Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আকাশের নিচে মানুষ – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প368 Mins Read0

    আকাশের নিচে মানুষ – ৩১

    একত্রিশ

    নির্বাচনের আর মাত্র চারটে দিন বাকী। গারুদিয়া এবং বিজুরি তালুকের তিরিশ বত্রিশটা গাঁ তিন চুনাওপ্রার্থীর ফেস্টুনে পোস্টারে সেজে উঠেছে। লাল শালুতে নিজের নিজের প্রতীক চিহ্ন আঁকিয়ে সুখন রবিদাস, প্রতিভা সহায় এবং রঘুনাথ সিং চারদিকে টাঙিয়ে দিয়েছেন। এমন কি হাইওয়ের পরাস বা কড়াইয়া গাছগুলোও রেহাই পায় নি; আঠা দিয়ে সেগুলোর গায়েও পোস্টার সেঁটে দেওয়া হয়েছে। মোট কথা, চুনাওর ব্যাপারটা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে।

    .

    আজ এখনও ভালো করে ভোর হয়নি। আকাশে আবছা আবছা আলোর ছোপ ধরেছে মাত্র। এরই মধ্যে কিন্তু দোসাদটোলাটা জেগে উঠেছে। খানিকটা মাড়োয়া সেদ্ধ বা মাড়ভাত্তা কিম্বা মকাই ভাজা খেয়ে এখনই তাদের ছুটতে হবে খামারবাড়িতে, সেখান থেকে ক্ষেতিতে।

    হঠাৎ আধবুড়ো গণেরি সামনের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠিল, ‘হো রামজী আজ কা হৈল? কা হৈল আজ? আঁখ সচমুচ দেখতা হ্যায় তো?’

    গণেরির চারপাশে যারা ছিল তারা সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কী হল, অ্যা কী হল?’

    ‘ওহী দেখ—’ গণেরি রাস্তার দিকে আঙুল বাড়িয়ে দেয়।

    সবাই সেদিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। খানিকক্ষণ কারো গলা দিয়ে একটু আওয়াজও বেরুল না। আকাশ থেকে চাঁদ সূরয নেমে এলেও কেউ এতটা অবাক হত না। স্বয়ং বড়ে সরকার রঘুনাথ সিং পায়ে হেঁটে তাদের মতো এই অচ্ছুৎ দুসাদদের মহল্লায় আসছেন। এই নিয়ে দু’বার তিনি এখানে এলেন। রঘুনাথ সিং তাঁর পঞ্চান্ন বছরের জীবনে একবারও এ তল্লাট মাড়াননি। এই চুনাওর সময়ে পনের দিনের মধ্যে দু-দু’বার এলেন। ভোটের জন্য তাঁর হয়ে যারা খাটছে তারা তো সঙ্গে রয়েছেই। তা ছাড়াও রয়েছে তাঁর একান্ত বশংবদ কুত্তার দল। হিমগিরিনন্দন, আজীবচাঁদ, রামলছমন—এমনি অনেকে।

    ধর্মাদের চোদ্দ পুরুষে কখনও যা ঘটে নি, এখন তা বার বার ঘটছে। সূরয কি আজকাল পছিমা আকাশে উঠতে শুরু করেছে! বড়ে সরকার, ভূমিদাস অচ্ছুৎদের পাড়ায় আজ রাত পোহাতে না পোহাতে আসবেন, বহুদর্শী গণেরিও তা ভাবতে পারে নি।

    কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে থাকার পর গোটা দোসাদটোলাটা প্রায় একই সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, ‘বড়ে সরকার আ গৈল—’

    যারা ঘরের ভেতর ছিল তারাও দৌড়ে বেরিয়ে আসে; তারপর রঘুনাথ সিংয়ের জন্য কে যে কী করবে, কোথায় বসাবে ঠিক করে উঠতে পারে না। বড়ে সরকারের পা রাখার জন্য তারা বুক পর্যন্ত পেতে দিতে পারে। যদিও নিজের হাতে তাঁর লাড্ডু বিলি করার একটা দৃষ্টান্ত আছে তবু এই ভোরবেলা তাদের মতো অচ্ছুৎদের ছু’লে যদি সরকারের পাপ লাগে তাই ভরসা করে সেটা আর ওরা পেরে ওঠে না।

    এর মধ্যে গিধনী সাহস করে তার ঘর থেকে একটা হাতলভাঙা পুরনো চেয়ার বার করে এনে পেতে দিয়েছে। এই ভূমিদাসদের মহল্লায় এই একখানা আস্ত চেয়ারই রয়েছে। এর চাইতে ব্যক্তিগত দামী সম্পত্তি আর কারো নেই।

    যদিও আগে রঘুনাথ সিং নিজেকে তাদের আপনজন বলে বার কয়েক ঘোষণা করেছেন তবু সবাই ভয়ে ভয়ে হাত জোড় করে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের ধারণা ছিল, বড়ে সরকার গিধনীর চেয়ারটা পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে ছুঁয়েও দেখবেন না। কিন্তু সবাইকে একেবারে তাজ্জব বানিয়ে তিনি চেয়ারটায় বসেই পড়েন। হাসি হাসি মুখ করে বলেন, ‘অনেকদিন ভেবেছি, তোদের কাছে মাঝে মাঝে আসব, গল্প করব। আমি তো তোদেরই লোক। লেকেন নানা ঝামেলায় আসতে পারি না।’

    ধর্মারা কি কথাগুলো ঠিক শুনছে? তারা কেউ কিছু বলে না। হাতজোড় করে আগের মতোই দাঁড়িয়ে থাকে।

    রঘুনাথ সিং এবার জনে জনে ডেকে কে কেমন আছে, কার কী সুবিধা-অসুবিধা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। সবার খবর নেবার পর বললেন, ‘এবার তোদের একটা ভাল খবর দিচ্ছি।’

    ধর্মারা আধফোটা গলায় বলে, ‘হুজৌর—’

    রঘুনাথ সিং বলতে লাগলেন, ‘আজ থেকে তিন রোজ তোদের কাম করতে হবে না। শ্রিফ খাও, পীও আউর আরাম কর। চাওর (চাল), গেঁহু, ঘিউ, মিরচি, আলু—সব কিছু আমার লোক দিয়ে যাবে। বহোত রোজ তোরা আমার ক্ষেতিতে কাম করছিস। এই তিন রোজ তোদের বিলকুল আরাম আউর আরাম।

    বলছেন কী রঘুনাথ সিং? তিনি যা বলছেন তা বুঝ-সমঝ করে বলছেন? না কি তারাই ভুলটুল শুনছে?

    এদিকে রঘুনাথ সিংয়ের এক নম্বর পা-চাটা কুত্তা আজীবচাঁদ আচমকা যেন ক্ষেপে ওঠে, ‘হোয় হোয় হোয়, এ্যায়সা বাত কো-ই কভি নায় শুনা! রামচন্দজী খুদ স্বরগসে উতারকে আয়ে রে। হোয়—হোয়—হোয়—’

    হাতের ইসারায় আজীবচাঁদকে থামিয়ে দিয়ে রঘুনাথ সিং আবার বলেন, ‘কাল থেকে তিন রাত আমার কোঠির সামনে নৌটঙ্কীর আসর বসবে। পুরা রাত ধরে চলবে। তোরা সবাই যাবি কিন্তু—’

    পুরো তিনদিন কাজ করতে হবে না অথচ ভালো ভালো খাদ্যবস্তু আসবে বড়ে সরকারের খামার থেকে। শুধু তাই না, তিন রাত তাদের নৌটঙ্কীও দেখানো হবে। চোদ্দ পুরুষে এমন ঘটনা গারুদিয়া তালুকের দোসাদদের জীবনে আর কখনও ঘটে নি।

    আজীবচাঁদ ফের চিৎকার করে, ‘হোয় হোয় হোয়, রামরাজ জরুর আ যায়গা, জরুর আ যায়গা—’

    রঘুনাথ সিং আর বসলেন না। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, ‘তা হলে আজ আমরা যাই। তোরা নৌটঙ্কীতে যাস কিন্তু—’

    তাঁর সঙ্গের সেই চুনাওকর্মী ছোকরারা চেঁচিয়ে উঠল:

    ‘রঘুনাথ সিং—’

    ‘অমর রহে—

    ‘রঘুনাথ সিং—’

    ‘অমর রহে—’

    ‘রঘুনাথ সিংকো—’

    ‘বোট দো—’

    ‘রঘুনাথ সিংকো—’

    ‘বোট দো—’

    .

    চিৎকারটা থামলে রঘুনাথ সিং ধর্মাদের বলেন, ‘তোরা তো সবাই জানিস, আমি এবার ভোটে নেমেছি।’

    ধর্মারা ঘাড় কাত করে দেয়, ‘জী বড়ে সরকার। এই জন্যে তো সেদিন আমরা লাড্ডুয়া খেলাম।’

    ‘আমি তোদের লোক, তোদের আপনা আদমী। ভোটের কাগজে হাতী-মার্কায় মোহর মারবি। তা হলে আমি ভোট পাব। হাতী মনে রাখবি।’

    ‘জী সরকার—’ সবাই আবার ঘাড় কাত করে।

    আজীবচাঁদ ঘুরে ঘুরে চিৎকার করতে থাকে, ‘হোয় হোয়, রামরাজ আ যায়গা রে, রামরাজ আ যায়গা। শুন তুলোগন, শুনকে লে। তোদের ভালাইর জন্যে সবাই বড়ে সরকারকে ভোট দিবি—’

    বুধেরি ঢোঁড়াই বুধনী কুঁদরী—সবাই একসঙ্গে গলা মিলিয়ে বলে, ‘জরুর দেব, জরুর দেব।’

    রঘুনাথ সিং হাসি হাসি মুখ করে বলেন, ‘চলি রে, গাঁওয়ে গাঁওয়ে ঘুরে সবাইকে নৌটঙ্কী শোনার নেমন্তন্ন করতে হবে।’

    রঘুনাথ সিং তাঁর দলবল নিয়ে চলে যাবার পর আচমকা ধর্মার মনে পড়ে গেল, এই তিনটে দিন ক্ষেতির কাজ থেকে মুক্তি পেয়ে ভালই হয়েছে। যেভাবেই হোক, যদি পুরো তিনটে দিনও দক্ষিণ কোয়েলের পাড়ে কেঁদ শাল পরাস সাগুয়ানের জঙ্গলে কাটাতে হয়, কাটিয়ে চিতার জোড়া বাচ্চা যোগাড় করবে। এর চাইতে বড় সুযোগ এ জীবনে আর আসবে কিনা সন্দেহ। রঘুনাথ সিং তিনদিনের ছুটি দিয়ে মুক্তির পুরো ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এখন সব কিছু তার নিজের ওপর নির্ভর করছে।

    রঘুনাথ সিং চলে যাবার ঘণ্টা তিনেক পর তাঁর খামার বাড়ি থেকে দু-তিনটে লোক ভয়েসের গাড়িতে চাপিয়ে চাল-ডাল-গম মকাই, এমন কি ঘি পর্যন্ত দিয়ে গেল।

    অচ্ছুৎ ভূমিদাসদের মহল্লায় এখন সুখের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। এত সুখ আগে আর তারা কখনও তো পায়ই নি, তাদের বাপ নানা, নানার বাপ, নানার বাপের বাপ, তার বাপের বাপ পর্যন্ত ওপরের দিকের কয়েক পুরুষে কেউ কখনও পেয়েছে বলে শোনা যায় নি। আজীবচাঁদ যে রামরাজের কথা বলে গেল তবে কি এই গারুদিয়া তালুকে সত্যি সত্যি তাই নেমে এসেছে!

    গোটা পাড়া জুড়ে এখন ঢিলেঢালা আর আলস্যের ভাব। মেয়েরা রান্নাবান্নার তোড়জোড় করছে। পুরুষেরা চৌপায়ায় বসে বসে খৈনি বানাতে বানাতে রঘুনাথ সিংয়ের কথাই হাজার বার করে বলতে থাকে। বড়ে সরকারের দিল রাতারাতি কি করে যে এরকম দরাজ হয়ে গেল তা ভেবে অবাক হয়ে যায়। সবই ভগোয়ান রামচন্দজীকা কিরপা।

    কেউ কেউ এরই মধ্যে গলা পর্যন্ত মহুয়া গিলে এসে মাতোয়ালা হয়ে বসে আছে কিংবা জড়ানো গলায় চেঁচাচ্ছে।

    .

    ঠিক দুপুরবেলা সূর্য যখন খাড়া মাথার ওপর, সেই সময় খাওয়া-দাওয়া সেরে কোমরে আধ হাত লম্বা বাঁকানো ছুরি গুঁজে আর কাঁধে টাঙ্গি ফেলে বেরিয়ে পড়ে ধর্মা। তার সঙ্গে সঙ্গে কুশীও যায়। দুপুরের জ্বলন্ত রোদে টাঙ্গির ফলা ঝলকাতে থাকে।

    এক সময় ওরা হাইওয়েতে দক্ষিণ কোয়েলের মরা খাতটার কাছে এসে পড়ল। বড় সড়কের বাঁ দিকে যতদূর চোখ যায় একেবারে ধু ধু দিগন্ত পর্যন্ত রঘুনাথ সিংয়ের ক্ষেতগুলো আজ একেবারে ফাঁকা। কোথাও লোকজন চোখে পড়ছে না। সব কিছু নির্জন আর শৃঙ্গ। আজ থেকে পুরো তিনটে দিন রঘুনাথ সিংয়ের জমিতে হালবয়েল পড়বে না। তারা তো মাঠে নামেই নি, এমন কি সেই মরসুমী ওরাঁও আর মুণ্ডা কিষাণগুলোকেও তিনদিনের জন্য ছুটি দিয়েছেন রঘুনাথ সিং।

    তবে হাইওয়ের ওপারে মিশিরলালজীর জমিতে যথারীতি মিশিনের লাঙল চলছে। বিশাল প্রান্তর জুড়ে ভট ভট শব্দ উঠছে।

    হাইওয়ে থেকে ধর্মা আর কুশী অন্য দিনের মতো কোয়েলের মরা খাতে নেমে এল। একসঙ্গে সাবুই ঘাসের জঙ্গল পর্যন্ত দুজনে এসে কুশী দাঁড়িয়ে পড়ল আর ধর্মা বালির ডাঙার ওপর দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে চলল জঙ্গলের দিকে।

    আগে থেকেই ওদের কথা হয়ে আছে, এ ক’দিন সাবুই ঘাসের বন পর্যন্ত ওরা একসঙ্গে আসবে। কুশী এখানে ফাঁদ পেতে পাখি ধরবে। আর একা একাই ধর্মা চলে যাবে আরশির মতো সেই স্বচ্ছ জলের পাড়ে শাল-কেঁদের জঙ্গলে।

    পেছন থেকে কুশী চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে, ‘তুরস্ত লৌটনা। আমার বহোত ডর লাগছে।’

    ধর্মা ঘাড় ফিরিয়ে বলে, ‘তুরন্তই আসব। ডর কীসের?’ কাঁধের সেই ধারাল টাঙ্গির ফলাটা দেখিয়ে বলে, ‘এটা তো আছে। জানবর যত খতারনাক হোক, আমার চামড়া ছুঁতে পারবে না।’ কথাটা আগেও আরো কয়েক বার বলেছে সে। কিন্তু ডরপুক কুশীটার ভয় কিছুতেই যায় না।

    কুশী এবার বলে, ‘বড়ে সরকারের কোঠিতে আন্ধেরা নামলেই নওটঙ্কি বসবে—’

    ‘তুই নওটঙ্কি শুনতে চলে যাস। আমার জন্যে দাড়িয়ে থাকিস না।’

    ‘নায় নায়। তুই না এলে আমি যাব না।’

    ‘একেলী এখানে দাড়িয়ে থাকবি না কুশী। হাইওয়ে দিয়ে বহোত আদমী যায়। তাদের মধ্যে খতারনাক বদমাসও রয়েছে। বুরা মতলব নিয়ে কেউ চলে আসতে পারে। তুই একেলী আওরত, তাদের ঠেকাতে পারবি না।’

    কুশী ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ধর্মার কথামতো চলে যাবার ইচ্ছা তার নেই।

    ধর্মা আবার বলে, ‘বগেড়ি মিললে ঠিকাদার সাবদের কাছে বেচে বড়ে সরকারের কোঠিতে নওটঙ্কি শুনতে চলে যাবি। আমি সিধা ওখানে যাব।’ বলে চলে যায় সে।

    আগের সব দিনের মতো যতক্ষণ নদীর ধুধু বাকে ধর্মা আর তার টাঙ্গির ফলাটা দেখা গেল ততক্ষণ তাকিয়ে রইল কুশী। তারপর সাবুই ঘাসের জঙ্গলে ঢুকে পড়ল।

    বিকেলের আগে আগে শাল-কেঁদের জঙ্গলে পৌঁছে গেল ধৰ্মা। খুব সতর্ক চোখে চারদিক দেখতে দেখতে ক্রমশ আরো গভীরে চলে যেতে লাগল।

    আজও চিতার বাচ্চা খুঁজতে খুঁজতে তার চোখে পড়ে, অগুনতি হরিণ লাফিয়ে চলেছে। একেবারে ঝুনঝুনকে। গোটা তিনেক বন-বেড়াল, একটা শজারুও দেখতে পেল। অনেক দূরে দেখা গেল, একটা দাঁতাল শুয়োর ঘোঁত ঘোঁত করতে করতে ঘন ঝোপের দিকে চলে যাচ্ছে।

    বনবেড়াল, হরিণ, শুয়োর ইত্যাদি সম্পর্কে ধর্মার কোনরকম উৎসাহ নেই।

    তার ছুরির তাক মারাত্মক। ইচ্ছা করলে দূর থেকে ছুঁড়ে কোন একটা জানোয়ারকে বিধতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে শক্তি বা সময় নষ্ট করতে সে চায় না। তার লক্ষ্য হলো চিতার বাচ্চা।

    ঘুরতে ঘুরতে সূর্য ডোবার সময় হয়ে গেল। জঙ্গলের ছায়া দ্রুত ঘন হয়ে আসতে লাগল। এরপর এখানে থাকা খুবই বিপজ্জনক। কেননা অন্ধকারে পেছন থেকে কিংবা মাথার ওপর গাছের ডাল থেকে যে কোন জন্তু আচমকা ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়তে পারে।

    একসময় ধর্মা জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। ছুটির একটা দিন কেটে যায়। অথচ কোন কাজই হল না। ফলে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে আসে তার।

    এখনও অবশ্য হাতে পুরো দুটো দিন রয়েছে। কাল আরো আগে আগে জঙ্গলে চলে আসতে হবে।

    আজ আর ধর্মার জন্য সাবুই ঘাসের জঙ্গলের কাছে কিম্বা হাইওয়ের ধারে উঁচু বালির স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে নি কুশী। ধর্মা একা একাই দোসাদটোলায় ফিরে এল।

    এখন বেশ রাত হয়ে গেছে। ভরা পূর্ণিমার পর অমাবস্যার পক্ষ চলছে বেশ কয়েকদিন ধরে। চাঁদ উঠবে আরো অনেকক্ষণ পর। সেই মাঝরাতের কাছাকাছি সময়। এখনকার চাঁদ বড় রুগ্ন। তার গায়ে যেটুকু আলো আছে এই গারুদিয়া তালুক পর্যন্ত এসে পৌঁছয় না। ফলে এ অঞ্চলের মাঠ প্রান্তর, দক্ষিণ কোয়েলের মরা খাতের স্তূপাকার বালি, গাঁও-গঞ্জ-বাজার, সব অন্ধকারে ডুবে থাকে।

    দোসাদদের পাড়াটা এখন একেবারে ফাঁকা। কোন ঘরেই কেউ নেই; এলাকা খালি করে সবাই রঘুনাথ সিংয়ের হাভেলিতে নৌটঙ্কী শুনতে গেছে।

    নিজেদের ঘরে ঢুকে ছুরি আর টাঙ্গি দেয়ালে টাঙিয়ে রেখে হাতড়ে হাতড়ে লণ্ঠন বার করে ধরিয়ে নেয় ধর্মা। তারপর পরনের ঘাম-ভেজা জবজবে হাফ প্যান্ট আর জামাটা ছেড়ে ডোরাকাটা পাজামা আর লাল কুর্তা গায়ে চড়িয়ে রঘুনাথ সিংয়ের হাভেলির দিকে যায়।

    বড়ে সরকারের মকানের সামনে যেন দশেরা পরবের মেলা বসে গেছে। গারুদিয়া আর বিজুরি তালুকের কোন গাঁওয়ের কোন মানুষই আজ আর বুঝি আর বুঝি ঘরে নেই। সব ঝেঁটিয়ে এখানে চলে এসেছে।

    সেদিন ফাগুরামের বেহুঁশ দেহ কাঁধে করে আনার পর এখানে আর আসেনি ধর্মা। এর মধ্যে নৌটঙ্কীর জন্য কবে যে বিশাল শামিয়ানা খাটানো হয়েছিল সে টের পায় নি।

    শামিয়ানার তলায় শুধু মানুষ আর মানুষ। মাঝখানে উঁচু মঞ্চে নৌটঙ্কীর আসর বসেছে। প্রচুর জোরালো আলো জ্বলছে গোটা শামিয়ানা জুড়ে।

    ভিড়ের ভেতর খুঁজে খুঁজে কুশীকে ঠিক বার করে ফেলে ধর্মা। চাপবাঁধা মানুষের মধ্যে রাস্তা করে করে তার গা ঘেঁষে বসে পড়ে।

    কুশী আজ সস্তা সাবানে কাচা একটা খাটো হলুদ শাড়ি আর লাল জামা পরেছে। উঁচু করে চুল বেঁধে গুঁজে দিয়েছে বুনো ফুল; কপালে দিয়েছে কাচপোকার টিপ।

    কুশী জিজ্ঞেস করে, ‘কখন ফিরলি?

    ধর্মা বলে, ‘এই তো। ঘরে টাঙি রেখেই চলে এসেছি।’

    ‘চিতার বাচ্চা মিলল?’

    ‘নায়। মুল্লুক ছেড়ে সব চিতা ভেগেছে। এত ঢুডলাম; একটাও চোখে পড়ল না। কাল সুবে নিদ ছুটলেই জঙ্গলে চলে যাব।’

    এই সময় হারমোনিয়াম তবলা আর ফ্লুট একসঙ্গে বেজে উঠল। তারপর চড়া মিঠে সুরে কোন আওরতের গলা কানে এল। রঘুনাথ সিংয়ের লোকেরা আসরে মাইকের ব্যবস্থা করেছে যাতে শামিয়ানার শেষ মাথার শ্রোতাও শুনতে পায়।

    দ্রুত ঘাড় ফিরিয়ে আসরের দিকে তাকায় ধর্মারা। প্রচুর সাজ-গোজ করে, গিল্টির গয়না পরে নৌটঙ্কী দলের পরীর মতো ছোকরিটা গলায় গিটকিরি খেলিয়ে গান ধরেছে। চোখমুখের কিবা ঠমক তার! গোটা শামিয়ানা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।

    বালমোয়া ঘর না আয়ে রে
    ওমরিয়া বীতী যায়ে রে
    যো ম্যায় ইতনা জানতী
    প্রীত কিয়ে দুখ হোয়
    নগর টিচঁড়ো (ঢোঁড়া) পিটতী
    প্রীত না করিয়ো কোই
    কোঠা উপর কোঠ লী
    উসমে কালা নাগ
    ঝরোখা পরকে লায়লী পুকারে
    মজনু ডসিয়ো (কামড়ানো) না যায়
    নদী কিনারে ধুয়া উঠৎ হ্যায়
    ম্যায় জানু কুছ হোয়
    কোঠা পর লায়লী পুকারে
    মজনু জ্বলিয়ো যায়–
    .

    ধর্মা বলে, ‘বহোত বঢ়িয়া গানা—’

    গান শুনতে শুনতে কুশী অন্যমনস্কের মতো বলে, ‘হুঁ, ফরবিশগনকা (ফরবেশগঞ্জকা) নওটঙ্কী—’

    ‘উসি লিয়ে ইতনা বঢ়িয়া। দুনিয়া ফরবিশগনের নওটঙ্কীর নাম জানে।’

    গান চলতে লাগল।

    শুধু ফরবেশগঞ্জেরই না, আরারিয়া ঘাট, পুর্ণিয়া, ভাগলপুর—এমনি নানা জায়গা থেকে নৌটঙ্কীর দল আনিয়েছেন রঘুনাথ সিং। একেক রাত একেক দল গাইবে।

    সারা রাত নৌটঙ্কী শুনে ভোরবেলা ঢুলতে ঢুলতে ধর্মারা দোসাদটোলায় ফিরে আসে।

    .

    রাতভর গান শোনার ফল হয় এই, পরের দিন সকালবেলা চিতার বাচ্চার খোঁজে জঙ্গলে যেতে পারে না ধর্মা। রঘুনাথ সিংয়ের মকান থেকে মহল্লায় ফিরেই শুয়ে পড়েছিল সে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম। ঘুম যখন ভাঙল, দুপুর হয়ে গেছে।

    ধড়মড় করে উঠে ধর্মা দেখল গোটা দোসাদপাড়া বেহুশ হয়ে ঘুমোচ্ছে। তার মা-বাপও পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। ডাকাডাকি করে তাদের আর জাগালো না ধর্মা। তাড়াতাড়ি কুয়োর জলে চানটান করে বাসি কুঁদরুর তরকারি দিয়ে খানকতক বাজরার রুটি খেয়ে কোমরে ছুরি গুঁজে আর কাঁধে টাঙ্গি ফেলে জঙ্গলে ছোটে সে।

    কি আশ্চর্য, পুরো দোসাদপাড়াটা ঘুমোলেও কুশী ঠিক জেগে আছে। তক্কে-তক্কে ছিল মেয়েটা। ধর্মা জঙ্গলের রাস্তা ধরতেই সে তার পিছু নেয়। তারপর অন্যদিনের মতো সাবুই ঘাসের বনের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে আর গনগনে আকাশের তলা দিয়ে ধর্মা চলে যায় শাল-কেঁদের জঙ্গলের দিকে।

    আজও জঙ্গলের ভেতর অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়াল ধর্মা কিন্তু না, চিতার বাচ্চা পাওয়া গেল না। সূর্যাস্তের সময় বনভূমিতে ছায়া যখন ঘন হয়ে আসে তখন বেরিয়ে এল সে। আগের দিনের মতোই ফাঁকা দোসাদটোলায় ফিরে, ছুরি-টাঙ্গি রেখে, জামাকাপড় বদলে বড়ে সরকার রঘুনাথ সিংয়ের মকানে নৌটঙ্কী শুনতে চলে গেল। শামিয়ানার তলায় গিজগিজে ভিড়ের ভেতর কালকের মতোই কুশীকে খুঁজে বার করে তার পাশে গিয়ে বসে পড়ল। তারপর সারারাত আরা জেলার নামকরা দামী দলের মনমাতানো গান শুনল।

    মেরে গোরে বদন পর সভী রাজী
    সাসুভি রাজী সশুর ভি রাজী
    বালমা আনাড়ী, নেহী রাজী
    মেরে গোরে বদন পর সভী রাজী
    ভাসুরজী রাজী, ননদভি রাজী
    দেওরা বেদরদী নেহী রাজী
    মেরে গোরে বদন পর সভী রাজী—
    .

    ভোর বেলা যখন ধর্মারা ঘরে ফেরে সবার চোখে ঘুমে জুড়ে আসছে।

    এইভাবে পর পর দুটো দিন বরবাদ হয়ে গেল। বাকী রইল মোটে একটা দিন।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleইতিহাসের গল্প – প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত
    Next Article পাগল মামার চার ছেলে – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }