Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প133 Mins Read0
    ⤷

    ০১. আয়নার দিকে তাকিয়ে মুহিব চমকে উঠল

    আয়নার দিকে তাকিয়ে মুহিব চমকে উঠল। কাকে দেখা যাচ্ছে আয়নায়? এটা কি তার নিজেরই ছায়া? না-কি এক চোখা দৈত্য–সাইক্লপ!

    যাকে দেখা যাচ্ছে তার বা চোখ বন্ধ হয়ে আছে। খুব চেষ্টা করলে চোখের সাদা অংশ দেখা যায়, কালো মণি দেখা যায় না। গালের হনু উঁচু হয়ে আছে। থুতনির কাছে খোচা খোচা দাড়ি। গালের হনু তো আগে উঁচু ছিল না। বেছে বেছে আজই উঁচু হয়ে গেল? সারা মুখে কেমন চিমশে ভাব চলে এসেছে। রাতে না ঘুমুলে এরকম হয়। কিন্তু গত রাতে তার ঘুম খুব ভালো হয়েছে। ঘুমের মধ্যে সে ইন্টারেস্টিং একটা স্বপ্নও দেখেছে। স্বপ্নটা এখন মনে পড়ছে না। দুপুরের দিকে মনে পড়বে। মুহিবের স্বপ্ন মনে পড়ে দুপুরের পর।

    এই চেহারা দুরুস্ত করা যাবে কীভাবে? শেভ করে থুতনির দাড়ি ফেলে দেয়া যাবে। ক্রিম ঘষে মুখের চিমশে ভাব হয়তো বা কিছুটা কাটান দেয়া যাবে। কিন্তু বা চোখের গতি কী হবে? এই চোখ নিয়ে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া যায়, কিন্তু চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাওয়া যায় না। আজ সকাল এগারোটায় দ্যা এরনস নামের একটা কোম্পানির সঙ্গে তার ইন্টারভিউ। তারা দ্বিতীয় দফায় ডেকেছে। দ্বিতীয়বার যখন ডাকছে তখন নিশ্চয়ই কোনো ঘটনা আছে। চোখের এই অবস্থা দেখলে কি ইন্টারভিউ বোর্ডের কর্তারা সেই বিশেষ ঘটনা ঘটাবেন? এখন বাজছে আটটা। হাতে আরো তিন ঘণ্টা সময় আছে। এই তিন ঘণ্টায় চোখের কোনো গতি করা যাবে কি?

    জল-চিকিৎসা শুরু করলে কেমন হয়? যে-কোনো রোগের প্রথম চিকিৎসা হলো জল-চিকিৎসা। কিছু কিছু রোগের শুধু যে প্রথম চিকিৎসা তা-না, শেষ চিকিৎসাও। কথাগুলো মুহিবের বড় চাচা তৌফিকুর রহমান সাহেবের। পেনশন নিয়ে পাঁচ বছর ধরে তিনি বাড়িতে বসে আছেন। অবসর কাটাচ্ছেন নানাবিধ চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে পড়াশোনা করে। উনার কর্মকাণ্ড পড়াশোনায় সীমাবদ্ধ থাকলে ভালো হতো। তা নেই, তিনি বাড়িতে কিছু ভেষজ ওষুধও বানাতে শুরু করেছেন। তাঁর প্রথম প্রচেষ্টা Olive leaf extract. হামানদিস্তায় জলপাই গাছের কচিপাতা পেষা হচ্ছে। তার সঙ্গে আগার-আগার মিশিয়ে ডালের বড়ির মতো বড়ি বানিয়ে রোদে শুকানো হচ্ছে। শুকানোর পর এই ঘোর কৃষ্ণবর্ণ বস্তুটাকে দেখাচ্ছে ছাগলের লাদির মতো। এই ছাগলের লাদি দৈনিক একটা করে খেলে নবযৌবন। কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ, আর্থরাইটিস, ডায়াবেটিস, ব্লাডপ্রেসার কিছুই থাকবে না। ছাগলের লাদি শরীরের সমস্ত দষিত পদার্থ ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিয়ে নিবে। শরীরে চলে আসবে কমনীয় কান্তি।

    মুহিব গত চারদিনে চারটা ট্যাবলেট খেয়েছে। আজ যদি খায় তাহলে শরীরে পঞ্চম ডোজ পড়বে। চোখে প্রবল বেগে পানির ঝাপ্টা দিতে দিতে তার মনে হলো কোনো কারণ ছাড়াই এই যে তার চোখ ফুলে গেল, চেহারায় চিমশে ভাব চলে এসেছে, এইসব ছাগলের লাদির সাইড এফেক্ট না তো? যে ওষুধে নবযৌবন নিয়ে আসবে তার কিছু সাইড অ্যাফেক্ট তো থাকারই কথা। নবযৌবন নিয়ে আসবে ঠিকই, সঙ্গে সঙ্গে নবযৌবন প্রাপ্ত মানুষটার একটা চোখ বসিয়ে দিয়ে যাবে।

    দরজায় টোকা পড়ছে। মুহিবের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, যে দরজায় টোকা দিচ্ছে। সে কোনো একটা কাজ নিয়ে এসেছে। কাজ ছাড়া ভোরবেলায় কেউ বেকার যুবকের কাছে আসে না। হয়তো সকালের নাস্তার ময়দা নেই। মোড়ের দোকান থেকে ময়দা আনতে হবে। কিংবা চিঠি নিয়ে এক্ষুণি কারোর বাসায় যেতে হবে। সেই লোক অফিসে চলে যাবার আগেই তাকে ধরতে হবে।

    যিনি দরজা ধাক্কাচ্ছিলেন তিনি এখন স্ব-গলায় জানান দিলেন। বিরক্ত গলা— মুহিব! মুহিব!

    মুহিবের বড়ভাবি ইয়াসমিনের গলা। এই মহিলা অনেক পরিশ্রম করে তার লায় স্থায়ী বিরক্তি নিয়ে এসেছেন। স্বাভাবিক গল্পগুজবের সময়ও তার গলায় রাজ্যের বিরক্তি ঝরে পড়ে। ভুরু কুঁচকে থাকে, চোখ সরু হয়ে যায়। মুহিব পানির কল বন্ধ করল। জল-চিকিৎসার এইখানেই ইতি।

    এতক্ষণ ধরে দরজা ধাক্কাচ্ছি, ব্যাপার কী?

    বাথরুমে ছিলাম ভাবি, শুনতে পাই নি।

    তোমার কি এখন কোনো জরুরি কাজ আছে?

    মুহিব হাসি মুখে বলল, আমার জরুরি কাজ থাকবে কী জন্যে?

    ইয়াসমিন তীক্ষ্ণ গলায় বলল, প্রশ্নের জবাব প্রশ্ন দিয়ে দেবে না। কাজ আছে কি নেই সেটা বলো।

    কাজ নেই।

    মাঝারি সাইজের দুটা ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ এনে দিয়ে যাবে। পদ্মার ইলিশ আনবে। বার্মিজ ইলিশ পাওয়া যায়। ভুলেও বার্মিজটা আনবে না।

    বার্মিজ ইলিশ পদ্মার ইলিশ চিনব কীভাবে?

    মাছওয়ালাকে জিজ্ঞেস করবে। পদ্মার ইলিশ গোলগাল হয়। বার্মিজটা হয় লম্বা টাইপের। মুখ বোচা। আধাকেজি সরিষা আনবে। পুরনো সরিষা আনবে না। পুরনোটা তিতা হয়। আধাকেজি নতুন রাই সরিষা। কাগজি লেবু। কাঁচামরিচ। দুইশ গ্রাম জিরা। মনে থাকবে?

    অবশ্যই মনে থাকবে।

    মনে থাকবে না। ভুলে যাবে, কাগজে লিখে নাও।

    ভাবি, মনে থাকবে। আমার স্মৃতিশক্তি ভালো।

    কী কী আনতে হবে বলো তো শুনি?

    দুটা পদ্মার ইলিশ। আধাকেজি নতুন রাই সরিষা, কাগজি লেবু, কাঁচামরিচ, দুইশ গ্রাম জিরা। হয়েছে না? দশে দশ পেয়েছি কি-না বলো।

    তুমি আসল ব্যাপারটাই ভুলে গেছ। ডিমওয়ালা ইলিশ। তোমার ভাই ইলিশ মাছ খাবে না। ইলিশ মাছের ডিমের ঝোল খাবে। এক হাজার টাকা রাখ। যা বাচে ফেরত দেবে।

    অবশ্যই ফেরত দেব।

    তোমার ভাইয়ের এক মহিলা কলিগ আছেন, নায়লা নাম। উনার মনে হয় কোনো কাজকর্ম নাই। প্রতিদিন একটা রান্নার রেসিপি বলেন। তোমার ভাই সেটা মাথায় করে বাসায় নিয়ে আসে।

    মুহিব গলা নামিয়ে বলল, প্রেম-ট্রেম হয়ে যায় নি তো ভাবি?

    আমার সঙ্গে রসিকতা করবে না। আমার রসিকতা ভালো লাগে না।

    সরি।

    বড়চাচা তোমাকে ডাকছেন। উনিও কী যেন আনাবেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করে যেও। আর দয়া করে এক্ষুণি একটা কাগজে লিখে নাও কী কী আনতে হবে।

    মুহিব আবারো বাথরুমে ঢুকল। জল-চিকিৎসায় চোখের কিছু হয় নি। শেভ করে মোটামুটি ভদ্রস্থ হবার চেষ্টা করা দরকার। তার চোখের এই অবস্থাটা ভাবি লক্ষ করেন নি। এটা খুবই আশ্চর্যজনক ঘটনা। মনে হচ্ছে এই বাড়ির কেউ এখন তার দিকে ভালো করে তাকায় না। তাকালেও কিছু দেখে না। বোধহয় সে H. G. Wells-এর অদৃশ্য মানব হয়ে যাচ্ছে। একটা পরীক্ষা করা যেতে পারে। সবার সামনে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করবে। অকারণেই কিছু কথাবার্তাও বলা হবে। দেখতে হবে যাদের সামনে ঘোরাঘুরি করা হলো তাদের মধ্যে কতজন বলে–আরে, চোখে কী হয়েছে? কেউ বলবে এরকম মনে হচ্ছে না।

     

    তৌফিকুর রহমান দোতলার বারান্দায় ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছেন। তার পায়ের পাতা রোদে, তিনি ছায়াতে। পায়ের পাতায় ওলিভ ওয়েল মাখানো। ওলিভ ওয়েল সূর্যের ক্ষতিকারক আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি থেকে পা-কে রক্ষা করবে, আবার সূর্যের উপকারী রশ্মি যা শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি করবে তাকে বাধাগ্রস্ত করবে না। তৌফিকুর রহমানের হাতে বিজ্ঞানের একটা বই। লেখকের নাম মিশিও কাকু। বইটার নাম হাইপার স্পেস। ভোরবেলায় তিনি ধর্ম এবং বিজ্ঞানের বই পড়েন। রাতে পড়েন বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি বিষয়ক বই। তৌফিকুর রহমান সাহেবের বয়স ষাটের উপরে। চিরকুমার থাকার কারণে কিংবা নানাবিধ চিকিৎসা পদ্ধতির কারণে চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে নি। যুবক বয়সে তিনি যে অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন তা এখনো বোঝা যায়। নিজের পোশাকআশাক নিয়ে তিনি অত্যন্ত সচেতন। এই ভোরবেলাতেও তিনি ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি পরেছেন। নীল পাড়ের ধবধবে সাদা লুঙ্গি। কোলের উপর ঘিয়া রঙের পাতলা মটকার চাদর ফেলে রাখা। এখন আষাঢ় মাস। চাদরের প্রয়োজন নেই। এই চাদরটা তার সাজসজ্জার অংশ।

    মুহিব বড়চাচার পাশে এসে দাঁড়াল। তৌফিকুর রহমান বই থেকে মুখ না তুলেই বললেন, গুড মর্নিং। তোর খবর কী?

    মুহিব বলল, আমার খবর ভাললা। আপনি আমাকে ডেকেছেন?

    না তো। ভোরবেলাটা আমি একা থাকতে পছন্দ করি। কাউকে ডাকাডাকি করি না।

    মুহিব বলল, বড় ভাবির কাছে শুনলাম আপনি ডেকেছেন।

    তৌফিকুর রহমান বই থেকে চোখ তুললেন। ইজিচেয়ারে সোজা হয়ে বসতে বসতে বললেন, মনে পড়েছে। বড় বৌমাকে বলেছিলাম তোকে খবর দিতে। তুই একবার সময় করে স্বর্ণকারের দোকানে যাবি। আমি রুপা এবং সোনা দিয়ে দুটা হামানদিস্তা বানাব। কত খরচ পড়বে জেনে আসবি।

    রুপা-সোনা দিয়ে হামানদিস্তা বানাতে হবে কেন?

    তৌফিকুর রহমান আগ্রহের সঙ্গে বললেন, রুপা আর সোনা হলো নন রিঅ্যাকটিভ মেটাল। নোবেল মেটাল। আমি যে-সব ওষুধপত্র বানাচ্ছি তার সঙ্গে নোবেল মেটালের তৈরি হামানদিস্তার কোনো রি-অ্যাকশন হবে না।

    রুপা নন রি-অ্যাকটিভ আপনাকে কে বলল? কিছুদিন রেখে দিলেই সিলভার অক্সাইডের কালো আস্তর পড়ে যায়। সোনা দিয়ে বানাতে পারেন। আধ সেরের মতো সোনা লাগবে। ছয় হাজার টাকা করে তোলা। লাখ দুএক টাকা লাগবে।

    বলিস কী? এ তো দেখি বিরাট প্রবলেম!

    পাথরের হামানদিস্তা ব্যবহার করতে পারেন। পাথর ইনার্ট বস্তু। পাথর কোনো রি-অ্যাকশন ফি-অ্যাকশনে যাবে না। ঝিম ধরে থাকবে।

    তৌফিকুর রহমান উৎসাহের সঙ্গে বললেন, কথাটা ভালো বলেছিস। পাথরের হামানদিস্তার কথা আমার মনেই আসে নি। সোনা-রুপা নিয়ে ঘটঘট করছি। তুই খোঁজ নে— কী রকম দাম, কোথায় পাওয়া যায়।

    আচ্ছা।

    জলপাই পাতার এক্সট্রাক্ট খাচ্ছিস তো?

    হুঁ।

    কী মনে হয়, উপকার পাচ্ছিস?

    বুঝতে পারছি না।

    বুঝতে পারবি না কেন? শরীরে সতেজ ভাব আসছে না?

    আসছে মনে হয়।

    ট্রিটমেন্ট শুরুর আগে একবার লিপিড প্রোফাইল করানো হয়েছে। এক মাস পার হবার পর একটা লিপিড প্রফাইল করাবি। আগেরটার সঙ্গে মিলিয়ে দেখব অবস্থা কী। আসলে আমাদের সঙ্গে একজন ফুলটাইম ডাক্তার থাকা দরকার। তোর বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে ডাক্তার আছে?

    নাহ্। আমার সবই বেকার বন্ধু-বান্ধব। এদের মধ্যে যারা যারা চাকরি পাচ্ছে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়ে যাচ্ছে। বেকাররা বেকার ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে মিশতে পারে না।

    চাকরির ব্যাপারটা মাথা থেকে দূর করে দে। স্বাধীনভাবে কিছু করার চিন্তাভাবনা কর। দুইশ বছর ব্রিটিশদের গোলামি করার ফল এই হয়েছে— জাতিগতভাবে আমাদের ডিএনএ-র ভিতর ঢুকে গেছে যে-কোনোভাবে একটা চাকরি করতে হবে। তুই এর ভেতর থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা কর।

    দেখি।

    দেখাদেখির কিছু নেই। কনক্রিট চিন্তা-ভাবনা করে আমার কাছে আয়। অল্প-স্বল্প ক্যাপিটেলের ব্যবস্থা করা যাবে। আমার নিজেরও কিছু চিন্তা-ভাবনা

    বড়চাচা, এখন তাহলে যাই?

    আচ্ছা যা, জলপাই এক্সট্রাক্ট-টা খেতে ভুল করবি না। রোজ ভোরবেলা একটা করে ট্যাবলেট।

    ওষুধটার একটা নাম দেন না কেন! এক্সট্রাক্ট শুনতে যেন কেমন লাগে।

    তৌফিকুর রহমান উৎসাহিত গলায় বললেন, ভালো কথা মনে করেছিস। আমিও নাম নিয়ে ভাবছি। কয়েকটা নাম মনে এসেছে। তুইও চিন্তা-ভাবনা কর। যে-সব নাম মাথায় আসে একটা কাগজে লিখে ফেল। তারপর একদিন বসে নাম সিলেক্ট করে ফেলব।

    মুহিব বলল, এই মুহূর্তে আমার মাথায় একটা নাম ঘুরঘুর করছে। জলপাইবটিকা। নামটা আপনার কাছে কেমন লাগছে?

    তৌফিকুর রহমানের মুখ সঙ্গে সঙ্গে কঠিন হয়ে গেল। তিনি কড়া গলায় বললেন, জলপাই-বুটিকা মানে?

    মুহিব মিনমিন করে বলল, দেশী ওষুধের দেশী নাম।

    তৌফিকুর রহমান গম্ভীর গলায় বললেন, তার কথার ধরন দেখে আমার মনে হচ্ছে, তুই পুরো ব্যাপারটি খুব হালকাভাবে দেখছিস। আমি এনয়েড বোধ করছি। আমি আর দশটা পেনশন খাওয়া মানুষের মতো না। আমি কোনো খেলা খেলছি না। আচ্ছা ঠিক আছে, এখন যা। তোর সঙ্গে পরে এই নিয়ে কথা হবে।

    মুহিব সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় বাঁ চোখে একবার হাত দিল। যা ভাবা গেছে তাই। জল-চিকিৎসায় উল্টা রিঅ্যাকশন হয়েছে। চোখ আরো ফুলেছে। বড়চাচার চোখে পড়ে নি। পড়ার কথাও না। তিনি কারোর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন না। মুহিবের ধারণা— তিনি যদি সরাসরি তার মুখের দিকে তাকিয়েও কথা বলতেন তাহলেও চোখে পড়ত না।

    মুহিবের মা মনোয়ারা রান্নাঘরে। চুলা থেকে দূরে দেয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে উঁচু জলচৌকিতে বসে আছেন। রান্নাবান্না তদারকির জন্যে তিনি অর্ডার দিয়ে জলচৌকিটা বানিয়ে নিয়েছেন। জলচৌকির উপর নারিকেলের ছোবড়া গদিও আছে। সকালের নাশতার সময় তিনি এসে জলচৌকিতে বসেন। দুপুরে রান্না না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই থাকেন। সবকিছু তার চোখের সামনে হতে হয়। তাওয়া থেকে পরোটা নামানোর সময় প্রতিটি পরোটা তাকে দেখিয়ে নিতে হয়। তিনি সারাক্ষণই নির্দেশ দিতে থাকেন— মতির মা! এর নাম পরোটা ভাজা? এক পিঠ হয়েছে আরেক পিঠ কাঁচা। তেলে চপচপ করছে। আমার কি তেলের খনি আছে? একটা পরোটার জন্য যে পরিমাণ তেল দিয়েছ এই তেলে ছোটখাট দুটা পরিবারের এক মাসের রান্না হয়। তোমাকে দিয়ে আমার পোষাবে না মতির মা। তুমি বরং বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট সাহেবের বাড়িতে বাবুর্চির কাজ পাও কি-না দেখ। আমার বাড়িতে তোমাকে দিয়ে হবে না।

    মনোয়ারার অভ্যাস ঘনঘন চা এবং জর্দা দিয়ে পান খাওয়া হয় তার মুখে ময়মনসিংহের স্পেশাল জর্দার পান থাকবে আর নয়তো চা থাকবে। মুখ কখনো খালি থাকবে না। মাঝে মাঝে দুটাই এক সঙ্গে থাকে। গালের এক পাশে পান। জর্দা রেখে দিয়ে অন্য পাশ দিয়ে তিনি না-কি চা খেতে পারেন। তাঁর কোনোই সমস্যা হয় না। তিনি প্রেসারের রোগী। রান্নাঘরে চুলার গরমে তাঁর থাকা নিষেধ, কিন্তু তিনি থাকবেন। এবং তার দুই পুত্রবধূর কারোর না কারোর সঙ্গে একটা ঝগড়ার সূত্রপাত করবেন। এই ঝগড়া তিনি একাই অনেকদূর টেনে নিয়ে যাবেন। রাগ দেখিয়ে দুপুরে ভাত না খেয়ে দরজা বন্ধ করে ঘুমুতে যাবেন। অনেক সাধ্য সাধনা করে সন্ধ্যাবেলায় তার রাগ ভাঙানো হবে। তিনি অবেলায় খেতে বসবেন। ভাত খাবার ঘণ্টাখানিকের মধ্যে তার মেজাজ পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবে। যার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে রাতে তাকে পাশে নিয়েই ডিভিডি প্লেয়ারে হিন্দি ছবি দেখতে বসবেন। ডিভিডি প্লেয়ারটা তার মেজো মেয়ের জামাই সৌদি আরব থেকে পাঠিয়েছে। এটা তার শোবার ঘরে টেলিভিশনের সঙ্গে সেট করা। তিনি প্রতি রাতে ঘুমুবার আগে একটা ছবি দেখেন। এই সময় বাড়ির সব মেয়েকে (কাজের দুটি মেয়েসহ) তার পাশে থাকতে হয়। ছবি দেখা তার অভ্যাসের মতো হয়ে গেছে। যে রাতে তিনি ছবি দেখতে পারেন না সে রাতে তাঁর ঘুম হয় না। প্রেসারে সমস্যা হয়। নিচেরটা ১২০-১২৫ হয়ে যায়।

    মুহিব মায়ের খোঁজে রান্নাঘরে ঢুকল। মুহিবের আসল উদ্দেশ্য তার চোখ ফোলাটা মার নজরে পড়ে কি না। মুহিব বলল, মা চা হবে?

    মনোয়ারা বললেন, না, চুলা দুটাই বন্ধ।

    তোমার লাগবে কিছু? নিউ মার্কেটে যাব।

    ভিডিওর দোকান থেকে একটা ছবি নিয়ে আসিস।

    কী ছবি আনব, নাম বলল।

    কয়লা নামে কোনো ছবি আছে কি-না দেখিস তো। বোবার কাহিনী। শাহরুখ খান আছে, মাধুরী আছে, অমরেশপুরী আছে। সবাই দেখে ফেলেছে, আমার দেখা হয় নি।

    জর্দা-টর্দা কিছু লাগবে না?

    না। রান্নাঘরে এতক্ষণ থাকবি না। কাজের মেয়েরা রান্নাঘরে থাকে। রান্নার সময় এদের কাপড়-চোপড়ের দিকে নজর থাকে না। এই জন্যে পুরুষ মানুষের রান্নাঘরে ঘুরঘুর আমার খুবই অপছন্দ।

    মা, একটু দেখ না এক কাপ চা দেয়া যায় কি-না।

    বললাম তো না। একটা কথা পঞ্চাশবার করে বলতে হবে?

    মুহিব রান্নাঘর থেকে বের হলো। তার চোখের অবস্থা মনোয়ারার নজরে পড়ল না। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার! সে কি সত্যি সত্যি ইনভিজিবল ম্যান হয়ে যাচ্ছে? সব বেকার যুবকের ক্ষেত্রেই কি এটা ঘটে? থাকে মানুষ এক সময় হয়ে যায় ছায়া মানুষ। Shadow Man.

    খাবার ঘরের ডাইনিং টেবিলে নাশতা দেয়া হয়েছে। মুহিবের বড় দুই ভাই পাশাপাশি গম্ভীর মুখে বসে আছে। দুজনকেই চরম বিরক্ত বলে মনে হচ্ছে। বড় ভাই তোফাজ্জল করিমের হাতে খবরের কাগজ। খবরের কাগজ আগে কেউ পড়ে ফেললে সে পড়তে পারে না। এই কারণেই ইয়াসমিন বাড়িতে খবরের কাগজ আসা মাত্র স্বামীর হাতে তুলে দেয়। সকালবেলার মতো ইয়াসমিনের কাজ শেষ। সে চায়ের কাপ হাতে নিজের ঘরে ঢুকে যায়। সবার নাশতা খাওয়া শেষ হবার পর বাড়ি যখন নীরব হয় তখন সে ধীরে সুস্থে নাশতা খেতে বের হয়। কোনোরকম হৈচৈ ইয়াসমিনের পছন্দ হয় না। তার মাথা ধরে যায়।

    মেজো ভাই মোফাজ্জল করিমের স্ত্রী রোকেয়ার সকালটা কাটে অসম্ভব ব্যস্ততায়। রোকেয়ার দায়িত্ব হলো তার দুই মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দেয়া। মেয়ে দুটা যমজ। একজনের নাম ক, আরেকজনের নাম খ। যমজ মেয়ে হবার সংবাদে খুশি হয়ে মোফাজ্জল করিম দুই মেয়ের এই অদ্ভুত নাম রেখেছে। মেয়ে দুটির জন্ম একুশে ফেব্রুয়ারিতে। সেই হিসেবে নাম দুটির হয়তো বা খানিকটা গুরুত্ব আছে। ক এবং খ দুই বোনই স্কুলের যাবার আগে আগে খুব যন্ত্রণা করে। কান্নাকাটি না, হৈচৈ চিৎকার না। ভারী কোনো কিছু আঁকড়ে ধরে বসে থাকে। কার সাধ্য তাদের ছুটিয়ে নিয়ে স্কুলে যায়। ক খ দুই বোনের যন্ত্রণায় বাড়ির সবাই অস্থির। তবে যন্ত্রণার পুরোটাই নীরব যন্ত্রণা। বাড়ির কেউ দুই মেয়েকে কখনো কাঁদতে শুনে নি।

    মুহিব বসার ঘরে ঢুকতেই মোফাজ্জল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তোর ভাবিকে একটু সাহায্য করতো। বিচ্ছ দুটাকে রিকশায় তুলে দে। এরা আমার জীবন নষ্ট করে ফেলল। যে-কোনো একদিন দেখবি বাড়িঘর ছেড়ে সুন্দরবনের দিকে হাঁটা দিয়েছি।

    মুহিব কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। দুই ভাইকে সুযোগ দিল তার দিকে ভালো করে তাকাবার। চোখ নিয়ে কেউ কিছু বলে কি-না তার জানার শখ। কেউ কিছু বলল না। বড় ভাই খবরের কাগজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। মেজোজন চামচ দিয়ে ঠানঠ্যানা পাতলা খিচুড়ি মুখে দিচ্ছে। তার চোখমুখের ভঙ্গি এরকম যেন চামচে করে ইঁদুর মারা বিষ খাচ্ছে।

     

    নটা দশ বাজে।

    মুহিব বসে আছে খায়রুল মিয়ার টি-স্টলে। আল মদিনা রেস্টুরেন্ট। পরোটা, বুন্দিয়া এবং ডিমের ওমলেট দিয়ে সকালের নাশতা করেছে। প্রথম কাপ চা খাওয়া হয়ে গেছে, এখন খাচ্ছে দ্বিতীয় কাপ চা। দ্বিতীয় কাপ চা খাবার ইচ্ছা তার ছিল না। খায়রুল মিয়ার জন্যে খেতে হচ্ছে। সে দুকাপ চা হাতে নিয়ে নিজেই এসে সামনে বসেছে। পান খাওয়া কুচকুচে কালো দাঁত বের করে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল— ভাইজান নেন, ইসপিসাল চা। কাচা পাত্তি।

    খায়রুল মিয়া একজন গলাবিহীন মানুষ। তাকে দেখে মনে হয় তার মাথাটা সরাসরি ঘাড়ে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। আল্লাহপাক গলার ঝামেলায় যান নি। ছোটবেলায় কী যেন সমস্যা হয়ে ভোকাল কর্ড নষ্ট হয়ে গেছে। তার বেশির ভাগ কথাই অস্পষ্ট। খায়রুল মিয়া এই সমস্যা জানে বলেই প্রায় সব বাক্যই সে দুবার তিনবার করে বলে।

    আল মদিনা রেস্টুরেন্টে মুহিব দীর্ঘদিন ধরে চা খাচ্ছে। মানুষটার সঙ্গে মুহিবের ভালো খাতির আছে। খায়রুল নামের মানুষটার পরিশ্রম করার ক্ষমতা এবং ব্যবসাবুদ্ধি দেখে সে মুগ্ধ। ছাপড়া ঘর দিয়ে টি-স্টল শুরু করেছিল। তখন সে নিজেই চা বানাত। আজ সেই টি-স্টল হুলুস্থুল ব্যাপার হয়েছে। বিরাট সাইন। বোর্ড দি আল মদিনা রেস্টুরেন্ট। দুপুরে এই রেস্টুরেন্টে সিট পাওয়া কঠিন ব্যাপার। আল মদিনার মুড়িঘণ্ট এবং গরু ভুনার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। পাশের ঘরটাও খায়রুল মিয়া নিয়ে নিয়েছে। সেখানে বসেছে টেলিফোনের দোকান। টিএন্ডটি এবং মোবাইল লাইন। সস্তায় দেশে-বিদেশে টেলিফোনের সুযোগ। এর সঙ্গে জিরক্স মেশিন আছে, স্টেশনারি জিনিসপত্র, বই-খাতা, পেনসিলও পাওয়া যায়। খায়রুল মিয়ার রেস্টুরেন্ট যেমন চালু এই দোকানটাও সে-রকমই চালু। এখন খায়রুল মিয়ার মাথায় ঢুকেছে শাড়ির দোকান। বেইলী রোডে সে একটা শাড়ির দোকান দিতে চায়।

    খায়রুল বলল, ভাইজানের চোখে কী হয়েছে?

    মুহিব বলল, জানি না।

    পোকায় কামড় দিছে? পোকা-মাকড় কামড় দিছে?

    দিতে পারে।

    ওষুধপত্র কিছু দিছেন?

    উঁহু।

    ব্যথা আছে? ব্যথা?

     

    মুহিব জবাব দিল না। চোখ প্রসঙ্গে এত কথা বলতে তার ইচ্ছা করছে না। খায়রুল তার দিকে ঝুঁকে এসে বলল, শাড়ির দোকানটা নিয়ে চিন্তা নিছেন? নিছেন কোনো চিন্তা?

    কী চিন্তা নেব?

    আপনাকে কী বলেছি— পুরাটা আপনার হাতে দিয়ে দিব। ক্যাপিটেল আমার, ব্যবসা আপনার। মাসের শেষে হিসাব-নিকাশ হবে।

    আরে দূর দূর।

    দূর দূর কী জন্যে? ব্যবসা কি খারাপ জিনিস? আমাদের নবিজি কি ব্যবসা করেন নাই? করেন নাই ব্যবসা? আমাদের নবিজি।

    মুহিব বিরক্ত গলায় বলল, নবিজি শাড়ির দোকান দেন নাই। মেয়েরা আসবে, গায়ের উপর শাড়ি ফেলে দেখাতে হবে শাড়ি গায়ে দিলে কেমন লাগবে। তিনশ শাড়ি নামাবে, কচলায়ে কচলায়ে দেখবে, তারপর না কিনে চলে যাবে পাশের দোকানে। আমি এর মধ্যে নাই।

    ভাইজান, এইগুলা তো আপনি করবেন না। কর্মচারী এইগুলা করবে।

    আমি কী করব?

    আপনি ক্যাশ দেখবেন। ব্যবসা দেখবেন।

    আমি ক্যাশবাক্সের সামনে বসে টাকা গুনব? ভুলে যান।

    ফট করে না বলা ঠিক না। চিন্তা করেন। চিন্তা করেন। চিন্তা করেন। চিন্তার প্রয়োজন আছে।

    এটা নিয়ে চিন্তা করার কিছু নাই।

    দোকান শুরু করতে আমার দেরি আছে। আরো দুই তিনমাস লাগবে। আপনি চিন্তা করেন। আপনাকে তো আমি কর্মচারী হতে বলতেছি না— আমি ব্যবসার শেয়ার দিব।

    চুপ করেন তো দেখি। ফ্যাসফ্যাস করে অনেক কথা বলে ফেলেছেন। আরো কথা বললে গলা পুরোপুরি অফ হয়ে যাবে। নিঃশব্দে চা খান। আমি এখন কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। কথা বললে আমার ডিসটার্ব হবে। সিদ্ধান্ত নিতে পারব না।

    কী সিদ্ধান্ত?

    কী সিদ্ধান্ত সেটা আপনার জানার দরকার নাই। আপনার শাড়ির দোকান বিষয়ক সিদ্ধান্ত না। ব্যক্তিগত ব্যাপার।

    আমি কি আপনার সামনে থেকে চলে যাব? চলে যাব ভাইজান?

    যান, চলে যান।

    খায়রুল মিয়া উঠে গেল। হাসান ঘড়ির দিকে তাকাল সাড়ে নটা বাজে। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এই মুহূর্তে নিয়ে নিতে হবে। হাতে সময় নেই।

    সিদ্ধান্ত এক,

    ইলিশ মাছ কেনার জন্যে নিউ মার্কেটে যাওয়া যাবে না। ইলিশ মাছ কিনতে গেলে যথাসময়ে চাকরির ইন্টারভিউতে হাজির হওয়া যাবে না।

    সিদ্ধান্ত দুই,

    ইলিশ মাছ কাউকে দিয়ে কেনাতে হবে। দায়িত্বটা দিতে হবে খায়রুল মিয়াকে। এই লোকটি নিখুঁতভাবে দায়িত্ব পালন করবে।

    সিদ্ধান্ত তিন,

    যেহেতু মাছ কিনতে যাওয়া হচ্ছে না, হাতে সময় আছে— এই সময়টা আনন্দে কাটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। টেলিফোনে নোরার সঙ্গে কথা বলা যায়। তার একটা বিপদ অবশ্যি আছে। নোরা বলে বসতে পারে— কী করছ, এক্ষুণি চলে আস তো। নোরা বললে অবশ্যই সব ফেলে দিয়ে চলে যেতে হবে। ইন্টারভিউ দেয়া হবে না। তখন মনে হবে কীসের ইন্টারভিউ, কীসের কী?

    মুহিব ভুরু কুঁচকে আছে। সে যে গভীর চিন্তায় ড়ুবে আছে এটা তার লক্ষণ। তার বুকে ধুকধুক শব্দ হচ্ছে। ধুকধুক শব্দ নিশ্চয়ই সারাক্ষণ তার বুকে হচ্ছে। কিন্তু সে শুনতে পায় শুধু যখন তার ভুরু কুঁচকে থাকে। ব্যাপারটা কি শুধু তার একার ক্ষেত্রে ঘটে, না সবার ক্ষেত্রে ঘটে? দি আল মদিনা রেস্টুরেন্টের মালিক খায়রুল মিয়ার বুকও কি গভীর চিন্তার সময় ধুকধুক করে?

     

    খায়রুল মিয়া তার পাশে রাখা চিলমচিতে পানের পিক ফেলতে ফেলতে বলল, ডিমওয়ালা ইলিশ কিনবেন কী জন্যে? ডিমওয়ালা ইলিশে স্বাদ হবে না।

    মুহিব বলল, স্বাদের দরকার নাই, আমার দরকার ডিম। বড়ভাইজানের খায়েস হয়েছে ইলিশ মাছের ডিম খাবেন।

    তাহলে এক কাজ করি, ধূপখোলার বাজারে ইলিশ মাছের ডিম আলাদা বিক্রি হয়। সেখান থেকে ডিম কিনে আনি আর আলাদা একটা ডিমছাড়া ইলিশ কিনি। ডিম আলাদা। মাছ আলাদা।

    যা ইচ্ছা করেন, শুধু মনে রাখবেন সকাল সকাল বাজার পৌঁছাতে হবে। লিস্টে যা যা লেখা সব যেন যায়। আরেকটা কথা, আমার সঙ্গে কথা বলার সময় দুবার তিনবার করে কিছু বলবেন না। শুধু শুধু সময় নষ্ট। আমি আপনার ঠোঁট নাড়া দেখেই বুঝতে পারি কী বলছেন।

    আপনি যান কই?

    আমি কোথায় যাই তা দিয়ে আপনার কোনো দরকার নেই। যা করতে বলছি করেন।

    কাঁচা সুপারি দিয়ে একটা পান খাবেন? হার্টের জন্যে ভালো।

    পান খাব না। আমার হার্টের ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন নেই। হার্ট ভালো আছে। বকরি লাদির ট্রিটমেন্ট চলছে।

    খায়রুল মিয়া গলা নামিয়ে বলল, ভাইজান, আজ সন্ধ্যার পর কি কোনো কাজ আছে?

    কেন?

    আমি যে ফ্ল্যাটটা কিনলাম আপনাকে দেখাতাম। মনে খায়েশ ছিল।

    দেখি, যদি সময় করতে পারি।

    ফার্নিচার কিনি নাই। আপনাকে সাথে নিয়ে কিনব।

    আমাকে সাথে নিয়ে কিনবেন কেন?

    কোনটা ভালো কোনটা মন্দ এটা তো আমি বুঝব না। বুঝেন না ভাইজান আমি পথের কাঙাল ছিলাম। পঞ্চাশ টাকা ভাড়ার বস্তির ছাপড়ায় থাকতাম। এখন পয়সা হয়েছে, কিন্তু মনের কাঙাল ভাব দূর হয় নাই।

    দেখি, যদি সময় করতে পারি…

    খুবই খুশি হবো ভাইজান। রাতে আমার সাথে খানা খাবেন। কী খাবেন। বলেন— খিচুড়ি আর মুরগি ঝালাই করি। মুরগি ঝালফ্রাই মজনু বাবুর্চিকে দিয়ে করাব। একবার খেলে বাকি জীবন আর ভুলতে পারবেন না। বলি মজনু বাবুর্চিকে? বলি ভাইজান, বলি?

    মুহিব প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলো। এখানে থাকা মানেই খায়রুল মিয়ার বকবকানি শোনা। সে বকবক করেই যেতে থাকবে। অতি ব্যস্ত মানুষদের বকবক করার স্বভাব থাকে না। এই লোকটার আছে। তার গলা দিয়ে শব্দ বের হয় না। তারপরেও সে কথা বলতেই থাকে। খায়রুল মিয়ার টেলিফোনের দোকান থেকে মুহিব নোরাকে টেলিফোন করল। প্রথমবার রিং হতেই নোরা ধরল। হ্যালো শব্দটা এত সুন্দর করে বলল যেন এটা কোনো ইংরেজি শব্দ না, এটা বাংলা গানের সঞ্চারী। মুহিব বলল, কী খবর নোরা?

    নোরা বলল, আপনি কে বলছেন জানতে পারি কি?

    বুকে ধাক্কা লাগার মতো বাক্য। এখনো কি নোরা তার গলা আলাদা করে চিনতে পারে না? না-কি সে চিনেও ভান করে চিনতে পারছে না। অবশ্যি এও হতে পারে যে আপনি কে বলছেন জানতে পারি কি বাক্যটি নোরা অভ্যাসবশত বলে। হয়তো খুব ছোটবেলায় তাকে শেখানো হয়েছে— কেউ টেলিফোন করলে প্রথমেই বলবে— আপনি কে বলছেন জানতে পারি কি? যে টেলিফোন করেছে তার পরিচয় জানার পর অন্য কথা বলবে। ছোটবেলার অভ্যাস এখনো রয়ে গেছে।

    নোরা, আমি মুহিব।

    ও আচ্ছা, তুমি? কী করছ?

    কিছু করছি না।

    নোরা খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল, আমি কী করছি বলো তো? তুমি কল্পনা করতে পারবে না এমন একটা জিনিস করছি।

    সেটা কী?

    নোরা হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, সিগারেট খাচ্ছি। সকালে চায়ের সঙ্গে প্রথম সিগারেট খেয়েছি। এখন তো প্রায় দশটা বাজছে, এর মধ্যে চারটা সিগারেট খেয়ে ফেলেছি। চতুর্থটা এখনো শেষ হয় নি। হাতে আছে।

    মুহিব বিস্মিত গলায় বলল, সিগারেট খাচ্ছ কেন?

    খেয়ে দেখছি কেমন লাগে। তেমন কোনো গুড ফিলিং হচ্ছে না, তবে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। খুব পানির পিপাসা হচ্ছে। এক জগ পানি খেয়ে ফেলেছি, তারপরেও পানির পিপাসা যাচ্ছে না।

    মুহিব বলল, সত্যি সিগারেট খাচ্ছ?

    নোরা বলল, হ্যাঁ। না খেলে মিথ্যা করে কেন বলব? এই মুহূর্তে আমি কী করছি মন দিয়ে শোন। আমি ডিভানে শুয়ে আছি। আমার হাতে একটা বই। বইটার নাম— Easy Hypnosis. বাবাকে বলে দিয়েছিলাম আমেরিকা থেকে আসার সময় আমার জন্যে মেসমেরিজম আর হিপনোটিজমের বই আনতে। বাবা হিপনোটিজমের দুটা বই এনেছেন। একটা শেষ করে ফেলেছি। দ্বিতীয়টা পড়ছি। আঠারো পৃষ্ঠা পড়া হয়ে গেছে।

    হঠাৎ হিপনোটিজমের বই পড়ছ কেন?

    কী করে মানুষকে হিপনোটাইজ করা যায় এটা শেখার জন্যে। পুরোপুরি শেখার পর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ম্যাজিশিয়ানরা যেমন যাদু দেখায় আমি হিপনোটিজমের খেলা দেখাব। কোনো একজন দর্শককে স্টেজে ডেকে এনে হিপনোটাইজ করব। তারপর তাকে বলব— আপনি এখন মানুষ না। আপনি একটা বড় সাইজের কোলা ব্যাঙ। আপনি স্টেজে লাফাতে থাকুন। সে তখন ব্যাঙের মতো লাফাতে লাফাতে স্টেজের এ-মাথা ও-মাথা যাবে। মজা হবে না?

    হবার তো কথা।

    এই শোন, তুমি যেখানে আছ সেখান থেকে কি আকাশ দেখা যায়?

    হ্যাঁ যায়।

    আকাশে মেঘ আছে?

    সামান্য, বেশি না। কেন বলো তো?

    আকাশ যদি খুব মেঘলা হয়ে থাকত আর ঝুমঝুম করে বৃষ্টি পড়ত, এক্ষুণি বৃষ্টি হবে, এক্ষুণি বৃষ্টি হবে ভাব থাকত তাহলে তোমাকে আসতে বলতাম।

    আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। মনে হয় সন্ধ্যার দিকে বৃষ্টি হবে। তুমি বললে আমি চলে আসতে পারি। আমার কোনো কাজ নেই।

    তোমার কাজ না থাকলেও আমার আছে। আমি এখন গভীর মনোেযোগ দিয়ে বই পড়ছি। তবে ঝুমঝুম করে বৃষ্টি হলে অবশ্যই তোমাকে আসতে বলতাম। আচ্ছা শোন, ঝুমঝুম করে বৃষ্টি শুরু হলে তুমি চলে এসো। আসার সময় আমার জন্যে দুটা জিনিস নিয়ে আসবে। একটা হচ্ছে লটকন।

    অবশ্যই লটকন নিয়ে আসব। আরেকটা কী?

    সিডির দোকানে যাবে। একটা গানের সিডি কিনে আনবে নাম উড়ালপঙ্খি।

    সিংগারের নাম বলে দাও।

    কী আশ্চর্যর কথা, সিংগারের নাম তুমি জানো না?

    না। তোমার গাওয়া না-কি?

    হ্যাঁ।

    কবে বের হয়েছে?

    গত মাসে।

    কই আমাকে তো কিছু বললা নি!

    এটা কি ঢাক পিটিয়ে বলার মতো কোনো ঘটনা? এমন তো না এটা আমার জীবনের প্রথম সিডি। কাসুন্দি আনতে পারবে? কাসুন্দি দিয়ে লটকন মাখিয়ে ভর্তা বানিয়ে খাব। এখন সব বড় বড় গ্রোসারি সপে পাওয়া যায়।

    পাওয়া গেলে নিয়ে আসব।

    ঝুম বৃষ্টি নামলে তবেই আসবে। খটখটে শুকনা সময়ে যদি আস তাহলে আমি কিন্তু উপর থেকে নিচেই নামব না। আমি টেলিফোন রেখে দিচ্ছি। আমার গায়ের উপর সিগারেটের ছাই পড়ে গেছে। সিগারেট খাবার সবচে বিরক্তিকর অংশ হলো ছাই ঝাড়া। সাইনটিস্টরা এত কিছু আবিষ্কার করছে ছাইবিহীন সিগারেট আবিষ্কার করতে পারছে না কেন?

    খট করে শব্দ হলো। নোরা তার অভ্যাসমতো হঠাৎ টেলিফোন রেখে দিয়েছে। মুহিব এখনো রিসিভার কানে ধরে আছে। ক্লান্তিকর টু টু শব্দ। মুহিবের মনে হলো সে অনন্তকাল ধরে টেলিফোন রিসিভার কানে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কান থেকে রিসিভার নামাতে ইচ্ছা করছে না। এখন সে যদি নোরাকে আবারো টেলিফোন করে, নোরা আগের মতোই বলবে— আপনি কে বলছেন জানতে পারি কি? মুহিব যদি তার পরিচয় দেয় তাহলে সে আবারো উৎসাহের সঙ্গে কথা বলা শুরু করবে। তারপর এক সময় আচমকা বলবে— রাখি কেমন? বলেই খট করে টেলিফোন রেখে দেবে।

    নোরাকে আরেকবার টেলিফোন করতে ইচ্ছা করছে কিন্তু হাতে সময় নেই। ইন্টারভিউ দিতে যেতে হবে। ছয়-সাতজন গম্ভীর এবং বিরক্ত মুখের মানুষের সামনে হাসি হাসি মুখ করে বসতে হবে। বিরক্ত মানুষরা সবাই ভাব করবে তারা সাধারণ কেউ না, তারা অতীশ দীপঙ্কর টাইপ মহাজ্ঞানী। এদের মধ্যে একজন থাকবে চার্লি চ্যাপলিন ধাচের। রসিকতা করার চেষ্টা করবে, ফাজলামি করার চেষ্টা করবে। কথা বলবে গ্রাম্য ভাষায়। তার ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ খাটি ব্রিটিশ একসেন্টে ইংরেজিতে কথা বলবে। বুঝানোর জন্যে যে আমি একটু আগে গ্রাম্য ভাষায় কথা বলছি এটা আমার পরিচয় না। গ্রাম-প্রীতির কারণে কাজটা করেছি। একজন থাকবে, যে-কোনো প্রশ্ন করবে না তার কাজ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। ভাব এরকম যে, আমার প্রশ্ন করার দরকার নেই। মুখের দিকে তাকিয়েই আমি সবকিছু বুঝে ফেলতে পারি। একজন থাকবে বিজ্ঞান-মনস্ক টাইপ। বিজ্ঞানের জটিল সব প্রশ্ন করবে, যার উত্তর দেয়া সম্ভব না। উত্তর না পেয়ে সেই গাধা মাথা নাড়তে নাড়তে মধুর ভঙ্গিতে হাসবে। হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দেবে— এখনকার ছেলেমেয়েরা বিজ্ঞানের কিছুই জানে না। এতে সে অত্যন্ত ব্যথিত।

    মুহিব তার চার বছরের বেকার জীবনে অনেক ইন্টারভিউ দিয়েছে। প্রতিটা ইন্টারভিউর একই চেহারা। দ্যা এরনসে সে চার মাস আগে একবার ইন্টারভিউ দিয়েছে। তার দ্বিতীয়বার ডাক পড়েছে। দ্বিতীয়বার ডাকের অর্থ কি এই যে চাকরি হবে? মুহিবের তা মনে হয় না। তার ধারণা এই কোম্পানির কোনো কাজ-কর্ম নেই। কোম্পানির ডিরেক্টররা চার পাঁচবার করে ইন্টারভিউ নিয়ে কাজ দেখাচ্ছেন। প্রথমবারের ইন্টারভিউ মোটেই ভালো হয় নি। সে কোনো প্রশ্নের জবাব পারে নি। এক ভদ্রলোক হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন— মর্মাহত শব্দটার মানে কী? বাংলায় কথা বলার সময় আমরা প্রায়ই বলি— এই ঘটনায় আমি মর্মাহত। অর্থাৎ সে মর্মে আহত; মর্ম জিনিসটা কী?

    মুহিব শুকনা গলায় বলেছিল, জানি না স্যার।

    মর্ম কী তুমি জানো না?

    জি-না স্যার।

    তোমার কোনো অনুমান আছে? তোমার কী মনে হয়— মর্ম কী?

    আমার ধারণা মর্ম হলো মন।

    মন মানে কী?

    মুহিব অস্বস্তির সঙ্গে বলল, মন হলো চেতনা। ইন্টারভিউ বোর্ডের সবাই হো হো করে হাসতে শুরু করল। তাদের ভাব এরকম যেন জীবনে এত হাসির কথা কেউ শুনে নি। তখন চার্লি চ্যাপলিন বাবাজি গম্ভীর গলায় বললেন, আপনার নাম মুহিব। মুহিব নামের অর্থ কী?

    মুহিব বলল, মুহিব নামের অর্থ প্রেমিক।

    আবারো হাসি শুরু হলো।

    এইখানেই তার ইন্টারভিউর সমাপ্তি। বলা যেতে পারে হাস্যকর সমাপ্তি। এ ধরনের ইন্টারভিউর পর আবারো তাকে কেন ডাকা হলো সে জানে না। জানার দরকারও নেই। তার জীবনটা একটা রুটিনের ভিতর পড়ে গেছে। এই রুটিনে মাঝে মধ্যে তাকে ইন্টারভিউ দিতে হবে। সে দিয়ে যাচ্ছে। ব্যস।

     

    মাঝারি ধরনের ঠাণ্ডা ঘরে মুহিব বসে আছে। ঘরে এসি চলছে। দরজা-জানালা সবই বন্ধ। মুহিব ছোটখাট এক ভদ্রলোকের সামনে বসে আছে। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের উপরে বলে মনে হচ্ছে। কত উপরে তা ধরা যাচ্ছে না। ভদ্রলোকের চেহারা শান্ত। তাকানোর ভঙ্গি শান্ত। কিছু কিছু মানুষ আছে প্রবল বড়-ঝঞার সময়ও যাদের দেখে মনে হয় বেশ শান্তিতে আছেন। ভদ্রলোক ঐ টাইপের। তিনিই সম্ভবত মুহিবের ইন্টারভিউ নেবেন। এই ভদ্রলোক কি প্রথম ইন্টারভিউ-র সময় ছিলেন? মুহিব মনে করতে পারছে না। মনে হয় ছিলেন না। থাকলে চেহারা মনে থাকত। ভদ্রলোক একাই মনে হয় ইন্টারভিউ নেবেন। প্রথম প্রশণটা কী হবে—আপনার নাম? বেশির ভাগ সময়ই এই প্রশ্ন দিয়ে শুরু হয়। দ্বিতীয় প্রশ্ন— এই নামের অর্থ কী? নামের অর্থ শুনে তিনি হাসাহাসি শুরু করবেন না তো? এইবার নামের অর্থ জিজ্ঞেস করলে ভুল অর্থ বলতে হবে। নামের অর্থ প্রেমিক না বলে সে বলবে সন্দেহকারী।

    মুহিবের সামনের ভদ্রলোক রিভলভিং চেয়ারে বসে আছেন। যারা রিভলভিং চেয়ারে বসে তারা সারাক্ষণই চেয়ার নিয়ে কিছু নড়াচড়া করে। এই ভদ্রলোক তা করছেন না। প্রশ্ন করবার সময় হয়তো করবেন। মুহিব প্রথম প্রশ্নের জন্যে অপেক্ষা করছে। ঘরটা বেশি ঠাণ্ডা। তার রীতিমতো শীত করছে। হয়তোবা বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। বাইরের আবহাওয়া ঠাণ্ডা হয়ে গেলে এসি বসানো ঘর বরফ শীতল হয়ে যায়। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে কি-না জানতে পারলে ভালো হতো। ঝুম বৃষ্টি হলে যেতে হবে নোরার কাছে। মুহিবের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে ইন্টারভিউ শেষ করে ঘর থেকে বের হয়েই সে দেখবে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। রাস্তায় হাঁটু পানি। যদি সে-রকম হয় সে যে কাজটা করবে তা হলো— রিকশা নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলে যাবে। সেখানে কদম ফুল বিক্রি হয়। নোরার জন্যে কিছু কদম ফুল কিনতে হবে। সিড়ি কিনতে হবে। সিডির নাম উড়ালপখি। উড়ালপখি মানে কী? যেই পাখি উড়ছে সেই পাখি? তাহলে বসে আছে যে পাখি তারে কী বলা হবে? বসালপঙ্খি? মাই গড, মস্ত একটা ভুল হয়ে গেছে তোমার জন্যে ডিভিডি ভাড়া করে আনা হয় নি। আজ রাতে বাসায় ফিরতে তার দেরি হবে। মা ছটফট করতে থাকবে ছবির জন্যে। ছবির নাম কয়লা।

    আপনার চোখে কী হয়েছে?

    মুহিব অন্য কিছু ভাবছিল বলেই হয়তো প্রশ্ন শুনে চমকে গেল। তার বুক ধড়ফড় করে উঠল। মনে হলো প্রশ্নটা খুবই কঠিন। এত কঠিন প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারবে না। তার চোখ যে ফুলে বন্ধ হয়ে আছে এটাও তার মনে ছিল না।

    মুহিব হড়বড় করে বলল, স্যার, চোখে কী হয়েছে আমি জানি না। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি এই অবস্থা।

    চোখ উঠে নি তো?

    বুঝতে পারছি না স্যার।

    ভদ্রলোক রিভলভিং চেয়ার সামান্য ঘুরালেন। শান্ত গলায় বললেন—১৯৭১ সনে সারা বাংলাদেশে চোখ উঠা রোগ হয়েছিল। এমন কোনো মানুষ ছিল না যার এই রোগ হয় নি। রোগটার নাম দেয়া হয়েছিল ‘জয় বাংলা’ রোগ। এমন প্রায়ই হয়েছে এই রোগে আক্রান্ত পাকিস্তানি মিলিটারিও চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে, আবার যে মুক্তিযোদ্ধাকে সে গুলি করে মারার জন্যে ধরে নিয়ে এসেছে সেও চোখ লাল করে মিলিটারির দিকে তাকিয়ে আছে।

    মুহিব চুপ করে আছে। এই গল্পটা শুনে তার কী রি-অ্যাকশন হওয়া উচিত সে বুঝতে পারছে না। সে কি হাসবে? এটা কি হাসির গল্প? মুহিব বলল— স্যার, আমার জন্ম ১৯৭১-এর পরে।

    সেটা জানি, জন্ম তারিখ অ্যাপ্লিকেশন ফরমে লেখা আছে। আমি আপনার ফাইল পড়ে দেখলাম। Extracuriculam activitis-এর কলামে আপনি লিখেছেন— আমার কোনো প্রতিভা নেই। আমি প্রতিভাশূন্য মানুষ। আপনার কি সত্যই ধারণা আপনার কোনো প্রতিভা নেই?

    জি স্যার। আমার নিজের এবং আমার বন্ধুবান্ধবদের আমার সম্পর্কে এই ধারণা।

    একজন প্রতিভাশূন্য মানুষকে আমরা চাকরি দেব কী জন্যে?

    চাকরি করার জন্য প্রতিভার দরকার হয় না স্যার।

    কীসের দরকার হয়?

    বুদ্ধির দরকার। আমার বুদ্ধি আছে। আমি পরিশ্রম করতে পারি।

    বুদ্ধি আছে?

    জি স্যার আছে।

    আমরা দুজনকে রিক্রুট করেছি। একজন ছেলে একজন মেয়ে। আপনি দুজনের মধ্যে একজন। কী কারণে আপনাকে রিক্রুট করা হয়েছে সেটা অনুমান করে বলুন। দেখি আপনার বুদ্ধি আছে কি-না।

    মুহিব সহজ ভঙ্গিতে বলল, আমাকে চাকরি দেবার আলাদা কোনো কারণ নেই। আমার ধারণা আমাকে আপনারা নিয়েছেন কারণ আমার চেহারা সুন্দর।

    আপনার ধারণা ঠিক আছে। আপনার বুদ্ধি ভালো। অফিসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে হাতে নিয়ে যান। আগামী মাসের এক তারিখে চাকরিতে জয়েন করতে পারেন। Welcome to the Aarons.

    ভদ্রলোক হ্যান্ডশেক করার জন্যে হাত বাড়িয়েছেন। মুহিবের ইচ্ছে করছে হেন্ডশেক না করে ভদ্রলোকের পা ছুঁয়ে সালাম করতে। সবচে ভালো হয় সে যদি কার্পেটের উপর হামাগুড়ি দিয়ে ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে যায়। ভদ্রলোকের পায়ে কিছুক্ষণ মুখও ঘষা যেতে পারে। কুকুররা মনিবের কাছে গেলে কোলে উঠার জন্যে এরকম করে।

     

    মুহিব ম্যানেজার সাহেবের ঘরে বসে আছে। এই ঘরের বড় বড় জানালা খোলা। পর্দা এক পাশে টেনে দেয়া। দোতলার এই ঘর থেকে আকাশ দেখা যাচ্ছে। রাস্তাঘাট দেখা যাচ্ছে। মুহিব জানালা থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। তার উচিত অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারের কথা ভুলে গিয়ে রাস্তায় নেমে পড়া। ভিজতে ভিজতে নোরাদের বাড়িতে চলে যাওয়া। কিছু কিছু বৃষ্টি আছে দেখলেই ভিজতে ইচ্ছা করে। এখন সেই ধরনের বৃষ্টি হচ্ছে। অথচ তাকে ম্যানেজার সাহেবের ঘরে বসে থাকতে হচ্ছে। তার সময় কাটছে না। ম্যানেজার ভদ্রলোক স্বল্পভাষী। একবার শুধু বললেন, আপনি কবে জয়েন করবেন?

    মুহিব বলল, জানি না।

    ব্যস এই পর্যন্তই কথা। ম্যানেজার একজন বেয়ারাকে চোখের ইশারায় কী যেন বলল। সে মুহিবকে এক কাপ চা দিয়ে গেল। চা-টা খেতে ভালো। সুন্দর গন্ধ। এরকম চা পরপর দুকাপ খেতে হয়। কিন্তু দ্বিতীয় কাপ চায়ের কথা তার বলতে ইচ্ছা করছে না। মুহিব ভেতরে ভেতরে টেনশন বোধ করছে। তার মনে হচ্ছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পেতে পেতে বৃষ্টি থেমে যাবে। আকাশে অবশ্যি ঘনকালো মেঘ এখনো আছে। যেভাবে বৃষ্টি পড়ছে— আকাশের সব মেঘ ধুয়ে মুছে চলে যাবে। মুহিব চেয়ার ছেড়ে জানালার পাশে দাড়াল। আকাশের দক্ষিণ দিকটা নজর করে দেখতে হবে। দক্ষিণের সমুদ্র থেকে মেঘের সাপ্লাই যদি ঠিক থাকে তাহলে বৃষ্টি আরো ঘণ্টা দুই থাকবে।

    রাতে দেখা স্বপ্নটা মনে পড়েছে। তার মানে দুপুর হয়ে গেছে। রাতের স্বপ্ন তার সব সময় দুপুরে কেন মনে পড়ে? ম্যানেজার সাহেবকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে?

    মুহিব সাহেব।

    জি।

    নিন— এইখানে সই করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা নিন। কনগ্রাচুলেশন্স।

    মুহিব অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে নিল। অতিদ্রুত চোখ বুলালো। অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। বেসিক পে দশ হাজার টাকা। হাউজরেন্ট, মেডিকেল অ্যালাউন্স সব মিলিয়ে পনেরো হাজার ছয়শ। প্রবেশনারি পিরিয়ড পার করলে রেগুলার পে-স্কেল শুরু হবে। রেগুলার পে-স্কেলটা কত? প্রবেশনারি পিরিয়ডটাই বা কত দিনের? মুহিব জানালা দিয়ে তাকাল। বৃষ্টি পড়া বন্ধ হয় নি। বরং বৃষ্টির জোর আরো বেড়েছে। মনে হচ্ছে পুরো ঢাকা শহর আজ বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যাবে।

     

    নোরাদের বাড়ির গেটের দারোয়ানের নাম ইসকান্দর। নোরা এই নাম সংক্ষেপ করে নিয়েছে। সে ডাকে ইস। ইসকান্দর থেকে ইস, কান্দর বাদ। নোরা যখন বলে, ইস ভাই, ছুটে চলে যান। খুব ঠাণ্ডা দেখে এক বোতল স্পাইট নিয়ে আসুন। গেট খোলা থাকুক। পাঁচ মিনিটের বেশি তো আপনার লাগবে না। এই পাঁচ মিনিটে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটার সম্ভাবনা কম। ইস ভাই নিতান্তই অনিচ্ছার সঙ্গে যায়। ইস ভাইয়ের বয়স ষাটের কাছাকাছি। দীর্ঘ ত্রিশ বছর সে নোরাদের বাড়ির গেটের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাটিয়েছে। গেট থেকে সামান্য দূরে গেলেই সে মনে হয় অস্থির বোধ করে। হয়তো নিজেকে সে গেটের অংশ বলেই এখন ভাবে।

    তুমুল বৃষ্টির মধ্যেও ইসকান্দরকে দেখা গেল ছাতা মাথায় দিয়ে টুলের উপর বসে আছে। মুহিব গেটের ওপাশ থেকে আনন্দিত স্বরে বলল, ইস ভাইয়া, গেটটা খুলুন।

    ইসকান্দর তাকাল। রাগী গলায় বলল, আমারে ইস ভাইয়া ডাকবেন না। আমার পিতামাতা আমার একটা নাম দিয়েছিল।

    মুহিব বলল, সরি, আর ডাকব না। গেটটা খুলুন।

    ইসকান্দর মুহিবের উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে বলল, গেট খোলা যাবে না।

    যাবে না কেন?

    আপা বাড়িতে নাই।

    মুহিব পরিষ্কার বুঝতে পারছে এটা একটা মিথ্যা কথা। ইস ভাইয়া ডাকায় দারোয়ান রেগে গেছে। দারোয়ানদের রাগের দৌড় গেট পর্যন্ত বলেই গেট খোলা হচ্ছে না। মুহিব বলল, ইসকান্দর শুনুন, আমি আপনার আপার কাছে এসেছি এটা আপনাকে কে বলল? আমি নোরার বাবার সঙ্গে কথা বলার জন্যে এসেছি। উনি কি বাসায় আছেন?

    আছেন।

    উনাকে খবর দিন।

    মুহিবের ধারণা ছিল এই কথায় দারোয়ানের হুশ হবে। সে গেট খুলে দেবে। মিনমিনে গলায় বলবে, আপা বাসায় আছে। আমার ইয়াদ ছিল না। আসেন, ভিতরে আসেন। সে-রকম কিছু ঘটল না। দারোয়ান টুল ছেড়ে ভেতরের দিকে চলে গেল।

    মুহিবের বুক ঈষৎ কেপে গেল। সত্যি কি নোরা বাড়িতে নেই? দারোয়ান কি নোরার বাবাকে খবর দিতে গিয়েছে? মুহিবের হাতে সাতটা দোলনচাপা। প্রবল বৃষ্টিতেও ধবধবে সাদা ফুলগুলির কিছু হয় নি। বরং সে নিজে চুপসে গেছে। ঠাণ্ডায় শরীর কাঁপছে। আয়নার সামনে দাঁড়ালে হয়তো দেখা যাবে ঠাণ্ডায় এবং বৃষ্টির পানিতে তার ঠোঁট নীলচে হয়ে গেছে। নোরার সিডি কেনা হয় নি। প্রধান কারণ টাকা ছিল না। সিডি না কেনায় ভালোই হয়েছে। এই বৃষ্টিতে সিডি বাঁচানোর কোনো উপায় থাকত না।

    দারোয়ান ফিরে এসেছে। গেট খুলছে। তার চোখ-মুখ কঠিন হয়ে আছে। সে মুহিবের দিকে না তাকিয়েই বলল, আসেন। বড় সাহেব আপনাকে যেতে বলেছেন। মুহিব বলল, সে-কী!

    নোরার বাবার সঙ্গে মুহিবের কখনো দেখা হয় নি। ভদ্রলোকের এমন অবস্থা যে বারো মাসের ভেতর তের মাসই থাকেন দেশের বাইরে। বার হাত কাঁকুড়ের তের হাত বিচির মতো অবস্থা। মাঝে মাঝে মেয়েকে ছবি পাঠান। ছবির পিছনে ছবি সম্পর্কে বর্ণনা থাকে। মুহিব এই ভদ্রলোককে প্রথম দেখে এরকম একটা ছবিতে। লম্বা ফর্সা এবং মাথাভর্তি আইনস্টাইনের মতো ঝাঁকড়া চুলের এক ভদ্রলোক কালো রঙের একটা পাথর হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। পাথরের দিকে তাকিয়ে আছেন মুগ্ধ দৃষ্টিতে। যেন এটা কোনো কালো পাথর না— এটা তাজমহল। বনসাই করে ছোট করা হয়েছে। ছবির উল্টা পিঠে ইংরেজিতে লেখা–মা নোরা, যে পাথর হাতে আমি দাঁড়িয়ে আছি এটা কোনো সাধারণ পাথর না। এটা একটা meteorite. অতি দূর কোনো নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে এটা পৃথিবীতে এসে পৌঁছেছে। ভালো থেকো…

    নোরার বাবা নাজমুল করিম সাহেব মুহিবকে দেখে চিন্তিত গলায় বললেন, এ-কী! তোমার কী অবস্থা! কতক্ষণ ধরে বৃষ্টিতে ভিজছ? দাড়াও দাঁড়াও, আমি টাওয়েল নিয়ে আসি। আগে মাথাটা মুছ। ইসকান্দর আমাকে বলেছে তুমি নোরার বন্ধু। তোমার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করব। তার আগে ভেজা কাপড় বদলাও। এক্কেবারে নতুন, ব্যবহার করা হয় নি এমন এক সেট কাপড় দিলে তোমার কি পরতে আপত্তি আছে?

    মুহিবের খুব অদ্ভুত লাগছে। সে বসে আছে নোরার বাবার পাশে। তার গায়ে এই ভদ্রলোকের পায়জামা-পাঞ্জাবি। তাদের দুজনের হাতে চায়ের কাপ।

    তোমার নাম মুহিব?

    জি স্যার।

    স্যার বলছ কেন?

    মুহিব হকচকিয়ে গেল। আসলেই তো, সে স্যার কেন বলছে? ইন্টারভিউ দিয়ে দিয়ে অভ্যাস হয়ে গেছে বলেই কি স্যার বলছে? না-কি এই ভদ্রলোককে তাদের কলেজের কোনো স্যারের মতো লাগছে? একজনের সঙ্গে অবশ্যি মিল পাওয়া যাচ্ছে। আনন্দমোহন কলেজের ইতিহাসের স্যার, কুমুদ বাবু। ছাত্ররা সবাই তাকে ডাকত সেন্ট স্যার। উনি গায়ে সেন্ট না মেখে বাসা থেকে বের হতেন না। পোশাকে-আশাকে ফিটফাট বাবু। ভদ্রলোক হঠাৎ পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতেন। কাউকে চিনতে পারতেন না, তবে ছাত্রদের দেখলেই চিনতেন। গল্প করার জন্যে খুব আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে যেতেন। মুহিবের সঙ্গে একদিন দেখা। তিনি হাসি হাসি মুখে এগিয়ে এলেন। কোমল গলায় বললেন, তোমার নাম মুহিব না?

    মুহিব বলল, জি স্যার।

    সেকেন্ড ইয়ার?

    জি স্যার।

    রোল থার্টি থ্রি?

    জি স্যার।

    দেখেছ, সব মনে আছে। পাগলদের কিছুই মনে থাকে না। আমার সবই মনে থাকে। ভালো আছ বাবা?

    জি স্যার।

    তুমি আমাকে এক শিশি সেন্ট কিনে দিতে পারবে? অন্য কোনো কিছুর অভাব বোধ করছি না। কাপড় ছাড়া ঘুরে বেড়াচ্ছি তাতেও তেমন অসুবিধা হচ্ছে না, তবে সেন্টের অভাবটা খুব বোধ করছি।

    স্যার, আমি এক্ষুণি সেন্ট কিনে নিয়ে আসছি।

    আমি তো সব সময় হাঁটাহাঁটির মধ্যে থাকি। আমাকে খুঁজে নাও পেতে পার। সেন্টটা কিনে তুমি আমার মার হাতে দিয়ে এসো। বাসা চিন তো? বকুল গাছওয়ালা বাড়ি।

    জি স্যার বাসা চিনি।

    মুহিব সেদিনই সেন্ট কিনেছিল। দামি সেন্টই কিনেছিল। কুমুদ স্যারকে সেই সেন্ট দেয়া হয় নি। কারণ স্যারের মা পুরনো বাসায় ছিলেন না। উনি কোথায় গিয়েছেন কেউ বলতেও পারল না। সেন্টটা মুহিবের কাছে এখনো আছে।

    নোরার বাবা বললেন, কী চিন্তা করছ?

    মুহিব চমকে উঠে বলল, কিছু চিন্তা করছি না।

    তিনি হাসি হাসি মুখে বললেন, নোরা হঠাৎ করে বলল, ঝুম বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি নিয়ে লং ড্রাইভে গেলে খুব নাকি মজা হবে। তুমি আমার মেয়ের বন্ধু, তার নেচার তো জানোই। যেই তার মাথায় চিন্তাটা এলো অমনি টেলিফোন করে বন্ধু-বান্ধব জোগাড় করল। মাইক্রোবাস নিয়ে বের হয়ে গেল। তোমাকে টেলিফোন করে নি?

    জি-না।

    তোমার হাতের ফুলগুলি দোলনচাপা না?

    জি।

    ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কী জানো? আমি আমার মেয়ের নাম দোলনচাঁপা রাখতে চেয়েছিলাম। মেয়ের মা বলল, দোলনচাঁপা শুনলেই কবি নজরুলের বইয়ের কথা মনে হবে। সঙ্গে সঙ্গে চোখে ভাসবে কবির ঝাকড়া চুলভর্তি ছবি। আমি ডাকব আমার মেয়েকে, চোখে ভাসবে কবি নজরুলের ছবি— তা হবে না। শেষে ডিসিশান পাল্টে ইবসেনের চরিত্রের নামে নাম রাখলাম— নোরা। নোরা নামটা তোমার কেমন লাগে?

    সুন্দর।

    নোরা সুন্দর না-কি দোলনচাপা সুন্দর?

    দোলনচাপা সুন্দর।

    নোরার আরেকটা খাস বাঙালি নাম আছে। সেটা জানো? গানের ক্যাসেট বা সিড়ি যা বের হয় সেখানে তার বাংলা নামটা থাকে। জানো বাংলা নামটা?

    জি, চন্দ্রাবতী।

    চন্দ্রাবতী নামের অর্থ জানো?

    জি-না।

    চন্দ্রাবতী নামের অর্থ হলো চাঁদের সখী। নোরার একটা আরবি নামও আছে। আরবি নামটা আমার মা রেখেছিলেন— ওয়ামিয়া। এই নামের অর্থ হলো বৃষ্টি। মানুষের স্বভাবের উপর নামের প্রভাব পড়ে— এই কথাটা মনে হয় সত্যি। বৃষ্টি নাম রাখার জন্যেই বোধহয় বৃষ্টি হলেই আমার মেয়ের মাথা খারাপের মতো হয়ে যায়।

    মুহিবের ঝিমুনি ধরে গেছে। নোরার বাবারও মনে হচ্ছে কথা বেশি বলার অভ্যাস। তিনি ক্রমাগতই কথা বলে যাচ্ছেন। এখন আর তার কথা মুহিব মন দিয়ে শুনছে না। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ঘর অন্ধকার। মুহিবের ধারণা কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ঘুমিয়ে পড়বে।

    মুহিব।

    জি।

    তুমি কর কী? পড়াশোনা?

    পড়াশোনা শেষ করেছি। আমি বেকার।

    ও আচ্ছা।

    মুহিবের মনে হলো সে নিজে ঘুমের মধ্যে কথা বলছে। সে বেকার না। তার পকেটে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আছে। ভিজে ন্যাতনাতে হয়ে গেছে। তাতে কী। সে কি ভুলটা শুদ্ধ করবে? বলবে যে এখন সে এরনস ইন্টারন্যাশনাল নামের মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করে। থাক, দরকার কী।

    মুহিব!

    জি স্যার।

    নোরার বন্ধুবান্ধদের আমি খুব পছন্দ করি। কেন জানো?

    জি-না।

    পছন্দ করি কারণ বেশির ভাগ সময় আমি দেশের বাইরে থাকি। নোরাকে ঘিরে একগাদা বন্ধুবান্ধব আছে— এটা ভেবে নিশ্চিত বোধ করি। আমি কী বলার চেষ্টা করছি বুঝতে পারছ?

    জি পারছি।

    তোমাদের বাসা কোথায়?

    ঝিকাতলা।

    নিজেদের বাড়ি?

    আমার বড়চাচার বাড়ি। সবাই এক সঙ্গে থাকি।

    ভালো তো। জয়েন্ট ফ্যামিলি উঠেই গেছে। বাবা-মা বেঁচে আছেন?

    জি।

    শুনতেই তো ভালো লাগছে। পিতা-মাতা-পুত্র-কন্যা সব এক ছাদের নিচে।

    মুহিব ঘুম ঘুম গলায় বলল, বাবা আমাদের সঙ্গে থাকেন না। আলাদা থাকেন।

    কেন?

    উনাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। উনি এখন আর আমাদের পরিবারের সদস্য না।

    বলতে বলতে মুহিব আরাম করে ঘুমিয়ে পড়ল।

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    একটি সাইকেল এবং কয়েকটি ডাহুক পাখি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }