Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আকাশের নিচে মানুষ – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প368 Mins Read0

    আকাশের নিচে মানুষ – ১৫

    পনেরো

    ঘন জঙ্গলে গিয়ে ধর্মা যখন পৌঁছায়, তখন প্রায় দুপুর। কিন্তু বন এখানে এত নিবিড়, মাথার ওপর ডালপালা আর পাতা এত ঘন হয়ে আছে যে জষ্ঠিমাসের গনগনে রোদ ভেতরে ঢুকতে পারেনি। চিকরিকাটা টুকরো টুকরো আলো এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে।

    জঙ্গলের ভেতরটা এই আগুনঢালা গরমের সময়ও বড় ঠাণ্ডা, ছায়াচ্ছন্ন। গা একেবারে জুড়িয়ে যায় যেন। অল্প অল্প হাওয়াও বায় যাচ্ছে। একধারে দক্ষিণ কোয়েলের একটা আধমরা খাতও চোখে পড়ে। এই গরমের সময় জল শুকিয়ে সেটা সরু হয়ে গেছে। সামান্য যেটুকু জল রয়েছে তা কাচের মতো পরিষ্কার আর টলটলে। দোসাদটোলার লোকজন এখানে যে জল নিতে আসে না তার কারণ ভয়ঙ্কর সব জন্তুজানোয়ার—চিতা, ভাল্লুক, হাড়চেঁবুয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।

    এই জঙ্গল ধর্মার বহুকালের চেনা। এখানকার প্রতিটি গাছ লতা, ঝোপঝাড় তার মুখস্থ। এই বনভূমিতে বেশির ভাগ গাছই হল শাল, মহুয়া, সাগুয়ান, গামায়ের, কাঁটাওলা পুটুস, তেতর, আমলকি, পরাস, কেঁদ ইত্যাদি ইত্যাদি।

    এধারে ওধারে, যেদিকেই চোখ ফেরানো যাক, থোকা থোকা মনরঙ্গোলি, সফেদিয়া, রাত-কি-রানী আর হলুদ রঙের চিলাম ফুলে বনের ভেতরটা রানীর মতো সেজে আছে। মাথার ওপর রয়েছে লাল ডগডগে সিমার আর পরাস ফুল। দূর থেকে মনে হবে মাইলের পর মাইল জুড়ে বনের মাথায় আগুন ধরে আছে। মহুয়া ফুলের গন্ধে বাতাস ম ম করছে।

    এতটা পথ হেঁটে আসার দরুন হাঁপ ধরে গিয়েছিল ধর্মার। কাঁধের টাঙ্গি একটা ঝাঁকড়া মাথা গামায়ের গাছের তলায় রেখে বসে পড়ল ধর্মা। খানিকক্ষণ জিরিয়ে কোটরার খোঁজে বেরিয়ে পড়বে সে।

    চারপাশে ঝাঁকে ঝাঁকে পোকা উড়ছে; আর উড়ছে ফড়িং। গাছের পাতার ফাঁকে থেকে পরদেশী শুগা আর চোটাদের অবিশ্রান্ত কিচিরমিচির ভেসে আসছে। দূরে দূরে দু-একটা ময়ূর দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে।

    একসময় ধর্মা লক্ষ করে, সূর্যটা খাড়া মাথার ওপর এসে উঠেছে। কাজেই আর বসে থাকা যায় না। টাঙ্গি ফাঙ্গি কাঁধে চাপিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। তারপর পরাস সাগুয়ান সীসম ইত্যাদি গাছের পাশ দিয়ে ডান দিকে এগুতে থাকে। খানিকটা যাবার পর চোখে পড়ে একটা হড়হড়িয়া (হেলে সাপ) এঁকে বেঁকে ওধারে ঘন ঝোপটার ভেতর ঢুকে যায়।

    ধর্মা ঝোপটা পেছনে ফেলে ক’পা গিয়েই থাকে যায় এবং চোখের পাতা পড়ার আগেই কাঁধ থেকে টাঙ্গি নামিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। সামনে দশ হাত তফাতে মোটা সাগুয়ান গাছটার গা ঘেঁষে একটা হাড়চেঁবুয়া দাঁড়িয়ে ধর্মার দিকে তাকিয়ে আছে। জানবরটার ছুঁচলো মুখ। জঙ্গলের ঘন ছায়ায় সেটার চোখ আগুনের মতো জ্বলছে।

    যে কোন মুহূর্তে ধর্মার ওপর জন্তুটা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। গলার ভেতর থেকে একটু পরে পরেই চাপা হিংস্র শব্দ বার করছে সেটা। মাঝে মাঝে করাতের মতো ধারাল দাঁত বার করছে।

    ধর্মা তৈরি হয়েই আছে। জানবরটা ঝাঁপাবার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ওটার ঘাড়ে টাঙ্গি হাঁকিয়ে দেবে। কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত হাড়চেঁবুয়াটা ঝাঁপালো না; পিছু হটতে হটতে আচমকা ঘুরে গেল। তারপর এক দৌড়ে কোয়েলের মরা খাতটা পেরিয়ে ওধারের জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেল।

    জোরে একটা শ্বাস ফেলে ধর্মা। একসময় টাঙ্গিটা হাতে ঝুলিয়েই এগিয়ে যায়।

    আরো অনেকটা সময় কেটে যায়। ধর্মা টের পায়, পশ্চিম আকাশের ঢাল বেয়ে সূর্যটা বেশ খানিকটা নেমে গেছে। চিকরিকাটা যে রোদের টুকরোগুলো বনের ভেতর এসে পড়েছে সেগুলোর রঙ হলুদ হয়ে যেতে শুরু করেছে।

    হাতে আর বেশি সময় নেই। দিন থাকতে থাকতেই ধর্মাকে এই ভয়ঙ্কর বনভূমি থেকে যেভাবেই হোক বেরিয়ে পড়তে হবে। চোখের সবটুকু জোর দিয়ে সে ডাইনে-বাঁয়ে সামনে-পেছনে অনবরত তাকাতে থাকে। কিন্তু কোটরা হরিণেরা আজ যেন ষড়যন্ত্রই করেছে, কিছুতেই গভীর জঙ্গল থেকে বেরুবে না। শুধু কি কোটরা, সজারু, ভালুক, চিতা, লাকরা, শিয়ার, শুয়ার—কিছুই চোখে পড়ছে না।

    এই জঙ্গলের হাড়হদ্দ, এখানকার জন্তু জানবর পশুপাখির স্বভাব, সব কিছুই ধর্মার জানা। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে যায় তার। বানরদের সঙ্গে হরিণদের খুবই দোস্তি। দূরে ডোরাকাটা শের কিংবা চিতা-টিতা দেখলে গাছের মাথা থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে হরিণদের হুঁশিয়ার করে দেয় বানরেরা। আবার গলার ভেতর থেকে অদ্ভুত আওয়াজ বার করে ডেকেও আনে। হরিণরা কাছাকাছি এসে গেলেই গাছের ডাল থেকে লাফিয়ে তাদের পিঠে পড়েই শিং ধরে মজাসে জঙ্গলের ভেতর ঘোড়দৌড় লাগিয়ে দেয়।

    বানরের ডাক হুবহু নকল করতে পারে ধর্মা। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল সে। তারপর টাঙ্গিটা মাটিতে রেখে দু হাত মুখের দুপাশে চোঙার মতো ধরে উপ উপ করে অবিরাম ডাকতে থাকে। এভাবে আওয়াজ করতে করতে চোয়াল ব্যথা হয়ে যায়, দম ফুরিয়ে আসে কিন্তু কোটরা দূরে থাক, অন্য জাতের সাদা সাদা ফুটকিওলা হরিণও চোখে পড়ে না।

    মেজাজ খারাপ হয়ে যায় ধর্মার; ভীষণ হতাশ হয়ে পড়ে সে। আজকের দিনটাই বেফায়দা বরবাদ হয়ে গেল।

    সূর্য আরো খানিকটা পশ্চিমে নেমে গেছে। জঙ্গলের ভেতর ছায়া আরো গাঢ় হতে থাকে। সন্ধ্যে হবার আগেই এখানে অন্ধকার নেমে যাবে। তার আগেই বেরিয়ে পড়া উচিত। বনভূমির সর্বত্র বিপদ ওত পেতে আছে। ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে কখন চিতা বা লাকরা ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বে, আগে হদিশ পাওয়া যায় না। হতাশ ক্লান্ত নিরানন্দ ধর্মা আজকের মতো কোটরার আশা ছেড়ে দেয়। তার মানে বিশটা টাকা পাবার কোন ভরসাই নেই। অগত্যা সে ফেরার পথ ধরে।

    জঙ্গল যেখানে পাতলা হতে শুরু করেছে তার কাছাকাছি আসতেই আচমকা চোখে পড়ে তিন চারটে খেরাহা অর্থাৎ খরগোস আস্তে আস্তে একটা ঝোপ থেকে বেরিয়ে আরেকটা ঝোপের দিকে চলেছে। ধর্মা যতদিন এই জঙ্গলে এসেছে, খালি হাতে ফেরেনি। কিছু না কিছু নিয়ে গেছে। ঠিক করে ফেলে, আজও খালি হাতে ফিরবে না।

    খরগোস যখন চোখে পড়েছে তখন এই নিরীহ জাবরটাকেই মারবে। পয়সা রুপাইয়া না মিলুক, দুটো দিন পেট ভরে মাংস তো খাওয়া যাবে। ঝড়ের বেগে টাঙ্গিটা কাঁধ থেকে নামিয়ে বাগিয়ে নেয় ধর্মা। কিন্তু সন্তর্পণে পা টিপে টিপে জন্তুগুলোর দিকে এগুবার আগেই বাঁ দিকের জঙ্গল থেকে একটা তীর ছুটে এসে একটা চলন্ত খরগোসকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়। নিরীহ, শান্ত, তুলোর মতো নরম প্রাণীটা বার দুই ছটফট করেই স্থির হয়ে যায়।

    ধর্মা চমকে ওঠে। তীরটা কে মারতে পারে? এটুকু ভাবতে যতটুকু সময় লাগে তার মধ্যেই দেখতে পায় বাকী খরগোস ক’টা বিজরী চমকের মতো ছুটে চলে যাচ্ছে। সে দৌড়ুবার জন্য পা বাড়ায় কিন্তু য’পা যাবার আগেই এবারও আরেকটা তীর ছুটন্ত একটা খরগোসকে বিঁধে ফেলে। অন্য খরগোসগুলোকে আর দেখা যায় না।

    এমন অব্যর্থ নিশানা আগে আর চোখে পড়ে নি ধর্মার। ছুটন্ত জানবরকে বিঁধতে পারে, কে এই তীরন্দাজ? এদিকে-সেদিকে তাকাতেই সে দেখতে পায়। একটা বিরাট সাগুয়ান গাছের পেছন থেকে লোকটা বেরিয়ে আসছে। খইওড়া চামড়া, ফাটা পা, খাড়া খাড়া চুল, হলদেটে চোখ, পরনে নোংরা একটা টেনি। বয়স চল্লিশ হতে পারে, পঞ্চাশ হতে পারে, পঞ্চান্নও হতে পারে। দেখেই টের পাওয়া যায়, সে আদিবাসী মুণ্ডা। মুণ্ডাটার সারা গায়ে দুর্ভিক্ষের ছাপ মারা।

    এই মুণ্ডাটাকে আগে আর কখনও দেখে নি ধর্মা। এমন কি দুপুরের আগে আগে যে আদিবাসীদের জঙ্গলের মুখে সে রেখে এসেছে তাদের মধ্যেও এই লোকটা ছিল না। তা হলে এ এল কোত্থেকে?

    মুণ্ডাটা তীরবেঁধা তার দুই রক্তাক্ত শিকারের দিকে যেতে যেতে হঠাৎ ধর্মাকে দেখে থেমে যায়। এই জঙ্গলে দু’নম্বর শিকারীকে সে খুব সম্ভব আশা করে নি।

    ধর্মাই পায়ে পায়ে মুণ্ডাটার দিকে এগিয়ে যায়। এই জঙ্গলে আর কেউ আসুক, সেটা সে চায় না। ভুরু কুঁচকে বেজায় বিরক্ত গলায় সে শুধোয়, ‘কে তুই?’

    লোকটা বলে, ‘রুখিয়া মুণ্ডা।’

    ‘তোকে তো আগে দেখি নি।’

    ‘আমি এখানকার লোক না।’

    ‘কোথাকার?’

    রুখিয়া মুণ্ডা পশ্চিম দিকে আঙুল বাড়িয়ে দ্যায়, ‘ঐখানে, দশ মিল (মাইল) পছিমে।’

    ধর্মা বলে, ‘এখানে এসেছিস কী করতে?’

    খরগোস দুটোকে দেখিয়ে রুখিয়া বলে, ‘কী করতে এসেছি তা তো দেখতেই পাচ্ছিস।’

    ‘খেরাহা দুটো মারলি কেন?’

    ‘কী করি। তিন রোজ বালবাচ্চা ভুখা রয়েছে। আমাদের ওদিকে পেটে দেবার মতো দানা নেই। কামের খোঁজে বেরুলাম, কাম নেই। ভিখ মাংতে বেরুলাম, ভিখ নেই। একজনের কাছে শুনলাম, এখানকার জঙ্গলে জানবর আছে, সুথনি আছে, মিট্টি আলু আছে। রাত থাকতে থাকতে তীরধনুক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।’

    দক্ষিণ থেকে এসেছে সকালের সেই আদিবাসীরা, পশ্চিম থেকে এসেছে রুখিয়া। হয়ত দু-চারদিনের মধ্যে আরো অনেকে এসে পড়বে। দেখা যাচ্ছে এই জঙ্গলের অনেক দাবীদার।

    প্রাণে বাঁচবার জন্য উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম চারদিক থেকে মানুষ ছুটে আসছে। এতকাল এই গভীর জঙ্গল ছিল ধর্মার একান্ত নিজস্ব। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে একে নিয়ে কাড়াকাড়ি ভাগাভাগি শুরু হয়ে যাবে, এটা জানা সত্ত্বেও রুখিয়ার ওপর তেমন ক্ষেপে উঠতে পারে না সে। উল্টে কিছুটা সহানুভূতিই বোধ করে। আহা ভুখা নাঙ্গা আদমী! সে বলে, ‘ঐ খেরাহা দুটোকে মারবার জন্যে আমি তাক করেছিলাম। তার আগেই তুই তীর বেঁধালি।’

    রুখিয়া কী ভেবে বলে, ‘ঠিক হ্যায়। তুই একটা খেরোহা নে, আমি একটা নিই।’

    এই ভাগ বাটোয়ারা খারাপ লাগে না ধর্মার। কিছু না বলে সে ঘাড় হেলিয়ে দেয়। অর্থাৎ এই ব্যবস্থায় তার পুরোপুরি সায় আছে।

    রুখিয়া মরা খরগোসদুটোর গা থেকে ধারালো তীরের ফলা বার করে ফেলে। একটু পর দেখা যায় দু’জনে দুটো মৃত জানবর হাতে ঝুলিয়ে জঙ্গল পেরিয়ে কোয়েলের শুকনো খাতে ধু-ধু বালির চড়ায় এসে দাঁড়ায়।

    জায়গাটা এখন একেবারে ফাঁকা, জনশূন্য। দোসাদটোলার খারিজ লোকজন আর দক্ষিণ থেকে আসা সেই আদিবাসীরা কেউ নেই। জঙ্গলের সামনের দিক থেকে কচু, কন্দ, মহুয়ার গোটা জোগাড় করে কখন চলে গেছে, কে জানে।

    সূর্যটা এখন আরো হেলে গেছে। পশ্চিমের আকাশ গনগনে লাল; ফিনকি দিয়ে সেখানে রক্ত ছুটছে। বেলা পড়ে এলেও রোদের তাত কিন্তু এখনও কমে নি। বালি যেন মাইলের পর মাইল জুড়ে আগুনের দানা হয়ে আছে। পা ফেললেই মনে হচ্ছে ফোস্কা পড়ে যাবে। তবে হাওয়া আছে প্রচুর; সেটুকুই যা বাঁচোয়া।

    পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ধর্মা বলে, ‘তুহারকা নিশানা বহোত আচ্ছা। ছুটন্ত খেরাহার গায়ে তীর বেঁধালি! এরকম বেঁধাতে আমি আগে আর কাউকে দেখিনি।’

    রুখিয়া বলে, ‘উড়াল পঞ্ছীকেও আমি তীর মেরে আকাশ থেকে নামাতে পারি।’

    ধর্মা অবাক হয়ে যায়, ‘হুঁ!’

    ‘হুঁ রে। নিজের আঁখে দেখতে চাস?’

    ধর্মা কী উত্তর দেবে, বুঝতে পারে না।

    রুখিয়া এবার জানায়, এখন থেকে প্রায় রোজই সে এই জঙ্গলে আসবে। ধর্মাও যদি আসে তীর বিঁধিয়ে আকাশ থেকে উড়ন্ত পাখি নামিয়ে দেখাবে।

    ধর্মা এবারও কিছু বলে না। রুখিয়ার পাশাপাশি বালির ওপর দিয়ে হাঁটতে থাকে। হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে অস্থির হয়ে ওঠে সে। রুখিয়ার তীরন্দাজি এতক্ষণ তাকে যেন যাদু করে রেখেছিল। ওদিকে টিরকে এসেছে কিনা কে জানে। সূরয ডোবার আগেই ক্ষেতিতে পৌঁছে যাওয়া চাই তার। সে লম্বা লম্বা পা ফেলতে শুরু করে। দেখাদেখি রুখিয়াও হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। একসময় সে বলে, ‘তোদের এদিকে আজই পয়লা এলাম।’

    অন্যমনস্কর মতো উত্তর দেয় ধর্মা, ‘হুঁ।’

    ‘ঐ জঙ্গলটায় অনেক জানবর আর পঞ্ছী আছে—না?’

    ‘হুঁ।’

    ‘বরা?’

    ‘হুঁ।’

    ‘হীরণ?’

    ‘হুঁ।’

    ‘কোটরা?’

    ‘হুঁ।’

    ‘তেতর?’

    ‘ও ভী—’

    ‘হরমদেওর কিরপা। বালবাচ্চা তা হলে ভুখা মরবে না।’

    ধর্মা উত্তর দেয় না।

    রুখিয়া থামে নি। সে বলতে থাকে, ‘কাল থেকে রোজ তোদের এই জঙ্গলে আসব।’

    এই কথাটা আগেও একবার জানিয়েছে রুখিয়া। ধর্মা এবারও জবাব দেয় না। হাঁটার গতিটা শুধু আরো বাড়িয়ে দেয়।

    সেই সাবুই ঘাসের ঝাড়গুলো পেরিয়ে রশি খানেক যাবার পর রুখিয়া বলে, ‘আমি এবার বাঁয়ে যাব।’

    ধর্মা মাথা কাত করে, ‘ঠিক হ্যায়।’

    ‘জঙ্গলে তুই রোজ আসিস?’

    ‘নায়; কভী কভী।’

    ‘এলে দেখা হবে।’

    রুখিয়া মুণ্ডা হাতে খরগোস ঝুলিয়ে কোয়েলের মরা খাতের বালি পেরিয়ে বাঁ দিকের উঁচু পাড়ে ওঠে। তারপর বড় বড় পা ফেলে খাড়া পশ্চিমে হাঁটতে থাকে। তার কাঁধে তীরের শানানো ফলাগুলো শেষবেলার রোদে অনবরত ঝলকাতে থাকে। একসময় গাছপালা এবং একটা মাঝারি টিলার আড়ালে সে অদৃশ্য হয়ে যায়।

    আকাশে যেখানে পিঠ বাঁকিয়ে দিগন্তে নেমেছে সূর্যটা একসময় সেখানে আধাআধি ডুবে যায়। বাকি অর্ধেক ওপরে মাথা তুলে থাকে। ঠিক সেই সময় ধর্মা এসে পাক্কীতে ওঠে। দ্যাখে বাস ‘ইস্ট্যাণ্ডে’ পীপর গাছের তলায় টিরকে দাঁড়িয়ে আছে। ধর্মাকে দেখে সে কাছে এগিয়ে আসে এবং তার হাতে ঝুলন্ত খরগোসটা দেখে বলে, ‘কা বাত! তোকে জ্যান্ত কোটরার বাচ্চার ‘অডার’ দিলাম। আর তুই নিয়ে এলি কিনা মুর্দা খেরাহা!’

    ধর্মা বলে, ‘খেরাহা তোর জন্যে না।’ একটু থেমে শুধোয়, ‘রাঁচী থেকে কখন এসেছিস?’

    ‘দুফারে (দুপুরে)। এখন সূরয ডুবতে চলল। ক্ষেতিতে যেতে কুশী বলল, তুই জঙ্গলে গেছিস। জঙ্গল থেকে এখান দিয়ে তো লোটতে হবে। তাই দাঁড়িয়ে আছি। সোচলাম, কোটরা জরুর পেয়ে যাব। তার বদলে নিয়ে এলি মরা খেরাহা।’

    ‘বহোত চেষ্টা কিয়া; কোটরা নায় মিলল। কা করে—’

    একটু ভেবে টিরকে বলে, ‘আমরিকী সাব আজ রাতে চলে যাবে। ফির আসবে এক মাহিনা বাদ। তখন কোটরা জুটিয়ে দিতে পারবি?’

    ধর্মা উৎসাহিত হয়ে ওঠে, ‘হুঁ, জরুর।’

    তার উৎসাহকে উস্‌কে দেবার জন্য হাফ প্যান্টের পকেট থেকে দুটো দশ টাকার নোট বের করে দিতে দিতে টিরকে বলে, ‘এই নে। পুরাটাই ‘ইডভান্স’ করে দিলাম।’

    টিরকের কথা শেষ হতে না হতেই রাঁচীর বাস এসে যায়। লাফিয়ে উঠতে উঠতে সে বলে, ‘আমি আজ চলি। কোটরার কথা ভুলে যাস না।’

    ‘নায় নায়।’ হাতে একমাস সময় পেয়ে ধর্মা খুশীই হয়েছে। কোটরার বাবদে বিশটা টাকার আশা সে ছেড়েই দিয়েছিল। আচমকা অপ্রত্যাশিত সেই টাকাটা পেয়ে তার উৎসাহ উদ্যম দশগুণ বেড়ে গেছে। এর ভিতর কোটরার বাচ্চা সে যোগাড় করে ফেলবেই।

    ওদের কথাবার্তার মধ্যেই রাঁচীর বাস ছেড়ে দেয়। টাকাটা প্যান্টের কোমরে যেখানে দড়ি ঢোকানো থাকে সেই ফোকরে পুরতে পুরতে সোজা হাইওয়ে বরাবর পুব দিকে হাঁটতে থাকে ধর্মা। খানিকটা যাবার পর তার চোখে পড়ে, সকালবেলার সেই আদিবাসীগুলো সড়কের ধারের পড়তি জমিতে চুল্‌হা ধরিয়ে রান্না চড়িয়েছে। জঙ্গল থেকে শাকপাতা মহুয়ার ফল যা যোগাড় করেছিল, খুব সম্ভব সে সব সেদ্ধ করে নিচ্ছে। তাদের মধ্যে সেই বুড়ো ওরাঁওটাকেও দেখা যায়। ধর্মা চেঁচিয়ে বলে, ‘তোরা এখানেই থেকে যাবি নাকি?’

    বুড়ো ওরাঁও বলে, ‘যদ্দিন মৌয়ার দানা আর শাকপাতা মিলবে তদ্দিন থেকে যাব।’

    ধর্মা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই চিৎকার শোনা গেল।

    ‘রঘুনাথ সিংকো—’

    ‘বোট দো।’

    ‘রঘুনাথ সিংকো—’

    ‘বোট দো।’

    সেই চেনা জীপ গাড়িটা হাইওয়েতে লাল ধুলো উড়িয়ে রঘুনাথ সিংয়ের বাড়ির দিকে ছুটে যাচ্ছে। অর্থাৎ চুনাওর পরব সমানে চলছে।

    সামনের বাঁকে জীপটা অদৃশ্য হবার পর কোণাকুণি শস্যের ক্ষেতগুলোর দিক তাকায় ধর্মা। না, কেউ নেই ওখানে। ফসলের বিশাল মাঠ এখন একেবারেই জনশূন্য। সারাদিন কাজের পর দোসাদটোলার খরিদী কিষাণরা হাল-বয়েল নিয়ে ফিরে গেছে।

    ধর্মা আর দাঁড়ায় না; হাইওয়ে ধরে এগিয়ে যেতে থাকে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleইতিহাসের গল্প – প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত
    Next Article পাগল মামার চার ছেলে – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }