Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আকাশের নিচে মানুষ – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প368 Mins Read0

    আকাশের নিচে মানুষ – ২০

    কুড়ি

    রঘুনাথ সেই যে কুয়োকাটাইদের পাঠিয়েছিলেন, তারা পুরনো কুয়োর বালি তো সাফ করেছেই, নতুন একটা কুয়োও কাটিয়ে দিয়ে গেছে। ফলে দোসাদটোলায় জলের কষ্টটা আর নেই। আগে কুয়ো ছেঁচে ময়লা শ্যাওলা-ভাসা জল দু-এক লোটা তুলে মাথায় ঢালতে হতো। এখন সেই কষ্টটা সরকার রঘুনাথ সিং লাঘব করে দিয়ে যে কিরপা করেছেন, অচ্ছুৎ দোসাদদের মধ্যে তার জন্য কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

    ধর্মারা সরকারের উপহারের কুয়ো থেকে জল নিয়ে চান করে খেয়ে যখন হাল বয়েলের জন্য রঘনুাথ সিংয়ের খামারবাড়ির দিকে রওনা হবে ঠিক তখন একটা মোটর জীপ ধুলো উড়িয়ে দোসাদটোলার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।

    দূর থেকে চেনা না গেলেও এটা যে রঘুনাথ সিংয়ের গাড়ি নয়, তা ধর্মারা ঠিকই বুঝতে পারে।

    গাড়িটা ওদের মহল্লায় এসে থামতেই প্রতিভা সহায়ের চুনাওর কর্মী অবোধনারায়ন পাণ্ডে বেরিয়ে এলো। অবোধনারায়নকে দেখে সব অচ্ছুৎ ভূমিদাসেরা জড়ো হয়ে দাঁড়ায়।

    অবোধনারায়ন পাণ্ডে তখন ধর্মাদের যা শোনালো তা এইরকম। কিছুদিন পর গারুদিয়া বাজারে প্রতিভা সহায়ের চুনাওর মীটিং হবে। সেখানে তাদের সবাইকে যেতে হবে। তাদের মীটিং এ নেওয়ার জন্য বড় বড় মোটর গাড়ি পাঠানো হবে।

    কথাগুলো বলার পর অবোধনারায়ন পাণ্ডে মোটরে চড়ার লোভটা দোসাদদের ওপর কী প্রতিক্রিয়া করছে, ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তা লক্ষ্য করতে থাকে।

    এই জনমদাসেরা চোদ্দ পুরুষে দু-একবার বাসে চড়া ছাড়া কখনও মোটরে চড়ে নি। হাওয়াই গাড়িতে তাদের চুনাওর মীটিংয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। নিজেদের কানে শুনেও এত বড় সৌভাগ্যের ব্যাপারটা তারা যেন পুরা বিশ্বাস করে উঠতে পারে না। খানিকক্ষণ অবাক বিস্ময়ে হাঁ হয়ে থাকার পর একসঙ্গে সবাই চেঁচিয়ে ওঠে, ‘সচমুচ মোটরিয়া চড়ে?’

    অবোধনারায়ণ হাসে, ‘সচমুচ না তো কী, ঝুটফুস?

    ‘নায়! অ্যায়সাই পুছল।’

    অবোধনারায়ণ কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই কুয়োর পশ্চিম ধারের একটা বারান্দা থেকে ধনপতের বাপ বুড়ো গৈরুনাথ চিলের গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, ‘হামনি মোঠরিয়া চড়েগা, হামনি মোটরিয়া চড়কে মীটিন যায়েগা।’

    গৈরুনাথের বয়েস হয়েছে শয়ের কাছাকাছি। পন্দর বিশ সাল আগে তার কোমর পড়ে গেছে, পায়ে, শোথ ধরেছে চামড়া ফেটে এখন কষ বেরোয়। চোখের রোশনি কবেই মরে গেছে। কিন্তু যম তাকে এখন পর্যন্ত ছোয় নি। বোধ হয় বিনাশ নেই গৈরুনাথের। অকেজো পঙ্গু বাতিল এই মানুষটা দিনরাত বারান্দায় দড়ির চৌপায়ায় শুয়ে থাকে। ছেলে ধনপত, পুতাহী লখিয়া এবং নাতি-নাতনীরা সর্বক্ষণ তার মৃত্যু কামনা করে, কেননা তার পাকস্থলীটা এত বয়সেও মারাত্মক রকমের তেজী। একটা টগবগে জোয়ান মরদের পুরো খাদ্য সে হজম করে ফেলতে পারে। যে একটা পয়সা কামায় না, এক কণা খাবার জুটিয়ে আনার ক্ষমতা যার নেই তাকে শুইয়ে শুইয়ে খাওয়াতে কে আর চায়? কিন্তু কী আশ্চর্য, গৈরুনাথ বছরের পর বছর বেঁচেই থাকে। চোখে তেজ না থাকলেও কানদুটো তার অত্যন্ত প্রখর। এই একশো বছর বয়সে মোটর গাড়ি চড়ার দুর্মর লোভ হঠাৎ তাকে পেয়ে বসে।

    গৈরুনাথের পুতাহী অর্থাৎ ধনপতের বউ লখিয়া বারান্দায় বুড়োর কাছাকাছি বসে লম্বা ঘোমটা টেনে অবোধনারায়ণদের কথাবার্তা শুনছিল। এবার ঘোমটার তলা থেকে চাঁছাছোলা খনখনে গলায় চেঁচাতে থাকে, ‘বুড়হা শিয়ারের মোটরিয়ায় চড়ার শখ গজিয়েছে। গিধ কাঁহাকা! মোটরিয়ায় তুলে তোকে চিতায় দিয়ে আসব। মর, মর, মর—’ মেয়েমানুষটার গলায় বিধ, জিভে ছুরির ধার।

    ধনপত স্বামীর অধিকারে গর্জে ওঠে, ‘চুপ হো যা মনুয়াকি মাঈ, চুপ হো যা—’ নিজেরা অকর্মণ্য বাপের সঙ্গে ঘরে যে ব্যবহারই করুক, সেটা নিজেদের ব্যাপার। কিন্তু এত লোকের, বিশেষ করে অবোধনারায়ণের মতো মান্যগণ্য বড়া আদমীর সামনে বউ তার বাপকে এভাবে অসম্মান করবে সেটা ছেলে হিসেবে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। ব্যাপারটা তার পক্ষে খুবই অস্বস্তিকর।

    দোসাদটোলার মাতব্বর হবার অধিকারে গণেরিও চাপা গলায় ধমকায়, ‘চুপ হো যা ধনপতকি বহু—’

    লখিয়ার গলার স্বর খানিকটা নামে ঠিকই কিন্তু ঘোমটার তলায় সে গজ গজ করতেই থাকে।

    নিজের সংসারে গৈরুনাথের দাম একটা ফুটো কড়িও নয়। ছেলে, পুতাহী, নাতিনাতনী—সবার কাছে বিলকুল বাতিল হয়ে গেলেও চুনাওর চোখে সে একটি অত্যন্ত মূল্যবান মানুষ। একটা মানুষ মানে একটা ভোট।

    অবোধনারায়ণ মুরখ কাণ্ডজ্ঞানহীন লোক নয়। সে চটপট বলে ওঠে, ‘হাঁ হাঁ, জরুর মোটরিয়ায় চড়ে তুমি মীটিনে যাবে।’ বলে জমায়েতের দিকে ফেরে, ‘সাত আট রোজ বাদে সন্ধ্যেবেলায় সূরয ডোবার পর গাড়ি পাঠিয়ে দেব, মনে রাখিস। ঐ সময়টা সবাই মহল্লাতেই থাকিস। কবে মীটিন তার আগের দিন এসে জানিয়ে যাব।’

    ভিড়ের ভেতর মোটরে চড়ে মীটিংয়ে যাবার ব্যাপারটা নিয়ে চাপা উত্তেজনা এবং গুঞ্জন চলতে থাকে।

    অবোধনারায়ণ ফের বলে, ‘একটা কথা ভেবে দেখিস, পরতিভাজীকে ভোট দিলে তোদের ভালাই হবে। বহোত বড় ঘরকা লেড়কী পরতিভাজী, বড়ে ঘরকা বহু। উনি যা বলবেন গরমিন্ট তা করবে। পরতিভাজীকে যদি এম্নে বানিয়ে দিতে পারিস, গারুদিয়া আউর বিজুরির হাল ফিরে যাবে। এখানে অসপাতাল বসবে, ডর্জন ডর্জন পাক্বী সড়ক হবে, গাঁয়ে গাঁয়ে ইস্কুল চালু হবে, কারখান্না ভি বসে যাবে। পরের জমিনে হাল ঠেলে জান বরবাদ করতে হবে না; কারখান্নায় মোটা তলবে তোরা নৌকরি পেয়ে যাবি।’

    জনমদাসেরা কেউ কোন কথা বলে না। তারা একবার অবোধনারায়ণকে, আরেক বার নিজেদের মাতব্বর গণেরিকে দেখতে থাকে। গারুদিয়া-বিজুরিতে কারখানা বসবে, নৌকরি মিলবে, বড়ে সরকার রঘুনাথ সিংয়ের জমিতে গতর চূরণ করে লাঙল ঠেলতে হবে না—এ সব নতুন কথা বটে এবং খুবই লোভনীয়।

    অবোধনারায়ণ পাণ্ডে আরো বলে, গণেরিদের সে একটু আধটু আভাস দিল মাত্র। তারা আরো কী সুবিধা পাবে, এ অঞ্চলের আর কী কী উন্নতি হবে, প্রতিভা সহায় ভালো করে বিস্তারিতভাবে তাদের বুঝিয়ে দেবেন। শুধু তাই না, যারা তাঁর চুনাওর মীটিনে যাবে তাদের নগদ নগদ কিছু লাভও আছে।

    গণেরি জিজ্ঞেস করে, ‘কী লাভ?’

    অবোধনারায়ণ অল্প একটু হাসে। জানায়, মোটরিয়াতে চড়বার  সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকে তিনগো করে রুপাইয়া পাবে।

    মীটিংয়ে গেলে এতগুলো করে টাকা! সবার চোখ বিস্ময় এবং আশায় ঝকমক করতে থাকে।

    অবোধনারায়ণ আর বসে না। ভুখানাঙ্গা অচ্ছুৎদের বুকের ভেতরকার নিদ্রিত লোভকে উসকে দিয়ে একসময় উঠে পড়ে। বলে, ‘রাত অনেক হল, এখন যাই রে।’ চেয়ারের দুবলা হাতলে আস্তে ভর দিয়ে বিপুল চর্বিগুলা শরীর টেনে তোলে সে।

    এই সময় ধনপতদের বারান্দা থেকে বুড়ো গৈরুনাথ জড়ানো গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, ‘তিনগো রুপাইয়া মিলেগা। হামনি মীটিন যায়েগা—’

    এবার আর ঘোমটার তলায় লখিয়া খনখনে গলায় খেঁকিয়ে ওঠে না। তিনটে টাকা যেখানে পাওয়া যাচ্ছে সেখানে মোটরিয়াতে চড়ে শ্বশুরের মীটিংয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তার পুরা সায় আছে। একশো বছরের এই পঙ্গু অথর্ব লোকটা যে একেবারে অপদার্থ গলগ্রহ না, নেহাতই পরমায়ু থাকার জোরে সেও যে দুটো পয়সা কামাই করতে পারে, এবারকার চুনাও তা টের পাইয়ে দেয়।

    অবোধনারায়ণ উঠবার সঙ্গে সঙ্গে গণেরিরাও দাঁড়িয়ে পড়েছিল। বাইরের রাস্তা পর্যন্ত তারা সঙ্গে আসতে চেয়েছিল। এটা সম্মান দেখাবার ব্যাপার। অবোধনারায়ণ বলেছে, সারাদিন সবাই খেটে-খুটে এসেছে। কষ্ট করে তাদের আর সঙ্গে যেতে হবে না। একরকম জোর করেই তাদের এখানে রেখে সে চলে যায়।

    অবোধনারায়ণ গেল বটে কিন্তু মোটরিয়া এবং মাথাপিছু নগদ তিনটে করে টাকার প্রতিশ্রুতি গোটা দোসাদটোলার শিরায় শিরায় উত্তেজনা ছড়িয়ে দিতে থাকে। সবাই গণেরির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘অব হামনিলোগ কা করে?’

    ‘শোচনা পড়ে—’ গণেরি গম্ভীর মুখে বলে।

    ‘শোচবার কী হলো?’ গোটা দোসাদটোলা ভয়ানক অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে, ‘পরতিভাজী আমাদের মোটরিয়া চড়াবে, নগদ রুপাইয়া দেবে। তিনগো রুপাইয়া কৌন দেতা হ্যায়? এর ভেতর শোচবার কিছু নেই।’

    ‘জরুর আছে।’

    ‘কা?’

    গণেরি যা উত্তর দেয় তা এইরকম। প্রতিভা সহায় বড়ে সরকারের বিরুদ্ধে এবার চুনাওতে নেমেছে। এদিকে তারা দোসাদরা রঘুনাথ সিংয়ের খরিদী কিষাণ, তাঁর ক্ষেতিতে পুরুষানুক্রমে খাটছে, তাঁর জমিতে ঘরবাড়ি তুলে থাকছে। এখন মোটরিয়া চড়া আউর তিনগো করে রুপাইয়ার লালচে তারা যদি প্রতিভা সহায়ের চুনাওর মীটিনে যায় তাতে বড়ে সরকার কি খুশী হবেন? বিলকুল না। গণেরি বলতে থাকে, ‘আমার এই কথাটা ভেবে দ্যাখ।’

    সবাই চমকে ওঠে। এদিকটা কেউ চিন্তা করে দ্যাখেনি। চুনাওতে তাঁরই ক্রীতদাসেরা লোভে বশে তাঁরই শত্রুপক্ষকে মদত দিতে যাবে আর এটা তিনি বরদাস্ত করবেন, এতখানি মহানুভবতা রঘুনাথ সিংয়ের কাছে আশা করা অন্যায়। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় এই কথাটা তারা বুঝতে পারে। তবু নগদ নগদ তিনটে করে টাকার লোভ একেবারে ঝেড়ে ফেলতে পারে না। তারা শুধোয়, ‘তা হলে কী করা দরকার?’

    এতগুলো মানুষকে হতাশ করতে ইচ্ছা হয় না গণেরির। সে বলে, ‘মীটিনের তো দেরি আছে। বীচমে পুরা সাত আট রোজ। ভেবে দেখি কী করা যায়। রাত হল, আর তেল পুড়িয়ে বসে থেকে কা ফায়দা? সব ঘরে যা—’

    .

    ঘরে ফিরে আরেকবার তাজ্জব বনে যায় ধর্মারা। শুধু সে-ই না, তার মা-বাপ, কুশী এবং কুশীর মা-বাপ পর্যন্ত। অবোধনারায়ণ আসার পর কেউ আর ঘরে ছিল না। এ পাড়ার সব দোসাদ আর দোসাদিন তার কথা শোনার জন্য কুয়োর পাড়ের ফাঁকা জায়গায় চলে গিয়েছিল।

    অন্ধকারে বারান্দায় একটা বাঁশের খুঁটিতে ঠেসান দিয়ে বসে বিড়ি ফুঁকছে টিরকে। রাঁচী থেকে কখন সে এসেছে, টের পাওয়া যায় নি।

    ভীষণ ব্যস্তভাবে ধর্মা বলে, ‘আরে তুম টিরকে ভেইয়া!’

    ‘ইয়াস, আমিই।’ টিরকে হাসে।

    ‘কতক্ষণ এসেছ?’

    ‘পাক্কা ওয়ান আওয়ার—এক ঘণ্টা।’

    ‘ডাকো নি কেন?’

    টিরকে জানায়, এতক্ষণ চুনাত্তর ব্যাপারে জমায়েত বসেছে বলে সে তাদের ডাকাডাকি করে নি।

    টিরকে আগেও বারকয়েক দোসাদটোলায় ধর্মাদের ঘরে এসেছে। তাকে ধর্মা এবং কুশীর মা-বাপেরা চেনে; যথেষ্ট খাতিরও করে। তারা জানে, টিরকের দৌলতে ধর্মা আর কুশী দু-চারটে বাড়তি পয়সা কামাই করতে পারে।

    টিরকেকে এত রাত্তিরে দেখে চার বুড়োবুড়ি কী করবে, ভেবে পায় না। ধর্মার মা দৌড়ে ঘরে ঢুকে ডিবিয়া এনে ধরিয়ে ফেলে, চুলহা আগুন দেয়। তারপর ঘর থেকে বাজরার আটা বার করে জল ঢেলে ছানতে ছানতে বলে, ‘লিটি বানাচ্ছি। রাত্তিরে খেয়ে যাবে।’

    টিরকে মাথা ঝাঁকিয়ে সমানে না না করতে থাকে। জানায় এত রাত্তিরে তার জন্য হুজ্জত করতে হবে না! পরে দিনের বেলা এসে একদিন পেট পুরে ভোজন করে যাবে। ধর্মার মা কিছুতেই শুনতে চায় না। অনেক বলে কয়ে শেষ পর্যন্ত তার লিট্টি বানানো বন্ধ করে টিরকে।

    ওদিকে কুশীর মা চা করে কলাই-করা গেলাসে বোঝাই করে এনে টিরকের সামনে রাখে। ধর্মাদেরও দেয়।

    চায়ে চুমুক দিতে দিতে ধর্মা শুধোয়, ‘এত রাত্তিরে কোত্থেকে এলে?’

    টিরকে জানায়, ‘সিধা রাঁচী থেকে।’

    ‘জরুরত কিছু আছে?’

    ‘হুঁ। না হলে এটা কি আসার সময়। বহোত আরজিন (আর্জেন্ট) কাম আছে তোর সাথ।

    ‘বল।’

    ‘আগে চা তো শেষ কর।’

    চা খেয়ে আচমকা উঠে পড়ে টিরকে। ধর্মাকে বলে, ‘আমার সাথ বাইরে চল—’

    দু’জনে দোসাদটোলার বাইরে কাঁকুরে জমিটায় চলে আসে। টিরকের চালচলন কথাবার্তা আজ কেমন যেন রহস্যজনক মনে হতে থাকে ধর্মার। এক ধরনের দুর্জ্ঞেয় কৌতূহলও সে বোধ করতে থাকে। আবছা অন্ধকারে টিরকের মুখের দিকে তাকিয়ে সে শুরু করে, ‘এবার বল—’

    টিরকে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বার করে একটা ধরিয়ে নেয়। ধর্মাকেও একটা দেয়। টিরকের জ্বলন্ত সিগারেট থেকে নিজেরটা ধরিয়ে নিয়ে গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে ধর্মা।

    টিরকে বলে, ‘কোটরার বাচ্চার কী হল?’

    ধর্মা বলে, ‘আর জঙ্গলে যাই নি। টেইন (টাইম) নায় মিলি।’ একটু থেমে ফের বলে, ‘তুমি তো এক মাহিনা টেইন দিয়ে গেলে সেদিন। তার ভেতর কোটরা ধরে আনব জরুর।’

    একটু চুপ করে থেকে টিরকে বলে, ‘গোলি মার দো কোটরাকা ছোয়াকো।’

    ‘মতলব!’ রীতিমত অবাক হয়ে যায় ধৰ্মা।

    গলা নামিয়ে টিরর্কে শুধোয়, ‘বহোত রুপাইয়া কামাই করতে চাস?’

    টাকা কামাতে কে আর না চায়? ধর্মা বলে, ‘চাই তো। লেকেন দ্যায় কে?’

    ‘আমি দেব।’

    ধর্মা মজাদার একটা ভঙ্গি করে হাত পাতে, ‘দাও’

    টিরকে বলে, ‘মাজাক না; কাজের কথা শোন। যে আমরিকী সাহাব কোটরার বাচ্চা চেয়েছিল সে আবার রাঁচী ফিরে এসেছে।’

    ধর্মা উত্তর না দিয়ে টিরকের মুখের দিকে তাকায়।

    টিরকে বলতে থাকে, ‘কাটরার বাচ্চা তার চাই না। সাহাবের শখ হয়েছে চিতার বাচ্চা পুষবে। একজোড়া ইণ্ডিয়ান চিতার বাচ্চা চাই তার। দেশে ফেরার সময় নিয়ে যাবে।’

    ধর্মা এবার বলে, ‘জঙ্গল থেকে জিন্দা চিতিয়ার বাচ্চা ধরে আনা বহোত খতরার কাজ।’

    টিরকে এবার ধর্মার লোভটা উসকে দেয়, ‘মেনি রুপীজ মিলেগা। তুই তো রঘুনাথ সিংয়ের ‘করজ’ শোধ করার জন্যে রুপাইয়া জমাচ্ছিস। এই টাকাটা পেলে ফ্রী ম্যান হয়ে যেতে পারবি।’ ধর্মা যে ভূমিদাস, বাপ-নানার করজের দায়ে সে যে রাজপুত ক্ষত্রিয় রঘুনাথ সিংয়ের ‘খরিদী’ হয়ে আছে, টিরকে তা ভাল করেই জানে।

    ধর্মার আচমকা মনে পড়ে যায়, স্বাধীন জীবন কেনার জন্য তাদের অনেক পয়সা দরকার। দু-আড়াই বছরে বগেড়ি টগেড়ি বেচে ছশো টাকার ওপর আর সামান্য কিছু তারা জমাতে পেরেছে। তাদের প্রয়োজন নগদ দুটি হাজার টাকার। এখনও কত জমাতে হবে সেই জটিল অঙ্কের হিসাব ধর্মারা জানে না। তবে মাস্টারজী জানিয়েছেন, এখনও প্রায় কিছুই জমেনি, ঋণশোধের জন্য আরো বহোত বহোত পয়সা চাই। টিরকে যে সুযোগ নিয়ে এসেছে তা ছাড়া ঠিক নয়।

    ধর্মা জিজ্ঞেস করে, ‘কিতনা রুপাইয়া দেওগে?’

    ‘বহোত—’ ধর্মাকে লুব্ধ করার একটা ভঙ্গি করে টিরকে, ‘ডোন্ট ওরি।’

    হরিণের বাচ্চা, মোষের শিং ইত্যাদি জুটিয়ে দেবার টাকা পয়সা বা দরদাম নিয়ে কোনদিন কথা বলে না ধর্মা কিন্তু আজ বলল, ‘বহোত তো ঠিক হ্যায়। লেকেন কেত্তে?’

    টিরকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুই কত চাস?’

    আর কত হলে দু হাজার পূর্ণ হয়, ধর্মার স্পষ্ট ধারণা নেই। খানিকক্ষণ ভেবে মনে মনে নিজের জ্ঞানবুদ্ধি অনুযায়ী হিসেবপত্তর কষে সে বলে, ‘দেড় হাজার।’

    ‘দেড় হাজার! থাউজেণ্ড অ্যাণ্ড ফাইভ হানড্রিড! নায়, নায়। বহোত জেয়াদা মাংতা হো ধম্মা ভেইয়া। হাই প্রাইস!’

    এর থেকে এক পাইসা ভি কমতি নেব না। চিতিয়ার বচ্চে আনতে গিয়ে আমার জান চলে যেতে পারে। কা, হামনিকা জানকা দাম দেড় হাজারসে কমী?’

    দামটা কমাবার জন্য অনেকক্ষণ টানা হ্যাঁচড়া করল টিরকে কিন্তু ধর্মাকে টলানো গেল না। সে দেড় হাজারেই অনড় হয়ে রইল। অগত্যা ঐ টাকাতেই রাজী হতে হল টিরকেকে। তাতে টিরকের অবশ্য লোকসান নেই। আমরিকী সাহেবের কাছে সে একজোড়া চিতার বাচ্চার দর হেঁকেছে আড়াই হাজার টাকা। তার মতলব ছিল, টিরকেকে আধাআধি ঠেকিয়ে বাকীটা নিজেই নিয়ে নেবে। কিন্তু এবার দোসাদদের এই নিরীহ মুখচোরা ছোকরাটা কেন যে বেঁকে বসল, কে জানে। যাক গে, একরকম ফোকটেই আড়াই হাজার থেকে এক হাজার তার পকেটে ঢুকে যাচ্ছে। রাঁচী থেকে বাসে বার দু-তিনেক গারুদিয়ায় ধর্মার কাছে ছোটাছুটি করেই যদি একরকম মুফতে অতগুলো টাকা এসে যায়, মন্দ কী। সে তো আর নিজে চিতার বাচ্চা ধরতে যাচ্ছে না। তার গায়ে একটা আঁচড়ও লাগছে না, অথচ টাকাটা দিব্যি এসে যাবে।

    টিরকে বলে, ‘ঠিক আছে, দেড় হাজারই পাবি। বাচ্চা দুটো কবে ‘ডিলভারি’ দিবি?’

    ‘ডিলভারি’ অর্থাৎ ডেলিভারি। টিরকের সঙ্গে কাজ-কারবার করতে করতে দু-চারটে আংরেজি শব্দ শিখে ফেলেছে ধর্মা। সে বলে, ‘থোড়েসে টেইন (টাইম) লাগবে। চিতিয়ার মুহ্ (মুখ) থেকে তার ছোঁয়া কেড়ে আনা তো সোজা না। মুহ্ থেকে কথা খসালেই ঐসা খতারনাক জানবরের বাচ্চা মেলে না।’

    টিরকে বলে, ‘আমরিকী সাহাব এখন পন্দর রোজ রাঁচী থাকবে। তারপর টু উইকের জন্যে কলকাতায় গিয়ে ফির রাঁচী লোটবে।’ মনে মনে হিসেব কষে বলল, ‘এক মাহিনার ভেতর বাচ্চাছটো দিতে পারবি?’

    ধর্মা একটু ভেবে বলল, ‘পারব।’

    টিরকে এবার পকেট থেকে এক গোছা টাকা বার করে তার ভেতর থেকে একশো টাকার একটা নোট ধর্মাকে দিতে দিতে বলে, ‘ইডভান্স (অ্যাডভান্স) রুপাইয়া দিয়ে গেলাম। তুরন্ত কামে লেগে যা।’

    আগে আর কখনও একসঙ্গে এতটাকা আগাম দেয় নি টিরকে। চিতার একজোড়া বাচ্চার ব্যাপারে তার গরজ কতখানি সেটা টের পায় ধৰ্মা।

    টিরকে ফের বলে, ‘বাত ফাইনিল (ফাইনাল) হয়ে গেল। আমি এখন যাই।’

    ধর্মা একশো টাকার নোটটা পাকিয়ে হাফ প্যান্টের কোমরের সেলাই খুলে পটির ভেতর পুরতে পুরতে ঘাড় কাত করে, ‘ঠিক হ্যায়।’

    .

    কালই সাবুই ঘাসের জঙ্গলে গিয়ে নোটটা পয়সার কৌটোর ভেতর রেখে আসবে সে।

    টিরকে আর দাঁড়ায় না। কাঁকুরে মাঠ পেরিয়ে দূরে হাইওয়ের দিকে চলে যায়।

    আর ধর্মা ভাবতে থাকে, দু-চার রোজের মধ্যেই চিতার বাচ্চার খোঁজে তাকে জঙ্গলে যেতে হবে। অন্যমনস্কর মতো দোসাদটোলার দিকে সে পা বাড়ায়।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleইতিহাসের গল্প – প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত
    Next Article পাগল মামার চার ছেলে – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }