Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আকাশের নিচে মানুষ – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প368 Mins Read0

    আকাশের নিচে মানুষ – ১৪

    চোদ্দ

    দেখতে দেখতে দিন কয়েক কেটে গেল। কিন্তু এর মধ্যে এমন একটু ফুরসত পাওয়া যায় নি যাতে কোটরা হরিণের বাচ্চা যোগাড়ের জন্য ধর্মা জঙ্গলে যেতে পারে।

    রাঁচী থেকে টিরকের আসার কথা ছিল পরশু দিন। ধর্মার পক্ষে বাচোয়া, সে আসেনি। হয়ত কোন কাজে আটকে গিয়ে থাকবে। তবে যে কোন মুহূর্তে এসে পড়তে পারে।

    অন্য দিনের মতো অন্ধকার থাকতে থাকতে উঠে পড়ল ধর্মা। সে ঠিকই করে ফেলেছে আজ আর ক্ষেতিতে লাঙল ঠেলতে যাবে না। মাঠকুড়ানি জঙ্গল-কুড়ানিদের সঙ্গে মাড়ভাত্তা খেয়েই বেরিয়ে পড়বে। দক্ষিণ কোয়েলের শুখা খাতের ওধারে সেই জঙ্গলটায় গিয়ে একবার চেষ্টা করে দেখবে—কোটরার বাচ্চা জোটাতে পারে কিনা। যদি দুপুরের মধ্যেও জোগাড় করা যায়, বিকেলে টিরকের হাতে তুলে দেওয়া যাবে। টিরকের সঙ্গে কাজ করে সুখ আছে।

    ক্ষেতিতে না যাবার ব্যাপারটা কুশীকে আগে জানায় নি ধর্মা। কুয়োয় নাহানা সেরে মাড়ভাত্তা খেয়ে সবাই যখন দোসাদটোলা থেকে বেরিয়ে পড়েছে তখন সে কুশীকে বলল, ‘আমি আজ ক্ষেতিতে যাব না।’

    কুশী জিজ্ঞেস করে, ‘কায়?’

    কাঁধে করে একটা টাঙ্গি নিয়ে এসেছিল ধর্মা। সেটা নামিয়ে কুশীর সামনে ঘুরিয়ে বলে, ‘এটা দেখলি তো? আজ আমি জঙ্গলে যাব।’

    হঠাৎ টিরকের কথা মনে পড়ে কুশীর। সে বলে, ‘কোটরার তালাসে?’

    ‘হুঁ। পরশু টিরকের আসার কথা ছিল। আসে নি। আজ এলে দাঁড়াতে বলবি।’

    ‘ঠিক হ্যায়। বেশি দেরি করিস না।’

    ‘নায়।’

    ‘বগুলা ভকত তোর কথা পুছলে কী বলব?’

    ‘বলবি বুখার হয়েছে।’ বলে একটু থেমে ফের শুরু করে ধর্মা, ‘আজ তুই গণেরিচাচার সাথ কাম করিস।’

    কুশী মাথা নাড়ে, ‘হুঁ।’

    দোসাদটোলার বাইরে শক্ত কাঁকুরে মাঠের ওপর দিয়ে খানিকটা যাবার পর কুশীরা বাঁ দিকে পাকা সড়কে গিয়ে ওঠে আর মাঠ-কুড়ানিদের সঙ্গে ডান দিকে হাঁটতে থাকে ধর্মা। সে যে দলটার সঙ্গে যায় তাতে তার এবং কুশীর মা-বাপেরাও রয়েছে। আর রয়েছে দোসাদটোলার অগুনতি বাচ্চাকাচ্চা। দলের প্রায় সবার মাথাতেই একটা করে মেটে হাঁড়ি। কোয়েলের বালি খুঁড়ে খুঁড়ে খাবার জল বার করে আনবে।

    ধর্মারা যখন নদীর শুখা খাতের মাঝামাঝি চলে আসে সেই সময় দেখা যায় জষ্ঠি মাসের সূর্য পুবের আকাশে মাথা তুলতে শুরু করেছে। এই সকালবেলাতেই তার রঙ গনগনে আগুনের মতো। দিনের প্রথম রোদ পড়ে লক্ষ কোটি সোনার দানার মতো কোয়েলের মরা খাতের বালি ঝিকমিকিয়ে উঠেছে। বাতাস গরম হচ্ছে ক্রমশ।

    এখান থেকে রাঁচী আর পাটনাগামী পাকা সড়কের দু পাশে গারুদিয়া এবং বিজুরি তালুকের শস্যক্ষেতগুলো ধু-ধু দেখায়।

    মাথার ওপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে পরদেশী শুগা বাতাসে ভেসে চলেছে। এই গরমের সময়টা কোত্থেকে যেন শুগার ঝাঁক এদিকে চলে আসে। শুগা ছাড়া ক্বচিৎ দু-একটা চোটা আর পেরোয়া চোখে পড়ে।

    আকাশ এখন গাঢ় নীল, মাঝে মাঝে তুলোর পাহাড়ের মতো সফেদ মেঘ। রোদ লেগে মেঘের কানাতে সোনার ঝিলিক লাগে।

    পাখি আকাশ মেঘ—কোন দিকেই নজর নেই ধর্মার। একজোড়া কোটরার বাচ্চা জঙ্গল থেকে তাকে ধরে আনতেই হবে।

    বাচ্চা দুটোর দাম নগদ বিশ রুপাইয়া। বিশটা টাকা মানে স্বাধীন জীবনের দিকে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া। কীভাবে কোটরার বাচ্চা খুঁজে বার করবে, ভাবতে ভাবতে বালিতে পা গেঁথে গেঁথে এগুতে থাকে ধর্মা।

    একসময় সবাই সেই সাবুই ঘাসের জঙ্গলটার কাছাকাছি চলে আসে। এখানেই রোজ ধর্মা আর কুশী বগেড়ির জন্য ফাঁদ পেতে রেখে যায়।

    সাবুই ঘাসের ঘন ঝোপটার পর রশিভর গেলেই দক্ষিণ কোয়েলের শুখা খাতের দুধারে পাতলা জঙ্গল আর আছে ঘাসেভরা অনেকটা মাঠ। এখানে বিজুরি আর গারুদিয়া তালুকের গৈয়া আর বকরি চরানিরা তাদের জন্তুগুলোকে খাওয়াতে নিয়ে আসে। কিন্তু এবার চৈত্র মাস থেকে আকাশে না একফোঁটা মেঘ, না ঝরছে এক বুঁদ বারিষ। মাঠে যেটুকু ঘাস ছিল চোত পেরিয়ে বৈশাখের পাঁচ সাতটা দিনও কেটেছে কিনা সন্দেহ; তার আগেই প্রায় খতম হয়ে গেছে। বাদবাকী যা আছে তা গনগনে রোদের তাতে জ্বলে হেজে হলদে মরকুটে হয়ে উঠেছে। গরু ছাগলে তা ছুঁয়েও দ্যাখে না। কাজেই আজকাল বকরিচরানি আর গৈয়াচরানিরা এদিকে বড় একটা আসে না।

    ধর্মার সঙ্গে দোসাদটোলা থেকে যারা এসেছিল তাদের জনাকতক মেয়ে পুরুষ আর সবগুলো বাচ্চা ছেলেমেয়ে কোয়েলের বালির ডাঙা খুঁড়ে খুঁড়ে জল বার করার জন্য বসে গেল। এক হাঁড়ি জল যোগাড় করার পর তারা জঙ্গলে আসবে সুথনি রামদানা বা অন্য কোন কন্দ অথবা ফল ফলারির খোঁজে। তবে বেশির ভাগই জঙ্গলে যাবার জন্য ধর্মার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। জঙ্গল থেকে কিছু খাদ্য জুটিয়ে এনে তারা বালি খুঁড়ে জল বার করতে আসবে।

    সাবুই ঘাসের ঝোপগুলো থেকে আরো দু রশি যাবার পর ওরা জঙ্গলের মুখে এসে পড়ে।

    এখানে বন ঘন নয়; বেশ ছাড়া ছাড়া। এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে আছে কড়াইয়া, পরাস, সিমার, সাগুয়ান আর কাঁটাওলা পুটুস গাছের ঝাড়। এই জষ্ঠি মাসে পরাস আর সিমার গাছগুলোর ডালে থোকা থোকা আগুনের মতো ফুল ফুটে আছে। তবে খুব বেশি করে যা নজরে পড়ে তা হলো মহুয়া। ফুল আর ফলের খুসবুতে বাতাস এখানে ভারী হয়ে আছে।

    ধর্মার সাথীরা এই পাতলা জঙ্গল থেকেই খাদ্যটাদ্য সংগ্রহ করবে। কিন্তু ধর্মা যাবে আরো তিন রশি—জঙ্গল ক্রমশ ঘন হতে হতে যেখানে চাপ বেঁধে আছে সেইখানে। কোটরা হরিণ সেখানে না গেলে মিলবে না।

    কিন্তু জঙ্গলের এই মুখটায় এসেই ধর্মারা থমকে গেল। ঘাস ফুরোবার পরে এখানে গৈয়া বা বকরিচরানিরা আর আসে না। জঙ্গল ফাঁকা পড়েই থাকে। কিন্তু আজ হাট্টাকাট্টা চেহারার অনেকগুলো লোককে দেখা গেল। তারা মহুয়ার ফল পেড়ে পেড়ে ঢাউস বাঁশের ঝোড়া বোঝাই করছে। লোকগুলোকে ধর্মারা চেনে।

    গারুদিয়া এবং বিজুরি তালুকে রঘুনাথ সিং এবং মিশিরলালজীকে বাদ দিলে আরো জনকয়েক পয়সাওলা লোক রয়েছে। রঘুনাথদের তুলনায় তারা অবশ্য কিছুই না। রঘুনাথদের মতো অত বিপুল জমিজমা বা ক্ষেতখামারও তাদের নেই। এ অঞ্চলের তাবত চাষের জমি ওঁরা দু’জনেই পুরুষানুক্রমে দখল করে রেখেছেন। বাকি যেটুকু ছিটেফোঁটা রয়েছে তা পড়েছে ঐ ক’জন ভাগ্যবানের ভাগে। জমিজমা না থাকলেও এদের আছে সুন্দর কারবার, গারুদিয়া আর বিজুরির বাজার-গঞ্জে বড় বড় আড়ত, দোকান, ভাড়ায় খাটানোর জন্য গৈয়া আর ভয়সা গাড়ি, লরি, সাইকেল রিকশা, ইত্যাদি ইত্যাদি। এ ছাড়া আছে পাল পাল গরু মোষ এবং ছাগল। যে লোকগুলো মহুয়া পাড়ছে তারা ঐ সব পয়সাওলা আদমীদের বকরিচরানি গাইচরানি মোষচরানির দল।

    বৈশাখ মাস পড়তে না পড়তেই কচু, সুথনি, মেটে আলু ইত্যাদি খাওয়ার যোগ্য যাবতীয় জিনিসই সাবাড় হয়ে আসছিল। এই গরমের সময়টা বড় কষ্ট এদিকের মানুষের। এখন না মেলে জল, না মেলে খাদ্য। কচু কন্দের টান পড়তে কিছুদিন ধরেই ধর্মার মা-বাপ থেকে শুরু করে দোসাদটোলার বাতিল মানুষেরা মহুয়ার ফল নিয়ে যাচ্ছিল। পেট তো কোন কথা শোনে না। অন্য বঢ়িয়া খাদ্য না পেলে মহুয়ার ফলই সই। দু-একটা মাস এই মহুয়ার ফল তাদের বাঁচিয়ে রাখে। বেশ কয়েক বছর ধরে এরকম চলছে। সে যাই হোক, ধর্মারা কিন্তু আগে আর কোনদিন গাইচরানি বকরিচরানিদের এভাবে মহুয়ার ফল পেড়ে নিয়ে যেতে দ্যাখে নি।

    ধর্মার গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দোসাদটোলার অন্য সবাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এইভাবে পয়সাওলা আদমীদের লোকেরা যদি তাদের মতো গরীব না-খাওয়া মানুষের খাদ্যে হাত বাড়ায় তা হলে বড়ই বিপদ; বিলকুল ভুখা মরে যেতে হবে তাদের। কী যে করবে, ভেবে উঠতে পারছিল না ওরা।

    হঠাৎ পেছন দিকে বহু লোকের পায়ের শব্দে ঘাড় ফেরাল ধর্মারা। শ দেড় দুই আদিবাসী মুণ্ডা ওরাঁও আর সাঁওতাল বালিতে পা ডুবিয়ে ডুবিয়ে এগিয়ে আসছে। হাড্ডিসার ক্ষুধার্ত চেহারা; চোখ এক আঙুল করে গর্তে ঢুকে গেছে। পরনে ময়লা চিটচিটে টেনি। মেয়েমানুষগুলোর বেশির ভাগই কোমরে একটি করে বাচ্চা ঝুলছে। মায়েদের মরুভূমির মতো ধু-ধু নির্জলা বুকের বোঁটায় চোঁ চোঁ করে দু-একটা টান দিয়েই তারা চিৎকার করে উঠছে। না-না, কিছুই নেই সেখানে। দেখেই টের পাওয়া যায়, দু-তিন দিন ওদের কারো খাওয়া হয় নি।

    ওরাঁও মুণ্ডারা ধর্মাদের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে গেল। ধর্মারা কিছুক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে ক্ষুধার্ত আধন্যাংটো মানুষগুলোকে দেখে। আগে আর কখনও আদিবাসী ওরাঁওদের দক্ষিণ কোয়েলের এদিকটায় আসতে দেখা যায় নি। দোসাদটোলার প্রতিনিধি হিসেবেই যেন ধর্মা শুধোয়, ‘কা বাত? তোরা কোথাকার আদমী?’

    আদিবাসীদের ভেতর থেকে একটা বুড়ো ওরাঁও বেরিয়ে এসে আঙুল বাড়িয়ে খাড়া পশ্চিম দিকটা দেখিয়ে বলে, ‘উঁহাকা—’

    ‘এখানে তো কোনদিন তোদের দেখিনি—’

    ‘নায়। এই পয়লা এলাম।’

    ‘কা বাত?’

    নিজের গর্তে ঢুকে যাওয়া চিমড়ে পেট দেখিয়ে ওরাঁওটা বলে, ‘ইসকে বাস্তে—’

    ধর্মা পুরোটা বুঝতে না পেরে তাকিয়ে থাকে।

    বুড়ো ওরাঁও ফের বলে, ‘আমাদের ওদিকে কিছু নেই—নায় চাওর (চাল), নায় গেঁহু, নায় রামদানা, নায় মাড়োয়া, নায় মকাই—কুছ নায়। জঙ্গলের গাছপাতাও পুরা খতম। পরশু শুনলাম, এখানকার জঙ্গলে কিছু মিলবে। কমসে কম মৌয়াকে (মহুয়া) ফল। শুনেই গাঁও ফেলে সব বেরিয়ে পড়েছি। কিছু না পেলে ভুখা মর যায়েগা।’

    ধর্মা খানিকক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারা অর্থাৎ অচ্ছুৎ ভূমিদাসেরাও ভুখা-নাঙ্গা আদমী। কিন্তু এমন ভয়াবহ দুর্দশার কথা যেন ভাবা যায় না। অবশ্য সেদিন চাহাঢ়ের হাটে মরসুমী ক্ষেতমজুর আনতে গিয়ে আদিবাসীদের কাছে কিছু কিছু শুনেছিল। উত্তর না দিয়ে আঙুল দিয়ে জঙ্গলের দিকটা দেখায় সে। ওখানে এখনও মহুয়ার ফল পাড়া চলছে।

    বুড়ো ওরাঁও এবং তার সঙ্গীরা দৃশ্যটা দেখার পর ভয়ানক হতাশ হয়ে যায়। হাপরের মতো জোরে শ্বাস ফেলে বালির ওপর সে বসে পড়ে। বলে, ‘মর যায়েগা, হামনিলোগ জরুর ভুখা মর যায়েগা।’

    ধর্মা আর দাঁড়ায় না। পায়ে পায়ে জঙ্গলের ভেতর যেখানে মহুয়ার ফল পাড়া হচ্ছে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। এই লোকগুলো তো পয়সাওলা আদমীদের গাই বকরি চরায় এবং দু বেলা ভরপেট খেতে পায়। তা হলে গরীবের খাদ্য মহুয়ার ফল পাড়ছে কেন? অনেকক্ষণ থেকেই জানার জন্য কৌতূহল হচ্ছিল ধর্মার। সে শুধোয়, ‘কা ভেইয়া, মৌয়ার ফল নিচ্ছ কেন?’

    বড়ে আদমীদের গাই বকরি চরানিদের মেজাজই আলাদা। প্রথমটা তারা ধর্মার কথার উত্তর দেওয়াটা প্রয়োজন মনে করে না। অনেক বার ঘ্যান ঘ্যান করার পর একজন রুক্ষ গলায় বলে, ‘গাই বকরির জন্যে।’

    ‘গাই-বকরি মৌয়া দিয়ে কী করবে?’

    ‘কী আবার করবে? খাবে।’

    ‘মৌয়া খাবে?’

    ‘না তো কী? দশ বিশ মিলের (মাইলের) মধ্যে কোথাও ঘাসপাতা আছে? সব জ্বলে গেছে। জানবরগুলো কি ভুখা মরবে?’

    জানবারের চাইতে মানুষের বেঁচে থাকাটা অনেক বেশি জরুরী, এই কথাটা বলতে গিয়েও বলা হয় না ধর্মার। দক্ষিণ কোয়েলের পার ধরে মাইলের পর মাইল এই জঙ্গলের মালিক কে, সে জানে না। তবে তার মনে হয় বড়ে সরকার রঘুনাথ সিংয়ের পায়ে পড়লে কিছু সুরাহা হলেও হতে পারে। তাঁকে জানাতে হবে এই শুখা মরসুমে প্রচণ্ড কষ্টের দিনগুলোতে গাই বকরি চরানিরা যেন মহুয়া ফলের দিকে হাত না বাড়ায়, ওগুলো যেন গরীব ভুখা মানুষদের জন্যই থাকে। রঘুনাথ সিং বলে দিলে কারো ক্ষমতা নেই গাই-বকরির জন্য জঙ্গলে যায়। রঘুনাথ সম্পর্কে এই কথাটা যে ধর্মা ভাবতে পারল তার কারণ একটাই। তা হল সেদিনকার সেই লাড্ডু বিতরণ। মাস্টারজীর কথায় ভোটকা ভোজ। যে মানুষ এত আদর করে নিজের হাতে তাদের মতো অচ্ছুৎদের মিঠাইয়া বেঁটে দিয়েছেন তিনি কি আর গরীব লোকদের না খেয়ে মরতে দেবেন! কিন্তু তাঁকে গিয়ে ধরবে কে? ধর্মা ভাবল, পরে এ নিয়ে গণেরিদের সঙ্গে কথা বলে দেখবে।

    এধারে মহুয়ার ফলে বারো চোদ্দটা ঝোড়া বোঝাই হয়ে গিয়েছিল। গাই বকরি চরানিরা সেগুলো মাথায় চাপিয়ে চলে গেল।

    ধর্মা জানে, জঙ্গলের সামনের দিকে খুব বেশি মহুয়ার গাছ নেই। তবে একটু ভেতর দিকে গেলে অগুনতি রয়েছে। কিন্তু গাই-ছাগলের জন্য অনবরত মহুয়া ফল নিয়ে গেলে ফুরিয়ে যেতে আর কতক্ষণ। কিন্তু এসব পরের কথা পরে চিন্তা করা যাবে। এখন আর দেরি করার উপায় নেই। বেলা চড়ে যাচ্ছে। এখান থেকে তিন রশি রাস্তা ভেঙে গভীর জঙ্গলে ঢুকে কোটরার বাচ্চার খোঁজ করতে কতটা সময় লাগবে, কে জানে। রাঁচী থেকে টিরকে এসে যেতে পারে। বিকেলের মধ্যেই জঙ্গল থেকে তার ফিরে যাওয়া দরকার।

    পেছন ফিরে সে দোসাদটোলার লোকজনকে আর আদিবাসী ওরাঁও-মুণ্ডাদের ডাকে, ‘আও আও—’

    কুশী আর তার চার বাপ-মা এবং ওরাঁও-মুণ্ডারা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে। ধর্মা তাদের জানায় জঙ্গলের ভেতর খানিকটা গেলে আর অজস্র মহুয়া গাছ আছে। তারা যেন সেখানে যায়।

    সেই বুড়ো ওরাঁওটা, যে একেবারে ভেঙে পড়েছিল, এবার বেশ চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তার গর্তে ঢোকা চোখ ঝকমকাতে থাকে। সে বলে, ‘তুমি আমাদের বাঁচালে।’ তারপর সঙ্গীদের দিকে ফিরে হাত নাড়তে থাকে, ‘আ যা—’

    রশিখানেক যাবার পর চাপ-বাঁধা মহুয়ার বন দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে সবাইকে রেখে এগিয়ে যেতে থাকে ধর্মা। পেছন থেকে তার এবং কুশীর চার মা-বাপ সাবধান করে দেয়, ‘জঙ্গলে হোঁশিয়ার থাকবি।’

    ধর্মা বনভূমির বেলেমাটির ওপর দিয়ে বড় বড় পা ফেলতে ফেলতে বলে, ‘হুঁ—’

    ‘হাড়চেঁবুয়া হ্যায়—’

    ‘জানি।’

    ‘শের হ্যায়—’

    ‘জানি।’

    ‘সাঁপ হ্যায়—’

    ‘জানি।’

    ‘ভালু (ভালুক) হ্যায়—’

    ‘জানি।’

    ‘বহোত বদমাস জাদবার ভি হ্যায়—’

    ‘জানি।’

    চার বুড়োবুড়ির গলার স্বর ক্রমশঃ ক্ষীণ হতে হতে পেছনে মিলিয়ে যায়।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleইতিহাসের গল্প – প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত
    Next Article পাগল মামার চার ছেলে – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }