Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সীতারাম – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    উপন্যাস বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক পাতা গল্প190 Mins Read0
    ⤷

    সীতারাম – ১ম খণ্ড – ০১-০৫

    সীতারাম
    প্রথম খণ্ড
    দিবা-গৃহিণী
    প্রথম পরিচ্ছেদ

    পূর্বকালে, পূর্ববাঙ্গালায় ভূষণা নামে এক নগরী ছিল। এখন উহার “ভূষ্য‍ণো |” যখন কলিকাতা নামে ক্ষুদ্র গ্রামের কুটীরবাসীরা বাঘের ভয়ে রাত্রে বাহির হইতে পারিত না, তখন সেই ভূষণায় একজন ফৌজদার বাস করিতেন। ফৌজদারেরা স্থানীয় গবর্ণর ছিলেন; এখনকার স্থানীয় গবর্ণর অপেক্ষা তাঁদের বেতন অনেক বেশী ছিল। সুতরাং ভূষণা স্থানীয় রাজধানী ছিল।
    আজি হইতে প্রায় এক শত আশী বৎসর পূর্বে একদিন রাত্রিশেষে ভূষণা নগরের একটি সরু গলির ভিতর, পথের উপর একজন মুসলমান ফকির শুইয়াছিলেন। ফকির, আড় হইয়া একেবারে পথ বন্ধ করিয়া শুইয়া আছেন। এমন সময়ে সেখানে একজন পথিক আসিয়া উপস্থিত হইল। পথিক বড় দ্রুত আসিতেছিল, কিন্তু ফকির পথ বন্ধ করিয়া শুইয়া আছে দেখিয়া, ক্ষুণ্ণ হইয়া দাঁড়াইল।
    পথিক হিন্দু। জাতিতে উত্তররাঢ়ী কায়স্থ। তাহার নাম গঙ্গারাম দাস। বয়সে নবীন। গঙ্গারাম বড় বিপন্ন। বাড়ীতে মাতা মরে, অন্তিম কাল উপস্থিত। তাই তাড়াতাড়ি কবিরাজ ডাকিতে যাইতেছিল। এখন সম্মুখে পথ বন্ধ।
    সে কালে মুসলমান ফকিরেরা বড় মান্য ছিল। খোদ আকবর শাহ ইসলাম ধর্মে অনাস্থাযুক্ত হইয়াও একজন ফকিরের আজ্ঞাকারী ছিলেন। হিন্দুরা ফকিরদিগকে সম্মান করিত, যাহারা মানিত না, তাহারা ভয় করিত। গঙ্গারাম সহসা ফকিরকে লঙ্ঘন করিয়া যাইতে সাহস করিল না। বলিল, “সেলাম শাহ সাহেব। আমাকে একটু পথ দিন |”
    শাহ সাহেব নড়িলেন না, কোন উত্তরও করিলেন না।-গঙ্গারাম জোড়হাত করিল, বলিল, “আল্লা তোমার উপর প্রসন্ন হইবেন, আমার বড় বিপদ! আমায় একটু পথ দাও |”
    শাহ সাহেব নড়িলেন না। গঙ্গারাম জোড়হাত করিয়া অনেক অনুনয় বিনয় এবং কাতরোক্তি করিল, ফকির কিছুতেই নড়িলেন না, কথাও কহিলেন না। অগত্যা গঙ্গারাম তাহাকে লঙ্ঘন করিয়া গেল। লঙ্ঘন করিবার সময় গঙ্গারামের পা ফকিরের গায়ে ঠেকিয়াছিল; বোধ হয়, সেটুকু ফকিরের নষ্টামি। গঙ্গারাম বড় ব্যস্ত, কিছু না বলিয়া কবিরাজের বাড়ীর দিকে চলিয়া গেল। ফকিরও গাত্রোত্থান করিলেন-সে কাজির বাড়ীর দিকে চলিয়া গেলেন।
    গঙ্গারাম কবিরাজের সাক্ষাৎ পাইয়া, তাহাকে আপনার বাড়ীতে ডাকিয়া আনিল; কবিরাজ তার মাকে দেখিল, নাড়ী টিপিল, বচন আওড়াইল, ঔষধের কথা দুই চারি বার বলিল, শেষে তুলসীতলা ব্যবস্থা করিল। তুলসীতলায় হরিনাম করিতে করিতে গঙ্গারামের মা পরলোক লাভ করিলেন। তখন গঙ্গারাম মার সৎকারের জন্য পাড়া-প্রতিবাসীদিগকে ডাকিতে গেল। পাঁচ জন স্বজাতি জুটিয়া যথাবিধি গঙ্গারামের মার সৎকার করিল।
    সৎকার করিয়া অপরাহ্নে শ্রীনাম্নী ভগিনী এবং প্রতিবাসিগণ সঙ্গে গঙ্গারাম বাটী ফিরিয়া আসিতেছিল, এমন সময়ে দুই জন পাইক, ঢাল-সড়কি-বাঁধা-আসিয়া গঙ্গারামকে ধরিল। পাইকেরা জাতিতে ডোম, গঙ্গারাম তাহাদিগের স্পর্শে বিষণ্ণ হইল। সভয়ে দেখিল, পাইকদিগের সঙ্গে সেই শাহ সাহেব। গঙ্গারাম জিজ্ঞাসা করিল, “কোথা যাইতে হইবে? কেন ধর?-আমি কি করিয়াছি?”
    শাহ সাহেব বলিলেন, “কাফের! বদ্ ‍বখ‍‍ত! বেত্স‍‍মিজ! চল্ |”
    পাইকেরা বলিল, “চল্ |”
    একজন পাইক ধাক্কা মারিয়া গঙ্গারামকে ফেলিয়া দিল। আর একজন তাহাকে দুই চারিটা লাথি মারিল। একজন গঙ্গারামকে বাঁধিতে লাগিল, আর একজন তাহার ভগিনীকে ধরিতে গেল। সে ঊর্ধশ্বাসে পলায়ন করিল। যে প্রতিবাসীরা সঙ্গে ছিল, তাহারা কে কোথা পলাইল, কেহ দেখিতে পাইল না। পাইকেরা গঙ্গারামকে বাঁধিয়া মারিতে মারিতে কাজির কাছে লইয়া গেল। ফকির মহাশয় দাড়ি নাড়িতে নাড়িতে হিন্দুদিগের দুর্নীতি সম্বন্ধে অতি দুর্বোধ্য ফারসী ও আরবী শব্দ সকল সংযুক্ত নানাবিধ বক্তৃতা করিতে করিতে সঙ্গে গেলেন।
    গঙ্গারাম কাজি সাহেবের কাছে আনীত হইলে, তাহার বিচার আরম্ভ হইল। ফরিয়াদী শাহ সাহেব-সাক্ষীও শাহ এবং বিচারকর্তাও শাহ সাহেব। কাজি মহাশয় তাঁহাকে আসন ছাড়িয়া দিয়া দাঁড়াইলেন, এবং ফকিরের বক্তৃতা সমাপ্ত হইলে, কোরাণ ও নিজের চশমা এবং শাহ সাহেবের দীর্ঘবিলম্বিত শুভ্র শ্মশ্রুর সম্যক সমালোচনা করিয়া, পরিশেষে আজ্ঞা প্রচার করিলেন যে, ইহাকে জীয়ন্ত পুঁতিয়া ফেল। যে যে হুকুম শুনিল, সকলেই শিহরিয়া উঠিল। গঙ্গারাম বলিল, “যা হইবার তা ত হইল, তবে আর মনের আক্ষেপ রাখি কেন?”
    এই বলিয়া গঙ্গারাম শাহ সাহেবের মুখে এক লাথি মারিল। তোবা তোবা বলিতে বলিতে শাহ সাহেব মুখে হাত দিয়া ধরাশায়ী হইলেন। এ বয়সে তাঁর যে দুই চারিটি দাঁত অবশিষ্ট ছিল, গঙ্গারামের পাদস্পর্শে তাহার মধ্যে অনেকগুলিই মুক্তিলাভ করিল। তখন হামরাহি পাইকেরা ছুটিয়া আসিয়া গঙ্গারামকে ধরিল এবং কাজি সাহেবের আজ্ঞানুসারে তাহার হাতে হাতকড়ি ও পায়ে বেড়ি দিল এবং যে সকল কথার অর্থ হয় না, এরূপ শব্দ প্রয়োগপূর্বক তাহাকে গালি দিতে দিতে এবং ঘুষি, কিল ও লাথি মারিতে মারিতে কারাগারে লইয়া গেল। সে দিন সন্ধ্যা হইয়াছিল; সে দিন আর কিছু হয় না-পরদিন তাহার জীয়ন্তে কবর হইবে।

    দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

    যেখানে গাছতলায় পড়িয়া এলোচুলে মাটিতে লুটাইয়া গঙ্গারামের ভগিনী কাঁদিতেছিল, সেইখানে এ সংবাদ পৌঁছিল। ভগিনী শুনিল, ভাইয়ের কাল জীয়ন্তে কবর হইবে। তখন সে উঠিয়া বসিয়া চক্ষু মুছিয়া এলোচুল বাঁধিল।
    গঙ্গারামের ভগিনী শ্রীর বয়স পঁচিশ বৎসর হইতে পারে। সে গঙ্গারামের অনুজা।
    সংসারে গঙ্গারাম, গঙ্গারামের মা এবং শ্রী ভিন্ন কেহই ছিল না। গঙ্গারামের মা ইদানীং অতিশয় রুগ্না হইয়াছিলেন, সুতরাং শ্রীই ঘরের গৃহিণী ছিল। শ্রী সধবা বটে, কিন্তু অদৃষ্টক্রমে স্বামিসহবাসে বঞ্চিতা।
    ঘরে একটি শালগ্রাম ছিল,-এতটুকু ক্ষুদ্র একখানি নৈবেদ্য দিয়া প্রত্যহ তাহার একটু পূজা হইত। শ্রী ও শ্রীর মা জানিত যে, ইনিই সাক্ষাৎ নারায়ণ। শ্রী চুল জড়াইয়া সেই শালগ্রামের ঘরের দ্বারের বাহিরে থাকিয়া মনে মনে অসংখ্য প্রণাম করিল। পরে হাত জোড় করিয়া বলিতে লাগিল, “হে নারায়ণ! হে পরমেশ্বর! হে দীনবন্ধু! হে অনাথনাথ! আমি আজ যে দুঃসাহসের কাজ করিব, তুমি ইহাতে সহায় হইও। আমি স্ত্রীলোক-পাপিষ্ঠা। আমা হইতে কি হইবে! তুমি দেখিও ঠাকুর!”
    এই বলিয়া সেখান হইতে শ্রী অপসৃতা হইয়া বাটীর বাহিরে গেল। পাঁচকড়ির মা নামে তাহার এক বর্ষীয়সী প্রতিবাসিনী ছিল। ঐ প্রতিবাসিনীর সঙ্গে ইহাদের বিলক্ষণ আত্মীয়তা ছিল, সে শ্রীর মার অনেক কাজ-কর্ম করিয়া দিত। এক্ষণে তাহার নিকটে গিয়া শ্রী চুপি চুপি কি বলিল। পরে দুই জনে রাজপথে নিষ্ক্রান্ত হইয়া, অন্ধকারে গলি-ঘুঁজি পার হইয়া অনেক পথ হাঁটিল। সে দেশে কোঠাঘর তত বেশী নয়, কিন্তু এখনকার অপেক্ষা তখন কোঠা-ঘর অধিক ছিল, মধ্যে মধ্যে একটি একটি বড় বড় অট্টালিকাও পাওয়া যাইত। ঐ দুই জন স্ত্রীলোক আসিয়া, এমনই একটা অট্টালিকার সম্মুখে উপস্থিত হইল। বাড়ীর সম্মুখে দীঘি, দীঘিতে বাঁধা ঘাট। বাঁধা ঘাটের উপর কতকগুলা দ্বারবান বসিয়া, কেহ সিদ্ধি ঘুঁটিতেছিল, কেহ টপ্পা গাইতেছিল, কেহ স্বদেশের প্রসঙ্গে চিত্ত সমর্পণ করিতেছিল। তাহাদেরই মধ্যে এক জনকে ডাকিয়া পাঁচকড়ির মা বলিল, “পাঁড়ে ঠাকুর! ভাণ্ডারীকে ডেকে দাও না?” দ্বারবান্ বলিল, “হাম পাঁড়ে নেহি, হাম্ মিশর হোতে হেঁ |”
    পাঁচকড়ির মা। তা আমি জানি না বাছা! পাঁড়ে কিসের বামুন? মিশর যেমন বামুন! তখন মিশ্রদেব প্রসন্ন হইয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোম ভাণ্ডারী লেকে কেয়া করোগে?”
    পাঁচকড়ির মা। কি আর করিব? আমার ঘরে কতকগুলা নাউ কুম‍‍ড়া তরকারি হয়েছে, তাই বলে যাব যে, কাল গিয়ে যেন কেটে নিয়ে আসে।
    দ্বারবান্। আচ্ছা, সো হাম্ বোলেঙ্গে। তোম ঘরমেু যাও।
    পাঁচকড়ির মা। ঠাকুর, তুমি বলিলে কি আর সে ঠিকানা পাবে কার ঘরে তরকারি হয়েছে?
    দ্বারবান। আচ্ছা। তোমারি নাম বোল‍‍কে যাও।
    পাঁচকড়ির মা। যা আবাগির বেটা! তোকে একটা নাউ দিতাম, তা তোর কপালে হলো না।
    দ্বারবান। আচ্ছা, তোম্ খাড়ি রহো। হাম্ ভাণ্ডারীকো বোলাতে হেঁ |”
    তখন মিশ্রঠাকুর গুন্গুরন্ করিয়া পিলু ভাঁজিতে ভাঁজিতে অট্টালিকামধ্যে প্রবেশ করিলেন, এবং অচিরাৎ জীবন ভাণ্ডারীকে সংবাদ দিলেন যে, “এক্প‍ঠো তরকারিওয়ালি আয়ি হৈ। মুঝ্র‍কো কুছ্ মেলেগা, তোম্ং‍কো কুছ মেল সক্তাল হায়। তোম জলদীও আও |”
    জীবন ভাণ্ডারীর বয়স কিছু বেশী, কতকগুলো চাবি ঘুন‍‍সিতে ঝোলান। মুখ বড় রুক্ষ। কিঞ্চিৎ লাভের প্রত্যাশা পাইয়া সে শীঘ্র বাহির হইয়া আসিল। দেখিল, দুইটি স্ত্রীলোক দাঁড়াইয়া আছে। জিজ্ঞাসা করিল, “কে ডেকেছে গা?”
    পাঁচকড়ির মা বলিল, “এই আমার ঘরে কিছু তরকারি হয়েছে, তাই ডেকেছি। কিছু বা তুমি নিও, কিছু বা দরওয়ান‍‍জীকে দিও, আর কিছু বা সরকারীতে দিও |”
    জীবন ভাণ্ডারী। তা তোর বাড়ী কোথা বলে যা, কাল যাব।
    পাঁচকড়ির মা। আর একটি দুঃখী অনাথা মেয়ে এয়েছে, ও কি বলবেি একবার শোন।
    শ্রী গলা পর্যন্ত ঘোমটাঃ টানিয়া প্রাচীরে মিশিয়া এক পাশে দাঁড়াইয়াছিল। জীবন ভাণ্ডারী তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া রুক্ষভাবে বলিল, “ও ভিক্ষেশিক্ষের কথা আমি হুজুরে কিছু বলিতে পারিব না |” পাঁচকড়ির মা তখন অস্ফুট স্বরে ভাণ্ডারী মহাশয়কে বলিল, “ভিক্ষে যদি কিছু পায় তবে অর্ধেক তোমার |”
    ভাণ্ডারী মহাশয় তখন প্রসন্নবদনে বলিলেন, “কি বল মা?” ভিখারীর পক্ষে ভাণ্ডারীর প্রভুর দ্বার অবারিত। শ্রী ভিক্ষার অভিপ্রায় জানাইল, সুতরাং ভাণ্ডারী মহাশয় তাহাকে মুনিবের কাছে লইয়া যাইতে বাধ্য হইলেন।
    ভাণ্ডারী শ্রীকে পৌঁছাইয়া দিয়া প্রভুর আজ্ঞামত চলিয়া গেল।
    শ্রী আসিয়া দ্বারদেশে দাঁড়াইল। অবগুণ্ঠনবতী, বেপমানা। গৃহকর্তা বলিলেন, “তুমি কে?”
    শ্রী বলিল, “আমি শ্রী |”
    “শ্রী! তুমি তবে কি আমাকে চেন না? না চিনিয়া আমার কাছে আসিয়াছ? আমি সীতারাম রায় |”
    তখন শ্রী মুখের ঘোমটা তুলিল। সীতারাম দেখিলেন, অশ্রুপূর্ণ, বর্ষাবারি-নিষিক্ত পদ্মের ন্যায়, অনিন্দ্যসুন্দরমুখী। বলিলেন, “তুমি শ্রী! এত সুন্দরী!”
    শ্রী বলিল, “আমি বড় দুঃখী। তোমার ব্যঙ্গের যোগ্য নহি |” শ্রী কাঁদিতে লাগিল।
    সীতারাম বলিলেন, “এত দিনের পর কেন আসিয়াছ? আসিয়াছ ত অত কাঁদিতেছ কেন?”
    শ্রী তবু কাঁদে—কথা কহে না। সীতারাম বলিল, “নিকটে এসো |”
    তখন শ্রী অতি মৃদুস্বরে বলিল, “আমি বিছানা মাড়াইব না-আমার অশৌচ |”
    সী। সে কি?
    গদগদস্বরে অশ্রুপূর্ণলোচনে শ্রী বলিতে লাগিল, “আজ আমার মা মরিয়াছেন |”
    সী। সেই বিপদে পড়িয়া কি তুমি আজ আমার কাছে আসিয়াছ?
    শ্রী। না-আমার মার কাজ আমিই যথাসাধ্য করিব। সে জন্য তোমায়দুঃখদিব না। কিন্তু আমার আজ ভারি বিপদ!
    সী। আর কি বিপদ!
    শ্রী। আমার ভাই যায়। কাজি সাহেব তাহার জীয়ন্তে কবরের হুকুম দিয়াছেন। সে এখন হাবুজখানায় আছে।
    সী। সে কি? কি করেছে?
    তখন শ্রী যাহা যাহা শুনিয়াছিল এবং যাহা যাহা দেখিয়াছিল, তাহা মৃদুস্বরে কাঁদিতে কাঁদিতে আদ্যোপান্ত বলিল। শুনিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া সীতারাম বলিলেন, “এখন উপায়?”
    শ্রী। এখন উপায় তুমি। তাই এত বৎসরের পর এসেছি।
    সী। আমি কি করিব?
    শ্রী। তুমি কি করিবে? তবে কে করিবে? আমি জানি, তুমি সব পার।
    সী। দিল্লীর বাদশাহের চাকর এই কাজি। দিল্লীর বাদশাহের সঙ্গে বিরোধ করে কার সাধ্য?
    শ্রী বলিল, “তবে কি কোন উপায় নাই?”
    সীতারাম অনেক ভাবিয়া বলিলেন, “উপায় আছে। তোমার ভাইকে বাঁচাইতে পারি। কিন্তু আমি মরিব |”
    শ্রী। দেখ, দেবতা আছে, ধর্ম আছেন, নারায়ণ আছেন। কিছুই মিথ্যা নয়। তুমি দীন দুঃখীকে বাঁচাইলে তোমার কখনও অমঙ্গল হইবে না। হিন্দুকে হিন্দু না রাখিলে কে রাখিবে? ”
    সীতারাম অনেকক্ষণ ভাবিল। পরে বলিল, “তুমি সত্যই বলিয়াছ, হিন্দুকে হিন্দু না রাখিলে কে রাখিবে? আমি তোমার কাছে স্বীকার করিলাম। গঙ্গারামের জন্য আমি যথাসাধ্য করিব |”
    তখন প্রীতমনে ঘোমটা টানিয়া শ্রী প্রস্থান করিল।
    সীতারাম দ্বার অর্গলবদ্ধ করিয়া ভৃত্যকে আদেশ করিলেন, “আমি যতক্ষণ না দ্বার খুলি ততক্ষণ আমাকে কেহ না ডাকে |” মনে মনে একবার আবার ভাবিলেন, “শ্রী এমন শ্রী? তা ত জানি না। আগে শ্রীর কাজ করিব, তার পর অন্য কথা |” ভাবিলেন, “হিন্দুকে হিন্দু না রাখিলে কে রাখিবে?”

    তৃতীয় পরিচ্ছেদ

    সীতারামের এক গুরুদেব ছিলেন। তিনি ভট্টাচার্য্য অধ্যাপক গোছ মানুষ, তসর নামাবলী পরা, মাথাটি যত্নপূর্বক কেশশূন্য করিয়াছেন, অবশিষ্ট আছে-কেবল এক “রেফ”। কেশাভাবে চন্দনের যথেষ্ট ঘটা,-খুব লম্বা ফোঁটা, আর আর বামুনগিরির সমান সব আছে। তাঁহার নাম চন্দ্রচূড় তর্কালঙ্কার। তিনি সীতারামের নিতান্ত মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী। সীতারাম যখন যেখানে বাস করিতেন, চন্দ্রচূড়ও তখন সেইখানে বাস করিতেন। সম্প্রতি ভূষণায় বাস করিতেছিলেন। আমরা আজিকার দিনেও এমন দুই একজন অধ্যাপক দেখিয়াছি যে, টোলে ব্যাকরণ সাহিত্য পড়াইতে যেমন পটু, অশাসিত তালুকে দাঙ্গা করিতেও তেমনি মজবুত। চন্দ্রচূড় সেই শ্রেণীর লোক।
    কিছুক্ষণ পরে গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া সীতারাম গুরুদেবের নিকেতনে উপস্থিত হইলেন। চন্দ্রচূড়ের সঙ্গে নিভৃতে সীতারামের অনেক কথা হইল। কি কি কথা হইল, তাহা আমাদের সবিস্তারে লিখিবার প্রয়োজন নাই। কথাবার্তার ফল এই হইল যে, সীতারাম ও চন্দ্রচূড় উভয়ে সেই রাত্রিতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া সহরের অনেক লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলেন, এবং সীতারাম রাত্রিশেষে গৃহে ফিরিয়া আসিয়া আপনার পরিবারবর্গ একজন আত্মীয় লোকের সঙ্গে মধুমতীপারে পাঠাইয়া দিলেন।

    চতুর্থ পরিচ্ছেদ

    এক খুব বড় ফর্দাআ জায়গায়, সহরের বাহিরে, গঙ্গারাম দাসের কবর প্রস্তুত হইয়াছিল। বন্দী সেখানে আসিবার আগেই লোক আসিতে আরম্ভ হইল। অতি প্রত্যূষে,-তখনও-গাছের আশ্রয় হইতে অন্ধকার সরিয়া যায় নাই—অন্ধকারের আশ্রয় হইতে নক্ষত্র সব সরিয়া যায় নাই, এমন সময়ে দলে দলে পালে পালে জীয়ন্ত মানুষের কবর দেখিতে লোক আসিতে লাগিল। একটা মানুষ মরা, জীবিতের পক্ষে একটা পর্বের সমান। যখন সূর্যোদয় হইল, তখন মাঠ প্রায় পুরিয়া গিয়াছে, অথচ নগরের সকল গলি, পথ, রাস্তা হইতে পিপীলিকাশ্রেণীর মত মনুষ্য বাহির হইতেছে। শেষ সে বিস্তৃত স্থানেও স্থানাভাব হইয়া উঠিল। দর্শকেরা গাছে উঠিয়া কোথাও হনুমানের মতন আসীন—যেন লাঙ্গুলাভাবে কিঞ্চিৎ বিরস, কোথাও বাদুড়ের মত দুল্যমান, দিনোদয়ে যেন কিঞ্চিৎ সরস। পশ্চাতে, নগরের যে কয়টা কোঠাবাড়ী দেখা যাইতেছিল, তাহার ছাদ মানুষে ভরিয়া গিয়াছে, আর স্থান নাই। কাঁচা ঘরই বেশী, তাহাতেও মই লাগাইয়া, মইয়ে পা রাখিয়া অনেকে চালে বসিয়া দেখিতেছে। মাঠের ভিতর কেবল কালো মাথার সমুদ্র-ঠেসাঠেসি, মিশামিশি। কেবল মানুষ আসিতেছে, জমাট বাঁধিতেছে, সরিতেছে, ঘুরিতেছে,আবার মিশিতেছে।কোলাহল অতিশয় ভয়ানক। বন্দী এখনও আসিল না দেখিয়া দর্শকেরা অতিশয় অধীর হইয়া উঠিল। চীৎকার, গণ্ডগোল, বকাবকি, মারামারি আরম্ভ করিল। হিন্দু মুসলমানকে গালি দিতে লাগিল, মুসলমান হিন্দুকে গালি দিতে লাগিল। কেহ বলে, “আল্লা!” কেহ বলে “হরিবোল |” কেহ বলে, “আজ হবে না, ফিরে যাই |” কেহ বলে, “ঐ এয়েছে দেখ্ |” যাহারা বৃক্ষারূঢ়, তাহার কার্যাভাবে গাছের পাতা, ফুল এবং ছোট ছোট ডাল ভাঙ্গিয়া নিম্নচারীদিগের মাথার উপর ফেলিতে লাগিল। কেহ কেহ তাহাতেও সন্তুষ্ট না হইয়া নিষ্ঠীবন প্রক্ষেপ করিতে লাগিল। এই সকল কারণে, যেখানে যেখানে বৃক্ষ, সেইখানে সেইখানে তলচারী এবং শাখাবিহারীদিগের ভীষণ কোন্দল উপস্থিত হইতে লাগিল। কেবল একটি গাছের তলায় সেরূপ গোলযোগ নাই। সে বৃক্ষের তলে বড় লোক দাঁড়ায় নাই। সমুদ্রমধ্যে ক্ষুদ্র দ্বীপের মত তাহা প্রায় জনশূন্য। দুই চারি জন লোক সেখানে আছে বটে, কিন্তু তাহারা কোন গোলযোগ করিতেছে না; নিঃশব্দ। কেবল অন্য কোন লোক সে বৃক্ষতলে দাঁড়াইতে আসিলে, তাহারা উহাদিগকে গলা টিপিয়া বাহির করিয়া দিতেছে। তাহাদিগকে বড় বড় জোয়ান ও হাতে বড় বড় লাঠি দেখিয়া সকলে নিঃশব্দে সরিয়া যাইতেছে। সেই বৃক্ষের শিকড়ের উপর দাঁড়াইয়া কেবল একজন স্ত্রীলোক বৃক্ষকাণ্ড অবলম্বন করিয়া ঊর্ধ্বমুখে বৃক্ষারূঢ় কোন ব্যক্তির সঙ্গে কথা কহিতেছে। তাহার চোখ-মুখ ফুলিয়াছে; বেশভূষা বড় আলুথালু—যেন সমস্ত রাত্রি কাঁদিয়াছে। কিন্তু এখন আর কাঁদিতেছে না। যে বৃক্ষারূঢ়, তাহাকে ঐ স্ত্রীলোক বলিতেছে, “ঠাকুর! এখন কিছু দেখা যায় না!”
    বৃক্ষারূঢ় ব্যক্তি উপর হইতে বলিল, “না |”
    “তবে বোধ হয়, নারায়ণ রক্ষা করিলেন |”
    পাঠক বুঝিয়া থাকিবেন যে, এই স্ত্রীলোক শ্রী। বৃক্ষোপরি স্বয়ং তর্কালঙ্কার। বৃক্ষশাখা ঠিক তাঁর উপযুক্ত নহে, কিন্তু তর্কালঙ্কার মনে করিতেছিলেন, “আমি ধর্মাচরণনিযুক্ত; ধর্মের জন্য সকলই কর্তব্য |”
    শ্রীর কথার উত্তরে চন্দ্রচূড় বলিলেন, “নারায়ণ অবশ্য রক্ষা করিবেন। আমার সে ভরসা আছে। তুমি উতলা হইও না। কিন্তু এখনও রক্ষার উপায় হয় নাই বোধ হইতেছে। কতকগুলা লাল পাগড়ি আসিতেছে, দেখিতে পাইতেছি |”
    শ্রী। কিসের লাল পাগড়ি?
    চ। বোধ হয় ফৌজদারি সিপাহী।
    বাস্তবিক দুই শত ফৌজদারি সিপাহী সশস্ত্র শ্রেণীবদ্ধ হইয়া গঙ্গারামকে ঘেরিয়া লইয়া আসিতেছিল। দেখিয়া সেই অসংখ্য জনতা একেবারে নিস্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইল। যেমন যেমন দেখিতে লাগিলেন, চন্দ্রচূড় সেইরূপ শ্রীকে বলিতে লাগিলেন। শ্রী জিজ্ঞাসা করিল, “কত সিপাই?”
    চ। দুই শত হইবে।
    শ্রী। আমরা দীন দুঃখী—নিঃসহায়। আমাদের মারিবার জন্য এত সিপাহী কেন?
    চ। বোধ হয় বহু লোকের সমাগম হইয়াছে শুনিয়া, সতর্ক হইয়া ফৌজদার এত সিপাহী পাঠাইয়াছেন।
    শ্রী। তার পর কি হইতেছে?
    চ। সিপাহীরা আসিয়া, শ্রেণী বাঁধিয়া প্রস্তুত কবরের নিকট দাঁড়াইল। মধ্যে গঙ্গারাম। পিছনে খোদ কাজি, আর সেই ফকির।
    শ্রী। দাদা কি করিতেছেন?
    চ। পাপিষ্ঠেরা তার হাতে হাতকড়ি, পায়ে বেড়ী দিয়াছে।
    শ্রী। কাঁদিতেছেন কি?
    চ। না। নিঃশব্দ-নিস্তব্ধ। মূর্তি বড় গম্ভীর, বড় সুন্দর।
    শ্রী। আমি একবার দেখিতে পাই না? জন্মের শোধ দেখিব।
    চ। দেখিবার সুবিধা আছে। তুমি এই নীচের ডালে উঠিতে পার?
    শ্রী। আমি স্ত্রীলোক, গাছে উঠিতে জানি না।
    চ। এ কি লজ্জার সময় মা?
    শিকড় হইতে হাত দুই উঁচুতে একটি সরল ডাল ছিল। সে ডালটি উঁচু করিয়া না উঠিয়া, সোজা হইয়া বাহির হইয়া গিয়াছিল। হাতখানিক গিয়া, ঐ ডাল দুই ভাগে বিভক্ত হইয়াছিল। সেই দুই ডালের উপর দুইটি পা দিয়া, নিকটস্থ আর একটি ডাল ধরিয়া দাঁড়াইবার বড় সুবিধা। চন্দ্রচূড় শ্রীকে ইহা দেখাইয়া দিলেন। শ্রী লজ্জা ত্যাগ করিয়া উঠিবার চেষ্টা করিল—শ্মশানে লজ্জা থাকে না।
    প্রথম দুই একবার চেষ্টা করিয়া উঠিতে পারিল না—কাঁদিতে লাগিল। তার পর, কি কৌশলে কে জানে, শ্রী ত জানে না—সে সেই নিম্ন শাখায় উঠিয়া, সেই জোড়া ডালে যুগল চরণ রাখিয়া, আর একটি ডাল ধরিয়া দাঁড়াইল।
    তাতে বড় গোলযোগ উপস্থিত হইল। যেখানে শ্রী দাঁড়াইয়াছিল, সেখানে সম্মুখদিকে পাতার আবরণ ছিল না। শ্রী সেই অসংখ্য জনতার সম্মুখবর্তিনী হইয়া দাঁড়াইল। সকলে দেখিল, সহসা অতুলনীয়া রূপবতী বৃক্ষের ডাল ধরিয়া, শ্যামল পত্ররাশিমধ্যে বিরাজ করিতেছে। প্রতিমার ঠাটের মত, চারি দিকে বৃক্ষশাখা, বৃক্ষপত্র ঘেরিয়া রহিয়াছে; চুলের উপর পাতা পড়িয়াছে, স্থূল বাহুর উপর পাতা পড়িয়াছে; বক্ষঃস্থ কেশদাম কতক কতক মাত্র ঢাকিয়া পাতা পড়িয়াছে, একটি ডাল আসিয়া পা দুখানি ঢাকা ফেলিয়াছে; কেহ দেখিতে পাইতেছে না, এ মূর্ত্তিমতী বনদেবী কিসের উপর দাঁড়াইয়াছে। দেখিয়া নিকটস্থ জনতা বাত্যাতাড়িত সাগরবৎ, সহসা সংক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল।
    শ্রী তাহা কিছুই জানিতে পারিল না। আপনার অবস্থান প্রতি তাহার কিছুমাত্র মনোযোগ ছিল না। অনিমেষলোচনে গঙ্গারামের পানে চাহিয়া দেখিতেছিল, দুই চক্ষু দিয়া অবিরল জলধারা পড়িতেছিল। এমন সময়ে শাখান্তর হইতে চন্দ্রচূড় ডাকিয়া বলিলেন, “এদিকে দেখ! এদিকে দেখ! ঘোড়ার উপর কে আসিতছে?”
    শ্রী দিগন্তরে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিল, ঘোড়ার উপর কে আসিতেছে। যোদ্ধৃবেশ, অথচ নিরস্ত্র। অশ্বী বড় তেজস্বিনী, কিন্তু লোকের ভিড় ঠেলিয়া আগুইতে পারিতেছে না। অশ্বী নাচিতেছে, দুলিতেছে, গ্রীবা বাঁকাইতেছে, কিন্তু তবু বড় আগু হইতে পারিতেছে না। শ্রী চিনিলেন, অশ্বপৃষ্ঠে সীতারাম।
    এ দিকে গঙ্গারামকে সিপাহীরা কবরে ফেলিতেছিল। সেই সময়ে দুই হাত তুলিয়া সীতারাম নিষেধ করিলেন। সিপাহীরা নিরস্ত হইল। শাহ সাহেব বলিলেন, “কিয়া দেখ‍‍তে হো! কাফেরকো মাট্টি দেও |”
    কাজি সাহেব ভাবিলেন। কাজি সাহেবের সে সময়ে সেখানে আসিবার কোন প্রয়োজন ছিল না, কেবল জনতা শুনিয়া শখ করিয়া আসিয়াছিলেন। যখন আসিয়াছিলেন, তখন তিনিই কর্তা। তিনি বলিলেন, “সীতারাম যখন বারণ করিতেছে, তখন কিছু কারণ আছে। সীতারাম আসা পর্যন্ত বিলম্ব কর |”
    শাহ সাহেব অসন্তুষ্ট হইলেন, কিন্তু অগত্যা সীতারাম পৌঁছান অপেক্ষা করিতে হইল। গঙ্গারামের মনে একটু আশার সঞ্চার হইল।
    সীতারাম কাজি সাহেবের নিকট পৌঁছিলেন। অশ্ব হইতে অবতরণপূর্বক প্রণতমস্তকে শাহ সাহেবকে বিনয়পূর্বক অভিবাদন করিলেন। তৎপরে কাজি সাহেবকে তদ্রূপ করিলেন। কাজি সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন রায় সাহেব! আপনার মেজাজ সরিফ |”
    সী। অলহম্- দল্-ইল্লা। মেজাজে মবারকের সংবাদ পাইলেই এ ক্ষুদ্র প্রাণী চরিতার্থ হয়।
    কা। খোদা নফরকে যেমন রাখিয়াছেন। এখন এই উমর, বাল সফেদ, কাজা পৌঁছিলেই হয়। দৌলতখানার কুশল সংবাদ ত?
    সী। হুজুরের এক্া‍বালে গরিবখানার অমঙ্গলের সম্ভাবনা কি?
    কা। এখন এখানে কি মনে করিয়া?
    সী। এই গঙ্গারাম—বদ্ে‍বখতঅ—বেত্প‍মিজ যাই হোক, আমার স্বজাতি। তাই দুঃখে পড়িয়া হুজুরে হাজির হইয়াছি, জান বখ‍‍শিশ ফরমায়েশ করুন।
    কা। সে কি? তাও কি হয়?
    সীতা। মেহেরবান ও কদরদান সব পারে।
    কা। খোদা মালেক। আমা হইতে এ বিষয়ের কিছু হইবে না।
    সী। হাজার আসরফি জরমানা দিবে। জান বখ‍‍শিশ ফরমায়েশ করুন।
    কাজি সাহেব ফকিরের মুখপানে চাহিলেন। ফকির ঘাড় নাড়িল। কাজি বলিলেন, “সে সব কিছু হইবে না। কবরমে কাফেরকো ডারো |”
    সী। দুই হাজার আসরফি দিব। আমি জোড় হাত করিতেছি, গ্রহণ করুন। আমার খাতির!
    কাজি ফকিরের মুখপানে চাহিল, ফকির নিষেধ করিল, সে কথাও উড়িয়া গেল। শেষ সীতারাম চারি হাজার আসরফি স্বীকার করিল। তাও না। পাঁচ হাজার-তাও না। আট হাজার-দশ হাজার, তাও না; সীতারামের আর নাই। শেষ সীতারাম জানু পাতিয়া করজোড়ে করিয়া অতি কাতরস্বরে বলিলেন, “আমার আর নাই। তবে, আর অন্য যা কিছু আছে, তাও দিতেছি। আমার তালুক মুলুক, জমি জেওরাত, বিষয়-আশয় সর্বস্ব দিতেছি। সব গ্রহণ করুন। উহাকে ছাড়িয়া দিন |”
    কাজি সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “ও তোমার এমন কে যে, উহার জন্য সর্বস্ব দিতেছ?”
    সীতা। ও আমার যেই হৌক, আমি উহার প্রাণদানে স্বীকৃত-আমি সর্বস্ব দিয়া উহার প্রাণ রাখিব। এই আমাদের হিন্দু ধর্ম।
    কাজি। হিন্দুধর্ম যাহাই হৌক, মুসলমানের ধর্ম তাহার বড়। এ ব্যক্তি মুসলমান ফকিরের অপমান করিয়াছে, উহার প্রাণ লইব-তাহাতে সন্দেহ নাই-কাফেরের প্রাণ ভিন্ন ইহার অন্য দণ্ড নাই।
    তখন সীতারাম জানু পাতিয়া কাজি সাহেবের আলখোল্লার প্রান্তভাগ ধরিয়া, বাষ্পগদ্গদস্বরে বলিতে লাগিলেন, “কাফেরের প্রাণ? আমিও কাফের। আমার প্রাণ লইলে এ প্রায়শ্চিত্ত হয় না? আমি এ কবরে নামিতেছি-আমাকে মাটি চাপা দিউন-আমি হরিনাম করিতে করিতে বৈকুণ্ঠে যাইব-আমার প্রাণ লইয়া এই দুঃখীর প্রাণদান করুন। দোহাই তোমার কাজি সাহেব! তোমার যে আল্লা, আমারও সেই বৈকুণ্ঠেশ্বর! ধর্মাচরণ করিও। আমি প্রাণ দিতেছি—বিনিময়ে এই ক্ষুদ্র ব্যক্তির প্রাণদান কর |”
    কথাটা নিকটস্থ হিন্দু দর্শকেরা শুনিতে পাইয়া হরিধ্বনি দিয়া উঠিল। করতালি দিয়া বলিতে লাগিল, “ধন্য রায়জী! ধন্য রায় মহাশয়! জয় কাজি সাহেবকা! গরিবকে ছাড়িয়া দেও |”
    যাহারা কথা কিছুই শুনিতে পায় নাই, তাহারাও হরিধ্বনি শুনিয়া হরিধ্বনি দিতে লাগিল। তুমুল কোলাহল পড়িয়া গেল। কাজি সাহেবও বিস্মিত হইয়া সীতারামকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কি বলিতেছেন, রায় মহাশয়! এ আপনার কে যে, ইহার জন্য আপনার প্রাণ দিতে চাহিতেছেন?”
    সীতা। এ আমার ভ্রাতার অপেক্ষা, পুত্রের অপেক্ষাও আত্মীয়; কেন না, আমার শরণাগত। হিন্দুশাস্ত্রের বিধি এই যে, সর্বস্ব দিয়া, প্রাণ দিয়া শরণাগতকে রক্ষা করিবে। রাজা ঔশীনর, আপনার শরীরের সকল মাংস কাটিয়া দিয়া একটি পায়রাকে রক্ষা করিয়াছিলেন। অতএব আমাকে গ্রহণ করুন—ইহাকে ছাড়ুন।
    কাজি সাহেব সীতারামের উপর কিছু প্রসন্ন হইলেন। শাহ সাহেবকে অন্তরালে লইয়া চুপি চুপি কথাবার্তা কহিতে লাগিলেন। বলিলেন, “এ ব্যক্তি দশ হাজার আসরফি দিতে চাহিতেছে। নিলে সরকারী তহবিলের কিছু সুসার হইবে। দশ হাজার আসরফি লইয়া এই হতভাগ্যকে ছাড়িয়া দিলে হয় না?”
    শাহ সাহেব বলিলেন, “আমার ইচ্ছা, দুইটাকেই এক কবরে পুঁতি। আপনি কি বলেন?”
    কাজি। তোবা! আমি তাহা পারিব না। সীতারাম কোন অপরাধ করে নাই-বিশেষ এ ব্যক্তি মান্য, গণ্য ও সচ্চরিত্র। তা হইবে না।
    এতক্ষণ গঙ্গারাম কোন কথা কহে নাই, মনে জানিত যে, তাহার নিষ্কৃতি নাই। কিন্তু শাহ সাহেবের সঙ্গে কাজি সাহেবের নিভৃতে কথা হইতেছে দেখিয়া সে জোড়হাত করিয়া কাজি সাহেবকে বলিল, “হুজুরের মর্জিক মবারকে কি হয় বলিতে পারি না, কিন্তু এ গরিবের প্রাণ রক্ষা সম্বন্ধে গরিবেরও একটা কথা শুনিতে হয়। একে অপরাধে অন্যের প্রাণ লইবেন, এ কোন্ সরায় আছে? সীতারামের প্রাণ লইয়া, আমায় প্রাণদান দিবেন—আমি এমন প্রাণদান লইব না। এই হাতকড়ি মাথায় মারিয়া আপনার মাথা ফাটাইব |”
    তখন ভিড়ের ভিতর হইতে কে ডাকিয়া বলিল, “হাতকড়ি মাথায় মারিয়াই মর। মুসলমানের হাত এড়াইবে |”
    বক্তা, স্বয়ং চন্দ্রচূড় ঠাকুর। তিনি আর গাছে নাই। একজন জমাদার শুনিয়া বলিল, “পাকড়ো বস্কো |” কিন্তু চন্দ্রচূড় তর্কালঙ্কারকে পাকড়ােন বড় শক্ত কথা। সে কাজ হইল না।
    এদিকে হাতকড়ি মাথায় মারার কথা শুনিয়া ফকির মহাশয়ের কিছু ভয় হইল, পাছে জীয়ন্ত মানুষ পোঁতার সুখে তিনি বঞ্চিত হন। কাজি সাহেবকে বলিলেন, “এখন আর উহার হাতকড়িতে প্রয়োজন কি? হাতকড়ি খসাইতে বলুন |”
    কাজি সাহেব সেইরূপ হুকুম দিলেন। কামার আসিয়া গঙ্গারামের হাত মুক্ত করিল। কামার সেখানে উপস্থিত থাকিবার প্রয়োজন ছিল না, তবে সরকারী বেড়ী হাতকড়ি সব তাহার জিম্মা, সেই উপলক্ষে সে আসিয়াছিল। তাহার ভিতর কিছু গোপন কথাও ছিল। রাত্রিশেষে কর্মকার মহাশয় চন্দ্রচূড় ঠাকুরের কিছু টাকা খাইয়াছিলেন।
    তখন ফকির বলিল, “আর বিলম্ব কেন? উহাকে গাড়িয়া ফেলিতে হুকুম দিন |”
    শুনিয়া কামার বলিল, “বেড়ী পায়ে থাকিবে কি? সরকারী বেড়ী নোক্সারন হইবে কেন? এখন ভাল লোহা বড় পাওয়া যায় না। আর বদমায়েসেরও এত হুড়াহুড়ি পড়িয়া গিয়াছে যে, আমি আর বেড়ি যোগাইতে পারিতেছি না |” শুনিয়া কাজি সাহেব বেড়ী খুলিতে হুকুম দিলেন। বেড়ি খোলা হইল।
    শৃঙ্খল-মুক্ত হইয়া গঙ্গারাম দাঁড়াইয়া একবার এদিক ওদিক দেখিল। তার পর গঙ্গারাম এক অদ্ভুত কাজ করিল। নিকটে সীতারাম ছিলেন; ঘোড়ার চাবুক তাঁহার হাতে ছিল। সহসা তাঁহার হাত হইতে সেই চাবুক কাড়িয়া লইয়া গঙ্গারাম এক লম্ফে সীতারামের শূন্য অশ্বের উপর উঠিয়া অশ্বকে দারুণ আঘাত করিল। তেজস্বী অশ্ব আঘাতে ক্ষিপ্ত হইয়া এক লম্ফে কবরের খাদ পার হইয়া সিপাহীদিগের উপর দিয়া চলিয়া গিয়া জনতার ভিতর প্রবেশ করিল।
    যতক্ষণে একবার বিদ্যুৎ চমকে, ততক্ষণে এই কাজ সম্পন্ন হইল। দেখিয়া, সেই লোকারণ্যমধ্যে তুমুল হরিধ্বনি পড়িয়া গেল। সিপাহীরা “পাক‍‍ড়ো পাক‍‍ড়ো” বলিয়া পিছু পিছু ছুটিল। কিন্তু তাহাতে একটা ভারি গোলযোগ উপস্থিত হইল। বেগবান অশ্বের সম্মুখ হইতে লোকে ভয়ে সরিয়া যাইতে লাগিল, গঙ্গারাম পথ পাইতে লাগিল, কিন্তু সিপাহীরা পথ পাইল না। তাহাদের সম্মুখে লোক জমাট বাঁধিয়া দাঁড়াইল। তখন তাহারা হাতিয়ার চালাইয়া পথ করিবার উদ্যোগ করিল।
    সেই সময়ে তাহার সবিস্ময়ে দেখিল যে, কালান্তক যমের ন্যায় কতকগুলি বলিষ্ঠ অস্ত্রধারী পুরুষ, একে একে ভিড়ের ভিতর হইতে আসিয়া সারি দিয়া তাহাদের সম্মুখে পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইল। তখন আরও সিপাহী আসিল। দেখিয়া আরও ঢাল-সড়কিওয়ালা হিন্দু আসিয়া তাহাদের পথ রোধ করিল। তখন দুই দলে ভারী দাঙ্গা উপস্থিত হইল।
    দেখিয়া, সক্রোধে কাজি সাহেব সীতারামকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ কি ব্যাপার?”
    সী। আমি ত কিছু বুঝিতে পারিতেছি না।
    কা। বুঝিতে পারিতেছ না? আমি বুঝিতে পারিতেছি, এ তোমারই খেলা।
    সী। তাহা হইলে আপনার কাছে নিরস্ত্র হইয়া মৃত্যুভিক্ষা চাহিতে আসিতাম না।
    কা। আমি এখন তোমার সে প্রার্থনা মঞ্জুর করিব। এ কবরে তোমাকেই পুঁতিব।
    এই বলিয়া কাজি সাহেব কামারকে হুকুম দিলেন, “ইহারই হাতে পায়ে ঐ হাতকড়ি, বেড়ী লাগাও |” দ্বিতীয় ব্যক্তিকে তিনি ফৌজাদারের নিকট পাঠাইলেন-ফৌজদার সাহেব যাহাতে আরও সিপাহী লইয়া স্বয়ং আইসেন, এমন প্রার্থনা জানায়। ফৌজদারের নিকট লোক গেল। কামার আসিয়া সীতারামকে ধরিল। সেই বৃক্ষারূঢ়া বনদেবী শ্রী তাহা দেখিল।
    এ দিকে গঙ্গারাম কষ্টে অথচ নির্বিঘ্নে অশ্ব লইয়া লোকারণ্য হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। কষ্টে-কেন না, আসিতে আসিতে দেখিলেন যে, সেই জনতামধ্যে একটা ভারী গণ্ডগোল উপস্থিত হইল। কোলাহল ভয়ানক হইল, লোকসকল সম্মুখে ছুটিতে লাগিল। তাঁহার অশ্ব এই সকলে অতিশয় ভীত হইয়া দুর্দমনীয় হইয়া উঠিল। অশ্বারোহণের কৌশল গঙ্গারাম তেমন জানিতেন না; ঘোড়া সামলাতেই তাঁহাকে এত ব্যতিব্যস্ত হইতে হইল যে, তিনি আর কোন দিকে চাহিয়া দেখিতে পারিলেন না যে, কোথায় কি হইতেছে। কেবল “মার! মার!” একটা শব্দ কানে গেল।
    লোকারণ্য হইতে কোন মতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গঙ্গারাম অশ্বকে ছাড়িয়া দিয়া, এক বটবৃক্ষে আরোহণ করিলেন, দেখিবেন-কি হইতেছে। দেখিলেন, ভারি গোলযোগ। সেই মহতী জনতা দুই ভাগে বিভক্ত হইয়াছে। এক দিকে সব মুসলমান-আর এক দিকে সব হিন্দু। মুসলমানদিগের অগ্রভাবে কতকগুলি সিপাহী, হিন্দুদিগের অগ্রভাবে কতকগুলি ঢাল-সড়কিওয়ালা। হিন্দুরা বাছা বাছা জোয়ান, আর সংখ্যাতেও বেশী। মুসলমানেরা তাহাদিগের কাছে হঠিতেছে। অনেকে পলাইতেছে। হিন্দুরা “মার মার” শব্দে পশ্চাদ্ধাবিত হইতেছে।
    এই মার্ মার্ শব্দে আকাশ, প্রান্তর, কানন প্রতিধ্বনিত হইতেছিল। যে লড়াই করিতেছে, সেও মার্ মার্ শব্দ করিতেছে, যে লড়াই না করিতেছে, সেও মার্ মার্ শব্দ করিতেছে। মার মার শব্দে হিন্দুরা চারি দিক হইতে চারি দিকে ছুটিতেছে। আবার গঙ্গারাম সবিস্ময়ে শুনিলেন, যাহারা এই মার মার শব্দ করিতেছে, তাহারা মধ্যে মধ্যে বলিতেছে, “জয় চণ্ডিকে! মা চণ্ডী এয়েছেন! চণ্ডীর হুকুম, মার! মার! মার! জয় চণ্ডিকে!” গঙ্গারাম ভাবিলেন, “এ কি এ?” তখন দেখিতে দেখিতে গঙ্গারাম দেখিলেন, মহামহীরুহের শ্যামল-পল্লবরাশি-মণ্ডিতা চণ্ডমূর্তি, দুই শাখায় দুই চরণ স্থাপন করিয়া, বাম হস্তে এক কোমল শাখা ধরিয়া, দক্ষিণ হস্তে অঞ্চল ঘুরাইতে ঘুরাইতে ডাকিতেছে, “মার! মার! শত্রু মার!”-অঞ্চল ঘুরিতেছে, অনাবৃত আলুলায়িত কেশদাম বায়ুভরে উড়িতেছে-দৃপ্ত পদভরে যুগল শাখা দুলিতেছে, উঠিতেছে, নামিতেছে,-সঙ্গে সঙ্গে সেই মধুরিময় দেহ উঠিতেছে, নামিতেছে-যেন সিংহবাহিনী সিংহপৃষ্ঠে দাঁড়াইয়া রণরঙ্গে নাচিতেছে। যেন মা অসুর-বধে মত্ত হইয়া ডাকিতেছেন, শ্রীর আর লজ্জা নাই, জ্ঞান নাই, ভয় নাই, বিরাম নাই-কেবল ডাকিতেছে-“মার—শত্রু মার! দেবতার শত্রু, মানুষের শত্রু, হিন্দুর শত্রু-আমার শত্রু-মার! শত্রু মার!” উত্থিত বাহু, কি সুন্দর বাহু! স্ফুরিত অধর, বিস্ফারিত নাসা, বিদ্যুন্ময় কটাক্ষ, স্বেদাক্ত ললাটে স্বেদবিজড়িত চূর্ণকুন্তলের শোভা! সকল হিন্দু সেই দিকে চাহিতেছে, আর “জয় মা চণ্ডিকে!” বলিয়া রণে ছুটিতেছে। গঙ্গারাম প্রথমে মনে করিতেছেন যে, যথার্থই চণ্ডী অবতীর্ণা-তার পর সবিস্ময়ে, সভয়ে চিনিলেন, শ্রী!
    এই চণ্ডীর উৎসাহে হিন্দুর রণজয় হইল। চণ্ডীর বলে বলবান হিন্দুর বেগ মুসলমানেরা সহ্য করিতে পারিল না। চীৎকার করিতে করিতে পলাইতে লাগিল। অল্পকালমধ্যে রণক্ষেত্র মুসলমানশূন্য হইল। গঙ্গারাম তখন দেখিলেন, একজন ভারী লম্বা জোয়ান সীতারামকে কাঁধে করিয়া লইয়া, আর সকলে তাঁহাকে ঘেরিয়া, সেই চণ্ডীর দিকে লইয়া চলিল। আরও দেখিলেন, পশ্চাৎ আর একজন সড়কিওয়ালা শাহ সাহেবের কাটামুণ্ড সড়কিতে বিঁধিয়া উঁচু করিয়া সঙ্গে সঙ্গে লইয়া যাইতেছে। এই সময়ে শ্রী সহসা বৃক্ষচ্যুতা হইয়া ভূতলে পড়িয়া মূর্ছিতপ্রায় হইল। গঙ্গারামও তখন বৃক্ষ হইতে নামিলেন।

    পঞ্চম পরিচ্ছেদ

    এমন সময়ে একটা গোল উঠিল যে, কামান, বন্দুক, গোলাগুলি লইয়া, সসৈন্য ফৌজদার বিদ্রোহীদিগের দমনার্থ আসিতেছেন। গোলাগুলির কাছে ঢালসড়কি কি করিবে? বলা বাহুল্য যে, নিমেষমধ্যে সেই জোয়ানের দল অদৃশ্য হইল। যে নিরস্ত্র বীরপুরুষেরা তাঁহাদের আশ্রয়ে থাকিয়া লড়াই ফতে করিতেছি বলিয়া কোলাহল করিতেছিলেন, তাঁহারা বলিলেন, “আমরা ত বারণ করিয়াছিলাম!” এই বলিয়া আর পশ্চাদ্দৃষ্ট না করিয়া ঊর্ধশ্বাসে গৃহাভিমুখে ধাবিত হইলেন। যাহারা দাঙ্গার কোন সংস্রবে ছিল না, তাহারা ‘চোরা গোরুর অপরাধে কপিলার বন্ধন’ সম্ভাবনা দেখিয়া সীতারাম গঙ্গারামকে নানাবিধ গালিগালাজ করিয়া আর্ত্তনাদপূর্বক পলাইতে লাগিল। অতি অল্পকালমধ্যে সেই লোকারণ্য অন্তর্হিত হইল। প্রান্তর যেমন জনশূন্য ছিল, তেমনই জনশূন্য হইল। লোকজনের মধ্যে কেবল সেই বৃক্ষতলে চন্দ্রচূড়, সীতারাম, গঙ্গারাম আরমূর্ছিতাভূতলস্থা শ্রী।
    সীতারাম গঙ্গারামকে বলিলেন, “তুমি যে আমার ঘোড়া চুরি করিয়া পলাইয়াছিলে, সে ঘোড়া কি করিলে? বেচিয়া খাইয়াছ?”
    গঙ্গারাম হাসিয়া বলিল, “আজ্ঞে না। ঘোড়া মাঠে ছাড়িয়া দিয়াছি-ধরিয়া দিতেছি |”
    সী। ধরিয়া, তাহার উপর একবার চড়িয়া পলায়ন কর।
    গ। আপনাদের ছাড়িয়া?
    সী। তোমার ভগিনীর জন্য ভাবিও না।
    গ। আপনাকে ত্যাগ করিয়া আমি যাইব না।
    সী। তুমি বড় নদী পার হইয়া যাও। শ্যামপুর চেন ত?
    গ। তা চিনি না?
    সী। সেইখানে অতি দ্রুতগতি যাও। সেইখানে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হইবে; নচেৎ তোমার নিস্তার নাই।
    গ। আমি আপনাকে ত্যাগ করিয়া যাইব না।
    সীতারাম ভ্রূকুটি করিলেন।
    গঙ্গারাম সীতারামের ভ্রূকুটি দেখিয়া নিস্তব্ধ হইল; এবং সীতারাম কিছু ধমক চমক করায় ভীত হইয়া অশ্বের সন্ধানে গেল।
    চন্দ্রচূড় ঠাকুর সীতারামের ইঙ্গিত পাইয়া তাহার অনুবর্তী হইলেন। শ্রী এদিকে চেতনাযুক্ত হইয়া ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিয়া মাথার ঘোমটা টানিয়া দিল। তার পর এদিকে ওদিকে চাহিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদেবী চৌধুরাণী – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
    Next Article ব্রেজিলের কালো বাঘ ও অন্যান্য

    Related Articles

    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    চলিত ভাষার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    যুগলাঙ্গুরীয় – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (চলিত ভাষায়)

    May 7, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }