Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আকাশের নিচে মানুষ – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প368 Mins Read0

    আকাশের নিচে মানুষ – ৩

    তিন

    খামার বাড়ি থেকে দেড়-দুই ফার্লং দূরে বড়ে সরকার রঘুনাথ সিং-এর প্রকাণ্ড কোঠি। পুরনো আমলের মোটা মোটা থামওলা বিশাল দোতলা বাড়িটা বানিয়েছিলেন রঘুনাথ সি-এর ঠাকুর্দা মেঘরাজ সিং। একতলা এবং দোতলা মিলিয়ে মোট শ দেড়েকের মতো বিরাট বিরাট ঘর। একেকটা দরজা আট ফুট উচু আর ছ ফুটের মতো চওড়া। জানলাগুলোতে খাঁজকাটা রঙিন কাচের শার্সি। ঘরের দেয়াল এবং ছাদে পঙ্খের কাজ আর প্রতিটি ঘরে ঝাড়লণ্ঠন। আগে ঝাড়লণ্ঠনের বাতিদানে মোম জ্বলত। রঘুনাথ সিং দশ মাইল দূরের সাব ডিভিসনাল টাউন থেকে নিজের পয়সায় শালকাঠের খুঁটি বসিয়ে বিজলী আনিয়েছেন। বাতিদানে এখন তাই নানা রঙের বাল্ব জ্বলে। প্রত্যেকটা দরজায় বড় বড় পেতলের গজাল বসানো! এগুলো বাহার খোলার জন্য।

    দোতলার খানকতক ঘর জুড়ে রয়েছে ছোটোখাটো একটা মিউজিয়ম। রঘুনাথ সিংয়ের বাবা বনরাজ সিংজী ছিলেন দুর্দান্ত সৌখিন মানুষ। দেশ-বিদেশের নানা দুষ্প্রাপ্য কিউরিও যোগাড় করে তিনি ঘরগুলো সাজিয়েছেন। তা ছাড়া শিকারেরও প্রচণ্ড শখ ছিল তাঁর। তিনটে ঘর ভর্তি রয়েছে বাঘ আর হরিণের ছাল, চিতার মুণ্ডু, পাইথনের চামড়া, হাতীর দাঁত ইত্যাদি ইত্যাদি। ঠাকুরদা মেঘরাজজীর ছিল গানবাজনার ঝোঁক। ইণ্ডিয়ার নানা জায়গা থেকে ধ্রুপদ খেয়াল আর গজল গাইয়েদের এবং সেতার সরোদ আর এস্রাজ বাজিয়েদের আনিয়ে গান-বাজনা শুনতেন, নিজেও চর্চা করতেন। তাঁর বাজনার হাত এবং গানের গলা ছিল বেশ রেওয়াজী। দুটো ঘর বোঝাই হয়ে রাজ্যের সরোদ সেতার হারমোনিয়াম তবলা ডুগি তাঁর গানবাজনার স্মৃতি ধরে রেখেছে। তবে এখন এই কোঠিতে এ সবের সমঝদার কেউ নেই। মাঝে মধ্যে নৌকরদের দিয়ে ঐ ঘর দুটো খুলিয়ে বাদ্যযন্ত্রগুলি ঝাড়ামোছা করানো হয়। হাজার হোক পিতৃপুরুষের স্মৃতি তো!

    বিরাট বাড়ির সামনের দিকে সুবিশাল কমপাউণ্ড। তার একধারে রয়েছে ঘোড়ার আস্তাবল। দামী দামী ডজনখানেক ওয়েলার ঘোড়া আছে রঘুনাথ সিংয়ের; আছে ঝকঝকে ফীটন অ’র মোটা মোটা থামে বাঁধা রয়েছে গোটা তিনেক হাতী। কখনও সখনও ইচ্ছা হলে বন্ধুবান্ধব নিয়ে হাতীতে চড়ে ছোটনাগপুরের জঙ্গলে চিত্রা হরিণ কি পাখি শিকার করতে যান।

    তবে মোটরের ব্যাপারে বিশেষ শখ নেই রঘুনাথ সিংয়ের। আজকাল কত রকমের ঝকঝকে নতুন ডিজাইনের মোটর বেরিয়েছে,  কখনও সখনও যখন তিনি পাটনা বা কলকাতায় যান, সে সব চোখে পড়ে ইচ্ছা করলে ঐ রকম দু-চারটে গাড়ি তিনি যখন তখন কিনে ফেলতে পারেন কিন্তু ইচ্ছা হয় না। পুরনো মডেলের বড় বড় চাকাওলা আর কাপড়ের হুড-লাগানো মোটর নিয়েই তিনি খুশী। মোট কথা সাবেক আমলের খানদানী চালের দিকেই তাঁর ঝোঁক।

    .

    হিন্দু কোড বিল পাশ হবার আগেই দুটো বিয়ে চুকিয়ে ফেলেছিলেন রঘুনাথ সিং। অবশ্য যে ভারতবর্ষে হিন্দু কোড বিল চালু আছে তার সীমানার বাইরে রঘুনাথ সিংয়ের এই গারুদিয়া তালুক। এখানে তাঁর নিজস্ব আরেক ভারতবর্ষ। ইণ্ডিয়ান পার্লামেন্ট যত আইনকানুনই পাশ করুক, দিল্লী থেকে দু-আড়াই হাজার কিলোমিটার পার হয়ে তার খুব সামান্যই এখানে এসে পৌঁছতে পারে। নিজের ইচ্ছামত কিছু আইনকানুন তৈরি করে পুরনো ফিউডাল সিস্টেমটাকে প্রায় পুরোপুরিই বজায় রেখেছেন রঘুনাথ। ইচ্ছা করলে একটা কেন, কয়েক ডজন বিয়ে করলেই বা তাঁকে ঠেকাচ্ছে কে!

    তাঁর এক স্ত্রী স্বজাত রাজপুত ক্ষত্রিয়ের ঘর থেকেই এসেছিল, আরেক জন এসেছে কায়াথদের ঘর থেকে। মহিলাটি ছিল মহকুমা হাসপাতালের নার্স। রাস্তায় তাকে দেখে মজে গিয়েছিলেন রঘুনাথ সিং। রাত্তিরে লোক পাঠিয়ে তার মুখে কাপড় গুজে নার্সের কোয়ার্টার্স থেকে তুলে এনেছিলেন। তবে রঘুনাথ সিংয়ের নাম তাঁদের কৌলিক ইতিহাসে সোনার হরফে লেখা থাকবে এই জন্য যে, নার্স মেয়েমানুষটির শাঁসটুকু খেয়ে ছিবড়ে করে ফেলে দেন নি। সেই রাতেই মৈথিলী পুরুত ডেকে রীতিমত বৈদিক মতে হোম-যজ্ঞটজ্ঞ করে বিয়ে করেছিলেন। এই নিয়ে প্রথম স্ত্রী খুব গণ্ডগোল করেছিল। হাজার হোক রাজপুত ক্ষত্রিয়ের ঘরের মেয়ে, কয়েক শো বছর আগের একটা তেজী ঐতিহাসিক ব্যাকগ্রাউণ্ড তো রয়েছে।

    কিন্তু রঘুনাথ সিং মারদেকা বাচ্চা। বলা যায় শেরের বাচ্চাও। গণ্ডগোলে দু-দিনেই থামিয়ে দিয়েছিলেন। তবে রাজপুতের মেয়ে আর কায়াথের মেয়েতে বনিবনা হয়নি। পারতপক্ষে কেউ কারো মুখ দেখতে চায় না। একই কোঠির পিজরাতে দুই জেনানাকে দুই মহল্লায় রেখেছেন রঘুনাথ সিং। তিরিশ-বত্রিশ সাল পাশাপাশি থেকেও দুই সতীনের কথাবার্তা নেই। তাদের মধ্যে আমৃত্যু শত্রুতা এবং যুদ্ধ।

    সতীনরা এ রকম হয়েই থাকে। কাজেই এ বাপারে মাথা ঢোকান না রঘুনাথ। কে কী করছে, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র পরোয়া নেই তার।

    দুই স্ত্রীর সাতটি করে মোট চোদ্দটি ছেলেমেয়ে, এ ব্যাপারে রঘুনাথ সিংয়ের এতটুকু পক্ষপাতিত্ব নেই। দু’জনকেই নিরপেক্ষভাবে সমান সমান সন্তান উপহার দিয়েছেন। অন্য দিক থেকেও তিনি খুব বিবেচক। মাসের শুক্লপক্ষ এক স্ত্রীর কাছে কাটান, কৃষ্ণপক্ষ আরেক স্ত্রীর কছে।

    কায়াথনী আর রাজপুতানীর মুখ দেখাদেখি বন্ধ, কথাবার্তা বন্ধ, দুই সতীনের দুই মহলের মাঝখানে অদৃশ্য কাচের বাউন্ডারি ওয়াল। তা হলে কী হবে, চোদ্দটি সওতেলা ভাইবোনের মধ্যে মায়েদের মতো ঝগড়াঝাটি নেই। তারা মাঝখানের বউণ্ডারি ভেঙে দু-ধারেই যাওয়া-আসা করে।

    যাই হোক, পুরনো ফিউডাল জমানাই এ বাড়ির আবহাওয়ায় অনড় হয়ে আছে।

    ধর্মারা বড়ে সরকার রঘুনাথ সিংয়ের কোঠিতে এসে দেখল, এই জষ্ঠি মাসে দশেরা কি রামনবমীর মতো পরব শুরু হয়ে গেছে। সামনের কমপাউণ্ডে অনেক গুলো ফ্লাড লাইট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে! আলোর তেজ এত বেশি যে মাটিতে সুই পড়লে তুলে নেওয়া যাবে।

    কমপাউণ্ডের মাঝখানে সিংহাসনের মত প্রকাণ্ড হাতল-ওলা সোফায় বসে আছেন রঘুনাথ সিং। লোকটার গায়ে প্রচুর চর্বি। গোল চাকার মতো মুখ, প্রকাণ্ড কাঁধ, টেরি-কাটা বাবরি চুল, লম্বা টান টান নাক, ঘন ভুরুর তলায় ছোট ছোট চোখ গাল, নিখুঁত কামানো, তবে একজোড়া মোমেমাজা ছুঁচলো গোঁফ রয়েছে।

    রঘুনাথের পরনে চুস্ত আর ফিনফিনে কালিদার পাঞ্জাবি। গলায় সোনার সরু চেন হার। পাতলা পাঞ্জাবির তলায় সোনার চওড়া বিছে লাগানো বড় তাবিজ দেখা যাচ্ছে। পায়ে নকশা-করা নাগরা।

    এই মুহূর্তে বড়ে সরকার রঘুনাথ সিংয়ের গলার সোনার হারের ওপর গোছা গোছা ফুলের মালা ঝুলছে। কপাল, মাথা এক গালগলা আর চুস্ত পাঞ্জাবি গুলালে মাখামাখি।

    তাঁকে ঘিরে এখন গারুদিয়া তালুকের প্রচুর মানুষজন মহকুমা শহরের বড় ভকিল গিরধরলালজী, বঙ্গালী ডাগদর শ্যামলাল সেন, হেড মাস্টারজি বদ্রীবিশাল চৌবে—এমনি আরো অনেকে। এঁরা সবাই রঘুনাথ সিংয়ের বন্ধুবান্ধব, দিলের দোস্ত। নামেই দোস্ত। তবে এ অঞ্চলের প্রতিটি মানুষ, গাঁওবদলা ক্ষেতমজুর থেকে মহুকুমা শহরের সরকারী সেরেস্তার ছোট কেরাণীবাবুটি পর্যন্ত সবাই জানে ঐ মাস্টেরজী ভকিলজী কি ডাগদরসাবরা রঘুনাথ সিংয়ের পা-চাটা কুত্তা। নানাভাবে বড়ে সরকার নানা রকম কুকুর পুষে আসছেন। কেউ এক নম্বর কুত্তা, কেউ দু নম্বর কুত্তা, কেউ তিন নম্বর কুত্তা। চারদিকের হারামজাদা মানুষজন রঘুনাথ সিংয়ের বন্ধুবান্ধবের গায়ে এইভাবে নম্বর মেরে দিয়েছে। বড় সরকারের পা যে বেশি চাটতে পারে তার নম্বর আগের দিকে! যে তুলনায় কম চাটতে পারে তার নম্বর পেছন দিকে।

    রঘুনাথ সিংয়ের চারপাশে তাঁর বন্ধুরা বলাবলি করছিলেন, ‘ক্যা! খুশ খবর, সিংজী এম-এল-এ বনেগা।

    ‘বাহোত আনন্দকা দিন।’

    ‘পুরা দোনো তালুক বিজুরি ঔর গারুদিয়াকে। ছে সাত লাখো অ্যাদমীকা ক্যা সৌভাগ—’

    ‘ভগোয়ান রামজীকো কিরপা, সিংজী ইহাকা এম-এল-এ বননে রাজী হুয়া—’

    চারদিকে এত কথা হচ্ছে, কিন্তু রঘুনাথ সিং একেবারে চুপচাপ। সারা মুখে তৃপ্তি এবং নকল বিনয়ের একটি হাসি ফুটিয়ে অনুগত কুকুরদের তোষামোদের কথাগুলো উপভোগ করছিলেন।

    এদিকে এক নম্বর কুত্তা মুনশী আজীবচাঁদ গোটা মাথায় আর পোশাকটোশাকে গুলাল মেখে কাঁধে একটা পেল্লায় লাড্ডুর ঝোড়া চাপিয়ে ছোটাছুটি করছে আর সবাইকে লাড্ডু বিলোতে বিলোতে গলার শিরা ছিড়ে ছিঁড়ে চিৎকার করে চলেছে, ‘মেরে সরকার এম্লে বনে। হো রামজী, তেরে মায়া। লীজিয়ে ডাগদরসাব, লীজিয়ে ভকিল সাব, লীজিয়ে মাস্টার সাব—মুহু্, মিঠা কীজিয়ে। মেরে সরকার এম্লে বনে। ভেইয়া রামনৌশেরা, ভেইয়া ছেলিালজী, ভেইয়া মধুকরজী মিঠাইয়া পাকড়ে—’

    আজীবচাঁদ যেন একেবারে ক্ষেপে গেছে। রঘুনাথ সিং রাজধানী পাটনা থেকে আজ এম-এল-এ হবার টিকিট পেয়েছেন। সেই উপলক্ষে গুলাল মাখামাখি এবং লাড্ডু বিলি হচ্ছে। বড়ে সরকারের এই কোঠিতে কম করে তিরিশ-চল্লিশটা নোকর রয়েছে। তাদের কারো ঘাড়ে লাড্ডুর ঝোড় চাপিয়ে বিলি করানো যেত। কিন্তু আজীবচাঁদ কাউকে সে দায়িত্ব দিতে নারাজ।

    এ সব পরবের মতো ব্যাপার যেখানে চলছে সেখান থেকে কম করে একশো গজ দূরে এই মুহূর্তে দাড়িয়ে আছে ধর্মারা। সাহস করে কেউ আর এগুতে পারছিল না!

    ধর্মার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল কুঁদরী। সে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ক্যা, জেঠ মাহিনামে ফাগোয়া আ গৈল? কায় আবীর, কায় গুলাল—’

    ধর্মা জানালো, হোলি না। বড়ে সরকারের ভোটে নামার ব্যবস্থা পাকা হয়েছে। তাই খুশিতে গুলাল মাখা, মিঠাই খাওয়া চলছে।

    বুধেরি ওধার থেকে বলে উঠল, ‘ইসকা বীচমে হামনিকো (আমাদের) কায় বুলায়া?’

    ‘ক্যা জানে।’

    রাত হয়ে যাচ্ছে, কুশীটা সাবুই ঘাসের জঙ্গলে নিশ্চয়ই ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। তা ছাড়া, অন্য একটা কারণে ধর্মার ভয় এবং দুশ্চিন্তা দুই-ই হতে থাকে। সন্ধ্যের পর অন্ধকার নামলে দক্ষিণ কোয়েলের ওদিকটায় কৈয়ারা হানা দেয়। কৈয়া বড়ই খতারনাক জানোয়ার। বাদামী রঙের এই জন্তুগুলো যেমন ভয়ঙ্কর তেমনি হিংস্র। বেকায়দায় পেলে মানুষ তো ছার, বাঘকেই কাবু করে ফেলে। ধর্মা খুবই অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে লাগল। কিন্তু এ অবস্থায় চলেও যাওয়া যায় না। বড়ে সরকারের কোঠি থেকে কখন যে ছাড়া পাওয়া যাবে তা-ই বা কে জানে।

    আরো খানিকক্ষণ পর হঠাৎ রঘুনাথ সিংয়ের নজর এসে পড়ল ধর্মাদের ওপর। কয়েক পলক তাকিয়ে থাকার পর গলায় অজস্র স্নেহ ঢেলে তিনি হাত নেড়ে নেড়ে ডাকতে লাগলেন, ‘কি রে তোরা অতদূরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’

    বড়ে সরকার যে এভাবে কোনদিন কথা বলতে পারেন, ধর্মাদের চোদ্দপুরুষে কেউ কোনদিন ভাবতে পারেি বিহ্বলের মতো তাকিয়ে তাকিয়ে তারা শুধু বলতে পারল, ‘জী সরকার—’

    ‘কাছে আয়।’

    যে মালিক আবহমান কাল নাগরা দিয়ে তাদের পিঠে স্থায়ী নকশা এঁকে দিয়েছেন, পোষা পহলবান লাগিয়ে তাদের ঠেঙিয়েছেন, ঘরের চালে আগুন লাগিয়েছেন, তাঁর এত কোমল কণ্ঠস্বর বড়ই তাজ্জব কা বাত। নিজেদের ইচ্ছায় নয়, একটা ঘোরের মধ্যে তারা সামনে এগিয়ে এল।’

    বড়ে সরকার এবার সবাইকে দেখতে দেখতে বলতে লাগলেন, ‘কেমন আছিস রে বুধেরি? তুই ঢোড়াইলাল? তুই কুঁদরি? তুই রামনেহাল?’ জনে জনে সবাইকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন তিনি। প্রতিটি মানুষের নাম জানেন রঘুনাথ সিং। শুধু নামই না, কার সঙ্গে কার কী সম্পর্ক, কার ক’টা ছেলেমেয়ে এবং তাদের নামধাম—সব তাঁর মুখস্থ।

    ‘জী, আচ্ছা—’ উত্তর দিতে গিয়ে বুধেরিদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে।

    ‘বালবাচ্চা কেমন আছে?’

    ‘জী আপহিকো কিরপা। আচ্ছাই ছায়।’

    ‘এ্যাই গণেরি, গেল সাল তোর বউর পেটে না জল জমেছিল?’

    ‘জী সরকার। অসপাতাল (হাসপাতাল) ভেজাওল।’

    ‘এখন কেমন আছে সে?

    ‘ভালাই তো গৈল। আভিতক আচ্ছাই হ্যায় মালিক।’

    ‘গিধনী তোর খবর কী?’

    গিধনী নামের যুবতী বিধবা মেয়েটি চোখ নামিয়ে বলল, ‘মালিক দেওতা, আপহিকো ক্ষেতির কাম করে যাচ্ছি।’

    রঘুনাথ সিং বললেন, ‘ক্ষেতির কাম তো পুরা জীবন আছেই। বাপ-মা নেই, মরদ নেই, জোয়ানী লড়কী আপনা জাতের মধ্যে একটা ছোকরা দেখে সাদি করে ফেল। আমি তোর সাদির খরচা দিয়ে দেব।

    ওপাশ থেকে মুনশী আজীবচাঁদ লাড্ডু বিলি কিছুক্ষণের জন্য স্থগিত রেখে ডুকরে ওঠার মতো শব্দ করল। ‘হোয় হায়, ক্যা দিল মেরে বড়ে সরকারকো। বেওয়া রাঁড়কো সাদির পুরা খরচা দিতে চাইছেন। সরকার এম্লে বনে তো জারুর রামরাজ হো যায়েগ—’ বলেই আবার লাড্ডু বিতরণ শুরু করল।

    এদিকে গিধনী থেকে আরম্ভ করে তাবত দলটা একেবারে হকচকিয়ে গেছে। বলছেন কী রঘুনাথ সিং! তারা কি সঠিক শুনছে! দুনিয়া কি হঠাৎ একেবারে ওলট-পালট হয়ে গেল!

    এই লোকগুলোর মনোভাব যেন খানিকটা আন্দাজ করতে পারলেন রঘুনাথ সিং। গলাটা আরো কোমল করে বললেন, ‘আরে বাবা, হামনি তোহারকা আপনা আদমী—তোদের আপনজন। আমার কাছে তোরা থাকিস, আমার ক্ষেতিতে কামকাজ করিস। তোদের ভালাইতে তাদের বুরাইতে আমি পাশে থাকব না তো কে থাকবে?’

    আজ কি ধর্মাদের শুধুই তাবাক হবার গো! একের পর এক কী বলে যাচ্ছেন রঘুনাথ সিং! তিনি তাদের খুদ আপনা আদমী—এমন কথা কি তারা কোনদিন স্বপ্নেও চিন্তা করেছে? মুনশী আজীবচাঁদ যে খানিক আগে রামরাজের কথা বলছিল—সত্যি সত্যিই কি তা এসে গেল! হো রামজী, তেরে কিরপা।

    রঘুনাথ সিং ফের বললেন, ‘এ গিধনীয়া একটা ভালো লেড়কা পসন্দ করে ফেল। আগলে মাহিনায় ভোট ভাটের পর তোর সাদি দিয়ে দেব।

    গিধনী আরক্ত লাজুক মুখ নামিয়ে নখ খুঁটতে লাগল। বাপ নেই, মা নেই—কেউ নেই তার। এই ভরা যৌবনে একটা সঙ্গীর বড় দরকার। নতুন করে সাদির স্বপ্ন এখনও দেখে সে। এই মুহূর্তে রঘুনাথ সিংয়ের কথা শুনতে শুনতে তার বুকের ভেতরটা বর্ষার কোয়েল হয়ে উঠল। নিজের মধ্যে উথালপাথাল তুফানের শব্দ শুনতে লাগল সে।

    এবার রঘুনাথ সিং ধর্মার দিকে তাকালেন, ‘তোর হালচাল কী রে ধর্মা?’

    ধর্মা জানালো, বড়ে সরকারের কিরপায় দিন কেটে যাচ্ছে।

    ‘তোর মা-বাপ ভালো আছে?

    ‘জী সরকার।’

    এদিক সেদিক লক্ষা করতে করতে রঘুনাথ সিং বললেন, ‘কুশীটাকে দেখতে পাচ্ছি না। ছোকরিটা তো তোর গায়ে সব সময় পরছাঁইয়ের মতো লেগে থাকে।’

    ধর্মা বলল, ‘ক্ষেতির কাম পুরা করে ও চলে গেছে।’

    রঘুনাথ সিং ধর্মা আর কুশীর সম্পর্কটা খুব ভালো করেই জানেন। বললেন, ‘কতদিন আর দু’জনে চরকির মতো ঘুরবি। এবার সাদিটা করে ফেল।’

    গিধনীর মতোই লজ্জা পেয়ে মুখ নীচু করে রইল ধর্মা!

    রঘুনাথ আর কিছু না বলে ঘাড় ফিরিয়ে আজীবচাঁদকে ডাকলেন, ‘মুনশী, এদের মিঠাইয়া দাও—’

    ‘জী সরকার। তুরন্ত লাতে হ্যায়।’ আজীবচাঁদ এবার থেকে চেঁচিয়ে উঠল।

    চোখের পলক পড়তে না পড়তেই দেখা গেল মুনশী আজীব চাঁদ প্রকাণ্ড লাড্ডুর একটা ঝোড়া নৌকরের ঘাড়ে চাপিয়ে নিয়ে আসছে অন্য সবাইকে নিজের হাতে মিঠাই বিলি করলেও অচ্ছুৎ ভূমিদাসদের সে নৌকর দিয়েই দেওয়াবে। উঁচু বর্ণের মানুষ আজীবচাঁদ এই সন্ধ্যেবেলায় জল-অচল বেগার-খাটিয়েদের ছুঁয়ে চোদ্দ-পুরুষকে নরকে পাঠাতে পারে না।

    আজীবচাঁদ যখন কাছাকাছি এসে পড়েছে সেই সময় একটা তাজ্জব কাণ্ড ঘটে গেল। রঘুনাথ সিং বললেন, ‘মিঠাইয়ার ঝোড় আমার কাছে আনো। নিজের হাতে আমি ওদের দেব।’

    ধর্মারা আবার কী শুনছে! সরকার মালিক নিজের হাতে তাদের মতো জল-অচল, অচ্ছুৎদের মিঠাইয়া বেঁটে দেবেন! হে ভগোয়ান, হো পবনসুত, দুনিয়ায় কি সত্যি সত্যি স্বরগ নেমে এল! সবাই যে বলাবলি করছে. রঘুনাথ সিং এম্লে বনলে রামরাজ নেমে আসবে সেটা এখন আর মিথ্যে মনে হচ্ছে না। অবশ্য রামরাজ ব্যাপারাটা যে কী সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোন ধারণা নেই ধর্মাদের। ভাসাভাসা ভাবে তারা জানে রামরাজ কায়েম হলে তাদের এত দুঃখ এত কষ্ট থাকবেনা, মোটামুটি সুখেই তারা থাকতে পারবে।

    এদিকে রঘুনাথ সিং নিজের হাতে লাড্ডু বিলি করতে শুরু করেছেন। মাথা পিছু দুটো করে খাঁটি ভয়সা ঘিয়ে ভাজা দামী সুস্বাদু মিঠাই সবার হাতে নিতে লাগলেন। যাদের বাড়িতে বুড়োবুড়ি বা কাচ্চাবাচ্চা রয়েছে, হিসেব করে তাদের ভাগেরটাও গুনে গুনে দিলেন।

    মুনশী আজীবচাঁদ যে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। দুই হাত কচলাতে কচলাতে শরীরটা নানাভাবে বাঁকিয়ে চুরিয়ে গদগদ ভঙ্গিতে সমানে বলে যাচ্ছিল, ‘বড়ে সরকার মালিক আপনা হাতে অচ্ছুৎদের মিঠাইয়া দিচ্ছেন! রামরাজ আ গৈল রে, জরুর আগৈল।’

    সবাইকে মিঠাই দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত ধর্মার পালা এল। রঘুনাথ সিং বললেন, ‘এই নে–তোর মা-বাপের চরগো আর তোর দোগো—ছে’গো।’

    ছ’টা লাড্ডু, বেঁধে নিয়ে ধর্মা যখন কুশীর কথা ভাবছে সেই সময় রঘুনাথ সিং বললেন, ‘তুই কিরকম জোয়ান রে?’

    ধর্মা হকচকিয়ে গেল, ‘জী—’

    ‘আরে বুদ্ধু, স্রিফ নিজেই মিঠাইয়া খাবি। তোর দুলহানিয়ার জন্যে নিয়ে যাবি না?’

    রঘুনাথ সিংয়ের বিবেচনার বহর দেখে একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল ধর্মা। কুশীর কথাটা তিনি ভোলেন নি। মনে মনে ধর্মা ঠিক করেই রেখেছিল নিজের ভাগ থেকে একটা লাড্ডু কুশীকে দেবে! বাপ-মায়ের ভাগ থেকে দেওয়া যাবে না। কেননা যখন তারা মহল্লার অন্য সবার মুখে শুনবে বড়ে সরকার মাথাপিছু দুটো করে লাড্ডু দিয়েছেন আর যখন দেখবে তাদের ভাগে দুটোর কম পড়েছে তখন চিল্লিয়ে সাতপাড়া মাথায় তুলে ফেলবে। বড়ে সরকার দেওতা, ভাগোয়ান—তিনি যে কুশীকে ভোলেন নি সে জন্য মনে মনে ধর্মা আরো চোদ্দ জন্ম তাঁর বাঁধা নৌকর হয়ে রইল।

    রঘুনাথ সিং আবার বললেন, ‘এই নে কুশীর দোগো, আর তার মা-বাপের চারগো—পুরা আধা ডজন।’ বলে একটু মজা করলেন, ‘দেখিস, দুলহানিয়ারটা আবার নিজেই খেয়ে ফেলিস না।’

    কৃতজ্ঞ ধর্মা বলল, ‘নায় সরকার—’

    মিঠাই বিতরণ হয়ে গেলে রঘুনাথ সিং বললেন, ‘যা, এবার ঘরে যা। পুরা রোজ ক্ষেতিতে কার্মকাজ করেছিস। আর তোদের আটকে রাখব না। ঘরে গিয়ে আরাম কর।’

    ধর্মারা মাথা ঝুকিয়ে বড়ে সরকারকে সসম্ভ্রমে নমস্কার করে ফিরে চলল।

    রঘুনাথ সিংয়ের কোঠি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় আসতেই ধর্মারা দেখতে পেল, অনেক লোকজন এদিকে আসছে। সবই চেনা মুখ। গারুদিয়া তালুকের নানা গাঁও-এর মানুষ। বাজার-গঞ্জ আর দশ মাইল দূরের ছোট মহকুমা শহরের কিছু লোকও রয়েছে তাদের মধ্যে।

    কাছাকাছি আসতেই লোকগুলো খুব আগ্রহের গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘ক্যা, বড়ে সরকার এম্লে বন গৈল?’

    গণেরি বলল, ‘নহী। ভোটকা বাদ বনেগা জরুর।’

    ‘শুনা গাঁওবালা সব কোইকো মিঠাইয়া দেগা বড়ে সরকার—’

    ‘কিধর শুনা?’

    ‘মুনশীজী আদমী ভেজল, উ আদমী কহল। সচ্?’

    বোঝা গেল, রঘুনাথ সিংয়ের ভোটে দাড়ানো উপলক্ষে মুনশী আজীবচাঁদ গাঁয়ে-গঞ্জে আর মহকুমা শহরে লোক পাঠিয়ে লাড্ডু খাবার নেমন্তন্ন করেছে। গণেরি ঘাড় কাত করে বলল, ‘হাঁ, সচ্—’

    লোকগুলোর চোখ চকচকিয়ে উঠল, ‘ক্যা মিঠাইয়া?’

    ‘লাড্ডু।’

    ‘হর আদমীকো ক’গো মিলল?’

    ‘দোগো।’

    লোকগুলো আর দাঁড়ালো না। ঊর্ধ্বশ্বাসে রঘুনাথ সিংয়ের বড় মকানের দিকে দৌড় লাগাল। লাড্ডু ফুরিয়ে যাবার আগেই তাদের সেখানে পৌঁছনো দরকার।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleইতিহাসের গল্প – প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত
    Next Article পাগল মামার চার ছেলে – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }