Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আকাশের নিচে মানুষ – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প368 Mins Read0

    আকাশের নিচে মানুষ – ১১

    এগারো

    আজ সকাল থেকেই রঘুনাথ সিংয়ের হাভেলিতে বিপুল তোড়জোড় শুরু হয়েছে। বড়ে সরকার কিছুক্ষণের ভেতর বিজুরি তালুকে মিশিরলালজীর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। রঘুনাথ সিংয়ের ভাগে যে নির্বাচনকেন্দ্রটি পড়েছে তার একদিকে গারুদিয়া তালুকের গোটা সতের আঠার গ্রাম, অন্যদিকে বিজুরি মৌজার পনের ষোলটা গ্রাম। সব মিলিয়ে বত্রিশ তেত্রিশটা গ্রাম। মোট ভোটদাতা লাখের ওপরে। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, এই নির্বাচনকেন্দ্রের এবং তার ভোটদাতাদের অর্ধেকটাই পড়েছে বিজুরিতে। চুনাওতে জিততে হলে বিজুরির ভোটদাতাদের কথা ভাবতেই হবে। তাদের বাদ দিয়ে জেতা অসম্ভব। এই নির্বাচনে আরো কয়েকজন প্রার্থী রয়েছে। তাদের কেউ যদি আগেভাগেই এসে মিশিরলালজীকে ভজিয়ে নিজের দিকে টানতে পারে তা হলে ভরাডুবি অনিবার্য। তাই এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে রঘুনাথ সিং বিজুরি ছুটছেন।

    বিজুরি তালুক যার খাস দখলে এবং সেখানকার মানুষজনের ওপর যাঁর পুরো কনট্রোল, তিনি হলেন মিশিরলালজী—উচ্চবর্ণের এদেশী ব্রাহ্মণ। তাঁর কথায় বিজুরির দু-তিন লাখ মানুষ ওঠে বসে, বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়। অতএব এই মানুষটির সঙ্গে দেখা হওয়াটা রঘুনাথ সিংয়ের পক্ষে অত্যন্ত জরুরী এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মিশিরলালজী একটা আঙুল তুললে বিজুরি মৌজার তাবত ভোটদাতা ভোটের কাগজে রঘুনাথ সিংয়ের নামের পাশে রাবার স্ট্যাম্পের মোহর মেরে দেবে।

    মিশিরলালজীর সঙ্গে কোনরকম অসদ্ভাব নেই রঘুনাথ সিংয়ের। বরং এক জাতের প্রীতি এবং বন্ধুত্বের সম্পর্কই রয়েছে। মিশিরলালজী উঁচু জাতের ব্রাহ্মণ আর রঘুনাথ সিং রাজপুত ক্ষত্রিয়। এমনিতে জাতপাতের প্রচণ্ড কড়াকড়ি আর বাছবিচারের দেশ এই বিহারে তাঁদের মধ্যে পারিবারিক কোন সম্পর্ক থাকার কথা নয়। নিমন্ত্রণ করলে মিশিরলালজী গারুদিয়ায় রঘুনাথ সিংয়ের কোঠিতে যান কিংবা রঘুনাথ সিং বিজুরিতে আসেন। তৌহারের দিনে কিংবা বিয়ে-টিয়ের মতো কোন পারিবারিক উৎসবে পাশাপাশি বসে খেতে, গল্প-গুজব বা ঠাট্টা-তামাসা করতে তাঁদের আটকায় না।

    সামাজিক ও আর্থিক দিক থেকে মিশিরলালজী যে ‘ক্লাসে’ পড়েন, রঘুনাথ সিংও হুবহু সেই ক্লাসেরই একজন জবরদস্ত প্রতিনিধি। দু’জনেই স্বাধীন ভারতের এক প্রান্তে পুরনো ফিউডাল সিস্টেমকে বিপুল দাপটে কায়েম করে রেখেছেন। এদিক থেকে তাঁরা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। রক্তের সম্পর্কের চাইতেও ‘ক্লাসে’র এই সম্পর্ক অনেক বেশি গাঢ় এবং গভীর।

    একই শ্রেণী বা ক্লাসের মানুষদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতাই স্বাভাবিক কিন্তু অন্য অসুবিধাও আছে। একজনের প্রতিপত্তি বা বাড়বাড়ন্ত অন্যের ঈর্ষার কারণ হয়ে ওঠে অনেক সময়। রঘুনাথ সিং বা মিশিরলালজী পরস্পরকে হয়ত ঈর্ষা করেন কিন্তু তা খুবই সূক্ষ্ম এবং ভেতরকার ব্যাপার। বাইরে তার প্রকাশ নেই। উল্টে বাইরের দিকে অতীব ভদ্রতা এবং বিনয়ের একটা চকচকে চোখ-ধাঁধানো পালিশ রয়েছে।

    কাল রাতেই সাবেক আমলের ঢাউস ঢাউস চাকাওলা এবং হুডখোলা প্রকাণ্ড ফোর্ড গাড়িটাকে দু গণ্ডা নৌকর ধুয়েমুছে তকতকে করে রেখেছিল। আজ ভোরেও মুনশী আজীবচাঁদের তদারকিতে নতুন করে আরেক দফা মোছা-টোছা চলছে। গলার শিরায় দড়ি পাকিয়ে সে সমানে চেঁচিয়ে যায়, ‘এ বুদ্ধু, এ লাঙ্গুর হিয়াঁ কাপড়া মার (কাপড় দিয়ে মোছ), এই টায়রিয়া (টায়ার) সাফা কর—’ তারপরেই গদগদ ভঙ্গিতে বলে ওঠে, ‘মেরে সরকার এম্লে বনে! হোয় হোয়—’

    খানিক দুরে চৌকো চৌকো শ্বেত পাথর বসানো বারান্দায় পুরু গদিওলা ইজিচেয়ারে আধশোয়ার মতো করে কাত হয়ে আছেন রঘুনাথ সিং। তাঁর পরনে দামী চুস্ত বা মলমলের কলিদার পাঞ্জাবী বা নাগরা টাগরা নেই। তার বদলে অত্যন্ত সস্তা পোশাক—খেলো হ্যাণ্ডলুমের সাদা পাঞ্জাবী, ঢোলা পাজামা, মোটা চামড়ার চপ্পল। গলায় না সোনার হার, আঙুলে না হীরে-বসানো আংটি। এখন হাজার লোকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলে তাঁকে আলাদা করে চেনা যাবে না; একেবারে জনগণের একজন হয়ে গেছেন তিনি।

    রঘুনাথ সিংকে ঘিরে বারান্দা আলো করে বসে আছেন বড় ভকিল গিরিধরলালজী, বঙ্গালী ডাগদর শ্যামদুলাল সেন, হেড মাস্টারজী বদ্রীবিশাল চৌবে। অর্থাৎ রঘুনাথ সিংয়ের বন্ধু-বান্ধব বা তাঁর পা-চাটা কুত্তার দল। বড়ে সরকারের সঙ্গে তাঁরাও বিজুরিতে যাবেন। এঁদের বাদ দিয়ে এক পা-ও চলতে পারেন না রঘুনাথ।

    বারান্দার আরেক ধারে রয়েছে টাটকা ভয়সা ঘিয়ের একটা টিন, বাদামের বরফি আর মুগের লাড্ডুর বিরাট ঝুড়ি, দুটো আমের টুকরি, লাল টকটকে মজঃফরপুরী লিচুর একটা ঝুড়ি আর চিতাবাঘের আস্ত ছাল এবং হাতীর ধবধবে দুটো দাঁত। রঘুনাথ সিংয়ের তরফ থেকে মিশিরলালজীকে এগুলো উপহার দেওয়া হবে। সূক্ষ্মভাবে এটাকে এক ধরনের ঘুষই বলা যায়।

    রঘুনাথ সিং মিশিরলালজীর কাছে বিজুরি তালুকের ভোট পাওয়ার ব্যাপারে কীভাবে সাহায্য চাইবেন তাই নিয়ে ভকিল সাহেব ডাগদর সাহেবদের সঙ্গে পরামর্শ করতে করতে ফোর্ড গাড়িটার দিকে নজর রেখে যাচ্ছিলেন। এবার তিনি আজীবচাঁদকে তাড়া লাগালেন, ‘অনেক সাফসুতরো হয়েছে। আর দেরি করা যাবে না। জষ্ঠি মাসের রোদ যেভাবে চড়ছে, এরপর বেরুলে বিজুরি থেকে ফিরে আসতে আসতে ‘লু’ ছুটতে শুরু করবে—’

    আজীবচাঁদ ঘাড় ফিরিয়ে বলে, ‘হো গিয়া বড়ে সরকার। আপ গাড়ি পর চড়িয়ে—’

    দলবল নিয়ে বারান্দা থেকে নামতে নামতে রঘুনাথ সিং ফল মিষ্টির টুকরি ফুকরির দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললেন, ‘ওগুলো ক্যারিয়ারে তুলে দাও—’

    তৎক্ষণাৎ আদেশ পালিত হল।

    একটু পর পুরনো মডেলের ফোর্ড গাড়ি শব্দ করতে করতে স্টার্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

    পেছন থেকে আজীব চাঁদ গুনগুনিয়ে বলতে থাকে, ‘মেরে সরকার এম্লে বনেগা। রামরাজ আ যায়েগা রে, রামরাজ আ যায়েগা।’

    ঘণ্টাখানেকের ভেতর বিজুরি তালুকে মিশিরলালজীর হাভেলিতে পৌঁছে গেলেন রঘুনাথ সিংরা।

    প্রায় তিন একর জায়গা জুড়ে মিশিরলালজীর হাভেলি। বিরাট কমপাউণ্ড ঘিরে রয়েছে উঁচু মজবুত দেয়াল। ভেতরে ঢোকার জন্য লোহার বড় বড় চাকতি বসানো প্রকাণ্ড দরজা। সেখানে বন্দুক কাঁধে এক জোড়া সাড়ে ছ’ফুট মাপের দারোয়ান; তাদের গায়ে খাকী উর্দি; গলা থেকে কোমর পর্যন্ত নেমে আসা টোটার মালা; নাকের তলায় চৌগাফা।

    এ অঞ্চলে জমির বড় বড় মালিকদের বাড়ি যেমন হয়, মিশিরলালজীর বাড়িটা প্রায় তেমনিই। ভেতরে ঢুকলে প্রথমে অনেকটা জায়গা ফাঁকা। তার একধারে অ্যাসবেস্টসের শেডের তলায় ঝকঝকে নতুন মডেলের খান পাঁচেক দিশী এবং ইমপোর্টেড গাড়ি। রঘুনাথ সিংয়ের মতো ওয়েলার ঘোড়া, টমটম বা হাতী মিশিরলালজীর নেই।

    যেদিকে গাড়ির শেড তার উল্টোদিকেও একটা ছোট শেডের তলায় খানকতক বেঞ্চ পাতা রয়েছে। এ বাড়িতে যারা একবারও এসেছে তারাই জানে শেডের তলায় ঐ বেঞ্চগুলো মিশিরলালজীর দর্শন-মাঙনেওহা লোকেদের জন্য। সকালের দিকে বেলা এগারটা পর্যন্ত মিশিরলালজী লোকজনের সঙ্গে দেখা করেন। নিয়ম হল, নৌকর এসে একজন করে দর্শনার্থীকে মিশিরলালজীর কাছে নিয়ে যাবে। একজনের সঙ্গে কথা শেষ হলে আর একজনের পালা।

    ঢাকা জায়গাটার পর মধ্যযুগের দুর্গের মতো তিন ফুট পুরু দেয়াল আর মোটা মোটা থামওলা বিশাল তেতলা বাড়ি। বাড়িটার মাথায় রামসীতার মন্দির। মন্দিরের চূড়াটা দু মাইল দূর থেকে নজরে পড়ে।

    জোড়া দারোয়ান সসম্ভ্রমে স্যালুট ঠুকে রঘুনাথ সিংয়ের ফোর্ড গাড়ির জন্য রাস্তা করে দিল। রঘুনাথ সিংকে তারা চেনে।

    ভেতরে বাঁ দিকের শেডের তলায় মিশিরলালজীর সঙ্গে দেখা করার জন্য অনেক লোক বসে আছে। তা ছাড়া এধারে ওধারে রয়েছে নৌকরেরা।

    এ বাড়ির দারোয়ানদের মতো নৌকরেরাও রঘুনাথ সিংকে চেনে। বেশ কয়েক বার পারিবারিক উৎসব বা অন্য কোন তৌহারের দিনে তিনি এখানে এসেছেন। ফোর্ড গাড়ি একধারে থামতেই গণ্ডাখানেক নৌকর দৌড়ে এল। ঘাড় নুইয়ে বলল, ‘নমস্তে সরকার—’ একজন আবার তাড়াতাড়ি গাড়ির দরজা খুলে দিল। এরা সবাই জানে তাদের মালিক মিশিরলালজীর মতোই বহোত বড়া আদমী এই রঘুনাথ সিং। রাজা মহারাজা য্যায়সা। শুধু দু জনের তালুকই যা আলাদা।

    রঘুনাথ সিং জিজ্ঞেস করলেন, ‘মিশিরলালজী ঘরমে হ্যায়?’

    ‘জী সরকার—’

    রঘুনাথ সিং গাড়ি থেকে নেমে এলেন। তাঁর সঙ্গীরাও নামতে যাচ্ছিলেন; তাঁদের বললেন, ‘আপনারা একটু বসুন। আমি আগে গিয়ে দেখা করি।’

    এ বাড়ির প্রতিটি ইট রঘুনাথ সিংয়ের চেনা। সকালবেলা কোথায় মিশিরলালজীর আম-দরবার বসে, কোথায় কীভাবে বসে তিনি দর্শন-মাঙোয়াদের সঙ্গে কথা বলেন—সবই জানা আছে। সুতরাং লম্বা লম্বা সিঁড়ি ভেঙে বিশাল বারান্দায় উঠে ডান দিকে খানিকটা যাবার পর একটা বিরাট ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন রঘুনাথ সিং।

    ভেতরে ছ ইঞ্চি পুরু কার্পেট পাতা। একেবারে বিলিতী কেতায় চারদিকে দামী দামী সোফা আর সেন্টার টেবল সাজানো। একটা প্রকাণ্ড সোফায় দু পা তুলে বসে আছেন মিশিরলালজী পয়সাওলা বড়লোক মাত্রেরই কিছু পা-চাটা কুত্তা থাকে। তেমনি জনকয়েক মিশিরলালজীকে ঘিরে আছে।

    একটা ব্যাপার বরাবরই লক্ষ্য করেছেন রঘুনাথ সিং, মিশিরলালজীর বাড়িটা বাইরে থেকে মধ্যযুগের দুর্গের মতো মনে হলেও ভেতরে একেবারে ঝকঝকে বিলাইতী চাল। বাড়িটা ভেঙে ওখানে নতুন ধরনের বাংলো বানাবার ইচ্ছা মাঝে মাঝে জাগে মিশিরলালজীর। বানান না, তার একমাত্র কারণ, এটা তাঁর ঠাকুরদার তৈরি হাভেলি। পুরনো সেন্টিমেন্টকে কিছুটা দাম তিনি এখনও দিয়ে থাকেন।

    পৃথিবীর এই অংশে মধ্যযুগ যখন মোটামুটি কায়েম হয়ে আছে তখন মিশিরলালজী পুরনো চাল পুরনো কেতার সঙ্গে হাল আমলকে অনেকখানি মিশিয়েছেন। হাতি ঘোড়া আর সাবেক মডেলের গাড়ি-টাড়ি বিদায় দিয়ে তিনি নতুন মডেলের ঝকমকে ‘কার’ আনিয়েছেন। হাল-বয়েল দিয়ে মান্ধাতার বাপের আমলের চাষবাসের বদলে ট্রাক্টর দিয়ে জমি চষার বন্দোবস্ত করেছেন। এ অঞ্চলে, এ অঞ্চল কেন, বিশ পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে মিশিরলালজী ছাড়া আর কারো জমিতে ‘মিসিনে’র লাঙল নামে নি। তা ছাড়া বাড়ির ছেলেমেয়েদের পড়াতে পাঠিয়েছেন কলকাতায় আর লণ্ডনে। তিনি নিজে সাবেকী চালে ধুতি-কুর্তা বা পাঞ্জাবী পরলেও ছেলেমেয়েদের পোশাক খাস বিলাইতী ধাঁচের। মিশিরলালজীর ধ্যানধারণা বা জীবনযাত্রায় ‘পুরাপাক্কা’ না হলেও বারো আনা সাহেবী কেতা।

    রঘুনাথ সিং যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেখান থেকে কোণাকুণি তাকালে মিশিরলালজীকে দেখা যায়। তবে মিশিরলালজী এখনও তাঁকে লক্ষ্য করেন নি। তিনি ভেতরে ঢুকতে যাবেন, একটা নৌকর অন্য দরজা দিয়ে আরেকটা লোককে নিয়ে ঢুকে পড়ল। ঢুকেই লোকটা মিশিরলালজীর পায়ের দিকে হাত বাড়ায়।

    লোকটা পায়ে হাত দেবে বলে মিশিরলালজী যেন কতই বিব্রত হয়েছেন এমন ভঙ্গি করে দু-হাত নাড়তে নাড়তে বলেন, ‘আরে নেহী নেহী—’ বলেন ঠিকই, কিন্তু লোকটার কপালের কাছ জোড়া পা বাড়িয়ে দেন।

    রঘুনাথ সিং জানেন, শুধু তিনিই বা কেন, বিশ পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে যে কয়েক লাখ মানুষ বাস করে তারা সবাই জানে মিশিরলালজীকে প্রণাম করতে গেলে মুখে ‘না না’ বলবেন কিন্তু পা দুটো ঠিক কপাল বরাবর এগিয়ে দেবেন। এ অঞ্চলে তাঁর নাম ‘চরণ ছুঁ মহারাজ’।

    লোকটার ‘চরণ’ ছোয়া হয়ে যাবার পর মিশিরলালজী বললেন, ‘বৈঠো—’

    লোকটা কার্পেটের এক কোণে হাতজোড় করে জড়সড় হয়ে বসল।

    মিশিরলালজী ফের বললেন, ‘বাতাও ক্যা মাঙতা হ্যায়—’ কিন্তু লোকটা উত্তর দেবার আগেই রঘুনাথ সিংকে দেখতে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত ব্যস্তভাবে উঠে দাড়ালেন, ‘আরে মেরা ক্যা সৌভাগ! সবেরে কার মুখ দেখে আজ উঠেছিলাম। আসমানকা তারা মেরা দরোয়াজা পর খাড়া হ্যায়। আইয়ে আইয়ে রঘুনাথজী—’ বলে নিজে উঠে এসে রঘুনাথ সিংয়ের হাত ধরে তাঁর পাশের সোফাটায় বসালেন। তারপর নিজের জায়গায় বসতে বসতে সেই লোকটাকে বলল, ‘আজ যাও। পরশু এসো—’

    লোকটা আরেক বার মিশিরলালজীর পা ছুঁয়ে চলে গেল।

    সেই নৌকরটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। মিশিরলালজী তাকে জানিয়ে দিলেন, আজ আর কারো সঙ্গে দেখা যাবে না। দৰ্শন- মাঙোয়াদের যেন চলে যেতে বলা হয়।

    রঘুনাথ সিং মিশিরলালজীকে বললেন, ‘কৃপা করে যদি হুকুম করেন— ‘

    ‘হুকুমকা ক্যা বাত! কহিয়ে কহিয়ে—’

    ‘আমার তিন বন্ধু এসেছেন, বাইরে গাড়িতে বসে আছেন। কিছু জিনিসও এনেছি। নৌকর বন্ধুদের যদি ডেকে আনে আর জিনিসগুলো, নিয়ে আসে—’

    ‘ক্যা তাজ্জবকা বাত; বন্ধুদের বসিয়ে রেখে এসেছেন!’ বলেই নৌকরের দিকে তাকালেন মিশিরলালজী, ‘যা, রঘুনাথজীর দোস্তদের ডেকে আন আর ফাগুয়াকে পাঠিয়ে দে।’

    নৌকর দৌড়ে বেরিয়ে গেল।

    এবার রঘুনাথের দিকে পুরোপুরি ঘুরে মিশিরলালজী বললেন, ‘ক্যা, দিনমে ম্যায় খোয়াব দেখ রহা হো? আপনি আসল রঘুনাথ সিংজী তো?’

    রঘুনাথ সিং হাসলেন।

    এদিকে মিশিরলালজীর পা-চাটা কুত্তারা ঘাড় ঝুঁকিয়ে এধার ওধার থেকে সমানে ‘নমস্তে’ বা ‘পরণাম’ জানাতে লাগল। তাদের মালিকের সমান স্তরের এই স্তরের এই মানুষটার সঙ্গে খাতির রাখা ভালো। কখন মিশিরলালজী ‘গুসসা’ হয়ে যাবেন তখন দাঁড়াবার মতো আরেকটা আশ্রয় আগে থেকেই ঠিক করে রাখা উচিত। এ জাতীয় পরগাছাদের নিয়মই এই।

    মিশিরলালজী ফের বললেন, ‘আপনি এসেছেন; ভারি খুশ হয়েছি রঘুনাথজী।’

    রঘুনাথ সিং বললেন, ‘আগে খবর না দিয়ে আচানক (হঠাৎ) চলে এসে খুব অসুবিধা ঘটালাম। কিন্তু না এসে উপায় ছিল না। একটা জরুরী কাজের—’

    তাঁকে থামিয়ে দিয়ে মিশিরলালজী বললেন, ‘কাজের কথা পরে হবে। আগেই একটা আর্জি পেশ করছি। দয়া করে যখন এসেছেন, দুপুরে এখানে ‘ভোজন’ করে যেতে হবে।

    হাত জোড় করে রঘুনাথ সিং বলেন, আজ তাঁকে ক্ষমা করে দিতে হবে। পরে আরেক দিন এসে নিশ্চয়ই খেয়ে যাবেন।

    এ ব্যাপারে আর জোর করলেন না মিশিরলালজী।

    এই সময় গাট্টাগোট্টা চেহারার ফাগুয়া নৌকর এসে ঘরে ঢোকে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঢুকলেন গিরধরলালরা অর্থাৎ রঘুনাথ সিংয়ের পা-চাটা তিন কুত্তা। অন্য দুটো নৌকর ঘাড়ে এবং মাথায় করে সেই লাড্ডু-বরফির ঝোড়া টোড়াও নিয়ে এসেছে।

    উপহারের জিনিসগুলো দেখে একটু অবাক হয়েই মিশিরলালজী জিজ্ঞেস করেন, ‘এসব কী?’

    রঘুনাথ সিং জানান, খুব সামান্য ব্যাপার। মহারাজের দর্শন করতে এলে কিছু নজরানা আনা নিয়ম।

    অত্যন্ত বিব্রত যে হয়ে পড়েছেন, মিশিরলালজীর মুখচোখের ভাবে তা প্রকাশ পায়। তবে ‘মহারাজ’ বলায় মনে মনে তিনি বেজায় খুশী। বলেন, ‘ইসকা ক্যা জরুরত থা রঘুনাথজী—’

    ‘বললাম তো, তুচ্ছ ক’টা জিনিস। স্রেফ আপনার সম্মানের জন্যে আনা—’ বলেই হাত নেড়ে নৌকর দুটোকে ফল-মিঠাইর টুকরিগুলো বাড়ির ভেতরে নিয়ে যেতে বলেন রঘুনাথ সিং।

    হাল ছেড়ে দেবার মতো ভাব করেন মিশিরলালজী। বলেন, ‘আপনাকে নিয়ে আর পারা যায় না।’

    এদিকে গিরিধরলালেরা মাথা ঝুকিয়ে মিশিরলালজীকে ‘নমস্তে’ বা ‘পরণাম’ (প্রণাম) জানাতে থাকেন। মিশিরলালজীর পোষা কুকুরেরা এইভাবেই রঘুনাথ সিংকে ‘নমস্তে’ জানিয়েছিল। মালিকের সমগোত্রীয় লোকেদের তোয়াজ এবং তোষামোদ করাটা চাটুকারদের পবিত্র কর্তব্য। দুনিয়ার পা-চাটা সব কুত্তারই এক আদত।

    মিশিরলালজী ঈষৎ হেসে এবং দু-একটা কথা বলে গিরিধরলালদের চোদ্দ পুরুষকে কৃতার্থ করে ফাগুয়া নৌকরের দিকে তাকান। বলেন, মাঈজীকে খবর দে, গারুদিয়া থেকে রঘুনাথ সিংজী এসেছেন—’ মাঈজী অর্থাৎ মিশিরলালজীর স্ত্রীকে এই খবর দেওয়ার মধ্যে একটা ইঙ্গিত রয়েছে। তা হল অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা।

    ‘জী’ ফাগুয়া ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

    —এবার রঘুনাথ সিং নতুন করে আসল কথাটা তুলতে চান। যে কারণে জষ্ঠি মাসের গনগনে রোদ মাথায় নিয়ে ঝলসানো মাঠের মাঝখান দিয়ে এতদূর ছুটে এসেছেন এবং তাঁরই মাপের একটা লোককে বাড়তি পাঁচশো গুণ মর্যাদা চড়িয়ে ‘মহারাজা’ পর্যন্ত বলেছেন, এমন কি উপহারের নাম করে অত্যন্ত চতুরভাবে ভেট বা ঘুষ দিয়েছেন সেই ব্যাপারটা সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত না হওয়া পর্যন্ত ভেতরে ভেতরে এক ধরনের অস্বস্তি আর উত্তেজনা হচ্ছে। রঘুনাথ বললেন, ‘একটা জরুরী দরকারে আপনার কাছে—’

    হাত তুলে তাঁকে থামিয়ে দেন মিশিরলালজী, ‘জীওনভর দরকার তো আছেই। আগে বাড়ির খবর বলুন। আমার বহেনজীরা কেমন আছেন? রঘুনাথ সিংয়ের কায়াথ এবং রাজপুত দুই স্ত্রীকে তিনি ‘বহেনজী’ বলেন।

    রঘুনাথ বললেন, ‘ঠিক আছে।’

    ‘দুই বহেনজীর বনিবনা হল?’

    কায়াথনী এবং রাজপুতানীর ঝগড়া এ গারুদিয়া আর বিজুরি অঞ্চলের এক বিখ্যাত ঘটনা।

    প্রায় কিংবদন্তীর মতো ব্যাপার। তালুকের প্রতিটি মানুষ এ ব্যাপারটা জানে। রঘুনাথ সিং নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বলেন, ‘মৌত পর্যন্ত বনিবনা হবে না। বলা যায় না, মরার পরও হয়ত শাঁখরেল হয়ে দু’জনে লড়াই করবে। তবে এ নিয়ে আমি ভাবি না।’

    ‘ছেলেমেয়েরা?’

    ‘ভালই আছে।’

    রঘুনাথ সিংও মিশিরলালজীর বাড়ির খুঁটিনাটি খবর নেন। এই সব অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তার মধ্যে ফাগুয়া নৌকর ঢাউস ঢাউস রুপোর থালায় বিরাট আকারের গণ্ডা গণ্ডা মিঠাই আর গরমকালের যাবতীয় দামী ফল এনে সবার সামনে সাজিয়ে দেয়। চাঁদির কারুকার্য করা গেলাসে ঠাণ্ডাইও নিয়ে আসে সে। পেস্তা বাদাম দই বরফ দিয়ে তৈরি আর খুসবু মেশানো উৎকৃষ্ট ঠাণ্ডাই। এই জষ্ঠি মাসে স্নায়ু এবং মস্তিষ্ক শীতল রাখার পক্ষে এর চাইতে ভাল জিনিস আর হয় না।

    খাবারের পরিমাণ দেখে ভীতভাবে রঘুনাথ সিং বলেন, ‘আরে বাবা, এ যে আমার দশদিনের ‘র‍্যাশন’। এত খাওয়া যায় নাকি?’

    এ ঘর থেকে অন্দরের দিকে যাবার জন্য একটা দরজা আছে। সেখানে পর্দা ঝুলছে। পর্দার ওধার থেকে মহিলার মৃদু সুরেলা গলা ভেসে আসে, না বললে শুনছি না। এমন কিছুই দেওয়া হয় নি।’

    মিশিরলালজীর স্ত্রী পদ্‌মাবতী। এমনিতে বাড়ি থেকে বিশেষ বেরোন না; তবে পর্দানশীন নন। খুবই কম কথা বলেন; তাঁর মধ্যে অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব রয়েছে। ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মেশানো আছে স্নেহপ্রবণতা। মিশিরলালজীর বিশাল সংসার এবং অগুনতি আশ্রিত আত্মীয়-স্বজনকে অত্যন্ত সুচারুভাবে তিনি সামলান। এ বাড়িতে এলে তাঁর যত্ন এবং মমতার ছোঁয়া পাওয়া যায়।

    রঘুনাথ সিং সসম্ভ্রমে উঠে দাড়ালেন। তাঁর দেখাদেখি মিশিরলালজী বাদে ঘরের বাকী সবাইও। রঘুনাথ হাতজোড় করে বললেন, ‘নমস্তে ভাবীজী। আপনি আবার কষ্ট করে এলেন কেন?

    পদ্‌মাবতী বললেন, ‘নমস্তে। আপনি এসেছেন; আমি আসব না! কষ্ট কিসের?’

    ‘হুকুম করলে নৌকরই আপনার কাছে হাজির হত।’

    ‘ছি ছি কী বলছেন আপনি! বিনয়ের আর শেষ নেই। এখন ভালো ছেলের মতো বসে বসে সব খেয়ে নিন। আমি দাঁড়াচ্ছি।’

    আরা জেলার রাজা খেতাবওলা বাপের মেয়ে পদ্‌মাবতী। তাঁর আচার ব্যবহার রাহান সাহানই আলাদা। মহিলাকে খুবই শ্রদ্ধা করেন রঘুনাথ সিং। বলেন, ‘এত খেতে হলে বিলকুল মরে যাব ভাবীজী।’ মুখচোখের অবস্থা করুণ হয়ে ওঠে তাঁর।

    পদ্‌মাবতীর হয়ত করুণা হয়। বলেন, ‘ঠিক আছে, যা পারেন খান।’

    অগত্যা রুপোর থালার দিকে রঘুনাথ সিং এবং ঘরের বাকী লোকজনেরা হাত বাড়ায়। খেতে খেতে এলোমেলো টুকরা টাকরা কথা হয়। এরই ফাঁকে মিশিরলালজীর মতো পদ্‌মাবতীও জানান, দুপুরে রঘুনাথ সিংরা এখানে ভোজন করে গেলে তাঁর আনন্দের কারণ হত। ক্ষমা চেয়ে আগের মতোই রঘুনাথ সিং উত্তর দ্যান, আরেক দিন এসে অবশ্যই খেয়ে যাবেন।

    পদ্‌মাবতী বলেন, ‘তা হলে দিন ঠিক করে আমাদের জানিয়ে দেবেন। আর বহেনজীরাও সেদিন এখানে যেন দয়া করে আসেন। মঞ্জুর?’

    ‘মঞ্জুর।’

    .

    খাওয়া দাওয়ার পর নৌকররা এসে থালা-গেলাস তুলে নিয়ে যায়। পর্দার আড়াল থেকে পদ্‌মাবতীও সরে যান।

    এবার রঘুনাথ সিং মুখ খোলার আগেই মিশিরলালজী শুরু করেন, ‘আপনি কী জরুরী কাজে এসেছেন, আমি বোধহয় জানি। বলছি, দেখুন তো মেলে কিনা—’

    খানিকটা অবাক হয়েই মিশিরলালজীর দিকে ঘুরে বসেন রঘুনাথ সিং।

    মিশিরলালজী বলতে থাকেন, ‘চুনাওতে নামছেন, এম-এল-এ হয়ে পাটনার অ্যাসেম্বলিতে যাবেন—এই জরুরী ব্যাপারে আমার কাছে এসেছেন তো?’

    রঘুনাথ সিংয়ের বিস্ময় এক লাফে অনেকখানি বেড়ে যায়। তিনি বলেন, ‘আপনি জানলেন কী করে?’

    ‘আরে ভেইয়াজী, আপনাদের গারুদিয়া আর আমাদের বিজুরি তালুকের গাঁওকে গাঁও জেনে গেল। শুধু আমি জানব না? পাটনায় চুনাওর বাত পাক্কা করে ফিরে এসে গারুদিয়ার হর আদমীকে মিঠাই খাইয়েছেন, এ খবরও আমার জানা।’

    ‘তবে তো আপনি সবই জানেন।’

    ‘লেকিন ভেইয়াজী—’

    ‘কী?’

    ‘আপনি পোলটিক্সে (পলিটিক্স) গেলেন কেন? পোলটিক্স বহোত গান্ধা চীজ। উসমে বহোত বহোত বদবু—’ খুব বেশি লেখাপড়া শেখেন নি মিশিরলালজী। তবে দেখেছেন অনেক, জেনেছেন তার চাইতেও বেশি। তার কথার ফাঁকে ফাঁকে দু-একটা আংরেজি বুলি ঢুকে যায়।

    একটু থেমে মিশিরলালজী ফের বলেন, ‘আমরা যারা জমিজমার মালিক তাদের আঁখ জমিতে রাখাই ভালো; অন্য দিকে আঁখ ফেরালে জমিও যায়, অন্য ব্যাপারটাও যায়। অবশ্য আমার কথা শোনা বা না-শোনা আপনার মর্জি।’

    অত্যন্ত বিনীতভাবে রঘুনাথ সিং এবার বলেন, ‘আপনি যদি অপরাধ না নেন, একটা কথা বলি—’

    ‘হাঁ হাঁ জরুর। একটা কেন, বিশটা বলুন না।’

    ‘জমি-জায়গীরের মালিকদের স্বার্থেই আমাদের কাউকে না কাউকে পোলটিক্সে ঢুকতে হবে। জনতাকে প্রতিনিধি হয়ে অ্যাসেম্বলিতে যেতে হবে। না হলে এত জমিজমা কিছুই রাখতে পারবেন না।’

    ভুরু কুঁচকে যায় মিশিরলালজীর। তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘কী রকম? থোড়েসে সমঝা দিজিয়ে—’

    রঘুনাথ সিং বুঝিয়ে যা বলেন তা মোটামুটি এই রকম। ল্যাণ্ড রিফর্মের কানুন দিনকে দিন যেরকম কড়া হচ্ছে তাতে পুরনো ফিউডাল সিস্টেম আর খরিদী কিষাণদের বেট বেগারি চিরকাল চালিয়ে যাওয়া যাবে না। এখনও যে তারা চালাচ্ছেন তা বে-কানুনি। বড় বড় শহরের খবরের কাগজে এই নিয়ে লেখালিখিও হচ্ছে। নানা ‘পোলটিক্যাল’ দলের নজরও এসে পড়েছে এদিকে। এই সব রাজনীতিক দলের কাজই হল একটা কিছু হুজ্জুত বাধিয়ে বাজার গরম করা। এখন না হলেও ভবিষ্যতে এ নিয়ে ঝামেলা হবেই।

    ফী বছরই লোকসভায় বা বিধানসভায় একবার করে ভূমি সংস্কারের ব্যাপারে কানুন পাশ হয়ে যায়, তাতে জমির মালিকদের ক্ষমতা কমতে থাকে। এভাবে কিছুকাল চলতে থাকলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত দশ ইঞ্চি মাটিও কেউ রাখতে পারবে না। এই বিপজ্জনক ভূমিসংস্কার যেভাবেই হোক রুখতে হবে। সেই কারণে যারা কানুন বানায় তাদের মধ্যে নিজেদের লোক ঢোকানো প্রয়োজন। রঘুনাথ সিং জমিজমার মালিকদের প্রতিনিধি হিসেবে আপাতত বিধানমণ্ডলে যেতে চাইছেন।

    শুনতে শুনতে বিশাল সোফার ভেতর নড়েচড়ে বসেন মিশিরলালজী। বলেন, ‘আপনি খুব ভালো ভেবেছেন। আমি এসব চিন্তা করি নি। হামে আপনা ইন্টারেস্ট জরুর দেখনা হ্যায়। হাম আপনে লীডরোসে সোসালিজম পর লম্বী চওড়ী বাত শুনতা আয়ে হ্যায়। ও চীজ আনেসে হাম বিলকুল চৌপট হো যায়েঙ্গে।’

    রঘুনাথ সিং এবং মিশিরলালজীর পা-চাটা কুত্তারা সমস্বরে বলে, ‘জরুর, জরুর।’ এরা সব হাঁ’তে হাঁ মিলানোর দল। মালিক প্রভুরা মুখ দিয়ে যা বার করবেন এরা তাতেই সায় দেবে।

    রঘুনাথ সিং বলেন, ‘এই জন্যেই তো সবেরা হতে না হতেই আপনার কাছে দৌড়ে এলাম। চুনাওর ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাই।’

    মিশিরলালজী জিজ্ঞেস করেন, ‘কীভাবে সাহায্য করতে পারি বলুন—’

    রঘুনাথ জানান, দিল্লীর লোকসভা বা পাটনার বিধানসভায় যেতে হলে জনগণের ভোট পেয়ে পাশ করতেই হবে। এবারের চুনাওতে তিনি যে নির্বাচনকেন্দ্র থেকে দাঁড়িয়েছেন তার শতকরা পঞ্চাশজন ভোটদাতাই বিজুরি তালুকের। মিশিরলালজী দয়া করে যদি একবার আঙুল তোলেন, এই ভোটদাতাদের মতদান পুরোটাই রঘুনাথ সিংয়ের স্বপক্ষে যেতে পারে। একবার বিধানসভায় যেতে পারলে ক্লাস ইন্টারেস্ট দেখার জন্য তিনি সমস্ত রকম চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। এখন সবটাই মিশিরলালজীর অনুগ্রহ।

    মিশিরলালজী বলেন, ‘এ তো আপনা ইন্টারেস্ট আপনা জাত-ওয়ারিকা সওয়াল (এখানে স্বজাত অর্থাৎ নিজের ক্লাসের প্রশ্ন)। আপনাকে বিধানসভায় পাঠাতে যা করার দরকার সব করব।’

    হাত বাড়িয়ে মিশিরলালজীর দু হাত জড়িয়ে ধরেন রঘুনাথ সিং। বলেন, ‘কী বলে ধন্যবাদ জানাব বুঝতে পারছি না। আমি আপনার খরিদী নৌকর হয়ে রইলাম।’

    এ সবই যে উৎকৃষ্ট চাটুকারিতা, বুঝতে অসুবিধা হয় না মিশিরলালজীর। তবে মন্দ লাগে না। মনেপ্রাণে তিনি স্বীকার করেন, রঘুনাথ সিং তাঁর আঁখ ফুটিয়ে দিয়েছেন। দূরদর্শী হলেও ভূমি সংস্কারের দিকে এতকাল তাঁর নজর পড়ে নি। অথচ পড়া উচিত ছিল। ভূমি সংস্কারের বিপজ্জনক দিকটা সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত ছিল। তিনি বলেন, ‘আপনি কেন ধন্যবাদ দেবেন, আমারই ওটা দেওয়া উচিত। ভূমি সম্‌স্কারের কথাটা আপনি মনে করিয়ে না দিলে ওটা আমি ভাবতামই না।’

    ‘তা হলে বিজুরির ভোট নিয়ে আমি কিন্তু কিছু ভাবছি না।’

    ‘বিলকুল না। সব তো ঐরু-গৈরু-নাত্থু আর গৈরুর (রামা-শ্যামা-যদু-মধু) দল। যাকে যা বলব বকরার পালের মতো লাইন দিয়ে তাই করে আসবে। একেবারে দুশ্চিন্তা করবেন না।’

    এরপর সামান্য দু-একটা কথা বলে বিদায় নেন রঘুনাথ সিং এবং তাঁর তিন পা-চাটা কুকুর।

    .

    আরো খানিকক্ষণ বাদে বিজুরি তালুক পেরিয়ে হাইওয়ে ধরে গারুদিয়া তালুকের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে রঘুনাথ সিংয়ের চোখে পড়ে, জষ্ঠি মাসের রোদে ঝলসে যেতে যেতে তাঁর জমিগুলোতে লাঙল ঠেলে চলেছে ধর্মারা। এইসব আনপড় অচ্ছুৎ খরিদী মানুষগুলো জানে না আগামী চুনাওতে তাদের ভাগ্য এবং ভবিষ্যৎ কীভাবে নির্ধারিত হতে চলেছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleইতিহাসের গল্প – প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত
    Next Article পাগল মামার চার ছেলে – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }