Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আজ চিত্রার বিয়ে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 26, 2025

    আমাদের সাদা বাড়ি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 26, 2025

    আমি এবং কয়েকটি প্রজাপতি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 26, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আশাবরী – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প120 Mins Read0
    ⤷

    ১. তিন মাস ধরে কোন আয়না নেই

    “যদি আজ বিকেলের ডাকে
    তার কোন চিঠি পাই?
    যদি সে নিজেই এসে থাকে
    যদি তার এতকাল পরে মনে হয়
    দেরি হোক, যায়নি সময়?”

     

    ০১.

    জানেন, আমাদের বাসায় গত তিন মাস ধরে কোন আয়না নেই। ঠাট্টা করছি। সত্যি নেই। একমাত্র আয়নাটা ছিল বাবার ঘরে। ড্রেসিং টেবিল নামের এক বস্তুর সঙ্গে লাগানো। একদিন সন্ধ্যায় বিনা নোটিশে সেই আয়না ঝুর ঝুর করে ভেঙ্গে পড়ে গেল। অভ্যাসের বশে আমরা এখনো ড্রেসিং টেবিলটার সামনে দাঁড়াই। যেখানে আয়না ছিল সেখানে দাঁড়িয়ে নিজেদের দেখতে চেষ্টা করি। ভুল ধরা পড়া মাত্র খানিকটা লজ্জা পাই। শুধু ভাইয়া এমন ভাব করে যেন সে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে, আয়না থাকলে আমরা যে ভাবে মাথা এদিক ওদিক করে চুল আঁচড়াই সেও তাই করে।

    মজার ব্যাপার কি জানেন, ঘরে যে আয়না নেই এ নিয়ে কারো কোন মাথাব্যথাও নেই। আপা সব কিছু নিয়ে কঠিন গলায় কথা বলে, এ ব্যাপারে একটি কথাও বলছে না। ভাইয়াও চুপ। অথচ সংসারের দায়দায়িত্ব এখন অনেকখানি তার। পুরুষ মানুষ বলতে সে একা। বাবার কোন খোঁজ নেই। কোথায় আছেন আমরা জানি না। তাকে নিয়ে আমরা তেমন চিন্তিতও নই। মাঝে মাঝে ডুব দেয়া পুরানো অভ্যাস। বাবার ব্যবসা যখন খারাপ চলে, সংসারে টাকা পয়সা দিতে পারেন না তখন উধাও হয়ে যান। মাসখানিক পর একটা পোস্টকার্ড এসে উপস্থিত হয়। পোস্টকার্ডের এক পিঠে সম্বোধনহীন চিঠি। যে চিঠিতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা হয়–পর সমাচার এই যে ব্যবসার কারণে আমাকে সুনামগঞ্জে আসিতে হইয়াছে। এক ঠগবাজের পাল্লায় পড়িয়া সামান্য অর্থনৈতিক ঝামেলায় পড়িয়াছি। তোমরা কোনমতে চালাইয়া নাও। যথা শীঘ্ন চলিয়া আসিব। চিন্তার কোন কারণ নাই।

    যদিও লেখা থাকে সুনামগঞ্জ থেকে লিখছি কিংবা চাঁদপুর থেকে লিখছি তবু আমাদের সবার ধারণা তিনি লেখেন ঢাকায় বসেই কারণ পোস্টকার্ডে সুনামগঞ্জ কিংবা চাদপুরের কোন সীল থাকে না। একবার চিঠিতে লিখলেন যশোহর থেকে লিখছি। ওমা সেই চিঠি পরের দিন এসে উপস্থিত। ভাইয়া শার্লক হোমসের মত চিঠির ঠিকানা থেকে এই তথ্য বের করল এবং মাকে ক্ষেপাবার জন্য বলতে লাগল–সন্দেহজনক। খুবই সন্দেহজনক।

    বাবা উধাও হলে টাকা পয়সার বড় রকমের সমস্যা হয়। তখন সংসার কি ভাবে চলে আমি জানি না। তবে আমাকে কলেজে যাবার সময় ঠিকই দশটাকা হাতখরচ দেয়া হয়।

    টাকাটা নিতে লজ্জা লাগে তবু আমি আমার অভ্যাস মত বলি–আরো দশটা টাকা দাওনা মা প্লীজ। মা বিস্ময় এবং ব্যথিত চোখে তাকিয়ে থাকেন। হয়ত মনে মনে ভাবেন তার এই মেয়েটা এত বোকা? কিছুই বুঝে না? আমি ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকি–দাও না মা প্লীজ। প্লীজ। দশ টাকাতো রিকশা ভাড়াতেহ চলে যাবে। দুপুরে না খেয়ে থাকব?

    এ রকম ঘ্যান ঘ্যান করা, সবকিছু বুঝেও না বোঝা আমার অভ্যাস। মানুষের অভ্যাস কি চট করে যায় আপনি বলুন? আয়না নেই জেনেওতো আমরা আয়নার সামনে দাঁড়াচ্ছি। দাঁড়াচ্ছি না সবই অভ্যাস। যেমন ভাইয়ার অভ্যাস হচ্ছে রসিকতা করা এবং দার্শনিক ধরনের কথাবার্তা বলা। তার যদি কোন কারণে ফাসি হয় আমার ধারণা সে ফঁসির দড়ির কাছে গিয়ে চিন্তিত গলায় বলবে–দড়ি তো খুব পলক। মনে হচ্ছে–ছিড়ে পড়ে যাবেন। তো ভাই? আমার ওজন কিন্তু অনেক বেশী–একশ পঞ্চাশ পাউণ্ড রোগা পটকা চেহারা দেখে বিভ্রান্ত হবেন না।

    ভাইয়া তার রসিকতার অভ্যাস কিছুতেই বদলাতে পারবে না। আমার ধারণা তার মৃত্যুর সময়ও সে কোন না কোন রসিকতা করে আমাদেরতো হাসাবেই যে আজরাইল তার জীবন নিতে আসবে তাকেও হামাবে। একবার কি হল শুনুন, ভাইয়ার প্রচণ্ড জ্বর। ঘরে থার্মোমিটার নেই কাজেই কত জ্বর তা বুঝতে পারছি না। আমি গ্রীণ ফার্মেসীর ডাক্তার সাহেবকে ডেকে আনলাম। তিনি জ্বর মেপে আঁতকে উঠলেন–একশ পাঁচ। এক্ষণি শাওয়ারের নীচে বসিয়ে দিতে হবে, ক্রমাগত পানি ঢালতে হবে।

    ভাইয়া আমাকে বলল, ও রেনু যাতে এক কেতলি পানি এনে আমার মাথার উপর বসিয়ে দে। পানি ফুটলে সেই পানিতে চা বানিয়ে আমাকে খাওয়া–মাছের তেলে মাছ ভাজা কাকে বলে দেখিয়ে দিচ্ছি। নিজের টেম্পারেচারে নিজের ফুড প্রিপারেশন।

    ভাইয়ার রসিকতায় আমরা সবাই হাসি। সবচে বেশী হাসেন আমার বাবা। হাসতে হাসতে বলেন–ফানি ম্যান। ভেরী ফানি ম্যান।

    শুধু আপা হাসে না। মুখ কঠিন করে বলে, গোপাল ভাঁড়। আপার ব্যাপার আমি ঠিক বুঝি না–যেখানে খুশী হওয়া উচিত সেখানে সে বেজার হয়। রাগ করার কোনই কারণ নেই এমন সব জায়গায় সে রাগ করে।

    আপা অসম্ভব রূপবতী। নিজের বোন না হয়ে অন্যের বোন হলে আমি হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরে যেতাম। তার চোখ সুন্দর, গায়ের রঙ সুন্দর, নাক মুখ সবই সুন্দর। না আমি মোটেই বাড়িয়ে বলছি না একটা উদাহরণ দিলেই বুঝবেন। আপা যখন ইডেন কলেজে সেকেণ্ড ইয়ারে পরে তখনকার ঘটনা। সন্ধ্যা হয়েছে। আমরা সবাই বসে চা মুড়ি খাচ্ছি, বিরাট একটা গাড়ি এসে বাসার সামনে থামল। দুজন অপরিচিত ভদ্রলোক এলেন। তারা বাবার সঙ্গে কথা বলতে চান। শুনলাম তাঁরা সিনেমার লোক। নতুন ছবি বানাচ্ছেন–ছবির নাম বোনের সংসার। ছবিতে একজন টিন এজ নায়িকা থাকবে। দর্শকদের নতুন মুখ উপহার দেয়া হবে। মীরা আপা হচ্ছে সেই নতুন মুখ। এখন বাবা রাজি হলেই হয়। তাঁরা দশ হাজার টাকা সাইনিং মানি নিয়ে এসেছে।

    বাবা বললেন, সাইনিং মানি ব্যাপারটা কি?

    ছবি করতে রাজি হলে চুক্তিপত্রে সই হবে, তখন টাকাটা দেয়া হবে। তারপর ছবি যত এগুবে তত ভাগে ভাগে টাকা দেয়া হবে। ফিল্ম লাইনে পুরোটা এক সঙ্গে দেয়ার নিয়ম নেই।

    বাবা খুব আগ্রহ নিয়ে বললেন, সব মিলিয়ে কত হবে?

    নতুনরা খুব বেশী পায় না তবে আমরা ভালই দিব পঞ্চাশ তো বটেই।

    পঞ্চাশ কি?

    পঞ্চাশ হাজার।

    ও আচ্ছা আচ্ছা হাজার। হাজারতো হবেই পঞ্চাশ টাকাতো দিতে পারেন না। হা-হা-হা। চা খাবেন স্যার?

    জিনা চা খাব না। আপনার মেয়েকে ডাকুন তার সঙ্গেও কথা হোক। আমাদের কি কথাবার্তা হচ্ছে তার শোনা দরকার।

    বাবা বললেন, ও আছে। এইখানে কি কথাবার্তা হয় সব বারান্দা থেকে শুনা যায়। একটা কথা জিজ্ঞেস করি।

    স্যার আপনারা আমার মেয়ের খোজ পেলেন কোথায়?

    তার এক বান্ধবীর জন্মদিনে সে গিয়েছিল আমিও সেখানে ছিলাম। মনে ধরল, বেশ সুইট চেহারা। অবশ্যি হাইট কম। সেটা আমরা ক্যামেরায় ম্যানেজ করব।

    অভিনয় তো জানে না।

    শিখিয়ে পড়িয়ে নেব। সিনেমা হচ্ছে ডাইরেক্টরস মিডিয়া। ডাইরেক্টর ইচ্ছা করলে একটা কাঠের চেয়ারকেও নায়িকার রোল দিয়ে পার করে নিয়ে আসতে পারে?

    তাই না-কি?

    না মানে কথার কথা বলছি–আর কি। রূপক অর্থে বলা। ডাকুন আপনার মেয়েকে।

    বাবা দুঃখিত গলায় বললেন, ওকে ডাকাডাকি করে লাভ নেই ও করবেনা। বরং আমার ছোট মেয়েটাকে দেখতে পারেন–রেনু। চটপটে আছে। ডাকবাক্স না পোস্টবক্স নামে রবি ঠাকুরের একটা নাটক আছে না? ঐটাতে অভিনয় করেছিল। ভাল হয়েছিল। আমি অবশ্যি দেখিনি–শুনেছি। নানা কাজ কর্মে ব্যস্ত থাকি সময় পাই না। টুকটাক বিজনেস করি। ছোট বিজনেসম্যান হল–ফকিরের মত। শুধু হাঁটাহাঁটি। স্যার ছোট মেয়েটাকে ডাকব?

    না আপনি বড় জনের সঙ্গেই কথা বলুন। সিনেমার কথা শুনলে রাজি হতেও পারে। টিন এজারদের এই দিকে খুব ঝোঁক।

    বাবা উঠে এলেন। আপা বাবাকে দেখেই পাথরের মত মুখ করে বলল–না।

    বাবা ইতস্ততঃ করে বললেন, ভদ্রলোক মানুষ, কষ্ট করে এসেছেন। টাকা পয়সাও নিয়ে এসেছেন। সেকেণ্ড থট দিবি নাকি?

    না।

    সরাসরি না বলার কি দরকার? তুই গিয়ে বল আমি ভেবে দেখব। ভদ্রলোক কষ্ট করে এসেছেন।

    আপা আগের চেয়েও কঠিন স্বরে বলল, না।

    বাবা নীচু গলায় বললেন, সিনেমা লাইনটা খারাপ না। ভাল ভাল মেয়েরা এখন যাচ্ছে। তা ছাড়া নিজে ভাল থাকলে জগৎ ভাল। নিজে মন্দ হলে জাৎ মন্দ। ভাল মন্দ নিজের কাছে। কি, ওদের চলে যেতে বলব?

    হ্যাঁ।

    ভদ্রলোকরা চলে গেলেন ঠিকই তারপরেও দুবার এলেন। শেষবার এলেন পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে। সব একশ টাকার নোট। বসার ঘরের বেতের টেবিলটা ঢাকায় প্রায় ভরে গেল। আমি আমার আঠারো বছরের জীবনে এত ঢাকা এক সঙ্গে দেখিনি। ভাইয়া বলল একশ টাকার নোটে পঞ্চাশ হাজার টাকার ওজন কত জানিস? মাত্র এক পোয়া।

    আমি বললাম, কেমন করে জানলে, তুমি ওজন করেছ?

    করেছি। একশটা একশ টাকার নোট ওজন করে সেখান থেকে বের করেছি। সহজ ঐকিক নিয়ম।

    ভাইয়ার এইসব কথা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। সে মিথ্যা কথা সত্যের মৃত করে বলে। সত্য কথাগুলি মিথ্যার মত বলে। আমরা সবাই তাতে খুব মজা পাই। বাবা হাসি মুখে বলেন, ফানি ম্যান, ভেরী ফানি ম্যান। শুধু আপা রাগ করে।

    ভাইয়ার উপর আপার রাগ আরো বাড়ল যখন ভাইয়া তাকে ম্যাডাম ডাকা শুরু করল। সিনেমাতে নায়িকাঁদের নাকি ম্যাডাম ডাকার নিয়ম। ভাইয়া ম্যাডাম ডাকছে আর আপা রাছে। রাগলে আপার ফর্সা মুখ লাল টকটকে হয়ে যায়। নাক ঘামতে থাকে। চোখের মনি হয়ে যায় স্থির। তখন আমি আপার দিকে তাকিয়ে ভাবি–ইস আমি কেন এত সুন্দর হলাম না। যদিও অভিনয় করার জন্যে আমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে হত না। বিনা টাকাতেই আমি অভিনয় করে দিয়ে আসতাম ইস আরেকটু যদি সুন্দর হতাম। দরিদ্র পরিবারে সুন্দরী হয়ে জন্মানো খুব সুখের নয়। আমি খুব ভাল করে জানি।

    যেই দেখছে সেই বিয়ের প্রস্তাব পাঠাচ্ছে। পিওন এক গাদা চিঠি রোজ দিয়ে যাচ্ছে। যার বেশীর ভাগই রেজিস্ট্রি। সেই সব চিঠির সবই প্রেমপত্র। খুব কাচা হাতে লেখা। ভুল বানান। লাইনে লাইনে কবিতা–। কিছু কিছু চিঠির কথাবার্তা অসম্ভব নোংরা। সেসব চিঠি হাত দিয়ে ছুলেও হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হয়।

    মজার ব্যাপার হচ্ছে আপা কোনদিনও একটি চিঠি পড়ে দেখেনি। মানুষের সাধারণ কৌতুহলওতো থাকে–কি লিখছে, জানার আগ্রহ। আপার নেই। সেইসব চিঠি পড়তাম আমরা দুজন। আমি এবং ভাইয়া। চিঠিতে নাম্বার দেওয়া হত। কোনটা পাচ্ছে একশতে দশ, কোনটা একশতে পাঁচ। এর মধ্যে একটা চিঠি এল ইংরেজীতে। সম্বোধন হচ্ছে–

    My dearest Moonshine

    ভাইয়া পনেরে৷ টাকা খরচ করে সেই চিঠি বাঁধিয়ে এনে আপীর জন্মদিনে আপাকে প্রেজেন্ট করল। আপা খানিকক্ষণ ঠাণ্ডা চোখে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইয়া তুমি যদি আর কোনদিন আমার সঙ্গে এ রকম রসিকতা কর তাহলে আমি কিন্তু এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।

    কোথায় যাবি?

    আমার যাবার জায়গার অভাব নেই–তুমি এটা ভালই জান। ঐ সিনেমা। ওয়ালাদের কাছেও যেতে পারি। ওরা কার্ড দিয়ে গেছে।

    সরি, আর করব না।

    আপা খাবার টেবিল থেকে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। দরজা বন্ধ করে দিল। জন্মদিন দিন তো আমাদের পরিবারে হয় না। হবার কথাও না। সেদিন মজা করবার জন্যেই ভাইয়া একটা কেক কিনে এনেছিল। কেকের উপরে লেখা–

    My dearest moonshine

    কোনই মজা হল না। শুধু বাবা ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, ফানি ম্যান। ভেরী ফানি ম্যান। মনে হল বাবাই খুব মজা পাচ্ছেন। কেকটাও বাবার খুব ভাল লাগল। পাঁচ পিস কেক খেয়ে ফেললেন। বারবার বিস্মিত গলায় বললেন–মারাত্মক টেস্ট হয়েছে তো! ভাইয়া বলল, মারাত্মক টেস্ট হবার কারণ জানতে বাবা? মারাত্মক পচা ডিম ব্যবহার করা হয়েছে। কেকের স্বাদ নির্ভর করে কি ধরনের পচা ডিম ব্যবহার করা হয়েছে তার উপর।

    আচ্ছা, আমার কথাবার্তা শুনে আপনার কি মনে হচ্ছে আমি আমাদের এই ফানি ম্যানকে খুব পছন্দ করি? ঠিকই ধরেছেন। হ্যাঁ, আমি খুব পছন্দ করি। যদিও আমি কাউকেই খুব পছন্দ করতে পারি না, আবার কাউকে খুব অপছন্দও করতে পারি না। তবে … না থাক পরে বলব। এখন ভাইয়ার কথা বলি। ভাইয়াকে সবাই পছন্দ করে। এমন কি আমাদের বাড়িওয়ালাও। পৃথিবীর কোন বাড়িওয়ালাই ভাড়াটেদের পছন্দ করে না। যে ভাড়াটে নিয়মিত ভাড়া দেয় তাকেও না। কারণ বাড়িওয়ালার নিজের অতি আপন একটি জিনিস ভাড়াটে ব্যবহার করে। তাকে পছন্দ করার কোনই কারণ নেই। অথচ আমাদের বাড়িওয়ালা সুলায়মান সাহেব–ভাইয়াকে পছন্দ করেন। দু মাস, তিন মাস বাড়ি ভাড়া বাকি থাকে–সুলায়মান সাহেব কিছুই বলেন না–অবশ্যি এক সময় ডেকে পাঠান। ভাইয়া বিস্ময়ের ভঙ্গি করে যায় এবং অবাক হওয়া গলায় বলে, কি জন্যে ডেকেছেন চাচা?

    ভাইয়ার এই বিস্ময় দেখে সুলায়মান সাহেব হকচকিয়ে যান। আমতা আমতা করে বলেন, আছ কেমন?

    জ্বি ভাল। আপনি কেমন চাচা?

    আছি কোনমত।

    আপনার ডায়াবেটিস কি কিছু কমের দিকে?

    ইনসুলিন নিচ্ছি না। ডায়েটের উপর আছি। করলা খাচ্ছি। মেথি খাচ্ছি, হাঁটাহাঁটি করছি।

    আপনাকে কিন্তু আগের চেয়ে অনেক ভাল দেখাচ্ছে।

    না ভাল আর কোথায় শরীরে জোর পাই না।

    শরীরের জোরটা আসল না চাচা, মনের জোরটাই আসল। মনে জোর রাখবেন–মনটাকে শক্ত রাখবেন। এই দেখুন না, টাকা পয়সার কি সমস্যা আমাদের যাচ্ছে। টিকে আছি মনের জোরে। আপনাকে তিন মাস ধরে বাড়ি ভাড়া দেয়া হচ্ছে না–লজ্জায় মরে যাচ্ছি। আপনার সঙ্গে যাতে দেখা না হয় এই জন্যে খুব সাবধানে থাকি। ঐদিন দেখি আপনি বাজার করে ফিরছেন। আমি সিগারেট কিনছিলাম, ধাঁই করে গলিতে ঢুকে পড়লাম। এই যে আপনি ডেকে পাঠালেন, আমি ভয়ে অস্থির যদি বাড়িভাড়া চান কি বলব?

    সুলায়মান সাহেব বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন–আরে না ঐ জন্যে তোমাকে ডাকি নি। এম্নি খবর দিয়েছি। অনেকদিন দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। করছ কি আজকাল?

    চারটা প্রাইভেট টিউশানি করছি। পত্রিকায় একটা কাজ জোগাড় করেছি–বিভিন্ন প্রতিবেদন টেন লিখি। ছাপা হলে শখানিক দেয়।

    কি পত্রিকা?

    ফালতু পত্রিকা। নাম হচ্ছে শতদল–এই পত্রিকার একমাত্র আকর্ষণ হল ধর্ষণের খবর। যে সপ্তাহে কোন মেয়ে রেপড় হয় না সেই সপ্তাহে আমাদের পত্রিকার মালিক এবং সম্পাদকের খুব মন খারাপ থাকে।

    কি বলছ এসব?

    আমি দুএকটা সংখ্যা দিয়ে যাব, পড়লেই বুঝবেন। ধর্ষণের এত সুন্দর বর্ণনা আপনি কোন পত্রিকায় পাবেন না। আমরা কোন ডিটেইল বাদ দেই না।

    বল কি? হচ্ছে কি দেশটার? খুবই চিন্তার কথা।

    চাচা আজ তাহলে উঠি। আমার আবার একটা ইন্টার নিতে হবে। রেপড় হয়েছে এমন একটা মেয়ে।

    শুনলে সবার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে–আমরা পাঁচ বছর এ বাড়িতে আছি–বাড়ির ভাড়া বাড়ে নি। কেন বাড়েনি জানেন? ভাইয়ার জন্য। একবার চারশ টাকা ভাড়া বাড়ল। সুলায়মান সাহেব নিজে এসে বাবাকে এই খবর দিয়ে গেলেন। হাত টাত কচলে বললেন, কি করব ভাই বলুন–প্রপার্টি ট্যাক্স ডাবল করে দিয়েছে। প্রপার্টি বলতে তো এই বাড়ি ভাড়ার উপর বেঁচে আছি। মেয়েগুলিকে বিয়ে দিয়েছি–একা মানুষ বলে কোন রকমে চলে যায়। এমন সমস্যা কি আর বলব আপনাকে–জামাইরা প্রতি মাসে টাকার জন্য আসে। ফকিরেরও অধম। ভাড়া না বাড়িয়ে তো পারছি না। চারশ টাকা করে বেশী দিতে হবে সামনের মাস থেকে। তিন ঘর ভাড়াটের সবার ভাড়াই চারশ করে বাড়িয়েছি।

    বাবা বললেন–আচ্ছা ঠিক আছে।

    সব কিছুতেই রাজি হয়ে যাওয়া বাবার স্বভাব। তিনি এমন ভাব করলেন যে চারশ টাকা কিছুই না। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল আমাদের। চারশ টাকা বাড়তি দেয়া একেবারেই অসম্ভব। ভাইয়া বলল, কোন চিন্তা নেই, আমি ঠিক করে দেব।

    সন্ধ্যাবেলা সে গেল। মুখ কাঁচু মাচু করে বলল, চাচা আপনি নাকি আমাদের বের করে দিচ্ছেন?

    সুলায়মান সাহেব হতভশ্য হয়ে বললেন–সেকি। তোমাদের বের করব কেন? ছিঃ ছিঃ–কার কাছে শুনেছ এসব কথা?

    বাড়িভাড়া চারশ বাড়িয়েছেন–আমাদের বের হয়ে না যাওয়া ছাড়া উপায় কি? কোত্থেকে দেব বাড়তি চারশ টাকা? যা ভাড়া তাই দিতে পারি না। দুদিন পরে পরে বাকি পড়ে।

    সুলায়মান সাহেব বিব্রত গলায় বললেন–আচ্ছা আচ্ছা থাক। বাদ দাও। যা আছে তাই। অন্য ভাড়াটেদের কিছু জানিও না।

    ভাইয়া দরাজ গলায় বলল, আমার একটা চাকরি বাকরি হোক। তারপর দেখবেন, আপনাকে বলতে হবে না। পাঁচশ টাকা বাড়তি আপনার হাতে খুলে দিয়ে

    যাব।

    সুলায়মান সাহেব বললেন–আচ্ছা আচ্ছা–ঠিক আছে। একবার তো বললাম ঠিক আছে।

    আপনার ব্যবহারে মনে খুব কষ্ট পেয়েছি চাচা।

    আহা বাদ দাও না। চা খাও। কই নসু—বাবা আমাদের দুজনকে চা দাও তা।

    সুলায়মান সাহেব ভাইয়াকে কেন এত পছন্দ করেন আমি জানি না। এত বাড়াবাড়ি ধরনের পছন্দ দেখা যায় না বলে ব্যাপারটাকে অনেকদিন আমরা সন্দেহের চোখে দেখতাম। আমাদের ধারণা দিল–সুলায়মান সাহেবের কোন আত্মীয়ার সঙ্গে তিনি ভাইয়ার বিয়ে দিতে চান। সেই আত্মীয়ার এমনিতে বিয়ে হবার সম্ভাবনা নেই। হয়ত এসিডে পুড়ে মুখ ঝলসে গেছে কিংবা পঙ্গু। আমাদের সব ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে সুলায়মান সাহেবের ভাল লাগার পেছনে তেমন কোন স্বার্থ নেই। এটাও খুব অস্বস্তিকর। স্বার্থ ছাড়া ভালবাসে এমন মানুষ আমরা দেখি না। হঠাৎ কাউকে দেখলে খানিকটা অস্বস্তি লেগেই থাকে।

    একটা লোক যে তাকে এত পছন্দ করে তা নিয়ে ভাইয়ার কোন মাথাব্যথা নেই। যেন সে ধরেই নিয়েছে সবাই তাকে পছন্দ করবে।

    মজার ব্যাপার–করছেও তাই। আমাদের পেছনেই থাকেন ব্যারিস্টার মুশফেকুর রহমান। তিনি তাঁর দোতলা বাড়ি এত বড় করে বানিয়েছেন যে আমরা শীতের সময় ভোরের রোদ পাই না। অসম্ভব ব্যস্ত এই মুশফেকুর রহমান সাহেবের সঙ্গেও ভাইয়ার খাতির আছে। এই খাতির কি ভাবে হল আমরা জানি না। ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলে সে হাসে। প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার রাত নটার দিকে মুশফেকুর রহমান সাহেব লোক পাঠিয়ে দেন–ভাইয়াকে তাঁর প্রয়োজন। একহাত দাবা খেলবেন। ভাইয়া দাবা খেলতে যায়–রাত এগারোটা বারটার দিকে ফিরে। তার মুখে হাসি।

    কি ভাইয়া হারলে না জিতলে?

    প্রথম দিকে উইন করছিলাম। একটা পণ এবং দুটা পিস আপ ছিল। শেষটায় যুবলেট করে দিয়েছি।

    প্রতিবারই তো শুনি একই ব্যাপার।

    ব্যারিস্টার সাহেব শুরুতে খুব খারাপ খেললেও শেষের দিকে সামলে খেলেন। একেকটা দুর্দান্ত চাল দিয়ে–ছেড়াবেড় করে দেন।

    ব্যারিস্টার সাহেবের সবচে ছোট মেয়ে দুলু আপাও যে আমাদের মত গরীব মানুষদের বাসায় আসা যাওয়া করে আমার ধারণা তার একমাত্র কারণ ভাইয়া।

    দুলু আপা তাদের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে গল্প করেন। তখনি করেন যখন ভাইয়া উঠানে থাকে। আমি মনে মনে হাসি। প্রকাশ্যেই হাসতাম–তা হাসি না কারণ দুলু আপাকে আমি খুব পছন্দ করি।

    চমৎকার মেয়ে। হিস্ট্রিতে অনার্স ফাইনাল দেবেন। খুব ভাল ছাত্রী। দিনরাত হাতে বই। চাপা ধরনের মেয়ে। একটু পাগলাটে ভাব আছে। হয়ত ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। আমি কলেজে না গিয়ে বাসায় বসে আছি। দুলু আপাদের বাসার কাজের লোক আমার জন্যে চিঠি নিয়ে এল। চিঠিতে লেখা–রেনু, খুব বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজবে? যদি রাজি থাক–চলে আস। আমরা গাড়ি করে গ্রামের দিকে চলে যাব।

    তারপর রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে বৃষ্টিতে ভিজব।

    একদিন কথামত গেলাম। গাড়ি জয়দেবপুর ছাড়িয়ে চলে গেল। মোটামুটি নির্জন একটা জায়গা বের করে দুলু আপা বললেন, ড্রাইভার সাহেব থামেন তো। ড্রাইভার গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে বসে রইল–আমরা বৃষ্টিতে ভিজে এলাম। দুলু আপা কয়েকবার বলল, ইন্টারেস্টিং লাগছে, না রেনু?

    আমার মোটেই ইন্টারেস্টিং লাগছিল না–তবু বললাম, দারুন লাগছে।

    দুলু আপা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, পুরোপুরি নগ্ন হয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে পারলে আরো চমৎকার হতো–তাতো আর সম্ভব না।

    যে মেয়ে এ জাতীয় কথা বলে তার মাথায় ছিট আছে তাতো বলাই বাহুল্য।

    দুলু আপার মত ভাবুক, অসম্ভব রোমান্টিক, আবেগতাড়িত একটি মেয়ে ভাইয়ার মত মানুষের জন্য দুর্বলতা পোষণ করা স্বাভাবিক কিন্তু তাই বলে এতটা কি উচিত? তাও যদি ভাইয়ার সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা হত। চোখের দেখাতে প্রেম গল্প উপন্যাসে হয়। বাস্তবে প্রেমে পড়ার জন্যে একজনকে অন্যজনের কাছাকাছি যেতে হয়। ভাইয়া এবং দুলু আপা, দুজন দুপ্রান্তের মানুষ।

    ভাইয়ার সঙ্গে দেখা হলে ভাইয়া তার স্বভাবমত রসিকতা অবশ্য করে। কিন্তু দুলু আপাকে দেখে বোঝার কোন উপায়ই নেই–তিনি এই রসিকতাগুলি পছন্দ করছেন কি করছেন না। হয়ত দুলু আপা ভোরবেলায় আমাদের বাসায় এসেছেন। ভাইয়া মেঝেতে বসে দাড়ি কামাচ্ছে। যেহেতু আয়না নেই দাড়ি কাটতে হচ্ছে সম্পূর্ণ অনুমানের উপর। দুলু আপাকে দেখে ভাইয়া খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল–

    তারপর দুলু, খবর ভাল?

    জ্বি ভাল।

    হিস্ট্রি পড়ছ কেমন? ভাজা ভাজা করে ফেলছ নাকি?

    ভালই পড়ছি।

    আচ্ছা বল তো দেখি সম্রাট শাহজাহানের খালা শাশুড়ির নাম কি? দশটাকা বাজি। তুমি বলতে পারবে না।

    দুলু আপা তার উত্তরে কিছু বলবে না–পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকবে। তাকে দেখে তখন মনে হওয়া অস্বাভাবিক না যে দাড়ি কামানোর দৃশ্যই হচ্ছে পৃথিবীর সবচে সুন্দর দৃশ্য।

    ভাইয়া নিরাসক্ত ধরনের মানুষ। কোন কিছুতেই তার আসক্তি নেই। যখন পয়সা হচ্ছে–ধুমসে সিগারেট টানছে। টাকা পয়সা শেষ–নির্বিকার ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাকে দেখে মাঝে মাঝেই আমার মনে হয়–সে চোখবন্ধু একজন মানুষ। তাকিয়ে আছে কিন্তু তেমন কিছু দেখছে না। যদি দেখত তাহলে অবশ্যই বুঝতে পারত দুলু আপী গভীর আগ্রহে তার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। যে আগ্রহে তিল পরিমাণ খাদ নেই।

    ভাইয়া যখন ব্যারিস্টার সাহেবের সঙ্গে দাবা খেলেন, দুলু আপা তখন বসার ঘরে পর্দার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। সেই দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটা অদ্ভুত। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে থাকে। থর থর করে কাঁপতে থাকেন। আমি একদিন দৃশ্যটা দেখে ফেললাম। অবাক হয়ে বললাম, কি হয়েছে আপা?

    দুলু আপা বিব্রত গলায় বললেন, কিছু হয়নি তো।

    এখানে দাঁড়িয়ে আছি কেন?

    দুলু আপা ফিস ফিস করে বলল, এম্নি। এম্নি দাঁড়িয়ে আছি। বলতে বলতে তার চোখ ভিজে উঠল। গলা ধরে গেল।

    ভাইয়ার যেবার একশ পাঁচ জ্বর হল তখন কি পরিমাণ অস্থিরতা যে দুলু আপার দেখেছিলাম তা কখনো গুছিয়ে বলতে পারব না। মানুষ খুব অস্থির হলে নানা ভাবে সেই অস্থিরতা প্রকাশ করে। কাঁদে, হৈ চৈ করে। দুলু আপা অস্থিরতা প্রকাশ করতে পারেন না। নিজের মধ্যে চেপে রাখেন। তার কষ্টও সীমাহীন। জ্বর নামানোর জন্যে যখন আমরা ধরাধরি করে ভাইয়াকে বাথরুমে নিয়ে যাচ্ছি–শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে জ্বর নামাবো। তখন দুলু আপা আমাদের ঘরে এলেন। তাকে দেখে মনে হল, ভাইয়াকে ধরে নিয়ে যাবার কাজটির বিনিময়ে তিনি তার সমগ্র জীবন এক কথায় দিয়ে দিতে পারেন। ভাইয়া দুলু আপার দিকে তাকিয়ে বললেন, কি খবর দুলু? ভাল? অসময়ে কি মনে করে?

    দুলু আপা হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, আজকের খবরের কাগজটা নিতে এসেছি।

    ভাইয়া বলল, ভল জায়গায় এসেছ আমরা খবরের কাগজ রাখি না। একটা কাগজের দাম তিন টাকা। ত্রিশ গুনন তিন, মাসে নব্বই টাকা–ফর নাথিং চলে যায়। নব্বই টাকায় ছ সের চাল হয়।

    দুলু আপার সঙ্গে কখনো ভাইয়া এই ভঙ্গিতে কথা বলে না। সেবার বলল তার কারণ জ্বর তার মাথায় উঠে গেছে। সে কি বলছে নিজেও জানে না।

    আমরা ভাইয়াকে বাথরুমে ঢুকিয়ে কল ছেড়ে দিলাম। দুলু আপা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেলেন। পুরোপুরি গেলেন না, তাদের দোতলার বারান্দার এক কোণায় পঁড়িয়ে রইলেন, যেখান থেকে আমাদের ঘরের অনেকটা দেখা যায়।

    ভাইয়ার জ্বর নামতে নামতে দুটা বেজে গেল। তখনো দুলু আপা দাঁড়িয়ে। আমি উঠোনে গিয়ে বললাম, আপা ভাইয়ার জ্বর নেমে গেছে।

    দুলু আপা যেন আমার কথা শুনতে পাননি এমন ভঙ্গিতে বললেন, বেনু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জোছনদেখছিলাম। কি সুন্দর জোছনা হয়েছে দেখেছিস? দুলু আপার ভাবটা এমন যেন সারাক্ষণ তিনি জোছনা দেখার জন্যেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভাইয়ার জ্বর কমল কি না কমল সে ব্যাপারে তার কোন আগ্রহ নেই।

    কি কথা থেকে, কি কথায় চলে এসেছি–শুরুতে কি বলছিলাম যেন? ও আচ্ছা–আয়না। হ্যাঁ আমাদের বাসায় কোন আয়না নেই। তিন মাস ধরেই নেই। এবং এই নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথাও নেই। ভাইয়া বরং একটু খুশী। আমাকে বলল, আয়না না থাকার একটা বড় সুবিধা কি জানিস? রোজ নিজেকে দেখতে হয় না। মানুষ নিজেকে যেমন ভালবাসে নিজেকে তেমন ঘৃণাও করে। ঘৃণার মানুষটাকে রোজ দেখতে হচ্ছে না এটা আনন্দের ব্যাপার না?

    আয়না না থাকার কষ্ট মীরা অপর সবচে বেশী হওয়ার কথা। সুন্দরীরা বার বার নিজেকে দেখতে চায়। রূপকথার রাজকন্যাদের মত আয়নার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে–বল তো সুন্দরী কে আমার চেয়ে? কিন্তু আপাকেও নির্বিকার মনে হচ্ছে। একদিন সে শুধু নীচু গলায় বলল, আমার নিজের চেহারাটা কেমন আমি ভুলে গেছি। সত্যি ভুলে গেছি। মজার ব্যাপার কি জানিস ভুলে গিয়ে ভালই লাগছে।

    ঠিক দুমাস এগারো দিন পর, আমাদের বাসায় নতুন আয়না এল। বাবা কাঠের ফ্রেমের বেশ বড় সড় একটা আয়না নিয়ে অনেকদিন পর উদয় হলেন এবং হাসিমুখে বললেন–খবর সব ভাল?

    সেই আয়না বারান্দায় টানানো হল। আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখি দুটা মুখ দেখা যাচ্ছে।

    বাবা বিস্মিত হয়ে বললেন, এরকম হচ্ছে কেন? আমি তো দেখে শুনেই কিনলাম। বদলানোর তো কোন উপায় নেই, বদলাতে হলে চিটাগাং যেতে হয়। চিটাগাং থেকে কেনা।

    ভাইয়া বলল, বদলানোর দরকার কি? একটার জায়গায় দুটা মুখ দেখা যাচ্ছে। ভালই তো। একের ভেতর দুই। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল–একটা মুখকে হাসিখুশী দেখায় অন্যটা গম্ভীর। জ্যাকেল এণ্ড হাইড।

    বাবা হো হো করে হাসতে হাসতে বললেন, ফানি ম্যান। ভেরি ফানি ম্যান।

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article আমি এবং কয়েকটি প্রজাপতি – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আজ চিত্রার বিয়ে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 26, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    আমাদের সাদা বাড়ি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 26, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    আমি এবং কয়েকটি প্রজাপতি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 26, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আজ চিত্রার বিয়ে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 26, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আজ চিত্রার বিয়ে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 26, 2025
    Our Picks

    আজ চিত্রার বিয়ে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 26, 2025

    আমাদের সাদা বাড়ি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 26, 2025

    আমি এবং কয়েকটি প্রজাপতি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 26, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }