর বাম্বটা ফিউজ হল কখন? এই এই! টগর টগর।

    বড়োচাচা আমাদের ঘরেও এক বার উঁকি দিলেন। তারপর আবার বানরের মতো থপথপ শব্দ করে তেতলায় উঠে গেলেন। নেমে এলেন প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গেই। বান্ধ নিয়ে এসেছেন বোধ হয়। কিছুক্ষণ পরই বারান্দায় এক শ পাওয়ারের একটা বাতি জ্বলে উঠল। বড়োচাচা আবার থপথপ শব্দ করে নিচে নেমে যেতেই বাবু ভাই বান্ধটা খুলে নিয়ে এল। ব্ল্যাক টাওয়ার আমিও খানিকটা চেখে দেখলাম। জিনিসটা মন্দ নয়। কেমন যেন পচা নারকেলের পানির মতো। রাত বাজে দুটা দশ। বাবুভাই মৃদু স্বরে বলল, বুড়ে তাহলে মরেই যাচ্ছে?

    তা বোধহয় যাচ্ছে।

    দুঃখের ব্যাপার। বুড়োর সাথে আমার খাতির ছিল।

    তোমার একার না, সবারই খাতির ছিল।

    হুঁ। খুব মাই-ডিয়ার টাইপ ছিলেন।

    কথাটা ঠিক নয়। দাদা মাই—ডিয়ার টাইপ নন। তিনি এক জন কঠিন প্রকৃতির মানুষ। তবে বাবুভাইয়ের সঙ্গে তাঁর খাতির ছিল। সুস্থ থাকাকালীন রোজ এক বার করে খোঁজ করতেন–বাবু আছে? বাবুভাই বিরক্ত হয়ে বলতেন, বুড়োর যন্ত্রণায় শান্তিতে থাকা মুশকিল। তা সম্রাট শাহজাহান আমার কাছে চায় কী?

    দাদাকে আড়ালে আমরা সম্রাট শাহজাহন এবং শাহানাকে জাহানারা ডাকি। দাদাও প্রবল পরাক্রান্ত নৃপতির ভগ্ন ছবি হয়ে সারা দুপুর জাহানারার সঙ্গে গুজগুজ করেন। অনেক বয়স পর্যন্ত বেচে থাকাটা একটা ভয়াবহ ব্যাপার।

    বাবুভাই বোতলের আরো খানিকটা গলায় ঢািলল। আমি মৃদু স্বরে ডাকলাম, বাবুভাই!

    হুঁ।

    তোমার কি মনে হয়, মৃত্যুর পর কিছু আছে?

    খুব সম্ভব আছে। থাকারই কথা।

    বাবুভাই ঢকচক করে গ্লাসে আরো খানিকটা ঢালল।

    বাবু ভাই, আর খেয়ে না। তুমি বেশি খাচ্ছি।

    বেশি কোথায় দেখলি?

    শেষে একটা কেলেঙ্কারি করবে।

    কিছুই করব না।

    বড়োচাচার গলার শব্দ শোনা গেল, আরে, এই বান্ধটা কোথায় গেল? ব্যাপার কি? বাবুভাই খিকখিক করে হাসতে লাগল।

    কে হাসে, এই কে হাসে? বাবু, বাবু। এই টগর।

    আমার মনে হল, বড়োচাচা খানিকটা ভয় পেয়েছেন। গলার স্বর কেমন কাঁপা কাঁপা।

    কে হাসছিল? এই এই। কালাম! এই কালাম!

    বড়োচাচা দ্রুত নিচে নেমে গেলেন। তিনি সত্যি সত্যি ভয় পেয়েছেন।

     

    মগবাজারের ফুফু এলেন সবার আগে। নিজের গাড়ি আনলেন না। তাঁকে গিয়ে নিয়ে আসতে হল। তাঁর গাড়ির কাবুরেটরে নাকি কি একটা প্রবলেম হয়েছে। আমাদের বাড়িতে আসতে হলেই তাঁর গাড়ির কাবুরেটরে প্রবলেম হয় কিংবা ব্রেক শু লুজ থাকে। বাবুতাইয়ের ধারণা, সমস্ত ঢাকা শহরে মগবাজারের ফুফুর চেয়ে কৃপণ এবং ধূর্ত মহিলা এখনো জন্মায় নি এবং ভবিষ্যতেও জন্মানির সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাঁর বাড়িতে বেড়াতে গেলে তিনি চমৎকার জাপানী কফি-কাপে চা দেন। উদ্দেশ্য একটিই–কাপগুলি ছোট। চায়ের সঙ্গে কখনো কিছু থাকে না। আমরা কেউ দুপুরের দিকে তাঁর বাসায় গেলে তিনি বিরক্ত স্বরে বলেন, খবর দিয়ে আসতে পারিস না? ভাত চড়িয়ে ফেলেছে।

    ভাত খাব না।

    দুপুরে আবার ভাত খাবি না কি? বাস খানিকক্ষণ, আবার ভাত চড়াবে। কতক্ষণ আর লাগবে। রাইস কুকার আছে।

    না ফুফু, বসতে পারব না।

    শুধুমুখে যাবি? সময় হাতে নিয়ে আসতে পারিস না? সব সময় তাড়া, সব সময় তাড়া! কী এমন রাজকাৰ্য তোদের?

    মগবাজারের ফুফুকে আমরা কেউ সহ্য করতে পারি না। বাবুভাই প্রায় খোলাখুলি এমন সব অপমানজনক কথাবার্তা বলে যে অন্য কেউ হলে বড়ো রকমের ঝামেলা বেধে যেত। মগবাজারের ফুফু, অসম্ভব ধূর্ত বলেই কোনো কথা গায়ে মাখেন না এবং এমন ভাব করেন যে কিছু বুঝতে পারেন নি।

    গত বছর শীতের সময় তিনি হঠাৎ এসে বললেন, ফরিদের (তাঁর ছেলে) গ্রাজুয়েশন হবে সামারে, তাঁকে গ্রাজুয়েশন সেরিমনি এ্যাটেণ্ড করতে যেতে হবে। বাবুভাই গম্ভীর হয়ে বলল, বলেন কি ফুফু, ফরিদ ভাই তো দেশে তিন ধাক্কায়ও আই এ পাস করতে পারল না। ঐখানে গিয়ে একেবারে এম এ পাস করে ফেলল!

    দেশে কি পড়াশোনা হয়? বিদেশে পড়াশোনার একটা এ্যাটমোসফিয়ার আছে। টিচাররা যত্ন নেয়।

    এখানের ছেলেমেয়ে যেগুলি পাস করে, সেগুলি কীভাবে করে?

    কি জানি কীভাবে করে? নকল ছাড়া তো আমি কিছু জানি না।

    ফুফু, হাই তোলেন। কথা বন্ধ করতে চান। বাবুভাই ছোড়বার পাত্র না। সে প্যাঁচাবেই।

    ফরিদ ভাই তো মন্দ দেখায় নি। এইখানে ছিল আই এ ফেল, বিলেতে গিয়ে দুই বছরে একেবারে এম এ 1

    ফুফু, গম্ভীর হয়ে বললেন, ও দেশে তো আর আমাদের মতো নিয়ম না।–যে দুই বছর পড়তে হবে আই এ, দুই বছর পড়তে হবে বি এ, ওদের দেশে অন্য ব্যবস্থা।

    ফরিদ ভাই দেশে আসবে?

    আসবে। একটা মেয়েটেয়ে দেখ দেখি। ইউনিভার্সিটির ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে নাকি সুন্দর-সুন্দর মেয়ে আছে?

    মগবাজারের ফুফুর সঙ্গে কথা শুরু হলে তা এক সময় না এক সময় সুন্দরসুন্দর মেয়েতে এসে থেমে যাবে। গত চার বছর ধরে তিনি সুন্দর মেয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কোনোটাই তাঁর পছন্দ হচ্ছে না। হয় নাকটা প্রয়োজনের তুলনায় ছোট, কিংবা ঠোঁট একটু মোটা। সব কিছুই যখন ঠিক থাকে, তখন দেখা যায় মেয়েটা বেটে। বাংলাদেশের সুন্দরী মেয়ে প্রসঙ্গে ফুফুর সার্ভে হচ্ছে–এদেশে সুন্দরী মেয়ে নেই। যে কটি আছে তারা হয় বেটে, নয় শ্বেতী রোগগ্রস্তা।

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকিছুক্ষণ – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article একটি সাইকেল এবং কয়েকটি ডাহুক পাখি – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }